1 of 2

৪১. দলিলপত্ৰ : অষ্টম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ

দলিলপত্ৰ : অষ্টম খণ্ড

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়

যতিন্দ্ৰনাথ মণ্ডল

গ্ৰাম : শশীদ

ডাকঘর : মোশাণী

থানা : স্বরূপকাঠি

জেলা : বরিশাল

১৭ই বৈশাখ পাকবাহিনী গান বোট নিয়ে ঝালকাঠি দিয়ে কাটাখালী নদী দিয়ে শশীদের হাটে আসে। তারা এসে হাটের পাশে গান বোট রেখে গ্রামের উপর নেমে পড়ে। পাকবাহিনী গ্রামের ভেতর প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের নারী-পুরুষ প্ৰাণের ভয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে চেষ্টা করে। পাকবাহিনী গ্রামে প্রবেশ করে প্রথমে দামি দামি জিনিসপত্র লুঠতরাজ করে এবং পরে ৯ খানা বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিন ২জন লোককে তারা গুলি করে। এদের একজন সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় আর একজন গুরুতব রূপে আহত হয়।

২৬শে বৈশাখ পাকবাহিনী গু রাজাকাররা পুনরায় আমাদের গ্রামে আসে। তারা গান বোট ও স্পিড বোট নিয়ে ছোট খাল দিয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ে। মতিলাল দেবনাথ (ব্যানাজী) ও হিরালাল দেবনাথের কাপড়ের দোকান লুঠ করে স্পিড বোট বোঝাই করে কাপড় নিয়ে যায়। এই সময় মতিলাল দেবনাথের কাছ থেকে নগদ ১২০০০ হাজার টাকা নেয় এবং তাকে বেয়োনেট চার্জ করে পরে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। এইদিন আমাদের গ্রামের ১৮জন লোককে পাকবাহিনী গুলি করে বেয়োনেট চার্জ করে হত্যা করে। এর মধ্যে জিতেন নামে একজনকে পাক বর্বর বাহিনী নারিকেল গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে তার পায়ের কাছে খড়কুটা দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার সারা শরীরে আগুন ধরে গেলে সে ভীষণভাবে চিৎকার করতে থাকে, তখন পাক বর্বর বাহিনী গুলি করে তার মাথার অর্ধেক অংশ উড়িয়ে দেয়।

এই ঘটনা তার স্ত্রীর সম্মুখে হয়। কেননা পাকবাহিনী তার স্ত্রীকে ধরে এনে তার সম্মুখে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই সময় ক্ষীরদা সুন্দরী নামি এক বিধবা মেয়েকে পাকবাহিনী সারা শরীর বেয়োনেট নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এইসময় আর এক মহিলা পাশের জঙ্গলের ভেতর পালিয়ে ছিল তার ছোট ১ ছেলে ও ১ মেয়েকে নিয়ে। পাকবাহিনী তাদের লক্ষ করে গুলি ছুড়লে এক গুলিতে ছেলে, মেয়েসহ তিনজনই মারা যায়।

ঐ দিন আমাদের গ্রামের মোট চারখানা বাড়ি বাদে আর সব বাড়ি অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে দেয়।

৫ই জ্যৈষ্ঠ পাকবাহিনী ঝালকাঠি থেকে গান বোট নিয়ে পুনরায় শশীদ হাটে আসে এবং হাটের উপর ক্যাম্প স্থাপন করে। ঐ দিনই পাকবাহিনী আমাদের গ্রাম থেকে ২জন লোককে হত্যা করে। তার মধ্যে একজন ছিল স্থানীয় স্কুলের সেক্রেটারি কালী কান্ত মণ্ডল। এইসময় পাকবাহিনী স্কুলের লাইব্রেরি লুট করে এবং ভেঙেচুরে সব তছনছ করে দেয়। এবং লাইব্রেরির ভেতরে ছাত্রদের দেওয়া রিলিফের গম পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই গমের আগুন নেভাতে গিয়েই সেক্রেটারি সাহেব গুলি খান। পাকবাহিনী এই সময় ১০ দিন শশীদ হাটে ক্যাম্প করে। থাকে। এই সময় তারা ব্যাপক হারে নারী ধর্ষণ করে। একমাত্ৰ আমাদের গ্রামে অনেক মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করে।

পাকবাহিনী রাত্ৰিতে গ্রামের ভেতর ঢুকে মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে এবং কিছু কিছু মেয়েকে তারা ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং এক একজনের উপর পর পর কয়েকজন পাক পশু ধর্ষণ করে। এই সময় ১১ বৎসরের একটা ছোট মেয়েকে পাকবাহিনী তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং একাধারে তার উপর চলে পাশবিক অত্যাচার। পাকবাহিনী চলে যারবার পর এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা হয়। ৩ মাস পর্যন্ত এই ছোট মেয়েটি হাঁটতে পারত না।

৮ মাসের গর্ভবতী একটি মেয়ের উপর পাকবাহিনী এই সময় অমানুষিক পাশবিক অত্যাচার চালায়, যার দরুন সন্তান প্রসব করার পর সে ও সন্তান মারা যায়।

২৫শে শ্রাবণ পাকবাহিনী দালালের সহযোগিতায় ঝালকাঠি থেকে গান বোট নিয়ে শঙ্কর ধবল গ্রামে আসে এবং আছমত আলী ও রহিনী মিস্ত্ৰিকে ধরে নিয়ে শশীদ গ্রামে আসে এবং সুনীল সরকার নামে একটা ছেলেকে গুলি করে হত্যা করে। এই সময় খুব বৃষ্টি নেমে পড়ে। পাকবাহিনী তখন রহিনী কুমার মণ্ডলের ঘরে আশ্রয় নেয়। এবং হারমোনিয়াম, ঢোল, তবলা নিয়ে খুব গান-বাজনা করে এবং কলা খায়। বৃষ্টি শেষে যাবার সময় গৃহকর্তা রহিনী কুমার মণ্ডলকে গুলি করে হত্যা করে। যে দুইজন লোককে তারা বন্দি করে আনে, তাদের একজনকে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয় এবং একজনকে শশীদ হাটে বসে গুলি করে হত্যা করে। তাকে হত্যা করার আগে খুব মারপিট করে এবং খুব গালাগালি দেয়। যাকে এইসময় ছেড়ে দেয় তাকে বলে দেয় তোমরা জয় বাংলা বলতে পারবে না, বলবে জয় পাকিস্তান।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বরূপকাঠি থানার অশ্বথকাঠি, জিনহার, মাদ্রা, পূর্বজলা বাড়ি, মৌশানী, জুলুহার, আতা, জামুয়া, জৌসার, গণপতিকাঠি, আরামকাঠি প্রভৃতি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এই সময় বহু লোককে তারা নির্মমভাবে হত্যা করে। এই সময় মাদ্রা গ্রাম থেকে দুইজন লোককে কুঠার দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের অপরাধ ছিল পাকসৈন্য যখন একটা মেয়েকে ধর্ষণ করার জন্য যায়, তখন তারা দুইজন বাধা দেয়। এই সময় তারা বহু মেয়েকে ধর্ষণ করে। একমাত্র স্বরূপকাঠি থানাতেই ১০০০ হাজারের বেশি মেয়েকে পাকবাহিনী ধর্ষণ করেছে।

বিভিন্ন সময় আমাদের থানাতে প্ৰায় ২০০/৩০০ লোককে পাকবাহিনী হত্যা করে। স্বাধীনতার পর আটঘর কুড়িয়ানা স্কুলঘরের পেছনে একটা পুকুরের ভেতর থেকে ১৫৬টা মাথার খুলি উদ্ধার করা হয়।

পাকবাহিনী স্বরূপকাঠি দখল করার পর স্বরূপকাঠি, কুড়িয়ানা, শশীদ, বাউকাঠি, জলাবাড়ি–এইসব জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং এখান থেকেই বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন চালায়। জলাবাড়ি ক্যাম্প অঞ্চলে ৩৩টা গ্রাম শুধু হিন্দু বসতি ছিল, পাকবাহিনী সব গ্রাম একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

স্বাক্ষর/–যতিন্দ্ৰনাথ মণ্ডল

 

আলেয়া বেগম

গ্ৰাম : বাঘেরিয়া

ডাকঘর : সোনাগাজী

জেলা : নোয়াখালী

পাকবাহিনী সোনাগাজী ও মতিগঞ্জে শিবির স্থাপন করিয়া স্থানীয় দালাল ও রাজাকারদের সহায়তায় শিবিরের আশেপাশের গ্রামগুলি আক্রমণ করিত। হঠাৎ গ্রামে প্রবেশ করিয়া ধনরত্ন লুণ্ঠন করিত এবং অসহায় নারীদের উপর চালাইত নির্মম অত্যাচার। পাকবাহিনীর অত্যাচারের ভয়ে উক্ত এলাকার প্রায় সকল যুবক, যুবতীগণ নিজ বাড়ি ছাড়িয়া কেহ ভারতে এবং অন্যেরা সুদূর গ্রামে আত্মীয় পরিজনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে।

জুন মাসে পাকবাহিনী সোনাগাজী দখল করিলে আমি আমার স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করিয়া সুদূর পল্লীর গ্রামে পলাইয়া ছিলাম। আগষ্ট মাসে আমি নবজাত সন্তান প্রসব করি। সন্তান প্রসবের দুই মাস পর শরীর অসুস্থ থাকায় পিতার বাড়ি হইতে স্বামীর বাড়ি বাঘেরিয়ায় আশ্রয় নেই। তখন আমার স্বাস্থ্য অত্যন্ত দুর্বল ছিল। আমি তখন নিয়মিত ডাক্তারের ওষুধ ব্যবহার করিতাম।

অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে পাকবাহিনী, দালাল, রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসের অত্যাচার খুব বৃদ্ধি পায়, পাকবাহিনী গ্রামে প্ৰবেশ করার সংবাদ পাইলেই গ্রাম ছাড়িয়া অন্য গ্রামে আত্মগোপন করিতাম। নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে পাকবাহিনী ও মিলিশিয়া আমার স্বামীর বাড়ি আক্রমণ করে। পাকবাহিনীরা আমাকে ধরিয়া ফেলে এবং হাত হইতে আমার নবজাত সন্তানকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া সেখানেই নির্মমভাবে পশুর মতো অত্যাচার করে। তাহাদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলি। অনুমান ৪/৫ জন নরপশু আমার অসুস্থ দেহের উপর পাশবিক অত্যাচার করিয়া আমাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় ফেলিয়া চলিয়া যায়। পরে আমার স্বামী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন স্থানীয় ডাক্তারের সহায়তায় আমার জ্ঞান ফিরাইয়া আনে।

স্বাক্ষর/-
আলেয়া বেগম

 

ডা. আব্দুল লতিফ

গ্রাম : ছিরামিসি

থানা : বিশ্বনাথ

জেলা : সিলেট

৩১শে আগষ্ট রোজ মঙ্গলবার সময় সকাল ৯ ঘটিকার সময় অনুমানিক ১৫জন পাক সৈন্য ও সমপরিমাণ রাজাকার ছিরামিসি বাজারে আসে। তাহার পূর্বে ঐ বাজারে পাক সৈন্য আর আসে। নাই। রাজাকার কমান্ডার স্কুলের শিক্ষক, পোস্ট অফিস ও তহশিল অফিসের কর্মরত লোকজন সকলকে ছিরামিসি হাই স্কুলে যাইবার জন্য আদেশ দিল। সেখানে শান্তিকমিটি গঠন করা হইবে। নিরীহ জনগণ ভয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হইল। কয়েক মিনিট আলাপআলোচনার পর পাক বাহিনী ছিরামিসি এলাকার লোকদিগকে একদিকে এবং সরকারি কর্মচারী ও বাহির হইতে আগত লোকদের অপর পাৰ্থে বসাইল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদেরকে দুইভাগে দুই জায়গায় নিয়া যায়। আমি ঐ জায়গায় প্রায় ৭ বৎসর যাবৎ ডাক্তারি করিতেছি। সরকারি কর্মচারীসহ আমাদের বহিরাগত ২৬ জনকে উক্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অফিসে নিয়া শক্ত করিয়া দড়ি দিয়া বাধিয়া ফেলে এবং আমাদিগকে পার্শ্ববর্তী থানা জগন্নাথপুর নিয়া ছাড়িয়া দিবে বলিয়া ঘর হইতে বাহির করিয়া নৌকায় লইয়া যায়। অপর দিকে ছিরামিসি গ্রাম ও বাজারের ৩৭ জনকেও বাধিয়া অপর গ্রামের দিকে নিয়া যায়। আমাদের ২৬জনকে নৌকা যোগে কচর্যাকেলী গ্রামে নিয়ে যায়। সেখানে আমাদিগকে পুকুরের পাড়ে কিছু পানির মধ্যে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। ঐ সময় আমাদের হাত পেছনের দিকে শক্তভাবে বাধা ছিল। দুইদিক হইতে পাকবাহিনী ও রাজাকার গুলি করিতে থাকে। আমি হাতে ও পায়ে গুলিবিদ্ধ হইয়া পুকুরের পানিতে ড়ুব দেই। বহুকষ্টে পুকুরের অপর পাড়ে গাছের আড়ালে আশ্রয় নেই। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর আমি সেখান হইতে আবার পুকুরের অপর পাড়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শহিদ লোকদের পার্শ্বে আসি। সেখানে প্ৰত্যেককে ভালোভাবে লক্ষ্য করিয়া দেখি সকলেই নরপিশাচদের গুলিতে শাহাদৎ বরণ করিয়াছে। অপরদিকে ছিরামিসি এলাকার ৩৭জনকে মাঠে নিয়া অনুরূপ অবস্থায় গুলি করিয়া হত্যা করিয়াছে। আমি আহত অবস্থায় অপর গ্রামে গিয়া আশ্রয় নেই। সেইদিন যাহারা শহিদ হইয়াছেন তাহাদের নাম নিম্নে দেওয়া হইল।

আব্দুল বারিক মেম্বার, আব্দুল লতিফ, সুন্দর মিঞা, তহশীলদার ও তাহার দুই ছেলে, পোস্টমাস্টার ছিরামিসি বাজার, ছিরামিসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, ছিদ্রামিসি প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক একজন, নজীর আহমদ, একলাস মিঞা, মজীদ উল্লা, দবীর মিঞা, রুসমত উল্লাহ, তৈয়ুব আলী, মোসাদের আলী ও অন্যান্য। ৩১শে আগস্ট পাকবাহিনী ও তাঁহাদের অনুচরগণ ৬৩জন নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করিয়া ক্ষান্ত হয় নাই। ১লা সেপ্টেম্বর ছিরামিসি বাজার ও গ্রাম জ্বালাইয়া দেয় ও মা-বোনদের উপর পাশবিক নিৰ্যাতন করে।

স্বাক্ষর/–আবদুল লতিফ

 

মোছাঃ চানুভান

গ্রাম; ফুলবাড়িয়া

থানা : ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া

জেলা : কুমিল্লা

আমি দরিদ্র পিতৃহীন অবিবাহিতা নারী। বিধবা মাতা একমাত্র সংসারের আপনি পরিজন। আমার কোনো ভাইবোন নাই।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইলে পাকবাহিনী পত্তন ইউনিয়নে শিবির স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামের ও ইউনিয়নের বহু ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে। জুলাই মাসের ১৭ তারিখ বানু মিঞা, সোনা মিঞা ও চাদ মিঞা। গভীর রাত্রে আমার নিজ বাড়ি হইতে ধরিয়া লইয়া পাকবাহিনীর শিবিরে নিয়া যায়। আমাকে দেখিয়া পাকবাহিনীরা আনন্দে নাচিয়া উঠে, আমার ক্ৰন্দন তাহাদের প্রাণে একটুও মায়ার সঞ্চার করে নাই। রাজাকাররা ধরিয়া নিবার সময় তাহাদের নিকট বহু আকুতি মিনতি ও পায়ে জড়াইয়া পড়িয়াছি। উক্ত রাজাকারদের নিকট আমি যতই ক্ৰন্দন করিয়াছি, রাজাকারগুলি আমার সহিত তত বেশি অমানুষিক ব্যবহার করিয়াছে।

পাঁচদিন পাক নরপিশাচরা আমাকে তাহদের শিবিরে ও বাঙ্কারে আটকাইয়া রাখে ও আমার দুর্বল দেহের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে ও মুক্তিবাহিনীর সংবাদ জানি কি-না জিজ্ঞাসা করে। আমি মুক্তিবাহিনীর সম্বন্ধে জানি না বলিলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া প্ৰহার করে। এই পাঁচদিন তাহারা আমাকে গোসল করিতে পর্যন্ত দেয় নাই।

আমাকে ধরিয়া দিবার পরিবর্তে রাজাকারগণ পাক নরপিশাচদের হইতে প্রচুর মদ ও গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন করার অনুমতি পাইয়াছিল। সৈন্যদের অত্যাচারে বহুবার আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। জ্ঞান ফিরিয়া পাইলেও দেখি ও অনুভব করি আমার দুর্বল শরীরে অত্যাচার করিতেছে। সেই কথা ভাবিতে আজো আমার ভয় হয়।

আমাকে ১৭ জুলাই রাত্রে রাজাকাররা ধরিয়া নিবার পর ১৮ জুলাই আমার মা কেসবিপুর গ্রামে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নজীর আহমদ সাহেবের নিকট আমাকে পাক শিবিরে ধরিয়া নিবার করুণ সংবাদ বলিলে উক্ত মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ২১ জুলাই গভীর রাত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়া ফুলবাড়িয়া পাক সৈন্যদের শিবির ও বাঙ্কার আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমণে পাকবাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমৰ্পণ করে। আক্রমণের সময় তাহারা সকলে আমার উপর অত্যাচার করিতেছিল! মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা আমাকেসহ ১৪জন সৈন্য ও তিনজন রাজাকারকে গ্রেপ্তার করিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়া যান। তাহারা আমার সম্মুখে রাজাকার ও পাক নরপিশাচদের জীবন্ত মাটি চাপা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ত্রিপুরা রাজ্য হইতে নিজ জন্মভূমি ফুলবাড়িয়া ফিরিয়া আসি।

স্বাক্ষর/–

মোছাঃ চানুভান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *