৪১. ম্যানেজারের সঙ্গে আর একদিন দেখা

ম্যানেজারের সঙ্গে আর একদিন দেখা হয়ে গেল হঠাৎ। বার-শিমলেয় যাবার পথে ম্যানেজারও আসছিল ওদিক থেকে। হাতে সেই পেটফোলা ব্যাগ। রোগ-রোগা চেহারা। মুখের দু’পাশে ছুঁচলো গোফ। ভূতনাথ ডাকলে-ম্যানেজারবাবু–

ম্যানেজার হঠাৎ ডাক শুনে এদিক-ওদিক চাইতে লাগলো। –কে ডাকলে আমাকে? কে গো?

ভূতনাথ বললে—আজ্ঞে আমি, বড়বাড়িতে থাকি।

যেন চিনতে পারলে ম্যানেজার। বললে—তা ভালোই হলো, দেখা হয়ে গেল, আজই তো কোর্টে দরখাস্ত করে দিলাম, জানোনা বোধ হয়। এবার কোর্টে গিয়েই বাবুরা জবাব দিক-বাড়িও ছাড়বো না, টাকাও মিটোবো না—এ তত বড় আব্দার কম নয়!

ভূতনাথ বললে–ছোটবাবু যে মরে মরো-বাড়ি ছাড়ে কেমন করে!

—তা হলে টাকা ফেলে রাখে কেন চৌধুরীবাবুরা? বলে হনহন করে চলেই যাচ্ছিলো ম্যানেজার।

ভূতনাথ বললে—শুনুন, শুনুন, শুনে যান, অত ব্যস্ত কেন?

ফিরে দাঁড়ালো ম্যানেজার।—বলুন, ঝপ করে বলুন, আমার অনেক কাজ।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলেননীবাবু কবে ফিরবে বলতে পারেন?

–সাহেবের তত ফেরবার কথা ছিল, তা-ও ছ’মাস হয়ে গেল। করে ফিরবে কে জানে—কিন্তু সাহেবের খোঁজ কেন শুনি?

-না, এমনি জিজ্ঞেস করছি।

—ও সাহেবকে ধরলে কিছুই হবে না বলে রাখছি তোমাকে, সাহেবের কাছে হাতে-পায়ে ধরলেও একটি পয়সা মাফ নেই। সাহেব তো সাহেব ননীসাহেব, সাহেবের এক কথা, দান খয়রাৎ করবে দরকার হলে, কিন্তু সুদ ছাড়বে না একটি আধলা, সাহেবের আশা ছেড়ে দাও ভাই-—তারা ব্ৰহ্মময়ী

ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে–সাহেবের ঠিকানাটা একবার দিতে পারেন?

—কোথাকার ঠিকানা!

—বিলেতের।

–ওরে বাবাঃ-বলে দশ হাত পেছিয়ে গেল ম্যানেজার। বললে—চাকরিটা আমার খেতে চাও তোমরা পাঁচজনে। তার চেয়ে এক কাজ করোনা, গলাটা বাড়িয়ে দিচ্ছি, একটা কোপ বসিয়ে দাও না কাটারির।

ম্যানেজার চলে গেল লম্বা-লম্বা পা ফেলে। ভূতনাথ একদৃষ্টে চেয়ে রইল সেদিকে। সারাদিন ঘুরে-ঘুরে কত দিকে তাগাদা তদ্বির করে বেড়ায়। আশ্চর্য, অথচ ননীলাল একদিন নিজেই টাকার চেষ্টায় ধারের আশায় ওমনি করে ঘুরে বেড়িয়েছে। ওমনি করে কত ফিকিরে সারা কলকাতা চষেছে। কোথাও যখন মেলেনি, ” তখন ছুটুকবাবুর কাছে এসে হাত পেতেছে। আর আজ তার “ অবস্থা দেখো! যে-লোকটা ভগবানে পর্যন্ত বিশ্বাস করতো না, ” তারই ওপর ভগবানের আশীর্বাদের বহরটা দেখো!

কোথায় বৌবাজার আর কোথায় বার-শিমলে। রোজ-রোজ এই যাওয়া-আসা আর পোষায় না। ক’দিন পরে ছুটি ফুরিয়ে গেলে তখন কি আর এই দেখাশোনা করা যাবে। শেষ যখন হয়েই গিয়েছে, তখন সেই শেষের জেরটুকু যেন আর কাটতে চায় না। কিন্তু ‘ভূতনাথের মনে হয়–নিজের মনের গোপন ইচ্ছেটা সংসারের কাছে যেন বরাবর গোপনই থাকে। সে-কথা কাউকে জানাবার নয়, বলবারও নয়। লোকে হাসবে তা শুনে!

জবা অনেক আগে একদিন বলেছিল—আচ্ছা, আপনি যে এতদূর রোজ আসেন-কীসের আশায় আসেন বলতে পারেন? একঘেয়ে লাগে না?

ভূতনাথ কিছু উত্তর দিতে পারেনি চট করে।

জবা বলেছিল—আমারই লজ্জা করে যে এক-এক সময়ে।

ভূতনাথ শুধু বলেছিল—ওটা বোধ হয় আমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে “গিয়েছে জবা। এখন তুমি আসতে বারণ না করা পর্যন্ত আর আমার আসা বন্ধ হবে না।

তারপর জবা বলেছিল—আপনি সত্যি যেন তা বলে আসা বন্ধ করবেন না ভূতনাথবাবু!

কিন্তু তবু ভূতনাথের ভয় হয়। ভয় হয় যদি কোনো কারণে একদিন তার এখানে আসা বন্ধ হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। উপাসনা মরে যখন উপাসনা করতে বসে জবা, তখন এক-একদিন ভূতনাথও, যোগ দেয় তার সঙ্গে। যতক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকে ভূতনাথ, চোখের সামনে কেবল ভেসে ওঠে জবার মুখটা। ভূতনাথ জানে। নিজের অধিকারবোধের সীমা সম্বন্ধে সচেতন সে। কিন্তু মনে হয়, সেখানে যেন কেউ নেই আর। ফতেপুরের বারোয়ারিতলার মঙ্গলচণ্ডী, বাগবাজারের শীতলা, সমস্ত দেবতাকে স্মরণ করে সে যেন ভুলতে চেষ্টা করে। মুছে ফেলতে চেষ্টা করে জীবন থেকে। বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায় সব স্মৃতি। ভূতনাথ বোঝে-এ তার অনধিকারচর্চা। এখানে তার সম্পর্ক শুধু কর্তব্য আর পরোপকারের। তাদের সম্বন্ধ শুধু উপকারক আর উপকৃতের। দাতা আর গ্রহীতার। মনিব আর ভৃত্যের। বহুদিন আগে যেদিন জবার বিয়ের কথা প্রথম কানে, এসেছিল, সেদিন একটা অজ্ঞাত ব্যথা-বোধ সমস্ত চেতনাকে নিঃসাড় করে দিয়েছিল মনে আছে। মনে আছে, মনের কান মলে দিয়ে। বার-বার ভূতনাথ বলেছিল—এ অপরাধ, এ অপরাধ! যখনই সজ্ঞান মনে কথাটা উদয় হতো—ধমকে দিতে নিজেকে। আর নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাড়াবাড়ি দেখে নিজেরই লজ্জা হতো। কাউকে বলবার কথা দূরে থাক, নিজেই নিজের অপরাধে মনে মনে শাস্তি গ্রহণ করেছে কতবার।

কিন্তু তবু কি ভূতনাথ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারে, এ শুধু তার স্বভাবই, আর কিছু নয়!

সেদিন বার-শিমলের বাড়িতে ঢুকতেই ঝি বললে—আমি আর এখানে কাজ করতে পারবো না দাদাবাবু।

—কেন, কী হলো আবার তোমার?

ঝি কিছু উত্তর দিলে না।

-দিদিমণি তোমায় বলেছে কিছু?

ঝি বললে-না।

-তবে?

–রোজ-রোজ এ আর ভালো লাগে না আমার, রান্না করবো। আর ফেলা যাবে, তা হলে এ কার সংসার—কার জন্যে খেটে মরি!

ভূতনাথ অবাক হলো। বললে—কেন, দিদিমণি ভাত খায় না?

–কোথায় খায়! দুটিখানি দাতে চিবিয়ে যেমন ভাত তেমনি তত ফেলে রাখে। যদি তাই হয় তো কেন আমি রান্না করি, আমি তো বিধবা মানুষ, আমার খাওয়ার জন্যে অত ঘটা করে মাছ তরকারি বেঁধে লাভ কী!

ভূতনাথ বললে—আচ্ছা, আমি দিদিমণিকে বলবো’খন, তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।

জবা সেদিনও তেমনি সুবিনয়বাবুর ছবির নিচে চুপ করে বসেছিল।

ভূতনাথ বলেছিল—আচ্ছা জবা, এসব তোমার কী শুনছি, তুমি নাকি উপোস করে কাটাচ্ছো?

জবা মুখ তুলে চাইলে। শান্ত দৃষ্টি। কোনো অভিযোগ, কোনো অনুযোগ, এমন কি কোনো প্রশ্নও নেই সে-দৃষ্টিতে। যেন চোখ চাওয়া ভদ্রতা, তাই চোখ মেলেছে আর কিছু নয়।

ভূতনাথ বললে—আজকে তোমাকে খাইয়ে তবে আমি যাবো, যত রাত্তিরই হোক। আমার সামনে তুমি খেতে বসবে আজ।

জবা তবু কোনো কথা বলে না।

ভূতনাথ বললে—তুমি কি ভেবেছে, এমন করে থাকলে বাবার আত্মা শান্তি পাবে তোমরা পরজন্ম মানো কিনা জানি না, কিন্তু আমি ঠিক বলতে পারি, যিনি সর্বজ্ঞ তার এতে কষ্ট হয়। স্বর্গে গিয়েও তিনি কষ্ট পাচ্ছেন তোমার জন্যে।

জবা খানিক পরে বললে—আমি আর ভাবতে পারিনে ভূতনাথবাবু—বলে আস্তে-আস্তে উঠে সোজা গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো।

রোজ এমনিই হয়। একটা কথা উঠে যখন চরম জবাবদিহির সময় আসে, তখন জবা নিজের ঘরে গিয়ে খিল বন্ধ করে দেয়।

সেদিন কিন্তু ব্যতিক্রম হলো। রোজকার মতো ভূতনাথ অন্ধকার গলিটাতে ঢুকে জবাদের বাড়ি ঢুকতে যাবে, হঠাৎ মনে হলো পাশ দিয়ে যেন কে টুপ করে চলে গেল। চেনা-চেনা মুখ। কিন্তু গ্যাসের আলোটার তলায় আসতেই, এক ঝলক আলো মুখের ওপর পড়েছে। এবার স্পষ্ট দেখা গেল-সুপবিত্র! সুপবিত্র হনহন করে চলে যাচ্ছে। ভূতনাথও অবাক হয়েছে খুব। একবার চিৎকার করে সুপবিত্রকে ডাকতে যাচ্ছিলো। কিন্তু থমকে দাঁড়ালো তখনই। সুপবিত্র কি জবার বাড়ি থেকেই বেরুলো! কিন্তু জবার বাড়িতেই বা এমন সময়ে কেন এসেছিল!

ঠিক একই জায়গায় জবা চুপ করে বসে ছিল সেদিনও।

ভূতনাথ গিয়েই জিজ্ঞেস করলে—সুপবিত্র এসেছিল নাকি এখানে?

সুপবিত্রর নাম শুনে জবা যেন একটু বিচলিত হলো।

 

ভূতনাথ আবার জিজ্ঞেস করলে—সুপবিত্রকে দেখলাম, এসেছিল বুঝি তোমার কাছে?

করে বললে-না। তবে এই গলিতেই যেন দেখলাম, ভাবলাম তোমার কাছে এসেছিল বুঝি!

জবা তেমনি মুখ নিচু করে বললেও তো রোজই আসে।

রোজই আসে? তোমার কাছে?

—আমার কাছে নয়, আমার কাছে ও আসবে না কিন্তু এ-রাস্তায় সুপবিত্র আসে।

-এ-রাস্তায় কী করতে আসে?

জবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—আমি জানতুম ও থাকতে পারবে না, কিন্তু ভেতরে তো আসতে পারে না, তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে, রাস্তা থেকে জানালার দিকে চেয়ে দেখে।

ভূতনাথ বললে–তুমি দেখেছো?

জবা বললে—দু’তিন দিন দেখেছিলুম, কিন্তু এখন আর দেখি, ও জানালাটা তাই আর খুলি না, বন্ধ করে রেখে দিয়েছি।

ভূতনাথ দেখলে রাস্তার ধারের জানালাটা বন্ধই রয়েছে। বললেবার-বার তোমায় জিজ্ঞেস করেও অবশ্য উত্তর পাইনি, তবু জিজ্ঞেস করছি, এ দুর্ভোগ কেন তোমার, বলতে পারে?

জবা চুপ করে রইল।

ভূতনাথ বললে-দোহাই তোমার জবা, আজো যেন উত্তর এডাবার জন্যে ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিও না। আমি তোমার ভালোর জন্যেই বলছি।

জবা মুখ তুললো এতক্ষণে। বললে—আমার ভালোর চেষ্টা করার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ ভূতনাথবাবু—কিন্তু কষ্ট কি আমারই হয় না-সুপবিত্রকে কষ্ট দিয়ে আমিই কি সুখে আছি বলতে চান? বলতে বলতে জবার চোখ সজল হয়ে এল।

ভূতনাথ চুপ করে রইল।

জবা খানিক পরে বললে—আপনি যদি আমার ভালো চান, তো একটা উপকার করবেন?

–বলো।

—আপনি ওর বাড়িতে গিয়ে ওকে বলে আসবেন ও যেন এমন করে আমার বাড়ির সামনে ঘোরাফেরা না করে—তাতে আমি কষ্ট পাই।

ভূতনাথ বললে—তা যেন বললুম-কিন্তু তোমার এ অকারণ জেদ-এর পক্ষে যদি ও কোনো যুক্তি চায় তখন কী জবাব দেবো?

জবা বললে—সুপবিত্র তা জানে, ওকে আমি বলেছি সব কথা।

ভূতনাথ বললে–আমার কি তা জানতে নেই?

জবা করুণভাবে আর একবার ভূতনাথের দিকে চেয়ে চোখ নামালে। তারপর বললে—আপনিও তো সব জানেন, সেদিন তো ধর্মদাসবাবু আপনার সামনে সবই বলে গেলেন, পতিব্রতা স্ত্রীর কর্তব্যই হচ্ছে একনিষ্ঠতা, এষাস্থ্য পরমা গতি, এষাস্থ্য পরম আনন্দ, এষাস্য পরম সম্পদ।

ভূতনাথ তবুও কিছু বুঝতে পারলে না যেন। বললে— পতিব্রতা স্ত্রীর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক জবা?

জবা চোখ নামিয়ে বললে—আমারও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ভূতনাথবাবু!

ভূতনাথ বললে—সে কি?

জবা তেমনি মুখ নিচু করেই বললো, কিন্তু আমাকে আপনি আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না।

ভূতনাথ অভিভূতের মতন আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগলো। এতদিনের আয়োজন, এত প্রতীক্ষা সবই কি তবে ব্যর্থ! যদি বিয়েই হয়েছে, তবে এতদিন পরে সে-কথা কে জানাতে এল জবাকে! দু’ মাস বয়সে যে-বিয়ে তার কথা এতদিন পর্যন্ত গোপন ছিল কেন? জবার দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। জবাকে যেন হঠাৎ তপস্বিনীর মতো মনে হলো। মুখ নিচু করে তেমনি নির্বিকার বসে আছে তার প্রতিদিনের নির্দিষ্ট জায়গাটিতে। ভূতনাথের আরো মনে হলো—জবার শরীর মন যেন এক আশ্চর্য অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে, যে-অনুভূতির মধ্যে দিয়ে সূর্য পৃথিবীকে টানছে, যে-অনুভূতির মধ্যে দিয়ে আলোক-তরঙ্গ লোক থেকে লোকান্তরে তরঙ্গায়িত হয়ে চলেছে। শশাকের আকস্মিক আঘাত সামলে নিয়ে যেন সে শশাকের ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছে। ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—কিন্তু কার কাছে শুনলে এ-কথা এতদিন পরে?

জবা বললে-বাবার কাছে।

ভূতনাথ আরো স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে—তা-ই যদি সত্যি হয় তত সুপবিত্রকে তিনি আশীর্বাদ করে গেলেন কেমন করে? তিনি কি তোমার এ-বিয়েতে অমত করেছিলেন?

-না।

ভূতনাথ তবু বুঝতে পারলে না। বললে—তাঁর কি মত ছিল তবে?

-বাবার মত ছিল ভূতনাথবাবু—কিন্তু আমার মত নেই। এক নারীর স্বামী থাকতে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে হতে নেই।

—তোমার স্বামী আছে?

জবা বললে—আছে।

—কিন্তু এ কেমন করে ঘটলে জবা? তাহলে সুপবিত্রকেই বা এতদিন তিনি প্রশ্রয় দিলেন কেন?

জবা মুখ তুললো এবার। বললে-বাবা তো একে সংস্কার বলতেন ভূতনাথবাবু, তাঁর তো এতে বিশ্বাস ছিল না। এতদিন ঠাকুর্দার কৃতকর্মের জন্যে তিনি অনুতাপ করেছেন, শুধু প্রকাশ করেন নি কিছু।

ভূতনাথ বললে—তিনি কি জানতেন সব?

জবা বললো, জানতেন তিনি, কিন্তু স্বীকার করেন নি।

—স্বীকার করেন নি তিনি? তা হলে কেন তিনি প্রকাশ করে। গেলেন শেষকালে?

জবা বললে—স্বীকার তিনি করতেন না, কিন্তু মৃত্যুর আগের দিন তিনি যখন প্রকাশ করলেন আমাকে সব ঘটনা, তখন বললেন–তুমি ধর্মান্তর গ্রহণ করেছে মা, তোমার সে-বিবাহ মিথ্যে—আমি তোমাকে সম্মতি দিচ্ছি-তোমার কোনো সঙ্কোচ করার প্রয়োজন নেই। তারপর আমাকে তিনি চিঠি দেখালেন।

—চিঠি?

জবা বললো, ঠাকুমা যে-চিঠি লিখেছিলেন বাবাকে।

জবা আবার বললে-বাবা বললেন—তোমাকে এতদিন বলিনি মা, সংসারে কাউকেই আমি বলি নি কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করো এখন কেন বলছি, তার উত্তরে বলবো-জীবনে কোনো দিন জ্ঞানত কোনো মিথ্যাচার করিনি আমি, এতদিন অনেক দ্বিধা ছিল মনে, অনেক সঙ্কোচ ছিল, ভেবেছিলাম, তুমি মনে খুব আঘাত পাবে, কিন্তু তবু তা জেনেও আজ প্রকাশ না করে পারছি না মা, আমার ঈশ্বর বলেছেন—এ মিথ্যাচার, এ অন্যায়, না বললে মুক্তি পাবো না আমি…আর তা ছাড়া তোমার সে-বিয়েতে আমার সমর্থন ছিল না, বাল্যবিবাহে আমার সমর্থন নেই তা তো তুমি জানো, কিন্তু এ শৈশব-বিবাহ—তোমার জ্ঞানোদয় হবার আগেই ঘটেছে।

ভূতনাথের মনে পড়লে সে-রাত্রের কথা। বোধহয় মাঝরাত হবে। হঠাৎ সুবিনয়বাবু যেন একবার চোখ খুললেন। তারপর ডাকলেন—মা-

ভূতনাথ সুপবিত্রকে নিয়ে ওদিকে পাশের ঘরে গিয়ে অপেক্ষা করেছে। আর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে বহুকালের সঞ্চিত গোপনীয়তা জবার কাছে প্রকাশ করে দিয়েছেন সুবিনয়বাবু। জব একে-একে সমস্ত ঘটনা বলে গেল সেদিনকার!

সুবিনয়বাবু বলেছিলেন—মা, আমার জন্ম ঝড়ের লগ্নে, সে এক চরম দুর্যোগ সেদিন সারা জীবনটা সেই ঝড়ের মতোই কেটে গেল, কিন্তু ভেবেছিলাম তোমাকে আমি ঝড়-ঝাপটা থেকে দূরেই রাখবো–কিন্তু জন্মের একমাস পরেই তোমাকে হারিয়েছিলাম। ফিরে যখন পেলাম তার আগেই চরম দুর্দৈব ঘটে গিয়েছে তোমার জীবনে।

জবার কাছে শোনা সেদিনকার ঘটনাগুলো আজো সমস্ত মনে পড়ে। সে কত বছর আগের ঘটনা। রামহরি ভট্টাচার্য সেদিন সবে জবাকে নিয়ে গিয়ে উঠেছেন বলরামপুরে।

গৃহিণী বললেন—একে যে মা’র কোল ছাড়া করে নিয়ে এলে— মানুষ করবে কী করে?

রামহরি বললেন—তুমি মানুষ করবে! একটা ছেলেকে মানুষ করেছিলে যেমন করে আবার তেমনি করে করবে।

–কিন্তু এ যে এখনও মায়ের দুধ ছাড়েনি।

—তা দুধের বন্দোবস্ত আমি করছি—বলে চাদরটা নিয়ে তখনই বেড়িয়ে পড়লেন। সারা গায়েই প্রভাব-প্রতিপত্তি তার। রামহরি পাঁজি দেখে বলে দিলে তবে জমিদারের বাড়িতে শুভ-কাজ শুরু হয়। রামহরির কথায় সন্ধিপূজোর ঢাক বেজে ওঠে, ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়, কনে-বউ শ্বশুরবাড়ি যাত্রা করে। একটা কথার শুধু তোয়াক্কা। রামহরি ভটচার্যিকে গাছের প্রথম ফলটা দিয়ে তকে। যজমানরা খায়। গাছের বেগুন, পুকুরের মাছ, গরুর দুধ এ-সব ভটচার্যি মশাই-এর আগে খাওয়া পাপ যেন।

সূর্যি পায়রাপোড়া সকাল থেকে বসে ছিল দাওয়ায়। ঠাকুর। গিয়েছেন বাগানে। তা বাগানে যাওয়া মানে, বাগান থেকে দশটা বাড়ি ঘুরে দশটা ভালো-মন্দ জিনিষ নিয়ে ফিরতে-ফিরতে বেলা হয়ে যায়। তারপর এসে তামাক খেয়ে দাওয়ায় বসে-বসে পুঁথি– গুলো খুলে এক-এক করে বিছিয়ে রদ্দরে শুকোতে দেওয়া। ধুনোগঙ্গাজল দিয়ে পূজোর ঘর পবিত্র করা। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই বললেন—কে রে ওখানে বসে? সূর্যি না?

সূর্যি পায়রাপোড়া সেখান থেকেই মাটিতে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। বলে এসেছিলাম ঠাকুর মশাই-এর কাছে—ছেলেটার জন্যে। পাঠশালায় ভর্তি করাবো মনে করছি—একটা দিন দেখে দ্যান যদি।

–তোরও গলায় দড়ি জোটে না সূর্যি—গয়লা মানুষ, দুধ বেচতে শেখাবি ছেলেকে, তা নয় লেখাপড়া। লেখাপড়া শিখিয়ে কি বেহ্ম করতে চাস ছেলেকে?

—আমরা মুখ্য মানুষ বলে কি ছেলেটাকেও মুগ্ধ করবে। ঠাকুরমশাই, আজকাল সবাই শিখছে, যে?

তবে তাই কর, আমার গুপী যেমন বেহ্ম হয়ে গো-মাংস খেতে শিখেছে—তোর ছেলেও তাই করুক, তখন তোর আমাকে দুষিস নে—কিন্তু দক্ষিণে কী দিবি?

—আজ্ঞে, আপনার আশীর্বাদেই সব হয়েছে, আপনি নেবেন সে আর বড় কথা কি?

পাঁজি-পুঁথি খুলে বসলেন রামহরি ভট্টাচার্য। বললেন—তোর একটা বিয়েন-গাই দিয়ে যাস দিকিনি—দুধ খেতে হবে।

—তা সের চারেক দুধই না হয় দিয়ে যাবো ঠাকুরের প্রেণামী বলে।

-না, না, ওতে হবে না, আমার কাজ ফুরিয়ে গেলে তোর গরু তোকেই ফিরিয়ে দেবো। নাতনী আমার দুধ খাবে বলে তাই নেওয়া।

-নাতনী? সুর্যি পায়রাপোড়াও অবাক হয়ে যায়।

—হ্যাঁ রে, নাতনী, আমার গুপীর মেয়ে।

পরদিনই দেখা হয়ে গেল নারাণ ময়রার সঙ্গে। প্রাতঃপ্রণাম সেরে নারাণ ময়রা বলে—আপনার নাতনীকে এনেছেন নাকি বাড়িতে—শুনলাম?

-হ্যাঁ, তা এনেছি, ছেলে না হয় বেহ্ম হয়েছে, নাতনী কী দোষ করলো। বয়েস তত এক মাস—আমারই তো রক্ত ওর নাড়িতে, বংশ তেলোপ হয়নি রে, খাঁটি ব্ৰহ্মতেজ এখনও আছে রক্তের মধ্যে–বলে পৈতে ধরে কটমট করে তাকান নারাণ ময়রার দিকে।

তারপর একে-একে সবাই জিজ্ঞেস করে। সবাই অবাক হয়ে যায়। ছেলে যখন ব্রাহ্মজ্ঞানী, ছেলের সন্তানও ব্রাহ্ম। ছেলে যদি গো-মাংস খেয়ে থাকে, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে থাকে, ভগবান না মানে, তার সন্তানেও সে-পাপ অর্সায়।

রামহরি বলেন—না রে, না—যত সব অর্বাচীন। বলেন—দু’মাস বয়েস পর্যন্ত শিশু নিস্পাপ-সর্বস্পর্শদোষমুক্ত। ওর এখন কোনো জাতই নেই—আমার কালীও যা ও-ও তাই—ওই বেটির মতোই শুদ্ধ, অপাপবিদ্ধ।

—কিন্তু যখন ও বড় হবে?

রামহরি ভট্টাচার্য বলেন—তার আগেই আমি ওর বিয়ে দিয়ে দেবো হিন্দুপাত্রের সঙ্গে।

দু’ মাস তখনও পূর্ণ হয়নি জবার। বোশেখ মাস। সন্ধ্যে থেকেই কাল-বোশেখীর ঝড়-ঝাপটা আরম্ভ হয়েছে। রাত হবার আগেই গৃহিণী দরজা-জানালা বন্ধ করে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়েছেন। নিজের বিছানায় দু’ মাসের নাতনীকে নিয়ে শুয়ে আছেন। মাঝ রাত্রে কর্তার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। গৃহিণী দেখলেন—ঘরে প্রদীপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কর্তা। বাইরে যেন চণ্ডীমণ্ডপের কাছে গলার আওয়াজ পেলেন অনেক লোকের। বললেন—কী হলো? কখন এলে তুমি? ও শব্দ কীসের?

রামহরি বললেন—লোকজন এসে গিয়েছে—জবাকে দাও।

–কেন? জবাকে কোথায় নিয়ে যাবে?

রামহরির এক হাতে আলো। আর একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন—দেরি হয়ে যাচ্ছে, লগ্ন বয়ে যাবে।

গৃহিণী কাঁদতে লাগলেন—কীসের লগ্ন গো? লগ্ন কীসের?

রামহরি ভট্টাচার্যের তখন সময় নেই। গৃহিণীর কোল থেকে ছিনিয়ে নিলেন জবাকে। বললেন—জবার বিয়ে।

–হ্যাঁ গো জবার বিয়ে, তা ওর বাপকে একবার খবর দিলে —তার মেয়ে আর তাকেই…

রামহরি ভট্টাচার্য চলেই যাচ্ছিলেন। যেতে-যেতে বললেনআমার গুপী মরে গিয়েছে মনে করে।

একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে আঁতকে উঠলেন গৃহিণী। বললেনকার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছো?

–সে তোমাকে ভাবতে হবে না, জাত, কুল, বংশ দেখে তবে কাজ করছি।

…পাত্রকে দেখেছো তো ভালো করে? আমার যে ভয় করছে গো?

বাইরে যেন তখন হঠাৎ ঝড়ের গর্জন আবার দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু হলো। রামহরি ভট্টাচার্য সেই ঝড় উপেক্ষা করেই বেরিয়ে গেলেন। বাইরে শখের শব্দ হলো। ঘণ্টা বাজলো। মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ এল। মহা আশঙ্কার মধ্যে ব্রাহ্মণী রাত কাটালেন। শেষ রাত্রের দিকে ফিরে এলেন রামহরি ভট্টাচার্য। জবাকে কোলে ফিরিয়ে দিলেন। তখন তার সিঁথিতে সিঁদুর। কিন্তু আশ্চর্য, মেয়ে এতটুকু কঁদেনি। মেয়ে চুপ করে সমস্ত অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত ঘুমিয়ে ছিল রামহরির কোলে।

তারপর দিন কোথায় গেল পাত্র! আর কোনো সংবাদ নেই কারো।

রামহরি বলতেন—আমি আমার কর্তব্য করেছি—আমার নাতনীকে তো আমি বেহ্মর হাতে তুলে দিতে পারিনে। গল্প শুনতে শুনতে ভূতনাথ অভিভূত হয়ে গিয়েছিল। বললে–তারপর?

জবা বললে—তারপর আর নেই। বাবা বললেন—এ ঘটনার কথা ঠাকুমা বাবাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন কিন্তু বাবার তখন আর কিছু করবার নেই। বাবা বললেন—সে-বিবাহ অসিদ্ধ বলেই আমি মনে করি, তোমার অনুমতি গ্রহণ না করে যে-বিবাহ, তা কখনও সিদ্ধ হতে পারে না।

ভূতনাথ বললে—তারপর?

বার-শিমলের রাস্তায় তখন আরো অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে। শেয়ালদ’ স্টেশনের দিকে একটা মালগাড়ি বুঝি ছুটে চলেছে উধ্ব শ্বাসে। তারস্বরে হুইশল দিচ্ছে বার-বার। সমস্ত পটভূমিকার শুচিতা বুঝি খান-খান করে টুকরো-টুকরো করে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায়। ভূতনাথের মনে হলো—লক্ষ যোজন দূরের একটি ঘুমহারা তীর যেন রুদ্ধনিঃশ্বাসে ছুটে আসছে বর্তমানকে লক্ষ্য করে। জবার সমস্ত শান্তি নষ্ট করবে সে। কোন অলক্ষ্য তীরন্দাজের অব্যর্থ লক্ষ্য বুঝি আজ আর ব্যর্থ হবে না। ভূতনাথের সমস্ত শক্তিকে অগ্রাহ্য করে সে সর্বনাশের শেষ পর্যায়ে নামিয়ে দেবে জবাকে।

জবা বললে-বাবা আরো বললেন—আজ যাবার দিন আর গোপন করে রাখতে পারলাম না মা, আমার সত্য-বিশ্বাস-বোধে অনেকদিন এ-কথা বেধেছে, তাই কাউকেই বলিনি—কারোর কাছেই প্রকাশ করিনি—তোমার মাকেও না, তিনি তত বললেও বুঝতে পারতেন না—কিন্তু তোমাকে শেষ পর্যন্ত না বলে পারলাম, তোমার বয়েস হয়েছে, তুমি নিজের বুদ্ধি দিয়েই বুঝবে মা যে, এ মিথ্যা—এ অসিদ্ধ।

জবা আবার বলতে লাগলো-শুনে আমি চুপ করে রইলাম।

বাবা বললেন–তুমি সুপবিত্রকেই গ্রহণ কোরো মা–আমি আশীর্বাদ করছি।

আমি তবু কোনো কথা বললাম না। বাবার নিঃশ্বাস দ্রুত হয়ে এল। তিনি অনেকক্ষণ কথা বলে ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন। আমি তার বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তিনি স্তিমিত হয়ে এলেন খানিকক্ষণের জন্যে। রাত শেষ হয়ে আসছিল। তারপর একবার আবার চোখ তুললেন। বললেন–পবিত্ৰকে তুমি গ্রহণ করবে তো মা?

বললাম-না।

বাবার চোখ দিয়ে তখন জল পড়ছে। আমার উত্তর শুনে হঠাৎ কিছু মুখ দিয়ে বেরোলো না তার। তারপর বললেন—কিন্তু আমাকে তো তুমি ক্ষমা করবে মা?

আমি আর থাকতে পারলাম না। তার বুকের ওপর মুখ রেখে চোখ মুছে নিলাম অজ্ঞাতে। আমার সেই তখনকার অবস্থার কথা আমি আজ আর বলতে পারবো না ভূতনাথবাবু, মনে হয়েছিল মাথার ওপর সারা আকাশটা ভেঙে পড়লেও সে-যন্ত্রণা বুঝি এমন নয়। কিন্তু তখন আমি সে-কথা কাকে বলবো, কে আমাকে বুঝবে? মনে হলো—সুপবিত্রকে আর আমার বাড়িডে আসতে দেওয়া উচিত নয়, যাকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছি, তাকেই আজ দূর করে দিতে হবে—এ যে কী কষ্টের, কেমন করে বোঝাবে আপনাকে। বাবার বুকের মধ্যে মুখ গুজে রইলাম। বাবা বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন। তিনিও আর কিছু বললেন না আমাকে। খানিক পরে তার বুকের মধ্যে যেন এক অস্বাভাবিক আলোড়ন শুরু হলো। বাবা ধীরে-ধীরে তখন বলছেন-অসতো মা সদগময়ঃ, তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ, মৃত্যোর্মামৃতম গময়ঃ—ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ–হরি ওঁ…

—তারপর?

বার-শিমলের আকাশে তখন ট্রেনের আর্তনাদ কর্কশ হয়ে বাজছে। কোথায় বুঝি ট্রেনটা থেমে গিয়েছে মাঝপথে। স্টেশনে আসবার অনুমতি মেলেনি। বার-বার গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে করুণ আবেদন জানাচ্ছে আর্তনাদ করে। ভূতনাথ চুপ করে রইল। তারও যেন সমস্ত যুক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। তবু জিজ্ঞেস করলে—তারপর?

জবা সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে—সুপবিত্রর সঙ্গে যদি দেখা হয় আপনার, আপনি বলে দেবেন ওকেও যেন এ-রাস্তায় আর না আসে। আমার বাড়ির সামনে যেন অমন করে আর দাঁড়িয়ে। থাকে। আমি কষ্ট পাই—আমি ওকে ভুলতেই চেষ্টা করি।

–কিন্তু কেন? তুমি কি সত্যিই বিশ্বাস করো, সে-বিয়ে তোমার সিদ্ধ?

জবা বললে—সে-কথার উত্তর তো বাবাকে আমি দিয়েছি ভূতনাথবাবু।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখো তুমি।

—ভালো করে ভেবে দেখেছি ভূতনাথবাবু, দিনরাত ভেবেছি, এক-একবার মনে হয়েছে, সব বুঝি স্বপ্ন, স্বপ্নের মত সব মিথ্যে, কিন্তু যখনি মনে পড়ে বাবার কথা তখনি আর অবিশ্বাস করে উড়িয়ে দিতে পারি না।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু তুমি তো ব্রাহ্ম? তুমিও কি হিন্দু-ধর্মে বিশ্বাস করো?

–কিন্তু আমার ব্রাহ্ম হওয়াও যে পুরোপুরি সত্য নয় ভূতনাথবাবু, আমি মনে প্রাণে যে হিন্দুই, হিন্দু-ঘরে আমার বিয়ে হয়েছে, আমি যদি আগে জানতে পারতাম এ-কথা, তা হলে অন্তত সুপবিত্রকে আর আসতে দিতাম না আমার বাড়িতে।

—আর তোমার স্বামী?

জবা বললে—তার কথা আমি আর জানিনে, বড় হবার আগেই ঠাকুর্দা মারা গেলেন, ঠাকুমাও আগেই মারা গিয়েছেন, বাবা এখানে নিয়ে এলেন আমাকে, তারপর আর তার খবর রাখা প্রয়োজন মনে করেন নি বাবা।

—কিন্তু কোথায় তার দেশ? কী তার নাম, কোনো পরিচয়ই পাবার উপায় নেই আর?

—সে পরিচয় আছে, কিন্তু সে-কথা ভাবতেও ভয় করে ভূতনাথবাবু, নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে হবে। আমার সমস্ত আদর্শের সঙ্গে সংঘাত বাধবে পদে-পদে।

-কিন্তু তবে সে-পথে কেন পা বাড়াচ্ছো?

জবা বললে—কী জানি, কেন যেন মনে হয়, সেখানেই আমার সত্যিকারের পরিচয়, সেখানেই আমার সত্যিকারের আশ্রয়, আমার সংস্কার, আমার শিক্ষা, আমার মুক্তি আমার স্বামীর কাছে, বিধাতার সেই ইচ্ছেই বোধহয় ছিল, নইলে…

ভূতনাথ তবু বললে—যাকে জানো না, যাকে চেনো না, যার অবস্থার সঙ্গে তোমার অবস্থার, তোমার শিক্ষার হয় তো কোনো সঙ্গতি নেই-তাকে গ্রহণ করে সুখী হতে পারবে তো?

—আমার মন বলছে, সঙ্গতি না হোক, সামঞ্জস্য না থাক, তবু তাতেই আমার মঙ্গল, তাতেই আমার কল্যাণ। বাবার মুখেই শুনেছি-স্বাচ্ছন্দ্যটা বড় কথা নয়, কল্যাণটাই বড়। বাবা বলতেন-তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপক্ষী সহজেই পশুপক্ষী, কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ—এতদিন তো আরামই চেয়ে এসেছি ভুতনাথবাবু, পেলাম কই? এবার কল্যাণ চেয়ে দেখি, পাই কিনা।

—কিন্তু সত্যিই কি তুমি মনে করে জবা এ কল্যাণেরই পথ? মঙ্গলেরই পথ?

জবা বললে—এইটুকু জানি যে, শুধু আরামের মধ্যে কল্যাণ নেই। বাবা তাই তার সমস্ত আরাম ত্যাগ করে কল্যাণের পথ বেছে নিয়েছিলেন।

ভূতনাথ বললে—কিন্তু আরো একটা দিকের কথা ভেবে দেখেছো কি?

-কোন্‌দিক?

–ধরো তোমার স্বামী যদি ইতিমধ্যে আর একটা বিয়ে করে থাকেন—হতেও তো পারে, তোমার ধর্মান্তর গ্রহণের খবর পেয়ে তিনি হয় তত তোমার আশা ত্যাগ করেছেন।

জবা বললে তা-ও যদি হয় তবু তাকেই আমি গ্রহণ করবে। যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন তাকে স্বীকার করতেই হবে—ততদিন তিনিই আমার স্বামী।

—তারপরও তুমি সুপরিত্রকে গ্রহণ করতে পারবে না?

–না, পারবো না। আমার সংস্কার আমার শিক্ষা আমাকে বলে যে, বিয়েটা ধর্ম, ধর্মেরই অঙ্গ, বিয়েটা তুচ্ছ বিলাসিতাও নয়, লোকাচারও নয়।

—কিম্বা যদি দেখে তোমার স্বামী দরিদ্র কিম্বা লম্পট।

—তবু তিনি তো আমার স্বামী।

—কিন্তু যদি তার অকালেই মৃত্যু হয়ে থাকে?

জবা খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—হিন্দুধর্মের বিধান ছিল সে-ক্ষেত্রে বিবাহ হতে পারে, কিন্তু কুলীনের ঘরে নয়, মৌলিকের সঙ্গে। সে-মেয়েকে বলা হয়…কিন্তু আপনি এত কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন? আমি তো সব অবস্থার জন্যেই তৈরি হয়ে আছি ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথ বললে—তবু তো খোঁজ নেওয়া দরকার।

–আপনি খোঁজ করবেন?

ভূতনাথ বললে—আমি তো তোমায় বলেছিলাম জবা, তোমার যদি কোনোদিন কোনো উপকার করতে পারি, তা হলে নিজেকে কৃতার্থ মনে করবো—আজ আমার সেই সুযোগ এসেছে।

জবার চোখ দুটো সজল হয়ে এল। খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল তেমনি করে। তারপর ধীরে ধীরে-বললে—আপনার ঋণ জীবনে শোধ হবে না ভূতনাথবাবু।

ভূতনাথ বললে—সে কথা থাক, আমাকে তাদের ঠিকানাটা দিতে পারে?

জবা বললে—সে অনেক দূর ভূতনাথবাবু। কলকাতার বাইরে, কোন্ এক গ্রামে।

ভূতনাথ বললে—যতদূরেই হোক, আমি নিজে গিয়ে খবর নিয়ে আসবোকিন্তু তারা কি আর কোনো দিন তোমার খবর নেননি?

জবা বললে—বাবা বলেছিলেন, পাত্র পক্ষের অমতে ঠাকুর্দা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বোধহয় শুনেছিলেন আমরা ব্রাহ্ম হয়ে গিয়েছি, তখন আর খবর রাখবার প্রয়োজন মনে করেননি।

ভূতনাথ বললে—তবে কেন তুমি এত বিচলিত হয়েছে, এমন তো হতে পারে তারাই তোমাকে গ্রহ করবেন না—তুমি বিধর্মী বলে।

জবা বললে—তবু তিনিই আমার স্বামী যে—স্বামী স্ত্রীকে গ্রহণ করলেও স্ত্রীর যে অন্য কোনো গতি নেই।

ভূতনাথ বললে—তোমার স্বাধীন ইচ্ছেয় বাধা দেবো না আমি, কিন্তু আমাকে তাদের ঠিকানাটা দাও।

জবা এবার উঠলো। উঠে ঘরের একপাশে কাঠের সিন্দুকটা খুলে একটা কাগজের টুকরো বার করলে। ভূতনাথের কাছে এসে বললে–এতেই ঠিকানা লেখা আছে, এ-চিঠি ঠাকুমা লুকিয়ে বাবাকে লিখেছিলেন।

 

অনেক বছর আগের চিঠি। ভাঁজে-ভাঁজে ছিঁড়ে গিয়েছে। সাদা কাগজ কালো হয়ে এসেছে। তবু স্পষ্ট বাঁকা-চোরা অক্ষর ডিঙিয়ে ভূতনাথ সমস্তটার পাঠোদ্ধার করলো। যে-ঘটনা জবা এতক্ষণ বলেছে হুবহু সেই কাহিনী। শেষে পাত্রের নাম ঠিকানা লেখা। ভূতনাথ পড়লে-পাত্রের নাম—শ্রীঅতুল চক্রবতী, পিতার নাম শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী, স্বভাব কুলীন—নিবাস ফতেপুর, পোস্টাপিস-গাজনা, জেলা নদীয়া। পড়তে-পড়তে ভূতনাথের হাতটা হিম হয়ে এল! মনে হলো—এ কার কাহিনী শুনছে সে! তাদেরই গ্রাম, তাদেরই পোস্টাপিস, তারই বাবার নাম। আর তারই বাবার দেওয়া নাম—অতুল। বাবা মারা গিয়েছেন তার জ্ঞান হবার আগে। অল্প-অল্প মনে পড়ে বাবার কথা! বাবার সঙ্গে ঘুরতো সে। পিসীমা’র কাছেও শুনেছে। জমিদারীর কাছারিতে কাজ করতেন বাবা আর ঘুরতেন গ্রামে-গ্রামে। তার বেশি আর কিছু মনে নেই। কিন্তু এ-ঘটনা কেমন করে কবে তার জীবনে ঘটে গিয়েছে কেউ তো বলেনি। অথচ ভূতনাথ ছাড়া যে এ আর কেউ, সে-সন্দেহও করবার কারণ নেই। ও ঠিকানায় আর কে থাকবে। বাবার যে একমাত্র ছেলে সে!

আশ্চর্য হবার শক্তিও যেন চলে গিয়েছে ভূতনাথের। বিস্ময়ও নয়, আনন্দও নয়, দুঃখও নয়, অবসাদও নয়। এ এক অপূর্ব অনুভূতি। কোথায় কেমন করে এ-সংবাদ এতদিন লুকিয়েছিল কে জানে। কোথায় কী ভাবে কার অদৃশ্য ইঙ্গিতে সে এখানে এসে হাজির হয়েছিল, কে বলবে। কে বলবে এ সুসংবাদ না দুঃসংবাদ! সে কি অকপটে স্বীকার করবে নিজের পরিচয়! সে কি দাবি করবে তার ন্যায্য পাওনা! যা ছিল স্বপ্নের জিনিষ তা-ই যখন সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে, তখন কি ত্যাগের মহিমা দেখিয়ে বিড়ম্বিত হবে সারা জীবন! অযাচিত এমন দান সে কি গ্রহণ করতে অস্বীকার করবে! সে কি জবার সামনে এখনি স্বীকার করবে—এ নাম আমারই! এ ঠিকানা আমারই—এ আমারই বাবার নাম। আমিই সেই অতুল। আমার বাবার দেওয়া নাম অতুল আর পিসীমা নাম দিয়েছিল ভূতনাথ।

জবার মুখের দিকে চেয়ে দেখলে ভূতনাথ। সে-মুখে যেন কোনো বৈলক্ষণ্য নেই। কিন্তু আজ মনে হলো জবা যেন অনেক সুন্দরী। পৃথিবীর সমস্ত সৌন্দর্য যেন ওই মুখে এসে আশ্রয় নিয়েছে আজ। এতদিনের দেখা জবাকে যেন নতুন ঠেকছে আজ এই মুহূর্তে! এখন এ-জবা তার নিজের। এখনি জবাকে সে নিজের বলে দাবি করতে পারে। জবার ওপর তার যেন বহুদিনের অধিকার। শুধু অধিকার নয়। অধিকারের চেয়েও বেশি কিছু। জন্মজন্মান্তরের পরিচয়ে তাদের দুজনের যেন হৃদয় বিনিময় হয়ে গিয়েছে। যেন বহুযুগ ধরে জবাই তার সঙ্গিনী হয়ে বার-বার পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে! আরো বহু যুগ ধরে বার-বার জন্মগ্রহণ করবে।

বড় ভালো লাগলো ভূতনাথের। ভালো লাগলো সান্নিধ্য। আজ এ-সান্নিধ্যে যেন কোনো অন্যায় নেই, কোনো অনুতাপ নেই। এই ভালো লাগা আজ আর অপরাধ নয়। এতদিন মনের যে প্রবণতাকে সে সযত্নে গোপন করে এসেছে, তার শিক্ষা, তার ধর্ম দিয়ে তাকে অগোচরে রেখেছে, আজ আর তার প্রয়োজন নেই। সে-প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে। আজ সে সগৌরবে বিশ্বসংসারকে তা জানিয়ে দিতে পারে। ঘোষণা করতে পারে ছাদের চূড়োয় উঠে নিজের সৌভাগ্যের কাহিনী।

কখন যে ভূতনাথ বার-শিমলে থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিল তার খেয়াল ছিল না। সমস্ত অন্ধকার রাস্তাটাতে সে নিজের এই অবস্থার কথাতেই মগ্ন ছিল।

বেরোবার সময় জবা বলেছিল——আবার কবে আসবেন?

ভূতনাথ বলেছিল—এ খবরটা নিয়ে আসবো একদিন।

–আপনি কি ওদের দেশে যাবেন?

–ও তো আমাদেরই দেশ।

জবাও যেন আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এক আশ্চর্য কৌতূহলে সমস্ত মুখখান ভাস্বর হয়ে উঠেছে যেন। বলেছে—আপনাদের বাড়িও কি ওখানে?

–শুধু বাড়ি নয়, এক দেশ, এক পোস্টাপিস, এক গ্রাম, এক পাড়া—একই…বলতে গিয়েছিল—একই নাম। বলতে গিয়েছিল

—ভূতনাথ আর অতুল নাম একই লোকের। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়েছে ভূতনাথ ঠিক সময়ে। হঠাৎ তাড়াতাড়ি কিছু করে ফেলা ভালো নয়। একটু ভাববে সে। নিরিবিলিতে তার চোরকুঠুরিতে তক্তপোশটার ওপর শুয়ে-শুয়ে সে ভাববে। ভাববে —এ কেমন করে সম্ভব হলো। কোথা থেকে কোন্ অদৃশ্য ঈশ্বরের ইঙ্গিতে এ সম্ভব হলে তার জীবনে। এ তার আশীর্বাদ অভিসম্পাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *