৪০.
যে যার অস্ত্র বেছে নিন, অ্যালার্মের কর্কশ আওয়াজকে ছাপিয়ে উঠল পিটের চিৎকার, লাথি মেরে খুলে ফেলল গাড়ির দরজা।
দ্বিতীয়বার বলতে হলো না অ্যাডমিরালকে, বগলে টর্চ জে অ্যামুনিশন কেবিনেট হাতড়াতে শুরু করলেন। তোমাদের কি পছন্দ বলছ না যে? পিটের মত তিনিও চিৎকার করলেন।
ছোঁ দিয়ে এক জোড়া কোল্ট কমব্যাট কমান্ডার অটোমেটিক পিস্তল তুলে নিল পিট। ফরটিফাইড অটোমেটিক! ক্লিপ ইজেক্ট করল ও।
সঠিক ক্যালিবার খুঁজে পেতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন অ্যাডমিরাল। পিটের দিকে দুটো বাক্স ঠেলে দিলেন তিনি। উইনচেস্টার সিলভার টিপস। ঘুরলেন অ্যালের দিকে। তোমার কি দরকার?
তিনটি রেমিং-১১০০ শটগান নামিয়েছে অ্যাল র্যাক থেকে। টুয়েলভ গজ, ডাবল-অটো লোড।
সরি, কঠিন সুরে বললেন অ্যাডমিরাল। অল্প সময়ের নোটিসে আমি শুধু নাম্বার-ফোর ম্যাগনাম বাকশট ম্যানেজ করতে পেরেছি। শটগান কেসিঙের কয়েকটা বাক্স ঠেলে দিলেন অ্যালের দিকে। নিচু হয়ে ছুটলেন তিনি, ঢুকে পড়লেন পেইন্ট সেকশনে।
তাড়াতাড়ি করুন, টর্চটা নেভান, তাঁকে সাবধান করল পিট, বেল্টের বাঁট দিয়ে অবশিষ্ট হেডলাইটটাও ভেঙে ফেলল।
ভ্যানগুলো কাছাকাছি দাঁড়িয়েছে, দোকানের ভেতর থেকে লোকগুলোকে দেখতে পাচ্ছে না ওরা। আততায়ীরা নিজেদের গাড়ি থেকে দ্রুত নেমে ছড়িয়ে পড়ল। হার্ডওয়্যারের দোকানের দিকে ছুটে এল না, দাঁড়িয়ে পড়ল।
স্টেশন ওয়াগনে গুলি চালিয়ে আরোহীদের ছাতু বানাবার প্ল্যানটা ভেস্তে গেছে। পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় রণকৌশল বদলাতে হবে ওদেরকে। তাড়াহুড়ো করল না, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করছে।
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ওদের বুদ্ধি ঘোলা করে দিল। পালাবার সময় স্টেশন ওয়াগন থেকে কোন গুলি করা হয়নি, ওরা ধরে নিল প্রতিপক্ষ নিরস্ত্র, কাজেই সিদ্ধান্ত নিল দোকানের দিকে একযোগে ছুটে এসে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলবে।
তবে ওদের টিম লীডার সতর্ক হবার মত বুদ্ধি রাখে। রাস্তার উল্টো দিকের একটা দোরগোড়া থেকে বিধ্বস্ত দোকানটার দিকে তাকিয়ে থাকল সে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। রাস্তার আলো দোকানের ভেতরে খুব কমই ঢুকেছে। স্টেশন ওয়াগনটা ছায়ার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে। কর্কশ অ্যালার্ম বাজছে, ফলে কোন শব্দও শুনতে পেল না সে।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেখছে, এই সময় দোকানের উপর কয়েকট অ্যাপার্টমেন্টের জানালা আলোকিত হয়ে উঠল। এখুনি কিছু একটা করার তাগাদা অনুভব করল সে। বাড়ি-ঘর থেকে লোকজন বেরিয়ে এলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যে-কোন মুহূর্তে পুলিশ পৌঁছে যেতে পারে। আরও একটা ভুল করল সে, স্টেশন ওয়াগনের অন্তত দুএকজন লোক আহত হয়েছে। তার ধারণা হলো, মৃত্যুভয়ে দোকানের ভেতর লুকিয়েছে তারা। দোকানের পিছনে লোক পাঠানো দরকার, এই বুদ্ধিটা তার মাথায় এল না।
দোকানের ভেতর ঢুকে ওদেরকে মেরে ভ্যানে ফিরে আসবে, তিন মিনিটের মধ্যে। সাবধানের মার নেই, রাস্তার আলোগুলো গুলি করে নিভিয়ে দিল সে। বাঁশি বাজিয়ে নিজের লোকদের সঙ্কেত দিল প্রস্তুত হবার, দেখতে হবে সবার ৫,৫৬ মিলিমিটার, ৫১-রাউন্ড সওয়া অটোমেটিক রাইফেলের সিলেক্টর সুইচ যাতে সে পজিশন থেকে সরানো থাকে। এরপর তিনবার বাঁশি বাজাল সে। শুরু হলো হামলা।
ভৌতিক ছায়ার মত নিঃশব্দে দোকানের ভেতর ঢুকল, মোট ছয়জন। ভেতরে পা দিয়েই স্থির হয়ে গেল যে যার পজিশনে, সামনে লম্বা হয়ে আছে মাজল, একদিক থেকে আরেকদিকে দ্রুত ঘুরছে, অন্ধকার ভেদ করতে চাইছে নিস্পলক চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। তারপর হঠাৎ জ্বলন্ত কাপড়ে জড়ানো রঙের একটা প্যাচানো ক্যান উড়ে এসে পড়ল ওদের আর ফুটপাথের মাঝখানে, বিস্ফোরিত হলো নীল ও কমলা শিখা। একই সাথে পিট ও অ্যাল গুলিবর্ষণ শুরু করল, আগুনের দিকে অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ছুঁড়ে দিলেন আরেকটা রঙের ক্যান।
কোল্টটা দুহাতে ধরে গুলি করছে পিট। তাক করছে, তবে সতর্কতার সাথে লক্ষস্থির করছে না। ওর গুলিতে জানালার ডান দিকে দাঁড়ানো তিনজন লোক ধরাশয়ী হলো, কি ঘটছে বুঝতে পারার আগেই। তাদের মধ্যে মাত্র একজনই ক্ষণস্থায়ী এক পশলা গুলি করার সময় পেল বুলেটগুলো সারি সারি ক্যানগুলোকে ফুটো করে দিল, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল তরল রঙ।
অ্যালের গুলি খেয়ে জানালা গলে ফুটপাথে গিয়ে পড়ল এক লোক। বাকি দুজন অন্ধকারে ছায়া মাত্র, তবু রেমিংটন খালি না হওয়া পর্যন্ত থামল না সে। তারপর ফেলে দিল সেটা, লোড করা দ্বিতীয় একটা তুলে নিয়ে বারবার গুলি করল যতক্ষণ না পাল্টা গুলির শব্দ থামল।
দোকানের সামনে আগুন ও ধোয়া দুর্ভেদ্য পাচিল তৈরি করেছে, সেদিকে তাকিয়ে রি-লোড করল পিট। কালো নিনজা আউটফিট পরা খুনীরা পিছু হটে গেছে। মরিয়া হয়ে আড়াল খুঁজছে, নয়তো উঁচু ফুটপাথের নিচে নর্দমার চাকনির উপর শুয়ে পড়ছে। কিন্তু পালায়নি। এখনও দোকানের আশপাশেই আছে তারা, আগের মতই বিপজ্জনক।
আবার একত্রিত হবে ওরা, ফিরে আসবে। তবে এবার আরও সাবধানে। এবার তারা দেখতেও পাবে। দোকানের কাঠের ফ্রেমে আগুন ধরে গেছে, ভেতরটা দিনের মত উজ্জ্বল। গোটা ভবনসহ লোকজন ছাই হতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি।
অ্যাডমিরাল? চিৎকার করল পিট।
এদিকে, জবাব দিলেন স্যানডেকার। পেইন্ট সেকশনে।
এখানে আমাদের মেয়াদ আগেই শেষ হয়েছে। পিছনে কোন দরজা আছে। কিনা দেখবেন, দুৰ্গটা আমি আর অ্যাল পাহারা দিই?
রওনা হয়ে গেছি।
তোমার সব খবর ভাল তো, দোস্ত?
হাতের রেমিংটনটা নাড়ল অ্যাল। ফুটো করার মত কাউকে পাচ্ছি না।
সময় হয়েছে যাবার। মনে আছে, আমাদের একটা প্লেন ধরতে হবে?
রাইট।
লাশগুলোর দিকে তাকাল পিট। ঝুঁকল, হাত বাড়িয়ে একটা মাথা থেকে হুডটা সরাল। আগুনের আভায় জাপানি লাগল চেহারা। হিদেকি সুমা নামটা মনে পড়তেই সারা শরীরে যেন আগুন ধরে গেল ওর।
হঠাৎ অ্যাডমিরাল স্যানডেকার চিৎকার করলেন, এদিকে কাঠ আর তক্তা, মাঝখানে প্যাসেজ। একটা দরজা দিয়ে লোডিং ডকে বেরিয়ে যাওয়া যায়।
খপ করে অ্যালকে ধরে ঠেলে দিল পিট। তুমি আগে যাও, আমি কাভার দিচ্ছি।
রেমিংটন হাতে প্যাসেজ ধরে ছুটল অ্যাল। ঘুরল পিট, শেষবার গুলি করল কয়েকটা। খালি হয়ে গেল অটোমেটিক। পরে লোড করবে ভেবে কোমরে খুঁজে রাখল ওটা, ছুটল দরজার দিকে।
প্রায় দরজার কাছে পৌঁছে গেল পিট। টিম লীডার,নিহত ছয়জনের চেয়ে অনেক বেশি সতর্ক, আগুনের উপর দিয়ে দোকানের ভেতর এক জোড়া স্টান গ্রেনেড ছুঁড়ল, তারপরই গুলি করল এ পশলা। উত্তপ্ত সীসা বৃষ্টির মতো আঘাত করল পিটের চারপাশে।
পরমুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড় দুটো। ব্রাউনস্ এমপোরিয়ামের ক্ষতবিক্ষত হৃৎপিণ্ডের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা-ও এবার ধ্বংস হয়ে গেল। শক ওয়েভের ধাক্কায় ধসে পড়ল ছাদটা, চারদিকে আগুনের ফুলকি ছুটল, আশপাশের প্রতিটি বাড়ির শার্সি ঝন ঝন শব্দে ভেঙে পড়ল। দোকানের ভেতর পুরোটা জায়গা জুড়ে এখন শুধু আগুন ছাড়া আর কিছু দেখার নেই।
পিছন থেকে বিস্ফোরণের ধাক্কা খেল পিট, দরজা দিয়ে কেউ যেন ছুঁড়ে দিল ওকে প্রচণ্ড বেগে। লোডিং ডকে ড্রপ খেল ও, ছিটকে পড়ল সরু গলিতে। রাস্তার ওপর পিঠ দিয়ে পড়ল পিট, ফুসফুস থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেছে। ওখানেই পড়ে থাকল, বাতাসের অভাবে হাঁসফাঁস করছে, ছুটে এসে টেনে তুলল ওকে অ্যাডমিরাল ও অ্যাল। হোঁচট খেতে খেতে তাদের সাথে গলিমুখের দিকে ছুটল ও। পাশেই একটা পার্কের কোণ, ভাঙা পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকল ওরা, কোণাকুণি ছুটে আরেক রাস্তায় বেরিয়ে যাবে।
ইলেকট্রিক তার পুড়ে যাওয়ায় সিকিউরিটি অ্যালার্ম থেমে গেছে। সাইরেনের আওয়াজ পেল ওরা। শেরিফ আর দমকল বাহিনীর লোকজন পৌঁছে গেছে।
পার্কের ভেতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে অ্যাল জিওর্দিনো ঘাড় ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। ভোরের প্রথম আলোয় আশাটাকে ধোয়ায় ঢাকা দেখতে পেল ও।
.
৪১.
লাস ভেগাসে শনিবারের রাত, ঝকমকে রঙিন গাড়ি গিজগিজ করছে বুলেভার্দে। হোটেল আর ক্যাসিনোগুলোয় জমজমাট জুয়ার আড্ডা বসেছে। অ্যাভান্তি-এর সীটে হেলান দিল স্টেসি ফক্স, জানালা দিয়ে নিওন সাইনগুলোর দিকে তাকাল। সত্যি সত্যি হানিমুন ছুটি কাটাতে এলে দারুণ ভাল লাগত, ভাবল সে। কিন্তু এখানে ওরা বিপজ্জনক কাজ নিয়ে এসেছে, সময়টা উপভোগ করার কোন সুযোগ নেই। জুয়া খেলার জন্যে আর যেন কত টাকা আছে আমাদের? জিজ্ঞেস করল সে।
জবাব দেয়ার আগে নতুন স্বামীর ভূমিকায় নিখুঁত অভিনয় করল ওয়েদারহিল, ঝুঁকে আলতোভাবে চুমো খেল স্টেসির গালে। এই ধরো হাজার দুয়েক ডলার। কাগজে-কলমে শুধুচন্দ্রিমা উদযাপন করতে লাস ভেগাসে এসেছে ওরা।
এমন হতে পারে, আমরা শুধু জিতবই? দুহাজার ডলার বাজি ধরলাম, পেলাম ও ছয়হাজার। ছয়হাজার ধরলাম, পেলাম আঠারো হাজার। এভাবে এক সময় দশ লাখ ধরলাম, পেলাম ষাট লাখ?
টাকাটা কে জিতবে? আমি, না তুমি?
এটা আমাদের টাকা। জিতব আমরা দুজনেই।
অসুবিধে আছে, বলল ওয়েদারহিল। অত টাকা জিতলে তুমি আমাকে ভাগ্যবান বলে মনে করবে। মেয়েমানুষের লোভ, ষাট লাখকে ষাট কোটি, তারপর সাত হাজার কোটি করার ইচ্ছেটা সামলাতে পারবে না। অর্থাৎ এই অভিনয়টা চালু রাখতে চাইবে তুমি।
তাতে অসুবিধে কি? আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিলাম। কথা দিচ্ছি, আমাকে বিয়ে করলে সুখীই হবে তুমি।
সুখী হব? কিভাবে? সত্যি সম্ভব নয়। তাহলে প্রস্তাবটা ফিরিয়ে নিলাম।
ড, টিমোথি ওয়েদারহিল গাড়ি-বোমা ভর্তি ট্রেইলার থেকে পালিয়ে আসার পর, তাঁকে ও স্টেসিকে লস এঞ্জেলসে চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন রেইমন্ড জর্ডান। সার্ভেইল্যান্স এক্সপার্টদের আরেকটা টিম দায়িত্ব বুঝে নেয়, কার ট্রান্সপোটারটাকে অনুসরণ করে চলে আসে লাস ভেগাসে। তারা রিপোর্ট করে, প্যাসিফিক প্যারাডাইস হোটেলের রেখে ট্রেইলারটা খালি অবস্থায় ফিরে গেছে।
কাজেই ওয়াশিংটনে বসে রেইমন্ড জর্ডান ও ডোনাল্ড কার্ন টিমোথি ও স্টেসির জন্যে এটা প্ল্যান তৈরি করলেন। সুমার তৈরি অ্যাটম বোমা পরীক্ষা করে দেখার জন্য একটা ওয়ারকন্ডিশনিং কমপ্রেসর চুরি করে আনতে হবে। বোমা অর্থাৎ সেটা দেখে হুবহু ওরকম দেখতে একটা তৈরিও করা হয়েছে। আসলটা বের করে নকলটা তার জায়গায় রেখে আসা হবে।
ওই যে হোটেলটা, বলল ওয়েদারহিল, মাথা ঝাঁকিয়ে বুলেভার্দের দিকটা দেখার স্টেসিকে। বিশাল আলোকমালায় সজ্জিত ভবনটা। নিওন দিয়ে তৈরি একটা পাম গাছ ঘন ঘন জ্বলছে আর নিভছে। নিচে সাঁতার কাটছে একটা সবুজ ডলফিন, তাও নিওনের তৈরি। বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে, জলকেলির জন্যে এমন আদর্শ জায়গা আর হয় না। ভবনের মাথায়, ছাদের উপর, আরেক ধরনের আলোকমালা। আলিঙ্গনে আবদ্ধ একটি পুরুষ ও একটি নারী মূর্তি, সম্পূর্ণ বিবস্ত্র, পরস্পরকে বারবার চুমো খাচ্ছে। হরফগুলো একসাথে জ্বলছে আর নিভছে-প্যাসিফিক প্যারাডাইস হোটেল।
প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ভেতরে ঢুকল ওয়েদারহিল, গাড়ি নিয়ে পাশ কাটাল বিরাট একটা সুইমিং পুলকে। পুলের চারদিকে বনভূমি, ঢাল ও জলপ্রপাত। গোটা হোটেলটাই যেন আফ্রিকার জঙ্গল। জঙ্গলের ভেতরই পার্কিং লট।
হোটেলটার বিশালত্ব উপলব্ধি করে হাঁপিয়ে উঠল স্টেসি। সুমার আর কিছুর দরকার আছে কি?
প্যাসিফিক প্যারাডাইস-এর মত আরও নয়টা রিসর্ট হোটেল আছে তার বিভিন্ন দেশে।
ভাবছি ক্যাসিনোর নিচে চারটি অ্যাটম বোমা আছে শুনলে কি বলবে নেভাডা গেমিং কমিশন।
ভবনের সামনের দরজায় গাড়ি থামাল টিমোথি, ডোরম্যানকে বকশিশ দিল। গাড়ির পিছন থেকে লাগেজ নামাল লোকটা, অ্যাটেনড্যান্ট পার্ক করল গাড়ি। ডেস্কের সামেন দাঁড়িয়ে খাতায় নাম লেখাচ্ছে ওরা, ঠোঁটে মধুর হাসি আর চোখে সুখের নেশা ফুটিয়ে তুলে চেহারায় কনে-কনে ভাব আনার চেষ্টা করল স্টেসি।
নিজেদের কামরায় ঢুকে বেলম্যানকে বকশিশ দিল টিমোথি ওয়েদারহিল, তারপর বন্ধ করে দিল দরজা। এক সেকেন্ড দেরি করল না, সুইকেস খুলে হোটেলের এক স্টে বু প্রিন্ট বের করে বিছানায় মেলল। থার্ড-লেভেল বেসমেন্টের একটা বড় ভল্টে গাড়িগুলো সীল করে রেখেছে ওরা।
একটা প্ল্যানে নিচের বেসমেন্টের পুরোটা দেখানো হয়েছে। সেটার উপর চোখ বুলিয়ে সার্ভেইল্যান্স টিমের রিপোর্টটা পড়ল স্টেসি ডাবল রিএনফোর্সড কংক্রিট, তার উপর ইস্পাতের পাত। বড় একটা ইস্পাতের দরজা, সিলিং পর্যন্ত উঁচু। সিকিউরিটি ক্যামেরা আছে, গার্ড আছে তিনজন, সাথে দুটো ডোবারম্যান। তার মানে, সামনে দিয়ে ঢোকা সম্ভব নয়। ইলেকট্রনিক সিস্টেম যদি অচল করে দিয়ে যায়, কিন্তু শুধু আমরা দুজন গার্ড আর কুকুর দুটোকে সামলাতে পারব না।
ব্লু প্রিন্টের এক জায়গায়, আঙুলের টোকা দিল টিমোথি। ভেন্টিলেটর দিয়ে। ঢুকব আমরা।
ভাগ্য ভাল যে আছে একটা।
রাখতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। ভেন্টিলেশন-এর ব্যবস্থা না থাকলে কংক্রিটের গায়ে ফাটল ধরতে পারে, ক্ষতি করতে পারে হোটেলের ভিতে।
কোত্থেকে শুরু হয়েছে?
ছাদ।
আমাদের সরঞ্জামের জন্যে অনেক দূর হয়ে যায়।
সেকেন্ড আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লেভেল থেকে আমরা একটা ইউটিলিটি রুম। হয়ে ভেতরে ঢুকতে পারি।
চাও আমিও ঢুকি?
মাথা নাড়ল টিমোথি। একা আমি ঢুকব, তুমি থাকবে লাইনের দায়িত্বে।
ভেন্টিলেটর ডাক্ট-এর ডাইমেনশনগুলো পরীক্ষা করল স্টেসি। কোনরকমে ভেতরে হয়তো গলতে পারবে, কিন্তু তারপর আটকে যাবে না তো? আশা করি তোমার ক্লসট্রোফোবিয়া নেই।
.
কাঁধে ব্যাগ, হাতে র্যাকেট, পরনে টেনিস টাস, দেখে বোঝাই যাচ্ছে হোটেলের কোর্টে টেনিস খেলতে যাচ্ছে ওরা। খালি একটা এলিভেটরের জন্যে অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ, তারপর নেমে এল সেকেন্ড-লেভেল পার্কিং গ্যারেজে। ইউটিলিটি রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজায় একটা তালা লাগিয়ে দিল পিট।
কামরার ভেতর বাষ্প ও পানির পাইপ, ডিজিটাল-ডালসহ বিভিন্ন ধরনের ইন্সট্রুমেন্ট রয়েছে, টেম্পারেচার ও হিউমিনিটি মনিটর করে। এক সার র্যাকে ঝাঁটা, ক্লিনিং সাপ্লাই, তার ইত্যাদি দেখা গেল। ব্যাগ ভুলে এরই মধ্যে ইকুইপমেন্টগুলো বের করতে শুরু করেছে স্টেসি। এক প্রস্থ নাইলনে তৈরি স্যুটটা পরে নিল পিট। বড়ি হারনেস ও ডেল্টা বেল্ট বাঁধল কোমরে।
এরপর স্টেসি স্প্রিং-পাওয়ারড পিস্টন টিউবের সাথে জোড়া লাগাল বীনব্যাগ গান নামে একটা ব্যারেল। ওটার সাথে জোড়া লাগাল একটা হেজাগ জিনিসটা অদ্ভুত, চারদিকে গোল বলবেয়ারিঙের মত দেখতে হুইল, মাঝখানে একটা পুলি তিন প্রস্ত নাইলন লাইন খুলে হেজাগ আর বীনব্যাগ গান সংযুক্ত করল স্টেসি।
শেষ বারের মত ব্লু প্রিন্টে চোখ রেখে ভেন্টিলেশন সিস্টেমটা দেখে নিল টিমোথি। ছাদ থেকে নেমে এসেছে খাড়া একটা শ্যাফট, প্রতিটি সিলিং ও পার্কিং এরিয়ার মেঝের মাঝখানে একটা করে ছোট ডাক্ট আড়াআড়িভাবে মিলিত হয়েছে ওটার সাথে। গাড়ি-বোমাগুলো রয়েছে একটা ভল্টে, ওটার দিকে যে ডাক্টটা এগিয়েছে সেটা রয়েছে ওদের পায়ের তলার মেঝে ও নিচের বেসমেন্টের সিলিঙের মাঝখানে।
ব্যাটারি চালিত ইলেকট্রিক করাত দিয়ে শিট-মেটাল দেয়ালে বড় একটা গর্ত তৈরি করল টিমোথি, তিন মিনিট পর ঢাকনিটা সরিয়ে ছোট্ট একটা টর্চ জ্বেলে ডাক্টের ভেতর আলো ফেলল। এক মিটারের মত নেমে গেছে, তারপর বাঁক নিয়েছে ভল্টের দিকে, বলল ও।
তাহলে কত দূরে? জানতে চাইল স্টেসি।
ব্লু প্রিন্টের দেখা যাচ্ছে প্রায় দশ মিটার।
বাঁক নেয়ার সময় যেখানে খাড়া থেকে আড়াআড়ি হয়ে গেছে ডাক্ট, হামাগুড়ি দিয়ে জায়গাটা পার হতে পারবে তুমি?
শুধু যদি দম বন্ধ করে রাখি, সামান্য হেসে জবাব দিল টিমোথি।
রেডিও পেক, বলল, স্টেসি, মাথায় গলাল একটা মিনিয়েচার মাইক্রোফোন ও রিসিভার সেট।
কব্জিতে বাঁধা খুদে ট্র্যান্সমিটার অন করল টিমোথি, মুখের সামনে তুলে ফিসফিস করল, টেস্টিং, টেষ্টিং। আমার গলা শুনতে পাচ্ছ?
পরিষ্কার। আমারটা?
পরিষ্কার।
টিমোথিকে একবার আদর ও আশ্বাসসূচক আলিঙ্গন করল স্টেসি, তারপর ভেন্টিলেটরের দিকে ঝুঁকে বীনব্যাগ গানের ট্রিগার টেনে ধরল। স্প্রিং বহুল পিস্টন অন্ধকারে ছুঁড়ে দিল হেজঅগটাকে, বাঁকের কাছে বাড়ি খেয়ে গতি কমলেও, রোলার বেয়ারিং হুইলগুলো সাবলীলভাবে বাঁক ঘুরতে সাহায্য করল ওটাকে। বাঁক ঘুরে এগিয়ে যাচ্ছে ওটা, কয়েক সেকেন্ড শুনতে পেল ওরা আওয়াজটা, টেনে নিচ্ছে তিনটি নাইলন লাইন। তারপর মৃদু একটা ধাতব শব্দ হলো, তার মানে ভল্টের দেয়ালে লাগানো ফিল্টার স্ক্রীনে ধাক্কা খেল জিনিসটা। এরপর আরেকটা ট্রিগার টানল স্টেসি, এক জোড়া রড হেজঅগ থেকে বেরিয়ে ডাক্টের দুদিকে শক্তভাবে আটকে গেল।
হারনেসে ক্লিপ দিয়ে রশি আটকাল টিমোথি, ছোট টর্চটা খুঁজে নিল কোমরে। ব্যাগ থেকে এয়ারকন্ডিনিং কমপ্রেসরটা বের করল। খাড়া শ্যাফটে ঢুকল ও নিচের দিকে মাথা দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে, মাথার সামনে রয়েছে কমপ্রেসরটা। একটা লাইন শক্ত করে ধরে আছে স্টেসি, একটু একটু করে ছাড়ছে। খাড়া শ্যাপটে জায়গার কোন অভাব নেই, তবে আড়াআড়িভাবে ডাক্টে ঢোকার সময় শরীরটা সাপের মত সংকুচিত করতে হলো টিমোথিকে। চিৎ হয়ে ডাক্টে ঢুকল ও। কব্জিতে বাঁধা রেডিওতে বলল, ঠিক আছে, স্টেসি, টানো এবার।
কেমন লাগছে?
বোকার মত প্রশ্ন কোরো না।
হাতে দস্তানা পরল স্টেসি, নাইলনের একটা রশি ধরে টানতে শুরু করল। রশিটা হেজঅগের গুলিতে জড়ানো আছে, বাধা আছে টিমোথির কোমরের হারনেসে। স্টেসি ওটা টানতে শুরু করায় সরু ভেন্টিলেশন ডাক্ট দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে টিমোথি।
স্টেসিকে সাহায্য করার তেমন কোন উপায় নেই টিমোথির। রশিতে টান পড়ছে, অনুভব করে নিঃশ্বাস ছাড়ল ও। নাইলন স্যুটের ভেতর ঘামতে শুরু করেছ। এরই মধ্যে। হেজঅগ আর পিেন্টলেটর স্ক্রীনে দেখতে পাচ্ছি আমি, আট মিনিট পর রিপোর্ট করল টিমোথি।
আর পাঁচ মিনিট পর ওখানে পৌঁছে যাবে ও। ভল্টে টিভি ক্যামেরা আছে কিনা ব্লু প্রিন্টে তা দেখানো হয়নি, তবু অন্ধকারের ভেতর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকায় ওটার খোঁজে। পকেট থেকে ছোট্ট একটা সেনশন বের করল, লেজার বা হিটসিকিং স্ক্যানার আছে কিনা পরীক্ষা করার জন্যে।
আপনমনে হাসল পিট। ব্যাপক প্রতিরক্ষা ও অ্যালার্ম সিস্টেম সবই ভল্টের বাইরে, ভেতরে কিছুই রাখা হয়নি। অনেক সিকিউরিটি সিস্টেমে এ ধরনের ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়।
স্ক্রীনে ছোট একটা তার বাঁধল টিমোথি, তারপর নিঃশব্দে মেঝেতে নামিয়ে রাখল সেটা। লিভার টেনে হেজঅগের অ্যাংকর প্রং রিলিজ করল, ভল্টে নামিয়ে রাখল নকল কমপ্রেসরের পাশে। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নামল ও, একটা গড়ান দিল কংক্রিটের মেঝেতে। ভেতরে ঢুকছি, স্টেসিকে জানাল শুনতে পাচ্ছি।
বল্টের চারদিকে টর্চের আলো ফেলল টিমোথি। কংক্রিটের চার দেয়ালের ভেতর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি-বোমাগুলোকে ভীতিকর লাগল ওর। দাঁড়াল ও, হারনেসটা খুলে ফেলল। পায়ে বাধা ছোট টুলকিটটা খুলে ফেল্ডারে রাখল। গাড়ির ভেতর কি আছে না দেখেই হুডটা খুলে ফেলল ও।
বম্ব ইউনিটের দিকে তাকিয়ে থাকল টিমোথি, নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে কোডেড রেডিও সিগন্যালের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়। শুধু এটুকুই জানে ও। আকস্মিক নাড়াচাড়ার ফলে ডিটোনেশন মেকানিজম সচল হবে বলে মনে হয় না। সুমার অণু বিজ্ঞানীরা এমন একটা বোমাই তৈরি করবে যেটা খারাপ রাস্তায় গাড়ির ঝাঁকি হজম করার শক্তি রাখে। তবু কোন ঝুঁকি নিতে রাজি নয় টিমোথি, বিশেষ করে ডিভাইন স্টারের বিস্ফোরণের কারণ এখনও যেহেতু জানা যায়নি।
কমপ্রেসর থেকে প্রেশার হোস সরাবার কাজে হাত দিল টিমোথি। তার সন্দেহই সত্যি প্রমাণিত হলো। সাবধানে সংযোগগুলো কাটল টিমোথি, নতুন করে জোড়া লাগাল নকল কমপ্রেসরের সাথে, ওগুলোর সার্কিট না ভেঙে। কমপ্রেসরের মাউন্টিং ব্র্যাকেটে বোল্ট আছে, তবে ওগুলো সময় নিয়ে সরালেও হবে। বোমাটা গাড়ি থেকে বের করে এনেছি, রিপোর্ট করল ও। এবার ওটার জায়গায় আমাদেরটা রাখব।
ছয় মিনিট পর নকল কমপ্রেসর জায়গা মত বসিয়ে সংযোগগুলো জোড়া লাগাল টিমোথি। স্টেসিকে বলল, বেরিয়ে আসছি।
আমি তৈরি।
ভেন্টিলেটরের ফাঁক গলে পিছিয়ে আসছে টিমোথি, হঠাৎ কি যেন একটা দেখতে পেল ও, এতক্ষণে অন্ধকারে চোখে পড়েনি।
কে যেন বসে রয়েছে গাড়িটার সামনের সীটে।
ভল্টের চারদিকে টর্চের আলো ফেলল টিমোথি। এখন চারটে গাড়িতেই ওদেরকে দেখতে পাচ্ছে ও। স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসে আছে। ভল্টটা ঠাণ্ডা, কিন্তু টিমোথির মনে হলো একটা তন্দুরের ভেতর রয়েছে ও। এক হাতে এখনও ধরে আছে টর্চটা, অপর হাতে উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের গাম মুছল। সামনের দিকে বুকিল ও, ড্রাইভারের দিকে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে তাকাল।
হুইলের পিছনে বসা কাঠামোটাকে যান্ত্রিক মানুষ বলা ঠিক হবে না। আবার রোবট বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। তবে আসলে ওটা রোবটই। মাথা মানে কমপিউটরাইজ ভিজুয়াল সিস্টেম, ধাতব একটা শিরদাঁড়ার ডগায় বসানো হয়েছে। আর বুক মানে বাক্স ভর্তি ইলেকট্রনিক্স। থাবা আকৃতির ইস্পাতের হাত তিন আঙুলে ধরে আছে স্টিয়ারিং হুইল। হাত ও পায়ে মানুষের মতই জয়েন্ট রয়েছে, তবে মিল বলতে ওইটুকুই।
প্লীজ রিপোর্ট, আবেদন জানাল স্টেসি, টিমোথির ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে অস্থিরতা অনুভব করছে।
ইন্টারেস্টিং একটা জিনিস পেয়েছি, বলল টিমোথি।
আগে তুমি উঠে এসো, তাগাদা দিল স্টেসি।
লাইন টেনে যেভাবে নিচে নামতে সাহায্য করেছিল টিমোথিকে, সেই একই পদ্ধতিতে লাইন টেনে ওকে উপরে উঠে আসতে সাহায্য করছে স্টেসি। ডাক্ট থেকে শ্যাফটে চলে এল টিমোথি, রশি টানতে নিষেধ করল স্টেসিকে। প্রথমে ভল্ট থেকে হেজঅগটা তুলল, তারপর জায়গামত বসিয়ে দিল স্ক্রীনটাকে। ও এসেছিল, তার কোন প্রমাণ রাখা চলবে না।
আবার লাইন টানতে শুরু করল স্টেসি। অ্যাটম বোমাটা টিমোথির সামনে, সেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, ভাবছে জীবনের মেয়াদ সম্পর্কে।
আমি তোমার পা দেখতে পাচ্ছি, অবশেষে বলল স্টেসি। টিমোথির হাত ও পায়ের পেশী অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছে, পরিশ্রমে ও উত্তেজনায় বুকের ভেতর লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।
হাত বাড়িয়ে পিটের কাছ থেকে বোমাটা নিয়ে ইউনিলিটি রুমে তুলল স্টেসি, নরম একটা কাপড়ে জড়িয়ে রেখে দিল ব্যাগের ভেতর। কামরায় উঠে এসে নাইলন লাইন রিলিজ করল টিমোথি, খুলে ফেলল হারনেস ট্রিগার টেনে হেজঅগের জ্যামিং প্রং রিলিজ করল স্টেসি, লাইন টেনে তুলে নিল ম্যাফট থেকে, রেখে দিল ব্যাগের ভেতর। নাইলন টেনে তুলে নিল শ্যাফট থেকে, রেখে দিল ব্যাগের ভেতর। নাইলন স্যুট খুলে টেনিস সোয়েটার ও শর্টস পরছে পিট, প্যানেলটা রিসীল করার জন্যে ডাক্ট টেপ ব্যবহার করল সে।
কোন ঝামেলা হয়নি? জানতে চাইল টিমোথি।
মাথা নাড়ল স্টেসি। গাড়ি পার্ক করার পর দুএকজন লোক পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে। হোটেল স্টাফরা এদিকে কেউ আসেনি। ব্যাগটার দিকে তাকায় সে, একটা আঙুল তাক করল সেদিকে। ওটার ভেতর অ্যাটম বোমা আছে, না জানলে তুমি বিশ্বাস করতে?
মাথা নাড়ল টিমোথি। করতাম না। ওটার ক্ষমতা জানো? মুহূর্তে গোটা হোটেলটা বাস্প করে দিতে পারে।
নিচে কোন সমস্যা হয়নি? জানতে চাইল স্টেসি।
না। তবে আমাদের বন্ধু সুমার একটা নতুন চমক আবিষ্কার করেছি আমি, বলল টিমোথি, স্যুট আর হারনেস ব্যাগে ভরল। গাড়িগুলোতে রোবোটিক ড্রাইভার রয়েছে। ডিটোনেশন পয়েন্টে দিয়ে যাবার জন্যে রক্ত মাংসের মানুষ দরকার নেই।
বাস্টার্ড! হিসহিস করে উঠল স্টেসি। তার মানে শেষ মুহূর্তে ভাবাবেগে আক্রান্তহতে পারে মানুষ, এ কথা ভেবে কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না সুমা। অকস্মাৎ দলত্যাগী কেউ বোমাটা না ফাটাবার সিদ্ধান্ত নিল, সে-ধরনের কিছু যাতে না ঘটে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা। টার্গেট এরিয়ায় যাবার পথে পুলিশ যদি গাড়িগুলোকে থামায়, জেরা করার জন্যে কাউকে পাবে না তারা।
বোকা হলে কি এতটা পথ পাড়ি দিতে পারত? বলল টিমোথি। নোংরা কাজটা করার জন্যে বোবটাকে কাজে লাগাচ্ছে, সত্যি বুদ্ধি রাখে লোকটা। রোবোটিক্সে গোটা দুনিয়াকে নেতৃত্ব দিচ্ছে জাপান, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এডো সিটির বিজ্ঞানী ও এঞ্জিনিয়াররাই ওগুলোর ডিজাইন তৈরি করছে।
হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে গেল স্টেসির চেহারা। ডিটোনেশন সেন্টারেও যদি মানুষের বদলে রোবট থাকে?
ব্যাগটা বন্ধ করল টিমোথি। সেটা জর্ডানের সমস্যা। তবে আমার ধারণা, ওখানে ঢোকা প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার।
তুমি বলতে চাইছ সুমাকে আমরা ঠেকাতে পারব না? সে তার কমান্ড সেন্টারের বাকি কাজ নির্বিঘ্নে সারতে পারবে? ফাটাবার জন্যে তৈরি করে ফেলবে বোমাগুলো?
সত্যি বোধহয় তাকে ঠেকানোর কোন উপায় নেই, গম্ভীর সুরে বলল টিমোথি। আমরা তাকে নাগালের মধ্যে পাচ্ছি কোথায়?
.
৪২.
ছোট্ট একটা কিমানো পরে আছে তোশি কুদো, কোমরের কাছে ঢিলে করে বাঁধা। স্টীম রুম থেকে বেরিয়ে এল হিদেকি সুমা, বড় একটা নরম তোয়ালে বাড়িয়ে ধরে তার উদ্দেশ্যে মাথা নত করল তোশি। তোয়ালেটা কোমরে জড়িয়ে বালিশবহুল একটা নিচু চৌকিতে বসল উয়ামাদা। হাঁটুগেড়ে নিচু হলো তোইআমা, তার পা টিপতে শুরু করল।
মুরো কামাতোরি বসে আছে কাছাকাছি একটা টেবিলে। তার পরনে ঢোলা আলখেল্লা, রঙচঙে এক ঝাঁক পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে সারা গায়ে। টেবিলে তার উল্টো দিকে বসেছে রয় ওরশিয়া। দুজনেই নিঃশব্দে চুমুক দিচ্ছে চায়ের কাপে। হিদেকি সুমা প্রথমে কথা বলবে, তার অপেক্ষায় রয়েছে ওরা।
কিছুক্ষণ ওদের দিকে তাকালই না সুমা। রাগে ফুলে আছে তার চেহারা। উদ্বিগ্নযৌবনা তোশির উত্তেজক সেবাও তাকে শান্তি দিতে পারছে না আজ। চোখ নামিয়ে রেখেছে মুরো কামাতেরি, সুমার দিকে তাকাচ্ছে না। চলতি হপ্তায় দুবার সুমাকে হতাশ করেছে সে।
তাহলে তোমার টিম ব্যর্থ হয়েছে? অবেশেষে হিসহিস করে উঠল হিদেকি সুমা।
ব্যাপারটাকে আকস্মিক দুর্ঘটনা বলতে হয়, জবাব দিল মুরো কামাতোরি, এখনও টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
আকস্মিক দুর্ঘটনা? ধমকের সুরে বলল সুমা। আমি তো দেখতে পাচ্ছি। সর্বনাশ হয়ে গেছে!
ডার্ক পিট, অ্যাডমিরাল স্যানডেকার আর অ্যাল জিওর্দিনে, তিনজনই ওরা ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছে!
কিসের ভাগ্য! বলো শত্রুপক্ষকে ছোট করে দেখার পরিণতি। কয়জন লোককে হারিয়েছ তুমি
সাতজন, লীডারকে নিয়ে।
আশা করি কেউ ধরা পড়েনি।
লাশ নিয়ে বাকি সবাই ফিরে এসেছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পৌঁছানোর আগেই। এমন কোন সূত্র রেখে আসেনি যার সাহায্যে ধাওয়া করতে পারবে।
কিন্তু তবু রেইমন্ড জর্ডান বুঝতে পারবেন কারা দায়ী, বলল রয় ওরশিয়া।
তাতে উদ্বিগ্ন হবার কিছু নেই, বলল কামাতোরি। তার মেইট টিম এখন আর আগের মত কাজ করবে না। জাপানে তার অপারেশন থামিয়ে দেয়া হয়েছে।
চায়ের বদলে তোশির হাত থেকে সাকি নিল সুমা। রেইমন্ড জর্ডান এখনও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন, তার অপারেটররা যদি আমাদের কমান্ড সেন্টারের অবস্থান জেনে ফেলে।
চব্বিশ ঘণ্টা আগে আমি যোগাযোগ কেটে দেয়ার পর রেইমন্ড জর্ডান ও ডোনাল্ড কার্ন অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছেন, জোর দিয়ে বলল রয় ওরশিয়া। লোকেশন সম্পর্কে কোন ক্লু ওদের হাতে নেই।
কিন্তু আমরা জানি গাড়ি-বোমাগুলো খুঁজে পাবার চেষ্টা করছে ওরা, বলল সুমা।
ধোঁয়ায় ঝাপসা আয়নায় ছায়া দেখে ধাওয়া করছেন রেইমন্ড জর্ডান, নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল কামাতোরি। গাড়িগুলো গোপনে, সুরক্ষিত অবস্থায় লুকানো আছে। খুবই কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে ওগুলো। এক ঘণ্টা আগের খবর জানি আমি, ওগুলোর কাছাকাছি যেতে পারেনি কেউ। যদি ধরেও নেয়া হয় ভাগ্যগুণে দুএকটা গাড়ি-বোমা পেয়ে যাবে ওরা, তারপর বোমাগুলো অকেজোও করতে পারবে, তবু তাতে আমাদের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। দুনিয়ার অর্ধেকটায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক শীল্ড তৈরি করার জন্যে যে-কয়টা দরকার তারচেয়ে অনেক বেশি গাড়ি-বোমা আছে আমাদের।
কেজিবি বা ইউরোপিয়ান কমিউনিটি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিগুলোর তৎপরতা সম্পর্কে রিপোর্ট আছে? জানতে চাইল সুমা।
সম্পূর্ণ অন্ধকারে আছে ওরা, জবাব দিল রয় ওরশিয়া। কারণটা আমরা জানি, না রেই জর্ডান কিছুই ওদেরকে জানাননি।
চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে কামাতোরি, কাপের কিনারা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বন্ধুর দিকে। তুমি তাকে হারিয়ে দিয়েছ, সুমা। আমাদের রোবোটিক টেকনিশিয়ানরা উইপর সিস্টেমে ইলেকট্রনিক্সের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে। শিগগির, খুব শিগগির, এমন একটা পজিশনে পৌঁছে যাচ্ছ তুমি, অধঃপতিত পশ্চিমা দুনিয়াকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিতে পারবে।
সুমার পাথুরে চেহারায় নিমিষের জন্যে সন্তুষ্টির একটু ভাব ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। বেশিরভাগ লোক অগাধ টাকা কামাতে পারলে আর কিছু চায় না, টাকাকেই তারা ক্ষমতা বলে মনে করে, কিন্তু হিদেকি সুমা শুধু টাকা বা টাকার কারণে প্রাপ্ত ক্ষমতায় তৃপ্ত নয়। একচ্ছত্র আধিপত্য চাই তার। চাই গোটা দুনিয়ার ওপর ছড়ি ঘোরাবার ক্ষমতা। আমার মনে হয় এবার সময় হয়েছে, বিদ্রুপাত্মক কৌতুকের সুরে বলল সে অতিথিদের জানানো দরকার কেন তাদেরকে এখানে ধরে এনেছি আমরা।
আপনি যদি বলেন, শ্রদ্ধায় মাথা নত করল ওরশিয়া, হাসছে সে।
নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলেছে লরেন। কিডন্যাপ করার পরপরই তাকে ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। মাত্র দুঘণ্টা আগে ঘুম ভেঙেছে তার। ড্রাগ-এর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে দেখল, দামী আসবাবে সাজানো একটা বেডরুমে রয়েছে সে, সংলগ্ন বাথরুম ও বাথটাব সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরে তৈরি। একটা দেয়াল আলমিরা খুলে দেখল, কয়েকটা সিল্ক কিমোনো ভেতরে, যেন তার মাপেই তৈরি করা হয়েছে। নিচের দেরাজটাও খুলল সে, তারই মাপের ফিমেল আন্ডারওয়্যার রয়েছে বেশ কয়টা, সাথে সান্ডেলও আছে।
গোটা ব্যাপারটা হতবুদ্ধিকর। যারাই তাকে কিডন্যাপ করে আনুক, মেরে ফেলার কোন ইচ্ছে তাদের নেই। অন্তত এখুনি নয়। মন থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বাথটাবের ঠাণ্ডা পানিতে আধশোয়া হয়ে থাকল সে, বিশ মিনিট পর ড্রায়ার-এ চুল শুকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল একগাদা দামী কসমেটিকস ও পারফিউম নিয়ে। সাদা ও রঙিন গোলাপ আঁকা কাপড়ের তৈরি একটা কিমোনো পরল লরেন, এই সময় মৃদু নক করে ভেতরে ঢুকল মুরো কামাতোরি। একটা হাত আলখেল্লার ভেতর ঢুকিয়ে রেখেছে সে।
শরীরের ওপর কিমোনোটা টান টান করল লরেন, কোমরে বেল্ট বাঁধল, তারপর জানতে চাইল, এটাই কি জাপানিদের রীতি? কোন ভদ্রমহিলা না ডাকলেও তার ঘরে ঢুকে পড়বে?
মাফ করবেন, হাসি চেপে বলল কামাতোরি। সম্মানীয় কংগ্রেস সদস্যকে অশ্রদ্ধা করার কোন ইচ্ছে আমার নেই বা ছিল না।
কি চাও তুমি?
আপনি আরামে আছেন কিনা দেখার জন্যে আমাকে পাঠালেন হিদেকি। আমার নাম মুরো কামাতোরি। আমি মি. সুমার বন্ধু, দেহরক্ষী ও সহকারী।
লরেন কঠিন সুরে বলল, আমার ধারণা আমাকে কিডন্যাপ করার জন্যে সেই দায়ী।
আপনার এই অসুবিধে নিতান্তই সাময়িক, কথা দিচ্ছি, বলল মুরো কামাতোরি।
কি কারণ, কেন আমাকে জিম্মি রাখা হয়েছে? প্রতিশোধ ছাড়া বিনিময়ে আর কি আশা করে সে মার্কিন সরকারের কাছ থেকে?
মি. সুমা চান কংগ্রেস ও প্রেসিডেন্টের কাছে আপনি তার একটা মেসেজ নিয়ে যাবেন।
মি. সুমাকে বলো, নিজের রেকটামে চোখা একটা লাঠি ঢুকিয়ে মেসেজটা নিজেই ডেলিভারি দিক।
কৌতুক বোধ করল কামাতোরি। কি আশ্চর্য! সিনেটর ডিয়াজও একই কথা বললেন। তবে তার ভাষায় আরও বেশি ঝাঁঝ ছিল।
সিনেটর ডিয়াজ? ফাটল ধরল লরেনের সাহস ও আত্মবিশ্বাসে। তাকেও তোমরা কিডন্যাপ করেছ?
হ্যাঁ, আপনাদের দুজনকে একসাথে আনা হয়েছে এখানে। হাসছে কামাতোরি।
এখানে মানে কোথায়? তীক্ষ্ণকণ্ঠে জানাতে চাইল লরেন।
জাপানের উপকূল থেকে খানিকটা দূরে, একটা আইল্যান্ড রিসর্টে।
সুমা একটা উন্মাদ।
ঠিক উল্টো, বলল কামাতোরি। তাঁর মত সুস্থ ও ঠাণ্ডা মাথার লোক খুব কমই আছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে কিছু নিয়ম-নীতি ও শর্ত ঘোষণা করবেন তিনি, পশ্চিমা দুনিয়ার কর্ণধাররা তার ওই নির্দেশ মেনে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি পরিচালনা করবেন ভবিষ্যতে।
লালচে হয়ে উঠল লরেনের মুখ। এ দেখছি শুধু পাগল নয়, বোকাও।
মি. সুমা বোকা? তার মতো টাকা দুনিয়ার আর কারও নেই। এত সম্পত্তি ইতিহাসে আর কারও ছিল না। পাগল বা বোকা হলে এসব তিনি অর্জন করতে পারতেন না। শিগগিরই আপনারা উপলব্ধি করবেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ও অর্থনীতির ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে তার। কিমোনোর ওপর ফুলে থাকা লরেনের স্তন জোড়ার ওপর চোখ বুলাল কামাতোরি। নিজের ভাল করবেন, সময় থাকতে যদি তার বন্ধু হবার সুযোগটা হাতছাড়া না করেন। এতদিন আমেরিকার সেবা করেছেন, ভাল কথা; কিন্তু যদি নিজের ভাল চান তাহলে এখন থেকে মি. সুমার সেবা করতে হবে আপনাকে।
লরেন বিশ্বাস করতে পারছে না, এসব প্রলাপ সত্যি সত্যি শুনছে সে, দুঃস্বপ্ন দেখছে না। আমার বা সিনেটর গ্রাফটনের যদি কোন ক্ষতি হয়, তোমাদেরকে চরম মূল্য দিতে হবে। প্রেসিডেন্ট এবং কংগ্রেস…।
মুসলিম টেরোরিস্টরা বহু বছর ধর আমেরিকানদের জিম্মি রাখছে, আপনরা। কিছুই করেননি বা করতে পারেননি, হেসে উঠে বলল বেনামি। আপনাদের প্রেসিডেন্ট জানেন কারা আপনাদেরকে কিপন্যাপ করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত আপনাদেরকে উদ্ধার করার কোন চেষ্টা হয়নি। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, উদ্ধারের কোন চেষ্টা করা যাবে না, মিডিয়াকেও কিছু জানানো নিষেধ।
তুমি মিথ্যে কথা বলছ। আমার বন্ধুরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারেন না।
বন্ধু বলতে কি ডার্ক পিট আর অ্যাফ্রেড জিওর্দিনোকে বঝাচ্ছেন আপনি? জানতে চাইল কামাতোরি।
তুমি তাদের চেনো?
হ্যাঁ, তা বলা যায়। একটা ব্যাপারে নাক গলাতে চেয়েছিল, অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।
ওরা কি আহত? দ্রুত জানতে চাইল লরেন।
ঠিক বলতে পারছি না। শুধু একুটু বলতে পারি, বোধহয় অক্ষত অবস্থায় পালাতে পারেনি।
লরেনের ঠোঁট কাঁপছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তারপর জানতে চাইল, আমাকে কেন? সিনেটর ডিয়াজকেই বা কেন?
জাপানের সাথে সারা বিশ্বের একটা অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বলল মুরো কামাতোরি। আপনারা দুজন সে যুদ্ধের নগণ্য খুঁটি মাত্র। কাজেই মি, সুমা অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত আপনারা মুক্তি পাচ্ছেন না। কেউ জানে না কোথায় আপনারা আছেন। তার মানে কেউ এসে আপনাদেরকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে, সে আশাও ত্যাগ করুন। আমাদের ডিফেন্স সিস্টেম এমনই, কোন সেনাবাহিনীও ভেতরে ঢুকতে পারবে না তবে, সুখবর হলো, পরশুই আপনাদেরকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে প্লেনে করে ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লরেন। তাকে বিস্মিত করাই উদ্দেশ্য ছিল কামাতোরির। আলখেল্লার ভেতর থেকে হাতটা বের করে খপ করে লরেনকে ধরে ফেলল সে, অপর হাত দিয়ে এক টানে খুলে ফেলল কোমরের কাছে কিনোর বধানটা। ধস্তাধস্তি শুরু করল লরেন, কিন্তু ইতোমধ্যে তাকে প্রায় বিবস্ত্র করে ফেলেছে কামাতোরি। গায়ে প্রচণ্ড শক্তি রাখে লোকটা, একটা মেয়ের পক্ষে তার সঙ্গে পারা সম্ভব নয়।
ঠোঁট টিপে হাসল কামাতোরি। সময়টা আপনি যাতে উপভোগ করতে পারেন, সেজন্যে আমার ক্ষমতায় যতটুকু কুলায় সব আমি করব। এমন হতে পারে, আমি হয়তো আপনাকে শেখাব, ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে একটা পুরুষের সাথে পার্থক্য রয়েছে একটা মেয়ের, কথা শেষ করে ঘুরল সে, দরজায় সজোরে টোকা দিল। বাইরে থেকে খুলে গেল দরজা, দ্রুত বেরিয়ে গেল কামাতোরি। লরেন বুঝল, মুক্তি পাবার আগে নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে তাকে।
.
৪৩.
দেখুন এবার, বলে টেবিলের উপর থেকে এক টানে কাপড়টা তুলে নিলেন মেল পেনার, যেন জাদু দেখাচ্ছেন ওদেরকে। সোসেকি আইল্যান্ড, অনেক কাল আগে যেটাকে আজিমা দ্বীপ বলা হত।
টেবিলের উপর মডেলটার দিকে তাকিয়ে থাকল স্টেসি, বলল, অদ্ভুত সুন্দর তো। এত নিখুঁত, দেখে মডেল বলে মনেই হচ্ছে না।
মডেল বানানো আমার হবি, বললেন ডাইরেক্টর অভ ফিল্ড অপারেশনস, মেল পেনার।
টেবিলের উপর ঝুঁকে সাগর থেকে উঠে আসা খাড়া পাহাড় প্রাচীরের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন ড. টিমোথি ওয়েদারহিল। আকারে এটা কত বড়?
চৌদ্দ কিলোমিটার লম্বা, সবচেয়ে চওড়া জায়গাটা পাঁচ কিলোমিটার।
পালউ-এর কোরব দ্বীপে, ছোট্ট একটা বিল্ডিঙে রয়েছে ওরা। দ্বীপটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না স্টেসি। এত সুন্দর লাগছে দ্বীপটাকে, যেন এক টুকরো স্বর্গ।
এক গ্লাস পানিতে লেবু নিঙড়ে চুমুক দিচ্ছে পিট। সুইমিং ট্রাঙ্ক আর নুমা টি শার্ট পরে আছে ও, পায়ে লেদার সান্ডেল। বাইরে থেকে দেখে স্বর্গীয় উদ্যান বলে মনে হলেও, ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটা দানব, মন্তব্য করল ও।
আপনার ধারণা সুমার পারমাণবিক অস্ত্রের গুদাম ওডিটোনেশন সেন্টার এই দ্বীপটার নিচে? প্রশ্ন করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। পাঁচজনের ঘরটায় সবার শেষে যোগ দিয়েছেন তিনি।
সাগর থেকে ওঠা খাড়া পাহাড়গুলোর দিকে তাকাল আবার স্টেসি। জাহাজ ভেড়ার কোন জায়গা নেই। নির্মাণ কাজের সমস্ত উপকরণ আকাশ পথে আনতে হয়েছে ওদের।
কিভাবে তৈরি করল, আমাদের স্পাই স্যটেলাইটকে ফাঁকি দিয়ে? প্রশ্নটা টিমোথি ওয়েদারহিলের।
হাত বাড়িয়ে মডেলের একটা অংশ, খানিকটা সাগর, তুলে নিলেন মেল পেনার। খুদে এটা টিউবের দিকে আঙুল তাক করলেন তিনি। এটা একটা টানেল, ব্যাখ্যা করার সুরে বললেন। এডো সিটির নিচে, পাতালের প্রায় শেষ মাথায়, একটা টানেল তৈরি করেছে সুমার এঞ্জিনিয়াররা। উপকূলের দিকে দশ কিলোমিটার এগিয়েছে ওটা, তারপর আরও পঞ্চাশ কিলোমিটার এগিয়ে সোসেকির নিচে সীফ্লোরে পৌঁছেছে।
সুমার প্রশংসা করতে হয়, বলল পিট। আপনার স্যাটেলাইটে অস্বাভাবিক কোন তৎপরতা ধরা পড়েনি, কারণ এডো সিটি তৈরি করার সময় যে মাটি সরানো হয় তাদের সাথে সারানো হয় টানেল কাটার মাটিও।
পারফেক্ট কাভার, বলল অ্যাল।
এ এক বিস্ময়কর কীর্তি, মন্তব্য করলেন মাইনিং এঞ্জিনিয়ার ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। যদি এদিক থেকে শুরু করা হয়, এ ধরনের একটা টানেল তৈরি করতে কম করেও সাত বছর লাগবে।
মাথা নাড়লেন পেনার। চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করলে, আধুনিক বোরিং ইকুইপমেন্ট ব্যবহার করলে, সুমার এঞ্জিনিয়াররা চার বছরেই শেষ করতে পারবে ওটা। কথা শেষ করে দ্বীপের একটা অংশ তুলে নিলেন তিনি, ভেতরে দেখা গেল গোলকধাঁধার মত অসংখ্য প্রাসেজ আর কামরা। এখানে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, ফ্যাসিলিটির ইন্টেরিয়ন লেআউট। রয় ওড়শিয়ার পাঠানো খসড়া স্কেচ দেখে বানিয়েছি তো, আকার-আকৃতির মধ্যে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। উপস্থিত সবাইকে একটা করে ফোল্ডার দিলেন তিনি। এগুলো এডো সিটি ও কন্ট্রোল সেন্টার-এর প্ল্যান, টানেলটাও দেখানো হয়েছে।
ড্রইং-এর ভাঁজ খুলে লেআউট দেখল সবাই। প্রতিটি প্যাসেজ, শাখা টানেল, ল্যাবরেটরি ইত্যাদির নাম রেখা রয়েছে, মনের পর্দায় গেঁথে নিচ্ছে ওরা।
দ্বীপটার সারফেস থেকে সেন্টারটা বোধহয় প্রায় তিনশো মিটার নিচে, মন্তব্য করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।
স্টেসি বিড়বিড় করল, দ্বীপে কোন এয়ারস্ট্রিপ বা ডক নেই। ঢাকার মাত্র দুটো পথ হেলিকপ্টার, টানেল।
গ্লাসে শেষ চুমুক দিল পিট। তুমি যদি পাহাড় বেয়ে উঠতে পারো, তাহলে সাগরপথেও যাওয়া যায়। তবে সুমার ডিফেন্স সিস্টেম তোমাকে দেখে ফেলবে।
সারফেসে এই বিল্ডিংগুলো কি? জানতে চাইলেন টিমোথি ওয়েদারহিল।
সুমার টপ এক্সিকিউটিভরা ওখানে বিশ্রাম নেয়, বিজনেস কনফারেন্সের আয়োজন করে। রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে গোপন বৈঠকও হয় ওখানে।
শিমজুর পেইন্টিঙে কিন্তু দেখানো হয়েছে দ্বীপটায় কোন গাছপালা নেই, বলল ডার্ক। কিন্তু এখানে দেখছি দ্বীপের অর্ধেকটাই গাছপালার ঢাকা।
সুমার লোকজন গত বিশ বছর ধরে লাগিয়েছে ওগুলো, বললেন মেল পেনার।
চিন্তিতভাবে নাক চুলকাচ্ছন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। সারফেস বিল্ডিং আর কন্ট্রোল সেন্টারের মাঝখানে এলিভেটর নেই?
প্ল্যানে কিছু দেখানো হয়নি, বললেন মেল পেনার।
এই মাপের একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্যাসিলিটিতে আউটসাইড ভেন্টিলেশন থাকতেই হবে।
আমাদের এঞ্জিনিয়াররা সন্দেহ করছে, সারফেসের কয়েকটা বিল্ডিং আছে যেগুলো ভেস্ট ও এগজস্ট ডাক্ট হিসেবে কাজ করছে।
ডাক্ট হলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে দেখতে পারি, হেসে উঠে বলল পিট। আমর অভিজ্ঞতা আছে।
এক্ষেত্রেও, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন মেল পেনার, তেমন কোন তথ্য নেই আমাদের হাতে। এমন হতে পারে, এড়ো থেকে পাম্প করে নিচে পাঠানো হয় বাতাস। দূষিত বাতাস বের করে দেয়া হয় পাইপের সাহায্যে।
আমরা কি জানি, দ্বীপটায় বন্দী করে রাখা হয়েছে লরেন আর সিনেটরকে? জিজ্ঞেস করল পিট।
নিশ্চিতভাবে জানি না, তবে আন্দাজ করা যায়। জায়গটাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ বলে মনে করছে ওরা, আসলেই তাই, কাজেই ওখানেই ওদেরকে রাখার কথা।
এত কথায় কাজ কি, ভেতরে ঢোকার কি প্ল্যান করা হয়েছে তাই বলুন, তাগাদা দিল অ্যাল।
ভেতরে ঢুকে সেন্টারের ইলেকট্রনিক সিস্টেম অচল করে দেয়ার একটা প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। তবে আমরা জানি না কি ধরনের সিকিউরিটি বা মিলিটারি টেকনলজির সাহায্য পাচ্ছে সুমা। ধরে নিচ্ছি, অত্যাধুনিক সেনসরি গিয়ার ব্যবহার করছে সে। ল্যান্ড অ্যান্ড সী ডিটেকশন-এর জন্যে রাডার ইকুইপমেন্ট, আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাপ্রোচ-এর জন্যে সোনার সেনসরপুরোটা তীর ঘিরে লেয়ার ও হিট ডিটেকশন সিস্টেম। সশস্ত্র রোবটও থাকবে।
সারফেস-টু-সী ওসারফেস-টু-এয়ার মিসাইল? পিটের প্রশ্ন।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ করে থাকলেন মেল পেনার।
এ দেখছি বহুত শক্ত নারকেল, ভাঙা অসম্ভব, হতাশ গলায় বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল।
পেনারের দিকে সকৌতুকে তাকাল অ্যাল। আমার তো মনে হচ্ছে, একটা ন্যাভাল ক্যালিয়ার এয়ারক্রাফট, অন্তত পাঁচটা স্পেশ্যাল ফোর্স অ্যাসল্ট টিম আক্রমণ না করলে ওখানে পা ফেলার কোন উপায় নেই।
আরও একটা উপায় আছে, বলল পিট। অ্যাটম বোমা ফেলা।
আমাদের এসব প্রস্তাব যেহেতু প্র্যাকটিক্যাল নয়, সেহেতু আমাদের প্ল্যানটা নিয়েই আলোচনা করা যাক, গম্ভীর সুরে বললেন মেল পেনার।
সেটাই তো জানতে চাইছি, প্ল্যানটা কি? নড়েচড়ে বসল অ্যাল।
কে কে যাচ্ছি আমরা মরতে? জানতে চাইলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। নিশ্চয়ই টানেল দিয়ে যেতে হবে?
আপনারা পাঁচজনই, শান্ত গলায় বললেন মেল পেনার। তবে টানেল দিয়ে নয়।
আমরা কি কালো নিনজা স্যুট পরে টানেলের ভেতর দিয়ে বাদুড়ের মত উড়ে যাব? বলল পিট, ব্যঙ্গটুকু চাপা থাকল না।
আপনি ও মি. অ্যাল আকাশ থেকেই দ্বীপে নামবেন। নামার পর একটা ডাইভারশন ক্রিয়েট করবেন, অপর দলটা যাতে এডো সিটি থেকে ভেতরে ঢোকার সুযোগ পায়।
দোহাই লাগে, প্যারাসুট নিয়ে নামতে বলবেন না, কাতর অনুনয় করল অ্যাল। আমার দুচোখের বিষ।
আচ্ছা! পিট উদ্বিগ্ন। দ্য গ্রেট ডার্ক পিট ও অ্যাল দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সুমার প্রাইভেট রিসর্ট দুর্গে ঘণ্টা, ড্রাম ও বিউগল বাজিয়ে উড়ে যাবে। তারপর সামুরাই স্টাইলে খুন হয়ে যাবে স্পাই হিসেবে ধরা পড়ে। ধরেই নিয়েছেন, আত্মহত্যা করতে রাজি হব আমরা, তাই না, মি, মেল পেনার?
খানিকটা ঝুঁকি আছে, স্বীকার করি আমি, গা বাঁচানোর সুরে বললেন মেল পেনার। তবে আপনাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার কোন ইচ্ছে, আমার নেই।
পিটের দিকে তাকাল অ্যাল। তোমার অনুভূতিও কি আমার মত, আমাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে?
খুঁটি হিসেবে।
পিট জানে ডিরেক্টর অভ ফিল্ড অপারেশনস মেল পেনারের মাথা থেকে প্ল্যানটা বেরোয়নি। প্ল্যানটা তৈরি করেছেন ডোনাল্ড কার্ন, প্রশংসা করেছেন রেইমন্ড জর্ডান, অনুমোদন দিয়েছেন ওঁদের প্রেসিডেন্ট। স্টেসির দিকে তাকাল ও। তার চেহারায় লেখা রয়েছে যেয়ো না। দ্বীপে পৌঁছালাম আমরা, তারপর কি হবে? জানতে চাইল ও।
যতক্ষণ সম্ভব ধরা না পড়ার চেষ্টা করবেন, লুকিয়ে থাকবেন। তারপর আমরা পুরো টিমটাকে তুলে আনার জন্যে একটা রেসকিউ মিশন পাঠাব।
কিন্তু ধরা না পড়ার চেষ্টা সম্ভবত দশ মিনিট সফল হবে।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে মেল পেনার বললেন, কেউ আপনাদের কাছ থেকে মিরাকুলাস কিছু আশা করছে না।
তো? জিজ্ঞেস করল পিট।
তো কি?
আকাশ থেকে পড়লাম আমরা লুকোচুরি খেলোম, এই ফাঁকে তিনজন সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ষাট কিলোমিটার টানেল ধরে ছুটবে? এই আপনার প্ল্যান?
হ্যাঁ। পিটের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছেন মেল পেনার।
আপনারা পাগল নাকি! মুখে যা-ই বলুক, পিট জানে সুমার আস্তানায় পৌঁছানোর সহজ বা নিরাপদ কোন উপায় নেই। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও, ওই দ্বীপে লরেনের থাকার ক্ষীণ সম্ভাবনাও যদি দেখতে পায়, যাবে ও।
অ্যালের জানতে চাইল, মেইনল্যান্ডে আপনারা ওদের পাওয়ার সোর্স বিচ্ছিন্ন করছেন না কেন? তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?
কন্ট্রোল সেন্টার স্বয়ংসম্পূর্ণ, মেল পেনার বললেন। ওদের নিজস্ব জেনারেটিং স্টেশন আছে।
অ্যালের দিকে তাকাল পিট। তুমি কি বলো, অ্যাল দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট?
ওখানে গেইসা আছে?
ক্ষীণ হাসি দেখা গেল মেল পেনারের ঠোঁটে। সুমা সম্পর্কে জানা গেছে, সে শুধু সুন্দরী মেয়েদের কাজ দেয়।
পিট জানতেন চাইল, কিভাবে উড়ে যাব আমরা? যদি আকাশে থাকতেই গুলি খাই?
কোন অসুবিধেই হবে না। পৌঁছানোর অপারেশনটা ষোলো আনা নিরাপদ।
তাই যেন হয়, বলল পিট। তা না হলে যারা এই প্ল্যানটা তৈরি করেছেন, তাদের সাথে আমি দেখা করতে চাইব।
.
৪৪.
মেল পেনার ঠিকই বলেছেন, আকাশ থেকে ওদেরকে গুলি করে নামাবার প্রায় কোন সম্ভাবনাই নেই। ইউএস নেভির ডিটেকশন অ্যান্ড ট্র্যাকিং শিপ রালফ আর. বেনেট এর ল্যান্ডিং প্যাড থেকে আলট্রালাইট পাওয়ার গ্লাইডার নিয়ে আকাশে উঠবে ওরা। গ্লাইডারগুলো কালো রঙ করা, আকৃতিও অদ্ভুত, ফলে রাডারে ধরা পড়বে না।
জাহাজটার রাডার সিস্টেম ছয়তলা উঁচু, অ্যান্টনার সংখ্যা আঠারো হাজার। রাডারের আসল কাজ রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের মিসাইল টেস্টের ইন্টেলিজেন্স ডাটা সংগ্রহ করা। প্রেসিডেন্টের নির্দেশে কামছাইকা পেনিসুলা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে রালফ আর. বেনেটকে। ওটার নতুন মিশন, পাওয়ার গ্লাইডার পাঠানো এবং সোসেকি দ্বীপের চারধারে কি ঘটছে তা মনিটর করা।
খোলা ডেকে নুমার দলটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রেইমন্ড সিম্পসন। শক্ত-সমর্থ গড়ন, কঠিন চেহারা, বয়েস তবে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ। মেইন্টেন্যান্স ক্রুদের ওপর কড়া নজর রাখছেন তিনি। ক্রুরা খুদে প্লেনটার ফুয়েলিং ট্যাঙ্কের চারধারে ব্যস্ত, চেক করছে ইন্সট্রুমেন্ট ও কন্ট্রোল।
টেস্ট ফ্লাইট ছাড়া ম্যানেজ করতে পারব বলে মনে করেন? জিজ্ঞেস করল পিট।
অনায়াসে। আমাকে বলা হয়েছে, দুজনই আপনারা দক্ষ পাইলট। উপুড় হয়ে শুয়ে হাসলেন লে. ক, রেইমন্ড সিম্পসন।
আগে কখনও আলট্রালাইট এয়ারক্রাফট দেখেনি পিট। এক ঘণ্টা হলো জাহাজটায় ল্যান্ড করেছে ওদের টিল্ট-রোটর প্লেন। তার মধ্যে চল্লিশ মিনিট ক্লাস করতে হয়েছে। এই চল্লিশ মিনিটে যা কিছু শিখেছে তাই সম্বল করে একশো কিলোমিটার উড়ে যেতে হবে ওদেরকে, আহত না হয়ে ল্যান্ড করতে হবে বিপজ্জনক পাহাড়বহুল সোসেকি দ্বীপে।
বিদঘুটে এই পাখিগুলো কদ্দিন হলো বাজারে এসেছে? জানতে চাইল অ্যাল।
নাম হলো আইবিস এক্স-টোয়েনটি, শুধরে দেয়ার সুরে বললেন রেইমন্ড সিম্পসন। বাজারে ছাড়া হয়নি, এখনও এক্সপেরিমেন্টাল।
ওহ্ গড! গুঙিয়ে উঠল অ্যাল। তার মানে নিরাপদ কিনা বলার উপায় নেই।
ও গুলোর টেস্টিং প্রোগ্রাম এখনও শেষ হয়নি। দুঃখিত, আরও ভাল কিছু অফার করতে পারছি না আমরা। ওয়াশিংটন কর্তৃপক্ষ জরুরি তাগাদা দিলেন, আঠারো ঘণ্টার মধ্যে দুনিয়ার অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ডেলিভারি দিতে হবে ওগুলো।
ও গুলো উড়ে, স্বভাবতই? জিজ্ঞেস করল পিট।
কি যে বলেন! উড়বে না কেন! আমি নিজে দশ ঘণ্টা উড়েছি। সুপার এয়ারক্রাফট। ওয়ান-ম্যান রিকন্ডিশন ফ্লাইটস হিসেবে ডিজাইন করা হয়েছে। অত্যাধুনিক টারবাইন এঞ্জিনের সাহায্যে চলে, স্পীড প্রতি ঘণ্টায় তিনশো কিলোমিটার, রেঞ্জ একশো বিশ কিলোমিটার। দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নতমানের পাওয়ার গ্লাইডার আমাদের এই আইবিস।
অবসর নেয়ার পর আপনি হয়তো ডিলারশিপ খুলে বসবেন, শুকনো গলা বলল অ্যাল।
জ্বী? তাঁকে যে মৃদু খোঁচা মারা হয়েছে, বুঝতে সময় নিলেন লে. ক. সিম্পসন।
রাডার শিপ-এর স্কিপার, কমান্ডার হারপার, সিঁড়ি বেয়ে ল্যান্ডিং প্যাডে নেমে এলেন, হাতে বড় একটা ফটো। ভদ্রলোক দীর্ঘদেহী, মাংসল, ভুড়ি বিশিষ্ট। আমাদের আবহাওয়া অফিসাররা জানিয়েছেন, ফ্লাইটের সময় ফোর-নই টেইল উইন্ড পাবেন, কাজেই ফুয়েল কোন সমস্যা হবে না।
ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকিয়ে পিট বলল, স্যাটেলাইট থেকে যদি নিরাপদ একটা ল্যাণ্ডিং সাইট পেতাম, ভাল হত।
একটা বাল্কহেডের গায়ে স্যাটেলাইট ফটোটা মেলে ধরলেন স্কিপার। পেয়েছেন। একটা দ্বীপটায় ঘাসে ঢাকা সমতল জায়গা বলতে এই একটাই, ষাট মিটার লম্বা ও বিশ মিটার চওড়া।
সরে এসে ফটোর দিকে ঝুঁকল পিট ও অ্যাল। ফটোয় চারকোণা লন দেখা যাচ্ছে, মাঝখানে একটা বাগান, শুধু পূর্ব দিকে খোলা। বাকি তিনটে দিক ঘন গাছপালা ও প্যাগোড়া ধাচের ছাদসহ বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। বিল্ডিংগুলোর ঝুল বারান্দা থেকে খোলা ব্রিজ নেমে এসেছে একটা পুকুরে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মত পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আড়ষ্ট হাসল পিট ও অ্যাল।
উদ্ধার টিম না পৌঁছানো পর্যন্ত লুকিয়ে থাকুন, বিড়বিড় করল অ্যাল।
হুম। পৈতৃক প্রাণটা না এবার হারাতে হয়। পিট গম্ভীর।
কমান্ডার হারপারের চেহারায় অস্বস্তি। আপনারা কি অপারেশনটা বাতিল করতে চান?
প্রশ্নটা ওঠে না, তাড়াতাড়ি বলল পিট।
আপনাদেরকে তাগাদা দিতে চাই না তবে আর মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে সূর্য ডুবে যাবে। পথ চিনতে হলে দিনের আলো দরকার হবে আপনাদের।
এই সময় ক্রুদের চীফ এগিয়ে এসে জানাল, পাওয়ার গ্লাউড়ার আকাশে ওড়ার জন্যে সম্পূর্ণ তৈরি। ভঙ্গুর ভোট এয়ারক্রাফটার দিকে তাকাল পিট। টারবাইন এঞ্জিনের জোরালো ধাক্কা না পেলে ঠিক একটা ইটের মত খসে পড়বে ওটা।
প্রিফ্লাইট চেক শেষ করে ল্যান্ডিং প্যাড থেকে নেমে একপাশে দাঁড়াল ফ্লাইট ক্রুরা। গুড লাক, বললেন স্কিপার হারপার, হ্যান্ডশেক করলেন ওদের সঙ্গে। পুরোটা পথ আপনাদেরকে মনিটর করব আমরা। ল্যান্ডিং করার পর সিগন্যাল ইউনিট অ্যাকটিভেট করতে ভুলবেন না। আপনারা নিরাপদে নামতে পেরেছেন, ওয়াশিংটনকে রিপোর্ট করতে চাই আমরা।
গুড বাই। অনেক করেছেন, সেজন্যে আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
পিটের কাঁধে হাত রাখল অ্যাল, উৎসাহ দেয়ার ছলে চোখ মটকাল, আর কোন কথা না বলে এগিয়ে গেল নিজের এয়ারক্রাফটের দিকে।
পিট ওর গ্লাইডারে উঠল নিচের দিক থেকে, সরু একটা হ্যাঁচ গলে। ফোম রাবার প্যাডে পেট দিয়ে শুয়ে পড়ল ও। পা দুটোর চেয়ে সামান্য একটু উঁচুতে রয়েছে কাঁধ ও মাথা, কনুই দুটো মুক্ত অবস্থায় ঝুলছে মেঝে থেকে এক সেন্টিমিটার উপরে। সেফটি হারনেস আর বেল্ট অ্যাডজাস্ট করল ও। তারপর ভার্টিকাল স্ট্যাবিলাইজার ও ব্রেক পেডালের গ্লিপ-এর পা ঢোকাল, এক হাতে ধরল কন্ট্রোল স্টিক, অপর হাতে অ্যাডজাস্ট করল কন্ট্রোল সেটিং।
উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে ক্রুদের দিকে তাকাল পিট, কেবল রিলিজ করার জন্যে অপেক্ষা করছে তারা। স্টার্টার এনগেজ করল ও। সচল হলো টারবাইন। অ্যালের দিকে তাকাল। শুধু তার চোখ দুটো দেখতে পেল। বুড়ো আঙুল খাড়া করে সঙ্গেত দিল পিট, উত্তরে অ্যালও আঙুল খাড়া করল।
ইঙ্গিতে টাই-ডাউন কেবল রিলিজ করতে বলল পিট। তারপর ফুল স্টপে সরিয়ে আনল থ্রটল। জোরাল বাতাস আর টারবাইনের শক্তি পেয়ে কাঁপতে শুরু করেছে আইবিস। ব্রেক রিলিজ করল ও, তাকিয়ে আছে ল্যান্ডিং প্যাডের শেষ মাথার দিকে। লাফ দিয়ে ছুটল আইবিস। একটু পর ধীরে ধীরে কন্ট্রোল স্টিক পিছিয়ে আনল ও। গ্লাইডারের ছোট্ট নোজ হুইল প্যাড ছেড়ে শূন্যে উঠে পড়ল, সামনে মেঘ দেখতে পেল পিট।
চল্লিশ মিটার উঠে আইবিসকে সিধে করে নিল ও, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল অ্যালের দিকে। ওর পিছনেই রয়েছে সে। দুজনেই জাহাজটাকে ঘিরে একটা চক্কর দিল, হাত নাড়ল ক্রু ও অফিসারদের উদ্দেশে। তারপর কোর্স স্থির করে রওনা হলো সোসেকি দ্বীপের দিকে। নিচে অশান্ত প্রশান্ত মহাসাগর।
পিটের ইচ্ছে হলো আকাশের আরও অনেক উপরে ওঠে যায়, দুএকটা ডিগবাজি খায়, মজা করে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। যে-কোন অস্বাভাবিক নড়াচড়া জাপানিদের রাডার স্ক্রীনে ধরা পরে যেতে পারে। আইবিসকে সোজা ও সরল একটা রেখায় রেখে, ঢেউয়ের মাথা ছুঁয়ে এগোলে, ধরা পড়ার কোন আশঙ্কা নেই।
এতক্ষণে ভাবতে শুরু করল পিট, দ্বীপে পৌঁছানোর পর কি ঘটবে। ভবনগুলোর উঠান থেকে পালানোর সুযোগ খুবই কম। কি একটা সেট-আপ, ভাবল ও। সুমার উঠান ক্র্যাশ ল্যান্ড করো, তার সিকিউরিটি ফোর্সের চোখে ধরা পড়ো, তা না হলে দ্বিতীয় দলটা ওদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারবে না।
নেভিগেশনে মন দিল পিট, একটা চোখ রাখল কম্পাসে। গতি বজায় রাখতে পারলে পঁয়ত্রিশ মিনিট পর দ্বীপে নামবে ওরা। তবে দুএক ডিগ্রী এদিক ওদিক হয়ে গেলে দ্বীপটাকে খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে।
সাতাশ মিনিট পর, দিগন্তরেখায় খিলান আকৃতির আংশিক সূর্য দেখা যাচ্ছে উইন্ডস্ত্রীনের ভেতর দিয়ে সামনে তাকাল পিট।
কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে সাগর আর আকাশের মাঝখানে লালচে-বেগুনি একটা ছায়া যতটা না বাস্তব, তার চেয়ে বেশি কল্পিত। ধীরে ধীরে একটা দ্বীপের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠছে। এবড়োথেবড়ো পাহাড়-প্রাচীন অশান্ত সফেন সাগর থেকে খাড়া উঠে এসেছে।
মাথা ঘুরিয়ে পাশের জানালা দিয়ে তাকাল পিট, ওর ডান দিকেও খানিকটা পিছনে রয়েছে অ্যাল। একটা হাত তুলে দ্বীপটার দিকে ইঙ্গিত করল সে।
ইন্সট্রুমেন্ট চেক করে নিল পিট, তারপর আইবিসকে কাত করে দিক পরিবর্তন করল, পূর্ব দিকের অন্ধকার হয়ে আসা আকাশ থেকে বেরিয়ে এল দ্বীপটার মাঝখানে। নিচের মাটি খুঁটিয়ে দেখার জন্যে চক্কর দেয়া যাবে না। বিস্ময় ওদের একমাত্র বন্ধু। প্রথম সুযোগেই ছোট্ট আইবিসকে বাগানে নামাতে হবে, সারফেস-টু এয়ার মিসাইল আঘাত করার আগেই।
প্যাগোডা আকৃতির ছাদগুলো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পিট, দেখতে পাচ্ছে বাগানটাকে ঘিরে থাকা গাছপালার পাঁচিলে একমাত্র ফাঁকটা। একটা হেলিকপ্টার প্যাড দেখল ও, মেল পেনারের মডেলে ছিল না। প্যাডটা সম্ভবত। পরিত্যক্ত, কারণ আকারে খুব ছোট মনে হলো, চারপাশে প্রচুর গাছ।
কব্জি ঘুরিয়ে আইবিসকে একবার ডানে, পরমুহূর্তে বাম দিকে যোরাল পিট। নিচে ঝাপসা লাছে সাগরটাকে। আকাশ ছোঁয়া পাহাড়-প্রাচীরগুলো ছুটে আসছে, দ্রুত ঢেকে ফেলছে উইন্ডস্ক্রীন। স্টিক খানিকটা পিছিয়ে আনল পিট। তারপর হঠাৎ যেন ওর নিচে থেকে চাদর সরিয়ে নেয়া হয়েছে, অদৃশ্য হলো সাগর, আইবিসের হুইল কঠিন আগ্নেয় শিলার মাত্র কয়েক মিটার উপর রয়েছে।
ল্যান্ডিং গিয়ারের টায়ার কয়েকটা ঝোঁপের ডগা ছুঁয়ে দিল। থ্রটল পিছিয়ে আনল পিট। স্টিক সামান্য একটু টানল। ল্যান্ডিং হুইল ঝাঁকি খেল হালকাভাবে স্পর্শ করেছে লন, একটা ফ্লাওয়ার বেড-এর কিনারা থেকে পাঁচ মিটার দূরে।
এঞ্জিন বন্ধ করে ব্রেকে চাপ দিল পিট। গতি কমছে না। লনের ঘাস ভিজে আছে, চাকাগুলো হড়কে যাচ্ছে যেন তেলের উপর।
সামনে এক সারি গাছ। তারপর কি আছে পিট দেখতে পাচ্ছে না। এভাবে ছুটতে থাকলে গাছের সাথে ধাক্কা লাগবে। আর ধাক্কা লাগলে বাঁচার কোন আশা নেই। আইবিসের নাক থেকে পিটের দূরত্ব মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার। আড়ষ্ট হয়ে উঠল পিটের শরীর। ঝোঁপ ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ল আইবিস, এখনও ঘণ্টায় ত্রিশ কিলোমিটার গতি। ডানায় লেগে ঝোঁপের ডালপালা ভাঙছে, ছড়িয়ে পড়ছে, চারদিকে। কয়েকটা গাছকে পাশ কাটিয়ে ডাইভ দিল আইবিস, সরাসরি ঝপাৎ করে পড়ল একটা পুকুরে।
কয়েক সেকেন্ড কোন শব্দ নেই আর। তারপর শোনা গেল একই ধরনের আরও একা ডাইভ দেয়ার শব্দ। পাশে এসে থামল অ্যালের আইবিস। ব্যস্ত হাতে হারনেস খুলে ফেলল পিট। মাথাটা অর্ধেক ডুবে আছে পানিতে, শ্বাস ফেলার জন্যে কাত করে রেখেছে সেটা। অ্যালের ফিউজিলাজের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি, আইবিস থেকে প্রায় অনায়াসে বেরিয়ে এল সে। কাদা আর পানির উপর দিয়ে পিটের সাহায্যে এগিয়ে আসছে।
দুজন একসাথে পুকুরের কিনারায় উঠল। কোথাও লেগেছে? জানতে সাহায্যে করার জন্যে ধন্যবাদ।
বিল পাঠিয়ে দেব, বলল অ্যাল, কাদা ভর্তি বুট জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে
হেলমেট খুলে পুকুরে ফেলে দিল পিট, তাকাল দোমড়ানো-মোচড়ানো আইবিসের দিকে। যে-কোন মুহূর্তে ধাওয়া শুরু করবে ওরা। সুইচ টিপে সিগন্যাল পাঠাও। প্লাস্টিক এক্সেপ্লোসিরে টাইমারও সেট করো। জলদি।
রালফ আর বেনেটে সঙ্কেত পাঠাল অ্যাল, নিরাপদে পৌঁছেছে ওরা। তারপর আইবিসে রাখা প্লস্টিক এক্সপ্লোসিভের প্যাকেট খুলে টাইমারের কাটা ঘোরাল।
সামান্য খোঁড়াচ্ছে পিট, বাগানে ঢুকে এদিক-ওদিক তাকাল। চারদিকে কোন মানুষ জন নেই। সশস্ত্র লোকজন বা রোবোটিক প্রহরীরা উদয় হয়নি। বিল্ডিংগুলোর বারান্দা ও জানালায় প্রাণের কোন লক্ষণ নেই। টারবাইন এঞ্জিনের গর্জন বা ঝপাৎ করে ডাইভ দেয়ার আওয়াজ কেউ শুনতে পায়নি, এ অবিশ্বাস্য। আশপাশে মানুষ না থেকে পারে না, অন্তত বাগানের মালিরা তত থাকবে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ফুলগাছের নিয়মিত যত্ন নেয়া হয়।
গা ঢাকা দেয়ার জন্যে দুমিনিট সময় দিলাম তোমাকে, ফিরে এসে বলল পিট। তারপরই ফাটবে ওগুলো।
বনভূমির দিকে ছুটল পিট। আমি লুকাচ্ছি।
হঠাৎ একটা ইলেকট্রনিক কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে স্থির হয়ে গেল পিট। ওখানেই দাঁড়াও।
দাঁড়াল বটে পিট, তবে আধ সেকেন্ডের জন্যে। বিদ্যুৎগতি প্রতিক্রিয়া হলো, স্যাৎ করে ঢুকে পড়ল একটা ঝোঁপের ভেতর, দেখাদেখি অ্যালও। এক ঝোঁপ থেকে আরেক ঝোপে সরে যাচ্ছে ওরা, অচেনা শত্রুর কাছ থেকে যতটা দূরে সরে পরা যায়। মাত্র পঞ্চাশ মিটারের মত এগিয়েছে, সামনে হঠাৎ একটা উঁচু বেড়া দেখতে পেল, গায়ে-মাথায় ইলেকট্রিফায়েড তার আর ইনসুলেটর গিজগিজ করছে।
বৃথা চেষ্টা, বিড়বিড় করল পিট, পরমুহূর্তে বিস্ফোরিত হলো আইবিস দুটো, পাঁচ সেকেন্ডের ব্যবধানে।
কিসের একটা শব্দ পেয়ে দুজনে একযোগে ঘাড় ফেরাল ওরা। সতর্ক হয়ে থাকা সত্ত্বেও, যান্ত্রিক মানুষগুলোকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ল ওরা। একটা ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়াল তারা। টেলিভিশন বা সিনেমায় যেমন দেখা যায়, এগুলো সে ধরনের রোবট নয়। এগুলোর গায়ে অনেকগুলো যান্ত্রিক হাত রয়েছে, রয়েছে ভিডিও ক্যামেরা, স্পীকার, কমপিউটার, চারটি করে অটোমেটিক রাইফেল। সবগুলো পিট বা অ্যালের পেটের দিকে তাক করা।
প্লীজ, নড়বে না। তা না হলে তোমাদের আমরা খুন করব।
কথা বলার সময় ওদের জিভ আর ঠোঁট নড়ে কি? জিজ্ঞেস করল অ্যাল, চোখে অবিশ্বাস।
মাঝখানের রোবটটার দিকে তাকিয়ে আছে পিট। ওর মনে হলো, দূর থেকে একজন কন্ট্রোলার অত্যন্ত সফিসটিকেটেড একটা টেলিপ্রেজেন্স সিস্টেমের সাহায্যে পরিচালনা করছে ওটাকে।
বিভিন্ন ভাষা বুঝতে পারি আমরা, সেভাবেই আমাদেরকে তৈরি করা হয়েছে, ফাঁপা গলায় বলল মাঝখানের রোবটটা। তোমাদের পালাবার কোন উপায় নেই। আমাদের রাইফেলগুলোকে তোমাদের বডি গাইড করছে।
চেহারায় অস্বস্তি, পিট ও অ্যাল দৃষ্টি বিনিময় করল। সাবধানে, ধীরে ধীরে, মাথার উপর হাত তুলল ওরা। লক্ষ্য করল, ওদের দিকে তাক করা রাইফেলগুলো এক চুল নড়ছে না।
শুরু হবার আগেই ব্যর্থ হয়ে গেছে আমাদের অপারেশন। ঠিক বলিনি? জানতে চাইল অ্যাল।
সামনে বারোটা রাইফেল, পিছনে ইলেকট্রিফায়েড বেড়া, কাজেই পালাবার কোন সুযোগ নেই। পিট শুধু আশা করল, রোবটগুলোর কন্ট্রোলার অন্তত বুঝতে পারবে যে ও আর অ্যাল আসলে কোন হুমকি নয়।
ওদেরকে বলার সময় হয়েছে, আমাদেরকে লীডারের কাছে নিয়ে যাক? জিজ্ঞেস করল অ্যাল।
বলে দেখতে পারো। কিন্তু বলতে গিয়ে গুলি খেলে আমাকে দায়ী করতে পারবে না।
.
৪৫.
এডো সিটির তলায় অনুপ্রবেশ করা সহজ কাজ নয়, তবে ওদের জন্যে তেমন কোনো সমস্যা হলো না। হলিউডের একজন মেকআপ এক্সপার্টকে টোকিওতে পাঠিয়েছেন রেইমন্ড জর্ডান, সে-ই ওদের চেহারা বদলে দিয়েছে। স্টেসি, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউমো ও ড. টিম ওয়েদারহিলকে পুরোপুরি জাপানি বলে চালিয়ে দেয়া যায়। ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো জাপানি ভাষা জানেন, কাজেই তাঁকে স্টেসি ও টিম ওয়েদারহিলের বস্ বানানো হয়েছে। বিজনেস স্যুট পরে আছেন তিনি। সুমা এঞ্জিনিয়ারিং ইনেসপেকশন টিমের সদস্যরা হলুদ জাম্পস্যুট পরে, ওরা দুজনও তাই পরেছে।
টিম হানামুরার রিপোর্টে সিকিউিরিটি সিস্টেম সম্পর্কে প্রচুর তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, আইডেনটিফিকেশন কার্ড আর পাস কোড পাওয়া গেল একজন ব্রিটিশ ডীপ কাভার এজেন্টের কাছ থেকে। এই ব্রিটিশ অপারেটর সম্ভাব্য সব রকম উপায়ে সাহায্য সহযোগিতা করছেন রেইমন্ড জর্ডানকে। চেক পয়েন্টগুলো পার হয়ে আসতে ওদের তিন জনের কোনো অসুবিধে হলো না। অবশেষে টানেলের ঢোকার মুখে পৌঁছে গেল ওরা। অপারেশনের এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক মুহূর্ত।
রক্ত-মাংসের সিকিউরিটি গার্ড বা আইডেনটিটি ডিটেকশন মেশিনকে সহজেই ফাঁকি দেয়া গেছে, এবার শেষ বাধাটা পেরুতে হবে ওদেরকে। শেষ বার ব্রিফ করার সময় মেল পেনার বলেছেন, এটাই আসল বাধা।
সম্পূর্ণ খালি একটা কামরায় ঢুকল ওরা, ভেতরে চোখ ধাঁধানো আলো। সামনেই একটা রোবোটিক সেনসরি সিকিউরিটি সিসেটম। ঘরে কোনো ফার্নিচার নেই, দেয়ালগুলোয় নেই কোনো ছবি। কামরায় একটাই দরজা।
আপনাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলুন, যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর, জাপানি ভাষায় জানতে চাইল রোবট।
ইতস্তত করছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। তাকে বলা হয়েছে, রোবট সেন্ট্রি মেশিন প্রশ্ন করবে। চাকা লাগানো একটা ডাস্টবিন থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে আসবে, এ তিনি আশা করেন নি। জবাব দিলেন, ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশন সিস্টেম মডিফাই করতে হবে।
আপনার জব অর্ডার আর পাস কোড।
কমিউনিকেশন ইন্সপেকশন ও টেস্ট প্রোগ্রামের জন্যে ইমার্জেন্সি অর্ডার ফরটি সিক্স- আর, খোলা হাত দুটো এক করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, আঙুলের ডগাগুলো আলতোভাবে পরস্পরের সঙ্গে ছোঁয়ালেন, ফিসফিস করে তিনবার বললেন, বাহ বিপদ হলে এখনই হবে, ভাবলেন তিনি। ব্রিটিশ অপারেটর সঠিক পাস সাইন ও কোড রোবোটিক সিকিউরিটি মেমোরিতে জমা করতে পেরেছে কিনা তার ওপর। নির্ভর করছে সব কিছু।
আমার সেনসিং স্ক্রীনে আপনাদের ডান হাত চেপে ধরুন, নির্দেশ দিল রোবোগার্ড।
ড্রাম আকৃতির বুকে নীল স্ক্রীন মিটমিট করছে, পালা করে প্রত্যেকে ওরা ডান হাত চেপে ধরল সেটার ওপর। কয়েক সেকেন্ড বোবা হয়ে থাকল রোবট, কমপিউটারে ডাটা প্রসেস করছে, মেমোরি ডিস্কের বর্ণনার সাথে মুখের আকার আকৃতির ও শরীরের গড়ন মিলিয়ে দেখছে।
একপাশে সরে দাঁড়াল রোবট। আপনারা ভেতরে ঢুকতে পারেন। বারো ঘণ্টার বেশি থাকতে হলে ছনম্বর সিকিউরিটি ফোর্সকে জানাতে হবে।
ব্রিটিশ অপারেটর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। শেষ বাধাটাও নির্বিঘ্নে পেরিয়ে এসেছে ওরা। কামরা থেকে বেরিয়ে কার্পেট মোড়া একটা প্যাসেজে চলে এলো তিনজন। প্যাসেজটা মেইন টানেলের সঙ্গে মিলেছে।
একটা বোডিং প্ল্যাটফর্মে চড়ল ওরা। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠল লাল আর সাদা আলো। নির্মাণ উপকরণে ভর্তি একটা ট্রেন আন্ডারগ্রাউন্ড রেলস্টেশন থেকে এইমাত্র রওনা হলো। টানেলের মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অনেকগুলো ট্রাক। টানেলের মুখটা চার কি পাঁচ মিটার হবে ডায়ামিটারে, আন্দাজ করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।
তিন মিনিট ভৌতিক নিস্তব্ধতার ভেতর কাটল। একটা মাত্র রেললাইনের ওপর দিয়ে প্ল্যাটফর্মে এলো কারটা। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি ওটা, মাথাটা বুদবুদ আকৃতির কাঁচ দিয়ে ঢাকা, দশজন লোক বসতে পারবে। কারের ভেতরটা ফাঁকা, কন্ট্রোলে কেউ নেই। হিসহিস শব্দে খুলে গেল দরজা, কারে চড়ল ওরা।
এটা একটা ম্যাগলেভ, টিমোথি ওয়েদারহিল বললেন।
একটা কী? জিজ্ঞেস করল স্টেসি।
ম্যাগলেভ, ম্যাগনেটিক লেভিটেশন। দুটো চুম্বক পরস্পরকে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করে। এর ওপর ভিত্তি করে ধারণাটা গড়ে উঠেছে। ট্রেনের নিচে শক্তিশালী ম্যাগনেট আছে, আর আছে সিঙ্গেল লাইনের কিনারায়, ওগুলোর ইন্টার অ্যাকশনে ফরে কারটা ছোটে একা ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম ফিল্ডের ওপর দিয়ে। সেজন্যেই এটাকে সাধারণত ফ্লোটিং ট্রেন বলা হয়।
দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কমপিউটরাইজড সেনসর সঙ্কেত দিল, সামনে কোনো বাধা নেই। ট্রাক-এর ওপর সবুজ আলো জ্বলে উঠল। নিঃশব্দে মেইন টিউব-এ ঢুকে পড়ল ওরা। ক্রমশ বাড়ছে গতি।
ড্রাগন খানিক পর স্টেসি জানতে চাইল, কত স্পীডে ছুটছি আমরা?
ঘণ্টায় তিনশো বিশ কিলোমিটার, টিমোথি ওয়েদারহিল জবাব দিলেন।
মাথা ঝাঁকালেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এই গতিতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব আমরা।
কয়েক মিনিট পরই ফ্লোটিং ট্রেনের গতি কমতে শুরু করল। তারপর কোনো শব্দ না করে দাঁড়িয়ে পড়ল। আরেকটা খানি প্ল্যাটফর্মে নামল ওরা। ওরা নামতেই একটা টার্নটেবিলে উঠল ট্রেন। উল্টো দিকের রেইল-এ চলে গেল, তারপর এডো সিটির দিকে ছুটল আবার।
লাইনের শেষ মাথা, বিড়বিড় করলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। প্ল্যাটফর্মে একটা দরজা, সবাইকে নিয়ে সেদিকে এগোলেন তিনি। প্যাসেজে বেরিয়ে এলো ওরা। প্যাসেজটা শেষ হয়েছে এলিভেটরের সামনে।
এলিভেটরে চড়ে আরবি সংখ্যা লেখা কন্ট্রোলগুলোর দিকে তাকালেন টিমোথি ওয়েদারহিল। ওপরে, না নিচে? জানতে চাইলেন তিনি।
কটা ফ্লোর? কোনটায় রয়েছি আমরা? পাল্টা প্রশ্ন করল স্টেসি।
ফ্লোর বারোটা। দু নম্বরে রয়েছি।
কিন্তু হানামুরার স্কেচে মাত্র চারটে ফ্লোর ছিল, বললেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো।
ওগুলো প্রাথমিক ড্রইং ছিল, পরে নিশ্চয় বদলানো হয়।
তার মানে লেআউটের ওপর নির্ভর করাটা বোকামি হবে, মন্তব্য করল স্টেসি।
কমপিউটারাইজড ইলেকট্রনিক্স স্টেশন কোন দিকে জানি না, বললেন টিমোথি ওয়েদারহিল। কাজেই অরিজিন্যাল প্ল্যান ধরে কাজ করতে হবে আমাদের। প্রথমে যাব পাওয়ার জেনারেটিং স্টেশন।
যদি কেউ বাধা না দেয়। ইলেকট্রিকাল ওয়ারিং অনুসরণ করলে সময় কম লাগবে।
বারোটা ফ্লোরে অসংখ্য কামরা, অসংখ্য প্যাসেজ, বিড়বিড় করল স্টেসি। হয়তো ঘণ্টার পর ঘন্টা ঘুরঘুর করাই সার হবে।
এছাড়া কোনো উপায় নেই, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো বললেন, তাকালেন হাতঘড়ির দিকে। মি, পিট ও মি, অ্যাল যদি দ্বীপে পৌঁছে থাকেন, সুমা সিকিউরিটি সিস্টেমকে যদি ব্যস্ত রাখতে সমর্থ হন, প্ল্যাস্টিক বসিয়ে পালাবার যথেষ্ট সময় পাব আমরা।
ছ নম্বর বোতামে চাপ দিলেন টিমোথি ওয়েদারহিল। মাঝখানের ফ্লোরে উঠে দেখা যাক।
ব্রিফকেসটা তুলে বগলের নিচে চেপে ধরলেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। এক ছোঁড়া অটোমেটিক উইপনকে আড়াল করে রেখেছে ব্রীফকেসটা।
একটু পরই ছ তলায় পৌঁছে গেল এলিভেটর। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলো ওরা। সবার আগে রয়েছেন ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো, তিনি দাঁড়িয়ে পড়তে বাকি দুজন তার সঙ্গে ধাক্কা খেল।
ওদের সামনে গম্বুজ আকৃতির বিশাল একটা গ্যালারি। অসংখ্য কমপিউটার আর ইন্সট্রুমেন্টাল কনসোল একটা অর্ধবৃত্ত রচনা করেছে। টেকনিশিয়ান ও এঞ্জিনিয়াররা সবাই একেকটা রোবট, অত্যন্ত ব্যস্তভাবে যে যার কাজ করছে। কারও মুখে কথা নেই, কেউ কাউকে নির্দেশ দিচ্ছে না। রোবটগুলো বিভিন্ন আকৃতির।
প্রথম বারই সোনা পেয়ে গেছে ওরা। ভাগ্য ওদেরকে সরাসরি সুমার নিউক্লিয়ার কমান্ড সেন্টারের ইলেকট্রনিক ব্রেনের ভেতর নিয়ে এসেছে। গোটা কমপ্লেক্সের কোথাও কোন মানুষ নেই।
বেশিরভাগ রোবটের পায়ে চাকা রয়েছে। কয়েকটা শুড়বহুল অক্টোপাসের মত দেখতে, আটটা করে বাহু।
আমরা গুরুত্ব হারিয়েছি, এ-ধরনের কোন অনুভূতি হচ্ছে আপনার? ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোকে জিজ্ঞেস করল স্টেসি।
ওদের সাথে লাগতে যাওয়া উচিত হবে না, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ফিসফিস। করলেন। চলুন, এলিভেটরে ফিরে যাই।
প্রশ্নই ওঠে না, প্রতিবাদ করলেন টিমোথি। এই কমপ্লেক্সটাই ধ্বংস করার জন্যে এসেছি আমরা। মানুষের কাজে বাধা দেয়ার জন্যে প্রোগ্রাম করা হয়নি ও গুলোকে। চারদিকে কোথাও যোবাটিক সিকিউরিটি গার্ডও দেখতে পাচ্ছি না। সত ডার্ক ও মি. অ্যালের কৃতিত্ব, ও গুলোকে ব্যস্ত রেখেছেন। আমার কথা হল, সুযোগ যখন পাওয়া যখন পাওয়া গেছে, আসুন, রোবটদের এই ঘাঁটিটাকে চাদে পাঠিয়ে দিই।
এলিভেটর রওনা হয়ে গেছে, বলল স্টেসি, ডাউন লেখা বোতামটা চেপে ধরল আঙুল দিয়ে। এই মুহূর্তে যাবার কোন জায়গা নেই আমাদের।
কথা বাড়িয়ে আর সময় নষ্ট করলেন না ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। মেঝেতে ব্রিফকেসটা রাখলেন, টেপ ছিঁড়ে পা থেকে খুলে নিলেন সি-এইট প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভের প্যাকেট। ওরা দুজনও জাম্পস্যুট ইউনিফর্মের ভেতর থেকে একটা করে প্যাকেট বের করল।
স্টেসি, আপনি কমপিউটার সেকশন আমার দায়িত্ব।
যে যার টার্গেটের দিকে এগোল ওরা। কেউই পাঁচ কদম এগোতে পারেনি, একটা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, যে যেখানে আছ সেখানেই দাঁড়াও। তা না হলে এখুনি মারা যাবে তোমরা। নিখুঁত ইংরেজিতে দেয়া হলো নির্দেশটা।
বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলেও, উপস্থিত বুদ্ধি হারালেন না ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো। আমরা টেস্ট এঞ্জিনিয়ার, বললেন তিনি। ইন্সপেকশনে এসেছি। আমাদের পাস কোড দেখতে ও শুনতে চাইলে বলো।
এদিকে মানুষের কোন কাজ নেই, কারণ রোবটরাই নিখুঁতভাবে সব করতে পারে।
কিন্তু আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ফাইবার অপটিক কমিউনিকেশন চেক করার…।
ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসোর কথা শেষ হলো না, খুলে গেল এলিভেটরের দরজা। কন্ট্রোল সেন্টারের মেঝেতে বেরিয়ে এল রয় ওরশিয়া। বীরত্ব দেখাতে গিয়ে মরো না, সাবধান করল সে, উল্লাসে চকচক করছে তার চেহারা। তোমাদের অপারেশন ভেস্তে গেছে। কেইটেন প্রজেক্ট ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে তোমরা। মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও।
ক্যাম্প ডেভিডে প্রেসিডেন্টের সাথে ব্রেকফাস্ট সারলেন রেইমন্ড জর্ডান এবং অ্যাডমিরাল স্যানডেকার। কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন প্রেসিডেন্টের স্পেশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেইল নিকোলাস, হাতে এক গ্লাস দুধ। বাইরে অপেক্ষা করছেন ডোনাল্ড কার্ন, রেইমন্ড জর্ডানকে জানালেন তিনি।
উনি সম্ভবত সোসেকি দ্বীপের সর্বশেষ খবর নিয়ে এসেছেন।
ডেইল নিকোলাসের দিকে তাকিয়ে প্রেসিডেন্ট বললেন, দ্রলোককে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। ভাল কথা, কিচেনে বলে দাও তার জন্যে ব্রেকফাস্ট পাঠাতে।
ডোনাল্ড কার্ন শুধু এক কাপ কফি নিলেন, বসলেন কাছাকাছি একটা সোফায়। চোখে প্রত্যাশা, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে প্রেসিডেন্ট। তবে রেইমন্ড জর্ডান তাকিয়ে আছেন ফায়ার প্লেসের গনগনে আগুনের দিকে।
ওরা ঢুকেছে, ঘোষণা করলেন ডোনাল্ড কার্ন।
সবাই? কোনো বিপদ হয় নি? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।
হ্যাঁ, তিনজনই। কোনো সমস্যা হয়েছে কিনা এখনো আমরা জানি না। তবে রহস্যময় একটা ব্যাপার ঘটেছে। টানেল দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে ওরা, এই রিপোর্ট দেয়ার পরপরই আমাদের ব্রিটিশ কন্ট্রাক্ট যোগাযোগ কেটে দেয়। কেটে দিল, নাকি ছিঁড়ে গেল, বোঝা যায় নি।
সামনের দিকে ঝুঁকে জর্ডানের সাথে করমর্দন করলেন প্রেসিডেন্ট। কংগ্রাচুলেশন্স।
সময়ের আগে হয়ে যাচ্ছে, মি. প্রেসিডেন্ট, রেইমন্ড জর্ডান বললেন। ওদেরকে আরো অনেক বাধা পেরুতে হবে।
আমার লোকদের খবর কী? গুরু গম্ভীর সুরে জানতে চাইলেন স্যানডেকার।
সেফ ল্যান্ডিং-এর সিগন্যাল পেয়েছি আমরা, জবাব দিলেন ডোনাল্ড কার্ন। আশা করি ওঁরা আহত হন নি বা সুমার সিকিউরিটি গার্ডের হাতে ধরা পড়েননি।
এরপর কী ঘটবে? জানতে চাইলেন প্রেসিডেন্ট।
বিস্ফোরণের সাহায্যে কমান্ড সেন্টার কিছু সময়ের জন্যে অচল করে দেওয়া হবে। তারপর ওরা মিস লরেন ও মি, ডিয়াজকে উদ্ধার করবেন। সব কিছু যদি প্ল্যান মতো চলে, হিদেকি সুমাকে গ্রেফতার করবেন ওঁরা। ওঁদের কাছ থেকে সিগন্যাল পাবার পর পানির ওপর মাথা তুলবে আমাদের একটা সাবমেরিন, ডেল্টা টিম পাঠানো হবে দ্বীপ থেকে ওদেরকে উদ্ধার করে আনার জন্যে। তারপর দ্বীপ থেকে ওদেরকে উদ্ধার করে আনার জন্যে। তারপর দ্বীপে নামবে আমাদের মেরিন কমান্ডোরা, পুরোপুরি ধ্বংস করে দেবে কমান্ড সেন্টার।
.
৪৬.
গ্রেফতার করার ঘটনাটার ভিডিও টেপে দেখে পিট ও অ্যালকে চিনতে পারল রয় ওরশিয়া। খবরটা সঙ্গে সঙ্গে মুরো কামাতোরিকে জানালো সে।
ডার্ক পিটকে খুন করার দায়িত্ব আগেই দেওয়া হয়েছে কামাতোরিকে, খবরটা শুনে উল্লাস অনুভব করল সে। ওরশিয়াকে বিদায় করে দিয়ে ধ্যানে বসল, ধ্যান ভাঙার পর প্ল্যান করতে বসল কীভাবে মারা যায় শত্রুকে। বিড়াল যেমন ইঁদুরকে নিয়ে খেলে পিটকে নিয়ে সে রকম একটা খেলা খেলতে ইচ্ছে হলো তার। তাতে প্রমাণ হয়ে যাবে পিটের মতো দক্ষ ও যোগ্য একজন শত্রুর সাথে লড়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা। ডার্ক পিট নাকি একাই একশো। দেখা যাক। সুমার বিরোধিতা করেছে, এমন বহু লোকের সঙ্গে এ ধরনের খেলা খেলেছে কামালোরি, কেউ তারা যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রমাণ করতে পারে নি নিজেকে।
পিট ও অ্যালকে একদল সেন্ট্রি রোবট সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখছে। ওদেরকে যারা গ্রেফতার করেছে, সেই রোবটদের একটার সাথে খানিকটা বন্ধুত্ব পাতাবার চেষ্টা করল অ্যাল। আলাপটা এভাবে শুরু করল সে, কেমন আছ, মনা?
আমার নাম মনা নয়, ইংরেজিতে বলল রোবট। আমার নাম মুরাসাকি। মুরাসাকি মানে হলো লালচে-বেগুনি।
লালচে-বেগুনি? কিন্তু তোমার গায়ে তো হলুদ রঙ। মনা নামটাই তোমাকে মানাবে।
আমাকে তখনো পুরোপুরি তৈরি করা হয় নি, একজন শিন্টো প্রিস্ট ফুল আর খাদ্যবস্তু প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করে আমার নাম রাখেন মুরাসাকি।
পিটের দিকে ফিরল অ্যাল। আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে নাকি?
পিট কিছু বলল না।
তুমি তাহলে, ফিরল আবার অ্যাল। সত্যি ইয়ার্কি মারছে, না?
কী করে বলি। তুমি বরং জিজ্ঞেস করে দেখো, পালাতে চেষ্টা করলে কী করবে সে।
মুরাসাকি জবাব দিল, আমি আমার সিকিউরিটি অপারেটরকে সতর্ক করব, গুলি করব খুন করার জন্যে, যেভাবে আমাকে কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
তোমার লক্ষ্য কি অব্যর্থ? জানতে চাইল পিট। কার্পেটের ওপর শুয়ে আছে ও।
আমার কর্মসূচিতে ব্যর্থ হবার কোনো নির্দেশ নেই।
পরিস্থিতি বোঝা গেল, হতাশ গলায় বললো অ্যাল।
দ্বীপ ছেড়ে তোমরা পালাতে পারবে না, আর দ্বীপে লুকাবারও কোনো জায়গা নেই।
বাইরে থেকে নক হলো, স্লাইডিং দরজা একপাশে সরিয়ে ভেতরে ঢুকল এক লোক। রোবটের পাশে দাঁড়ানো অ্যালের দিক থেকে পিটের দিকে তাকালো সে, বলল, আমি মুরো কামাতোরি। মি. হিদেকি সুমার প্রধান সহকারী।
অ্যাল জিওর্দিনো, এক গাল হেসে একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে, যেন কতদিনের বন্ধু তারা। বিশ্রামরত ওই ভদ্রলোক আমার বন্ধু, মি. ডার্ক পিট। বিনা নিমন্ত্রণে উদয় হওয়ায় দুঃখিত আমরা, তবে…।
তোমাদের পরিচয়, কীভাবে সোসেকি দ্বীপে এসেছ, এ সবই আমরা জানি, অ্যালকে বাধা দিয়ে বলল কামাতোরি। ভুল বোঝানোর জন্যে মিথ্যে গল্প বানিয়ে কোনো লাভ হবে না। একটা খবর শুনে মনে ব্যথা পাবে তোমরা, তবু না বলে পারছি না। ডাইভারশন ক্রিয়েট করে কোনো লাভ হয় নি। এভো সিটি থেকে টানেলে নামার খানিক পরই তোমাদের তিন বন্ধু ধরা পড়ে গেছে।
নিস্বব্ধতা নামল কামরার ভেতর। কামাতোরির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যাল। তারপর চোখ ফেরালো পিটের দিকে, চেহারায় প্রত্যাশা। সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত পিট। এখানে পড়ার মতো কিছু নেই নাকি? একটা গাইড হলেও চলত দ্বীপটায় হোটেল-মোটেল কি আছে জানতে পারলে ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।
পিটের দিকে ঠাণ্ডা চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকল কামাতোরি। প্রায় এক মিনিট পর নড়ে উঠল সে। এগিয়ে এসে কাছাকাছি দাঁড়াল, ঝুঁকল ওর দিকে। হান্ট গেম পছন্দ কর তুমি, ডার্ক? হঠাৎ জিজ্ঞেস করল সে।
তেমন না। শিকার যদি পাল্টা গুলি করার সুযোগ না পায়, সেটাকে স্পোর্ট বলি কী করে?
তার মানে কি রক্ত ও মৃত্যু তুমি অপছন্দ কর?
বেশিরভাগ মানুষই কি তাই করে না?
সম্ভবত শিকার হতে চাচ্ছ তুমি?
আমেরিকানদের তো চেনো না। আন্ডারগডদের সাথে আমরা আবার ভালো পারি।
চোখে খুনের নেশা, পিটের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকল কামাতোরি। তারপর বলল, মি. সুমা তোমাদেরকে ডিনার খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে সম্মানিত করেছেন। সাতটার সময় তোমাদেরকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যাওয়া হবে। ক্লজিটে কিমোনো পাবে। পরার মধ্যে যেন কোনো খুঁত না থাকে। ঝট করে ঘুরলো সে, ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে।
কী ব্যাপার, পিট? কী নিয়ে কথা বললে তোমরা? অ্যালের চোখে কৌতূহল।
ঘুমোবার জন্যে চোখ বন্ধ করল পিট। ওর মতলব খুব খারাপ। খরগোশ মারার মতো আমাদেরকে শিকার করতে চায়। বোধহয় জবাই করবে।
যেন একটা রাজ দরবারে ঢুকল ওরা। ডাইনিং রুমের সিলিং বারো মিটার উঁচু মেঝেতে লাল সিল্ক দিয়ে বোনা ব্যাম্বো কার্পেট, দেয়ালগুলো পালিশ করা রোজউড দিয়ে ঢাকা। অসংখ্য কাগুঁজে লণ্ঠনের ভেতর জ্বলছে মোমবাতি, গোটা কামরা তাতেই আলোকতি হয়ে আছে। জাপানি শিল্পীদের আঁকা পেইন্টিং দিয়ে সাজানো দেয়াল। ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল লরেন। তার আশপাশে হাঁটাহাঁটি করছেন সিনেটর ডিয়াজ, তিনিও ডাইনিং রূমের সাজসজ্জা দেখে প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন। কামরার মাঝখানে একটা সেরামিক টেবিল, লম্বা নয়, কয়েকবার বাঁক নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে গেছে। চেয়ারগুলো এমনভাবে ফেলা হয়েছে, অতিথিরা পরস্পরের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে বসতে পারবেন, মুখোমুখি বা পরস্পরের দিকে পেছন ফিরে।
সামনে এসে মাথা নত করল তোশি কুদো। তার পরনে নীল সিল্ক কিমোনো। দেরি হবার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন মি, সুমা। তবে একটু পরই এসে পড়বেন তিনি। আপনাদের কী দেব, বলুন?
আপনি চমৎকার ইংরেজি বলেন, প্রশংসা করল লরেন।
লাজুক হাসি দেখা দেয় তোশির ঠোঁটে। ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান ও রুশ। ভাষাও জানি আমি।
ধন্যবাদ, ডিনারের আগে আমার কিছু দরকার নেই, বলল লরেন।
গার্ডদের নির্দেশে লরেন ও সিনেটর ডিয়াজকেও কিমোনো পরতে হয়েছে। আমার দরকার আছে। কারণ আমি খুব অস্বস্তিবোধ করছি। কী দিতে পারেন আপনি, শুনি?
জিন, ব্র্যান্ডি, হুইস্কি, শ্যাম্পেন, লেমন জুস।
জিন।
তোশি একজন ওয়েটারকে ইঙ্গিত করল, ট্রে হাতে অপেক্ষা করছে সে।
টেবিলটা ছজনের জন্যে সাজানো হয়েছে দেখে লরেন জানতে চাইল, মি. সুমা ছাড়া আর কে যোগ দেবেন আমাদের সঙ্গে?
মি. সুমার ডান হাত মি. মুরো কামাতোরি ও দুজন বিদেশি অতিথি।
বিদেশি জিম্মি, সন্দেহ নেই, বিড় বিড় করলেন সিনেটর ডিয়াজ। ওয়েটারের ট্রে থেকে জিন ভর্তি একটা গ্লাস তুলে নিলেন তিনি, এগিয়ে গিয়ে একটা ছবির সামনে দাঁড়ালেন। পাখির চোখ দিয়ে দেখা একটা জেলেদের গ্রাম। কত দাম এটার? জানতে চাইলেন তিনি।
ছয় মিলিয়ন মার্কিন ডলার, মার্জিত কণ্ঠস্বর, বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ।
দুজনেই ওরা ঘুরে দাঁড়ালো। হিদেকি সুমাকে দেখামাত্র চিনতে পারলেন সিনেটর ডিয়াজ। বহু পত্র-পত্রিকায় তার ছবি দেখেছেন। গুহা আকৃতির কামরায় ধীর পায়ে ঢুকলো সুমা, তার ঠিক পেছনেই রয়েছে কামাতোরি। সুমার ঠোঁটে স্মিত হাসি। দ্য লিজেন্ড অভ প্রিন্স জেনজি, ছবিটার নাম বলল সে। আঁকা হয়েছে চৌদ্দশো পঁচাশি সালে শিল্পীর নাম টয়োমা। আপনার রুচির মধ্যে কমার্শিয়াল একটা ভাব আছে, সিনেটর ডিয়াজ। সবচেয়ে দামী ছবিটাই আপনার দৃষ্টি কেড়েছে।
এগিয়ে এসে হাতটা বাড়িয়ে দিল সুমা। হিদেকি সুমা। মাথাটা নত করল সে। আশা করি আমার প্রধান সহকারী মুরো কামাতোরির সাথে আগেই আপনার পরিচয় হয়েছে।
হ্যাঁ, তিক্ত কণ্ঠে বললেন সিনেটর। আমাদের জেলার।
এবং অত্যন্ত অস্ত্র, যোগ করল লরেন।
কিন্তু ভারী যোগ্য, বিদ্রুপাত্মক সুরে বলল সুমা। কামাতোরির দিকে ফিরল। সে। আমাদের দুজন অতিথিকে যে দেখছি না?
কামাতোরি কিছু বলার আগে পায়ের শব্দ ভেসে এলো। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো সবাই কামরায় ঢুকল পিট ও অ্যাল, সঙ্গে দুজন রোবট সেন্ট্রি। এখনো ওরা ওদের ফ্লাইং স্যুট পরে আছে, তবে গলায় রঙচঙে একটা নেকটাই রয়েছে। কিমোনো পরার নির্দেশ পালন করে নি ওরা, শুধু ফিতে কেটে গলায় বেঁধে নিয়েছে।
ওরা তোমাকে সম্মান দেখাতে রাজি নয়, হিসহিস করে বলল কামাতোরি। ওদের দিকে এগোল সে, তবে একটা হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দিল সুমা।
পিট! হাঁপিয়ে উঠল লরেন। অ্যাল! ছুটে এলো সে, পাগলের মতো চুমো খেলো পিটের মুখে। ওহ্ গড! কাউকে দেখে এতো খুশি হই নি কখনো। এরপর অ্যালের হাত ধরে চাপ দিল সে। তোমরা এখানে কীভাবে এলে?
একটা জাহাজ থেকে উড়ে এসেছি, হাসি মুখে বলল পিট।
কানে এলো, এখানে নাকি অনেক রকম সার্কাস দেখানো হয়, তাই চলে এলাম, বলল অ্যাল, সে-ও হাসছে।
ডার্ক, মি. অ্যাল, বলল সুমা। আপনাদের মতো বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সত্যি আমি নিজেকে সম্মানিত মনে করছি।
কার সঙ্গে কথা বলছি আমরা? জানতে চাইল অ্যাল। সার্কাসের কোন জোকার?
আমি হিদেকি সুমা। ওয়েলকাম টু সোসেকি আইল্যান্ড।
আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হয়েছি, এ কথা বলতে পারছি না বলে আমি দুঃখিত, মি. সুমা। আপনার অগাধ টাকা থাকতে পারে, কিন্তু সে তো চোর ডাকাতদেরও থাকে। আপনার ক্ষমতাও অনেক, তবে শয়তানের ক্ষমতাও কম নয়।
অপমানিত হতে অভ্যস্ত নয় সুমা, হতভম্ব হয়ে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।
সুমা কামরায় ঢোকার পর টেবিলের ওপর ট্রে রেখে বেরিয়ে গেছে ওয়েটার। তোশি সেদিকে এগোচ্ছে দেখে নড়ে উঠল অ্যাল। চমৎকার জায়গা, সুন্দরভাবে সাজানো, বললো সে। আরো ভাল লাগছে সুন্দরী সঙ্গিনী থাকায়।
সিনেটর ডিয়াজ হ্যান্ডশেক করলেন পিটের সাথে। আবার দেখা হওয়ায় ভারী ভালো লাগছে, বললেন তিনি। আরো খুশি হতাম যদি পেছনে করে একটা ডেল্টা টিম নিয়ে আসতেন।
ওদেরকে রিজার্ভ রাখা হয়েছে, শেষ চাল দেয়ার জন্যে।
এসব কথা শুনতে না পাবার ভান করে একটা সুদৃশ্য চেয়ারে বসল সুমা। ড্রিঙ্কস, জেন্টলমেন?
টেকুইলা মার্টিনি, অর্ডার দিল পিট।
আপনি, মি. অ্যাল? জিজ্ঞেস করল তোশি।
আ বার্কিং ডগ, যদি জানে কীভাবে তৈরি করতে হয়।
খানিকটা জিন, সামান্য ড্রাই ভারমুখ, সামান্য সুইট ভারমুথ…, তোশি শুরু করল।
রীতিমত একটা প্রতিভা, বলল লরেন। কয়েকটা ভাষায় কথা বলতে পারেও।
ওকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বলল অ্যাল, কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তোশির দিকে। চোখাচোখি হতে ক্ষীণ একটু হাসল মেয়েটা।
এসব ঠাট্টা-ইয়ার্কি রাখুন তো! প্রায় গর্জে উঠলেন সিনেটর ডিয়াজ। এমন ভাব দেখাচ্ছেন, আমরা যেন কোনো বন্ধুর ককটেল পার্টিতে এসেছি। ইতস্তত করলেন এক সেকেন্ড, তারপর সুমার দিকে ফিরে সরাসরি জানতে চাইলেন, ব্যাখ্যা করুন, কেন আমাদেরকে কিডন্যাপ করা হয়েছে? এই মুহূর্তে উত্তর চাই আমি।
প্লীজ, বসুন, সিনেটর। শান্ত হোন, ঠাণ্ডা সুরে বলল সুমা। আপনাদের কালচারের অনেক খারাপ দিকের এটা একটা, ধৈর্য হারানো। সে জন্যেই আমাদের কালচার আপনাদের তুলনায় এতো উন্নত।
আপনি একটা ভুত, গাল দিলেন সিনেটর, রাগে কাঁপছেন। ভূতের আবার কালচার কি?
মনে মনে হিদেকি সুমার প্রশংসা না করে পারল না পিট। তার চেহারায় রাগ বা উত্তেজনার চিহ্নমাত্র নেই। দৃষ্টি দেখে মনে হলো, সিনেটরকে সে অবোধ শিশু বলে মনে করছে।
ঘৃণা দেখতে হলে তাকাতে হবে কামাতোরির দিকে। শরীরের পাশে হাত দুটো মুঠো করে রেখেছে সে, বাহু পর্যন্ত কাঁপছে রাগে। দেখে মনে হলো পাগলা একটা শেয়াল, লাফ দেয়ার জন্যে তৈরি হয়ে আছে।
কামাতোরি যে বিপজ্জনক খুনী, প্রথমবার তাকে দেখেই বুঝে নিয়েছে পিট। টেবিলের দিকে শান্ত পায়ে এগোল ও, ট্রে থেকে জিন ভর্তি একটা গ্লাস তুলে নিল। ফিরে এসে দাঁড়াল কামাতোরি আর সিনেটরের মাঝখানে। কাজ হলো তাতে। সিনেটরকে দেখতে না পেয়ে পিটের দিকে তাকিয়ে থাকল কামাতোরি, সমস্ত রাগ ওর ওপর পড়ল তার। ঠিক এ সময় দুই হাঁটুর মাঝখানে হাত দুটো রেখে মাথা নত করল তোশি, ঘোষণা করল, ডিনার রেডি।
ডিনারের পর আলোচনায় বসব আমরা, বলল সুমা।
টেবিলে সবার শেষে বসল পিট ও কামাতোরি। পরস্পরের দিকে এখনো ওরা নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, যেন দুজন বক্সার পরস্পরের ওজন নিচ্ছে লড়াই শুরুর আগে। কামাতেরির কপাল লালচে হয়ে আছে, থমথম করছে চেহারা। ঠোঁটে হিংস্র হাসি ফুটিয়ে তুলে তাকে আরো খেপিয়ে তুলছে পিট।
একটা কথা দুজনেই জানে। তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি, একজন আরেকজনকে খুন করবে ওরা।
.
৪৭.
এটা আসলে প্রাচীন জাপানি রন্ধন শিল্পের নাটকীয় একটা ধরণ। সমতল কাঠের তক্তার ওপর পড়ে রয়েছে বড় একটা টুনি মাছ, দেখেই চিনতে পারল পিট। ওস্তাদ শিকিবোচো-র সাথে পরিচয় করিয়ে দিল হিদেকি সুমা। তক্তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল লোকটা, পরে আছে সিল্ক ব্রোকেড়ে তৈরি পোশাক, মাথায় মানার আকৃতির টুপি। ইস্পাতের চপস্টিক ও কাঠের হাতল সহ লম্বা ছুরি নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা কসরৎ দেখালো সে, বলা যায় মাছ কাটার পাঁয়তারা কষছে বা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কর্তন পর্বটা দর্শনীয় বটে। লোকটার হাত দুটো এতো দ্রুত নড়ে উঠল যে ঝাপসা লাগল চোখে নড়াচড়াটা চোখ দিয়ে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। চোখের পলকে মাছটাকে নির্দিষ্ট কয়েকটা টুকরোয় ভাগ করল সে। রীতি, অনুসারে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে মাথা নোয়াল, তারপর বেরিয়ে গেল ডাইনিং রুম থেকে।
ওই কি আপনার শেফ? জানতে চাইল কংগ্রেস সদস্য লরেন স্মিথ।
মাথা নাড়ল হিদেকি সুমা। ও শুধু মাছ কাটা অনুষ্ঠানের প্রধান। সী ফুড সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ আমার অন্যতম একজন শেফ এখন মাছটাকে নতুন করে সাজাবে, পরিবেশন করা হবে হজমি হিসেবে।
আপনার কিচেনে তাহলে একাধিক শেফ রয়েছে?
তিনজন। একজন ফিশ ডিশ সম্পর্কে এক্সপার্ট। মাংস ও তরি-তরকারির জন্যে আলাদা একজন শেফ। আরেকজন শুধু মেধা খাটায় সুপের পেছনে।
মাছ পরিবেশেনের আগে গরম নোতা চা দেয়া হলো, সঙ্গে মচমচে মিষ্টি বিস্কিট। লেবুর গরম রসে ভেজা তোয়ালে এলো হাত ধোয়ার জন্যে, ধোয়া উঠছে এখনো। এরপর কিচেন থেকে ফিরিয়ে আনা হলো মাছ, টুকরোগুলো প্রতিটি যার যার জায়গামতো রয়েছে, খাওয়া হলো হজমি হিসেবে কাঁচা।
কাঠি দিয়ে খেতে হিমশিম খাচ্ছে অ্যাল ও সিনেটর ডিয়াজ, লক্ষ করে কৌতুক অনুভব করল সুমা। তবে জোড়া আইভরির সাহায্যে খাবারগুলো দ্রুত মুখে পুরছে পিট ও লরেন, দেখে কিছুটা বিস্মিতও হলো সে।
প্রতিটি কোর্স পরিবেশন করল এক জোড়া রোবট। ওদের লম্বা হাত আশ্চর্য দ্রুত টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল ডিশগুলো। এক কণা খাবার খসে পড়ল না, টেবিলে ডিশগুলো রাখার সময় কোনো শব্দ হলো না। কথা বলল শুধু নির্দিষ্ট কোনো কোর্স শেষ হয়েছে কিনা জানার জন্যে।
যান্ত্রিক মানুষের ওপর আপনি দেখছি একটু বেশি নির্ভর করেন, সুমাকে বলল পিট।
আপনি বোধহয় জানেন না, জাপানে আমরা একটা রোবোটিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে যাচ্ছি। নাগোয়াতে আমার যে ফ্যাক্টরি আছে, ওটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড়। ওখানে কমিউটারাইজড, রোবোটিক মেশিনের সাহায্যে প্রতি বছর ২০ হাজার স্বয়ংসম্পূর্ণ রোবট তৈরি করছি আমরা।
একটা আর্মি আরেকটা আর্মি তৈরি করছে, বলল পিট।
নিজের অজ্ঞাতে আসল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছেন আপনি, ডার্ক। এরই মধ্যে আমরা জাপানের রোবোটিক মিলিটারি ফোর্স গঠন করছি। আমার এঞ্জিনিয়াররা রক্ত-মাংসের ক্রু ছাড়া পুরোপুরি অটোম্যাটেড যুদ্ধজাহাজের ডিজাইন তৈরি করেছে, উৎপাদনের কাজও শুরু হয়ে গেছে। প্লেনের ব্যাপারেও একই কথা, একই কথা ট্যাংক সম্পর্কে এ-সবই পরিচালিত হবে রোবটদের দ্বারা, রোবটগুলো পরিচালিত হবে রিমোট কন্ট্রোলে। শুনে হয়তো আশ্চর্য হবেন, যুদ্ধ করার জন্যে সৈনিক বোটও তৈরি করেছি আমরা। ওগুলো আর্মারড মেশিন, শক্তিশালী অস্ত্রে সজ্জিত, এক লাফে পঞ্চাশ মিটার পেরিয়ে যেতে পারে, ঘণ্টায় ছুটতে পারে ষাট কিলোমিটার।
ওগুলো সহজেই মেরামত করা যায়। দশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর কোনো সেনাবাহিনী আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না। জাপান ছাড়া বাকি সবাই যুদ্ধ। করে প্রাণ হারাবে, আহত হবে, কিন্তু বড় মাপের যে-কোনো যুদ্ধে একজন জাপানিকেও আমরা হারাব না।
কথাগুলোর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পুরো এক মিনিট সময় নিল অতিথিরা। গোটা ব্যাপারটা কল্পনায় ধারণা করা কঠিন বলেই মনে হলো। পুরোপুরি রোবোটিক সেনাবাহিনীর ধারণা আগেও অনেক সময় বিশেষজ্ঞদের মাথায় এসেছে, কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই সেরকম একটা সেনাবাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করে নি। জাপান কি তার ব্যতিক্রম? হিদেকি সুমা কি মিথ্যে গর্ব করছে, নাকি সব সত্যি?
একা শুধু অ্যাল জিওর্দিনোকে নিরুদ্বিগ্ন দেখালো।
আমরা বিশ্বাস করি ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ সমস্ত বস্তুই একটা করে আত্মা পেয়েছে, এমন কি যে-কোনো জড় পদার্থও। এদিক থেকে পশ্চিমাদের চেয়ে এগিয়ে আছি আমরা। আমাদের হাতিয়ারকে আমরা, তা সে ইন্ডাস্ট্রিয়াল টুলই হোক বা সামুরাই তলোয়ার, হিউম্যান হিসেবে শ্রদ্ধা ও পবিত্র জ্ঞান করি। আমাদের, এমন কি, এমন মেশিনও আছে যেগুলো আমাদের অনেক কর্মীকে মেশিনের মতো আচরণ করতে শেখায়।
এ যেন নিজেদের লোককে বেকার করার চেষ্টা, মন্তব্য করল পিট।
এটা আসলে একটা সেকেলে ধারণা, ডার্ক, জবাব দিল সুমা, হাতের আইভরি জোড়া টেবিলের ওপর টুকল। জাপানে মানুষ ও মেশিন ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। নতুন শতাব্দীর শুরুতে এক মিলিয়ন রোবটকে ব্যবহার করতে যাচ্ছি আমরা, যারা দশ মিলিয়ন মানুষের সমান কাজ করবে।
আর ওই দশ মিলিয়ন মানুষ? তারা কী করবে?
ওদেরকে আমরা আন্যান্য দেশে রফতানি করব, ঠিক যেভাবে জাপানে তৈরি অন্যান্য পণ্য রফতানি করি, শান্ত গলায় বলল হিদেকি সুমা। নতুন দেশে শিকড় গাড়বে তারা, আইন মেনে চলবে, যদিও তাদের আনুগত্য ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুরোপুরিই বজায় থাকবে জাপানের সাথে।
সান ডিয়াগোয় এরকম একটা ব্যাপার লক্ষ আর্কিটেক্ট থেকে শুরু করে শ্রমিক পর্যন্ত সবাই ছিল জাপানি, বিল্ডিং তৈরির সাজ-সরঞ্জামও জাপান সরকার সরবরাহ করে, জাপানি জাহাজে করে।
কাঁধ ঝাঁকাল সুমা, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। অর্থনৈতিক যুদ্ধে কোনো নিয়মনীতি নেই। থামল সে, হাত-ইশারায় রোবট দুটোকে দেখালো। গুড়, পরবর্তী কোর্স এসে গেছে।
কাঠের ট্রেতে করে খোসা না ছাড়ানো এপ্রিকট পরিবেশন করা হলো, পাশে পাইন গাছের কাটা। তার সঙ্গে রয়েছে পাহাড়ের মতো উঁচু শুক্তি। একটু পরই পরিবেশন করা হলো ফ্লাওয়ার সুপ_স্বচ্ছ, একটি মাত্র অর্কিড ভাসছে প্রতিটি বড় আকারের পেয়ালায়।
লরেন ভাবল, ডিনারের অর্ধেকটা বোধহয় পরিবেশন করা হয়ে গেছে। আসলে সবেমাত্র শুরু হয়েছে। সুস্বাদু ডিশগুলো একের পর এক স্রোতের মতো আসতে থাকল। সিসে, সস-এর সঙ্গে ডুমুর, পুদিনা দিয়ে রান্না করা ভাত, ডিমের কুসুম দিয়ে বানানো আরেক প্রস্থ সুপ, নিখুঁতভাবে ছাল ছাড়ানো সামুদ্রিক বানমাছ, ব্যাঙের ছাতার সাথে ডিম ভরা সামুদ্রিক শামুক, সামুদ্রিক গুল্ম ও আগাছ দিয়ে মোড়া বহুরঙা কোলাজের মতো দেখতে বিভিন্ন ধরনের মাছ সূক্ষ্মভাবে কাটা ঝিনুকের সাথে জলপদ্মের শিকড় শসাসহ তরিতরকারির শীষ। তারপর আবার সুপ দেওয়া হলো, চাল তরিতরকারি ও সিসেম দিয়ে তৈরি। সবেশেষে পরিবেশিত হলো ফল ও চা।
ফাঁসির আসামীদের জন্যে শেষ ভুরিভোজ? জানতে চাইলেন সিনেটর ডিয়াজ।
মোটেই না, অমায়িক হেসে বলল হিদেকি সুমা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার প্রাইভেট জেটে চড়ে ওয়াশিংটনে ফিরে যাচ্ছেন আপনারা আপনি ও মিস লরেন।
এখুনি নয় কেন?
কারণ আমার উচ্চাশা, লক্ষ্য গন্তব্য সম্পর্কে আপনাদের একা ধারণা দিতে চাই আমি। আমি নিজে আপনাদেরকে ড্রাগন সেন্টারটা ঘুরিয়ে দেখাব, তাহলে বুঝতে পারবেন নতুন জাপানের শক্তির উৎসটা কী রকম।
ড্রাগন সেন্টার মানে?
নিউক্লিয়ার গাড়ি-বোমা সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন না, সিনেটর? জিজ্ঞেস করল পিট। ওরা ওগুলো এরই মধ্যে অনেক দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।
হাঁ হয়ে গেলেন সিনেটর। গাড়ি-বোমা? নিউক্লিয়ার গাড়ি-বোমা? মানে?
মি. সুমার নীল নকশা, বড় ভাইদের সাথে বাজাবাজি করতে চান। ড্রাগন সেন্টারের বাকি কাজ শেষ হলেই বোতামে চাপ দিয়ে গাড়িবোমাগুলো ফাটিয়ে নিতে পারবেন তিনি। গাড়িগুলো রোবট চালায়, প্রতিটি গাড়িতে একটা করে অ্যাটম বোমা আছে।
চোখ দুটো বিস্ফারিত, একটা ঢোঁক গিলে লরেন বলল, সত্যি? জাপান গোপনে আটম বোমা বানিয়েছে?
ইঙ্গিতে সুমাকে দেখালো পিট। ওঁকে জিজ্ঞেস করছ না কেন?
পিটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমা, একটা সাপের দিকে বেজি যেভাবে তাকায়। আপনি খুব জেদি মানুষ, ডার্ক। অত্যন্ত বুদ্ধিমান। শুনলাম গাড়ির কোথায় বোমাগুলো রেখেছি তা নাকি আপনিই মার্কিন সরকার ও ইন্টেলিজেন্সকে জানিয়েছেন।
এয়ারকন্ডিশনারের কমপ্রেসর-এর বোমা লুকিয়ে রাখার বুদ্ধিটা যার মাথা থেকেই বেরুক, তার প্রশংসা না করে পারা যায় না, বলল পিট। দুর্ঘটনাবশত অটো ট্রান্সপোর্ট শিপে প্রথমে একটা বোমা না ফাটলে আপনার অপারেশন অবশ্যই সফল হতে, কেউ আপনাকে ঠেকাতে পারত না।
লরেন হতভম্ব ভাটা কাটিয়ে উঠতে পারছে না, জানতে চাইল, এ থেকে কী পাবার আশা করেন আপনি?
গত তিনশো বছর ধরে ঘৃণ্য ওরিয়েন্টাল জাতি হিসেবে অবজ্ঞা করা হয়েছে জাপানিদের, বলল সুমা। শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্যে আমাদের উন্নতি পশ্চিমা জগৎ সহ্য করতে পারছে না। পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়। কেইটেন প্রজেক্টের উদ্দেশ্যে হলো, আত্মরক্ষার জন্যে জাপানকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো।
কেইটেন প্রজেক্ট আবার কী? জানতে চাইলেন সিনেটর।
দুনিয়াকে ব্ল্যাকমেইল করার একটা প্ল্যান, তিক্তস্বরে ব্যাখ্যা করল পিট।
আশ্চর্য! বিস্ময় প্রকাশ করল লরেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে কিছুই আপনারা শেখেন নি? মিথ্যে গর্ব আর লোভের বশে আবার আপনারা নিজেদের সর্বনাশ করতে চান? যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইউরোপ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে জাপানের ওপর, এই সরল সত্যটা আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন না?
সুমার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। কী মূল্য দিতে হবে, এটা বুঝতে পারলে সবাই ওরা পিছিয়ে যাবে, দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সুর তার গলায়। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করবে, সমস্যাটা তারা কূটনৈতিক পদ্ধতির সাহায্যে সমাধান করবে। এছাড়া আর কি-ই বা তাদের করার আছে?
জাপানকে এর জন্যে চড়া মুল্য দিতে হবে, বললেন সিনেটর ডিয়াজ। আমার ধারণা, এটা আপনার ব্যক্তিগত পাগলামি। সরকার বা জনসাধারণ কিছুই জানে না। ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভ আপনাকে এ পথে নিয়ে এসেছে।
ধন্যবাদ, সিনেটর। সম্পূর্ণ শান্ত সুমা। আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনার দৃষ্টিতে আমি একটা ক্ষমতালোভী ম্যানিয়াকই। আপনার অভিযোগ আমি অস্বীকার করব না। তবে এ কথা বলব, ইতিহাসের অন্যান্য ম্যানিয়াকদের মতোই, আমিও আমার দেশকে রক্ষা করতে চাই, রক্ষা করতে চাই জাপানের সার্বভৌমত্ব। অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে জাপানকে পেতে হবে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ, পশ্চিমা অপসংস্কৃতির বদলে গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে জাপানি কালচার। সেজন্যে প্রয়োজনে আমরা শক্তি প্রয়োগ করতেও পিছপা হব না।
অপসংস্কৃতি বলতে আপনি কী বোঝাতে চান? প্রশ্ন করলেন সিনেটর। তার দিকে ঘৃণাভরে তাকাল সুমা। নিজের দেশের দিকে তাকান, সিনেটর। ড্রাগ অ্যাডিক্টদের দখলে চলে গেছে গোটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট। নেপথ্যে থেকে দেশটাকে শাসন করবে ইহুদি আর মাফিয়া। হত্যা-খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস প্রতিটি রাজ্যে প্রতি মুহূর্তে বাস্তবতা। আপনাদের কালচার পাঁচমেশালি, তাই জাতিগত দাঙ্গা লেগেই আছে। আপনাদের পতন ঘটছে, যেমন পতন ঘটেছে গ্রীস, নোম ও ব্রিটেনের। এই পতন প্রক্রিয়া থামানোর কোনো উপায় নেই।
কিন্তু জাপানি কালচার জাপানিদের জন্যে অন্যান্য জাতি তা গ্রহণ করবে কেন? সব জাতিরই তো গর্ব করার মতো নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। তাছাড়া, সমাজ যদি কালচারের প্রতিচ্ছবি হয়, জাপানি কালচারেরই বা অবস্থা কী? আপনাদের ক্রিমিন্যালেরা এতো শক্তিশালী, বলা যায় আড়াল থেকে ওরাই সরকারকে চালায়। মন্ত্রী বলুন, প্রধানমন্ত্রী বলুন, সবাই ঘুষখোর। শুধু লাভের জন্যে এমন কোনো দেশ নেই যাদের কাছে আপনারা হাইলি সিক্রেট মিলিটারি টেকনলজি বিক্রি করছেন না। সুযোগ পেলেই আপনারা অন্য দেশের গোপন প্রযুক্তি চুরি করছেন। তারপরও বলছেন, জাপানি কালচার শ্রেষ্ঠ?
রাগে লালচে হয়ে উঠল সুমার মুখ। জাপানে এ সব যা দেখছেন, সেই পশ্চিমা অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশের ফল। আমাদের কালচার আবার নিখাদ হয়ে উঠবে। পয়তাল্লিশ বছর আগে আমরা ছিলাম পরাজিত একটা জাতি, যুক্তরাষ্ট্র সেই থেকে আমাদের মাথার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। আজ, হঠাৎ করে, বিজয়ী জাতি হিসেবে উদয় হয়েছি আমরা। শিল্প বা বাণিজ্যে আমরা অপরাজেয়, অন্যান্য যে-কোনো জাতির চেয়ে কারিগরি জ্ঞানে শ্রেষ্ঠ। জাতি হিসেবে আমরা কঠোর পরিশ্রমী, এ সবের সাথে এখন যোগ হয়েছে পারমাণবিক শক্তি। কে আমাদের ঠেকায়?
কিন্তু আপনি কি দুনিয়ার সবাইকে চিরকালের জন্য জিম্মি করে রাখতে পারবেন? জিজ্ঞেস করল পিট। তাছাড়া জাপানের সরকার ও জনসাধারণ আপনাকে ছাড়বে কেন, তারা যখন দেখবে সুপার পাওয়ারগুলো জাপানের দিকেও অরহেড তাক করে রেখেছে? রাশিয়ায় বা যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও যদি দুর্ঘটনাবশত আপনার একটা গাড়ি-বোমা ফেটে যায়, আবার একটা নিউক্লিয়ার অ্যাটাকের ঝুঁকিতে পড়বে জাপান, সে কথা ভেবে দেখেছেন?
মাথা নাড়ল সুমা। আমাদের ইলেকট্রনিক সেফগার্ড রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বেশি অ্যাডভান্সড। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে কারেক্ট কোড প্রোগ্রাম না করতে কোনো বিস্ফোরণ ঘটবে না।
শব্দ করে দম ছাড়ল লরেন। অসম্ভব, অবিশ্বাস্য আপনি একটা পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করতে পারেন না।
হেসে উঠলো সুমা। পারমাণবিক যুদ্ধ বলতে রাশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র যা বোঝে, আমরা বোকার মতো সে রকম কিছু করতে যাচ্ছি না। আমরা অ্যাটম বোমা ফাটালে কোনো শহর ধ্বংস হবে না, মানুষও তেমন একটা মরবে না। ওগুলো ফাটানো হবে নির্জন এলাকায়, বিশাল একটা ইলেকট্রেম্যাগনেটিক ফোর্স তৈরি করার জন্যে, উন্নত বিশ্বের অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বংস করার লক্ষে।
তার মানে সত্যি বোমাগুলো আপনি ফাটিয়ে দেবেন, তাই না?
কেন ফাটাব না, ফাটাবার জন্যেই তো ওগুলো তৈরি করে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। তবে আক্রমণটা হবে বিশেষ ধরনের। আমরা কাউকে জানে মারব না। মারব ভাতে। প্রথমে অকেজো করা হবে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো ও রাশিয়ার কমিউনিকেশন ও উইপন সিস্টেম। জাপানি শিল্পপতি ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে পিটের দিকে। তবে আমার বিজয় দেখার জন্যে আপনি উপস্থিত থাকবেন না, ডার্ক। সত্যি আমি দুঃখিত।
ভয়ে শুকিয়ে গেল লরেনের মুখ। আমাদের সাথে পিট ও অ্যাল ওয়াশিংটন যাচ্ছে না?
বড় করে শ্বাস টানল সুমা, ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। না, বলল সে। ওদেরকে আমি আমার বিশ্বস্ত বন্ধু মুরো কামাতোরির হাতে তুলে দিয়েছি।
ঠিক বুঝলাম না।
মুরো কামাতোরি অত্যন্ত দক্ষ শিকারী। মানুষ শিকার তার হবি। আপনার দুই বন্ধু ও বাকি তিনজন ইন্টেলিজেন্স অপারেটর যারা ধরা পড়েছে, সবাইকেই একবার করে দ্বীপ ছেড়ে পালাবার সুযোগ দেওয়া হবে। তবে এ সুযোগটা পাওয়া যাবে যদি তারা চব্বিশ ঘণ্টা ফাঁকি দিতে পারে মুরো কামাতোরিকে।
পিটের দিকে তাকালো মুরো কামাতোরি, ভুরু নাচিয়ে হাসল। আমাকে ফাঁকি দেওয়ার প্রথম সুযোগ পেয়েছেন ডার্ক।
অ্যালের দিকে ফিরল পিট, নিজ মুখে ক্ষীণ হাসির রেখা।
দেখলে তো, আমি যা বলেছিলাম তাই।
.
৪৮.
পালাব? বিড়বিড় করল অ্যাল, ছোট্ট ঘরটারে ভেতরে পায়চারি করছে সে, রোবট গার্ড মুরাসাকির সামনে। কোথায় পালাব? তীব্র স্রোতের মধ্যে ষাট কিলোমিটার কী সতারানো সম্ভব? তারপরও হয়তো দেখা যাবে, মেইনল্যান্ডে পৌঁছুলে তুমি সুমার শিষ্যরা তীরে দাঁড়িয়ে আছে তোমাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য।
তাহলে আমাদের রণকৌশল কী হবে? জানতে চাইল পিট, মেঝেতে ঘন ঘন ওঠবোস করছে।
যতক্ষণ সম্ভব বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। আর কি বিকল্পই বা আছে?
ঠিক আছে, নির্ভীক হৃদয়ে নিয়তির অমোঘ বিধানকে মেনে নেব আমরা।
একটা ভুরু উঁচু করে পিটের দিকে তাকালো অ্যাল, চোখে সন্দেহ। হ্যাঁ, তাই। উদোম বুক পেতে দাঁড়াব, চোখে পট্টি বাঁধতে অস্বীকার করব, কামাতোরি যখন তলোয়ার তুলবে আমরা তখন সিগারেট ফুকবো।
হ্যাঁ, শুধু শুধু লড়ে লাভ কী।
লাভ নেই সত্যি, তবে তোমাকে আমি এই প্রথম লড়াই শুরুর আগেই হেরে যেতে দেখছি, বলল অ্যাল, ভাবছে বন্ধুর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে কিনা।
দ্বীপের কোথাও লুকিয়ে থাকা যায়, কিন্তু কতক্ষণ? আমার ধারণা, কামাতোরি চিট করবে। আমাদেরকে খুঁজে বের করার জন্যে রোবোটিক সেনসর ব্যবহার করবে সে।
স্টেসির কী হবে? জানতে চাইল অ্যাল। তাকেও খুন করবে কামাতোরি, আর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখবে তুমি?
ব্যায়াম শেষ করল পিট, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো। আমরা নিরস্ত্র, কাজেই উপায় কী। রক্ত-মাংসের মানুষের পক্ষে রোবটদের সাথে পারা সম্ভব নয়। তাছাড়া কামাতোরি অত্যন্ত দক্ষ একজন ফেনসার। গলায় ঝাঁঝ, বিস্ময় প্রকাশ করল অ্যাল, তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। তুমি এভাবে হাল ছেড়ে দিচ্ছ, এ অবিশ্বাস্য।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগোল পিট, মুরাসাকিকে পাশ কাটিয়ে তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালো। তোমার পক্ষে বলা সহজ, বন্ধু। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছ। পুকুরে ক্রাশ-ল্যান্ড করার সময় হাঁটুতে আঘাত পেয়েছি, হাঁটতে গেলে জান বেরিয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। কামাতোরিকে ফাঁকি দেয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
পিটের ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি দেখে ভুল ভাঙলো অ্যালের। হঠাৎ করে নিজেকে তার বোকা হদ্দ বলে মনে হলো। মুরাসাকির সেনসর ছাড়াও কামরার ভেতর আরো অনেক আড়িপাতা যন্ত্র ও ভিডিও ক্যামেরা লুকানো আছে। পিটের মনোভাব বুঝতে পেরে সেও এবার অভিনয় শুরু করল। কামাতোরি একজন সামুরাই বীর, আহত ও অসহায় প্রতিপক্ষে শিকার করতে বাধবে তার। আমরা ধারণা, তোমার এ অবস্থা দেখে অস্ত্র ফেলে দেবে সে, তোমার সাথে খালি হাতে লড়বে।
মরতে আমার আপত্তি নেই, খালি হাতে মারুক বা তলোয়ার দিয়ে। শুধু ব্যথাটা কমলেই খুশি হই।
মুরাসাকি, রোবটের দৃষ্টি আকর্ষণ করল অ্যাল, বাড়িতে কোনো ডাক্তার আছে?
আমার কর্মসূচিতে সে-ধরনের কোনো তথ্য দেয়া নেই।
তাহলে তোমার রিমোট বসকে ডেকে জেনে নাও।
প্লীজ স্টান্ড বাই।
রোবটের কমিউনিকেশন সিস্টেম একটা অনুরোধ পাঠালো কন্ট্রোল সেন্টারে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর চলে এল। অল্প কজন স্টাফসহ একটা ক্লিনিক আছে পাঁচতলায়। মি. পিটের কী চিকিৎসা সুবিধে দরকার?
দরকার, বলল পিট। মি. কামাতোরির সাথে খেলতে হলে একটা পেইনকিলার ইনজেকশন নিতে হবে আমাকে। আঁটসাঁট একটা ব্যান্ডেজও দরকার।
ঘণ্টা কয়েক আগেও তো আপনাকে আমি খোঁড়াতে দেখি নি, বলল রোবট গার্ড মুরাসাকি।
হাঁটুটা অসাড় লাগছিল, বলল পিট। এখন এমন ব্যথা করছে যে হাঁটতে পারছি না। সাবধানে সামনে বাড়লো ও, কুঁচকে উঠল চোখ-মুখ, যেন প্রচণ্ড ব্যথা পাচ্ছে।
যা দেখল তাই রিপোর্ট করল গার্ড। ড্রাগন সেন্টার অনুমতি দিয়ে বললো, আহত ব্যক্তিকে পাহারা দিয়ে ক্লিনিক নিয়ে যেতে হবে। আরেকটা রোবো গার্ড হাজির হলো অ্যালের ওপর নজর রাখার জন্যে। আল ওটার নাম পাল্টে নিল দ্রুত। আবুল।
মুরাসাকির পিছু পিছু গোলকধাঁধার মতো অনেকগুলো প্যাসেজ পেরিয়ে এসে একটা এলিভেটরে চড়ল পিট। বোতামে চাপ দিল রোবট, নিচে নামতে শুরু করল এলিভেটর। পিট ভাবল, এটা একটা নতুন তথ্য, টিমগুলো জানে না। ড্রাগন সেন্টারে নামার জন্যে এলিভেটর আছে। কয়েক মুহূর্ত পর আলোকিত একটা প্যাসেজে বেরিয়ে এলো ওরা।
আপনার বাম দিকে চার নম্বর দরজা। ভেতরে ঢুকুন।
দরজাটা আগ্রাউন্ডের সব কিছুর মতো সাদা রঙ করা। কপাটের গায়ে ছোট একটা ক্রসচিহ্ন আঁকা। কোনো নব বা হাতল নেই, শুধু একটা বোম দেখল পিট। চাপ দিতেই খুলে গেল কবাট। পা টেনে ভেতরে ঢুকল ও। কামরার এক ধারে কয়েকটা বেড় দেখা গেল। ইউনিফর্ম পরা এক সুন্দরী নার্স ডেস্ক থেকে মুখ তুলল। কোনো কথা বলল না, ডেস্ক ছেড়ে পাশের কামরায় চলে গেল। ফিরে এলো একজন ডাক্তারকে নিয়ে। ডাক্তারের গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলছে। ডার্ক? মি. ডার্ক পিট? ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল ডাক্তার, উচ্চারণ ভঙ্গি আমেরিকান।
ইয়েস।
আপনার কথা আমাকে বলা হয়েছে। জশ নগামি। আমি আপনার ভক্ত, ডার্ক। নুমায় আপনার কৃতিত্ব সম্পর্কে, বিশেষত, টাইটানিক জাহাজ উত্তোলনের ব্যাপারে পত্রিকায় বেশ কয়েকটা লেখা পড়েছি। ওগুলো পড়েই স্কুবা ডাইভিং শিখেছি আমি।
মাই প্লেজার, বললো পিট, সামান্য অস্বস্তিবোধ করছে। আপনাকে ঠিক লোকাল বলে মনে হচ্ছে না।
জন্ম হয়েছে সান ফ্রানসিকোয়, ওখানেই বড় হয়েছি। ইন্টার্নি করেছি সান্তা অ্যানার সেন্ট পলস হাসপাতালে।
এদের খপ্পরে পড়লেন কীভাবে? জানতে চাইল পিট। ব্ল্যাকমেইলিঙের শিকার?
আমি মি. হিদেকি সুমারও একজন ভক্ত, ডার্ক। কেউ বাধ্য করে নি, স্বেচ্ছায় তাঁর দলে যোগ দিয়েছি বছর চারেক আগে।
তার কাজ আপনি সমর্থন করেন?
একশো ভাগ।
তা কি করে সম্ভব! নিশ্চয়ই আপনাকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
কেউ আমাকে ভুল বোঝায় নি, ডার্ক। আমি একজন জাপানি, বিশ্বাস করি বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে জাপানিরা অন্য সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমাদের কালচারও। অন্যান্য কালচারের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।
তর্ক করার প্রবৃত্তি হলো না, হাত দিয়ে আহত হাঁটুটা দেখালো পিট। কাল এটা ব্যবহার করতে হবে, অন্তত কাজ চালাবার মতো মেরামত করে দিতে পারেন কিনা। দেখেন। বোধ হয় মচকে গেছে। ব্যথাটা কি কমানো সম্ভব?
প্যান্ট গুটিয়ে হাঁটুটা দেখান আমাকে।
ডাক্তার হাঁটুতে হাত ছোঁয়াতেই ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল পিট। অভিনয়টা ভালোই হলো।
কোথাও ছড়ে নি, ফুলেও ওঠে নি। ভেতরে কিছু ছিঁড়েছে বলেও মনে হচ্ছে না।
কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। ভাঁজ করতে পারছি না।
ক্র্যাশ-ল্যান্ড করার সময় চোট খেয়েছেন, তাই না?
খবরটা দেখছি সবই জানে।
রোবটরা কোনো খবরই চেপে রাখতে জানে না, কী ঘটেছে না ঘটেছে সব নিজেদের মধ্যে আলাপ করবে। পুকুরে চার লাখ ইয়েনের পোনা ছিল, বেশির ভাগই মারা গেছে। সেজন্যে মি. সুমা আপনার ওপর রেগে আছেন।
তাহলে এ-ও আপনি জানেন যে কাল আমাকে শিকার করা হবে?
জশ নগামির মুখের হাসি নিভে গেল। আমি চাই আপনি জানুন, মি. সুমার নির্দেশ আমার শিরোধার্য হলেও, মুরো কামাতোরির মানুষ শিকার করার এই নোংরা খেলটাকে আমি ঘৃণা করি।
দুর্ভাগার জন্যে কোন পরামর্শ আছে?
ইঙ্গিতে কামরার চারদিকটা দেখালো জশ নগামি। এখানে চোখ আর কানের কোনো অভাব নেই। আমি আপনার দলে নাম লেখালে, আমাকেও মানুষ শিকারের খেলায় অংশগ্রহণ করতে হবে। আপনার জন্যে আমি শুধু দুঃখ প্রকাশ করতে পারি, ডার্ক। তবে যা ঘটতে যাচ্ছে তার জন্যে আপনিই দায়ী।
তবে আমার হাঁটুর জন্যে কিছু একটা করবেন, নাকি?
ডাক্তার হিসেবে ব্যথা কমানোর জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু করব, হ্যাঁ। আমার ওপর কামাতোরির নিদের্শ আছে, কালকের খেলার জন্যে আপনাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তুলতে হবে।
ওষুধের নামটা উচ্চারণযোগ্য নয়, তবে ব্যথা কমানোয় ওটার কোনো জুড়ি নেই। ওষুধ লাগিয়ে অ্যাথলেটিক টেপ দিয়ে হাঁটুটা ঢেকে দিল ডাক্তার জশ নগামি। ডার্কের মুঠোয় ট্যাবলেট ভর্তি ছোট একটা শিশি খুঁজে দিল সে। চার ঘণ্টা অন্তর দুটো করে খাবেন। বেশি থাবেন না, কারণ আচ্ছন্নবোধ করলে কামাতেরি আপনাকে সহজেই কাবু করে ফেলবে।
ওষুধ আর টেপ আনতে দুবার কামরা থেকে বেরিয়ে গেল নার্স। আপনাদের একটা খালি বিছানায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে পারি আমি? ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলও।
আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনার রোবো গার্ডকে জানিয়ে দিচ্ছি, এক দেড় ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখছি আমি আপনাকে। পিটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ডাক্তার। পালানোর কথা চিন্তা পর্যন্ত করবেন না। ক্লিনিকে কোনো জানালা নেই, পেছন দিয়ে বেরুনোও যায় না। আর এলিভেটরের দিকে দৃপাও এগোতে পারবেন না, রোবটরা আপনাকে ঘিরে ফেলবে।
চিন্তা নেই, পালাব না, বলল পিট।
খালি একটা বিছানা দেখিয়ে ডাক্তার বলল, শুয়ে পড়ুন। নরম তোষকের ওপর কম্বল আছে।
বাথরুম?
সাপ্লাই রূমের ভেতর দিয়ে যেতে হবে, আপনার বামদিকে।
ডাক্তারের সাথে করমর্দন করল পিট। আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, মি, নগামি দুঃখ শুধু এই যে আমাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে।
ডাক্তার চলে যাবার পর পিটের দিকে পিছন ফিরে নিজের ডেস্কে আবার বসল নার্স। খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাথরুমের দিকে এগোল পিট। ভেতরে ঢুকল না, তবে দরজা খোলার ও লাগাবার আওয়াজ করল। নার্স তার নিজের কাজে ব্যস্ত, সাপ্লাই রূমের ভেতর দিয়ে এ দিকটায় তাকালো না।
সাপ্লাই রুমের দেরাজ খুলে তল্লাশি চালাচ্ছে পিট। বাক্স ভর্তি-প্লাস্টিকের ব্যাগ পেল, প্রতিটি সরু টিউবের সাথে জোড়া লাগানো, টিউবের শেষ মাথায় একটা বড়সড় সুচ। ব্যাগে লেখা সিপিডিএ-ওয়ান রেড ব্লাড সেলস। বাক্স থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে শার্টের নিচে লুকিয়ে ফেলল।
কামরার এক কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোবাইল এক্স-রে ইউনিট। ওটার দিকে চোখ পড়তেই মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। নখ দিয়ে প্লাস্টিকের একটা নেমপ্লেট খুলল ও, ম্যানুফ্যাকচারারের নাম লেখা রয়েছে। এক্স-রে ইউনিটের পিছনটা খোলার জন্যে স্ত্র-ড্রাইভার হিসেবে ব্যবহার করল ওটা। একজোড়া সিক্স-ভোল্ট ড্রাই-সেল রিচার্জেবল ব্যাটারি ভরল পকেটে। তারপর যতটা সম্ভব ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যার ছিঁড়ে জড়িয়ে নিল কব্জিতে।
বাথরুম সারল পিট, বেডে ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। নার্স এখনো তার কাজে ব্যস্ত। পাশের অন্য এক কামরায় ফিসফিস করে ফোনে কথা বলছে ডাক্তার জশ নগামি।
সাদা সিলিঙের দিকে তাকিয়ে রয়েছে পিট, মনে কোনো উদ্বেগ নেই। ওর প্ল্যানটা রেইমন্ড জর্ডান বা ডোনাল্ড কার্ন হয়তো দারুণ বলে প্রশংসা করবেন না, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এরচেয়ে ভালো আর কিছু করার নেই।
.
৪৯.
ভোর পাঁচটায় আকাশ এখনও অন্ধকার। ঢোলা ট্রাউজার পরেছে মুরো কামাতোরি, দুভাগ করা স্কার্ট-এর মতো দেখতে। গায়ে চড়িয়েছে কেইটেন আমলের সিল্ক হান্টিং জ্যাকেট। পায়ে শুধু স্যান্ডেল।
পিটের পরনে শুধু টি-শার্ট ও শর্টস, শর্টস জোড়া ওর ফ্লাইং স্যুট কেটে তৈরি করা। পায়ে জুতো নেই, শুধু সাদা এক জোড়া মোজা।
ঘুম ভাঙিয়ে কামাতোরির ব্যক্তিগত স্টাডিতে নিয়ে আসা হয় পিটকে। কামরাটা গরম রাখার কোনো আয়োজন নেই, ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে হি হি করতে হয়েছে পিটকে। তবে ওর মনোযোগ কেড়ে নেয় দেয়ালগুলো। দুনিয়ার সব এলাকার সব যুগের অস্ত্র অ্যান্টিকস হিসেবে শোভা পাচ্ছে কামরার চারদিকে। আমার সুট, আমেরিকান ও জাপানি, সৈনিকদের মতো দাঁড়িয়ে আছে কামরার মাঝখানে। দেয়ালে শত শত তলোয়ার, বর্শা, তীর-ধনুক ও আগ্নেয়াস্ত্রের মাঝখানে রয়েছে বাঘ ও সিংহের ছাল, হাতির দাঁত, হরিণের শিং, মানুষের মাথা। মাথা থেকে ছাল ছাড়াবার পর গর্তগুলো ভরা হয়েছে মোম দিয়ে, ফলে প্রতিটি চেহারা চেনা যায়।
বিশেষ করে মানুষের মাথাগুলো গুনলো পিট। ত্রিশটা গোণার পর বমি পেল ওর। প্রতিটি মাথার কোটরে জ্বলজ্বল করছে কাঁচের চোখ। দেখে মনে হলো, বেশির ভাগই এশিয়ান। তবে ইউরোপিয়ানও কম নয়। রয় ওরশিয়ার মাথাটা চিনতে পেরে শিউরে উঠল পিট।
আমার ট্রফি রুমে স্বাগত, ডার্ক, দরাজ গলায় বলল মুরো কামাতোরি। এসো, কফি খাই। নিচু টেবিলের পাশে খালি কুশনটা দেখালো সে। কয়েক মিনিট গল্প করি, তারপর…।
বাকি সবাই কোথায়? বাধা দিল পিট।
কামাতোরির চোখে ঠাণ্ডা দৃষ্টি। পাশের ছোট্ট অডিটোরিয়ামে বসে আছে, ভিডিও স্ক্রীনে খেলাটা দেখতে পাবে।
ইউ বাস্টার্ড!
দেখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছে ওদের উপকারের জন্যে, হাসল কামাতোরি। প্রথম দিকের শিকাররা কে কোথায় কী ভুল করল দেখে সাবধান হবার সুযোগ পাবে।
আবার এমনো হতে পারে, ভয়ে চোখ বুজে থাকবে ওরা।
ঠোঁট বাঁকা হয়ে গেল কামাতেরির। এটা এক্সিপেরিমেন্টাল কোনো ব্যাপার নয়, ডার্ক। এ ঘটনা বহুবার ঘটেছে, ফলে পদ্ধতিটা পুরোপুরি নিখুঁত। শিকারদের বেঁধে রাখা হয় চেয়ারের সাথে, প্রয়োজনে টেপ দিয়ে আটকে খোলা রাখতে বাধ্য করা হয় চোখ। তোমার নিয়তি ও পরিণতি না দেখে উপায় নেই ওদের।
আমার বিশ্বাস, মি. কামাতোরি, লাশটি তুমি আমার দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবে, বলল পিট, দেয়ালে ঝুলন্ত মানুষের মাথাগুলোর ওপর দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিল। ওর চোখের দৃষ্টি স্থির হলো র্যাক ভর্তি তলোয়ারের দিকে।
মনে মনে ভয়ে মরে যাচ্ছ তুমি, মি. পিট। তবে সাহস দেখাবার ভানটা সত্যি প্রশংসনীয়, মন্তব্য করল কামাতোরি। তোমার যা খ্যাতি, এর চেয়ে কম কিছু আশা করি নি আমি।
আমার পর কার পালা? জানতে চাইল পিট।
কসাইটা কাঁধ ঝাঁকাল। তোমার বন্ধু অ্যাল জিওর্দিনো কিংবা মহিলা অপারেটর স্টেসি ফক্স। মেয়েটা হলে ভালো হয়। কারণ একটা মেয়েকে নির্মমভাবে শিকার হতে দেখলে বাকি প্রতিদ্বন্দ্বীরা খেপে যাবে, শিকার হিসেবে হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর। আমি আবার ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ ছাড়া শিকার করে আনন্দ পাই না।
আর যদি আমাদের একজনকে তুমি ধরতে না পারো? জানতে চাইল পিট।
দ্বীপটা ছোট্ট। আট ঘণ্টার বেশি কেউ আমাকে ফাঁকি দিতে পারে নি।
তুমি কোনো ছাড় দাও না? জিজ্ঞেস করল পিট। ধরা পড়ার পর ক্ষমার প্রশ্নও নেই?
না, বলল কামাতোরি, সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল ত্রুর হাসি। এটা বাচ্চাদের লুকোচুরি খেলা নয়, ডার্ক। এটা প্রাণ নিধনের প্রতিযোগিতা। তবে কথা দিচ্ছি, তোমার মৃত্যু হবে দ্রুত ও পরিচ্ছন্ন।
সামুরাইয়ের চোখে তাকিয়ে থাকল পিট। এটা তাহলে খেলা নয়? মানুষ শিকার? তার মানে আমাকে ডেঞ্জার রেইনসফোর্ড-এর ভূমিকা নিতে হবে? আর তুমি বেনে জেনারেল য্যারফ-এর ভূমিকা।
চোখ কোঁচকালো মুরো কামাতোরি। এ-সব নাম আমার পরিচিত নয়।
রিচার্ড কনেল-এর মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম পড়ো নি তুমি? ক্লাসিক একটা গল্প, এক লোক খেলাচ্ছলে মানুষ শিকার করতো।
আমি পশ্চিমা সাহিত্য পড়ি না। দরজার দিকে ইঙ্গিত করল সে। শুরু করার সময় হয়েছে।
কিন্তু এখনো তুমি নিয়ম-কানুন কিছু বলো নি।
কোনো নিয়ম নেই, ডার্ক। দয়া করে আমি তোমাকে এক ঘণ্টা সময় দেব। তুমি রওনা হবার এক ঘণ্টা পর রওনা হব আমি। আমার সাথে শুধু একটা তলোয়ার থাকবে, যে-কোনো মানুষকে শিকার করার জন্যে ওটাই আমার জন্যে যথেষ্ট। তবে ওটা একটা বিশেষ তলোয়ার। আমাদের পরিবারে কয়েক প্রজন্ম ধরে রয়েছে, রক্তও ঝরিয়েছে প্রচুর।
তুমি বলতে চাইছ তোমার পুর্ব-পুরুষরাও ভোমার মতো কাপুরুষ ছিল? নিরস্ত্র লোকদের এভাবে মারতো?
কামাতোরি জানে, তাকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে পিট। কথাটা গায়ে না। মেখে হাত তুললো সে। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। এক ঘণ্টা পর আসছি আমি।
ইলেকট্রিফায়েড কাঁটাতারের বেড়ায় গায়ে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো পিট। সেই সঙ্গে চেহারা থেকে খসে পড়ল নির্লিপ্ত ভাবটুকু। রিসর্ট ঘিরে থাকা গাছের সারিগুলো দূরে লম্বা, একটা রেখা তৈরি করেছে, সেদিকে ছুটলো ও। অদম্য রাগে লালচে হয়ে উঠেছে মুখ। গাছগুলোকে পেরিয়ে এসে নগ্ন, কর্কশ ও বৈরী-দর্শন পাথর আর কালো ছায়ার দিকে ছুটছে। অনুভব করতে পারছে ও, নিজের ভেতর মানুষটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ইন্দ্রিয়গুলো হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ, মাথাটা অসম্ভব ঠাণ্ডা। সমগ্র অস্তিত্ব আশ্চর্য সচেতন হয়ে উঠেছে, একটা মাত্র চিন্তা পরিচালিত করছে ওকে।
বাকি সবাইকে বাঁচানোর জন্যে নিজেকে বাঁচতে হবে ওর।
শুধু মোজা পায়ে ছুটতে কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। পাতুরে জমিনে ভেজা মাটির পাতলা আস্তরণ জমেছে, পায়ে জুতো থাকলে বরং অসুবিধে হত।
ছুটছে পিট প্রাণ হাতে করে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত ও, এ ধরনের কৌশল আগে কোনো দুর্ভাগা শিকার অবলম্বন করে নি। অপ্রত্যাশিত চমক ওর পক্ষে। অন্যান্যারা চেষ্টা করেছে রিসর্ট ও তাদের মাঝখানে যতটা সম্ভব দূরত্ব সৃষ্টি করার, তারপর উন্মত্তের মতো খুঁজে ফিরেছে লুকাবার মতো একটা জায়গা। কিন্তু সবাই তারা ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থতার খেসারত দিতে হয়েছে প্রাণ দিয়ে। কাজেই তারা যা করেছে পিট তা করবে না।
আরো একটা সুবিধে রয়েছে পিটের। মেল পেনারকে ধন্যবাদ, তার তৈরি দ্বীপের মডেলটায় খুঁটিনাটি সব কিছুই ছিল, তার মানে দ্বীপটাকে পিটের অচেনা বলা যায় না। দ্বীপটা কোন দিকটা বেশি উঁচু জানে ও, জানে ওদিকেটায় তার যাওয়া চলবে না।
ধাওয়া খেয়ে পলায়নরত ব্যক্তির একটা সাধারণ প্রবণতা হলো, ওপর দিকে উঠে যাওয়া। সিঁড়ি দেখলে ছাদে ওঠে, গাছ দেখলে মগডালে পাহাড় দেখলে চুড়ায়। ওগুলো যে আসলে শেষ মাথা, তারপর আর পালাবার জায়গা নেই, এক কথা মনে থাকে না।
বাঁক ঘুরে পুব দিকে ছুটলো পিট, তীরে পৌঁছুতে চায়। বাক ঘোরার সময় কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল, একবার এদিক গেল একবার ওদিক, যেন কোনো দিকে যেতে হবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। বাঁক ঘঘারার পরও বার কয়েক পিছিয়ে এল, চক্কর মারল, যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে। জমিন যেন চাঁদের পিঠ, আবছা অস্পষ্ট আলোয় দিক সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বোঝা যায় না, তবে তারাগুলো এখনো ম্লান হয় নি আকাশে, ফলে উত্তর দিকটা চিনতে কোনো অসুবিধে হলো না। একবার দাঁড়ালো পিট, বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে চারদিকটা ভালো কলে দেখে নিল।
পিট উপলব্ধি করল, স্যান্ডেল পায়ে ধাওয়া করে কামাতোরি তার শিকারকে কখনোই মাত্র আট ঘণ্টায় ধরতে পারে নি। শক্ত-সমর্থ যে-কোনো লোক, তার যদি বন-জঙ্গল সম্পর্কে খানিকটা অভিজ্ঞতা থাকে এবং ভাগ্য খানিকটা সহায়তা করে, দুই বা তিন দিন অনায়াসে প্রতিপক্ষের চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে, এমনকি তাকে খোঁজার জন্যে কুকুর লেলিয়ে দিলেও। আট ঘণ্টার মধ্যে ধরা সম্ভব, শিকারী যদি ইলেকট্রনিক বডি সেন্সর ব্যবহার করে। পিটের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে ওকেও সেন্সর বহুল একটা রোবট ধাওয়া করবে। আবার রওনা হলো ও, তবে এবার কোনো উত্তেজনা বা ক্লান্তি নেই।
এক ঘণ্টা শেষ হলো। সাগর থেকে উঠে আসা পাহাড় প্রাচীরটাকে পাশ কাটাচ্ছে পিট। খোটা পুঁতে বেড়া তৈরি করা হয়েছে, প্রতিটি বেড়া ঘেঁষে জন্মেছে গাছ ও ঝোঁপ। ছোটার গতি কমিয়ে বেড়ার গায়ে কোনো ফাঁক আছে কিনা লক্ষ করছে ও, বিশ মিটার নিচে সফেন সাগর ফুঁসছে। ওর তীক্ষ্ণ নজরে কোথাও কোনো ভিডিও ক্যামেরা বা বডি হিট সেনসর ধরা পড়লো না। দাঁড়ালো পিট, এখানটায় ছোট একটা ফাঁকা জায়গা দেখা যাচ্ছে, বড় বড় পাথরের স্তূপ আড়াল করে রেখেছে জায়গাটাকে। একেবারে কিনারায় ছোট একটা পাইন গাছ, কয়েকটা শিকড় বেরিয়ে রয়েছে পাথুরে জমিনের ওপর।
পিট প্রায় নিশ্চিত, কেউ ওকে দেখতে পাচ্ছে না। বাহু ও কাঁধের চাপ দিয়ে গাছের কাণ্ডটা পরীক্ষা করলো ও। কাত হলো গাছ, পাইন বহুল মগডাল সাগরের ও নিচের দিকে আরো পাঁচ সেন্টিমিটার ঝুকল। ওর হিসেবে, ও যদি মগডালের শাখায় উঠে যায়, ওর ভারে জমিনে বেরিয়ে থাকা শিকড়গুলো নিচে থেকে ছিঁড়ে যাবে, পিটকে নিয়ে শাখাটা পাহাড়-প্রাচীর ঘেঁষে পড়ে যাবে অশান্ত সাগরে।
এরপর কালো পানির দিকে তাকাল পিট। পাথরের দুটো স্তূপের মাঝখানে সাগর সম্ভবত তিন মিটার গভীর। গভীরতা চার মিটারে দাঁড়াবে ঢেউ ছুটে এলে। ঢেউ, ঢেউয়ের ভেঙে পড়া, পাল্টা স্রোত, ইত্যাদি লক্ষ করার সময় পিটের মাথায় যে আইডিয়াটা এলো, সুস্থ কোনো মানুষ তা বিবেচনা করে দেখতে না। ড্রাই বা ওয়েট স্যুট ছাড়া ওই ঠাণ্ডা পানিতে একজন সাতারু বিশ মিনিটও টিকবে না, আক্রান্ত হবে হাইপোথারমিয়ায়, পতনের ফলে যদি সঙ্গে সঙ্গে মারা না যায়।
একটা পাথরে বসে স্নাস্টিকের ব্লাড ব্যাগটা বের করল পিট, পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল বাম হাতটা লম্বা করল, আঙুলগুলো শক্ত করে মুঠো পাকার, চাপ দিল ডান হাতের আঙুল দিয়ে যতক্ষণ না কনুইয়ের উল্টোদিকে চিনতে পারল শিরাটাকে। কয়েক মুহূর্ত বিরতি নিল ও, মনের পর্দায় দেখতে পাচ্ছে শিরাটাকে, একটা হোস পাইপ হিসেবে কল্পনা করছে ওটাকে। এরপর ব্লাড ব্যাগের সাথে সংযুক্ত সূচটা তেরছাভাবে ধরে চাপ দিল শিরায়।
শিরার পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকল সুচ। আবার চেষ্টা করল পিট! তিনবারের বার শিরায় ঢুকল ওটা। পেশী শিখিল করে দিয়ে বসে থাকল ও, শরীরের রক্ত বেরিয়ে এসে জমা হচ্ছে ব্যাগে।
দূর থেকে ভেসে এলো কুকুরের অস্পষ্ট ডাক। বিস্ময়ের ধাক্কাটা প্রচণ্ড গুসির মতো আঘাত করল পিটকে, অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা অপ্রত্যাশিত কোন ব্যাপার নয়। কামাতোরিকে ছোট করে দেখায় ধিক্কার দিল নিজেকে। সে ব্লাড হাউন্ড লেলিয়ে দিতে পারে, এ-কথা একবারও মনে হয় নি ওর। অন্ধের মত ধরে নিয়েছিল শিকারকে খুঁজে পাবার জন্যে ইলেকট্রনিক যন্ত্র বা রোবট ব্যবহার করবে সে।
অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বসে থাকল পিট, কুকুরের রোমহর্ষক ডাক শুনছে আর দেখছে ধীরে ধীরে প্লাস্টিকের ব্যাগটা ভরে উঠছে নিজের রক্তে। দ্রুত কাছে চলে আসছে শিকারী কুকুর। আর বোধহয় দুশো মিটার দূরেও নয়, এ সময় ব্যাগে ৪৫০ মিলিলিটার রক্ত জমল। হ্যাঁচকা টান নিয়ে হাত থেকে সুচটা খুলে নিল পিট। রক্ত ভরা ব্যাগটা পাথরের একটা স্তূপের লুকিয়ে রাখল, ঢেকে দিল কয়েক মুঠো ধুলো দিয়ে।
কামাতোরি যাদের খুন করেছে তারা বেশির ভাগই কুকুরের ভয়ে ছুটতে শুরু করে, চেষ্টা করে নাগালের বাইরে চলে যেতে। কিন্তু তা সম্ভব নয়। এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা, পড়ে যায় মাটিতে। শুধু সাহসী লোকেরা রুখে দাঁড়িয়ে লড়ার চেষ্টা করেছে কুকুরের সঙ্গে, হাতের কাছে যা পেয়েছে তা-ই দিয়ে।
এক পা সামনে বাড়লো পিট, এখনো জানে না কী ধরনের বিস্ময় অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। লম্বা, মোটা একটা ডাল পেল ও। দুটো বেশ বড় সাইজের পাথরও নিল হাতে একটা বোল্ডারের ওপর রাখল ওগুলো, তারপর গা বেয়ে উঠে পড়ল মাথায়।
জমিন থেকে পা মাত্র তুলেছে, গাছগুলোর আড়াল থেকে তীরবেগে বেরিয়ে এলো কুকুরটা, পাশ কাটাচ্ছে পাহাড়-প্রাচীরকে।
হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল পিট। লোমে ঢাকা কোনো হিংস্র প্রাণী নয়, ওকে ধাওয়া করছে ভয়াল-দর্শন একটা রোবট।
সন্দেহ নেই হিদেকি সুমার রোবোটিক ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে কুকুরটাকে। লেজ খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ওটা আসলে একটা অ্যান্টেনা। পাগুলো হুইলের স্পোক-এর মতো ঘুরছে, শেষ প্রান্ত নব্বই ডিগ্রি বাঁকা করা, সহজেই যাতে মাটি কামড়াতে পারে। শরীর মানে হলো একটা আলট্রাসোনিক রেঞ্জার সেনসরকে ঘিরে ভিড় করে থাকা অসংখ্য ইলেকট্রনিক্সের সমষ্টি। এটা সম্ভবত রোবোটিক এঞ্জিনিয়ারিঙের সর্বশেষ আবিষ্কার। মানুষের গন্ধ, তাপমাত্রা ও ঘাম চিনতে পারে। একটা ডোবারম্যানের গতিতে যে-কোন বাধা এড়াতে সক্ষম। আসল কুকুরের সঙ্গে পার্থক্য হলো, এটা যান্ত্রিক চোয়াল কুৎসিত দর্শন ও ভয়ঙ্কর। দাঁতগুলো ধনুকের মতো বাঁকা করে সাজানো হয় নি, সাজানো হয়েছে গোল করে। ওটার ধাতব নাকের ভেতর হাতের ডালটা ঢোকাবার চেষ্টা করল পিট। চোখের নিমেষে হাত থেকে বেরিয়ে গেল ডাল, দাঁতের কামড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
তবে কৃত্রিম কুকুরটা পাথরের গা বেয়ে বোল্ডারের ওঠার কোন চেষ্টা করল না। বোল্ডারের গায়ে পা দিয়ে স্থির হয়ে থাকল। মিনিয়েচার ভিডিও ক্যামেরা পিটের অবস্থান ও গতিবিধি রেকর্ড করে নিচ্ছে। তার মানে, পিট ধারণা করল, ওটার কাজ হলো শিকারকে খুঁজে বের করে কোণঠাসা করে রাখা, এরপর যাতে ছুটে এসে খুনটা করতে পারে কামাতোরি।
মাথার ওপর একটা পাথর তুলে ছুঁড়ল পিট। ক্ষিপ্রগতিতে লাফ দিয়ে একপাশে সরে গেল যান্ত্রিক কুকুর। দ্বিতীয় পাথরটা তুলল পিট। এটাই ওর শেষ অস্ত্র তুলে ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করল, হাত থেকে ছাড়ল না। এবারও লাফ দিল রোবট, সেই ডান দিকেই। আবারও একই ভঙ্গি করল পিট, লাফটা ডান দিকেই দিল প্রতিপক্ষ। তৃতীয়বার ভান নয়, পাথরটা ছেড়ে দিল পিট। অব্যর্থ লক্ষ্য, সময়ের হিসেবে ভুল করে নি। পাথরটা ছুঁড়েছেও খুব জোরে। ইতোমধ্যে ওর জানা হয়ে গেছে, হামলার সময় শুধু ডান দিকে সরে যাবার প্রোগ্রাম করা আছে রোবটটার।
কুকুরটা ডাক ছাড়ল না, গোঙালও না। নীলচে বা গোলাপি আগুনের ফুলকি কিংবা আলোও দেখা গেল না। দুর্বলভাবে নেতিয়ে পড়ল শুধু। কাত হলো না, নিচের দিকে যেন ডেবে গেল, কমপিউটার ও মনিটরিং-সিস্টেম ধ্বংস হয়ে গেছে বোন্ডার থেকে নেমে ওটার ইলেকট্রনিক পেটে ঝেড়ে একটা লাথি মারল পিট, ফেলে দিল পাথুরে জমিনে। ভিডিও ক্যামেরা কাজ করছে না, নিশ্চিত হলো ও। তারপর ধুলো সরিয়ে রক্তের ব্যাগটা বের করল।
পিট আশা করল শরীর থেকে রক্ত বের করায় দুর্বল হে য় পড়ে নি। সামনে। কঠিন কাজ, শরীরের সবটুকু শক্তি দরকার হবে ওর।
হঠাৎ করে কব্জিতে বাঁধা খুদে টিভি মনিটর থেকে অদৃশ্য হলো ছবিটা। ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠল মুরো কামাতোরির, উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল সে। যান্ত্রিক কুকুরের সেনসর থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে তীর ঘেঁষা বেড়ার কাছে রয়েছে পিট। পুর্বদিকে, কম বেশি একশো সত্তর মিটার দূরে। নিজেকে এতো তাড়াতাড়ি কোণঠাসা হতে দিয়েছে পিট, বিস্মিত না হয়ে পারে নি সে। পুর্বদিকে রওনা হয়ে ভাবল, রোবটের কোথাও বোধহয় যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিয়েছে। গন্তব্যের কাছাকাছি এসে তার সন্দেহ হলো, যান্ত্রিক কুকুরটা কাজ না করার জন্যে পিটই বোধহয় দায়ী।
এ ধরনের ঘটনা আগে কখনো ঘটে নি। অন্যান্য শিকাররা রোবট দেখলে পালাতে দিশে পায় নি, ক্ষতি করা তো দূরের কথা। বাকি সবাই যা পারে নি তা যদি পিট পেরে থাকে, পৌঁছুবার সময় অত্যন্ত সাবধান থাকা উচিত তার। হাঁটার গতি কমাল সে। তার অন্তত সময়ের কোনো অভাব নেই।
বাকি দূরতুটুকু পেরুতে বিশ মিনিট সময় নিল রেবানামি, পৌঁছে গেল ফাঁকা জায়গাটায়। ঝোঁপের ফাঁক দিয়ে অস্পষ্টভাবে রোবটটাকে দেখতে পেল সে। কাত হয়ে পড়ে রয়েছে ওটা। তার মানে তার সন্দেহই সত্যি।
গাছপালার আড়ালে দাঁড়িয়ে ভোলা পাথরের স্তূপগুলোর ওপর চোখ বুলাল। কামাতোরি। তারপর সতর্ক পায়ে নিঃসাড় পড়ে থাকা কুকুরটার দিকে এগোল। খাপ থেকে বের করল তলোয়ারটা, খাড়া করল মাথার ওপর, ধরে আছে দুহাতে।
বড় করে শ্বাস টানল সে, তীক্ষ্ণ ও দুর্বোধ্য চিৎকার বেরিয়ে এলো গলা চিরে। তারপর লাফ দিল।
কিন্তু পিট ওখানে নেই।
ছোট্ট ফাঁকা জায়গাটা পরিত্যক্ত রণক্ষেত্রের মতো লাগছে। জমিন পাথর ও যান্ত্রিক কুকুরের ওপর রক্ত লেগে রয়েছে। পাহাড়-প্রাচীরের কিনারার দিকে এগিয়ে গেছে একটা মোটা ধারা, ঝরে পড়েছে নিচে। জমিনটা পরীক্ষা করল কামাতোরি। পিটের পায়ের দাগগুলো গভীর ও এলোমেলো, কিন্তু রক্তের কোনো দাগ ফাঁকা জায়গাটা থেকে বেরিয়ে যায় নি। কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে নিচের সাগর ও পাথর স্তূপের দিকে তাকালো সে। একটা গাছ দেখতে পেল। পাল্টা স্রোতের মধ্যে পড়ে খানিকদূর এগোচ্ছে সেটা, তারপর আবার ঢেউয়ের ধাক্কায় ফিরে আসছে পাহাড় প্রাচীরের গায়ে। প্রাচীরের কিনারায় বড় একটা গর্তও দেখল সে, দেখতে পেল ছেঁড়া কয়েকটা শিকড়।
আক্রান্ত হয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে রোবোডগ, আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে পিটকে। পালাবার কোনো জায়গা নেই, নড়ারও কোনো উপায় নেই, কাজেই আত্মরক্ষার জন্যে নিশ্চয়ই পিট গাছে চড়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু গাছের ডাল ওর ভার সহ্য করতে পারে নি, ওকে নিয়ে পড়ে গেছে নিচের পাথরে। পিটের লাশটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না বটে, নয়তো টেনে নিয়ে গেছে তার।
অন্ধ আক্রোশে বিস্ফোরিত হলো কামাতোরি। যান্ত্রিক কুকুরটাকে হ্যাঁচকা টানে তুলে নিয়ে কিনারা দিয়ে সাগরে ফেলে দিল সে। তার রাগের কারণ হলো, এই প্রথম একজন শিকার তাকে ফাঁকি দিয়েছে। ডার্ক পিটের মাথা তার দেয়ালে শোভা পাবে না।
ঠিক আছে, বাকি জিম্মিদের ওপর প্রতিশোধ নেবে সে। সিদ্ধান্ত নিল, তার পরবর্তী শিকার হবে স্টেসি ফক্স। একে একে অ্যাল জিওর্দিনো, ফ্রাঙ্ক ম্যানকিউসো ও টিমোথি ওয়েদারহিলের চেহারাগুলো ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। রঙিন টিভি স্ক্রীনে সবাই ওরা দেখতে পাবে স্টেসিকে কীভাবে টুকরো টুকরো করা হচ্ছে। তলোয়ার দিয়ে।
নাকের সামনে তলোয়ার খাড়া করে ফিরে আসছে মুরী কামাতোরি। নতুন সূর্য উঠল আকাশে, রোদ লেগে ঝিক্ করে উঠল তার তলোয়ারের ফলা।