৪১-৪৫. কুন্তীকে হাওড়া স্টেশনে

কুন্তীকে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দিল অর্ক। ধর্মতলা থেকে ট্যাক্সি নিয়েছিল কুন্তী, আসার পরে ভাড়া দিয়েছিল নিজেই। তারপর বলেছিল, আজ সকালে ভাবতেই পারিনি যে আপনি আমাকে এতটা সময় দেবেন। অর্ক হেসে ফেলল, বিখ্যাত লেখকরা বোধহয় এভাবেই উপন্যাসে লিখে থাকেন যা পাঠক আগে আন্দাজ করতে পারে না।

আমার কথা বলতে পারি, যে ভয়ংকর চাপে আমি স্যান্ডউইচ হয়ে ছিলাম তা থেকে এই সময়টুকু পেরিয়ে এসেছিলাম আপনার দেখা পেয়ে। আপনি চলে গেলে আবার–! কথা শেষ করল না সে।

কুন্তী বলল, একদিন আসব আপনার মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে।

অর্ক মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না। কুন্তী চলে গেল ব্যান্ডেলে।

এতক্ষণ একসঙ্গে কাটানোয় কুন্তী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে পেরেছে। অর্ক। কুন্তী ব্যান্ডেলে থাকে স্কুলের চাকরির কারণে। শনিবার বিকেলে কলকাতার বাড়িতে এসে রবিবার বিকেলে ফিরে যায়। কলকাতার পৈতৃক বাড়িতে এখনও ওঁর মা বাস করেন। ব্যান্ডেলে দুজন শিক্ষিকার সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে কুন্তী থাকেন। রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার সময় এইসব তথ্য জানার আগে অর্ক জিজ্ঞাসা করেছিল, এই যে সকালের কাগজে প্রতিবাদের মিছিল হবে খবর পেয়ে চলে এলেন, তার জন্য কোনও সমস্যা হল না?

কীরকম সমস্যা?

সংসারে যা হয়ে থাকে।

ও। আমার হয়নি কারণ আমি সেই অর্থে সংসারী মানুষ নই।

অর্ক ব্যাপারটা অনুমান করার চেষ্টা করছে দেখে কুন্তী হেসে বলল, বুঝতে পারছেন না? আমি সিঙ্গল উয়োম্যান। এক মহিলা। কোনও সন্তান নেই। ফলে পিছুটান নেই। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে একটা চার কামরার বাড়ি ভাড়া করে ব্যান্ডেলে থাকি আর সেই বাড়ির যাবতীয় হ্যাঁপা ওরাই সামলে নেয়। আমি ঝাড়া হাত-পা। আপনি এই ব্যাপারটাকে সুবিধেবাদ বলতে পারেন।

আর এই প্রসঙ্গে কথা বাড়ায়নি অর্ক। একজন সুশ্রী শিক্ষিত মহিলা মধ্য তিরিশ পেরিয়ে এই জীবনযাপন করলে তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষের কিছুটা কৌতূহল তৈরি হয় যা কোনও পুরুষের ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু কোনও মানুষ অতীতে কী কাজ করেছিল বা করেনি তার নিরিখে বর্তমানকে বিচার করা কি অত্যন্ত জরুরি? এক জীবনে মানুষকে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের অবস্থান যতবার বদলাতে হয় অন্য কোনও প্রাণীকে তা করতে হয় না। গিরগিটিরও রং বদলাবার ক্ষমতা বেশ সীমিত।

ট্রামে উঠল অর্ক। সামনের আসনে বসা দুজন যাত্রী আজকের মিছিল নিয়ে কথা বলছে। একজন টিভিতে মিছিল দেখেছে, তার মুখ থেকে অন্যজন শুনছে।

শ্রোতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলছ? অ্যান্টি বামফ্রন্ট মিছিল? খুব বড়?

যে টিভিতে দেখেছে সে বলল, ভুল হল। বলতে পারো সিপিএম-এর সরকারের আচরণের প্রতিবাদে ওই মিছিল হয়েছে, টিভি দেখলাম প্রায় সব স্তরের মানুষ রাস্তায় হাঁটছেন।

তৃণমূল, কংগ্রেসের নেতারা সামনে ছিলেন?

না। কোনও রাজনৈতিক নেতাকে মিছিলে দেখিনি।

মানে? এরকম হয় নাকি?

আগে হতে দেখিনি, আজ দেখলাম। চিত্রশিল্পী, লেখক, অভিনেতা অভিনেত্রী, অধ্যাপক থেকে সাধারণ মানুষ, যাঁদের নাম কখনওই কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখিনি, তারা মিছিলে হেঁটেছেন।

ভাবতেই পারছি না। কে কে ছিলেন?

আমি টিভিতে অপর্ণা সেন, বিভাস চক্রবর্তী, শীর্ষেন্দু মুখার্জি, শুভাপ্রসন্নকে দেখেছি। ধরে নাও, আমরা যাঁদের চিনি তাদের অধিকাংশই ছিলেন।

শ্রোতা হাসল, বাপস, এ তো বৈপ্লবিক ব্যাপার। বামফ্রন্ট এই ধাক্কা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাবে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্কর মনে হল, আজকের দিনটা বামফ্রন্টের কাছে কালাদিবস হয়ে যাবে। নন্দীগ্রামের কৃষকরা যা শুরু করেছিলেন তা হয়তো গতি হারাত, কিন্তু আজকের মিছিলের পর তা বেগবান হবে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলবেন, ভূমিহীন মানুষ, দরিদ্র কৃষক, শ্রমজীবীরা যখন রুখে দাঁড়ান তখন পরিবর্তনের সূচনা হয়। কিন্তু এত তত্ত্ব যখন তৈরি হয়েছিল তখনকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির বিস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যারা সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত এবং সুবিধেবাদী, তাদের ঘুম ভেঙে গেলে যদি একত্রিত হতে পারেন তা হলে সেই শক্তিই শেষ কথা বলবে। আজ তারই সূচনা হয়ে গেল।

.

ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢোকার মুখেই রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠল। মোড়ের মুখেই আট-নয়জনের একটা জটলায় যে যার মতো কথা বলছিল, অর্ককে দেখে সবাই চুপ করে গেল। ব্যাপারটাকে গুরুত্ব না দিয়ে আর একটু এগোতেই গলির রকে বসা কয়েকজন তার দিকে তাকিয়েই অন্য পাশে মুখ ঘোরাল। এবার দাঁড়াল অর্ক। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার ভাই? কিছু হয়েছে নাকি?

একজন বলল, বাড়িতে যান, দেখতেই পাবেন। কিন্তু বাড়ি অবধি যেতে হল না। বিশ্বজিৎ চারজন সঙ্গী নিয়ে উলটো দিক থেকে বেশ ব্যস্ত হয়ে আসছিল, অর্ককে দেখে দাঁড়িয়ে গেল, আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?

কেন? আমার তো ব্যক্তিগত কাজ থাকতেও পারে।

তা থাকুক। চলুন। বিশ্বজিৎ ঘুরে দাঁড়াল।

কী ব্যাপার বলো তো? অবাক হচ্ছিল অর্ক।

ঘণ্টা দুয়েক আগে এই বস্তিতে একটা হামলা হয়েছিল।

সে কী? কার ওপর কারা হামলা করল?

যারা করেছিল তারা পালিয়ে যেতে পেরেছে। ওরা ভাঙচুর করেছে, নষ্ট করেছে জিনিসপত্র। কিন্তু আগুন ধরাতে পারেনি, কারণ বস্তির মানুষের চিৎকারে ওরা ভয় পেয়েছিল, আমরাও ছুটে এসেছিলাম। বিশ্বজিৎ বলল।

পথটুকু হেঁটে বাড়ির সামনে এসে অর্ক দাঁড়িয়ে গেল। তাদের উঠোনে ঢোকার দরজার সামনে মানুষ জড়ো হয়ে কথা বলছে, তাদের দেখে সবাই চুপ করে যেতে অর্ক পা বাড়াল। দরজা খোলা, সেখানে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেল অর্ক। দুটো ঘর, রান্নাঘরের দরজা ভাঙচুর করা হয়েছে। খাট টেবিল থেকে যাবতীয় জিনিসপত্র উঠোনে এনে আছড়ানো হয়েছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে গেল যেন, বুকে চাপ অনুভব করল অর্ক।

বিশ্বজিৎ বলল, হয়তো কেরাসিন সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছিল তাই পালাবার আগে আগুন ধরাতে পারেনি, ধরালে কী হত ভাবতেই পারছি না। আপনাদের বাড়ি তো বটেই পুরো বস্তি ছাই হয়ে যেত।

কারা করল এসব? কোনওমতে প্রশ্নটা করল অর্ক।

কেউ তো নিজের পরিচয় দিয়ে এসব করে না। কিন্তু আমরা এতটা মূর্খ নই যে বুঝতে পারব না। দেখুন, খবর দেওয়া হয়েছিল ঘটনার পরপরই। অথচ তাদের দেখা এখনও পাওয়া গেল না। বোঝাই যাচ্ছে যারা কাজটা করেছে তাদের আড়াল করতেই পুলিশ টালবাহানা করছে।

ভেতরে ঢুকল অর্ক। সঙ্গে বিশ্বজিৎ। তার সঙ্গীরা দরজায় দাঁড়িয়ে বস্তির লোকদের ভেতরে ঢোকা আটকাচ্ছিল। এতক্ষণ তারা বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিল,

অর্ককে বাড়িতে ঢুকতে দেখে ভেতরটা দেখার জন্যে পা বাড়াচ্ছিল।

বিশ্বজিৎ বলল, আমরা দেখছি। যেসব ফার্নিচার ভাঙেনি সেগুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে ছেলেরা। যেগুলো ভেঙে গেছে সেগুলো ফেলে দিতেই হবে। এমনিতেই ওগুলো পুরোনো হয়ে গেছে।

অর্ক নিজের মনে বলল, মা-বাবার কালই এখানে আসার কথা। এসে এসব দেখলে ওঁরা যে কী করবেন!

ওঁরা কালই আসছেন?

সেইরকম কথা আছে।

মাথা নাড়ল বিশ্বজিৎ, দেখুন, ওঁদের কাছ থেকে তো আপনি এসব লুকোতে পারবেন না। আমরা এখনই কিছুটা ভদ্রস্থ করে দিতে পারি কিন্তু

পুলিশ এসে দেখার আগে তো এসবে হাত দিতে পারি না।

অর্ক এগিয়ে গিয়ে একটা ছবির ফ্রেম টেনে তুলল। কাঁচ ভেঙে গেছে। ছবিটা রবীন্দ্রনাথের। বিশ্বজিৎ বলল, অর্কা, হাত দেবেন না। যেমন আছে তেমন থাকুক। পুলিশ আগে আসুক–।

এই সময় বাইরের জনতা চেঁচিয়ে উঠল, পুলিশ, পুলিশ এসেছে।

বড়বাবু দেখা দিলেন, সঙ্গে একজন সেপাই। ভেতরে পা দিয়ে চারদিক দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। ভুলটা আপনারই। মাওবাদীদের মধ্যে অনেক দল আছে। এক দল অন্য দলকে সহ্য করতে পারে না। যাকে আপনি আশ্রয় দিয়েছিলেন তার অ্যান্টি দল বোধহয় জানত না লোকটা এই বাড়ি থেকে চলে গিয়েছে। তাকে না পেয়ে ভাঙচুর করে গিয়েছে।

অর্ক শান্ত গলায় বলল, আপনার কাছে এত তথ্য যখন আছে তখন যারা ভাঙচুর করেছে সেই দলটাকে ধরুন।

নিশ্চয়ই ধরব। আগে আপনি কানটাকে দিন, আমি মাথাটাকে টেনে নিয়ে আসি। হাসলেন বড়বাবু, আমার সঙ্গে চালাকি করার চেষ্টা করবেন না অর্কবাবু।

আমি সেটা কখন করলাম? অর্ক বিরক্ত হচ্ছিল।

এইরকম জমজমাট এলাকায় বাইরে থেকে কয়েকজন ভেতরে ঢুকে জিনিসপত্র ভাঙল আর সেটা কেউ টের পেল না, যে শিশু মায়ের পেটে রয়েছে সেও বিশ্বাস করবে না। যেহেতু আমি আপনাকে চারদিন সময় দিয়েছি ওই মাওবাদীটার হদিশ জানাতে তাই নিজেকে ধোওয়া তুলসীপাতা প্রমাণ করতে এই ঘটনা সাজালেন। ঠিক আছে। আমি রেকর্ড করে রাখছি আপনার বাড়িতে কে বা কারা হামলা করেছে, বাকিটা আপনার হাতে। বড়বাবু রবীন্দ্রনাথের ছবিটাকে দেখলেন। বললেন, ইস।

আমার হাতে মানে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

আজকের দিনটা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আরও তিনটে দিন আপনি সময় পাচ্ছেন। ওই লোকটা কোথায় আছে আমাকে জানিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বড়বাবু ঘুরে দাঁড়াতেই বিশ্বজিৎ কথা বলল। এতক্ষণ সে চুপচাপ শুনছিল। এবার এক পা এগোল, আচ্ছা, এখানে আসতে আপনার এত দেরি হল কেন?

কৈফিয়ত চাইছেন? অমায়িক হাসলেন বড়বাবু।

আমি তো পুলিশ কমিশনার নই যে কৈফিয়ত চাইতে পারি। অবশ্য তিনিও আজকাল ওইসব চাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। পশ্চিমবাংলার মানুষ জানে কোথায় কাদের কাছে আপনাদের কৈফিয়ত দিতে হয়। বিশ্বজিৎ বলল।

একজন পুলিশ অফিসারকে অপমান করার জন্যে আপনাকে আমি অ্যারেস্ট করতে পারি। আপনি কথাটা উইথড্র করুন। মুখের চেহারা পালটে গেল অফিসারের। চোখ ছোট হয়ে গেল তার।

আমাকে অ্যারেস্ট করতে হলে আর একজনকেও করতে হবে।

অ্যাঁ? মানে?

আচমকা আবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনলেন বড়বাবু, বাঃ, আপনি দেখছি বেশ বুদ্ধিমান। ওহো, অর্কবাবু, আপনার এখানে যখন এসব নাটক হচ্ছিল তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি মিছিলে গিয়েছিলাম।

মিছিলে? আজ মাওবাদীদের কোনও মিছিল হয়েছে বলে শুনিনি তো!

আজ সাধারণ মানুষ এবং শিল্পী সাহিত্যিকরা নন্দীগ্রামের ইস্যুতে বিশাল মিছিল করেছেন। অর্ক বলল।

ওরে বাব্বা। আপনি সেখানেও ছিলেন! চমৎকার। বড়বাবু তার সঙ্গে আসা সেপাইকে বললেন, এখানে যেসব ভাঙা জিনিস পড়ে আছে তার একটা লিস্ট তৈরি করে নাও। আমি যাচ্ছি।

বিশ্বজিৎ বলল, এক মিনিট স্যার। আপনি কি এই ঘটনা নিয়ে সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলেছেন?

আবার ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছেন?

একদমই নয়। আপনি আমাদের থানার দায়িত্বে আছেন। আর সুরেন মাইতি সরকারি দলের আঞ্চলিক নেতা যাঁর কর্তব্য এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই আপনাদের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকা খুব জরুরি। বিশ্বজিৎ হাসল।

সেটা আমি বুঝে নেব, হ্যাঁ? বড়বাবু এগোলেন। ঠিক তখন একেবারে মুখ বন্ধ করে জমাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি গলা চেঁচিয়ে উঠল, সুরেনদা থানায় গিয়েছে দুঘণ্টা হল। এখনও ফেরেনি।

বিশ্বজিৎ বলল, এটা বললেই পারতেন। এই হামলার ব্যাপারে পরামর্শ করার জন্যে সুরেন মাইতিকে থানায় ডেকেছেন।

বড়বাবু আর দাঁড়ালেন না। ভিড় দুভাগ হয়ে তাকে যাওয়ার পথ করে দিল। সেই সময় ভিড়ে মিশে থাকা কেউ চেঁচিয়ে উঠল, বাপি বাড়ি যা।

খানিকটা দূরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন বড়বাবু, তার হাত কোমরের অস্ত্রের কাছে পৌঁছে গেল, কে? কে বলল কথাটা? আয়, এগিয়ে আয় শালা। আমাকে পাক দেওয়া হচ্ছে? এতটা সাহস? কে বলল?

ভিড় এবার নিশ্ৰুপ হয়ে গেল।

বড়বাবু চিৎকার করলেন, বিশ্বজিৎ, এক ঘণ্টার মধ্যে লোকটাকে নিয়ে থানায় এসে ক্ষমা চাইতে বলুন। নইলে ওকে বের করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। সুরেনবাবুকে বললেই ওকে পেয়ে যাব। তখন কিন্তু–! শেষ করলেন না কথা, বড়বাবু গলি থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কিন্তু গোলমালটা শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ শোনা গেল অনেকগুলো গলা একসঙ্গে চিৎকার করছে, বাপি বাড়ি যা। তারপর কথাটা বদলে গেল। ধ্বনি উঠল, সুরেন তুই বাড়ি যা।

বিশ্বজিৎ তখন তার ছেলেদের নির্দেশ দিচ্ছিল ভাঙা জিনিসগুলো সরিয়ে ভালগুলো ভেতরে সাজিয়ে রাখতে। নতুন আওয়াজ শুনে সে অর্ককে বলল, আমি এদের কাউকে এই স্লোগানটা বলতে শেখাইনি।

অর্ক কিছু বলল না। সে দেখল জনতা তাদের বাড়ির সামনে থেকে সরে বাইরের চায়ের দোকানের কাছে চলে গেল। এই সময় একজন ছুটতে ছুটতে ভেতরে ঢুকে উত্তেজিত গলায় বলল, বিশুদা, তাড়াতাড়ি এসো, প্রতুলদারা চলে এসেছেন। তোমার খোঁজ করছেন।

বিশ্বজিৎ তৎক্ষণাৎ অর্ককে চলে যাওয়ার ইশারা করে দৌড়াল। ছেলেরা উঠোন মোটামুটি পরিষ্কার করে দিতেই মাইকের আওয়াজ ভেসে এল। সেটা শুনে দাদা আসছি বলে বিশ্বজিতের ছেলেরা বেরিয়ে গেল। কোনওমতে দরজাগুলো বন্ধ করে অর্ক দেখল গলি কঁকা হয়ে গিয়েছে। বস্তির প্রায় সবাই গিয়ে ভিড় করেছে চায়ের দোকানের সামনে যেখানে গলিটা বেশ চওড়া, সেখানে পৌঁছে অর্ক অবাক হয়ে দেখল মানুষের জমায়েত অনেক। বড় হয়ে গেছে এই সন্ধে পার হওয়া সময়ে। এরই মধ্যে রকের ওপর বেঞ্চি তুলে বক্তৃতা শুরু হয়ে গেল। মাইকে সকালে আলাপ হওয়া প্রতুল রায়ের গম্ভীর গলা শোনা যাচ্ছিল। তিনি বারংবার সতর্ক করে দিচ্ছিলেন, আপনারা একটুও উত্তেজিত হবেন না। ওরা চাইছে ওদের ফাঁদে পা দিয়ে এমন কাজ করুন যা থেকে ওরা ফায়দা তুলতে পারে। প্রিয় বন্ধুগণ, আজ আপনাদের এলাকায় ওরা যে কাণ্ড করেছে তার নিন্দা যে ভাষায় করতে হয় তা আমি উচ্চারণ করতে পারব না। তেত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকে ওরা এতটাই উদ্ধত হয়ে গিয়েছে যে এখন দেওয়ালের লিখন পড়তে পারছে না। ক্ষমতার নেশা ওদের অন্ধ করে রেখেছে। পুলিশকে করে রেখেছে ক্রীতদাস। যে পুলিশ অবাধ্য হবে তাকে সুন্দরবন অথবা পুরুলিয়ায় বদলি করে দিতে ওদের দুদিন সময় লাগে না। পুলিশ সেটা জানে বলে ওদের পদলেহন করে যাচ্ছে। কিন্তু বন্ধুগণ, আমি আপনাদের বলছি, সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন মা-মাটি মানুষের সরকার এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা সভ্য ভদ্র মানুষ। সরকারে এলে আমরা দলতন্ত্রে না গিয়ে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করব। কারও বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না। কিন্তু জনতার টাকায় মাইনে নিয়ে যেসব পুলিশ অফিসার জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন তাদের তালিকা আমরা তৈরি করে রাখছি। আপনাদের আর একবার বলছি, প্ররোচনায় উত্তেজিত হবেন না। বন্দেমাতরম।

সঙ্গে সঙ্গে জনতা চিৎকার করল, সুরেন মাইতি বাড়ি যা।

ক্রমশ ভিড়টা এগিয়ে গেল সুরেন মাইতির বাড়ির দিকে। বাড়ির সব জানলা দরজা বন্ধ। সেই বাড়ির সামনে তেত্রিশ বছরে এই প্রথম জনতার সমস্ত ক্রোধ চিৎকার হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে গাড়ির আওয়াজ ভেসে আসতেই জনতা সেদিকে কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ করে তাকাল।

তারপরেই মুখগুলো থেকে শব্দ ছিটকে উঠল, পুলিশের গাড়ি, পুলিশের গাড়ি। তারপরেই যোগ হল, সুরেন মাইতি পুলিশের গাড়িতে।

কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। জনতা সেদিকে এগোতেই গাড়ির ড্রাইভার দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে চলে গেল।

অট্টহাসি হাসল জনতা।

দাদা, আপনার মোবাইল বাজছে। পাশের লোকটা অর্ককে সচেতন করতেই সে পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করল। মায়ের ফোন।

কানে চেপে গলা তুলে জনতার চিৎকারকে উপেক্ষা করে অর্ক বলল, হ্যাঁ, মা, বলল।

অস্পষ্ট হলেও অর্ক শুনতে পেল, আজ ট্রেনে উঠছি।

যন্ত্রটাকে বন্ধ করে ঠোঁট কামড়াল অর্ক। ঠিক তখনই বিশ্বজিৎ পাশে এসে বলল, দাদা, আজ রাত্রে বাড়িতে থাকবেন না।

.

৪২.

ঈশ্বরপুকুর লেনের ছবিটা আচমকা পালটে গেল। অনেকেই মনে করতে পারছিল না শেষ কবে সুরেন মাইতিদের পার্টি অফিস বন্ধ থেকেছে। সুরেনের শিষ্যরা তখন উধাও, গলির ভেতর যারা আমোদ করছে তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, তৃণমূল বা কংগ্রেসের সক্রিয় সমর্থক নয়।

অর্ক ঘরে ফিরে এল। তাদের মূল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। প্রৌঢ়া। মুখে বেশ উদ্বেগের ছাপ। একজন জিজ্ঞাসা করল, সব ভেঙে দিয়ে গেছে, না?

প্রায় সব। অর্ক দরজার তালা খুলছিল, ভাঙা তালাটাকেই ঝুলিয়ে বেরিয়েছিল সে।

এ পাড়ার ছেলে নয় ওরা। দ্বিতীয়জন বলল।

আপনারা ওদের দেখেছেন? দরজা খুলে ঘুরে দাঁড়াল অর্ক।

যখন পালাল, ওই উলটো দিক দিয়ে, তখন দেখেছিলাম। ঢোকার সময় দেখিনি। নিঃশব্দে ঢুকেছিল। একজনকে মাঝে মাঝে সুরেন মাইতির কাছে আসতে দেখেছি। কিন্তু এসব বলে ফেললাম বলে পরে সাক্ষী মেনো না। এই ভাড়ায় ঘর তো আর কোথাও পাব না। সুরেন মাইতি শেষ করে দেবে আমাদের।

ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল অর্ক। বাইরের তালাটাই খারাপ করেছে। ওরা, কড়া ভাঙেনি। ওখানে একটা নতুন তালা ঝোলাতে হবে। উঠোনের এক কোণে ভাঙা আসবাবগুলোর তূপ দেখল সে। এই রাত্রে বাইরে ফেলতে ইচ্ছে করল না। দুটো ঘরে ঢুকে যেটুকু পারল সাজাবার চেষ্টা করল সে। কিন্তু উঠোনে পা দিয়েই মা সব বুঝতে পারবে। কেমন এমন হল তার উত্তর বানিয়ে দেওয়া চলবে না। আশেপাশের মানুষ যেচে সত্যি কথা শোনাবে। আর তখনই রামজির প্রসঙ্গ চলে আসবে। রামজিকে এখানে থাকতে দেওয়া নিয়ে মা প্রশ্ন তুলেছিল। আগামীকাল মায়ের সঙ্গে সে ঝগড়া করবে, না তার সব অভিযোগ মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করবে?

অর্ক ভেবে পাচ্ছিল না। মা এবং বাবা এখন ট্রেনে। কাল সকাল আটটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসবে ওরা। মাথা নাড়ল অর্ক। না, ঝগড়া করে কোনও লাভ নেই। মা যত কটু কথা বলুক মেনে নেওয়াই উচিত। একটা কথা তো ঠিক, সে যদি এখানে রামজিকে আশ্রয় না দিত তা হলে আজকের ঘটনাটা ঘটত না।

কিন্তু হঠাৎ আজকেই কেন ঘটনা ঘটল? যদি ধরে নেওয়া যায়, সুরেন মাইতির লোক ভাঙচুর করেছে তা হলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন করল? সে তো বামফ্রন্ট বা সুরেন বিরোধী কোনও কথা আজ দুপুর পর্যন্ত কাউকে বলেনি। থানাতেও সে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। যদি ধরে নেওয়া যায় তাকে ওরা বামফ্রন্ট বিরোধী বলে ভেবেছে তা হলে বাড়িতে এসব না করে তাকেই নির্যাতন করল না কেন? আর করার জন্যে এই বিকেলটাকেই বেছে নিল। কেন?

মাথা কাজ করছিল না। সন্ধে পেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ কিন্তু অর্কর ইচ্ছে হল এক কাপ চা খেতে। রান্নাঘরে ঢুকে দেখল মায়ের প্রিয় রান্নাঘরেও তাণ্ডব চলেছে। চা-চিনির প্লাস্টিকের কৌটোগুলো মুখ খুলে মাটিতে পড়ে আছে। অর্ক মাথা নাড়ল। এই ঘরটাকে অন্তত ঠিকঠাক করতে হবে মা আসার আগে।

দরজায় নতুন তালা ঝুলিয়ে গলির চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়াল সে। বস্তির বাইরে বেরিয়ে দেখল দোকানটা এখন বন্ধ। অনেক রাত পর্যন্ত যে দোকান খোলা থাকে তা কী কারণে বন্ধ রয়েছে তা বুঝতে অসুবিধে হল না।

হঠাৎ অনেকগুলো কণ্ঠ একসঙ্গে ভেসে এল, বোঝা গেল স্লোগান দিতে দিতে ট্রামডিপোর দিক থেকে মানুষগুলো এগিয়ে আসছে। মিনিটখানেক পরেই দেখা গেল ওদের, বেশ বড়সড় একটা মিছিল বামফ্রন্টের পক্ষে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেল। মিছিলের পুরোভাগে হাতজোড় করে হেঁটে আসছেন সুরেন মাইতি। বিশ্বজিত্রা এখন ধারে কাছে নেই। যারা এতক্ষণ হইচই করছিল তারা একেবারে চুপ। স্লোগান উঠল, সর্বহারার বন্ধু কে? সিপিএম, আবার কে? স্বার্থলোভী উঠাইগিরির দল, দূর হঠো, দূর হঠো। মিছিল এগিয়ে গিয়ে থামল সুরেন মাইতির বাড়ির সামনে।

মিছিলের সঙ্গে হেঁটে আসা মানুষদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ এগিয়ে এলেন অর্কর কাছে। এঁকে মাঝেমধ্যেই অনিমেষের সঙ্গে গল্প করতে দেখেছে অর্ক। এককালে সরকারি বাসের ডিপোয় কাজ করতেন। অবসর নেওয়ার পর খবরের কাগজ পড়ে আর এর ওর সঙ্গে কথা বলে সময় কাটিয়ে দেন। বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা কবে আসবেন?

আগামীকাল।

শুনলাম তোমাদের বাড়ি ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। এসে কী দেখবেন ওরা? কারা করেছে তা জানো?

না।

যত কম জানা যায় তত ভাল। তুমি সে সময় কোথায় ছিলে?

সত্যি কথা বলল অর্ক, মিছিলে।

অ্যাঁ? তুমি রাজনীতি করো নাকি?

না, ওটা অরাজনৈতিক মিছিল ছিল। নন্দীগ্রামে পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদে অরাজনৈতিক মানুষেরা ধিক্কার মিছিল করেছেন আজ। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকালেন, সোনার পাথরবাটি হয় নাকি?

মানে?

মিছিল হবে, তার ওপর ধিক্কার মিছিল বলে কথা, অথচ তাতে রাজনীতি থাকবে না, শিশুভোলানো কথা বলছ বাবা। তা তোমাকে ওই মিছিলে

এখানকার কেউ নিশ্চয়ই দেখেছিল। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

এ কথা কেন বলছেন?

দেখো, রাগ প্রকাশ করার জন্যে একটা উপলক্ষ তো চাই। ফিসফিসানি শুনছিলাম, তোমার বাড়িতে একটা মাওবাদী লুকিয়ে আছে। তোমাকে মিছিলে দেখে ওদের মনে হতেই পারে বাড়ির ভেতরটা খুঁজে দেখা দরকার। মানুষ না পেয়ে অন্যভাবে মনের ঝাল মিটিয়েছে। এতক্ষণে বুঝলাম। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

অর্ক বলল, আপনি যাদের কথা বলছেন তারা তো আপনার সঙ্গে এইমাত্র হেঁটে আসতে পারে।

হয়তো পারে।

আপনিও তাদের সঙ্গে হাঁটলেন!

কোনও অন্যায় করিনি বাবা। একটু হাঁটাহাঁটি হল আবার সময়ও কাটল। আজ ওদের সঙ্গে আমি ঝোলে আছি, কাল অন্য কেউ অম্বল নিয়ে এলে তাতেও থাকব। বাঁচতে হলে জলের মতো হতে হবে। যে পাত্রে যেমন। সাবধানে থেকো বাবা। এই যে এসব কথা যখন তোমার বাবাকে বলি তখন তিনি চুপচাপ শুনে যান। হ্যাঁ না কিছুই বলেন না। ওটাও বাঁচার একটা ভাল পদ্ধতি। বৃদ্ধ চলে গেলেন সুরেন মাইতির বক্তৃতা শুনতে।

অর্কর মনে হল বৃদ্ধের কথাটাই ঠিক। নিশ্চয়ই তাকে মিছিলে দেখে কেউ মোবাইলে সুরেন মাইতিকে জানিয়েছিল। সুরেন যা নির্দেশ দেওয়ার দিয়ে সোজা থানায় গিয়ে বড়বাবুর কাছে বসে ছিল।

এটুকু ভাবতেই অর্কর মনে হল বিশ্বজিৎ তাকে ভুল সতর্ক করেনি। আজ রাত্রে তার ওপর আবার আক্রমণ হতে পারে। যেভাবে বিশ্বজিৎত্রা এলাকা দখল করে সুরেন মাইতিকে চলে যেতে বাধ্য করেছিল তাতে মনে হয়েছিল এখান থেকে ওরা একেবারেই উৎখাত হয়ে গেল। কিন্তু আধঘণ্টার মধ্যেই সুরেন মাইতি বেশ বড় দল নিয়ে ফিরে এসে আবার জাঁকিয়ে বসল। বিপক্ষের কোনও সংগঠন নেই জানা থাকায় সুরেন মাইতি একটুও দেরি করেনি। এই অবস্থায় জেনেশুনে রাত্রে বাড়িতে একা থাকা খুবই বোকামি হবে।

দ্রুত বাড়ি ফিরে এসে একটা কাপড়ের কাধ ঝোলানো ব্যাগে দু-তিনটে জামা একটা প্যান্ট আর প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে এটিএম কার্ডটা নিয়ে দরজায় তালা দিয়ে উলটোদিকের পথটা ধরল। এই পথটা বস্তির ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে বেলগাছিয়া ব্রিজের কাছে গিয়েছে, কপাল খুব খারাপ না হলে কেউ চট করে তাকে দেখতে পাবে না।

ডিপো থেকে বেরিয়ে আসা ট্রামে উঠে বসল অর্ক। খালি ট্রাম। বসামাত্র খেয়াল হল, কোথায় যাবে ঠিক করা হয়নি, কোথায় গিয়ে রাতটা থাকা যায়? এই মুহূর্তে পরিচিত কোনও মুখ মনে পড়ল না। কোথায় যাওয়া যায়? শিয়ালদায় বেশ কিছু অল্প দামের হোটেল আছে, তার একটা নিয়ে রাত কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এসে ট্রাম থেকে নামল অর্ক। এখন রাত সাড়ে নটা বেজে গেছে। শিয়ালদার হোটেলের পাড়ায় হেঁটে এল সে। প্রথম যে হোটেল চোখে পড়ল তাতেই ঢুকে পড়ল। ঘর পাওয়া যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই টেবিলের উলটোদিকে বসা লোকটি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে হাত বাড়াল।

কী চাইছেন?

আপনার পরিচয়পত্র। ভোটার কার্ড আছে?

না।

তা হলে যা দিয়ে বোঝা যাবে আপনি কে তাই দিন।

আমি তো সঙ্গে কিছু আনিনি।

তা হলে ঘর দেওয়া সম্ভব নয়।

কিন্তু কেন? আমি শুধু আজকের রাতটা থাকব।

আর সঙ্গে মালপত্র নেই। তাই তো? দেখুন, থানা থেকে কড়া অর্ডার এসেছে। উইদাউট আইডেন্টিটি কাউকে ঘর দেওয়া যাবে না। যান। ঝামেলায় পড়তে চাই না। লোকটা বিরক্ত গলায় বলল।

মহাত্মা গাঁধী রোডে দাঁড়িয়ে কী করবে যখন মাথায় আসছিল না, ঠিক তখন ট্রামটাকে দেখতে পেল অর্ক, হাওড়া স্টেশন যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিটা মাথায় এল। সোজা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে যে-কোনও একটা বেঞ্চিতে বসে সে দিব্যি রাতটা কাটিয়ে দিতে পারে।

হাওড়া স্টেশন পৌঁছে ভেতরে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াতেই সে দেখল একটা যাত্রীকে খুব শাসাচ্ছেন স্টেশনের টিকিট চেকার। লোকটি ভেতরে ঢোকার জন্যে প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনেছিল কিন্তু চেকার বলছেন প্ল্যাটফর্ম টিকিট কিনে রাত পর্যন্ত সেই অধিকারে ভেতরে থাকা যায় না। তা ছাড়া চেকারের ধারণা ওই প্ল্যাটফর্ম টিকিট সকালে কাটার পর অনেকবার হাতবদল হয়েছে। লোকটি স্বীকার করল সে ঘণ্টাখানেক আগে কম দামে টিকিটটি কিনেছে।

অর্ক সরে এসে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। এখন টিকিট কিনে ভোর পর্যন্ত স্টেশনে থাকা যাবে কি না তা ওর জানা নেই। ঝামেলায় না পড়ার জন্যে সে খড়গপুর পর্যন্ত একটা সাধারণ টিকিট কিনে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে চমকে গেল অর্ক। গিজগিজ করছে মানুষ। কোনও বেঞ্চি খালি নেই, মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে বসে আছে প্রচুর মানুষ। অর্ক অনুমান করল এরা হয় মধ্যরাতের নয় ভোরের ট্রেন ধরবে। কিন্তু এখানে রাত কাটাতে হলে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

খিদে পাচ্ছিল এবার। পাশের স্টল থেকে চিকেন রোল এবং চা খেয়ে সে দেখল এখন রাত পৌনে এগারোটা। কী করা যায় ভাবতেই সে দেখল সামনের প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে গেল। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ক্রমাগত কোন ট্রেন ছাড়বে এবং আসবে তার ঘোষণা চলছে। হঠাৎ মাথায় খেলে গেল ভাবনাটা। তার পকেটে খগপুরের টিকিট আছে। কোনও লোকাল ট্রেনে সে স্বচ্ছন্দে আরাম করে খঙ্গপুরে চলে যেতে পারে। তারপর সেখানে নেমে হাওড়ার টিকিট কিনে ফিরে আসতে আসতে রাত শেষ হয়ে যাবে। ভাগ্য ভাল থাকলে বসার বদলে সে শুয়েও যেতে পারে। ট্রেনটা যদি খড়গপুরেই যাত্রা শেষ করে তা হলে ঘুমিয়ে পড়লেও ক্ষতি নেই।

রাত সাড়ে এগারোটার লোকাল ট্রেনে উঠে খুব খুশি হল অর্ক। দু তিনজন যাত্রী ছাড়া কামরা বিলকুল ফাঁকা। ট্রেন চলতে শুরু করলে বেঞ্চিতে শরীর মেলে দিল সে। আঃ, কী আরাম! সেই সকালের পর এরকম বিশ্রামের সুযোগই পাওয়া যায়নি। সারাদিন শুধু টেনশন আর টেনশনে কেটে গেছে। কাল সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা সে শিয়ালদায় চলে যাবে। মা বাবা যে ট্রেনেই আসুক সকাল নটার মধ্যে শিয়ালদায় পৌঁছে যাবে। স্টেশনে ওকে দেখতে পেলে নিশ্চয়ই খুশি হবে ওরা।

ব্যাপারটা ভেবে আরাম বোধ করল অর্ক। সে কঁধব্যাগ মাথার নীচে রেখে আরাম করে পাশ ফিরে শুল। ট্রেনটা চলেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মাঝেমধ্যে স্টেশনগুলোতে থামছে কিন্তু যাত্রী উঠছে খুব কম। ফলে অর্কর ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছিল না। হঠাৎ মাথাটা ওপরে উঠেই বেঞ্চিতে আছাড় খেলে সে উঃ বলে উঠে বসতেই একটা লোক দৌড়ে নেমে গেল প্ল্যাটফর্মে। থেমে থাকা ট্রেন চলতে শুরু করেছে, অর্ক দৌড়ে দরজার সামনে পৌঁছোতে না পৌঁছোতে প্ল্যাটফর্ম পেছনে চলে গেল।

এইরকম মড়ার মতো ঘুম কেউ কি রেলগাড়িতে ঘুমায়?

প্রশ্নটা শুনে মুখ ফেরাল অর্ক। পাকা দাড়ি, মাথায় সাদা টুপি পরা প্রৌঢ় মানুষটি বললেন, আসুন শান্ত হয়ে বসুন, যা গেল তার জন্যে শোক করবেন না।

লোকটাকে আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে দেখেও চিৎকার করলেন না কেন? অর্ক রেগে গেল।

প্রাণের ভয়ে। ওর কাছে নিশ্চয়ই ছুরি আছে, সেটা যদি আমার বুকে বসিয়ে দিত তা হলে কি আমার ভাল লাগত? আপনি খুশি হতেন। দামি কিছু ছিল?

জামাকাপড়।

ইনসাল্লা। আল্লা যা ভাল মনে করেন তাই করেছেন।

আমার আর কোনও জামাকাপড় সঙ্গে থাকল না এটা ভাল হল?

মনে করুন, আরও খারাপ কিছু হতে পারত। এটা মনে করলে বোঝাটা কমে যাবে। প্রৌঢ় হাসলেন, বসুন। রাতের এইসময় লোকাল ট্রেনে কেউ ঘুমায়?

অভিজ্ঞতা ছিল না বলে! এইরকম ছিনতাই হয় কে জানত?

ও অতি নিম্নশ্রেণির ছিনতাইবাজ। অতি উচ্চশ্রেণির হলে আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলত। ব্যাগের দিকে হাত না বাড়িয়ে বলত, পকেটে যা আছে সব বের করে দিতে। আপনি কোনও প্রতিবাদই করতে পারতেন না কারণ আগ্নেয়াস্ত্র দেখাত। তারপর দিব্যি সিগারেট খেত আপনার সামনে বসে। যে স্টেশনে দরকার নেমে যেত। এই কারণেই মাঝরাত্রের ট্রেনে উঠলে আমি সঙ্গে কিছু রাখি না। প্রৌঢ় তাঁর সাদা দাড়িতে আঙুল বোলালেন।

অর্ক বসল, তার পকেটে ট্রেনের টিকিট, কিছু টাকা আর এটিএম কার্ড, মোবাইল রয়েছে। এখন ফিরে আসার ট্রেন থাকলেও সেটা না ধরে ভোরের ট্রেন ধরতে হবে। যাতে ওগুলো ছিনতাই না হয়ে যায়।

কোথায় যাচ্ছেন?

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন।

কোথাও না।

লাখ টাকার উত্তর। সত্যি তো আমরা কে কোথায় যাচ্ছি জানি না।

আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

খড়্গপুরে, আমার ভাইয়ের বাসায়। ও কাল সকালে হজ করতে যাবে। বাসা খালি পড়ে থাকবে। তাই কদিন পাহারা দিতে হবে। প্রৌঢ় হাসলেন, সেখান থেকে যাব ইসলামপুরে। বাপ-মাকে নিয়ে এক বন্ধু আজমিরে যাবে, তারও বাসা পাহারা দেবার জন্য আমাকে দরকার।

অর্ক অবাক হল, আপনি বিয়ে থা করেননি?

করেছিলাম। আমাকে তার পছন্দ হয়নি বলে আর একজনের সঙ্গে চলে গেছে। ওই যে বললাম, যা গেছে তার জন্যে শোক না করতে। আমিও করিনি। প্রৌঢ় বললেন, খড়্গপুর অবধি ঠিক আছে, তারপরেই আসল। বিপদ।

কীরকম?

কখন ট্রেনলাইন বোমা মেরে উড়িয়ে দেবে তা কামরায় বসে জানতেও পারবেন না। দেখছেন না, খোদ সরকারও মাওবাদীদের ভয় পাচ্ছে। প্রৌঢ় গলা নামালেন শেষ কথাগুলো বলতে।

অর্ক সতর্ক হল। এই বৃদ্ধ আসলে কী তা যখন সে জানে না তখন মুখ খোলা অত্যন্ত বোকামি হবে। লোকটা তো পুলিশের চর হতে পারে। সে জিজ্ঞাসা করল, খঙ্গপুর আর কতদূর?

প্রৌঢ় শব্দ করে হাসলেন, কতবছর পরে আপনি মনে করিয়ে দিলেন। তা একসময় খুব গল্প পড়তাম। উপন্যাস পড়ার ধৈর্য ছিল না। বউ চলে যাওয়ার পর ওই পড়াটড়া ছেড়ে দিয়েছি। সেই সময় একটা গল্প পড়েছিলাম, ডানকুনি আর কতদূর? লেখকের নাম শ্রীশচীন ভৌমিক। এখনও বেঁচে আছেন কিনা জানি না। আমিও ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি খঙ্গপুর আর কতদূর জিজ্ঞাসা করতে মনে পড়ে গেল। এই যে কথা থেকে কথা মনে পড়ে যাওয়া, গন্ধ থেকে স্মৃতি ফিরে পাওয়া, ভারী চমৎকার ব্যাপার। খড়গপুর থেকে কতদূরে যাবেন?

কোথাও না। হাওড়ায় ফিরে যাব। অর্ক উঠে চলন্ত ট্রেনের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বাইরের ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে একটু-আধটু টিমটিমে আলো, বাতাসও বেশ শীতল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুন্তীর মুখ মনে পড়ল। অদ্ভুত ছিমছাম মেয়ে যার সঙ্গে কথা বললে দূরের মানুষ বলে মনে হয় না। যদি আরও আগে ওর সঙ্গে আলাপ হত? হেসে ফেলল সে। তবে কী হত? কুন্তী নিশ্চয়ই এম এ পাশ করে শিক্ষকতা করছে। ওর ধারেকাছে বিদ্যে তার নেই। যেসব কারণে সংসারী হওয়ার কথা ভাবা যায় তা কোনওদিন মাথায় আসেনি এবং তার জন্য কোনও আক্ষেপ কখনও হয়নি। আজ হঠাৎ এসব ভাবছে কেন সে? মোবাইল বের করে সময় দেখল অর্ক। এখন গভীর রাত। ট্রেন কোনও নদী পার হচ্ছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটছে বলে অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে। হঠাৎ বাবার মুখ মনে এল। ছেলেবেলায় বাবাকে কবিতা আবৃত্তি করতে শুনত স্কুল থেকে ফিরে। একটা কবিতা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তার। আজ এই রাতের এমত সময়ে আচমকা লাইনগুলো বুকে পাক খেয়ে গেল, আধেক লীন হৃদয়ে দূরগামী/ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি/সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া/অবনী বাড়ি আছ?

খড়গপুরে এর আগে গিয়েছেন?

না। অর্ক ফিরে দাঁড়াল।

স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনটা বিশাল অজগর সাপের মতো ঘুমিয়ে পড়ল। কয়েকজন যাত্রী চোখের পলকেই চলে গেলেন যে যার গন্তব্যে।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন ফেরার ট্রেনটা কখন পাবেন বোর্ড দেখে বলে দিই। দেখা গেল তাকে আরও একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। প্রৌঢ় চিন্তিত হলেন। এরকম নির্জন স্টেশনে একা বসে থাকা ঠিক হবে না।

কেন?

পুলিশ এসে খামোকা হয়রানি করবে। তার চেয়ে বাইরে চলুন। স্টেশনের বাইরে একটা চায়ের দোকান আছে। সেখানে বসে চা খেয়ে সময় কাটাতে পারবেন। আমিও ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। প্রৌঢ় বললেন।

চায়ের দোকান এত রাত্রে ভোলা থাকবে?

আগের বার দেখেছি খোলা ছিল। প্রৌঢ় এগোলেন।

এত রাতেও দোকানে আলো জ্বলছে। দুজন খদ্দের। অর্ক প্রৌঢ়ের সঙ্গে ভেতরের বেঞ্চিতে গিয়ে বসার আগে সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল। সুন্দর করে লেখা, লাল কেবিন।

এই নাম সে কার মুখে শুনেছে? চোখ বন্ধ করল অর্ক।

.

৪৩.

প্রৌঢ় বললেন, দুকাপ চা নতুন করে বানিয়ে দিন লালবাবু। খুব রোগা, লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা বৃদ্ধ, যিনি ক্যাশবাক্সের পাশে বসে ছিলেন তিনি বললেন, রাত বারোটার পর এই দোকানে পুরনো চা বিক্রি হয় না। বসুন।

বেঞ্চিতে বসতে বসতে মনে পড়ে গেল অর্কর। রামজির মুখে এই দোকানের কথা সে শুনেছিল। হাওড়া থেকে এই দোকানে এসে কোথায় যাবে তার খবর নিতে বলা হয়েছিল তাকে। বৃদ্ধের দিকে তাকাল অর্ক। তা হলে কি নিরীহ দেখতে এই মানুষটির সঙ্গে রামজির দলের লোকদের যোগাযোগ রয়েছে? একেবারে স্টেশনের বাইরে এই দোকান ঘেঁষে যদি বৃদ্ধ পোস্ট অফিসের কাজ করেন তা হলে তা পুলিশ জানতে পারল না? অর্কর ইচ্ছে হচ্ছিল বৃদ্ধকে রামজির ব্যাপারে প্রশ্ন করে। রামজি এখন কোথায় তা ইনি নিশ্চয়ই জানেন, কিন্তু নিজেকে সামলাল অর্ক। যদি সন্দেহ সত্যি হয় তা হলে অচেনা লোকের কাছে ইনি মুখ খুলবেন না।

চা দিয়ে গেল একজন। প্রৌঢ় সেটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পেট খালি নাকি?

মাথা নাড়ল অর্ক, তারপর চুমুক দিল। চায়ের স্বাদ ভাল।

প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে এইসময় রাস্তায় হাঁটা কি নিরাপদ?

বৃদ্ধ বললেন, ভবিষ্যৎ বলতে পারব না। তবে এখন চোর ছিনতাইবাজের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। অন্তত গত কয়েকমাসে সেরকম খবর কানে আসেনি।

প্রৌঢ় হাসলেন, তা হলে তারা সবাই লোকাল ট্রেনগুলোতে আস্তানা গেড়েছে। এই যে, আমার এই ভাইয়ের ব্যাগ ট্রেন থেকে ছিনতাই হয়ে গেল।

খবরটা খুব দুঃখের। আপনারা কোথায় যাবেন? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বি-ই কলেজের কাছে যাব। ভোর হোক, তখন রওনা হব। প্রৌঢ় চায়ের কাপ রাখলেন, ইনি ফাস্ট ট্রেন ধরে ফিরে যাবেন।

সে কী? এসেই ফিরে যাবেন কেন?

হোটেলে থাকলে যা খরচ হত ট্রেনে যাতায়াত করলে তার চেয়ে অনেক কমে হয়ে গেল। অর্ক জবাব দিল।

তা ভাই কি হোটেলেই বসবাস করেন? স্থায়ী বাসা নেই? বৃদ্ধ হাসলেন।

তা থাকবে না কেন? কিন্তু আজকের রাতটা বাইরে কাটাতে হচ্ছে।

তাই বলুন। অনেকে শুনেছি পুলিশের ভয়ে বেশ্যাপাড়ায় গিয়ে রাতটা কাটিয়ে আসে। বোধহয় তেমন ঘরে গেলে হোটেলের চেয়ে সস্তা হয়। আপনি তা না করে নতুন পথ দেখালেন। বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন। বেঁচে থাকলে আরও কত নতুন দেখব।

প্রৌঢ় বললেন, দেখবেন তো নিশ্চয়ই। এখন থেকেই তো পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করে দিয়েছে। পরিবর্তন হয়ে গেলে নতুন দেখার সুযোগ পাবেন।

হাওয়া বলছেন কী ভাই, ঝড় উঠল বলে। এই দোকানে আমি দিনের বেলায় বসি না। রাত দশটায় আসি, আলো ফুটলে চলে যাই তখন দুই ছেলে পালা করে বসে। কী করব বলুন? রাতে কিছুতেই ঘুম আসে না। যত ঘুম দুপুরে। তাই রাত জেগে চেয়ে চেয়ে দেখি। পরিবর্তনের ঝড় আসছে। বলতে বলতে বৃদ্ধ মুখ ফেরালেন। একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ড্রাইভারের পাশে বসে অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও খবর আছে। লালবাবু?

বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন, না স্যার। রাতের বেলায় কোনও খবর পাইনি।

ছেলেদের বলবেন দিনের বেলায় কান খাড়া রাখতে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু হলে অফিসার চেঁচিয়ে বললেন, এবার নিজের আর দোকানের নাম পালটাতে হবে যে, নতুন নাম ভাবুন। জিপ বেরিয়ে গেল।

বৃদ্ধ অর্কদের দিকে তাকালেন, শুনলেন? ঠাকুরদার দেওয়া নামটা এবার বদলাতে হবে। আর সবুর সহ্য হচ্ছে না ।

এই সময় একটি ছেলে দ্রুত সাইকেল চালিয়ে দোকানের সামনে চলে এল, দাদু, এখনই এলাকা ঘিরে সার্চ করবে পুলিশ? বড়বাবু কিছু বলল?

না ভাই। খবর আছে কিনা জিজ্ঞাসা করল। বৃদ্ধ জবাব দিতেই ছেলেটা উধাও হয়ে গেল।

প্রৌঢ় উঠে দাঁড়ালেন, চায়ের দাম নিন। এখন এখানে বসে থাকলে ঝামেলায় পড়তে হবে। কী বলেন দাদা?

বৃদ্ধ বললেন, ওরে বাবুর কাছ থেকে টাকাগুলো নে।

যে চা দিয়েছিল সে দাম নিয়ে গেল। অর্ক বুঝতে পারল লালবাবু প্রৌঢ়ের প্রশ্নের উত্তর দেবেন না। সে উঠে দাঁড়াল, আমি তা হলে প্ল্যাটফর্মেই চলে যাই। ওয়েটিং রুম নিশ্চয়ই খোলা পাব।

বৃদ্ধ বললেন, কুমিরের মুখে মাথা গলিয়ে দেবেন? অবশ্য আপনার যা ইচ্ছে।

প্রৌঢ় বললেন, ভাই, চলুন, পায়ে হেঁটে এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাই। আঁধার কাটলে না হয় রিকশায় ফিরে এসে ট্রেন ধরবেন।

বৃদ্ধ বললেন, সেই ভাল, সেই ভাল।

প্রৌঢ়র পেছন পেছন বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল অর্ক, আমি আগে কখনও খঙ্গপুরে আসিনি, কিন্তু আপনার দোকানের নাম শুনেছি।

প্রশংসা না নিন্দে? বৃদ্ধ নিরুত্তাপ।

কোনওটাই নয়। আমার পরিচিত একজন বলেছিল সে আপনার দোকানে আসবে।

কী নাম?

রামজি।

মনে নেই। রাম লক্ষ্মণ থেকে নকুল সহদেব, কতজনই তো আসছে। যান, আর দেরি করবেন না। বৃদ্ধ চোখ বন্ধ করলেন। খঙ্গপুরের রাস্তায় যথেষ্ট আলো। কিন্তু এই সময়ে চারধার খাঁ খাঁ করছে। প্রৌঢ় হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তা ছেড়ে গলির ভেতর ঢুকলেন, একটু শর্টকাট করি। তা ছাড়া বড় রাস্তায় হাঁটলে মহাজনদের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ভাইয়ের নামটা বোধহয় এখনও জানা হয়নি।

অর্ক।

বা রে, বা। চমৎকার নাম। আমি আবুল কালাম আজাদ। অবাক হওয়ার। কোনও কারণ নেই। আমার এই নাম অন্তত দশ হাজার মুসলমানের আছে। তবে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত তার দশ হাজারের এক ভাগ গুণ আমার নেই। কথাগুলো বলে খানিকটা পথ চুপচাপ হাঁটলেন আজাদভাই। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু ভাই, আপনি তখন বললেন রামজির কাছে লালবাবুর দোকানের নাম শুনেছেন। রামজি তো বাঙালির নাম হতে পারে না।

রামজি বাঙালি নয়। ঝাড়খণ্ডের মানুষ।

তাই বলুন।

কিন্তু গলি থেকে বড় রাস্তায় আসতেই হল ওদের। এঁকেবেঁকে সেটা আবার বেরিয়ে এসেছে। খানিকটা হাঁটতেই পেছন থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে এল। প্রৌঢ় বললেন, তাড়াতাড়ি পা চালান, স্টেশনে গুলি চলছে।

পুলিশ? প্রশ্নটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অর্কর।

জবাব দিলেন না প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ। দুটো সাইকেলে চারটে ছেলে পাঁইপাঁই করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

আপনি যেখানে যাচ্ছেন সেই জায়গা এখান থেকে কত দূরে? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

প্রৌঢ় বললেন, আমার সব হিসেব গুলিয়ে গেছে।

তার চেয়ে রাস্তার পাশে কোনও শেড-এর নীচে ভোর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বোধহয় ঠিক হবে। অর্ক বলল।

বৃদ্ধ চারপাশে তাকালেন। এই রাস্তায় দোকানপাটও তেমন নেই। যা আছে। তাদের সামনে কোনও শেড নেই।

এইসময় তৃতীয় সাইকেলটি পেছন থেকে চলে এল। অর্ক দেখল সাইকেল নড়বড় করছে। রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশে যেতে যেতে মাটিতে পড়ে গেল। যে চালাচ্ছিল তার গলা থেকে গোঙানি ছিটকে বের হল।

প্রৌঢ় দৌড়ে গেলেন ছেলেটার কাছে। রাস্তার আলোয় বোঝা গেল ওর পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। প্রৌঢ় জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে ভাই?

ছেলেটা ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল, মা! মাগো!

প্রৌঢ় ওকে টেনে সোজা করার চেষ্টা করলেন। রক্তাক্ত হয়ে জ্ঞান হারায়নি ছেলেটা। জিজ্ঞাসা করল, আপনারা কি পুলিশ?

প্রৌঢ় বললেন, না

তা হলে আমাকে বাঁচান। আমাকে সামনের গলির ভেতরে স্কুলের পেছনে নিয়ে চলুন। প্লিজ। ছেলেটি কাতরাতে লাগল।

প্রৌঢ় অর্কর দিকে তাকাল, ওকে কি সাহায্য করবেন?

অর্ক বলল, ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াটাই জরুরি।

ছেলেটি দ্রুত মাথা নাড়ল, হাসপাতালে গেলেই পুলিশ অ্যারেস্ট করবে। স্কুলের পেছনে গেলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমার হাঁটুর ওপরে একপাশে গুলি লেগেছে। উঃ, মাগো!

অর্ক বলল, তা হলে ওকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে চলুন। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়।

সাইকেল দাঁড় করিয়ে ছেলেটিকে সিটে বসিয়ে ওরা যখন গলির ভেতর ঢুকছে তখন দেখতে পেল স্টেশনের দিক থেকে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি আসছে। ওটা যে পুলিশের গাড়ি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

গলির ভেতরে খানিকটা যাওয়ার পর প্রৌঢ় ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বাসা কোথায় ভাই?

এখানে আমার বাসা নেই। আমাকে ওই বারান্দায় নামিয়ে দিলেই হবে।

ওই বারান্দায় নামালে কে তোমাকে দেখবে? এখনই ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার, কী করি বলুন তো? অর্ককে প্রশ্ন করলেন প্রৌঢ়।

আমরা ওকে কোথায় নিয়ে যাব? ও যা বলছে তাই করাই ভাল। বলতে বলতে অর্ক দেখল দুটো গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে বড় রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা গলির দিকে মুখ করে দাঁড়ালেই তাদের দেখতে পেত।

অগত্যা প্রৌঢ়র সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছেলেটিকে বারান্দায় শুইয়ে দেওয়া হল। এখন আশেপাশের সব বাড়ির জানলা দরজা বন্ধ। গলির ভেতরের দিকটা অন্ধকার। শোওয়ার পর ছেলেটি পকেট থেকে সেলফোন বের করে চোখের সামনে যন্ত্রটা এনে বোতাম টিপতে গিয়ে থমকাল, আপনারা চলে যান, প্লিজ।

প্রৌঢ় বললেন, চলুন। কয়েক পা হেঁটে অর্ক পেছন ফিরে দেখল ছেলেটা সেলফোনে কথা বলছে। আশ্চর্য! অত রক্তপাতের পরেও ছেলেটার হুশ ঠিকঠাক রয়েছে। গলির মুখে এসে অর্ক বলল, বড়রাস্তায় হাঁটলেই পুলিশ আটক করবে।

করলে করবে। আমি রাতের শেষ ট্রেনে এসেছি! কোন ঠিকানায় যাব তা ওদের বলব। খোঁজ নিলেই বুঝবে মিথ্যে বলছি না।

প্রৌঢ়র গলায় বেপরোয়া সুর। অর্ক অবাক হয়ে বলল, আমি তো কিছুই বলতে পারব না।

প্রৌঢ় মাথা নাড়লেন। হ্যাঁ। আপনি সমস্যায় পড়বেন।

তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, সমস্যা বলছি কেন? আপনি একজন ভদ্রলোক। খুন জখম বা ছিনতাই কখনও করেছেন? যাকে বলে উগ্রপন্থী রাজনীতি, সেই দলে কি আপনি?

না।

তা হলে আপনি সমস্যায় পড়বেন না।

মানে? পুলিশ ধরলে সত্যি কথা বলবেন। নিজের পরিচয় দেবেন।

কিন্তু পুলিশ নিশ্চয়ই জানতে চাইবে এত রাত্রে খড়গপুরের রাস্তায় আমি কী করছি? কী জবাব দেব?

একটা কিছু ভেবে নিন ভাই।

মাথায় কোনও জবাব প্রথমে আসছিল না। প্রৌঢ় হাঁটতে শুরু করলে অর্কর আচমকা মনে হল, সে পুলিশকে বলবে ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে থানার বড়বাবুর চাপে বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। বড়বাবু বলেছেন, যেমন করেই হোক রামজির সন্ধান তাকে দিতে হবে। সময়ও বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু রামজির ঠিকানা সে জানে না। আজ বিকেলে মনে পড়ে গেল রামজি তার কাছে খঙ্গপুর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। ওর গ্রামের এক বন্ধু খঙ্গপুরের থানায় পোস্টেড। জিজ্ঞাসাবাদ করে সেই লোকটাকে বের করলে হয়তো তার কাছ থেকে রামজির ঠিকানা জানা যাবে এই আশায় মরিয়া হয়ে সে চলে এসেছে।

প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদ হনহনিয়ে হেঁটে যাওয়ায় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। হঠাৎ অর্কর মনে পড়ল লোকটার সঙ্গে গিয়ে তার কী লাভ হবে? রাত ফুরোতে তো মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি। তার চেয়ে ফিরে গিয়ে লালবাবুর দোকানে বসাই ভাল। চট করে ট্রেনে ওঠা যাবে। তার মধ্যে পুলিশ ধরলে তো জবাব তৈরি হয়ে গেছে।

প্রৌঢ় মানুষটাকে এখন আবছা দেখাচ্ছে। এই সময় ওপাশ থেকে একটা জিপ হেডলাইট জ্বালিয়ে আসতেই মানুষটাকে সিলুট হয়ে যেতে দেখল সে। জিপটা থেমে গেল। চিৎকার কানে আসতে অর্ক দ্রুত গলির মুখে গিয়ে দাঁড়াল। সে দেখল প্রৌঢ় মাথার ওপর দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন এবং দুটো পুলিশের অবয়ব তার সামনে। তখনই প্রচণ্ড শব্দ হল। পরপর চারটে বোম পুলিশের গাড়ির ওপর আছড়ে পড়তেই প্রৌঢ় দৌড়ে পালাতে চাইলেন। যে দুটো পুলিশ তার সামনে ছিল তাদের একজন রিভলভারের ট্রিগার টিপতেই প্রৌঢ় রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়লেন। পুলিশের গাড়ি তখন ধোঁয়ার আড়ালে। এখনই জায়গাটায় অনেক পুলিশ এসে যাবে। অর্ক আর ভাবতে পারল না। রাস্তার ধার ঘেঁষে সে দ্রুত হাঁটতে লাগল স্টেশনের দিকে। ভূতে তাড়া করলে মানুষ যেভাবে ছোটে দিকবিদিকে জ্ঞান হারিয়ে সেইভাবে হাঁটতে গিয়েও মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল অর্ক। স্টেশনের দিক থেকে একের পর এক পুলিশের গাড়ি ছুটে যাচ্ছে ঘটনাস্থলে। সেই আলো দেখেই তাকে লুকোনোর জায়গা খুঁজতে হচ্ছিল। এই করতে করতে সে যখন স্টেশনে পৌঁছাল তখনও লালবাবুর দোকান খোলা কিন্তু সেখানে না গিয়ে সে সোজা টিকিট কাউন্টারের সামনে এসে দেখল ভিতরে লোক বসে আছে। হাওড়ার টিকিট কিনে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ভুতুড়ে চেহারার ট্রেনটাকে দেখতে পেয়ে চুপচাপ উঠে বসল। একটাও মানুষ নেই কামরায়। এই ট্রেন আদৌ কোথাও যাবে কি না সে জানে না। রাত শেষ হয়ে আসছে। কামরার ভেতরে অন্ধকার। সে জানলা দিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে দেখল দুজন রাইফেলধারী রেলের পুলিশ হেঁটে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো পরে হঠাৎ ট্রেনে আলো জ্বলে উঠল। তারপর যেতে হয় তাই যাওয়ার ভঙ্গিতে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে হাওড়ার দিকে এগোতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল অর্ক। ঘুমিয়ে পড়লেও তার পকেট থেকে জোর করে বের না করলে কেউ লাভবান হবে না। সে চোখ বন্ধ করল। করতেই প্রৌঢ় আবুল কালাম আজাদের শরীরটাকে রাস্তার ওপর আছাড় খেয়ে পড়তে দেখল। নিশ্চয়ই পিঠে বা মাথায় গুলিটা লেগেছিল। যে পুলিশ ছুঁড়েছিল সে কী ভেবেছিল? মাওবাদীরা প্রৌঢ়কে টোপ দিয়ে পুলিশের গাড়ি থামিয়েছে? থামার পর তারা বোম চার্জ করেছে? এই ঘটনার আর কেউ সাক্ষী আছে কি না কে জানে, কিন্তু কাল কাগজে ছাপা হবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন মাওবাদী প্রৌঢ় নিহত। ওই মানুষটা তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিল। তাকে চা খাইয়েছিল। মানুষটার জীবিকা কী তা অর্ক জানে না, কিন্তু আত্মীয় বন্ধুদের উপকারের জন্যে এর বাড়ি ওর বাড়ি পাহারা দিতে ভালবাসত। প্রৌঢ় জানত না, প্রশ্নের বদলে পুলিশ বুলেট ব্যবহার করতে অনেক বেশি পছন্দ করে। যারা লুকিয়ে থেকে পুলিশের গাড়িতে বোমা ছুঁড়েছিল তারা সন্ত্রাসবাদী অথবা মাওবাদী হলে যে পুলিশ প্রশ্ন না করে প্রৌঢ়কে গুলি করে মেরেছে সে উগ্রপন্থী নয় কেন?

প্রথম রোদে কলকাতাকে এখনও মোলায়েম দেখায়। এখনও চিৎকার, শব্দের কোরাস শুরু হয়নি। গঙ্গার জল এই সময় সত্যি পবিত্র বলে মনে হয়। হাওড়া থেকে অর্ক ট্রাম ধরে চলে এল শিয়ালদায়। একটু একটু করে শহর জাগছে। স্টেশনও।

সত্তরের নকশাল আন্দোলন হয়েছিল ভারতের সংবিধান পালটাতে, সমাজব্যবস্থা বদলাতে। তখন ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস, যুক্তফ্রন্ট, বামফ্রন্ট তারপর আবার কংগ্রেস। সে সময় রাজনৈতিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করার জন্যে। সরকার পুলিশকে ব্যবহার করতেন। মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার আগে পুলিশ দিয়ে মানুষ খুন করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিল। বুর্জোয়া শাসকদের সমালোচনা করে গিয়েছে সমানে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর ধীরে ধীরে তাদের ঔদ্ধত্য যত বেড়েছে, যত তারা আগের আদর্শচ্যুত হয়েছে, তত পুলিশকে ব্যবহার করে আনন্দিত হয়েছে।

দূর থেকে বাবা এবং মাকে দেখতে পেল অর্ক। কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে মা তাকে সামলে হেঁটে আসছে, একটু পেছনে ক্রাচ হাতে বাবা। অর্কর মনে হল দুজনকেই বেশ ভাল দেখাচ্ছে। চেহারায় পরিবর্তন এসেছে।

এই যে, দাঁড়াও। কুলিকে দাঁড়াতে বলে মাধবীলতা সামনে এল, তুই?

তোমাদের নিতে এলাম, চলো। অর্ক হাসল।

অনিমেষ ততক্ষণে চলে এসেছিল কাছে। অর্ককে দেখে মাধবীলতাকে বলল, ওর চেহারাটা দেখেছ? রাত জেগে চুরিচামারি করে বেড়াচ্ছে নাকি?

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, রাতে ঘুমোসনি?

অর্ক বলল, চলো, তোমাদের সব বলছি। এই কুলি, ট্যাক্সিস্ট্যান্ড চলো।

লাইন দিয়ে ট্যাক্সি পেতে আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল। ট্যাক্সি যখন চলতে শুরু করেছে তখন মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী বলবি বলছিলি?

আমাদের বাড়িতে সুরেন মাইতির লোকজন হামলা করেছিল কাল।

সে কী? কেন? মাধবীলতা অবাক।

আমার কাছে যে ছেলেটি ছিল তাকে ওরা মাওবাদী বলে সন্দেহ করেছিল। বিশ্বাস করো আমার সঙ্গে ছেলেটি কখনওই রাজনীতি নিয়ে কথা বলেনি। ও চলে যাওয়ার পরে পুলিশ আমায় ডেকে ওর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিল। অর্ক বলল।

এইজন্যে হামলা করেছে! মাধবীলতার গলায় বিস্ময়।

হ্যাঁ, তার সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে রেগে যাওয়াটাও ছিল। আমি গতকাল বামফ্রন্ট বিরোধী বিশাল অরাজনৈতিক মিছিলে হেঁটেছিলাম এই খবরটা ওরা পেয়েছিল। সেই রাগে বাড়ি ভেঙে তছনছ করেছে। অর্ক বলল।

সর্বনাশ। তা হলে আমরা থাকব কোথায়? মাধবীলতা যেন পরে পড়ল। এতক্ষণে অনিমেষ কথা বলল, মনে হচ্ছে এতদিনে তুমি রাজনীতিতে নামবে। নামো, আরও নামমা, কিন্তু আমাদের জড়িয়ে নয়।

.

৪৪.

বিস্তারিত শোনার পরে মাধবীলতা একটি কথাও বলেনি, বাড়িতে ঢুকে হতভম্ব হয়ে চারপাশে তাকাল। জিনিসপত্র ঘরে নিয়ে গিয়েছিল অর্ক। অনিমেষ হতাশ গলায় বলল, এখানে না ফিরে এলেই ভাল হত।

মাধবীলতা অনিমেষের দিকে তাকাল। তারপর শ্বাসজড়ানো শব্দগুলো উচ্চারণ করল, আর কতদিন কতবার আমি সহ্য করব! কথাগুলো একেবারেই নিজেকে বলা। সেটা বুঝেই অনিমেষ ঠোঁট কামড়াল। বহু বছর, সেই জেল থেকে বের হয়ে মাধবীলতার সঙ্গে চলে আসার পর থেকে যে হীনমন্যতাবোধ তার মনে আঁচড় কাটত, যা ক্রমশ নেতিয়ে ধুলোচাপা হয়ে গিয়েছিল তা মাধবীলতার কথায় আবার জেগে উঠল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে উঠোনে পা রেখে বারান্দায় বসে পড়ল। নিজেকে অর্থহীন বলে মনে হচ্ছিল তার।

অর্ক বেরিয়ে এল। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, পুলিশ তোর ডায়েরি নেয়নি?

ডায়েরি করার সুযোগ পাইনি। থানার ওসি নিজেই দেখতে এসে আমাকেই যা ইচ্ছে তাই বলে গেলেন। অর্ক জানাল।

কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।

আমিই নাকি এসবের জন্যে দায়ী।

সত্যি কথা বল, তুই জেনেশুনে একটা মাওবাদী ছেলেকে বাড়িতে রেখেছিলি?।

সত্যি কথাই বলছি মা, আমি কিছুই জানতাম না। ও ঝাড়খণ্ডের ছেলে। আমার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কোনও কথাই বলেনি। আমার তো ওকে ভদ্র সরল মানুষ বলে মনে হয়েছে। পরে বুঝেছি ও কোনও দলের সঙ্গে যোগ দিতে এসেছে। সেই দল প্রকাশ্যে কাজ করে না। কিন্তু এটা যখন বুঝেছি তখন ওর চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। অর্ক বলল।

মাধবীলতা ধীরে ধীরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। তাকে ফিরতে দেখে ইতিমধ্যেই বস্তিতে ছোটখাটো জটলা তৈরি হচ্ছিল, এখন তারাই কৌতূহলী হয়ে সঙ্গ নিল। মাধবীলতা বস্তি থেকে বেরিয়ে সোজা সুরেন মাইতির পার্টি অফিসে পৌঁছে গেল। অত সকালে অফিসের দরজা খোলেনি কিন্তু সুরেন মাইতির দুজন ছায়াসঙ্গী বারান্দায় বসে ছিল। মাধবীলতা তাদের বলল, সুরেনবাবুকে একটু ডেকে দাও তো ভাই।

মাধবীলতা এবং তার পেছনে জনা পনেরো মানুষ, যাদের বেশিরভাগই মহিলা, দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল ছেলে দুটো। দ্রুত মাথা নেড়ে চলে গেল সুরেন মাইতিকে ডাকতে। তাদের সঙ্গে সুরেন মাইতি আসার আগেই ভিড়ের আয়তন বেড়ে গেল। লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি চাপিয়ে সুরেন মাইতি মাধবীলতার সামনে এসে নমস্কার জানাল হাতজোড় করে। তারপর বলল, যাক আপনি এসে গেছেন। কী ঝামেলা বলুন তো! আপনার ছেলে না জেনেশুনে উটকো লোককে বাড়িতে ঢুকিয়ে বিপদ ডেকে আনল। মাওবাদী এক্সট্রিমিস্ট। যে ছিল তার অ্যান্টি গ্রুপ এসে ওই হামলা করে গেছে। আমি তখন এলাকায় থাকলে ওদের হাতেনাতে ধরে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতাম। আপনি বাড়ি যান, বিশ্রাম নিন। আমি চেষ্টা করছি যে ক্ষতি আপনাদের হয়েছে তার অন্তত কিছুটা পূর্ণ করে দিতে।

মাধবীলতা শান্ত গলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনার কথা শেষ হয়েছে?

সুরেন মাইতি একটু বোকা হাসি হাসল, হ্যাঁ, এই আর কী!

মাধবীলতা বলল, দেখুন, আমি রাজনীতির মানুষ নই, সাদা চোখে যা দেখছি তাই বলছি, আপনারা নিজেদের পায়ে কুড়োল মারছেন, আপনাদের যে শক্তি ছিল তা অপব্যবহারে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন মানুষ আপনাদের একফোঁটা ভালবাসে না। ভয় করতে করতে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে ভাবছে কবে আপনারা চলে যাবেন। মিথ্যে দিয়ে যে অন্যায়গুলো ঢাকতে চাইছেন তা সবাই বুঝতে পারছে শুধু আপনারা তা পারছেন না। খুব খারাপ লাগে, বুঝলেন?

কথাগুলো শেষ করে মাধবীলতা হনহন করে ফিরে গেল। সুরেন মাইতি তার যাওয়াটা দেখে হাত ঘোরাল, কী বলে গেল তা মাথায় ঢুকল না।

যারা এতক্ষণ সবিস্ময়ে দেখছিল তারা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সারা সকাল ধরে আলোচনা করার সুযোগ পেয়ে বর্তে গেল।

তৃতীয় দিনের শেষে থানায় গেল অর্ক। বড়বাবুর জন্যে একটু অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এই সময় একজন এস আই, যিনি ডিউটিতে ছিলেন, বসতে বললেন। চা খাওয়ালেন। তারপর বেশ আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী বুঝছেন?

কী ব্যাপারে?

চারধারে যা হচ্ছে তা দেখছেন, শুনছেন তো?

অর্ক বলল, ও, কিন্তু আমি তো রাজনীতি করি না।

আপনার কি মনে হচ্ছে আমি রাজনীতি করি? এস আই হাসলেন। আমরা পিঁপড়ের মতো। কেন বললাম?

বুঝতে পারলাম না।

ঝড়বৃষ্টি আসার কিছু আগে, দেখবেন, পিঁপড়েরা লাইন বেঁধে নিরাপদ জায়গায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। কেন করে? কারণ ওরা ঠিক টের পেয়ে যায় বৃষ্টি আসছে। আমরাও টের পেতে শুরু করেছি। আপনাদের বস্তির লোকজন কিছু বলছে না?

আমি শুনিনি। কারণ আমি সকালে বেরিয়ে যাই, রাত্রে ফিরি। কারও সঙ্গে আড্ডা মারার সময় পাই না। অর্ক বলল।

বুঝলাম, আপনি কেন বড়বাবুর দেখা চাইছেন?

উনি আমাকে বলেছিলেন যাকে আমি আমাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম তার হদিশ জানাতে। না হলে আমার বিপদ হবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, সে যে এখন কোথায় তা আমি জানি না। এটাই ওঁকে বলতে চাই। অর্ক সরল গলায় বলল।

ঠিক আছে, ওঁর জন্যে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে না। আমি বলে দেব আপনি এসেছিলেন। নিশ্চিন্তে চলে যান।

আমি সত্যি জানি না। অর্কর অবিশ্বাস হচ্ছিল এস আই-এর কথায়।

কী করে জানবেন? পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী না থাকলে তার ঠিকানা আপনি কী করে জানবেন? এস আই হাসলেন।

মানে? হকচকিয়ে গেল অর্ক।

খবরের কাগজ পড়েন না? বিরোধী নেত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। বড়বাবু কাল থেকে সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। তা হলে আপনাকেও কোনও মাওবাদীর ঠিকানা জানাবার জন্যে চাপ দেওয়া হবে না।

কথাটা বিশ্বজিৎকে বলতেই সে খুব হাসতে লাগল।

হাসছ কেন?

হাওয়া ঘুরতে শুরু করেছে, বুঝলেন না? নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, একটার পর একটা ব্রহ্মাস্ত্র বামফ্রন্টের হাত পা কাটছে। সামনের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়বেই। দাদা আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আপনাদের ওপর সুরেন মাইতিরা যে অত্যাচার করল তার কি কোনও কারণ ছিল? আপনি আমাদের সঙ্গে আসুন। আপনাকে দেখলে মানুষ ভরসা পাবে। এত বড় সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জীবনে এখনই পরিবর্তন আসা দরকার। বিশ্বজিৎ বলল।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আমাকে কী করতে বলছ?

আপনি টিএমসির সক্রিয় সদস্য হন। আপনার মতো একজনকে পেলে দল শক্তিশালী হবেই। দিদি যে স্বপ্ন দেখছেন তা সার্থক করতে এগিয়ে আসুন অকা। আমাদের পার্টি অফিসে আপনাকে নিয়ে কথাও হয়েছে। বিশ্বজিৎ বলল।

কিন্তু বিশ্বজিৎ, আমি আজ অবধি রাজনীতি করিনি। করতে চাইও না।

ছোটমুখে বড় কথা বলছি, অনেকেই জীবনে যা করেননি তা চাপে পড়লে করতে বাধ্য হন। আপনি কি আগে কখনও কলকাতার রাস্তায় মিছিলে হেঁটেছেন? অপর্ণা সেন, শুভাপ্রসন্ন কি রাজনীতি করেছেন? কিন্তু ওঁদের সঙ্গে আপনিও পথে মিছিল করেছেন। কারণ আপনারা কৃষকদের ওপর পুলিশের নির্মম গুলি চালানোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বামফ্রন্টকে ধিক্কার দিয়েছেন। দাদা, এটাও তো রাজনীতির অঙ্গ। বিশ্বজিৎ অর্কর হাত ধরল।

অর্ক হাত ছাড়িয়ে নিল, এ কী বলছ? ওই প্রতিবাদ মানুষ হিসেবে করা উচিত বলেই সবাই করেছেন, তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই।

তা হলে তো দিদি কোনও রাজনীতি করছেন না। বিশ্বজিৎ বলল।

মানে?

দিদি সম্পূর্ণ মানবিক কারণে মা-মাটি-মানুষের সম্মান বজায় রাখতে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের কাছে আবেদন করেছেন। আজ চৌত্রিশ বছর ধরে পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গঞ্জে সুরেন মাইতির মতো অত্যাচারী শোষকরা যে ভয়ংকর ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে তা থেকে মানুষকে মুক্ত করতে চাইছেন উনি। এই মহৎ কাজে আমরা যদি তার পাশে না দাঁড়াই তা হলে দেশটা শেষ হয়ে যাবে। অর্কা, এই জনসেবাকে কি আপনি রাজনীতি করা বলে ভাববেন? বিশ্বজিৎ বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল।

একমুহূর্ত ভাবল অর্ক। তারপর বলল, ঠিক আছে, তুমি যা বললে তা নিয়ে একটু ভাবি। ভেবে বলব।

বাড়িতে ফিরে এলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী কথা হল? আমি তো ভাবলাম তোমাকে লকআপে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

সাব-ইন্সপেক্টারের সঙ্গে যা কথা হয়েছিল তা বলল অর্ক। মাধবীলতা চুপচাপ শুনছিল। বলল, অদ্ভুত ব্যাপার। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

অর্ক বলল, আমারও প্রথম বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, পাগল!

মাধবীলতা বলল, কে?

অনিমেষ বলল, একজন মহিলা যাঁর দেশপ্রেম ছাড়া কোনও আদর্শ নেই, যাঁর পাশে কোনও সুশৃঙ্খল দল নেই, কোনও রাজনৈতিক চিন্তাধারা নেই, যাঁদের একমাত্র স্লোগান বামফ্রন্ট হঠাও তারা দেশের মানুষের ভোটে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারে না। বামফ্রন্ট যতই অত্যাচার করুক তাদের সাংগঠনিক শক্তি এতটাই যে বন্দুকের সঙ্গে তিরধনুক নিয়ে লড়ে জিততে হবে বিরোধীদের। সেটা কি সম্ভব? এটা হল একজন বনাম এক লক্ষ লোকের লড়াই। ইম্পসিবল।

মাধবীলতা বলল, মিরা তো হয়েই থাকে।

অনিমেষ শব্দ করে হাসল। বলল, বেশ, তোমার কথাই সত্যি হল। ভদ্রমহিলা তার দলবল নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেন। হওয়ার পর তাকেই মুখ্যমন্ত্রী হতে হবে। কংগ্রেস তার ভোটসঙ্গী হলে তাদের কিছু দপ্তর দিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে সেটা ভেবেছ?

কী হবে মানে?

উনি যে দল করেছেন সেই দলের প্রথম সারির নেতাদের একটাই পরিচয়, তারা দিদির আলোয় আলোকিত। বটগাছ থেকে নেমে আসা ঝুরির মতো। তাই মুখ্যমন্ত্রী হলে দিদি কাদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করবেন? মুখ্যমন্ত্রী দিদি, অর্থমন্ত্রী দিদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিদি, শিল্পমন্ত্রী দিদি। এইসব মন্ত্রকে রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ওইসব নেতাদের নিয়োগ করা ছাড়া তার অন্য কোনও উপায় থাকবে না। অবশ্য আর একটা উপায় আছে। দলের বাইরে থেকে যোগ্য মানুষদের এনে নির্বাচন জিতিয়ে পূর্ণমন্ত্রী করতে পারেন।

অনিমেষ বেশ মজা পাচ্ছিল কথাগুলো বলার সময়ে। মাধবীলতা বলল, তুমি বেশি বেশি ভাবছ। বাংলার মানুষ যদি তার ওপর আস্থা রাখে তা হলে তিনি নিশ্চয়ই তার সম্মান দেবেন। আচ্ছা বলো তো, পশ্চিমবঙ্গে এবং আগের অবিভক্ত বাংলায় অনেক রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাদের জনপ্রিয়তা কম ছিল না। কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তা কি তাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যায়নি?

অনিমেষ অর্কর দিকে তাকাল। অর্ক বলল, মা, তুমি কী বলছ?

ঠিকই বলছি। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, জ্যোতি বসু হয়তো অনেক মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন কিন্তু এই মহিলার জনপ্রিয়তার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেননি। মাধবীলতা বলল, আমার তো মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, সুভাষচন্দ্র বসু জনপ্রিয় হয়েছেন তার নিখোঁজ হওয়ার পরে। যতদিন বেঁচে ছিলেন, এই কলকাতায় ছিলেন ততদিন কি তিনি এই মহিলার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন? আমার ধন্দ আছে।

অনিমেষ বলল, যা তা বলে যাচ্ছ! একজন মহিলা জপ করার মতো করে পশ্চিমবাংলার মানুষের কানে বামফ্রন্ট বিরোধী মন্ত্র বলে সুড়সুড়ি দিয়ে যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তা যে-কোনও মুহূর্তে উধাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সুভাষ বোসের প্রতি শ্রদ্ধা বাঙালির মনে বহুকাল থাকবে। ভালবাসায় শ্রদ্ধা মিশে না থাকলে আর আয়ু বেশিদিন থাকে না। যাক গে, এসব দেখি আর মনে মনে গুমরোই। আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। অনিমেষ ক্রাচ টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দা থেকে ঘরে চলে গেল। মাধবীলতা সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, তোর বাবার মুখে এরকম কথা বহু বছর পর শুনলাম!

বুঝলাম না! অর্ক বলল।

তুই তখন নার্সারিতে পড়িস। তোর বাবাকে জেলখানা থেকে ট্যাক্সিতে নিয়ে আসছিলাম। জেলে থাকার সময় আমি ওকে জানাইনি তোর কথা। তাই জেল থেকে বেরিয়ে হতাশায় ভেঙে পড়েছিল। তখন বলেছিল, আমার তো আর কিছু করার ক্ষমতা নেই। তারপর তোকে পেয়ে ধীরে ধীরে মনে জোর পেল। আজ আবার সেই কথাটা শুনলাম। মাধবীলতা উঠে দাঁড়াল, তুই চল, আমার সঙ্গে হাত লাগা। বাড়িটাকে একটু বসবাসযোগ্য করে নেওয়া দরকার। কেউ ভেঙে দিয়ে চলে গেলে আমি তার মধ্যে পড়ে থাকব কেন? আয়।

হাওয়া দ্রুত বদলে যাচ্ছে। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। বামফ্রন্টকে হঠিয়ে মা-মাটি-মানুষের সরকারকে ক্ষমতায় আনলে বাংলার চেহারা বদলে যাবে। শহরের মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তরা জঙ্গলমহল বা দার্জিলিং পাহাড়ের সমস্যা নিয়ে মোটেই ভাবিত নয়। সেখানে যা হচ্ছে তা সেখানকার মানুষের সমস্যা। শহরের বেকার যুবকদের চাকরি হবে, জিনিসপত্রের দাম কমবে, কলকাতা শহরটা ধীরে ধীরে লন্ডন হয়ে উঠবে। মানুষ শান্তিতে বাস করতে পারবে। এগুলোর কোনওটাই বামফ্রন্টের আমলে হয়নি। তারা পেশিশক্তি দেখিয়েছে। যেখানে বাধা পেয়েছে সেখানেই রক্তবন্যা বইয়েছে। যারা নিখোঁজ বলে পুলিশের খাতায় ঘঘাষিত তাদের মাটির নীচে শুইয়ে দিয়েছে শক্ত হাতে। মা-মাটি-মানুষের সরকার এলে বদলার রাজনীতি বাতিল হবে। দলতন্ত্রের বদলে সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। দিদি মুখ্যমন্ত্রী হলে যে সমস্ত বাঙালি নেতা, কবি, লেখক বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁদের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে, তাদের নতুন করে সরকারি সম্মান দেওয়া হবে। এই স্বপ্নের ঢেউ কোচবিহার থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বিশাল বটগাছের গোড়া ক্ষয়ে ক্ষয়ে যেখানে পৌঁছেছে, একটা মৃদু ধাক্কা লাগলেই গাছটা হুড়মুড়িয়ে লুটিয়ে পড়বে। প্রায় সমস্ত মিডিয়া ওই ঢেউটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে হাত লাগালেও অনিমেষের মতো কিছু মানুষ যারা শিক্ষিত রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন তারা একমত হতে পারছিলেন না। কিন্তু পরিবর্তন চাই স্লোগান আকাশ ছুঁয়ে গেল।

বিশ্বজিতের চাপে অর্ক এই ঢেউটাকে উপেক্ষা করতে পারল না। সে নিজের চোখে মাওবাদীদের কার্যকলাপ খঙ্গপুরের রাস্তায় দেখে এসেছে। জলপাইগুড়ির বাড়ি থেকে সুরেন মাইতিদের পেশিশক্তিতে ক্ষুব্ধ হয়েও চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ এই কদিন পর্যন্ত ছিল সরকারের ক্রীতদাস, নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। তাই যখনই সময় পাচ্ছিল তখনই সে বিশ্বজিৎদের প্রচারসভায় পৌঁছে যাচ্ছিল। বিশ্বজিৎ অনুরোধ করলেও অর্ক মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু তার উপস্থিতি শ্রোতারা ভাল চোখে দেখছে বুঝে বিশ্বজিত্রা চাইছিল প্রায় প্রতিটি সভায় তাকে হাজির করতে। বক্তৃতা না দিলেও, এই কারণে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল অর্কর।

অফিস থেকে ফিরছিল অর্ক। সাধারণত সন্ধেবেলায় এবং ছুটির দিনে সে নির্বাচনী প্রচারে বের হয়। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখল একটা মিছিল ঈশ্বরপুকুর লেনে ঢুকছে বামবিরোধী স্লোগান দিতে দিতে। সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। মিছিলে যারা হাঁটছে, স্লোগান দিচ্ছে, তাদের বেশ কয়েকজনকে এ যাবৎকাল সিপিএমের কর্মী বলে সে জানত। দুজনকে তো সুরেন মাইতির হয়ে চোখ গরম করতে দেখেছে। ওরা কখন কেমন করে সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিল? এত সাহস পেল কী করে? অর্কর মনে পড়ল সেই সাব-ইন্সপেক্টরের কথা। বর্ষার আগে পিঁপড়েরা ঠিক টের পেয়ে যায় জল পড়বে। সাব-ইন্সপেক্টররা যখন টের পেয়ে গেছে তেমনি মস্তানবাহিনীও। কিন্তু কয়লা তার চরিত্র পালটায় না। দলে এদের দেখলে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হবেই, ভয়ও পাবে। কী করে বিশ্বজিত্রা এদের দলে ঢুকতে দিল?

বিশ্বজিৎকে খুঁজে বের করল সে। তৃণমূলের সদ্য তৈরি পার্টি অফিসে বসে সে অন্যদের কাজ বোঝাচ্ছিল। তাকে বাইরে ডেকে নিয়ে কথাগুলো বলল অর্ক।

বিশ্বজিৎ মাথা নাড়ল, অর্কদা, যখন জলোচ্ছাস হয় তখন কি জল পরিষ্কার থাকে? যাবতীয় আবর্জনা স্রোতের মধ্যে ঢুকে যায়। কী করব বলুন! এমন কোনও ছাঁকনি নেই যে তাদের আটকাব।

অর্ক বলল, আটকাতে হবেই। নইলে এরাই কিছুদিন পরে সিপিএমে থেকে যা যা করছিল তাই করবে।

না। তা করতে পারবে না। যদি নির্বাচনে আমরা জিতি তা হলে ঝাড়াই বাছাই করে এদের বাদ দেওয়া হবে। এখন কিছু করা ঠিক হবে না। তা ছাড়া আমাদের দল নতুন। লড়াই করার মতো সক্রিয় কর্মীর সংখ্যাও বেশি নয়। সিপিএমের হার্মাদবাহিনীর সঙ্গে টক্কর দিতে এরাই পারবে। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। বিশ্বজিৎ তাকে আশ্বস্ত করতে চাইল।

অস্বস্তির কাটাটা তবু দূর হচ্ছিল না। বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই অর্কর মোবাইল বেজে উঠল। অন করতেই শুনতে পেল, আপনি কোথায়?

হঠাৎ মন শান্ত হয়ে গেল। অর্ক বলল, বেলগাছিয়া। আপনি?

আর জি কর হাসপাতালে। একজন সহকর্মীকে দেখতে এসেছিলাম। এখন কি হাতে সময় আছে? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

.

৪৫.

শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ের নির্বাচনী জনসভায় তৃণমূলের বক্তৃতা চলছে। বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে তৃণমূলের মিছিল নিপাত যাক নিপাত যাক ধ্বনি দিতে দিতে এগিয়ে এসেও মুখ ঘুরিয়ে খালের দিকে চলে গেল।

কর্নওয়ালিশ স্ট্রিস্টের একটি চায়ের দোকানে মুখোমুখি বসে কুন্তী হাসল, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন হয়েছিল তখন কীরকম চিৎকার দুপক্ষ করেছিল বলে আপনার মনে হয়?

এই দোকানে ভরসন্ধ্যাতেও চায়ের সঙ্গে টোস্ট পাওয়া যায়। কারণটা জানা নেই, উত্তর কলকাতার বেশিরভাগ মিষ্টির দোকানে যেমন বিকেল বেলায় জিলিপি তৈরি করে বিক্রি করা হয় না তেমনি চায়ের দোকানদাররা ওই সময় টোস্ট বিক্রি না করে চপ কাটলেট বিক্রি করতে পছন্দ করেন। চা-টোস্টের অর্ডার দিয়ে প্রশ্নটা শুনতেই হেসে ফেলল অর্ক, যুদ্ধের সময় নিশ্চই দুপক্ষই হুংকার দিত কিন্তু বিকেলে যখন যুদ্ধ স্থগিত রাখা হত ভোর অবধি, তখন একসঙ্গে গল্প করত সবাই।

কুন্তী মাথা নাড়ল, ঠিক। আমরা অনেক পালটে গিয়েছি।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, এদিকে এসেছিলেন বলে আমার কথা মনে এল?

না। এদিকে এসেছিলাম বলে আপনাকে ফোন করলাম। মনে আসলেই যদি ফোন করি তা হলে কেন করলাম তার কৈফিয়ত দিতে হয়। তাই করিনি। কুন্তী বলল, আমার ফোন পেয়ে অবাক হয়েছেন?

একটু। কারণ অনেক আগেই ফোনটা আশা করেছিলাম। বলুন, খবর কী? অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল।

কুন্তী কপালে চলে আসা চুল পেছনে সরিয়ে বলল, ব্যান্ডেলের বাস চুকিয়ে দিলাম।

তার মানে? ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন?

না। চাকরিটাই ছেড়ে দিলাম। কুন্তীর মুখ গম্ভীর।

কিছু হয়েছিল?

হ্যাঁ। আমার ব্যক্তিগত জীবনে স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশিরকম নাক গলাচ্ছিলেন। সহ্য করে ছিলাম। নতুন সেক্রেটারি এসে তার সীমা পেরিয়ে গেলে ছেড়ে এসে স্বস্তিতে থাকতে পারলাম। কুন্তী বলল, এখন কলকাতার বাড়িতে?

হ্যাঁ। বাড়িতেই ছেলেমেয়েদের পড়াব। তাতে দিব্যি চলে যাবে। মায়ের মনে একটা ক্ষোভ ছিল আমি বাইরে থাকি বলে, সেটাও চলে গেল। কুন্তী বলল, আপনার খবর বলুন।

চা আর টোস্ট এসে গেল। টোস্টের প্লেট কুন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে অর্ক বলল, চাকরিটা যেতে যেতে যায়নি বলে এখনও করে যাচ্ছি। যে ব্যাপারটা থেকে চিরদিন দূরে থাকতাম তা আর না থেকে সামনের নির্বাচনে একটি দলকে সমর্থন করছি। ভোট হয়ে গেলে আবার নিজের জায়গায় ফিরে যাব।

অর্থাৎ আবার শামুকের মতো খোলের আড়ালে গুটিয়ে থাকবেন?

যা ইচ্ছে বলতে পারেন।

সমর্থন করছেন, তা মনে মনে নাকি সক্রিয় হয়ে?

কিছুটা সক্রিয় হয়েছি। না হলে নির্বাচনী সভাগুলোতে যাব কেন?

বেশ। যাঁদের সমর্থন করছেন তারা যদি ক্ষমতায় আসেন তা হলে তাদের পাশে থেকে দেখবেন না, যে কারণে সমর্থন করেছিলেন তা বাস্তবে হচ্ছে কিনা! কুন্তী তাকাল।

অর্ক হাসল, আমি কোন দলের সমর্থক তা আপনি বুঝে গেলেন?

স্বাভাবিক। বামফ্রন্টের প্রয়োজন নেই আপনাকে। এই নির্বাচনে কী হবে তা ওরা ভালভাবেই জানে। আপনি তৃণমূল নেত্রীকে সমর্থন করছেন। নির্বাচনে ওঁর জয়ের সম্ভাবনা শতকরা নব্বই ভাগ। আমি জ্যোতিষী নই। সাধারণ মানুষের কথা শুনেই বলছি। তবে আপনি সমর্থন করেছেন বলে একটা সুবিধে পাবেন। আগামী পাঁচ বছর নিরাপদে বাস করতে পারবেন। কুন্তী বলল।

নইলে বিপদে পড়তাম? বাঁকা গলায় প্রশ্ন করল অর্ক।

দেখুন আমি রাজনীতি বুঝি না। বাবা একমাত্র রাজনীতি করতেন। পরে যখন রিয়েলাইজ করলেন তখন রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেলেন। এমনিতেই বাঙালি মেয়েরা রাজনীতি করতে চাইলে পরিবার থেকে তুমুল আপত্তি ওঠে। বাবার ব্যাপারটা আমাকেও রাজনীতি বিমুখ করেছিল। কিন্তু চোখ ভোলা থাকলে যা দেখা যায় তা কল্পনার সঙ্গে নাও মিলতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক। পশ্চিমবাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একজন ভদ্রমহিলার ওপর যদি নির্ভর করে তা হলে তা বহন করতে হবে তাকেই। সেই হিমালয়ের চেয়ে ভারী বোঝার সঙ্গে তাকে সামলাতে হবে নির্বাচিত বিধায়ক থেকে পাড়ার নেতাদের যারা প্যারাসাইটের মতো তারই পরিচয়ে পরিচিত হয়ে ভেবে নেবে আমরাই রাজা। খুব কঠিন কাজ। বাবার মুখে শুনেছিলাম, সাতষট্টির নির্বাচনের আগে প্রবীণ কংগ্রেসি নেতারা বলতেন, আমরা তো খেয়ে দেয়ে ফুলে ফেঁপে গেছি, আর খাওয়ার ক্ষমতা নেই, কিন্তু কমিউনিস্টরা তো উপোসি ছারপোকার মতো শুকিয়ে আছে, ক্ষমতায় এসে খাওয়া ছাড়া অন্য চিন্তা করবে না। ভয় হয় নেত্রী যা চাইছেন তা তাঁর অনুগামীরা না শুনে ওই খাওয়ার পথে না চলে যান। সেরকম হলে বিপদ তো অনিবার্য। কুন্তী খুব সিরিয়াস গলায় কথাগুলো বলল।

অর্ক মাথা নাড়ল। আপনি ভুল করছেন। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সময় অনেক নোংরা ভেসে আসে। পুরনো যা তা ভেঙে চুরমার করে জল যখন থিতিয়ে যায় তখন ওই নোংরাগুলোকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আপনি খুব আশাবাদী। সেরকম হলে আমিও খুশি হব। কুন্তী বলল। চা শেষ করেই সে মাথা নাড়ল, আচ্ছা, আমরা তখন থেকে শুধু রাজনীতির কথা বলে যাচ্ছি কেন? আমরা কি অন্য বিষয়ে কথা বলতে পারি না?

সামান্য দূর থেকে ভেসে আসা গরম বক্তৃতা, স্লোগান আচমকা থামতেই কুন্তী নিজেই জবাব দিল, ওঃ, শান্তি! ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো ওটা বেজে চলছিল বলে আমরাও প্রভাবিত হয়েছি। ঘড়ি দেখল সে, আপনাকে আমাদের বাড়িতে আসতে বললে আসবেন?

নিশ্চয়ই। অর্ক বলল।

নির্বাচনের পরে?

না না। যে-কোনও দিন। অর্ক পকেটে হাত ঢোকাল। কুন্তী মাথা নাড়ল।

না। আমি দেব। কারণ আমার ফোন পেয়ে আপনি এসেছেন।

অর্ক ওয়েটারের রেখে যাওয়া প্লেটে টাকা দিয়ে বলল, আপনি-আমি করবেন না তো!

আচমকা শব্দ করে হেসে উঠল কুন্তী। অর্ক অবাক হয়ে তাকাল। হাসি শেষ হলে কুন্তী বলল, গোটা পশ্চিমবঙ্গ যেখানে আমরা-ওরা-তে দুভাগ হয়ে যাচ্ছে তখন আপনার গলায় অন্য কথা কেন?

অর্ক উত্তর দিল না। কুন্তী বলল, এবার বলুন। ওরা দোকানের বাইরে পা রাখামাত্র আবার স্লোগান শুরু হয়ে গেল। সেদিকে তাকিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, আপনার কী মনে হচ্ছে এসব শুনে?

কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হতে চলেছে। কুন্তী বলল।

কুরুক্ষেত্রে? অর্ক চোখ বড় করল।

হ্যাঁ। পাণ্ডব বনাম কৌরবদের। কুন্তী বলল, সে সময় ভারতবর্ষ দুভাগ হয়ে গিয়েছিল। দুভাগ হয়ে দুপক্ষকে সমর্থন করেছিল।

তারপর?

অত্যাচারীর পতন হয়েছিল। শুভ ইচ্ছার জয় হয়েছিল।

এখন?

আমি তো জ্যোতিষী নই। তবে পড়েছি, ইতিহাস কথা বলে। ঘুরে ফিরে আসে। সেটা এবারও হতে পারে।

তার অর্থ হল বামফ্রন্টের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী?

হতেই পারে। কিন্তু তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ফলে সীমাবদ্ধ। কুন্তী হঠাৎ ব্যস্ত হল, এখন এদিকে বাস চলছে না বলে মনে হচ্ছে। আমি পাতাল রেলে ফিরে যাই। স্টেশনটা কোথায়?

এই তো, ওপাশের রাস্তায়। চলুন। অর্ক এগোল। ভিড়ের ফুটপাত দিয়ে ওরা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে পৌঁছে পাতাল রেল স্টেশনের দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ একটা উচ্ছ্বসিত চিৎকার কানে এল, এই কুন্তী।

কুন্তী দাঁড়িয়ে মুখ ফেরাতেই মহিলা প্রায় দৌড়ে এলেন, সঙ্গে বছর পাঁচেকের বালক। বললেন, কী রে! তুই এখানে? উঃ, কতকাল পরে তোকে দেখলাম। একদম আগের মতো সুন্দর আছিস তুই। আর দ্যাখ, আমি কীরকম বুড়ি হয়ে গিয়েছি। প্রায় ঝড়ের মতো কথাগুলো বলে গেলেন মহিলা।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে হাসল কুন্তী, শিপ্রা!

এই দ্যাখ, তোর চিনতে সময় লাগল! লাগবেই বা না কেন? সিজার হয়েছিল, তারপর থেকেই শরীরটা ভেঙে গেল। গলা নীচে নেমে গেল মহিলার, তলপেটের চর্বি কিছুতেই কমছে না। তোর বর?

না গম্ভীরমুখে বলল কুন্তী।

উড বি? বলেই মহিলা বলল, যাক গে, এখনও বিয়ে করিসনি, খুব ভাল করেছিস। তুই তো সাউথে থাকতিস?

হ্যাঁ। এখনও সেখানে আছি।

তুই একবার আমাদের বাড়িতে আয়। এই তো কাছেই! আচ্ছা এখন না। ইলেকশনের রেজাল্ট বের হওয়ার পর আসবি। তোর মোবাইলের নাম্বার দে।

তোর বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে ইলেকশনের রেজাল্টের কী সম্পর্ক? কুন্তী জিজ্ঞাসা করল।

এই যাঃ। তোকে বলা হয়নি। আমার শ্বশুরবাড়ি তো মেদিনীপুর। ওর বাবা সেখানকার একটা আসনে তৃণমূলের ক্যান্ডিডেট হয়েছে। এই প্রথম দাঁড়াল। হারার কোনও চান্স নেই। সব পাবলিক তো তৃণমূলকেই ভোট দেবে। তার পরে আয়।

তখন এম এল এর বউ হয়ে স্পেশ্যাল খাতির করবি?

অর্ক দেখল মহিলার চোখেমুখে খুশি ছড়িয়ে গেল।

কুন্তী বলল, চলি।

নাম্বারটা দে?

কুন্তী নাম্বারটা বললে মহিলা তার মোবাইলে সেটা সেভ করে নিল, খুব ভাল লাগল রে। তারপর অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে মশাই,

আপনিও আসবেন।

কুন্তী হটতে আরম্ভ করেছিল, জবাব না দিয়ে অর্ক তার সঙ্গী হল। পাতালরেলের দরজায় পৌঁছে কুন্তী জিজ্ঞাসা করল, কী বুঝলেন?

কোন ব্যাপারে?

শিপ্রাকে দেখে? আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। বহু বছর পরে দেখা। আর এই অল্প সময়ের মধ্যে ও ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারগুলো আমাকে জানিয়ে দিল।

মহিলা সম্ভবত খুব সরল।

না। সরল নয়, তরল হয়েছে। এম এল এর বউ হবেই এই আনন্দে। আপনাকে দেখে আমার সঙ্গে যে সম্পর্কটা বানিয়ে নিল তা বাঙালি বউদের মাথায় প্রথমে আসে।

আপনি তো সেটা ভেঙে দিলেন।

তাতে দমে যায়নি। বর্তমানে যখন নয় তখন ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বলে ভাবল!

আপনি খুব বিরক্ত হয়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

না হওয়ার কোনও কারণ নেই। মেয়েরা এসবের বাইরে সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ভাববে না কেন? এই একুশ শতকে? তা হলে ঠাকুমা দিদিমাদের সঙ্গে পার্থক্য কোথায়? যাক গে, কবে আসছেন আমাদের বাড়িতে?

যাব।

নিশ্চয়ই বলবেন না ইলেকশনের রেজাল্ট বের হলে যাব?

হেসে ফেলল অর্ক, না। অবশ্যই না।

তা হলে এলাম। কুন্তী নেমে গেল পাতালের সিঁড়ি বেয়ে। অর্ক সেদিকে তাকিয়ে ভাবল একবার হয়তো মুখ ফিরিয়ে তাকাবে, কিন্তু তাকাল না।

ফুটপাতে না নেমে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল অর্ক। এখন কলকাতায় রাত নেমে গেছে। সন্ধের মুখে যখন আলোগুলো জ্বলে ওঠে তখন চারধার যেরকম ঝকমকিয়ে ওঠে, রাত বাড়লে তা ক্রমশ নেতিয়ে যায়। একটা হলদেটে ভাব ফুটে ওঠে।

এতক্ষণ বেশ কেটে গেল। কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগছিল। এই যে কুন্তী উত্তর কলকাতায় এসে তাকে মনে করে ডেকে নিল, গল্প করল, তার কারণ কী? এই অঞ্চলে কি ওর অন্য কোনও পরিচিত মানুষ নেই? না থাকলেও তাকে কেন ডাকবে? কাজ শেষ করে ফিরে যেতেই পারত!

তাড়াহুড়োয় কাজে যাওয়ার সময় যে মোবাইলটা নিয়ে আসা হয়নি তা অর্ক টের পেল বেলা বারোটা নাগাদ। প্রথমে মনে হয়েছিল বাসে পকেটমার হয়ে যায়নি তো! তার মোবাইল প্রিপেইড। ব্যালেন্স বেশি ছিল না। হারিয়ে গেলে থানায় গিয়ে ডায়েরি করাই নিয়ম। অর্কর মনে হল সেটাও একটা ঝামেলা। তারপরেই খেয়াল হল, বাড়িতে ফেলে আসেনি তো? সে ল্যান্ডলাইন থেকে মাধবীলতার মোবাইলে ফোন করল।

মাধবীলতার সাড়া পেলে জিজ্ঞাসা করল, মা, দ্যাখো তো আমি সেলফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি কিনা!

হ্যাঁ। দুটো ফোন এসেছিল। তাতেই জানতে পারলাম। মাধবীলতা বলল।

কারা ফোন করেছিল?

প্রথমটা একটা মেয়ের ফোন ছিল। নাম বলল কুন্তী। বলল তোর সঙ্গে কাল দেখা হয়েছিল। বেশ ভালভাবে কথা বলল মেয়েটি। কবে আলাপ হল?

বেশিদিন নয়। ওর বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন, মারা গিয়েছেন। বাবাকে চিনতেন। কুন্তী স্কুলে পড়াত। এখন সেটা ছেড়ে বাড়িতে ছেলে মেয়েদের পড়াবে। বলেই অর্ক জিজ্ঞাসা করল। দ্বিতীয় ফোনটা কার?

আমি জানি না।

তুমি ধরোনি?

না। ধরলে তো বলতেই পারতাম। তোর বাবা ধরেছিল। কথা বলেছিল।

কার সঙ্গে কথা বলেছিল?

আমাকে বলেনি।

ঠিক আছে, বাবাকে দাও ফোনটা।

তোর বাবা বাড়িতে নেই।

কোথায় গেছে?

মোবাইলে কথা বলার পর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে বলল, আমি আসছি, দেরি দেখলে তুমি খেয়ে নিয়ো। মাধবীলতা বলল, প্রায় চল্লিশ মিনিট আগে বেরিয়ে গেছে।

মোবাইলটা কোথায়?

সঙ্গে নিয়ে গেছে।

প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল অর্কর। কুন্তীর ফোন নিশ্চয়ই স্বাভাবিক। গতকাল ফিরে যাওয়ার পর ভদ্রতা করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় ফোনটা কে করেছিল? নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নইলে কথা বলার কিছুক্ষণ পরে বাবা বাড়ির বাইরে যাবে কেন? ইদানীং বাবা বড়জোর গলির ভেতরের কাকার দোকান অবধি যায়, ঈশ্বরপুকুর লেনের বাইরে কখনওই নয়। শরীরের জন্যে যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি মন চায় না বলেই যেতে পারে না। তা হলে?

অর্ক ল্যান্ডলাইনে নিজের নম্বর ঘোরাল। সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল ওটা সুইচ অফ করে রাখা হয়েছে।

কাজে মন দিতে পারছিল না অর্ক। তার মনে হচ্ছিল যে ফোন করেছিল সে নিশ্চয়ই বাবাকে ডেকে নিয়ে গেছে। বাবার কোনও পরিচিত মানুষ তার মোবাইলে বাবাকে চাইবে না। তা হলে যে ফোন করেছিল সে তারই পরিচিত। লোকটা কি সুরেন মাইতি? তার নাম্বার পেতে লোকটার একটুও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাকে না পেয়ে সুরেন মাইতি বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কী বলতে পারে? কেন অর্ককে তৃণমূলের নির্বাচনী সভায় দেখা যাচ্ছে তার কৈফিয়ত চাইবে? অর্ক নিশ্চিত এর উত্তর বাবা ঠিকঠাক দিতে পারে।

কাজ থেকে বাড়িতে ফিরে অর্ক দেখল মাধবীলতা বস্তির কয়েকজন মহিলার সঙ্গে কথা বলছে, অর্ক তাদের এড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচেক পরে মহিলারা বেরিয়ে গেলে মাধবীলতা দরজা বন্ধ করলে অর্ক বারান্দায় এল, বাবা এখনও ফিরে আসেনি?

না। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

আশ্চর্য! কোথায় গেছে?

দুপুরে ফোন করেছিল। বলল ফিরতে দেরি হবে।

আমি ফোন করেছিলাম তখন মোবাইল বন্ধ ছিল। অর্ক বলল।

ও।

তুমি এমন নিশ্চিন্ত হয়ে কথা বলছ? বাবা কি কখনও এভাবে এতক্ষণ কোথাও গিয়েছে? অর্ক উষ্ণ হল।

তোর বাবা ছেলেমানুষ নয়। সে বাইরে গিয়েছে, ফোনে খবর দিয়েছে আসতে দেরি হবে। তারপরে আমি খবরদারি করতে যাব কেন? মাধবীলতা ঝাঁঝিয়ে উঠল, তুই হঠাৎ এত চিন্তিত হয়ে পড়লি কেন?

অর্ক জবাব দিল না। তার সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। এতদিন পরে মা এরকম নির্লিপ্ত হয়ে গেল কী করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *