1 of 2

৪০. জয়িতা হতভম্ব

জয়িতা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তার মনে হল সে বোধ হয় সব কথার অর্থ ঠিক বুঝতে পারছে না। কোন মেয়ে প্রকাশ্যে এই রকম আকাঙক্ষা নির্লজ্জ ভঙ্গিতে জানাতে পারে? আনন্দ এবং সুদীপ এগিয়ে এসেছিল। গ্রামের লোকেরাও ভিড় করে দাঁড়িয়েছে এখন। বন্দীদের ছেড়ে দেওয়াতে ওদের মুখে স্পষ্টতই অসন্তোষ। কিন্তু এখন এই যুবতীকে নিয়ে কি করা যায় সেটাও প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ও কি বলছে রে? ওরা কি ওকে অসম্মান করেছে?

জয়িতা কোন উত্তর দিল না। ওর শরীর ঘিন ঘিন করছিল। মেয়েটাকে তার হঠাৎ খুব কুৎসিত বলে মনে হল। যেন একটা আকাঙক্ষা ওর সমস্ত সৌন্দর্যের ওপর কাদা ছড়িয়ে দিয়েছে। সে কোনরকমে জিজ্ঞাসা করতে পারল, তোমার এমন কথা বলতে লজ্জা করছে না?

লজ্জা করবে কেন? আমি কি বুড়ি হয়ে গেছি? আমি কি তোমার মত মেয়ে হয়েও ছেলে সেজে থাকি? প্রশ্নটা স্বাভাবিক গলায় নয়।

ওর তীব্র কণ্ঠ যেন সমস্ত চরাচরে ছড়িয়ে পড়ল। আর সেটা কানে যাওয়ামাত্র জয়িতার শরীরে যেন হিমালয়ের বাতাস ঢুকে পড়ল। তার কাঁপুনি এল। কোনরকমে পালদেমের দিকে তাকিয়ে সে বলতে পারল, একে তোমরা বোঝাও।

তারপর যেন শীতলতা অতিক্রম করতেই সে জোরে জোরে পা চালাল। সুদীপ এবং আনন্দ তো বটেই, গ্রামের তাবৎ মানুষ অবাক হয়ে ওর যাওয়াটা দেখল। এই যাওয়াটা যে স্বাভাবিক নয় তা প্রত্যেকের কাছেই স্পষ্ট কিন্তু কারণটা নিয়ে কেউ একমত হতে পারত না। আনন্দ দেখল জয়িতা তাদের আস্তানার ভেতরে ঢুকে গেল। সে পালদেমকে বলল, অনেক রাত হয়ে গেছে, এবার তোমরা শুয়ে পড়।

পালদেম এগিয়ে গেল গ্রামবাসীদের কাছে। ওরা নিচু গলায় কথা বলল কিছুটা সময়। তারপর পালদেম ফিরে এসে বলল, ওদের ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজ করা হয়নি। আমাদের ভয় হচ্ছে ওরা আবার আক্রমণ করতে পারে চোরের মত। এখন আর সামনা-সামনি আসবে না তোমাদের জন্যে। তাছাড়া ওরা আমাদের দেবতাকে নোংরা হাতে স্পর্শ করেছে। এই অন্যায়ের জন্যেও ওদের শাস্তি হওয়া উচিত ছিল।

আনন্দ বলল, শাস্তি দিলে অপরাধ আরও বেড়ে যেত। তোমরা নিশ্চয়ই চাও শান্তিতে বসবাস করতে। ওরা যদি আবার আক্রমণ করে তাহলে আমরা কোন দয়া দেখাব না। আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখো তোমরা।

পালদেম তার গ্রামবাসীদের এই কথা জানালে তারা ধীরে ধীরে ঘরে ফিরতে লাগল। এখন আকাশে চমৎকার জ্যোৎস্না। ও-পাশে পাহাড়ের গায়ে যেন রুপোর ঢল নেমেছে। আনন্দরা দাঁড়িয়েছিল। দেখা গেল সমস্ত মানুষ চলে যাওয়ার পরেও মেয়েটি মাটি থেকে ওঠেনি। দুটো হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সে চুপচাপ বসে আছে। সুদীপ তাকে ডাকল, এই যে, তুমি এখানে বসে আছ কেন?

মেয়েটি কোন জবাব দিল না। তার বসার ভঙ্গিতে এক ধরনের অসহায়তা থেকে উত জেদ প্রকট হচ্ছিল। সুদীপ চিৎকার করে পালদেমকে ডাকল। পালদেম ফিরে যাচ্ছিল। বন্দী-মুক্তির কারণে সে যে। সন্তুষ্ট নয় তা বোঝা যাচ্ছিল। ডাক শুনে সে পেছন ফিরে তাকাল। সুদীপ চিৎকার করেই বলল, এই মেয়েটা যে এখানে একা পড়ে রইল।

পালদেম নিরাসক্ত গলায় বলল, তাতে আমার কি?

হঠাৎ মেয়েটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, আমার কি, আমার কি!

সুদীপ চাপা গলায় আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, পাগল হয়ে গেল নাকি? তারপর পালদেমকে ইশারায় ডাকল। নিতান্ত বাধ্য হয়েই পালদেম ফিরে এল। সুদীপ বলল, একে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছ

কেন?

পালদেম বলল, কে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে? ওর সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। গ্রামের লোকের ধারণা ওর প্রশ্রয় না পেলে ওরা এখানে আসত না।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ধারণা, প্রমাণ তো নেই।

প্রমাণ আছে। ওকে যখন ওরা নিয়ে যাচ্ছিল তখন একটুও চিৎকার করেনি সাহায্যের জন্যে। তারপরেও ওর হুঁশ হয়নি জো-কে অপমান করেছে। পালদেম জানাল।

জো! সুদীপ অবাক হল, জো কে?

যে আমাদের সম্মান বাঁচাল। তোমাদের বন্ধু।

সুদীপ এবার হো হো করে হেসে উঠল, বাঃ, সুন্দর নাম দিয়েছ তো! জয়িতা থেকে জো!

আনন্দ বলল, ঠিক আছে। কিন্তু পালদেম, এভাবে পড়ে থাকলে তো ও মরে যাবে ঠাণ্ডায়। তোমরা ওকে অন্য গ্রামে যেতেও দেবে না, আবার গ্রামেও জায়গা দিতে চাইছ না, এটা কি রকম ব্যাপার?

হঠাৎ পালদেম বলল, এটাই এই গ্রামের নিয়ম। ও থাকবে নিজের মত। যতদিন গ্রামের কোন ছেলে ওকে বিয়ে না করছে ততদিন ও কোন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবে না। অবশ্য যেহেতু ও একবার সংসার করেছে তাই বিয়ে না করেও কেউ যদি স্বীকৃতি দেয় তাহলে একই কথা হবে। এসব ও জানে। তাই নিজে থেকে ফিরে যাচ্ছে না ঘরে। আমি চলি।

ওকে চলে যেতে দেখে আনন্দ মন্তব্য করল, ভাগ্যিস বলেনি এটা আমাদের গ্রামের ব্যাপার, তোমরা নাক গলিও না।

সুদীপ বলল, এখন আর বলবে না। মালপত্তর হাতছাড়া হয়ে গেছে তো। কিন্তু একে নিয়ে কি করা যায়?

আনন্দ কয়েক পা এগিয়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়াল, তুমি ঘরে ফিরে যাচ্ছ না কেন?

মেয়েটা মাথা নাড়ল। কিন্তু কিছু বলল না। আনন্দ আবার জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওই গ্রামে যেতে চাও?

মেয়েটা এবার মুখ তুলে তাকাল। এখন তার চোখে জল। ঠোঁট কাপছে। কোনরকমে বলল, ওরাও আর আমাকে নেবে না। আমি মরে যেতে চাই। আমার কেউ নেই, কেউ নেই।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কিভাবে মরবে?

মেয়েটা হাত তুলে দূরের পাহাড় দেখাল, ওই ওখান থেকে লাফিয়ে পড়ব।

সুদীপ বলল, ওটা কালকে করলে হয় না? আজকের রাতটা একটু ভাল করে ঘুমিয়ে নাও।

মেয়েটা এবার উঠে দাঁড়াল, আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ, না? ঠিক আছে, আমি মরে দেখাচ্ছি। কথা শেষ করেই মেয়েটা পাহাড়ের দিকে ছুটতে লাগল।

আনন্দ উত্তেজিত হল, সর্বনাশ, ও সত্যি সত্যি আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সুদীপ, ইনস্যানিটি গ্রো করেছে। ওকে থামা। কেন যে ইয়ার্কি করিস।

সুদীপ হকচকিয়ে গিয়েছিল। এবার সে-ও ছুটল। খানিকটা উঁচু পথ ভাঙতেই তার হাঁফ ধরে গেল। কিন্তু এই নির্জন হিম-জ্যোৎস্না রাত্রে একটি মেয়ে পৃথিবীতে আর থাকতে চাইছে না শুধু তার রসিকতার কারণে এই বোধ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। মেয়েটা কোনদিকে তাকাচ্ছে না। সুদীপ ক্রমশ দূরত্বটা কমিয়ে আনছিল। এই পথের শেষেই খাদ। সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়লে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মেয়েটির হাত ধরল। স্পর্শ পাওয়ামাত্র তীব্র চিৎকার করে মেয়েটি ঝটকা মারল নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। সুদীপ প্রথমে টালমাটাল হল। মেয়েটির শরীরে ভাল শক্তি আছে। ওর নখের আঘাতে তার মুখ জ্বলছে। মুহূর্তের জন্যে আলগা হয়েছিল মেয়েটি। এবং সেই সুযোগে আবার ছুটতে চাইল। আক্রমণ, বিশেষত নখের জ্বালায় মাথায় আগুন জ্বলে গেল সুদীপের। সে প্রচণ্ড জোরে মেয়েটিকে আঘাত করল। মেয়েটি টলে গেল, তারপর হুমড়ি খেয়ে আছড়ে পড়ল পাথরের ওপরে যেখান থেকে খাদের দূরত্ব খুব বেশি নয়। চাঁদের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে সুদীপ নিজের মুখে হাত বোলাচ্ছিল। তার গালের চামড়া ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরা এখনও বন্ধ হয়নি। শালা, মেয়েটার উপকার করতে গিয়ে এই হল! নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তার। সেই সময় আনন্দর গলা কানে এল, মেরে ফেললি নাকি? অত জোরে মারতে আছে?

জ্ঞান দিস না। দ্যাখ, আমার মুখের কি অবস্থা করেছে! নেকড়ে মাইরি, পাহাড়ি নেকড়ে! সুদীপ ঝঝিয়ে উঠল।

আনন্দ ওর মুখের দিকে তাকাতে জ্যোৎস্নায় রক্ত দেখল। সে একটু উদ্বেগের সঙ্গে বলল, চটপট ঘরে গিয়ে ডেটল লাগা। মানুষের নখের বিষ তার ওপর। সে এগিয়ে গেল মেয়েটির কাছে। ঝুঁকে দেখল ওর নিঃশ্বাস পড়ছে। কিন্তু চেতনা নেই। আঘাত বোধ হয় বেকায়দায় হয়ে গেছে। এখন যদি মেয়েটার কিছু হয় তাহলে গ্রামবাসীরা উলটে তাদের দায়ী করবে। সুদীপটা এখানে আসার পর থেকে ইচ্ছে বা অনিচ্ছায় একটার পর একটা ঝামেলা বাধাচ্ছে। উঠে দাঁড়িয়ে আনন্দ উষ্ণ গলায় জিজ্ঞাসা করল, তুই এটা কি করলি? এত জোরে কাউকে মারতে আছে? এ মেয়েটা মরে গেলে কি হবে?

ও তো মরতেই যাচ্ছিল। সুদীপ এগিয়ে এল কাছে, ঠিক আছে, তুই যা, আমি দেখছি।

আনন্দ কাঁধ ঝাঁকাল। সে আর দাঁড়াল না। আর একটা নতুন ঝামেলা আসছে কিন্তু তার কিছু করার নেই। যাওয়ার আগে বলে গেল, মেয়েটার জ্ঞান ফিরলে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে চলে আসিস। রাত শেষ হতে চলল।

সুদীপ কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটার মাথার পাশে একটা পাথরে বসল। এখন তার আরও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। সে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আনন্দর চলে যাওয়া দেখল। একটু ঝুঁকে সে মেয়েটার গালে চড় মারতে লাগল আলতো করে, আই অ্যাই মেয়েটা, উঠে পড়। বেশ খানিকটা চেঁচামেচির পর চোখ মেলল মেয়েটা। দৃষ্টি স্বচ্ছ হতেই সে আতঙ্কিত হতে গিয়ে অবাক হল। দুর্বোধ্য একটা শব্দ করে আঙুল তুলে সে সুদীপের মুখটাকে দেখতে চাইল। সুদীপ ঠোঁট ওল্টাল, এ তোমারই দান খুকী। এবার ঘরে যাও।

বাংলায় বলার জন্যেই সম্ভবত মেয়েটা কিছু বুঝতে পারল না। সুদীপ এবার তাকে হাত ধরে দাঁড় করাল। উঠে দাঁড়িয়েই মেয়েটা আবার কান্না শুরু করল। একটু নার্ভাস গলায় সুদীপ তাকে বলল, শোন, আত্মহত্যা করা খুব কাজের ব্যাপার নয়। কার জন্যে নিজেকে মাবছ? পৃথিবীটা কি ভাল, একে ছেড়ে যেতে হয়! ওই দ্যাখ, মাথার ওপর কি সুন্দর চাঁদ! তুমি একে আর দেখতে পাবে মরে গেলে? অবশ্য এখানে আর কিছুক্ষণ দাঁড়ালে আর খাদে ঝাঁপ দিতে হবে না, এমনিতেই পৃথিবী ছাড়তে হবে। তার চেয়ে আজ রাত্রে তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়। চল। এসব কথাই সুদীপ বলছিল হিন্দীতেও নয়, কিন্তু মেয়েটা যেন তার অর্থ বুঝতে খুব চেষ্টা করছিল। এবং তার হাতের ইঙ্গিত বুঝে উঁদের দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। সুদীপ ওর কাঁধ ধরে টানতে মেয়েটা সম্মোহিতের মত হাঁটতে লাগল। পুরোটা পথ কেউ কোন কথা বলল না। গ্রামের ভেতর ঢুকে সুদীপ ভাঙা শব্দ ব্যবহার করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার ঘরটা কোথায়? মেয়েটা এবার চারপাশে তাকাল। তারপর একটা ভোলা দরজা আঙুল তুলে দেখাল। সেই দরজার কাছে ওকে পৌঁছে নিয়ে সুদীপ ফিরল। যেন হঠাৎ বিরাট একটা বোঝা তার মাথা থেকে নেমে গেল। অত্যন্ত হালকা পায়ে সে চাঁদ মাথায় নিয়ে হাঁটতে চোখ তুলল ওপরে। তারপর স্মৃতি থেকে শব্দ তুলে নিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে লাগল, এইখানে পৃথিবীর এই ক্লান্ত এ অশান্ত কিনারার দেশে/ এখানে আশ্চর্য সব মানুষ রয়েছে।

তাদের সম্রাট নেই, সেনাপতি নেই তাদের হৃদয়ে কোন সভাপতি নেই;/ শরীর বিবশ হলে অবশেষে ট্রেড-ইউনিয়নের কংগ্রেসের মত কোন আশা হতাশার কোলাহল নেই।

আস্তানায় ফিরে এসে ও দাঁড়িয়ে পড়ল। আনন্দ প্রায় চিৎকার করে বলছে, তোদের জন্যে আমি পাগল হয়ে যাব জয়িতা। একজন দার্জিলিং-এ গেল তো গেলই। আর একজন এমনভাবে মেয়েটাকে মেরেছে যে মরে গেলে আর দেখতে হবে না। তারপরে তুই-ও!

আমি কি? জয়িতার গলা তীক্ষ্ণ, আমি তোর কি অসুবিধে ঘটালাম?

এই ঠাণ্ডায় তুই আমাকে বাইরে যেতে বললি। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করতে নিজেই যাচ্ছিল। ব্যাপারটা কি তা জানার প্রয়োজন বোধ করছিস না। হঠাৎ যে কি খামখেয়ালিপনা শুরু হল সবার।

তুই অযথা উলটাপালটা ভাবছিস।

অযথা? ও। তোর যদি প্রাকৃতিক প্রয়োজন থাকে সেটা বলতে পারতিস। প্রশ্ন করলে যা হোক জবাব দিতে কি হয়? উই ওয়ান্ট টু ড়ু সামথিং হেয়ার। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হোক চাই না।

ঠিক আছে। আমি নিজে কিভাবে বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তুই ভুলে গেছিস আমি একটা মেয়ে। আই অ্যাম হ্যাভিং মাই পিরিওড়। এই ঘরে সবার সামনে! জয়িতার গলাটা থেমে গেল।

যাচ্চলে। এটা নিয়ে এত ভাবনা করার কি আছে! এতক্ষণ বলতে কি হচ্ছিল। তোরা না এখনও এইটিন সেঞ্চুরিতে থেকে গেলি। এটা অন্তত তোর কাছে আশা করিনি।

তুই এমন গলায় বলছিস যেন আমার হাত কেটে গেছে।

তার বেশি কি। শান, ওই ব্যাগটা এখানে আনার পর ভোলা হয়নি। ওটা তোর প্রয়োজনে লাগবে। আমি বাইরে যাচ্ছি।

কি আছে ওতে?

তোর প্রয়োজনীয় জিনিস।

মাই গড! তুই এসব এনেছিস? কখন আনলি?

আনন্দর গলা শোনা গেল না। কিন্তু দরজা খোলার শব্দ হল। জয়িতার চিৎকার কানে এল, আনন্দ, তুই খুব ভাল, খুব। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ।

আনন্দকে দেখা গেল, থাক আর ন্যাকামো করতে হবে না। ছেলে বলেই ভেবে এসেছিস এতদিন, বন্ধু বলে নিতে পারিসনি। তারপরেই আনন্দ সুদীপকে দেখতে পেল। সুদীপ চুপচাপ সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখাচোখি হতে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, মেয়েটাকে পৌঁছে দিয়েছিস?

সুদীপ নীরবে ঘাড় নাড়ল। আনন্দ এগিয়ে এল, এই নে, আচ্ছা দাঁড়া, মুখ তোল, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। সুদীপ দেখল আনন্দর হাতে ডেটল আর তুলল। সে ঠোঁট কামড়াল। হঠাৎ তার শরীর সমস্ত জলকণা বুকের মধ্যে ছুঁড়ে দিচ্ছিল। প্রাণপণে নিজেকে শাসন করার চেষ্টা করছিল সে। আনন্দ ডেটলে ভেজানো তুলো মুখে চেপে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কাঁদছিস। এত জ্বলছে?

সুদীপ কোন কথা বলল না। অনেক কষ্টে সে নিজেকে অতিক্রম করতে পারল। তারপর ছাউনির তলায় পা ভাজ করে বসল। আনন্দ বসতে বসতে বলল, যা ঠাণ্ডা, আমার স্কিন-ডিজিজ না হয়ে যায়। নাক-টাক সবার ফেটে গেছে।

সুদীপ কিছু বলল না। ওর কথা বলতে খুব ভয় হচ্ছিল। জ্যোৎস্না ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। চাদের যেন আর সে তেজ নেই। সুদীপ লক্ষ্য করল আনন্দ জয়িতার ব্যাপারটা বলল না। একই বয়সী, অথচ এই মুহূর্তে সুদীপের মনে হল আনন্দ অনেক এগিয়ে আছে। সে এইভাবে কথা বলতে পারত না জয়িতার সঙ্গে।

আনন্দ বলল, আর কদিনের মধ্যে বরফ পড়বে। আমরা তো কেউ কখনও বরফের মধ্যে থাকিনি। বই-পড়া বিদ্যেগুলো কাজে লাগানো যাবে। কিন্তু এ বছর খুব দেরি হয়ে গেলেও, এর মধ্যে বুঝলি, যতটা পারি গুছিয়ে নিতে হবে যাতে লোকগুলো বরফের সময় কিছুটা আরাম পায়। সে যেন কিছু ভাবছিল, সুদীপ, কাল তুই একটা কাজ করিস। এই গ্রামে ঠিক কটা পরিবার আর পরিবার পিছু মানুষের সংখ্যা কাউন্ট করে নিস। সেই বুঝে আমাদের একটা হিসাব করতে হবে। এই গ্রামটার চেহারা একদিন পালটে দিতে হবে সুদীপ। প্রত্যেকটা মানুষ যেন বুঝতে পারে সে জন্মেছে শুধু মরে যাওয়ার জন্যে নয়।

আনন্দর স্বরে উত্তেজনা ছিল। সুদীপ ওর দিকে তাকাল। আনন্দর বাবা নকশাল রাজনীতি করতেন। আনন্দ একদিন বলেছিল ওর প্রপিতামহ গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের শরিক ছিলেন, জেলও খেটেছেন। ওর রক্তে অনেক বিশ্বাস অবিশাস মোমেশি হয়ে নিজস্ব চেহারা তৈরি করে নিয়েছে। গোটা ভারতবর্ষের চেহারা ফেরানোর কথা অনেকেই ভাবে। কিন্তু সেটা ভাবনার পর্যায়ে থেকে যায় বুর্জোয়াদের সঙ্গে বাঁচার তাগিদে যারা আঁতাত করে তাদের ওরা গালাগাল দিয়ে থাকে। তত্ত্বের বাঁধা পথ থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেই সংশোধনবাদের গালাগালি কপালে জোটে। কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে বিপ্লবটাকে দেখিয়ে দেয় না। নিজের নিজের নিরাপদ বৃত্তে বাস করে ক্যুনিজমের তাকে কপচে যাওয়ার মধ্যে একটা বিপ্লবী চরিত্র প্রকাশ করাই এদের একমাত্র মুক্তি। এই সব চিন্তা শুধু রোবট তৈরি করায় বিশ্বাসী, মানুষ সৃষ্টিতে নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে আনন্দ তারপর তারা অবশ্যই ব্যতিক্রম। এই দেশে ব্যক্তি হত্যা বা অস্ত্র ব্যবহার করে কখনও বিপ্লব আসবে না। বিপ্লব আসতে পারে ভালবাসা যদি প্লাবনের মত ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়। একটা গ্রাম, একেকটা গ্রাম, সেই গ্রামগুলোর সমষ্টি একটা জেলা, সেই জেলাগুলোর সমষ্টি, একটা প্রদেশ এবং প্রদেশগুলো একত্রিত হয়ে গেলে পুরো একটা দেশ যখন একসঙ্গে হাত মেলাবে তখনই বিপ্লব। এই গ্রামে কোন মধ্যবিত্ত নেই। উচ্চবিত্ত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। অনেক মানুষ আছে এইখানে। স্বাভাবিক মধ্যশ্রেণী, নিম্নশ্রেণী, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থেকে ঝরে/এরা তবু মৃত নয়। জীবনানন্দের লাইনগুলো গুনগুন করল সে আনমনে।

সেটা কানে যাওয়ামাত্র আনন্দ মুখ ফেরাল, বাঃ, একটা পদ্য বল তো।

সুদীপ মাথা নাড়ল, না। কবিতার কথা মনে হলেই উলটোপালটা লাইন মাথায় আসছে। তুই বল।

আনন্দ মাথা নাড়ল। তারপর দরাজ হল, তোমাকে দেখার মত চোখ নেই তবু/গভীর বিস্ময়ে আমি টের পাই তুমি/আজও এই পৃথিবীতে রয়ে গেছ। কোথাও সান্ত্বনা নেই পৃথিবীতে আজ বহুদিন থেকে শান্তি নেই–কে আসছে?

শেষ শব্দ দুটো যেন কবিতারই মনে হয়েছিল সুদীপের। চোখ তুলতে দেখল মাঠ ভেঙে উঠে আসছে কেউ। এত রাত্রে, বলা যায় রাত শেষের রাত্রে, ওই রকম ক্লান্ত পায়ে কে আসে? সুদীপ বলল, বুঝতে পারছি না!

পেছন থেকে জয়িতার গলা ভেসে এল, থামলি কেন আনন্দ?

ওরা মুখ ফিরিয়ে দেখল, জয়িতা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মৃত জ্যোৎস্নায় তাকে যেন অশরীরী বলে মনে হচ্ছে। আনন্দ বলল, কেউ আসছে, কল্যাণ নয় তো!

সুদীপ বলল, দূর! ওই হাটা ছেলেদের হতেই পারে না।

জয়িতা টিপ্পনি কাটল, আমাদের সঙ্গে একজন মহিলা-বিশেষজ্ঞ আছে।

সুদীপ মাথা নাড়ল, বাংলাও বলতে পারিস না? ওই শব্দটার মানেও জানিস না।

এই সময় মেয়েটিকে ওরা দেখতে পেল। সুদীপ বলে উঠল, একি রে! এ যে আবার ফিরে এল। আনন্দ জয়িতার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কেসটা দ্যাখ তো!

জয়িতা এগিয়ে এল বারান্দার কোণায়। মেয়েটি ততক্ষণে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, আমি ও ঘরে একা থাকতে পারব না।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, কেন? তোর সঙ্গে কে থাকত এতদিন?

মেয়েটা উত্তর দিল না কথাটার। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জয়িতা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোর সঙ্গে এতদিন কে ছিল বললি না, কিন্তু কেন থাকতে পারবি না সেটা বল।

আমার ভয় করছে।

ভয়। কেন ভয় করছে? তুই তো বেশ ওদের সঙ্গে চলে যাচ্ছিলি না!

সেই জন্যেই তো ভয় করছে। গেলামও না, আবার গ্রামের কোন পুরুষও আমার কাছে এখন ঘেঁষবে। এই সুযোগে দানোটা পাহাড় থেকে নেমে আসবে। দানো যে মেয়ের ওপর–।

দানোটা কে?

পাহাড়ে রাত হলে কেঁদে কেঁদে ডাকে, শোননি তোমরা?

তাহলে তুই কি চাস?

আমি তোমাদের সঙ্গে থাকব। এখানে।

হঠাৎ জয়িতার গলা শীতল হল, না। তোমার এখানে থাকা চলবে না। ঠিক আছে, তোমার যদি ওখানে একা শুতে ভয় করে তাহলে আমি থাকব তোমার সঙ্গে। আমার কাছে যে অল্প আছে তার ভয়ে তোমার দানোর বাবাও কাছে আসবে না। তারপর আনন্দর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যদি ওর ঘরে থাকি তোদের আপত্তি আছে?

উইদ প্লেজার। সুদীপ বলল, এতে তোর প্রাইভেসিও থাকবে। কিন্তু মেয়েটা মনে হচ্ছে আমার প্রেমে পড়েছে। কেমন ঘুরে ঘুরে আমার দিকে তাকাচ্ছে দ্যাখ!

জয়িতা কথা না বাড়িয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সুদীপ মেয়েটাকে বলল, তুমি আমায় কি করেছ দ্যাখো! গ্রামের অন্য কেউ হলে তোমাকে মেরেই ফেলত।

মেয়েটা ঝকমকিয়ে হাসল, গ্রামের কেউ হলে আমাকে বাঁচাতেই যেত না।

এই সময় জয়িতা তার বিছানা গুটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল, আনন্দ, সুদীপটাকে বারণ কর। ও বেড়ালটাকে মাছ দেখাচ্ছে। মানুষকে প্রভোক করা একই অপরাধ।

ঠিক তখনই চিৎকার উঠল। কান্নাটা আকাশে ছড়িয়ে পড়ল। ওরা পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে সেই নারীকন্ঠের বিলাপ শুনছিল। ক্রমশ সেই চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে আশেপাশের ঘরে কণ্ঠ পরিষ্কার হল। এই সময় সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি বলে উঠল, যাঃ, মরে গেল!

কথাটা কানে যাওয়ামাত্র বিছানা ফেলে রেখে জয়িতা দৌড়তে লাগল। আনন্দ একবার ঘরের দিকে তাকাল। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কে মরেছে রে?

আনন্দ বলল, মনে হচ্ছে সেই বাচ্চা মেয়েটা। তুই এখানে থাক। ঘরে মালপত্রগুলো আছে। তাছাড়া ওরা এখন তোকে দেখুক তা আমি চাই না। বলেই সে ছুটল। সুদীপ খুব নার্ভাস হয়ে গেল।

এখন অবশ্য তাদের কাছে অস্ত্র আছে। কিন্তু ওই মেয়েটা যদি মরে যায় তাহলে গ্রামের মানুষরা ছেড়ে দেবে না বলে শাসিয়ে রেখেছে। তার মনে হল অস্ত্রগুলো হাতের কাছে রেখে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। হবে। তারপরেই সে মন পালটাল। সে বাচ্চা মেয়েটার কোন ক্ষতি করেনি। উপকার করতে গিয়ে যদি লোকে ভুল বোঝে তো তার কিছু করার নেই। দেখাই যাক কি হয়। সে দেখল মেয়েটা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, তুমি গেলে না?

সুদীপ মাথা নাড়ল, না।

মেয়েটি হাসল, না গিয়ে ভালই করেছ। ওরা তোমাকে দেখলেই ক্ষেপে যেত। বউটার তো আর বাচ্চা হবে না। পনেরো বছরের স্বামী এতদিন ছেলের মতন ছিল।

তুমি যাও না। সুদীপ মেয়েটিকে এড়াতে চাইল এবার।

না বাবা। আমি মৃত্যু দেখতে পারি না। ভীষণ ভয় লাগে। মেয়েটি উদাস গলায় বলল।

ভয় লাগে অথচ নিজে তো মরতে যাচ্ছিলে। সুদীপ খিঁচিয়ে উঠল।

মেয়েটি কিছু মনে করল না। সুদীপের দিকে তাকিয়ে আবার হাসল।

 

জয়িতা দেখল বেশ ভিড় জমে গেছে এর মধ্যে। মেয়েটির মা পাগলের মত মাথা ঠুকছে। বোঝা গেল একটু আগেই ওর প্রাণ বেরিয়ে গেছে। জয়িতাদের দেখে ভিড় আলগা হল। ওরা সেই পথে ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। মেয়েটির কিশোর স্বামী মাথা নেড়ে জানাল মরে গেছে। এবার মহিলার নজর পড়ল ওদের দিকে। জয়িতা ভেবেছিল সে নির্ঘাৎ একটা কাণ্ড করবে। কিন্তু কিছুই না করে আশ্চর্যজনকভাবে কান্নাটা থামিয়ে দিল। জয়িতা এগিয়ে গিয়ে ওর কাধে হাত রাখল। এখন কিছুই করার নেই। আনন্দ বাইরে বেরিয়ে এল। তার মনে হল উপস্থিত জনতা তাকে লক্ষ্য করছে। পালদেম ধারেকাছে নেই। সম্ভবত ও কোন অপ্রিয় ব্যাপারের মুখোমুখি হতে চায় না। কাউকে ডেকে নিজেদের অপরাধহীনতার কথা বোঝনোর চেষ্টা করাও বৃথা। সে ঠিক করল পরিস্থিতি যেমন হবে তেমন করা যাবে। ভেতর থেকে আর কান্না ভেসে আসছে না। হঠাৎ যেন থমথমে হয়ে গেল চারপাশ। আজ তাপল্যাঙের মানুষ ঘুমাতে পারছে না। আগুন জ্বলে উঠেছে চার-পাঁচ জায়গায়। সেগুলো ঘিরে বসে আছে সবাই। অন্ধকারে কোন মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলে ভোরের জন্যে জেগে বসে থাকতে হয়। কারণ চোখ বন্ধ করলেই মৃতরা ডাক দিতে পারে সঙ্গী হওয়ার জন্যে।

এই সময় কাহনকে আবার নেমে আসতে দেখল আনন্দ। গম্ভীরমুখে দুজন অনুচরকে নিয়ে কাহন এগিয়ে যাচ্ছেন ঘরের দিকে যেখানে মৃত মেয়েটি শুয়ে রয়েছে। আনন্দর সামনে দিয়ে তিনি যখন যাচ্ছিলেন তখন সে নীরবে মাথা নাড়ল। কিন্তু তার কোন প্রতিক্রিয়া হল না কানের মধ্যে। এবার পালদেমকে দেখা গেল। কোন একটা অগ্নিকুণ্ডের পাশে সে নিশ্চয়ই বসেছিল, কাহুনকে দেখে এগিয়ে এল। দুজনে চাপাগলায় কিছু বলল। তারপর দুজনেই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। মুহূর্তের জন্যে আনন্দর মনে হল এই অশিক্ষিত এবং কুসংস্কারগ্রস্ত মানুষদের বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে ওরা লাফিয়ে পড়তে পারে তাদের ওপরে। এবং কাহুন যদি নির্দেশ দেন ধর্মের নামে তাহলে তো কথাই নেই। বন্দুকের সঙ্গেও হয়তো খালি হাতে লড়ে যেতে চাইবে। অতএব এখান খেকে আপাতত আস্তানায় সরে যাওয়াই উচিত। রাতের অন্ধকারে মানুষের মুখ যতই অচেনা হয়ে যাক দিনের আলোয় তার মোকাবিলা করা সহজ। সে চিৎকার করে জয়িতাকে ডাকল। এবং তার এই চেঁচিয়ে কথা বলায় গ্রামবাসীরা তো চমকে তাকালই, তার নিজের কানেও অত্যন্ত কর্কশ ঠেকল।

জয়িতা বেরিয়ে এল বিস্মিত মুখে। চারপাশে তাকিয়ে আনন্দকে লক্ষ্য করল। তারপর দ্রুত দূরত্বটা কমিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ওরকম অসভ্যের মত চিৎকার করছিস কেন?

আনন্দ বলল, আই অ্যাম সরি। কিন্তু মনে হচ্ছে আমাদের এখানে থাকাটা উচিত হবে না।

কেন? তোকে কেউ কিছু বলেছে? জয়িতা যেন তখনও বিরক্ত।

না। কিন্তু কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছে না। পালদেম তো সামনেই আসেনি। ওরা বলেছিল মেয়েটা মরে গেলে আমাদের ছাড়বে না। আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। আনন্দ চারপাশে তাকাল।

জয়িতা মাথা নাড়ল, ওরা আমাদের ভয় করছে। আমাদের হাতের অস্ত্রের শক্তি ওরা বুঝেছে। উপায় ছিল না, কিন্তু এভাবে ভয় বাড়াতে আরম্ভ করলে আমাদের কখনই ওরা বিশ্বাস করতে পারবে না। এই গ্রামে আমরা চিরকালই বিদেশী হয়ে থাকব। ওরা ভয়ে তোর সঙ্গে কথা বলছে না।

তোর সঙ্গে বলছে? তোরই হাতে রিভলভার ছিল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল।

প্রথমে করেনি। কিন্তু মেয়েটার মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই যেই আমার চোখে জল এসে গেল তখন আবার কাঁদতে শুরু করেছে।

মহিলা তোকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল? জয়িতার কথা অবিশ্বাস্য ঠেকল আনন্দর কাছে।

শোক বড় বিচিত্র অনুভূতি। ধরাবাঁধা ব্যাখ্যায় তাকে ধরা যায় না। মেয়েটির শেষকৃত্য হবে সূর্য ওঠার মুহূর্তে। সেই অনুষ্ঠানে আমরা অংশ নেব। তুই সুদীপকে ডাক। কথাটা শেষ করে জয়িতা আবার ভেতরে ঢুকে গেল। আনন্দ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎ তার নিজেকে একজন টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত বলে মনে হল। অতিক্রম করতে চায় সে কিন্তু এক একটা শেকড় এমনভাবে জড়িয়ে থাকে যে—। কাকে দোষ দেবে সে এ জন্যে? এখানে আসার পর জয়িতা যতটা সহজ এবং ভোলা মনে এগোচ্ছে ততটা সে কেন পারছে না? আনন্দ হাঁটতে শুরু করল। শিক্ষাই মানুষকে শিক্ষিত করে। একটু একটু করে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাই তো আসল কথা।

আস্তানায় ফিরে সুদীপকে সে বাইরে দেখতে পেল না। আনন্দ একটু বিস্মিত হল। তারপর ঘরের দরজা খুলে অন্ধকারে মুখ বাড়াল, সুদীপ?

সুদীপের গলা ভেসে এল, বল্‌।

ও তুই শুয়ে পড়েছিস! ওঠ।

আবার উঠতে হবে কেন? সারাটা রাত এভাবে জেগে থাকা যায়?

মেয়েটাকে সূর্যোদয়ের সময় সৎকার করা হবে। আমাদের তিনজনের সেখানে থাকা উচিত।

আমাকে দেখলে ওরা খেপে যাবে না?

যেতে পারে, আবার নাও পারে।

তাহলে?

রিস্ক নিতে হবে।

আমি সঙ্গে মাল নিয়ে যাব।

না। সেটা আরও শত্রুতা বাড়াবে। মেয়েটা কোথায়?

ও-পাশে শুয়ে আছে।

অ্যাঁ, এই ঘরে?

তাছাড়া ঠাণ্ডায় যাবে কোথায়? ও একটু বেশি বকে, কিন্তু মনটা ভাল।

এর মধ্যে মনের খবর নিয়ে ফেলেছিস।

বাজে বকিস না। প্রেমট্রেম আমার দ্বারা হবে না। সুদীপ উঠে একটা মোমবাতি জ্বালাল, মোমবাতির স্টক শেষ হয়ে আসছে।

অনেক কিছুই শেষ হয়ে আসছে।

আনন্দ, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার যদির দলের স্বার্থের ক্ষতি না করে তাহলে তোদের কিছু বলার নেই। শুধু উটকো মন্তব্য করিস না। সুদীপ আবার পোশাক চড়িয়ে নিচ্ছিল।

আনন্দ দেখল মেয়েটা খানিকটা দূরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। এই ঠাণ্ডায় কোন মানুষ ওইভাবে শুয়ে থাকতে পারে বিছানা ছাড়া? সে মেয়েটির কাছে গিয়ে বলল, ওঠো।

সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, ওকে তুলছিস কেন?

এই ঘরে ওকে একা রেখে যেতে পারি না।

মেয়েটি থতমত হয়ে উঠে বসল। সুদীপ তাকে ইশারায় ডাকল বেরিয়ে আসতে। কোন প্রতিবাদ না করে মেয়েটি ওদের সঙ্গে বেরিয়ে এল। আনন্দ লক্ষ্য করল মেয়েটি সুদীপের পেছন পেছন হাঁটছে। ব্যাপারটা তার ভাল লাগল না কিন্তু কোন মন্তব্য করল না সে।

 

ভোর হতে আর দেরি নেই। আকাশে স্বর্গীয় রঙের খেলা শুরু হয়েছে। পাহাড়ের চুড়ায় বরফ আরও নিচে নেমে এসেছে। এই সময় ওরা চিকারটা শুনতে পেল। ওপাশের পাহাড় থেকে চিৎকার করতে করতে মানুষটা নেমে আসছে। আনন্দরা তখন গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে। দৌড়তে দৌড়তে মানুষটা কাছে আসতে প্রথমে চিনতে পারেনি আনন্দ। ছেলেটা একটি অগ্নিকুণ্ডের সামনে পেীছে হাটু গেড়ে বসে পড়ল। ভিড়ের মধ্যে থেকে পালদেম ছুটে এল তার কাছে। ছেলেটা হাঁপাচ্ছে। প্রায় সাদা হয়ে গেছে ওর মুখ। আগুনের কাছে ওকে নিয়ে গিয়ে শুক্রষা চলল কিছুক্ষণ। কেউ যেন একটা পাত্রে খানিকটা তরল পদার্থ এনে ওর মুখে ঢেলে দিল। একটু ধাতস্থ হয়ে ছেলেটা কথা বলতে শুরু করল জড়িয়ে জড়িয়ে। খানিকটা শোনার পর পালদেম চমকে আনন্দের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেটির এক হাতে তখনও বিরাট ঝোলাটা ধরা। পালদেম সেটাকে ছাড়িয়ে নিল আস্তে আস্তে। পালদেমের দৃষ্টি অনুসরণ করে আনন্দ কাছে যাওয়ামাত্র ছেলেটি আচমকা কাদল।

পালদেম মুখ নিচু করল। তারপর বলল, তোমাদের বন্ধুকে পুলিশ মেরে ফেলেছে।

বুকের মধ্যে ধক্ করে লাগল আনন্দর। তার সমস্ত শরীর অসাড় হয়ে গেল। কল্যাণ নেই? কল্যাণ। সে কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না।

পেছন থেকে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? পালদেম কি বলল?

পালদেম বলল, তোমাদের বন্ধু আমাদের বন্ধু। না হলে সে আমাদের জন্যে ওষুধ আনতে যেত না। ওষুধ এনে এই ছেলেটির হাতে পৌঁছে দিতে পারত না।

হঠাৎ ছুটে এল সুদীপ ছেলেটির সামনে। দুহাতে তাকে খামচে ধরে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে? কল্যাণের কি হয়েছে?

ছেলেটি কোন কথা বলতে পারল না। কোনরকমে ঝোলাটাকে আঙুল দিয়ে দেখাল। সুদীপ সেখানে চাপ চাপ রক্ত দেখতে পেলার তকিয়ে কালচে হয়ে আছে। সে পাগলের মত ঝোলা খুলতেই প্রচুর ওষুধ এবং সিগারেটের প্যাকেট দেখতে পেল। সব কিছুই রক্তের হেয়ামাখা। হঠাৎ বউ হাউ করে কেঁদে উঠল সুদীপ। গ্রামের মানুষগুলো পাথরের মত মাথা নিচু করে চারপাশে দাঁড়িয়ে। আনন্দ কোন কথা বলতে পারছে না। তার চিন্তাশক্তি অসাড় হয়ে গিয়েছিল। সে কল্যাণের মুখটাকেই কনা করতে পারছিল না। এই সময় জয়িতার গলা পাওয়া গেল, পালদেম, কাহন বলছেন আর দেরি করা যাবে না।

পালনে তার দিকে তাকাল। সুদীপ চিৎকার করে কেঁদে উঠল, জয়ী, কল্যাণ মরে গেছে। আমি–আমি ওকে–।

জয়িতার মুখ অগ্নিকুণ্ডের আলোয় ঈশ্বরীর মত মনে হচ্ছিল। সে আন্দর দিকে তাকাল। তারপর গ্রামের মানুষদের বলল, আমাদের এক বন্ধুর কথা তোমরা শুনলে। এসো, এই সূর্যোদয়ের মুহূর্তে বাচ্চা মেয়েটির শরীর সৎকারের জন্যে নিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের বন্ধুর আত্মাকেও নিয়ে যাই। ও তোমাদের জন্যে একটা কাজ করতে গিয়েছিল। তোমাদের আপত্তি আছে?

সবাই মাথা নাড়ল, না। না। না। শব্দটা ছড়িয়ে পড়ল হিমালয় পর্যন্ত।

হঠাৎ সুদীপ বিড় বিড় করল, জয়ী, তুই মানুষ?

হ্যাঁ, মানুষ। জয়িতা কান্নাটা সামলালো, কল্যাণ এখানে আমাদের পায়ের তলায় মাটি দিয়ে গেল। শহীদের জন্যে কাঁদব কেন? আমি গর্বিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *