৪০
রাশু চুপচাপ বসে আছে। তার সামনে বসে আছে মতিন মিয়া। দূরে অনিক দাঁড়ানো। মতিন মিয়া বলল, খুব সাবধান, রাশু। একচুলও যেন কিছু এদিক-সেদিক না হয়।
রাশু কথা বলল না। সে হাতের আঙুলে উদ্দেশ্যহীন নকশা আঁকছে মাটিতে। মতিন মিয়া বলল, যা হইছে হইছে। তুমি নিজে যে এখনো ঠিকঠাক আছ, এইটার জন্য আল্লাহর কাছে শোকর করো।
রাশু চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, একটা জায়নামাজ নিয়াসেন।
জায়নামাজ নিয়াসবো কেন? এখন কি নামাজের সময়?
তাইলে কিসের সময়?
তোমার সাবধান হওনের সময়।
আমি তো সাবধানই।
কিন্তু তোমারে দেখে তো তা মনে হয় না।
আমারে দেখে তাইলে কী মনে হয়?
মনে হয় তোমার ভেতরে আগুন, বাইরে পানি।
পানির নিচে আগুন থাকতে পারে?
পারে। শুনছি সমুদ্রের নিচেও নাকি আগ্নেয়গিরি আছে। সেই আগ্নেয়গিরিতে আগুনও জ্বলে।
তাতে পানির কী ক্ষতি হয়!
পানির না হলেও মাছের হয়।
আমার মধ্যে তো মাছ নাই যে ক্ষতি হবে।
আমরা নিজেরাই এইখানে মাছ। জামশেদ স্যাররা হইছেন পানি। তোমার ওই আগুনে তাদের কোনো ক্ষতি হইব না। ক্ষতি হইব আমাদের নিজেদেরই। লাল চানের ঘটনায় বোঝো নাই?
বুঝছি।
কী বুঝছ?
বুঝছি যে সব মাছের ক্ষতি হয় না। কিছু মাছ আগুনে পোড়া মাছ খাইতেও পায়।
এই কথায় মতিন চুপ করে গেল। তারা বসে আছে ডোবাটার পাশে। মাছগুলো এখন শান্ত, চুপচাপ। কিছুদিন আগেই যে এখানে একটা আস্ত মানুষকে তারা ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়েছে, তা বোঝার বিন্দুমাত্র উপায় নেই। বিষয়টা ভাবলেই মতিন মিয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাশু বলল, ওই ভাইরে ডাকেন।
কোন ভাইরে?
ওই যে নতুন আসছে। মাছের পুস্কুনির টংঘরে থাকে।
মতিন পেছন ফিরে তাকাল। অনিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এই জগৎ সংসারের কোথাও নেই। একটা ঘোর তাকে আচ্ছন্ন। করে রেখেছে। রাশু বলল, সে কি এইখানে মাছ চাষ করতে আসছে?
এইখানে মাছ বলতে তো আলাদা কিছু নাই। সবই সাপ চাষ।
ডাকেন তারে।
অনিক এসে দাঁড়াল। ন্যুজ, শঙ্কিত। রাশু বলল, অনিক ভাই, কেমন আছেন?
জি, ভালো।
সব ঠিকঠাক তো?
অনিক জবাব দিল না। রাশু বলল, আপনের এইখানে কাজটা কী?
এখনো বুঝতে পারছি না।
জামশেদ স্যারে কিছু বলে নাই?
না।
কেন?
সেই প্রথম দিন রাতের পর তো আর দেখা হয় নাই তার সঙ্গে। এইখানে আর আসেনও নাই উনি।
ওই দিনও কথা হয় নাই?
না। সেই পরিস্থিতিই তো ছিল না।
হুম। তা-ও কথা। জায়গা কেমন লাগতেছে?
অনিক এই প্রশ্নের জবাব দিল না। রাশু বলল, আপনের সমস্যাটা কী, বলেন তো?
কী সমস্যা?
আপনি এই সবের মধ্যে আসলেন কেন?
অনিক চুপ করে রইল। রাশু উঠে দাঁড়াল। বলল, চলেন, আশপাশ থেকে একটু হাঁইটা আসি।
তারা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। কিছু দূর যেতেই পাতলা হয়ে এল জঙ্গল। তারপর আবার খোলা মাঠ। সেই খোলা মাঠ ধরে দীর্ঘ সময় হাঁটল তারা। মাঠের পরে নদী। নদীর ধারে ঘেসো জমি দেখে বসল রাশু। বলল, আপনে তো শিক্ষিত মানুষ। আপনেরে একটা প্রশ্ন করি?
কী প্রশ্ন?
মানুষের এত দুঃখ কেন?
অনিক জবাব দিল না। রাশু বলল, আমার মায়ে ছিল বেশ্যা। আমার জন্মও বেশ্যাপাড়ায়। মাদারীপুর শহরে বড় এক পাড়া আছিল। পরে পুলিশ সেইটা ভাইঙ্গা দিছে। সেইখানে আমার জন্ম। আমি বড়ও হইছি সেইখানে। তারপর আমার মায়ে কই জানি চইলা গেল। আমার তো বাপের ঠিক নাই। এই জন্য আমার যাওয়ারও কোনো জায়গা রইল না। আমি তখন মায়রে খুঁজতে কই গেলাম, জানেন?
কই?
দৌলতদিয়া। লোকে কইল, তুই ওইখানে খোঁজ। ওইখানে একটা পতিতালয় আছে।
পেয়েছিলেন?
না।
অন্য কোথাও খোঁজেন নাই?
অন্য কই খুঁজব?
আর যে পতিতালয়গুলা আছে, ওই সব জায়গায়?
এই প্রশ্নে রাশু চুপ করে গেল। বেশ কিছুটা সময়। তারপর বলল, বিষয়টা কেমন না?
কী?
আমি জানি আমার মায়ে কোথায় আছে। আপনেও জানেন।
আমি তো জানি না। অনুমান করে বললাম।
রাশু হাসল, ওইটাই। ধরেন কেউ যদি কারও মায়ের খোঁজ না পায়, হারাই ফেলে, তাইলে সে তারে তার আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে খোঁজে। মামাবাড়ি, খালাবাড়ি। নানিবা ড়ি, চাচিবাড়ি খোঁজে। এইগুলাই তার যাওয়ার জায়গা। খুঁজে পাওয়ার ঠিকানা। আর আমি খুঁজি পতিতালয়ে।
অনিক কথা বলল না।
রাশু বলল, কারণ, ওইটাই আমার মায়ের ঠিকানা। তার আর কোনো ঠিকানা নাই। বলে চুপ করে থাকে রাশু। তারপর আচমকা একটা ঢিল ছুঁড়ে মারে নদীতে। বলে, এইটা নিয়া তো আমার দুঃখ হওনের কথা না। কারণ, আমিও তো ওই একই ঠিকানার মানুষ। আমারও তো কোনো ঠিকানা নাই। তারপরও আমার দুঃখ হয় কেন, কন তো?
অনিক এই প্রশ্নের কী জবাব দেবে?
রাশু বলল, আপনার কোনো দুঃখ নাই, অনিক ভাই?
অনিক কথা বলল না। সে নদীর জলে ভেসে থাকা রোদের বিচ্ছুরণ দেখতে লাগল। রাশু বলল, আপনার দুঃখের কথা কন। শুনি।
অনিক মৃদু হাসল। বলল, আমার দুঃখের কথা বলতে ভালো লাগে না।
তাইলে সুখের কথা বলেন।
সুখের কথা হলো আমি মানুষকে সহসা ঘৃণা করতে পারি না। রাশু হাসল, এইটা কোনো কথা হইল?
কেন, কথা হবে না কেন?
ঘৃণা করতে না পারলে বাঁইচা থিকা লাভ কী? ধরেন কেউ আপনের কোনো ক্ষতি করল, ঠকাইল। তারে আপনে ঘৃণা করবেন না?
ঘৃণা করলে কী হয়? পাল্টা প্রশ্ন করল অনিক।
মনে শান্তি আসে। প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছা হয়।
আর ক্ষমা করে দিলে?
সব অপরাধ কি ক্ষমা করন যায়? এই যে জামশেদ স্যার লাল চান চাচারে খুন করল। এখন আমি তারে ক্ষমা কইরা দিব? তারপর শান্তিতে থাকব?
তাহলে কী করবেন?
রাশু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে আবারও ঢিল ফেলল জলে। অনিক বলল, খুন ক্ষমা করার মতো অপরাধ না। কিন্তু…।
কিন্তু কী?
খুনের প্রতিশোধ আপনি কী করে নেবেন?
রাশু জবাব দিল না। অনিক বলল, খুন ছাড়া তো অন্য কোনোভাবে খুনের প্রতিশোধ নিয়ে আপনি শান্তি পাবেন না। তার মানে আপনাকেও একটা খুন করতে হবে, তাই না?
রাশু আচমকা উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, খুন আমি তারে করব না।
তাহলে? ক্ষমা করে দেবেন?
রাশু বাঁকা ঠোঁটে হাসল। জবাব দিল না। সেই রাতেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। অনিক প্রথমবারের মতো খামারের বাইরে বের হতে পারল। গ্রামের দিকটাতে রাতের বেলায় হুট করে ঠান্ডা নেমে আসে। সেই কারণেই হোক কিংবা অন্ধকারে নিজেদের আরও আড়াল করতেই হোক, কালো দুখানা চাদরে নিজেদের আবৃত করে নিয়েছে মতিন আর অনিক। অন্ধকারে একটা বড় কাভার্ড ভ্যান সামান্য সময়ের জন্য চট করে থামল বড় রাস্তার ধারে। সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল তারা। গাড়ি দেখামাত্রই মতিন মিয়া বলল, তাড়াতাড়ি ওঠেন, অনিক ভাই। তাড়াতাড়ি।
এই গাড়িতে?
হুম।
এই গাড়িতে উঠব কী করে? এটা তো গার্মেন্টসের মালামাল বহনের গাড়ি। সামনে লেখা জরুরি রপ্তানি কাজে নিয়োজিত?
ওইটা নিয়া আপনের ভাবতে হইব না। আপনে আমার পেছন পেছন ওঠেন। ড্রাইভারের পাশে দুই সিট আছে। আমি উঠতেছি।
অনিক মতিন মিয়ার পেছন পেছন গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করল। তবে পুরোপুরি পারল না। তার আগেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল। ফলে বাইরের হাতল ধরে বেশ। কিছুক্ষণ চলন্ত গাড়িতে ঝুলে থাকতে হলো তাকে। পাহাড়ের মতো উঁচু ভিমসাই গাড়ি। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বার কয়েক প্রায় ছিটকে যাওয়ার উপক্রম হলো তার। তবে শেষ পর্যন্ত পড়ল না সে। বরং মতিন মিয়ার সহায়তায় উঠে বসল। সম্ভবত কোনো সমস্যা হয়েছে কোথাও। ড্রাইভার তীব্র গতিতে গাড়ি ছোটানোর চেষ্টা করছে। তার পুরো মনোযোগ রাস্তায়। আশপাশে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না সে। অনিক অবশ্য বসে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে নিল। তারপর তাকাল ড্রাইভারের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গেই জায়গায় জমে গেল সে।
ড্রাইভারের আসনে এ কে বসে আছে?
৪১
রোখসানা বেগম বললেন, হৃদি ফোন ধরছে না কেন, বাবা?
ঘুমাচ্ছে মা। বলল নেহাল।
কিন্তু ও গতকালও ফোন ধরে নি। তার আগের দিনও না।
ওর শরীরটা একটু খারাপ, মা।
কেন, কী হয়েছে?
তেমন কিছু না,। এখানে হঠাৎ অনেক ঠান্ডা পড়েছে। প্রচণ্ড স্নো পড়তে শুরু করেছে। এই জন্য একটু জ্বর জ্বর।
ওহ্। সাবধানে থেকো, বাবা। মায়ের মন তো! সন্তান দূরে থাকলে সারাক্ষণ হাঁস ফাঁস লাগে। টেনশন হয়। মনে হয় কী জানি কী হলো!
আপনি একদম চিন্তা করবেন না। ও ভালো আছে। সুস্থ আছে।
আচ্ছা। বলে ফোন রাখলেন রোখসানা বেগম। তার হঠাৎ করেই হৃদির জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। পরপর কয়েক রাত ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। এদিকে হৃদিও ফোন ধরছে না। এই নিয়ে খুব অস্থির লাগছে। বিষয়টা তিথির কাছেও ভালো লাগছে না। হঠাৎ সেদিন ফোন করে অনিককে কেন চেয়েছিল হৃদি? এত কিছুর পরও অনিকের সঙ্গে কথা বলতে চাওয়াটা মোটেই স্বাভাবিক কিছু নয়। তাহলে?
কথাটা সে বার কয়েক দিকে জিজ্ঞেসও করেছিল। কিন্তু উত্তর দেয় নি সে। এদিকে অনিকও হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেছে। কদিন পরপরই অবন্তীকে থানায় ডেকে নিচ্ছে পুলিশ। চারপাশে কী যেন কী হচ্ছে। কিন্তু সে কিছুই বুঝতে পারছে না।
রোখসানা বেগম বললেন, আমার মন কেমন করছে।
কেন?
বুঝতে পারছি না। হৃদির জন্য খুব অস্থির লাগছে।
এত অস্থির হয়ো না তো, মা। জামাইর সঙ্গে বিদেশে গেছে। হানিমুন। এই সময়ে তুমি যদি সারাক্ষণ ফোন করে বিরক্ত করো, কার ভালো লাগবে?
তাও কথা। কিন্তু তারপরও নিজেকে বোঝাতে পারেন না রোখসানা বেগম। তিনি দিন দুই বাদে আবার ফোন করলেন হৃদিকে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এবারও ফোন ধরল না সে।
নেহাল ধরল। বলল, মা?
হ্যাঁ, বাবা। কেমন আছ?
এই তো মা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে।
হৃদি কোথায়?
ও একটু বাজার করতে বেরিয়েছে। আমার ঠান্ডা লেগেছে।
ওহ! কিন্তু ওকে ফোন করলে পাওয়াই যায় না।
সারাক্ষণ যে কী সব করে, কে জানে! আচ্ছা, বাজার থেকে এলে আমি ফোন করতে বলছি।
একটু বোলো, বাবা। আর নিজের দিকে খেয়াল রেখো।
আচ্ছা মা।
হৃদি ফোন করল পরদিন সন্ধ্যায়। তবে প্রথমে কথা বলল নেহাল। বলল, মা, আমাদের বাসায় একটা পার্টি আছে তো আজ। এই জন্য গত কয়েক দিন বাজারটাজার করতেই কেটে গেছে। হৃদিই সব করেছে। ওর আবার এসবে খুব আগ্রহ।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। সে খুব চটপটে। ইউনিভার্সিটিতে তো ডিপার্টমেন্টের বেশির ভাগ আয়োজন সে-ই করত। রোখসানা বেগম যেন একটু ভালো বোধ করতে লাগলেন।
জি মা। এখানেই তাই। আমাকে তো কিছু করতেই দিচ্ছে না।
ওকে একটু দাও। কথা বলি।
দিচ্ছি মা। কিন্তু কথা ঠিকমতো বুঝতে পারবেন কি না, জানি না। বাসায় প্রচুর হইচই, গান-বাজনা হচ্ছে। এখনো পার্টি চলছে। বলেই হৃদিকে ফোনটা দিল নেহাল। রোখসানা বেগম বার কয়েক হ্যালো হ্যালো করলেও ঠিকঠাক হৃদির কথা শুনতে পেলেন না। ফোনের অপর প্রান্তে উচ্চ স্বরে গান বাজছে। তা ছাড়া হৃদির কণ্ঠও কেমন অনুচ্চ। ম্রিয়মাণ।
রোখসানা বেগম বললেন, কী হলো, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?
বলো মা।
তুই ফোন ধরিস না কেন?
ধরলাম তো!
এ কদিন ধরিস নি কেন?
ঘুমিয়ে ছিলাম।
সারাক্ষণই কি ঘুমিয়ে ছিলি? কবে থেকে ফোন দিচ্ছি তোকে?
জানি না, মা। খেয়াল নেই।
খেয়াল নেই মানে কী? বিদেশে গিয়ে মা-বোনকে পর্যন্ত ভুলে গেলি?
ভুলে যাই নি, মা।
তাহলে?
আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব। এখানে অনেক শব্দ। আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না। বলে ফোন রেখে দিল হৃদি। কিন্তু রোখসানা বেগমের হঠাৎ মনে হলো, হৃদি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কিছু একটা হয়েছে তার। কিন্তু সেই কিছু একটা পরিষ্কার ধরতে পারলেন না তিনি।
তিথি বলল, আপুর সঙ্গে কী কথা হলো, মা?
এই তো। কেমন আছে, কী করছে।
এত দিন ফোন ধরে নি কেন?
বলল তো খেয়াল করে নি।
এত দিনে একবারও খেয়াল করে নি?
তা-ই তো বলল। রোখসানা বেগম বুঝতে পারছেন না তিনি কী বলবেন। নিজ থেকে কাউকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চান না তিনি।
তিথি বলল, তুমি কি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ, মা?
কী লুকাব?
আপুর কি কিছু হয়েছে?
এই প্রশ্নে রোখসানা বেগম চুপ করে রইলেন। তিথি বলল, তোমাকে একটা কথা বলা হয় নি, মা।
কী কথা?
আপু না মাঝখানে কয়েক দিন আমাকে খুব ফোন দিত?
হুম।
তখন সে কী করত, জানো?
কী?
সারাক্ষণই কেবল অনিক ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাইত!
কী বলছিস তুই? ওই ছেলের সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইবে?
তা তো জানি না। আমাকে খুলে কিছু বলে নি। জিজ্ঞেস করলেই বলত, তোকে যেটা বলছি, সেটা কর।
কথা বলেছিল?
না। অনিক ভাইয়াকে আমি বলেছিলাম। উনি কিছু বলেন নি। আবার কথাও বলতে চান নি। চুপ করে ছিলেন।
ছেলেটা কই এখন?
তা তো জানি না। অনেক দিন কোনো খোঁজ নেই। সে তার ফোনও আর ব্যবহার করে না।
রোখসানা বেগম আর কথা বললেন না। তবে তার বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা চিনচিনে তীক্ষ্ণ ব্যথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তিথি মায়ের কাছে এসে বসল। বলল, আপুর কি খারাপ কিছু হয়েছে, মা?
খারাপ কিছু হলে তো সে বলতই। তেমন কিছু না মনে হয়। তবে কেমন একটা ঘুম ঘুম ভাব ওর গলায়। আর চারপাশে অনেক উচ্চ শব্দে গান বাজছিল। নেহাল বলছিল, বাসায় পার্টি চলছে।
ওহ্! তাহলে তো মজাই। আপুর তো এসব খুব পছন্দ।
হুম। সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন রোখসানা বেগম। তারপর খানিক চুপ থেকে বললেন, আমার কেন জানি ভয় হচ্ছে।
কিসের ভয়?
ওকে তো চিনিস। নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যা মন চায়, তা-ই করে বেড়াবে। ওখানে গিয়ে আবার মদটদ খাওয়া শুরু করে নি তো?
তিথি হাসল, তা একটু-আধটু তো খাবেই। ওসব দেশে সবাই খায়।
একটু-আধটু না। ওর কথা বলার ভঙ্গি শুনে আমার ভালো লাগে নি। মনে হচ্ছিল ও অনেক দূর থেকে টেনে টেনে কথা বলছে। কে জানে, ওই সব পার্টিফার্টিতে কী চলে? তা ছাড়া ও নাকি সারাক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে।
ধুর। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো। এখন ও বড় হয়েছে, এত ভেবো না। আর ভাবলেও দেশে এলে ভেবো। তখন ইচ্ছেমতো বকাঝকা করতে পারবে।
কথাটা বললেও তিথি নিজেও মনে মনে শঙ্কিতই হয়ে রইল। তারও কেন যেন মনে হচ্ছে, কোথাও না কোথাও একটা ঝামেলা হচ্ছে।
তাদের সেই শঙ্কা যেন কিছুটা হলেও সত্যি হলো দিন দুই বাদে। নেহাল হঠাৎ ফোন করে বলল, মা, একটা খারাপ খবর আছে।
কী খারাপ খবর, বাবা? আঁতকে ওঠা গলায় বললেন রোখসানা বেগম।
হৃদির ছোটখাটো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে।
কী বলছ, বাবা? কী অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে ওর? কেমন আছে ও? নেহাল, আমার মেয়ে কেমন আছে? কী হয়েছে ওর? আতঙ্কিত কণ্ঠে হড়বড় করে বলতে লাগলেন। রোখসানা বেগম। কাঁদছেন তিনি।
নেহাল অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করল। বলল, মা, আপনি ঘাবড়াবেন না। তেমন কিছু না। বাংলাদেশে যেমন বৃষ্টি, এখানে তেমন স্নো। এর আগে তো কখনো স্নো পড়তে দেখে নি ও। প্রথমবার দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারে নি। খুব ছোটাছুটি করছিল। বাচ্চাদের মতো। তারপর হঠাৎ পা পিছলে পড়ে একটু আঘাত পেয়েছে।
ওহ্! যেন বুকে আটকে রাখা দমটা ছাড়লেন রোখসানা বেগম। বললেন, বেশি কিছু না তো?
না মা। এই ঘাড়ে-মাথায় সামান্য আঘাত পেয়েছে। তারপরও সাবধানতাবশত আমি সঙ্গে সঙ্গেই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি।
কেমন আছে এখন? কথা বলা যাবে?
অবশ্যই যাবে, মা। তবে ও তো এখন ঘুমাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠলেই আপনার সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা বাবা। বিড়বিড় করে বললেন রোখসানা বেগম। তবে তাকে খুব একটা আশ্বস্ত মনে হলো না। হৃদির সঙ্গে তার কথা হলো বিকেলের দিকে। হৃদি বলল, মা, কেমন আছ?
এই তো ভালো। তুই?
আমিও ভালো।
তোর শরীর এখন কেমন?
ভালো।
কী হয়েছিল তোর?
বুঝতে পারছি না। মাথাটা ঝিমঝিম লাগছে।
তুই নাকি বরফে পা পিছলে ব্যথা পেয়েছিস।
মনে হয়। বলে চুপ করে রইল হৃদি। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বলল, নেহাল বলেছে?
হুম।
তাহলে ঠিক আছে। ও হা হা, মনে পড়েছে। আমি বরফের মধ্যে হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলাম। এখনো নতুন তো। কীভাবে শোর মধ্যে হাঁটতে হয় জানি না। মা?
হ্যাঁ।
আমার না মাথা কাজ করছে না, মা। ঘুম পাচ্ছে। আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা
বলি?
তুই ঠিক আছিস, মা?
আছি।
তুই আমাকে সত্যি করে বল, ওখানে তোর কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?
না মা। আমার খালি ঘুম পায়। আমি ঘুমাই, মা?
বলেই ফোন রেখে দিল হৃদি। নেহাল ফোন নিয়ে বলল, মা, ওর কথায় আপনি কিছু মনে করেন না। ব্যথা কমাতে ওকে প্যাথেড্রিন দেওয়া হয়েছে। এই জন্য কথাবার্তা
একটু এমন। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।
রোখসানা বেগম কিছু বললেন না। তিনি দীর্ঘ সময় ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইলেন। তিথি বলল, কী হয়েছে, মা?
হৃদির কিছু হয়েছে, তিথি।
কী হয়েছে?
তা জানি না। তবে হৃদি ওখানে ভালো নেই।
কী বলছ তুমি? কোনো ঝামেলা হয়েছে? নেহাল ভাইয়া কিছু বলেছে?
না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি। নেহালের সঙ্গে হৃদির কিছু হয়েছে। কিন্তু হৃদি সেটা আমাকে বলার মতো অবস্থায় নেই।
মানে কী?
ওর গলা শুনে মনে হচ্ছে ও ঘুমের মধ্যে কথা বলছে। আগের চেয়েও অবস্থা খারাপ। যেন কেউ কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে, আর ও সেটা ঘুম ঘুম গলায় বলে যাচ্ছে। ভয়ও পাচ্ছে।
কে শিখিয়ে দেবে? কাকে ভয় পাবে ও?
নেহালকে।
নেহাল ভাইয়াকে?
নেহাল ভাইয়াকে কেন ও ভয় পাবে?
তা তো জানি না। এমন কি হতে পারে যে নেহাল কোনোভাবে হৃদির বিয়ের কথাটা জেনে গেছে?
তাহলে সেটা সবার আগে তোমাকেই বলত, তাই না?
রোখসানা বেগম কথা বলল না। তিথি বলল, তুমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করো?
এখন না। আগে ও দেশে ফিরুক। ও দেশে ফেরার আগে কিছু করা যাবে না। যেভাবেই হোক, আগে হৃদিকে দেশে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। নেহালকে কিছু বলা। যাবে না তার আগে। তুইও বলিস না। একদম স্বাভাবিক। রোখসানা বেগমের গলা কাঁপছে। চোখ ছলছল করছে।
মা! তিথি গাঢ় গলায় ডাকল। তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?
কারণ, আমার মন কু ডাক ডাকছে।
কী কু ডাক?
হৃদির খারাপ কিছু হয়েছে। খুব খারাপ কিছু এবং সেটা করেছে নেহাল। আমার ধারণা, হৃদিকে কোনো ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। হাই ডোজের ওষুধ অথবা নেশাজাতীয় কিছু।
কী বলছ তুমি?
রোখসানা বেগম কথা বললেন না।
তবে দিন দশেক পর একদিন হঠাৎ হৃদি ফোন করল। ফোন ধরল তিথি। সে বলল, আপু?
হৃদি অবশ্য তার কথা শুনল কি না বোঝা গেল না। সে হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তিথি বলল, তোর কী হয়েছে, আপু? তুই কাঁদছিস কেন?
হৃদি ভয়ার্ত গলায় বলল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও, মা। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। মা, ও মা। মা গো।
তিথি কী বলবে ভেবে পেল না। হৃদি কান্নাজড়ানো গলায় বলল, আমাকে একবার অনিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। খালি একবার। আমি মরে যাওয়ার আগে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ও মা, মা। সে ঝরঝর করে কাঁদছে। কান্নায় তার গলা বুজে আসছে।
তিথি বলল, তোর কী হয়েছে, আপু? আমাকে বল? কী হয়েছে তোর?
আমার কিছু হয় নি। আমাকে একবার অনিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। ও মা? মা? আমাকে একবার অনিকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দাও। দেবে মা? একবার? দেবে?
তিথি ডাকল, আপু, আপু!
হৃদি তিথির কথা শুনল কি না বোঝা গেল না। সে হাউমাউ করে বলতে লাগল, আমি অনিকের কাছে যাব, অনিকের কাছে যাব আমি। আমি ওর পায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকব। মা, আমি অনিকের পায়ের কাছে গিয়ে কুকুরের মতো বসে থাকব, ও মা…
৪২
জামশেদ বললেন, মালের কোনো খোঁজ মিলল, রাশু?
জি না, স্যার।
লাল চান কিন্তু বলছিল যে সে মাল তোর কাছে দিয়েছিল?
মিথ্যা কথা বলছে।
মিথ্যা কথা বলছে? অবাক গলায় বললেন জামশেদ। লাল চান তোরে নিয়া মিথ্যা কথা বলছে?
আমারে নিয়া তার মিথ্যা কথা বলতে সমস্যা কী? জানের ভয়ে মানুষ নিজের পোলাপানরে নিয়া পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলে। আর আমি তো সেইখানে তার কিছুই না।
কিন্তু সে তো তোরে খুব ভালোবাসত।
হহ। টাকাপয়সা কামাই করতে পারলে দুনিয়ার সবাই সবাইরে ভালো পায়। আপনে আমারে যত টাকা দিছেন এখন পর্যন্ত, সেই টাকা কই? একটা টাকাও আছে। আমার কাছে? নাই।
কই গেছে তাহলে?
সব সে নিয়া গেছে?
সব?
জে। শুধু তা-ই না, সে আমারে ভয় দেখাইয়াই রাজি করাইছিল যে আমি যাতে আপনের কাছে মিথ্যা কথা বলি যে মাল আমি হারাইছি। তাতে সে-ও বাঁচল, আমিও বাঁচলাম।
তুই বাঁচলি কেমনে? তখন তো আমি তোকে ধরতাম?
তার ধারণা আপনে আমারে খুব পছন্দ করেন, এই জন্য আমারে কিছু বলবেন না। বড়জোর চড়-থাপ্পড় মারতে পারতেন। কিন্তু খুন তো করবেন না।
হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন জামশেদ। বললেন, আমার সঙ্গে চালাকি করবি। চালাকি আমার পছন্দ না। মাল যে-ই হারাক, তুই মাল খুঁইজা বাইর কর। আমার ধারণা, তুই জানস, মাল কই আছে? সে তোরে না জানাই কিছু করে নাই।
আমি কী করে জানব?
রাশু! ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন জামশেদ। তোরে আমার দরকার। তোর জাত আলাদা। অনেক সাপের মধ্যে যেমন জাতসাপ চেনা যায়, তুইও তেমন। কিন্তু আমি চাই, তুই আমাকে ভয় পা। সাপ যেমন সাপুড়েরে ভয় পায়, তেমন।
রাশু কথা বলল না। জামশেদ বললেন, আমার ধারণা ছিল অন্তত লাল চানের অবস্থা দেখে তুই ভয় পাবি। কিন্তু সেই লক্ষণ তোর মধ্যে নাই। বিষয়টা স্যাড। বাট, মনে রাখিস, দিস ইজ ইয়োর লাস্ট চান্স। আমি পেছনে চিহ্ন রেখে সামনে এগোই না।
রাশু নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। সামনে দাঁড়ানো লোকটার কথা ঠিক নয়। সে এই পৃথিবীতে এত ভয় কখনো কাউকে পায় নি। জামশেদ এগিয়ে এসে রাশুর কোমরে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, সব ঠিক আছে তো?
হুম।
যেখানে-সেখানে অযথা শক্তি ক্ষয় করবি না। জিনিস খুঁজে বের কর।
রাশুর শিরদাঁড়া হঠাৎ টানটান হয়ে গেল। তার মনে হলো, জামশেদ যেকোনো সময় তার কোমরে লুকিয়ে থাকা যন্ত্রটার ট্রিগার টেনে দেবেন।
.
অনিক থমথমে মুখে বসে আছে পুকুরপাড়ে। রাশু বলল, কী হইছে, ভাই?
কিছু না।
বলেন আমারে। আপনেরে আমার পছন্দ। যেকোনো কথা আপনি আমারে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
আমি একটা খুন করতে চাই।
খুন! অবাক গলায় বলল রাশু। আপনে?
হুম।
কারে?
সেটা শুনে আপনার কাজ নাই।
তাহলে আমার কাজ কী?
হেল্প করবেন।
খুনের সহযোগী? চোখ টিপে হাসল রাশু। কী হেল্প?
আপনার কাছে একটা পিস্তল আছে। পিস্তলটা আপনি আমাকে দেবেন।
রাশু তার কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে অনিককে দিল। বলল, নেন। চালাইতে জানেন? আমি বহুদিন ধইরা সঙ্গে রাখি, কিন্তু চালাইতে জানি না।
অনিক কথা বলল না। রাশু বলল, আপনে না ক্ষমা পার্টি? আপনে হঠাৎ খুন পার্টি হইলেন কেমনে?
অনিক জবাব দিল না। রাশু বলল, খুন কিন্তু আমরা সবাই করি। কিন্তু সেইগুলা সব দেখি না। দেখি শুধু শইলের খুন। কথা ঠিক কি না?
অনিক চোখ তুলে রাশুর দিকে তাকাল। ছেলেটার প্রতি তার একধরনের সমীহ রয়েছে। কিন্তু সেই সমীহের কারণ সে জানে না। তবে তার মাঝে মাঝেই মনে হয়, এই ছেলের ভেতরে কিছু একটা আছে। কিন্তু সে ভুল সময়ে ভুল জায়গায় জন্মেছে। আর এখন সে এসে পড়েছে আরও এক ভুল জায়গায়।
রাশু বলল, ধরেন, আমরা কারও বিশ্বাস ভাঙলাম, এইটাও তো খুনই। খুন না? বা ধরেন, কথা দিয়া কথা রাখলাম না? ঠকাইলাম কাউরে। এইগুলা সবই কিন্তু খুন। কিন্তু দোষ হয় খালি গুলি কইরা মানুষ খুন করলে। এই এক খুনেরই খালি শাস্তি আছে, বাকিগুলার কোনো শাস্তি নাই। এইটা কোনো কথা, বলেন? ওইগুলায় দোষ হয় না?
কথাটা অনিকের কানে আলপিনের মতো বিঁধে রইল। রাশুর কথা সত্য। আর সব খুন মানুষ দেখে না। তার শাস্তিও হয়তো নেই। কেবল এই এক খুনেরই শাস্তি আছে। অথচ সেই সকল খুনও কম ভয়ানক কিছু নয়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও লুকায়। পলাতক এই জীবনে আর কত লুকাবে সে?
সেদিন রাতে কাভার্ড ভ্যানে উঠেও নিজেকে লুকাতে হয়েছিল তাকে। গাড়িতে তার পাশে বসেছিল মতিন মিয়া। মতিন মিয়ার পাশে ড্রাইভার। অনিক সেই ড্রাইভারকে দেখে চমকে গিয়েছিল। এই জীবনে এত অবাক আর হয় নি সে! ড্রাইভারের সিটে বসে গাড়ি চালাচ্ছে ছাত্তার চাচা! তার দৃষ্টি সামনের অন্ধকার রাস্তায়। গভীর মনোযোগে গাড়ি চালাচ্ছেন তিনি। চট করে মুখ ঘুরিয়ে পাশের জানালায় তাকিয়ে ছিল অনিক। তারপর নিজের মুখ ঢেকে ফেলেছিল চাদরে। তারা এসে নেমেছিল ঘণ্টাখানেক পর। জায়গাটা গাজীপুরের দিকে। সেখানে রাস্তার পাশে অন্ধকারে তাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল ছাত্তার চাচা। অনিকের হঠাৎ মনে হলো, সে তার বাবার হঠাৎ অত টাকাপ্রাপ্তি এবং মৃত্যুর কারণ বুঝে গেছে। ভাগ্য কী আশ্চর্য উপায়েই না তার সামনে সেই রহস্য উন্মুক্ত করল। কিন্তু এই ভাগ্য তার জন্য আর কী কী রেখেছে?
জামশেদের সঙ্গে তার দেখা হলো শেষরাতের দিকে। তারা মুখোমুখি বসে ছিল একটা পুরোনো গাড়ির গ্যারেজে। সেখানে মৃদু হলুদ আলো। সেই আলোতে জামশেদ হঠাৎ বললেন, তোমাকে কি আগে কোথাও দেখেছি আমি? মানে…। বলতে গিয়েও হঠাৎ থমকে গেলেন তিনি। থমকে গেল অনিকও। তারও মনে হলো, এই লোকটাকে সে এর আগেও কোথাও দেখেছিল। কিন্তু কোথায়?
জামশেদ অবশ্য বেশিক্ষণ বসলেন না। কিছু জরুরি কথাবার্তা বলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই উঠে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে ক্যাপটা ঠিকঠাক মাথায় পরে নিলেন তিনি। অনিকের আচমকা মনে হলো, বাবার লাশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গভীর রাতে ফেরিতে এই লোকটির সঙ্গেই তার দেখা হয়েছিল!
সম্ভবত বাবার বিষয়ে আরও নিশ্চিত হতে চাইছিলেন জামশেদ। বাবার সঙ্গে অন্য কেউও জড়িত কি না। কিংবা আর কোনো তথ্য নিশ্চিত হতেই সেই রাতে ফেরি পর্যন্ত গিয়েছিলেন তিনি!
৪৩
রিয়ার বিষয়ে পুলিশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। মঈনকে তিন দফায় রিমান্ডে নিয়েও তেমন কোনো তথ্য পায় নি পুলিশ। বিষয়টা আবছার আহমেদকে ভারি অবাক করেছে। একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে এই পরিমাণ জিজ্ঞাসাবাদের পরও তথ্য না দিয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু মঈন নতুন তেমন কিছুই বলে নি। সে অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে যে অবন্তীর কারণেই রিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল সে এবং তারপর ঘটনাচক্রেই তাদের মধ্যে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। কিন্তু এর বেশি কিছু আর সে জানে না। এই নিয়ে একদিন অবন্তীরও মুখোমুখি করা হলো তাকে।
মঈনের সারা শরীরে কলশিটে দাগ। চোখের কোলে কালি জমে গেছে। মাত্র কদিনেই কণ্ঠার হাড় পর্যন্ত উঁকি দিচ্ছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সে। তাকে। দেখে হতভম্ব হয়ে গেল অবন্তী। এ কাকে দেখছে সে? মঈন অবশ্য কিছু বলল না। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইল। অবন্তী কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। এত দিশেহারা আর কখনো লাগে নি তার! এত অসহায়, শূন্য, ব্যথাভার। মঈন তাকাল। ফ্যাকাশে, ক্লান্ত চোখ। অবন্তী সেই চোখে চোখ রাখতে পারল না। সে হঠাৎ তার মাথার ওপর ঘুরতে থাকা পুরোনো সিলিং ফ্যানটা দেখতে থাকল। কিংবা কে জানে, হয়তো লুকাতে চাইল নিজের চোখ।
মঈন হঠাৎ বিড়বিড় করে বলল, আমি কিছু করি নি। আমি সত্যি কিছু করি নি। ওরা শুধু শুধু আমাকে মারল।
অবন্তীর মনে হলো তার বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখের ভেতর অজস্র ঘুণপোকা একনাগাড়ে জেগে উঠেছে। মঈন বলল, আমি সত্যিই কিছু করি নি। আমি শুধু তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাইছিলাম। আর কিছু না। ওরা আমায় শুধু শুধু মেরেছে। এই দেখো?
সে তার পেটের কাছের জামাটা তুলে ধরার চেষ্টা করল। হাতা গুটিয়ে কনুই বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার হাত কাঁপছে। বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। আঙুলগুলো বীভৎসভাবে ফুলে আছে। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁচকে গেছে মুখ। মঈন বলল, আমি আর কখনো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইব না। বিশ্বাস করো। আর কোনো দিন না। তুমি একটু ওদের বলবে যে আমি কিছু করি নি? মঈনের গলা কাঁপছে। চোখ টলমল করছে। প্রচণ্ড আতঙ্কে বিবর্ণ হয়ে আছে সে। কিন্তু কী করবে অবন্তী?
মঈন বলল, তুমিও আমার কথা বিশ্বাস করো না, তাই না?
আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, মঈন। আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। কম্পিত কণ্ঠে দ্বিরুক্তি করল অবন্তী, আমি জানি তুমি কিছু করো নি। আমি তোমার কথা কাউকে কিছু বলিও নি…। অবন্তী হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মঈনকে অবচেতনেই তুমি করে বলতে শুরু করেছে সে। মঈন অবশ্য কথা বলল না। সে আবারও মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
অবন্তী দিশেহারা ভঙ্গিতে বলল, আমি এখন কী করব? আমি কী করলে ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে? তুমি বলো, প্লিজ। আমাকে বলে দাও…আমি তা-ই করব। প্লিজ, আমাকে বলে দাও তুমি।
মঈন এবারও কথা বলল না। অবন্তী হঠাৎ মঈনের কাছে ছুটে এল। তাদের দুজনের মাঝখানে একটা টেবিল। সে সেই টেবিল ডিঙিয়ে মঈনের কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর দুহাতে আলতো করে তার মাথা চেপে ধরল। বলল, আমাকে বললা…। বলো আমাকে।
মঈন মুখ তুলে অবন্তীর চোখের দিকে তাকাল। তার সেই চোখ গড়িয়ে টুপটাপ। অশ্রু ঝরে পড়ছে। আর সেই অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে মঈন। তার চোখ, ঠোঁট, গাল। অবন্তী ফিসফিস করে বলল, ওরা তোমাকে এত মেরেছে! আমি কী করব, আমাকে একটু বলে দাও?
মঈন বিড়বিড় করে বলল, আমি রিয়ার কিছু করি নি। আমি শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। আর কিছু করি নি আমি।
কেন তুমি ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে?
আর যাব না। আর কোনো দিন যাব না।
তুমি আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে গেলে না? কেন তুমি ওর সঙ্গে কথা বলতে গেলে? তুমি আমার সঙ্গেই কথা বলতে যেতে…। আমি না চাইলেও যেতে। প্রতিদিন যেতে…তুমি কেন ওর সঙ্গে…। অবন্তী কাঁদছে। কান্নায় তার কথা জড়িয়ে আসছে।
আর যাব না। আমি তোমার সঙ্গেও আর কখনো কথা বলতে যাব না।
মঈন! বলে আচমকা তার পায়ের কাছে বসে পড়ল অবন্তী। তারপর দুহাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। বলল, আমি কী করব, বলো? আমি কী করলে ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে? আমি তা-ই করব। তুমি যা বলবে তা-ই করব আমি। শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়ল অবন্তী।
মঈন উত্তর দিল না। তবে এই মুহূর্তে ঘরে ঢুকলেন আবছার আহমেদ। বললেন, অবন্তী, এখানে এমন করবেন না। এমনিতেই এভাবে আসামির সঙ্গে দেখা করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমি চেয়েছি যে আপনি যদি কোনো তথ্য বের করতে পারেন। সে কারণেই এভাবে দেখা করতে দেওয়া।
ও রিয়ার কোনো ক্ষতি করে নি। আমি আপনাকে লিখে দিতে পারব। আমি ওকে চিনি। বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল অবন্তী। আপনি বিশ্বাস করুন, ও ও রকম মানুষ না। একটা মানুষ এই পরিমাণ টর্চারের পরও তার মুখ বন্ধ রাখতে পারে?
আবছার আহমেদ হাসলেন, এটা তো তেমন কিছুই না। এর চেয়ে ভয়ানক জিজ্ঞাসাবাদেও অপরাধীরা টু শব্দটা পর্যন্ত করে না।
কিন্তু ও পেশাদার কোনো অপরাধী না। আমি বলছি ও অপরাধী না। ও সেই রাতে আমাকে গুলিও করে নি। এমনকি রিয়ারও কোনো ক্ষতি ও করে নি। আপনি চাইলে আমি লিখে দিতে পারি। আমাকে কী করতে হবে, বলুন?
আপনি বললেই তো আর হবে না, অবন্তী। আইনের কিছু নিয়মকানুন আছে। আমাদের কিছু বোঝাপড়া আছে। বিষয়টা সেই অ্যাঙ্গেলেই এগোবে।
তাই বলে একটা মানুষকে বিনা অপরাধে…।
বিচারে প্রমাণিত হওয়ার আগেই আপনি তাকে নির্দোষ বলে দিতে পারেন না!
আপনিও কোনো প্রমাণ ছাড়াই তাকে এভাবে…। অবন্তী নিজেকে সামলাতে পারল না। দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল সে। মঈন ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে।
আবছার আহমেদ বললেন, তার আত্মীয়স্বজন এসেছেন। তারা তার পক্ষে লইয়ারও ঠিক করেছেন। সো, তিনি দোষী না নির্দোষ, তা কোর্টে ঠিক হতে হবে। তাই না?
কিন্তু আপনিই বলুন, ও ঠিক কী কারণে রিয়ার কোনো ক্ষতি করবে? একটা কারণ বলুন?
আবছার আহমেদ হঠাৎ বিরক্ত হলেন। বললেন, ক্ষতি করার পক্ষে চাইলে একশটা কারণ আমরা খুঁজে বের করতে পারি। না করার পক্ষে যেমন কারণ আছে, করার পক্ষেও আছে। কিন্তু সে আসলেই করেছে কি না, সেটা প্রমাণ করবে আদালত।
অবন্তী আর কথা বলল না। সে চুপচাপ টেবিলে মাথা দিয়ে বসে রইল। আবছার আহমেদ বললেন, আপনার সময় শেষ।
.
রিয়ার বিষয়ে তার ডিপার্টমেন্টেও খোঁজখবর নেওয়া হলো। জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও। সেই জিজ্ঞাসাবাদে অবধারিতভাবেই উঠে এল মাহমুদ হাসানের নাম। এমনিতেই বিষয়টি নিয়ে তিনি মানসিকভাবে ভয়াবহ ভেঙে পড়েছেন। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। ঠিকমতো ক্লাসেও আসেন না। এর মধ্যে পুলিশ যখন তার সঙ্গে কথা বলতে এল, তখন তিনি শারীরিক-মানসিকভাবে ভয়ানক বিপর্যস্ত।
আবছার আহমেদ বললেন, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমরা যতটুকু খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি, তাতে অনেকেই বলেছেন যে আপনার সঙ্গে রিয়ার বেশ একটা বোঝাপাড়া ছিল।
মাহমুদ হাসান কথা বললেন না। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ লাল। মুখ ফ্যাকাশে। আবছার আহমেদ বললেন, আমাদের তো একটু সহায়তা করতে হবে, স্যার। বুঝতে পারছি বিষয়টা নিয়ে আপনি খুব আপসেট! আপনার খুব প্রিয় ছাত্রী ছিল সে। এ কারণেই আপনার দায়িত্বটা আরও বেশি।
মাহমুদ এবারও কথা বললেন না। একটা প্যাডে আনমনে বাঁ হাতে কাটাকুটি করছেন তিনি। এতটা বিষণ্ণ আর কখনো লাগে নি তাকে। যেন তার জগৎসংসার সব শূন্য হয়ে গেছে। তিনি স্লান চোখে আবছার আহমেদের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, আমি রিয়ার কথা কিছু বলতে পারছি না। আমি কোনো কথাই গুছিয়ে আনতে পারছি না। সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার।
স্যার! বলে তার হাতখানা আলতো ছুঁয়ে দিলেন আবছার আহমেদ। তাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন, বিপদে যদি আমরা ভেঙে পড়ি, তাহলে স্টুডেন্টরা কী করবে, স্যার?
তিনি কথা বললেন না। প্যাডের ওপর এলোমেলো দাগ কাটতেই থাকলেন। অর্থহীন এটা-সেটা লিখে যেতে থাকলেন। যেন এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে কোথাও লুকানোর পথ খুঁজছেন। বিরাম চাইছেন খানিক। কিন্তু কিছুতেই পারছেন না। রিয়ার সঙ্গে তার অসংখ্য স্মৃতি। অসংখ্য অনুভব, স্পর্শ। সেসব থেকে নিজেকে কী করে লুকাবেন তিনি? কী করে আড়াল করবেন তার বুকে বয়ে চলা এই অথই জলের কান্না? উথালপাতাল ঝড়? এই কথা কাউকে বলতেও পারবেন না তিনি। কাউকে না।
মাহমুদ হাতের কলমটা খানিক রাখলেন। তারপর নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে নিয়ে বললেন, রিয়া মাঝেমধ্যেই আমার বাসায় যেত। ওর কিউরিসিটি একটু বেশি ছিল। বলতে শুরু করলেন মাহমুদ।
জি।
আর আমি সব সময়ই স্টুডেন্টদের জন্য ওপেন। যার যেকোনো সমস্যা, আমাকে অকপটে বলা যেত। বলেও তারা। রাতদুপুরে ফোন করেও নানাজন নানান সমস্যার কথা বলে আমাকে।
জি স্যার। অনেকেই সেটা বলেছে আমাদের। আপনি তাদের সবার কাছেই অসম্ভব প্রিয়।
শুধু যে ক্লাসের বিষয় নিয়ে কথা হয়, তা-ও না। ক্লাসের বাইরের নানা বিষয়েও তারা আমার সঙ্গে কথা বলে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, প্রেম, ক্যারিয়ার–সবকিছু নিয়ে। তবে এর মধ্যেও রিয়া একটু আলাদা ছিল। অন্য রকম।
কীভাবে?
ও খুব ছটফটে আর ডানপিটে ছিল। ভীষণ বেপরোয়া। কারও কোনো কথাই শুনতে চাইত না সে। তবে আমাকে অসম্ভব পছন্দ করত। রেসপেক্ট করত। ফলে এমনও হয়েছে যে ওর বাবা-মা আমাকে ফোন করে বলেছেন ওকে বোঝাতে। ও যখন ইচ্ছে করেই ফাস্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে আবারও ফাস্ট ইয়ারেই রয়ে গেল, তখনো।
জি। আপনার সঙ্গে ওর শেষ কবে দেখা হয়েছিল?
মাহমুদ বললেন, ও আমার বাসায় এসেছিল সেদিন সকালের দিকে। তারিখটা এক্সাক্ট মনে নেই। আমি বাসায় একা ছিলাম। আমার স্ত্রী তার বাবার বাড়ি। এদিকে বাসায় ইন্টেরিয়রের কাজ শুরু হবে। সবকিছু এলোমেলো। ফলে, আমি সময় দিতে পারি নি। কিন্তু ওকে খুব আপসেট মনে হচ্ছিল। বলছিল, কিছু একটা বলতে চায় সে আমাকে। আমি বললাম, পরে ডিপার্টমেন্টে এলে আমি কথা বলব।
এটুকুই?
হুম।
এরপর একদিন ফোন করেছিলাম। কিন্তু বন্ধ পেলাম। ওদিকে বাসা নিয়ে ব্যস্ততায় আমার মোটামুটি পাগল হওয়ার দশা। কাঠমিস্ত্রি, রংমিস্ত্রি থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রি, ডিজাইনার। এগুলো চলল প্রায় দিন পনেরো। রাত-দিন একাকার অবস্থা। ফলে পরে আর আমার ফোন করা হয় নি।
তারপর আর যোগাযোগ হয় নি?
নাহ্। আর ফোন করে নি সে। বিভাগেও আসে নি।
হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন আবছার আহমেদ। বললেন, থ্যাংক ইউ স্যার। প্রয়োজন হলে আমি আবার আপনার সঙ্গে কথা বলতে আসব।
মাহমুদ কথা বললেন না। চশমার ফাঁকে জল ভরে ওঠা চোখ জোড়াকেও আড়াল করতে পারলেন না তিনি।
৪৪
হৃদি শুয়ে আছে একটা খোলা মাঠে। মাঠভর্তি সবুজ ঘাস। তবে সেই ঘাসের বুকে রংবেরঙের বুনো ফুল। ফুলগুলো আকারে তেমন বড় নয়। হৃদির কপালে যে টিপ, সেই টিপের চেয়ে সামান্য কিছু বড়। মৃদু হাওয়ায় ফুলগুলো তিরতির করে কাঁপছে। যত দূর চোখ যায়, কেবল ওই ফুল ফুটে আছে। দেখে মনে হচ্ছে রঙের মেলা বসেছে দিগন্তজুড়ে। মাথার ওপর ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ। সেই আকাশের এখানে-সেখানে তুষারশুভ্র মেঘ। তার ফাঁকে সূর্যের বিচ্ছুরিত আভা। কোথাও থেকে অদ্ভুত মোহময় সুরে গান ভেসে আছে, দেয়ার ইজ সামওয়ান ফর মি সাহোয়ার, অ্যান্ড আই স্টিল মিস সামওয়ান।
সে-ও কি কাউকে মিস করছে? হৃদি উঠে বসল। তার চারপাশে সে ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু এখানে কার সঙ্গে এসেছে সে? ওই যে নদী, নদীর ধারে গাঙচিলদের মেলা। নাম-না-জানা ফুল। চিরলবিরল পাতা। তুলোর মতো নাও। নাওয়ের ওপর বইঠা হাতে কে?
কে ওখানে? হৃদি আচমকা উঠে দাঁড়ায়। তারপর ছুটতে থাকে রুদ্ধশ্বাসে। লম্বা গাছ পেরোলেই ছোট্ট কখান ঘর। ঘরের পাশে উঠোন। উঠোনজুড়ে নানান রঙের পাখি। তার ওপাশে নদী। নদীর ঘাটে নৌকা ভেড়ায় কে?
সে সবুজ ঘাসের শেষে দাঁড়ায়। জলের ভেতর ছায়ার মতো মানুষ। ভাসে, ডোবে। ডোবে, ভাসে। কে ওখানে? অনিক? বুকের ভেতর হঠাৎ কেঁপে ওঠে। অচেনা এক ঝড়, তুমুল হাওয়ায় দানব হয়ে আসে। ছলকে ওঠে জল। ভিজিয়ে দেয় মন। অনিক?
হুম।
তুমি এখানে?
হুম?
কী করে এলে?
তোমায় খুঁজতে খুঁজতে।
কিন্তু পথ চিনলে কী করে?
তা তো জানি না।
না জানলে আসা যায়?
আমি তো এলাম।
কীভাবে?
মন জানে।
কী জানে মন?
অচেনা পথেও কী করে পথ চিনতে হয়।
ভুল হয় না?
হয়।
তাহলে? এই পথ যদি ভুল হয়?
ভালোবাসায় ভুল পথ বলে কিছু নেই, হৃদি।
কিন্তু কেউ যদি তোমায় ঠকায়?
তাতে কী? আমি তো ঠকাই নি! ঠকেছ তো? অন্যজন তো তোমায় ঠকিয়েছে?
উঁহু।
তাহলে?
মানুষ কখনো অন্যকে ঠকাতে পারে না, জানো তো?
কেন?
কারণ, অন্যকে ঠকাতে গিয়ে সে আসলে নিজেকেই ঠকায়।
তুমি তাহলে ঠকো নি?
নাহ্। যার তোমাকে ভালোবাসতে ভালো লাগে, তুমি যেমনই হও না কেন, তারপরও যে তোমাকে ভালোবাসতে পারে, তাকে তুমি ঠকাবে কী করে! তাকে কখনোই ঠকানো যায় না। বরং তাকে ঠকানোর চেষ্টা করা মানে তো নিজেকেই ঠকানো, তাই না?
হৃদি কথা বলল না। অনিক বলল, পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসার বড় অভাব, জানো তো?
হুম।
এই যে জগজুড়ে এত এত মানুষ ভালোবাসে, তার কতটুকু নির্ভেজাল? নিঃশর্ত, নিঃস্বার্থ? তুমি জানো?
হৃদি জবাব দেয় না।
অনিক বলে, খুব সামান্যই। পৃথিবীতে ওই নির্ভেজাল ভালোবাসার খুব অভাব। বলে থামে সে। তারপর বলে, কেউ যদি অমন ভালোবাসা পেয়েও তা দূরে ঠেলে দেয়, তাহলে সে আসলে কাকে ঠকাল?
নিজেকেই।
হ্যাঁ। যে ভালোবাসে সে কখনো ঠকে না, হৃদি। ঠকে সে, যে লোভ করে সেই ভালোবাসা পায়ে দলে চলে যায়।
হৃদি কথা বলে না। অনিকও না। কোথাও থেকে এসে একটা ঘুমঘুম হাওয়া বয়ে যেতে থাকে। একটা পাখি টুপ করে মাছ তুলে নিয়ে যায় নদীর জল থেকে। আর ঠিক তখুনি মেয়েটাকে দেখতে পায় হৃদি। অবিকল তার মতোই দেখতে, কিন্তু সে নয়। নৌকার কাছে এসে দাঁড়ায় সে। অনিক তাকে হাত ধরে তোলে। তারপর পাল তুলে দেয় হাওয়ায়। তারপর হৃদির দিকে তাকিয়ে হাসে। বলে, ভালো থেকো, হৃদি। ওই যে, নেহাল আসছে। সে তোমাকে ডাকছে।
হৃদি ফিরে তাকায়। নেহাল মাঠ পেরিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। নেহালের হাতে রংবেরঙের অনেকগুলো কৌটা। কৌটাভর্তি ওষুধ। তার সঙ্গে এভিলিন। এভিলিনের হাতভর্তি সিরিঞ্জ। তারা এগিয়ে আসতে থেকে। হৃদি হঠাৎ চিৎকার করে অনিককে ডাকতে থাকে, অনিক, অনিক। কাঁদছে সে। কিন্তু অনিক ততক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে। জলের বুকে দিগন্তরেখায় ক্রমশ বিন্দুতে পরিণত হচ্ছে সে। হৃদি অকস্মাৎ ছুটতে শুরু করল। সে এই জল পেরিয়ে নদীর ওপারে পৌঁছে যেতে চায়। দূরে চলে যেতে চায় নেহাল আর এভিলিনের কাছ থেকে। কিন্তু অতটা দূর সে যাবে কী করে?
ততক্ষণে আকাশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। নিভে যেতে থাকে দিনের আলো। কিন্তু লাল, নীল, হলুদ আলোর রশ্মি নেমে আসতে থাকে আকাশ থেকে। সেই আলোয় হৃদির দৃষ্টিবিভ্রম হতে থাকে। সে আর সামনে এগোতে পারে না। তার হঠাই মনে হয়, সতার ভুলে গেছে সে। ডুবে যাচ্ছে অতল জলের গভীরে। তাকে সেই গভীর জলের ভেতর থেকে টেনে তোলে নেহাল। হৃদি চোখ মেলে তাকায়। নেহাল বলে, ওঠ। ওঠ। না খেয়ে মরে গেলে হবে? তোকে নিয়ে আমার বাংলাদেশে যেতে হবে না?
হৃদিকে খাওয়ায় নেহাল। কিন্তু কী খাওয়ায়, তা বুঝতে পারে না সে। তার স্বাদ নেই, গন্ধ নেই, অনুভব নেই। সে মৃত মানুষের মতো পড়ে থাকে। আর তারপর ভেসে যেতে থাকে আকাশে আকাশে, মেঘে মেঘে। জলের ভেলায়। তার আর কিছুই মনে থাকে না। সে মাঝে মাঝে গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠে। কিন্তু তখনো সেই ঘুমের ঘোর তার কাটে না। বরং নিজেকে এক অদ্ভুত দ্বিধার পৃথিবীতে আবিষ্কার করে সে। সেই পৃথিবীর কোনটি সত্যি আর কোনটি মিথ্যে, তা আলাদা করতে পারে না সে। সবকিছুই স্বপ্ন মনে হয়। কিংবা সাবানের ফেনার রঙিন বাবলের মতো। ধরতে গেলেই নিমেষে উধাও হয়ে যায়। তার ওই পৃথিবীটাও অমন। সেখানে সত্যি-মিথ্যা, বাস্তব-অবাস্তব কিছু আলাদা করতে পারে না হৃদি। তবে এত কিছুর মধ্যেও তার অনিকের কথা মনে পড়ে। আর কখনো অনিকের সঙ্গে দেখা হবে তার? একমুহূর্তের জন্য? একপলকের জন্য?
যদি দেখা হয়ই, তাহলে কী করবে সে?
হৃদি এরপর আর ভাবতে পারে না। তার ভাবনা গুলিয়ে যায়। এলোমেলো হয়ে যায় সব। নেহাল বলে, আমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে, হৃদি। তার আগে তোমাকে পুরোপুরি আমার কথা শোনার মতো অবস্থায় পৌঁছে যেতে হবে। পারবে না?
হৃদি মাথা নাড়ে। সে পারবে। আজকাল পারেও। এমন নয় যে সে ইচ্ছে করেই সব করে। বরং কেন যেন নেহাল যা বলে তা-ই শুনতে ইচ্ছে করে তার। সে যা শিখিয়ে দেয়, তা-ই বলতে ইচ্ছে করে। এমন কেন হয় তার? তারা তাকে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রাখে। ঘুমের ওষুধ দেয়। শরীরে সুই ফোঁটায়। দুয়েকবার নাকেও এটা-সেটা গুঁজে দিয়েছে। ধোঁয়ার মতো। তারপর তার পৃথিবীটা ধোঁয়ার মতোই কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যেতে থাকে। আর তখন সবই ভালো লাগে হৃদির। নেহালকেও। এভিলিনকেও। তারা যা বলে, তা-ই শুনতে ইচ্ছে হয়। করতে ইচ্ছে হয়। বলতে ইচ্ছে হয়।
আচ্ছা, এমন কেন হয় তার?
তবে মাঝে মাঝে ওই গভীর ঘোর থেকে জেগে ওঠে সে। তখন অকস্মাৎ বুকের ভেতর অব্যাখ্যেয় এক শূন্যতার বান ডাকে। সেই বানে ভেসে যায় একূল-ওকূল। তখন মায়ের জন্য কান্না পায়। তিথির জন্য কষ্ট হয়। আর অনিকের জন্য?
এরপর আর ভাবতে পারে না হৃদি। তার দমবন্ধ লাগে। চোখের কোণে জল জমতে থাকে। গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। বুকের ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে। উঠতে থাকে তীব্র যন্ত্রণা। ওই যন্ত্রণা থেকে উপশম কিসে কে জানে! সে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, অনিক, অনিক।
জোরে কাঁদতে ভয় পায় সে। নেহাল যদি শোনে? সে যদি এসে কিছু বলে! যদি আবারও ওষুধ দিয়ে দেয়? কিংবা মারে? কিংবা এভিলিন তাকে নগ্ন করে ঠান্ডায় ফেলে রাখে? কিংবা…। আর ভাবতে পারে না হৃদি। সে বরং কাঁদতেই থাকে। নীরব, নিঃশব্দ কান্না। এই কান্নার শেষ নেই। শুরু নেই। এ যেন আদি ও অনন্ত। এই জীবন থেকে মুক্তি কিসে তার? কিংবা আদৌ কি মুক্তি আছে?
হৃদির প্রথম দিন মনে হয়েছিল, নেহাল বুঝি তাকে মেরেই ফেলবে। তার সব গোপনীয়তাই তত দিনে জেনে গেছে সে। ফলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। কিন্তু তার ধারণা সত্যি হয় নি। নেহাল তাকে খুন করে নি। বরং এক অদ্ভুত উপায়ে সে তাকে বশংবদ করে রাখতে চাইল। নিমজ্জিত করে রাখতে চাইল গভীর এক ঘোরে। কারণ, নেহাল জানে তাকে আবার দেশে ফিরে আসতে হবে এবং হৃদিকে ছাড়া সে কিছুতেই দেশে আসতে পারবে না। ফলে সে হৃদির চিন্তা ও চেতনার জগত্তাকে এলোমেলো করে দিতে লাগল। ওই জগৎ থেকে সহজে বের হতে পারবে না সে। অনুগত হয়ে থাকবে নেহালের। তা থাকেও। বেশির ভাগ সময়ই ওই ঘোর থেকে বের হতে পারে না হৃদি। নেহাল তাকে ওষুধ দেয়। আর সে ডুবে যায় ঘোর থেকে ঘোরে।
৪৫
আবছার আহমেদ জরুরি ভিত্তিতে অবন্তীকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তার মুখ থমথমে। কপালে চিন্তার রেখা। অবন্তী বলল, কোনো সমস্যা?
একটু।
রিয়ার কোনো খবর?
না।
তাহলে?
কোথাও কোনো একটা বড় সমস্যা আছে, অবন্তী। কিন্তু সমস্যাটা আমরা পুরোপু রি ধরতে পারছি না।
মানে?
মানে…। বলে থামলেন আবছার আহমেদ। তারপর বললেন, আপনার বিষয়টা একটু জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কী হয়েছে?
রিয়ার বিষয়টা নিয়ে আমরা হলের কয়েকজন দারোয়ান, আয়া, মালি–এদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি এবং জিজ্ঞাসাবাদে তারা একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে।
চাঞ্চল্যকর তথ্য? কপাল কুঁচকে তাকাল অবন্তী। কী?
রিয়াকে নয়, বরং আপনার সম্পর্কে কেউ খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছিল। বেশ কয়েকবার। এমনকি তারা আপনার হলের রুম নম্বর, রুমের লোকেশন পর্যন্ত জানতে চেয়েছিল।
কী বলছেন আপনি?
হুম।
অবন্তী হঠাৎ চুপ করে গেল। দীর্ঘ সময়। তারপর ভীত কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বলল, আমি জানতাম, মঈন এর সঙ্গে যুক্ত নয়। এমনকি রিয়ার বিষয়েও না। আপনারা ওকে শুধু শুধু…।
এখনো সেটা বলার সময় আসে নি, অবন্তী। তবে এটাও তো সত্যি যে অনিক যেমন পালিয়ে গিয়ে আমাদের দ্বন্দ্বে ফেলেছে, তেমনি মঈনও নানা কারণেই তার প্রতি আমাদের সন্দিগ্ধ করেছে। তাই না?
কিন্তু কোনো প্রমাণ ছাড়াই কেবল সন্দেহের বশে কি কাউকে এভাবে…। অবন্তীর গলা আর্দ্র হয়ে উঠল।
আবছার আহমেদ বললেন, আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, যাতে তার প্রতি কোনো অন্যায় না হয়। কিন্তু অবন্তী, তার আগে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আপাতত কিছুদিনের জন্য আপনি হল থেকে বাসায় চলে আসবেন। পুরোপুরি। মানে ভাবটা এমন যে আপনি আর কখনোই হলে ফিরে যাবেন না। আপনার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের।
এটা কেন করব?
আমরা দেখতে চাই এতে আপনাকে যারা অনুসরণ করেছে, তাদের মুভমেন্ট পাল্টায় কি না। আমার ধারণা, আপনি আবার বাসায় থাকতে শুরু করলে তারা সময় সুযোগ বুঝে আবারও কোনো একটা অ্যাটেম্পট নিতে চাইবে। আপনি ভয় পাবেন না। পুলিশ সাদাপোশাকে আপনার আশপাশেই থাকবে।
অবন্তী কোনো কথা বলল না। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে সে। কিন্তু মঈনের জন্য হলেও সে এই কাজটা করবে। যেকোনোভাবেই হোক, তাকে সন্দেহমুক্ত করতে চায় সে। অবন্তী হল ছেড়ে দিল পরদিন দুপুরেই। এমনকি তার হলের বিছানা, বালিশ, নিজের কেনা চেয়ার, টুকিটাকি জিনিস, লেপ-তোশক, বইপত্র–সব নিয়েই সে চলে এল। বুদ্ধিটা অবশ্য আবছার আহমেদেরই। তিনি চাইছেন তার এই স্থানান্তর যেন। প্রকাশ্যে সরবে হয়। কেউ যদি এখনো তার ওপর নজর রেখে থাকে, তবে তারা যেন। বুঝতে পারে যে সে এখন থেকে খালার বাসাতেই থাকবে।
হৃদির রুমটা আপাতত বন্ধই আছে। ফলে অবন্তী উঠল তিথির সঙ্গে। কিন্তু বেশ কয়েক দিন কেটে গেলেও তেমন কিছুই ঘটল না। সাদাপোশাকের কয়েকজন পুলিশ সারাক্ষণ নজর রাখতে লাগল বাড়ির আশপাশে। আবছার আহমেদও যতটা সম্ভব সতর্ক হয়ে রইলেন। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হলো না। বরং সবকিছুই যেন অবিশ্বাস্যরকম শান্ত। অবন্তীর নামে কোনো চিঠিও আর এল না।
তবে এক সন্ধ্যায় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। এই ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল। না অবন্তী বা অন্য কেউ।
কাজের মেয়েটা ঘরদোর পরিষ্কার করছিল। অবন্তীর জিনিসপত্র সব গুছিয়ে। রাখছিল সে। এই মুহূর্তে হঠাৎ চিৎকার করে অবন্তীকে ডাকল সে। বলল, খালা, এইদিকে দেইখা যান।
অবন্তী সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এল। বলল, কী হয়েছে?
কী হইছে এখনো জানি না। তবে বড়ই আচানক কাণ্ড।
কী আচানক কাণ্ড।
দেখেন, এইখানে হাত দিয়া দেখেন।
অবন্তী মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল। সে তার হল থেকে আনা মোটা তোশকটার একটা অংশ ধরে আছে। অবন্তী বলল, কী হয়েছে?
আপনের তোশক সরাই রাখতে গেছিলাম। এত মোটা আর ভার যে খুব কষ্ট হইতেছিল।
হুম।
তারপর হঠাই দেখি তোশকের এই কোনায় জানি শক্ত শক্ত কী?
তোশকের ভেতরে আবার শক্ত কী থাকবে?
আপনে এই কোনার দিকে হাত দিয়ে দেখেন।
তোশকের মাঝখানের দিকটাতে ঘুমানো হয় বলে সেদিকটা অনেকটাই মিইয়ে গেছে। কিন্তু দেয়ালের দিকে থাকা কোনার অংশটা তখনো বেশ ফুলেফেঁপে আছে। অবন্তী সেই জায়গায় হাত দিয়ে চাপ দিতেই শক্ত কিছুর অস্তিত্ব টের পেল। একটা দুটো নয়, বরং বেশ কিছু শক্ত উপাদানের অস্তিত্ব সেখানে। যেন তোশকের ভেতর কিছু রেখে সেলাই করে দিয়েছে কেউ। জায়গাটা পরখ করে দেখল অবন্তী। অন্যান্য জায়গার তুলনায় এই কোনার অংশের সেলাইটাও আলাদা। সে বেশ কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর বলল, যা, রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি নিয়ে আয়।
মেয়েটা ছুরি নিয়ে এল। অবন্তী খুব সাবধানে তোশকের ওই প্রান্তটা কাটল। তারপর অবাক বিস্ময়ে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইল। ছোট ছোট চারটা কাঁচের কৌটা বেরিয়ে এল তোশকের ওই কাটা অংশ থেকে। সে হতভম্ব চোখে সেই কৌটার দিকে তাকিয়ে রইল। কী এই কৌটার ভেতর? কে রেখেছে এসব?
খবর পেয়ে পুলিশ অফিসার আবছার আহমেদ এলেন তখুনি। তিনি কাঁচের কৌটাগুলো হাতে নিয়ে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তারপর বললেন, এই তোশক আপনি কোথা থেকে কিনেছেন?
লাল চান বেডিং স্টোর।
কোথায় এটা?
নীলক্ষেত।
হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন আবছার। বললেন, আমার মনে হয় ঘটনা আমি বুঝতে পেরেছি।
কী ঘটনা?
সেটা এখুনি না বলি। কিন্তু আপনি খুব সাবধান থাকবেন। বিষয়টা আমরা যতটা হালকাভাবে দেখেছি, এটা মোটেই ততটা হালকা কিছু নয়। এ এক ভয়াবহ ঘটনা!
কী ঘটনা?
আমি সব বলব। তবে তার আগে এই কথা আপনি কাউকে বলবেন না। আর এই বাড়ির নিরাপত্তার ব্যবস্থা আরও জোরদার করছি আমি। দয়া করে আপনারা কেউ আপাতত আর বাড়ির বাইরে যাবেন না।
কিন্তু কেন?
আমি বলেছি, তাই।
বলে উঠে দাঁড়ালেন আবছার আহমেদ। অবন্তী বলল, মঈন ছাড়া পাবে তো? ও কিছু করে নি তো?
আবছার আহমেদ এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তিনি হেঁটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার চোখেমুখে হতবিহ্বল ভাব। খানিক ভয়ও। এত দিন কেঁচো খুঁড়তে সাপ পাওয়ার গল্প শুনেছেন। এবার সরাসরি দেখলেন।
৪৬
জামশেদ বললেন, এটা কী হলো?
রাশু কথা বলল না। তিনি রাশুর দিকে দুই পা এগিয়ে এলেন। তারপর বললেন, পুলিশ এত বড় ঘটনা কী করে জানল? তারা লাল চানের বেডিংয়ের দোকানে কেন সার্চ করল? আর এখন নাকি আবার লাল চান আর তোর খোঁজ করছে?
জি।
তুই লাল চানের বিষয়ে কাউকে কিছু বলেছিস?
রাশু মাথা নাড়ল, না।
পুলিশ তাহলে জানল কী করে? তারা লাল চানের দোকানে কাকে খুঁজতে গিয়েছিল? কী খুঁজতে গিয়েছিল?
রাশু কথা বলল না।
জামশেদ আরও দুই পা এগোলেন। তারপর বললেন, রাশু! ঘটনা কী? তুই আমাকে ঘটনা খুলে বল?
রাশু কথা বলল না। জামশেদ অবশ্য তার উত্তরের অপেক্ষাও করলেন না। তিনি বললেন, এদিকে আয়।
কোথায়?
তোকে আজকে আমি একটা খেলা দেখাব।
কী খেলা?
সেটা নিজেই দেখতে পাবি।
তিনি তাকে সাপের ঘরটার দিকে নিয়ে গেলেন। ঘরটা আরও বড় করা হয়েছে। ভেতরে সাপের সংখ্যা বেড়েছে। চারদিকে কিলবিল করছে তারা। জামশেদ বললেন, তুই একটা কাজ কর।
কী কাজ?
জামাকাপড় খুলে ন্যাংটা হ।
রাশু ভয়ার্ত গলায় বলল, স্যার! স্যার! সত্যি আমি কাউরে কিছু বলি নাই। লাল চান চাচার খুনের কথা আমি কাউরে কিছু বলি নাই।
বলিস নাই?
না।
তাহলে কী বলছিস?
কিছু বলি নাই। আল্লাহ-খোদার কসম।
না বললে তারা জানল কী করে? তারা লাল চানের দোকানে কী করতে গেছে? কারে খুঁজতে গেছে?
রাশু কথা বলল না। জামশেদ বললেন, তুই জামাকাপড় খোল। রাশুর ধারণা সে জামশেদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে।
জামশেদ বললেন, এখন বাজে বিকেল পাঁচটা। তুই কাল সকাল পাঁচটা পর্যন্ত এই ঘরে ন্যাংটা অবস্থায় সাপের সঙ্গে বসবাস করবি। পারবি না?
রাশু এবারও কথা বলল না। সে দৃশ্যটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। তার শরীর হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে আসতে শুরু করেছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। জামশেদ বললেন, কাল সকালে তোকে আমি এখান থেকে বের করব। ততক্ষণ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারবি না?
ভয়ে রাশুর গলা থেকে কথা বেরোল না। জামশেদ অকস্মাৎ তার তলপেটে লাথি বসালেন। তারপর বললেন, শুয়োরের বাচ্চা, তুই আমাকে চিনিস নাই। তুই এখনো জামশেদরে চিনিস নাই।
রাশু পেট চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল। তীব্র যন্ত্রণায় তার মুখ কুঁচকে আছে। জামশেদ বললেন, বসবাস করতে না পারলে আমি তোকে সাপের সঙ্গে সহবাস করাব। খোদার কসম, আমি তোর পেছন দিক দিয়ে এক ডজন রাসেল ভাইপার…।
রাশু ভয়ে, আতঙ্কে জড়সড় হয়ে বসে রইল। সে এখান থেকেই সাপগুলোর হিসহিস শব্দ শুনতে পাচ্ছে। প্রতিটি শব্দ যেন তার কানের ভেতর দিয়ে হৃৎপিণ্ডে গিয়ে আঘাত করছে। জামশেদের পরের লাথিটা পড়ল রাশুর কাঁধে। সে এবার পুরোপুরি মাটিতে শয্যাশায়ী হয়ে গেল। জামশেদ বললেন, হারামজাদা, খানকির…, বল। পুলিশ এই সব জানল কী করে, বল?
রাশু এবারও কথা বলল না। জামশেদ হঠাৎ এলোপাতাড়ি লাথি মারতে লাগলেন তাকে। তারপর পা দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন মাটিতে। হিসহিসে গলায় বললেন, তুই আমাদের এই ক্ষতিটা কেন করলি? বল, কেন করলি? তুই জানিস, কত বছরের কত কত প্ল্যান আমাদের? এত বছরে কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পায় নাই। আর আজ তোর। জন্য আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়ে গেল! শুয়োরের বাচ্চা, পুলিশ এখন কী করবে, বল? তারা কিছু টের না পেলেই দোকানে সার্চ করছে? তোকে আর লাল চানকে খুঁজছে?
রাশুর মনে হচ্ছিল তার মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। দম নিতে পারছে না সে। জামশেদ বললেন, বল, কী করেছিস তুই, বল? পুলিশ কেন লাল চানকে খুঁজছে? লাল চানের দোকানে কেন আসছে?
আমার কারণে। গুঙিয়ে উঠল রাশু।
কী করেছিস তুই? লাল চানের খুনের কথা বলেছিস?
না।
তাহলে?
আমি অন্য একটা ভুল করে ফেলছিলাম।
কী ভুল? পা সামান্য শিথিল করলেন জামশেদ।
লাল চান চাচায় ওই জিনিসগুলা আমার কাছেই দিছিল। চারটা কাঁচের ছোট্ট কৌটা।
কী!
হুম।
তারপর? তুই সেই জিনিস কী করেছিস?
বলতেছি। বলে ঢোঁক গিলল রাশু। সম্ভবত মুখের ভেতর কোথাও কেটে গেছে। তার। জামশেদ উন্মাদের মতো মেরেছেন তাকে।
বল।
সে তো তারপর পুলিশের ভয়ে পালাই গেল। আমারে বলল সে ফিরা না আসা পর্যন্ত মালগুলা যেন আমি নিরাপদে লুকাই রাখি।
হুম।
আমি কী করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর…। বলে গোঙাতে লাগল রাশু। তেষ্টায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে। মাথাটা যেন তীব্র যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ে যেতে চাইছে। জামশেদ বললেন, তারপর? কী করেছিলি তুই?
উপায়ান্তর না দেইখা দোকানেই এখানে-ওখানে রাখা শুরু করলাম। কিন্তু একটু পরপরই আবার মনে হইতে লাগল যে কেউ যদি হঠাৎ দেইখা ফালায়! দোকানে তো অনেক কর্মচারীও আছে। তা ছাড়া দোকান ছাড়া রাখার তো আর জায়গাও নাই।
তারপর?
কারও কাছে আবার ওই জিনিসের কথা বলাও যাইব না। খুক খুক করে কাশল রাশু। কাশির সঙ্গে রক্ত বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। জামশেদ তার মাথার ওপর থেকে পা সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। রাশু যেন খানিক স্বস্তি পেল। বলল, হঠাই বুদ্ধিটা মাথায় আসল। আমাদের দোকানের পিছন দিকে কিছু বানানো তোশক আছিল। রেডিমেড। বিক্রি হয় নাই দেইখা অনেক দিন থিকাই পইড়া আছে। আমি রাতে একলা একলা একটা কাজ করলাম।
কী কাজ?
সেই স্তূপ কইরা রাখা তোশকের সবচাইতে নিচের তোশকটার এক কোনার সেলাই কাটলাম। বলে হাঁপাতে লাগল রাশু।
তারপর সেই তোশকের মধ্যে রাখলি জিনিস?
জে।
তারপর?
তারপর আরও কী কী কাজে যেন ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কয় দিন পর দোকানে গিয়া দেখি সেই তোশক নাই!
জামশেদ কথা বললেন না। থক করে একদলা থুতু ফেললেন রাশুর মুখের সামনে। রাশু বলল, দোকানের ছেলেটা তো আর ঘটনা জানে না। সে ওই তোশক বিক্রি করে দিছে।
কার কাছে? থমথমে কণ্ঠে বললেন জামশেদ।
ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রীর কাছে।
তারপর?
আমি তো পাগলের মতো হয়ে গেলাম। ওরে অনেক বকাঝকা করলাম। কিন্তু ওর দোষ কী? ও তো আর ঘটনা জানে না। মেয়েটার হলের নাম লেখা আছিল মানি রিসিপ্টে। আমি সেই মানি রিসিপ্ট থিকা ঠিকানা নিয়া তার খোঁজখবরের চেষ্টা করতে লাগলাম। তার হলের সামনে গিয়া দাঁড়াই থাকতাম। বোঝার চেষ্টা করতাম, কিছু করন যায় কি না। এমনই এক বিষয় যে কাউরে সাহায্য করতেও বলা যাইব না। আবার ওই মেয়েদের হোস্টেলে ঢোকাও যাইব না। বাসাবাড়ি বা অন্য কোথাও হইলে তাও না হয় একটা ব্যবস্থা করা যাইত। কিন্তু মেয়েদের হলে আমি ঢুকব কী করে!
তো তারপর তুই কী করলি?
আমি তখন দিনের পর দিন খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম যে কী করা যায়।
তারপর?
তারপর…। বলে আবার খকখক শব্দে কাশল রাশু। প্রচণ্ড ব্যথায় পেট কুঁকড়ে আসছে তার। মাথা ভার হয়ে আছে। ফুলে গেছে চোখও। ঠিকভাবে তাকাতে পারছে না সে। তারপর বুঝলাম যে আর কোনো উপায় নাই। ওইখান থিকা ওই জিনিস বাইর করন যাইব না। যদি না…। বলে থামল রাশু। তার মাথাটা বনবন করে ঘুরছে। চোখের সামনের পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে। সে হড়বড় করে বমি করে ফেলল। জামশেদ অবশ্য সেসব গুরুত্ব দিলেন না। তিনি শান্ত গলায় বললেন, কী?
যদি না মেয়েটারে খুন করা যায়।
মানে! কী বলছিস তুই? ওই মেয়েরে খুন করলে তুই জিনিস পাবি কেমনে? আরও তো ঝামেলায় পড়বি।
না। আমি খোঁজ নিয়া জানলাম, কেউ যদি মারা যায়, মানে কোনো ছাত্রী, তাহলে হল কর্তৃপক্ষ হল থেকে তার নিজের কেনা জিনিসপত্র সব হিসাব করে বুঝাইয়া দেয়।
জামশেদ আগুনচোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে আছেন, তার মানে তুই তখন ওই মেয়েরে খুন করার চেষ্টা করলি?
এইটা ছাড়া আর উপায় কী আমার? জিনিস বাইর করতে তো আর কোনো উপায় নাই।
তারপর?
আমি তক্কে তক্কে থাকলাম। তারপর একদিন রাতে মেয়ের খালার বাসায় গেলাম। জানালা দিয়া গুলিও করছিলাম। দুইটা। কিন্তু গায়ে লাগাইতে পারি নাই। যন্ত্র আপনে আমারে দিছিলেন, কিন্তু যন্ত্র ঠিকঠাক চালানো তো শিখান নাই!
জামশেদ কথা বললেন না। তিনি হতভম্ব চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই ছেলে বলে কী!
রাশু বলল, পুলিশ কোনোভাবে ওই মালের খোঁজ পাইয়া গেছে এবং তারা জানছে যে ওই তোশক কই থেকে কেনা হইছে। এই জন্যই কাল দোকানে আসছিল তারা!
জামশেদ অকস্মাৎ সজোরে লাথি বসালেন রাশুর পাঁজরের হাড় বরাবর। রাশুর মুখ থেকে কোত করে একটা শব্দ বের হলো। সে গড়িয়ে গেল পাশে। জামশেদ অবশ্য থামলেন না। বললেন, তোর জন্য এখন আমার সব শেষ। সব শেষ। পুলিশের এখন এই জায়গা খুঁজে বের করতে লাগব বড়জোর এক সপ্তাহ। তোকে আমি…তোকে আমি…। জামশেদ তার কথা শেষ করতে পারলেন না। রাগে-ক্রোধে যেন অন্ধ হয়ে গেছেন। চট করে কোমর থেকে পিস্তল বের করলেন তিনি। তারপর হ্যাঁমার টানলেন। বললেন, ওঠ। ওঠ কুত্তার বাচ্চা। আমি আজ তোকে সাপের পাঁচ পা দেখাব। ওঠ। কাপড় খুলে ন্যাংটা হ।
তিনি হঠাৎ অনিক আর মতিন মিয়াকে ডাকলেন। অনিক ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। জামশেদ বললেন, এই কুত্তার বাচ্চাকে ন্যাংটা কর। তারপর ওই ঘরে ঢোকা। ওই রাসেল ভাইপারের ঘরে। তারপর সারা রাত এই হারামজাদারে ওইখানে আটকাই রাখবি।
রাশু বুঝতে পারছিল আজ তার ভাগ্যে খারাপ কিছু আছে। কিন্তু সেই খারাপ কিছু যে এত খারাপ হতে পারে, এটা সে চিন্তাও করতে পারে নি। জামশেদ যখন তাকে প্রথম প্রশ্নটা করেছিলেন, ঠিক তখুনি বুঝে গিয়েছিল রাশু, দোকানের ওই ঘটনার জের তাকে টানতে হবে। কিন্তু তাই বলে অমন সাপভর্তি একটা ঘরে তিনি তাকে আটকে রাখবেন!
রাশুর মনে হলো তার মেরুদণ্ড বেয়ে তীব্র ভয়ের হিমশীতল স্রোত নেমে গেল। সে উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু জামশেদ এবার লাথি বসালেন তার মুখে। ঠোঁট কেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে এল রাশুর। পরের লাথিটা বসালেন গলা বরাবর। অনিক আর মতিন মিয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠছেন জামশেদ। যেন তার মাথায় উন্মাদ ভর করেছে। মতিন মিয়া আর অনিক ছুটে এল। তারপর রাশুকে ধরে দাঁড় করাল। তারা। কিন্তু রাশুর ততক্ষণে আর দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থা নেই। সে হাঁটু ভাঁজ করে আবার বসে পড়ল।
জামশেদ বললেন, ওকে এইভাবেই ওই ঘরে নিয়ে যা। ওই ঘরে।
মতিন রাশুর বাঁ হাত ধরে টানছিল। কিন্তু অনিক হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল। তার চকিতে মনে হলো রাশু তার ডান হাতটাকে নিচু করার চেষ্টা করছে। সে কি তবে তাকে কিছু ইঙ্গিত করছে? মুহূর্তের জন্য থমকে গেল অনিক। রাশুর কোমরের পিস্তলটা উঁকি দিচ্ছে। সে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে অনিকের কোমর ছুঁয়ে দিল। তারপর যেন ইশারায় বোঝাতে চাইল কিছু। অনিক কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ তার ধরে রাখা হাতটা ছেড়ে দিল। একদিকে কাত হয়ে গেল রাশু।
মতিন বলল, কী হইল?
আপনি এই পাশে আসেন, মতিন ভাই। আমি ওই হাত ধরি।
কেন? ওই হাতে সমস্যা কী?
সমস্যা কিছু না। এই দিক থেকে এত ওজন তুলতে আমার কষ্ট হয়। ওই পাশটা সহজ।
মতিন মিয়া বিরক্ত ভঙ্গিতে হাতটা ছেড়ে দিল। রাশু ততক্ষণে খানিক বিরাম পেয়ে গেছে। তার দুই হাতই মুক্ত। অনিক ইচ্ছে করেই অন্য হাতটা ধরতে খানিক বিলম্ব করল। দেরি করিয়ে দিল মতিন মিয়াকেও। জামশেদ ততক্ষণে বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছেন। রাশুর গতি ধীর। হাত জোড়া প্রায় অবশ। তা ছাড়া সে এখনো ঠিকভাবে পিস্তল চালাতে পারে না। তারপরও ঝুঁকিটা নিল সে। এ ছাড়া আর উপায় নেই তার। এমনিতেও মরবে সে। কিন্তু শেষ চেষ্টাটা করে দেখতে চায়। তারপর যা হওয়ার হবে। সমস্যা হচ্ছে অনিক। যদি কোনোভাবে সে ব্যর্থ হয়, তবে বিপদে পড়বে অনিকও। কারণ, রাশুর গতি ধীর। সে জানে কাজটা করতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি সময় লাগবে তার। ফলে মতিন মিয়াকে আটকাতে হবে অনিকের। কিন্তু এই নিয়ে অনিকের সঙ্গে তার আগে কোনো কথা হয় নি। পুরো ব্যাপারটাই তাৎক্ষণিক। ফলে বিষয়টা নির্ভর করছে কে কতটুকু পরিস্থিতি বুঝতে পারবে, তার ওপর। অনিক কি ওইটুকু সময় মতিন মিয়াকে আটকে রাখতে পারবে? সে কি নিজ থেকে বুঝতে পারবে ব্যাপারটা?
অনিক বহু কষ্টে কোমর থেকে পিস্তলটা বের করল। কিন্তু হাতে কোনো সাড়া পাচ্ছে না সে। যেন বিবশ, বিমূঢ়। মতিন মিয়ার অবশ্য ঘটনা বুঝতে একটু সময় লাগল। সে যতক্ষণে পিস্তলটা দেখে ফেলেছে, ততক্ষণে অনিক তার কাছে চলে এসেছে। তারপরও চিৎকার করে জামশেদকে সতর্ক করল সে। জামশেদ চকিতে ঘুরলেন। অনিকের হাতে উদ্যত পিস্তল দেখে হঠাৎ থমকে গেলেন তিনি। মতিন মিয়াকে ততক্ষণে জাপটে ধরেছে অনিক। তারপরও সমানে হাত-পা ছুঁড়ে ছোটার চেষ্টা করছে সে। জামশেদ অবশ্য ভড়কে গেলেন। বরং তার ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসি ফুটে উঠল। কপাল বেয়ে নেমে। আসা রক্তের স্রোতে রাশুর এক চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আছে। তার হাত কাঁপছে। জামশেদ। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসতে লাগলেন, যেন তিনি নিশ্চিত যে রাশু শেষ পর্যন্ত গুলি ছুঁড়তে পারবে না। সেই শক্তি কিংবা সাহস কোনোটিই তার নেই। তার ধারণাই সত্যি। হলো, রাশু গুলি ছুঁড়তে পারল না। বরং তার কম্পিত হাত ক্রমশ শিথিল হয়ে যেতে লাগল। জামশেদ খানিক ঝুঁকলেন। অনিক চাইলেই এখন তার বুক বরাবর গুলি করতে পারে। মাত্র হাত কয়েক দূরত্ব তাদের মধ্যে। কিন্তু রাশু তা করল না। সে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।
জামশেদের চোখেমুখে একটা ক্রুর হাসি ফুটে উঠল। তিনি আরও এক পা এগোলেন। তারপর নিচু হয়ে রাশুর হাত থেকে পিস্তলটা তুলে নিতে চাইলেন। রাশু নড়ে উঠল ঠিক তখনই। সে পরপর দুবার গুলি করল। জামশেদ গুলির ধাক্কায় চরকির মতো আধপাক ঘুরে গেলেন। তারপর ছিটকে পড়লেন মাটিতে।
অনিক ভেবেছিল গুলি তার বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে। সে মতিন মিয়াকে ছেড়ে দিল। ভীত, আতঙ্কিত মতিন মিয়া অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। জামশেদ অবশ্য মারা গেলেন না। কারণ, রাশু শেষ পর্যন্ত তার বুকে গুলি করে নি। সে গুলি করেছে তার পায়ে। অত কাছ থেকে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় নি। তার দুটো পা ই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে। হতবিহ্বল মতিন, বিমূঢ় অনিক আর আহত জামশেদকে চমকে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রাশু। তার চোখ, মুখ, নাক দিয়ে তখনো রক্ত ঝরছে। ব্যথায় কুঁকড়ে আছে শরীর। তারপরও সে জামশেদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর তার হাত থেকে ছিটকে যাওয়া পিস্তলটা মাটি থেকে তুলে নিল। জামশেদের চোখেমুখে তীব্র ব্যথার চিহ্ন। তবে সেই ব্যথার ভেতর থেকেও একটা প্রবল অবিশ্বাস যেন ঠিকরে বের হতে লাগল। তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না যে রাশু তাকে সত্যি সত্যিই গুলি করেছে!
রাশু হাঁপাচ্ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে খানিক ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল সে। তারপর মতিন মিয়ার দিকে ফিরে তাকাল। বলল, স্যাররে এদিক নিয়াসেন, মতিন ভাই।
মতিন মিয়া কী করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার। ঘোর এখনো কাটাতে পারছে না সে। রাশু শীতল কণ্ঠে বলল, কী হইল, মতিন মিয়া? কথা কানে যায় না? তার সেই কণ্ঠে কিছু একটা ছিল। মতিন মিয়া ছুটে গিয়ে জামশেদের পাশে দাঁড়াল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে এল বেশ খানিকটা সামনে। রাশু ততক্ষণে সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জামশেদ এতক্ষণে যেন রাশুর উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তিনি হঠাৎ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন। হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগলেন রাশুর কাছে। রাশু সেসব শুনতে পেল কি না বোঝা গেল না। তবে সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একটা গাছের গুঁড়ির ওপর বসল। তারপর মতিন মিয়াকে ডাকল, মতিন ভাই।
জে স্যার। মুহূর্তেই যেন ভোল পাল্টে গেল তার।
জামশেদ স্যার কি মারা গেছেন?
না, স্যার।
তাইলে?
জে স্যার?
তাইলে উনি যদি এখন মারা যায়, সেই দোষ কার?
মতিন মিয়া কথা বলল না। রাশু বলল, সেই দোষ আপনেরও হইতে পারে। আপনে যদি এখন তারে ধাক্কা দিয়া ওই ডোবাতে ফালাই দেন, তাইলে তারে খুন করনের দোষ হইব আপনের। কথা পরিষ্কার?
মতিন মিয়া বিস্ফারিত চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইল। রাশু বলল, ভয় নাই। শুধু ঝামেলা কইরেন না।
বলে উঠে দাঁড়াল সে। জামশেদ তুমুল কান্নায় তার প্রাণভিক্ষা চাইতে লাগলেন। অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন। রাশু বলল, স্যার, আমার ইচ্ছা ছিল আমি আপনেরেই ন্যাংটা কইরা ওই রাসেল ভাইপারের ঘরে রাখব। কিন্তু তাতে লাল চান চাচার উপর অন্যায় হয়ে যাবে। ঠিক না?
জামশেদ কিছু বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তীব্র কান্নায় তার কথার কিছুই বোঝা গেল না। রাশু তার শরীরটা ধাক্কা দিয়ে পাশের ডোবার মধ্যে ফেলে দিল। ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে। সেই অন্ধকারে জামশেদের ভয়ানক আর্তচিৎকার বড় কানে বিধল। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই চিৎকার ঢেকে গেল পচা জলের বুকে জেগে ওঠা তীব্র জলকেলির শব্দে। যেন উৎসবের মেলা বসেছে সেখানে।
রাশু চুপচাপ সেই অন্ধকারে বসে রইল। আর কান পেতে শুনতে লাগল ওই জলের শব্দ। তার হঠাৎ মনে হলো, জলের বুকে জেগে ওঠা ওই ছলাৎ ছলাৎ শব্দের চেয়ে। সুমধুর কোনো সংগীত আর এই পৃথিবীতে নেই।
৪৭
সেই রাতেই দেশে এল নেহাল। সে তখনো ঘটনার কিছুই জানে না। রোখসানা বেগম হৃদিকে দেখে কাঁদলেন না। নেহালকে কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না। কেবল চুপচাপ মেয়ের পাশে বসে রইলেন। হৃদি মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। খুব একটা কথা বলে না সে। মাঝেমধ্যে দুয়েকটা যা বলে, তা-ও অসংলগ্ন। নেহাল অবশ্য বোঝানোর চেষ্টা করে, মা, আপনি একদম আপসেট হবেন না। ও কিছুদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। আপনি তো প্রথম দিকের অবস্থা দেখেন নি। তখন দেখলে স্থির থাকতে পারতেন না। এই জন্যই আমি আপনাকে তেমন কিছু জানাই নি।
রোখসানা বেগম কথা বলেন না। নেহাল বলে, ওকে তো চেনেন আপনি। যতই বারণ করেন, কিছুই শুনবে না সে। যেই স্নো পড়তে দেখল, অমনি বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাফাতে নেমে গেল। এত বারণ করলাম, শুনল না। সাবধানে পা ফেলতে বললাম, কিন্তু কে শোনে কার কথা! সে হাত-পা ছুঁড়ে নাচানাচি করতে লাগল। তাও কোনো ধরনের সেফটি কিটস ছাড়া।
রোখসানা বেগম নেহালের কথা শুনছেন কি না বোঝা গেল না। তবে নেহাল বলতেই থাকল, তারপর হঠাই পা পিছলে পড়ল সে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্ল্যাকআউট। আঘাতটা লেগেছে মাথা আর ঘাড়ে। ডাক্তার তো প্রথম দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। তারপর মাসখানেক বলতে গেলে একদম কোমায়ই চলে গিয়েছিল। দেন দ্য মিরাকল হ্যাঁপেনড। অনেকে তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু আমি আর ডাক্তার, আমরা দুজন আশা ছাড়ি নি। তো এখন যেটা হয়েছে, ওর বিশেষ ট্রিটমেন্ট চলছে। খুবই সেন্সিটিভ ট্রিটমেন্ট। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। সিডেটিভও আছে। ফলে ওর কথাবার্তা একটু অসংলগ্ন মনে হতে পারে। স্লিপি লাগবে। ডাক্তারের অনেক শর্ত মেনেই তবে ওকে দেশে আনতে পেরেছি, শুধু আপনার কথা ভেবে।
বলে থামল নেহাল। সে রোখসানা বেগমের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করছে। যদিও তাকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
নেহাল বলল, ডাক্তারের প্রধান শর্ত হলো ওর সঙ্গে বেশি কথা বলা যাবে না। বাইরের মানুষের সঙ্গে একদম কথাবার্তা, দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ। মানে যত বেশি একা থাকা যায় আরকি! দুই হচ্ছে, অন্য কোথাও এখন কোনো চিকিৎসাও করানো যাবে না। বাংলাদেশে তো না-ই। মানে ওর অবস্থা একটা পর্যায়ে না যাওয়া পর্যন্ত। তো এই দুটো জিনিস মাথায় রাখতে হবে, মা। যেভাবেই হোক, আপাতত বাইরের সবকিছু থেকে তাকে আলাদা রাখতে হবে। আমরা মাসখানেক থেকেই আবার চলে যাব। তখন ওখানে গিয়ে বাকি চিকিৎসা।
বলে সামান্য থামল নেহাল। রোখসানা বেগমের ভাবভঙ্গি খুব একটা সন্তোষজনক মনে হচ্ছে না। মেয়ের অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছেন তিনি। সেই ধাক্কা সামলে উঠতে পারছেন না।
নেহাল তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করতে লাগল। বলল, আপনি একটু দেখবেন, মা। সবাই যেন হৃদিকে নিয়ে এই কথাগুলো মেনে চলে। না হলে সামান্য ভুলেও কিন্তু অনেক বড় বিপদ হয়ে যেতে পারে। সো, খুব সাবধান থাকতে হবে আমাদের সবার।
রোখসানা বেগম নেহালের কোনো কথারই উত্তর দেন না। কেবল চুপচাপ শোনেন। কিংবা শোনেন না। কিংবা শোনার ভান করেন। নেহাল অবশ্য তারপরও তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতে থাকে। হৃদিকে খুব যত্ন-আত্তিও করে সে। সহসা তার কাছছাড়া হয় না। প্রথম কদিন বাসার বাইরেও গেল না সে। ফলে হৃদির সঙ্গে কথা বলারও তেমন সুযোগ পেলেন না রোখসানা বেগম।
তবে সেদিন খুব ভোরে হঠাই বাইরে বের হলো নেহাল। আর এই সুযোগে মেয়ের কাছে গেলেন রোখসানা বেগম। হৃদি ঘুমিয়ে ছিল। তিনি তাকে ডাকলেন না। বসে রইলেন পাশে। ঘুমন্ত হৃদিকে এত প্রাণহীন আর ফ্যাকাশে লাগছে! চোখের কোলে কালি পড়ে গেছে তার। ঘুমের মধ্যেও যেন বারবার ভয়ে আঁতকে উঠছে। রোখসানা বেগম আলতো হাতে মেয়ের কপাল ছুঁয়ে দিলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, মা। মারে।
হৃদি অবশ্য তার ডাক শুনল না। জেগেও উঠল না। বেঘোরে ঘুমাতে লাগল সে। তার সেই ঘুম ভাঙল বিকেলে। এই পুরোটা সময় মেয়ের পাশে বসে রইলেন রোখসানা বেগম। সন্ধ্যার পরপর ঘুমের মধ্যেই কেমন অস্থির হয়ে উঠতে লাগল হৃদি। বারবার এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। ক্ষণে ক্ষণে মুখের অভিব্যক্তি বদলে যেতে লাগল। যেন প্রচণ্ড ভয়ের কিছু দেখছে সে। বার কয়েক হাত তুলে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেও লাগল। রোখসানা বেগম নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না। তিনি হঠাৎ আধো ঘুম, আধো জাগরণে থাকা মেয়েকে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন।
হৃদি সঙ্গে সঙ্গেই জেগে উঠল। তারপর তীব্র চিঙ্কারে উঠে বসল সে। রোখসানা বেগম কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিটকে সরে গেল দূরে। বিছানার এক পাশের দেয়ালের সঙ্গে মিশে গিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ভীত হরিণের মতো কাঁপতে লাগল। রোখসানা বেগম বললেন, কী হয়েছে, মা?
হৃদি কথা বলল না। তার চোখে তীব্র ভয়। মুখ ফ্যাকাশে। হাত দুখানা মুখের কাছে জড়ো করা রাখা। কাঁপছে সে। রোখসানা বেগম মেয়ের কাছে এগিয়ে যেতে চাইলেন। এগোলেনও খানিক। আর সঙ্গে সঙ্গেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল হৃদি। তার চোখের কোল গড়িয়ে নেমে আসতে লাগল জলের ধারা। যেন সে কিছুতেই চায় না কেউ তার কাছে আসুক, তাকে স্পর্শ করুক, তার সঙ্গে কথা বলুক। কিংবা তার শরীরে সুই ফুটিয়ে দিক। জোর করে কিছু খাইয়ে দিক। কিংবা অন্য কিছু। সে তা কিছুতেই চায় না। তার খুব ভয় হতে থাকে। সে আরও পিছিয়ে দেয়ালের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়। কিন্তু পারে না। আর পারে না বলেই তীব্র আতঙ্ক নিয়ে অসহায় চোখে কাঁদতে থাকে সে। তার সেই কান্না রোখসানা বেগমের বুকের ভেতরটা ভেঙে চৌচির করে দিতে থাকে। পৃথিবীর কোনো মা-ই তার সন্তানের এমন কান্না সহ্য করতে পারেন না। দেখতে পারেন না চোখের সামনে।
তিথি দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, কী হয়েছে, মা?
রোখসানা বেগম কথা বললেন না। তবে চোখের ইশারায় হৃদিকে দেখালেন। তিথি বলল, কী হয়েছে, আপু? এই আপু?
হৃদি কথা বলল না। তবে তার কান্না থামল। যেন সে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে স্থান-কাল-পাত্র বুঝতে সমস্যা হচ্ছিল তার। তিথি বলল, আপু। আপু?
হৃদি এবারও কথা বলল না। তবে ধীরে ধীরে দেয়াল ঘেঁষেই বসল সে। তিথি বলল, তোর কী হয়েছে, আপু?
কিছু হয় নি তো।
কিছু হয় নি, তাহলে এমন করছিস কেন?
আমি মনে হয় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম। তারপর সব অন্ধকার হয়ে গেছিল। বলল হৃদি।
আপু! তিথির গলায় কান্না। তুই সত্যি করে বল তো তোর কী হয়েছে?
হৃদি কথা বলল না। রোখসানা বেগম বললেন, নেহাল তোকে মেরেছে? তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?
হৃদি অকস্মাৎ তীব্র গতিতে ডানে-বাঁয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল, না না। নেহাল আমাকে মারবে কেন? সে খুব ভালো, মা। খুব ভালো।
নেহাল কি তোকে কোনো ইনজেকশন দিত? তোর হাতে-পায়ে এত দাগ!
এগুলো ওষুধ, মা। আমার যে মাথায় আঘাত হলো! এই জন্য ডাক্তার ওষুধ দিতে বলেছিল। নেহাল আমাকে বলেছে। ভেঙে ভেঙে সময় নিয়ে কথাগুলো বলল হৃদি। তবে তার চোখ থেকে ভয়টা কাটে নি। বরং সে এদিক-সেদিক তাকিয়ে যেন কিছু খুঁজতে লাগল।
রোখসানা বেগম ধীরে ধীরে মেয়ের দিকে এগোলেন। হৃদি প্রথমে দূরে সরে যেতে চাইলেও পরে কী বুঝে আবার থমকে গেল। রোখসানা বেগম তার পাশে এসে বসলেন। তারপর তার হাতের দাগগুলোতে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিতে লাগলেন। হৃদি প্রথমে গুটিয়ে গেলেও পরে ধীরে ধীরে তার হাত বাড়িয়ে দিল। সে তীক্ষ্ণ চোখে রোখসানা বেগমকে দেখছে। যেন বোঝার চেষ্টা করছে, মানুষটা তার জন্য ক্ষতিকর কি না! তাকে আঘাত করবে কি না! কিংবা অন্য কোনো দুর্বোধ্য দ্বিধায় ভুগছে সে।
মারে। নরম গলায় ডাকলেন রোখসানা বেগম।
হৃদি তাকাল। তবে মুখে জবাব দিল না। তোর কী হয়েছে?
আমার কিছু হয় নি, মা। মৃদু হাসল হৃদি।
তুই আমাকে বল।
কী বলব?
কী হয়েছে তোর?
হৃদি চকিতে আবার এদিক-সেদিক তাকাল। যেন কাউকে খুঁজছে সে। রোখসানা বেগম বললেন, বল?
কী বলব? আমার কিছু হয় নি তো।
এখানে তোর কোনো ভয় নেই। এখানে কেউ তোকে কিছু বলবে না। বল মা।
হৃদি মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। অপলক, নির্নিমেষ। যেন মায়ের কথার কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
রোখসানা বেগম বললেন, নেহাল কী করেছে তোকে? কেন করেছে?
হৃদি তা-ও জবাব দিল না। তবে খাঁচায় বন্দী পাখির মতো বাইরে ইতিউতি তাকাতে লাগল সে। যেন এই ঘর, ওই বারান্দা, ওই দরজার ওপাশে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করছে কোনো শব্দ। কারও অস্তিত্ব। তিথিও এগিয়ে এল বোনের দিকে। বলল, আপু?
হৃদি তাকাল না। তার চোখও স্থির হলো না। কেবল ঘুরে বেড়াতে লাগল এদিক সেদিক। তবে হঠাই রোখসানা বেগমের উন্মীলিত বাহুর ভেতর নিজেকে এলিয়ে দিল সে। তারপর শান্ত শিশুর মতো মিশে যেতে লাগল তার বুকে। রোখসানা বেগমেরও হঠাৎ মনে হলো, তিনি যেন বহু বহু বছর বাদে আবার তার সেই ছোট্ট হৃদিকে বুকের ভেতর খুঁজে পেলেন। সেই ছোট্ট, এতটুকু এক হৃদি। এমন করেই শিমুল তুলোর ওমের মতন মায়াময় তুলতুলে আদুরে স্পর্শে মিশে থাকত সে। তিনি নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলেন। তার সেই কান্নায় শব্দ নেই, কিন্তু স্পন্দন আছে।
হৃদিকে সেদিন নিজ হাতে তুলে খাওয়ালেন রোখসানা বেগম। গোসল করিয়ে দিলেন। নতুন কাপড় পরতে দিলেন। ছাদের বেঞ্চিটাতে বসে মাথা আঁচড়ে দিলেন। হৃদি চুপচাপ সব করল। তবে কথা বলল না খুব একটা। কেবল মাঝে মাঝে হঠাৎ আঁতকে ওঠা গলায় বলল, নেহাল কই? নেহাল এখনো আসে নি?
কেন?
হৃদি এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে হুটহাট এদিক-সেদিক তাকাল। চমকে উঠল। তারপর আবার চুপ হয়ে গেল। তারপর ছোট্ট শিশুর মতোই কখন যে ঘুমিয়ে গেল, টেরই পেল না। তবে নেহাল এলে আর ঘর থেকে বের হয় না সে। একা অন্ধকারে কোনো এক অচেনা ঘোরের দেশে কুঁদ হয়ে থাকে।
.
সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। তিথি বলল, আপু, তুই কি ছাদে যাবি?
হৃদি তাকিয়ে থাকে। নির্বাক। নিস্পন্দ। তিথি বলল, তোর কি মনে আছে তুই একদিন ফোন করে খুব কেঁদেছিলি?
হৃদি চুপ। তিথি বলল, তুই ভেবেছিলি, আমি মা। আমাকে মা মনে করেই কাঁদছিলি তুই। মনে আছে?
হৃদি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। যেন তিথির কথা কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তিথি বলল, তোর কিছু মনে নেই? ওই যে ফোন করে খুব কাঁদলি? বললি, মা, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও? আমার খুব ভয় হচ্ছে। মনে নেই তোর?
হৃদি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। যেন তিথির এমন আবোলতাবোল কথার কিছুই বুঝতে পারছে না সে। তিথি হঠাই বলল, তুই কাঁদতে কাঁদতে বলছিলি, অনিক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চাস। একবার হলেও তার সঙ্গে দেখা করতে চাস। মনে আছে তোর?
তিথি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হৃদির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে যদি কোনো স্পন্দন ধরা পড়ে! কোনো চিহ্ন। যেই চিহ্ন তাকে গভীর গহিন অন্ধকারের ঘোর থেকে ফিরে আসবার পথ দেখাবে। কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পড়ে না। হৃদি বরং একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। যেন শূন্য, নিষ্প্রাণ এক জোড়া চোখ। তিথি হঠাৎ পেছন ফিরে তাকায়। বারান্দার গ্রিলে একটা পাখি এসে বসেছে। চড়ুই পাখি। হৃদি সেই পাখির দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। তার মানে এতক্ষণ সে তার কথা কিছুই শোনে নি! দেখেও নি তাকে! সে তাকিয়ে ছিল পেছনের ওই পাখিটির দিকে! অথচ সে কিনা ভেবেছিল হৃদি তাকিয়ে আছে তার দিকেই। তার কথাই শুনছে!
তিথি হাত বাড়িয়ে হৃদির চোখের সামনে বাধা সৃষ্টি করল। হাত নাড়াল। তার দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা করল। সে কিছুতেই আর ওই পাখিটা দেখতে দিতে চায় না হৃদিকে। সে চায় হৃদি তার কথা শুনুক, অনুভব করুক। কিন্তু তাতে লাভ হলো না। হৃদির দৃষ্টি তাতে সরল না। বরং ওই একই জায়গাতে নিবদ্ধ হয়ে রইল। এমনকি পাখিটি তাড়িয়ে দেওয়ার পরও।
তিথি তারপরও চেষ্টা করে যেত থাকল। বলল, তোর অনিক ভাইয়ের কথা মনে আছে?
হৃদি হঠাৎ কথা বলল, নেহাল এসেছে।
কই?
আসে নি?
না।
তাহলে কে ওখানে? নেহালই তো।
তিথি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। তাদের বাসার সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে নামছে নেহাল। এই গাড়িটি নেহালের নয়। হয়তো ভাড়া করা গাড়ি। তাহলে অত দূর থেকে এত আগেভাগেই বুঝল কী করে হৃদি? নাকি সে সারাক্ষণই নেহালের ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে? কোথাও কোনো কম্পন কিংবা স্পন্দন দেখলেই ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে গুটিয়ে যায় সে?
হৃদি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। তারপর পাগলের মতো ছুটতে শুরু করল তার দোতলার ঘরের দিকে। তিথি বলল, কী হলো, অমন ছুটছিস কেন?
হৃদি জবাব দিল না। সে ছুটতেই লাগল। তারপর উঠতে শুরু করল দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। তিথিও বোনের পেছন পেছন ছুটল। চিৎকার করে বলল, তুই তো পড়ে যাবি, আপু! ওভাবে ছুটিস না।
কিন্তু হৃদি তার কথা শুনল না। সে দৌড়ে উঠে গেল দোতলায়। তারপর তার ঘরে গিয়ে দরাম করে দরজা বন্ধ করে দিল। তিথি ভারি অবাক হলো হৃদির আচরণে। এমন কেন করল সে? তবে কি হৃদি যে এ কদিন তাদের সঙ্গে একটু-আধটু মিশেছে, সেটা পছন্দ হয় নি নেহালের? এ কারণে হৃদিকে কিছু বলেছে সে? কিংবা কোনোভাবে ভয় দেখিয়েছে তাকে বা অন্য কিছু?
বিষয়টা মাথায় গেঁথে রইল তিথির। পরদিন নেহালকে কথাটা বলল সে।
হৃদিপুর শরীরটা তো খারাপ। ও কটা দিন যদি মা বা আমার সঙ্গে ঘুমায়, তাহলে সমস্যা আছে?
না না, সমস্যা থাকবে কেন? সেটাই তো বরং ভালো।
তাহলে আজ থেকে থাকবে আমাদের সঙ্গে?
অবশ্যই থাকবে। কোনো সমস্যা নেই। তবে…।
কী?
ওকে তো অনেকগুলো ওষুধ খেতে হয়। খুব টাইম মেইনটেইন করতে হয়। ওগুলো খুব সেন্সিটিভ। আর সমস্যাটাও তো বুঝতে পারছ। আঘাতটা ব্রেনে। সো, আর কটা দিন যাক। আরেকটু ধাতস্থ হোক। কী বলে?
আপনি শিখিয়ে দিলে আমরা পারব না ওগুলো মেইনটেইন করতে?
কেন পারবে না, কিন্তু আমার নিজেরই সারাক্ষণ টেনশন লাগবে। মনে হবে, যদি একটু এদিক-সেদিক হয়ে যায়? তা ছাড়া ডক্টরের সঙ্গেও আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকছে। তিনি নানা অ্যাডভাইস দিচ্ছেন। সেসব ফলো করতে হচ্ছে। বুঝতেই পারছ। আমি আসলে চাই না দিনের বেলাও ও খুব একটা বেশি কথাবার্তা বলুক। সিঁড়ি ভেঙে নিচে বা ওপরে যাক। নড়াচড়া করুক। ও যত মুভমেন্টে থাকবে, তত ওর জন্য ক্ষতি। ওর আসলে বেশির ভাগ সময় ঘুমিয়েই থাকা উচিত। এতে ব্রেনও বিশ্রাম পায়। মনে রেখো, সামান্য এদিক-সেদিক হলেই কিন্তু ওর মহা বিপদ তিথি!
তিথি বলার মতো আর কথা খুঁজে পেল না। তবে মাকে কথাটা বলল সে, তোমার কি মনে হয় না আমাদের কিছু একটা করা উচিত?
কী করব?
ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস কোনো অ্যাকশন নেওয়া উচিত না? অ্যাটলিস্ট আপুকে ডাক্তারের কাছে তো নেওয়া যায়?
যায়। কিন্তু নেহাল কী বলল তুই শুনিস নি? কারও সঙ্গে কথা বলা যাবে না। এখানে ডাক্তার পর্যন্ত দেখানো যাবে না। তাতে বরং ওর ক্ষতি হতে পারে!
ক্ষতির আর বাকি কী আছে, মা? আর নেহালের কথা তুমি এখনো বিশ্বাস করো?
বিশ্বাস না করে আমি যাব কোথায়? এই কথা আত্মীয়স্বজন কারও কাছে বলতে পারব? হৃদির আগের বিয়ের ঘটনাটাও এখন সবাই জেনে গেছে। সেই বিয়ে ভেঙে এনে এখানে বিয়ে দিলাম। এখন এখানেও আবার এই অবস্থা! লোকে কী বলবে? বলবে মেয়ে পাগল হয়ে গেছে বা নেশা করে…।
লোকের বলার কারণে তুমি এত বড় একটা ঘটনা এভাবে চেপে রাখবে?
রোখসানা বেগম জবাব দিলেন না। তিনি যে বিষয়টা নিয়ে ভাবেন না, তা নয়। কিন্তু হৃদির এই ঘটনা তাকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও নানা ঘটনা। বিশেষ করে হৃদি ও অবন্তীর ঘটনায় অনিক নামের ছেলেটার জীবন যে এলোমেলো হয়ে গেল, এটা তার ভেতরে প্রবল এক আত্মদহন তৈরি করেছে। কোথায় আছে ছেলেটা? এই জীবনে এমন শান্ত জলের মতো স্বচ্ছ, নরম, সহজ মানুষ আর তিনি দেখেন নি। এমন কেন ছেলেটা?
মাঝে মাঝে অনিকের জন্য একধরনের মায়াও অনুভব করেন তিনি। সেই মায়ায় চুপি চুপি হৃদিও এসে যায়। মনে হয়, কী অসাধারণ একটি মানুষই না জীবনভর পাশে পেত পারত হৃদি! অথচ তিনি নিজে সেই জীবনটা টুকরো কাগজের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন। নিজেকে এত অপরাধী কখনো লাগে নি তার।
তিনি তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ওই ছেলেটার আর কোনো খবর পেলি, তিথি?
কোন ছেলেটার, মা?
অনিকের।
অনিক ভাইয়ের খবর দিয়ে তুমি কী করবে?
কিছু করব না। এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।
তিথি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, না।
পুলিশও কিছু জানে না?
না।
রোখসানা বেগম আর কথা বললেন না। আর কিছু বলার মতো খুঁজেও পান না তিনি। কিংবা সেই সাহসও তার নেই।
৪৮
আবছার আহমেদ বসে ছিলেন অফিসে। এই সময়ে খবরটা এল। কেউ একজন তার সঙ্গে দেখা করতে চায়। জরুরি প্রয়োজন। তিনি আসতে বললেন। ছেলেটার বয়স উনিশ-কুড়ি। শুকনো টিনটিনে। প্রথম দর্শনে আলাদা কিছু মনে না হলেও তার চোখের দিকে তাকালেই ধাক্কা খেতে হয়। হালকা বাদামি রঙের চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি গভীর, অন্তর্ভেদী। ছেলেটার চোখেমুখে অসংখ্য ক্ষত। আবছার আহমেদ বললেন, কী চাই?
পানি। রাশু শুকনো কণ্ঠে বলল।
পানি! ক্রু কুঁচকে বললেন আবছার আহমেদ। এটা পানি খাওয়ার জায়গা?
পানি যেকোনো জায়গায় খাওয়া যায়, স্যার। নবীজি বলেছেন, মানুষরে পানি খাওয়ানো উত্তম সদকা।
ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন আবছার আহমেদ। বয়সের তুলনায় তার চলন-বলন পরিণত। মনে মনে রেগে গেলেও সেটি প্রকাশ করলেন না তিনি। বরং কী ভেবে সেন্ট্রিকে পানি আনতে নির্দেশ দিলেন। রাশু সময় নিয়ে পানি খেল। তারপর হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছতে মুছতে বলল, আপনে আমারে খুঁজতেছিলেন। আমার নাম রাশু। লাল চান বেডিং স্টোরে কাজ করি।
মুহূর্তেই শিরদাঁড়া শক্ত হয়ে গেল আবছার আহমেদের। তিনি উত্তেজিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াতে চাইছিলেন। ডাকতে চাইছিলেন কাউকে। কিন্তু রাশু তাকে হাত তুলে নিবৃত্ত করল। বলল, আমি তো ধরা দিতেই আসছি, স্যার। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। তবে তার আগে কিছু কথা বলব।
কী কথা? রাশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আবার বসে পড়লেন তিনি।
আপনে যেই কারণে আমারে খুঁজতেছেন, আমি তার চেয়েও বড় অপরাধ করছি।
কী অপরাধ?
খুন। আমি দিন কয়েক আগে জামশেদ নামের একজনরে খুন করছি। তার লাশ আছে বৈদ্যবেলঘরিয়া নামের এক জায়গায়। কিন্তু আপনে সেইখানে গিয়া তার লাশ পাবেন না। পাবেন হাড্ডি।
মানে? বিস্মিত গলায় বললেন আবছার আহমেদ। তার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। এই সব কী বলছে এই ছেলে! সেইখানে একটা আফ্রিকান মাগুর মাছের পুকুর আছে। আমি তারে গুলি করে সেই পুকুরে ফেলে দিছি।
কী!
হুম। সে লাল চান চাচারে খুন করছিল।
লাল চান কী হয় তোমার?
সে আসলে কী যে হয় আমার! বলে যেন চিন্তায় পড়ে গেল রাশু। তারপর বলল, আমার জন্ম খারাপ জায়গায়। মায়ের পরিচয় আছে, কিন্তু বাপের পরিচয় নাই। লাল চান চাচা আমারে বাপের পরিচয় দিছিলেন। নিজের পোলার মতো আদর করতেন। কিন্তু জামশেদ স্যার তারে গুলি কইরা খুন করছেন আমার সামনে। খুন কইরা লাশ ওই মাগুর মাছের ডোবায় ফালাইছিলেন। এই জন্য আমিও তারে মাগুর মাছ দিয়া খাওয়াইছি। বলে থামল রাশু। আবছার আহমেদের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। এমন ভয়ংকর ঘটনা তিনি এর আগে আর কখনো শোনেন নি। তার ঘাড়ের কাছটা শিরশির করছে। কিন্তু ঘটনা জানার কৌতূহলও সংবরণ করতে পারছেন না তিনি।
রাশু শান্ত গলায় বলল, ওই পুস্কুনিতে সে লাল চান চাচারে মাইরা তারপর ফালাইছিল। আর আমি তারে ফালাইছি জ্যাতা। অর্ধেক জ্যাতা।
আবছার আহমেদ বেশ খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তীক্ষ্ণ চোখে রাশুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, চালাকি করতেছ? মিথ্যা গল্প সাজাইছ? উদ্দেশ্য কী?
রাশু হাসল, মিথ্যা না। যা বলছি, সব সত্য। আর উদ্দেশ্যও কিছু না। জীবন ভাল্লাগে না। ভালো না লাগলে মানুষ কী করে, ভালো লাগানোর চেষ্টা করে। আমি ভালো লাগার সন্ধানে এইখানে আসছি।
মানে! আবছার আহমেদ বিভ্রান্ত বোধ করছেন।
মানে…। খুন করার আগে খুব অশান্তি লাগত। ঘুমাইতে পারতাম না। চোখ বন্ধ করলেই লাল চান চাচার ওই দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাইসা উঠত। তারে গুলি করনের দৃশ্য। তার লাশ ডোবায় ফালানোর দৃশ্য। আর তারপর মাছের ছপছপানির শব্দ। চাইরদিকে অন্ধকার। কানে খালি ছপছপ শব্দ। একটুও ঘুমাইতে পারতাম না। অস্থির লাগত। লাল চান চাচার জন্য বুকে যন্ত্রণা হইত। এত চেষ্টা করছি ভুলতে, পারি নাই। তখন ভাবলাম, জামশেদ স্যাররে খুন করলে মনে হয় শান্তি পাব। সবকিছু আবার ঠিকঠাক হইয়া যাইব। এই জন্য খুন করলাম।
তাহলে ধরা দিতে আসছ কেন?
এই কথায় রাশুর মন খারাপ হয়ে গেল। প্রবল বিষাদের ছাপ ফুটে উঠল তার চোখেমুখে। সে বেশ খানিকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, লাভ হয় নাই।
লাভ হয় নাই মানে?
শান্তি পাই নাই। এখনো বুক জ্বলে। রাইতে ঘুমাইতে পারি না। চাচার জন্য সারাক্ষণ খালি অস্থির লাগে। মনে হয়, দুনিয়ায় কিছু নাই। কোথাও কিছু নাই। চাইরদিকে খালি অশান্তি আর অশান্তি। খুন কইরা লাভ হয় নাই। অশান্তি আরও বাড়ছে।
এই জন্য ধরা দিতে আসছ?
জে।
রাশুকে গ্রেপ্তার করা হলো। তবে গ্রেপ্তারের আগে আরও একটা ঘটনা ঘটল। সে বলল, আমার সঙ্গে একজন লোক আছে। আপনে অভয় দিলে তারে ভিতরে আসতে বলব।
কে?
তারে আপনে চিনবেন।
কীভাবে?
আপনেরা তারে মিথ্যা অভিযোগে খুঁজতেছেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় বৈদ্যবেলঘরিয়া। আপনেদের থিকা পালাইতে গিয়া শেষে ওইখানে আশ্রয় নিছে সে। নির্দোষ, ভালো মানুষ। কিন্তু ভাগ্য তারে কই থিকা কই নিয়া গেল। তারে দেইখাই আমি বুঝছি। সে ওইখানে থাকনের লোক না। অনেক জিজ্ঞাস করছি ঘটনা। কিন্তু কিছুতেই কিছু বলে না। শেষে আসল ঘটনা জানলাম।
কী ঘটনা?
রাশু হাসল, দুনিয়া বড় আজব জায়গা। মানুষ যে বলে দুনিয়া গোল, কথা সত্য। নাইলে আমারে চেনে না, জানে না, এমন একজন কেন আমার দোষের বোঝা টানব? আবার তার সঙ্গেই কেন এমন কইরা দেখা হইব আমার?
ঘটনা খুলে বল?
দোষ আমার, জানালা দিয়া গুলি করছি আমি, আর আপনেরা সেই দোষে এই লোকরে ধরার জন্য খুঁজতেছিলেন। বলে সামান্য থামল রাশু। তারপর বলল, গতকালই তার কাছ থিকা ঘটনা জানলাম আমি। সে তো আর জানে না যে আমিই সেই লোক যে ওই ঘটনা ঘটাইছে। হা হা হা। মানুষটা ভালো। শুধু শুধু তার জীবনটা আপনেরা তামা তামা কইরা দিলেন।
কে? অনিক?
জে।
আবছার আহমেদ কুঞ্চিত কপালে তাকিয়ে রইলেন। অনিক ওখানে গেল কী করে!
.
সেদিনই চাঞ্চল্যকর সব তথ্য পাওয়া গেল। বৈদ্যবেলঘরিয়ায় অভিযান চালাল পুলিশ। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হলো মতিন মিয়াসহ আরও কয়েকজনকে। পুলিশ অল্প সময়ের মধ্যেই জামশেদের ঠিকানা বের করে ফেলল। তার বাসায় থাকা বিভিন্ন ডিভাইস থেকে নানান তথ্যও উদ্ধার করা হলো। সেই তথ্যের সূত্র ধরেই নাম উঠে এল নেহালের। উঠে এল এই পুরো প্রকল্পের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যুক্ততাও। বিষয়টা রীতিমতো হতভম্ব করে দিল আবছার আহমেদকে। তিনি নেহালের বিষয়টা জেনে স্তম্ভিত হয়ে রইলেন।
.
সেদিন একটু আগেভাগেই বাড়ি ফিরেছে নেহাল। হৃদি তখন বসে ছিল বারান্দায়। তার সাথে বসে ছিল তিথি। কিন্তু নেহালকে দেখেই পাগলের মতো ছুটতে আরম্ভ করল সে। তারপর উঠে গেল দোতলায়। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল হৃদি। নেহাল দরজায় আঘাত করল, দরজা খোলো। তাড়াতাড়ি খোলো।
আমি বাইরে যাই নি। হৃদি ভীত গলায় বলল।
দরজা খোল। তাড়াতাড়ি খোল। কুইক। এবার কঠিন হলো নেহালের গলা।
আমি সত্যি যাই নি।
ওহ্ গড! তুই দরজা খুলবি, না ভাঙব আমি? এবার চেঁচাল নেহাল।
হৃদি দরজা খুলল। তারপর প্রচণ্ড আতঙ্কে ছুটে গিয়ে দেয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে রইল। সে ভেবেছিল নেহাল তাকে কিছু বলবে। ভয়ংকর কিছু। কিন্তু নেহাল তার দিকে ফিরেও তাকাল না। তার মুখ থমথমে। কপালে চিন্তার রেখা। প্রচণ্ড রাগে, ক্রোধে, হতাশায় কটমট করছে চোয়াল।
দেশে আসার আগের দিনই জামশেদকে ই-মেইল করেছিল সে। জামশেদ তার রিপ্লাইও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর যোগাযোগ হয় নি তাদের। সাবধানতাবশতই ফোন কলটা এড়িয়ে চলত নেহাল। তা ছাড়া এবার এসে ইচ্ছে করেই সবকিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল সে। একটু সময় নিয়ে হৃদির পরিস্থিতিটা সামলে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় বৈদ্যবেলঘরিয়ার খবর কানে এসেছে তার। সেই খবর শোনার পর থেকে দিশেহারা হয়ে গেছে নেহাল। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ঝট করে একবার হৃদির দিকে তাকাল সে। যেন এই সবকিছুর জন্য সে-ই দায়ী। যেন সে না হলে এসব কিছুই হতো না। কিংবা হৃদির কারণেই বৈদ্যবেলঘরিয়ার ঘটনাটা এত দেরিতে জানতে পেরেছে সে। কিংবা অকারণেই তার সব রাগ গিয়ে পড়ল হৃদির ওপর। হৃদি অবশ্য কিছুই বুঝল না। সে তীব্র আতঙ্কে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। বলল, আমি আর যাব না। আর বাইরে যাব না আমি।
নেহাল অবশ্য তাকে কিছু বলল না। সে একটা ছোট্ট ব্যাগে ঝড়ের বেগে তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঢোকাতে লাগল। তারপর অকস্মাৎ উঠে দাঁড়াল। হৃদি অবাক ও ভীত চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে। নেহালের হঠাৎ কী যে হলো! সে তার হাতের কাছে যা কিছু পেল ছুঁড়ে ফেলতে লাগল। যেন তার মাথায় উন্মাদনা ভর করেছে। আতঙ্কিত হৃদি থরথর করে কাঁপতে লাগল।
সেই কম্পিত হৃদিকে দেখেই যেন রাগে, ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেল নেহাল। সে আচমকা হৃদির গলা টিপে ধরল। হৃদি চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। তার মুখ থেকে একনাগাড়ে গোঁ গোঁ শব্দ বের হতে লাগল। কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল চোখ। ফুসফুসটা বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে লাগল। তারপর হঠাই সে নেতিয়ে পড়ল নেহালের হাতের ওপর। নেহাল তার শরীরটা বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। উঠানে তার গাড়ি প্রস্তুত। সে এখন কোথায় যাবে। ইতিমধ্যেই মনস্থির করে ফেলেছে। কিন্তু ততক্ষণে উঠানে একটা পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে। আবছার আহমেদ সেই গাড়ি থেকে নামলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, এত রাতে কোথায় যাচ্ছেন মি. নেহাল?
৪৯
আবছার আহমেদ বললেন, কিছু মনে করবেন না, স্যার, বিষয়টা সিরিয়াস। এই জন্যই আপনাকে আবার বিরক্ত করছি।
মাহমুদ হাসান বললেন, জি।
আপনি কি অনিক নামে কাউকে চেনেন?
হ্যাঁ।
কীভাবে চেনেন?
সে আমার ছেলেকে পড়াত।
মানে হাউস টিউটর?
জি।
এর বাইরে তার সঙ্গে আপনার আর কোনো সম্পর্ক ছিল?
না।
আপনি কি জানতেন যে তাকে পুলিশ খুঁজছিল?
এই প্রশ্নে চুপ করে রইলেন মাহমুদ হাসান। আবছার বললেন, স্যার, চুপ করে থাকবেন না, প্লিজ। আপনি খুবই সম্মানিত একজন মানুষ। আমরা আপনার সঙ্গে অসম্মানজনক কোনো আচরণ করতে চাই না।
জি, জানতাম।
তারপরও আপনি তাকে কেন পালিয়ে থাকতে হেল্প করেছেন?
বিষয়টার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে আমার স্ত্রীর ধারণা ছিল দোষটা অনিক করে নি। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। অনিক তখন ভয়াবহ মানসিক-আর্থিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ওর বাবা-মা দুজনই মারা গেলেন কিছুদিনের ব্যবধানে। চাকরিবাকরি, পড়াশোনা নিয়ে খুব স্ট্রাগল করছে। সব মিলিয়ে ওর ওই অবস্থা দেখে আমাদের সবারই একটু সিম্প্যাথি ছিল ওর ওপর। ফলে, আমার স্ত্রী যখন আমাকে খুব অনুরোধ করলেন যে আমি যেন তাকে একটা লুকিয়ে থাকার জায়গার ব্যবস্থা করে দিই, তখন আর আমি না করতে পারি নি।
আপনার কি মনে হয় না কাজটা আপনি অন্যায় করেছেন?
আইনের দৃষ্টিতে তো অবশ্যই। বলে চুপ করে রইলেন মাহমুদ হাসান। তবে ও যে ও রকম একটা কাজ করতে পারে, সেটা আমাদের বিশ্বাস হচ্ছিল না।
কিন্তু স্যার, সেটা তো আইন বিচার করবে। তাই না?
জি।
স্যার…। বলে থামলেন আবছার আহমেদ। তারপর বললেন, তবে এর চেয়েও একটা বড় অপরাধের অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে আছে।
আমার বিরুদ্ধে? বড় অপরাধের অভিযোগ? অবাক ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে বললেন মাহমুদ হাসান।
জি স্যার।
কী?
আপনি অনিককে কার কাছে পাঠিয়েছিলেন?
আমার বন্ধু জামশেদের কাছে।
জামশেদ আপনার কেমন বন্ধু?
আমরা ইউনিভার্সিটিতে একসঙ্গে পড়েছি।
উনি কি দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন? জার্মানিতে?
হুম।
দেশে উনি কী করতেন, আপনি জানতেন?
জানতাম। মানে ও আমাকে বলেছিল আরকি! মানিকগঞ্জের বা গাজীপুরের দিকে কী একটা মাছের খামার ছিল তার। সঙ্গে আরও নানান ধরনের প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করার প্ল্যান ছিল।
আপনি কখনো গিয়েছিলেন সেখানে?
না। তবে ও অনেকবারই বলেছিল। কিন্তু যাব যাব করেও আর যাওয়া হয় নি।
তার মানে আপনি এখনো কিছুই জানেন না?
কী জানব! অবাক চোখে তাকালেন মাহমুদ।
ওখানে মাছের খামারের আড়ালে কী হতো?
মাহমদু হাসান ভ্রু কুঁচকে বললেন, মাছের খামারের আড়ালে কী হতো মানে কী?
তার মানে আপনি কিছু না জেনেশুনেই অনিককে ওখানে পাঠিয়েছিলেন?
আসলে জামশেদ অনেক দিন আগে আমাকে বলেছিল যে ওর একটা কর্মঠ, শিক্ষিত ছেলে দরকার, যাকে বিশ্বাস করা যায়। তো অনিকের সমস্যাটা শুনে আমার স্ত্রী যখন আমাকে খুব প্রেশার দিচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই ওর কথা মনে পড়ল আমার।
তারপর আপনি তাকে ফোন করে বললেন?
হা। কেন, কী হয়েছে, বলুন তো!
অনিককে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
আগের ঘটনায়?
না।
তাহলে?
আপনি আসলেই কিছু জানতেন না?
মাহমুদ অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।
আবছার আহমেদ বললেন, আপনার বন্ধুর মাছের খামারের আড়ালে স্নেক ভেনম উৎপাদন, পাচার আর তা দিয়ে ড্রাগ ও মেডিসিন এক্সপেরিমেন্ট চলছিল।
কী বলছেন আপনি! চোখ বড় বড় করে তাকালেন মাহমুদ হাসান। বারবার মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি।
কিছু মনে করবেন না, স্যার। আমরা স্যার একটু আপনার বাসাটা তল্লাশি করতে চাই। আজই। আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। আশা করছি আপনি আমাদের সহযোগিতা করবেন।
মাহমুদ হাসান সম্ভাব্য সকল উপায়েই তাদের সহযোগিতা করলেন। কিন্তু তার বাসায় কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। বরং আবছার আহমেদ বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মাহমুদ হাসান হঠাৎ তার হাতখানা ধরে ফেললেন। তারপর প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, রিয়ার কোনো খবর কি পেলেন, অফিসার? মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল? কী হলো তার?
চশমার আড়ালে ছলছল করছে মাহমুদের চোখ। তিনি হাত তুলে সেই চোখ আড়াল করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। তার হাত কাঁপছে। তিনি হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, মেয়েটা এত ভালো ছিল, অফিসার! চটপটে, কিন্তু মানুষ হিসেবে খুব ভালো। শিশুর মতো ভোলা মন। তবে অভিমানীও ছিল খুব। সারাক্ষণ শুধু ভাবত, ওর ওই দুরন্তপনার কারণে অন্যরা বুঝি ওকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।
আবছার আহমেদ কী বলবেন ভেবে পেলেন না। তিনি আলতো করে তার। হাতখানা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলেন। তারপর গাঢ় গলায় বললেন, সরি স্যার। কিন্তু আমরা চেষ্টার ত্রুটি রাখছি না।
.
সেদিনই সুমির বাবার বাসায় গেলেন আবছার আহমেদ। তিনি সুমিকে বললেন, আপনি আর আপনার হাজব্যান্ড দীর্ঘদিন থেকেই আলাদা থাকছেন, এই কথা কি সত্যি?
সত্যি।
আপনারা কি ডিভোর্স নিয়েছেন?
না।
তাহলে আলাদা কেন থাকছেন?
আশ্চর্য! আমরা কেন আলাদা থাকছি, সেটাও পুলিশকে বলতে হবে? এটা আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ইস্যু। অন্যের প্রাইভেসিকে আপনাদের সম্মান করা। উচিত।
সরি ম্যাডাম। আসলে আমরা অকারণে আপনার কাছে আসি নি। প্রয়োজনেই এসেছি।
কী প্রয়োজন?
আপনি রিয়াকে নিশ্চয়ই চিনতেন?
জি।
রিয়া নিখোঁজ। আপনি সম্ভবত পত্রপত্রিকা পড়েন না। এই জন্য জানেন না।
ওহ্! অস্ফুটে বলল সুমি। কবে থেকে?
বেশ কয়েক মাস। নিখোঁজের আগে তার নাকে-মুখে আঘাতের চিহ্নও ছিল।
এই কথায় সতর্ক হয়ে গেল সুমি। শেষ দিন রিয়াকে করা তার আঘাতের কথা চট করে মনে পড়ে গেল তার। এখন রিয়া যদি সেই ঘটনার পরপরই নিখোঁজ হয়ে গিয়ে থাকে, তবে বিষয়টার দায়ভার তার দিকেও আসতে পারে। সে সাবধানী ভঙ্গিতে বলল, কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক যে আছেই, তা নয়। তবে কিছু ফিসফাস আমরা শুনতে পেয়েছি।
কী ফিসফাস?
আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে রিয়ার একটা ভালো সম্পর্ক ছিল। আর তার জের ধরেই আপনাদের আলাদা থাকা?
সুমি ততক্ষণে আরও সতর্ক হয়ে উঠেছে। সে বলল, মাহমুদের সঙ্গে কেবল তার ডিপার্টমেন্টেরই না, অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের অনেক স্টুডেন্টের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক। এটা আলাদা কিছু না। সে যতটা সম্ভব নিজেদের নিরাপদ রেখেই কথাটা বলল। নিজেকে কিছুতেই এই ঘটনার সঙ্গে জড়াতে চায় না সে। আর নিজেকে নিরাপদ রাখতে হলে রিয়ার ঘটনাটা কিছুতেই সামনে আনা যাবে না।
আবছার আহমেদ বললেন, কিন্তু রিয়া নিখোঁজ হওয়ার কিছুদিন আগেও সে আপনাদের বাসায় গিয়েছিল।
আমাদের বাসায় মাহমুদের বন্ধু, কলিগ, স্টুডেন্টরা রোজই আসে। তো এই জন্য তাদের কেউ নিখোঁজ হলে তার দায়ভার আমাদের?
তা না। বলে থামলেন আবছার আহমেদ। আর কথা বাড়ালেন না তিনি। তবে অনেক দিন পর সুমি মাহমুদকে হঠাৎ ফোন করল। বলল দেখা করতে চায় সে। তারা দেখা করল সেই দিনই। মাহমুদের কাছ থেকে ঘটনা সব শুনল সুমি। শুনে সে-ও হতভম্ব হয়ে গেল, মেয়েটা তাহলে কোথায় গেল?
বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল সে।
ওই দিনের ঘটনায় রাগ বা অভিমান করে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে নি তো?
কী দুর্ঘটনা?
ধরো সুইসাইড-টুইসাইড?
তাহলে লাশটা তো অন্তত পাওয়া যেত?
হুম। তা-ও কথা। কিন্তু তাহলে মেয়েটি গেল কোথায়?
বুঝতে পারছি না আমি। মাহমুদ যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন। নিজের ভেতরে কী চলছে, তা তিনি সুমিকে বুঝতে দিতে চান না।
সুমি চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা? এমন কি হতে পারে যে কোনো ব্রিজট্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়ে সুইসাইড করল? লাশ ভেসে গেল নদীতে। এমনও তো হতে পারে। পারে না? আজকালকার ছেলেমেয়েরা কিছু হলেই সুইসাইড করে!
মাহমুদ কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। সুমি বলল, তোমার খুব মন খারাপ, না?
মাহমুদ বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, না না।
তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, তুমি খুব আপসেট। মানুষ সবকিছু লুকাতে পারে না, বুঝলে?
হুম। তুমি এখন কী করবে ভাবছ? জিজ্ঞেস করল মাহমুদ।
কিছু করব না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি বলে ভেবো না আমি সব ভুলে গেছি। কিছু ভুলি নি আমি। আমি জাস্ট এসেছি নিজেকে সেভ করতে। তুমি কাইন্ডলি রিয়ার সঙ্গে আমার ইনসিডেন্টের কথা পুলিশকে বোলো না।
বলব না। মলিন গলায় বললেন মাহমুদ। তুমি তাহলে ফিরবেই না?
না। আমি কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্সের ফাইল রেডি করছি।
মাহমুদ কথা বললেন না। তার বুকটা হঠাৎ ভার লাগতে লাগল। তিনি আচমকা বললেন, আমি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে কোথাও চলে যাব, সুমি। এমন কোথাও, যেখানে কেউ আমাকে চেনে না। একা।
যাও। তবে তুমি একা কোথাও থাকতে পারবে না। তোমার নিত্যনতুন নারীসঙ্গ দরকার। বলে ভ্রুকুটি করল সুমি।
মাহমুদ অবশ্য সেটা গায়ে মাখলেন না। তিনি বললেন, দিন শেষে ওই বাসাটাতেও আমার আর ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। তোমার ডিজাইন অনুযায়ী সাজানোর কাজও চলছিল। কিন্তু আমি পরে ওটা অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই বন্ধ করে রেখেছি।
কেন?
তুমি যেখানে নেই, সেখানে অত আয়োজনও দরকার নেই আমার।
সুমি কথা বলল না। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। মাহমুদ বললেন, ভাবছি বাইরে কোথাও চলে যাব।
আর তোমার ফ্ল্যাট?
জানি না। ও রকমই তালাবদ্ধ থাকবে। শূন্য ঘর। শূন্য মানুষ। অথবা বিক্রিও করে দিতে পারি। কী হবে রেখে?
সুমি জবাব দিল না। উঠে দাঁড়াল আচমকা।