1 of 2

৪১. ভোর বেলায় অনিমেষ ফিরে এল

 একচল্লিশ

ভোর বেলায় অনিমেষ ফিরে এল বাড়িতে। আজ জুলিয়েনের ওখানে খুব জরুরী আলোচনা ছিল। ডুয়ার্সের বিভিন্ন প্রান্তের কয়েকজন মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনিমেষ যখন জানাল যে সে জলপাইগুড়িতে পাকাপাকি থেকে যাচ্ছে তখন জুলিয়েনের আগ্রহে আলোচনায় অংশ নিতে অনুরোধ জানাল সবাই।

এখানে এসে অনিমেষ কয়েকটি তথ্য জানল। পুলিস এখনও ওদের ওপর লক্ষ্য রাখছে।

বামফ্রন্ট চাইছে না তারা সক্রিয় হোক। আন্দোলনের সময় যারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পা বাড়িয়েছিল তাদের অনেকেই এখন ছিটকে গেছে নানান দিকে। ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অনেক দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে সবাই। বেশীরভাগই বসে গিয়েছে এবং বাকিদের মধ্যে মিলনের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব। অথচ দেশে এখন বিপরীত হাওয়া গোপনে বইছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট জিতেছে কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। যদিও সংগঠনশক্তি এবং জনসাধারণের ওপর প্রভাব বামফ্রন্টের এখনও অম্লান তবু আর একটি জিনিস চোখে পড়ছে। বিভিন্ন কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে বামফ্রন্ট সমর্থনপুষ্ট সংস্থার। সেখানে ছাত্র পরিষদ বিজয়ী হয়ে চলেছে। অর্থাৎ, দেশের শিক্ষিত যুবকরা বামফ্রন্টের বদলে ছাত্র পরিষদ তথা কংগ্রেসকে সমর্থন করছে। একথা ঠিক যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় শক্ত হয়ে বসেছিল তখন কলেজগুলোয় ছাত্র ফেডারেশনের আধিপত্য ছিল। তার পরিণতিতেই এক সময় কংগ্রেসকে নির্বাচনে গো-হারা হতে হয়েছে। বর্তমানে কংগ্রেসের ওপরতলার নেতাদের চেহারা এবং চরিত্র দেখে জনসাধারণের উৎসাহিত হবার কোন কারণ নেই। তা সত্ত্বেও ছাত্র ইউনিয়নগুলো ছাত্র পরিষদের দখলে চলে যাচ্ছে। এটা থেকেই বোঝা যায় দেশে বামফ্রন্ট বিরোধী চোরাস্রোত বইছে। অতএব এটাই উপযুক্ত সময় মানুষকে সঙ্গী করার।

একজন মানুষ, একটি গ্রাম। একজন মানুষ যদি একটি গ্রামের মানুষকে স্পষ্টভাবে বোঝাতে পারে কম্যুনিজমের আসল সংজ্ঞা এবং তার প্রয়োগে কি সাফল্য আসে তাহলে সত্তরে যা সম্ভব হয়নি তা আসতে বাধ্য। কাল সারারাত জুলিয়েন এই সংক্রান্ত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুনল। প্রথমে তার মনে হয়েছিল, যারা একসময় সশস্ত্র বিপ্লবের কথা ভাবত, বন্দুকের নলকেই শক্তির উৎস বলে জানতো তাদের চিন্তাধারায় কত পরিবর্তন হয়েছে! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার এই পরিবর্তনটাকে ভাল লেগে গেল। ভোর বেলায় বাড়ি ফেরার সময় অনিমেষ খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। যেন অনেকদিন বেকার হয়ে থাকার পর একটা মনের মত কাজ পেয়ে গেছে সে এরকম বোধ হচ্ছিল। পঙ্গু, পরনির্ভর জীবন থেকে মুক্তির একটা পথ দেখতে পেয়ে সে খুশি হল। জুলিয়েনের সঙ্গে কাজ করলে তার শারীরিক অসুবিধেগুলো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না এটাই বড় কথা। আলোচনায় এমন বুঁদ হয়েছিল অনিমেষ যে কিছুক্ষণ তার মাথায় একটু আগের ঘটনা নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। মাধবীলতা চলে যাবে, অর্ক তার জন্মবৃত্তান্ত জেনে গেছে, এই ভয়াবহ সত্য বাড়ি ফেরার পথে তার মাথায় ফিরে এল। ঘোলাটে অন্ধকার মাখা তিস্তার চরের শেষে দাঁড়িয়ে অনিমেষের বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল। কিন্তু যে কষ্টটা প্রথম রাত্রে বুকের মধ্যে আহত হয়ে ছটফট করছিল তার সাড় যেন অনেকটা কমে এসেছিল। অনিমেষ ধীরে ধীরে যখন বাড়ির কাছে পৌঁছাল তখন আকাশের কোণে লালচে ছোপ লেগেছে।

সারাটা রাত নিঘুমে কেটেছিল মাধবীলতার। প্রায়ই সমস্ত শরীর থরথরিয়ে কাঁপছিল এবং সেই সঙ্গে বমি। মায়ের এই অবস্থা দেখে অর্ক ভীষণ নাভার্স হয়ে পড়েছিল। মাধবীলতা মাথা নেড়েছিল, ‘তুই শুয়ে পড়, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’ দুহাতে মুখ ঢেকে মাধবীলতা বসে ছিল।

রাতটা কখন বরফের মত ধীরে ধীরে গলে গেল ওরা কেউ টের পায়নি। ঘুমুতে পারেনি অর্ক। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তার অথচ কি করা উচিত তাও বুঝে উঠতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত কেমন থিতিয়ে গেল সে। ছোটঘরে শুয়ে শুয়ে জীবনে প্রথমবার আবিষ্কার করল দুচোখে ঘুম আজ স্বাভাবিকভাবে নেমে এল না। চোখের দুটো পাতা যে কখনও কখনও শুকনো হয় এই প্রথম সে টের পেল।

গেটের বাঁধন খুলে বাগানে পা দেওয়ামাত্র অনিমেষ দেখতে পেল বারান্দার কোণে কেউ দাঁড়িয়ে। তার প্রথমে মনে হয়েছিল মাধবীলতার কথা। এক লহমায় মনের মধ্যে প্রতিরোধশক্তি জন্মাতেই সে ভুলটা বুঝতে পারল। সাদা কাপড়ে মোড়া শরীরটা ধীরে ধীরে বাগানে নেমে এল। টগর গাছের বিরাট ঝোপটার পাশে এসে বলল, ‘অনি, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

অনিমেষ ছোটমার মুখের দিকে তাকাল। সাদাটে কপাল, গাল এবং টেপা ঠোঁটে এখন ছোটমাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। ছোটমা একবার আড়চোখে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে আমি যে অনুরোধ করব তা রাখবে?’

‘অনুরোধ?’ অনিমেষ কিছুই বুঝতে পারছিল না। এই ভোরে ছোটমা এভাবে অপেক্ষা করবেন, গাছের আড়ালে এসে তাকে অনুরোধ জানাবেন নরম গলায়, কেন?

‘হ্যাঁ। তুমি, তুমি ওদের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে যাও।’

‘ফিরে যাব?’

‘হ্যাঁ। আমি চাই তুমি ফিরে যাও।’

অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল এবার। আজ বিকেলে যাঁরা তাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল, যাঁদের অসহায় অবস্থা দেখে সে থেকে যেতে চেয়েছে তাঁদেরই একজন তাকে চলে যেতে বলছে। এবং তৎক্ষণাৎ মনে হল কাল রাত্রে মাধবীলতার সঙ্গে তার যে কথা হয়েছে সেগুলো নিশ্চয়ই ছোটমার কানে গিয়েছে। না, সেসব কথা মাধবীলতা নিশ্চয়ই ছোটমাকে সাতসকালে বলতে যায়নি, ছোটমাই আড়াল থেকে শুনেছেন! একটু বিরক্তি এল মনে, আড়িপাতা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু তারপরেই যে কথাটা ভেবে সে সংযত হল তা ছোটমার দিকে তাকিয়েই। মানুষ কখন এমন উদার হতে পারে?

ছোটমা স্পষ্ট গলায় বললেন, ‘তোমার চলে যাওয়া উচিত।’

‘কেন?’

‘কারণ তুমি জানো। কাউকে দুঃখ দিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না।’

‘কাউকে দুঃখ দিচ্ছি তা জানলে কি করে?’

‘ছেলেমানুষী করো না। এই বাড়িতে রাত্রে নিচু গলায় কথা না বললে সব ঘরে শব্দ পৌছায়।’ ছোটমা মুখ নামালেন।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, তাই। এই বাড়ির এটাই ত্রুটি। রাত বাড়লে শব্দ গম গম করে। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি সব শুনেছ?’

‘হ্যাঁ। আমি সারারাত ঘুমুতে পারিনি। মেয়েটা তোমাকে সত্যিই ভালবাসে। ওকে আর কষ্ট দিও না।’

‘কিন্তু আমি তো কোন অন্যায় করিনি। আমি এখানে থাকতে চেয়েছি। এতে তার কোন আপত্তি নেই শুধু আগেভাগে অনুমতি নিইনি বলে—। এত সামান্য কারণে কেউ যদি অপমানিত বোধ করে তাহলে একসঙ্গে থাকা খুব মুশকিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।’

‘সামান্য কারণ? অনি, তুমি জীবনে বোধহয় অনেক অভিজ্ঞতা পেয়েছ কিন্তু মেয়েদের মন বোঝনি। যা তোমার কাছে সামান্য মনে হচ্ছে একটি মেয়ে তার জন্যে জীবন দিয়ে দিতে পারে।’

‘কিন্তু আমি চলে গেলে তোমাদের কি হবে?’

‘কিছু একটা হবে! এতদিন যখন সে কথা ভাবোনি আজ নতুন করে তা নাইবা ভাবলে।’

‘তাহলে তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?’

ছোটমা সহসা মুখ তুললেন। তাঁর শুকনো মুখে কিছু একটা চলকে উঠল। অনিমেষ দেখল, কোত্থেকে একটা চোরা জলের স্রোত চোখের পাতায় টৈটুম্বুর হয়ে উঠল। ছোটমা বললেন, “তুমি কখনও কাউকে ভালবেসেছ অনিমেষ? বাসনি। কিন্তু তোমার কি ভাগ্য, শুধু ভালবাসা পেয়েই গেলে তাই তার দাম বুঝতে পারলে না। পারলে আজ আমাকে এই প্রশ্ন করতে না। আমার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, আমি জীবনে কি পেয়েছি?’

অনিমেষ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, ‘আমি জানি।’

‘কিছুই জানো না তুমি।’ ছিটকে বেরুলো শব্দগুলো, ‘তোমার বাবার সঙ্গে চিরকাল ভাসুর-ভাদ্রবউ হয়ে রয়ে গেছি, তা তুমি জানো? তুমি চলে যাও, দয়া করে চলে যাও।’ ছোটমা বেরিয়ে আসা কান্নাটাকে গিলতে গিলতে বাগান ডিঙ্গিয়ে ছোট বাড়ির খিড়কি দরজার দিকে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন। অনিমেষ অসাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মাথার প্রতিটি কোষ যেন নিষ্ক্রিয়, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা। অনেক অনেক বছর আগের একটি দৃশ্য আজ হঠাৎ ছিটকে উঠে এল সামনে। স্বৰ্গছেঁড়ায় পাশ করার পর দেখা করতে গিয়েছে তরুণ অনিমেষ। কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়া স্থির। ছোটমা ছিলেন চা-বাগানের এক বিয়ে-বাড়িতে। তাঁর পাশাপাশি বেরিয়ে এসেছিল সে। বিরাট মাঠ ডিঙ্গিয়ে, স্বর্ণচাঁপার গাছের নিচ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ ছোটমা তার হাতে একটা সোনার আংটি পরিয়ে দিয়েছিলেন। আংটির ওপর লেখা ছিল, অ। সেদিন সেই প্রাপ্তিতে শিহরিত হয়েছিল সে। ছোটমার মাথায় মাথায় তখন। ছোটমা বলেছিলেন অ শব্দটার মানে না।

আজ এই কচি কলাপাতা রঙের রোদ যখন সুপুরি গাছের মাথা থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার উপক্রম করছে তখন অনিমেষের মনে হল তার জীবনের সব কিছুই না হয়ে গেল। সেই আংটিটাকে কোথায় ফেলেছে আজ আর মনে নেই। হয়তো আন্দোলনের সময়, কিংবা জেলে, এখন আর স্মৃতিতে নেই কোথায় সেটা হারিয়েছে। কিন্তু একটা বিশাল না তার সামনে ঈশ্বর কুঁদে দিয়েছেন নির্মম হাতে।

‘কে ওখানে? অ্যাঁ, কে ওটা?’

অনিমেষ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল হেমলতা বাগানে। পায়ে শিশির কিংবা কাঁটা থেকে বাঁচবার জন্যে যে ছেঁড়া কাপড়ের জুতো সেটা বোধহয় সরিৎশেখরের ফেলে যাওয়া। ডান হাতে বাঁকানো লাঠি আর বাঁ হাতে ফুলের সাজি। গন্ধরাজ গাছের সামনে দাঁড়িয়ে এদিকে মুখ করে চোখ পিটপিট করছেন। অনিমেষ বলল, ‘আমি।’

‘অ, অনি। কখন উঠেছিস?’ তারপর ফোকলা মুখে একগাল হেসে বললেন, ‘স্কুলে পড়তে দাদু তোকে কাকভোরে বিছানা থেকে ডেকে তুলতো, মনে আছে? তুই যেতেই চাইতিস না। তা এই সাতসকালে উঠে বাগানে কি করছিস?’ কথা বলতে বলতে হেমলতা লাঠি উঁচিয়ে গন্ধরাজের মগডালটাকে নিচে নামিয়ে একটা ফুল ছিড়ে সাজিতে রাখলেন।

অনিমেষ বলল, ‘ঘুম আসছিল না তাই—।’

‘নিশ্চয়ই বায়ু হয়েছে পেটে। আমার তো বাবা জলপাইগুড়িতে এসে একদিনও অম্বল ছাড়া গেল না। এমন বিচ্ছিরি জল স্বৰ্গছেঁড়াতে ছিল না। বাবাকে বলতাম বাড়ি বানাবার আর জায়গা পেলেন না? কাশী বৃন্দাবন না যোক দেওঘরে বাড়ি করলে শরীরটা নষ্ট হতো না। কি হল বাড়ি করে, কদিন পরে দেখবি রাস্তার লোক দখল করে নেবে এসব।’ হেমলতা মুখ বিকৃত করলেন, ‘সকালে উঠে আর পারি না। হাঁটু কনকন করে আর চোঁয়া ঢেঁকুর ওঠে। চোখেও দেখি না ভাল করে, এই যে তুই দাঁড়িয়েছিলি আমি চিনতেই পারিনি। তুই তো অনেক ঘুরেছিস, সব জায়গায় মেয়েরা দেরিতে মরে রে?’

অনিমেষ হাসল। সকাল বেলায় এই প্রথম তার একটু হালকা লাগল। তারপর ক্রাচে ভর দিয়ে সে হেমলতার কাছে এগিয়ে এল। হেমলতা বললেন, ‘দেখিস, ছুঁয়ে ফেলিস না আবার।’

অনিমেষ বলল, ‘দিনরাত মরার কথা বল অথচ এই বাতিকগুলো গেল না।’

হেমলতা বললেন, ‘তুই এসব বুঝবি কি! নাস্তিক কোথাকার। যারা মানুষ খুন করে তাদের কোন বোধ থাকে না।’

বোধ শব্দটি হেমলতার মুখে অদ্ভুত শোনাল অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি মানুষ খুন করেছি তা কে বলল?’

‘শুনেছি, সব শুনেছি। তবে তোর বউটা খুব ভাল। বড় ভাল মেয়ে। এই সাতসকালে উনুন ধরিয়ে চা করতে বসে গেছে। তা হ্যাঁরে, মেয়েটার কলকাতায় একা থাকতে অসুবিধে হবে না তো?’

অনিমেষের কপালে ভাঁজ পড়ল। কাল রাত্রের ওই কথাবার্তার পর মাধবীলতা আজ সকালে উনুন ধরিয়ে চা করছে? তাহলে কি গতরাত্রের ঘটনা শুধু উত্তেজনার ফসল? আজ সকালে সেটা কমে যেতেই—, অনিমেষ আরও হালকা হল। শুধু অর্কর কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল এই যা। ভালই হল, যা সত্যি তা ছেলেটার জানা উচিত।

‘কি রে হাঁ করে আকাশের দিকে চেয়ে আছিস কেন?’

হেমলতার গলা শুনে অনিমেষের সংবিৎ ফিরল, ‘অসুবিধে হবে কিনা তা ওকে জিজ্ঞাসা করলে হতো না?’

‘জিজ্ঞাসা করেছিলাম। বলল, মোটেই হবে না। ছেলে বড় হয়েছে এখন আর কোন চিন্তা নেই। কিন্তু তুই ওর জন্যে একটা চাকরির খোঁজ কর এখানে।’

‘কখন জিজ্ঞাসা করেছিলে?’

‘এই তো একটু আগে।’

অনিমেষ গম্ভীর হয়ে গেল। মাধবীলতা যেন ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে বিদ্ধ করতে চাইছে। এই সময় হেমলতা প্রফুল্ল মনে বললেন, ‘তুই এ বাড়িতে থাকবি জানলে পরিতোষ মাথার চুল ছিঁড়বে। ভেবেছিল তোরা চলে গেলেই এসে হাজির হবে। খবরদার ওর কাঁদুনিতে কান দিবি না।’

অনিমেষ অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, ‘আচ্ছা পিসীমা, আমি যদি এখানে না থাকি তাহলে তোমার খুব অসুবিধে হবে?’

হেমলতা যেন চমকে উঠলেন, ‘ওমা, একি কথা! তুই যে বললি থাকবি!’

অনিমেষ দেখল হেমলতার মুখ পলকেই শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। কি অসহায় দেখাচ্ছে ওঁকে। সে হাসবার চেষ্টা করল, ‘বলেছিলাম, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমি এখানে থাকি তা অনেকে চায় না।’

হেমলতা যেন ঘোরের মধ্যে অনিমেষের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ছোঁওয়াছুঁয়ির বিচার ভুল হয়ে গেল তাঁর। অনিমেষের কনুই-এ হাত রেখে অসহায় গলায় বললেন, ‘অন্য লোক যাই বলুক তুই আমার জন্যে থাক অনিবাবা। আমি তো কখনও তোর কাছ থেকে কিছু চাইনি। বেশীদিন বাঁচবো না রে, প্রায়ই মনে হয় এই শরীরটা থেকে আমি বেরিয়ে যাচ্ছি, দেরি নেই আর। ততদিন তুই কাছে থাক।’

অনিমেষ হেমলতার শীর্ণ মুখের কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় জলের ফোঁটা গড়িয়ে যেতে দেখল। অনিবাবা শব্দটা যেন হঠাৎ তার দুটো পাকে দীর্ঘতর করে মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত করে গেল। হেমলতার ব্যাকুল দৃষ্টির সামনে সে মাথা নাড়ল, থাকব।

হেমলতার যেন বিশ্বাস হল না, ‘ঠিক বলছিস? একবার ভাল মুখে বল।’

অনিমেষ হেসে ফেলল, ‘বললাম তো থাকব।’

‘চা।’

বারান্দায় কখন মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি ওরা। অনিমেষ দেখল মাধবীলতার হাতের কাপ থেকে ধোঁওয়া উড়ছে। হেমলতা ততক্ষণে আবার সহজ হয়ে গিয়েছেন। বললেন, ‘ওমা, ওখান থেকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? ওকে না হাঁটিয়ে এখানে এসে দিয়ে যাও না। বাগানে দাঁড়িয়ে খাক।’

মাধবীলতা সিঁড়ি ভেঙ্গে অনিমেষের হাতে যখন কাপ ধরিয়ে দিল তখন হেমলতা বললেন, ‘তোমার বেশীদিন কলকাতায় থাকা চলবে না। এখানে যদি চাকরি হয় তাহলে চটপট চলে আসবে। বুঝলে?’

মাধবীলতা কোন উত্তর না দিয়ে ফিরে গিয়ে সিঁড়িতে উঠে দাঁড়াল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষের মনে হচ্ছিল এই মেয়েকে সে চেনে না। ওর বুকের ভেতর একটা বল যেন আচমকা ড্রপ খেতে খেতে গড়িয়ে যাচ্ছিল। চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার কথা খেয়ালে নেই, অনিমেষ প্রচণ্ড চেষ্টায় নিজেকে সামলাচ্ছিল। মাধবীলতা যেন একটু ইতস্তত করল তারপর নিচু গলায় হেমলতাকে বলল, ‘পিসীমা, আজকে আমরা চলে যাব।’

হেমলতা আঁতকে উঠলেন, ‘ওমা, আজকেই?’

‘হ্যাঁ। দিনের ট্রেন তো রোজ রোজ ছাড়ে না। তাছাড়া রাত্রের ট্রেনে রিজার্ভেশন না থাকলে ওঠা মুশকিল। আমার ছুটি আর একদম নেই।’ মাধবীলতার কণ্ঠস্বর খুবই বিনীত এবং অসহায় শোনাচ্ছিল।

‘দিনের ট্রেন কটায়। তোমাদের তো শিলিগুড়িতে যেতে হবে।’ হেমলতা অনিমেষের দিকে তাকালেন, ‘হ্যাঁ রে, এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে?’

অনিমেষ কিছু বলল না। তার কথা বলতে ভয় করছিল। হঠাৎ যেন বুকের ভেতরটা কালবৈশাখীতে ছেয়ে গেছে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল।

মাধবীলতা বলল, ‘আমি খোকাকে পাঠাচ্ছি স্টেশনে। যদি এখান থেকে টিকিট পাওয়া যায় তো ভাল নইলে কখন ট্রেন ছাড়বে জেনে আসবে।’ কথাগুলো কার উদ্দেশ্যে বলা বোঝা গেল না। কিন্তু আর দাঁড়াল না মাধবীলতা, ধীরে ধীরে বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে চলে গেল।

হেমলতা ফুল তুলতে লাগলেন নিজের মনে। অনিমেষ সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে বারান্দায় উঠে এসে চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিল। মুখ হাত ধোওয়া হয়নি, কাল সারারাত না ঘুমিয়ে এখন ঝিম ঝিম করছে সমস্ত শরীর। অথচ চোখের পাতায় ঘুমের চিহ্নমাত্র নেই। এখন রোদ নেমে এসেছে ঘাসে। শিশির দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে। এই ভোরবেলায় একটা কাক গেটের ওপর বসে প্রাণপণে চিৎকার করে যাচ্ছে। অনিমেষের ইচ্ছে করছিল এক দৌড়ে মাধবীলতার কাছে যায়, তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, যেতে দেব না তোমাকে। এই মুহূর্তে অনেক যুক্তি তর্ক ছাড়িয়ে শুধু এটুকুই মনে হচ্ছে মাধবীলতাকে যেতে দেওয়া উচিত হবে না।

ঠিক তখনই ভেতর থেকে অর্ক বেরিয়ে এল। বাইরে যাওয়ার পোশাক পরনে। চুপচাপ নেমে গেল বারান্দা দিয়ে। তারপর গেট খুলে এমুখো হল বন্ধ করতে। অনিমেষ দেখল ছেলের ঠোঁট শক্ত। উড়ে যাওয়া কাকটার দিকেও নজর করল না। অর্ক যে তার সঙ্গে কথা বলছে না লক্ষ্য করে অনিমেষ অসহায়ের মত জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় যাচ্ছিস?’

অর্ক যেন এরকম প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল। চোখ না তুলে জবাব দিল, ‘স্টেশনে।’

তারপর তার শরীরটা আড়ালে চলে গেল। অনিমেষ পাথরের মত বসেছিল। ভীষণ নির্জীব মনে হচ্ছিল নিজেকে। দুহাতে মুখ ঢাকল সে। এবং সেই অবস্থায় নিজের শরীরের সমস্ত কম্পনকে সে সংযত করতে চাইল। কেউ যদি চলে যেতে চায় তাহলে সে কেন খামোকা বাধা দেবে? যা সহজ যা স্বাভাবিক তাই মেনে নেওয়া ভাল। শোক আঁকড়ে যারা বসে থাকে তাদের মানুষ বলে না।

দুটো ক্রাচ বগলে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। তারপর বড় ঘর পেরিয়ে সে শোওয়ার ঘরে এল। মাধবীলতা নেই। তোয়ালে এবং ব্রাশ নিয়ে সে বাথরুমে চলে এল। মহীতোষ মারা যাওয়ার পর এদিকের বাথরুমটা তারা ব্যবহার করছে। ফলে আর ওঠানামা কিংবা ভেতরের বাগান পার হওয়া করতে হচ্ছে না তাকে। মুখে হাতে জল দিতে শরীরটায় স্বস্তি এল। এখন আর এক কাপ চা পেলে ভাল হত। কিন্তু কে দেবে?

নিজের ঘরে ফিরে এসে অনিমেষ খাটে বসল। তারপর লক্ষ্য করল জিনিসপত্র এর মধ্যেই গোছানো হয়ে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে ক্রমশ নিজেকে উদাস করে ফেলছিল সে। আর তার পরেই মাধবীলতা ঘরে এল। এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি আর এক কাপ চা খাবে?’

হ্যাঁ বলতে গিয়ে অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘দরকার নেই।’

‘আমরা যে সুটকেসটা এনেছি, ওটাই নিয়ে যেতে হচ্ছে।’

‘ঠিক আছে। আমার তো লাগছে না এখন।’ অনিমেষ খুব নিস্পৃহ ভঙ্গীতে বলল।

মাধবীলতা জিনিসপত্র ঠিকঠাক করতে করতে নিচু গলায় বলল, ‘আমাদের যা লাগবে সেটুকু নিয়ে বাকিটা ওই টেবিলে রেখে গেলাম।’

অনিমেষ বুঝতে পারেনি প্রথমটা, জিজ্ঞাসা করল, ‘কি?’

‘যে টাকাটা এনেছিলাম তার কিছুটা এখনও রয়ে গেছে।’

‘ও।’ অনিমেষ হাসল, ‘ওটা তুমি নিয়ে যাও। আমার দরকার হবে না।’

মাধবীলতা একটু স্থির হল, তারপর বলল, ‘ঠিক আছে।’

অনিমেষ বলল, ‘জানি না কখন ট্রেন তবে মনে হচ্ছে কে যেন বলেছিল দুপুরের দিকে ছাড়ে, রাত্রেই হাওড়া পৌঁছে যায়। সাবধানে যেও।’

মাধবীলতা কোন জবাব দিল না। অনিমেষের ব্যবহৃত ভোয়ালেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। অনিমেষ শুয়ে পড়ল এবার। এতক্ষণ তারা এই ঘরে কিছু অর্থহীন কথা বলেছে এটা স্পষ্ট। অথচ এই কথাগুলো না বললে আবহাওয়াটা আরও ভারী হয়ে যেত। চোখ বন্ধ করল অনিমেষ। না, সে কিছুতেই হারবে না। মাধবীলতা যদি সত্যি সত্যি ওই মানসিকতায় পৌঁছে যায় তাহলে সে নিশ্চয়ই অভিনয় করতে পারবে। অনিমেষের শরীরে একটা কনকনে স্রোত উঠে আসছিল। সে সেটাকে চাপা দেবার জন্যেই বোধহয়, উপুড় হয়ে শুল।

সরিৎশেখরের সেই সাধের বাড়ির চারপাশে যে ফুল আর ফলের গাছ তার ডালে বসে তখন নানানরকম পাখি নিজেদের সুরে ডেকে যাচ্ছে। মৃদু হাওয়ায় দোল খাচ্ছে গাছের ডালগুলো।

ট্রেনটা ছাড়বে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সকাল সাড়ে দশটায়। টিকিট পাওয়া যাবে সেখান থেকেই। জলপাইগুড়ি থেকে সাড়ে আটটার ট্রেন না ধরলে মুশকিলে পড়তে হবে। কারণ সব বাস নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে যায় না।

অর্ক এসে এই সব খবর দিল যখন তখন আর হাতে বেশী সময় নেই।

মাধবীলতার স্নান হয়ে গিয়েছিল। হেমলতা এবং ছোটমা বড় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন। ছোটমাকে এখন অত্যন্ত নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে। কথা বলছেন হেমলতা। অনর্গল বক বক করে যাচ্ছেন। সাবধানে থাকতে হবে, ছেলে যাতে মন দিয়ে পড়াশুনা করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ছুটিছাটা হলেই যেন চলে আসে আর প্রত্যেক সপ্তাহে মনে করে চিঠি যেন দেয় মাধবীলতা।

অর্ক রিকশা ডাকতে গিয়েছে। ওরা তিনজন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। একটু পেছনে অনিমেষ, মাধবীলতার পেছনে। এত চেনা এত জানা অথচ আজ কিছু করার নেই। হেমলতা আফসোস করছিলেন, একটু আগে জানলে ওদের ট্রেনে খাওয়ার ব্যবস্থা বাড়ি থেকেই করে দিতে পারতেন। মাধবীলতা কোন কথা বলছিল না। হঠাৎ ছোটমা মাধবীলতাকে ডাকল, ‘শোন, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

মাধবীলতা অবাক চোখে তাকাল। তারপর ছোটমাকে অনুসরণ করে ভেতরের ঘরে গিয়ে বলল, ‘বলুন।’

ছোটমা ওর চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘আমি অনিমেষকে চলে যেতে বলেছিলাম।’

মাধবীলতা বুঝতে পারছিল না ছোটমা কি বলতে চাইছেন! সে নিচু গলায় বলল, ‘ও এখানে থাকলে আপনাদের সুবিধে হবে।’

ছোটমা এবার মাধবীলতার হাত ধরলেন, ‘তুমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করো না মানুষমাত্রেই ভুল বোঝাবুঝি হয়। তাছাড়া অনিমেষ চিরকালই এইরকম, কেমন শেকড়ছাড়া। তুমি ভুল বুঝো না।’

মাধবীলতা কোন কথা বলল না।

ছোটমা আবার বললেন, ‘তুমি ওর জন্যে এত করেছ, আর একটু করতে পারবে না?’

এই সময় হেমলতা বাইরে থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘রিকশা এসে গিয়েছে।’

মাধবীলতা চট করে ছোটমাকে প্রণাম করে বাইরে চলে এল। তারপর নিচু হয়ে হেমলতাকে প্রণাম করতেই তিনি ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন, ‘বাড়ির বউ হয়ে তুমি মা দূরে দূরে রইলে!’

অর্ক জিনিসপত্র রিকশায় তুলে বলল, ‘আর সময় নেই মা।’

অনিমেষ যে কখন বাগানে নেমে এসেছে সে নিজেই জানে না। অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘তুই একটা রিকশা ডেকে এনেছিস?’

অর্ক মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ।’

মাধবীলতা অন্যরকম স্বরে বলল, ‘সবাইকে প্রণাম কর খোকা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *