অধ্যায় ৪০
প্রচণ্ড ক্ষিদের চোটে মাথাটা টলে গেলো বাবলুর। রাত প্রায় দশটা বাজে। আজ তিন দিন হলো পানি ছাড়া আর কিছু খায় নি। বস্তির কারো কাছে হাত পাতার মতো ছেলে সে নয়। শত্রুভাবাপন্ন বস্তির লোকগুলো যে তাকে সাহায্য করবে সে ব্যাপারেও সন্দেহ রয়েছে।
বাবার পিস্তলটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে সেই বিকেলে। এটা দিয়ে কী করবে তার কোনো ধারণাই নেই, যদিও এটার ক্ষমতা কতোটুকু তা এতোদিনে জানা হয়ে গেছে।
পথে ঘুরতে ঘুরতে বস্তি থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে সে। একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলো বস্তিতে ফিরে যাবে। এমন সময় দেখতে পেলো দূরে একটা প্রাইভেটকার দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় আর কোনো গাড়ি-ঘোড়া কিংবা লোকজনও নেই।
প্রাইভেটকারটির বনেট খোলা। বেশ পরিপাটি পোশাক পরা এক ভদ্রলোক ঝুঁকে ইঞ্জিনটা দেখছে। পথে গাড়ি নষ্ট হয়ে যাওয়ার বিরক্তি তার চোখেমুখে। দেখে মনে হলো বেশ পয়সাওয়ালা লোক।
বাবলু তার পেছনে এসে দাঁড়ালে লোকটা যেনো টের পেয়ে গেলো। আস্তে করে পেছন ফিরে দেখলো সে।
বাবলু পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার, ভদ্রলোক একটুও চমকালো না।
কম্পিত কণ্ঠে সে বলে উঠলো, “একদম নড়বেন না!”
পেছন ফিরে বাবলুকে আপাদমস্তক দেখে নিলো ভদ্রলোক। তার মধ্যে ভয়ের কোনো লেশমাত্র নেই। একেবারে ধীরস্থির।
শান্তকণ্ঠে বললো, “কি চাও, খোকা?”
“আ-আপনার…মানিব্যাগটা!” ভদ্রলোককে চুপ মেরে থাকতে দেখে তাড়া দিলো সে, “আমাকে দিয়ে দিন…প্লিজ!”
ভদ্রলোক এবার অবাক হলো। “প্লিজ!” ভুরু তুললো সে। একটু চুপ থেকে কী যেনো ভেবে তারপর বললো, “টাকা দিয়ে তুমি কি করবে, বাবা?”
বাবলু অবাক। লোকটা তার সাথে এমন আচরণ করছে কেন? তার দিকে একটা পিস্তল তাক করা। ছিনতাইয়ের কবলে পড়া কেউ কি এমন করে? একটু ভ্যাবাচ্যাকাই খেলো বাবলু। “আমার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই…খুব খিদে পেয়েছে।”
ভদ্রলোক মাথা নেড়ে সায় দিলো। যেনো চট করেই সবকিছু বুঝতে পেরেছে। তারপর মানিব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললো, “পুরো মানিব্যাগটা চাও নাকি শুধু টাকাগুলো দিয়ে দিলেই চলবে?”
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো বাবলু। ভদ্রলোকের কথাবার্তা কেমনজানি অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এতে ধীরস্থির আছে কী করে!
ভদ্রলোক যেনো তার হতবুদ্ধিকর অবস্থাটা বুঝতে পারলো। “মানিব্যাগে আমার কিছু জরুরি কাগজপত্র আর বিজনেস কার্ড রয়েছে, ওগুলো তোমার কোনো কাজে লাগবে না। তাছাড়া আমার স্বর্গীয় মায়ের একটা ছবিও আছে এখানে।” কথাটা বলেই মানিব্যাগের ভেতরে রাখা ছবিটা দেখালো তাকে। “তোমাকে টাকাগুলো দিয়ে দিচ্ছি…ঠিক আছে?”
বাবলু কিছুই বলতে পারলো না। বাড়িয়ে দেয়া টাকাগুলো দ্রুত পকেটে ভরে নিলো সে। ভয়ার্ত চোখে আশেপাশে অস্থির হয়ে তাকালো সে। না। পথে এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
ঘুরে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে লোকটা তাকে বললো, “আমি জানি তুমি এ লাইনের ছেলে নও।”
ফিরে তাকালো বাবলু। সে বুঝতে পারছে না কী করবে। তার মনের একটা অংশ বলছে দ্রুত এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো, অন্য অংশটা বলছে, এই লোক তার কোনো ক্ষতি করবে না।
এইমাত্র বলা নিজের কথাটাকে সমর্থন করে মাথা নেড়ে সায় দিলো ভদ্রলোক। “মনে হচ্ছে তুমি লেখাপড়া জানা ছেলে,” তারপর টাকাবিহীন মানিব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। “এটা নাও। আমার বিজনেস কার্ড। যদি দরকার মনে করো তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারো।”
কার্ডটা নেবার কোনো ইচ্ছে নেই তার কিন্তু বাড়িয়ে দেয়া কার্ডটার দিকে চেয়ে রইলো। বাবলু যারপরনাই বিস্মিত। ভদ্রলোকের যেনো সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতার প্রভাব পড়লো তার উপর। কিছু না বলে চুপচাপ কার্ডটা নিয়ে নিলো।
“এভাবে পিস্তল হাতে এখানে দাঁড়িয়ে থেকো না। চলে যাও,” তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো ভদ্রলোক। “ওটা কোমরে খুঁজে নাও। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হবে।”
পিস্তলটা শার্টের নীচে কোমরে গুঁজে নিয়ে দৌড়ে চলে গেলো সে।
*
“তুমি কি পরে ঐ ভদ্রলোকের সাথে দেখা করেছিলে?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ। ইন্টেরোগেশন রুমে এখন বাবলু আর সে ছাড়া কেউ নেই। তবে যেকোনো সময় জামান ফিরে আসবে।
“না।” একটু চুপ থেকে বলে উঠলো, “ঐ ভদ্রলোকই আমার সাথে দেখা করেছিলেন।”
“তাই নাকি? ইন্টরেস্টিং।”
মুচকি হাসলো বাবলু।
“আচ্ছা, ঐ ভদ্রলোকের নাম কি?”
স্থিরচোখে ইনভেস্টিগেটরের দিকে চেয়ে রইলো সে। “আপনার দরকার কাহিনী। নাম দিয়ে কী করবেন? তাছাড়া ঐ ভদ্রলোক আমার কাছে খুবই মূল্যবান। বলতে পারেন অমূল্য! তার নাম আমি মরে গেলেও বলবো না। এমনকি টর্চার করলেও না।”
জেফরি বেগ মাথা দোলালো। “আমি তো আগেই বলেছি, টর্চার করা আমার পদ্ধতি না…আমি অন্যভাবে কাজ করি।”
“শুধু গল্প শুনে শুনে?”
হেসে ফেললো জেফরি। “না।”
“তাহলে?”
“বিজনেস সিক্রেট।” মিটিমিটি হাসছে ইনভেস্টিগেটর।
বাবলুও মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“আমরা আমাদের মেথড সম্পর্কে কাউকে কিছু বলি না।”
“ভালো!”
“এখন বলল, ঐ লোক কিভাবে তোমাকে খুঁজে বের করলো। কেন খুঁজে বের করলো।”
“উনি আমাকে কিভাবে খুঁজে বের করেছিলেন জানি না, শুধু এটুকু জানি, আমার মতো একজনকে খুঁজে বের করাটা উনার জন্য তেমন কঠিন কাজ ছিলো না।”
“তো উনি তোমাকে খুঁজে বের করে কী করলেন?”
“আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না…”
আবারো হাসলো জেফরি বেগ। “আমি কল্পনা করতে চাচ্ছিও না। তুমিই বলো।”
“সব কথা শুনে উনি আমার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। চিরকুমার ভদ্রলোক, বেশ টাকা-পয়সার মালিক, খুব কম কথা বলেন। রহস্যময় একজন।”
জেফরি বেগ আগ্রহী হয়ে উঠলো আবার। “আচ্ছা…”
“তবে উনি আমাকে নিজের কাছে রাখেন নি। কলেজের হোস্টেলে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেন। আমিও সব ভুলে পড়াশোনায় মন দেই। ভদ্রলোক খুব কমই আসতেন আমার সাথে দেখা করতে। তবে লোক দিয়ে প্রায়ই জামাকাপড়, খাবার-দাবার আর হাতখরচের টাকা পাঠিয়ে দিতেন।”
জেফরি বেগ মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ঐ ভদ্রলোক তো তোমাকে অন্ধকার থেকে টেনে তুলেছিলেন, তাহলে এরপর এমন কি হলো, তুমি এই লাইনে চলে এলে? মানে একজন পেশাদার খুনি হয়ে উঠলে?”
বাবলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো যেনো। “আমার এই অবস্থা খুব বেশি দিন টেকে নি।”
“কেন?”
একটু চুপ থেকে বললো সে, “কলেজে পড়ার সময় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে যায়। এটাকে দুর্ঘটনা বলবো না। হয়তো এটাই আমার নিয়তি ছিলো। তারপর থেকে সবকিছু খুব দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে…”
অধ্যায় ৪১
এসএসসি’তে খুব ভালো রেজাল্ট করার পর ঢাকা শহরের নামকরা একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলো বাবলু কিন্তু তার বাবা জেলে যাবার পর একদম অসহায় হয়ে পড়ে। ভেবেছিলো কলেজে পড়াশোনা করা বুঝি তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। এরপর অমূল্য বাবুর কল্যাণে তার জীবনটা দ্রুত পাল্টে যেতে শুরু করে। এসবই সম্ভব হয়েছে ঐ লোকের কারণে যার সর্বস্ব ছিনতাই করেছিলো সে।
অমূল্য বাবু। এক রহস্যময় ব্যক্তি। সকাল দশটা-এগারোটা পর্যন্ত কারো সাথে কোনো কথা বলে না। মৌনব্রত পালন করে। এমনিতেও কথা বলে খুব কম। বাবলু যতোটুকু বুঝতে পেরেছে, এই লোকের সাথে সমাজের ক্ষমতাধরদের সুসম্পর্ক রয়েছে। তার বিত্তবৈভব আর ক্ষমতা নিরূপণ করা অসম্ভব। কোনো কিছুতেই বিচলিত হয় না। তার চরিত্রে অস্থিরতা বলেও যেনো কিছু নেই। এক ধরণের নির্লিপ্ততার মধ্যে সারাক্ষণ তার বসবাস।
চিরকুমার এই ভদ্রলোক বাবলুকে নিজের বাড়িতে নিয়ে তোলেন নি। কলেজের হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে সে। তবে তার ভরণপোষণের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে অমূল্য বাবু।
শুরুতেই বাবলু তার জীবনের সব ঘটনা বলেছে। তার কাছ থেকে সব শুনে অমূল্য বাবু চুপ মেরে বসেছিলো কয়েক মিনিট, তারপর অবাক করে দিয়ে সুকঠিন ব্যক্তিত্বের লোকটি ছলছল চোখে উঠে চলে গেছিলো পাশের ঘরে।
এখন নিজের দুঃসহ অতীত পেছনে ফেলে সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করেছে সে। এই নতুন জীবনে অমূল্য বাবু ছাড়া সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি হলো সহপাঠী মেঘলা।
খুব দ্রুত তাদের মধ্যে যেমন বন্ধুত্ব হয়েছে তেমনি সম্পর্কটা অন্য দিকে মোড় নিতেও দেরি করে নি। মেঘলা ছাড়াও বাবলুর আরো কয়েকজন ভালো বন্ধু জুটে গেছে। তাদের সবার কাছে নিজের ভিন্ন এক অতীত তুলে ধরেছে সে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্যে তার কোনো সত্যের দরকার নেই। খুইন্যা বাবুল, বস্তির জীবন, কিশোর বয়সে একাধিক খুন-খারাবি, সবকিছু বাদ দিয়ে সে কেবলই তৌফিক আহমেদ, যার ডাক নাম বাবলু।
বন্ধুরা তার মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে সে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে, তার মা অনেক ছোটো বয়সে মারা গেছে। বাবা বিদেশে চাকরি করে। সেখানে এক ম্যামকে বিয়ে করেছে। তাই বাবার সাথে তার শীতল সম্পর্ক। তবে তার ভরণপোষণের সবকিছু করে বাবা। মাসে মাসে টাকা পাঠায়। এক চাচা এখন তার গার্জিয়ান।
মিথ্যের একটি জগত তৈরি করে সে তার সমস্যাসঙ্কুল অতীতকে ভুলে আছে।
সকাল আটটা থেকে দুপুর পর্যন্ত কলেজে দারুণ সময় কাটে তার। ক্লাশ শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর মেঘলার সাথে কাটানো সময়গুলো তাকে অন্য এক মানুষে পরিণত করেছে।
সামনে এইচএসসি পরীক্ষা, তারা সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। হাতে খুব বেশি সময় নেই। আর কদিন পর কলেজ বন্ধ হয়ে যাবে।
বাবলু আর তার এক বন্ধু মিলে কলেজের খেলার মাঠের এককোণে বসে পরীক্ষা নিয়ে কথা বলতে বলতে সিগারেট খাচ্ছে। তার এই অভ্যাসটা হয়েছে কলেজে ঢোকার পর থেকে কিন্তু মেঘলার ভয়ে ঠিকমতো সিগারেট খেতে পারে না কলেজে। মেয়েটা সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারে না। তিন-চারবার তার কাছে প্রতীজ্ঞা করেছে আর কখনও সিগারেট ছুঁয়েও দেখবে না। তারপরও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খায়। তা-নাহলে বন্ধুরা টিটকারী টিপ্পনী মারে। প্রেমিকার ভয়ে যে ছেলে সিগারেট ছেড়ে দেয় সে আবার কেমন পুরুষ?
তাই মেঘলার কাছে করা প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করে মাঝেমধ্যেই বন্ধুদের সাথে সিগারেট খায়। আজকেও তাই করছে। তার বন্ধু রনিকে নিয়ে খেলার মাঠের এককোণে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে সেটার নীচে বসে আরামে সিগারেট ফুকছে দু’জনে। আজ মেঘলা কলেজে আসে নি, এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না।
আরাম করে যখন রনির সাথে সিগারেট খাচ্ছে, সিগারেটের ধোয়ার রিং কেনফেশন, বানানোর ছেলেমানুষি খেলা খেলছে ঠিক তখনই তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো মেঘলা।
বাবলু তার নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারলো না। তার বন্ধু রনি আস্তে করে উঠে চলে যাবার সময় শুধু বলে গেলো : “দোস্ত, তোমাদের দাম্পত্য কলহের মধ্যে আমি নাই।”
কাচুমাচু খেয়ে মেঘলার দিকে চেয়ে রইলো বাবলু। মেয়েটা রাগে ফুঁসছে রীতিমতো। তার ফর্সা চেহারা লালচে হয়ে গেছে। এ নিয়ে পঞ্চম বারের মতো প্রতীজ্ঞা ভঙ্গ করা হলো।
“তুমি আবারো সিগারেট খাচ্ছো!” প্রায় কান্না জড়ানো কণ্ঠে বললো সে। “তুমি না আমাকে ছুঁয়ে প্রতীজ্ঞা করেছিলে আর কখনও সিগারেট খাবে না!”
বাবলু অপরাধী হয়ে বললো, “বিশ্বাস করো আজ সাতদিন পর এই একটা ধরিয়েছি!”
“তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আর কোনো দিন ওটা খাবে না।” রাগে ফুঁসে উঠলো মেঘলা। “আর কোনো দিন আমার সাথে কথা বলতে আসবে না। লায়ার!”
কথাটা বলেই মেঘলা চলে গেলে বাবলু তার পিছু নিলো।
“প্লিজ, আর খাবো না,” মেঘলার পেছন পেছন আসতে আসতে বললো সে। “প্লিজ, মেঘ…”
চট করে ঘুরে দাঁড়ালো মেঘলা। “এসব বানোয়াট নাম ধরে আমাকে ডাকবে না।”
“আচ্ছা, ডাকবো না,” বললো সে। “কিন্তু তোমার ঐ আনিকা তাবাসসুম দিলশাদ নামটা ধরেও ডাকতে পারবো না। কেমন জানি ভারিক্কি লাগে। মনে হয় মোটা গ্লাসের চশমা পরা অঙ্কের ম্যাডাম।” কথাটা বলেই হেসে ফেললো বাবলু।
“শাটআপ!” গর্জে উঠলো মেঘলা। “আবার হাসছো? লজ্জা করে না বার বার প্রমিজ করতে? এ নিয়ে কয়বার করলে, মনে আছে?”
কাচুমাচু খেলো বাবলু। “আসলে খুব মাথা ব্যথা করছিলোর তাই একটা খেতে ইচ্ছে করলো। বিশ্বাস করো, আমি চেষ্টা করছি সিগারেট ছেড়ে দেবার।”
“এই তোমার ছেড়ে দেবার নমুনা!”
“শোনো, একটা সত্যি বলি…”
“কি সত্যি?”
“সিগারেট এভাবে হুট করে ছাড়া যায় না, আস্তে আস্তে কমিয়ে দিতে দিতে ছাড়তে হয়।”
কৃত্রিম হাসি দিলো মেঘলা। “ও, তাই? কিন্তু আমি তোমার মতো আস্তে আস্তে না, এক কথায় ছেড়ে দিতে পারি।”
বাবলু অবাক। “তুমি ছেড়ে দিতে পারো…মানে?!”
“তোমাকে!” বলেই আবার গটগট করে হাঁটতে লাগলো সে।
“প্লিজ, কথা শোনো,” বলেই পেছন থেকে মেঘলার একটা হাত ধরে ফেললো সে।
ঘুরে দাঁড়ালো মেয়েটি। “হাত ছাড়ো!”
“ছাড়বো না,” মিটিমিটি হেসে বললো।
“বাবলু, আমার হাত ছাড়ো,” এবার খুব রেগে গেলো মেঘলা।
“না ছাড়লে মারবে নাকি?”
“আমি যে কী করবো তোমার কোনো আইডিয়াই নেই।”
ভুরু তুললো বাবলু। “বাপরে! কী করবে তুমি?”
“হাত ছাড়ো বলছি,” মেঘলা বেশ জোরে বললো কথাটা।
সঙ্গে সঙ্গে বাবলু তার হাতটা ছেড়ে দিলো কিন্তু মেঘলার মনে হলো তার ধমকের কারণে নয়, অন্য কোনো কারণে ছেড়ে দিয়েছে সে। বাবলুর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পেলো তিনজন যুবক তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এদের মধ্যে একজন এই কলেজের নেতাগোছের, বাকি দুজন তার ক্যাডার বাহিনীর সদস্য। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের এই নেতাকে সবাই বেশ সমীহ করে। সেই সমীহ আসে ভয় থেকে।
মেঘলা আর বাবলু একটু সরে দাঁড়ালো।
তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো নেতা, তার সঙ্গে দু’জন ক্যাডার। তিনজনই চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। নেতা কিছু বললো না, তার হয়ে একজন ক্যাডার ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো :
“ওই…মাইয়া মানুষের হাত ধইরা টানাটানি করোস ক্যান?”
বাবলু আর মেঘলা ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
অন্য যুবক নেতাকে দেখিয়ে বললো, “ভায়েরে দেইখা সালামও দিলো না! পুরা বেয়াদ্দপ!”
প্রথম যুবক আবার চেঁচিয়ে বললো, “ওই, তুই ভায়রে চিনোস না?”
বাবলু মাথা নেড়ে সায় দিলো। “জি, আমি উনাকে চিনি।”
অন্য যুবক তেড়ে এলো এবার। “ভায়েরে চিনলে সালাম দিলি না ক্যান?”
বাবলু কিছু বুঝতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো কেবল।
“এক থাপ্পর মাইরা বয়রা কইরা দিমু!” বলে উঠলো প্রথম যুবক।
নেতা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো। “কোন্ ইয়ারে পড়ো?”
“এইচএসসি ক্যান্ডিডেট।”
মেঘলার দিকে তাকালো এবার।
ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে সে। “আমিও…”
মাথা দুলিয়ে নেতা আক্ষেপের ভঙ্গি করলো। “সামনে ইন্টার পরীক্ষা আর তোমরা কিনা প্রেমপিরিতি কইর্যা বেড়াইতাছো! হাত ধইরা টানাটানি করতাছো। বাপ-মা কি এইজন্য কলেজে পাঠাইছে?”
“এইসব পোলাপান ভর্তি হইয়া কলেজটারে এক্কেবারে নষ্ট কইরা ফালাইছে, ভাই,” প্রথম যুবক বললো নেতাকে।
“আশ্চর্য, আপনারা এভাবে কথা বলছেন কেন? আমরা কী করেছি?” প্রতিবাদের সুরে বললো বাবলু।
রাজনীতি করা ছেলেগুলোর আঁতে ঘা লাগলো যেনো।
“ভাই, আমরা তো কারোর কোনো ক্ষতি করি নি। কেন আমাদের পেছনে লেগেছেন?”
বাবলুর এ কথা শোনার পর আর ঠিক থাকতে পারলো না তারা। প্রথম যুবক রেগেমেগে এক চড় বসিয়ে দিলো তার গালে। হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো সে।
“বেয়াদ্দপ! ভায়ের লগে কেমনে কথা কইতে হয় জানোস না?” দ্বিতীয়জন বললো।
বাবলু হকচকিয়ে গেলো। তার সারা শরীর রাগে কাঁপতে শুরু করেছে। মেঘলা যেনো প্রায় কেঁদেই ফেলবে। মুখে হাত চাপা দিয়ে রেখেছে সে।
“আপনি আমাকে চড় মারলেন কেন?” তেতে উঠলো বাবলু।
প্রথম যুবক যেনো বিশ্বাসই করতে পারলো না। সাধারণ ছাত্রছাত্রিদের কাছ থেকে তারা এরকম আচরণ প্রত্যাশা করে না। চড়থাপ্পড় খেয়ে মাথা নীচু করে চলে যাবে। টু শব্দটিও করবে না-এ হলো গ্রহণযোগ্য আচরণ।
আরেকটা চড় মেরে বসলো প্রথম যুবক। “থাপ্পড় মারুম না তো কি চুমা খামু?”
মেঘলা মিনতি করে বললো, “প্লিজ…ওকে মারবেন না। আমাদেরকে ছেড়ে দিন…প্লিজ।”
“চুপ! একদম চুপ!” ধমক দিয়ে বললো দ্বিতীয় যুবক।
অমনি রনিসহ বাবলুর আরো কয়েকজন বন্ধু দৌড়ে চলে এলো।
“ভাই স্লামালেকুম,” হাপাতে হাপাতে বললো রনি।
নেতা রনিকে চেনে। মাথা নেড়ে সালামের জবাব দিলো।
“ভাই, কি হয়েছে?”
“এই ছেলেটা তোমার বন্ধু নাকি?” নেতা বললো রনিকে।
“হ্যাঁ, ভাই। ওরা দুজনেই আমার বন্ধু।”
“এরা তো কলেজে প্রেমপিরিতি কইরা বেড়াইতাছে…ক্যাম্পাসে হাত ধইরা টানাটানি করে। পুরা বেলেল্লাপনা।”
রনি কাচুমাচু খেলো কথাটা শুনে।
“আবার মুখে মুখে তর্ক করে,” বাবলুর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বললো নেতা।
রনি নেতার দলের একজন কর্মী। ভালো খাতির আছে তার সাথে। “ও খুব ভালো ছেলে…বুঝতে পারে নি। ওরে আপনি মাফ করে দেন, ভাই,” অবশেষে বললো সে।
“ঠিক আছে, তুমি যখন বলো…আর যেনো এরকম কাজ না করে। সাবধান কইরা দিও। তোমার বন্ধুটা কিন্তু বেয়াদ্দপ আছে।”
বাবলুর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে নেতা তার দুই ক্যাডার নিয়ে চলে গেলো। এ যাত্রায় বন্ধুদের সাহায্যে রক্ষা পেলো তারা। চড় খাবার অপমান ভুলে কলেজ থেকে চলে গেলো মেঘলাকে নিয়ে।
পরদিন কলেজে ঢুকতেই দেখতে পেলো ঐ ক্যাডার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এই ছেলেটাই তাকে চড় মেরেছিলো।
বাবলুর চাহনিতে হয়তো এক ধরণের ক্ষুব্ধতা ছিলো। এটা পছন্দ হলো না ঐ ক্যাডারের।
“কিরে, চায়া আহোস ক্যান?” ক্যাডার ধমকের সুরে বললো তাকে। “এক্কেবারে চোখ গাইল্যা দিমু…চোখ নামা খানকিরপোলা?”
এই গালিটা সহ্য করতে পারলো বাবলু। মুহূর্তে সারা শরীরে কী যেনো বয়ে গেলো। খুন চেপে গেলো মাথায়। চোখেমুখে আগুন জ্বলে উঠলো।
ক্যাডারের আর সহ্য হলো না। তেড়ে এসে বাবলুর কলার ধরলো। “কাইলকার মাইর খাইয়া শিক্ষা হয় নাই, খানকিরপোলা?”
বাবলু আর নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ক্যাডার ছেলেটার বুকে ধাক্কা মেরে বসলো। চিৎ হয়ে পড়ে গেলো সে। মাটিতে পড়ে অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো বাবলুর দিকে। কোমর থেকে পিস্তল বের করতে উদ্যত হলে বাবলু ঝাঁপিয়ে পড়লো তার উপর। নিজের সমস্ত রাগ উগলে দিলো। ছেলেটার নাক-মুখ ফাটিয়ে অজ্ঞান করে দিলো নিমেষে।
তারপরই সম্বিত ফিরে পেলো সে। কলেজের ভেতরে থাকা ক্যাডারের সঙ্গিসাথিরা খবর পেয়ে ছুটে আসছে গেটের দিকে। বাবলু আর দেরি না করে দৌড়ে পালালো।
“ধর! ধরু!”
পেছন থেকে দশ-বারোজন ছেলের গালাগালি আর চিৎকার শুনতে পেলো সে কিন্তু দৌড় থামালো না। এমনকি পেছনে ফিরেও তাকালো না। ঐ ছেলেগুলো তাকে কতোক্ষণ তাড়া করেছিলো সে জানে না। অনেক দূর চলে আসার পর বুঝতে পারলো তার পেছনে কেউ নেই। হাফ ছেড়ে
বাঁচলো। সোজা চলে এলো হোস্টেলে।
নিজের রুমে এসে আবিষ্কার করলো তার শার্টে রক্তের দাগ লেগে আছে। বাথরুমে গিয়ে ধুয়ে এলো। মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে শুরু করলো, রাগের মাথায় যে কাজ করেছে তার পরিণাম কী হতে পারে।
তবে এটা নিশ্চিত, কয়েক দিন কলেজে যাওয়া হণে না। তার বন্ধু রনির সাথে যোগাযোগ করতে হবে। ওর সাথে ঐ ছাত্রনেতার বেশ ভালো খাতির। তাকে দিয়ে একটা আপোষরফা হয়তো করা যাবে।
যাইহোক, ঐ দিন আর হোস্টেল থেকে বের হলো না। সন্ধ্যাবেলা নিজের ঘরে ঘুমিয়ে আছে, হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে গেলো লোকজনের চিল্লাফাল্লার কারণে। বিছানায় উঠে বসতেই শুনতে পেলো হোস্টেলের ছেলেরা চিৎকার আর হৈহুল্লোর করছে।
বিছানা থেকে নামতেই ঘরের দরজা সশব্দে খুলে গেলো। দেখতে পেলো দশ-বারোজন যুবক ঢুকে পড়ছে তার ঘরে। কয়েক জনের হাতে হকিস্টিক, রড আর চেইন।
এদের সবাইকে সে চেনে। ঐ ক্যাডারের সঙ্গিসাথি।
ছেলেগুলো বাবলুকে ঘিরে ধরলো। একটু পরই ঘরে ঢুকলো কলেজের সেই ছাত্রনেতা। তার চোখেমুখে হিংস্রতা।
“আমার পোলাপানের গায়ে হাত উঠাইছে! এতো বড় আস্পর্ধা!” হুঙ্কার দিলো নেতা। “খানকিরগোলারে পিড়া!”
সঙ্গে সঙ্গে আট-দশজন ছেলে একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লে তার উপর। রড আর হকিস্টিক দিয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলো তারা। দু’হাত দিয়ে সব মার ঠেকানোর বৃথা চেষ্টা করে গেলো বাবলু। অতোগুলো ছেলের
সাথে পেরে ওঠার কথা নয়। একতরফা মার হজম করতে লাগলো সে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নাক-মুখ ফেঁটে একাকার। ডান চোখের ভুরুও কেটে গেলো। রক্তে ভেসে গেলো সারা মুখ। হাতে-পায়ে তীব্র ব্যথা হতে লাগলো।
জ্ঞান হারানোর আগপর্যন্ত দু’হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেলো বাবলু।
অধ্যায় ৪২
হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে বসে বাবলুর কাছ থেকে তার কলেজ জীবনের গল্প শোনার পর জেফরি বেগ কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকলো।
“ওরা তোমাকে খুব মারলো?” অবশেষে বললো সে।
“হুম।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো বাবলু, হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো কয়েক দিন। বন্ধুরাই ব্যবস্থা করেছিলো।”
“কয়দিন ছিলে?”
“তিন-চারদিন।”
“এ ঘটনা ঐ লোক জানতে পারে নি?”
জেফরির প্রশ্নটা বুঝতে পারলো সে। ইনভেস্টিগেটর অমূল্য বাবুর কথা বলছে। “না। আমি উনাকে জানাই নি। এমন কি বন্ধুদের বলে দিয়েছিলাম মেঘলাকেও যেনো না জানায়।”
জেফরি বেগ মুচকি হাসলো। “আচ্ছা, তাহলে মেয়েটার নাম মেঘলা?”
বাবলুর মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। মুচকি হেসে বললো, “আমি ছাড়া এই নামে তাকে কেউ ডাকতো না, কারণ এই নামটা আমি দিয়েছিলাম।”
ভুরু কুচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো জেফরি তারপর মাথা দোলালো। “মেঘলা কি এ ঘটনা জানতে পারে নি?”
“পরে জানতে পেরেছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনভেস্টিগেটর। “তারপর কি হলো?”
“হাসপাতাল থেকে রিলিজ হবার পরদিনই আমি ঐ নেতাকে খুন করি!”
“মাইগড!” জেফরি বেগের মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো কথাটা। “কিভাবে?”
“গুলি করে…”
“পিস্তল পেলে কোথায়?”
আবারো মুচকি হাসলো বাবলু। “আপনি ভুলে গেছেন, বাবার পিস্তলটা আমার কাছেই ছিলো। আমার কাপড়চোপড়ের ট্রাঙ্কে ওটা কেন রেখে দিয়েছিলাম জানি না। অনেক দিন পড়ে ছিলো। এই ঘটনার আগে একবারের জন্যেও ওটা হাতে নিয়ে দেখি নি। কিন্তু ওভাবে মার খেয়ে অপমানিত হবার পর আমার মাথায় খুন চেপে যায়। নিজের রাগ আর দমন করতে পারি নি।”
এমন সময় জামান আবার ইন্টেরোগেশন রুমে ঢুকে চুপচাপ বসে পড়লো।
“হ্যাঁ, বলো?”
“হোস্টেলে গিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেই। পিস্তলটা কোমরে খুঁজে বের হয়ে পড়ি। ওই নেতাকে দূর থেকে ফলো করি। তার সঙ্গে সব সময়ই কিছু সাঙ্গপাঙ্গ থাকতো। পুরোটা বিকেল আর সন্ধ্যা ফলো করার পর রাত দশটার দিকে তাকে একা পেয়ে যাই।” একটু থেমে আবার বললো, “ঐ নেতা ধারণাও করতে পারে নি আমার মতো সাধারণ একজন ছাত্র মার খেয়ে এমন প্রতিশোধ নিতে যাবে।”
“তুমি তাকে কোথায় মারলে?” জানতে চাইলো জেফরি বেগ।
“ফেন্সিডিল খাবার জন্য একটা আখড়ায় গিয়েছিলো সে। একদম একা ছিলো। আমি তাকে ফলো করে সেখানে চলে যাই। ওখান থেকে ফিরে আসার সময় একটা গলিতে তাকে একা পেয়ে গেলে আর দেরি করি নি। গুলি করে পালিয়ে যাই।”
“কেউ বুঝতে পারে নি খুনটা তুমি করেছো?”
মাথা দোলালো বাবলু। বার বার এটা হতে পারে না। এবার সবাই বুঝে গেলো খুনটা আমিই করেছি।”
“তারপর পুলিশ তোমার পেছনে লাগলো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু।
“তখন কি করলে?”
“কী আর করবো…পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম।”
“মেঘলার সাথে যোগাযোগ করো নি?”
“করেছি।”
“সব শুনে সে কী বললো?”
বাবলুর ঠোঁটে মৃদু হাসি। “মেঘলার কাছে আমি মিথ্যে বলতে পারি নি।” কথাটা বলেই মাথা নীচু করে ফেললো সে।
জেফরি বেগ কোনো কথা না বলে শুধু চেয়ে থাকলো তার সামনে বসা পেশাদার খুনির দিকে।
“তুমি তার কাছে স্বীকার করেছিলে এটা?” অবশেষে বললো সে। “হ্যাঁ।”
*
ছাত্রনেতাকে খুন করার পর পাঁচ-ছয়দিন কেটে গেছে, পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে বাবলু। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় শুধু তার নাম। উঠেপড়ে লেগেছে তারা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি আর স্থানীয় এমপি ঘোষণা দিয়েছে, খুনিকে যেভাবেই হোক গ্রেফতার করা হবে।
খুনের ঘটনার পর পরই মেঘলা সব জেনে যায় কলেজের বন্ধুদের কাছ থেকে। সে অনেক চেষ্টা করেছে তার সাথে যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু আজকের আগে বাবলুর পক্ষে দেখা করা সম্ভব হয় নি।
এখন সে বসে আছে গুলশান পার্কের একটি বেঞ্চে। তার পাশে মেঘলা। দেখা হওয়ার পর থেকেই নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে সে। এরকম একটি পরিস্থিতির জন্যে মেয়েটা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তার সমস্ত দুনিয়া যেনো ভেঙে পড়েছে।
“আমার মাথা ছুঁয়ে বলল, খুনটা কি সত্যিই তুমি করেছো?” কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো সে।
বাবলু মুখ তুলে তাকালেও কিছু বলতে পারলো না।
“চুপ করে আছো কেন? কথা বলো?”
“আমিই করেছি…” অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথাটা বলতে পারলো সে।
মেঘলার চোখেমুখে হতাশা নেমে এলো আবার। “আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আমার মাথা ছুঁয়ে বলো, প্লিজ!”
আস্তে করে মেঘলার মাথা ছুঁলো বাবলু।
হতাশায় যেনো ভেঙে পড়লো মেয়েটি। তার দু’চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো। “তুমি! তুমি খুন করেছো!”
বাবলু মেঘলার হাত ধরতে গেলে সে ঝটকা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো।
“তুমি আমাকে ছোঁবে না, প্লিজ!” কেঁদে কেঁদে বললো সে।
মাথা নীচু করে রাখলো বাবলু।
“হায় আল্লাহ! তুমি এটা কেন করতে গেলে? আমার কথা…তোমার কথা একবারও ভাবলে না?”
মেঘলার কষ্ট দেখে সে যারপরনাই যন্ত্রণার মধ্যে আছে এখন।
“পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। ধরা পড়লে কী হবে বুঝতে পারছো?”
বাবলু মুখ তুলে তাকালো এবার। “আমার কী হবে সেটা নিয়ে আমি ভাবছি না। আমার যা হবার তা হবে।”
মেঘলা বিশ্বাসও করতে পারলো না কথাগুলো বলছে তার ভালোবাসার মানুষটি।
“আজ তোমার সাথে আমি দেখা করতে রাজি হয়েছি অন্য একটা কারণে।”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো সে।
“আমি চাই না তুমি এসবের মধ্যে জড়িয়ে পড়ো।”
“তুমি কী বলতে চাচ্ছো?” বুঝতে না পেরে বললো মেঘলা।
চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো বাবলু। কথাটা বলতে তারও কষ্ট হচ্ছে। “তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। দেখা করা উচিতও হবে না।”
“বাবলু!” আৎকে উঠলো মেঘলা। “তুমি এসব কী বলছো?” কাঁদতে শুরু করে দিলো আবার।
“তোমার ভালোর জন্যেই বলছি,” আস্তে করে বললো সে।
মেঘলা শুধু কেঁদেই চললো।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।”
অধ্যায় ৪৩
পেশাদার খুনি এখন নিজের জীবনের সব কথা অকপটে বলে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো দ্বিধা কাজ করছে না। খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে জেফরি বেগ, কিন্তু সহকারী জামান যারপরনাই বিরক্ত। সে এসবের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে তার বস আজ এই খুনির সব কথা না শুনে ছাড়বে না।
বাবলুর জীবনের এক একটা ঘটনার কথা শুনছে আর অবাক হচ্ছে হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর। মানুষের জীবন কতোই না বিচিত্র। প্রত্যেকের জীবনে কতো গল্পই না আছে।
তার সামনে বসে থাকা খুনির জীবনটা কিভাবে একে একে বদলে গেলো সেটা এখন বুঝতে পারছে। এই ছেলেটা যদি এরকম পরিস্থিতিতে না পড়তো তাহলে হয়তো আট-দশজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই হতো। এমনকি সে হতে পারতো জেফরি বেগের মতো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন। খুনি না হয়ে খুনিদের ধরার কাজ করতো তখন।
এই খুনির সাথে তার পার্থক্য রচিত হয়েছে পরিবেশ আর পরিস্থিতির কারণে। নিয়তি হয়তো এভাবেই একেকজনের জীবন একেকরকম করে দেয়। কিন্তু এই নিয়তি জিনিসটা কী জেফরি বেগ জানে না। সে কখনও নির্দিষ্ট করে দেয়া নিয়তিতে বিশ্বাস করে না। এটা কি মানুষ নিজে সৃষ্টি করে? নাকি সমাজ, রাষ্ট্রে বসবাসরত সব মানুষের অজ্ঞাতসারে এটার জন্ম হয়?
তার ধারণা, নিয়তি আসলে সমগ্র মানুষের কর্মফলের একটি বাই প্রোডাক্ট। চক্রাকারে এটা আবার মানুষের কর্মকাণ্ড আর জীবন-যাপনে প্রভাব ফেলে। এভাবেই নিয়তির খেলা অব্যাহত আছে। মানবসভ্যতার অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত এটা চলবে।
মাথা থেকে এসব দার্শনিক চিন্তা ঝেড়ে ফেললো সে। “এরপর তুমি কী করলে? পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলে?” জিজ্ঞেস করলো জেফরি বেগ।
“হ্যাঁ,” বললো বাবলু। “এ শহরে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। বন্ধুবান্ধব বলতে যারা ছিলো তারা প্রায় সবাই কলেজের। ওদের পক্ষে আমাকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব ছিলো না। কয়েক দিন এখানে ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর পুলিশের কাছে ধরা পড়ে যাই।” একটু থেমে আবার বললো, “কিন্তু জেলে বেশি দিন থাকতে হয় নি…”।
অবাক হলো জেফরি বেগ। সরকারী দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকে হত্যা করার পরও জেলে বেশি দিন ছিলো না? ব্যাপারটা তো অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।
“…জামিনে বেরিয়ে আসি।” যেনো জেফরি বেগ কী ভাবছে সেটা বুঝে ফেলেছে সে।
“তোমাকে জামিন করালো কে?” অবাক হয়েই জানতে চাইলো ইনভেস্টিগেটর।
মৃদু হাসি ফুটে উঠলো বাবলুর ঠোঁটে। “আপনাকে তো আগেই বলেছি, আমার একজন মেন্টর ছিলো।”
“ও,” কথাটা মনে পড়তেই বলে উঠলো সে। “তুমি পুলিশের কাছে ধরা পড়ার পর উনি সব জানতে পারেন?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো বাবলু। “উনি খুব রেগে গেলেও আমাকে জামিনে বের করে নিয়ে আসেন।” একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “তারপর আমাকে অনেক বকাঝকা করলেন। জানিয়ে দিলেন, উনি আর আমার দেখভাল করবেন না। কোনো খুনির জন্য তার দরজা খোলা নেই। আমার পথ যেনো আমি নিজেই দেখি। অনেকটা অভিমান করেই এ কথা বলেছিলেন।”
“ভদ্রলোক খুব কষ্ট পেয়েছিলেন,” বললো জেফরি। “সেটাই স্বাভাবিক।”
“কষ্টের চেয়ে উনার হতাশাই ছিলো বেশি। আমাকে উনি নতুন জীবন দিয়েছিলেন আর আমি সেটা নিজের হাতে নষ্ট করে ফেলেছিলাম।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি বেগ। “তারপর তুমি কি করলে?”
“আমিও অভিমান করে তার সাথে আর যোগাযোগ না করে পুরনো। ঠিকানায় ফিরে গেলাম।”
“পুরনো ঠিকানা মানে?”
“বস্তিতে।”
“ওখানে তো তোমার কেউ ছিলো না…ওখানে কেন গেলে?”
“আমার এক বন্ধু ছিলো, ইরফান। ওর কাছে যাই।”
“যার সাথে এক হুজর খারাপ কাজ করেছিলো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ইরফান ছাড়া আর কেউ আমাকে আশ্রয় দেবার সাহস করে নি। আমি জানতাম ও তখন বস্তির হর্তাকর্তা হয়ে উঠেছে।”
“ওর কাছে কততদিন ছিলে?”
“তিন-চার মাসের মতো।” জেফরি বেগকে চুপ করে থাকতে দেখে বাবলু নিজে থেকেই বলতে লাগলো, “ইরফানের সঙ্গি হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। আমার কাছে একটা পিস্তল ছিলো, সুতরাং আমাকেও বস্তির লোকজন সমীহ করতো তখন। খুব দ্রুত আমিও বস্তির একজন হতাকর্তা হয়ে গেলাম।”
“ঐ ভদ্রলোক আর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে নি?”
“না। হয়তো উনি আমার এসব কথা জানতে পেরে আরো রেগে গেছিলেন।” একটু থেমে আবার বললো, “কিছুদিনের মধ্যেই বস্তিতে আমার নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়ে।” নিঃশব্দে হেসে উঠলো বাবলু। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। “লোকজন আড়ালে আবডালে আমাকে বাস্টার্ড বলে ডাকা শুরু করে তখন থেকে।”
“আচ্ছা, তাহলে সেখান থেকে তোমার এরকম নাম হলো?”
ইনভেস্টিগেটরের দিকে স্থিরচোখে তাকালো সে। “বস্তিতে ইরফানের দলে আরেকজন বাবলু ছিলো। ওকে সবাই হোন্ডা বাবলু বলে ডাকতো। ওর একটা হোন্ডা মোটরবাইক ছিলো।” একটু থামলো এবার। “আমার কোনো বাইক ছিলো না তবে আমার জন্ম পরিচয় নিয়ে সবার সন্দেহ ছিলো, তাই আমি হয়ে গেলাম…” বাঁকা হাসি হাসলো সে।
জেফরি বেগ চুপ মেরে গেলো। তারপর বস্তি ছেড়ে কোথায় গেলে? কেন গেলে?”
“লম্বা কাহিনী।”
জেফরি বেগ চেয়ারে হেলান দিলো। আমি আগেই বলেছি, আমার হাতে অনেক সময় আছে।”
কিন্তু আমার হাতে নেই, মনে মনে বললো বাবলু।
“আমার মনে হয় তোমার হাতেও যথেষ্ট সময় রয়েছে,” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বললো ইন্টেরোগেটর।
মুচকি হাসলো বাবলু। আমার হাতে অন্য কিছু আছে, মি: বেগ। তারপর আস্তে করে বললো, “আমি আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকে পড়ি।”
“হঠাৎ করে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কেন ঢুকে পড়লে?”
জেফরির দিকে চেয়ে রইলো বাবলু।
অধ্যায় ৪৪
বাবলু একটা পুরনো আমলের পরিত্যাক্ত বাড়িতে বসে আছে। এই বাড়িটা তাদের বস্তি থেকে বেশ দূরে। ইরফান আর তার দলের লোকজন এ জায়গাটাকে নিজেদের আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে।
আজ অল্পের জন্য বেঁচে গেছে সে। বস্তিতে পুলিশ রেইড দিয়েছিলো। আগে থেকে কিছুই আঁচ করতে পারে নি। হুট করেই পুলিশের গাড়িটা ঢুকে পড়ে তাদের বস্তিতে। ইরফানের এক ছেলে এসে যখন খবরটা দিলো তখন হাতে বেশি সময় ছিলো না। ভাগ্য ভালো, পুলিশ বস্তির অলিগলি ভালো করে চেনে না। পেছন দিকে যে খেলার মাঠটা আছে সেখান দিয়ে পালিয়ে গিয়ে এ যাত্রায় বেঁচে গেছে।
তার সাথে আছে ইরফানের এক ছেলে মাসুম। সে সিগারেট ফুকছে একটু দূরে বসে। বাবলু চুপচাপ বসে আছে। ভাবছে পুলিশ কেন তাকে ধরতে এলো? নতুন কোনো কেস হয়েছে নাকি তার বিরুদ্ধে? এরকম খবর তো তার জানা নেই। মাসুম ছেলেটাও কিছু জানে না। তবে সে বলেছে ইরফান এলেই সব জানা যাবে।
পনেরো-বিশ মিনিট পর ইরফান এলো সেখানে।
“ঘটনা কি?” তার কাছে জানতে চাইলো সে।
“দোস্ত, ঘটনা খুব খারাপ। তোমার জামিন বাতিল হয়া গেছে,” বললো সে।
জামিন? তারপরই মনে পড়ে গেলো, কলেজের ছাত্রনেতা খুনের মামলায় সে জামিনে আছে আজ কয়েক মাস ধরে।
বাবলুকে চুপ থাকতে দেখে বললো ইরফান, “লোকাল থানায় যে ইনফর্মার আছে…ঐ যে, বিহারী কাশেম…ও-ই আমারে কইলো।” একটু থেমে আবার বললো সে, “তুমি ধরা খায়া যাইবা। যে-কাম করছো…বাপরে! পুলিশ তো পাগল হইয়া খুঁজতাছে এখন। বস্তিতে থাকা ঠিক হইবো না।”
“তাহলে কোথায় থাকবো?” চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলো বাবলু।
“হুম…চিন্তার কথা।” একটু ভেবে নিলো ইরফান। “তোমার দরকার একটা শেল্টার।”
বাবলু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। এই শহরে তার কোনো আশ্রয় নেই। কে দেবে তাকে নিরাপদ আশ্রয়?
“আমার এক বড় ভাই আছে। খুব পাওয়ারফুল। পুলিশও হেরে ট্যাক্স দিয়া চলে। হের ওইখানে গেলে বাঁচবার পারবা।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বাবলু।
“পুরানা ঢাকায়…যাইবা?”
বাবলুর এখন অতো কিছু ভাবার সময় নেই। তার দরকার আশ্রয়। ইরফানের কথায় মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
*
“ইরফান তোমাকে ওখানে নিয়ে গেলো আর তারাও তোমাকে ঠাঁই দিয়ে দিলো?”
“দিলো।” ছোট্ট করে বললো বাবলু। তারপর ইনভেস্টিগেটরকে লক্ষ্য করলো কী যেনো ভেবে যাচ্ছে সে। মনে রাখবেন আমার কাছে একটা পিস্তল ছিলো আর ছিলো খুন করার রেকর্ড। এটা আন্ডারওয়ার্ল্ডে ক্রেডিট হিসেবে বেশ ভালোই কাজে দিয়েছিলো। খুব দ্রুতই আমি ওখানকার একজন হয়ে উঠি।”
“আর পলিশ? তারা কি করলো?”
“তারা আমাকে পুলিশের হাত থেকেও বাঁচিয়ে রাখে। টাকা-পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছিলো আর কি। ওখানে যোগ দেবার পর থেকে আমি নিশ্চিন্তে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতাম।”
“কোন্ আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকেছিলে সেটা কিন্তু বলে নি।”
মুচকি হাসলো বাবলু। “আমার মনে হয় না সেটা বলার দরকার আছে। আপনার দরকার গল্প…কেন যে বার বার নাম জানতে চাচ্ছেন!”
জেফরি বেগ মিটিমিটি হাসলো।
“হতে পারে আকবর শেঠ, হাসান মোল্লা, সহিদ চেয়ারম্যান কিংবা হাজী…” ইচ্ছে করেই থেমে গেলো বাবলু। মুচকি হাসি লেগে রইলো তার ঠোঁটে।
জেফরি বেগ মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ওখানে তোমার কাজটা কি ছিলো? খুনখারাবি করা?”
মাথা দোলালো আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাবেক সদস্য।
“তাহলে?”
“আমি ভায়ের বডিগার্ড ছিলাম।”
“বডিগার্ড!” মনে হলো জেফরি খুব অবাক হয়েছে। “তোমার জন্য একটু ছোটোখাটো কাজ হয়ে গেলো না?”
“মোটেই না,” জোর দিয়ে বললো সে। “বলতে পারেন আমার মত নতুন আর স্বল্পপরিচিত একজনের জন্য ওটা ছিলো অনেক বড় কাজ। এজন্যে পুরনোরা আমাকে হিংসে করতো।”
“এতো দ্রুত তোমার মতো একজন অপরিচিত ছেলে কিভাবে ভায়ের সুনজরে পড়লো?”
একটু চুপ করে রইলো সে। যেনো কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এটা সম্ভব হয়েছিলো ইরফানের কারণে। ওর সাথে ভায়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো। সম্ভবত আমার ব্যাপারে সবকিছু ভাইকে সে বলেছিলো। এজন্যে শুরু থেকে ভাই আমাকে অনেক স্নেহ করতেন।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি।
“আন্ডারওয়ার্ল্ডের জীবনটা ছিলো অন্যরকম,” বাবলু নিজ থেকেই বলতে লাগলো। প্রতিদিন এতো ঘটনা ঘটতে যে বুঝতে পারছি না কোটা রেখে কোন্টা বলবো।”
“তাহলে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি বলো?”
মুচকি হাসলো বাবলু। “ওখানে যোগ দেবার কিছুদিন পরই খুব খারাপ একটা ঘটনা ঘটে যায়…”
অধ্যায় ৪৫
পুরনো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে একচ্ছত্র অধিপতি হাসান মোল্লা। তার নিকটজন থেকে শুরু করে সবাই তাকে মোল্লা ভাই নামে সম্বোধন করে। এক সময় পুরনো ঢাকার আরেক গডফাদার আকবর শেঠের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই মোল্লা ভায়ের উত্থান কান্দুপট্টি নামক শত বছরের পুরনো বেশ্যাপাড়া থেকে। আকবর শেঠ খুন হবার দু’বছর আগে তাকে ঐ পল্লীর দায়িত্ব দিয়েছিলো। বেশ্যাপাড়া মানে শুধু বেশ্যাদের কারবার নয়, মাদক, জুয়া থেকে শুরু করে সব ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। হাসান মোল্লার বাড়ি এই বেশ্যাপাড়ার ঠিক পেছনেই। ওখানকার সব কিছুই তার নখদপর্নে। হয়তো এজন্যেই আকবর শেঠ তাকে পাড়ার দায়িত্ব দিয়েছিলো।
বেশ্যাপাড়া থেকে উত্থান হলেও হাসান মোল্লা নিজের প্রজ্ঞা, মেধা আর বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে দ্রুত হয়ে ওঠে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিতে।
বাবলু যখন কলেজের ছাত্র নেতাকে হত্যা করার পর হাসান মোল্লার দলে যোগ দেয় তখন পুরনো ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে একক আধিপত্য কায়েম করে ফেলেছে এক সময়কার আকবর শেঠের ঘনিষ্ঠ এই লোকটি।
প্রথম দিন থেকেই হাসান মোল্লা বাবলুকে খুব পছন্দ করে ফেলে। এটা হয়তো তার আচার-ব্যবহার, ভিন্ন রকম বক্তিত্ব কিংবা দেবদূতের মতো চেহারার কারণে। হতে পারে তার বাল্যবন্ধু ইরফানের কাছ থেকে সব শোনার পর তার প্রতি মায়া জন্মে গেছে।
মোল্লা ভায়ের ছত্রছায়ায় চলে যাবার পর পুলিশ আর বাবলুকে ‘ডিস্টার্ব’ করে নি। এখন নির্বিঘ্নে ঢাকা শহরে ঘুরে বেড়াতে পারে সে। দলের অনেকেই তাকে বলেছে পুলিশকে নাকি এজন্যে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছে ভাই। বাবলু খুব অবাক হয়েছিলো কথাটা শোনার পর। তার পেছনে এতো টাকা খরচ করা হলো কেন? দলে ঢোকার পর থেকে তো তাকে দিয়ে কোনো কাজই করায় নি।
ভায়ের বেশ ক’জন ক্যাডার আছে, যাদের আসল কাজ বডিগার্ড হিসেবে কাজ করা। ভাই যখনই বাইরে কোথাও যায় এদের সঙ্গে নিয়ে যায়। তবে বাবলু যোগ দেবার পর থেকে তাকেও সব সময় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে মোল্লা ভাই, যদিও সে তার বডিগার্ড নয়। দলের সবাই জানে, এই নতুন ছেলেটার প্রতি ভায়ের এক ধরণের অন্ধস্নেহ রয়েছে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডে যোগ দেবার এক বছর পরের ঘটনা। ভায়ের সাথে একদিন বাইরে গেলো সে, সঙ্গে চারজন ক্যাডার। সবাই তার বহুদিনের পুরনো আর বিশ্বস্ত। একটা মাইক্রোবাসে করে মিরপুরে এক রাজনীতিকের সাথে দেখা করে ফিরে আসার সময় ওখানকার মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের সামনে তাদের গাড়িটা থামলো। এখানে দোতলায় বিহারীদের একটি চুল কাটার সেলুন আছে। হাসান মোল্লা এখানে এলেই এক বিহারী নাপিতের কাছে চুল কাটায়, শেভ করে, শরীর ম্যাসেজ করায়।
সঙ্গে করে একজন বডিগার্ডকে নিয়ে দোতলায় চলে গেলো সে। বাকি তিনজন বডিগার্ডের সাথে বাবলু রয়ে গেলো নীচে পার্ক করা মাইক্রোবাসে।
বডিগার্ডদের মধ্যে একজন গাড়ির ড্রাইভার, বাকি দু’জন তাদের দলের বেশ পুরনো সদস্য। এদের একজন পান্না মিয়া। বয়স পঁয়ত্রিশ-চল্লিশের মতো হবে। সব সময় সিগারেট খায়। দলের জুনিয়ররা একে বেশ সম্ভ্রম করে চলে। মোল্লা ভায়ের বডিগার্ডদের নেতা সে। অন্যজন চিকা নামে পরিচিত। কেন যে তার এমন অদ্ভুত নাম বাবলু জানে না। অবশ্য দেখতে সে মোটেও চিৎকার মতো নয়, বেশ দশাসই শরীরের এক যুবক।
চিকা, পান্না আর মোল্লা ভায়ের সাথে যে ক্যাডার ছেলেটা গেছে সেই শামীমের কাছে অস্ত্র আছে। বাবলুকে অস্ত্র বহন করার অনুমতি দেয়া হয় নি এখন পর্যন্ত। কিন্তু সবার অগোচরে নিজের পিস্তলটা সব সময় নিজের কাছেই রাখে সে। পান্নাসহ বাকিরা এটা জানে না।
তো বাবলু মাইক্রোর ভেতরে কিছুক্ষণ থাকার পর বেরিয়ে এলো। গ্রীষ্মকালের ভ্যাপসা আবহাওয়া। বেশ গরম পড়েছে আজ। পান্না আর চিকা গাড়ি থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সিগারেট খাচ্ছে আর নীচুস্বরে কথা বলছে তারা। বাবলুকে গাড়ি থেকে বের হতে দেখে পান্না তাকে ইশারায় কাছে ডাকলো।
“কিরে, গাড়ি থিকা বাইর হইছোস ক্যান?” বললো সে।
দলের মধ্যে একমাত্র পান্নাই বাবলুকে তুই-তোকারি করে, আর কারোর এ কাজ করার সাহস হয় না। সবাই জানে ভায়ের খুব স্নেহভাজন সে।
“ভেতরে অনেক গরম,” শান্তকণ্ঠে বললো বাবলু।
“গাড়ির ভিতরে থাক। ড্রইভারে ক এসি চালু করতে। আমরা একটু আইতাছি।”
“কোথায় যান?”
বাবলুর এ প্রশ্ন শুনে পান্না আর চিকা কটমট চোখে তাকালো একসঙ্গে। ভায়ের লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠেছে এই ছেলেটা। কতো বড় আস্পর্ধা? তাদেরকে প্রশ্ন করে!
“কথাবার্তা হুঁশ কইরা কইবি,” রেগে বললো পান্না। “তোর মতো পোলাপানরে আমি ট্যাক্স দিয়া চলি না। গাড়ির ভিতরে যা! আমরা ফিরা না আসা পর্যন্ত বাইর হইবি না।” শেষ কথাটা বেশ ধমকের সাথে বললো সে।
বাবলু চুপ মেরে শুনে গেলো তার কথা। দেখতে পেলো পান্না আর চিকা চলে যাচ্ছে। মাইক্রোর কাছে ফিরে এলে ড্রাইভার আবুল তাকে কাছে ডাকলো।
“মন খারাপ কইরো না, ভাই, আহো, এসি ছাইড়া দিতাছি। দুইজনে মিলা গান হুনি।”
এসিটা ছেড়ে দিয়ে গাড়ির ক্যাসেটপ্লেয়ারে হিন্দি সিনেমার গান চালু করে দিলো। আবুল। বাবলু চুপচাপ মাইক্রোর গায়ে হেলান দিয়ে চেয়ে রইলো চিকা আর পান্নার দিকে। তারা এখনও দৃষ্টিসীমার মধ্যে আছে। চাপাস্বরে কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে।
একটু পরই দোতলা থেকে নেমে এলো আরেক বডিগার্ড শামীম।
“শামীম ভাই নীচে নামলো কেন?” বাবলু জানতে চাইলো ড্রাইভারের কাছে।
“ও,” হিন্দি গানের সাথে তাল ঠুকতে ঠুকতে শামীমকে দেখে নিলো সে। “ভায়ে মনে হয় পান খাইবো। এইহানে খুব ভালা খিলিপান পাওয়া যায়।”
বাবলু দোতলা মার্কেটের বাম দিকে তাকালো। ওখানে একটা পানের দোকান আছে কিন্তু শামীম সোজা চলে গেলো পান্না আর চিকা যেদিকে গেছে সেদিকে।
বাবলুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠলো। তার মনে হলো কিছু একটা হতে যাচ্ছে। খারাপ কিছু। মাইক্রোর গায়ে হেলান দিয়ে যখন এসব ভাবছে তখনই দেখতে পেলো সাদা রঙের আরেকটি মাইক্রো এসে থামলো মার্কেটের নীচে।
ওটা থেকে বেরিয়ে এলো তিন যুবক। একজন গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে বাকি দু’জনকে ইশারা করতেই তারা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করলো।
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো বাবলু। আন্ডারওয়ার্ল্ডে থেকে এ কয়দিনে সে বুঝে গেছে কার কোমরে অস্ত্র আছে আর কার সাথে নেই।
এইমাত্র গাড়ি থেকে যে তিনজন নেমেছে তাদের প্রত্যেকের কোমরেই অস্ত্র আছে! বাবলু একদম নিশ্চিত।
দ্রুত তার মাথাটা খেলে গেলো। বুঝতে পারলো কি হতে যাচ্ছে। কোমর থেকে পিস্তলটা বের করে দৌড়ে গেলো সাদা রঙের মাইক্রোবাসটার কাছে। গাড়ির কাছে যে যুবক দাঁড়িয়ে আছে তার দৃষ্টি দোতলার দিকে ছিলো, কিছু একটা টের পেয়ে পাশ ফিরে দেখতে পেলো পিস্তল হাতে ছুটে আসছে বাবলু। সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে পিস্তল বের করতে উদ্যত হলো সে কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। বাবলুর প্রথম গুলিটা তাকে ছিটকে ফেলে দিলো মাটিতে।
গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠলো চারপাশ। লোকজনের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেলো।
এতোক্ষণে দোতলায় উঠে গেছে ঐ দুই যুবক। ওরা রেলিংয়ের সামনে এসে নীচে তাকাতেই দেখতে পেলো বাবলুকে। এরকম পরিস্থিতির জন্য একদম প্রস্তত ছিলো না তারা। ঝটপট কোমর থেকে পিস্তল বের করে গুলি চালানোর আগেই নীচ থেকে পর পর দুটো গুলি করলো বাবলু। তার মধ্যে কোনো ভয়-ডর নেই। সাদা রঙের মাইক্রোবাসটার আড়ালে কভার নিয়েছে সে।
দোতলা থেকে দুই যুবক পাল্টা গুলি ছুঁড়তে শুরু করলে পুরো এলাকাটি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়ে গেলো চোখের নিমেষে।
গ্রিলের রেলিং কভার হিসেবে খুব একটা সুবিধা দিতে পারলো না। বাবলুর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গুলি দুটো ব্যর্থ হলেও চতুর্থ আর পঞ্চম গুলিতে ঘায়েল হলো ঐ দুই যুবক। একজনের কাঁধে আর অন্যজনের পেটে গুলি লেগেছে। মারাত্মক আহত তারা। পাল্টা গুলি করা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হলো না।
মাইক্রোর আড়াল থেকে এটা দেখতে পেয়ে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এলো সে।
আহত যুবকেরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাবলু তাদেরকে গুলি করে বসলো আবার। এবার খুব কাছ থেকে।
অস্ত্রধারী দুই যুবক নিস্তেজ হবার আগ পর্যন্ত তাদের দিকে পিস্তল তাক করে রাখলো। তারপরই কিছু একটা টের পেয়ে চমকে উঠে প্যাসেজওয়ের বাম দিকে তাকালো সে।’
এক গালে শেভিংক্রিম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাসান মোল্লা। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে বাবলুর দিকে। পুরোপুরি হতভম্ব।
“বাবলু!” মোল্লা ভায়ের মুখ দিয়ে কথাটা বের হয়ে গেলো।
“জলদি নীচে আসেন,” তাড়া দিলো সে।
“পান্না আর চিকা-”
মোল্লা ভায়ের কথাটা শেষ হবার আগেই শান্তকণ্ঠে বললো, “বেঈমানি করেছে, ভাই।”
“কি?” বললো হাসান মোল্লা। তার যেনো বিশ্বাসই হতে চাইছে না।
“জলদি আসেন?” আবারও তাড়া দিলো সে।
বাবলু আর মোল্লা ভাই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসতেই দেখতে পেলো দূর থেকে চিকা, পান্না আর শামীম দৌড়ে আসছে তাদের দিকে। সবার হাতেই অস্ত্র। ওদেরকে দেখে মোল্লা থমকে দাঁড়ালো। এখনও তার বিশ্বাস হচ্ছে না দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ লোকগুলো তার সাথে বেঈমানি করেছে।
বেঈমানিই যদি করবে তাহলে গোলাগুলির শব্দ শুনে ওরা ছুটে আসছে কেন?
বাবলু অধৈর্য হয়ে তাড়া দিলো, “ভাই! ওরা আপনার সাথে বেঈমানি করেছে!”
মাথা দোলালো হাসান মোল্লা। না। বাবলু নিশ্চয় ভুল বুঝছে ওদের।
“ভাই!” বাবলুর চিৎকারটার সঙ্গি হলো দু’ দুটো গুলির শব্দ। দুটোই অল্পের জন্য ব্যর্থ হয়েছে।
এবার আর মোল্লার বুঝতে বাকি রইলো না। তার নিজের লোকজন তার সাথে আসলেই বেঈমানি করেছে। প্রতিপক্ষের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে তারা। কিন্তু হাসান মোল্লা বেঁচে যাওয়াতে পরিস্থিতি বদলে গেছে। তাই নিজেরাই খুন করতে নেমে পড়েছে এখন।
মার্কেটের নীচে মোলা ভাই আর বাবলু পুরোপুরি অরক্ষিত এখন। তাদের দিকে অস্ত্র হতে ছুটে আসছে পান্না, চিকা আর শামীম। তারা আবারো গুলি চালালো।
মোল্লা ভাইকে আড়ালে করে সামনে এসে গুলি করতে শুরু করলো বাবলু। পান্নাদের গুলি যদি নিশানা খুঁজে পায় তাহলে তার বুক ঝাঁঝড়া হয়ে যাবে।
বাবলু পর পর আরো দুটো গুলি চালালে পান্না, চিকা আর শামীম কাছের একটি ট্রাকের আড়ালে চলে গেলো। সেখান থেকে পাল্টা গুলি চালালো তারা। এখন তাদের মধ্যেকার দূরত্ব বেশ কম। মোল্লা ভাই কী করবে বুঝতে পারলো না। গুলি দুটো যেনো তার কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো।
ঠিক এমন সময় তাদের মাইক্রোবাসটা ঝড়ের গতিতে চলে এলো বাবলু আর মোল্লা ভায়ের সামনে। আচমকা ব্রেক করাতে টায়ার আর মাটির ঘর্ষণ হলো। ক্ষণিকের জন্য পান্না, চিকা আর শামীমের বুলেট আড়াল করতে পারলো গাড়িটা।
বাবলু একটানে মাইক্রোর সাইড ডোরটা খুলে মোল্লা ভাইকে নিয়ে উঠে পড়লো। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার মাথা নীচু করে সিটের উপর পড়ে থাকলেও বাবলু জানালা দিয়ে পিস্তল বের করে শেষ দুটো গুলি ছুঁড়লো অস্ত্রধারীদের লক্ষ্য করে। ড্রাইভার আবুল দেরি করলো না, পূর্ণ গতিতে ছুটে চললো।
পান্না, চিকা আর শামীম মাইক্রোবাসটা লক্ষ্য করে অনেকগুলো গুলি চালালেও কোনো লাভ হলো না। আবুলের কৃতিত্বে খুব দ্রুত সটকে পড়তে পারলো তারা।
মাইক্রোটা যখন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলো তখন জানালা দিয়ে পান্না, চিকা আর শামীমকে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো বাবলু।
তারা বুঝে গেছে হাসান মোল্লা প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানে তাদের মুখোশ খুলে গেছে। তার মতো লোকের সাথে বেঈমানি করার শাস্তি কি হতে পারে সেটা তাদের চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
*
“এ তো দেখি সিনেমার গল্প।”
জেফরি বেগের কথায় বাঁকা হাসি দিলো বাবলু। “সিনেমায় যা দেখানো হয় তারচেয়ে বাস্তব আরো বেশি কঠিন।”
“এরপর ওদের কি হলো?” জিজ্ঞেস করলো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।
“পান্নাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। সে হয়তো বিদেশে চলে গেছিলো।”
“আর বাকি দু’জন?”
“শামীম এক সপ্তাহের মাথায় খুন হয়ে যায়। চিকা খুন হয় আরো একমাস পর।“
“কাজটা কি তুমি করেছিলে?”
বাঁকা হাসি হাসলো সে। “আপনি এখনও সিনেমার মতো করে ভাবছেন, মি: বেগ। এসব কাজ করার জন্য ওখানে আরো অনেক লোকজন ছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “তা হয়তো ছিলো, কিন্তু তুমি তো দারুণ পারফর্মেন্স দেখিয়েছো…”
স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো বাবলু, “আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ে কথা বলতে আর ইচ্ছে করছে না।”
জামান ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো তার দিকে। এই খুনির আস্পর্ধা তো কম নয়! ধরা পড়ে সে এখন বন্দী, ইন্টেরোগেশন রুমে আছে অথচ ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে তার খেয়াল-খুশিমতোই সব চলবে।
জেফরি বেগ অবশ্য চাপাচাপি করলো না। প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো সে। “ওখানে কতোদিন ছিলে?”
“ঠিক করে বলতে পারবো না। তবে পাঁচ-ছয় বছর তো হবেই।”
“এই সময়টাতে আর মেঘলার সাথে তোমার দেখা হয় নি?”
একটু উদাস হয়ে বললো বাবলু, “ঐ ঘটনার তিন-চার বছর পর একবার খুব অল্প সময়ের জন্য আমাদের দেখা হয়েছিলো।”
“এই তিন-চার বছরে তোমাদের মধ্যে আর দেখা হয় নি?”
“না।”
“আশ্চর্য, তোমরা তো একই শহরে থাকতে, নাকি?”
“হ্যাঁ,” কথাটা বলে চেয়ারে হেলান দিলো সে। “একই শহরে থাকতাম কিন্তু ইচ্ছে করেই তার সাথে যোগাযোগ রাখি নি। কারণ আমার জীবনটা ততোদিনে পুরোপুরি বদলে গেছিলো।”
“তোমাদের দেখা হলো কোথায়?”
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।”
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে?”
“আমি জানতাম না মেঘলা ওখানে পড়ে।”
“ওখানে তুমি কি করতে গেছিলে?” জেফরি বেগ আরো কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
যেনো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। “একটা কাজে…”
অধ্যায় ৪৬
মোল্লা ভায়ের জীবন বাঁচানোর পর বাবলুর অবস্থান দ্রুত পাল্টে গেছে। সে হয়ে উঠেছে ভায়ের সবচাইতে ঘনিষ্ঠ লোক। আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদার নিজের ছেলের মতো তাকে স্নেহ করে। কোনো রকম খুনখারাবির কাজ তাকে দিয়ে করায় না।
দলের সবাই তাকে অন্য চোখে দেখে এখন। এই ঘটনার পর থেকে মোল্লা ভাই তাকে নিজের বাড়ির চিলেকোঠায় এনে রেখেছে। এর আগে অন্য কিছু ছেলের সাথে একটা বাড়িতে থাকতো সে।
বাবলুর বিরুদ্ধে যে মামলাটা ছিলো সেটা রাজনৈতিক মামলা দেখিয়ে তুলে নেবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে মোল্লা ভাই। সরকার দলের বিশাল বড় এক নেতার সাথে তার দহরম-মহরম সম্পর্ক। তার মাধ্যমেই কাজটা করা হয়েছে।
এখন পুরোপুরি মুক্ত বাবলু। এ শহরের যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে। আর একজন বিশ্বস্ত লোক হিসেবে ভায়ের সবচেয়ে গোপন কাজগুলো সে-ই করে। যেমন আজকের কাজটা।
গতকাল রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মোল্লা ভাই তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলো। একটা সহজ অথচ জরুরি কাজ করতে হবে তাকে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রনেতাকে দুটো পিস্তল দিয়ে আসতে হবে। কাজটা করার জন্য অনেক ছেলেপেলেই আছে দলে কিন্তু মোল্লা ভাই চায় নি অন্য কেউ কাজটা করুক। তাই বাবলুকে পাঠিয়েছে। কারণটা সে অবশ্য ধরতে পেরেছে-মোল্লা ভাই যে ঐ ছাত্র নেতাকে তলে তলে সাহায্য করছে এ খবরটা যেনো বাইরে চাউড় না হয়। বিশেষ করে সরকারী দল যেনো সেটা জানে। সেজন্যে নিজের সবচাইতে বিশ্বস্ত লোকটিকেই পাঠাতে চাইছে।
কথামতো গুলিভর্তি দুটো পিস্তল নিয়ে সকাল সকাল চলে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফুলার রোডের বৃটিশ কাউন্সিলের উল্টো দিকে একটি নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এখানেই ঐ ছাত্রনেতার হাতে দুটো জিনিস দিয়ে ফিরে যাবে।
দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করার পরই একটি মোটরসাইকেলে করে দু’জন চলে এলো তার কাছে। পেছনে বসা যুবক তার উদ্দেশ্যে শুধু বললো, “মোল্লা ভায়ের লোক?”
বাবলু মাথা নেড়ে সায় দিলো।
“দেন।”
“এখানে?” একটু অবাক হলো সে। রাস্তাটা যদিও নির্জন কিন্তু অস্ত্রের হাতবদলের জন্য মোটেও উপযুক্ত জায়গা নয়।
“সমস্যা নাই,” আশ্বস্ত করলো ছাত্রনেতা।
বাবলু কোমর থেকে দুটো পিস্তল বের করে নেতার হাতে তুলে দিতেই ঝটপট দুটো জিনিস নিজের কোমরে গুঁজে নিলো।
“মোল্লা ভাইরে আমার সালাম দিয়েন,” বললো নেতা। তারপরই মোটরসাইকেলটা সাই করে চলে গেলো।
আশেপাশে তাকালো বাবলু। রাস্তার উল্টো দিকে বৃটিশ কাউন্সিলের সামনে একটা খালি রিক্সা দেখতে পেলো। রাস্তাটা পার হতে গেলো সে। বাবলু যখন রাস্তার মাঝখানে ঠিক তখনই বৃটিশ কাউন্সিল থেকে বেরিয়ে এলো এক তরুণী। তার হাতে দু তিনটে বই।
রাস্তার মাঝখানেই থমকে গেলো বাবলু।
মেয়েটা তড়িঘড়ি করে রিক্সার কাছে আসতেই বাবলুকে দেখতে পেলো। দেখামাত্র সেও থমকে দাঁড়ালো। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে।
বাবলু টের পেলো তার বুকটা হু হু করে উঠছে।
আজ দু’তিন বছর পর মেঘলার সাথে তার দেখা হয়ে গেলো!
মেঘলা শুধু অস্ফুটস্বরে বলতে পারলো, “বাবলু!”
আজ এতোদিন পর মেঘলাকে দেখে তার ভালো লাগলেও মুখোমুখি হতেই একটা অস্বস্তিও জেঁকে বসলো তার মধ্যে।
তারা দু’জন ফুলার রোডের নিরিবিলি ফুটপাতে বসলো। আজ অনেক দিন পর মেঘলার শরীরের ঘ্রাণ টের পেলো সে। এ কয় বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে কিন্তু মেঘলার ঘ্রাণ আগের মতোই আছে। বুক ভরে মেঘলার ঘ্রাণ নিলো সে।
বাবলু তার জীবনের সে-সব সত্য কথা বলতে শুরু করলো যা মেঘলা কিংবা কলেজের বন্ধুরা জানতো না। তারা জানতো ভিন্ন একটি গল্প। সেটা একান্তই বাবলুর নিজের তৈরি।
খুইন্যা বাবুল। বস্তির জীবন। শিশু নিপীড়ককে খুন…সব কিছুই বলে দিলো। নিজের অতীত যতোই খারাপ হোক সেটা একান্তই নিজের। জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। একটা সুস্থ জীবনের জন্য এসব ভুলে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে এসেছে অন্যখানে। এখন কোনো কিছু লুকানোর দরকার নেই। সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে।
সব শোনার পর মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে রইলো মেঘলা। অনেকক্ষণ তারা দুজনে কোনো কথা বললো না।
“এতোদিন তুমি ঢাকা শহরেই ছিলে! অথচ একবারও আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করো নি,” অনেকক্ষণ পর মুখ খুললো মেঘলা। যেনো এইমাত্র শোনা গল্পটা ভুলে যেতে চাইছে সে।
বাবলু চুপ মেরে রইলো, এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেলো না।
“প্রতিদিন আমি অপেক্ষায় থাকতাম তুমি বুঝি আসবে। পত্রপত্রিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তাম কোথাও তোমার খবর আছে কিনা দেখার জন্য। এক পর্যায়ে ভেবেছি তুমি বোধহয় বিদেশ চলে গেছে। কিংবা…”
“মারা গেছি?” আস্তে করে বললো বাবলু।
“মিথ্যে বলবো না, কিন্তু বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও অনেক সময় এটা আমার মনে হয়েছে।”
মেঘলার দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। “তুমি আরো বেশি সুন্দর হয়েছে।”
মেঘলার মুখটা আরক্তিম হয়ে উঠলো। “আর তোমাকে দেখে চেনাই যায় না। তুমি অনেক বদলে গেছে, বাবলু।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “হুম। অনেক বদলে গেছি।”
“আমাকে দেখতে ইচ্ছে করতো না?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সে, “করতো। অনেক ইচ্ছে করতো।”
মেঘলা তার একটা হাত ধরলো। মেয়েটার স্পর্শ বাবলুকে কাঁপিয়ে দিলো ক্ষণিকের জন্য। কেমন জানি অবশ করা অনুভূতিতে আক্রান্ত হলো সে।
“আমি তোমাকে এখনও ভালোবাসি। তুমি এতোক্ষণ যা বললে তা যদি সত্যি হয়ে থাকে তারপরও আমি এ নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না।”
কথাগুলো বাবলুর কানে ঢুকলো না, যেনো সরাসরি বিদ্ধ হলো তার হৃদপিণ্ডে। সব কিছু জানার পরও মেয়েটা এ কথা কিভাবে বলছে! মেঘলাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাবার অদ্ভুত একটি ইচ্ছে জেগে উঠলো তার মধ্যে।
“আমারও খুব লোভ হয় তোমার ভালোবাসা পেতে,” অন্য দিকে তাকিয়ে কথাটা বললো সে। মেঘলার চোখের দিকে তাকাতে পারছে না এখন। “তোমার সাথে এ শহরে রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াতে…তোমার কাছাকাছি থাকতে…বিশ্বাস করো, প্রচন্ড লোভ হয়। কিন্তু আমি তো তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি! তোমার জীবনটা নষ্ট করি কিভাবে, বলো?” মাথা দোলালো বাবলু। “এটা আমি করতে পারি না।”
মেঘলা তার হাতটা শক্ত করে ধরলো। “তাহলে ফিরে আসো?”
মাথা দোলালো আবার। “সম্ভব না।”
“চেষ্টা করলেও কি এই পথ থেকে ফিরে আসতে পারবে না?” আকুতি নিয়ে বললো মেয়েটা।
বাবলু কোনো জবাব দিলো না। সে বুঝতে পারছে তার অতীত জীবনের কথা শুনে মেঘলার মধ্যে প্রচণ্ড সহানুভূতি তৈরি হয়েছে। অথচ সে আশা করেছিলো একেবারেই উল্টো কিছু।
“আর কারোর জন্য না হোক, আমার জন্য এটা করতে পারবে না?” বাবলুর মুখটা ধরে তার দিকে ফেরালো সে।
দু’চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিলো। “যদি পারতাম তাহলে অনেক আগেই করতাম,” অবশেষে বললো। “বিশ্বাস করো, শুধু তোমার জন্যেই করতাম!”
মেঘলার চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। “তাহলে এখন করো!” আকুল হয়ে বললো সে।
বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো বাবলুর ঠোঁটে। “দেরি হয়ে গেছে, মেঘ। অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
মেঘলা তার জামার হাতা শক্ত করে ধরে রাখলো। তার চোখে অশ্রু।
“আমি কী করে তোমার জীবনটা নিয়ে জুয়াখেলা খেলবো!”
মেঘলা কিছু বলতে পারলো না। শুধু অশ্রুপাত করে চললো। বাস্তবতা সেও বোঝে। কিন্তু তার মন মানতে চাইছে না।
“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি!”
মেঘলার কান্নাভেজা কথাটা শুনে বাবলুর চোখও ছলছল করে উঠলো।
“আমার ভাগ্য, তোমার মতো একজন আমাকে ভালোবাসে।” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “আমিও তোমাকে ভালোবাসি…আর সেজন্যে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে আমাকে।”
নিঃশব্দে কেঁদে চললো মেয়েটি।
“তুমি বিয়ে করবে, তোমার ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে…সুন্দর একটা সংসার হবে…”
“চুপ করো!” মেঘলা আর সহ্য করতে পারলো না।
“আমি হয়তো তখন অন্য কোথাও থাকবো…অনেক দূর…কিন্তু এটা জেনে সুখি হবো, তুমি ভালো আছো।”
“না, না…” তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করলো সে। “তুমি কোথাও যাবে না। কোথাও না!”
*
ইন্টেরোগেশন রুমের থমথমে পরিবেশে জেফরি বেগের চাপা দীর্ঘশ্বাসটিও বেশ জোরে শোনালো।
“এরপর মেঘলার সাথে আর দেখা হয় নি?” জিজ্ঞেস করলো ইনভেস্টিগেটর।
তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালো বাবলু। “না।”
“তাই?”
“হ্যাঁ।” জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করলো সে।
জেফরি বেগ কপালের এক পাশটা চুলকে বললো, “আমার অবশ্য তা মনে হচ্ছে না। একই শহরে ভালোবাসার মানুষটি থাকবে অথচ দেখা হবে না…” মাথা দোলালো সে, “খুব কঠিন।”
বাবলু কোনো জবাব দিলো না।
“এবার বলো, যে লোক তোমার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, সেই লোকের সাথে কি তোমার আর কখনও দেখা হয় নি?”
“হয়েছিলো। অনেক দিন পর।”
“কে দেখা করেছিলো? তুমি নাকি ঐ ভদ্রলোক?”
“আমি।”
“ভদ্রলোক তোমাকে দেখে কী বললেন?”
“খুব বেশি কিছু বলতে পারেন নি।”
“কেন?”
“বলার মতো অবস্থা ছিলো না উনার!”
“মানে?” জেফরি বেগ বুঝতে পারলো না।
“আমি তখন আন্ডারওয়ার্ল্ড ছেড়ে একা একা কাজ করতে শুরু করেছি-”
কথার মাঝখানে বলে উঠলো জামান, “ইউ মিন, প্রফেশনাল কিলার?”
জামানের দিকে তাকিয়ে জেফরির দিকে ফিরে বললো বাবলু, “হ্যাঁ।” মুক্ত হাতটা দিয়ে মাথার চুল ব্রাশ করে নিলো সে। “একদিন পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম উনি গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন। অবস্থা খুব খারাপ।”
জেফরি বেগ নড়েচড়ে বসলো। “ওই ভদ্রলোককে কারা গুলি করেছিলো?”
“পত্রিকাগুলোর রিপোর্টে সন্দেহ করা হয়েছিলো উনার এক ব্যবসায়িক পার্টনারের কাজ এটা। তাদের সন্দেহ অবশ্য ভুল ছিলো না।”
“তুমি তখন হাসপাতালে গিয়ে উনার সাথে দেখা করলে?”
“হ্যাঁ।”
“উনি জানতেন তুমি একজন প্রফেশনাল খুনি হয়ে উঠেছো?”
“মনে হয় জানতেন।”
অধ্যায় ৪৭
পত্রিকায় খবরটা পড়ার পর থেকে অস্থির হয়ে উঠেছে বাবলু। সকাল থেকে এই অস্থিরতা। অবশেষে ঠিক করলো হাসপাতালে যাবে। দেখা করবে তার সাথে। সে জানে হাসপাতালে গেলেই দেখা করা যাবে না। আততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে যখন সেখানে অবশ্যই পুলিশি প্রহরা থাকবে। তারপরও নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো সে। হাসপাতালে যাবার আগে অন্য একটা জায়গায় গেলো। তাকে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে।
এক ঘণ্টা পর বাবলু হাসপাতালে ঢুকতেই সালাম পেতে শুরু করলো। এটা শুরু হলো মেইন গেট থেকে।
ডাক্তারের অ্যাপ্রোন আর গলায় টেথিস্কোপ। বাবলু এখন এই প্রাইভেট হাসপাতালের একজন ডাক্তার। চোখে যে চশমাটা আছে সেটার কাঁচের কোনো পাওয়ার নেই। তবে তাকে খুব মানিয়েছে। মাথার চুল পরিপাটি করে আচড়ানো। তাকে দেখে কিছু নার্সও সালাম দিলো।
করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবলুর মনে হলো হাসপাতালে ঢোকার চেয়ে সহজ কাজ আর নেই। তুমি শুধু ডাক্তার হয়ে যাবে। ব্যস! হাসপাতালের দরজা খুলে যাবে তোমার জন্য।
অমূল্য বাবু কতত নাম্বার কেবিনে আছে সেটা খুঁজে বের করতে বেগ পেতে হলো না। যদিও হাসপাতালের পেশেন্টদের তালিকায় ভদ্রলোকের নাম নেই। বাবলু ধরেই নিয়েছে কোনো লাক্সারি কেবিনে থাকবে গুলিবিদ্ধ এই রোগি। চারতলায় অনেকগুলো কেবিন আছে। কয়েকটা কেবিনের সামনে দিয়ে ধীরপায়ে হেঁটে গেলো। শেষমাথার একটি কেবিনের সামনে পুলিশের এক কনস্টেবলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বুঝে গেলো সে। বেশ রাশভারি মেজাজে ঐ কনস্টেবলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
অল্পবয়সী এক যুবক। সদ্য পুলিশে ঢুকেছে। তাকে আর কিছু করতে হলো না কারণ একটা টুলের উপর বসে ঝিমুচ্ছে সে।
মুচকি হেসে সোজা দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো বাবলু। তার কাজটা একেবারে সহজ হয়ে গেলো।
ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেলো বেডে শুয়ে আছে বাবু। হাতে সেলাইনের নিড়ল। একেবারে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। এমনিতেই ভদ্রলোক হালকা পাতলা, তার উপর প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে আরো রোগা হয়ে গেছে।
নিঃশব্দে বেডের কাছে এগিয়ে গেলো বাবলু।
বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মৌব্রত পালনকারী ভদ্রলোক।
বেডের পাশে একটা চেয়ার দেখতে পেলো সে। চুপচাপ সেই চেয়ারে বসে পড়লো। কী করবে বুঝতে পারলো না। তার কাছে মনে হলো নিথর অমূল্য বাবু যেনো শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলতে ভদ্রলোকের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। পত্রিকার ভাষ্যমতে, মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।
প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাবার পরও অমূল্য বাবুর কোনো সাড়া-শব্দ পেলো না। উঠে দাঁড়ালো বাবলু। এভাবে এখানে বসে থাকার কোনো মানে হয় না।
দরজার দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেলো অস্ফুট স্বরে কেউ তাকে ডাকছে। প্রথমে ভাবলো এটা তার মনের ভুল। কিন্তু বেডের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো বাবু চোখ খোলার চেষ্টা করছে। ঠোঁট দুটোও একটু নড়ছে যেনো।
তার মুখের কাছে ঝুঁকে পড়লো সে। অমূল্য বাবু তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে।
“বাবলু!” একেবারে দুর্বল কণ্ঠে বললো ভদ্রলোক।
তার একটা হাত ধরলো ভদ্রলোক।”কেমন আছো?” খুব অবাক হলো সে। “ভালো আছি।” শুধু এটুকুই বলতে পারলো।
কথাটা শুনে মুচকি হাসলো বাবু, তারপরই চোখ বন্ধ করে ফেললো। আবার।
আস্তে করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো বাবলু। ছোট্ট শিশুর মতো আবার ঘুমিয়ে পড়লো অমূল্য বাবু।
*
“উনি কী করে বুঝলেন তুমি এসেছো?”
জেফরি বেগের এ প্রশ্নে ঠোঁট উল্টালো বাবলু। “জানি না। তবে ভদ্রলোক অনেক অদ্ভুত। রহস্যময়ও বলতে পারেন।”
“হুম, তাই তো মনে হচ্ছে,” কথাটা বলেই পাশে বসা জামানের দিকে তাকালো জেফরি। ছেলেটা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। এই খুনির কনফেশন শুনতে তার একটুও ভালো লাগছে না। পুরো ব্যাপারটাই তার কাছে অহেতুক বলে মনে হচ্ছে।
জেফরি আবার ফিরলো সামনে বসা খুনির দিকে। তারপর কি করলে?”
“হাসপাতাল থেকে চলে আসার দুদিন পর উনার এক ব্যবসায়িক পার্টনার অজ্ঞাত সন্ত্রাসীর গুলিতে খুন হয়ে যায়!” কথাটা বলে বাঁকা হাসি হাসলো সে।
মাথা দোলালো ইনভেস্টিগেটর। “কাজটা তুমিই করেছিলে।”
এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না বাবলু, শুধু নিঃশব্দে হাসলো।
জেফরি বেগও আর চাপাচাপি করলো না। “উনি কি পুরোপুরি সুস্থ হতে পেরেছিলেন? আই মিন, রিকভার করতে পেরেছিলেন?”
“হ্যাঁ। খুব দ্রুত। এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে উনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।”
“সুস্থ হবার পর তুমি উনার সাথে দেখা করো নি?”
“করেছি।”
“উনি বুঝতে পেরেছিলেন তুমি তার ব্যবসায়িক পার্টনারকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছো?”
“অবশ্যই। উনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।”
“ব্যাপারটা উনি কিভাবে নিয়েছিলেন?”
“এ নিয়ে আমাকে কোনো দিন কোনো প্রশ্ন করেন নি। আমার কাজে খুশি হয়েছিলেন নাকি হন নি সেটা বুঝতে পারি নি।” একটু থেমে আবার বললো, “তবে সুস্থ হবার পর এক বিকেলে আমি তার সাথে দেখা করতে গেলে উনি অনেক কথা বলেছিলেন আমাকে। তার মধ্যে একটা কথা হয়তো ছিলো আমাকে ইঙ্গিত করে।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো জেফরি।
“উনি বলেছিলেন, মানুষ নিয়তির দাস নয়। তবে প্রত্যেকের জন্য অনেকগুলো নিয়তি বরাদ্দ থাকে। কেউ জেনেবুঝে বেছে নেয়, কেউ বেছে নেয় না বুঝে।”
জেফরি বেগ চুপ মেরে রইলো কিছুক্ষণ।
একটা হাই তুললো বাবলু। “উনার মতে আমি না বুঝেই আমার নিয়তি বেছে নিয়েছি।”
“আমি অবশ্য নিয়তিতে বিশ্বাস করি না,” বললো জেফরি। “আমি বিশ্বাস করি মানুষ তথাকথিত নিয়তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। নিজের নিয়তি নিজেই সৃষ্টি করতে পারে।”
বাবলু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো। “সৃষ্টি করতে পারে না…বেছে নিতে পারে।”
জেফরি আর এ নিয়ে কিছু বললো না। “ঐ ঘটনার পর থেকে ভদ্রলোকের সাথে নিশ্চয় তোমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো?” প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললো হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটর।
মুচকি হেসে বললো সে, “আপনি বেশ বুদ্ধিমান, মি: বেগ,” একটু থেমে আবার বললো, “আপনার কৌতূহল আরেকটু বাড়িয়ে দিচ্ছি।” একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো। “উনার সাথে আমার এখনও যোগাযোগ আছে। আর উনি যখন জানবেন আমি ধরা পড়ে গেছি তখন যেভাবেই হোক আমাকে জেল থেকে বের করে আনবেন। উনার ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই।”
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো জেফরি বেগ। তারপর হেসে বললো, “মনে হচ্ছে এবার তার ক্ষমতা সম্পর্কে শুধু ধারণাই পাবো না, লোকটি কে সেটাও জানতে পারবো।”
বাবলু আবারও হাসলো। “আপনি কখনই সেটা জানতে পারবেন না।”
অধ্যায় ৪৮
টেলিফোনটা পাবার পর থেকেই ভেবে যাচ্ছে সে। কিছু একটা ঘটেছে কিন্তু সেটা কি বুঝতে পারছে না। এরকম পরিস্থিতি তার কাছে একদম অসহ্য লাগে, তাই বলে অন্য সবার মতো অস্থির হয়ে ওঠা তার স্বভাব নয়। জীবন থেকে যদি কোনো সত্যিকারের শিক্ষা নিয়ে থাকে তাহলে সে জানে ধৈর্য ধারণ আর ধীরস্থির থাকার কোনো বিকল্প নেই।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে কিংবা অনিবার্য মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ালেও সে এরকমই ধীরস্থির থাকবে।
কিন্তু সেও মানুষ, আর সবার মতো তারও আবেগ, ক্রোধ আর রিপুর তাড়না রয়েছে। সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। বরাবর তাই করে এসেছে। ঠিক এখন যেমন করছে।
অন্ধকার ঘরে একা বসে আছে আর গভীর করে দম নিচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করার মধ্য দিয়ে মানুষ যে কতো অসাধ্য সাধন করতে পারে সেটা প্রাচীণকাল থেকেই ভারতীয় সন্ন্যাসীরা জানতো। এটা শরীর এবং মনের উপর খুব দ্রুত আর কার্যকরী প্রভাব ফেলে।
আজ সকালে ম্যানেজার ভদ্রলোক যখন ফোন করে জানালো বাবলু আবারও রিসোর্টের বাইরে গেছে তখন ব্যাপারটাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। ওই সময় বেশ কয়েকজন রাজনীতিকের সাথে মিটিঙে ছিলো। ভেবেছিলো ম্যানেজার বুঝি নিছক রিপোর্ট করার জন্যই ফোন করেছে। “ঠিক আছে,” বলেই ফোনটা রাখতে গেছিলো, কিন্তু ওপাশ থেকে আরেকটা তথ্য জানানো হলে সে একটু ভাবনায় পড়ে যায়। রিসর্টে এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলো বাবলুকে!
কয়েক মুহূর্তের জন্য তার মনে হয়েছিলো ঐ মেয়েটার কথা, যার সাথে খুব গভীরভাবেই জড়িয়ে পড়েছে বাবলু কিন্তু পরক্ষণেই সেটা বাতিল করে দেয়। ছেলেটার নিজের সেলফোন আছে, মেয়েটা তাহলে ম্যানেজারের কাছে ফোন করবে কেন?
একটা অসঙ্গতি।
তারচেয়েও বড় কথা, বাবলু সেই ফোনটা পেয়ে তড়িঘড়ি রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যায় বাইকে করে। এখন প্রায় মাঝরাত হয়ে গেছে অথচ সে আর ফিরে আসে নি।
আজ সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলো, বাবলুর ব্যাপারটা নিয়ে ঠিকমতো ভাববার ফুরসত পায় নি। কয়েক ঘণ্টা আগে বাসায় ফিরে আসার পর তাকে কল করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তার ফোনটা বন্ধ।
আরেকটা বড় অসঙ্গতি।
একটু আগে ম্যানেজারের কাছ থেকে ঐ ইনকামিং কলটির নাম্বার কালেক্ট করে নিয়েছে। ঢাকা শহরের একটি ল্যান্ডফোন নাম্বার। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বারিধারার একটি আবাসিক নাম্বার এটি। এরইমধ্যে নাম্বারটি কার সেটাও জেনে নিতে পেরেছে। এহসান চৌধুরি নামের এক ব্যবসায়ির বাসা থেকেই কলটা করা হয়েছিলো।
এটুকু তথ্য জোগার করার পর আরো কৌতূহলী হয়ে ওঠে সে। দ্রুত একজনকে মাঠে নামায়। এরপর যা জানতে পারছে তাতে করে হিসেব আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
আজ সকালেই খুন হয়েছে এহসান চৌধুরির ড্রাইভার!
এক ধনী পরিবারের ড্রাইভার খুন হবার পরই মিসেস চৌধুরি বাবলুকে রিসোর্টে ফোন করে।
সে নিশ্চিত, ফোনটা মিসেস চৌধুরিই করেছে। কারণ তার সোর্স বলেছে ঐ বাড়িতে চাকরবাকর ছাড়া এহসান চৌধুরি, তার স্ত্রী আর তাদের এক সন্তান রয়েছে।
গত সপ্তাহে বাবলু এক এসিড সন্ত্রাসীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। ঐ বদমাশটা এক কিশোরী মেয়ের মুখ ঝলসে দিয়েছিলো। তার বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়, মেয়েটার সাথে বাবলুর কোনো সম্পর্ক আছে। এখন আবার আরেকটা মেয়ে তাকে ফোন করামাত্রই সে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে রিসোর্ট থেকে। এখনও ফিরে আসে নি।
ছেলেটা কোনো বিপদে পড়লো না তো?
তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে বাবলুর কিছু একটা হয়েছে। সে বিয়ে করে নি। সন্তানের প্রতি টান, মমত্ব কেমন সেটা জানে না। বাবা-মা নাকি সন্তানের অমঙ্গলের কথা আগেভাগেই টের পেয়ে যায়। কিন্তু সে জানে না তার এখন যেরকম অনুভূতি হচ্ছে ওরকম কিনা।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে।
গত সপ্তাহের ঐ ঘটনার পরই বাবলুর সাথে তার কথা হয়েছে। তাকে আবারো স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আর মাত্র একটা মাস পরেই সব কিছু ঠিকঠাক করে ফেলা হবে। বর্তমান সরকার আগের সব সরকারের মতোই রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা তুলে নেয়ার নামে পাইকারীভাবে হাজার হাজার মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাজটা অনেক আগেই করা হতো কিন্তু পত্রপত্রিকা-টিভি চ্যানেল আর বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু করে দেয়ায় একটু দেরি হয়ে যায়। তাকে আগেই বলা হয়েছিলো, এইসব হাউকাউ থেমে গেলেই সেটা করা হবে। গত সপ্তাহেই তাকে জানানো হয় সামনের মাসেই এই প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। তখন বাবলুর বিরুদ্ধে হাতেগোনা যে কয়টি মামলা রয়েছে সেগুলো প্রত্যাহার করা যাবে অনায়াসে। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি তাকে এ ব্যাপারে আশ্বাসও দিয়েছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা।
সবকিছু গুছিয়ে আনার পর বাবলু হঠাৎ করে এসব অদ্ভুত ঘটনায়
জড়িয়ে পড়ছে কেন? সে কি তীরে এসে তরী ডোবাবে?
গভীর করে আরো দশ বার নিঃশ্বাস নিলো।
মিসেস চৌধুরির সাথে বাবলুর কি সম্পর্ক? সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনায় ছেদ ঘটালো টেলিফোনের মৃদু বিপ। ডিসপ্লেতে দেখলো নাম্বারটা। কলটা রিসিভ করলো সে।
“বলো।”
ওপাশ থেকে শুনে গেলো চুপচাপ।
“ঠিক আছে।” ফোনটা রেখে দিলো। চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠলো তার কপালে।
কয়েক ঘণ্টা আগে এহসান চৌধুরির মেয়েকে অপহরণকারীদের হাত থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে!
অধ্যায় ৪৯
বাবলুর দিকে স্থিরচোখে চেয়ে আছে জেফরি বেগ। একটু আগে জামান আবারো তার দু’হাত পেছন মোড়া করে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দিয়েছে। এ সময় পেশাদার খুনির ঠোঁটে দুর্বোধ্য একটা হাসি দেখেছে সে।
জেফরি এখন জানে, পর্দার আড়ালে শক্তিশালী এমন একজন আছে যে বাবলুকে বার বার রক্ষা করে। কিন্তু সেই লোকটা যে কে তা বুঝতে পারছে না। সিদ্ধান্ত নিলো এ নিয়ে আর কথা বাড়াবে না। এতে করে হয়তো পেশাদার এই খুনি কথা বলার মেজাজ হারিয়ে ফেলতে পারে।
“আন্ডারওয়ার্ল্ড কেন ছাড়লে সেটা তো বললে না, আবারো প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো সে।
“ভাই মারা যাবার পর আমি আর ওখানে থাকি নি,” বললো বাবলু।
“সে কি খুন হয়েছিলো?”
মাথা দোলালো। “না। হার্ট অ্যাটাক।”
“ও,” জেফরি আর কিছু বললো না।
“প্রচুর মদ খেতেন…একরাতে একটু বেশিই ড্রিঙ্ক করে ফেলেছিলেন। ভোর রাতের দিকে হার্ট অ্যাটাক হয়। আমি নিজে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম।”
“হাসপাতালে নেবার আগেই মারা যায়?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“তোমার ভায়ের মৃত্যুর পর তার দলটাও নিশ্চয় ভেঙে যায়?”
“হ্যাঁ, দলের অনেকেই নিজেদের নেটওয়ার্ক তৈরি করে চাঁদাবাজি আর মাদক ব্যবসায় নেমে পড়ে।”
“আর তুমি নেমে পড়লে খুনখারাবিতে?”
জেফরি বেগের দিকে চেয়ে রইলো সে, তবে কিছু বললো না।
“এরকম একটা কাজ বেছে নিলে কেন?”
“আমি কিছুই বেছে নেই নি…” আড়ষ্ট ঘাড়টা দু’পাশে ঘুরিয়ে নিলো।
“তুমি বলতে চাচ্ছো এটাও ঘটনাচক্রে হয়ে গেছে?”
“যদি তাই বলি তাহলে সত্যি বলা হবে না।”
“সত্যিটা কি?”
মুচকি হাসলো বাবলু। “আপনি হয়তো মনে করছেন টাকা পেলে আমি যে কাউকে খুন করি, তাই না?”
জেফরি চেয়ে রইলো, কিছু বললো না।
“আন্ডারওয়ার্ল্ড ছাড়ার পর প্রথম খুনটা কিন্তু আমি টাকার বিনিময়ে করি নি…করার পর টাকা পেয়েছিলাম।”
ভুরু কুচকে তাকালো জেফরি বেগ। “সেই টাকা তুমি নিলে?”
“সবারই টাকার দরকার আছে, মি: বেগ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। “ঘটনাটা কি ছিলো?
“এই গল্পটা আসলে বলতে চাচ্ছি না।”
“কেন?” আরো বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠলো ইনভেস্টিগেটর।
“কারণ ওটার সাথে আমার ঐ মেন্টর জড়িত ছিলেন।”
জেফরি বেগ চুপ মেরে গেলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, “এই যে টাকার বিনিময়ে মানুষ হত্যা করো, তোমার বিবেক দংশন করে না?”
“আমি নির্বিচারে খুনখারাবি করি না,” শান্তকণ্ঠে বললো বাবলু।
“একটা বিবেচনাও কাজ করে নাকি?”
“করে,” ছোট্ট করে বললো সে।
জামান ঠোঁট ওল্টালো। “পেশাদার খুনির নীতি!” ভুরু তুলে বললো সে। অনেকক্ষণ পর যেনো কথা বলার মওকা পেয়েছে।
জামানের দিকে তাকালো বাবলু।
“নীতিটা কি?”
জেফরির দিকে ফিরলো আবার। “আমি যে কাউকে খুন করি না। যেমন, নারী-শিশু-পঙ্গু, নিরাপরাধ…”।
হোমিসাইডের চিফ ইনভেস্টিগেটরের বলতে ইচ্ছে করছিলো, তাহলে পক্ষাঘাতগ্রস্ত জায়েদ রেহমানকে মারলে কেন-কিন্তু সে কিছুই বললো না।
বাবলু স্থিরচোখে তাকালো তার দিকে। “ঐ লোকটা শিশু নিপীড়নকারী ছিলো…”
এ কথায় ভীষণ চমকে উঠলো জেফরি। সে কি থট রিডিং করতে পারে নাকি! মনে মনে বললো সে।
বাবলু নিঃশব্দে হাসছে।
জেফরির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “তার মানে যে কেউ তোমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসলেই তুমি রাজি হও না?”
“যে কেউ ইচ্ছে করলেও আমার কাছে ওরকম প্রস্তাব নিয়ে আসতে পারে না।”
আবারো অবাক হলো সে। “তাহলে কিভাবে আসতে হয়?”
“বিজনেস সিক্রেট!”
মাথা দোলালো জেফরি। তার নিজের কথাই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। “আচ্ছা।”
বাবলু শুধু মুচকি হাসলো।
জেফরি আর চাপাচাপি করলো না। সে জানে তাতে কোনো লাভ হবে না। “সবই তো বুঝলাম, কিন্তু এহসান চৌধুরির একমাত্র মেয়ের কিডন্যাপ কেসে তুমি জড়ালে কিভাবে?”
যথারীতি নিরুত্তর রইলো বন্দী।
“বুঝতে পারছি তুমি কিডন্যাপার দলের কেউ নও। বরং মেয়েটাকে উদ্ধার করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। আমি তো বলবো মারাত্মক ঝুঁকি। কিডন্যাপারদের সবাইকে খুনও করেছে। এদিক থেকে বলতে গেলে আমাদের কাজ অনেক সহজ করে ফেলেছে। কিন্তু কেন?”
“আমার গল্প বলা শেষ,” মুখটা অন্য দিকে সরিয়ে ফেললো সে।
“কিন্তু আমার গল্পটা তো এখনও শুরুই করি নি,” জেফরি বেগ বললো।
“আপনার গল্প?” ইনভেস্টিগেটরের দিকে অবাক হয়ে তাকালা সে।
“ঠিক আমার না। মেঘলার গল্প!” জেফরির চোখেমুখে অন্য রকম ইঙ্গিত।
ভুরু কুচকে চেয়ে রইলো বাবলু।
“মানে মিসেস চৌধুরির গল্প!”
“আমি জানি না আপনি এসব কী বলছেন?”
“আমিও তো জানতাম না মিসেস চৌধুরিকে কেউ এক সময় মেঘলা বলে ডাকতো!”
হা-হা-হা করে হেসে ফেললো সে। দু’পাশে মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, “হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেশনের পাশাপাশি সিনেমার গল্প লেখার কাজ করতে পারেন, মি: বেগ। আমি নিশ্চিত ওখানেও আপনি ভালো করবেন।”
“থ্যাঙ্কস ফর দি সাজেশন,” জেফরি বেগ হেসে বললো। কিন্তু সমস্যা হলো গল্পলেখকদের মতো আমার ইমাজিনেশন অতোটা স্ট্রং নয়। আমি গল্প বানাতে পারি না, শুধু টুকরো টুকরো ঘটনা যুক্তি আর প্রমাণের আঠা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে সত্যিকারের ঘটনাটি দাঁড় করাতে পারি।”
বাবলু কিছু বললো না, স্থিরচোখে চেয়ে রইলো।
“এহসান সাহেবের মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় কিডন্যাপ হলো…” জেফরি বলতে শুরু করলো। “…তার ড্রাইভার কিডন্যাপারদের গুলিতে মারা গেলো। আমরা তদন্তে নেমে জানতে পারি বাচ্চাটাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। মেয়েটার বাবা-মা আমাদের কাছে স্বীকার করে নি এটা। কিছুটা তদন্ত করতেই বুঝতে পারি আসলে ড্রাইভারের খুনটা নিছক দুর্ঘটনা। কিডন্যাপারদের কাজে বাধা দেবার জন্যেই তাকে খুন করা হয়েছিলো।”
বাবলু বিরক্ত হবার ভান করলো। “আপনি আমাকে এসব গল্প বলছেন কেন?”
“কারণ মিসেস চৌধুরি তার মেয়েকে কিডন্যাপ করার কথা পুলিশকে না জানিয়ে এমন একজনকে জানায় যে একসময় তার…” একটু থামলো জেফরি। “…অবশ্য এজন্যে আমি মিসেস চৌধুরিকে দোষ দেই না। তিনি ভালো করেই জানতেন কিডন্যাপাররা মুক্তিপণ নেবার পর তার মেয়েকে মেরে ফেলতো। আজকাল তো এরকমই হয়ে আসছে, তাই না?”
বাবলু কিছু বললো না। মুখটা অন্য দিকে সরিয়ে রাখলো।
“ভদ্রমহিলা বেশ দারুণভাবে কিডন্যাপারদের সাথে ডিল করে গেছেন,” স্থিরচোখে চেয়ে বললো সে। “আমি মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ভেবেই পাচ্ছিলাম না অপহৃত সন্তানের মা হিসেবে এতোটা মানসিক শক্তি কোত্থেকে পেলেন।”
বাবলুও স্থিরচোখে চেয়ে রইলো তার সামনে বসে থাকা ইনভেস্টিগেটরের দিকে।
“এখন অবশ্য আন্দাজ করতে পারছি কে তাকে সাহস আর বুদ্ধি জুগিয়ে গেছে।”
মুচকি হাসলো বাবলু। যেনো জেফরি বেগের কথাগুলো অর্থহীন শোনাচ্ছে তার কাছে।
“মিসেস চৌধুরি যার শরণাপন্ন হয়েছিলো সে এখন আমার সামনেই বসে আছে।”
“আপনার যা খুশি ভাবতে থাকুন।”
“আমার দিক থেকে যা খুশি ভাবার কোনো সুযোগ নেই, মি: বাবলু! তুমি অস্বীকার করতে পারো কিন্তু আমার কাছে শক্ত প্রমাণ আছে!”
ভুরু কুচকে তাকালো সে। “প্রমাণ?”
“তুমি অনেক সতর্ক। আনরেজিস্টার্ড সিম ব্যবহার করো সব সময়। তোমার মোবাইলফোনে কোনো নাম্বার পর্যন্ত স্টোর করা নেই। একদম ফাঁকা। কিন্তু একটা নাম্বার থেকে তোমাকে কয়েকবার কল করা হয়েছে, তুমিও ঐ নাম্বারে কল করেছে।”
বাবলু স্থিরচোখে চেয়ে রইলো।
“তোমাকে ধরার কিছুক্ষণ পর তোমার মোবাইলে একটা কল আসে। এক ভদ্রমহিলা ফোন করেছিলো। কিন্তু আমার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে লাইন কেটে দেয়। আমরা ঐ ফোনকলটা ট্র্যাকডাউন করলেই জানতে পারতাম ফোনটা কোত্থেকে করা হয়েছিলো কিন্তু তার আর দরকার পড়ে নি।”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো বন্দী।
“ভুলে যাচ্ছো কেন, তুমি একজন সাক্ষীকে বাঁচিয়ে রেখেছো!”
সবুজের কথা বলছে? এই বদমাশটাকে খুন করার সুযোগ পায় নি। আন্ডারকস্ট্রাকশন ভবনের সামনে বাচ্চুর স্টেশনওয়াগনে হাত-পা-মুখ বেধে ফেলে রেখেছিলো সে।
মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি। তার মুখে হাসি। এবার যেনো বন্দীর মনের কথা সে পড়ে ফেলতে পেরেছে। “তোমার পকেট থেকে তার মোবাইলফোনটাও পেয়েছি আমরা।”
বাবলু চুপ মেরে রইলো।
“অপারেশনে নামার আগেই আমরা জেনে গেছিলাম চৌধুরি সাহেবের কাজের লোক সবুজ এ-ঘটনার সাথে জড়িত।
মেনে নেয়ার ভঙ্গিতে মাথাটা নীচু করে রাখলো সে।
“আমরা তাকেও উদ্ধার করেছি। বাকিটা ওর কাছ থেকেই জেনেছি।”
.
জামানের দিকে তাকালো সে। ছেলেটা বাঁকা হাসি হাসলো। “কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি অন্য একটা কথা ভেবে…”
মুখ তুলে তাকালো বাবলু।
“কিডন্যাপারদের এতো দ্রুত কিভাবে খুঁজে বের করলে? আর বাড়ির কাজের ছেলে যে জড়িত ছিলো সেটাই বা কি করে জানতে পারলে? আমাদের কাছে না হয় অনেক ইন্সট্রুমেন্ট আছে, কিন্তু তোমার কাছে তো এরকম কিছু নেই।”
চুপ মেরে রইলো বন্দী।
“অবশ্য তোমার দুটো বাড়তি সুবিধা আছে যা আমাদের নেই,” তার হয়ে জেফরি বেগই বলতে লাগলো। “তুমি অপরাধজগতের অনেককেই ভালোভাবে চেনো। এখানকার আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্পর্কে তোমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।”
“আর দ্বিতীয়টা?” এবার প্রশ্ন করলো বাবলু।
“তুমি পুলিশের মতো টর্চার করার পদ্ধতি ব্যবহার করো না। পিস্তল ধরো। জিজ্ঞেস করো। ব্যস, হয়ে যায়। না হলে ক্লিক?” কথাটা বলেই হেসে ফেললো জেফরি। “মানছি, পদ্ধতিটা খুবই কার্যকর।”
কিছু বললো না বাস্টার্ড নামের পেশাদার খুনি।
“সবুজের সাথে ঠিক এ কাজটাই করেছিলে, তাই না?”
কোনো জবাব পাওয়া গেলো না।
“কিন্তু ছেলেটাকে কেন মেরে ফেললে না?”
বাঁকা হাসি হাসলো বাবলু। “কাজ শেষ হবার পর মারতাম।”
“বুঝতে পেরেছি,” একটু ভেবে বললো জেফরি। “কোনো ঝুঁকি নিতে চাও নি।”
অমনি ঘরের এককোণে ইন্টারকমটা বেজে উঠলো। জেফরি আর জামান অবাক হয়ে তাকালো সেদিকে।
“আমি দেখছি, স্যার,” জামান উঠে চলে গেলো কলটা রিসিভ করার জন্য।
জেফরি চেয়ে রইলো সেদিকে। ইন্টেরোগেশন রুমে ইন্টারকম আছে কিন্তু সেটা হোমিসাইডের মহাপরিচালক ছাড়া সচরাচর কেউ ব্যবহার করে না। মহাপরিচালক তো চলে গেছে অনেক আগে। তাহলে কে ফোন করলো?
“ডিজি স্যার আপনাকে ডাকছেন!” জামানও বিস্মিতকণ্ঠে বলে উঠলো।
“স্যার?!” জেফরিও যারপরনাই অবাক।
“কিছুক্ষণ আগে অফিসে এসেছেন। আপনাকে দেখা করতে বলছেন। খুব নাকি জরুরি।”
একটু ভাবলো জেফরি বেগ, তারপর উঠে দাঁড়ালো। “তুমি থাকো। আমি স্যারের সাথে দেখা করে আসছি। বাট কিপ ইওর আইজ অন হিম। ওকে?”
জামান মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো, “জি স্যার।”
জেফরি রুম থেকে চলে যাবার পর জামান চুপচাপ চেয়ারে বসে চোখমুখ শক্ত করে চেয়ে রইলো বাবলুর দিকে। এখনও তার বাম কানের পাশটা টনটন করে ব্যথা করছে। আইসব্যাগ দিয়ে অনেকক্ষণ চেপে রেখেছিলো জায়গাটা। জেফরি তাকে সকালে অফিসে আসার আগে হাসপাতালে গিয়ে সিটিস্ক্যান করিয়ে আসতে বলেছিলো। প্রথমে জামান ভেবেছিলো তার কোনো দরকার হবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটা করা জরুরি। ব্যথাটা যেনো ক্রমশ বাড়ছে।
“কী?” টেবিলের ওপাশ থেকে বললো বাবলু। “এভাবে চেয়ে আছেন। কেন?”
জামানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো এই খুনি বন্দী অবস্থায়ও এতোটুকু ঘাবড়ে যায় নি।
“চপ কর, হারামজাদা!” রেগেমেগে বললো জামান। “আমি কিভাবে তাকাবো তা নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না।”
“তাহলে কী নিয়ে মাথা ঘামাবো, ব্রাদার।”
জামানের গা রি রি করে উঠলো। এই খুনি নিঃশব্দে হাসছে।