৪০. শুক্লযজুর্বেদ – চত্বারিংশ অধ্যায়

চত্বারিংশ অধ্যায়

মন্ত্রঃ– ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য। স্বিদ্ধন৷৷১। কুন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমা। এবং ত্বয়ি নান্যখেতোহস্তিন কর্ম লিপ্যতে নরে৷৷২। অসূর‍্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ। তাঁস্তে প্রেত্যাপি গচ্ছন্তি যে কে চাত্মহননা জুনাঃ ৷৷৩৷ অনেজদেকং মনসোজবীয়ো নৈনদেবা আয়ুব পূর্বমর্শৎ। তদ্ধাবহোহন্যানতত্যতি তিষ্ঠত্তস্মিন্নপো মাতরিশ্বা দধাতি৷৷৷৷ তদেজতি তমৈজতি তদূরে তদ্বন্তিকে। তদন্তরস্য সর্বস্য তদু সর্বস্যাস্য বাহ্যতঃ ৫৷৷ যস্তু সর্বাণি । ভূতান্যাত্মৈম্নেবানু পশ্যতি। সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিচিকিৎসতি৷৷৬৷৷ যস্মিন্ । সর্বাণি ভূতান্যাত্মৈবাভূদ্বিজানতঃ। তত্র কো মোহঃ কঃ শোকঃ একত্বমনু পশ্যতঃ।।৭৷৷ স পর্যগাছুক্রমকায়মব্রণমস্বাবিং শুদ্ধমপাপবিদ্ধ। কবিৰ্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভর্যাথা তথ্যতোহথা ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।৮। অন্ধং তমঃ প্রবিশন্তি যেহসংভূতি মুপাসতে। ততো ভূয় ইবতে তমো য উ সত্যাং রতাঃ।।৯। অন্যদেবাহুঃ সম্ভবাদন্যদাহুরসম্ভবাৎ। ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে৷১০৷৷ সতিং চ বিনাশং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ। বিনাশেন মৃত্যুং তীৰ্বা সত্যামৃতমতে৷১১৷ অন্ধং তমঃ প্ৰ বিশন্তি যেহবিদ্যামুপাসতে। ততো ভূয় ইবতে তমো য উ বিদায়াং রতাঃ।১২৷৷ অন্যদেবাহুর্বিদ্যায়া অনাদাহুরবিদ্যায়াঃ। ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে।১৩৷৷ বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ। অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীৰ্বা বিদ্যয়াহমৃতমতে৷১৪। বায়ুরনিমমৃতমথেদং ভস্মান্তং শরীর। ও ক্রতো স্মর। ক্লিবে স্মর। কৃতং স্মর৷৷১৫৷৷ অগ্নেনয় সুপথা রায়ে অস্মান্বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান্। যুযোধ্যজুহুরাণমেনো ভূষিষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম৷৷১৬৷৷ হিরন্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্। যোহসাবাদিত্যে পুরুষঃ সোহসাবহ। ওঁ স্বম্ ব্রহ্ম।১৭৷

[কাণ্ড-১৭ : মন্ত্র : ১৭]।

.

মন্ত্রার্থঃ— ১। [উবট বলছেন–সমাপ্তং কর্মকাণ্ডমিদানীং জ্ঞানকাণ্ডং প্রয়তে। মহীধরও বলেছেন–একোণচত্বা রিংশতাধ্যায়ৈঃ কর্মকাণ্ডং নিরূপিত। ইদানীং কর্মাচরণশুদ্ধান্তঃকরণং প্রতি জ্ঞানকাণ্ডমেকেনাধ্যায়েন। নিরূপতে। অর্থাৎ–এ পর্যন্ত.৩৯টি অধ্যায়ব্যাপী শুক্লযজুর্বেদোক্ত সংহিতা অংশে কর্মকাণ্ডের বিষয় বা মন্ত্ৰসমূহ বিধৃত। সুতরাং ঐ পর্যন্ত বেদানুসারী কর্ম আচরণ পূর্বক অন্তঃকরণ শুদ্ধ হওয়ার পর এই শেষ ৪০তম অধ্যায়টিতে জ্ঞানকাণ্ড বিধৃত হয়েছে। এই সকলই ঈশ্বরের দ্বারা অভিব্যাপ্ত হয়েছে। যা কিছুই এই জগতে চরাচর প্রপঞ্চ বিদ্যমান আছে, সেই ঈশ্বরের দ্বারা প্রদত্ত পদার্থসমূহকে নিষ্কাম ভাবের দ্বারা সেবন করো। কোনও ধনের প্রতি লালসা করো না। (বক্তব্যসর্বাণি দ্রব্যাণ্যণ্যোমুপগচ্ছন্তি দৃশ্যন্তে অতো মমেদমিতি বুদ্ধিরবিদ্যা তাং ত্যজতে যোগেহাধিকার ইত্যর্থঃ।)–আমার এই বুদ্ধি, বা অবিদ্যাকে পরিত্যাগ করলে তবেই আমি যোগে, অধিকার লাভ করব।

২। কর্ম করেই মনুষ্য শত বৎসর পর্যন্ত জীবিত থাকতে ইচ্ছা করে। সেই রকমে, হে জীব! তোমার মুক্তি হতে পারে। এ ব্যতীত ভিন্ন মার্গের দ্বারা তোমার মুক্তি নাই। এই রকম কর্মরত জীবন অতিবাহিত করার পরও মনুষ্যের মধ্যে কর্ম সংসক্ত (আসক্ত) হয় না; (অর্থাৎ তাকে কর্মফল ভোগ করতে হয় না)। (বক্তব্য–দ্বাবিমাবথ পন্থনৌ যত্র বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ। প্রবৃত্তিলক্ষণো ধর্মো নিবৃত্তৌ চ। বিভাষিতঃ। এক কথায় নিবৃত্তিঃ, অর্থাৎ নিষ্কাম কর্মে প্রবৃত্তির দ্বারাই মনুষ্য মুক্তি লাভ করতে পারে)।

৩। ঘোর তমসায় বা অজ্ঞানতার অন্ধকারে আবৃত সেই লোক (যোনিসকল) অসুর্য (অর্থাৎ অসুরগণের বশীভূত) নামশালী হয়ে থাকে। সেই লোকসমূহ মরণের পর স্থাবর জঙ্গম ইত্যাদিরূপে পুনর্জাত হয়. যারা আপন কর্মকে বা নিজেকে হনন করে থাকে। অনুচিত কর্ম করার সময় যে আপন অন্তরাত্মার আওয়াজ শ্রবণ করেও তাকে অবহেলনা করে এবং সেই অনুচিত কর্ম করে, তারাই প্রাণপোষণপর অসুর)। (মহীধর-ভাষ্য অনুসারে, শুধু মনুষ্যই অসুরত্ব প্রাপ্ত হয় না, দেবগণও অসুর।–অসুর্যাঃ অসুরাণামিমে অসুৰ্যা অসুষু প্রাণেষু রমন্তেহসুরাঃ, প্রাণপোষণপরা)।

৪। সেই পরমাত্মা অচল অর্থাৎ কম্পন বা গতি করণশালী নন। তিনি এক। অথচ তিনি মনেরও অধিক বেগশালী। সেই বেগে দেবতাও পাদক্ষেপে সক্ষম হয় না; (অর্থাৎ পা ফেলে চলতে পারে না। তিনি প্রথম হতেই সর্বত্র ব্যাপ্ত হয়ে আছেন; অথচ তিনি সকল চক্ষু-শ্রোত্র ইত্যাদি ইন্দ্রিয়েরও অগোচর। ধাবমান হয়ে তিনি তাতেই ব্যাপ্ত অন্যান্য লোকসমূহকেও উল্লঙ্ঘন করে যান।সেই পরব্রহ্মেই স্থিত হয়ে অন্তরিক্ষগামী (মাতরিশ্বা) পবন আপ (জল)-কে ধারণ করে থাকে; (জল অর্থে–তানি কর্মাণি যজ্ঞহোমাদীনি যস্মিন্ দধাতি স্থাপয়তি স্বাহা বাতে ধাঃ (৮২১) ইতি সমিষ্টয়জুষি বায়ুস্থত্বোক্তেঃ কর্মাণি তাবদ্বায়ৌ স্থাপ্যন্তে সমষ্টিরূপোহসৌ বায়ুরপি যস্মিন কর্মাণি স্থাপয়তি। যাগহোমদানাদিকর্মণাৎ পরমং নিধান)।

৫। জীবরূপ সেই পরমাত্মা গমন করে থাকেন এবং স্থাবররূপ তিনি কখনও গতিশীল নন। (তিনি চরাচর অর্থাৎ স্থাবর-জঙ্গমাত্মক নিখিল ব্রহ্মাণ্ড)। অজ্ঞানীর নিমিত্ত তিনি দূরস্থ, অর্থাৎ বোধের অগম্য; পরন্তু জ্ঞানীর নিমিত্ত তিনিই অত্যন্ত নিকটস্থ, অর্থাৎ হৃদয়ের অন্দরে স্থিত। তিনি সকলের অন্তরে বিরাজিত; আবার তিনিই এই প্রপঞ্চের বাহিরেও স্থিত হয়ে থাকেন; অর্থাৎ তার বিকার সমূহের উর্ধ্বে থাকেন।-(চেতনাচেতনরূপমনস্তং ব্রহ্ম)।

৬। যে বিদ্বান্ সকলভূতকে অর্থাৎ প্রাণীজাতমাত্রকে সেই পরমাত্মাতেই স্থিত দর্শন করেন এবং সকল ভূতে অর্থাৎ প্রাণীজাতমাত্রে অবস্থিত সেই পরমাত্মাকে দর্শন করেন (বা জ্ঞাত হন), তখন কোন বিষয়ে কখনও কোন সন্দেহ আরোপ করেন না। (তার সকল কার্য নিভ্রান্ত অর্থাৎ ভ্রান্তিহীন এবং উচিতই হয়ে থাকে)।(আত্মজ্ঞ মুমুক্ষুর বিচারনিবৃত্তি হয়ে যায়)।

৭। যে অবস্থায় উপনীত হয়ে যোগী সকল প্রাণীকে ঈশ্বরের স্বরূপ বলেই জ্ঞান করেন, তখন সেই অবস্থায় সেই একত্বকে দর্শনশালীর মোহই, বা কি এবং শোকই বা কি? অর্থাৎ তার কোনও শোক মোহ অবশিষ্ট থাকে না।–(অবিদ্যাকার্যয়োঃ শোকমোহোরসম্ভবাৎ সকারণস্য সংসারস্যাত্যন্তমুচ্ছেদ)।

৮। সেই পরমাত্মা সর্বত্র ব্যাপক হয়ে আছেন; তিনি বীর্যরূপ, অর্থাৎ শুদ্ধ (শুক্র) স্বরূপ; তিনি অকায়, অর্থাৎ প্রাকৃত শরীরহীন বা নিরাকার; তিনি অব্রণ, অর্থাৎ শিরারহিত; স্নায়ুসমূহের বন্ধনের উর্ধ্বে স্থিত; তিনি শুদ্ধ, অর্থাৎ নির্মল; তিনি অপাপবিদ্ধ, অর্থাৎ অধর্ম ইত্যাদি বর্জিত; তিনি কবি, অর্থাৎ ক্রান্তদর্শী, তিনি মনীষী, অর্থাৎ সর্বজ্ঞ, তিনি পরিভূঃ, অর্থাৎ পরিতঃ ব্যাপ্ত (সকলের উপর্যুপরি বর্তমান); এবং স্বয়ম্ভু, অর্থাৎ স্বয়ং জায়মান (অর্থাৎ নিজেকে নিজেই সৃষ্টি করণশালী)। সেই পরমাত্মা সদা-সর্বদার নিমিত্ত পূর্বকল্পের অনুকূলেই পঞ্চভূত ইত্যাদিকে সৃষ্টি করেন। এই রকম পরব্রহ্মকে জ্ঞাতশালী জন্যই তাকে (অর্থাৎ ব্রহ্মকে) প্রাপ্ত হন।(য এবমাত্মানং পশ্যতি স ঈদৃশং ব্রহ্ম পর্যগাৎ পরিগচ্ছতি প্রাণোতী)।

৯। সেই ব্যক্তি প্রগাঢ় অন্ধকারময় যোনিকে (অর্থাৎ জন্ম) প্রাপ্ত হয়ে থাকে, যে অসম্ভুতিকে (অর্থাৎ ত্রিগুণাত্মিকা মূল প্রকৃতিকে) উপাসনা করে থাকে। যে ব্যক্তি সম্ভুতিকে (অর্থাৎ স্থল প্রপঞ্চকে বা স্থল জগৎকেই পরমার্থ জ্ঞানে) উপাসনা করে, তাকে তারও অধিক অন্ধকারকে প্রাপ্ত হতে হয়। (ত্রিগুণাত্মিকা মূল প্রকৃতির উপাসক অবিদ্যা সম্ভুত কর্মে লিপ্ত হওয়ার কারণে মরণের পরে পুনরায় অন্ধকারময় সংসারে জীবরূপে জন্ম প্রাপ্ত হয়)।

১০। সম্ভব বা স্থূল জগতের উপাসনায় ভিন্নই ফল হয় এবং অসম্ভূতা মূল প্রকৃতির উপাসনাময় ভিন্ন ফলেরই কথা বলা হয়ে থাকে–ধীমান জনগণের মুখে এই রকম কথন আমরা শ্রবণ করি; যে ধীমান তত্ত্ববিদগণ আমাদের নিমিত্ত সেই ব্রহ্মতত্ত্ব বিবেচনা করে দিয়েছেন।(স্থূল জগতের উপাসনা অর্থে কার্যরূপ ব্রহ্মের উপাসনা; এতে অনিমাদি ঐশ্বর্যলক্ষণ ফল লাভ হয়–কার্য ব্রহ্মোপাসনাৎ অন্যদেব পৃথগেবানিমাদ্যৈশ্বর্যলক্ষণং ফলমাহুঃ…। আর অসংভূতেরব্যাকৃতাদব্যাকৃতেপাসনাদন্যদেব বলমুক্তম্। অর্থাৎ অসংভূতের উপাসনা অর্থে অব্যাকৃতের উপসানা; এতে যোগী-উপাসক প্রকৃতির মধ্যে লয় প্রাপ্ত হন)।

১১। (জগতের) উৎপত্তি এবং বিনাশ এই দুটিকে যে বিদ্বান্ সাথে সাথে জ্ঞাত হন, তিনি বিনাশের দ্বারা মৃত্যুকে উত্তীর্ণ করে সন্তুতির দ্বারা অমৃতকে প্রাপ্ত হন, অর্থাৎ মুক্তি বা মোক্ষ প্রাপ্ত হয়ে যান। (সম্ভুতি অর্থে সর্ব জগতের উৎপত্তির একমাত্র কারণ রূপ ব্ৰহ্ম এবং বিনাশ অর্থে বিনাশধর্মী শরীর–এই দুটি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের দ্বারাই যোগী মোক্ষ লাভ করেন)।

১২। সে প্রগাঢ় অন্ধকারকে প্রাপ্ত হয়ে থাকে, যে অবিদ্যার উপাসনা করে। তারও অধিক অন্ধকারে সে গমন করে, যে বিদ্যার উপাসনা করে। (নবম মন্ত্রে সম্ভুতি ও অসম্ভুতি এই দুটির উপাসনাহানিপ্রদ বলা হয়েছে। দশম মন্ত্রেও এই কথা সমর্থিত হয়; পরন্তু একাদশতম মন্ত্রে অসম্ভুতির স্থানের উপর বিনাশ আসে এবং এই দুটির অর্থ হিতকরী, এমন বলা হয়। বিনাশেনএবং স্যুত্যাপদ করণকারক তৃতীয়া বিভক্তিতে হয়েছে। অতএব এই মন্ত্র অসম্ভুতি (বিনাশ?) এবং সম্ভুতির প্রয়োগ (করণত্ব)-কে বোঝাচ্ছে, না কি তাদের উপাসনাকে বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ সঙ্কুতি অসম্ভুতির উপযোগ করে তো মৃত্যু হতে সন্তরণ (বা উত্তরণ) এবং অমৃতত্ব লাভ করা যায়; পরন্তু ঐ দুটিরই বা ঐ দুটির মধ্যে কোনও একটির উপাসনা হানিপ্রদ। সম্ভুতি পদ তিনটি মন্ত্রে এক এবং তাদের অর্থও সর্বত্র একই প্রতীত হয়ে থাকে; পরন্তু একাদশতম মন্ত্রে বিনাশ পদ অসম্ভুতির পর্যায়ই মানা উচিত। তবে প্রশ্ন এই ওঠে যে, অমৃতলাভের নিমিত্ত ত্রিগুণাত্মিকা মূলপ্রকৃতির উপযোগ কি প্রকারে করা যায়? মৃত্যু হতে পার হওয়াই তো অমৃতত্ব প্রাপ্তি। তবে দুটির উপযোগের অবকাশও কোথায় থাকে? এইরকম অবস্থায় স্যুতি, বিনাশ এবং মৃত্যু কোন ভিন্ন অর্থশালী বলে প্রতীত হয়। এই একাদশতম মন্ত্রে সম্ভুতির অর্থ পরব্রহ্ম প্রতীত হয়। উবট ও মহীধরও সেই অর্থ করেছেন। বিনাশ পদের দ্বারা বিনাশী ঘট-পট ইত্যাদি পদার্থ প্রতীত হচ্ছে। এগুলির সদুপযোগের দ্বারা ঠিকই মৃত্যু হতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়।মৃত্যু পদ এখানে জন্ম-মরণের বাচক প্রতীত না হয়ে সাধারণ দুঃখের পর্যায়-সদৃশ মনে হয়। লৌকিক পদার্থসমূহের কুপ্রয়োগের দ্বারা আমরা সদাই দুঃখ প্রাপ্ত হয়ে থাকি। সাংসারিক দুঃখগুলি হতে পার হওয়া অমৃতলাভ হওয়ার প্রশ্ন। প্রথম লক্ষ্য–সাংসারিক শরীর ইত্যাদি পদার্থসমূহকে উচিত প্রয়োগের দ্বারা সিদ্ধ হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় ফল প্রাপ্তির নিমিত্ত পরব্রহ্মের উপাসনাই একমাত্র সধন)।

১৩। বিদ্যার উপাসনার ফল অন্যই বলা হয়; এবং অবিদ্যার উপাসনার ফলকে অন্যই বলা হয়; (অর্থাৎ একের উপসনার ফলের সাথে অপরের উপাসনার ফলের ভিন্নতা আছে)। এইরকমে আমরা সেই ধীমন্ত আচার্যগণের সকাশে শ্রবণ করেছি, যাঁরা আমাদের প্রতি সেই বিদ্যা ও অবিদ্যার উপাসনার ফলকে ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন।–(বিদ্যা কিংবা অবিদ্যার উপাসনার ফল কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে, তা যোগীদের কথিত বাণী হতেই জ্ঞাত হলে আমাদেরও উপাসনাপদ্ধতি যথার্থ হতে পারে। এই ফল সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধি আপনা হতে জ্ঞাত হয় না)।

১৪। বিদ্যা ও অবিদ্যা এই দুটিকে যিনি সাথে সাথে জ্ঞাত হন, তিনি অবিদ্যার দ্বারা মৃত্যু হতে অতিক্রান্ত হয়ে বিদ্যার দ্বারা অমৃতকে উপভোগ করে থাকেন। (বিদ্যা অর্থে আত্মজ্ঞান, অবিদ্যা কর্ম-সম্পর্কিত। সুতরাং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জ্ঞানকাণ্ডে উপনীত হওয়াই যোগীর মোক্ষ লাভ। এতদ্ধি অমৃতমুচ্যতে যদ্দেবতাত্মগমনং ইতি তেঃ)।

১৫। বায়ু (সপ্তদশ পদার্থে গঠিত লিঙ্গ শরীর) প্রাণত্বে মিলিত হয়ে যায় এবং (জীবাত্মা) সেই অমৃতময় পরমাত্মায়। এক্ষণে এই লিঙ্গ শরীর? ভস্ম পর্যবসায় হয় শরীর। (লিঙ্গ শরীর, জীবাত্মা এবং স্থূল শরীর, মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর আপন আপন গতিকে প্রাপ্ত হয়)। হে জীব! সংসারের কর্তা পরমাত্মাকে ওঁ বলে (অর্থাৎ ওঙ্কারের দ্বারা) স্মরণ করো। এই পরমাত্মাকে তুমি মৃত্যুশয্যার উপরে ক্লীবতার নিমিত্ত স্মরণ করো। সেই সাথেই আপন কৃতকর্মকেও সদা বিচার করতে থাক (–কি বলেছি, কোন অনুচিত কর্ম হয়ে যায় নি তো? ইত্যাদি)। (এই বিদ্যা-অবিদ্যার উপাসনার নিষেধ রয়েছে। দুটিরই স্বয়ং আপনাতে কোন লক্ষ্য নেই। সেই দুটিই সাধন হয়ে থাকে। এক অবিদ্যার (লৌকিক জ্ঞানের) দ্বারা লৌকিক দুঃখ হতে উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়া যায় এবং দ্বিতীয় বিদ্যার (ব্রহ্মবিদ্যার) দ্বারা অমৃতলাভ করা যায়)।

১৬। হে অগ্নি (বা পরমাত্মা)! সৎপথে আমাদের ধন প্রাপ্ত করণের দিকে নিয়ে গমন করো, কারণ তুমি সকল পথ জ্ঞাত আছ। কুটিল পাপকর্ম হতে আমাদের অত্যন্ত দূরে স্থাপিত করো (বা পৃথক্ করে দাও), যাতে আমরা তোমার উদ্দেশে নমঃ বাণী উচ্চারণ করতে পারি (অর্থাৎ পূর্ণ শ্রদ্ধাভক্তির সাথে আমরা তোমাকে নমস্কার করতে পারি)। (কুটিল পথে উপার্জিত ধনে পরমাত্মা বা পরব্রহ্মের পরিচর‍্যা করা যায় না। সম্পূর্ণ নির্মল চিত্তশালী হলেই ঈশ্বরের.অর্চনা করা সম্ভব হয়)।

১৭। সুবর্ণমণ্ডিত পাত্রের (আকর্ষক ঘট-পট ইত্যাদির) দ্বারা সত্যের (অর্থাৎ পরমাত্মার) মুখ (অর্থাৎ প্রবেশ দ্বার) আবৃত হয়ে রয়েছে। ঐ যে আদিত্যমণ্ডলে পরম পুরুষ প্রত্যক্ষীভূত হয়ে রয়েছেন, তা কার্যকারণের সংঘাতে এই আমিই। আমি আকাশের ন্যায় বৃহৎ ব্যাপক পরমাত্মা বা ব্রহ্মকে তার ওঁ নামের দ্বারা ধ্যান করছি; (অর্থাৎ আমি ব্রহ্মরূপী আমাকেই ধ্যান করছি)। (যদ্যপি ব্ৰহ্ম চেতনমাকাশচেতনস্তথাপ্যেকদেশে সাদৃশ্যং–অর্থাৎ যদিও ব্রহ্ম চেতনাত্মক এবং আকাশ অচেতনাত্মক, তথাপি এক দিক দিয়ে উভয়ের সাদৃশ্য রয়েছে।–এই কণ্ডিকায় যোগী সাধক যোগসাধনার মাধ্যমে অর্থাৎ জ্ঞানকাণ্ড অবলম্বন করে ব্রহ্মসাযুজ্য লাভ করছেন)।

বাজসনেয়ি মাধ্যন্দিন শুক্লযজুর্বেদসংহিতা সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *