৪০
আজকে আজাদের প্রথম অপারেশনে যাওয়া ৷ দুপুরবেলা বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করতে করতে আজাদ মাকে বলে, ‘মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ৷ আজকে রাতে ফিরব না ৷’
মা বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস ?’
আজাদ বলে, ‘যাব একদিকে ৷ দোয়া কোরো ৷ ইনশাল্লাহ কালকে ফিরে আসব ৷’
মা বলেন, ‘একা যাবি ?’
আজাদ বলে, ‘না ৷ কাজী, জুয়েল ওরাও যাবে ৷ মা, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না ৷’
মায়ের বুকটা ধক করে ওঠে ৷ শরীরটা অবশ অবশ লাগে ৷ তিনি বুঝতে পারেন, ছেলে আজকে এমন কোথাও যাবে, যেটা ঠিক সে বলতে চায় না ৷ তিনিও আর বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করেন না ৷
শেভ করা হয়ে গেলে ছেলের মুখের দিকে তিনি তাকান ৷ ছেলের ফরসা গাল ৷ শেভ করার পরে সবুজ হয়ে আছে ৷ তিনি বলেন, ‘ভাত খেয়ে যাবে তো ?’
আজাদ বলে, ‘হুঁ ৷’
মা তাড়াতাড়ি করে ভাত বাড়েন ৷ আজকে তরকারি তেমন ভালো নয় ৷ যুদ্ধের কারণে আজাদের ব্যবসাপাতি বন্ধ ৷ ঘরে টানাটানি চলছে ৷ বাজার তেমন করে আর করা হয় না ৷ ছেলে তাঁর কী খেয়ে যাবে ? তিনি তাড়াতাড়ি একটা ডিম ভাজতে চলে যান ৷ তখন তাঁর মনে হয়, ছেলের পরীক্ষার দিনে তিনি তাকে কিছুতেই ডিম খেতে দিতেন না, দেখতেও দিতেন না ৷ আজ ছেলে তাঁর যে অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তাতে তো ডিম খেতে অসুবিধা নাই ৷ নিশ্চয় নাই ৷
আজাদেরও মনের মধ্যে উত্তেজনা ৷ উত্তেজনা বেশি হলে তার বারবার পেশাব পায় ৷ সে এরই মধ্যে দুবার জলবিয়োগ করে এসেছে ৷ সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না ৷ ঘাড় না ঘুরিয়ে সামনে নাকের দিকে তাকিয়ে থাকছে ৷ ব্যাপারটা আর কারো চোখে ধরা পড়ছে না বটে, মায়ের চোখে ঠিকই পড়ছে ৷ মা অবশ্য কিছুই বলছেন না ৷
আজাদের বাঁ চোখের পাতা লাফাতে শুরু করে দেয় ৷ এটা কেন হচ্ছে ? এর মানে কী ?
আজাদ ভাত খেতে বসে ৷ ভাতও সে খাচ্ছে মুখ নিচু করে ৷ মা লক্ষ করেন, আজাদ ভাত মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে না, গিলে ফেলছে, বারবার গেলাসে করে পানি খাচ্ছে ৷ মা মুখটা হাসি হাসি করে বলেন, ‘আস্তে আস্তে খাও বাবা, চিবিয়ে চিবিয়ে খাও ৷ পানি পরে খেও ৷’
মা যখন সিরিয়াস হয়ে যান, তখন আজাদকে ‘তুমি’ করে বলেন ৷
ভাত খেয়ে উঠে আজাদ কাপড়-চোপড় গোছাতে থাকে ৷ একটা ছোট্ট হাতব্যাগে দুটো ঘরে-পরার কাপড় নেয় ৷ কাজটা করার সময় সে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে, এলভিস প্রিসলির গান ৷
তারপর বোনদের ঘরে উঁকি দেয় ৷ মহুয়ার একটা বাচ্চা হয়েছে ৷ সে ঘরে যাওয়া যাবে কি না, কে জানে ৷ দরজায় দাঁড়িয়ে সে গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে তারপর গলা খাঁকারি দেয় ৷ তারপর বলে, ‘মহুয়া, শরীর ঠিক আছে ?’
‘জি দাদা ৷’
‘বাবুটা রাতে খুব কেঁদেছে মনে হলো ?’
‘জি দাদা ৷ কী যে হইছিল ৷’
‘কিরে কচি, তোর কী অবস্থা ? রোজ দশটা করে অঙ্ক করতে বলেছিলাম, করেছিস ?’
‘জি দাদা ৷’ কচি ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় ৷ দাদা যদি এখন খাতা আনতে বলে তাহলেই সে ধরা পড়ে যাবে ৷
দাদা তেমন কিছুই বলে না ৷ সে বেঁচে যায় ৷
‘জায়েদ কই ?’ আজাদ বলে ৷
মা বলেন, ‘ও তো বাইরে গেছে ৷’
আজাদ বলে, ‘ওকে বেশি বাইরে যেতে মানা কোরো ৷’
মা বলেন, ‘ও তোকে মানে বেশি ৷ তুই একদিন ভালো করে কড়া করে বুঝিয়ে বলিস ৷’
‘আচ্ছা ৷’ আজাদ তার ঘরে আসে আবার ৷ জর্জ হ্যারিসনের গান লেখা কাগজটা সঙ্গে নেয় ৷ সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার ঠিক আছে কিনা পরখ করে ৷ তারপর মায়ের সামনে এসে তাঁর মুখের দিকে তাকায় ৷ এই প্রথম সে গত এক ঘন্টায় মায়ের মুখের দিকে তাকাল ৷ ঠোঁটটা কামড়ে ধরে মুখে একটা ঝাঁকি দিয়ে সে বলে, ‘যাই তাহলে ৷’
মা বলেন, ‘বাবা, যাই না, বলো আসি ৷’
আজাদ বলে, ‘আসি ৷ দোয়া কোরো ৷’
মা বলেন, ‘সাবধানে থেকো ৷ সাবধানে চোলো ৷ বিসমিল্লাহ করে বের হয়ো ৷ বিপদে লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা পোড়ো ৷ মাথা ঠাণ্ডা রেখো ৷’
আজাদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলে, ‘ওকে ওকে ৷’
সে আর পেছনে তাকায় না ৷ সোজা বের হয়ে বেবিট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে যায় ৷
মা তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷ ছেলে অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেন তার চলে যাওয়ার দিকে ৷
কাজী কামালের নেতৃত্বে জনা-দশেক মুক্তিযোদ্ধা যাচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা সার্ভে করতে ৷ মেজর খালেদ মোশাররফ কাজী কামালকে মেলাঘর থেকে অস্ত্রশস্ত্র আর লোকজন দিয়ে পাঠিয়েছেনই সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ৷ এটা করতে পারলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগটা অন্ধকার হয়ে পড়বে ৷ এর আগে দুবার যোদ্ধারা চেষ্টা করেছিল এটা উড়িয়ে দিতে, পারেনি ৷ এবার কাজী কামালের দল বেশ ভারী ৷ ১০ জনের গ্রুপ নিয়ে সে ঢুকেছে ঢাকায় ৷ একটা সাড়ে তিন ইঞ্চি রকেট লাঞ্চারও আনা হয়েছে ৷ ৮ টা রকেট শেল ৷ ভীষণ ভারী ৷ রকেট লাঞ্চার চালানোর জন্যে আর্টিলারির গানার দেওয়া হয়েছে ৷ তার নাম ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম ৷ আর আছে কানা ইব্রাহিম ৷ এক চোখ কানা তার ৷ কোনোভাবে যদি পাওয়ার স্টেশনের ভেতরে ঢোকা না যায়, বাজার থেকে শেল মারলে কী হয়! এই হলো মেলাঘরের পরামর্শ ৷ অস্ত্রের মধ্যে আরো আছে দুটো এসএলআর, সঙ্গে আন্যার্গা লাঞ্চার ৷ প্রত্যেকের জন্যে একটা করে স্টেনগান, চারটা ম্যাগাজিন, দুটো গ্রেনেড আর অসংখ্য বুলেট ৷
ভাদ্র মাস ৷ আকাশে মেঘ ৷ তাই একটা গুমোট ভাব ৷ সন্ধ্যার পরে বাড্ডার ওপারের পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউট থেকে দুটো নৌকাযোগে গেরিলারা রওনা হয় সিদ্ধিরগঞ্জের দিকে ৷ বেরুনোর আগে আজাদ বুকপকেট থেকে বের করে একবার দেখে নেয় জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা ৷ তারপর আবার সেটা রাখে যথাস্থানে ৷ তারা দুটো নৌকায় ওঠে ৷ একটা নৌকায় বদি, কাজী, জুয়েল, আরো দুজন ৷ আরেকটা নৌকায় আজাদ, জিয়া, ইব্রাহিম, রুমী ৷ নৌকা চলতে শুরু করলে বাতাস এসে গায়ে স্পর্শ রাখে, একটুখানি শীতল হয় শরীর ৷ এখনও অন্ধকার তেমন ঘন হয়ে নামেনি ৷ আজাদ উত্তেজিত ৷ তার হাতে একটা স্টেনগান ৷ বলা যায় না, হয়তো আজই তার শত্রুর দিকে গুলি ছোড়ার উদ্বোধন হতে পারে ৷ উত্তেজনা গোপন করতে সে গান ধরেছে, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা কজন নায়ের মাঝি, হাল ধরেছি, শক্ত করে রে ৷ সামনের নৌকা থেকে তার গান শুনে জুয়েল বলে, ‘ঢেউয়ের সাগর নারে, এইটা আসলে ডোবা ৷ গানটা হইব : ব্যাঙ-ডাকা এই রামপুরা বিল পাড়ি দিমু রে, আমরা কয়জন কাউবয়…’
সামনে কাজী কামালদের নৌকা ৷ সবাই যার যার স্টেনগান নৌকার পাটাতনে নামিয়ে রেখেছে ৷ কারণ কেউ অস্ত্র দেখে ফেললে তাদের আসার উদ্দেশ্যই মাটি হয়ে যাবে ৷ কিন্তু বদি কিছুতেই তার স্টেনগান নামিয়ে রাখবে না ৷ সে রেখেছে তার কোলের ওপরে ৷
কাজী কামাল এই অপারশেনের কমান্ডার ৷ সে বলে, ‘বদি, স্টেনটা নামায়া রাখো ৷’
বদি গম্ভীর গলায় বলে, ‘আপনেরা নামায়া রাখছেন রাখেন ৷ আমারে কন ক্যান ৷ আর্মি আসলে কি বুড়া আঙুল টাইনা ইনডেঙ্ দিয়া গুলি করব ? নেভার ৷ আই অ্যাম আ ফাইটার অ্যান্ড আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি টু শুট…’
আজাদ বদির কথা শুনে অবাক ৷ কাজী না এই অপারেশনের কমান্ডার ৷ তার আদেশ কি বদির মেনে নেওয়া উচিত ছিল না ৷
দুই নৌকা ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পাওয়ার স্টেশনের কাছাকাছি ৷ সব নিস্তব্ধ ৷ কেবল নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না ৷ অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়ছে ৷ আকাশে মেঘ থাকায় তারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে এখানে-ওখানে বিলের মধ্যে ঝোপের ওপরে জোনাকি দেখা যাচ্ছে ৷ আর একটা কিটিকিটি শব্দও যেন আছে ৷ ঝোপেঝাড়ে কি ঝিঁঝিও ডাকছে নাকি ? এর মধ্যে আবার শেয়ালের ডাকও কানে আসে ৷ সামনের নৌকায় কাজী সিগারেট ধরায় ৷ লাইটারের আলোয় হঠাৎ চমকে ওঠে আজাদ ৷ কাজীর মুখে লাইটারের আলো পড়ায় ওর মুখটা কিছুক্ষণের জন্যে ভেসে ওঠে আজাদের চোখে ৷ বন্ধুর মুখ দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করে ৷
আজাদ বলে, ‘আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি ?’
‘ও শিয়োর’-জিয়া জবাব দেয় ৷
আজাদ একটা সিগারেট ধরায় ৷ তার কাছে ব্যাপারটাকে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে ৷ নাজ বা গুলিস্তান সিনেমা হলে সে কত কত যুদ্ধ-চলচ্চিত্র দেখেছে ৷ আজকে সে নিজেই এক যুদ্ধ-অভিযানের কুশীলব ৷
তাদের নৌকা দুটো এগিয়েই চলেছে ৷ সবাই একদম চুপ ৷ কারণ তারা প্রায় সিদ্ধিরগঞ্জের কাছাকাছি এসে পড়েছে ৷ দূরে পাওয়ার স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে ৷ ওখানে আছে পাকিস্তানি সৈন্যদের সতর্ক প্রহরা ৷ তাদের জন্যে এটা খুবই স্পর্শকাতর ও সংরক্ষিত এলাকা, সন্দেহ নাই ৷
ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ৷ এতক্ষণে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে ৷ অন্ধকারের মধ্যেও নিজেদের কে কোথায় বসে আছে, দেখা যাচ্ছে ৷
আজাদ একটা শ্বাস নেয় জোরে ৷ সেই শ্বাস নেওয়ার শব্দটাও তার কানে প্রবলভাবে বাজে ৷ সে কি ভয় পাচ্ছে ?
হঠাৎই সামনে একটা নৌকার মতো নড়তে দেখা যায় ৷ কী নৌকা, কাদের নৌকা, অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না ৷ তবে তাদের মাঝি বাঙালি ৷ সে হাঁক ছাড়ে, ‘কে যায়!’ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই হাঁক প্রলম্বিত হয়ে বিলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন আছড়ে পড়ে ৷
আজাদ ভাবে, হয়তো কোনো সাধারণ নৌকা ৷ বাঙালি কেউ যাচ্ছে ৷ কাজী জবাব দেয়, ‘সামনে যাই ৷’
কাজীর গলার স্বরটাকে যেন খানিকটা, মাঝির স্বরের তুলনায়ও এই পরিবেশে, আগন্তুকের মতো শোনায় ৷
ওই নৌকাটা কাছে আসতেই দেখা যায় : সর্বনাশ ৷ ওই নৌকায় পাকিস্তানি মিলিটারি ৷ একটা মুহূর্ত সময় শুধু ৷ আজাদ এখন কী করবে ? তার সামনে কাজীদের নৌকা ৷ সে ফায়ার ওপেন করলে তো কাজীরা মারা পড়বে ৷ তার নিজেকে দিশেহারা লাগে ৷ বদি কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে স্টেন তুলে ব্রাশফায়ার করে ৷ পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেয় ৷ এই শান্ত নিরিবিলি অন্ধকারে অসাড় হয়ে শুয়ে থাকা বিলটার ওপরে আর মেঘভারে নিথর আকাশটার নিচের সমস্ত স্তব্ধতা তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ৷ প্রতিপক্ষ নৌকা থেকেও গুলি বর্ষিত হয় ৷ অন্ধকারে ফুটে ওঠে আগুনের ফুলকি ৷ বারুদের গন্ধ বাতাসের ভেজা গন্ধে এসে মেশে ৷
আজাদ ঠকঠক করে কাঁপে ৷ সামনে শোনা যায় নৌকার ডুবে যাওয়ার শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ ৷ মানুষ সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে, তাই জলে উঠছে আলোড়ন ৷
আজাদ এরই মধ্যে নৌকার পাটাতনে রাখা অস্ত্র তুলে নিয়েছে ৷ ফায়ার করার জন্যে সে প্রস্তুত ৷ কিন্তু কমান্ডারের অর্ডার ছাড়া ফায়ার করাটা উচিত হবে না ৷ সে চিৎকার করে অর্ডার চায়, ‘কাজী, কাজী…’
কাজী তাড়াতাড়ি বলে, ‘ডোন্ট ফায়ার, ডোন্ট ফায়ার ৷’
আজাদ বলে, ‘ওকে ৷ ওকে ৷’
কাজী বলে, ‘এই, ওই নৌকা এদিকে আনো ৷ এইটা ফুটা হইয়া গেছে ৷ পানি উঠতেছে ৷ কাম শার্প ৷’
আজাদদের নৌকা তাড়াতাড়ি সামনে যায় ৷ এদিকে অন্ধকারে বদির গলা, ‘হেল্প মি, আই অ্যাম গোয়িং টু বি ড্রাউন্ড ৷’ টর্চের আলোয় দেখা যায় বদি পানিতে ভাসছে ৷ ও বোধহয় পড়ে গিয়েছিল ৷ ভাসমান বদিকে নৌকায় তোলা হয় ৷ কাজীরাও নৌকা বদল করে উঠে পড়ে আজাদদেরটায় ৷ ওরা এসে আজাদদের নৌকায় উঠতে না উঠতেই প্রথম নৌকাটা ডুবে যায় ৷
কাজী বলে, ‘দেয়ার বোট হ্যাজ বিন টোটালি ডেস্ট্রয়েড ৷ লেট্স রিট্রিট ৷ স্পিডবোট নিয়া আবার অ্যাটাক করতে আইতে পারে ৷’
পাকিস্তানি সৈন্যদের নৌকাটা ডুবে গেছে ৷ সৈন্যরা হয় গুলিবিদ্ধ অথবা নিমজ্জিত ৷
চারদিক অন্ধকার ৷
একমাত্র নৌকাটি দ্রুত বাইতে বাইতে তারা ফিরে আসছে ৷ দুই নৌকার মাঝি একই নৌকায় ৷ তারা জোরে জোরে দাঁড় বাইছে ৷
জুয়েল বলে, ‘আমার আঙুলে কী যেন হইছে রে ৷’
পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখা যায়, ডান হাতের তিনটা আঙুল গুলিতে জখম ৷ রক্তে জায়গাটা একাকার ৷ মনে হয় গুলি আঙুল ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ৷
আজাদের শরীর কাঁপছে ৷ উত্তেজনায় ৷ জুয়েলের হাতে রক্ত দেখে সে বুঝতে পারে, তারা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরছে ৷
দুই মাঝি নৌকা বাইছে ৷ মনে হচ্ছে, তবুও নৌকার গতি বড় শ্লথ ৷ আজাদ আর জিয়া পানি সেচা থালা হাতে নিয়ে বৈঠা বাওয়ার কাজ করছে ৷
কাজী কামাল হ্যা-হ্যা করে হাসে ৷ ‘আজাদ, আওয়ার এলভিস প্রিসলি, ইজ রোয়িং দ্য বোট ৷ দিস ইজ ফানি ৷’
আজাদ বলে, ‘আরে আমি বিক্রমপুরের পোলা না ? গ্রামে গিয়ে কত নৌকা বেয়েছি ৷’ এবার নৌকা সত্যি দ্রুত এগোচ্ছে ৷ অবশেষে বিলের শেষে ডাঙা দেখা যায় ৷ আকাশে মেঘের ফাঁকে একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে ৷ শাদা পেয়ালায় পানি নিয়ে রংমাখা তুলি ছেড়ে দিলে যেমন রঙগুলো ছড়াতে থাকে, চাঁদের ওপরে মেঘগুলোকে দেখা যাচ্ছে তেমনি ৷ শেয়ালের ডাক কানে আসছে, কুকুরদের সম্মিলিত প্রতিবাদধ্বনিও ৷ জোনাকি এখন অনেক ৷
ডাঙা এসে গেছে ৷ নৌকা ঘাটে ভিড়লে সবাই নৌকা থেকে অবতীর্ণ হয় ৷
রাতটা পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউটেই কাটায় তারা ৷ এটাও আজাদের জন্যে এক নতুন অভিজ্ঞতা ৷ কাঁচা ঘর ৷ প্রাকৃতিক শৌচাগার ৷
জুয়েলের দিকে তাকিয়ে আজাদের মায়া লাগতে শুরু করে ৷ তার হাতের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না ৷ আহা বেচারা এর পরে ব্যাট করতে পারবে তো ৷
হারিকেনের আলোয় জুয়েলের রক্তকে মনে হচ্ছে খয়েরি ৷
এই হারিকেনের আলোতেই বদি একটা চটিবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ৷ কী বই ? আজাদ এগিয়ে যায় ৷ দেখে আলবেয়ার কামুর দি আউট সাইডার ৷ বদির বই পড়ার বাতিকটা গেল না!
কাজী কামাল বেরিয়ে যায় ফার্স্ট এইডের জন্যে সরঞ্জাম জোগাড় করতে ৷ আজাদ বলে, ‘জুয়েল, ব্যথা করছে ?’
জুয়েল বলে, ‘হেভি আরাম লাগতেছে ৷ দেশের জন্যে রক্ত দেওয়াও হইল, আবার জানটাও রাখা হইল ৷ কইয়া বেড়াইতে পারুম, দেশের জন্যে যুদ্ধ কইরা আঙুল শহীদ হইছিল ৷ হা-হা-হা ৷’
আজাদ জুয়েলের কথায় হাসতে পারে না ৷ বোঝাই যাচ্ছে তার খুবই ব্যথা লাগছে ৷ সে ব্যথা ভোলার জন্যে রসিকতা করার চেষ্টা করছে ৷
কাজী কামাল তুলা আর ডেটল জোগাড় করে আনে ৷ জুয়েলের হাতে ফার্স্ট এইড দেওয়া হয় ৷