০৪০. মুজিবনগর অফিসে

৪০

টাঙ্গাইলের আবদুল মান্নান বললেন, মুকুল ভাই, আজকে রাত দশটায় মুজিবনগর অফিসে একটু আসেন। খুব জরুরি তবে খুব গোপন একটা মিটিং করতে হবে।

আবদুল মান্নান মুজিবনগর এলাকায়, মানে কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ি আর কলকাতার বাংলাদেশ মিশন অফিস এলাকায়, খুবই ব্যস্ত এক মানুষ। বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগের দায়িত্ব এক্সিকিউট করা, মানে কাজগুলো বাস্তবে সম্পাদন করে ফেলার সঙ্গে তিনি বিশেষভাবে যুক্ত। মেহেরপুরের আম্রকাননে সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য যেমন তিনি যুক্ত ছিলেন, তেমনি মেহেরপুর আম্রকাননে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের দায়িত্বও ছিল তারই ওপরে। মজলিশি লোক।

জয় বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছে। ১১ মে ১৯৭১। অফিস হলো ২১/এ বালু হাক্কাক লেন পার্ক সার্কাস। পত্রিকার নিচে ঠিকানা লেখা : মুজিবনগর, বাংলাদেশ, অথবা তথ্য, গণসংযোগ ও প্রচার বিভাগ, বাংলাদেশ মিশন, ৯, সার্কাস অ্যাভিনিউ, কলকাতা, ১৭। জয় বাংলা বের হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আহমদ রফিক। এটা আসলে মান্নান। কিন্তু মান্নানের ফ্যামিলি রয়ে গেছে মিলিটারি-কবলিত বাংলাদেশে। কাজেই মান্নান স্বনামে আবির্ভূত হতে চান না। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুল্লাহ চৌধুরী। নাম ছাপা হয় আবদুল মতিন চৌধুরী। আর কাজ করেন রাজশাহী বেতারের অনু ইসলাম। পত্রিকার নামহরফ সুন্দর করে লিখে দিয়েছেন শিল্পী কামরুল হাসান। এত সুন্দর হয়েছে জয় বাংলা লেখাটা!

এই পত্রিকার মাত্র দুটো সংখ্যা বের হয়েছে। এরই মধ্যে কলকাতায় আসা সব বুদ্ধিজীবী লেখক জয় বাংলা অফিসে নিরন্তর আড্ডায় মেতে উঠছেন। মান্নানও সেই আড্ডায় থাকেন।

২২ মে রাতে এম আর আখতার মুকুল গেলেন মুজিবনগর সরকারের অফিসে। নিচতলায় বৈঠকখানায় বসেছেন আবদুল মান্নান। একটু পরে দুজন অচেনা লোক এলেন। দুজনই ভারতীয় বাঙালি। একজন একটিবারের জন্য মুখ খুললেন না, আরেকজন নিজের পরিচয় দিলে ভট্টাচার্য বলে। কলকাতায় অন্তত এক লাখ ভট্টাচার্য আছে। কাজেই এই পরিচয়ের কোনো মানে হয় না।

ভট্টাচার্য গৌরবর্ণ, গায়ে হাফহাতা সাদা শার্ট, পরনে একটা ধূসর রঙের প্যান্ট, কথা বলার সময় কারও চোখের দিকে তাকান না, বললেন, একটা পঞ্চাশ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা হয়েছে। ট্রান্সমিটার জায়গামতো বসে গেছে। ট্রান্সমিটার চালু রাখার দায়িত্বে লোক আছে। এখন শুধু অনুষ্ঠানের রেকর্ড দরকার। আপনারা আমাদের হাতে টেপ দেবেন। আমরা সেই টেপ নিয়ে যাব। রোজ আপনারা অনুষ্ঠান করতে পারবেন। রোজ অনুষ্ঠান প্রচার করা যাবে। আপনারা ঠিক করবেন কটা থেকে কটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান হবে, কী অনুষ্ঠান হবে।

মুকুল বললেন, আপনারা ট্রান্সমিটারের টেকনিক্যাল দিক দেখছেন। এটা খুব ভালো কথা। কিন্তু কী অন এয়ার হবে না-হবে, সেসব ব্যাপারে আপনারা কিছু বলতে পারবেন না।

না না। সেসব তো বাংলাদেশ সরকারের ব্যাপার। আমাদের কিছু বলার নেই।

খুব ভালো। আমাদের অনেক শিল্পী, কলাকুশলী এপারে চলে এসেছেন। আমরা খুব ভালো অনুষ্ঠান করতে পারব।

ভট্টাচার্য বললেন, অনুষ্ঠান তৈরির ব্যাপারে আপনাদের কোনো সাহায্য লাগবে?

মান্নান বললেন, আমাদের রেকর্ডিংয়ের যন্ত্রপাতি লাগবে।

এই যে টেপরেকর্ডার আর টেপ সঙ্গে করেই এনেছি।

মান্নান বললেন, তাহলে আর কোনো সাহায্য লাগবে না। আমাদের সরকার বাকিটা দেখবে। আপনারা শুধু প্রচার করবেন। অনুষ্ঠানে কী প্রচার হবে না-হবে, এটা আমরা দেখব।

মুকুল বললেন, আমাদের তো খবর দিতে হবে। ক্রেডিবল সোর্স লাগবে। রণাঙ্গনের খবর পাওয়ার কোনো উপায় আছে।

ভট্টাচার্য বললেন, ইস্টার্ন কমান্ডের পাবলিক রিলেশনস অফিসার কর্নেল রিকখে তো রোজ ব্রিফ করেন। আমি বলে রাখব। আপনারা তাদের কাছ থেকে ডিটেইল সংগ্রহ করে নিতে পারবেন।

কবে থেকে পারবেন বলুন তো! ভট্টাচার্যের জিজ্ঞাসা।

এম আর আখতার মুকুল, ৫৩ বছর বয়সী, পান খান, ধূমপান করেন, দিনাজপুরের মানুষ, কিন্তু কথা বলেন ঢাকাইয়া কুট্টিদের মতো, রসিকতার তুবড়ি ফোঁটাতে ওস্তাদ–বললেন, ১১ জ্যৈষ্ঠ। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন।

তাহলে আপনি সময় পাচ্ছেন মাত্র দুদিন। ভট্টাচার্য বললেন।

আমার দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠান রেকর্ড করতে তো লাগবে দুই ঘণ্টা। আমার হাতে তো ৪৮ ঘণ্টা আছেই। মুকুল বললেন।

ভট্টাচার্যরা চলে গেলেন। মান্নান বললেন, ওই মিয়া, কওয়ার সময় তো খুব কয়া দিলা ৪৮ ঘণ্টা মেলা টাইম। এখন করবাটা কী?

মুকুল একটা চারমিনার সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে কলকাতার রাস্তায় দাঁড়িয়ে বললেন, ধরেন খবর হইব ১০ মিনিট, আমার নিজের একটা কথিকা ২০ মিনিট, ৩০ মিনিট তো হইয়াই গেল।

মান্নান বললেন, তাহলে চলেন দোতলায় যাই। তাজউদ্দীন ভাইকে পুরা ঘটনা জানায়া আসি।

চলেন। আমগো একটা স্টুডিও লাগব। আর লাগব একটা অফিস।

তাজউদ্দীন সাহেব ওই ভবনের দোতলায় ছোট্ট একটা ঘরে একা ঘুমান। নিজের কাপড়চোপড় নিজেই ধোন। দুই সেট কাপড়। একটা যদি বৃষ্টির দিনে

শুকায়, তিনি মুশকিলে পড়েন। রান্নাবাড়া এই বাসাতেই হয়। অফিসের সবাই এখানে খান।

কাজেই তাদের দোতলায় উঠে যেতে কোনো অসুবিধা হলো না। তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে এগারো। তাজউদ্দীন জেগেই আছেন।

তাজউদ্দীন সব শুনলেন। হাসলেন। কারণ, তিনি জানেন, ট্রান্সমিটার জোগাড় হয়েছে। ভারতীয়রা তাকে সব রিপোর্ট আগেই করে।

বললেন, আপনারা অনুষ্ঠান করতে পারবেন শুনে খুব ভালো লাগল। এই বাড়িতেই একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। খালিই আছে। কাল থেকে কাজ শুরু করে দিন। আমরা তো এই অফিস ছেড়ে চলে যাব থিয়েটার রোডে। আপনাদের তাহলে আর কোনো অসুবিধা হবে না।

মুকুল মেলা রাতে ভাড়া করা বাড়িতে ফিরলেন। স্ত্রী বললেন, এত রাত হলো যে!

মুকুল বললেন, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসছি, রাত বেশি না কম, হিসাব করার টাইম নাই।

রাতের বেলা আর ঘুমালেন না। কাগজ-কলম নিয়ে বসে পড়লেন মুকুল। আলাদা ঘর নেই। যাহা বেডরুম, তাহাই রিডিং রুম। মশারির ওপরে একটা লুঙ্গি দিয়ে আলো আড়াল করলেন, ওরা ঘুমুচ্ছে, ঘুমোক। টেবিল নেই, মেঝেতে বসে লিখে চললেন চরমপত্রের প্রথম কিস্তি।

পরের দিন মুকুল গেলেন বালু হক্কাক লেনে, জয় বাংলা অফিসে। মান্নান বসে আছেন। তাঁর মুখ গোমড়া। কপালে চিন্তারেখা স্পষ্ট। ওই মিয়া, আর তো ৪৮ ঘণ্টা নাই, আছে আর মোটে ৩২ ঘণ্টা।

আমি একটা জিনিস লিখে ফেলছি। একটু পইড়া দেন।

মান্নান পড়ছেন আর হাসছেন।

মুকুল বললেন, যাক আপনে হাসছেন। মেঘ সইরা গেছে। আলো ফুইটা উঠছে।

সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে আলো ফুটে উঠল যেন। ঢাকা বেতারের তিন কর্মী এসেছেন। আশফাকুর রহমান, তাহের সুলতান, টি এইচ শিকদার। তাঁরা বললেন, তাঁরা তিনজনই প্রোগ্রামের লোক।

মুকুল হাসছেন। আমাদের তো প্রোগ্রামের লোকই চাই।

আমরা সঙ্গে করে দেশাত্মবোধক গানের টেপ এনেছি।

তাহের সুলতান বললেন, আমি প্রোগ্রাম রেকর্ড করে দিতে পারব।

টেপগুলো ওরা এনেছিলেন বালিশের ভেতরে ভরে, ফিতা সব জড়াজড়ি করে একেবারে ছ্যাড়াব্যাড়া অবস্থা। ওরা সেই টেপগুলো নতুন স্কুলে ওঠালেন। ওদের কাজ দেখে মুকুল বললেন, মান্নান ভাই আর চিন্তা নাই।

এর মধ্যে এসে গেছেন আমিনুল হক বাদশা আর শিল্পী কামরুল হাসান। তাঁরা দুজনেই অনুষ্ঠানের জোগাড়যন্ত্র, পরিকল্পনা বিষয়ে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন।

সার্কুলার রোডের মুজিবনগর অফিসের একটা রুমকে স্টুডিও বানানো হলো। দোতলার এই ঘরের পাশেই থাকেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রথম দিনের অনুষ্ঠানসূচি: সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত। অগ্নিশিখা (মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ অনুষ্ঠান)। বাংলা সংবাদ। রক্তস্বাক্ষর (গণমুখী সাহিত্য অনুষ্ঠান)। বজ্রকণ্ঠ (বঙ্গবন্ধুর ভাষণ)। জাগরণী। ইংরেজি সংবাদ। চরমপত্র। দেশাত্মবোধক গান।

সংবাদের দায়িত্ব নিলেন কামাল লোহানী। খবর পড়লেন সৈয়দ হাসান ইমাম। ছদ্মনাম সালেহ আহমেদ। ইংরেজি খবর মিসেস টি হোসেন (নাম নিলেন পারভিন হোসেন)। কোরআন তিলাওয়াত করলেন জয় বাংলা সম্পাদক মাহমুদুল্লাহ চৌধুরী। অনুষ্ঠান ঘোষণা ও অনুষ্ঠানের দায়িত্ব আশফাকুর রহমান।

২৫ মে দেশের মানুষ মিডিয়াম ওয়েভ ৩৬১.৪৪ মিটার ব্যান্ডে শুনতে পেল : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, দলে দলে শিল্পীরা আইসা স্বাধীন বাংলা বেতারে অংশ নিতে লাগল।

ব্যাঙ্গমি বলে, দেশের মানুষ জাইগা উঠল। সারা দেশের সব মানুষের কাম দাঁড়াইল রোজ রাইতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা।

ব্যাঙ্গমা বলে, মুজিবনগর সরকারের সেরা কাজগুলানের একটা হইল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এই এক বেতার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচায়া রাখছিল, জাগায়া রাখছিল। এই এক বেতারের অনুষ্ঠান শুইনা বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, রেহানা নিজেদের মন শক্ত রাখতেন, মুক্তিযোদ্ধারা খালি পায়ে, ছেঁড়া লুঙ্গি পইরা, কাদাপানিতে থ্রি নট থ্রি কাঁধে ফিট কইরা খিদা ভুইলা থাইকা ট্রিগারে আঙুল টিপত, এক কোটি শরণার্থী দ্যাশ স্বাধীন হইলে আর দুঃখু থাকব না, এই তো আর কয়টা দিন বইলা বাইচা থাকনের চেষ্টা করত!

.

বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দোতলা বাড়ির নিচতলার ক্যানটিন। এখানেই সরকারের মন্ত্রীরা খান। নেপালি দারোয়ান তাঁদের পাহারা দিতে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মন্ত্রীরা খেয়েদেয়ে চলে গেলেন।

অমনি বেতার কর্মীরা এসে ঢুকলেন ক্যানটিনে।

এম আর আখতার মুকুল একটা খাসির মাংস দাতে ছেঁড়ার চেষ্টা করছেন, ছিঁড়ছে না, ছিঁড়ল যখন এক টুকরা ছিটকে গিয়ে পড়ল রাজশাহী থেকে আসা বেতার কর্মী শামসুল হুদা চৌধুরীর শার্টে, মুকুল বললেন, সরি, খাসির মাংস ভাইবা টান দিছিলাম, কুত্তার মাংস আছিল, তাই ছিটকায়া আপনার গায়ে পড়ছে, মাইন্ড কইরেন না।

শুনে বেলাল মোহাম্মদ হাসেন। প্লেট কম। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে একটা প্লেট পেয়েছেন। ভাত নিলেন। মাংস নিলেন। একটু ডাল কি নেবেন?

পেছন থেকে একজন বললেন, ভাই, দুজনের খাবার নেন। প্লেট নাই। আমি খুবই ক্ষুধার্ত। আপনার প্লেটে ভাগ করে খাই?

বেলাল মোহাম্মদ তাকিয়ে দেখলেন, আর কেউ না, দাঁড়িয়ে আছেন চশমা পরা শেখ কামাল। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই। আসুন। যুদ্ধের মধ্যে ছাদের নিচে বসে রান্না করা খাবার খাচ্ছি, এই কি বেশি নয়!

তারা মুখোমুখি একটা টেবিলে বসলেন। একই থালা থেকে খাবার ভাগ করে খেতে খেতে বেলাল মোহাম্মদ বললেন, আমার নাম বেলাল। চট্টগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আমরাই সবার আগে প্রচার করি। ২৬ মার্চ আমরা বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনেকবার প্রচার করেছি।

কামাল বললেন, পরে কী হলো?

বেলাল একটা আলুতে কামড় দিয়ে বললেন, ৩০ মার্চের পর পাকিস্তানিরা কালুরঘাটে বোমা মারে। পরে আমরা একটা এক ওয়াটের ট্রান্সমিটার নিয়ে সরে পড়ি। পরে আবার আগরতলা থেকে ৫০ ওয়াটের একটা বেতার থেকে অনুষ্ঠান করেছি।

কামাল বললেন, এক মিনিট। এক মিনিট। ১ ওয়াট। ৫০ ওয়াট। এখন যে স্বাধীন বাংলা বেতার এখান থেকে রেকর্ড হচ্ছে আর আমরা সবাই শুনছি, এটা কত ওয়াট?

এখনকারটা ৫০ কিলোওয়াট।

দাঁড়ান দাঁড়ান। কিলো মানে হাজার। মানে ৫০ হাজার ওয়াট। আর আপনাদেরটা ছিল ১ ওয়াট আর ৫০ ওয়াট? রাইট?

রাইট।

মানে এখনকারটা হাজার গুণ শক্তিশালী?

জি।

কামাল মাথা নাড়লেন। বেতারের শিল্পীদের অধিকাংশই তার পরিচিত। তিনি নিজে গান করেন, নাটক করেন, অনুষ্ঠান করেন, কাজেই শিল্পীরা সবাই তাঁর বন্ধু। সবার সঙ্গে ক্যানটিনে ভাগাভাগি করে খেতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি। না হলে চাচাঁদের সঙ্গে বসে গুরুগম্ভীরভাবে খেতে হয়। বাড়িতে আব্বা-মা সবার সঙ্গে তারা গল্পগুজব করেই খেতেন।

খাওয়া হয়ে গেলে কামাল বললেন, প্লেটটা আমাকে দেন।

বেলাল ভাবলেন, কামাল হয়তো আরেকটু খাবার আনবেন। ও মা, তিনি। খাবার না এনে প্লেট ধুতে শুরু করে দিলেন।

বেলাল বললেন, করছেন কী, করছেন কী!

শেখ কামাল বললেন, বেলাল ভাই, আপনি তো খাবার নেবার আগে ধুয়েছিলেন, এবার আমার পালা। আমরা এক প্লেটে খেতে পারলে সেই প্লেট কি আমি ধুতে পারব না?

৪১

শেখ লুৎফর রহমান রহমান সাহেব বসে আছেন তাঁদের টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির বারান্দায়। কবুতরগুলো বাকবাকুম রব তুলে গলার পালক ফুলিয়ে ডাকছে। কবুতরের বাসাটা চারটা বাঁশের ওপরে, ঘরের দেয়াল ঘেঁষে। সুন্দর ডিজাইনের এই দোতলাটা লুত্যর রহমান সাহেব কিছুদিন আগে করেছেন। খোকা বাড়ি এলে দুনিয়ার লোক এসে বাড়ি ভরে যায়। ১৯৬৯ সালে। ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালা থেকে বের হয়ে লঞ্চ ভাড়া করে যখন খোকা সবাইকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিল, তখন ইউসুফ হারুন সাহেব হেলিকপ্টার নিয়ে এসেছিলেন। কাজেই বাড়িঘর ভালো করা দরকার। তাতে সুবিধা হয়েছে।

তবে সারা বছর বাড়ি তো খালিই পড়ে থাকে। লুৎফর রহমান সাহেব এবং খোকার মা মাঝেমধ্যে ঢাকায় গিয়ে থাকেন। নাসেরও তো থাকে খুলনা। বাড়ি তো বলতে গেলে ফাঁকা। এখন তিনি আছেন, খোকার মা আছে। একটা ঘরই লাগে। বাকি ঘরগুলো বছর ধরে পড়ে থাকে।

উঠানে মোরগ-মুরগি চড়ছে। দুটো কুকুর রান্নাঘরের সামনে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। সারা রাত কুকুরদের জাগতে হয়, তাই তারা সারা দিন ঘুমায়। একটা কাক ডেকে উঠল বাড়ির পেছনের শজনেগাছের ডালে।

কাক কেন ডাকে? অনেক দিন আগে লুৎফর রহমান সাহেব একটা বটতলার বই দেখেছিলেন, কোন প্রহরে কার ডাকের কী ব্যাখ্যা। কাকের ডাকের সঙ্গে অন্য কোনো কিছুর কোনো যোগ আছে–এই সব কুসংস্কারে

তার একেবারেই সায় ছিল না কখনো। তবু আজ তার মনে অজানা শঙ্কা এসে। ভর করল।

আরশাদ কাঁসার গেলাস হাতে এসে পাশে দাঁড়াল।

লুৎফর রহমান সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী?

আরশাদ বলল, ডাবের পানি। খান। আপনের না পেশাবে সমস্যা। একটু খান। পেশাব ক্লিয়ার হবেনে।

লুৎফর রহমান সাহেব গেলাস হাতে নিয়ে বললেন, খোকার মারে দিছ?

জি। দিছি।

খোকার মা কই?

পাকঘরে।

গরমের মধ্যে পাকঘরে গেছে ক্যান? শেফালির মা নাই?

খালা পাকঘরে না গিয়া পারে না। অভ্যাস।

ঠিকই কইছ। অভ্যাস। দেশের খবর কী?

আর কোনো খবর নাই। মুক্তিফৌজ ভালো যুদ্ধ করতেছে। এইটা খালি জানি।

খোকার আর কোনো খবর পাইছ?

না। পাই নাই তো। করাচিতে রাখছে মনে হয়।

নাসেরের খবর পাইছ?

নাসের ভাইজান তো ইন্ডিয়া গেছে গা। ওইপার থাইকা যুদ্ধ করতাছে।

কামাল পৌঁছাইছে কি না খবর পাইছ।

হ। পাইছি তো। আপনারে না কইলাম। দুইজন আসছিল। মুক্তিযোদ্ধা। বইলা গেল, বর্ডার থাইকা খবর পাঠাইছে। কামাল মামা কলকাতা পৌঁছায়া গেছে।

রেনুর কোনো খবর পাইছ?

না। নতুন খবর পাই নাই কিছু। শুনলাম ভাবিরে নাকি বাড়িতে আটকায়া রাখছে।

গরুগুলানরে পানি দিছ?

জি দিছি।

আয়নাল কই। খেতে গেছে?

জি গেছে।

আইব কখন?

এই তো। বেলা তো অনেক হইছে। আয়া পড়ব।

জামিল কি গরুর ঘাস কাটতে গেছে?

জি গেছে।

কাশেম কই?

কাশেমরে কইলাম বাড়ির পেছনে একটু কোদাল চালাইতে। পুঁইশাক লাগান যায়। কথা শুনে না। জাল নিয়া খালে গেল। কয়, মাছ ধইরা আনি। আপনার কথা কয়। আপনে নাকি টাকি মাছের ভর্তা খাইতে চাইছেন।

কখন চাইলাম?

আরে নিজে খাতি চায়। সে জন্য কয়।

লুৎফর রহমানের বয়স কত কেউ জানে না। তিনি বলেন, এইটি প্লাস। সেই কবে তিনি আদালতের চাকরি ছেড়েছেন।

তাঁর গায়ে একটা গেঞ্জি। গেঞ্জির হাতা কনুই পর্যন্ত নেমে গেছে। তার নিচে সাদা ফরসা হাতের চামড়া কুঁচকানো। আর তাতে সাদা সাদা রোম। পরনে লুঙ্গি।

সায়েরা খাতুন পাকঘর থেকে বের হয়ে এলেন। তিনি ঘেমে গেছেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, কাশেম নাকি জাল নিয়ে গেছে খালে। মাছ আনলে কখন আনবে? মাছ কুটতে হবে। ঝামেলা না। তুমি ভর্তা খাইতে চেয়েছ, পুইড়ে করব নাকি পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে চচ্চড়ি করে নিয়ে ভর্তা কইরে দেব?

লুৎফর রহমান হাসেন।

হাসো ক্যানো?

আমি তো ভর্তা খাইতে চাই নাই। কাশেম বানায় বানায় কথা কয়েছে।

নামাজের ওয়াক্ত হতে কত বাকি?

এখনো তো হয় নাই টাইম।

কালকে নাকি রেডিওতে কয়েছে, সাতক্ষীরাতে যুদ্ধ হয়েছে। নাসেরের জন্যি চিন্তা হচ্ছে। সায়েরা খাতুন বললেন।

তোমারে কে বলল?

শেফালি এসেছিল অর মার জন্য তেল নিতে। অর কাছে শুনলাম। লিলির মেয়ে দুইটা নাকি তার দাদার বাড়ি গেছে।

গেলে তো ভালো। কিন্তু শহর বলো গ্রাম বলো কোনো কিছু কি আর নিরাপদ আছে?

হঠাৎই হইহই শব্দ উঠল। উঠানে মোরগগুলো গলা উঁচিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। চালের ওপর কবুতরগুলো উড়ে উঠল। বাড়ির খোলায় বাধা বাছুরটা দড়ি ছিঁড়ে পালাতে চাইছে। কাক ডেকে উঠছে কা কা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে কুকুরগুলো উঠেই ঘেউ ঘেউ করতে করতে তেড়ে গেল বাইরে।

দৌড়ে এল ওই বাড়ির আয়নাল। দাদি দাদি, দাদা দাদা, পালাতে হবি গো।

ক্যান পালাতে হবি ক্যান? লুত্যর রহমান সাহেব বললেন।

মিলিটারি আসতিছে।

মিলিটারি এলে আসবে। আমাদের পালাতে হবি ক্যান?

মিলিটারি কি মানুষ? তারা তো পশু। কিছু বুঝে না। খালি মানুষ মারে। দাদা-দাদি আপনেরা পালিয়ে যান।

পালিয়ে যাব কই? আর এই বয়সে আমি দৌড়াতে পারব? যা তো। যা হবার হবি। লুৎফর রহমান নির্বিকার মুখে বললেন।

কাশেম ভেজা শরীরে পানি টপ টপ করে ফেলতে ফেলতে জালটা উঠানে রাখল। বলল, দাদা, মিলিটারি আসতিছে। পালাতে হবি গো।

পালাবি ক্যান? আমরা কার কী ক্ষতি করিছি? লুৎফর রহমান বললেন।

জামিল দৌড়ে এসে গরুর জন্য ঘাস কাটার খুরপিটা বাড়ির পেছনের গোয়ালের বেড়াতে গুঁজে রাখল। হাতের ডালিটায় কিছু দূর্বাঘাস দেখা যাচ্ছে। জামিল বলল, দাদা মিলিটারি আসতিছে গো।

চুপ করে থাক-সায়েরা খাতুন বললেন।

কথা শেষ হওয়ার আগেই তিন দিক থেকে অস্ত্র উঁচিয়ে খাকি পোশাক পরা সৈন্যরা এসে দাঁড়াল বাড়ির উঠানে। তারা তাক করল অস্ত্র। হ্যান্ডস আপ।

শেখ লুত্যর রহমান বললেন, বাবারা, মাথা ঠান্ডা করো। আমার বয়স এইটির বেশি। আই অ্যাম এইটি প্লাস। আমার এক পা কবরে। আমাকে অস্ত্রের ভয় দেখাচ্ছ ক্যানো? অস্ত্র নামাও। কী চাও, বলো।

লুত্যর রহমান সেগুন কাঠের চেয়ারে বসেই রইলেন। সায়েরা খাতুন তার হাতল ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

হু ইজ লুৎফর রহমান?

আই অ্যাম লুৎফর রহমান।

ইয়োর সন ইজ দ্য এনিমি অব পাকিস্তান। ইয়োর সন ইজ দ্য এনিমি অব কায়েদে আজম। হি উইল বি পানিশড। সার্চ দ্য হাউস।

সৈন্যরা বাড়ির ভেতরে গেল। এই ভবনের নিচতলা, দোতলা, খাটের নিচ ভালো করে তল্লাশি চালাল।

সৈন্যদের কমান্ডার বলল, এই বুড়ঢ়া। বারান্দা থেকে নামো। বুড়টি নামো। আমরা বাড়িতে আগুন দেব।

লুত্যর রহমান জানেন, উত্তেজিত সৈনিকদের সঙ্গে তর্ক করতে নেই। তিনি সায়েরা খাতুনকে বললেন, চলো।

সায়েরা খাতুন বললেন, ঘরে কোরআন শরিফ আছে। নিয়ে আসি।

লুৎফর রহমান বললেন, দেয়ার ইজ আ কোরআন শরিফ ইন দ্য রুম। শি ইজ গোয়িং টু পিক দ্যাট।

ইউ হিন্দু। হোয়াট কোরআন? নো নিড টু ব্লাফ আস। জাস্ট গেট আউট অব দ্য হাউস।

লুত্যর রহমান বারান্দা ছাড়লেন। উঠান ছেড়ে বাড়ির প্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালেন। একটা নিমগাছের ডালপালা-পাতা তাদের মাথার ওপরে ছায়া নাড়তে লাগল।

কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।

সৈনিকেরা বাড়িতে পেট্রল ঢালতে লাগল। গানপাউডার ছিটাল। তারপর ফ্লেয়ার গানের ট্রিগার টিপল বাড়ির দিকে তাক করে। মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে লাগল পুরো বাড়ি।

এর দরজা, জানালা, কপাট, বারান্দা, দোতলা, সিঁড়ি সবখানে আগুন আর আগুন। লুৎফর রহমানের পাশে এসে দাঁড়াল তার কেয়ারটেকার আরশাদ (বয়স ৩৩)।

তার পাশে দাঁড়াল কাশেম (২২), জামিল (১৬)। দাঁড়াল এসে শেফালির মা (৩৮)। শেফালির মায়ের হাতে রান্নার পেষা মসলা লেগে আছে, হলুদ, মরিচ, পেয়াজের দাগ…তার হাতে চুড়ি, নাকে নথ…

শেফালির মা ডুকরে কেঁদে উঠল–ও মা গোয় আগুন দিয়া সব পুড়ায়ে দেল গো…

সায়েরা খাতুন হতবাক হয়ে গেলেন। তার চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল।

লুত্যর রহমান কিছু বলছেন না। শুধু একবার রোদে পোড়া আকাশটার দিকে তাকালেন, আকাশে ধোয়া, আকাশে আগুন, আকাশে ছাই, তিনি আল্লাহকে বললেন, আল্লাহ জালিমের জুলুম তুমি সহ্য করো কেমন করে?

আগুনে বাড়িটা পুড়ছে। ঠাস ঠাস শব্দ হচ্ছে জানালার কপাট খুলে খুলে পড়ার…

মিলিটারিরা চারপাশে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবের পিতার বাড়ির ব্যুৎসব প্রত্যক্ষ করছে। তাদের বুটের নিচে কাদা। তাদের পিঠে অনেক বড় বড় ব্যাগ। কোমরভরা গুলি। হাতের মেশিনগানে জলপাই রঙের বেল্টে গুলির সারি। তাদের মাথায় হেলমেট। তাদের চোখে ক্ষুধার্ত হায়েনার ক্রোধ।

আজান হচ্ছে মসজিদে। কে আজান দিচ্ছে?

আগুন নিভে আসছে। অনেকগুলো কুকুর জড়ো হয়ে সৈন্যদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছে। বাথান থেকে ছুটে পালিয়েছে গরুরা।

আগুনের তেজ কমে এল।

ওকে ওল্ডম্যান। আমাদেরকে তোমরা যত ব্যারব্যারিয়ান ভাবো, আমরা তত খারাপ নই। দ্যাখো, তোমাদের বুড়োবুড়ির গায়ে আমরা একটা ফুলের টোকাও দেই নাই। বিদেশি সাংবাদিকেরা এলে বোলো, দ্য কমান্ডার ওয়াজ। ভেরি জেন্টল। হি ওয়াজ কাইন্ড অ্যান্ড কনসিডারেট। ওকে। বাই। টেক কেয়ার। ট্রপস। ফল আউট।

সৈন্যরা চলে যাচ্ছে। তারা বোধ হয় বাইগার খাল দিয়ে গানবোটে এসেছে। খালের দিকে যাচ্ছে।

আরশাদ বলল, আপনারা কার বাড়িতে এসেছিলেন, জানেন তো। এইটা শেখ বাড়ি। শেখ মুজিবের বাপের ভিটা। দাদার ভিটা। এই বাড়ির একটা নিয়ম আছে। দুপুরের খাবার টাইম হয়েছে। এই বাড়িতে দুপুরে কেউ আইলে

খেয়ে যেতে পারে না। অফিসার, আপনে দুপুরে দুমুঠো জয় বাংলার ভাত খেয়ে যাবেন। নালি পরে গৃহস্থের অকল্যাণ হবে।

কী বলল লোকটা?

একজন দোভাষী কথাটা অনুবাদ করে দিল।

সঙ্গে সঙ্গে হাতের মেশিনগান তুলল অফিসারটা। তাক করল আরশাদের দিকে। ট্রিগারে আঙুল রাখল। পেশাদার আঙুলে চাপ দিল নির্ভুলভাবে। ট্যা ট্যা ট্যা করে একঝক গুলি বেরোতে লাগল। আরশাদের বুক ফুটো হলো, কান উড়ে গেল, কপালে গুলি লেগে করোটির পেছন দিক ফুটো করে মগজ গেল উড়ে। আরশাদ এসে গড়িয়ে পড়ল লুৎফর রহমানের কোলে। লুৎফর রহমান আরশাদকে ধরলেন। পাথরের চোখ দিয়ে তাকালেন একবার অফিসারটার দিকে। সেই চোখে আগুন ছিল। অফিসার চোখ নামিয়ে ফেলল। পাশের জওয়ানটা তখন অস্ত্র তুলল জামিল, কাশেম, শেফালির মায়ের দিকে। আবার প্রচণ্ড শব্দ, আগুনের ফুলকি আর রক্তের ফিনকি। চিৎকার, আর্তনাদ…

চার-চারটা লাশ পড়ে রইল খোলায়।

সৈন্যরা চলে গেল। লুত্যর রহমান, সায়েরা খাতুন পোড়া বাড়ির আগুনছাই ধোয়ার দিকে একবার তাকাচ্ছেন। ধোঁয়ায় চোখ খোলা যাচ্ছে না। একবার নিজের হাত-পা-বুকের দিকে তাকাচ্ছেন। এত রক্ত কার? আরশাদের…

সৈন্যরা চলে যাচ্ছে, পেছনে পেছনে তেড়ে যাচ্ছে কুকুরগুলো…

কাক ডাকছে কা কা…

আরশাদের রক্তে ভিজে গেছে লুৎফর রহমানের গায়ের কাপড়, পরনের লুঙ্গি…

৪২

রিমি, রিপি, সোহেল, মিমি সবাই এসে উঠেছেন কোহিনূর ম্যানশনে। মওলানা ভাসানীর সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে কদিন থাকতে হবে।

মওলানা ভাসানী খুবই খুশি। জোহরা তাজউদ্দীন ওরফে লিলি রান্না করেন। আর কাঁচা মরিচ কচকচ করে চিবিয়ে মওলানা ভাসানী দুপুরে খান।

বাচ্চারা তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। তিনি গল্প করেন।

বুঝলা মা, তাজউদ্দীন একটা খাঁটি মানুষ।

৫৪ সালে ইলেকশনের সময় তার লগে একসাথে গেছিলাম হাতির পিঠে চইড়া, শাল-গজারির বনের ভিতর দিয়া, কাঁপাসিয়া।

রিপি বলল, আপনি হাতির পিঠে চড়লেন। আপনার ভয় লাগল না।

রিমি বলে, হাতিটা নাকি আগুন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

রিপি বলে, আপনি কি বাঘের সামনে পড়েননি?

রিমি বলে, আমার দাদি একাই একটা লাঠি হাতে বাঘকে তাড়া করেছিলেন।

মওলানা ভাসানী খান। আর গল্প করেন। বলেন, মজিবর নাই। আওয়ামী লীগরে সামলানো কি যা-তা কথা? কে কারে মানে? মোশতাক মনে করে সে। সিনিয়র। তারই হওনের কথা প্রধানমন্ত্রী। মনসুর আলী মনে করেন তিনি প্রাদেশিক পরিষদের নেতা। তারই হওনের কথা প্রধানমন্ত্রী। কামারুজ্জামান। মনে করে, সে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। তারই হওনের কথা সভাপতি। এই দিকে আছে রাজ্জাক, তোফায়েল, শেখ মণি, সিরাজ। তাজউদ্দীন বড়ই ঝামেলায় আছে। তবে তাজউদ্দীন সিনসিয়ার আছে। পারলে সে-ই পারব।

.

রিমি, রিপিদের এই ফ্ল্যাটে এলেন শেখ কামাল। লিলির সঙ্গে দেখা করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কাকি, আপনার কিছু লাগবে?

লিলি বললেন, বাবা, তুমি তো আরও শুকিয়ে গেছ। তুমি বসো। আমি রান্না করছি। খেয়ে যাও। তোমার কাকু তো আসে না। আমিও ভালোমতো

খবরাখবর পাই না। মুজিব ভাইয়ের নতুন কোনো খবর পাওয়া গেল?

না। নতুন খবর তো নাই। পাকিস্তানের কোনো জেলখানায় রেখেছে। কোথায় রেখেছে, তা-ও তো কেউ ঠিকঠাক বলতে পারে না।

তোমার মায়ের কোনো খবর পেলে? হাসিনা, রেহানা এরা কেমন আছে?

আমি তো দেখা করে এসেছি। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি পালিয়ে পালিয়ে থাকত। এখন নাকি মিলিটারি ধরে হাউস অ্যারেস্ট করে রেখেছে।

কী দুশ্চিন্তার কথা? হাসিনার ডেট কবে জানো?

না কাকি।

লিলি রাঁধতে লাগলেন। কামাল রিমি-রিপির সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন।

রিমি বলল, কামাল ভাই, আপনি কি বন্দুক চালাতে জানেন?

জানি তো।

কী কী চালাতে পারেন?

সবকিছু।

রাইফেল?

পারি।

স্টেনগান?

পারি।

মর্টার? কামাল হেসে ফেললেন। মর্টার চালানোর ট্রেনিং নিতে আমি যাচ্ছি। লিলি বললেন, সত্যি?

জি কাকি। আমি বাংলাদেশ ওয়ার ফোর্সের ফার্স্ট ব্যাচে যাব। মুরতি ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং হবে। মিলিটারি ট্রেনিং।

লিলি বললেন, আমার অনেক দোয়া থাকল বাবা। তুমি যেন ভালো থাকো। কী শুকিয়ে গেছে ছেলেটা আমার! এখানকার খাবার ভালো না?

ভালোই তো কাকি। তাজউদ্দীন কাকুর সঙ্গেই তো খাই। একই ক্যানটিনে।

কী খাও না-খাও। আর কিছু পারি না-পারি, রাঁধতে তো পারি। কথাটা লিলি কাকে যে বললেন, কামালকে নাকি রিমি, রিপির আব্বাকে, সে শুধু অন্তর্যামীই বলতে পারবেন।

৪৩

কলকাতায় সাইফুল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে থাকেন। বাইরে প্রহরা। বেরোনো যাবে কি না জানেন না। গোয়েন্দারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। কেন তিনি। ন্যাপ মোজাফফর করা লোক ভাসানী ন্যাপের সভাপতির সঙ্গে এসেছেন? শেষে গোয়েন্দারা বলল, মওলানা ভাসানীর একটা সংবাদ সম্মেলন করা উচিত। ভাসানী রাজি হলেন। তবে তিনি নিজে বাইরে যেতে চাইতেন না। বলতেন, কলকাতায় নকশালদের বড় উৎপাত। বাইরে যাওন ঠিক না।

সাইফুল মওলানা ভাসানীর পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করলেন। বললেন, ভাসানী বাংলাদেশের ভেতরেই এক গোপন জায়গায় আছেন। তিনি একটা বিবৃতি দিয়েছেন। সাইফুল সেটা পড়ে শোনালেন।

জয় বাংলা পত্রিকার ৯ জুন সংখ্যায় বের হলো :

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়–মওলানা ভাসানী

গত ৩১ মে বাংলাদেশের কোনো এক স্থানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান। ভাসানী বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সকল প্রকার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির দাবীতে যাদের মুখে মুখে সব সময় খই ফোটে, বাংলাদেশের প্রশ্নে সেই সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশের পূর্ণ নীরবতায় মওলানা ভাসানী বিস্ময় প্রকাশ করেন।…

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য সর্বদলীয় সরকার গঠনসম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে মওলানা বলেন, আমি সর্বদলীয় জগাখিচুড়িতে বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশের উভয় অংশে আমরা সর্বদলীয় সরকারের কাণ্ড কারখানা দেখেছি। তাতে কোনো কাজের কাজ হয় না। তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিই আজ সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। সুতরাং সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রশ্নে আমাদের কারও কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়।

সংবাদ সম্মেলনের পর সাইফুল বাইরে বের হতেন। থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়, পার্ক সার্কাস রোডে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। পার্ক সার্কাসের নাসিরুদ্দীন রোডে ন্যাপ কার্যালয়। সাইফুল সেসব অফিসে যাতায়াত করতে আরম্ভ করলেন।

মওলানা ভাসানী ফ্ল্যাট থেকে বের হন না। মাঝেমধ্যে বিকেলে গাড়ি করে যান গঙ্গার ধারে হাঁটতে।

হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন কলকাতা এসেছেন। তাঁরা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে চান। সাইফুল সেই বার্তা নিয়ে এলেন মওলানার কাছে। ভাসানী বললেন, এখন না। সময় হইলে নিজেই বলব।

তিনি রননা, মেননের সঙ্গে দেখা করলেন না।

ভাসানী ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া কলকাতা এলেন। উঠলেন টাওয়ার হোটেলে। পাশেই টাওয়ার লজ।

১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটার এক স্কুলে আয়োজিত হলো বাংলাদেশের চীনাপন্থী বাম ও কমিউনিস্ট সংগঠনগুলোর এক সম্মেলন। যাদু। মিয়া তাতে দুই দিন যোগ দিলেন।

মওলানা ভাসানীর অনুপস্থিতিতে তাঁকে প্রধান করে গঠন করা হলো বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ।

সাইফুলকে ধরলেন যাদু মিয়া–তাঁর নেতার সঙ্গে তাঁকে দেখা করিয়ে দিতে।

সাইফুল বললেন মওলানা ভাসানীকে, টাওয়ার লজে সিকদার, রনো, মেনন, অমল সেনদের সাথে যাদু ভাইদের বৈঠক হচ্ছে।

ভাসানী বললেন, ভালোই তো। যদি একখান পথ বাইর করতে পারে, তা তো ভালোই হইব। স্বাধীনতার লড়াই তো অনেক ফ্রন্টেই হইতে পারে।

যাদু ভাই আপনার সাথে দেখা করতে চান।

না না। ওর সাথে দেখা করা যাইব না।

ক্যানো? আপনার পার্টির সেক্রেটারি, তাঁর সঙ্গে দেখা করবেন না?

না। সে আমারে জাদুটোনা করব। সে আমারে ফিরায়া লইতে চায়।

আপনাকে ফিরিয়ে কই নেবে?

আমারে পাকিস্তান সমর্থন করতে কয়। আমার সাথে চীনারা দেখা করছে। কয়, পাকিস্তান সমর্থন করো। আমি কি সেইটা হইতে দেই? আমি ভারতে আসি, এইটা যাদু মিয়া চায় না। কয় আমারে চীনে নিয়া যাব। যেই দেশ বাংলার স্বাধীনতা চায় না, সেই দেশ আমি ক্যান যামু? যাদু আইছে আমারে ফিরায়া লইতে। অর সাথে দেখা করন যাইব না। কইলাম স্বাধীনতার লড়াই যদি দ্যাশে করতে না পারি, যেই দ্যাশ আমগো স্বাধীনতার লাইগা সাহায্য দিব, সেই দ্যাশে যামু। আমি আসলে লন্ডন যাইতে চাইছিলাম।

লন্ডন ক্যান?

বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যাওনের পথে লন্ডন আটকা পড়ছিলাম না! আন্তর্জাতিক একটা শহর। স্বাধীনভাবে কাজ করা যাইত।

লন্ডন যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠলেন!

তোমারে ডাইকা নিলাম, তুমি বুঝলা না। শুনো, ভারত হইল রবি ঠাকুর, গান্ধী, দেশবন্ধু, নেতাজি, নেহরু, আবুল কালাম আজাদের দ্যাশ। নেহরুর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো আছিল। ইন্দিরা নেহরুর বেটি। সে বাংলার স্বাধীনতারে সাহায্য কইরবই। ভারত আমগো বন্ধু। আর যে চীনের সাথে আমাদের এত দোস্তি, বিপদে সেই চীন মুখ ফিরায়া রইল। আমার দুঃখটা তুমি বুঝ!

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, মশিউর রহমান যাদু মিয়া কলকাতা থাইকা ভাইগা গেলেন। গিয়া যোগ দিলেন পাকিস্তানিগো লগে। রাজাকারির চরম করতে লাগলেন। কলকাতায় বইসা ন্যাপ নেতারা মিটিং কইরা যাদু মিয়ারে বহিষ্কার করলেন ভাসানীর সম্মতি লইয়া।

.

তাজউদ্দীন এসেছেন তার স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের সঙ্গে দেখা করতে।

এসে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। তাজউদ্দীন বললেন, হুজুর, আমার জন্য দোয়া করবেন। মনে হয় বিশাল একটা ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সাগরে একা ছোট্ট ডিঙা ভাসিয়েছি।

মওলানা বললেন, এত দিন তো আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল হরতাল করার, মিটিং করার, প্রেস রিলিজ লেখার, আর প্রস্তাব পাস করার। এবার তো অস্ত্র। হাতে যুদ্ধ করতে হইতেছে। আর করতে হইব কূটনীতি! একলা পারবা?

তাজউদ্দীন বললেন, আপনার দোয়া থাকলে পারব। আমার দলের মধ্যে নানান মত আছে। ভেতরে-ভেতরে ষড়যন্ত্র আছে। তবে আপনি দোয়া করবেন। সেটা আমার বিশেষভাবে চাই।

লিলির সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করলেন তাজউদ্দীন। ছেলেমেয়েদের চুমু খেয়ে তিনি বেরোনোর উদ্যোগ করলেন। ডাকলেন সাইফুলকে। ইসলাম সাহেব!

সাইফুল এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।

তাজউদ্দীন বললেন, আপনাকে মওলানা সাহেব খুবই পছন্দ করেন। আপনি একটু খেয়াল রাখবেন। তাঁর দলের অনেকেই কলকাতায় ঘুরঘুর করছে। পাকিস্তানের এজেন্ট। তাদের মতলব ভালো না। আপনি মওলানা সাহেবকে দেখে রাখবেন।

সাইফুল বললেন, আপনি চিন্তা করবেন না। দলের লোক না এনে তিনি আমাকে এনেছেন বুঝেশুনেই। আবার যাদু ভাই বা মেনন, রনোর সঙ্গে দেখা করেননি, সেটাও তিনি সচেতনভাবে বুঝেশুনে করেছেন।

তাজউদ্দীন বললেন, তবু আপনি অ্যালার্ট থাকবেন।

সাইফুল তাকিয়ে আছেন তাজউদ্দীনের মুখের দিকে। মাঝারি আকারের মানুষটার গোলাকার মুখ, বড় বড় চোখ। কণ্ঠস্বর পাতলা, জননেতার গর্জন তাতে নেই। কাঁপাসিয়ার বন-বনানীর পাতার মর্মর যদিও খানিকটা পাওয়া যায়, প্রমত্ত পদ্মর গর্জন তাতে নেই।

.

কয়েক দিন পরের কথা। জোহরা তাজউদ্দীন তাঁর ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেছেন পার্ক সার্কাসের কাছে সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউতে। সেখানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিসহ মুজিবনগর মন্ত্রিসভার অন্যরাও পরিবার নিয়ে থাকেন। তাজউদ্দীন আবার এসেছিলেন মওলানা ভাসানীর ফ্ল্যাটে। হুজুরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দীর্ঘ বৈঠক।

মওলানা আর তাজউদ্দীনের কী কথা হলো সাইফুল শোনেননি। মিটিং শেষে তাজউদ্দীন এলেন সাইফুলের ঘরে।

সাইফুল ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন, ভাই আসেন, ভেতরে বসেন।

তাজউদ্দীন ঘরে ঢুকলেন। সাইফুল তাকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন বসার জন্য। বসতে বসতে তাজউদ্দীন সাইফুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই চেয়ারটা তো বেশ মজবুত। তারপর হেসে বললেন, সাইফুল, আমার নিজের চেয়ারের খুঁটি অসমান।

সাইফুল তাকিয়ে রইলেন তাজউদ্দীনের মুখের দিকে, চোখ দুটোতে কী

যেন অব্যক্ত একটা বেদনা তিনি দেখতে পাচ্ছেন।

সাইফুল সাহেব, মওলানাকে একটু বোঝাবেন। তাঁকে তো সরাসরি সব কথা বলা যাবে না। রেগে গিয়ে উল্টাপাল্টা বিবৃতি দিয়ে বসবেন।

আমার যেটুকু সাধ্য তা না হয় আমি করব। তবে হুজুর চলেন তার নিজের মতে। আপনাকে তিনি খুবই পছন্দ করেন।

কলকাতা ভরে গেছে আমেরিকান সাহায্য সংস্থার লোক দিয়ে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান স্টাডিজ একটা ইন্টারন্যাশনাল রিলিফ কমিটি খুলেছে। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই তাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে। তারা বুঝছে অথবা বুঝছে না যে এটা সিআইএর উদ্যোগ। তারা আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে বিভ্রান্ত করতে চায়। রাজনৈতিক সমাধান? মানে আবার ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে ৬ দফা বাস্তবায়নের নামে সময়ক্ষেপণ। মানে মুক্তিযুদ্ধটাকেই বিনষ্ট করে দেওয়া। যুদ্ধ করে দেশ শত্রুমুক্ত করা ছাড়া আর কোনো লাইন নেওয়া মানেই পুরো সংগ্রাম, এত মানুষের আত্মদান শেষ হয়ে যাওয়া।

সাইফুল চিন্তিত হলেন। শুধু আমেরিকান লবি, খন্দকার মোশতাক লবি ষড়যন্ত্র করছে তা নয়। মুজিববাহিনী তো আছেই, আরও আছে সেনাবাহিনীর লোকদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব না মানার বা তাদের অশ্রদ্ধা করার প্রবণতা। আসলে তাদের ট্রেনিং তো হয়েছে পাকিস্তানি সৈনিক হিসেবে। সিভিলিয়ানদের বাস্টার্ড সিভিলিয়ান ছাড়া তারা কোনো দিনও বলেনি। শুধু ব্যাটেল বা ওয়ার দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয় না, রাজনৈতিক নেতৃত্ব লাগে, পুরো ব্যাপারটাই যে আসলে সামরিক নয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক–এটা বাঙালি মিলিটারি অফিসারদের সবাই কি বোঝেন। এরা ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা তৈরি করবে।

তাজউদ্দীন বললেন, আসি সাইফুল। তবে আমাদের প্রধান শক্তি কী। জানেন?

সাইফুল বললেন, আপনি বলেন।

তাজউদ্দীন বললেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ। তারা কিন্তু কে আওয়ামী লীগ, কে ন্যাপ, কে মুক্তিফৌজ, কে মুজিববাহিনী, কে বেঙ্গল রেজিমেন্ট, কে ইপিআর–তা বোঝে না, শুধু বোঝে জয় বাংলার পক্ষে না বিপক্ষে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের সবাই–শুধু মুসলিম লীগ, জামাত, নেজামে ইসলামী আর কয়েকটা চীনা অতিবিপ্লবী ছাড়া সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। মুজিব ভাইয়ের ওইটাই ম্যাজিক, তিনি স্বাধীনতার মন্ত্র দিয়ে সবাইকে বশীভূত করে ফেলতে পেরেছেন। আমি আসি। আরেকটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।

বলে তাজউদ্দীন কোহিনূর প্যালেস থেকে নেমে গেলেন। সাইফুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওপর থেকে দেখলেন। তাজউদ্দীন গাড়িতে উঠলেন। অ্যাম্বাসেডর গাড়ি। আরও দুজন সশস্ত্র লোক গাড়িতে উঠল। তাঁর গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করতে লাগল।

.

পিকিংপন্থী দলগুলোর বাংলাদেশ জাতীয় সমন্বয় কমিটির ঘোষণাপত্র নিয়ে রনো আর কাজী জাফর গেলেন তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে। তাজউদ্দীন আহমদ আগে থেকেই সব খবর রাখেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট তার কাছে আসে, খবরের কাগজেই ছাপা হয়। নকশাল আন্দোলন নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ রকমের স্পর্শকাতরতা আছে, এটা তাজউদ্দীন আহমদ জানেন। চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশের বিরোধিতা করছে, যেকোনো পরিস্থিতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ রোধে তারা পাকিস্তানের পাশে সামরিকভাবেও থাকবে, এই অঙ্গীকার প্রকাশ্যে ব্যক্ত করছে, এটা তাজউদ্দীন জানেন। এ অবস্থায় রনো আর কাজী জাফরকে তাজউদ্দীন কীভাবে গ্রহণ করবেন। তিনি চেষ্টা করছেন মুখে হাসি ধরে রাখতে। ওদের ঘোষণাপত্রটা নিয়ে তিনি দিলেন ফারুক আজিজ খানকে। তারপর বললেন, চা খান। এই একটু চা দিতে বলো তো।

এরপর বললেন, দেখেন, বামপন্থীদের সঙ্গে আমার সব সময় বন্ধুত্ব ছিল। তোয়াহা সাহেব আমার পারিবারিক বন্ধু। তার মেয়ের বিয়েতে আমি গেছি। আমাদের দুই পরিবার সব সময়ই যোগাযোগ রাখে। তোয়াহা কোথায়? ওকে বলবেন তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রনো আর কাজী জাফরকে চা খাইয়ে তিনি বিদায় দিলেন। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক কথায় গেলেন না।

এর বেশ কিছুদিন পরে, তাজউদ্দীনের অফিসে এল দিনাজপুরের কমিউনিস্ট নেতা বরদা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে জাতীয় সমন্বয় কমিটির আরেকটা প্রতিনিধিদল। তারা এসেছেন স্মারকলিপি নিয়ে। তারা তাজউদ্দীনকে বললেন, মস্কোপন্থী ক্যাডারদের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে, তাদের ক্যাম্প আছে। আমাদেরও ক্যাম্প করতে দিতে হবে। আমাদেরও অস্ত্র দিতে হবে।

তাজউদ্দীন বললেন, এটা তো আওয়ামী লীগের যুদ্ধ নয়, রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টিরও যুদ্ধ নয়, এটা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, তাই তো?

হ্যাঁ। আমরা তো সেই কথাটাই বলতে এসেছি।

তাজউদ্দীন মৃদু কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললেন, বাংলাদেশের কোনো দল বা গোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে তো কারও অনুমতির দরকার হয় না। কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইলে লড়াই করছেন, তিনি তো ভারতে আসেননি, হালিম বাহিনী, আফসার বাহিনী, হেমায়েত বাহিনীসহ যেসব বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে বীরের মতো যুদ্ধ করছে, তারা আমার কাছে দেখাও করতে আসেনি, অস্ত্র চাইতেও আসেনি। তারা আওয়ামী লীগ না ছাত্রলীগ, রুশপন্থী নাকি চীনপন্থী, আমি কোনো দিন জিজ্ঞাসাও করতে যাইনি। দেখুন, মার্ক্সবাদ নিয়ে আমিও কিছু পড়াশোনা করেছি, মাও সে তুংয়ের গেরিলাযুদ্ধের বই, চে গুয়েভারার বই আমারও সামান্য হলেও পড়া আছে। আমার জানামতে, এসব বইয়ে লেখা আছে, শত্রুর অস্ত্রই হচ্ছে বিপ্লবী গেরিলাদের অস্ত্র। আসল মার্ক্সিস্ট গেরিলারা শত্রুর অস্ত্র কেড়ে নিয়ে লড়াই করে। তারপর আরও আরও অস্ত্র তাদের দখলে আসে। কিন্তু এখন দেখছি, আপনারা বিপ্লবীরা অস্ত্রের জন্য পেটিবুর্জোয়া আওয়ামী লীগের কাছে অস্ত্র চাইতে এসেছেন। চীনের সব সরকারি কাগজে দেখেন, লিখেছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই। এখন যাদের বিরুদ্ধে আপনাদের লড়াই, তাদের কাছ থেকে অস্ত্র নেবেন। ভারতীয়রা জানে না যে সেই অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হবে? আপনার হাতে আমি অস্ত্র দেব, আর সেটা কালকে পশ্চিম বাংলা বিহারের নকশালদের হাতে যাবে না, এটার নিশ্চয়তা আপনারা দিতে পারেন, আমি পারি না। কাজেই আমার হোস্ট কান্ট্রি আমাকে বলে দিয়েছে, অস্ত্র যেন চীনাদের হাতে না যায়।

আমরা তো ভারতে এসেছি, চীনের ওই লাইন আমরা মানি না বলেই।

আপনাদের থিসিসগুলো আমি পড়ে ফেলেছি। আপনারা একই সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং ভারতের বিরুদ্ধে লড়বেন। একই সঙ্গে পাকিস্তানি মিলিটারি এবং আওয়ামী লীগের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বেন।

কাজেই আপনারা আমাকে সমর্থন দিতে এসেছেন, আমি আপনাদের স্বাগত জানাই। আপনারা এ দেশে থাকেন, সিপিআইএম চারু মজুমদার অসীম চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, বাংলাদেশে লড়াই করেন, আমি আপনাদের সাফল্য কামনা করি। দয়া করে আমার মতো বুর্জোয়া দলের আহাম্মক প্রধানমন্ত্রীর কাছে অস্ত্র চাইবেন না, ক্যাম্প চাইবেন না।

৪৪

এমন একঘেয়ে বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে গিয়ে আকাশ পরিষ্কার হবে, তা না। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। আমীর-উল একবার আকাশের দিকে তাকালেন। এত ঘোলাটে দেখাচ্ছে আকাশটা। সেকি তার চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেছে বলে। নাকি চোখই ঢেকে আছে অশ্রুর বাষ্পে।

কলকাতার মুসলিম গোরস্থানে একটা ছোট্ট কবর খোঁড়া হয়েছে। এক হাত হবে লম্বায়।

এখানে আমীর শুইয়ে দিলেন সাদা কাফনে ঢাকা সাত দিন বয়সী তার পুত্রসন্তান জয়কে।

তিনি তো বাড়ি ছেড়েছেন সেই ২৫ মার্চ রাতে, এরপর আর দেখা পাননি স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের।

জুন মাসে আগরতলা থেকে কলকাতা ফিরে এসে আমীর-উল জানতে পারলেন, লীলা এসেছে কলকাতায়। উঠেছে কোহিনূর ম্যানশনে। তিনি ছুটে গেলেন কোহিনূর ম্যানশনে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন খানিকক্ষণ।

স্ত্রী কান্না মুছে জানালেন বিবরণ। তিনটা মাস কী কষ্টই না তাদের করতে হয়েছে। চার বছরের ছেলে পাবলো, দুই বছরের কন্যা শম্পাকে নিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়তে হয়। শম্পা অতটুকুন বাচ্চা আশ্রয় নেয় নানির বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। শম্পার মামা আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা সরোয়ার। কাজেই তাদের বাড়িতে মিলিটারি আসে আর সেই বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। আর লীলা এ বাড়ি ও বাড়ি, আত্মীয়র বাড়ি, পরিচিতের বাড়িতে নীড়ভাঙা পাখির মতো ঘুরতে থাকেন। পাবলোকে নিয়ে। বহু কষ্টে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে দেখেন, বাড়ির ভিটেতে ছাই। লোকজন নেই। নৌকায় ওঠেন। উদ্দেশ্য লীলার দাদাবাড়ি জামালকান্দি। মিলিটারিদের গানবোটের চোখ এড়িয়ে বহুদিনের ভাসানের পর জামালকান্দি পৌঁছান তাঁরা। সেখানে পরে আসে শম্পা। এরপর রহমত আলী তাঁদের নিয়ে আসেন আগরতলা। আগরতলা থেকে কার্গো বিমানে দমদম।

কোহিনূর ম্যানশনে কোনো আসবাব নেই। মেঝেতে চাদর পাতা। হলো। পাবলো আর শম্পা বাবাকে জড়িয়ে ধরল।

লীলা বললেন, আমারও তো ডেট এগিয়ে আসছে।

আমীর-উল বললেন, হ্যাঁ। তোমার শরীরের যত্ন দরকার। এত ধকল, এত পালানো, এত দৌড়, এত খাটুনি গেছে এই শরীরের ওপর দিয়ে।

আমীর-উল কৃষ্ণনগর গিয়েছিলেন। সেখানে এসে উঠেছে তার নির্বাচনী এলাকা কুষ্টিয়ার সাতটা গ্রামের মানুষ। সাতটা গ্রামের ঘরবাড়ি পাকিস্তানি মিলিটারি জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে, তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে করতে কলকাতা ফিরতে দেরি হয়ে গেল।

কলকাতায় ঢুকে গাড়ি সোজা গেল ক্লিনিকে। আমীর-উল নামলেন গাড়ি থেকে। ক্লিনিকে ঢুকলেন। দরজা ঠেলে ঢুকলেন লেবার ওয়ার্ডে। দেখা পেলেন লীলার। তার কোলে একটা ছোট্ট বাচ্চা। লীলা বললেন, ছেলে হয়েছে। তারা নাম রাখলেন জয়।

ছেলে নিয়ে তারা ফিরে এলেন কোহিনূর ম্যানশনে। পাবলো, শম্পা নতুন ভাই পেয়ে খুশিতে আহ্লাদিত। জয় নামটাও তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু তিন দিনের মাথায় জয় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ল। বারবার পায়খানা হচ্ছে। ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার বললেন, ডিসেন্ট্রি হয়েছে। তবে এতবার পায়খানা হওয়া ভালো না। ক্লিনিকে ভর্তি করুন। স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।

আমীর-উলের মুখ শুকিয়ে এল। টাকা পাবেন কই?

শুনে তাজউদ্দীন তিন শ টাকা দিলেন আমীর-উলের হাতে। আবারও ক্লিনিকে ভর্তি করা হলো জয়কে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। সাত দিন বয়সী জয় মারা গেল।

ছেলেকে কবরে নামালেন। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমীরের চুল ভিজে আসছে। ছেলেকে কবরে শুইয়ে মাটি ঢালতে শুরু করলেন তিনি। আর সঙ্গের লোকেরা। সন্তানকে মাটির নিচে শুইয়ে দিয়ে তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন খানিকক্ষণ। মোনাজাত করলেন। তখনই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। ভালোই হলো। বৃষ্টিতে কাদলে কেউ সেই কান্না দেখতে পায় না।

আমীর-উলের শোক সামলাতে সাত দিনের বেশি সময় লাগল। কিন্তু লীলা কিছুতেই সামলাতে পারছেন না। মাতৃদুগ্ধধারা গড়িয়ে পড়ছে বুক থেকে, আর কান্না উথলে উঠছে দুই চোখে। তিনি শুধু কাঁদেন। শুধু কাঁদেন।

আমীর-উল বললেন, চলো আমার সঙ্গে।

কোথায়?

শরণার্থীশিবিরে।

কেন?

দেখবে, শরণার্থীশিবিরে মায়েরা কত কষ্ট করছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার শিশু মারা যায় সব কটি শিবিরে। ওদের সেবা করো। ওদের পাশে দাঁড়াও।

আমীর-উলের সঙ্গে জিপে করে শরণার্থীশিবিরে গেলেন লীলা। এটা কি মানুষের বসতি! সারি সারি তাঁবু। পুরো রাস্তা কর্দমাক্ত। বাথরুম নেই। গর্ত খুঁড়ে কোনোরকমে ছালা দিয়ে ঘিরে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে পায়খানা। সেই গর্ত উপচে গড়াচ্ছে মলধারা। বৃষ্টির পানি ঢুকে পড়েছে তাঁবুর ভেতরে।

হাড্ডিসার একেকটা শিশু। চোখ কোটরাগত। খালি গা। খালি পা। মেয়েদের পরনে শতচ্ছিন্ন পোশাক। পর্দার বালাই নেই। লোকগুলোর মুখে ক্ষুধা, হতাশা, অনাহারের চিহ্ন। খাবারের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ায় ওরা। হাতে একটা করে থালা। আধঘণ্টা, এক ঘণ্টা পরে খিচুড়ির মতো কিছু একটা পাতে পড়ে। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে বড় বড় ড্রেনের পড়ে থাকা পাইপের ভেতরে। যশোর রোডের দুই ধারে ঝুপড়িঘর তুলে, চালা তুলে, প্রাচীরের পাশে পলিথিনের চালা তুলে, ছই ফেলে থাকে মানুষ।

মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প কিংবা মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণদের জন্য যুব শিবিরের অবস্থাও কিছুমাত্র ভালো নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের মধ্যে হাঁটুপানি। সেখানেই থাকছে তারা। কোনো কিছু নিয়েই তাদের কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ একটাই : বেশি করে অস্ত্র দিন। বেশি করে গোলাবারুদ দিন। এই গোনা গুলি আর সীমিতসংখ্যক ছোট অস্ত্র দিয়ে তো দেশকে শত্রুমুক্ত করা সম্ভব না। অস্ত্র চাই। অস্ত্র চাই।

লীলা এই কাদার মধ্যে হাঁটলেন। একটামাত্র শিবিরে এক ঘণ্টা হাঁটতেই দুটো শিশুর লাশ তার চোখে পড়ল।

তিনি একটা তাঁবুর সামনে দাঁড়ালেন। পুরো এলাকার বাতাস বোটকা গন্ধে ভারী হয়ে আছে। ভেতরে মানুষগুলো কীভাবে থাকে, দেখার জন্য উঁকি দিলেন। একজন মা তার শিশুসন্তানের লাশ বুকে জড়িয়ে আছে। তাঁর কাঁদার শক্তিটুকুনই নেই। লাশ সৎকার করবেন, সেই সামর্থ্য নেই।

শরীরের বলও নেই।

তাঁর স্বামী তাকে বলছেন, জড়িয়ে ধরে থেইকে হবিটা কী। যা, ফেলে দিয়ে আয় ওই ওদিকটায় রাস্তার ওপারে। লোকেরা দেখলে ওরাই পোড়ানির ব্যবস্থা কইরবে…

লীলা নিজের সন্তান হারানোর দুঃখ ভুলতে শরণার্থীশিবিরের জন্য কাজ করতে লেগে পড়লেন। বিদেশ থেকে ফান্ড আনতে হবে। লিখতে হবে। জনমত গড়ে তুলতে হবে।

৪৫

জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা হলো প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজিজ খানের। জিয়ার গায়ে একটা সাফারি স্যুট, পাতলা কাপড়ের, গ্রীষ্মে পরার উপযোগী, চোখে কালো চশমা। তাঁকে খানিকটা উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। যদিও চোখ কালো চশমায় ঢাকা বলে তাঁর মনের খবর যে খুব পড়া যাচ্ছে, তা নয়!

ফারুক খান বললেন, বসুন। চা খান।

জিয়া বসলেন।

ফারুক বললেন, প্রধানমন্ত্রী তো এখন নেই। কোনো কথা ছিল?

না। কোনো কথা ছিল না। একটু দেখা করতাম। সৌজন্য সাক্ষাৎ। আমার মনে হচ্ছে, জেনারেল ওসমানী আমার ওপরে খুশি নয়। হয়তো সরকারের লোকজনও আমার ওপরে নাখোশ।

ফারুক বললেন, না না, তা হবে কেন। আপনার কথা তো প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন।

জিয়া বললেন, তারা মনে করে আমি যথেষ্ট যুদ্ধ করি নাই।

না না। সরকার আপনার ব্যাপারে মোটেও কোনো বিরূপ ধারণা রাখে না। তবে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি কেন কালুরঘাট থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর না হয়ে বান্দরবানের দিকে চলে গেলেন? আমরা আশা। করছিলাম আপনি চট্টগ্রাম অ্যাটাক করবেন। চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ছিল সিরিয়াস। আপনার উপস্থিতি খুব দরকার ছিল।

জিয়া বললেন, আমার কাছে খবর ছিল বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর আসছে। আমি সেটা মোকাবিলা করার জন্য সাগরের দিকে যাওয়া জরুরি মনে করেছিলাম।

জিয়া ক্যান্টনমেন্টে বন্দী তার স্ত্রী-পুত্রের জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন।

ফারুক জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ফ্যামিলির কোনো খবর জানেন?

জিয়া বললেন, না। তেমন কিছু জানি না। আমি পাকিস্তানি অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছি, ওদের সঙ্গে তোমরা যেমন ব্যবহার করবে, তোমাদের সঙ্গে আমরা তেমন ব্যবহার করব।

কীভাবে জানালেন?

চিঠি লিখেছি। চিঠিটা শাফায়াত জামিলকে দিয়েছি। আমাদের ছেলেরা অনেকেই ঢাকা যায়। তাদের একজন চিঠিটা ডাকে ফেলে। ঢাকার প্রধান মেজর জেনারেল জামশেদের ঠিকানায় চিঠিটা লিখেছি…

জিয়া উদাস হলেন। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন :

ডিয়ার জেনারেল জামশেদ,

মাই ওয়াইফ খালেদা ইজ আন্ডার ইয়োর কাস্টোডি। ইফ ইউ ডু নট ট্রিট হার উইথ রেসপেক্ট, আই উড কিল ইউ সামডে।

মেজর জিয়া।

৪৬

ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট, চব্বিশ পরগনা। সকাল থেকে আকাশটা খোসা ছাড়া লিচুর মতন হয়ে আছে। সাদা মেঘের নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে কালোর আভাস। এ ধরনের মেঘেই বৃষ্টি বেশি হয়। ২২ জুন ১৯৭১ তারিখটা। শেখ কামাল হিসাব কষে দেখলেন, বাংলাদেশে এখন বর্ষাকাল, হয়তো আষাঢ় মাসের ৮-৯ তারিখ এসে গেছে। ঢাকায় কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে? ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের মেডিকেল সেন্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একমুহূর্তের জন্য উদাস হয়ে গেলেন ২১+ বছরের কামাল। ছিপছিপে শরীরের ওপরে একটা হাফহাতা ঢোলা শার্ট চব্বিশ পরগনার বৃষ্টিভেজা বাতাসে উড়ছে। ভীষণ গরমে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখের চশমার কাঁচে জলীয় বাষ্প। ধানমন্ডিতে এখন কি বৃষ্টি হচ্ছে? ৩২ নম্বর বাড়ির গাছগুলো কি এখন বৃষ্টি আর দমকা বাতাসে মাথা ঝাঁকাচ্ছে? মাকে দেখেছেন তিনি, গোসলের পর মাথায় গামছা বেঁধে রাখেন, আর তারপর চুলটা মাথার এক পাশে ঝুলিয়ে মাথাটা কাত করে গামছা দিয়ে বাড়ি মারেন। গাছগুলো তেমন করছে? হাঁসগুলো কি দল বেঁধে প্যাক প্যাক করতে করতে ৩২ নম্বরের গেট পেরিয়ে ঝিলের দিকে যাচ্ছে, আর হাঁসের ঝাকের রাস্তা পার হওয়া দেখে থেমে গেছে। ধাবমান গাড়ি, বেবিট্যাক্সি, রিকশা? তারপর তার মনে হয় যে দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে, আব্বা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে (সম্ভবত), মা, আপা, রেহানা, জামাল এবং আদরের রাসেলরা কোথায় তিনি জানেন না। মাঝেমধ্যে ঢাকা থেকে লোকেরা আসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে, স্বাধীন বাংলা বেতারে কণ্ঠ দিতে, তাদের কাছ থেকে আবছা আবছা শোনা যায় যে তাঁদের ধানমন্ডিতে একটা বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। সেই বাড়ির চারদিকের দেয়ালের ওপারে কাটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে বিশেষ রকম অভেদ্য করে, বাড়ির সামনে বালুর বস্তা, এলএমজি পোস্ট, সঙিন উঁচিয়ে সদা সতর্ক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে ভয়ংকর-দর্শন পাকিস্তানি সৈন্যরা। রাসেল কী করছে এখন? সে কি এখনো ভাতের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খায়? তাঁদের বাড়ির গরুগুলোই বা এখন কোথায়? পোষা বাঁদরটা? গরু না থাকলে আর বাড়িতে সারাক্ষণ মিলিটারি প্রহরা থাকলে দুধই-বা তারা পাবেন কোথায়? আপার ডেট তো কাছে আসছে, এই দুর্দিনে আপা ভালো খাবার পাবেন কোথায় আর ডাক্তারই-বা দেখাবেন কীভাবে?

একটা মুহূর্তই শুধু উদাস হলেন কামাল।

হঠাই প্রশ্ন, এই কামাল, তুই এখানে কী করিস?

সংবিৎ ফিরে পেয়ে কামাল তাকালেন, দেখলেন, তার এক পুরোনো বন্ধু শচীন। শচীন কর্মকার।

কামাল বললেন, তুই ক্যান আইছস?

যুদ্ধের ট্রেনিং লইতে। এইখান থাইকা মুরতি অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্পে যামু। ফার্স্ট ওয়ার কোর্সে বাংলাদেশ আর্মির কমিশন নিমু।

আমিও আইছি। একই কাজে।

কামাল আর শচীন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। একটু আগে ডাক্তারের চেম্বারে সব কাপড়চোপড় খুলতে হয়েছে দুজনকেই। নাভির নিচে হাত দিয়ে ডাক্তার বলেছেন, কাশি দিন। জোরে কাশি দিন। হার্নিয়া আছে কি না চেক করলেন। হাইড্রোসেল আছে কি না, সেটাও চেক করেছেন। যুদ্ধে এসেছেন দেশের জন্য জীবন দিতে, ডাক্তারি পরীক্ষায় লজ্জা বিসর্জন দেওয়া খুবই সামান্য ব্যাপার।

তারা দুজনেই জানেন তারা এখানে কেন এসেছেন, এখান থেকে কোথায় যাবেন। মুজিবনগর সরকার মে মাসে এসে নিজেদের একটু গুছিয়ে নিতে পেরেছে, আর এ-ও বুঝতে পারছে যে, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে।

কামাল প্রধান সেনাপতি ওসমানী সাহেবের এডিসি (এইড-ডে-ক্যাম্প)। তিনি ভেতরের খবর জানেন।

ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে বললেন, আমাদের মুক্তিবাহিনীতে এখন আছে সেনাবাহিনী থেকে আসা অফিসাররা, জওয়ানরা, ইপিআর, অফিসার আর জওয়ান, পুলিশ, আনসার, আর আছে ছাত্ররা, সাধারণ মানুষ, কিছু আছেন শ্রমিক, কিছু আছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ, শিক্ষক, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার-উকিল। এরা আমাদের এফএফ–ফ্রিডম ফাইটারস। দেশের মধ্যে অনেকগুলো বাহিনী আছে, যাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। অনেক জায়গায় অস্ত্রশস্ত্রও পাঠানো হচ্ছে। আমরা এখন কনভেনশনাল ওয়ারফেয়ার আর গেরিলা ওয়ারফেয়ার দুটোই করছি। ইন্ডিয়ান এজেন্সি র আবার মুজিববাহিনী গড়ছে। যেটাকে আমাদের অধীনে আনতে হবে। মুজিববাহিনীর অস্ত্র, ট্রেনিং সবকিছু মুক্তিবাহিনীর চেয়ে বেটার। সে ক্ষেত্রে আমাদেরও কিছু লিডার তৈরি করতে হবে। বেটার ট্রেনিং বেটার ইকুইপমেন্ট দিয়ে। আমরা কমিশন দিব। অফিসার তৈরি করব। মিলিটারি অফিসার। বাংলাদেশ আর্মির।

তাজউদ্দীন আহমদ সম্মতি দিলেন। ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। প্রথম ব্যাচে নেওয়া হবে ৬০ জন। ট্রেনিং হবে মুরতি ট্রেনিং ক্যাম্পে।

কামাল বললেন, ৬০ জনের জায়গায় ৬১ জন করতে হবে। আমি যাব।

ওসমানী বললেন, তুমি যাবে?

হ্যাঁ। আমি আপনার এডিসি আছি। তা-ও না হয় থাকলাম। কিন্তু আমরা জানি না যুদ্ধ কবে শেষ হবে। আমাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আমারও অফিসার ট্রেনিং থাকা কি উচিত নয়?

ঠিক আছে। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে জিজ্ঞেস করে নিচ্ছি।

ওসমানী জানেন, কামাল কেবল তার এডিসি নন, তিনি প্রেসিডেন্টের ছেলে। যদিও কামালের মতো নরমশরম ভদ্র বাধ্য ছেলে তিনি এই জীবনে। দ্বিতীয়টা দেখেছেন কি না সন্দেহ!

তাজউদ্দীন আর ওসমানী একই ভবনে বসেন। ৮, থিয়েটার রোড, কলকাতা।

কামাল বললেন, স্যার আপনি বললে আমি তাজউদ্দীন কাকুর কাছে নিজেই যেতে পারি।

না। আমি যাই। একটা ডিসিপ্লিনের ব্যাপার আছে। হয়তো উনি তোমাকে মনের কথা বলতে চাইতে না-ও পারেন।

ওসমানী গেলেন তাজউদ্দীনের কাছে। একটু পরে ফিরে এসে বললেন, কংগ্রাচুলেশনস, মাই বয়। তুমি যাচ্ছ ওয়ারটাইম কোর্সের ফার্স্ট ব্যাচেই।

২২ জুন কামাল, শচীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের বিখ্যাত ফিরু ভাই, যিনি এনএসএফের গুন্ডাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সমীহ অর্জন করেছেন, খোন্দকার নুরুন্নবী, অলীক কুমার গুপ্ত, মঈনুল, মোহাম্মদ আলীসহ ১২ জন ব্যারাকপুরের ব্যারাকেই রাত কাটালেন। ২৩ জুন তাঁদের তোলা হলো আর্মির ট্রাকে। জঙ্গল-পাহাড় ডিঙিয়ে অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত আঁকাবাঁকা পথে চলল ট্রাক। সন্ধ্যায় তাঁরা গেলেন একটা সেনানিবাসে। একেবারে জঙ্গলের মধ্যে। সেখানেই রাতের খাওয়া আর ঘুমানো। রাতের বেলা সেই ব্যারাকের ওপরে কয়েকটা যুদ্ধবিমান চক্কর দিল। শচীনের ধারণা, এটা দিচ্ছে কামালের নিরাপত্তা চেক করে দেখার জন্য। কামাল বললেন, হ। কামাল তো ইন্দিরা ম্যাডাম, তারে পাহারা দেওয়ার জন্য যুদ্ধবিমান পাঠায়া দিছে! ২৪ জুন তাঁরা উঠলেন আর্মির বাসে। টাটা কোম্পানির বাস। বেশ শক্তপোক্ত। জানালার কাঁচে কাদার দাগ। কামাল জানালার ধারে বসলেন। তারা এসেছেন সমভূমি থেকে। ঢাকা বলো, টুঙ্গিপাড়া বলো, ল্যান্ডস্কেপ মানে সমভূমি, মনে হয় জমি কেউ ইস্তিরি করে সমান করেছে। জমির সঙ্গে একই তলে জলাভূমি। সেই সব খাল-বিলের পানির তলও সমান। এই পাহাড়ি পথ, আঁকাবাঁকা, মারাত্মক ভয়াবহ গভীর খাদ, পাহাড়ের গায়ে পাইনগাছ, আর ওই দ্যাখো নীল পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছে ঝরনা–এসব দেখে কার না মন ভরে ওঠে। তখন যুদ্ধের কথা, রক্তের কথা, স্বজন হারানোর কথা, শরণার্থীশিবিরে নারী শিশু-বৃদ্ধসহ সবার পর দুর্ভোগের কথা কিছুক্ষণের জন্য যেন ভুলে থাকা যায়।

যায় কি? একটু পরপর মনে পড়ে। কত ভয়াবহ কাহিনি আছে! একটা এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর দখলে। পাকিস্তানি আর্মি কয়েকবার আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীকে সরাতে পারছিল না। সে এপ্রিলের শুরুর দিকের কথা। তারপর তারা বিপুল শক্তি নিয়ে ফিরে এল, মর্টার, আকাশ থেকে জঙ্গি বিমান–একযোগে আক্রমণ চালাল। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের গোলাবারুদও ফুরিয়ে এসেছে। ভারত থেকে তখনো অস্ত্র, গোলাবারুদ যাওয়া শুরু হয়নি। কাজেই মুক্তিবাহিনী পিছু হটে চলে এল ভারতের ভেতরে। এবার পুরো এলাকা ঘিরে ফেলল মিলিটারিরা। বাড়িঘরে আগুন দিল। আর চলল নির্বিচার গুলি। পুরুষ মানুষেরা আগেই পালিয়েছিল। যারা ছিল, সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করল। নারীদের মধ্যে যারা বৃদ্ধ, তাদের ছুঁড়ে দিল জ্বলন্ত বাড়িঘরের মধ্যে। প্রায় ৫০ জন কিশোরী, তরুণী, যুবতী নারীকে তারা আলাদা করল। তাদের বলল, তোমাদের মারা হবে না। তোমাদের কোনো ভয় নেই। তারা তাদের নিয়ে গেল ক্যাম্পে। সেখানে তাদের উলঙ্গ করে রেখে দিল। সারা রাত ধরে চলল ধর্ষণ। কামড়ের দাগে মেয়েগুলোর প্রত্যেকের সারা গা ক্ষতবিক্ষত। একই নারীকে ধর্ষণ করল ৫ জন, ৬ জন, ১০ জন। অসহ্য হয়ে ওঠে! তারপর দিনের বেলা ৫০ জন উলঙ্গ নারীকে এক দড়িতে বেঁধে পাকিস্তানি মিলিটারি নিয়ে গেল নদীতে। গোসল করানোর জন্য। এই ধরনের করুণ কাহিনি শুনলে চোখের পানি আটকানো যায় না। কামাল এই কাহিনি শুনেছেন একজনের কাছ থেকে, তিনি আবার শুনেছেন ভারতীয় জেনারেল উবানের মুখ থেকে। বাসের জানালার ধারে বসে কামাল চোখ মোছেন, আর মনে মনে শপথ নেন, ট্রেনিং শেষ করে তিনি অবশ্যই যুদ্ধের ময়দানে যাবেন। বাংলার মেয়েদের এই অপমানের প্রতিশোধ নিতেই হবে।

বাস থেকে গিয়ে তারা উঠলেন ট্রেনে। ট্রেন থামল একটা ছোট্ট পাহাড়ি স্টেশনে। সবুজ পাহাড় পেছনে, ছবির মতো স্টেশনটাকে বলা হয় নিউ মল। সেই স্টেশনে নেমে দেখা গেল আরও আরও ক্যাডেট এসেছেন। একে অপরের পরিচিত। হইহই করতে লাগলেন যুবকেরা। আগরতলা মেলাঘর থেকে মেজর খালেদ মোশাররফ পাঠিয়েছেন ১২ জনকে। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের, ক্যাডেট কলেজের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ছাত্রলীগের–একেকজন একেকভাবে আরেকজনের সঙ্গে পূর্বপরিচিত। এ ওকে জড়িয়ে ধরছে, ও একে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কবি কায়সার হকও আছেন এই দলে।

আবার আর্মি বাস এল। তারা পৌঁছালেন মুরতি ওটিএস–অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে। শিলিগুড়িতে, ইকো সেক্টর ৩৩ কোরের অধীনে। বাঁশের তৈরি ঘর, টিনের ছাদ। পাহাড়ি উঁচু-নিচু জমিনে ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই ক্যাম্প।

এই ক্যাম্পের বেশির ভাগজুড়ে আছে এফএফ প্রশিক্ষণার্থীরা। তাদের ট্রেনিং দুই সপ্তাহের। তাদের উইংয়ের নাম মুজিব উইং। শেখ কামালরা গেলেন ভাসানী উইংয়ে। তাদের ট্রেনিং হবে ১৮ সপ্তাহের।

তাঁদের দেওয়া হলো বেডিং, পরার জন্য শার্ট, সেই শার্ট রঙিন ফুল আঁকা, তার বোতাম বুকের নিচে থেকে শুরু হয়েছে, আর তাতে ফতুয়ার মতো নিচের দিকে দুপাশে দুটো পকেটও আছে। একটা করে ঢোলা আর লম্বা হাফপ্যান্ট দেওয়া হলো। আর ট্রেনিংয়ের সময় পরার জন্য দেওয়া হলো খাকি ডুঙ্গারি।

বেডিং বিছাতে হবে সিমেন্টের মেঝেতে। হারিকেনের আলো নেভানোর অর্ডার যখন আসবে তখন। পরে অবশ্য তাদের জন্য আসে বাঁশের তৈরি খাঁটিয়া। বাঁশের খুঁটির ওপরে বাঁশের ফ্রেম, মধ্যখানে দড়ির জাল।

রাতের বেলা তাদের ৬১ জনকে জড়ো করা হলো। দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী ক্যাম্প থেকে সবাই এসেছেন। দুজন যমজ ভাই আছেন-মুহিব আর মিজান। আরও দুই ভাই আছেন, সেলিম আর আনিস (সেলিম পরে শহীদ হবেন, এই ব্যাচ থেকে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনজন শহীদ হন)।

চিফ ইনস্ট্রাক্টর কর্নেল দাশগুপ্ত কথা বললেন। তিনি জানালেন, এটা আর্মি অফিসারদের পূর্ণ ট্রেনিং। যেহেতু মাত্র ১৮ সপ্তাহে কোর্স শেষ করতে হবে, কাজেই যুদ্ধে লাগবে না, এমন সব সাবজেক্ট বাদ দেওয়া হবে। তোমাদের টেবিল ম্যানার্স শেখানো হবে না। প্যারেড ভালোভাবে করতে হবে না। পিটি করানো হবে, যাতে তোমরা যুদ্ধের ময়দানের কষ্ট, পরিশ্রম সহ্য করা শিখতে পারো। আর শেখানো হবে যুদ্ধ, অস্ত্রচালনা, যুদ্ধ পরিকল্পনা, নেতৃত্ব দেওয়া, কমান্ড দেওয়া।

তিনি জানালেন, ব্রিগেডিয়ার টি ডে যোশি, এখানকার ব্রিগেড কমান্ডার, পদাধিকারবলে এই ট্রেনিং সেন্টারের প্রধান। মেজর আশমান সিং থাপা হলেন সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর। ক্যাপ্টেন যাদব, ক্যাপ্টেন চন্দন, ক্যাপ্টেন আর পি সিং, ক্যাপ্টেন স্তাহান পাতি প্রমুখ হলেন ইনস্ট্রাক্টর।

দিন শুরু হয় ভোরের আগের ভোরে। তখন পুরো মুরতি ঢেকে থাকে অন্ধকারে। উত্তরবঙ্গের ভ্যাপসা গরমে আর আর্দ্রতায় সারা রাত সেদ্ধ হয়ে। তারা এই ভোররাতে বিছানা ছাড়েন, বিছানা গোটান। তারপর লাইনে দাঁড়ান, আধা মগ করে দুধ-চিনি দেওয়া চা নেওয়ার জন্য। এরপর যেতে হবে গর্তের ওপরে বানানো ল্যাট্রিনে, পানির জন্য ব্যবহার করতে হবে খালি বিয়ারের বোতল। সেখান থেকে এসে নাশতা। পুরি আর ভাজি। আবারও চা। তারপর ডুঙ্গারি পরে নিয়ে ৬১ জন চললেন ট্রেনিংয়ে। হাতে তুলে নিতে হলো রাইফেল। পিটি হলো, প্যারেড হলো। তারপর অস্ত্রচালনা ট্রেনিং। মাঝেমধ্যে লেকচার। রণকৌশল বিষয়ে ক্লাস। রাতের বেলা নাইট এক্সারসাইজ। জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে বাস্তবের শত্রুর সঙ্গেও লড়া, মশা আর জোক। জঙ্গল থেকে ফেরার পর দেখা গেল অনেকেই সঙ্গে করে এনেছেন রক্ত খেয়ে ফুলে ওঠা জোঁক। কয়েক দিনের ট্রেনিং চলার পরেই অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিখ্যাত ফিরু ভাই তাঁদের একজন। ক্রলিং করতে করতে তার হাঁটু ফুলে উঠল। কিন্তু ট্রেনিংয়ে মাফ নেই। ট্রেনাররা বললেন, তোমাদের এক বছরের ট্রেনিং চার মাসে করানো হবে। কাজেই দিন-রাত তোমাদের ক্লাস করতে হবে, মাঠে থাকতে হবে। অস্ত্র চালানো শেখার জন্য তাদের নিয়ে যাওয়া হলো বাগডোরা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে তাদের ফায়ারিং শেখানো হলো। টার্গেট প্র্যাকটিস। এই যুবকদের হাতের নিশানা দেখা গেল বেশ ভালো।

ভোর চারটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম। খাবার সবজি ডাল। মাসে হাতখরচ হিসেবে দেওয়া হয় ১০০ টাকা। সেই ১০০ টাকা দিয়ে ছেলেরা দোকান থেকে হরলিকস বিস্কুট, দই ইত্যাদি কিনে খায়। কিছুদিনের মধ্যেই সেই টাকা শেষ হয়ে যায়। শচীন আর ফিরু ভাই সেক্টর থেকে এসেছেন। তাঁদের আসার সময় হাতখরচ হিসেবে দুই হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। তা দিয়ে তারা মোটামুটি বড়লোক।

একদিন শচীন দেখলেন, বিকেলবেলা সবাই কিছু না কিছু খাচ্ছেন, শুধু শেখ কামাল ছাড়া।

শচীন বললেন, কামাল, কিছু খা। এমনিতেই তুই শুকনা-পটকা। না খেলে তো মারা যাবি।

কামাল ম্লান হেসে বললেন, টাকা পাব কই?

শচীন বললেন, জাতির পিতার দরিদ্র পুত্র! চল তোকে খাওয়াই। শচীন কামালকে হরলিকস বিস্কুট কিনে দিলেন। তারপর দুই শ টাকা গুঁজে দিলেন। কামালের পকেটে।

মুরতি ক্যাম্প জায়গাটা ভয়াবহ সুন্দর। পাহাড়, জঙ্গল। আর আছে। ঝরনা। মুরতি নুল্লাহ নাম ঝরনাটার। ডুয়ার্সের চা-বাগান পাশেই।

একদিন রাতের বেলা সবাই ডাবল মার্চ করে জঙ্গলের পথে ঢুকলেন। লেফট-রাইট-লেফট-রাইট। বুনো পথ। আস্তে আস্তে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। দুজনের হাতে টর্চ। টর্চের আলো মার্চের সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া করছে। বনের ভেতরে শিয়াল, বনবিড়াল, বেজির চোখে আলো পড়লে জ্বলে ওঠে সেসব চোখ। বড় বড় গাছ সব। রেইন ফরেস্ট। সবাই জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। হঠাত্র ক্যাপ্টেন দাশগুপ্ত বলে উঠলেন, স্টপ। সামনে হাতির পাল। এদিকেই আসছে ধুপধাপ শব্দ তুলে। আবার ডাকছে হাতির দল। বৃংহিত।

সবাই থেমে গেল। সবাই চুপ। কিন্তু তাঁদের শ্বাসের শব্দ মিলে যাচ্ছে পাতার মর্মর আর ঝিঁঝির ডাকের সঙ্গে।

গুড়ুম গুড়ুম।

ইনস্ট্রাক্টর দাশগুপ্ত ফায়ার করলেন হাতির মাথার ওপর দিয়ে। অনেকগুলো। কিন্তু হাতির পাল বিন্দুমাত্র পাত্তা দিল না সেই শব্দকে। ক্যাপ্টেন যাদব বললেন, জোকাররা, শোনো, তিনি সবাইকে ডাকেন জোকার বলে, এই হাতি এই রাইফেলের গুলিতে টলবে না। একমাত্র অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন এদের টলাতে পারবে। চলো, পালিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাই। কয়েকজন পালাতে গিয়ে আহত হন। তাঁদের একজন পরে মারা যান। আবদুর রউফ এমপি এলেন ক্যাম্পে। তিনিও ছেলেদের সঙ্গেই একটা রুমে থাকেন। আর মুজিব উইং ও ভাসানী উইংয়ের প্রশিক্ষণার্থীদের রাজনৈতিক উদ্দীপনা দেন। শোষণমুক্ত সোনার বাংলা কী, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন কী, পাকিস্তানি মিলিটারি কত ধরনের অত্যাচার-নিপীড়ন করছে, সেসব সম্পর্কে বলেন।

মুজিব উইংয়ের মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা দুই সপ্তাহ পর চলে যায়। নতুন ব্যাচ আসে। তারা চলে যায় সেক্টরে। সেক্টর থেকে যুদ্ধের ময়দানে। সীমানা অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে বাংলাদেশে। হাইড আউটে থাকে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপরে অতর্কিত আক্রমণ করে।

শেখ কামালরা রয়ে যান। তারা হলেন আর্মি অফিসার। বাংলাদেশ আর্মির প্রথম ব্যাচ। ফার্স্ট ওয়ারকোর্স ক্যাডেট। তাদের ১৮ সপ্তাহের ট্রেনিং কমিয়ে ১৫ সপ্তাহ করা হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্র তাদের চায়।

ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান জেনারেল অরোরা তাঁদের দেখতে আসেন। তারা সেদিন অবস্টাকল ট্রেনিং করছিলেন। ছেলেরা বহুগুণ উৎসাহ নিয়ে তাদের বাধাগুলো পার হয়ে গন্তব্যের দিকে ধেয়ে যায়। অরোরা ছেলেদের প্রশংসা করেন। বাঙালি অফিসার উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার, লে. ক. নজরুল হক, মেজর নাজমুল হক আসেন তাদের অগ্রগতি দেখতে।

ক্যাপ্টেন আর পি সিংকে বলে দেওয়া হয়েছে, শেখ কামালের দিকে নজর রেখো। কারণ, ওর বাবা পাকিস্তানিদের হাতে আটক। মা, ভাই, বোনও ঢাকায় আটক। ওর মনটা যেন ভালো থাকে।

আর পি সিং আসেন শেখ কামালের ডেরায়। সন্ধ্যার পর আজ আর ট্রেনিং নেই। বাঁশের ব্যারাকের ঘরগুলোতে কেরোসিনের হারিকেন জ্বলছে।

কামাল এসো। তারা ক্যাম্পের বাইরে পাথরের বেঞ্চিতে বসেন। আকাশে চাঁদ। চাঁদের আলো প্রতিফলিত হচ্ছে ঝরনায়। বর্ষাকাল। ঝরনা যেন যৌবনবতী। কলকল করে কথা কইছে।

তোমার বাবার কোনো নতুন খবর পেলে? আর পি সিং জিজ্ঞেস করেন।

না ওস্তাদ। তবে বাবাকে নিয়ে আমি কমই দুশ্চিন্তা করি। বাবার তো জেলে যাওয়ার অভ্যাস আছে। আমরা তো আব্বাকে কমই জেলখানার বাইরে দেখেছি। সব সময় দেখেছি তিনি জেলেই থাকেন। আমার দুশ্চিন্তা মাকে নিয়ে।

হ্যাঁ। আমরা তোমার মায়ের অনেক সুনাম শুনি।

মা-ই আমাদের ফ্যামিলির খুঁটি। আমাদের পাঁচ ভাইবোনকে দেখেশুনে রেখেছেন মা। শুধু আমাদের ভাইবোনদের নয়, আমাদের মামাতো ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন, ফুফাতো ভাইবোন–সবাইকে মা-ই দেখেন। এখন মা ও বন্দী।

তুমি কি বেশি দুশ্চিন্তা করো?

না। মা-ও শক্ত আছেন। উনি আগরতলা মামলার সময় আব্বাকে বলেছিলেন, প্যারোলে মুক্তি নিবা না। এবারও বারবার করে বলেছেন, খবরদার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা চিন্তাও কোরো না। আমার ছোট ভাইটা অনেক ছোট। মাত্র ৬ বছর বয়স। ওকে মিস করি। আমার বড় আপার বাচ্চা হওয়ার কথা। জানি না তারা কে কোথায় কেমন আছেন।

রাত বাড়ে। আর পি সিং বলেন, যাও, ঘুমাতে যাও।

সারা দিনের ধকলের পর ছেলেরা পড়ে পড়ে ঘুমান। কেউ কেউ রেডিও শোনেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর। বিবিসির খবর। আকাশবাণীর খবর। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র তাদের বড় প্রিয়।

কামাল বিছানায় যান। উল্টো দিকে শুয়ে আছে শচীন। ওর সঙ্গে প্রায়ই কাপড়চোপড় ওলটপালট হয়। ধোপার কাছ থেকে কাপড়গুলো যখন ফেরে, কোনটা যে কার বোঝা মুশকিল। তাই কাপড়ের গায়ে লিখে রাখতে হয় শে কা। শচীনের নাক ডাকার শব্দ আসছে।

কামালের খুব রাসেলের কথা মনে পড়ছে। রাসেল কেমন আছ, আদরের ভাইটি!

৪৭

আনিসুজ্জামান দাঁড়িয়ে আছেন থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের কার্যালয়ের সামনে। দোতলা কোঠাবাড়ি। চারদিকে উঁচু, মোটা প্রাচীর। ভেতরে অনেক খোলা জায়গা। গেটের ভেতরে ঢুকলে সুপরিসর প্রাঙ্গণ খোলা জায়গা মনটাকে একটা উন্মুক্ততার আশ্বাস দেয়। প্রাঙ্গণে বড় বড় গাছ আছে, গোড়া বাঁধানো গাছগুলোর বৃষ্টিস্নাত পাতা এবং সেসবের ছায়া শরীর ও মনকে আরামের স্পর্শ বোলায়। ছোট ছোট ফুলের ঝাড়ে নাম না-জানা হলুদ ফুল বর্ষার ভেজা বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। আনিসুজ্জামানের মনে হলো, বাড়িটা বেশ বড়, আঙিনাও সুপরিসর, তা সত্ত্বেও এটা একটা সরকারের কার্যালয় হওয়ার মতো বড় নয়। এটা আগে ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি। বাড়ির মালিকানা বদলে গেছে, আনিসুজ্জামান খেয়াল করে দেখলেন, সবাই এটাকে থিয়েটার রোড বললেও সাইনবোর্ডে রোডের নাম লেখা– শেক্সপিয়ার সরণি। গেটে বিএসএফের পাহারা। বিএসএফের লোকজনের সঙ্গে দর্শনার্থী ওপার বাংলার মানুষদের বচসা হচ্ছে। স্বদেশের মাটি ছেড়ে যারা কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন, তাঁরা থিয়েটার রোডে এসে বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে দেখা করবেন, তাদের আবার গেটে আটকানো কেন? আনিসুজ্জামান মনে মনে হাসছেন, দর্শনার্থীদের একজন এখনই নিশ্চয় বলে বসবেন, আপনি জানেন আমি কে? কিন্তু হাসলেন না, কারণ, তাঁর নিজেকেও এই গেট পেরোতে হবে। তিনি নিজেই-বা কী পরিচয় দেবেন, কী বলবেন, এই আনিসুজ্জামান কে?

যাক। তিনি ভেতরে গেলেন, গেটের সামনে উপস্থিত দুজন সরকারের কর্মচারী তাকে চিনলেন, স্যার আপনি আসুন বলে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

আনিসুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিরোধ পর্যায়ের দিনগুলো পার করে অন্য সব শরণার্থীর মতো বহু ক্রোশ পাড়ি দিয়ে, বহু পথ কষ্ট স্বীকার করে আগরতলা এসে পৌঁছান সপরিবার। তিনি তাঁর গাড়িখানাও আগরতলায় নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। সেখানে কিছুদিন থেকে মে মাসের মাঝামাঝি তিনি এবং তাঁর পরিবার কার্গো বিমানের টিকিট কেটে উড়ে চলে এসেছেন কলকাতা। গাড়ি আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধা পরিবহন হিসেবে কাজে লাগছে। কলকাতায় এসে দিলখুশা স্ট্রিটে ফুফুর বাসায় ওঠেন। তা ছিল এরই মধ্যে অতিথি এবং বাড়ির লোকজন দিয়ে পরিপূর্ণ। রাতে ফুফা নিজে ঘুমানোর জন্য অন্য বাড়ি যান, তাতে তার মনের মধ্যে খচখচ করে, নিজের শৈশব কেটেছে যে পাড়ায়, সেই পাড়াতেই ফুফুর বাড়িতে আজ এত দিন পর এসে নিজেকে উদ্বৃত্ত বলে গণ্য করতে হবে কি? তা সত্ত্বেও রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল। কারণ, রাতে গুলির শব্দ ছাড়া ঘুমাতে পারছেন, এ রকম রাত ২৫ মার্চের পর আসেনি। এবং তার সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে রুচি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, এখানে যুদ্ধ লাগলে কি আবার আমাদের অন্যখানে চলে যেতে হবে? এখানে। যুদ্ধ লাগবে না বলে বাবা আশ্বস্ত করেছিলেন মেয়েকে। ফুফুর বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকার সময় তিনি সব সময় মনে করেছেন শরণার্থীদের দুঃখ দুর্দশার কথা। প্রায় ত্রিশ লাখ মানুষ এরই মধ্যে পূর্ব বাংলা ছেড়ে ভারতে ঢুকে পড়েছে। রোদে-বৃষ্টিতে মাইলের পর মাইল হেঁটে, পেছনে দগ্ধভিটা, নিহত পরিবার-পরিজনের লাশ রেখে যারা আসছেন, তাঁরা কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, কোথায় বাথরুম করবেন, কোনো কিছুরই তো ঠিক নেই। আনিসুজ্জামান ভারত সরকারের খাদ্য বিভাগের কর্তা অশোক ভট্টাচার্যের। কাছে একটা ঘটনা শুনেছেন, তা মনে করামাত্রই নিজের থাকা-খাওয়ার কষ্ট এক নিমেষেই উবে যায়–

শরণার্থীশিবিরে লোক বেশি। তার ধারণক্ষমতাও কম। বরাদ্দ করা খাদ্যের পরিমাণও কম। সরকার থেকে যা বরাদ্দ করা হয়, তা এমনিতেই অপ্রতুল, তার মধ্যে মধ্যখানে সরকারি লোকেরাও খেয়ে ফেলে অনেকটাই। একটা শরণার্থীশিবিরে শিশুদের জন্য দুধ দেওয়া হচ্ছে। মগে করে দুধ তুলে। ঢেলে দেওয়া হয় প্রার্থী-মায়েদের আনা পাত্রে। শিশুদের মায়েরা শিশুদের কোলে নিয়ে, কিংবা পাশে দাঁড় করিয়ে লাইনে দাঁড়ান। দুধ কম, লাইনে মায়েদের সংখ্যা বেশি। সবাই দুধ পাবেন না, এ স্বাভাবিক। একটা দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে মা লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে চলে এসেছেন, এবার তার দুধ নেওয়ার পালা। পেছন থেকে এক মহিলা বললেন, ওর বাচ্চাকে তো ও বুকের দুধই খাওয়াতে পারে। ওকে দুধ দেবেন না।

শুনে সামনের মা তার বুকের আঁচল সরিয়ে দেখালেন, দেখুন, আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গেছে। আমার বাচ্চার বাইরের দুধই লাগে।

.

আনিসুজ্জামান ভবনের ভেতরে ঢুকলেন। অনেক ভিড়। এপার বাংলায় যারা এসেছেন, তাঁরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা, সুতরাং প্রত্যেকের অধিকার ও কর্তব্য হলো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নিজের সুখ-দুঃখের কথা বলা এবং এখনই করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে মূল্যবান পরামর্শ ও সুচিন্তিত অভিসন্দর্ভ পেশ করা।

নিচতলাতেই একটা অপরিসর ঘরে বঙ্গবন্ধুর ছবি টাঙিয়ে বসেন তাজউদ্দীন। নিচতলাতেই আরেকটা ঘরে তিনি রাত কাটান।

পাশের রুমে বসেছেন ফারুক আজিজ খান। কাপ্তাইয়ে ছিলেন, সুইডিশ পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির পরিচালক। মার্চ-এপ্রিলে কাপ্তাই এলাকায় প্রতিরোধ সংগ্রামে যুক্ত থেকে তিনিও চলে এসেছেন বন-জঙ্গল পেরিয়ে প্রথমে আগরতলা, পরে কলকাতা। প্রধানমন্ত্রী তাঁকে পিএস হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। নিচতলাতেই প্রধান সেনাপতি ওসমানী বসেন এবং পাশেই একটা ঘরে রাত্রিবাস করেন।

এই ভবনে সব মন্ত্রী বসেন, ব্যতিক্রম খন্দকার মোশতাক। তিনি বসেন। বাংলাদেশ হাইকমিশনে। ৯ পার্ক সার্কাস অ্যাভিনিউতে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে তিনি আগরতলা থেকে আনিয়ে নিয়েছিলেন মাহবুবুল আলম চাষীকে, করেছিলেন পররাষ্ট্রসচিব। বহুদিন পরে আনিসুজ্জামানের মনে হবে, এই যে সরকারের অন্যদের থেকে মোশতাক নিজেকে দূরে রাখলেন, এই দূরত্ব ১৯৭৫ সালের আগস্টে কিংবা নভেম্বরে প্রকাশ পাবে তা নয়, এটা মুক্তিযুদ্ধকালেও স্পষ্ট হয়েছিল। সেটাও ১৯৭১-এর আগস্টেই।

তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করলেন আনিসুজ্জামান। তাজউদ্দীন তাঁকে বলেছিলেন সরকারে যোগ দিতে, আনিসুজ্জামান বাংলাদেশের শিক্ষকদের নিয়ে সমিতি করছেন, বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব দ্য ইন্টেলিজেন্সিয়া করছেন। কাজেই অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।

আজকে প্রধানমন্ত্রী তাকে ডেকেছেন একটা বক্তৃতার মুসাবিদা করার জন্য। তিনি নিয়ে গেলেন তার শয়নকক্ষে। একটু পরে এলেন অধ্যাপক খান। সারওয়ার মুরশিদ। তিনি বক্তৃতার ইংরেজি ড্রাফট করবেন।

খান সারওয়ার মুরশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক। বয়সে তাজউদ্দীনের চেয়ে এক বছরের বড়ই হবেন। কথা বলেন অননুকরণীয় ভঙ্গিতে, ক বছর আগেও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ তাজউদ্দীন আহমদের পারিবারিক বন্ধু। ধবধবে ফরসা, উন্নতনাসিকা খান সারওয়ার মুরশিদ তাজউদ্দীন আহমদের ইংরেজি বক্তৃতা লিখে দেন।

আনিসুজ্জামান এর আগেই তাজউদ্দীনকে বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং শুধু আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সব দলের জন্য উন্মুক্ত রাখতে। তাজউদ্দীন বলেছিলেন, কথাটা আপনি আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের বলুন। তিনি সেই কথা পেড়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াসকে। ইলিয়াস এই প্রশ্ন শুনতে অভ্যস্ত, শুনে বিরক্ত, আর তার উত্তরও ছিল প্রস্তুত। তোমাকে লাল মিয়ারা পাঠাইছে নাকি?

না না। আমাকে কেউ পাঠায়নি। আমি নিজে এসেছি।

ওদেরকে কেন নেবে? ৬ দফার পর ওরা বলে নাই ৬ দফা সিআইএ বানায়া দিছে! অরা কি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় নাই। এখনো কি বলছে না স্বাধীনতাযুদ্ধ করতে হবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আর ভারতের বিরুদ্ধে?

এখন তাজউদ্দীন তৈরি হচ্ছেন সামনে পরিষদ সদস্যদের সম্মেলন করা নিয়ে। তিনি বেশ চিন্তিত। তাঁর কাছে খবর আছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব উঠবে এবং ভোটাভুটি হবে।

আনিসুজ্জামান বললেন, বিরোধিতা কোন দিক থেকে আসছে? যুবনেতাদের দিক থেকে?

তাজউদ্দীন বললেন, ওদের দিকটা থেকে যা আসছে, তা প্রকাশ্য। আমাদের জানা-বোঝার ভেতরে। ওরা বিএলএফ করেছে। এটা আমাদের সরকারের অনুমতি নিয়ে নয়। র এটাকে দেখভাল করছে। দিল্লিকে বললে তারা বলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। আমাদের কন্ট্রোলে আছে। কিন্তু এর বাইরেও বিরোধিতা আছে। মোশতাক সাহেব আমাকে মানতে পারেনই না। আসলে মুজিব ভাই তো আমাদের হাইকমান্ডকে নিয়ে বসতেন। অসহযোগের সময় বিকল্প সরকার আমরা পাঁচজনই চালিয়েছি। কিন্তু মুজিব ভাই অনেকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখতেন, সবাই নিজেকে তার পরে তাঁর উত্তরসূরি বলে নিজেকে ভাবে। আবার সেনাবাহিনীর মধ্যেও নিজেদের বড় ভাবার এবং রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে না মানার প্রবণতা আছে।

আনিসুজ্জামান এবং খান সারওয়ার মুরশিদ দুজনেই শরীর এলিয়ে দিলেন।

তাজউদ্দীন বললেন, এত অল্পতে হতাশ হলে চলবে না। বাংলাদেশ বিজয়ী হবেই। আমি সবচেয়ে বড় সাপোর্ট পাচ্ছি সৈয়দ নজরুল সাহেবের কাছ থেকে। উনি না থাকলে ঝড়ের ঝাঁপটায় এতক্ষণে উড়েই যেতাম। তবে আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। নানা মতের, পথের লোক এখানে একটা অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে সমবেত হয়েছে, বাংলার মানুষের মুক্তি। কিন্তু সেটা কী উপায়ে হবে, সে বিষয়ে প্রত্যেকের মত আলাদা। আর প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব বুর্জোয়া দলে হবেই। আওয়ামী লীগ তো বিপ্লবী দল নয়। গণতান্ত্রিক দল।

একটু পরে একজন এলেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা করতে। আনিসুজ্জামান আর খান সারওয়ার মুরশিদ বসে রইলেন তাজউদ্দীনের শয়নকক্ষে।

পাশের ঘরে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হলো। এই ঘরে সব শোনা যাচ্ছে।

আনিসুজ্জামান বললেন, কণ্ঠস্বর তো মনে হচ্ছে শেখ মণির।

খান সারওয়ার মুরশিদ বললেন, আমারও সে রকমই প্রত্যয় হচ্ছে।

.

তাজউদ্দীন বলছেন, মণি, বিএলএফকে ওসমানী সাহেবের কমান্ডের অধীনে আনতে হবে।

ওসমানী সাহেবের অধীনে কেন? বিএলএফের কমান্ডার আমি। এটা আমার অধীনেই থাকবে।

তাহলে তোমাকে ওসমানী সাহেবের কমান্ডের আন্ডারে আসতে হবে।

ওসমানী কে?

আমাদের প্রধান সেনাপতি!

শোনেন। আমি আপনাকে বলেছি কি না আপনাদের এই সরকারকে আমরা মানি না। বঙ্গবন্ধু আমাদের পাঁচজনকে একসঙ্গে ডেকে নিয়ে বলে দিলেন রাজেন্দ্র প্রসাদ রোডে যাওয়ার কথা। আর আপনি আমাদের কাউকে কিছু না বলে চলে গেলেন দিল্লি। ইন্দিরাজির সঙ্গে দেখা করে নিজেই নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ডিক্লেয়ার করলেন। আপনি একজন অবৈধ প্রাইম মিনিস্টার। আপনার সরকার অবৈধ সরকার। আপনার সেনাপতি একজন অথর্ব। আপনাদের মানার প্রশ্নই আসে না।

এই বিভেদের মধ্য দিয়ে তোমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাও? কিন্তু এর ফলে তোমাদেরও লাভ হচ্ছে না। আমাদেরও লাভ হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ গতি পাবে, যদি সরকার বাতিল করে রেভলুশনারি কাউন্সিল করেন।

মণি, আমার সরকার বৈধ না অবৈধ, আমরা এমএলএ, এমএনএদের ডেকে ভোটে দেব। তারা যদি অনাস্থা জানায়, আমি তোমাদের কথা মেনে নেব। যাকে লিডার বানাবে, তাকে প্রধানমন্ত্রী করব। তার আগপর্যন্ত এই সরকারকেই তোমাদের মানতে হবে। আর একবার পরিষদ সদস্যদের ভোট হয়ে গেলে তোমাদের আমাদের অধীনে আসতে হবে।

দেখেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করে গেছেন। আপনি নিজে একজন লেফটিস্ট। সব লেফটিস্টকে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং দিচ্ছেন। সব চীনাপন্থী নকশালপন্থীরা ট্রেনিং পাচ্ছে, অস্ত্র পাচ্ছে। এর পরিণতি ইন্দিরাজির জন্যও ভালো হবে না। আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো হবে না। আপনাকে সরানো হচ্ছে আমাদের এক নম্বর কাজ।

তুমি অযথা শক্তিক্ষয় করছ। এই শক্তিটা পাকিস্তানি অকুপেশনাল ফোর্সের বিরুদ্ধে কাজে লাগাও। হাজার হাজার ছাত্রলীগ কর্মীকে তুমি নিয়ে যাচ্ছ। তারা দেশে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরছে। আল্লাহর দোহাই লাগে, তোমরা থামো।

আপনি থামেন।

ওকে। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা আর জাতীয় পরিষদ প্রাদেশিক পরিষদের সভাতেই ফয়সালা হয়ে যাবে। তুমি থেকো। দ্যাখো কী দাঁড়ায়।

আচ্ছা দেখা যাবে।

বলে মণি হনহন করে চলে গেলেন।

.

খান সারওয়ার মুরশিদ আর আনিসুজ্জামান মন খারাপ করে বসে রইলেন।

৪৮

কাজী জহিরুল কাইয়ুম কুমিল্লা চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত এমএনএ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বিশাল শিল্পপতি তিনি। ফলে বঙ্গবন্ধুও পার্টির জন্য চাঁদার দরকার হলে তাঁকে খবর দিতেন। পার্টিকে চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারে, এমনকি জনহিতকর কাজে টাকাপয়সা দেওয়ার ব্যাপারে জহিরুল কাইয়ুমের হাত সত্যিই উদার। তিনি বলে থাকেন, সত্তরের নির্বাচনের আগে শেখ সাহেব বললেন, নির্বাচন করতে ১০ লাখ টাকা দরকার হবে। জহিরুল কাইয়ুম তাঁকে বলেন, আমি আপনাকে ৫ লাখ টাকা জোগাড় করে দেব। তিনি এ-ও বলে থাকেন, নির্বাচনের আগেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেন, নির্বাচনে আপনি জিতবেন, কিন্তু ক্ষমতা পাবেন না। ক্যান্টনমেন্টে ইস্পাহানি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। স্কুল কমিটির প্রেসিডেন্ট জেনারেল মিঠঠা খান। ভাইস প্রেসিডেন্ট কাইয়ুম। ফলে প্রায়ই ক্যান্টনমেন্ট যেতে হয়। পাকিস্তানি জেনারেলদের প্রকাশ্য কথা, ইলেকশনে আওয়ামী লীগ জিতলে তাদের ক্ষমতা দেওয়া হবে না। শেখ সাহেব নাকি তাঁকে বলেছিলেন, তাহলে কী করতে হবে? কাইয়ুম বলেন, শুনেছি আপনার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ ছিল। জানি না কথা সত্য কি না। যোগাযোগটা আবার পুনরুজ্জীবিত করুন। এরপর কাইয়ুম কুমিল্লা আসেন। কুমিল্লা পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান স্বদেশি নেতা বাবু অতীন্দ্র মোহন রায়কে আগরতলা পাঠিয়ে দেন। এক মাস, দেড় মাস অতীন্দ্রবাবু আগরতলা কাটিয়ে এসে রিপোর্ট করেন, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীনবাবু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। ভারতের কথা হলো, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করলে এবং পাকিস্তানি জান্তা ক্ষমতা না দিলে ভারত আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয় দেবে। তখন তিনি বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, শেখ সাহেব, আপনি ভারতে যাবেন কি না। উত্তরে মুজিব বলেন, আমি এত লম্বা মানুষ, কীভাবে ভারতে যাব, আপনারা তাজউদ্দীনের জন্য আশ্রয় ঠিক করে দিন।

এই জহিরুল কাইয়ুমের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের ভালো দোস্তি। এর একটা কারণ, খন্দকার মোশতাক সমাজতন্ত্র পছন্দ করেন না। কাইয়ুমেরও সমাজতন্ত্র পছন্দ না। আরেকটা কারণ উভয়েই কুমিল্লার।

২৫ মার্চের পর স্থানীয় প্রতিরোধ গড়তে তিনি এলাকায় যান। আগরতলার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ভারত থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র আনান। আর তার নিজের দাবি হলো, ৩ এপ্রিল তিনি পরশুরাম বিলোনিয়া সীমান্তে যান। সেখানে তিনি তিন দিনের না কাটা দাড়ি-গোঁফসমেত মেজর জিয়াউর রহমানের দেখা পান। জিয়াউর রহমানকে একটা রেস্টহাউসে সঙ্গীসহ নিয়ে গিয়ে তিনি বলেন, আপনি কি ভারতে যাবেন?

জিয়া জিজ্ঞেস করেন, আপনি যাবেন?

কাইয়ুম তখন ভারতের ক্যাপ্টেন সেনের কাছে গিয়ে বলেন, মেজর জিয়া আর তার দলবলকে ভারতে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিন। সেই অনুযায়ী জিয়া ভারতে আশ্রয় নেন। ৯ এপ্রিল কাইয়ুম নিজে আগরতলা যান।

তারপর খবর পান, যে অতীন্দ্রমোহন রায়কে তিনি ১৯৭০ সালে আগরতলা পাঠিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে অসীম রায়কে পাকিস্তানিরা কুমিল্লার বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। অসীম রায় ছিলেন জগন্নাথ কলেজের কেমিস্ট্রির ডেমোনস্ট্রেটর।

আগরতলাতেই তারা ক্যাম্প করেন। গেরিলাদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেন। শরণার্থীদের খোঁজখবর করতে থাকেন। তিনি ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে যাননি। কলকাতায়ও কম যেতেন।

এবার জুলাই মাসের শুরুতে তাজউদ্দীন শিলিগুড়ির বাগডোরায় এমএনএ, এমপিএদের সম্মেলন ডেকেছেন। কাইয়ুম উত্তেজিত। কারণ, তিনি এটাতে যাবেন এবং তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনবেন। প্রধানমন্ত্রী বদলে দেবেন।

তিনি গিয়ে হাজির হলেন কলকাতায়।

খবর তাজউদ্দীনের কানে চলে গেল। এমএনএ, এমপিএরা এসে বললেন, বিএসএফের গোয়েন্দারাও জানালেন তাঁকে। জহিরুল কাইয়ুম তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে চান।

তাজউদ্দীন ডেকে আনালেন কাইয়ুমকে। কী ব্যাপার কাইয়ুম ভাই, আপনি নাকি আমার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনবেন? কারণ কী?

কাইয়ুম বললেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এপ্রিলে। এটা জুলাই মাস। এর মধ্যে কোনো দিনও আপনি আগরতলা গিয়েছেন? আপনি কি জানেন কীভাবে আমরা মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং সেন্টার চালাচ্ছি। হাজার হাজার ছেলে প্রতিদিন আসছে ট্রেনিং নেবে বলে। তাদের কীভাবে বাছাই করা হয়, কোথায় রাখা হয়, কীভাবে তারা দেশে যুদ্ধ করতে যায়, আপনি জানেন? শরণার্থীশিবির আমরা আগরতলায় কীভাবে চালাচ্ছি, আপনি কি জানেন? আপনি নিজ চোখে দেখতে যাবেন না?

তাজউদ্দীন বললেন, কাইয়ুম ভাই। আপনি একবার এসে আমার ঘরে বসে দেখেন আমি কী করি। রাতে ঘুমানোরও সময় পাই না। নিজের ফ্যামিলির কাছে যাই না। সারা দেশের বর্ডার লাইনে ১০০টা ক্যাম্প আছে। ৬০ লাখ শরণার্থী এসে গেছে। আমার একটা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আছে। অনেক অফিশিয়াল কাজ থাকে। বাজেট দেখতে হয়, অনুমোদন করতে হয়। আপনি তো আমাদের দেশের মানুষের টাকাপয়সার অ্যাকাউন্টিং সেন্স কেমন জানেন। পুরোটার সমন্বয় করতে হচ্ছে। ঘর সামলাতে হচ্ছে। আবার দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। কিন্তু আমি আপনার কথা মানছি, আমার আগরতলা যাওয়া উচিত ছিল। আপনি হয়তো জানেন না, আমাকে খুন করার জন্য আমার অফিসে পিস্তলসহ একজন যুবক এসেছিল।

আমার ঘরে শত্রু, বাইরে শত্রু। তারপরেও আপনি বলছেন আমি যাব।

কাইয়ুম কণ্ঠ নিচে নামিয়ে বললেন, আমার কাছে দেড় কোটি টাকা আছে। সে টাকাটা নিতেও তো বাংলাদেশ সরকারের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারত। আপনি স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। আপনাকে আমরা প্রধানমন্ত্রী বানাই নাই। আপনাকে কষ্ট তো করতেই হবে। প্রাণের ভয়ে আপনি কলকাতা থেকে নড়বেন না, এটা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়।

তাজউদ্দীন বললেন, কাইয়ুম ভাই, আপনি বলছেন, আমি অবশ্যই আগরতলা যাব।

.

তাজউদ্দীন তাঁর থিয়েটার রোডের অফিসে। বেলা একটার দিকে আগরতলা থেকে এসে হাজির হলেন পরিষদ সদস্য ময়েজউদ্দীন। তাজউদ্দীন তাঁকে দেখে প্রমাদ গুনলেন। তাজউদ্দীন তাকে তার বিরোধী পক্ষ বলে মনে করেন।

ময়েজউদ্দীন বললেন, আগরতলায় পরিষদ সদস্যরা যারা ছিলেন, বসেছেন। ৫০-৬০ জনের মতো। মাইক ছিল। মাইকে আপনাকে গালিগালাজ করেছে। এমন হলো যে, বাইরের কৌতূহলী জনতা সেই সব গালিগালাজ শুনে ফেলেছে। লজ্জায় আমাদের মাথা কাটা গেছে। আপনি এখনই প্রস্তুত হোন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনাকে সমর্থন। করব। আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি। এই সময় সারা পৃথিবীর সামনে আমাদের মুখ ছোট করা যাবে না। বাইরের লোকেরা শুনলে কী মনে করবে? দেশের মানুষ শুনলে কী মনে করবে? মিলিয়ন মানুষ শহীদ হয়েছে, আর আমরা প্রধানমন্ত্রী পদ নিয়ে মারামারি করছি।

কী করা উচিত বলে মনে করেন?

আপনি ঢাকার পরিষদ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওরা ব্যাপক টাকা ছিটাচ্ছে।

তাজউদ্দীন আহমদের মুখ রক্তিমাভ হয়ে গেল। এই কাজটা তিনি। পারবেন না।

এর আগে শেখ মণিরা বেশ কয়েকজন পরিষদ সদস্যের স্বাক্ষরসহ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধু ভারতে গিয়ে ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন চারজন মাত্র যুবনেতাকে–শেখ মণি, তোফায়েল, রাজ্জাক আর সিরাজুল আলম খানকে। র এটা আগে থেকেই জানে। ইন্দিরা গান্ধী একটুখানি দমে যান। তিনি এই চার নেতার নেতৃত্বে বিএলএফ তথা মুজিববাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। তাঁদের চিন্তা, সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা যাবে না, আর যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে চীনপন্থী বিপ্লবী, নকশালদের হাতে অস্ত্র চলে গিয়ে উভয় বাংলার ভাগ্যকে ছিন্নভিন্ন করার যে আশঙ্কা আছে, তাকে শুরু থেকেই বাগে আনতে শুধু এই চারজন বঙ্গবন্ধু অনুগত-প্রাণকে দিয়েই একটা সংগঠিত যুবশক্তি গড়ে তুলতে হবে।

তাজউদ্দীনকে কেউ কেউ পরামর্শ দেয়, পরিষদ সদস্যদের টাকা দিন, সেটা তিনি একেবারেই অপছন্দ করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন চলার সূত্রে তিনি জানেন, পরিষদ সদস্যরা টাকা খেয়ে পক্ষ পরিবর্তন করে, এই জিনিসটাকে মুজিব ভাই চরম ঘৃণা করেন। তাজউদ্দীন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ময়েজউদ্দীন ভাই, মুজিব ভাই আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, আমি বাঙালিকে হাড়ে হাড়ে চিনি, তবে চিনেছি একটু দেরিতে, আগে যদি জানতাম, তাহলে আমি রাজনীতিই করতাম না। টাকা আমি দিতে পারব না।

.

ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে :

ডি পি ধর যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত পদ থেকে চলে আসেন–ইন্দিরা গান্ধীর ১ নম্বর উপদেষ্টা এবং মুখ্য সচিব হিসেবে যোগ দেবেন মাসখানেক পর, তখন আবারও ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তাজউদ্দীনের অপসারণ চেয়ে পরিষদ সদস্যদের চিঠি যায়। এই সময় ডি পি ধর তাজউদ্দীন আহমদের পরামর্শক ও বিশেষ দূত মঈদুল হাসানকে বলেছিলেন, এটা কেন হচ্ছে, কেন পরিষদ সদস্যরা তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে চিঠি লেখেন?

মঈদুল হাসান বলে, তার প্রতিপক্ষ অনেক টাকাপয়সা খরচ করে।

ডি পি ধর বলেন, ভারত বাংলাদেশের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছে, তাহলে আমরা তাজউদ্দীনের হাতেও টাকা দিতে পারি, তিনিও খরচ করুন।

মঈদুল ডি পি ধরকে বলেন, তাজউদ্দীন আর যা-ই করুন, এমএনএ, এমপিএ কেনাবেচা করতে পারবেন না। তিনি নীতিমান লোক।

ময়েজউদ্দীন চললেন শেয়ালদা স্টেশনের কাছে টাওয়ার হোটেল এবং লজে। সেখানে ঢাকার পরিষদ সদস্যরা আছেন। ময়েজউদ্দীন তাঁদের বললেন, এখনই তৎপর হতে হবে। কুমিল্লার পরিষদ সদস্যরা, মিজান চৌধুরী, মোশতাক, শাহ মোয়াজ্জেম, তাহের উদ্দীন ঠাকুর গং এক হয়েছে। তাজউদ্দীনকে সরাতে চায়। তাদের উসকানি দিচ্ছে শেখ মণি।

ঢাকার সদস্যরা ব্যাপারটা বুঝলেন। এক. তারা কেউই খন্দকার মোশতাককে পছন্দ করেন না। লোকটা যেন একটা চলমান পাকিস্তানের প্রতিমূর্তি। দুই. তারা শেখ মণিকেও পছন্দ করেন না। কারণ, এই যুবনেতারা মুজিব ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বলে নিজেকে দাবি করে অনেক ধরনের বেয়াদবি করে। এইটা পরিষদ সদস্যদের পছন্দ নয়। সবচেয়ে বেশি উৎসাহী হলেন শামসুল হক। তারা বেরিয়ে পড়লেন অন্য সদস্যদের খোঁজে। শিলিগুড়ি যাওয়ার আগেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের তাজউদ্দীনের পক্ষে আনতে হবে।

তাজউদ্দীন চলে গেলেন মন্ত্রীদের ফ্ল্যাটে। লিফটে উঠলেন। এই সময় দেখা হয়ে গেল লিলির সঙ্গে।

লিলি জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

অন্যমনস্ক তাজউদ্দীন জবাব দিলেন, এই তো আছি।

লিলি বললেন, সোহেলের খুব জ্বর। একটু দেখতে এসো।

তাজউদ্দীন বললেন, আমি খুব ব্যস্ত লিলি।

লিলি বললেন, তোমার দুগ্ধপোষ্য শিশুর খুব জ্বর। ১৮ মাসের বাচ্চাটা আব্বু আব্বু বলে ডাকে আর কাঁদে।

তাজউদ্দীন বললেন, আসব একবার। নজরুল ভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। খুবই ব্যস্ততা যাচ্ছে।

সৈয়দ নজরুল খুবই চিন্তিত। এমএনএ, এমপিএরা আসে, তারা তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বলে। কিন্তু তাজউদ্দীন সরকারটা দাঁড় করানো আর পরিচালনার জন্য যে পরিশ্রম করছেন, আর তার লেখাপড়া ও প্রজ্ঞা যে পর্যায়ের, তাঁর সঙ্গে কারও তো তুলনা চলে না। আর সরকার প্রেসিডেনশিয়াল। সব ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের হাতে। প্রধানমন্ত্রী তো মুখ্য নয়। তাজউদ্দীন কাজ বেশি বেশি করে তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করছেন। তিনি তো তাকে কাজ কম করতে বলতে পারেন না। কিন্তু তার আরেকটা সমস্যা আছে। তাঁর ছেলে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মুজিববাহিনীতে যোগ দিয়েছে। শেখ মণি, রাজ্জাক, তোফায়েলদের সঙ্গে মিলে চলছে। এটা হলো জেনারেশন গ্যাপ। ছেলে তার কাছে আসেও না।

তাজউদ্দীন এলেন। তাঁর চোখমুখে উদ্বেগ।

সৈয়দ নজরুল বললেন, এত রাতে?

তাজউদ্দীন বললেন, শিলিগুড়ির সম্মেলনে ঝড় বয়ে যাবে। আমার ওপর দিয়েই যাবে। আপনি হাল ধরে থাকবেন। শক্ত করে হাল ধরবেন। আমরা এই পর্যায়ে এসে সরকারের বদলে ওয়ার কাউন্সিল বানাতে পারব না। আর আপনি যদি মনে করেন, সরকার থাকুক, প্রধানমন্ত্রী অন্য কাউকে করবেন, তা আপনি করতে পারেন। আমি ছেড়ে দেব। আর আমি ছেড়ে দিলেও আপনার যেকোনো অর্ডার আমি পালন করব। আপনি কাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন, ঠিক করে রাখেন। সবাই যোগ্য। আমার কোনো অসুবিধা নাই।

সৈয়দ নজরুল অভিজ্ঞ মানুষ। বয়সে তাজউদ্দীনের সমান যদিও। তিনি মুহূর্তখানেক ভাবলেন। মনসুর আলী সাহেব বয়স্ক। নিজের পরিবার পরিজন নিয়ে চিন্তিত। কামারুজ্জামান সাহেব কবিতা লেখেন আর পান খান। পরিশ্রমী কিন্তু একদিকে দিল্লি আরেক দিকে সৈন্য, একদিকে ভারতীয় আর্মি আরেক দিকে আমলাতন্ত্র, একদিকে বাংলাদেশ প্রশাসন আরেক দিকে মুক্তিবাহিনী, একদিকে আওয়ামী লীগ নামের অতল অসীম প্রতিষ্ঠান আরেক দিকে ন্যাপ, সিপিবি, বুদ্ধিজীবী নানা দল–এই কঠিন দড়ি-টানাটানির মধ্যখানে কামারুজ্জামান সাহেব কঠিন দৃঢ়তা বজায় রাখতে পারবেন না। মোশতাক তো আগাগোড়া একটা প্রতিক্রিয়াশীল লোক। আর থাকে যুবনেতারা। তারা দুর্বিনীত। বয়সের কারণেই বিদ্রোহী। শেষটা হলো শেখ সাহেবের আত্মীয়রা। আত্মীয়তা কোনো যোগ্যতা হতে পারে না, আর তা যদি যোগ্যতা হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর কোনো করণীয় থাকবে না। কাজেই দিল্লি যাকে পছন্দ করে, যিনি তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু করেন না, সেই তাজউদ্দীনই সবচেয়ে ভালো প্রধানমন্ত্রী এবং এই মুহূর্তে তার কোনো বিকল্প নেই। শেখ সাহেবেরও তিনি ছিলেন ডান হাত।

সৈয়দ নজরুল বলেন, দীর্ঘদিন শেখ সাহেবের সঙ্গে রাজনীতি করেছি, আমি জানি, এই সব ঝড় শেখ সাহেব কীভাবে সামলাতেন। সামলানোর উপায় হলো, আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখা, আর বলিষ্ঠভাবে সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নেওয়া। আপনি চিন্তা করবেন না, তাজউদ্দীন। আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। ডোন্ট ওয়ারি।

সৈয়দ নজরুলের বাসা থেকে বেরিয়ে তাজউদ্দীন গেলেন লিলির কাছে।

আব্বু এসেছে, আব্বু এসেছে বলে রিমি, রিপি তার কাছে চলে এল। তিনি মেয়ে দুটোকে দুই হাতে ধরে চলে গেলেন বেডরুমে। মিমি খেলছে। সোহেলের মাথায় পানি ঢালছেন লিলি।

তাজউদ্দীন বললেন, ডাক্তার দেখিয়েছ? ডাক্তারকে খবর দাও।

পরে তিনি তাঁর পিএস ফারুক আজিজ খানকে বলবেন, দেখুন, ছেলের জ্বর হয়েছে। আমি কী করব? আমি কি ডাক্তার? আপনি চিন্তা করুন, সারা বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ লোক আহত। যুদ্ধক্ষেত্রে যে মানুষটা গুলিবিদ্ধ হয়েছে, কে তাকে দেখছে। শরণার্থীশিবিরে কত লক্ষ শিশু রোগেশোকে পুঁকছে। কে তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এখানে ফ্ল্যাটে আছে, নিরাপদে আছে। একটা ডাক্তার ডেকে দেখাবে, এটা যদি আমাকেই দেখতে হয়, তাহলে আমি সরকারের কাজ করব কখন?

.

শিলিগুড়ির বিমানবন্দরে একে একে পরিষদ সদস্যরা নামছেন। তাঁদের বাসে তুলে নেওয়া হচ্ছে গভীর জঙ্গলে, বাগডোগরা, বিএসএফের ক্যাম্পে। এত ঘন জঙ্গল যে সদস্যরা দিনে বেলাতেও রাতের অন্ধকার দেখছিলেন পথের দুধারে।

ক্যাম্পের ভেতরে পৌঁছানোর পরপর বিএসএফের একজন জেনারেল সমবেত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বললেন, এটা খুবই ভয়ংকর একটা জায়গা। এই বাউন্ডারির বাইরে যাওয়ার কথা কেউ ভুলেও ভাববেন না। এই বনে বাঘ আছে এবং সবচেয়ে ভয়ংকর হলো বন্য হাতির পাল। আপনাদের নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই প্রত্যেকেই বাউন্ডারির ভেতরে অবস্থান করবেন।

.

৫ জুলাই ১৯৭১। আজ পরিষদ সদস্যদের সম্মেলন। জাতীয় পরিষদের ১৩৫ জন, প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৯ জন সদস্য উপস্থিত। ক্লিয়ার মেজরিটি। তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল উপস্থিতি দেখে সন্তুষ্ট। আসলে এটা করতে সাহায্য করেছে ভারতীয় বাহিনী। তাদের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক আছে। টেলিফোনে যোগাযোগের চেইন আছে। তারা সারা বাংলাদেশের প্রতিটা বর্ডারে, যে এক শ ক্যাম্প আছে, সবখানে, বিএসএফ চ্যানেল ব্যবহার করে এবং গোয়েন্দাদের লাগিয়ে রেখে সবাইকে খবর দিয়ে, ডেকে, কখনোবা সঙ্গে থেকে নিয়ে এসেছে।

সম্মেলনের শুরুটা হলো ঝোড়ো হাওয়ার মতো। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের একচোট তর্ক হয়ে গেল। তাজউদ্দীন মাথা ঠান্ডা রাখলেন। চিৎকার যা করার জহুর আহমেদই করলেন।

তাজউদ্দীন ভেতরে গেলেন। বিশাল অডিটরিয়াম। সবই আর্মিদের। পাশেই এয়ারফোর্স আর আর্মি বেস। এইটা মনে হয় দরবার হল।

খন্দকার মোশতাক গিয়ে বসলেন সভাপতির আসনে।

প্রথমেই কথা বলার জন্য মঞ্চের দিকে গেলেন শেখ আজিজুর রহমান। মোরেলগঞ্জ এলাকা থেকে নির্বাচিত পরিষদ সদস্য। ময়েজউদ্দীন জানেন, তাজউদ্দীনবিরোধীদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। ময়েজউদ্দীন তাঁর কলার চেপে ধরে তাকে বাইরে টেনে নিতে লাগলেন। ময়েজউদ্দীনের কোমর টেনে ধরলেন শাহ মোয়াজ্জেম। তখন শাহ মোয়াজ্জেমের পেটে বা কনুই দিয়ে সর্বশক্তিতে আঘাত করলেন ময়েজউদ্দীন। মোয়াজ্জেম পড়ে গেলেন। শেখ আজিজকে সম্মেলনকক্ষের বাইরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শামসুল হক এসে তাঁকে জাপটে ধরে আটকে রাখলেন। ময়েজউদ্দীন দ্রুত মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন দখল করলেন। সভাপতির আসনে বসা মোশতাক বললেন, সভা অ্যাডজরন করা হলো। তিনি উঠে মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন।

তখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এসে সভাপতির দায়িত্ব নিলেন আর সভার কাজ শুরু হলো।

মিজানুর রহমান চৌধুরী তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ দেখালেন। মোট ৬০ জন সদস্য বক্তব্য দেন। অনেক সমালোচনা। অনেক আপত্তি।

একজন সদস্য প্রশ্ন তুললেন, ভারত আমাদের সাহায্য করছে। ৬০ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিচ্ছে। তারা স্বীকৃতি দিচ্ছে না কেন আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রকে?

সৈয়দ নজরুল বললেন, প্রধানমন্ত্রী, এই প্রশ্নের জবাব দিন।

তাজউদ্দীন বললেন, আপনারা জানেন, আমরা সারা পৃথিবীর সব শান্তিকামী দেশ এবং সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। পৃথিবীর সব সংবাদমাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তারপরও সরকারগুলো অনেকেই এটাকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে গণ্য করছে। ভারতের এই সাহায্যকে জাতিসংঘের একটা সদস্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস পাচ্ছে।

আমরা যদি মুক্তিবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে বিজয়ে দ্বারপ্রান্তে না নিতে পারি, ভারতের স্বীকৃতি তাদের একঘরে করে ফেলবে। তবে আমাদের সরকার, আমাদের সব মন্ত্রী, এমনকি আমাদের পরিষদ সদস্যদের মধ্যেকার প্রতিনিধি এবং বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে ভারত সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও নীতিনির্ধারকদের কথা হয়েছে। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আমাদের সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আপনারা জানেন চীনের প্রতিক্রিয়া। তারা প্রকাশ্যে ভারতের এই সাহায্যকে সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা হিসেবে বর্ণনা করেছে। ভুট্টো চীন সফর করেছেন। চীন পাকিস্তানকে কথা দিয়েছে, ভারতের কোনো রকমের আক্রমণ হলে তারা পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়াবে। ১৩ এপ্রিল চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানকে চিঠি দিয়েছেন, আপনারা খবরের কাগজে পড়েছেন, যদি ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করে, চীন পাকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়াবে।

কাজেই ভারতকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলতে হচ্ছে। তারা আমাদের কথা দিয়েছেন, ঠিক সময়ে তারা স্বীকৃতি দেবেন। শুধু ঠিক সময়ে স্বীকৃতি দেবেন তা-ই না, আর যা যা করার তা-ই করবেন। তবে আমি প্রথম দিন থেকেই মিসেস গান্ধীকে বলে আসছি, আমাদের লড়াই আমাদের করতে হবে। আমাদের লড়াই আপনারা করে দেবেন, তা হয় না। আমাদের অস্ত্র দিন, ট্রেনিং দিন। ব্যাকআপ দিন। এই আহ্বান আমি পৃথিবীর সব স্বাধীনতাকামী দেশের প্রতিই দিয়েছি। আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আমাদের চাওয়া, আমাদের অস্ত্র দিতে হবে না, পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া, সমর্থন দেওয়া, অর্থসাহায্য দেওয়া বন্ধ করুন।

পরের প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু কেন ধরা দিলেন? ওই সময় আপনার ভূমিকা কী ছিল? আর আপনারা যদি জানেনই তাঁকে ধরা হয়েছে, তাহলে কেন বলা হলো, তিনি আমাদের মধ্যে থেকে সংগ্রাম পরিচালনা করছেন? এতে তার প্রাণহানি হতে পারত। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে গুম করে ফেলে বলতে পারত, তাজউদ্দীনকে বলুন, শেখ সাহেবকে তারা কোথায় রেখেছে? কোথা থেকে তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করছেন? এত বড় ভুল আমরা কেন করলাম?

ব্যারিস্টার আমীর বললেন, আপনারা অনেকেই ২৫ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত ৩২ নম্বরে গেছেন। আপনারা সব জানেন। বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি পালিয়ে যাবেন না। এটা কি আপনারা কল্পনা করতে পারেন যে তার মতো বিশাল নেতা, যিনি সমস্ত পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা, তিনি ছদ্মবেশ নিয়ে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশে আসবেন? তাকে কি লুকিয়ে রাখা সম্ভব হতো? আর তিনি কেন পালাবেন? এটা তাঁর সচেতন সিদ্ধান্ত। তিনি পালাবেন না। লুকোবেন না। যদিও তিনি প্রথমে বলেছিলেন সবাইকে পুরান ঢাকায় যেতে। সেখান থেকে নদী পার হয়ে তিনি হামিদ সাহেবের লঞ্চে উঠবেন। তবে এটা ঠিক যে আমরা এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে জানিনি যে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর জনগণ যাতে হতাশ না হয়ে পড়ে, সারা দেশের প্রতিটা জেলা, মহকুমা, থানায় গড়ে ওঠা প্রতিরোধসংগ্রাম যেন স্তিমিত না হয়ে যায়, সে জন্য আমরা বলেছি তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন। তার অনেকগুলো ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। আপনারা চট্টগ্রামের নেতারা জানেন, চট্টগ্রাম বেতার থেকে এ-ও বলা হয়েছিল যে দুপুরের লালদীঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। পরে নেতাদের নির্দেশে সেই ঘোষণা পাল্টানো হয়।

সৈয়দ নজরুল ঘোষণা করলেন, এবার বক্তব্য রাখবেন অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী।

অর্থমন্ত্রী মনসুর আলী মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি বললেন, দুষ্কৃতকারীরা বাস্তুত্যাগী বাঙালিদের যে ঘরবাড়ি, বিষয়সম্পত্তি দখল করেছে, তা প্রকৃত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এ কথা ঠিক যে শত্রুকবলিত এলাকায় আমাদের মুক্তিবাহিনী পুল-সেতু উড়িয়ে দিচ্ছে, রাস্তা কেটে দিচ্ছে, শত্রুর আবাসস্থল গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। এতে আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। দেশ শত্রুমুক্ত হলে এসব রাস্তাঘাট, দালানকোঠা, পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু হবে। বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে তাই বুলেট-বেয়নেট, শেল-গোলায় স্তব্ধ করা যাবে না। রক্তের যখন মাতন জেগেছে, পদ্মা-মেঘনায় বান ডেকেছে, তখন তাকে রুখতে পারে, এমন সাধ্য কারও নেই। জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা।

তাজউদ্দীন আহমদ দাঁড়ালেন। চশমা পরে নিয়ে তিনি বক্তৃতা শুরু করলেন :

মাননীয় সদস্য ও সদস্যাগণ,

আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা আমার চেয়ে আপনারাই বেশি জানেন।

আজকের এই যুদ্ধের ফলে ৬০ লক্ষেরও অধিক লোক ছিন্নমূল হয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দলমত-নির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি মানুষ বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই বন্ধুত্বের কথা মনে রাখবেন।

অন্য সব ভুলে গিয়ে আমাদের বড় লক্ষ্য হবে আমার দেশের মুক্তিসংগ্রামকে জোরদার করা এবং হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করা। আমাদের আজ বড় লক্ষ্য হবে ৬০ লক্ষাধিক ছিন্নমূল মানুষকে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা। ৬০ লক্ষাধিক যদি ভারতে চলে গিয়ে থাকেন, ১০ লক্ষাধিক মানুষ যদি মৃত্যুবরণ করে থাকেন, তা হলে সাড়ে ৭ কোটি মানুষের মধ্যে এখনো সাড়ে ৬ কোটি মানুষ বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রয়ে গেছেন। তারা যে নির্যাতন ভোগ করছেন, যে কষ্ট ভোগ করছেন, তাঁদের যে হাহাকার, যে দুঃখ, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। হৃদয় দিয়ে বুঝতে হলেও হৃদয়ের অনেক বল দরকার। ভালো করে বুঝতে হলেও নিজেরা সজ্ঞান থাকতে পারব কি না সন্দেহ।

আজ সেই সমস্ত মানুষ পরম দুঃখ-কষ্টের মাঝেও প্রতিনিধিদের মুখের পানে চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেন বাংলার যুবকদের আশায়, মুক্তিবাহিনীর আশায়। একদিন তারা আমাদের উদ্ধার করবেন, একদিন তারা আমাদের লাঞ্ছনা থেকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করবেন, সেই আশায় তারা আকুল হয়ে পথ চেয়ে আছেন। আমার বিশ্বাস বাংলার প্রতিটি যুবক, প্রতিটি প্রতিনিধি সে ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা তাদের এই অটুট আশা, এই আস্থা পূরণ করবই করব।

তাজউদ্দীন আহমদ বুকের সমস্তটা বল একত্র করে, মুখমণ্ডল রক্তে লালিম করে এই ভাষণ দিলেন। সভাস্থল নীরব হয়ে গেল।

এবার উঠলেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টাক, তার চেহারার মধ্যে একটা সৌম্য ভাব আছে, চেহারাটাই এমন যাকে সবাই মান্য করবেন, শ্রদ্ধা করবেন। বঙ্গবন্ধু যেমন আমেরিকানদের বলেছেন, আমার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুলই নেতা, তেমনটা দু-একজন নেতার সামনেও বলেছেন, কিন্তু তাঁকে সিনিয়র সহসভাপতি পদ দেওয়া, পরিষদের ডেপুটি লিডার বানানোর মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর পর আওয়ামী লীগে তিনিই, এটার স্পষ্ট বার্তা বঙ্গবন্ধু দিয়ে গেছেন।

কাজেই সৈয়দ নজরুল ভাষণ দিতে উঠলে স্তব্ধ সভা কান পেতে রইল তিনি কী বলেন।

সৈয়দ নজরুলও বুঝতে পারলেন, আজ তাঁকে তাঁর জীবনের সেরা ভাষণটা দিতে হবে। তিনি বলতে থাকলেন :

আমরা যখন এই পরিষদের সম্মেলনকক্ষে, তখন বাংলাদেশের বীর মুক্তিফৌজ অপূর্ব বীরত্বের সঙ্গে শত্রুবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে।

২৫ মার্চের রাতের আঁধারে এই বীভৎস ঘটনার পর আপনারা রুখে দাঁড়ালেন। রুখে দাঁড়ালেন বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা যে। যেখানে ছিলেন। মফস্বল শহরে, জেলা শহরে, গ্রামে, বন্দরে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করব আমাদের বীর বাঙালি সৈনিকেরা। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছেলেরা, যাদের বীরত্ব আজকে ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু বন্ধুরা যা ভাবতেও পারি নাই তা হয়েছে। আমাদের ইপিআর বাহিনী, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের আনসার, আমাদের মুজাহিদরাও বাংলার মানুষের পাশে এসে দাঁড়াল। বন্দুক আর কামান তুলে নিল। আজ তারা সংগ্রামের পুরোভাগে। বাংলার গ্রামে, বন্দরে, গঞ্জে আপনারা দাঁড়ালেন। আমি কীভাবে আপনাদের শ্রদ্ধা জানাব, তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। যে সমস্ত মিথ্যাবাদী বলে আওয়ামী লীগের নেতারা এবং সদস্যরা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিল না, তাদের আমি জবাব দিতে চাই। বাংলার মানুষ জানে আপনারা ছিলেন পুরোভাগে। আমি জানি চট্টগ্রামে, ময়মনসিংহে, যশোরে, রংপুরে, খুলনায়, বরিশালে, ঢাকায়, ফরিদপুরে বাংলার সবখানে আপনাদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম হয়েছে।

মূলত ও বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী রেখে যান। আমরা দীর্ঘকাল যারা বঙ্গবন্ধুর পাশে পাশে থেকে সংগ্রাম করেছি, তারা জানতাম, বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হয়ে যান, তবে স্বাধীনতা ঘোষণা তিনিই করে যাবেন। আর সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে।

প্রিয় বন্ধুরা, ২৫ মার্চের রাতের পর আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই আপনারা জানেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।

আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার বনে বনে, জঙ্গলে ঘুরেছি। ১৩ এপ্রিল আমরা বাংলার পূর্ব অঞ্চলে প্রথম একত্র হলাম। আমরা মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সামনে সেদিন আমার সহকর্মীদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।

১৭ এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণা(পত্র) পাঠের পর আমি আমার সহকর্মী বন্ধু জনাব তাজউদ্দীন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। তারই পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতন নির্দেশের বলে আমি আমার সহকর্মী বন্ধু মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। জনাব মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রীর কাজে নিয়োগ দিয়েছিলাম। জনাব কামারুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম।

আপনাদের একটা কথা বলব, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সরকারের জন্মমুহূর্ত থেকেই কর্নেল এ জি ওসমানীর মতো একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমী সমরবিশারদকে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি।

মনে রাখবেন, রণক্ষেত্রে পশ্চাদপসরণ মানে পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করতে হয়, যাতে তীব্র আক্রমণ করে জয়লাভ করা যায়। যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসি দেশ আক্রমণ করেছিল, সেদিন শত শত, হাজার হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী ফরাসি সরকারকে হিটলারের কাছে মাথা নত করতে হয়েছিল। আপনারা মনে রাখবেন, মাত্র তিন দিনে হিটলারের ট্যাংক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন ফরাসি দেশের বীর নায়ক জেনারেল দ্যাগল মাত্র কিছু সৈন্য নিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে চলে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে আপনারা জানেন দ্যাগল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে অবতরণ করেছিল, সেদিন হিটলারের বাহিনী তার সামনে টিকতে পারেনি।

দীর্ঘকাল সুখে-দুঃখে আমি আপনাদের পাশে ছিলাম। আমার প্রিয়তম নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন, আপনারা দীর্ঘকাল আমাকে ভালোবাসা দিয়েছেন, স্নেহ দিয়েছেন আমার বন্ধু তাজউদ্দীন সাহেবকে, যেমন দিয়েছেন। আমার বন্ধু কামারুজ্জামান সাহেবকে, যেমন দিয়েছেন আমার বন্ধু মুরব্বি মোশতাক সাহেবকে, মনসুর আলী সাহেবকে। কোনো দিন কি আমরা আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছি? বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস, আপনাদের স্নেহ, ভালোবাসার বিনিময়ে আমরা কি কোনো দিন আপনাদের আদর্শ থেকে চ্যুত হয়েছি? ২০-২২ বছরের ইতিহাস যদি এ কথা বলে সুখে-দুঃখে জয়-পরাজয়ে গৌরবে-অগৌরবে আপনাদের পাশে ছিলাম। আপনাদের বিশ্বাসের অমর্যাদা করিনি। তাহলে আপনাদের কাছে আকুল আবেদন জানাব, আবার আপনারা বিশ্বাস স্থাপন করুন। দেখুন আমরা কী করতে পারি। যদি না পারি, তবে শুধু আপনাদের কাছে নয় অনাগত ভবিষ্যতের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। আমার বিশ্বাস, আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা ও প্রধান সেনাপতিও এ সম্বন্ধে সজাগ।

বন্ধুরা, ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল এই তিন বছর আমি আপনাদের পরিচালনা করার দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু এই তিন বছর কারাগারে ছিলেন। আইয়ুব শাহির দাপট আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমি দেখেছি তখনো আপনারা অধৈর্য হতেন। আমি কোনো দিন ধৈর্য হারাই নাই। বহুবার সংগ্রামের বহু কৌশল নিয়ে আপনাদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়েছে। আমার সহকর্মী ভাইয়েরা, আজকে আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমার প্রবর্তিত কৌশলের ফলে ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করেছিলাম, তথা আইয়ুব শাহিকে খতম করেছিলাম।

বন্ধুরা আমার, আমি জানি এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে আবার বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে প্রধান সহসভাপতি করেছিলেন। এই বিশ্বাসের বলে আপনারা আমাকে জাতীয় পরিষদে ডেপুটি করেছিলেন।

আমি জানি, এই বিশ্বাসের বলে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে আবার আপনারা আমাকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিয়েছেন। আমার ভাগ্য এই যে আমার নেতা, আমার ভাই, আমার প্রিয়তম বন্ধু শেখ সাহেব যখনই যান, তার অসমাপ্ত কাজের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়ে যায়।

বন্ধুরা আমার, সেই কাজ চিরকাল আপনাদের পাশে পাশে থেকে করেছি। বন্ধুরা আমার, আজও আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি–যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, যদি সংকল্পে কোনো রকম মলিনতা দেখেন, আপনারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সংকট মুহূর্তে জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে আজকে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজার হাজারে সৈনিক আজ বন প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহূর্তে আপনারা আরেকবার আস্থা স্থাপন করুন। আমার বন্ধু তাজউদ্দীন দীর্ঘদিন আপনাদের পাশে সংগ্রাম করেছে। বহু জেল খেটেছে। আমার ভাই, মোশতাক সাহেব, মনসুর সাহেব, কামারুজ্জামান সাহেব দীর্ঘকাল সংগ্রামের পরীক্ষিত সেনাপতি। তাদের ওপর আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। এ কথা আমি বলব না নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আপনারা সমালোচনা করবেন না। সমালোচনা করার অধিকার আপনাদের আছে। সমালোচনার উদ্দেশ্য হবে একটি–কী করে স্বাধীনতাসংগ্রামকে জোরদার করা যায়।

আর যদি বাংলার স্বাধীনতা এই মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে একদিন অর্জিত হয়, সেই গৌরব আপনারা নেবেন, আওয়ামী লীগের কর্মীরা নেবেন, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নেবেন, মুক্তিযোদ্ধারা নেবেন। আর যদি সেদিন শুধু কিছু ধন্যবাদ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দেন, তবে আমি কৃতার্থ হব। আপনাদের খাদেম আজকে এবং ভবিষ্যতে থাকব। আপনাদের সবাইকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। আসোলামু আলাইকুম।

সৈয়দ নজরুলের এই আবেগপ্লাবী বক্তৃতার পর সবাই একেবারে চুপ করে গেলেন। তাজউদ্দীন আহমদের বুক থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেল।

.

শাহ মোয়াজ্জেম ভারতীয় সৈন্যদের কথা না শুনে বাইরে বের হলেন। পাশেই দার্জিলিং। দেখতেই হবে। তাঁর সঙ্গে আরও আরও সদস্য বের হলেন। একটা ঝরনা দেখে শাহ মোয়াজ্জেম নেমে গেলেন গোসল করতে। রাতে ফিরে এলেন অ্যাডভেঞ্চার করার তৃপ্তি নিয়ে। পরের দিন আওয়ামী লীগের মিটিং হলো। তখন শাহ মোয়াজ্জেম শুরু করলেন হাঁচি দেওয়া। বিকেলে জ্বর এল। সারা রাত জ্বরের ঘোরে সুলতা সুলতা বলে প্রলাপ বকলেন। পরের দিন তাঁকে বাগডোগরার হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। সুলতা কলকাতার এক তরুণী, যিনি শাহ মোয়াজ্জেমের বাকপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। আর তিনি শুনেছিলেন, শাহ মোয়াজ্জেম অবিবাহিত, এবং লন্ডন যাচ্ছেন, সুলতা তাকে বলেছিলেন, আমাকে লন্ডন নিয়ে যাবেন। শাহ মোয়াজ্জেম বলেছিলেন, আমি তো বিবাহিত, আমার সন্তান আছে। তখন ছাদের পূজামণ্ডপে নির্জনে নিয়ে গিয়ে শাহ মোয়াজ্জেমকে তিনি বলেছিলেন, যদি বাংলাদেশে আপনার স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে যায়, তাহলে আমাকে সঙ্গে নেবেন? বালাই ষাট। তা হবে কেন বলে শাহ মোয়াজ্জেম চলে আসেন। এখন এই পাহাড়ি এলাকায় ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে প্রচণ্ড জ্বরে তিনি সুলতা সুলতা বলে সারা রাত এপাশ-ওপাশ করতে লাগলেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম কইলেন, এই সরকারের নেতৃত্বে যদি স্বাধীনতা অর্জিত হয়, তাইলে কিছু ধন্যবাদ দেবেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, এই সরকারের নেতৃত্বেই তো বিজয় আইছিল।

ব্যাঙ্গমা বলবে, ধন্যবাদ তাগো চিরকাল জাতি দিব। কিন্তু শত্রুরাও বুইঝা ফেলছিল কারা স্বাধীনতা আনছে। এই জন্য সবার আগে মারছে শেখ মুজিবরে, মারছে বেগম মুজিবরে, মারছে শেখ কামাল, শেখ জামাল, এমনকি শেখ রাসেলরে, তারপর কয়দিন গ্যাপ দিয়া তারা জেলে ঢুইকা মারছে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, কামারুজ্জামান আর মনসুর আলী সাবরে। তাগো অপরাধ, তারা বাংলাদেশ স্বাধীন করছিলেন। এ ছাড়া আর কী হইব?

তাইলে খন্দকার মোশতাকরে মারল না ক্যান?

হেরে মারব ক্যান? হে-ই তো মারছে!

কিন্তু অহন তো সৈয়দ নজরুল তারে কইলেন মুরব্বি। বন্ধু। বঙ্গবন্ধুর হাইকমান্ড।

হ। শেখ সাহেব মোশতাকরে তো পাশে রাখতেনই। কারণ, সামনাসামনি মোশতাক সবচায়া বেশি আনুগত্য দেখাইতেন। কিন্তু আজীবন তিনি আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থী এলিমেন্টই আছিলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন মুসলিম বাদ দিয়া আওয়ামী লীগ হইল, তখন তিনি আওয়ামী লীগ থাইকা পদত্যাগ করছিলেন। অহন যুদ্ধের ময়দানে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হইয়া কলকাতা বাংলাদেশ হাইকমিশনের রুমে বইসা তিনি কী কইতাছেন শুনো।

.

কাজী জহিরুল কাইয়ুম গেছেন মোশতাকের অফিসে। তাঁকে বললেন, শেখ সাহেব কোথায় আছেন? কেমন আছেন? যদি বেঁচে থাকেন তাহলে তাঁকে মুক্ত করা, তাঁর যাতে ক্ষতি না হয়, তাকে যেন ফাঁসি না দেয়, এটা কি মুজিবনগর সরকারের একটা প্রধান কাজ হওয়া উচিত নয়?

মোশতাক চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর আবার টেবিলে ঝুঁকে কাইয়ুমের দিকে মুখটা এনে বললেন, কাইয়ুম সাহেব, আপনি আমার দেশি মানুষ। আপনার সাথে আমার বহুদিনের দোস্তি। তারপরও আপনাকে পছন্দ করি না। এমন না যে আপনার গুণগুলা আমার অপছন্দ। আপনার এই সব গুণই তো আমি পছন্দ করি। খোদাভক্তি। বন্ধুবাৎসল্য। দয়াদাক্ষিণ্য। রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। খালি একটা দোষ আছে। যেই কারণে আমি আপনেরে শেষ পর্যন্ত পছন্দ করে উঠতে পারি না।

আমার দোষ? কী দোষ? আপনি বলেন আমি সেই দোষ কাটায়া ওঠার চেষ্টা করব।

আপনি শেখ মুজিবের মতো একটা অশিক্ষিত লোককে এত সমর্থন করেন কেন?

কাইয়ুম চমকে উঠলেন। শেখ মুজিব, শেখ মুজিব করে যে লোকটা মুজিবের সামনে, বেগম মুজিবের সামনে মুখে ফেনা তুলে ফেলে, তার মনের মধ্যে এই! কেমন করে সম্ভব?

কাইয়ুম বললেন, আমি অশিক্ষিত লোককে সমর্থন করি। কিন্তু ইতিহাস ভুলে গেলে তো চলবে না। আমি তো আওয়ামী লীগ করতাম না। আমাকে আওয়ামী লীগে আনছেন আপনি। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কাছে আমাকে নিয়ে গেছলেন আপনি। কিন্তু এরপর আমি কিন্তু আর আওয়ামী লীগ ছাড়ি নাই। আপনি ছাড়ছিলেন। আপনি আওয়ামী লীগ ছাড়ছিলেন লোভে। সামান্য হুইপ হওয়ার লোভে পার্টি ছেড়েছিলেন। সেটা কি আপনার উচিত হয়েছিল?

আমি তো দল ছেড়েছিলাম আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটা বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে। আমি আবার দলে আসছি। কিন্তু আপনি আমার ড্রেসটা দেখেন। মাথায় সেই জিন্নাহ টুপিই কিন্তু আছে। শেরওয়ানি পরি। ওদের মতো পাঞ্জাবির ওপরে নেহরু কোট লাগায়া আমি মুজিব কোট পরেছি, এটা বলি না।

.

হায়দার আকবর খান রনো আর কাজী জাফর দেখা করলেন খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে। মোশতাক বললেন, বাবারা, তোমরা তো কমিউনিস্ট।

জি হ্যাঁ।

আমি তো কমিউনিস্ট না। সমাজতন্ত্র আমার পছন্দ না। আমি ডেমোক্র্যাট। আদর্শগতভাবে আমি কমিউনিস্টদের বিরোধী। বাট অ্যাজ অ্যান ডেমোক্র্যাট আই ক্যান সিট অ্যাক্রোস দ্য টেবিল উইথ দ্য কমিউনিস্টস। বসো।

হায়দার আকবর খান রনো এবং কাজী জাফর বসলেন। মোশতাক বললেন, চা খাও। চা খাওয়াই। বুঝলা না, অন্যের দেশে এসেছি। ভারত তো আমার পছন্দের দেশ না। কিন্তু এখন এই দেশে থাকতে হচ্ছে। এই দেশের চা খাইতে হচ্ছে। শোনো, আমি পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছি। আমি পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করি। আমি মনে করি, ছয় দফা যদি পাকিস্তান মাইনা নিত, পাকিস্তান আরও শক্তিশালী হইত। পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে জোরদার করত। আমি সশস্ত্র সংগ্রামেও বিশ্বাসী নই। আমি কনস্টিটিউশনাল পলিটিকসে বিশ্বাস করি। বলো আওয়ামী লীগে কোন ঘোষণায় স্বাধীন বাংলার কথা আছে? আমি ভালো আওয়ামী লীগার। তবে আজকের বাস্তবতায় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ মেনে নিতে হচ্ছে। আমি বাস্তবতা মেনে নিচ্ছি।

রনো আর জাফর এরপর গেলেন কামারুজ্জামানের কাছে। তার বাসায়। কামারুজ্জামান তাঁর ডা. সুন্দরীমোহন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে বাইরের ঘরে বসা। সেখানে তার সামনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই, জীবনানন্দ দাশের কবিতার বই।

রননা, জাফর বসলেন। কামারুজ্জামান বললেন, আমার এখন ভালো লাগে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা :

প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা
চোখে আর করুণার নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।

আমি তো কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছি। সুকান্তকে নিয়ে কবিতা লিখেছি। এখন সুভাষ মুখোপাধ্যায় পড়ছি। চা খাও। তারপর পান দেব। আমি ফার্স্টক্লাস খিলি বানাতে পারি।

আপনি কমিউনিস্ট হয়ে যাচ্ছেন। এইটাই তো স্বাভাবিক। মানুষ ধীরে ধীরে পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদের দিকে যাবে। এটাই নিয়ম। বললেন রনো।

কামারুজ্জামান হেসে বললেন, কিন্তু আমি পুরা কমিউনিস্ট না। কারণ, আমি ধর্ম মানি। তোমাদের সঙ্গে আমার এই একটা জায়গাতে পার্থক্য আছে।

কাজী জাফর বললেন, হেনা ভাই, একটা কাজ করে দিতে হবে। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ করছি। অনেক জায়গায় আমাদের বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কঠিন লড়াই করছে। আমরা তো আবদুল হক, সিরাজ শিকদার, তোয়াহাদের মতো না। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। আমরা মনে করি, এই যুদ্ধ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ। এটায় আগে সফল হওয়া দরকার।

কামারুজ্জামান বললেন, খুবই ভালো কথা। আসলে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজকে ঐক্যবদ্ধ। সবাই মিলে লড়াই করছে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।

রনো বললেন, তবে দুই লাখ লোক বাদ দিয়ে। সাড়ে সাত কোটির মধ্যে দুই লাখ পাকিস্তানের দোসর আছে।

কামারুজ্জামান বললেন, ঠিক। হাজারে হাজারে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রসংঘ মিলে বানিয়েছে। আলবদর। বিহারিদের দিয়ে বানিয়েছে আলশামস। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সব খবরই আমি পাই। এই রাজাকার, আলবদর, আলশামস খুবই অত্যাচার করছে। বাড়িঘর দখল করছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের বাবা-মা পরিবারদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

কাজী জাফর বললেন, ভারতে তো আরেক সমস্যা। নকশাল। ভারতীয় বাহিনী নকশাল সন্দেহ হলেই ধরে ফেলে। আমাদের তো আবার চীনা লাইন। কাজেই আমাদের যেকোনো সময় ইন্ডিয়ান পুলিশ আর্মি ধরে ফেলতে পারে। আপনি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আপনি আমাদের দুইজনকে সার্টিফিকেট দেন যে এরা জয় বাংলার লোক। আমাদের ধরলে সেটা আমরা দেখাব।

কামারুজ্জামান সাহেব বললেন, ওকে। তাহলে কালকে অফিসে আসো। প্যাডে টাইপ করে দেব। সিল দিয়ে দেব।

রনো, মেনন ও কাজী জাফর কামারুজ্জামানের সার্টিফিকেট নিয়ে ভারতে নির্বিঘ্নে চলাচলের সুযোগ পেয়েছিলেন।

.

ব্যাঙ্গমা বলবে, হায়দার আকবর রনোগো লগে দেখা হইব আরেকজনের।

ব্যাঙ্গমি বলবে, কার? মোয়াজ্জেম চৌধুরীর।

হ।

সেই ঘটনাটা কও।

রনো আর কাজী জাফর বাইর হইতাছেন আগরতলা সিপিআই (এম) অফিস থাইকা। তাগো ধইরা ফেলল ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের লোক। কইল, আপনাগো দুইজনরে একটু শিলং যাইতে হইব। গাড়ি কইরা চললেন। অনেক লম্বা পথ। পাহাড়ি পথে চলতে দুইজনের ভালোই লাগতেছিল। দুই রাত পথের ধারের হোটেলেও থাকতে হইল। গোয়েন্দার লোক নানা গল্প কইরা অবশেষে তাগো লইয়া গেলেন সেনাবাহিনীর একটা অফিসে। একজন। মেজর জেনারেল তাগো সামনে হাজির হইলেন। কইলেন, আপনারা তো চীনপন্থী। আপনারা কি জানেন, চীন আমগো শত্রু?

আমরা চীনপন্থী নই। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতাছি। চীন পাকিস্তানরে সাপোর্ট করতাছে। বুঝতেই পারতেছেন।

রনো কইলেন, আমার ভাই যুদ্ধ করতাছে দেশের ভিতরে। আমার বাবা মা গ্রামে। তারা কে কেমন আছে কিছু জানি না। রনোর চোখ ছলছল কইরা উঠল। তিনি দেখলেন, ভারতীয় মেজর জেনারেল, অবাঙালি, তারও চোখটা ছলছল করতাছে। তিনি অনেক কথা কইলেন, দেখা গেল, রনো, জাফর, মেনন। সম্পর্কে তিনি বেশি জানেন। এরপর কইলেন, সিপিআই (এম) আপনাগো টাকা দেয়। এই টাকায় তো চলে না। আমরা আপনাদের টাকা দিব।

কাজী জাফর কইলেন, কত দিবেন? কত কোটি?

না না। কোটি না। তবে বেশ।

টাকা লাগব না। অস্ত্র দেন।

তা তো পলিটিক্যাল ডিসিশন। নট মাই কাপ অব টি। আপনাগো লগে পরিচয় করায়া দেই, একজনরে, তিনি পারবেন।

.

যিনি এলেন তিনি মোয়াজ্জেম চৌধুরী। রেজা আলীর মামা। সিলেটে চা বাগানের মালিক। বঙ্গবন্ধু ১৯৬২ সালে রেজা আলীকে নিয়ে মোয়াজ্জেম চৌধুরীর মাধ্যমেই আগরতলা গিয়েছিলেন, স্বাধীনতায় ভারতীয় সাহায্যের কানেকশন উন্মুক্ত করতে।

রনো বললেন, আপনি না কনভেনশন মুসলিম লীগ থেকে ইলেকশন করে আইয়ুব খানের পার্লামেন্টের মেম্বার হয়েছিলেন।

মোয়াজ্জেম চৌধুরী বললেন, সবই ক্যামোফ্লেজ। শেখ সাহেব আমাকে করতে বলেছিলেন। আসলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো এই মেজর জেনারেল সাহেবদের।

মেজর জেনারেল বললেন, হি ইজ আওয়ার ম্যান। হি হ্যাঁজ অলওয়েজ বিন আওয়ার ম্যান।

রনো, কাজী জাফর অবাক হলেন। শেখ সাহেব যে আগে থেকেই ভারতীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, এটা জেনে তাদের বিস্ময় যাচ্ছে না। মোয়াজ্জেম বললেন, আমি সেই কবে থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি। এ জন্য ভারতীয়দের সাহায্য আমাদের লাগবে, এটা আমার ভালো করেই জানা ছিল। আমি শেখ সাহেবকে কনভিন্সড করেছিলাম। শেখ সাহেব বলেছিলেন, দেশের মানুষ ভারতবিরোধী। আমি আগে দেশের মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করি। তারপর আপনার এই কানেকশন আমার লাগবে।

কাজী জাফর বললেন, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ দিতে বলেন।

মোয়াজ্জেম চৌধুরী বললেন, কাল যাচ্ছি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে। বলব।

রনো বললেন, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।

আচ্ছা চেষ্টা করব।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধু চাইছিলেন বিনা রক্তপাতে দেশ স্বাধীন করতে। চাইছিলেন গান্ধীজির মতন অহিংস অসহযোগ আন্দোলন কইরা পাকিস্তানিদের তাড়াইতে। কিন্তু সেটা যে হইব না সেটা তিনি খুব ভালো জানতেন।

ব্যাঙ্গমি বলে, তাই তিনি প্ল্যান বি রেডি রাখছিলেন। চিত্তরঞ্জন সুতারকে পাঠায়া দিয়া রাখছিলেন কলকাতায় বাসা নিয়া থাকতে। ইন্ডিয়ান অথরিটির লগে যোগাযোগ কইরা অস্ত্রশস্ত্র সাপোর্টের ব্যবস্থা রাখতে।

ব্যাঙ্গমা বলে, তা না হইলে ২৫ মার্চের সাথে সাথে ইন্ডিয়া বর্ডার খুইলা দিল, আর মুক্তিযোদ্ধা বিদ্রোহী বাহিনীকে সাপোর্ট দিতে শুরু করল, এইটা তো ভেলকিবাজি না।

.

৬ জুলাই বাগডোগরায় হলো আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সভা। এতে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমিটি বাতিল করে দেওয়া হলো। প্রাদেশিক কমিটিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কমিটি বলে ঘোষণা দেওয়া হলো। পাকিস্তানই যদি না থাকে, নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ থাকে কী করে? সহজ যুক্তি সবাই মেনে নিলেন।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে আওয়ামী লীগের কমিটি এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা অনুমোদন করে নিলেন। তারা প্রকাশ্য অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন, সরকারকে সমর্থন করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন।

৪৯

আনিসুজ্জামান থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অফিসে ঢুকবেন। তিনি যে এখানকার নিয়মিত আগমনকারী, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার লেখক, তাতে কুলোচ্ছে না। বিএসএফ কিছুতেই ঢুকতে দেবে না। ব্যাপার কী?

ভেতরে খুব গোপন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হচ্ছে।

আনিসুজ্জামান খানিকটা হতভম্ব, খানিকটা বিষণ্ণ। তিনি শেরে বাংলা ও নাজিমউদ্দিনের সাবেক বাড়িটার গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পান, একপশলা কালো মেঘ। না। ঢুকতে না দিলে আর অনাহূত

অতিথির গেটে দাঁড়িয়ে থেকে কী লাভ? এই সময় ভেতর থেকে বের হলেন। কালো চশমা আর সাফারি স্যুট পরা একজন। তিনি রাস্তা পার হয়ে জিপের দিকে যাচ্ছেন। আনিসুজ্জামানের তাঁকে চিনতে একমুহূর্ত সময় বেশি লাগল।

মেজর জিয়াউর রহমান।

আনিসুজ্জামান রাস্তা পার হয়ে তাঁর কাছে গেলেন। বললেন, কেমন আছেন?

জিয়া বললেন, ভালো।

আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল রামগড়ে, চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে, আমি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইচ্ছা। করেই অধ্যাপক কথাটা জুড়ে দিলেন আনিসুজ্জামান।

জি চিনতে পেরেছি–তাঁর চোখ যেহেতু দেখা যাচ্ছে না, আদৌ চিনতে পারলেন কি না, কে বলতে পারবে।

আনিসুজ্জামানের মনে আছে, সেদিন জিয়া ম্যানেজারের বাংলোতে এসেছিলেন সম্ভবত টেলিফোন করতে। তাঁকে আনিসুজ্জামান নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন, রেডিওতে আপনার ঘোষণা শুনেছি!

কোনটা?

যেটাতে আপনি শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।

শুনে জিয়া বলেছিলেন, পুয়োর শেখ। হি মাস্ট বি রটিং ইন দ্য প্রিজন নাই।

আনিসুজ্জামান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ডু ইউ নো ফর শিয়ের?

দিস ইজ মাই গেস!

আনিসুজ্জামান বললেন, আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিল না। খুব গুরুত্বপূর্ণ আর গোপন নাকি বৈঠক হচ্ছে!

জিয়া বললেন, সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন হচ্ছে। সেই জন্য এসেছি।

কেমন হচ্ছে সম্মেলন।

কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। সময় নষ্ট হচ্ছে।

পরে আনিসুজ্জামান সরকারের কার্যালয়ে ঢুকে ফারুক আজিজ খানের কাছ থেকে শুনতে পেলেন বিবরণ।

প্রথম দিনেই মেজর জিয়া এম এ জি ওসমানীর ভয়ানক সমালোচনা করেন। বলেন, তাঁকে সেনাপতি করা হয়েছে কেন? কারণ, তিনি পরিষদ সদস্য। ইটস আ পলিটিক্যাল রিক্রুটমেন্ট। সেনাপতি তো পলিটিক্যাল পোস্ট না। এটা একটা টেকনিক্যাল পোস্ট। ওনাকে মন্ত্রী করেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী। আর আমাদের সাতজন অফিসারকে নিয়ে ওয়ার কাউন্সিল করেন।

খালেদ মোশাররফ উঠে বলেন, না, ওয়ার কাউন্সিল করা যাবে না। তিনি বলেন, সাংগঠনিক কিছু বদল দরকার। সেটা করলেই হবে। আর ওসমানী সাহেবকে সরানোর যেকোনো প্রয়াস আমি এবং আমার কমান্ডের সৈনিকেরা সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করব।

লে. কর্নেল রব ওসমানীর প্রশংসা করে একটা বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, ওসমানী হলেন রূপকথার নায়ক।

ওসমানী পদত্যাগপত্র জমা দেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের একটা দিন চলে যায় ওসমানীর গোস্বা ভাঙাতে।

সম্মেলন ১১ জুলাই থেকে ১৫ জুলাই। যত ধরনের সমস্যা আছে সব আলোচনা হয়।

.

ব্যাঙ্গমা বলে, ১২ জুলাই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন এক আবেগময় বক্তৃতা করেন। তাতে সবার সমালোচনা স্তিমিত হইয়া যায়।

ব্যাঙ্গমি বলে, ঠিক হয়–সেনাপ্রধান হইবেন কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানী। চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ রব। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। আর এগারোটা সেক্টর থাকব।

১ নম্বর সেক্টর হইব চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা এবং নোয়াখালী জেলার মুহুরী নদীর পূর্ব এলাকা নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর রফিকুল ইসলাম। তিনি ১১ জুন থাইকা দায়িত্ব পালন করছিলেন। এর আগে ১০ এপ্রিল থাইকা ১০ জুন পর্যন্ত অধিনায়ক আছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

২ নম্বর সেক্টর হইব ফরিদপুর জেলার পূর্বাঞ্চল, ঢাকা শহরসহ ঢাকা জেলার দক্ষিণাংশ, আখাউড়া-আশুগঞ্জ রেললাইনের উত্তরাংশ বাদে কুমিল্লা। জেলা এবং মুহুরী নদীর পূর্বাঞ্চল বাদে নোয়াখালী জেলা নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর খালেদ মোশাররফ। পরে তিনি কে ফোর্সের অধিনায়ক হইলে মেজর এ টি এম হায়দার অধিনায়ক নিযুক্ত হন।

৩ নম্বর সেক্টর হইব কুমিল্লা জেলার একাংশ, সিলেট জেলার একাংশ, ঢাকা জেলার উত্তরাংশ ও ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমা নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর কে এম সফিউল্লাহ। পরে তিনি এস ফোর্সের অধিনায়ক হইলে মেজর এ এন এম নুরুজ্জামান অধিনায়ক নিযুক্ত হন।

৪ নম্বর সেক্টর হইব সিলেট জেলা সদরের অর্ধাংশ, মৌলভীবাজার মহকুমা ও সুনামগঞ্জ মহকুমার একাংশ নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর সি আর দত্ত।

৫ নম্বর সেক্টর হইব সিলেট জেলার সদর, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ মহকুমার ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ থানা নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর মীর শওকত আলী।

৬ নম্বর সেক্টর হইব দিনাজপুর জেলার একাংশ ও রংপুর জেলার একাংশ নিয়া। অধিনায়ক হইবেন উইং কমান্ডার এম কে বাশার।

৭ নম্বর সেক্টর হইব রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর জেলার একাংশ ও রংপুর জেলার একাংশ নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর নাজমুল হক। তিনি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হইলে এই সেক্টরের অধিনায়ক হন কাজী নূর উজ-জামান।

৮ নম্বর সেক্টর হইব কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর জেলার একাংশ ও খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমা নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর আবু ওসমান। চৌধুরী। পরে অধিনায়ক নিযুক্ত হন মেজর এম এ মঞ্জুর।

৯ নম্বর সেক্টর হইব বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা জেলার একাংশ ও ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার একাংশ নিয়া। অধিনায়ক হইবেন মেজর এম এ জলিল।

১০ নম্বর সেক্টর হইব নৌকমান্ডোগো লাইগা।

১১ নম্বর সেক্টর হইব ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়া। অধিনায়ক। হইবেন মেজর জিয়াউর রহমান। তিনি থাকবেন ১০ জুনের পর থাইকা ১২ আগস্ট পর্যন্ত। এরপর তিনি জেড ফোর্সের অধিনায়ক হইলে এই সেক্টরের অধিনায়ক হন মেজর আবু তাহের। তিনি একটা যুদ্ধে আহত হইলে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ অধিনায়ক হন।

ঠিক হয়, ট্রেনিং দেওয়ার গতি বাড়াইতে হইব, যাতে অনেক বেশিসংখ্যক গেরিলা তৈরি করা যায়। গেরিলা অপারেশন করতে ছোট ছোট দলরে দেশের ভিতরে পাঠানোর সংখ্যা আর তীব্রতা বাড়ানো হইব। পাশাপাশি কনভেনশনাল ওয়ার কইরা ঢাকা জয় করার পরিকল্পনা নিয়াও আগাইতে হইব। নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, গোলান্দাজ বাহিনী, সিগন্যাল কোরের যারা আসছেন, তাগো সমবেত ও সংগঠিত কইরা জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে যুদ্ধ করবার মতো উপযুক্ত বাহিনী গইড়া তোলা হইব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *