৪০
রাজ অন্তঃপুরে মহারানী শিরোমণি যেদিন মনোহরাকে পঞ্চম মাসের সাধ খাওয়াচ্ছিলেন, সেদিনই মল্লভূমিতে ঘোর দুর্যোগ ঘনিয়ে এল।
বহুদিন ধরে ছাইচাপা আগুন জ্বলতে জ্বলতে ভয়ের সেই শিখা লকলকিয়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। মল্লরাজ্যের সীমান্তের গ্রামগুলো থেকে লোকজন ছুটে আসতে লাগল রাজধানীর দিকে, ‘ওরা—ওরা আসছে!’
‘কারা? কারা আসছে?’ শান্তিপ্রিয় গ্রামবাসীরা উঁকিঝুঁকি দেয়। তাদের মাটির খড়ের চালাগুলো বাতাসে কেঁপে কেঁপে ওঠে, যেন জানান দেয় আসন্ন বিপদের। কুটীরের লতাগাছগুলো দুলতে থাকে অশুভ কিছুর অগ্রিম সংকেত হয়ে।
অবশেষে এসে পড়ল কালাপাহাড় ঝড়। সঙ্গে দামাল ঘূর্ণি মোঘল চৌকির সেনারা।
কালাপাহাড়ের সৈন্যরা কামরূপ ও উৎকল জয়ের পর এখন হিংস্র পিশাচে পরিণত হয়েছে। উৎকল থেকে সোজা পূর্বদিকে ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে তারা, পথে যে গ্রাম পড়ছে, সেগুলোকে ছারখার করে দিচ্ছে। চলছে যথেচ্ছ অত্যাচার, লুণ্ঠন, ধ্বংসলীলা।
নিস্তার পাচ্ছে না বাড়ির মেয়েবউরাও। কোনো সেনা বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য সকলের সামনেই বলপূর্বক টেনে উন্মোচিত করে দিচ্ছে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকা কূলবধূর বক্ষের আঁচল, কোন সেনা আরো সাহসী হয়ে প্রকাশ্য জনপথে হিড়হিড় করে টেনে এনে জাপটে ধরছে কোনো সুশীলা কিশোরীকে।
এই অঞ্চলে প্রতিটা গ্রামই প্রায় হিন্দু অধ্যুষিত, পুরুষদের ওপরও চলছে অবাধে প্রহার। কোনও কোনও সেনা রঙ্গ দেখার আশায় নিজের ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে নিচ্ছে কোনো দরিদ্র ব্রাহ্মণের ব্রহ্মশিখা, ঘোড়া ছোটার সঙ্গে সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণের করুণ আর্তনাদে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে উঠছে।
তবে ওইটুকুই। এই সব সামান্য গ্রামের নারীদের বলাৎকার বা পুরুষদের ধর্মান্তর করার সময় এখন নেই। সিপাহশালারের কড়া নির্দেশ সোজা গিয়ে থামতে হবে মন্দিরনগরী বিষ্ণুপুরে।
কংসাবতী নদী অতিক্রম করে পাঠান সেনারা আরও এগিয়ে আসতেই দুঃসংবাদ পৌঁছে গেল মল্ল রাজসভায়।
যে গুপ্তচর সংবাদ নিয়ে এল, সে অনেকখানি পথ প্রবল গতিতে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘কালাপাহাড় আসছে মহারাজ! সব তছনছ করতে করতে আসছে!’
অমাত্যরা সচকিত। মৃদু গুঞ্জন উঠল, আশঙ্কার ছায়া ঘনাল। সংবাদ সংগ্রহের কাজ গোপনে করলেও উত্তেজনায় গুপ্তচর রাজধানীতে প্রবেশের পর সংবাদ চেপে রাখতে পারেনি। যে কয়েকজন অধিবাসী জেনেছে, উল্কার গতিতে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছে।
বীরহাম্বীর হতচকিত হয়ে গেলেও সামলে নিলেন। তিনি প্রস্তুত ছিলেন মানসিকভাবে। গুপ্তচরের পিছন উপস্থিত হয়েছে শীতলও।
বীরহাম্বীর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শীতল, কোন দরজা দিয়ে ঢুকছে ওরা?’
‘এখনও ঢোকেনি পিতা।’ শীতল উত্তর দিল, ‘আসছে। আমার এক নিজস্ব চর আরও কিছু সংবাদ এনেছে। ওরা সম্ভবত রানীসাগর গ্রামের কাছে ছাউনি ফেলবে।’
‘সে তো বিষ্ণুপুর থেকে দূরে!’
শীতল নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘প্রদ্যুম্নপুরের মাধব মল্ল তাঁদের সাহায্য করছেন। প্রদ্যুম্নপুরের রাজবাড়ির পাশেই নাকি তারা রাত্রিযাপন করবে।’
‘এই আশঙ্কা আগেই করেছিলাম। নিজের রাগ চরিতার্থ করতে গিয়ে তিনি শত্রুর হাতে তুলে দিচ্ছেন আমাদের রাজ্যকে। মল্লভূমের মাটি তাঁকে ক্ষমা করবে না।’ বীরহাম্বীর রাগে কাঁপছিলেন।
শ্রীনিবাস আচার্য শান্তকণ্ঠে বললেন, ‘মাথা ঠান্ডা রাখো। বলো তো, রাজধানীতে ওরা কোনদিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারে?’
প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন বলে উঠলেন, ‘বিষ্ণুপুরে প্রবেশের দ্বার প্রধানত তিনটে। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে বীরদরজা, উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে লালদরজা, এবং উত্তর-পূর্ব দিকে হলদি দরজা। শত্রুপক্ষের বিষ্ণুপুরে প্রবেশের একমাত্র পথ হল হলদি দরজা। অন্য দুই দরজা দিয়ে বহিরাগতদের প্রবেশ সম্ভব নয়।’
‘কেন?’
‘কারণ, বীরদরজা সারাবছর স্থায়ীভাবে বন্ধ থাকে। একমাত্র মা মৃন্ময়ীর বার্ষিক পুজোর সময়েই তা খোলা হয়। আর লালদরজা পরিত্যক্ত, তার সামনে-পিছনে দুর্ভেদ্য অরণ্য।’
শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘হুম, হলদি দরজা মানে যার বাইরে পাথর দরজা ও পরিখা খনন করা হয়েছে?’
‘আজ্ঞে আচার্যমশাই!’ জীমূতবাহন বললেন, ‘রাজধানীতে প্রবেশ করতে গেলে প্রথমেই ওদের সামনে পড়বে প্রথম পাথর দরজা।’
বীরহাম্বীর বললেন, ‘সেই পরিখায় যথেষ্ট জল আছে তো?’
‘আছে পিতা।’ শীতল বলল, ‘রয়েছে কুমিরও। পাঠানরা বড় পাথর দরজা যদি অতিক্রম করেও ফেলে, ছোট পাথর দরজার আড়ালি দেওয়ালের পেছনে আমাদের সশস্ত্র সৈন্যরা অপেক্ষা করছে।’
‘উত্তম। বিলম্ব কোরো না, চলে যাও। আর দলমাদল কামানকে রাজদরবারে আনার ব্যবস্থা করো।’
‘যথা আজ্ঞা, পিতা। শীতল বলল, ‘আমি ইতিমধ্যেই কয়েকজন উপসেনাপতিকে সেখানে পাঠিয়েছি। তাঁরা গিয়ে সৈন্যদের মোতায়েন করছেন। মহাসেনাপতিও রওনা হয়ে গিয়েছেন। তবে আমার মনে হয়, কিছু সৈন্য আমাদের লাল দরজা ও বীর দরজার কাছেও মোতায়েন করা উচিত। বীর দরজা বন্ধ থাকলেও তারা ভেঙে ফেলতে পারে। আর লাল দরজা চিনে ঢুকে পড়তে পারলে অরণ্যের পরেই দ্বারকেশ্বর নদীর পোত।’
জীমূতবাহন হাসলেন। বললেন, ‘তুমি এখনও অপরিণত বাবাজীবন। আমাদের লক্ষ লক্ষ সৈন্য নেই, যে আমরা তাদের ছড়িয়ে দেব। যখন আমরা জানি যে, কালাপাহাড় প্রদ্যুম্নপুরে বিশ্রাম করে হলদি দরজার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন সেখানে সবচেয়ে বেশি সৈন্য না-রেখে অন্যত্র পাঠানোটা কি বুদ্ধিমানের কাজ? তোমার দ্রোণাচার্য কী বলেন?’
দ্রোণাচার্য অর্থে কুম্ভ। শীতল চুপ করে রইল। এ’কথা কারুরই অজ্ঞাত নয়, শাক্ত জীমূতবাহন বৈষ্ণব মহাসেনাপতিকে পছন্দ করেন না। চাইলে নিজের শ্বশুরমশাইয়ের সঙ্গে শীতল তর্ক করতে পারত, কিন্তু করল না।
অন্তর্দ্বন্দ্বের সময় এটা নয়!
বীরহাম্বীর বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ঠিকই বলেছেন। শীতল, তুমি পাথর দরজার কাছে চলে যাও। আমাদের যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে ওদের সেনারা বিষ্ণুপুরে ঢুকতে না পারে।’
‘যথা আজ্ঞা, পিতা!’ শীতল বেরিয়ে এল। অন্দরমহলে গিয়ে সামরিক সাজে সজ্জিত হয়ে ঘোড়ায় ওঠার আগে তার মনোহরাকে দেখতে বড় ইচ্ছা হল।
মনোহরার গর্ভাধানের এখন পঞ্চম মাস। তন্বী কন্যা এখন মেদবহুল, মুখও হয়েছে ভরাট, সে হয়ে উঠেছে আরও লাবণ্যময়ী।
তবে মনোহরার চলাফেরা একটুও শ্লথ হয়নি। মায়েদের শত নিষেধেও সে ধীর স্থির হতে শেখেনি, এখনও পাখির মতোই উড্ডীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়, কথায় কথায় হাসে। সেই প্রাণখোলা হাসিতে শীতলের মন আনন্দে ভরে যায়।
আর মাত্র চার মাস! তারপরই তাদের দুজনের মধ্যে জন্ম নেবে নতুন প্রাণ!
যতবারই নিজের পিতৃত্বের কথা শীতল ভাবে, তার রোমকূপ শিহরিত হয়ে ওঠে। তার ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে রক্তমাংসের ছোট্ট শরীরটিকে সে কোলে নেবে, তার ধমণীতে বইবে নিজের রক্তধারা।
মনোহরা অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে তার প্রতি শীতলের যত্ন কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। মনোহরা এক মহল থেকে আরেক মহলে যেতে গেলেও শীতল সঙ্গে পরিচারিকা দিয়ে দেয়। প্রতিদিন মনোহরা ঠিকমতো খাচ্ছে কিনা, কড়া নজর রাখে।
মনোহরা হেসে কুটিপাটি হয়। বলে, ‘তুমি কেমন পুরুষমানুষ গা! এমনতরো সোহাগ কেউ করে বলে শুনিনি।’
‘আমি করি।’ গম্ভীরমুখে বলে শীতল, ‘যে আসছে, সে শুধু তোমার একার নয়, আমারও। তাই আমাকেও খেয়াল রাখতে হবে। দেরি কোরো না। দুধটা খেয়ে নাও।’
মনোহরা মুখ বেঁকায় বটে, কিন্তু ভিতরে ভিতরে গলে যায়। গোটা রাতে অন্তত দশবার শীতল স্ত্রীর কপালে চুম্বন করে। আলতো আলিঙ্গনে সারারাত দুজনে ঘুমোয়।
যুদ্ধে রওনা হওয়ার আগে মনোহরাকে একবার দেখতেই হবে। কিন্তু আজ আবার মনোহরার সাধভক্ষণ। সে রয়েছে শিরোমণির মহলে। সাধভক্ষণের সময় পুরুষরা থাকে না, তবু শীতল সেদিকে এগোল।
৪১
মহারানীর মহল একটু দূরে। পুষ্করিণীর পাশ দিয়ে শীতল হাঁটছে। তার পরনে পুরোদস্তুর যুদ্ধের পোশাক, কোমরে তরবারি, মাথায় শিরস্ত্রাণ। দাসদাসীরা কৌতূহলী হয়ে দেখছে।
অশ্বশালা থেকে রঘুনাথ পঞ্চকল্যাণকে নিয়ে বেরোচ্ছিল, শীতলকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘আজ খেলার আসরে যাবি শীতলদাদা?’
শীতলের হাসি পেল। বেচারি ভাইটা ছোটমানুষ। বিপদের খবর পায়নি।
শীতল, হাঁটতে হাঁটতে বলে ওঠে, ‘নারে ভাই। তুই যা। পরে একদিন যাব’খন!’
আকস্মিক শীতলকে দেখে শিরোমণি অবাক, ‘ওমা! তুই এখানে?’
শীতল লজ্জা পেল। মনোহরার প্রতি প্রবল টানে সে ঝোঁকের মাথায় চলে এসেছে। এখন দেখছে মনোহরা মহিলা পরিবৃতা হয়ে বসে রয়েছে। শিরোমণি, সুলক্ষণা, কাঞ্চনমণি ও অহল্যা ছাড়া বাকিরা সবাই পরিচারিকা। একমাত্র মেনকা ছাড়া সব পরিচারিকারা রাজকুমারেকে দেখে ঘোমটা টানতে ব্যস্ত।
চারিপাশে সাজানো খাদ্যদ্রব্য, পুজোর ফুল। সবকিছুর মাঝে শ্যামাকুমারী টলোমলো পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে চলেছে।
মহারাজার এক বৃদ্ধা আত্মীয়া শিরোমণির মহলেই থাকেন। তিনি গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ওমা! সাধের সময় পুরুষমানুষ ভেতরে চলে এল! এ আবার কেমনধারা সোয়ামি গো!’
শীতল অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ‘না, মানে…ভাবলাম…কবে ফিরব তা তো জানি না…!’
শীতলকে লজ্জিত মুখে ইতস্তত করতে দেখে শিরোমণি হেসে বললেন, ‘বেশ করেছিস। আয়, বোস। এই কে আছিস, ওকে জল মিষ্টি দে।’
মেনকা মুখ টিপে হাসছিল। হাতে শাঁখাপলা, সিঁথির সিঁদুরে তার সৌন্দর্য ঝলমল করছে। সে পাত্রে মিষ্টি সাজাতে সাজাতে বলল, ‘ও বুড়িমা, তোমার বর তোমার সাধের দিন ছিল না?’
‘আমার বর! দূর হ’ মুখপুড়ি!’ বৃদ্ধা খনখনিয়ে উঠলেন, ‘আমরা কখন আঁতুড়ে যাচ্ছি, কখন আসছি, সেই খবরই সোয়ামিরা রাখত না, তো সাধ! পুরুষ মানুষের আবার এসব দিকে নজর দিলে চলে নাকি?’
শীতলের কানে এসব কথা প্রবেশ করেছে বলে মনে হচ্ছিল না। সে নির্নিমেষে দেখছে মনোহরাকে।
মনোহরা আজ একটা গোলাপরঙা শাটিকা পরেছে, তার ওপর ঘিয়ে রঙের একখানা দোলাই। স্বর্ণালংকারে স্ফীতদেহে তাকে মনে হচ্ছে ঈশ্বরী। সেও অপাঙ্গে দেখছে স্বামীকে। রাঙা হয়ে উঠছে তার মুখ।
শিরোমণি উপভোগ করছিলেন এই যুবাদম্পতির প্রণয়। বললেন, ‘কী হয়েছে রে বাছা? কোন সামন্তরাজা বিদ্রোহ করল নাকি?’
‘না বড়মা। কঠিন সমস্যা। সুলতানের সেনাপতি রানীসাগরে ছাউনি ফেলেছে। সঙ্গে মোঘল চৌকির সেনারাও আছে।’
‘সেকি রে!’ শিরোমণি আঁতকে উঠলেন, ‘সুলতান হঠাৎ এদিকে নজর দিল কেন?’
‘সুলতান নয় মা, তার সেনাপতি কালাপাহাড়!’
‘কালাপাহাড়? কেমন নাম! সে কি হিন্দু না মুসলিম?’
‘আগে হিন্দু ব্রাহ্মণ ছিল, পরে ধর্মান্তরিত হয়েছে। আদি বাড়ি উত্তরের ভাদুড়িয়াতে। আসল নাম রাজীবলোচন রায় ভাদুড়ী, এখন হয়েছে মহম্মদ ফারমুলী। সে অনেক কথা বড়মা, ফিরে এসে বলব!’
শীতলের কথা শেষ হয় না, মেনকার হাত থেকে হঠাৎ মিষ্টির পাত্রটা সজোরে মাটিতে আছড়ে পড়ল। ছড়িয়ে গেল সমস্ত মিষ্টি।
শ্যামাকুমারী চোখ বড় বড় করে বলল, ‘এই দাহ! থব পলে গেল!’
‘একিরে!’ অহল্যা বললেন, ‘কাজের সময় কোনদিকে মন থাকে তোর? ইশ, কাল সারারাত জেগে নবীন মোদক এমন রসালো মতিচুরগুলো বানাল!’
মেনকা অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে রইল।
অহল্যার উষ্মা অকারণ নয়। আগে এই রাঢ়বঙ্গে মিষ্টান্নের চল তত ছিল না। কিন্তু শ্রীনিবাস আচার্যের আগমনের পর বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হওয়ার সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। এবং তাঁদের নিরামিষ খাদ্য তালিকায় ছানার মিষ্টি, দুধ, ঘি, দই ইত্যাদি প্রাধান্য লাভ করছে। শ্রীনিবাস আচার্যের কথায় সুদূর গৌড় থেকে এসেছেন প্রখ্যাত নবীন মোদক। রাজা তাঁকে এখানে বসতবাড়ি ও জমি দান করে থিতু করেছেন।
নবীন মোদক এসে বানাতে শুরু করেছেন কাঞ্চন লতিকা, লবঙ্গ লতিকা বা মৌক্তিকাক্ষের মতো মিষ্টি। লোকমুখে এই মিষ্টির নাম মতিচুর। পিয়াল ফলের বীজ দিয়ে তৈরি মতিচুর এখন সকলের এত প্রিয় হয়ে উঠেছে, যে কেশব ছড়াকার একে নিয়ে ছড়াই বেঁধে ফেলেছিল।
‘গান বাজনা মতিচুর
এই তিনে বিষ্ণুপুর।’
মনোহরার সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টান্ন মতিচুর। তাই তার সাধ উপলক্ষে নবীন মোদক নিজে বানিয়েছে এই মিষ্টি।
মেনকাকে প্রস্তরবৎ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রানী শিরোমণি রেগে উঠে বললেন, ‘কী হল, স্বপ্নের জগতে চলে গেলি নাকি? ওগুলোকে মেঝে থেকে তুলতে হবে তো! দেখছিস না, শ্যামা ঘাঁটছে!’
মেনকা অস্থির, উদভ্রান্তের মতো বলল, ‘অ্যাই মল্লিকা, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? হাড়ে কি দুব্বো গজাল নাকি? শিগগির এগুলো তোল। আমি…আমি একটু আসছি রানীমা!’
বলতে বলতে মেনকা প্রায় ছুটে নিষ্ক্রান্ত হল ঘর থেকে।
শীতল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাই বড় মা। যে করেই হোক কালাপাহাড়কে আটকাতে হবে। পিতা অনেক বড় দায়িত্ব আমায় দিয়েছেন।’
‘যাই বলতে নেই বাছা, বল আসি।’ শিরোমণি বললেন।
‘আসি বড়মা!’ শীতল একে একে সবাইকে প্রণাম করল।
‘আয়।’ শিরোমণি সস্নেহ চুম্বন এঁকে দিলেন, ‘জয়ী হয়ে ফিরে আয়।’
৪২
মল্লরাজা বীরহাম্বীরের অনুমান ছিল নির্ভুল। কালাপাহাড় হাত মিলিয়েছে ইন্দ্রহাস ও রায়নার মোঘল চৌকির সেনাদের সঙ্গে। আড়ালে রয়েছেন ‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ মাধব মল্লও। কিন্তু এই তিনটি দলকে বিষ্ণুপুরে প্রবেশ করতে গেলে অতিক্রম করতে হবে দুটি অতি সুরক্ষিত দুর্গ। সেই দুর্গদুটো অতিক্রম করার সময়েই আসবে নীচে কুমীর ও ওপরে কামানের আক্রমণ। শত্রুপক্ষ যে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়বে, বীরহাম্বীর নিশ্চিত ছিলেন।
শ্রীনিবাস আচার্যও রাজাকে সম্ভাব্য দুই বিশ্বাসঘাতক সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। এক, মাধব মল্ল। দুই, জগতকুমার।
মাধব মল্ল বিষ্ণুপুরের বাইরে বাস করলেও জগতকুমার থাকেন রাজধানীতেই। তবে তাঁর লাঠিয়ালরা, তারা থাকে নাটকাঞ্চন মৌজায়। সুতরাং বিষ্ণুপুরে প্রবেশ করতে গেলে তাদেরও পেরোতে হবে দুই পাথর দরজা।
শ্রীনিবাস আচার্য এও বলেছিলেন, ‘বিপদের সময় প্রথম কাজ হল নিজের রাজধানী সুরক্ষিত করা।’
বীরহাম্বীর সেইমত বিষ্ণুপুরকে কঠোর সুরক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে রেখে নিজের রণকৌশল সাজাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁর কল্পনাতেও আসেনি যে রাজ্যের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন মানুষটি বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
যখন জানতে পারলেন, তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে।
শীতল সবেমাত্র পৌঁছেছে পাথর দরজার সামনে। সেখানকার সেনানায়ককে সে নির্দেশ দিচ্ছে, কীভাবে সৈন্যরা আড়ালি দেওয়ালের পিছনে কামান নিয়ে লুকিয়ে থাকবে। কীভাবে বড় পাথর দরজার পরে পরিখার উপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বিছিয়ে দিতে হবে শুকনো গাছগাছালি! শত্রুপক্ষ দুর্গ পেরিয়েই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ভেবে ঝাঁপ দেবে মরণখাদে।
কালাপাহাড় কবে ঢুকে পড়বে, কেউ জানে না। যুদ্ধের নীতি হল, রাজ্য আক্রমণের আগে সন্ধি প্রস্তাব পাঠানো। কিন্তু কালাপাহাড়ের মতো উন্মাদের লক্ষ্য যেখানে শুধুমাত্র ধ্বংস, সে এই নীতি আদৌ মানবে কিনা, কে জানে!
মহাসেনাপতি কুম্ভও ছিলেন শীতলের সঙ্গে। তিনিও উপসেনাপতিদের নানা নির্দেশ দিচ্ছিলেন। একেক উপসেনাপতির অধীনে চারজন করে জমাদার। একেকজন জমাদার হাজারি সেনার প্রধান। এক হাজার সৈন্যকে বলা হয় হাজারি।
ঠিক এইসময় খুব কাছে থেকে শিঙার শব্দ হল। এক দুই তিন চার! পরপর চারবার।
সকলে সচকিত। রাজধানী বিষ্ণুপুর থেকে মল্লভূমের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত এক সরলরেখায় প্রতি চার ক্রোশ অন্তর মাচানস্তম্ভ নির্মাণ করিয়েছেন বীরহাম্বীর। প্রতিটি মাচানের ওপর প্রহরী থাকে। অনেক দূর থেকে শত্রুর গতিবিধি দেখার জন্যই এই ব্যবস্থা।
শিঙার শব্দ নিকটের মাচানের উপর থেকে এসেছে। চারবার সংকেতের অর্থ রাজপ্রাসাদ থেকে দূত আসছে।
‘আবার কী হল?’ কুম্ভ বললেন।
শীতল বলল, ‘কালাপাহাড় কি সন্ধিপ্রস্তাব পাঠিয়েছে?’
‘হতে পারে।’ কুম্ভ বললেন, ‘শর্তাবলী দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
রাজবাড়ির দূত হয়ে যে কিছুক্ষণের মধ্যে দুর্গের নীচে এসে উপস্থিত হল, সে আর কেউ নয়, রঘুনাথ। পঞ্চকল্যাণের পৃষ্ঠদেশ থেকে নামতে নামতে সে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘পাঠান সৈন্যরা রাজ্যে ঢুকে পড়েছে! আমাকে পিতা পাঠালেন।’
‘মানে? কীভাবে ঢুকল? কোনদিক দিয়ে ঢুকল?’ বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল শীতল।
রঘুনাথ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘লাল দরজা দিয়ে। তারা সোজা ঢুকে চলে গিয়েছে মুণ্ডমালাঘাটের দিকে। সেখানকার সর্দার অখিল সিংহ ইতিমধ্যেই নিহত হয়েছে। মৃত্যুর আগে কোনওমতে দূত মারফত জানিয়েছে। পাঠানবাহিনী এখন ছুটে যাচ্ছে মুণ্ডমালা ঘাটের দিকে। ব্রীড়াবতী নদী পার হল বলে!’
‘আমি তখনই বলেছিলাম, কিছু সৈন্য লাল দরজায় পাঠাতে।’ ক্ষোভে দুঃখে শীতল বজ্রমুষ্টি করে শূন্যে হাত ছুঁড়ল, ‘লাল দরজার অখিল সিংহের মতো দক্ষ সর্দারকে আমরা নিজের দোষে হারালাম। তার মতো বিশ্বস্ত যোদ্ধা মল্লভূমে বেশি নেই।’
‘পরিতাপ করার সময় এখন নেই, শীতল!’ মহাসেনাপতি কুম্ভ বললেন, ‘মহারাজের কী আদেশ?’
রঘুনাথ কম্পিতস্বরে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী সামন্তরাজাদের সংবাদ পাঠাচ্ছেন। আর পিতা শীতলদাদাকে এখনই সেনাদল নিয়ে মুণ্ডমালাঘাটের দিকে যেতে বললেন।’
মুণ্ডমালাঘাট মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুরের উত্তর সীমান্তে শেষ পরিখার ওপারে। সেখানে প্রাচীন এক মন্দির রয়েছে, তাতে অধিষ্ঠান করছেন এক ভয়ংকর কালী প্রতিমা। তাঁর কণ্ঠে একসময় নরমুণ্ডের মালা পরানো থাকত। সেই থেকেই মুণ্ডমালাঘাট।
দুদিকে দুটো ছোট গ্রাম দেউলি ও চাকদহ, মাঝখানে মুণ্ডমালাঘাটের প্রকাণ্ড উন্মুক্ত প্রান্তর। মুণ্ডমালাঘাটের অবস্থানটাই অতি তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে আগেও ছোট-বড় যুদ্ধ হয়েছে। দক্ষিণে বিস্তীর্ণ পরিখা পাহাড়, উত্তরে ও পশ্চিমে ব্রীড়াবতী নদী এবং পূর্বে দ্বারকেশ্বর নদী ও ব্রীড়াবতী নদীর সঙ্গম।
মুণ্ডমালাঘাটের পশ্চিমের যুঝঘাটি গ্রামের অবস্থান আরও গুরুত্বপূর্ণ। যে পক্ষ আগে অধিকার করে নেবে সে গ্রাম, যুদ্ধ আরম্ভের আগেই সে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে যাবে। যুঝঘাটি গ্রামের সীমান্তে পাহাড়ের আড়ালে সেনা সাজালে মুণ্ডমালাঘাটে শত্রুপক্ষ প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যমান হয়ে পড়বে! তখন তাদের দিকে তীর চালানো ও গোলা ছোঁড়া খুবই সহজ। আড়ালে থাকার দরুণ শত্রুরা এদিকের কাউকে দেখতে পাবে না।
অতীতে যখনই রাজ্য আক্রান্ত হয়েছে, মল্ল রাজারা আগেই গিয়ে দখল নিয়েছেন যুঝঘাটির। মুণ্ডমালাঘাটের প্রান্তরে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছেন শত্রুদের।
কিন্তু শত্রুদল এবারে কীভাবে আগে পৌঁছে গেল?
মহাসেনাপতি কুম্ভ বললেন, ‘তুমি আর বিলম্ব কোরো না শীতল, কিছু সৈন্য নিয়ে যুঝঘাটি চলে যাও। কালাপাহাড়ের সেনারা মুণ্ডমালাঘাটে আমাদের আগে পৌঁছতে পারলেও যুঝঘাটির দিক তাদের পক্ষে জানা অসম্ভব!’
‘সঠিক বলেছেন খুড়ো!’ শীতল লাফিয়ে ঘোড়ায় চড়তে চড়তে বলে, ‘আমি আর রমজান যাচ্ছি কিছু সেনা নিয়ে। আপনি এইদিকটা দেখুন। এটা কালাপাহাড়ের একটা চালও হতে পারে। ওদিকে কিছু সৈন্য মোতায়েন করে আমাদের দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা। আমরা মুণ্ডমালাঘাটের দিকে পৌঁছনোমাত্র এদিক দিয়ে সে নিজে সসৈন্যে রাজধানীতে ঢুকে পড়বে!’
‘অসম্ভব নয়।’
দুর্গের সামনের প্রাঙ্গণ কলরোলে মুখরিত। সৈন্যরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে রাজ্যের দুই তরুণ রাজপুত্রকে, যারা নিজেরা ছুটে এসেছেন সমরক্ষেত্রে।
নেতা তো এমনই হওয়া উচিত!
সৈন্যরা চিৎকার করে উঠল, ‘জয় রাজকুমারের জয়!’
রঘুনাথ বলল, ‘দাদা, আমি তোর সঙ্গে যাব।’
‘না—।’ শীতল চিৎকার করে বলল, ‘তুই রাজদরবারে ফিরে যা। তোর যোগ্যতা প্রমাণের সময় এসে গেছে রঘু! তুই আজ থেকে বড় হয়ে গেলি। দেখিস, একটা শত্রুমাছিও যেন সেখানে ঢুকতে না পারে!’
রঘুনাথ উত্তেজনায় হাঁপাচ্ছিল, ‘আচ্ছা দাদা!’
শীতল এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার মুখ আবার ফেরাল, ‘রঘু!’
‘বলো দাদা।’
শীতল বলল, ‘তোর বউদিদিকে দেখিস ভাই! আমি তাড়াতাড়িই ফিরে আসব।’
প্রবল উল্লাসের মধ্যে শীতলের ঘোড়া দুরন্ত গতিতে ছুটতে ছুটতে মিলিয়ে গেল দূর প্রান্তরে। তার পিছু নিল এক ঝাঁক মল্লসৈন্য।
শীতল দ্রুতগতিতে ঘোড়া ছোটাতে ছোটাতে মনে মনে হিসেব কষছিল। এই মুহূর্তে মল্লভূমের সেনাবাহিনীতে রয়েছে ত্রিশ হাজার পদাতিক, দশ হাজার গোলন্দাজ ও দশ হাজার অশ্বারোহী। গোলন্দাজদের মধ্যে প্রায় দু’হাজার জন রয়েছে পাথর দরজার দুর্গে। তাদের সঙ্গে রয়েছে কামান, হাতকামান এবং কিছু বোমা।
মুণ্ডমালাঘাটে কাদের বেশি সংখ্যায় নিয়ে গেলে লাভ বেশি? পদাতিক, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ না গোলন্দাজদের?
মল্লভূমের করদ রাজ্য হিসেবে চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে যে ক’জন সামন্তরাজা, তাঁরাও বিপদের দিনে মল্লরাজার পাশে থাকেন। তাঁদের বিরাট সেনাবাহিনী না থাকলেও পাঁচ থেকে সাত হাজার সৈন্য ও দশ-বারোটি কামান সব রাজ্যেই রয়েছে। তাই বা মন্দ কি? রঘুনাথ তো বলল, প্রধানমন্ত্রী প্রত্যূষেই সমস্ত সামন্তরাজাকে সংবাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন।
এতক্ষণে ডুমনীগড়, যাদবগড়, রাজগড়, হোমগড়ের মতো সামন্ত রাজ্যের সেনারা বোধহয় অর্ধেক পথ চলেও এসেছে। তুঙ্গভূম থেকে বড়দাদা ধাড়ীও নিশ্চয়ই সসৈন্য চলে আসছেন।
নাহ, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়াই হল অর্ধেক যুদ্ধ জেতার সমান।
শীতল প্রাণপণে নিজেকে সংহত করার ছেষ্টা করে। কালাপাহাড় সম্পর্কে সে শুনে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। ভয়াল অবয়ব ও অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় কালাপাহাড় মানুষজনের কাছে প্রবাদপ্রতিম ত্রাস।
দুঃসংবাদ পাওয়ার পরে মাত্র দুটি প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে, এরই মধ্যে দলে দলে সাধারণ মানুষ বিষ্ণুপুর ছাড়তে শুরু করেছে। এও মহামারীর মতো এক আতঙ্ক।
শীতল শহরের মধ্য দিয়েই তীব্রগতিতে ঘোড়া ছোটাচ্ছিল। পথে দলে দলে লোক। সবার মুখ ভীত সন্ত্রস্ত, মাথায়-হাতে ঘটিবাটি, কোলে দুগ্ধপোষ্য শিশু। গুঞ্জন উঠছে, ‘কালাপাহাড় আসছে! সব ধ্বংস করে দেবে! পালাও, পালাও!’
‘কোথায় পালাতে চাইছ তোমরা? কতদূরে পালাবে? তার চেয়ে রাজধানীতেই থাকো। আমরা জীবন দিয়ে তোমাদের রক্ষা করব!’
শীতল দু’একবার ঘোড়া থামিয়ে নিরস্ত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়, তারপর হাল ছেড়ে দেয়।
ঘোড়া ছুটছে। সহসা নিজের নাম শুনে গতি শ্লথ করে শীতল।
‘শীতলদাদা! শীতলদাদা!’ তাকে কে যেন ডাকছে!
একী? পবন? পবন রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
‘কী ব্যাপার পবন? কিছু বলবে?’
পবন দ্রুত কাছে আসে। ঢোঁক গিলে বলে, ‘তোমাকে একটা কথা বলি শীতলদাদা। কাল দুপুরে লাল দরজার পাশে আমি মহাদানীমশাইকে ঘোরাফেরা করতে দেখেছি। সঙ্গে কয়েকজন আচকান পরা লোক ছিল।’
‘মহাদানীমশাই? কোন মহাদানী?’ শীতল বুঝতে পারে না।
‘কেশব মহাদানী। ছড়াকার গো!’
‘কেশব ছড়াকার?’ শীতলের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে, ‘সে তো বহুদিন ধরে নিখোঁজ! লাল দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে কী করছিল? তবে কি সে-ই পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে কালাপাহাড়ের লোকেদের?’
পবন সতর্ক দৃষ্টিতে দ্যাখে। তারপর গলা নামিয়ে বলে, ‘সঙ্গে এই রাজ্যের আরেকজনও ছিলেন, শীতলদাদা!’
৪৩
নিতাই সর্দার এসে আভূমি প্রণাম করে বলল, ‘মহারাজ, আমার দলের সবাই এসে গেচে। তীর, বর্শা, টাঙি, তলোয়ার নিয়ে সকলে প্রস্তুত। আপনি আজ্ঞা দিলেই কাড়া-নাকাড়া বেজে উঠবে।’
বীরহাম্বীর বললেন, ‘আর বিপুল ডোম?’
মল্লরাজ্যের পদাতিক সৈন্য যে ত্রিশ হাজার রয়েছে, তাদের সিংহভাগই হল ডোমেরা। তাদের নেতা বিপুল ডোম। এর আগে বহু ছোট-বড় যুদ্ধে তারা রাজ্যকে বাঁচিয়েছে। শুধু পদাতিক নয়, অশ্বারোহী হয়ে, এমনকী ঢাল তলোয়ারে সজ্জিত হয়ে কাঁসর ঘণ্টা, দামামা বাজিয়েও মহাপরাক্রমে যুদ্ধ করেছে তারা।
নিতাই সর্দার বলে, ‘শুধু বিপুল ডোম নয় রাজামশাই! গোপ সদগোপ, কৈবর্ত, তিলি, বাউরি, এরা সকলেই আসছে। আজ রাজ্যের এত বড় বিপদ। সবাই বুক পেতে না দিলে হয় নাকি?’
‘সামন্তরাজারাও নিশ্চয়ই সংবাদ পেয়ে গিয়েছেন। তাঁরাও এসে পড়বেন এবার।’
সচিব দুর্গাপ্রসাদ বললেন, ‘কিন্তু প্রধানমন্ত্রীমশাই নিজে কোথায়, মহারাজ? সকাল থেকে তাঁকে দেখতে পাইনি।’
‘তিনি নিশ্চয়ই সামন্তরাজাদের সৈন্য একত্রিত করায় ব্যস্ত রয়েছেন।’ বীরহাম্বীর গভীরভাবে কিছু ভাবছেন, ‘কীভাবে পাঠান সেনারা লাল দরজা অতিক্রম করে মুণ্ডমালাঘাটের দিকে গেল জানি না, তবে শীতল সৈন্য নিয়ে সেদিকে গেছে। মহাসেনাপতি দেখছেন পাথর দরজার দিকটা। আমার মনে হয় না, কালাপাহাড়ের পক্ষে রাজধানীতে প্রবেশ সহজ হবে। কী বলেন আচার্যমশাই?’
‘শীতল কত সৈন্য নিয়ে মুণ্ডমালাঘাটের দিকে গিয়েছে? পর্যাপ্ত তো?’ শ্রীনিবাস আচার্য প্রশ্ন করলেন।
দুর্গাপ্রসাদ উত্তর দিলেন, ‘মুণ্ডমালাঘাটের যুঝঘাটিতে লুকিয়ে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলা বা তির ছুঁড়লে একজন সৈন্য প্রচুর শত্রু ঘায়েল করতে পারে। সে নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই।’
শীতল যুঝঘাটির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে, এইসময় বিপরীতদিক থেকে ঘোড়া ছুটিয়ে এল উপসেনাপতি রমজান। বয়সে তরুণ, সাহসী, শীতলের অত্যন্ত বিশ্বস্ত।
‘কুমার! ওদিকে যাবেন না!’
‘কেন?’
রমজান সামান্য দম নিয়ে বলল, ‘পাঠান সেনারা যুঝঘাটির মূর্চা পাহাড় দখল করে নিয়েছে!’
নীল আকাশে একফোঁটা মেঘ নেই, বাতাসও বইছে। তবু আকাশ থেকে বজ্রপাত হলেও বোধহয় এতটা স্তম্ভিত হত না শীতল।
‘যুঝঘাটির পথ তারা জানল কীভাবে?’
যুঝঘাটির মূর্চা পাহাড় মুণ্ডমালাঘাটের সামনে এক কৃত্রিম পাহাড়। কয়েক বছর আগে মোঘল আক্রমণের সময়ে গোপগ্রামের কারিগরদের দিয়ে বীরহাম্বীর বিশেষ কৌশলে নির্মাণ করিয়েছিলেন এই অনুচ্চ টিলা। দিল্লি থেকে আনা হয়েছিল কারিগর। পাহাড়টা ফাঁপা। তার ভিতরে একইসঙ্গে লুকিয়ে থাকতে পারে অন্তত চার হাজার সৈন্য।
দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই, গোটা পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট অসংখ্য ছিদ্র। কিন্তু সেই ছিদ্রতে চোখ রেখে সামনের মুণ্ডমালাঘাট উন্মুক্ত প্রান্তরে শত্রুপক্ষকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া যায়। প্রান্তরে যদি দশগুণ শত্রুও থাকে, তবু মূর্চা পাহাড়ের ভিতরে বসে তাদের কয়েক মুহূর্তেই নিকেশ করা সম্ভব। কোথা থেকে গুলিচালনা করা হচ্ছে, বুঝতে পারার আগেই তারা লুটিয়ে পড়বে মাটিতে।
এই কৌশলেই যুবরাজ বীরহাম্বীর প্রতিহত করেছিলেন মুঘল সিপাহশালার মুনিম খাঁয়ের বিশাল সৈন্যবাহিনীকে। তারপর থেকে বড় আক্রমণ হলেই শত্রুপক্ষকে কৌশলে আনা হয় মুণ্ডমালাঘাট প্রান্তরে, তারপর এই গুপ্ত যুদ্ধে ধরাশায়ী করা হয়।
মূর্চার পাহাড়ে পৌঁছনোর পথ অত্যন্ত গোপন। যুঝঘাটি থেকে বারবার পথের দিক পরিবর্তন করতে হয়। অনতিদূরে পাহাড়টিকে দেখতে পেলেও নতুন লোকেদের পক্ষে অরণ্যপথে সেখানে পৌঁছনো কঠিন।
শেষপর্যন্ত পৌঁছতে পারলেও তার ভেতরে প্রবেশ অসম্ভব। কারণ, পাহাড়ের পিছনে অরণ্যের মধ্যে লুকোনো প্রবেশদ্বারটি লোহার তৈরি। মাকড়া পাথর গলিয়ে লোহা উৎপাদন করে সেই প্রকাণ্ড দরজাটি বানিয়েছিল মল্লভূমের সেরা কারিগর গণেশ কর্মকার। সেই দরজা খোলার পদ্ধতিও জটিল। চাবি ঢুকিয়ে একটি বিশেষ বিন্যাসে দরজার গায়ে চাপ দিলে তবেই খুলবে, নয়তো নয়।
সেই চাবি গোটা মল্লরাজ্যে রয়েছে দুটি।
একটি মহারাজ বীরহাম্বীরের ব্যক্তিগত কোষে, অন্যটি রাজকোষের সুরক্ষিত অন্দরে। শুধু তাই নয়, চাবি যে রাজকোষে থাকে, সেই তথ্যও শুধুমাত্র কয়েকজন জানে।
শীতল অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘পাহাড়ের দরজা কি তবে ওরা ভেঙে ফেলেছে?’
রমজান দু’পাশে মাথা নাড়ল, ‘না। তাহলে আশপাশের গ্রাম থেকে প্রচণ্ড শব্দ পাওয়া যেত। কেউ কোন শব্দই পায়নি।’
শীতল চুপ করে রইল। তার মাথায় শিরাগুলো দপদপ করছে। মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েক দণ্ড আগে পথমধ্যে পবনের অনুচ্চ স্বরে বলা কথাগুলো।
‘তুমি রাজধানীতে ফিরে যাও।’
‘সেকি!’ রমজান চমকে উঠল, ‘রাজকুমার, আপনি ইতিমধ্যেই যুঝঘাটিতে প্রবেশ করেছেন। শুনতে পাচ্ছেন না গোলাগুলির শব্দ?’
‘হ্যাঁ পাচ্ছি।’
রমজান বলল, ‘এখানে আমাদের সৈন্যসংখ্যা খুব অপ্রতুল। মাত্র পাঁচশোজন। বেশিরভাগ রাজধানীর পাথর দরজা দুর্গে। আমি চলে গেলে আপনার একার পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া কঠিন হয়ে উঠবে।’
‘রমজান! তুমি চলে যাও রাজধানীতে, এটা আমার আদেশ।’ কঠিন সুরে বলল শীতল, ‘একমুহূর্ত দেরি করা মানে মল্লভূমিকে বিপদের দিকে এক পা ঠেলে দেওয়া।’
রমজান তরবারি তুলে রাজকুমারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। তারপর প্রস্থানোদ্যত হতে পেছন থেকে শীতল বলল, ‘শোনো রমজান। তুমি যত দ্রুত সম্ভব রাজদরবারে যাবে। মহারাজকে জিজ্ঞাসা করবে, এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী রাজকোষে গিয়েছিলেন কিনা?’
রমজান জিজ্ঞাসু চোখে শুনছিল। কিন্তু রাজকুমারের কথার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারছিল না।
‘যথা আজ্ঞা রাজকুমার।’
‘উত্তর যদি হ্যাঁ হয়,’ শীতল শ্বাস টানল, ‘পিতাকে বলবে, জীমূতবাহন কালাপাহাড়কে সাহায্য করছেন। মূর্চার পাহাড়ের চাবি তিনিই ওদের দিয়েছেন। আমার আরও বিশ্বাস, তিনি এখনও অবধি কোনও সামন্তরাজাকেই বার্তা পাঠাননি।’
রমজান হতভম্ব। প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন সম্পর্কে শীতলকুমারের শ্বশুরমশাই!
তার মুখের ভাব লক্ষ্য করে শীতল বলল, ‘হ্যাঁ রমজান, আমি নিশ্চিত। তুমি আর দেরি কোরো না। মুণ্ডমালাঘাট অধিকার করে নিতে পারলে ওরা রাজধানীতে ঢুকে পড়বেই। তার আগেই আমাদের তৈরি থাকতে হবে।’
রমজান বলল, ‘আমি যদি এখানে থেকে যাই? আপনিই গিয়ে জানালেন!’
‘না, তা হয় না।’ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল শীতল, ‘আমি নেতৃত্ব দিলে এখানকার সৈন্যরা মনে বেশি বল পাবে। তুমি আর দেরি করো না রমজান! কালাপাহাড়ের করাল গ্রাস থেকে মল্লভূমকে বাঁচাতেই হবে। তুমি যাও, আমি ততক্ষণ লড়ে যাব, যাতে ওরা রাজধানীতে ঢুকতে না পারে।’
রমজান আর দাঁড়াল না। ঘোড়া বিপরীত মুখে ছুটিয়ে চলে গেল রুদ্ধশ্বাসে।
শীতল ঘোড়া ছুটিয়ে দিল সামনের দিকে। তার বুকের মধ্যে হাতুড়ি পিটছে। অবিশ্বাসে, ক্রোধে, দুঃখে, হতাশায়।
শেষে কিনা জীমূতবাহন? তার শ্বশুরমশাই? কিন্তু কেন? কীসের আকাঙ্ক্ষা তাঁর? রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থ, সম্মান, আভিজাত্য—তাঁর কোন অভাব নেই! ঠাকুমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে পিতা বানিয়েছিলেন নিজের বেহাই!
তা সত্ত্বেও এত বড় বেইমানি! মনোহরা যখন জানতে পারবে নিজের পিতার দুষ্কীর্তি, তার কী অবস্থা হবে?
শীতলের বুকের মধ্যে অসহনীয় যন্ত্রণা কামড়ে ধরছে।
এই মল্লভূমেই আর কয়েকদিন পর জন্ম নেবে তার উত্তরসূরী। এই মল্লভূমের মাটিতেই বড় হয়ে উঠবে সে।
কালাপাহাড় কোথায় সে জানে না, কিন্তু যেভাবেই হোক এই মল্লভূমে তাকে একটা আঁচড়ও শীতল কাটতে দেবে না! আর যে বা যারা কালাপাহাড়কে সাহায্য করছে, তাদের সবাইকে সে কোতল করে দেবে।
তারা যতই নিজের জন হোন না কেন!
৪৪
মূর্চার পাহাড়ের পিছনে দুর্গম অরণ্যের মধ্যে ফেলা হয়েছে পাঠান সেনাদের ছাউনি। কামরূপ ও উৎকল জয় করে এসে সেনারা এখন উত্তেজনায় ফুটছে। কাজের প্রতি উৎসাহও বেড়েছে কয়েকগুণ। রাতারাতি জঙ্গল কেটে সাফ করে সেখানে ফেলেছে অস্থায়ী ছাউনি।
নিজের শিবিরের বাইরে বসে কালাপাহাড় কী যেন ভাবছিলেন। অদূরে প্রবাহিত হয়ে চলেছে একটি নদী। রাঢ়বাংলার অন্য নদীর মতো এখানেও হাঁটু জল।
কালাপাহাড় উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘মকবুল! এই নদীর নাম কী?’
মকবুল শিবির পরিষ্কার করছিল। সে ইন্দ্রহাস চৌকির খিদমদগার, কয়েকদিন হল পাঠান দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সেনাপতির কথার উত্তরে সে দূরে বসে থাকা লোকটিকে জিগ্যেস করল, ‘ও শায়ের! ও আল্লামা! এই নদীর নাম কী?’
‘আহ!’ লোকটি চাপাস্বরে বলল, ‘ফের আল্লা বলছ! বলেছি না, আমি হিঁদুর পো।’
‘আরে আল্লা নয়, আল্লামা। তুমি শায়েরি লেখো তো, আমরা তাদের আল্লামা শায়ের বলি।’ লোকটা হালকা চালে বলল।
‘আমি শায়েরি লিখি না। ছড়া বাঁধি, এখানকার সবচেয়ে নামকরা ছড়াকার আমি।’ লোকটা গর্বিতভাবে স্বগতোক্তি করল। তারপর গলা তুলে বলল, ‘এই নদীর নাম দ্বারকেশ্বর হুজুর!’
দ্বারকেশ্বর! কালাপাহাড় নামটা কয়েকবার উচ্চারণ করলেন। তারপর এগিয়ে গেলেন নদীটির দিকে।
এই নদীর সম্বন্ধে পড়েছিলেন বৃন্দাবনের সেই টোলে। গঙ্গা অববাহিকার একটি নদী হল দ্বারকেশ্বর। আবার অন্যভাবে ভাবলে দ্বারকার ঈশ্বর। দ্বারকা হল সপ্তজনপদের একটি। অবন্তী, অযোধ্যা, কাঞ্চী, কাশী, দ্বারকা, মথুরা, হরিদ্বার এই সাতটি ছিল সপ্তজনপদ।
দ্বারকার ঈশ্বর কে? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, আবার কে?
অবচেতন মন এই উত্তরটা দিতে কালাপাহাড় রোমাঞ্চিত হলেন। এতকাল পরে এত কিছুর পরেও এই নাম তাঁর মনে আসছে কী করে?
আসছে যে, সেটা লক্ষ্য করছেন কিছুদিন ধরে। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার পর প্রকৃতি হয় শান্ত, ওঠে ঝলমলে রৌদ্র। তেমনই প্রচণ্ড ক্রোধ, উত্তেজনার পরে সেই উত্তেজনা যখন স্তিমিত হয়ে আসে তার স্থান নেয় গভীর অবসাদ।
উন্মত্তের মতো উৎকল ও কামরূপ আক্রমণ করেছেন। ক্রোধাগ্নিতে জ্বলতে জ্বলতে তছনছ করেছেন দুই দেবভূমি, ছারখার করে দিয়েছেন প্রাচীন সভ্যতা। তারপর কোথায় উল্লাসে মেতে উঠবেন, কিন্তু সে তো হচ্ছে না। বরং মন কেমন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে। প্রশ্ন করছে, ‘এত ধ্বংস করে কী পেলে? শান্তি পেলে কি?’
নগরবাসীর যে হাহাকার, বিলাপধ্বনি, তা যেন কোন জাদুবলে এতদিন পরে তাঁকে তীব্র যন্ত্রণায় বিদীর্ণ করছে।
কেন এই আকস্মিক পরিবর্তন? কেন মনে হচ্ছে, আদৌ কি কোনও প্রয়োজন ছিল এত ধ্বংসলীলার? কেন মন চলে যাচ্ছে বহুযুগ আগের স্মৃতিতে?
মনে হয় তা বুঝি পূর্বজন্মের কথা। উত্তরভারতের পবিত্র তীর্থস্থান বৃন্দাবন। বৃন্দা অর্থাৎ তুলসী, বন অর্থাৎ অরণ্য। গোটা নগরেই, বিশেষত নিধুবন ও সেবাকুঞ্জের সেই তুলসীবনের নামেই নগরের নাম।
সেই বৃন্দাবন নগরীর উপান্তে সবুজ শ্যামল গাছগাছালি পরিপূর্ণ এক চতুষ্পাঠী। প্রাঙ্গণে খেলে বেড়াচ্ছে ময়ূর, চরে বেড়াচ্ছে গরু ছাগল। গাছের ডালে বসে নাম না জানা পাখি গাইছে সুমিষ্ট গান।
সব মিলিয়ে বড় মনোরম প্রকৃতি।
তারই মাঝে উন্মুক্ত পাঠগৃহের ভূমিতে বসে আছে কিশোর রাজীবলোচন। সুদূর বাংলা থেকে সে পড়তে এসেছে এখানে। সামনে খোলা ভূর্জপত্র। তার মুখ নড়ছে, উচ্চারিত হচ্ছে কিছু শ্লোক। সে নিবৃত্ত করছে নিজের জ্ঞান লিপ্সা।
চতুষ্পাঠীর অদূরেই যমুনা নদী। কেশী ঘাট। মাতুল কংস প্রেরিত ভয়ঙ্কর কেশী দৈত্যকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ নাকি এই ঘাটেই স্নান করেছিলেন।
সেই ঘাট থেকে স্নান করে এসে চতুষ্পাঠীতে প্রবেশ করছেন রাজীবলোচনের তরুণ শিক্ষাগুরু। তাঁর গৌরবর্ণ সুঠাম অঙ্গে শ্বেতশুভ্র উপবীত সিক্ত হয়ে লেগে আছে। মুণ্ডিত মস্তকের পেছনের দীর্ঘ শিখা থেকেও ঝরছে বিন্দু বিন্দু জল।
তিনি প্রশান্তমুখে প্রিয় ছাত্রকে বললেন, ‘কী ভাবছ, রাজীবলোচন?’
‘প্রণাম গুরুদেব। মনে একটি প্রশ্ন জেগেছে।’
‘প্রশ্নের উদ্ভবই তো মানুষের উত্তরণ ঘটায়। বলো, নির্ভয়ে বলো।’
‘বিষ্ণুর নানা রূপ। কখনও তিনি চতুর্ভুজ, কখনও দ্বিভুজ, আবার কখনও জগন্নাথ রূপে ভুজহীন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাঁর রূপটি কী? সে তো কোথাও পড়িনি!’
তরুণ শিক্ষক স্মিত হাসলেন। উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন,
দ্বিভুজ কি চতুর্ভুজ কি দশভুজ বেশ
হেরিয়া ভেবেছ মন, এই কি রূপের শেষ
চিন্তিলে অন্তরে ওরে
দেখিবে কি রূপ ধরে
চিৎরূপে যে ভাতে, সেই এই অনন্ত বিশ্বাকারে।
তুমি যা দ্যাখো, যাদের দ্যাখো, সেগুলো তো সবই মূর্তি, রাজীবলোচন! ঈশ্বরের আবার রূপ কী? তিনি তো বিশ্বরূপ, তাই অরূপ!’
‘তবে কি তিনি নিরাকার?’ আয়ত চোখ মেলে প্রশ্ন করে কিশোর রাজীবলোচন।
শিক্ষক হাসলেন, ‘এই বিশ্বের ক্ষুদ্র বৃহৎ তুচ্ছ মহান যাই বলো, সবই তাঁহার রূপ। তাঁকে নিরাকার বললেই বা আপত্তি কোথায়!’
এসব কতকাল আগের কথা! তবু সহসা সেই স্মৃতি জেগে উঠতেই কালাপাহাড়ের রোমকূপ শিহরিত হয়ে উঠল। অশ্রু মুছতে গিয়ে তাঁর চোখ পড়ল নদীর জলে ঈষৎ কম্পমান প্রতিবিম্বের দিকে।
ও কে? কে ও? ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া ঘাড় পর্যন্ত চুল, চোখ দুটোয় জ্বলন্ত হিংসা আর দ্বেষ! চোখের নীচের গাঢ় কালিমা বুঝি লজ্জা দেবে অন্ধকারকেও।
এই করালদর্শন দানব কি তিনি নিজে? ভাদুড়িয়া গ্রামের সেই সুদর্শন রাজীবলোচন রায় ভাদুড়ী, যাকে দেখে মানুষ বলত, শ্রীচৈতন্য পুনরাবির্ভূত হয়েছেন ধরাধামে, সেই কোমল মুখ কোথায় হারিয়ে গেল এই কয়েক বছরে?
কোথায় হারিয়ে গেল দাদুর স্নেহ, মায়ের ভালোবাসা? আর তার দুই স্ত্রী? রূপালী আর রূপানি? তারাই বা কোথায়? যার জন্য এত কিছু ঘটল, সেই সুলতানকন্যা দুলারীই বা কেন ক্ষোভে অভিমানে মূক হয়ে গিয়েছে?
কার পেছনে ছুটছেন কালাপাহাড়? গ্রামের সমাজপতি আর পুরীমন্দিরের পাণ্ডাদের উপর প্রতিহিংসায় কেন ধ্বংস করছেন হিন্দু সম্প্রদায়কে?
পিছনে কেউ ডাকছেন। বাষ্পঘন চোখে তিনি পিছন ফিরলেন। মনসবদার রহিম খাঁ এসে দাঁড়িয়েছে।
‘কী খবর, রহিম খাঁ?’
‘আজ্ঞে হুজৌর! মুণ্ডমালাঘাট পুরো সান্নাটা হয়ে গেছে। সব খতম!’
‘শাবাশ! কাল ভোরে আমরা বিষ্ণুপুরে হামলা করবো।’ কালাপাহাড় মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলেন দ্বিধা। বলেন, ‘আর ওদের সেই যুবা রাজকুমার?’
‘সে আখরি ওয়াক্ত অবধি লড়ে গেছে হুজৌর! বহত তকলিফ দিয়েছে আমাদের।’
কালাপাহাড় তীক্ষ্নচোখে তাকান, ‘সে বান্দা কোথায়?’
‘জন্নতে, হুজৌর। ওদের কেউই আর বেঁচে নেই।’ রহিম খাঁ বলল, ‘আপনি এদিকটা আসুন মেহেরবানি করে।’
শিবির পেরিয়ে কিছুদূর গিয়ে সেই মূর্চার পাহাড়। যেখানে ঢোকার চাবি দিয়ে গিয়েছে মল্লভূমেরই প্রধানমন্ত্রী।
কালাপাহাড় চলতে চলতে একদলা থুতু ফেলেন মাটিতে। শালা, সব জায়গায় বেইমান! এই মল্লভূমের গদিতে বসার জন্য তিনজন ঢুকফুঁক করছে। এক বুঢঢা ভাতিজা, একটা অপদার্থ ভাই আর একটা লোভী মন্ত্রী।
সব শালা নিমকহারামের দল! শত্রু হোক বা নিজের লোক, নিমক খেয়ে যারা গদ্দারি করে, তাদের কালাপাহাড় জ্যান্ত পুঁতে দেন। এই হারামখোররা জানে না, এদের নসিবেও সেটাই লেখা রয়েছে।
কালাপাহাড় বলেন, ‘রুদ্রাক্ষের কোনও খবর পেলে, রহিম?’
‘কৌন? আপকা দোস্ত রহমান?’
রুদ্রাক্ষের এখনকার নামটা কেন যে খেয়াল থাকে না! কালাপাহাড় বলেন, ‘হাঁ।’
‘নেহি হুজৌর! অনেক খুঁজেছি, তিনি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। শেষ চিঠি রায়নার চৌকি থেকে যখন পেয়েছিলাম, তখন আমরা উৎকল থেকে রওনা হয়েছিলাম। তারপর থেকে কোনও খোঁজ নেই!’
‘তাজ্জব কী বাত!’ কালাপাহাড় মূর্চার পাহাড়ে এসে দাঁড়ান। পাহাড়ে ঢোকার পাশে একটি ফাঁকা এলাকা, যেখান থেকে গোটা মুণ্ডমালাঘাট দেখা যায়।
কালাপাহাড় দেখতে পান, আকাশ থমথম করছে। ঈশানকোণে পুঞ্জীভূত হয়েছে কৃষ্ণবর্ণ ঘন মেঘ।
মুণ্ডমালাঘাটের প্রাঙ্গণের মাটি দেখা যাচ্ছে না। মৃত মক্ষিকার মতো পড়ে রয়েছে শয়ে শয়ে লাশ। কিছু ঘোড়া মৃত, কিছু ঘোড়া দিকভ্রান্ত হয়ে বিচরণ করছে মৃত্যুপুরীতে। থেকে থেকে তাদের অবোধ আর্তনাদ কাঁপিয়ে দিচ্ছে নিস্তব্ধতা।
সামনে যে ঘোড়াটা অনাথ শিশুর মতো ছুটে বেড়াচ্ছে, তার পিঠে শুয়ে আছে এক যুবকের দেহ। পরনে রাজপোশাক। মাথার শিরস্ত্রাণ অর্ধেক খুলে ঝুলছে। তার শরীরের অসংখ্য ক্ষতস্থান থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত ঘোড়াটাকে রঞ্জিত করে তুলেছে।
কালাপাহাড়ের বুক আবার মুচড়ে উঠল। মহম্মদ ফারমুলীর ভিতর ঘুমিয়ে থাকা রাজু যেন তেড়েফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চায়, বলে ওঠে, ‘পুরীর ওই পাণ্ডাদের অপরাধের প্রতিশোধ নিরপরাধদের ওপর দিয়ে কেন নিচ্ছ, হে রাজীবলোচন! মল্লরাজ্যের এই যুবক রাজকুমার তোমার কী ক্ষতি করেছিল?’
কালাপাহাড় জোর করে মনকে টেনে সরিয়ে আনেন। ক্লান্ত স্বরে বলেন, ‘শিবিরে চলো, রহিম!’
রহিম কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই পুরুষ কণ্ঠের প্রচণ্ড হাহাকারে নৈঃশব্দ্য ভেঙে খানখান হয়ে গেল।
কালাপাহাড় বলে ওঠেন, ‘কে? কে কাঁদে, রহিম?’
সেই বিকট আর্তনাদ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ভেসে আসছে কাতরোক্তিও।
‘আমায় ছাড়ো! যেতে দাও সেনাপতির কাছে!’
‘রহিম! নিয়ে এসো লোকটাকে!’ কালাপাহাড় ভ্রূ কুঁচকে বলেন। এই স্থানে অচেনা কারোর পক্ষে আসা সম্ভব নয়।
ছুটতে ছুটতে আসছে এক ব্যক্তি। তার অঙ্গে রাজপোশাক, বিধ্বস্ত মুখচোখ।
‘রহিম, ইয়ে কৌন হ্যায়?’
রহিম কিছু বলার আগেই লোকটি চিৎকার করে ওঠে, ‘আমি মল্লরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন! কাল চাবি দিয়ে গিয়েছিলাম, আর আজ চিনতে পারছেন না?’
না, কালাপাহাড় চিনতে পারেন না। চিনতে চানও না।
‘কী চান?’
লোকটি বিকৃত স্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘আমার জামাতাকে আপনার ফৌজ খুন করেছে। আমার…আমার মেয়ে গর্ভবতী! আপনাকে সাহায্য করলাম, এই কি তার ইনাম?’
জামাতা? প্রধানমন্ত্রীর জামাতা রাজপুত্র? কালাপাহাড় ভ্রূ কুঞ্চিত করে তাকান রহিম খাঁর দিকে।
রহিম খাঁ নীচু স্বরে জানায়, যে যুবক রাজকুমার সামনে নেতৃত্ব দিয়ে মুণ্ডমালাঘাটে মৃত্যুবরণ করেছেন, সে প্রধানমন্ত্রীর জামাতা। যুবক রাজকুমারের সেইসময় এখানে থাকার কথা ছিল না, কথা ছিল অন্যদিকে থাকার।
জীমূতবাহন থরথর করে কাঁপছিলেন। শোকে, অনুতাপে হারিয়ে ফেলছেন ভারসাম্য। এ কী হল? নিজের কন্যাকে মহারানী করতে গিয়ে শেষে ঠেলে দিলেন অকালবৈধব্যের অন্ধকার কূপে? পিতা হয়ে এত বড় পাপের ভাগীদার হলেন তিনি? তাঁর বুক পুড়ে যাচ্ছিল অসহনীয় দহনে।
কালাপাহাড় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। সূর্যকে আর দেখা যাচ্ছে না, তবে পশ্চিমাকাশ এখনও কমলা। পাখিরা ফিরে যাচ্ছে নিজেদের বাসায়।
দূরে একইভাবে ঘোড়ার পিঠে শুয়ে রয়েছে শীতলকুমারের মৃতদেহ। বইছে এক অদ্ভুত শিহরন জাগানো বাতাস।
৪৫
সূর্যদেব অস্তাচলে গিয়েছেন। মহারানী শিরোমণি সন্ধ্যার শঙ্খে ফুঁ দিয়েছেন, শীতলের মা সুলক্ষণা সন্ধ্যার গাত্রপ্রক্ষালন শেষে প্রসাধনে বসেছেন।
মনোহরাও অন্দরমহলে সজ্জিত হচ্ছে। নিজের সদ্যস্নাত সিঁথি রাঙিয়ে দিচ্ছে রক্তসিঁদুরে।
ঠিক এমন সময়ে ভয়ংকর দুঃসংবাদটা এল। এই সব কথা বাতাসে আগুনের মতো ছড়ায়। মুণ্ডমালাঘাটে যে যুদ্ধ করতে করতে সকলে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছে, আর সামনে থেকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন রাজকুমার শীতল, শুনতে শুনতে লোকে পথেঘাটেই উচ্চঃস্বরে বিলাপ শুরু করেছে।
শান্ত, মিষ্টভাষী শীতলকুমার ছিল সর্বজনপ্রিয়। শুধু মৃত সৈনিকদের পরিবার নয়, বিষ্ণুপুরের প্রতিটি ভদ্রাসন থেকে উঠছে নারীকণ্ঠের হাহাকার। সুখ যেখানে চিরস্থায়ী, মা লক্ষ্মী যেখানে অচলা, সেই শান্তিধাম মল্লভূমিতে এত বড় দুঃস্বপ্নের সন্ধ্যা আগে কখনও আসেনি।
‘পালাও! পালাও! কালাপাহাড় আসছে!’
কিন্তু বিষ্ণুপুরের মানুষজন পালাবে কোথায়? হলদি দরজা পেরিয়ে দুই পাথর দরজায় চলছে মরণপণ যুদ্ধ। মুহুর্মুহু কামানের গগনবিদারী শব্দে কান পাতা দায়। কামানের গোলায় অর্ধেক উড়ে গিয়েছে হলদি দরজা। সেখান দিয়ে অর্গলভাঙা নদীর মতো ঢুকছে ইন্দ্রহাস ও রায়নার চৌকির মোগল সেনারা। বাতাস ভারী হয়ে উঠছে মৃত্যুর গন্ধে।
আর এদিকে লাল দরজা দিয়ে ঢুকে আসছে মুণ্ডমালাঘাটকে শ্মশান বানিয়ে দেওয়া সৈন্যদল। যাদের প্রধান স্বয়ং কালাপাহাড়।
সন্তানশোকের চেয়েও বড় রাজধর্ম। শীতলকুমারের মৃত্যুসংবাদে শোকে বিহ্বল হয়ে গেলেও বীরহাম্বীর নিজেকে অমানুষিক শক্তিতে শক্ত রাখছিলেন। তিনি রাজা! গোটা মল্লভূমের অধীশ্বর তিনি! বিলাপের উপায় তাঁর নেই।
রমজান যখন প্রথম এসে জানিয়েছিল, মূর্চার পাহাড় অধিকার করতে কালাপাহাড়কে সাহায্য করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জীমূতবাহন, বীরহাম্বীর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারেননি।
জীমূতবাহনকে যে তিনি নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করতেন। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি এখন অতি নিকট আত্মীয়ও!
পাশেই মেজরানী সুলক্ষণার মহল। সেখান থেকে করুণ কান্না নাড়িয়ে দিচ্ছে বীরহাম্বীরের অন্তরাত্মাকে। বিলাপ শোনা যাচ্ছে শিরোমণি এবং স্বর্ণময়ীর মহল থেকেও।
তবু বীরহাম্বীর প্রস্তরমানব। সহসা তাঁর মনে এল মনোহরার কথা। নিজের কন্যার চেয়ে যাকে এতটুকু আলাদা করে দেখেননি, সেই মনোহরা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থাতেই স্বামীকে হারাল।
অসহ্য কষ্টে বীরহাম্বীরের হৃদপিণ্ড রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছিল। ঠিক এই মুহূর্তে শ্রীনিবাস আচার্য প্রবেশ করলেন কক্ষে।
এসেই তিনি বীরহাম্বীরকে টেনে নিলেন নিজের বুকের মাঝে। অনেকসময় সান্ত্বনায়, কথায়, উপদেশে যা হয় না, শক্ত আলিঙ্গনে তা হয়। জমিয়ে রাখা ব্যথা ভেঙে পড়ে বাঁধভাঙা স্রোত হয়ে। বীরহাম্বীরেরও তাই হল। তিনি কেঁদে ফেললেন। সেই নীরব ক্রন্দনে ভিজে যেতে লাগল শ্রীনিবাস আচার্যের উত্তরীয়। কিন্তু তিনি কিছু বললেন না। বীরহাম্বীরের কান্না থামানোর চেষ্টাও করলেন না। শুধুমাত্র রাজার পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে যেতে লাগলেন।
কিছুসময় কেটে গেল। তারপর শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘শক্ত হও বীরহাম্বীর! তোমার এক পুত্র গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাজ্যের হাজার হাজার প্রজা তোমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদেরও তুমি পিতা!’
বীরহাম্বীর কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আপনি আসার আগে বছরের পর বছর অসহায় মানুষকে লুণ্ঠন করে যে পাপ আমি করেছি, এ তারই শাস্তি, প্রভু! আমার…আমার সবচেয়ে বিচক্ষণ…সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটা আজ চলে গেল।’
‘না বীরহাম্বীর! তোমার ধারণা ভ্রান্ত!’ শ্রীনিবাস আচার্য বললেন, ‘তুমি সে’কাজের জন্য অনুতপ্ত। অনুতাপের চেয়ে বড় প্রায়শ্চিত্ত আর কিছুই নেই!’
‘কত কষ্ট পেয়েছে ছেলেটা…তার শরীর ঝাঁঝরা করে দিয়েছে পাঠান সেনারা…তবু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ে গিয়েছে! জীমূতবাহন নিজেই ওকে হত্যা করল?’ বীরহাম্বীর নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছিলেন।
বংশের নিয়মানুযায়ী ধাড়ী মল্লকে যুবরাজ করতে হলেও শীতলকুমার ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য পুত্র। শীতল নিজেও জানত যে, সিংহাসনের সে-ই সবচেয়ে যোগ্য উত্তরাধিকারী। তবু কোনওদিন সেই ইচ্ছা সে প্রকাশ করেনি।
‘বীরহাম্বীর! তুমি এখানে কাঁদছ? তুমি কি শুনতে পাচ্ছ না, বাইরে কীভাবে প্রজারা হাহাকার করছে? কালাপাহাড় একের পর এক দরজা ভাঙছে, যে-কোনও মুহূর্তে সে প্রবেশ করবে রাজপ্রাসাদে! তোমার বিশ্বাসঘাতকরা পালিয়েছে। তারা অপেক্ষা করছে কখন সব পুড়ে ছাই হবে। পাঠান সেনারা তোমার প্রজাদের নির্মমভাবে হত্যা করবে। ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেবে মন্দিরগুলো। মল্লভূমের মা-বোনেরা প্রকাশ্য রাজপথে নিগৃহীতা হবে।’
শ্রীনিবাস আচার্য বীরহাম্বীরকে জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগলেন, ‘ঠিক যেমন জগন্নাথধাম শ্মশান হয়ে গিয়েছে, তেমন মল্লভূমও শেষ হয়ে যাবে! বীরহাম্বীর! তুমি কি এখনও কাঁদবে?’
প্রবল ঝাঁকুনিতে বীরহাম্বীর যেন বহু বছরের ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘না! আমি তা দেখতে পারব না। মল্লভূম আমার প্রাণ।’
‘তবে? তুমি কি জানো, বালক রঘুনাথ পর্যন্ত চলে গিয়েছে দুর্গে, সম্মুখসারিতে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেনাদের? তোমার অন্যান্য পুত্ররাও ব্যস্ত যুদ্ধযাত্রায়?’
বীরহাম্বীর রুদ্ধস্বরে বললেন, ‘আমি…আমি কালাপাহাড়কে প্রতিহত করব!’ শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে।
‘এই তো রাজার মতো কথা, বীরহাম্বীর!’ শ্রীনিবাস বললেন, ‘যাও! যাও! আর দেরি করো না। শীতল যে কারণে নিজের জীবন আহুতি দিয়েছে, সেই কারণকে অর্থহীন করে দিও না! শীতল নেই। নেই জগতকুমার, জীমূতবাহনের মতো বিশ্বাসঘাতকরাও। কিন্তু রঘুনাথ রয়েছে, মহাসেনাপতি কুম্ভ রয়েছেন। তুঙ্গভূমে তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র ধাড়ীকে কিছুক্ষণ আগেই বার্তা পাঠিয়েছি। আসছে সেও! যাও বীরহাম্বীর! ঝাঁপিয়ে পড়ো, রক্ষা করো মাতৃভূমিকে!’
বীরহাম্বীর দ্রুত স্বাভাবিক হলেন। অশ্রু মুছে নিলেন পোশাকে। তারপর গুরুকে প্রণাম করে বেরিয়ে গেলেন।
৪৬
অশ্বশালা পেরিয়ে দক্ষিণদিকে হিকিমমহল। কিন্তু তা এখন অন্ধকার। মেনকা ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না। সেই আশাও করেনি। কারণ জগতকুমার গতকালই গোপনে চলে গিয়েছেন নিজের নাটকাঞ্চন মৌজায়।
মেনকা সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে উঠতে লাগল। বিবাহের পর থেকে সে নিজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে এনেছে। রানীর অন্দরমহল আর মহারাজের মহল ছাড়া সেভাবে কোথাও আর যায় না।
কিন্তু আজ ও এসেছে। নিরুপায় হয়েই এসেছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে আবছা অন্ধকারের মধ্যেও প্রায় ম্লান প্রদীপটা চোখে পড়ল ওর। আশেপাশে তাকাতেই দেখতে পেল, উমাপতি ঘরের এককোণে বসে নীরবে মদ্যপান করে চলেছে।
মেনকাকে আবছা অন্ধকারে উমাপতি চিনতে পারল না। চেঁচিয়ে উঠল, ‘কে? কে ওখানে?’
মেনকা উত্তর না দিয়ে আরও কাছে এগিয়ে গেল। উমাপতি যেন ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। একবার চোখ ঘষে পরীক্ষা করে নিল যে নেশার ঘোরে তার ভ্রম হচ্ছে কিনা।
স্বাভাবিক। যে নারী শত অনুরোধেও কোনওদিন ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত, শত প্রলোভনেও ওর ডাকে সাড়া দেয়নি, সে বিবাহের পর এভাবে এই স্ত্রীবর্জিত মহলে এসে উপস্থিত হয়েছে, তাও আবার এই ভর সন্ধেবেলা!
মেনকা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। মদির কটাক্ষ হেনে বলল, ‘কেমন আছ উমাপতি? আমাকে কি ভুলে গেছ?’
উমাপতি বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছিল মেনকাকে। বিবাহের পর সব নারীকেই ভরন্ত লাগে। আর মেনকাকে মনে হচ্ছে স্বর্গের কোন অপ্সরা। বিবাহের পরেও সে পোশাক পরার ধরন পরিবর্তন করেনি। বক্ষদেশের কতটুকু আবরণের অন্দরে রাখতে হয়, আর কতটুকু উন্মুক্ত রেখে পুরুষ মনে কামনা জাগাতে হয়, তা সে ভালো করে জানে।
মেনকার পেটের অনাবৃত অংশে এসে পড়েছে প্রদীপের আলো। সুগভীর পরিখার মতো নাভির দিকে তাকিয়ে উমাপতির ঝিম ধরে গেল। শুধু বলতে পারল, ‘তুমি…এখানে?’
মেনকা আরও কাছে এগিয়ে গেল। তারপর উমাপতির কাঁধে হাত রেখে গাঢ় স্বরে বলল, ‘কেন? আগে তো কত ডাকতে! এখন আসতে পারি না বুঝি? তোমার মনিবও তো আজ নেই!’
উমাপতি বিস্ময় আর মুগ্ধতার চূড়ান্তে পৌঁছে যাচ্ছিল। হিকিমমহলে আজ সে একা।
জগতকুমার গতকালই প্রাসাদ ছেড়েছেন। তিনি অবশ্য জানতেন না শীতলকুমারের মৃত্যু হবে। এখন তিনি নাটকাঞ্চন মৌজার প্রাসাদে। সেখান থেকেই তাঁর লাঠিয়ালরা যোগ দেবে পাঠান সেনাদলে। আগামীকাল সকালে যখন কালাপাহাড় রাজপ্রাঙ্গণে ঢুকবেন, গুঁড়িয়ে দেবেন সব কিছু, ততক্ষণ পর্যন্ত উমাপতিকেই সবকিছু পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। কোনওরকম প্রতিকূল অবস্থা দেখলে প্রেরণ করতে হবে বার্তা।
জগতকুমার বলে গিয়েছেন, আগামীকাল সকালে এক নতুন মল্লভূমের জন্ম হবে। জন্মের প্রথম লগ্নে সব শিশুই দুর্বল থাকে, পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চলে সংগ্রাম। তেমনই আগামীকাল কালাপাহাড়ের অভিযানের পর জগতকুমার যখন সিংহাসনে অভিষিক্ত হবেন, তার পরের কয়েকদিন একটু তোলপাড় হবে। তারপর উমাপতি হবে মহাসচিব।
মেনকা আরও কাছে এগিয়ে এল। এত কাছে যে, তার দেহের এক অদ্ভুত ফুলের ঘ্রাণ গিয়ে ঝাপটা মারল উমাপতির নাকে। মেনকার শরীর কি ফুলের মতোই কোমল?
উমাপতি ঢোঁক গিলে বলল, ‘শ্রীধর কোথায়?’
মেনকা ভ্রূ নাচিয়ে হাসল, ‘সে খোঁজে তোমার কী? তুমি তো তাকে পছন্দ করো না!’
কথাটা মিথ্যা নয়। শ্রীধরের মেনকাকে বিবাহের সংবাদ উমাপতি যখন পেয়েছিল, ওর ইচ্ছা হয়েছিল, মৃন্ময়ী মন্দিরে গিয়ে শ্রীধরকে বলি দিতে। বহুকষ্টে নিজেকে সংবরণ করেছিল। মেনকার মতো লাস্যময়ী যৌবনা কী করে ওই বুড়োটে লোকটার গলায় বরমাল্য দিতে পারে, তা সে ভেবে পায়নি।
উমাপতি বলল, ‘না মানে তবু…সে কোথায় জানতে চাইছিলাম।’
‘সে হল গিয়ে ঢোঁড়া সাপ, তাকে দিয়ে কি মেনকার মন ভরে? চোখের সামনে যখন গোখরো আছে?’ মেনকা মুখ টিপে হাসল।
তিন দণ্ড পরে মেনকা হিকিমমহল থেকে বেরিয়ে এল। ঘর্মাক্ত শ্রান্ত দেহ। কিন্তু মনে চাপা উত্তেজনা। মুখ সাফল্যের হাসিতে পূর্ণ।
কাজ হয়ে গেছে। উমাপতি ছাড়তে চাইছিল না, মেনকা ‘একটু পরে আবার আসছি’ বলে বেরিয়ে এসেছে।
সতীসাধ্বী সে নয়, কোনওদিনও ছিল না। আর সেই দাবিও সে কখনও করে না। কিন্তু শ্রীধরকে সে সত্যিই ভালোবাসে। ভালোবাসে এই রাজ্যকেও। ভালোবাসা মানে কি শুধুই সতীত্বরক্ষা? না। নিজের সতীত্বের চেয়ে আরও অনেক কিছু এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
অন্নদা অশ্বশালার পিছনে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ছিল। মেনকা কাছে আসতেই শঙ্কিতমুখে বলল, ‘জানতে পারলি?’
‘হ্যাঁ।’ মেনকা আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘পাঠান সেনাপতির সঙ্গেই রয়েছে কেশব। মূর্চার পাহাড়ের পিছনের শিবিরে। আমি সেখানেই যাব।’
‘আমিও যাব!’ বিহ্বল অন্নদা মেনকার হাত চেপে ধরল, ‘একবার…একবার তাকে চোখের দেখা দেখবো!’
‘নাহ। তুমি যাবে না।’ মেনকা মুখ বিকৃত করে বলল, ‘পাঠান সেনাপতির শিবিরে গেলে যুবতী হোক কি প্রৌঢ়া, কেউ ছাড় পায় না। ফারমুলীর মতো নরকের কীট খুব কম আছে!’
‘মেনকা!’ ধমকে উঠল অন্নদা, ‘তোকে এই ক’দিনে পইপই করে বলেচি, তার নামে বাজে কথা বলবি না।’
অন্নদা একটু থেমে বলল, ‘হাজার হোক, তুই হিঁদুর মেয়ে। তার সঙ্গে তুই আমি দুজনেই সাত পাক ঘুরেছি। আমাদের দুজনেরই…!’
‘চুপ করো দিদি!’ মেনকা এবার স্থান কাল বিস্মৃত হয়ে গর্জে উঠল, ‘অনেকদিন ধরে সহ্য করে যাচ্ছি তোমার এই ন্যাকামি। যে কোনোদিন খোঁজ নিল না, উল্টে আরেকটা বিয়ে করল, যার পাপে আমাদের ভিটেছাড়া হতে হল, যার জন্য অকালে মরতে হল আমাদের বাপকে, তাঁকে তুমি স্বামী মানতে পারো, আমি মানি না।’
‘তুই তখন শিশু ছিলি, মেনকা!’ সজল চোখে অন্নদা বলল, ‘তোকে সে কোনদিনও স্বামীভাবে স্পর্শ করেনি। তুই ছিলি কুমারী। সেইজন্যই তো তোর একখানা গতি করলুম। কিন্তু…কিন্তু আমি তো তা নই! তার সঙ্গে একই ঘরে থেকেচি। সেবা করেচি। সুখ দুঃখ ভাগ করে নিয়েচি। তাকে সোয়ামী মানব না তো কাকে মানব? যবে থেকে শুনেচি সে আসচে, বড় ইচ্ছে করছে একবারটি তাকে চোখের দেখা দেখতে! হিন্দু হোক মুসলমান হোক, মানুষটা তো একই!’
মেনকা নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে শৈশবের কথা। তখন তার বয়স মোটে তিন। নাম রুপানী। তার মা সেজে থাকা অন্নদা ওর নিজের দিদি, নাম রূপালী। বয়স ষোলো। ওদের বাবা রাধামোহন লাহিড়ী এমন এক সর্বগুণসম্পন্ন সুপাত্রের সন্ধান পেলেন যে কালবিলম্ব না করে দুই কন্যাকেই তুলে দিলেন তার হাতে। মেনকার আবছা মনে পড়ে যায় ধূসর ছবির মতো। বাকি সে শুনেছে দিদির মুখে।
তাদের স্বামী নাকি সুলতানের রাজধানীতে মস্ত পদে আসীন। মাঝেমধ্যে আসে। রাত কাটায় দিদির সঙ্গে, আর মাঝেমধ্যে আদর করে তার গাল টিপে দেয়।
মেনকার এখনো ঝাপসা মনে আছে, স্বামী গ্রামে ফেরার সময় তার জন্য আনত মাটির পুতুল, চুড়ি, কাঠের খেলনা। কখনও-কখনও তাকে কোলে নিয়ে গ্রাম ঘুরতে বেরত। আর তাই দেখে দিদিমা দন্তহীন হাসিতে লুটিয়ে পড়তেন, ‘ওরে রাজীবলোচন, শেষে কিনা বউকে কোলে নিয়ে ঘুরছিস!’
মেনকার যুবক স্বামী তখন লাজুক হাসত। অবোধ শিশু মেনকা তখন স্বামীর গলা জড়িয়ে দিদিমার দিকে তাকিয়ে চোখ পাকাত। আর তার কাণ্ড দেখে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ত।
সেসব কতদিন আগেকার কথা! তবু আজও মনে আছে।
তারপর কত ঝড় ঝঞ্ঝা! তাদের স্বামী হঠাৎই তন্দায় মুসলমান কন্যার পাণিগ্রহণ করেছে, সেই অপরাধে জাতিচ্যুত হওয়া, যখন তখন গ্রামের পুরুষদের এসে হেনস্থা করা, কু ইঙ্গিত করা।
তারপর একদিন বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার ভয়ে ভোররাতে বাবা ও দিদির হাত ধরে গৃহত্যাগ করা।
পিতার সঙ্গে ক্রোশের পর ক্রোশ হেঁটেছে দুই বোন। কখনও রুপানী ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে, দিদি রূপালী কোলে তুলে নিয়েছে বোনকে। কখনও শ্রান্ত দুই বোনকে নিয়ে অবিরাম চলেছেন পিতা।
তারপর কী যে হল! গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্রে একদিন পথের মধ্যেই বসে পড়লেন পিতা রাধামোহন। সেই যে বসলেন, আর উঠলেন না। লোকসমাজের অপমান ভেতরে ভেতরে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল তার শরীরকে।
তারপর শুরু হয়েছিল দুই বোনের আরও কঠোর সংগ্রাম। পিতা সারাক্ষণ বলে চলতেন, ‘যে করেই হোক, আমাদের মল্লভূমে পৌঁছতেই হবে রে মা! ওদিকে আমাদের কেউ চেনে না। শুনেছি বড় শান্তির রাজ্য মল্লভূম। একটু কষ্ট করে চল, তারপর দেখবি আর দুঃখ নেই!’
ভিক্ষা থেকে শুরু করে সম্ভ্রান্ত বাড়িতে কিছুদিনের জন্য রাঁধুনিবৃত্তি, কী না করেছে রূপালী! দুই সধবা ব্রাহ্মণী অবশেষে ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছেছে এই মল্লভূমে। ভাগ্যজোরে স্থান পেয়েছে রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলে।
কিন্তু মনে আশঙ্কা সর্বক্ষণ। এত সুখ কি কপালে সহ্য হবে? দুই ভদ্র পরিবারের মেয়ে দেখলেই মানুষের কৌতূহল জাগ্রত হয়ে ওঠে, তার ওপর সুলতানের যে সেনাপতি বাংলায় আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, ওরা তার সহধর্মিনী—এ’কথা জানতে পারলে মল্লভূম কেন, দেশের কোনও হিন্দু রাজ্যেই তাদের ঠাঁই হবে না।
রূপালী তার নাম বদলে ফেলল রাতারাতি। মল্লরাজবাড়ির নবনিযুক্ত দাসীর নাম হল অন্নদা। আর তেরো বছরের ছোট বোন? হলই বা সপত্নী, তার কাছে সে তো কন্যাসমাই! আর যে বালিকাকে স্বামী একদিনের জন্যও কামভাবে স্পর্শ করেনি, তাকে অবিবাহিতা সাজাতে দোষ কী? আর পাপ হলেও তার থেকে পেটের জ্বালা বড়।
এরপর রুপানী হয়ে গিয়েছিল অন্নদার কন্যা, নাম মেনকা। স্বামী পরিত্যক্তা সুন্দরী সকন্যা অন্নদা অল্পদিনের মধ্যেই অন্দরমহলে স্বর্ণময়ীর হৃদয় জিতে নিয়েছিল।
সময় এগোতে থাকল। স্বর্ণময়ীর খেয়াল রাখতে গিয়ে একদিন যুবতী অন্নদার চুলে পাক ধরল, বয়স গেল মধ্যযৌবনে। বালিকা মেনকার জীবনে এল ভরন্ত যৌবন। একে একে মেনকার জীবনে এল বিপরীতপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুরুষ। প্রথমজন মেনকাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে। আর দ্বিতীয়জন এসে সেই ক্ষতচিহ্নে দিল ভালোবাসার প্রলেপ!
‘কীরে?’ ঝাঁকুনি দিয়ে প্রশ্ন করল অন্নদা, ‘কী ভাবছিস? বল না, নিয়ে যাবি আমায়?’
‘না।’ মেনকা বলল, ‘আমি একা যাব। তুমি অন্দরমহলে থাকো। মনোহরার খেয়াল রেখো। চিন্তা করো না।’
৪৭
লাল দরজা যখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল, প্রথমে প্রচণ্ড ধুলোয় কিছু দেখা গেল না। মল্লরাজ্যের সৈন্যরা ক্রমাগত গোলা ছুঁড়ে চলেছিল। সেই আওয়াজে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। কালাপাহাড়ের সৈন্যদলের চেয়ে মল্লভূমের সৈন্যসংখ্যা বেশি হলেও পাঠান বাহিনী অস্ত্রের আধুনিকতা, রণকৌশল, সর্বোপরি নিষ্ঠুরতায় অনেক এগিয়ে।
মল্লভূমের সৈন্যদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়ছিল সাঁওতালরাও। নিতাই সর্দার, বিপুল ডোমের মতো সর্দাররা নেতৃত্ব দিচ্ছিল। টাঙি, কুঠার, তীর, বর্শা নিয়ে লড়ছিল তারা। বিষাক্ত তীরের নির্ভুল নিশানায় বিদ্ধ হয়ে একেকটা পাঠান সেনা ঘোড়া থেকে লুটিয়ে পড়তেই তারা উল্লাস করে উঠছিল। দ্বিগুণ উদ্যমে আবার ‘হুই-ই-ই-ই!’ শব্দ করে তেড়ে যাচ্ছিল। পরমুহূর্তে হয়তো পাঠানসেনার গোলায় লুটিয়ে পড়ছিল।
বীরহাম্বীর পায়ে হেঁটে পৌঁছলেন রাজদরবারের সামনে। ইতিমধ্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহাসেনাপতি কুম্ভ। তাঁর সঙ্গে রয়েছে পাঁচজন উপসেনাপতি ও বারো জন হাজারি সর্দার। তুঙ্গভূম থেকে এসে পৌঁছেছে ধাড়ীমল্ল। রয়েছে রঘুনাথ ও রমজানও।
রঘুনাথের চোখ লাল, ফুলে রয়েছে। চুলও উসকোখুসকো। তবু সে নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে। যেন পলক ফেললেই ঝরবে অশ্রু, তাই পলকও ফেলছে না।
কুম্ভ বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সামন্তরাজাদের বার্তা পাঠানোর নাম করে সেই যে বেরিয়েছিলেন, আর কোনও সন্ধান নেই। আমাদের এক গুপ্তচর তাঁকে প্রদ্যুম্নপুরের দিকে যেতে দেখেছে, মহারাজ!’
‘বটবৃক্ষকে লতা আঁকড়ে ধরে, চলেও যায়। তাতে বটবৃক্ষের কোন ক্ষতি হয় না, যায়ও আসেনা।’ বীরহাম্বীর গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আর তাছাড়া সে বিশ্বাসঘাতক, প্রধানমন্ত্রী পরিচয়টা তার আর নেই।’
‘যথা আজ্ঞা মহারাজ।’ কুম্ভ বললেন, ‘এখনও পর্যন্ত ওদের পরিকল্পনা যা বুঝতে পারছি, সংক্ষেপে বলছি। প্রথমে ওরা আমাদের গড় পাথর দরজা অতিক্রম করে হলদি দরজা দিয়ে ঢোকার ইঙ্গিত দেয়। আমরা সেই ফাঁদে বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের গরিষ্ঠভাগ সৈন্যকে সেখানে মোতায়েন করে দিই। সেই সুযোগে লাল দরজা দিয়ে ঢুকে মুণ্ডমালাঘাটের দিকে যাত্রা করে যুঝঘাটিতে পৌঁছোয় ওদের মূল দল। সেখানে বেইমানির সুযোগে অধিকার করে নেয় মূর্চার পাহাড়। ততক্ষণে আমাদের কাছে ওদের সংবাদ এসে গিয়েছে। রাজপুত্র শীতলকুমার অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে সেখানে যান। কিন্তু তার আগেই ওরা ঘাঁটি গেঁড়ে ফেলেছিল।’
কুম্ভ বলে চলেন, ‘সেখান থেকে ওরা সোজা এসেছে লাল দরজায়। একই সময়ে শুরু হয়েছে হলদি দরজা পেরিয়ে গড় পাথর দরজাতেও আক্রমণ।’
রঘুনাথ ভাঙা স্বরে বলল, ‘আমার এক বন্ধু গতকাল লাল দরজার বাইরে কেশব ছড়াকার ও জীমূতবাহনকে দেখেছিল।’
‘কে কী করেছিল, তা নিয়ে তদন্ত করার সময় এখন নয়।’ বীরহাম্বীর বললেন, ‘পাঠান সেনারা কামরূপ ও উৎকল তছনছ করে এসেছে। তাদের মনোবল তুঙ্গে। যেভাবে হোক, তাদের মনের জোর আমাদের ভেঙে দিতে হবে।’
‘কিন্তু কীভাবে?’ মহাসেনাপতি কুম্ভ বললেন, ‘আমাদের গোলাবারুদ ওদের তুলনায় তুচ্ছ, ওদের ঘোড়াগুলো অনেক তেজী। আমাদের চেয়েও বেশি শিক্ষিত ওদের সৈন্যদল। দরজা ভেঙে তিনদিক থেকে ওরা ছুটে আসছে। সেই অশ্বারোহীদের আমরা রুখব কী করে?’
‘কুম্ভ, আপনি যে যে যুক্তিগুলো দিলেন, সবগুলো নৈরাশ্যজনক। আমাদের পক্ষেও তো অনেক যুক্তি রয়েছে। দুর্বলতাগুলো না দেখে সেগুলোকে আগে দেখুন।’ বীরহাম্বীর ব্যাখ্যা করলেন, ‘দুটি বিষয়ে আমরা পাঠান সেনাদের থেকে এগিয়ে। এক, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা। দুই, দেশ বাঁচানোর সাহস। ভেবে দেখুন, ওরা লড়ছে উল্লাসের জন্য, হিংসার জন্য। আর আমরা লড়ছি প্রাণের জন্য, আমাদের মা-বোনেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য, আমাদের মন্দির রাজ্য বাঁচাবার জন্য! আজ মল্লভূমের প্রতিটি প্রজাকে শামিল হতে হবে এই যুদ্ধে।’
‘কিন্তু সাধারণ প্রজারা কী করে যুদ্ধ করবে মহারাজ? তারা তো কৌশল জানে না, জানে না কামানের ব্যবহারও।’
‘তারা তীরধনুক চালাতে জানে। প্রতিটা ঘরে রয়েছে শঙ্খ। পল্লীতে পাঠান সেনারা প্রবেশ করলেই বাজাতে হবে শঙ্খ। প্রতিটি পল্লীর ছেলেদের তিরধনুক নিয়ে উঠে বসে থাকতে হবে উঁচু গাছের ডালে। পাঠান সেনারা পাড়ায় ঢোকামাত্র উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁড়তে হবে তীর। তারা হকচকিয়ে যতক্ষণে উপরের দিকে গোলা ছুঁড়তে শুরু করবে, ততক্ষণে বেশ কয়েকজনকে ঘায়েল করা যাবে।’
‘দারুণ।’ উপসেনাপতি রমজান বলে উঠল, ‘আমাদের মুসলমান গ্রামগুলোয় শঙ্খ নেই। কিন্তু সব ঘরেই দামামা আছে, মহারাজ!’
কী হিন্দু, কী মুসলমান, মল্লভূমের প্রতিটি গ্রামে সাড়া পড়ে গেল। কালাপাহাড়ের সেনারা রাজধানী অধিকার করার পরই নজর দেবে আশপাশের গ্রামগুলোয়। তাই সকলে সেভাবে প্রস্তুত হতে লাগল।
এ তাদের জীবন বাঁচানোর লড়াই।
৪৮
রাজপ্রাঙ্গণের প্রবেশপথে উদভ্রান্ত মুখে দাঁড়িয়েছিল পবন।
মল্লভূমের রাজধানী বিষ্ণুপুর আজ বিধ্বস্ত। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, যে যা পারছে করছে। প্রজারা ঝড়ে-পড়া পাখির মতো ছুটে আসছে প্রাঙ্গণে। প্রধান দ্বার আজ রক্ষকহীন। মহারাজ নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন, একজন আশ্রয়প্রার্থী প্রজাকেও যেন না আটকানো হয়। বিপদের দিনে তারা যদি রাজপ্রাসাদের অন্দরে নিরাপদে থাকতে চায়, তা তাদের অধিকার। একমাত্র রানীদের অন্দরমহল ছাড়া তাদের যেন যেখানে খুশি থাকতে দেওয়া হয়।
পবনের পাশ দিয়ে উদ্বাস্তুর মতো ছুটে যাচ্ছিল মানুষ। তাদের কোলাহলে, চারপাশ মুখরিত। কেউ চলেছে খালি হাতে, কেউ শিশুক্রোড়ে, কেউ আবার নিজের কিছু সম্বল কাঁধে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে গিয়ে ঢুকছিল ভিতরের ভোজনালয়ে।
পবন দেখছিল, প্রতিটি মানুষের মুখেই ভয়। যে কালাপাহাড়ের কুখ্যাতি তারা শুনেছে বহুদিন ধরে, সে যে নিঃশ্বাস ফেলছে ঘাড়ের কাছে, এই প্রবল আতঙ্ক তাদের স্থির থাকতে দিচ্ছে না।
পবনের খুড়ো ভাদ্রচন্দ্র তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে অনেকক্ষণ আগে ঢুকে গিয়েছে ভেতরে। পবন যায়নি। সে অপেক্ষা করছে বন্ধুর জন্য। রঘুনাথ গিয়েছে তার মায়ের কাছে বিদায় নিতে। ফিরে এলেই তারা রওনা দেবে গড় পাথর দরজার দিকে। রঘুনাথ প্রথমে পবনকে বারণ করেছিল যেতে, কিন্তু পবন শোনেনি।
শীতলদাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পবন ভেঙে চৌচির হয়ে গেলেও রঘুকে সামনে কিছু বুঝতে দেয়নি। বরং রঘু কাঁদছিল অঝোরে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছিল, ‘আমার বউদিদির কী হবে রে পবন! ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেল!’
পবনের মনে পড়ে যাচ্ছিল মনোহরার শেষ দেখা সীমন্তরঞ্জিত মুখখানি। সাদা থানে সে কল্পনা করতে পারছিল না হাসিখুশি উচ্ছ্বল মনোহরাকে। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছিল। নিজের আবেগ সংবরণ করে সে সান্ত্বনা দিচ্ছিল প্রিয় বন্ধুকে।
আজ আর কোন আগল নেই। মানুষের বেঁচে থাকাটা যখন প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হয়ে যায়, তখন ধর্ম, জাত, বর্ণ সব তুচ্ছ। হয়তো তুচ্ছ হয়ে যায় পরকালের ভয়ও।
রঘুনাথ এল প্রায় দুই দণ্ড পর। ততক্ষণে কামানের আওয়াজ কমে গিয়েছে। পাঠান সেনাদের উল্লাস শোনা যাচ্ছে, ক্রমেই স্পষ্টতর হচ্ছে সেই উল্লাস।
রঘুনাথ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলল, ‘পবন! শিগগির আমার সঙ্গে আয়!’
‘কেন? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’
‘তুই আয় না!’ রঘুনাথ পবনের হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গেল ভিতরে।
দু’পাশ দিয়ে অগুনতি মানুষ ছুটছে ভেতরে। কেউ কেউ রঘুনাথকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কে রাজকুমার, কে ভিক্ষুক তা দেখার সময় এখন নেই।
ওরা ভোজনশালা পেরিয়ে এগোতে থাকে। শীতলকুমারের বিবাহের সময় সেই একবারই পবন প্রবেশ করেছিল এই রাজপ্রাঙ্গণে, এই ভোজনশালা পর্যন্ত। এরপর সবই তার অচেনা।
পুষ্করিণীর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রস্তরহস্তীটি অতিক্রম করতেই রঘুনাথ ওকে টেনে নিয়ে যায় পাশে। সেখানে এক পরিত্যক্ত হাতিশালা। একটাও হাতি নেই, কিন্তু ঘরগুলো পড়ে আছে। তবে যে স্রোতে মানুষ ঢুকছে রাজপুরীতে, কিছুক্ষণের মধ্যে এগুলোও ভর্তি হয়ে যাবে।
ঘরে সূর্যের আলো তেমন ঢোকে না। প্রায়ান্ধকার কক্ষে দৃষ্টি বুলিয়ে পবন প্রথমে কিছু অনুধাবন করতে পারল না। একদিকের দেওয়ালে ছোট কুলুঙ্গি। মাটিতে পড়ে রয়েছে কিছু পাটের দড়ি।
‘কী হয়েছে রঘু? এখানে আনলি কেন?’
রঘু ফ্যাকাসে চোখে বলল, ‘পবন, বউদিদিকে ওরা সিদ্ধি খাইয়েছে! আমি…আমি দেখে এলাম, বউদিদি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে।’
‘মানে? কারা সিদ্ধি খাইয়েছে? কেন খাইয়েছে?’
‘বাহ, সিদ্ধি না খাওয়ালে সজ্ঞানে কেউ চিতায় উঠতে পারে?’ রঘুনাথ অসহায়ভাবে বলল, ‘দাদার মৃতদেহ এসে পৌঁছেছে রাজপ্রাসাদের পিছনে শ্মশানে। সেখানেই বউদিদিকে রাজপণ্ডিত শ্রীব্যাস আচার্য আর তাঁর দলবল দাদার চিতাতে সতী করবে।’
‘কী বলছিস তুই!’
‘হ্যাঁ রে। পবন, বউদিদিকে কি মরতেই হবে? আমার…আমার বউদিদিটা খুব ভালো রে!’ রঘুনাথ সামলাতে না-পেরে কেঁদে ফেলে, ‘প্রথমে ভাবতাম, ও আমার পেছনে লাগে। হিংসা করে। কিন্তু পরে বুঝেছি, বউদিদি আমাকে খুব ভালোবাসে। ঠিক দাদার মতোই। সেই ভালোবাসার মধ্যে দ্যাখানেপনা নেই। দাদাকে হারালাম, এবার কি বউদিদিকেও হারাব? আর যে আসছে, সে?’
পবন স্বকর্ণকে বিশ্বাস করতে পারে না।
রঘুনাথ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে, ‘পিতা উপস্থিত নেই। মা, বড়মা, মেজমা’রা শোকে এত আচ্ছন্ন, কিছু বলছেন না। বলছেন শাস্ত্রে যা আছে, তাই হবে। শ্রীব্যাস পণ্ডিত বলছেন, দাদা রণক্ষেত্রে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। এরপর তাঁর চিতায় বউদিদি সতী হলে রাজ্যের পুণ্য নাকি অনেক বেড়ে যাবে। সত্যিই শাস্ত্রে এমন কথা লেখা আছে রে?’
‘রঘু। শান্ত হ’। পবন বলল, ‘তর্কালঙ্কার মশাই চতুষ্পাঠীতে তোদের নারদীয় পুরাণ পড়িয়েছিলেন, মনে আছে?’
‘না, কিচ্ছু মনে নেই। ওসব বাদ দে।’ রঘুনাথ পবনের হাত চেপে ধরল, ‘শ্রীনিবাস আচার্যও পিতার সঙ্গে গিয়েছেন। শ্রীব্যাস পণ্ডিত আর তার লোকেরা উন্মত্তের মতো আচরণ করছে। কিছু কি করা যায় না, পবন?’
‘রঘু তুই শান্ত হ’। আগে আমার কথা মন দিয়ে শোন।’ পবন শক্ত গলায় বলল, ‘মনোহরা তো গর্ভিণী?’
‘হ্যাঁ।’ রঘুনাথের কান্নার তোড় আরও বেড়ে যায়, ‘একটা প্রাণ জন্মের আগেই ঝরে যাবে, তাতে তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই কেন রে পবন? এসব কী নিয়ম?’
‘রঘু!’ পবন এবার কঠিন মুখে বলল, ‘নারদীয় পুরাণের দ্বিতীয় খণ্ডে মহামুনি নারদ বলেছেন, স্বামীর মৃত্যুকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা ক্রোড়ে দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকলে সে কোনভাবেই সহমৃতা হতে পারবে না। একই কথা বলেছেন ঋষি বৃহস্পতিও।’
‘সত্যি?’ রঘু পবনের দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকায়, ‘তুই ঠিক বলছিস পবন? কিন্তু শ্রীব্যাস আচার্য পণ্ডিত মানুষ, সে এইসব শ্লোকগুলো জানে না?’
‘রঘু, তুই এক মুহূর্তও দেরি করিস না। এখনি চলে যা শ্মশানে। গিয়ে সকলের সামনে এই কথা বল। শ্রীব্যাস আচার্য যত বড় পণ্ডিতই হন, শাস্ত্র অমান্য করার অধিকার তাঁকে কেউ দেয়নি! শাস্ত্র তাঁকে মান্য করতেই হবে।’
‘আ-আমি!’ রঘুনাথ বলল, ‘আমি তো শাস্ত্র কিছু জানি না রে পবন। যদি আরও প্রশ্ন করে, আমি কি উত্তর দিতে পারব? তুই চল না?’
পবন ম্লান হেসে বলল, ‘আমি নাহয় গোপনে যাব, কিন্তু উত্তর তো দিতে পারব না। শূদ্রসন্তানের মুখে শ্লোক শুনলে হিতে বিপরীত হবে। উত্তর তোকেই দিতে হবে। ভয়ের কিচ্ছু নেই রঘু। তুই যা, দেরি করিস না। মনোহরাকে বাঁচাতেই হবে। বিশ্বাস কর, শীতলদাদাও যেখানেই থাকুন, সেখান থেকে প্রাণভরে তোকে আশীর্বাদ করবেন।’
রঘু কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে ঝালিয়ে নিল পবনের বলা শ্লোকের সূত্রটা। তারপর চোখের জল মুছে ছুটে বেরিয়ে গেল।
পবন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর অনুসরণ করল রঘুনাথের যাত্রাপথকে। শাস্ত্রোচ্চারণের অধিকার তার না থাক, শ্মশানগমন তো করাই যায়। বিশেষত এই দুঃসময়ে।
৪৯
মেনকা যখন যুঝঘাটিতে পৌঁছল, তখন সূর্য গিয়েছে অস্তাচলে। লাল খুব জোরে ঘোড়া ছুটিয়ে ওকে নিয়ে এসেছিল। মেনকা ঘোড়া থেকে নেমে লালকে বলল, ‘ওদিকে কী হচ্চে রে?’
লালের কপালে বিন্দু বিন্দু স্বেদ জমে উঠেছিল। সে বলল, ‘কী জানি! রাজামশাই নিশ্চয়ই লড়ে যাচ্চেন। শ্রীধর দাদা বলছিলেন, মন্দির ধ্বংস করতে গেলে রাজামশাইয়ের বুকের ওপর দিয়ে যেতে হবে।’
মেনকা চুপ করে রইল। বলল, ‘দে।’
‘কী দেব মেনকাদিদি?’ লালের খেয়াল পড়ল, ‘ও হ্যাঁ। এই নাও।’
ঝোলা খোলামাত্র মেনকা তার ছোট ছোট সাদা ডানা ঝাপটাতে লাগল। শ্রীধর যে সদ্যোজাত পক্ষীশাবককে ফুলশয্যার রাতে মেনকাকে উপহার দিয়েছিল, তার নামও মেনকা।
মেনকা ঝোলা থেকে বের করামাত্র পায়রাটা তার ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে বসল মেনকার কাঁধে। মুখ দিয়ে কিচ কিচ শব্দ করল বারকয়েক। লাল ঝোলা থেকে বের করল একটা পাত্র। তাতে সাজিয়ে দিল ফল।
পাত্রটা নিয়ে মেনকা বলল, ‘ঠিক আছে। তুই যা।’
‘যাব কী গো?’ লাল বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তুমি একা ফিরবে কী করে? না না, আমি দূরে দাঁড়াচ্ছি।’
‘না। তোকে দাঁড়াতে হবে না।’ কঠিন সুরে বলল মেনকা, ‘তুই চলে যা। সামনেই নদী। নদী বরাবর কয়েক ক্রোশ দূরে গিয়ে অপেক্ষা কর। যদি বেঁচে বেরোতে পারি, মেনকাকে তোর কাছে উড়িয়ে দেব। ওকে দেখলে তখন নাহয় আসবি।’
লালের উত্তরের অপেক্ষা করল না মেনকা। আরেক মেনকাকে কাঁধে নিয়ে সে মাথা উঁচু করে হেঁটে গেল মূর্চার পাহাড়ের দিকে।
মূর্চার পাহাড়ে পাঠান সেনাদের ছাউনিতে আজ খুশির আমেজ। বিপরীতের মুণ্ডমালাঘাটের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে গত সন্ধ্যায় যে শ্মশানের সৃষ্টি হয়েছিল, যে কৃত্রিম শ্মশানের সামনে ছিলেন মল্লরাজ্যের যুবা রাজপুত্র, সেই একই শ্মশান যে রচিত হচ্ছে রাজধানী বিষ্ণুপুরের দিকেও, সেই সংবাদ ছাউনিতে এসে পৌঁছেছে।
ফারমুলীর আদেশ, কাল সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবশিষ্ট সৈন্যদল যাত্রা করবে রাজধানী সমীপে। সূর্যাস্তের আগেই রাজধানী সম্পূর্ণ ধ্বংস করা চাই।
মেনকা সন্তর্পণে হাঁটছিল। উমাপতি বলেছে, মূর্চার পাহাড়ের দক্ষিণে কয়েক পা বনপথে গেলেই ওদের শিবির।
সেখানে গেলে কি ও কেশব ছড়াকারকে দেখতে পাবে?
মেনকার সর্বাঙ্গে কালো একটি লইয়া এমনভাবে আচ্ছাদিত, তাকে নারী না পুরুষ ঠাহর করা যায় না। চোখদুটো ছাড়া প্রায় গোটা দেহই আবৃত। সেনাদের রসুইকররাও এমনই পোশাক পরে। তাই, বিপরীতদিক থেকে কোন সেনা হেঁটে এলেও ওর হাঁটার প্রত্যয়ীভাবে আর হাতে ফল দেখে কোনও প্রশ্ন করছিল না।
দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে এসে মেনকা ডানদিক ফিরল। তখনই ওর চোখে পড়ল মাথায় সবুজ রঙের পতাকা উড়তে থাকা শিবিরটাকে।
‘পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড় রয়েছেন সবচেয়ে বড় শিবিরে, তার মাথায় উড়ছে সবুজ রঙের পতাকা। বাকি শিবিরগুলোর উপর পতাকা নেই।’ মেনকার নগ্ন বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলেছিল উমাপতি।
‘ওখানেই বুঝি তোমার প্রভু হিকিমকুমার আর ছড়াকার মশাই রয়েচেন?’ মেনকা উমাপতির চুলগুলো খামচে ধরে জিগ্যেস করেছিল।
উমাপতি তখন সুখস্বপ্নে বিভোর। যে উদ্ভিন্নযৌবনাকে সে মনে মনে কামনা করে এসেছে, সে তার বুকের মধ্যে! মেনকা কী প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, তা তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছিল না। বলা যেতে পারে, খুব যান্ত্রিকভাবে সে সব সত্য জবাব দিয়ে যাচ্ছিল।
মেনকার বারংবার প্রশ্নে এবারেও সে লেহন করতে করতে বলেছিল, ‘না রে, হিকিমকুমার তো নাটকাঞ্চন মৌজায়! সেনাপতির সঙ্গে আমাদের লোক বলতে রয়েচে শুধু কেশব! সে-ই পাঠান সেনাদের পথ চিনিয়ে আনবে যে!’
মেনকা সবুজ পতাকা উড্ডীন শিবিরের সামনে এগিয়ে গেল। সন্ধে নেমে এসেছে। মেনকা শেষবারের মতো দেখে নিল আকাশটাকে। গায়ে মেখে নিল নদীর শীতল বাতাস। আহরণ করে নিল মল্লভূমের গন্ধ।
মাতৃভূমি কি জন্মালেই হয়? জন্মদাত্রী মায়ের চেয়েও বড় হল পালিকা মা। তাই যে মল্লভূম তাকে এতবছর আশ্রয় দিয়েছে, নিজের বুকে আগলে রেখেছে, সে-ই মেনকার মাতৃভূমি। তার ঋণ ওকে শোধ করতেই হবে।
মেনকা হাঁটছিল। ওর কাঁধের ওপর বসেছিল পাখি মেনকা। শিবিরের একেবারে কাছাকাছি এসে নিজের কোমরবন্ধনি থেকে একটা ভূর্জপত্র বের করে সন্তর্পণে বেঁধে দিল পাখিটার পায়ে। ফিসফিস করে কিছু বলল। তারপর আলতো করে উড়িয়ে দিল তাকে।
পাখিটা দূরে উড়ে গেল না, ডানা ঝাপটে উড়ে গেল একেবারে কাছের আমগাছটায়। কিচকিচ করে মুখে শব্দ করল দুবার। তারপর নিজের ঘাড়টা অল্প ঠুকরে নিয়ে স্থির হয়ে বসল।
মেনকা গভীরচোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল পাখিটার দিকে। পাখিটার মধ্য দিয়ে ও যেন সেই মানুষটাকে দেখতে পাচ্ছিল, যে মাত্র কয়েকদিনে ওকে বুঝিয়েছে ভালবাসার মানে।
ও ফিসফিস করে বলল, ‘ভালো থাকিস, মেনকা! আমি মেনকা বলে ডাকলেই উড়ে যাস তোর মনিবের কাছে!’
তারপর পায়ে পায়ে ঢুকল শিবিরে। আশা করেছিল, পাঠান সেনাপতির শিবির থেকে বুঝি ভেসে আসবে বাঈজির সুরেলা ঠুংরি। সঙ্গে সারেঙ্গীর টান আর তবলচির লহরা।
কিন্তু সে’সব কিছুই নেই। নিস্তব্ধ রাতের মাঝে ভেসে আসছে পুরুষকণ্ঠে কিছু বক্তব্য। তাতে সুর নেই। আছে শুধু শব্দ।
উমাপতির কথা যদি সঠিক হয়, তবে আজ সূর্যাস্তের পর থেকে আগামীকাল সূর্যোদয় পর্যন্ত আফগান সেনাপতির শিবির নির্জন থাকবে। কারণ, কোন বড় আক্রমণের আগের রাতে তিনি শিবিরে একা থাকেন। নিজের মনে শায়েরি বলেন, গান করেন। কেউ তাঁকে ঘাঁটায় না। খানিকটা কুসংস্কারের মতো। মহাপাপের আগে মানসিক প্রস্তুতি নিতেই বোধহয়।
মেনকা উমাপতিকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তাহলে তো কেশব ছড়াকারকেও বের করে দেবে!’
‘তাই দিত।’ রতিকার্যে ব্যস্ত উমাপতি উত্তর দিয়েছিল, ‘কিন্তু কেশবের ছড়া সেনাপতির ভারী মনে ধরেছে যে! কেশবের মুখ থেকে সেনাপতি প্রায়শই মল্লভূমের ছড়া শুনছেন।’
ভিতরে ঢোকামাত্র প্রদীপের আলোয় গোটা দৃশ্যপট উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
প্রকাণ্ড এক গদি। তার ওপর জাজিম। মখমলে মোড়া কয়েকটি তাকিয়া ইতস্তত বিক্ষিপ্ত।
তার ওপরে অর্ধশয়ান যে বিশালদেহী পুরুষ, সেই কি মহম্মদ ফারমুলী? সেই কি বাংলার ত্রাস কালাপাহাড়? সেই কি রাজীবলোচন রায় ভাদুড়ী? হাতে আলবোলার যারসি, নাগরা পরা পা এলিয়ে রয়েছে সামনে।
মেনকা সন্তর্পণে হাতের পাত্রটা নীচে নামিয়ে রাখে। কালো লইয়ার আড়াল থেকে নির্নিমেষে দেখে। এই কি একসময়ের সেই সুদর্শন তরুণ, যে মেনকার সীমন্ত রাঙিয়ে দিয়েছিল? এই কি সেই বিদ্বান যুবক, যে বিতাড়িত হয়েছিল নিজের গ্রাম থেকে? কোথায় সেই প্রাজ্ঞ কোমল চাহনি? এ যে এক যমদূত!
আর তার বিপরীতে যে বসে আছে, সে আজও মেনকার হৃদয়ের বড় অংশ অধিকার করে রয়েছে।
কেশব ছড়াকার। সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে সে ছড়া কাটছে।
‘সংসারের ফুল দেখতে ভালো, ওরে অবোধ ছেলে
দেখে রেখো ছুঁয়ো নাকো, ছুঁলেই যাবে জ্বলে।’
ছড়া শেষ করে সে বলল, ‘আজ্ঞে হুজৌর, এখানে ফুল মানে হল সংসারের রমণী।’
‘কেয়া বাত!’ সেনাপতি হৃষ্টমুখে বললেন, ‘তোমার ঝুলিতে তো প্রচুর মনিমুক্তো দেখছি! মল্লরাজ্যের পরের সভাকবি তোমাকেই করার ব্যবস্থা করব!’
মেনকা জাফরির ফাঁক দিয়ে দেখল, কেশবের চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠল কথাটা শুনে। বলল, ‘হুজৌর মা বাপ!’
‘আরও কুছ শোনাও!’ সেনাপতি বললেন, ‘মজেদার কিছু নেই?’
‘জরুর আছে হুজৌর!’ কেশব শশব্যস্তে বলে, ‘পাশের বাড়ির বউ পরকীয়া করচে। তাতে এ’বাড়ির বউ মুখ নাড়িয়ে বলচে,
‘পর পুরুষের ঘর করচ কেমন করে?
ভাসুরের সঙ্গে থেকেই আমি লজ্জায় যাই মরে!’
‘হা হা হা!’ সেনাপতি এবার অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন। পানপাত্র ঠোঁটে ছুঁইয়ে উপভোগ করতে থাকেন এই নৈশ আমেজ।
মেনকা একমুহূর্ত দেরি করে না। হতে পারে কেশব তার প্রণয়ী, হতে পারে নিজের কৌমার্য সে এই কেশবকেই উৎসর্গ করেছিল, তবু এই কেশবের জন্যই মল্লভূম আজ ধ্বংস হওয়ার পথে। তারই জন্য মল্লরাজ হয়েছেন সন্তানহারা। তারই জন্য অন্তঃসত্ত্বা মনোহরা আজ বিধবা!
মেনকা প্রচণ্ড রাগে কাঁপছে। তার চোখে উপচে আসছে অশ্রু। সামনের এই দুই পুরুষ মিলে তার জীবনের মোড় ঘুরিয়েছে বারবার।
যে-কোনও মুহূর্তে প্রহরী এসে পড়বে, উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে অধোবাসের ভেতর লুকিয়ে রাখা চকচকে ধারালো ছুরিটা বের করে আনে সে।
কেশব যখন তার হলুদ দাঁতগুলো বের করে সেনাপতির তালে তাল মেলাচ্ছে, অকস্মাৎ পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ঘাড়ে বিঁধিয়ে দেয় সেই ছোরা। লড়াকু মেয়ে সে, ছুরিকাঘাতে কীভাবে ঘায়েল করতে হয় অপরাধীকে, ঘাড়ের কোনখানে গেঁথে দিলে মৃত্যু অনিবার্য, তা সে বহুদিন আগেই শিখে রেখেছে রাজার সেনাদের কাছে।
‘আ আ আ!’ এই অতর্কিত আঘাতে কেশব ঠিকরে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসে বাইরে। ঘাড় থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। বসে থাকতে থাকতেই সামনের দিকে ঘাড় ঝুঁকে যায় তার।
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে উঠে বসেন কালাপাহাড়। ধ্বংসের পূর্বরাতে সঙ্গে অস্ত্র বা প্রহরী না রাখলেও তিনি সঙ্গে রাখেন একটি শিঙা। সেই শিঙায় ফুঁ দেওয়া মাত্র বাইরে থেকে ছুটে এল প্রহরীর দল।
কেশব মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল। তার মুখ ভর্তি হয়ে গেছে ছিটকে আসা রক্তস্রোতে। তার দেহ থেকে প্রাণবায়ু নির্গত হতে যতটুকু সময় নিল, তার মধ্যেই সে বিস্ফারিত চোখে দেখল, আলখাল্লায় ঢাকা এক মূর্তির মুখ থেকে তার দিকে ধেয়ে আসছে ছুঁড়ে দেওয়া একদলা ঘৃণার থুতু!
তিন-চারজন বলিষ্ঠ চেহারার সৈন্য ঢুকে এসেছে, বিস্মিত চোখে দেখছে, আততায়ীর নিশানা সেনাপতি নন, বরং আপাতনিরীহ ছড়াকার!
তারা দুদিক থেকে এসে খুনির হাত চেপে ধরল। কালাপাহাড় উঠে এসে আলখাল্লার সামনের আবরণ হ্যাঁচকা মেরে টেনে খুলে দিতেই সবাই হতভম্ব হয়ে গেল।
নারীবুভুক্ষু সৈন্যশিবিরে কে এই যৌবনবতী নারী! কোন দুঃসাহসে সে এখানে প্রবেশ করেছে?
কালাপাহাড় প্রথমে বুঝতে পারলেন না, নেশার ঘোরে ভুল দেখছেন কিনা। চোখদুটো রগড়ে নিয়ে তিনি বন্দির আরও কাছে এলেন।
না, শুধু নারীই নয়, রূপসী এক যুবতী! তার রূপের যেমন আগুন, আগুন তার অশ্রুপূর্ণ চোখেও।
এরই মধ্যে বন্দিনী মেনকা সর্বশক্তি জড়ো করে চিৎকার করে উঠল, ‘মেনকা! মে-ন-কা-আ-আ-আ! উড়ে যা!’
কালাপাহাড় চিনতে পারলেন না তাঁর অগ্নিসাক্ষী মতে বিবাহ করা শিশু স্ত্রীকে। বুঝতে পারলেন না, একদিন একেই কোলে নিয়ে ঘুরতেন তিনি। স্নেহে, ভালোবাসায় খাইয়ে দিতেন মিষ্টান্ন। কিনে আনতেন খেলনা।
যতক্ষণে নিজের স্ত্রীকে তিনি তুলে দিলেন সেনাদের ‘ঢালাও ফুর্তি’ করার লক্ষ্যে, ততক্ষণে কবুতরদূত মেনকা উঠে গিয়েছে আকাশে।
আকাশে একটি পাক খেয়ে সে রওনা হয়ে গিয়েছে রাজধানী বিষ্ণুপুরের দিকে। মহারাজের খাস ভৃত্য শ্রীধরের কাছে।