অধ্যায় ৪০
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করে সবার আগে একটা জায়গায় গেলো চারু। যে কাজটা তার শুরুতে করার কথা ছিলো সেটা এখন করবে।
প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ-সংক্ষেপে পিআইবি, ঢাকার সিদ্ধেশরি সার্কুলার রোডে অবস্থিত। এখানকার লাইব্রেরিটি পত্রিকার আকাইভ হিসেবে বেশ সমৃদ্ধ। দেশের সব দৈনিক আর ম্যাগাজিনের পুরনো ভাগাড় এটা। গবেষক, ইতিহাসবিদ আর সাংবাদিকেরা ভালোমতোই ব্যবহার করে এই আকইিভ। তবে এটা সবার জন্যই উন্মুক্ত।
বিশাল আকাইভ-লাইব্রেরিতে গিয়ে গত বছরের পহেলা নভেম্বরের সবগুলো দৈনিক পত্রিকার কপি নিয়ে বসলো সে। ক্ষমতাবান মায়ের হস্তক্ষেপের কারণে মিসকাতের খুনের কোনো খবরই পত্রিকায় আসেনি, আর যদি আসতেও, সেটা পরদিন পত্রিকার পাতায় ঠাই পেতো না। কারণ মিসকাত খুন হয়েছে রাত দুটোর দিকে। বেশিরভাগ পত্রিকাই তখন প্রিন্টে চলে যায়। সুতরাং চারু এসেছে ভিন্ন একটি সংবাদের খোঁজে।
যুক্তিবাদি সমিতিতে কাজ করার সুবাদে পত্র-পত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সাথে তার বেশ সখ্যতা তৈরি হয়েছে। সে জানে, প্রতিটি দৈনিক পত্রিকা আর ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যম তাদের একজন মেডিকেল রিপোর্টার নিয়োগ দিয়ে থাকে। ঢাকা মেডিকেল হলো সংবাদের একটি নিয়মিত এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কখনও কখনও বিরাট কিছুও পাওয়া যায় এখান থেকে। সে কারণে মেডিকেলের জরুরি বিভাগে বেশ কিছু সাংবাদিকের দেখা মেলে সব সময়।
আধ-ঘণ্টা ঘাঁটাঘাঁটি করে তিনটি জাতীয় দৈনিকের মেডিকেল রিপোর্টারের সংবাদ চোখে পড়লো তার। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের আভ্যন্তরীন মারামারির কারণে ঐদিন একজন খুন হয়েছিলো সন্ধ্যার পর। একটি সংবাদে বলা আছে নিহতকে ঠিক সাড়ে সাতটার দিকে নিয়ে আসা হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। একটি রিপোর্ট থেকে জানতে পারলো ছাত্রনেতার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মেডিকেলে জড়ো হয় প্রচুর রাজনৈতিক কর্মির। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ছোটখাট ভাঙচুরও করেছে হাসপাতালের বাইরের রাস্তায়।
তার মানে সংবাদমূল্য আছে এমন কিছু ঐদিন ঘটেছিলো মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আশাবাদি হয়ে উঠলো চারু। পিআইবি থেকে সোজা চলে গেলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে। ওখানে গিয়ে তিন-চারটা পত্রিকার রিপোর্টার পেয়ে গেলো সে। তারা একসাথে বসে সিগারেট খেতে খেতে অলস সময় পার করছে। তাদের মধ্যে একজন চারুর পূর্ব-পরিচিত।
“এক বছর আগের ঘটনা?” মহাকাল-এর মেডিকেল রিপোর্টার মিঠ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “নাহ্, এইরকম কোনো কিছুর কথা তো মনে পড়ছে না।”
হতাশ হলো না চারু। এটাই স্বাভাবিক। এরা প্রতিদিন নানারকম ঘটনা দেখে থাকে, সেগুলো নিয়ে রিপোর্টও করে, আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে বাইকার বাবুর অ্যাকসিডেন্টের মতো ঘটনা মনে থাকার কথাও নয়।
“ঐদিন সরকারদলের ছাত্র সংগঠনের এক নেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে এখানে এসেছিলো…ছেলেটার নাম ছিলো পলাশ। আপনিই রিপোর্ট করেছিলেন আপনার পত্রিকার জন্য, তাকে মনে করিয়ে দিলো যুক্তিবাদি। পিআইবি থেকে এ তথ্যটা পেয়েছে সে।
“আচ্ছা…পলাশ মার্ডারের দিন?” সিগারেটে আবারো টান দিলো মিঠু, “এইটা মনে আছে, কিন্তু আপনে যেটা বলতাছেন ওইটা মনে নাই।” পাশের জনের দিকে ফিরে তাকালো সাংবাদিক। “তুমি কি ঐদিন ছিলা এইখানে?”
হালকাপাতলা গড়নের সাংবাদিক মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিলো সে ঐদিন ছিলো না।
চারু হতাশ হলো। যদিও ভালো করেই জানে, ঐদিন এখানে উপস্থিত থাকলেও বাবুর অ্যাকসিডেন্টের ঘটনাটা তার মনে থাকার কথা নয়। সময় বিরাট ফ্যাক্টর। ঘটনার পর পর যদি পুলিশ এটা খতিয়ে দেখতো সম্ভবত মূল্যবান তথ্য পেতে পারতো।
“আচ্ছা, ছাত্রনেতা পলাশকে কখন এখানে আনা হয়, সেটা কি মনে আছে?”
মিঠু নামের রিপোর্টার সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলতে লাগলো, “ঐদিন পলাশ ভায়ের ডেডবডিটা যখন নিয়া আসছিলো সেইটা মনে আছে। সন্ধ্যা সাতটার একটু পর…আমি ঠিক এইহানে দাঁড়ায়া কার সাথে জানি কথা বলছিলাম, এমন সময় পলাশভাইরে নিয়া অ্যাম্বুলেন্সটা চইলা আসলো…লগে লগে ভুরভুরাইয়া ঢুকলো ওয়ার্ল্ড নিউজ আর সীমানা টিভির রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান।”
কথাগুলো চারু শুনে গেলেও তার চোখ চলে গেলো ইমার্জেন্সির মেইন গেট থেকে একটু দূরে। সেখানে এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যামেরাম্যানকে কী জানি ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে ছেলেটা, রিপোর্ট করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। রিপোর্টারের পেছনে ইমার্জেন্সিতে আসা কতোগুলো গাড়ি-সিএনজি পার্ক করা আছে।
“আইজকাইল এইসব টিভি চ্যানেলগুলাই সবার আগে খবর পায়, বুঝলেন?” বলে যাচ্ছে মিঠু, “মানুষজন কোনো ঘটনা ঘটলেই সবার আগে ওগোরে ফোন দিয়া জানায়। আমাগো আর বেইল নাই।”
মহাকাল-এর রিপোর্টারের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু, কিন্তু তার সমস্ত মনোযোগ ঐ টিভি রিপোর্টারের দিকে, তার ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকা পার্ক করা গাড়িগুলোর দিকে।
মিঠু এখনও কথা বলে যাচ্ছে কিন্তু সে কথা আর চারুর কানে ঢুকছে। ঐদিন বাইকার-বাবুকে যে সিএনজিটা নিয়ে এসেছিলো সেটাও নিশ্চয় ওখানে পার্ক করেছিলো।
রিপোর্টারের দিকে ফিরে তাকালো সে। “কোনদুটো টিভি নিউজের কথা যেন বললেন?”
মহাকাল-এর রিপোর্টার আবারো বলল, “ওয়ার্ল্ড নিউজ আর সীমানা টিভি। পরে আরো কিছু চ্যানেলও আসছিলো…তয় ওই দুইটা চ্যানেলের গাড়ি আসছিলো অ্যাম্বুলেন্সটার লগে লগে।”
চারু আবারো তাকালো প্রস্তুতি নিতে থাকা রিপোর্টারের দিকে। তার যদি ভুল না হয়ে থাকে তাহলে ওখান থেকে কেউ ছবি তুললে পার্ক করা গাড়িগুলো ফ্রেমের মধ্যে চলে আসবে।
আসতে বাধ্য!
.
অধ্যায় ৪১
ডক্টরের বাসায় মায়া বসে আছে। তার হাতে ভোগ ম্যাগাজিন। সামনে কফি টেবিলের উপর রাখা মগ থেকে উঠছে ধোঁয়া।
ডক্টর আজফারের বাড়িতে এলে এই একটা জিনিস মায়ার খুব ভালো লাগে-বই আর পত্র-পত্রিকার কোনো অভাব নেই এখানে। তবে তার ধারনা ভোগ-এর মতো ফ্যাশন ম্যাগাজিন ডক্টর পড়েন না, এটা তিনি মায়ার জন্যই রাখতে শুরু করেছেন। ভদ্রলোক খুবই কেয়ারিং-এই জিনিসটা তার খুব ভালো লাগে।
উইন্টার ফ্যাশনের একটি কালেকশানে চোখ বোলাতে বোলাতে কফির মগটা তুলে নিলো সে।
“কখন এসেছো?”
ডক্টরের ভরাট কণ্ঠ শুনে মুখ তুলে তাকালো মায়া। ছরি হাতে অভিজাত ভঙ্গিতে দরজা দিয়ে ঢুকছেন তিনি। “এই তো, একটু আগে,” স্মিত হাসি দিয়ে বলল।
“চারু কোথায়?” মায়ার বিপরীতে একটা সোফায় বসে পড়লেন আজফার হুসেন।
মায়া কফির মগটা নামিয়ে রাখলো আস্তে করে। “দু-দিন ধরে চারু আহসানের সাথে কোনো যোগাযোগ নেই আমার। ফেসবুকেও দেখলাম না।”
“পরবর্তি স্টেপটা কি হবে সেটা নিয়ে ভেবে যাচ্ছে বোধহয়।”
“আমার মনে হয় উনি অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছেন।”
মায়ার দিকে ভুরু কুচকে তাকালেন ডক্টর। “শুরু করে দিয়েছে মানে? তুমি না বললে দু-দিন ধরে যোগাযোগ নেই?”
“তাতে কি…উনি উনার মতো কাজ করে যাচ্ছেন।’
মাথা দোলালেন ডক্টর আজফার। “না, না। এটা ঠিক হচ্ছে না। এই তদন্তে সব সময় তোমরা দু-জন থাকবে…মানে, থাকতে হবে। এটা আমি শুরু থেকেই পরিস্কার করে বলে দিয়েছি তোমাদেরকে।”
“আমি এতে আপত্তি করার কিছু দেখছি না। কিছু কিছু কাজ উনি একা একা করতেই পারেন।”
“এটা সে করতে পারে না, জোর দিয়ে বললেন ডক্টর।
“সমস্যা কি?” অবাক হলো সাবেক রেডিও জকি। “উনি তো আমার সাথে সব শেয়ার করেন। আমি এতে কোনো সমস্যা দেখছি না।”
পুরোপুরি সন্তুষ্ট না-হলেও ডক্টর আর কিছু বললেন না।
“আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না,” মায়া আশ্বস্ত করলো আজফার হুসেনকে। “উনি একা একা এরকম কাজ করে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাই হয়তো…” নিজের কথাটা শেষ করলো না সে।
“তারপরও, ওর আসলে…” ডক্টর মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেন চারুকে ঘরে ঢুকতে দেখে।
চারু আহসান যে প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে সেটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। দুচোখ দিয়ে যেন আগুন বের হচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে ডক্টরের মতো মায়াও ভীষণ অবাক হলো।
“আপনার মতলবটা কি, ডক্টর?” দাঁতে দাঁত পিষে ডক্টরের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। “এসব কেন করছেন? কেন!?” শেষ কথাটা রীতিমতো চিৎকার করে ধমকের সুরে বলল। তার আচরণ বেশ মারমুখি।
ডক্টর আজফার কিছু বুঝতে না পেরে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন কেবল। তার ধারণা একটু আগে মায়ার যেসব কথা বলছিলেন তার কিছু কথা হয়তো শুনে ফেলেছে। কিন্তু তাতে এত রাগ করার কী আছে বুঝতে পারছেন না।
“চারু!” ধমক দিয়ে বলল মায়া। “আপনি এসব কী বলছেন? বিহেইভ ইওর সেফ!”
মেয়েটার দিকে কটমট চোখে তাকালো যুক্তিবাদি।
“সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে খুব বেশি রিঅ্যাক্ট করছেন আপনি।”
“সামান্য ব্যাপার!” ভুরু কুচকে তাকালো চারু। “কীসের কথা বলছেন আপনি? আমি কেন রেগে আছি সেটা কি আপনি জানেন?”
মায়া বুঝতে পারলো না কী বলবে। ডক্টরের মতো সে-ও ভেবেছে একটু আগে তাদের কথাবার্তা হয়তো চারুর কানে গেছে, আর তাতেই সে ক্ষেপে আগুন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, র্যাশনালিস্ট সোসাইটির এই নেতার ক্ষোভের কারণ সেটা নয়।
“আপনি একটু চুপ করে বসুন…কেন রেগে আছি সেটা ভালোমতোই বুঝতে পারবেন।”
“তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো তো,” চারু ঘরে ঢোকার পর এই প্রথম মুখ খুললেন ডক্টর। “যা বলার সেটা মাথা ঠাণ্ডা রেখেই বলতে পারো।”
“মাথা ঠাণ্ডা রেখে বলবো!” চেঁচিয়ে উঠলো চারু। “এসব জানার পর কারোর মাথা ঠিক থাকে?!”
মায়া এবার উঠে দাঁড়ালো, চারুর কাছে এসে দাঁড়ালো সে। ছেলেটার ভাবসাব তার কাছে ভালো ঠেকছে না। ডক্টরের সাথে বাজে ব্যবহার করছে, যেকোনো সময় সেটা আরো খারাপের দিকে যেতে পারে।
“আপনি বসেন তো…” চারুর বামহাতের কনুইটা ধরে তাকে ডক্টরের বিপরীতে বসালো। নিজেও বসে পড়লো তার পাশে। “কি হয়েছে সেটা শাউটিং না করে কি বলা যায় না?”
ঝট করে মায়ার দিকে তাকালো চারু আহসান। “না, যায় না! কারণ উনি যা করেছেন সেটা… রাগেক্ষোভে ফুঁসতে লাগলো সে। “…হি ইজ অ্যা ক্রিমিনাল!” যেন ডক্টর সম্পর্কে নিজের শেষ রায়টা ঘোষণা করে দিলো। আমি আগেই বলেছিলাম, এই লোকের মতলব ভালো না। আপনি বিশ্বাসই করলেন না আমার কথা!”
“আহ্! আপনি কিন্তু অনেক বাড়াবাড়ি করছেন!” মায়াও রেগে গেলো। “কি হয়েছে সেটা আগে বলবেন তো?”
নিজের রাগ প্রশমিত করা জন্য কিছুটা সময় নিলো চারু। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলো বেশ কয়েকবার।
ডক্টর আজফার চোখ পিটপিট করে মায়া আর চারুর দিকে তাকাচ্ছেন। তার ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি সম্ভবত যুক্তিবাদির ক্ষোভের কারণ কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন।
“এই লোক!” আঙুল তুলে বলল চারু আহসান, “উনি আমদের দু জনকে একটি রহস্যের সমাধান করতে দিয়ে বিকৃত খেলা খেলছেন! আসলে উনি নিজেই হচ্ছেন নাটেরগুরু! শুরু থেকে ঘটনাটার সাথে জড়িত!”
মায়া হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো।
“অনেক চালাক আর ধুরন্ধর একজন মানুষ! কিন্তু আজকে আপনাকে আমি ছাড়ছি না!”
ঠিক এমন সময় হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো খর্বাকৃতির টোটা। তার হাতে একটি অটোমেটিক পিস্তল!
.
অধ্যায় ৪২
ডক্টর আজফার হুসেন মিসকাতের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত!
কথাটা হজম করতে পাছে না মায়া।
টোটা পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে চারুর সামনে-দৃশ্যটা দেখে তার আৎকে ওঠার কথা, কিন্তু তার মাথায় ঘুরছে এই প্রশ্ন।
চারু আহসান বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে চেয়ে আছে টোটার দিকে। অবশ্য সেটা কয়েক মুহূর্তের জন্য। ডক্টর আজফার পরিস্থিতি বুঝে উঠতে কিছুটা সময় নিয়ে নিলেন। যখন বুঝতে পারলেন তখন গর্জে উঠলেন।
“টোটা! আমি কি তোমাকে এখানে আসার কোনো সিগন্যাল দিয়েছি?!”
বামনটা কাচুমাচু খেলো। নাকিকণ্ঠে বলে উঠলো, “না, মানে…উনি তো খুব…”
“পিস্তলটা নামাও!” টোটা এখনও পিস্তল তাক করে রেখেছে বলে মৃদু ভর্ৎসনার সুরে আদেশ করলেন আজফার হুসেন। “এখানে এমন কিছু হয়নি যে তোমাকে ওটা নিয়ে ছুটে আসতে হবে।”
ডক্টরের কথায় আশ্বস্ত হয়ে পিস্তলটা নামিয়ে ফেলল বামন। একটু বিব্রত দেখাচ্ছে তাকে।
“এখন যাও…আমাদের জন্য কফি নিয়ে এসো।”
চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো টোটা। পিস্তল হাতে মারমুখি এক ত্রাণকর্তার মুহূর্তে চাপরাশি বনে যাওয়া দেখতে হলো হতবিহ্বল চারু আর মায়াকে।
তাদের দুজনের দিকে তাকালেন ডক্টর। “সরি… কিছু মনে করো না। একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে।”
হতবাক হয়ে ডক্টরের দিকে তাকালো চারু আহসান।
“পিস্তলটা কিন্তু লাইসেন্স করা…” আজফার হুসেন ব্যাখ্যা করলেন। “আমার নামে আর কি।” কথাটা বলে দাঁত বের করে হাসলেন তিনি। “বলতে পারো, ও আমার বডিগার্ড হিসেবেও কাজ করে বাড়ির ভেতরে।”
চারু আর মায়ার বিস্ময় তারপরও কমলো না। তারা দু-জন অবিশ্বাসে চেয়ে আছে।
“গত বছর এ বাড়িতে ডাকাত ঢুকে পড়েছিলো, তখন এই টোটা আমার লাইসেন্স করা পিস্তলটা নিয়ে ডাকাতদের একজনকে ঘায়েল করেছিলো। বাকি দু-জন তখন জান নিয়ে পালায়।” নিঃশব্দে হাসলেন তিনি, যেন কথাটা বেশ মজার। “ছেলেটা খুব কাজের। পারে না এমন কাজ কমই আছে ওর ডিকশনারিতে।”
“আপনি কেন বলছেন উনি মিসকাতের খুনের সাথে জড়িত?” নিরবতা ভাঙলো মায়া। যেন অনেকটা ধাতস্থ হয়েছে সে।
চারু হাফ ছেড়ে বাঁচলো। “উনি খুবই বিপজ্জনক একজন মানুষ। কতোটা বিপজ্জনক সেটা তো একটু আগেই দেখেছেন। একটা আধা সাইজের মানুষের হাতে পিস্তল দিয়ে রেখেছেন, আবার বলছেন, ওনার বডিগার্ড!”
ডক্টর এক ভুরু উঁচু করে আহতদৃষ্টিতে তাকালেন, যেন টোটাকে হেয় করে কথা বলায় তিনি মর্মাহত।
“দয়া করে আপনি খুলে বলবেন কি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘটনা কি!” মায়াকে খুব অসহায় দেখাচ্ছে।
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে চারু বলল, “আমি যেটা জানতে পেরেছি সেটা শুনলে আপনি বুঝবেন এই লোক কতো ভয়ঙ্কর, কতোটা বিকৃতমনা।”
“ওহ!” ডক্টর যেন কষ্ট পেলেন কথাটা শুনে।
“উনি কি করেছেন সেটা আগে বলবেন তো?” অধৈর্য হয়ে উঠলো মায়া।
“মিসকাতের ঐ খুনি, চাঁন মিয়ার সহযোগি কে জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই তর্জনি উঁচিয়ে বলল সে, “আপনার এই ডক্টর!”
আজফার হুসেনের দিকে তাকালো মায়া। ভদ্রলোক চোখ পিটপিট করে তাদের দুজনের দিকে তাকাচ্ছেন। “উনি এসব কী বলছেন, ডক্টর?”
আজফার হুসেন ঠোঁট উল্টে কাঁধ তুললেন কেবল।
“আমি বলছি কি করেছেন।” কথাটা বলেই চারু তার মোবাইল ফোনটা বের করে একটা ভিডিও ফাইল ওপেন করলো। “এটা দেখেন।” ফোনটা বাড়িয়ে দিলো মায়ার দিকে।
একটা ভিডিও ফাইলের ব্লো-আপ ভার্সন। ছোট ছবিকে বড় করার ফলে রেজুলুশন কমে গেছে।
“এটা কি??”
“উনাকে দিন…উনি দেখলেই বুঝতে পারবেন,” ডক্টরকে দেখিয়ে বলল চারু।
ফোনটা ডক্টরের হাতে তুলে দিলো মায়া।
পকেট থেকে রিডিংগ্রাস বের করে নিলেন ডক্টর আজফার, নাকের উপর চাপিয়ে ভালো করে দেখলেন ভিডিওটা। “ওহ…এটা!” শব্দটার অর্থ কি আক্ষেপ, অনুতাপ নাকি সম্মতি, বোঝা গেলো না।
“এটা কি, ডক্টর?” মায়া জিজ্ঞেস করলো আগ্রহভরে।
“একটা স্কুটার মনে হচ্ছে…আমরা যাকে সিএনজি বলি,” স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন তিনি।
চারু রেগেমেগে বলল, “আর কিছু কি আপনার চোখে পড়ছে না? শুধু সিএনজি!”
সোফার ডানহাতার পাশে নিজের প্রিয় ছবিটার দিকে বিব্রত ভঙ্গিতে তাকালেন ডক্টর। “দেখে মনে হচ্ছে আমার এই ছরিটাও আছে।”
“অবশ্যই আছে!” চেঁচিয়ে বলল যুক্তিবাদি। “এরকম বিরল জিনিস এ দেশে দুটো থাকার কথাই না, আপনি নিজেই বলেছিলেন। হাজার বছরের প্রাচীন আমাজনিয়া ট্রি দিয়ে তৈরি, তাই না?”
“কাপোক ট্রি,” শুধরে দিলেন ডক্টর। “আমাজনের সবচাইতে প্রাচীন বৃক্ষ।”
আক্ষেপে মাথা দোলাল চারু। “আপনি আসলে ঠাণ্ডা মাথার খুনি!”
“আ-হা,” ডক্টর আজফার বলে উঠলেন, “পুরো ঘটনা না শুনে যা তা বলা ঠিক হচ্ছে না।”
“দেখি,” মায়া এক ঝটকায় ডক্টরের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিলো ভালো করে তাকিয়ে দেখলো আরেকবার। তারপর অবিশ্বাসে মুখ তুলে তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। এখানে তো দেখছি এক লোক আপনার ছরিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!”
চারুকে হতাশ দেখালো।
থুতনি চুলকে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ডক্টর। হুম… আমারটাই।”
“আরে! সাদা প্যান্ট, সাদা ব্লেজার, সাদা জুতো, আর ছরিটা দেখার পরও বুঝতে পারছেন না?”
চারুর প্রশ্নে মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। ছবিতে এক লোককে দেখা যাচ্ছে ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একটা সিএনজির পাশে। লোকটার ডান কাঁধের কিছুটা অংশ আর পা-টা দেখা যাচ্ছে। তবে ডানহাত ধরে রাখা ছুরিটা একদম স্পষ্ট। ভিডিওটা মাত্র ছয়-সাত সেকেন্ডের। তবে সেটা বার কয়েক কপি করে একটা ফাইল করা হয়েছে। ফলে বার বার দৃশ্যগুলো ভেসে উঠছে মোবাইলফোনের ছয়ইঞ্চির ডিসপ্লেতে।
“যে সিএনজিটা দেখছেন সেটা কার জানেন?”
মায়া যেন কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
“চাঁন মিয়ার!”
“হোয়াট!” বজ্রাহত হলো মেয়েটা।
“অ্যাকসিডেন্টের পর বাইকার বাবুকে চাঁন মিয়াই যে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম,” বলল চারু আহসান, “কিন্তু ঐ সিএনজিতে আপনার এই ডক্টরও ছিলেন!”
মায়া অবিশ্বাসে তাকালো ডক্টরের দিকে। ভদ্রলোক কাঁধ তুলে কী বোঝালেন কে জানে।
“আপনি কি এটা অস্বীকার করতে পারেন?”
চারুর প্রশ্নে স্কুলের বাচ্চাদের মতোই মাথা দোলালেন ডক্টর। তবে তুমি যেটা ভাবছো ঘটনা আসলে–”
“আপনি চুপ করুন!” চেঁচিয়ে উঠলো যুক্তিবাদি। “আপনার কোনো কথাই আমি আর বিশ্বাস করছি না।”
“উনি যা বলছেন তা কি সত্যি?” মায়া ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলো।
বামহাত দিয়ে ডান গালের ট্রিম করা চাপদাড়ি আলতো করে চুলকে নিলেন আজফার হুসেন। ডানহাতে ছরিটা শক্ত করে ধরে মেঝেতে ঠুকলেন দু-বার।
“আমার বিশ্বাস হচ্ছে না,” জোর দিয়ে বলল সাবেক রেডিও-জকি। “এই লোক নিশ্চয় অন্য কোনো ব্যাপার আছে…ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে সে অন্য কেউ।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। “ওটা আমারই ছবি!”
.
অধ্যায় ৪৩
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মায়া।
কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘরে নেমে এসেছে সুকঠিন নিরবতা।
ডক্টর আজফার হুসেন মাথা দোলালেন। “ভিডিওটা মিথ্যে নয়।”
মায়ার বিস্ময় আর বিমূঢ় অবস্থা দেখে চারুর একটু করুণাই হলো। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে, এভাবেই বিশ্বাসিরা প্রতিদান পেয়ে থাকে। তারপরও তাদের শিক্ষা হয় না।
“দেখলেন তো..উনি ঐদিন সিএনজিতে ছিলেন। সব জানেন আপনার এই ডক্টর…মিসকাতের খুনের সহযোগি ইনি!”
চারুর কথায় ডক্টর মাথা দোলালেন, কিন্তু মায়া এমনভাবে চেয়ে রইলো যেন তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। মেয়েটা পুরোপুরি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।
“ও যেটা বলছে সবটা কিন্তু সত্যি নয়,” মায়াকে আশ্বস্ত করে বললেন ডক্টর।
“তাহলে সত্যি কোনটা?” চারু রেগেমেগে জানতে চাইলো।
“বলছি, তুমি আগে শান্ত হও। এটা এমন কোনো ঘটনা নয় যে উত্তেজিত হতে হবে।”
“কি!” চারু বিশ্বাসই করতে পারছে না এতকিছুর পর কেউ এভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলতে পারে। “এটা এমন কোনো ঘটনা নয়!”
মাথা দোলালেন ডক্টর হুসেন। “আশ্চর্য, আমার কথা না শুনে রিঅ্যাক্ট করলে হবে? আমাকে বলতে দাও।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু, মায়ার দিকে তাকালো সে। মেয়েটার চোখ ছল ছল করছে। তার টিয়ার ড্রপ ট্যাটুর পাশে সত্যিকারের অশ্রুজল আছে কিনা নিশ্চিত হতে পারলো না। মেয়েটা ডক্টর আজফারের দিকে চেয়ে আছে একদৃষ্টিতে।
“আচ্ছা…বলুন, কী বলবেন।” চারু যেন অনুমতি দিলো আসামিকে।
গভীর করে দম নিয়ে বলতে শুরু করলেন ডক্টর হুসেন। “ঐদিন আমি আড্ডা দিতে গেছিলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির এক বন্ধুর সাথে…ফুলার রোডে তার কোয়ার্টারে। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আলী আসগর আমার পুরনো বন্ধু। মাসে দুয়েকবার এখনও তার সাথে আড্ডা দেই। তো, ঐদিন আড্ডা দেয়ার জন্যই রওনা দিয়েছিলাম একটা সিএনজিতে করে
“নিজের গাড়ি থাকতে সিএনজিতে কেন?” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো চারু আহসান। তার চোখেমুখে সন্দেহ।
মুচকি হাসলেন আজফার হুসেন। “যাদের গাড়ি আছে তাদের কি গাড়ি নষ্ট হতে পারে না? আর নষ্ট হলে তারা কি ট্যাক্সি কিংবা সিএনজিতে উঠবে না?”
ডক্টরের এমন আমুদে মেজাজ দেখে চারুর গা জ্বলে গেলো, কিন্তু কিছু বলল না। সে পুরো ঘটনাটা শুনতে চায় আগে।
“আমার গাড়িটা তখন মেকানিকের কাছে ছিলো…ইঞ্জিনের কী একটা সমস্যা হয়েছিলো যেন। তুমি চাইলে পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে পারো আমি যা বলছি তা সত্যি কিনা।” হাতের ছরিটা সোফার পাশে রেখে দিলেন তিনি। “যেটা বলছিলাম, সিএনজি নিয়ে রওনা দেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো সেদিন, শাহবাগের কাছে আসতেই বৃষ্টির তোড় বেড়ে গেলো। আমার সিএনজিটা যখন ফুলার রোডের ভাস্কর্য চত্বরের কাছে তখনই দেখলাম একটা মোটরবাইক উল্টে পড়ে আছে, কিছু দূরে পড়ে আছে এক ছেলে। পুরোপুরি অচেতন ছিলো সে। মাথায় হেলমেট পরা, পেছনে একটা ব্যাকপ্যাক। তখনও বাইকের চাকাদুটো ঘুরছিলো…তার মানে কয়েক সেকেন্ড আগে অ্যাকসিডেন্টটা হয়েছে। বৃষ্টির তোড় খুব বেশি ছিলো বলে মানুষজনও কম ছিলো। ঐ জায়গাটা এমনিতেও একটু নিরিবিলি থাকে…আশেপাশে মানুষজন তেমন একটা ছিলো না।” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “আমি আমার সিএনজিওয়ালাকে বললাম। ড্রাইভার সিএনজি থেকে নেমে ছেলেটাকে দেখে জানালো বেঁচে আছে। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটাকে সিএনজিতে তুলে নিতে বললাম। আহত ছেলেটাকে নিয়ে গেলাম মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে। সিএনজিওয়ালা খুব সাহায্য করলো, ছেলেটার হেলমেট আর ব্যাকপ্যাক খুলে গাড়িতে রেখে তাকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলো ওখানে উপস্থিত কিছু লোকের সাহায্যে।
“আর বাবুর বাসায় ফোন করেছিলো কে? আপনি?” ভুরু কুচকে জানতে চাইলো চারু।
মাথা দোলালেন ডক্টর। “না। ইমার্জেন্সি থেকে সিএনজিওয়ালা ফিরে এলো ছেলেটার জুতো আর মোবাইলফোনটা নিয়ে। তখন আমি তাকে বললাম, ছেলেটার বাড়িতে ফোন করে ঘটনাটা ওর পরিবারকে জানানো দরকার।”
মায়াকে দেখে মনে হলো এতক্ষণে সে হতবিহ্বল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে।
“তারপর চাঁনমিয়া বাবুর বাসায় ফোন দিলো?”
চারুর প্রশ্নে মুচকি হাসলেন ডক্টর। “ওটা চাঁনমিয়া ছিলো কিনা তা তো জানি না। তবে ড্রাইভার ফোন ঘেঁটে ছেলেটার মায়ের নাম্বার বের করে কল করেছিলো।”
চারু বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। বেশিরভাগ মানুষই তার মায়ের নাম্বার সেভ করে ‘আম্মু নয়তো ‘মা’ হিসেবে। যে মায়ের সাথে চারুর এত দূরত্ব তার নাম্বারটাও তার ফোনে সেভ করা আছে মা হিসেবেই। সুতরাং ফোনবুক থেকে বাবুর মায়ের নাম্বার খুঁজে বের করতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।
“তারপর কি হলো?” অনেকক্ষণ পর কথা বলল মায়া।
“ছেলেটার মাকে ফোন করার পর পরই ইমার্জেন্সিতে একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে ঢুকলো। সেই সাথে কিছু মোটরবাইক আর একটা কিছু প্রাইভেট কার। এক ছাত্রনেতা নাকি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। মুমূর্ষ অবস্থা। একেবারে হৈচৈ পড়ে গেলো। আমি সিএনজির ভেতর থেকে বের হয়ে গেলাম। জানোই তো, থেমে থাকা সিএনজির ভেতরে বেশিক্ষণ বসে থাকলে কেমন লাগে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মায়া।
“ওরকম ক্লোজড জায়গায় বসে থেকে আমার সাফোকেশন হচ্ছিলো। তাই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ভিডিওটা তখনই করা হয়েছে। কিন্তু আমার কোনো ধারণাই ছিলো না…আমি তো পেছন ফিরে ছিলাম।”
কিছু বলতে পারলো না চারু। ডক্টরের কথা অযৌক্তিক কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
“ওদিকে দারোয়ান সে এসে আমাদের সিএনজিটাকে বাইরে নিয়ে যাবার জন্য তাগাদা দিলো। ইমার্জেন্সির সামনের প্রাঙ্গণটায় তখন ভিড় লেগে গেছে। প্রচুর মানুষ আর গাড়ি। তাই সিএনজিটা নিয়ে বাইরে চলে গেলাম। বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর সিএনজিওয়ালা এসে আমাকে জানালো, এখানে থেকে আর কোনো লাভ নেই। আমাদের যা করার করেছি, ছেলেটার পরিবার চলে আসবে এক্ষুণি। আমিও বুঝতে পারলাম ড্রাইভার ঠিকই বলেছে।”
“বাবুর ব্যাকপ্যাক আর মোবাইলফোনটা?”
চারুর কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ডক্টর। “ততোক্ষণে ওটার কথা আমার মনেই ছিলো না। বেমালুম ভুলে গেছিলাম।”
“তারপর কি হলো বলেন?” তাগাদা দিলো যুক্তিবাদি।
“তারপর আর কি, ফুলার রোডে নামিয়ে দিলো ড্রাইভার। আমি তাকে খুশি হয়ে বেশ ভালো একটা বখশিস দিয়েছিলাম ওকে। এই তো…আর কিছু মনে নেই।”
“তার মানে আপনি মিসকাতের খুনের ব্যাপারে কিছু জানতেন না?” সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো চারু আহসান।
“মিসকাতের খুনের ঘটনাটা পত্রপত্রিকায় আসেনি, সুতরাং আমার পক্ষে সেটা জানা সম্ভব ছিলো না তখন। তবে…”
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো চারু আর মায়া।
“ঘটনার বেশ পরে, সম্ভবত তিন-চার মাস পরে হবে, ঢাকা ক্লাবে আড্ডা দিতে গিয়ে আমি ওটা প্রথম জানতে পারি। আমার এক ব্রিজ পার্টনার গল্প করছিলো এই ঘটনাটা নিয়ে। মিসকাতের মায়ের সাথে ওর আবার বেশ ভালো সম্পর্ক। ওদের কেমনজানি পারিবারিক বন্ধু হয়।”
“আপনি তখন রিলেট করতে পারলেন দুটো ঘটনার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে?” মায়া বলল।
মাথা নেড়ে সায় দিলেন আজফার হুসেন। “মিসকাতের অদ্ভুত খুনের ঘটনাটা শোনার পর আমার মনে প্রশ্ন জাগলো, ঐদিন আমি আর সিএনজিওয়ালা যে ছেলেটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম সে-ই কি তবে বাবু। ঘটনা আরেকটু জানতেই আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, ওটা বাবুই ছিলো। আমরাই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলাম।”
“আপনি এটা পুলিশকে বলেননি কেন?” জানতে চাইলো চারু।
“পুলিশকে কি বলবো? আমি যেটা অনুমাণ করছি, সে-ব্যাপারে তো নিশ্চিত নই। সিএনজি ড্রাইভারের চেহারাটাও ততোদিনে ভুলে গেছি। শুধু আবছা আবছা মনে আছে। ভুলে যাবে না, আমার বয়স সত্তুরের উপরে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল চারু আহসান।
“এ কারণেই কি আপনি এই কেসটার ব্যাপারে আগ্রহি হয়ে উঠেছিলেন?” জানতে চাইলো মায়া।
প্রসন্ন হাসি দিলেন ডক্টর আজফার। “একজন কৌতূহলি মানুষের জন্য কি সেটাই স্বাভাবিক নয়?”
সায় দিলো মেয়েটি।
“এই ঘটনার সাথে যদি আমি কোনোভাবে জড়িতও না থাকতাম, তারপরও এটা নিয়ে আগ্রহি হতাম। এরকম ঘটনা তো হররোজ ঘটে না।”
“আপনি এটা আমাদের কাছ থেকে গোপন রাখলেন কেন?” চারুর কথার মধ্যে রাগক্ষোভ থাকলেও সেটা অনুযোগের মতোই শোনালো।
মাথা দোলালেন ডক্টর। “এটা না বলার জন্য অনেকগুলো কারণ আছে।”
“কি কারণ?” যুক্তিবাদি জানতে চাইলো।
“প্রথমত, এটা বললে তোমরা ভাবতে আমি এই ঘটনার সাথে জড়িত…এখানে আমার স্বার্থ আছে। দ্বিতীয়ত, সিএনজি ড্রাইভারের ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়। মিসকাতের খুনের সাথে এই লোক আদৌ জড়িত কিনা তাতে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিলো। তৃতীয়ত, তোমাদের তদন্তটা কিভাবে এগোবে, কোন দিক থেকে এগোবে সেটা ঠিক করে দিতে চাইনি। আমি চেয়েছি, কাজটা তোমরা তোমাদের মতো করেই করবে। কোনো কিছু যেন তোমাদের তদন্তকে প্রভাবিত না করে।”
মায়াকে দেখে মনে হলো সে সন্তুষ্ট, কিন্তু চারুর বেলায় এ কথা জোর দিয়ে বলা গেলো না। অবশ্য এ নিয়ে আর কোনো কথাও বলল না সে।
এমন সময় ঘরে ঢুকলো টোটা। এবার কফির ট্রে নিয়ে।
চারু বুঝতে পারলো বামনটা এই ঘরের সবকিছু মনিটর করে, সেজন্যেই দরকারের মুহূর্তে কোনো রকম ডাক ছাড়াই চলে আসে। অনেকক্ষণ আগেই ডক্টর তাকে কফি দিতে বললেও সচরাচর যতোটুকু সময় নেয় তার চেয়ে বেশি সময় নিয়েছে আজ। এর কারণ, সম্ভবত ডক্টরের গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ে বিরক্ত করতে চায়নি।
“আপনার উচিত উনাকে সরি বলা,” টোটা চলে যাবার পর নিজের মগটা হাতে নিয়ে বলল মায়া।
হতাশ হয়ে তাকালো চারু আহসান। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ডক্টর বলে উঠলেন, “আরে না…ও কেন সরি বলবে? এটা একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝি। আমারই ভুল হয়েছে। তোমরা যখন সিএনজি ড্রাইভারের বিষয়টা জেনে গেছিলে তখনই সবটা খুলে বলার দরকার ছিলো কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, তদন্তটা পুরোপুরি শেষ হলেই বলবো।”
“হুমম…বুঝতে পেরেছি,” বলল মায়া।
“কি ভাবছো?” চারুকে চুপ থাকতে দেখে বললেন ডক্টর আজফার।
ডক্টরের দিকে স্থিরচোখে চেয়ে রইলো চারু। এই ঘটনাটা জানার পর সে ভেবেছিলো চাঁন মিয়ার সকল অপকর্মের সহযোগি এই ডক্টর লোকটাই হবে। কিন্তু এখন তার সব হিসেবে আবার ওলট পালট হয়ে গেছে। “না, ভাবছি, আপনার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে চাঁন মিয়ার সহযোগি কে ছিলো!”
হা-হা করে হেসে ফেললেন ডক্টর। “আমি যে নই সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি তোমাকে। তবে তুমি আমার বলা কথাগুলো খতিয়ে দেখতে পারো। আশা করি হতাশ হবে না।” একটু থেমে আবার বললেন তিনি, “ভালো কথা…এই ছবি তুমি কোথায় পেলে?”
মায়াও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো, সে-ও জানতে চায় এটা।
চারু গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো কিভাবে ভিডিওটা খুঁজে পেলো।
.
মেডিকেলের ইমার্জেন্সি থেকে চারু একটা ব্যাপার জানতে পেরেছিলো। বাইকার বাবু হাসপাতালে আসার পর পর সরকারদলিয় এক ছাত্রনেতাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে আনা হয়েছিলো। অ্যাম্বুলেন্সটা ঢোকার সাথে সাথে ওয়ার্ল্ড নিউজ আর সীমানা টিভি’র রিপোর্টার-ক্যামেরাম্যানও ছুটে আসে। তারা সবার আগে ঘটনাটা রিপোর্ট করেছিলো।
চারু গতকাল আরেকটা বিষয় দেখেছে মেডিকেলের ইমার্জেন্সির সামনে। অন্য একটি টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার পার্ক করা গাড়িগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে রিপোর্টিং করছিলো। তখনই এটা তার মাথায় আসে। যদি ঐ দিন ছাত্রনেতার নিতহ হবার রিপোর্টটি দুটো চ্যানেলের কোনো একজন এভাবেই পার্ক করা গাড়িগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে করে থাকে তাহলে বাইকার বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলো যে সিএনজিটা তার ছবি পাওয়া যাবার ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকবে।
অনুসন্ধানি কাজের অভিজ্ঞতা থেকে চারু জানে সব ধরণের সম্ভাবনাই বাজিয়ে দেখতে হয়। ক্ষীণ সম্ভাবনাও হয়ে উঠতে পারে অমূল্য কিছু। সেজন্যে মেডিকেল কলেজ থেকেই ফোন করে ওয়ার্ল্ড নিউজ চ্যানেল আর সীমানা টিভিতে যোগাযোগ করে সে। ওই দুটো প্রতিষ্ঠানের যে দু-জন সাংবাদিক রিপোর্টটা করেছিলো তারা তাকে জানায়, প্রায় বছরখানেক আগের ঘটনা, তাদের আর্কাইভে ঐ রিপোটিংয়ের ফুটেজ আছে কিনা নিশ্চিত নয়। এসব ফুটেজ খুঁজে পেতে বেশ দেরি হবে। তবে ওয়ার্ল্ড নিউজের সাংবাদিক চারুকে বলে, সে চাইলে কাজটা খুব সহজেই করতে পারে। তাদের সব রিপোর্টিং আর প্রোগ্রামগুলোর ভিডিও ইউটিউবে পাওয়া যায়। নির্দিষ্ট নাম দিয়ে সার্চ দিলে পেয়ে যাবে ওখানে।
কথাটা শুনে আশাবাদি হয়ে ওঠে সে। ওয়ার্ল্ড নিউজের রিপোর্টার চারুকে বলে দিয়েছিলো কি লিখে সার্চ দিলে ঐ রিপোর্টটা সহজে পেয়ে যাবে। বাসায় এসে ইউটিউব থেকে খুঁজে বের করে ওয়ার্ল্ড নিউজের প্রায় এক বছর আগেকার সেই টিভি-রিপোর্টিংটি। মাত্র দেড় মিনিটের ভিডিওটা দেখেই নড়েচড়ে বসে সে।
যেমনটা ধারণা করেছিলো, ওয়ার্ল্ড নিউজের রিপোর্টার ইমার্জেন্সির সামনে পার্ক করা গাড়িগুলোকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে রিপোর্ট করেছে। আর বিস্ময়কর ঘটনা হলো রিপোর্টারের পেছনে অনেকগুলো গাড়ির মধ্য একটা সিএনজিও দেখতে পায়।
ক্যামেরার ফ্রেমের এককোণে ঐ সিএনজিটার পেছনের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিলো। তাতে সিএনজিটার লাইসেন্স নাম্বার ধরা পড়লেও গাড়িটা ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোক তার মনোযোগ বেশি আকর্ষণ করে। সাদা প্যান্ট আর সাদা ব্লেজার পরা ডানহাতে নক্সাখচিত একটি ছরি!
দেখে মনে হয় সিএনজির প্যাসেঞ্জার। ক্যামেরার দিকে পেছন ফিরে থাকা লোকটার মুখ না দেখা গেলেও চারুর মনে কোনো সন্দেহই রইলো না সে কাকে দেখছে।
ডক্টর আজফার হুসেন।
ডক্টরের সার্বক্ষণিক সঙ্গি এই ছরিটা এরইমধ্যে তার কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠেছে। যখনই ভদ্রলোকের সাথে দেখা করতে যায় তখনই এটা চোখে পড়ে। তাছাড়া আমাজনের এটা বিরল একটি গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এর পেছনের গল্পটাও ডক্টর তাকে বলেছিলেন।
এই আবিষ্কার চারুকে রীতিমতো হতবাক করে রেখেছিলো কয়েক মুহূর্ত। বিমূঢ় আর বিস্মত চারুর মনে হচ্ছিলো তার মাথাটা বুঝি ভো ভো করে ঘুরছে।
ডক্টর আজফার হুসেন ঐদিন চাঁন মিয়ার সাথে ছিলেন!
.
অধ্যায় ৪৪
ডক্টরের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর সারাটা রাত ভেবে গেছে চারু।
সবটা শোনার পর ডক্টর আজফারের ব্যাপারে তার মনে আর কোনো সন্দেহ নেই এখন। চারু বুঝতে পারছে, ঐদিন সিএনজিতে যাত্রি হিসেবে ছিলেন বলেই পরবর্তিকালে মিসকাতের হত্যারহস্য নিয়ে ডক্টর আগ্রহি হয়ে ওঠেন।
তার কাছে এখন যে সিএনজিটা বাইকার বাবুকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলো সেটার নাম্বার আছে। ভিডিও থেকে অনেক কষ্ট করে নাম্বারটা বের করতে পেরেছে। তারচয়েও বড় কথা চাঁন মিয়ার সিএনজি নাম্বারটার সাথে এই নাম্বারটা মিলে গেছে।
এখন শক্ত একটি প্রমাণ আছে তার কাছে।
কুড়িল বস্তির ইনফর্মার ট্যাপাকে আগেই বলে দিয়েছিলো নাম্বারটা জোগাড় করার জন্য। লোকটা ব্যর্থ হয়নি। একটু আগে তাকে ফোন করে নাম্বারটা দিয়েছে সে। পাঁচশ’ টাকার একটি নোট পাওনা রইলো তার জন্য।
চারু ঐ ইফর্মারকে বলে দিয়েছে আগামিকাল সকালে কুড়িল বস্তিতে তা সথে দেখা করবে। জরুরি আরেকটি কাজ আছে।
কথামতো পরদিন সকালে বস্তির সামনে গিয়ে দেখা গেলো ট্যাপা তার জন্য অপেক্ষা করছে।
“ছার, বিশ্বাস করেন আমি নিজের চক্ষে দেখছি,” চারুকে পেয়েই বলল সে, “সুরুজ বাঁইচ্যা আছে। ও মরে নাই।”
“হুম,” বলল যুক্তিবাদি। “বিশ্বাস করি তোমার কথা।”
ট্যাপা খুবই খুশি হলো।
“তুমি যেটা দেখেছো সেটা জ্যান্ত মানুষ। অন্য কিছু না।”
ট্যাপা বোঝার চেষ্টা করলো চারুর কথাটা।
“এজন্যেই সুরুজের কবরটা দেখতে হবে।”
“ওর কব্বর তো ওইহানে…” আঙুল তুলে বস্তির অপর পাশে একটা জায়গা দেখালো ইনফর্মার। “র্যাললাইনের পরে।”
চাঁন মিয়ার সিএনজির লাইসেন্স নাম্বারটা জোগাড় করে দেয়ার জন্য পাঁচশ’ টাকার বখশিস দেবার পর ট্যাপাকে জিজ্ঞস করলো চারু, “আচ্ছা, সুরুজের লাশ কি তুমি দেখেছিলে?”
“হ…নিজের চক্ষে দেখছি,” টাকা পেয়ে খুশি ইনফর্মার জোর দিয়ে বলল। “আমি ক্যান…বস্তির আরো অনেকেই দেখছে।”
“কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে ওটা সুরুজের লাশ?” ধন্দে পড়ে গেলো ট্যাপা। “মাইনে?”
“লাশটার তো মাথাই ছিলো না। তুমি নিজে আমাকে বলেছে এ কথা।”
মাথা নেড়ে সায় দিলে ইনফর্মার। “হ…মাথা তো আছিলো না।”
“তাহলে কিভাবে বুঝলে ওটা সুরুজ?”
“ওর বাপে কইছে….বস্তির বেবাকতে কইছে।”
মুচকি হাসলো চারু আহসান। “আর পা? ছেলেটা তো পঙ্গু ছিলো। তুমি কি ওর পা দেখেছিলে?”
“না। লাশ তো ঢাইক্যা রাখছিলো চাদ্দর দিয়া…পা দেখুম কেমনে?”
মাথা দুলিয়ে বলল চারু, “এটাই ঘটেছে। কেউ কিছু দেখেনি, কিন্তু সবাই জানে সুরুজ আত্মহত্যা করেছে। ওর লাশটাও দেখেছে…মাথাবিহীন লাশ।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ট্যাপা। “আপনের কথায় যুক্তি আছে, ছার।”
“সুরুজ আত্মহত্যা করার পর কি থানা থেকে পুলিশ এসেছিলো?”
“হ…আইছিলো তো,” উৎসাহি হয়ে বলল ইনফর্মার। “আমি নিজে গিয়া এসআই কাউছাররে খবর দিছিলাম।”
“এসআই কাউসার কে?”
“এই বস্তির দায়িত্ব হের..বস্তির সব খবর হের কাছে রিপুট করন লাগে।”
বুঝতে পারলো চারু। প্রতিটি বস্তিই অপরাধ আর মাদকের আখড়া। সেজন্যে বস্তির জন্য আলাদা নজরদারি করার ব্যবস্থা করে থানাগুলো। “ঐ এসআই এসে কি করলো?”
“হে যহন আইছে তহন তো লাশের গোসল হইয়া গেছে…জানাযা পড়ার জন্য রেডি করতাছিলো।”
“এসআই তাহলে কি করলো?”
“এসআই কইলো এই ঘটনা রিপুট করনের দরকার আছিলো। বস্তির লোকজন কইলো, ছার যা হওনের হইছে, এইসব রিপুট কইরা কী লাভ। এসআই তহন ওয়াকিটকি দিয়া ওসির লগে বাতচিত করলো, তারপর কইলো, ঠিক আছে, দান করো। কুনো সমস্যা নাই।”
“তারপর ওই গোরস্তানে কবর দিয়ে দিলো সুরুজকে?”
“হ, ছার।”
“ঠিক আছে, চলো…সুরুজের কবরটা একটু দেখে আসি। মরা মানুষ কিভাবে ঘুরে বেড়ায় সেই রহস্য বের করতে হবে।”
.
কুড়িল বস্তির লোকজন মারা গেলে সবাই রেললাইনের ওপাড়ে, একটু ভেতরের দিকে ছোট্ট একটা কবরস্তানে দাফন দেয়। চার-পাঁচ বছর আগে বস্তির লোকজন স্থানিয় এমপির কাছ থেকে জায়গাটা বরাদ্দ নিয়েছিলো লাশ সকারের জন্য। তারা নির্বাচনের আগেই এমপি পদপ্রার্থিদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলো, নির্বাচনে জয়লাভ করলে যেন কবরস্তানের জন্য তাদেরকে এক টুকরো জায়গার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়।
বস্তির বিশাল সংখ্যক ভোট পাবার আশায় প্রায় সব প্রার্থিই এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো।
এখন ট্যাপা নামের ইনফর্মার চারুকে সেই কবরস্তানে নিয়ে যাচ্ছে।
“এক এমপির ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলো সুরুজ…এটা কি তুমি জানতে?”
“জানুম না ক্যান, ছার। আমি এই বস্তির সব খবর রাখি,” বলল ইনফর্মার। “চাঁন মিয়ারে তো ওসিসাব খুব প্রেসার দিছিলো মামলা তুইল্যা নিবার জন্য, কিন্তু সুরুজ রাজি হয় নাই।”
“ছেলেটার সাহস ছিলো তবে,” বলল চারু। তারা এখন রেললাইন পার হয়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে হাটছে।
“হ, সাহস আছিলো সুরুজের। ওসিসাব কইছিলো মামলা কইরা লাভ হইবো না, কেসটা তুইল্যা নে। এমপিসাহেব তার পা ঠিক করনের লাইগ্যা যা লাগে দিবো। কিন্তু সুরুজ রাজি হইলো না
হাঁটতে হাঁটতে তারা কবরস্তানে চলে এলো।
কুড়িল বস্তির দক্ষিণ-পুব দিকের রেললাইনের ওপাড়ে একটা নিচু জমিতে মাটি ফেলে কবরস্তানটি করা হয়েছে। যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে আছে তাই নিশ্চিত করেই বলা যায় লাশ দাফনের রেকর্ড থাকবে।
কবরস্তানের ভেতরে দুটো টিনশেডের ঘর। ঘরদুটোর সামনে বিরাট বারান্দা। পাশে লাশ গোসল দেবার জন্য উন্মুক্ত কংক্রিট বিছানো চত্বর। সেটার পাশে আছে কিছু মুরদা বহন করার খাটোলা। কবরস্তানটির আয়তন খুব বেশি না। তবে বেশিরভাগই কবরে ভরে উঠেছে। খালি জায়গা খুব কমই চোখে পড়লো চারুর। লুঙ্গি পরা ত্রিশ-বত্রিশ বছরের খালি গায়ের এক যুবককে দেখা গেলো সামনের একটা কবরের দিকে ঝুঁকে কী যেন দেখছে।
“ওই ছেলেটাকে ডাকো,” ট্যাপাকে বলল চারু।
“এই, এইদিকে আয়।”
খালি গায়ের যুবক এগিয়ে এলে তাদের দিকে।
“আপনাদের কেয়ারটেকার কোথায়?” চারু জিজ্ঞেস করলো।
“হে তো কাইল সকালে দ্যাশের বাড়িতে চইল্যা গেছে…একটা ঝামেলা হইছে। কি দরকার, আমারে কন?”
“আমি একটা কবরের রেকর্ড খুঁজতে এসেছি…তাকে একটু দরকার ছিলো।”
“ও,” যুবক বলল। “তাইলে পরশু আসেন…উনি আইস্যা পড়বেন।”
একটা দিনের দেরিও সহ্য হচ্ছে না চারুর। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছে।
ইনফর্মার তাকালো চারুর দিকে। “ওরেই কন না কব্বরের কথাটা।”
“কার কব্বর, আমারে কইতে পারেন, গোরখোদক বলল। “সব কব্বরের দেখশোন আমিই করি। এইহানে বেশি মানুষ কাম করে না, সব
কাম আমারেই করতে অয়।”
“আমি আসলে একটা কবর দেখতে চাচ্ছিলাম। ছেলেটার নাম সুরুজ।”
“নাম যহন জানেন, ঐদিকে গিয়া নিজেই খুঁইজ্যা দেখেন,” কবরস্তানের ডানদিকটা দেখিয়ে বলল গোরখোদক। “সব কব্বরেরই নাম লেখা আছে।” কথাটা বলেই সে চলে গেলো টিনশেডের ঘরের ভেতরে
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে কবরস্তানটা ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিলো চারু। দুই ভাগে বিভক্ত এই গোরস্তান। মাঝখান দিয়ে পাঁচ-ছয় ফুট চওড়া ইটবিছানো কাঁচা রাস্তা চলে গেছে। বামদিকেরগুলো মহিলাদের কবর দেবার স্থান, ডানদিকটা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ।
ট্যাপাকে নিয়ে চারু পা বাড়ালো গোরস্তানের ডান অংশের দিকে। তার মনে পড়ে গেলো কলেজে থাকতে এক বন্ধুর সাথে বাজি ধরে অমাবস্যার রাতে প্রত্যন্ত এক গ্রামের কুখ্যাত গোরস্তানের ভেতর দিয়ে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছিলো সে।
গুণে দেখলো ডানদিকে প্রায় আটটি সারি রয়েছে। প্রতিটি সারিতে অনেকগুলো কবর। একে একে কবরগুলো দেখতে শুরু করলো সে। ভাগ্য ভালো থাকলে অল্প কিছু দেখার পরই পেয়ে যেতে পারে।
অযত্নে আর অবহেলার শিকার কবরগুলো। এখানে যাদের গোর দেয়া হয় তারা সবাই বস্তির বাসিন্দা। একটাও পাকা কবর চোখে পড়লো না। হাতেগোনা কিছু কবর বুক সমান উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা।
কবরের মাথার দিকে দশ-বাই-ছয় ইঞ্চির ছোট ছোট কালো রঙের টিনের উপর সাদা রঙে নাম, বাবার নাম আর মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা আছে।
প্রায় বিশ মিনিট ধরে খোঁজার পর অবশেষে সুরুজের কবরটা খুঁজে পেলো চারু। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।
টিনশেডের ঘরের দিকে তাকালো। এখন ঐ গোড়খোদককে ম্যানেজ করতে হবে। আর কাজটা ট্যাপার চেয়ে ভালোভাবে কেউ করতে পারবে না।
.
অধ্যায় ৪৫
মায়া কিছুই বুঝতে পারছে না, চারু কেন সকাল সকাল তাকে রেডি থাকতে বলল?
কারণ জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলেনি। শুধু বলেছে, সকালে তার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। জায়গাটা কোথায় সেটা পর্যন্ত বলেনি। ছেলেটার এমন আচরণে সে বিরক্ত। কিন্তু তারা হ্যালোউইন পার্টির ঐ হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করছে, অনেকটা অগ্রগতিও হয়েছে সেই তদন্তে, আর এর পুরো কৃতিত্ব বলতে গেলে চারু আহসানেরই।
মানুষজনকে খুব বেশি চাপাচাপি করতে পারে না মায়া। তাই গত রাতে চারু যখন কোনো কিছু বলতে চাইলো না তখন ইচ্ছে করলে সে বলে দিতে পারতো, সবটা খুলে না বললে কোথাও যাবে না, কিন্তু সে তা করেনি। মিসকাতের কেসটার ব্যাপারে তর নিজেরও আগ্রহ আছে।
এখন বেলকনিতে বসে সকালের চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবছে, কোথায় নিয়ে যেতে পারে তাকে। কিন্তু অনেক ভেবেও সামান্য আন্দাজও করতে পারলো না।
মায়া ভেবে অবাক হচ্ছে, বহুদিন পর তার সেই অনুভূতিটি আবার জেগে উঠেছে। অশরীরি কিছুর উপস্থিতিতে তার এমনটা হয়। গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। স্পষ্ট বুঝতে পারে অশরীরি কেউ আছে আশেপাশে। এটা প্রথম টের পেয়েছিলো মাত্র বারো বছর বয়সে। যখন…
নিচের রাস্তা থেকে মোটরসাইকেলের হর্নের শব্দে তার ভাবনায় ছেদ পড়লো। তাকিয়ে দেখলো চারু আহসান তার বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বেলকনির দিকে।
.
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
কথাটা বেশ জোরে বলল মায়া। চারুর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে আছে সে, তার মাথায়ও একটা হেলমেট। তাদের বাইকটা কুড়িল বস্তির দিকে ছুটে যাচ্ছে দেখে কৌতূহল আর দমাতে পারলো না।
“আপনার সমস্যা কি? কোথায় যাচ্ছি সেটা বলছেন না কেন? আজব!”
“ভয়ের কিছু নেই, সামনের দিকে তাকিয়েই বলল চারু আহসান। “নিশ্চিত থাকতে পারেন, ঐ বস্তিতে যাচ্ছি না।”
“আশ্চর্য, তাহলে কোথায় যাচ্ছি?”
“গেলেই বুঝতে পারবেন।”
“উফ! বিরক্তিকর।” সত্যি সত্যি সাবেক রেডিও-জকি বিরক্ত হয়ে উঠেছে চারুর এমন আচরণে। বাকি পথটুকু আর কিছু বলল না সে।
কিছুক্ষণ পর মেইনরোড থেকে তাদের বাইক কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলো। গোরস্তানের প্রবেশমুখের সামনে বাইকটা থামিয়ে দিলে নেমে পড়লো মায়া। সঙ্গে সঙ্গে হেলমেটটা খুলে ফেলল সে।
“উফ! এই জিনিস এতক্ষণ পরে থাকে কিভাবে মানুষ!” চারুর হাতে হেলমেটটা দিয়ে দিলো। নিজেরটাসহ হেলমেটদুটো লক করে রাখলো বাইরে পেছনে।
“আসুন।”
“কোথায়?” অবাক হলো মায়া।
“কোথায় মানে? আমরা কি সাফারি পার্কে বেড়াতে এসেছি? দেখতে পাচ্ছেন না, এটা একটা কবরস্তান।”
“আহা, সেটা তো বুঝতে পারছি কিন্তু…”
“কিন্তু কি?”
“আমি কেন এখানে ঢুকবো?”
এবার চারু অবাক হলো। “একটা জিনিস দেখাবো আপনাকে। চলুন।”
“আগে বলুন, কি দেখাবেন,” অনড় ভঙ্গিতে বলল মায়া।
“এতদূর এসে আপনি দেখি গোয়ার্তুমি শুরু করছেন!”
“আমি না, আপনি গোয়ার্তুমি করছেন। এখানে কি দেখাতে নিয়ে এসেছেন সেটা বলতে আপনার সমস্যা কি?”
চারু কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। “ওকে,” হাত তুলে আশ্বস্ত করলো এবার। “সুরুজের কবর…ওটা দেখাতে নিয়ে এসেছি।”
ভুরু কুচকে তাকালো মায়া। “সুরুজের কবর? এখানে সুরুজের কবর আছে?”
“হুম।”
“আপনি ওটা খুঁজে বের করেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে ওটা দেখার কি আছে?”
“আমি নিজেও জানি না আসলে যেটা ভাবছি সেটা দেখতে পাবো কিনা। তবে আমার লজিক বলছে, চমকে যাওয়ার মতো কিছু দেখতে পাবো।”
মায়ার কপালের ভাঁজ আরো ঘন হলো। “চমকে যাওয়ার মতো?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু আহসান।
“কিন্তু আমি তো ভেতরে গিয়ে আপনার সেই চমক দেখতে পারবো না।”
দারুণ বিস্মিত হলো চারু। “কেন?”
“আপনাকে এটা বোঝানো যাবে না,” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মায়া। “সমস্যাটা কি সেটা বলেন?”
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মায়া বলল, “কারণ কবরস্তানে গেলে আমার ভীষণ বাজে অনুভূতি হয়।”
এবার কিছুক্ষণের জন্যে চুপ মেরে গেলো চারু। শৈশবে বাবা মারা যাবার পর সবার সাথে কবরস্তানে যাবার স্মৃতিটা এখনও তার মনে জ্বল জ্বল করে। ছোট্ট চারু বাবার নতুন কবরটার সামনে যেতেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলো। এরপর আর কখনও সে বাবার কবর দেখতে যায়নি। সত্যি বলতে, র্যাশনালিস্ট সোসাইটির কর্মকাণ্ড শুরু করার আগপর্যন্ত কবরস্তানে যায়নি। কিছু ভণ্ডের মুখোশ খুলে দেবার জন্য, কিছু রহস্যের ব্যবচ্ছেদ করতে মাঝেমধ্যে গোরস্তানে যেতে হয় তাকে।
“কি হলো, চুপ মেরে আছেন যে?”
মায়ার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো সে। “না। কিছু না।” একটু থেমে আবার বলল, “তাহলে এখন কি করবো?”
“আমি কী করে বলবো। আপনি যে কী দেখাতে নিয়ে এসেছেন সেটাই তো জানি না।”
“আমি আসলে…” চারুকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখালো।
“আমাকে এখানে নিয়ে আসার আগেই যদি বলতেন তাহলে আর এতদূর কষ্ট করে আসতে হতো না।”
“কিন্তু এটা তো আমাদের দুজনকেই দেখতে হবে, শুধু আমি দেখলে হবে না।”
“কেন হবে না?”
“কারণ আপনি তখন বলবেন…মানে, এটা আমার নিজের মনগড়া কিছু।”
মায়া হতাশ হলো কথাটা শুনে। “আমি কেন এটা বলতে যাবো? আপনি দেখি আমাকে একটুও বিশ্বাস করেন না।”
“আহা, আমি কি সেটা বলেছি নাকি।” চারুকে অসহায় দেখালো।
“তাহলে এসব বলছেন কেন? আর আমাকে কিছু না বলে এখানে নিয়েই বা এসেছেন কেন?”
নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে চারু। তার উচিত ছিলো কথাটা আগেই বলে দেয়া। কিন্তু বিষয়টা এমনই বলতেও সঙ্কোচ হচ্ছিলো, তাই চেয়েছিলো সরাসরি এখানে নিয়ে এসে দেখিয়ে দিতে।
“সরি। আমার ভুল হয়ে গেছে, আস্তে করে বলল সে।
“স্টুপিড,” বিড়বিড় করে বলল মায়া, ঠিক যেমন করে স্কুলের দুষ্টু বাচ্চাকে বকুনি দেয়া হয়।
চারুর চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেলো কথাটা শুনে।
“শুনুন, কি দেখাতে নিয়ে এসেছেন সেটা এখন বলুন। গোরস্তানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না।”
গভীর করে শ্বাস নিলো চারু আহসান। “আমি চাঁন মিয়ার ছেলে সুরুজের কবরটা দেখতে চাচ্ছি।”
অবাক হলো মায়া। “আপনি না একটু আগে বললেন, ওই ছেলের কবরটা খুঁজে পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ, সেটা তো পেয়েছি।”
“তাহলে এখন আবার কী দেখবেন?”
“ইয়ে মানে, কবরটার ভেতরে কি আছে দেখতে চাচ্ছি।”
“কি!” বিস্মিত হলো মায়া, পরক্ষণেই বুঝতে পারলো। “আপনি কবরটা খুঁড়ে দেখতে চাইছেন!?”
বিব্রত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু।
“মাই গড! আপনি তো ভয়ঙ্কর লোক।”
“আশ্চর্য, এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। ওটা না খুঁড়ে কিভাবে বুঝবো?”
“আপনি এটা কিভাবে করবেন, অ্যাঁ? এটা তো ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়া পুলিশও করতে পারে না।”
এবার চারুর ঠোঁটে হাসি দেখা গেলো। সেই ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি।”
অবাক হলো মায়া। “কিভাবে?”
“মাত্র দু-হাজার টাকায়।”
“ওহ্..আপনি আসলেই একটা জিনিস।”
কথাটা প্রশংসা হিসেবেই নিলো চারু।
“যান, যা করার জলদি করেন…আমি এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না।”
“তাহলে আপনাকে কিভাবে দেখাবো? মানে, কবরের ভেতরে কি পেলাম না পেলাম…”
“উফ,” বিরক্ত হলো মায়া। “আপনি যা-ই খুঁজে পান না কেন, আমি বিশাস করবো। এবার যান তো।”
“ওকে।” চারু আর কোনো কথা না বলে মায়াকে রেখে কবরস্তানের ভেতরে চলে গেলো।
একা একা অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর কাজ আর হয় না। বিশেষ করে সেটা যদি গোরস্তানের সামনে হয়। মায়াকে এখন সেই কাজটাই করতে হবে।
গোরস্তানের সামনে এক সুন্দরি মেয়ে বাইকের উপর বসে আছে-পরাবাস্তববাদি পেইন্টিং হিসেবে দারুণ কিন্তু ঢাকা শহরের দৃশ্য হিসেবে যেমন বেমানান তেমনি সন্দেহজনক। মায়া টের পেতে শুরু করলো, নিরিবিলি গোরস্তানের আশেপাশে একজন দু-জন করে কৌতূহলি মানুষের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হচ্ছে। মোবাইলফোনে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করে একঘেয়ে সময়টা কাটাতে চাইলো সে।
এ প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট পর চারু বের হয়ে এলো গোরস্তানের ভেতর থেকে। তার মুখে বিজয়ির হাসি।
বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালো মায়া। “কি হয়েছে?
হাত তুলে তাকে ধৈর্য ধরতে বলল। “আগে এখান থেকে চলুন, তারপর বলছি।”
মায়া আর কিছু না বলে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। হেলমেট দুটোর একটা মায়ার হাতে দিয়ে চারুও পরে নিলো তারটা।
“বসুন, বাইকটা স্টার্ট দেবার আগে বলল সে। “এখন কড়া করে কফি খেতে হবে সবার আগে।”
“একটা পুরনো কবর খোঁড়ার পর কারো কফি খেতে রুচি হয় কিভাবে?” পেছ থেকে বলে উঠলো মায়া। “ডিসগাস্টিং!
এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে চারু তার বাইকটা স্টার্ট দিয়ে দিলো।
“আপনি কবরের ভেতরে কোনো কঙ্কাল পাননি, তাই না?” বাইকটা কাঁচা রাস্তা ধরে চলতে শুরু করলে আস্তে করে বলল মায়া। “কবরটা ফাঁকা?”
“না, কঙ্কাল আমি ঠিকই পেয়েছি,” বলল চারু। “একদম পারফেক্ট কঙ্কাল!”
.
অধ্যায় ৪৬
“কঙ্কালটার সবই দেখি অক্ষত আছে!”
ডক্টর আজফার হুসেন যার নাই বিস্মিত।
চারু আর মায়া কুড়িল বস্তির কবরস্তান থেকে সোজা চলে এসেছে। ডক্টরের বাড়িতে। তারা এখন বসে আছে ডক্টরের প্রিয় জায়গা, তার স্টাডি কাম-ড্রইংরুমে। আজকে ডক্টর আর হুইলচেয়ার ব্যবহার করেননি, তার বদলে ক্রাচে ভর দিয়ে ঢুকেছেন ঘরে। এখন চারুর মোবাইল ফোনের দিকে পিটপিট করে চেয়ে আছেন তিনি। ছোট্ট ভিডিও ফাইলটা কম করে হলেও এ নিয়ে তিনবার দেখেছেন।
এখানে আসার পর মায়াকে সবার আগে ভিডিওটা দেখিয়েছে চারু।
“হুম। এটা যে সুরুজের কঙ্কাল নয় তার জন্যে ডিএনএ পরীক্ষা করার দরকার নেই, চারু বলল। “শুধু পা-ই নয়, ট্রেনে কাটা পড়ার পর ছেলেটার মাথা পুরোপুরি থেতলে গিয়েছিলো।”
চারুর ফোনটা সামনের টেবিলের উপর রেখে দিলেন ডক্টর। “অবিশাস্য!”
মুচকি হাসলো চারু আহসান। মায়া অবশ্য থমথমে মুখ নিয়ে বসে আছে।
“তার মানে, সিএনজি ড্রাইভার নিজের ছেলের ফেইক মৃত্যু সাজিয়েছে!”
ডক্টরের কথার সাথে সায় দিয়ে বলল চারু, “আর এটা সে একটা কারণেই করেছে…মিসকাতকে খুন করার জন্য।”
“কিন্তু একটা জিনিস এড়িয়ে যাচ্ছেন,” আস্তে করে বলল মায়া।
মেয়েটার দিকে তাকালো চারু। “কি?”
“চাঁন মিয়া যদি নিজের ছেলের মৃত্যুটা সাজিয়েই থাকে তাহলে সে কেন আমাদের বলল তার ছেলেকে ডিস্টার্ব না করতে? তার ছেলে কখন আসে, কখন যায় সেটা সে জানে না? ছেলেটার মনে অনেক দুঃখ…তাকে যেন আমরা না ঘাটাই?”
কথাটা শুনে চারুর কপালে ভাঁজ পড়লো।
“আপনার কথাই যদি সত্যি হবে, তাহলে লোকটা বলতো তার ছেলে মারা গেছে বহু আগেই। ছেলের মৃত্যুর কথা লুকাতে যাবে কেন? এমন ভান করবে কেন, তার ছেলে এখনও বেঁচে আছে?”
“হুমম…” ডক্টর আজফার বলে উঠলেন। “…এত নিখুঁত পরিকল্পনা করে যদি ছেলের ফেইক মৃত্যু সাজিয়ে থাকে তাহলে এসব বলতে যাবে কোন্ আক্কেলে? খাপ খাচ্ছে না তো।”
“সম্ভবত চাঁন মিয়া মানসিকভাবে সুস্থ নয়।”
চারুর কথা শুনে মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন ডক্টর।
“আবার এমনও হতে পারে লোকটার নিশ্চয় কোনো মোটিভ আছে। হয়তো আমাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য এরকম আচরণ করেছে।”
“মানে, চাঁন মিয়া ইচ্ছেকৃতভাবে মানসিক রোগি সাজার চেষ্টা করেছে?”
কাঁধ তুলল চারু আহসান। “অপরাধি নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক কৌশলই খাটায়। আমি সম্ভাবনার কথা বলছি। হতে পারে লোকটা আসলেই মানসিকভাবে অসুস্থ…আবার এমনও হতে পারে, পুরোপুরি ভান করেছে।”
“চাঁন মিয়া কেন ভান করবে? নিজেকে বাঁচানোর জন্য?”
মায়ার কথাটা শুনে মাথা দোলাল চারু। “না। তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য।”
“কবরের লাশ দেখে আপনি এ সিদ্ধান্তে আসতে পারেন না ছেলেটা বেঁচে আছে।”
কথাটা শুনে রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলো চারু। “আপনি এটা কী বললেন! সুরুজের কবরের ভিডিওটা দেখার পরও আপনার মনে এ নিয়ে সন্দেহ আছে!”
ডক্টর আজফার পুরোপুরি নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলেন। তাদের দুজনের দিকে পালাক্রমে তাকাচ্ছেন তিনি। দেখতে চাইছেন তাদের কথাবাতা কোন দিকে গড়ায়।
“ভিডিওটা…” মায়া একটু থেমে আবার বলল, “মানে, কঙ্কালটার কথা বলছেন তো? এটা দিয়ে কি প্রমাণ হয়?”
চারু যেন আকাশ থেকে পড়লো। “কী প্রমাণ হয় মানে? আপনি দেখতে পাচ্ছেন না, এটা কোনভাবেই ঐ সুরুজের কঙ্কাল হতে পারে না। এটা অন্য কারোর। এমন একজনের যার দুটো পা আছে…একটা মাথাও আছে।”
চারুর উত্তেজিত ভঙ্গি মায়াকে মোটেও স্পর্শ করতে পারলো না। সে মাথা নেড়ে সায় দিলো। “হুম, আমিও সেটাই মনে করি। এটা অবশ্যই অন্য কারোর।”
“তাপরও আপনি বিশ্বাস করছেন না?”
মায়া গভীর করে নিঃশ্বাস নিয়ে নিলো। “কথা সেটা নয়। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি কি করে নিশ্চিত হলেন, কবরটাও অন্য কারোর নয়?”
চারু যেন ইলেক্ট্রিক শক খেলো। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলতে পারলো না। “ঐ কবরে নামফলক আছে…সুরুজমিয়া…পিতা চাঁন মিয়া। মৃত্যুর তারিখও লেখা আছে।”
“তাতে কি?”
“তাতে কী মানে?” চারুকে এবার ক্ষিপ্ত দেখালো। এত কষ্ট করে যে অসাধারণ একটি প্রমাণ জোগাড় করেছে সেটাকে এই তথাকথিত সাইকি মেয়েটি আমলেই নিচ্ছে না!
“আপনি আগে নিশ্চিত হোন, কবরটা সুরুজের। নইলে আপনার সব কিছু ভেস্তে যাবে।”
“বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে, আপনি এ কথা বলছেন!” চারুকে আহত দেখালো। “যার জন্যে আমি আপনাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম…আপনার সামনেই কবরটা খুঁড়ে দেখাতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি ভেতরে গেলেন না। আর এখন কিনা বলছেন, আমি ভুল কবর খুঁড়ে দেখেছি!”
“আশ্চর্য,” মায়া বিরক্ত হলো এবার। “আমি বলছি, ঐ কবরটাই যে সুরুজের সেটা আগে নিশ্চিত হন। একটা নামফলক দেখে নিশ্চিত হওয়াটা ঠিক হবে না।”
“ওর কথাটা কিন্তু গুরুত্ব দিতে হবে,” আস্তে করে বললেন ডক্টর। এতক্ষণ তিনি চুপচাপ তাদের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। শুধুমাত্র নামফলক দেখে নিশ্চিত হওয়াটা ঠিক হবে না। এসব জিনিস খুব সহজেই মিস-ম্যাচ হতে পারে।”
ডক্টরের কথা শুনে চারুকে আরো বেশি হতাশ দেখালো।
“আমি মানবিক ভুলের কথা বলছি,” ব্যাখ্যা করলেন ডক্টর। “হয়তো ফলকটা কোনো কারনে খুলে পড়ে গেছিলো, তারপর আবার সেটা লাগাতে গিয়ে ভুল কবরে পুঁতে দিয়েছে…এটা তো হতেই পারে।”
মাথা দোলাল চারু। তার অকাট্য প্রমাণ নিয়ে যে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন কোনো মানুষ এমন সব সন্দেহ করবে সেটা কল্পনাও করেনি।
“তোমার উচিত কবরস্তানের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা,” ডক্টর আজফার হুসেন থুতনি চুলকে বললেন।
“ওখানকার কেয়ারটেকার জরুরি একটা কাজে দেশের বাড়িতে গেছে, তাই রেকর্ড দেখতে পারিনি,” চারু জানালো।
“তুমি রাগ কোরো না, এটা অনেক বিরাট ব্যাপার। পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে এ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে পরে কিন্তু তদন্তটা ভুলপথে চলে যাবে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো চারু। “ঠিক আছে, আমি তাহলে সেটাই করবো। আবার যাবো ওখানে, রেকর্ডটা চেক করে দেখবো।”
“দ্যাটস গুড,” বলে উঠলেন আজফার হুসেন। “আমি খুবই রোমাঞ্চিত বোধ করছি।”
কিন্তু চারু আহসান মোটেও রোমাঞ্চিত বোধ করছে না। রীতিমতো হতাশ আর বিরক্ত সে। প্রচণ্ড জেদ চেপে বসেছে তার মধ্যে।
.
অধ্যায় ৪৭
ওইদিন ডক্টর আজফারের বাড়ি থেকে চলে আসার পর ইচ্ছে করেই মায়ার সাথে আর যোগাযোগ করেনি চারু। মায়াও তাকে ফোন দেয়নি।
ভণ্ড আর অলৌকিক ঘটনাগুলোকে যখন মিথ্যে প্রমাণ করার যুদ্ধে নামে তখন এরকম হতাশাজনক মুহূর্ত আসে-চারু এতে ভেঙে পড়ে না।
তবে এই ঘটনায় তার খারাপ লেগেছে মায়ার আচরণে। শুধুমাত্র এ কারণেই মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিলো কবরস্তানে। তার সামনেই কবরটা খুঁড়ে দেখাতে চেয়েছিলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মায়া ইচ্ছে করেই কবরস্তানে ঢোকেনি ওইদিন। হয়তো একটা ফাঁক রাখতে চেয়েছিলো।
তবে চারুর মনের যুক্তিবাদি অংশটা বলছে, ডক্টর আর মায়ার কথাগুলো মোটেও অমূলক নয়। বিশেষ করে অকাট্য প্রমাণের কথা যখন উঠছে তখন শুধুমাত্র নামফলক দেখে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়াটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
যাই হোক, একটা দিন নিজের ঘরে বসে কোনো কাজ না করেই কাটিয়ে দিলো সে। পরদিন সকালে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লো আবার। পথে একটা রেস্টুরেন্টে নাস্তা করে সোজা চলে গেলো কুড়িল বস্তির সেই গোরস্থানে। তাকে আবার দেখে যার পর নাই অবাক হলো গোরখোদক।
“কি হইছে?” একটু ভয়ে ভয়ে বলল সে। এই লোকের সঙ্গে আসা একজনের কাছ থেকে হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে একটা কবর খুঁড়ে কঙ্কাল দেখিয়েছে। কাজটা যে বেআইনি সে ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই। এই ঘুষ দেয়া লোকটা ছদ্মবেশি সাংবাদিক না তো, যারা গোপন ক্যামেরা দিয়ে মানুষকে ফাঁদে ফেলে দুর্নীতির সংবাদ প্রচার করে? কয়েকদিন আগে টিভিতে কবরস্তান থেকে কঙ্কাল চুরির উপরে এমনই একটি অনুষ্ঠান দেখেছিলো। তাকে না আবার কঙ্কালচোর বানিয়ে দেয়!
ইয়া মাবুদ!
“কেয়ারটেকার আছে?” চারু জানতে চাইলো তার কাছে।
“হ…আছে,” আস্তে করে বলল গোরখোদক। “ঘরেই আছে।”
চারু আর কোনো কথা না বলে সোজা পা বাড়ালো কবরস্তানের টিনশেড ঘরের দিকে।
গোরখোদক মনে মনে দোয়া ইউনুস আওড়াতে শুরু করলো। বিপদ থেকে বাঁচতে হলে এই সুরার কোনো বিকল্প নেই। তার মনে হচ্ছে, হাজার টাকার লোভে পড়ে বিশাল বিপদ ডেকে এনেছে।
যাই হোক, ফ্যাকাশে মুখের গোরখোদককে বাইরে রেখে চারু ঢুকে পড়লো টিনশেডের ঘরে। ভেতরে দাড়ি-টুপি পরা এক লোক চেয়ারে বসে তসবিহ হাতে নিয়ে সুরা-কালাম পড়ছে বিড়বিড় করে।
“স্লামালেকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসোলাম,” সালামের জবাব দিলো কেয়ারটেকার।
“আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”
“জি, জি…বসেন,” একটা প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে বলল তাকে।
“আপনাদের গোরস্থানের তো রেকর্ড থাকে, তাই না?”
“জি। কোন লাশ কবে দাফন হইছে সেইটার রেকর্ড রাখি আমরা। এই গোরস্থানটা সিটি কর্পোরেশনের আন্ডারে, রেকর্ড রাখতে হয়। এইটাই নিয়ম।”
“বছরখানেক আগে একটা লাশ এখানে দাফন করা হয়েছিলো, আমি সেই রেকর্ডটা একটু দেখতে চাচ্ছি।”
কেয়ারটেকারের কপালে ভাঁজ পড়লো। “আপনে কে? কইথেন আসছেন?”
পকেট থেকে একটা বিজনেস কার্ড বের করে লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিলো। আমি একটা ইস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে এসেছি,” বলল চারু। এ কাজ সে আগেও করেছে র্যাশনালিস্ট সোসাইটির হয়ে তদন্ত করার সময়। এরকম পাঁচ-ছয়টা বিজনেস কার্ড আছে তার পকেটে। “যে ছেলেটা মারা গেছে তার বাবা ছেলের নামে আমাদের প্রতিষ্ঠানে একটা লাইফ ইন্সুরেন্স করেছিলেন। এখন ইস্যুরেন্স ক্লেইম করছেন উনি। আমি এসেছি ব্যাপারটা ইনকোয়্যারি করতে।”
“পোলার বাবা ডেথ সার্টিফিকেট দেয় নাই?” কেয়ারটেকার বিজ্ঞের মতো বলল।
“দিয়েছেন কিন্তু বোঝেনই তো, আজকাল এসব জিনিস হরহামেশা জাল করা যায়। তাই খতিয়ে দেখার জন্য আমার কোম্পানি পাঠিয়েছে এখানে।”
“হ, ঠিকই কইছেন,” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো লোকটা। “দুনিয়াটা বাটপারে ভইরা গেছে। হেননা কুনো সার্টিফিকেট নাই যেইটার নকল পাওন যায় না। নীলক্ষেতে গেলে সব পাইবেন।”
কথাটা শুনে মনে মনে মুচকি হাসলো চারু। এ ব্যাপারে তার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। তার পকেটে থাকা বিজনেস কার্ডগুলো নীলক্ষেত থেকেই বানিয়ে নিয়েছে। যখন যেটার দরকার পড়ে ব্যবহার করে।
“আপনে বসেন, আইতাছি আমি,” কেয়ারটেকার উঠে পাশের ঘরে চলে গেলো।
চুপচাপ বসে রইলো চারু। ভাবতে লাগলো, এখন যদি রেকর্ডে দেখা যায় সুরুজের ছেলেকে সত্যিই ঐ কবরটায় গোর দেয়া হয়েছে তাহলেও কি মায়া আর ডক্টর আজফার অবিশ্বাস করবে? আরো অকাট্য প্রমাণ চাইবে?
চারু সিদ্ধান্ত নিলো, এরকম কিছু হলে সে বেঁকে বসবে। তার পক্ষে এমন শত্রুভাবাপন্ন পরিবেশে কাজ করা সম্ভব হবে না বলে জানিয়ে দেবে।
“ডেটটা কইবার পারেন?” হাতে একটা পুরনো টালি খাতা নিয়ে ঘরে ফিরে এলো কেয়ারটেকার।
চারু তার মোবাইলফোন বের করে কবরের ভিডিওটা ওপেন করলো। কবরের নামফলকে মৃত্যুর যে তারিখ দেয়া আছে সেটা জানিয়ে দিলো লোকটাকে।
নিজের চেয়ারে বসে কিছু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে অবশেষে পেয়ে গেলো সে। “মৃত সুরুজমিয়া…পিতা চাঁন মিয়া…তারিখটা হইলো…এই যে দেখেন…” খাতাটা চারুর দিকে বাড়িয়ে দিলো কেয়ারটেকার।
চারু দেখতে পেলো রেকর্ডটা। তার চোখেমুখে হাসি ফুটে উঠলো। এমনটাই আশা করেছিলো সে। একেবারে অকাট্য প্রমাণ। এবার ডক্টর আর মায়া কি বলবে?
তারপর তার চোখ গেলো আরেকটা লেখার দিকে। ‘বেওয়ারিশ’ শব্দটার পাশে আরেকটা মৃত্যুর তারিখ লেখা। আজ থেকে চার-পাঁচ মাস আগের!
“এটা কি?”
কেয়ারটেকার খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলো। “এইটা হইলো বেওয়ারিশ একটা লাশ…এই এলাকায় পাওয়া গেছিলো। পরে আঞ্জুমানে মফিদুল লাশটার সকার করে।”
“কিন্তু এটা সুরুজের কবরের নাম্বারে কেন রেকর্ড করা?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো সে।
“কব্বরটা নতুন কইরা চাইলা ফালানো হইছিলো…ওই কব্বরেই বেওয়ারিশ লাশটারে দাফন করা হইছে।”
কথাটা শুনে চারুর মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো। “কিন্তু ঐ কবরটায় তো এখনও সুরুজের নামই লেখা আছে?” অবিশ্বাসে বলে উঠলো সে।
“বেওয়ারিশ লাশের তো নামফলক থাকে না, তাই আগেরটাই রয়া গেছে। এইটা তো খুব ছুটো গোরস্থান…একেকটা কব্বর বেশিদিন রাখন যায় না। পুরা জায়গা ভইরা গেছে, তাই কিছুদিন বাদে বাদে পুরান কব্বরগুলান চাইল্যা ফালাইতে হয়। এইটা না করলে এত লাশের জায়গা হইবো কেমনে?”
কিন্তু কথাগুলো চারু শুনতে পেলো না ঠিকমতো। তার কানে এখন শুধু ভো ভো শব্দ হচ্ছে।
.
অধ্যায় ৪৮
একটা দ্বন্দ্বে ভরা সময় কাটিয়েছে চারু-যে সত্য আজ জেনেছে সেটা কি মায়া আর ডক্টরকে জানাবে?
র্যাশনালিস্ট সোসাইটিতে এতদিন ধরে কাজ করছে, কখনও এমনটা হয়নি। কিন্তু এবার তার মনের একটা অংশ চেয়েছিলো সত্যটা ওদেরকে না জানানোর জন্য।
অবশ্য আশার কথা, তার মনের যুক্তিবাদি অংশটি আগের মতোই সত্যকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত।
চাঁন মিয়ার ছেলে যদি সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করে থাকে তাহলেই বা কি? তাতে করে চাঁন মিয়া যে মিসকাতকে খুন করেনি সেটা তো প্রমাণ হয়ে যায় না। লোকটা হয়তো অন্য কোনো সহযোগিকে নিয়ে কাজটা করেছে।
দীর্ঘ সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলো মায়ার ফেসবুক আইডিতে ঢুকে ইনবক্সে দীর্ঘ একটি মেসেজ দিয়ে আজকের ঘটনাটা সংক্ষেপে জানিয়ে দেবে। একজন যুক্তিবাদি হিসেবে, এটুকু সততা না করে উপায় নেই। তাছাড়া তদন্তের যদি কোনো কূলকিনারা করতে চায় তাহলে প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি মুহূর্তে সত্যকে মেনে নেবার মতো সাহস দেখাতে হবে।
কিন্তু ফেসবুকে ঢুকতেই চারু দেখতে পেলো নিউজফিডে হ্যালোউইনের কিছু পোস্ট।
আজ ৩১ শে অক্টোবর।
অবাক হলো সে। এক বছর আগে, আজকের রাতেই মিসকাত খুন হয়েছিলো। আর কয়েক ঘণ্টা পরই আসবে সেই ক্ষণ। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন সেজে এক সিএনজিওয়ালা বিভৎসভাবে মিসকাতকে খুন করেছিলো গাজীপুরে গিয়ে।
যাই হোক, মায়াকে বিস্তারিত সব জানিয়ে ইনবক্স করে দিলো। মন মেজাজ ভালো নয় বলে একটা মুভি দেখার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু উপভোগ করতে পারলো না। বার বার দুচোখের পাতা লেগে আসলো।
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বিছানায় ল্যাপটপটা চালু অবস্থায় রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। মুভি দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারণে সকাল নটায় ঘুম ভাঙলো তার, তা-ও মোবাইলফোনের রিংটোনের শব্দে।
বিছানার পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে ভুরু কুচকে ফেলল সে।
অ্যাঞ্জেল কল করেছে!
“হ্যালো…কি খবর, অ্যাঞ্জেল…এত সকালে?”
“ইউ জাস্ট কান্ট বিলিভ ইট! ওহ মাইগড! এটা আমি কী দেখলাম!” হরবর করে আতঙ্কিত অ্যাঞ্জেল বলে উঠলো ফোনের ওপাশ থেকে।
“কি হয়েছে? ঘটনা কি?” নড়েচড়ে বসলো চারু।
“আজ একটু আগে আমি আন্টির বাসায় গেছিলাম…মিসকাতদের বাড়িতে…ইউ নো, আজকের তারিখেই মিসকাত খুন হয়েছিলো,” বলে চলল সে, “আন্টি তো আমাদেরকে সহ্যই করতে পারেন না। তারপরও ভাবলাম এ সময় তার সাথে দেখা করি, কিন্তু দেখা করতে পারিনি। আন্টি নাকি আজ কারোর সঙ্গে দেখা করবেন না। একটু পর মিসকাতের কবর জিয়ারত করতে যাবেন।” অ্যাঞ্জেল একটু থামলো, দম নেবার জন্য সম্ভবত।
অধৈর্য হয়ে উঠলো চারু। “কি হয়েছে সেটা বলো?”
“ওহ, যেটা বলছিলাম…একটু আগে আন্টির বাসা থেকে বের হবার সময় যা দেখলাম…উফ! ভয়ে আমার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেছে।”
“কি দেখেছো তুমি?” অধৈর্য হয়ে বলল চারু আহসান।
“ঐ সিএনজিটা!” চাপাস্বরে বলল অ্যাঞ্জেল।
“কি?”
“হুম। আমার গাড়িটা আন্টির অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে পার্ক করেছিলাম, বের হয়ে গাড়িতে যখন উঠবো তখনই দেখতে পেলাম রাস্তার উল্টোদিকে ওই সিএনজিটা দাঁড়িয়ে আছে। মাই গড! ভাবতে পারেন!”
চারুর ধারণা অ্যাঞ্জেল অতিরিক্ত আতঙ্কিত হয়ে আবারো এমন আচরণ করছে। এর আগে তার বাড়ির সামনে সিএনজি দেখে কী কাণ্ডটাই না করলো। চারুও বোকার মতো ছুটে গেলো বাইক নিয়ে।
নিজের কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব শান্ত রেখে চারু আহসান বলল, “রাস্তার পাশে সিএনজি থাকতেই পারে, হয়তো প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মনে হচ্ছে তুমি একটু বেশি প্যানিকড হয়ে পড়েছে। এতটা ভয় পাবার কিছু নেই। আমি তোমাকে বলেছিলাম একটু সতর্ক হয়ে চলাফেরা করতে, কয়েকটা দিন সিএনজি ব্যবহার না করতে…তার মানে এই না, রাস্তায় সিএনজি দেখলেই তোমাকে ভয় পেতে হবে।”
“লিসেন,” দম ফুরিয়ে হাফাতে লাগলো অ্যাঞ্জেল। “আমি সিএনজিতে কাকে দেখেছি জানেন?”
“কাকে?”
“ঐ ছেলেটার বাপকে। প্লিজ…বিলিভ মি?”
“তুমি ঐ লোকটাকে চেনো?” প্রশ্নটা করার পর পরই চারু বুঝতে পারলো।
“বাহ্, আমি কোর্টে গিয়ে মিসকাতের পক্ষে সাক্ষি দিয়েছি না। ওখানে ছেলেটার বাপকে দেখেছি তো।”
চারু টের পেলো ভয়ের একটি শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে তার শিরদাঁড়া বেয়ে। “অ্যাঞ্জেল, তুমি এখন কোথায়?”
“আমি তো বাসায় চলে এসেছি। ঐ লোকটাকে দেখার পর কী যে ভয় পেয়েছিলাম। ড্রাইভারকে বলেছি তাড়াতাড়ি যেন বাসায় নিয়ে যায় আমাকে, পথে কোনো জায়গায় যেন না থামে।”
“ভালো করেছো,” বলল চারু আহসান। “তুমি যখন ওখান থেকে। বাসায় এলে তখন কি সিএনজিটা তোমাকে ফলো করেছিলো?”
“না। তা করেনি।”
মই গড! চারুর মাথার ভেতর উচ্চারিত হলো।
.
অধ্যায় ৪৯
বাইক নিয়ে ছুটে চলছে চারু। তার গন্তব্য এখন বনানী কবরস্তান!
অনেকটা পথ পাড়ি দেবার পর চারু খেয়াল করলো তাড়াহুড়া করতে গিয়ে আজ হেলমেট না পরেই বের হয়ে গেছে। হেলমেট না পরে সে কখনও বাইক চালায় না। এটাকে প্রায় অলঘনিয় নিয়মে পরিণত করেছে। এর কারণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাইক অ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেছিলো। মাথায় হেলমেট ছিলো না বলে মারাত্মক আঘাত পেয়ে কোমায় চলে যায় সে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে আর ফিরে আসতে পারেনি।
অ্যাঞ্জেলের ফোন পাবার পর চারু বুঝতে পারে এক্ষুণি মিসকাতের মাকে সতর্ক করে দেয়াটা খুবই জরুরি, আর সেটা ডিবি অফিসার মুর্তজাকে দিয়ে খুব সহজেই করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে তাকে এই অনুরোধটা করলে মুর্তজা এমপিকে ফোন করে সতর্ক করে দিতে রাজি হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ফোন করে সে জানায়, অনেক চেষ্টা করেও মিসকাতের মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। ভদ্রমহিলা তার সবগুলো ফোনই বন্ধ করে রেখেছেন আজ।
চারু বুঝতে পারছে, একজন মায়ের জন্য নিজ সন্তানের মৃত্যুদিবসটি কতোটা বেদনাদায়ক হতে পারে। এরকম মুহূর্তে তিনি একটু একা থাকতে চাইতেই পারেন।
চারুকে আশ্বস্ত করার জন্য ডিবি অফিসার বলেছিলো, এমপিকে নিয়ে অতোটা ভয় পাবার কিছু নেই। তিনি কখনও একা বের হন না। সঙ্গে কেউ না কেউ থাকেই। সিএনজিওয়ালা চাঁন মিয়ার পক্ষে একজন এমপির কোনো ক্ষতি করা সম্ভব হবে না।
চারু কথাটার সাথে দ্বিমত পোষণ না করলেও তার যুক্তি-বুদ্ধি বলছে, প্রচণ্ড প্রতিশোধপরায়ণ এক বাবা, যে কিনা মানসিকভাবে অসুস্থ, সে এসব সম্ভব-অসম্ভব নিয়ে ভাববে না। নিজের জীবন তুচ্ছ করে হলেও কিছু একটা করতে চাইবে।
অবশেষে চারুর পীড়াপিরিতে মুর্তজা বলেছে, সে এক্ষুণি এমপির বাড়িতে গিয়ে চাঁন মিয়ার সিএনজির ব্যাপারটা দেখবে, সেই সঙ্গে তাকে সতর্কও করে দেবে।
মুর্তজার ফোন রেখেই মায়াকে ফোন দেয় চারু। মেয়েটাকে জানায় সে এক্ষুণি ডক্টরের বাড়িতে যাচ্ছে সে, মায়াও যেন চলে আসে। জরুরি কথা আছে।
ডক্টরের বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হবার পর গুলশান দুই নম্বরে ঢোকার আগেই ডিবি অফিসারের ফোন পায় সে। এমপির বাড়িতে গিয়ে মুর্তজা জানতে পেরেছে শোস্ত মা একটু আগেইই বের হয়ে গেছেন বনানী কবরস্তানে ছেলের কবর জিয়ারত করার জন্য। সঙ্গে গাড়ির ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকে নেননি।
কথাটা শুনে এক ধরণের আশঙ্কা জেগে উঠেছে চারুর। মুর্তজাকে অনুরোধ করেছে, সে যেন এক্ষুণি বনানী কবরস্তানে চলে যায়। এমপি মোটেও নিরাপদ নন। সে নিজেও আসছে যত দ্রুত সম্ভব।
ডিবি অফিসারের কাছে ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি মনে হলেও শেষ পর্যন্ত কবরস্তানে যেতে রাজি হয়েছে সে।
এসব কারণেই ডক্টরের বাড়িতে না গিয়ে এখন গন্তব্য পাল্টে ছুটে চলেছে বনানী কবরস্তানের উদ্দেশে।
.
ছেলের কবরের পাশে বসে সুরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে এ কথা ঘুণাক্ষরেও কখনও ভাবেননি মিসেস সোবহান। তার নাড়িছেঁড়া ধন, একমাত্র ছেলে মিসকাত শুয়ে আছে মার্বেল পাথরে বাধানো কবরের নিচে। সেই মসৃণ মার্বেলের গায়ে হাত বুলিয়ে গেলেন তিনি। ছোট্ট মিসকাতের মাথায় ঠিক এভাবেই হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন।
একটু আগে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে এখানে ঢুকেছেন। চমৎকার একটি ফুলের কাসকেট রেখেছেন ছেলের কবরে। সঙ্গে আনা আগরবাতি জ্বালিয়ে দেবার পর ড্রাইভারকে গাড়িতে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে বলে দিয়েছেন।
চোখ বন্ধ করে সুরা ফাতেহা পড়তে শুরু করলেন মিসকাতের মা। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠলো ছেলের নানান বয়সের নানান স্মৃতি-ছবি-শব্দ-মুহূর্ত। দুচোখ বেয়ে গড়াতে শুরু করলো অশ্রু।
বড় মেয়েটাকে বিয়ে দেবার পরই স্বামির সাথে চলে যায় কানাডায়, সেই থেকে এই ছেলেকে নিয়েই তার ছোট্ট সংসার। মিসকাতের বাবা চিরটাকালই নিরীহ আর কাজপাগল একজন মানুষ। নিজের ব্যবসা নিয়েই তার যতো ব্যস্ততা। স্ত্রীকে কখনও কোনো বিষয়ে কিছু বলেন না। তিনি যখন রাজনীতিতে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন তখনও ভালোমন্দ কিছু বলেননি প্রকাশ্যে। অবশ্য পরে ঢাকা ক্লাবের আড্ডা থেকে জানতে পেরেছিলেন, তার এই সিদ্ধান্তে স্বামি আসলে খুশি হতে পারেননি।
নির্বিবাদি মানুষটা মিসকাতের খুনের পর থেকে কেমন গুটিয়ে গেলেন। এমনতি কম কথা বলা আশরাফ সোবহান পুরোপুরি বোবা হয়ে রইলেন প্রায় একটা মাস। এই এক বছরে মানুষটাকে একবারের জন্যেও মিসকাতের কবর জিয়ারত করাতে নিয়ে আনতে পারেননি। নরম মনের মানুষ, হয়তো ছেলের কবর দেখার মতো মানসিক জোর নেই, সেজন্যে খুব একটা জোরাজুরিও করেননি তিনি।
মিসকাতের জন্য আজ দুপুরে কাঙ্গালি ভোজের আয়োজন করা হয়েছে, বিকেলে মিলাদ। বাড়িতে আসবে অনেক আত্মীয়স্বজন। খুবই ব্যস্ত সময় যাবে, পরে আর ফুরসত পাবেন না, তাই সকাল সকাল ছেলের কবর জিয়ারত করতে চলে এসেছেন।
তার এসব চিন্তাকে ছাপিয়ে আরেকটা বিষয় জুব্ধ করে তুলল। দেখতে দেখতে আজ এক বছর হয়ে গেলেও ছেলেহত্যার বিচার পাননি। অথর্ব পুলিশ এতদিনে কোনো কূলকিনারা করতে না পারলে তিনি ধরেই নিয়েছিলেন ছেলের প্রকৃত হত্যাকারি কে সেটা বুঝি এ জীবনে আর দেখে যেতে পারবেন না। তবে কয়েক দিন আগে তদন্তকারি কর্মকর্তা এসে জানালো, একজন সাসপেক্ট পেয়েছে তারা। সিএনজি ড্রাইভার চাঁন মিয়ার কথাটা শোনামাত্র তিনি বুঝে গেছিলেন কাজটা ঐ লোকই করেছে। এ নিয়ে তার মনে কোনো সন্দেহই নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মিসকাতের মায়ের বুকের ভেতর থেকে। চাঁন মিয়ার সেই মুখটা, সেই অসহায় আর চাপাক্ষোভে পুড়তে থাকা চোখদুটো তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না।
লোকটাকে পুলিশ দিয়ে ধরে এনেছিলেন, কিছু টাকা নিয়ে কেসটা তুলে নেবার জন্য চাপও দিয়েছিলেন। এই টাকা দিয়ে ছেলের চিকিৎসা যেন করায়। মামলা করে কোনো লাভ হবে না তাদের। ঢাকা শহরের সবচয়ে বড় ব্যারিস্টার লড়ছেন তার ছেলে হয়ে। মিসকাতকে যেভাবেই হোক খালাস করিয়ে ছাড়বেন তিনি। কোনোভাবেই রায় তাদের পক্ষে যাবে না। খামোখা আদালতে দৌড়াদৌড়ি করে সময় আর টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তার চেয়ে ভালো আপোসরফা করে ফেলা।
সামান্য এক সিএনজিওয়ালা তার মতো ক্ষমতাধর একজনকে কতো সহজেই না অগ্রাহ্য করতে পারলো! উল্টো রেগেমেগে অভিশাপ দিয়েছিলো তাকে আর তার ছেলেকে।
কতো বড় আস্পর্ধা! চাঁন মিয়ার গালে ঠাস করে চড় মেরেছিলেন তিনি। পুলিশ দিয়ে লোকটাকে বেদম পিটিয়েওছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত আদালতেই ফয়সালা হয় মামলাটির। বলা বাহুল্য, রায় তাদের পক্ষেই গেছিলো।
আজ তিনি জানতে পেরেছেন, সেই চাঁন মিয়া তার ছেলেকে খুন করেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, একজন অশিক্ষিত সিএনজিওয়ালা এমন নিখুঁতভাবে তার ছেলেকে হত্যা করেছে যে, ডিবি-পুলিশেরও এক বছর লেগে গেছে সেটা বের করতে। যদিও ডিবির লোকটা পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলো না কিন্তু তিনি জানেন, কাজটা ঐ সিএনজিওয়ালাই করেছে।
সামান্য একজন সিএনজিওয়ালাকে নিয়ে একদমই মাথা ঘামাননি। এখন বুঝতে পারছেন কতো বড় ভুল করে ফেলেছেন।
যাই হোক, সন্তানের হত্যাকারির কথাটা জানার পর ভেবেছিলেন, খুব সহজে লোকটাকে প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে দিতে পারবেন, কিন্তু চাঁন মিয়া নামের লোকটা ধারণার চেয়ে বেশি ধূর্ত আর দুঃসাহসি বলে মনে হচ্ছে। তিন তিনজন গুণ্ডার হাত থেকে শুধু বেঁচেই পালায়নি, একজনের হাতও কেটে ফেলেছে। খুব বেশিদিন তাকে দুনিয়ার বুকে ঘুরে বেড়াতে দেবেন না। যতো টাকাই লাগুক, যেভাবেই হোক চাঁন মিয়াকে তিনি উপযুক্ত শাস্তি দেবনই দেবেন।
অনেকক্ষণ বসে থাকার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে চোখদুটো মুছে নিলেন। লালচে চোখদুটো ঢাকার জন্য পরে নিলেন গগলস। আরো একবার চিরন্দ্রিায় শায়িত ছেলেকে একা রেখে ধীরপায়ে হেঁটে বের হয়ে গেলেন কবরস্তান থেকে।
গাড়ির কাছে এসে দেখতে পেলেন ড্রাইভার নেই। আশেপাশে তাকালেন। নিশ্চয় সিগারেট ফুঁকতে গেছে। বিরক্ত হয়ে প্যাসেঞ্জার ডোরটা খুলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। গগলস খুলে ব্যাগে রেখে দিলেন, মোবাইলফোনটা বের করে কল দিলেন ড্রাইভারকে।
রিং হলেও তার কলটা ধরলো না ড্রাইভার। সেটাই স্বাভাবিক। কাছেই আছে, তার কল পেয়ে দৌড়ে ছুটে আসছে হয়তো।
তার ধারণাই ঠিক। বামদিকে মুখ ঘুরিয়ে কবরস্তানটার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় টের পেলেন ড্রাইভার এসে গাড়িতে ঢুকলো। মন মেজাজ ভালো নয় বলে কিছু বললেন না। নইলে একটা মৃদু ধমক অন্তত দিতেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন তিনি, “নিয়ামত…চলো।”
গাড়ির ইঞ্জিন সচল হয়ে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে।