৪০
আমার লড়াই শেষ। আমি, দেবোপম বসু, যে চূড়ান্ত ঘৃণা সম্পন্ন হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, যে-ঘৃণার দিকে তাকিয়ে আমি শান্তিতে মরতে পারব এই ভেবে যে শুধু জন্মানোর দুর্ঘটনা নয়, আমার জীবনে আরও অনেক দুর্ঘটনা আছে যা আমাকে বাঁচতে সাহায্য করেনি এবং মৃত্যুর জন্য প্ররোচিত করেছে—সেই ঘৃণা আমার সম্পন্ন হয়েছে। এখন দুঃখ একটাই। ওই চূড়ান্ত ঘৃণার মধ্যেও সামান্যতম স্বৰ্গছেঁড়া আলো আমাকে জড়িয়ে গেছে যার জন্য, সমস্ত দুর্ঘটনার পরও, আমি বেঁচে থাকতে পারতাম। এবং ঠিক এ কথাই আমার মনে হয়েছে যে যে-জন্য আমি বেঁচে থাকায় লোভী হয়ে উঠেছি, সে-জন্যও আমার আর বেঁচে থাকা উচিত নয়। ঈশ্বর যদি সত্যিই থাকেন কোথাও, আর আমার মৃত শরীর ছেড়ে যাওয়া অমৃত অবিনশ্বর আত্মাকে জিজ্ঞাসা করেন— কী এনেছ আমার জন্য? ঘৃণা? পৃথিবী থেকে কি ঘৃণা নিয়ে এলে তুমি, যা সারাক্ষণ বুকের তলায় বয়ে বেড়াতে?
আমি বলব—না, ঘৃণা নয়। সে-সব আমি আমার শরীরের সঙ্গে পৃথিবীতে ফেলে এসেছি। এই দেখো, তোমার জন্য আমি এই এনেছি।
আমি হাত প্রসারিত করব ভগবানের দৃষ্টি পর্যন্ত, আর দেখাব, আমার এইটুকু স্বর্গের আলো৷ আমার স্বৰ্গছেঁড়া আলো।
আমাকে যে মরতে হবে, আমার যে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না, এটা আমার নিজের কাছে খুবই স্পষ্ট ছিল। আমার কোনও ঈশ্বরচেতনাও ছিল না। অথচ আজ আমি ঈশ্বর লিখে ফেললাম। যেন সত্যিই বিশ্বাস করতে বসেছি, মৃত্যুর পর সেই পরম শান্তিময়ের কাছে যাব।
অনেকবার ভাবলাম, দাদা যেভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে, আমিও সেভাবে বাঁচি না কেন! ভাল। থাকার চেষ্টা করতে করতে বাঁচা, নাকি ভাল থাকার চেষ্টা করতে করতে মৃত্যু! কোনটা ঠিক?
হবে না। আমার দাদার মতো হবে না। দাদা জীবনকে দেখে। আমি মৃত্যুকে দেখি। ওর সব ভাবনা জীবনের উপসংহারে পৌঁছয়। আর আমি সব কিছুর পর মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই দেখি না। মরণকে দেখতে দেখতে মৃত্যুর সঙ্গে আমার একটা টানের সম্পর্ক হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি রি-অ্যাকটিভ ডিপ্রেশনে ভুগছি। কিংবা বলা যেতে পারে আমি একজন উন্মাদ। আমার ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিস হয়েছে। আমি যাই হই, সিসিফাস হতে চাই না। আনন্দের জন্য সাত মাইল চড়ে আবার গড়িয়ে পড়া পাথর নতুন করে টানার কষ্টের প্রতি আমার মোহ নেই। যতই চেষ্টা করো, শেষ অঙ্কটা সেই শূন্যই। আমার অমরত্বে লোভ নেই। কোনও কিছুতেই আমার লোভ নেই। শুধু একটি জিনিস ছাড়া। ওই চোখ দু’টি। জীবনের অন্তিম পর্বে এসে, বিতৃষ্ণার চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে, ওই একটিই জিনিস আমাকে তৃষ্ণার্ত রাখল। ওই দু’টি চোখ। যদি একবার ছুঁতে পেতাম! থাকগে। যা আমার নয়, তা নিয়ে ভেবে কী হবে! এই পৃথিবীতে কিছুই আমার নয়। কিছুই আমার নেই। তবু আমিও, একবারের জন্য হলেও বিয়াত্রিচের জন্য ভাবিত হলাম।
কাল আমি জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম মরণ ব্রিজই সবচেয়ে ভাল জায়গা। আমার পরমশ্রদ্ধেয়া মাতা আমাকে রোজ ওখানে পাঠান খাটাল থেকে খাঁটি দুধ নিয়ে আসার জন্য। সেই দুধ আমার অনন্ত যৌবনা মা যৌবন ধরে রাখার জন্য পান করেন। সেই দুধ আমার দুধের মতো নিষ্পাপ সরল বউদিদি পান করে। যদিও বউদিদিকে আমি বউদিদি বলি না। বলি পপু। আমার চেয়ে সে বয়সে অন্তত দশ বছরের ছোট হওয়ায়। মাঝে মাঝে মনে হয়, পুপু না হয়ে ওর নাম ডল হলে বেশ হত। আমার নিষ্পাপ দাদা, সাধ করে, একটি ছোট, আদুরে, পুতুল পুতুল সুন্দর নিষ্পাপ মেয়ে এনে পস্তাচ্ছে কারণ মেয়েটি নির্বোধ। আমার যা সবচেয়ে অবাক এবং মজারও লাগছে, তা হল, আমাদের ব্যক্তিত্বময়ী মায়ের সঙ্গে পুপুর অপূর্ব সম্পর্ক। আমরা কেউই কখনও আলোচনা করিনি, কিন্তু সকলেই মনে মনে জানতাম যে পুপুকে মেনে নিতে শবরীদেবীর প্রাণপাত হবে। কিন্তু প্রত্যেকের আশঙ্কা ভুল প্রতিপন্ন করে দেখা গেল পুপু শবরীদেবীর পায়ে পায়ে সাদা বেড়ালছানা হয়ে ঘুরছে আর শবরীদেবী তাকে দুধ ছানা খাওয়াচ্ছেন। গোল-গাল মেয়েটা শাশুড়ির যত্নে এই ক’ মাসেই বেশ ওজন বাড়িয়ে ফেলেছে। পুপুকে নিয়ে মা’র সত্যিই কোনও অসুবিধে নেই। আমারও নেই। পরেশ বোসেরও নেই। বরং পুপু সত্যিই ঘর আলো করা চমৎকার মেয়ে। কারও ওকে নিয়ে কষ্ট নেই। ও যখন দু’-এক দিনের জন্য বাপের বাড়ি যায়, বেশ ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। মা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পরেশ বোস হাজারবার বলে। শুধু দাদা নীরব থাকে। আমি জানি, পুপুকে নিয়ে অসুবিধে যদি কারও হয়, সে দাদার। হ্যাঁ, যে ভালবেসে বিয়ে করে এনেছে, তারই। ভাল থাকার চেষ্টা করার না জীবন—দাদা বলে। কিন্তু বেশি দিন আর বলবে না হয়তো। দাদা নিষ্পাপ দেখে মজেছিল। তখন বোঝেনি, পুপু নিষ্পাপ মেয়ে পুতুল। নিষ্পাপকে দূর থেকে মোহন লাগে, কাছে এলে তার মধ্যে প্রাণের অভাব। নীল আকাশ সুন্দর কিন্তু তাতে সূর্যাস্তের লালের ছিটে লাগলে চোখ ফেরানো যায় না। অপরূপ মুখশ্রীতে অভিজ্ঞতার দু’-একটি আঁচড় বড় তীব্র টানে। পুপু কি কোনওদিন বড় হবে? অভিজ্ঞ? কোনওদিন পৌঁছবে দাদার কাছাকাছি?
পুপুর বাবা পুপুকে একটা টেলিভিশন দিয়েছেন। টেলিভিশন ছাড়া নাকি মেয়ে থাকতে পারে না। এতে শবরী বোসও উপকৃত। দু’জনে সারাক্ষণ টি ভি দেখছে। একজন টয়লেটে গেলে আর একজনকে বলে যায়—কী হল এর মধ্যে, আমায় বলবে কিন্তু।
পুপুর গা ভর্তি গয়না। ও গয়না ভালবাসে। দাদার এত গয়নাগাটি পছন্দ নয়। তবু খুলবে না। নিজের বেশ কয়েকটা গয়না ও শবরী বোসকেও পরিয়ে দিয়েছে। শবরী বোস আবেগ আবেগ গলায় বলছিল—‘তোর বাবা তো কোনওদিন দিল না, তোরাও দিলি না!’ আমার মুখে এসে গিয়েছিল—‘কেন, অরুণ সেন দেয় তোমাকে। এই বাড়ি, এই টাকা, এই জীবন-যাপন। মাই ডিয়ার মাদার, লোকটা তোমার পায়ে এত কিছু নিবেদন করল, তোমার দয়ায় আমরা খেয়ে-পরে বেঁচে রইলাম, তোমার আর দুঃখু কি মা আমার!’
বললাম না, পুপুর জন্য। পুপু এত ছোট, এত সরল। ওকে আমার বোনের মতো লাগে। কিন্তু আমার না হয় বউদির বদলে বোন দিয়ে চলে। দাদার তো চলে না। যেহেতু অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি, আমি শুনতে পাই ওদের কথা। বুঝতে পারি দাদা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। শূন্য হয়ে যাচ্ছে।
দাদার বিয়ের পর বাবা-মা ওদের ওপরের শোবার ঘরটা দিয়ে নীচে নিজেদের ব্যবস্থা করেছে। ভালই হয়েছে। পরেশ বোস, শবরী বোসের এখনও যা সেক্স, জোর চেঁচাতে পারবে। এদিকে আমার দুঃখী দাদা রাতের পর রাত চাঁদ দেখার জন্য বউকে ডাকছে। পুপু বলছে— ধুস। তুমি দেখো। আমার ঘুম পাচ্ছে।
একা একা ব্যালকনিতে চলে যায় দাদা। সিগারেট খায়। অবস্থা এমন যে আমিও ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। একদিন কানে এল, দাদা বলছে—
O lift me from the grass!
I die, I faint, 1 fail!
Let thy love in kisses rain
On my lips and eyelids pale
পুপু বলছে—কী বলছ! আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
দাদা কী করছিল আমি জানি না। হয়তো রোমান্টিক কিছু। মুখে বলছিল—
My cheek is cold and white, alas!
My heart beats loud and fast;
O! Press it close to thine again
While it will break at last
পুপু চেঁচাচ্ছে—ধুর্। ঝরঝর করে ইংরিজি বলছ! আমি কিছু বুঝি?
দাদা বলল—বুঝিয়ে দেবো। শোনো। মানেটা শোনো।
হায়! শব্দ আসছে আমার কানে। আর মনে হচ্ছে সপ্তদশ শতকের কোনও মধুরাত্রি যাপন করছি আমরা। মানে দাদা আর বউদি তা যাপন করছে। আর আমি সাক্ষী থাকছি।
পুপু বলছে—না। আমি শুনব না। আমি গান শুনব। তার চেয়ে তুমি একটা গান গাও।
দাদা বলল—এই রাত্রে গান গাওয়া যায়? জানো না তুমি? পুপু। আমি তোমাকে মানে বলে দিচ্ছি শোনো। এই দেখো—চিক মানে তুমি জানো, কোল্ড মানে জানো, হোয়াইট মানে জানো।
আমার মনে হল বলি—দাদা, এই যদি তোর ভাল থাকার প্রয়াস হয়ে থাকে তবে তুই খারাপ থাক।
পুপু বলল—করবে? আজ করবে? কই দেখি? শক্ত হয়নি। আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমোলাম।
দাদা অসহায়ের মতো নেমে এসেছে বিছানা ছেড়ে। ব্যালকনিতে দাঁড়াল। পুপুও এল একটু বাদে। নাকে কাঁদছে—চলোঁ নাঁ। আমার ইঁচ্ছে কঁরছে। ঘুঁম হঁচ্ছে না।
দাদা ॥ আজ আর হবে না পপু। তুমি শুতে যাও।
পুপু ॥ নাঁ—আ। হবে। রোজ করতে হয়। আমি জানি।
দাদা ॥ তুমি জানো? কে বলল তোমাকে?
পুপু ॥ উঁ! মা বলেছে! রোজ করতে হয়। নইলে ভালবাসা থাকে না।
দাদা ॥ পুপু। প্লিজ। ঘরে যাও। তোমার মা জানতে চাইলে বোলো আমি নপুংসক!
দাদা! বেচারা দাদা! কী হবে ওর! আমি জানি ও মনের সঙ্গী চেয়েছিল। শৈশব থেকে এই বিশ্রী নোংরা কুটিল আবর্তে কাটিয়ে ও নিষ্পাপ খুঁজেছিল। কিন্তু পুপুকে না দেখলে এ সত্য অজ্ঞাত থাকত সে নিষ্পাপের তলায় নির্বুদ্ধিতার সম্ভাবনা খুবই প্রবল। সারল্য এক জিনিস, কিন্তু অগভীরতা অন্য। পুপু দাদার মনের সঙ্গী হয়নি। যে মনের সঙ্গী হয়নি সে শেষ পর্যন্ত প্রাণের সঙ্গী হবে কী করে? যে প্রাণের সঙ্গী নয় সে কী করে শরীর জাগিয়ে তুলবে! বিশেষ করে দাদার ক্ষেত্রে তা খুবই কঠিন। ও তো আমি নয় যে শুধুমাত্র শরীরের জন্যই ছন্দা বউদির সঙ্গে গড়িয়ে নিলাম বিছানায়। দাদার জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার। দাদাকে আজীবন বইতে হবে। পুপুর পাপবিহীনতার বোঝা। ও তো ভাল থাকার সাধনা করে যাবে, তাই ওকে হতেই হবে এ কালের এক সিসিফাস। ওর ঠেলে তোলা পাথরটা এই প্রথমবার গড়াল। ও আবার তুলুক। কিন্তু সেটা দেখার জন্য আমি আর থাকব না।
আচ্ছা, আমার ডায়রিটা নিয়ে কী করব! নষ্ট করে ফেলব, না দাদাকে দিয়ে যাব! ঠিক করিনি এখনও। একটা নোট লিখতে হবে— আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। কেন লিখব আমি? কেন লিখব? আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী নয় পরেশ বোস, অরুণ সেন, শবরী বোস? দায়ী নয় আগ্রার সেই বিকেল? কেন আমার মৃত্যুর জন্য ওদেরও মৃত্যু হবে না?
না। বিচার চাইব না। কে কার বিচার করবে! এ দেশের সবটাই অবিচারের পরিকাঠামো।
সে-দিন বেশ মজার কাণ্ড হল। মরণ ব্রিজ ঘুরে যখন এ দিকে আসছি, ক্লাবের কাছটায় কুঁজি ঘুঁটেকুড়ানি ফুলরেণুর সঙ্গে দেখা। ওর বুকটা খুব দুলছিল। আমার ধরতেও ইচ্ছে করছিল। ও বোধহয় আমার চোখ টের পেল। বলল— রেল লাইনে এসে শুয়ে থাকো কেন বলো তো? তোমার কি ঘর-বাড়ি খাট-বিছানা নেই?
ও কি ইচ্ছে করে বিছানার প্রসঙ্গ আনল? কোনও ইঙ্গিত? আমি এটা-ওটা প্রসঙ্গ টানলাম আর বুক দেখলাম। ওর গায়ে গোবরের গন্ধ। পিঠে কুঁজ। ও কি একটা পুরো মানুষ? ও কি পরিপূর্ণ নারী? ধুর! আমার আবার পরিপূর্ণ কিছু লাগে নাকি? দু’টো বুক ও ভাঁজ করা দু’পায়ের মধ্যবর্তী অবস্থান হলেই আমার চলে যায়। যেমন মূত্রত্যাগের জন্য যে কোনও দেওয়াল, এমনকী ট্রেনের দু’কামরার মধ্যবর্তী ফাঁক! না হলে কি আর ছন্দা বউদির সঙ্গে শুতে পারতাম? কিন্তু আশ্চর্য হল সেই বিয়াত্রিচের পর ছন্দা বউদির সঙ্গে শুতে আমার আর ইচ্ছে করে না।
যা বলছিলাম। সেদিন মরণ ব্রিজ থেকে ফেরার সময় ফুলরেণুর সঙ্গে দেখা। খাট-বিছানা ইত্যাদির পর আমাকে বলল— তোমার কী ব্যাপার বলো তো?
বললাম—কেন?
ফুল ॥ ও দিকে কী দেখছিলে? মরার কথা-টথা ভাবব নাকি?
আমি ॥ ঠিকই ধরেছ দেখছি। ওখানে মরা যায় কিনা দেখছিলাম।
ফুল ॥ হুঁ। রেল তোমাকে টানছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি রেলের নীচেই তুমি মরবে।
আমি ॥ তাই নাকি? কী করে বুঝলে?
ফুল ॥ আমি জানি গো জানি। মরার আগে ওইখানে সব ঘুরঘুর করে। ওখানে যে কত প্রেত, কত আত্মা আছে! এক আত্মা আর একজনকে টেনে নেয়। কী দেখছিলে ওখানে? মরে গেলে কোথায় পড়বে?
আমি ॥ একেবারে ঠিক বললে তো! সত্যি আমি তাই দেখছিলাম। কিন্তু তুমি কী করে জানলে!
ফুল ॥ এ ছাড়া আর কী দেখবে! রেল লাইনের ধারে ধারে দিন গেল। কত মৃত্যুই যে দেখলাম! মরে যাবে, তবু শরীরটা কোথায় রইল দেখার ইচ্ছে যাবে না। পৃথিবীতে কীসের ওপর মানুষের সবচেয়ে বেশি লোভ জান?
আমি ॥ টাকা।
ফুল ॥ না। শরীরের ওপর। নিজের শরীরের ওপর। এই আমাকেই দেখো, ভগবান সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা দেয়নি। তবু বুক ঘষটে ঘষটে বেঁচে থাকি। ঘুঁটে দিই। গোবর কুড়িয়ে দিন গুজরান করি। স্নান করি। খাই। মাথায় তেলও মাখি। শরীর দিয়ে কষ্ট পাই আবার শরীরকেই যত্ন করি। বলো? করি না? মরা মানে কী? শরীরটা মারবে তুমি, তাই না? তা হলে বাঁচা মানে কী বলো? শরীরটাই তো? শরীরটা চলছে ফিরছে এই তো আনন্দ! মরবেই তো একদিন। তখন হাজার কাঁদলেও আর শরীরটা নাড়াতে পারবে নাকো। তোমার শরীর তোমার পর হয়ে যাবে। তখন? তার জন্য এত ব্যস্ততা কেন বাপু?
আশ্চর্য লাগল। এ সবই তো ফুলরেণু জীবন থেকে নিয়েছে। লেখেনি। পড়েনি। কিছুই জানে না। তবু কত জানে! আনিসুজ্জাদা ঠিকই বলেন। দর্শন সাধারণ মানুষের চিন্তায় চিন্তায় ব্যাপৃত আছে। তা উপলব্ধি করা চাই। দার্শনিক একা দর্শন সৃষ্টি করেন না। দার্শনিক তত্ত্ব আসলে জনজীবন থেকে উঠে আসা ব্যাপক পর্যবেক্ষণ ও গভীর উপলব্ধি।
সে যাক গে। আমার আর এ সবে কাজ কী! আমার যোলোকলা পূর্ণ হয়েছে। এবার অস্ত চাই। আরে! চাঁদ কি অস্ত যায় নাকি! যায়। সূর্য অস্ত গেলে চাঁদ যাবে না কেন? চন্দ্ৰাস্ত, কী চমৎকার কথাটা! আসল ব্যাপার হল চোখের আড়াল হওয়া।
পুরী গিয়েছিলাম। মোটেই যেতাম না আমি। দাদার ইচ্ছেয় গিয়েছিলাম। ও চেয়েছিল একটা ফ্যামিলি ট্যুর। সেই যে আগ্রা গিয়েছিলাম আমরা আর ধ্বংস করেছিলাম আমাদের শৈশবকে সারল্যকে, তার পর থেকেই নাকি ও ভেবে রেখেছিল একটা ফ্যামিলি ট্যুর করবে কোনওদিন। ধুর। হয় না, হয় না। আমাদের দিয়ে এ সব হয় না। কষ্ট হয় দাদার জন্য। ও যে কবে বুঝবে এ সব! এখনও কত স্বপ্নিল ওর চোখ!
ওর জন্যই গিয়েছিলাম আমি। না হলে আমার যাবার কোনও ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ভাগ্যিস গিয়েছিলাম!
আমাদের পাঁচজন, অরূপ দেবাশিস আর দেবাশিসের বউ জিনি— শিঞ্জিনী— এই ক’জন গিয়েছিলাম।
বেরুবার সময় আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রায় বছর কুড়ি আগের সেই আগ্রা যাবার কথা। দাদারও নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল। আমার আর দাদার ছোটবেলার সমস্ত স্মৃতি একরকম। তবু ও ওর মতো তৈরি হল। আমি আমার মতো। হয়তো দু’জনের মূল উৎসে পার্থক্য আছে বলে। আর পার্থক্য যদি নাই থাকে তাহলেও আমার আলাদাই হওয়ার কথা। একই পরিবেশে থাকলেও প্রত্যেকটি মানুষই পরস্পরের থেকে আলাদা। সেটাই স্বাভাবিক। তবু আমরা যখন একলা হই, যখন দু’জনই থাকি, যখন গভীর চোখে পরস্পরের দিকে তাকাই, আমরা মনে মনে এ ওর যন্ত্রণা স্পর্শ করি। এ ওর উদ্বেগ স্পর্শ করি। বাবা মদ খেয়ে মাকে গালাগালি করছে। মা এটা-ওটা ভাঙছে। আমি আর দাদা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। আমি ফিসফিস করে বলছি— বাবা কি আজ মাকে মারবে?
দাদা বলছে—না। মারবে না।
—যদি মারে?
—আমরা অরুণ জ্যেঠুকে বলে দেব, কেমন?
অরুণ সেনকে আমরা দু’ভাই ভাবতাম আমাদের আপন জ্যেঠু! ওঁকে দেখলেই দু’জন দু’হাত ধরে ঝুলে পড়তাম আর চিৎকার করতাম— জ্যেঠু, জ্যে—ঠু, জ্যে—এ—এ—ঠু।
আমরা বিশ্বাস করতাম, অরুণ সেনের ওই বিশাল বাড়ি, যার মাথায় মাথুরের গড়ের প্রথম সূর্য ওঠে, সেটা আমাদের। ওই রাজেশ্বরী হোটেল, যার একটা ঘরে, এই বাড়িটা তৈরি হওয়ার আগে আমরা থাকতাম, সেটাও আমাদেরই বলে আমরা মনে করতাম। বন্ধুদের বলতাম— জানিস, ওটাআমাদের হোটেল। অরুণ সেনের বাড়ি দেখিয়ে বলতাম— জানিস, ওটা আমাদের জ্যেঠুর বাড়ি। আমাদের জ্যেঠু খুব বড়লোক!
অরুণ সেন আমাদের আদর করতেন কখনও কখনও। আমাকে কোলে নিতেন। দাদার গালটা টিপে দিতেন। দাদা তো খুব সুন্দর। ওকে সবাই আদর করত। আর মার মুখটা তখন নরম হয়ে যেত। যেন আমাদের আদর করে অরুণ সেন মাকে ধন্য করে দিচ্ছেন।
অনেক-অনেক পরে বুঝেছিলাম, ওই হোটেল-ফোটেল কিস্যু নয়, ওই বাড়ি-টাড়ি কিস্যু নয়, আমরা রাস্তার কুকুর, আমরা ভিখারির চেয়েও অধম। আমরা প্রায়-প্রায়-একটা বেশ্যার বাচ্চা। হ্যাঁ, শবরী বোস, একটা— একটা বেশ্যা। আমি যা দেখেছি, তারপর আর ওকে অন্য কিছু বলা যায় না।
আগ্রায় আমি আর দাদা হঠাৎ জেনেছিলাম অরুণ সেন আমাদের আপন কেউ নন। তিনি আমাদের বাবার প্রভু। আমাদের পালক ও মায়ের ভোক্তা। এ সবই আমরা একসঙ্গে জেনেছিলাম। এমনকী, প্রথম নারী-মাংসদৰ্শন সেও আমাদের একসঙ্গেই। রেখাদি বলে ছিল একজন, ওই অরুণ সেনের বাড়িতে কাজ করত। কীরকম আগলা-পাগলা ছিল মেয়েটা। খালি হাসত। টাইট জামা পরত আর কোনওদিন পিঠের বোতামগুলো লাগত না। একদিন ও বাড়ির উঠোনে আমি আর দাদা গুলি খেলছি, ও আমাদের ডাকল। একতলার একটা আধো-অন্ধকার ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে বলল— লুকোচুরি খেলবি?
আমরা রাজি হলাম না। ও বলল— গল্প শুনবি? গল্প? তখন ওকে ঘিরে বসে পড়লাম আমরা দু’জন। দাদার তখন বারো। আমার দশ পেরিয়েছে। ও গল্প বলতে লাগল। কেমন খারাপ খারাপ সব গল্প। রাত্তিরে বর-বউ কী করে, কেমন করে বাচ্চা আসে, এইসব। আমাদের শুনতে মোটেও ভাল লাগছিল না। কীরকম যেন পাপ করছি-পাপ করছি লাগছিল, কিন্তু উঠতেও পারছিলাম না। দাদার কপাল দেখি ঘামে চকচক করছে। হঠাৎ রেখাদি বলল— তোরা মেয়েমানুষ দেখবি? আমি কিছু বলার আগেই দাদা বলল—‘হ্যাঁ। দেখব।’ রেখাদি ফ্রক তুলল। ফ্রকের তলায় বিবর্ণ প্যান্ট। তার ওপর প্রথমে একটা নাদামতো পেট। নাইকুণ্ডুলি। তার ওপর অদ্ভুত স্ফীত দু’টো বস্তু। বিশ্রী, বীভৎস মাংসপিণ্ড। ও দাদাকে বলল, ধর। এইখানে ধর।
দাদা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। আমাকে বলল—‘ছোটপম পালা।’ আমরা ছুট লাগালাম। পকেট থেকে সব গুলি এদিক ওদিক ছিটকে পড়ল। আমাদের গুলির দিকে মন নেই। রেখাদি প্রথমে এই-এই-যাস না … বলছিল, তারপর হাসতে লাগল হি হি হি হি। আমার কীরকম মনে হচ্ছিল রেখাদি নাচছে। হাততালি দিচ্ছে। নাচছে। ওই হি হি হি হি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল। আমরাও, যেন ভূত-পেত্নী তাড়া করেছে মতো ছুটতে থাকলাম। ছুটতে ছুটতে সোজা আছড়ে পড়লাম লাইব্রেরির মাঠে। অনেকক্ষণ ধরে হাঁফাতে লাগলাম। হঠাৎ দাদা হাসতে লাগল। হেসে গড়িয়ে পড়ল আর বলল—‘মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষ।’ আমিও হেসে গড়িয়ে পড়লাম। বলতে লাগলাম—‘মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষ।’ দাদা বলল—‘কী বিশ্রী!’ আমি বললাম—‘কী খারাপ!’ তারপর আবার হাসতে হাসতে মাঠে গড়িয়ে পড়লাম দু’জনে।
আমরা একসঙ্গে জীবনের অন্ধকার চিনেছি। একসঙ্গে মেয়েমানুষ দেখেছি। এবং একসঙ্গে অনেক কবিতা পড়েছি। সে-দিন দাদা পুপুকে যে কবিতা শোনাচ্ছিল সেটা আমাদের বহুবার পড়া।
দাদা ফ্যামিলি ট্যুর চেয়েছিল। হল না। ফ্যামিলিই নেই আমাদের। ভেবেছিলাম দাদা বিয়ে করলে ওর নিজের মতো একটা সুন্দর পরিবার গড়ে নেবে। ওর বাচ্চারা হাসবে খেলবে, আমার ছবি দেখবে। কিন্তু এখন আর আমার বুঝতে বাকি নেই যে দাদার আর আদর্শ পরিবার করা হল না। পুপু বড় বেশি সাধারণ, খুবই অগভীর, একেবারেই নির্ভরশীল আদুরে সুখী মেয়ে। দাদাকে ও কোনওদিন বুঝতে পারবে না।
কতদিন আগেকার সেই সপরিবার বেড়াতে যাওয়া আমাদের— আজও তাড়া করে চলেছে। আমরা চারজন আর অরুণ সেন। জ্যেঠু আমাদের সঙ্গে যাচ্ছেন। আমরা খুশি। সারা রাস্তা মা আর জ্যেঠু পাশাপাশি। আমরা দু’ভাই বাবার দু’পাশে। জ্যেঠু আর বাবা ওরই মধ্যে কায়দা করে মদ খেলেন। বাবা দু’ বোতল দ্রাক্ষারিষ্ট এনেছেন। আসলে তাতে মদ। আমরা গা টেপাটেপি করছি। আমি বলছি— ‘দাদা। মদের গন্ধে ঘুম আসছে না।’ দাদা আমার মুখে হাত চাপা দিচ্ছে— ‘চুপ। চোখ বন্ধ করে থাক।’ আমি আর দাদা এক বার্থে। দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়লাম। কখন যেন ঘুম ভেঙে গেল আমার। দেখতে পেলাম, মা বসে আছে, মার কোলে অরুণ জ্যেঠুর মাথা। মা জ্যেঠুর চুল ঘেঁটে দিচ্ছে। বাবা ওপরের বার্থে। ঘুমোচ্ছে। আমার রাগ হল। ভয় করল— যেন নিষিদ্ধ কিছু দেখে ফেলেছি— চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি। খুব জলতেষ্টা পেয়েছে কিন্তু সাহস করে চাইতে পারছি না। বোধহয় ওই একটাই দৃশ্য যা আমি দেখেছি কিন্তু দাদা দেখেনি। কিংবা হয়তো আরও এরকম কোনও দৃশ্য আছে। যা দাদা দেখেছে। আমি দেখিনি।
আগ্রায় এসেছি। তাজমহল দেখতে যাব আমরা। অরুণ জ্যেঠুর মাথাব্যথা করছে। যাবেন না। আমার রাগ হচ্ছে।। আমি বলছি— জ্যেঠুর খালি মাথাব্যথা করে। জ্যেঠু বলছেন— কেন? আমার আবার কবে মাথাব্যথা করল। আমি চুপ করে আছি। মা’র দিকে চোখ চলে গেছে আমার। মা’রও আমার দিকে স্থির চোখ। বাবা বলতে লাগল— ‘অরুণদার মাথাব্যথা। একা কী করে ফেলে যাই! শবরী, তুমি তবে থাকো!’ মা এক কথায় রাজি। যেন তাজমহল দেখতে নয়, মা অরুণ জ্যেঠুর মাথা টিপতেই এসেছে। আমরা দু’ভাই বাবার হাত ধরে তাজমহল দেখতে বেরুলাম। অনেক জায়গায় ঘুরেছিলাম। সব আমার মনে নেই। তাজমহল সম্পর্কে এটুকু মনে আছে— একটা সাদা বাড়ি। দিনের আলোয় ফ্যাটফ্যাট করছে। একটুও ভাল লাগছে না আমার। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া দেখেছি। তাজমহলকে অবিকল ভিক্টোরিয়ার মতো লাগছে আমার। একটুক্ষণ যেতে না-যেতেই বাবা হঠাৎ ফেরার তাড়া লাগাল। আমরা ভাবলাম আমাদের মতো বাবারও তাজমহল ভাল লাগছে না। আমার মতো দাদারও যে তাজমহল খুব ভাল লাগছে না সেটা দাদাকে দেখেই আমি বুঝতে পারছিলাম।
আমরা ফিরলাম। দেখলাম। জানলাম। কী দেখলাম! কী জানলাম! আমাদের জীবন। আমাদের বাস্তব। আমাদের সব সত্য। যা-কিছু আমাদের পর্যবেক্ষণে ছিল, বোধে ছিল না, সে-দিন আমরা তার প্রায় সবটাই উপলব্ধি করে ফেললাম।
পুরীতে যাওয়া। এ-ও এক আশ্চর্য বিষয়। আশ্চর্য প্রাপ্তি। আমার ঘৃণার ষোলোকলা পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্র। আমার চন্দ্রোদয় এবং চন্দ্ৰাস্ত।
প্রচুর মদ নিয়ে গিয়েছিল পরেশ বোস, ওরফে আমার পিতা। তাকে সহায়তা করেছিল আমার বন্ধু, সুহৃদ, পুলিশকর্মী, নায়ক ও রোম্যান্টিক— অরূপ। পবিত্র তীর্থস্থান পুরীতে মদ পাওয়া যাবে কি যাবে না ভেবে মদ দিয়ে ব্যাগ বোঝাই করতে রোম্যান্টিক অরূপের কোনও ক্লান্তি আসেনি। হ্যাঁ। এখানে একটা কথা আছে বটে, পুলিশকর্মী রোম্যান্টিক হয় কি না, তবে এ ক্ষেত্রে আমার সূত্র হল, যার-তার সঙ্গে যখন-তখন রোম্যান্স করে ফেলাটা যদি রোম্যান্টিকতার মাপকাঠি হয় তো অরূপ এক নম্বর।
সকালবেলা আমরা পৌঁছলাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচুর মদ খেয়ে শুয়ে পড়ল অরূপ আর পরেশ বোস৷ অবশ্যই, খেল এক ঘরে বসে, কিন্তু শুলো আলাদা আলাদা ঘরে!
স্নানের সময় বয়ে যাচ্ছিল। সমুদ্রের পাড়ে আমি, দাদা আর পুপু। দাদা বলল— ওরা কী করছে? ডাক সবাইকে।
পুপুর হাত ধরে জলে নামল ও। বেশ লাগছিল দেখতে। পুপু খুব খুশি। দাদা সবই করছে। কিন্তু কেমন যেন ম্লান। যেন গানটা বেশ গাইছে। সুরেও লাগছে। কিন্তু প্রাণে বলছে না। হয়তো সবাই মিলে হইচই করে স্নান করলে দাদার ভাল লাগবে ভেবে আমি গেস্ট হাউসে ফিরলাম। প্রথমে দেবাশিসের ঘরে গেলাম। বেশ টেনেছে দেবাশিস। ঘুমোত চাইছে। জিনি মুখ গোঁজ করে বসে আছে। আমি যেতেই বলল— দেখুন তো, কিছুতেই স্নানে যাবে না। পুরীতে এসে স্নান না করলে ভাল লাগে?
দেবাশিস বালিশ থেকে মাথা তুলে বলল— অ্যাই! ছোটপম! তুই নিয়ে যা ওকে! মাইরি! মাথা খেয়ে ফেলল! এই, যাও তো। ছোটপমের সঙ্গে যাও।
আমি জিনিকে বললাম— দাদা আর পুপু আছে তুমি যাও। আমি বাবা-মাকে ডাকতে যাচ্ছি।
পাশের ঘরে বাবা অচেতন। মা নেই। মা অরূপের ঘরে। মানে আমার ঘরেও। আমার আর অরূপের একই ঘরে থাকার কথা। গিয়ে দেখি অরূপও দেবাশিসের মতো বলছে— আমি যাব না। ঘুমোব। তুমি যাও না।
মা অরূপকে টানছে। টানছে, না জড়াচ্ছে! মা’র মুখ প্রায় ওর মুখে। গায়ে গা লেগে আছে। মা’র এক পা মেঝেয়, এক পা বিছানায় তোলা। অরূপকে খামচাচ্ছে— না। চলো। তুমি চলো। চলো না।
মা’র গলাতেও ঝোঁক। মাও বেশ খেয়েছে। আমি যে এসেছি কোনও খেয়াল নেই। আমিও আর ডাকিনি। দৃশ্যটা ভাল লাগেনি আমার। কিন্তু শবরী বোস অরূপকে নিয়ে লীলা করছে, তাও আমার মনে হয়নি। আমি আবার সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। দাদা আর পুপুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। জিনি একা বালুতে বসে আছে। আমাকে দেখে বালিকার মতো খুশি হল সে। বলল— নামবেন না? চলুন না। আমি আর না নেমে থাকতে পারছি না।
আমরা জলে নামলাম। এক-একটা বড় বড় ঢেউ আসতে লাগল। জিনি ভয়ে খুশিতে লাফাতে লাগল। চিৎকার করতে লাগল। স্নানে আসবে বলে সালোয়ার-কামিজ পরেছে সে। লেপটে গেছে সে-সব। চুল খুলে ছড়িয়ে গেছে মুখময়। মুখের ওপর জলের ঝাপটা লাগছে। আর সে, তরুণী থেকে বালিকা— বালিকা থেকে শিশু হয়ে উঠছে। আমি পাশে পাশে আছি। তাকে ধরছি না। দেখছি। একা একা— শুধু জলের সঙ্গে কী আনন্দ করছে সে! তার চোখ দু’টি জলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কারণ সে মার্জারনয়না। এভাবে আমি কখনও কোনও মেয়েকে দেখিনি। কারওকে দেখে মনের মধ্যে এমন ভাল লাগা জাগেনি। হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ, আমার মনে হল, এ মেয়েটি আমার হল না কেন? সঙ্গে সঙ্গে একটা বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ল আমাদের ওপর। আমরা আঁকুপাকু করতে করতে টাল সামলালাম।
হ্যাঁ। অস্বীকার করব না, ওইটুকু স্নানের পর থেকে আমার চোখ সারাক্ষণ জিনিকে খুঁজেছে। আকুল তৃষ্ণার্তের মতো আমার মনে হচ্ছিল ও যেন এতটুকু চোখের আড়াল না হয়। আমার মনে থাকছিল না ও আমার নয়। আমার জন্য ওর মনে কোথাও কোনও জায়গা নেই। এরকম কারও জন্য আমার হয়নি।
মা-বাবা অরূপ আর দেবাশিসের ঘোর কাটল বেশ বেলায়। সন্ধেবেলা সকলে মিলে সমুদ্রের পারে যাওয়া হল। অরূপ থাকলে ও একাই সম্রাট। নিরন্তর কথা বলবে, কবিতা বলবে, গান গাইবে। আর সবটাই ও এমনভাবে পারে যে ভাল না লেগে উপায় নেই। কিন্তু আমি ওকে সহ্য করতে পারছিলাম না। অথচ ও আমারই বন্ধু। এখন অবশ্য দাদারও বন্ধু। এবং অনেক কিছু, কারও কারও ক্ষেত্রে।
আমি দল থেকে উঠে একা একা অন্ধকারের দিকে হেঁটে গেলাম। আমার মগজ থেকে অকারণ ক্রোধ, অকারণ ঘৃণা, অকারণ সন্দেহ ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল। বালিতে মিশে যেতে লাগল। ওদেরও গর্জন আছে। সেইসব সমুদ্রের জলে মিশে গেল। সব চাপা পড়ে গেল জলে, ভেজা বালুতে, মানুষের পায়ের তলায়। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। ঝকঝকে আকাশ। থেকে থেকে বসন্তের ঝাপটা লাগছে। গত বসন্তে অমলেন্দু মারা গেল। তার চার বসন্ত আগে নীলাদ্রি আর দেবার্চন। কিছুদিন বাদে আমি মারা যাব। আশ্চর্য সমাপতন। এই মাথুরের গড়ের সমস্ত দু’ছেলের সংসার থেকে একজন করে খসে যাবে নাকি? নীলাদ্রি নেই, প্রণবেশদা আছেন। দেবার্চন নেই, দেবাশিস আছে। অমলেন্দু নেই, কমলেন্দু আছে। আমি থাকব না, অনুপম থাকবে। আমি আকাশের অসংখ্য নক্ষত্রদের দিকে তাকালাম। ছোটবেলায় শিখেছিলাম মানুষ মরে গেলে তারা হয়ে যায়। দেবার্চন, নীলাদ্রি, কমলেন্দু, সেই সত্যজিৎ— সবাই কি আকাশে আছে? নক্ষত্র হয়ে জ্বলজ্বল করছে আকাশে! আমিও কি তারা হয়ে যাব? হঠাৎ সেই দু’টি চোখ আমি দেখতে পেলাম। যে আমার নয়, আমার হবে না কোনওদিন, সে কেমন, কিছুই আমি জানি না। তবু তারই জন্য বুকের মধ্যে টনটন করে উঠল! মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের সেই আশ্চর্য কবিতা—
…— সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা— আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে—
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!…
৪১
বলো বলো ও কী করেছে তোমাকে? তোমার গায়ে হাত দিয়েছে?
জিনি চুপ করে আছে। কতদিন হল এই প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে সে? তার মনে নেই। মনে হয় অনন্তকাল। মনে হয় গতজন্ম থেকে, এই জন্মের প্রথম লগ্ন থেকে আজ অবধি। শুনে শুনে এ-ও সেই প্রশ্বাসের মতো যাকে আলাদা করে মনে করার দরকার নেই। প্রথম প্রথম সে জবাব দিয়েছে— বলো বলো— সে বলেছে ‘না’। তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? — সে বলছে— ‘না।’ অফিসে যাবার আগে প্রশ্ন করছে দেবাশিস৷ বলছে— বলো, সত্যি কথা বলো, ও তোমায় কিছু করেছে?
—না।
অফিস থেকে ফিরে এসে প্রশ্ন করছে দেবাশিস— ও তোমার গায়ে হাত দিয়েছে? ওরা সব শয়তানের বাচ্চা। শালাদের জন্মের ঠিক নেই।
—উঃ মাগো।
জিনির ধৈর্য ভাঙছে। ভাষা এত নিষ্ঠুর কেন! এত অকরুণ কেন। ভাষাই যে মুহূর্তে বন্ধু হতে পারে। মুহূর্তে শুশ্রূষা।
—জন্ম থেকে দেখে আসছে কে বাপ কে জ্যেঠা তার ঠিক নেই, সব এক মাল হাতায়। জিনি দু’কানে আঙুল দিচ্ছে। তারপর স্তব্ধ হয়ে গেছে। দেবাশিস লক্ষ্মীর কাছে গিয়ে কেঁদে পড়েছে— মা, মা, ও সাড়া দিচ্ছে না।
—কী সাড়া দিচ্ছে না?
—ওকে কথা বললে উত্তর দিচ্ছে না।
লক্ষ্মী ছুটে আসছেন— কী ব্যাপার? ছেলেটা এত করে তোমাকে প্রশ্ন করছে, তুমি জবাব দিচ্ছ না কেন?
জিনি দু’টি ব্যথিত চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। সে বুঝতে পারছে, ক্রমশ বুঝতে পারছে, যতক্ষণ সে সব স্বীকার করে না নিচ্ছে ততক্ষণ তার মুক্তি নেই।
লক্ষ্মী বলছেন— বড়খোকা বলল, তোমরা অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলে।
জিনি চুপ করে আছে। দাঁড়িয়েছিল তো, সত্যিই তারা দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকলে কী হয়? অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেই কি ঢুকে পড়ে যাবতীয় অপবিত্র সন্দেহ!
লক্ষ্মী বলছেন— ছি ছি কী নোংরা কাজই করেছ! আমার এত সুন্দর ছেলে, তাকে তোমার পছন্দ হল না! একটা বাজে ছেলে, জন্মের ঠিক নেই, চরিত্র ঠিক নেই।…দেবতার মর্ম বুঝবে কেন! তোমাদের চোখ হল ভাগাড়ের দিকে।
জিনি সারা ঘর দেখছে। এ ঘর কার?
তোমার, জিনি, তোমার।
—না, এ ঘর আমার নয়।
এই খাট, এই রেকর্ড প্লেয়ার, এই এত বই— এ সব কার গো?
তোমার জিনি, তোমার।
—না, এ সব আমার নয়।
ওই যে আলনায় শাড়ি ঝুলছে, ম্যাক্সি শুকোচ্ছে তারে, দু’খানি ভাঁজকরা সালোয়ার-কামিজ, যা এখানে পরতে নেই, কিন্তু বাইরে পরলে দোষ নেই, এ সব কার?
তোমার, জিনি, তোমার।
—না, কিচ্ছু আমার নয়। এরা আমাকে বিশ্বাস করে না। কেন বিশ্বাস করছে না? যে-ঘর বিশ্বাস করছে না সে-ঘর আমার কেমন করে হবে?
জিনির মা আগরতলা থেকে ফোন করেছেন— জিনি—
—হ্যাঁ মা।
—কেমন আছিস?
—ভাল।
—আর সবাই?
—ভাল।
—পুরী থেকে কী আনলি?
—অনেক কিছু মা। সে পরে বলব।
—তোকে চিঠি দিয়েছি। তোর জন্য মনটা বড় খারাপ লাগে রে।
লক্ষ্মী বলছেন— এ বার তো খুব কথা ফুটছে! শুধু বাপের বাড়ি আর ওদের বাড়ি। বরের বাড়ি পরের বাড়ি। না? শয়তান মেয়ে। আমার ছেলেকে কষ্ট দিচ্ছে!
দেবাশিস মা’র কোলে মুখ ঘষছে— মা ও সাড়া দেয় না। সারা রাত দাঁতে দাঁত চেপে কাটাই। আমি আর পারছি না।
লক্ষ্মী দাঁতে দাঁত পেষেন। লক্ষ্মীও আর পারেন না। তাঁর রাগ হয়। ঘৃণা হয়। তুমুল আক্রোশে মাথা ফেটে যায়। ছেলের মাথা বুকে তুলে নিতে নিতে বলেন—কী কষ্ট তোর! কী কষ্ট! আমি ওকে নিয়ে যাব। এক জায়গায় নিয়ে যাব।
দুপুরবেলায় স্কুল থেকে ফিরে এসেছেন লক্ষ্মী। জিনি স্নান করেনি। খায়নি। লক্ষ্মী হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। ধাক্কা দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন বাথরুমে। শুকনো জামা সঙ্গে নেই, শুকনো কাপড় সঙ্গে নেই, জিনির মাথার ওপর শাওয়ার খুলে দিচ্ছেন। কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জিনি। ভাবছে। শুধু ভাবছে—ওরা আমাকে বিশ্বাস করছে না কেন? ভেজা কাপড় পরা জিনিকে ধাক্কা দিচ্ছেন লক্ষ্মী। ধাক্কা দিচ্ছেন। জিনি বসে পড়ছে। ঠাকুরঘরের মেঝেয় বসে পড়ছে। শীতল পরিষ্কার ঘরে নিথর অকর্মণ্য দেবতার দল। জিনি তাকাতে পারছে না। তার চুল থেকে গাল থেকে শরীর ও শাড়ি থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। লক্ষ্মী কপালে করাঘাত করছেন— হে ভগবান! হে ঈশ্বর! এ কোন পাগলের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিলাম! পাগল, না শয়তান! শয়তান, চরিত্রহীন!
জিনির ওপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। তাঁরও চুল খুলে গেছে। তাঁরও শাড়ি লুটিয়ে পড়ছে। জিনির ঘাড় ধরে মাটিতে নুইয়ে দিচ্ছেন তিন— ঠেকা। ঠেকা মাথা মাটিতে। এটা আমার ঠাকুরঘর। আমি যদি সতী হই তবে এই বলে রাখছি তোর শয়তানি আমি বন্ধ করব। এখানে সত্যি কথা বল্! বল্।
প্রতিটি শব্দের সঙ্গে তিনি জিনিকে প্রণাম করাচ্ছেন। প্রণাম করাচ্ছেন, নাকি মাথা ঠুকে দিচ্ছেন! জিনির কপালে লাগছে। লাগুক, লাগুক। জিনি বলছে— ‘মা গো!’ লক্ষ্মী, হে লক্ষ্মী, তিনি মানুষ কেমন? ভাল ভাল। লক্ষ্মী, হে লক্ষ্মী—তিনি কি পাখি মারতেন ছোটবেলায় আর ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলতেন? জানি না তো! লক্ষ্মী মেয়ে ছিলেন কেমন? ভাল ভাল। লক্ষ্মী বউ হলেন কেমন? বেশ বেশ। লক্ষ্মী মা কেমন, মা? ভাল মা। লক্ষ্মী মা। লক্ষ্মী লক্ষ্মী লক্ষ্মী শাশুড়ি তবে ভালই? না-আ-আ-আ! লক্ষ্মী শাশুড়ি হয়ে আর ভাল নেই। লক্ষ্মী শাশুড়ি হয়ে আর মানুষ নেই। লক্ষ্মী, শাশুড়ি হয়ে, নিজের কাছে নিজেই এক অচেনা পরিজন।
দরজার কাছে ছায়া পড়ছে কার! লক্ষ্মী মুখ ফিরিয়ে দেখছেন অন্ধর মা। তার মুখ হাঁ হয়ে গেছে। চোখ দু’টি বোবা, বিদ্ধ। লক্ষ্মী জিনিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। বলছেন—‘দেখো, দেখো অন্ধর মা। আমার কপাল দেখো। একটা ছেলে মরে গেল। আর একটা মাত্র ছেলে, তার কপালে কীরকম পাগল বউ জুটেছে দেখো। হাড় জ্বালিয়ে খেলো আমার।’ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ছেন তিনি। কী আছে হাতের কাছে, কী নেওয়া যায়? দরজার হুড়কো তুলে নিচ্ছেন। খোঁচা দিচ্ছেন জিনিকে— ‘ওঠ্। ঘরে যা।’
অন্ধর মা ঝাঁপিয়ে পড়ছে— মাইরেন না। মাইরেন না। আমি লইয়া যাইতাসি।
সে জিনিকে আড়াল করছে। জড়িয়ে ধরে বলছে— চলো বউদি, ঘরে চলো।
জিনির মুখ বিষাদ হয়ে গেছে। জিনির মুখ হাহাকার হয়ে গেছে। সে অন্ধর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। তার কপাল ফুলে গেছে। রোগা শরীরে ভেজা কাপড় শুকোতে শুকোতে কাঁপন তুলেছে। অন্ধর মা ধরে নিয়ে যাচ্ছে জিনিকে। জিনি? সে জিনি? তার জন্য ভালবাসা বাপের বাড়ি আছে? তার জন্য ভাল ভাল পরীক্ষার ফলাফল, ইস্কুলের স্মৃতি, বন্ধুত্বের কলরব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি রাখা আছে? সে কি শিক্ষিত? দর্শনের শাস্ত্রজ্ঞ? সে? জিনি? অন্ধর মা ফিসফিস করে শুধোচ্ছে— অরা মারসে? আপনেরে মারসে?
হায়! মারামারি, মাথা ঠুকে দেওয়া, লাঠি তোলা এতদিন বস্তিতেই দেখেছে সে। বাবুদের বাড়িতেও হয় এ সব? কালীতারা চোখ ঘুরিয়ে সবসময় বলে— হয় না? খুব হয়। আরে বাবুদের নোংরা কেচ্ছা আরও বেশি। আমাদের যা হল খোলাখুলি মিটে গেল।
সত্যিই তো! সত্যি! সে কি নিজের চোখেই দেখল না? জিনি বলছে— না না। মারেনি। অন্ধর মা, ওটা মার নয়। তুমি যেন এ সব বাইরে বোলো না লক্ষ্মীটি।
—না, কমু না। বউদি, অরা যা কয় আপনে করেন না ক্যান?
—করা সম্ভব নয় অন্ধর মা, কিছুতেই সম্ভব নয়।
লক্ষ্মী দাপিয়ে বেড়ান সারা মাথুরের গড়। খাতিরের প্রতিবেশীদের কাছে গিয়ে দুঃখের কথা তোলেন— পাগল মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছি।
—ও মা! তাই নাকি!
সকলে অবাক হয়ে শোনে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ করে না। ভাবে—এই তো বউভাতের দিন দেখলুম। কেমন মিষ্টি হেসে কথা কইছে! কই তখন তো বোঝা যায়নি, পাগল!
কেউ বিশ্বাস করে। বলে—হ্যাঁ, হ্যাঁ। হতেই পারে। পাগলের পাগলামি ওমনি হঠাৎ দেখা দেয়।
লক্ষ্মী সরবে ফিসফিস করছেন। যেন এই প্রতিবেশীরা তাঁর কতই আপনার জন। তাঁর চোখে জল আসছে। বলছেন— কী আর বলব, নিজের ছেলের বউ, হুঁ হুঁ…স্বভাবচরিত্র…।
হায়! পাগল সে! পাগলের আবার স্বভাবচরিত্র! লোকে তবু শোনে। পাগল বিষয়ক, স্বভাবচরিত্র বিষয়ক আলোচনা শুনতে কারই-বা ভাল না লাগে!
ডাকে একখানি চিঠি এসেছে শিঞ্জিনীর নামে। সে চিঠির মুখ খোলা। কে খুলল? কে? কেন খুলল? অন্যের চিঠি বুঝি খুলতে হয়? সে চিঠি না পড়ে পাশে সরিয়ে রেখেছে! কিন্তু কতক্ষণ! আর পারছে না।
জিনির নব্বই বছরের দাদু চিঠি দিয়েছেন। বীরভূমের কোন প্রান্তে বসে অক্ষম জরাগ্রস্ত শরীরে দিদা আর দাদু ডাকছেন জিনিকে। একবার এলি না? জামাইকে নিয়ে একবার এলি না তুই? জিনির মনে পড়ছে, দাদুবাড়ির পুকুরে সে হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্যাঁক-প্যাঁক-প্যাঁক। সে হাঁস তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পেয়ারা দেখে দাদুকে বলছে— দাও। আমাকে পেড়ে দাও। দিদা বলছেন—সর খাবি?
—না আমি আচার খাবো। আমাকে আচার দা-আ-আ-ও।
“রাস্বা”
কোটা
বীরভূম
পিন : ৭৩১১২৪
পরম স্নেহাস্পদেষু,
স্নেহের জিনি, তোর দিদিমা ও আমার স্নেহশীষ নে। বহুদিন তোর কোনও চিঠি বা সংবাদ পাই নাই। আশা করেছিলাম জামাইকে নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করে যাবি। তোর বিবাহে যেতে পারি নাই। শরীর দেয় না। ভাগ্যের পরিহাসে তোর জামাই দেখা হল না! এটা আমাদের পক্ষে কতখানি মর্ম্মান্তিক তা লিখে জানাবার নয়। আমি নিজে এ আঘাত সামলে নিতে পারলেও তোর দিদিমা যে কতটা আঘাত পেয়েছে তা চাক্ষুষ না দেখলে অনুমান বা উপলব্ধি করতে পারবি না। একেই তো দেড় মাস আগে হঠাৎ পড়ে গিয়ে শরীরের ডান দিক পড়ে গিয়েছে এবং এখন শয্যাশায়ী হয়ে আছে তার ওপর তোর না আসা এত বড় আঘাত হয়ে উঠেছে যে দিনে রাতে কান্নাই তার একমাত্র সম্বল হয়ে উঠেছে। … …
জিনি ডুকরে কাঁদছে। ও দাদু গো। ও দিদা। আমাকে তোমাদের অসুস্থতার কথা কেউ বলেনি কেন? কেন বলেনি? ও দাদু। আমাকেও তোমাদের কাছে নিয়ে চলো। আমারও যে কান্না ছাড়া আর কিছু নেই। কিছু না। এখানে আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না দাদু। তোমাদের দিব্যি দাদু। আমি কোনও অন্যায় করিনি।
“…তোর দিদাকে কোনও সান্ত্বনাবাক্যই আর স্পর্শ করে না। গত ১৫ মাস আগে আগরতলায় আমাকে যেমন দেখেছিলি তেমন আর নেই আমি। এখন হাঁটাচলা করতেও খুব কষ্ট হয়। অতখানি যাবার ধকল ১৫ মাস আগেও কেমন করে নিয়েছিলাম তাই ভাবি। হয়তো এখন আমাকে দেখলে তুই চিনতেও পারবি না। এই নব্বই বছর বয়সে শরীর তো ভাঙবেই। কিন্তু আমার মানসিক বিপর্যয়ও আমাকে কুরে খাচ্ছে। তোর দিদার পরিচর্যাদি আমাকে করতে হয়। সব সহ্য করে যথাযথ করে যাচ্ছি। কিন্তু রোজ বুঝতে পারি শরীর-মন বাদ সাধছে। আমাদের আদরের একমাত্র নাতনি, একমাত্র নাতজামাই একবার এল না আমাদের কাছে! গাছের ফল-পাকুড় সব নষ্ট হচ্ছে। জামাইয়ের পাতে একটু ফল দেব, টাটকা শবজি, পুকুরের মাছ দেব— সে সাধ আর পূর্ণ হল না। মন বড়ই অবাধ্য রে। যতই মনে করি যারা আমাকে চায় না তাদের জন্য চিন্তা-ভাবনার দরকার কি! কিন্তু তোর দিদা যখন স্মৃতিচারণ করে—কবে কার জন্য কী করেছিল, কে কী খেতে ভালবাসে, তুই ছোটবেলায় কেমন ছিলি— শুনে নিজেকে স্থির রাখতে পারি না। আমিও অতলে ডুবে যাই।… …
জিনির বালিশ ভিজে যাচ্ছে। জিনির আঁচল ভিজে যাচ্ছে। ও দাদু, আমার যদি ডানা থাকত, আমি উড়ে যেতাম। ও দাদু, আমিও যে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি প্রতিদিন। আমি যে কারওকে বলতে পারব না, মরে গেলেও বলতে পারব না আমি কষ্টে আছি। মা বলবে— ‘জিনি, তোকে এই শিক্ষা দিলাম, শ্বশুরবাড়িতে মানাতে পারলি না তুই!’ বলো দাদু মা কি আমাকে বিশ্বাস করবে? মা কি জানবে কোনও দোষ আমার নেই?
“… ‘স্মৃতির সমাধিতলে, মালা গাঁথি আঁখিজলে।’ সেই আঁখিজলের মালার পাপড়ি একটি একটি করে যখন ঝরে পড়ে তখন বুকের পাঁজরের হাড়গুলিও যেন একটি একটি করে খসে যায়। তাই তো মৃত্যুপথযাত্রী তোর দিদিমা আজও দু’নয়নের জলে তোর স্মৃতি নিয়ে বুক ভাসায়। জসীমউদ্দিনের লেখা— এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিমগাছের তলে, ত্রিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দু’ নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মুখ, কোন কিছু হলে দু’নয়ন জলে কাঁদিয়ে ভাসাত বুক… …” একবার কি আসতে পারিস না জিনি? একবার দেখতে পারিস না তোর দিদার কান্না বন্ধ করা যায় কিনা। একবার আয়। ওরে ফিরে আয় এই স্নেহের নীড়ে। একবার এই মৃত্যুপথযাত্রীর কানের কাছে মুখে রেখে বল— আমি এসেছি। দিদা, তোমার কাছে এসেছি।” আমার কথা নাই বা লিখলাম। আমি পুরুষ মানুষ। ব্যাটাছেলে। সহ্য-ধৈর্য মেয়েদের চেয়ে অনেক বেশি। তবুও এই ৯০ বছর বয়সে ধৈর্যের বাঁধ রাখতে পারছি না রে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে আর কখনও গুমরে গুমরে কেঁদে উঠি আর বলি— ওরে একবার আয়। মরার আগে একবার দেখি।
আশীর্ব্বাদক
দাদু
পুঃ— তোর ঠিকানাটা ঠিক হল কিনা জানাস। পিন কোডটাও জানাস। চোখে ভাল দেখতে পাই না। ভুল থাকলে শুধরে নিস্।’
দেবাশিস এল। সন্দেহাকুল চোখ। বলছে—
—দেখি কার চিঠি!
—না দেখবে না। জিনি চিঠি কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে।
—আমি দেখব।
—না। দাও। আমার চিঠি দাও। কেন তোমরা আমার চিঠি খুলবে?
—খুলতাম না যদি তোমার চরিত্রটা না বুঝতাম।
—কী করেছি আমি! কেন তোমরা বলছ এরকম?
কাঁদছে জিনি। দাদু গো, কান্না ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।
—ন্যাকামো থামাও। পুরী থেকে ফিরে আসার পর একটা দিন তুমি আমাকে করতে দিয়েছ?
—কী ব্যবহার করেছ তুমি আমার সঙ্গে! কীসব কথা বলেছ! ও সব শুনলে ইচ্ছে করে? ইচ্ছে করে একটুও? আচ্ছা, ওটা দিলেই তোমার বিশ্বাস হবে তো সব সত্যি?
নিজের স্বর কানে যাচ্ছে জিনির। এ কী ভাষা তার। সেও কি পাল্টে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে নিজের থেকে?
জিনি শরীর মেলে দিচ্ছে। তার রোগা শরীর আরও রোগা হয়েছে। নির্মেদ শরীর থেকে লাবণ্য ঝরে গেছে। দেবাশিস ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার উত্থিত মোটা পুরুষ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। জিনি, একটা মাটির প্রলেপের মতো, বোধহীন অস্তিত্বের তলায় ক্ষয় অনুভব করছে ক্রমশ। দেবাশিস শরীর মেটাচ্ছে। জিনি চোখ বন্ধ করে ভাবছে। কী ভাবছে সে? কী ভাববে? দাদুর চিঠির কথা ভাবছে। দাদু তোমার চিঠিতে কত বানান ভুল অথচ কী সুন্দর লিখেছ তুমি! জসীমউদ্দিনের কবিতা এখনও মনে আছে তোমার? আমার মনে নেই জানো। লাইনগুলো ঠিক লিখেছ দাদু? আমার কাছে কোথায় যেন ছন্দ লাগছে না।
ছন্দ লাগছে না। কোথাও ছন্দ লাগছে না। দেবাশিস সবল শরীর দিয়ে জোরে শরীর মেটাচ্ছে। আজ সে কন্ডোম পরেনি। জিনির খেয়াল নেই। সে শুধু নিস্তেজ এলিয়ে আছে। দু’চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে কানে ঢুকে যাচ্ছে।
পাশের শূন্য ঘরে একা একা জেগে আছে দেবার্চনের ছবি। তার বই জেগে আছে। চিন্তা জেগে আছে। না, চিন্তা জেগে নেই, সেগুলি উধাও হচ্ছে ক্রমশ। তার পাশের ঘরে ঠাকুরদেবতা ঘুমোচ্ছন কিন্তু লক্ষ্মীর ঘরে লক্ষ্মী আর বিকাশ জেগে। লক্ষ্মী ডান পা তুলে দিয়েছেন বিকাশের গায়ে। হাঁটুতে চাপ দিচ্ছেন। বিকাশের পুরুষ জাগছে। লক্ষ্মী নকল দাঁতে কান কামড়াচ্ছেন। বিকাশের কান জাগছে। দু’খানি কানই পুরোপুরি জেগে উঠলে লক্ষ্মী বলছেন— বউ কতখানি দুশ্চরিত্র!
বিকাশ অবিশ্বাসের গলায় বলছেন— যাঃ! অত ভাল মেয়েটা!
—আমি তবে ভুল বলছি? যাও!
লক্ষ্মী পাশ ফিরছেন। বিকাশ লক্ষ্মীকে কাছে টানছেন— হ্যাঁ, চরিত্র খারাপ, হ্যাঁ। কী করেছে?
—শুধু কি চরিত্র খারাপ? পাগলও। মাথা খারাপ মেয়ের মাথার দোষ আছে লুকিয়ে বিয়ে দিয়েছে। আমি সে-দিনই বুঝেছিলাম। নতুন বউ, লাজ নেই, লজ্জা নেই, ওভাবে কথা বলতে পারে?
—চরিত্র খারাপ বলছিলে কেন?
—ছি ছি! কত কাণ্ড করেছে পুরীতে। তোমাকে বলিনি। বড়খোকার বুক ভেঙে গেছে। ও নিজের চোখে দেখেছে, নিজের কানে শুনেছে—।
দেবাশিস সিগারেট ধরাচ্ছে। হাসছে। এক ঝটকায় হাত টেনে উঠিয়ে বসাচ্ছে জিনিকে। চড় মারছে। খুব সতী হয়েছ না? আজ তুমি নিজে প্রমাণ করলে তুমি কী! অন্য দিন আমাকে দিতেই চাও না। কী আছে তোমার? ওই তো দুটো সুপুরির মতো বুক। আজ তুমি দিয়ে দিলে। নিজেকে সতী প্রমাণ করতে চাও, না? সতী? নিজেকে কে সতী বলতে চায় জানো? যে সতী নয়। আমি নিজে দেখেছি। নিজের কানে শুনেছি।
জিনি নিথর হয়ে থাকে। ক্রমশ রাত্রির চেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়।
৪২
রাত্রে আবার মদের আসর বসল। সবাই খেল। জিনি, এমনকী পুপু পর্যন্ত। শুধু আমি খেলাম না। আমি খাই না তা নয়। কিন্তু কিছুতেই ইচ্ছে করল না সে-দিন। জিনি খেতে চায়নি প্রথমে। দেবাশিসই ওকে জোর করল। শবরী বোস-পরেশ বোসের সামনে মদের গ্লাস তুলতে লজ্জাই পাচ্ছিল ও। আমার মাননীয়া মাতা গ্লাস তুলে জিনির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন—যাও। পাড়ায় গেলে আমরা কাকু-কাকিমা। এখানে সবাই বন্ধু।
পান করে গান ধরলেন শবরী— ‘আমায় নহে গো। ভালবাসো শুধু, ভালবাসো মোর গান…।’
শবরীর পর শেয়ালের মতো গান ধরল পরেশ বোস। তারপর পুপু, অরূপ, দাদা, এমনকী জিনিও। কার ক’রাউন্ড চলছে কে জানে! আমার মনে হল চোখের সামনে খালাসিটোলার পানশালা দেখছি। ছ’টা মাতাল এক সঙ্গে গান ধরলে যা হয়, কান ঝালাপালা হতে থাকল। ভাবলাম, বেরিয়ে সমুদ্রের ধারে চলে যাই। হঠাৎ চোখে পড়ল জিনি বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। টলছে। ঠিকমতো হাঁটতে পারছে না। কোনওমতে দরজা পর্যন্ত গিয়ে বমি করে ফেলল। ওয়াক-ওয়াক-ওয়াক— ক্রমাগত বমি করতে লাগল ও। আমি ছুটে গেলাম কারণ কেউ ওকে সাহায্য করার জন্য ছুটে আসেনি। ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। আমি দিশেহারা বোধ করলাম। দেবাশিসকে বললাম—যা। জিনিকে ধর। ও অসুস্থ।
দেবাশিস দাঁড়াতে পারছে না। আমাকে বলল— তুই ধর। আমার ক্ষমতা নেই। অ্যাখো— ন্ থেকে আমার ব-উ তোরও ব-উ বুঝলি? এক থাবড়া মারলাম ওর মাথায়। কিন্তু ছুটেও গেলাম জিনির কাছে। দু’হাতে ভার রেখে বাথরুমের মেঝেয় উবু হয়ে বসে আছে ও। বমিতে গা ভিজে গেছে। আমি ওর পিঠ ডলে দিলাম। মুখহাত জলে ধুয়ে দিলাম। দু’কাঁধ ধরে নিয়ে গেলাম ওদের ঘরে। ও আমার গায়ে নিজেকে ছেড়ে দিল। একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল আমার। নারী তার রক্তমাংস নিয়ে পুরুষকে ছুঁলে যেমন হয় তেমনি নয়। ছন্দাবউদি ছুঁলে যেমন হয় তেমনও নয়। এ সুন্দর। এই অনুভূতি অন্য রকম। এমন আমার আগে কখনও হয়নি। আমি ক্রমশ ভুলে গেলাম আমি কে, কোথায় আমার জন্ম। এখানে আমি কেন এসেছি, কাদের সঙ্গে এসেছি। ভুলে গেলাম ও কে, ও কারও স্ত্রী কি না, প্রেমিকা কি না। ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলাম।
ও সোজা হয়ে বসতে পারছিল না। কোনওরকমে বলল— খেতে চাইনি। ও বলল তাই। না খেলে বলত, আমার কোনও কথাই শুনবে না, না? এত জোরে চেপে ধরত আমাকে… ওর মাকে এমন বলত… আমার ভাল লাগে না। তাই খেয়ে নিলাম।…
ওর কথা শুনতে শুনতে আমার বুকের মধ্যে মুচড়ে উঠল। এতক্ষণের সব রাগ চলে গেল আমার। ও মদ খাচ্ছে বলে খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু এখন ওকে ক্ষমা করে দিলাম আমি। এত সহজে কখনও কারওকে ক্ষমা করিনি। যদিও আমি রেগে গিয়েছি কি যাইনি, ক্ষমা করেছি কি করিনি তাতে ওর কিছু এসেও যায় না। দেবাশিসকে খুশি করার জন্য ও মদ খেয়েছিল। আমার রাগে ওর কী যায় আসে! কিন্তু আমার তো যায় আসে! মরার মুহূর্ত পর্যন্ত ওকে তো সঙ্গে রাখব আমিই। শুধু ওকেই সঙ্গে রাখব না। দাদাকেও রাখব। এটা ঠিক, দাদাকে আমি ভালবাসি। এতদিন শুধু দাদাকেই ভালবাসতাম। মৃত্যুর আগে জিনি আমার দ্বিতীয় ভালবাসা। যদি এটা ভালবাসা হয়।
ধীরে ধীরে ওর শাড়ি খুলতে লাগলাম আমি। ছোট বালিকার মতো শরীর ওর। শিশুর মতো বলল— আমার লজ্জা করছে!
বললাম— লজ্জা পেয়ো না। তোমার শাড়িটা ভিজে গিয়েছে তো! বদলে দিই। কেমন?
ওকে শাড়ি পরাতে লাগলাম। কাজটা কঠিন। ও সোজা হয়ে বসতে পারছে না। আমিও শাড়ি পরাতে জানি না। তবে খুলেছি তো অনেকবার, একটা ধারণা আছে। কোনওক্রমে পরিয়ে ওকে শুইয়ে দিতে দিতে ভাবলাম, আশ্চর্য, আমার কোনও উত্তেজনা নেই! আমি যেন কোনও শিশুকে ছুঁয়ে ছিলাম এতক্ষণ। অথচ ছন্দাবউদি বুকের কাপড় ফেললেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে যায়! নিজের ওপর ঘেন্না ধরল নতুন করে। আমার দ্বারা কৃত সমস্ত পাপের জন্য অনুশোচনা হতে লাগল। মনে হল, শুধু এটুকুর জন্যই, এই মেয়েটাকে একটু ছোঁবার জন্যই, আমার হাত দু’টি পবিত্র রাখার প্রয়োজন ছিল।
ও বলল—মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে।
আমি নীচে গেলাম। কেয়ারটেকার আমাদের রান্না করছিল। একটা লেবু চেয়ে নিলাম ওর কাছ থেকে। কিছু বলার আগেই লোকটা লেবুটাকে পিস্ পিস্ করে দিল। বলল— লাগলে বলবেন, তেঁতুলও আছে।
সমুদ্রের শব্দ পাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে চিতা পোড়ানোরও গন্ধ পাচ্ছিলাম। এটুকু না হলে বোঝাই যেত না আমরা পুরীতে এসেছি। লেবুজল করে ওকে খাইয়ে দিলাম আমি। ওর কপালে হাত রেখে আস্তে আস্তে টিপে দিলাম। ও একবার বলল—ও কোথায়?
বললাম—আছে। ডাকব
ও বলল—না। থাক। আপনি চলে যাবেন না তো?
আমি বললাম—না। যাব না।
আমার একটা হাত ধরল ও। বলল—আপনি খুব ভাল!
চোখে জল এসে গেল আমার। মনে হল এটুকু শোনার জন্যই বেঁচেছিলাম।
ও ঘুমিয়ে পড়ল। খেতেও উঠল না। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া হল না ভাল করে। সবাই ফেলে-ছড়িয়ে নষ্ট করল। কারও আর ঠিকমতো কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। যে যেখানে পারল শুয়ে পড়ল। আমার ঘুম এল না। আমি ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। অনেকটা সমুদ্র দেখা যায় এখান থেকে। অনেকটা আকাশও দেখা যায়। সব কিছুই খুব ভাল লাগছিল আমার। আমি বসে পড়লাম। ওই অন্ধকার, ওই গভীরতা, ওই সুদূর নিঃসীম সময়— একদিন পায়ে পায়ে চলে যাব ওইখানে। ঠিক চলে যাব। অন্ধকারের ছেলে, ফিরে যাব অন্ধকারে।
কে জানে কতক্ষণ বসেছিলাম, কে জানে ক’টা বাজে তখন! জিনি এসে ব্যালকনিতে দাঁড়াল। আমি বসেছিলাম। ও প্রথমে আমাকে দেখতে পায়নি। বললাম—এখন একটু ভাল লাগছে?
ও চমকে উঠল—আপনি! ঘুমোতে যাননি!
বললাম—ঘুম আসছে না।
ও বলল—আমাকে ক্ষমা করবেন।
বললাম—কেন?
ও বলল—খুব জ্বালিয়েছি আপনাকে। ছি ছি। বাথরুমটাও আপনি ধুয়েছেন বোধহয়।
আমি হাসলাম। বাথরুম ধুতে হয়েছিল ঠিকই।
ও বলে উঠল—কী অন্যায়! কোনও দিন খাইনি তো আগে। সামলাতে পারব না জানলে খেতাম না আমি।
বললাম—যা হয়েছে, হয়েছে। ভুলে যাও। এ সব অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই কম-বেশি আছে। কত কী-ই তো হয় জীবনে। হয় না? সব অভিজ্ঞতারই একটা প্রথম দিন থাকে।
ও হাসল। কী সুন্দর হাসিটা। বলল—এই প্রথম। এই শেষ। আবার ছেলেমানুষ দেখাল ওকে। বলল—কী সুন্দর, না?
আমি বললাম— কী?
ও বলল—সমুদ্রটা। আকাশটা। ঢেউ ফেটে যাওয়া সাদা ফেনাগুলো! ও সব না খেলে সন্ধে থেকে দেখতে পেতাম।
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম দু’জনেই। তখনও ও দাঁড়িয়ে আছে। আমি বসে আছি। ওর এই কাছে থাকায় অসম্ভব ভাল লাগছে আমার। কেন লাগছে আমি জানি না। কী দেখেছি আমি জিনির মধ্যে? জানি না। শুধু এইটুকু জানি, জিনি আমার মধ্যে এমন সব অনুভূতি সঞ্চার করেছে যার খোঁজ আমি আগে পাইনি। ওর মুখে আলো আঁধার। ছেঁড়া ছেঁড়া কারুকাজ। ওর ঠোঁট নড়ছিল। যেন কোনও আত্মগত উচ্চারণ করছে। আমি অপলক ওকে দেখছিলাম। ওকে ছুঁতে ইচ্ছে করেনি। ছানতে ইচ্ছে করেনি। শুধু ওর থাকার মধ্যে কী একটা গাঢ় অর্থ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম। ও হঠাৎ আমার দিকে ফিরল। বলল—আপনি কবিতা পড়েন?
বললাম—পড়ি।
ও এ বার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। বলল—কার কবিতা সবচেয়ে ভাল লাগে? আধুনিক কবিদের মধ্যে?
বললাম—জীবনানন্দ দাশ।
ও কি একটু হাসল? ঠিক বুঝলাম না। বলল—আধুনিক, মানে, সাম্প্রতিক লেখা পড়েন?
বললাম—হ্যাঁ। মাঝে মাঝে পত্রিকাগুলো দেখি।
ও বলল—আমিও পড়তাম। সব। পত্রিকা। নতুন প্রকাশিত কবিতার বই, সব। এখন আর পড়া হয় না। পত্রিকা কোথায় পাব! মাঝে মাঝে বইগুলো পড়ি।
আমি চুপ করে আছি। আমার কী বলার থাকতে পারে! বিয়ে হলে মেয়েদের স্বাভাবিক ভাল লাগার বিষয়গুলি হারিয়ে যেতে থাকে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক বলে মানা হয়। এমনকী মেয়েরাও এটাই তার অনিবার্য গতি বলে ভাবে। জিনি যেমন বলছিল—তেমন কিছু স্বগতোক্তি ছাড়া আর কিছুই মেয়েদের জীবনে তেমন বেঁধে থাকে না। আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ত সুনন্দা স্যান্যাল। আমরা ওকে অরুণিমা স্যান্যাল বলে ডাকতাম। দারুণ দেখতে ছিল ওকে। তার চেয়েও বড় কথা—দারুণ গাইত। ছবি আঁকত। ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে বিয়ে হয়ে গেল ওর। ফাইনালের আগে শেষ ছ’-সাত মাস ক্লাস করতে এল আবার। তখন আর গায় না ও। আঁকে না। তখন ও সুনন্দা ব্যানার্জি। বলেছিল—‘ধুর, সময় কোথায়! ও সব বিয়ের আগে থাকে মেয়েদের। পড়াশোনাই ছেড়ে দিচ্ছিলাম। ও জোর করল, তাই…!’ ওকে দুঃখিত লাগেনি। গান গাইছিল না বলে, আঁকে না বলে ওর কোনও বিষাদ ছিল না। জিনির কথার মধ্যে বিষাদ জড়িয়ে ছিল। একটা হারিয়ে ফেলার বেদনা। এ সব কি কেটে যাবে ওর? ও কি সুনন্দার মতো সুখী ও দাম্পত্যতৃপ্ত হয়ে উঠবে? বিষণ্ণতা ওকে ছেড়ে যাবে, নাকি যাবে না! ও আবার কথা বলল। এ বার আর আমার দিকে তাকাচ্ছে না। বলছে—আজ একটা কবিতার কয়েকটা লাইন খুব মনে পড়ছে! অথচ কোথায় পড়েছি, কার লেখা, মনে পড়ছে না।
জিজ্ঞেস করলাম—কী লাইন?
বলল—
…অথচ সেদিন রাত্রে যখন আরক্ত ঘন মদে
ভরে দিল ওর মুখ একা একা সবার অমতে,
আর ধীরে ধীরে ওকে ঘিরে নিল সিঁদুর শৃঙ্খল…
বললাম—জয় গোস্বামী। ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’র কবিতা।
ও চমকে তাকাল। বলল— হ্যাঁ! হ্যাঁ! তাই তো! আপনি জানেন? পড়েছেন? কী কবিতা?
বললাম— কী কবিতা মনে নেই। বইটা পড়েছিলাম।
ও বলল—ছোট্ট বই। পিসির বাড়িতে ফেলে এসেছি।
আবার চুপ করে থাকল ও। বোধ হয় জোরে শ্বাস টানল। তারপর বলল—আমারও জীবনানন্দ প্রিয়।
আমি নীরব থাকলাম।
ও বলতে শুরু করল—
রয়েছি সবুজ মাঠে— ঘাসে—
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রঙ তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে? — সে এক বিস্ময়
আমি উঠে দাঁড়ালাম উত্তেজনায়। আশ্চর্য! আজই সন্ধ্যায় আমি এই কবিতার কথা ভেবেছি। একই কবিতা আমরা দু’জনেই জানব এতে কোনও আশ্চর্য নেই। কিন্তু একই দিনে, প্রায় একই দিনে, প্রায় একই দৃশ্য দেখে একই কবিতা আমারই মতো কারও মনে পড়বে, এ কি আমি কোনওদিন ভেবেছিলাম? আমি আস্তে আস্তে বললাম—
পৃথিবীতে নাই তাহা— আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ঐ সমুদ্রের জল;
ও আমার দিকে ফিরল। চোখ দু’টি নিবদ্ধ হল আমার চোখে। কোনও কথা বলল না। পাশের ঘরে আলো জ্বলে উঠল তখন। ও চমকে তাকাল। দেবাশিস। বলল—ও! তোরা! তোমার মাথা ব্যথা সেরে গেল, জিনি?
জিনি কোনও উত্তর করল না। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম তিনজনে। দেবাশিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাই তুলতে লাগল। ওদের গা থেকে বাসি অ্যালকোহলের গন্ধ বেরুচ্ছে। আমার আর কিছু ভাল লাগছিল না। ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। আমার আর অরূপের এক বিছানায় শোবার কথা। অরূপ নেই। আমি চোখ বন্ধ করলাম। জিনির চোখ দু’টি আমার বন্ধ চোখের তলায় ভাসতে লাগল! বুকের তলায় কী যেন কষ্ট হতে লাগল! কেন যে পুরী এলাম! কেন যে! ভালবাসা টের পাইনি এতদিন, সে একরকম ছিল। তখন চরমভাবে প্রেম অস্বীকার করেছি। চরমভাবে যৌনতা চিনেছি। সে-দিন বুঝলাম—এই যে দাবি নেই, যৌনতা নেই, চাহিদা নেই— তবু এই যে বুকে লেগে থাকা কষ্ট, এই মনে পড়া, এই জেগে থাকা বোধ— এরই নাম প্রেম। সুন্দর, অনাবিল প্রেম।
৪৩
সকালবেলায় জিনিকে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন বিকাশ। বললেন— তোমার কি এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে?
জিনি মাথা নেড়ে না বলে।
বিকাশ বলেন— আমরা খুব ভালবেসে তোমাকে বউ করে এনেছিলাম। তুমি শিক্ষিত। ভাল পরিবারের মেয়ে। তোমার আচরণে অসংযম আসবে কেন?
জিনির মাথা টলে যায়। স্বামী আর শাশুড়ির কাছ থেকে শুনে সে কষ্ট পেয়েছিল, শ্বশুরের কথা তাকে দ্বিগুণ ধাক্কা দিয়ে যায়। বিকাশ বলেছিলেন— তোমার শাশুড়ি তোমাকে খুবই ভালবাসেন। নিজের মেয়ের মতো…।
জিনির মনে পড়ে যায় শাশুড়ির স্তন সম্পর্কিত মন্তব্য, মনে পড়ে জিনিকে দেমাকি বলার কায়দা, মনে পড়ে ইদানীং বাড়িতে কেউ এলেই তাকে বলা—কী বিয়ে দিলাম ছেলের, বউয়ের তো মাথা খারাপ— এবং মনে পড়ে— ঠাকুরঘরে টেনে হিঁচড়ে ফেলে মাথা ঠুকে দেবার কথা। মনে পড়ে নানান ছোট-বড় কটু ভাষণ, জিনিকে অলক্ষুণে বলা। তার মা কি বলতে পারত তাকে এরকম? ভাবতে পারত? মায়ের শাসনের তলায় আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছাটি চিনতে পৃথিবীর কোনও সন্তানের কোনও দিন ভুল হয়নি। সুতরাং সে ম্লান হাসে। কোনও কথা বলে না।
বিকাশ বলেন— এত ভালবাসা, এত সুন্দর পরিবার পেয়েও যখন তোমার অসুবিধা হচ্ছে তখন আমি ঠিক করেছি তোমার মাকে জানাব। তিনি যা ভাল বুঝবেন, করবেন।
জিনি চমকে ওঠে। মা! মাকে বলা হবে সব? এইসব? অসম্ভব। এতখানি অপমান মাকে পেতে দেবে না সে। সে ধীরে ধীরে শ্বশুরের পায়ের কাছে বসে পড়ে, বলে—মাকে জানাবেন না কিছু। আপনারা যা বলবেন আমি তাই করব। শুধু মাকে বলবেন না।
তার চোখে বাষ্প নেই। রোগা শরীরে হাড়গুলি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছে। সে মনে মনে সমস্ত চড় ও সমস্ত মারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে এখন। সে নিজেকে কেমন করে প্রকাশ করবে! এরা তাকে বিশ্বাস করে না। সে কেমন করে সেই বিশ্বাস নিয়ে আসবে! সত্য যা তা সত্যই। মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, সত্যকে যায় না।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট পান বিকাশ। এই ক’দিনে মেয়েটা কেমন শুকিয়ে গেছে। তাঁর বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে ওই মেয়ে সত্যি নষ্ট আচরণ করেছে। তবু দেবাশিস ও লক্ষ্মীর কথা ঠেলতে পারেন না তিনি। ভাবেন, মানুষ ভুল করে, শুধরেও নেয়, একে শোধরানোর সুযোগ দেওয়া যাক। তবু পুত্রবধূর চরিত্র নিয়ে কিছু শুনতে বড় খারাপ লাগে। হঠাৎ একটা হাওয়ার ঝলক আসে ঘরে। ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। দেবার্চনের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটি ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ে। বিকাশ ছুটে যান। লক্ষ্মী আর দেবাশিসও ছুটে আসে। আর কোথাও কোনও ওলট-পালট নেই, শুধু দেবার্চনের ছবিটা খান-খান হল! লক্ষ্মী বলতে লাগলেন— ‘এতদিনে কিছু হল না, আর আজই! কী অলক্ষুণে ব্যাপার!’ বিকাশের মনে হল— দেবার্চন কি কিছু বলতে চাইছে? কোনও ইঙ্গিত? দেবার্চন কি চলে যাচ্ছে? বিকাশ ভয় পান। ইদানীং ছোট ছেলেকে নিয়ে ভাববার অবকাশ মেলেনি। দেবাচন কি সে-কথাই মনে পড়িয়ে দিল?
দু’বার বেল বাজল দরজায়। দেবাশিস দরজা খুলল। আনিসুজ্জামান। তাঁকে ভেতরে আহ্বান করল দেবাশিস। গলা পেয়ে বিকাশ এলেন। বসতে বললেন। দরজাটা ভাল করে খুলে দিতে দিতে দেবাশিস দেখল তানপুরা কাঁধে এগিয়ে যাচ্ছে অনুপম। অন্য দিন হলে সে ডাকত। দাঁড়িয়ে সিগারেট খেত একসঙ্গে। আজ ইচ্ছে করল না। ওদের দেখলেই পুরীর রাতগুলো মনে পড়ছে। দেবাশিস এখনও স্পষ্ট করে জানে না যে জিনি সত্যি দেবোপমের সঙ্গে কিছু করেছে কি না। কিন্তু তার ঈর্ষা হচ্ছে। গভীর ঈর্ষা। দেবোপম যখন জিনিকে ধরে ধরে পাশের ঘরে নিয়ে যায় এবং যত্ন করতে থাকে তখন দেবাশিস একবার ও ঘরে যাবার জন্য এসেছিল। শুনতে পেয়েছিল জিনি বলছে— ‘আমার লজ্জা করছে।’ দেবাশিস থমকে গিয়েছিল। কী করছে ওরা? তার প্রথমেই মনে পড়েছিল তার হাতে জিনির শরীর কত শীতল! সে উঁকি মারার চেষ্টা করেছিল। দেখেছিল, দেবোপম, কত যত্নে ও সাবধানে ভেজা শাড়ি খুলে শুকনো শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে জিনিকে। নিজের কাছে স্বীকার না করে উপায় নেই যে দেবোপমের আচরণে কোনও অসততা ছিল না। দেবাশিস হয়তো নিজেও পারত না, কোনও মাতাল মেয়ের শরীর ওই নিষ্পাপ উপায়ে ঢেকে দিতে। দেবোপম পারল! কেন পারল! ঈর্ষা— দারুণ ঈর্ষা দেবাশিসের। জিনিকে যখন শুইয়ে দিচ্ছিল দেবোপম তখন আবার লুকিয়ে পড়েছিল দেবাশিস। পরে বাকিটাও সে দেখেছে। জিনিকে তবুও উত্যক্ত করছে সে। কোথায় যেন একটা হেরে যাওয়া কাজ করছে। জিনি দেবোপমকে যে স্বীকৃতি দিয়েছে তা কি এক মুহূর্তের জন্যও বলেছে দেবাশিসকে! ওই স্বরে! ওই সমর্পণে! কোথাও খারাপ কিছু নেই কিন্তু সবটাই দেবাশিসের কাছে খারাপ। বিকৃত। দেবাশিস জিনিকে বারবার বলছে— ‘ও কি তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল?’ জিনির প্রতিটি না বলার সঙ্গে দেবাশিস বিশ্বাস করতে চেয়েছে যে ওরা লিপ্ত হয়েছিল। নিশ্চয়ই হয়েছিল। সে প্রাণপণে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, হয়েছিল। জিনি যদি একবার বলত, অন্তত একবার বলত— ‘ছি, তোমার বন্ধুটা কী অসভ্য!’ তবে সামান্য হলেও আরাম পেত দেবাশিস। দেবোপমকে খাটো হতে দেখে নিজেকে উচ্চতর ভাববার অবকাশ পেত। কিংবা সে, জিনিকে, যতটুকু অমূলক ভেবেছিল, শরীরে যতটুকু অপূর্ণ, তার জন্য যত অবহেলা ও অপমান সে জিনিকে করেছিল, তার সামান্যতমও দেবোপমের মধ্যে ছিল না বলে সে নিজেকেই বড় হীন দেখেছিল। তাই ঈর্ষা। তাই রাগ। এবং হিংস্র ক্রোধ, কেন-না জিনি তার কাছে নিজেকে পরিপূর্ণ সমর্পণ করে উঠল না কোনওদিন। এখন সে বিশ্বাস করছে জিনি অসংলগ্ন। জিনি শীতল। সে প্রতিদিন অতৃপ্ত থাকছে। প্রথম দিন থেকে অতৃপ্ত থাকছে। তার ভেতরকার সমস্ত ঘন দ্রবণ বেরিয়ে যাবার সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও পরিপূর্ণ তৃপ্তি তাকে একদিনের জন্যও জিনি দিতে পারেনি। দেবাশিস জিনিকে চায় আবার চায়ও না। পায় আবার পায়ও না। দেবাশিস জিনিকে চড় মেরেও ভাবতে থাকে— ‘ও আমার হাত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্য কোথাও।’ দেবাশিস জিনিকে ভালবাসেনি কিন্তু জিনির ওপর থেকে একচুল অধিকার হারাতেও সে রাজি নয়। সে অতএব, নিজের অধিকার রক্ষার জন্য একটি দল গড়ে তুলতে চায়, সমর্থন পেতে চায় আরও অনেক লোকের এবং ঘৃণা প্রতিষ্ঠা করে। সন্দেহ প্রতিষ্ঠা করে। সেই ঘৃণা, সেই সন্দেহ ঘর ছাড়িয়ে চলে যায় পাড়ায় পাড়ায়। দেবোপম, সে এমনই এক পিতার সন্তান, যার জন্ম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে পাড়া এবং সে সকলের চোখে নিন্দার্হ হয়, ঘৃণিত হয়, এটা হওয়াই তার পক্ষে সহজ কারণ দেবাশিসের পক্ষেও এটা করাই সবচেয়ে সহজ।
বিকাশ চা করতে বলেন জিনিকে। লক্ষ্মী কাচের টুকরো তুলছেন। আঁচল দিয়ে মুছে দিচ্ছেন মৃত সন্তানের ছবি। বুঝি-বা একটু ম্লান হয়ে গেছেন তিনি, বুঝি-বা মনে পড়ে যাচ্ছে, ছোটখোকা ক্ষীরের সন্দেশ ভালবাসত। নাড়ু ভালবাসত। বড় অল্প চাইত সে। বড় অল্প পেয়েই চলে গেল তাই। লক্ষ্মী জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখেন। পাশের বাড়ির পাঁচিলে রোদ্দুর পড়েছে। মিথিলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেতারির সেতারবাদন ভেসে আসছে রোজকার মতো। বর্ষায় পাঁচিলে শ্যাওলা পড়েছিল, তার কালচে শুকনো ছোপ ধরা আছে। রোদ্দুরে অনেক বেশি স্পষ্ট লাগছে এখন। দেবার্চন সেতারের শব্দে রাগরূপ ধরার চেষ্টা করত। লক্ষ্মীর অর্থহীন লাগত এ সব। সবার কথা থামিয়ে দিয়ে, নিশ্চল থেকে, রাগরূপ বোঝার চেষ্টা করার মধ্যে কী আনন্দ থাকতে পারে তিনি বোঝেননি। তাঁর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছোটছেলেকে কোনও দিনই তিনি বোঝেননি। যখন ছোট ছিল তখনই তাকে দূরের মনে হত। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে-দূরত্ব অলঙ্ঘনীয় হয়ে গেল ক্রমে।
জিনি চা আর বিস্কিট সাজিয়ে আনল। আনিসুজ্জামান দুর্গার প্রবন্ধ বিষয়ে কথা বলছিলেন। জিনির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন তিনি! বলে ফেললেন— শিঞ্জিনী, তোমার কি শরীর খারাপ?
জিনি মুখ নিচু রেখে জবাব দিল— না।
লক্ষ্মী পাশের ঘর থেকে প্রশ্নটা শুনতে পেলেন। বিছানায় ছবি-টবি রেখে তাড়াতাড়ি এসে বললেন— হ্যাঁ, শরীর ভাল হবে কী করে! এই পুরী থেকে দাপাদাপি করে এল।
জিনি চলে গেল সামনে থেকে। মেয়েটির জন্য কষ্ট পেলেন আনিসুজ্জামান। অল্প-স্বল্প যতটুকু কথা বলেছেন, ভাল লেগেছিল। মেয়েটির গভীর পড়াশুনো আছে। এখনকার বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীর মতো ওপর-ওপর নয়। আজ তাকে বড় বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কারওকে কারওকে বিষণ্ণতা মানায় না। কলেজেও দেখেছেন তিনি। কোনও ছাত্রী বা ছাত্র, হঠাৎ বিষণ্ণ মুখে এসে দাঁড়ালে বুকের মধ্যে টনটন করে। ছাত্র-ছাত্রীদের মুখে দু’টি অভিব্যক্তি চমৎকার মানিয়ে যায় এমনই মনে করেন আনিসুজ্জামান। রাগ আর খুশি। তুমুল খুশি। এই মেয়েটি, জিনি, শিঞ্জিনী তাঁর ছাত্রী ছিল না। তবু, সে তো ছাত্রীবৎ। তার বিষণ্ণতা, শুকনো, অযত্নের প্রকাশ আনিসুজ্জামানকে যন্ত্রণা দিতে থাকল। বেশিক্ষণ কথা বলতে ভাল লাগল না তাঁর। যতখানি আলোচনা করবেন ভেবেছিলেন, করা হল না। উঠে পড়লেন।
অন্য সময় কেউ এলে লক্ষ্মীও বিকাশের সঙ্গে বসে কথা বলে থাকেন। আজ, দেবার্চনের ছবি ভেঙে যাওয়া তাঁকে বিমর্ষ করেছিল। তবু, কিছু কথা না বললে তাঁর শান্তি হয় না—এমনই কারণে তিনি আবার ও ঘর থেকে এ ঘরে এলেন। আনিসুজ্জামান চলে যাচ্ছেন। লক্ষ্মীর কাপগুলোর দিকে নজর গেল। আঁতকে উঠে বলতে লাগলেন— দেখলে, মেয়েটার কাণ্ড দেখলে। কতবার বলেছি যাকে-তাকে এ কাপে চা দেবে না!
তিনি ছুটে গেলেন ঘরে। জিনিকে ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন—তুমি কি একটু কথা শুনতে জানো না? তোমার বাড়িতে কি কোনও শিক্ষাই তোমাকে দেয়নি?
জিনি কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল— কী হয়েছে?
—কী হয়েছে তুমি জানো না? আমার সংসারে একটু আচার-বিচার রাখবে না তুমি? ওই মুসলমানটাকে তুমি ঘরের কাপে চা দিলে? ওই কাপে চা খেয়ে আমি পুজো করতে যাই না?
—মুসলমান তো কী হয়েছে মা? ওঁর মতো মানুষ হয়! কত জ্ঞানী! কী বিশাল ওঁর পড়াশুনো!
—কী? আমাকে শেখাবে? তক্ক করছ মুখে মুখে?
মায়ের গলা পেয়ে দেবাশিস এসে যায়। জিনির খোঁপা ধরে টান মারতে থাকে সে। বলে— ‘মায়ের মুখের ওপর কোনও কথা বলবে না তুমি। একটা কথাও না। বাজে, নোংরা মেয়েছেলে!’
পাশের ঘরে বিকাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কোনও প্রতিবাদ আসে না তাঁর।
প্রহারের প্রবৃত্তিও হয়তো-বা মানুষের আদিতম প্রবৃত্তিগুলির একটি। সভ্যতা ও সুসংস্কৃতির দাবিতে অন্যান্য প্রবণতার মতোই প্রহারও লুকিয়ে থাকে। ঘুম দেয় দীর্ঘ-দীর্ঘকাল। কিন্তু একদিন—হঠাৎ সেই ঘুম ভেঙে গেলে—প্রহার দানবপ্রায়। তখন সভ্যতা অন্ধকারে। সুসংস্কৃতি বিস্মৃত। পাপের দরজা প্রথমবার ডিঙোতেই কষ্ট বেশি। ধীরে ধীরে প্রহারও পাপেরই মতো অভ্যাসে দাঁড়ায়।
৪৪
রক্তের গন্ধ পাচ্ছে অন্ধ। মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছে। তার ঘুম হচ্ছে না। কী যেন একটা ঘটবে! বড় কষ্ট হচ্ছে তার। সে হাতড়ে হাতড়ে বাইরে চলে এল। দু’দিন হল মাস্টারের জ্বর এসেছে। পাঁজরে ব্যথা। কাজে যাচ্ছে না ক’দিন। অন্ধ পায়ে পায়ে মাস্টারের বাড়ির দিকে চলল। এখনও ভোর হয়নি ভাল করে। পাখিরা স্বরের আড় ভাঙছে। যেন কচি শিশুদের সা রে গা মা গলা সাধা।
কপিলা মাঠ করতে বেরিয়েছিল! এত ভোরে অন্ধকে দেখে বলল—কোথায় যাস অন্ধ?
—কপিলাদি? তুমি কোথায় গেছিলে?
—বিলের পাড় গেছিলাম।
—অ।
—তুই কোথায় যাস অন্ধ?
—মাস্টারকাকার কাছে যাব। কাকার জ্বর তো। কপিলাদি?
—বল।
—একটা গন্ধ পাচ্ছ?
—কী গন্ধ? ফটিক বিল থেকে কত গন্ধই তো আসে।
—না। মানে রক্তের গন্ধ পাচ্ছ?
—রক্তের গন্ধ? অ অন্ধ। অন্ধ রে। সত্যি তুই রক্তের গন্ধ পাচ্ছিস? তুই কি ভগবান রে অন্ধ? সত্যিই তুই এত গন্ধ কেমন করে পাস?
কপিলা ভেঙে পড়ছে। তার বিস্ময় ও বিলাপ ভোরের আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। অন্ধ চুপ করে আছে। কপিলা তার পায়ের কাছে বসে পড়েছে। তার কোমর সাপটে ধরেছে। তার উদরে কপিলার কান্নার জল পড়ছে এখন। কপিলা বলছে—পাপ করেছি রে অন্ধ। খুব পাপ করেছি। রক্তের গন্ধ তো পাবিই তুই। এ আমার পাপের গন্ধ।
—ওঠো কপিলাদি। কাঁদছ কেন? আমাকে মাস্টারকাকার কাছে যেতে দাও।
—শোন অন্ধ শোন। আমি বুঝিনি লোকটা এরকম করবে। কী করল জানিস? টাকা দিল। মা’র মুখের ওপর একগাদা টাকা ছুঁড়ে দিয়ে বলল— মেয়ের পেট খালাস করে আয়। অনেক টাকা দিলাম, ভাল ডাক্তারের কাছে যাবি। তোদের তো লালচ যায় না। তোরা শুস একজনের সঙ্গে, বদনাম করিস আর একজনের। আমার টাকা দেখেছিস। একটা অজুহাত দেখিয়ে চলে এলি লালা ফেলতে ফেলতে।
—এইসব বলল?
—হ্যাঁ রে। মা ফিরে এল চোখের জল ফেলতে ফেলতে।
—তোমরা টাকাটা নাওনি তো কপিলাদি?
—নিয়েছি রে অন্ধ। না নিয়ে কী করব বল? কাল আমি পেট খসিয়ে এসেছি। অন্ধ, কী যন্ত্রণা! ভগবান আমাকে পাপের শাস্তি দিল রে! কিন্তু বিশ্বাস কর, নগেন মিত্তির ছাড়া আমি কারও সঙ্গে শুইনি। ওই লোকটাই আমার সতীচ্ছদ ভেঙেছে। আমাকে বলত—‘তুই কী ভাল রে কপিলা। তোকে বিয়ে করব। আমার রানি করে রাখব। আমার বয়সটা একটু বেশি। কিন্তু তাতে কী? দেখ। তোকে কত সুখ দিই আমি।’ সুখের লোভ। সুখের ভীষণ লোভ। ওই লোভে লোকটার সব কথা আমি বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। আর বিশ্বাস করতে করতে কবে যেন ভালও বেসে ফেললাম রে! মনে হতে লাগল, বয়স বেশি তো কী? বুড়ো বর তো কত মেয়েরই হয়! ও যখন ডাকল আমাকে— জাপটাল, আদর করল—আমি গলে গেলাম। আমাকে ও ওর ওই নরম ঝকঝকে বিছানায় পর্যন্ত নিয়ে গেল। কতদিন কত গল্প শুনেছি, বাবুরা মেয়েদের সর্বনাশ করে। তাও আমি বুঝলাম না নগেন মিত্তির আমার সর্বনাশ করছে। আমি বোকা রে অন্ধ। আর পাপী। ঘোর পাপী। আমার গায়ে পোকা পড়বে, দেখিস।
অন্ধ মুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে কপিলার চোখে হাত রাখে। জল মুছিয়ে দিতে চায়। কপিলার সব কথাই সে বুঝেছে এমন নয়। কিন্তু এই ভোরে এক দুঃখের রাগিণী তার স্নায়ুতন্ত্রী স্পর্শ করেছে। এই বসন্তের শুরুতে শিশির অল্প হয়ে আসা বেলায় কপিলার অশ্রু কিছু ধুলো ভিজিয়ে দিল।
—কেঁদো না। কপিলাদি। রক্তের গন্ধ কেন পাচ্ছি আমি তো জানি না। আমাকে যেতে দাও।
—আমাকে খারাপ ভাবলি, না রে অন্ধ? খুব খারাপ?
কপিলা অন্ধকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অন্ধ ঠোঁটের তলায় পাতলা হাসে। সে খারাপ ভাববে কেন? কী খারাপ, কী ভাল সে কি বুঝতে পারে? সে কি জানে? তার ধাঁধা লাগে। কপিলাদির আসল দুঃখটা কোথায়? নগেন মিত্তির টাকা দিয়ে আবার লোভী বলেছে বলে? পেট খালাস করেছে বলে? নাকি নগেন মিত্তিরকে ভালবেসে কপিলাদি সত্যিই দিওয়ানি বনে গেছে। মুন্নাদা অবশ্য বলে, ভালবেসে ছেলেরা যতখানি দিওয়ানা হয়, মেয়েরা ততখানি হয় না কখনও। মুন্নাদা কাকে ভালবেসেছিল আর ধাক্কা খেয়ে অন্ধকে বলেছিল—পুরা উমর ও তুঝে ইয়াদ আয়েগী কিঁউ কি উসনে তুমে দিয়া ভি কুছ তো সিরফ জখম।
এই ক’দিন যে অসহ্য কষ্ট আর অপমান কপিলা চেপে রেখেছিল, অন্ধর কাছে সে-সব উগরে দিয়ে কীরকম হালকা বোধ করছে সে। সে দেখল অনিবার্য পা ফেলে এগিয়ে চলেছে অন্ধ। চোখে দেখে না কিন্তু এতটুকু ভুল পা ফেলছে না সে৷ সে আকাশের দিকে তাকায়। ফিকে হয়ে আসছে অন্ধকার। একটি একটি করে তারা নিভছে। এত তারা দিনের বেলায় কোথায় যে সব থাকে সে জানে না। ফটিক বিলের দিকে চেয়ে তার মনে পড়ে আরও একটা কাজ তাকে দ্রুত খুঁজে নিতে হবে। আবারও হয়তো কোনও বাবুর প্রলোভনে ভাল থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে এবং ভুল করবে। স্বপ্ন দেখা কি আটকানো যায়? কপিলা জানে না।
অন্ধ পায়ে পায়ে মাস্টারের দরজায় পৌঁছয়। দরজায় শব্দ করে। মাস্টার দরজা খুলে বলে— অন্ধ, এত সকালে! ঘুম হয়নি রে তোর? মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন?
অন্ধ চুপ করে থাকে। মাস্টার তার কাঁধ জড়িয়ে বলে— আয় আমার সঙ্গে শুয়ে নিবি একটু।
অন্ধ টের পায় মাস্টারের গায়ে তখনও জ্বর আছে। সে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থেকে বলে— আমি একটা গন্ধ পাচ্ছি।
—কী গন্ধ?
—খারাপ গন্ধ। রক্তের গন্ধ।
মাস্টার জানে অন্ধ গন্ধ পায়। এতদিন সে সময়ের ঘ্রাণ পেত। মরশুমের ঘ্রাণ, বইয়ের গন্ধ। এ পর্যন্ত মাস্টারের আশ্চর্য লাগেনি। কারণ কোনও ইন্দ্রিয় নিষ্ক্রিয় হলে অন্য অনুভূতিগুলি প্রখর হয়ে যায়, কিন্তু ইদানীং অন্ধ যেন ভবিতব্যের গন্ধ পাচ্ছে। মাস্টারের বুকের মধ্যে সিরসির করে। সে কোনওদিন অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করেনি। কিন্তু অন্ধের অনুভূতিগুলি ক্রমে ব্যাখ্যাতীত হয়ে যাচ্ছে। অন্তত সাতদিন আগে, যখন মাস্টার রীতিমতো সুস্থ তখন অন্ধ তাকে বলেছিল— তোমার গায়ে আমি জ্বরের গন্ধ পাচ্ছি—এখন মাস্টারের গা ভর্তি জ্বর। আজ অন্ধ রক্তের গন্ধ পাচ্ছে। মাস্টার বুঝতে পারে এ গন্ধের এত তীব্রতা যে অন্ধের মুখে কষ্টের ছাপ পড়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে মাস্টারের দু’চোখ বুজে আসে। অন্ধ মাস্টারের বুকের কাছে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে ক্রমে। সে আগেও দেখেছে মাস্টারের কাছে এলে তার জ্বালা যন্ত্রণা কষ্ট কিছুই থাকে না।
সকালবেলায় হইচই শুনে ঘুম ভেঙে গেল মাস্টারের। আজ তার কাজে যাওয়া নেই। তাই বেলা অবধি পড়ে ছিল। জ্বরে শরীরটা কাহিল করে দিয়েছে। কারা যেন দৌড়ে যাচ্ছে কোথায়, কারা যেন ইস্ ইস্ করছে। হঠাৎ কোন সর্বনাশের ঘূর্ণী আছড়ে পড়েছে বস্তির ওপর। মাস্টারের মনে পড়ে গেল অন্ধ রক্তের গন্ধ পেয়েছিল! জ্বর ভুলে দুর্বলতা ভুলে লাফিয়ে উঠল মাস্টার। অন্ধ অসাড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। মাস্টার দরজা খুলে বাইরে এল। কোলাহলের মধ্যে, ছোটাছুটির মধ্যে একটি শব্দ কানে গেল তার। —মরণব্রিজ-মরণব্রিজ! হাবু আর নেপা ছুটে যাচ্ছিল। যেতে যেতে বলল, শুনেছ মাস্টার, মাথুরের গড়ের একটা ছেলে রেলে কাটা পড়েছে।
মাস্টার চমকে উঠল। —কে কাটা পড়ল, কে? —বস্তির কেউ নাম জানে না। শুধু আশ্চর্যের কথা হল—সেই ছেলেটার থেকে একটু দূরেই মরে পড়ে আছে কুঁজি ঘুঁটেকুড়ানি ফুলরেণু। সে কিন্তু কাটা পড়েনি। বোধহয় রেলে ধাক্কা খেয়েছিল। মাথা ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
অন্যদের সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারও পৌঁছে গেল মরণব্রিজে। লোকজন ঘিরে আছে জায়গাটা। কে যেন অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। তাকে ঘিরেও জটলা। লোকে বলছে—যে মরেছে তার দাদা—।
—কখন হল? কখন হল ঘটনাটা?
—এই তো আধঘণ্টা হবে বুঝি।
ইতিমধ্যে জেনে গেছে সবাই। মাস্টার দেখছে। ছেলেটির বুকের ওপর দিয়ে চাকা চলে গেছে। অর্ধাংশ আটকে আছে পাটাতনে। নীচের দিকের আধখানা লাইন ও পাটাতনের খাঁজে আটকে ঝুলছে। যেন মরবে বলে বুক পেতে দিয়েছিল ছেলেটা। নিটোল মুখ। একটি নিটোল জগৎ। সেই হাতে তখনও ধরা আছে চকচকে স্টিলের ক্যান। ক্যান থেকে দুধ গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে গিয়েছে মাটির দিকে। দুধ—তা আর চেনা যায় না। মাস্টার আর সহ্য করতে পারল না। রক্তের কী বীভৎস গন্ধ। এই রক্তই যখন শরীরে থাকে তখন কোনওরকম আঁশটে গন্ধের সন্ধান পাওয়া যায় না। মাস্টার মুখ নিচু করে ঘরে ঢোকে। অন্ধর ঘুম এখনও ভাঙেনি। মাস্টার তাকে জাগিয়ে দিল। বলল—তুই যে রক্তের গন্ধ পেয়েছিলি এ কথা আর কাউকে বলিস না রে—।
—কেন মাস্টার কাকা?
—একটা ছেলে ট্রেনে কাটা পড়েছে, দেখে মনে হল আত্মহত্যা করেছে।
—কোথায়? মরণব্রিজে?
—হ্যাঁ, তুই কী করে জানলি?
—গন্ধটা ও দিক থেকেই আসছিল যে।
মাস্টার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল—মরণ একজনের হয়নি, দু’জনের হয়েছে।
—আর কার?
—কুঁজি ফুলরেণু— ঘুঁটে বেচত।
—এই বস্তিতে তো থাকে না।
—না, ও স্টেশনের কাছে ঝুপড়িতে থাকত। মাঠঘাট থেকে গোবর কুড়িয়ে রেলের স্লিপারে ঘুঁটে দিত। ও যে কী করে মরল?
দু’জনে চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। অবশেষে অন্ধ বলল—গন্ধের কথা আমি একজনকে বলেছিলাম—
—কাকে?
—কপিলাদিকে।
মাস্টার ভাবছে, কপিলা কি বলবে কারওকে? বলবে কিছু? অন্ধ যে আগে থেকে বুঝতে পারছে তা কি ঐশ্বরিক বলে ভেবে নেবে সবাই? গভীর অনুভূতিপ্রবণতা থাকলে এরকম হয়। কোনও কল্পনা ও বাস্তবের সমাপতনও হতে পারে। যে মারা গেছে মাস্টার তাকে চেনে না। তবু ক্লান্তভাবে শুয়ে শুয়ে দু’টি ঘটনাকে জুড়ে নেবার চেষ্টা করে। ফুলরেণুর জন্য মানুষের তেমন ঔৎসুক্য নেই এখানে। বাবুদের বাড়ির ছেলের জন্য আছে। কিন্তু ফুলরেণু কেন মরে গেল? সে কি ছেলেটিকে বাঁচাতে চেয়েছিল? সারা শরীরে অবসাদ ছড়িয়ে যায়। অন্ধকে নিয়ে কামারহাটির দিকে হাঁটতে থাকে মাস্টার। কামারহাটির পাশ দিয়ে বাঁদিকে একটি ছোট রাস্তা ধরে দক্ষিণেশ্বর চলে যাওয়া যায়। আজ মাস্টার অনেকক্ষণ গঙ্গার ঘাটে বসে থাকবে। অন্ধও থাকবে। মাস্টার জল দেখবে আর অন্ধ জলের শব্দে শুনবে। আজ তারা কোনও কথা বিনিময় করবে না।