1 of 3

৪০. গত সাত দিন ধরে হেমাঙ্গ ভাবছে

৪০

গত সাত দিন ধরে হেমাঙ্গ ভাবছে। ভাবছে, একটা পারসোন্যাল কমপিউটার তার দরকার আছে কিনা। উইথ প্রিন্টার। সাদামাটাভাবে দেখতে গেলে, দরকার নেই। কারণ তার অফিসেই কমপিউটার রয়েছে। তার জীবিকার যাবতীয় তথ্য তার মধ্যেই স্টোর করা আছে। সুতরাং আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে তার পি-সি-র কোনও প্রয়োজনই নেই। কিন্তু উপর-উপর চিন্তা করে সমাধানে পৌঁছনো না গেলে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। অনেকটা তলিয়ে দেখলে হয়তো ব্যক্তিগত কমপিউটার কেনার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ সে খুঁজে পাবে। লোকের কাছে জবাবদিহি বা অজুহাত খাড়া করাটাই তো সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই সাতদিন ধরে সে গভীরভাবে ভাবছে। ভাবতে গিয়ে চৌরঙ্গীর কাছে ট্র্যাফিক লাইট ভায়োলেট করে সে ট্র্যাফিক পুলিশের ধমক খেয়েছে। আনমনে আটকাতে গিয়ে একটা পুরনো আমলের পার্কার ডুয়োফোন্ড কলমের ক্যাপের প্যাঁচ কেটে ফেলেছে। এবং রশ্মি রায় একদিন ফোন করে ‘আমি রশ্মি’ বলায় সে গভীর অন্যমনস্কতার সঙ্গে প্রশ্ন করেছে, কে রশ্মি?

এইসব দুর্ঘটনার পরও সে অন্যমনস্কতা কাটাতে পারেনি। তার চেয়েও বড় কথা পি-সি কেনার ব্যাপারে এখনও কোনও স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। আসতে পারেনি আরও একটা গুরুতর কারণে। বন্ডেল রোডে তার সেজদি নীলা থাকে। তার দেওরের বিয়ের জন্য একখানা বাড়ি দরকার। গড়িয়াহাটের আশেপাশে এবং বন্ডেল রোডের গা ঘেঁষেই বিস্তর বিয়ে বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়। তা সত্ত্বেও সেজদি গর্চার বাড়িতেই বউভাত করার জন্য গোঁ ধরেছে বলে প্রায়ই যাতায়াত করছে। সেজদি আবার হিসেবী লোক। হেমাঙ্গর ঘরে জিনিসপত্রের বহর দেখে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। প্রথম দিনই সব দেখেশুনে বলে দিল, দাঁড়া, তোর এই অপব্যয়ের কথা বাবাকে বলে দেবো। এভাবে পাগল ছাড়া কেউ টাকা নষ্ট করে?

তার ওপর দিদিদের খবরদারি এবং অত্যাচার কবে বন্ধ হবে তা ভাবতে ভাবতে হেমাঙ্গ বলল, সব জিনিসই কাজে লাগে। মডার্ন টেকনোলজির খবর রাখিস না, সংসার করিস কি করে?

সেজদি রাগে গরগর করতে করতে বলল, খবর রাখি না তোকে কে বলল? ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি এসসি কি এমনি এমনি পাশ করেছি? কিন্তু খবর তুই-ই রাখিস না। ওই ভ্যাকুয়াম ক্লিনার দিয়ে কী পরিষ্কার করিস তুই? ওতে ময়লা যায়? আমার ঘরেও একটা পড়ে আছে। গুচ্ছের টাকা নষ্ট। বিজ্ঞাপন দেখে কিনলেই হল?

হেমাঙ্গ তর্কের লাইনে না গিয়ে মোলায়েম গলায় বলল, তোর দেওরের কোথায় বিয়ে ঠিক হল রে? দেনা-পাওনা কি রকম?

বিয়ে এবং দেনা-পাওনা দুটো জিনিসকেই হেমাঙ্গ আদ্যন্ত ঘেন্না করে। কিন্তু সে এও জানে, মেয়েদের বিবাহ প্রসঙ্গে ডাইভার্ট করতে পারলে তারা আর অন্যান্য তুচ্ছ জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাবে না। হলও তাই। নীলা ডাইভার্টেড হয়ে গেল। দেওরের বিয়ের এবং দেনা-পাওনার একটা বিস্তারিত বিবরণ দিতে গিয়ে হেমাঙ্গর অপব্যয়ের ব্যাপারটা চাপা পড়ে গেল। আপাতত।

মুশকিল হল, সেজদি আজকাল মাঝে মাঝেই আসছে। একতলায় অনেক জায়গা। বিয়ে উতরে যাবে। সেখানে মজুর লাগিয়ে সারাই, ঝাড়পোঁচ এবং রং হচ্ছে। যতদিন বিয়েটা না পার হয় ততদিন পি-সি কেনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েও কোনও লাভ নেই। কেনা যাবে না। সেজদি তাহলে ফ্যাসাদে ফেলে দেবে। কারণ, রোজ দুপুরে সেজদি মিস্তিরিদের কাজ দেখতে এসে তার ঘরেই জিরোয়। ডুপ্লিকেট চাবি চেয়ে নিয়েছে।

মাইকেলের কয়েকটা লাইন আজকাল প্রায়ই মনে পড়ে হেমাঙ্গর। কী কুক্ষণে তুই রে অভাগী, কাল পঞ্চবটী বনে কালকূটে ভরা দেখেছিলি এ ভুজগে। ভুলভাল হতে পারে, সেই ইস্কুলের পর মাইকেল আর পড়া হয়নি। তবে ব্যাপারটা মোদ্দা এরকমই। এই ভুজগটি রশ্মি। কারণ চারুদি মারফত রশ্মি সম্পর্কে মেলা গুজব ছড়িয়ে গেছে তাকে জড়িয়ে। সেজদি—দেখা হলেই—নানাবিধ প্রশ্ন করছে। বিলিতি মেয়ে? মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারবে তো? সুন্দরী বলতে ঠিক কি রকম? রং ফর্সা না ফ্যাকাসে?

ব্যাপারটা জটিলতর করে তুলছে রশ্মি নিজেও। চারুশীলার সঙ্গে সে আজকাল প্রায় রোজ রাতে টেলিফোনে কথা কয় বলে খবর পেয়েছে হেমাঙ্গ। কি কথা হয় কে জানে! হেমাঙ্গর নিজের ফোন তিন চারদিন হল ডেড। চারুদির কাছ থেকে কোনও রানিং কমেন্টারি পাওয়া যায় না। কিন্তু উদ্বেগ রয়েছে। খুব উদ্বেগ। তার পায়ের তলায় কি ভূমিক্ষয় শুরু হল? দুটি মেয়ে যখন পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে তখন কত কি হয়ে যেতে পারে। চারুদির সঙ্গে রশ্মির এত কিসের কথা? কেন কথা? তাকে নিয়েই কি কথা হয় ওদের?

এরকম অদ্ভুত ধরনের সমস্যায় পীড়িত হয়ে হেমাঙ্গর দিন কাটছে। না, সাদামাটাভাবে কাটছে না। তার মধ্যেই কাজ করতে হচ্ছে। বিস্তর ইনকাম ট্যাক্স থেকে বিপন্ন ক্লায়েন্টদের উজ্জ্বল উদ্ধার করতে হচ্ছে। আইন ও হিসেবের নানা জটিল, কুটিল এবং জটিলতর কুটিলতর ফন্দিফিকিরে মন দিতে হচ্ছে। দেঁতো হাসি হাসতে হচ্ছে এবং ফাঁকে ফাঁকে ভাবতে হচ্ছে, কেন তার একটা পারসোন্যাল কমপিউটার দরকার। শুধু অন্যদের বোঝালেই চলবে না, নিজেকেও বোঝাতে হবে। টেকনোলজি-মুগ্ধ, বেহিসাবী হেমাঙ্গর মধ্যে আবার একজন হিসাবী ও সতর্ক যুক্তিবাদী হেমাঙ্গও বাস করে। কিছু কিনলেই তার দ্বৈত সত্তায় একটা দ্বৈরথ উপস্থিত হয়। তখন হেমাঙ্গ একটু আত্মগ্লানিতে কষ্ট পায়।

গাঁয়ের নাম বিষ্টুপুর। স্কুলেরও একটা বড়সড় নাম আছে। বাসরাস্তায় নেমে মাইলটাক হাঁটতে হল হেমাঙ্গকে। তারপর যথারীতি খাতির যত্ন এবং বিশ্রী গরমিলে ভরা হিসেবের খাতা নিয়ে বসতে হল। ব্যাপারটা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। স্কুল অডিটের কাজটা এবার ছাড়তে হবে তাকে। ছেড়েই দিত, শুধু শহুরে গন্ধটা গা থেকে ঝেড়ে ফেলতেই মাঝে মাঝে গাঁয়ে আসা।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে হেডস্যার নানা গল্প ফেঁদে বসছিলেন। তার মধ্যেই হঠাৎ চেনা নামটা আচমকা জানালা দিয়ে উড়ে আসা একখানা পাটকেলের মতো পড়ল। কৃষ্ণজীবন। হেডস্যার বলছিলেন, এই স্কুল থেকেই পাশ করে গেছে ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ নিয়ে। স্ট্যান্ডও করেছিল। এখন দুনিয়াজোড়া নাম। মস্ত এনভিরনমেন্টালিস্ট। চেনেন নাকি?

হেমাঙ্গ একটু অবাক হয়ে বলে, বিলক্ষণ চিনি। এই গাঁয়ে বাড়ি?

আজ্ঞে। তার মা বাপ ভাই সব এখানে। আমেরিকা থেকে শিগগির একটা বইও বেরোবে শুনছি। ডারলিং আর্থ।

অতটা আবার হেমাঙ্গ জানত না। বলল, পাবলিক না জানুক আমি তাঁকে জানি।

কাজ শেষ করে কৃষ্ণজীবনের গ্রামটা একটু ঘুরে দেখল হেমাঙ্গ। আর পাঁচটা গাঁয়ের মতোই গরিব সাধারণ গাঁ। গৌরব করার মতো কিছুই নেই। কৃষ্ণজীবনের মতো দু-চারজন লোকের জন্যই যা একটু অহংকার।

ফিরে এসে পরদিন অফিস থেকেই কৃষ্ণজীবনের বাড়িতে ফোন করল সে। এবং আশ্চর্যের বিষয়, কৃষ্ণজীবনকে বাড়িতেই পেয়ে গেল। অধ্যাপকদের ওই এক সুবিধে, সপ্তাহে একাধিক ডে অফ।

একটু উৎসাহিত গলায় হেমাঙ্গ বলল, আরে মশাই, আমি তো আপনার গাঁয়ে ঘুরে এলাম। একটা অডিটে গিয়েছিলাম।

কৃষ্ণজীবনের গলায় একটা আলাদা মাত্রা যোগ হল, গিয়েছিলেন? কী দেখলেন?

কী আর দেখব? দেয়ার ইজ নেচার, মাঠ ঘাট পুকুর অ্যান্ড এভরিথিং।

কৃষ্ণজীবন মৃদু শব্দে হাসল, দেখেননি।

কী দেখিনি?

কিছুই দেখেননি। বাইরে থেকে কি দেখা যায়?

তা অবশ্য ঠিক। আমার তো সেন্টিমেন্টটা নেই, আপনার মতো।

সেন্টিমেন্ট এক মস্ত জিনিস। খুব মূল্যবান। লোকে কেন যে আজকাল আর এর মূল্য দেয় না।

একটু দেয়। এখনও দেয়।

দেয় না হেমাঙ্গবাবু। লোকে শিকড় ভুলে যাচ্ছে।

জানি কৃষ্ণজীবনবাবু।

দুঃখের বিষয় কী জানেন? যারা ওই গাঁয়ে থাকে তারাও গ্রামটাকে ভাল করে চেনে না। কূটকচালি নিয়ে মেতে আছে।

সে কথাও ঠিক। কিন্তু আমার একটু হলেও সেন্টিমেন্ট আছে। আমি গাঁয়ে যাই শহরের গন্ধ গা থেকে মুছে ফেলতে। কিছুক্ষণের জন্য।

আজ অফিসের পর চলে আসুন, আড্ডা মারা যাবে।

আপনার সময় নষ্ট হবে না তো! শুনেছি আপনি খুব ব্যস্ত মানুষ।

তাতে কি? আপনার কাছে আমার গাঁয়ের গল্প শুনব সেটা কি কম লাভ?

আপনি সত্যিই বিষ্ণুপুরকে ভীষণ ভালবাসেন, না?

ভীষণ।

আপনার কি আমেরিকা থেকে বই বেরোচ্ছে একটা।

লাজুক কৃষ্ণজীবন সংকুচিত গলায় বলে, বেরোচ্ছে একটা। ওরকম কত বেরোয়।

বইটার নামও আমি শুনে এসেছি। ডারলিং আর্থ।

কৃষ্ণজীবন মৃদু স্বরে বলল, ওরা খবর রাখে বুঝি?

খুব রাখে। আপনার কথা বলতে তারা গর্ব অনুভব করে।

চলে আসুন, কথা হবে।

হেমাঙ্গর সময়ের অভাব নেই। অফিসের পর কোথাও যেতে তার খারাপও লাগে না। দুটো কথা শুনলে বা বললে সময়টা কাটে। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা মিষ্টির প্যাকেট কিনে নিল হেমাঙ্গ। তারপর সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে এল গোলপার্কের কাছে।

কৃষ্ণজীবন তাকে সোজা নিয়ে গেল নিজের ঘরে। বসাল। পাখা খুলে দিল। তারপর খাপ পেতে বসল তার মুখোমুখি। লোকটা পণ্ডিত মানুষ, কিন্তু চেহারাখানা গুলবাগের মতো। এখনও মাসকুলার, শক্তপোক্ত এবং দুর্দান্ত হ্যান্ডসাম। চোখ দুখানা ঝলমল করছে অভ্যন্তরী জীবনীশক্তি এবং উদ্দীপনায়।

বলুন কেমন দেখলেন বিটুপুর। ওই গাঁয়ে আমি বড় কষ্ট করে বড় হয়েছি। খাওয়া পরার কষ্ট, মানুষের ব্যবহার দেখে কষ্ট, দারিদ্র্য দেখে কষ্ট। কিন্তু সব সত্ত্বেও কিছু একটা ছিল। সেটা আজও অজানা থেকে গেছে। কিছুতেই বুঝতে পারি না বিষ্ণুপুরের ওপর কেন আমার এত মায়া।

সেটাই তো স্বাভাবিক।

সোৎসাহে ঘাড় নাড়ল কৃষ্ণজীবন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো ঠিকই। আপনি সেন্টিমেন্টের কথা বলছিলেন। এটা সেই সেন্টিমেন্টই হবে। কিন্তু সেন্টিমেন্টেরও একটা লজিক থাকে, রুট থাকে। আমি সেইটে খুঁজে পাই না। আপনার চোখ দিয়ে কী দেখলেন বলুন।

হেমাঙ্গ লোকটার ছেলেমানুষের মতো আবেগ দেখে একটু হাসল। অবাকও হল। বলল, আর পাঁচটা গাঁয়ের মতোই তো।

সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দিল কৃষ্ণজীবন, সে তো ঠিক কথা। বরং আরো অনেক গ্রামের চেয়ে বিষ্ণুপুর আরও শ্রীহীন। আরও গরিব, আরও কম সবুজ। নাম বিষ্ণুপুর। লোকে তাচ্ছিল্য করে বলে বিষ্ণুপুর। তবু বিষ্ণুপুর আমাকে শিখিয়েছে কি করে পৃথিবীকে ভালবাসতে হয়।

ভালবাসা কি বাইরের জিনিস কৃষ্ণজীবনবাবু? সেটা তো ভিতরের জিনিস। ভালবাসা আপনার ভিতরেই ছিল।

কৃষ্ণজীবন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে সায় দেয়, ঠিক ঠিক। সব ঠিক কথা। একটা গ্রামের সঙ্গে সেই গ্রামের একটা ছেলের সম্পর্ক কোনও হাইলি ফিলজফিক্যাল জিনিস নয়। আমি জানি। বিষ্ণুপুর আমাদের দেশও নয়। আমরা উদ্বাস্তু ঢাকা জেলার আর একটা গ্রাম থেকে আমরা এখানে এসে ডেরা বাঁধি। আমার বাবা এখনও দাখিল্যা গ্রামের কথাই বলেন, তাঁর আজন্মকৈশোরের গ্রাম। কিন্তু বিষ্ণুপুর হ্যাজ সামথিং ফর মি। আমি কি হিপনোটাইজড? কে জানে! আমার মনে হয়, সব জায়গা ছেড়ে আমি একদিন ওখানে ফিরে যাবো।

তা কেন? আপনার ফিল্ড তো অনেক বড়।

জানি, জানি। আমার ফিল্ড তো সারা পৃথিবী। তবু আপনাকে বলছি, বিষ্ণুপুর আমাকে পৃথিবীকে চিনতে শিখিয়েছে। আমি তো অকৃতজ্ঞ নই।

মনে মনে হেমাঙ্গ বলল, আপনি একটি পাগল। মুখে বলল, ঠিক কথা। কেন বলল তা সে বুঝতে পারল না।

কৃষ্ণজীবন হঠাৎ খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেল। ভাবালু গলায় বলল, দিনরাত লোকেরা ঝগড়া করত, দলাদলি করত, প্রায়ই দাঙ্গাহাঙ্গামা হত, খুব কূটকচালি হত, ইস্কুলে লেখাপড়া একদম হত না। বিষ্ণুপুরের সবই ছিল খারাপ। বিচার করে দেখলে, বিষ্ণুপুরের কোনও সৌন্দর্যও ছিল না। তবু যখন আমি নিজের হাতে চাষ করতাম তখনই মনে হত বিষ্ণুপুরের মাটির ভিতর থেকে একটা প্রাণের স্পন্দন লাঙল বেয়ে আমার শরীরে উঠে আসছে। বর্ষাকালে ভীষণ বাজ পড়ত, ঝড়-বাদল তো ছিলই। কিন্তু ভয় করত না। খোলা মাঠের মধ্যে, ঝড়-বাদলে, বজ্রপাতের মধ্যে খুব তুচ্ছ লাগত নিজেকে। মনে হত, এই তো এইটুকু মাত্র আমি। আমি মরে গেলেও তো কিছু নয়। ওই বিরাট আকাশ, ভীষণ বৃষ্টি, মস্ত নীল আগুনের ঝলক—এত ঘটনার মধ্যে আমার মৃত্যু এমন কীই বা! শুধু আমার মতো একটা পোকাকে মারার জন্য তো ভগবান এত আয়োজন করেননি। তিনি আমাকে দেখাচ্ছেন কত বড় তিনি, কত তাঁর ক্ষমতা। আমি কি বোঝাতে পারছি আপনাকে? আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না।

আপনি বোঝাতে না পারলেও আমি কিন্তু বুঝতে পারছি। আপনি কি ঈশ্বর মানেন? কয়েকবার ভগবানের কথা বললেন, সায়েন্টিস্টরা তো নাস্তিক হয়।

কেউ কেউ হয়। আমি নাস্তিক কিনা তা কে বলবে? আসলে বিশ্বজগৎটা এত বিরাট, ইনফাইনিট যে, আমার ব্রেন ফেল করতে থাকে। একটা সময় আসে যখন আমরা সবাই স্তব্ধ ও মূক হয়ে যাই। আকাশটা কোথাও শেষ হচ্ছে না, আর সময় নিরবধি কেবলই বয়ে চলেছে। শুরু নেই, শেষ নেই। খুব গভীরভাবে ভাবলে আপনিও দেখবেন, স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়, কথা হারিয়ে যায়। ওই স্তব্ধতাই বোধ হয় ঈশ্বর। তাই না? নাকি আমি ফের গুলিয়ে ফেলছি সব?

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে মাথা নাড়ল, গুলিয়ে ফেলেননি। তবে প্রসঙ্গ ছিল বিষ্ণুপুর।

হ্যাঁ হ্যাঁ, বিষ্ণুপুর। আমি বিষ্ণুপুরের কথাই তো বলছি। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন বিষ্ণুপুরের বাইরের জগৎটাকে তো জানতাম না। কিন্তু ওখানকার জল-হাওয়া-মাটি আমাকে কিছু বলতে চাইত। আমার বন্ধুর মতো ছিল সব। আপনি শুনলে হাসবেন, আমি গাছের সঙ্গে, পোকামাকড়ের সঙ্গে, কুকুর-বেড়াল-গরুর সঙ্গে, পাখির সঙ্গে কথা বলতাম। খাওয়ার কষ্ট, পরার কষ্ট, অত পরিশ্রম, তবু মন ভাল থাকত। সবসময়ে যেন আনন্দ একটা নদীর মতো কুলকুল করে বয়ে যেত বুকের ভিতর দিয়ে। আমি কি ভাবালু হয়ে যাচ্ছি?

না। বেশ তো বলছেন।

আসলে তখন খুব মনে হত, আমি কখনও একা নই। আমার সঙ্গে বিষ্ণুপুরের গাছপালা, পশুপাখি সবাই আছে। ওই যে ভালবাসা ওটাই আমাকে এখনও ধরে রাখে। বাঁচিয়ে রাখে। এখন তো বুড়ো হতে চললাম, কত বয়স হল, তবু মনে হয় এখনও এক যুক্তিহীন বাচ্চা ছেলে আমাকে হাত ধরে বিষ্ণুপুরের দিকে কেবলই টানে। খুব টানে।

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, এরকম হতেই পারে।

আচ্ছা, বসুন। আপনার সঙ্গে আমি খুব অভদ্রতা করছি। বাড়ির কারও সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই!

হেমাঙ্গ মৃদু হেসে বলে, কেন থাকবে না। আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমার তো পুরনো আলাপ। ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, মনে নেই?

ওঃ, তা হবে। বলে কৃষ্ণজীবন খুব হাসল, আমার কিছু মনে থাকে না।

শুধু বিষ্ণুপুরের কথা খুব মনে থাকে, না?

কৃষ্ণজীবন যখন হাসে তখন তার মুখখানা সত্যিই শিশুর মতো হয়ে যায়। হাসিটা হেসে কৃষ্ণজীবন ঘর ছেড়ে চলে গেল এবং এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল রিয়াকে নিয়ে।

দেখ, কে এসেছেন।

রিয়া তটস্থ হয়ে বলে, আগে বলবে তো? ডোরবেল শুনেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি কে এসেছে। ছি ছি, দেখুন তো, শুকনো মুখে এতক্ষণ বসে আছেন!

ব্যস্ত হবেন না। আমি এঁর কথা শুনছিলাম।

রিয়া হাসল, আজকাল খুব কথা বলে। আগে কিন্তু মুখ থেকে কথাই বেরোতো না। ভীষণ গম্ভীর আর মুখচোরা ছিল। তবে সব বিষয়ে নয়, মনের মতো বিষয় পেলে তবেই বলে।

কৃষ্ণজীবন লাজুক মুখে বসে রইল, যেন অপরাধ হয়েছে।

রিয়া জিজ্ঞেস করে, কী খাবেন বলুন তো! নোতা কিছু করে দিই?

বলতে নেই হেমাঙ্গ খেতে ভালবাসে। ফটিকের হাতের রান্না বা হোটেলে খেয়ে সেরকম তৃপ্তি নেই। বিশেষ করে ভোজনরসিকদের। সুতরাং কেউ খাওয়াতে চাইলে সে খুব একটা প্রতিবাদ করে না।

তবে পেটুক না ভাবে সেই জন্য নরম করে একটু আপত্তি করল, না না, ঝামেলা কেন করবেন?

ঝামেলা হবে কেন? আমার একজন ভাল রাঁধুনী আছে। কচুরি খাবেন তো? আর হিং দিয়ে আলুর দম?

কচুরির কথায় হেমাঙ্গর খিদে চাগিয়ে উঠল। বলল, ব্যাচেলর মানুষ সব খাই।

রিয়া চলে যাওয়ায় কৃষ্ণজীবন মৃদু স্বরে বলল, আমি সত্যিই আজকাল বোধ হয় একটু বেশী কথা বলে ফেলি। আপনি কিছু মনে করেননি তো!

হেমাঙ্গ মাথা নেড়ে বলে, আপনার গলার স্বর এত অ্যাট্রাকটিভ এবং যা বলেন তাতে এত কনভিকশন থাকে যে শুনতেই হয়। আমি শহুরে মানুষ, তার ওপর মডার্ন টেকনোলজির অন্ধ ভক্ত। তাই বোধ হয় আপনার সঙ্গে আমার চরিত্রের একটু পার্থক্য আছে।

কৃষ্ণজীবন যে অভ্যন্তরের একটা অস্থিরতা সবসময়ে ঢেকে রাখে বা রাখতে চেষ্টা করে তা বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না।

সেই অস্থিরতায় হঠাৎ মাথা নেড়ে কৃষ্ণজীবন বলে উঠল, টেকনোলজি! নিশ্চয়ই টেকনোলজিরও দরকার। সেই টেকনোলজি আমাদের লোভ দেখাবে না, অলস করবে না, বস্তুর ভার বাড়িয়ে তুলবে না। টেকনোলজি হবে হেলপফুল। অতিরিক্ত টেকনোলজি প্রকৃতির নিয়মকে গুরুত্বহীন করে দিতে চায়। আমাদের জীবনে প্রকৃতিরও যে একটা ভূমিকা আছে সেটা কিছুতেই বুঝতে চায় না মানুষ। কিন্তু এবার তাকে বুঝতেই হবে। বুঝতেই হবে।

ডারলিং আর্থ বইটা আপনি কি এসব নিয়েই লিখেছেন?

হ্যাঁ, ওইসব, আরও অনেক কিছু। হয়তো পড়ে লোকে হাসবে। তবু আমার কথা তো আমাকেই বলতে হবে। তাই না?

তা তো বটেই। কবে বেরোচ্ছে বইটা?

হয়তো অক্টোবরের শেষে। আমাকে লস এঞ্জেলেসে যেতে হবে। ওরা যখন কোনও বই পাবলিশ করে তখন খুব একটা পাবলিসিটি দেয়। লেখককে সাংবাদিকদের মুখোমুখি বসিয়ে দেয়। অনেক রকম প্রশ্ন করা হয়। চোখা চোখা প্রশ্ন।

বলে খুব হাসল কৃষ্ণজীবন। যেন ব্যাপারটা খুব মজার।

হেমাঙ্গর কাছে মোটেই মজা বলে মনে হচ্ছিল না।

এই ক্ষ্যাপাটে লোকটা মার্কিন সাংবাদিকদের গোলমেলে, ক্ষুরধার সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে তো? পারবে হয়তো। কারণ কৃষ্ণজীবনকে যতই গ্রাম্য বা ক্ষ্যাপাটে মনে হোক, দুনিয়ার জ্ঞানীগুণীরা তো একে রাহাখরচ দিয়ে সম্মানের সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে এর কথা শুনবার জন্যই!

কিন্তু আড্ডা মারার পক্ষে লোকটা ভাল কি? মোটেই নয়। সবসময়ে যেন অন্যমনস্ক, সবসময়ে মুখের ভাব পাল্টে যাচ্ছে। ভিতরকার একটা অস্থিরতার সঙ্গে যেন লোকটার নিরন্তর লড়াই। এ আড্ডাবাজ মানুষই নয়।

কৃষ্ণজীবন অনেকক্ষণ নীরবে বসে রইল। একটাও কথা বলল না।

হেমাঙ্গও চুপ করে বসে রইল।

এক সময়ে কৃষ্ণজীবনই নীরবতা ভেঙে প্রশ্ন করল, আপনি টেকনোলজির এত ভক্ত কেন বলুন তো!

আমি টেকনোলজি বা প্রকৃতি সব কিছুরই ভক্ত। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি আমাকে খুব মজা দেয়। ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ, সোলার কুকার। হয়তো আমি নিজে টেকনিক্যাল লোক নই বলেই একটা বিস্ময় কাজ করে। আবার গাছপালা, সবুজ ক্ষেত, নদী এসবও ভাল লাগে। তা না হলে কি প্রায় প্রতি উইক-এন্ড এই গাঁয়ে যাই শখ করে?

কৃষ্ণজীবন একটু হাসল। বলল, নিশ্চয়ই। ভালবাসাটাই আসল জিনিস।

“নিশ্চয়ই” এবং “ভালবাসাটাই আসল জিনিস” এ দুটো কথাকে মেলাতে পারল না হেমাঙ্গ। কথাগুলো তার কথার প্রকৃত জবাবও নয়। কৃষ্ণজীবন কি তাহলে নিজের সঙ্গে কথা বলছে? তার সঙ্গে নয়? এ কি সলিলোকি? হেমাঙ্গ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কৃষ্ণজীবনের মতো লোকেরা একটা ভিন্ন স্তরে বাস করে। এরা ঠিক তার লেভেলের মানুষ নয়।

রিয়া যখন কচুরির থালা নিয়ে এল তখন ঘরের আবহাওয়াটাই গেল পাল্টে। নীরবতার বলয়টা ভেঙে স্বাভাবিক হল আবহ। খেতে খেতে আর একটা ব্যাপারও লক্ষ করল হেমাঙ্গ। কৃষ্ণজীবন খেতে ভালবাসে। খুব প্যাশন নিয়ে, আবেগ নিয়ে খায়। উপভোগ করে না, ক্ষুধার্তের মতো আক্রমণ করে খাদ্যবস্তুকে।

রিয়া বলল, আচ্ছা, আপনি কেন একা থাকেন বলুন তো! নিজের বাড়িঘর ছেড়ে একা একটা মস্ত বাড়িতে থাকেন, তাই না?

একা থাকার একটা আলাদা মজা আছে।

ভয়-ভয় করে না?

কিসের ভয়? ভূতের নাকি?

রিয়া খুব হাসল, বলল, আমার কিন্তু খুব ভূতের ভয়। এই যে ফ্ল্যাট দেখছেন এখানেই একা থাকতে হলে আমি ভয়ে মরে যাবো।

না, আমার ভূতের ভয় নেই।

চারুশীলা খুব আপনার কথা বলে। মুখে বাউণ্ডুলে লক্ষ্মীছাড়া বললেও ভীষণ ভালবাসে আপনাকে।

হ্যাঁ, তা বাসে। কিন্তু মাঝে মাঝে সেটা প্রায় আমার গলার ফাঁস হয়ে ওঠে।

বিয়েতে নেমন্তন্ন করবেন তো!

বিয়ে! বলে হেমাঙ্গ হাঁ করে রইল, কার বিয়ে?

আপনার।

আমার? এ খবর কে দিল আপনাকে?

কেন, চারুশীলাই তো বলছিল।

কী বলছিল?

একজন বিলেতফেরত সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে আপনার বিয়ে। নামটাও জানি। রশ্মি রায়।

কী সর্বনাশ! দোষী জানিল না কী দোষ তাহার, বিচার হইয়া গেল!

ও মা, আপনি জানেন না নাকি?

না তো! রশ্মির সঙ্গে আমার একটুখানি মাত্র বন্ধুত্ব। তাও অডিট করতে গিয়ে। নাথিং সিরিয়াস।

কিন্তু চারুশীলা যে খুব জোর দিয়ে বলল।

ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেন না। দিনকে রাত করতে পারে।

আচ্ছা যা হোক, আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে আপনার বিয়ে।

লোককে বোকা বানাতে চারুশীলার জুড়ি নেই।

রশ্মি কিন্তু ভীষণ ভাল মেয়ে। বিয়ে করলে বেশ মানাত আপনার সঙ্গে।

বিয়ের প্রশ্নই ওঠে না।

কেন বলুন তো!

এমনিই। রশ্মির মতো মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? চারুদির যত সব আকাশ-কুসুম চিন্তা।

এবার খুব অবাক হয়ে রিয়া বলল, ও মা, সে কি কথা! কে বলল আপনাকে যে রশ্মি আপনাকে বিয়ে করবে না?

আমি জানি।

এ মা! আপনি কিছুই জানেন না। রশ্মির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে যে।

পরিচয় হয়েছে? কি করে?

রশ্মি যে প্রায়ই আসে চারুশীলার বাড়িতে। গত কালও এসেছিল।

কচুরিটা মুখে বিস্বাদ ঠেকছিল হেমাঙ্গর।

সে বলল, আমি এত সব খবর জানি না।

খিলখিল করে হেসে রিয়া বলল, আপনি অনেক কিছুই তো জানেন না দেখছি। এমন কি একটা মেয়ে যে আপনার প্রেমে পড়েছে সেই খবরটা অবধি নয়। আপনি তো দেখছি আমার কর্তাটির মতোই আনমনা মানুষ।

আমি আনমনা নই, তবে লেস ইনফর্মড। আমাকে না জানিয়ে পৃথিবীর ঘটনাবলী অনেক এগিয়ে গেছে।

আপনার কিন্তু এ খবরটা জানার কথা।

কিন্তু প্রেমের কথা বলছেন কেন? আমরা তো প্রেমে পড়িনি!

কি জানি বাবা। আমার তো মনে হল মেয়েটির আপনাকে ভীষণ পছন্দ। আপনার প্রসঙ্গ উঠলেই এমন লজ্জা পাচ্ছে, ব্লাশ করছে আর মিষ্টি মিষ্টি হাসছে যে, ভুল হওয়ার কথাই নয়।

খানিকক্ষণ স্তব্ধ থেকে হেমাঙ্গ বলল, এটা কি করে হল তা আমি একদম বুঝতে পারছি না।

এই ব্যক্তিগত ব্যাপার আমি প্রকাশ্যে বলে ফেললাম বলে কিছু মনে করবেন না। আমি তো জানতাম আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।

হেমাঙ্গ বেশীক্ষণ বসতে পারল না। কচুরিগুলো খানিক ফেলে খানিক গিলে উঠে পড়ল।

তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তিটা মানসিক, কিন্তু সেটা শরীরটাকেও চঞ্চল আর অস্থির করে তুলেছে।

কোনওরকমে বিদায় নিয়ে সে নিচে এসে গাড়ি ছাড়ল। প্রথমে ভেবেছিল, চারুশীলার কাছে গিয়ে একটা জবাবদিহি চাইবে। কিন্তু সেটাও বিপজ্জনক। কে জানে হয়তো রশ্মি সেখানে এসে বসে আছে।

এমন নয় যে, রশ্মিকে তার অপছন্দ। এমনও নয় যে, বিয়ে করা তার পক্ষে একটা অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু যেটা বিস্ময়কর তা হল, রশ্মির পক্ষে তার প্রেমে পড়াটা। এরকমও হয় নাকি? এত অল্প পরিচয়ে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *