৪১
হ্যাঁ গো, তর্পণের দিন কি এসে গেল নাকি?
নয়নতারা একখানা পুরোনো জং-ধরা কৌটো খুলবার বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে, সে এখনও দেরি আছে।
পঞ্জিকাখানা দেখে রেখো।
পঞ্জিকা তো এ বছর আনাই হয়নি। রামজীবন প্রতিবার একখানা হাফ পঞ্জিকা এনে দেয়। এবারটায় বুঝি ভুলে গেছে।
তা হলে?
ও নিয়ে ভাবতে হবে না। ভুল তো কোনওদিন হয়নি। এবারও হবে না। বাংলা ক্যালেন্ডার আছে।
খেয়াল রেখো।
কৌটোটা একটু খুলে দেবে নাকি? বর্ষার পর কৌটো-বাউটোর মুখ জং ধরে বড় আঁট হয়ে বসে। দেখ তো পারে কিনা।
বিষ্ণুপদ কৌটোটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু দেখল। চাড় দিয়ে খোলার জিনিস নয়, প্যাঁচের ঢাকনাও নয়। এ হচ্ছে বসানো ঢাকনা। ভিতরে মাল আছে, বেশ ভারী। নাড়লে ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে।
বিষ্ণুপদ খোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, কী আছে এর মধ্যে?
তা কি ছাই জানি? রাজ্যের কৌটো, কোনটার মধ্যে কী কে জানে। খুললে বুঝব। চাল, ডাল, তিল, পোস্ত কিছু একটা হবে। যা-ই থাক, ছাতা পড়ে আছে হয়তো। চনচনে রোদে একটু রেখে দিলে দোষ কাটে।
উঠোনের মাঝখানে চাটাই বিছিয়ে বিস্তর জিনিস রোদে দিয়েছে নয়নতারা। কিছু মশলাপাতি, ডাল, পুরোনো তেঁতুল অবধি।
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, হাত পিছলে যাচ্ছে। আঁচলটা দাও তো, সেঁটে ধরে খুলে ফেলি।
থাক বাপু, বেশি কসরতে কাজ নেই। রেমো আসুক, খুলে দেবে।
বিষ্ণুপদ নিজের ধুতির খুঁট দিয়ে আরও কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে বলে, এ একেবারে তোমার আমার মতো কৌটো আর ঢাকনা দুজনকে-দুজনায় সেঁটে ধরেছে। কেউ কাউকে ছাড়তে চাইছে না।
নয়নতারা বালিকার মতো একটু হাসল, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে তাই যেন থেকো। কৌটো আর ঢাকনা—তোমার মাথায় খেলেও বাপু সব অদ্ভুত কথা!
চাটাইয়ের দিকে চোখ কুঁচকে চেয়ে ছিল বিষ্ণুপদ। বলল, সাদামতো ওটা কী দিয়েছে রোদে? সাও নাকি?
হ্যাঁ, গেলবার পটলের জ্বরের সময় আনানো হয়েছিল।
বড় দানা?
বড়ই।
ভিজিয়ে লেবুপাতা, চিনি আর নুন দিয়ে খেতে ভারী চমৎকার। একখানা পাকা কলা আর একটু কোরানো নারকোল হলে তো কথাই নেই।
বড্ড নোলা হয়েছে আজকাল, না গো?
তা বুড়ো বয়সে একটু হয়। সাগুতে কোনও দোষ নেই। খেলে পেট ঠাণ্ডা থাকে। কী বলে? দেরোখন ভিজিয়ে। কৌটোটা খুলতে পারলে?
না। বুড়ো হাড়ে কি আর সেই শক্তি আছে? আগে হলে এক মোচড়ে খুলে ফেলতাম।
না গো, কৌটোর মুখে মরচে পড়লে বড্ড এঁটে যায়। কথায় কথায় বুড়ো বয়স এনে ফেল কেন?
বিষ্ণুপদ ফর্সা রোদের উঠোনে চোখ দুখানা ফেলে রেখে বলে, দিনে পনেরো বিশ মাইল সাইকেল চালাতাম, নিজের হাতে চাষ করতাম। শরীরে তখন হাতির মতো জোর ছিল। এখন কেমন ঝিম মেরে গেছি। মনে হয় ভেজা কাঁথা জড়িয়ে বসে আছি।
জাঁতির কোণা দিয়ে মুখটা আলগা করে অবশেষে খুলে ফেলল নয়নতারাই।
কৌটোর ভিতরে চেয়ে বলল, সর্ষে গো!
শুনে বিষ্ণুপদ খুব হাসল, আর ভাল জিনিস কিছু বেরোলো না! সর্ষে? আমি তো ভাবছিলাম সোনাদানা হীরে-জহরত কিছু বেরোবে।
আমাদের কপালে কি তাই আছে গো! তা সর্ষেই খারাপ কি? রোদে মচমচে করে শুকিয়ে রাখলে ঝাঁঝ উঠে যাবে। কচুবাটা খাবে আজ? ছাইগাদা থেকে মানকচুটা তবে ভোলাই।
উদাসভাবে বিষ্ণুপদ বলে, বর্ষাকালটা তো কচুঘেঁচু খেয়েই কাটালাম। এ সময়ে নতুন ফুলকপি ওঠে, খুব স্বাদ।
এখানে কি আর ওঠে? সে কলকাতায়, দামও তেমনি।
বিষ্ণুপদ একটু খেদের সঙ্গে বলে, ওইটেই তো মুশকিল। ভাল জিনিসের দামটাও আবার ভাল। আজকাল শুনি, বড়লোকরা নাকি বেশী খায়-টায় না। বেশী খেলে নাকি কিসব হয়। প্রেসার, কোলেস্টোরাল, হার্টের ব্যামো। আর আমাদের দেখ, পেলাম তো খেলাম। মরি মরব, মরণ তো আর খণ্ডানো যাবে না, তা খেয়েই না হয় মরলাম। কী বলে?
মরবে কোন দুঃখে? বড়লোকদের ভাল খেয়ে খেয়ে অরুচি, তাই বেশী খায় না।
বিষ্ণুপদ যেন একটু অবাক হয়ে বলে, অরুচিটা হয় কি করে বললা তো! আমার তো অরুচি হয় না কখনও। তেলাপিয়া মাছ থেকে গমের খিচুড়ি কোনটাই তো এ পোড়া জিবে কখনও খারাপ লাগেনি। খিদের ভাবটারও কখনও মন্দা হল না।
নয়নতারা হাসে, বড়লোকদের জিব তুমি পাবে কোথায়? ওসব বড়লোকদেরই হয়। অরুচি, অখিদে।
একবার বলে দেখো তো রেমোটাকে। বললে একদিন ঠিক এনে দেবে।
ফুলকপি তো! বলে দেখব’খন।
আগে বাগানেই হত দু’চারটে। আজকাল আর বাগান কেউ করে না। করলে আর বাজার থেকে দুনো দামে কিনতে হত না।
কে করবে বলে! কার দায়? যতদিন তুমি করেছছ ততদিন হয়েছে। এখন বাগানে একখানা কুমড়োবিচিও কেউ পোঁতে না। আমি মরে মরে দু’চারটে যা গাছ লাগাই, গরু ছাগলেই খেয়ে যায় সব। ভাগের জমি বলেই বুঝি কারও গা নেই।
বিষ্ণুপদ হঠাৎ বলল, বুঝলে, সামনের বছর অবধি যদি বাঁচি, তাহলে আমি বাগানটায় হাত লাগাবো। জলটল না হয় পটলকে দিয়ে দেওয়াবো।
খুব বাঁচবে। হেসে-খেলে এখনও মেলা বাঁচবে।
বিষ্ণুপদর মেজাজটা আজ ভাল।
নয়নতারা সর্ষে রোদে দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই বলল, একখানা গরদ দিয়ে গেল না তোমাকে কৃষ্ণজীবন?
গরদ বলে গরদ! একেবারে আসল জিনিস।
কত দাম হবে মনে হয়?
তা কি আর জিজ্ঞেস করিনি! মিটিমিটি হাসল শুধু, বলল না। দাম ভালই হবে মনে হয়। জীবনে গরদ ক’টা চোখে দেখেছি যে, দাম জানব?
একদিনও তো পরতে দেখলাম না!
বাপরে! পরব কি গো? সারা দিন গোবর-ন্যাতা, জলকাদা ঘাঁটছি, গরদ পরে বসে থাকলে তো চলবে না। ওসব বড়মানুষদের ঘরে হয়।
ওইটে কৃষ্ণজীবন ভুল করল। সাধ করে গরদ এনে দিল, কিন্তু বুদ্ধি করে যদি ও-টাকায় কয়েকখানা আটপৌরে শাড়ি এনে দিত তাহলে কত সুবিধে হত বলো তো!
শখ করে দিয়েছে। কী করবে বলে!
গলাটা একটু নামিয়ে বিষ্ণুপদ বলে, ও গরদ তোমার গায়ে তো উঠবে না, ও পরে বেড়াবে বামার বা রেমোর বউ। তুমি পটলটি যেই তুলেছে সেই থাবা মারবে সব জিনিসে।
নয়নতারা একটু হেসে বলে, এতদিনে তাহলে সংসার চিনতে শিখলে!
আগেই চিনেছি, চুপ করে থাকি বলে বোকা ভেবো না।
বোকা তো তুমি নও, তবে বোকা ভাবব কেন?
তাই বলছি গরদটা দু’চারদিন পরে নাও। আমাদের তো বেশি কিছু নেই। তোমাকে সারা জীবন দিতে-থুতেও পারিনি কিছু। মনে ইচ্ছে অনেক হয়েছে। পারলাম কই?
নয়নতারা বলে, ওরকম বোলো না তো! দাওনি তো কী হয়েছে? পারলে কি দিতে না? ছেলের দেওয়াই তোমার দেওয়া। ছেলে তো তোমারই।
তাই ধরে নিচ্ছি। কিন্তু একটু পরো। না পরলে কি দেওয়ার দাম থাকে?
আচ্ছা পাগলামি শুরু করলে দেখছি। গরদটাকে একটু জুড়োতে দাও।
বিষ্ণুপদ মৃদু স্বরে বলে, আমাদের এখন ভাঁটির বয়স। কোনও কাজে দেরী করা ভাল নয়।
আজ বাড়ি ফাঁকা। রাঙা তার দুই ছেলে নিয়ে দিন কয়েকের জন্য বাপের বাড়ি গেছে। বামাচরণের বউ নিজের ঘর থেকে বড় একটা বেরোয় না আজকাল। তার হাঁড়িও আলাদা। তারা বুড়োবুড়ি একটু একা হয়েছে। সকালের দিকটায় দুজনে কথা হচ্ছে।
নয়নতারা আর একটা কৌটো খুলে কী যেন দেখছিল। বলল, ঠিক আছে, পরব না হয়। শীতলামন্দিরে গিয়ে একটু পুজোও দিয়ে আসব গরদ পরে। কতকাল যাই না ওদিকে।
আজ রাঁধবে-বাড়বে কি?
সেই তো ভাবছি। রেমো তো সকালে বেরিয়ে গেল। বাজার করলে হত একটু। তেমন কিছু নেই। তেলেরও টান রয়েছে।
বিষ্ণুপদ একটু হাসল, তাতে কি তোমার আটকায়? চিরটা কাল তো টানাটানির সংসারেই হাত পাকালে। সেদ্দ পোড়া ছ্যাঁচড়া দিয়ে দিব্যি খেয়ে গেলাম আমরা। কিছু লাগলে বলো, এনে দিই। কৃষ্ণজীবন তো কিছু টাকাপয়সা দিয়ে গেছে সেদিন।
নয়নতারা চোখ পাকিয়ে বলল, ওতে হাত দেবে কেন? আছে ক’টা টাকা থাক না। দুর্দিনে কাজে লাগবে।
বিষ্ণুপদ একটু দুঃখের হাসি হেসে বলে, তোমার বড় সরল মন। দুর্দিন আর আসবে কি? চিরটা কাল তো দুর্দিন মাথায় করেই কাটিয়ে এলে। তার চেয়ে খারাপ আর কী হবে? তাই তো বলি, চোখ ওল্টালে ছেলেরা বউরা সব হাঁটকে মাটকে নিয়ে নেবে। ভূতভুজিতে যাবে সব কিছু। তার চেয়ে ও টাকা নিজেরা খরচ করাই ভাল।
তোমার কেবল খরুচে বুদ্ধি। ও বুদ্ধি ভাল নয়। চলছে চলুক না।
আচ্ছা কেন মানুষ তুমি।
বিষ্ণুপদ আর কথা বাড়াল না। বসে বসে নয়নতারার কাজ দেখতে লাগল। জিনিসপত্রের কী যত্ন মানুষটার। একটা দানা অবধি নষ্ট হয় না। একটু তিল, একটু ধনে, একটু ডাল কি চাট্টি পোস্ত সব কুলোয় ঝেড়ে রোদে দিয়ে নির্দোষ করে যত্নে আবার কৌটোয় ভরে রেখে দেয়। গরিবের সংসারে কত অভাব থাকে। সাধ্যমতো নয়নতারা চিরকাল গতর খাটিয়ে ফুটো নৌকো সামাল দিয়েছে। অনুযোগ করেনি, ঝগড়া করেনি। এই একজনের কাছে নিজেকে বড় ঋণী লাগে বিষ্ণুপদর! বড্ড মায়াও হয়। এই মানুষটাকে কোনওদিন হাতে করে একখানা ভাল জিনিস এনে দেয়নি। কী খেতে ভালবাসে, কোন রঙের শাড়ি পছন্দ সেই খোঁজটাও নেয়নি কখনও।
তুমি বড় ভাল মানুষ গো!
বিষ্ণুপদর কথাটা শুনে কুলো থেকে মুখ তুলে নয়নতারা একটু হাসল, তুমি ভাল বলেই আমিও ভাল। মেয়েমানুষ জলের মতো, যে পাত্রে থাকে তার মতোই হয়।
সে তো তুমি বললে। একালের মেয়ে বউরা বলবে?
আমাদের আর একাল দিয়ে দরকার কি? ওরা ওদের মতো থাক।
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, সে কথা তো আমিও তোমাকে বলি। তোমার মতো মানুষ হলে সংসারে অশান্তি হয় না। সব দিক বুঝে, ঠিক রেখে চলতে জানা চাই।
মেয়েদের কথা বলছো! পুরুষগুলোরও হাল একবার চেয়ে দেখ। তুমি যেমন মানুষ তেমনটা একালে পাবে খুঁজে? নেশা-ভাঙ নেই, বায়নাক্কা নেই, তর্জন গর্জন নেই, মেয়েমানুষের দোষ নেই। তা আমার ভাগ্য সেদিক দিয়ে বড্ড ভাল। খাওয়া-পরার কষ্ট সয়ে নিয়েছি শুধু তুমি ভাল বলে।
বিষ্ণুপদ খুব হাসল দুলে দুলে। তারপর বলল, সেই ভাল। তুমি ভাল, আমিও ভাল। দুজনেই দুজনের কাছে ভাল, কেমন তো?
নয়নতারাও হাসল, বলল, হ্যাঁ তো।
উঠোনের আগল ঠেলে এই সময় দুটি মানুষ ঢুকল উঠোনে। একটি বেশ ঝলমলে শাড়ি-পরা মেয়ে। সঙ্গে একজন পুরুষ। বিষ্ণুপদ চোখ কুঁচকে ঠাহর করে বলল, কে?
নয়নতারা কুলোটা নামিয়ে রেখে কলধ্বনি করে উঠল, ও মা! এ যে নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না! বীণাপাণি! আয় আয়।
বিষ্ণুপদ যে খুব খুশি হল তা নয়। এই মেয়েটি সম্পর্কে ভাল কথা শোনা যায় না। লোকে আজকাল খারাপ কথাই বলছে। তবু জলচৌকি ছেড়ে বিষ্ণুপদ উঠে দাঁড়াল।
বীণাপাণি দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল, কেমন আছো মা?
তোকে নিয়ে খারাপ স্বপ্ন দেখে যে কী মন খারাপ আমার! তোর বাবাকে নিয়ে বনগাঁয়ে যাবো বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম। তারপর আর যাওয়া হল না।
বীণা আর নিমাই বিষ্ণুপদকে প্রণাম করে বারান্দায় মাদুর পেতে বসল। দুজনের কারও মুখেই সুখের ছাপ দেখতে পেল না বিষ্ণুপদ। নিমাইয়ের দিকে চেয়ে বলল, কেমন চলছে তোমার?
নিমাই শুকনো মুখ করে বলল, ওই টুকটাক করে চলছে।
জবাবটায় বিষ্ণুপদ খুশি হল না। ভ্রূটা কোঁচকানোই রইল। বলল, কেন বাবা, তুমি কাজকর্ম কিছু করো না?
একটা দোকান খুলবার ইচ্ছে আছে।
বিষ্ণুপদ দেখল, বীণাকে নিয়ে নয়নতারা গিয়ে ঘরে ঢুকল। মেয়েদের নানা কথাবার্তা থাকে।
বিষ্ণুপদ বলল, দোকান তো তোমার একখানা ছিল।
ছিল। সে তুলে দিতে হয়েছে।
তাহলে তোমাদের চলছে কিসে?
বীণা কিছু পায়।
কথাটা শুনেছি। শুনে আমার ভাল লাগেনি। বীণা যাত্রাদলে কেন নামল বলতে পারো?
আজ্ঞে, আমি বারণ করেছিলাম। শোনেনি।
কেন শোনেনি?
তখন আমার বুকের দোষ হয়েছিল। রোজগারপাতি বন্ধ। পেটের দায়ে আর আমাকে বাঁচাতেই নেমেছিল।
বিষ্ণুপদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ওসব ভাল ব্যাপার নয়। চারদিকে মেয়েদের যে কত বিপদ।
বীণা তো আমার কথা শোনে না। আপনারা বলে দেখুন।
আমি! বলে বিষ্ণুপদ আকাশ থেকে পড়ল, আমার কথায় কি কাজ হয় বাবা? বলিও না কাউকে কিছু। তোমাকে বললাম, ধর্মভীরু মানুষ বলে।
ধর্মভীরু মানুষদের এখন ভাত জোটে না।
তাই দেখছি। একটা ভারি উল্টোপাল্টা রকম চলছে এখন। কী বলো?
আজ্ঞে।
অনেকদিন এদিকে আসো-টাসোনি। দেখতে ইচ্ছে যায়। তোমার মুখখানাই তো ভলতে বসেছিলাম।
বড্ড আটকা পড়ে আছি ওদিকে। বীণা মন করল, তাই আসা।
যাত্রাদলে কি ও অনেক টাকা পায়?
না, তেমন কিছু নয়। আগের চেয়ে এখন একটু বেশি পাচ্ছে।
একটা কথা কি জানো? মেয়েদের রোজগার হঠাৎ খুব বেড়ে গেলে লক্ষণটা ভাল নয়। ওর মধ্যে একটা কিন্তু ঢুকে থাকে।
নিমাই সামান্য লজ্জিত হয়ে বলে, তেমন কিছু বাড়েনি।
বিষ্ণুপদ সামান্য চুপ করে থেকে বলে, দুনিয়াটায় এখন টাকা আর মেয়েমানুষ ছাড়া যেন কিছু নেই। আর একটা জিনিসও দেখি, খুব বেড়েছে। নেশা।
তা যা বলেছেন।
বনগাঁ কেমন জায়গা?
ভাল মন্দ মিশিয়ে।
দোকানটা কবে করবে বাবা?
খোঁজা হচ্ছে। সুবিধেমতো পেলেই খুলে ফেলব।
তখন বীণাকে যাত্রাদল থেকে ছাড়িয়ে নিও।
আজ্ঞে, চেষ্টা করব।
জামাটামা খুলে তেলটেল মাখো। কুয়োয় চান করবে, না কি পুকুরে?
নিমাই একবার আকাশের দিকে চেয়ে বলল, এখনও বেলা অনেক আছে। এগারোটার বেশি বাজেনি। হবে’খন সব।
বিষ্ণুপদর কথা ফুরিয়ে গেল। আজ দম ধরে অনেক কথা বলে ফেলল। এত বেশী কথার মানুষ নয় সে। কথা বেরিয়ে যাওয়ায় শরীরটাও একটু কাহিল লাগছে। ঘামও হচ্ছে যেন একটু।
নয়নতারা বেরিয়ে এসে বলল, ওগো, একটু এধারে শুনে যাও।
বিষ্ণুপদ উঠল। কাছে যেতেই নয়নতারা চাপা গলায় বলল, জামাইকে তো আর কচুঘেঁচু খাওয়াতে পারি না। একবার বাজারপানে যাবে নাকি?
বাজার! কতকাল যাইনি।
আজ যে রেমোটাও বাড়ি নেই। পারবে না?
পারব। টাকা দেবে নাকি?
দেবো।
বাজারের দরদাম কিছু জানি না। ঠকিয়ে দেবে হয়তো। কী কী আনতে হবে বলে দাও। বুদ্ধি খাটিয়ে কিন্তু আনতে পারব না।
একটু মাছ তো লাগবেই। একটু সর্ষের তেল। কয়েকটা আলু আর দুটো বেগুন।
নয়নতারা টাকা বের করে দিল। একখানা ব্যাগ ধরিয়ে দিল হাতে, তারপর বলল, ছাতাটাও নিয়ে যাও। রোদ বেশ চড়া লাগছে।
বাজার করতে ছাতায় সুবিধে হয় না। ও থাক। তেমন গরম নয়।
চটিজোড়া পরে রওনা দিতে যাবে এমন সময় নিমাই ‘হাঁ হাঁ’ করে ওঠে, আহা আপনি বাজারে যাচ্ছেন কেন? কিছু নেই নাকি বাড়িতে?
নয়নতারা বলল, সে যা আছে তাতে জামাইকে দুটি ভাত বেড়ে দেওয়া যায় না।
নিমাই মাথা নেড়ে হেসে বলে, আজ্ঞে, ওসব বলে লজ্জা দেবেন না। আমি তালেবর লোক নই। গরিবের ছেলে, দুটি ডালভাতই অমৃত। বুড়ো মানুষকে এই দুপুরে বাজারে পাঠাতে হবে না।
বিষ্ণুপদ না-যেতে পারলে বাঁচে। ঘটনাটা কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রইল।
নয়নতারা বলল, পাঠাতে হতই বাবা। দুচারটে জিনিস না হলেই চলবে না।
হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা বিষ্ণুপদর হাত থেকে নিয়ে নিমাই বলে, তাহলে দিন আমি এনে দিই।
সে কি হয়! তুমি জামাইমানুষ, ধুলোপায়ে বাজারে পাঠাবো?
নিমাই এক গাল হেসে বলে, দু’গ্রাস ভাত না হয় বেশী খাবো। দিন, আমার খেটে অভ্যাস আছে।
বীণাপাণি দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলে, ওকেই দাও মা। বাজার ভাল করে।
নিমাই বাজারে রওনা হয়ে যাওয়ার পর হাঁফ ছাড়ল বিষ্ণুপদ। জলচৌকিতে বসে ধুতির খুঁটে মুখের ঘাম মুছল, ফাঁড়াই কেটেছে বলা যায়। বাজারে যাওয়ার নামে যেন অকূল পাথারে পড়ে গিয়েছিল। বয়সকালে বাজারহাট এত ভাল লাগত যে সারাদিন বাজারেই পড়ে থাকতে ইচ্ছে যেত। আর মনে হত গোটা বাজারটাকেই গন্ধমাদনের মতো তুলে বাড়িতে নিয়ে আসে। কিন্তু এখন যেন কোথাও যাওয়ার নামে কে যেন ভেজা কম্বল জড়িয়ে দেয় গায়ে।
ও বাবা! তুমি যে চিনতেই চাইছে না আমাকে! কতকাল পর এলাম মুখে একটু হাসি অবধি দেখলাম না।
এই হাসছি মা। হাসতেই তো যাচ্ছিলাম, তোর মা কাজের কথা পেড়ে ফেলল যে!
বীণাপাণি তার দীর্ঘ বেণীটি খুলতে খুলতে কাছটিতে এসে ধপ করে বসে পড়ল মেঝের ওপর, কত বুড়ো হয়ে গেছ বাবা! কেমন যেন দেখাচ্ছে তোমাকে!
অপ্রতিভ বিষ্ণুপদ মেয়ের সামনে কেমন যেন স্বস্তি বোধ করছিল না। বড় অপ্রতিভ লাগছে। মাথায় কথা আসছে না।
বীণা বাপের দিকে চেয়ে বলল, চুল পেকে শনের নুড়ি হয়েছে, গালের চামড়া ঢলঢল করছে, রোগাও হয়েছে অনেক। কই, মা তো তোমার মতো এত বুড়িয়ে যায়নি।
বয়স তো হচ্ছে।
সে তো বুঝলাম, কিন্তু মুখখানা অত গম্ভীর কেন? আমাকে দেখে একটুও খুশি হওনি তুমি!
পাগল! কী যে বলিস! কতকাল পর এলি, খুশি হবো না কেন?
মাথা নেড়ে বীণাপাণি বলে, খুশি কেন হওনি তা জানি। তুমি ভাবো, তোমার বীণাপাণি যাত্রায় নেমে নষ্ট হয়ে গেছে! হ্যাঁ বাবা, তাই ভাবো তুমি?
বিব্রত বিষ্ণুপদ বলে, ওই দেখ, কী কথা! আরে দূর! তা ভাববো কেন?
বীণাপাণির চোখ দুটো ছলছল করতে থাকে, তাই ভাবো বাবা, আমি জানি। তোমার মতো ভাল একজন মানুষের মেয়ে হয়ে কি আমি নষ্ট হয়ে যেতে পারি বাবা?
বিষ্ণুপদ আমতা আমতা করে বলে, তাই কি বলেছি?
আমার তো খবরও তোমরা রাখো না। এই তো একটুখানি পথ পালপাড়া। একবার কেউ গিয়ে উকি মেরে দেখে আসত না আমাকে। ঠিক যেন বেড়াল পার করে দিলে! এক দুঃখী সংসার থেকে আর এক দুঃখী সংসারে গিয়ে পড়লাম। কীই বা আমার বয়স বললা! এক্কা দোক্কার কোট ছেড়ে গিয়ে একেবারে কুম্ভীপাকে। সংসারটা বড় নয় বলে রক্ষে। তার পর তোমার জামাইয়ের হল অসুখ। কী দিনই গেছে। পথ্যির জোগাড় নেই, ওষুধ আনতে সংসারের ভাতে টান পড়ে যায়, গায়ে কাঁথাকানি জোটে না। হ্যাঁ বাবা, এমন জামাইয়ের মধ্যে তুমি কোন কার্তিক ঠাকুরটি খুঁজে পেলে বলো তো!
বিয়ের সময় তো চাকরি করত।
আহা, কী চাকরি! ঠিকাদারের গুদামের দারোয়ান। তাও উপরি নিলে কিছু হত। তাও নয়, ইনি হলেন দড়কচা-মারা সাধুবাবা। এদিকে পেটে ছুঁচো বুকডন মারছে।
এহেন আক্রমণ জীবনে অনেক সয়েছে বলে বিষ্ণুপদ চুপ করে থাকতে পারল। মেয়ের এসব কথা বলার হক আছে। সত্যিই তো, নিমাইয়ের মধ্যে এমন কী দেখেছিল বিষ্ণুপদ? চেহারা নেই, চাকরি ভাল নয়, শুধু পাঁচজনে বলেছিল, ছেলেটি ভারি সৎ প্রকৃতির। দেখেও তাই মনে হয়েছিল বিষ্ণুপদর।
বীণার চোখের বাটি ছাপিয়ে গেল। টপ টপ করে গাল ভাসিয়ে জল আসছে। বিষ্ণুপদ অস্ফুট স্বরে বলে, কাঁদিস কেন?
কাঁদব না? অত অভাবের সংসারে দিলে বলেই তো আমার এত হেনস্থা হল। যাত্রায় নেমেটি বলে ঘেন্না করো? যাত্রায় নামলাম বলেই তো প্রাণে বাঁচলাম! নইলে মরতে হত যে!
বিষ্ণুপদ একবার হাঁ করল। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে নাকি? দমটা কম পড়ছে কেন হঠাৎ?
বীণা আঁচলে চোখ চেপে ধরে কাঁদছে। বিষ্ণুপদর বড় আত্মগ্লানি হচ্ছে তাতে। সে বড় নির্বোধ, বড় আহাম্মক। কত ভুলের জালে জড়িয়ে ফেলল নিজেকে আর সন্তানদেরও। সারাজীবন ধরে কত ভুল দেখল, ভুল বুঝল, ভুল করল। আজ তাই বেঁচে থাকতেই ভয় হয়। ভয় হয়, আরও বেঁচে থাকলে পরের পর আরও কত ভুলভাল হতে থাকবে!
এ গাঁয়ে হরিশ বলে একজন লোক থাকত। এখন সে আর এখানে থাকে না। তারই লতায়-পাতায় ভাই হল ওই নিমাই। হরিশের সঙ্গে তখন খুব দহরম মহরম চলছে বিষ্ণুপদর। এক একটা সময় আসে যখন এক একটা লোক এসে যেন ভর করে। তখন হরিশ যা বলে তাই ছিল বিষ্ণুপদর কাছে বেদবাক্য। হরিশই একদিন সম্বন্ধ আনল। বলল, পাত্র জজ ম্যাজিস্ট্রেট নয়, তবে এমন চরিত্রের ছেলে পাবেন না। সংসারটাও ছোটো। শুধু, বুড়োবুড়ি। হরিশের কথায় অন্য সকলের মত খানিকটা অগ্রাহ্যই করেছিল বিষ্ণুপদ। পাত্রপক্ষ এক পয়সা পণ বা আর কিছু দাবি করেনি। পাত্রটিকে বিষ্ণুপদ দেখেছিল। লম্বা-চওড়া মিলিটারি নয়। কিন্তু ভারি কমনীয়, নরম-সরম মানুষ। বড্ড মিঠে কথাবার্তা। চোখের দৃষ্টিতে একটা দেবভাব ছিল। এখনও কি আছে? কে জানে।
বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ওরে, জামাই কি খারাপ ব্যবহার করে?
মুখটাকা বীণাপাণি মাথা নাড়ল, না। সে মুরোদ আছে নাকি?
কোন দিক দিয়ে খারাপ বল তো! পয়সা নেই তা তো জানি। সে তো আমারও নেই। তা বলে তোর মা আমার নামে বলে বেড়ায় না।
বীণাপাণি আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখ তুলল। একটু ঠাণ্ডা হয়েছে। ধরা গলায় বলল, ওরকম সৎ মানুষ হয় না। কিন্তু সেটাই কি সব বাবা? পুরুষের আর কিছু গুণ থাকতে নেই? বড্ড ভীতু আর মুখচোরা। সাহস করে কোনও কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে না। কিছু একটা ফলিয়ে তুলতে পারে না। সব সময়ে কেমন জলে-ডোবা ভাব। ওরকম মেনিমুখো মানুষের ঘর করতে গেলে একটু উল্টো রকমের না হলে চলে? বললা তো!
বিষ্ণুপদ অবাক হয়ে বলে, সৎ-এর উল্টো যে অসৎ! ভালর উল্টো যে খারাপ!
তাই বললাম বুঝি! আর কাকেই বা বলছি! তুমিও তো আর ভিন্ন রকমের নও!
বিষ্ণুপদ একটু হাসল, আমি নিমাইয়ের চেয়েও আর এক কাঠি সরেস রে।
হ্যাঁ বাবা, আমার একটা জিনিস গচ্ছিত রাখবে?
জিনিস! কী জিনিস রে?
একটা ছোট প্যাকেট।
দামী জিনিস নাকি?
দামীই। তবে কাউকে কিছু বলতে পারবে না। খুব লুকিয়ে রাখবে। তুমি জানবে, আর মা।
বিষ্ণুপদ আবার আতান্তরে পড়ে গিয়ে বলে, আমি গচ্ছিত রাখব কোথায় বল তো! বাক্স-প্যাঁটরা যা আছে সব খোলামেলা। তালাটালা নেই। চাবিও সব হারিয়ে গেছে।
রাখবে না?
রাখতে পারা যায়। তবে নিরাপদ হবে না। আমাদের তো সিন্দুক বা স্টিলের আলমারি নেই। তার ওপর বয়স হয়েছে। কবে চোখ বুজব আর সব ছেলেরা বউরা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নেবে। আমাদের কাছে রাখা ঠিক হবে না রে মা।
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু গচ্ছিত না রাখলেই যে নয়।
এমন কী জিনিস রে?
আছে বাবা। সব বলা যায় না।
কেন বলা যাবে না? চুরি তো আর করিসনি।
চুরি নয়। তবে জিনিসটার পিছনে অনেকে লেগেছে। রক্ষা করতে পারব না বোধহয়।
নিমাই জানে?
জানে বাবা। আর জেনেই তো বিপদ হল। এ মানুষটাকে নিয়ে চলা যে কী দায়!