নীলু হা করে তাকিয়ে আছে। তার চোখে গভীর বিস্ময়।
কি রে, এমন করে দেখছিস কেন? চিনতে পারছিস না?
পারছি, পারব না কেন? তোর এ কী হাল হয়েছে।
বন্যা হাসল। হাসি আর থামেই না। আশপাশের সবাই তাকাচ্ছে। অফিসে এসে কেউ এমন করে হাসে? নীলু বলল, এ্যাই, তোর কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
এত হাসছিস কেন?
জানি না কেন হাসছি। পাগল-টাগল হয়ে যাচ্ছি বোধহয়। তুই আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?
নীলু বন্যাকে ক্যান্টিনে দিয়ে গেল। তার মনে হল বন্যা ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়। চেহারা ভীষণ খারাপ হয়েছে। মাথার সামনের দিকের চুল উঠে কপাল অনেক বড়ো বড়ো লাগছে। শাড়িতে ইন্ত্রি নেই। ইন্ত্রি-ছাড়া শাড়িতে বন্যাকে কল্পনাও করা যায় না। নীলু বলল, তোর কী হয়েছে বল তো?
কিছুই হয় নি।
চাকরি ছেড়ে দিয়েছিস?
হুঁ, সে তো এক বছর আগে। তুই কোনো খোঁজখবর নিতি না, কাজেই জানিস না। কেউ খবর রাখে না।
নীলু লজ্জিত বোধ করল। সে সত্যিই কোনো খোঁজ নেয় নি। অথচ তার আজকের এই চাকরি বন্যাই জোগাড় করে দিয়েছে। কত উৎসাহে সে ছোটাছুটি করেছে। কত ঝামেলা করেছে।
নীলু, আমাকে হাজারখানেক টাকা দিতে পারবি?
পারব। কাল আসতে হবে। কাল আয়, আমি টাকা জোগাড় করে রাখব।
এখন তোর কাছে কত আছে?
পঞ্চাশ টাকার মতো আছে।
পঞ্চাশ টাকাই দে। কাল আবার আসব।
নীলু ব্যাগ খুলে টাকা বের করল। নিচু গলায় বলল, তোর আর সব খবর বল। কর্তা কেমন আছে?
জানি না কেমন আছে। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।
বলছিস কী তুই!
ডিভোর্স হয়েছে তিন মাস হল।
নীলু ভয়ে-ভয়ে বলল, তোর বাচ্চাটা কার কাছে থাকে? তোর কাছে?
না।
ওনার সঙ্গে থাকে?
না, কারো সঙ্গেই থাকে না। চা খাওয়া তো নীলু চায়ের সাঙ্গে আর কিছু থাকলে তাও দিতে বল। খিদে লেগেছে।
ভাত খাবি?
না, ভাত খাব না।
বন্যা চায়ের কাঁপে চুমুক দিয়ে নিতান্ত স্বাভাবিক গলায় বলতে লাগল, বাচ্চাটা মরে গেল, বুঝলি? চার মাস হবার আগেই শেষ। ওর ধারণা হল, আমার জন্যেই মরেছে। আমি যত্ন নিই নি, অফিস নিয়ে থেকেছি। কী যে কু ৎসিত ঝগড়া! শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে দিলাম। তাতেও কিছু লাভ হল না। রোজ ঝগড়া। রোজ হৈচৈ, চিৎকার। এক দিন কী হয়েছে জানিস? লোকজনের সামনে হঠাৎ আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দিয়ে বলল–
থাক, শুনতে চাই না। এখন কী করছিস তুই?
কিছু করছি না। বড়ো ভাইয়ের বাসায় থাকি আর ভাবীর সঙ্গে ঝগড়া করি। ভাবী কী যে ঝগড়া করতে পারে, তুই কল্পনাও করতে পারবি না। ঝগড়ায় কোনো ডিগ্রি থাকলে ভাবী পি-এইচ.ডি. পেয়ে যেত।
বন্যা। আবার হাসতে শুরু করল। হাসাতে-হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। নীলুতাকিয়ে রইল অবাক হয়ে। বন্যা বলল, আমার হাসিরোগ হয়েছে, বুঝলি? গতকাল ভাবী আমাকে কালনাগিনী বলে গাল দিয়েছে। রাগ ওঠার বদলে আমার হাসি উঠে গেল। হাসি দেখে ভাবী মনে করল, আমি পাগল হয়ে গেছি। ভয়ে তার চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল। হিহিহি।
নীলু বলল, এই বন্যা। চুপ করতো।
তোরও কি ধারণা, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না হলেও শিগগিরই হবে। তুই একটা চাকরি-টাকরি করা। কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাক।
হ্যাঁ, তাই করব।
বন্যা উঠে দাঁড়াল। সহজ স্বরে বলল, যাই রে নীলু কাল আবার আসব, টাকাটা জোগাড় করে রাখবি।
টাকা ফেরত দিতে হবে না।
তাহলে তো আরো ভাল।
নীলু বন্যাকে এগিয়ে দিতে গেল। তার খুবই খারাপ লাগছে। ইচ্ছা হচ্ছে বন্যার সঙ্গে চলে যেতে। দুজনে মিলে সারা দিন ঘুরে বেড়াতে পারে। বন্যার ঠিক এই মুহূর্তে এক জন বন্ধু দরকার। যে তাকে সাহস দেবে, ভরসা দেবে। মাঝে-মাঝে জীবন ভিন্ন খাতে বইতে থাকে, সব কেমন জট পাকিয়ে যায়-তখন এক জন প্রিয়জনকে কাছে থাকতে হয়।
নীলু, যাই রে।
কাল আসিস।
আসব। একটা কথা নীলু, আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমি যদি চাকরি না করতাম, যদি বাসায় থেকে বাচ্চার দেখাশোনা করতাম, তাহলে সে द5ऊ?
এখন আর এসব নিয়ে কেন ভাবছিস?
ভাবছি না তো! এমনি মনে হল, তাই বললাম।
আর ভাবিস না।
না, ভাবব না। বাচ্চাটার জন্যে বড়ো কষ্ট হয় নীলু ওর নাম রেখেছিলাম অভীক। নামটা সুন্দর না?
হ্যাঁ, সুন্দর।
নামের মানে বল তো?
নীলু তাকিয়ে রইল।
সারা দিন তার আর অফিসের কাজে মন বসল না। বন্যার মতো প্ৰাণময় মেয়ের আজ কী অবস্থা! কী কঠিন দুঃসময়! সন্তানের মৃত্যুর পুরো দায়ভাগ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তার উপর। বন্যা নিজেও তা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
নীলু ঠিক করল, আগামী কাল সে ছুটি নেবে। বন্যা এলেই তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে। দূরে কোথাও যাবে বেড়াতে। বোটানিক্যালে গার্ডেনে কিংবা বলধা গার্ডেনে। কোথায় যেন সে পড়েছিল, গাছপালা মানুষের বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে পারে।
বন্যা পর দিন এল না। অফিস চারটায় ছুটি হয় নীলু পাঁচটা পর্যন্ত তার জন্যে অপেক্ষা করল। অফিসের গাড়ি চলে গিয়েছে। সে এক-একা বাসায় রওনা হল। রিকশা নিতে ইচ্ছা করছে না। হাঁটতে ভালো লাগছে। সন্ধ্যা নামছে। সন্ধ্যার বিষণ্ণ আলোয় তার মন কেমন করতে থাকে। জগৎ-সাংসার তুচ্ছ মনে হয়।
নীলুর হাতব্যাগে এক হাজার টাকা। তার কেন যেন মনে হল, এই টাকা নিতে বন্যা কোনো দিনই আর আসবে না।
শাহানা অসময়ে শুয়ে আছে।
এখন বাজছে সন্ধ্যা সাতটা। অথচ শাহানা মশারি খাটিয়ে শুয়ে আছে। জহির বিস্মিত হয়ে, ঘুমুচ্ছ নাকি? শাহানা বলল, হ্যাঁ।
একটু মনে হয় সকাল—সকাল শুয়ে পড়লে?
ভালো লাগছে না। ভালো না-লাগলে শুয়ে পড়তে হয় নাকি?
কী করব তাহলে?
কত কিছু করার আছে-বই পড়, টিভি দেখ, তোমাদের বাসা থেকে বড়িয়ে আস, শপিং-এ যাও।
শাহানা তার মাথার উপর লেপ টেনে দিল। সে আর কোনো কথা-বার্তায় উৎসাহী নয়। এখন সে ঘুমুবে।
জহির বলল, শাহানা, বাতি নিভিয়ে দেব?
দাও।
রাতে কিছু খাবে না?
না।
আমার উপর কি কোনো কারণে রাগ করেছ? শাহানা জবাব না-দিয়ে পাশ ফিরল। এর মানে পরিষ্কার বোঝা গেল না। হয়তো রাগ করেছে। অনেক চিন্তা করেও রাগের কারণ কী, জহির বের করতে পারল না। সে বাতি নিভিয়ে বসার ঘরে চলে গেল। টিভি চলছে। পর্দায় নানান ছবি, কিন্তু শব্দ নেই। এও শাহানার কাণ্ড। সে সন্ধ্যা হতেই টিভি ছেড়ে সামনে বসে থাকে। শব্দ ছাড়া টিভি দেখে। এর কী মানে, কে জানে! চেনাজোনা কোনো সাইকিয়াটিষ্ট থাকলে আলাপ করা যেত। তেমন কেউ নেই। জহিরের মনে হয় যে-কোনো কারণেই হোক, শাহানার মন খুব বিক্ষিপ্ত। প্রচুর কাজে তাকে ড়ুবিয়ে রাখতে পারলে মানসিক এই অবস্থাটা হয়তো কাটত। তাও করা যাচ্ছে না। শাহানা আর পড়াশোনা করতে রাজি নয়। সে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, কিন্তু ক্লাসে যাচ্ছে না। আর পড়াশোনা করবে না, এ-রকম একটা ঘোষণা গত সপ্তাহে দিয়েছে। জহির বলেছে, কোন পড়াশোনা করবে না?
ভালো লাগে না, তাই করব না।
সময় কাটবে কী করে?
যেভাবে কাটছে সেইভাবে কাটবে। আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবতে হবে না।
কেন ভাবতে হবে না?
জানি না। আমি এত সব প্রশ্নের উত্তর জানি না।
এই বলেই শাহানা উঠে গিয়ে শব্দহীন টিভির সামনে বসেছে। বসার ভঙ্গি দেখে মনে হয়, পর্দার ছবিগুলির নড়াচড়া দেখে সে খুব মজা পাচ্ছে। জহির এসে বসল। তার পাশেই! শাহানা তা যেন লক্ষই করল না। জহির বলল, সাউণ্ড দাও। বিনা শব্দের ছবিতে কী আছে?
শাহানা ক্লান্ত গলায় বলল, আমার এইভাবেই দেখতে ভালো লাগে।
শব্দ তোমার ভালো লাগে না?
না।
আগে লাগত? যখন তুমি তোমাদের বাড়িতে থাকতে?
জানি না। তোমাকে তো বলেছি, আমি এত সব প্রশ্নের উত্তর জানি না। জহির চুপ করে গেল। সে বুঝতে পারছে, তাদের দু জনের ভেতর দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এটাকে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। কীভাবে দূরত্ব কমান যায় তাও তার জানা নেই। এক দিন সে বলল, গান শিখবে শাহানা? গানের মাস্টার রেখে দিই? শাহানা হাঁ-না কিছুই বলল না। গানের মাস্টার এক জন এলেন। হারমোনিয়াম, তবলা, সেতার এল। হুঁলুস্কুল ব্যাপার। শাহানা দু দিন মাস্টারের কাছে বসে তৃতীয় দিনে বলল, ওনার কাছে গান শিখব না।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
উনি কথা বলার সময় মুখ থেকে থুথু বের হয়। আমার গায়ে থুথু লেগে যায়।
নতুন এক জনকে রেখে দেব?
দাও।
তোমার উৎসাহ আছে তো, নাকি আমাকে খুশি করবার জন্যে। শাহানা উত্তর দিল না। দ্বিতীয় মাস্টারও এক সপ্তাহের বেশি টিকলেন না। উনি খুব সিগারেট খান। সিগারেটের গন্ধে শাহানার মাথা ধরে যায়। তৃতীয় এক জন এলেন। ইনি কী করছেন না-করছেন জহির জানে না। গান শেখার সময়টাতে সে থাকে না। শাহানা রেয়াজ করে। কিনা তাও জহিরের জানা নেই। রেয়াজ করতে তাকে সে কখনো শোনে নি। জহির গানটাকে দেখছে। সময় কাটানোর একটা পথ হিসেবে। কিছু একটা নিয়ে শাহানা ব্যস্ত থাকুক। মনের অস্থিরতা কমুক। কিন্তু তা কি সত্যিই কমছে?
রফিকের অফিস শুরু হয়েছে গত মাসের গোড়ায়।
শুরুর পনের দিন কিছু করার ছিল না। রফিকের কাজ ছিল সকালে এসে অফিসে বসে থাকা। দুপুরবেলা ঘন্টখানিকের জন্যে ছুটি। হোটেল থেকে খেয়ে এসে আবার বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত একনাগাড়ে বসে থাকা। কথা বলার দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই, কারণ সাদেক আলি নানান জায়গায় ছোটাছুটি করছে। টাইপিস্ট হিসেবে একটি মেয়েকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে। সেও আসছে না। সাদেক আলিকে এই প্রসঙ্গে কিছু বলতেই বিচিত্র একটা ভঙ্গি করে বলেছে, সময় হলেই সে আসবে। কাজ নেই কোনো, এসে করবেটা কী? রফিক বিস্মিত হয়ে বলেছে, কাজ না থাকলে অফিসে আসবে না?
আসবে স্যার, আসবে। ওর কাজ তো স্যার অফিসে না। কাজ অন্য জায়গায়।
তার মানে?
এইসব স্যার এখন আপনার জানার দরকার নেই। তাহলে খারাপ লাগবে।
রফিক আর কিছু জিজ্ঞেস করে নি। জিজ্ঞেস করবার ইচ্ছেও হয় নি। দু দিন মেয়েটির সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তার কাছে মনে হয়েছে বেশ ভালো মেয়ে। চেহারা ভালো, স্মার্ট। কথায়-কথায় হাসে, এবং বেশ রসিক। রফিকের দু-একটা রসিকতায় সে বেশ শব্দ করে হাসল। একটু গায়ে-পড়া ধরনের স্বভাব আছে। সেই স্বভাব রফিকের কাছে খুব খারাপ লাগে নি। প্রথম দিনেই সে রফিককে বলেছে, আমার ডাক নাম হল কুসুম। আপনি স্যার আমাকে কুসুম ডাকবেন। আমার ভালো নাম নিজের কাছেই সহ্য হয় না। অবশ্যি কুসুমও খুব বাজে নাম।
আপনি টাইপ কেমন জানেন?
কাজ চালাবার মতো জানি। এইসব অফিসে তো স্যার মিনিটে পঞ্চাশ ওয়ার্ড টাইপ করার দরকার নেই। সমস্ত দিনে হয়তো তিন থেকে চারটা চিঠি টাইপ করা হয়।
তাই নাকি?
জি স্যার। কাজকর্ম হয় টেলিফেনে এবং টেলেক্সে। এই জাতীয় কাজের সঙ্গে আমি অনেক দিন থেকেই আছি। সবই জানি।
অনেক দিন মানে কত দিন?
প্ৰায়ছ বছর।
আগের চাকরিটা ছাড়লেন কেন?
খাটুনি বেশি ছিল, সেই তুলনায় রোজগার ছিল না। নতুন ফার্মগুলিতে খাটুনি থাকে কম, রোজগার হয় বেশি। স্যার, আপনি কিন্তু আমাকে তুমি করে বলবেন।
কেন?
ছোট ফার্ম, সবাই বলতে গেলে ফ্যামিলি মেম্বারের মতো। তাই নয় কি স্যার?
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
এক-একা অফিসে বসে থাকার মতো যন্ত্রণা অন্য কিছুতেই নেই। টেলিফোন লাইন এসেছে গত সপ্তাহে। ইদরিসের সঙ্গে কথাবার্তা বলে কিছু সময় কাটছে। তবে ইদরিসও ব্যস্ত মানুষ। বকবক করার সময় কোথায় তারা? টেলিফোন করলেই দু-একটা কথা বলার পরই বলে, দোস্ত, তাহলে রাখলাম। রফিক সহজে রাখতে দেয় না।
ইদরিস, বসে থাকতে থাকতে তো শিকড় গজিয়ে গেল। কাজ-কর্ম কিছু নেই।
হবে দোস্ত, হবে। ধৈর্য ধর ধৈর্য ধরা-বাঁধ বাঁধ বুক।
আর কত ধৈৰ্য ধরব?
এইসব অফিসের কর্তাদের হতে হয় মাকড়সার মতো। জাল ফেলে লুকিয়ে বসে থাকতে হয়। জালে কিছু একটা পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সুতো দিয়ে পেচিয়ে ফেলতে হয়। এক বার তো পড়েছিল, তুই তো পেঁচাতে পারলি না, অন্য পার্টি নিয়ে নিল। চিন্তা করিস না, আমি সাদেক আলিকে একটা বড়ো টিপস দিয়েছি। হতে পারে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, হবার সম্ভাবনা আশি ভাগ, তবে এইসব লাইনে কিছুই বলা যায় না। শেষ দেখবি ডাইস উল্টে গেল। রাখলাম দোস্ত!
ব্যাপারটা কী বল। কাজটা কী?
কাজ শুনে তুই করবিটা কী? বসে মাছি মারছিস, মাছি মার। যা করবার সাদেক আলি করবে। ও টাকা পয়সা যা চায়, সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিবি কী জন্যে চাচ্ছে, কিছু জিজ্ঞেস করবি না।
রহস্যসয়া ব্যাপার মনে হচ্ছে!
রহস্য কিছু না। দোস্ত রাখলাম।
ইদরিসের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হয়েছে চার দিন আগে। এই চার দিনে কাজের অগ্রগতি কী হচ্ছে, রফিক কিছুই জানে না। সাদেক আলিকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে। তারও উপায় নেই। তার দেখাই পাওয়া যায় না।
আজ রফিক অফিসে এসে খুব বিরক্তি বোধ করল। গাদাখানিক ম্যাগাজিন জোগাড় করে রেখেছিল, অফিসে নিয়ে আসবে। পড়ে সময় কাটাবে। আসার সময় ভুলে ফেলে এসেছে। আবার ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। অফিসে কোনো লোকও নেই যাকে পাঠানো যাবে। রফিকের ইচ্ছা ছিল এক জন অফিস এ্যাসিসটেন্ট রাখার। সাদেক আলি রাজি হয় নি। দাঁত বের করে বলেছে, এখনো সময় হয় নি স্যার। সময় হলে সব হবে। অফিস এ্যাসিসটেন্ট হবে, পি.এ.হবে, ক্যাশিয়ার হবে, হেডক্লার্ক হবে। কয়টা দিন ধৈৰ্য্য ধরেন।
রফিক ধৈৰ্য ধরেই আছে। ধৈর্যেরও সীমা আছে। এখন একেবারে সীমা অতিক্রম করার মতো অবস্থা। রফিক ইলেকট্রিক হিটার বসিয়ে দিল। আপাতত চমৎকার জাপানি কাঁপে চা খাওয়া যাক। চা খেতে-খেতে জীবন সম্পর্কে কিছু ফিলসফিক চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে। লেখার অভ্যাস থাকলে সময়টা কাজে লাগত। দারুণ রোমান্টিক একটা গল্প ফাদা যেত। যেখানে তিনটি মেয়ে ভালোবাসে একটি ছেলেকে। ছেলেটি আবার চতুর্থ একটি মেয়েকে ভালোবাসে। কিন্তু সেই মেয়ে বিবাহিতা। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই আছে। জটিল পঞ্চভুজ প্রেম। সবচে ভালো হয় নিজেকে নিয়ে গল্প শুরু করলে। ধনী বাবার কন্যা ভালবাসত প্রবাসী এক ছেলেকে। হঠাৎ কী মতিভ্রম হল, বিয়ে করে বসল। চালচুলো নেই এক বেকার যুবককে। সেই বেকার যুবক হচ্ছে এক জন আদর্শবান, অনুভূতিপ্রবণ, কোমলহৃদয় পুরুষ।
রফিক বসে আছে চুপচাপ। গল্প তরতর করে এগুচ্ছে। মনে মনে গল্প লেখার কাজটা এত সহজ, তার ধারণা ছিল না। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে টেলিফোন ধরল।
হ্যালো।
স্যার, আমি সাদেক।
কী খবর সাদেক সাহেব?
হাজার পাঁচেক টাকা দরকার স্যার। আধা ঘণ্টার মধ্যে।
কেন?
ব্যাপার আছে স্যায়! একটা মেয়ে আসবে আপনার কাছে। তাকে টাকাটা দেবেন। নাম হচ্ছে নমিতা। নমিতা নাম বললেই টাকাটা দিয়ে দেবেন। আমি আসতে পারছি না। অন্য জোগাড়যন্ত্র করতে হচ্ছে।
ক্যাশ টাকা তো নেই।
ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়ে আসেন স্যার। যাবেন আর আসবেন। মেয়েটা যেন আবার না চলে যায়।
মেয়েটা কে?
তা দিয়ে আমাদের দরকার নেই। কাজ হওয়া দিয়ে কথা। বহু কস্টে একে জোগাড় করা হয়েছে।
ব্যাপারটা কী একটু বলুন।
একটা ঘরোয়া ধরনের পার্টির মতো হবে। ঐ সব পাটির শোভা দুজন মেয়ে যাবে শোভা হিসেবে। একজন হচ্ছে আমাদের কুসুম, অন্য জননমিতা। রাস্তার মেয়ে তো আর পাঠানো যায় না। সবটা নির্ভর করছে ওদের উপর। স্যার, আমি টেলিফোন রাখলাম, আপনি টাকাটার জোগাড় দেখেন।
নমিতা কোনো রকম কথা ছাড়া টাকাটা তার ব্যাগে তরল। কী মিষ্টি চেহারা মেয়েটির চোখ দুটি বিষন্ন। ছায়াময় চোখ বোধহয় একেই বলে। বড়ো বড়ো পল্লব ছায়া ফেলেছে চোখে। মেয়েটির গায়ে গাঢ় নীল রঙের একটা চাদর। এই নীল রঙের জন্যেই কি তাকে এত বিষণ্ণ দেখাচ্ছে?
নমিতা বলল, আমি আপনার অফিসে খানিকক্ষণ বসব। সাদেক আলি সাহেব এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।
বসুন।
উনি কি আমার ড্রেস সম্পর্কে কিছু বলেছেন?
না, কিছু বলে নি। যা পরে এসেছেন তাতেই আপনাকে খুব চমৎকার লাগছে। w
মেয়েটি এক পলক তাকালি রফিকের দিকে।
বরফের মতো শীতল চোখ। কোনো রকম আবেগ-উত্তেজনা সেখানে নেই। রফিকু বলল, আপনি কি চা খাবেন?
না।
আমি খাব। আমার সঙ্গে এক কাপ চা খান।
মেয়েটি হ্যাঁ-না কিছুই বলল না। রফিক দু কাপ চা বানোল। এক কাপ রাখল মেয়েটির সামনে। সে এই চা ছুঁয়েও দেখল না। ক্লান্ত গলায় বলল, দুটা প্যারাসিটামল এনে দিতে পারেন?
এক্ষুণি এনেদিচ্ছি। যাব আর আসব।
আপনি নিজেই যাবেন?
মেয়েটি হেসে ফেলল। কী সুন্দর হাসি! রফিকের ইচ্ছা হল বলে-আপনার কোথাও যেতে হবে না। আপনি বাড়ি যান। আমরা অধিকাংশ কথাই বলতে পারি না।
শারমিন ছাদে একা-একা হাঁটছিল। এ বাড়ির ছাদে সে খুব কম আসে। কেন জানি তার ভালো লাগে না। ছাদে উঠলেই নিজেদের বাড়ির বিশাল ছাদের কথা মনে হয়। উঁচু রেলিংঘেরা ছোটখাট ফুটবল মাঠ। সেখানে যখন শারমিন গিয়ে দাঁড়াত, আশেপাশের কেউ তাকে দেখতে পেত না। কত সহজেই একা হওয়া যেত। এখানে সে সুযোগ নেই। চিলেকোঠার ঘরে থাকে আনিস। আশপাশের বাড়ির কয়েক জন ছেলেমেয়েও এখানে খেলতে আসে। চেঁচিয়ে মাথা ধরিয়ে দেয়।
আজ অবশ্যি কেউ নেই। আনিসের ঘর তালাবন্ধ। দরজার উপর একটা কাগজে বড়ো বড়ো করে লেখা-আমি এ সপ্তাহের জন্যে বাইরে গেলাম। সেই এক সপ্তাহ কবে শুরু হবে আকার কবেই—বা শেষ হবে, কে জানে। শারমিনের খুব ইচ্ছা করল ছোট ছোট করে লেখে—আপনার এই সপ্তাহ কবে থেকে শুরু।
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। শারমিনের মন খারাপ হয়ে গেল। ভেবেছিল সন্ধ্যা মেলানোর আগ পর্যন্ত ছাদে থাকবে। সূর্য ডোবা দেখবে সেটা আর সম্ভব হল না। পৃথিবীটাই এমন, যারা একা থাকতে চায়, তারা একা থাকতে পারে না। রাজ্যের মানুষ এসে তাদের চারপাশে ভিড় করে।
শারমিন।
আরে ভাবী, তুমি!
নাও, চা নাও।
বুঝলে কী করে আমি ছাদে?
নীলু হাসতে বলল, আমি হচ্ছি মহিলা শার্লক হোমস। ছাদে কী করছ?
তেমন কিছু না। এবার শীত তেমন পড়ল না, তাই না ভাবী?
হুঁ। ফাল্গুন চলে এসেছে নাকি?
কী জানি। আমি এখন আর দিন-তারিখের হিসাব রাখি না।
শারমিন রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়াল। নীল বলল, তোমার কী হয়েছে শারমিন, বল তো?
কই, কিছু হয় নি তো।
কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছ। রফিকের সঙ্গে কি কোনো কিছু নিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ?
না।
ও কী সব অফিস-টফিস খুলেছে, তুমি তো দেখতেও যাও নি!
যাব একদিন, দেখে আসব।
তুমি বাইরে চলে যাবে, এ-রকম একটা কথা শুনতে পাচ্ছি। এটা কি গুজব না। সত্যি?
সত্যি।
রফিক এক জায়গায়, তুমি এক জায়গায়?
হ্যাঁ।
এটা কি ভালো হবে?
শারমিন অল্প হাসল। খুব সহজেই সেই হাসি ঠোঁট থেকে মুছে ফেলে বলল, কত ছেলেই তো বৌকে ফেলে পি-এইচ.ডি. করতে যায়। আমি গেলে সেটা দোষের হবে কেন?
দোষের হবেনা। এখন তোমাদের দুজনেরই ভালোবাসাবাসির সময়। এ সময় আলাদা হওয়াটা ঠিক হবে না। তুমি আরো ভালো করে ভেবে দেখা।
দিন-রাতই ভাবছি।
বরং একটা কাজ কর, তুমি তোমাদের বাড়িতে গিয়ে থাক। একটা বৈচিত্ৰ্য আসুক। দিনের পর দিন এক জায়গায় থেকে তুমি হাঁপিয়ে উঠেছ। কিছুদিন ওখানে থাকলে তোমার ভালোলাগবে।
শারমিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমিও তাই ভাবছি ভাবী।
এত ভাবাভাবির কিছু নেই। বেশ কিছু দিন থেকে আসা। এখানে দিন-রাত কেমন গম্ভীর হয়ে থাক, আমার ভয়-ভয় লাগে। রফিকের না-छनेि না जवश्ा।
নীলু তরল গলায় হেসে উঠল। শারমিন বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় চলে গেলে কেমন হয় ভাবী।
আজই যাবে?
বাড়িওয়ালার বাসা থেকে টেলিফোন করলেই গাড়ি চলে আসবে। ভাবী, যাব?
বেশ তো, যাও। রফিককেও আমি পাঠিয়ে দেব।
নীলু লক্ষ করল শারমিনের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দিনের শেষ আলো পড়েছে শারমিনের চুলে। চুলগুলি কেমন লালচে দেখাচ্ছে। সুন্দর লাগছে। শারমিনকে।
রফিক বাসায় ফিরল রাত নটায়। তাকে দেখেই টুনি বলল, ছোট চাচী চলে গিয়েছে। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, কোথায় গেছে?
ওনার নিজের বাড়িতে। সব জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। মনে হয়। আর আসবে का!
রফিক গম্ভীর হয়ে গেল। রাত এগারটায় ম্যানেজার সাদেক আলি এসে ংশুমুখে বলল, স্যার, কাজটা হয় নি।
রফিক শান্ত স্বরে বলল, না হলে কী আর করা যাবে? আপনি আপনার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। বাড়ি যান, বিশ্রাম করুন। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যে মারা যাবেন।
সাদেক আলি মৃদুস্বরে বলল, ওরা স্যার আগেই অন্য পার্টির সঙ্গে সব ঠিকঠাক করে আমাকে বলেছে একটু আমোদ-আহল্লাদের ব্যাবস্থা করতে। বলেছে—আমাদের খুশি করে দিন, তারপর দেখুন। আপনাদের খুশি করতে পারি। কিনা।
ঠিক আছে বাদ দিন। যা হবার হয়েছে।
আমি বাদ দেব? বলেন কী স্যার? আমার নাম সাদেক আলি না? আমার সাথে মামদোবাজি করবে, আমি চুপ করে থাকব?
কী করবেন আপনি?
আমি যে কী পরিমাণ শয়তান, আপনি তা জানেন না স্যার।
সাদেক আলি সাহেব!
জ্বি?
কাজটা না-হওয়ায় আমি খুশিই হয়েছি। সামান্য একটা কাজের জন্যে আমি মেয়েমানুষ পাঠাব, এটা তো হয় না। আমি ভদ্রলোকের ছেলে। আমার বাবা জীবনে কোনো দিন মিথ্যা কথা বলেন নি। আমার এক মামা-কবির মামা, তিনি তাঁর নিজের জীবনটা দিয়ে দিয়েছিলেন অন্যের জন্যে। সাদেক আলি সাহেব, আমার সারাটা দিন খুব মনখারাপ ছিল। কাজটা হয় নি। শুনে মনটা ভালো হয়েছে।
আপনি তো স্যার ব্যবসা করতে পারবেন না!
বোধহয় পারব না। বসুন, এক কাপচা খেয়ে তারপর যান।
সাদেক আলি বলল, আপনার মন ভালো হয়েছে, খুব ভালো কথা। আমার মনটা এখনও খারাপ, ঐ শালাকে শিক্ষা দিতে না পারলে স্যার আমার মন ভালো হবে না। চা খাব না স্যার। আমি যাই। স্নামালিকুম।