৪০
বেলা দশটা। না আরো বেশি। রোদ কড়কড়ে হয়ে গেছে। উঠোনে মাটি গরম হয়ে উঠল বলে। বাড়ির লোকজন কিছু কমেছে। তাই শাড়ি সায়া লুঙি চাদর বাইরের দড়িতে কম ঝুলছে। বেশ ফাঁকা ঠেকেছে উঠোনটা। যেন অনেকটা জায়গা পেয়ে মাস্টারের ঘরের হুলা, হুলার ছোট নেলা, প্রমথদের ঘরের গোলা, ভুবনের ঘরের শম্ভুচরণ, বিষ্ণুচরণ এবং এ- বাড়ি ছাড়াও পাড়ার সময়বয়সী গুর্খা চন্দন পল্টু ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় দশ-বারেটি ছেলে হাতে একটা করে মানকচুর ডগা নিয়ে নিশানের মত সেগুলো শূন্যে নেড়ে হই-হই চিৎকার ক’রে বারো ঘরের উঠোনের চার দিক ঘুরে ঘুরে খেলছে। আর সেই শোভাযাত্রার সঙ্গে ঘুরছে মাছির ঝাঁক। এবং সকলের পিছনে লেজ নেড়ে নেড়ে, যেন ছেলেদের পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে ঘুরছে রমেশের ঘাড়-মোটা কালো ভুশভুশে রঙের কুকুর ভোম্বল। ভোম্বলের পিঠে এতবড় একটা ঘা। দু’তিন ডজন মাছি সেই ঘা কামড়ে থেকে ভোম্বলের পিঠে চড়ে শোভাযাত্রার সঙ্গে ঘুরছে। এমন সময় কে একজন বারো ঘরের উঠোনে ঢুকে রমেশের ঘরের দরজার সামনে কি একটা ভারি মতন জিনিস ধুপ্ করে মাটিতে ফেলল। ছেলের দল চমকে উঠল, মাছির ঝাঁক ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, লেজ নাড়া বন্ধ রেখে এক সেকেন্ড স্থিরভাবে তাকিয়ে ভোম্বল বড় কচ্ছপটাকে দেখল। চার পা দড়ি দিয়ে বাঁধা। গলা বার করে পিটপিট চোখে বারো ঘরের উঠোনে দেখছে। পিঠে হলুদ সবুজ চাকা চাকা দাগ। কিন্তু কচ্ছপটাকে সবচেয়ে বেশি চমকে দিল তেমনি হলুদে সবুজে ছোপ দেওয়া ও তার ওপর ফিকে লাল ডোরাকাটা চমৎকার শাড়ি-পরা মল্লিকা। ঘামছে। এইমাত্র উনুন থেকে কি যেন ভাজা শেষ করে বেরিয়ে এসে ওর টকটকে লাল রঙের চারহাত গামছাখানা দিয়ে মুখ মুছছে। কচ্ছপ দেখে মল্লিকার চোখ কপালে উঠল। ‘কে পাঠাল।’
‘কর্তাবাবু।’
বত্রিশটা দাঁত বের করে বাজারের আলুর গুদামের গোমস্তা শশী মল্লিকার নরমলাল মুখখানা দেখছিল। ‘আরো দু’জন বাবুর খাবার নেমন্তন্ন করেছেন এই বেলা। আমি গিয়ে আলু আর আদা পেঁয়াজ পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘তুমি ওটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও শশী। আর কর্তাবাবুকে গিয়ে বল আর কোথাও ভোট-বাবুদের বেঁধে নিয়ে নিমন্তন্ন খাওয়াক। আমার কোমরে এত তেল নেই, হাতে জোর নেই, বেলা বারোটার সময় কচ্ছপ কেটে মাংস রাঁধতে বসি। ওমা মা, আমি কোথায় যাব গো।’ তীব্রস্বরে মল্লিকা আর্তনাদ করে উঠল। ‘আমার মরণ নেই, আমার গলায় ডাকাতের দল দা বসায় না!’
ছেলেরা তো বটেই, শশী, ভোম্বল, মাছিগুলো এবং নবাগত কচ্ছপটাও মল্লিকার সুন্দর চোখের দিকে, নরম ঘেমে-ওঠা মুখের দিকে কতক্ষণ ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে।
পারিজাতের ইলেকশনের ব্যাপারেও তার আর পাঁচটা কাজের মত রমেশ কাল থেকে পরিশ্রম করছে ভোটার যোগাড়ের চেষ্টায়, লোকের সঙ্গে মেলামেশা, বন্ধুত্ব এবং নিমন্ত্রণ করে খাওয়াবার দিকে মনোযোগ দিয়েছে। কাল দুপুরেও কে কে জানি রমেশের ঘরে খেয়ে গেল। মল্লিকা আলু-কড়াইশুঁটি দিয়ে ইলিশের ঝোল আর বেগুন সিম দিয়ে কই মাছ, কপির ডালনা আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে লাউমুগ রেঁধেছিল। আপত্তি করেছিল এতসব পদ করতে। আজ এখন এই ভরদুপুরে এসেছে কাছিম।
‘তা আমার কি হবে ভোটার বাবুদের রেঁধে খাইয়ে। পারিজাত জিতলে দু’শো পাঁচশো ঘরে আসবে, না দু’চার বিঘা জমি বাড়বে? অই খাটুনিই সার। আঙুল ছোঁয়াবে তোমাদের রমেশ দাদাকে। উঁহু। রোজ রোজ আমি বেলা তিনটে অবধি উনুন গুঁতিয়ে শরীর অঙ্গার করতে পারব না। যাও বলে যাওগে। কোথায় গেছেন বাবু বাজার সেরে? চায়ের দোকানে? এই তো আজ পেট ব্যথা কাল পিট ব্যথা। তবু খাওয়া আর খাওয়ানো কমছে না। পেত্নী দৃষ্টি না ফেললে, শনি ঘাড়ে না চাপলে কারো এমনধারা মতিগতি হয়? অ্যাঁ! আমার মরণ নেই কেন গো, আমার কপালে এই সুখ!’
মল্লিকা ফরসা লাল গামছা দিয়ে চোখ ঢাকল। হাতের ষোলটা সোনার চুড়ি রিনঠিন ক’রে উঠল।
প্রমথর দিদিমাকে শেষ রাত থেকে কফে কাবু করে ফেলেছে। তেমন গলা বাড়িয়ে কথা বলতে পারল না। জানালার একটা পাল্লা খুলে বিষণ্ণ চোখে চেয়ে রইল। বিধু মাস্টারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণিরও শরীরের অবস্থা ভাল না। শেষ রাত থেকে আজ আবার তলপেটের দিকটা টনটন করছে টাটাচ্ছে। একরকম বেদনাই বলা যায়। তাই ঘরে চুপচাপ শুয়ে। ভুবনের স্ত্রী এক ছেলেকে নিয়ে প্রীতি-বীথি অফিসে বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতায় একটা বাড়ির খোঁজ করতে বেরিয়ে গেছে। রুচি বেরিয়ে গেছে স্কুলে। প্রভাতকণা, কিরণ কমলা তো নেইই
কাজেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে একলা হিরণকে মল্লিকার কান্না শুনতে হ’ল এবং দুটো একটা সহানুভূতির বাক্যও ছাড়তে হল শেষ পর্যন্ত।
‘লক্ষ্মীর সংসারে দিদি রান্না খাওয়ার বেলা-অবেলা কি। কড়াই-খুন্তি, ডেকচিহাতা, থালা- ঘটি আর তোমার সোনার চুড়ির বাদ্যি-বাজনা যদি অষ্টপ্রহর বাজে, ঈশ্বর থামতে না দেয় তো করবে কি। এত বড় কাছিম এদিনে ক’জনের ঘরে আসে। নেমন্তন্ন করে চার পদ রেঁধে বাইরের লোককে খাওয়াবার ক্ষমতা কটা লোকের আছে? বড় যে মরণ চাইছ।’
শুনে মল্লিকা চোখ থেকে গামছা সরাল। হিরণের দিকে তো তাকালই, পরে চোখ দুটো তেরছা করে পাঁচু ভাদুড়ীর ঘরের দিকে তাকাল। যশোদাকে দেখা যাচ্ছে না। রমেশ রায়ের দরজায় দশ সের ওজনের কচ্ছপ দেখে তাড়াতাড়ি সামনের পাল্লা দুটো বন্ধ করে দিয়েছে যশোদাও চুপ করে আছে বাড়ির বাকি ঘরগুলো টের পায়।
‘এখন গলা কাটি কী দিয়ে? তুমি তো বৌ বলে খালাস, চুড়ির বাজনা, হাতা-খুন্তি, থালা- গেলাসের বাজনা বাজাও। কাটারি দিয়ে এত বড় জন্তুর গলা পিঠ আমি মেয়েমানুষ আলগা করতে পারি! মল্লিকা এবার অল্প হেসে হিরণের দিকে তাকায়।
প্রমথম দিদিমা খনখনে গলার কফ অতি কষ্টে সরিয়ে আস্তে আস্তে মাথা দুলিয়ে বলল, ‘কাটারি দিয়ে সুবিধা হবে না বৌ, কুড়ুল দিয়ে কচ্ছপ মহারাজের পিঠের শক্ত চারাটি খুলে ফেল।’
বুঝি কুড়ুল আনতে মল্লিকা ঘরে ঢুকেছিল, শশী গোমস্তা ফাঁক বুঝে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। চরম সময় উপস্থিত দেখে ছেলের দল, মাছির ঝাঁক ও ভোম্বল কচ্ছপটার কাছে তাড়াতাড়ি সরে গিয়ে জলের জীবটির সবুজ-হলুদে মেশানো পিঠের চমৎকার চক্রগুলো দেখেছিল।
এমন সময় কে এসে সংবাদ দিল জানা গেল না। অবশ্য দরকারও নেই তাকে জানবার খবরটাই এখানে বড়। যেমন আগুনের হলকা ছড়িয়ে দিতে দমকা হাওয়া বয়, গাছপালা ভেঙে দিতে অরণ্যে ঝড় ওঠে, ভূমিকম্পে জগৎসংসার দুলে ওঠে, তেমনি সেই ভীষণ সংবাদ শুনে মস্ত উঠোন কেঁপে উঠল, রোয়াক দরজা জানালা টিন টালি কড়িকাঠ সমেত বারো কামরার জাহাজ টলমল করতে লাগল। শোরগোল উঠল। আর্তনাদ শোনা গেল। ভয়। বিস্ময়। একটু সময়।
তারপর সমস্ত বাড়ির শোরগোল, আতঙ্ক ও কান্না একজায়গায় একটা দরজায় কেন্দ্রীভূত হয়। খবর শুনে মল্লিকা কেঁদে আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়ল, তারপর মূর্ছা গেল।
রমেশ রায়কে কেটে ফেলেছে। ক্ষিতিশের দায়ের কোপে তার দাদা রমেশের ইহলীলা শেষ। হ্যাঁ, তাদের চায়ের দোকানে। এইমাত্র। তৃপ্তিনিকেতনের মেজেয় রক্তগঙ্গা বইছে।
না, মল্লিকাকে শুশ্রূষা করতে মাছিটাও যেন আর উঠানে রইল না। সব রাস্তায়। মেহেদির বেড়া ঘেঁষে বড় কাঁঠাল গাছটার গুঁড়িতে যেখানে বাড়ির সব জঞ্জাল জমে ও কিছু বেওয়ারিশ ইট ফেলে রাখার দরুন উঁচু টিলার মতন হয়েছে তার ওপর উঠে দাঁড়ায় হিরণ, যশোদা, ময়না, ময়নার মা, প্রমথর মা, প্রমথর ছোট মাসি, পাশের বস্তির সুকুমার নন্দীর স্ত্রী এবং আরো পাঁচ-সাতটি বৌ-ঝি। গাছের নিচে সমান জায়গাটায় পেটের বেদনা নিয়ে কাতরাতে কাতরাতে গিয়ে দাঁড়ায় লক্ষ্মীমণি, কথাশ্রিত খনখনে বুড়ী, লাঠি ভর দিয়ে দু’বার আছাড় খেয়ে কোনরকমে ভুবনও গিয়ে দাঁড়াল, এমন কি যার ঘরের বার হওয়া নিষেধ, বসন্ত-রোগী বিমল হালদার বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে না গিয়ে পারল না। সকলের দৃষ্টি সামনের দিকে। ওখান থেকে দেখা যায় কি রমেশের চায়ের দোকান? বাদামতলার ওদিকটায় খোলা-ঢালা সরু রাস্তাটা একটু বেশি বেঁকে গেছে। তিন নম্বর বস্তির টিনের চালটা অতটা ঝুলে না পড়লে পরিষ্কার দেখা যেত কাফেলা গাছের ওধারে তৃপ্তি-নিকেতন। তিন মিনিটের পথ। কিন্তু সেই সাংঘাতিক জায়গায় যেতে কারো সাহস হচ্ছে না। কিছুদূর এগিয়ে বড় নর্দমার মুখের কাছে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে ছেলে-ছোকরার দল। রমেশ রায়ের ঘেয়ো কুকুরটাও সেই অবধি দাঁড়িয়ে আছে, নেজ নাড়া বন্ধ রেখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
অবশ্য ভয়টা এ বাড়ির লোকের বেশি। বারো ঘরের একজন বাসিন্দা খুন হয়েছে। রমেশের চেহারাটা সকলের চোখের সামনে ভাসছিল। এখন খুন হবার পর না-জানি লোকটার চোখ-মুখ কেমন হয়ে আছে চিন্তা করে তাদের হাত-পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে! যশোদার হাত ধরে আছে হিরণ, লক্ষ্মীমণির কাপড়ের খুঁট ধরে প্রমথদের ঘরের বুড়ী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রীতিমত কাঁপছিল। ভুবন লাঠি ভর দিয়ে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে এখন ঘাসের ওপর বসে পড়েছে। বিমলের গলার ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। একটা কথা সরছে না কারুর মুখ দিয়ে। হতভম্ব। স্থির সব।
কিন্তু তাই বলে কি আর মানুষ চায়ের দোকানের দিকে যাচ্ছে না। অন্য বাড়ির মানুষ। ভিন্ন পাড়ার মানুষ। ঊর্ধ্বশ্বাসে সব ছুটছে। কি ক’রে যে খবরটা এর মধ্যে চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে পড়ল সেটাই আশ্চর্য। এধার থেকে যেমন যাচ্ছে তেমনি খালের ওধার থেকে লোক আসছে। রমেশ রায় খুন হয়েছে। ছোট ভাই ক্ষিতীশ রমেশকে খুন করেছে। বলছিল সব। বলতে বলতে নারকেলডাঙ্গা, কাদাপাড়া, বিবিবাগান, পামারবাজার রোড, মুন্সিবাজার ওধারে পাগলাডিঙ্গি, বাঁধা-তলা, চিনাবাজার থেকে পর্যন্ত লোক আসতে লাগল কুলিয়া ট্যাংরা ‘তৃপ্তিনিকেতনে’র দিকে।
ভিড় থেকে সরে গিয়ে কাফেলা গাছের ওপাশটায়, রাত্রে যেখানে ঠেলা গাড়িগুলো জড়ো ক’রে রাখা হয়, একটা সিগারেট ধরিয়ে পাঁচু ভাদুড়ী বিধু মাস্টারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, ‘এই মাত্তর বাক্সের কারখানার সাধনের মুখে শুনলাম, ও নাকি বেলা ন’টা পর্যন্ত দোকানে ছিল। কে. গুপ্তর মেয়েটাকে দোকানে রেখে রমেশ রায় বাজার করতে বেরিয়েছিল।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাজার থেকে ফিরে আসার পরই তো এ-ব্যাপার।’ বিধু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।
‘কাল দুপুর থেকে ক্ষিতীশ দোকানে ছিল না এবং বাড়িতেও আসেনি।’
‘না। ক’দিন থেকেই খুব রাগারাগি চলছিল দাদার সঙ্গে। শুনলাম লোকের মুখে। এখন শুনছি। শালার দোকানে তো আমি পেচ্ছাব করতেও যাই না।’ বলে পাঁচু চুপ করল। বিধুও চুপ করে রইল। ভিড় দেখতে লাগল। দোকানের দরজার কাছে দু’জন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, কাজেই সেখানে পর্যন্ত কেউ যেতে পারছে না। আবার যেন গাড়ি এল। দোকানের সামনে থেকে পুলিস লোকজন হটিয়ে দিচ্ছে। হ্যাঁ, আর একটা পুলিসের গাড়ি। এবার আর শুধু লাল পাগড়ি না, সাদা টুপি, সাদা পোশাক পরা সার্জেন্ট এসে গেছে।
‘সব আসবে, সার্জেন্ট, দারোগা, ইন্সপেক্টর-একটা তাজা মানুষ খুন হয়েছে, এ কি আর–’ প্রায় দম বন্ধ করে বিধু বলল, ‘কত এনকোয়ারি কত স্টেটমেন্ট জবানবন্দী নেয়া হবে একবার দ্যাখো না।’
‘তা নিক না। তোমার আমার কি।’ যেন একটু বিরক্ত হয়ে পাঁচু ফিসফিসিয়ে বলল, ‘যেমন শালা চিটিংবাজ ছিল–আক্কেল হয়েছে, বেশ করেছে ক্ষিতীশ। একটা কাজের মত কাজ করেছে!’
‘কিন্তু লোককে চিট্ করতো বলে তো আর ক্ষিতীশ ভাইকে খুন করেনি। কারণটা যে গুরুতর।’
ভিন্ন পাড়ার লোক এসে হঠাৎ পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল ব’লে পাঁচু কথা বলল না। বললেও অবশ্য ক্ষতি ছিল না। কেননা, এর মধ্যে সবাই জেনে গেছে। কি ক’রে এর মধ্যেই এত সব জানাজানি হয়ে গেল তা দিয়ে দরকার নেই। রমেশের গলায় ক্ষিতীশ কেন দা বসায় সেটাই বড় কথা। হ্যাঁ, খুনের কারণ। বাজার সেরে রমেশ যখন দোকানে ঢোকে তখন দোকানে খদ্দের কেউ ছিল না। একটু অবসর বুঝেই পর্দার ওদিকটায় বসে বেবি এক কাপ চা তৈরি করে খাচ্ছিল। রমেশ সরাসরি সেখানে চলে যায়। বাজার থেকে ফেরার পর রমেশকে খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। যেন কোথায় সে কি শুনে এসেছে। দোকানে ঢুকেই সে চোখ লাল করে বেবিকে নানারকম জেরা করতে আরম্ভ করে। তারপর মেয়েটার গায়ে হাত দেয়। এমন সময় পাগলের মত কোথা থেকে ছুটে এসে দোকানে ঢুকে ক্ষিতীশ পিছন থেকে এক কোপে রমেশের গলা আলগা করে দেয়। না, ক্ষিতীশ পালিয়ে যায়নি! সেই রক্তমাখা দা হাতে করে সে তৎক্ষণাৎ থানায় চলে গেছে। খুন দেখে ভয়ে চিৎকার করতে করতে বেবি দোকান থেকে বেরিয়ে সামনের কারখানায় গিয়ে ঢুকেছিল।
‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না।’ ভিন্ন পাড়ার লোকটা সরে যেতে বিধু বলল, ‘রমেশটা যে তলে তলে কে. গুপ্তর মেয়েটার সঙ্গে এসব মতলবে ছিল মাঝে মাঝে আমার ডাউট হত। কেননা, ইদানীং ও একটু বেশি সময় দোকানে থাকত, তুমি কি লক্ষ্য করনি পাঁচু?’
‘বেশ হয়েছে। হারামজাদার খুব বাড় হয়েছিল।’ সিগারেটের টুকরোটায় শেষ টান দিয়ে পাঁচু সেটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ‘আরে আমরা শালা ওপেনলি বেশ্যাপাড়ায় যাই। কিন্তু এ যে,–শুনলাম ক্ষিতীশ নাকি থানায় গিয়ে বড় দারোগাকে তাই বলেছে। পাশবিক অত্যাচার করতে চেয়েছিল রমেশ কে. গুপ্তর নাবালিকা মেয়ের ওপর। তাই তাকে সংসার থেকে সরিয়ে দিল।’
‘গড। বুঝলে পাঁচু। মাথার ওপর একজন আছে, সে সব অন্যায়ের বিচার করে সব পাপের শাস্তিবিধান করে। আমরা তো আর এটা সব সময় মনে রাখি না। বেবিকেও কি অ্যারেস্ট করা রয়েছে? শুনলাম কে যেন বলল?’
মাথা নেড়ে পাঁচু বলল, ‘জানি না।’
মিনমিনে গলায় বিধু বলল, ‘ওর স্টেটমেন্টের ওপর এখন অনেক কিছু নির্ভর করছে। ক্ষিতীশ থানায় গিয়ে সারেন্ডার করেছে যদিও। এটা–’ কথা বন্ধ হ’ল। ভিন্ন পাড়ার মানুষ পিছনে।
আর একটু দূরে, যেখানে খোয়াঢালা রাস্তাটা একটা পড়ো জমির গা ঘেঁষে সোজা বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে, করিগাছের নিচে দেখা গেল পারিজাতের চকচকে সবুজ গাড়িটা দাঁড়িয়ে। পারিজাত ভিতরে বসে কথা বলছে। গাড়ির দরজার সামনে বারো ঘরের দু’জনকে দেখা গেল। বলাই ও শিবনাথ।
সেখান থেকে রমেশ রায়ের চায়ের দোকানের দরজা দেখা যাচ্ছে।
শিবনাথ একটু সময় সেদিকে চোখ রেখে পরে ঘাড় ফিরিয়ে পারিজাতের দিকে তাকায়।
‘ডেড-বডি কি এখনি মর্গে নিয়ে যাবে?’
‘দেরি হবে।’ পারিজাত শিবনাথের দিকে তাকায় না। জানালার বাইরে রৌদ্রখচিত আকাশের দিকে চোখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে বলল, ‘অনেকের স্টেটমেন্ট নিতে হচ্ছে, এখন আবার একটা পুলিসের গাড়ি এল না?’
বলাই মাথা নাড়ল।
‘পুলিস কারখানায় ঢুকেছে। শুনলাম ওখানে দারোয়ান ম্যানেজার সবাইকে কি সব জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
‘তা তো করবেই।’ পারিজাত এবার শিবনাথের দিকে তাকাল। ‘বাড়িতেও যাবে, মানে আমি আট নম্বর বস্তির কথা বলছি।’
‘আমাদের কারোর কোনরকম স্টেটমেন্ট নেবে কি?’ চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল শিবনাথকে।
‘না।’ পারিজাত মৃদু হাসল। ‘মনে তো হয় না’–সম্ভবত বাড়িতে রমেশ রায়ের ওয়াইফের স্টেটমেন্ট নেবে।’
‘বেবি যখন এর মধ্যে আছে কে. গুপ্তর পরিবারকেও তো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, কি বলেন স্যার?’
পারিজাত বলাইর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। ‘তা পারে।’
শিবনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘রমেশ রায়ের মুখটা চোখের ওপর ভাসছে।’
পারিজাতও একটা নিশ্বাস ফেলল।
‘ব্রাইট কেরিয়ার ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য এটা-ওটা সবই সুন্দর বুঝত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এমন একটা ন্যাস্টি ব্যাপারে–কষ্ট হয়!’ কথা শেষ করে পারিজাত আবার আকাশ দেখে।
‘আপনার কাজকর্মের খুব ক্ষতি হ’ল?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল। একবার চোখ বুজে কি যেন একটা চিন্তা করল পারিজাত, তারপর শিবনাথের চোখে চোখ রেখে গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, ‘খুব বেশি না। ইলেকশন সম্পর্কে বলছেন তো। ও অবশ্য নিজে থেকেই খাটছিল। বাবার সময়ও খুব খেটেছিল। না এসব ব্যাপারে সব সময় তার হেল্গ পেয়েছি, পাচ্ছিলাম আমরা। ধাপার বাজার টেংরার ওদিকটায় বেশ ইনফ্লুয়েন্স ছিল রমেশের। তা অ্যাক্সিডেন্ট তো আছেই, করা কি’–থেমে চোখ বুজে আবার একটু কি ভেবে নিয়ে পরে পারিজাত শিবনাথ এবং বলাই দু’জনের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে স্বচ্ছ গলায় হাসল। ‘এখন আপনাদের হেপ্ নেব। আপনাকে বলাইচরণকে পেয়ে গেছি যখন আমি, চিন্তা করি না।’
শিবনাথ এবং বলাই দু’জনের চেহারাই উজ্জ্বল হয়। বলাই মাথা নেড়ে বলল, ‘লোকটার সব ভাল ছিল, ওই একটু চরিত্তির দোষে সব গেল। কে. গুপ্তর ডব্কা মেয়েটা যেদিন চায়ের দোকানে ঢুকেছিল, সেদিনই আমি মনে মনে বলছিলাম এর ইহ-পরিণাম অতি সাংঘাতিক।’
বলাইর বাঙলা শব্দ-প্রয়োগ শুনে শিবনাথের হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু সামলে নিল।
অল্প হেসে পারিজাত বলল, ‘তোমাকে কিন্তু রমেশ যথেষ্ট সাহায্য করত।’
‘তা করত, তা কিছুটা করেছে, আমি অস্বীকার করব না স্যার। রমেশ এখন পরলোকগামী, তার নিন্দা করা পাপ। কিন্তু ক্ষিতীশ হালে বেবিটাকে নিয়ে দাদার সঙ্গে এমন খিটিমিটি করত, পরশু থেকে তো ও একরকম দোকান ছাড়া, ভাগের টাকা পয়সা দিয়ে দাও আমি ডিগবয় চলে যাই, কেবল এই বুলি। তা আমি রমেশকে বলছিলাম ওই হারামজাদী ছুঁড়িটাকে বিদায় কর দোকান থেকে। গণ্ডগোলের মূলে তিনি। ওই পাপ দোকানে না থাকলে কি আজ রমেশের এমন অপমৃত্যু হত, কি বলেন শিবনাথবাবু?’
গম্ভীরভাবে শিবনাথ মাথা নাড়ল।
‘আরো গণ্ডগোল হবে, আমি বলছি। সমর্থ কন্যা তো আমারও আছে। আমি কি মেয়েকে ছাড়া-ছাগল গাইয়ের মত বাড়ির বাইরে ছেড়ে দিই! বেবিটা কোথায় না যায়। রাতবেরাতে বাজারে-দোকানে মাঠে-ঘাটে ঘুরছে আমি দেখি। মেয়ে জাত, তার ওপর সর্বনাশা বয়েস। ও এ-তল্লাটে থাকলে আরো আগুন লাগবে। ভাই ভাইকে কেটেছে, ছেলে বাপকে কাটবে, আপনারা দেখুন না। আমি বলছিলাম কি স্যার–’ বলাই উত্তেজিত চাপা গলায় পারিজাতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই পাপ বাড়ি থেকে কালই তুলে দিন। বাপ তো রাস্তার পাগল, ঘরে থাকে না। কে. গুপ্তর পরিবারকে আপনি সরকার মশাইকে দিয়ে একবার ভাল করে বলান। শুনেছি তিনির ভাই আলিপুরের হাকিম। বুঝিয়ে বললে চলে যাবে।’
‘কোথায় আর যাচ্ছে, অনেক বলা হয়েছে, সবাই ভদ্রলোক, জোরজুলুম করতেও কেমন লাগে।’ পারিজাত গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পরে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমিও এ-বাড়ি সম্পর্কে প্ল্যান ঠিক করে ফেলেছি। এমনিও তো তিন-চার ঘর চলে গেছে। রমেশের ফ্যামিলিও এর পর নিশ্চয় আর থাকছে না। কাল বনমালীর কাছে ইনফরমেশন পেলাম ভুবনের মেয়েরাও নাকি শহরে ঘর খোঁজাখুঁজি করছে। সরকারকে আমার বলা আছে, নতুন ভাড়াটে কেউ আট নম্বর বস্তিতে এসে উঠতে চাইলে যেন না করে দেয়। ঘর খালি নেই।’
শিবনাথ অল্প হাসল।
‘আমি তাই লক্ষ্য করছি। নার্স চলে গেল, অমল চলে গেল, ডাক্তার উঠে গেল, অথচ আর ভাড়াটে আসছে না। মদন ঘোষ সব কটা ঘরে তালা ঝুলিয়ে দিচ্ছে।’
‘তাই।’ পারিজাত বলল, ‘আরো দু’চার ঘর উঠে যাবে ঠিকই।’ আপনারা দু’চার জন যাঁরা থাকবেন তাদের জন্য টেম্পোরারী একটা ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি ওখানে পাকা বাড়ি তুলব। একটা দুটো করে আমার সব কটা বস্তি সম্পর্কে এই প্ল্যান করা আছে। কেন, আপনাকে কাল আমি কিছুটা আইডিয়া তো দিয়েছি শিবনাথবাবু?’
শিবনাথ মাথা নাড়ল।
বলাইর চেহারা হাসি-হাসি হয়ে গেল। ‘খুব ভাল হয় স্যার। আমার স্ত্রী তো পরশু থেকে এমন বায়না ধরেছে। পাকা বাড়ি দেখ, পাকা বাড়ি খোঁজ। আমি অবশ্য বলছি রায় সাহেব কি পারিজাতবাবু এখানে বস্তি রাখবে না। ভাড়া দিতে পারে না অনেকেই, খামকা লোকসান। লাভ নেই বাণিজ্যের চেঁচামেচি সার। মিছা বললাম?’
পারিজাত বলাইর দিকে চেয়ে ঠোঁট টিপে হাসল এবং সমর্থনের ভঙ্গিতে ঘাড়টা ঈষৎ কাত করল। পারিজাত কেন হাসছে শিবনাথের বুঝতে কষ্ট হয় না। বলতে কি, একটু ঈর্ষার দৃষ্টিতেই সে বলাইর গায়ে নতুন সিল্কের জামাটার দিকে আড়চোখে তাকাল। যেন কাল রাত্রে জামাটা তৈরী করিয়ে এনেছে। কি আজ সকালেও হতে পারে। পারিজাত বলল, ‘যাকগে, আপনাদের দু চারটা ফ্যামিলিকে একটা সুবিধামতন জায়গায় সিফট্ করিয়ে টিনের বাড়ি আমি খুব শিগগির ডিমোলিশ করে দিচ্ছি।’
‘তাই করুন।’ আমারও মনে হয় এসব বস্তি না রাখা ভাল। যত সব আনডিজায়ারেল এলিমেন্ট এসে বাসা বাঁধছিল। জায়গাটার ইমপ্রুভমেন্টের জন্যে ওই যে বলাই বলছিল, এসব পাপ তুলে দেওয়া উচিত।’ শিবনাথ একটু টেনে হাসল।
‘বিধু মাস্টারটার চুল, চেহারা, কাপড়-চোপড়ের যা জঘন্য অবস্থা হয়েছে, আমার তো ওকে দেখলেই মাথা ঝিম্ঝিম্ করে। আমার স্ত্রী কাল রাত্রে বলছিল, বারো ঘরের বাড়িতে যদি এ বৎসর ব্যাধিট্যাধি লাগে তো ওই পরিবারটার জন্যেই লাগবে। মাস্টারের মেজ ছেলেটা, কি যেন নাম শিববাবু, হুলা। কাল ধাপার বাজারে মেছুনিরা কুঁচো চিংড়ির ডালা থেকে এইটুকুন এইটুকুন কাঁকড়া বেছে ফেলছিল। পচা ভুশভুশে গন্ধ ছাড়ছিল। কাকগুলো পর্যন্ত ছোঁয়নি। হারামজাদা দিব্যি সব ক’টা তুলে নিয়ে এল। পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে রাত্রে কলাই সিদ্ধর সঙ্গে চালিয়েছে। কলেরা হবে না কেন আপনি বলুন স্যার।’
পারিজাত মৃদু হাসল। ‘মরুক গে। কলেরা ভ্যাকসিন নিয়ে ফেল। আপনি নিয়েছেন তো? শিবনাথ ঘাড় কাত করল। ‘আমি এসব বিষয়ে অত্যন্ত পাট্টিকুলার। অনেক দিন আগেই কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে নিজে গরজ করে ওয়াইফ এবং মেয়েটা সহ ওই কাজটা সেরে এসেছি। সাবধানের মার নেই।’
‘একজ্যাক্টলি সো।’ পারিজাত স্টিয়ারিং-এ হাত রাখল। রমেশের দোকানের ওদিকটায় চোখ বুলিয়ে ছোট্ট হাই তুলে বলল, ‘যাকগে, আপনারা রেডি হন। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই প্রিলিমিনারী মিটিংটা ডাকছি। সন্তোষ ওরা কালকের কথা বলছিল। আমি একদিন সময় চেয়েছি। কিন্তু ইনভিটেশন কার্ড ছাপানো দরকার। আমার হলঘরটা একটু পরিষ্কার করতে হয়। সরকার মশায়কে অবশ্য বলে রেখেছি,–আর হ্যাঁ, পারিজাত বলাইর চোখের দিকে তাকাল। ‘পরশুর ফাংশনে তোমার ময়নাকে কিন্তু গান গাইতে হবে। ও তো আগে সুন্দর গানটান গাইত দীপ্তির সমিতিতে যখন আসতো, চর্চা রেখেছে কি?’
চোখমুখ উজ্জ্বল ক’রে বলাই বলল, ‘দেখি বলে। কটা মাস তো আমি আর ওদিকটায় নজর দিতে পারছিলাম না স্যার। এবার ভেবেছি একটা হার্মোনিয়াম কিনে দেব।’
‘গুড। অস্ফুট উচ্চারণ করে পারিজাত গাড়িটাকে একবার একটু পিছনের দিকে নিয়ে তারপর মোচড় দিয়ে বাঁ-দিকে ঘুরিয়ে সুপারী ও জলপাই গাছের নিচে দিয়ে সরু রাস্তাটা ধরে সোজা বাংলোর দিকে ছুটল। বলাই ও শিবনাথ ফ্যালফ্যাল করে কতক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল।
কিন্তু বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা হয় না।
তাদের পিছনে রাস্তা ধরে দু’টি লোক রমেশ সম্পর্কে আলোচনা করতে করতে ফিরে যাচ্ছে।
‘এক রমেশ গেছে, আর এক রমেশ গজিয়েছে।’ লম্বা লোকটি এক গাল হেসে বেঁটে লোকটিকে বলছিল, ‘এ তল্লাটে রমেশদের অভাব হয় না।’ বেঁটে লোকটি মাথা নাড়ে। তারপর দু’জনে বলাই ও শিবনাথের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে একসঙ্গে নাকের অনুচ্চ শব্দ ক’রে উঠে দ্রুত পায়ে বড়রাস্তার দিকে সরে গেল।
শিবনাথ বলাইর দিকে তাকায়।
‘কার কথা বলছে, কিছু বোঝা গেল?’
‘কি ক’রে বলি বলুন।’ বলাই, যেন শিবনাথের কথা উপেক্ষা করতেই ক্যাপস্টানের প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁট গুঁজল। ‘পেটের ধান্দায় চোরাবাজারে নামলাম, আবার ওদিকে জমিদারের ছেলের সঙ্গে বড় বড় বিষয় নিয়ে দহরম-মহরম করছি। এই তো দাঁড়িয়ে পারিজাতের সঙ্গে হাজারটা কাজের কথা বললাম। খুন দেখতে এসে তাই দেখে গেল ওরা, আর অমনি আমাকে রমেশ বলে ঠাট্টা করে গেল আর কি।’
লোকটার নির্লজ্জ উক্তি শুনে শিবনাথ রাগ করবে কি খুশি হবে ঠিক করতে না পেরে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
একগাল ধোঁয়া ছেড়ে একটা চোখ বোজা রেখে বলাই বলে, ‘অথবা আপনিও হ’তে পারেন কর্তা। রমেশ,–হি-হি।’বলাই হাসল। ‘পারিজাতের হয়ে ওর ভোটের যুদ্ধে খাটবেন আর মুঠ মুঠ টাকা পকেটে ঢোকাবেন। ওরা টের পেয়ে গেছে আর কি। তাই খোঁচাটা আপনাকেই দিয়ে গেল। রমেশও নানারকম সুবিধা আদায় করতে পারিজাতের ভোটাভুটির ব্যাপারে খাটতে শুরু করেছিল।’
‘মূর্খ মূর্খ!’ শিবনাথ রাগে মনে মনে হিহিস্ করে উঠল। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। রক্তাভ চেহারা। ‘কি ব্যাপার নিয়ে আমি,–আমাকে পারিজাতের সঙ্গে একটু গভীরভাবে মেলামেশা করতে হচ্ছে জানলে, অথবা জানতে পারার মত ব্রেইন থাকলে ঈশ্বর তোমাকে বলাইচরণ ক’রে পাঠাত না। তাহলে আমার মত তোমাকেও গ্র্যাজুয়েট ক’রে পাঠাত!’ নতুন সিল্কের পাঞ্জাবি গায়ে ওঠা সত্ত্বেও যে কতখানি ‘ফেরিওয়াল, ফেরিওয়ালা’ দেখাচ্ছিল ওকে বুঝিয়ে বলতে পারলে শিবনাথের ভাল লাগত। চিন্তা ক’রে দাঁতে দাঁত চেপে কোনোমতে রাগ সংবরণ করে আর বলাইর দিকে না তাকিয়ে শিবনাথ বিপরীত দিকে হাঁটতে লাগল। ‘সুবিধা আদায়ের জন্যে আমি পারিজাতের সঙ্গে একটু বেশি ভিড়েছি বলে তোমার চোখ টাটাচ্ছে বেশ বুঝতে পারছি। তাতে আমি গ্রাহ্য করি না। হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো সুবিধাই আদায় করতে পারব না। হয়তো আলেয়ার পেছনে ঘুরে পায়ের চামড়া ক্ষয় করছি। হাতে পায়ে ধরে কোনরকমে রুচিকে যেমন দীপালী সংঘের সেক্রেটারীর ‘অনারারী’ পোস্টটা নিতে ও একটু কাজটাজ করতে প্রায় রাজী করিয়ে এনেছি নিতান্ত সংস্কৃতির নামে, তেমনি ভদ্রতা,–সৌজন্যতার খাতিরে বলা যায়, আমাকেও পারিজাতের ইলেকশনের জন্যে খাটতে হবে, হয়তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারব না, এবং চাওয়া হলো না বলে একটি আধলাও পকেটে আসবে না। কিন্তু তা হলেও আমার,–আমার মেয়ে মঞ্জু ষোল বছর বয়সে পা দিয়ে বর্ণবোধ বগলে নিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে যাবে না। ইডিয়েট।’
বস্তুত মনে মনে শিবনাথ বলাইকে যে কতটা ঘৃণা ও অনুকম্পা করল, তা সে ছোট ভাইয়ের হাতে রমেশের খুন হওয়ার কারণটি জানার পরও বুঝি রমেশ রায়কে মনে মনে এতখানি ঘৃণা ও অনুকম্পা করছিল না। তুলনাটা শিবনাথই চিন্তা ক’রে বার করল। বলাই যদি টাকার গরমে হাতে এখন থেকে ‘গোল্ড-ফ্লেকের’ টিন নিয়েও হাঁটে তাতে শিবনাথ চঞ্চল হবে না। কেননা এক জায়গায় তাকে মাথা হেঁট করতেই হবে। করতে হয়েছে। মেয়ের লেখাপড়ার আর্জি নিয়ে বলাইকে রুচির সাহায্য ও দয়া ভিক্ষা করতে হয়েছিল শিবনাথের স্ত্রীর। শিবনাথের এখানেই জিত। ‘রাতারাতি বড় হলেও তুই আমার চেয়ে বড় হবি না।’ শিবনাথ মনে মনে বলল। না, শিবনাথের আশঙ্কা অমূলক। মুখ ফুটে তাকে কিছু চাইতে হয়নি।
বস্তুত পারিজাত যে কতখানি ভদ্র, সুবিবেচক ও সরল সেদিন সন্ধ্যায় শিবনাথ আরো বেশি টের পেল। হ্যাঁ, পারিজাতের এই সুন্দর ড্রয়িংরুমে ব’সে।
কালকের ছোট ল্যাম্প না। সবুজ ডোমের পরিবর্তে গোলাপী ঢাকনা পরানো একটা বড় বাতি টেবিলে জ্বলছিল। ফুলদানীতে মোটা করে গুঁজে দেওয়া হয়েছে রজনীগন্ধার ঝাড়। ধূপকাঠি জ্বলছে।
হ্যাঁ, আজ প্রাথমিক পরিচয়। সোজাসুজি আলাপ হয়ে গেল পারিজাতের সঙ্গে রুচির। একলা পারিজাত না। সেই পার্কসার্কাসের সন্তোষ এবং তার বন্ধুদের সঙ্গেও। আর বৃদ্ধ ডক্টর নাগের সঙ্গে। এঁরা কালকের কথাটা পাকা করতে এবং রুচির সঙ্গে পরিচিত হ’তে দুপুরের পর থেকেই পারিজাতের বাংলোয় এসে অপেক্ষা করছেন।
রুচি ও শিবনাথের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রুচি স্কুল থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত শিবনাথ (রমেশের খুনের পর তার দুপুরবেলা একলা বাড়িতে থাকতে ইচ্ছা হয় না) কিছুক্ষণ বনমালীর দোকানে এবং অধিকাংশ সময়টা ওদিকে বড় রাস্তায় কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে বসে কাটিয়ে একটু আগে রুচিকে সঙ্গে নিয়ে এখানে এসেছে। সেক্রেটারিশিপ না নিক, কয়েকজন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হয়ে থাকতে দোষ কি। শিবনাথ এখানে আসার সময় রাস্তায় রুচিকে বুঝিয়েছিল এবং আজ সারাদিন স্কুলে চিন্তা করে ও কিছু ঠিক করতে পেরেছে কি না খুব ব্যস্ত হয়ে শিবনাথ রুচিকে প্রশ্ন করতে রুচি আর বাড়ি ফিরে যায় নি। শিবনাথের সঙ্গে বড় রাস্তার মোড়ে তার দেখা হয়। সেখান থেকেই মঞ্জুর হাত ধরে সে শিবনাথের পিছে পিছে পারিজাতের সাজানো বৈঠকখানায় চলে আসে। তা ছাড়া বাড়ির একটা লোক খুন হয়েছে পর থেকে তারও কেমন ভয় ভয় করছিল। আজ স্কুল থেকে বেরিয়ে শিয়ালদায় বাসে ওঠার পর কুলিয়া-টেংরার সেই বস্তিটাই নানারকম বীভৎস চেহারা নিয়ে রুচির চোখের সামনে ভাসছিল। তাই যতক্ষণ পারা যায় সেই বাড়িতে না ঢুকে বরং কালকের সন্তোষ ও তার বন্ধুদের এবং শিবনাথের উপাস্য দেবতা পারিজাতের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগটাই সে চট্ ক’রে গ্রহণ করল। বাধ্য হ’ল গ্রহণ করতে। এবং কিছুক্ষণ এখানে কাটাবার পর রুচি বুঝতে পারল এখানকার পরিবেশ কত শান্ত, মার্জিত, উন্নত এবং–সুরক্ষিত।
কেবল পরিচয় না, সকলেই এমন অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কথা বলল যে তাকে অভিভূত হয়ে যেতে হল। সবচেয়ে বেশি অভিভূত হ’ল সরল উদার আনন্দময় ছেলেমানুষের মত ডক্টর নাগের ব্যবহারে। মঞ্জুকে কোলে বসিয়ে তিনি পর পর তিন-চারটি ছানার সন্দেশ খাওয়ালেন। কথা বললেন ওর সঙ্গে হাজারটা। আজ বাড়িতে কি খেয়ে এসেছে, বাবা বেশি ভালবাসেন কি মা, খরগোস দেখতে সুন্দর কি হরিণ, আলিপুর চিড়িয়াখানায় যে নতুন এক ঝাঁক পাখি এসেছে মঞ্জু কি দেখে না ইত্যাদি।
আর মঞ্জুকে নিয়ে কাড়াকাড়ি করল সন্তোষ ও তার বন্ধুরা। একজন এতবড় একটা গোলাপের তোড়া গুঁজে দিল ওর হাতে। একজন দিল এতবড় একটা পুতুল। প্লাস্টিক? দু’টাকা আড়াই টাকা দাম হবে (যদি রবারের হয়) রুচি অনুমান করল। এতবড় পুতুল মঞ্জুকে সে কোনদিন কিনে দিতে পেরেছে মনে করতে পারল না।
আর মুগ্ধ হ’ল রুচি পারিজাতরে ব্যবহারে। বস্তুত শিবনাথের মুখে শুনে রুচি যে লোকটির অর্ধেকও পরিচয় পায়নি, এখন পারিজাতের মুখোমুখি হয়ে ব’সে তার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলার পরই রুচি টের পেল। টের পেল পারিজাত অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং ভদ্র। শিবনাথের সঙ্গে পারিজাত কাজের কথা বলছিল। চায়ের পর সন্তোষের এক বন্ধু, আর্টিস্ট হঠাৎ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একটা কাগজ ও পেন্সিল হাতে ক’রে রুচির থেকে তিনচার হাত দুরে সরে গিয়ে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দু’মিনিটে রুচির প্রফাইলটা এঁকে ফেলল। আঁকা হয়ে যেতে সন্তোষ আর আর অন্য বন্ধুরা কাগজটা আর্টিস্টের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্কেচ দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘ব্রিলিয়্যান্ট’।
‘এঞ্জেল।’ আর্টিস্ট বলল, ‘এ ছাড়া এই মুখের অন্য কোন ডেফিনিশান নেই।
‘দেবী।’ সন্তোষ বলল, ‘এই কল্যাণীকে আমাদের মধ্যে পেলে আমরা পৃথিবী জয় করতে পারব, কি বলিস জীবন?’
জীবন মাথা নাড়ল। অসিত মাথা নাড়ল। ‘অদ্ভুত, সুন্দর।’
রুচির ছবি হাতে নিয়ে এত আস্তে তারা তার সমালোচনা করছিল যে পারিজাত, শিবনাথ বা ডক্টর নাগ কিন্তু টের পেলেন না। রুচি ঠিক টের না পেলেও একটা কিছু অনুভব করল। শিবনাথ ইলেকশনের ব্যাপারে পারিজাতের সঙ্গে কথা বলছিল। পারিজাত বোঝাচ্ছিল, শহর ও শহরতলিতে তার যেসব বন্ধু আছেন, তাঁদের কার সঙ্গে কবে শিবনাথ দেখা করবে, প্রেসে দু’টো খবর পাঠাতে হবে, রিপোর্ট কি ক’রে লিখতে হবে, একটা প্যাম্ফ্লেট ছাপতে শিবনাথকে কোন্ দোকানে কাগজ কিনে কোন্ প্রেসে দিতে হবে ইত্যাদি।
যেন সে-সব কথাই বুঝি বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। পারিজাতের সঙ্গে তার দুবার চোখাচোখি হয়। শেষবার সুন্দর হেসে পারিজাত বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই ধৈর্যহারা হচ্ছেন মিসেস দত্ত। বড্ড বেশি নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করছি, নিজের কথা বলছি। এইবেলা আপনার সমিতির প্রসঙ্গে চলে আসব। কই হে সন্তোষ, তোমার এঁর সঙ্গে কথা বলো। আমি এঁর সঙ্গে কথাটা সেরে নিই।
সন্তোষ ও তার বন্ধুরা দেয়ালের ধার থেকে সরে আসতে রুচি উঠে দাঁড়ায়। কেননা পারিজাত তখন শিবনাথের শহর ও শহরতলিতে ঘোরাঘুরি, ট্রাম-বাস ও দরকার হলে ট্যাক্সি রিক্সা ভাড়া বাবদ বেশ একটা মোটা অঙ্ক ধরে এক টুকরো সাদা কাগজে রাহাখরচের টোটেল ধরছিল চেক্ বই সামনে রেখে। অঙ্কটা এখনো বসানো হয়নি। শিবনাথ শ্যেনদৃষ্টিতে পারিজাতের কলমের ডগাটা লক্ষ্য করছিল। এ-অবস্থায় বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকা অশোভন চিন্তা করে রুচি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়। মঞ্জুর হাত ধরে সন্তোষ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়ে বারান্দায় এবং ওপরে পারিজাতের সুন্দর ফুলবাগানে নেমে এল। ফিকে জ্যোৎস্না।
বেল ও হাহানার গন্ধে জায়গাটা ভুরভুর করছিল। রুমাল বিছিয়ে সবাই ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে গোল হয়ে বসল। ছেলেদের মত পা না ছড়িয়ে একটু ভেঙে ঈষৎ বাঁকা হয়ে বসে রুচি কথা বলতে লাগল। গল্প করতে লাগল।
‘আমরা আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, এমন এঞ্জেলের মত যিনি দেখতে তিনি কেন পারিজাতবাবুর টিনের শেড-এর তলায় এসে মাথা গুঁজবেন। নিশ্চয় এর অন্য কারণ আছে। নিতান্তই অভাব না। কোনো মহোত্তর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য ঈশ্বর আপনাকে এখানে টেনে এনেছেন আমরা বলব।’
সন্তেষের সুন্দর কথাগুলি শুনে রুচি হাসল।
শিবনাথের চাকরি নেই, কি রুচি কম বেতনে একটা ছোট্ট স্কুলে মাস্টারী করে এই যুক্তি তারা, সন্তোষ ও তার বন্ধুরা গ্রহণ করত না। তারা সেই লাইনেই কথা বলছে না।
‘আমরা জানি যে, আপনার মত এমনি সব উচ্চশিক্ষিতা এবং বেশ উঁচু উঁচু ঘরের মেয়েরাও আজকাল অফিসেই বেশি চাকরি করছে, আর্টিস্টের স্টুডিওতে গিয়ে বসছে এবং দরকার হলে সিনেমায় নামছে। তাদের চোখে পয়সাটাই বড়। মহৎ উদ্দেশ্য বলতে কিছু নেই!’
আমি কি আদর্শ রক্ষা করতে এখানে কাঁচা বস্তিতে বাস করছি, তোমরা বলছ?’ অল্প হেসে রুচি প্রশ্ন করল। ‘কি দেখে তা বুঝলে, আমার কি দেখে তোমরা তা বিচার করছ?’
‘অপনার ক্ষমাসুন্দর এক জোড়া চোখ, বুদ্ধিউজ্জ্বল কপাল, শান্ত ভ্রুযুগল ও প্রতিভামণ্ডিত নাক। সবাই তা দেখছে কিনা রুচিদি জানি না। কিন্তু আমার মনে হয়েছে,– ইচ্ছা করে এই টিচারী করা, আর কষ্ট ক’রে বস্তিতে থাকার মধ্যে একটা ভীষণ মমতাবোধ, একটা ভয়ঙ্কর দরদ, অসীম ভালবাসা অর্থাৎ প্রেম আপনি আপনার ওই নরম বুকে লুকিয়ে রেখেছেন। যাকে বলা যায় সত্যিকারের নারীহৃদয়।’
সাহিত্যিকের ভাষা শুনে রুচি মুগ্ধ হল।
‘না দেখুন, টাকা আনা পাই দিয়ে জীবনকে বিচার করা যায় না। করা চলে না। আমি করি না। টু স্পীক দি টুথ। একটু সময় কথা ব’লে দু’একবার দেখেই বুঝেছি আপনার চেয়ে শিবনাথবাবু একটু বেশি প্র্যাকটিক্যাল, মনি মাইন্ডেড বলা চলে, সাদা কথায় বলতে গেলে কবিতার একটা লাইন শোনার চেয়ে লোহা কি সিমেন্টের দর কত আগে তো জেনে নিতে তাঁর উৎসাহ বেশি।’ কথা শেষ করে সন্তোষ হাসল।
অন্ধকারে বোঝা গেল না। কিন্তু রুচির মুখ আরক্ত হ’ল। ‘হ্যাঁ, না, ইলেকশনের ব্যাপার নিয়ে পারিজাতবাবুর সঙ্গে ওকে প্রায় সবটা সময়ই কাজের কথা বলতে হয়েছে।’
‘হ্যাঁ না।’ সন্তোষও নিজেকে সংশোধন করল। ‘একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে কেবল কবিতা আর লোহা সিমেন্টের কথা বললাম। আমার মনে হয়েছে। হয়তো শিবনাথবাবু ততটা-না-ও। কিন্তু তুলনা করলে, আপনাদের দু’জনের মধ্যে আমার তো মনে হয় আপনি আইডিয়ার পূজারিণী। তখন একটা কথা থেকে আমি টের পেলাম। সমিতি সম্পর্কে আপনি খুব বেশি কথা তো আর বলেন নি। পারিজাতবাবুকে যখন বললেন যে, রুণু মারা গেলে তার নামেই সমিতির নামকরণ করা হবে এবং এই শর্তেই শুধু আপনি সেক্রেটারিশিপ নিতে পারেন, শুনে আমরা অভিভূত হয়ে গেছি। এ দ্বারা আমরা কি বুঝলাম, কি দেখলাম? দেখলাম আপনার মন, হৃদয়। বস্তির একটা সাধারণ ছেলে সম্পর্কেও যে আপনি কী ভীষণ ফীল্ করছেন তা।’
রুচি চুপ করে রইল।
‘সেকথাই বলছিলাম, ভাবছিলাম।’ সন্তোষ আবার বলল, ‘সিনেমায় যাঁরা নামছেন, কি আর্টিস্টের মডেল হচ্ছেন, তাঁরা যে সকলেই সমাজের শ্রদ্ধা হারিয়েছেন তা না, বেশ সম্মানের সঙ্গে আছেন এমন মেয়ের সংখ্যাও কম না। ইচ্ছা করলে আপনি সেই সুখ, তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য অনায়াসে ভোগ করতে পারতেন কিন্তু–’
‘ওরে বাপ, সিনেমায় নামব, আর্টিস্টের মডেল হব, সেই চেহারা আমার কোথায়?’ সন্তোষের কথা শুনে রুচি ছোট্ট ক’রে হাসল। ‘আদর্শ-টাদর্শ কিছু না। অন্য কোন রাস্তা খোলা নেই আর কোথাও সুবিধা হবে না, তাই স্কুলটিচার।’
‘তা আপনি বলতে পারেন, এটা আপনার মনগড়া কথা। কিন্তু চোখ দেখলে বোঝা যায়, আমি সেদিন প্রথম শেয়ালদায় আপনার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিলাম আপনি কি, আপনি কে।’ একটু থেমে সন্তোষ বলল ‘চেহারার কথা বলছেন। পর্দার কোন্ চেহারাটি দেখতে কত ভাল আর এক একটি মডেলের সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ড অর্থাৎ মান কি দিয়ে আজ বিচার করা হচ্ছে, তা আমরা জানি, জানা হয়ে গেছে।’ সন্তোষ নাকের অল্প শব্দ করল। ‘দে ওয়ান্ট সেক্স এন্ড সেক্স এন্ড সেক্স চেহারা যত বেশী ভলাপট্যুয়াস হবে, চোখে যার যত বেশি প্যাশন জেগে থাকবে, লাস্টি ফীগার হবে, সেই মেয়ে তত বেশি সুন্দর, সেই মুখের সেই শরীরের তত জয়জয়কার। কিন্তু আমরা তো তা চাই না। আমরা সুন্দরকে যেমন চাই তেমনি চাই কল্যাণকে, শ্রীকে, তাই বলছিলাম আমাদের চাওয়া, আমাদের স্বপ্ন আমাদের ইচ্ছা আপনার মধ্যে পূর্ণতা লাভ করবে। এর বেশি আজ কিছু বলতে পারছি না।’ আপনাকে সমিতির মধ্যে পেয়ে আমরা যে কতটা ইন্সপিরেশান পাচ্ছি তা ভাষায় বর্ণনা করব কি করে।’
সন্তোষ থামল।
ইতিমধ্যে আর্টিস্ট উঠে গিয়ে এক মুঠো বেলফুল তুলে এনে কিছু রুচির কোলের ওপর, কিছু তার পায়ের কাছে ঘাসের ওপর ছড়িয়ে দিলে–
তোমরা কনস্ট্রাকটিভ কিছু করছ, পারিজাতবাবু সমিতির মধ্য দিয়ে জায়গাটাকে উন্নত করবেন, আগে তাঁর মনে যা-ই থাক, অন্তত এখন তিনি এ-বিষয়ে খুব সিরিয়াস হয়েছেন যখন শুনলাম, কাল রাত্রে ও আমাকে সেক্রেটারিশিপ নেবার কথা বলতে তাই আর না করতে পারলাম না।’
‘আপনি রাজী না হ’লে আমরাও এখানে ভিড়তুম না।’ জীবন বলল।
রুচি সন্তোষের দিকে তাকাল এবং চট্ ক’রে তার ময়নাকে মনে পড়ল।
‘ময়না আজ আসেনি?’
‘এসেছিল সন্ধ্যার দিকে। একটু আগে বাড়ি চলে গেছে।’ অসিত বলল।
‘আমার আসতে একটু রাত হল। তা না হলে দেখা হত। রুচি হাসিটাকে কথা দিয়ে চাপা দিল।
সন্তোষ বলল, ‘সম্ভবত কালই আমাদের নতুন সমিতির ওপেনিং সেরিমনি হবে। আমি পারিজাতবাবুর কাছে পাকা কথা চেয়েছি। এ-সব কাজ় আমি ফেলে রাখতে দিই না। তা ছাড়া–’
সন্তোষের কথা অসমাপ্ত থেকে গেল। তিনজনেই বাগানে এসে ঢোকেন। ডক্টর নাগ, পারিজাত, শিবনাথ
‘তোমরা যে অতটা সময় ঘরে না ব’সে থেকে ওপেন এয়ারে এসে ব’সে গল্প করছ দেখে আমার সত্যি খুব আনন্দ হ’ল।’ হার্ট স্পেশ্যালিস্ট বুড়ো নাগ, সন্তোষ, অসিত, জীবন প্রত্যেকের দিকে একবার তাকিয়ে পরে রুচির দিকে তাকান। ‘কেমন পারিজাতের বাগানটি আপনার ভাল লাগছে মিসেস দত্ত?’
‘অসম্ভব সুন্দর! এখানে এসে প্রথম বুঝলাম বসন্ত এসেছে।’ রুচি যথাসম্ভব সুন্দর ও সুশ্রী গলায় ডক্টর নাগের কথার উত্তর দিলে।
‘পারিজাত জানে, পারিজাতের মেজাজ আছে আমি তো ওকে বলি। সত্যি বাগানটি ওর চমৎকার।’
‘আপনাদের কালকেই ওপেনিং সেরিমনি ঠিক হ’ল মিসেস দত্ত।’ পারিজাত রুচির দিকে তাকাল।
‘হ্যাঁ, যতটা তাড়াতাড়ি পারা যায় স্টার্ট দেয়া ভাল।’ রুচি ডক্টর নাগের দিকে তাকাল। ডক্টর নাগ মাথা নাড়লেন। ‘শুভস্য শীঘ্রম্। দি আর্লিয়ার দি বেটার।
এসব আলাপের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শিবনাথ মাথা গুঁজে চুপ ক’রে মাঠের অন্ধকার ঘাসের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিল। রুচির চোখ এড়াল না।
৪১
বাড়িতে।
‘তা ওটা দেখাতে দোষ কি, কী মুশকিল!’
‘না এখন না, খেয়ে উঠে।’ শিবনাথ গলার কাছে হাসিটা চেপে রেখে মাথা নাড়ছিল।
মঞ্জুকে শুইয়ে রেখে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে হ্যারিকেন হাতে রুচি।
কাপড়-চোপড় ছাড়া হয়েছে, মুখ হাত ধোওয়া হয়নি। বলল আর আলোটা একটু তুলে ধরে শিবনাথের হাসি দেখতে চেষ্টা করল। ‘খুব তো সেখান থেকে বেরিয়েছি পর থেকে খুক খুক্ করে কেবল হাসছ। রাস্তায় বেরোবার আগেই যে তুমি হুট্ করে রাহাখরচের কথা তুলবে আমি ভাবতে পারিনি। কত টাকার চেক্?’
তোমার খুব লজ্জা করছিল?’
‘তা একটু করছিল বৈকি।’ রুচি না-হাসতে চেষ্টা করল।
‘তা তখনই তো তুমি চট্ ক’রে উঠে বেরিয়ে গেলে সন্তোষদের সঙ্গে দেখলাম।’ শিবনাথ চোখ গোল ক’রে হাসল। ‘বেশ ইন্টেলিজেন্ট তুমি।’
‘কত টাকা দেখি না?’
শিবনাথ নিঃশব্দে ঘড়ির পকেট থেকে চেক্টা বের ক’রে রুচির হাতে দিতে রুচি সেটা আলোর সামনে ধরল ও অঙ্কটা পড়ল, তারপর ভাঁজ করে কাগজটা শিবনাথকে ফিরিয়ে দিলে।
‘ধন্যি লোক তুমি, বাবা, আমি পারতাম না। ঘর থেকে পা না বাড়িয়ে পথ খরচের টাকা।’ শিবনাথ এবার একটু বাঁকা দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকায় এবং কোনরকম মন্তব্য প্রকাশ না ক’রে জামা খুলে সেটা বেড়ার গায়ে ঝুলিয়ে রাখল। চেটা গুঁজল ট্যাঁকে। ওটা বালিশের নিচে রেখে শোয়া হবে অনুমান করতে রুচির কষ্ট হ’ল না।
খাওয়ার পাট চুকিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় শোবার পর শিবনাথ বলল, ‘পারিজাতের মেজাজ আজ খুব ভাল। একটু বলেছি কি অমনি পথ খরচ স্যাংশন হয়ে গেল বেলেঘাটা ডু শ্যামবাজার। শুধু তার জন্য কুড়ি টাকা।’
‘ট্যাক্সি-ভাড়া?’ রুচি বলল।
‘তবে কি ট্রাম বাসের জন্য!’ শিবনাথ বলল, ‘বড় ঘরের ছেলে ইলেকশনে নামছে। অনেক ঘোরাঘুরি, প্রচুর পয়সা খরচের ব্যাপার। গোড়া থেকেই এখন এর সঙ্গে ওর সঙ্গে দেখা- সাক্ষাৎ করা, চিঠি-পত্র পৌঁছে দেওয়া, অনুরোধ-উপরোধ জানানো হচ্ছে। তার জন্য টুয়েন্টি- ফোর আওয়ার্স একজন লোকের দরকার। আমায় তো আর হুট করে কর্মচারী রাখার কথা বলতে পারছে না, বলছিল এই ব্যাপারে তাকে যেন হেল্প করি। বলছিল, বিশেষ তুমি যখন তার সমিতির সেক্রেটারিশিপ নিচ্ছ, তখন আমার ওপর পারিজাতের রাইট জন্মেছে, আমাকে তার এই কাজে একটু খাঁটিয়ে নেবে। কাজেই উচিত পথখরচ, রেস্টুরেন্ট খরচ, দরকার হলে শহরের বড় বড় হোটেলে নিয়ে গিয়ে এঁকে ওঁকে দলে ভেড়াবার জন্যে ডিনার খাওয়ার খরচ পারিজাত আমাকে ধরে দেবে বলছিল। সবই অবশ্য চেক্ মারফত হবে। আমি খুশিমত দরকারমত ভাঙিয়ে নেব আর খরচ করব।’
‘তা হলে এই তিন মাসে তো অনেক টাকাই পাবে।’ রুচি বলল, ‘টেম্পোরারী হলেও চাকরিটা ভালই। বেশ, আরও উন্নতি হবে, লেগে থাকো।’
‘কেন, তোমার কি বিশেষ পছন্দ হচ্ছে না কাজটা?’ শিবনাথ শুকনো গলায় প্রশ্ন করল। ‘আমার পছন্দে অপছন্দে কি এসে যায়? আমি তো আর তুমি একাজ পাবে বলে সেখানে যাই নি। সন্তোষ তো পরিষ্কার বলল, ইলেকশনের সঙ্গে সমিতির কোনো বিভাগেরই সম্পর্ক রাখা হবে না।’
‘আহা, তা কি আমি জানি না। তোমাদের সঙ্গে আমার এই কাজের সম্বন্ধ থাকবে না। তোমাদের হচ্ছে সম্পূর্ণ আইডিয়ার ব্যাপার–তোমরা একটা বড় আদর্শের, সংস্কৃতির, সৌভ্রাত্রের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছ। আমি পারিজাতের দরকারী কাজে ঘুরছি, কাজেই আমাকে ট্রামবাস ভাড়া–’
তাই বলছিল সন্তোষ ওরা।’ রুচি পাশ ফিরে শোয়। ‘সমিতি সম্পর্কে তোমার ইন্টারেস্ট যে খুব বেশি নেই তা ওরা ধরে ফেলেছে।’
‘তাতে আমি ঘামি না।’ শিবনাথও পাশ ফিরে শোয়। ‘আমি বেকার মানুষ। স্রেফ সংস্কৃতি আদর্শ নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে না। সুযোগ বুঝে সুবিধা বুঝে কিছু টাকাকড়ি পারিজাতের কাছ থেকে খসাতেই হবে।’
রুচি কথা বলল না।
‘বাগানে তোমরা অনেকক্ষণ ছিলে। আর কি কথা হ’ল? সন্তোষের এক বন্ধু তো তোমার ছবি এঁকে ফেললে।’
‘তুমি দেখেছিলে নাকি?’
‘না।’ শিবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, ‘ডক্টর নাগ পরে আমায় বললেন। তোমাকে পেয়ে ওদের বেজায় ফুর্তি হয়েছে।’ একটু থেমে থেকে পরে শিবনাথ যেন অনেকটা নিজের মনে আস্তে বলল, ‘স্বাভাবিক।’
রুচি কথা বলল না।
‘একেবারে দেবীর আসনে বসাতে চাইছে ওরা তোমাকে, শুনলাম।’ কথা শেষ করে শিবনাথ মদু হাসল।
এবার রুচি মুখ খুলল।
তোমার খুব খারাপ লাগছে নাকি?’
‘আমার? কেন?’ শিবনাথ এ-পাশ ফিরল। ‘বাস্তবিক, তুমি আমাকে এমন ভুল বোঝ।’ রুচি আবার গম্ভীর।
‘যাকগে’, শিবনাথ রুচির কোমরের ওপর হাত রাখল ‘সব তো আর ট্যাক্সি রিক্সায় খরচ করছি না। মাঝে মাঝে ফাঁকে ফাঁকে ট্রাম বাসেই চড়ব। হ্যাঁ, এই থেকে আমাকে কিছু কিছু বাঁচাতে হবে। মনে করেছি কাল চেক্টা ভাঙিয়েই তোমার একটা ভাল শাড়ি কিনে আনব মিটিং-ফিটিং-এ যাবে। তেমন ভাল কাপড়ও তো নেই।’
বেশ বিরক্ত হয়ে রুচি কোমর থেকে হাত সরিয়ে দিলে।
আমার কাপড়ের দরকার নেই। পাঁচজন ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার দেখা সাক্ষাতের কাজ, এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি, নিজের জন্যে একজোড়া জুতো ও দু’টো পাঞ্জাবি করিয়ে নাও।’
‘আহা, তা তো করতেই হবে।’ শিবনাথ বলল, ‘সেটা সামনের সপ্তাহে হচ্ছে। কাল তোমার—’
রুচি বাধা দেয়।
‘আমার কাপড় পরে হলে চলবে। একটা মাদ্রাজী তোলা আছে। সেটা আর ব্যবহার করা হচ্ছে না। কাল মিটিং-এর জন্য ওটা খারাপ হবে না–বরং।’ যেন কি একটু ভাবল রুচি, তারপর : ‘ভাল কথা, তুমি কাল কি পরশু একবার মঞ্জুকে ডাক্তার দেখবার ব্যবস্থা কর তো।’
‘কেন?’ শিবনাথ অবাক। ‘মঞ্জুর তো কোনো অসুখ নেই।’
তা তুমি সাদা চোখে কি ক’রে জানবে।’ রুচি বিরক্ত হ’ল। ‘তুমি পারিজাতের সঙ্গে তখন ইলেক্সনের কথা নিয়ে মত্ত। আর কারো কথা শুনবার কথা নয়। ডক্টর নাগ আমাকে দু’বার বলেছেন : ‘আপনার মেয়ে ভীষণ রোগা মিসেস দত্ত। এখন থেকে একটু ওর দিকে মনোযোগ না দিলে সারাজীবন বেচারা কষ্ট পাবে, ভুগবে।’
‘ওর জেনারেল হেল্থ খারাপ।’ শিবনাথ হৃষ্ট গলায় বলল, ‘তা একটু দুধ-টুধ খাক। আমি তো ভাবছি কাল মঞ্জুর জন্যে আধ সের ক’রে দুধ রেখে দিতে তোমায় বলব। এটা আমার গোড়া থেকেই ঠিক করা আছে মনে মনে।
কেবল দুধ খাওয়ালে হবে না। ক’টা ক্যালসিয়াম ইঞ্জেকশন, একটা ভাল জেনারেল টনিক ওকে না দিলে চলবে না।’
‘তাই হোক, তাই দেওয়াবার ব্যবস্থা করব। প্রথম টাকাটা সন্তানের জন্যেই খরচ করি, কি বলো! তাতে একটা স্যাটিশফ্যাসন থাকে।’ শিবনাথ আবার অল্প শব্দ করে হাসে।
রুচি এ-পাশ ফিরে শোয়।
‘আর কে কি বলছিল আমার সম্পর্কে ডক্টর নাগের কাছে ছেলেরা?’
‘আরে বাপরে! সেকি প্রশংসা! এঞ্জেল, গডেস, কেবল এই সব।’
‘ভীষণ ছেলেমানুষ সব।’
শিবনাথ স্ত্রীর কথার উত্তর দিল না। বেশ একটু সময় চুপ করে থাকার পর সে সিগারেট ধরায়। ওদিকে ঘুমের ঢল নেমেছে রুচির চোখে, চোখের পাতায়, শরীরে।
ছোট্ট একটা হাই তুলে সে ঘুমটাকে তাড়াতে চেষ্টা করে বলল, ‘যাগে, একটি কথা তোমায় বলে রাখছি মনে রাখতে হবে।’
‘কি কথা?’
‘কাজের কথা বলতে আপত্তি নেই, হ্যাঁ–আমি যখন ওখানে থাকি আমার সামনে পারিজাতের সঙ্গে তোমার পাওনা-টাওনার কথাটা কিন্তু মোটেই বলবে না।’
‘আরে পাগল!’শিবনাথ সিগারেটে লম্বা টান দিল।’তোমার সেখানে হ’ল গিয়ে অন্যরকম স্টেটাস, মান মর্যাদা। না না, সে বিষয়ে আমি সাবধান আছি।’
‘এবং সন্তোষদের সামনেও না।’
‘না।’বুক থেকে অনেকটা ধোঁয়া ঠেলে বার করে দিয়ে শিবনাথ বলল, ‘সে-বিষয়ে আমি খুব এলার্ট। সমিতির সেক্রেটারিশিপ নিয়ে, একটা সেক্রিফাইসিং স্পিরিট নিয়ে সেখানে তুমি কাজ করছ। তোমার প্রেস্টিজ কত সে-বাড়িতে! আলাদা সম্মান
রুচি কথা বলল না।
‘কেমন বুঝলে পারিজাতকে?’
প্রশ্নটা অস্পষ্ট হওয়াতে রুচি চুপ করে রইল।
স্ত্রী পালিয়ে যাওয়াতে এতটুকু দুঃখিত নয়, বুঝতে পারিনি? কেবল কাজ আর কাজের কথা, আর তোমাদের সমিতির!’ বলে শিবনাথ রুচির বুকের ওপর হাত রাখতে রুচি ওপাশে ফিরে শোয়।
‘প্রকৃত যে..পুরুষ দুষ্ট স্ত্রীর জন্যে সে দুঃখিত হয় না।’
‘বুঝলাম।’শিবনাথ চোখ বুজে সিগারেট টানতে টানতে হাসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে গলার ধোঁয়াটা চেপে রেখে তাঁরপর সেটা বার করে দিয়ে বলল, ‘আমি হলে পারতাম না। মানে তুমি যদি কোনদিন খারাপ হয়ে এভাবে পালিয়ে টালিয়ে যেতে কারোর সঙ্গে, আমি শালা কাজ টাজ ফেলে নিজের গলায় ছুরি লাগাতাম, নয়তো তোমাকে আনতে তোমাকে শিক্ষা দিতে পৃথিবীর যে-কোন প্রান্তে ছুটে যেতাম।‘
রুচি রাগ করল না। একটা উপেক্ষার হাসি হেসে বলল, ‘তোমার চিন্তাধারাই ওরকম! সৎ-বুদ্ধি সৎ-চিন্তা তো আর মাথায় নেই। কোনোদিনই নেই–’
গাল খেয়ে রাগ না ক’রে শিবনাথ হাসে, হাসিটাকে যথাসম্ভব গলার কাছে ধরে রাখতে চেষ্টা করে পরে বলে, ‘আরে পাগল, একটা তুলনা দেখাচ্ছিলাম শুধু–তুমি কি আর—’
‘না, ছাড়ো, লাগে।’ বিরক্ত হয়ে রুচি শিবনাথের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। ‘পৃথিবীতে আর ভাল তুলনা নেই।‘
.
নিশুতি রাত। তেমনি একটা চেক্ নিয়ে বারো ঘরের আর এক ঘরের কথা হচ্ছিল বেশ মোটা অঙ্কের চেক্। এক সঙ্গে অনেক টাকা।
মিহির আগেই বীথিকে টাকাটা দিয়ে রেখেছে। শহরে বাড়ি পাওয়া গেছে খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে সেলামি অ্যাডভান্স দিয়ে তারা ওটা বুক করে রাখতে পারে।
সবটা টাকা লাগবে না এটা বীথি ও প্রীতি দুজনেই জানে। বাড়ি ভাড়া হয়ে যাওয়ার পর এখান থেকে সিফ্ট ক’রে যে-টাকাটা বাঁচবে আন্দাজে তার সংখ্যাটা ঠিক ক’রে যেন খুশি হয়ে বীথি আজ দুপুরে মিহির কখন চেক্টা লিখে দিয়েছিল দিদির কাছে পুরোপুরি তার বর্ণনা দিচ্ছিল। দুপুরে টুটুল ঘুমোচ্ছিল খাটে। বীথিও এক পাশে শুয়ে মিহিরের আলমারী থেকে একটা বাংলা নভেল টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ছিল। এমন সময় মিহির হঠাৎ বাইরে থেকে বাড়ি ফেরে এবং সরাসরি বীথির কামরায় ঢুকে একটা খবরের কাগজের কাটিং পকেট থেকে বার ক’রে সেটা বীথির হাতে দেয়। একটা বাড়ির ঠিকানা। সকালে কাগজ পড়তে পড়তে মিহিরের চোখে পড়েছে। আজই বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে বীথি যাতে একবার রামকানাই দত্ত লেন ঘুরে যায় এবং বাড়িটা সম্বন্ধে পাকাপাকি কথা বলে অন্তত কিছু টাকা দিয়ে যায়। মিহির পকেট থেকে নোটের তাড়া বার করতে বীথি চোখ কপালে তোলে। এত টাকা সঙ্গে নিয়ে সে রাস্তায় বেরোতে পারবে না, তার ভয় করে। শুনে মিহির হেসে দু’টো মাত্র নোট বীথির হাতে দিয়ে তৎক্ষণাৎ চেক্ বই নিয়ে এসে বীথির খাটের ওপর বসেই একটা চেক্ লিখে দেয়। কথার যাতে নড়চড় না হয় সেজন্য বীথি কুড়িটা টাকা আজ বাড়িওয়ালাকে দিয়ে যাক–কাল চেক্ ভাঙিয়ে সেলামি অ্যাডভান্স বাবদ বাড়িওয়ালা যা চায় যেন সে দিয়ে দেয়। মোটের ওপর বারো ঘরের আস্তানা ছেড়ে যে ক’রে হোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বীথি তার বাবা মা ভাই বোনদের নিয়ে শহরে চলে আসুক। মিহিরের ইচ্ছা।
‘তারপর কি তিনি আবার বেরিয়ে গেলেন? হ্যাঁ, বাড়ি থেকে?
‘কই না তো! তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছল।’
‘বসে বসে গল্প করলেন বুঝি তোর সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ, কেন, গল্প করলেন মানে আমাকে একটু চা করতে বললেন। ইলেট্রিক কেটলি থাকাতে চট্ করে গরম জল হয়ে যায়। ‘
প্রীতি আর কিছু বলল না।
বীথি বলল, ‘টুটুলও আজ সন্ধ্যা অবধি ঘুমিয়েছিল।’
‘তবে তো অনেকক্ষণ বসে গল্প করার করার সুযোগ পেয়েছিলি তোরা?’ প্রীতি না বলে পারল না।
‘হ্যাঁ, তা তো পেয়েছিলাম।’ যেন প্রীতির কথা বীথির কানে লাগল। ‘অনেকক্ষণ বসে গল্প করলেন আমার সঙ্গে বলতে তুই কি বলতে চাস তিনি সারাক্ষণই আমার খাটের উপর ব’সে ছিলেন? কি চুপ ক’রে আছিস কেন?
‘আরে!’ প্রীতি অসুবিধায় পড়ল। ‘আমি কি তাই জিজ্ঞেস করছি নাকি তোকে। আমি তো তা বলিনি বোকা।’
‘বুঝতে পেরেছি।’ বীথি পাশ ফিরে শোয়। ‘এতগুলি টাকা আজ আমায় দিয়েছেন তাতে তোর মনে একশ রকমের প্রশ্ন জাগবে তা কি আমি জানি না, দিদি আমি তোর পিঠের বোন।’
‘কী মুশকিল! আমি তো–‘
‘থাক হয়েছে–তোকে আমি চিনি।’
আদর করতে গায়ে হাত দিতে চেয়েছে প্রীতি, বীথি হাতটা সরিয়ে দেয়।
‘আমি কি জানি না, সন্দেহ করতে তুই-ই আগে করবি। আমি অবশ্য—’ একটু চুপ থেকে তারপর হঠাৎ যেন ফোঁস ফোঁস ক’রে কাঁদতে লাগল বীথি। প্রীতি ধমক দেয়।
‘কি আরম্ভ করলি তুই দুপুর রাতে!’
‘কি হয়েছে!’ প্রীতি বীথির মা জেগে ওঠে।
‘বীথি কাঁদছে।’
তুই কিছু বলেছিলি নাকি?’ বড় মেয়েকে প্রশ্ন করতে ভুবনগিন্নী বালিশ থেকে মাথা তুলল।
‘কি বলেছি তুমিই ওকে জিজ্ঞেস কর না। এত বড় মেয়েকে কিছু বলা আমার কী অধিকার আছে। আমি আবার কি বলতে যাব।’ প্রীতির গলায় ঝাঁজ।
ভুবনগিন্নী কিছু বলল না। প্রীতি চুপ। বীথি এমন জোরে কাঁদছিল যেন মনে হল ওর মাথার বালিশ ভিজে যাচ্ছে।
‘হরি হরি!’ভুবন হাই তুলল, ‘রাত দু’টো বেজেছে। তুমি কি বেল্ শুনতে পেয়েছ গিন্নী?’
‘না।’ বীথির মার গলায় অস্পষ্ট ঝাঁজ। ‘কেন তুমি কি এখনো ঘুমোও নি নাকি। আর কতই বা ঘুমোবে। মেয়েদের রোজগারে দুধ আফিং খেয়ে খেয়ে সাধ পুরিয়ে ঘুমিয়ে নিচ্ছ।’
ভুবন নীরব।
‘এই বীথি!’প্রীতির মা উঠে হামাগুড়ি দিয়ে বীথির শিয়রের ধারে চলে গেল। ‘কি হয়েছে শুনি?’
‘কিছু না।
‘তো ওরকম কান্নাকাটি করছিস কেন হঠাৎ দুপুর রাতে?’
‘আমার ইচ্ছা। তুমি যাও, তুমি এখান থেকে সরে যাও মা।’
‘কি যে তোদের রকম! প্রীতি তোকে তো কিছু বলেনি। আমি তো এতক্ষণ জেগেছিলাম। দেখি বালিশের তলায় চেক্টা ঠিক্ আছে তো?’
‘হ্যাঁ, মা, আছে, তুমি যাও, তোমার পায়ে ধরি, তুমি নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো।’ ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দিয়ে বীথি হঠাৎ দাঁড়ায়। অন্ধকার। তা হলেও বোঝা যায় নিজের কাপড় মানে শায়া ও কাঁচুলি ছাড়া বীথির গায়ে আর কিছু নেই, যেমন কাঁচুলির বাঁধনও ঢিলে হয়ে একটা পাশে ঝুলে পড়েছে। বীথি তা গ্রাহ্য করল না। করে না। অনেক সময় গায়ে কাপড় না থাকলেও তারা অন্ধকার ঘরে হাঁটাহাঁটি করে। ঘরে বয়স্ক পুরুষ বলতে এক ভুবন। ভায়েরা প্রীতি বীথির চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। অসুখে ভুগে ভুগে ভুবন রাতকানা হয়ে গেছে। রাত্রে উঠে হাওয়ার জন্য এক আধ বার জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে কি ছারপোকা মারতে কি পিপাসা পেলে কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেতে কাপড়চোপড় সম্পর্কে প্রীতি বীথির বিন্দুমাত্র সতর্ক হবার প্রয়োজন হয় না। বোঝা গেল বীথিও এখন জল খেতে উঠে ওধারে কুঁজোর কাছে গেল। যেন এক সঙ্গে অনেকটা জল ঢক্ ঢক্ ক’রে গিলে আবার সে বিছানায় ফিরে এল! বেণী খুলে গেছে। বসে বীথি হাত দিয়ে মাথার চুল ঠিক করল। তারপর আস্তে আস্তে ধরা গলায় মাকে বলল, ‘হ্যাঙ্গারফোর্ড স্ট্রীটের বাড়িতে আমার চাকরি যত দিন আছে অনেক চেক্ পাওয়া যাবে। তার জন্যে ভেবো না। কিন্তু তোমরা,–তোমাদের চোখে যদি কোনদিন আমি এতটুকু সন্দেহ দেখি আমি চেক্ ছিঁড়ে ফেলব। ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যেদিকে দু’চোখ যায় বেরিয়ে যাব ঠিক ক’রে রেখেছি। তুমি প্রীতিকেও বলে দাও, আর যাই করুক, ও যেন মিহিরবাবুর সঙ্গে আমার অন্য কোনরকম একটা সম্পর্ক দাঁড়াতে পারে এই দুশ্চিন্তা সকলের আগে মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয়। তারপর আমি ওখানে কাজ করতে যাব।’
‘না, কেন এসব কথা ওর মনে আসবে, আসেনি তো, কেমন রে প্রীতি, তুই কি–’
মার কথা শেষ হতে না দিয়ে প্রীতি মদু-মন্দ হাসল। ‘আমার তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। বললাম অনেকক্ষণ গল্প করছিলি, তাতেই ও—’
‘যাক গে, ওর বুঝতে ভুল হয়েছে, এই বীথি, এবার শুয়ে পড়। লক্ষ্মী মা আমার, বাজে কথায় রাগারাগি না করে এই বেলা ঘুমিয়ে পড়, রাত বেশি নেই।’
বারো ঘরের বাকি সবগুলো ঘর ঘুমে অচৈতন্য। তাই কি? আজ আর একটা ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। মদন ঘোষ সন্ধ্যার পর দারোয়ান সঙ্গে নিয়ে এসে রমেশের ঘরের দরজায় তালা পরিয়ে গেল। মল্লিকা নেই। মল্লিকা ও রমেশের ছেলেময়েরা রমেশের খুড়া সম্পর্কিত কে এক অন্নদা নাগের সঙ্গে তার উল্টোডাঙ্গার বাসায় চলে গেছে। ওয়েলিংটন স্ট্রীটে এক লোহা-লক্কড়ের দোকানে খাতা লেখে অন্নদা। খবরটা সেখানেও পৌঁছেছিল।
এখন রমেশের দরজার সামনে তার ঘেয়ো কুকুরটা একলা চুপচাপ শুয়ে আছে। শুয়ে আছে আর থেকে থেকে বাতাসে যখনই দরজার তালাটা নড়ে উঠছে মাথা তুলে কান খাড়া রেখে তালাটার দিকে একদৃষ্টে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর একসময় মাথাটি নামিয়ে বুকের মধ্যে মুখটা গুঁজে ভীষণ কান্নাকাটি করছে। রমেশ খুন হয়েছে শুনে মল্লিকা মূর্ছা গিয়েছিল। ভয়ে ছেলেমেয়েদের গলা দিয়ে শব্দ বেরোয়নি একমাত্র রমেশের প্রিয় কুকুর ‘ভোম্বলই’ মনিবের জন্য শোক প্রকাশ করতে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থেকে কাঁইকুঁই কান্নার শব্দে রাত্রির অন্ধকার ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল।
প্রমথদের ঘরে বুড়ীর বুকের কফ বেড়ে যাওয়ার দরুন রাত সাড়ে বারোটার পর থেকে তার গলা দিয়ে কেমন বিশ্রী ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোচ্ছিল।
ওদিকে বিধুমাস্টারের ঘরে লক্ষ্মীমণি পেটের ব্যথায় ছটফট করছে। এতক্ষণ খুবই ছটফট্ করছে। যেন এইবার ব্যথাটা কমে আসাতে লক্ষ্মীমণি নিঃঝুম হয়ে পড়ে আছে। বেদনার বাড়াবাড়ি দেখে বিধুর বুঝতে বাকি থাকে না চরম সময় উপস্থিত। অম্বলের ব্যথা ব’লে আর উড়িয়ে দেওয়া চলবে না। কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ে মাস্টার রগ দুটো দু’ আঙুলে টিপে ধরে ভাবে। মমতা সাধনা বোতলে গরম জল পুরে মার হাতে পায়ে সেঁক দিচ্ছে। কোন রকমে রাত ভোর পর্যন্ত টেনে নিতে পারা যায় কি না সকলেরই এই চিন্তা। গভীর রাতে এম্বুলেন্স ডাকার হাঙ্গামা কত!
আর ঘুম নেই চোখে সুপ্রভার। অন্ধকারে শুয়ে ভাবে। যেন চিন্তা ক’রে সে ঠিক করতে পারছিল না ক্ষিতীশ রমেশের সঙ্গে, রমেশের পাপ ইচ্ছার সঙ্গে বেবি কতখানি জড়িত ছিল। হ্যাঁ, তার মেয়ে! তার গর্ভের সন্তান। চৌদ্দ বছরের বেবি কতটা যৌবন শরীরে ধরতে পেরেছিল যার জন্য চায়ের দোকানে রক্তগঙ্গা বয়ে গেল। আশ্চর্য, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, খবরটা শুনে সুপ্রভা অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করছিল প্রথম, একটা পাশবিক উল্লাস। কিন্তু শরীর নিস্তেজ বলে সেই উল্লাস সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেনি। শ্রান্ত অবসন্ন চোখ মেলে অন্ধকারে কড়িকাঠ দেখছিল। বেবি ঘরে ফিরল কিনা ভুলেও আজ একবার দরজার দিকে চোখ ফেরাল না। বেবি ফিরে এলে সুপ্রভা তাকে কি প্রশ্ন করত, কি বলত বলা কঠিন।
৪২
রমেশ খুন হওয়ার পর বারো ঘরের বস্তি তো বটেই, সমস্ত পাড়াটা যেন কেমন ঝিম মেরে ছিল। একটা থমথমে বিষণ্ণতা, চাপা-চাপা ভাব। এ ওর সঙ্গে মেলামেশা করতে, ভিন্ন বাড়ির দরজায় যেতে, এমন কি পাশের ঘরের রকে বসে প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা বলতেও যেন লোকে কেমন আটকা বোধ করছিল। সবাই কেমন সঙ্কুচিত সন্ত্রস্ত হয়ে চলাফেরা করছিল। ক্ষিতীশের কি ফাঁসি হবে? না বেবির জবানবন্দীতে পুলিসের ‘বিশ্বাস’ হচ্ছে না। আরো ‘ইকোয়ারী’ হবে। খুনের পিছনে কি আরো ‘মানুষ’ আছে?’ঠাণ্ডা রক্তে’ খুন না কি ‘গরম রক্তে’ খুন! ক্ষিতীশ এত বড় ‘দা’ কোথায় হুট করে পেল। কে ‘সাপ্লাই’ করেছিল? বেবিকে হাজত থেকে কবে ছাড়া হবে। না দা-টা বেবিই ‘ফ্রকের’ তলায় করে দোকানে কয়লার নিচে লুকিয়ে রেখেছিল। আগে-ভাগে? এই অস্ত্র ক্ষিতীশের হাতে না উঠে রমেশের হাতে উঠতে পারত না কি ইত্যাদি চাপা গলার ফিসফিস আওয়াজে কুলিয়া-টেংরার বাতাস দূষিত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই পারিজাত আবহাওয়া সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছিল। হ্যাঁ, সংস্কৃতি-সম্মেলন। পাড়ার ছেলে-বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ, বিদ্বান-মূর্খ সকলেই সেদিন পারিজাতের প্রশ্নস্ত লনে সামিয়ানার তলায় এক একটি আসন দখল করে বসতে পেরেছিল। হল-ঘরে এত লোকের জায়গা হবে না চিন্তা করে বাইরে সামনের সবুজ মাঠে চাঁদোয়া খাঁটিয়ে প্রত্যেকটা খুঁটি দেবদারু পাতা ও খেজুর পাতায় মুড়ে নিশান গুঁজে ও প্রবেশদ্বারে লাল সালুর গায়ে সাদা কাপড় দিয়ে ‘কুলিয়া-টেংরা কৃষ্টি বাসর’ লিখে পারিজাত, সন্তোষের দল, ময়না এবং রুচি সকলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে বসালো।
এ পাড়ার নিমন্ত্রিতরা তো ছিলেনই, ওদিক থেকে পারিজাতের আরামবাগের সেই জার্মানি রাশিয়া ফেরত বন্ধু বিশিষ্ট জননেতা শশাঙ্ক বাগচী, ডক্টর মধুসূদন নাগ, সন্তোষের বাবা-মা, এদিক থেকে রুচির স্কুলের কয়েকজন টিচার, সন্তোষের পার্ক স্ট্রীট, বালিগঞ্জ এবং এন্টালির বন্ধুরা, সন্তোষের বোন, বোনের সখীরা, অসিতের বোন ও বোনের সখীরা উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানকে সুন্দর সফল করে তুললেন। ডক্টর নাগ মঙ্গলাচরণ করলেন, অসিতের বোন উদ্বোধনী সঙ্গীত গাইল, সভাপতি শশাঙ্ক বাগচী ‘সংস্কৃতি’বলতে কি বোঝায় তা তাঁর ভাষণে চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করে সমবেত সকলকে মুগ্ধ করলেন। ‘অশিবকে অসুন্দরকে অকল্যাণকে অবিদ্যার পাপকে দারিদ্র্যের গ্লানিকে চিরতরে বিদায় দেবার মহতী ব্রত নিয়ে এই সংস্কৃতি বাসর আপনাদের মধ্যে জন্ম নিল। অকুণ্ঠ আত্মত্যাগ অপরিসীম প্রেম অপরিমেয় নিষ্ঠা অমিত উদ্যম এবং অশেষ সাহস নিয়ে আপনারা সমিতির প্রচেষ্টাকে সার্থক জয়যুক্ত করে তুলবেন এবং সমাজকে, জাতিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবেন আমার এই কামনা।’ ভাষণ শেষ হবার পর করতালি-ধ্বনিতে আসর মুখরিত হ’ল। মদু গুঞ্জন ক’রে অনেকেই বলাবলি করলেন কন্টিনেন্ট ঘুরে আসা এত বড় লোকটার এই দীর্ঘ বক্তৃতায় একটা ‘ইংরাজী’ শব্দ নেই। কী অদ্ভুত দখল বাঙলা ভাষার ওপর! কী চমৎকার বলার ভঙ্গি!
এরপর অনুষ্ঠানের যেটা সবচেয়ে প্রধান অংশ অর্থাৎ রুচিকে সম্পাদিকার পদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করা–সুন্দর সংক্ষিপ্ত একটি বক্তৃতা ক’রে পারিজাত তা আরম্ভ করল। আজ আর টাই স্যুট না, পাঞ্জাবি ধুতি চাদরে পারিজাতকে অতি সুন্দর দেখাচ্ছিল। রুচি এই আমন্ত্রণ গ্রহণ ক’রে তার প্রত্যুত্তরে ছোট কয়েকটি কথায় এবং তা’তে অসতর্কতাবশত দুটো ইংরেজী শব্দ মিশিয়ে ফেলে কাঁপা গলায় বক্তৃতা করল। ‘এই সীমিত শক্তি নিয়ে এতবড় আদর্শকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলা সহজ না বলে আজ আমিও আপনাদের সকলের সহযোগিতা ও শুভেচ্ছা কামনা করছি।’ শেষদিকে আর ইংরেজী শব্দ ছিল না, তাই শিবনাথের চেহারা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। বস্তুত আনন্দে গর্বে আজ তার বুক ফুলে উঠেছিল। মালার স্তূপ জমল রুচির সামনে কোলের ওপর। সন্তোষ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে রুচি বসেছিল। মালাগুলো পরে সে একটা একটা করে সবদিকে বিলিয়ে দিয়েছিল অবশ্য। অনুষ্ঠান শেষ হবার আগে অর্থাৎ সকলের শেষে সাহিত্যিক সন্তোষ সমিতির পক্ষ থেকে কর্মীদের সকলের হয়ে তার চমৎকার ভাষায় বক্তৃতা করল। ‘আমরা দল বুঝি না, আমরা রাজনীতি জানি না,–মুক্ত আকাশের নিচে নতুন দিনের সূর্যের কিরণসম্পাত ললাটে নিয়ে তরুণের দল তরুণীর দল হাত ধরাধরি করে আজ যে অভিযান শুরু করলাম তার শেষ কোথায়, সমাপ্তি কোথায় জানি না। নদীর তরঙ্গের মত লাভ-ক্ষতির হিসাব না নিয়ে মহাসমুদ্রের দিকে অর্থাৎ জাতিগঠনের বিরাট সাধনার দিকে কেবল অগ্রসর হতে থাকব। আমাদের এই গতি, এই বেগ এই উচ্ছলতা আজ এক কল্যাণীকে এক দেবীকে পেয়ে স্ফীততর হয়ে উঠলো। রুচিদির প্রেরণায় নির্দেশনায় আমরা যে কত কাজ করতে পারব, তা এখনি বলে মাননীয় অতিথিদের, বন্ধুদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না,–ফলেন পরিচীয়তে।’ আবার করতালিধ্বনি। ময়না সমাপ্তি সঙ্গীত গাইল। সন্তোষের দেবী কল্যাণী কথাগুলির সময় রুচির চেহারার পরিবর্তনটা শিবনাথের চোখে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ল। বস্তুত সবাই রুচিকে ওপর থেকে দেখছিল, দেখছিল তার বাইরের রূপ। এ-কাজে সে-কাজে বার বার শিবনাথকে ছুটতে হচ্ছে; পারিজাতের সঙ্গে এটা-ওটা নিয়ে পরামর্শ করতে হচ্ছে; কিন্তু তা হলেও থেকে থেকে এক এক সময় চুপ করে সে স্ত্রীর দৃষ্টি, হাসি, তার কথা বলার প্রত্যেকটি ভঙ্গি নিরীক্ষণ করে মুগ্ধ এবং বিস্মিত হচ্ছিল। কমলাক্ষী গার্লস স্কুলের একটি সেকেন্ড টিচার উপযুক্ত সময়ে উপযোগী পরিবেশে যে কতখানি বদলে যেতে পারে, তা সে আজ রুচিকে দেখে বুঝল। অথচ আজ সকালেও ওর সঙ্গে শিবনাথের হাল্কামতন ঝগড়া হয়ে গেছে। শিবনাথ অবশ্য ঠাট্টা করে বলেছিল, জাতে স্ত্রীলোক–তাই রুচির মনের ক্ষুদ্রতা ধরা পড়ে গেছে। দীপ্তি নেই, কাজেই স্বামীর কোনরকম চিত্তচাঞ্চল্য ঘটবার আশঙ্কা নেই নিশ্চিন্ত হবার পর সে কাজ করতে পা বাড়াল। তার কর্মের আদর্শটা নিতান্তই শর্তসাপেক্ষ। এখন সেই ঝগড়ার কথা মনে আছে কিনা, পত্রপুষ্পশোভিত প্যান্ডেলের একটা কোনায় বসে কাজের স্কীম নিয়ে রুচি আলোচনায় মগ্ন ছিল, একবার ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করতে শিবনাথের ভয়ঙ্কর ইচ্ছা হচ্ছিল। যদিও তার সুযোগ এবং সময় পেল না শিবনাথ। আমের মুকুলের গন্ধ ও মিষ্টি হাওয়া নিয়ে পারিজাতের লনে ফাল্গুনের সুন্দর অপরাহ্ণ শেষ হয়ে যখন সন্ধ্যা নামল, তখন অনুষ্ঠানও শেষ হ’ল।’
তখনও পারিজাত ভীষণ ব্যস্ত। শিবনাথ ব্যস্ত। শশাঙ্ক বাগচী ডক্টর নাগ এঁরা একে একে বিদায় হচ্ছেন। সঙ্গে শিবনাথও রাস্তায় দাঁড় করান তাঁদের এক একটা গাড়ির দরজা পর্যন্ত যাচ্ছে। মনে মনে ভাবছিল, এখনি সে অবসর হবে, সবাই তো প্রায় বিদায় হলেন, রুচি অবশ্য তখনও খুব বেশি ব্যস্ত হয়ে সন্তোষ ও সন্তোষের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় হঠাৎ একটি পরিচিত মুখ দেখে শিবনাথ চমকে উঠল।
‘আপনি?’
চারু রায় হাসল।
‘আমি তো প্রথম থেকেই আছি।’ তার হাতে ক্যামেরা। ‘ভিড়ের মধ্যে লক্ষ্য করেন নি। একখানা কার্ড পেয়েছিলাম। বোধকরি পারিজাতবাবুর জমিদারী এলাকায় আমার স্থায়ী কর্মকেন্দ্র বলে আমিও এখানকার একজন সেই সুবাদে নিমন্ত্রণ পেলাম।’ কথার শেষে চারু মেয়েদের মত হাসল। চারুর কথা বলার ভঙ্গিতে শিবনাথ মুগ্ধ হ’ল। গর্বিত ভঙ্গিতে সে প্যান্ডেলের দরজায় সন্তোষের বোন, অসিতের বোন এবং আরো দু-একটি মেয়ের হাত ধরে দাঁড়ানো রুচির দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে হেসে চারুর দিকে তাকায়। ‘কেমন লাগল?’
‘অদ্ভুত। চলুন ওধারে গিয়ে একটু গল্প করি।’
চারু শিবনাথের হাত ধরল।
বস্তুত শিবনাথও পরিচিত, বলতে গেলে বন্ধুস্থানীয় এমন একটি লোককে এতক্ষণ পর পেয়ে হাল্কা নিশ্বাস ফেলল। পারিজাত এবং বিশিষ্ট অভ্যাগতদের মধ্যে থেকে তেমন মন খুলে কথা বলতে না পারার দরুন সে অস্বস্তিবোধ করছিল বৈকি। চলুন–ও এখন ফিরবে কিনা কে জানে।’ আর একবার রুচির দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে শিবনাথ বলল, তার পর আর অপেক্ষা না করে চারুর হাত ধরে রাস্তায় নামল। পারিজাত তখন ডক্টর নাগের সঙ্গে ইলেক্শন সম্পর্কে জরুরি কথা বলতে বলতে মন্থরগতি গাড়িটার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে অনেকদূর চলে গেছে। তাতে শিবনাথ একটু অন্যদিকে সরবার সুযোগ পেল। সবচেয়ে বড় কথা এত সব সম্ভ্রান্ত লোকের সামনে সে মোটেই সিগারেট খেতে পারেনি।
‘আপনি দেখছি মশাই সর্বঘটেই আছেন।’ চারুর প্রসারিত প্যাকেট থেকে সিগরেট তুলে শিবনাথ হাসল।
‘ভাল-মন্দ নিয়ে আমার মায়াকানন। আপনাকে অনেকদিন আগেই বলেছি। বস্তিজীবনের দুঃখ-দারিদ্র্য, অশিক্ষা, দুর্নীতির অন্ধকার যথেষ্ট ঢোকানো হয়েছে বইয়ে। কিন্তু আলোর ইঙ্গিত, সভ্যতা-সংস্কৃতি আশার কোন আভাস যদি পাই, তবে সেই চিত্র কি গ্রহণ করব না? সেই ছবি তো আজ পেয়ে গেলাম হা হা।’
শিবনাথ চারুর লাইটার থেকে সিগারেট ধরাতে ধরাতে কথাগুলি রীতিমত উপভোগ করল। ‘গুড। সেই লোভেই বুঝি চুপটি করে লুকিয়ে বসে থেকে এতক্ষণ সব শুনছিলেন?’ বলে সে শব্দ করে হাসল।
‘ওয়ান্ডারফুল! কি যেন নাম সেই ছেলেটির। সন্তোষ। সুন্দর বক্তৃতা দিল। কী চমৎকার আইডিয়া! অতটুকুন ছেলে!’
‘খুব ভাল লাগল কথাগুলো?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।
‘খুব।’
যেন আর একটা কি প্রশ্ন করবার জন্য শিবনাথের জিহ্বা নড়ে উঠেছিল। কিন্তু নিবৃত্ত হ’ল। মুখের ধোঁয়া বার করে দিয়ে বলল, ‘কনস্ট্রাকটিভ কাজের প্ল্যান শুনলেন সন্তোষের। ওর আবার অন্য গুণও আছে। হ্যাঁ, সাহিত্যিক, আর্টিস্ট। সিনেমার জন্যে অলরেডি একখানা বই লিখে ফেলেছে।’
‘তাই নাকি?’চারু রীতিমত লাফ দিয়ে উঠল। ‘তবে তো ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হওয়া দরকার।’
‘হবে হবে।’–শিবনাথ হাসি হাসি চেহারা করে বলল, ‘ওর সঙ্গে, ওদের সকলের সঙ্গে, আই মিন কৃষ্টি-বাসরের সমস্ত সভ্য-সভ্যার সঙ্গে আমি আপনাকে ইনট্রোডিউস করিয়ে দিচ্ছি। ভিড়টা কমুক।’
রমেশের তালাবন্ধ চায়ের দোকান ডাইনে রেখে সুপারি ও জলপাইতলার সরু পথ ধরে দু’জনে অগ্রসর হয়
‘আপনার গাড়ি কোথায়?
‘ভিড়ের মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। বড় রাস্তায়। চলুন সেদিকে যাচ্ছি।’
.
গাড়িটা ঠিক জায়গায় আছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে চারু শিবনাথের হাত ধরে আবার হাঁটতে লাগল। ‘অনগ্রসর অঞ্চল এটা। এখানে এরা–’ শিবনাথ এবার রুচির কথা উল্লেখ করতে ইতস্তত করল না। ‘এখানে এরা ক’জন তরুণ-তরুণী শিল্প-সংস্কৃতি এবং সমাজসেবার আদর্শ নিয়ে কাজ করবে শুনে পারিজাত রাজি হ’ল। তৎক্ষণাৎ আমাকেও রিকোয়েস্ট করে পাঠাল রুচি দেবীকে এসোসিয়েশনের সেক্রেটারিশিপ নিতে হবে। আমি দেখলাম, ওটা এখন আর নিছক শো না, দেখলাম যে এরকম একটা কিছু হওয়া দরকার। বুঝতেই পারছেন, প্রগেসিভ আউটলুক আছে এমন সব লোক যদি এগিয়ে না যায়–’ শিবনাথের কথা থেমে গেল। গল্প করতে করতে ক্যানাল সাউথ রোডের এক জায়গায় এসে দু’জন থমকে দাঁড়ায়।
ঊর্বশী হেয়ার কাটিং সেলুনের আজ অপরূপ সজ্জা। দরজার দু’দিকে কলাগাছ ও মঙ্গলঘট বসানো, দেবদারুর পাতায় মুখে দেওয়া হয়েছে চৌকাঠ। ঝালর ঝুলছে, নিশান উড়ছে, লাল নীল সবুজ হলুদ ইলেকট্রিক বালবের মালা প’রে পাঁচু ভাদুড়ীর দোকান পথচারীদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
‘কি ব্যাপার?’ শিবনাথ অস্ফুটে বলল।
‘দেখতে পাচ্ছেন না? চারুর চোখে আগে পড়েছে সেলুনের মাথায় দোতলার বারান্দায় ঝোলানো চকচকে নতুন প্রকাণ্ড একটা সাইনবোর্ড। চারু আঙুল তুলে দেখাতে শিবনাথ ঘাড় তুলল। তারপর শব্দ করে হেসে উঠল। আই সি।’
‘ভাদুড়ী তা হ’লে আজই ম্যাসেজ ক্লিনিক স্টার্ট দিলেন?’
‘হ্যাঁ স্যার, আজ দিনটা ভাল। আমি পাঁজি দেখে দিয়েছি। অত্যন্ত অপিশাস ডে। আসুন আসুন।’
চমকে উঠল শিবনাথ। বিধু মাস্টার দোকান থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর হাত ধরে ফেলেছে। একটু বিরক্ত হয়ে শিবনাথ হাতটা ছাড়াতে চেষ্টা ক’রে চারুর দিকে তাকাল। বিধু এবার চারু রায়ের হাত ধরল। ‘আসুন স্যার। পাঁচু ভায়া একটা নতুন কনসার্ন ওপেন করল, একবারটি এসে দেখুন। আপনাদের কো-অপারেশন সিম্পেথি সে আশা করে বৈকি।’
দরজায় দাঁড়িয়ে পাঁচু শিবনাথকে ডাকল।
আসুন স্যার, সিগারেট খেয়ে যান।’
অগত্যা চারুর হাত ধরে শিবনাথ ভিতরে ঢুকল। দু’জনকে দুটো চেয়ারে বসতে দিয়ে বিধু মাস্টার বলল, ‘সে কথাই এতক্ষণ পাঁচুকে বলছিলাম। ওদিকে পারিজাত সংস্কৃতি কালচার সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক’রে লাফাচ্ছে। কিন্তু আসলে কাজ কতটুকু হচ্ছে বা হবে। আসলে এটা হ’ল, মানে আমি আজকের ফাংশনের কথাই বলছিলাম, পারিজাতের ওটা একটা ইলেকশন-স্টান্ট ছাড়া আর কিছু না। কি বলেন আপনি?’ বিধু চারুর মুখের দিকে তাকাল। চারু হাসল, কথা বলল না। শিবনাথ গম্ভীর হয়ে থেকে পাঁচুর প্রসারিত হাত থেকে সিগারেট তুলে নিল। সিগারেট ধরানো শেষ করে তেমনি গম্ভীর গলায় বলল, ‘এটা,–যার যেমন চিন্তাধারা। কি আর বলব। আমি তো মনে করি ভাল কাজ সব সময়েই ভাল। ইলেকশনের নামেও যদি কিছু কাজ হয়ে যায় আপত্তি কি।
যেন বিশেষ সন্তুষ্ট হল না শিবনাথের কথা শুনে। বিধু মাস্টার চুপ ক’রে দরজার বাইরে তাকায়। এবার পাঁচুর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে পরে শিবনাথ এক চোখ ছোট করে মাস্টারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল : ‘কানুকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তো ম্যাসেজ ক্লিনিকে?’
বিধু মাস্টার মাথা নাড়ল।
‘কানু মানে? আমি মমতা সাধনাকেও ঢুকিয়ে দিলাম।’
হতভম্ব হয়ে শিবনাথ বিধুর মুখের দিকে চেয়ে রইল।
‘কি, আপনি খুব অবাক হলেন। কেন আপনাকে কি অনেকদিন বলিনি আমার এসব প্রেজুডিস নেই। ডিগনিটি অব্ লেবার কথাটার মূল্য আমি খুব বেশি দিই। হ্যাঁ, সে কথাই এতক্ষণ পাঁচু ভায়াকে বলছিলাম। সংস্কৃতি ওয়লেফেয়ার করে পারিজাতের দল খুব লাফাচ্ছে, কিন্তু রিয়েলি একটা কাজের মত কাজ করল আজ আমাদের ভাদুড়ীই। দু’টো গরিবের ছেলেমেয়েদের প্রভিশনের ব্যবস্থা হয়ে গেল এখানে। ইজ্ দ্যাট নট্ সো?’
‘তা মমতা সাধনাকে ম্যাসেজ ক্লিনিকে ঢোকালেন। ওদের মা মানে আপনার স্ত্রী আপত্তি করেন নি তো? তিনি তো আবার—’
‘ও, আপনি ওদিকে ব্যস্ত ছিলেন বলে খবর জানেন না, শেষ রাতে ভীষণ পেইন ওঠে সাধনার মা’র। তাড়াতাড়ি পাঁচুর কাছ থেকে একটা টাকা চেয়ে নিয়ে রিক্শায় করে সকালে হাসপাতালে রেখে এলাম। এম্বুলেন্স ডাকার সময় ছিল না। আপত্তি? হ্যাঁ, হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে যখন শুনবেন তখন একটু মুখভার–তা আপত্তি আর শোনে কে। বৎসরান্তে একটি নতুন মুখ নিয়ে হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে তিনি অনেক ঝগড়াই আমার সঙ্গে করেছেন এ পর্যন্ত। এবার সেরকম কিছু করলে আমি ঠিক মাথা ফাটিয়ে দেব!’ দাড়ির জঙ্গলের কাছে ঢাউস মাছিটা উড়ু-উড়ু করছিল। বিধু হাত তুলে সেটাকে তাড়িয়ে দেবার একটুও চেষ্টা করল না। এমন সময়, বিস্ময়ের ওপর বিস্ময়, ওপর থেকে খটখট শব্দ ক’রে একটি লোক নিচে নেমে এল। চারু এবং শিবনাথ কে. গুপ্তকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। আজ আর বেশভূষা তেমন নোংরা না। বরং সুন্দর সার্ট গায়ে রংদার লুঙি কে. গুপ্তর পরনে, পায়ে নতুন চটি এবং হাতে বাঁধানো একখানা খাতা! কে. গুপ্তর দাড়িগোঁফ কামানো।
‘হ্যালো, কি ব্যাপার।’ কে. গুপ্ত চারুকে দেখে সামান্য হাসল। কিন্তু চারু বা শিবনাথের তরফ থেকে তেমন সাড়াশব্দ না পেয়ে সোজা পাঁচুর সামনে চলে গেল এবং খাতা খুলে কি যেন তাকে বোঝালে। পাঁচু মাথা নাড়ে। ‘হ্যাঁ, আপনাদের বিলিতি অফিসের হিসাব আমাদের দিশি দোকান অফিসের হিসাব সবই একরকম–মূলে সব এক। হা-হা।’ কথা শেষ ক’রে পাঁচু হাসল। পাঁচুর প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট তুলে কে. গুপ্ত চারু বা শিবনাথের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে আবার বাঁ-দিকে বারান্দার ঝোলানো সিঁড়ি বেয়ে খট্খট্ ক’রে ওপরে উঠে গেল।
বিধুমাস্টার শিবনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী রকম দুরবস্থায় পড়েছিল লোকটা জানেন তো। তাই বলছিলাম, এই সমাজের জন্য কিছুই করবে না পারিজাত।’ হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিধু মুখটাকে বিকৃত করল। ‘কেবল কথার ফুলঝুরি। রিয়্যালি যদি কারো হার্ট থেকে থাকে দু’টো লোকের উপকার করার, দু’টো লোককে বাঁচাবার ইচ্ছা যদি কারো থাকে তো এ-তল্লাটে আমি পাঁচু ছাড়া আর কাউকে দেখি না। ড্রিঙ্ক করে ভাদুড়ী ইয়ে বাড়ি যায়, কিন্তু তার অন্তঃকরণ যে কত উদার আমি প্রত্যেক স্টেপে তার পরিচয় পাচ্ছি। না খেয়ে লোকটা মরে যাবে দেখে পাঁচু ডেকে কে. গুপ্তকে এখানে প্রভাইড করল। তাছাড়া হিসাবপত্র দেখারও একজন লোক চাই। এবং ক্লিনিক যখন চালু হবে বেবিকেও এখানে নিয়ে আসা হবে। কে. গুপ্তরও তাই ইচ্ছা। পুলিসের হাঙ্গামাটাও তদ্দিনে মিটে যাবে। ক্ষিতীশ রমেশকে খুন করেছে, তার জন্যে তো আর বেবিকে দায়ী করতে পারবে না।’
শিবনাথ বলল, ‘কে. গুপ্তর স্ত্রীর কি বেবিকে এ কাজে এলাউ করবে?’
‘আলবত করবে।’বিধুমাস্টার রীতিমত ধমক দিয়ে উঠল। ‘না করলে গুপ্ত স্ত্রীকে বলেছে, সে যেখানে খুশি চলে যাক। ডটারের ওপর ফাদারের রাইট বেশি। গুপ্ত নিজে এই কনসার্নে আছে। এখন এখানে বেবি চাকরি করলে ওকে চোখে চোখে রাখতে পারবে। এবং দুটো পয়সাও উপায় করা হবে, বলছিল কে. গুপ্ত একটু আগে আমাকে। আমি তার স্পিরিটের প্রশংসা করি।’
এমন সময় ওপরে হঠাৎ কে. গুপ্তর গলা শোনা গেল। কবিতা আওড়াচ্ছে বোঝা যায় :
Are women wise? Not wise, but they be witty,
Are women witty? Yes, the more the pity;
They are so witty, and in wit of wily,
they ye be ne’r so wise, the will beguile ye.
‘ভায়ার আমার আজ আনন্দ হয়েছে, কবিতা আবৃত্তি করছে।’ বিধুমস্টার চারুর দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘খুব স্বাভাবিক। আমার মনটা আজ সবদিক থেকে ভাল, পাঁচু, হা-হা। ওপেনিং-ডে। একটা মাইক্ ফিট্ করলে মন্দ হত না।’
পাঁচু নীরব।
‘তা আমি অবশ্য কে. গুপ্তর মত সাহেব মানুষ না। ইংরেজী কবিতা রিসাইট না ক’রে বরং একটা বাংলা ছড়া বলছি, ভারি সুন্দর। কাল রাতে পেইন ওঠার আগে গিন্নী বাচ্চাগুলোকে শেখাচ্ছিল মনে আছে, হা-হা।’ ব’লে আনন্দের আতিশয্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দু’বাহু শূন্যে নেড়ে বিধুমাস্টার চেঁচিয়ে আরম্ভ করল :
বাঁশবনের কাছে,
ভূঁড়োশিয়ালী নাচে;
তার গোঁফজোড়াটি পাকা,
মাথায় কনক-চাঁপা!
ছড়া শেষ করে মাস্টার জোরে হাসতে লাগল। পাঁচু হাসল। শিবনাথ হাসে। চারু হাসে কিন্তু শব্দ হয় না।
‘আচ্ছা উঠি আমরা এখন।’ চারু উঠে দাঁড়াল।
‘চলি, দেখা হবে মাঝে মাঝে।’ শিবনাথ বিধু এবং পাঁচুর দিকে তাকিয়ে আসন ছেড়ে উঠল।
রাস্তায় নেমে শিবনাথ বলল, ‘আপনার মায়াকানন ছবির আরো কিছু মালমশলা পেয়ে গেলেন, হা-হা।’
চারু সেই হাসিতে যোগ দিল না। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘না মশাই, এসব যথেষ্ট হয়েছে। দুঃখ-দারিদ্র্যের চিত্র বেশী দিতে গেলে ছবি অনাবশ্যক দীর্ঘ এঘেয়ে হয়ে পড়বে। লোকের ধৈর্য থাকবে না। তা ছাড়া আজকের ফাংশন বিশেষ করে রুচি দেবীর অমন সুন্দর স্পিচটার জন্যে আমাকে অতিরিক্ত কয়েক শ’ ফুট রীল স্পেয়ার করতে হবে।’ শিবনাথ সপ্রশংস দৃষ্টিতে চারুর মুখের দিকে তাকিয়ে অল্প অল্প হাসে। অদূরে অনেক লটবহর নিয়ে একটা ঠেলাগাড়ি চলেছে। পিছনে একটা রিক্শায় দুটি মেয়ে। শিবনাথ দু’জনের খিলখিল হাসির শব্দ শুনে চমকে ঘাড় ফেরায়। বারো ঘরের বাড়ির প্রীতি-বীথি। চারু রায়কে দেখে না কি তাকে দেখে দু’বোন এমনভাবে হাসছে, ঠিক বুঝতে পারে না।
রিকশাটা একটু দূরে সরে যেতে শিবনাথ চারুর দিকে মুখ ফেরায়। ‘চিনতে পারলেন?’
‘আপনাদের বস্তিতে থাকে, তাই না? হ্যাঁ, আমি দেখেছি–তা বাড়ি ছেড়ে দিলে নাকি?’
‘তাই তো দেখতে পাচ্ছি।’ শিবনাথ খুক্ ক’রে হাসল। ‘বড়টা টেলিফোনে চাকরি করে জানেন বোধ হয়, আর ছোটটা, হ্যাঁ বীথি, যার গলায় রুমাল বাঁধা দেখলেন, ভারী মজার এক চাকরি জুটিয়েছে।’
‘কি রকম?’ চারুর খুব যে একটা কৌতূহল হ’ল তা না, তথাপি প্রশ্ন করল, ‘কি কাজ?’
শিবনাথ গলা পরিষ্কার ক’রে সংক্ষেপে বীথির কাজের ধরনটা চারুকে বলল। শুনে চারু রায় চুপ ক’রে রইল।
‘নাউ ইউ ক্যান ওয়েল আন্ডারস্ট্যান্ড মিঃ রায়।’ এক গাল হেসে শিবনাথ বোঝায় : ‘মানে পাব্লিক ইয়ে আপনি বলতে পারবেন না বীথিকে, প্রাইভেট হয়ে রইলেন আর কি। সাদা কথায় যাকে কে বলে, মানে ভদ্দরলোকের রক্ষিতার মত থাকবেন আর কি, কি বলেন। ছেলে দেখাশোনা করা না কচুপোড়া। ওটা শো। তত যার বাচ্চার জন্যে চিন্তা ভাবনা সে পাস করা নার্স রাখবে, নয়তো বিয়ে করবে। বীথির মত এমন একটা কাঁচা কচি মেয়েকে অন্তঃপুরে টেনে নেওয়া কেন?
চারু এবারও কোন কথা বলল না।
যেন একটু অস্বস্তিবোধ করছিল শিবনাথ।
‘দিন মশাই এসব দিন আপনার মায়াকাননে। এখানে বীথি একটা এগ্জাম্পল। ইকনমিক ক্রাইসিস গেরস্থ ঘরের মেয়েদের আজ কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে–’
শিবনাথের কথা শেষ হবার আগে চারু মুখ খুলল : ‘নাঃ, বলেছি তো আপনাকে এসব চিত্র বেশি দেবার আর আমার ইচ্ছা নেই। এখন ভাল জিনিস, সুন্দর ছবি–’ কথার শেষ না ক’রে চারু থামল, ‘কি একটু ভেবে পরে আস্তে প্রশ্ন করল, ‘তিনি কোথায়, তিনি কি এই রাস্তা দিয়ে বাড়ির ফিরবেন?’
‘কে? অ।’ মুহূর্তে বুঝতে পারল শিবনাথ। ‘রুচির কথা বলচেন? ঠিক এখুনি কি ফিরবে, মনে তো হয় না। সমিতি নিয়ে সন্তোষের সঙ্গে যেমন আলাপে মেতে গেছেন দেখলাম।’
বড় রাস্তা ছেড়ে দু’জন বাঁদিকের গলিতে ঢুকল।
শিবনাথ বলল, ‘টু স্পীক দি টুথ, বুঝলেন মিঃ রায়, আমি, ভাবতে পারিনি সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের কথা শুনে ও হ্যাঁ, আমার স্ত্রীর কথা বলছি, এমন মেতে উঠবে, কী ইন্টারেস্ট, শুনলেন তো বক্তৃতা, বাবা, এত কথা ওর মধ্যে লুকিয়ে ছিল আমি কোনদিন ধারণা করতে পারনি।’
‘হয়।’ চারু বলল, ‘এক একটা সময় আসে সুযোগ এসে ধরা দেয় যখন মানুষের ভিতরের ইচ্ছা-শক্তি, হ্যাঁ, প্রতিভাও বলতে পারেন, আপনা থেকে ফুটে ওঠে। আপনার স্ত্রীরও তাই হয়েছে আর কি। সুন্দর তাঁর বলার ভঙ্গি। আমি বলেছি তো আপনাকে। চার্মিং।’
চারুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ বড় রকমের একটা আলো দেখা গেল। দুধারের গাছপালা সাদা হয়ে গেল।
‘কে ওরা?’ চারু বিড়বিড় ক’রে উঠল।
‘মনে হচ্ছে আমার স্ত্রী, হ্যাঁ, ওই তো সন্তোষের দল।’
শিবনাথের অনুমান সত্য। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে বাঁক ঘুরে রুচি, সন্তোষ, জীবন, অসিত, দু’টি মেয়ে এবং আরো দু’ একটি ছেলে সামনে এসে দাঁড়ায়। তাদের পিছনে মদন ঘোষ। হাতে একটা হ্যাঁজাক ঝুলছে।
‘কি ব্যাপার?’ শিবনাথ বড় ক’রে হাসল।
‘দাদাবাবু দিদিমিণিরা ঘুরে ফিরে জায়গাটা দেখছেন।’ মদন ঘোষও হাসল। ‘অন্ধকার, বাবু আমাকে আলোটা সঙ্গে দিয়ে পাঠালেন।’
‘পারিজাতবাবু কি বাংলোয় ফিরে এসেছেন? ওঁরা সব চলে গেছেন?’শিবনাথ তাড়াতাড়ি বলল, ‘আমাকে ডেকেছিলেন কি?’
‘না।’ মদন ঘোষ মাথা নাড়ল। কাল খুব সকালে আপনাকে দেখা করতে বলছেন। আরো কি কাজের কথা যেন আছে। আজ,–আজ পারিজাত একটু ক্লান্ত, বললেন।’
‘না না, আজ আর আমি তাঁকে ডিস্টার্ব করতে চাই না, বিশ্রাম করুন।’ শিবনাথ ব্যস্ত হয়ে বলল, টায়ার্ড তো হবে, এত বড় একটা ফাংশনের ধকল কি আর কম গেছে। কাল আৰ্লি মর্নিং-এ মানে চা খেয়েই আমি পারিজাতের সঙ্গে দেখা করতে যাব।’কথা শেষ করে শিবনাথ আড়চোখে রুচির দিকে তাকাল। রুচি মুখ ফিরিয়ে সন্তোষের সঙ্গে সমিতির কথা বলছে।
‘কাল, কাল আর্লি মর্নিং-এ তোমরা কি একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবে। লাইব্রেরীর চাবি আমি নিয়ে নিয়েছি। আমার ইচ্ছা পুরানো কি কি বই আছে তার একটা লিস্ট তৈরী করে রাখব।
‘তাই করবেন।’ সন্তোষ ঘাড় নাড়ল। ‘আপনাকে আর একটা কথা ব’লে রাখছি রুচিদি, আসতে পারব কি পারব না এভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলবেন না। যেন আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনি কাজের কথা বলছেন। হুকুম করবেন, আদেশ করবেন। আর্লি মর্নিং মানে, রাত দু’টোর সময় দরকার হলে আমাদের ডাকবেন, অবশ্য দু’দিন পরে ডাকতেই হবে। নার্সিং-এর কাজ আছে, পাড়ার কারো অসুখ হ’লে হাসপাতালে পাঠাবার প্রশ্ন আছে, তা ছাড়া—’
‘এটা আপনি মনে রাখবেন রুচিদি। আপনার হুকুম পেলে আমরা আগুনে ঝাঁপ দেব, পাহাড়ের চূড়ায় উঠব, ঝড়ের মুখে নিজেদের ছেড়ে দিয়ে যে-কাজটি করবার তা ক’রে শেষ করব। দেবীর আদেশ মনে ক’রে আমাদের তা করতে হবে।’
রুচি সুন্দর ক’রে হাসল। খুব সম্ভব এই ছেলেটিই আর্টিস্ট, শিবনাথ অনুমান করল। লম্বা চুল। লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি গায়ে। পরনে ঢিলে স্যালোয়ার।
‘তোমার সঙ্গে এদের পরিচয় হয়েছে কি?’ রুচি শিবনাথের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘তুমি তখন ডক্টর নাগের সঙ্গে মঞ্জুর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলছিলে, পারিজাত আমার সঙ্গে এদের সকলের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। বরং এঁর সঙ্গে তোমাদের পরিচয় নেই, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।’ শিবনাথ হাত দিয়ে চারু রায়কে দেখাল।
রুচি এবার যখন হাসল, সুন্দর দাঁতগুলি দেখা গেল। ‘নমস্কার, আমি আপনাকে মিটিং- এ লক্ষ্য করেছি। মিঃ গুপ্তর সঙ্গে আপনাকে এপাড়ায় দেখেছি।’
কে. গুপ্তর বন্ধু চারু রায় স্বাভাবসুলভ মেয়েলি হাসি হেসে রুচিকে প্রত্যাভিবাদন জানাল।
শিবনাথ সন্তোষদের দিকে তাকিয়ে পরে চারু রায়ের দিকে তাকায় : সাহিত্যিক সন্তোষকুমার, আর্টিস্ট ইনি, ইনিও, তাদের এক গুণী শিল্পী বন্ধু, অসিতকুমার, এর নাম জীবনকুমার। সবাই কৃষ্টি-বাসরের সভ্য। এঁরা এদের বোন,–সভ্যা।’
চারু রায় হাত জোড় করল।
‘আর ইনি বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজক চারু রায়।’ শিবনাথ জানিয়ে দিল।
শিবনাথের কথা শেষ হতে না হ’তে সন্তোষদের মহলে একটা আনন্দগুঞ্জন উঠল। ভাল, খুব সুখী হলাম, আপনার মত শিল্পীর আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন হবে।’ আর একজন বলল,—-এই সমিতির কাজকর্ম নিয়ে ডকুমেন্টারী ছবি তোলা হবে।’ একজন বলল, ‘উই আর ভেরি গ্লাড টু মিট ইউ। আপনিও আমাদের মধ্যে থাকবেন।
চারু রায় স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে ছেলেদের অভিনন্দনের উত্তর জানাল।
রুচি বলল, ‘এত গুণ আপনার আমি কিন্তু বুঝতে পারিনি।’
‘তুমি কি ভেবেছিলে কে. গুপ্তর সঙ্গে আমার সঙ্গে মুদি দোকানে বসে আড্ডা দেন ব’লে খুব অর্ডিনারী কেউ?’
শিবনাথের কথাটা মোটাধরনের হ’ল ব’লে রুচি ভিতরে আহত হ’ল। এবং লজ্জিত।
‘যাকগে, খুশি হলাম।’ বলে সে তৎক্ষণাৎ সুন্দর হাসি দিয়ে মুখের ভাব গোপন করল। ‘হ্যাঁ, আপনার কো-অপারেশন চাই।’
‘একশ’বার হাজারবার। চারু রায় দু’বার মাথা নাড়ল।
প্রাথমিক আলাপ-পরিচয়ের একটা পর্যায় শেষ হয়েছে টের পয়ে ওদিকে থেকে সন্তোষের বোন দয়মন্তী চট করে হাতঘড়ি দেখে নিয়ে রুচির দিকে তাকায়।
‘চলি বৌদি, রাত হয়েছে। আবার কাল আসব, এসে আপনাকে অত্যাচার করব।’
‘হ্যাঁ, অনেকদূর যেতে হবে আমাদের।’ আর একটি মেয়ে, সম্ভবত জীবনের বোন হাতঘড়ি দেখতে দেখতে বলল, ‘কোথায় পার্ক স্ট্রীট, কোথায় কুলিয়া-টেংরা। যেতে বেশ রাত হবে—’
বাধা দিয়ে সন্তোষ বলল, ‘মোটেই না, কতটুকুন পথ। তা ছাড়া আমরা তো আর ট্রামে বাসে যাচ্ছি না। ট্যাক্সি ডাকব।’
শিবনাথ বলল, ‘এখানে তো ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, একটু এগিয়ে গিয়ে– মদন ঘোষ বলল, ‘ট্যাক্সির জন্যে আগেই লোক পাঠানো হয়েছে। হয়তো এসে গেছে, চলুন বড় রাস্তায়।’
এবার বিদায়ের পালা। ‘আচ্ছা চলি বৌদি!’
‘রুচিদি আজকের মত বিদায়।’
‘উইশ ইউ হ্যাপি গুড্ নাউট।’
‘আচ্ছা নমস্কার।’
‘নমস্কার।’
আলো দেখিয়ে মদন ঘোষ সঙ্গে চলছিল। সন্তোষ বাধা দিলে। ‘না সরকার, আমাদের সঙ্গে আর আসতে হবে না। তুমি বরং এঁদের বাড়ি পৌঁছে দাও। রাস্তাটা খারাপ।’
মদন ঘোষ নিবৃত্ত হ’ল। নিবৃত্ত হল কিন্তু অইটুকুন একটা ছেলের মুখে ‘তুমি’ সম্বোধনটা যেন মদনের ভাল লাগল না। কিছু বলল না যদিও। এক হাতে আলো ঝুলিয়ে আর এক হাতে জামার বোতাম ঠিক করতে করতে হাঁ ক’রে ওদের চলে যাওয়া দেখতে লাগল। হাঁ করে আর একজনও ওদের দিকে তাকিয়ে ছিল। শিবনাথ। ওদের সকলের দিকে না। দেখছিল উগ্র আধুনিক সাজে সজ্জিতা সুশ্রী তন্বী পার্ক স্ট্রীটের তিনটি কুমারীকে। শিবনাথ গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
এদিকে রুচি ও চারুর মধ্যে বাক্য-বিনিময় হচ্ছিল।
‘আপনি গাড়ি নিয়ে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভাল কথা’ নতুন কোনো বইয়ে হাত দিয়েছেন কিনা জিজ্ঞস করা তো হ’ল না।’ কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে রুচি আবার হাসল এবং তার সুন্দর দাঁত ক’টি দেখা গেল।
‘হ্যাঁ, অনেকদূর কাজ এগিয়েছে। মায়াকানন।
‘এন্ড দ্যাট্ উইল বি এ গ্রেট পিক্চার। তোমায় বলিনি রুচি।’ শিবনাথ এদিকে ঘাড় ফেরায়। ‘মিঃ রায় প্রথম শ্রেণীর একটি চিত্র তৈরি করছেন!’
‘ভাল, আমরা দেখব।’ রুচি বলল।
চারু রায় কিছু বলল না, চোখ বুজে হাসল। চারু রায় কেন হাসছে বুঝতে পেরে শিবনাথও হাসল। রুচির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, রিলিজ্ড হোক, দেখবে,– দেখিয়ে তোমাদের বিস্মিত অভিভূত ক’রে দিতেই তো রায় এমন প্রাণপণে খাটছেন।’
মাথার ওপর গাছের পাতার খসখস শব্দ হয়। মৃদুমন্দ হাওয়া দিয়েছে। আলো হাতে নির্বাক মদন ঘোষ এবার গলার একটু শব্দ করে।
‘আচ্ছা–’ দু’হাত একত্র ক’রে রুচি বিদায় সম্ভাষণ করতে যাচ্ছিল। শিবনাথ ব্যস্ত হয়ে চারুর দিকে তাকায়।
‘ও কি, মিঃ রায়, আপনি কি এখুনি চললেন?’
‘হ্যাঁ, তা–’ ইতস্তত করে চারু রায় কি একটা বললে।
‘কেন, রাত এগারোটা বারোটাও তো কোনদিন হয়ে যায় আপনার এ-পাড়ায়। না, তেমন কিছু রাত হয়নি। চলুন হাঁটতে হাঁটতে গল্প করব। আবার না হয় আপনাকে আমি বড় রাস্তায় তুলে দিতে সঙ্গে আসব। চলুন ওদিকে।’ শিবনাথ চারুর হাত ধরল। আর এক সেকেন্ড ইতস্তত না ক’রে চারু তাদের সঙ্গে চলল, ‘হ্যাঁ, এদিকে তো আর দোকান টোকান নেই,–দেখা যাক আমাদের বনমালীর দোকান খোলা আছে কিনা।’
‘সিগারেট ফুরিয়েছে বুঝি?’
শিবনাথের দিকে না তাকিয়ে চারু মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টি সমানের দিকে। মদন ঘোষ আলো দেখিয়ে আগে যাচ্ছে, তার পিছনে রুচি, রুচির পাশে পারিজাতের একটা চাকরের কোলে মঞ্জু। ঘুমিয়ে পড়েছে।
চারু ও শিবনাথ হাত ধরাধরি ক’রে তাদের পিছে পিছে হাঁটে।
.
এত রাত্রে দোকান খোলা রাখার কারণ শুনে চারু চুপ ক’রে রইল। শিবনাথ বনমালীর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘আর ক’দিন সবুর কর বনমালী, মাসে আটটা দশটা ক’রে পাড়ায় মিটিং সম্মেলন হবে। তখন আরো বেশি রাত অবধি লোকের আনাগোনা থাকবে, আর তোমার দোকানের সিগারেটটা দেশলাইটা চকোলেটটা কাটবে। এবং তার সঙ্গে কিছু টয়লেট- ফয়লেটও।’ কথা শেষ করেও শিবনাথ হাসে।
রুচি আবার বিরক্ত হয়।
এবং দেখা যায় বনমালীও শিবনাথের রসিকতায় যোগ দিচ্ছে না। ‘কি, মুখখানা তোমার ভার-ভার দেখছি?’
‘হ্যাঁ মশাই, হাসব আর কি দিয়ে। রকম সকম দেখে ক্রমশই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’
‘আরে খুলেই বল না কি হয়েছে।’ এবার চারু রায় প্রশ্ন করল। এক প্যাকেট সিগারেট ও একটা দেশলাইয়ের দাম দিতে চারু একটা নোট বাড়িয়ে দেয়। কথা না বলে বনমালী সেটা ধরবার জন্যে হাত বাড়ায়।–এমন সময় দেখা যায় বিধু মাস্টারের সেই ইঁচড়ে পাকা ছেলে হুব্লা এসে সেখানে দাঁড়িয়েছে। বড় বড় দাঁত বার ক’রে নিঃশব্দে হাসছে, আর, একবার শিবনাথ একবার চারুর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
‘ভাগ হারামজাদা এখান থেকে।’ বনমালী গর্জন ক’রে উঠল : ‘রাতে বেরাতে শুয়োরগুলোর ঘুর ঘুর আর কমে না।’
ভয় পেয়ে হুব্লা বাড়ির ভিতর পালিয়ে গেল।
শিবনাথ শব্দ ক’রে হাসল।
মদন ঘোষ আলোটা মাটিতে রাখল। কাল সে এসে বাতিটা নিয়ে যাবে। আজ থাক। বৌদিমণির অন্ধকারে তালা খুলতে অসুবিধা হবে। পারিজাতের সরকারের ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে রুচি ঘাড় কাত করল। মদন চলে গেল।
ঘুমন্ত মঞ্জুকে নিজের কোলে নিয়ে শিবনাথ চাকরটাকেও বিদায় দিলে। ‘যা বাবা যা, সারাদিন খেটেছিস। এখন গিয়ে খাওয়া দাওয়া কর, বিশ্রাম কর।’
পারিজাতের চাকরটা সরে যেতে বনমালী খবরটা বলল। হাসপাতালে রুণু মারা গেছে। বিকেলে বাড়িতে সংবাদ এসেছে।
রুচি এবং চারু হঠাৎ কথা বলল না।
শিবনাথ কি প্রশ্ন করতে গিয়ে থামল।
বনমালী বলল, ‘আমিও ছিলাম না পাড়ায়। এই তো একটু আগে দোকান খুললাম। ওই সালা বিধুর মাছি ছেলেটা, কি যেন নাম, হুব্লা এসে আমায় বলে গেল।’
‘আমাদেরও সেই খবর দিতে এসেছিল বোধহয় হুব্লা?’ রুচি হাসল না। আকাশের দিকে চোখ তুলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। ‘সমিতির নামটা কালই পাল্টাতে হবে।’
‘হ্যাঁ, তোমরা তাই করো।’ শিবনাথ উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘রুণুর নামে সমিতির নামকরণ হচ্ছে তোমরা তো আগেই বলেছিলে। তাই না?’
রুচি কথা বলল না।
‘মহিলা খুব কাঁদাকাটা করছেন বুঝি? আমি কে. গুপ্তর ওয়াইফের কথা বলছি।’
শিবনাথের প্রশ্ন সঠিক জবাব দিতে পারল না বনমালী। হুব্লাকে সে অত কথা জিজ্ঞেসা করেনি। তা ছাড়া সে বাইরের লোক। বাড়ির লোক কেউ যখন এ-ব্যাপার নিয়ে ভাবে না তখন সে খামকা কেন–বনমালী তাই চুপ করে আছে।
কিন্তু শিবনাথ বনমালীর চেয়েও চতুর, যেন এটা প্রতিপন্ন করতেই সে চারুর দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল : বাড়ির লোকের আর দোষ কি। ছেলের ফাদার, মানে আমি আপনার ফ্রেন্ড কে. গুপ্তর কথা বলছি, পাঁচুর ম্যাসেজ-ক্লিনিকে দিব্যি চাকরিটি বাগিয়ে কেমন ইংরেজি কবিতা আওড়াচ্ছিল তখন শুনলেন তো। মানে সেখানে আর যাই হোক, ওয়াইন উয়োম্যানের অভাব হবে না–গুপ্ত এটা খুব ভাল বুঝতে পেরেছে। ছেলে মরেছে শুনলেও যে খুব একটা শোক- আফসোস করবে মনে হয় না, হা-হা, আপনি চুপ ক’রে আছেন মিঃ রায়?’
চারু রায় কথা বলল না।
বন্ধু সম্পর্কে শিবনাথের উক্তিগুলি তাঁর মনঃপুত না-ও হ’তে পারে বুঝতে পেরে বুদ্ধিমতী রুচি তাড়াতাড়ি বলল, ‘না, আমি মহিলাকেই বেশি দোষ দিচ্ছি, মিঃ রায়, ভীষণ অহংকারী এবং আনসোশ্যাল। তিনি,–তাঁরই তো উচিত ছিল সংসারটাকে সামলানো। ইচ্ছা করলে পারতেন। ভদ্রলোক,–হ্যাঁ, কে. গুপ্তর কথা বলছি, না হয় অবুঝ পাগল মানুষ।’
‘বদমায়েস, স্কাউন্ডেল!’ যেন শিবনাথ ধমক দিয়ে উঠল। ‘এত যার মদ মেয়ে-মানুষের দিকে ঝোঁক, তার পরিবার তার ছেলেমেয়ে সাফার করবে না তো কি। ঠিকই হয়েছে। অ্যাম আই রং মিঃ রায়?’
মিঃ রায় এবারও কিছু বলল না।
যেন খাতায় কি একটা হিসাব টুকছিল বনমালী। লেখা শেষ করে যখন মুখ তুলল দেখা গেল তার ঠোঁটের কোনায় একটা সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দিয়েছে। চারুর দিকে তাকিয়ে অবশ্য সে তৎক্ষণাৎ হাসির ধারটা মজিয়ে নেয়। বরং চেহারাটা একটু গম্ভীর ক’রে আস্তে আস্তে বলল, ‘না, কেবল লেখাপড়া শিখলে কি হয়। সাংসারিক জ্ঞান বলতে আমাদের গুপ্ত সাহেবের একবোরে কিছু নেই। মদ মেয়েমানুষে করবে কি, পাঁচু ভাদুড়ীর কি ওদিকে ঝোঁক কম, না টাকাপয়সা কম উপায় করছে। পয়সা, পয়সা রোজগার করা, পয়সা চিনতে পারার চোখ না থাকলে এবাজারে খড়কুটোর মত ভেসে যেতেই হবে।’
‘হ্যাঁ, ওদিক থেকে গুপ্ত–’ মাথা নেড়ে চারু বনমালীকে সমর্থন করতে যাচ্ছিল, শিবনাথ তাচ্ছিল্যের সুর বার করে হাসল। ‘একেবারে হোপলেস, সাদা কথায় লোকটাকে অপদার্থ বলা চলে।’
বনমালীর ঠোঁটে আবার সূক্ষ্ম হাসি উঁকি দেয়। শিবনাথের দিকে বা চারুর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা চোখ ছোট ক’রে সে হাসল কি কাশল বোজা গেল না, বলল, ‘এ বাড়ির সকলকে টেক্কা দিয়েছেন আমাদের এই শিববাবু। এসেই দু’দিনের মধ্যে পারিজাতকে হাত করে ভোটের কাজখানা বাগিয়ে রোজগারের বেশ ভাল রাস্তাটা বেছে নিয়েছেন, হা-হা।’
হাসিটাকে শেষ দিকে উচ্চগ্রামে তুলে নিজের সারল্য প্রতিপন্ন করতে বনমালী চেষ্টা করল বটে, কিন্তু শিবনাথ তাতে সন্তুষ্ট হ’ল না এবং শিবনাথের চেয়েও বেশি ক্ষুব্ধ আহত ক্রুদ্ধ হ’ল রুচি। কিন্তু চেহারায় তার আভাসমাত্র ছিল না। দু’পা অগ্রসর হয়ে রুচি চারুকে বলল, ‘সিগারেট কিনতে এসে মুদিদোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করার ফল আপনিই শেষটাই ভুগবেন, মিঃ রায়। বেশ দূরে যেতে হবে। এদিকে আমিও এখন একেবোরে ঘরের দরজা থেকে একটু চা না খাইয়ে আপনাকে ছেড়ে দিতে পারছি না, সুতরাং –?’
চারু এই প্রথম এবাড়ির একটি মেয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে খুশি হ’ল। চট ক’রে হাত-ঘড়ি দেখল। তারপর প্রফুল্ল হয়ে হেসে ঘাড় কাত ক’রে বলল, ‘চলুন। সত্যি আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার কী যে আনন্দ হচ্ছে! অনেকক্ষণ ধরে মনে মনে একটু চা-ও খুঁজছিলাম।
তারা অগ্রসর হয়।
পিছনে শিবনাথ।
বস্তুত যথাসময়ে ধূর্ত মুদীর বিদ্রূপের বিষদাঁত ভেঙে দিয়েছে রুচি। চারু রায়কে আজ উপযুক্ত ক্ষণে স্ত্রী বাড়িতে ডাকছে দেখে শিবনাথ উল্লসিত হয়।
ঘাড় ফিরিয়ে আর একবার সে বনমালীকে দেখল। বাংলা পাঁচের মত মুখখানা ক’রে পেন্সিলটা থুতনিতে ঠেকিয়ে তাদের দিকে চেয়ে আছে। ‘তুই মুদী, তুই চুপ ক’রে থাক শালা।’
কে. গুপ্তর উক্তিটা শিবনাথের মনে পড়ে। মনে মনে সে হাসে। বনমালীও পারিজাতের দল ছাড়া না। ঈর্ষা। ঈর্ষার বশে চারুর সামনে সে শিবনাথকে এভাবে এখন হুল ফোঁটাল। কিন্তু তা হলে হবে কি। চারুও পাকা ব্যবসায়ী। ভাল ছবি তুলে নিছক পয়সা উপায় করবে বলে সেও ছুটোছুটি কিছু কম করছে না। নানা কারণে মান অপমানবোধের চামড়াটাকে সে হয়তো শিবনাথের চেয়েও বেশি পুরু ক’রে ফেলেছে। ইলেকশনের কাজ ভাল। কিরণকে ফিল্মে নামাবে ব’লে চারু যে পন্থা অবলম্বন করেছিল, তাতে তার গলাধাক্কা খবার ভয় ছিল, মাথা ফাটতে পারত অমলের লাঠির বাড়ি খেয়ে। কিন্তু চারু কিছু গ্রাহ্য করে কি?
এক হাতে চারুর হাত ধরে ও অন্য হাতে পারিজাতের হ্যাঁজাক্ ঝুলিয়ে লম্বা পা ফেলে শিবনাথ রুচিকে নিয়ে বারো ঘরের উঠোনে ঢুকল। এত বড় আলো দেখে রমেশের কুকুরটা হঠাৎ ভীষণ চীৎকার ক’রে ওঠে, তারপর চেনা লোক দেখে চুপ ক’রে যায়।
সেই রাত্রে চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প করল চারু রুচির সঙ্গে। বস্তুত শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে এমন অনর্গল কথা বলতে পারে তার স্ত্রী শিবনাথের আগে ধারণা ছিল না। সে অবশ্য চুপ ক’রে রইল। আলোচনায় রুচিকেই সবটা অংশ গ্রহণ করতে দিয়ে শিবনাথ বসে বসে চারুর প্যাকেট থেকে সিগারেট তুলে ধ্বংস করতে লাগল। ‘আমার এইটেই লাভ মিঃ রায়।’ এক একটা সিগারেট ধরায় আর চারুর দিকে তাকিয়ে শিবনাথ হাসে। চারু শুধু স্মিত হেসে আড়চোখে শিবনাথের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে এবং তারপর আবার রুচির দিকে চোখ ফেরায় : ‘মিটিং-এ আপনার স্পীচ শুনে আমি তখন অভিভূত হয়ে পড়েছিলুম, মিসেস দত্ত। এখন এখানে সামনা-সামনি ব’সে কথা ব’লে, আমার মনে প্রথমেই যে ধারণা জন্মেছিল তা, যাকে বলে ইয়ে, আরো দৃঢ়মূল হল। আপনার চোখ, আপনার হাসি, আপনার কথা বলার মধ্যেই এমন একটা মাধুর্য, কমনীয়তা, শক্তি, সেবা ও কল্যাণের ইঙ্গিত পাওয়া যায় যা দেখে মনে হয় সংস্কৃতি মানে কাঁচার বলতে আমরা যা বুঝি বা বলি,আপনার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই তা প্রচুরভাবে বিদ্যমান। বিদ্যমান কথাটা কারেক্ট হ’ল কি মিসেস দত্ত? আমি আবার বাংলা শব্দটব্দগুলো সবসময়-–’
একটি মেয়ের মত হাসছিল চারু।
‘না না, ঠিক আছে।’ রুচিও দু’চোখ আধবোজা ক’রে দুই ঠোঁট ঈষৎ বিস্তৃত করল। ‘কিন্তু আপনি ভীষণ বাড়িয়ে বলছেন মিঃ রায়, অতটা প্রশংসা পাবার যুগ্যি সত্যি কি আমি?’
‘কেন।’ শিবনাথ সোজা হয়ে বসল। ‘তখন সন্তোষের সেই আর্টিস্ট বন্ধু কী বলেছিল। ‘দেবীর আদেশে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে, সমুদ্রে ঝাঁপ দেবে–
‘নিশ্চয়ই, কারো কারো চেহারায় এমন একটা আকর্ষণ থাকে, গলার স্বরে এমন একটা কমান্ডিং টোন্ থাকে যে–’ চারু পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে রুচিকে দেখল। ‘একটুও মিথ্যে বলেনি পার্ক স্ট্রীটের ছেলের দল, সেন্ট পার্সেন্ট কারেক্ট। আমি তো, আমি–’ এবার শিবনাথের দিকে ঘাড় ফেরায় চারু। ‘আপনি তো জানেন আমার পেশা মিঃ দত্ত। আজ অবধি ক’শ নারী-মুখ আমি স্টাডি করেছি বলুন দিকিনি?’ চারু মৃদু হাসছিল।
‘ওকে বোঝান।’ প্যাকেট থেকে আর একটা সিগারেট তুলে শিবনাথ বলল, ‘চিরকাল ওর মধ্যে ভয়ংকর একটা ইন্ফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বাসা বেঁধে আছে। এটা অবশ্য ওর দোষ না কেবল স্কুলে টিচারি করলে কি আর–’
‘না না এখন থাকবে না, এখন যথেষ্ট সোশ্যাল হবার সুযোগ পেয়েছেন মিসেস দত্ত, তাঁর শক্তির তাঁর প্রতিভার ফুলফ্রেজেড্ বিকাশ আমার তো মনে হয় অলরেডি আরম্ভ হয়ে গেছে।’
কোন কথা বললল না রুচি। অধোবদন হয়ে নখ দিয়ে বিছানার চাদরটা খুঁটতে লাগল।
৪৩
আর একটা দিন। পরদিন। এ-দিনের ইতিহাস ব’লে বারো ঘরের কাহিনী শেষ করব।
শেষ রাত্রের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হ’ল। প্ৰথম ফাল্গুনের বৃষ্টি। জোর কম। মাটি ভিজল কি ভিজল না। কিন্তু তা হ’লে হবে কি। গাছের পাতার ধুলো কমল, বারো ঘরের পিছনের ঘাসবনে সবুজ লাবণ্য জাগল, ঘরের চালের টালিগুলোর লাল রং দেখা দিল। সকালের রৌদ্রে চারদিক ঝিক্মিক্ করছিল। আর নরম কোমল সুন্দর একটা হাওয়া বইছিল। হলুদের ওপর কালো ফুট্কি পরা এতবড় একটা প্রজাপতিকে অনেকক্ষণ উড়তে দেখা গেল উঠোনের ওপর। এবং বলা নেই কওয়া নেই, যা কোনদিনই চোখে পড়ে না, দু’টো সাদা পায়রা, যেন কাদের ঘরের চাল ও উঠোনের চৌহদ্দি ডিঙিয়ে এই প্রথম এবাড়ির উঠোনে নেমে বারান্দায় উঠে তালাবন্ধ কমলার ঘরের দরজায় কিছুক্ষণ খুঁটে খুঁটে কি খেয়ে পরে শেখর ডাক্তারের তালাবন্ধ দরজার কাছে গেল, তারপর বীথিদের ঘরের সামনে, সেখানে কিছু না পেয়ে কিরণের দরজায়, তারপর আবার একটু এগায়, কিন্তু তারপর আর যেতে সাহস পায় না। মল্লিকার তালাবন্ধ দরজাটা আগলে ব’সে আছে রমেশের ‘ভোম্বল’ সর্দার। পায়রা দুটো বারান্দা ছেড়ে উঠোনে নেমে এবং সেখান থেকে ফুড়ুৎ ক’রে উড়ে গিয়ে রুচির ঘরের চালের ওপর বসে। তারপর আর তাদের দেখা যায় না।
এই মনোরম সকালটা রুচির খুব ভাল কেটেছে। সন্তোষ ও তার বন্ধুরা এসেছিল। শিবনাথ সব সময় উপস্থিত থাকতে পারেনি যদিও। দু’বার দু’টো কাজে পারিজাতের কাছে তাকে ছুটে যেতে হয়েছে। শেষবার সে যখন ফিরে এল, সন্তোষের দল চলে গেছে। সমিতির বিষয় নিয়ে রুচি একদিকে ওদের সঙ্গে কথা বলেছে, আর একদিকে রান্না নামিয়েছে। সন্তোষ নাকি রুচির মসুর ডালের কড়ায়ে কাঁটা দিতে এগিয়ে এসেছিল। ‘আপনাকে একটু হেল্প করছি, রুচিদি।’ হেসে, রুচি সন্তোষকে নিবৃত্ত করেছে। এঁটো বাসন ছুঁতে দেয়নি।
‘এমন বড়লোকের ছেলে, কিন্তু অহংকার নেই। এত মিশুক!’
‘না হলে সমিতি করবে কি ক’রে।’ শিবনাথ রুচির কথার জবাব দিয়েছে হেসে। রুচি আর অবশ্য কিছু বলতে পারল না। কথায় কথায় বেলা হয়ে গেছে বলে চট করে খেয়ে মঞ্জুকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে।
রুচি ওরা চলে যাবার পর বাড়িটা যেন আরো বেশি খালি খালি ঠেকছিল। তা বাড়িতে আর তেমন লোকজনই বা তখন কই। পাঁচু দোকানে গেছে। মাস্টারের বড় ছেলে ও মেয়ে দু’টো গেছে পাঁচুর দোকানে। মাস্টার হয়তো ম্যাসেজ ক্লিনিক স্টার্ট করা হয়েছে দেখে আজ আর কামাই না করে নিশ্চিন্ত মনে স্কুলে পড়াতে গেছে। ওদিকে প্রমথর বাবা বেরিয়েছে কাজে। বলাই নেই। ময়না স্কুলে গেছে রুচির সঙ্গে। আর কে? বিমলের শুধুই ‘ছোট’ না, গায়ে মুখে ‘বড়গুটি’ও দেখা গেছে। কাল তাকে হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে। হিরণ ঘরে একলা থাকবে বলে খিদিরপুরে পিসতুতো ভায়ের কাছে গেছে। থাকবে সেখানে কিছুদিন। আর কে? কিরণ নেই, বীথিরা চলে গেছে। রমেশ মৃত। ছেলেময়ে নিয়ে মল্লিকা স্থানান্তরিত। ক্ষিতীশ হাজতে। ওঘরে আছে প্রমথর দিদিমা। কাল থেকে বুড়ীরও জবাব বন্ধ হয়ে গেছে। নিউমোনিয়ার লক্ষণ। প্রমথর মা বুড়ীকে নিয়ে আর পারছে না। একলা কত খাটুনি গায়ে সয়, কাল থেকে সে-ও জ্বরে পড়েছে। উঠোনটা একেবারে ফাঁকা। এক ফালি কাপড় পর্যন্ত চোখে পড়ে না বাইরে দড়িতে কেউ শুকোতে দিয়েছে। লোকজন কমে গেছে বলে বাকি মানুষেরা এখন ঘরেই ভেজা শাড়ি কাপড় সায়া লুঙি বেড়ার গায়ে শুকোতে দেয়।
ফাঁকা উঠোন বলে এঘর থেকে ওঘরের চৌকাঠ দেখা যায়। শিবনাথের ঘরের ভিতর থেকে ওধারে প্রায় সবগুলো ঘরের দরজা দেখা যাচ্ছিল। ঘুমোয়নি সে। খাওয়া দাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করছিল। একটা সিগারেট শেষ ক’রে আর একটা ধরায়। এখনি তাকে আবার কাজে বেরোতে হবে। পারিজাতের দল ভারী করতে আজ থেকেই সে লেগে গেছে। এখন বেরিয়ে কমসে কম আট জায়গায় তাকে যেতে হবে। আটটা ঠিকানা দিয়েছে পারিজাত। অবশ্য, শিবনাথ যদি পেরে না ওঠে, টায়ার্ড ফীল করে, তবে অন্তত পাঁচ জায়গায় দেখা করে বাকি তিন জায়গা কালকের জন্যে ফেলে রাখার স্বাধীনতা না পেলে এ-কাজে সে লাগত না। ভাবছিল শিবনাথ। প্রায় তন্দ্রা এসেছিল তার। হঠাৎ রমেশের কুকুরটা তীব্রস্বরে চিৎকার করে উঠল। যেন অপরিরচিত লোক দেখেছে। অস্বাভাবিক কিছু দেখেছে। একটু চমকে উঠে শিবনাথ তাড়াতাড়ি দরজায় উঁকি দেয়। উঁকি দিয়ে দেখতে পায় কে. গুপ্তর ঘরের সামনে বিধুর ছেলে হুলা দাঁড়িয়ে। রমেশের কুকুরটাও সেখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে।
শিবনাথ ঘরে থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। শিবনাথকে দেখে হুলা বত্রিশটা দাঁত বার করে নিঃশব্দে হাসে ও হাতছানি দিয়ে তাকে ডাকে। যেন শিবনাথ তার সমবয়সী। ছেলেটার পাকামি দেখে তার খুব রাগ হয়। কিন্তু কুকুরটা পাশের ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে ক্রমাগত চিৎকার করছে। কেমন একটু সন্দেহ হল শিবনাথের। আস্তে আস্তে সে দু’পা অগ্রসর হয়। দরজার একটা পাল্লা খোলা। সকাল থেকে দরজাটা বন্ধ ছিল। যেন বাতাসে এখন খুলে গেছে। শিবনাথ কাছে যেতে হুব্লা আঙুল দিয়ে ঘরের ভিতরটা দেখিয়ে দেয়
তুই কখন দেখলি? ফিস্ফিসে গলায় শিবনাথ প্রশ্ন করে। ‘ঘরে ঢুকেছিলি নাকি?’
মাতব্বরের মত মাথা নাড়ে হুব্লা।
‘ভোম্বলের চিৎকার শুনে তো আমি এই মাত্তর ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট ভাইটাকে ঘুম পাড়চ্ছিলাম। দিদিরা কাজে বেরিয়েছে, মা গেছে হাসপাতালে।’
‘তা জানি। তোর আর একটা ভাই হবে।’ সংক্ষেপে হুব্লার কথার উত্তর দিয়ে শিবনাথ আবার কে. গুপ্তর ঘরের ভিতরে তাকায়। হুব্লাও কথা বন্ধ ক’রে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। যেন বাড়ির দু দু’টো লোক জিনিসটা লক্ষ্য করছে বুঝতে পেরে নিশ্চন্ত হয়ে ভোম্বল একটু সময়ের জন্য চুপ করে।
কেরোসিন কাঠের বাক্স দু’টো ঘরের মেঝেয় চিত হয়ে পড়ে আছে। দু’টো বাক্সের ওপর উঠে বেবির মা কড়িকাঠ নাগাল পেয়েছিল অনুমান করতে শিবনাথের কষ্ট হ’ল না। কিন্তু ওটা কি? যেন একটা ভাঁজ করা কাগজ পড়ে আছে ওধারে।
ঘাড় ফিরিয়ে বাকি ঘরগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে শিবনাথ মুখ নিচু করে হুলার কানে কানে বলল, ‘তুই ভিতরে ঢুকে ওই কাগজটা নিয়ে আয়। ভয় করে?’
মাতব্বর হুলা মাথা নেড়ে ফিক্ করে হাসল। ‘না ভয়ের কি। সেবার প্রমথদের বিধবা শৈল মাসি এমনি ফাঁস লাগিয়ে মরল। গত ভাদ্দর মাসে ছ’নম্বর বস্তির যমুনা ফাঁস লাগিয়ে মরল। যমুনার পেট হয়েছিল, হি-হি।’
‘তা হোকগে। তুই গিয়ে কাগজটা নিয়ে আয়।’
আর দ্বিরুক্তি না ক’রে হুলা সরাসরি ঘরে ঢুকে মেঝে থেকে ভাঁজ করা কাগজটা কুড়িয়ে এনে শিবনাথের হাতে দেয়। সুন্দর পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষর সুপ্রভার : বেবির জন্য দুঃখ করি না। হয়তো ওর মধ্যে পাপ ছিল। আমার রুণুর কোনো দোষ ছিল না। পারিজাত ওকে গাড়ি চাপা দিয়ে ওকে জন্মের মত পঙ্গু করে দিলে অথচ তার কোনো প্রতিকার হ’ল না? এমনকি ঘটনাটা যাতে প্রকাশ না পায় তার চেষ্টার ত্রুটি দেখছি না। গুরুদেব, জানি না আপনি আমাকে এখন কি করতে উপদেশ দেবেন। আমার নিজের কোনো হাত-পা নেই। আপনার উপদেশ ছাড়া আমি এক পা-ও নড়তে পারি না। রুণু ক্যাম্বেল হাসপাতালে আছে। ওকে একদিন গিয়ে দেখুন আর আপনার পাদোদক খাইয়ে আসুন। যাতে তাড়াতাড়ি ও ভাল হয়ে ওঠে। ইতি–সুপ্রভা।
শিবনাথ চিঠিটা ভাঁজ করে তাড়াতাড়ি হাতের মুঠোয় লুকোল। সন্দিগ্ধ চোখে হুলার চেহারা দেখতে চোখ ফেরাতে দেখে সে আবার গিয়ে কে. গুপ্তর ঘরে ঢুকেছে। সুপ্রভার কোমর বেয়ে আঁচলটা নিচে সিমেন্টের ওপর লুটোচ্ছিল। যেন আবার কিছু একটা আবিষ্কার করছে হুলা। হামাগুড়ি দিয়ে সেই লুটানো আচলের গিঁঠ, এমনি পারছে না, বড় বড় দাঁত দিয়ে খুলে কি একটা উদ্ধার করে বাইরে চলে এল।
একটা ঘষা দু’ আনি।
‘নে তুই রেখে দে।’শিবনাথ অভয়বাণী দিয়ে বলল, ‘দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে চলে আয়, তোকে আমি আর একটা দু’আনি দেব।’
শিবনাথ তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গায়ের জামা জুতো ও দরজার চাবি নিয়ে বেরিয়ে এল।
‘চিঠি পাওয়া গেছে কাউকে বলিস না। নে ধর্।’
আরো একটা দু ‘আনি হাতে পেয়ে হুব্লার চোখ দুটো গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম করছিল।
‘না আমার কোন্ গরজ। আমি শালা গলায় দড়ি মামলায় নাক ঢোকাতে যাই কেন। বাবাকেও বলছি না। ওই পয়সা দিয়ে স্রেফ ডবল ডিমের মামলেট খেয়ে আসব রাসমণির বাজারে রাধুর রেস্টুরেন্টে।’
‘তাই খাস্।’
শিবনাথ স্বল্প হেসে হুব্লার থুতনি ধরে একটু আদর করে তাড়াতাড়ি রাস্তায় বেরিয়ে এল।
.
বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিবনাথ প্রথমে পারিজাতের কুঠিতে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারে পারিজাত আরামবাগ চলে গেছে ফিরতে রাত হবে। অগত্যা শিবনাথ কাজে বেরোয়। একটা অস্থিরতা দুশ্চিন্তা নিয়ে সে ছুটোছুটি করল, লোকজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করল, কথা বলল আর হাজারবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে অনুভব করল গুরুদেবের কাছে লেখা সুপ্রভার চিটিটা ঠিক আছে কিনা। রুণু মারা যাবার আগে এই চিঠি লেখা হয়েছিল বোঝা যায়, কিন্তু সেটা আর ডাকে ফেলা হয়নি, তার আগেই–
সারাদিন শিবনাথ এই চিঠি, সুপ্রভার আত্মহত্যা, পুলিশ, রুণুর গাড়ি চাপাপড়া, পারিজাত, ময়না, রুচি, সমিতি, ইলেক্শনের কাজ ইত্যাদি হাজার কথা চিন্তা করতে করতে যখন রিক্সায় চড়ে ক্যানেল সাউথ রোডে ফিরে এল, তখন রাত সাড়ে এগারোটা।
প্রায় সব ক’টা দোকানের আলো নিভে গেছে।
পাঁচুর সেলুন কাম্ ম্যাসেজ ক্লিনিকটার ওপরের ঘরে একটিমাত্র আলো জ্বলছে। তাও টিম্ টিম্ করে। সবুজ হয়ে গেছে পর্দা খাটানো তেল মালিসের ঘরটা।
সেটাকে বাঁদিকে ফেলে শিবনাথের রিক্সা সুপুরি গাছ ও জলপাই গাছের তলা দিয়ে মাঠ পার হয়ে সোজা পারিজাতের কুঠির দিকে ছুটল।
আগে সেখানে, তারপর বাড়ি। শিবনাথ মনে মনে বলল। এবং রিক্সাওয়ালাকে সেইভাবে রাস্তার বাঁক ঘুরতে বলল।
কিন্তু পারিজাতের কামরায় ঢুকে শিবনাথ খুব উৎসাহবোধ করল না।
সেখানে শশাঙ্ক বাগচী উপস্থিত। সামনে টেবিলে মদের বোতল। গ্লাস ভর্তি মদ। এবং আনুষঙ্গিক প্লেট ডিশ।
শিবনাথকে দেখে পারিজাত মুখ থেকে শূন্য গ্লাস নামাল।
‘এই যে প্রিন্স, খবর কি?’
অবশ্য পারিজাতের লাল চোখ দেখেই শিবনাথ এই সম্বোধন শুনে ততটা কাতর হল না।
অল্প হেসে ঘাড় কাত করে বলল, ওঁদের সকলের সঙ্গেই দেখা হয়েছে। আমি বলে এসেছি স্যার।
শশাঙ্ক বাগচী মদে ফোলা লাল লাল চোখ তুলে শিবনাথকে দেখল এবং হাত বাড়িয়ে একটা ভাজা গলদা চিংড়ি তুলে বেশ রকমের কামড় বসাল।
যেন একটা প্রাইভেট কথা আছে হঠাৎ মুখটা পারিজাতের কানের কাছে নামিয়ে শিবনাথ পকেটের সেই চিঠিটা বার করল। কাগজের ভাঁজ খুলে পারিজাতের চোখের সামনে মেলে ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘আমাদের পাশাপাশি ঘর, দেখুন চিঠিটা উড়ে এসে আমার চৌকাঠের কাছে পড়েছিল। কী সাংঘাতিক জিনিস রেখে গেছে কে. গুপ্তর ওয়াইফ! এটা হাতে পড়লে পুলিশ–’
‘আমায় বাঁধত, তাই বলতে চান তো?’ পারিজাত কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দু টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। যত বাজে চিন্তা নিয়ে আপনারা মাথা ঘামান। সেই কখন পুলিশ এসে ডেঙ্ বডি নামিয়ে নিয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা হিসাবে ওরা আমার একটা স্টেটমেন্ট নিয়ে গেল। বললাম : ‘পুয়র, একবেলা খেতো তো আর একবেলা জুটত না। হাজব্যান্ড আএম্প্লয়েড। বাস্, চুকে গেল। ছোট দারোগা আমায় নিজের মুখে বলে গেল : হামেশা এইরকম কেস্ তারা পাচ্ছে। ও এখন জলভাতের সামিল হয়ে গেছে। কেমন হ’ল তো?’
শিবনাথ ঘাড় কাত করল।
‘তোমার কর্মচারী বুঝি?’
লাল চোখ তুলে শশাঙ্ক পারিজাতের দিকে তাকাল। পারিজাত মাথা নাড়ল।
‘ওসব ভাবনা ভেবে আমার বিপদ হবে ভেবে মিছিমিছি আপনারা ব্যস্ত না হলেই আমি সুখী হব। বলুন, আর কি কাজের কথা আছে।’
শিবনাথ কথা বলল না।
পারিজাত এবার এক চুমুকে প্রায় অর্ধেকটা গ্লাস সাবাড় করল। যখন মুখ সোজা করল, দেখা গেল রক্তাক্ত চোখ দু’টো হঠাৎ হাসছে। চেহারায় এক ফোঁটা গাম্ভীৰ্য নেই।
‘বাই বাই, আপনাকে দেখেই মশাই আর একটা চিঠির কথা মনে পড়ল, হা-হা।’ ড্রয়ার টেনে পারিজাত একটা নীলচে রঙের সুদৃশ্য খাম বার করল। ‘হুঁ, অবনী মুখজ্যের বড়লোক মেয়ে, যিনি এখন মন্টু ব্যানার্জীকে নিয়ে রাত কাটাচ্ছেন, দ্যাট্ ডটার অফ এ বীচ্, দীপ্তির কাছে একটা চিঠি দিচ্ছি। হ্যাঁ, যাবার সময় আমাকে চিঠি দিয়ে গেছে ও। এটা তার উত্তর। দেখুন না পড়ে কি লিখেছি। পড়ুন।’
খোলা খাম থেকে চিঠি বার ক’রে পারিজাত শিবনাথের দিকে বাড়িয়ে দেয়। শিবনাথ কেমন আড়ষ্ট হয়ে যায়। চিঠিটা ছুঁতে সাহস পায় না। জড়সড় হয়ে টেবিলের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। ওধারে শশাঙ্ক বাগচী একটা ঢেকুর তুলে আবার বড় বড় চোখে শিবনাথের দিকে তাকায়। কথা বলে না।
‘আরে মশাই, আপনিও দেখছি একটা নাম্বার ওয়ান ইডিয়েট। চিঠিটা পড়তে দোষ কি, আমিই তো পড়তে দিচ্ছি।’ পারিজাত বিরক্ত হয়ে শিবনাথকে ধমক লাগায়। অগত্যা শিবনাথ চিঠি হাতে নিয়ে তার ওপর চোখ বুলোয়। দাগ দেওয়া অংশটা দু’বার পড়ল। সেখানে রুচির উল্লেখ আছে।
পড়া শেষ করে শিবনাথ চিঠি ফিরিয়ে দেয়।
পারিজাতের লাল চোখ আবার হাসিতে টলটল করছিল। ‘আপনি কিন্তু আবার মশাই রাগ করবেন না। আসলে আপনার ওয়াইফের সঙ্গে কাল দু’টো এবং আজ সকালে একটির বেশি কথা আমি বলিনি। ওই চিঠিতেই কেবল এসব লেখা হয়েছে। হা-হা। দ্যাট্ লাটসাহেব অবনী মুখুজ্যের বখাটে মেয়ে স্টুপিড দীপ্তিকে শুধু জানিয়ে রাখলাম মন্টু ব্যারিস্টারকে নিয়ে তুমি সুখে আছ, আমিও এখানে কিছু দুঃখে নেই! বরং ভালই আছি। স্কুল টিচার বস্তিতে থাকে বটে কিন্তু মেয়েটি দেখতে ভাল, বুদ্ধিমতী। আমি তার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলছি। হ্যাঁ, তোমার কথাই ঠিক, আমি সাম্যবাদী হওয়াই পছন্দ করি। হি-হি, কেমন, দ্যাট্ বীচ্ একটু জ্বলেপুড়ে মরুক এ চিঠি পেয়ে, আমার খসড়া খারাপ?’
পারিজাতের হাত কাঁপছিল ব’লে গ্লাস থেকে কিছুটা পানীয় টেবিলে ছিটকে পড়ল। ‘তাকে আমি সমিতির সেক্রেটারী করেছি আমার সিঁড়ি বারান্দা বাগান প্রত্যেক দিন ছ’সাত ঘণ্টা আলো করে রাখবে বলে, — খারাপ?’
‘এই পারিজাত।’ মোটা খসখসে গলায় শশাঙ্ক বাগচী পারিজাতকে সাবধান ক’রে দেয়। ‘ইনি তোমার কর্মচারী। তোমাদের পারিবারিক জীবনের এসব দুর্ঘটনা এঁর কাছে এ-ভাবে বলা ঠিক না। আপনি তা’ হলে এখন চলে যান। কাল সকালে একবারটি আসুন।’
শিবনাথ এতক্ষণ পর লজ্জা পেল।
তার আগেই উচিত ছিল দীপ্তির নাম লেখা সবুজ খামটা দেখেই সেখান থেকে সরে পড়া সেটাই ভাল হত। পিছনের দেয়ালে ঘড়িতে দেখলো বারোটা বাজে।
‘আমি আজ চলি।’ শিবনাথ হাত দু’টো একত্র ক’রে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে বিদায় নিতে চেয়েছিল। পারিজাত অট্টহাস্যে টেবিল গ্লাস কাঁপিয়ে শিবনাথের আস্তিন চেপে ধরল। ‘এই যা! তুমি একেবারে ভদ্রলোককে না চিনেই এসব ওপিনিয়ন ঝাড়ছ। তুমি চেন ইনি কে? শিক্ষিত উদারমন বাংলাদেশের যুবক যদি দেখতে চাও তো এঁদের দ্যাখো। এঁদের দিকে তাকাও। গ্রাজুয়েট ভদ্র বংশের ছেলে, চেহারা ভাল, স্বাস্থ্য ভাল। অথচ কী সেক্রিফাইস! হ্যাঁ ফ্যামিলীর জন্যে। তিনি জানেন তাঁর স্ত্রীকে প্রতিদিন ট্রামবাসে চেপে কর্মক্ষেত্রে যেতে হয়। সহস্র পুরুষ তাকে স্পর্শ করে, সহস্র কামুক তাকে দেখে! কিন্তু জিজ্ঞেস করো হি বিয়িং হার হাজবেন্ড্, একদিন, ভ্রমেও তিনি স্ত্রীকে সন্দেহ করেছেন কিনা। করেন না। কেননা তিনি পরিপূর্ণভাবে স্ত্রীকে বিশ্বাস করেন। তেমনি তাঁর স্ত্রী করেন তাঁকে। চাকরি নেই ভদ্রলোকের। উপায় ক’রে যা পারছেন স্ত্রী টেনে টেনে আনছেন আর স্বামীকে খাওয়াচ্ছেন। এর জন্যে গ্রাম্বল করে না, অভিমান নেই। কেননা তিনি মানে তাঁর স্ত্রী জানেন বেকার থাকাটা আজ সমাজের ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর স্বামীর দোষ না। পরস্পরের প্রতি এই সহানুভূতি আছে বলেই তাঁদের জীবনে সন্দেহ ঈর্ষা রাইভেরি, তোমাদের বড়লোকদের সমাজে বা কথায় কথায় উঁকি দেয় তা এদের মধ্যে এসে সুবিধে করতে পারে না। বুঝলে বাগচী? দ্যাট্, ফিলিং-এর অভাবে পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে আজ এই ভঙ্গুরতা, এত হাহাকার।’
‘হ্যাঁ, তা তো বুঝলাম, এঁকে ছেড়ে দাও, কাজের কথা কাল সকালে বললে ভাল হবে। আজ রাত হয়ে গেছে।’
যেন একটু অসন্তুষ্ট হয়েই শশাঙ্ক বাগচী ভুরু কুঁচকোয়। অত্যধিক মদ খেয়েও ইনি পারিজাতের চেয়ে ঢের বেশি সুস্থ আছেন দেখে শিবনাথ একটু স্বস্তিবোধ করে।
‘চিঠিতে তাঁর স্ত্রীর কথা একটু রেফার করেছি বলেই যে বাড়ি গিয়ে তিনি ওয়াইফকে মারধর করবেন এতটা ছুঁচিবাই এঁদের নেই। উপমা হিসেবে রুচি দেবীর কথা টেনে এনে দ্যাট বীচ দীপ্তিকে আমি ঘায়েল করতে চাইছি, হা-হা, কি বলেন শিবনাথবাবু। ডু ইউ মাইন্ড?’ পারিজাত একটু নরম গলায় কথা বলল।
শিবনাথ মেঝের দিকে চোখ রেখে আস্তে মাথা নাড়ে।
‘বুঝলে বাগচী লোয়ার মিডল ক্লাস ছেলে ও মেয়েদের মধে একটা জিনিস আমাকে মুগ্ধ করে। টলারেশন। আর এর জন্যে ওদের কনজুগ্যাল লাইভ চিরকাল হ্যাপি থেকে যায়। ক্লেদ জমতে পারে না,–কামড়কামড়ি নেই, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন।’
পারিজাতের কথা শেষ হ’তে শিবনাথ মুখ তুলল।
‘আজ আমি চলি, স্যার।’
দাঁড়ান মশাই, সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবেন, কিন্তু সকালে আমি থাকছি না।’ পারিজাত হাই তুলল। ‘ওদিকটা তো শেষ হয়ে গেছে, সকলের সঙ্গে দেখা করেছেন, বাস, সারা গেছে। মোস্ট ইম্পর্টেন্ট এরিয়া ধাপার বাজার ঐ এলাকাটা যে করে হোক আপনাকে হাত করতেই হবে। কাল ওখানে যান।’
‘আপনি মনে রাখবেন পারিজাতের সাকসেস ওই বাজারটার ওপর নির্ভর করছে।’
শশাঙ্ক বাগচী তার হাতের সাদা মোটা আঙুল তুলে শিবনাথকে বোঝায়। ‘প্রত্যেকটা আড়তদার দোকানদার ওখানকার বস্তির লোকগুলোকে যেভাবে হোক আমাদের হাত করতেই হবে। হ্যাঁ, যদি দরকার হয়, দরকার হবেই, টাকা না খেয়ে কোন শালা ভোট দিতে আসে না এখন। দশ বিশ পঞ্চাশ যে যা চায় দিয়ে দিন। তুমি এখনি বরং এঁকে একটা চেক্ দিয়ে দাও, পারিজাত। ‘
হাত থেকে গ্লাস নামিয়ে পারিজাত চিৎকার করে ডাকল, ‘সরকার, সরকার।’
মদন ঘোষ এক কামরায় ঢুকতে পারিজাত বলল, ‘একটা চেক্ বই বার করে দাও। ওই ড্রয়ারে আছে,–এই যে চাবি।’
মদন চেক্ বই বার করে নিয়ে এল।
শিবনাথের বুকের ভিতর দুরদুর করছিল।
লেখা শেষ করে চেক্টা শিবনাথের হাতে দিয়ে পারিজাত বলল, ‘চলে যান কাল আর্লি আওয়ারে ব্যাঙ্কে। ওটা ভাঙিয়ে নিন। ‘
রুদ্ধশ্বাসে ত্রস্ত আঙুলে কাগজটা ভাঁজ ক’রে শিবনাথ পকেটে পুরল। একটু ইতস্তত ক’রে বলল, ‘টাকা দিয়ে কি ওদের কাছ থেকে রসিদ লিখিয়ে আনতে হবে?’
শশাঙ্ক বাগচী বড় করে হাসল।
‘রসিদ ওরা কেউ ‘আপনাকে দেবে না মশাই। আমাদের দলে টানতে ঘুষ হিসাবে আপনি ওদের মধ্যে এটা ছড়িয়ে দিচ্ছেন।’
‘সবটা না লাগলে বাকি টাকাটা কি কালই আপনাকে এনে ফিরিয়ে দেব? এখানে জমা দেব?’ শিবনাথ পারিজাতের দিকে তাকায়।
‘লাগবে লাগবে।’ মোটা খসখসে গলায় শশাঙ্ক বাগচী বলল, ‘আরো লাগতে পারে। কাল আবার দরকার হলে পারিজাতের কাছ থেকে এসে চেক্ লিখিয়ে নিয়ে যাবেন।
‘বেশ তো, দুহাজার টাকা এখন দিচ্ছি। যদি কিছু এর থেকে বাঁচে, মানে আপনি হাতে রাখতে পারেন, বৌদিকে হ্যাঁ, আপনার ওয়াইফ রুচিদেবীকে দিন না কাল বেশ ভাল একখানা কি দু’খান মুর্শিদাবাদী কিনে; এখানে কিছু এনে জমা দিতে হবে না।’
পারিজাত বোতল উপুড় করে গ্লাসে ঢালল।
‘দ্যাটস্ গুড।’ শশাঙ্কও মাথা নাড়ল। ‘মোটের ওপর আমাদের কাজ হাসিল করা চাই। কত টাকা বাঁচল, কত আরো বেশি লাগল অত এখন হিসাব করার সময় নেই, বুঝেছেন?
শিবনাথ ঘাড় কাত করল।
‘আচ্ছা, চলি স্যার।’ দু’জনকেই সে নমস্কার জানাতে চাইছিল। শশাঙ্ক বাধা দিল।
‘হাঁ, কালকে আমার সঙ্গে পরিচয় হ’ল। মিটিং-এ। এ চার্মিং লেডী।’ শশাঙ্ক বাগচী শিবনাথের চোখে চোখে তাকিয়ে এই প্রথম হাসল! ‘আমার তো মনে হ’ল খুব অ্যাক্টিভ গার্ল। সুযোগ পাচ্ছিল না একটু সোশ্যাল হবার, সুযোগ না পেয়ে এদেশের অনেক মেয়ের প্রতিভার অপচয় ঘটছে। যাকে আমি ক্রাইম বলি। আমরা যে এখনো কনজার্ভেটিভ আছি বা মেয়েদের সম্পর্কে উদাসীন তা না, বরং একটা গোপন ঈর্ষা জাগছে, হ্যাঁ, আমাদের পুরুষদের মনে। প্রথম ধাক্কায় এটা হবেই, সকলেরই হয়েছিল। কিন্তু আমি বলি লাভ নেই ওদের আটকে রেখে। কেবল সমাজহিতকর কাজ কেন, যদি রাজ্য চালাতে পারে পুরুষদের সাহায্য না নিয়ে তো ওটা তাদের হাতেই এখন ছেড়ে দিতে আমাদের আপত্তি থাকবে কেন। এরাই তো সৃষ্টির, সব সৃষ্টিরই আদিমূলে। এদের স্বাধীনতা আগে দিতে হবে। আসছে হিন্দুকোভ্ বিল, আপনাদের পুরুষদের আচ্ছা করে বংশদণ্ডটি দেবে, তখন বুঝবেন মেয়েদের কেবল চাকরি বাকরি করার যৎসামান্য স্বাধীনতা দিয়ে আর তাদের ওপর ছেলেমেয়ে গর্ভে ধরানো, মানুষ করানোর দায়িত্ব, রান্নাবান্না মিলিয়ে হাজারটা ঘরের কাজের বোঝা চাপিয়ে আপনাদের সভা-সমিতি, সাহিত্য- ইলেক্শন-এসেম্বলী করা। অন্যসব যথেচ্ছাচারিতার কথা চেপেই গেলাম।’
‘না, আমিও আপনাকে সাপোর্ট করছি, স্যার।’ নম্র হেসে শিবনাথ বাগচীর কথার উত্তর দিল।
না, উনি পারবেন। শশাঙ্ক দেয়ালের দিকে চোখ রেখে গ্লাসে চুমুক দিয়ে গদগদ গলায় বলল, ‘ভারি মিষ্টি মেয়ে, চমৎকার লেডী। ইয়েস সী ক্যান ওয়েল ম্যানেজ অ্যান অর্গেনাইজেশান। আপনি দেখবেন আপনাকে তাক্ করে দেবে। আই লাইক দ্যাট্ টাইপ অব উয়োম্যান।‘
‘আপনি এখন যান।‘
পারিজাত গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। মাছ-মাংস-ডিম-ফল সব ছেড়ে দিয়ে একটা নির্জলা আলুসেদ্ধ তুলে ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে বলল, ‘কাল ধাপার বাজার আবার ভুলে যাবেন না যেন, আপনার চেহারা দেখলে তো মনে হয় সকালে চা খেতে বসে বৌদির সঙ্গে গল্প করতে পারলে জীবনে কিছু চাইবেন না।’
শিবনাথকে সলজ্জ হেসে উত্তর দিতে হ’ল, ‘না না–কাজের সময় মেয়েদের সঙ্গে বসে গল্পটল্প করা আমি ঘৃণা করি, স্যার। ‘
‘যাকগে, বাজে কথা।’ শশাঙ্ক বাগচী দেয়াল থেকে চোখ ফেরায়। ‘আপনার কি ঐ একটি ইসু?’
শিবনাথ মৃদু হেসে ঘাড় নাড়ল।
পারিজাত বলল, ‘না না, এদিক থেকে তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুখী। পাঁচটা বাচ্চা দেবার পর দীপ্তির আর একটি পুরুষের সঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কতবড় সর্বনাশা কামনা পাপা-ক্ষুধা লুকিয়ে আছে তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না বাগচী!’
‘তুমি তোমার দীপ্তির কথা কিছুদিনের জন্যে এখন ভুলে যাও। আর একটা ধমক দিয়ে উঠল শশাঙ্ক। ‘আশ্চর্য! এর সঙ্গে আমি কথা বলছি।’
পারিজাত চুপ ক’রে গ্লাস তুলল।
শশাঙ্ক হেসে প্রশ্ন করল, ‘আপনার মেয়ের বয়স?’
শিবনাথ মঞ্জুর বয়েস বলল।
‘তা’লে আপনার স্ত্রীর বোধ হয়–?’ শশাঙ্ক একটা অনুমানে এসে অপেক্ষা করছিল।
রুচির প্রকৃত বয়সটা বলতে হঠাৎ যেন বাধল শিবনাথের, কমিয়ে বলল, তেইশ।’
‘তা’লে তো এখনো একেবারে বাচ্চা।’ পারিজাত মন্তব্য করল।
‘হ্যাঁ, একটু কম বয়সেই আপনাদের বিয়ে হয়েছিল আর কি। কেমন তাই না?’ শশাঙ্ক মন্থর হাসল। ‘কম বয়স মানে আজকাল মেয়েদের যে-বয়সে জেনারেলি বিয়ে হচ্ছে আমি– তার তুলনায় বলছি।’
শিবনাথ নীরব থেকে মাথা নাড়ল।
‘তাই বলুন।’ পারিজাত চেয়ারের পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে জড়িত গলায় বলল, ‘কেমন কোমল টেন্ডার মনে হচ্ছিল বৌদিকে, আই মিন্ আপনার ওয়াইফকে। আমার তো ধারণা ছিল উনি দীপ্তির সমবয়সী বুঝি। মাই গড়। দীপ্তির টুয়েন্টি নাইন, হ্যাঁ নিয়ারলি থাট্টি। বুড়ী হতে চলল। আর এই দেখুন স্টুপিড কি কাণ্ড করে বসল। মন্টুর সঙ্গে –‘
আবার বিরক্তিব্যঞ্জক চাপা গুঞ্জন শোনা গেল শশাঙ্কর গলায়।
‘যাকগে, কথাবার্তা হ’ল, রাত বাড়ছে, এই বেলা আপনি বাড়ি যান শিবনাথবাবু।’ শশাঙ্ক সিগারেট ধরায়। ‘বেশ ভাল করে বাজারের ওদের বুঝিয়ে বলুন। গুড্ নাইট।’
সোৎসাহে মাথা নেড়ে শিবনাথ ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
.
নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে হ্যারিকেনটা কপালের কাছে তুলে দাঁত বার ক’রে মদন হাসছিল।
সরকারের হাসিটা শিবনাথের ভালো লাগল না।
যেন হাসি দেখাতেই মদন আলোটা এত উঁচোয় তুলে ধরেছে। শিবনাথ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আলো দেখাতে হবে না। এমনি যেতে পারব, বেশ জোনা আছে।’
‘আহা চলুন না, একসঙ্গে একটু হাঁটা যাক।’ এবার নাকের শব্দ করে মদন হাসল। ‘তা কত টাকার চেক্ লিখিয়ে আনলেন?
‘টু থাউজেন্ড।’ স্বরটাকে আরো বেশি গম্ভীর ক’রে ফেলল শিবনাথ। ‘কেন, এ-সম্পর্কে আপনার কিছু বলবার আছে নাকি?’
‘আরে না না।’ শিবনাথ না অন্য কিছু ভাবে চিন্তা ক’রে মদন ঘোষ এবার মুখে হাসল। ‘অই রমেশ হলে পাঁচশ টাকা দিয়েই বাবু ওকে ধাপার বাজারে পাঠাত। ওর মুখটা ছিল কিনা। কথা দিয়েই চিঁড়ে ভেজাতো, টাকাপয়সা বেশি খরচ করত না।’
শিবনাথ হাসল না।
মদন বলল ‘পাঁচ শ টাকা থেকেই সে খাবলা মারত, ওই টাকা রেস্টুরেন্টে ঢালত কি অন্য কোন কারবারে।’
‘আমি অনেস্টলি কাজ ক’রে যাব। যদি কিছু ব্যালেন্স রাখতে পারি, পারিজাতকে ফেরত দেবো বলে এসেছি।’
‘রমেশটা একটা ছোটলোক ছিল।’ মদন বলল।
‘তা আর আমি কি করে বলব। ওসব বাজে লোকের সঙ্গে আমি বেশি মিশিনি।’
‘না, তা কেন মিশবেন, আপনারা শিক্ষিত, ওটা ছিল গজমূর্খ। চতুর মদন প্রসঙ্গটাকে সেখানে চাপা দিতে চেষ্টা করে আবার দাঁত বার ক’রে হাসল এবং হ্যারিকেনটা কপালের কাছে তুলে ধরল। ‘তা কর্তারা কি রকম চালাচ্ছেন দেখে এলেন?’
এবার হাসিটা তত খারাপ লাগল না সরকারের। চট করে প্যাকেট থেকে একটা নিজের জন্যে এবং সরকারের জন্যে আর একটা সিগারেট তুলে মদনের হাতে সেটা দিয়ে শিবনাথ বলল, ‘তা চালাচ্ছেন মন্দ না’ দু’টো বোতল তো খালি হয়েছে দেখলাম। সারারাতই চলবে নাকি?’
‘অনেকটা সেরকম।’ হাত থেকে হ্যারিকেন নামিয়ে মদন সিগারেট ধরাল।
‘ওটির সঙ্গে আর কিছু চলবে বোধ হয়?’। শিবনাথ ফিসফিসে গলায় প্রশ্ন করল, ‘না কি এ পাড়ায় সে সুবিধা হবে না?’
‘এই তো সবে শুরু, সমিতি গড়া হ’ল, ইলেক্শন শুরু হল। ফাল্গুনের হাওয়া বইতে আরম্ভ করেছে। এখন এখানে ঘন ঘন মিটিং হবে, বক্তৃতা হবে, চিলড্রেনস-এগজিবিসন হবে, ছুঁচ সূতোর কাজের প্রদর্শনী শুরু হচ্ছে। আসবেন না মানে? পাবে না মানে? শশাঙ্ক যার কাণ্ডারী, তার আবার মেয়েছেলের অভাব হয় নাকি? রাতারাতি পেয়ে যাবে দেখুন না।’
শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘আমাদের কি, আপনি যেমন তার কর্মচারী তেমনি আমাকেও অনেকটা, হ্যাঁ, কাজ যখন করছি এবং পারিজাত ইলেক্শনে সাকশেসফুল হলে কাজের রিওয়ার্ড হিসাবে কিছু প্রত্যাশাও করি যখন,–তখন আমাদের এসব ব্যাপারে চোখমুখ বুজে থাকাই ভাল। কি বলেন সরকার মশাই।’
‘আরে মশাই সে কথা বলতেই তো অন্ধকারে অদ্দুর হাঁটতে হাঁটতে আপনার সঙ্গে আসা, . হি-হি।’ মদন ঘোষ অন্তরঙ্গ গলায় বলল, দুজনে মিলে একটু সুখ-দুঃখের গল্প করা।
‘হ্যাঁ, তা ছাড়া আর কি। ‘
দু’জন একে সঙ্গে আরো কিছুটা অগ্রসর হ’ল।
‘বাড়িতে সবাই আপনার স্ত্রীর প্রশংসা করছে কেবল! ‘
‘কেবল প্রশংসায় আর কি হয় ঘোষ।’ শিবনাথ মাথা নাড়ল। ‘প্রশংসায় চিঁড়ে ভেজে না।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’ মদন সোৎসাহে থুতনি নাড়ল। শিবনাথ এখন কেবল অর্থকরী চিন্তায় মগ্ন সরকারের বুঝতে কষ্ট হয় না।
‘কেবল সমিতি করলে তো আর,’ একটু ইতস্তত ক’রে মদন পরে বলল, ‘তা বৌদিমণি যখন এখন পাড়ার লোকদের সঙ্গে মিশতেই আরম্ভ করছেন, বিকেলটা সমিতির জন্যে হাতে রেখে সকালরে দিকে এক-আধটা টুইশানি করলেও মন্দ হত না, কি বলেন?’
শিবনাথ উপেক্ষার হাসি হাসল।
‘আপনি দেখছি সরকারি ক’রে ক’রে বুদ্ধিটাও সেরকম ক’রে ফেলেছেন। বৌয়ের রোজগার বাড়ুক, স্ত্রী আরো বেশি টাকা উপায় ক’রে এনে আমাকে খাওয়াক, আমি মোটেই সে লাইনে চিন্তা করি না। বরং আরো একটা মাস গেলে, আমি ঠিক করেছি ওকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনব। দেশের কাজ দশের কাজ নিয়ে যদি ও থাকতে চায় আমি বাধা দেব না। আমি আমার কথা বলছি। কাজ তো ক’রে যাচ্ছি। পারিজাত ভোটে জিতবে বলে রাত দিন এই খাটুনি। কাজের প্রশংসাও করছেন কর্তারা। কিন্তু কেবল,–একটু চুপ থেকে শিবনাথ নাকের শব্দ করে হাসল। ‘কেবল মুখের ওই প্রশংসা দিয়েই শেষ অবধি তুষ্ট রাখতে চাইবেন কিনা কে জানে। এখন তো একটি আধলাও নিচ্ছি না।
যেন মদন জব্দ হয়ে গেল। আর একটা কথা বলতে পারল না। হাসির রেশটা ধরে শিবনাথ বলল, ‘যান, আর আলো দেখাতে হবে না। ঐ তো এসে গেছে, বনমালীর দোকান দেখা যাচ্ছে। নিন, রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে টানবেন।’ অতিরিক্ত দু’টো সিগারেট মদনের হাতে গুঁজে দিয়ে ও নিজে আর একটা ধরিয়ে শিবনাথ এক লাফে জলপাইতলার নর্দমা ডিঙিয়ে বনমালীর দোকানের সামনে উঁচু জমিতে উঠে এল।
***
‘কে?’
‘আমি।’
শিবনাথের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল গলার স্বর শুনে।
‘এখানে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আপনি করছেন কি?’
‘মশাই, আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।’
‘রাস্তা ছেড়ে দিন।’ শিবনাথ গম্ভীর হয়ে বলল, ‘এখন আড্ডা দেবার সময় না।’
‘কে. গুপ্ত অন্ধকারে মাথা নেড়ে বলল, ‘ব্রিলিয়্যান্ট খবরটা আপনাকে শোনাতে রাত জেগে বসে আছি, শুনবেন না?’
দাঁতে দাঁত চেপে শিবনাথ ক্রোধ সংবরণ করল।
তা খবর তো এ-বাড়িতে নিত্যই লেগে আছে,–কি আবার এমন নতুন খবর হল।’ ইচ্ছা করেই শিবনাথ তার ছেলের হাসপাতালে মরা, কি তার স্ত্রীর গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে থাকার ভীষণ খবর দু’টোর উল্লেখ করলে না! এবং লোকটাকে একটু অনুকম্পাই করল। ‘পাগল পাগল।’ অনেকটা নিজের মনে ফিসফিসিয়ে শিবনাথ নতুন প্যাকেটের মোড়ক ছিঁড়ে দু’টো টাকা সিগারেট বার ক’রে বলল, ‘নিন, স্মোক করুন। তা কখন ছুটি হ’ল আপনার? পাঁচুর ম্যাসেজ ক্লিনিক রাত কটায় বন্ধ হয়?’
‘আরে মশাই, সে সারারাত চালালেও চলে। ও ছেড়ে দিন। কাল থেকে আর আমি ওখানে যাচ্চি না। দেশলাই দিন।’
‘কি হ’ল, ছেড়ে দিলেন নাকি চাকরি?’
‘আরে মশাই, আপনিও দেখছি এমন একটা রসের খবরের মুখে পাঁচু, ক্লিনিক, চাকরি আগরবাগর পাঁচ কথা টেনে আনছেন। দিন দেশলাই, দিন।’ কথা শেষ ক’রে গুপ্ত, মনে হ’ল যেন খুব জোরেই হাসল, কিন্তু তা না, একটু কান পেতে থেকে শিবনাথ বুঝল নাকের তলায় গলার কাছে হাসিটাকে চেপে ধরে একটা বিশ্রী ঘিনঘিনে আওয়াজ বার করল মাত্ৰ।
হাসির ধরন দেখে শিবনাথের মেজাজ আরো বেশি খারাপ হয়ে গেল। ‘আপনার সঙ্গে রাত দুপুরে আমি হাতহাতি করতে চাই না। কাইন্ডলি রাস্তাটা ছেড়ে দিন।’
বারো ঘরের উঠোনে ঢুকবার সরু পথ আগলে কে. গুপ্ত দাঁড়িয়ে। সাত ও এক নম্বর ঘরের মাঝখান দিয়ে পথ। কমলার ঘরের বেড়ার গায়ে একটা হাত ও রমেশের ঘরের বেড়ার গায়ে আর একটা হাত রেখে কে. গুপ্ত ফের সোজা হয়ে দাঁড়াল। সিগারেট ধরাতে হাত দু’টো সে এইমাত্র একত্র ক’রেছিল। জ্বলন্ত সিগারেট মুখে নিয়ে বলল, ‘খবরটা শুনলে আপনার একটু উপকার হত স্যার।’
‘পাগল!’ উপেক্ষার হাসি হাসল শিবনাথ। ইচ্ছা করলে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সে ওপারে যেতে পারে তার ঘরে, কিন্তু তার আগে সে চেটি কাটল।
‘স্ত্রী গলায় দড়ি দিয়েছে, ছেলে হাসপাতালে মরেছে, মেয়ে হাজতে, ইন্টারেস্টিং খবর বলার সময়টা বেছে নিয়েছেন ভাল, পথ দিন!’
‘আপনি রাত দেড়টায় এখন ফিরছেন কোথা থেকে?
‘কাজ থেকে। বেড়িয়ে। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মেরে। কেন, তার কৈফিয়ত তোমাকে দিতে হবে নাকি। ইডিয়েট রাস্তা ছাড়ো।’
‘মশাই, একটুতেই এমন চটে যান।’
‘আপনি আমায় যেতে দিন।’ শিবনাথের রক্ত মাথায় উঠল। ঘাড়ে হাত রাখতে যাচ্ছিল সে কে. গুপ্তর। গুপ্ত আবার সেই ঘিনঘিনে গলায় হেসে উঠল। হাত সরিয়ে নিয়ে শিবনাথ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘অপদার্থ, পাপ, শিক্ষিত বাঙালী সমাজের কলঙ্ক। পটাসিয়াম সায়নাইড গিলে মরতে পার না নচ্ছার।’
‘মরব, মরলে তো সবই শেষ হয়ে যাবে। আমি মরলে আপনাদের মজার মজার খবর শোনাবে কে, বলুন, হি-হি
‘রাস্কেল।’
‘চারু এসেছিল।’ রাগ না করে কে. গুপ্ত বলল। ‘চারু রায়।’
‘কোথায়?’
‘আপনার ঘরে।’
শিবনাথ একটা বড় ঢোক গিলল।
‘হ্যাঁ, এসেছিল কাল রাত্রে, সমিতির কাজকর্ম নিয়ে ডকুমেন্টারী ছবি তোলা হবে, তার জন্যে রুচির সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছিল। তাতে হয়েছে কি? সমিতির সেক্রেটারী হয়েছে ও।’
‘আরে মশাই, আজ বিকেলেও চারু এসেছিল।’
‘হ্যাঁ, যদি এসেই থাকে তো দোষেরটা কি শুনি? এই নিয়ে হাসছ কেন স্টুপিড।’
‘আঃ গায়ে হাত দেবেন না, লাগছে।’
কে. গুপ্ত ঘাড় থেকে শিবনাথের হাতটা সরাতে চেষ্টা করল। ‘আপনি মশাই আবার ভায়লেন্ট হয়ে উঠছেন।’
‘তো ওসব বাজে বক্ছ কেন কুকুর, খেতে পাও না, রাস্তায় গাছতলায় আশ্রয় নিচ্ছ–আমার সময়ের মূল্য আছে, কাল সকালে কাজে বেরোতে হবে, পথ দাও ঘরে যাই।’
‘বেশ তো, এভাবে কথা বলুন।’ শিবনাথ ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিতে কে. গুপ্ত অনেকটা স্বস্তিবোধ করল। কথা আরম্ভ করতেই আপনি ঘাড়ে ধাক্কা দেবেন, মারধর করবেন, এটা মশাই টু স্পীক দি ট্রুথ মনে লাগে, আফটার অল্ আমি আপনার নেক্সড ডোর নেবার। ‘
‘হ্যাঁ, বলুন কি হয়েছে, এক সেকেন্ডে ব’লে শেষ করুন।’ শিবনাথ অস্থির গলায় বলল, ‘আমার সময়ের দাম আছে।’
চট্ ক’রে কথা বলল না কে. গুপ্ত। ঘিনঘিনে গলায় আবার হাসল। হাত দু’টো বাড়িয়ে দু’দিকের বেড়ার গায়ে ঠেকাল। যেন বাড়িটা এধার এবং ওধার দু’দিক থেকে আরম্ভ হয়েছিল। সেভাবেই ঘরের নম্বর বসানো। তাই কমলা ও রমেশের ঘরের মাঝখান দিয়ে ভিতরে ঢোকার পথ।
ঘামছিল শিবনাথ। পকেট থেকে রুমাল বার ক’রে কপাল মুছল।
‘তা আমি অতটা খেয়াল করিনি চারু যখন বাড়িতে ঢুকেছিল। দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আজ অনেকদিন পর খালি ঘর পেয়ে মশাই একটু ফ্লোরে শুয়েছিলাম। হ্যাঁ, পুলিশের হাঙ্গামাটা মিটবার পর। ডেড বডি সরিয়ে নিতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেল কিনা।’
‘হ্যাঁ, তা তো হবেই। সী কমিটেড সুইসাইড, এ মামলার অনেক তথ্য, অনেক তল্লাসী। তারপর, খালি ঘরে একলা শুয়ে শুয়ে কি ভাবছিলেন? অদৃষ্ট, জীবন? আপনাদের গুরু ভোলাগিরি কি বলেন?’
‘মশাই, আবার আপনি বাঁকা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলেন, শুনুনই না ইন্টারেস্টিং বলতে আমি এখানে কি মিন্ করছি। হি-হি। ‘
‘তাড়াতাড়ি শেষ, কর, কুকুর।’ শিবনাথ গর্জে উঠল।
কিন্তু কে. গুপ্ত তা গায়ে মাখল না।
‘শুয়ে শুয়ে বেবিটার কথা ভাবছিলাম। হাজত থেকে ফিরে এলে ব’লে কয়ে ওটাকে আবার স্কুলে পাঠানো যায় কিনা, এমন সময়, বুঝেছেন? যেন মনে হ’ল চারু আপনার ঘরে ‘দেবি’
‘দেবি’ বলে হঠাৎ গদ্গদ্ সুরে মন্ত্র পাঠ করছে। শুনে মশাই আমার এমন হাসি পেল! শালা ভূতের মুখে হরিনাম–হাড়বদমায়েস রায় পূজোআচ্চা আরম্ভ করল কি ভর সন্ধ্যেবেলা? ভীষণ কিউরিয়সিটি হ’ল।’
‘তারপর?’ রুদ্ধশ্বাসে শিবনাথ গর্জন করতে গিয়ে থেমে গেল। যেন রমেশের কুকুরটা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারে ভাল দেখা যায় না। গাছের পাতার সর্সর্ শব্দ হয়। সারা বাড়ি ঘুমে নিঃসাড়।
‘আর সিগারেট আছে?’
‘না।’
‘হি-হি। থাকগে। শুনুন গল্পটাই তা হ’লে বলে শেষ করি। আমার ও আপনার ঘরের মাঝে, হুঁ এগারো ও বারো নম্বর ঘরের মাঝখানে টিনের বেড়াটার একজায়গায় একটা বড় ফুটো আছে লক্ষ্য করেছেন?’
‘না না আমি করিনি, আমি করি না স্টুপিড। অপরের ঘর দেখতে নিজের ঘরের ফুটো তল্লাস করা আমার নেচার না। ফুটো দিয়ে তুমি কি দেখছিলে হারামজাদা আমায় বল।’
কথাটা শেষ, করার সঙ্গে সঙ্গে শিবনাথ পায়ের জুতো খুলে কে. গুপ্তর মুখে দু’ঘা বসিয়ে দিল।
ফ্যালফ্যাল করে একটু সময় তাকিয়ে থেকে পরে গুপ্ত আস্তে আস্তে বলল, ‘মশাই আপনি এত চট্ করে মারামারি করেন।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ইয়ার্কি করার জায়গা পাও না, রাস্কেল!’ শিবনাথ জুতোটা ফের পায়ে পরল। ‘আমি তো বলছি, গোড়ায় বলে রেখেছি আপনার ঘরে চারু কি করছিল না করছিল আমার দেখার কোন ইনটেনশন ছিল না। অন্ গড়।’
‘তো তুমি হাসছ কেন, শয়তান!
কে. গুপ্তর মুখে তখন হাসি ছিল না।
‘মশাই আমার দেখার ভুল হ’তে পারে,–আমি হয়তো ভুলও দেখতে পারি, বিশ্বাস করা না-করা দ্যাট্ ইজ আপ্ টু ইউ। কিন্তু তাই ব’লে-–’
‘আমি তোমাকে মেরে ঠাণ্ডা ক’রে দেব যদি আমার ঘর আমার পরিবার আমার স্ত্রী সম্পর্কে কোনরকম খারাপ ইঙ্গিত শুনি বজ্জাত!’
‘মুশকিল! কোথায় একটু স্ত্রী-চরিত্র, মানে সেক্স-সাইকলজি নিয়ে এরপর আলোচনা করব, সবটা ঘটনা ব’লে শেষ ক’রে, মানে আমার স্ত্রী এই অবস্থায় কি করত, আপনার স্ত্রী কেন এটা করল–না, তা না, আপনি শুরুতেই–’কে. গুপ্ত ঘিনঘিনে সুরে আবার একটুখানি হাসল।
‘আমার স্ত্রী কি করেছে?’ উন্মাদের মত শিবনাথ লোকটার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত, কিন্তু চট্ করে ধৈর্যধারণ করল। রুমাল দিয়ে কপাল মুছে কাঁপা গলায় বলল, ‘বলুন, কি ঘটনা?’
শিবনাথ নতুন সিগারেট ধরালে।
কিন্তু সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কে. গুপ্ত ঘিনঘিনে হাসিটাকে ক্রমশ বড় করতে লাগল। ‘ইন্টারেস্টিং বলছিলাম মশাই এই জন্যে যে, চারু গদ্গদ্ সুরে ‘দেবি দেবি’ ডাকার সঙ্গে সঙ্গে উনি, হ্যাঁ, আপনাদের ঘরের খুকির মা এমন অদ্ভুত গলায় হেসে উঠল! কী বলব,– ইয়েস, সী গিড লাইক এ বেব্। একবোরে কচি খুকির মত। তাই না ব্যাপারটা কেমন স্ট্রেঞ্জ মনে হ’ল। আর তখনই আমি মেঝে থেকে উঠে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ার ধারে গিয়ে সেই ফুটোর গায়ে চোখ রাখলাম।’
‘ফুটোর গায়ে চোখ রেখে তুই কি দেখেছিলি আমায় বল্, বলে শেষ কর্ স্কাউন্ডেল, না হ’লে আজ তোকে আমি–উঃ, গিগ্লড লাকি এ বেবি! তোমার বিলাতী বাটখারা নিয়ে এসেছ আমার ঘরের হাসির ওজন করতে, আমাদের গেরস্থ ঘরে! এই বল্, বলে শেষ কর্, না হলে —
‘ইস! কে. গুপ্ত যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল। মারবেন না, এভাবে মারধর—’
শিবনাথ প্রবল শক্ত হাতে কে. গুপ্তর গলা টিপে ধরেছে, মুখের কাছে মুখ নিয়ে সাপের মত হিস্হিস্ শব্দ ক’রে বলল, ‘আমি জানতে চাই তুই শেষ পর্যন্ত কি দেখেছিলি পশু–’
‘বলছি বলছি।’ প্রাণপণে শিবনাথের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে করতে কে. গুপ্তও সাপের মত হিস্হিস্ আওয়াজ বার করল মুখ দিয়ে, দম বন্ধ হয়ে কথা আটকে গিয়ে এই অবস্থা হচ্ছিল। ‘আমি, আমি ভুল দেখতে পারি, কিন্তু আমি তো পরিষ্কার দেখলাম মশাই, দ্যাট বাগার, হুঁ চারু–হি কিল্ড রাইট অন হার—’
একটা আলো জ্বলল সামনে। শিবনাথ চোখ তুলল। হ্যারিকেন হাতে রুচি।
‘আশ্চর্য! এত রাত্রে কি নিয়ে তুমি চেঁচামেচি করু ওর সঙ্গে, ছেড়ে দাও, বদ্ধ উন্মাদ, তুমি কি জান না?’ রুচি ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল।
শিবনাথ কে. গুপ্তর গলা ছেড়ে দেয়।
কে. গুপ্ত চুপ ক’রে একটু দাঁড়ায়। একবার রুচির মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে তারপর নিজের মনে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে শিবনাথের গায়ে না লাগে এভাবে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি অন্ধকারে বাইরে রাস্তায় নেমে যায়।
‘পাগল, তাই না?’ অন্ধকার থেকে চোখ ফিরিয়ে শিবনাথ রুচির দিকে তাকায়। রাতের আধখানা ঘুমিয়ে উঠে চোখ মন্দ ফুলে ওঠেনি স্ত্রীর, হ্যারিকেনের আলোয় শিবনাথ চট ক’রে লক্ষ্য করল।
‘আমি তো তোমার গলার আওয়াজ শুনেই টের পেলাম পাগলাটার সঙ্গে ঝগড়া করু। রাত দুপুরে।’
‘কী যা তা বকছিল!’ শিবনাথ গলা পরিষ্কার করল।
‘ও তো আর নিজের মধ্যে নেই। সব শেষ করেছে। ছেলে গেছে, বৌটাকে মেরেছে, মেয়েটা হাজতে। আর এদিকে নিশ্চিন্ত হয়ে এখন যা-তা করছে। কে এক ভদ্রলোক এসেছিল সন্ধ্যাবেলা পাঁচুর ম্যাসেজ ক্লিনিকে তেল মাখাতে। শুনলাম ভদ্রলোক পোশাক ছেড়ে প্রাইভেট কামরায় ঢুকতে কে. গুপ্ত তার শার্ট পেন্টুলন টাই জুতো পরে পাশের ঘরে টেবিলে উঠে লাফালাফি তো করছিলই, তারপর হঠাৎ অশ্লীলভাবে শিস দিতে দিতে ছুটে গিয়ে বিধুমাস্টারের ছোট মেয়ে মমতার গায়ের ওপর পড়েছিল। মমতা তখন একজন কাস্টমারকে বিদায় ক’রে দিয়ে রেস্ট নিচ্ছিল।’
‘তারপর?’শিবনাথ একটা ছোট ঢোক গিলল। ‘তুমি কার কাছে শুনলে? ছি ছি, কী অসভ্য!’
‘এই তো একটু আগে পাঁচু এসে বলাবলি করছিল। পাঁচু কে. গুপ্তকে তখনই দোকান থেকে তাড়িয়ে দেয়। বিধু মাস্টার বেবির বাবার নামে কেস করবে।’
‘তাই বলো! তাই তো ও—’
অন্ধকারের দিকে চোখ ফিরিয়ে শিবনাথ আবার কি ভাবল।
‘কি ভাবছ তুমি?’
শিবনাথ অল্প হাসল। রুচির দিকে তাকায়।
ডুবতে আর কিছু বাকি নেই, কিন্তু এখনো কেমন রসিক গুপ্ত তাই ভাবছিলাম।’
‘বেরিয়ে যাবে রস জেলখানায় গেলে।’ রুচি বলল, ‘এদিকে থানা থেকে লোক এসেছিল খবর দিতে। মর্গে কাল রাত থেকে রুণুর ডেড বডি পচছে, পোড়াতে হবে।’
‘কি বলছে গুপ্ত?’
‘ওরাই যেন পুড়িয়ে ফেলে, তার সময়, অর্থ এবং লোকজন কোনোটাই নেই। বলছে সৎকার সমিতিকে খবর দেওয়া হোক। ওরা সব করবে।’
‘বৌয়ের বেলায়ও তাই বলবে হারামজাদা।’ শিবনাথ ক্ষীণ গলায় হাসল। স্যুইসাইড। এরও পোস্ট মর্টম হবে।’
বলে সে আবার অন্ধকার দেখতে লাগল। জোনাকি পোকারা নাচানাচি করছিল। হুঁ, বাড়ির বাইরে যাবার রাস্তার মুখ ওটা। এইমাত্র ওখান দিয়ে কে. গুপ্ত বেরিয়ে গেল।
শিবনাথ ভাবে এই রাস্তা দিয়ে কিরণ গেছে কমলা গেছে সুনীতি গেছে।
বেবি গেছে প্রীতি বীথি দুই বোন গেল।
সুপ্রভা গেছে, মল্লিকা নেই।
বিধুমাস্টারের মেয়ে মমতা সাধনা ম্যাসেজ ক্লিনিকে চাকরি করতে বেরিয়ে গেছে ওখান দিয়ে।
এক সঙ্গে অনেকগুলি বিবাহিত অবিবাহিত মেয়ের মুখ শিবনাথের চোখের সামনে ভেসে উঠল। এমন কি এবাড়ির মালিক পারিজাতের স্ত্রী দীপ্তির চেহারাও মনে পড়ল তার। আর একটু সময়। তারপর অন্ধকারকে সম্পূর্ণ পিছনে রেখে শিবনাথ আলোর দিকে, রুচি যেখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে ঘুরে দাঁড়াল।
‘কি বলছিল তোমায়?’ রুচি প্রশ্ন করল : ‘পাগলটার সঙ্গে কি নিয়ে ঝগড়া করছিলে?’
‘পয়সা চাইছিল। অনেক পয়সা দিয়েছি ওকে। আজ আবার।’ শিবনাথ স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে সুন্দর করে হাসল। ‘রাস্কেলটা আমার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখতে এসেছিল পয়সা আছে কি না।’
‘দাওনি তো?’
‘না, আমার এত মায়াদয়া নেই।’ স্বরটাকে কঠিন করল শিবনাথ। ‘বলে কিনা এই পয়সা রোজগার করতে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে আমাকে।
‘এসো, ঘরে এসো।’ রুচির হাতের আলো নড়ে উঠল।
শিবনাথ স্ত্রীকে অনুসরণ করল।
‘সন্তোষ ওরা তো বলছেই, আজ চারুবাবু পর্যন্ত বলছিলেন ঠাট্টা ক’রে, টাকা-পয়সার গন্ধ পেয়ে পারিজাতের ইলেক্শনের কাজে খাওয়া ঘুম বন্ধ রেখে তুমি খাটতে আরম্ভ করে।’ ঘাড় ফিরিয়ে রুচি হাসল।
চারু এসেছিল বুঝি? কখন এসেছিল?’ একটুও অবাক হবার ভান করল না শিবনাথ। ‘বিকেলে। রাত ন’টা পর্যন্ত তো ব’সে অপেক্ষা ক’রে গেল তোমার জন্যে। একটু চা ক’রে দিলাম। বাবা! কত জানে লোকটা। আর্ট, কালচার, এদেশের বিউটি, ওদেশের বিউটি। ব’সে থেকে থেকে কত গল্প ক’রে গেল।’
‘আর সেই সঙ্গে আমার একটু বদনাম।’ শিবনাথ না বলে পারল না।
‘আহা, বদনাম আর কি, ঠাট্টা ক’রে তো কথাটা বলছিল।’ যেন একটু ঝাঁজ ফুটল-রুচির গলায়। ‘তা যেমন বদনাম ক’রে গেছে, তেমনি তার দাম দিয়ে গেছে। আস্ত এক টিন সিগারেট রেখে গেছে তোমার জন্যে, বলছিল বার বার শিবনাথবাবুকে দেবেন, ভাল জিনিস নিউ মার্কেট থেকে জোগাড় ক’রে’-
রুচির কথা অসমাপ্ত থেকে গেল।
‘‘এ্যাঁ, তাই নাকি, তাই বলো!’ প্রবল উচ্ছ্বসিত গলায় শিবনাথ, বারো ঘরের উঠোন কাঁপিয়ে হেসে উঠল। ‘বেশ বেশ, ভাল ভাল, পেটে খেলে পিটে সয়, একটু বদনাম করেছে তাতে কি, কি বলো?’ বলে সে এমন অদ্ভুতভাবে স্ত্রীর দিকে তাকাল যে রুচি রীতিমত ভয় পেল।
‘কি, তুমি অন্য কিছু ভাবছ নাকি,–এমনভাবে তাকিয়ে দেখছ কি আমার মুখের দিকে?’
হাসল না এবার আর, জোরে মাথা নেড়ে যেন হাজার চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে শিরনাথ বলল, ‘পাগল, কিচ্ছু না, কি আবার ভাবব আমি, আমার অত শত ভাবলে চলে? এসো, ‘ঘরে এসো।’ ব’লে সহজ স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী হাতে হাত রেখে উঠোন পার হয়ে সে বারান্দায় উঠে গেল।
*****