অধ্যায় ৪০
২৩শে নভেম্বর, বুধবার
করাচি বিচসংলগ্ন এলাকা
আজ থেকে দু-মাস আগে করাচির এরকমই একটি সৈকতের তীরে মুজাহিদ কিছুদিন মাছ ধরার ট্রলারে কাজ করেছে। রাতের অন্ধকারে তার কাছে মনে হলো এটা বুঝি আগের সেই জায়গাটাই কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলো না।
একটু আগে রাত দশটার পর হাসপাতাল থেকে কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে তাদের দশজনকে মালসামানসহ এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। রওনা দেবার আগে তাদের সবাইকে গোসল করিয়ে তওবা পড়ায় বুজুর্গ। তারপর প্রত্যেককে ভিটামিন ইনজেকশন দেয়া হয়। শেষে নরম আর আর্দ্র হয়ে সবাইকে বুকে জড়িয়ে বিদায় জানায় সে। তারা সবাই জানে এটাই বুজুর্গের সাথে তাদের শেষদেখা। সত্যি বলতে এখন থেকে তারা যেটাই করবে সেটাই হবে তাদের এই ছোট্ট জীবনের সর্বশেষ কাজ!
রাতের অন্ধকারে আরব-সাগরের ঢেউয়ের গর্জন সম্মোহনের মতো কাজ করছে যেনো। দশজন যুবক তেমন কথাবার্তা বলছে না। একটা ঘোরের মধ্যে আছে সবাই। ওদের পিঠে যে ভারি ব্যাক-প্যাক আছে সেটার ওজন টেরই পাচ্ছে না। ওদের কাছে তুচ্ছ এই জিন্দেগির বোঝাই এখন বেশি ভারি! আর সেই ভার থেকে খুব জলদিই মুক্তি পাবে।
ইসমাইল ভায়ের দিকে তাকালো মুজাহিদ। তার মুখ পাথরের মূর্তির মতোই নির্বিকার। চুপচাপ পকেটে দু-হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরব সাগরের দিকে মুখ করে। তাদের দলের সবার অবস্থাই প্রায় একই রকম। কোনো প্রশ্ন করছে না, যে কাজের জন্য তাদেরকে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে তার জন্য অপেক্ষা করছে শুধু।
আরব-সাগর থেকে ভেসে আসা ঠাণ্ডা বাতাস দশজন নিশ্চল যুবকের চোখেমুখে ঝাঁপটা মেরে যাচ্ছে, মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে কিন্তু কাউকে বিন্দুমাত্রও টলাতে পারছে না। তাদের সঙ্কল্পের মতোই অটল তারা। মুজাহিদ জোর করে নিজেকে বাকি নয়জনের মতো অটল রাখার চেষ্টা করলো।
একটু পর আরো তিনটি গাড়ি চলে এলো সেই নির্জন সৈকতে। ছয়জন বলশালী লোক দৃঢ়ভাবে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। যে দু-জন লোক তাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছে সেই কাফা আর ওয়াসি সম্ভ্রমের সাথে নতুন আসা একজনকে সালাম ঠুকে চুপচাপ একপাশে সরে গেলো।
“আসস্লামালাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ,” চাপদাড়ি আর মাঝারি উচ্চতার একজন তাদের সামনে এসে বললো।
দশজনের সবাই সালামের জবাব দিলো বিড়বিড় করে।
“উনি মীর…আমাদের কমান্ডারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠজন,” কাফা পরিচয় করিয়ে দিলো।
দশজনের সবাই সম্ভ্রমের সাথে তাকালো সাদামাটা দেখতে লোকটার দিকে। এই নামটা তারা বেশ কয়েকবার শুনেছে, তাদের অপারেশনের দায়িত্বে আছে এই লোক, তবে এর আগে কখনও একে চোখে দেখে নি, যেমনটা দেখে নি মেজর জেনারেলকে।
“ভায়েরা আমার,” আস্তে করে বললো মীর, “আপনারা যে মহান উদ্দেশ্যে আজ জান-কোরবান করতে প্রস্তত হয়েছেন তার জন্য আমি আপনাদেরকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আপনাদের খোশনসিবকে আমি হিংসা করি, আবার আপনাদের এই আত্মত্যাগের নিদর্শন দেখে আমি গর্বিতও। আমি জানি আপনাদের বেশি কথা বলার দরকার নেই। কি করতে হবে কিভাবে করতে হবে সেটা আপনারা আমার চেয়ে কোনো অংশেই কম জানেন না। দীর্ঘদিনের কঠিন সাধনার পর আজ আপনারা যে নিয়তে দরিয়া পাড়ি দিচ্ছেন তাতে যে সফল হবেন সে-ব্যাপারে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই।” গভীর করে দম নিয়ে নিলো মীর। “আপনারা এক একজন ফেদেইন…আমৃত্যু লড়াই করার জন্য প্রস্তত! আপনারা পেশাদার কোনো সৈনিক নন। সরকারের কাছ থেকে বেতন নিয়ে যারা অস্ত্র ধরে তাদের সাথে আপনাদের তুলনা করাটাও কবিরা গুনাহ্।”
দশজনের মুখের দিকে তাকালো মীর। মানুষ চিনতে তার কখনও ভুল হয় না, সেজন্যেই এতো অল্প বয়সে আজ এতোটা অর্জন করতে পেরেছে। সে জানে এই দশজন যে কাজ করতে যাচ্ছে সেটা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেবে। বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেবে কাফিরদের।
“মনে রাখবেন, আমি…আমরা সবাই আপনাদের সাথে আছি। তারচেয়েও বড় কথা, মহান আল্লাহপাক আপনাদের সাথে আছেন। উনি আপনাদের জেহাদের সুকঠিন পথ পাড়ি দিয়ে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে নিয়ে যাবেন। ইসলাম আর তার আল্লাহর জন্য জীবন দেয়ার চেয়ে মহান কিছু আর নেই!”
কথা শেষে করে কয়েক মুহূর্ত চুপ মেরে রইলো মীর। “খোদা হাফেজ!”
তারপর এক এক করে দশজনের সাথে কোলাকুলি করলো। প্রত্যেককে বুকে জড়িয়ে ধরে পিঠে আলতো করে চাপড় মারলো সে।
মীর আর তার সঙ্গে আসা দু-জন দেহরক্ষী নিয়ে চলে গেলেও তিনজন বলশালী লোক থেকে গেলো। রাত এগারোটার দিকে তাদের সবাইকে একটা ইনফ্ল্যাটাল বোটে করে সাগরের বুকে নোঙর করা ট্রলারে তুলে দেয়া হলো দু-দফায়। রাতের অন্ধকারে ট্রলারটি ভালোমতো দেখতে না পেলেও মুজাহিদের কেনজানি মনে হলো এই ট্রলারটি সে আগেও দেখেছে।
সাড়ে এগারোটার একটু আগে কাফা, ওয়াসি আর নতুন আসা তিনজন লোককে নিয়ে তাদের ট্রলারটি রওনা দিলো গহীন অন্ধকারে।
অধ্যায় ৪১
গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিরক্তিকর কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে হোটেলে ফিরে এসেছিলো বাস্টার্ড। মওলানার বাড়ি যেনো পরিত্যাক্ত দূর্গ। কাউকে ঢুকতে কিংবা বের হতে দেখা যায় নি। তার মনে হচ্ছে মওলানা সম্ভবত অসুস্থ। বয়স হয়েছে, একটু আধটু অসুখ-বিসুখ থাকতেই পারে।
তবে আশার কথা সকালে জাভেদ ফোন করে জানিয়েছে আলীর ডিসকো আবার খুলছে আজ থেকে। সেজন্যে বুধবার বিকেলের পর আর গুলজার-এ হিজরিতে গেলো না। ওখানে গিয়ে লাভ নেই। মওলানা আবার অফিসে যেতে শুরু না করলে রেকি করে কোনো লাভ হবে না।
ব্যায়াম করে, সাঁতার কেটে লাঞ্চ করলো হোটেলের নিজস্ব রেস্টুরেন্টে। দুপুরের পর আশেপাশে একটু হাটাহাটি করে বিকেলে রুমে এসে বিশ্রাম নিলো সে।
জাভেদ ওয়ার্সি এলো সন্ধ্যা সাতটার পর। সময়ক্ষেপন না করে রওনা দিলো আলীর ডিসকোর উদ্দেশ্যে। ওখানে গিয়ে দেখতে পেলো সত্যি সত্যি বেশ কড়াকড়ি করা হয়েছে। মেইনগেটের সামনে থেকে ইয়াসিনকে ফোন দিলো জাভেদ, ওর রেফারেন্স নিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো তাকে।
ডিসকোর ভেতরে লোকজন ফুর্তিতে ডুবে আছে। দিন-দুনিয়ার কোনো খবর রাখাটা যেনো এখানকার নিয়মের মধ্যে পড়ে না। এখানে একটাই মটো-খাও-দাও-ফুর্তি করো!
অনেকক্ষণ বসে বসে বিয়ার খাওয়ার পরও আইনাতের দেখা মিললো না। এমনকি এখানকার মূল আকর্ষণ আলীরও কোনো খবর নেই। তার পাশে বসা কেউ একজন নীচুস্বরে বললো, আলী আজ আসবে না। হতাশ হয়ে বসে রইলো সে। ডিসকোতেও আজ লোকজন একটু কম তবে তাদের উন্মত্ততায় ভাটা পড়ে নি। ডান্সফ্লোর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেশ কিছু নর-নারী। নাচের ছুতোয় তারা একে অন্যের শরীর স্পর্শ করছে প্রকটভাবে। এসব দেখতে দেখতে রাত প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেলো কিন্তু আইনাতের খবর নেই। অবশেষে যখন ঠিক করলো ডিসকো থেকে বের হয়ে যাবে তখনই দেখতে পেলো মওলানার মেয়েকে। আশার কথা, আজ সে একা!
আলী নেই। আইনাতও একা! বাস্টার্ড এটাকে দারুণ সুযোগ মনে করলো। কয়েক মুহূর্ত আগেও ভেবেছিলো আরেকটি ব্যর্থ দিন অতিবাহিত করতে যাচ্ছে।
আবারো নিজের আসনে ফিরে এলো সে। খুব সহজেই চোখে পড়ে গেলো মেয়েটার। দূর থেকে তাকে দেখে হাই জানালো। সেও জবাব দিলো হাত তুলে। মুখে হাসি এঁটে মেয়েটা চলে এলো তার কাছে।
“তুমি এখনও আছো?” তার পাশে এসে বসলো আইনাত।
“কেন, আমাকে এক্সপেক্ট করো নি?”
“আরে না…তুমি তো বেশি রাত পর্যন্ত থাকে না, তাই বলছিলাম।”
“তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
ভুরু তুললো আইনাত।
“সত্যি। নইলে কি এততক্ষণ থাকি? বসে বসে বোর হয়ে গেছি।”
“তাহলে চলল…আর অপেক্ষা করে কী লাভ!”
তার হাতটা ধরে ডান্সফ্লোরে টেনে নিয়ে গেলো মেয়েটি। দ্রুতলয়ের সঙ্গিতের তালে তালে নাচতে শুরু করলো। ডান্সফ্লোরে উঠলেই সে বদলে যায়। অগত্যা বাস্টার্ডকেও হাত-পা দুলিয়ে মেয়েটার সাথে তাল মেলাতে হলো।
“আগে একটু পান করে নিলে ভালো হতো না?”
আইনাত কোনো জবাব না দিয়ে নাচতে লাগলো।
“আমি ড্রিঙ্ক করার কথা বলছিলাম।”
“বুঝেছি…” তার হাত ধরে ফ্লোরের মাঝখানে নিয়ে গেলো মেয়েটি। “কিন্তু আমার এখন ভীষণ নাচতে ইচ্ছে করছে…এ কয়দিন বাড়িতে থাকতে থাকতে বোর হয়ে গেছি। হরিল লাইফ!”
মুচকি হাসি দিয়ে বাস্টার্ড তার সাথে নেচে গেলো, তবে চোখ বুলালো চারপাশে। আইনাতের পরিচিত যে সার্কেলটা আছে তাদের কেউ আশেপাশে আছে কিনা। এদের খপ্পর থেকে মেয়েটাকে দূরে রাখতে হবে। নইলে ওরা এসে ছিনিয়ে নেবে ওকে। তার ভাগ্য আজ ভালো, আইনাতের পরিচিত একটা মুখও দেখতে পেলো না ডিসকোর ভেতরে।
কিন্তু বারো শ’ মাইল দূর থেকে আসা লোকটির ধারণাই নেই একটু দূরে এক যুবক তাদের দিকে কড়া নজর রাখছে।
*
আরব-সাগরের বুকে বেশ ধীর গতিতে ছুটে চলেছে কুবের নামের একটি ট্রলার। এরকম অসংখ্য ট্রলার মুম্বাইর জেলেপল্লীর অভিমুখে ছুটে যাচ্ছে এখন। তিন-চারদিনের সমুদ্র অভিযানে প্রচুর মাছ নিয়ে ফিরে আসছে তারা। কারো পক্ষে বোঝার কথা নয় কুবের-এর উদ্দেশ্য কি?
ঘড়ির কাঁটায় এখনও রাত নটা বাজে নি। আরব-সাগরের উপরে নেমে এসেছে রাতের গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে আলোঝলমলে মুম্বাই নগরীর উপকূল চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছে প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর শহরটি।
ইসমাইলের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে বিস্ময়ে চেয়ে চেয়ে দেখছে মুজাহিদ। সিনেমায় এ শহরটি অসংখ্যবার দেখেছে কিন্তু সমুদ্রের বুক থেকে রাতের অন্ধকারে কখনও দেখা হয় নি। তার কাছে মনে হচ্ছে সিনেমার চেয়েও শহরটি দেখতে বেশি আলোকিত।
ইসমাইলের দিকে তাকালো সে। তার মতোই একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে উপকূলের দিকে। একটু আগে কুবের-এর কাপ্তানকে সরিয়ে দিয়ে ট্রলারের হাল ধরেছে সে। তাদের দশজনের দলে বাদা আর ফাহাদুল্লাহ নামে যে দু-জন আছে তারা এখন ব্যস্ত ইনফ্ল্যাটাবল বোর্টটা প্রস্তুত করতে। আরো অনেক কিছুর সাথে এটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তারা। আবু আলী আর সোয়েব নামের দু-জন ট্রলারের পাটাতনের নীচে কুবের-এর কাপ্তানকে জবাই করছে। ট্রলারটা ছিনতাই করার পরও এই লোকটাকে তারা বাঁচিয়ে রেখেছিলো কেবলমাত্র মুম্বাই পর্যন্ত পথ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য। এখন আর তার কোনো দরকার নেই। ট্রলারের বাকি লোকজনকে তাদের সঙ্গে আসা কাফা আর ওয়াসিসহ লস্করের অন্য তিনজন আল-হোসাইনী ট্রলারে তুলে নিয়ে চলে গেছে। গতকালই ওদের সবাইকে কাপ্তানের মতো পরিণাম ভোগ করতে হয়েছে সম্ভবত।
ইসমাইলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও মুজাহিদ কোনো কথা বলছে না। সময় যতো ঘনিয়ে আসছে তার অস্থিরতা ততোই কমে যাচ্ছে। আগের মতো। আর বকবক করছে না। যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে সে।
গতপরশু রাতে লস্করের লোকজন তাদেরকে নিয়ে একটা ট্রলারে ওঠে। রাতের অন্ধকারে সে দেখতে পায় নি ট্রলারটার গায়ে কি লেখা ছিলো। গতকাল যখন কাফা আর ওয়াসির নেতৃত্বে তারা সবাই কুবের-কে ছিনতাই করে সেটা দখল করে নেয় তখনও সে জানতো না করাচি থেকে কোন ট্রলারে করে এতোটা পথ চলে এসেছে। কিন্তু কুবের-এ ওঠার পর কাপ্তান ছাড়া বাকি খালাসি আর জেলেদের বন্দী করে যখন ঐ পাঁচজন তাদেরকে শেষবিদায় জানিয়ে ট্রলারটা নিয়ে চলে যায় তখন মুজাহিদ দেখে ওটার গায়ে লেখা আল হোসাইনী।
এই ট্রলারে করেই তো সে মাছ ধরার কাজ করেছে!
কথাটা ইসমাইলকে বলেছিলো, কিন্তু সে কিছুই বলে নি। যেনো এটা কোনো বিষয়ই না।
“আমি আর আপনি একসাথেই তো থাকবো…তাই না, ইসমাইলভাই?”
“হুম।” নির্বিকারমুখে জবাব দিলো ইসমাইল। “এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে ওদের সাথে হাত লাগা…আমরা এক্ষুণি রওনা দেবো।”
মুজাহিদ দেখলো ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। গতি হারিয়ে আরব-সাগরের বুকে দুলতে শুরু করেছে।
আবু ইসমাইল মুজাহিদের গালে আলতো করে চাপড় মেরে বললো, “জলদি কর, আজমল।”
আজ অনেকদিন পর আজমল আমের কাসাব নিজের আসল নামটা শুনতে পেলো।
অধ্যায় ৪২
একটানা অনেকক্ষণ ধরে নাচার অভিজ্ঞতা নেই তার। আইনাতের পাল্লায় পড়ে ডান্সফ্লোরে নেচে-টেচে ক্লান্ত হয়ে পড়লো বাস্টার্ড।
এখন ঘরের এককোণে সোফায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে সে। সারা শরীর ঘেমে একাকার। দম ফুরিয়ে হাপাচ্ছে। অবাক হয়ে দেখছে, আইনাত এখনও ডান্সফ্লোরে নেচে যাচ্ছে। ফ্লোর ছাড়ার আগে ওকে বলেছিলো একটু বিরতি দিতে, মেয়েটা সে-কথা কানেই তোলে নি। বুঝতে পারছে, এই মেয়ে লন্ডনে থাকার সময় নিয়মিত নাইটক্লাব আর ডিসকোতে যেতো।
দুটো বিয়ার নিয়ে ইয়াসিন যোগ দিলো তার সাথে। একেবারে মোক্ষম সময়ে বিয়ার নিয়ে এসেছে সে। খুব তেষ্টা পেয়েছিলো তার।
“নিন, তওফিক ভাই,” একটা বিয়ার তার দিকে বাড়িয়ে দিলো জাভেদের জ্ঞাতিভাই। “এটা আমার তরফ থেকে।”
“থ্যাঙ্কস,” বিয়ারটা হাতে নিয়েই খুলে ফেললো। ঢক ঢক করে পান করে নিলো কিছুটা।
“আজকে লোকজন কম বলে আমার কাজের চাপও কম,” নিজের বিয়ারে চুমুক দিতে দিতে বললো ইয়াসিন। “তাই ভাবলাম, একটু মেহমানদারি করে আসি।”
হাসলো বাস্টার্ড। “শুকরিয়া।”
“বাহ, আপনি তো ভালোই উর্দু পারেন।”
“আপনার ভাই জাভেদের সঙ্গে থেকে এ ক-দিনে একটু আধটু শিখেছি। সত্যি বলতে, আমি আসলে হিন্দি দিয়ে কাজ চালাচ্ছি এখানে। উর্দু খুব কঠিন মনে হয় আমার কাছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ইয়াসিন। “জাভেদের মতো আমরাও মোহাজের…বাড়িতে হিন্দি বলি। সুতরাং কোনো সমস্যা নেই। আপনি হিন্দিই বলেন।”
“থ্যাঙ্কস অ্যাগেইন।”
বিয়ারে চুমুক দিলো ছেলেটা। “কেমন লাগছে আমাদের ডিসকো?”
“গ্রেট,” বললো সে। “খুবই সুন্দর পরিবেশ।”
“কাউকে বাগাতে পারলেন?” চোখ টিপে বললো ইয়াসিন। এখানে কিন্তু একলা মেয়েমানুষ প্রচুর আসে।”
বিয়ারটা দিয়ে কপালে টোকা মেরে বললো, “এখনও সেই সৌভাগ্য হয় নি।”
“আহ্,” আফসোসের সুরে বললো জাভেদের ভাই। “এরকম হ্যান্ডসাম একজন যদি এ কথা বলে তাহলে কেমনে?”
“সত্যি বলছি, এখনও কপাল খোলে নি।”
“চেষ্টা করেন…পেয়ে যাবেন।” আবারো বিয়ারে চুমুক দিলো সে। “নাকি করাচির মেয়ে পছন্দ হচ্ছে না? বিলাতি মেম দেখতে দেখতে রুচি পাল্টে গেছে?”
হাসতে হাসতে মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “তা নয়। আসলে একজনের ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়েছে কিন্তু সুবিধা করতে পারছি না।”
ভুরু কপালে তুললো ইয়াসিন। “আমাকে বলা যাবে?”
শিওর। ঐ যে…আপনাদের রেগুলার কাস্টমার,” ফ্লোরে নাচতে থাকা আইনাতকে দেখিয়ে বললো সে।
“ও,” প্রশংসার সুরে বলে উঠলো ছেলেটি। “ওর পেছনে তো অনেকেই ঘুরছে। আলীর সাথে দারুণ খাতির।”
ইয়াসিন মওলানার মেয়ে আইনাতকে চিনতে পেরেছে দেখে বাস্টার্ড খুশিই হলো। সম্ভবত ওর কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
“কারো সাথে চক্কর আছে নাকি?”
“মনে হয় সিঙ্গেলই আছে। সবাইকে তো বেশ নাচায়…খুব কঠিন জিনিস।”
“ওর সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“তেমন কিছু না…তিন-চার মাস ধরে এখানে আসছে। শুনেছি লন্ডনে থাকতো। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।”
নতুন কোনো তথ্য নেই। এটা সেও জানে।
“আপনার সাথে তো মনে হয় কথাবাতা হয়…তাই না?”
এটা অস্বীকার করলো না সে। ইয়াসিন নিশ্চয় আইনাতের সাথে তাকে। কথা বলতে দেখেছে। “হ্যাঁ।”
“লেগে থাকুন…কাজ হয়ে যেতে পারে,” বলেই চোখ টিপে দিলো। “আমি এখন উঠি। এনজয় করেন, ভাই। পরে কথা হবে।”
“শুকরিয়া, ইয়াসিন ভাই।”
জাভেদের ভাই লিকার রুমে চলে যেতেই ডান্সফ্লোরের দিকে তাকালো সে। আইনাতকে দেখা যাচ্ছে না। মেয়েটা গেলো কোথায়? একটু আগেও তো নাচতে দেখেছে। অস্থির হয়ে উঠলো সে। চারপাশে চোখ বুলিয়েও তার দেখা পেলো না। তাহলে কি তাকে না বলেই চলে গেলো? হতাশ হয়ে যে-ই না উঠতে যাবে অমনি দেখতে পেলো ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসছে। আইনাত। এবার ডান্সফ্লোরে আর গেলো না সোজা চলে গেলো ঘরের অন্যপাশের সোফাগুলোর দিকে।
বাস্টার্ড উঠে চলে গেলো লিকার রুমে। একটু পর ফিরে এলো এক বোতল হুইস্কি আর দুটো গ্লাস নিয়ে।
“অনেক নাচলে দেখি,” আইনাতের পাশের সোফায় বসতে বসতে বললো সে।
তাকে দেখতে পেয়ে প্রসন্ন হাসি দিলো মেয়েটি। “ও, তুমি এখনও আছো!”
“ম্যাডামকে সার্ভিস দেবার জন্য,” বলেই বোতলটা বাড়িয়ে দিলো।
“থ্যাঙ্ক গড!” হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো। “নাচতে নাচতে ক্লান্ত হয়ে গেছি…এটাই চাচ্ছিলাম।”
“আমার মনে হয় গড় এই জিনিস তোমার জন্য বয়ে আনে নি!”
কথাটার মানে বুঝতে পেরে হেসে ফেললো আইনাত। “ও সরি!” তার পর হাসতে হাসতে বললো, “থ্যাঙ্ক ইউ, তওফিক।”
“ইউ আর ওয়েলকাম,” বলেই গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো এবার।
বোতলটা খোলাই আছে, আইনাত সেটা থেকে তাদের দুজনের জন্য হুইস্কি ঢেলে দিলো।
“চিয়ার্স,” হুইস্কিপূর্ণ গ্লাসটা বাড়িয়ে ধরলো মেয়েটি।
“চিয়ার্স।”
ঢক ঢক করে পান করলে আইনাত, তবে বাস্টার্ড ছোট্ট একটা চুমুক দিলো কেবল। “তোমার স্ট্যামিনা দেখে আমি অবাক। এর অর্ধেকও আমার নেই।”
“ইচ্ছের বিরুদ্ধে নাচলে অল্পতেই হয়রান হয়ে যাবে, কিন্তু প্রাণ খুলে নাচলে সহজে ক্লান্ত হবে না।”
বাস্টার্ড জানে কথাটা সত্যি। এ নিয়ে আর কিছু বললো না। “আলী আজ আসবে না?” প্রসঙ্গ পাল্টালো সে।
বাঁকা চোখে তাকালো আইনাত। “ওকে মিস্ করছো নাকি?”
হাত নেড়ে বললো, “আরে না। আমি স্ট্রেইট! আলীকে মিস করবে ওরা…ঐ যে, মি: পোলো।” ডান্সফ্লোরে পোলো শার্ট পরা এক যুবককে দেখিয়ে বললো সে।
মুখ টিপে হাসলো আইনাত। “ও কি তোমাকেও নক করেছিলো নাকি?”
“বলতে পারো আমার কপাল খারাপ। তবে তার ভাগ্যও যে ভালো ছিলো সেটা বলার উপায় নেই। ও আমার ব্যবহারে খুব হতাশ হয়েছে মনে হয়।”
“হা-হা-হা।” আবারো প্রাণখোলা হাসি দিয়ে উঠলো আইনাত। “এখানে খুব কম পুরুষই আছে যাকে ও নক করে নি। ওর ধারণা করাচির বেশিরভাগ পুরুষ ওর মতোই।”
মুচকি হাসলো সে। “ও কি এখানে পার্টনার খোঁজার জন্য আসে?”
“অবশ্যই,” বলেই চুলগুলো ঠিক করে নিলো। “যারা একা তারা তো এখানে সঙ্গ পাবার জন্যই আসে।”
“আমার মতো?”
আইনাত তার দিকে ভুরু কুচকে তাকালো। “তাই?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“তোমার হাতটা একটু দেখি।”
বাস্টার্ড বুঝতে পারলো না। “কি?”
“তোমার হাতটা।”
আইনাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো সে।
মুচকি হেসে তার হাতে আলতো করে চিমটি কেটে দিলো মেয়েটি। “আমিও।”
এবার অট্টহাসি দিলো মি: তওফিক আহমেদ। “তুমি তো খুব মজার।”
হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললো আইনাত, করাচিতে ক-দিন আছো?”
“যে ক-দিন ভালো লাগে।”
ঠোঁট উল্টালো মেয়েটি। “গুড। আচ্ছা, তুমি কি করো?”
“ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার।”
“ওয়াও!” কৃত্রিম বিস্ময় দেখালো মওলানার মেয়ে। কোথায় কাজ করো?”
“ফ্রি-ল্যান্সার। তবে ডিসকভারি আর জিওগ্রাফিতেই বেশিরভাগ কাজ ব্রডকাস্ট হয়,” মিথ্যেগুলো বেশ ভালোভাবেই চালিয়ে যেতে পারলো। এরজন্যে অবশ্য আলীকে কৃতিত্ব দিতে হয়। “ইউরোপের আরো কিছু দেশেও কাজ করেছি।”
“দারুণ।” একটু থেমে আইনাত বললো, “ও, মনে পড়েছে…ঐদিন আলী মনে হয় এরকম কিছুই বলেছিলো…কিন্তু যতোদূর মনে পড়ে তুমি বোধহয় অস্বীকার করেছিলে, না?”
কপাল চুলকালো সে। “সত্যি বলতে, অস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি।”
“কেন?” বিস্মিত হলো মেয়েটি।
“আসলে কয়েক মাস আগে আমার ছোটোভাই এখানে এসে সম্ভবত আলীর সাথে দারুণ চালিয়ে গেছিলো…ও আবার আমার মতো স্ট্রেইট না।”
মুখে হাতচাপা দিয়ে কৃত্রিম অবাক হবার ভান করলো আইনাত। “তাই নাকি?”
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। “তুমি কি করো?” দ্রুত তথ্য আহরোনের দিকে চলে গেলো সে।
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিলো মেয়েটি। যেনো বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। “কিছু না,” অবশেষে বললো।
“বুঝতে পেরেছি।”
“কি?”
“পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই বুঝতে পারে না কোটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেবে। আমারও এই সমস্যা হয়েছিলো…দেড় বছর নষ্ট করেছি সিদ্ধান্তহীনতায়।”
মলিন হাসি দিলো মেয়েটি।
“এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। একটু সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াই ভালো।”
“তুমি কি সিঙ্গেল?” প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো আইনাত।
মুচকি হাসি দিলো সে। “আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয়?”
“দেখে কি সব বোঝা যায়?”
“অবশ্যই বোঝা যায়।”
“যেমন?”
“তুমিও আমার মতো সিঙ্গেল।”
মেয়েটা চেয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। যেনো একটুখানি অবাকই হয়েছে। “তুমি কি করে জানলে?”
“বাহ্, এটা বোঝা কী আর এমন কঠিন। তুমি যদি সিঙ্গেল না হতে তাহলে এখানে একা একা আসতে পারতে? হয় তোমার হাবি থাকতো তোমার সঙ্গে নয়তো সে তোমাকে…” কথাটা শেষ না করে হেসে ফেললো। “…পাকিস্তানি স্বামীদের আমি ভালো করেই চিনি। ওরা ওদের বউকে ডিসকোতে যেতে দেবে না। নো ওয়ে!”
হা-হা-হা করে হেসে ফেললো আইনাত। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “তুমি তো খুব মজা করে কথা বলো।”
মুখে হাসি এঁটে হুইস্কির গ্লাসে ছোট্ট চুমুক দিলো সে। “আচ্ছা, তুমি আর কতোক্ষণ থাকবে এখানে?”
“কেন?”
“এখানে আমার খুব মাথা ধরে যাচ্ছে…কাছে এতো চমৎকার বিচ থাকতে সবাই কেন যে বদ্ধঘরে ফুর্তি করে বুঝি না।”
“তুমি বিচে যেতে চাইছো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। মওলানার মেয়ে যে ইজি-গোয়িং সেটা বুঝতে পারছে। “তবে একা নয়। একজন সঙ্গি পাওয়া গেলে যেতাম। একা একা বিচে ঘোরার মতো বিরক্তিকর কাজ আর হয় না।”
“উমম…আমি কি এটাকে বিচে যাবার প্রস্তাব হিসেবে ধরে নেবো?”
“অবশ্যই।”
মুখ টিপে আবারো হাসলো আইনাত। “ওকে, যেতে পারি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না।”
“আধঘণ্টা?”
“হুম…ঠিক আছে।”
“গুড।” হুইস্কির গ্লাসটা রেখে দিলো সে। “তাহলে চলো…আধঘণ্টার একমিনিটও নষ্ট করতে রাজি নই।”
আইনাত হেসে বললো, “কিন্তু এই বোতলটার কি হবে?”
বাম হাতে ধরা হুইস্কির বোতলটার দিকে তাকালো সে। “সঙ্গে করে নিয়ে যাই?”
“আলীর ডিসকো থেকে হুইস্কি-বিয়ার বাইরে নেয়া যায় না।”
“তাই নাকি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মেয়েটি। “আলীর নিয়ম।”
“নিয়মটা কি আলীর ঘনিষ্ঠজনদের বেলায়ও খাটে?”
আইনাত মুখ টিপে হেসে তার কাছ থেকে বোতলটা নিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগের ভেতর চালান করে দিলো। “বন্ধুরা সব সময় স্পেশাল। নিয়মের উর্ধ্বে! বুঝতে পেরেছো?”
হেসে বললো সে, “অবশ্যই।”
“তাহলে চলল…আজ রাতে আমি তোমার গাইড।”
“মাত্র আধঘণ্টার জন্য!” আফসোসের সুরে বললো বাস্টার্ড।
খিলখিল করে হেসে উঠলো আইনাত। “চিন্তার কোনো কারণ নেই…আজরাতে কেয়ামত হচ্ছে না।”
অধ্যায় ৪৩
জাভেদ গাড়ির ভেতর থেকেই দেখলো তওফিক আহমেদ এক মেয়েকে নিয়ে ডিসকো থেকে বের হয়ে বিচের দিকে চলে যাচ্ছে। মেয়েটাকে সে চিনতে পারলো। এর আগে ঢাকার লোকটিকে এর সাথেই কথা বলতে দেখেছে। এই মেয়েটার বাড়ির সামনেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে তারা দু-জন রেকি করে যাচ্ছে সপ্তাহখানেক ধরে।
তার পাশ দিয়ে যাবার সময় তওফিক আহমেদ তাকে দেখেও না-দেখার ভান করলো। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট : জাভেদ গাড়ি নিয়ে এখানেই বসে থাকুক।
প্রেম করার জন্য সমুদ্রসৈকত খুবই ভালো জায়গা। এখানে প্রচুর প্রেমিক প্রেমিকা আসে রোমান্স করতে। তবে তওফিক আহমেদের চালটা সে বুঝতে পারছে না। লোকটার টার্গেট কে? মেয়ে নাকি মেয়ের বাপ-ভাই?
জাভেদ গাড়ি থেকে বের হয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। এ নিয়ে পাঁচটি। তওফিক আহমেদের মধ্যে কিছু একটা আছে-এ কয়দিনে এটা ভালো করেই বুঝতে পারছে সে। ওর পেশা আসলে কি? পেশাদার খুনি, নাকি গোয়েন্দা? তবে তার তার মনে হচ্ছে এই লোক সামাদভায়ের মতোই কোনো কাজে এসেছে এখানে। এসব ভাবতে ভাবতে জাভেদ খেয়ালই করে নি কখন তার পাশে এসে আরেকটা গাড়ি থেমেছে। গাড়ির ভেতরে দু-জন মানুষের কথাবার্তায় তার মনোযোগ আকর্ষিত হলো হঠাৎ করে। ফিরে তাকালো সে। একটা সাদা রঙের প্রোটন সাগার ভেতরে লম্বা-চওড়া এক লোক বসে কানে ফোন চেপে কথা বলে যাচ্ছে উর্দুতে। এই লোকটা ঐ সব অসভ্যদের মতো যারা আস্তে আস্তে কথা বলতে পারে না।
“একটু আগে বাইরে গেছে?”
ড্রাইভিং ডোরের কাঁচ নামানো বলে লোকটার রাগি মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলো জাভেদ।
“সঙ্গে একজন ছিলো?” এবার সেই রাগিমুখ তিক্ততায় ভরে উঠলো। কটমট চোখে তাকালো আলীর ডিসকোর দিকে। “ঠিক আছে…আমি আসছি…তুমি ওখানেই থাকো।” বলেই ফোনটা মুঠো করে ধরে নিজের উরুতে আঘাত হানলো। “খোদার কসম, আজ আমি ওই দুইটাকে খুনই করে ফেলবো!” দাঁতে দাঁত পিষে কথাটা বলেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে। হনহন করে এগিয়ে গেলো বিচের দিকে।
জাভেদ বোঝার চেষ্টা করলো ঘটনা কি। তার মন বলছে এই লোক তওফিক আহমেদ আর ঐ মেয়েটার ব্যাপারেই কথা বলেছে। কারণ আধঘণ্টা ধরে আলীর ডিসকো’তে কিছু লোক প্রবেশ করলেও একটু আগে সামাদ ভায়ের লোকটি ঐ মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে আসে, তার একটু পর আরেকজন লোক বের হয়ে এলেও সে বুঝতে পারে নি লোকটা ওদের অনুসরণ করে বিচের দিকে গেছে। এখন মনে হচ্ছে তওফিক আহমেদের পেছনে ফেউ লেগেছে।
জাভেদ সিদ্ধান্তহীনতায় পড়ে গেলো। তবে ভালো করেই জানে পুরোপুরি নিশ্চিত না-হয়ে কিছু করা যাবে না। ঘটনা কোন্ দিকে যায় দেখার জন্য সে অপেক্ষা করাই শ্রেয় মনে করলো।
*
ট্যাক্সি ক্যাবটা চলতে শুরু করতেই আজমলের চোখে পড়লো ওটা।
একটু আগে ইনফ্ল্যাটাবল-বোটে করে মুম্বাইর এক মছুয়াপট্টিতে নেমেছে তারা দশজন। মছুয়াপট্টির কর্মব্যস্ত মানুষগুলো আগ্রহভরে তাকালেও নিজেদের কাজে মন দেয়। ইচরে পাকা এক ছেলে জানতে চেয়েছিলো তারা কোত্থেকে এসেছে, কি চায়।কিন্তু ঐ নাদানটার প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করে নি তাদের দলের কেউ। বলতে গেলে নির্বিঘ্নেই তাদের দলটি মুম্বাইয়ে ঢুকে পড়েছে।
পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে তারা রওনা দিয়েছে যার যার গন্তব্যে। ইসমাইল আর তার গন্তব্য এখন ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস-সিএসটি নামেই যেটা বেশি পরিচিত।
ইসমাইলের বাহুতে আলতো করে টোকা মেরে ইশারা করলো সে। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর বহু পুরনো একটি স্টিকার, সেখানে আরবিতে কিছু লেখা :
লা-ইলাহা ইন্না আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজুজোয়ালেমিন!
ইসমাইল কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো কোরানের আয়াতটির দিকে। তার বুঝতে বাকি রইলো না ড্রাইভার একজন মুসলিম। পাশে বসা আজমলের দিকে তাকালো। একঘণ্টার টাইমিং সেট করে সিটের নীচে আরডিএক্স রাখতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে সে।
“ভাই, কি করবো?” ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো ছেলেটি।
কয়েক মুহূর্ত ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে বসে রইলো ইসমাইল, তারপর গভীর করে দম নিয়ে চাপাস্বরে বললো, “যেভাবে কথা হয়েছিলো সেভাবেই কাজ কর।” এরপরও বিশ বছরের তরুণের দ্বিধা কাটলো না দেখে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললো তাকে, “ধর্মের জন্য কখনও কখনও সবই করতে হয়!”
অধ্যায় ৪৪
রাতের এ সময়ে ক্লিফটন বিচটা অসাধারণ লাগছে তার কাছে। কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতটি দিনের বেলায় যতো ভালোই লাগুক রাতের বেলায় নিরাপত্তাহীনতা প্রকট হয়ে ওঠে, ফলে সৈকতের রাত্রিকালীন সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ খুব কম লোকের ভাগ্যেই জোটে। সেদিক থেকে দেখলে বোমার শহর, সন্ত্রাসের জনপদ করাচির এই বিচ রাতের বেলায়ও বেশ জমজমাট। তার মানে এখানকার নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ খুব একটা চিন্তিত নয়। অন্তত মসজিদের চেয়ে বিচ অনেক বেশি নিরাপদ! ধর্মের কারণে সৃষ্ট পাকিস্তানের জন্য ব্যাপারটা নির্মম পরিহাসই বটে।
সৈকতের পাশে রেস্টুরেন্ট আর হোটেলগুলো নানা রঙের বাতিতে জীবন্ত হয়ে আছে। ফুডকোর্টগুলো দেদারসে বিক্রি করছে খাবার। বিচে হাটাহাটি করছে প্রচুর মানুষ। কেউ বসে বসে গল্প করছে, অনেকেই আবার উট আর ঘোড়ায় চড়ে সৈকতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিচে বসে কোল্ড ড্রিঙ্কসও পান করছে কেউ কেউ। আইনাত জানালো এইসব কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলগুলো এক ধরণের কাভার। মদ আর হুইস্কি ভরে পান করছে লোকজন।
“তাহলে আমরাও কি একটু ড্রিঙ্ক করতে পারি?” আইনাতের সাথে হাঁটতে হাঁটতে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি জায়গায় এসে বললো বাস্টার্ড।
“আরেকটু সামনে চলো। ওই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। আমাদের তো কোল্ডড্রিঙ্কসের বোতল নেই!”
মুচকি হাসলো সে। চারপাশে তাকালো। তেমন একটা লোকজন নেই। বালির ঢিবির মতো উঁচু একটি জায়গা দেখতে পেলো। ওটার অন্যপাশে বসলে কেউ দেখতে পাবে না। “ওখানে চলো?” জায়গাটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো।
“ওকে।”
মেয়েটাকে নিয়ে ঢিবির পাশে বসে পড়লো বাস্টার্ড।
আইনাত ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে হুইস্কির বোতলটা বের করে বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।
“লেডিস ফার্স্ট!” মজা করে বললো সে।
“ওকে,” আর সৌজন্যতা না দেখিয়ে বোতল খুলে ঢক ঢক করে পান করলো মওলানার মেয়ে। “নাও, মি: তওফিক।” বোতলটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে।
বোতলটা হাতে নিয়ে রাতের সমুদ্রের দিকে তাকালো সে। প্রমোদতরী, ট্রলার আর জাহাজ ভেসে বেড়াচ্ছে সেখানে। সংখ্যায় অনেক। সমুদ্র থেকে চোখ সরিয়ে আইনাতের দিকে ফিরলো। “সুন্দর।”
“কি?”
“সমুদ্র…এই বিচ…আজকের রাত…আর তুমি!”
“হুইস্কি না খেয়েই এই অবস্থা,” হাসতে হাসতে বললো মেয়েটি।
অল্প একটু হুইস্কি পান করলো সে। “নাও,” আবারো আইনাতের দিকে বোতলটা বাড়িয়ে দিলো।
তৃষ্ণার্তের মতো পান করে গেলো মেয়েটি।
“তোমার কথা বলো…শুনি…”
“আমার কথা?” বামহাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো আইনাত। “আমার কি কথা জানতে চাও?”
সে কিছু বলতে যাবে অমনি হুট করে দু-জন লোক এসে হাজির হলো তাদের সামনে। একজন বেশ লম্বা-চওড়া, অন্যজন মাঝারি গড়নের। দশাসই লোকটার চোখ দিয়ে যেনো আগুন বের হচ্ছে।
“মাইগড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো আইনাত। মদের বোতলটা দ্রুত ব্যাগে ঢুকিয়ে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, তার সঙ্গে সঙ্গে বাস্টার্ডও।
“তুম?!” উর্দুতে বললো বিস্মিত মেয়েটি।
তার বুঝতে বাকি রইলো না এই লোকটা আইনাতের পরিচিত।
“ঘাস্তি কে বাচ্চে!”
লোকটা রেগেমেগে উর্দুতে বললেও সে বুঝতে পারলো এটা একটা গালি।
“দাফা হো যাও!” চিৎকার করে বললো মওলানার মেয়ে। “তোমার হিম্মত তত কম নয়…আমাকে ফলো করতে করতে এখানে চলে এসেছে! “
দশাসই লোকটি আইনাতের দিকে তেড়ে আসবে অমনি বাস্টার্ড তার সামনে এসে দাঁড়ালো। “ওর গায়ে হাত দেবে না!” ইংরেজিতেই বললো, বেশ শীতল কিন্তু সিরিয়াস ভঙ্গিতে।
বিস্ময়ে দু-চোখ বড় বড় করে দাঁতমুখ খিচে বললো পাণ্ডামতো লোকটি, “বাহেনচোদ্দ!” তারপর সঙ্গির দিকে তাকালো সে, “চাওয়াল কে বাঁচে আংরেজি মারাতা হায়।” এরপর বাস্টার্ডের দিকে ফিরে উর্দুতে আরো যা বললো তার সম্ভাব্য মানে হতে পারে : কুত্তারবাচ্চা, তোর সাহস তো কম নয়! তুই এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! ভাগ!
“ম্যায়নে কাহা না দাফা হো যাও!” আইনাত আবারো গর্জে উঠলো। “গেট লস!”
দশাসই লোকটি এবার আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারলো না। সজোরে চড় মারার জন্য হাত তুলতেই ক্ষিপ্রগতিতে বাস্টার্ড তার কুচকি বরাবর লাথি মেরে বসলো। ব্যথায় ঝাঁকিয়ে উঠলো সে। বিচি ধরে কিছুটা উপুড় হয়ে গেলো। “মাদারচোদ্দ!” চিৎকার করে বললো যন্ত্রণাকাতর মুখে।
আইনাত আর লোকটার সঙ্গি বিস্ময়ে চেয়ে রইলো বাস্টার্ডের দিকে।
তারপরই ব্যথা আর যন্ত্রণা ভুলে সোজা হয়ে দাঁড়ালো সে। দাঁত খিচে ঘুষি মারতে উদ্যত হলো বাস্টার্ডকে। এক ঝটকায় বাম হাতটা অ্যান্টি ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে লোকটার বলশালী হাতটাকে সরিয়ে দিতে পারলো সে। তারপর একবিন্দু সময়ও নষ্ট না করে ডানহাতের তালু দিয়ে দশাসই লোকটার নাক বরাবর আঘাত হানলো।
আঘাতের ধাক্কায় এক পা পিছিয়ে গিয়ে টলতে শুরু করলো লোকটি। মাত্র দুয়েক সেকেন্ড, তারপর বিশাল শরীরটা নিয়ে ধপাস করে বালির মধ্যে পড়ে গেলো সে।
পুরো ব্যাপারটা তিন-চার সেকেন্ড ঘটে গেলো বলে তার সঙ্গি যুবক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে আইনাতের অবস্থা তারচেয়ে করুণ। সে যেনো নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। মুখে হাতচাপা দিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে।
বাস্টার্ড জানে নোকটা কমপক্ষে পাঁচ মিনিট পড়ে থাকবে এভাবে। নাকের এই আঘাতটি মারাত্মক। যতো বলশালীই হোক, এটা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় নেবেই। নিজের থেকে লম্বা-চওড়া কিংবা একাধিক কারোর সাথে মারামারি করার সময় খুব দ্রুতই সে এটা প্রয়োগ করে। বলা বাহুল্য, দারুণ ফল পায়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।
এবার লোকটার সঙ্গির দিকে ফিরলো, কিন্তু তাকে কিছু বলার আগেই ভয় পেয়ে উল্টোদিকে দৌড় লাগালো সে। কিছুটা দূরে গিয়ে একটু থেমে ফিরে তাকালো আবার, ক্ষুব্ধকণ্ঠে কিছু বললেও সেটা বোঝা গেলো না।
“ও কি বললো?” আইনাতের কাছে জানতে চাইলো সে।
“তোমাকে দেখে নেবে।” বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যেই বললো মেয়েটি।
মুচকি হেসে বালিতে পড়ে থাকা দশাসই লোকটার দিকে তাকালো। প্রায় অচেতন, নাক দিয়ে গলগল করে রক্তপাত হচ্ছে। ঘোঘোৎ শব্দ করছে নিঃশ্বাস নেবার সময়।
“তু-তুমি…” মেয়েটা এখনও ধাতস্থ হতে পারে নি। “…এটা কিভাবে করলে?”
কাঁধ তুললো সে। “এটাকে বলে সেল্ফ-ডিফেন্স।”
তারপরও আইনাতের বিস্ময় কাটলো না।
“এখন বলো এই লোকটা কে? আমার ধারণা তুমি ওকে ভালো করেই চেনো।”
আইনাত মুখ খোলার আগেই হুইসেলের শব্দ শোনা গেলো।
“পুলিশ?”
“বিচে প্রচুর পুলিশ আছে,” বললো মেয়েটি।
মাই গড। করাচিতে এসে এক পাণ্ডার সাথে মারামারি করে ফৌজদারি কেসে জড়ানোর ইচ্ছে তার নেই। “চলল,” তাড়া দিলে আইনাতকে। “জলদি!”
মেয়েটাকে নিয়ে বিচ থেকে দৌড়ে চলে গেলো সে, পেছনে ফেলে গেলো দশাসই লোকটাকে। এখনও নাক দিয়ে সমানে রক্ত বের হচ্ছে। একটু নড়াচড়া করলেও উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই তার।
অধ্যায় ৪৫
একটু আগে আজমলের যেমন বাজে অনুভূতি হয়েছিলো ঠিক তেমনটি আবারও হলো ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনাস নামের মুম্বাইর সবচেয়ে বড় রেলস্টেশনে ঢুকে।
হাজার-হাজার নারী-পুরুষ আর শিশু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্টেশনের প্লাটফর্মে। এদের মধ্যে অসংখ্য শিশু যেমন আছে তেমনি আছে প্রচুর মুসলিম!
মাথায় টুপি, বোরকা পরা নারী আর তাদের সঙ্গে থাকা বাচ্চা-কাচ্চা। মা বাবার সাথে ঈদ করার জন্য সবাই পরিবার-পরিজন নিয়ে রওনা দিয়েছে। ট্যাক্সি-ড্রাইভার একজন মুসলমান ছিলো বলে খুব খারাপ লাগছে আজমলের। একঘন্টা পর ঐ বেচারার কি হবে সেটা তার ভালোই জানা আছে। মনে মনে দোয়া করলো, বোমাটা বিস্ফোরণের আগে যেনো আল্লাহপাক তাকে ট্যাক্সি থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন।
“চল,” আস্তে করে বললো ইসমাইল। “একদম স্বাভাবিক থাকবি। ঠিক আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আজমল। ব্যাক-প্যাক নিয়ে দু-জন যুবক স্টেশনের টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলে কেউ বুঝতেই পারলো না মানুষরুপি দুটো যমদূত একটু পর কি করতে যাচ্ছে। ইসমাইল আর আজমলকে দেখে কর্মব্যস্ত রেলস্টেশনের কারোর বিন্দুমাত্র সন্দেহও জাগলো না।
সিএসটি’র টয়লেটটা যেমন বড় তেমনি নোংরা। শত শত লোকজনের মল-মূত্রে উপচে পড়ছে যেনো। প্রস্রাবরত কেউই পর্যটকরুপি দু-জন যুবকের দিকে ফিরেও তাকালো না। বলতে গেলে সবার অলক্ষ্যে খুব সহজেই টয়লেটের একটি কিউবিকলে ঢুকে পড়লো তারা। ইসমাইলের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে সে বুঝি হরহামেশা এখানে যাতায়াত করে। তবে সশরীরে না-হলেও ভিডিও’তে অসংখ্যবার দেখে আর বর্ণনা শুনে জায়গাটা তার মুখস্ত হয়ে গেছে।
“আস্তিন গোটা,” আজমলকে বললো ইসমাইল। ব্যাক-প্যাক থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে আনলো সে।
“ভিটামিন ইনজেকশন দেবেন, ভাই?!” অল্পবয়সি ছেলেটা অবাক হলো ভীষণ।
“হুম। কাজ শুরুর আগে আমাদের আরো এনার্জির দরকার।” কথাটা বলেই আজমলের হাতে সুঁইটা ঢুকিয়ে পুশ করে দিলো। “কি করতে হবে মনে আছে তো?”
ইনজেকশনের ব্যথায় একটুও সাড়া দিলো না আজমল আমের কাসাব। “জি, ভাই…সব মনে আছে।”
“একটুও ভাববি না…সমানে গুলি চালিয়ে যাবি…গ্রেনেড মেরে যাবি…ওদের যতো বেশি মারতে পারবি ততো বেশি সওয়াব হবে…ঠিক আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছেলেটি।
*
পুলিশের তাড়া খেয়ে উল্টো পথে চলে এসেছে তারা। বিচের যে অংশে লোকজন প্রচুর সেখানে মিশে গেলো দ্রুত। তবে আইনাত তাকে আশ্বস্ত করে বলেছে, আলীর ডিসকো থেকে তারা খুব একটা দূরে নেই। একটু ঘুরপথে হেঁটে গেলেও ওখানে খুব জলদি চলে যাওয়া সম্ভব। কোনো কথা না বলে তারা দু-জন সেই কাজই করলো।
কপাল খারাপ, মনে মনে বললো বাস্টার্ড। তাদের বিচ-অভিসার শুরু না হতেই পণ্ড। কোত্থেকে উটকো দু-জন লোক এসে হাজির হলো কে জানে। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে কিন্তু সে কিছু বলার আগে আইনাত কথা বলে উঠলো।
“চিন্তা কোরো না…আমার সঙ্গে গাড়ি আছে। আমি তোমাকে লিফট দিতে পারবো।”
যাক, কপাল তাহলে পুরোপুরি খারাপ নয়। তার সঙ্গেও যে গাড়ি আছে সেটা বেমালুম চেপে গেলো। “ড্রাইভ করবে কে?” হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলো।
“কে আবার, আমি।” জোর দিয়ে বললো সে। “টিপিক্যাল পাকিস্তানি পুরুষদের মতো মেয়েদের ড্রাইভিং নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ো না, ওকে? লন্ডনে থাকতে নিয়মিত ড্রাইভিং করতাম আমি। এখন সুযোগ পেলে করি।”
“আমি তোমার ড্রাইভিং নিয়ে উদ্বিগ্ন নই, আমি জানতে চাচ্ছি তোমার সাথে আর কেউ আছে কিনা…মানে ড্রাইভারের কথা বলছি।”
“মাথা খারাপ তোমার, ড্রাইভার নিয়ে আসবো ডিসকোতে?”
মেয়েটার দিকে তাকালো সে। “কেন? বাড়ির সবাই কি টিপিক্যাল পাকিস্তানি?”
“অবশ্যই, সঙ্গে সঙ্গেই বললো আইনাত। “তুমি কি ভেবেছো আলীর ডিসকোতে যারা আসে তারাই পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ?” মাথা দোলালো সে। “এই করাচিতে আমাদের মতো অনেক মানুষ আছে কিন্তু তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি আছে পরহেজগার, ধর্মান্ধ আর তালিবান-টাইপ মানুষজন।”
“হুম…এরকম কথা আমিও পাকিস্তানি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনেছি। তাদের বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন সবাই খুব ধর্মপ্রাণ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত। “আমার বাবার কথা শুনলে তো তুমি অবাক হয়ে যাবে।”
বলো, আমি তো সেটাই শুনতে চাচ্ছি! মনে মনে বলে উঠলো সে। অবশ্য মুখে বললো, “কেন?”
“উনি একজন মওলানা, বুঝেছো? খুবই পরহেজগার মানুষ।”
“ওয়াও, মওলানা!” বললো সে। “উনি যদি জানেন তুমি ডিসকোতে আসো, ড্রিঙ্ক করো, তাহলে কি হবে?”
“খুব বকাঝকা করবেন…বলবেন আমি উচ্ছন্নে গেছি…বরবাদ হয়ে গেছি।”
বাস্টার্ড কিছু বললো না, চুপচাপ শুনে গেলো। সে এখন ভালো শ্রোতা।
“কিন্তু আমি আর এসব পরোয়া করি না। কোনো কিছুই পরোয়া করি না। তাদের কথা শুনে আমার জীবনটা বরবাদ হয়ে গেছে।”
বরবাদ! আগ্রহী হয়ে উঠলো সে। “বুঝলাম না?”
“এই তো, এসে গেছি, তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলে উঠলো মেয়েটি। “বলেছিলাম না, খুব কাছেই।”
বাস্টার্ড দেখতে পেলো আলীর ডিসকোর সামনে যে খোলা জায়গায় গাড়ি পার্ক করা হয় সেখানে চলে এসেছে তারা। জাভেদের গাড়িটাও চোখে পড়লো কিন্তু ছেলেটাকে দেখতে পাচ্ছে না। আইনাতের গাড়ি ওর গাড়ি থেকে মাত্র তিনটি গাড়ির পরই পার্ক করা।
“চলো,” মেয়েটি বললো তাকে। “ঐ যে আমার গাড়ি।”
“হুম।” পা বাড়ালো সে আইনাতের পেছন পেছন। জাভেদের গাড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখতে পেলো ভেতরটা অন্ধকার। দরজার কাঁচ তোলা। ছেলেটা যে গাড়িতে নেই সেটা বুঝতে পারলো। তাহলে গেলো কোথায়? প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরপাক খেলেও আইনাতের গাড়ির কাছে চলে এলো। ভাবলো ফোন করবে কিনা।
মেয়েটা গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসতেই সে পকেটে হাত ঢোকালো ফোনটা নেবার জন্য। জাভেদকে বলে দেয়া দরকার সে যেনো চলে যায়। আজকের জন্য তার ডিউটি শেষ। মেয়েটার লিফট নেবার কারণ একটাই, সম্পর্কটা আরেকটু গাঢ় করা। যেতে যেতে হয়তো মূল্যবান কিছু তথ্যও জোগাড় করতে পারবে।
“ওহ্ মাই গড!” গাড়ির ভেতর থেকে আইনাতের কণ্ঠটা শোনা গেলো।
একটু ঝুঁকে ভেতরে উঁকি দিলো সে। “কি হয়েছে?”
“জলদি গাড়িতে ওঠো! মাদারফাঁকারটা এখানে আসছে!”
চট করে সামনের দিকে তাকালো বাস্টার্ড। ওদের দিকে পাঁচ-ছয়জন যুবক এগিয়ে আসছে মেইনরোড থেকে। একহাতে নাক চেপে রাখা লম্বুটাকে সহজেই চোখে পড়লো। শিট! সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো সে। হারামজাদা এতো দ্রুত সামলে উঠেছে বলে একটু অবাকই হলো। আরেকটা মারা দরকার ছিলো। কিংবা আরো জোরে!
আইনাত সময় নষ্ট না করে দ্রুত গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো আলীর ডিসকো থেকে। পাণ্ডার দল গাড়িটা চলে যেতে দেখে দৌড় দিলো কিন্তু চোখের নিমেষে বহু দূরে চলে গেলো তারা। পেছনে তাকিয়ে দেখলো বাস্টার্ড, লোকগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগালি করছে।
“ফাঁক!” বলে উঠলো আইনাত।
“কি হয়েছে আবার?”
“তার মানে ও জানতো আমি আলীর ডিসকোতে যাই?”
পাণ্ডাটাকে যে আইনাত চেনে সেটা আগেই বুঝেছে, কিন্তু মেয়েটার সাথে ওর কী সম্পর্ক বুঝতে পারছে না। ভাই? মওলানার এক ছেলেকে সে দেখেছে, আইনাতের নিশ্চয় আরো ভাই আছে। নাকি বয়ফ্রেন্ড!
গাড়িটা করাচির ব্যস্ততম সড়কে যানবাহনের সাথে মিশে গেলে অবশেষে প্রশ্নটা না করে পারলো না। “ওই লোকটা কে?”
তার দিকে না তাকিয়েই দীর্ঘশ্বাস ফেললো আইনাত। “সন অব অ্যা বিচ!”
“বুঝলাম…কিন্তু তোমার সাথে তার কী সম্পর্ক?”
চোখমুখ কঠিন করে বললো সে, “আমার হাজব্যান্ড!”
অধ্যায় ৪৬
দশ মিনিট পর ওরা দু-জন বসে আছে পিং ক্যাডিলাক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টে। ক্লিফটন বিচ থেকে জায়গাটা বড়জোর ছয়-সাত মিনিটের পথ, খায়াবান-এ-শেহার নামক একটি এলাকায় অবস্থিত। নিজের জীবনের ঘটনাটা খুলে বলার জন্য এখানে থেমেছে মেয়েটি। সে যে একজন বিবাহিত রমনী, তার যে স্বামী আছে-এটুকু বললে পুরো সত্যটা বলা হয় না।
একটু আগে আইনাত যখন বললো দশাসই লোকটি ওর স্বামী তখন বাস্টার্ড যারপরনাই বিস্মিত হয়। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথাই বলতে পারে নি। তখনই মেয়েটি সিদ্ধান্ত নেয় এই প্রবাসী যুবককে পুরো ঘটনা খুলে বলবে।
করাচির হাতেগোনা কয়েকটি জায়গার মধ্যে পিং ক্যাডিলাক ক্যাফে আইনাতের প্রিয়। ভালোমানের খাবারের জন্য নয়, চমৎকার ছিমছাম পরিবেশ আর রুচিসম্মত ডেকোরেশনের কারণে তার ভালো লাগে।
হুইস্কি ছাড়া আর কিছু খায় নি বলে এতোক্ষণে বেশ খিদে পেয়ে গেছে, সেজন্যে ক্যাফেতে ঢুকেই চিকেন ড্রামস্টিক আর ফ্রেঞ্চফ্রাই অর্ডার দিয়েছে। মেয়েটি, তবে বাস্টার্ডের মনোযোগ তার জীবনকাহিনী শোনার দিকেই।
মওলানা ইউসুফ হোসাইনীর দুই বিয়ে। আইনাত দ্বিতীয়পক্ষের সন্তান। মওলানার প্রথম স্ত্রীর ঘরে আরো এক মেয়েসহ দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে করাচির লিয়াকতাবাদ টাউনে বসবাস করে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাবার সাথে তার সম্পর্ক শীতল। ছোটো ছেলে আইনাতের চেয়ে বয়সে বড় হলেও এখনও বিয়ে করে নি। বাবার ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সে জড়িত। বাস্টার্ড তাকেই দেখেছে।
আইনাতের মা জোহার তাবরেজি ছিলেন একজন আফগান। আশির দশকে রাজনৈতিক সমস্যার কারণে আরো অনেক আফগানের মতো তাদের পুরো পরিবার চলে আসে করাচিতে। মওলানার প্রথম স্ত্রী থাকতেই জোহারকে বিয়ে করে। একই বাড়িতে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতো। প্রথম স্ত্রী পাঁচ ছয় বছর আগেই মারা গেছে আর গত বছর ব্রেস্ট-ক্যাঙ্গেরে মারা যান আইনাতের মা। তার মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখনই আইনাতের সাথে বিয়ে দেয়া হয় করাচির সম্ভ্রান্ত আর ধনী রাঙ্গুওয়ালা পরিবারের ছোটো ছেলে মানসুর রাঙ্গুওয়ালার সাথে। এই বিয়েটা ছিলো পুরোপুরি মওলানার ইচ্ছেয়।
আইনাত কলেজ পর্যন্ত করাচিতে পড়াশোনা করে চলে যায় লন্ডনে। ওখানে বিবিএ শেষ করে ব্যাঙ্কিয়ের উপর পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু তড়িঘড়ি তাকে দেশে এনে অনেকটা জোর করেই বিয়ে দেয়া য় মানসুরের সাথে। এই বিয়েতে কোনোমতেই রাজি ছিলো না সে, তাকে বাধ্য করা হয় মৃত্যুপথযাত্রি মায়ের সাহায্যে। মওলানা ইউসুফ বেশ ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। মেয়েকে জোর-জবরদস্তি না করে দ্বিতীয় স্ত্রীর মাধ্যমে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কাজ হাসিল করে নেয়।
তার মৃত্যুপথযাত্রি মা যখন মাথায় হাত রেখে কসম দিয়ে বলেছিলেন বিয়েতে রাজি হয়ে যেতে তখন আর আইনাত না করতে পারে নি। কিন্তু ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করার পরই তার ভুল ভাঙে। মানসুর রাঙ্গুওয়ালা আস্ত একটা জানোয়ার। বাসরঘর থেকেই শুরু হয় তাদের বিচ্ছেদের সূচনা। কলেজ পর্যন্ত পড়াশোনা করা মাথামোটা মানসুর বাসরঘরে রীতিমতো ধর্ষণ করে তাকে। শুধু এটা করেই ক্ষান্ত হয় নি সে, উল্টো অভিযোগ আনে, তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী কুমারী নয়! লন্ডনে নিশ্চয় অনেকের সাথে শুয়েছে। নইলে বাসরঘরে রক্তপাত হলো না কেন! সাদা চাদরে কেন কয়েক ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়লো না? এর মানে কি সেটা তো আর বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। এই মেয়ে লন্ডনে গিয়ে কী ছাই পড়াশোনা করেছে কে জানে, কিন্তু সে যে কুমারীত্ব হারিয়েছে এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিত।
কয়জনের সাথে এ পর্যন্ত সে শুয়েছে? ওদের সবাই কি বিলেতি সাহেব ছিলো? রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে এরকম অসংখ্য নোংরা প্রশ্ন করতে শুরু করে সে বিয়ের রাতেই। আইনাতও চুপ করে থাকে নি। নতুন স্বামীকে যা-তা ভাষায় গালিগালাজ করে। মানসুর বিয়ের আগে কতোজনের সাথে শুয়েছে সে কথাও জানতে চায়। এক পর্যায়ে রাগের মাথায় এও বলে, সে হাজার হাজার ছেলের সাথে শুয়েছে। খৃস্টান-ইহুদি কিছুই বাদ দেয় নি। এমনকি হিন্দুদের সাথেও!
কথাটা শুনে মানসুরের মাথায় খুন চেপে যায়। নতুন বৌয়ের গায়ে হাত তুলে বসে। ঘটনা আরো খারাপের দিকে যেতে পারতো কিন্তু রাঙ্গুওয়ালা পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাদের কারণে বেশিদূর এগোয় নি। ঐ দিনের পর থেকে আইনাতের সাথে মানসুর স্বামী-স্ত্রীর মতো একছাদের নীচে থাকলেও কখনও এক বিছানায় ঘুমাতো না। তাদের সম্পর্কটা ছিলো দমবন্ধ করা এক দাম্পত্য। দিনের বেলায় লোকজনের সামনে অভিনয় করতে হতো দু জনকেই। রাতে তারা আলাদা বিছানায় ঘুমাতো। পারতপক্ষে দু-জনের মধ্যে কোনো কথাই হতো না। আর যদি কথা বলতো সেগুলো হতো গালাগালি। এক্ষেত্রে আইনাতও মানসুরকে ছাড় দিতো না। দুজন দুজনকে তীব্র ঘৃণা করতো। অবশ্য নারীদের সতীত্ব নিয়ে সোচ্চার মানসুর তার স্ত্রীকে যতোই ঘৃণা করুক, রেন্ডি বলে গালাগাল দিক না কেন, প্রায়শই মাঝরাতে স্বামীর অধিকার আদায় করতে পিছপা হতো না। পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো ঘুমন্ত আইনাতের উপর। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক ঘরে নিশুতি রাতে যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেতো সেটা যেনো সবাই জেনেও না জানার ভান করতো।
বিয়ের ছয়মাস পরই আইনাতের মা মারা যান। মায়ের মৃত্যুর পর সেই যে বাপের বাড়িতে চলে আসে আর স্বামীর বাড়িতে ফিরে যায় নি। দুই পরিবারের অনেকে অনেক চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে অবশেষে। কিন্তু মানসুর নাছোরবান্দা। স্ত্রীর প্রাপ্য সম্মান দিতে নারাজ হলেও তালাকের ব্যাপারে তার বড় অনীহা। কোনোমতেই সে তালাক দেবে না। এটা তার অহংয়ের বিষয় হয়ে উঠেছে। যা-ই ঘটুক আইনাতকে সে তালাক দেবে না। বনিবনা না হলেও এই স্ত্রীর সাথেই ঘর করবে। শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে হৈহল্লা আর গালাগালি করার কারণে দু-মাস আগে মওলানা তার জামাইকে মেয়ের সাথে দেখা করতে নিষেধ করে দিয়েছে। অবশ্য এর আগে খুব একটা দেখাও হতো না স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে। মানসুর হয়তো আইনাতের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বন্ধ দরজা ধাক্কাধাক্কি করে কিছু গালাগালি দিয়ে চলে যেতো। তবে গত দু-মাস কাগজে-কলমের স্বামীর বদসুরত দেখার যন্ত্রণা আর পোহাতে হচ্ছে না তাকে।
আইনাতের জীবন-কাহিনী শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাস্টার্ড। তার মতো মেয়ে এরকম ঘটনার শিকার সেটা হয়তো অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য বলে মনে হতে পারে কিন্তু পাকিস্তানের ব্যাপারে যারা একটু খোঁজখবর রাখে তারা ভালো করেই জানে এখানকার সমাজের উঁচু-নীচু যে স্তরের নারীই হোক না কেন, তাতে কিছুই যায় আসে না, এরকম ভাগ্য বরণ করাটাই যেনো সাধারণ ঘটনা। যেখানে বেনজীর ভুট্টোর মতো অক্সফোর্ড শিক্ষিতা মেয়ে, যার বাবা ছিলো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, তাকেও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন আসিফ আলী জারদারির মতো এক লম্পট জমিদারপুত্রের দ্বিতীয় স্ত্রী হতে হয়েছে, বিমানবন্দরে প্রকাশ্যে হাজার-হাজার লোকের সামনে স্বামীর চড় খেয়ে হজম করতে হয়েছে, সেখানে আইনাতের মতো মেয়েদের আর কী করার থাকতে পারে। পাকিস্তানী সমাজের এই চিত্রটাই অনেক বেশি বাস্তব। আলীর ডিসকো নিতান্তই ব্যতিক্রমি ঘটনা।
“তুমি ওকে ডিভোর্স দিচ্ছো না কেন?” সব শুনে অনেকক্ষণ পর বলে। উঠলো সে।
“বাবা আর ভাইয়ের জন্য দিতে পারছি না,” বললো আইনাত। “অনেকদিন ধরে চেষ্টা করছি কিন্তু…” মাথা দোলালো। “…তুমি বুঝবে না। সমস্যাটা খুব জটিল।”
“যেমন?” আগ্রহভরেই জানতে চাইলো তওফিক আহমেদ। “তোমাকে দেখে কিন্তু আমার মোটেও অসহায় মেয়ে বলে মনে হয় না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আইনাত। “দেখে কিছু বোঝা যায় না, তওফিক,” একটু থেমে আবার বললো, “এ দেশে যতোদিন আছি ওকে আমি ডিভোর্স করতে পারবো না।”
“সমস্যা কি…থাকবে না, লন্ডনে চলে যাবে। আমার ধারণা ওখানে তুমি খুব সহজেই রেসিডেন্সিয়াল পারমিশন পেয়ে যাবে।”
“তা পাবো কিন্তু আমি দেশ ছাড়বো কিভাবে?”
“মানে?” বুঝতে পারলো না বাস্টার্ড।
গম্ভীর হয়ে বললো মেয়েটি, “ওরা আমার পাসপোর্ট আটকে রেখেছে।”
ওহ। চুপ মেরে রইলো সে।
“মার অসুখের সময় যখন লন্ডন থেকে চলে এলাম তারপরই ওরা আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করলো। আমার পাসপোর্ট আমার কাছ থেকে নিয়ে নিলো। এখনও সেটা ওদের কাছেই আছে।”
“তুমি চাইলে নতুন আরেকটি পাসপোর্ট জোগাড় করতেই পারো?”
মাথা দোলালো আইনাত। “পারি না।”
“কেন?”
“আমি যদি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই পাসপোর্ট পাবো না। নতুন করে আবেদন করলেও না।”
“বলো কি?”
“হুম। এটা করতে হলে আমাকে বাড়ি ছাড়তে হবে। পরিবারের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দিতে হবে। তারপরও পাবো কিনা সন্দেহ।”
“আজব!” সত্যি সত্যি অবাক হলো বাস্টার্ড। “পকিস্তানী পাসপোর্ট জোগাড় করা এতো কঠিন?”
“উপরমহলের সাথে যাদের কোনো খাতির নেই তাদের জন্য কঠিনই।” একটু চুপ থেকে আবার বললো, “তারচেয়েও বড় কথা আমি দেশে ছেড়ে চলে যেতে পারি না। আমার একটা পিছুটান আছে।”
“কি সেটা?” কয়েক মুহূর্তের জন্য বাস্টার্ডের মনে হলো আইনাতের বোধহয় সন্তান-সন্ততি আছে।
“আমার একটা ভাই আছে। ও শারিরীক আর মানসিক প্রতিবন্ধী।”
বিস্মিত হলো সে। “এর কথা তো তুমি বলো নি?”
গভীর করে করে নিঃশ্বাস নিলো মেয়েটি। “ওর কথা আমরা কেউই বলি না।”
“তোমাদের সাথেই থাকে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আইনাত। “বলতে পারো আমার সাথে থাকে। আমি যদি কিছু করি তাহলে বাবা আর ভাই ওকে…” কথাটা আর শেষ করতে পারলো না। “…তাই আমি যা করার এখানেই করবো…যেভাবে আছি হয়তো সেভাবেই থাকতে হবে অনেকদিন…কবে মুক্তি পাবো জানি না।”
পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠলো। বাস্টার্ড কি বলবে বুঝতে পারলো না।
“তুমি কোন্ হোটেলে উঠেছো?” অবশেষে প্রসঙ্গ পাল্টে জানতে চাইলো আইনাত।
“সামুনাবাদ…গুলশান-এ-ইকবাল।”
“ভালোই হলো। আমার বাসায় যাবার পথেই পড়বে ওটা। তাহলে চলো, অনেক রাত হয়ে গেছে।”
“এগুলো খেয়ে নাও…তারপর উঠি?”
“ওকে…তুমিও খেয়ে নাও।”
আর কিছু না বলে চুপচাপ খেতে শুরু করলো তারা দুজন। হঠাৎ খেয়াল করলো ক্যাফের লোকজন ফিসফাস করছে। দূরের দেয়ালে যে টিভিটা চলছে সেটার সামনে কিছু কাস্টমার জড়ো হয়ে কী যেনো দেখছে।
আইনাতের দিকে তাকালো সে। মেয়েটা কাঁধ তুললো। তাদের পাশের টেবিলে বসা এক তরুণকে জিজ্ঞেস করতেই সে খুব আমুদে ভঙ্গিতে জানালো হিন্দুস্তানের মুম্বাই শহরে মারাত্মক সন্ত্রাসী হামলা চলছে।
অধ্যায় ৪৭
মানসুর রাঙ্গুওয়ালা রাগে ফুঁসছে। ঐ বানচোতটা তার নাক এমনভাবে ভেঙে দিয়েছে যে ব্যথার চোটে মাথা ধরে আসছে, তার উচিত হাসপাতালে যাওয়া, দ্রুত চিকিৎসা নেয়া কিন্তু এসব উপেক্ষা করে নিজের হারানো পৌরুষ ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। একজন প্রবাসীর কাছে নিজের শহরে মার খেয়ে পড়ে থাকবে বিছানায় আর তার ধর্মমত স্ত্রীকে নিয়ে ঐ ব্যাটা ফুর্তি করে যাবে!
চাওয়াল কে বাচ্চে!
মুখ বিকৃত করে থুতু ফেললো সে। দেখতে পেলো থুতুর সাথেও হালকা রক্ত বের হয়ে আসছে। নাকের ব্লিডিংটা বন্ধই হচ্ছে না। তার ইচ্ছে করছে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে। টাকা-পয়সা যা লাগে লাগুক, আজকের মধ্যেই ঐ হারামিটাকে ধরতে হবে। দরকার হলে একরাতে সে পাঁচলাখ রুপি খরচ করে ফেলবে। শূয়োরটাকে ধরার পর কি করবে সেটাও ঠিক করে ফেলেছে এতোক্ষণে। ওকে জানে মারবে না, বিচি গালিয়ে দেবে। নাক-মুখ এমনভাবে থেতলে দেবে যে ওর নিজের মাও যদি দেখে চিনতে পারবে না।
হারামজাদার আদৌ যদি মা-টা কিছু থেকে থাকে!
এখন তারা দুটো প্রাইভেটকার নিয়ে ছুটে চলেছে ওই হারামিটাকে ধরার জন্য। আলীর ডিসকোর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চেয়ে চেয়ে দেখেছে তার স্ত্রীর গাড়িতে করে ঐ লোকটা সটকে পড়ছে। এই দৃশ্য দেখার যে কী যন্ত্রণা সেটা ভুক্তভোগি ছাড়া আর কে বুঝবে? শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছিলো ভেবে তার সঙ্গিরা হাল ছেড়ে দেয়। একজন অবশ্য বলেছিলো গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করতে কিন্তু মানসুরের গাড়ি ডিসকো থেকে বের করতে করতে ওটা আরেক মুলুকে চলে যাবে। সুতরাং সিনেমা-স্টাইলে গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করার বুদ্ধিটা নিতান্তই বালখিল্যতা। তাছাড়া করাচির এক মসজিদে বোমা হামলারপর থেকে শহরের নিরাপত্তায় নেমেছে মিলিটারি। এমন সময় গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করতে গেলে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হতে হবে। মিলিটারির হাতে বেঘোরে মারা যাবার সম্ভাবনা আছে। ওরা তো আর বুঝবে না এক বাহেনচোদ্দ তার বউকে নিয়ে ভেগেছে!
আজকের রাতের মধ্যেই ওই হারামজাদাকে খুঁজে বের করতে হবে, এটা স্পষ্ট করে বলে দেবার পর তার খুব ঘনিষ্ঠ হাবিবের কথা শুনে মাথায় রক্ত ওঠার জোগাড় হয়েছিলো। ভাই আপনার বিবিসাবই তো ওকে গাড়িতে করে নিয়ে চম্পট দিলো। উনাকে ধরলেই জানা যাবে চুতিয়েটা কোথায় থাকে, তাই না?
হুম। কথাটাতে যুক্তি আছে কিন্তু সে তো সব খুলে বলতে পারছে না, নিজের শ্বশুড়বাড়িতে তার ঢোকাই নিষেধ। অনেক কষ্টে রাগ দমন করে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলো। তার বউ কখনও বলবে না ঐ লোকটা কোথায় থাকে। গায়ে হাত তুললেও না। বরং শূয়োরটাকে জানিয়ে দেবে, আর তার ভয়ে সে সটকে পড়বে অন্য কোথাও। সুতরাং বিবিকে এসব না বলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
ছয়জন যুবকের দলটি এ কথার সাথে সায় না দিয়ে পারে নি। এ কথাতেও যুক্তি আছে! কিন্তু রাতের মধ্যে অজ্ঞাত এক লোককে তারা কিভাবে খুঁজে বের করবে? চেনাজানা হলে না-হয় কথা ছিলো।
ঠিক তখনই হাবিবের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। ছেলেটা ভীতুর ডিম হতে পারে কিন্তু তার মাথা বেশ পরিস্কার। এজন্যে সব সময় ওকে সঙ্গে রাখে। একজন সাহসী মানুষের সাথে বুদ্ধিমান কেউ থাকলে আর কি কিছু লাগে এই দুনিয়াতে?
তো, হাবিবের আইডিয়াটা একদিক থেকে খুব সহজ ছিলো। শোনামাত্রই সে বুঝে গেছিলো, জোর-জবরদস্তি ছাড়াই কাজটা করা সম্ভব। যদিও জোর জবরদস্তি করার মতো লোকবল আর মেশিন আছে তাদের সঙ্গে। তারপরও প্রথমে সে-দিকে যায় নি। সময় নষ্ট না করেই হাবিবের হাতে বিশ হাজার রুপি তুলে দেয়। যাও, যেমনে পারো কাজটা করো। দরকার পড়লে আরো দেবো। সে জানতো, পিস্তল ব্যর্থ হলেও টাকা ব্যর্থ হয় না।
এটা আরেকবার প্রমাণিত হয়েছে আজ।
*
বিষণ্ণ মুখে আইনাত গাড়ি চালাচ্ছে। যে দুঃসহ জীবনের কথা ভুলে ডান্সফ্লোরে মেতে থাকতো সে-সব কথা বলতে গিয়ে যেনো হুট করে আবিষ্কার করেছে, তার জীবনটা আসলে অনিশ্চিত এক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। এরকম জীবন তার মতো এক মেয়ের মোটেও কাম্য নয়।
বাস্টার্ড চুপ মেরে আছে। আর কোনো প্রশ্ন করে মেয়েটাকে তার দুঃসহ স্মৃতির মধ্যে নিপতিত করার ইচ্ছে নেই। তার মিশন মওলানা ইউসুফ-ওই লোকের নাগাল পাবার জন্যই এতো কিছু করছে সে। আইনাতের কাছ থেকে যতোটুকু জানার জেনেছে, তবে তাতে তার বাবা সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য নেই। এ মুহূর্তে আর কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। ভাগ্য ভালো থাকলে, আবারো দেখা হবে ওদের। তখন হয়তো চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।
“আজকের পর কি তুমি আমার সাথে দেখা করবে?” আস্তে করে জানতে চাইলো সে। “তোমার হাজব্যান্ড তো জেনে গেছে তুমি আলীর ডিসকোতে যাও…সম্ভবত ওখানে ওর কোনো লোক আছে।”
“হুম, তা আছে। সব সময়ই একদঙ্গল গুণ্ডা-পাণ্ডা নিয়ে ঘোরে, তবে আমি ওকে খুব একটা পাত্তা দেই না। ভয়ও পাই না,” গাড়ি চালাতে চালাতে বললো মেয়েটি।
“তুমি অনেক সাহসী।”
মুচকি হাসলো আইনাত। “ঠিক তা নয়…তবে ও আমার তেমন ক্ষতি করতে পারবে না। আমার আব্বাকে ও খুব ভয় পায়।”
“তাহলে তুমি আবার আলীর ডিসকোতে আসছো?”
“অবশ্যই।”
“যাক, তোমার সাথে দেখা হচ্ছে আবার,” স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।
“না।”
“না?” আৎকে উঠলো বাস্টার্ড।
“তুমি আর আলীর ডিসকোতে যাবে না। ও তোমাকে ছেড়ে দেবে না। মানসুর আস্ত একটা জানোয়ার। তুমি ওকে চেনো না। ও সবই করতে পারে।”
“তাহলে তোমার সাথে…?”
রাস্তা থেকে অল্প সময়ের জন্য চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকালো মেয়েটি। “দেখা হবে তবে ওখানে না…অন্য জায়গায়…”
হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।
মুচকি হাসলো আইনাত। “আমার ফোন নাম্বার রাখো…তোমারটাও দাও…আমরা কন্ট্যাক্ট করে দেখা করবো।”
“দ্যাটস গুড,” খুশিতে বলে উঠলো সে। “তুমি তোমার নাম্বারটা বলল, আমি সেভ করে রাখছি।”
গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন নাম্বারটা বলে গেলো আইনাত।
“ওকে, আমি তোমাকে মিসকল দিচ্ছি…তুমি সেভ করে রেখো,” মেয়েটার নাম্বারে একটা কল দিলো।
“এই হোটেলটা না?” সামনের দিকে দেখিয়ে বললো আইনাত।
“হুম।” হোটেল সামুনাবাদের কাছে চলে এসেছে তারা।
“মাই গড!” গাড়িটা হোটেলের কাছে আসতেই সে বলে উঠলো।
“কি হয়েছে?”
“ফাক ফাক!” মেয়েটা গাড়ির গতি বাড়িয়ে চলে গেলো হোটেল সামুনাবাদ পেরিয়ে আরো সামনের দিকে।
বাস্টার্ড বুঝতে না পেরে তাকালো আইনাতে দিকে। “কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছো?”
“ঐ মাদারফাকারটা তোমার হোটেলে এসে পড়েছে!”
“কি?!” এটা কিভাবে সম্ভব! জাভেদ ছাড়া আর কেউ জানে না সে কোন্ হোটেলে আছে! তাহলে কি জাভেদ বলে দিয়েছে? আনমনেই মাথা দোললো না সে। “তুমি কি তোমার হাজব্যান্ডকে হোটেলে দেখেছো?”
“না। আমি ওর গাড়িটা দেখেছি হোটেলের বাইরে…” বললো আইনাত। “…ওর গাড়িটা আমি ভালো করেই চিনি। বিয়ের সময় ঐ গাড়িটাই আব্বা আমাদেরকে দিয়েছিলো।”
কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধিকর হয়ে গেলো সে। “কিন্তু ও কিভাবে জানতে পারলো আমি ওখানে উঠেছি?”
বাস্টার্ডের দিকে ফিরে তাকালো মেয়েটি, “আমার মাথায়ও কিছু ঢুকছে না\প[;লন।”
“শিট!” রাগেক্ষোভে বলে উঠলো।
“ওই জানোয়ারটা থেকে তোমাকে দূরে থাকতে হবে…নইলে…”
“নইলে কি? ও আমাকে মেরে ফেলবে?”
বাঁকাহাসি দিলো আইনাত। “তোমার কি ধারণা ও তোমাকে কিল-ঘুষি দেবার জন্য তোমার হোটেল পর্যন্ত চলে এসেছে?”
“তুমি আর ঐ হোটেলে থাকতে পারবে না।”
“সমস্যা নেই…অন্য একটা হোটেলে উঠবো।”
আইনাত তার দিকে চকিতে তাকালো। “পাসপোর্ট, লাগেজ…পাবে কোথায়?”
ভুরু কপালে উঠলো তার। “ওগুলো তো ঐ হোটেলের রুমে!”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মেয়েটি। “ফাঁক।”
“কি?”
“আজ রাতে তুমি আর ওখানে ফিরে যেতে পারবে না। আমি নিশ্চিত, ওখানে ওর লোক আছে।”
“বলো কি!”
“ওরা যখন তোমার হোটেলের খোঁজ পেয়ে গেছে তখন নিশ্চয় তোমার জন্য ওয়েলকাম পার্টির ব্যবস্থাও করেছে।”
“তাহলে আমি কোথায় উঠবো এখন?” আৎকে উঠলো সে। “পাসপোর্ট ছাড়া তো একজন বিদেশীকে কোনো হোটেলই তুলবে না।”
“তুমি যদি পাকিস্তানীও হতে তারপরও আজরাতে ন্যাশনাল-আইডি ছাড়া তোমাকে কেউ তুলতো না। করাচিতে বোমা ফুটেছে। এখন আবার বোম্বাইতে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। পথেঘাটে চেকিং বেড়ে যাবে। হোটেলগুলোও আইডিকার্ড কিংবা পাসপোর্ট ছাড়া কাউকে তুলবে না।”
“মাই গড!” অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো বাস্টার্ড।
অধ্যায় ৪৮
সামুনাবাদ হোটেলের ম্যানেজারের পক্ষে মানসুর রাঙ্গুওয়ালার কোনো অনুরোধ যে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব হয় নি তার কারণ লোকটার প্রতিপত্তি নয়। করাচিতে এরকম ক্ষমতাবান লোক প্রচুর আছে। কারো আছে রাজনৈতিক খুঁটির জোর, কারোর আবার জঙ্গি-সন্ত্রাসী দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা। সেনাবাহিনী, আইএসআই-র সদস্য, বিভিন্ন প্রদেশ আর অঞ্চলের জমিদারদের দাপট তো পাকিস্তানের ঐতিহ্যের সাথেই জড়িয়ে আছে। তবে এখানে সবচাইতে বেশি খাতির করা হয় টাকাওয়ালাদের। মানসুর রাঙ্গুওয়ালার টাকা এবং পারিবারিক প্রতিপত্তি দুটোই আছে। তাকে ফিরিয়ে দেয়াটা প্রায় অসম্ভব।
এক হাজার রুপি! একজন বোর্ডার রুমে আছে কিনা এটা জানতে একহাজার রুপি?
মানসুর রাঙ্গুওয়ালার হয়ে তার ঘনিষ্ঠসহচর হাবিবই প্রস্তাবটা দিয়েছে ম্যানেজারকে। আলীর ডিসকো’তে সে-ই নজরদারি করছিলো আইনাতের উপরে। এ কাজে নেমে প্রথম দিনই সে দেখতে পায় এক সুদর্শন যুবকের সাথে মানসুরের স্ত্রী দহরম-মহরম করছে। এখন তারা জানতে পারছে লোকটার নাম তওফিক আহমেদ।
এই লোকটা তাদের কাছে একদম অচেনা ছিলো। কোত্থেকে এসেছে, কোথায় থাকে কিছুই জানতো না। পরে যখন মানসুর চাইলো লোকটার পরিচয় খুঁজে বের করতে হবে, সে কোথায় থাকে তা জানতে হবে, তখন খুব সহজেই হাবিবের মাথায় আইডিয়াটা চলে আসে। আলীর ডিসকোতে ওকে এমন একজনের সাথে কথা বলতে দেখেছে যাকে অল্পবিস্তর চেনে।
মানসুর যখন তার হাতে বিশ হাজার রুপি ধরিয়ে দিলো তখন মনে মনে খুশিই হয়েছিলো। ইয়াসিনের মতো একজনকে কিনতে বড়জোর পাঁচ হাজার রুপি লাগবে-এই হিসেবটা আগেভাগেই করে নিয়েছিলো সে। সত্যি বলতে, কোনো টাকা না দিয়েও শুধুমাত্র ভয়-ভীতি দেখিয়ে ছেলেটার পেট থেকে কথা বের করতে পারতো।
যাকগে, পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে যা পেয়েছে সেটার মূল্য কম করে হলেও পঞ্চাশ হাজার টাকা। কিংবা আরো বেশি। অবশ্যই সেটা মানসুরের কাছে!
ইয়াসিনকে প্রথমে সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছে সে যা জানতে চায় তা না বললে কি পরিণাম হতে পারে। তারপর পাঁচ হাজার রুপি ধরিয়ে দেয় ছেলেটার হাতে। দুই ধরণের চাপে পড়ে ইয়াসিন যা যা জানতো সবই বলে দিয়েছে তাদের। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিলো লোকটর নাম আর কোথায় থাকে সেটা জানা। ইয়াসিন বলেছে তওফিক নামের লোকটা লন্ডন থেকে এসেছে। তার এক কাজিন ওর গাইড হিসেবে কাজ করেছে কয়েকদিন। সেই সুবাদেই যতোটুকু জানার সে জানে। আর হোটেল সামুনাবাদের কথাটাও ঐ কাজিনের কাছ থেকেই সে শুনেছে। তাদের ডিসকোতে একজন বিদেশী আসবে কয়েকটা দিন আর সে কিছু তথ্য জানতে চাইবে না? তবে রুম নাম্বার কতো সেটা তার জানা নেই।
হাবিবের জন্য এর বেশি দরকারও ছিলো না। লোকটার নাম আর হোটেল সামুনাবাদই যথেষ্ট।
ডিসকো থেকে বের হয়ে এসে মানসুরকে চমকে দেয় সে। ঐ হারামজাদাকে চাইছেন? কোনো সমস্যা নেই। আধঘণ্টার মধ্যেই ওকে আপনার হাতে তুলে দেবো।
তারপর দেরি না করে তাদের ছয়জনের দলটি চলে আসে সামুনাবাদে। হারামজাদা আর হোটেলে ফেরে নি। সম্ভবত রেন্ডিটাকে নিয়ে কোথাও ফুর্তি করছে। তারা প্রায় একঘণ্টা অপেক্ষা করার পর বুঝে যায় চিড়িয়া আজ রাতে হোটেলে নাও ফিরতে পারে। হয়তো কোনোভাবে সে বুঝে গেছে তাদের আগমনের খবর। তারপরও তাদের দলের সাহসী দু-জনকে সামুনাবাদে রেখে চলে আসে তারা। ঐ বাহেনচোদ্দটা হোটেলে ঢুকলেই তাকে কজায় নিয়ে নেবে ওরা। হোটেল কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে মাথা ঘামাবে না। এমনটাই আশ্বাস দিয়েছে। ম্যানেজার।
মানসুর রাঙ্গুওয়ালার নাকের অবস্থা যা-তা। ঐ লোক তাকে এমনভাবে মেরেছে যে, সম্ভবত বাকি জীবন এই চিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে তাকে। নাকটা একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নাকের হাড্ডি একবার ভেঙে গেলে নাকের আকার চিরতরের জন্য বদলে যায়। সেটা আর আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া যায় না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে বিদ্যুৎগতিতে আঘাত হেনে ছয় ফুট দুই ইঞ্চির দেহটাকে কাবু করে ফেলে। হাবিব জানে খুব জলদি তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার। বেচারা জোর করে নিজের দুরাবস্থা লুকিয়ে রেখেছে।
হোটেল সামুনাবাদের মেইনগেটের বাইরে প্রোটন সাগা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মানসুর রাঙ্গুওয়ালা রুমাল দিয়ে নাক চেপে রেখেছে এখনও। রক্তপাত বন্ধ হলেও শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার সময় মাঝেমধ্যেই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে, তাই রুমাল দিয়ে নাকটা চেপে না রেখে উপায় নেই।
হাবিব মুচকি হেসে তার দিকে এগিয়ে গেলো।
অধ্যায় ৪৯
আইনাতের গাড়িটা কোথায় যাচ্ছে বাস্টার্ড জানে না, এ নিয়ে তার কোনো আগ্রহও নেই, তার মাথায় এখন একটাই চিন্তা, এতো রাতে করাচির মতো শহরে পাসপোর্ট ছাড়া সে কোথায় গিয়ে উঠবে!
“চিন্তায় পড়ে গেছে মনে হয়?”
মেয়েটার দিকে তাকালো সে। মুখ টিপে হাসছে! কে জানি বলেছিলো পুরুষ মানুষকে বিপদে পড়তে দেখলে মেয়েরা এক ধরণের সুখ পায়। আইনাত কি সেই সুখ পাচ্ছে? তার এমন ঘোরতর বিপদেও?
“চিন্তা করবো না? তুমি বুঝতে পারছো কোন্ বিপদে পড়েছি?” অসহায়ের মতো বলে উঠলো সে।
“অবশ্যই বুঝতে পেরেছি। আমিই তো বিপদটার কথা খুলে বললাম তোমাকে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো বাস্টার্ড। “হুম, তা ঠিক।”
“আজকে তোমার যে পরিচয় পেলাম তাতে তো মনে হচ্ছে তুমি খুব সাহসী…ঐ জানোয়ারটাকে যেভাবে তুড়ি বাজিয়ে ঘায়েল করে ফেললে…” একটু থেমে আবার বললো, “আমি জীবনেও এরকম দেখি নি। মাইন্ড ব্লোয়িং!”
বাস্টার্ড কিছু বললো না। কোনো বাঘ যদি বিপদে পড়ে অসহায় হয়ে যায় তখন তাকে বাঘেরবাচ্চা বলে প্রশংসা করাটা এক ধরণের পরিহাস।
“কি ভাবছো?”
“না। কিছু না।”
“নিশ্চয় কিছু ভাবছো,” জোর দিয়ে বললো আইনাত। “কোথায় থাকবে…পরিচিত কেউ আছে কিনা…এসব ভাবছো তো?”
মেয়েটার দিকে চেয়ে রইলো বাস্টার্ড।
“এরকম কেউ আছে?” ভুরু নাচিয়ে বললো এবার।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
“নেই?”
রেগেমেগে বললো এবার। “আমাকে নিয়ে চিন্তা করার দরকার নেই। ধন্যবাদ।”
“বাহ্, আমি চিন্তা না করলে কে করবে?”
স্থিরচোখে চেয়ে রইলো সে।
“আমার জন্যই তো আজ তোমার এই অবস্থা…আমি একটু চিন্তা করবো না?”
“তোমার খুব গিল্টি ফিলিংস হচ্ছে?”
“হুম।”
“তাহলে যথেষ্ট হয়েছে। এখন এসব বন্ধ করো।”
“আমি এসব বন্ধ করলে কি তোমার সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে?”
কিছু বললো না বাস্টার্ড। সে বুঝতে পারছে মওলানার মেয়ে অতিরিক্ত হুইস্কি পান করার কারণেই এমন হেয়ালি কথাবার্তা বলছে। হুইস্কি তার ক্রিয়াকর্ম শুরু করে দিয়েছে। এর সঙ্গে থাকলে আরো জ্বালাবে। কিন্তু একে ছেড়েই বা কোথায় যাবে? পুরোপুরি নিশ্চিত না-হয়ে জাভেদকেও ফোন করতে পারছে না। আইনাতের স্বামীকে তার সম্পর্কে এতোসব খবর কে দিলো-এ ব্যাপারে নিশ্চিত না-হয়ে ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করা মানে ফাঁদে পা দেয়া।
“কি…কিছু বলছে না যে?”
মেয়েটার দিকে তাকালো সে। “একটা পপুলার ডায়লগ বলতে ইচ্ছে করছে তোমাকে।”
ভুরু কপালে তুলে ফেললো মেয়েটি। “রোমান্টিক কোনো ডায়লগ না তো?”
“না।”
“তাহলে বলো, শুনি।”
“গো হোম। ইউ আর ড্রাঙ্ক।”
হা-হা-হা করে হেসে উঠলো আইনাত। “আমি মাতাল?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“আমার এসব কথা তোমার কাছে মাতলামি বলে মনে হচ্ছে?”
“হ্যাঁ।” কাটাকাটাভাবে জবাব দিলো।
“মাই গড!” একহাতে মুখ চাপা দিলো মেয়েটি। “তাহলে এখন যে কথাটা বলবো সেটা শুনে কি বলবে?”
ভুরু কুচকে আইনাতের দিকে তাকালো সে। ঠিক তখনই খেয়াল করলো গাড়িটা চলছে না। “গাড়ি থামিয়েছো কেন?”
মওলানার মেয়ে মুখ টিপে হেসে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বোরকার মতো একটি পোশাক বের করে দারুণ দক্ষতায় গাড়িতে বসে থেকেই গায়ে চাপিয়ে নিলো। এরপর মাথায় জড়িয়ে নিলো একটি স্কার্ফ।
বাস্টার্ড বুঝতে পারলো, এই পোশাকেই সে বাড়ি থেকে বের হয়, আবার ঢোকার আগে পরে নেয়।
“পেছনের সিটে যাও,” এবার আদেশের সুরে বললো আইনাত।
“কি?”
“পেছনের সিটে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো।”
“তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না?”
“আমি বাড়িতে ঢুকছি। ওকে? তুমিও যাচ্ছো আমার সাথে,” একটু থেমে আবার বললো, “আমি চাই না গেটের দারোয়ান তোমাকে দেখে ফেলুক।” বিস্ময়ে চেয়ে রইলো সে। “আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে।”
“এছাড়া তো আর কোনো উপায় দেখছি না।”
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোমার বাড়ির লোকজন আছে?!”
“বাবা আর ভাই থাকে ওদের বিল্ডিংয়ে…আমি থাকি আলাদা বিল্ডিংয়ে। শুধু ঢোকার রাস্তা একটা। সুতরাং কোনো সমস্যা হবে না।”
“কাজের লোকজন?”
“আমি না ডাকলে ওরা কেউ আমার ফ্ল্যাটে আসে না। আমি আমার মতো থাকি।”
বাস্টার্ড নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মওলানা ইউসুফের বাড়িতে ঢোকার এমন একটা সুযোগ চলে আসবে স্বপ্নেও ভাবে নি।
“ওকে।” সৌভাগ্যকে ফিরিয়ে দেবার মতো বোকা সে নয়। “তুমি যখন বলছো…”
“এখন পেছনে চলে যাও,” মুচকি হেসে বললো আইনাত। বাস্টার্ড বাইরে তাকালো। গুলজার-এ-হিজরি’র ঢোকার মুখে যে রাস্তা আছে সেখানে তাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে মওলানার বাড়ি খুব কাছেই। দরজা খুলে যে-ই না বের হবে অমনি টের পেলো তার ফোনটা ভাইব্রেট করছে। “এক্সকিউজ মি।” বলেই গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে কলটা রিসিভ করলো। “হ্যাঁ, বলো জাভেদ?”
“ভাই, আপনি কোথায়? ঠিক আছেন তো? আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে ফোন করে যাচ্ছি…”
সে বুঝতে পারছে না এই কলটি কোনো উদ্বিগ্ন লোকের নাকি ফাঁদে ফেলার কোনো কৌশল। “হুম, ঠিক আছি।”
“আপনি সামুনাবাদে যাবেন না, আল্লাহর কসম লাগে। ওরা ওখানে আছে!”
জাভেদের কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো সে। “ওরা কিভাবে জানলো আমি ওখানে আছি?”
“আপনাকে কী বলবো…আমার ভাই ইয়াসিন…ওই বাহেনচোদ্দটা ওদের বলে দিয়েছে। হারামজাদা ভয় পেয়ে বলেছে…বুঝলেন…তারপরও আমি ওকে ছাড়বো না। এটা তো আমার সঙ্গে গাদ্দারি করা হলো!”
জাভেদের কণ্ঠে রাগের বহিপ্রকাশটি যে একদম নির্ভেজাল সেটা বুঝতে পারলো সে। “শোনো, জাভেদ,” একটু থেমে আবার বললো, “তুমি ইয়াসিনকে কিছু বোলো না, আর আমিও হোটেলে যাচ্ছি না আজ।”
“আমিও সেটাই বলছি। আজকে আর হোটেলে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আপনি থাকার জায়গা নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না…আপনি আমার ওখানে থাকবেন।”
হাসলো সে। ভাগ্য কতো দ্রুতই না বদলে যায়। একটু আগেও সে ভেবে পাচ্ছিলো না কোথায় থাকবে-আর এখন দু-দুটো জায়গা পেয়ে গেলো। “শোনো, জাভেদ। থাকার জায়গা পেয়ে গেছি। তুমি এ নিয়ে চিন্তা কোরো না। কাল তোমার সঙ্গে কথা হবে। ওকে?”
একটু চুপ থেকে জাভেদ ওয়ার্সি বলে উঠলো, “ওকে, ভাই।”
বাস্টার্ড ফোনটা রেখে গাড়ির কাছে চলে গেলো আবার। পেছনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই বললো, “সরি। একটা জরুরি ফোন ছিলো।”
“ইটস ওকে। মেইনগেটের সামনে আসার আগে শুয়ে পড়বে। ঠিক আছে?”
“ওকে।”
আইনাতের গাড়ি তাদের বাড়ির মেইনগেটের সামনে চলে আসতেই আস্তে করে সিটের উপরে শুয়ে পড়লো সে। হর্ন বাজালো মেয়েটি। পর পর কয়েকবার। শব্দ করে গেটটা খোলার আওয়াজ কানে গেলো। কয়েক মুহূর্ত পরই গাড়িটা ঢুকে পড়লো ভেতরে।
স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। মওলানা ইউসুফ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারবে না, তার খুনি তারই মেয়ের গাড়িতে করে তার বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলো!
হঠাৎ করেই তার মনে হলো, করাচি অপারেশনটি এক লহমায় পানির মতো সহজ হয়ে গেছে। এখন মওলানার কপালে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেয়া কোনো ব্যাপারই হবে না।
গাড়িটা ব্রেক করে থামতেই তার চিন্তা-ভাবনাও আচমকা ঝাঁকি খেলো। কিন্তু আমার পিস্তল!