এখন দুপুর। কিন্তু আকাশে সূর্য আছে কিনা চোখ তুললে বোঝা যাচ্ছে না। হাওয়া বইছে। তার দাঁতের ধার আরও তীব্র। পাহাড়ে পাহাড়ে বরফ যেন হামাগুড়ি দিয়ে নিচে নামছে। সুদীপ বাইরে বেরিয়ে এসে চুপচাপ বসেছিল। শিস বাজছে বাতাসে। গাছের মাথাগুলোর ঝুটি যেন নেড়ে দিয়ে যাচ্ছে। খোলা চোখে বসে থেকেও অবশ্য সুদীপ কিছুই দেখছিল না। অত্যন্ত ক্লান্ত লাগছে, মাথায় টিপটিপানি। শুধু ওই ক্লান্তির জন্যেই সম্ভবত ঘণ্টা তিনেক ঘুমিয়েছিল ও। এখন বুকের মধ্যে যে চাপ তাতে ঘুম কোন উপকার করেছিল বলে মনে হচ্ছে না। ধারেকাছে আনন্দ নেই। জয়িতাও।
সুদীপ চোখ বন্ধ করল। সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণের মুখটা ভেসে উঠল। কালিয়াপোকরি থেকে কল্যাণ ছুটে এসেছিল সান্দাকফু ছাড়িয়ে সেই পর্যন্ত যেখানে ছেলেটি ওর জন্যে অপেক্ষা করছিল। যে ছেলে প্রতিমুহূর্তে সন্দেহ প্রকাশ করত সাহস দেখানো যার স্বভাবে ছিল না, সে–! সুদীপ মাথা ঝাঁকাল। একমাত্র ওর সঙ্গে কল্যাণের লাগত। কল্যাণকে সে কি পছন্দ করত? কিন্তু এখন এমন লাগছে কেন? মৃত্যুভয় ওরই বেশি ছিল। সবসময় দুরকম মানসিকতায় দুলত কল্যাণ। শেষবেলায় একলা জিতে গেল। চোখ বন্ধ অবস্থায় সুদীপ কল্যাণের চলে যাওয়াটা দেখল। জয়িতার গালে আঙুল ছুঁইয়ে কেমন চট করে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছিল কল্যাণ।
আশ্চর্যের ব্যাপার জয়িতা কাঁদেনি। জয়িতাকে কাঁদতে দ্যাখেনি সুদীপ। কাল রাত্রে একসময় আনন্দ ড়ুকরে উঠেছিল। উঠেই চুপ করে গিয়েছিল। অন্ধকার ঘরে সেই শব্দটা সুদীপকে খুব শান্তি দিয়েছিল।
একটা মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলে কোন কিছুই আটকে থাকে না। কেউ একুশ বছর বয়সে পুলিশের গুলিতে মারা যায় কেউ সত্তরে রোগে মারা পড়ে। যদ্দিন প্রাণ তদ্দিন সব চোখের সামনে, যেই শরীরটা গেল অমনি অস্তিত্বের বিলোপ। কারও কারও স্মৃতি কিছু বছর, কয়েক বছর অথবা শতাব্দী মনে রাখে মানুষ। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষকে তিনমাসেই বিস্মরিত হয় মানুষ, যারা থেকে গেল। হেসে ফেলল সুদীপ। কেউ থাকে না। যাওয়ার জন্যে অপ্রস্তুত থাকে। মা এখন কোথায়? একটাই তো জীবন আর তার সময়টাও বড় অল্প অথচ মানুষ ভাবার সময় কয়েক শতাব্দী ধরে নিজেকে ছড়িয়ে ভাবে। কল্যাণ তবু যাওয়ার আগে কিছু ওষুধ পৌঁছে দিয়ে গেল। তার পরে যে মানুষগুলো যাবেই তাদের থাকার সময়টা যাতে একটু স্বস্তিতে কাটে তারই ব্যবস্থা করে গেল। এইটুকুই বা কজন করতে পারে! সাবাস কল্যাণ। এই প্রথম আমি তোর কাছে হারলাম। সুদীপ যেন নিজের অস্বস্তি ঢাকতেই উঠে দাঁড়াল। তারপর কনকনে জলে মুখ এবং হাত ভেজালো। এরমধ্যেই মুখের চামড়া ফেটেছে। চুলে আঠালো ভাব। হাতের দিকে তাকালে বোঝা যায় চর্মরোগ হতে বেশি দেরি নেই। কেমন ঘিনঘিনে ভাব চলে এল। সুদীপ ঠিক করল সে স্নান করবে। যতই ঠাণ্ডা হোক, সময় শরীরে জল ঢালবে। সে চলে এল আস্তানার ভিতরে। দুটো সাবান ছিল। অনেক হাতড়ে হাতড়ে তার একটাকে বের করল। দ্বিতীয় সেট জামা প্যান্ট বের করল সে। অনেক দিন এগুলো শরীরে সেটে রয়েছে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বিচ্ছিরি গন্ধ বের হচ্ছে। অভ্যেসে কি না করতে পারে মানুষ!
প্রথমে ভেবেছিল জল গরম করে নেবে! তার পরেই আর একটা জেদ বড় হল। কোন দরকার নেই, যতই ঠাণ্ডা হোক ঝরনার জলেই স্নান করবে সে। গরম জামা প্যান্ট আর সাবান তোয়ালে নিয়ে সুদীপ হেঁটে এল ঝরনার পাশে। এখানে এখন কোন মানুষ নেই। অদ্ভুত আদুরে ভঙ্গিতে জলেরা বয়ে যাচ্ছে। জলের শরীরে ছায়া জমলে তাকে ভীষণ গভীর দেখায়। একটু বেঁকে যেখানে জল গর্তের মধ্যে পড়েছে সেইখানে অর্কস্মাৎ উদোম হয়ে নেমে পড়ল সুদীপ। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীরে তীব্র কনকনানি, যেন হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত অসাড়। কাঁপুনি আসছিল বেদম, তবু মাথা ডোবাল সুদীপ। শরীর বড় বিচিত্র। সে শীতলতা থেকেও উত্তাপ আহরণ করতে জানে। ধীরে ধীরে আরাম পেল সে। সমস্ত শরীরে কালো দাগ জন্মেছে বিন্দু বিন্দু করে। সাবান ঘষে তৃপ্ত হল। তারপর হাত বাড়িয়ে ময়লা জামা প্যান্ট জলে টেনে এনে তাদের একটা সুরাহা করল। কিন্তু জল থেকে উঠতেই সমস্ত গায়ে কদম ফুটল, সুদীপের মনে হল সে মরে যাবে। তাড়াতাড়ি পরিষ্কার জামা প্যান্ট এবং গরম জামা প্যান্টে নিজেকে মুড়ে নিয়েও সে দাঁতের বাজনা থামাতে পারছে না। ঠাণ্ডা থেকে বাঁচতেই সে লাফাতে লাগল। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র উপকার হল না। এবং তখনই তার হাঁচি শুরু হল। নাক দিয়ে জল গড়িয়ে আসতেই সুদীপের খেয়াল হল তার নিউমোনিয়া হতে পারে। এই পাহাড়ে একবার ওই অসুখ করলে আর দেখতে হবে না। শুধু রোগে ভুগে মরে যাওয়া—সে দৌড়োত লাগল। আস্তানায় পৌঁছে সে চটপট কয়েকটা ট্যাবলেট পেটে চালান করে দিল। কিন্তু এই দৌড়াবার সুবাদেই শরীর থেকে শীতভাবটা দূর হয়ে গেল। হঠাৎ বেশ ঝরঝরে লাগল নিজেকে। ভেজা জামাপ্যান্টগুলো বারান্দায় ছড়িয়ে দিয়ে সুদীপ নেমে এল। অনেকদিন বাদে শরীর হালকা লাগছে। ঘুম থেকে ওঠার পর যে চিন্তাগুলো জেঁকে বসেছিল তারা এখন সরে দাঁড়িয়েছে। সুদীপ দুপকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে লাগল বড় বড় পা ফেলে।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল ওদের। শুধু ওরা নয়, গ্রামের বেশ কিছু মানুষ সঙ্গে রয়েছে। যারা ঠিক সঙ্গী হয়নি তারা দূর থেকে লক্ষ্য করছে। গাছের লম্বা লম্বা শক্ত ডাল কাটছে কেউ কেউ। অনেকটা জায়গা জুড়ে একটা চালাঘর তৈরি হচ্ছে। খুঁটিগুলো গোল করে পুঁতে মাটি থেকে হাত তিনেক উঁচুতে সেই ডাল বিছিয়ে মাচা তৈরি করে তার ওপর ছাউনি ফেলা হবে। সুদীপ কাছে পৌঁছাবার আগে জয়িতা দুটি মেয়ের সঙ্গে অন্যদিকে চলে গেল। সে কাছে পৌঁছতে আনন্দ বলল, তুই একবার চেক করবি?
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি?
যাদের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল তাদের কি কি রি-অ্যাকশন হচ্ছে। অবশ্য খারাপ কিছু হলেও আমাদের হাত বন্ধ। ভাল হচ্ছে কিনা তাই দ্যাখ। তারপর গলা পালটে জিজ্ঞাসা করল, সে কি রে, তুই স্নান করেছিস মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
দেখিস অসুখ বাঁধিয়ে না বসিস। আমি রোলেন আর জনা ছয়েক লোককে জোর করে পাঠালাম চ্যাঙথাপুতে চাল ডাল কিনে আনতে। পুরো স্টকটা এখানে থাকবে।
ওরা যেতে চাইল?
পালদেম না রাজী করালে যেত না।
জয়িতা কোথায় গেল?
ও মেয়েদের সঙ্গে বসছে। ইটস ভেরি ডিফিকাল্ট টু মেক দেম আন্ডারস্ট্যান্ড। কথা শেষ করে আনন্দ অন্যদের সঙ্গে আবার হাত লাগাল। সুদীপ কয়েক মুহূর্ত ওদের দিকে তাকাল। এখন এই কাজের সময়ে আনন্দর মনে নিশ্চয়ই কল্যাণের কোন অস্তিত্ব নেই। সে শুধু সময়গুলো নষ্ট করেছে গুমরে থেকে। সন্ধ্যে হয়ে গেলে আর কেইবা দিনের জনন্য হা-হুতাশ করে। কাছে দাঁড়ানো একটি বৃদ্ধকে সে কোনমতে বোঝতে পারল কি করতে চায়। বৃদ্ধটি সোৎসাহে তাকে নিয়ে গেল প্রথম বাড়িটায়। কোন গৃহপালিত পশু নেই, দরজা হাট করে খোলা। বৃদ্ধটির চেঁচামেচিতে যে বৃদ্ধা সমস্ত শরীরে ছেড়া কাপড় জড়িয়ে বেরিয়ে এল কাঁপতে কাপতে, তার চোখে ইতিমধ্যে ছায়া নেমেছে। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?
মাথা ঝাঁকাল বৃদ্ধা। বিড় বিড় করে কিছু বলল। বৃদ্ধ এগিয়ে গিয়ে তার মুখের কাছে কান রাখল। তারপর ফিরে বলল, ওর খুব খিদে পাচ্ছে বলছে।
খায়নি কেন? প্রশ্নটা করামাত্র সুদীপের খেয়াল হল সে নিজেও আজ কিছু খায়নি।
বৃদ্ধ বলল, জঙ্গলে যেতে পারিনি। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।
সুদীপের মনে হল সঙ্গে কাগজ কলম আনা দরকার ছিল। প্রত্যেকের বৃত্তান্ত আলাদা করে তার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। ঘরে ঘরে ঘুরতে ঘুরতে ওর মনে হল এখানেও তিনটে শ্রেণী রয়েছে। একদল সারাবছর মোটামুটি খেতে পায়। তাদের চাষের জমিতে যে ফসল ফলে তাতে কুলিয়ে যায়। এদের গৃহপালিত পশুপাখির সংখ্যাও কম নয়। খচ্চরওয়ালার কাছ থেকে জিনিসপত্র কিনে নেয় এরা। দ্বিতীয় শ্রেণী থাকে প্রায় আধপেটা খেয়ে। সারা দিনে শুধু সন্ধ্যেবেলায় এদের খাওয়া। আর একদল যাদের সংখ্যাই বেশি, বছরের বেশির ভাগ সময় তারা নির্ভর করে থাকে আশেপাশের জঙ্গলের ওপর। সেই জঙ্গলে এক ধরনের উদ্ভিদ এদের প্রাণধারণে সাহায্য করে। শাকপাতা ছাড়া শেকড়ও এদের কাছে উপাদেয় খাদ্য। এই শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই চর্মরোগের প্রাবল্য বেশি। এদের দিকে তাকালেই বোঝা যায় অপুষ্টি কাকে বলে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার, এই মানুষগুলোই সবচেয়ে বেশি কুঁড়ে এবং ঝিমোতে ভালবাসে। যে মানুষগুলোকে ওষুধ দেওয়া হয়েছিল তাদের সত্তরভাগই এখন ভাল আছে অথবা অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এদের কাছে গিয়ে আপ্লুত হল সুদীপ। দুহাত ধরে মানুষগুলো কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। একটি পরিবার পোড়া রুটি এবং শাকসেদ্ধ না খাইয়ে ছাড়বে না। এখন আর সুদীপের বমি পায় না। সে পা মুড়ে বসে খাবারটা খেল। এই পরিবারে প্রেীঢ় প্রৌঢ়া এবং একটি রোগগ্রস্ত সন্তান। তাকেই ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গী বৃদ্ধ জানাল এই প্রৌঢ়ের হাতে যে মদ তৈরি হয় তেমন গ্রামের আর কেউ তৈরি করতে পারে না। প্রৌঢ় যেন লজ্জিত হল। দুহাত নেড়ে প্রতিবাদ করল, না না, কথাটা ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, আমার বাবার হাত ছিল খুব ভাল। তার মদ ঠাণ্ডা হলে যে গন্ধ ছড়াত তাতে মৌমাছিও ছুটে আসত। আমি তার কিছুই নিতে পারিনি। আমার বাবার ছেলে হিসেবে ছেলেবেলায় কোনদিন অসুখে ভুগিনি আর আমার ছেলেকে দ্যাখো! কিন্তু ওষুধ পেটে পড়ার পর ছেলেটার উপকার হয়েছে। জীবনে ওষুধ বস্তুটির সঙ্গে পরিচয় ছিল না ওর। পাতার রস বা শেকড়বাটা খেয়ে এসেছে এতদিন। প্রৌঢ় বলল, তা সবাই যখন বলছে তখন আপনি আমার হাতের সেবা গ্রহণ করুন। মাচার তলা থেকে প্রৌঢ় একটা মোটা বাঁশের চোঙা টেনে নিয়ে এল। এ তল্লাটে বাঁশগাছ চোখে পড়েছে কিনা মনে করতে পারছিল না সুদীপ। কিন্তু চোঙাটাকে যেভাবে কেটেকুটে ঠিকঠাক করা হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে এর পেছনে অনেক যত্ন রয়েছে। মদ ঢালা হল ছোট ছোট আরও কয়েকটা চোঙায়। সেগুলোকে বিয়ারের জাগের মত দেখতে। বৃদ্ধ বোধ হয় এরই আশায় ছিল এতক্ষণ, এবার পুলকিত হল। রুটি তরকারি খাওয়ার পর সুদীপের পেট ঠাণ্ডা হয়েছিল। সেদিন মদ খাওয়া নিয়ে বন্ধুরা তেমন কিছু বলেনি কিন্তু আনন্দ বা জয়িতা যে খুশি হয়নি তা বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু এই ঘরে বসে ওদের অপমান করা অন্যায় হবে। পানীয়টি রঙিন কিন্তু বড় তরল। সুদীপ চোঙাটি ধরল। তীব্র গন্ধ বের হচ্ছে। কলকাতার ছেলেরা ঘাটশিলায় বেড়াতে গেলে মহুয়া খায় শখে, তার চেয়ে বেশি কি হবে? গন্ধটার মধ্যেই অবশ্য ঝিমঝিমে ভাব আছে। সে সতর্ক হয়ে চুমুক দিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল জিভ প্রায় অসাড় এবং কণ্ঠনালীতে সূর্য গড়িয়ে গড়িয়ে নামছে। সে চোখ বন্ধ করল। বুক থেকে নামমাত্র সমস্ত শরীর অসাড়। প্রৌঢ় বলল, আস্তে আস্তে খেতে হয় এই জিনিস। এই গ্রাম কেন, আশেপাশের কেউই এই জিনিস তৈরি করতে জানে না। অবশ্য বিলিতি মদের কাছে এটা কিছু নয়!
সুদীপ মাথা নাড়ল। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে মনে হল জিভটা কেমন হয়ে যাচ্ছে। বিলিতি মদের তুলনায় এ জিনিস হাজারগুণ জোরালো তাই বোঝবার জন্যে সে সময় নিল। মিনিট পাঁচেক পরে ধীরে ধীরে সাড় ফিরে আসতে লাগল। সুদীপ ঠিক করল আর খাবে না। কিন্তু পানীয়টির জোরালো গন্ধ তাকে এমন টানছিল যে দ্বিতীয়বার চুমুক না দিয়ে পারল না। এবার সাড় ফিরে আসতে আরও কম সময় লাগল। ক্রমশ তার মনে হতে লাগল একটার পর একটা ঢেউ যেন শরীরে পুরে পুরে নিচ্ছে। আর ঢেউগুলো পা থেকে এখন গলা পর্যন্ত খেলে যাচ্ছে। তার মাথাটা পরিষ্কার আছে কিন্তু আত এক সুখানুভূতি সমস্ত বোধকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বৃদ্ধ সেখানেই শুয়ে পড়েছে। যেন হঠাৎ-পাওয়া সুযোগ হাতছাড়া না করার জন্যে সে খুব দ্রুত খাচ্ছিল। প্রৌঢ় তার দিকে তাকিয়ে বললে, শরীর খুব খারাপ লাগছে না তো?
সুদীপ বলল, না। শব্দটা তার ঠোঁট থেকে বেরিয়ে কানে পৌঁছাল না।
প্রৌঢ় বলল, এখন শুধু মাথা ঘাড়ের ওপর সোজা করে রাখুন, ব্যস। দেখবেন, পৃথিবীটা আপনার হুকুমে চলবে।
সুদীপ বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। পা টলছে। চোখের সামনে সব কিছুই আঁকাবাঁকা। একেই কি মাতাল হওয়া বলে? দুর! মাতাল হলে সে এসব টের পাচ্ছে কি করে? তার মাথা তো পরিষ্কার আছে। সে কথাটা মনে পড়তেই যতটা সম্ভব আকাশের দিকে মাথা রাখল। সে টিপসি হয়েছে। নেহাতই টিপসি। হাসল সুদীপ। তবে এই অবস্থায় আনন্দর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। সে ছোট ছোট পায়ে হাঁটতে লাগল। এবং তখনই তার মনে হল এখন সবে ভোর হচ্ছে। আকাশের গায়ে অন্ধকার সেঁটে আছে এখনও। কয়েক মুহূর্ত বাদেই ভুল ভাঙল। সে এসেছিল দিনের বেলায়। তাহলে এখন ভোর হবে কি করে? নিশ্চয়ই দিনটা ফুরিয়ে গেছে, সন্ধ্যে হচ্ছে। কিন্তু আনন্দ রাগ করবে কেন? সে তার কাজ ঠিকমত করেছে। কাজের শেষে যদি একটু ফুর্তি করা হয় তাহলে অন্যায় হবে কেন? চিন্তাটা মাথায় আসামাত্র মিলিয়ে গেল। কি ব্যাপার? কোন কিছুই বেশিক্ষণ মাথায় আটক থাকছে না কেন? সুদীপ চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে চাইল তার নিজের কোন দুঃখ আছে কিনা। সেরকম কিছু মনে পড়া দূরে থাক, কোন কষ্টদায়ক ঘটনার কথাই মনে পড়ল না। সমস্ত শরীরে শুধু ভাললাগা অনুভূতি ঢেউ হয়ে দুলছে। এইসময় পেছন থেকে একটা চিৎকার শুনে অনেক কষ্টে সে আকাশের দিকে মাথা রেখে পেছন ফিরল। একটা লোক ভেঙেচুরে তার কাছে আসছে এগিয়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল লোকটা মারামারি করতে আসছে। কাছাকাছি হতে সে বৃদ্ধকে চিনতে পারল। এখন বৃদ্ধ কিছুতেই সোজা হতে পারছে না। দুহাত বাড়িয়ে যেন সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে আসছে।
সুদীপ হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধকে ধরল। একটা অবলম্বন পেয়ে বৃদ্ধ যেন কৃতার্থ হয়ে অনেক কষ্টে শরীর সোজা করল। তারপর হঠাই কাঁদতে লাগল। সুদীপ বেদম ঘাবড়ে গেল। সে বৃদ্ধকে কেবলই জিজ্ঞাসা করতে লাগল কাদবার কারণ কি? কিন্তু তার কথাগুলো যে বেকেরে যাচ্ছে তা টের পাচ্ছিল সে। শেষ পর্যন্ত বৃদ্ধ প্রশ্নটার উত্তর প্রশ্নের মাধ্যমে জানাল, তুই কবে মরে যাবি?
সুদীপ বলল, ও, এই ব্যাপার! সে এবার মনে করতে চেষ্টা করল কবে মরে যাবে। তারপর ভেবে টেবে না পেয়ে জানাল, সে মরবে না।
বৃদ্ধ বারংবার মাথা নাড়তে লাগল তাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে, না। তুই, তোরা মরে যাবি। মরে যাবি বলেই তোরা স্বর্গ থেকে আমাদের গ্রামে এসেছিস। তোরা মানুষ না। তোরা ভগবানের ছেলেমেয়ে, আমাদের বাঁচাতে এসেছিস!
সুদীপ মাথা নাড়ল, দূর! বাজে কথা। তবে আমি মরব না।
মরবি। আমাদের উপকার করতে এসেছিস বলেই মরে যাবি। বৃদ্ধ আবার কান্না শুরু করল, তোদের একজন যেমন আমাদের বাঁচাতে গিয়ে নিজে মরে গেল।
কথাটা মাথায় ঢুকতে সময় লাগল। সঙ্গে সঙ্গে সুদীপের শরীরে একটা সিরসিরানি জন্ম নিল। কল্যাণটা মরে গেছে। পুলিশ ওকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। কল্যাণ যদি মরতে পারে তাহলে সে মরবে না কেন? কিন্তু সুদীপ হঠাৎ বেশ জোরে সরিয়ে দিল বৃদ্ধকে। পড়ে যেতে যেতে বৃদ্ধ কোনরকমে বসে পড়তে পারল। সুদীপ আর দাঁড়াল না। অন্ধকার নেমে আসা গ্রামের পথে বৃদ্ধ তখনও কেঁদে চলেছে। পথটা যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। সামনে আশেপাশে অনেক মানুষ কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে। বুকের মধ্যে একটা কষ্টবোধ কিন্তু ঠিক কি কারণে কষ্টটা এল তা সুদীপের এখন খেয়ালে নেই। হঠাৎ তার কানে চিৎকার চেঁচামেচি পৌঁছাল। দুজন যেন ক্ষিপ্ত হয়ে ঝগড়া করছে। সুদীপ মুখ তুলে চারপাশে তাকাল। তারপর আওয়াজটা যেদিক থেকে ভেসে আসছিল সেদিকে চলল। কয়েকজন মানুষ চুপচাপ ঝগড়া দেখছিল। তারা সুদীপকে দেখামাত্র বেশ সখ্রমে সরে দাঁড়াল। নিজের ওপর কোনরকম নিয়ন্ত্রণক্ষমতা নেই, সুদীপ টলতে টলতে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হেলেটা হটে এল। ইনিয়ে বিনিয়ে অনর্গল কিছু বলে যাচ্ছে সে। সঙ্গে সঙ্গে মহিলাটি এসে দাঁড়াল সামনে। সে যে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ তা বোঝা যানিল। সুদীপ একটু একটু করে চিনতে পারল ওদের। এই অসমবয়সী স্বামী-স্ত্রটির কন্যাবিয়োগ হয়েছে কদিন আগে। হঠাৎ এক ধরনের অপরাধ বোধ চেপে বসল তাকে। সে যদি মেয়েটার উপকার করতে না যেত–। তার মনে হল এদের ঝগড়া থামিয়ে দেওয়া তার কর্তব্য। একটা হাত উপরে তুলে সে কোনরকমে বলতে পারল, চুপ চুপ। কেউ কথা বলবে না, আমি ঝগড়া থামিয়ে দেব।
ছেলেটা বলল, আমি কিছুতেই এই ঘরে ওর সঙ্গে থাকব না। কিছুতেই না।
মহিলা বলল, কত বড় অপাদা! এইটুকু থেকে বুকে পিঠে করে মানুষ করেছি আর তোমরা সবাই দ্যাখো, মুখে মুখে তর্ক করছে। আমি কানের কাছে যাব।
সুদীপ বলল, অ্যাই চোপ। আমি যখন বিচার করছি তখন তুমি ওকে বকবে না।
আশেপাশে দাঁড়ানো মানুষদের কেউ কেউ বলল, আহা, চুপ করো না, একটু শুনতে দাও।
সুদীপ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ ঠিক। আমরা কেউ শুনি না, সবাই শুধু বলে যাই। তারপর ছেলেটার দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করল, প্রব্লেমটা কি? ছেলেটা কিছুই বুঝতে পারল না দেখে সে বিরক্ত হল। বিড় বিড় করে বলল, এর চান্স গেল। সে মহিলাকে জিজ্ঞাসা করল, ওকে বকছ কেন?
মহিলাটি উত্তর দিল, কেন বকব না। আমি ওর স্ত্রী, কাহুন আমাদের বিয়ে দিয়েছে। অথচ মেয়েটা মরে যাওয়ার পর থেকে ও আমার সঙ্গে একঘরে থাকতে চাইছে না। ও বলুক আমার অপরাধটা কি? আমি কি ওকে রেধে খাওয়াই না? আমি কি চাষ করি না? আমি কি গুভ্রকে রেখে দিইনি বরফের জন্যে?
সুদীপ জিজ্ঞাসা করল ছেলেটিকে, ও যা বলছে তা সত্যি?
ছেলেটি মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
সুদীপ এবার হাসল, তাহলে বাবা তোমার অন্যায় হয়েছে। বিচার শেষ, যে তোমার সেবা করবে তার কথা তোমাকে শুনতে হবে। কি, আমি ঠিক বললাম কিনা?
একজন লোক বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন তবে ওর কথাটাও অন্যায্য নয়।
কি কথা? এই, তোমার কি কথা আছে? সুদীপ বিরক্ত হল।
ছেলেটা উত্তর দিল না। লোকটা বলল, ও বলছে বউ-এর সঙ্গে এখন শুতে পারবে না। শুলে ওর শরীর খারাপ হয়ে যায়। সারাদিন ঘুম পায় দুর্বল লাগে। আর ভাল করে শুতে পারে না বলে ওর বউ নাকি ওকে খুব গালাগালি দেয়। এইটে অবশ্য খুব ন্যায্য কথা।
সুদীপের মাথায় সমস্যাটা ঢুকল না। সে ছেলেটার দিকে তাকাল। ছেলেটা বলল, আমি তো বলেছি বড় হয়ে গেলে শোব।
সঙ্গে সঙ্গে মহিলা চাপা গলায় শব্দ করল, ইশ! উনি বড় হতে হতে আমি বুড়ি হয়ে যাব না? তার বেলায়? আসলে এ ছোড়ার অন্য বাচ্চা মেয়ের ওপর নজর আছে। তোমরাই বল, এতদিন আমি কিছু জোর করিনি। কিন্তু স্ত্রী হিসেবে স্বামীর কাছে আমি চাইতেই পারি, পারি না? অনেকেই মাথা নাড়ল।
এই সময় একটা লোক এসে ঘোষণা করল, কাহন বলেছে ছেলেটাকে তার বউ-এর সঙ্গেই শুতে হবে। তবে যদি এতে তার আপত্তি থাকে তাহলে পালার কাছে দুজনে যেতে পারে। পালা যা বলবে তাই করতে হবে।
এই গ্রামে একজন পালা আছে। কিন্তু তার ভূমিকা খুব জোরালো নয়। পালার ওপর দায়িত্ব গ্রামের মানুষের দেখাশোনা করার। অনেকটা মোড়লের আদল। পালদেম হল সম্পর্কে বর্তমান পালার ভাইপো। এই গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষটি পালা হলেও এখন চোখে কম দ্যাখে, কানে কম শোনে। কাহুনের উপদেশ কানে যাওয়ামাত্র অত্যন্ত অপমানিত বোধ করল সুদীপ। এক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হল ওই কথাগুলো তাকে ছোট করতে বলা। সে দুহাত ছড়িয়ে বলল, ও! আমি তাহলে তোমাদের মধ্যে নেই। যা ইচ্ছে করো।
দু-তিনজন তাকে বোঝাতে গেল কিন্তু সেসব কথা কানেই তুলল না সুদীপ। তার পা থেকে বুক পর্যন্ত অনেকগুলো ঢেউ পরপর দুলছিল, এখন তারা ছিটকে উঠছে ওপরে। যেন ফেনা ছুঁড়ে দিচ্ছে মস্তিষ্কে। দ্রুত অনেকটা একা চলে এসে সে মুখথুবড়ে পড়ল অন্ধকারে। পড়ে চুপচাপ শুয়ে রইল।
ঠিক সেই সময় আনন্দ এবং জয়িতা পালদেমের সঙ্গে কথা বলছিল। এই গ্রামের যা চাষযোগ্য জমি তা রয়েছে বিভিন্ন পরিবারের দখলে। এ ব্যাপারে মালিকানার কোন কাগজপত্র নেই, কাউকেই খাজনা দিতে হয় না। কয়েক পুরুষ ধরে সবাই জেনে এসেছে কোন্টা কার জমি। অভাবের তাড়নায় কোন কোন পরিবার নিজস্ব জমির কিছুটা আর একজনকে বিক্রি করেছে কখনও। না হলে এখন কারও জমি বেশি কারও কম হবে কি করে। ইয়াক আছে একমাত্র কানের দখলে। মুশকিল হল ইয়াকদের বংশ লোপ পেতে চলেছে। পরপর পাঁচটি ইয়াকসন্তান পুরুষ হয়েছে। মকাই, কোদো, ডুং ডুং, শুক ছাড়া এক ধরনের আতপ চালের চাষ হয় যা থেকে চমৎকার শেলটি তৈরি করে নেয় ওরা। এই আতপের ফলন নির্ভর করে বর্ষার ওপর। এ বছর বীজধান যা ছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছে কিন্তু বৃষ্টির পরিমাণ খারাপ না হওয়া সত্ত্বেও মাটি থেকে গাছগুলো যেন মাথাচাড়া দিতেই চায়নি। না, কোনরকম সারের ব্যবহার এই গ্রামের মানুষ জানে না। যে জমি ফসল কমিয়ে দেয় সেই জমির ওপর ঈশ্বরের দয়া নেই মনে করে একটা চাষ বন্ধ রাখে।
পালদেম বলল, তোমরা যা বলছ তা তাপল্যাঙের সবাই মানবে বলে মনে হয় না। অন্তত যারা সারাবছর মোটামুটি খেতে পারে তারা কেন অন্যের সঙ্গে নিজেরটা ভাগ করবে?
আনন্দ বলল, আমরা তাদের বুঝিয়ে বলব এ থেকে তারা কি উপকার পাবে। আচ্ছা, আমাদের এখানে কি তেমন কোন মানুষ আছেন যিনি প্রতিবাদ করতে পারেন?
নতুন তৈরি তিনটে মাচার একটায় ওরা বসেছিল। মাটির তিন হাত ওপরে কাঠ বিছিয়ে সমান্তরাল মেঝে করে নেওয়া হয়েছে। মাথার ওপরেও ছাউনি, চারপাশের দেওয়ালগুলো এখনও ছিদ্রহীন হয়নি। রাতের বাতাস হু হু করে ঢুকে মাঝখানে জ্বেলে রাখা মশালের আগুন কাঁপিয়ে যাচ্ছে সমানে। বৃদ্ধ পালা এখানে এসে দুহাত চোখের ওপর আড়াল করে দেখে টেখে বলেছিল, ছেলেবেলায় আমাদের সুদকেরঘর এরকম ছিল। তবে আরও ছোট। শুধু যার বাচ্চা হত সে আর বাচ্চার মাইলিআমা যেতে পারত সে ঘরে। তারপর আলোচনা শুরু হতেই সেই যে পালা দুচোখ বন্ধ করে ঝিমোতে লাগল এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আনন্দর প্রশ্নটা শোনার পর কয়েকজনের মুখে অস্বস্তি দেখা গেল। পালদেমের ভেনা বসেছিল খানিকটা তফাতে। লোকটাকে দেখলেই মনে হয় সবসময় কোন মতলব ভাঁজছে। পালদেম তাকেই জিজ্ঞাসা করল, ভেনা, তুমিই কিছু বল। তোমার জমির ফসল অন্য লোককে খেতে দেবে?
কেন দেব? সঙ্গে সঙ্গে লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, আমার বাপ ঠাকুর্দা আমার জন্যে জমি রেখে গেছে আর আমি পাঁচ ভূতে সেটা বিলিয়ে দেব? তোমার বহিনীকে জিজ্ঞাসা করো সে রাজি কিনা! এই সাথীরা হয়তো লোক খারাপ নয়। কিন্তু আমার তাউজি, জাহান, আমা কিছুতেই রাজি হবে না।
জয়িতা চুপচাপ শুনছিল। এবার জিজ্ঞাসা করল, পালদেমের বহিনীকে তুমি বিয়ে করেছ?
লোকটা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। আমি ওর ভেনা।
তাহলে তোমার বউয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মেয়েটা খুব ভাল।
যে কেউ তার ইচ্ছেমত ভাল হতে পারে তাতে আমার কথার কোন হেরফের হবে না।
আনন্দ বলল, ঠিক আছে, প্রথমে দেখা যাক গ্রামের কটা পরিবার নিজের মত থাকতে চায়?
ভেনা জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মতলবটা কি? গ্রামের লোকগুলোকে নিয়ে কি করতে চাও?
পালদেম জবাব দিল, ভেনা, এইভাবে কথা বল না। ওরা চাইছে এই গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ যেন না-খেয়ে না থাকে। তাই দশটা পরিবার এক জায়গায় এই রকম এক একটা ঘরে ওঠা বসা করবে। তাদের খাওয়াদাওয়া একসঙ্গে হবে। সেই দশটা পরিবার যাতে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে পারে তার জন্যে সবাইকে পরিশ্রম করতে হবে। আমাদের নতুন সাথীরা বুদ্ধি দেবে, আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করবে যাতে সবাই সুখে থাকে।
ভেনা জিজ্ঞাসা করল, তাতে সাথীদের কি লাভ? ওরা কেন এসব করবে?
প্রশ্নটা শোনামাত্র সবাই মুখ-চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। এবং একসময় সব জোড়া চোখ এসে পড়ল আনন্দ আর জয়িতার ওপরে। জয়িতা হাসল, ভেনা, মানুষ কি সবসময় নিজের লাভের জন্যেই সব কাজ করে? আমা তার বাচ্চাকে বড় করে কোন্ লাভের জন্যে?
ভেনা ঠোঁট ওলটাল, যাতে সে বুড়ি হলে খাবার পায় তাই।
ও। বুড়ো বাউকে যে তোমরা যত্ন করো কিসের আশায়! সে তো তোমাদের জমি দিয়ে এখন ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। কি লাভ তোমাদের তাকে সেবা করে?
এটা একটা কথা হল? বাউ হল আমার আত্মীয়।
ঠিক। আমরা যদি মনে করি পৃথিবীর কষ্ট পাওয়া নিঃস্ব মানুষরা আমাদের আত্মীয় তাহলে তাদের জন্যে যখন কিছু করব তখন মনে হবে নিজের জন্যেই করছি। জয়িতা হাসল।
হঠাৎ হাসি উঠল। যে হাসছে সে হেসেই থেমে গেল। সবাই মুখ ঘুরিয়ে দেখল লা-ছিরিঙ গম্ভীর হবার চেষ্টা করছে। পালদেম জিজ্ঞাসা করল, হঠাৎ হাসির কি হল লা-ছিরিঙ?
হাসির কথা হলে হাসব না? লা-ছিরিঙ শান্ত গলায় বলল, মাঝে মাঝে এইরকম কথা না বললেই নয় যা আমরা বুঝতে পারি না? পৃথিবীর কষ্ট পাওয়া নিঃস্ব মানুষ! ধৎ! তারা কারা? কোথায় থাকে? যাদের আমরা দেখিনি তাদের গল্প শুনে কি শিক্ষা হবে? তার চেয়ে আমাদের কথা বল। আমরা খেতে পাই না, পরতে পাই না। আমাদের কষ্টটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়।
অনেকেই মাথা নাড়ল, ঠিক ঠিক, লা-ছিরিঙ ঠিক বলছে।
পালদেম লা-ছিরিঙকে চোখের কোণায় দেখল। না খেতে পেলেও স্বাস্থ্য ভাল। একটু বেশি কথা বলে। এর আগে দুবার ওর সঙ্গে পালদেমের লেগেছিল। তরুণদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ছোকরা। কিন্তু এই মুহূর্তে ছোকরা মিথ্যে বলেনি কিছু। জয়িতা বলল, তুমি পুরো ঠিক বলেনি। তোমার কষ্ট দূর হতে পারে যখন তুমি জানবে তোমার মত কষ্ট পাওয়া মানুষ কি করে তাদের সুখের সন্ধান পেয়েছে। সেটা জানলেই পথটা তোমার সামনে খুলে যাবে।
আনন্দ বাধা দিল, এই প্রসঙ্গ পরে আলোচনার জন্য থাক। ভেনা, আমাদে কোন লাভের উদ্দেশ্য নেই। ভারতবর্ষের পুলিশ আমাদের খুঁজছে। সে-দেশে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে কোটি কোটি মানুষকে শোষণ করছে। অনেকে অনেক রকম ভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চেয়েছে কিন্তু নিজেদের দুর্বলতার জন্যেই সফল হয়নি। আমরা দেশের মানুষকে নাড়া দিতে চেয়েছিলাম বলে পুলিশ আমাদের খুঁজছে।
হঠাৎ আনন্দকে থামিয়ে দিয়ে লা-ছিরিঙ বলে উঠল, লোকগুলো যখন অল্প তখন তাদের খুন করে সমস্যাটা মিটিয়ে নিলেই হয়।
জয়িতা চট করে ছেলেটির দিকে তাকাল। আনন্দ বলল, তাদের শক্তি অনেক। আমরা সেই চেষ্টাই করেছিলাম। তবে যারা আসল শক্তিমান তাদের ছুঁতে পারিনি। এখন বুঝেছি এই রকম দু-তিনটে খুন করে সমসার সমাধান হবে না। যদি অভাবী মানুষেরা নিজেদের অভাব দূর করতে একসঙ্গে এগিয়ে না আসে তাহলে এদের খুন করেও কোন লাভ হবে না। যেকথা বলছিলাম, পুলিশ আমাদের ধরতে এখানেও আসতে পারে। আমরা তোমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিলাম। কিন্তু এসে দেখলাম, তোমাদের অবস্থা ভারতবর্ষের অনেক মানুষের মতই। কিন্তু এখানে সেই অর্থে কোন শোষক নেই। তোমাদের ক্ষতি করছে তোমাদেরই অজ্ঞতা। শিক্ষিতদের শত্রু অনৈক্য। সেটা তোমাদের মধ্যেও হয়তো আছে। আমরা চেয়েছি তোমাদের এই গ্রামটার চেহারা পালটে দেব যাতে কেউ কখনও অভুক্ত না থাকে, অজ্ঞতায় না মরে। আর এই দৃষ্টান্ত যদি আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এই পাহাড়ে একটা নতুন পৃথিবী গড়ে উঠবে। সেইটেই আমাদের লাভ ভেনা।
ভেনা মাথা নাড়ল, এসব ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না। তবে একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি, আমি আমার জমির ফসলের ভাগ কাউকে দেব না, ব্যস।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, আর কজন ভেনার মত একই চিন্তা করছ?
খানিকটা গুঞ্জন উঠল। শেষ পর্যন্ত এক এক করে জনা ছয়েক মানুষ ভেনাকে সমর্থন করল। অর্থাৎ সাতটি পরিবার একাই চলতে চায়। আনন্দ পালদেমকে বলল, গ্রামের সবাই তো এখানে আসেনি। প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করে মতামত নাও। যারা আমাদের সঙ্গে আসতে না চাইবে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। যদি কখনও তারা বুঝতে পারে যে এতে ক্ষতি হবে না তাহলে নিজেরাই আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। আমরা প্রত্যেক সন্ধ্যায় এইরকম আলোচনা করব। বরফ পড়ার আগেই অনেক কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।
নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে করতে সবাই যখন বেরিয়ে আসছে তখন পালদেম বলল, আমার ছেলে তো একদম ভাল হয়ে গেছে। তোমরা আমার ঘরে রুটি খাবে?
আনন্দ বলল, বাঁচালে। এখন আবার চালেডালে ফোঁটাতে হত।
জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, সুদীপ কোথায় রে?
আনন্দ উত্তর দিল, জানি না। দুপুরে ওকে বলেছিলাম যাদের ওযুধ দেওয়া হয়েছে তাদের চেক করতে। তারপর আর দেখা পাইনি।
জয়িতা বলল, তুই একবার আস্তানাটা ঘুরে আয়। বোধ হয় ওখানেই আছে। আমি আমার নতুন ঘর থেকে এখনই আসছি।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, তুই তাহলে ওখানেই পাকাপাকি থাকবি ঠিক করলি?
জয়িতা বলল, পাকাপাকি কিনা জানি না। তবে ওই মেয়েটার জন্যে আমার ওখানে থাকা দরকার।
পালদেমের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা দুজন দুদিকে হাঁটতে শুরু করল। জয়িতা গ্রামের মেয়েদের কথা ভাবছিল। সারাটা দিন ওদের সঙ্গে কাটিয়ে আহত নাড়া খেয়েছে সে। প্রায় প্রত্যেকেই নিজেকে পুরুষের সম্পত্তি বলে জাহির করতে ভালবাসে।
ঘরের দরজাটা বন্ধ। ঠেলতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল জয়িতা। ভেতর থেকে গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসছে। সেই সঙ্গে মেয়েটির গলা, এত খেয়েছ কেন? এত খেলে পুরুষমানুষের সব শক্তি দানো কেড়ে নেয়। আরে আরে, এই তুমি উঠছ কেন?