৪০. রমেনের ছোট্ট বিছানা

চল্লিশ

রমেনের ছোট্ট বিছানা আর টিনের সুটকেস পড়ে আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই জিনিসপত্র রেখে গেলে ফিরে আসার সম্ভাবনাও রেখে যায়। কিন্তু রমেনের বেলায় এ-নিয়ম খাটবে কি? ও দুটো তুচ্ছ জিনিস রমেনকে ফিরিয়ে আনবে, এ-কথা ভাবতে ললিতের ভরসা হয় না।

তবু নিজের অজান্তে রমেনের জন্য অপেক্ষা করে ললিত। রমেন যত দিন তার কাছে ছিল, তারা পাশাপাশি শুত, তখন প্রায়ই ললিত টের পেত, সারা রাত জেগে আছে রমেন। মাঝরাতে কি ভোর রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে অসহায় ললিত মৃদু অস্পষ্ট গলায় ডাকত, রমেন। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেত, কী রে! ললিত জিজ্ঞেস করত, জেগে আছিস? উত্তর পেত, আছি। তাই আবার নিশ্চিন্তে ঘুমোত ললিত। রমেনের এই নিরন্তর জেগে থাকা দেখে ললিত বড় অবাক হয়েছে প্রতি রাত্রে। ললিত ডাকবে, ডেকে পাছে সাড়া না পায়, সেইজন্যই কি জেগে থাকত রমেন? তুই কী রে রমেন? আমার জন্য কই কেউ তো কখনও এ-রকম জাগিয়ে রাখেনি নিজেকে!

কত কথা মনে পড়ে ললিতের। অপর্ণার মোটর গাড়িটা তার হাতে এক বিকেলে ছেড়ে দিয়েছিল রমেন, তারা ঘুরপাক খেয়েছিল ময়দানের নির্জন রাস্তায়। বহুকাল বাদে সেইদিন প্রথম নিজের ওপর কিছুক্ষণের জন্য একটা গভীর বিশ্বাস ফিরে পেয়েছিল সে। কিংবা মনে পড়ে, শ্মশানের সেই ঘটনার কথা, তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ভয় ভেঙে দিয়েছিল রমেন। কিংবা মনে পড়ে, কীর্তনের মধ্যে তাকে টেনে নিয়েছিল, অলৌকিক জয়ধ্বনি বের করেছিল তার অবিশ্বাসী কণ্ঠ থেকে।

এখনও মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে অদুরে রমেন আছে ভেবে ঘুম-গলায় ললিত ডাকে, রমেন! উত্তর পায় না। মাঝরাতে তাই হঠাৎ এক শূন্যতা ভূতের মতো শিয়রের জানালা জুড়ে দাঁড়ায়।

রমেনের সঙ্গে আর দেখা হবে কি তার? সময়মতো রমেন যদি না ফেরে? মরার সময়ে রমেন যদি কাছে থাকে তবে বোধ হয় ললিতের তেমন কষ্ট হবে না।

বিজয়া দশমীর দশ দিন বাদে একদিন শাশ্বতী এল মাকে বিজয়ার প্রণাম করতে।

প্রণাম করে উঠে হাসিমুখে বলল, বড় দেরি করে এলাম।

সতেজ, সুন্দর হাসিটি। ঝকঝকে দাঁতে সকালের রোদ আর পেয়ারাপাতার সবুজ আভা চিকমিক করে গেল।

ললিতকে ইচ্ছে করেই একটু উপেক্ষার ভান করে শাশ্বতী। ‘কেমন আছেন! শরীর ভাল তো!’ এ রকম দুটি-একটি মামুলি প্রশ্ন করে সোজা চলে গেল রান্নাঘরের দরজায়। মা’র সঙ্গে বসে গল্প করল অনেকক্ষণ।

চলে যাওয়ার সময়ে ললিত তাকে এগিয়ে দিতে সঙ্গ নেয়। আর তখন দু’জনেরই বড় লজ্জা করতে থাকে। শাশ্বতী রমেনকে বলেছিল, সে যেন ললিতকে বলে যে, শাশ্বতী তাকে ভালবাসে। রমেন সে কথা বলে গেছে। তাই তারা বড় লজ্জা পায়। রমেন বলে গেছে, কিন্তু তারা কেউ পরস্পর পরস্পরকে সে-কথা বলে না।

শাশ্বতী মুখ তুলে প্রশ্ন করে, আপনার সেই সন্ন্যাসী বন্ধু—তিনি কোথায়?

কী জানি!

রমেন বলেছিল, ক্যান্সারের ওষুধ জানে। সে-কথা বিশ্বাস হয় শাশ্বতীর। ক্যান্সারের ওষুধ এখনও বাজারে বেরোয়নি। তা বলে কি নেই? কেউ না কেউ ঠিক জানে। লুকিয়ে রেখেছে। বলছে না। শাশ্বতী এও জানে যে, রমেনই সেই লোক। ঈশ্বর তাকে পাঠিয়েছেন। সময় হলে ঠিক মুহূর্তে সে এসে দেখা দেবে আবার। ভোজবিদ্যার মতো আরোগ্য দান করবে ললিতকে। এ-কথা মুখে বলে না শাশ্বতী। কিন্তু অন্তরের গভীরে সে বিশ্বাস করে। ভীষণ বিশ্বাস করে।

একচল্লিশ

কালীপুজোর রাত্রে খুব অদ্ভুতভাবে মারা গেল বিভু। পাড়ার পুজো। বিকেলে প্রতিমা আনার সময়ে তাদের লরির ধাক্কায় বোসপাড়ার মণ্ডপের একটা স্টিকলাইট ভেঙেছিল। সেইজন্য বোসপাড়ার ছেলেরা আটকে রেখেছিল প্রতিমাসুদ্ধ তাদের লরি। লাইটের দাম না দিলে তারা প্রতিমা ছাড়বে না।

কয়েকটা ছেলে দৌড়ে এসে এ-খবর পাড়ায় রটিয়ে দেয়। শুনে ভীষণ খেপে গিয়েছিল বিভু। বিভু মাস্তান। বস্তুত শহিদ বা সৈন্য কোনওটাই হওয়া যায়নি বলে তার ক্ষোভ নানা দিকে ফেটে বেরোচ্ছিল। তাই সকলের আগে দৌড় দিয়েছিল সে। বোসপাড়ায় যাওয়ার ঘুরপথ একটা আছে। সে-রাস্তায় বিভু যায়নি। সে গিয়েছিল দলবল নিয়ে। মহীনের খাটাল পার হয়ে বস্তি, নালা, মাঠ পেরিয়ে। বোমবাজি আর ছোরার ঝিলিকে বোসপাড়া ম্লান হয়ে গিয়েছিল। খাঁ খাঁ করছিল ওদের মণ্ডপ। আলোজ্বালা শূন্য মণ্ডপে ওদের অসহায় কালী, খাঁড়া তুলে বিভুর মাস্তানি দেখছিল। চল্লিশ-পঞ্চাশ মিনিট তারা দখল করে রইল মণ্ডপ। বোসপাড়ার ছেলেরা ছাদ কিংবা অলি-গলি থেকে কয়েকটা ইট পাটকেল ছুড়ল মাত্র। ওদের ছ’জনকে মাটি নেওয়াল বিভু আর তার দল। বাদবাকিরা পালাল।

ফেরার পথে বিভু রাস্তার আলোর বালব ভাঙতে ভাঙতে এল। তার কচি শাকরেদরা এ-ব্যাপারে নিখুঁত পরিপাটি হাতের কাজ দেখাচ্ছিল। গোটা পাড়া অন্ধকার করে দিয়ে ফাঁকা নিরাপদ কয়েকটা পটকা ফাটিয়েছিল তারা।

অন্ধকারেই ঘটল ঘটনাটা। নিজেদের পাড়ার সীমানায়। অনেক রাতে মণ্ডপের পিছনেই সেই রাতে চমৎকার ভোজ রান্না হচ্ছিল। মাংস আর ভাত। ঝুড়ি ভরতি ছিল বাংলা মদের বোতল। বিভু রাত বারোটার পর খিদে বাড়াতে দুটো বোতল তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিল মণ্ডপ ছাড়িয়ে মহীনের খাটালের পাশে বস্তিতে ঢুকবার কঁচা রাস্তার ধারে, যেখানে একটা নতুন বাড়ি উঠছে। বাঁশের ভারার শেষ ধাপটাতে বসে শান্তভাবে বিভু খাচ্ছিল। নেশা হয়েছিল খুব। দাঁড়িয়ে উঠে সে একটা হাঁক ছেড়েছিল। রুস্তমি হাঁক।

ভয়ে কেঁপে কুঁকড়ে আরও ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল পাড়া।

তারপর সামান্য টলোমলো পায়ে মণ্ডপের দিকে ফিরছিল বিভু।

সামনে রহস্যময় একটা আলো-আঁধারি, দূরে ধূ ধূ করে জ্বলে মণ্ডপের আলো। মাইক্রোফোনে বাজছে হিন্দি গান।

ঠিক এ সময়েই অন্ধকার থেকে একটা বাচ্চা ছেলেকে লাফিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেছিল বিভু। সে সতর্ক হয়নি। হওয়ার কারণও ছিল না। আজ কত ছেলে রাত জেগেছে।

ছেলেটা মুখোমুখি ঠিক ছায়ার মতো এগিয়ে এল। তার ডান হাত পকেটে। তারপরই পকেট থেকে হাতটা বেরিয়ে এল। বিভু কেবল দেখতে পেয়েছিল হাতখানা একটু পিছিয়ে নিয়ে তারপর সামনের দিকে জোর চালাল ছেলেটা। খুব নিখুঁতভাবে নয় অবশ্য। কচি হাতে তেমন জোরও ছিল না।

তবু তখনই বিভু টের পেয়েছিল তার পেটের ভিতর পর্যন্ত ঠান্ডা অবশ করা কঠিন অনুভূতি। প্রথমে ব্যথা লাগে না। ছেলেটা কুঁজো হয়ে তার পেটের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছোরাটা টানার চেষ্টা করল। কিন্তু টেরিলিনের শার্টটা আর ভিতরের গেঞ্জিতে আটকে ছিল বলে ছোরাটা খুব বেশি দূর গেল না। ছেলেটা ছোরার হাতলে জড়ানো রুমালটা দ্রুত খুলে নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

তখন বিভু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল তার পেটের ওপর আলো-আঁধারিতে একটা ছোরার হাতল। খুবই আনাড়ি হাতের কাজ। তবু এও যথেষ্ট।

‘আঁক’ করে একটা শব্দ তুলেছিল বিভু। হাঁটু ভেঙে সামনে পড়তে পড়তে সামলে নিয়েছিল। তারপর মুহূর্তে নিজের সর্বনাশ বুঝতে পেরে কয়েক পা প্রাণপণে দৌড়ে গিয়ে সে চিৎকার করেছিল—বি…শু…

যখন তার শরীর নিয়ে হইরই করছে ছেলেরা, অ্যাম্বুলেন্স ডাক্তার ডাকতে ছুটছে তখন বিভু চোখ বুজে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখতে পেয়েছিল। বেলা শেষের পড়ন্ত আলোয় চষা খেতের ও-পারে লম্বা একটা লাঠি উঁচু করে ধরে একজন মুসলমান লোক তাকে চেঁচিয়ে বলছে—ভাই রে…এ, তুই এঁকে বেঁকে ছোট, এঁকে বেঁকে ছোট…

বস্তুত মৃত্যুর সময়টা বেশ উপভোগই করেছিল বিভু। শেষ পর্যন্ত তার কোনও দুঃখ ছিল না। যতক্ষণ তার জ্ঞান ছিল ততক্ষণ সে জিজ্ঞেসও করেনি, কে তাকে মেরেছে।

পাড়ার ছেলেদের সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে পুলিশ গিয়ে রাত্রে বোসপাড়ার কয়েকটা ছেলেকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিভু-হত্যা-মামলার কোনও কিনারা হয়নি।

কালীপুজোর রাত্রেই খুব জ্বর এসেছিল টুপুর। অন্তত টুপুর তাই মনে হয়। যেদিন সে যে ভয়ংকর কাজটা করেছিল, তারপর অন্ধকারে অনেকটা দৌড়েছিল সে। যদিও এ-পাড়া তার শিশুবয়স থেকে চেনা, তবু সে দিক ঠিক করতে পারছিল না। তার আবছা মনে পড়ে সে বস্তির বাইরের কাঁচা নর্দমা পেরোতে গিয়ে একটা আছাড় খায়। কোনও ব্যথা টের পায়নি, তারপর খাটালের পাশের নাবাল মাঠটা পার হয়। কারও বাগানের বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় ধাক্কা খেয়ে আবার পড়ে যায়। এমন প্রাণভয় সে আগে কখনও বোধ করেনি। বাগানের বেড়ার শব্দ শুনে কুপি হাতে একটা বুড়ো তোক মাঠকোটা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। সেই কুপির আলোতেই টুপু বাগানের এক কোণে কয়েকটা কলাগাছের ঝোপ দেখতে পেয়েছিল। হামাগুড়ি দিয়ে, তারপর বেড়া টপকে সে যখন ঠান্ডা, ভেজা-ভেজা সেই কলাঝোপের ভিতর গিয়ে দাঁড়াল, তখনই টের পেল, তার সমস্ত শরীর হি-হি করে কাঁপছে, গলা শুকনো, বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস শব্দ। হয়তো সেই সময়ে কিছুক্ষণ তার চেতনাও ছিল না। আবার আধচেতনার মধ্যে সে টের পেল, তাকে প্রবল মশা খুবলে খাচ্ছে, পায়ের পাতার ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কেঁচো, কানের কাছে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। তার বড় ভূতের ভয়। তবু সেই অন্ধকারে, বাগানের ঝোপঝাড় দেখেও তার ভূতের কথা মনে পড়েনি। কেবল প্রবল জ্বর আর শীতের ঠকঠকানি টের পেয়েছিল সে।

চারিদিক সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ টের পেয়ে অনেক রাতে কলাঝোপ থেকে বেরিয়ে জ্বর গায়ে বাসায় ফিরল সে। মা জেগে বসে ছিল, বাবাও ঘর-বার করছেন দেরি দেখে। তাঁরা কেউ কিছু বলার আগে সে কোনওক্রমে বলল, আমার বড় জ্বর হয়েছে। আমি শোব।

দেখি। বলে মা গায়ে হাত দিতেই সে ভীষণ চমকে উঠেছিল। তখনও তার প্রতিটি রোমকূপ শিউরে কাঁটা দিয়ে আছে।

সারা রাত তার মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙল। সে এ-পাশ ও-পাশ করে ভাবল, বড় আনাড়ির মতো কাজ হয়েছে। ওই ছুরিটা! এটা তার বন্ধুরা দেখেছে। এখন যদি তারা বলে দেয় এটা টুপুর ছুরি! রুমাল দিয়ে হাতের ছাপ এড়িয়েছে সে, কিন্তু ছুরিটা যে অনেকেই চেনে। তা ছাড়া, বিভু যদি না মরে গিয়ে থাকে! নিশ্চয়ই তাকে চিনেছে বিভু। যদি কাল-পরশু এসে তাকে ধরে! কিংবা মরার আগে যদি পুলিশের কাছে এজাহার দিয়ে যায়!

ভয়ে উঠে বসেছে টুপ। মাকে ডেকে বলেছে, জল দাও।

আবার শুয়েছে। আবার উঠে ডেকেছে মাকে আমি পেচ্ছাপ করতে যাব। আলোটা জেলে দাও।

সকাল হতেই প্রবল ভয় তার কণ্ঠা পর্যন্ত হয়ে এল। এবার! এবার কিছু একটা হবে। সে যত ভাবে ততই তার নিজের ভুলগুলো চোখে পড়ে। দেয়ালির রাতে অনেক লোক জেগে ছিল। তাদের কেউ কি টুপুকে ছুটতে দেখেছে! যদিও তখন বেশি রাতে সব বাড়িতেই প্রদীপের আলো নিভে গেছে, তার ওপর ছিল অমাবস্যা, তবু দেখে থাকা অসম্ভব নয়।

সে বাড়ি থেকে বেরোল না। বলল, জ্বর হয়েছে। কিন্তু তার মা আর বাবা তার গায়ে হাত দিয়ে কিছুই টের পেল না। তারা চুপ করে রইল। ওদিকে পাড়ায় প্রবল উত্তেজনা। কারা এসে বাবাকে ডেকে নিয়ে গেল। কাঠ হয়ে পড়ে রইল টুপু।

বাবা ফিরে এসে হঠাৎ খুব খুশিমুখে মাকে বলল, ওই যে বিভুটা—ওটাকে কাল বোসপাড়ার কোনও ছেলে স্ট্যাব করেছিল। রাত্রেই মারা গেছে।

কয়েক দিন ধরে আস্তে আস্তে টুপু বুঝতে পারল, কেউ তাকে সন্দেহ করছে না। তবু অস্বস্তি বোধ করত সে। খাওয়া হত না, ঘুম হত না। রাস্তায় বা বাড়িতে কেউ তার দিকে তাকালে সে বড় চমকে উঠত।

মাঝখানে সে দিনকতক বেড়িয়ে এল মৃদুলার কাছ থেকে। সেই বেড়ানোটা ভালই লেগেছিল তার। এ-বছর পরীক্ষা হয়ে গেলে সামনের বছর থেকে তাকে পলাশপুরেই ভরতি করা হবে হয়তো। তাই যেন হয়। বেহালায় সম্ভবত আর থাকতে পারবে না টুপু।

কিন্তু আবার আস্তে আস্তে তার মন অন্য দিকে ফিরছে এখন। সে বুঝে গেছে বিভুর মৃত্যুর জন্য বোসপাড়ার ছেলেদেরই সন্দেহ করছে পুলিশ। বোসপাড়ার মারপিট লেগেই আছে। ভদ্রলোকেরা নিষ্ফল নাগরিক কমিটি তৈরি করে শান্তিরক্ষার কথা ভেবে আরও বুড়ো আর অথর্ব হয়ে যাচ্ছে।

বাবাকে আজকাল একটু সজীব দেখায়। এখন বাবা খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সকাল ন’টার রোদে পাড়ার ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলে। নিশ্চিন্ত মনে হাঁটাচলা করে রাস্তায়। বাবাকে আজকাল আর তেমন বুড়ো দেখায় না।

মাঝে মাঝে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে টুপু। দেখে অবাক হয়। তার মুখের মেয়েলি কচি ভাবটা সে আর খুঁজে পায় না।

বড় হয়ে সে কী হবে, এ-কথা ভাবতে গেলে আজকাল সে বিভুর কথাই ভাবে। তবে সে হয়তো বিভুর মতো অসতর্ক আর বোকা হবে না। সে যদি হয়, তবে হবে আরও বুদ্ধিমান এক মাস্তান।

পিতুর মর্নিং স্কুল শেষ হয় প্রায় এগারোটায়। সে সময়ে পিতুর সঙ্গিনীরা প্রায়ই দেখতে পায় স্কুলের সামনেই বড় রাস্তায় একটা সাইড-কার সমেত লাল মোটর সাইকেল থেমে আছে। কালো কিন্তু স্বাস্থ্যবান চেহারার সার্জেন্ট লোকটা চোখে গগলস এঁটে বসে থাকে। মেয়েরা হাসে। পিতুকে ঠাট্টা করে বলে, চিলা চিভা চির?

পিতু একটু রাঙা হয়। কিন্তু গর্বে অহংকারে ময়ূরের মতো পেখম ধরে সে মনে মনে।

শম্ভু আজকাল আর ব্যায়াম করে না। এবার “দক্ষিণ কলকাতাশ্রী” কম্পিটিশনেও সে নাম দেয়নি। আসলে পিতুরই ব্যাপারটা পছন্দ নয়। সে কয়েক বারই বলেছে, শরীরে সাপের মতো মাংস কিলবিল করে—মাগো! ঘেন্না করে আমার। সেই থেকে শম্ভুরও বীতরাগ এসেছে ব্যায়ামে।

প্রথম চাকরি। তাই ভয় করে। নইলে পিতুকে সে মোটর-সাইকেলে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিত। এখন শুধু গলিতে-ঘুঁজিতে একটু আধটু চক্কর দেয়। এগিয়ে দেয় বাস-স্টপ পর্যন্ত। তারপর বিমর্ষ মনে কোনও এক রাস্তার মোড়ে একা একঘেয়ে গাড়ি-ঘোড়া সামলানোর কাজ করে।

কিন্তু পিতুর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। দেখা হতে থাকে।

মাস দুয়েকের মধ্যেই আকাশের শেষ অংশটুকু ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল বিমানের মাথা থেকে। চিন্তাশক্তি ফিরে এল। এখন তাকে হাসপাতালের দালানের বাইরে যেতে দেওয়া হয়। সে মাঝে মাঝে বাগানে চলে আসে। চমৎকার বাগান। ভেজা মাটির গন্ধে বুক ভরে যায়। সে পপি আর চন্দ্রমল্লিকার সারির ভিতর দিয়ে ঘোরে। মালীদের সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলে।

অপর্ণার প্রকাণ্ড গাড়িটা এসে প্রায় রোজই ফুলগাছগুলোর কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। অপর্ণার সঙ্গে বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলে বিমান। আকাশের নীচে। চারদিকে ফুলের আলোর মধ্যে। কত কথা হয়।

আর কিছুদিন মাত্র তাকে রাখা হবে এইখানে। অবজার্ভেশনের জন্য। তারপর বিমানের ছুটি। তখন তারা দু’জনে এক অদ্ভুত স্বর্গ রচনা করবে, এই কথা ভাবে অপর্ণা।

অপর্না মাঝে মাঝে রমেন নামে সেই লোকটির কৃতজ্ঞতা বোধ করে। একদিন নিভৃতে মোটর গাড়িতে বসে সে ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সেই মানুষের কথা যে নিরন্তর সততায় অপর্নাকে রক্ষা করবে। আছে কি তেমন মানুষ! সাধু-সন্নাসীর মতো সেই লোকটা বলেছিল, আছে। বিমান। সেই যে চমকে গিয়েছিল অপর্না, তারপর আজও সে সেই সত্য কথাটা ভুলতে পারে না। সত্য যে, বিমান ছাড়া আর কেউ নেই তার।

অপর্ণা রোজ আসে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে। একদিন এক শীতের বিকেলে অপর্ণা তার প্রকাণ্ড গাড়িখানা নিয়ে হাসপাতাল থেকে তুলে নিল বিমানকে। বলল, আমরা কিন্তু নতুন জায়গায় যাচ্ছি। তুমি আপত্তি করতে পারবে না।

না, বিমান আপত্তি করল না। ছেলেবেলা থেকে সে কখনও সুখের মুখ দেখেনি। সুখকে গ্রাহ্যও করেনি। কিন্তু এখন সে টাকার শক্তিকে অগ্রাহ্য করতে ভয় পায়। তার পুরনো ব্যাধি সেরে গেছে। যেদিন সে দু’জন ছিনতাইবাজের হাত থেকে নিজের ঘড়ি আর মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছিল, সেদিন থেকেই বস্তুত তার এই ব্যাধির সূত্রপাত হয়েছিল। এখন সেই সব পাগলাটে ইচ্ছে তার আর হয় না। অপর্ণার পাঠানো নানা মহার্ঘ ফল ও খাবার, দামি ওষুধ এ-সবের ফলে ব্যাধি সেরে তার শরীর এখন মোটাসোটা, উজ্জ্বল গায়ের রং, মাথার চুল সুবিন্যস্ত, গায়ে ভাল জাতের জামা প্যান্ট। তবে, তাকে কেমন একটু ভিতু, সুখী আর লাজুক দেখায়। তার মাঝে মাঝে মনে হয় সে বোধ হয় আর ইচ্ছে করলেও মাথার ভিতরে আকাশটাকে টের পাবে না। আকাশ চিরকালের জন্য মাথার ওপরে, অনেক ওপরে, সরে গেছে।

মোটর গাড়ির এক কোণে গভীর গদির মধ্যে ডুবে থেকে সে বিকেলের স্নিগ্ধ, নীল সুন্দর আকাশের দিকে নিস্পৃহভাবে একটু চেয়ে দেখল।

চোখ ফিরিয়ে দেখল আকাশি নীল শাড়ি পরেছে অপর্ণা। সামনের দিকে ঝুঁকে ড্রাইভারকে পথের নির্দেশ দিচ্ছে। কয়েক বারই জিজ্ঞেস করেছে বিমান, কোথায় নিয়ে যাবে আমাকে? অপর্ণা তার উত্তর দেয়নি। কেবল রহস্যময়ভাবে হেসেছে।

এখন আর জিজ্ঞেস করছিল না বিমান। যেখানেই হোক, খুব সুন্দর ভাল জায়গাতেই তাকে নিয়ে যাবে অপর্ণা, এ-কথা বিমান জানে। তারপর সেখানেই সে আর অপর্ণা থাকবে সুখে, চিরকাল, যত দিন না অমোঘ বিচ্ছেদগুলি আসে। কিন্তু এখন বিমান কেবল এটুকুই দেখতে পায় যে, অপর্ণার শাড়িখানার আকাশি নীল রংটা বড় সুন্দর। এ-রং অপর্ণাকে মানায়।

আশ্চর্য এই যে, ডাক্তারেরা কত জাদু জানে। কত ভোজবিদ্যা লুকোনো আছে ভাল ওষুধ আর পুষ্টিকর খাবারে। এখন আর কিছুতেই একটা অন্ধকার পৃথিবীর কথা ভাবা যায় না, যে-পৃথিবীতে জন্মান্ধ মানুষেরা হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজছে।

অপর্ণা তার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাসল। আস্তে করে বলল, তোমার মাথার আসলে কোনও গোলমাল ছিলই না, ডাক্তার বলেছে।

কী বলেছে?

বলেছে অপুষ্টি এবং বেশি চিন্তা-ভাবনা থেকে তোমার ও-রকম হয়েছিল। ওটা কিছু না। তুমি একদম সেরে গেছ।

বিমান, সেটা টের পায়। কতক জিনিস আছে যা টের পেতে ভুল হয় না।

অপর্ণা বলল, বাবা রাজি হয়েছেন।

কীসে?

লাজুক হেসে মুখ নামাল অপর্ণা। বলল, তুমি একটুও আমার কথা ভাবো না। ভাবলে বুঝতে পারতে।

বিমান বুঝতে পেরে যায়। সামান্য একটু সুখ এবং দুঃখ সে যুগপৎ বোধ করে। হ্যাঁ, বোধ হয় এখন সে অপর্ণাকে ভালবাসে। এতকাল সেই ভালবাসা সে বুঝতে পারত না।

বুঝতে পেরে নিজেও লাজুক হাসল বিমান। বলল, রাজি হলেন? কী করে!

বাঃ! আমি বাবার এক মেয়ে না! একটাই তো সন্তান আমি। আমার ইচ্ছে না রেখে কি বাবা পারে!

বিমান চুপ করে থাকে।

একটু ইতস্তত করে অপর্ণা বলে, কিন্তু এরপর থেকে তোমাকে ওই বিদঘুটে চাকরি ছেড়ে আমাদের কারখানা-টারখানার ভার নিতে হবে। তুমি আর আমি দু’জনে মিলে চালিয়ে নেব, কী বলো?

বিমান ঘাড় নাড়ে। এখন আর কোনও কাজই তার শক্ত বলে মনে হয় না।

হিন্দুস্থান পার্কে অপর্ণাদের বাড়ির অদূরে একটা সাদা সুন্দর ছোট বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সদ্য রং করা বাড়ি, এখনও এধারে ওধারে কাজ চলছে। অপর্ণা বলল, এটা আমাদেরই একটা বাড়ি। এত দিন ভাড়াটে ছিল।

তারা গেল কোথায়?

তাদের তুলে দেওয়া হল। পুরনো ভাড়াটে কম টাকা দিত। তা ছাড়া ওদের অবস্থাও পড়ে গিয়েছিল।

কী করে তুললে? মামলা করে?

অপর্ণা মাথা নাড়ল, না। তাতে অনেক সময় লাগত। আমরা ওদের কিছু নগদ টাকা দিয়েছি। ঘুষ।

বলে মাথা নিচু করল অপর্ণা। বিমানের সামনে হয়তো এটুকু ওর অপরাধবোধ।

কিন্তু তার দরকার ছিল না। কবিতার আর দর্শনের বই কেনার জন্য বিমানও ঘুষ নিত জমাদারদের কাছ থেকে। মাথা পিছু দশ পয়সা।

মিস্ত্রিদের কাজের তদারক করতে করতে ধুলোবালি আর চুনের গুঁড়ো লাগা চেহারার উঁচু করে পরা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরা অপর্ণার বাবা সদরের সামনে এসে গম্ভীর মুখে ওদের সামনে দাঁড়ালেন।

বিনা দ্বিধায় বিমান এগিয়ে গিয়ে তাকে প্রণাম করল।

যত দূর গম্ভীর দেখাচ্ছিল তাঁকে তিনি আসলে তত দূর গম্ভীর ছিলেন না। তিনি বিমানের মুখে কী একটু খুঁজে দেখলেন। তাঁর হিসেবি চোখ কিছু একটা খুঁজে পেল। পরমুহূর্তেই বিমানের কাধে একখানা হাত রেখে বললেন, এই বাড়ি তোমার।

তারপর একটু থেমে বললেন, শুধু এই বাড়ি কেন, ক্রমে ক্রমে আমার যা আছে সবই তোমার হবে। সব দেখেশুনে নিয়ো।

এই কথা শুনে একটু কুঁকড়ে গেল বিমান। কেন কুঁকড়ে গেল তা সে বুঝতে পারল না তক্ষুনি। কিন্তু অস্বচ্ছভাবে তা হল, কোনও দিনই আর তার দ্বারা কোনও মহান মানুষের জন্ম হবে না।

এক রবিবারের সকালে রিনি আর পিকলুকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে এল সঞ্জয়। ললিতের মাকে ডেকে বলল, চলুন মাসিমা, দক্ষিণেশ্বর, বেলুড়, আর যেখানে যেখানে যেতে চান, সব ঘুরিয়ে আনি। সারা দিনের প্রোগ্রাম।

সঞ্জয় ললিতের মুখের দিকে ভাল করে তাকাল না। লজ্জা পাচ্ছিল বোধ হয়। মা বেরোবার জন্য গোছগাছ করতে রান্নাঘরে গেল, সঙ্গে রিনি। পিকলু ললিতের কোলে বসে দুই স্বাস্থ্যবান হাতে তার মুখে থাবা দিচ্ছিল। সেই সময়ে সিগারেট ধরিয়ে সঞ্জয় জানালার বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। ললিত মনে মনে হাসে! ইচ্ছে করে, উঠে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে একটা ঝাঁকুনি দেয় সঞ্জয়কে। বলে, ইডিয়েট, তোর লজ্জা করে না? সব পেয়েও ফাউ-এর জন্য হাত বাড়াস, ভিখিরি হ্যাংলা কোথাকার!

কিন্তু কিছু বলে না ললিত। অনেক পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় বলে নিজেকে দুর্বল লাগে। বহুকাল আগে, তখনও সঞ্জয় ম্যাকগুইয়ের অ্যান্ড কোম্পানির অফিসার, সে-সময়ে সার্কুলার রোডের একটা বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িতে একটি মেয়ের কাছে মাঝে মধ্যে যেত সঞ্জয়। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, নিখুঁত সম্পন্ন গৃহস্থের মতো সাজানো ড্রয়িংরুম, আলমারিতে রবিঠাকুরের বই, দেয়ালে সুন্দর ছবি, অথচ সেটা প্রকৃতপক্ষে এক বেশ্যার আস্তানা। জোর করে সেখানে একবার সঞ্জয় টেনে নিয়ে গিয়েছিল ললিতকে। ললিত সেই সুন্দর ঘর দেখে অবাক হয়েছিল। মেয়েটিও কুচ্ছিত ছিল না, ছিপছিপে শরীর, টানা চোখ, কথাবার্তা শিক্ষিতার মতোই। মেয়েটি গিটারে তাদের রবীন্দ্রসংগীত শুনিয়েছিল। ললিতের মাথা ঘুরে গিয়েছিল অল্প। তারপর কী হয়েছিল তা ললিত ইচ্ছে করেই মনে না করার চেষ্টা করে। কিন্তু উঠে গিয়ে সঞ্জয়ের চুলের মুঠি ধরার মতো জোর আর সে পায় না। ওই একবার, মাত্র একবার, একটি নীতিবোধহীনতার ঘটনা তাকে সারা জীবন সঞ্জয়ের কাছে দুর্বল করে দিল কি? আশ্চর্য! অতীতের স্খলন, পতন কিংবা দুর্বলতাগুলির স্মৃতিকে জয় করতে না পারলে মানুষ কি আর কোনও দিন সোজা হয়ে দাড়াতে পারে না!

ললিত পিকলুর পেটের মধ্যে মুখ গুঁজে তার শিশুদেহের গন্ধে আর-একবার সেই অতীতের ঘটনাটি ভুলবার চেষ্টা করল।

ওরা চলে গেলে একা একা ঘর পাহারা দিচ্ছিল ললিত। এক ডাঁই পরীক্ষার খাতা খুলে বসে। পুজোর পর থেকেই আবার স্কুলে যাচ্ছে সে। নিয়মিত। একদিনও কামাই করেনি। একসময়ে সে ছাত্রদের পড়া ফেলে রাখত। টাস্ক দিয়ে বসিয়ে রাখত চুপচাপ। পরে টাস্ক দেখত না। ফলে ছাত্রদের পড়া পড়ত বাকি। সে-সব এখন আর করে না সে। খুব মন দিয়ে পড়ায়। আজকাল সে কাজের মধ্যে ডুবে থাকার চেষ্টা করে। স্কুল ম্যাগাজিনটার ভার ইচ্ছে করেই সে নিয়েছে এবার, সামনের সেশনে সে একটা ডিবেটিং ক্লাবও খুলবে।

সিগারেট ধরাতে গিয়ে ললিত দেখে দেশলাই ফুরিয়েছে। মোড় থেকে কিনে আনবে বলে গায়ে জামা দিয়ে বেরোল ললিত। গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় পা দিতেই সে আপাদমস্তক বিদ্যুৎপ্রবাহে কেঁপে উঠল। দেখল, শাশ্বতী আসছে।

মাঝে মাঝেই আসে শাশ্বতী। মায়ের সঙ্গে গল্প করে যায়। কখনও বা স্কুলে ফোন করে ললিতের শরীরের খবর নেয়। তাই, শাশ্বতীর আসাটা তেমন বিচিত্র নয়। কিন্তু আজ! একা ফাঁকা ঘরে শাশ্বতীকে নিয়ে যাবে ললিত! তারা বসবে মুখোমুখি! এই দুরন্ত নির্জন শীতের দুপুরে। কেবল সে আর শাশ্বতী!

গুড়গুড় করে ডেকে ওঠে বুকের ভিতরটা ললিতের। উৎকণ্ঠা, ভয়, উত্তেজনা চেপে রাখতে গিয়ে তার হাসিটা ক্লিষ্ট হয়ে যায়।

আসুন।

শাশ্বতী তার মায়াবী চোখ তুলে সুন্দর হাসে।

ললিত মুগ্ধ হয়।

আজ মা নেই কিন্তু।

কোথায় গেছেন? শাশ্বতী একটু ভ্রূ তোলে।

দক্ষিণেশ্বর, আরও কোথায় কোথায় যাবে। আমার এক বন্ধু গাড়ি করে নিয়ে গেছে।

শাশ্বতী তবু এগিয়েই আসে। ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, কোথায় বেরোনো হচ্ছিল দুপুরে?

ললিত হাসে, দেশলাই নেই। আনতে যাচ্ছিলাম।

শাশ্বতী আবার ভ্রূ কোঁচকায়, সিগারেট খাওয়া কিন্তু বড্ড বেড়েছে। এতটা ভাল নয়।

সেই কাঁপা বুক, ক্লিষ্ট মুখখানা, অস্বস্তি নিয়ে শাশ্বতীকে ঘরে আনে ললিত। সদর দরজাটা হাট করে খুলে রাখে।

বসুন।

কালোর জমির ওপর হলুদ এমব্রয়ডারি করা একখানা রোব ছিল শাশ্বতীর গায়ে। সেখানা খুলে রেখে শাশ্বতী বলে, এতটা হেঁটে এসে গরম লাগছে।

আশ্চর্যের বিষয়, শাশ্বতীর হাবভাবে এতটুকু জড়তা নেই। ওর কি বোধশক্তি কম! ও কি বুঝতে পারছে না যে ললিতের সঙ্গে এই ভয়ংকর দুপুরে ও একা! ঠিক যেন নিজের বাড়িতে এসেছে, এরকমই হাবভাব ওর।

কপালের ঘাম ছোট্ট রুমালে মুছে বলল, কী করছিলেন! ওমা, কত খাতা!

বলতে বলতে ললিতের কাছে উঠে এসে ঝুঁকে খাতাগুলো কৌতূহলে দেখে শাশ্বতী। বলে, ইস! কত ফেল করিয়েছেন! একটুও মায়া দয়া নেই আপনার।

ললিত কাঁপা বুক নিয়ে বসে থাকে। মেয়েরা কত নিঃসংকোচ হতে পারে! সেদিন মিতু এসেছিল; সেও কত নিঃসংকোচে কথা বলল। অত ঘটনার পর ললিত তো মরে গেলেও কোনও দিন কথা বলতে পারত না মিতুর সঙ্গে।

মায়ের বিছানায় পা তুলে, হাঁটু মুড়ে বসে শাশ্বতী মৃদু চিকমিকে হাসি হাসে। অনায়াসে চোখ রাখে ললিতের চোখে। বলে, অনেক হেঁটে এসেছি। একটু চা খাব।

শুনে ললিত উঠতে যাচ্ছিল।

ও কী! কোথায় চললেন?

দোকানে চা বলে আসি।

কেন! অবাক হয় শাশ্বতী, চা আমি নিজেই তৈরি করে খেতে পারব। রান্নাঘরে কোথায় কী আছে আমি তো সব জানি।

অসহায়ভাবে ললিত বসে। চেয়ে থাকে।

হয়তো শাশ্বতী কিছু বুঝতে পারে। মাথা নিচু করে নরম অভিমানী গলায় বলে, আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন?

ললিত ভীষণ লজ্জা পায়। লাল হয়ে কী একটু বলতে যায়। শাশ্বতী বাধা দিয়ে বলে, তা হলে আমি বরং চলে যাই।

কেমন যেন উদাসীন, অভিমানী, দুঃখী শোনাল ওর গলা। ললিতের অন্তর ককিয়ে ওঠে, না। যাবে কেন! গেলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।

কিন্তু সে-কথা বলে না ললিত।

আচমকা তাকে আপাদমস্তক শিহরিত করে শাশ্বতী বলে, তুমি আমাকে অত ভয় পেয়ো না।

ললিত স্তব্ধ হয়ে নিজের রক্তের কলরোল শোনে।

দুরন্ত দুপুর বয়ে যায়।

কত ঘটনাই ঘটে যেতে থাকে পৃথিবীতে!

একদিন অপর্ণা আর তার সঙ্গে ফরসাটে এবং মোটামুটি ভাল চেহারার একজন লোক এসে হাজির। তখন সকালবেলা। অপর্ণা লাজুক মুখে একটু হাসল। সঙ্গের লোকটিও। তারপর লোকটি বলল, আমাদের বিয়ে। নেমন্তন করতে এলাম। যেয়ো। দোসরা ফাল্গুন।

ভীষণ অবাক হয়েছিল ললিত। রেগেও গিয়েছিল, অচেনা উটকো লোকটা তাকে ‘তুমি’ বলায়।

কিছুক্ষণ পরে ভুল ভাঙল। লোকটি যে বিমান— একথা কে বিশ্বাস করবে? তার ইচ্ছে হয়েছিল বিমানের কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দেয়, চোখের তারার গভীরে অনুসন্ধান করে দেখে এই সেই পুরনো বিমান কি না।

বিমানকে দেখে ডাক্তার আর হাসপাতালের ওপর ভক্তি বেড়ে গেল ললিতের। ভক্তি বাড়ল ওষুধের ওপর। আধুনিক বিজ্ঞানের প্রতি সে কৃতজ্ঞতা বোধ করতে লাগল। মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। হে ভগবান, মানুষকে আর-একটু শক্তি দাও। আমি মরার আগেই সে আবিষ্কার করুক ক্যান্সারের ওষুধ।

নেমন্তন্ন করতে এল আদিত্যও। খুব ব্যস্তসমস্ত আর উদভ্রান্ত দেখাচ্ছিল তাকে।

এসে এক গাল হাসল। অমলিন হাসি। সেই আদিত্য, যার গড়ানে মন, সেখানে কোনও জল দাঁড়ায় না। বলল, মাঘের পঁচিশে বিয়ে, বুঝলি! পাত্রী ঠিক করেছেন বাবা। তাকে আমি চোখেও দেখিনি। বাবা দেখার কথা বলেছিল, কিন্তু আমি রাজি হইনি। দেখলুম, বাবার ইচ্ছেমতোই যখন চলব ঠিক করেছি, তখন আর নিজে দেখে কী হবে! নিজে তো আমি কিছুই করতে পারলুম না! জানি তো, সেই মেয়ে টাকার কাঁড়ি আর জিনিসপত্রের জঙ্গল নিয়ে আসছে। বনেদি ঘরের মেয়ে, যার গায়ে রোদ লাগেনি! কিন্তু সেজন্য আর দুঃখ নেই রে। আমি সব ভুলে গেছি। অতীতের সব।

বলে হাসল।

তারা দু’জন এসে বসল গণেশের চায়ের দোকানে। ললিত আর আদিত্য। সেদিনকার মতো বেঞ্চটাতে বসল দু’জন। কেবল মাঝখানে শাশ্বতী ছিল না। হয়তো তারা অনুভব করল সেটা, হয়তো করল না। কিন্তু গোপন এক অপরাধবোধে অস্বস্তি পেতে লাগল ললিত।

আদিত্য আস্তে আস্তে বলল, প্রকৃতি-টকৃতির মাঝখানে তিন মাস কাটিয়ে এলুম বুঝলি! একা থাকতুম একটা বাংলোয়। বাংলোর সামনেই একটা পিপুল গাছ, দুপুরে যখন হু হু করে গরম বাতাস বইত, তখন সেই গাছের ছায়ায় একটা চেয়ার নিয়ে বসতুম। বহুদূর পর্যন্ত ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখা যেত। জীবনে আমি এত দূর পর্যন্ত কমই দেখেছি। তাই নেশা লেগে যেত খুব। মাঝে মাঝে দেখতুম সামনের তিরতিরে নদীটা হেঁটে পার হয়ে বিকেলের দিকে দেহাতি লোকরা দূরের হাটে যাচ্ছে। সঙ্গ ধরতুম তাদের। কিছুতেই কলকাতায় ফিরতে ইচ্ছে করত না। ফেরার কথা ভাবলেই মনে হত, সভ্য জগতে সম্পর্কগুলো বড় জটিল। ফিরলেই আবার সে বনেদি বাড়ির কমপ্লেকস চেপে ধরবে। চেপে ধরবে ব্যর্থতার সব বোধ, হতাশা। তার চেয়ে এখানেই থেকে যাই না কেন! এক-একদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে উঠে বসতুম। কী নিস্তব্ধ লাগত চার দিক। কী উদাসী বৈরাগীর মতো দেখাত মাঠ ঘাট, নদী দূরের পাহাড়। মনে হত এরা আমাকে ভিক্ষা চাইছে। বলছে, দিয়ে দাও। নিজেকে দিয়ে দাও। অমনি রমেনের কথা মনে পড়ত। ইচ্ছে হত, চলে যাই। রমেনের মতো চলে যাই। একদিন হয়তো তাঁকে খুঁজে পাব যে একদিন রমেনকে নিশির ডাকের মতে ডেকে নিয়েছিল। লোলিটা, এক-একদিন আমি চলেও যেতাম। পায়ে পায়ে এগিয়ে নদী পার হতাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পাহাড়ের তলাকার জঙ্গল পর্যন্ত। সেইখানে গাছগাছালির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে বিড় বিড় করে বলতাম, ফিরব না। ফিরব না। কিন্তু যেই সন্ধে হল, অন্ধকারে যখন সব ডুবে যাচ্ছে, অমনি ঘরের জন্য, আলোর জন্য, বিছানার জন্য কেমন অস্থির লাগত। কত বার ভাবতুম, আর মায়ের কাছে টাকা চাইব না, যে-ক’দিন এখানে আছি দেহাতি বস্তি কিংবা এর-ওর-তার কাছে ঘুরে ঘুরে চেয়ে-চিন্তে কাটিয়ে দিই, যেমন ফকির কি সন্ন্যাসীরা করে। কিন্তু হাতের টাকা ফুরিয়ে আসতেই কেমন ধকধক করত বুকের ভিতরটা। ভয় করত বড়। তাই মাকে আবার টাকা পাঠাতে লিখতুম। দ্যাখ, ফিরব না ফিরব না করেও আবার ফিরতে হল। ভালই হল, কী বলিস! সবাই কি আর রমেন হতে পারে!

হাসল আদিত্য।

যাস কিন্তু লোলিটা। পঁচিশে মাঘ। মনে থাকে যেন।

যাব। নিশ্চয়ই যাব।

লোলিটা, পুরনো কিছু মনে রাখিস না।

আদিত্য অস্থিরভাবে মাঘ মাসের প্রতীক্ষা করে আজকাল। রোজই নিমন্ত্রিতের তালিকায় একটু-দু’টি নতুন নাম যোগ করতে থাকে। তালিকা বড় হয় রোজ।

অনেক দিন বাদে নিশ্চিন্তে বাপের বাড়িতে এসেছে মৃদুলা। সঙ্গে তুলসী।

খ্রিস্টমাসের বন্ধটা তারা বেহালায় কাটাবে। খুশিতে ডগমগ করে মৃদুলা। এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। তাদের দুর্গ্রহ কেটে গেছে। একজনের মৃত্যু যে কত আনন্দদায়ক হতে পারে! বুকের চাপ হালকা করে দিতে পারে কতটা।

পলাশপুরে ফিরে যাওয়ার আগের দিন তুলসী দেখা করতে এলে তার মুখে চাপা আনন্দের আভা দেখে একটু অবাক হয় ললিত। বহুকাল ধরে সে তুলসীর এ-রকম তাজা, প্রাণময় মুখশ্রী দেখেনি।

বুঝলি রে, আমার একটা ফাঁড়া খুব জোর কেটে গেছে। বলে তুলসী। তারপর মৃদু মৃদু হাসতে থাকে আপনমনে। বস্তুত এবার বোধ হয় সে মৃদুলাকে পুরোপুরি পাবে। কোথাও আর মৃদুলার কোনও ভয়ংকর দাবিদার নেই।

তুলসীর কাছেই শুনল ললিত, পলাশপুরে কয়েক দিন থেকে আবার কোথায় চলে গেছে রমেন। বলে গেছে, আসবে। কবে আসবে কে জানে! তুলসী ঠোঁট উলটে বলে, ও শালা নৌকো বাঁধে না।

সুবলকে আজকাল আর চেনা যায় না। যাতায়াতের পথে মাঝে মাঝে সুবলকে দেখতে পায় ললিত। হয় গণেশের দোকানের সিঁড়িতে, নয়তো রায়বাবুর শূন্য বারান্দায় বসে আছে। একা একা বিড়বিড় করছে। গালে দাড়ি, রুখু চুল, চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচকে। কখনও তাকে ছেঁড়া পায়জামা আর ময়লা রঙিন শার্ট পরে উদভ্রান্তের মতো ঘুরতে দেখা যায়। আ-ছাঁটা চুল বাবরি হয়ে নামছে ঘাড়ে।

দেখে লুলিত বড় দুঃখ পায়। দেখা হলে সুবল সিগারেট চায়, নয়তো বলে, একটু চা খাওয়াবেন ললিতদা? আগে সুবল ললিতের সামনে সিগারেট লুকোত। কিন্তু সে-সব কথা মনে রাখে না ললিত। মাঝে মাঝে নিজেই ডেকে বলে, নে সুবল, সিগারেট খা। চা খাবি? আর কী খাবি বল!

সুবলের সারাটা দিনই প্রায় কাটে হিন্দুস্থান পার্কের রাস্তায় ঘুরে। দূর থেকে সে অপর্ণাদের বাড়িটাকে দেখে। দেখতে পায় বাড়িটাতে রং করা হচ্ছে। বাঁশের ভাড়ায় উঠে কাজ করছে মিস্ত্রিরা। ওরা অপর্ণার কত কাছে আছে, এই ভেবে সে হিংসা বোধ করে। একা একা বিড়বিড় করে কথা বলে সে, মাঝে মাঝে তার মাথার মধ্যে এক দুর্বোধ্য যন্ত্রণা হয়।

অপর্ণাদের প্রকাণ্ড গাড়িটা তার গা ঘেঁষে রাজহাঁসের মতো মাঝে মাঝে চলে যায়। সুবল দেখে, অপর্ণাদের বাড়িতে অনেক জিনিসপত্র কিনে আনা হচ্ছে। আনাগোনা করছে বহু লোকজন।

কী হবে এ-বাড়িতে? কোন উৎসব?

সুবল তা কিছুতেই ভেবে পায় না।

যাবে। দু’জনের বিয়েতেই যাবে ললিত। সুন্দর উপহার দিয়ে আসবে। জানিয়ে আসবে সত্যিকারের শুভকামনা।

ঘুরে-ফিরে শাশ্বতীর সঙ্গে দেখা হয়। রোজই। যেমন সাধ ছিল ললিতের, ঠিক তেমনি সন্ধেবেলার কলকাতার রাস্তায়, দোকানের আলোতে তারা পাশাপাশি হাঁটে। কখনও বা চুপচাপ বসে থাকে পাশাপাশি। এখন তারা পরস্পর কম কথা বলে। পৃথিবীতে আর কেউ তেমন করে টের পায় কি না কে জানে, তবে তারা যখন পরস্পরের কাছাকাছি থাকে, তখন স্পষ্টই টের পায়, সময় বয়ে যাচ্ছে। সময় বয়ে যাওয়ার কোনও শব্দ নেই, তবু তারা এক রকমের অদ্ভুত শব্দও বোধ করে। সেই ঢিপ ঢিপ শব্দ তাদের নিস্তব্ধতাকে ভয়াবহ করে তোলে।

মাঝে মাঝে শাশ্বতী রমেনের কথা জিজ্ঞেস করে, উনি কোথায় গেলেন? ফিরবেন না?

কে জানে! ঠোঁট ওলটায় ললিত।

মৃত্যুর কথা ভাবলেই পৃথিবীর প্রতি মায়া-দয়া বেড়ে যায়। অন্তরে অন্তরে ললিত মানুষের প্রতি জীবজগৎ ও গাছপালার প্রতি এক দুর্বোধ্য ভালবাসাকে অনুভব করে। এ রকম ভালবাসা সে কখনও টের পায়নি। একদিন সে যখন মানুষের মুক্তির কথা বলত, বিপ্লবের রাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত থাকত, তখনও না। তার মরে যেতে ইচ্ছে হয় না। সে ভাবে, এ-পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য সে একটা কিছু করে যাবে। খুব শিগগিরই করবে। মরে যাওয়ার আগেই।

কিন্তু মরেই কি যাবে ললিত! মাঝে মাঝে এর উত্তর সে খোঁজে শাশ্বতীর মুখে। শাশ্বতী সুন্দর হাসে। নিশ্চিন্ত মুখখানা। যেন সে নিশ্চিত বুঝে গেছে যে ললিত বেঁচে থাকবে, অসুখ সেরে যাবে।

মাঝে মাঝে সে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। কাঠকুড়ুনির মতো কোলকুঁজো মা ঘরের কাজ সারছে। খুটখুট করে ইদুরের মতো শব্দ করছে ঘরময়।

কেমন ছিল মায়ের সেই বয়সের চেহারা যখন ললিত ছিল তার কোলে?

কে জানে! ললিতের কেবল ইচ্ছে করে আর-একবার শিশু হয়ে এই মায়ের কোলে ফিরে আসতে। মাকে আরও কত ভালবাসার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু আচমকা ফুরিয়ে গেল বেলা।

রমেনের সঙ্গে আর দেখা হবে কি তার? সময়মতো রমেন যদি না ফেরে! মরার সময়ে রমেন যদি কাছে থাকে তবে বোধ হয় ললিতের তেমন কোনও কষ্ট হবে না। রমেন তার সুন্দর, শান্ত মুখখানা মুখের কাছে এনে বলবে, আবার আমাদের দেখা হবে ললিত, আবার আমাদের দেখা হবে। সেই গভীর বিশ্বাসের কথা শুনে মৃত্যুপথযাত্রী ললিতের মুখ হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে যাবে আনন্দে।

আসবে কি রমেন? মনে মনে অস্থির হয় ললিত। আকুল প্রতীক্ষা করে। সেই প্রতীক্ষায় তার আয়ু একটু একটু বাড়তে থাকে। অলক্ষে। সে টের পায় না। কিংবা টের পায়। কে জানে!

রাতে মাঝে মাঝে এখনও ঘুম ভাঙে তার। হঠাৎ মনে হয়, কাছেই রমেন বসে আছে। পরমুহূর্তেই ভুল ভাঙে। ললিত পাশ ফিরে শোয়। কিন্তু তার কেবলই মনে হয়, কোথাও না কোথাও রমেন ঠিকই জেগে আছে। পাপ-পুণ্যময় দিনশেষে মানুষ যখন ঘুমোয়, তখন কারও কারও শিয়রের কাছে নিরন্তর জেগে আছে রমেন।

পলাশপুরে এক রাতে মৃদুলার চিৎকারে ঘুম ভাঙল তুলসীর। ভয় পেয়ে উঠে বসল। হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় দেখা গেল মৃদুলা চোখ বড় করে তাকিয়ে ঘন শ্বাস টানছে।

কী হয়েছে মৃদুলা?

দেখো, আমার পেটের মধ্যে কী যেন নড়ছে।

নড়ছে? ভারী অবাক হয় তুলসী, কী নড়ছে?

ভীষণ ভয় করছে আমার। একটু তন্দ্রার মতো লেগে এসেছিল, অমনি হঠাৎ নড়ে উঠল। মৃদুলা ভিতু গলায় বলে।

তুলসীও ভয় পায় প্রথমে। তারপর মৃদুলার পেটের ওপর সে হাত রাখে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। তারপর টের পায়, হঠাৎ টোকা দেওয়ার মতো সেই নড়া, নড়ে ওঠা।

ওই দেখো। মৃদুলা চমকে বলে।

বোধ হয় বাচ্চাটা। তুলসী ফিসফিস করে বলে।

নড়ছে! বাচ্চাটা নড়ছে! ইস, কী রকম যে লাগছে আমার!

তুলসী মৃদুলার পেটের ওপর কান পাতল। অপেক্ষা করল অনেকক্ষণ। আবার সেই নড়ে ওঠা টের পেল। তার শরীর কাঁটা দিল রোমাঞ্চে। কী রকম পোকার মতো নড়ছে! শব্দটা কীসের? ওটা কি ওর হৃৎপিণ্ড, না কি হাত। না কি পা? কে জানে? সে জানান দিচ্ছে যে সে আছে, সে আসছে।

দুঃখময় পৃথিবীতে মানুষ কত পুরনো হয়ে গেল! তবু মানুষের জন্ম এখনও কী রোমাঞ্চকর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *