1 of 2

৪০. সামরিক বিধি

অধ্যায় : ৪০ সামরিক বিধি

ধারা – ৯৫৭

জিহাদ ফরয (ক) বহিশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করিয়া ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত ও সার্বভৌমত্বের হেফাজত, অন্যায়-অত্যাচারের মূলোৎপাটন করিয়া ন্যায়-ইনসাফ প্রতিষ্ঠা এবং দীন ইসলামকে সমুন্নত করার প্রচেষ্টা হইতেছে জিহাদ এবং ইহাতে যোগদান করা মুসলমানদের জন্য ফরয বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।

(খ) জিহাদ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সকল প্রকার প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে হইবে।

(গ) কেবল রাষ্ট্রপ্রধানই কোন দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে পারিবেন।

(ঘ) কোন মুসলিম জনগোষ্ঠী বহিঃশত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হইলে তাহাদের সাহায্যার্থে আগাইয়া যাওয়া সকল মুসলমানের উপর ফরয।

বিশ্লেষণ

দীন ইসলাম মুসলমানদের উপর যে সকল দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছে, ইসলাম ও মুসলমানদের স্বকীয় স্বাতন্ত্র, জাতীয় স্বাতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের হেফাজত করা এবং নিজেদের জাতীয় ও ধর্মীয় অস্তিত্ব কোনক্রমেই কোন অরাজকতা ও আক্রমণে পর্যুদস্ত হইতে না দেওয়াও উহার অন্তর্ভুক্ত। এই উদ্দেশ্যে ইসলাম তাহার অনুসারীদের শুধুমাত্র যুদ্ধের অনুমতিই দেয় নাই, বরং ইহার জন্য কঠোরভাবে তাগিদও দিয়াছে। তাই জিহাদ হইতেছে মুসলমানদের জাতীয় কর্তব্য। জিহাদের চিরন্তনতা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

৩০২

وقتلوهم حتى لا تكون فتنه ويكون الدين لله .

“তোমরা তাহাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে থাক যাবত ফেতনা দূরীভূত না হয় এবং আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত না হয় “ (২: ১৯৩; আরও দ্র. ৮ ও ৩৯)।

এই প্রসঙ্গে মহানবী (সা) বলেনঃ

الجهاد ماض من بعثني الله تعالى إلى يوم القيامة لا يبطله

جور جائر ولا عدل عادل.

“আল্লাহ তাআলা আমাকে পাঠানোর সময় হইতে কিয়ামত পর্যন্ত জিহাদ অব্যাহত থাকিবে। কোন স্বৈরাচারীর স্বৈরাচার বা ন্যায়পরায়ণ শাসকের ইনসাফ উহা বাতিল করিতে পারিবে না”।

….aj, jiki। – I L “হে নবী! কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর” (৯ঃ৭৩; ৬৬ : ৯)।

كتب عليكم القتال وهو گره لكم.

“তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল, যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়” (২ঃ ২১৬)।

এই সকল আয়াতের ভিত্তিতে সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব (র) বলেন, জিহাদ সর্বাবস্থায় সর্বকালের জন্য ফরযে আইন অর্থাৎ সকল মুসলমানের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য (মিরকাত, ৭খ, পৃ. ২৬৮)।

জিহাদের জন্য কোন বিশেষ সময় নির্দিষ্ট নাই, কিয়ামত পর্যন্ত যখনই প্রয়োজন হইবে তখনই জিহাদে যোগদান ফরয হইবে। এই বিষয়ে ফকীহগণ একমত (আশিআতুল লুমআত, ৩খ., পৃ. ৩৫০)।

জিহাদ পরিচালনার জন্য সার্বিকভাবে যথাশক্তি নিয়োগ করিতে হইবে এবং তদুদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনীর যথার্থ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিতে হইবে, তাহাদেরকে সমকালীন সর্বাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রে সুসজ্জিত করিতে হইবে এবং অস্ত্র কারখানা নির্মাণ ও নিত্য নূতন যুদ্ধাস্ত্র আবিস্কারের ইজতিহাদ ভিত্তিক কার্যক্রম জোরদার করিতে হইবে। এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন :

وأعدوا لهم ما استطعتم من قوة ومن رباط الخيل ترهبون به عدو

الله وعوم واخرين من دونهم ج “ تعلمونهم الله يعلمهم.

৩০৩

“তোমরা তাহাদের মোকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অর্শ বাহিনী প্রস্তুত রাখিবে। এতদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করিবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদিগকে, যাহাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাহাদেরকে জানেন” (৮ : ৬০)

রাষ্ট্রপ্রধানই কেবল কোন দেশে বা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিতে পারেন। মহানবী (সা) ও খােলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলের সবগুলি যুদ্ধই প্রধান নির্বাহীর নির্দেশে পরিচালিত হইয়াছিল এবং তিনিই সরাসরি প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করিয়াছিলেন।

কোন মুসলিম জনগোষ্ঠী অমুসলিম রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হইলে বিশ্বের সকল যুদ্ধক্ষম মুসলমানের উপর প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগদান বাধ্যতামূলক হইয়া যায়। এই বিষয়ে ফকীহগণ একমত।

বস্তুত ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন মজীদে জিহাদ সম্পর্কে যত গুরুত্ব সহকারে যে বিস্তারিত তাগিদমূলক বর্ণনা আসিয়াছে তাহা প্রণীধানযোগ্য। সরকারী কার্যক্রমের মধ্যে ইহাকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ কার্যক্রম ঘোষণা করা হইয়াছে। হযরত উমার (রা) ইহার গুরুত্ব বিবেচনা করিয়াই সর্বপ্রথম শাসন বিভাগকে স্বতন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত করেন ও শাসন বিভাগ ও সামরিক বিভাগ। অতএব এই গুরুত্ব বিবেচনায় আধুনিক কালের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের সহিত ইসলামী রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকারের চতুর্থ বিভাগ হইল সামরিক বা প্রতিরক্ষা বিভাগ।

ধারা-৯৫৮

সেনাবাহিনী গঠন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী থাকিবে।

বিশ্লেষণ

রাষ্ট্রের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্বে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকিবে। যাহারা প্রয়োজন মুহূর্তে রাষ্ট্রের জন্য জীবন বাজি রাখিয়া জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করিবে। রাসূলুল্লাহ (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে এই জাতীয় সেনাবাহিনী ছিল। চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রা) রাষ্ট্রের জন্য সেনাবাহিনীর গুরুত্বের কথা উল্লেখ করিয়া তাহার নিযুক্ত গর্ভনর মালিক আশতারকে

৩০৪

বলিয়াছেন : “আল্লাহর আদেশে সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় একটি দুর্জয় দুর্গের ভূমিকা পালন করে। তাহারা একজন শাসকের জন্য অলংকার, তাহারা একটি শক্তির উৎস, ঈমানদারদের মর্যাদা ও শান্তি। যাহারা মানুষের মধ্যে শান্তি নিশ্চিত যে, তাহারা হইতেছে নিরাপত্তার অভিভাবক যাহাদের মাধ্যমে দক্ষ আভ্যন্তরীণ প্রশাসন সুনিশ্চিত হইতে পারে। জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা তাহাদেরকে ছাড়া রক্ষা করা অসম্ভব। সেনাবাহিনীর সংরক্ষণ তাহাদের জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত করের উপর নির্ভরশীল। এই কর দিয়া তাহারা নিজেদের ভরণ-পোষণ, অন্যান্য প্রয়োজন মিটানো এবং ও ন্যায়ের পথে সংগ্রামে শক্রদের পরাভূত করিবার জন্য অস্ত্রশস্ত্র লইয়া সদাপ্রস্তুত থাকে”।

সেনাবাহিনীর সেনাপতিবৃন্দ ও হযরত আলী (রা) তাহার গভর্ণর হযরত মালিক আশতার (র)-কে এ সম্পর্কে বলেন, “তুমি এমন কাহাকেও সেনাপতি নিয়োগ করিবে যে তোমার মতে সবচেয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ, তাঁহার রাসূল ও তোমার সরকারের প্রতি নিবেদিত, যাহার একটি স্বচ্ছ বিবেক রহিয়াছে, যাহার ধার্মিকতা, জ্ঞান ও দ্র আচরণের জন্য খ্যাতি রহিয়াছে, যিনি হঠাৎ রাগ করেন না। অজুহাতকে সহৃদয়তার সহিত বিবেচনা করেন, যিনি সবলদের প্রতি শক্তি প্রয়োগে কঠোর ও দুর্বলদের প্রতি দয়া ও মহানুভবতা প্রদর্শন করিবেন। যিনি হইবেন প্রতিশোধ পরায়ণতা ও জিঘাংসার মনোভাব হইতে মুক্ত, যাহা মানুষকে অবৈধ শক্তি প্রয়োগে বাধ্য করে। হীনমন্যতা হইতে তাহাকে মুক্ত হইতে হইবে, যাহা তাহার অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কারণে মানুষকে অসহায় করিয়া তোলে। ভাল সেনাধ্যক্ষ বাছাই ও যোগ্য অফিসার নিয়োগের জন্য তোমাকে এমন সব লোকের সঙ্গে মিশিতে হইবে ও সম্পর্ক রাখিতে হইবে যাহারা বংশ মর্যাদার দিক দিয়া উন্নত এবং যাহারা ধার্মিকতা, আম্‌দর্শ ও মহান কার্যাবলীর প্রেরণা প্রদানকারী উৎস্য হিসাবে পরিগণিত হইতে থাকিবে। এইভাবে বাছাইকৃত লোকদের কাজকর্মের প্রতি পিতৃসুলভ দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিবে যাহাতে তাহাদের কোন দোষত্রুটি অতি সহজে তোমার নিকট ধরা পড়ে। তাহাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করিবে এবং ইহাতে তোমার প্রতি তাহাদের শ্রদ্ধা ও আস্থা বৃদ্ধি পাইতে থাকিবে। যে সকল প্রচেষ্টার মাধ্যমে তাহাদেরকে শক্তিশালী করা হইয়াছে, সুবিবেচনার যোগ্য হওয়া সত্বেও তাহা অতিরঞ্জিত করিও না। তাহাদের ছােটখাট অভাব পূরণে উদাসীনতা প্রদর্শন করিবে না। যদিও প্রধান প্রয়োজনাদি পূরণ করাটা অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ, তথাপি অনেক সময় ছােটখাট প্রয়োজনের প্রতি নজর প্রদান ও অনুগ্রহ প্রদর্শন অত্যধিক ফলপ্রসূ হইয়া থাকে। তাহাদের বড় বড় বিষয়ের প্রতি যথাযথ নজর প্রদান করা

৩৫

হইয়াছে একমাত্র এই অজুহাতে ক্ষুদ্র ব্যাপারগুলিকে খাটো করিবে না। যে সকল সামরিক কর্মকর্তা তাহাদের শত্রু সৈন্য ছাড়া অন্য সকল অধীনস্থ সৈনিকদের সর্বপ্রকারের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণে অত্যধিক মনোযোগী ও তৎপরতা প্রদর্শন করিয়া থাকে, তাহারাই সামরিক সম্মান ও বিবেচনার যোগ্য হইবে। এসকল অফিসার তাহাদের অধীনস্ত সৈনিকদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সুখশান্তির নিশ্চয়তা বিধানের জন্য তাহার ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদ দিয়া সাহায্য করিয়া থাকেন। যেন পরিবার ও সন্তান-সন্তুতির চিন্তামুক্ত হইয়া তাহারা সন্তুষ্টচিত্তে জীবন যাপন করিতে পারে। এমনিভাবে তুমি তাহাদের অন্তরকে জয় করিয়া লইবে। তাহারা সর্ববিধ চিন্তা-ভাবনামুক্ত মন লইয়া সাহসিকতাপূর্ণ আন্তরিকতার সহিত যুদ্ধ করিয়া যাইবে। তোমার অফিসার ও সৈনিকদের প্রতি সদা যত্নবান থাকিবার কারণে তাহারও তোমাকে অন্তরের অন্তস্থল হইতে ভালবাসিতে থাকিবে”।

ইসলামী রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী প্রকৃতই দেশ, জাতি ও জাতীয় আম্‌দর্শের খাদেম। তাহারা জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে সদা-সর্বদা আত্মনিয়োগ করিয়া থাকে। মূলত তাহারা দীনের মুজাহিদ। কুরআন মজিদে সামরিক বাহিনী ও সামরিক

প্রশিক্ষণ গ্রহণ সম্পর্কে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ দিকনিদের্শনা রহিয়াছে। কুরআনের কতিপয় আয়াতে তীর নিক্ষেপণ অশ্বারোহণ ও অস্ত্র পরিচালনার শিক্ষা লা, শিক্ষাদান এবং নিরবিচ্ছিন্নভাবে সামরিক চর্চা ও তৎপরতায় লিপ্ত থাকিবার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। এই ব্যাপারে দক্ষতা অর্জন প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে। কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করা হইলো।

ايها الذين أتموا اقوا الله واتوا اليه الوسيلة وجاهدوا في

سبيله لعلكم تفلحون (المائدة :۳۰) .

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাহার নৈকট্য সন্ধান কর এবং তাঁহার পথে জিহাদ কর। আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করিতে পারিবে” (সূরা আল-মাইদা : ৩৫)।

ঈমানের দাবি, তাকওয়ার দাবি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা, আর এই নৈকট্য লাভের উপায় হইতেছে আল্লাহর পথে জিহাদ করা।

انفروا خفافا وثقالا وجاهدوا بأموالكم وأنفسكم في سبيل

الله ذلك ځي لكم إن كنتم تعلمون (التوبة – 41) .

৩০৬

“তোমরা বাহির হইয়া পড়, হালকাভাবে ছােট ছােট বাহিনী কিম্বা ভারী অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত হইয়া (বিরাট বাহিনী লইয়া) এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর তোমাদের জান ও মাল দিয়া। ইহাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জান। (সূরা তওবা ও ৪১)।

وجاهدوا في الله حق جهاده هو اجتبم (سورة الحج – ۷۸) .

“এবং তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ কর যেভাবে জিহাদ করা উচিৎ” (২২:৭৮)।

ইসলাম উত্তর যুগে প্রাথমিক পর্যায়ে সুশৃংখল সৈন্যবিভাগ ছিল না। হযরত উমার (রা) সর্বপ্রথম ইসলামী খেলাফতে সুশৃংখল সেনাবাহিনী গঠন করেন। প্রথম খলীফা হযরত আবু বা সিদ্দীক (রা)-এর সময় প্রথম বৎসর গনিমত হইতে প্রাপ্ত সমস্ত মাল সৈন্যদের মাঝে বণ্টন করিয়া দেওয়া হয়। হযরত আবু বাকর (রা)-এর খেলাফতকালেও সৈন্যদের কোন প্রকার বেতন ধার্য অথবা কোন প্রকার তালিকা প্রস্তুত বা পৃথক কোন সামরিক বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। হযরত উমার (রা)-এর খিলাফতের প্রথম ভাগের অবস্থাও তদ্রূপই ছিল। হিজরী ১৫ সনেই হযরত উমার (রা) এই বিভাগকে এইরূপ সুশৃংখল ও নিয়মতান্ত্রিক করিলেন যে, তাহাকে সে যুগের তুলনায় সত্যই বিস্ময়কর বলা যায়। সৈন্যবিভাগের প্রতি হযরত উমার (রা)-এর মানোযোগ আকৃষ্ট হইবার বিভিন্ন কারণ বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বিশেষ কারণ এই যে, বাহরাইনের শাসনকর্তা হযরত আবু হুরায়রা (রা) একবার গনীমত, খিরাজ ইত্যাদি নানা প্রকার রাষ্ট্রীয় আয় বাবদ পাঁচ লক্ষ দিরহাম লইয়া মদীনায় হাযির হন এবং এ সমন্ধে হযরত উমার (রা)-কে জ্ঞাত করেন। সেই সময় পাঁচ লক্ষ দিরহাম এমন আশ্চর্যের বিষয় ছিল যে, প্রথমত হযরত উমার (রা) তাহা বিশ্বাসই করিতে পারিলেন না। তিনি বলিলেন, হে আবু হুরায়রা! তোমার মাথা ঠিক আছে তো? এইসব কি বলিতেছ? আবু হুরায়রা পুনরায় পাঁচ লক্ষ দিরহামের কথা জানাইলে ইহাতে হযরত উমার (রা) উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, টাকা-পয়সা গুনতে পার তো? আবু হুরায়রা (রা) বলিলেন, নিশ্চয়। এই বলিয়া তিনি পুনরায় পাঁচবার বলিলেন, লাখ, লাখ, লাখ। তাহার পূর্ণরূপে বিশ্বাস হইলে তিনি মজলিসে শূরার সভা আহবান করিয়া সকলের পরামর্শ চাহিলেন যে, এত অর্থ কিভাবে খরচ করা হইবে। হযরত আলী, হযরত উসমান এবং অন্যান্য প্রবীণ সাহাবীগণ নানা প্রস্তাব করিলেন। হযরত ওলীদ ইবন হিশাম (রা) বলিলেন, আমি সিরিয়ার বিভিন্ন শাসনকর্তাদের দেখিয়াছি, সৈন্যদের পৃথক দফতর ও নিয়মিত রেজিষ্টার থাকে। উমার (রা)-র নিকট এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয় এবং ইহার পর

৩০৭

হইতেই তাহার মনে সৈন্যবাহিনীর তালিকা প্রস্তুত ও পৃথক সামরিক দপ্তর কায়েম করার কল্পনা জাগরিত হয়।২ সৈন্যবাহিনীর পৃথক দপ্তর কায়েম হইলে ইহার নামকরণ করা হয় দীওয়ান’। হিজরী ১৫ সনে হযরত উমার (রা) সম্পূর্ণ পৃথকভাবে সামরিক দপ্তর কায়েম করেন। এই বিষয়ে তাহার সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনা ছিল, সমস্ত মুসলিম জাতিকেই সৈন্যবাহিনীতে পরিণত করা। মুসলিম মাত্রই সৈনিক ইহাই তিনি পূর্ণভাবে কার্যকরীও করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু প্রথমাবস্থায় এরূপ কাজ ব্যাপকভাবে করা সম্ভবপর ছিল না। এইজন্য তিনি সর্বপ্রথম কুরাইশ গোত্র এবং আনসারদের মধ্য হইতে কাজ আরম্ভ করেন। সেই যুগে মদীনা শহরে মাখরামা ইবন নাওফাল, জুবাইর ইবন মুতইম এবং আকীল ইবন আবু তালিব এই তিনজনকে তিনি সমস্ত কুরাইশ ও আনসারদের বিস্তারিত নসবনামাসহ তালিকা প্রস্তুত করিতে নির্দেশ দেন। তাহারা এই নির্দেশমত একটি প্রাথমিক খসড়া পেশ করেন। অতঃপর হযরত উমার (রা)-এর পরামর্শ মোতাবেক চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করিলেন। উক্ত তালিকা হযরত উমার (রা) অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করিয়া বিভিন্ন গোত্রের লোকদের জন্য নির্দিষ্ট হারে বৃত্তি বা অনুদান ঘোষণা দিলেন। ইহা ছাড়া যে সকল লোকদের নাম সৈনিকদের দপ্তরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্য তথা স্ত্রী-সন্তানদের জন্যও বিশেষ বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। সৈনিক দপ্তরে যাহাদের নাম তালিকাভুক্ত করা হইয়াছিল তাহাদের প্রত্যেকেই ইসলামী খেলাফতের নিয়মিত সৈন্য ছিলেন। তবে সৈনিকদের মধ্যে দুই শ্রেণীর সেনা ছিল। প্রথমভাগের সৈন্যগণ সর্বদা সামরিক কাজে লিপ্ত থাকিতেন এবং যে কোন ময়দানে যাইতে প্রস্তুত থাকিতেন। দ্বিতীয় ভাগের সৈন্যগণ অনেকটা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পর্যায়ে ছিলেন। ইহারা নিজ নিজ আবাসে বসবাস করিতেন, কিন্তু প্রয়োজনে যুদ্ধে যাইতে বাধ্য থাকিতেন।

ধারা—৯৫৯

সেনানিবাস স্থাপন দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার লক্ষ্যে সৈন্যবাহিনীকে সদা প্রস্তুত রাখার জন্য ও তাহাদের প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনানিবাস স্থাপন করিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনানিবাস স্থাপন করা সরকারের দায়িত্ব। এ ব্যপারে হযরত উমার (রা) যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ

তo৮

করিয়াছিলেন। দেশ রক্ষার ব্যাপারে হযরত উমারের প্রধান দায়িত্ব ছিল সামরিক গুরুত্ব অনুযায়ী স্থানে স্থানে সেনানিবাস স্থাপন করিয়া সেই অনুপাতে এলাকা ভাগ করিয়া দেওয়া। এইজন্য তিনি হিজরী ২০ সনে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করেন। উহার একটি শাসন বিভাগ ও অপরটি সামরিক বিভাগ। সামরিক বিভাগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে স্থায়ী সেনানিবাস স্থাপন করেন। তখন এইগুলিকে “জুন্দ” বলা হইত। আজ পর্যন্তও প্রতিটি সভ্য দেশে এই ব্যবস্থা কায়েম রহিয়াছে। উল্লেখিত স্থায়ী সেনানিবাসগুলি হইতেছে মদীনা, কূফা, বসরা, মাওসিল, ফুসতাত মিসর, দামেশক, হিমস, জর্দান ও ফিলিস্তীন। হযরত উমার (রা)-এর খেলাফতকালে বিজয়ী মুসলমানগণ যদিও পাক ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বেলুচিস্তানের অংশবিশেষ পর্যন্ত অধিকার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, কিন্তু কেবলমাত্র ইরাক, মিসর, জাযীরা ও সিরিয়া প্রদেশই স্থায়ী প্রদেশের মর্যাদায় ছিল। সুতরাং প্রধান প্রধান সেনানিবাসগুলি সাধারণত উক্ত এলাকাগুলিতেই স্থাপন করা হয়। মাওসিল ছিল জাযীরার কেন্দ্রস্থল। এইজন্য সেই এলাকার সেনানিবাস ঐখানেই স্থাপন করা হয়। ফুসতাত বা কায়রো শহরের প্রধান সেনানিবাস দ্বারা সমস্ত মিসর প্রভাবান্বিত হইত। বসরা ও কুফার সেনানিবাসই পারস্য, খােজিস্তান ইত্যাদি সমস্ত পূর্বাঞ্চল বিজয়ের সিংহদার বলিয়া বিবেচিত হইত।

ধারা-৯৬০

যানবাহনের ব্যবস্থা প্রত্যেক সেনানিবাসে প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

শত্রুর মোকাবিলা এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে প্রতিটি সেনানিবাসে প্রয়োজনীয়ও পর্যাপ্ত যানবাহনের ব্যবস্থা থাকিতে হইবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যানবাহনের ব্যবস্থা বলিতে প্রধানত ঘোড়াই ছিল একমাত্র উপায়। তাই তখনকার যুগে যাতায়াতের একমাত্র অবলম্বন ঘোড়ার প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করা হইত। প্রতিটি সেনানিবাসে পর্যাপ্ত সংখ্যক ঘোড়ার ব্যবস্থা থাকিত। হযরত উমার (রা)-এর খেলাফতকালে এ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করিয়া বলা হইয়াছে যে, প্রত্যেক সেনানিবাসে বিরাট আকার আস্তাবল থাকিত। উহার মধ্যে নূন্যতম চারি হাজার

৩০৯

ঘোড়া প্রস্তুত রাখা হইত। এইভাবে বিভিন্ন সেনানিবাসের সমন্বয়ে যে কোন প্রয়োজনীয় মুহূর্তের জন্য ছত্রিশ হাজার সৈন্যের একটি রিজার্ভ বাহিনী প্রস্তুত রাখা হইত।৬

এইরূপ সুব্যবস্থার দ্বারাই হিজরী ১৭ সনে জাযীরাবাসীদের বিদ্রোহ অতি সহজে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হইয়াছিল। এই ঘোড়াগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং শিক্ষা ও ট্রেনিং-এর অত্যন্ত সুব্যবস্থা ছিল। মদীনার আস্তাবলের তত্ত্বাবধান হযরত উমার (রা) নিজে করিতেন। মদীনা হইতে চার মাইল দূরে এই সকল ঘোড়ার জন্য বিরাট চারণভূমির ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। হযরত উমার (রা) “হানী” নামক জনৈক কর্মচারী দ্বারা এই চারণভূমির রক্ষণাবেক্ষণ করিতেন। এই শ্রেণীর প্রত্যেকটি সরকারী ঘোড়ার উরুদেশে প্রতীক অঙ্কিত থাকিত। ~ … অর্থাৎ আল্লাহর রাস্তার সৈনিক।৭

কুফা শহরস্থ সেনানিবাসের রক্ষণাবেক্ষণের এবং দেখাশুনার ভার ছিল সুলায়মান ইবন আল-বাহিনীর উপর। তিনি এই দায়িত্ব পালনে এত দক্ষ ছিলেন যে, এইজন্য তাহাকে ‘সুলতানুল খায়ল” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সুলায়মান সর্বদা ঘোড়াগুলিকে নানা প্রকারে প্রশিক্ষিত করিয়া তুলিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতেন। বৎসরে একবার পরীক্ষামূলকভাবে ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা করা হইত। কুফার যে স্থানে সর্বদা ঘোড়া রাখা হইত সেই স্থানটি হিজরী চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত “আরী” নামে প্রসিদ্ধ ছিল। ইহার অর্থ হইতেছে আস্তাবল এবং একই কারণে পারস্যবাসীগণ ইহাকে বলিত “আরুখে শাহজান”।

বসরার আস্তাবলের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল যুব ইবন মুয়াবিয়ার উপর। তিনি এক সময় আহওয়াজ প্রদেশের শাসনকর্তার দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন। আধুনিক কালে ঘোড়ার বিকল্প যে সকল যানবাহন আছে তাহার ব্যবস্থা করিতে, হইবে।

ধারা—৯৬১

সীমান্ত রক্ষাব্যবস্থা দেশের সীমান্ত রক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা থাকিবে হইবে।

বিশ্লেষণ

দেশের সীমান্ত রক্ষার ব্যবস্থা সরকারকে করিতে হইবে। সীমান্ত রক্ষার এই ব্যবস্থা হযরত উমার (রা) সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। হিজরী সতের সনে হযরত উমার

৩১০

সিরিয়া সফরে আসিয়া উলুফ, মানবিজ, বাইয্যান, কোরেশ, তাইযীন, এনতাকীয়া প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত শহরগুলি ভ্রমণ এবং প্রত্যেক স্থানেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন ও অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করিয়া যান। যে সমস্ত জনপদ সমুদ্রের উপকূল ভাগে অবস্থিত ছিল, আরবীতে তাহাকে বলা হইত ‘বেলাদুস সাহেলা। তম্মধ্যে আসকালান, ইয়াফা, কায়সারীয়া, আরসুফ, আফা, বৈরূত, তারসুস, সাঈদ, আয়াছ ও লাযীকিয়া ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত উপকূলবর্তী শহর যে কোন সময় রোমীয়দের নৌ-শক্তির কবলে পতিত হইবার আশংকা ছিল। এইজন্য হযরত উমার (রা) এই শহরগুলির সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করেন। এই শহরগুলির তত্ত্বাবধায়ক সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ দান করেন হযরত আবদুল্লাহ ইবন কায়েসকে।

ফুরাত নদীর পশ্চিম তীরবর্তী সীমান্ত শহর বালেসে সৈন্য মোতায়েনের সঙ্গে বিরাট সংখ্যক নওমুসলিম শামী আরবের বসতি স্থাপন করাইয়াছেন। হিজরী উনিশ সনে ইয়াযীদ ইবনে আবু সুফিয়ানের মৃত্যুর পর তাহার ছােট ভাই মোয়াবিয়া হযরত উমার (রা)-এর নিকট লিখিয়া পাঠাইলেন যে, সিরিয়া প্রদেশের উপকূলবর্তী শহরগুলির রক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার। হযরত উমার (রা) ইহার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ লিখিয়া পাঠাইলেন, সমস্ত দুর্গ নূতনভাবে সংস্কার করিয়া তথায় নূতনভাবে সৈন্য আমদানী করিয়া রাখ এবং সমুদ্র তীরবর্তী প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ স্থানে উপযুক্ত পাহারার ও রাত্রি বেলায় ঐগুলিতে উজ্জ্বল আলো প্রজ্বলিত রাখিবার ব্যবস্থা কর। মিসরের শাসনকর্তা হযরত আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে যে সমস্ত সৈন্য ছিল তাহার এক-চতুর্থাংশ এস্কান্দারীয়ায় অবস্থান করিত। আর এক-চতুর্থাংশ সৈন্য তীরবর্তী (সীমান্তবর্তী) শহরগুলিতে মোতায়েন করা হইয়াছিল। আরববাসী অর্ধেক সৈন্য হযরত আমর ইবনুল আসের সহিত ফুসতাতে থাকিত! এই সকল সৈন্য বিশাল বিশাল ভবনে অবস্থান করিত। প্রত্যেক ইমারত বাসিন্দাদের একজন করিয়া নেতা (ইয়ারীফ) থাকিতেন। তাহার মাধ্যমে অধীনস্থ সকলের বেতন ও রসদ সরবরাহ করা হইত। প্রত্যেকটি ইমারতের সম্মুখভাবে প্রশস্ত খােলা ময়দান থাকিত।

হিজরী ১৬ সনে রোম সম্রাট সমুদ্র পথে মিসর আক্রমণ করার আয়োজন করিলে হযরত উমার (রা) সমুদ্র তীরবর্তী এলাকার স্থানে স্থানে অসংখ্য সেনা ছাউনি তৈয়ার করিয়া তথায় আমর ইবনুল আসের সমস্ত সৈন্যের এক-চতুর্থাংশ সেই সমস্ত ছাউনীতে মোতায়েন করেন।১০

৩১১

ইরাক প্রদেশের বসরা ও কুফা অত্যন্ত সুরক্ষিত শহর ছিল। একমাত্র কুফা শহরেই সর্বদা চল্লিশ হাজার সৈন্য মোতায়েন থাকিত। তাহার মধ্যে দশ হাজার সৈন্য সর্বদা বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে লিপ্ত থাকিত। এতদসত্ত্বেও প্রদেশের যে সমস্ত এলাকায় প্রাক-ইসলামী যুগের দুর্গ বা সেনানিবাস ছিল হযরত উমার (রা) সেসবগুলিকে নূতনভাবে সংস্কার করেন এবং যথেষ্ট সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করিয়া রাখেন। খারিবা বা মাবুকা নামক স্থানে প্রায় সাতটি ছােট ঘোট ফৌজি ছাউনী ছিল। এগুলিকেও নূতনভাবে সংস্কার করা হয়।১১ খুযিস্তান প্রদেশে সবচাইতে বেশী ছাউনী তৈয়ার করা হয়। নহরতীরী, মানাযের, সকুল, আহওয়াজ, হরমুজান, সূস, বিনয়ান, জুন্দিশাপুর প্রভৃতি এলাকায় থাকার প্রসিদ্ধ সেনানিবাস ছিল। এতদ্ব্যতীত রায় এবং আযারবাইজানের সেনানিবাসগুলিতেও সর্বদা দশ হাজার সংখ্যক সেনা প্রস্তুত থাকিত। ঠিক এইভাবে স্থানে স্থানে আরও অসংখ্য ছাউনী নির্মিত হইয়াছিল। সিরিয়া এবং মিসর সমুদ্রতীরে অবস্থানের কারণে গ্রীক এবং রোমীয়গণ যে কোন মুহূর্তে আক্রমণ করিতে পারে এই আশংকায় হযরত উমার (রা) অধিকাংশ সেনানিবাস সামুদ্রিক বন্দরগুলিতে এবং রোমীয়দের শক্তিকেন্দ্র এশিয়া মাইনরের নিকটবর্তী স্থানে নির্মাণ করিয়াছিলেন। ইরাকের অবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তথায় রাজশক্তির পরও ছােট ছােট রাইস ও জমিদারের নিরংকুশ প্রভাব বিদ্যমান ছিল। স্থানীয় পরিভাষায় উহাদিগকে “মিরযেবান’ বলা হইত। ইহারা প্রায়ই নিজেদের প্রভাব ও জমিদারী বজায় রাখার জন্য বিদ্রোহ করিয়া বসিত। আবার পরাস্ত হইয়া আনুগত্য স্বীকার করিয়া লইত। কিন্তু কোন সময়ই তাহাদের আনুগত্যের উপর ভরসা ছিল না। এই কারণে ঐ সমস্ত প্রদেশে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখিতে হইত, যাহাতে ক্ষমতা লোভীগণ বিদ্রোহের কল্পনাও করিতে না পারে।১২

ধারা—৯৬২

সৈন্যবিভাগের সম্প্রসারণ প্রয়োজনে সৈন্যবিভাগের সম্প্রসারণ করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

দেশের প্রয়োজনে সৈন্যবিভাগের সম্প্রসারণ করা যাইবে। হযরত উমার (রা) দেশকে বহিঃ আক্রমণ হইতে রক্ষার সমস্ত ব্যবস্থার সংগে সংগে হুকুমতের

৩১২

অন্যান্য বিভাগের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগ দেন এবং অতি অল্প দিনের মধ্যেই এক একটি বিভাগকে এমন সুশৃংখল ও সুষ্ঠ করিয়া তোলেন যে, এখনকার দিনে সভ্যতার মান অনুযায়ী চিন্তা করিতে গেলে উহা সম্পূর্ণ অলৌকিক বলিয়া মনে হয়। যে সৈন্য বিভাগের প্রারম্ভ হযরত উমার (রা) মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন অতি অল্প দিনে তাহা ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হইয়া মক্কার নিকটবর্তী উসফান এলাকা পর্যন্ত সমস্ত কাবিলাগুলির মধ্য ছড়াইয়া পড়ে এবং প্রত্যেক যুদ্ধক্ষম ব্যক্তির তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আরবের শেষ সীমান্তবর্তী ও ইরাকের সংলগ্ন এলাকা বাহরাইনের ও সমস্ত আরব কাবিলাগুলির আম্‌দমশুমারী করিয়া মুজাহিদদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। তালিকা প্রস্তুত হইয়া যাওয়ার পর এই বিরাট সৈন্যবাহিনীর প্রত্যেকের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হয়। এই বিরাট বাহিনীর মোট সংখ্যা কত ছিল তাহা স্পষ্টভাবে কোথায়ও উল্লেখ নাই। তবে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্র দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, এই বাহিনীতে মোট দশ লক্ষ সশস্ত্র সৈন্যের কম কখনও থাকিত না। ঐতিহাসিক ইবন সাদ বর্ণনা করেন যে, এই রিজার্ভ বাহিনী হইতে প্রতি বৎসর ত্রিশ হাজার করিয়া নূতন ফৌজ বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করা হইত। কুফা সম্বন্ধে আল্লামা তাবারী লিখিয়াছেন যে, তথায় এক লক্ষ যোদ্ধাকে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। তাহার মধ্যে চল্লিশ হাজার সৈন্য সর্বদা পর্যায়ক্রমে রায় ও আজারবাইজানের দিকে যুদ্ধে লিপ্ত থাকিত।১৩

হযরত উমার (রা)-এর এইরূপ অভূতপূর্ব সুব্যবস্থার ফলে দীর্ঘকাল পর্যন্ত দুনিয়ায় মুসলমানদের সম্ভ্রম ও মর্যাদা কায়েম ছিল এবং অপ্রতিহতভাবে সর্বত্র ইসলামী মুজাহিদদের বিজয়শ্রোত উদ্যম গতিতে বহিয়া চলিয়াছে। এই সুব্যবস্থায় যে পরিমাণ অপ্রতুলতা দেখা দিয়াছে আরবদের শক্তিতে ততটুকু দুর্বলতা অনুপ্রবেশ করিয়াছে। সর্বপ্রথম আমীর মুয়াবীয়া (রা) এই ব্যবস্থায় ব্যতিক্রম করেন অর্থাৎ তিনি মুজাহিদদের দুগ্ধপোষ্য শিশুদের বৃত্তি বন্ধ করিয়া দেন। তৎপর আবদুল মালেক ইবন মারওয়ান এই ব্যবস্থা আরও সংকুচিত করিয়া দেন এবং শেষ পর্যন্ত খলীফা মুতাসিম বিল্লাহ সৈন্যবিভাগ হইতে আরবদের নাম একেবারে খারিজ করিয়া দেন এবং প্রকৃতপক্ষে এই দিনই রাষ্ট্রক্ষমতাও আরবদের হাত হইতে চিরতরে বিদায় হয়।

হযরত উমার (রা) তাহার সৈন্যবিভাগকে এত ব্যাপক করিয়াছিলেন যে, আরব ব্যতীত বহু অনারব যোদ্ধা সম্প্রদায়কেও তিনি সৈন্যবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করিয়াছিলেন। পারস্য সম্রাট ইয়াযদগির দায়লামবাসীদের চারি হাজার বিশিষ্ট বীরের সমন্বয়ে

একটি দুর্ধর্ষ বাহিনী গঠন করিয়াছিলেন। উহাদিগকে “জুন্দেশাহী বা খাছ শাহী বাহাদুর” বলা হইত। ইহারা কাদেসিয়ার ময়দানে মুসলমানদের সহিত উপর্যুপরি কয়েকটি লড়াই করার পর পারসিকদের নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া মুসলমানদের সহিত আসিয়া মিলিত হয় এবং ইসলাম গ্রহণ করে। কুফার তদানীন্তন শাসনকর্তা হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রা.) ইহাদিগকে ইসলামী ফৌজে ভর্তি করত কুফার নিকটই বসতি স্থাপন করান। সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের পর্যাপ্ত বৃত্তি ও ভাতার ব্যবস্থাও করা হইয়াছিল। পরবর্তী কালে ইসলামী বিজয়ের ইতিহাসে ইহাদের অপূর্ব বীরত্বের কাহিনীও অমর হইয়া রহিয়াছে।

সম্রাট ইয়াজদগির্দের সেনাবাহিনীর আর একজন অগ্রনায়ক ছিলেন “সিয়াহ’ নামক মস্তবড় এক বীরপুরুষ। হিজরী সতের সনে সম্রাট যখন ইস্পাহান চলিয়া যান তখন তিনি সেনানায়ক সিয়াহ-কে তিন শত সাহসী বীরসহ কতিপয় শহর হইতে একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী প্রস্তুত করিবার জন্য ইস্তাখার অভিমুখে প্রেরণ করিয়াছিলেন। তৎপর হযরত আবু মূসা আশয়ারী (রা) যখন সূস শহর অবরোধ করেন তখন সম্রাট তাহার গতিরোধ করার জন্য এই সেনাপতি সিয়াহ-এর বাহিনীকে প্রেরণ করিয়াছিলেন। মুসলমানদের দ্বারা সূস অধিকৃত হওয়ার প্র সেনাপতি সিয়াহ সদলবলে কতিপয় শর্তাবলীসহ শান্তির আবেদন করেন। হযরত আবু মূসা কোন প্রকার শতাধীনে তাহাদিগকে নিরাপত্তার আশ্বাস দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। সুতরাং তিনি সমস্ত বিষয় হযরত উমারের নিটক লিখিয়া পাঠাইলেন। প্রতিউত্তরে হযরত উমার সব শর্ত মানিয়া লওয়ার নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী ইহাদিগকে বসরা শহরে আবাদ করিয়া সকলকে ফৌজের তালিকাভুক্ত করত উপযুক্ত পরিমাণে বৃত্তি ও ভাতার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হয়। সিয়াহ খশরু শাহরিয়ার, শিরওয়াহ শাহরুবীয়া ও আফরুদ্দীন প্রমুখ বিশিষ্ট বাহাদুরদিগকে মাসিক আড়াই হাজার দিরহাম এবং আরও এক শত বাহাদুরকে মাসিক দুই হাজার দিরহাম করিয়া বেতন দেওয়া হইত। তুসতারের ভীষণ যুদ্ধে এই মহাবীর সিয়াহ-এর অপূর্ব কলাকৌশল দ্বারাই মুসলমানগণ জয়যুক্ত হন।১৪

ইয়ামন বিজয়ের পরও তথাকার অধিকাংশ সৈন্য ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিল। এই সমস্ত নওমুসলিম সৈন্যদিগকে ইসলামী ফৌজে শামিল করিয়া লওয়া হইয়াছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, হযরত উমারের সৈন্যবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্যও ছিল। কেননা সিন্ধুর জাঠ জাতির লোকের বিরাট একদল পারস্য সম্রাটের ফৌজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সূস-এর যুদ্ধ জয়ের পর ইহারা সকলেই দলে দলে

৩১৪

মুসলমান হইয়া যায়। অতঃপর ইহাদিগকেও সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করিয়া বসরা শহরে বসতি স্থাপন করানো হয়।১৫

বহু সংখ্যক গ্রীক দেশীয় রোমীয় সৈন্য হযরত উমারের ফৌজের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। মিসর বিজয়ের সময় এই শ্রেণীর পাঁচ শত সৈন্য তাহাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করিয়াছিল। মিসর জয়ের পর সেনাপতি হযরত আমর ইবনে আস ফুসতাত নগরে পৃথক মহল্লায় তাহাদিগকে পুনর্বাসিত করেন। মিসর বিজয়ের অভিযানে প্রায় এক হাজার ইয়াহুদী সৈন্যও ইসলামী সৈন্যবাহিনীতে ছিল।১৬ মোটকথা ইসলামের পূর্ণতার যুগে হযরত উমার (রা) তাহার সৈন্যবাহিনীকে এতদূর সম্প্রসারিত করিয়াছিলেন যে, তাহাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর বীর পুরুষদিগকেই একত্র করা হইয়াছিল। অধিকন্তু স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে সর্ব জাতীয়, বিশেষ করিয়া অগ্নি উপাসক মাজুসীদের বহু লোক শামিল ছিল। এমনকি গুরত্বপূর্ণ সামরিক পদেও মাজুসীদের অস্তিত্বের কথা কোথাও পাওয়া যায়। তবে সর্বদা এই কথা মনে রাখিতে হইবে যে, এইরূপভাবে সর্বজাতি ও সর্ব শ্রেণীর লোককে সৈন্য বাহিনীতে স্থান দেওয়া ইসলামের উদারতা। অন্যথায় অগণিত যুদ্ধ জয়ের জন্য মুসলমানগণ সর্বদা নিজেদের উপরই নির্ভর করিত। এই কথাও অস্বীকার করিবার অবকাশ নাই যে, কোন জাতির সহিত যুদ্ধ করার সময় শত্রু পক্ষীয়দের স্বজাতির দ্বারা যুদ্ধ করানোযুদ্ধবিদ্যার বিরাট কৃতিত্ব এবং মুসলমানগণ অনেক সময়ই এই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়াছেন।

প্রাথমিক যুগে সৈন্যদের নিয়মিত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা ছিল না। এইরূপ অনেক কর্মচারী ছিলেন যাহারা হয়ত অন্য কোন দপ্তরের বেতন ভোগ করিতেন কিন্তু কাজ করিতেন সর্বদা সৈন্যবিভাগে এবং সৈন্যবিভাগের তালিকায় তাহাদের নাম লিখিত থাকিত। কিন্তু কিছু দিন পরেই হযরত উমার এই বিশৃংখল নীতি উঠাইয়া দিয়া সৈন্যবিভাগের দপ্তরকে সম্পূর্ণ পৃথক করিয়া দেন। প্রথম প্রথম যোগ্যতার তারতম্য অনুযায়ী বেতনের তারতম্য করিতে যাইয়া কুরআনের জ্ঞানের দিকেও লক্ষ্য রাখা হইত। কিন্তু যেহেতু সৈন্যবিভাগে দক্ষতা অর্জন করার সহিত কুরআন বিশেষজ্ঞের কোনরূপ সম্বন্ধ ছিল না, সেইজন্য হযরত উমার কুরআন বিশেষজ্ঞের বৈশিষ্ট্যকে সেনাবিভাগের যোগ্যতার মাপকাঠি হইতে বাদ দিয়া উহাকে শিক্ষা বিভাগের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ব্যাপারে তিনি সেনাপতি হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাসকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিলেন যে, সৈন্যদের মধ্যে কুরআন বিশেষজ্ঞের যোগ্যতার প্রতি লক্ষ্য করিয়া কাহাকেও আর বেশি বেতন দিও না।১৭

ধারা-৯৬৩

সৈন্যদের বেতন নির্ধারণ সেনাবাহিনীর জন্য সরকার কর্তৃক নির্দিষ্ট বেতন নির্ধারিত থাকিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য সরকার নির্দিষ্ট হারে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করিবে। হযরত উমার (রা) তাহার সৈন্যদিগকে ব্যবসায়-বাণিজ্য, কৃষিকাজ ইত্যাদি সর্বপ্রকার সাংসারিক ঝামেলা হইতে দূরে রাখিতেন। এইজন্য তিনি তাহাদের প্রত্যেকের জন্য পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছিলেন। পূর্বেকার বেতন সর্বনিম্ন হার বার্ষিক দুই শত দিরহামের স্থলে তিন শত দিরহাম করিয়াছেন। পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদেরকে বার্ষিক হাজার দিরহামের স্থলে দশ হাজার দিরহাম নির্ধারণ করেন। পূর্বে সৈনিকদের শিশুদের ভাতা মায়ের দুধ ছাড়ার দিন হইতে দেওয়া হইত। পরে তিনি তাহা পরিবর্তন করিয়া জন্মদিন হইতে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। উমার (রা) সৈন্যদের রসদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই পদ্ধতিটি গ্রীক দেশীয়দের মধ্যে প্রচলিত ছিল। হযরত উমার (রা) হবুহু তাহার অনুকরণ করিয়াছিলেন। এইজন্য এই বিভাগের নাম ইউনানী বা গ্রীক নাম অনুসারে ‘আহরা’ রাখা হয়। ইহার অর্থ ‘গুদাম’। আহরা বা রসদ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করিয়া হযরত উমার (রা) সিরিয়া প্রদেশে ইহার প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত করেন আমর ইবন উতবাকে। সৈন্যদের সমস্ত শস্য আনিয়া একটি প্রশস্ত গুদামে জমা করা হইত এবং মাসের প্রথম দিকে নির্দিষ্ট এক তারিখে তথা হইতে সৈন্যগণকে মাথাপিছু এক মন পাঁচ সের করিয়া খাদ্যশস্য, ছয় সের জয়তুন তৈল ও ছয় সের সিরকা দেওয়া হইত। পরবর্তী যুগে অবশ্য এই রসদ বিভাগের আরও উন্নতি হইয়াছিল। তখন কাঁচা শস্য বিতরণের পরিবর্তে সৈন্যদেরকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হইত। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইয়াকূবী ওমার (রা)-এর সিরিয়া প্রদেশ সফরের বর্ণনা দিতে গিয়া ইহার বিষয় আলোচনা করিয়াছেন। বেতন এবং রসদের পর সৈন্যদের প্রয়োজনীয় পোশাকের ব্যবস্থাও খলীফার তরফ হইতে করা হইত। উল্লেখিত সমস্ত ব্যবস্থার পরও সৈন্যদিগকে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হইত। আরবীতে এই ভাতাকে বলা হইত মাতুবা’। যুদ্ধের ঘোড়ার ব্যবস্থা সৈন্যকে নিজ ব্যয়ে করিতে হইত। তবে অপারগতা প্রকাশ করিলে সরকারীভাবে ঘোড়ার ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হইত। এইরূপ বিশেষ প্রয়োজনের জন্যই হযরত উমার (রা) দারুল খেলাফতে (রাজধানী) সর্বদা চারি হাজার উৎকৃষ্ট ঘোড়া রাখিতেন।১৮

৩১৬

হযরত উমার (রা) সৈন্যদের বেতন ও ভাতা বণ্টনের জন্য বিভিন্ন মৌসুম নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছিলেন। বৎসরের প্রথমভাগে সৈন্যদের বেতন বসন্তকালের দিকে এবং ফসল কাটার মৌসুমে বড় বড় জায়গীরদারের দেয় করের বিলি-ব্যবস্থা করা হইত।১৯ বেতন বিলির নিয়ম ছিল প্রত্যেক কবিলায় একজন করিয়া ইররীফ বা রঈস থাকিতেন। ইররীফের নিম্নে প্রতি দশজন সৈন্যের মধ্যে একজন করিয়া নেতা থাকিতেন। ইহাদিগকে উমারাউল আশার বলা হইত।১৯

বেতন সর্বপ্রথম ইহাদের হাতে দেওয়া হইত এবং তাহারা ইহা ইররীফের হাতে দিতেন, আর ইররীফ তাহার নিজ নিজ কবিলার লোকদের হাতে তাহা

পৌছাইয়া দিতেন। প্রত্যেক ইররীফ অন্তত এক লক্ষ টাকা বণ্টন করিতেন। একমাত্র কূফা ও বসরা শহরেই এক শত ইররীফ ছিলেন। ইহাদের মাধ্যমে গড়ে বৎসরে এক কোটি দিরহাম বণ্টনের ব্যবস্থা করা হইত। বেতন বণ্টন ব্যবস্থায় অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করা হইত। একবার ইরাকে উমারাউল-আশারগণ বেতন বণ্টন করিতে যাইতে সামান্য দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই কথা হযরত উমার (রা) জানিতে পারিলেন। তিনি হযরত সায়ীদ ইবনে ইমরান, মাশয়ালী ইবনে নাযীম প্রমুখ আরবের বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তিগণকে উহার তদন্তের জন্য নিযুক্ত করেন। তাহারা উহা সূক্ষ্মভাবে তদন্ত করিয়া দ্বিতীয়বার সৈন্যদের পদমর্যাদা এবং বেতন নির্ধারণ করিয়া এবং প্রতি দশজনের পরিবর্তে প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন করিয়া আমীর নিযুক্ত করার সুপারিশ করেন।২০।

প্রতি কাবিলায় একজন করিয়া রঈস বা ইররীফ নিযুক্ত করাও হযরত উমারেরই আবিস্কার। কানযুল উম্মাল কিতাবের বাবুল জিহাদে ইমাম বায়হাকী হইতে বর্ণনা করা হইয়াছে, সর্বপ্রথম যিনি সৈন্যদের নিয়ম-শৃংখলা এবং ইররীফ নিযুক্তির ব্যবস্থা করেন তিনি হইতেছেন উমার ইবনুল খত্তাব (রা)। সৈন্যদের বেশি দিনের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ বিশেষ বীরত্বের জন্য কিছু দিন পরপর বেতন বৃদ্ধিরও ব্যবস্থা ছিল। কাদেসিয়ার ময়দানে যুহরা আসমা আদাবী প্রমুখ বাহাদুরদের অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শনের পুরস্কারস্বরূপ তাহাদের বেতন দুই হাজার হইতে আড়াই হাজারে উন্নীত করা হইয়াছিল। বেতন ব্যতীত যুদ্ধ শেষে গনীমতের যে সমস্ত মাল পাওয়া যাইত তাহারও নির্দিষ্ট একটা অংশ সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হইত। এই অর্থের নির্দিষ্ট কোন পরিমাণ ছিল না। একমাত্র জালুলার যুদ্ধেই প্রত্যেক অশ্বারোহী সৈন্য মাথাপিছু নয় হাজার দিরহাম এবং নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে ছয় হাজার দিরহাম লাভ

করিয়াছিলেন।২১

৩১৭

ধারা-৯৬৪

সৈন্যদের স্বাস্থ্য রক্ষাব্যবস্থা প্রত্যেক সৈনিকের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

সামরিক বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের জন্য স্বাস্থ্য রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করিতে হইবে। হযরত উমার (রা) সৈনিকের স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছিলেন। যেমন (ক) মৌসুম অনুযায়ী সৈন্য চালনা, (খ) বসন্ত কালে সৈন্যদের অবস্থান, (গ) সেনানিবাসের আবহাওয়া, (ঘ) বিশ্রামের ব্যবস্থা, (সা) বার্ষিক ছুটি ও (চ) সৈন্যদের পোশাক।

সুম অনুযায়ী সৈন্য চালনা : দেশের কোন অঞ্চলে তথাকার ঋতু ও আবহাওয়ার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া সৈন্য প্রেরণ করা হইত। অর্থাৎ শীত প্রধান অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে এবং গ্রীষ্ম অঞ্চলে শীতকালে সৈন্য প্রেরণ করিতেন। তদানীন্তন আরবদের পরিভাষায় এই ব্যবস্থাকে শাতীয়া (L.) এবং সাফীয়া (L) বলা হইত। আজ পর্যন্ত উক্ত শব্দগুলির ব্যবহার দেখা যায়। এই ব্যবস্থাটি হযরত উমার (রা) হিজরী সতের সনে প্রবর্তন করেন।

বসন্ত কালে সৈন্যদের অবস্থান ও বসন্ত কালে সৈন্যদের এমন স্থানে প্রেরণ করা হইত যেখানকার আবহাওয়া উত্তম। স্বাস্থ্যসম্মত এবং ভূমি শস্য শ্যামল থার্কিত। হিজরী সতের সনে মাদায়েন জয় হওয়ার পর যখন সেখানকার খারাপ আবহাওয়ায় সৈন্যদের স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল তখন এই নিয়মের প্রবর্তন করা হয়। হযরত উমার (রা) সেনাপতি উতবা ইবন গাযওয়ানকে লিখিয়াছিলেন যে, বসন্ত ঋতুতে সর্বদা সৈন্যদিগকে উত্তম আবহাওয়া এবং ফলমূলের এলাকায় পাঠাইয়া দিবে। মিসরের শাসনকর্তা হযরত আমর ইবনুল আস সর্বদা গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে সৈন্যগণকে শহরের বাহিরে পাঠাইয়া দিতেন এবং নির্দেশ দিতেন যেন সৈন্যগণ বনে-জঙ্গলে শিকার করিয়া বেড়ায় এবং উন্মুক্ত মাঠে ঘোড়া চরায়।

সেনানিবাসের আবহাওয়া : সেনানিবাসের ছাউনী সবত্রই উৎকৃষ্ট আবহাওয়াপূর্ণ স্থানে তৈয়ার করা হইত এবং ছাউনীর সম্মুখে বিস্তীর্ণ খােলা ময়দান রাখা হইত। কুফা, বসরা, ফুসতাত প্রভৃতি যে শহরগুলি বিশেষ করিয়া সেনাবাহিনীর জন্য তৈয়ার করা হইয়াছিল সেগুলির রাস্তা, নর্দমা বড় ও প্রশস্ত করিয়া তৈয়ার করা

৩১৮

হইত। হযরত উমার (রা) এই ব্যাপারে এত গুরুত্ব দিতেন যে, স্বয়ং তিনি প্রতিটি রাস্তা ও গলির পরিমাণ ঠিক করিয়া দিতেন।

বিশ্রাম ও কোথায়ও সৈন্য প্রেরণের সময় বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হইত যেন যাত্রাপথে সৈন্যগণ প্রতি শুক্রবার দিন কোথাও পূর্ণ একদিন ও একরাত বিশ্রাম করিয়া এবং পোশাক-পরিচ্ছদ ও অস্ত্রশস্ত্র গুছাইয়া লয়। বিশেষ করিয়া প্রতিদিন যেন এতটুকু পথ চলে যাহাতে কাহারও মধ্যে ক্লান্তি না আসে এবং শিবির স্থাপন করার সময় স্থান দেখিয়া তাঁবু স্থাপন করা হয়, যেখানে সর্ব প্রকার প্রয়োজনীয় বস্তু, বিশেষত প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। উমার (রা) সেনাপতি সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস (রা)-এর নিকট যে নির্দেশনামা প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহার মধ্যে উল্লেখিত বিষয়গুলির বিস্তারিত উল্লেখ ছিল।

বার্ষিক ছুটি ও জন্মভূমি হইতে দূরে কর্মব্যস্ত সৈনিকদিগকে বৎসরে একবার বা দুইবার ছুটি দেওয়া হইত। একদা হযরত উমার (রা) জনৈক প্রবাসী সৈনিকের স্ত্রীকে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী বিরহগাথা গাহিতে শুনিয়া শেষ পর্যন্ত সৈনিকের প্রতি চার মাস অন্তর একবার ছুটি দেওয়ার নির্দেশ দেন। উল্লেখিত সুযোগ-সুবিধা কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় অবস্থা বিশেষেই দেওয়া হইত। অন্যথায় হযরত উমার (রা) তাহার সৈন্যদের আরামপ্রিয়তা, আলস্য ও অকর্মন্যতা প্রভৃতি যাবতীয় দোষ হইতে সর্বদা দূরে রাখার জন্য অত্যন্ত কঠোরতার সহিত চেষ্টা করিতেন। সৈন্যদের প্রতি তাহার বিশেষ নির্দেশ ছিল, গদী না করিয়াই অশ্বে আরোহণ করিতে হইবে। কেহ পাতলা সূক্ষ্ম কাপড় পরিধান করিতে পারিবে না।

সৈন্যদের পোশাক : হযরত উমার (রা) তাহার সৈন্যদের জন্য বিশেষ কোন ইউনিফর্ম বা উর্দির প্রচলন করিয়াছিলেন কিনা ইতিহাসে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সৈন্যদের প্রতি তাহার যে সমস্ত নির্দেশাবলী ইতিহাসে পাওয়া যায় তাহাতে শুধু এতটুকু পরিদৃষ্ট হয় যে, তিনি সৈন্যদিগকে আজমী বা অনারবদের পোশাক পরিতে নিষেধ করিতেন। যতদূর মনে হয় এই নির্দেশের কোনরূপ কড়াকড়ি ছিল না।২২ কেননা হিজরী একুশ সনে মিসরে যিম্মীদের উপর যে জিয়া কর ধার্য করা হয় তাহার মধ্যে সৈন্যদের পোশাক সরবরাহের কথাও উল্লেখ ছিল। আর সেই পোশাক ছিল পশমী জুব্বা, বিশেষ এক প্রকার টুপি বা পাগড়ি, পায়জামা ও মোজা। অথচ প্রাথমিক যুগে হযরত উমার (রা) সৈন্যদেরকে পায়জামা ও মোজা পরিধান করিতে সরাসরি নিষেধ করিতেন।২৩

ধারা-৯৬৫

অধিনায়ক নিয়োগ সরকার যে কোনো সেনা অভিযানের পূর্বে একজনকে অধিনায়ক নিয়োগ করিবেন।

বিশ্লেষণ

কোথাও সেনা অভিযানের প্রয়োজন দেখা দিলে সকরার একজনকে অধিনায়ক নিয়োগ করিয়া সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করিবে। সামরিক অভিযানের আমীর বা

অধিনায়ক নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার আগে ইসলামী সামরিক ব্যবস্থার সংগঠনে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অবস্থান সম্পর্কে দুই-একটি কথা বলা প্রয়োজন। মদীনার সনদ’ নামে সাধারণভাবে পরিচিত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর “কিতাব অনুযায়ী তিনি ইসলামী উম্মাহ তথা ইসলামী রাষ্ট্রের ঐশী পরিচালক হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন। বিশেষভাবে সংবিধানের সনদের ৩৬ ধারাবলে তাহার হাতে সামরিক ক্ষমতাও অর্পিত হইয়াছিল। ফলে মদীনার ব্যবসায়ীগণকে যুদ্ধে যোগদানের অনুমতি প্রদানের অধিকার তাঁহার ছিল। কিন্তু ইহার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেনাবাহিনীসহ সকল প্রশাসনিক শাখায় কর্মকর্তা নিয়োগের সর্বময় ক্ষমতা ও অধিকার। এই ক্ষমতা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে ইসলামী বাহিনীর সর্বাধিনায়কে পরিণত করে এবং এই কারণে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিপুল সংখ্যক যুদ্ধাভিযানে নেতৃত্ব দেন। ইহা সর্বজনবিদিত যে, হিজরতের মাত্র ৬ মাস পর ১ম হিজরীর রমযান মাসে (৬২৩ খৃস্টাব্দের মার্চ) একটি সামরিক অভিযানের প্রথম সামরিক অধিনায়ক নিয়োগ করা হয় এবং সর্বশেষ সেনাধিনায়ক নিয়োগ করা হয় ১১শ হিজরীর রবিউস সানী

৬৩২ খৃষ্টাব্দে জুন মাসে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনের অন্তিমকালে। প্রথম ও শেষ সেনা-অভিযানের অধিনায়কদের মধ্যে সর্বমোট ৭২টি নিয়োগ দান করা হইয়াছিল। অবশ্য মাত্র ৪৭ জন বিভিন্ন সারিয়ায় (ক্ষুদ্র সামরিক অভিযান) সেনা অধিনায়কের দায়িত্বভার লাভ করেন। অধিনায়ক পদে নিয়োগের সংখ্যা এবং সেনা অধিনায়কদের প্রকৃত সংখ্যার মধ্যে ব্যবধানের কারণ এই যে, কতিপয় অধিনায়ক একাধিকবার এ মর্যাদাজনক পদে নিযুক্তি লাভ করিয়াছিলেন। এই সকল অধিনায়কের মধ্যে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা, আলী ইবন আবু তালিব, গালিব ইবন আবদুল্লাহ এবং হযরত খালিদ ইবন ওয়ালীদ খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। প্রথম দুইজন ৩টি অভিযানে নেতৃত্ব প্রদান করেন। অন্যদিকে শেষোক্ত দুইজন ৪টি অভিযানে ইসলামী

৩২০

সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ২৪ কিন্তু মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের প্রথম ৬ বৎসরে সবচাইতে খ্যাতিমান ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অধিনায়ক কুরাইশ বা আনসারদের কেহই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিখ্যাত আরব পরিবারের সদস্য এবং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আযাদকৃত গোলাম যায়দ ইবন হারিসা। তিনি ৯টি অভিযানে মুসলিম সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দান করেন। তাহার প্রথম অভিযান ছিল ৩য় হিজরীর জামাদিউস সানী মাসে এবং সর্বশেষ অভিযান পরিচালনা করেন ৮ম হিজরীর জামাদিউল আওয়াল মাসে (৫২৯ খৃস্টাব্দে)। তথ্যসমূহ জোর দিয়া উল্লেখ করিয়াছে যে, যায় কোন অভিযানে উপস্থিত থাকিলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাহাকেই অধিনায়ক হিসাবে মনোনীত করিতেন। ২৫ প্রথম সারির অধিনায়কবৃন্দ ছাড়াও আরও ৬জন

অধিনায়ক মুসলিম সেনাবাহিনীকে দুইবার করিয়া নেতৃত্ব দেন।২৬

স্বাধীনভাবে কোন অভিযানের দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছে এইরূপ সামরিক অধিনায়কদের মোট সংখ্যা ছিল ৭৪টি। কিন্তু ৭৪টি সেনা অভিযানে ৪৯ জন অধিনায়ক নিয়োগ লাভ করিয়াছিলেন। আমীর-ই সারায়া অর্থাৎ সেনাধিনায়ক পদে এইরূপ বিপুল সংখ্যক নিয়োগ প্রদান এই সত্যকে প্রতিফলিত করে যে, অধিনায়কদের পদ তখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে নাই। ইহা কোন স্থায়ী নিয়োগ ছিল না এবং সেনাধিনায়কগণ কোন বিশেষ অভিযানের দায়িত্ব লাভ করিতেন মাত্র। অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি আর ঐ পদে থাকিতেন না। দুইটি কারণে সারায়ার অধিনায়কদের অস্থায়ী দায়িত্ব দেওয়া হইত।

প্রথমতঃ ইসলামী রাষ্ট্রের কোন সেনাবাহিনী ছিল না। কোন বিশেষ অভিযান শেষ হওয়ার পর মুসলিম বাহিনীকেও ভাঙ্গিয়া দেওয়া হইত।

দ্বিতীয়তঃ রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই ছিলেন মুসলিম বাহিনীর একমাত্র স্থায়ী সামরিক অধিনায়ক। প্রকৃতপক্ষে তিনি সাময়িকভাবে সারায়ার (অভিযানসমূহের) অধিনায়কবৃন্দের কাছে তাঁহার সামরিক ক্ষমতা হস্তান্তর করিতেন। সামরিক অধিনায়কদের পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোত্র হইতে সাধারণত বেশী অধিনায়ক নিয়োগ লাভ করিত। কারণ আরবের গোটা গোত্রীয় সমাজের মধ্যে কুরাইশ গোত্রের সদস্যরাই ছিল সামর্থ্য এবং সংখ্যার দিক হইতে শক্তিশালী। মক্কার শাসককুলে বনূ মাখযুম সামরিক নেতৃত্বে সবচাইতে বেশী প্রসিদ্ধ অর্জন করে এবং এই গোত্রের প্রতিনিধি খালিদ ইবন ওয়ালীদ মাখযুমী বিভিন্ন অভিযানে এক বিরল সামরিক কৃতীত্ব অর্জন করেন। ফলে এই বংশগুলির মধ্যে কোনটি অধিক সামরিক শৌর্যবীর্যের অধিকারী তাহা নির্ধারণ করা খুবই দুরুহ ব্যাপার।

৩২১

কুরাইশ গোত্রের শেষোক্ত ৩টি বংশ সামরিক পেশায় ততটা প্রতিনিধিত্ব করিতে পারে নাই। অথচ তায়ম বংশের আবু বাকর (রা), আদী বংশের উমার ইবনুল খাত্তাব এবং ফিহর বংশের আবু উবায়দা ইবনুল জাররাহ (রা) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পর ইসলামী উম্মার সবচেয়ে শক্তিধর ও সম্মানিত সদস্য হিসাবে বিবেচিত ছিলেন। কুরাইশ বংশের পর অন্যান্য গোত্রের মধ্যে মদীনার দুইটি প্রধান গোত্র আওস ও খাজরাজ যুগ্মভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল। তাহাদের গোত্র হইতে ১১জন সদস্য ১৭ টি সেনা অভিযানে অধিনায়কের পদ অলংকৃত করেন।২৭

ধারা—৯৬৬

সেনাবাহিনীর বিন্যাস প্রয়োজনমত সেনাবাহিনীতে বিন্যাস সাধন করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

সেনাবাহিনীতে যে কোন প্রয়োজনে বিন্যাস সাধন করা যাইবে। ইসলামের বিখ্যাত দার্শনিক ঐতিহাসিক ইবন খালদুল বলিয়াছেন, পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে যুদ্ধের যে সাধারণ রীতি প্রচলিত ছিল তাহা হইল “আলকার ওয়া আলফার” অর্থাৎ আক্রমণ ও পশ্চাদপসরণ। কিন্তু ইসলাম আবির্ভাবের প্রাক্কালে তাহারা অনারব লোকদের লইয়া সেনাবাহিনী গড়িয়া তুলিতে আরম্ভ করে। ইহা করার পিছনে তাহাদের দুইটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ শত্রুপক্ষের যুদ্ধের মোকাবিলা, দ্বিতীয়তঃ স্বীয় বাহিনীকে অধিকতর কার্যকর করিয়া গড়িয়া তোলা। তাহাদের বেপরোয়া লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ইহাই ছিল অধিকতর সঠিক পদ্ধতি ইস্তিমাতাহ। ২৮ পূর্ববর্তী লেখকগণ কর্তৃক “আল-খামিস” নামে আখ্যায়িত পদ্ধতিতে সেনাবাহিনীকে পাঁচটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হইত।২৯ প্রচলিতভাবে এ ভাগগুলি কালব (কেন্দ্র), মায়মানাহ (দক্ষিণ বাহু) মায়সারাহ (বাম বাহু), মুকাদ্দামাহ (অগ্রবর্তী বাহিনী) ও সাবাহ (পশ্চাদরক্ষী)। ইবন খালদূন এই নয়া বিন্যাসকে যাহফ বলিয়াও আখ্যায়িত করিয়াছেন এবং এমন এক রণপদ্ধতি বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন যাহাতে সেনাবাহিনী নামাযের সারির মত বিভিন্ন সারিতে বিভক্ত হইয়া দাঁড়ায়। এই পদ্ধতি শত্রুবাহিনীর জন্য ছিল রীতিমত ভীতিকর। ইসলামের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে আরবে এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) পরবর্তী কালে ভিন্নভাবে সৈন্যবাহিনী বিন্যাস

৩২২

সাধন করেন। গ্রন্থসূত্ৰসমূহ “খামিস” পদ্ধতি এবং ইসলামী বাহিনীর শাখা

অধিনায়কদের নিয়োগ সম্পর্কে পর্যাপ্ত বিশ্বাসযোগ্য তথ্য প্রদান করিয়াছে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর গাযাওয়াত সম্পর্কে এই ধরনের তথ্য যত বেশী পাওয়া যায় সারায়া’ সম্পর্কে সে তুলনায় অনেক কম তথ্য পাওয়া যায়। ইহা খুবই স্বাভাবিক। কারণ সারায়া সাধারণত ক্ষুদ্র অভিযান ছিল। অন্যদিকে পাঁচটি শাখা (বাহু) সম্বলিত “খামিস” পদ্ধতিতে সেনা বিন্যাসের জন্য এক বড় বাহিনীর প্রয়োজন হইত। অবশ্য বৃহৎ সারায়া’গুলিতেও এই ধরনের সামরিক বিন্যাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। মনে হয় মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকের মাসগুলিতে যেহেতু কোন নিয়মিত সেনাবাহিনী ছিল না, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া হয় নাই। তখন সকল প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানকে লইয়া ইসলামী বাহিনী গঠিত হয়। উপরন্তু মুসলমানদের তখন পর্যন্ত কোন সুপরিকল্পিত যুদ্ধ বা শত্রু বাহিনীর সহিত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকায় তাহারা তাহাদের সামরিক ব্যবস্থাকে সংগঠিত করিবার কথা ভাবেনাই।

যাহা হউক অল্পকাল পর ২য় হিজরী / ৬২৪ সালে বদরের যুদ্ধে সুসংগঠিত মক্কা বাহিনীর সম্মুখীন হইলে মুসলিম বাহিনী তড়িঘড়ি করিয়া প্রচলিত পদ্ধতিতে সৈন্য বিন্যাস করে। এই যুদ্ধে যদিও “খামিস” পদ্ধতির সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই, তবুও উহার অনুসরণ ও প্রয়োগের আভাস সর্বত্র পাওয়া যায়। ওয়াকিদী বদর যুদ্ধের কয়েক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সেনাবাহিনীর মায়মানা ও মায়সারা বাহুর উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা সুবিদিত ঘটনা যে, রাসূলুল্লাহ (সা) একটি সুবিধাজনক স্থানে দাঁড়াইয়া যুদ্ধ পরিচালনা করেন।৩১ সুতরাং ইহা হইতে বুঝা যায় যে, তিনি নিজে মুসলিম বাহিনীর কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন। একটি বিবরণ অনুযায়ী হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা) ডান বাহুর নেতৃত্ব দিয়াছিলেন। বাম বাহুর নেতৃত্বেও হয়ত কেহ ছিলেন। মদীনার শিশু ইসলামী রাষ্ট্র যদিও সময় বা অভিজ্ঞতার কারণে তাহার সেনাবাহিনী সংগঠিত করিতে পারে নাই, কিন্তু মক্কার কুরাইশদের ক্ষেত্রে সে সময় এবং পাঁচটি খামিস’ বাহুতে সেনাবাহিনীকে বিন্যস্ত করার দীর্ঘ ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল। একটি দুর্বল সূত্রে এ কথা উল্লেখিত হইয়াছে।

উপরন্তু ইসলামী বাহিনীর ৩টি সুনির্দিষ্ট বাহু ছিল। মুহাজির, খাজরাজী ও আওসীদের লইয়া পৃথক পৃথকভাবে এই সকল বাহু গঠন করা হয়। কার্যকরভাবে মোকাবিলার লক্ষ্যে ইসলামী বাহিনী সুনিশ্চিতভাবে খালিদ ইবন ওয়ালীদ মাখযুমীকে ডান বাহু ও ইকরামা ইবন আবু জাহল মাখযুমীকে ডান বাহুতে মোতায়েন করার প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (সা)-ও তাঁহার বাহিনীকে স্ব স্ব অধিনায়কের অধীনে দুইটি

৩২৩

বাহুতে বিন্যস্ত করেন। উসদ গ্রন্থে বলা হইয়াছে, আল-মুনযির ইবন আস মুসলিম বাহিনীর বাম বাহুর নেতৃত্ব দিয়াছিলেন। ইহা হইতে ধারণা পাওয়া যায় যে, ডান বাহুতে কোন একজন নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে পরোক্ষভাবে হইলেও তাবারী এই ঘটনার সত্যতা সমর্থন করিয়াছেন। তিনি বলেন, হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব ইসলামী অগ্রবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। সুনির্দিষ্টভাবে অন্য বাহু বা এই বিষয়ে আর কোন উল্লেখ না করা হইলেও ইহা বলা যায় যে, উহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার সময়ের মধ্যেই ‘খামিস’ পদ্ধতি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হইয়াছিল।

মুরায়সী অভিযানকালে মুসলিম বাহিনীর আরেকটি শাখা সাবাহ (পশ্চাদ বাহিনী)-র উল্লেখ পাওয়া যায়। অন্যদিকে বনূ কুরাইজার বিরুদ্ধে গাযাওয়াহ পরিচালনাকালে মুকাদ্দিমার (অগ্রবাহিনী) কথা জানা যায়। হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা) এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। ৪।

ওয়াকিদী খায়বার অভিযানের যে বর্ণনা দিয়াছেন সেখানে ‘আল-খামিস’ বিষয়টির প্রথম স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। ইহার পর হইতে মুসলিম বাহিনীর ৫টি বিন্যাস পদ্ধতির কথা স্পষ্ট বা অস্পষ্টভাবে বারংবার উল্লেখিত হইয়াছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা) প্রেরিত উমরাতুল কাজা, মুতা, মক্কা বিজয়, হুনায়ন, আওতাস, তাইফ, তাবুক অভিযান। উমরাতুল কাযা অভিযানে ১০০ অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া গঠিত অগ্রবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা আওসী। অন্যদিকে অস্ত্রশস্ত্রসহ আর একটি ডিভিশনকে (আস্-সিলাহ) বাশীর ইবন সাদ খাযরাজীর নেতৃত্বে দেওয়া হইয়াছিল।

৬ মাস পূর্বে মুতা অভিযানে যায়দ ইবন হারিসার নেতৃত্বাধীন মুসলিম বাহিনীর ডান বাহুর কমান্ডার হিসাবে কুতবা ইবন কাতাদাকে নিয়োগ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক এই অভিযানে নিযুক্ত তিনজন সেনাপতি পরপর নিহত হওয়ায় মুসলিম সৈন্যরা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় খালিদ ইবন ওয়ালীদ মাখযুমী মুসলিম বাহিনীর সংকটময় মুহূর্তে নিজেই সেনাপতি নিযুক্ত হন এবং তিনি পঞ্চ বিন্যাস পদ্ধতির কৌশলগত পরিবর্তন ঘটান। এই নূতন ও অপরাজেয় সেনাপতি মুসলিম সৈন্যের অগ্রবাহিনীকে পশ্চাদ বাহিনীর স্থানে স্থাপন এবং দুইটি বাহুর অবস্থান পরিবর্তন করিয়া মুসলিম বাহিনীর সেনাবিন্যাসে আমূল পরিবর্তন ঘটান। মক্কা অভিযানকালে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, খালিদ ইবন ওয়ালীদ ১০০০ সৈন্যের মুসলিম অগ্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেন এবং অন্য তিনটি বাহুর নেতৃত্ব দেন রাসূলুল্লাহ (সা) স্বয়ং। উল্লেখ্য, মুসলিম বাহিনী আরবের বিভিন্ন গোত্র কর্তৃক সরবরাহকতৃ

মক্কা অভিযুলবাহিনীর নেতৃত্ব বাহিনী আরবে

৩২৪

সৈন্য লইয়া গঠিত ছিল। স্ব স্ব গোত্র বা শাখা প্রধানগণ স্ব স্ব দলের নেতৃত্বে ছিলেন। কিন্তু সম্মিলিত বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সা) নিজেই। হুনায়ন ও তাইফ এবং খায়ল অভিযানে খামিস পদ্ধতির কথা জানা যায়। এই সকল

অভিযান খালিদ ইবন ওয়ালীদের সুদক্ষ নেতৃত্বে পরিচালিত হইয়াছিল। এসকল সাক্ষ্য-প্রমাণের আলোকে বলা হয় যে, তাবুক অভিযানকালে বিশাল মুসলিম বাহিনীকে “খামিস” পদ্ধতিতেই বিন্যস্ত করা হইয়াছিল। সব মিলাইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ কৌশল এবং সেনা বিন্যাসে খামিস’ পদ্ধতি গ্রহণ করা হইয়াছিল।

ধারা-৯৬৭

আল-হারাস বাহিনী মোতায়েন দেশের রাজধানীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার জন্য আল-হারাস বা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা যায়।

বিশ্লেষণ

যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দেশের রাজধানীকে সুরক্ষা করিবার জন্য আল-হারাস বা বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। আল-হারাস সম্পর্কে কিতাবে উল্লেখ আছে বৈরিতার সময় ইসলামী সেনাবাহিনী তাহার বিরুদ্ধে উথিত চ্যালেঞ্জমোকাবিলায় রাজধানীর বাহিরে চলিয়া গেলেও রাজধানীতে একটি সেনা গ্যারিসন মোতায়েন থাকিত। যাহাতে সেনাবাহিনীর অবর্তমানে আশপাশের কোন বৈরী শত্রুর হামলার বিরুদ্ধে রাজধানীর অধিবাসীরা আত্মরক্ষা, প্রতিরোধ বা পাল্টা আক্রমণ চালাইতে পারিত। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গোড়ার দিকে এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের পরও মদীনায় মুসলমানগণ নিজেদের খুব একটা নিরাপদ ভাবিতে পারিত না। কারণ স্বার্থলোভী মুনাফিক ও ইয়াহুদী গোত্রের শাখাগুলি রাজধানী শহরের বিষয়াদিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য শক্তি সঞ্চয়ে ব্যস্ত থাকিত।

এমতাবস্থায় সদর দফতরের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে অধিক মনোযোগের ও প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার সামরিক দূরদৃষ্টিবলে মদীনার প্রতিরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। একারণেই দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা) যখনই মদীনার বাহিরে যাইতেন, তাহার অনুপস্থিতকালে মদীনার উপর বাহিরের হামলা প্রতিরোধ বা আভ্যন্তরীণ গোলযোগ দমনের উপযোগী একটি শক্তিশালী

৩২৫

সেনাবাহিনী রাখিয়া যাইতেন। এমনকি তাঁহার মদীনায় অবস্থানকালেও বাহিরে কোন মারাত্মক হামলা মোকাবিলায় তিনি এই কর্তব্য পালনে সচেতন থাকিতেন। ইহা ছাড়াও তিনি সাধারণভাবে মুসলিম সম্প্রদায় এবং বিশেষত ইসলামী রাষ্ট্রের কার্যাদি পরিচালনার জন্য তাঁহার পক্ষ হইতে একজন নায়েব নিয়োগ করিতেন। এই সকল ডেপুটিগণ সমর নায়কের চাইতেও অনেক বেশী বেসামরিক প্রশাসক ছিলেন। প্রায় সকল গাযওয়ার ঘটনাতেই আল-হারাস নামে রাজধানী রক্ষার জন্য নিয়োজিত একটি গ্যারিসন বাহিনীর কথা জানা যায়।

উহুদ অভিযানকালে আওসীয় প্রধান সাদ ইবন মুয়াযকে হারাস-এর কমান্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল। খন্দক অভিযানের কঠিন পরিস্থিতির সময় কুরায় গোত্রের ইয়াহুদীদের সম্ভাব্য হামলা বা আরব ষড়যন্ত্রকারীদের আক্রমণ হইতে মদীনাকে রক্ষার জন্য কালব গোত্রের যায়দ ইবন হারিসা এবং আওস গোত্রের সালামা ইবন আসলামের নেতৃত্বে যথাক্রমে ৩০০ ও ২০০ অশ্বারোহী সৈন্যের দুইটি বাহিনী মোতায়েন করা হয়। ৬ হিজরীর রবিউস সানী মাসে গাতাফান গোত্রের একটি অংশের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অভিযানকালে খাযরাজ গোত্রের প্রধান সাদ ইবন উবাদাহ এককভাবে তাহার গোত্রের ৩০০ সৈন্য লইয়া গঠিত হারাস -এর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। হারাস সম্পর্কে যদিও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়

, তবুও একথা বলা যায় যে, হারাস-এর দায়িত্বভার প্রদান এবং সৈন্য সংগ্রহ উভয়ই দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া মদীনার দুইটি প্রধান আরব গোত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

আরেক ধরনের আল-হারাস ছিল যাহাকে পর্যবেক্ষক বাহিনী হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। এই বাহিনী শত্রুর নৈশ আক্রমণ প্রতিহত করিবার লক্ষ্যে শিবির স্থাপন এবং বিশেষ করিয়া রাতের বেলা শত্রুবাহিনীর গতিবিধির উপর নজর রাখিত। বদর যুদ্ধের সময় এই ব্যবস্থা লওয়া হইয়াছিল কিনা তাহা সুনির্দিষ্টরূপে জানা যায়

। তবে ধারণা করা হয় যে, খুব সম্ভব এই ব্যবস্থাই হইয়াছিল। কিন্তু উহুদ অভিযানকালে আল-হারাস সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা যায়।৩৯ বিভিন্ন সফল অভিযানের ঘটনা হইতে উহা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, একজন কমান্ডারের অধীনে নৈশ্য প্রহরী বা পর্যবেক্ষক বাহিনী গঠন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।

, আওস গোত্রের মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ও আব্বাদ ইবন বিশর খাযরাজ গোত্রের আওস ইবন খাওলী এবং কুরাইশ গোত্রের উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) আল-হারাস-এর খ্যাতনামা কমান্ডার ছিলেন। তবে মনে হয় এ ব্যাপারে আওস গোত্র দক্ষতা ও নৈপুণ্যে অন্য সবাইকে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। কারণ ৩ হিজরী হইতে

৩২৬

,

৮ হিজরীর মধ্যে এই গোত্রের দুইজন সদস্য এইরূপ ৬টি নিয়োগ লাভ করিয়াছিলেন। সূত্ৰসমূহ হইতে জানা যায় যে, প্রথম উল্লিখিত দুইজন কমান্ডার মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা ও আব্বাদ ইবন বিশর বিভিন্ন উপলক্ষে নৈশ্য কালীন প্রহরায় অত্যন্ত দক্ষতা প্রদর্শন করেন।

কোন অভিযানকালের পুরা সময়টিতে হারাস-এর নেতৃত্বের দায়িত্ব সাধারণত এক ব্যক্তির উপরই ন্যস্ত করা হইত। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন বড় ধরনের কোন বিপদ দেখা দিত তখন একটিমাত্র হারাস -এর জন্যও একাধিক কমান্ডার নিয়োগ কিংবা স্ব স্ব প্রধানের নেতৃত্বে হারাস-এর বিভিন্ন দলকে ন্যস্ত করা হইত। যেমন উমরাতুল কাজা অভিযানকালে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা, আব্বাদ ইবন বিশর ও আওস ইবন খাওলী পর্যায়ক্রমে নৈশ বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হইয়াছিলেন।

নৈশরক্ষী ছাড়াও আল-হারাস-এর অপর একটি অংশ ছিল শিবিররক্ষী। তাহারা তাহাদের নিজস্ব কমান্ডারের অধীনে সহযোগী সৈন্যদের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত থাকিত। কোন কোন সময় এক বা দুইজনকে এই দায়িত্ব দেওয়া হইত ৪০ ইহা করা হইত অবশ্য উদ্ভূত পরিস্থিতি অনুযায়ী। যখন বিপদের সম্ভবনা নিতান্ত কম থাকিত বা অভিযান হইত ছােট আকারের কিংবা এমন বিচিত্র পরিস্থিতির উদ্ভব হইত যে, একজন মাত্র রক্ষী হইলেই চলে, শুধু তখনই এই রকম করা হইত। উদাহরস্বরূপ, খন্দকের যুদ্ধের সময় আব্বাদ ইবন বিশর ও সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাসের নেতৃত্বে আল-হারাস-এর একটি দলকে একটি ঘাটি প্রহরার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর এই স্থানটি অতিক্রম করার আশংকা ছিল। সকল বিষয় বিবেচনা করিয়া ইহা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময়ে গাযওয়াত বা সরায়া যাহাই হউক না কেন, মুসলিম বাহিনীর সকল অভিযানেই সামরিক ব্যবস্থার অপরিহার্য অংশ ছিল আল-হারাস।

ধারা—৯৬৮

• শিবির অধিনায়ক সরকার সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মাফিক সংখ্যায় বিভিন্ন পদের অধিনায়ক নিয়োগ করিতে পারিবে।

বিশ্লেষণ

সরকার সেনাবাহিনীর প্রয়োজন মোতাবেক সেনা অধিনায়ক নিয়োগ করিতে পারিবে। সাধারণ ইসলামী বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তাহার শিবিরেরও অধিনায়ক

৩২৭

ছিলেন। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে শিবিরের জন্য স্বতন্ত্র অধিনায়ক নিয়োগ করা হইত। এই ধরনের ঘটনার কমপক্ষে দুইটি প্রমাণ পাওয়া যায় এবং বেশ কয়েকটি সূত্রে আরও কয়েকটি ঘটনার কথা জানা যায়। ওয়াকিদী সুস্পষ্টভাবে বলিয়াছেন যে, বনূ হাশিমের হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা) ৪১ ও বনূ উমাইয়ার হযরত উসমান ইবন আফফান (রা) ৪২ বনূ নাজীর ও খায়বার অভিযানকালে মুসলিম শিবিরের অধিনায়ক ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার সাময়িক অনুপস্থিতকালে তাহাদেরকে ইসলামী বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। খায়বার অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার আর-রাজী শিবির হইতে দূরে অবস্থানকালে বনূ উমাইয়ার হযরত উসমান ইবন আফফান (রা)-কে তাহার ডেপুটি এবং তাঁহার সাথে সাথে শিবিরেরও অধিনায়ক নিযুক্ত করিয়াছিলেন।

ধারা—৯৬৯ সামারিক বাহিনীর সংখ্যা নির্ধারণ সৈন্যবাহিনীর পূর্ণ হিসাব থাকিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামরিক সংগঠনের আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হইল সেনা সমাবেশ। সেনা সমাবেশ কৌশলে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ এমন সাহাবীদের উপর তিনি সাধারণত এ দায়িত্ব অর্পণ করিতেন। সাধারণত স্থায়ী সেনাবাহিনী না থাকার কারণে সৈন্য সংগ্রহ করিবার সাথে সাথেই তাহাদের সমাবেশ ও গণনার ব্যবস্থা করা হইত। কোন কোন সময় সৈন্যদের অভিযানে যাওয়ার আগে অথবা যুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত পূর্বেও সগ্রহকৃত সৈন্যের গণনা কাজ সমাধা করা হইত। যাহা হউক ইহা নিশ্চিত যে, মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ থেকেই সেনা সংগ্রহের ও গণনার ব্যবস্থা চালু ছিল।

ওয়াকিদী বলেন, ২য় হিজরীর রমযান মাসে বদর ময়দানের পথে বির আবী ইনাবাহ নামক স্থানে মুসলিম বাহিনী পৌঁছাইলে রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত কায়স ইবন আবী সাসাআহ নামক একজন সাহাবীকে মুসলিম যোদ্ধাদের একটি সমাবেশ করিয়া গণনার নির্দেশ প্রদান করেন। নির্দেশ অনুযায়ী তিনি তাহাদের হাজিরা গ্রহণ করিয়া। যথাযথভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবহিত করেন। ইবন সাদ বলেন, রাজধানী হইতে এক মাইল যাওয়ার পর এই গণনা করা হয়। যাহাদের বয়স কম ছিল

৩২৮

তাহাদের ফেরত পাঠানো হয়। এক বৎসর পর উহুদ অভিযানে আল-শায়খায়ন নামক স্থানে মুসলিম বাহিনীকে একত্রে সমাবেশ করিয়া গণনা করা হয়।৪৪

ওয়াকিদী বলেন, ১১টি বালককে তাহাদের নিতান্ত কম বয়সের কারণে ফেরত পাঠানো হয়। তবে ইহাদের মধ্যে দুইজনকে রাফে ইবন খাদীজ ও সামুরা ইবন জুনদুবকে তাহাদের শারীরিক যোগ্যতা, সামরিক শৌর্য এবং তীর নিক্ষেপে দক্ষতার কারণে সৈন্যদলে থাকিবার অনুমতি দেওয়া হয়।৪৫

মুসলিম বাহিনীর পরবর্তী গণনা ঘটে ৫ হিজরীর যিলকদ মাসে খন্দক যুদ্ধের সময়। উল্লেখ্য, আবদুল্লাহ ইবন উমার, যায়দ ইবন সাবিত ও আল-বারাআ ইবন আযিবের ন্যায় উহুদ যুদ্ধের সময় কম বয়সের জন্যে প্রত্যাখ্যাত তরুণেরা ১৫ বছর পূর্তি হওয়ায় এই যুদ্ধ যোগ দেওয়ার অনুমতি লাভ করে।

ইহা হইতে বুঝা যায় যে, মুসলিম বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির নিম্নতর বয়স ছিল ১৫ বৎসর। খায়বার অভিযানকালে সমাবেশের মাধ্যমে সৈন্য গণনার যদিও কোন বিবরণ পাওয়া যায় না, তবুও এ কথা জানা যায় যে, বিশেষত মালে গনিমত ভাগ-বাটোয়ারার লক্ষ্যে মুসলিম সৈন্যদের সংখ্যা জানিবার জন্য যায়দ ইবন ছাবিতকে দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল। উল্লেখ্য যে, খায়বার অভিযানের পর যায়দ ইবন ছাবিতকে তাহার অল্প বয়স সত্বেও স্থায়ীভাবে সৈন্য গণনার দায়িত্বে নিয়োগ করা হইয়াছিল। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনকালে সকল অভিযানে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এই কথা হইতে জানা যায় যে, মুসলিম সৈন্য গণনার কাজটি একজন সাহাবীই করিতেন এবং হযরত যায়দ ইবন ছাবিত ইহার দায়িত্বে স্থায়ীভাবে নিযুক্তি লাভ করেন।

ধারা—৯৭০

আঞ্চলিক সামরিক সংগঠন প্রয়োজন অনুসারে আঞ্চলিক সামরিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা যাইবে।

বিশ্লেষণ

দেশের নিরাপত্তার চাহিদা মোতাবেক আঞ্চলিক সামরিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা যায়। আঞ্চলিক সামরিক সংক্রান্ত প্রশাসনকে ‘বিলায়েত’ বলা হইত। ইহা সংশ্লিষ্ট ওয়ালীর (গভর্নর) কার্যক্রম ও ক্ষমতার আওতাধীন ছিল। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে সামরিক বিষয়াদি তাহাদের ক্ষমতা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়া হইত এবং এতদুদ্দেশ্যে নিযুক্ত বিশেষ সামরিক অধিনায়কের নিকট ন্যস্ত করা হইত।

৩২৯

রাসূলুল্লাহ (সা) আল-ইয়ামনের ক্ষেত্রে এমনটি করিয়াছিলেন। উসদুল গাবা গ্রন্থে উল্লেখ আছে, মাখযুম কুরাইশ বংশের আবদুল্লাহ ইবন আবু রাবীয়াকে সেখানকার কেন্দ্রীয় বাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব প্রদান করা হয় সম্ভবত ৯ হিজরী ও ১১ হিজরীর মধ্যে। হযরত মুয়াজ ইবন জাবাল আল-খাজরাযী ইয়ামনের গভর্নর জেনারেল থাকিবার সময় তাহাকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়। পরে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)-এর খেলাফতকালে দীওয়ান আল-জুনদ নামে অভিহিত একটি পূর্ণাঙ্গ সামরিক দফতরকে সমগ্র খিলাফতের মুসলিম সেনাবাহিনীর বিষয়াদি দেখাশুনা করার জন্য স্থাপন করা হয়। হযরত আবু বাকর (রা) তাবুক অভিযানকালে বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। ওয়াকিদী বলেন, ইসলামী বাহিনী শিবিরে জড়াে হইবার পরপরই রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবু বাকর (রা)-কে শিবিরে তাঁহার প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। সেখানে তিনি মুসলমানদের সালাতের ইমামতিও করিতেন এবং এই সময় তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে তাহাকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়।৪৬

ধারা—৯৭১

সেনাধিনায়ক নিয়োগ সরকার সেনাবাহিনীর উচ্চতর লোকদেরকে সৈন্যবাহিনীতে অধিনায়ক পদে নিয়োগ দান করিবে।

বিশ্লেষণ

সরকার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ডিভিশনে যোগ্য লোকদেরকে নিয়োগ দান করিবে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অধীনে ইসলামী সেনাবাহিনীর বিভিন্ন সেনা ডিভিশনে এইভাবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। কুরাইশরাই এই পর্যায়ের সামরিক অধিনায়ক পদে বেশিরভাগ নিয়োগ লাভ করিলেও খাযরাজ ও আওস গোত্রের সম্মিলিত অধিনায়কের সংখ্যা তাহাদের সংখ্যাকে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। শুধুমাত্র আওস গোত্রের অধিনায়কের সংখ্যাই মক্কার মুহাজিরদের প্রায় সমান ছিল। কুরাইশ অধিনায়কদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং তাহাদের মধ্যে কয়েকজনকে একাধিকবার নিয়োগ করা হইয়াছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুবাইর ইবন আওয়াম, খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ এবং উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) একবার অথবা আরও দুইবার এই পদে নিয়োগ লাভ করিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ (রা.) সব সময়ই ইসলামী সেনাবাহিনীর অগ্রবাহিনী অশ্বারোহী দলের অধিনায়ক ছিলেন। আওসী অধিনায়কদের মধ্যে অত্যন্ত খ্যাতিমান ছিলেন মুহাম্মাদ

৩৩০

ইবন মাসলামা, আব্বাদ ইবন বিশর, উসায়দ ইবনুল হুদায়র এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়র। খাজরাজ গোত্রের অধিনায়কদের মধ্যে ছিলেন যায়দ ইবন সাবিত, আবদুল্লাহ ইবন আতীক ও আওস ইবন খাওলী। মদীনার দুইটি গোত্রের লোকেরাই একক নৈশ শিবিররক্ষীর পদগুলিতে নিয়োজিত ছিল। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যায়দ ইবন সাবিত (রা) স্থায়ীভাবে অধিনায়ক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন।৪৭

ধারা-৯৭২

পতাকাবাহী দল সেনাবাহিনীর মধ্যে “পতাকাবাহী একটি বিশেষ দল থাকিবে।

বিশ্লেষণ

সেনাবাহিনীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পতাকা বহনকারী একটি বিশেষ দল থাকিবে। এ সম্পর্কে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়, আরবের সামরিক ঐতিহ্যে কোন অভিযানে বা যুদ্ধক্ষেত্রে স্ব স্ব জাতীয় বা গোত্রীয় পতাকা তুলিয়া ধরা ছিল এক বিরাট মর্যাদার ব্যাপার।৪৮

সাধারণত কোন মর্যাদাবান পরিবার বা শাখাকে এই বিশেষ দায়িত্ব পালনের ভার দেওয়া হইত। মুসলিম যুদ্ধকৌশলে পতাকার অন্যবিধ তাৎপর্য ছিল। প্রতিটি গোত্রের নিজস্ব পতাকা ছিল এবং যুদ্ধেক্ষেত্রে তাহা ছিল সমবেত হইবার স্থান। কারণ সেনানায়ক এই পতাকার নিকটেই অবস্থান করিতেন।৪৯।

মক্কার বাহিনীর ক্ষেত্রে পতাকা বহনের সম্মানজনক দায়িত্বটি স্থায়ীভাবে অর্পিত হইয়াছিল কুরাইশ গোত্রের আবদুদ দার শাখার উপর। ইসলাম-পূর্ব ও পরবর্তী সময়েও তাহারা সকল যুদ্ধে এই দায়িত্ব পালন করেন। মদীনা ইসলামী রাষ্ট্র। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার চাচা হযরত হামযার নেতৃত্বে সীফুল-এর বিরুদ্ধে প্রথম

অভিযান প্রেরণকালে এই আরবীয় প্রথা বজায় রাখেন।৫০

যেহেতু বিভিন্ন গোত্রের লোকের সমন্বয়ে ইসলামী বাহিনী গঠিত হইয়াছিল, সেহেতু সেই সকল গোত্রের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে বেশ কিছু পতাকাবাহী ছিল। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময়কালের পুরাটাই এই জাতীয় গোত্রীয় চরিত্র বজায় ছিল। তবে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রতিনিধিত্ব হিসাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একটি বিশেষ পতাকা বহন করা হইত এবং তাহার উম্মতের যে কোন সম্মানী ব্যক্তিকে উক্ত পতাকা প্রদান করা হইত।৫১।

৩৩১

সারায়াতে একজন পতাকাবাহী থাকিলেও গাযওয়াতে, বিশেষ করিয়া বড় কোন গায়ওয়াতে, একাধিক পতাকাবাহী থাকিতেন। ইহারা মুহাজির, খায়রাজ ও আওস গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করিতেন। কিন্তু বড় বড় অভিযানগুলিতে, যেমন মক্কা বিজয় ও তাবুক অভিযান, সকল গোত্র ও তাহাদের বিশিষ্ট শাখাসমূহ নিজস্ব পতাকা বহন করিত। বিভিন্ন সূত্র হইতে জানিতে পারা যায় যে, প্রতিনিধিত্বের সিংহভাগই ছিল মুহাজির ও আনসারদের মধ্য হইতে। কারণ সে সময় পর্যন্ত তাহারাই ছিল ইসলামী সেনাবাহিনীর মূল ভিত্তি। মদীনার ৩টি গ্রুপের মধ্যে কুরাইশদের সকল পদে নিয়োগের সংখ্যা ছিল সর্বোচ্চ। তবে পতাকা বহনকারীর ক্ষেত্রে কুরাইশগণ খাযরাজীদের চাইতে অনেক পিছনে পড়িয়াছিল। প্রকৃতপক্ষে এক্ষেত্রে কুরাইশদের চাইতে খাযরাজী ভাইদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ ছিল। আনসারদের আরেকটি অংশ আওসদের নিয়োগের ক্ষেত্রে স্থান ছিল তৃতীয়। কিন্ত সৈন্যদের সংখ্যার ক্ষেত্রে তাহাদের সংখ্যা কুরাইশদের সমান ছিল। ইহা হইতে পরোক্ষভাবে এই কথাই বুঝা যায় যে, সকল অভিযানে ইসলামী সেনাবাহিনীর বড় অংশই আনসারদের মধ্য হইতে সংগ্রহ করা হইয়াছিল এবং খাযরাজ গোত্রের অবদানই ছিল সবচাইতে বেশী। অন্যান্য গোত্রের ক্ষেত্রে বলা যায়, তাহারা মক্কা বিজয়ে অংশগ্রহণ করায় প্রথমবারের মত পতাকা বহনের দায়িত্ব লাভ করিয়াছিল। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, তাহাদের পতাকা বহনকারীদের সংখ্যা ইসলামী বাহিনীতে তাহাদের সংখ্যাগত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়াছিল।৫২

যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্য ও গোত্র বা শাখার পতাকা বাহকদের আনুপাতিক সংখ্যা না থাকায় অনুমান করা যায় যে, একটি পতাকা বহনের জন্য ২ শত হইতে ৩ শত সৈন্যের একটি দলের প্রয়োজন হইত। কুরাইশদের মধ্য হইতে এই ধরনের পতাকাধারীদের মধ্যে ছিলেন বনু হাশিমের আলী ইবন আবু তালিব (রা)। তিনি ১০ বারের মত পতাকাধারীর পদে নিয়োগ লাভ করিয়াছিলেন। আসাদ গোত্রের আল-জুবায়র ইবনুল আওয়াম, বনু হাশিমের হ্যরত হামযা ইবন আবদুল মুত্তালিব (রা), জুহরা গোত্রের হযরত সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস, আবদুদ দার গোত্রের মুসআব ইবন উমায়র, তায়ম গোত্রের আবু বাকর (রা) এবং আদী গোত্রের উমার ইবনুল খাত্তাব (রা)। খাযরাজ গোত্রের মধ্য হইতে বিশিষ্ট ছিলেন সাদ ইবন উবাদাহ, আল-হুবাব ইবনুল মুনজির, যায়দ ইবন সাবিত এবং উমারাহ ইবন হাযম। অন্যদিকে আওস গোত্রের মধ্য হইতে ছিলেন সাদ ইবন মুয়াজ ও উসায়দ ইবনুল হুদায়র। আরবীয় গোত্রগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন আসলাম গোত্রের বুরায়দা ইবনুল হুসায়র। পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে যে, এ সকল গোত্রীয় পতাকা

৩৩২

বহনকারী এবং আরবের অন্যান্য গোত্র, যেমন মুযায়না, জুহায়না, খুযাআ, আশজা প্রভৃতির বহু পতাকা বহনকারীই তাহাদের গোত্র ও শাখায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি বা প্রধান ছিলেন। আরো উল্লেখ্য যে, এই জাতীয় মর্যাদা শুধু তাহারাই লাভ করিতেন। এই ধরনের পতাকাধারীর আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে সহজেই বুঝা যায় যে, বিপুল সংখ্যক পদই মধ্য আরবের লোকদের দখলে ছিল। তাহাদের পরই ছিল পশ্চিম আরবের পতাকা বহনকারীদের, অন্যদের প্রতিনিধিত্ব ছিল নিতান্তই নামমাত্র। দক্ষিণ আরবের কোন প্রতিনিধিত্বই ছিল না। ৫৩ এ সকল বিষয়ে সৈন্যবাহিনী বা সরকার পরিবেশ-পরিস্থিতি মোতাবেক যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিবে।

ধারা-৯৭৩ তালিয়া বা গোপন পর্যবেক্ষক দল। সেনাবাহিনীর প্রয়োজনে একটি তালিয়া বা পর্যবেক্ষক দল থাকিবে।

বিশ্লেষণ

সেনাবাহিনী প্রয়োজন মনে করিলে তাহাদের জন্য একটি তালিয়া বা গোপন পর্যবেক্ষণ দল গঠন করিতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সামরিক সংগঠনে তালিয়াদের প্রতি যথাযযাগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ তাহারা সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য আহরণে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিত। এ পর্যায়ে তালিয়ার অনুরূপ দায়িত্ব পালন করিয়াছিল এমন কিছু সংগঠনের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে, যাহাদের কাজও ছিল অতি প্রয়োজনীয়। তালিয়া ছিল পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত ক্ষুদ্র সেনাদল। তাহাদের কাজ ও গুপ্তচরদের কাজের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রহিয়াছে। সম্ভবত এই কারণেই ড, হামীদুল্লাহ তালিয়া কাজকে সামরিক গুপ্তচরের অংশ হিসাবে গণ্য করিয়াছেন।৫৪

যাহাই হউক, এই দুইটি সংগঠনের কাজের প্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য রহিয়াছে। প্রথমতঃ তালিয়া ছিল সব সময় ৩ অথবা ২০ জন ব্যক্তিকে লইয়া গঠিত একটি দল। দ্বিতীয়তঃ তালিয়া খােলাখুলি এবং প্রকাশ্য দিবালোকে কাজ করিত। পক্ষান্তরে গুপ্তচরেরা কাজ করিত গোপনে। তৃতীয়তঃ তালিয়া ছিল সেনাবাহিনীরই একটি অংশ এবং শত্রু বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য তাহাদেরকে আগে পাঠানো হইত। বদর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে মক্কা হইতে

৩৩৩

আগমনকারী কুরাইশ সেনাবাহিনীর অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য আল-জুবায়ের ইবনুল আওয়াম, আলী ইবন আবু তালিব, কাসাম ইবন আমর ও সাদ ইবন আবু ওয়াক্কাস (রা)-কে লইয়া গঠিত চারজনের এই দলটির ক্ষেত্রে তালিয়া শব্দটি যদিও প্রয়োগ করা হয় নাই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় সেইটিও একটি তালিয়াহ দল ছিল। ৫৫

উপরন্তু তাবারী আল-যুবায়র ইবনুল আওয়ামের সহিত রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীদের একটি দল (উসবাহ) প্রেরণের যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা হইতেও নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ইহা একটি নেতার অধিনায়কত্বে প্রেরিত তালিয়া ছিল।৬

ঘটনাচক্রে এই দলটি বদরের একটি কূপ পর্যন্ত গমন করে এবং পানি বহনকারীদের (সুক্কা) ৩ জনকে গ্রেপ্তার করিতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, মুসলমানদের সুনির্দিষ্টভাবে বলা হইয়াছিল যে, মক্কী বাহিনী আসিতেছে এবং তাহাদের অগ্রবর্তী দলে রহিয়াছে নিজস্ব পানি বহনকারী দল। মুসলমানগণ তাহাদেরকে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়া হইতে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকারী মক্কী কাফেলার অংশ বলিয়া মনে করিয়াছিলেন। এই ঘটনা মুসলমানদের বদরের সমস্ত পানির উৎস (মিয়াহ-ই বদর) দখল করিয়া একটি কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে থাকিবার সুযোগ করিয়া দিয়াছিল। মুসলিম বাহিনী সমভূমিতে শিবির স্থাপন করে এবং শত্রু বাহিনীকে তাহাদের আনুকূল এমন অসুবিধাজনক স্থানে যুদ্ধ করিতে বাধ্য করে।৫৭

“উসদুল গাবা হইতে জানা যায়, আসলাম গোত্রের দুই ভাই মালিক ইবন খাওলা ও তাঁহার ভাই আন-নুমান উহুদ যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রেরিত তালিয়াদের অন্যতম ছিলেন। তাঁহারা উভয়ে দায়িত্ব পালনকালে শহীদ হইয়াছিলেন।

হামরাউল আসাদ অভিযানে আসলাম গোত্রের ৩ জনের একটি দলকে পশ্চাদপসরণরত মক্কী বাহিনীর প্রকৃত অভিসন্ধি জানিবার জন্য তালিয়া হিসাবে পাঠানো হয়, তাহারাও শহীদ হইয়াছিলেন। ৬ষ্ঠ হিজরীর রবিউল আওয়াল মাসে রাসূলুল্লাহ (সা) লিহইয়ান-এর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এ সময় তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা)-কে শত্রু বাহিনীর খোঁজ-খবর জানিবার জন্য একটি দল আল-গাম নামক স্থান অভিমুখে প্রেরণ করেন। ৫৮।

ওয়াকিদী ও ইবন সাদের মতে আল-হুদায়বিয়া অভিযানে মুসলিম বাহিনীর তালিয়া আওস গোত্রের আব্বাদ ইবন বিশর-এর নেতৃত্বে ২০ জন অশ্বারোহীকে লইয়া গঠিত হইয়াছিল। ইনি ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি খায়বার অভিযানে মুসলিম বাহিনীর তালিয়ার নেতৃত্ব দিয়াছিলেন। তাহারা খায়বারের এক ইয়াহূদী গুপ্তচরকে

৩৩৪

গ্রেপ্তার করিতে সক্ষম হন। এই গুপ্তচর আশজা গোত্রের ছিল। সে ব্যক্তি ইহুদীদের সমর প্রস্তুতির বিস্তারিত তথ্য ফাঁস করিয়া দেয় এবং শেষে ইসলাম গ্রহণ করে। একই অভিযানে আওস গোত্রের অন্য এক ব্যক্তি মুহাম্মদ ইবন মাসলামাকে মুসলিম বাহিনীর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান খুঁজিয়া বাহির করিবার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সে দায়িত্ব অত্যন্ত দক্ষতার সহিত পালন করিয়াছিলেন।

মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে মুসলিম বাহিনী মদীনা ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ (সা) এক মহিলা গুপ্তচরের নিকট হইতে হাবিব ইবন আবু বালতা (রা) লিখিত একটি পত্র উদ্ধার করিবার জন্য হযরত আলী ও যুবায়ের (রা)-কে পাঠান। এই পত্রে পবিত্র নগরীর উপর মুসলিম আক্রমণ সম্পর্কিত তথ্য ছিল। তাবুকের বিখ্যাত অভিযানে আওস গোত্রের উসায়দ ইবনুল হুদায়রকে মুসলমানদের জন্য একটি পানির উৎস্য খুঁজিয়া বাহির করিবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল।

ইহা হইতে বুঝা যায় যে, তালিয়া বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে যাহা শুধু কৌশলগত কারণেই নহে, মুসলমানদের নিরাপত্তার জন্যও অতীব জরুরী ছিল। অন্যান্য সংগঠনের কাজের মধ্যে মুসলমানদের বিজয় বার্তা ঘোষণা অথবা মুসলিম বাহিনীর মঙ্গল সংবাদ সম্পর্কে মক্কার জনগণকে অবহিত করার কাজ ছিল অন্যতম। মুহাম্মদ ইবন হাবীব আল-বাগদাদী তাঁহার গ্রন্থের একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একজন বুশারার কথা বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। যেমন মক্কার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর জয়লাভের বিজয়বার্তা মদীনার অধিবাসীদের মাঝে ঘোষণার জন্য যায়দ ইবন হারিসা ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহাকে প্রেরণ করা হইয়াছিল। একইভাবে যাতুর রিকার সকল অভিযানের পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার নিজের ও মুসলিম বাহিনীর মঙ্গল সংবাদ জানানোর জন্য জিয়াল ইবন শুরাকা আল-যামুরীকে মদীনাতে প্রেরণ করিয়াছিলেন। হুদায়বিয়ার সন্ধি হওয়ার পর সালামা ইবন আসলাম আল-আশহালির বিজয়ের খরবও ঘোষণা করা হইয়াছিল। অন্যদিকে হুনায়নের বিরাট সাফল্যের শুভ সংবাদ মদীনার লোকদের জানানোর জন্য খাযরাজের নুওয়ায়ম ইবন আওসকে প্রেরণ করা হয়।

সশস্ত্র সংঘর্ষের সময় বিবিধ প্রকার দায়িত্ব পালনকারীদের দিয়া আরও একটি সংগঠন বা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছিল। উদাহরণ হিসাবে বনু কায়নুকার আবু লায়লা খাযরাজী ও আবদুল্লাহ ইবন সালামের কথা উল্লেখ করা যায়। ইহারা ছিলেন ইয়াহূদী, পরে মুসলমান হন। অবরুদ্ধ শত্রুদের হয়রানী করা ও তাহাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য এক বিশেষ ধরনের খেজুর গাছ কাটিয়া ফেলা ছিল তাহাদের দায়িত্ব।

৩৩৫

শেষে এ কথা বলা যায় যে, শত্রুদের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্যই অভিযান কালে সর্বদাই তালিয়া প্রেরণ করা হইত এবং তাহাদের সাফল্য মুসলিম বাহিনীকে কৌশলগত সুবিধাজনক অবস্থানে রাখিত। এ ধরনের বিভাগ রাখার সিদ্ধান্ত সরকার বা সৈন্যবাহিনী আজকের যুগের প্রয়োজনীয়তাকে ভিত্তি করিয়া নিবে।

ধারা-৯৭৪

গোয়েন্দা বিভাগ সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি গোয়েন্দা বিভাগ থাকিবে।

বিশ্লেষণ

শত্রু সৈন্যদের গতিবিধি ও তাহাদের সম্পর্কে জরুরী তথ্য সরবরাহের জন্য সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি গোয়েন্দা বিভাগ থাকিতে হইবে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গোয়েন্দা ব্যবস্থাকে পুরাপুরি কার্যকর করিয়া গড়িয়া তোলেন, বিশেষ করিয়া শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর চলাচল ও গতিবিধি সম্পর্কে সঠিক সংবাদ পাওয়ার সুষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। এই ব্যবস্থার সাহায্যে যথেষ্ট কল্যাণ লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা সামরিক বিজয়ে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করিয়াছে। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর যুদ্ধজয়ের ইতিহাসে তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হইয়া রহিয়াছে। রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক নিয়োজিত ব্যক্তিরা গোপনে প্রতিপক্ষের তৎপরতা ও গতিবিধি যাহা কিছু দেখিতে পাইত তাহার যথাযথ বিবরণ তাঁহাকে জানাইয়া দিত। ফলে রাসূলুল্লাহ (সা) শত্রুর মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ গ্রহণ করিতেন এমনভাবে যে, শত্রুপক্ষ কিছুই কল্পনা করিতে পারিত না। তাহারা তাহাদের পদক্ষেপের পূর্বেই আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হইয়া যেমন ভীত-সন্ত্রস্ত হইয়া পড়িত, তেমনি ইসলামী বাহিনীর নিকট পরাজিত হইয়া চরমভাবে বিপর্যস্ত হইয়া পড়িত। কুরআন মজীদে এই সম্পর্কে বলা হইয়াছে?

والعاديات ضبا. فالموريت قا . فالمغيرات صبا .

• (-): Jl 119)

“শপথ সেই (ঘোড়াগুলির) যাহারা হ্রেষাধ্বনি করিয়া দৌড়ায় পরে (নিজেদের ক্ষুর দিয়া) অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরে আর অতি প্রত্যুষে তাহারা আকস্মিক আক্রমণ চালায়”। রাসূলুল্লাহ (সা) আরও উল্লেখ করিয়াছেন?

اكمن النهار وسر الليل ولا تفارقك العين ..

“দিনের বেলা লুকাইয়া থাকিবে, রাত্রিবেলা চলিবে এবং গোয়েন্দা সাহায্য যেন কখনও বিচ্ছিন্ন না হয়”।

বদর যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবায়ে কেরামদেরকে সাথে লইয়া মদীনা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। পথিমধ্যে এক আরব গোত্রপতির বাড়িতে অবস্থান লইলেন। তিনি কুরাইশদের খবরাখবর জানিবার চেষ্টা করিলেন। তিনি আরব গোত্রপতিকে কুরাইশ এবং মুহাম্মাদ ও তাঁহার সঙ্গীদের সম্পর্কে চিন্তাভারাক্রান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন। জবাবে আরব গোত্রপতি বলিলেন, শুনিয়াছি মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁহার সঙ্গীরা অমুক দিন মদীনা হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছেন। এই খবর সত্য হইলে আজ তাহার আমার এই স্থানে উপস্থিত হইবার কথা। আর ইহাও খবর পাইয়াছি যে, তাহারাও অমুক দিন মক্কা হইতে বাহির হইয়া আসিয়াছে। এই খবর সত্য হইলে আজ তাহাদের অমুক স্থানে উপস্থিত হইবার কথা। সেটি ঠিক সেই স্থানই ছিল, যেখানে কুরাইশগণ সেদিন অবস্থান লইয়াছিল।

দ্বিতীয় বদর-এ উপস্থিত হইয়া রাসূলুল্লাহ (সা) খবর সংগ্রহের জন্য চারিদিকে লোক পাঠাইয়া দিলেন। তাহারা দুইজন ক্রীতদাস ধরিয়া লইয়া আসিলেন। তাহাদের নিকট হইতে কুরাইশ বাহিনীর অবস্থান, তাহার লোকসংখ্যা এবং নেতৃত্বে কাহারা রহিয়াছে ইত্যাদি সর্ব বিষয়ে আগাম খবর সংগ্রহ করিলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) সাহাবাদের বলিলেনঃ।

هذه مكة قد القت اليكم أفلا نكيدها.

“এবারে মক্কা তাহার কলিজার টুকরাগুলিকে তোমাদের সম্মুখে পেশ করিয়া দিয়াছে”।৬১

মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোকদের ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে শত্রু বাহিনীর মধ্যে ও তাহাদের এলাকায় গোয়েন্দাগিরির কাজে নিযুক্ত করিতেন। তাহাদের পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে তিনি যুদ্ধের কৌশল তৈয়ার করিতেন এবং শত্রুপক্ষের সকল পরিকল্পনা ব্যর্থ ও নিষ্ফল করিয়া দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সা) হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহশ (রা)-কে একটি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান করিয়া মক্কায় পাঠাইলেন। সঙ্গে একখানি মুখ বন্ধ করা পত্র দিলেন এবং বলিলেন, দুই দিন দুই রাত্রি পথ চলিবার পর এই পত্ৰ খুলিয়া

পড়িবে এবং উহাতে যে নির্দেশ আছে সেই অনুযায়ী কাজ করিবে। দুই দিন পথ চলিবার পর তিনি পত্রখানি খুলিয়া উহাতে লেখা পাইলেন?

اذا نظرت في كتابي هذا فامض حتى تنزل نخله بين مكة

والطائف فتوصد بها قريشا وتعلم لنا من اخبارهم .

“আমার এই পত্র পাঠ করার পর কিছু দূর চলিলেই মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী নাখলা নামক স্থানে (খেজুর বাগানে) উপস্থিত হইবে এবং তথায় ঘাপটি মারিয়া বসিয়া থাকিয়া কুরাইশদের সম্পর্কে খবরাখবর জানিবে এবং আমাদের জানাইবে” (সীরাত ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬০২)।

খন্দকের যুদ্ধে কুরাইশ এবং ইয়াহূদী ও গাতফান ঐক্যবদ্ধ হইয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে নামিয়াছিল। এই সময় রাসূলুল্লাহ (সা) এমন এক কৌশল অবলম্বন করিয়াছিলেন, যাহার ফলে তাহাদের মধ্যে অনৈক্য ও বিরোধ বাধিয়া যায়। পরে তিনি হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা)-কে পাঠাইয়া তাহাদের ভিতরকার অবস্থা

জানিবার ব্যবস্থা করিয়াছেন। বলা বাহুল্য, রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক গৃহীত কৌশল এক শত ভাগ সফল হইয়া ছিল।৬২

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রা) কুরাইশদের ইচ্ছা, সংকল্প ও যুদ্ধের প্রস্তুতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পূর্ণ ও বিস্তারিত তথ্য দিয়াছিলেন। ঐতিহাসিকভাবে এই সত্য প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক শত্রুপক্ষ সম্পর্কে আগাম খবর জানিবার জন্য গৃহীত এই পন্থা ছিল তদানীন্তন আন্তর্জাতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অভিব। সেকালের কোন রাষ্ট্রনায়ক বা সমরবিদের পক্ষে এ জাতীয় কর্মপন্থা গ্রহণের চিন্তাও সম্ভব হয় নাই। এজন্যই আল্লাহ পাক বলিয়াছেন?

والذين جاهوا فينا لنهدينهم سبلنا وان الله لمع المحسنين

• (1): 29Kill 539) “আর যাহারা আমাদের পথে জিহাদ করে আমি অবশ্যই তাহাদেরকে আমারি পথে পরিচালিত করি। আল্লাহ অবশ্যই সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন” (২৯ : ৬৯)।

এই সত্যের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়াই চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বলিয়াছেন, একজন সদাসচেতন মেধাবী প্রতিভাসম্পন্ন সূক্ষ্ম খবর সংগ্রহকারী বিশ হাজার যোদ্ধার তুলনায় যুদ্ধের ময়দানে অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করিতে সক্ষম।

৩৩৮

তাবুক যুদ্ধে রওয়ানার সময় রাসূলুল্লাহ (সা) লোক মারফত খবর লাভ করিয়াছিলেন যে, মদীনারই একটি বাড়িতে কিছু সংখ্যক মুনাফিক একত্র হইয়া লোকদিগকে যুদ্ধযাত্রায় বিলম্ব করিবার জন্য উসকানী দিতেছে। তিনি এই খবর পাওয়ার পর হযরত তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ (রা)-কে কতিপয় লোকসহ সেখানে পাঠাইয়া দিলেন এবং সেই সভাগৃহকে জ্বালাইয়া দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। শেষ পর্যন্ত তাহাই করা হইয়াছিল।

ইহা হইতে স্পষ্টভাবে জানা যায় যে,রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য লোক মদীনার সবত্র নিয়োজিত ছিল, যাবতীয় খবরাখবর যথা সময়ে তাঁহার নিকট পৌছাইবার জন্য। মদীনার ইয়াহূদীরা অত্যন্ত গোপনে ইসলামের বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই করিয়াছে উহার প্রায় সবগুলির আগাম খবর পাইয়া তিনি উহা ছিন্নভিন্ন ও ব্যর্থ করিয়া দিয়াছিলেন। খায়বার যুদ্ধে ইয়াহুদীদের সুরক্ষিত প্রাচিনতম দুর্গ জয় করাও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর পক্ষে এই পন্থার সাহায্যে সহজ ও সম্ভব হইয়াছিল।

এই প্রেক্ষিতে চূড়ান্ত কথা হইল, ইসলামী রাষ্ট্রকে সংবাদ সংগ্রহের ব্যবস্থাকে অত্যাধুনিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। মধ্যযুগে অন্যান্য বিষয় ছাড়াও সামরিক সাফল্য দক্ষ গুপ্তচর ব্যবস্থার উপর বিপুলভাবে নির্ভরশীল ছিল। ইহারা শত্রু বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছিদ্র পথের অন্বেষণে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখিত।৬৩

গোয়েন্দারা সামরিক অভিযানকালে শত্রু বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে খবরাখবর সগ্রহের মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিত। উহুদ যুদ্ধকালে মহানবী (সা) খাযরাজ গোত্রের ফাছালার দুই পুত্র আনাস ও মুনসীকে গোয়েন্দারূপে পাঠান। আল-আকীক পৌছাইয়া তাহারা কুরাইশ বাহিনীর সহিত মিশিয়া যাওয়ার সুযোগ পান। তাহাদের সাথে থাকিয়া আল-বিলা নামক স্থানে পৌছান এবং সেখান থেকে চুপিসারে সরিয়া পড়িতে সক্ষম হন। তাহারা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট আসিয়া কুরাইশদের বিস্তারিত যুদ্ধ পরিকল্পনা ফাঁস করিয়া দেন। কুরাইশরা গন্তব্য স্থানে পৌছাইবার আগেই ঘটনা ঘটে।

মক্কী বাহিনী উহুদে শিবির স্থাপন করার পর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার জন্য একজন গোয়েন্দা আল-হুবাবকে নিযুক্ত করেন। আল-হুবাব ইবনুল মুনযির ছিলেন একজন বিখ্যাত রণকৌশলবিদ ও সামরিক বিশেষজ্ঞ। রাসূলুল্লাহ (সা) তাহাকে নির্দেশ দিয়াছিলেন যে, তিনি ফিরিয়া না আসা পর্যন্ত কোন তথ্য যেন কাহারও নিকট প্রকাশ করা না হয়। কারণ তাহা মুসলিম বাহিনীর মনোবলের উপর বিরূপ প্রভাব

৩৩৯

সৃষ্টি করিতে পারিত। গোপনে কুরাইশ বাহিনীর পলায়নরত মক্কী বাহিনীর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য সগ্রহের জন্য হযরত আলী ইবন আবু তালিব (রা)-কে নিয়োগ করা হয়। উসদুল গাবা গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে, আর-রাজীর মর্মান্তিক ঘটনার পর কুরাইশদের অভিসন্ধি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য উমাইয়া ইবন খুয়াইলিদ আল-মুরীকে গোয়েন্দা হিসাবে প্রেরণ করা হইয়াছিল। মুরাইসীতে বনু মুসতালিক গোত্রের সৈন্য সমাবেশের খবর মদীনায় আসিয়া পৌঁছাইলে রাসূলুল্লাহ (সা) তাহার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বুরাইদা ইবনুল হুসাইবাকে প্রেরণ করেন। তিনি তাহাদের পানির উৎস স্থানে গিয়া প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসেন। বিপক্ষ সম্পর্কে এইরূপ প্রাথমিক তথ্য ইসলামী বাহিনীকে শত্রুদের বিরুদ্ধে সুবিধা আনিয়া দিয়াছিল এবং মুসলিম বাহিনীর আল-মুরাইসী অভিযানকালে

তাহাদেরকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছিল।

খন্দকের যুদ্ধকালেই মুসলিম গোয়েন্দাদের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি সংঘটিত হয়। এসময় মদীনা একমাস যাবত অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। রাজধানী শহর দীর্ঘ সময় অবরুদ্ধ থাকাকালে মুসলিম যোদ্ধারা শুধু শত্রুর সম্ভাব্য হামলার শিকারই ছিল না, পশ্চাৎ দিকে ইয়াহুদী গোত্র বনু কুরাইযার হামলারও আশংকা ছিল। এই দুইটি শক্রদলের অভিসন্ধি জানিবার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) খাওয়াত ইবনু জুবায়েরকে প্রেরণ করিলে তিনি সাফল্যের সহিত সে দায়িত্ব পালন করেন। ৬৫

ইহার পূর্বে তাহাদের আহযাইবের (খন্দকের যুদ্ধে যোগদানের খবরের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) আল-যুবায়র ইবনুল আওয়ামকে গোয়েন্দা হিসাবে নিয়োগ করেন। অবরোধের শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) হুযাইফা ইবনুল ইয়ামানকে তাহার গোয়েন্দা হিসাবে কুরাইশ শিবিরে প্রেরণ করেন। তিনি কুরাইশ শিবিরে ঢুকিয়া আগুন জ্বালাইয়া চারপাশ ঘিরিয়া বসিয়া থাকা মক্কার লোকদের একটি দলের সহিত সহজেই মিশিয়া যান। কেহ তাহাকে চিনিতে পারে নাই। তাহার প্রবেশের পরপরই কুরাইশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আবু সুফিয়ান সেখানে আসিয়া উপস্থিত হন এবং শত্রু বাহিনীর গোয়েন্দা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করিয়া দেন। তিনি তাহাদেরকে স্বীয় সঙ্গীদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হইবার নির্দেশ দেন। মুসলিম গোয়েন্দারা এভাবে ধরা পড়িবার ব্যাপারে যথেষ্ট হুঁশিয়ার ছিলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ তাহার পাশের প্রথম লোকটির পরিচয় জিজ্ঞাসা আরম্ভ করেন। তাহার উপর কাহারও সন্দেহ থাকিলেও তাহা নিরসন হয় এবং অবশেষে তাহাদের সকল গোপন পরিকল্পনার কথা বিস্তারিতভাবে জানিয়া দায়িত্বের সহিত উহা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে অবহিত করেন।

৩৪০

ধারা-৯৭৫

দালীল (পথপ্রদর্শক) নিয়োগ সেনাবাহিনীর নিরাপদ গমন ও গন্তব্যে পৌঁছার জন্য পথপ্রদর্শক নিয়োগ করা যায়।

বিশ্লেষণ

সেনাবাহিনীর নিরাপদ গমন ও গন্তব্যে পৌঁছার জন্য দালীল বা পথপ্রদর্শক নিয়োগ করা যায়। আরব উপদ্বীপে বিশেষত মরুভূমিতে সড়ক মহাসড়ক তেমন কিছু না থাকায় পর্যটক কাফেলা, এমনকি সেনাবাহিনীরও পথ হারাইয়া ফেলা একটি সাধারণ ব্যাপার ছিল। ইহার ফলে জীবনহানিও অস্বাভাবিক ছিল না। সেকারণে সকল মুসাফির, বণিক, কাফেলা, সেনাবাহিনীর নিরাপদ গমন ও গন্তব্যে পৌঁছাইবার জন্য পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। আরব সেনাবাহিনীর জন্য তাহা ছিল অত্যাবশ্যক। কারণ সম্পূর্ণ সঠিক দিকে তাহাদেরকে অগ্রসর হইতে হইত এবং পথপ্রদর্শকের উপর তাহাদের অগ্রযাত্রা দারুনভাবে নির্ভরশীল ছিল। দালীল ছিল পেশাগতভাবে দক্ষ (খিররীত) পথ ঘাট (সানান) সম্পর্কে ছিল জ্ঞাত এবং শত্রুদের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য তাহারা সংক্ষিপ্ত ও তানাকিব (চেনা পথ হইতে সরিয়া অচেনা পথ ধরিয়া অগ্রসর হওয়া) জানিত বলিয়া শত্রুরা বিরোধী পক্ষের আগমন সম্পর্কে বুঝিতে পারিত না।৬৬

সুতরাং দালীলদের সাহায্য অতি প্রয়োজন ছিল। সাধারণত এই সকল লোক ছিল যাযাবর গোত্রের এবং যে কোন লোক তাহাদেরকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করিতে পারিত। সাধারণভাবে আরবদের সামাজিক জীবনে এবং বিশেষ করিয়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বিভিন্ন সফর ও সামরিক অভিযানের সময় চলাচল পথ সম্পর্কে এই সকল বিশেষজ্ঞের নিয়োগের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। এই কথা বলিলে অতির ত হইবে না যে, মুসলিম সামরিক বাহিনীতে সর্বদাই একজন পথপ্রদর্শক থাকিত। একথা সর্বজন বিদিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা হইতে মদীনায় হিজরতকালে তাঁহার সাথী হযরত আবু বাকর (রা)-এর সহিত আলোচনার পর একজন পথপ্রদর্শকের ব্যবস্থা করেন।৬৭

একই সফরে আল-আরাজ হইতে তাহাদেরকে পথ দেখাইবার জন্য সাদ আরজী নামক আরেক পথপ্রদর্শক নিয়োগ করেন। এই স্থানটি মদীনা হইতে সামান্য দূরে ছিল। সকল অভিযানেই পথপ্রদর্শক থাকিলেও বদর যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত

৩৪১

তাহাদের উপস্থিতির উল্লেখ পাওয়া যায় না। উহুদ অভিযানকালে সর্বপ্রথম একজন পথপ্রদর্শকের কথা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়। ওয়াকিদীর বক্তব্য অনুযায়ী আবু হাসমাহ আল-হারিসী পথপ্রদর্শক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।

হামরাউল আসাদ অভিমুখে মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রাকালে হযরত ছাবিত ইবনুদ দাহ্হাক আল-খাযরাজী পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি খুব সম্ভব রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ঘনিষ্ঠ সাহাবী হযরত যায়দ ইবন সাবিতের পিতা ছিলেন। ওয়াকিদী বলেন, আবু সালামা ইবন আবদুল আসাদের কাতান অভিযানে তায়ী গোত্রের এক ব্যক্তি আল-ওয়ালীদ ইবন জুবায়র পথপ্রদর্শক নিযুক্ত হন। ইহা হইতে মনে হয় যে, একই অভিযানে মুসলিম বাহিনীর প্রত্যাবর্তনের সময় আরেকজনকে পথপ্রদর্শক হিসাবে নিয়োগ করা হইয়াছিল। তিনি গানীমতের মালের খুমুস (এক-পঞ্চমাংশ) পারিশ্রমিক লাভ করেন। দুমাতুল জানাল অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সেনাবাহিনীর সহিত বনু উরাহ-এর মাষকুর নামক এক দক্ষ পথপ্রদর্শক (হাদী খিররীত) ছিলেন এবং তিনি তালিয়া (পর্যবেক্ষক) হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শত্রু সৈন্যদের অবস্থান খুঁজিয়া পান। উসদুল গাবা গ্রন্থে মুসলিম বাহিনীর মুরাইসী অভিযানকালে মাসউদ ইবনে হুনাইদাহ আসলামী নামক একজন পথপ্রদর্শকের উল্লেখ পাওয়া যায়।

৬ষ্ঠ হিজরীর গোড়ার দিকে গাতাফানের বিরুদ্ধে গাযওয়ায় হযরত আবু হাদরাদ আল-আসলামী পথপ্রদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন।৯

ওয়াকিদী একই বৎসর হযরত যায়দ ইবন হারিসার নেতৃত্বে হিসমা অভিযানে বনু উরার আরেকজন পথপ্রদর্শক নিয়োগের কথা জানাইয়াছেন।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আল-হুদাইবিয়া অভিযানকালে আসলাম গোত্রের আরেক ব্যক্তি আমর ইবন আবদ নাহম পথপ্রদর্শক হিসাবে তাঁহার সঙ্গে ছিলেন। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, খায়বার অভিযানে কমপক্ষে ৩জন স্থানীয় ইয়াহুদী স্বেচ্ছায় পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে এবং বিনিময়ে আকর্ষণীয় পুরস্কার লাভ করে। তাবারী ও ইবনুল আছীর (উসদুল গাবা) একই অভিযানে আরেকজন পথপ্রদর্শক নিয়োগের কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তাহাদের মতে হুসাইল ইবন নুওয়ায়রা বা খারিজা ছিলেন আশজা-গাতফান গোত্রের একজন পৌত্তলিক এবং তিনি খায়বারের নিকট বসবাস করিতেন। ইহা ঘটিয়াছিল এই কারণে যে, অভিযানের অব্যবহিত পূর্বে তিনি মদীনার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী কিনিতে আসিতেন। সেইখানে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সহিত সাক্ষাত করেন। তিনি তাহাকে খায়বার অভিযানে পথপ্রদর্শক হওয়ার বিনিময়ে ২০ সা মদীনার খেজুর প্রদানের প্রস্তাব দেন। তিনি

৩৪২

তৎক্ষণাৎ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তাহার কাজ ভালভাবে সম্পন্ন করেন। উল্লেখ্য যে, অভিযান শেষ হইবার পরপরই তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই অভিযানে অপর যে পথপ্রদর্শক নিয়োগ করা হয় তিনি হইলেন হযরত আবদুল্লাহ ইবন নুয়ায়ম আশজা। পূর্বে উল্লেখিত হুসায়ল ৭ মাস পর বশির ইবন সাদ-এর আল-জিনাব সারিয়াতে আরো একবার পথপ্রদর্শক নিযুক্ত হন।

একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হইল যে, রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কা বিজয়ের সামান্য পূর্বে কিনানার গালিব ইবন আবদুল্লাহ আল-লায়সীর নিকট সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ সম্পর্কে জানিতে চাহেন। পরে এই অভিযানকালে তিনি মুসলিম বাহিনীর পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁহার শেষ অভিযানকালে অর্থাৎ তাবুক অভিযানকালে আলকামা ইবন ফাগাওয়া আল-খুযাইকে তাঁহার পথপ্রদর্শক নিয়োগ করেন। সবশেষে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রেরিত সর্বশেষ অভিযান উসামা ইবন যায়দের সারিয়ায় একজন উযরী পথপ্রদর্শকের উল্লেখ পাওয়া যায়।

এইভাবে দেখা যায়, প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সকল পথপ্রদর্শকই রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক নিযুক্ত হইয়াছিল। ইহার বাহিরে ১৪ জন পথপ্রদর্শকের নাম জানা যায়। কোন সন্দেহ নাই যে, বিভিন্ন সারিয়া ও গাযাওয়ার জন্য আরো অনেক পথপ্রদর্শক ছিলেন। তবে তাহাদের নাম অথবা তাহাদের ব্যাপারে কোন উল্লেখ পাওয়া যায়

। ১৪ জন পথপ্রদর্শকের মধ্যে ৪ জন মক্কার শেষ পর্যায়ের বা মদীনার প্রথম পর্যায়ের, ৫ জন আল-হুদায়বিয়া পর্যায়ের, ৪ জন ৬২৮ হইতে ৬৩০ খৃস্টাব্দে এবং শেষ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনের শেষ দুই বৎসরে মুসলমান হন। তবে এক্ষেত্রে অমুসলিম কাফের ও ইহুদীদের পথপ্রদর্শক হিসাবে নিয়োগ সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

ধারা-৯৭৬ মালে গনীমত ও যুদ্ধবন্দীর দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা নিয়োগ

যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী (মালে গনীমাহ) ও যুদ্ধবন্দীর দায়িত্বে বিশেষ কর্মকর্তা নিয়োগ করা যায়।

বিশ্লেষণ

যুদ্ধলব্ধ সামগ্রী বা গনীমতের মাল সংরক্ষণ ও যুদ্ধবন্দীদের দায়িত্বে সামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা যায়। কোন যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মুসলমানদের হাতে প্রায়ই যুদ্ধলব্ধ বিভিন্ন সামগ্রী ও যুদ্ধবন্দী আসিত।৭১

৩৪৩

মালামাল এবং বন্দীদের আল-মাগানিম বলিয়া আখ্যায়িত করা হইত। সূত্র সমূহে উল্লেখ আছে, সকল অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক আল-মাগানিমের দায়িত্বে একজন কর্মকর্তা নিযুক্ত হইতেন। কোন কোন সময় একাধিক কর্মকর্তাকেও এই পদে নিয়োগ দান করা হইত। গাযওয়া বা সারায়া সকল ক্ষেত্রেই তিনি ইহা করিতেন। বদরের যুদ্ধ থেকে শেষ যুদ্ধ পর্যন্ত এ দায়িত্বে নিয়োজিত বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার কথা জানা যায়। বদর যুদ্ধে প্রথম এ ধরনের কর্মকর্তা নিয়োগের কথা ইতিপূর্বে বলা হইয়াছে। ওয়াকিদী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) খাযরাজের হযরত আবদুল্লাহ ইবন কাবকে দখলীকৃত মাগানিমের এবং তাহার নিজের গোলাম শুকরানকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে পুরস্কৃত করেন।

উসদ অনুযায়ী কাব বদর যুদ্ধের পরবর্তী বেশ কিছু অভিযানে খুমূস (রাষ্ট্রের অংশ হিসাবে প্রদত্ত এক-পঞ্চমাংশ সামগ্রী)-এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। উসদ-এর মতে আবদুল্লাহ ইবন কাব আল-খাযরাজী বদর যুদ্ধের পর বেশ কয়েকটি অভিযানে খুমূস-এর দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

মুরায়সী অভিযান প্রসংগে শুকরানের অন্য একটি দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। তখন তিনি পুনরায় যুদ্ধলব্ধ মালের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। এইখানে আরও উল্লেখ্য যে, বনু মুসতালিকের বিরুদ্ধে তাঁহার অভিযানে আরও ৩জন অফিসারকে নিয়োগ করা হয়। ইহাদের মধ্যে বুরায়দা ইবনুল হুসায়ব আল-আসলামীকে যুদ্ধবন্দী, মাহমিয়া ইবন মাজা আল-জাবিদীকে মুসলিম যোদ্ধাদের অংশ এবং মাসউদ ইবন হুনায়দাকে আল-খুমূস-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কোন কোন সময় একজন মাত্র ব্যক্তি একই সঙ্গে যুদ্ধলব্ধ মাল ও বন্দীদের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকিতেন। যেমন বনু কায়নুকার বিরুদ্ধে অভিযানে মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা একাই এই দায়িত্ব পালন করেন। একই অভিযানে আরো দুইজন কর্মকর্তাকে ভিন্ন দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আল- মুনযির ইবন কুদামা আওসীকে ধৃত ব্যক্তিদের হাজতে লইয়া যাইবার জন্য হাতকড়া (কাতাফ) পরাইবার নির্দেশ দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে রাজধানীর গোপন স্থানগুলিতে লুকাইয়া থাকা ইয়াহুদীদের বহিষ্কারের ব্যবস্থা তদারকির জন্য উবাদা ইবনুস সামিত আল- খাযরাজীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মদীনার আর একটি ইয়াহুদী গোত্র বনু নাজীর-এর আত্মসমর্পণের পর অনুরূপ দায়িত্ব পালন করেন মুহাম্মদ ইবন মাসলামা।৭২

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর আযাদকৃত গোলাম আবু রাফেকে যুদ্ধলব্ধ মালামাল তাহার নিজ দায়িত্বে লইবার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল।

৩৪৪

মদীনার ইয়াহূদীদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযান হিসাবে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ গোত্র বনু কুরাইযার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। এই সময় বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। হযরত আবদুল্লাহ ইবন সালাম ছিলেন যুদ্ধবন্দীদের সার্বিক দায়িত্বে। হযরত মাহমিয়া ইবন যাজা খুমুস তদারকি করিতেন। মুহাম্মাদ ইবন মাসলামাকে যুদ্ধবন্দীদের হাতকড়া পরাইবার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। হযরত আলী ইবন আবু তালিব (র) ও হযরত যুবায়ের ইবন আওয়াম দণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড কার্যকর করিবার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং হযরত মুসলিম ইবন বাহরাই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের দায়িত্বে ছিলেন। হযরত সাদ ইবন উবাদা ও সাদ ইবন যায়দ নামক দুইজন কর্মকর্তা বিক্রয়যোগ্য বন্দীদের যথাক্রমে সিরিয়া ও নজদের বাজারে বিক্রয় করিতেন।

খায়বারের ইয়াহুদীদের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের পর ৩জন কর্মকর্তাকে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। ওয়াকিদী এবং তাহার অনুসারী বলেন, খাযরাজ গোত্রের ফারওয়া ইবন আমর আল বায়াজিকে সাহিব আল-মাগানিম হিসাবে নিয়োগ করা হয়। অন্যদিকে উসদ দাবি করেন যে, মিরদাস ইবন মারওয়ানকে এতদসংক্রান্ত দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল। সম্ভবত ইহা হইতে পারে যে, মিরদাসকে খুমুস অথবা মুসলমানদের অংশ দেখাশুনার দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল। তৃতীয় একজন কর্মকর্তা ছিলেন হযরত আবু জুহায়না আল-আনসারী। তাহাকে যুদ্ধে প্রাপ্ত ভেড়া ও ছাগলের পাল রাজধানী মদীনায় লইয়া আসিবার দায়িত্ব প্রদান করা হয়।৭৪

মক্কা বিজয়ের প্রসংগে ওয়াকিদী যদিও যুদ্ধলব্ধ মালামালের দায়িত্বে নিয়োজিত কোন কর্মকর্তার নিয়োগের কথা উল্লেখ করে নাই কিন্তু উসদ তাহা করিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, রাসূলুল্লাহ (সা) এই সৌভাগ্যময় দিনে যুদ্ধলব্ধ মালামাল সংগ্রহের জন্য খুযায়াহ ইবন আবদ নাহমকে নিয়োগ করেন।

তাবারী এবং ইবন খালদুন একমত যে, আল জিরানাহ-এর যুদ্ধে প্রাপ্ত মালামাল ও বন্দী সগ্রহের ব্যবস্থা করিবার জন্য মাসউদ ইবন আমর আল-গিফারী (রা)-কে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে উসদ বলেন, এইজন্য আমর ইবন আল-কারীকেও প্রেরণ করা হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হইল যে, আল-জিরানাহ যুদ্ধলব্ধ মালামাল সংগৃহীত হইবার পর একজন নিয়োগ করা হইয়াছিল। এইখানে একটি বিশেষ বিষয় উল্লেখের প্রয়োজন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) হুনায়নের যুদ্ধে আটক বন্দীদের ছিন্ন কাপড় দেখিবার পর বুসর ইবন আবু সুফিয়ান আল-খুযাইকে তাহাদের জন্য নূতন কাপড় খরিদ করিবার নির্দেশ প্রদান করেন।৭৫

৩৪৫

সেকালের সেরা পরিসংখ্যানবিদ হযরত যায়দ ইবন ছাবিত আল-জিরানাহ যুদ্ধে সংগৃহীত যুদ্ধবন্দীদের গণনা ও তালিকা প্রনয়ণের দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। আরও উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) হাওয়যিনের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত লইবার পর মুহাজির, আনসার ও যাযাবর গোত্রগুলিকে তাহাদের ভাগে প্রাপ্ত বন্দীদের মুক্তি প্রদানে রাজী করাইতে হযরত উমার ইবনুল খত্তাব, যায়দ ইবন সাবিত ও আবু রহুম আল গিফারীকে নির্দেশ প্রদান করেন।

শুধু গাযওয়াতেই যে এই সকল কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হইত তাহাই নহে, সারিয়াতেও এইরূপ কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হইয়াছিল। ইবন সাদের বিবরণ অনুযায়ী, আল-ফুলস-এ আলীর সারিয়াকালে হযরত আবু কাতাদাকে যুদ্ধলব্ধ মালামাল ও বন্দীদের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ করা হয়। এইগুলিকে খাপছাড়া প্রমাণ বলিয়া বলিয়া মনে হইলেও এই কথা বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সা) অথবা সারায়ার কমান্ডারদের স্বীয় ব্যবস্থাপনায় এই ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছিল। এক হিসাবমতে দেখা যায় যে, অধিকাংশ নিয়োগই হইয়াছে মধ্য আরব হইতে এবং খাযরাজ ও আওস গোত্রের নিয়োগপ্রাপ্তদের সংখ্যা সর্বোচ্চ। অন্যদিকে কুরাইশদের সংখ্যা একেবারেই কম। ইহার পরে রহিয়াছে। পবিত্র শহর দুইটির পশ্চিমে বসবাসকারী গোত্রগুলি। একত্রে তাহাদের সংখ্যা ৭ জন, যদিও ব্যক্তিগতভাবে কেহই গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। এই সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন হইলেনঃ আওস গোত্রের হযরত মুহাম্মাদ ইবন মাসলামা, খাযরাজের আবদুল্লাহ ইবন কাব ও যায়দ ইবন সাবিত। আসলাম গোত্রের বুরায়দা-ইবনুল হুসায়ব, মাসউদ ইবন হুনায়দাহ প্রমুখ।

ধারা-৯৭৭

অস্ত্রাগারের দায়িত্বে কর্মকর্তা নিয়োগ সামরিক বাহিনীর অস্ত্রাগারের নিরাপত্তার জন্য কর্মকর্তা নিযুক্ত করা যাইবে।

বিশ্লেষণ, দেশের প্রতিরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীর অস্ত্রভাণ্ডারের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা নিয়োগ করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। এ বিষয়ে ইসলামী গ্রন্থে বিস্তারিত কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু ইহা নিশ্চিত যে,

পরিচা জন্থে বিস্তীe-in

৩৪৬

সামরিক বাহিনীর এই শাখায় বেশ কিছু পদাধিকারী ব্যক্তি ছিলেন। ইহার কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) অশ্বসহ যুদ্ধসামগ্রী সংগ্রহে ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করিয়াছিলেন। পূর্বেই বলা হইয়াছে, মুসলিম সেনাবাহিনীর গোড়ার দিকে সামরিক সরঞ্জাম এবং অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল। বদর, উহুদ এবং অন্যান্য যুদ্ধে তাহা স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে মুসলমানদেরকে পবিত্র কুরআনে উক্ত পরামর্শ বেশি সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সামগ্রী সংগ্রহে বাধ্য করে। ৭৭ মদীনার উপর কুরাইশদের আশু হামলার বিপদ অনুধাবন করিয়া রাসূলুল্লাহ (সা) একেবারে প্রথম থেকেই বিশেষভাবে অশ্বারোহী বাহিনীসহ একটি কার্যকর “যুদ্ধযন্ত্র” গড়িয়া তুলিবার ব্যাপারে কোন প্রকার গাফিলতি করেন নাই। এ ব্যাপারে উসদ গ্রন্থে একটি উল্লেখযোগ্য তথ্য উপস্থাপিত হইয়াছে। তথ্যানুযায়ী বদর যুদ্ধের কিছু আগে রাসূলুল্লাহ (সা) মাত্র ৩টি অশ্ব সগ্রহ করেন এবং তাহাই হ্যরত সাদ ইবন আসাদ ইবন যুরারাহ খাযরাজীর তত্ত্বাবধানে রাখেন। এই ঘটনা হইতে বুঝা যায়, প্রথম থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা) অস্ত্র ও অশ্বসহ সমর সরঞ্জাম সংগ্রহের নীতি গ্রহণ করেন এবং বিশেষ ব্যক্তিকে ইহার দায়িত্ব অর্পণ করেন।

ধারা-৯৭৮

অস্ত্রাগার প্রতিষ্ঠা সেনাবাহিনীর জন পর্যাপ্ত অন্ত্রভাণ্ডার গড়িয়া তুলিতে হইবে।

বিশ্লেষণ

দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করিতে সেনাবাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্রাগার থাকা একান্ত প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সময় হইতেই মুসলিম সেনাবাহিনীর এই অস্ত্রভাণ্ডারের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুসলিম বাহিনীতে অশ্ব ও অশ্বারোহী বাহিনীর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধি সম্পর্কে পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে মুসলিম বাহিনীর অস্ত্র সংগ্রহের পরিসংখ্যানগত পর্যালোচনা করা যাইতে পারে। প্রথম যুদ্ধ বিজয় হইতে মুসলমানগণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মালে গনীমত সংগ্রহ করে। তবে এই অশ্ব মুসলিম যোদ্ধাদের মাঝে বিতরণ ও খুমুস (রাষ্ট্রের অংশ) রাখা হইয়াছিল কিনা কিংবা সবই খুমুস হিসাবে রাখা হইয়াছিল সে ব্যাপারে তথ্যসূত্রে বিস্তারিত কিছু উল্লেখ করা হয় নাই। তবে যাহাই করা হউক না কেন, এসকল যুদ্ধলব্ধ মালামাল

৩৪৭

মুসলমানদের যুদ্ধ ক্ষমতা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধিতে সহায়তা করিয়াছিল। পরবর্তী অভিযানকালে ইহার সত্যতা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে উহুদের প্রান্তরে মক্কার কাফির বাহিনীর সহিত যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী সকল প্রকার যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত ছিল এবং তাহাদের মধ্যে ১০০ জন ছিল বর্ম পরিহিত (দারি), ৫০ জন অশ্বারোহী। পরবর্তী কালে অন্যান্য যুদ্ধে আরো অস্ত্র সংগৃহীত হয়। অনেক অস্ত্র স্বাভাবিকভাবে তৈরিও করা হয়।

রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অবশিষ্ট অভিযানগুলি হইতে মনে হয়, মুসলিম বাহিনী পর্যাপ্ত সমর সরঞ্জামেও সজ্জিত ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ৭ম হিজরীতে উমরাতুল কাজা নামে আখ্যায়িত উমরাহ পালনকালে ২০০০ যোদ্ধার সকলেই বর্ম পরিহিত এবং তলোয়ার, বর্শা ও অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত ছিল। হুদায়বিয়ার স্বাক্ষরিত সন্ধির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করিয়া রাসূলুল্লাহ (সা) সকল অস্ত্রশস্ত্র পবিত্র শহরের বাহিরে রাখেন এবং বশীর ইবন সাদকে তাহার তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত রাখেন। পরে মুসলমানগণ মক্কায় প্রবেশ করিলে সেগুলি পাহারা দেওয়ার জন্য ২০০ সৈন্যসহ আওস ইবন খাওলীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

প্রায় এক বৎসর পর মক্কা বিজয়াভিযানকালে মুসলিম বাহিনীর ১০,০০০ সৈন্যের সকলেই সম্পূর্ণ বর্ম সজ্জিত ছিল। ইসলামী বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন উল্লেখ না থাকিলেও ওয়াকিদী সুনির্দিষ্টভাবে সুলায়ম গোত্রের ৯০০ সৈন্যের একটি সুসজ্জিত বাহিনী এবং তাহাদের বর্ম, কানার -এর কথা উল্লেখ করিয়াছেন। ওয়াকিদী সুলায়ম ও ফাজারা গোত্রের অস্ত্রশস্ত্রের বর্ণনা দিয়াছেন এবং তাহাদের সামরিক শৌর্যের কথাও বলিয়াছেন।

মুহাজির ও আনসারদের লইয়া রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুবিখ্যাত বাহিনীর শেষ ব্যক্তিটি পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে বর্ম সজ্জিত ছিল। তাহাদের প্রত্যেকের শুধু চোখের মনি ছাড়া আর কিছু দেখা যাইত না। একটি বিবরণমতে শুধুমাত্র তাঁহার সেনাদলে ১০০০০ জন যোদ্ধা পূর্ণ বর্ম সজ্জিত ছিল। তৎকালীন মক্কা বাহিনীর প্রধান আবু সুফিয়ান তাহার স্ত্রীকে মুসলিম বাহিনী সম্পর্কে বলিয়াছেন, লৌহ বর্ম সজ্জিত ১০,০০০ সৈন্য লইয়া মুহাম্মাদ আসিতেছে। হুনায়নের আসন্ন যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার পতনের পর ইসলাম গ্রহণকারী নওমুসলিমদের জন্য মক্কার অন্যতম ধনী ব্যক্তি সাফওয়ান ইবন উমাইয়ার নিকট হইতে এক শত বর্ম ক্রয় করেন। ৯

উস গ্রন্থে উল্লেখিত হইয়াছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর একজন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুর রহমান ইবন আওফ (রা)-এর ভ্রাতুস্পুত্র আবদুর রহমান ইবন

৩৪৮

আযহারকে এই অভিযানে যুদ্ধাস্ত্রের দায়িত্ব দিয়াছিলেন। তাইফ দুর্গ অবরোধকালে আযদ-এর ৪০০ লোক মুসলিম বাহিনীতে যোগ দেয়। ফলে তাহাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। একটি দাব্বাবাহ ও একটি মিনজানীকসহ আযদ-এর সৈনিকবৃন্দ মুসলিম বাহিনীর সহিত যোগ দেওয়ার জন্য তাহাদের মাতৃভূমি হইতে আসিয়াছিল। ওয়াকিদী বলেন, আযদীরা যে দাব্বাবাহ সাথে করিয়া আনিয়াছিল তাহা ছিল গরুর চামড়ার তৈরী। যাহা হউক, অবরোধ, চাপ বৃদ্ধি এবং শত্রুর আক্রমণ হইতে শিবির রক্ষার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) তাহাদের দুর্গের চারিপার্শ্বে আল-হাসক (কাঁটা ঝোপ) ছড়াইয়া দিয়াছিলেন এবং দাব্বাবাহ ও মিনজানিক ব্যবহার করেন।

ধারা-৯৭৯

দেহরক্ষী নিয়োগ যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনবােধে দেহরক্ষী নিয়োগ করা যায়।

বিশ্লেষণ

যে কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য তাহার দেহরক্ষী নিয়োগ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেহরক্ষী ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেহরক্ষী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। যেহেতু তিনি ছিলেন মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের মূল কেন্দ্রবিন্দ, সে কারণে তাঁহার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়টি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এ সময় তাঁহার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িলে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিই ধ্বংস হইয়া যাইত। উল্লেখ্য, তখনকার যুগে শত্রুপক্ষের নেতা ও প্রধানদের গুপ্তভাবে হত্যার রীতি আরব সমাজে প্রচলিত ছিল। এই ধরনের ঘটনা বিরোধী গোত্র বা শাখার মনোবলে কুঠারাঘাত করিত।

যুদ্ধের সময় তাঁহার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাইত বলিয়া মুসলমানগণ স্বতঃপ্রবৃত্তি হইয়াই তাহার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন এবং এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সমর্থনও আদায় করেন। আনসারদের দুইটি গোত্র আকাবার শপথকালে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিরাপত্তা বিধানের অঙ্গীকার করে। তাহারা রাসূলুল্লাহ (সা) ও তাঁহার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা বজায় রাখিতে নিয়োজিত থাকিয়া বিশ্বস্তভাবে অঙ্গীকার পালন করে। মূলত আওস ও খাযরাজ গোত্র

৩৪৯

দুই-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সহিত রাসূলুল্লাহ (সা) এবং তাঁহার পরিবারের নিরাপত্তা বিধানে নিয়োজিত ছিল। এক্ষেত্রে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দুই ব্যক্তি ব্যক্তি ছিলেন আওস গোত্রের সাদ ইবন মুয়ায এবং খাযরাজ গোত্রের সাদ ইবন উবাদা। বদর অভিযানে রাসূলুল্লাহ (সা) যে তাঁবুতে অবস্থান করিতেছিলেন, সাদ ইবন মুয়ায তাহার সামনে প্রহরায় নিয়োজিত থাকিতেন।

উহুদ যুদ্ধ শেষ হইবার পর শত্রু বিজয়ীর বেশে হামরাউল আসাদ-এর দিকে ফিরিয়া গেলে আওস গোত্রের উসায়দ ইবনুল হুদায়রসহ আনসারদের দুইজন গোত্র প্রধান তাঁহার উপর আশু হামলার আশংকায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর বাসভবন প্রহরায় ছিলেন।৮২

পরে হামরাউল আসাদে শত্রুর মোকাবিলার উদ্দেশে মুসলিম বাহিনীর অগ্রযাত্রাকালে আওস ও খাযরাজ গোত্রের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর তাঁবু পাহারা দেন। ইহাদের মধ্যে ৪ জন ছিলেন আওস গোত্রের : হযরত সাদ ইবন মুয়ায, আব্বাস ইবন বিশির, উবায়দা ইবন আওস ও কাতাদা ইবনুন নুমান এবং ৪ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের : সাদ ইবন উবাদা, হুবাব ইবনুল মুনযির, আওস ইবনুল মুনযির এবং আওস ইবন খাওলী (রা)।৩

পরবর্তী বিভিন্ন অভিযান, যেমন জাতুর-রিকা, হুদায়বিয়া, ওয়াহদিউল কুরা-সহ প্রায় সকল অভিযানে দেহরক্ষী নিয়োগের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়। দেহরক্ষীদের মধ্যে সবচাইতে বিশিষ্ট ছিলেন আব্বাদ ইবন বিশর। তিনি সব সময় তাহার প্রিয় নেতা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করিতেন। এ ব্যাপারে তাহার নাম বিশেষ গুরুত্বের সহিত উল্লেখিত হইয়াছে। আরও যে দুইজন বিশেষভাবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করিতেন তাহারা হইলেনঃ হযরত আম্মার ইবন ইয়াসির, মক্কার বনু মাখযুমের হালীফ এবং আবিসিনিয়াবাসী সুবিখ্যাত মুয়াজ্জিন হযরত বিলাল ইবন রাবাহ (রা)। উল্লেখ্য যে, “আল্লাহ তোমাকে মানুষ হইতে রক্ষা করিবেন” (৫ঃ ৬৭) শীর্ষক আয়াত নাযিল হওয়ার পর মহানবী (সা) তাঁহার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করেন।

৩৫০

তথ্যনির্দেশিকা? ১. নাহজুল বালাগা, পত্র পৃষ্ঠা ৫৩-৫৪। ২. মাকরিযী, পৃ. ৯২; ফাতহুল বুলদান, পৃ. ৪৪। ৩. শিবলী নোমানীর “আল-ফারূক, পৃ. ২২৮-২৯। ৪. ঐ গ্রন্থ, পৃ. ২৩১। ৫. ঐ গ্রন্থ, পৃ. ১৩৩। ৬. ঐ গ্রন্থ, পৃ. ১৩৩। ৭. কানযুল উম্মাল, ২খ, পৃ. ২৩১। ৮. তারীখে তাবারী, ২৩,২৫। ৯. মাকরিযী, ১খ, পৃ. ১৬৬। ১০. তাবারী, ২, পৃ. ৫৪৯। ১১. মাকরিযী, ১খ, পৃ. ১৬৫। ১২. তারীখে তাবারী, ৬খ, পৃ. ৮০৫। ১৩, কানযুল উম্মাল, ৫খ, পৃ. ৩৩১; ইমাম মালিক (র) ৩০ হাজারের স্থলে ৪০ হাজার উল্লেখ

করিয়াছেন। ১৪. তাবারী, পৃ. ৩৭৩-৭৫। ১৫. ফাতহুল বুলদান, পৃ.৩৭৫। ১৬. মাকরিযী, পৃ. ২৯২। ১৭. মাকরিযী, পৃ. ২৯২। ১৮. কিতাবুল খারাজ, পৃ. ২৭। ১৯. তাবারী, ২৪৮। ২০. ঐ, ২খ, পৃ. ৪৯৫। ২১. আল-ফারূক, পৃ. ২৪০-৪১। ২২. ঐ, পৃ. ২৪৪। ২৩. ফুতুহুল বুলদান, পৃ. ২১৫। ২৪. ইব্‌ন সাদ, ৩খ, পৃ. ৪৫। ২৫. উসদুল গাবা, ২খ, পৃ. ২৩৪; তাবাকাত, ৩২, পৃ. ৪৫-৪৬। ২৬. ইবন ইসহাক, পৃ. ২৩২। ২৭. আল-ইকদুল ফারীদ, ৩২,পৃ. ৩১৫। ২৮. ইবন খালদুন, মুকাদ্দিমা, শাখা ৩৭, পৃ. ২৭২-৩। ২৯. তারীখে তাবারী, ২, পৃ. ২০৯-১০।

৩০. ওয়াকিদী, পৃ. ৫৮, ৭০-৭১। ৩১, ঐ, পৃ. ৫৮। ৩২. ঐ, পৃ. ৩২, ৩৪, ৪২, ৪৬, ৫৮-৫৯, ১৪৪, ২০১, ৩০২। ৩৩. ঐ, পৃ. ৪৯৯; তাবারী, ২খ, পৃ. ৫৮২। ৩৪. ইবন সাদ, ২খ, পৃ. ১০৬। ৩৫. ওয়াকিদী, পৃ. ৮০১, ৮১৫, ৮১৯, ৮২৫। ৩৬. ঐ, পৃ. ৮৯৭-৮, ৯১২, ৯২৩। ৩৭. রাসূল মুহাম্মাদ (সা)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৫৮। ৩৮. উসদুল গাবা, ২খ, পৃ. ২৯৬-৭; ওয়াকিদি, পৃ. ৪৬০, ৫৪৭। ৩৯. ইবন সাদ, ২খ, পৃ. ৬৭-৮০। ৪০. ওয়াকিদী, পৃ. ৪৬০- ৬৪। ৪১. ঐ, পৃ. ৩৭১। ৪২. ঐ, পৃ. ৩৭১। ৪৩. ঐ, পৃ. ২১। ৪৪. ঐ, পৃ. ২৬। ৪৫. তাবাকাত, ২খ, পৃ. ১২; তাবারী, ২খ, পৃ. ৫০৫। ৪৬. ওয়াকিদী, পৃ. ৯৯৫। ৪৭. রাসূল মুহাম্মাদ (সা)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৬৫। ৪৮. আজরাকী, পৃ. ৭০-৭১।

৪৯. ইবন ইসহাক, পৃ. ৩৭৯। ৫০, জুবাইরা, পৃ. ২৫১-৪। ৫১. ইন সাদ, ২খ, পৃ. ৬। ৫২. রাসূল মুহাম্মাদ (সা)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৬৬-৭। ৫৩. ঐ, পৃ. ১৬৮। ৫৪. ওয়াকিদী, পৃ.৫১; তাবারী, ২খ, পৃ. ৪২২, ৪৩৬। ৫৫. ওয়াকিদী, পৃ. ৫১; তাবারী, ২খ, পৃ. ৪২২, ৪৩৬। ৫৬. তাবারী, ২খ, পৃ, ৪২২। ৫৭. ওয়াকিদী, পৃ. ৪২। ৫৮. কিতাবুল মুহাব্বার, পৃ. ২৮৭। ৫৯. ওয়াকিদী, পৃ. ১৪১; তাবারী, ২খ, পৃ. ৪৫৮। ৬০. ওয়াকিদী, পৃ. ৩৭২।

৬১. সীরাতে ইবন হিশাম, ১খ, পৃ. ৬১২-১৭। ৬২. ওয়াকিদীর মাগাযী, পৃ. ৪৮২। ৬৩. ঐ, পৃ. ৫৪। ৬৪. ঐ, পৃ. ৪৬০-৬১। ৬৫. ঐ, পৃ. ৪৮। ৬৬, ঐ, পৃ. ৮৯৩ ও ৩৪৮। ৬৭. ইব্‌ন সাদ, ৩২, পৃ. ১৭৩। ৬৮. উসদুল গাবা, ২খ, পৃ. ২৮৬-৭। ৬৯, তাবারী, ৩খ, পৃ. ২৩। ৭০. ঐ, ৩খ, পৃ. ২৬৮। ৭১. রাসূল মুহাম্মাদ (সা)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৭৬। ৭২. ওয়াকিদী পৃ. ৫০৯; ইবন সাদ, পৃ. ৭৫। ৭৩. ইবন সাদ, ২খ, পৃ. ৭৫; উসদুল গাবা, ৪খ, পৃ. ১৭৬-৭। ৭৪. ওয়াকিদী, পৃ. ৯২৮। ৭৫. রাসূল মুহাম্মাদ (স)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৭৮। ৭৬. ওয়াকিদী, পৃ. ৬৮০। ৭৭, সূরা আনফাল, ৬০-৬৫ নং আয়াত দ্র.। ৭৮. উসদুল গাবা, ২খ, পৃ. ২৬৮। ৭৯. রাসূল মুহাম্মাদ (সা)-এর সরকার কাঠামো, পৃ. ১৮১। ৮০. ওয়াকিদী, পৃ. ৯২৩। ৮১. ওয়াকিদী, পৃ. ৫৫; তাবারী, পৃ. ৪৪৯। ৮২. ওয়াকিদী, পৃ. ২০৮; ইবন সাদ, ২৩, পৃ. ৩৭; উসদুল গাবা, ২খ, প. ২৯৬। ৮৩. ওয়াকিদী, পৃ. ৩৩৬, ৩৯৭ ও ৫০৬; উসদুল গাবা, ৩খ, পৃ. ১০০-১০১।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *