‘অনুরণন’ এবং ‘বং কানেকশান’ নামের দুই অত্যাধুনিক ছবিতে
পুরুষের স্ত্রী বা প্রেমিকা হওয়া ছাড়া মেয়েদের আর কোনও ভূমিকা নেই
দুটো বাংলা ছবি নিয়ে হৈ চৈ শহরে। চারদিকে বিজ্ঞাপন। লেখালেখি। পরিচালক এবং অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার। বাংলা ছবিতে প্রচুর ইংরেজি সংলাপ দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে ছবিগুলো শিক্ষিত এবং সচেতন শ্রেণীর জন্য, আধুনিক মনের মানুষদের, এবং নতুন প্রজন্মের নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ছেলেমেয়েদের, যারা এক বাক্য বাংলা বললে পাঁচ বাক্য ইংরেজি বলে। উচ্চবিত্ত হলে অবশ্য বাংলা উচ্চারণ খুব বিচ্ছিরি রকম হওয়া চাই। অস্বীকার করার উপায় নেই নাগরিক নবীন নবীনাদের চাল চলন চেহারা এমনই। অনুরণনে রাহুল আর অমিতের তাই হয়েছে। রাহুল আর অমিত, অনুরণনের দুটো পুরুষই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত, একজন স্থপতি, আরেকজন ব্যবসায়ী। আর তাদের বউ, ভীষণ স্মার্ট, শিক্ষিত। কী করছে? না, ‘হাউজওয়াইফ’। পরনির্ভর। কাজ বলতে সেজেগুজে থাকা, সুন্দর সুন্দর পোশাক পরা, স্বামীর সঙ্গেী হওয়া, আর ফালতু ঘুরে বেড়ানো।
অনুরণনে এক পুরুষের সঙ্গে আরেক পুরুষের স্ত্রীর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পুরুষটি রাহুল, আরেক পুরুষের স্ত্রীটি প্রীতি। প্রীতির জীবনটা এমন, স্বামীর প্রেম তো পাওয়াই হয় না, এমনকী শরীরের সাধ মেটানোর জন্যও স্বামীকে মেলে না। স্বামী দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়ে মেয়ে আরেক পুরুষের পানে ধায়। মেয়ের চোখের চাহনিতে আর মুখের হাসিতে সেই পুরুষের জন্য খেলা করে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়। খুব স্বাভাবিক, কারণ স্বামী তাকে মানসিক শারীরিক কোনও সুখই দিতে পারে না। স্বামীর সঙ্গে নয়, স্বামীর বন্ধুটির সঙ্গে অের্থাৎ রাহুলের সঙ্গে তার মনে মেলে। দুজনের মধ্যে কমন গ্রাউজ্ঞের পাহাড়। আবার রাহুলও সদ্য পাহাড়ে, দূরের সেই পাহাড়ে বন্ধুটির কাছে দিব্যি সে চলে যায়। এখানে ভাবার কোনও কারণ নেই যে সম্পর্কটি প্রেমে পরিণতি লাভ করবে না। পুরুষটি স্পর্শ করলেই মেয়েটি এলিয়ে পড়বে, এরকমই মুহূর্ত সৃষ্টি করা হয়েছে। দুর্বল চিত্রনাট্যের নিয়মই এই, বারবার চমক দেওয়ার চেষ্টা, দ্যাখো দ্যাখো, আই লাভ ইউ বলবে বলবে মনে হচ্ছে, কিন্তু বলছে না। শোবে শোবে, কিন্তু শুচ্ছে না। রাতে দুজন যার যার ঘরের দিকে যখন যাচ্ছে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেয়ে পিপাসার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, এই বুঝি দুজন দু ঘরে না গিয়ে এক ঘরে ঢুকবে। না, তাও হল না। সেই রাতে না হোক, অন্য রাতে হবে, তার তো অমিত সম্ভাবনা রয়ে গেল। রাহুল যখন তার আদরের স্ত্রী নন্দিতাকে, যাকে সে কারণে অকারণে ফোন করে কলকাতায়, ফোনে জানাচ্ছে না যে অমিতের স্ত্রী প্রীতি পাহাড়ে তার কাছে গেছে, প্রীতিও যাওয়ার আগে, বা যাওয়ার পথে এবং পৌঁছেও জানাচ্ছে না নন্দিতাকে যে সে রাহুলের কাছে যাচ্ছে, তখন নিশ্চিতই রাহুল আর প্রীতির মধ্যে সম্পর্কটা সাদামাটা বন্ধুত্বের নয়। এবং কানাঘুষো যা হয়েছে, ঘেন্না যা পেয়েছে প্রীতি, কিছুই অপ্রত্যাশিত নয়। অন্য নারীর সঙ্গে বিবাহিত পুরুষের প্রেম বা যৌন সম্পর্ক হয়ে যাওয়ার পর পুরুষেরা ভারতীয় সিনেমায় স্ত্রীর ক্ষমা পেয়ে আসছে সে নতুন নয়, স্ত্রীরা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে পুরো ব্যাপারটাকেই দেখে এবং স্বামীদের পরম আদরে বুকে তুলে নেয়। (অনুরণনে বুকে তুলে নেওয়ার ব্যাপারটি একটু অন্য ভাবে ঘটে, স্বামী যেহেতু বেঁচে নেই, স্বামীর বান্ধবী বা হতে যাওয়া প্রেমিকা প্রীতিকে বুকে তুলে নিয়ে স্বামীকে বুকে তুলে নেওয়ার কাজটিই পরোক্ষভাবে করে নন্দিতা।) অনেককাল ধরে দেখানো হচ্ছে এমন গল্প। মোত্তা কথা, এই সমাজের পুরুষদের পলিগ্যামি অ্যাকসেপ্ট করার জন্য একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া এসব আর কিছু নয়। এর আগে ঋতুপর্ণ ঘোষের দোসর হয়েছে। আজকাল একটু টাফ হয়েছে অ্যাকসেপ্ট করা, তাই একজনকে মরতে হয়। দোসরে মেয়ে মরে, অনুরণনে ছেলে। কেউ মরলে দর্শকদের সহানুভূতি হু হু করে বেড়ে যায় বলে পরকীয়াকে সামাল দিতে সুবিধে হয়। আজকাল আধুনিকতা বোঝানো হচ্ছে, এই দেখিয়ে, যে, মেয়েরা স্বামীদের ক্ষমা করে বুকে তুলে নেওয়ার আগে একটু অভিমান করে বা একটু রাগ দেখায়। ক্ষমা করে দেওয়া ছাড়া পরনির্ভর নারীদের আর উপায়ই বা কী! পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত প্রেম এবং যৌনতাকে আরও গভীর করে মেনে নেওয়ার মন তৈরি করার জন্য আজকাল পুরুষ-পরিচালকরা অঢেল টাকা এবং বুদ্ধি খরচ করে হৃদয় ঢেলে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন এবং সকলের বাহবা কুড়োচ্ছেন।
অনুরণনের তুলনায় বং কানেকশনএর গল্পের প্রেক্ষাপট ভালো। কিন্তু অতি অবাস্তবতা, অতি গল্প ছবিটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। বং কানেকশনে ওই একই ব্যাপার। অপু আর অ্যান্ডি দুই প্রধান পুরুষ-চরিত্র, একজন কমপিউটার সায়েন্স বা ইনফরমেশন টেকনোলজিতে নিজের কেরিয়ার গড়তে চাকরি নিয়ে বিদেশ যায়, এবং ওখানে বার বারই দেখা যায় যে সে অফিসের কাজে ব্যস্ত, আরেকজন বিদেশ থেকে দেশে আসে, মিউজিক নিয়ে প্যাশোনেটলি কাজ করতে সে ব্যস্ত। আর দুটো প্রধান নারীচরিত্রের জব কী? পুরুষের প্রেমিকা অথবা বান্ধবী হওয়া। কাজের ফাঁকে পুরুষদের যখন অবসর জোটে, তখন তারা পুরুষদের সঙ্গে দেয়, অনাবিল ভালো লাগা দেয়। এই দুই প্রধান নারীচরিত্র কিন্তু ইয়ং, ফাটাফাটি, হাল ফ্যাশনের পোশাক, চোস্ত ইংরেজি। কিন্তু তাদের পরিচয় একটাই, ভূমিকা একটাই, পুরুষের প্রেমিকা তারা। পুরুষ দেশ ও দশের গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে যারপরনাই ব্যস্ত, এবং মেয়েরা পুরুষের প্রেম পেতে ব্যস্ত, এবং পুরুষনির্ভর লতা হওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করতে ব্যস্ত। ভারতীয় চলচ্চিজ্ঞে পুরুষ এবং নারীর ভূমিকা বরাবরই এমন। কিন্তু নতুন যুগের, নতুন সময়ের, আধুনিকতার কথা বড় গলায় বলে যখন চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়, তখন প্রত্যাশা থাকে যে সাহসী সংগ্রামী স্বনির্ভর এবং সচেতন মেয়েদের বুঝি আধুনিক হিসেবে দেখানো হবে। কিন্তু কোথায়? পুরোনো পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের ছবি যখন বলে কয়েই বানানো হয়, ওসব তত ভয়ংকর নয়, যত ভয়ংকর আধুনিকতার ঘোষণা দিয়ে আধুনিক হিসেবে খ্যাত পরিচালকদের আধুনিকতার মোড়কে বানানো প্রাচীনপন্থী ছবি। এরা আধুনিকতার সঠিক সংত্তা পাল্টাতে বেশ বিপ্লব করছেন বটে।
আধুনিকতা মানে এখন এই সমাজে শুধু বহির্বাস, শুধু বুলি। যতই আধুনিকতার কথা বলা হোক না কেন, আধুনিকতার ছিটে ফোঁটা এসব ছবিতে নেই। তরুণ তরুণীর ফ্যাশনেবল জীবনযাপন দেখিয়ে মানসিকতা রাখা হয় সেই পুরোনো। আধুনিকতা তো পোশাকে থাকে না, বড় বড় বুলিতেও থাকে না। থাকে মননে, মস্তিষ্কে, মানসিকতায়। থাকে বোধে, বিবেকে, বৈদজ্ঞে। বং কানেকশনের অন্যান্য মেয়েরা বাড়ির রান্নাবান্না, পরিবেশন, এবং পুরুষদের সেবায় দিনরাঙ্গির ব্যস্ত। নবীনারাও সেই পথে নিজেদের গোছাচ্ছে না কি? বা তাদের দিয়ে গোছানো হচ্ছে না কি?
অসমকামী নারী পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ খুব স্বাভাবিক। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব, প্রেম, আত্মীয়তা গড়ে ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে যদি তা গড়তে হয়, তবে সেই সম্পর্ক কখনও সুস্থ সম্পর্ক নয়। সুস্থ সম্পর্ক সেই সম্পর্ক যে সম্পর্কে মানুষ হিসেবে একজন বেশি মূল্যবান, এবং আরেকজন কম মূল্যবান নয়। সুস্থ সম্পর্ক সেই সম্পর্ক যে সম্পর্কে কারও অধিকার বেশি, কারও অধিকার কম নয়। এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা কারওর ওপর কারওর নেই। থাকলেই একজন ওপরে, আরেকজন নিচে। থাকলেই একজন পাওয়ারফুল, আরেকজন পাওয়ারলেস। থাকলেই অসন্তোষ এবং আপোস।
আমাদের শিল্প সাহিত্য পুরুষতন্ত্রকে তোল্লাই দিয়ে যাচ্ছে চিরকালই। আর কতকাল নারীর অধিকারকে দাবিয়ে রেখে, তাদের পণ্য বানিয়ে শিল্পী সাহিত্যিকরা নিজেদের আধুনিক দাবি করবে! মূর্খামির তো শেষ হয়। কেবল এই উপমহাদেশেই বোধহয় এসব মহাসমারোহে রাজত্ব করে যায়।