নীলগঞ্জ থেকে বাবলুর একটা চিঠি এসেছে। চিঠি কার কাছে লেখা বোঝা যাচ্ছে না, কারণ কোনো সম্বোধন নেই। চিঠির রক্তব্যও সার্বজনীন-এ আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? ইতি বাবলু। চিঠি যেমনই হোক চিঠির সঙ্গের শিল্পকর্মটি অসাধারণ-একটি তিন মাথাওয়ালা গরু, ঘাস খাচ্ছে। মনোয়ারা ছবি দেখে আঁৎকে উঠে বললেন-তোমাকে কত বার বলেছি বৌমা, ছোঁড়াটার মাথা খারাপ। তুমি তো বিশ্বাস কর না। দেখ একটা গরু এািকছে, মাথা তিনটা। নীলুহাসতে-হাসতে বলল, ছেলেমানুষ।
ছেলেমানুষ হলেই তিন মাথার গরু, আঁকতে হবে? ছিঃ ছি, কী ঘেন্নার কথা।
ছবি দেখে টুনি বেশ মন খারাপ করল। বাবলু যে ছবি আঁকতে পারে, তাই তার জানা ছিল না। তাও এমন সুন্দর ছবি, যা সবাই কত আগ্রহ নিয়ে দেখছে! টুনি তার মাকে ধরল, মা, গরু, আঁকা শিখিয়ে দাও।
নীলু বিরক্ত হয়ে বলল, গরু আঁকা আমি জানি না মা, তোমার দাদুর কাছে যাও।
না, তুমি শিখিয়ে দাও।
দেখছি না, আমি একটা চিঠি পড়ছি। কেন বিরক্ত করছি টুনি?
না, তুমি শিখিয়ে দেবে। তুমি…
নীলু মেয়ের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল। টুনি ইদানীং খুব বিরক্ত করছে। যা এক বার বলবে, তা-ই করতে হবে। গত রাতেও তাই করেছে। রাতে খাবার টেবিলে বলে বসিল, পোলাও খাব মা। নীলু বলল, পোলাও তো রান্না হয় নি, খাবে কী করে?
এখন রাঁধ।
কী বলছ টুনি এখন পোলাও রাঁধব কি?
না, রাঁধতে হবে। এখনই রাঁধ।
কাল পোলাও হবে। এখন খেয়ে নাও!
তাহলে আমি খাব না। টুনী টেবিল ছেড়ে উঠে গেল। কিছুতেই তাকে খেতে বসানো গেল না। ত্য-সত্যি রাত দশটায় রান্না চড়াতে হল। মনোয়ারা গজগজ করতে লাগলেন, একটা মাত্র বাচ্চা, এরকম তো করবেই। তিন-চারটা ভাইবোন থাকলে এমন হত না। কী আর করা যাবে? সবাই হয়েছে আধুনিক। একটামাত্র বাচ্চা। ছেলে হলেও একটা কথা ছিল, মেয়ে পরের বাড়ি চলে যাবে।
কিছু দিন থেকেই মনোয়ারা এই লাইনে কথাবার্তা বলছেন। কথার সারমর্ম হচ্ছে, আরো ছেলেপুলে দরকার। বংশরক্ষার জন্যে হলেও ছেলে দরকার। তাছাড়া এক সন্তান সংসারে অলক্ষ্মী ডেকে আনে। এইসব কথাবার্তা হয় কাজের মেয়েটির সঙ্গে, কিন্তু উদ্দেশ্য নীলু সেদিন নীলু অফিসে যাবার সময় শুনল, মনোয়ারা কাজের মেয়েটিকে বলছেন, এক সন্তান সংসারে থাকলে কী হয় জানিস? এক-একা থাকে তো, কাজেই অলক্ষ্মীকে ডাকে। তখন অলক্ষ্মী এসে সংসারে ঢুকে পড়ে। আর অলক্ষ্মী এক বার সংসারে ঢুকলে উপায় আছে? সব ছারখার হয়ে যায়।
নীলু, শুনেও না-শোনার ভান করে। মাঝে মাঝে বড়ো বিরক্ত হয়। তাঁর শাশুড়ির মাথায় এক বার কোনো জিনিস ঢুকে পড়লে খুব মুশকিল। তিনি সেটা নিয়ে দিনের পর দিন কথা বলবেন। অন্যে কী ভাবছে না-ভাবছে তা নিয়ে মোটেও মাথা ঘামাবেন না। এ-রকম একচোখো হয় কীভাবে!
তবে টুনি যে বেশ নিঃসঙ্গ, তা নীলু বুঝতে পারে। :: জেদী হয়, টুনি যেমন হয়েছে। একটু আগে সে চড় খেয়েছে। চোখে আসে নি। মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। নীলু বলল, কী হল, এখনও দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমি গরু, আঁকতে পারি না এক বার তো বললাম।
তুমি পার।
তুমি বললেই তো হবে না। আমাকে আঁকা জানতে হবে।
তুমি জান।
নীলু দ্বিতীয় চড়টা বসাল। টুনি এতেও কাঁদল না। কিছুক্ষণ চোখ বড়ো—বড়ো করে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। মনোয়ারা পুরো দৃশ্যটি দূর থেকে দেখছিলেন। তিনি বললেন, বেশ করেছ, ভালো করেছ। শুধু যন্ত্রণা করে।
নীলুর বেশ মন খারাপ হল। তার শাশুড়ি এ রকম কেন বলবেন? দাদু-নানুরা সংসারে থাকেন কেন? নীলু নিজে যখন টুনির মতো বয়েসী, তখন তার দাদী থাকতেন তাদের সঙ্গে। চোখে ভালো দেখতেন না। হাঁটাচলাতেও কষ্ট হত। অথচ কেউ যদি নীলুকে কড়া কোনো কথা বলেছে, উনি ছুটে এসে চিলের মতো ছোঁ দিয়ে নীলুকে নিয়ে গেছেন। আর কী রাগ! এক বার নীলু একটা কানের দুল হারিয়ে ফেলেছে। নীলুর মা তাকে খুব মার দিলেন। নীলুর দাদী এসে বললেন, বৌমা, তোমার এত সাহস! তুমি আমার সামনে মেয়েটাকে মারলে? কোনের দুল হারিয়েছে তো কী হয়েছে? জিনিস হারায় না? তুমি বুঝি সারা জীবনে কিছু হারাও নি?
নীলুর মা বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে মা। এ-রকম আর হবে না।
নীলুর দাদী সেদিন ভাত খেলেন না। সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিলেন। নীলুর মা অনেক কান্নাকাটি করে হাত-পা ধরে তাঁর রাগ ভাঙলেন।
সংসারে দাদী-নানীরা এরকম হবেন। টুনির দাদীর মতো মুখ কুঁচকে বলবেন না-মেরেছ বেশ করেছ। ভালো করেছ। শুধু যন্ত্রণা করে।
নীলুর মনে হল, চাকরি করতে গিয়ে সে অফিসের সঙ্গে বড়ো বেশি জড়িয়ে পড়েছে। অবহেলা করছে তার মেয়েকে। মারা বাচ্চাদের হাত ধরে–ধরে স্কুলে নিয়ে যান, ফিরিয়ে আনেন। সারা পথে বাচ্চারা মনের আনন্দে বুড়ি ঘুরে মার সঙ্গে। স্কুলের গল্প, বন্ধুবান্ধবদের গল্প। টুনির সে সুযোগ নেই।
নীলু ঠিক করল, আজ অফিসে দেরি করে যাবে। টুনীকে নিজেই স্কুলে পৌঁছে দেবে। বিকেলে তাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাবে। কয়েকটা গল্পের বই, একটা ফুলব্যাগ, এক বাক্স ভালো চকলেট। বাবলু না-থাকায় মেয়েটা খুব একা হয়ে গেছে। মামার কুলখানি তো কবেই হয়েছে, এখনও তারা আসছে না কেন, কে জানে। দুলাভাই মানুষটা কাণ্ডজ্ঞানহীন, কে জানে হয়তো নীলগঞ্জেই খুঁটি গেড়ে বসে গেছে। ছেলের স্কুলের কী হবে, কিছুই ভাবছে না।
টুনি তার মার সঙ্গে স্কুলে যাবার কোনো আগ্রহ দেখাল না। কঠিন মুখে বলল, আমি তোমার সঙ্গে স্কুলে যাব না।
কেন, আমি কী দোষ করেছি?
আমি যাব না।
দু জনে গল্প করতে—করতে যাব।
বললাম তো যাব না।
বিকেলে তোমাকে নতুন স্কুলব্যাগ কিনে দেব।
না না না।
তুমি খুব অবাধ্য হয়েছ টুনী।
হয়েছি, ভালো করেছি।
মনোয়ার ভেতর থেকে বললেন, বৌমা, একটু চড় দাও! তেজ বেশি হয়ে গেছে। তেজ কমুক।
নীলু অফিসে চলে গেল। তার মন বিষন্ন। মেয়েটা অনেকটা দূরে সরে গেছে, সে বুঝতে পারেনি। আজ মেয়েটাকে নিয়ে বেরুতে হবে। সারা সন্ধ্যা ঘুরবে।
অফিসে পৌঁছতেই শরিফ সাহেব বললেন, আপা, আপনাকে বড়ো সাহেব আর্জেন্ট মেসেহ দিয়ে রেখেছেন। আপনি যেন আসামাত্র তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। খুব জরুরি।
ব্যাপার কী?
আপনাকে চিটাগাং যেতে হবে।
কেন?
আছে অনেক ব্যাপার।
কবে যেতে হবে?
আজ দুপুরের মধ্যেই রওনা হতে হবে।
সে কি!
বড়ো সাহেব নিজেও যাবেন, আমিও যাচ্ছি। দু দিনের মামলা। কোম্পানির মাইক্রোবাস যাবে।
নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। দুপুরে রওনা হতে হলে হাতে একেবারেই সময় নেই। বাসায় যেতে হবে। জিনিসপত্র গোছগাছ করতে হবে। শফিককে খবর দিতে হবে। আচ্ছা, টুনিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে হয় না? না, তা কি আর হয়! সে থাকবে অফিসের কাজে ব্যস্ত, টুনি গিয়ে কী করবে? কী বিশ্ৰী ঝামেলা।
নীলু রওনা হল একটার সময়। সে শফিকের সঙ্গে দেখা করে গেল। কিন্তু টুনির সঙ্গে দেখা হল না, টুনির পড়ার টেবিলে একটা চিঠি লিখে গেল–
মা গো, আমার দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র মেয়ে। সেই মেয়ে যদি আমার উপর রাগ করে, তাহলে আমার খুব কষ্ট হয়।