ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও কয়েকটি আর্ট গ্যালারি দু’তিনদিনে দেখে নিল অলি। তারপর বিশাখাকে নিয়ে সে এলো ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে। দেশের খবরের কাগজ পড়ার জন্য তার মন ছটফট করছিল। দুতিনটি বাংলা কাগজে সে দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল, খবর মোটেই ভালো নয়, বন্যা শুরু হয়ে গেছে, মালদহ বিচ্ছিন্ন, মানিকতলায় আবার একজন কনস্টেবল হত্যা, গত দেড় বছরে এই নিয়ে ৩৮ জন পুলিশ খুন হলো, আসানসোল স্পেশাল জেলে এক সংঘর্ষে ন’জন নকশাল বন্দী নিহত বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত সত্তর লক্ষ উদ্বাস্তু এসেছে…। অলি তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখলো, কৌশিকদের ধরা পড়ার কোনো খবর নেই। অলি কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
সেখান থেকে ওরা দু’জনে চলে এলো ট্রাফালগার স্কোয়ারে। লন্ডন শহরে যে কত বাঙালী থাকে তার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া গেল এখানে এসে। আজ এখানে শুধু বাংলা কথা শোনা যাচ্ছে। চতুর্দিকে বাঙালী মুখ। বাংলাদেশের বিচারপতি আবু সয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আজ এখানে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। বিচারপতি আবু সয়ীদ চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত, তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালীদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন।
ট্রাফালগার স্কোয়ারে সব সময় টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। আজ সেখানে প্রায় চার পাঁচ হাজার বাঙালী এসে জড়ো হয়েছে। প্রথমে এক শো তিরিশ জন ব্রিটিশ এম পির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হলো, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। তারপর বিভিন্ন বক্তা শোনাতে লাগলেন বাংলার গ্রামে গঞ্জে পাকিস্তানী সৈন্যদের অমানুষ অত্যাচারের কাহিনী। একজন প্রস্তাব তুললেন, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সকে পৃথিবীর সব দেশের বয়কট করা উচিত, কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনী ভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনী বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়।
একজনের বক্তৃতার মাঝখানেই হঠাৎ একটা উল্লাসের কোলাহল শোনা গেল। এইমাত্র লন্ডনের পাকিস্তান হাই কমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করে এসে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য জানাতে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠলো, জয় বাংলা! জয় বাংলা!
অলি বিশাখাকে জিজ্ঞেস করলো, মঞ্চে সভাপতির পেছনে ঐ যে দাঁড়িয়ে আছেন, উনি ডাক্তার আলম না?
বিশাখা বললো, তাইতো মনে হচ্ছে। ইয়েস, দ্যাটস হিম। তোমার দুলাভাই!
অলি বললো, তাহলে তুতুলদি নিশ্চয়ই একটু ভালো আছেন। উনি যখন মিটিং-এ এসেছেন…কাল যাবার আগে তুতুলদির সঙ্গে আর একবার দেখা করে যেতে হবে।
বিশাখা বললো, অলি, আই মাস্ট সে, তোমার ঐ তুতুলদি ইজ আ ব্রেইভ উয়োম্যান!
অলি বললো, আমরা দেশে থাকতে কিন্তু তুতুলদিকে দেখেছি, দারুণ লাজুক, কারুর সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে পারতো না।
একটু থেমে অলি আবার বললো, অনেকে ভাবে লাজুকরা বুঝি সব সময় খুব দুর্বল হয়। তা। ঠিক না। কোনো কোনো সময়ে লাজুক মেয়েরাও সাঙ্ঘাতিক মনের জোর দেখাতে পারে। আমি ছোটবেলা থেকেই তুতুলদিকে খুব অ্যাডমায়ার করি।
ওরা পুরো মিটিং না শুনে আবার বেরিয়ে পড়লো। হঠাৎ আজ বেশ গরম পড়ে গেছে। আমেরিকার অল্পবয়েসী টুরিস্টরা গেঞ্জি পরে রাস্তায় ঘুরছে। লন্ডনে যে এরকম স্বল্পবাস মানুষ দেখা যেতে পারে, সে সম্পর্কে অলির কোনো ধারণাই ছিল না। ইংরিজি সাহিত্যে সে ইংল্যান্ডের গরমের কোনো বর্ণনা পড়েনি।
টিউব স্টেশানের দিকে যেতে যেতে অলি বললো, এই ইংল্যান্ড ঘুরে গিয়ে এক সময় আমাদের দেশের লোকেরা কী রকম পাক্কা সাহেবের ভাব করতে! আজ সকালে দেখলুম, তোমাদের বাড়ির উল্টোদিকে একজন বুড়ো ইংরেজ খালি গায়ে বাগানে মাটি খুঁড়ছে। আগে। আমার ধারণা ছিল, সমুদ্রের ধারে ছাড়া আর কোথাও সাহেবরা খালি গা হয় না!
পাঁচ-সাতটি ছেলে সিঁড়ির ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে নামতে নামতে অলিদের ধাক্কা দিয়ে ঠেলে চলে গেল। অলি বিশাখার দিকে তাকালো, যেন সে বলতে চায়, এই কি বিখ্যাত ব্রিটিশ ভদ্রতার নমুনা?
বিশাখা বললো, বাঁদিকের রেলিং ধরে চলো। ট্রেন ধরার তাড়ায় এইসব টিন এজারদের কোনো জ্ঞান থাকে না।
অলির স্বভাবে কোনো তিক্ততা নেই। একটু পরেই সে বললো, আমার কিন্তু লন্ডন শহরটা। খুব ভালো লেগে গেছে। আমার কল্পনার সঙ্গে অনেকটাই মেলেনি যদিও, তবু সব মিলিয়ে খুব লাইভলি।
–তা হলে, তুমি ইংলিশ লিটরেচার পড়তে আমেরিকা যাচ্ছে। কেন? ইংল্যান্ডেই পড়তে পারতে।
–এখানে আমাকে কে স্কলারশীপ দেবে?
–অ্যামেরিকায় গেলে তোমার কালচার শক অনেক বেশি হবে। ওখানকার ক্যাম্পাসগুলো হিপিতে ভরে গেছে। বিটনিকদের দল, তারপর হিপিরা এসে হোল ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ডে পোশাকের কনসেপ্ট, আরও অনেকগুলো ভ্যালুজ-এ খুব জোর ধাক্কা দিয়েছে! শুনেছি ওখানকার ক্যাম্পাসের মাঠেই জোড়ায় জোড়ায় ছেলেমেয়ে শুয়ে থাকে। নতুন একটা স্লোগান উঠেছে। মেক লাভ, নট ওয়ার।
–সাউন্ডস্ গুড। আমেরিকানরা যুদ্ধ চায় না?
–ইয়াংগার জেনারেশান চায় না। ভিয়েৎনাম যুদ্ধের বিরোধিতা থেকেই তো হিপি মুভমেন্টের শুরু।
–তা হলে বাংলাদেশে যে এত অত্যাচার হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার প্রতিবাদ না করে পাকিস্তানের মিলিটারি রেজিমকেই সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে কেন?
–সেটা তো সরকারের ব্যাপার, স্টেট পাওয়ার। পেন্টাগন। বড় বড় আর্মস ম্যানুফ্যাকচারারদের চাপে আমেরিকান সরকার পৃথিবীতে সব সময়ই কোথাও না কোথাও যুদ্ধ। চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ফর দা ফাস্ট টাইম অ্যামেরিকান ইয়ুথ এই সরকারি পলিসির বিরুদ্ধে গেছে। গায়ক বব ডিলান, কবি অ্যালেন গীনস্বার্গ এরা অনেকে ঘুরে ঘুরে বাংলাদেশ ভিকটিমদের জন্য চাঁদা তুলছে।
রাত্তিরে অলির নেমন্তন্ন তার বান্ধবী চন্দনার বাড়িতে। চন্দনা খুব করে ধরেছে, তাকে যেতে হবেই। চন্দনারা থাকে রিডিং স্টেশানের কাছে, তারা স্টেশানে অপেক্ষা করবে অলির জন্য। বিশাখা অলিকে ট্রেনে তুলে দিল।
বিলেতের ট্রেনে কেউ কারুর সঙ্গে যেচে কথা বলে না। কম্পার্টমেন্টে চার পাঁচজন ভরতীয় নারীপুরুষ রয়েছে, তারাও চোখে চোখ পড়লে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। প্রায় সকলেরই হাতে একখানা করে বই কিংবা খবরের কাগজ। সিনেমায় এরকম পশ্চিমী ট্রেনের দৃশ্য অনেক দেখেছে অলি, কিন্তু পাশাপাশি বসে থাকলেও যে মানুষে মানুষে এতখানি দূরত্ব হতে পারে তা সে এই প্রথম অনুভব করলো।
কম্পার্টমেন্টে যথেষ্ট ভিড়। রিডিং-এ নামবে অনেকেই। হঠাৎ যদি ট্রেন ছেড়ে দেয় এই ভয়ে অলি একটু ব্যস্তভাবেই নামতে গেল, তাতে সে একটা ঠ্যালাঠেলির মধ্যে পড়ে গেল। প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই সে অনুভব করলো তার হাতটা খালি। হ্যান্ডব্যাগ কোথায় গেল? ট্রেনে ফেলে এলো? না, ব্যাগটা সে সব সময় কোলের ওপর রেখেছিল, সেটা নিয়েই উঠে দাঁড়িয়েছিল। তাহলে–
অলির মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। বিশাখার বাবা প্রথম দিনই সাবধান করে দিয়েছিলেন এখানকার ট্রেনে প্রায়ই পকেটমারি আর ছিনতাই হয়। এই প্রথম অলি বিশাখাকে বাদ দিয়ে একা ট্রেন জার্নি করলো। ভিড়ের মধ্যে কেউ তার ব্যাগটা টেনে নিয়ে গেছে!
হাতব্যাগের মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, প্লেনের টিকিট, তিরিশ-বত্রিশ পাউন্ড ক্যাশ, দুশো ডলার ট্রাভার্স চেক, জরুরি ঠিকানা লেখা একটা নোট বই, এক জোড়া সোনার দুল। প্লেনের টিকিটটা সে আজ নিয়ে বেরিয়েছিল তার আমেরিকার ফ্লাইট কনফার্ম করার জন্য। পর পর অনেকগুলো ভয় অলির শরীরের মধ্যে পাক খেতে লাগলো, টিকিট হারাবার জন্য সে আর আমেরিকা যেতে পারবে না, বাবলুদা এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে যাবে, মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে তার ভর্তি হবার দিন পেরিয়ে যাবে, পাসপোর্ট নেই বলে তাকে পুলিশে ধরবে, তারপর অপমান করে তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে…।
প্ল্যাটফর্ম প্রায় খালি হয়ে গেছে, চন্দনা আর তার স্বামী মনোজ এসে দেখলো অলি ট্রেন লাইনের দিকে স্থির ভাবে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখখানা রক্তশূন্য। চন্দনা তাকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিতে অলি খুব আস্তে আস্তে বললো, আমার সব শেষ!
ব্যাপারটা অবশ্য এত গুরুতর কিছু নয়। মনোজ সব শুনে বললো, ডুপ্লিকেট পাসপোর্টের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আবার ইউ এস ভিসা নিতে হবে। থানায় ডায়েরি করলে টিকিটও পাওয়া যাবে, ট্রাভলার্স চেকের নম্বরগুলো আলাদা করে রেখেছেন তো? আর যা গেছে তা তো গেছেই—
প্রথমেই তারা অলিকে নিয়ে গেল থানায়। অফিসারটি সহানুভূতির সঙ্গে সব শুনে বললেন, এই লাইনে একটা গ্যাং অপারেট করছে, প্রত্যেকদিনই একটা-দুটো কেস রিপোর্টেড হচ্ছে, এবার ওরা ধরা পড়ে যাবে! তারপর তিনি মনোজকে জিজ্ঞেস করলেন, স্টেশানের পুরুষদের টয়লেটটা একবার দেখে এসেছেন তো?
তক্ষুনি আবার ফিরে যাওয়া হলো স্টেশানে। অলি আর বউকে দাঁড় করিয়ে মনোজ ছুটে চলে গেল, ফিরে এলো হাসতে হাসতে। অফিসারটি ঠিকই বলেছেন। ছিনতাইবাজরা ব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে যায় না, ভেতরের জিনিসগুলো বার করে ব্যাগটা ফেলে রেখে যায় কাছাকাছি কোনো টয়লেটে বা ট্র্যাশ ক্যানে। প্লেনের টিকিট আর পাসপোর্টটাও ওরা অপ্রয়োজনীয় বোধে রেখে গেছে। বাকি জিনিসগুলো আর পাবার আশা নেই। ট্রাভলার্স চেকের নম্বর লেখা কাগজটাও অলি আলাদা করে রাখেনি।
মাত্র আধঘণ্টার জন্য অলির জীবনটা একেবারে বিস্বাদ হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার সে একটা বিরাট স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এর আগে কোনোদিনই তার সেরকম কিছু জিনিস হারায়নি, প্রথম বিদেশে এসেই সে সর্বস্বান্ত হতে বসেছিল! লজ্জায়-দুঃখে-অভিমানে তার আত্মহত্যা করার কথাও মনে জেগেছিল সেই সময়ে। ঘটনা পরিবর্তনের দ্রুততায় সে দারুণ ক্লান্ত বোধ করলো।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অলির সহপাঠিনী ছিল চন্দনা। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে, পড়াশুনোতেও ব্রিলিয়ান্ট ছিল, গ্র্যাজুয়েট হবার আগেই বিয়ে করে চলে আসে এদেশে।
অলি আর চন্দনাকে বাড়িতে নামিয়ে মনোজ চলে গেল ওদের আড়াই বছরের ছেলেকে কিছু দূরের এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে। স্বামী স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করে, তাই প্রত্যেকদিন দু’জনে বেরুবার সময় শিশু সন্তানকে অন্যবাড়িতে রেখে যায়।
অলি লক্ষ করলো, চন্দনার মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ। সকাল সাড়ে সাতটায় বেরুতে হয় তাকে, সে কাজ করে একটা ডেফ অ্যান্ড ডামব স্কুলে। একদা ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবিনী ছাত্রী ডেফ অ্যান্ড ডামৰ স্কুলে কী কাজ করে তা আর জিজ্ঞেস করলো না অলি। মনোজ মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, কথায় কথায় সে বলে, আমি মিস্তিরি মানুষ, বই-টই কিছু পড়ি না।
দু’খানা বেডরুমের ছোট বাড়ি। আজ ছুটির দিন নয়, তাই সারাদিন খেটেখুটে ফিরে চন্দনাকে এখন রান্না করতে হবে। অলির লজ্জা করতে লাগলো। তার বিশেষ কিছু খাবার ইচ্ছে নেই, কিন্তু চন্দনা সে কথা কিছুতেই শুনছে না। ওরা নিজেরা অনায়াসেই স্যান্ডউইচ খেয়ে চালিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু অতিথিকে তা দেওয়া যায় না। এখানে যারাই অলিকে নেমন্তন্ন করে, তারাই ভাত-ডাল-মাছের ঝোল খাওয়াবার চেষ্টা করে। অলি মাত্র কয়েকদিন আগে দেশ ছেড়ে এসেছে, ভাত-মাছের জন্য তার একটুও অভাববোধ নেই, সে বিলিতি খাবার স্বচ্ছন্দে খেতে পারে, কিন্তু এরা কেউ তা বুঝবে না। কিংবা অলির মতন দেশ থেকে সদ্য আগত কারুককে দেখলেই বোধহয় এদের নিজেদের ভাত-মাছ খাওয়ার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে।
ছেলেকে আনতে গিয়ে মনোজ তার জামাইবাবুর সঙ্গে দু’এক গেলাস বীয়ার পান করে আসে, তাই তার ফিরতে একটু দেরি হয়। রান্নাঘরে চন্দনাকে সাহায্য করতে করতে অলি জিজ্ঞেস করলো, এখানে কেমন আছিস রে, চন্দনা?
পেঁয়াজ কাটা থামিয়ে চন্দনা অলির দিকে কয়েক পলক গাঢ় ভাবে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, এক একদিন রাত্তিরে মনে হয় এক্ষুনি দেশে ফিরে যাই। আবার সকালবেলা উঠে সেই ইচ্ছেটা চলে যায়।
অলি বললো, তুই তো বিয়ের পর সেই যে চলে এলি, আর একবার বেড়াতেও গেলি না!
চন্দনা বললো, টাকা জমাচ্ছি। এখনো বাড়ি কিনতে পারিনি। তা ছাড়া বাচ্চাটা হলো–এখানে এত খাটতে খাটতে প্রাণ বেরিয়ে যায় যে আমার মনে হয়, একবার দেশে গেলে আর আমার কিছুতেই এখানে ফিরতে ইচ্ছে করবে না। আর যাই বল, দেশে বিনা পরিশ্রমে দিন কাটাবার মতন সুখ এখানে পাবি না!
–তাহলে এখানে কী আছে? কিসের টানে অনেকেই থেকে যায়?
–এক ধরনের সিকিউরিটি। এখানে ছেলেটাকে ভেজাল খাওয়াতে হবে না, ঠিক মতন লেখাপড়া শেখার সুযোগ পাবে, আমরা দু’জনে আর দশ বছর চাকরি করতে পারলে যা টাকা জমবে, তাতে বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে চলে যাবে। এখানে লোকে সুখ খোঁজে না, আরাম খোঁজে। মেটেরিয়াল কমফর্ট।
–প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় চন্দনা ব্যনার্জির মুখে কখনো টাকা পয়সার আলোচনা শুনিনি। আমাদের ধারণা ছিল, তুই ভালো করে টাকা গুনতেই জানিস না। একদিন কফি হাউসে সাড়ে সাত টাকার বিল হয়েছিল, তুই কুড়ি টাকার নোট দিয়ে বলেছিলি খুচরো ফেরত চাই না, তোর মনে আছে? আমরা সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠেছিলুম!
–তখন বড় সরল আর বোকা ছিলুম রে, অলি। আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের আদর যত্নের তুলোয় মুড়ে রাখতো। অনেক কিছুই জানতে বুঝতে শিখিনি। এদেশে হিসেবী হতেই হয়। এখানকার যে কোনো ইন্ডিয়ানদের বাড়িতে গিয়ে তুই শুনবি বাড়ি আর গাড়ির গল্প। আমার কী মনে হয় জানিস, অলি, সুখ কথাটা বোধহয় একটা ফিলোসফিক্যাল ধাপ্পা, আমাদের দেশেই বা ক’জন মানুষ সত্যিকারের সুখে থাকে? সাধারণ মানুষের সুখ নামে একটা এলিউসিভ ব্যাপারের পেছনে ছোটা উচিত নয়, তার চেয়ে বাড়ি-গাড়ি ভালো খাওয়া-দাওয়া, এসব পেলেই তো জীবনটা আরামে কাটে!
–হয়তো এর পরেও নিজের ভালো লাগা বলে একটা ব্যাপার আছে রে, চন্দনা। সেইজন্যই কেউ কেউ এইসব ক্রিচার কমফর্ট ছেড়েও তো চলে যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজের ভালো ভালো ছেলেরা বনে জঙ্গলে গিয়ে পিজান্ট মুভমেন্ট অর্গানাইজ করছে।
–দেশের অবস্থা তো খুব খারাপ শুনতে পাই। কলকাতায় রোজ খুন হচ্ছে। এখানে কলকাতার নাম শুনলেই সবাই ঠাট্টা করে। তুই চলে এসেছিস ভালো করেছিস। তোর সেই বন্ধু, কী যেন নাম, অতীন, তাই না? সে কিছুদিন লন্ডনে এসে ছিল শুনেছি, সে নাকি জেল থেকে পালিয়ে এসেছে? আর দেরি করিস নি, তোরা দু’জনে এবার একটা কিছু ঠিকঠাক করে ফ্যাল!
বাচ্চাকে নিয়ে মনোজ ফিরে এলো, আর এবিষয়ে কোনো কথা হলো না।
আগেই ঠিক ছিল অলি আজ রাতটা এখানেই থেকে যাবে। তবু বেশী রাত পর্যন্ত গল্প হলো না। ছুটি নেবার উপায় নেই, কাল ভোর থেকেই চন্দনা আর মনোজকে কাজে বেরুবার তোড়জোড় করতে হবে। মনোজ আর চন্দনার ব্যবহার দেখে কিছু বোঝা না গেলেও অলির কেন যেন মনে হতে লাগলো, ওদের দু’জনের মধ্যে কিসের যেন একটা টানাপোড়েন চলছে। চন্দনা অন্যদিকে মুখ ফেরালেই তার মুখখানা বিষণ্ণ হয়ে যায়, মনোজের চিবুকে ঝিলিক দিয়ে যায় একটা কিছু অস্বস্তি বা বিরক্তির রেখা। এত পীড়াপীড়ি করে চন্দনা অলিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে রাখলো, হয়তো সে নিজের কথা কিছু বলবে ঠিক করেছিল, অথচ প্রাণ খুলে কিছুই বললো না। চন্দনা মনে করে, সুখ কথাটা একটা ফিলোসফিক্যাল ধাপ্পা! এটা তো এক ধরনের সিনিসিজম, যা চন্দনার মতন মেয়ের কাছ থেকে আশাই করা যায় না।
বিছানায় শুয়ে অলির আবার মনে পড়লো ব্যাগ হারাবার ঘটনাটা। তার মর্মমূল পর্যন্ত একেবারে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। চোর-জোচ্চোর পৃথিবীর সব দেশেই আছে, ইংল্যান্ডেই বা থাকবে না কেন? ইংরেজদের লেখা ক্রাইম স্টোরি কী সে পড়েনি? তবু কয়েক মিনিটের জন্য অলির মনে হয়েছিল, এই কী ভারতের তুলনায় অনেক উন্নতদেশের আইন শৃঙ্খলার নমুনা? টাকা পয়সা যা গেছে যাক, তবু ভাগ্যিস পাসপোর্ট আর টিকিটটা ফেলে গেছে। তা না হলে বাবলুদার সঙ্গে আর দেখা হতো না! আর অলির লন্ডন ভালো লাগছে না। পরশু সন্ধেবেলা তার ফ্লাইট, সেই পরশু যেন কত দূরে! বাবলুদা কি এখনও দাড়ি রেখেছে?
অলির ঘুম আসছে না, এই বিছানাটায় একটা শিশু-গন্ধ। এদেশে খুব বাচ্চা ছেলে-মেয়েরাও মা-বাবার কাছ থেকে আলাদা শোওয়া অভ্যেস করে। উত্তর কলকাতায় চন্দনাদের মস্ত বড় বাড়ি, সে বাড়িতে অন্তত তিরিশ-চল্লিশজন মানুষ দেখেছিল অলি, আর এখানে চন্দনার ছেলেকে দেখবার জন্য একজনও কেউ নেই। ঝি-চাকর রাখার প্রশ্নই ওঠে না, মনোজের দাদা-বৌদিরা কাছাকাছি না থাকলে চন্দনার ছেলেকে কে রাখতো সারাদিন?।
অলি বিছানা ছেড়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়ালো। সারাদিন গরমের পর ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। সামনের বাগানে দু তিনটে গোলাপ গাছ, সেই বৃষ্টিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। একবার বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টি ভিজতে ইচ্ছে করলে অলির, কিন্তু সদর দরজাটা খুলতে গেলে শব্দ হবে, অলি আগেই লক্ষ করেছে যে ভেতরের সুইইং ডোরটা খুলতে গেলেই ক্যাঁচ করে শব্দ হয়, তাতে চন্দনারা জেগে উঠতে পারে। অলি একদৃষ্টিতে বাগানটার দিকে চেয়ে রইলো। বিলিতি গোলাপ ফুলের ওপর ঝরে পড়ছে বিলিতি বৃষ্টি। দেশে থাকবার সময় বিলেত কথাটা শুনলেই এক ধরনের রোমাঞ্চ হতো, এখন অলি সত্যিই সেই বিলেতে এসেছে, কিন্তু তীব্র কোনো অনুভব তাকে কাঁপিয়ে দেয়নি। অ্যামেরিকা কি এর চেয়ে খুব বেশী আলাদা হবে?
এক ঝলক তার মনে পড়ছে বাবলুদার মুখ, আবার পরের মুহূর্তে মনে আসছে কৌশিক আর পমপমদের কথা। বাবলুদা আর কৌশিক দুই প্রাণের বন্ধু, অথচ দু’ জনের জীবন চলে গেল দু’ দিকে। জেল ভেঙে পালিয়ে এসেছে কৌশিক, দু হাতে রিভলভার চালিয়েছে, এসব গল্পে শোনা যায়, সিনেমায় দেখা যায়, কিন্তু তাদের অতি পরিচিত কৌশিক সেই রকম একটা ঘটনার সত্যিকারের নায়ক। বাবার মুখে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনা শুনেছে অলি, বইতেও পড়েছে, মাস্টারদা, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিং-এর মতন বীর যোদ্ধাদের সঙ্গে কৌশিকদের তুলনা করতে ইচ্ছে করে। কৌশিককে বাঁচতেই হবে। পমপম আর কৌশিকের কথা মনে পড়লেই অলির বুকটায় একটু ব্যথা হয়।
বাবলুদা আমেরিকায় রয়েছে বলে অনেকে তাকে ভুল বুঝছে। ওদের পার্টির কেউ কেউ বাবলুদার নামে বিরূপ মন্তব্য করে। ওরা আসলে সব কথা জানে না। বাবলুদা মোটেই আসতে চায়নি, তাকে জোর করে পাঠানো হয়েছে, সেই সময় অবস্থা অন্য রকম ছিল, পালিয়ে না এলে বাবলুদাকে অন্য পার্টির ছেলেরা খুন করে ফেলতো।
বাগানের গোলাপ গাছের পাশে অলি যেন দেখতে পেল বাবলুদাকে। পা-জামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা, বৃষ্টিতে ভিজে গেছে তার চুল। অলি ফিসফিস করে বললো, বাবলুদা, আমি আসছি, আমি আসছি, আমি আর তোমাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারছি না।
পরদিন সকালে কোনোরকমে ব্রেক ফাস্ট খেয়েই ওরা বেরিয়ে পড়লো। চন্দনার ছেলে এখনও ঘুমোচ্ছ, সেই অবস্থায় তাকে পৌঁছে দেওয়া হলো মনোজের দিদির বাড়িতে। মনোজের দিদি এখন কোনো চাকরি করছেন না, সেই জন্যই তাঁর কাছে বাচ্চাটাকে রাখা যায়। এতবড় সুবিধের জন্যই তো চন্দনারা রিডিং-এ পড়ে আছে। বাচ্চাটা শনি-রবিবার ছাড়া বাবা-মাকে ভালো করে দেখতেই পায় না।
অলি একা একা প্যাডিংটন স্টেশানে নামলো পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে। হাতের ব্যাগটা সে দোলাচ্ছে, কেউ এসে নিক তো আর একবার! চন্দনাদের কাছ থেকে তাকে পাঁচটা পাউন্ড ধার করতে হয়েছে, বিশাখাকে বলতে হবে একটা চেক পাঠিয়ে দিতে।
আজ থেকে বিশাখার আবার কাজ শুরু, সে সারাদিন অলিকে সঙ্গ দিতে পারবে না। টিউব রেলের ম্যাপ দেখে অলি একা একা ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু যাবে কোথায়? নোট বইটা খোয়া গেছে, তুতুলের বাড়ির ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর তার মনে নেই। ইস, তুতুলদি ভাববে, অলি আর একবার তার খোঁজও নিল না!
লন্ডনের মিউজিয়াম কিংবা আর্ট গ্যালারিগুলোতে ঢুকতে কোনো পয়সা লাগে না। এই একটা বড় সুবিধে। দশটা বাজবার পর অলি আবার টেট গ্যালারিতে ঢুকে পড়লো। এখানে অনেকক্ষণ কাটানো যায়। সে একা, স্বাধীন, যেখানে খুশি যেতে পারে, আজই যেন সে লন্ডন শহরে প্রথম ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দেখতে পাচ্ছে কবি-শিল্পীদের লন্ডন, ইতিহাসের লন্ডন। তবু, মনের মধ্যে কোথায় যেন খচখচ করে। পৃথিবীর অন্যদেশের আগন্তুকরা যেভাবে লন্ডনকে দেখবে, একজন ভারতীয়ের পক্ষেও কি ততটা মুগ্ধভাবে দেখা সম্ভব? দু শো বছরের ব্রিটিশ শাসনের কথা মনে পড়েই যায়। এক একটা মোটা মোটা থামওয়ালা প্রাচীন বাড়ি দেখলে মনে হয়, কলোনির কুলিদের রক্ত জল করা টাকায় কি এসব তৈরি হয়নি? অবশ্য দেখতে দেখতে চোখে সয়ে গেলে কিছুদিন পরে আর এসব মনে পড়ার কথা নয়!
রাস্তা দিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরলো অলি, হাইড পার্ক কর্নারে বসেও ছিল কিছুক্ষণ, তবু একজন কেউও তার সঙ্গে কথা বলেনি। তার দিকে তাকিয়েছে অনেকে, যদিও শাড়িপরা নারী এখানে দুর্লভ কিছু নয়, তাহলেও কিছু লোক, হয়তো তারা কনটিনেন্টের টুরিস্ট, শাড়িপরা মেয়েদের দিকে ফিরে ফিরে চায়। কিন্তু কেউ আলাপ করতে এগিয়ে আসে না। ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের এই চরম রূপটি দেখে অলি আহত হয় না, বিস্মিত বোধ করে। একটা শব্দও উচ্চারণ না করে এ শহরে সারাদিন ঘোরাঘুরি করে বাড়ি ফেরা যায়।
হঠাৎ বৃষ্টি নামতে অলিকে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতেই হলো।
পরদিন বিশাখা আর তার বাবা তাকে তুলে দিতে এলেন হিথরো এয়ারপোর্টে। অলির কাছে একটাও ডলার বা পাউন্ড নেই। শেষপর্যন্ত টাকা হারাবার ঘটনাটা সে বিশাখাদের কাছে বলতে পারেনি, চন্দনার ধারটাও শোধ দেওয়া হলো না। টাকা-পয়সা আর লাগবে কিসে? নিউ ইয়র্কের জে এফ কে এয়ারপোর্টে বাবলুদা তাকে নিতে আসবে, সব ঠিক হয়ে আছে।
সুটকেস চেক ইন করার পর অলি বিশাখা আর তার বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। এরপর বাবলুদার ওপর তার পুরোপুরি নির্ভরতা। মাঝখানে আর কেউ রইলো না। অলি হঠাৎ একটু মুচকি হাসলো। নিউ ইয়র্কে প্লেন থেকে নেমেই সে বাবলুদাকে বলবে, আমি নিঃস্ব হয়ে তোমার কাছে এসেছি।
সঙ্গে একটাও পয়সা না থাকলে কেমন যেন অসহায় অসহায় লাগে। যদিও অলি বারবার নিজেকে বোঝাচ্ছে, মাঝখানে পয়সা খরচ করার কোনো প্রশ্নই উঠছে না। বিমানটি এবার এক লাফে আটলান্টিক পাড়ি দেবে, যাত্রীরা শুধু খাবে আর ঘুমোবে। কেউ কেউ অবশ্য নিজের পয়সায় মদ কিনে খায়।
অলির পাশে একজন মাঝবয়সী পুরুষ বসেছে, মুখ দেখে মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। গায়ে একটু একটু রসুনের গন্ধ। বিমানটি আকাশে ওড়ার পরেই সে সীট-বেল্ট খুলে পাশ ফিরে অলিকে জিজ্ঞেস করলো, পাকিস্তানী? ইন্ডিয়ান?
লোকটি ইংরিজি বলে ভাঙা ভাঙা, তার কণ্ঠস্বরে একটা সরল, ভালো মানুষীর ভাব আছে। এই যে বিনা দ্বিধায় তার আলাপ করার চেষ্টা, এটাতেই অলি একটা প্রাচ্যদেশীয় স্পর্শ পায়। লোকটির বাড়ি কায়রো শহরে, সে শিকাগোতে ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, তার ছেলে সেখানে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো করে।
অলি বললো, তোমরা এক সময় পিরামিড বানিয়েছে, আর এখন সেই তোমরাই নিজের ছেলেদের স্থাপত্যবিদ্যা শেখার জন্য আমেরিকা পাঠাচ্ছো?
লোকটি গলা কাঁপিয়ে হা হা শব্দে হেসে উঠলো।
আগে হয়তো অলির এই ধরনের হাসি কর্কশ কিংবা সভ্যতাসম্মত মনে হতো না, কিন্তু এখন মনে হলো, সে যেন কোনো মরুভূমির বেদুইনের হাসি শুনলো এই বিমানের মধ্যে। তার বেশ পছন্দই হলো।
লোকটি একটু পরেই হুইস্কির অর্ডার দিয়ে অলিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার জন্য কী। নেবো? অলি কিছু চায় না, লোকটিও নাছোড়বান্দা। জিন, কোনিয়াক বা ওয়াইন একটা কিছু নিতেই হবে। অলির আবার মনে পড়লো তার কাছে পয়সা নেই। লোকটিকে নিবৃত্ত করার জন্য সে একটা কিছু নরম পানীয় কিনতে পারতো। লোকটি জোর করে একটি ছোট বোতল রেড ওয়াইন নিল অলির জন্য। তার সনির্বন্ধ অনুরোধে অলি একটুখানি ঠোঁটে ছোঁয়াতেও বাধ্য হলো।
বেশ জোরে জোরেই গল্প জুড়ে দিল লোকটি। সে শাড়িপরা যুবতী এর আগে দু’তিনজন মাত্র দেখেছে। ভারতীয় পুরুষদের তুলনায় ভারতীয় মেয়েরা খুব কমনীয় হয়। অবশ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা, তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে কী যেন একটা গণ্ডগোল করছেন! পূর্ব পাকিস্তানের সব মুসলমানদের তিনি হিন্দু করে দিতে চাইছেন না? এই রকম খবরই তো তাঁর দেশের কাগজে বেরোয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তো একজন আর্মি জেনারেল, তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করে কি ঐ মহিলা পারবেন?
তৃতীয় পেগ হুইস্কি শেষ করার পর লোকটি অবলীলাক্রমে অলির উরুতে হাত রাখলো।
অলি ভয় পেল না। সে তার নরম হাতের মুঠিতে লোকটির হাত ধরে গভীর মিনতির সুরে, খুব আস্তে বললো, প্লীজ, এরকম করো না।
লোকটি অবাক চোখে অলির মুখের দিকে চেয়ে রইলো। অলি আবার বললো, তোমার হাতটা সরিয়ে নাও। নইলে আমাদের বন্ধুত্ব থাকবে না!
বন্ধুত্ব শব্দটির মধ্যে যেন একটা জাদু আছে। লোকটি সঙ্গে সঙ্গে হাতটা সরিয়ে নিল। আর কথা বললো না একটাও। একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লো।
অলির ঘুম আসছে না। পাশের লোকটি তার উরুর যেখানটায় হাত রেখেছিল, সেই জায়গাটার শাড়ি সে প্লেন করলো অনেকবার। যেন ঐ স্পর্শটা মুছে দিতে চাইছে। সে জানে, ওরকম একটু আধটু ছোঁয়াছুঁয়িতে কিছু আসে যায় না। লোকটি খারাপ নয়, তার ওপর কোনো জোর করেনি, মদের নেশায় একটু উচ্ছল হতে চেয়েছিল।
বাবলুদা ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ তাকে পুরুষ হিসেবে স্পর্শ করতে পারেনি। এ জন্য মনে মনে অলির একটু গর্ব আছে। চেষ্টা করেছে অনেকে, এমনকি পমপম আর কৌশিকের সঙ্গে সে যখন ঘাটশিলায় যায়, তখন কৌশিকের এক বন্ধু তাকে নিবিড় ভাবে কামনা করেছিল, দু’তিনবার জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু কখনো মেনে নিতে হয়নি, কোনোবারই চাচামেচি করে নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করতে হয়নি। তার শান্ত দৃঢ় প্রত্যাখ্যান অন্যরা ঠিক বোঝে–এই জোর অলির আছে। একমাত্র বাবলুদাই তার কোনো বাধা বা নিষেধ মানেনি, সেইজন্য বাবলুদার জন্যই তার শরীর মন উন্মুখ হয়ে আছে।
বাবলুদার সঙ্গে প্রথম দেখা হলে কী কী মিথ্যে কথা বলতে হবে, অলি মনে মনে আবার ঝালিয়ে নেয়। বিদেশে যারা একা থাকে, তাদের হঠাৎ খারাপ খবর দিতে নেই। মানিকদার মৃত্যুসংবাদ দেওয়া চলবে না। জেল ভেঙে পালাবার সময় কৌশিক যে সাঙ্ঘাতিক আহত হয়ে এখনো মৃত্যুর কাছাকাছি রয়েছে, তা বলা যাবে না। পমপমকে লালবাজারে কী ধরনের অত্যচার করেছে, তাও বলার দরকার নেই। ওরা সব ভালো আছে ৷ বাবলুদার পিসিমণি ভালো আছে। লন্ডনে যে তুতুলদির এত বড় অপারেশন হয়েছে, তাও উল্লেখ না করাই সঙ্গত। আর?
আটলান্টিক মহাসমুদ্রের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বিমান, ওপরে রাত্রির আকাশ। মেঘের স্তরের ওপর দিয়ে যাচ্ছে বলে চাঁদটা অনেক বেশী উজ্জ্বল। বিমানের মধ্যে অধিকাংশ মানুষই এখন ঘুমন্ত। সোজা হয়ে বসে আছে অলি। প্রতি মিনিটে সে প্রায় আট মাইল করে এগিয়ে। যাচ্ছে বাবলুদার দিকে।
একবারও সে তন্দ্রায় ঢলে পড়লো না। পুরো সময়টা জেগেই কাটালো। এক সময় জেগে উঠলো ভেতরের আলো, ফুটে উঠলো সটি-বেল্ট বাঁধার নির্দেশ। পাশের লোকটির পিঠে। আলতো করে হাত রেখে অলি ডাকলো, প্লীজ গেট আপ!
পিকচার পোস্টকার্ডের ছবির মতন দেখা যাচ্ছে নিউ ইয়র্ক শহর। বড় বড় আলোকোজ্জ্বল বাড়ি। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং চিনতে অসুবিধে হয় না। এক ঝলক দেখা যায় স্ট্যাচু অফ লিবার্টি।
বিমানটি ভূমি স্পর্শ করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ইজিপশিয়ান লোকটির চোখে মুখে খানিকটা আশঙ্কা জমেছিল। মৃদু ঝাঁকুনিটি লাগার পর সে অলিকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে কেউ নিতে আসবে তত? না হলে আমি তোমাকে কোনো হোটলে পৌঁছে দিতে পারি।
অলি বললো, ধন্যবাদ। আমাকে নিতে আসবে একজন। তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি।
তারপরেই অলির বুকটা একবার কেঁপে উঠলো। যদি বাবলুদা কোনো কারণে না আসতে পারে? তার কাছে একটা টেলিফোন করারও পয়সা নেই। পরমুহূর্তেই সে এই আশঙ্কাটাকে ঝেড়ে ফেলে দিল। বাবলুদার ওপর সে ভরসা রাখতে পারছে না? সে এত দুর্বল?
ইমিগ্রেশান, কাস্টমস পেরুবার পরই সে দেখতে পেল অতীনকে। এই দু’আড়াই বছরে সে। যেন আরও রোগা আর লম্বা হয়েছে, মুখে দাড়ি নেই, সে হাতছানি দিচ্ছে অলির দিকে। অলি যেন তার সুটকেসটা টানতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সুটকেসটা ফেলেই ছুটে যেতে। ছেলেমেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, এখানেই চুমু খাচ্ছে সবার সামনে। অলি চাইছে বাবলুদার বুকের ওপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
অলি কাছাকাছি আসতেই অতীন বেশ চেঁচিয়ে বাংলায় বললো, অলি! অলি! তুই এসেছিস তা হলে শেষ পর্যন্ত! আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। প্লেন প্রায় চল্লিশ মিনিট লেট।
তারপর অলি কিছু বলার আগেই সে একটু সরে গিয়ে পাশের একটি যুবতীর দিকে হাতের পাঞ্জা তুলে বললো, আলাপ করিয়ে দিই, এ আমার বান্ধবী শর্মিলা, আর শর্মিলা এই হচ্ছে অলি।
এর পরেও সে অলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বললো, তোমরা দু’জনে এখানে। একটু দাঁড়াও, আমি দেখি সিদ্ধার্থ গাড়িটা কোথায় পার্ক করলো। ও বেচারা জায়গাই পাচ্ছিল না!
অতীন দৌড়ে চলে গেল। শর্মিলা কাছে এসে অলির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো। খুব টায়ার্ড, তাই না? লন্ডন থেকে এই জার্নিটা একটানা এতক্ষণ, বড় বোরিং। আসুন ভাই, এই দিকটায় সরে আসুন। ওখানে বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। দু’দিন ধরে নিউ ইয়র্কে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। লন্ডনের ওয়েদার কী রকম ছিল?
অতীনের ব্যবহারের আড়ষ্টতা চোখে পড়লেও এই মেয়েটির কথার মধ্যে আন্তরিক সুরটা স্পর্শ করলো অলিকে। প্রথম দর্শনেই সে শর্মিলাকে পছন্দ করে ফেললো। সে শর্মিলার কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল না।