৪০. জব চার্নকের কোলকাতা

অধ্যায় ৪০

জব চার্নকের কোলকাতা; এক সময়কার ভারতের রাজধানী। বহু ইতিহাসের সাক্ষী শহরটাতে পা রাখলো বাস্টার্ড ।

বাবু বিনয় কৃষ্ণকে হত্যা করার পরদিনই কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে। সাতক্ষীরা শহরে পৌঁছেই কেরাণীগঞ্জ থানায় ফোন করে নিজের পরিচয় না দিয়ে জানিয়ে দেয়, কোথায় গেলে তারা কুখ্যাত সন্ত্রাসী রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ বন্টুকে খুঁজে পাবে। ঝন্টু হবে জেফরি বেগের জন্য একটা কানাগলি। উমার পেছনে না ছুটে এই ঝন্টুর পেছনে সময় নষ্ট করবে সে।

বর্ডার ক্রশ করে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই, তারপর বাসে করে সোজা চলে আসে সল্টলেক সিটির কাছে নতুন বাস টার্মিনালে। তার পুরনো আর বিশ্বস্ত এক লোক সীমান্ত পার করার কাজে তাকে সাহায্য করেছে। সল্টলেক থেকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মির্জা গালিব স্টটে যখন এলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়।

গালিব স্ট্রটের ঠিক পাশে কিড স্ট্রটের একটা মাঝারি মানের হোটেলে রাতটা কাটিয়ে দিলো সে। এ জায়গাটা তার অনেক বেশি চেনা। এর আগে যতোবার এসেছে এখানেই থেকেছে। মুসলিম অধ্যুষিত এই পুরনো এলাকাটি তার কাছে বিদেশ বলে মনে হয় না। তবে প্রয়োজনের পাশাপাশি আরেকটা বড় কারণ হলো, এখানে সুস্বাদু গরুর মাংসের কাবাব আর মগজ ভুনা পাওয়া যায়।

মির্জা গালিব স্টটের পাশেই নিউ মার্কেট আর গ্র্যান্ড হোটেল। হাটা দূরত্বে। আরো আছে এসপ্লানেড-মেট্রো স্টেশন, ইডেন গার্ডেন আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

এটা এমন একটা জায়গা যেখান থেকে টাকা, অস্ত্র, ভুয়া দেশি পাসপোর্ট, সবই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশ থেকে সড়কপথে যেসব বাস আসে তাদের বেশিরভাগের অফিসও এ এলাকায়। বিদেশ-বিভুয়ে অপারেশন চালানোর বেলায় এরকম পরিচিত জায়গা থেকে শুরু করাই ভালো।

রঞ্জু চায়না টাউনে থাকে কথাটা জানার পরই সে সিদ্ধান্ত নেয় খুব কাছে কোথাও থাকবে না । একটু দূরে থাকাই নিরাপদ হবে। কারণ কোলকাতায় রঞ্জুর দলটি কতো বড় সে ব্যাপারে তার কোনো ধারণাই নেই। আগে সে সম্পর্কে ভালো করে খোঁজ নিতে হবে, তারপরই রঞ্জুর কাছাকাছি চলে যাবে সে। এতো কাছাকাছি যে রঞ্জু কল্পনাও করতে পারবে না।

পরদিন সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠলো বাস্টার্ড। রুম সার্ভিসকে দিয়ে নাস্তা আনিয়ে খেয়ে নিলো।

সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় সঙ্গে করে পিস্তলটা নিয়ে আসে নি, পাছে সাধারণ কোনো তল্লাশীর শিকার হলে সর্বনাশ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতো। অস্ত্রসহ একজন বাংলাদেশি বিএসএফ’র হাতে গ্রেফতার হওয়া মানে নির্ঘাত কোনো জঙ্গিগোষ্ঠির সদস্য। শুধু যে গ্রেফতার করা হবে তা-ই নয়, মিডিয়াতে ফলাও করে ছবিসহ প্রচারও করা হবে।

তবে লাগেজের ভেতর নানান ফালতু জিনিসপত্রের মাঝে কৌশলে সাইলেন্সারটা নিয়ে এসেছে। গুলি আর পিস্তল চলে আসবে দুপুরের মধ্যে। তাকে যে ছেলেটা সীমান্ত পাড় করিয়ে দিয়েছে সে-ই এটা নিয়ে আসবে। ছেলেটা সঙ্গে করে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু বাস্টার্ড মানা করেছে। তার সঙ্গি হিসেবে ছেলেটা ধরা পড়লেও তার সমস্যা হতো। বর্ডার পার হয়ে হাবড়া জেলা পর্যন্ত বাস্টার্ডকে সঙ্গ দিয়েছে ছেলেটা, তারপর ফিরে গেছে সীমান্তের ওপারে। বাস্টার্ড তাকে বলে দিয়েছে পরদিন সকালে যেনো সে আবার রওনা দেয় পিস্তলসহ।

বেলা যখন বারোটা বাজে তখন সে হোটেল থেকে বের হয়ে এলো। এই হোটেলে সে উঠেছে ভুয়া নামে, ভুয়া পরিচয়ে। সে কোনো বাংলাদেশী নয় । কোলকাতার বাইরে বাকুরা জেলার পিনাকী দাস। এ নামে ভুয়া আইডি কার্ড তাকে সীমান্ত পাড়ি দেবার আগেই দিয়ে দেয়া হয়েছে।

অনেক দিন পর এসে দেখতে পেলো মির্জা গালিব স্টুটটা যেনো কয়েক বছর আগের মতোই রয়ে গেছে। একটুও বদলায় নি। কিছুটা যদি বদলেও থাকে সেটা তার চোখে ধরা পড়লো না। পুরনো কোলকাতা, পুরনোই রয়ে গেছে। শুধু ঝকমকে কিছু অত্যাধুনিক নিয়নসাইন জানান দিচ্ছে শহরের বাকি অংশ থেকে তারা মোটেও পিছিয়ে নেই। বাস্টার্ডের কাছে মনে হলো বুড়ো মানুষের হালফ্যাশনের পোশাক পরার মতো ব্যাপার এটি। হাস্যকর।

কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে কিনতেই দুপুরটা পার হয়ে গেলো। একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এলো হোটেলে । ফ্রন্ট ডেস্কের লোকটা তাকে দেখেই বললো, “পিনাকী বাবু, আপনাকে খুঁজতে এক লোক এসেছিলো একটু আগে।”

“নাম বলেছে?”

“হ্যাঁ, মৃদুল। বলে গেছে শ্যামলী পরিবহনের অফিসে আছে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ ।” বাস্টার্ড এইমাত্র কেনা জিনিসগুলো রুমে রেখেই আবার বেরিয়ে গেলো।

মৃদুল নামের লোকটাই তাকে বর্ডার পার করিয়ে দিয়েছে। ভুয়া আইডি কার্ডও জোগার করে দিয়েছে সে। আরো কিছু জিনিস জোগার করে দেবার কথা।

কিড স্ট্রটের একটা পুরনো তিনতলা বাড়িতে শ্যামলী পরিবহনের অফিস, নীচতলায় কাউন্টার, দোতলায় অফিস আর তিন তলায় যাত্রিদের বিশ্রাম নেবার জন্যে ছেড়ে দেয়া হয়েছে পুরোটা ফ্লোর। বাস্টার্ড সোজা চলে গেলো তিন তলায়। ঢুকতেই দেখা হয়ে গেলো মৃদুলের সাথে ।

“বস্‌, কোথায় গেছিলেন?” দাঁত বের করে হেসে বললো ত্রিশ বছর বয়সের মৃদুল কান্তি সরকার।

“একটু কাপড়চোপড় কিনতে গেছিলাম।”

“এখানেই কথা বলবেন, নাকি আপনার রুমে?”

বাস্টার্ড ঘড়িতে দেখলো প্রায় দুটো বাজে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। “দুপুরে তো খাও নি, তাই না?” মৃদুল শুধু হাসলো। “চলো, আগে কিছু খেয়ে নেয়া যাক।”

শ্যামলী পরিবহণের অফিস থেকে পঞ্চাশ গজ দূরত্বেই বাংলাদেশী মালিকানায় দুটো হোটেল আছে : রাধুনী আর কস্তরী। বাস্টার্ড ঢুকে পড়লো রাধুনীতে।

খেতে খেতেই কথা হলো তাদের।

“সিম কিনেছো?” জানতে চাইলো সে।

মাথা নাড়লো মৃদুল। তার মুখে খাবার। একটু পর খাবারটা গিলে বললো, “মাত্র এলাম, বিকেলের আগেই পেয়ে যাবেন।”

“একটা প্রাইভেটকার ভাড়া নিতে হবে। চার দিনের জন্যে।”

“হয়ে যাবে, বস।” খাবারের দিকে থেকে মনোযোগ না সরিয়েই বললো মৃদুল।

“আমি চাই তুমি আরো দুটো দিন থেকে যাও।”

গোগ্রাসে খাবার খেতে খেতে মৃদুল মুখ তুলে তাকালো। “তাই?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড ।

“ঠিক আছে,” কথাটা বলেই আবার খাওয়াদাওয়ায় মনোযোগ দিলো মৃদুল। অনেকটা পথ ভ্রমণ করেছে, প্রচুর খিদে ছিলো।

মুচকি হাসলো বাস্টার্ড । ছেলেটা তার খুবই বিশ্বস্ত । প্রায় আট বছর ধরে পরিচয় তার সাথে । দক্ষিণবঙ্গে সর্বহারা পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলো। অন্য এক লোকের মাধ্যমে তার সাথে এই ছেলের পরিচয়। বাস্টার্ড তাকে ঢাকা শহরে নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রেখেছিলো প্রায় চার-পাঁচ মাস। সেই থেকে তাদের মধ্যে গাঢ় সম্পর্কের সূচনা। মৃদুল আর এখন সর্বহারাদের সাথে নেই। সীমান্তে অবৈধভাবে লোকজন পার করা, জাল পাসপোর্ট তৈরি করে দেয়া, অস্ত্র চালান ইত্যাদি কাজ করে। তার প্রায় সব আত্মীয়স্বজন থাকে কোলকাতা, হাওড়া এবং বাকুরা জেলায়। মির্জা গালিব স্টটেও মৃদুলের ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয় থাকে, বাস্টার্ড ইচ্ছে করলে সেখানেও থাকতে পারতো কিন্তু রাজি হয় নি। তার দরকার একদম অচেনা জায়গা। সুতরাং ছিমছাম কোনো হোটেলে ওঠাই ভালো।

মৃদুলের খাওয়া শেষ । বাস্টার্ডের শেষ হয়েছে তারও আগে।

“বস, জিনিসটা কি এখানেই নেবেন?” হাত মুছতে মুছতে বললো সে।

“তোমার সঙ্গে আছে?” মাথা নেড়ে সায় দিলো মৃদুল। “ওয়াশরুমে চলে যাও। আমি আসছি।”

মৃদুল চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেলে বাস্টার্ড কিছুক্ষণ পর উঠে গেলো।

সেভেন পয়েন্ট সিক্স ফাইভ পিস্তল আর গুলির প্যাকেটটা ওয়াশরুমেই অদলবদল করে নিলো তারা। তারপর যেভাবে গিয়েছিলো ঠিক সেভাবেই ফিরে এলো এক এক করে।

“তাহলে আমাকে দু’দিন থাকতে হবে?” মৃদুল বললো।

“হ্যাঁ।”

“আমি আমার মাসির বাড়িতেই উঠি, কি বলেন?…আপনার কাছাকাছি থাকা গেলো, দরকার হলেই দেখা করা যাবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।

“আমি এখন যাই, সিম কিনে ট্যাক্সি ঠিক করে আসছি। আপনি তো রুমেই থাকবেন, না?”

“হ্যাঁ।” কথাটা বলেই বাস্টার্ড পকেট থেকে কিছু বংলাদেশি টাকা বের করে দিলো। “এখানে পঞ্চাশ হাজার আছে, ইন্ডিয়ান কারেন্সি করে নিও। পাঁচ হাজার রেখে দিও তোমার কাছে।”

টাকাগুলো পকেটে রেখে দিলো মৃদুল। “ওকে, বস।”

রাধুনী রেস্তোরাঁ থেকে সোজা নিজের রুমে ফিরে এলো বাস্টার্ড । আবারো বিশ্রাম নেবে। তার কাঁধের ক্ষতস্থানে যে ব্যান্ডেজটা আছে সেটা খুলে নতুন করে ড্রেসিং করতে হবে । হোটেলে ফেরার পথে একটা ওষুধের দোকান থেকে কিছু তুলা, কটনটেপ আর অ্যান্টিসেপটিক লোশন কিনে নিলো। শারিরীক যন্ত্রণাকে সে কখনই পাত্তা দেয় না, কিন্তু ক্ষতস্থানের পরিচর্যা করাটা যে জরুরি সেটা সে জানে । এই গুলির আঘাতটা নিয়েই তো কতো কাজ করে ফেললো। কেউ বুঝতেও পারলো না তার কাঁধে গুলির ক্ষত রয়েছে।

নিজের রুমে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে যখন নতুন করে ড্রেসিং করতে লাগলো তখন আচমকাই উমা নামের মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেলো তার। মেয়েটা কোথায় আছে, কেমন আছে সে জানে না। পুলিশ নিশ্চয় তাকে এতো সহজে ছেড়ে দেয় নি। অবশ্য মেয়েটা যদি তার কথামতো কাজ করে থাকে তাহলে বেঁচে যাবে।

মাথা থেকে চিন্তাটা জোর করে বাদ দেয়ার চেষ্টা করলো। তাকে এখন অন্য বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।

ব্ল্যাক রঞ্জু।

তারা এখন একই শহরে আছে। ঢাকায় পুলিশ আর হোমিসাইড তার পেছনে হন্যে হয়ে লেগেছিলো কিন্তু এখানে সে চিন্তা নেই। এখন ধীরেসুস্থে পরিকল্পনা করে এগোতে পারবে।

রঞ্জুর খুব কাছে চলে এসেছে। আস্তে আস্তে তার সুরক্ষিত জগতটা ভেদ করে ঢুকে পড়ছে সে। ঘুণাক্ষরেও রঞ্জু বুঝতে পারছে না তার মৃত্যুদূত এ শহরে পা রেখেছে আজ।

.

অধ্যায় ৪১

চায়না টাউনের একটি ব্যস্ত রেস্তোরাঁর চার তলায় কারা থাকে সে সম্পর্কে আশেপাশের লোকজনের কোনো ধারণাই নেই। দোতলাটি রিজার্ভ স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয় আর তিন তলায় রেস্তোরাঁর কর্মচারিরা থাকে। তবে রেস্তোরাঁর লোকজন জানে চার তলায় থাকে স্বয়ং মালিক। বিশাল স্পেসটা তিনি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছেন। ভোগ-বিলাসের প্রায় সব উপকরণই ওখানে আছে।

যে কেউ ইচ্ছে করলেই ওখানে যেতে পারে না। অবশ্য এ নিয়ে আশেপাশে কেউ মাথাও ঘামায় না, কারণ চায়না টাউনের এই এলাকাটিতে যে কয়টি রেস্তোরাঁ আছে তার প্রায় সব কটির মালিকই রেস্তোরাঁর উপরে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে। “ একতলা থেকে দোতলা আর তিন তলায় যাওয়ার যে সিঁড়িটা আছে সেটা দিয়ে চার তলায় যাওয়া যায় না। কিন্তু ঠিক কোন সিঁড়িটা দিয়ে চার তলায় পৌঁছানো যায় সেটা খুব কম মানুষই জানে।

এ মুহূর্তে চার তলার পরিবেশ স্বজন হারানো শোকে থমথম করছে। গুমোট আর স্তব্ধ। গোঁফওয়ালা লোকটা প্রচুর মদ পান করে জানালার সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে আছে। সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে, পানাহারপ্রিয় লোকজন আসতে শুরু করেছে চায়না টাউনে। নীচের রেস্তোরাঁটা কিছুক্ষণের মধ্যেই সরগরম হয়ে উঠবে।

জানালার পাশে বসা লোকটার হাতে জ্যাক ড্যানিয়েলের একটা বোতল । অর্ধেকটা খালি হয়ে গেছে এরইমধ্যে। তার ঠিক পাশেই বসে আছে তার প্রায় সমবয়সী কালো কুচকুচে এক লোক। তার ঠোঁটে সিগারেট।

লম্বা একটা টান দিয়ে সিগারেটটা সামনের টেবিলে রাখা অ্যাস্ট্রে’তে খুঁজে রেখে বললো সে, “আমাদের কেউ কোনো খবর দিতে পারছে না?”

জানালার সামনে বসা লোকটা নীচের রাস্তা থেকে চোখ সরালো না । “বিনয় বাবুর কথা তো কেউ জানতো না,” একটু থেমে আবার বললো সে, “ঝন্টু ছাড়া।”

“তাহলে তোমার ধারণাই ঠিক, ঝন্টু শেষ,” পাশে বসা লোকটি বললো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “কাজটা কে করছে, কারা করছে আমরা কেউ জানি না, তাই না?” একই রকম উদাস দৃষ্টি তার।

বলা হলো তার কাছেও এর কোনো জবাব নেই। তার ধারণা প্রশ্নকর্তা নিজেও এটা জানে না ।

বোতল থেকেই ঢকঢক করে কিছুটা পান করে নিলো জানালার সামনে বসা লোকটি। পাশে বসা লোকটি কিছু বললো না। তার বন্ধু যে বেশি পান করে ফেলেছে সেটা সে জানে।

“না জেনে কোনো কিছু করা যাবে না।” বোতল থেকে আবারো কিছুটা পান করে নিলো সে। “এখানে বসে বসে কিছু জানাও সম্ভব না।” আপন মনেই বলতে লাগলো সে।

“মনে হচ্ছে তুমি আজ একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে, তার হাতের বোতলের দিকে ইঙ্গিত করে বললো পাশে বসা তার বন্ধু।

মাথা দুলিয়ে কথাটা বাতিল করে দিলো সে। “বেশি খেলেই আমার মাথাটা খুলে যায়। জানালা থেকে মুখটা সরিয়ে তাকালো বন্ধুর দিকে। কিছু দিন পরই বিরাট একটা অপারেশনে নামতে হবে আমাদেরকে। ঐ কাজটা ভালো ভালোেয় শেষ করলে আমরা শুধু দেশেই ফিরতে পারবো না, আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবো। ক্ৰশফায়ারের ভয়ে বিদেশে পড়ে থাকার দিন শেষ হবে। পুলিশও আমাদের কিছু করতে পারবে না”

“তাহলে কি করতে চাও?”

“আমি ঢাকায় যাবো।”

আৎকে উঠলো তার বন্ধু। এই সময়?”

গর্দভ! মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে চেয়ে মনে মনে বললো সে। মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে করতে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেয়ে গেছে। “ভুলে গেছে, আমার কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তোমাকে নিয়ে!”

চুপ মেরে রইলো তার বন্ধু। কথাটা সত্যি।

“আমি ঢাকায় গিয়ে সব গুছিয়ে নেবো…কাজটা কে করছে সেটাও জেনে নিতে পারবো।”

.

বিকেলের মধ্যেই মৃদুল এসে সিম কার্ড দিয়ে গেলো। একটা প্রাইভেটকার ঠিক করে ফেলেছে সে, বাস্টার্ড চাইলে ড্রাইভারের সাথে যোগাযোগ করে যখন তখন গাড়িটা ব্যবহার করতে পারবে। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত গাড়িটা পাওয়া যাবে। চাইলে আরো কিছুটা সময়ও বাড়তি পাবে যদি সে চায়।

মৃদুল চলে যাবার পরই বাস্টার্ড ড্রাইভারকে ফোন করে তার হোটেলের কাছে আসতে বললো। সন্ধ্যার পর কোনো চায়নিজ রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়া যাবে সেইসাথে জায়গাটাও দেখে আসা যাবে।

চায়না টাউনে যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা হয় হয়। এক জায়গায় এতোগুলো চায়নিজ রেস্তোরাঁ সম্ভবত খুব কম জায়গায়ই আছে। এখানকার সবগুলো চায়নিজ রেস্তোরাঁয় মদ-বিয়ার পাওয়া যায়। কোলকাতা শহর হচ্ছে। মদ-বিয়ারের জন্য উন্মুক্ত। সবচাইতে বড় কথা, চায়না টাউনের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর মালিক চীনাবংশোদ্ভূত। ইদানিং মালিকানা বদল হয়ে কিছু স্থানীয় লোক এই ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে। মাউন্ট অলিম্পাস সেরকমই একটি রেস্তোরাঁ।

রেন্ট-এ-কারটা বেশ ঝকঝকে একটি টয়োটা লেক্সাস। দেখে মনে হবে এটা কোনো ভাড়া করা গাড়ি। মৃদুল ছেলেটা যে কাজের সেটা বুঝতে পারলো । ড্রাইভার লোকটির নাম যাদব। সম্ভবত বিহারের। ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। বাস্টার্ড এখন পিনাকী দাস। বাকুরা জেলার উঠতি এক ব্যবসায়ী।

ড্রাইভার যখন জানতে চাইলো কোথায় নামবে, বাস্টার্ড তাকে মাউন্ট অলিম্পাস রেস্তোরাঁর কথা বললো। হ্যাঁ, সে চেনে। ওটা খুব ভালো রেস্তোরাঁ।

চায়না টাউনের মেইন রোড থেকে ডান দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে তাদের গাড়িটা সেখানে ঢুকে পড়লো। কিছু দূর যাবার পর সারি সারি চায়নিজ রেস্তোরাঁর সামনে থামলো গাড়িটা। বাস্টার্ড জানালার কাঁচ দিয়ে দেখতে পেলো মাউন্ট অলিম্পাস-এর সামনেই গাড়িটা থেমেছে।

ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলে ঢুকে পড়লো ভেতরে।

ভেতরটা বেশ বড়, কততগুলো পিলার ছাড়া এটা বড়সড় হলরুমের মতো। ডান দিকে লম্বা একটা বার চলে গেছে। কম পক্ষে চল্লিশ ফিট দৈর্ঘের। বাম দিকে, সারি সারি রাউন্ড আর স্কয়ার টেবিল পাতানো। একটা পাটিশানের ওপাশে কতোগুলো সোফা পাতা আছে। এটা হলো লাউঞ্জ। সব মিলিয়ে একেবারে আধুনিক একটি রেস্তোরাঁ। সন্ধ্যার মাত্র শুরু অথচ লোকজন নেহায়েত কম নয়। বাস্টার্ড বুঝতে পারলো রেস্তোরাঁটা পসার ঘটেছে ভালোমতোই।

এককোণের একটি ছোট্ট রাউন্ড টেবিলে গিয়ে বসলো সে। তরুণ ওয়েটার মেনু দিয়ে গেলে গভীর মনোযোগের সাথে দেখতে লাগলো, তবে তার আসল মনোযাগ রেস্তোরাঁরর ভেতরের পরিবেশের দিকে।

ফিশবোল আর দুটো বিয়ারের অর্ডার দিলো । খুব একটা খিদে নেই। শুধু সময় পার করতে হবে। এখানে এক ঘণ্টার মতো থাকার ইচ্ছে তার।

কাস্টমারদের বেশিরভাগই যুগল। প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী কিংবা অন্য কিছু। তবে কয়েক জন পুরুষ আর মহিলাকে দেখতে পেলো একা বসে আছে। কারোর জন্য অপেক্ষা করছে পুরুষগুলো, কিন্তু মেয়েগুলোর ব্যাপারে। সে কথা বলা যাবে না।

খেয়াল করলো তার ঠিক পাশের টেবিলেই এক সুদর্শন যুবক বসে আছে। চেনা চেনা লাগলো। হ্যাঁ, ধরতে পেরেছে। এখানকার টিভি’কে ছেলেটা অভিনয় করে। নায়ক। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শেভ করে নি। তার সামনে ম্যাকডাওয়েলের আস্ত একটি বোতল। পান করে যাচ্ছে। দেখে মনে হলো হতাশাগ্রস্ত।

ফিশবোল আর বিয়ার এসে পড়লে একটা গ্লাসে বিয়ার ঢেলে ছোটো ছোটো চুমুক দিতে লাগলো সে। তার নজর ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে বিরামহীন। তিন-চারজন তরুণীর দিকে চোখ পড়লো । একা বসে আছে তারা। বাস্টার্ড জানে এরা কেন বসে আছে।

চায়না টাউনের এসব রেস্তোরাঁয় এরকম মেয়েদের দেখা যায় সব সময়। কোন্ রেস্তোরাঁর মেনু ভালো, খাবারের মান ভালো তার সাথে সাথে এরকম কতো সুন্দর আর স্মার্ট মেয়ে আছে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। বাস্টার্ড শুনেছে আজকাল নাকি এই লাইনে কিছু যুবকও নেমেছে, তবে সেরকম কাউকে দেখতে পেলো না।

নিঃসঙ্গ কাস্টমারকে সঙ্গ দেয়াই এদের কাজ। তবে নিছক সঙ্গ থেকে ব্যাপারটা আরো বেশি দূরও গড়াতে পারে দু’জনের বোঝাপড়ার মাধ্যমে। একটু দূরে এরকমই এক মেয়ে বসে আছে, তার সাথে বার কয়েক চোখাচোখি হলো। মুচকি হাসলো বাস্টার্ড । সে নিঃসঙ্গ থাকতে চায় না।

অন্য একটা খালি গ্রাসে বিয়ার ঢেলে রেখে দিয়ে নিজের গ্লাসে চুমুক দিলো। দেখতে পেলো মেয়েটা মুচকি হেসে নিজের টেবিল থেকে উঠে আসছে।

“বসতে পারি?” মিষ্টি কণ্ঠে বললো মেয়েটি। মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড। “থ্যাঙ্কস।” মেয়েটা গ্লাসের বিয়ার তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিলো। “ওয়াইন চলে না?”

আন্তরিক একটা হাসি দিয়ে বললো বাস্টার্ড, “এততক্ষণ চলে নি, এখন মনে হচ্ছে চলবে।”

“দ্যাটস গুড,” মেয়েটা চোখ নাচিয়ে বললো।

ওয়েটারকে ওয়াইনের অর্ডার দিয়ে দিলো বাস্টার্ড ।

“নাম কি, মিস্টার?”

“পিনাকী।”

“টাইটেল বলতে সমস্যা আছে?” আবারো চোখমুখ নাচিয়ে বললো মেয়েটি।

“কাস্ট নিয়ে ম্যাডামের রিজাভেশন আছে নাকি?” পাল্টা বললো সে।

“ওহ্ নো। ওসব ফালতু জিনিস নিয়ে মিস টুম্পা মাথা ঘামায় না।”

“তাহলে ম্যাডামের নাম টুম্পা,” মুচকি হেসে বললো বাস্টার্ড ।

“নো ম্যাডাম, বড় বিচ্ছিরি লাগে…জাস্ট টুম্পা।”

“ওকে, টুম্পা…” বিয়ারে এক চুমুক দিয়ে বললো বাস্টার্ড। এখানে এলে কি তোমাকে পাওয়া যাবে?”

“ওমা, আমাকে পেতে চাও নাকি,” কথাটা বলেই ভুরু নাচালো টুম্পা।

“আমি আরো এক সপ্তাহ কোলকাতায় আছি, এই এক সপ্তাহ চাচ্ছি আর

ভুরু কুচকে মেয়েটা বললো, “তুমি কোলকাতায় থাকো না?”

“দিল্লি,” বিয়ারে আরেকটু চুমুক দিলো সে। “বারো বছর ধরে ওখানেই আছি। ব্যবসার কারণে।”

“দ্যাটস গুড,” বললো টুম্পা, “দিল্লির কোথায় থাকো গো?”

দিল্লির যে জায়গাটা সবচাইতে বেশি চেনে সেটার কথাই বললো । “কনৌট প্লেস।”

“আচ্ছা,” আবারো ভুরু নাচালো টুম্পা। “তো সাতদিনই কি আমাকে চাচ্ছো, মি: পি?” মুখ টিপে হাসলো মেয়েটি।

“তোমার কি কোনো সমস্যা আছে?”

“আগে দেখি তুমি আমার সাথে কেমন বিহেইভ করে তারপর ভাববো, বুঝলে?” রহস্য করে বললো।

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ওকে।”

“কোথায় নিয়ে যাবে আমায়?”

একটু ভাবলো বাস্টার্ড । “এখানে তো আমার পরিচিত কোনো জায়গা নেই, আমি উঠেছি হোটেলে…”।

“আমি কিন্তু হোটেলে যাই না,” ন্যাকামি করে বললো মেয়েটি।

টাকা দিলে তুমি হোটেলে কেন জাহান্নামেও যেতে রাজি হবে, মনে মনে বললো বাস্টার্ড। “তাহলে তুমিই আমাকে কোথাও নিয়ে চলো?”

একটু ভাবলো মেয়েটি। “উমমম…আমার এক পিসাত বোন আছে, ওর ওখানে যাওয়া যায়, বাট ওর রুমটা ব্যবহার করার জন্য ওকে এক হাজার টাকা দিতে হবে।”

“নো প্রবলেম,” মেয়েটার দিকে একটু ঝুঁকে বললো, “আর তোমাকে?”

“পাঁচ।”

মাথা দোলালো বাস্টার্ড। “একটু বেশি হয়ে গেলো না? আমি কিন্তু সাত দিন তোমাকে চাই। বুঝতে পেরেছো?”

“পুরো সাত দিন! ওয়াও, আমাকে এতো মনে ধরে গেছে!” মেয়েটাও একটু ঝুঁকে এলো তার দিকে। “দেন, ফোর থাউজেন্ড । জাস্ট ফর ইউ। ওকে, মি: পি?”

“ওকে,” একটু থেমে আবার বললো সে, “কোথায় নিয়ে যাবে?”

“ভয় পেয়ো না, খুব বেশি দূরে নিয়ে যাবো না গো ।”

“এই রেস্তোরাঁটা আমার খুব ভালো লেগে গেছে, এর হলেই আমার জন্যে ভালো হয়, বাস্টার্ড বললো।

“তাই বুঝি?” ন্যাকামি করে বললো টুম্পা। “যাও, তাহলে তোমাকে বেশি দূরে নিয়ে যাবো না। সত্যি বলতে কি জানো, আমার পিসাতো বোনের বাড়িটা খুব কাছেই।”

“দ্যাটস ভেরি গুড।” কথাটা বলেই মেয়েটার গালে আঙুল দিয়ে আলতো করে টোকা দিলো। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তোমার কাজিন এই রেস্তোরাঁর উপরেই থাকে,” বলেই হেসে ফেললো সে।

“কেন, এর উপরে হলে তোমার কি অসুবিধে হবে?”

“তুমি থাকলে কোথাও আমার অসুবিধে হবে না।” আবারো মেয়েটার গালে টোকা দিলো।

“কী ব্যাপার, এখানেই শুরু করে দেবে নাকি?” কপটভাবে বললো টুম্পা।

হাতটা সরিয়ে নিলো বাস্টার্ড। “বললে না তো কোথায় যাচ্ছি?”

“কেন, তর সইছে না বুঝি?” মুখ টিপে হেসে ফেলো মেয়েটি।

“অনেক দিন পর তো তাই সইছে না,” কাটাচামচে একটা ফিশবোল তুলে মেয়েটার মুখের কাছে ধরলো। “কাছে কোথাও হলে চলো এখনই চলে যাই।”

“ডোন্ট অরি, খুব কাছেই যাবো,” ফিশবোলটা মুখে পুরে বললো টুম্পা নামের মেয়েটি।

“উপরে?” ছাদের দিকে ইঙ্গিত করে বললো বাস্টার্ড ।

“আরে না।”

“কেন, ওখানে এসব চলে না?”

“ওখানে আরো বেশি চলে,” বলেই রহস্য করলো টুম্পা।

“বেশি?”

“এই রেস্তোরাঁটার মালিক চার তলায় থাকে। ও আর ওর বন্ধুর নিত্য নতুন মেয়ে চাই।”

“তাই নাকি?”

“আর বোলো না, মালিকের বন্ধুটা হাড়ে হাড়ে বদমাশ, মাঝেমধ্যে একসাথে দুটো মেয়েকে নিয়ে ঢোকে।”

“দুটো!?”

“আর বলছি কী,” এবার নিজেই একটা ফিশবোল তুলে নিলো টুম্পা। “আমার বান্ধবী শিমকি কি বলেছে, জানো?” বাস্টার্ড সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো। “বলেছে, লোকটা নাকি এক ঘন্টা সময় নেয়।”

ভুরু কপালে তুলে বিস্মিত হবার ভান করলো সে। শিমকি? ঠিক আছে। “বাপরে!” তারপর মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো, “ওর ওয়াইফ থাকে না?”

মাথা দোলালো মেয়েটি। মুখে ফিশবোল, তাই কথা বলতে পারলো না। “বিয়ে করে নি তো।”

“একা থাকে?”

“না, বললাম না, ওর এক বন্ধুও থাকে। বন্ধুটা বদমাশ হলেও মালিক লোকটা অতোটা খারাপ নয়।”

“কেন, তোমার সাথে ভালো ব্যবহার করে বুঝি?”

“তা করে বৈ কি…আমার সাথে যারা রাফ বিহেইভ করে আমি তাদের সাথে যাই না।”

“তুমি কি ওর সাথে যাও?”

“ছি ছি, এসব নিয়ে কথা বলছো কেন, অন্য কিছু নিয়ে বলো।” কপট লজ্জা পাবার ভান করলো মেয়েটা। “ও কাউকে নেয় না, সুষমাই ওর রেগুলার।”

“সুষমা?…তোমার বান্ধবী?”

“হ্যাঁ,” এবার এক ঢোক বিয়ার খেলো মেয়েটি। “অনেক সুন্দরী, দেখলে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে…”

ভুরু কপালে তুললো বাস্টার্ড। “তাহলে তো মাথা খারাপ করতে হয়!”

“বাব্বা, আমাকে দেখে মন ভরছে না, বুঝি? তোমরা পুরুষেরা একজনে খুশি থাকো না, সবগুলো একরকম,” অভিমানী সুরে বললো টুম্পা।

“ঠিক আছে যাও, দেখবো না। শুধু তোমাকে দেখবো।” বাস্টার্ড একদৃষ্টে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে ।

“ওলে বাব্বা, এ দেখি অভিমানও করে!” হেসে বললো টুম্পা। “আগে তোমার সাথে মিশি তারপর দেখা যাবে, ঠিক আছে?”

মেয়েটার থুতনী ধরে বললো, “ঠিক আছে।”

এরপর তারা কয়েক পেগ মদ পান করে টুকটাক গল্পগুজব করলো। রাত আটটার পর দুজনে একসাথে বের হয়ে গেলো মাউন্ট অলিম্পাস থেকে বের হবার আগে টয়লেটে গিয়ে বাস্টার্ড রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিলে চলে যেতে। কাল সকালে জানাবে কখন কোথায় আসতে হবে।

টুম্পা যে বিল্ডিংটাতে ঢুকলো সেটা মাউন্ট অলিম্পাস থেকে খুব কাছে। চার তলার একটি ফ্ল্যাটে ঢোকার আগেই টুম্পা নামের মেয়েটি তার তথাকথিত পিসাতো বোনকে ফোন করে বলে দিলো তারা আসছে।

চারতলার ফ্ল্যাটে ঢোকার আগে বাস্টার্ড ঘুণাক্ষরেও জানতো না এই ফ্ল্যাট থেকে সে কী দেখতে পাবে।

বেডরুমের দক্ষিণমুখী বিশাল জানালা দিয়ে যখন বাইরে চোখ রাখলো অবাক হয়ে দেখতে পেল মাউন্ট অলিম্পাস রেস্তোরাঁর চার তলার ফোরটি

স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে।

এটাকে কী বলা যেতে পারে…

সৌভাগ্য?

.

অধ্যায় ৪২

জেফরি বেগ গোয়েন্দা রিপোর্ট পড়ে যা জানতে পেরেছে সেটা একেবারেই অভূতপূর্ব ঘটনা। একটা সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সাথে এর কোনো মিলই নেই, অথচ কী গভীর কানেকশানই না আছে। অদ্ভুত!

আরেকটু তদন্ত না করে ব্যাপারটা কারো সাথে শেয়ার করা যাবে না। আরো কিছু বিষয় স্পষ্ট হওয়ার দরকার আছে। তার আগ পর্যন্ত পুরো বিষয়টা নিজের মধ্যেই রাখতে হবে। এমনকি তার সহকারী জামানকেও জানানো যাবে না। সে চায় না এই নোংরা ষড়যন্ত্রের সাথে খামোখা কেউ জড়িয়ে পড়ুক। বিস্ফোরকের মতো একটি তথ্য।

একটানা দুই ঘণ্টা নিজের অফিসে বসে বসে ভেবে যাচ্ছে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। পুরো তদন্তটি ধাপে ধাপে সাজিয়ে নিতে হবে, তার আগে কিছু বিষয় সম্পর্কে আরো স্পষ্ট জানতে হবে তাকে। সমস্যা হলো এসব বিষয় জানা মোটেও সহজ কাজ হবে না।

প্রধানমন্ত্রীকে যদি রিপোর্টটা জানানো হয়েই থাকে তাহলে তিনি এ বিষয়ে পরবর্তী কি পদক্ষেপ নিয়েছেন সেটা তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। তবে অনুমাণ করতে পারে সে। কিছু সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী কিছু নাও করতে পারেন। যেমনটি ধারণা করছেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান। পুরোটাই কেয়ারটেকার সরকারের উপর ছেড়ে দেবেন।

তিনি হয়তো অন্য কোনো গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করিয়েছেন। তবে সেই তদন্তের ফলাফল তারপক্ষে জানা সম্ভব হবে না।

প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট কিছু দিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন যা বাস্তবায়ন করবে কেয়ারটেকার গভমেন্ট। সেক্ষেত্রেও আগাম কিছু জানা অসম্ভব।

কিন্তু সবইতে সহজ কাজ কোনটা?

যাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র তাদেরকে জানিয়ে দেয়া!

হ্যাঁ। এটাই সবচাইতে সহজ আর কার্যকরী ব্যবস্থা।

কিন্তু এই সহজ কাজটা করা হয়েছে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেলে সিদ্ধান্তে আসাটা সহজ হয়ে যেতো।

“স্যার, আসতে পারি,” জামানের কথায় তার চিন্তায় ছেদ পড়লো।

“আসো।”

জামান তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললো, “স্যার, কেরাণীগঞ্জ থানার পুলিশ রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ ঝন্টু নামের একজনকে রিকভারি করেছে।”

“রিকভারি করেছে মানে?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো জেফরি বেগ।

“অজ্ঞাত এক লোক ফোন করে জানায় বন্ধ হয়ে যাওয়া এক পাটকলে রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক ঝন্টু আছে। পুলিশ ওখান থেকে হাত-পা-মুখ বাধা ঝন্টুকে উদ্ধার করেছে।”

“অদ্ভুত!” জেফরি বুঝতে পারলো ঘটনা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে।

“জি, স্যার। আমি নিশ্চিত, এটা ঐ খুনির কাজ।”

“তাহলে তো তাকে খুন করতো, এভাবে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার কথা না। এখন পর্যন্ত তো খুনি কাউকে রেহাই দেয় নি।”

“স্যার, উমা রাজবংশী নামের মেয়েটাকেও কিন্তু খুনি হত্যা করে নি।”

জেফরিকে মনে করিয়ে দিলো জামান। মাথা নেড়ে সায় দিলো ইনভেস্টিগেটর।

“এর বেলায়ও নিশ্চয় সেরকম কিছু হয়েছে,” বললো জামান।

“ঠিক আছে, আগামীকাল আমরা ঐ ঝন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো। তুমি পুলিশকে বলে দাও।”

“জি, স্যার।” জামান একটু থেমে আবার বললো, “স্যার, আরেকটা ব্যাপার আছে।”

“কি?”

“পুরনো ঢাকার ওয়ারিতে একটা খুন হয়েছে, আমাদের কাছে মনে হচ্ছে। এই খুনের সাথেও আগেরগুলোর কনেকশান থাকতে পারে।”

আরেকটা”ভিকটিম কে?”

“এক স্বর্ণব্যবসায়ী…বাবু বিনয় কৃষ্ণ। বয়স পঞ্চাশের উপর হবে।”

“কিভাবে বুঝলে, আগেরগুলোর সাথে কানেকশান আছে?”

“স্যার, লোকটা খুন হয়েছে এক অ্যাপার্টমেন্টে, ওখানে তার এক রক্ষিতা ছিলো…ঐ মহিলা বলেছে কোনো রকম গুলির শব্দ শোনে নি অথচ লোকটা মারা গেছে গুলিতে।”

“তার মানে আমাদের সেই খুনির কাজ,” বললো জেফরি। “কিন্তু এই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর সাথে কি রঞ্জুর দলের কোনো কানেকশান আছে?”

“এখন পর্যন্ত আমরা সেটা জানি না, তবে…”

“তবে কি?”

“লোকটা নাকি স্বর্ণব্যবসার পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসাও করতো। পুলিশ বলছে, তার আসল ব্যবসা হলো হুন্ডি।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো জেফরি । এবার সে কানেকশানটা ধরতে পেরেছে। রঞ্জুর দলের সমস্ত চাঁদাবাজির টাকা কোলকাতায় পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমেই, সুতরাং একজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর সাথে তাদের দলের সম্পর্ক থাকবেই।

“লোকাল থানাকে বলে দাও, আমরা এ হত্যাকাণ্ডেও তদন্ত করবো, আমাদের আগের কেসের সাথে এর কানেকশান আছে।”

“জি, স্যার।”

জেফরি ভাবতে লাগলো, এই খুনখারাবি শেষ হবে কখন। পরক্ষণেই বুঝতে পারলো সামনে আরো বড় ধরণের কিছু হতে যাচ্ছে। সে তুলনায় এসব খুনখারাবি কিছুই না।

.

টুম্পাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেও বাস্টার্ডের মনোযোগ পড়ে রইলো দক্ষিণ দিকের জানালার দিকে। বার বার তার চোখ ওখানে চলে যাচ্ছে। তার ধারণা জানালা দিয়ে রঞ্জুকে দেখা যেতে পারে। কিন্তু মেয়েটা যখন তাকে প্রশ্ন করলো ওদিকে

কেন বার বার তাকাচ্ছে তখন বুঝতে পারলো এভাবে তাকানো ঠিক হচ্ছে না। ঠিক করলো মেয়েটার সাথে কথাবার্তা বলে আরো কিছু জেনে নেবে।

“তোমরা ক’জন কাজ করো ঐ রেস্তোরাঁয়?”

টুম্পা তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। “তোমার ক’জন দরকার এই সাত দিনে?” মেয়েটা স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে জবাব দিলো ।

“আপাতত মিস টুম্পাই যথেষ্ট,” বললো বাস্টার্ড।

“তাহলে এতো কথা জানতে চাচ্ছো কেন, মিস্টার?”

“এখানে আমার কয়েকজন বন্ধু আসবে সামনের মাসে, একটু রিক্রেয়েশন করতে…বুঝতেই পারছো, তাই জেনে নিচ্ছি।”

“কী বিজনেস করো গো, অ্যাঁ? তোমাদের বুঝি অনেক টাকা?”

“বিজনেস যা করি খারাপ না,” বলেই হেসে ফেললো সে, “তবে সারাদিন প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, সেজন্যে একটু…”

বাস্টার্ডের ইঙ্গিতটা ধরতে পারলো টুম্পা। “আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি।”

“আমার অনেক বন্ধু আছে, নিরাপদ জায়গা চায়, বুঝলে? আমার মনে হচ্ছে তোমার এই জায়গাটা বেশ নিরাপদ।” ।

“ঠিক বলেছো। এখানে নিয়ে আসবে ওদের, কোনো সমস্যা নেই, তুমি শুধু বলবে, আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারবো।”

তারা দু’জনে বিছানার উপর পা তুলে বসে আছে।

“একটা ভুল হয়ে গেছে, আক্ষেপের সুরে বললো বাস্টার্ড ।

“কি?”

“একটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে আসা উচিত ছিলো। তোমার সাথে সারা রাত ওয়াইন খেয়ে আড্ডা মারা যেতো।”

“এটা কোনো ব্যাপার হলো, মিঃ পি,” হেসে বললো টুম্পা। “আমি ফোন করে দিলেই রেস্টুরেন্ট থেকে ওরা বোতল পাঠিয়ে দেবে।”

“তাই নাকি?” অবাক হবার ভান করলো পিনাকী দাস।

“এক বোতল দিয়ে যেতে বলবো?”

বাস্টার্ড সম্মতি দিলে মেয়েটা বেডসাইড টেবিল থেকে ফোন করে কাকে যেনো বললো তার এই ফ্ল্যাটে একটা হুইস্কির বোতল দিয়ে যেতে। দশ পনেরো মিনিট পরই এক অল্পবয়সী ছেলে এসে বোতল দিয়ে টাকা নিয়ে চলে গেলো।

মদ খেতে খেতে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলে যেতে লাগলো তারা। বাস্টার্ড খুব সাবধানে তার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে নিতে লাগলো, সতর্ক থাকলো মেয়েটা যেনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে না পারে। মেয়েটা বুঝতেই পারলো না তার সঙ্গি নিজে না যতো বেশি পান করছে তারচেয়ে অনেক বেশি তাকে পান করতে দিচ্ছে।

একটা সময় মেয়েটা যখন বুঝতে পারলো সে খুব একটা ড্রিংক করছে না তখন এর কারণ জানতে চাইলে মি: পি জানালো সে খুব বেশি ড্রিংক করতে পারে না।

রাত ১২টার পর মেয়েটার অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়লো। বাস্টার্ড দেখতে পেলো এক লিটার মদের বোতলটিতে সামান্য পরিমাণ মদই অবশিষ্ট আছে। সে নিজে খুব কমই পান করেছে।

মিস টুম্পা এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণহীন।

“শিমকি, সুষমা এরা কি তোমার চেয়েও সুন্দরী?…আমার তো মনে হয় তারা তোমার চেয়ে বেশি সুন্দরী।”

ঢুলুঢুলু চোখে তাকালো মেয়েটি। “আমি কিভাবে বলবো, তোমরা পুরুষেরা বলতে পারবে…তোমরা যাকে দেখে মজে যাও তাদেরকেই তো লোকে সুন্দরী বলে।”

“কিন্তু তারা নিশ্চয় তোমার মতো এতোটা স্মার্ট না।”

“স্মার্ট?…মাই ফুট!” একটা ঢেকুর তুললো সে। “সুষমা তো দু’বছর আগেও হাওড়ায় ছিলো আর শিমকি কয়েক দিন আগে এসেছে নদীয়া থেকে।”

“আর তুমি?” আরেকটু মদ ঢেলে দিলো মেয়েটার গ্লাসে।

“আমি এখানকার মেয়ে…উত্তর কোলকাতার।”

“তাহলে মাউন্ট অলিম্পাসের মালিক তোমাকে বাদ দিয়ে শিমকি আর সুষমাকে নিয়ে পড়ে থাকে কেন?”

“ওরা যখন প্রথম এখানে আসে তখন আমাকে নিয়েই পড়ে থাকতো, মিস্টার। অনেক দিন পর আমি নিজেই হাপিয়ে উঠলাম। ঐ যে রঞ্জু আছে না, ও তো মেয়েদেরকে জানোয়ারের মতো ব্যবহার করে। আমি নিজেই ওদের কাছ থেকে সরে এসেছি । শিমকি আর সুষমাকে নিয়েই থাক বাবা…”

টুম্পার একনাগারে বলে যাওয়া কথাগুলো মন দিয়ে শুনে গেলো বাস্টার্ড ।

রঞ্জু!

তার ধারণা ছিলো ব্ল্যাক রঞ্জু অন্য কোনো নামে কোলকাতায় বসবাস করছে। কিন্তু এখন জানতে পারলো ঐ শীর্ষ সন্ত্রাসী নিজের নামেই বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে। সমস্যা কি? এখানে তো তাকে কেউ চেনে না।

“ওরা দুজনেই কি রেস্টুরেন্টটার মালিক?”

“না।” গ্লাসটা হাতে নিয়ে আরেকটু পান করলো টুম্পা। “মৃণাল।”

“মৃণাল কে?”

“বললাম না ওরা দু’জন থাকে…রেস্টুরেন্টটার মালিক মৃণাল। রঞ্জু ওর ওখানেই থাকে।”

“আমি তো শুনেছি রঙুই রেস্টুরেন্টটার মালিক।” একটা ঢিল ছুঁড়ে মারলো সে।

“রঞ্জু কিভাবে মালিক হবে, অ্যাঁ?” ভারসাম্য রাখতে না পেরে টলে গেছিলো টুম্পা, বাস্টার্ড ধরে ফেললো।

“কেন, সমস্যা কি?”

“আরে, কী যা তা বলো…ওতো ওপারের!” কথাটা ফিসফিস করে বললো মেয়েটি।

“তাই নাকি?” বিস্মিত হবার ভান করলো মি: পি।

“হ্যাঁ, কেউ জানে না, বুঝলে?” আবারো একটা ঢেকুর তুললো টুম্পা। “খবরদার কথাটা কাউকে বলতে যেও না কিন্তু…মৃণাল শুনলে আমাকে আর অলিম্পাসে ঢুকতে দেবে না।”

“আরে না। আমি আবার কাকে বলতে যাবো। এটা কি বলার মতো কথা হলো।”

“সেটাই তো, রঞ্জু ওপারে থাকে এটা নিয়ে এতো লুকোছাপার কি আছে বাপু?” মেয়েটা হাত নেড়ে কথা বলছে এখন। পুরোপুরি মাতালই বলা চলে।

“নিশ্চয় কোনো কাহিনী আছে…তা না হলে এতো লুকোছাপা করবে কেন?” বোতল থেকে আরো মদ ঢেলে দিলো সে। “দ্যাখো গিয়ে ওপার থেকে খুনটুন করে এখানে গা ঢাকা দিয়ে আছে কিনা।”

“হ্যাগো, তুমি ঠিকই বলছো মনে হয়.. রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার আছে না, ঐ ম্যানেজার একদিন আমাকে বলেছিলো…ব্যাটা প্রচুর মাল টেনেছিলো, বউয়ের সাথে মনে হয় ঝগড়া হয়েছিলো…আমাকে বলে, অ্যাই বর্ণা, আ আমিই তোর ক্লায়েন্ট…চিন্তা করিস না, তোকে ভালো টাকা দেবো।”

টুম্পা বকবক করতে করতে নিজের নামটা বলে ফেলেছে। বাস্টার্ড মুচকি হাসলো। তারপর তুমি গেলে ওর সঙ্গে?”

“বা রে, যাবো না? ও তো বিনে পয়সায় কিছু চায় নি, চেয়েছে?”

“তাতো ঠিকই।”

“শীতল বাবু সারা রাত আমার সাথে মদ খেয়েছে আর গল্প করেছে। বয়স হয়েছে তো তাই ওসব করতে-টরতে পারে না। ঘরে ঢুকেই একবার চেষ্টা করেছিলো, মাইরি, কী আর বলবো, এক মিনিটেই শেষ…” হা হা করে হাসতে শুরু করে দিলো টুম্পা।

বাস্টার্ড বুঝতে পারছে এই মেয়েটার কাছ থেকে এখন যা শুনতে চাইবে তাই বলবে সে।

“তখন তোমায় এ কথা বললো?”

“হ্যাঁ। বলে কিনা, রঞ্জু খুব খারাপ…ওর কাছে তুমি যেও না, বর্ণা। আমি বললাম কেন গো, ও কী করেছে?…শীতল বাবু বলে, সে কথা তোমায় বলা যাবে না। একটু থেমে আবার বলতে লাগলো বর্ণা। “কী এমন কাজ করেছে

যে বলা যাবে না, অ্যাঁ?”।

“নিশ্চয় খুনটুনই হবে…” বললো বাস্টার্ড । সে একেবারেই একনিষ্ঠ শ্রোতা।

“তাই হবে গো…আমি আর কিছু জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করি নি।”

হঠাৎ মেয়েটা বাস্টার্ডের দিকে ভুরু কুচকে তাকালো। বুঝতে পারলো না সে। “কি হয়েছে?”

“অ্যাই, তুমি আবার শীতল বাবুর মতো এক মিনিটেই খালাস হয়ে যাবে না তো? কিছুই তো করছে না, শুধু কথা বলে যাচ্ছো আমার সাথে। আসো, তোমাকে একটু আদর করি।” বলেই বাস্টার্ডের গলা জড়িয়ে ধরে তার গালে, ঠোঁটে, ঘাড়ে চুমু খেতে লাগলো।

.

অধ্যায় ৪৩

জেফরি বেগ গোয়েন্দা রিপোর্ট নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। রিপোর্টের কিছু বিষয় পরিস্কার হবার দরকার কিন্তু গোয়েন্দা রিপোর্টে উল্লেখ করা আছে পিজি হাসপাতালের ঐ ডাক্তার আর কর্মচারিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদেরকে খুঁজে বের করাটা সহজ কাজ হবে না।

তবে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের আরেকজনকে পাওয়া গেছে অদ্ভুতভাবে। সম্ভবত খুনি লোকটাকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে যায় কেরাণীগঞ্জের বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি পাটকলে। পাটকলটি নদীর তীরে অবস্থিত। একেবারে নিরিবিলি আর পরিত্যাক্ত একটি জায়গা। অজ্ঞাত পরিচয়ে একজন ফোন করে যে লোকটার কথা পুলিশকে জানিয়েছে সেটা ভেবেই জেফরি অবাক হচ্ছে। তার নিশ্চিত বিশ্বাস, ফোনটা খুনি নিজে করেছে। কিন্তু এরকম একটা কাজ খুনি করতে যাবে কেন? এর আগে একের পর এক রঙুর লোকজনকে নির্দয়ভাবে খুন করেছে যে খুনি সে কিনা এরকম একজনকে প্রাণে তো মারলোই না বরং পুলিশের কাছে তুলে দিলো।

খুনি কি তাদেরকে কোনো মেসেজ দিতে চাচ্ছে?

না। তার কাছে এটা মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে তাদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যেও এটা করা হতে পারে। তবে জেফরি জানে রঞ্জুর এই লোকের কাছ থেকে মূল্যবান কিছু তথ্য আদায় করতে পারবে, কারণ এখন সে গোয়েন্দা রিপোর্টটি সম্পর্কে পুরোপুরি জানে। জানে বিশাল একটি ষড়যন্ত্রের কথা।

তার বস ফারুক স্যারকে রিপোর্টের কথা বললে সব শুনে হোমিসাইডের মহাপরিচালক চিন্তিত হয়ে পড়ে। জেফরিকে বলে দিয়েছে খুব সাবধানে এগোতে। এ নিয়ে যেনো কারো সাথে কোনো রকম কথাবার্তা না বলে । রঞ্জুর দলের কয়েক জনের খুন নিয়েই তার তদন্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত। তারপর যদি তদন্তের এক পর্যায়ে সব বের হয়ে আসে তখন বলা যাবে কেঁচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাই ছিলো না।

জেফরির কাছে তার বসের কথাটা যৌক্তিক মনে হয়েছে। তার এখন এভাবেই কাজ করা উচিত।

ঠিক তখনই রমিজ লস্কর এসে জানালো পুলিশ রঞ্জুর যে সহযোগীকে উদ্ধার করেছে তাকে ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে আসা হয়েছে।

ইন্টেরোগেশন রুমের দিকে যেতে যেতে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো জেফরি বেগ : আজকের জিজ্ঞাসাবাদটি সে একান্তে করবে। কেউ থাকবে না রুমে।

.

টুম্পা কিংবা বর্ণা, সকাল ন’টার আগে ঘুম থেকে উঠলো না। কোলকাতার বাসিন্দারা এমনিতেই দেরি করে ওঠে, আর মেয়েটা এতো বেশি পরিমাণ মদ খেয়েছে যে, বেহুশের মতো সারা রাত ঘুমিয়েছে। একবারের জন্যেও তার ঘুম ভাঙে নি। বাস্টার্ডের জন্যে অবশ্য সুবিধাই হয়েছে। সারা রাত সে ঘুমায় নি। দক্ষিণ দিকের জানালার সামনে বসে সারা রাত পার করে দিয়েছে। শুধু যে মাউন্ট অলিম্পাসের দিকেই তার নজর ছিলো তা নয়, এর চারপাশের পরিবেশ, বাড়িঘর, পথঘাটসহ সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে গেছে।

মাউন্ট অলিম্পাসের চার তলার ফ্লোরে রাত তিনটা পর্যন্ত বাতি জ্বলতে দেখেছে সে। খুবই টেনশনে কেটেছে ওখানকার বাসিন্দাদের রাত, বাস্টার্ড বুঝতে পারলো। তবে একবারের জন্যেও কাউকে জানালার সামনে আসতে দেখে নি। জানালার ভারি পর্দার আড়ালে দুয়েকবার আবছায়া অবয়ব ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে নি তার।

সবচাইতে বড় যে জিনিসটা সে জানতে পেরেছে সেটা এই অবলোকনের মাধ্যমে নয়। তার খুব কাছেই দুর্লভ একটা জিনিস পড়ে ছিলো-টুম্পার মোবাইল ফোন।

বাস্টার্ড সেই ফোনের সিমটা ফোনসেট থেকে খুলে তার ফোনসেটে ঢুকিয়ে সিমের সমস্ত কন্ট্যাক্ট কপি করে রেখেছে। কন্ট্যাক্ট থেকে নাম্বারগুলো ভালো করে চেক করে দেখেছে, কোনটা রঞ্জুর হতে পারে বোঝার চেষ্টা করেছে। তার ধারণা মেয়েটার ফোনে রঞ্জুর নাম্বার থাকবে। কিন্তু হতাশ হলো সে। এ নামে কোনো নাম্বার সেভ করা নেই। তবে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার, শিমকি, সুষমা আর মৃণাল নামগুলো সেভ করা আছে-এ নামগুলো সে কথা প্রসঙ্গে টুম্পার কাছ থেকে শুনেছে। মাথার মধ্যে গেঁথে রেখেছে নামগুলো ।

টুম্পা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পেলো মি: পি তার পাশে বসে আছে।

“ক’টা বাজে গো?” ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলো সে।

“নটা।” তার মুখে হাসি।

মেয়েটা ধাতস্থ হতে আরো পাঁচ মিনিট সময় নিলো।

বিছানায় উঠে বসতে যাবে তখনই বুঝলো তার গায়ে কোনো কাপড় নেই। একেবারে নগ্ন। একটা চাদর জড়িয়ে আছে।

“আমার জামা কোথায়?”

বাস্টার্ড বিছানার নীচে ইঙ্গিত করলো। মেয়েটার জামা-কাপড় মেঝের এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।

“এক রত্তি কাপড়ও রাখো নি গায়ে!” কপট বিস্মিত হবার ভান করলো সে। তারপরই চিন্তিত হয়ে গেলো। “কনডম ইউজ করেছে তো?…ড্রয়ারে যে কনডম আছে সে কথা তোমায় বলতেই ভুলে গেছিলাম।”

মেয়েটার চেহারায় আতঙ্ক দেখে হেসে ফেললো বাস্টার্ড । সাইড টেবিল থেকে কনডমের দুটো ছেঁড়া প্যাকেট হাতে নিয়ে মেয়েটার সামনে তুলে ধরলো। সব কিছুই সাজিয়ে রেখেছে সে, একেবারে নিখুঁত দক্ষতায়।

“ওমা!” চোখ নাচিয়ে বললো টুম্পা। “দু’বার!”

মিটিমিটি হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলো বাস্টার্ড ।

“আমি তো কিছুই মনে করতে পারছি না।”

“তুমি অনেক বেশি খেয়ে ফেলেছিলে,” বলেই মেয়েটার গালে আলতো করে টোকা মারলো। “একদম হুশ ছিলো না।”

“সেই অবস্থায়ই আমাকে…!” আবারো ভুরু নাচিয়ে বললো টুম্পা।

হা হা করে হেসে ফেললো বাস্টার্ড। “আমার কিন্তু ভালোই লেগেছে।”

টুম্পাও হেসে ফেললো। “আমাকে তোমার ভালেগেছে?”

“খুব।” আবারও মেয়েটার গালে টোকা দিলো সে। কিন্তু মিস, টুম্পা, আমার তো অনেক দেরি হয়ে গেছে…আমাকে এক্ষুণি চলে যেতে হবে। তুমি ঘুমাচ্ছিলে বলে ডাকি নি।”

“ওমা, তাই তো,” বিছানা থেকে উঠে বসলো মেয়েটি। গায়ে চাদর জড়িয়ে নিয়ে বললো, “আজ আবার আসবে তো?”

পকেট থেকে প্রচুর টাকা বের করলো বাস্টার্ড, সেখান থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দিলো টুম্পাকে । “এক হাজার তোমাকে বখশিস দিলাম।” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়ালো সে। “তুমি রেস্ট নাও, আমি যাই।”

“কখন আসছো?” আহ্লাদ করে বললো মেয়েটি।

“একটু ভেবে বললো সে, “সন্ধ্যার পর, অলিম্পাসে।”

“ঠিক আছে, তাহলে সন্ধ্যার পর দেখা হচ্ছে।”

বাস্টার্ড তিন তলা থেকে নেমে গেলো। রাস্তায় এসে আবারো ভালো করে দেখে নিলো এলাকাটি। সন্ধ্যার আগেই আবার সে আসবে। তার শরীরে এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেলো।

রঞ্জুর অনেক কাছে এসে পড়েছে ।

.

রঞ্জুর সহযোগী ঝন্টু বসে আছে সাদা ধবধবে ইন্টেরোগেশন রুমে। ঘরে আর কেউ নেই। জেফরি বেগ সবাইকে চলে যেতে বলেছে। তার সহকারী জামান খুব অবাক হয়েছে যখন তাকেও চলে যেতে বলে। সাধারণত এর আগে এরকম ঘটনা ঘটে নি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় তারা অনেকেই উপস্থিত থাকে, এমন কি ঘরে যে বিশাল আয়নাটা রয়েছে, সেই দ্বিমুখী আয়নার ওপাশে একটা ছোট্ট রুমে বসে অন্যেরাও জিজ্ঞাসাবাদের সবকিছু দেখতে পারে। আজ এর ব্যতিক্রম হলো। কেউ অবশ্য জানতে চায় নি কেন এরকম করা হচ্ছে। চুপচাপ রুম থেকে চলে গেছে সবাই। জেফরি জানে, কেন্টিনে গিয়ে সবাই এখন এ নিয়ে নানা রকম কথা বলাবলি করবে।

ঝন্টুর শরীরে পলিগ্রাফের সেন্সর লাগানো আছে। চুপচাপ বসে আছে সে, মনে হচ্ছে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। তিন দিন একটি পরিত্যাক্ত পাটকলের জঘন্য গুদামঘরে হাত-পা-মুখ বাধা অবস্থায় পড়েছিলো সে। নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে সন্দেহ নেই। তবে খুনি যে তাকে শারিরীকভাবে কোনো টর্চার করে নি সেটা বোঝা যাচ্ছে। তবে তিনদিন না খেয়ে, ভয়ানক পরিবেশে থেকে ঝন্টু অনেকটা বাকরুদ্ধ।

“চা খাবেন?”

জেফরির কথাটা শুনে মুখ তুলে তাকালো ঝন্টু। কিছুটা অবাক হয়েছে।

“চা, সিগারেট খেতে চাইলে খেতে পারেন,” বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো সে। খেয়াল করলো লোকটা ঢোক গিললো। হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

“ঠিক আছে, আমি দুকাপ চা আর সিগারেট দিতে বলি, কেমন?” তার সিদ্ধান্ত নেয়ার কষ্ট লাঘব করে বললো জেফরি।

মাথা নেড়ে সায় দিলো ঝন্টু।

“কি সিগারেট খান?”

“বেনসন,” দূর্বল কণ্ঠে বললো ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ লোকটি।

ইন্টারকম তুলে চা আর সিগারেটের কথা বলে দিলো সে।

“আপনার শরীর এখন কেমন?”

ঝন্টু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। পুলিশী জেরা কেমন হয় সেই অভিজ্ঞতা তার রয়েছে কিন্তু এ কেমন ব্যবহার! এরা কি পুলিশ নাকি অন্য কিছু?

“জি, ভালো।”

“তিন দিন ছিলেন, ওখানে…?”

মাথা নেড়ে সায় দিলো ঝন্টু।

“আপনাকে কোত্থেকে তুলে নিলো?”

“ঢাকা মেডিকেল থেকে।”

“কয়জন ছিলো?”

“একজন।” কথাটা বলার সময় মাথা নীচু করে রাখলো ঝন্টু।

“আচ্ছা, একটু থেমে আবার বললো জেফরি বেগ, “খুনি নিশ্চয় আপনাকে ওখানে যেতে বলেছিলো?”

“জি।”

“লোকটাকে দেখলে চিনতে পারবেন তো?”

“পারবো।”

জেফরির সামনে একটা ল্যাপটপ আর ম্যানিলা ফোল্ডার। ফোল্ডার থেকে একটা স্কেচ করা মুখমণ্ডলের ছবি বের করে ঝন্টুর সামনে মেলে ধরলো।

“এই ছবিটা দেখে চিনতে পারছেন?”

ঝন্টু ছবিটার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলো। “অনেকটা ঐ লোকটার মতোন।” তার কণ্ঠ এখনও খ্রিয়মান তবে চোখেমুখে বিস্ময় দেখা যাচ্ছে। হয়তো ভাবছে এরা কিভাবে খুনির ছবি তৈরি করতে পারলো । ছবিটা যে কেউ এঁকেছে সেটা বুঝতে পারছে সে।

“অনেকটা?” মাথা নেড়ে আবার বললো জেফরি, “অনেকটা মানে কতোটুকু মিল আছে?”

“চোখটা হয় নি,” আস্তে করে বললো সে।

“তাই?”

রুমে একজন পিয়ন চা আর সিগারেট নিয়ে ঢুকলো।

“তাহলে খুনির চোখ দেখতে কেমন?” পিয়ন চলে যাবার পর বললো জেফরি।

ঝন্টু একটু ভেবে বললো, “এরকম না…” তারপর জেফরির দিকে। তাকিয়ে রইলো। “তার চোখ দুটো ঠিক আপনার মতো।”

বিষম খেলো জেফরি বেগ। আবার! তার মনে পড়ে গেলো বাস্টার্ডের কথা। জায়েদ রেহমানের কেসের তদন্ত করতে গিয়েও তার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে এজন্যে সে কাউকে দোষ দিতে পারে না। সত্যি বলতে কি, ঐ বাস্টার্ডের সাথে তার অনেক মিল আছে। উচ্চতা, শারিরীক গঠন, গায়ের রঙ….তবে সবচাইতে বেশি মিল চেহারায়।

কিন্তু ব্ল্যাক রঞ্জুর এই লোকও একই কথা বলছে কেন? তবে কি…?

অসম্ভব! তার কাছে যতোটুকু তথ্য আছে তাতে করে সে জানে ঐ হিংস্র খুনি বিদেশ চলে গেছে । সহসা দেশে ফিরে আসার কথা নয়। জেফরির ধারণা কমপক্ষে ছয় মাস সে দেশের বাইরে থাকবে।

আবার এমনও হতে পারে, যে অজ্ঞাত খুনিকে তারা খুঁজছে তার চেহারার সাথেও হয়তো জেফরির চেহারার কিছুটা মিল আছে। কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ঝন্টু গুলিয়ে ফেলেছে।

“আমি কি চা-সিগারেট নেবো?” আস্তে করে বললো ঝন্টু। তার কথায় সম্বিত ফিরে পেলো জেফরি।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ। নিন।” খুনির স্কেচটা সরিয়ে রাখলো সে। তার জন্যেও এককাপ চা দেয়া হয়েছে, কাপটা তুলে আনমনে চুমুক দিতে লাগলো।

ঝন্টু চায়ে চুমুক দিচ্ছে, তবে সিগারেটটা ধরাচ্ছে না। জেফরি সিগারেট ধরাতে বললে ট্রে থেকে ম্যাচটা তুলে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালো।

“খুনি আপনার কাছ থেকে কি জানতে চেয়েছিলো?” চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো ইনভেস্টিগেটর।

“রঞ্জু ভায়ের ঠিকানা।” এখন তার গলাটা একটু স্বাভাবিক শোনাচ্ছে। চা আর সিগারেট যেনো তাকে নতুন করে শক্তি দিয়েছে।

“রঞ্জু তো কোলকাতায় থাকে, তাই না?”

“জি।”

“ওর ঠিকানা নিয়ে খুনি কি করবে?”

ঝন্টু চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। “সেটা তো আমাকে বলে নি।”

“কিন্তু আপনার কাছে কি মনে হয়, রর ঠিকানা নিয়ে সে কী করবে?”

সিগারেটে পর পর দুটো টান দিয়ে ভেবে নিলো ঝন্টু। “কী আর করবে…খুন করবে হয়তো।”

“রঞ্জুকে?”

মাথা নেড়ে নায় দিলো ঝন্টু।

“কেন?”

“আমি সেটা কিভাবে জানবো?”

কথাটায় সস্তুষ্ট হতে পারলো না এমনভাবে মাথা দুলিয়ে জেফরি বললো, “কিন্তু আপনার তো জানা উচিত…রঙুর দলে আছেন অথচ এটা জানবেন না কে আপনাদের পেছনে লেগেছে, কেন লেগেছে?”

মাথা নীচু করে রাখলো ঝন্টু।

“আপনার বিরুদ্ধে ঢাকা শহরের তিনটি থানায় মোট তেরোটি মামলা আছে,” বললো জেফরি। এরমধ্যে পাঁচটিই হত্যা মামলা।”

ঝন্টু মুখ তুলে তাকালো। অনুশোচনা আর করুণ ভবিষ্যতের আতঙ্ক তার চোখেমুখে।

“ফেরারি আসামী আপনি। রঞ্জুর সাথে কোলকাতায় ছিলেন দীর্ঘদিন ধরে, হঠাৎ কী মনে করে দেশে এলেন?”

জেফরি দেখলো লোকটা ভড়কে গেছে কিছুটা।

আগের প্রশ্নের জবাব না পেলেও আরেকটা প্রশ্ন করলো সে, “কতো দিন আগে এসেছেন দেশে?”

“দুই সপ্তাহ।”

“কেন? কি কারণে? কোন্ প্রয়োজনে?”

ঝন্টু নিশ্চুপ।

মুচকি হাসলো জেফরি। “আপনি বাঁচতে পারবেন না। একটা হত্যা মামলার রায় কয়েক দিনের মধ্যেই হয়েই যাবে। তারপরও এতো ঝুঁকি নিয়ে দেশে এলেন!” মাথা দোলাতে লাগলো সে। “আপনি না বললেও আমি সব জানি, মি: ঝন্টু।”

মুখ তুলে তাকালো লোকটা।

“হয়তো ভাবছেন আন্দাজে ঢিল ছুড়ছি,” একটু থেমে সামনের দিকে ঝুঁকে এলো সে। “আপনি চাইলে আমি পুরো কাহিনীটা আপনাকে শোনাতে পারি । শুনবেন?”

“কি কাহিনী, স্যার?” ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চাইলো ব্ল্যাক রঞ্জুর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী ।

“কিছুদিন পর আপনারা যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছেন সেই কাহিনী!”

ঝন্টু নিষ্পলক চেয়ে রইলো জেফরি বেগের দিকে।

এই লোক দেখি সব জেনে গেছে!

.

এদিকে বাস্টার্ড চায়না টাউন থেকে বের হয়ে নিজের হোটেলে ফিরে এলো না। কাছেই একটা পার্কে গিয়ে প্রথম টোপটা ব্যবহার করলো।

“হ্যালো, শীতল বাবু বলছেন?” একটা নাম্বারে ডায়াল করে বললো সে। তার বাচনভঙ্গিতে নিখুঁত পশ্চিমবঙ্গিয় টান। ছোটোবেলায় এক ঘটি শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভের ফলাফল।

“হ্যাঁ, বলছি…আপনি কে?” ওপাশ থেকে একটা রোগাটে কণ্ঠ বললো।

“আমি পীযুষ মুখার্জি, অরকাট ডট কমের সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার…আপনি কি মাউন্ট অলিম্পাসের ম্যানেজার বাবু বলছেন?”

“হ্যাঁ, বলছি। কী ব্যাপার বলুন?”

“আমি আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।”

“হ্যাঁ, কি ব্যাপারে?”

“আমরা সামনের হপ্তায় একটি কনফারেন্স করবো কোলকাতায়, ভাবছি। আপনাদের রেস্টুরেন্টটায় করা যায় কিনা। শুনেছি আপনাদের খাবারের মান বেশ ভালো।”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমরা সব সময় চেষ্টা করি কাস্টমারকে ভালো কিছু দেবার…সেজন্যে আমাদের রেস্টুরেন্টটা নতুন হলেও বেশ নাম করে ফেলেছে। কোনো সমস্যা নেই। আপনি চলে আসুন সন্ধ্যার দিকে, বিস্তারিত কথা হবে তখন?”

“আমি আসলে অনেক ব্যস্ত আছি…একটা কাজে বেরিয়েছিলাম, তো আপনি যদি আমাকে এখন একটু সময় দিতেন আমার খুব সুবিধে হতো।” বাস্টার্ড জানে চায়না টাউনের রেস্টুরেন্টগুলো দুপুর থেকে খোলে।

“মুখার্জি বাবু, আমাদের রেস্টুরেন্ট তো দুপুরের আগে ওপেন হয় না।”

“ও তাই নাকি, আমি অবশ্য জানতাম না, থাকি তো বাঙ্গালোরে, মাঝেমধ্যে আসি কোলকাতায়…কি করা যায় বলুন তো? আমার হাতে একদম সময় নেই। ভেবেছিলাম আপনার সাথে দেখা করে সব ফাইনাল করে ফেলবো।”

শীতল বাবু একটু ভেবে নিলো। “ঠিক আছে, আপনি চলে আসুন আমার রেস্টুরেন্টে।”

“তাই? সো কাইন্ড অফ ইউ । আমি চলে আসছি।”

লাইনটা কেটে দিয়ে রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে বলে দিলো কোথায় আসতে হবে।

পনেরো মিনিট পর আবারো মাউন্ট অলিম্পাসের সামনে এসে থামলো তার গাড়িটা। ড্রাইভার লোকটা অবাক। এই রেস্টুরেন্টে লোকটা কী এতো মজা পেয়েছে ভগবানই জানে!

ভেতরে ঢুকে দেখতে পেলো একেবারে ফাঁকা। চেয়ার টেবিলগুলো পরিস্কার করছে তিনচারজন লোক। কয়েক ঘণ্টা পরই এটি খুলে দেয়া হবে। তাকে ঢুকতে দেখে এক লোক এগিয়ে এলো তার কাছে।

“আপনি কি মি: মুখার্জি?”

“হ্যাঁ।”

“আসুন আমার সাথে, ম্যানেজার বাবু আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।”

লোকটার সাথে রেস্টুরেন্টের আরো ভেতরে চলে গেলো সে। কিচেনের পাশে সরু আর ছোেট্ট একটি প্যাসেজের মাঝখানটায় এসে বন্ধ দরজার কাছে থামলো তারা। দরজায় ইংরেজিতে লেখা : ম্যানেজার।

দরজায় টোকা মারতেই ভেতর থেকে খুলে দেয়া হলো। মাঝবয়সী হাড্ডিসার এক লোক দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে।

“নমস্কার, আমিই শীতল বাবু,” দু’হাত জোর করে বললো লোকটা।

কিন্তু মি: মুখার্জি হাত বাড়িয়ে দিলো। “পীযুষ মুখার্জি।”

করমর্দন করার পর তাকে চেয়ারে বসতে দিয়ে শীতল বাবু বসলো ডেস্কে নিজের চেয়ারে। “আপনাদের কনফারেন্সটা কবে হচ্ছে?” সরাসরি কাজের কথায় চলে এলো ভদ্রলোক।

“নেক্সট উইকের প্রথম দিকে। রেস্টুরেন্ট বুকিং হলেই আমরা ফাইনাল করে ফেলবো।”

দাঁত বের করে হাসলো ম্যানেজার। নেক্সট উইকের একটা দিন তাহলে ঠিক করে ফেলুন।”

“ওহ গড, বাঁচালেন। এটা নিয়েই একটু টেনশনে ছিলাম।”

“আপনাদের অ্যারেঞ্জমেন্টটা কেমন?”

“আপনাদের ক্যাপাসিটি কতো?” পাল্টা বললো সে।

“দুশোর মতো।”

“তাহলে তো একটু সমস্যা হয়ে গেলো। আমাদের প্ল্যান অবশ্য তিনশোর মতো।”

“কোনো সমস্যা নেই। উপরে একটা রিজার্ভ ফ্লোর আছে।”

“উপর তলায়?” আবারো একটু ভেবে নিলো মি: মুখার্জি। “কিন্তু জায়গাটা কি দেখা যাবে?”

“অবশ্যই দেখা যাবে। সাধারণত আমরা উপরতলাটা পার্টি-কনফারেন্সের জন্যেই রাখি। এমনিতে ওটা খালি পড়ে থাকে। কিছু স্টাফ থাকে আর কি। আপনার পছন্দ হবে।”

“ঠিক আছে…নো প্রবলেম। টোটাল প্যাকেজটা কী রকম হবে একটু বলবেন?”

“ড্রিঙ্কসহ নিশ্চয়?”

“তাতো অবশ্যই,” হেসে বললো বাস্টার্ড ।

ডেস্কের ড্রয়ার থেকে কয়েকটা কাগজ বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিলো ম্যানেজার। এখানে বিভিন্ন ধরণের প্যাকেজ আছে। পার-হেড হিসেব দেয়া আছে। আপনি দেখুন আপনার জন্যে কোনটা সুট করে।”

বাস্টার্ড কাগজগুলোর দিকে কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে গেলো। “আচ্ছা, একটা ব্যাপার জানতে চাচ্ছিলাম।”

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো ম্যানেজার।

“এন্টারেটেইনের কোনো ব্যবস্থা নেই…মানে, বুঝতেই তো পারছেন, উইমেন কোম্পানির কথা বলছি,” বললো সে।

ম্যানজারের হাসি আরো চওড়া হলো। তারপর তকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গি করে বললো, “এ নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না। একটু সামনের দিকে ঝুঁকে এলো লোকটা। “আমরা শুধু কলেজ-ইউনিভাসির্টি গোয়িংদের রাখি…অন্যদের মতো হাউজওয়াইফ কিংবা ম্যারেড আমাদের এখানে পাবেন না।” চায়না টাউনে এ ব্যাপারে আমাদের সুনাম সবচেয়ে বেশি।”

বাস্টার্ড মুখ টিপে হেসে বললো, “সত্যি বলতে কি, আমি সেজন্যেই আপনাদের রেস্টুরেন্টটা চুজ করেছি।” বলেই দুষ্টুমিভরা হাসি দিলো।

দাঁত বের করে হাসলো ম্যানেজার। “তাহলে কোনটা ঠিক করলেন?”

একটা কাগজ বাড়িয়ে দিলো মি: মুখার্জি। “আমার মনে হয় এটাই আমাদের জন্যে ভালো হবে।”

কাগজটা হাতে নিয়ে ম্যানেজার মাথা নেড়ে সায় দিলো। “ভালো জিনিস চুজ করেছেন।”

এভাবে ব্যবসায়িক আলাপ আলোচনা আরো কিছুক্ষণ চলার পর মি: মুখার্জি অন্য প্রসঙ্গে চলে এলো। “আপনি কি চার তলায় থাকেন?”

“না, না, আমি এখান থেকে ওয়াকিং ডিসটেন্টে থাকি।’

“আমি ভাবলাম এখানকার অন্যসব রেস্টুরেন্টের মতো আপনিও বোধহয় উপরতলায়ই থাকেন।”

“ঠিকই বলেছেন, এখানকার সবগুলো রেস্টুরেন্টেই প্রোপাইটররা থাকেন। আমাদের প্রোপাইটরও থাকেন চার তলায়।”

“তাই নাকি,” কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করলো সে। “আপনাদের প্রোপাইটর কি চীনা?”

“না, আমাদের প্রোপাইটর বাঙালি। এর আগের প্রোপাইটর ছিলো চীনা। পরে এটা আমাদের প্রোপাইটর কিনে নেন।”

“ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন?”

“না, না। এখনও সিঙ্গেল।”

“তাহলে চলুন, দোতলাটা একটু দেখে আসি।”

ম্যানেজারের রুমের ঠিক পাশেই একটা সিঁড়ি, সেটা দিয়ে তারা দোতলায় চলে এলো। শীতল বাবু ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগলো কিন্তু মি: মুখার্জির সেদিকে মন নেই। তার আগ্রহ অন্য কিছুতে।

“ভালো, জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে,” মন্তব্য করলো সে।

“তাহলে চলুন আমার অফিসে গিয়ে বসি। কিছু ফর্মালিটিজ আছে…” ম্যানেজার বললো।

আবারো তারা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে যাবে এমন সময় বাস্টার্ড নিতান্তই স্বাভাবিক কৌতূহলের মতো করে বললো, “চার তলায় যাবার সিঁড়িটা তো দেখলাম না?”

“অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে ওখানে যেতে হয়। এই ভবনের পেছন দিকে ওটা। বুঝলেন না, প্রাইভেসি। আমাদের মালিক প্রাইভেসির ব্যাপারে খুবই সজাগ।”

“সেটাই ভালো। রেস্টুরেন্ট থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

তারা নীচে নামতে লাগলো।

“আচ্ছা, আপনাদের কি ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি নেই?..আমাদের চেয়ারম্যান লোকটা আবার এসব ব্যাপারে খুঁতখুঁতে।”

ম্যানেজারের দাঁত বের করা হাসি আবারো দেখা গেলো । “দোতলার জন্য কি ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ির দরকার আছে?”

“বললাম না, আমাদের চেয়ারম্যান লোকটা…”

মাথা নাড়লো শীতল বাবু। “চিন্তার কিছু নেই। আছে।”

“কোথায়?”

তারা ম্যানেজারের রুমের সামনে এসে পড়লো। “পেছন দিকের যে সিডিটা দিয়ে চার তলায় যাওয়া আসা করে আমাদের প্রোপাইটর, সেটাই আসলে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি ছিলো।”

“ওটা কি এখন আর ব্যবহার করা হয় না…মানে বন্ধ করে রেখেছেন?”

ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে গেলো তারা। “দরকার পড়ে না, তাই প্রেপাইটর ওটাকে চার তলায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে। তবে আপনাদের কনফারেন্স যেদিন হবে বন্ধ গেটটা খুলে রাখবো।”

“গেটটা কোন্ দিকে ছিলো…দেখলাম না তো?” মি: মুখার্জির প্রশ্ন।

“দোতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে গেটটা আছে। বন্ধ ছিলো তাই খেয়াল করেন নি। প্রোপাইটর ভেতর থেকে তালা মেরে রাখেন।”

“আচ্ছা,” একটু থেমে আবার বললো বাস্টার্ড । “বাকি ফর্মালিটিজগুলো আমার এক জুনিয়র এক্সিকিউটিভ এসে আপনার সাথে সেরে নেবে। তাকে কালই পাঠিয়ে দেবো। আর ফোনে জানিয়ে দেবো কোনদিন আমাদের কনফারেন্সের ডেটটা ঠিক করেছি। আপনার বিজনেস কার্ডটা একটু দিলে সুবিধে হয়…”

“ওহ্ নিশ্চয়,” শীতল বাবু তার বিজনেস কার্ডটা বের করে দিলো।

কার্ডটা হাতে নিয়ে বললো বাস্টার্ড, “ভুল করে আমার কার্ড নিয়ে আসি নি। তাই দিতে পারছি না।”

“না, না…ঠিক আছে।”

হাতটা বাড়িয়ে দিলো শীতল বাবুর সাথে। “আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। ফোনে কথা হবে। তাহলে আমি এখন আসি।”

শীতল বাবু মেইনগেট পর্যন্ত তাকে এগিয়ে দিলো।

রেন্ট-এ-কারে বসতেই বিহারি ড্রাইভার যখন জানতে চাইলো এরপর কোথায় যাবে তখন শুধু বললো, “কিড স্টুট।”

.

অধ্যায় ৪৪

জেফরির কাছু থেকে সব শুনে ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ট সহচর ঝন্টু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো। সে বুঝতেই পারছে না তাদের গোপন অপারেশনের কথা এরা কিভাবে জানলো। রঞ্জু যদি এটা জানতে পারে তাহলে কী করবে, ভাবলো সে।

জেফরি বেগ নামের লোকটাকে তার কাছে ঠিক পুলিশ বলে মনে হচ্ছে না। এই লোকটা যা বলেছে তার প্রায় সবটাই সত্যি। রঞ্জু আর তার দলের হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া এ অপারেশনের কথা কেউ জানে না। বাইরের কেউ যদি জেনে থাকে তাহলে সে স্বয়ং ঐ ব্যক্তি যার মাথা থেকে এই আইডিয়াটা বের হয়েছে।

মোটামোটি সব গুছিয়ে নিয়ে এসেছে তারা। এখন শুধু নির্দিষ্ট একটা ক্ষণের অপেক্ষা। সব কিছু সুন্দরভাবেই সম্পন্ন করা হয়েছে। কাজটাও যে এমন কঠিন তা নয়, কিন্তু এখন, এই লোকটার কাছ থেকে সব শুনে বুঝতে পারছে তাদের সমস্ত পরিকল্পনা কেবল ভণ্ডুলই হবে না, তাদের পুরো দলটাও শেষ হয়ে যাবে।

অজ্ঞাত সেই খুনি তাহলে ঠিকই বলেছে, পুলিশের চেয়েও বড় কিছু। হ্যাঁ। এটা নির্ঘাত কোনো গোয়েন্দা সংস্থার কাজ। এখন তার কাছে সব স্পষ্ট হয়ে গেছে। রঞ্জু শেষ। তার সময় এসে গেছে। যতো ধূর্তই সে হোক না কেন, তার সমস্ত খেলা শেষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু তার কী হবে? এরা তাকে ক্ৰশফায়ারে দেবে না তো? অন্য রকম ক্ৰশফায়ার! যেমনটি তার দলের অন্যদের সাথে করা হয়েছে।

“কি ভাবছেন?” ঝন্টুকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ বললো।

জেফরির দিকে তাকালো ঝন্টু। “আপনারাই তাহলে আমাদের দলের লোকজনকে খুন করছেন?”

ভুরু কুচকে ফেললো হোমিসাইড ইনভেস্টিগেটর। “আমরা খুন করছি মানে?”

“আমাকে যে তোক তুলে নিয়ে গেছিলো সে আমাকে একটা কথা বলেছে…’

“কি?” উদগ্রীব হয়ে উঠলো জেফরি ।

“তারা পুলিশের চেয়েও বড় কিছু।”

মাইগড!

.

কিড স্ট্রটে নেমে রেন্ট-এ-কারটা ছেড়ে দিলো বাস্টার্ড, ড্রাইভারকে বলে দিলো বিকেলের পর তাকে আবার দরকার হবে। গাড়িটা চলে গেলে সে হোটেলের দিকে পা বাড়িয়ে সোজা চলে গেলো নিউ মার্কেটে। কিড স্ট থেকে নিউ মার্কেট হাটা দূরত্ব।

হার্ডওয়্যার দোকান থেকে একটা পাঞ্জ, স্কচট্যাপ, ম্যাচবক্সসহ আনুষঙ্গিক আরো কিছু জিনিস কিনে নিলো। হোটেলে ফেরার পথে কিড স্ট্রটের একটি রেস্তোরাঁর সামনে দিয়ে যাবার সময় গরুর মগজের ভুনার ঘ্রাণ নাকে যেতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। পেট ভরে খেয়ে নিলো মগজভুনা আর গরম গরম ভাত।

হোটেলে ফিরে এসে গোসল করে নিলো। সারা রাত ঘুমাতে পারে নি। তার দরকার এখন ঘুম। সব কিছু দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। এই কন্ট্রাক্টটা যখন নেয় তখন তার কাছে মনে হয়েছিলো এক মাস সময় অনেক কম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এর অর্ধেক সময়ের মধ্যেই ব্ল্যাক রঞ্জুর ভবেরলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারবে। ইতিমধ্যে তার দলের অনেককে শেষ করে দিয়েছে। বাকি আছে শুধু রঞ্জু। তার মন বলছে, কাজটা শেষ করতে আর মাত্র দু’একদিনের বেশি লাগবে না। তবে আজকের দিনটাই যদি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ হয় তাহলে সে অবাক হবে না। পুরোপুরি প্রস্ততি নিয়েই সে বের হচ্ছে।

বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে লাগলো বিকেলে কি করবে। খুব বেশি ভাবনার কি আদৌ দরকার আছে, প্রশ্ন করলো নিজেকে। তার কাজ তো এখন একটাই। ব্ল্যাক রঞ্জুকে খুন করা। রঞ্জুর সুরক্ষিত ডেরায় ঢুকে পড়েছে। এখন শুধু আঘাত হানার পালা। ভাবলো, মৃদুল নামের ছেলেটাকে রেখে দিয়ে ভালোই করেছে। কাজটা ভালোয় ভালোয় শেষ করতে পারলে এই ছেলেটাকে নিয়েই সীমান্ত পাড়ি দিতে পারবে।

ঠিক কখন ঘুমে তলিয়ে গেলো বুঝতে পারলো না। আর সেই ঘুমের মধ্যে উমা নামের মেয়েটিকে কেন স্বপ্নে দেখলো সেটা তার কাছে আরো দুবোধ্য ঠেকলো ঘুম থেকে ওঠার পর।

চমৎকার একটি স্বপ্ন । এ জীবনে এরকম স্বপ্ন সে দেখে নি।

উমার কোলে মাথা রেখে নির্জন এক জায়গায় শুয়ে আছে।

.

ব্ল্যাক রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ লোক ঝন্টু যা বলেছে সেটা শুধু পলিগ্রাফ টেস্টই পজিটিভ বলছে না জেফরির মনও বলছে লোকটা সত্যি কথাই বলেছে। এর আগে উমা নামের মেয়েটিও একই কথা বলেছে তাকে। পলিগ্রাফ টেস্টও তখন মেয়েটার পক্ষে ছিলো। এখনও টেস্টের রেজাল্ট একই রকম। ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের মাথা দ্রুত কাজ করতে শুরু করলো । সে এখন নিশ্চিত, কোনো না কোনোভাবে একটা গোপন অপারেশন পরিচালিত হচ্ছে ব্ল্যাক রঞ্জুর দলের বিরুদ্ধে আর এটা করা হচ্ছে এই দেশটাকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু কারা এটা করছে সে সম্পর্কে আগের মতোই অন্ধকারে রয়ে গেছে সে। তবে সে জানে খুনির পরিচয় উদঘাটন করতে পারলে সেই সূত্র ধরে সবটা জেনে নিতে পারবে।

স্কটল্যান্ডইয়ার্ডে খুনি আর বাস্টার্ডের ব্যবহৃত বুলেটের খোসা পাঠিয়েছিলো আজ থেকে প্রায় আট-নয় দিন আগে, সেটার রেজাল্ট এখনও। জানা যায় নি। এরজন্যে অবশ্য ইয়ার্ডকে দায়ি করতে পারছে না সে। এ দেশের ডাক বিভাগের বদান্যতায় তারা বুলেটের খোসা দুটো পেয়েছে পুরো এক সপ্তাহ পরে। দুটো খোসা টেস্ট করতে এক দিনের বেশি লাগবে না। সে। হিসেবে আজকালের মধ্যে টেস্টের রেজাল্ট জানা যেতে পারে।

অজ্ঞাত খুনির বুলেটের খোসা পাঠানোর সময় বাস্টার্ডের ব্যবহৃত বুলেটের খোসাটাও সে পাঠিয়েছে, কারণ জেফরি চায় ঐ খুনির আঙুলের ছাপ ডাটা ব্যাঙ্কে থাকা দরকার, তাতে করে ভবিষ্যতে তাকে ট্র্যাকডাউন করা সম্ভব হবে।

ইন্টেরোগেশন রুম থেকে ফিরে এসে নিজের রুমে বসে বসে এসব কথা যখন ভাবছিলো তখন অনেকটা কাকতালীয়ভাবেই তার কাছে একটা সংবাদ এসে পৌঁছায়।

তার সহকারী জামান হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো তার রুমে। রুমে ঢোকার অনুমতি চাইতে হয় কথা ভুলে গেলো তার এই সহকারী । জেফরি বেগ তাকে দেখেই বুঝতে পারলো দারুণ কোনো সংবাদ আছে । জামানের হাতে একটা ফ্যাক্সকপি ।

“স্যার!” জামান ফ্যাক্সকপিটা বাড়িয়ে দিলো তার বসের দিকে। সে রীতিমতো হাফাচ্ছে। “স্কটল্যান্ডইয়ার্ড থেকে বুলেটের খোসার রিপোর্ট এসেছে।”

কাগজটা হাতে নিয়ে পড়ে দেখার আগেই উত্তেজিত জামান বলে উঠলো, “বাস্টার্ড! স্যার, এটা বাস্টার্ড!”

.

অধ্যায় ৪৫

বাস্টার্ড ঘুম থেকে উঠলো বিকেলের দিকে। বেশ চাঙ্গা বোধ করলো সে। মাথাটাও হালকা লাগছে। দেরি না করে কাজে নেমে পড়লো। প্রথমেই মৃদুলকে ফোন করলো। ছেলেটা খুবই বুদ্ধিমান। তাকে দিয়ে ছোটোখাটো নিরীহ গোছের একটা কাজ করাবে। বিস্তারিত বলে দিলো তাকে। এই ছেলের সবচাইতে ভালো গুন হলো, কেন, কি কারণে এসব প্রশ্ন করে না। যা করতে বলা হবে শুধু তাই করবে।

এরপর ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা দৈনিক পত্রিকা মেলে রেখে তার উপর কয়েকটি বুলেট রেখে দিলো । পাঞ্জ দিয়ে একে একে দশটা বুলেট থেকে সুগ অর্থাৎ সীসার অংশটা টেনে খুলে ফেললো সে। বুলেটের ভেতর থাকে বি ফোর এক্সপ্লোসিভ। খুবই দাহ্য পদার্থ । সহজ ভাষায় যাকে বলে গানপাউডার। সেই গানপাউডার বের করে একসাথে জমিয়ে রাখলো একটা দেয়াশলাইয়ের খালি বাক্সে।

এরপর আরো পাঁচটা বুলেট নিয়ে অন্য রকম একটি কাজ করলো। ধারালো ব্লেড দিয়ে প্রতিটি বুলেটের ত্রিভূজাকৃতির সীসার অংশটার চারদিকে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত দাবিয়ে দাবিয়ে দাগ কাটলো। এটাকে তারা বলে কামরাঙ্গা বানানো। এভাবে পাঁচটা বুলেট কামরাঙ্গা করে রেখে দিলো আলাদা একটি ম্যাগাজিনে। এই বুলেটগুলোর কোনো দরকার নাও লাগতে পারে, তবে সে জানে সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। যদি প্রয়োজন পড়ে এই বুলেটগুলো হয়ে উঠবে আরো বেশি ভয়ংকর। ফায়ার করার পর প্রতিটি বুলেটের ধনুকের ফলা আকৃতির স্লগ কয়েকটি টুকরোয় বিভক্ত হয়ে আঘাত হানবে লক্ষ্য বস্তুতে। ফলে একটা গুলি কাজ করবে অনেকগুলো গুলির । কয় টুকরো হবে সেটা নির্ভর করে কতোগুলো দাগ কাটা হয়েছে তার উপর। বাস্টার্ড প্রতিটি স্লগের গায়ে পাঁচটি করে দাগ কেটেছে। তার মানে তার কাছে থাকা এই পাঁচটি বুলেট এখন পঁচিশটি বুলেটের কাজ করবে। তারচেয়েও বড় কথা এতে করে টার্গেট মিস হবার সম্ভাবনাও কমে যায়। পাঁচটি খণ্ডিত শ্লাগ একবর্গফুটের মতো জায়গায় ছড়িয়ে আঘাত হানবে।

বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে চমৎকার আর আরামদায়ক জামাকাপড় পরে নিলো-কালো প্যান্ট আর কালো রঙের টি-শার্ট । টি-শার্টের বুকে বড় বড় করে লেখা : বিগ বয় প্লেইজ অ্যাট নাইট । টি-শার্টের উপর ফুলহাতা শার্ট পরে নিলেও সবগুলো বোতাম খোলা রাখলো।

দেয়াশলাইয়ের বাক্স, স্কচটেপটা পকেটে নিয়ে সাইলেন্সর পিস্তলটা কোমরে গুঁজে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো সে।

.

জেফরি বেগ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে যে ফ্যাক্সটা এসেছে সেটা বার বার পড়লো। অবশেষে বিড়বিড় করে বললো, “বাস্টার্ড!”

“জি, স্যার!” জামানের উত্তেজনা এতোটুকু কমে নি। ছেলেটা রীতিমতো হাফাচ্ছে। করিডোরের শেষ মাথায় কমিউনিকেশন্স রুম থেকে যে দৌড়ে এসেছে সেটা বুঝতে পারলো জেফরি।

এই খুনি, জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমানকে নিখুঁত দক্ষতায় খুন করে সমস্ত দায়দায়িত্ব লেখকের তরুণী, স্ত্রী আর প্রেমিকের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলো। জেফরি এমন বিভ্রান্তিতে পড়ে গেছিলো যে, লেখকের সাবেক স্ত্রী, এক প্রকাশক আর এক অভিনেত্রীকে পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় ঠাঁই দিয়েছিলো।

যাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে জেফরি বেগ। যাকে ট্রেস করার জন্য রীতিমতো একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করে ফেলেছে-জেফরি-বেক টেকনিক। কাকতালীয়ভাবে খুনির সাথে তার চেহারার রয়েছে অনেক মিল। প্রচণ্ড স্মার্ট আর ধূর্ত এক খুনি। ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করে। দেখলে মনে হবে নিষ্পাপ চেহারার এক যুবক। আদতে হাইলি পেইড প্রফেশনাল হিটম্যান।

“স্যার?” জামান তার বসকে দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থাকতে দেখে বললো।

সম্বিত ফিরে পেলো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ। “কি?”

“এখন কি করবো আমরা?” জামানের রক্ত যেনো টগবগ করছে।

তাই তো, এখন কি করবো? মনে মনে ভাবলো সে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। “বাস্টার্ডের যে ছবিটা আমাদের কাছে আছে সেটা নিয়ে আস।”

“জি, স্যার,” বললো জামান কিন্তু জায়গা থেকে নড়লো না, সে জানে তার বস্ আরো কিছু নির্দেশনা দেবে।

“রঞ্জুর লোকটা, মানে ঝন্টু এখন কোথায়?”

“লকআপে।” হোমিসাইডের নিজস্ব লকআপ আছে, যেকোনো থানা হাজতের লকআপের চেয়ে সব দিক থেকেই উন্নত আর মানবিক ।

“ওকে ইন্টেরোগেশন রুমে নিয়ে যাও, আমি আসছি।”

জামান দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলো ।

পাঁচ মিনিট পর জেফরি বেগ হোমিসাইডের ইন্টেরোগেশন রুমে বসে আছে ব্ল্যাক রঞ্জুর সহযোগী ঝন্টুর বিপরীতে। একটু আগেও তারা ঠিক এখানে বসেছিলো, তবে এবার জেফরি একা নয়, তার সাথে জামানও আছে।

জামানের কাছ থেকে বাস্টার্ডের ছবিটা হাতে নিয়ে ঝন্টুর দিকে মেলে ধরলো জেফরি। এই ছবিটা কম্পিউটারের সাহায্যে এনলার্জ করে তৈরি করা হয়েছে।

“চিনতে পারছেন একে?”

ঝন্টু যেনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। বজ্রাহত হলো সে। শুধু মাথাটা একটু নাড়াতে পারলো। হ্যাঁ। চিনতে পেরেছে। না চেনার কোনো কারণই নেই।

“এ ছবিটার সাথে তার বর্তমান চেহারার কতোটুকু পার্থক্য আছে?”

ঝন্টু ছবিটা হাতে নিয়ে আরো ভালো করে দেখে নিলো। “চুলগুলো এখন অনেক ছোটো…”।

“হ্যাঁ…” জেফরি তাড়া দিলো। আরো জানতে চাইছে সে।

“গায়ের রঙ রোদে পোড়া…” সম্মোহিতের মতো বলে চললো ঝন্টু।

“আর?”

“এই…বাকি সব ঠিকই আছে।”

“ভালো করে দেখুন!” অনেকটা ধমকের মতো শোনলো জেফরির কথাটা।

“না, স্যার…বাকি সব ঠিকই আছে।”

আশ্বস্ত হলো সে। ফিরে তাকালো জামানের দিকে। “ওকে, দ্যাটস এনাফ,” টেবিলের উপর চাপড় মেরে বললো জেফরি । “জামান, আমার মনে হয় ও ঠিকই বলেছে। আমাদের আর্টিস্টের যে স্কেচ তাতে ছোটো ছোটো চুলই আছে। তুমি এক্ষুণি কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে বাস্টার্ডের এই ছবিটা নিয়ে রিকন্ট্রাক্ট করে ফেলল। কি কি পরিবর্তন করতে হবে সেটা তো তুমি জানোই…”

“জি, স্যার।”

“ওকে, মেক ইট কুইক।”

জামান ছবিটা নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যেতেই জেফরি তাকালো ঝন্টুর দিকে।

“মি: ঝন্টু। আপনাকে এখন সাহায্য করতে হবে। সব বলতে হবে। আমি যা যা জানতে চাইবো তার ঠিক ঠিক উত্তর চাই। ফাঁসি থেকে বাঁচতে চাইলে আপনাকে শুধু সব কিছু বললেই হবে না, আপনাকে হতে হবে রাজসাক্ষী।”

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো ঝন্টু। রাজসাক্ষী! ঐ খুনিও তাকে এই কথা বলেছিলো। এরা কি সবাই একই দলের নাকি? বুঝতে পারছে এদের সহযোগীতা না করলে তার আর বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। তাদের তো সাক্ষী লাগবে, নাকি!

“স্যার, আপনি যা বলবেন আমি তাই করবো। বলুন কি করতে হবে?” অবশেষে বললো ঝন্টু।

“গুড!” কথাটা বলেই নিজের অস্থিরতা একটু দমিয়ে নিলো সে। বড় করে নিঃশ্বাস নিলো। ঝন্টু ভয় মিশ্রিত কৌতূহল নিয়ে তাকে দেখে যাচ্ছে।

“ব্ল্যাক রঞ্জু কোলকাতার কোথায় থাকে?”

.

অধ্যায় ৪৬

রেন্ট-এ-কারটা যখন মাউন্ট অলিম্পাসের সামনে এসে থামলো তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজে। বাস্টার্ড ইচ্ছে করেই অনেক আগে এসেছে। তার কিছুটা সময় দরকার।

ড্রাইভারকে একটু সামনে গিয়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে বললো সে । আরো বলে দিলো ফোন করে জানাবে কখন কোথায় আসতে হবে।

মাউন্ট অলিম্পাসের পেছন দিকটা দেখে নি, এবার সেখানেই গেলো সবার আগে। ম্যানেজার লোকটার কথামতো পেছন দিকেই একটা সিঁড়ি আছে, আগে যেটা ছিলো ফায়ারএস্কেপ, আর সেই সিঁড়িটাই ব্যবহার করে ব্ল্যাক রঞ্জু। ভবনটার পাশে আরো দুটো পাঁচ তলার ভবন। দ্বিতীয় ভবনটির বাম পাশ দিয়ে সরু একটা গলি চলে গেছে পেছন দিকে। অলিম্পাসের পেছন দিকে বেশ বড় ফাঁকা একটি জায়গা, চার দিকে কতোগুলো ভবনের পেছন দিক সেটা। এখান থেকে কোথাও যাওয়া যায় না । জায়গাটা কানাগলির মতো।

সংকীর্ণ একটা দরজা খুঁজে পেলো সে। লোহার দরজা। বাইরে দিয়ে কোনো তালা মারা নেই। দরজাটার কাছে গিয়ে ধাক্কা মেরে দেখলো । ভেতর থেকে লক করা আছে। তার মানে ব্ল্যাক রঞ্জু এখন উপরেই আছে।

আবার ফিরে এলো অলিম্পাসের সামনে। দেখতে পেলো রেস্টুরেন্টে কাস্টমার ঢুকছে। সন্ধ্যা যতো ঘনিয়ে আসবে কাস্টমার ততোই বাড়বে। তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে বাইরে। ভেতরে গিয়ে যদি ঐ ম্যানেজারের সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে সমস্যা। অবশ্য দেখা হয়ে গেলে কি বলতে হবে সেটাও ঠিক করে রেখেছে : আপনাদের এন্টারটেইনমেন্ট কম্প্যানিয়নদের একটু দেখতে এসেছি!

টুম্পার আসতে এখনও অনেক দেরি আছে। একটু হেঁটে অলিম্পাসের বিল্ডিং থেকে দূরে গিয়ে ভালো করে তাকালো চার তলার দিকে। পাঁচটা জানালা আছে এদিকটায়। ডান দিকের জানালাটার পদা সরানো। তার কাছে মনে হলো জানালার সামনে একটা আবছা অবয়ব বসে আছে। তবে সে নিশ্চিত হতে পারছে না ।

এটাই হলো ব্ল্যাক রঞ্জুর গুহা। তার ধারণা চার তলা থেকে সহসা সে, নীচে নামে না, যদি না বিশেষ কোনো প্রয়োজন পড়ে। তবে এখান থেকে তাকে কিভাবে বের করা যাবে সেটা সে ভালো করেই জানে ।

পরিকল্পনাটা গুছিয়ে নিলো। সোজা ঢুকে পড়লো অলিম্পাসের ভেতরে।

কাস্টমারের সংখ্যা মোটামোটি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সব। আগের দিন যে টেবিলে বসেছিলো ঠিক সেই টেবিলটাই ফাঁকা দেখতে পেয়ে সেটাতে বসে পড়লো। চারপাশে তাকিয়ে দেখলো টুম্পার মতো কোনো মেয়ে আছে কিনা। আছে। কমপক্ষে দু’জন। কাছাকাছি দুটো রাউন্ড টেবিলে বসে আছে তারা। একজনের পরনে টাইট জিন্স আর গেঞ্জি, অন্যজনের শাড়ি।

গতকালের মতোই করলো। প্রথমে চোখাচোখি । তারপর মুচকি হেসে ওয়েটারকে ডেকে দুটো বিয়ারের অর্ডার দিলো সে। ওয়েটার ছেলেটা চলে যেতেই টাইট জিন্স ক্যাটওয়াকের ভঙ্গিতে চলে এলো তার কাছে।

“বিগবয় কি শুধু রাতেই খেলে নাকি?” শার্টের বোতাম খোলা থাকার কারণে বাস্টার্ডের টি-শার্টের শ্লোগানটা দেখা যাচ্ছে। সেটার দিকে ইঙ্গিত করে বললো টাইট জিন্স।

“সুযোগ পেলে দিনেও খেলে,” কথাটা বলেই বাস্টার্ড বসার জন্য ইশারা করলো মেয়েটাকে।

“থ্যাঙ্ক ইউ,” মুচকি হেসে বললো টাইট জিন্স।

“ওয়াইন চলবে?” মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো সে। “শিউর।”

ওয়েটারকে ডেকে একটা ওয়াইনের অর্ডার দিয়ে দিলো। “আমি পিনাকী।”

“হ্যালো মি: পিনাকী। আমি অঞ্জলী ।”

“নাইস নেইম।”

“থ্যাঙ্কস।”

ওয়াইন আর বিয়ার চলে এলে মেয়েটাকে অফার করলো পান করার জন্য। তারা দুজনেই পান করতে শুরু করলো।

“তোমার অন্য বান্ধবীদের দেখছি না যে?”

ভুরু নাচিয়ে জানতে চাইলো অঞ্জলী, “আমার বান্ধবীদেরও চেনা হয়ে গেছে দেকচি!”

“সবাইকে না…শুধু টুম্পা, সুষমা আর শিমকিকে চিনি।”

“ওমা, আর বাকি থাকলো কে!”

“কেন, তুমি?” হেসে বললো সে।

“ওদের ছেড়ে আমাকে ভাল্লাগবে তো?” ন্যাকা ন্যাকা সুরে বললো মেয়েটি।

“আগে যদি তোমাকে দেখতাম তাহলে ওদের কাছে যেতামই না।”

অবিশ্বাসে চেয়ে রইলো অঞ্জলী । “আমাকে তোমার মনে ধরেছে বুঝি?”

“ধরেছে দেখেই তো ডাকলাম।” একটু থেমে আবার বললো, “ইউ আর সো হট!”

“বাপরে, এতো অল্প সময়েই এভাবে কথা বলছে! অনেক মেয়ে ঘেঁটেছে নাকি এ জীবনে?”

“আহ, এভাবে বোলো না । মেয়েরা আমার কাছে আবর্জনা নয় যে ঘাঁটাঘাঁটি করবো। তারা আমার কাছে একেকটি ফুল। আর ফুলের গন্ধ নিতে আমার খুব ভালো লাগে।”

“বাব্বা, কথাও বলতে জানো দেকচি।” একটা বিয়ার খুলে চুমুক দিলো অঞ্জলী ।

“তোমার বান্ধবীরা কোথায়?…দেখছি না যে?”

“আবার ওদের কথা বলা হচ্ছে কেন, মিস্টার?”

“কারণ, ওরা আসার আগেই তোমাকে নিয়ে কেটে পড়তে চাই।”

“ডোন্ট অরি, ওরা আসবে না।”

“কেন, ওরা কি এখন এখানে আসে না?”

“সুষমা আর শিমকি আজকাল নীচে আসে না। তবে টুম্পা আসে। ওকে নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের মধ্যে ওসব হিংসেটিংসে হয় না, বুঝলে?”

“গুড।” কথাটা বলেই মেয়েটার চুলে আলতো করে হাত বোলালো। “সুষমা আর শিমকি নীচে আসে না কেন?”

“রাজরাণী হয়ে গেছে যে…উপর তলায় যায় তো তাই আজকাল মাটিতে পা পড়ে না।”

“উপর তলা মানে?”

একটু কাছে এসে ঝুঁকে বললো অঞ্জলী, “এই রেস্টুরেন্টের মালিক আছে না, ঐ যে মৃণাল বাবু…সুষমা তো এখন ওর সাথেই রেগুলার যায়।”

“আর শিমকি?” বাস্টার্ড বিয়ারে চুমুক দিয়ে বললো।

“মৃণাল বাবুর সাথে তার এক বন্ধু থাকে…শিমকিকে লোকটার খুব মনে ধরেছে বোধহয় । এ কদিন ধরে তো দেখছি ও একবার উপরে গেলে সহজে নামে না।”

মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। “ঐ যে কালোমতো লোকটাই কি মৃণাল বাবুর বন্ধু?”

“আরে ওরা দুজনেই কালো। মৃণাল বাবুর গোঁফ আছে, ওর বন্ধুর নেই।”

আচ্ছা! একটু চুপ করে থেকে বললো, “টুম্পা কার সাথে আছে এখন?”

“ও কারো সাথে নেই। আমার মতো…এখানে রোজই আসে।”

“এখনও কি সুষমা আর শিমকি উপরে আছে?”

“একটু আগে মৃণাল বাবু বের হয়ে গেলে শিমকিকে উপরে যেতে দেখেছি। মৃণাল বাবুর ঐ বন্ধুর তো আবার খিদে বেশি।”

বাস্টার্ড নড়েচড়ে বসলো। “এখান থেকে যেতে দেখলে? কিভাবে? আমি তো জানি উপরে যেতে হলে পেছন দিয়ে যেতে হয়।” বিস্মিত হবার ভান করলো সে।

“কে বলেছে শুধু পেছন দিয়ে যেতে হয়?”

“ঐ যে ম্যানেজার, শীতল বাবু বলেছে।”

“মিথ্যে বলেছে…ম্যানেজারের রুমের পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি আছে না, ওটা দিয়েও যাওয়া যায়। লোকটা এমন ভান করে যেনো চার তলায় সাত রাজার ধন লুকিয়ে রেখেছে।”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, তুমি।” বিয়ারে চুমুক দিলো বাস্টার্ড । “ওখানে আছেটা কী?”

“কিছু নেই, তবুও এতো লুকোছাপা।” তারপরই কপট অভিমানের সুরে বললো অঞ্জলী, “আচ্ছা, আমরা কেন অন্য মানুষদের নিয়ে এতো কথা বলছি?”।

“তাই তো!” বাস্টার্ডও সায় দিলো।

“বাদ দাও ওদের কথা।” বিয়ারে চুমুক দিয়ে আবার বললো অঞ্জলী, “এখন বললো, আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে?”

“তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে যাও। টাকা যা লাগে দেবো, বাট নিরাপদ হতে হবে।”

একটু ভেবে অঞ্জলী বললো, “ঠিক আছে। কাছেই আমার এক মাসতুতো বোন থাকে, তার ওখানে যাওয়া যেতে পারে। তবে এক হাজার টাকা দিতে হবে ওকে।”

“টাকা নিয়ে তুমি ভেবো না, ডার্লিং!”

“তাই? তোমার বুঝি অনেক টাকা?” কথাটা বলেই চোখ নাচালো মেয়েটা । “তাহলে আমকে কতো দেবে, বলি?”

“অনেক…একেবারে ভরে দেবো,” ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বললো কথাটা।

“ওমা, তুমি দেখছি বড় নটি আছো?”

হেসে ফেললো বাস্টার্ড । এবার ওয়াইনের বোতল খুলে অঞ্জলীর গ্লাসে ঢেলে দিয়ে নিজেও কিছুটা নিলো। “চিয়ার্স ফর আওয়ার নেক্সট অ্যাডভেঞ্চার।

“নেক্সট অ্যাডভেঞ্চার!” গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকি হলো। “ওয়াও!” রহস্য করে বললো মেয়েটা।

“ইয়েস,” মদে চুমুক দিয়ে মি: পিনাকী বললো। “বিকজ, আমি একটু ডিফারেন্ট কিছু করতে চাচ্ছি আজ।”

“সেটা আবার কেমন?” ভুরু নাচিয়ে বললো অঞ্জলী।

“তুমি আমি আর…” কথাটা বলেই চোখেমুখে লম্পটের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো বাস্টার্ড।

“আর কি?”

“টুম্পা।”

ভুরু কুচকে মুখ টিপে হাসতে লাগলো টাইট জিন্সের অঞ্জলী। “বাব্বা, তুমি এতো নটি! দেখে কিন্তু বোঝা যায় না।”

“দেখে কী মনে হয়?”

“মনে হয় স্বামী বিবেকানন্দ…রাম নাম যপ করা ছাড়া আর কিছু করো না,” বলেই হেসে ফেললো মেয়েটা।

বাস্টার্ডও দুষ্টুমিপূর্ণ হাসি হাসতে লাগলো। “বাট আজকে আমি রাম নাম নয়…অঞ্জলী-টুম্পার নাম যপ করতে চাইছি।”

“আমার দিক থেকে নো প্রবলেম,.বাট টুম্পা রাজি হবে তো?”

“হবে,” মদে চুমুক দিয়ে বললো বাস্টার্ড। “না হবার তো কিছু নেই। উই আর গোয়িং টু হ্যাভ এ গ্রেট ফান!”

হা হা করে হেসে ফেললো অঞ্জলী। “আই থিঙ্ক আম গোনা লাইক ইউ,” মদে চুমুক দিয়ে বললো সে।

“আই হোপ সো,” মেয়েটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে বললো বাস্টার্ড, “আশা করি তোমরা…” চারপাশটা একবার চকিতে দেখে নিলো। হ্যাঁ, যাকে দেখার কথা দেখতে পেয়েছে। “…দীর্ঘদিন আমাকে মনে রাখবে।”

.

জেফরি বেগ জানে বাস্টার্ড এখন ঢাকায় নেই ।

রঞ্জুর ঘনিষ্ঠ দু’জন লোকের কাছ থেকে কোলকাতার ঠিকানা জানতে পেরে সে আর দেরি করে নি, চলে গেছে পশ্চিমবঙ্গে। এজন্যেই তিন-চার দিন ধরে রঞ্জুর দলের বিরুদ্ধে পর পর কয়েক দিনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড হঠাৎ করেই যেনো থেমে গেছে। ঝন্টুর কাছ থেকে ঠিকানা জেনে বাবু বিনয় কৃষ্ণকে হত্যা করে সোজা চলে গেছে কোলকাতায়। তার ধারণা দু’তিন দিন আগেই এই ভয়ঙ্কর খুনি কোলকাতায় চলে গেছে।

সিদ্ধান্ত নিতে আর দেরি করলো না। হোমিসাইডের মহাপরিচালক ফারুক আহমেদের কাছ থেকে অথোরাইজেশন নিয়ে কোলকাতার মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে বিস্তারিত জানিয়ে দিলো সে।

চায়না টাউনের মাউন্ট অলিম্পাস রেস্টুরেন্ট। সেখানকার চার তলায় বসবাস করে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী, বহু হত্যা-খুন আর চাঁদাবাজির হোতা ব্ল্যাক রঞ্জু। কিন্তু কমিশনারের জন্যে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, আরেক ভয়ঙ্কর খুনি ওখানে গেছে রঞ্জুকে খুন করতে । জেফরির আশংকা আশেপাশের অনেক নিরীহ লোকজন এসবের মাঝখানে পড়ে প্রাণ হারাতে পারে। নিজের শহরের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তার জন্যেই কমিশনারের উচিত এক্ষুণি পদক্ষেপ নেয়া। খুনি কিছু করার আগেই সন্ত্রাসীকে অ্যারেস্ট করতে পারলে একটা রক্তাক্ত ঘটনা এড়ানো যাবে সেইসাথে বিরাট একটি ষড়যন্ত্রও উন্মোচিত করা সম্ভব হবে। তবে পুলিশকে যেনো সতর্ক করে দেয়া হয় খুনি এবং তার টার্গেট উভয়েই ভয়ঙ্কর প্রকৃতির। তাদের কাছে রয়েছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। আর জায়গাটা জনপ্রিয় রেস্টুরেন্ট হওয়াতে কাস্টমারদের নিরাপত্তার কথাও যেনো মাথায় রাখা হয়। খুনির একটি ছবি এক্ষুণি ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দেবে সে। আরো সাহয্যের দরকার হলে তাকে যেনো ফোন করা হয়।

সব শুনে কমিশনার আশ্বাস দিলেন, তিনি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তাকে খবরটা জানানোর জন্যে জেফরি এবং হোমিসাইডকে ধন্যবাদও জানালেন ভদ্রলোক। অল্পক্ষণের এই ফোনালাপে তিনি এটা জানাতেও ভুললেন না যে, তার আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলায়। পিতা আর পিতামহের আদি নিবাসে তিনি প্রায়ই আসেন সপরিবারে । ফোন রাখার আগে কমিশনার জানালেন, কি হলো না হলে সে সম্পর্কে তিনি জেফরিকে অবহিত করবেন কিছুক্ষণ পর পর ।

ফোনটা রেখেই জামানকে বলে দিলো কম্পিউটারে রিকন্ট্রাক্ট করা বাস্টার্ডের ছবিটা যেনো এক্ষুণি কোলকাতার মেট্রোপলিটান পুলিশ কমিশনারকে ফ্যাক্স করে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

জেফরি বেগ কিছুক্ষণ চুপ মেরে বসে রইলো। বেলকাতার পুলিশ যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে তাহলে ভয়ঙ্কর সেই খুনি ধরা না পড়লেও রঞ্জু ধরা পড়বে। নস্যাৎ হয়ে যাবে বিরাট একটি ষড়যন্ত্র।

তারপর ঐ খুনিকে সে হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবে, কারণ এখন তার আঙুলের ছাপ জেফরির কাছে রয়েছে। খুব দ্রুতই তাকে ধরা সম্ভব হবে। কিভাবে তাকে ধরা হবে সে ব্যাপারে বাস্টার্ডের কোনো ধারণাই নেই।

ব্যাপারটা ভাবতেই এক ধরণের শিহরণ বয়ে গেলো জেফরি বেগের শরীরে।

.

অধ্যায় ৪৭

মদ্যপান আর কথাবার্তা সমানে চলতে লাগলো মাউন্ট অলিম্পাসের ভেতরে। মি: পিনাকী আর মিস অঞ্জলী আসন্ন অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে উত্তেজিত, শিহরিত।

বাস্টার্ড আসলে সময়ক্ষেপণ করছে। কিছু বিষয়ে নিশ্চিত জানা দরকার তার। মাউন্ট অলিম্পাসের চারতলায় দেবতা জিউসের সাথে আর কে কে আছে, কি রকম লোকজন আছে এইসব। সে জানে না ওখানে সব সময় কতোজন থাকে, আর তাদের কাছে আদৌ কোনো অস্ত্রশস্ত্র আছে কিনা। চার তলায় রঞ্জুর আখড়া সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া মাত্রই দেরি করবে না। এমনকি সে যদি দেখতে পায় মাউন্ট অলিম্পাস থেকে স্বয়ং জিউস নেমে আসছে তাহলেও দেরি করবে না। কারণ তার মিশনটা খুব কঠিন হলেও একদিক থেকে এটা একেবারে সহজ সরল : স্রেফ রঞ্জুকে খুন করা ।

তবে খুন করা যতোটা সহজ হবে তার পরের কাজগুলো ততটা সহজ হবে না বলেই তার বিশ্বাস। বিশেষ করে চায়না টাউন থেকে বের হওয়াটা একটু কঠিন হয়ে যেতে পারে যদি না একটা বিরাট হট্টগোল বাধায় । হট্টগোল একটা ঠিকই বাধাবে সে। তার জন্যে প্রয়োজনীয় প্রস্ততি নিয়ে এসেছে। শুধু সময়টা ঠিক করতে পারছে না। এ নিয়ে তার মধ্যে কোনো অস্থিরতাও নেই, কারণ হাতে প্রচুর সময় আছে। ধীরেসুস্থে কাজ করাই ভালো। দেখা যাক সুযোগটা কখন আসে।

“তাহলে আমরা কখন যাচ্ছি?” অঞ্জলী বললো।

সম্বিত ফিরে পেয়ে বাস্টার্ড মেয়েটার দিকে তাকালো। “কী বললে?”

“বাব্বা! তুমি দেখছি স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছো…কোথায় ছিলে গো?”

হেসে ফেললো সে। “কী যেনো বলছিলে?”

“বলছিলাম, কখন যাবো আমরা…ভালো কথা, টুম্পা কখন আসছে?”

একটু ভেবে নিলো বাস্টার্ড । “টুম্পা এক্ষুণি এসে যাবে। ও এলেই আমার চলে যাবো। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে,” একটু টেনে বললো অঞ্জলী।

বাস্টার্ড নড়েচড়ে বসলো । চকিতে হাত ঘড়িটা দেখে নিলো সে। “আচ্ছা, দাঁড়াও, টুম্পাকে ফোন দেই। দেখি ও কোথায় আছে।”

“দাও, ওকে বলো জলদি চলে আসতে,” অঞ্জলী মদে চুমুক দিতে শুরু করলো।

একটা নাম্বারে ডায়াল করলো বাস্টার্ড। “হ্যাঁ, তুমি কোথায়?” ওপাশ থেকে কী বলা হলো সেটা বোঝা গেলো না। “আচ্ছা, আসো…আর মাত্র কয় মিনিট?…ঠিক আছে। রাখি।”

“কি বললো ও?” জানতে চাইলো অঞ্জলী।

“আসছে। কাছেই এসে পড়েছে। বেশিক্ষণ লাগবে না। মেয়েটাকে আরো ড্রিংক ঢেলে দিলো সে।

“আরে, আমাকে এতো দিচ্ছো কেন…তুমিও নাও, তোমার গ্লাস তো দেখি একেবারেই খালি।”

“আমার একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে, সেজন্যে আর নিচ্ছি না। তুমি একটু বসো, আমি ওখান থেকে আসি।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মুচকি হাসলো অঞ্জলী।

বাস্টার্ড উঠে চলে গেলো রেস্টুরেন্টের পেছনে। ওখানেই ওয়াশরুমটা । এর আগে এখানে এসে দেখে গেছে ওয়াশরুমের পাশেই ম্যানেজারের রুম আর তার ঠিক পাশেই একটা সিঁড়ি আছে, যেটা চলে গেছে উপর তলায়। সেই সিঁড়ির নীচে বৈদ্যুতিক মিটার, মেইনসুইচ এসব আছে। ওয়াশরুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিলো সে। পকেট থেকে দুটো দেয়াশলাইয়ের বাক্স বের করলো, এরমধ্যে একটি ম্যাচবক্সের সবগুলো কাঠির বারুদের অংশ বের করে বাক্সটা লাগিয়ে রাখলো যাতে করে কাঠিগুলো আঁটকে থাকে। এবার একটি রাবার ব্যান্ড বের করে সেই দেয়াশলাইয়ের বাক্সে একটা জ্বলন্ত সিগারেট পেঁচিয়ে রাখলো এমনভাবে যাতে করে সিগারেটটার আগুন কিছুক্ষণের মধ্যেই দেয়াশলাইয়ের বারুদ স্পর্শ করে। কাজটা করার সময় একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো তার : ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঠিক এমনই একটা কাজ করেছিলো সে। তবে সেবার ব্যবহার করেছিলো গ্যাসের চুলার গ্যাস। এবার সে ব্যবহার করবে বৈদ্যুতিক মিটার আর সার্কিটবোর্ড।

আরেকটা দেয়াশলাই বের করে সেটার মুখ একটু খুলে রাখলো। এই বাক্সে আছে গানপাউডার।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির নীচে এসে পড়লো। চারপাশটা আরেকবার দেখে নিলো সে। না, কেউ নেই। জায়গাটা এমনিতেও নিরিবিলি থাকে। ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিটবোর্ডের কাছে গিয়ে মেইনসুইচের উপর সিগারেটসহ দেয়াশলাইটা সুন্দর করে রেখে দিয়ে হাটা ধরলো, তবে গানপাউডার ভর্তি দেয়াশলাইটা বাম হাতে এমনভাবে ধরে রাখলো যেনো সেটার ফাঁক করা মুখ দিয়ে গানপাউডার পড়তে থাকে।

তাই হলো। অনেকটা পথ পর্যন্ত গানপাউডারগুলো সরু ধারায় পড়তে লাগলো, মেঝেতে গানপাউডারের একটি সরু রেখা তৈরি হলো যা কারো চোখে পড়বে না। রেস্টুরেন্টের মাঝখানে এসে একটা খালি টেবিলের নীচে সবার অলক্ষ্যে ম্যাচবাক্সটা ফেলে দিলো। সে জানে এখনও বাক্সে যথেষ্ট পরিমাণ বারুদ রয়ে গেছে। এটাই সে চেয়েছিলো।

নিজের টেবিলে ফেরার আগে একটা টেবিলের সামনে যাবার সময় বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেও কেউ সেটা শুনতে পেলো না।

চেয়ারে বসতেই অঞ্জলী হেসে তার দিকে মদের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এবার নাও…”

“থ্যাঙ্ক ইউ,” মদের গ্লাসটা হাতে নিয়েই আলতো করে একটা চুমুক দিলো ।

“এখন ফ্রেশ লাগছে তো?”

“শিউর,” বললো সে।

আচমকা কিছু মানুষের হৈহট্টগোল শুনতে পেয়ে তারা দুজনেই ফিরে তাকালো সেদিকে।

খেলা শুরু হয়ে গেছে! মনে মনে বললো বাস্টার্ড ।

.

অলিম্পাস হোটেলের কাস্টমাররা অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আছে মাঝখানের এক টেবিলে দিকে। এক রাগি যুবক থাইসুপের পেয়ালা থেকে মৃত আরশোলা হাতে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে প্রদর্শন করে বোঝাতে চাইছে এই রেস্টুরেন্টের লোজন কতো কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে খাবার প্রস্তত করে থাকে, কতটা বাজে তাদের কিচেনের অবস্থা। উপর দিয়ে ফিটফাট থাকলেও আসলে এদের খাবারের মান এতো জঘন্য পর্যায়ে চলে গেছে। আরশোলাটা দেখেই দুতিনজন কাস্টমার, যারা কিনা এইমাত্র থাইসুপ মুখে দিয়েছিলো, বমি না করে পারলো না।

রেস্টুরেন্টের সবার মনোযোগ মাঝখানের টেবিলের রাগি যুবকের দিকে। ইতিমধ্যেই অনেকের সহমর্মিতা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে সে। রাগেক্ষোভে চিৎকার করে শাসাচ্ছে রেস্টুরেন্টের সবাইকে। তাকে কোনোভাবেই শান্ত করতে পারেছে না ওয়েটাররা। এক বিতিকিচ্ছরি অবস্থা।

“উফ! কী অবস্থা!” অঞ্জলী বললো। “আস্ত একটা আরশোলা! এদের কিচেনের এমন হাল হয়েছে জানতাম না তো।”

বাস্টার্ড ওয়াক করে উঠলে মেয়েটা তার দিকে তাকালো। “কি হয়েছে তোমার?”

“আমার বমি বমি লাগছে…ঐ আরশোলাটা দেখে…” আবার একটা ওয়াক করলো।

“তুমি ওয়াশরুমে চলে যাও। এক্ষুণি।”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে মি: পিনাকী ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো আবার।

কিন্তু ওয়াশরুমে না ঢুকে আস্তে করে উঠে পড়লো দোতলায় যাবার সিঁড়িটা দিয়ে। সিঁড়িতে ওঠার আগে চকিতে দেখে নিলো জ্বলন্ত সিগারেটটা কাঠির বারুদ ছুঁই ছুঁই করছে। প্রচণ্ড হৈহল্লার কারণে সবার মনোযোগ এখন রেস্টুেরেন্টের ভেতরে। বাস্টার্ডকে কেউ খেয়ালই করলো না।

দোতলার ল্যন্ডিংয়ে আসার আগেই ধপ করে একটা শব্দ হলো, তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরই রেস্টুরেন্টের ভেতরে সমস্ত বাতি বন্ধ হয়ে নেমে এলো ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে লোকজনের চিৎকার চেঁচামেচি। আতঙ্ক।

যেনো পাগলা ঘণ্টা বেজে গেছে মাউন্ট অলিম্পাস রেস্টুরেন্টের ভেতরে।

আগুন! আগুন!

একসাথে অনেকগুলো মানুষের চিৎকারটা গাঢ় অন্ধকারে ভীতিকর এক পরিবেশের সৃষ্টি করলো।

কানফাঁটা শব্দে বেজে উঠলো ফায়ার অ্যালার্ম ।

দোতলার ল্যান্ডিংয়ে ছোট্ট একটা লোহার দরজার সামনে গাঢ় অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো বাস্টার্ড, শিকারীর ধৈর্য নিয়ে প্রতীক্ষায় থাকলো। সে জানে ভেতর থেকে বন্ধ এই দরজাটা একটু পরই খুলে যাবে। এছাড়া চার তলার লোকগুলোর আর কোনো উপায় নেই। পেছন দিককার লোহার দরজাটা, যেটা তারা ব্যবহার করে সেটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে সামান্য একটি টিপ তালা দিয়ে।

দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থেকেই টের পাচ্ছে অলিম্পাসের ভেতরে আগুনের লেলিহান শিখার থাবা বেশ ভালোভাবেই বিস্তার লাভ করেছে। গানপাউডারের আগুন কতো দ্রুত ছড়ায় সেটা সে ভালো করেই জানে, তার উপর ইলেক্ট্রিক সার্কিট আর প্রচুর পরিমাণের অ্যালকোহল যোগ করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে বেশি লাগার কথা নয়। জেনারেটর থাকলেও সেটা যে কাজ করছে না তার কারণ সব ধরণের সার্কিট অচল হয়ে পড়েছে। এটাই সে চেয়েছিলো।

কিন্তু মাউন্ট অলিম্পাস থেকে জিউস নেমে আসছে না কেন?

প্রশ্নটা তার মনে উঁকি দিতেই লোহার দরজাটা ভেতর থেকে খোলার শব্দ পেলো। হাতে তুলে নিলো পিস্তলটা ।

যে-ই দরজাটা খোলার চেষ্টা করুক না কেন, ঘন অন্ধকারে তালার মধ্যে চাবি ঢোকাতে বেগ পাচ্ছে। একটা উৎকণ্ঠিত নারীকণ্ঠ তার সমস্ত অনিশ্চয়তা দূর করে দিলো।

“জলদি করো, রঞ্জু!”

অন্য কণ্ঠটা জবাব দিলো, “মোবাইল ফোন দিয়ে আলো ফেলো, শিমকি । দেখতে পাচ্ছি না!”

বাস্টার্ড একদম প্রস্তত। আর কোনো অনিশ্চয়তা নেই তার মধ্যে। দরজার ওপাশে আছে তার টার্গেট।

ব্ল্যাক রঞ্জু!

তালা খুলে ফেলার শব্দ পেলো সে। লোহার দরজাটা এক ঝটকায় খুলে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে পর পর তিনটি থুতু ফেলার শব্দ! একটা জান্তব গোঙানি। সেই গোঙানির সঙ্গি হলো নারী কণ্ঠের তীক্ষ্ম চিৎকার ।

কিন্তু তাদের শব্দ নীচের হট্টগোল ছাপিয়ে যেতে পারবে না, বাস্টার্ড সেটা ভালো করেই জানে। অন্ধকারেই নারী কণ্ঠটা রোধ করতে পারলো কারণ মেয়েটার হাতে থাকা মোবাইল ফোনের কল্যাণে বুঝতে পারলো সে। ডিসপ্লেটা এখনও জ্বলছে।

এক হাতে শিমকি নামের মেয়েটার মুখ চেপে ধরে অন্য হাতে পিস্তলটা ঠেকালো মেয়েটার তলপেটে। “চুপ!” তার কণ্ঠটা যেমন ভীতিকর তেমনি ফিসফিসে। অন্ধকারে সেটা ভৌতিক শোনালো।

পায়ের কাছে কিছু একটা নড়ে উঠতেই আবার গুলি চালালো সে।

শুধুই থুতু ফেলার শব্দ।

মেয়েটা বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে শক্ত করে মুখটা চেপে রেখেছে।

“আওয়াজ করলেই গুলি করবো!”

মেয়েটা তার হাত থেকে ছোটার জন্য হাসফাস করা বন্ধ করে দিলো সঙ্গে সঙ্গে।

“হাতের মোবাইল ফোনটা দিয়ে তোমার পায়ের নীচে আলো ফেলো,” তলপেটে পিস্তলের নল দিয়ে খোঁচা মেরে মেয়েটাকে বললো সে।

মোবাইল ফোনের ডিসপ্লের স্বল্প আলোতেও ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে বাস্টার্ড দেখতে পেলো ব্ল্যাক রঞ্জু চিৎ হয়ে দরজার কাছে পড়ে আছে। একটা গুলি লেগেছে রঙুর ডান চোখের ঠিক উপরে।

নির্ঘাত মৃতু!

বুঝতে পারলো, অসংখ্য খুনের হোতা ব্ল্যাক রঞ্জু কোনো মৃত্যুযন্ত্রণাই ভোগ করে নি। আফসোস!

শিমকি নামের মেয়েটাকে কী করবে সেটা যখন ভাবছে ঠিক তখনই ঘটলো আরেকটি ঘটনা।

স্পষ্ট শুনতে পেলো সাইরেনের আওয়াজ।

ফায়ার সার্ভিস? এতো দ্রুত!

কাছেই তাহলে সিভিল ডিফেন্স আছে। তা না হলে এতো দ্রুত আসার কথা নয়। ভালোমতোই আগুন লেগে গেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। দেরি করলে আগুনের কারণে বাইরে বের হতে পারবে না। ভালো করেই জানে সিঁড়ির নীচের আগুন আতঙ্কের চেয়ে বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। শিমকি নামের মেয়েটাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে এক্ষুণি।

পিস্তল ধরা হাতটা একটু উপরে তুলে পিস্তলের বাট দিয়ে মেয়েটার ডান কানের উপর প্রচণ্ড জোরে আঘাত করে বসলো সে। সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট শব্দ করে ঢলে পড়লো শিমকি।

ব্ল্যাক রঞ্জুর পাশে মেয়েটাকে শুইয়ে দিয়ে নীচে নেমে এলো সে। এইফাঁকে পিস্তলটা খুঁজে ফেলেছে কোমরে।

সিঁড়ির নীচে, যেখানে আগুন লেগেছিলো সেখানে আসতেই দেখতে পেলো আগুন নিভু নিভু করছে। আগুনের ব্যাপকতা যে খুব বেশি হবে না সেটা সে জানতো। এই রেস্টুরেন্টে রয়েছে অটোমেটিক সার্কিটব্রেকার। শটসার্কিট হয় নি।

ওয়াশরুমটা পেরিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে দেখতে পেলো কার্পেট আর কিছু টেবিলে আগুন জ্বলছে এখনও। একটা কাস্টমারও নেই। নেই কোনো ওয়েটার।

আজব!

কেউ আগুন নেভানোর চেষ্টাও করে নি? বুঝতে পারলো, কর্মচারিদেরকে আগুন নেভানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটাই হয়। এর ফলে আগুন নেভানোর সব ব্যবস্থা থাকলেও তাতে কোনো কাজ হয় না।

ঠিক এই সময় মেইনগেটের সামনে যে দৃশ্যটা দেখতে পেলো সেটার জন্যে মোেটও প্রস্তত ছিলো না সে।

নক্সা করা কাঠের তৈরি বিশাল দরজাটা পুরোপুরি খোলা। সেটা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে একদল লোককে। তারা ভেতরে আসতে উদ্যত।

পুলিশ!

.

অধ্যায় ৪৮

জেফরি বেগ উত্তেজনায় অস্থির হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ আগে কোলকাতা থেকে খবর এসেছে চায়না টাউনের মাউন্ট অলিম্পাস নামের রেস্টুরেন্টে বিরাট হট্টগোল শুরু হয়ে গছে। পুলিশ যাবার আগেই রেস্টুরেন্টের ভেতরে আগুন লেগে যায়। বিদ্যুত চলে গিয়ে অন্ধকার হয়ে যায় পুরো ভবনটি। পুলিশের দল ইতিমধ্যেই রেস্টুরেন্টটির সামনে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। তারা ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে বলেও জানানো হয়েছে তাকে।

জেফরি নিশ্চিত এটা বাস্টার্ডের কাজ, কিন্তু কোলকাতার পুলিশ অপারেশন চালাচ্ছে সেটা তো ঐ খুনির জানার কথা নয়। অথচ সে জেনে গেছে। পুলিশের কাছে যে ছবি দেয়া হয়েছে সেটা আগুনের ভয়ে দৌড়ে বাইরে আসা কাস্টমার আর ওয়েটারদের দেখালে তারা নিশ্চিত করেছে এরকম দেখতে এক লোক রেস্টুরেন্টে ছিলো। তবে আগুন লাগার পর তাকে আর দেখা যায় নি।

অদ্ভুত!

দশ মিনিট আগে যখন তাকে জানানো হলো তখনও গোলাগুলির কোনো ঘটনা রিপোর্ট করা হয় নি। পুলিশ নিশ্চিত, বাস্টার্ড নামের খুনি এখনও রেস্টুরেন্টের ভেতরেই আছে। তাদের সন্দেহ, রঞ্জু যেখানে থাকে, চার তলার উপরে হয়তো সে আটকা পড়ে গেছে।

কিন্তু চার তলার উপরে যদি রঞ্জু থেকে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতোক্ষণে সে বাস্টার্ডের শিকার হয়ে গেছে। কুখ্যাত এই খুনি-সন্ত্রাসী আর বেঁচে নেই। আবার এমনও হতে পারে বাস্টার্ডই রঞ্জুর শিকার বনে গেছে । নিশ্চিত করে কিছু বলার উপায় নেই। এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে আর কিছুক্ষণ পরই । যে খুনিকে হাতের কাছে পেয়ে ধরতে পারে নি তাকে এখন শত শত মাইল দূর থেকে ধরে ফেলতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা ভাবতেই শিহরিত হলো সে।

অমনি তার ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলো। দ্রুত তুলে নিলো সেটা। নিজের পরিচয় দেবার পর ওপাশ থেকে কিছু কথা শুনে কেবল “ইয়েস…ইয়েস…ও মাইগড!…অ্যাজ আই টোল্ড ইউ বিফোর, হি ইজ অ্যা ভেরি ভেরি ডেঞ্জারাস ম্যান….অ্যান্ড ভেরি ইনোভেটিভ…ইউ মাস্ট বি কেয়ারফুল…ওকে, থ্যাঙ্ক ইউ…থ্যাঙ্ক ইউ অ্যাগেইন,” বলে ফোনটা রেখে দিলো।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে জানতে চাইলো জামান, “স্যার, কি হয়েছে?”

“পুলিশকে লক্ষ্য করে অলিম্পাসের ভেতর থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি করা হয়েছে!”

* * *

মাউন্ট অলিম্পাসের মেইনগেট দিয়ে পুলিশের দলটাকে ঢুকতে দেখেই বাস্টার্ডের শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটি প্রবাহ বয়ে যায়। কোনো কিছু ভাবার আগেই বুঝতে পারে সে পেছন দিকে দৌড়ে ছুটে যাচ্ছে।

স্বতঃফুর্ত প্রতিক্রিয়া।

সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে যায় চার তলায়। ব্ল্যাক রঞ্জুর ডেরায়। জানালা দিয়ে যে আলো আসছে তাতে দেখতে পায়, ফাঁকা, পরিত্যাক্ত কোনো জায়গা যেনো । সামনের ঘরটা আয়তনে বিশাল। সোফা আর চেয়ারটেবিল পাতা আছে। বেশ সাজানো গোছানো। তবে সেসব দেখার সময় ছিলো না বাস্টার্ডের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যায় ভেতরের রুমে। বিলিয়ার্ড টেবিল, ছোটোখাটো একটি বার, বিশাল পর্দার এলসিডি টিভিসহ অনেক কিছুর সমাহার সেখানে।

বাস্টার্ড ভেবেছিলো ফায়ার সার্ভিস এসেছে, কিন্তু না, এসেছে পুলিশ। কোলকাতা পুলিশের সাদা পোশাকটি তার চেনা। তার দেখায় কোনো ভুল নেই। স্পষ্ট দেখেছে সে। একজন দু’জন নয়, মেইনগেটের সামনে যে পরিমাণ পুলিশ দেখেছে তাতে নিশ্চিত, রীতিমতো বিরাট একটি দল নিয়ে এখানে ছুটে এসেছে তারা। ভেতরে একদল ঢুকেছে, নিশ্চয় আরেকদল ব্যাকআপে আছে। তার মানে অনেক!

এই স্বল্প সময়ে সে কিছুতেই বুঝতে পারলো না পুলিশ এখানে কিভাবে এলো। কে পুলিশকে খবর দিলো? রেস্টুরেন্টের কেউ যদি খবরটা দিয়ে থাকতো তাহলে এতো দ্রুত পুলিশ আসতো না । অসম্ভব!

তবে এ নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করে নি সে। মাথাটা দ্রুত কাজ করতে শুরু করে। একটা ভাবনা মাথায় আসতেই ছুটে যায় সিঁড়ির দিকে। দোতলার ল্যান্ডিংয়ে এসে বুঝতে পারে পুলিশ সতর্কতার সাথে, পজিশন নিয়ে ফেলেছে রেস্টুরেন্টের ভেতরে। পুলিশ যাতে হুরমুর করে উপরে উঠে না আসে সেজন্যে একটা কাজ করার আছে।

এক ঝটকায় পিস্তলের সাইলেন্সরটা খুলে ফেলে, তারপর সিঁড়ির নীচে লক্ষ্য করে পর পর তিনটি গুলি করেই অপেক্ষা করে প্রতিক্রিয়ার জন্য ।

“ক্রলিং! ক্রলিং! এভরিবডি ক্রলিং!” একটা কণ্ঠ চিৎকার করে বলে ওঠে।

আরেকটা গুলি চালালেও পাল্টা জবাব দেয়া হয় না। বাস্টার্ড আর অপেক্ষা করে নি, দোতলার ল্যান্ডিংয়ে লোহার দরজাটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। ব্ল্যাক রঞ্জু আর শিমকি নামের মেয়েটা পড়ে আছে দরজার কাছেই। দু’জন মানুষকে টপকে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায় সে।

পুলিশ সম্ভবত সিঁড়ি দিয়ে উপরের তলাগুলো খুঁজে দেখবে। ফায়ারএস্কেপ সিঁড়িটার কথা জানতে পারবে চার তলায় গেলে। তার মানে কিছুটা সময় সে পাবে। কিন্তু এটাও বুঝতে পারে, নিজেই নিজের ফাঁদে পড়ে গেছে। এখান থেকে বের হবার একটা মাত্র উপায়ই আছে : ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যাওয়া।

হতাশাজনক ব্যাপার হলো, বাইরে থেকে সেই দরজাটাও বন্ধ করে রেখেছে টিপ তালা মেরে । ভেবেছিলো রঞ্জুকে বাধ্য করবে রেস্টুরেন্টের ভেতর দিয়ে আসার জন্য। সেইমতোই কাজ হয়েছে কিন্তু এখন পুলিশের আগমনে সে নিজেই ফাঁদে পড়ে গেছে।

তার কাছে পিস্তল ছাড়া আর কিছু নেই, গুলির পরিমাণও খুব বেশি নেই এখন। এ দিয়ে এতোবড় বিশাল পুলিশ বাহিনী কোনোভাবেই মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।

ঠিক তখনই বুদ্ধিটা মাথায় আসে। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে একটা নাম্বারে ডায়াল করে সে।

“মৃদুল?”

“বস, আপনি কোথায়?” মৃদুলের কণ্ঠে উৎকণ্ঠা।

“তুমি এখন কোথায় আছো?” তাড়া দিলো বাস্টার্ড ।

“আমি ঐ রেস্টুরেন্ট থেকে কোনোমতে বের হয়ে গেছি…এখন আছি মেইনরোডে।”

“তুমি তাড়াতাড়ি ঐ রেস্টুরেন্টটার পেছনে চলে আসো।”

“পুলিশ আছে তো, বস।”

“না। ওখানে পুলিশ নেই…যদি থাকে তাহলে আমাকে ফোন করে জানিও। না থাকলে একটা কাজ করতে হবে।”

“কি কাজ, বলেন?”

“পেছন দিকে একটা লোহার দরজা আছে, তালা মারা। যেভাবেই হোক তালাটা খুলতে হবে তোমাকে…জলদি।”

মৃদুল একটু ভেবে বললো, “ঠিক আছে বস, আমি এক্ষুণি আসছি।”

সিঁড়ি ভেঙে কতোগুলো লোক উপরে উঠে আসছে, শব্দ শুনেই বুঝতে পারলো সে। এরকম অসহায় অবস্থায় খুব কমই পড়েছে জীবনে। কিভাবে এখান থেকে বের হবে তার মাথায় ঢুকছে না। পেছন দিকের গেটের ওখানে যদি পুলিশ গিয়ে থাকে তাহলে তার আর কোনো আশা নেই।

পুলিশ কেন এতো দ্রুত চলে এলো সেই ভাবনাটা তার মাথায় জেঁকে বসলো আবার । এ প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পাচ্ছে না। রেস্টুরেন্টে পুলিশের এই আগমন তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। ঘুণাক্ষরেও ভাবে নি আজকের অপারেশনে এরকম কিছু হবে।

ফায়ারএস্কেপের সিঁড়ির নীচে, লোহার দরজার সামনে অপেক্ষা করতে থাকলো সে।

.

জামান খেয়াল করছে তার বস জেফরি বেগের উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। সুদূর কোলকাতায় কি ঘটছে সে সম্পর্কে জানার জন্য ছটফট করছে রীতিমতো। জামান জানে, লেখক জায়েদ রেহমানের খুনি হিসেবে বাস্টার্ডকে ধরার যে ব্যর্থতা তার জন্যে তার বসের মনে গহীনে একটা চাপা আক্ষেপ আছে। আজ যদি বাস্টার্ড জীবিত অথবা মৃত ধরা পড়ে তাহলে সেই ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে সে।

দশ মিনিট আগে শেষ কলটা আসার পর থেকেই নিজের রুমে পায়চারি করছে। বসকে উঠতে দেখে জামানও উঠে দাঁড়িয়েছিলো কিন্তু তার কাঁধে হাত রেখে তাকে বিরত করেছে জেফরি ।

“আমি নিশ্চিত, বাস্টার্ড ভেতরে আছে,” বললো হোমিসাইডের ইনভেস্টিগেটর। পুলিশের উদ্দেশ্যে গুলি করেছে!”

“বস, ব্ল্যাক রঞ্জুও তো হতে পারে?” বললো জামান।

পায়চারি থামিয়ে সহকারীর দিকে তাকালো জেফরি। “এটা বাস্টার্ড । আমি নিশ্চিত।”

“কি কারণে আপনার মনে হচ্ছে বাস্টার্ডই গুলি চালিয়েছে?”

“কারণ, ব্ল্যাক রঞ্জু খুব সম্ভবত সাথে অস্ত্র রাখে না। ওটা হলো তার নিরাপদ জায়গা। ওখানে অস্ত্র রাখার কোনো দরকারই নেই। এটা ঝন্টুও বলেছে আমাকে। আমি তার কথাটা বিশ্বাস করেছি।”

জামান মাথা নেড়ে সায় দিলো। রঞ্জুর কাছে যদি কোনো অস্ত্র না-ই থেকে থাকে তাহলে গুলিটা অবশ্যই বাস্টার্ড চালিয়েছে। তার মানে, ব্ল্যাক রঞ্জু হয়। মরেছে নাহয় বাস্টার্ডের সাথে সাথে সেও পুলিশের কাছে ধরা পড়বে।

ডেস্কের ফোনটা বেজে উঠলে জেফরি বেগ ছুটে গিয়ে সেটা ধরলো। “হ্যালো, জেফরি বেগ স্পিকিং।”

জামান দেখতে পেলো তার বসের চেহারাটা হতাশার কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে কী বলা হচ্ছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই তবে খুব ভালো কোনো খবর যে দেয়া হচ্ছে না সেটা বুঝতে পারছে।

বিমর্ষ হয়ে ফোনটা রেখে দিলো জেফরি বেগ। দু’হাত ডেস্কের উপর ভর দিয়ে চেয়ে রইলো সহকারি জামানের দিকে।

“খারাপ খবর?”

“খবরটা খারাপ না ভালো বুঝতে পারছি না,” চিন্তিতভাবে বললো জেফরি বেগ।

“কি হয়েছে, স্যার?”

“ব্ল্যাক রঞ্জু খুন হয়েছে। পুলিশ তার ডেডবডি রিকভার করেছে একটু আগে।”

জামান সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। সে জানে এটাই একমাত্র খবর না । “আর বাস্টার্ড?”

“পালিয়েছে!” টেবিলে একটা ঘুষি মেরে বললো ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ, “বাস্টার্ড!”

.

অধ্যায় ৪৯

মৃদুল ছেলেটা ইচ্ছে করলে তাকে এমন বিপদে রেখে সটকে পড়তে পারতো। কিন্তু ছেলেটা প্রচণ্ড সাহসী। তারচেয়েও বেশি বিশ্বস্ত। বাস্টার্ডকে সাহায্য করার জন্য বিরাট ঝুঁকি নিয়ে পুলিশে ঘিরে থাকা মাউন্ট অলিম্পাস রেস্টুরেন্টে ফিরে আসে সে।

রেস্টুরেন্টের সামনে প্রচুর সংখ্যক পুলিশ দেখে ভড়কে না গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের জটলার ভেতর থেকে লক্ষ্য করে পুলিশ শুধুমাত্র অলিম্পাসের সামনের দিকে পজিশন নিয়ে আছে । কারণটা সহজ। অলিম্পাসের দু’পাশে গা ঘেষা দুটো চার-পাঁচ তলার ভবন আছে। তারপরও পুলিশ কেন পেছন দিকটায় যায় নি মৃদুল সেটা বুঝতে পারলো একটু পরই।

সবার মনোযোগ রেস্টুরেন্টের সামনের দিকে, সুতরাং আস্তে আস্তে হেঁটে রেস্টুরেন্টটার পেছনে চলে আসতে মৃদুলের কোনো সমস্যা হলো না। পেছন দিকটা কানাগলি। কিন্তু সে বিস্ময়ের সাথে দেখতে পেলো পেছনে কোনো লোহার দরজাই নেই।

সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে কল করে সে।

“বস! পেছনে তো কোনো দরজা দেখতে পাচ্ছি না!” কলটা রিসিভ করা মাত্রই বলে মৃদুল।

“কি!” দারুণ অবাক হলো ফায়ারএস্কেপ সিঁড়িতে অবরুদ্ধ হওয়া বাস্টার্ড। “ভালো করে দ্যাখো!” তাড়া দেয় সে।

মৃদুল ফোনটা কানে চেপে রেখে পেছন দিকটা ভালো করে দেখে। কিছু নেই। শুধু একটা আদম রিক্সা ছাড়া। কোলকাতা শহরের অতিপরিচিত একটি আদম রিক্সা ভবনের পেছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে।

“বস, কোনো দরজা নেই…পেছনটা একেবারে খালি। শুধু একটা আদম রিক্সা দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা হয়েছে।”

“আদম রিক্সা?” বাস্টার্ড একটু ভেবে নেয়। সে যখন পেছন দিকটায় গেছিলো তখন এরকম কিছু ছিলো না। হতে পারে কিছুক্ষণ আগে কেউ হয়তো সেটা রেখেছে। তার মানে কি দরজাটা সেই রিক্সার কারণে আড়াল হয়ে আছে? “মৃদুল?…রিক্সাটার পেছনে ভালো করে দ্যাখো। আমার মনে হয় দরজাটা সেজন্যেই তুমি দেখতে পাচ্ছে না।”

মৃদুল বুঝতে পারে তার বস ঠিকই বলেছে । একটু কাছে এসে ভালো করে দেখতেই বুঝতে পারে ছোট্ট একটা লোহার গেট রিক্সাটার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে। বুঝতে পারে এই রিক্সাটা রাখার কারণেই পুলিশের চোখে ফায়ারএস্কেপের দরজাটা আড়ালে থেকে যায়। যার কারণে তারা আর এখানে কোনো পাহারার ব্যবস্থা করে নি।

“বস, দরজাটা খুঁজে পেয়েছি…একটা তালা মারা আছে। তালাটা ভাঙছি আমি, চিন্তা করবে না,” মৃদুল বলে।

দরজার ওপাশে হাফ ছেড়ে বাঁচে বাস্টার্ড । সে টের পায় পুলিশের দল দোতলা-তিনতলা কিংবা চার তলায় ঢুকে তল্লাশী শুরু করে দিয়েছে। সময় বেশি নেই। মনে মনে এই কামনাই করেছিলো, মৃদুল যেনো তালা ভাঙতে বেশি সময় না নেয় । কপালে হাত দিয়ে দেখে টেনশনে ঘাম জমতে শুরু করে দিয়েছে।

এদিকে মৃদুল ফোনটা রেখেই আদম রিক্সাটা টেনে একটু সরিয়ে রাখে। একটা সামান্য টিপ তালা। শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করলেই চিচিংফাঁক হয়ে যাবে । আশেপাশে তাকিয়ে শক্ত কিছু খোঁজে। একটু দূরে বড়সড় ইটের টুকরো পড়ে ছিলো। সেটা তুলে এনে তালার উপর সজোরে আঘাত করে সে। পর পর তিন আঘাতে তালাটা ভেঙে যায়।

দরজা খুলে বের হতেই মৃদুলের মুখে চওড়া হাসি দেখতে পায় বাস্টার্ড । ছেলেটার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, “দারুণ কাজ করেছো…এখন বলল, কোন্‌দিক দিয়ে যাওয়া যাবে?”

মৃদুল একটু ভেবে বলে, “দাঁড়ান, আমি দেখে আসি রেস্টুরেন্টের সামনে কী অবস্থা।”

কথাটা বলেই ছেলেটা চলে যায়, ফিরে আসে কিছুক্ষণ পরই।

“কি ব্যাপার?” উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায় সে।

“বস্, সামনে অনেক পুলিশ, এখন লোকজনের ভীড়ও বেড়ে গেছে। এদিক দিয়ে যেতে হলে একটা কেওয়াজ লাগাতে হবে।”

দ্রুত ভেবে নেয় বাস্টার্ড । “লোকজন ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিলে কাজ হবে?”

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলে মৃদুল, “হবে। কিন্তু কিভাবে এটা করবেন?”

“তোমার কাছে ম্যাচবক্স আছে?” মৃদুলকে বলে সে। বাস্টার্ড জানতো মৃদুল ধূমপায়ী।

মৃদুল পকেট থেকে একটা ম্যাচবক্স বের করে দেয়।

পকেট থেকে একটা ম্যাগাজিন বের করে সেটা থেকে ছয়-সাতটা গুলি বের করে নেয় সে। এই গুলিগুলো কামরাঙ্গা করা। রাস্তার উপর একটা রুমাল বিছিয়ে গুলিগুলো রেখে দেয়, তারপর মৃদুলের কাছ থেকে নেয়া ম্যাচবক্স থেকে একটা কাঠি বের করে রুমালে আগুন ধরিয়ে দেয় সে।

মৃদুলকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বলে, “প্রথম গুলিটা ফোঁটার পরই তুমি চিৎকার করতে করতে দৌড়ে চলে যাবে। লোকজন ভয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে আমিও দৌড়ে মিশে যাবো তাদের মধ্যে। আমাদের দেখা হবে কিড স্ট্রটে । ঠিক আছে?”

মৃদুল যেনো অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ পায়। বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে সে।

কয়েক সেকেন্ড পরই রুমালের আগুন একটা বুলেটকে স্পর্শ করতেই সেটা বিস্ফোরিত হয়। মৃদুল ভো দৌড় দিয়ে চলে যায় চিৎকার করতে করতে।

বাস্টার্ড শুনতে পায় লোকজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে শুরু করে দিয়েছে। সে আর দেরি করে নি। সোজা দৌড় দেয় প্রাণপনে । পেছন থেকে শুনতে পায় পর পর আরো দুটো গুলির শব্দ। মুহূর্তেই এদিকওদিক ছুটোছুটি করতে থাকা শত শত লোকজনের মাঝে মিশে যায় সে।

অলিম্পাসের সামনে পুলিশের বিশাল দলটি এ অবস্থা দেখে কিছুক্ষণের জন্যে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছিলো। একটু পর যখন পরিস্থিতি সামলে নেবার চেষ্টা করতে শুরু করে তারা বাস্টার্ড তখন মেইনরোডে চলে এসেছে প্রাণপনে ছুটতে থাকা একদল ভয়ার্ত লোকজনের সাথে সাথে ।

কিছুটা পথ এগোবার পর ফোন করে রেন্ট-এ-কারের ড্রাইভারকে। রেস্টুরেন্টের হট্টগোল আর পুলিশের কারণে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অন্য কোথাও সরে গিয়েছিলো। বাস্টার্ড তাকে বলে দেয় ঠিক কোত্থেকে তাকে পিক করতে হবে।

পাঁচ মিনিট পর গাড়িতে উঠেই গভীর করে নিঃশ্বাস নেয় সে। ধারণার চেয়ে কতত সহজ আর দ্রুতই না কাজটা করতে পারলো! তার ঠোঁটে দেখা যায় স্মিত হাসি।

ব্ল্যাক রঞ্জু শেষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *