৪০. যুধিষ্ঠিরের আশ্বমেধিক পর্বের স্মৃতি
ভীষ্মকে জলাঞ্জলি দেওয়ার পর মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে অনুগমন করে মহাবাহু যুধিষ্ঠির জল থেকে উত্থিত হলেন। এই সময় তিনি স্বজনবিয়োগে একদম ভেঙে পড়েছিলেন। রাজাকে এরকম হতোৎসাহ দেখে পান্ডবেরা। সকলেই শোকমগ্ন হয়ে তাঁর কাছে বসলেন।
কৃষ্ণ তখন বললেন, ‘মানুষ যদি মৃত প্রাণীর জন্য অত্যন্ত শোকাতুর হয়, তাহলে পরলোকবাসী পিতা পিতামহগণও অত্যন্ত সন্তপ্ত হন। সুতরাং আপনি সোমরস দ্বারা দেবগণকে এবং স্বাধ্যায় দ্বারা পিতৃপুরুষগণকে তৃপ্ত করুন।’
তখন যুধিষ্ঠির বললেন, ‘গদাধর, আমি পিতামহ ভীষ্ম এবং কর্ণের মতো বীরদের হত্যা করেছি। ফলে শান্তি আমার কাছে প্রবাসী পাখির মতো।’
ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরের এই ধরনের উত্তরে বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি বললেন ‘ক্ষত্রিয়ের ধর্ম সম্পর্কে তুমি অভিহিত হলেও তোমার বুদ্ধি এখনও রাজধর্মের পক্ষে উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। মোক্ষধর্মের কথাও এর আগে তোমাকে আমি বলেছি এবং তুমি বিস্মৃত হয়েছ। যা-ই হোক, তুমি অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করো।
–কিন্তু পিতামহ, ভ্রাতা-স্বজনদের মহা সংহারের পর রাজকোষ অর্থশূন্য। যুদ্ধে যে-পরিমাণে ভূমি সংহার হয়েছে, রাজস্ব দিতে প্রজারা অপারগ। সামান্য দক্ষিণা ও দানের অর্থও আমাদের নেই।
–তুমি প্রতিনিধি দক্ষিণার আয়োজন করো তবে।
–কেশব, সে কি খুব হীন যজ্ঞ হবে না? তখন কৃষ্ণ ব্যাসদেবকে অন্য কোনো উপায় বার করার জন্য অনুরোধ করলেন। সব শুনে ব্যাসদেব বললেন, ‘ঠিক আছে ধর্মরাজ, হিমালয় পর্বতে শীঘ্র গমন করো। সেখানে রাজা মরুত্তের প্রদত্ত প্রভূত স্বর্ণ ব্রাহ্মণেরা বহন না করার কারণে পরিত্যক্ত পড়ে রয়েছে, তুমি তা সংগ্রহে প্রবৃত্ত হও।’
কৃষ্ণ ও ব্যাসদেবের কথামতো হিমালয় পর্বতের কন্দরে কন্দরে কষ্টার্জিত ভ্রমণের ফলে প্রভূত স্বর্ণ সংগ্রহের পর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ সুসম্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু স্বস্তি শান্তি এসব পেলেন কই? দ্রৌপদীরও শয্যায় আসতে অনীহা, দূতক্রীড়ার আয়োজনও আর সম্ভব নয় কারণ তবে সমগ্র বসুন্ধরাকেই বাজি রাখতে হয়। সর্বপ্রকার পাপ আর দ্বন্দ্ব থেকে কিছুটা মুক্তির দিশা যিনি দেখাতে পারতেন সেই কৃষ্ণও অরণ্যাচারী হয়েছেন। তিনিও অজ্ঞানী পুরুষের ন্যায় তৃণে শয়ন করে কাল অতিবাহিত করছেন।
.
৪১. ব্রহ্মা উবাচ
তৃণে শায়িত মৃত্যু-তাপিত কৃষ্ণকে ব্রহ্মা বললেন, ‘কেশব, এবার আমি পদার্থাদির আদি, মধ্য ও অন্তের বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। প্রথমে দিন, তারপর রাত্রি। শুক্লপক্ষ মাসের, শ্রাবণ নক্ষত্রাদির এবং শীত ঋতুর আদি। গন্ধের আদি কারণ ভূমি, রসের জল, রূপাদির জ্যোতির্ময় আদিত্য, স্পর্শের বায়ু এবং শব্দের আদি কারণ আকাশ। এইগুলি গন্ধাদি পঞ্চভূত থেকে উৎপন্ন গুণ। সূর্য সমস্ত গ্রহের এবং অনল সমস্ত প্রাণের আদি। সাবিত্রী সমস্ত বিদ্যার এবং প্রজাপতি দেবতাদের আদি। এই জগতে যা নিত্য উচ্চারিত হয় তাকেই গায়ত্রী বলা হয়। ছন্দের আদি গায়ত্রী। সৃষ্টির প্রারম্ভ কাল। গাভী চতুষ্পদাদির মধ্যে শ্রেষ্ঠ, ব্রাহ্মণ মনুষ্যাদির মধ্যে সর্বোত্তম। সত্যযুগ সমস্ত যুগের আদি। রত্নের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সুবর্ণ, ভোজ্য পদার্থের মধ্যে অন্ন শ্রেষ্ঠ। পাকুড় বৃক্ষশ্রেষ্ঠ এবং সমস্ত প্রজাতির আদি আমি ব্ৰহ্মা এবং আমার অচিন্ত্য আত্মা তুমি কৃষ্ণ। তুমিই তো বিষ্ণু, তুমিই নারায়ণ এবং তুমিই স্বয়ম্ভু। পর্বতের মধ্যে মেরুপর্বত আদি, দিকের মধ্যে পূর্ব দিক প্রধান এবং সর্বনদীর শ্রেষ্ঠ গঙ্গা। জগতের আদি, অন্ত, অব্যক্ত হচ্ছেন প্রকৃতি।
.
৪২. কৃষ্ণের স্মৃতিতে দ্রৌপদী
বিজ্ঞানবেত্তা ব্রহ্মার কথায় অত্যন্ত প্রীত হলেন কৃষ্ণ। এই তবে মহাজীবন প্রবাহের অঙ্গীভূত দিন-রাত্রি, নক্ষত্রলোক যাবতীয় বস্তুবাদের এক অনিঃশেষ ব্যাখ্যা। ব্রহ্মাও প্রণাম করলেন কৃষ্ণকে, যিনি মৃত্যুর সন্নিকটে থেকেও নবীন মেঘবৎ উজ্জ্বল শ্যামবর্ণে কান্তিবান, বক্ষে অপূর্ব শ্রীবৎস লাঞ্ছিত, পদতল রক্তবর্ণবিশিষ্ট।
ব্রহ্মা বিদায় নেওয়ার পর কৃষ্ণের স্মৃতিতে আবার ফিরে এল সেই বহমান যমুনা নদী। তবে একদমই স্থায়ী হল না। ভেসে উঠল চন্দ্রাতপ আবৃত সভাস্থল। পুষ্পমাল্য ও বর্ণময় পতাকায় শোভিত। দুন্দুভি বাজছে, বীণার ধ্বনিও শ্রুত হচ্ছে। রাজনৰ্তকীরা নৃত্যগীত পরিবেশন করছে। এই সভাস্থল আসলে আজ এক বিশেষ আয়োজনে সমৃদ্ধ হয়েছে। দ্রুপদ রাজের কন্যা শ্যামবর্ণা কিন্তু অসামান্য রূপবতী, দীর্ঘাঙ্গী। আয়তনয়না দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভা। ভোজ, অন্ধক বংশীয়দের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরামও উপস্থিত আছেন এই সভায়। কৃষ্ণ উপবেশন করেছেন যাদব বংশীয় রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে। বহু নৃপতি এসেছেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। একদম পশ্চাতে সাধারণ জনগণও রয়েছে। রবাহূত হয়েই তারা এসেছে এই ঐশ্বর্যের, বীরত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে। সভার মধ্যস্থলে রয়েছেন আহূত রাজকুমার এবং নৃবৃন্দ।
ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীকে নিয়ে এসেছিলেন স্বয়ংবর মঞ্চে পুরোভাগে। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক দুর্দম কাহিনি। অবশেষে জয়ী হলেন এক ব্রাহ্মণকুমার। ধনহীন কিন্তু শক্তিমান। উপস্থিত পরাজিত রাজারা সংক্ষুব্ধ ছিলেন আর কৃষ্ণ অনুনয় বাক্যে বিমোহিত ও নিরস্ত্র করেছিলেন তাঁদের।
সেই কৃষ্ণ এবং পার্থের উভয়ের সখা হয়ে ওঠা। যদিও পথ ছিল অসম্ভব কন্টকিত। দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর ভার্যা হলেন। এ যেন পণ্যেরই মতো এক মহা মূল্যবান সম্পত্তি। কৃষ্ণ ব্যাখ্যা দিলেন দ্রৌপদীকে, রাজার। নিজের বলে থাকতে কিছু নেই। পাঁচজনের অধিকার রয়েছে এতে। পৃথা উত্তরে খুশি হলেন না। যজ্ঞাগ্নি অন্তরে থেকেই গেল। এরপর বিদুর যেদিন এলেন হস্তিনাপুরের দূত হয়ে কুন্তী-সহ পঞ্চপান্ডবকে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান নিয়ে, সত্যিই তখন সম্বলহীন, দীন পঞ্চপান্ডব। সৈন্য নেই, অর্থ নেই, বন্ধুরাষ্ট্রও নেই। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের বন্ধুত্ব প্রার্থনা করলেন। সম্মত হওয়ার অর্থ অকারণে যাদবকুলের শত্রুতা বৃদ্ধি করা। পশ্চিম ভারতের অনুপ্রবেশ উত্তর ভারতের রাজনীতির আবর্তে। ব্যক্তিক দিক থেকে দৃষ্টিপাত করলে কৃষ্ণের সময়ের সদ্ব্যবহার করা উচিৎ। আর প্রত্যাবর্তনের উপায় নেই রাধার কাছে। গর্ভপাতের পর সে কৃষ্ণকে ঘৃণা করে কি না তাঁর অজানা। গোপিনীদের সঙ্গে বৃন্দাবনলীলা প্রাচীন হয়ে এসেছে। কেমন যেন সম্মানহীন জীবন। সামান্য প্রজাতির রাজা। আর হস্তিনাপুর মানেই ভারতবর্ষ। সমগ্র ভারবর্ষের মানুষ জানবে তাঁকে। কূপমন্ডুকতা বিসর্জন দিয়ে কৃষ্ণ পান্ডবদের সঙ্গ নিলেন। আর নতুন সখি হিসেবে লাভ করলেন যাজ্ঞসেনীকে। অদ্ভুত এক সখ্য। কৃষ্ণ উপভোগ করলেন নারীর এক ভিন্ন রূপ।
ধৃতরাষ্ট্র পান্ডবদের দিলেন খান্ডবপ্রস্থের অরণ্য। এক জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি। অকর্ষণযোগ্য, অনুর্বর মৃত্তিকা, পাহাড় এবং অরণ্যবেষ্টিত খান্ডবপ্রস্থ। নতুন রাজনৈতিক নির্মাণ তখন তাঁর মনে। অবসাদ লুপ্ত হয় কৃষ্ণার হাস্যরসে। চটুলতা, বিশেষ করে নারীর, তিনি চিরকালই উপভোগ করেন। দেহজ কিছু নয় অথচ অসাধারণ এক আকর্ষণ। পুরুষের সখ্যের মধ্যে কর্মসম্পাদনের প্রয়াস বিয়োজিত হলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। পার্থক্য উদ্দীপ্ত করতে গেলে দ্রৌপদীর সঙ্গও এক অনিবার্য বিরতির সুখ দেয়। অরণ্য অচিরেই রূপ পেল নগরে। পরিখা খনন করা হল। অনুর্বর জমিতে এল উর্বরতা। এরপরের কাহিনি বহুশ্রুত। সঞ্জয়ের ধৃতরাষ্ট্রের সমীপে সেই ধারাভাষ্য নগর ছাড়িয়ে গ্রামান্তরেও জনপ্রিয়। যদিও গ্রাম, জনপদ সবই জনশূন্য। ভূমি, বায়ু সবই বিষময়। বিষ ধারণ করতে তিনিও এসেছেন এই অরণ্যে। খান্ডবপ্রস্থের উদ্দামতা এখন বিলীন। পাঞ্চালীর সংবাদ জানেন না দীর্ঘদিন। এই অরণ্যভূমিতেও বার বার ফিরে আসে কুরুক্ষেত্রের রণক্ষেত্র। চারিদিকে শব– মানুষের, হস্তীর, অশ্বের। দেহচ্যুত আভরণ– অসি, বর্ম, কৃপাণ, ধনুক, তির। শকুন, পেচকেরা বীর দেহগুলি খুবলে খুবলে খাচ্ছে। আর এই রণভূমি দেখে একমাত্র তৃপ্ত যাজ্ঞসেনী। প্রমীলাদের বিলাপ যেন কৃষ্ণের সখির অন্তরে প্রবেশ করছে না। সেই মুহূর্তে রাতের অন্ধকারে ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র নিহত হল।
কৃষ্ণও টের পেয়েছেন অশ্বত্থামা এই অরণ্যেই রয়েছে। ওর লক্ষ্য কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর বান্ধবকে অশ্বত্থামা ক্ষমা করতে পারেনি। আসল এই সময় বড়ো প্রতিস্পর্ধী। যাজ্ঞসেনী উত্তেজিত রেখেছেন কৃষ্ণকে। তিনিও প্লাবিত হয়েছেন, পাপে আকীর্ণ হয়েছেন। প্লাবিত হওয়ার মতো উজ্জ্বলতা কৃষ্ণার ছিল। দুঃশাসন তখন দ্রৌপদীর পরিধেয় বস্ত্র আকর্ষণ করে ভরা সভায় শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছে। পিতামহ ভীষ্ম, বিদুর, পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্র, দ্রোণাচার্য, পঞ্চপান্ডব– সকলেই নীরব দর্শক। হঠাৎ ঋজু ও দৃঢ় হয়ে দাঁড়ালেন পাঞ্চালী, ‘এখানে পুরুষ নেই, আছে কয়েক জন ক্লীব।
রাজ্যহীন ত্রয়োদশ বৎসরের বনবাসপর্ব পান্ডবদের শুরু হল। কৃষ্ণ এলেন সরস্বতী নদীর তীরে কাম্যক বনে। চেনা যায় না দ্রৌপদীকে। কৃষ্ণকে দেখে অভিমানে কেঁদে উঠল দ্রৌপদী।
আমায় কেউ নেই, পতি পুত্র বান্ধব পিতামাতা কেউ নেই। এমনকী কেশব তুমিও নেই।
–কী চাও তুমি সখি?
–ত্রয়োদশ বর্ষ অপেক্ষা নয়, এই মুহূর্তে যুদ্ধ। আমার অপমানের প্রতিশোধ। আমি কিন্তু তোমার কাছে কৃপা চাইছি না। অনিশ্চিত, অনির্ভরযোগ্য ধর্মের স্বস্তিবচন নয়, আমি চাই রক্তাক্ত প্রতিকার।
কৃষ্ণ ম্লান হেসে বললেন, যাজ্ঞসেনী, পান্ডবেরা এখন হীনবল। সম্পদ, সৈন্য, অস্ত্র কিছুই নেই ওদের। রাজসিংহাসনই শক্তির উৎস। রাজনীতির এটুকু উর্ণনাভ তোমার অবিদিত নয়। ধৈর্য ধরো সখি!
দ্রৌপদীর দৃষ্টি অনলবর্ষী। এরকম নারী কেশবের জীবনে কখনো আসেনি।
–ধর্মের জন্য, সত্যের জয়ের জন্য তুমি তো রয়েছ।
বাইরের আকাশ তখন রক্তবর্ণ। কুরুক্ষেত্র শ্মশানভুমি। অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্য নিহত। যুধিষ্ঠির পরিতাপ করছেন, ‘এই জয় আমি চাইনি।’ পাঞ্চালী কৃষ্ণকে অনুরোধ করলেন যুধিষ্ঠিরের অভিষেক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। তিনি অপেক্ষা চান না। কেশব সখির মনোগত ইচ্ছা ছলেবলে পূর্ণ করেছেন। তিনি নন্দিত। বৃকোদর শত্রুরক্ত পান করে তার অবশিষ্টাংশ পাঞ্চালীকে দিয়েছিলেন। বেণীবন্ধে মাখিয়ে রেখেছেন যাজ্ঞসেনী। রক্তের উষ্ণ তাপ বড়ো প্রিয়। পুরোহিত ধৌম্য অভিষেক ক্রিয়া আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণ বাজালেন পাঞ্চজন্য।
অরণ্যের প্রান্ত অন্ধকারে কৃষ্ণ অনুভব করলেন মহাকাল আসলে নারী। কালের গর্ভপাতে তিনিও ক্রীড়নক মাত্র।
.
৪৩. পুনরায় রাধা
চলভাষ যন্ত্রটা নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলতেই যেন দূরাগত বাঁশির ধ্বনি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
–আমি কিন্তু পরস্ত্রী। আয়ান আমায় সন্দেহ করছে।
–ভালোবাসায় পাপ নেই।
–কিন্তু শরীরে তো পাপ রয়েছে।
–ভালোবাসা দেহের অতীত।
–বাঁশির সুরের মধ্যে অস্তিত্বের সংবাদ থাকে, বিহ্বলতা থাকে, উদ্বেগও থাকে। আর রমণে থাকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। একবার তাকে গ্রহণ করে অস্বীকার করা যায় কি?
–মনের কোনো শরীর রয়েছে?
–শরীর মনের পরিপূরক। আলাদা করা যায় না।
–প্রবীণা হয়েও এখনো তুমি আমার সঙ্গ চাইছ। সে তো মনেরই খেলা।
–শরীরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে, ফলে তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার স্পর্ধা নেই। এখন তোমার প্রতি যেটা রয়েছে কৌতূহল।
অভিমান আর অবিশ্বাস যুগপৎ অন্বেষণ করছে মহাভারতের নায়ক অথচ প্রতারক কৃষ্ণকে।
নদীর জলের দিকে তাকিয়ে দেখল রাধা চলভাষের অস্তিত্ব কোথাও নেই। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আরেক জন ব্যক্তি যিনি চলভাষের কৃৎকৌশল জানতেন। হয়তো এই ভারতবর্ষের রাজচক্রবর্তী হিসেবে কৃষ্ণ তাঁকে দিয়েও থাকতে পারেন। যা-কিছুই চলে যায় আর প্রত্যাবর্তন করে না। সেই সময়ের জন্য সত্যি হয়ে থাকে। যুধিষ্ঠিরও সংযোগের বাইরে। জলপোকারা কখনো যদি ফিরিয়ে দেয় সেই আশ্চর্য যন্ত্র।
–মহাভারত, হরিবংশ, ভাগবতদর্শনের কাল ছুঁয়ে আমি থাকব। তুমি থাকবে।
–অশরীর, অনস্তিত্ব, প্রস্তরবৎ হয়ে রাধা বাঁচতে চায় না।
–রাধা তো প্রেমের প্রবাহ, তার শুরু নেই শেষও নেই– অনন্ত প্ৰবাহিণী ধারা।
নদীর জলের বাতাসে বিচিত্র হর্ষধ্বনি শ্রুত হচ্ছে যেন। বাঁশির মূর্ঘনায় আবার হারিয়ে যাচ্ছে রাধা। প্রতিরোধ ভেঙে যাচ্ছে। ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে কতকাল হয়ে গেল। বাঁশির সুরে সেই ঋতুস্রাব যেন পুনরায় ফিরে এসেছে। রক্তাক্ত হচ্ছে রাধা। বাঁশির সুর যেন প্রাচীন সময়ের হাত ধরেই প্রত্যাবর্তন করেছে।
–তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
–ন্যাকা পুরুষদের আমার একদম ভালো লাগে না।
–আমি মৃত্যু তাপিত কৃষ্ণ।
–আমার বাসনা অনন্ত। তৃষ্ণার শেষ নেই।
–তোমার আবার ঋতুস্রাব হবে।
–হচ্ছে।
–কতদিন নিজের হাতে ধরে তোমায় আদর করিনি।
–’আত্মনং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্ৰগ্ৰহমেব চ।’ অনুভূতি নয়, চিরকাল বুদ্ধিই তোমার রথের সারথি।
–আমি ওসব ভুলে যেতে চাইছি।
–’আসংযতাত্মনা যোগে দুস্পাপ্য ইতি মে মতিঃ।‘ কেশব, তুমি এতটাই আবার অসংযত হচ্ছ। তোমার আত্ম আবিষ্কার কোথায় গেল?
–আমি কতদিন রমণের সুখ উপভোগ করিনি।
–তুমি এখন অপারগ পুরুষ। আয়ানের মতোই তুমি এখন যৌনতা বিলুপ্ত হয়েছ।
–আমি সকাম প্রেমের শিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী।
–ব্রহ্মভাব সম্পন্ন হও।
–আমি চাই না ব্ৰহ্মভাব। আমি কৃষ্ণ রাধারমণ।
–অর্থ, ফল, খ্যাতির অন্যায় আকর্ষণে তুমি অনুপ্রবিষ্ট হয়েছ এমন গহ্বরে, যেখানে সুখের বাহ্য ক্রিয়াগুলি অনুপস্থিত। তুমি তো একেই ব্ৰহ্মভূত বলেছ।
–আমি ফিরিয়ে নিতে চাই দর্শন।
-কৃষ্ণ, আর তা সম্ভব নয়। প্রকৃতি আমায় ঋতুস্রাব ফিরিয়ে দিয়েছে কিন্তু তোমার রমণক্ষমতা আর ফিরবে না। প্রকৃতি তোমার প্রতি বিরূপ হয়েছেন।
–আমার চলভাষ যন্ত্রটা নদীতে নিক্ষেপ করলে কেন?
–কারণ তুমি কালকেও প্রতারণা করেছ। ধীমান হয়েও তাকে প্রকৃত মনীষা দাওনি, শুধু তগত করেছ।
–আমি কামের তাড়নায় কর্ম সম্পাদন করেছি। নিষ্কাম পুরুষের ব্ৰহ্মত্ব আমার কখনো লক্ষ্য ছিল না। এতে আমার সময় রক্তাক্ত হয়ে থাকলেও প্রবৃত্ত কর্ম ব্যতীত আমার কিছু করার ছিল না।
–সর্বনারী হচ্ছে সর্বগম্যা ও স্বৈরিণী– এটাই হচ্ছে কামিনীমোহন সনাতন ধর্ম। তোমারও সমর্থন রয়েছে এতে!
–সৌভঞ্জন বিভিন্ন শাক দিয়ে তুমি অপূর্ব ব্যাঞ্জন তৈরি করতে, আমি কখনো বিস্মৃত হইনি রন্ধনের সেই অনন্য কুশলতা। শাস্ত্রকারেরাও তাই, নারীকে ভোগের লেলিহান ইচ্ছে তাঁরা অবদমিত করে রাখেন, তাই যখন আপ্যায়ন প্রস্তুত হয় অমার্জিত ইচ্ছেগুলির বিকৃত প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।
–কেশব, রাতের পর রাত তুমি আমার সামনেই ত্যাগ করেছ উজ্জ্বল বেশবাস, শিরস্ত্রাণ, রত্নাভরণ। রূপসজ্জার মোহন বর্ণ ধৌত হয়ে তুমি সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে আমার কাছে প্রকাশিত ছিলে। এবারও আমি তোমাকে জানলাম একান্তে, যদিও সবিস্তার স্বীকৃতি তুমি কখনো করবে না লোকসমক্ষে।
–রাধা, তোমার মনীষায় আমি অভিভূত।
–তুমি কি আমায় পোষ্য নারায়ণী সেনাদের মতোই অর্বুদ মনে করেছিলে? শুধুই বলিপ্রদত্ত।
–কোনো কিছুই লুক্কায়িত থাকবে না। আমাদের অপার্থিব প্রেমের অবগুণ্ঠন কিছু বিরল মানুষ বিশ্বাস করবেন। ভক্ত তারা এবং যশের আকাক্ষী দেবগণের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। স্বাস্থ্য, আয়ু, যশ, কান্তি ও বিত্তের প্রাচুর্যও যাঁরা পাবেন তাঁরাও চাইবেন রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলার অপার্থিব প্রচার। আর বহু নারী যাদের অন্তঃসারকে নিংড়ে নিয়ে প্রেরণার অবলোক দীপ্ত রাখবে- সেই কবির দল মানবিক অভীপ্সার চোখে এই প্রেমের মূল্যায়ন করবে। এই মধুর, বিপরীতমুখী খেলায় কাল থেকে কালান্তরে জগৎ আহত হবে।
–এটাও তো এক ধরনের ভাগ্যদেবতার নিষ্ঠুর বিদ্রূপ।
–আয়ান তোমাকে কী বলতেন?
–ধ্যানস্থ হতে।
–ধ্যান করতে?
–তখন জলে, বস্ত্রে, তৈজসপত্রে সব কিছুতেই তুমি বিরাজমান থাকতে কৃষ্ণ।
–আয়ান রাগ করতেন?
–রাগের লক্ষণ কোনোদিন দেখিনি। আমার তাকে কখনো পুরুষ বলে মনে হয়নি।
–জটিলা, কুটিলা?
–বুদ্ধিনী। আয়ানের আজ্ঞাপালক পরিচারিকাদের মতো।
–আয়ানের নির্দিষ্ট নির্দেশ কিছু থাকত?
–অবশ্যই। ওটা অত্যন্ত ঘৃণয়, আমাকে অনুসরণ।
–তুমি এখন কোথায় আছ, রাধা?
–তুমি আসবে, নাথ?
–আমায় চিনতে কষ্ট হবে তোমার।
–কেন?
–পান্ডবদের যুদ্ধ তো শুধু কৃষ্ণেরই যুদ্ধ ছিল। এই মহাযুদ্ধ আমারও যাবতীয় জীবনরস নিংড়ে নিয়েছে।
–তোমার কি চিত্তবিকার ঘটেছে? তোমার মতো পুরুষের জন্যই তো আমার কতকালের প্রতীক্ষা।
–আমায় দেখতে চাও তুমি?
–হ্যাঁ নাথ।
নদীর জলে মরণশীলতায় রেখাঙ্কিত এক মুখমন্ডল ভেসে উঠল। রাধা বেদনার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেই প্রতিবিম্বের দিকে। তিনিই কৃষ্ণ। রাধারমণ।
.
৪৪. চার্বাক
–গুরুদেব, আমাদের উর্জি পরাক্রম নিয়ে এখন কর্মে তৎপর হতে চাই।
–সাত্বৎ আহারে তোমরা অভ্যস্ত হয়েছ তো?
–আমরা দীর্ঘ সদাচারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি।
–অশিষ্ট কদাচার কাউকে সুস্থ রাখতে পারে না।
–তোমাদের কর্মের উর্জনার কেন প্রয়োজন অনুধাবন করেছ?
–দেশের জন্য, সমাজের জন্য।
–দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তোমরা অবহিত তো?
–হ্যাঁ। অন্ধ তমসায় নিমজ্জিত।
–অন্তর-অগ্নিতে হোম-আহুতি দিতে প্রস্তুত তো?
রূপজ্যোতি-সহ জনা পঁচিশেক যুবক সমস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ’।
–তোমাদের আত্মিক সংবেগ বিচ্ছুরিত হয়ে উঠুক। তোমার প্রতি প্রত্যেককেই অগ্নি করে তোলে। আর সেই অগ্নি হবে সক্রিয় তাৎপর্যের। রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি কী?
–অস্তি বৃদ্ধির ধূতি।
–কিন্তু ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনীতি সভ্যতাকে বিনাশের দিকে নিয়ে চলেছে।
রূপজ্যোতি বলল, ‘গুরুদেব, এর জন্য দায়ী কে?’
–কৃষ্ণ।
–শুনেছি তিনি একানুধ্যায়ী। ভগবৎ প্রেরণায় উত্তাল করেছিলেন সমগ্র ভারতবর্ষকে।
–তিনিই আবার ভীতিপ্রদ শাসন সংস্থার অধিনায়ক।
–আমরা রাষ্ট্রীয় সত্তার সংরক্ষন চাই।
–আমারও তাই অভিপ্রেত। আমার গুরু চার্বাক ছিলেন প্রত্যক্ষের প্রমাণবাদী। তিনি বলতেন জ্ঞান নির্ভর করে প্রত্যক্ষের উপর। যেকোনো জড়বস্তু ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুৎ–এই চতুর্ভুতের সৃষ্টি। মানুষের। অহিভৌতিক আত্মা বলে কিছু নেই।
–বাঃ।
–জীবন সম্পূর্ণরূপে ভূতসৃষ্ট। কিন্তু তাঁরও কিছু ত্রুটি ছিল।
–যুগের অগ্রবর্তী ধারণার অধিকারী বলে?
–না। অতীত বিগত, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এই নিয়ে কোনো সংশয় নেই। সংশয় ছিল তাঁর জীবনযাপনে।
–তিনি কি সদাচারী ছিলেন না?
–তিনি ছিলেন অনাচারী, অভক্ষ ভোজী এবং অগম্যগামী। ফলে সত্তা সংবর্ধনা তাঁর দুঃস্থ ছিল।
–আর এই কৃষ্ণ?
–তিনি দ্বিচারিতার দোষে দুষ্ট। তিনি বলেন আসক্তিহীন কর্মের কথা। কার্যের সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সমবুদ্ধি। অথচ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ কী বার্তা বহন করে!
-’নির্বিচারে সংহার।’ রূপজ্যোতি বলল।
–তার চেয়েও বেশি নৈতিক জীবনের পঙ্কিলতা– এর সর্বব্যাপ্ত রূপ এর আগে দৃষ্ট হয়নি।
–এখন কোথায় রয়েছেন?
–দূরের অরণ্যে।
–এবার তাঁর বিনাশ প্রয়োজন।
–কোনো বস্তু যদি দূরে থাকে, অতিদূরাৎ তবে তা প্রত্যক্ষ হয় না। যদি অভিভূত থাকে যেমন সূর্যের তেজে গ্রহ-নক্ষত্রাদি অভিভূত থাকে। সদৃশ বস্তুতে মিশে যায় যেমন জলাশয়ের জল থেকে মেঘের জলকে আলাদা করা যায় না। তবে সেই বস্তু প্রত্যক্ষ হয় না। তিনি অরণ্যাচারী হয়েছেন ফলে অতিদূরাৎ। তিনি মৃত্যুর দ্বারা অভিভূত। তিনি কৃষ্ণ বর্ণের, ফলে বৃক্ষাদির সঙ্গে আলাদা করা যায় না। এই সমস্ত কারণে কৃষ্ণ অস্তমিত হয়েছেন। তাঁর কাল সমাপ্ত, ফলে হত্যা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তবুও প্রয়োজন রয়েছে তাঁর দর্শনের মৃত্যুর।
–সেটা কী, গুরুদেব?
–অনাচারী জীবনের কারণে চার্বাক পারেননি।
–রাষ্ট্রে তো এখনও কৃষ্ণনীতি অনুসৃত হয়। এখনও খুবই কঠিন সেই দর্শনের বিষয়ে জনমানসে সংশয় উপস্থিত করা।
–আমাদের দ্রোহ হবে অনীতির বিরুদ্ধে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মূল নীতির বিরুদ্ধে।
–কীভাবে?
–প্রকৃতির উপাদানে সত্ত্বজ্ঞান হচ্ছে যার প্রকাশিত হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, দর্পণে যে প্রতিবিম্ব পড়ে।
–এর অর্থ কী?
–কৃষ্ণ ছিলেন সত্ত্বজ্ঞানী।
–তবে উপায়?
–খুব সহজ। রজঃ আনে গতি। আমরা সেই গতির বার্তাবাহী। হব। রজঃ নিজে দুঃখরূপ। দুঃখের কারণও বটে। সীমান্তগুলি অশান্ত থাকবে। প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ সংঘটিত করতে হবে। কৌরবপক্ষে নিহত পরিবারবর্গকে একত্রিত করতে হবে।
–এতে রাষ্ট্রের লাভ?
-জাড্যতা আসবে রাজতন্ত্রে। বিষাদ, উৎকণ্ঠা অবস্থান করবে। ফলে জনগণের জয়।
–‘এতে পাপ হবে না প্রভু?’ এক সুকুমারমতি যুবক বলল।
–সমস্যা সমাধান বড়ো কথা নয়, সমস্যা সৃষ্টিই বড়ো কথা। সমস্যা ও সন্দেহ ছিল চার্বাকের উপজীব্য।
–আমরা তাই ছড়িয়ে দেব।
–এ ছাড়াও মানুষে মানুষে কৃত্রিম ভেদ নেই। রাজাকে প্রজানুরঞ্জক হতে হবে। তাঁর স্বৈরাচার বন্ধ করার কারণেই এই সীমান্তবিদ্রোহ ঘটাতে হবে। আর পাপ বলে কিছু নেই। দেহ ধ্বংস হলে তার পুনরাগমন সম্ভব নয়।
–আমরা কি এখনই সীমান্তপ্রদেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ব?
–তারও আগে জনগণের সমীপে আসতে হবে। কৃষকের সন্নিকটে আসতে হবে। চার্বাকের সাম্যদর্শন সহজভাবে বলতে হবে। বিপ্লব এভাবেই সর্বাত্মক হয়।
.
৪৫. রাসলীলা স্মৃতি
না পোড়াও রাধা অঙ্গ, না ভাসায়ো জলে,
মরিলে বাঁধিয়া রেখো তমালের ডালে।
অখন্ড মন্ডলেরশ্বর শ্রীকৃষ্ণের কোনো অবসান নেই। তিনি কালাতীত ও শাশ্বত। কিন্তু এ কোন প্রতিবিম্ব দেখল রাধা, পুরুষোত্তম অপ্রাকৃত রাসলীলা করছেন বৃন্দাবনের গোপিনীদের সঙ্গে! একসময় কৃষ্ণকুঞ্জে বার। বার গিয়েও রাধা তাঁর দেখা পায়নি। আবার যেন রাধার ইচ্ছে করছে রাই রাজা হওয়ার। মৃত্যু-তাপিত কৃষ্ণ এখন রাধার কাছে যেন ভরণীয় নারী। প্রৌঢ়া রাধা চাইছে আবার নতুন করে প্রারম্ভ হোক রাসলীলার। কৃষ্ণের অন্তর পুরুষ রাধার প্রণয় আকাঙ্ক্ষায় পুড়ে খাক হয়ে যাক। প্রেম জাগুক হৃদয়ে। শুকনো খ্যাতির অন্বেষণের অবসানে কৃষ্ণের প্রতিবিম্বই প্রমাণ করে তিনি আর কাউকে দয়া করতে পারেন না। তিনি প্রেমের কাছে, শুদ্ধা ভক্তির কাছে দয়াপ্রার্থী।
কৃষ্ণপ্রেমে আবার নতুন করে লীন হতে গিয়ে রাধা তার গভীর প্রেম এবং উদগ্র কাম বাসনা কৃষ্ণের মধ্যে সঞ্চারিত করল। বিরহ ভুজঙ্গ দংশনের পরিণতি হল রাধারমণের। অরণ্যের মধ্যভাগে অবস্থান করেও। তিনি অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি বিস্মৃত হলেন সাময়িক মুহূর্তের জন্যও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। আবার তাঁর শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে থাকল প্রেমের রমণপ্রবাহ। আবার যেন জেগে উঠল যমুনাতট। মৃত্যুমুখে পতিত যাদবেরাও যেন প্রাণ পেল। কৃষ্ণ কালো, তমাল কালো, হয়তো মৃত্যুর বর্ণও কালো। রাধার দগ্ধ হৃদয়ে সব একাকার হয়ে গেল।
এ যেন পূর্ণ রাই। ভক্ত আবার নতুন করে হয়েছে অকপট।
কৃষ্ণ ডাকলেন, ‘রাধা, আমার প্রতিবিম্বকে তুমি এতটাই অস্বীকার কর?’
–অতীতের যমুনা হারিয়ে যাক, এ আমি চাই না।
-আমার মৃত্যু সন্নিকটে জেনে তুমি এত ভীত কেন? সত্যভামা, জাম্ববতী, রুক্মিণী- ওরা কিন্তু অনুধাবন করেছে আমার জীবন। দোলক অচিরেই স্থির হয়ে যাবে। এই রাস পড়ে থাকবে অনন্তের জলে।
–আমি তো শূন্যের সঙ্গে শূন্যের মিলিয়ে দেওয়ার শেষ চেষ্টা করছি।
–বেদ বলে সন্ন্যাসী বেদশীর্ষ। আমি বলি, তুমি প্রেম-শীর্ষা। বলেছিলাম তো তোমার প্রেম শরীরকে অতিক্রম করেছে।
–তখন তো বুঝিনি, প্রভু।
–আমিই তোমাকে পুনরায় যৌবন প্রত্যর্পন করেছি, পুরুষও করেছি, অথচ সেই তুমি এখন সম্ভোগরহিত কৃষ্ণের আকাক্ষা করছ।
–রাধারমণ, প্রেম কি শরীর থেকে অন্ধ সময়ের তামসিক থেকে আলোয় যাত্রা?
কৃষ্ণ স্মিত হাসিতে নীরব থাকলেন। এর উত্তর তিনিও খুঁজছেন।
.
৪৬. জরা ও অশ্বত্থামা
–গুরুদেব, পাপের আশঙ্কায় অনিদ্রা আমাকে গ্রাস করছে।
–মানুষ হত্যা করতে ভালোবাসে।
–কিন্তু তিনি যে কৃষ্ণ, জগতের ধারক-পালক।
জ্যোৎস্না রাতের দিকে এক বার তাকালেন অশ্বত্থামা। মনে হল তিনি যেন এক ভয়ংকর নৈঃশব্দ্যকে উপভোগ করছেন।
তারপর বললেন, ‘কৃষ্ণ হচ্ছেন শক্তি ও হিংস্রতার উৎস। নিজের প্রজাতিকে নিরন্তর নিহত হতে দেখে তাঁর এক রকমের উল্লাস হয়। প্রতিটি হত্যালীলার পশ্চাতে তিনি নিজস্ব মতবাদ আনয়ন করেন। তার বিপরীত কিছুকে তিনি বলেন অধর্ম, অসত্য।
–প্রত্যেক হত্যাকারীরই নিজস্ব একটা যুক্তি থাকে। আমরা নিষাদেরা হত্যা করি নিজের প্রাণকে ভালোবেসে।
–এক্ষেত্রে তোমাদের প্রাণীনিধনের পেশা প্রাণের উপাসনা ভিন্ন আর। কিছু নয়।
জরা এবার ভালো করে নিরীক্ষণ করল অশ্বত্থামাকে। ধনুকের মতো বক্র শরীরটায় সবচেয়ে উদগ্র বাক্যের হিংস্রতা। চোখ দুটো শান্ত অগ্নিশিখার মতোই সবসময় প্রজ্বলিত। দাঁতও তীক্ষ্ণ, কারণ অগ্নিপক্ক মাংস গুরুদেব ক্ষত্রিয়ের ক্ষিপ্রতায় ভক্ষণ করেন। তিনি বিপ্রসন্তান হলেও ফলাহার ত্যাগ করে এই আমিষ আহারগ্রহণ তাঁর একান্ত অপছন্দের বলে মনে হয় না কখনো। আর অশ্বত্থামা এখন প্রায়ই অনুভব করেন ভূপৃষ্ঠের ভূকম্পন। সভ্যতার আয়ুষ্কাল কি সমাপ্তির দিকে ধাবমান। কৃষ্ণই কি তবে এই দ্রুত অপস্রিয়মাণ সভ্যতার শেষ পরিণতি? চিন্তার এই বিবর্তন দূরে নিক্ষেপ করে অশ্বত্থামা আবার মনোযোগী হলেন অত্যাকারীর প্রবৃত্তিটি সম্পূর্ণভাবে জাগরুক করতে।
–কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মানুষকে নিত্য হত্যা করাটা তিনি খুব স্বাভাবিক অভ্যাসের গন্ডিতে নিয়ে এসেছিলেন।
–কিন্তু যতদূর জানি, তিনি তো ছিলেন সারথি। যুদ্ধে অংশগ্রহণ তো তিনি কখনো করেননি।
–হ্যাঁ, তিনি যুদ্ধা অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু অর্জুনকে প্রতিনিয়ত প্রবৃত্ত করেছেন হত্যালীলা সম্পাদন করায় কখনো ব্যক্তিগত, কখনো-বা জাতিগত, আবার কখনো-বা ধর্মগত যুক্তির প্রহসন আনয়ন করে।
–গুরুদেব, কৃষ্ণের হত্যার পর আমার কর্ম কী হবে? আমার স্বজাতি আত্মজনেরাও তো আমায় ধিক্কার জানাবে।
এই সময় জরার যুবতী স্ত্রীটির কথা মনে পড়ল। কুয়াশা ঢাকা নদীতীরের মতোই অপুষ্ট সেই জীবন। নারীর সঙ্গে প্রতি রাতের যৌনমিলনই পৌরুষের শক্তি ও আকাঙ্ক্ষাকে প্রকৃত স্বীকৃতি দেয়। হঠাৎ জরার চাঁদের আলোয় খুব আকর্ষক মনে হল এই অরণ্যভূমিকে। প্রিয় নারীর সঙ্গে প্রতি রাতের সঙ্গমসুখ এক আশ্চর্য নিষ্ঠুর হত্যার পর অবশিষ্ট থাকবে না বলেই মনে হয়। হয়তো তখন জরাকে অন্ধকারে চোখ জ্বলতে থাকা পশুদের মতোই দেখাবে। হয়তো বার বার প্রমাণ দিতে হবে যে তারও মধ্যে মানুষের স্বভাব একেবারে অন্তর্হিত হয়নি।
এই লোলিতচর্ম, অনির্বাণ প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত বৃদ্ধটি নিজস্ব স্বার্থগত সত্যকে রোপণ করে জরাকে উত্যক্ত করছে। মৃত্যু জরার ক্ষেত্রে অবধারিত সত্য। কিন্তু কৃষ্ণের হত্যার পর সেই জীবন কুকুরের মতো ভয়ংকর লজ্জার হবে না তো! হয়তো নগরবাসীরা তাকে প্রহারে প্রহারে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে। ক্ষিপ্ত জনতার সমবেত ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে সে। এই জীবনে জরা যেন অকারণে প্রবেশ করছে। অন্তর্গত রক্ত থেকে প্রতিবাদ উঠে এলেও অশ্বত্থামার ঘৃণার সম্মোহনী বলয় থেকে সে কিছুতেই অতিক্রান্ত চলিষ্ণুতায় আপাত স্থবিরতাকে অতিক্রম করতে পারছে না। সত্যি উচ্চারণ করতে, মানবপ্রেমের স্বপক্ষে কিছু প্রতিবাদ জানাতে চেয়েও জরা নৈঃশব্দ্যকেই বেছে নিল। আকাশে গ্রীষ্মরাত্রির জ্যোৎস্না জরাকে অবলোকন করে কেমন যেন করুণাধারায় পৃথিবীর বুকে আরও একটু মায়াবী আচরণ করে ব্যাপ্ত হল।
.
৪৭. শ্রীরাধিকার অভিসারযাত্রা
শীতের রাত্রি এমনিতেই দীর্ঘতর। তার অন্তিম চরণ যেন আসতেই চায় না। নগরের বাতিস্তম্ভগুলি নির্বাপিত হয়ে গেছে। প্রৌঢ়া রাধার এই রাতের অভিসারে যাওয়ার কারণে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। শুধু প্রতিবন্ধক শরীর। যে-শরীর পুরুষোত্তম ভোগ করেছেন, বীর্যরসকে লিঙ্গশীর্ষে স্তব্ধ রেখে তিনি মিলনকে করে তুলেছেন অপার্থিব সেই শরীর এখন খুব ক্লান্ত। এই ক্লান্ত, যৌবনের উপান্তের শরীর নিয়ে রাধা বিপরীত বিহারের কথা ভাবছে, যেন কৃষ্ণকে রমণ করছে। কৃষ্ণের পুষ্ট স্তনযুগল মর্দন করতে করতে রাধার যোনিদ্বারে লিঙ্গশীর্ষের অবতারণা হল। আর স্বয়ং পুরুষ রাধারমণ বিপরীতক্রমে যোনিদ্বার উন্মুক্ত করলেন। হেমন্তের উষ্ণ রাত্রি পৃথিবীও প্রত্যক্ষ করল এক বিপরীত রমণবিহার। কৃষ্ণের ত্বক এমনিতে নির্লোম, কিন্তু আর ত্বকের অভিসন্ধি থেকে গুপ্ত লোমরূপের প্রতিটি কণায় কণায় রমণ হতে থাকল। উপভোগ্য কৃষ্ণের শরীর ভোগ করছে রাধা।
রমণ এবং ক্ষরণহীন পলের পর পল রাধাকে উন্মাদিনী করে তুলেছে।
কখন যে নীলাম্বরি শাড়িতে বুনো কাঁটা আটকে গিয়ে শরীরকে রক্তাক্ত করে তুলেছে সংবিত ফিরে এল নগরকোটালের ডাকে। নগরকোটাল রাধার পরিচয় জানে, ফলে সমীহ করে থাকে। আজও ব্যতিক্রম কিছু হল না। তবুও রাধা কেমন যেন অপমানিত বোধ করল। কৃষ্ণের পরিবর্তে নবাগত পুরুষের প্রতি অনাসক্ত নারী যেমন ভর্ৎসনা দৃষ্টিতে দেখে, রাধাও নগরকোটালের সম্ভ্রমপূর্ণ বাক্যালাপে প্রাথমিকভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করল। যদিও সেটা মুহূর্তের উন্মোচন। স্বপ্নের রমণ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতেই রাধা রক্তবর্ণ গোলাপের মতোই সলজ্জ হল। রাত্রি বোধ হয় তখন তৃতীয় প্রহরে পরছে। কখন যে শয়নকক্ষ অতিক্রম করে বৃদ্ধাবাসের দ্বারপালের ঘুমন্ত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে রাধা রাজপথে নেমে এসেছে অনেকটাই শরৎকালের আলোয় প্রতিভাত নগরীর মতোই সেই স্বপ্ন সমসাময়িক মুহূর্তগুলিকে অগ্রাহ্য করে এক আবহমানকালের শাশ্বত প্রণয়ের অভিমুখে যাত্রা করিয়ে দিয়েছে।
আবার গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাধা মৃদুস্বরে ডাকলেন, ভাবমুখের কেন্দ্ৰপতি এ কেমন তোমার প্রণয়লীলা?’
কোথাও যেন পৃথিবীর কম্পনাঙ্ক স্পর্শ করে বাঁশরির ধ্বনি বেজে উঠল। কৃষ্ণ বললেন, ‘জয় রাধে!’
–প্রভু, এই ঘুমন্ত শরীরকে তুমি আবার জাগালে কেন?
–বিপরীতবিহার উপভোগ করব বলে। এবং তুমি তো অমৃতময় যাত্রার সর্বাত্মক রূপটাই দেখতে চেয়েছিলে!
রাত্রি এবার চতুর্থ প্রহরে পড়ল।
–রাধাকে নিয়েই তোমার প্রণয়ের যাবতীয় খেলা!
কৃষ্ণ এবার তাঁর রতিসুখকর উত্তপ্ত পুরুষালি হাতের স্পর্শে রাধার বিগত হয়ে যাওয়া যৌবন ফিরিয়ে আনলেন। শরীর সন্ধানী পুরুষের মতোই তিনি খুঁজতে লাগলেন রাধার চিরকালীন রহস্যময়তা। বিপরীত বিহারের অবসান যখন ঘটল শীতের রাত্রিও অতিক্রান্ত হয়েছে। ঘন কুয়াশায় আবৃত প্রভাব সেই মনোমুগ্ধকর রমণবিহার দেখে আরও পক্ষকালের জন্যই অনাবৃত থেকে গেল।
.
৪৮. বাঁশরি
কমবয়েসি একটি মেয়ে সিঁড়ির ধাপে বসে রয়েছে। অদূরে শুকনো পাতার জঙ্গল ভেদ করে লণ্ঠনের আলোর সঙ্গে সঙ্গে নাচতে নাচতে আসছে বাঁশরির শব্দ। এক ধরনের ব্যথা জাগছে মেয়েটার হৃদয়ে, যেন সে কোনো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেছে অজ্ঞাতসারে। মোহগ্রস্তের মতোই সে ফিরে যেতে চাইছে তার কাছে। হারিয়ে যাওয়ার বেদনায়, শূন্যতার বেদনায় আচ্ছন্ন থাকত রাধার মন। কুমারী রাধার আয়ানের সঙ্গে পরিণয়ের পর সেই শূন্যতার পুরণ হল না। ব্যথাটা বোধ হয় গোপনই থেকে যেত যদি-না বাস্তবের পৃথিবীতে শুকনো অরণ্যের প্রান্তরকে ছাপিয়ে দিবানিশিকে ব্যাপ্ত করে কৃষ্ণের বংশীধ্বনি রাধার হৃদয়কে আচ্ছন্ন না করত।
সময় যত এগিয়েছে খ্যাতি ততই আঁকড়ে ধরেছে কৃষ্ণকে। তিনিও আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন সাফল্যকে। অথচ সাফল্যের গল্প তেমন স্থায়িত্ব পায় না। দ্বারকা যে জলগর্ভে হারিয়ে গেল এবং প্রায় লুপ্ত হল যাদবেরা, কৃষ্ণের সেই ব্যররথতার কাহিনি পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে দীর্ঘকাল।
বসন্তের মনোরম অপরাহ্ন। সূর্যের নিস্তেজ আলো যমুনা নদীর উপর থেকে লঘু পদক্ষেপে অপসৃত হচ্ছে। মথুরার হাট থেকে পুষ্প সাজে সজ্জিত হয়ে ফিরছে রাধা। দুই বেণিতে জড়ানো কুকলি। কণ্ঠে ফুলহার। পদযুগলে নূপুর।
কৃষ্ণ বাঁশরিতে রাগেশ্রী ধরলেন। কিন্তু হচ্ছে কই! কড়িমধ্যম লাগালেন।
মালিনী জিজ্ঞেস করল রাধাক, ‘রাইসুন্দরী, এত সজ্জা কার লাগি?’
কৃষ্ণ এবার কৌশিক কানাড়া ধরলেন। বাঁশরির এবারের ধ্বনিতে সাড়া দিয়েছে রাধা। বক্ষযুগলের মৃদু ছন্দ, শ্বাস-প্রশ্বাসের ঘাত-প্রতিঘাত এবার শ্রুত হচ্ছে। রাধার মৃণালভুজে ফুলের অঙ্গদের সৌরভে কৃষ্ণের বাঁশরির সুরে যেন প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। নৌকায় রাধার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন কৃষ্ণ। যমুনার কৃষ্ণ জলে আবছা চাঁদের আলো। মাঝিও কেমন বিবশ কৃষ্ণের সুরের জাদুতে। পাপ-পূণ্য রহিত হয়ে কৃষ্ণ চুম্বন করলেন সেই পদযুগলে যা কিনা অলক্ত রঞ্জিত, গুঞ্জরী নূপুরে কৃষ্ণের ঠোঁটে সামায় ক্ষত তৈরি হল। তবে সেই সামান্য আঘাত অগ্রাহ্য করে কৃষ্ণ রাধার বাম কর্ণে আবার চুম্বন করলেন। এবার রাধার আঁচল স্খলিত হল। কৃষ্ণের চুম্বনে চুম্বনে জেগে উঠছে নিতম্ব, জঘন। তবুও হঠাৎই। কপট ছলনায় সামান্য সরে গিয়ে রাধা বলল, ‘কেশব, এ মহাপাপ! ধরিত্রী এই পাপের পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে।
–পাপ-পূণ্যের বিচারক তো আমি। ঈশ্বর পাপ-পূণ্য জানেন না। তিনি শুধু জানেন প্রেম।
রাধা ভ্রূকুঞ্চন করে বলল, ‘প্রাণনাথ, এই সর্বনাশের খেলা সাঙ্গ করে তুমি একদিন বিদায় নেবে। তখন?’
কৃষ্ণ উত্তর না দিয়ে আরও বেশি কামোন্মত্ত হয়ে পড়লেন। ঈষন্মুক্ত রাধার ওষ্ঠাধার দন্ত দিয়ে দংশন করে তিনি রাধার মুখবিবরের অভ্যন্তরে জিহ্বা প্রবেশ করালেন। রাধার আঁখিপল্লবের কম্পন এবার সম্পূর্ণ নিমীলিত। তৃপ্তির আগাম আনন্দে রাধার জীবন্ত কাননে দাবানলের বহ্নি ছড়িয়ে পড়ল। বিষাক্ত সেই বাঁশরির আদরে রাধা তখন উন্মাদিনী প্রায়।
সেই বাঁশরি তিনি কি কখনো আর বাজাতে পারবেন না। রাধারমণ কৃষনের চোখ দিয়ে জল নয় যেন গলন্ত লোহা নিঃসৃত হচ্ছে। প্রেমহীনতার অনলে তিনি যেন পুড়তে পুড়তে শ্রীহীন হয়ে পড়বেন। কৃষ্ণ একাকী এই অরণ্যে হাহাকার করছেন। কোথায় গেল তাঁর সেই মোহনবাঁশরি। তার সুর কতদিন অতিক্রান্ত মধ্যপথে হারিয়ে গেছে। তিনি সুর লাগাতে পারছেন না।
.
৪৯. কথোপকথন এবং
–বিশাখজ্যোতি, তোমার দেশ জ্বলছে। মানুষ পরিবর্তন চাইছে। এসব তুমি অনুভব কর তো?
–দেশে সুশাসন এসেছে। রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠির ধার্মিক এবং প্রজাদের অত্যন্ত প্রিয়।
–এই দেশে প্রজা বলতে শুধু হস্তিনাপুরের অধিবাসীদের বোঝায় না। এমনকী শুধুমাত্র আর্যাবর্তের জনসাধরণই এই সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন না।
–গুরুদেব, আপনি কি বঙ্গদেশের কথা বলছেন?
–শুধু বঙ্গদেশ কেন, ভারতবর্ষের পশ্চিম প্রান্তও অশান্ত।
–কৃষ্ণ যতদিন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, পশ্চিম ভারত ভারতবর্ষের মূল ভাবকেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না। অবশ্য কীকদেশ অর্থাৎ বঙ্গদেশ বরাবরই পান্ডবদের বিরুদ্ধে, কৃষ্ণের বিপরীতে যুদ্ধে ন্যস্ত ছিল।
–শিশুপালের মতো বীরের হত্যা দিয়ে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা।
–গুরুদেব, শিশুপালের সভামধ্যে কুভাষণও যথেষ্ট প্ররোচনামূলক ছিল।
–তুমিও তো দুর্যোধনের বিশ্বস্ত সেনাধ্যক্ষ ছিলে, ধর্মের বিপক্ষে।
–আসলে ধর্ম ক্ষত্রিয়ের ধর্ম। সেখানে কোনো পাপ-পুণ্য নেই। রাজাজ্ঞার প্রতিপালন একমাত্র কর্তব্য ছিল।
–বিশাখজ্যোতি, তবে তোমার কোনো চরিত্র নেই, অস্তিত্বও নেই, অর্থাৎ ছিল না। কিন্তু এখন তো তুমি স্বাধীন। মুক্ত চিন্তা কোনো শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ার দায় নেই।
–দায় রয়েছে রাষ্ট্রের কাছে একজন নাগরিক হিসেবেই।
–সেই দায়বদ্ধতা আমারও রয়েছে। তাই তো আমি চাই জনগণের মুক্তি, প্রজাতন্ত্রের জয়।
–সে তো সীমাহীন অরাজকতা ডেকে নিয়ে আসবে। একে দীর্ঘকালীন যুদ্ধে রাজকোষ প্রায় অর্থশূন্য। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত। আমাদের উচিৎ রাজার পাশে থেকে রাষ্ট্রের কল্যাণকর কর্মে নিয়োজিত হওয়া।
–আবার স্মরণ করাই, বিশাখজ্যোতি, তুমি ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কোনো কার্য সমাধা করতে চাইলে নির্ভর করে অস্ত্র এবং বাহনের উপর। পুবের আকাশের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো। অতি উজ্জ্বল রক্তাভা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সূর্যের প্রভায় রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশ অন্তরালে চলে যাবে। তোমার পুত্র রূপজ্যোতি সেই অর্কপ্রভার অধিকারী। এই গণজাগরণের সে-ই হবে নায়ক। অন্তরাল থেকে তোমার ক্ষত্রিয়ের ধর্ম বজায় রেখে তুমি তাকে সাহায্য করো।
–গুরুদেব, আপনি আমার শিক্ষক। অন্ধকারে পাখির ডাকেই নিদ্রাভঙ্গ হয় বসুন্ধরার, তেমনিভাবে মৃত্তিকার গহ্বর থেকে আপনার জ্ঞানের স্পর্শে জেগে উঠেছিলাম। প্রত্যক্ষ করেছি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, লোকক্ষয়। তবে আবার কেন নতুন করে যুদ্ধের দ্যোতনা? বরং প্রান্তরগুলি শস্যশ্যামলে পূর্ণ হয়ে উঠুক। বিধ্বস্ত জনপদের পুনর্নির্মান হোক।
–এই যুদ্ধের রূপ ভিন্ন। ইতিমধ্যে রূপজ্যোতিরা ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্ত বঙ্গদেশের অভিমুখে যাত্রা করেছে।
–সে তো সুদীর্ঘ পথ! আমার অনুমতি ব্যতিরেকে আপনি তাকে। অজানা পথের গহন অন্ধকারে নিক্ষেপ করলেন?
–পিতা হিসেবে তোমার মঙ্গলকামনা তার সহায়ক হোক কিন্তু কোনো হৃদয়দৌর্বল্য যেন তার মধ্যে সংক্রামিত না হয় এই কারণেই তোমার অনুমতি ব্যতিরেকে আমি তাকে পাঠিয়েছি।
–অন্যায় করেছেন, গুরুদেব। রূপজ্যোতি নিতান্ত কিশোর। দীর্ঘপথের ক্লেশ সহ্য করার মানসিকতাই এখনও তার গঠিত হয়নি। এ ছাড়াও বঙ্গদেশের পথ অরণ্যসংকুল, সেখানে ব্যাধির প্রাবল্যও বেশি।
–অতটা নির্বোধ আমি নই। রূপজ্যোতিকে রক্ষা করার কারণে চৌদ্দ জন সুদক্ষ সৈনিক রয়েছে। তারা প্রাণত্যাগ ব্যতীত কোনো অবস্থায় রূপজ্যোতির সঙ্গত্যাগ করবে না।
–মহারাজ যুধিষ্ঠির খুব শিগগির রাজ্যত্যাগ করবেন। ভ্রাতারা এবং দ্রৌপদীও তাঁর অনুগামী হবেন। মহামতি কৃষ্ণ শায়িত হয়ে মৃত্যুর তাপগ্রহণ করছেন। তবে অজানা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কার বিরুদ্ধে?
–পরীক্ষিৎ সিংহাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী। ভারতবর্ষের সিংহাসনের পক্ষে সে অনুপযুক্ত। এ ছাড়াও আমি চাই, রাজা নির্বাচন করবে জনগণ। তাঁর মেধা, অস্তজ্ঞান, মানুষের প্রতি ভালোবাসা পরীক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। আমি ইতিমধ্যে সংবাদ পেয়েছি, বঙ্গদেশে পৌঁছানোর পূর্বেই রূপজ্যোতি ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তের মানুষের হৃদয়ের নিধি হয়ে উঠেছে।
–বঙ্গদেশের রমণীরা সুন্দরী এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরায় অভ্যস্ত। রাতেও সেখানে নৃত্য-গীত শ্রুত হয়। মদিরা দেবনে মত্ত থাকে নাগরিকেরা। বাতাস এত মধুময় যে শরীর ক্রমশ কর্মের পক্ষে অনুপযুক্ত হয়ে ওঠে। বর্ষা ঋতুও সেখানে ভয়ংকর, সরীসৃপের দংশনে নিত্য মৃত্যুর সংবাদ শ্রুত হয়। গ্রামে, জনপদে আর্যভাষার প্রচলন নেই। বঙ্গদেশের ভাষা সুললিত হলেও আমাদের পক্ষে সহজবোধ্য নয়। কোনোরকম প্রস্তুতি ব্যতিরেকে আপনি বঙ্গভূমিকেই নির্বাচন করেছেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে।
–ক্ষত্রিয়ের অন্যতম ধর্ম আত্মরক্ষা। বলবীর্যের দ্বারা মানুষকে নিরাপত্তা দান ও শান্তিস্থাপনের প্রচেষ্টাও দ্ৰোহকর্মের অন্যতম সূচির মধ্যেই পড়ে। সেই শিক্ষাও আমি যুবকদের দিয়েছি। নিগৃহীত, লাঞ্ছিত হতে হলেও তাকে সহ্য করবার আত্মিক-শক্তিও যুবকদের মধ্যে রয়েছে। অশক্ত হয়ে পড়া শরীরকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মানসিক শক্তিও তাদের মধ্যে রয়েছে। প্রেমের প্রতি তাদের বিরাগ, বিতৃষ্ণা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে। সেই সঞ্জীবনমন্ত্রও আমি তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছি।
–ঘৃণা আর হিংসার মন্ত্রে তার যদি এতই সুদক্ষ হয় তবে সেই যুবকের দল কীভাবে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দান করবে?
–রাষ্ট্র যেখানে উৎপীড়ক, রাজকর্মচারী মানেই যেখানে অসাধু; অহিংসা সেখানে মূলমন্ত্র হতে পারে না। মিথ্যে প্রেমও সেখানে কাপুরুষতা। ঘৃণা এবং হিংসার সংমিশ্রণ এখনই ব্যবহার্য যখন সভ্যতা সংকট থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বিতীয় কোনো পন্থা পেতে ব্যর্থ।
–কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধো হিংসার প্রদর্শনের পক্ষে যথেষ্ট ছিল না?
–কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জঙ্গণের কোনো অধিকার ছিল না, অংশগ্রহণও ছিল না। ধর্মের মোড়কে প্রজাদের শোষণের ক্ষেত্রে পান্ডব এবং কৌরবপক্ষ সমান পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ফলে ভূমি হয়েছে শস্যহীন, কোনো পক্ষের প্রতি অনুরাগ ছিল না এমন লক্ষ মানুষ হয়েছিল গৃহহারা। কৃষ্ণের শান্তির বচন মানুষকে জীবনবিমুখ করে দিয়েছে মাত্র। ধনুকের থেকে নিক্ষিপ্ত একেকটি তিরে সভ্যতা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে আর বাসুদেব তাঁর মুরলী ধ্বনির বিস্তারে অনগ্রসর জনপদকে ধর্মের মোহ-আবরণে আবৃত রেখেছিলেন। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অনাহার, রাষ্টের সন্ত্রাস– সবই পূর্বজন্মের কর্মের দ্বারা নির্ধারিত। কর্ম করো কিন্তু ফলের আশা কোরো না– এমন নিরর্থক। বাণী! কিন্তু হতে পারে আসলে নিরর্থকও নয়, বিনীত বাক্যে ধীমান এবং জ্ঞানীর প্রচ্ছদে সাধারণের সত্যভঙ্গের বিকৃতির প্রতি উদাসীনতা। প্রজারা, জনগণ যেন সারমেয়কুলের অধিক কিছু নয়। আমি প্রস্তরাদি নিক্ষেপ করে তাদেরি জাগাতে চাই। এই জনগণের প্রকৃত যুদ্ধের প্রারম্ভ না হলে আমি এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারব না।
বিশাখজ্যোতি দেখলেন গুরুদেবের আশ্রমের অদূরে ঋজু বিশাল মহিরুহসমূহ ছড়িয়ে রয়েছে। এই মহিরুহ ক্লান্ত পথিকদের শ্রান্তি দান করে। আসন্ন অস্তরাগের রক্তাভা জমুনার বুকে পড়েছে। কর্ষিত ক্ষেত্রগুলিতে নতুন করে ফসলের আভা দেখা যাচ্ছে। লোকালয় যখন। সবার শান্ত জীবনযাপনে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল, ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে। ফিরে আসার কারণে এক নতুন খেলার আরম্ভ সূচিত হচ্ছে। কৃষ্ণকাল সমাপ্ত। যুধিষ্ঠিরও রাজ্যত্যাগ করবেন। কালবেলা আবার নতুন করে তার পদযাত্রা শুরু করল। মহিরুহগুলিতে অপরাহ্নের আলোর বিচিত্র বর্ণের খেলার সঙ্গে প্রচুর পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে।
অন্যদিকে সেই ক্ষণে অশ্বত্থামাও সম্পূর্ণ করলেন দীক্ষা। জরা কালের অধীশ্বরকে নিহত করার প্রেরণায় সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। মধুমাসের আকাশে বাতাসে মধুমন্তী রাগের সূচনা হয়েছে। বিশাখা একদিন বলেছিল যুবক কৃষ্ণকে, ‘হে কৃষ্ণ, তোমার যৌবন সম্পূর্ণ হবে না যদি-না তুমি শ্রীরাধিকার মকরন্দ পান করে রমণপটু হয়ে ওঠ। আর রাধা দেখেছিল জলদপূর্ণ কৃষ্ণমেঘকে তার অভিসারযাত্রার একদম মধ্যপর্বে। সেই প্রেমিক, শিল্পীপুরুষের হত্যালীলা অচিরে প্রত্যক্ষ করবে কাল ও এই মহাপৃথিবী।