সরকারি হিসেব মতনই গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৬০,২২৯ জন; ভারত রক্ষা আইনে অবরুদ্ধ ১৮,০০০; পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত ১৪০ এবং আহত ১৬৩০ জন। ষাট জায়গায় সৈন্যবাহিনী মোকাবিলা করেছে বিদ্রোহী জনতার, কোথাও কোথাও বিমান থেকে মেশিনগান চালানো হয়েছে–এ রকম ঘটনা ঘটেছে অন্তত পাঁচ বার। ২৫০টি রেলস্টেশন বিধ্বস্ত হয়েছিল, ৫০০ ডাকঘরের ওপর আক্রমণ হয়, পুড়ে ছাই হয় অন্তত ৫০টি, ১৫০টির বেশি থানা জনতা দখল করতে গিয়েছিল, এ ছাড়া আছে রেললাইন উপড়ে ফেলার ঘটনা।
বলাই বাহুল্য, বেসরকারি হিসেবে এর বহু গুণ বেশি। বেসরকারি হিসেব অবশ্য সে সময় জানার উপায় ছিল না, সংবাদপত্রগুলির কণ্ঠরোধ করা হয়েছিল।
এই ভাবে শেষ হল বেয়াল্লিশের আগস্ট আন্দোলন বা তথাকথিত আগস্ট বিপ্লব। মাসখানেকের বেশি স্থায়ী হয়নি। বিক্ষিপ্ত ভাবে হলেও দেশের কয়েকটি অঞ্চলে জনতা সত্যিকারের খেপে উঠেছিল–মুষ্টিমেয় ব্রিটিশ বাহিনীকে ধুলিসাৎ করা অসম্ভব ছিল না, কিন্তু নেতৃত্বের অভাবেই সব ব্যর্থ হয়ে যায়। এত বৃহৎ কর্মকাণ্ডের সঠিক চরিত্রটি যাচাই করে নির্ভীক ভাবে সারা ভারতকে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক কেউ দেয়নি। যে-বিপ্লবের সম্ভাবনা শুধু দেখা গিয়েছিল, বিকলাঙ্গ অবস্থায় তার মৃত্যু হল। আগা খাঁ প্যালেসে অন্তরীণ অবস্থা থেকে গান্ধীজি বলতে লাগলেন, এইসব হিংসাত্মক ঘটনার জন্য কংগ্রেস দায়ী নয়। এসবই সরকারের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া।
ইংরেজ জাতির কতগুলি সুসভ্য রীতিনীতি আছে। তাদের শাসন ব্যবস্থা রুল অফ ল-র অধীন এবং অধিকাংশ জায়গাতেই তা মানা হয়। অন্যান্য ইয়োরাপীয় ঔপনিবেশিকদের তুলনায় ইংরেজরা যে অনেক ক্ষেত্রেই প্রচুর সংযমের পরিচয় দিয়েছে–সে কথাও ইতিহাসের খাতিরে স্বীকার করা দরকার। গান্ধী নেহরুর মতন নেতাদের সঙ্গে দরকষাকষির বদলে যদি তাদের দেওয়ালে দাঁড় করিয়ে সোজা গুলি করে মেরে ফেলা হত তা হলে তাদের কে আটকাত! গান্ধীজির ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতি বিশ্বময় ছড়াবার আগেই তাকে খতম করে দেওয়া যেত না? পৃথিবীর দু-চারটে কাগজে বড় জোর প্রতিবাদ বেরোত, তা ছাড়া কোনও সরকার মাথা ঘামাত না।
দর কষাকষির আপোস আলোচনায় ইংরেজ কখনও আপত্তি করেনি কারণ এতে কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই তার। তা ছাড়া দরকষাকষির শিল্প সে নিজে খুব ভালোই জানে। কিন্তু নিজের স্বার্থে সত্যিকারের ঘা পড়লে ইংরেজ চরম নির্মমতা দেখাতেও কুণ্ঠিত হয় না। সারা পৃথিবী জুড়ে ইংরেজ যখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ব্যতিব্যস্ত তখন ভারতীয় প্রজাদের এই বেয়াদবি তার একেবারে সহ্য হয়নি। প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত নিষ্ঠুরতায় সে এই নেতৃত্বহীন আন্দোলন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নেতাদের বন্দি করে রাখার বদলে তখনই যে খুন করেনি সে তার নিছক নিয়মরীতি রক্ষা বা দয়ামায়ার গুণে নয়। ইংরেজের তকালীন অভিভাবক মার্কিন সরকার ভারতে নিষ্পেষণ নীতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে। সুতরাং প্রকাশ্যে, বড় বড় নেতাদের বন্দি করে রেখে এবং গান্ধীজির সঙ্গে চিঠি চালাচালির ছলে মুখ-রক্ষা করে গ্রাম গ্রামান্তরে সাধারণ মানুষের কাছে ইংরেজ দেখিয়েছে তার রুদ্র রূপ। বিনা বিচারে অসংখ্য হত্যার নজির আছে সেই সময়।
পুরো তেইশ দিন মেদিনীপুরের একটি মহকুমা স্বাধীন করে রেখেছিল সূর্য আর যোগানন্দ। সতীশ সামন্তর নেতৃত্বে মেদিনীপুরে স্বাধীন সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। কিন্তু বাকি দেশের কোথায় কী ঘটছে তার কোনও খবরাখবর আসে না। অসহায় সংবাদপত্রগুলি মূক। নাইথ আগস্ট নামে একটি গুপ্ত পত্রিকায় গরম গরম খবর দেখলে মনে হয় সারা দেশই বুঝি স্বাধীন হয়ে গেলঅথচ এক জেলার মানুষ আর এক জেলায় গেলে হকচকিয়ে যায়। সেখানে বিপ্লবের নামগন্ধও নেই। গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ ডাক এবং ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’ ধ্বনির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে স্থানীয় কংগ্রেসি নেতারাও ভেবেছিলেন এ-আন্দোলন একটা চূড়ান্ত রূপ নেবেই। অথচ সর্বভারতীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে কোনও নির্দেশ আসে না। প্রথম সারির নেতারা জেলে গেলে দ্বিতীয় সারির নেতাদের প্রকৃত নেতৃত্ব নেবার জন্য তৈরি করা হয়নি। পদে পদে দ্বিধা ও সংশয়েই আমাদের ইতিহাস আকীর্ণ। অযথা প্রাণ দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
সূর্য এবং যোগানন্দ তাদের ব্যক্তিগত বীর্য, সামর্থ ও বুদ্ধি দিয়ে যতখানি করবার করেছে, তারপর তারাও থমকে গেল। দুজনেই মৃত্যুভয় অতিক্রম করে গেছে বলে নানা রকম অকল্পনীয় বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, স্থানীয় লোকরা ওদের দুজনকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত। কিন্তু একসময় দু’জনেই থমকে গিয়ে ভাবল, এর পর কী? খড়গপুর থেকে সৈন্যবাহিনী মার্চ করে আসছে, ওরা শুনতে পাচ্ছে সেই নিশ্চিত পদশব্দ–কী নিয়ে সেই সৈন্যবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়াবে? এ রকম তো কথা ছিল না। কেন আর একদল পেছন থেকে আক্রমণ করছে না সৈন্যবাহিনীকে। জয়প্রকাশ নারায়ণের নামে কিছু দিন ধরে অদ্ভুত সব কাহিনী শোনা যাচ্ছিল, কোথায় তিনি? আসাম সীমান্তে সৈন্যবাহিনী নিয়ে কোথায় সুভাষবাবু? সুভাষবাবু তখনও অনেক দূরে।
সন্ত্রাসবাদী বা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা তখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল– বেয়াল্লিশের আগস্টে তারা শেষ বার মরিয়া হয়ে নেমে পড়েছিল। এই বিপ্লব ব্যর্থ হওয়ায় তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। স্বাধীনতার সোনার পাথরবাটি অর্জনের কৃতিত্ব চলে গেল নরমপন্থীদের হাতে। বাটিটা ভেঙে আধখানা করে নিতেও যাদের আপত্তি নেই।
ব্যর্থ বিপ্লবীর মতন করুণ চরিত্র আর হয় না। পরাজিত নৃপতিরও একটা মহিমা থাকে–কিন্তু এরা শুধু অপবাদ নিয়েই চলে যায়। শকুনেরও বাসা থাকে, ইঁদুরেরও গর্ত থাকে, কিন্তু এদের কোনও আশ্রয় নেই।
সামরিক বাহিনী এসে ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করে দিল মেদিনীপুরের বিপ্লবের সাধ। সন্দেহজনক পল্লিগুলোতে জ্বালিয়ে দিতে লাগল আগুন। আগুনের নাম লাল ঘোড়া। সেই লাল ঘোড়া ছুটতে লাগল গ্রাম থেকে গ্রামে। আন্দোলনের পাণ্ডাদের মধ্যে যাদের হাতের কাছে পাওয়া গেল, গুলি করে শেষ করে দেওয়া হল তাদের বাকিদের মাথার মূল্য ধার্য করে লটকে দেওয়া হল নোটিশ।
সূর্য আর যোগানন্দর হাতে একটা পয়সা নেই, কিন্তু ওদের মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা করে। ওরা তখন তাড়াখাওয়া পাগলা কুকুরের মতন পালাচ্ছে। দুজনেই মরতে, রাজি, তবু অকারণে পুলিশের গুলি খেয়ে মরতে চায় না। ইতিমধ্যেই ওরা ব্রজগোপালের মৃত্যুসংবাদ শুনেছে। ব্রজগোপালকে মারবার আগে সামরিক বাহিনীর লোক বুটের ঘা দিয়ে তাঁর চোখ-নাক থেতলে দিয়েছিল।
দু’জন ব্যর্থ বিপ্লবী পালাচ্ছে। মাঠঘাট-জঙ্গল ভেদ করে অবিরাম ছুটে যাচ্ছে দু’জন যুবক–স্পষ্ট দেখা যায় এই দৃশ্য। এরা এখন অতি সাংঘাতিক প্রাণী, এরা না করতে পারে এমন কাজ নেই। যে-কোনও মূহূর্তে এরা মানুষ খুন করতে পারে। এরা এখন পৃথিবীর কারোকে বিশ্বাস করে না। সবাই ওদের শত্রু। এরা লোকের কাছ থেকে খাবার কেড়ে খায়, সামান্য প্রতিরোধেই মারধর করে।
অবিরাম ছুটে যাচ্ছে দুই পলাতক। কোথায় যাবে ওরা জানে না। দেশের জন্য ওরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল, এখন এই দেশের কোথাও ওদের স্থান নেই। ওরা শুধু পালাতে থাকবে।
সূর্যকে নিয়ে যোগানন্দ একটু মুশকিলে পড়েছে। সূর্য প্রায়ই রক্তবমি করে। বলশালী, স্বাস্থ্যবান ছেলে, কোথাও কেটে ছড়ে গেলে কিংবা হাত-পা ভাঙলেও চিন্তার কিছু ছিল না, কিন্তু ভেতর থেকে এত রক্ত পড়া খুব খারাপ লক্ষণ। এখনই চিকিৎসা করাতে না পারলে আর দু-এক দিনের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।
একটা খালের ধারে পড়ন্ত সন্ধ্যাবেলায় ওরা দুজনে বসেছে, যোগানন্দ একটা বিড়ি ধরাল। চিক করে মাটিতে থুতু ফেলে বলল, তুই কখনও নৌকোর ওপর থেকেছিস?
সূর্য একটা ঘাস ছিঁড়ে নিয়ে, গোড়ার দিকের সাদা নরম অংশটা চিবোতে চিবোতে বলল, না।
যোগানন্দ খালের জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বলল, বেশ লাগে থাকতে। রাত্তিরবেলা ঘুমটা ভালো হয়। আমি একবার ছিলাম প্রায় মাসখানেক, রসুলপুরের নদীর মুখটায়। এত ভালো লাগত, আঃ, টাটকা টাটকা মাছ ধরে নিয়ে ভেজে ফেলা, গরম গরম ভাত আর কাঁচালঙ্কা, ডালফাল লাগত না, শুকনো শুকনো ভাতই মেরে দিতাম এক থালা-মাছ যা খেয়েছি না–এক সের দেড়-সের আমি একাই
কথা বলতে বলতে যোগানন্দ হাসতে লাগল। আপন মনে হাসি, সহজে থামতেই চায়। তারপর উরুতে চাপড় মেরে উল্লাসের সঙ্গে বলল, শালা! সারা দিন কিছু খাইনি, রাত্তিরে কী খাব তার ঠিক নেই–আর মনেও পড়ে যাচ্ছে যতসব খাবার গল্প! তোর বউদি কী রকম রান্না করত বল তো?
সূর্য মৃদু গলায় বলল, একটা নৌকো এ-দিকেই আসছে।
হুঁ। আমি দেখেছি।
উঠে পড়তে হবে?
হুঁ।
একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলে হয় না? যদি পুলিশ ফুলিশ না থাকে–যদি জেলে নৌকো হয়–তা হলে ওদের কাছ থেকে নৌকোটা কেড়ে নিলে হয় না?
আমিও একবার তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ঝঞ্জাট আছে। লোকগুলোকে মেরে তাড়ালেও এক্ষুনি গিয়ে পুলিশে খবর দেবে। এই নৌকো নিয়ে তো তাড়াতাড়ি পালানো যাবে না! এই খাল দিয়ে কোথায়ই বা যাওয়া যায়!
তা হলে?
আর এক কাজ করা যায়। যদি একজন বা দু’জন লোক থাকে তা হলে একদম খতম করে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লাশ নিয়ে ঝামেলা হবে–এখানে কারওর না কারওর চোখে পড়ে যাবেই।
তা হলে আর বসে থাকার দরকার নেই।
সূর্য হাতটা উঁচু করল। যোগানন্দ আগে উঠে সূর্যর হাত ধরে টেনে তুলল। সূর্য বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে, বসলে সহজে উঠতে পারে না। তবে এখনও সে দৌড়োতে পারে, বেশ জোরেই পারে, কিন্তু দম থাকে না বেশিক্ষণ। প্রয়োজনে সে যে-কোনও লোকের মুখে ঘুষি মেরে এখনও ধরাশায়ী করে দিতে পারবে–তারপর নিজেই অনেকক্ষণ ধরে হাঁপাবে। ওর অসুখ যে কতখানি তা ওর মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না অবশ্য।
যোগানন্দ জিজ্ঞেস করল, ঠিক আছে তো?
সূর্য বলল, চলুন।
সন্ধ্যার অন্ধকারে আবার ওরা হাঁটতে লাগল।
চলো মুসাফির, চলো। থেমে থেকে লাভ কী? আরও কত দিন চলতে হবে তার ঠিক কী? পালাও, পলাতক! জীবন থেকে, মৃত্যু থেকে পালাও!
ওরা দৌড়োতে লাগল, থামতে লাগল, আবার দৌড়। কোথাও বিশ্রামের সুযোগ নেই, কোথাও একটু স্বস্তি নেই। তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনও খাবারের দোকান বা লোকজনের বাড়ি চোখে পড়ে না কিন্তু–পুলিশের গাড়ি দেখা যায়। সার্চ লাইটের মতন আলো ওদের খোঁজে।
ওরা লোকজনের চোখের সামনে আসতে চায় না। সাধারণ গ্রামবাসীদেরও এখন আর বিশ্বাস করা যায় না। ওদের কোনও জায়গায় দেখা গেলেই সে-গল্প ছড়িয়ে যায় একটু বাদেই, পুলিশের কানে গিয়ে ঠিক পৌঁছোয়। ইনফর্মার আর স্পাইতে ছেয়ে গেছে। গোটা জেলা। তা ছাড়াও, গ্রামবাসীরা ওদের পছন্দ করে না এখন–পুলিশি অত্যাচারের জন্য দায়ী এই বাবুরাই–এদের জন্যেই আজ তাদের বাড়িঘরের সর্বনাশ। কেউ ওদের আশ্রয় দিতে চায় না, কেউ খাবার দিতে চায় না। কোথাও কারওর বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সব পথ এখন ওদের রুদ্ধ।
চাঁদ ঢাকা পড়েছে মেঘে, পথঘাট ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। এরই মধ্যে সূর্য একবার বসে পড়ে খানিকটা রক্তবমি করল। মুখ ধোওয়ার জন্য তার জল দরকার। যোগানন্দ তার হাত ধরে টেনে টেনে আন্দাজে নিয়ে এল একটা ডোবার ধারে। ময়লা দুর্গন্ধ জলেই যোগানন্দ জোর করে মুখ ধুইয়ে দিল সূর্যর। তারপর বলল, এখানে এখন একটু শুয়ে থাক। কাছাকাছি লোকজন নেই।
আপনি কিছু খাবেন না?
ধুর শালা! কে আমার জন্য খাবার সাজিয়ে বসে আছে?
আপনার খিদে পায়নি?
পায়নি আবার? আগুন জ্বলছে পেটের মধ্যে। কাছাকাছি কোনও জন্তুজানোয়ার পেলে কাঁচাই খেয়ে ফেলতাম।
যোগানন্দদা আমি এখানে থাকছি। আপনি কিছু খাবারটাবার খেয়ে আসুন। ফাঁকায় কোনও বাড়িটাড়ি দেখলে সোজাসুজি চাইবেন। কাল ভোরের মধ্যেই আমরা এখান থেকে সরে পড়ব। রিস্ক বেশি নেই।
তুই থাকতে পারবি একলা?
হ্যাঁ? খুব পারব।
এই অন্ধকারে রাস্তা চিনব কী করে?
ওই যে তালগাছটা দেখছেন–ও রকম লম্বা তালগাছ এ-দিকে আর একটাও দেখা যাচ্ছে না। এক্ষুনি জ্যোৎস্না উঠবে, আপনি ঠিক দেখতে পাবেন।
তুই যেতে পারবি না আমার সঙ্গে? তোরও তো কিছু খাওয়া দরকার।
আমার খিদে নেই। আমি এখানে বসছি। আপনি ঘুরে আসুন।
সূর্য, তুই ঠিক একলা থাকতে পারবি তো! বুকে বেশি ব্যথা করছে নাকি?
না, না—
তা হলে যাই ঘুরেই আসি৷ খিদের জ্বালায় স্থির থাকতে পারছি না। যদি কিছু পাই, তোর জন্যও নিয়ে আসব।
আপনি ঘুরে আসুন।
তুই এই গাছটায় হেলান দিয়ে বোস। ঠিক আছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি।
যোগানন্দ চলে গেল, মিলিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে। সূর্য আকাশের দিকে চেয়ে দেখল–একটা বড় মেঘের চাই ঢেকে আছে চাঁদ–তবে শুক্লপক্ষের রাত, মেঘ ফুঁড়ে চাঁদ বেরোবেই। তালগাছটার ওপরে কোনও বড় জাতের পাখির বাসা আছে, শোনা যায় ডানার ঝটপটানি।
কোনও মানুষের পায়ের শব্দ শুনে সূর্য উৎকর্ণ হয়ে উঠল। রিভলবারটা বার করে ধরতেই চাপা গলায় শোনা গেল, আমি।
যোগানন্দই ফিরে এসেছে। সূর্যর পাশে ধপ করে বসে পড়ে বলল, থাক, আর যাব না।
কেন, গেলেন না কেন?
খিদের জ্বালায় আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম বলেই যাবার কথা ভেবেছিলাম। না হলে, এ ভাবে কেউ যায় না। তোকে এ ভাবে একলা ফেলে কি আমি যেতে পারি?
আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না।
না হোক। আমি যদি খাবারের সন্ধানে গিয়ে হঠাৎ ধরা পড়ে যেতাম, তা হলে তোর কী হত? তুই যা শরীরের অবস্থা করেছিস, একলা তো বেশি দূর যেতেই পারবি না।
আমার জন্য আপনার ফিরে আসা উচিত হয়নি।
এখন চুপ করে শুয়ে থাকতো।
হরদা আমাকে বলেছিলেন, আমাদের প্রত্যেকের প্রাণের দায়িত্ব আমাদের নিজেদের। কেউ অন্য কারওর জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবে না। আমি নিজেকে ঠিক সামলাতে পারব। আমার জন্য আপনার বসে থাকা উচিত নয়।
যোগানন্দ রেগে গিয়ে বলল, ওসব উচিত অনুচিতের গুষ্টির আমি ইয়ে করি। ওসব চুকেবুকে গেছে। এখন আর কোনও নিয়ম নেই। আমার খুশি আমি যাব না!
আমি একটু বিশ্রাম নিলেই ঠিক হয়ে যাব।
আজ তিন বার রক্তবমি করেছিস। রোজই বাড়ছে।
ও কিছু নয়। ভেতরে ভেতরে হেমারেজ হয়েছিল–সেই বাজে রক্তটুকু বেরিয়ে যাচ্ছে।
খুব সায়েন্সের জ্ঞান দেখছি তোর।
আপনি কি ভাবছেন আমার টি বি হয়েছে? যে টি বি রুগির মুখ দিয়ে রক্ত পড়ে তার দৌড়োবার ক্ষমতা থাকে না। অসম্ভব।
টি বি না কী তা আমি জানি না। কিন্তু আর চিকিৎসা না করলে এক দিনও চলবে না। শোন, কাজের কথা বলি। এই মাঠেঘাটে থেকে আর কোনও লাভ নেই। শহরে যেতে হবে। শহরের ভিড়ে মিশে যেতে না পারলে আর নিস্তার নেই।
কোন শহরে যাবেন?
যত বড় শহর হয়, ততই ভালো। তবে কলকাতা নয়। বোম্বের দিকে যেতে পারলে সুবিধে হয়, ওখানে কেউ চিনতে পারবে না।
সূর্য একটুক্ষণ চুপ করে রইল। তার বুকের মধ্যে অসহ্য ব্যথা–যেন একটা পাথর বুক ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। জোরে নিশ্বাস ফেলতে গেলেও কষ্ট হয়। আস্তে আস্তে বলল, বোম্বে অনেক দূর। অত দূর কি পৌঁছোতে পারব?
যোগানন্দ সূর্যর গায়ে হাত রেখে বলল, ঠিক পৌঁছে যাব। আমি নিয়ে যাব তোকে। আমরা খড়্গপুরের খুব কাছেই চলে এসেছি মনে হচ্ছে। খড়্গপুর শহর নিশ্চয়ই খুব গরম হয়ে আছে। দুটো-তিনটে দিন সাবধানে থাকতে হবে। যদি ট্রেন চালু থাকে–
খড়্গপুরে আমরা কোথায় থাকব?
একটা কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে, অত ভাবছিস কেন? ওখানে আমার দু-তিন জন চেনা লোক আছে তাদের বাড়িতে অবশ্য থাকা সম্ভব হবে কিনা বুঝতে পারছি না। না-থাকাই বোধহয় ভালো। তবু ওরা অন্তত কিছু সাহায্য তো করতে পারবে! যদি সাহায্য করতে না চায় গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
খড়্গপুরে আমারও চেনা একজন থাকে। আমার এক বোন, ওর শ্বশুরবাড়ি খড়্গপুরে–
কোন পাড়ায়?
সে-সব কিছু জানি না। ওর স্বামীর নামটা শুধু জানি, প্রভাসকুমার লাহিড়ী।
শুধু নাম জেনে কি কারওর ঠিকানা খুঁজে বার করা যায়? কী করেন ভদ্রলোক, উকিল কিংবা ডাক্তার হলেও–
সেসবও জানি না। ভদ্দরলোককে আমি দেখিইনি।
তা হলে আর কী হবে! যদি বা খুঁজে পাওয়া যায়, সে ভদ্দরলোক কি তোকে থাকতে : দেবেন? তোর চিকিৎসা করানো দরকার।
সূর্য চোখ বুজে শ্রীলেখার মুখখানা ভাববার চেষ্টা করল। আশ্চর্য, শ্রীলেখার মুখ তার কিছুতেই মনে পড়ছে না। এত চেনা মুখও মানুষ এ রকম ভাবে ভুলে যায়! সূর্য যেন দেখতে পাচ্ছে, শ্রীলেখা তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারের মধ্যে, টের পাওয়া যাচ্ছে তার অস্তিত্ব–কিন্তু তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। নিজের মাথার চুল খিমচে এক ঝাঁকুনি দিল সূর্য।
তারপর আস্তে আস্তে দেখতে পেল শ্রীলেখার চোখ, নাক ও মুখের একটু অংশ, শ্রীলেখা পাশ ফিরে আছে। ক্রমে ক্রমে ফুটে উঠছে আলো। শ্রীলেখার চেহারা একটুখানি বদলে গেছে। আগে খুব চুল ছিল তার মাথায়–এখন যেন একটু ছোট মনে হচ্ছে, কেটেছে কঁচি দিয়ে? কানের পাশ দিয়ে আলাদা ভাবে সরু চুলের গোছা নেমে এসেছে। তাকে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে এখন! সূর্য মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করল, আমি কি আর কোনও দিন ওর সামনে দাঁড়াতে পারব?
হঠাৎ যেন সত্যিই শ্রীলেখা তার সামনে এসে দাঁড়াল। অভিমানের সঙ্গে বলল, তুমি তো এক বারও আমার কাছে এলে না? তুমি আসবে বলেছিলে।
সূর্যর উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। তার ইচ্ছে হল, শ্রীলেখার কোমর ধরে ওঠে। শ্রীলেখার হাত জড়িয়ে ধরে বলে, আমি বাঁচতে চাই, আমি বেঁচে থাকতে চাই।
যোগানন্দ সূর্যকে আস্তে ঠ্যালা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই, বিড়বিড় করে কী বকছিস কী? ইস, জ্বর হয়ে গেছে দেখছি।
সূর্যর তখন বুকের যন্ত্রণায় তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থা। সেই অবস্থাতেই হঠাৎ তার খুব রাগ হয়ে গেল। চোখমুখ জ্বালা করতে লাগল তার। শ্রীলেখার কথা মনে হলেই তার এ রকম রাগ হয়। সেই রাগ তাকে আলাদা শক্তি দেয়।
মাঝখানে বেশ কয়েক দিন ভুলে ছিল। এখন আবার শ্রীলেখার কথা মনে পড়তেই সে ছটফটিয়ে উঠল। শ্রীলেখা সুখে স্বচ্ছন্দে জীবন কাটাবে আর সে এখানে মাঠের মধ্যে অন্ধকারে গাছতলায় পড়ে পড়ে অসুখে ধুকবে? যদি মরতেও হয়, তার আগে শ্রীলেখার সংসারটা সে তছনছ করে দিয়ে যাবে।
সূর্য প্রাণপণ শক্তিতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলুন, খগপুরেই যাওয়া যাক।
যোগানন্দ তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে বলল, রাত্তিরটা কাটুক। রাত্তিরটা বিশ্রাম করে নে এখানে।
সূর্য রুক্ষ গলায় বলল, বিশ্রামের কোনও দরকার নেই। চলুন, সময় নষ্ট করে লাভ কী!
আর কথা না বাড়িয়ে সে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল অন্ধকারের মধ্যে।