সারাদিন একটানা বৃষ্টি পড়ছে। এ বৎসর বৃষ্টি অতি প্রবল।
পুকুর-ডোবা-খাল-বিল এখন জলে টইটম্বুর, নদীগুলিও ভরে গিয়ে তটরেখা ছাপিয়ে যেতে চাইছে, কোনো কোনো জেলায় বন্যা শুরু হয়ে গেছে। চতুর্দিকের প্রকৃতি এখন সজল।
শ্রাবণ মাস ভরসার মাস, আবার দুঃখেরও মাস। বর্ষার জল পেয়ে ধান গাছ খলখলিয়ে বাড়ে, আবার অতিবৃষ্টি হলে সব নষ্ট হয়ে যাবারও আশঙ্কা থাকে। এবারের ফসলের সম্ভাবনা এ পর্যন্ত ভালোই। তবে, একটানা বর্ষণ হলে অন্যান্য রোজগারপাতি বন্ধ থাকে, হাটবাজার ঠিকমতন বসে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশী মানুষের দিন আনি দিন খাই অবস্থা। এক একটা দিন নষ্ট হলে তাদের উনুনে আঁচ পড়ে না!
অবশ্য জনসংখ্যা এখন আর সাড়ে সাত কোটি নেই, বেশ কমতে শুরু করেছে, এর মধ্যেই পঁচাত্তর-আশি লাখ মানুষ পাড়ি দিয়েছে ভারতের দিকে। কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিং, চিটাগাং, দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে এখনও প্রতিদিন হাজারে হাজার নারী-পুরুষ চলেছে এই বৃষ্টির মধ্যে, সামান্য পোঁটলা-পুটলি মাথায় করে। দুবেলা আহার না জুটলেও মানুষ নিজের ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে যেতে চায় না, তবু এরা যাচ্ছে নিছক প্রাণ বাঁচাবার আশায়, এরা চোখের সামনে জ্বলতে দেখেছে গ্রাম, গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছে দলে দলে মানুষকে, স্বামীর সামনে ধর্ষিত হয়েছে স্ত্রী, ভাইকে খুন করে কেড়ে নিয়ে যেতে দেখেছে বোনকে, এমনকি শিশুর শরীর ও ছিন্নভিন্ন হয়েছে বেয়নেটে। বৃষ্টি বাদলা, জল কাদার মধ্য দিয়ে উদভ্রান্ত এই পলাতকরা জানে না সীমান্তের ওপারে গিয়ে তারা কী পাবে। তবু তারা ছুটছে তাড়া-খাওয়া অসহায় প্রাণীর মতন এবং পথের মধ্যেও কোনো কোনো দল পড়ে যাচ্ছে হানাদারদের সামনে।
ভারত সীমান্তের ঠিক ওপারের ছোট ছোট শহরগুলিতে হঠাৎ জনসংখ্যা হয়ে গেছে দ্বিগুণের বেশী। এত শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে রাজ্য সরকারগুলি, যারা এমনিতেই নিজেদের নানা সমস্যায় জর্জরিত। আগেকার উদ্বাস্তুদের সমস্যারই সমাধান। করা যায়নি, ভারত সরকারকে নতুন করে খুলতে হচ্ছে শরণার্থী ক্যাম্প। এক দলের জন্য মাথার ওপর আচ্ছাদন, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে না করতেই এসে যাচ্ছে আরও দলের পর দল, এই জনস্রোতের বিরাম নেই। আরও কত মানুষ আসবে, কতদিন থাকবে এরা?
সারা পৃথিবী এই ব্যাপারে নির্বিকার। কোনো কোনো দেশ শরণার্থীদের কিছু সাহায্য পাঠিয়ে তাদের বিবেকের দায় চুকিয়ে দিচ্ছে, মূল সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কারুর কোনো আগ্রহ বৃষ্টি পড়ছে কলকাতা শহরেও, সারারাত এবং পরের দিন
বৃষ্টিতে বড় শহরের জনজীবন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায় না, কিছু কিছু গাড়ি-ঘোড়া চলে, অফিস-কাছারি খোলা থাকে। কলকাতার জনসংখ্যাও সূফীত হচ্ছে দিন দিন আশ্রয়প্রার্থীদের আগমনে। বাংলাদেশের ভদ্রলোকশ্রেণীর শরণার্থীরা কোনোক্রমে মাথা গোঁজবার স্থান পেয়েছে কলকাতায়, আর দমদম বিমানবন্দরের পর থেকে যশোর রোডের দু ধারে, বনগাঁ সীমান্ত পর্যন্ত সারি সারি ক্যাম্পে জড়ামারি করে রয়েছে লক্ষ লক্ষ নাম-না-জানা নারী-পুরুষ।
শ্রমিক অসন্তোষ, খাদ্যাভাব, দল-বদলের রাজনীতি, নকশালপন্থী যুবকদের সশস্ত্র আন্দোলন, এইসব সমস্যায় পশ্চিমবাংলার আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত, তার ওপর হঠাৎ এই লক্ষ লক্ষ অনাহুত অতিথিদের চাপ। এদের আহার-বাসস্থানের বন্দোবস্ত করার দায়ের চেয়েও আর একটা বড় ভয় সব সময় অনেকের মনে জেগে আছে, আবার নতুন করে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে না তো? সাতচল্লিশ সালের পর থেকে যারা বাস্তুচ্যুত হয়ে এসেছে, যাদের অনেকেই এখনও মানবেতর প্রাণীর মতন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে, তাদের মন থেকে তিক্ততার স্বাদ মুছে যাবার কথা নয়। তারা কি এই নবাগতদের মেনে নেবে? বিদেশী চর ও স্বার্থান্বেষী উস্কানিদাতারাও এই সুযোগে গণ্ডগোল সৃষ্টি করতে পারে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সেরকম কিছু এখনও দেখা যায়নি। বরং পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ মানুষ আবেগে উত্তাল হয়ে উঠেছে, অনেকদিন পর যেন উভয় বাংলার শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্য থেকে মুছে গেছে বিচ্ছেদের রেখা। ধর্মের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে ভাষার টান। নতুন করে সবাই ভাবতে শুরু করেছে যে রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ দ্বিখণ্ডিত হলেও পারস্পরিক আদান-প্রদান ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা ঠিক হয়নি। কলকাতার অফিসগুলিতে কর্মচারিরা মাসে একদিনের বেতন দান করছে শরণার্থীদের জন্য। ভারত সরকার শরণার্থীদের ব্যয় বহন করার জন্য অতিরিক্ত ডাকমাশুল চাপালে কেউ আপত্তি করেনি। দূরবর্তী জেলা শহর, গ্রামগঞ্জের মানুষও অসহায় বহিরাগতদের জন্য জায়গা করে দিচ্ছে।
যাদের আবেগ কম তারা সংশয়বাদী হয়। এমন মানুষও আছে, যারা হিন্দু-মুসলমানদের প্রশ্ন ভুলতে পারে না। প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তারা ঘরোয়া আলোচনায় প্রশ্ন তোলে, এই মুসলমানদের এখন তো আদর-যত্ন করে খাওয়ানো হচ্ছে, সব মিটে গেলেই দেখবে ওরা আবার আমাদের শত্রু হয়ে গেছে, চুটিয়ে ভারতের নিন্দে করবে। এখন তো খুব বাংলা বাংলা করছে, কিন্তু আসলে ওদের মন-প্রাণ আরবের দিকে!
যাদের গায়ে দেশ বিভাগের আঁচড়টিও লাগেনি, তাদেরও কারো কারো মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা। পাকিস্তান দু টুকরো হয়ে যাবার সম্ভাবনায় তারা খুশি, কারণ পাশের মুসলমান রাষ্ট্রটি এবার দুর্বল হয়ে যাবে। যদি বাংলাদেশ বলে নতুন রাষ্ট্রটির সত্যিই জন্ম হয়, তা হলে তার ওপরে চোখ রাঙানো যাবে যখন তখন। তারা চাপা গলায় বলে, আরে, এই যে সত্তর-আশি লাখ মানুষ ওপার থেকে এসেছে, এরে মধ্যে মুসলমান ক’জন? ক্যাম্পগুলোতে দ্যাখো গিয়ে বেশীর ভাগই হিন্দু। কিছু মুসলমান নেতা আর বুদ্ধিজীবী কলকাতায় বসে মজা মারছে, তারা আর ক’জন? পাকিস্তানের মিলিটারি তো হিন্দুদেরই মেরে মেরে তাড়াচ্ছে!
এরপর কি এরাও পার্মানেন্টলি এদেশে থেকে যাবে?
এইসব সংশয়বাদীরা অবশ্য প্রকাশ্যে গলা খুলতে পারছে না। অফিসে, ক্লাবে, পাড়ায় পাড়ায় আড়ায় এখন কেউ সাম্প্রদায়িকতার সামান্য ইঙ্গিত দিলেই অন্যরা রে রে করে উঠে প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অস্ত্রাঘাতের এই একটা মাত্র সুফল দেখা যাচ্ছে এখন, দু দিকের বাংলার অন্তত কয়েক কোটি মানুষ বুঝতে পেরেছে সাম্প্রদায়িক বিভেদের
বৃষ্টিতে জল জমে গেছে কলকাতার রাস্তায়। আজ অনেকেই বাড়ি থেকে বেরুতে পারেননি। মামুনের মতন কয়েক হাজার নিবাসিত মানুষ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মনে ভাবছে, কবে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায় ফিরে যাওয়া যাবে!
বৃষ্টি পড়ছে ঢাকায়। বৃষ্টি পড়ছে রাজশাহী, বগুড়া, টাঙ্গাইল, খুলনায়। বৃষ্টির সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কণায় যেন ছড়িয়ে পড়ছে মন খারাপের বীজাণু। আগামী দিনগুলি আরও কত ভয়ংকর রূপ নিয়ে আসবে কেউ জানে না। ভয় ও আশঙ্কার বদলে আস্তে আস্তে বুকে জমছে নৈরাশ্য।
ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর গোপন তৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে হঠাৎ। পাকিস্তানী মিলিটারি ও পুলিশ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাজার হাজার ছেলেকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে কতজনকে এখনো আটকে রেখেছে আর কতজনকে হত্যা করে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে লাশ, তা কেউ জানে না।
রুমীর আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি এ পর্যন্ত। রুমীর বন্ধুরা, বদি, চুলু, জুয়েল, কাজী, বাশার, বেনায়েত এরা কেউই ফেরেনি। ওদের শেষ দেখা যায় এস পি এ হস্টেলে, যেটা এখন আর্মি ইনটেলিজেন্সের ঘাঁটি। জাহানারা ইমামের মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতন অবস্থা। শেষপর্যন্ত তিনি পাগলাবাবার আখড়ায় গিয়ে ধনা দিয়েছেন। পাগলাবাবা একজন অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পীর, তিনি নাকি দূরের অনেক কিছু দেখতে পান। শিক্ষিতা, যুক্তিবাদী, জাহানারা ইমামের আগে এসব পীর-ফকিরে বিশ্বাস ছিল না। কিন্তু মায়ের প্রাণ, যে একটু ভরসা দেবে তাকেই আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছে করে। পাগলাবাবার আস্তানায় এখন এরকম প্রচুর ব্যাকুল ৩৩০
মা বাবার ভিড়, সেখানে বড় করে মিলাদ-মাহফিল হয়। পাগলাবাবা একদিন জায়নামাজে বসে খাসদেলে ধ্যান করে জেনেছেন যে রুমী ও আরও অনেকে বেঁচে আছে। তিনি ওদের শিগগিরই মুক্ত করে আনবেন।
আজ এই বৃষ্টির মধ্যেও জাহানারা ইমাম দশ সের অমৃতি নিয়ে এসেছেন পাগলাবাবার আশ্রমে মিলাদের জন্য।
বৃষ্টি পড়ছে গ্রামবাংলায়, বৃষ্টি পড়ছে চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা সীমান্তে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আজ সবাই হাত গুটিয়ে বসে আছে, কেউ কেউ গুলতানি করছে। কেউ কেউ বিমর্ষ মুখে চেয়ে আছে বাইরের দিকে, ওই মাঠঘাট পেরিয়ে কোনো এক জায়গায় তাদের বাড়ি, সেখানে ফেরা যাবে না।
যে প্রচণ্ড উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে প্রতিরোধ লড়াই শুরু হয়েছিল, হঠাৎ তাতে ভাটা পড়েছে কয়েক সপ্তাহ ধরে। পাকিস্তানী বাহিনী যেন নতুন ভাবে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে এবং সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে সীমান্তের ওপারে। এখন তাদের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়েও সুবিধে করা যাচ্ছে না, অযথা শক্তিক্ষয় হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর!
এরপর কী হবে? পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ তো দূরের কথা ভারত সরকারই আজও স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশকে। অর্থবল নেই, অস্ত্রবল নেই, শুধু মনের জোর নিয়ে আর কতদিন লড়াই চালানো যাবে? মনের জোরও নষ্ট হয়ে যায় আস্তে আস্তে।
একটা পরিত্যক্ত ইস্কুলবাড়ির বারান্দায় বসে গোটা পাঁচেক স্টেনগান পরিষ্কার করছে বাবুল চৌধুরী। তার ওপর এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই অস্ত্রগুলো ঠিকমতন কাজ করছে না, পরিষ্কার করার পর গুলি চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হবে। বারান্দায় অন্য এক প্রান্তে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা ছোট দলের মধ্যে তীব্র তর্কাতর্কি থেকে এখন কুৎসিত গালাগালি শুরু হয়ে গেছে, বাবুল সেদিকে একবারও মুখ ফেরায়নি। কোনো কাজ নেই বলেই এরকম ঝগড়া আর দলাদলি শুরু হয়ে যাচ্ছে মাঝেমাঝে। এমনকি দিনতিনেক আগে একজন মুক্তিযোদ্ধা খুন হয়েছে এই ক্যাম্পের মধ্যে। অ্যাকশানের সময় এরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে পারে, কিন্তু আলস্যের সময়ই ফুটে বেরোয়, কে কার শত্রু ছিল আগে, কে আওয়ামী লীগের আর কে ন্যাপের।
সিরাজুল এখানে নেই। ভারতের কোনো গুপ্ত জায়গায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিশেষ কোনো ট্রেইনিং-এ।
বৃষ্টি পড়ছে করাটিয়া, গোপালপুর, কোদালিয়া, নেয়ামতপুর, নাটিয়াপাড়া, জগন্নাথগঞ্জ, পাকুল্লা, মির্জাপুর, ভাতকুরা, ভুয়াপুর, পাথরাইল চণ্ডী, কালিহাতি গ্রামে। বর্ষণ হচ্ছে সারা বাংলার আকাশে। এই বৃষ্টির মধ্যেও চাষীকে বেরুতে হয়েছে মাঠে, জেলের নৌকো ভেসেছে নদীতে, তাঁতী বন্ধ করেনি তাঁত, এমনকি যে ভিখারিণীটি রোজ গান গেয়ে ভিক্ষে করে সে-ও ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। অন্নচিন্তা বড় চিন্তা। ভাত এমন চিজ খোদার সঙ্গে উনিশ-বিশ।
অনেক মানুষ জানেই না দেশ কাকে বলে, স্বাধীনতা কী বস্তু! করাচী রাওয়ালপিণ্ডি তো দূরের কথা। এইসব মানুষ অনেকেই ঢাকা শহরও চক্ষে দেখেনি। দশ-পনেরো মাইল বৃত্তের পরিধিতেই এদের কেটে যায় সারাটা জীবন। রাওয়ালপিণ্ডি, ইসলামাবাদ বা ঢাকায় বসে যারা শাসনযন্ত্র চালায়, তারা উর্দুতে কথা বলে না বাংলায় কথা বলে, তাতে এদের কিছুই যায় আসে না। হিন্দু জমিদারদের আমলেও এরা পেট ভরে খেতে পায়নি, পাকিস্তানী আমলেও এদের দু বেলা ভাত জোটার নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশের যুবশক্তির একটা অংশ যেমন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গেছে, তেমনি আবার একটা বেশ বড় অংশ তৈরি করেছে রাজাকার আলবদর বাহিনী। পাকিস্তানী সৈন্যরা এদের কাজে লাগায় লুঠতরাজ, হিন্দু বিতাড়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধান দেবার জন্য। শতকরা সাতানব্বই জন লোক শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিল কিন্তু তাদের অনেকেই এখন পাকিস্তানী অত্যাচারীদের সমর্থক। অনেক অধ্যাপক, স্কুলমাস্টার, জেলা পরিষদের প্রেসিডেন্টও এখন শান্তি কমিটির উৎসাহী সদস্য এবং গণহত্যার অংশীদার। পবিত্র ইসলামের নামে শপথ নিয়ে যে কোনো অমানবিক, বীভৎস কাজ করতেও তাদের আটকায় না। আবার অল্পবয়েসী নিরক্ষর। এমন অনেক ছেলে রাজাকার হয়েছে, যাদের এটুকু বোধও নেই যে রাজাকার হওয়াটা কিছু অন্যায় ব্যাপার। তাদের মুরুব্বিরা যা বলে, তারা তাই শোনে। রাজাকার হলে তারা হাতে দুটো পয়সা পায়, অস্ত্র পায়, দু বেলা আহার জোটে। লোকের বাড়িতে আগুন জ্বালালে কিংবা হাট-বাজার লুট করলে কেউ কোনো শাস্তি দেয় না, এও তো এক মজার ব্যাপার।
আত্মরক্ষার জন্য মানুষকে কত কিছু সহ্য করতে হয়, সেই তুলনায় ধর্মত্যাগই বা এমন কি বড় কথা! পচিশে মার্চের পর যে-সব এলাকার হিন্দুরা পালিয়ে যেতে পারেনি তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে প্রাণে বেঁচেছে। এবার হিন্দুদের বিরুদ্ধে সরকারি প্রচারও তীব্র। ঢাকায় হিন্দু নামের রাস্তাগুলির সব কটার নাম পরিবর্তন করে ঘোষণা জারি হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জানে যে পূর্বাঞ্চলে বিভেদমূলক গণ্ডগোল শুরু করেছে হিন্দুরা এবং সীমান্ত-সংঘর্ষ হচ্ছে হিন্দু ভারতের শত্রুতায়। পাকিস্তানী আর্মি হিন্দু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের শায়েস্তা করছে, এটা তো দোষের কিছু নয়!
সামরিক শাসন এখন শক্ত থাবা গেড়ে বসেছে। বাংলাদেশের সব জেলাগুলিতেই বেছে বেছে নিমূল করা হয়েছে বিদ্রোহীদের। ভারতীয় আকাশবাণী কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার যাই-ই বলুক, একথা সত্যি যে পূর্ব পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলা ফিরে এসেছে অনেকখানি। স্কুল-কলেজ খোলানো হয়েছে জোর করে। অফিস-ব্যাঙ্ক-কলকারখানা আবার চালু হয়েছে। মনে মনে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক তারাও মুখ বুজে এখন বাধ্য হয়েছে কাজে যোগ দিতে। শান্তি কমিটিগুলিকে দেওয়া হয়েছে অপর্যাপ্ত ক্ষমতা।
টাঙ্গাইলে বিন্দুবাসিনী স্কুলের মাঠে এক জনসভায় শান্তি কমিটির সেক্রেটারি অধ্যাপক আবদুল খালেক ঘোষণা করলো যে পাকিস্তানে একমাত্র মুসলমানরাই থাকবে। পাকিস্তান ইসলামী রাষ্ট্র, এ রাষ্ট্রে মুসলমান ব্যতীত অন্য জাতের কোনো নাগরিক অধিকার নেই। নিচু জাতের হিন্দু, যেমন ধোপা, নাপিত, মেথর, মুচিদের রেখে দেওয়া হবে, কারণ মুসলমানরা ওই ধরনের ছোট কাজ করে না। অন্য হিন্দুরা স্বেচ্ছায় মুসলমান হলে পাকিস্তানী হতে পারবে, কিন্তু উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কোনো হিন্দু মুসলমান হলে তাকে কোরবানী করা হবে!
এর আগে অনেক হিন্দুকে হানাদার-রাজাকাররা খুন করেছে, অনেক হিন্দু ভারতে পালিয়েছে। ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোর দুরবস্থা ও মড়কের খবরও পৌঁছেছে এখানে, তাই কিছু হিন্দু মনে করেছিল, যা হয় হোক, তবু পিতৃ-পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে মরতে যাবো না। এবার তাদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠলো। আবদুল খালেক হিন্দুদের নামের তালিকা তৈরি করে ফেলেছে, এখন আর তাদের পালাবারও উপায় নেই, পালাতে গেলেও মরতে হবে।
টাঙ্গাইলের বড় মসজিদে শুরু হলো দীক্ষার অনুষ্ঠান। নিকুঞ্জবিহারী সাহা, দুলাল কর্মকার, অসিত নিয়োগী, হরিপদ সরকার, বাদল বসাক, বিজয় চৌধুরী এইসব নামের প্রায় তিন শো জনকে দাঁড় করানো হলো মসজিদের বাইরে। শান্তি কমিটির নেতারা তাদের প্রত্যেককে উপহার দিল একটি করে টুপী। তুলা নামের এক মোল্লা এদের অজুর নিয়মকানুন ও কলেমা শেখাবার দায়িত্ব নিল। এই তুলা বড় মসজিদে দীর্ঘদিন আযান দিয়ে আসছে, আজ সে দারুণ খুশি, এতদিন আযান দেওয়ার পুণ্যে সে এতগুলি কাফেরকে দীক্ষা দেবার দায়িত্ব পেয়েছে, এবার সে সরাসরি আল্লাহের খাস দরবারে পৌঁছে যাবে।
এই মজা দেখার জন্য মসজিদের সামনে ভিড় করে এসেছে হাজার হাজার মানুষ। তাতেও অধ্যাপক আবদুল খালেকের খুব রাগ, তিনি চিৎকার করে ধমকাতে লাগলেন, এদের দেখার কী আছে! এরা কেউ আল্লার ফেরেস্তা না! এরা এখনও কাফের, এখনও মুসলমান হয়ে সারেনি।
তবু যেন শুরু হয়ে গেল উৎসব। নব দীক্ষিত মুসলমানদের মিষ্টি খাওয়াবার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। নিকুঞ্জ সাহা, দুলাল কর্মকারদের দল রহিমুদ্দিন, কলিমুদ্দিন হয়ে বাড়ি ফেরার একটু পরে সেখানেও ধেয়ে এলো ধর্মের ধ্বজাধারীরা এবং কৌতূহলী জনতা। শুধু পুরুষরাই তো মুসলমান হলে চলবে না, বাড়ির মহিলাদেরও ধর্মান্তরিত করাতে হবে।
এতে আর আপত্তি করার কী আছে। পুরুষরা জাত বদলালে মেয়েরাই বা বাকি থাকে কেন? মেয়েদের মতামত নেবার প্রশ্ন ওঠে না।
মাগরেবের নামাজের পর শুরু হলো মেয়েদের দীক্ষা দেবার পালা। অতি সর্টকাট পদ্ধতিতে। অন্তঃপুরচারিণী হিন্দু মহিলারা পরপুরুষের সামনে আসবে না, তাই একখানা কালো শাড়ির এক প্রান্ত ধরে বাইরে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব, সেই শাড়ির অন্য প্রান্তটি ধরে রইলো অন্দরমহলের লক্ষ্মীরানী, সিদ্ধিরানী, জ্যোৎস্নারানী, মিনু, পলি, অৰ্চনারা। ইমাম সাহেব কলেমা উচ্চারণ করলেন ভেতর থেকে ফৌপাতে ফোঁপাতে ওইসব মেয়েরা সেই উর্দু শ্লোকের কতটা সঠিক প্রতিধ্বনি করলো সে বিচারের দরকার নেই। ওতেই হবে।
বাইরের জনতা জয়ধ্বনি করে উঠলো।
এইভাবে ধর্মান্তরের অনুষ্ঠান চলতে লাগলো দিনের পর দিন। শুধু সাহাবসাক-চৌধুরীরাই নয়, চক্রবর্তী-ভট্টাচার্যরাও বাদ পড়লো না। এবং তারা যে প্রকৃত মুসলমান হয়ে উঠেছে তা প্রমাণ করার জন্য অতি উৎসাহ দেখিয়ে তারা নামাজের জমায়েতে বেশী বেশী ভিড় করে। অনেক সময় দেখা গেল, পুরোনো মুসলমানদের চেয়ে নব্যরাই মসজিদে আসছে বেশী সংখ্যায়। অভ্যেস নেই বলে কেউ কেউ নামাজ পড়তে গিয়ে হাঁটুতে চোট খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। সেরকম একজনকে এক কট্টর মৌলবাদী দয়াপরবশ হয়ে বললো, আপনি শুধু মসজিদে এসে বসে থাকবেন, তাতেই চলবে, তাতেই আপনি সরাসরি বেহেশতে চলে যাবেন।
কৌতূহলী জনতার মধ্যে অবশ্য সবাই মজা দেখতে বা আনন্দ করতে আসেনি। এদের মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু কিছু যুবক, যারা শান্তি কমিটির হঠাৎ-নেতা এবং ধর্মের দালালদের নাম লিখে নিচ্ছে ও মুখগুলো চিনে রাখছে। তারা মনে মনে শপথ নিয়েছে, একদিন এই সমস্ত ব্যক্তিদের যারা ভয় দেখিয়ে ও জোর জুলুম করে মুসলমান বানাচ্ছে, যারা পবিত্র ইসলামের নামে কলঙ্কলেপন করছে, তাদের চরম শাস্তি দিতে হবে! একজনও নিস্তার পাবে না।
গোটা বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দাপটে ঠাণ্ডা হয়ে গেলেও এই টাঙ্গাইল মহকুমাতেই গোপনে এক দুর্জয় শক্তিশালী যোদ্ধার দল কাজ করে যাচ্ছে। তাদের নেতার নাম কাদের সিদ্দিকী।
মাত্র চব্বিশ বছরের এক যুবক এই কাদের, তার ডাক নাম বজ্র। পড়াশুনো ছেড়ে সে। একসময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। বছর দু-এক থাকার পর তার মন টেকেনি, সৈনিকের চাকরি ছেড়ে এসে সে আবার কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশুনো শুরু করেছিল, যোগ দিয়েছিল ছাত্র রাজনীতিতে। বেশ লম্বা চেহারা, সুঠাম শরীর, মুখে ফিডেল কাস্ত্রোর মতন দাড়িগোঁফ। কিছুদিন আগেও লোকে তাকে চিনতে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের নেতা এবং জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য জনাব আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই ডানপিটে বজ্র হিসেবে।
ঢাকা শহর থেকে টাঙ্গাইলের দূরত্ব মাত্র ষাট মাইল। পচিশে মার্চ রাত্রে টাঙ্গাইলে কোনো অত্যাচারের ঘটনা ঘটেনি, ঢাকায় কী ঘটেছে তা জানা যায়নি। কিন্তু পরদিন সকাল থেকেই ঢাকা থেকে সোজা সড়ক পথে ছুটে আসতে লাগলো হাজার হাজার মানুষ, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু কেউ বাদ নেই, তাদের মুখ চোখে সাঙ্ঘাতিক আতঙ্ক,কেউ কোনো কথা বলতে পারে না, তারা পালাতে চায় গ্রামের দিকে। ক্রমে জানা গেল, ঢাকায় মিলিটারিরা ট্যাঙ্ক ও কামান। নিয়ে হঠাৎ আক্রমণ করেছে সাধারণ নাগরিকদের, বহু বাড়ি ধ্বংস হয়েছে, রাস্তায় পড়ে আছে। শত শত লাশ, রাজারবাগ-পিলখানায় গোলাগুলি চলেছে, গৃহস্থের ঘরে ঢুকে সৈন্যরা গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বাঙালী মারছে। একজন জানালো যে তার বাড়ি ধানমণ্ডিতে, সে দেখেছে মধ্যরাত্রিতে একদল সৈন্য এসে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গোলা চালাতে থাকে, বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসে বেরিয়ে আসেন তাদের সামনে, তারা বঙ্গবন্ধুকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে একটা গাড়িতে তুলে কোথায় নিয়ে গেছে কে জানে!
ক্রমে ঢাকায় অত্যাচারের কাহিনীর সত্যতা সম্পর্কে আর কোনো সন্দেহ থাকে না। তখন টাঙ্গাইলের প্রতিরক্ষা বিষয়ে নেতাদের চিন্তা করতেই হয়। নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি ও সমস্ত দলের নেতাদের নিয়ে তৈরি হলো এক কমিটি, টাঙ্গাইলের সমস্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়া হলো সেই কমিটির ওপর। একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর গ্রেফতারের আশঙ্কা করে আগেই তাঁর একটি নির্দেশ ঘোষণার ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, কাগমারী বেতারে শোনা গেল সেই ঘোষণা, তিনি বাঙালী জাতিকে শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বলেছেন।
বাড়িতে বাড়িতে পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে ফেলে ওড়ানো হলো সবুজ-লাল ও সোনালী রঙের বাংলাদেশের পতাকা। শুধু টাঙ্গাইলের সার্কিট হাউসে তখনও উড়ছে পাকিস্তানী পতাকা, এই সার্কিট হাউসে রয়েছে দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি, সৈন্যসংখ্যা ১৫০ জন, তাদের পাঁচজন অফিসারের মধ্যে দু’জন পাঞ্জাবী। এই বাঙালী সৈন্যরা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছুক কি না তা এখনও জানা যাচ্ছে না। এরা পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে রেখেছে কেন? এর মধ্যে পুলিশ ও আনসার বাহিনী গণপরিষদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, কিন্তু সার্কিট হাউসের সৈন্যবাহিনী বশ্যতা স্বীকার না করলে টাঙ্গাইলের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা নেই!
লতিফ সিদ্দিকীর ভাই কাদের সিদ্দিকী চায় তার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে সার্কিট হাউস ঘেরাও করতে। হাই কমাণ্ডকে রাজি হতেই হলো। কাঁদেরের দলে ছিল কিছু ছাত্র, শ্রমিক ও রিকশাচালক, তাদের সঙ্গে যোগ দিল কিছু পুলিশ ও আনসার বাহিনী। সব মিলিয়ে সত্তর পঁচাত্তর জন, এদের হাতের অস্ত্র কিছু অতি পুরোনো থ্রি-ও-থ্রি রাইফেল ও দু-একটা মান্ধাতার আমলের ব্রেটাগান। মাঝরাত্তিরে এই দলটি রওনা হলো, বিবেকানন্দ আশ্রমের পাশ দিয়ে, লৌহজং নদীর পাড় ঘেষে। শুশানঘাট পেরিয়ে সার্কিট হাউসের হাজার গজের মধ্যে এসে পড়তেই অতি উৎসাহী কেউ কোদালিয়া পুলের ওপর থেকে চালিয়ে দিল কয়েক রাউণ্ড গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সার্কিট হাউস থেকে গর্জে উঠলো চাইনিজ মেশিনগান, বৃষ্টির মতন ছুটে আসতে লাগলো গুলি। এই আনাড়ি যোদ্ধারা সবাই আছড়ে পড়লো মাটিতে, মেশিনগানের ভয়ংকর শব্দে তছনছ হয়ে গেল রাত্রির স্তব্ধতা।
কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ বন্ধ হলে কাদের দেখলো তার নিজস্ব কয়েকজন সঙ্গীসাথী ছাড়া বাকিরা সবাই উধাও। পুলিশ ও আনসাররা ভয়ে পালিয়েছে সবার আগে। কাদের কিছুতেই পশ্চাদপসরণ করতে রাজি নয়। যদিও সে জানে যে এই সামান্য অস্ত্র দিয়ে এক সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনীর মোকাবিলা করা যায় না। তবু সে সারা রাত জেগে বসে রইলো সেখানে।
ভোরবেলা সে বন্ধুদের দিয়ে কয়েকটা মাইক্রোফোন যোগাড় করে আনলো। তার উদ্দেশ্য। বাঙালী সৈন্যদের সমর্থন আদায় করা। তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা নয়। শেষ পর্যন্ত সেই মাইক্রোফোনে বারবার আবেদন জানিয়ে সে ওই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে ফেললো, সার্কিট হাউসে ওড়ানো হলো বাংলাদেশের পতাকা।
কিন্তু শেষপর্যন্ত দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট টাঙ্গাইল ছেড়ে পিছিয়ে গেল ময়মনসিংহের দিকে। এরপর এলো ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি বাহিনী, তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চায়। এদিকে ঢাকা থেকে পাকিস্তানী আর্মি টাঙ্গাইলকে জব্দ করতে এগিয়ে আসছে। ই পি আর বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে কাদের তার সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে গেল মুখোমুখি সংঘর্ষে।
আশিকপুরে যাদুকর পি সি সরকারের প্রাক্তন বাড়ির পাশে নির্বিঘ্নে কাটলো সেই রাত। পরদিন করাতিপাড়া। তারপর গোরান-সাটিয়াচোরায় পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে টাঙ্গাইলের মুক্তিবাহিনীর প্রথম লড়াই হলো। রাস্তার দু ধারে লুকিয়ে থাকা মুক্তিবাহিনীর আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানী আর্মির বেশ কয়েকটি গাড়ি উল্টে গেল, প্রস্তুত হবার আগেই মারা পড়লো অনেক জওয়ান। তারপর শুরু হলো পাল্টা আক্রমণ, ভারী ভারী কামানের গোলা ও হেলিকপ্টারে মেশিনগানের স্ট্র্যাফিং-এ মুক্তিবাহিনী দাঁড়াতে পারলো না।
থানাগুলোতে আবার উড়লো পাকিস্তানী পতাকা, কিছু লোক যারা বাংলাদেশ স্বাধীন করবে বলে লাফিয়েছিল তারা মুহূর্তে ভোল পাল্টালো। রাজনৈতিক নেতারা টাঙ্গাইলের আস্তানা ছেড়ে কেউ কেউ লুকোলেন গ্রামে, অনেকেই চলে গেলেন ভারত সীমান্তের দিকে। কাদের সিদ্দিকী কিছুতেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি নয়, সে তার ছোট দলটি নিয়ে এবং কয়েকটা গাড়িতে যতদূর সম্ভব অস্ত্র রসদ সংগ্রহ করে আত্মগোপন করতে চলে গেল পাহাড়ী জঙ্গলে।
অসীম ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে সে কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে তুললো নিজস্ব এক মুক্তিবাহিনী। অকস্মাৎ এই বাহিনী কোনো থানা আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয় কিংবা রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানী আর্মির কোনো ঘাঁটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেশ কিছু সৈন্যকে খতম করে আবার পালিয়ে যায় জঙ্গলে। এই বাহিনীকে দেখা যায় না, ধরা-ছোঁওয়া যায় না। সরকার থেকে ঘোষণা করা হলো, দেশদ্রোহী কাদের সিদ্দিকীকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরিয়ে দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। পাকিস্তানের দুশমন এই কাদের সিদ্দিকীকে কেউ আশ্রয় দিলে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। তবু গ্রামের মানুষ কাদের ও তার সঙ্গী-সাথীদের আশ্রয় দেয়, রাত দুপুরে তারা এসে পড়লে, রান্না করে খাওয়ায়। পাকিস্তানী বাহিনীর ওপর তার চোরাগোপ্তা আক্রমণও অব্যাহত রইলো। কাঁদেরের দল শুধু পাকিস্তানী শক্তিকেই আঘাত করে না, হঠাৎ এক-একটা গ্রামে উপস্থিত হয়ে কুখ্যাত কোনো বিশ্বাসঘাতক বা দালালকে ধরে সকলের সামনে তার বিচার করে, দোষী প্রমাণিত হলে তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে মারে। চোর-ডাকাতরাও এখন এই মুক্তিবাহিনীকে ভয় পায়।
গ্রামে গ্রামে রটে গেল কাদের সিদ্দিকী অর্থাৎ বজ্র ভাই অলৌকিক শক্তির অধিকারী। তার আর একটা ডাক নাম হলো টাইগার এবং তার দলটির নাম কাঁদেরিয়া বাহিনী।
দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী পিছু হঠতে হঠতে শেষপর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত পার হয়ে গেছে। এখন ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের তত্ত্বাবধানে তাদের প্রশিক্ষণ ও গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু টাঙ্গাইলের এই কাঁদেরিয়া বাহিনী সম্পূর্ণ নিজেদের চেষ্টায় কী করে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে? প্রথমে মুজিব নগরের বাংলাদেশ সরকার কিংবা ভারতীয় সহায়ক সেনানীরা এই বাহিনীর অস্তিত্ব বিশ্বাস করতে চায়নি, কিন্তু পাকিস্তানী ফোর্সের ওয়্যারলেস মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে এদের খবর পাওয়া যেতে লাগলো। পাকিস্তানী ফোর্স এদের হামলায় ব্যতিব্যস্ত, কোথাও কোথাও তাদের ক্ষতি মারাত্মক। দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী বাহিনীর বেষ্টনীর মধ্যে এসে এরা হামলা চালিয়ে যায়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের চরমপত্রে এবার টাঙ্গাইলের এই বিচ্ছুদের গাজুরিয়া মাইরের কথা বলা হতে লাগলো। বিদেশের কয়েকটি সংবাদপত্রে বিস্ময় প্রকাশ করা হলো। ক্রমে জানা গেল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে ছ’সাত হাজার মুক্তিযোদ্ধার একটি সুশৃঙ্খল, নিয়মিত বাহিনী গড়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে একদিন ঘাটাইল-ধলাপাড়ার সম্মুখ যুদ্ধে একটা ঘটনা ঘটে গেল। অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে কাদের এল এম জি নিয়ে হানাদার খতম করে যাচ্ছে, হঠাৎ, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে লাগলো তার ডান হাত দিয়ে। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারলো না সে, কিন্তু তার সারা গায়ে রক্ত, এমনকি তার এল এম জি-টাও রক্তে ভেসে যাবার উপক্রম। সেই অবস্থায় গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সে রাস্তার পাশের ঢালু জমি দিয়ে নেমে গেল। নিজের সম্পর্কে তার চিন্তা করার সময় নেই, এই যুদ্ধে হানাদারদের যথেষ্ট ক্ষতি হলেও কাঁদেরের সহযোদ্ধা হাতেম শাহাদাৎ মৃত্যুবরণ করেছে।
কিছু পরে নিরাপদ জায়গায় সরে এসে একটা চালাঘরে আশ্রয় নিয়ে কাদের পরীক্ষা করে দেখলো নিজেকে। শত্রুপক্ষের একটা গুলি এসে তার এল এম জির ফোরসাইট নবে লাগে। নক্টা ভেঙে সৃপ্লিনটার তার ডান হাতের তালু ভেদ করে চলে গেছে, আর বুলেটটা এক হাঁটুর ইঞ্চিখানেক ওপরে ঢুকে বসে আছে। সবাধিনায়কের এই অবস্থা দেখে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মাটি আছড়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। কাদের তার হাঁটুর কাছে প্যান্ট ছিঁড়ে ক্ষতস্থানটায় ঢুকিয়ে দিল বাঁ হাতের কড়ে আঙুল। খানিকটা টেপাটেপি করতেই বেরিয়ে এলো গুলিটা। কাদের তার সঙ্গীদের বললো, কাঁদছিস কেন? এই দ্যাখ আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি।
ভারতীয় সীমান্তের ওপাশের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের সঙ্গে এর আগেই যোগাযোগ হয়েছিল। এখন সেখানে হঠাৎ খবর এলো, পাকিস্তানী বাহিনী সর্বত্র সগর্বে প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, ধলাপাড়ার যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী খতম হয়ে গেছে। পাকিস্তানী ফৌজ মিষ্টি বিতরণও শুরু করে দিয়েছিল, কিন্তু তাদের সেই আনন্দ বেশীদিন স্থায়ী হলো না, আহত অবস্থায় প্রায় দেড় শো মাইল পায়ে হেঁটে, অনেকগুলি নদী পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত বুগাই নদীর অপর পারে ভারতীয় শিবিরে এসে উপস্থিত হলো কাদের সিদ্দিকী। অনেক চমকপ্রদ অভিযানের নায়ককে এবার সশরীরে জলজ্যান্ত অবস্থায় দেখা গেল। আহত হলেও সে কাহিল হয়নি, টাইগার নামটি তাকে মানায়।
ভারতীয় এলাকায় চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হবার পর প্রচুর সংবর্ধনা পাচ্ছিল কাদের, তবু সে দারুণ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আবার ফিরে গেল নিজের এলাকায়। নিজের বাহিনী ছেড়ে সে দূরে থাকতে চায় না, সে আবার লড়াই চালিয়ে যেতে চায়, টাঙ্গাইল শত্রু মুক্ত করার জন্য।
ধলেশ্বরী নদীর বুকে এই বাহিনী একদিন এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়ে দিল। নারায়ণগঞ্জ থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ ভর্তি সাতটি স্টিমার ও জাহাজ চলেছে উত্তরবঙ্গের দিকে। টাঙ্গাইল শহর এখন পুরোপুরি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অধীনে, এ ছাড়া কালিহাতি, ঘাটাইল, সিরাজগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মধুপুরেও হানাদারদের প্রচুর অস্ত্র ও সৈন্য মজুত। সেই জন্যই জাহাজগুলি চলেছে নিশ্চিন্তে, ঢিলেঢালা গতিতে। কিন্তু এরই মধ্যে ভুয়াপুর নামে একটি ছোট্ট জায়গায় রয়েছে মুক্তিবাহিনীর একটি গুপ্ত ঘাঁটি। সেখানে এসে পৌঁছোল ঐ জাহাজ চলাচলের খবর। কাদের সিদ্দিকী সেখানে নেই, তবে সে নদীপথের ওপর নজর রাখার পরামর্শ দিয়ে রেখেছে। ঐ জাহাজগুলির একটি বাঙালী সারেং গোপনে কিছু খবরও পাঠিয়েছে। সর্বাধিনায়ক ভুয়াপুরের ঐ মুক্তিবাহিনীর ইউনিটকে জাহাজগুলি আক্রমণ করার নির্দেশ পাঠালো।
এটা একটা অসম্ভব প্রস্তাব। এ যেন ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সদরের এক দৈত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতন। গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও সামান্য কিছু অস্ত্র নিয়ে কি পাকিস্তানী নৌবাহিনীর মোকাবিলা করা যায়? কিন্তু এত সব অস্ত্র গোলাবারুদ উত্তরবঙ্গে পোঁছোলে সেখানে পাকিস্তানী সীমান্ত রক্ষীরা দুর্জয় হয়ে উঠবে। মুক্তিবাহিনীরও সাঙ্ঘাতিক অস্ত্রের ক্ষুধা।
অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই তারা লেগে পড়লো। ধলেশ্বরীর ধারে মাটি-কাটা নামে একটি গ্রাম, সেখানে ঘাপটি মেরে বসে রইলো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছোট দলের কমান্ডার মেজর হাবিব ও তার কয়েকজন সঙ্গী। এর আগে ছেঁড়া লুঙ্গি পরে, মাথায় গামছা বেঁধে ও কাঁধে ঝাঁকি
জাল ঝুলিয়ে সাধারণ গ্রাম্য জেলের ছদ্মবেশে হাবিব জাহাজগুলোর কাছ থেকে ঘুরে এসেছে, পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলে এসেছে। এদের মনে কোনো রকম উদ্বেগের চিহ্নমাত্র নেই।
হাবিবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা মাত্র আঠেরো জন, আর সঙ্গে আছে দু ইঞ্চি মর্টার তিনখানা, দু’টা এল এম জি, কয়েকটি চাইনিজ ও ব্রিটিশ রাইফেল ও একটি ব্রিটিশ রকেট লঞ্চার। সাতটি জাহাজ সমান দূরত্ব রেখে আস্তে আস্তে এগোচ্ছে, হাবিব আগেই বলে রেখেছে। যে সে প্রথম গুলি না ছুড়লে অন্য কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। একটি জাহাজ পার হয়ে গেল, অল্প বয়েসী ছেলেরা অস্ত্র হাতে ছটফট করছে, কিন্তু হাবিব নীরব, স্থির। দুটি জাহাজ গেল, তিনটি জাহাজ গেল, তবু হাবিব অস্ত্র তুললো না।
নদীর মাঝখানে চর, পূর্ব দিকে জলের গভীরতা বেশী, জাহাজগুলি যাচ্ছে সেইদিক দিয়ে, ক্তিযোদ্ধারা ও সেই পাড়েই বসে আছে। পাঁচখানা জাহাজ পার হয়ে যাবার পর শেষ দুটি জাহাজ এলো, তাদের আকার বিরাট, আগাগোড়া ত্রিপলে ঢাকা। ওপরে অস্ত্র কোলে নিয়ে পাহারাদার সৈন্যরা গল্পগুজব করছে। রেঞ্জের মধ্যে আসতেই মেজর হাবিবের এল এম জি থেকে গুলি বর্ষণ শুরু হলো, সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জন করে উঠলো।
আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে কোনো রকম প্রতি-আক্রমণও এলো না প্রায়। কয়েকজন পাকিস্তানী সৈন্য প্রথম গুলির ঝাঁকে প্রাণ দিল, বাকিরা প্রাণ ভয়ে লাফিয়ে পড়লো নদীতে। অগ্রবর্তী জাহাজগুলো সাহায্যের জন্য পিছিয়ে এলো না, বরং তারা যেন আরও ভয় পেয়ে গতি বাড়িয়ে পালালো সিরাজগঞ্জের দিকে। তারা কল্পনাই করতে পারেনি যে, মুক্তিবাহিনী এত বড় দুটি জাহাজকে আক্রমণ করতে সাহস করবে। তা ছাড়া, জাহাজ দুটি গোলাবারুদে ঠাসা, যে-কোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে সব শুদ্ধ উড়ে যেতে পারে।
জাহাজ দুটো ঠেকে গেল মাটির চড়ায়। তখনি বিস্ফোরণ ঘটলো না। অসমসাহসী হাবিব তিন-চারজনকে সঙ্গে নিয়ে একটা ছোট নৌকোয় চেপে একটা জাহাজে উঠলো। এদিকে ওদিকে কয়েকটি মৃতদেহ ছড়ানো, আর জাহাজভর্তি লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি কার্তুজ, বুলেট ও কামানের গোলা, এ ছাড়া কিছু কামান ও মর্টার।
কাছাকাছি গ্রাম থেকে দলে দলে ছুটে এলো স্বেচ্ছাসেবকেরা। নামানো শুরু হলো অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রায় পাঁচশো জন লোক ছ’ঘণ্টা ধরে ওঠা-নামা করেও সেই দুটি জাহাজের এক-চতুর্থাংশের বেশী অস্ত্র গোলাবারুদের পেটি খালাস করতে পারলো না। আর দেরি করা যায় না, যে-কোনো মুহূর্তে হানাদার বাহিনী ফিরে আসবে। জাহাজ দুটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হলো। তার আগেই অস্ত্র ভর্তি নৌকোগুলো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে সকলের স্থানত্যাগ করাবার ব্যবস্থা হয়েছে।
পরবর্তী কয়েক দিন ধরে চললো সেই অগ্নিদগ্ধ জাহাজ দুটি থেকে গোলাবারুদের বিস্ফোরণ, কানে তালা ধরানো ভয়ংকর শব্দ। প্রতিশোধ নেবার জন্য তিন দিক থেকে এগিয়ে এলো পাকিস্তানী সৈন্যদল, আকাশ দিয়ে উড়ে এলো দুটি বিমান, একসঙ্গে গোলা বর্ষণ করেও তারা মুক্তিবাহিনীর গায়ে আঁচড় বসাতে পারলো না, তারা তখন একটার পর একটা সেতু ধ্বংস করে পিছিয়ে যাচ্ছে।
পাকিস্তান বাহিনীর দুটি জাহাজ সমেত প্রায় একুশ কোটি টাকার অস্ত্র ধ্বংস করে ফেললো গুটি কয়েক বাঙালী ছেলে, যাদের মধ্যে অনেকেই মাত্র কয়েক মাস আগেও কোনো অস্ত্র ছুঁয়ে দেখেনি।