মুনা জহিরের চিঠি পেয়ে নেত্রকোনায় চলে এসেছে। চিঠিতে সে ভেঙে কিছু বলেনি; অস্পষ্ট ভাবে কিছু কথাবার্তা লেখা যা পড়ে মুনা চমকে উঠেছে। সাতদিনের ছুটি নিয়ে রওনা হয়েছে। সঙ্গে আছে বাবু। বাবু কয়েকবার ভয়ে ভয়ে জানতে চেয়েছে চিঠিতে কি লেখা? মুনা বিরক্ত হয়ে বলছে কিছু লেখা নেই।
লেখা না থাকলে তুমি এত ব্যস্ত হয়ে রওনা হচ্ছে কেন?
লেখা নেই বলেই রওনা হচ্ছি। কি হল বুঝতে পারছি না। বেশির ভাগ মানুষই হল বোকা এরা গুছিয়ে একটা চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারে না। হয়ত গিয়ে দেখব কিছুই না। জহিরের চিঠিটা ছিল এ রকম–
শ্রদ্ধেয়া আপা,
আমার সালাম জানবেন। আশা করি ভালই আছেন। কয়েক’দিন পূর্বে বাবুর এক পত্রে আপনাদের কুশল জানতে পেরে সুখী হয়েছি।
এখানকার খবর একমত। বকুলের ব্যাপারে কিঞ্চিৎ সমস্যা হয়েছে। আচ্ছা। আপা, বকুলের কি মানসিক অসুস্থতার কোন পূর্ব ইতিহাস আছে? আমি ডাক্তার হিসেবে জানতে চাচ্ছি। দয়া করে অন্য কোন ভাবে নেবেন না। মাঝে মাঝে সে অর্থহীন কথাবার্তা বলে। তেমন উদ্বিগ্ন হবার কিছু নাই। সাক্ষাতে সব বলব। ইতি।
তারা নেত্রকোনা পৌঁছল সন্ধ্যাবেলা। জহিরের বাড়ি শহরের একটু বাইরে। নেত্রকোনা কোর্ট রেল স্টেশনে নেমে রিকশায় আধঘণ্টার মত লাগে। বাড়ি দেখে মুনা মুগ্ধ। বিশাল বাড়ি। রাজ্যের গাছপালা বাড়িটা ঘিরে জঙ্গলের মত করে রেখেছে। পুরানো আমলের খিলান দেয়া বাড়ি। লোহার ভারী গেট। গেট থেকে বাড়ির সদর দরজা পর্যন্ত সুড়কি বিছানো পথ। জাফরি কাটা রেলিং-এ মাধবীলতার ঝাড়। মুনা মুগ্ধ গলায় বলল, চমৎকার। মারু মাথা ঝাকিয়ে বলল, চমৎকার কোথায় আপা এ তো ভুতুড়ে বাড়ি।
বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানোর পর এটাকে সত্যি সত্যি ভুতুড়ে বাড়ি বলেই মনে হতে লাগল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ কোথাও বাতি জ্বলছে না। দুতিন জায়গা থেকে এক সঙ্গে তক্ষক ডাকছে।
কামলা ধরনের একজন কে বারান্দায় বসে দড়ি পাকাচ্ছিল। বাইরে মানুষজন দেখেও তার কোনো ভাবান্তর হল না। দড়ি পাকানোর মনোযোগ যেন আরো বেড়ে গেল।
মুন্না বলল, এই যে ভাই ভেতরে গিয়ে বলুন।–আমরা এসেছি।
লোকটি নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাড়িতে কেউ নাই।
সেকি! কোথায় গেছে?
মিরামপুর খালার ছোড় মাইয়ার বিয়া।
আসবে কখন?
ঠিক নাই রাইতের টেরেনে আসত পারে আবার নাও আসতে পারে।
বাড়িতে আপনি ছাড়া কেউ নেই?
ময়নার মা আছে।
আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমি বকুলের বড় বোন। থাকব। এখানে। কিছু-একটা ব্যবস্থা করুন। এখন দড়ি পাকানোটা কিছুক্ষণের জন্যে বন্ধ রাখা যায় না? আপনি উঠে দাঁড়ান ও ময়নার মাকে খবর দিন।
লোকটি নিতান্ত অনিচ্ছায় দাঁড়াল। মুনা উঁচু গলায় বলল, কি রকম কাণ্ডকারখানা কিচ্ছ বুঝতে পারছি না, চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে বাতি জ্বলছে না কেন?
ইলেকট্রিক নেই। রাইত দশটার পরে ইলেকট্রিক আয়।
রাত দশটার পরে ইলেকট্রিসিটি দিয়ে হবে কি? হারিকেন জ্বালান। নাকি ঘরে হারিকেনও নেই?
আছে।
মুনা নিজেই ভেতরে ঢুকে ডাকল, ময়নার মা, ময়নার মা। বাবু মুনার কাণ্ড দেখে খুব মজা পাচ্ছে। আপা কত সহজেই না কর্তৃত্ব নিয়ে নিচ্ছে। যেন সে এই বাড়িরই একজন, অপরিচিত কেউ না।
ময়নার মা এসে দাঁড়ানমাত্র মুনা বলল, গোসলের পানি গরম দাও তো ময়নার মা। ঘরে চা পাতা আছে? ভাল করে চা বানাও। আমরা ঢাকার মেহমান।
বকুলরা গিয়েছিল। ঠাকরাকোনা; রাত বারোটার ট্রেনে বকুল এবং জহির এই দু’জন ফিরেছে। বকুল আগে আগে বাড়ি ঢুকল। বারান্দার কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। মুনা আপার মত কে যেন বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছে। প্রথম কিছুক্ষণ সে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, কে?
মুনা বলল, ভূত। কেমন আছিস রে বকুল?
আপা তুমি?
মুনা হাসল। বকুল বলল, আপা তুমি নাকি সত্যিই তুমি?
না মিথ্যা আমি।
বকুল শিশুদের মত গলায় চেঁচিয়ে উঠল। আপা এসেছে আপা এসেছে। মুনা আপা, মুনা আপা।
জহির বারান্দায় উঠে এসে দেখল বকুল তার আপাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে এবং কিছুক্ষণ পর পর বলছে–আপা এসেছে, মুনা আপা এসেছে।
মুনা বলল, ছাড় তো–দম বন্ধ করে মারবি নাকি? জহির তুমি তোমার বউকে সামলাও।
জহির বিব্রত গলায় বলল, খুব নিশ্চয়ই অসুবিধা হয়েছে। খবর দিয়ে এলে হত না? স্টেশনে থাকতাম।
কোন অসুবিধা হয়নি।
খাওয়া-দাওয়া করছেন। আপা?
সব কিছু চমৎকার হয়েছে।
একা এসেছেন?
না। বাবুকে নিয়ে এসেছি। ও ঘুমিয়ে পড়েছে।
বকুলকে দেখে মুনা বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেল।
কি রোগা হয়েছে। কি অসম্ভব রোগা! চোখ দু’টি বিশাল বড় লাগছে। কেমন অন্য রকম ভাবে জ্বলজ্বল করছে। মুনা তার মাথায় হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল, কি হয়েছে তোর?
কি আবার হবে? কিছু হয়নি রোগা হয়েছি। কোন অসুখ-বিসুখ নেই। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে দেখ।
এত রোগাই বা হলি কেন?
ঘুম হয় না যে এই জন্যে রোগা হয়ে যাচ্ছি। ও মাগো বাবুকত লম্বা হয়েছে। ও এত লম্বা হচ্ছে কেন আপা? কিছু দিন পর তো তালগাছ হয়ে যাবে।
বলতে বলতে বকুল হাসতে শুরু করল। প্রথমে মৃদু স্বরে তারপর বেশ শব্দ করেই হাসতে লাগল। অচল মেঝেতে পড়ে গেল। জহির বিরক্ত মুখে তাকাচ্ছিল। সে গম্ভীর গলায় বলল, হাসি৷ বন্ধ করা তো বকুল। আপা কোথায় ঘুমাবেন কিছু-একটা ব্যবস্থা কর। শুধু শুধু হাসলে তো হবে না।
ওমা–তাই তো।
বকুল প্রায় ছুটে ভেতরে চলে গেল পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এসে বলল, বাবু, হেসেছি বলে রাগ করিাসনি তো? বলেই দেরি করল না। আবার ভেতরে চলে গেল। বাবু অবাক হয়ে তাকাল মুনার দিকে। মুনা বলল, জহির ওর কি হয়েছে?
কিছু হয়নি আপ ঢং করছে।
ঢং করছে মানে?
নানান রকমের যন্ত্রণা। আপা–এসেছেন যখন সবই শুনবেন।
ডাক্তার দেখাচ্ছ?
ডাক্তার দেখাব কি? আমি নিজেও তো একজন ডাক্তার। নাকি আপনারা তা মনে করেন না?
মুনা আর কিছু বলল না। বিস্মিত চোখে জহিরের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। জহির অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আপা কিছু মনে করবেন না উল্টাপাল্টা কি সব বলছি। আসলে আমার নিজের মাথার ঠিক নেই। বলব আপনাকে সব। আজ রাতেই বলব। শুনলে আপনি নিজেই বুঝবেন।
জহির যা বলল তা শুনে মুনা হতভম্ব হয়ে গেল। কাঁপা গলায় বলল, এসব তুমি কি বলছ?
সত্যি বলছি আপা। একটা কথাও মিথ্যা না। বকুল সারারাত ইচ্ছা করে জেগে থাকে ওর ধারণা ঘুমুলেই আমি ওর গলা টিপে দিম বন্ধ করে মেরে ফেলব।
ক’দিন ধরে এ রকম হচ্ছে?
তিন মাসের বেশি।
আগে জানাওনি কেন?
ইচ্ছা করেনি আপা। তাছাড়া…
তাছাড়া কি?
আমার ধারণা পুরো ব্যাপারটা তার সাজানো। আমাকে যন্ত্রণা দেবার একটা চেষ্টা।
তোমাকেই বা শুধু শুধু যন্ত্রণা দিতে চাচ্ছে কেন?
জানি না আপা। আপনি এসেছেন এখন দেখুন কিছু করতে পারেন। কি না।
ও আজ রাতে আমার সঙ্গে ঘুমুক–কি বল জহির?
নিশ্চয়ই আপা, আপনার বলার দরকার ছিল না। আমি নিজেই পাঠাতাম।
মুনার শোবার জায়গা করা হয়েছে দোতলার সবচে দক্ষিণের ঘরে। বিশাল ঘর। তিনটি বড় বড় জানালায় খুব হাওয়া খেলে। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিশাল পালঙ্ক। উঠতে কষ্ট হয় এমন উঁচু। মুনা হাসতে হাসতে বলল, গড়িয়ে পড়লে তো মাথা ফেটে যাবে রে বকুল।
বকুল এই কথাও মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে খুব হাসতে লাগল। কোনমতে হাসি থামিয়ে বলল, তুমি যা হাসাতে পার। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে আপা।
মুনা প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্যে বলল, বাবু কোথায় শুয়েছে?
ওরা দুলাভাইয়ের সঙ্গে। আরো ঘর ছিল— একা ঘুমুলে ভয় পায় যদি, সেজন্যে ও বলল ওর সঙ্গে ঘুমুতে।
তোর শাশুড়ি–উনি কোথায়?
আটপাড়া বলে একটা জায়গা আছে সেখানে গেছেন। ভাটি অঞ্চল। ভাটি অঞ্চলে উনাদের অনেক জমি আছে, দেখাশুনা করতে গেছেন।
উনাদের জমি বলছিস কেন? বল আমাদের জমি।
বকুল হাই তুলে বলল–ঐ একই হল।
ঘুম পাচ্ছে নাকি রে?
না। রাতে ঘুম হয় না তো। পান খাবে আপা? আমার শাশুড়ির কাছ থেকে আমি পান খাওয়া শিখেছি। আমার শাশুড়ির একটা পানের বাটা আছে তাতে আঠার রকমের মশলা রাখার জায়গা আছে।
খুব পান বিলাসী মনে হচ্ছে।
হুঁ খুব পান বিলাসী–জয়পুরী মশলা ছাড়া তিনি পান খেতে পারেন না।
জয়পুরী মশলাটা আবার কি?
দাঁড়াও নিয়ে আসছি। খেয়ে দেখ।
আনতে হবে না–আমি পান খাই না। আয় আমরা শুয়ে গল্প করি।
আমার পান খেতে ইচ্ছে করছে। যাব। আর আসব। মুখ ভর্তি পান নিয়ে বকুল ঢুকল। পানের রস উপচে পড়ছে। মুখ হাসি হাসি। হাতে পানের ডাটা।
নাও আপা খেয়ে দেখ। অল্প একটু জর্দা দিয়েছি। প্রথমবারের রস ফেলে দি ও তাহলে আর কিছু বুঝতে পারবে না।
বকুল পালঙ্কে উঠে এল। মুনা বলল, মশারি ফেলবি না?
মশা নেই। আপা মশারি লাগবে না।
একটু আগে একটা মশা আমার কানে কামড় দিয়েছে। এখনো জ্বলছে।
দু’একটা আছে। থাকুক না। ওদেরও তো খেয়ে বাঁচতে হবে। তাই না। আপা?
তা তো বটেই।
বকুল পানের বাটা নিয়ে বসেছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে পান সাজাচ্ছে। কথা বলছে নিজের মনে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা হয় তুমি এসেছ, তাই না। আপা? অথচ আমার মনে হচ্ছে তুমি যেন এ বাড়িতেই থাক। তোমারও এ রকম মনে হচ্ছে না?
না। হচ্ছে না। অপরিচিত একটা ঘরে শুয়ে আছি বলেই তো মনে হচ্ছে তুই মাঝ রাতে পান সাজাচ্ছিস কার জন্যে?
নিজের জন্যে। আর কার জন্যে? তুমি তো একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়বে। আমাকে জেগে৷ থাকতে হবে।
জেগে থাকতে হবে কেন?
ও তোমাকে কিছু বলেনি?
বলেছে–তোর মুখ থেকে আরেকবার শুনতে চাই আয় আমার পাশে শুয়ে বল।
বকুল সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়ল। মুনা বাতি নিভিয়ে দিল। বাইরে চাঁদ নেই। ঘরের ভেতর অসম্ভব অন্ধকার। বিবি ডাকছে। গ্রাম গ্রাম ভাব।
বকুল।
কি আপা? তোদের এই জায়গাটা এত অন্ধকার কেন? কাল থেকে ঘরে একটা হারিকেনটারিকেন কিছু রাখিস তো?
এখন নিয়ে আসি?
না এখন আনতে হবে না তোর ঘুম না হওয়ার গল্পটা শুনি।
বকুল ফিসফিস করে বলতে লাগল, মাস তিনেক আগের কথা। আপা সন্ধ্যাবেলা ঘুমিয়ে পড়েছি–দোতলায় একেবারে পশ্চিমে একটা ঘর আছে ঐ ঘরে। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। শুনি কি দরজায় টুকটুক করে কে যেন টোকা দিচ্ছে। আমি খুবই অবাক। দরজা হাট করে খোলা, টোকা দেবে কে? আমি বললাম।–কে ওখানে?
কেউ কোন শব্দ করল না। তখন শীতের সময়। সূর্য ডুবতেই সব অন্ধকার হয়ে যায়। খুব কুয়াশাও পড়ে। ঘরটা একদম অন্ধকার আবার মনে হচ্ছে ঘরের ভেতরেও কেমন যেন কুয়াশা। আমার বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। আমি আবার বললাম, কে?
তখন খুব পরিষ্কার গলায় বাবা কথা বললেন বললেন, বকুল আমি। কেমন আছিস রে মানিক?
আমি ভয়ে থারথার করে কাপছি, একটা কথাও বলতে পারছি না। বাবা তখন বললেন তোকে সাবধান করে দিতে এসেছি রে মা–জহির ছেলেটা তোকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। খুব সাবধানে থাকিস। খুব সাবধানে রে মা। খুব সাবধান মা।
তারপর?
তারপরের কথা আমার কিছু মনে নেই আপা। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান হলে দেখি সবাই ভিড় করে আছে। আমার শাশুড়ি আমার মাথায় পানি ঢালছেন।
ব্যাপারটা তাদের বলেছিলি?
না। কিছু বলিনি। শুধু ওকে বলেছি। রাতে ঘুমুলে তুমি আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে এই জন্যে ঘুমাই না।
আর কিছু বলিসনি তো?
না।
খুব ভাল করেছিস। এই ঘরে আমার সঙ্গে শুয়েছিস এখন তোর আর ভয় নেই। এখন ঘুমো।
না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার অভ্যেস হয়ে গেছে তুমি ঘুমাও।
বলতে বলতে বকুল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। জেগে রইল মুনা। সারারাত এক পলকেব জন্যেও ঘুম এল না। বিশাল ঘরের বিশাল পালঙ্কের শুয়ে তার গা ছমছম করতে লাগল।
মুনা দু’দিন থাকার পরিকল্পনা নিয়ে এসেছিল, থাকল সাত দিন। বকুলের শাশুড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে গিয়েই দেরি। কথা ছিল, উনি আটপাড়া থেকে ফিরলে মুনা ঢাকায় রওনা হবে। উনি ফিরলেন না।
এই সাত দিনে বকুল পুরোপুরি স্বাভাবিক। রাতে ঘুমুতে আসে মুনার সঙ্গে। খানিক্ষণ গল্প করেই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে যায়। মুনা বলল, তোর অসুখ আমাকে ধরেছে। তুই ঘুমুচ্ছিস আর আমি জেগে আছি। বিশ্ৰী অবস্থা।
বকুলের শরীর একটু ভাল হয়েছে। সব সময় দিশেহারার যে ভাব তার চোখে-মুখে লেগে থাকত তা নেই। জহিরের ধারণা এটা একটা মানসিক ব্যাপার। মুনা চলে গেলেই বকুল আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। এই সন্দেহ মুনার কাছেও অমূলক মনে হয় না। ঢাকায় রওনা হবার আগের দিন মুনা জহিরকে বলল, ওকে আমি সঙ্গে করে নিয়ে যাই জহির? আমার সঙ্গে কিছু দিন থাকুক। আমি ভাল ভাল ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলব। তুমি নিজেও চল।
জহির গম্ভীর হয়ে বলল, বাড়িঘর ছেড়ে আমার পক্ষে যাওয়া তো সম্ভব না আপা। মা নেই এত বড় বাড়ি। নেত্রকোনা কোর্টে জমিজমা নিয়ে বেশ কয়েকটা মামলা চলছে। দু’দিন পর পর হিয়ারিং হয়।
বেশ তো তুমি কিছু দিন কষ্ট করে থাক। আমি বকুলকে নিয়ে যাই। আমার মনে হয় এত বড় বাড়িতে একা একা থেকে তার এ ঝামেলাটা হয়েছে।
আপনার কাছে গেলেও তো সেই একা একাই থাকবে। আপনি যাবেন চাকরিতে, বাবু স্কুলে।
আমি মাস খানিকের ছুটি নিয়ে নেব। আমার ছুটি পাওনা আছে।
বকুল কি যেতে চাচ্ছে আপনার সঙ্গে?
না সে কিছু বলেনি–আমিই বলছি।
মা ফিরে আসুক। তারপর মার সঙ্গে কথা বলে দেখি। তবে মা রাজি হবেন না।
রাজি হবেন না কেন?
আপনি একা থাকেন। পুরুষ কেউ নেই–একটা কোন ঝামেলা যদি হয়?
মুনা আর কিছু বলেনি। বাবুকে রেখে ঢাকায় রওনা হয়েছে। সে ভেবেছিল বিদায়ের সময় বকুল খুব হৈচৈ করবে। তেমন কিছু হল না। বকুল শুকনো মুখে মুনার সুটকেস গুছিয়ে দিল। টিফিন বক্সে খাবার, পানির বোতল। মুনা বলল, যাবার আগে তোকে কয়েকটি কথা বলে যাই বকুল, খুব মন দিয়ে শোন।
বকুল ক্লান্ত গলায় বলল, তোমাকে কিছু বলতে হবে না আপা। তুমি আমার কথা ভেবে মন খারাপ করো না। আমার যা হবার হবে।
তোর কিছুই হবে না। ভাল থাকবি, সুখে থাকবি।
সুখেই তো আছি। খারাপ আছি নাকি? এত বড় বাড়িতে রানীর মত থাকি। এদের লাখ লাখ টাকা আপা। আমার শাশুড়ির গয়না যা আছে দেখলে তোমার মাথা ঘুরে যাবে। শাশুড়ি থাকলে তোমাকে দেখিয়ে দিতাম। সিন্দুকের চাবি তার কাছে। কাজেই দেখতে পেলে না।
গয়না দেখার সখ নেই। বকুল আমি কি বলছি মন দিয়ে শোন। বোস আমার পাশে।
বকুল বসল। মুনা তার পিঠে হাত রাখল। শান্ত স্বরে বলল, তুই যা দেখেছিলি তা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না। আমরা স্বপ্ন দেখি না? দেখি। ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখি। সেটা ছিল একটা দুঃস্বপ্ন। স্বপ্নটা তোর কাছে সত্যি বলে মনে হয়েছে।
বকুল কিছু বলল না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। মুনা মৃদু গলায় বলল, একটা স্বপ্নকে কেউ যদি দিনের পর দিন সত্যি ভাবে তাহলে সেটা তার কাছে সত্যি হয়ে যায়। তোর বেলা তাই হয়েছে। বুঝতে পারছিস?
পারছি আপা।
জহির ভাল ছেলে। বুদ্ধিমান ছেলে … তোর সমস্যা সে বুঝবে। যে সমস্যাটা তোর হয়েছে তুই একা তার সমাধান করতে পারছিস না। কাজেই জহিরের সাহায্যে তোকে নিতে হবে। দু’জন মিলে সমস্যার সমাধান করবি।
আচ্ছা করব।
মনে থাকবে তো?
থাকবে।
তোর শাশুড়ি এলে তাকে বলে ঢাকায় চলে আসবি। কিছু দিন থাকবি আমার কাছে।
উনি রাজি হবেন না।
রাজি হবেন। আমি তাকে গুছিয়ে একটা চিঠি লিখেছি। চিঠিটা তোর কাছে দিয়ে যাব তুই তোর শাশুড়িকে দিবি। মনে থাকবে।
থাকবে।
লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে থাকবি।
লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে তো থাকি।
বকুল মুনাকে ট্রেনে তুলে দেবার জনো স্টেশনে গেল না। কাউকে চলে যেতে দেখতে তার খুব খারাপ লাগে। এমন কি মুনা যখন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে তখনও সে সামনে পড়ল না। একা একা পুকুর পাড়ে বসে রইল।
রাতে খুব সহজ ভঙ্গিতে জহিরের সঙ্গে ঘুমুতে এল। খাটে এসে বসল। মুখ ভর্তি পান। জহির মামলার দলিলপত্র দেখছিল। সে ফাইল বেঁধে ফেলল। কাল একটা হিয়ারিং আছে কিন্তু এখন আর সেইসব নিয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করছে না। সে সহজ গলায় বলল, একটা পান খাওয়াও তো বকুল, জর্দা দিও না।
বকুল পান সাজাতে বসল।
আপা চলে যাওয়াতে খুব মন খারাপ?
হুঁ।
আরো কিছু দিন রেখে দিতে পারলে ভাল হত। অফিস আছে আমি আর জোর করলাম না। তাছাড়া এখানে তার ভালও লাগছিল না। বড় শহরে বেশিদিন থাকলে এ রকম হয়। অন্য কোথাও থাকলে ভাল লাগে না। এটাকে বলে কনডিশনিং।
বকুল হাই তুলল। জহির বলল, ঘুম পাচ্ছে নাকি?
হুঁ পাচ্ছে।
খুবই ভাল কথা। শুয়ে ঘুমিয়ে পড়। তার আগে একটা কাজ কর, ওষুধ খেয়ে নাও।
কি ওষুধ?
মাইন্ড একটা ঘুমের ওষুধ।
বকুল বিনাবাক্যে ওষুধ খেয়ে গুটিগুটি মেরে শুয়ে পড়ল। জহির বলল, মা এলে তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। দু’জন বেশ কিছু দিন কাটিয়ে আসব। আমি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি। মামলামোকদ্দমা, জমিজমা এসব আর ভাল লাগে না। কুৎসিত ব্যাপার। বকুল জবাব দিল না।
ঘুমিয়ে পড়েছ নাকি?
বকুল সাড়া দিল না। জহির অবাক হয়ে লক্ষ্য করল বকুল সত্যি সত্যি ঘুমুচ্ছে। বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলছে। ঠোঁট কপছে। গাঢ় ঘুমের লক্ষণ। জহির বাতি নিভিয়ে কাগজপত্র নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। কাগজগুলি ভাল রকম দেখে রাখা উচিত। দাগ নম্বরে কি সব ওলট-পালট নাকি আছে . কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। অনুকুল মুহুরিকে আসতে বলেছিল–সে আসেনি। লোক পাঠিয়ে আরেকবার ডাকবে না। সে নিজেই যাবে? রাত খুব হয়নি। দশটা পয়ত্রিশ। যাওয়াই উচিত–দাগ নম্বর পোর্চা ফোর্চ কিছুই মাথায় ঢুকছে না। বকুল ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এটাও একটা শুভ লক্ষণ।
জহির বাড়ি ছেড়ে বেরুবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বকুল উঠে বসল। ঘর অন্ধকার। বারান্দায় চল্লিশ পাওয়ারের একটা বাতি জ্বলছে তার খানিকটা আলো পর্দার ফাঁকে ঘরে এসেছে। দরজা ভেজানো। খুট করে দরজার ওপাশে শব্দ হল। বকুল অবাক হল। বকুল ভয়-পাওয়া গলায় বলল–এ কে?
কেউ উত্তর দিল না। কিন্তু মনে হচ্ছে কে যেন খুব সাবধানে দরজা খোলার চেষ্টা করছে। ক্যাঁচক্যাঁচ করে একটু শব্দ হচ্ছে আবার থেমে যাচ্ছে। বকুল বলল কে? কে? দরজার ওপাশ থেকে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ হল। সিগারেটের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বাবা ঘরে ঢুকলে ভক করে খানিকটা সিগারেটের গন্ধ নাকে লাগে। অবিকল সে রকম। নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ বকুলের চেনা। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–কে? কে ওখানে?
খুব নিচু স্বরে জবাব এল। প্রায় অস্পষ্ট কিন্তু বকুলের শুনতে কোন ভুল হল না।
কেমন আছিস রে মা?
ভাল আছি বাবা।
তুই এমন রোগা হয়ে গেছিস কেন?
আমার ঘুম হয় না। জেগে থাকি।
সেটাই তো ভাল। ঘুমুলেই সর্বনাশ হবে রে মা। গলা চেপে ধরবে। বলেছিলাম না? তার পরেও ঘুমিয়ে পড়লি? তুই এত বোকা কেন?
তুমি চলে যাও বাবা আমার ভয় লাগছে।
আমাকে ভয় কিসের রে বোকা মেয়ে। যাকে ভয় পাওয়ার তাকে ভয় পাবি।
দরজায় আবার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ হচ্ছে। দরজা খুলেও যাচ্ছে। ঐ তো দেখা যাচ্ছে পর্দার ওপাশে চাদর গায়ে রোগা একজন মানুষ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা হাত রেখেছে পর্দায়। যেন এক্ষুণি পর্দা ঠেলে সে ভেতরে ঢুকবে। বকুল কাতর গলায় বলল, আমার বড় ভয় লাগছে বাবা। তোমার পায়ে পড়ি ভেতরে এস না। বড় ভয় লাগছে।
জহির রাত বারোটার দিকে ঘরে ফিরে দেখে বকুলের মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। সে হাত-পা ছুড়ছে। পুরোপুরি হিস্টিরিয়ার লক্ষণ। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়াতে হল।
সারারাত তার পাশে জহির এবং বাবু বসে রইল। জহির কয়েকবারই বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড় বাবু। আমি তো জেগেই আছি।
বাবু নড়ল না। সে খুব ভয় পেয়েছে। মাঝে মাঝে অল্প অল্প কাঁদছে। জহির বলল, বকুলকে কিছু দিনের জন্যে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়াই ভাল। কি বল বাবু?
বাবু তারও জবাব দিল না। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হচ্ছে।