৪১. অচল দিন

অচল দিনকে প্রাণপণে ঠেলিতে হয়। সমস্ত উদগ্র শিরা-উপশিরা বিদ্রোহী, তবু বিশ্রাম কি শৈথিল্য দেওয়া চলে না। উত্রাইয়ের বাঁকে বোঝাও অনড় হইয়া সংগ্রামশীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে ব্যঙ্গ করে। উপত্যকায় তখন আবার ঝড় দেখা দিলে, অসহায়তা নৈরাশ্য মেঘ গর্জনের সঙ্গে বিকট প্রতিধ্বনি ধাক্কার বেগে ছুটিয়া আসে।

দরিয়াবিবি উত্রাইয়ের মুখে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। চারদিকে শ্বাপদসংকুল খাদ ভরা অরণ্যানী। পানি আর তৃষ্ণা মেটায় না, বাতাস আর শ্রান্তি হরণ করে না।

মা।

দরিয়াবিবি চাউলের কাঁকর বাছিতেছিল। উঠানের দিকে পিঠ। সুতরাং আগন্তুকের সংবাদ সে জানিতে পারে নাই। চকিতে চোখ ফিরাইয়া দরিয়াবিবি অবাক হইয়া গেল। মোনাদির আসিয়াছে। পিঠের উপর একটি বোঝা-সমস্ত শরীর ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। পথ-চলার ক্লান্তি পথিকের নিঃশ্বাসের দ্রুততায় ধরা পড়ে।

হঠাৎ এলি নাকি, বাবা?

গরমের ছুটি হতে এখনো তিন মাস বাকি। স্কুলে পরীক্ষা হচ্ছে, এক হপ্তা ছুটি। তাই চলে এলাম।

বেশ করেছ।

দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি নিজের হাতে মোনাদিরের জামা খুলিয়া ঘাম মুছিয়া দিল। হাঁকডাকে আমজাদ আসিয়া হাজির। সে একটা মোড়া আগাইয়া দিল।

দরিয়াবিবি বড় খুশি। তাড়াতাড়ি ভাত চাপাইয়া দিল। দুপুরের হাঁড়ি শূন্য। কিছুক্ষণ আগে তাহারা আহার সমাধান করিয়াছে। আমজাদ মাঝে মাঝে হাত-খরচের লোভে মুরগি-হাঁসের ডিম লুকাইয়া রাখে। সে একটি ডিম আনিয়া দিল।

দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আণ্ডা কোথা পেলি?

আমাদের লাল মুরগিটা যেখানে-সেখানে ডিম পাড়ে। কাল গোয়ালঘরের মাচাঙে। ছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।

পুত্রের আবিষ্কার-দক্ষতায় দরিয়াবিবি খুব উৎফুল্ল হয়। সে আলুভাজা আর ডাল করিতে চাহিয়াছিল। এখন ডিম পাওয়া গেল। আহারের মোলোকলা পূর্ণ।

মোনাদির পুকুরে গোসল করিয়া আসিল। অজানা পরিতৃপ্তি তার মনে। তাই ভাই বোনদের সঙ্গে নানা গল্প ছাড়িল। ঝোলা হইতে কয়েকটি মাটির পুতুল সে নঈমা ও শরীকে দিল। তাহাদের খুশির অন্ত নাই। একজোড়া ভালো লাটিম বাহির করিল মোনাদির আমজাদের জন্য। দুই ভাইয়ে কাল নদীর ধারে গাছতলায় খেলব, এই প্রস্তাবে আমজাদ লাফাইয়া উঠিল।

দরিয়াবিবির কাছে সমস্ত বৈকাল যেন সুরের মতো বাজিতে থাকে। ছেলেপুলেদের লইয়া সে বহুদিন এমন আনন্দ পায় নাই। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সে রাত্রির রান্নায় বসিল। আমিরন চাচির গাছ হইতে একটি লাউ চাহিতে গিয়াছিল আমজাদ। সে লাউয়ের সঙ্গে একটা মুরগিছানা দিয়াছে। কদু-গোস্তের তরকারী বাধিতে দরিয়াবিবি সমস্ত নৈপুণ্য ঢালিয়া দিল।

আহার শেষে দাওয়ায় অনেকক্ষণ গল্প-গুজব শুরু হইল। মোনাদিরের কাছে পরিবেশ আর অচেনা নয়। সে বেশ সহজ। দরিয়াবিবিও প্রাণ খুলিয়া ছেলেদের হল্লায় যোগ দিল।

পরদিন আমজাদ ও মোনাদির টো টো করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইল। চন্দ্র কোটালের ভিটায়, নদীর ধারে, মাঠে মাঠে, সড়কের আশপাশে ঝোপে-জঙ্গলে দুইজনের গতিবিধি। আমজাদ তো এমন স্বাধীনতাই প্রতিদিন কামনা করে। একা একা সে আবার বড় ভীরু ও লাজুক। শুধু মুনি ভাই সঙ্গে থাকিলেই সে সব কাটাইয়া উঠিতে পারে।

মার মেজাজ বড় হালকা আজকাল। আমজাদ তাই আরো খুশি।

মোনাদিরই প্রথম অনুজকে জিজ্ঞাসা করিল, আমু, মা বড় মোটা হয়ে যাচ্ছে।

হ্যাঁ। মুনি ভাই, আমার মনে হয় অসুখ!

না। মার শরীর আমার মতো কিনা।

তা ঠিক মুনি ভাই। বড় হলে তুমি চন্দ্র কাকার মতো জওয়ান হবে।

 তাই তো বেঁচে আছি। স্কুলের বোর্ডিংয়ে যা খাওয়ায়, এতদিন আমারও অসুখ করত।

ভ্রাতৃবিক্রমে আমজাদ গৌরবান্বিত। সে প্রস্তাব করিল, তুমি সাকের চাচার কাছে লাঠি খেলা শিখবে?

গ্রামে এসে থাকলে নিশ্চয় শিখব। আমি খুব ভালো লাঠিখেলা শিখতে পারব। মোনাদির হাতের পেশী দেখাইল।

নদীর ধারে এক জায়গায় দাঁড়াইয়া দুইজনের কথাবার্তা চলিতেছিল। চৈত্র মাস। তাই নদী শুষ্ক। দুই পাশে চলে খাগড়া বন। মাছরাঙার বাসা খুঁজিয়া অনেকক্ষণ দুইজনে কাটাইয়াছে। কোনো লাভ হয় নাই। একটি বড় চালতা গাছের গুঁড়ির উপর দুইজনে ঠেস দিয়া দূরে দূরে চাহিতেছিল। আকাশ একদম মেঘহীন। রৌদ্রের তরল ঝরণায় সমস্ত মাঠ ঝমঝম বাজিতেছে। নিঃসঙ্গ তালগাছ বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে প্রত্যঙ্গের থরথরানি মিশাইয়া দিয়াছে। গ্রাম্য দুই বালক কথার ফাঁকে ফাঁকে পৃথিবীর বিশালতা অনুভব করে।

শুধু ক্ষুধার তাড়না এই অবসর উপভোগে ছেদ টানিল। মোনাদির বাড়ি ফিরিয়া দেখিল ইয়াকুব আসিয়াছে। মা বলে নাই, তবে আমজাদ বলিয়াছে, এই লোকটি গত তিন-চার বৎসর তাহাদের বহু উপকার করিয়াছে। মোনাদির অচেনা লোকের সম্মুখে বড় লাজুক। শুধু সে আর নিজে কোনো আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারে না।

রাত্রে ছেলেরা আহারে বসিল। দরিয়াবিবি মিয়মাণ দাসীর মতো কর্তব্য সম্পাদন করিতে লাগিল। আমজাদ আসর জমাইতে চায়। কি একটা মুনি-সম্পর্কিত রসিকতা করিতে গিয়া সে ধমক খাইল। তখন আহারই একমাত্র তপস্যা হইয়া দাঁড়াইল সকলের পক্ষে।

দুইটি মাত্র কক্ষ। আমজাদ ও ইয়াকুব এক কামরায়, অন্য কামরায় মার কাছে নঈমা ও শরীর সহিত মোনাদিরের শয়ন ব্যবস্থা হইল।

আজ মার সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা হইল না। সারাদিন কত খাটে, এই ভাবিয়া মোনাদির ঘুমাইয়া পড়িল।

দরিয়াবিবি বিনিদ্র বহুক্ষণ পড়িয়া রহিল। গরমের দিন। তবু একটি কথায় তার হাঁটু পর্যন্ত চাপা। গরম, তার উপর দৈনন্দিন চিন্তার টানাপোড়েন। বাহিরে জানালা দিয়া দেখা যায় আকাশ ভরিয়া কত জ্যোৎস্না উঠিয়াছে।

ঘুম আসিতেছিল না। দরিয়াবিবি সকলকে ঘুমন্ত দেখিয়া ধীরে ধীরে উঁটি খুলিয়া উঠানে দাঁড়াইল। জানালার কাছে কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে জোছনা পড়িয়াছে মাটির উপর। দরিয়াবিবি আনমনা গিয়া দাঁড়াইল। আকাশে নিষ্প্রভ কয়েকটি তারা জ্বলিতেছে মাত্র। সমস্ত আকাশ তো গাছের তলা হইতে দেখা যায় না। দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া রহিল বেশ কিছুক্ষণ। সুপ্ত গ্রামের নীরবতা কৃচিৎ পাখির ডাকে, দূরাগত কুকুরের চিৎকারে চিড় খায় মাত্র।

হয়ত অনন্তকাল এমনভাবে দাঁড়াইয়া থাকিলে দরিয়াবিবি আনন্দিত হইত, কিন্তু হঠাৎ মানুষের ছায়া পড়িল জোছনায়। শিহরিয়া, তাড়াতাড়ি উঠানের দিকে যাইবে, সে দেখিল ইয়াকুব তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। সম্মোহিতের মতো দরিয়াবিবি নিজের জায়গায় স্থাণু।

কয়েক মুহূর্ত পরে সম্বিৎ ফিরিয়া আসিলে দরিয়াবিবি ফিসফিস কণ্ঠে বলিল, এখানে কেন?

কেন, তুমি জানো না, দরিয়া? ইয়াকুব তার হাত ধরিয়াছে ততক্ষণে।

হয়ত হাত টানাটানি শুরু হইত, জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া মোনাদির ডাকিল, মা, এত রাতে তুমি একা বাহিরে গেছ, আমাকে ডাকলে না কেন?

আসছি বাপ। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই আর জাগাইনি।

ইয়াকুব চোরের মতো আড়াল অন্ধকারে লীন হইতে গেল, কিন্তু তার লম্বা ছায়া জোছনার হাত এড়াইতে পারিল না।

দরিয়াবিবি কম্পিত বুকে তাড়াতাড়ি আসিয়া দরজা বন্ধ করিল। মোনাদির তখনো জানালায় দাঁড়াইয়া। মাকে, বলিল, মা চোরটোর হবে। একটা লোকের ছায়া পড়ল কাঁঠাল গাছের পাশে।

না। অন্ধকারে দরিয়াবিবি আবার বলিল, তুমি এসো, শুয়ে পড়।

যাই। মা, তুমি একলা এমন রাত্রে বেরিয়ো না।

কি আছে আমাদের, চোর আসবে?

মোনাদির কয়েক মিনিট জ্যোৎস্নার দিকে চাহিয়া নিজের বিছানায় ফিরিয়া আসিল।

সারাদিনের ক্লান্তি, উদ্বেগজনিত নিদ্রাহীনতা–ভোরের দিকে দরিয়াবিবির চোখে ভয়ানক ঘুম নামিয়াছিল। কাক ডাকা সকাল তার জীবনে প্রথম দেখে নাই।

আরো কতক্ষন ঘুমাইত কে জানে, হঠাৎ আমজাদ আসিয়া ডাক দিল, মা, মা।

খোঁয়ারি চোখে দরিয়াবিবি ধমক দিল, কি, এত ডাকছিস কেন?

মুনি ভাইয়ের কাপড়চোপড় কোথা?

বাঁশের আলনায় আছে।

কই নেই তো?

দরিয়াবিবি চোখ খুলিয়া চাহিল।

তোর ঘরে নেই?

না। ইয়াকুব চাচা সকালেই চলে গেছে।

দরিয়াবিবি কাঁথা জড়াইয়া উঠিয়া পড়িল। বারবার চোখ কচলাইল। মোনাদিরের ঝোলা, কাপড়চোপড় আলনায় নাই।

বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল দরিয়াবিবি। তার শরীর থরথর কাঁপিতেছে।

দিঘীর পাড়ে গিয়ে দেখ তুই, সেদিকে গেছে বোধহয়।

আমজাদ চলিয়া গেলে দরিয়াবিবি পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, মোনাদিরের বইপত্র নাই।

দরিয়াবিবি হয়ত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইত। কিন্তু মনে মনে বুকে জোর সঞ্চয় করে সে। না, মূৰ্ছা যাওয়া তার সাজে না।

তাল সামাল দেওয়ার জন্য ঝিম ধরা মাথা দুই হাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া দাওয়ার উপর দরিয়াবিবি বসিয়া পড়িল। একটু হাঁফ ফেলা দরকার শুধু।

.

৪২.

 চন্দ্রমণি এক রাত্রে রাজেন্দ্রের সঙ্গে গ্রাম ত্যাগ করিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল প্রায় একমাস আর গ্রামের ভিতর আসে নাই। আমজাদ নিজেই যাইত খোঁজ-খবর লইতে। চন্দ্র যেন আর এক রকম হইয়া গিয়াছে। তাড়ি সে খায়। কিন্তু নিঃশব্দে খায়। আর হল্লা করে না, গান করে না। চন্দ্রমণির ছেলে দুটি মামার কাছেই আছে।

দরিয়াবিবি এই সংবাদ শুনিয়াছিল হাসুবৌর মুখে, আমিরন চাচির মুখে। কিন্তু কোনো মন্তব্য করে নাই। বিপদে-আপদে কোটালের কাছে আমজাদকে পাঠানো বৃথা। যে যার মাথার ঘায়েই পাগল। এইজন্য দরিয়াবিবি কোটালের জন্য বড় দুঃখিত। আহা, এমন মানুষের কপাল বটে! কিন্তু উপায় কোথায়? দাদার গলগ্রহ জীবনের চেয়ে চন্দ্রমণি তার কারো আশ্রয়ে গিয়াছে। সংসারের কতটুকু ক্ষতি তাতে? হয়ত দরিয়াবিবির মনে এইসব কথা উঁকি দিয়াছিল।

দরিয়াবিবির একদিন সন্ধ্যায় কোটালের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমজাদ খুব রাজি না। কিন্তু আর যেন সেদিকে পা বাড়ানোর উৎসাহ নাই। খ্যাপা কোটালের সংসার দেখার ইচ্ছা কার না হয়? আজহারের মতো ধর্মান্ধ ধর্মভীরু লোকটি চন্দ্রকে চিনিয়াছিল। কিন্তু সে জীবিত থাকিতে দরিয়াবিবি এমন প্রস্তাব উত্থাপন করে নাই। আর যাওয়া হোলো না, দরিয়াবিবি সেদিন মনে মনেই উচ্চারণ করিল। গ্রাম্য জীবনে একজনের অপবাদ সমস্ত বাড়ির উপর ভর করিয়া থাকে।

এক মাস পরে আমজাদ মার কাছে আসিয়া জানাইল, মা, আজ মুনি ভাইয়ের টাকা ফেরত এল। এই নাও টাকা। আমজাদ পনেরোটি টাকা গণিয়া দিল।

টাকা ফেরত এল কেন?

পিয়ন বললে মুনিভাই সেখান থেকে চলে গেছে।

অস্ফুট কণ্ঠে দরিয়াবিবি একবার উচ্চারণ করিল, চলে গেছে! তারপর পুত্রের সহিত আর কোনো বাক্যালাপ করিল না। অবিচল মূর্তির মতো টাকা কয়টি হাতে দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল। দুশ্চারিণী জননীর দান সৎ সন্তান কেন গ্রহণ করিবে? মুনি–

আমজাদ হাসুবৌকে তখনই খবর দিয়া আসিয়াছিল। পিয়ন তাহাদের বাড়ির পাশেই দাঁড়ায়। হাসুবৌ আসিল। দরিয়াবিবির অশ্রুসজল মুখের দিকে চাহিয়া সে আর কোনো কথা বলিল না, নিঃশব্দে পাশে বসিয়া পড়িল।

দরিয়াবিবির মুখাবয়ব ক্রমশ থমথমে, গৌরসুডোল গণ্ডদেশ বহিয়া অশ্রু গড়াইতে লাগিল। হাসুবৌ আমজাদকে বলিল, বাবা, একটু পানি এনে দে।

আমজাদ বিলম্ব করিল না আদেশ-পালনে।

হাসুবৌ দরিয়াবিবির চোখের পানি মুছাইতে মুছাইতে বলিল, বুবু একটু বারফাট্টা ছেলে। আবার আসবে। বেটাছেলের জন্য এত চিন্তা কেন?

দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না। হাসুবৌ আবহাওয়া সহজ করিতে ছুঁতানাতা খোঁজে। বলিল, বুবু, সন্ধ্যা হয়, এখন কত কাজ তোমার, উঠে পড়।

উঠানে একপাল মুরগি-হাঁস কোলাহল তুলিয়াছিল। ইহাদের সান্ধ্য-ভোজন বাকি। হাসুবৌ আরো জিদ ধরিল, বুবু, তুমি না উঠলে আমি বাড়ি যেতে পারব না। তোমার ছেলে তোমারই আছে।

দরিয়াবিবির চোখে আর পানি নাই। কিন্তু বড় চিন্তান্বিত সে। হাঁটুর উপর থুত্রী রাখিয়া অবিচলতার নারী-প্রতীক রূপে বসিয়া রহিল।

ওঠো বুবু। হাসুবৌ হাত ধরিয়া বলিল, ওঠো। তোমার নিজের শরীরও ভালো নয়। কেমন ফোলা-দেখাচ্ছে। এমন করলে শরীর টেকে?

তুমি যাও। আমি উঠছি। দরিয়াবিবি মৃদু কণ্ঠে বলিল।

 তুমি ওঠো।

 উঠছি। তুমি যাও।

 বেশ, আমি উঠানের পৈঠা পর্যন্ত গিয়ে দেখব, না উঠলে আবার আসছি।

হাসুবৌর যা কথা তাই কাজ। কিন্তু দরিয়াবিবি সত্যই তাড়াতাড়ি উঠিয়া হাঁস মুরগির খবরদারীতে মনোযোগ দিল।

.

৪৩.

 সাকের নঈমাকে সদরের হাসপাতালে লইয়া গিয়াছিল। চোখের দৃষ্টি তার ক্রমশ নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছে। এত বেশি পিচুটি পড়ে, সকালে সে চোখই খুলিতে পারে না। তাই দরিয়াবিবি সাকেরের শরণাপন্ন হয়। চন্দ্র কোটাল বহুদিন এদিকে মাড়ায় নাই। হাসপাতালের ডাক্তার ঔষধ দিয়াছে। কিন্তু রোগের প্রতিকার অনিশ্চিত। ডাক্তারের অভিমত দরিয়াবিবি শুনিয়াছিল। কিন্তু সে ব্যাপারটা আর গুরুতর মনে করে না। অন্ধের কি দিন বন্ধ থাকে?

গত দুই মাসে দরিয়াবিবি বড় স্থির ও শান্ত হইয়া আসিল। কাজের গাফিলতি হয় না কিন্তু সব কাজ ধীরে ধীরে। মন যেন আর কোথাও উধাও, তারই পটভূমিকায় দৈনন্দিনতার কর্তব্য-সাধন মাত্র। ছেলেদের উপর রাগও নাই। শরী কত বিরক্ত করে, দরিয়াবিবি মোটেই তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। আমজাদ একদিন মার কোপন-স্বভাবের জন্য যেমন ভীত হইয়াছিল, আজ আবার বর্তমান অবস্থার জন্য তেমনই ভয় পাইল। তার ছেঁড়া লুঙি ও শার্ট সেদিন পাওয়া গেল না। নালিশ জানাইলে মা জবাব দিল, গেছে যাক। আর কোনো ধমক নয়। দরিয়াবিবি যেন ধমক দিতে ভুলিয়া গিয়াছে। আমজাদ তাই অস্বাভাবিকতার আবহাওয়া স্বতঃই টের পায়। আমিরন চাচি আসিলে দরিয়াবিবির চাঞ্চল্য সামান্য বাড়ে। হাসুবৌ কোনো পাত্তা পায় না। তাহার সহিত দু-একটি কথা হয় মাত্র। চুপচাপ বসিয়া বসিয়া সে চলিয়া যায়। দরিয়াবিবি কোনোদিন মুখরা ছিল না। কিন্তু এখন তার সমস্ত কথা যেন শেষ হইয়া গিয়াছে।

একদিন সকালেই রাজকীয় উপহারে সজ্জিত ইয়াকুব আসিল। ছেলেদের সম্মুখে দরিয়াবিবি কোনো নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘৃণা করে। সহজেই সে জিনিসপত্র গুছাইয়া রাখিল!

ইয়াকুব তাড়াতাড়ি আমজাদের বিছানায় শুইয়া পড়িল। তার চোখমুখ কোটরাগত ও শীর্ণ। দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসাবাদ কিছুই করে না। কখন এলে? বা এই জাতীয় মামুলী প্রশ্ন মাত্র।

একটু পরে আমজাদের কক্ষে দরিয়াবিবি প্রবেশ করিল।

ঘুমুচ্ছো? ইয়াকুবের নিকট তার প্রথম প্রশ্ন। ইয়াকুব মুখে চাদর ঢাকা দিয়া শুইয়াছিল। দিনের আলোয় মুখ দেখাইতে সে যেন ভয় পায়।

ইয়াকুব মুখের আবরণ খুলিয়া অন্যদিকে দৃষ্টি দরিয়াবিবির তরফে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কিছু বলছ?

দরিয়াবিবি প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। ইয়াকুবের মুখের উপর পনেরোটি রূপার টাকা ঝনঝন শব্দে রাখিয়া বলিল, মাস-মাস তোমাকে এই টাকা আর দিতে হবে না।

কেন? ইয়াকুবের মুখ বিবর্ণ। জ্বরে তার হাড় সিদ্ধ হইতেছিল, এমনই দেহে কোনো জৌলুশ ছিল না।

দরিয়াবিবি কক্ষ-ত্যাগের জন্য পা বাড়াইলে প্রায় আসন্ন-মৃত্যু রোগীর চেরা-কণ্ঠে ইয়াকুব ডাকিল, শোনো।

দরিয়াবিবি গমন-পথের দিকে চাহিয়া পেছন ফিরিয়া বলিল, বল।

আমার বড় জ্বর, আজ এক সপ্তাহ। আমি তোমাদের এখানে একটু শান্তি পেতে এসেছি।

আমরা কি তোমার কাপড়ে আগুন লাগাচ্ছি? বড় নির্মমের মতো দরিয়াবিবি জবাব দিল।

তা কেন? এমন দুঃখের দিনে তোমরা আমাকে জায়গা দিয়েছ, তা কি কম উপকার? আমার ঘরে শান্তি নেই, দেহ ভালো নয়। এই টাকাগুলো নিয়ে গেলে আমার মনে কোনো কষ্ট থাকবে না।

ও টাকাগুলোর আর দরকার নেই।

 নেই?

না। দরিয়াবিবি তখনই আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি সাগু খাবে?

হ্যাঁ। কাতর কণ্ঠের আর্তনাদের মতো শোনায় ইয়াকুবের জবাব।

দরিয়াবিবি রোগীর অন্য প্রয়োজন জানার অপেক্ষায় রহিল না। দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।

আমজাদ আজ মার উৎসাহ দেখিয়া অবাক। মাছ ছিল কয়েক রকমের। ইয়াকুব সের দুই খাসির গোস্ত ও অন্যান্য শাক-সজিসহ ঘি আনিয়াছিল। দরিয়াবিবি পরম আগ্রহে রন্ধন-বিদ্যা উজাড়ে মনোযোগ দিল। শত্রু কোথাও যেন ধরাশায়ী। তাই যেন বিজয়ী বীরের উল্লাস। খাওয়ার সময় উৎসাহে আদৌ ভাটা পড়িল না। মার এমন আগ্রহান্বিত আহার আমজাদ জীবনে দেখে নাই। রান্না হইয়াছিল চমৎকার।

ভূরিভোজনের বিশ্রামের পর সাগু হাতে ঢুকিয়া দরিয়াবিবি দেখিল, ইয়াকুব ঘুমাইতেছে। ভাঙা তক্তপোষের একদিকে বাটি বসাইয়া সে চাহিয়া দেখিল। তার মুখের এমন পূর্ণ আদল সে আগে দেখে নাই। মলিন লতার মতো সারা চেহারায় বিশীর্ণতা। কত দুঃখ-ভারাক্রান্ত এই শায়িত ব্যক্তি, তা তার চোখের কালি-মাখা কোণগুলিতে স্পষ্ট।

দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দরিয়াবিবি ঐ মুখ পুঙ্খানুপুঙ্খ অবলোকন করিল। বেচারা বড় দুঃখী! ঘরে সাতদিন জ্বরে ভুগিয়াছে, আজও জ্বর-জ্বর-দেহে গৃহত্যাগী। খুব জ্বর, হয়ত এই শেষ শয্যা। আজহারের শেষ কয়টি দিন দরিয়াবিবির চোখে নিমেষে খেলিয়া গেল।

নিঃশব্দে ইয়াকুব ঘুমাইতেছিল অথবা চোখ বুজিয়া ছিল কে জানে। দরিয়াবিবির কেমন মায়া হয়। হঠাৎ তার বুকে করুণা উথলিয়া উঠে। নৌকায় সারা পথ আসিয়াছে, এক মাইল হাঁটিয়াছে, এখনো অভুক্ত। এখনো অভুক্ত! দরিয়াবিবি আর স্থির থাকিতে পারে! তার ইচ্ছা হইল : একবার ঘুম ভাঙাই সাগুটুকু খেয়ে নিক। কিন্তু ডাকিতে গিয়া, খামিয়া গেল। কে যেন গলা টিপিয়া ধরিল অকস্মাৎ!

দুঃখী মানুষ দুয়ারে আশ্রয় লইয়াছে। সমস্ত ঘৃণা দরিয়াবিবির মন হইতে মুছিয়া যায়। ইয়াকুবের দিকে সে তাকাইল। গায়ে ঠিকমতো চাদর নাই। পাঁজরের প্রান্ত খোলা! পায়ের দিকে হাঁটুর পরে আর চাদর নাই। খোলা গায়ে জ্বর আরো বাড়িতে পারে?

দরিয়াবিবি ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল। জ্বরের উত্তাপ গা ছুঁইয়া বোঝা যাইবে। অতি সন্তর্পণে সে তাপ দেখিল। জ্বর যে খুব, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাই ধীরে ধীরে গাখানি চাঁদরে ঢাকিয়া দিল। তখনো হাত তোলা সম্পূর্ণ হয় নাই, ইয়াকুব চোখ মেলিয়া তাকাইল। বান মাছের গর্ত খুঁজিতে গিয়া যেন হঠাৎ সাপ ঠেকিয়াছে হাতে-দরিয়াবিবি এমনই আতঙ্কিত শিহরণে তাড়াতাড়ি পিছাইয়া দ্রুত কক্ষ হইতে নিষ্ক্রমণের পথ ধরিল ও তাড়াতাড়ি বলিল, তক্তপোষের উপর সাগু রইল, উঠে খেয়ো।

ইয়াকুব চোখ বুজিল, হয়ত পুনর্বার ঘুমাইতে।

.

৪৪.

 অসুখ কমিল না।

ইয়াকুবের বাড়ি হইতে লোক আসিয়াছিল খোঁজ লইতে। এখানে ডাক্তার দশ মাইল দূরে থাকে। চিকিৎসার দিকে ইয়াকুবের কোনো খেয়াল ছিল না। বাড়ির লোক ফিরিয়া গেল।

কিন্তু তিন দিন পরে নদীর ঘাট হতে খবর আসিল, আরো লোক আসিয়াছে। ইয়াকুবের এখানে থাকা হইবে না। দুই নৌকা বোঝাই ইয়াকুবের দুই পত্নীই হাজির হইল। গৃহে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর উপায় নাই। তা-ই হইল। ইয়াকুবের অগস্ত্য যাত্রা। ইয়াকুব অসুখে মরে নাই। কিন্তু আর ফিরিল না। মহেশডাঙার পথ সে চিরতরে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল।

দরিয়াবিবির চতুর্দিকে অন্ধকারের নৈরাজ্য। অন্ধকারই অন্ধকারের পরিসমাপ্তি ঘটায়। নচেৎ অভ্যস্ত জীবনে মানুষ আনন্দ পাইত কি করিয়া? এই ক্ষেত্রে সেই পথও চিরতরে বন্ধ হইয়া গেল।

দুই-তিন মাস পরেই তিলে তিলে অনটন-উপবাস, উদ্বেগের সড়ক বহিয়া সেই রাত্র আসিল– অন্ধকার যার লীলাভূমি। দরিয়াবিবির এই তমসার যেন প্রয়োজন ছিল। সে সত্যই হাত তুলিয়া আল্লার শোকরিয়া আদায় করিল। ও যদি দিবালোকে আসিত? এত মানুষের সম্মুখে, পুত্র-কন্যার সম্মুখে! তোমার কত মরজি আল্লা। তোমার এই রহমতটুকুর জন্য তোমার কাছে হাজার শোকরিয়া, হাজার মোনাজাত!

গভীর রাত্রের কালো ডানা মহেশডাঙার উপর প্রসারিত। সুপ্তির শাসন দিকে দিকে। নৈশ পাখির দল হয়ত জাগিয়া আছে। আর জাগিয়াছিল দরিয়াবিবি।

ধীর মৃদু বাতাস বহিতেছিল। দরিয়াবিবির হস্তস্থিত প্রদীপের শিখা তাই কম্পমান। দরিয়াবিবি জাগিয়া ছিল, জাগিয়া উঠিল। দাওয়ার উপর ডিপা হাতে দণ্ডায়মান। বাহির হইতে টাঁটির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছে সে কিছুক্ষণ আগে। আমজাদ, শরী, প্রায়ান্ধ নঈমা– সকলে ঘুমাইতেছে। কান পাতিয়া সে শুনিল শিশু-কিশোরদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ। এইভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।

দরিয়াবিবি নিঃশ্বাস চাপিয়া ধীরে ধীরে রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকিল ও ভিতর হইতে অর্গল বন্ধ করিয়া দিল। মজবুত বাঁধা কি না, তাও একবার টানিয়া দেখিল। তারপর কম্পিত হাতে ডিপা এক জায়গায় নামাইয়া একটি মাদুর পাতিল।

বহুদিন গোপন ছিল। কিন্তু বিকাশের ধারা কোথাও বন্ধ হয় না। সময় শুধু এই একটিমাত্র ক্ষেত্রের অপেক্ষা করে।

দরিয়াবিবির সমস্ত শরীর নাড়া দিতেছে, তবু এতক্ষণ সে মুখে যন্ত্রণার সামান্য কুঞ্চন পর্যন্ত ফেলে নাই। সমস্ত কাজের ভার তার নিজেরই উপর। তার তো কেউ সাহায্যে আসিবে না।– মাদুর পাতিয়া দরিয়াবিবি গায়ের ছেঁড়া কুর্তাখানি ভোলা মাত্র আরো কাপড় বাহির হইল। শরীর ব্যাপিয়া তখন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি শুরু হইয়াছে। তাড়াতাড়ি কোমরের কাপড় পর্যন্ত আলগা করিয়া দিল। তখন একরাশ কাপড়, ছেঁড়া ন্যাকড়া, নঈমার ফালি, আমজাদের ছেঁড়া শার্ট–এক স্থূপ বাহির হইল। আসন্নপ্রসবা জননীর স্ফীত উদরখানি প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয় না। আরো অন্ধকারে রহিয়াছে বিশ্বের বিস্ময়তম মানবশিশুর নীড়খানি। দরিয়াবিবির পেটের উপর হাত বুলাইতে লাগিল। হঠাৎ তার মনে পড়িল আমিরন চাচির কথা, বুবুর শরীর যেন ফেটে পড়েছে। আহ, সত্যি যদি ফাটিয়া যাইত-কি সুখই না পাওয়া যাইত। দরিয়াবিবি জোরে একবার প্রশান্তির নিঃশ্বাস লইল। আরো কাজ আছে। উদর অন্ধকারে মুমুক্ষু মানব শিশু যতই আর্তনাদ করুক বাহিরে আসার আকুলতায়, কর্তব্যের ডাকে দরিয়াবিবি সারাজীবন অনড়। আজ তার কোনো নড়চড় হইবে না। ঘুঁটের মাচা হইতে ছোট ছোট বহু কাঁথা দরিয়াবিবি মাদুরের এককোণে রাখিল।

তারপর উবুড় হইয়া সে সমস্ত মাদুর চাপিয়া ধরিল। আহ, এখন শুধু একটু চিৎকারের স্বাধীনতা পাওয়া যাইত। ছেলেরা না জাগিয়া ওঠে। তাই সারাদিন কাহাকেও ঘুমাইতে দেয় নাই। অসহ্য বেদনায় দরিয়াবিবি এই প্রথম মুখ কুঞ্চন করিল। মাদুরে হাত পিছলাইয়া যায়, তাই একটু আগাইয়া সে মাটি আঁকড়াইয়া ধরিল। মাটির কন্যা জননীর আশ্রয় ছাড়া আর কোথায় তাকৎ পাইবে?

দরিয়াবিবি অসহ্য যন্ত্রণায় দিশাহারা হয় না। আগন্তুক অতিথির অসম্মান সে কিরূপে সহ্য করিবে? এত হাত দিয়া পেছনে দেখিতে হয়, সে না হঠাৎ মাটির উপর আছাড় খায়।

দরিয়াবিবির চোখে আর কোনো প্রশ্ন নাই। ত্বরান্বিত হোক, হে আদিম শিশু তোমার আগমন। এত যন্ত্রণার মধ্যে জননী তোমার পথই তো চেয়ে থাকে। কত লজ্জা, কত অপমান ধিক্কার বাহিরের জগতে প্রতীক্ষমাণ, আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষমাণ। আপ্ত রমণী মাঝে মাঝে মনের সঙ্গে যোঝযুঝির ক্ষেত্রে কতবার পরাস্ত। আজ বিজয়িনীর মতো দরিয়াবিবি ধাত্রী ও প্রসূতি হইয়া যায় একত্রে। নিজে নিজের শরীরের উপর অসম্ভব ঝাঁকুনি প্রয়োগ করে সে। গৃহস্থের দুলালীর মতো সে তো বহুক্ষণ এই ঘরে পড়িয়া থাকিতে চায় না। প্রসূতি এবং সে আবার ধাত্রী একাধারে। আরো কাজ আছে। কাজ….

দেড় ঘণ্টা কেমন করিয়া কাটিল, বিধাতা হয়ত জানেন।

প্রথম শিশুর অসহায় চিল্কারে ছোট্ট রান্নাঘরটি একবার সচকিত হইল।

 মাটির গামলা ও পানি পূর্বেই রাখা ছিল।

দরিয়াবিবি প্রথমে শিশুকে বুকে তুলিয়া লইল। হয়ত তাকে বুকে চাপিয়াই বসিয়া থাকিত। শিশুর চিঙ্কারে খেয়াল হয়। এই সাবধানবাণীর জন্য দরিয়াবিবি বড় কৃতজ্ঞসজল চোখে শিশুর দিকে তাকাইল; তারপর গামলায় গোসলের সব খুঁটিনাটি সম্পন্ন করিল। অতঃপর শয্যার ব্যবস্থা। কয়েকটি রঙিন কাঁথা দরিয়াবিবি বিছাইল ও দুইটি কাঁথা মুড়িয়া নবজাতককে শোয়াইয়া দিল। সে নিজে তখনো দিসনা। তাড়াতাড়ি নিজে পরিষ্কার হইয়া তার নবতম অতিথিকে মাই খুলিয়া দিল। কি সুন্দর চুকচুক শব্দ হয়। কি মোটা তাজা গৌর রঙ শিশু! দরিয়াবিবি উম দিতে থাকে। শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ কয়েকবিন্দু অশ্রু পড়িল অলক্ষিতে।

বাহিরে শৃগাল প্রহর ডাকিল। দুই পেচক কলহ করিয়া আবার জুড়িকণ্ঠ মিশাইল।

দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল।

নব প্রসূতির দেহে কোথাও কি যন্ত্রণা আছে, দুর্বলতার আক্রমণ আছে? হয়ত নাই। তাই নির্বিকার দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল। উম পাইয়া শিশু ঘুমাইতে লাগিল। সেও কেমন। নির্বিকার। বাহিরের পৃথিবী সুপ্ত। এখানে গ্রাম্য রান্নাঘরের বুকে কি গভীর প্রশান্তি। পুত্র ও জননী পরস্পরের সান্নিধ্যে পৃথিবীকে ভুলিয়া গিয়াছে।

মানুষের পক্ষে বিস্মরণ কি এত সহজ? দৰ্মায় মোরগ বাক দিল। ভোর হইয়া আসিয়াছে। দরিয়াবিবি মনে মনে শুধু ভাবিল, ভোর হয়ে এসেছে। ভালো কথা একটু পরে সকাল হবে।

আবার মোরগ ডাকিল। সাকেরদের পাড়া হইতেও মোরগের আওয়াজ আসিতেছে। আরো ভোর হইল।

শিশুকে শোয়াতে গেলে সে হাত পা নাড়িয়া একটু শিহরিয়া উঠিল, তার কাঁচা ঘুমে। ব্যাঘাত। আবার সে শান্ত হইয়া গেল।

দরিয়াবিবি নবজাতকের দিকে অপলক চাহিয়া, বার কয়েক চুম্বন করিল।

তারপর উঠিয়া পড়িল। শ্লথ গতি নয়, দ্রুত। দরিয়াবিবি কর্তব্যে ঢিলা, কে এমন অপবাদ দিবে?

ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকিতেছিল চালের বাতার কাছাকাছি ফাঁক দিয়া। তখনো বাহিরে অন্ধকার।

গরুর দড়িগাছি দরিয়াবিবি নিজেই মাচাঙে দাঁড়াইয়া চালে টানাইল। শুধু প্রসূতি, ধাত্রী নয়। আর এক কর্তব্য সম্পাদনা বাকি আছে। দরিয়াবিবি যে জল্লাদ।

শিশুর বিছানায় গিয়া সে দেখিল, পুত্র ঘুমাইতেছে। পুত্র! বেটা ছেলে! কয়েকবার মৃদু চুম্বন দিয়া দরিয়াবিবি উঠিয়া দাঁড়াইল। কুকুটের কি অসীম স্নেহ ও প্রভু ভক্তি। নিজের হাতে ইহাদের দরিয়াবিবি কত খুদ কুঁড়া খাওয়ায় প্রতিদিন। কৃতজ্ঞ প্রাণী ভোরের সানাই বাজাইল।

আর দেরি করা চলে না। দরিয়াবিবি নিজের মনে উচ্চারণ করিল। হঠাৎ আসেকজানের কথা মনে পড়িল তার। বুড়ি চল্লিশা খাইয়া ঘরে ফিরিতেছে, হাতে খাবারের পুঁটলি, লাঠির উপর ভর দিয়া বৃদ্ধা হাঁটিতেছে।…

দড়ির ফাঁসের দিকে দরিয়াবিবি তাকাইল। সারাজীবনে কত উদ্বেগ, কত সংগ্রামজনিত ক্লান্তি ওইখানে ঝুলাইয়া রাখিয়া আজ সে নিশ্চিন্ত হইতে চায়।

তার আগে দরিয়াবিবি ডিপা নিভাইয়া ঘর অন্ধকার করিয়া দিল।

.

৪৫.

 রৌদ্র উঠিয়াছিল গাছপালায়, আকাশ ভরিয়া।

মার তাড়া নাই। আমজাদ নঈমা শরী খুব ঘুমাইয়াছিল।

কিন্তু সকালে উঠিয়া আর কেউ বাহিরে আসিতে পারে না। অগত্যা চেঁচামেচি। সাকেরের মা হাসুবৌকে খবর লইতে পাঠাইয়াছিল। সে টাঁটি খুলিয়া দিল।

আবার রান্নাঘরের টাটি বাহির হইতে তাহাকেই কৌশলে খুলিতে হইল। হাসুবৌর প্রথম চোখ পড়িল রঙিন কাঁথার অরণ্যে। সদ্যোজাত ঘুমন্ত শিশু।

তারপর উপরের দিকে চাহিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল। আতঙ্কিত পরিবেশের মধ্যে সে কাঁথাসহ শিশুটিকে বুকে তুলিয়া লইল আর নামাইল না।

কিছুক্ষণের মধ্যে জনবিরল গ্রামের এই অখ্যাত অঙ্গনটি ক্ষুদ্র জনতায় ভরিয়া উঠিল। আসিল রহিম বখশ, রোহিণী চৌধুরী, চৌকিদার, সাকের, আমিরন চাচি অনেকে। রহিম বখশ, রোহিণী চৌধুরী– যাহাদের পার ধূলা কোনোদিন দীন আজহারের অঙ্গনে পড়ে নাই, তাহারাও আসিয়াছিল। সংসারে প্রতিদিন মৃত্যুর তোরণ যারা সাজাইয়া রাখে, মৃত্যুর প্রতি তাহাদের কৌতূহল বেশি। কৌতূহল মিটাইতে হইবে বৈকি! তাহারা আসিয়াছিলেন।

ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের সার্টিফিকেটেই সব কাজ হইল। থানা পর্যন্ত আর দাঁড়াইল না।

হাসুবৌ শিশুটিকে বুকে করিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেল। সাকের প্রথমে আপত্তি করিয়াছিল। কিন্তু হাসুবৌ মরিয়া। তার সুপ্ত অদম্য তেজের মুখে, নিষ্পাপ শিশুর নিরপরাধিতার সাফাই কীর্তনের মুখে সকলের জবরদস্তি উবিয়া গেল।

আমিরন চাচি শরী, আমজাদ ও নঈমাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিল।

আরো দুই তিন মাস পরে আসিল মোনাদির। চটকলে কাজ লইয়াছে সে। আরো জওয়ান। জঙ্গীভাব চেহারায় স্পষ্ট।

আমিরন চাচি তাহার হাত ধরিয়া হাউমাউ করিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিল। মোনাদির রাজি হইয়াছে : শহরে তার কর্মস্থল, কিন্তু তার আবাসভূমি চিরদিনের জন্য মহেশডাঙায়।

আমজাদকে লইয়া মোনাদির চন্দ্র কোটালের ওখানে গেল। সাত দিনের ছুটি লইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু মন আর গ্রাম ছাড়িতে চায় না।

কোটালের কাছে মোনাদির প্রস্তাব করিল, গানের দল করা যায় কি না।

কোটাল বলিল, চাচা, লোকে আর গান শুনতে চায় না। গান গেয়ে পেটের ভাত জোটানো দায়।

মোনাদির বড় নিরাশ হইল। কোটাল নিজেই জানাইল, গ্রামে নিয়মিত কোনো কাজই আর মেলে না।

মোনাদির তাই বলিল, কাকা, আপনি শহরে চলেন। আপনার যা মেহনত করার। ক্ষমতা, চটকলে আপনাকে লুফে নেবে।

সত্যি।

হ্যাঁ। কাকা, আমি মেট’কে বলে আপনার কাজ জুটিয়ে দেব।

বেশ। তুমি কবে যাবে?

পরশু। আমজাদকেও কাজে লাগিয়ে দেব।

বেশ আমিও যাব।

অচেনা জীবনের জন্য কোটালের পরম উৎসাহ। তবু কোটাল একবার স্তব্ধ হইয়া গেল, দিগন্ত বিসারী বিরল তালগাছ ক্ষত মাঠের বুকের দিকে চাহিয়া।

অবেলার আকাশে নীড় সন্ধানী পাখিরা দল বাঁধিয়া অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হইতেছে। মেঠো আমেজে কোটাল তন্ময়, কেমন যেন বিষণ্ণতা বুকে।

তবু সে বলিল, চাচা, পরশু কখন বেরুবে? রেল স্টেশনে তিন জনে যাব।

আমজাদ মুনিভা’য়ের সঙ্গে সে দুনিয়ার অপর পিঠে যাইতে প্রস্তুত।

***

গোধূলি নামিয়াছিল।

আবছা অন্ধকারের প্রলেপ এখনই দিকে দিকে ছড়ানো। অস্তাচলের লালিমা নিভিয়া যাইতেছে।

দরিয়াবিবির কবরের পাশে তিনটি ছায়ামূর্তি দণ্ডায়মান। ইহাদের চেনা যায়। মোনাদির, আমজাদ ও কোটাল।

মাথা নিচু করিয়া মোনাদির দাঁড়াইয়া থাকে। দুই চোখ ভরিয়া অশ্রুর প্লাবন। মোনাদির এখন শহরের নাগরিক। গত ছমাসে চটকলে এমন সব মানুষের সন্ধান পাইয়াছে, তাদের ছোঁয়ায় সে চোখে নূতন অঞ্জন পরিয়াছে। এই পৃথিবীর বহু হদিস সে জানে। তবু চক্ষুর পানি আর রোধ করিতে পারে না। তার বুকে চাড়া দিয়া ওঠে বেদনার রাগ রাগিণীর তোড় মুখর ঝঞ্জার। অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে, মা গো, তোমার বুকে একটু ঠাই দিও।

মোনাদির হঠাৎ ডুকরাইয়া উঠিল, আবেগ আর রোধ করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য।

কোটাল আগাইয়া আসিয়া বলিল, চাচা, বেটাছেলে, মার জন্য কি এত কাঁদে? আমারও তো মা নেই। চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু চন্দ্র অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।

অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে সে নিজেও বলিয়া ফেলিল, দরিয়াবিবি, সেলাম… সেলাম…।

দুই বাহুর মধ্যে দুই ভাইকে জড়াইয়া চন্দ্র কোটাল অগ্রসর হইল।

তারা তিন জনে অগ্রসর হইল। চেনা-অচেনা সড়কের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *