দাঁত পড়ে গেলে অনেকেই নিরামিষাশী হয়। হাটখোলার মল্লিকবাড়ির প্রবল বিলাসী পুরুষ কালীপ্রসাদ মল্লিক নিদারুণ উদরের ব্যামোয় ভুগে একেবারে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এসে মদ্যপান একেবারে পরিত্যাগ করেছেন। পেটে আর এক ফোঁটাও সুরা সহ্য হয় না। সেজন্য তিনি এখন ঘোরতর সুরানাস্তিক। মদ্যপান রূপ অনাচারের ফলে দেশ যে একেবারে রসাতলে যেতে বসেছে, একথা তিনি এখন সর্বত্র বলে বেড়ান। সিমলের জগমোহন সরকার মদ্যপান বর্জনের জন্য যে আন্দোলন শুরু করেছেন, কালীপ্রসাদ মল্লিক তার জন্য চাঁদা দেন উদার হস্তে।
একটা কিছু নেশা তো দরকার। তাই কালীপ্রসাদ মল্লিক এখন মেতেছেন পুজোআচায়। ইয়ার-বক্সীদের নিয়ে আর মদের আসর বসান না বলে কালীপ্রসাদ মল্লিক তো আর দরিদ্র হয়ে যাননি। বাড়িতে নারায়ণ-শিলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁর পিতার আমলেই, এক বেতনভোগী বামুন দু বেলা ঘণ্টা নেড়ে ফুল-বেলপাতা ছুঁড়ে দিয়ে যেত এতদিন। এবার কালীপ্রসাদের আনুকূল্যে সেই কৃষ্ণবর্ণের প্রস্তর খণ্ডটির ভাগ্য ফিরলো। অবিলম্বেই সেই নারায়ণ-শিলাকে বসানো হলো সোনার সিংহাসনে। তার জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো শ্বেতপাথরের নতুন মন্দির, প্রতিদিন মহা ধুমধামে পুজো হয় সেখানে। সন্ধ্যেবেলা সেখানে চক্ষু মুদে দু হাত জোড় করে ধ্যানাসনে বসে কালীপ্রসাদ উদাত্ত গলায় বলেন, প্রভো, দয়া করো! তুমিই মোক্ষ, তুমিই মুক্তি! রাখে হরি, মারে কে?
এছাড়া বারো মাসে তেরো পার্বণ তো লেগেই রইলো। এত কম পার্বণে কালীপ্রসাদের মন ভরে না। ইতু, মঙ্গলষষ্ঠী, সুবচনী, ত্রিনাথ, মনসা ইত্যাদি পূজারও প্রচলন করলেন তিনি। প্রায়ই ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল ইত্যাদি পবিত্র বাজনার শব্দে পল্লীর বাতাস কাঁপে। শত শত কঙাল-আতুর প্রসাদ পায়।
শতবর্ষ পার হয়েও বৃদ্ধ জগাই মল্লিক এখনো বেঁচে আছেন। আর তাঁর সান্ধ্যভ্রমণের ক্ষমতা নেই। সন্ধ্যাকালে ভূত্যেরা তাঁকে ধরে ধরে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় বারান্দার রেলিংয়ে। দন্তহীন মুখখানি নেড়ে বৃদ্ধ শুধু ম-ম-ম-ম শব্দ করে চলেন। পুত্রের যে মতি ফিরেছে, এটা বেশ বুঝতে পারেন জগাই মল্লিক, কানে কিছুই শুনতে পান না। তিনি, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি একেবারে যায়নি। নতুন মন্দিরের প্রাঙ্গণে ঢাকী ঢুলীদের নৃত্য করতে দেখলেই তাঁর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
কনিষ্ঠপুত্র চণ্ডিকাপ্ৰসাদের অবশ্য বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। কালীপ্রসাদ ছোট ভাইকে মদ-মেয়েমানুষের পথ থেকে সরিয়ে ধর্মকর্মের দিকে আনার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। এ পথেও আমোদ কম নেই। অনেকে বাহবা দেয়, অনেকে ধন্য ধন্য করে, বিশেষত হজমশক্তিটি ঠিক থাকে। আর মধ্যরাত্ৰে বুকজালায় অস্থির হয়ে ঘটি ঘটি জল পান করতে হয় না। কালীপ্রসাদকে। এখন প্রতিরাত্রেই তাঁর সুস্থির নিদ্রা হয়। কিন্তু চণ্ডিকাপ্বসাদ এ সব কথায় কৰ্ণপাত করেনি, এখনো তার যৌবন আছে, শরীরে শক্তি আছে এবং তার মস্তিষ্কে মগজ নামক বস্তৃটি বরাবরই কম। উপরন্তু, দু বৎসর আগে সে একটি সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করেছিল। এক যবনী বারাঙ্গনার বাড়িতে তার নিজস্ব রক্ষিতার শয্যায় তারই বেতনভুক এক তবলাবাদককে অসমীচীন অবস্থায় অকস্মাৎ দেখে ফেলে সে এমনই কুপিত হয়ে উঠেছিল যে, প্ৰকাণ্ড একটি জল-ভর্তি কলসী ওর মাথায় নিক্ষেপ করে। তবলাবাদকটির মৃত্যু হয় সঙ্গে সঙ্গে। এর ফলে পুলিসের হাঙ্গামায় পড়তে হয়। চণ্ডিকাপ্বসাদকে। কালীপ্রসাদ অনেক অর্থ ব্যয় করে সেবার ছোট ভাইকে ছাড়িয়ে এনেছিলেন। কিন্তু এর পরও চণ্ডিকাপ্ৰসাদ সুপথে আসতে চায়নি।
বিরক্ত হয়ে কালীপ্রসাদ বিষয়সম্পত্তি ভাগ করে চণ্ডিকাপ্ৰসাদকে পৃথগান্ন করে দিয়েছেন। এক সঙ্গে অনেক টাকা হাতে পেয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ একেবারে কান্নিক খাওয়া ঘুড়ির মতন আরও বেশী লাট খেতে লাগলো। বাড়ি থেকে বেরুবার সময় হাতের লাল রুমাল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে গান গায়, অব হজরত জাতে লণ্ডন কো- আর বেসামাল অবস্থায় বাড়ি ফেরার সময় মুখে লেগে থাকে এই গান, পরেরো মনেরো ভাবো বুঝিতে কি পারে পরে–
এই তিন মহলা বাড়িটির তিনটি দৃশ্য এখানে উপস্থাপিত করা যাক।
কালীপ্রসাদের দুই পুত্র। এদের মধ্যে শিবপ্রসাদ বিবাহাদি করে সংসারী হয়েছে। এত ধনী পরিবারের সন্তান হয়েও সে স্বভাব-কৃপণ। হাত দিয়ে তার সহজে একটি আধলাও গলতে চায় না। এই কৃপণতার জন্যই সে কখনো উচ্ছৃঙ্খল হতে পারলো না, সে তার জীবনীশক্তিও ব্যয় করতে ভয় পায়। বাপের বিষয়-সম্পত্তি এখন সে-ই দেখে। কালীপ্রসাদের তিন কন্যার মধ্যে একজন মাত্র বিধবা, সে তার জননী ক্ষেমঙ্করীর ছত্রছায়ায় থাকে। ক্ষেমঙ্করীর এখন বড় সুখের দিন, তাঁর স্বামী কালীপ্রসাদ সৰ্বক্ষণ বাড়ি থাকেন।
কালীপ্রসাদের কনিষ্ঠপুত্র অম্বিকাপ্ৰসাদ কিছুদিন কলেজে পড়েছিল, তার ফলে সে একজন অতিমাত্রায় নব্য যুবক। প্রিন্স অব ওয়েলসের ছবি দেখে সেই কায়দায় সে চুলের টেরি কাটে এবং গলায় একটি সিল্কের স্কার্ফ বাঁধে। তার স্বাস্থ্যটি বেশ ভালো এবং তার শিকারের খুব শখ। প্রায়ই সে বন্দুক ও বন্ধুবান্ধব সঙ্গে নিয়ে শিকারে যায়। কিছুদিন আগেই সে জয়নগর-মজিলপুরে গিয়ে একটি বাঘ মেরে এসেছে।
এই অম্বিকাপ্ৰসাদ তার পিতার আকস্মিক পরিবর্তনে তেমন প্ৰসন্ন হয়নি। আর কোনো কারণে নয়, এত ঢাক-ঢোল খোল-কিতালের শব্দ তার সহ্য হয় না। এর আগে পিতা-পুত্রে সাক্ষাৎকারই হতো কদাচিৎ। এখন পিতার এই সরব উপস্থিতিতে সে ব্যতিব্যস্ত। প্রায়ই সে তার ফ্রেণ্ডদের নিয়ে ঘরে বসে ফিলজফি কিংবা সোসিয়াল প্ৰব্লেম বিষয়ে আলোচনা করে নিজের ঘরে। তার বন্ধুরা দু-একজন ব্ৰাহ্ম, কয়েকজন নিরীশ্বরবাদী, তারা এ বাড়িতে এত পূজার ধুম দেখে হাসে, তাতে অম্বিকাপ্ৰসাদের বড় অপমান হয়।
স্বাস্থ্যচৰ্চার দিকে ঝোঁক বলে অবিম্বকাপ্রসাদ এতদিন নেশা-ভাঙ কিছু করেনি, পিতার প্রতি বিরক্ত হয়ে এক সময় শুরু করে দিল। প্রথমে একটু-আধটু, তারপর অবাধ। তার বন্ধুদের মধ্যে যারা নিরীশ্বরবাদী তাদেরই বোতল-আসক্তি বেশী। দার্শনিকতত্ত্ব আলোচনার সময় সহসা তারা কোটের পকেট থেকে চ্যাপ্টা ব্ৰাণ্ডির বোতল বার করে চুমুক দিতে শুরু করে।
একদিন বিধবা বিবাহের গুণাগুণ বিষয়ে আলোচনা এবং ব্র্যাণ্ডিপান বেশ জমে উঠেছে। ক্রমে নেশার মাত্রাটি বেশ চড়ে যাবার পর বাইরের মন্দিরে সাড়ম্বরে ঢাকঢোল বেজে উঠলো। অম্বিকাপ্ৰসাদের এক বন্ধু মুখ বিকৃত করে বলল, আঃ, একটু শান্তিতে ডিপ থিংকিং করারও উপায় নেই! আর এক বন্ধু বলল, অম্বিকে, তোমার ফাদারের এই সাত্ত্বিক ড্রাম বিটিংয়ে যে আমাদের কৰ্ণপটহ ছিঁড়ে যাবার উপক্ৰম। আর একজন বললো, ওরে বাপ রে বাপ! উইণ্ডোগুলো সব ক্লোজ করে দে এক্ষুনি! আর একজন বললো, গুগগুলোর ধোঁ আমার সহ্য হয় না। আমার হাঁচি আসচে—
বন্ধুদের বিদ্রূপে নিদারুণ মৰ্মপীড়া বোধ করে না, এমন পুরুষ দুর্লভ। তখন পিতা মাতা তুচ্ছ। অবিম্বিকাপ্রসাদ দারুণ চটে উঠে হাতের অর্ধসমাপ্ত ব্র্যাণ্ডির বোতলটি জানলা দিয়ে ছুঁড়ে মারলো বাইরে। সেই সঙ্গে বলল, ধুর শালা!
ব্র্যাণ্ডির বোতলটি কারুকে আহত করলো না বটে, কিন্তু সেটি অদূরে ভেঙে যাবার পর ভিতরের তরল পদার্থটির গন্ধ কালীপ্রসাদের নাকে আসতেই তিনি দারুণ চমকে উঠলেন। মন্দিরের চাতালে মোসাহেব পরিবৃত হয়ে চক্ষু বুজে বসে তিনি তখন প্রভো, প্রভো করছিলেন, এমন সময় সেই পরিচিত গন্ধ যা নাকে এলেই তাঁর বিবমিষা আসে। আজ বিবমিষার বদলে এলো রাগ। তিনি সোজা চলে এলেন ছেলের ঘরে।
তার ছেলে বাড়িতেই সুরার আসর বসিয়েছে দেখে ক্ৰোধে তাঁর অন্তরাত্মা পর্যন্ত জ্বলে উঠলো। তিনি নিজে বাড়িতে কখনো এ জিনিস স্পর্শ করেননি। আর এখন তো তিনি মদ্যপানের ঘোর শত্ৰু, তাঁর ছেলে সে কথা জেনেও মান্য করেনি? তিনি কাঁপতে কাঁপতে বললেন, বেল্লিক! ছুঁচোর দল! বাঘের ঘরে ঘোঘের বাসা ফেঁদিচিস! আমি…আমি…আমি…
আর কথা বলতে পারলেন না। কালীপ্রসাদ, ছুটে এসে সজোরে এক চড় কষলেন। ছেলের গণ্ডদেশে।
চপেটাঘাত খেয়ে প্রথম কয়েক মুহূর্ত দিশাহারা হয়ে গেল অবিম্বকাপ্ৰসাদ। বন্ধুদের সামনে এতখানি অপমান! বন্ধুরা তাকে মনে করছে। দুগ্ধপোষ্য শিশু। পরীক্ষণেই উল্টে সে ঝাঁপিয়ে পড়লো পিতার ওপরে। ইস্টুপিট, ওল্ড ফুল বলতে বলতে সে প্ৰাণপণে মারতে লাগলো কিল-চিড়-ঘুষি। ব্যাপার বেগতিক দেখে বন্ধুরা দুদ্দাড় করে ছুটে পালালো। এর মধ্যে শব্দ শুনে এসে পড়লেন অম্বিকাপ্ৰসাদের জননী ক্ষেমঙ্করী। তিনি দু হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আর্তস্বরে বলতে লাগলেন, ওরে কী কচ্চিস! এ কী সৰ্ব্বেবানাশ! ও ছোটখোকা, ও বাপ আমার!
এক সময় নিবৃত্ত হয়ে হাঁপাতে লাগলেন অবিম্বকাপ্ৰসাদ। তখন কালীপ্রসাদ মাটিতে পড়ে গোঁ গোঁ শব্দ করছেন।
ব্যাকুলভাবে কেঁদে ফেলে ক্ষেমঙ্করী বললেন, ও অম্বিকে, এ কী কল্লি? লোকটা মরে গ্যালো নাকি? তুই পিতৃঘাতী হলি?
নেশায় চক্ষু দুটি করমচার মতন রাঙা, সমস্ত মুখ ঘর্মাক্ত অবস্থায় অম্বিকাপ্রসাদ সগর্বে বললো, মরুক। ঐ ওল্ড ফুলটা মরুক না, তাতে ক্ষতি কি? তুমি কাঁদচো কেন, মা? তোমার চিন্তা নেই। বেঁচে থাক বিদ্যেসাগর, তোমার আমি আবার বে দেবো! এবার ভালো করে দেকে শুনে একটা রিফর্মড বাবা নিয়ে আসবো! সেই বাবাতে আমাতে তোমার সঙ্গে বসে হেলথ ড্রিঙ্ক কর্বো! এই বুড়োটা না মলে নতুন বাবা আসবে কী করে?
সে যাত্রায় কালীপ্রসাদ মরলেন না অবশ্য। এবং কনিষ্ঠপুত্র যে-হেতু সব সময়ই বেশী প্রশ্রয় পায়, তাই গৰ্ভধারিণীর অনুরোধে অম্বিকাপ্ৰসাদকে তিনি ক্ষমাও করে দিলেন।
চণ্ডিকাপ্ৰসাদের মহলে দুর্গামণি প্ৰায় একাই বাস করে। তার স্বামী সপ্তাহান্তে একবারও ঘরে ফেরে কিনা সন্দেহ। এখন নিজেই হুণ্ডি-কাটার অধিকারী হবার ফলে অর্থ সংগ্রহের কারণেও তার বাড়িতে আসার তেমন কোনো দায় নেই। কখনো কখনো সে বিষয়-সম্পত্তির তদারকির অছিলায় মফস্বলে যায়, তখন সঙ্গে যায় বজরাভর্তি ইয়ার-বক্সী, পেটি পেটি মদ্য ও একাধিক বারবনিতা। যে গতিতে সে চলেছে, তাতে আর কয়েক বছরের মধ্যেই সে সব কিছু ফুকে দিতে সক্ষম হবে।
দুর্গামণি পুত্রহীনা। পঁচিশ বৎসর বয়স, যৌবনের সমস্ত সম্পদ এখন তার শরীরে। দুর্গামণির মুখশ্ৰীতে লাবণ্যের চেয়ে তেজের ভাবটাই বেশী। বেশ দীর্ঘকায়া, সবচেয়ে দর্শনীয় তার চুল। এক ঢাল কোঁকড়া, ঘন কৃষ্ণবৰ্ণ চুল তার পিঠ ছেয়ে থাকে। দুর্গামণি কখনো চুল বাঁধে না, পায়ে আলতা পরে না, মুখে পমেটম মাখে না। কিছুরই অভাব নেই তার। অনেক দাসদাসী, তবু সে এক বন্দিনী।
দুর্গামণি কিছুটা লেখাপড়া জানে। স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারে। আর সেটাই তার জ্বালা। তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তার সারাটা জীবন এমনভাবেই কাটবে। ফরাসডাঙ্গায় তার পিত্ৰালয়। বেশ বুনিয়াদী বংশের কন্যা সে, এখন সে বংশের অবস্থা পড়ন্ত। কারুকে কিছু না বলে দু-বার এ বাড়ি থেকে পালিয়ে সে একা চলে গিয়েছিল ফরাসডাঙ্গায়। প্রথমবারের সময় তখনও এ বাড়িতে যৌথ সংসার ছিল, গৃহকতা হিসেবে কালীপ্রসাদ লোক পাঠিয়ে ভ্ৰাতৃজায়াকে আবার পিত্বালয় থেকে আনিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার দুর্গামণির ভাইয়েরাই জোর করে তাকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যায় কিছুদিন বাদে। বয়স্থ সবধা স্ত্রীলোকদের বেশী দিন বাপের বাড়িতে থাকতে নেই। তাতে দুই কুলেরই অপবাদ হয়। তা হলে দুর্গামণি কোথায় যাবে?
এ বাড়িতে কুসুমকুমারীই তার একমাত্র বন্ধু। যদিও কুসুমকুমারী তার থেকে বয়েসে বেশ কিছুটা ছোট। তবু তার সঙ্গেই দুর্গামণির মনের কথা হয়। দুর্গামণির কথা শুনে সরলা কুসুমকুমারী চমকিত, শিহরিত হয়ে ওঠে।
দুর্গামণি বলে, আমার এক এক সময় কী ইচ্ছে যায় জানিস, কুসোম? ইচ্ছে যায়, বাজারে গিয়ে নাম লেকাই। নটী হই!
কুসুমকুমারীর মুখখানি বিবৰ্ণ হয়ে যায়।
দুর্গামণি বলে, কেন এখুনো যাইনি জানিস? শুদ্ধু আমার মায়ের জন্যে। আমি পাপ-পুণ্যের পরোয়া করিনি! এই জীবনেই তো নরক যন্তোন্না পাচ্চি, এর চে আর কী বেশী শাস্তি পাবো? কিন্তু আমার মা বড় ভালো, তার মনে দুঃখু দিই। কী করে বল? আমি নষ্ট হলে,আমি পাপ কল্পে আমার বাপ-মায়ের বংশে কলঙ্ক লাগবে, সেই কতা ভেবে আমি যেতে পারি না। তা হলে সারা জীবন এইভাবেই পচে মত্তে হবে? আমাদের মতন পোড়াকপালীদের আর কোন পথ খোলা আচে?
একটু থেমে সে আবার বলে, আর একটা পথ খোলা আচে বটে। কিন্তু আমি মত্তে চাই না রে, কুসোম। আমার বড় বাঁচতে ইচ্ছে করে!
দুর্গামণি অনেকবার কুসুমকুমারীকে প্ররোচনা দিয়েছে তার স্বামী অঘোরনাথকে বিষ খাইয়ে হত্যা করতে। দুর্গামণির মতে, এমন অনারোগ্য হিংস্র উন্মাদকে পৃথিবী থেকে অপসারণ করে দেওয়ায় কোনো পাপ নেই। তাতে সে-ও যন্ত্রণা থেকে বাঁচবে। কুসুমকুমারীও বাঁচবে।
এ সব কথা শুনে কুসুমকুমারী তার নীলবৰ্ণ চক্ষু দুটি পরিপূর্ণ ভাবে মেলে চুপ করে চেয়ে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না।
এক এক সময় দুর্গামণি কুসুমকুমারীর চিবুকটি নিজের করতলে ধরে বলে, তুই বড় সুন্দর রে, কুসোম। তোর মিতেনীর বর যে তোর নাম দিয়েছিল বনজ্যোৎস্না, বড় সাত্থক নাম। আমি যদি পুরুষমানুষ হতুম, আমি নিশ্চয় বিয়ে কত্তুম তোকে। আর যদি তা না হতো, তা হলে জোর করে ব্যভিচার কত্তুম তোর সঙ্গে।
সমস্ত বড় মানুষদের বাড়ির মতন, এ বাড়িতেও একগুচ্ছের আশ্রিত পরিজন থাকে। কেউ পল্পবিত শাখা প্রশাখার আত্মীয়, কেউ গ্রাম সম্পর্কের। সত্যপ্ৰসাদ নামে একটি যুবক এ-বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করে। একদিন কী কারণে অম্বিকাপ্ৰসাদের সঙ্গে তার মতান্তর হওয়ায় তাকে বিদায় নিতে বলা হলো। নিজের বইপত্র ও পোটলা-পুঁটলি বেঁধে যুবকটি যখন গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কোনো কেরাঞ্চি গাড়ির অপেক্ষায়, সেই সময় ছাদ থেকে দুর্গামণি দেখতে পেল তাকে। ছেলেটির দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটির মধ্যে এমন কিছু ছিল যা দেখে মমতা হলো দুর্গামণির। সে একজন ভৃত্য পাঠিয়ে ডেকে আনালো ছেলেটিকে। তার মুখে সব কথা শুনে দুর্গামণি বললো, যেতে হবে না তোমায়, তুমি এ মহলার নিচের তলায় থাকো।
এ নিয়ে অন্য মহলে দুর্গামণির নামে পাঁচ কথা কানাকানি হলো ঠিকই। কিন্তু দুর্গামণি সে সব গ্রাহ্য করে না।
সত্যপ্ৰসাদ ছেলেটি লাজুক প্ৰকতির। শৈশবে পিতৃহীন। দুর্গামণির চেয়ে সে বৎসর চারেকের ছোট। প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ে। দুর্গামণি তাকে ডেকে এনে তার কাছ থেকে কলেজের গল্প শোনে। এক এক সময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকে, তবে যেন পুরুষ হয়ে জন্মাই। তখন তোমাদের মতন আমিও কলেজে পড়বো। যখন খুশী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো, আসবো।
সত্যপ্ৰসাদ নানাপ্রকার বাংলা বইএনে দেয় দুর্গামণিকে। ইংরেজী বই থেকে গল্প পড়ে পড়ে শোনায়। শ্ৰোতা হিসেবে কুসুমকুমারীও এসে জুটে যায়। মাঝে মাঝে তারা তাস খেলে। মল্লিকবাড়ির দ্বিতীয় মহলের এক নিভৃত কক্ষে ওরা তিন সঙ্গী একত্র অনেক সময় কাটায়।
একদিন দুর্গামণি কুসুমকুমারীকে বললো, জনিস কুসোম, আমাদের সত্যর কিন্তু তোকে খুব পচন্দ! তুই অত দূরে দূরে বসিস কেন, ওর একটু কাচ ঘেঁষে বসলেও তো পারিস!
কুসুমকুমারীর মুখখানি লজ্জারুণ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ। সে বলে, যাও, খুড়ী, ও রকম কতা আর বলবে না। তা হলে আর তোমার কাচে আসবো না।
দুর্গামণি বলে, আহা, লজ্জায় তো মুখ একেবারে গোলাপ ফুলের বন্ন হয়ে গ্যাল। আমি সব বুজি, সত্য তোর দিকে কেমন ভারি ভরি চোক করে চায়, খেলায় তোকেই ইচ্ছে করে জিতিয়ে দেয়। আমি ফরাসডাঙ্গার দত্তবাড়ির মেয়ে, আমার চোককে কে ফাঁকি দেবে?
কুসুমকুমারী শরীরে ভালো করে আঁচল জড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আমি চল্লুম।
দুর্গামণি তার হাত চেপে ধরে বলে, পুরুষমানুষের গা থেকে একটা তাপ বেরোয়, কাচে গেলেই টের পাওয়া যায়। তুই টের পাস না? ঐ তাপে গা শোকতে বড় আরাম। পোড়ারমুখী, সারাটা জীবন এমনভাবে কাটাবি? শুদু কুঁকড়ে-মুকড়ে থাকবি।
কুসুমকুমারী এবারে খানিকটা ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর দেয়, তোমার যদি অত শক, তো তুমিই কেন বসে না ওর গা ঘেঁষে?
দুর্গামণি বলে, দূর, ও তো আমার হাঁটুর বয়িসী। আমি কি ওকে ঐ চোকে দেকতে পারি? আমি যদি তেমন মনের মানুষ পেতুম, তা হলে প্ৰাণ খুলে তার সঙ্গে ভাব-ভালোবাসা কত্তুম। আমার তে পাপ-পুণ্যর ভয় নেই। কিন্তু আমায় কেউ চায় না রে, কুসোম। আটকুড়ি হয়েই জীবনটা কাটাতে হবে আমায়।
একদিন সত্যপ্ৰসাদ আর ওরা দুজন তাঁস খেলছে এমন সময় নিচতলায় হল্লা শোনা গেল। এ হাল্লার সঙ্গে ওরা পরিচিত। বিশেষ কোনো কারণে চণ্ডিকাপ্রসাদ বাড়ি ফিরেছে। তাকে পাল্কি থেকে নামানো, সিঁড়ি দিয়ে তোলা, সে এক বিরাট পর্ব, ভৃত্যদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে যায়। সিঁড়ির কাছে শোনা যাচ্ছে চণ্ডিকাপ্ৰসাদের জড়িত কণ্ঠের সেই একই গান।
এই সময় খেলা ভেস্তে যায়, কুসুমকুমারী এবং সত্যপ্ৰসাদ দ্রুত প্ৰস্থান করে। কোনো কোনো সময় দিনের বেলা হলে দুর্গামণিও চলে যায় এ মহল ছেড়ে। আজ দুর্গামণি বললো, দাঁড়া। একটুক্ষণ ভেবে আবার বললো, তুই চলে যা, কুসোম। সত্যপ্ৰসাদ থাক।
কুসুমকুমারী চলে যাবার পর সত্যপ্ৰসাদের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকালো দুর্গামণি।
সত্যপ্ৰসাদ কম্পিত কণ্ঠে বললো, বৌঠান—
হাত তুলে তার কথা থামিয়ে দিল দুর্গামণি। তারপর তুমির বদলে তুই সম্বোধন করে তাকে বললো, তোর কোনো ভয় নেই। আমি আচি না! যা বলবো শুনিবি।
সত্যপ্ৰসাদের হাত ধরে তাকে দুর্গামণি নিয়ে এলো নিজের শয়নকক্ষে। বিছানা থেকে সুজনিটা তুলে বললো, তুই এখেনে শো, আমি তোর পাশে থাকবো। খপরদার, আমাকে ছবি না, চোক বন্ধ করে থাকবি। আমি না বললে চোক খুলবিনি।
সত্যপ্ৰসাদের পাশে শুয়ে পড়লো দুগগিণি, বুক থেকে আঁচল খসিয়ে লাস্যময়ীর ভঙ্গি করে রইলো। তার ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। কক্ষের দ্বার খোলা।
একটু পরেই ভিতর মহলে ঢুকে পড়লো চণ্ডিকাপ্ৰসাদ। পুরুষ ভৃত্যরা আর এ পর্যন্ত আসে না। টলতে টলতে নিজের কক্ষের দিকে এগোলো, মুখে তখনও সেই গান। নিজের রক্ষিতার শয্যায় এক তবলিয়াকে দেখে যার মাথায় খুন চেপেছিল, সে নিজের পত্নীর কক্ষের দিকে একবার দৃকপাত পর্যন্ত করলো না, দুর্গামণিকে ডাকলোও না, কোনোক্রমে কক্ষের পালঙ্কে ধড়াস করে পড়লো।
একটু পরেই তার প্রবল নাসিকা গর্জন শুরু হবার পর দুর্গামণি আস্তে উঠে নিজের বেশবাস সামলে নিয়ে বললো, তুই এবার যা, সত্য!
সত্যপ্ৰসাদ চলে যাবার পর দুর্গামণি নিজের আঙুলের নোখগুলো যেন মাজারীর মতন ধারালো করে তুললো, তারপর ফালা ফালা করে ছিড়তে লাগলো নিজের মাথা-দেওয়ার রেশমী বালিশটা।
তৃতীয় মহলে অঘোরনাথকে নিয়ে এক নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। অঘোরনাথ নিজের পত্নী কিংবা জননীকে একেবারেই চিনতে পারে না। সে একমাত্র চেনে বাড়ির এক অতি বৃদ্ধ দাসীকে। তার জন্মের সময় এই দাসীটিই ধাত্রীর কাজ করেছিল। শুধু এই ধাত্রীর হাতে ছাড়া আর কেউ খাবার দিলে সে খায় না। মোটা লোহার শিকল দিয়ে দুই হাত ও পা বেঁধে রাখা হয়েছে অঘোরনাথের, কারণ সে অতিশয় হিংস্র [ উন্মাদ হবার পর থেকে তার আর কোন রোগ হয় না, এমনকি জ্বর পর্যন্ত হয় না, দিন দিন তার শরীর হয়ে উঠছে দৈত্যের মতন, শরীরের পরতে পরতে ময়লা এবং নিজের মূত্র-পুরীষের মধ্যে বসে থাকে সে। প্রাচীন দাসীটি তাকে মায়ের অধিক সেবা করেছে এতদিন, কিন্তু মাত্র দুদিনের জ্বরে সে চিরকালের মতন চলে গেল।
এখন অঘোরনাথের কাছে কে যাবে? কে তার মুখে আহার তুলে দেবে? কেউ সামনে ঘেঁষতে সাহস পায় না। অঘোরনাথের জননী এর আগেই পুত্রের কাছ থেকে এমন পদাঘাত পেয়েছেন যে তাঁর কোমর ভেঙে গেছে, আর তিনি সিধে হয়ে দাঁড়াতে পারেন না।
তিনদিন চারদিন হয়ে গেল অঘোরনাথের মুখে এক দানা অন্ন ওঠেনি। সে চক্ষু দুটি গোলাকার করে। এদিক ওদিক চায়, মনে হয়। সেই দাসীটিকে খুঁজছে। কয়েকজন তাকে খাওয়াবার চেষ্টা করেও প্ৰচণ্ড হুংকার শুনে পালিয়ে এসেছে। অঘোরনাথের জননী মেঝের পাথরে কতবার মাথা ঠুকলেন, কত চিকিৎসক ডেকে আনা হলো, কিন্তু কোনো সুফলই দেখা গেল না। সকলের মনোভাব এই যে, একমাত্র কুসুমকুমারীই আন্তরিক চেষ্টা করলে ওকে খাওয়াতে পারবে। সতী সাধ্বী রমণীরা স্বামীর জন্য কত কী করে, বেহুলা তার মৃত স্বামীর-প্ৰাণ বাঁচিয়েছিল, আর কুসুমকুমারী এটা পারবে না? দুর্গামণিই একমাত্র নিষেধ করেছিল, তুই খপরদার যাবিনি কুসোম, লোকে যাই বলুক ও পাগল তোকে প্রাণে মেরে দেবে।
হলোও তাই। কুসুমকুমারী ঠাকুরঘরে প্রণাম করে, গুরুজনদের পায়ের ধুলো নিয়ে পায়েসের বাটি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে। যেন সে স্বামীর সঙ্গে চিতায় আরোহণ করতে যাচ্ছে। অঘোরনাথ প্রথমেই জোড়া পায়ে পদাঘাত করলো না, শিকারকে কাছে আসতে দিল। হাঁটু গেড়ে বসে কুসুমকুমারী যেই একটি হাত বাড়িয়েছে, অমনি অঘোরনাথ কামড়ে ধরলো তার কাঁধ, ঠিক যেন বাঘে ধরেছে এক হরিণীকে। দ্বারবানরা লাঠির ঘা মেরে ছাড়াবার চেষ্টা করলো, দুর্গামণিও হাতে লাঠি ধরে কষিয়ে দিল কয়েক ঘা। কুসুমকুমারীকে যখন ছাড়িয়ে আনা হলো তখন তার বামদিকের কাঁধের এক খাবালা মাংস উঠে এসেছে, সে চেতনা হারিয়েছে অনেক আগেই।
পরদিনই বাগবাজারে পিত্ৰালয়ে নিয়ে যাওয়া হলো কুসুমকুমারীকে। সেখানে থাকতে থাকতেই সে সংবাদ পেল যে একুশ দিন উপবাসের পর অঘোরনাথ প্রাণত্যাগ করেছে। সপ্তদশী কুসুমকুমারী বিধবা হওয়ায় একমাত্র অঘোরনাথের জননী ছাড়া খুশী হলো আর সকলেই। কুসুমকুমারীর শরীরে তার স্বামীর একমাত্র চিহ্ন রইলো বাম স্কন্ধের ঐ ক্ষতস্থানের দাগ।