৪০.
কেম্ব্রিজ য়ুনিভার্সিটির কলোনেড কাঁপিয়ে পুরো সাড়ে ছ ফিট দীর্ঘ একটা দেহ একদিন হাঁটত। শিরদাঁড়াটা ঋজু হয়ে মাথার দিকে উঠে গিয়েছে। চওড়া, কঠিন একখানা ঘাড়। কাঁধ বুক-পিঠ এবং উরুতে রাশি রাশি পেশী, থরে থরে সাজান। গ্রেট ব্রিটেনের কোনো এক ডিউক পরিবারের ছেলে। সেদিনের সেই সাড়ে ছ ফিট ঋজু মানুষটা আকাশ ফাটিয়ে হো হো করে অট্টহাসি হেসে উঠতে পারত। সে-মানুষটা শখ করলে কাঁধের ওপর ধনুক আর তৃণীর নিয়ে, বুকের সামনে গণ্ডারের চামড়ার বর্ম বুলিয়ে, মধ্যযুগের কোনো লিজেণ্ডের নায়ক হতে পারত। অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় সে পারত তুষারমেরুর দেশে পাড়ি জমাতে। ফলেন এঞ্জেলের মতো আলপসের চূড়া থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারত কোনো গভীর পাতালে। সে পারত উন্মাদ সমুদ্রে জীবনতরী ভাসিয়ে দিতে।
কী সে চেয়েছিল? রোমান্স না অ্যাডভেঞ্চার? কী সে হতে পারত? রবিন হুড না অডিসিয়স? লিজেণ্ড না এপিকের নায়ক?
কিছুই হল না, কিছুই হওয়া গেল না। বলা যায়, কিছুই হতে পারল না সে। শুধু বিপুল এক কৌতুকে সাড়ে ছ ফিট মানুষটা কেম্ব্রিজ য়ুনিভার্সিটির কলোনেড ডিঙিয়ে একদিন সরাসরি চার্চের পবিত্র চত্বরে চলে গেল। সেখানে সুনীতি এবং সংযমের পাঠ নিয়ে, শুদ্ধ জীবনের দীক্ষাকাল কাটিয়ে, কোহিমার পাহাড়ে এসে পড়ল।
রবিন হুড নয়, অডিসিয়সও নয়, লিজেণ্ড কি এপিকের নায়কও নয়। সে পরম আগ্রহে তুলে নিল নিরুত্তেজ শান্ত স্নিগ্ধ মিশনারির জীবন।
আশ্চর্য! কোহিমা শহর থেকে মাও-গামী পথের দিকে যেতে যেতে অতীত জীবনটাকে এখন একটা অলীক স্বপ্নের মতো মনে হয়। কী সে হতে চেয়েছিল, আর কী সে হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে পিয়ার্সনের মনে অতীত এবং বর্তমান জীবনের একটা তুলনামূলক বিচার চলছিল। বলা যায়, চাওয়া এবং পাওয়া, খেয়াল মর্জি স্বপ্ন এবং বাস্তবের মধ্যে তুমুল ধুন্ধুমার চলছিল। পিয়ার্সনের মনে যে পরিমাণে ভাবাবেগ রয়েছে সেই পরিমাণে বিশ্লেষণ করার প্রবণতা নেই। ভাবাবেগই তার চরিত্রের মূল লক্ষণ। কিন্তু আজকাল সে ভাবে, মোটামুটি বিশ্লেষণ করে, বিচার করে। একটু নিরালায় এলে কিংবা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লে আপনা থেকেই কতকগুলি সূক্ষ্ম এবং তীক্ষ্ণ চিন্তা মনের মধ্যে ভিড় জমায়। কোহিমা পাহাড়ে এই মিশনারি জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে এক-একসময় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
নাগা পাহাড়ে আসার আগে কী ধারণা ছিল মিশনারিদের সম্বন্ধে? প্রেমে ক্ষমায় শুদ্ধাচারে পবিত্র এক জীবন। অন্তত সেই শিক্ষাদীক্ষাই সে দেশের চার্চে পেয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে এসে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জিকে দেখতে দেখতে তার সেই সুন্দর ধারণাটাই ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গিয়েছে। সব মোহ, সব কল্পনা রঙিন বুদ্বুদের মতো ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।
সাড়ে ছ’ ফিট দীর্ঘ দেহটার মধ্যে একটা জ্বালা, একটা আক্ষেপ অবিরাম ছুটে বেড়ায়। শিরায়-স্নায়ুতে, মেদে-মজ্জায়, ভাবনায়-চিন্তায় একটা অসহ্য বিক্ষোভ টগবগ করে ফোটে। পিয়ার্সন ভাবে, এই নাগা পাহাড়ে আসার আগে পাদ্রি ম্যাকেঞ্জিকে দেখার কথা সে কি কস্মিনকালেও ভাবতে পেরেছিল?
আর্চারি! হ্যাঁ, এককালে আর্চারি শিখেছিল পিয়ার্সন। সেদিনের স্পোর্টসম্যান পিয়ার্সনের দৃষ্টিতে জীবনের সংজ্ঞা একেবারেই স্বতন্ত্র ছিল। সেদিন তার রাইফেলের নিশানা ছিল কী অব্যর্থ! কী নির্ভুল ছিল স্পিয়ারের লক্ষ্য! স্পোর্টস, গেম, শিকার, রোমান্স, অ্যাডভেঞ্চার। ভাবাবেগের সকল নেশাতেই মন ভরপুর ছিল। তাই সুন্দর একটা খেয়ালের খেলার মতো এই সহজ স্নিগ্ধ মিশনারি জীবনের ভূমিকা গ্রহণ করতে অসুবিধা হয়নি। এতটুকু দ্বিধা হয়নি স্পোর্টসম্যান পিয়ার্সনের। প্রিচিঙকে কৌতুককর এক ধরনের গেমের মতো মনে হয়েছে। বেঁড়ে টাটুর পিঠে চড়ে পাহাড়ীদের গ্রামে ঘুরে ঘুরে গলা ফাটিয়ে খ্রিস্টমাহাত্ম্য শোনাতে হয়। সাপ-পাথর নুড়ি পুজোর বিপক্ষে, মোষ কি মুরগি বলির বিপক্ষে, বুনো নাগাদের বিবেককে রীতিমতো তাতিয়ে তুলতে হয়। শয়তান এবং অন্ধকারের এই অসহায় শিকারগুলোকে খ্রিস্টধর্মরূপ আলোর সড়কে নিয়ে আসার জন্য আপ্রাণ কসরত করতে হয়। ভাবতেই আমোদ পায় পিয়ার্সন, মজা লাগে। সারা দিন ঘুরে ঘুরে কপালে, চোখে, লালচে চুলে এবং ভুরুতে পাথুরে পথের ধুলো মেখে, সর্বাঙ্গ পাহাড়ী বাতাসে জুড়িয়ে, টক টক ঝাঁঝাল রিলক ফল চিবুতে চিবুতে এবং চার্চে ফিরতে ফিরতে অদ্ভুত নেশায় মনটা কুঁদ হয়ে থাকে। বেশ লাগে পিয়ার্সনের। অতীত জীবনের চেয়েও এই মিশনারি জীবনে যেন অনেক বেশি মাদকতা, অনেক বেশি মোহ রয়েছে।
চলতে চলতে পিয়ার্সন ভাবে, দেশে থাকতে তার ধারণা ছিল, মিশনারি জীবন বড়ই স্নিগ্ধ, সরল এবং পবিত্র। কিন্তু কোহিমা পাহাড়ে এসে স্নিগ্ধতা, সরলতা এবং পবিত্রতার লেশমাত্র খুঁজে পায়নি পিয়ার্সন।
মিশনারি জীবন তার সারা গায়ে সারপ্লিস এবং হাতে জপমালা দিয়েছে। পিয়ার্সন শিক্ষা পেয়েছে, অকারণে-অকারণে কেন, কোনোক্রমেই দেহমনকে উত্তেজিত করে তোলা ধর্মপ্রচারকের পক্ষে অপরাধের কাজ। নিজের ইন্দ্রিয় যে সংযত করে রাখতে পারে না, প্রশান্তি উদারতা যার মধ্যে নেই, সে কেমন করে অপরকে শীলাচরণ এবং প্রবৃত্তির শাসনের কথা শেখাবে? পিয়ার্সন এসব ভাবে, জানেও। তবু সে উত্তেজিত হয়। চড়াই-উতরাই-মালভূমি উপত্যকায় জড়ানো বিশাল, বিস্তীর্ণ এই নাগা পাহাড়ে মিশনারি জীবনের ভূমিকা সহজ নয়, সুন্দর নয়, পবিত্র নয়। অন্তত বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জিকে দেখে এই ধারণা হয়েছে পিয়ার্সনের। মিশনারি জীবনের গতি এখানে বক্র এবং কুটিল। রোষে রাগে সমগ্র সত্তা আর বুকের মধ্যে অন্তরাত্মা অহরহ যেন চিৎকার করতে থাকে পিয়ার্সনের। সে ভাবে, পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির মতো কতকগুলো জীব দিন দিন খ্রিস্টমাহাত্ম্যকে কতখানি খর্ব করে দিচ্ছে! যেশাসের পবিত্র নামে কী পরিমাণ কলঙ্ক মাখাচ্ছে–ভাবে, ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয়। যীশু সম্বন্ধে এই একান্ত সরল নাগাদের মধ্যে কী হীন ধারণারই না সৃষ্টি করেছে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। অবশ্য এই পাহাড়ী মানুষগুলোর মন এত নিষ্পাপ, এত অপরিণত যে হীন কি মহৎ, কোনো কিছুর তারতম্য বোঝার ক্ষমতা তেমন নেই। তবু পিয়ার্সনের বিশ্বাস, আজ হোক কাল হোক, দশ-বিশ বছর পরেই হোক, এই পাহাড়ীরা শিক্ষাদীক্ষা পাবে। তাদের অজ্ঞতা ঘুচবে, মন পরিণত হবে। সমস্ত কিছু বুদ্ধি দিয়ে, বিচার দিয়ে বিশ্লেষণ করে করে দেখতে শিখবে। সেদিন? ভাবতেও শিউরে ওঠে পিয়ার্সন। সেদিন যীশুর নাম ধুলোয় লুটোবে। ঘৃণিত, অপমানিত ক্রাইস্টের কথা কল্পনা করতেও ভীষণভাবে চমকে ওঠে পিয়ার্সন। সে ভাবে, দাঁতে দাঁতে কড়মড় শব্দ হয়। বিড়বিড় করে বলে, আর একটা জুডাস, ম্যাকেঞ্জিটা আর একটা জুডাস।
কোহিমা থেকে আঁকবাঁকা পথ ধরে দক্ষিণ-পুব দিকে অনেকখানি এসে পড়েছে পিয়ার্সন। সাদা কপালের ওপর এক আক্তর ধুলো জমেছে। সারপ্লিসটাকে হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে মাও-গামী সড়ক থেকে নিচের উপত্যকায় নেমে গেল সে। গোটা দুই ছোট টিলা, একটা আতামারি জঙ্গল এবং নিটে ঝরনা পেরিয়ে গেলেই লাংফু গ্রামের সীমানা শুরু। লাংফু, তারপর ইয়াগুচি, লাঞ্চ, ফচিয়াগা। এমনি অনেক, অসংখ্য গ্রাম। আজ কয়েকদিন ধরে এই সব গ্রামে নিয়মিত আসছে পিয়ার্সন। সাঙসু ঋতুর সমস্ত দিনটা গ্রামে গ্রামে কাটিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে সে কোহিমার চার্চে ফেরে।
চারিদিকে একবার তাকাল পিয়ার্সন। ডান পাশে একটা পাথর-ঢাকা আধো-গোপন ঝরনা। ঝোপে ঝোপে উঁচু উঁচু টিলার মাথায় যে-সব বন রয়েছে সেখানে রঙবেরঙের অজস্র ফুল ফুটেছে। নীলচে রঙের সোনু ফুল, হলদে রিলক ফুল, থোকা থোকা সবুজ রঙের আরেলা ফুল। যতদূর চোখ যায়, ফুল আর পাতা, পাতা আর ফল। রঙে রঙে পাহাড় এবং বন স্বপ্নের মতো মনে হয়। আশ্চর্য নীল আকাশে ভেঁড়া ঘেঁড়া পাপড়ির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গুটসুঙ পাখির ঝাক। আতামারি বনের ওপাশে প্রপাতের গমগম শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এতক্ষণ ম্যাকেঞ্জির কথা ভেবে সমস্ত মনটা উত্তেজিত হয়ে ছিল। এখন সেটা শান্ত, প্রসন্ন হয়ে গেল। সাঙসু ঋতুর এই উজ্জ্বল সকালে নাগা পাহাড়ের উপত্যকাটিকে বড় ভালো লাগছে। এই বনে, আকাশে, সাঙসু ঋতুর পরিপূর্ণতার মধ্যে যেন পরম পিতার নীরব অস্তিত্ব রয়েছে। নিজের অজান্তে সমগ্র সত্তার মধ্যে গুনগুন শব্দে যীশু-মেরির ভজনার সুর বাজতে লাগল যেন। খানিকটা উঁচু গলায় গাইতে শুরু করল পিয়ার্সন। প্রশান্তিতে সমস্ত সত্তা ভরে গিয়েছে তার।
উপত্যকার ওপর দিয়ে আচ্ছন্নের মতো চলতে চলতে একবার থমকে দাঁড়াল পিয়ার্সন। নির্জন উতরাই। এতক্ষণ খেয়াল হয়নি, আচমকা মনে হল, সরীসৃপের মতো সরসর শব্দ করে কী একটা তার পিছু পিছু আসছে। স্বাভাবিক নিয়মেই যীশু-মেরির ভজন থামিয়ে সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল পিয়ার্সন। আর ঘুরেই চোখে পড়ল, মোটা একটা খাসেম গাছের আড়ালে নিজের বেটপ শরীরটাকে লুকোবার চেষ্টা করছে স্টুয়ার্ট।
তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল পিয়ার্সন, কী ব্যাপার স্টুয়ার্ট, লুকোচ্ছ কেন?
মুখের ওপর একটা অসহায় ভঙ্গি ফুটিয়ে তাকিয়ে রইল স্টুয়ার্ট। রক্তমাংসের শরীরটাকে বায়বীয় করে বাতাসে মিলিয়ে দেওয়া যায় কিনা, হয়তো সেই কথাই ভাবছিল সে। ভাবতে ভাবতে ঘেমে উঠছিল।
মাথার চুল নিরপেক্ষভাবে ছাঁটা। গায়ের রং তামাটে। বেয়াড়া রকমের বেঁটে শরীরটার ওপর বিরাট এক মাথা। ঢলঢলে সরেপ্লিসটা পায়ের পাতা ছাপিয়ে আধ হাত খানেক পাথুরে মাটিতে লুটোচ্ছে। ঘোট ঘোট, কুতকুতে দুটো পিঙ্গল চোখ। সে চোখ সবসময় কুঁচকেই থাকে। এই হল স্টুয়ার্ট।
স্টুয়ার্ট লোকটার অতীত ইতিহাস জানে পিয়ার্সন। বছর তিনেক আগেও লোকটার নাম ছিল ইয়ুথু জেমি। বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির ভাষায় এই হিলি হিদেনদেরই রক্তবীজের বংশধর। কিন্তু ম্যাকেঞ্জিই তাকে তিন বছরের প্রাণান্ত সাধনায় স্টুয়ার্ট নামের মহিমা দিয়েছে, সাদা সারপ্লিসের গৌরব দিয়েছে।
ইয়ুথু জেমি থেকে স্টুয়ার্ট। অদ্ভুত এক জন্মান্তর। এ তিনটে বছরে ধবধবে সারপ্লিস, জপমালা আর ঘন ঘন ক্রস আঁকার মধ্যে এক জ্যোতির্ময় পৃথিবীর আলো দেখতে পেয়েছে স্টুয়ার্ট। এক-একসময় নিজের সারপ্লিস-পরা দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে যেশাসের বড় অন্তরঙ্গ মনে হয় স্টুয়ার্টের।
এতক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে স্টুয়ার্টকে দেখছিল পিয়ার্সন। তার দু’টি চোখের নীল মণি নীল তীর হয়ে স্টুয়ার্টের হাড়-মাংস, শিরা-স্নায়ু, মেদ-মজ্জা কুঁড়ে কুঁড়ে দিচ্ছিল। বেথেলহেমের সেই উজ্জ্বল তারাটির কাছাকাছি পৌঁছুতে আর কতটা দেরি স্টুয়ার্টের? বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির কাছে তার কতটা পাঠ বাকি?
আচমকা, একান্তই আচমকা, পিয়ার্সনের মনে একটা কুটিল সন্দেহের ছায়া পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে জ দুটো বেঁকে গেল, চোখদুটো আরো তীক্ষ্ণ হল।
মোটা খাসেম গাছটার আড়ালে দেহটাকে সঙ্কুচিত করে রাখতে হিমসিম খাচ্ছিল স্টুয়ার্ট। ভয়ে আর আশঙ্কায় কপাল, বুক এবং বাহুসন্ধি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ক্রস আঁকতে শুরু করল। পিয়ার্সনের চোখের আগুনে সে যেন ঝলসে যাচ্ছে। বেশ বুঝতে পারছে, সমস্ত শরীর একটু একটু করে কুঁকড়ে যাচ্ছে তার।
চড়া গলায় পিয়ার্সন ডাকল, স্টুয়ার্ট–
ইয়াস ফাদার–খাসেম গাছের ওপাশ থেকে ভীরু, মিনমিনে গলায় সাড়া দিল স্টুয়ার্ট।
গাছের আড়ালে লুকোচ্ছ কেন?
নো, ইয়াস–ছোট ফাদার, আমি—মানে–থতমত খেতে লাগল স্টুয়ার্ট, আমি এদিকে এসেছিলাম। হুই লাংফু বস্তির দিকে–
লাংফু বস্তির দিকে তো আমিও যাচ্ছি। তুমি লুকোচ্ছ কেন?
হুই বড় ফাদার বলে দিয়েছে যে।
মনের ভেতর য়ে সন্দেহটা এতক্ষণ হালকা ছায়ার মতো ছড়িয়ে ছিল, এবার সেটা ঘন হল, কুটিল হল। –দুটো ভীষণভাবে বেঁকে গেল পিয়ার্সনের। প্রখর গলায় সে বলল, বড় ফাদার, মানে ম্যাকেঞ্জি তোমাকে পাঠিয়েছে?
হু-হু–ছোট ফাদার–বিরাট মাথাটা ঘন ঘন দোলাতে লাগল স্টুয়ার্ট।
ওহ্! এসপিওনেজ! হরিবল! সাঙসু ঋতুর উজ্জ্বল সকালটাকে কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল পিয়ার্সন।
এতক্ষণ পিয়ার্সনের জ্বলন্ত চোখদুটোর দিকে তাকাতে পারছিল না স্টুয়ার্ট। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। একবার ভয়ে ভয়ে তাকাল। তারপরেই খাসেম গাছটার আড়াল থেকে উদ্ধশ্বাসে সামনের টিলার দিকে দৌড় লাগাল।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল পিয়ার্সন। বিস্ময়ের ঘোর কাটলে রক্তে রক্তে যেন সাইক্লোন বেজে উঠল তার। চক্ষের পলকে সাদা সারপ্লিসটা খুলে পাথুরে মাটিতে ছুঁড়ে দিল। তারপর একটা টগবগে ঘোড়ার মতো বড় বড় পা ফেলে স্টুয়ার্টের দিকে ছুটল।
যীশু, মাদার মেরি, ও টেটসে আনিজা, বাঁচা বাঁচা–চড়াই বেয়ে ওপর দিকে উঠতে উঠতে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করল স্টুয়ার্ট। দম ফুরিয়ে এসেছিল। নিশ্বাস নেবার জন্য একবার থমকে দাঁড়াল স্টুয়ার্ট, পেছন ফিরে দেখল একটা সাদা উল্কা দূরন্ত গতিতে ছুটে আসছে। আবার আকাশ ফাটিয়ে আর্তনাদ করে উঠল স্টুয়ার্ট, ও যীশু, ও মেরি, ও বড় ফাদার, ও আনিজা–বাঁচা বাঁচা–উঁচু চড়াইর দিকে আবার ছুটল স্টুয়ার্ট। মহাপ্রাণীটার জন্য বড় মায়া তার। সাঙসু ঋতুর ঝকমকে সকালটা তার জন্য এমন একটা দুর্বিপাক ঘনিয়ে রেখেছিল, তা কি জানত সে!
মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত। তারপরেই স্টুয়ার্টের মাথায় বাজ পড়ল। বাজ নয়, পিয়ার্সনের বিরাট একটা থাবা।
ও যীশু–কাতর শব্দ করে লুটিয়ে পড়ল স্টুয়ার্ট।
কপালে একে আস্তর পাহাড়ী ধুলো জমেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে বেরিয়েছে। ঝকঝকে দু’পাটি দাঁত মেলে হেসে ফেলল পিয়ার্সন। চোখের নীলাভ মণি দুটো কৌতুকে ঝিকমিক করছে। পিয়ার্সন বলল, স্টুয়ার্ট, শুধু শুধু দৌড়লে। জানো তো, মিশনারি হবার আগে আমি স্পোর্টসম্যান ছিলাম। হোমে থাকতে আমি কত ট্রফি জিতেছি! আর তুমি একটা ন্যাম্বিপ্যাম্বি পাহাড়ী চ্যাপ, আমার সঙ্গে ছুটে পারবে! হোঃ-হোঃ-হোঃ, হোয়াট আ ফান! তুমি আর আমি দৌড়চ্ছি, একবার ভাব তো দৃশ্যটা। ইজ ইট নট কমিক! হোঃ-হোঃ-হোঙ!
আশ্চর্য হাসি পিয়ার্সনের। এ-হাসির ঝাঁপটায় মনের সব কপাট জানালা খুলে যায়। আর সেগুলোর মধ্য দিয়ে একটা সুন্দর প্রাণের শেষ পর্যন্ত দেখা যায়।
স্টুয়ার্ট নিরত্তর। পাহাড়ী টিলায় চুপচাপ নিস্পন্দ পড়ে রয়েছে। রুক্ষ পাথরের ঘা লেগে হাত পাকপাল ছড়েছে, চামড় ছিঁড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে।
পিয়ার্সন বলল, কি স্টুয়ার্ট, একেবারে ঘাপটি মেরে পড়ে রইলে যে! দৌড়তে ইচ্ছে হয়েছে, তা আমাকে বললেই পারতে। তোমার জন্যে এই নাগা পাহাড়ে নতুন করে আবার অলিম্পিকস্ বসাতাম। হোহোহোর–
আবারও সেই অবাধ, চারপাশ-মাতিয়ে-দেওয়া হাসি হেসে উঠল পিয়ার্সন, হোয়াট আ ওয়াণ্ডার! স্টুয়ার্ট দৌড়চ্ছে পিয়ার্সনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে–
ও-পক্ষ নির্বিকার। স্টুয়ার্টের জবাব নেই।
আচমকা হাসি থামিয়ে দিল পিয়ার্সন। মুখেচোখে ভয়ানক কাঠিন্য দেখা দিয়েছে এবার। চোখের দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠেছে। শিরা-স্নায়ু-ইন্দ্রিয়গুলো ধনুকের ছিলার মতো টানটান হয়ে গিয়েছে। এ এক অন্য পিয়ার্সন। হাসি-কৌতুক-পরিহাসে এই মানুষটা যে সবসময় সরস এবং সতেজ, এখন দেখলে একেবারেই বোঝা যায় না।
ঢোলা আলখাল্লাটা গুটিয়ে হাঁটু মুড়ে স্টুয়ার্টের পাশে বসে পড়ল পিয়ার্সন। তারপর তার পাঁজর বরাবর আঙুল দিয়ে খোঁচা লাগিয়ে দিল। দাঁত দাঁতে চেপে বলল, ঘাপটি মেরে রয়েছে। একটা ডেভিলস সন। আর একটা জুডাস। ওঠ–
আঙুলের খোঁচা খেয়ে কোঁৎ করে উঠেছিল স্টুয়ার্ট । এবার ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। কপাল থেকে খানিকটা তাজা গাঢ় রক্ত ফাটা ফাটা ঠোঁটের ওপর এসে পড়েছিল। জিভ বার করে ফোঁটাগুলি চাটতে লাগল স্টুয়ার্ট। ভুরু দুটোও কেটেকুটে রক্তাক্ত। তামাটে গাল থেকে এক খাবলা মাংস উঠে গিয়েছে। এখন অত্যন্ত অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। নিতান্তই নিরুপায়।
পিয়ার্সন চিৎকার করে উঠল, স্পাই। তুই একটা স্পাই। মোস্ট হেঁটেড বিস্ট–আমাকে ফলো করে করে আসছিলি?
ইয়াস ফাদার। হাউ হাউ করে ডুকরে উঠল স্টুয়ার্ট। পিয়ার্সনের হাঁটু দুটো আঁকড়ে ধরে বলল, হু-হু– ফাদার, আমি স্পাই। কী করব? হুই বড় ফাদার যে তোর পিছু পিছু যেতে বলে। আমি কিছু জানি না। আমার কোনো দোষ নেই। তুই রোজ পাহাড়ী বস্তিগুলোতে যাস। এই লাংফু, লাঞ্চ, ফচিয়াগা–সব বস্তিতেই তোর পিছু নিই।
স্নায়ুশিরাগুলো এতক্ষণ টান টান হয়ে ছিল। পিয়ার্সনের মনে হল, এবার সেগুলো একসঙ্গে কটাৎ করে ছিঁড়ে যাবে। ভীষণ গলায় সে বলল, তারপর রোজ ম্যাকেঞ্জির কাছে গিয়ে বলিস, বস্তিতে ঘুরে ঘুরে আমি কী করি, কী বলি–তাই না?
হু-হু–প্রবলভাবে মাথা নাড়তে লাগল স্টুয়ার্ট, আমার কোনো দোষ নেই ফাদার, সব হুই বড় ফাদারের কাজ। পারডন মি।
এই তিন বছরে স্টুয়ার্টের বুনো পাহাড়ী জিভের নিচে কয়েকটা ইংরেজি শব্দ এবং বিচিত্র উচ্চারণের মহিমা গুঁজে দিয়েছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। ইংরেজি এবং নাগাদু’টি ভাষার অদ্ভুত বিস্ময়কর মিলন ঘটেছে স্টুয়ার্টের মুখে।
ভয়ে, আতঙ্কে এবং আশঙ্কায় স্টুয়ার্ট কাঁপতে শুরু করেছে। ফিসফিস গলায় সে বলল, পারডন মি ফাদার। আমাকে যেতে দে, আমার কোনো দোষ নেই।
কোনো দিকে বিন্দুমাত্র হৃক্ষেপ নেই পিয়ার্সনের। সে ভাবতে লাগল। সাঙসু ঋতুর এই পাহাড়ী পৃথিবী থেকে তার মন এক অপরূপ জগতের দিকে উধাও হয়ে গেল। শ্ৰদ্ধার ক্ষমায় প্রেমে সে জগৎ সুন্দর, শোভন এবং শুচিময়। পৃথিবী-ঘেরা সব অন্ধকার এবং কালিমা, সব অন্যায় এবং অবিচার একটি মধুর ক্ষমায় আর প্রেমে স্তব্ধ করে এগিয়ে চলেছেন এক জ্যোতির্ময় পুরুষ। মানবপুত্র। সেই অমৃত পুরুষের নির্দেশ কি সফল হল নাগা পাহাড়ের এই স্টুয়ার্টের মধ্যে? ক্রিশ্চানিটির মহিমা কি চরিতার্থ হল?
একটু আগে পিয়ার্সনের মনে হয়েছিল, এই পাহাড়ের টিলায় টিলায়, ঝোপে জঙ্গলে,লতায় পাতায়, এই সমাহিত বনভূমিতে পরম পিতার নীরব অস্তিত্ব রয়েছে। সে কি একটা বিভ্রান্তি? সে কি মিশনারির আশ্চর্য পরিতৃপ্ত এবং প্রশান্ত মনের বিলাস? আচমকা নিজের মনেই একটা ধমক খেল পিয়ার্সন। না না, এ কথা চিন্তা করাও মিশনারির পক্ষে অপরাধ। এ এক ঘৃণিত পাপাঁচরণ। এই পৃথিবী, তার চারপাশে যে সীমাহীন, অন্তহীন সৌরলোক রয়েছে, তার সর্বত্র, সমস্ত প্রাণে, জীবলোকে, সৃষ্টি এবং বিনাশে, বস্তুতে, আকারে নিরাকারে, জাগতিক অস্তিত্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে পরম পিতার কল্যাণস্পর্শ রয়েছে, মঙ্গলদৃষ্টি রয়েছে। ভাবতে ভাবতে সমস্তু মন ভরে গেল পিয়ার্সনের।
নিরবধি কালের এই পৃথিবী রয়েছে। আছে মানবপুত্রের প্রেম। আছে শয়তানের কুৎসিত কারসাজি। প্যারাডাইসের স্বপ্ন। আছে ইনফার্নোর অন্ধকার। সব কিছুর ওপর এই বিক্ষুব্ধ, অশান্ত পৃথিবীর উর্ধ্বে লাইট-হাউসের মতো রয়েছে বেথেলহেমের উজ্জ্বল তারাটি। সমস্ত দুর্যোগের মধ্যে সেই অনির্বাণ দিশারি পৃথিবীকে পথ দেখাচ্ছে। রিপু, লালসা এবং আসক্তির ডাঙস খেয়ে খেয়ে যে পৃথিবী অস্থির, বিভ্রান্ত এবং ক্রমাগত তাড়িত হয়ে চলেছে, যীশু তাকে শান্ত, নিরুত্তেজ এবং স্নিগ্ধ করে চলেছেন।
আজ প্রথম এই ধরনের অদ্ভুত এক ভাবনায় মগ্ন হয়ে গিয়েছিল পিয়ার্সন। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। আচমকা তার দৃষ্টি পড়ল সামনের দিকে। তাজ্জবের ব্যাপার। তার ভাবনার সুযোগ নিয়ে কখন যেন টিলার ওপর থেকে স্টুয়ার্ট পালিয়ে গিয়েছে। শুধুমাত্র কয়েক ফোঁটা রক্ত পাথুরে মাটিতে জমাট বেঁধে রয়েছে।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল পিয়ার্সন। বাঁ দিকে মাও-গামী পথটা আঁকাবাঁকা ময়াল সাপের মতো পড়ে আছে। হঠাৎ দৃষ্টিটা চমকে উঠল তার। একটা সাদা বিন্দু অনেক দূরের বাঁকে সাঁ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। নির্ঘাত স্টুয়ার্ট।
সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পিয়ার্সন চাপা গলায় গর্জে উঠল, সন অব আ বীচ! আচ্ছা, কোহিমায় ফিরে বোঝাপড়া হবে। বলতে বলতে উতরাই-এর দিকে নামতে লাগল, তোকেও ছাড়ব না, ওই ম্যাকেঞ্জিকেও না।
.
৪১.
গোটা দুই ছোট ছোট টিলা, একটা আতামারী জঙ্গল এবং তিনটে ঝরনা পেরিয়ে লাংফু গ্রামের সীমানায় এসে পড়ল পিয়ার্সন। সুন্দর ছবির মতো এক পাহাড়ী জনপদ। পাথরের খাঁজে খাঁজে ঘরবাড়ি।
এই সাঙসু ঋতু। ফুল এবং পাখির মরশুম। রাশি রাশি ফুল। আরেলা, সোনু, গুনু, টুঘুটুঘোটাঙ। অগুনতি পাখি। গুটুসঙ, আউ, খুকুঙগুঙ। ফুল আর পাখির রঙে রঙে ছোট্ট গ্রাম লাংফুকে বড় সুন্দর দেখাচ্ছে।
খেজাঙের কাঁটাঝোঁপটা পেছনে রেখে লাংফু গ্রামের মোরাঙের পাশে এসে পড়ল পিয়ার্সন। সামনের চত্বরে অনেকগুলো ছোট ছেলে বর্শা ছুঁড়ে ছুঁড়ে নিশানা ঠিক করছিল। বড় হয়ে এরাই ওস্তাদ শিকারি হবে। পিয়ার্সনকে দেখতে পেয়ে তারা চেঁচামেচি শুরু করল। তাদের। বয়স আট থেকে দশের মধ্যে। ন্যাংটো, হলদেটে গায়ের রং। বর্শা ফেলে সবাই ছুটে এসে পিয়ার্সনকে ঘিরে ধরল, পাগলা সায়েব এসেছে, পাগলা সায়েব এসেছে–
এই সব গ্রামের লোকেরা পিয়ার্সনকে পাগলা সায়েব বলে।
কয়েকটা ছেলে পিয়ার্সনের দীর্ঘ দেহটা বেয়ে বেয়ে কাঁধে, ঘাড়ে আর কোমরে উঠতে লাগল। দু’পাটি সাদা দাঁত বার করে নির্বিকার ভঙ্গিতে হাসতে লাগল পিয়ার্সন।
ইতিমধ্যে নানা গলায় বায়না শুরু হয়েছে, ও পাগলা সায়েব, চল আমরা টেফঙ (পাহাড়ী বানর) ধরতে যাব। শিগগির চল–
না না, বাঘ শিকার করতে যাব হুই ঝরনার ধারে।
না না, শিকার না, আখুশি ফল আনতে যাব হুই ফচিয়াগা বস্তিতে।
না না, শিকারেও যাব না, হই ফচিয়াগা বস্তিতেও যাব না। গল্প বল পাগলা সায়েব–
জনকয়েক পিয়ার্সনের লালচে চুলের গোছা বাগিয়ে ধরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে। কেউ ধারাল নখ বসিয়ে দিয়েছে সাদা ধবধবে হাতে। কোনোদিকে নজর নেই। এতটুকু বিরক্তি পর্যন্ত নেই। শুধু নিঃশব্দ, মিটিমিটি হাসিতে মুখখানা ভরিয়ে রেখেছে স্পোর্টসম্যান পিয়ার্সন। অজস্র শিশুকণ্ঠের কলকলানিতে সাঙসু ঋতুর সকালটা মেতে উঠেছে।
মাসতিনেক ধরে এই সব গ্রামে আসছে পিয়ার্সন। প্রথম প্রথম এদের ভাষা পরিষ্কার বুঝত না সে। পাহাড়ী মানুষের দেশে সাড়ে ছ ফিট ধবধবে পিয়ার্সন এক সীমাহীন বিস্ময়। প্রথম দিকে গ্রামের লোকজনের সংকোচ ছিল। দুচোখের কোঁচকানো দৃষ্টিতে ছিল সন্দেহ আর সংশয়। হুন্টসিঙ পাখির মতো সাদা এই মানুষটা তাদের অভ্যস্ত পাহাড়ী জীবনে কিসের খোঁজে এসেছে? দূরত্ব বজায় রেখে তারা তাকিয়ে থাকত পিয়ার্সনের দিকে।
লাংফু গ্রামের সর্দারই তাকে প্রথম নিয়ে এসেছিল। বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির কাছে ঘন ঘন যাতায়াত আছে সর্দারের। তাকে তিন চোঙা রোহি মধু কবুল করে এই ছোট্ট গ্রামে আসার অধিকার পেয়েছিল পিয়ার্সন।
প্রথম প্রথম পাহাড়ী মানুষগুলো দৃষ্টিতে যে সন্দেহ এবং সংশয় বল্লমের ফলার মতো চোখা হয়ে থাকত, একদিন তার বদলে প্রসন্ন অভ্যর্থনা ফুটে বেরুল। এই পাহাড়ী জীবন হাসি, খুশি, সহজ ভালবাসা, এবং সরলতা দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আজকাল এদের ভাষা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। নিজের ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে এখানকার ভাষা বলতে পারে পিয়ার্সন।
ছোট ছোট ছেলেগুলো এবার অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, ও পাগলা সায়েব, দাঁড়িয়ে রইলি যে? আমাদের কথা মোটেই শুনছিস না তুই।
শুনছি তো।
একটা খুব ছোট ছেলে পিয়ার্সনের লালচে চুলের গোছা ধরে বাদুড়ের মতো ঝুলছিল। তীক্ষ্ণ গলায় সে চেঁচিয়ে উঠল, হুই দ্যাখ সায়েব, সদ্দারেরা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। হুই দ্যাখ, হুই–যাবি?
নিচের উপত্যকার দিকে তাকাল পিয়ার্সন।
উপত্যকাটা টিলায় টিলায় দোল খেয়ে বহুদূরে চলে গিয়েছে। সেখানে নিবিড় বন। অজস্র বুনো গাছ এবং লতার বাঁধনে অরণ্য জটিল হয়ে রয়েছে। বনটাকে একটা বাঁকা খারে বর্শার মতো ঘিরে রেখেছে দোইয়াঙ নদী। অনেক উঁচু থেকে নদীর পারের লাংফু গ্রামের মানুষগুলোকে খুব ছোট ছোট দেখাচ্ছে। তাদের থাবায় বর্শার ফলায় ফলায় আর তীরের মাথায় মাথায় সাঙসু ঋতুর রোদ ঝলকে যাচ্ছে।
সকলের সামনে রয়েছে গ্রামের সর্দার। তার মুঠোয় একটা বিরাট বল্লম।
জিজ্ঞাসু চোখে ছোট ছোট ছেলেগুলোর দিকে তাকাল পিয়ার্সন। বলল, তোদের গ্রামের লোকেরা জঙ্গলে শিকার করতে যাচ্ছে নাকি রে?
না না–ছেলেগুলো একসঙ্গে হল্লা শুরু করল।
তবে কী করতে যাচ্ছে? জুমের আবাদের জন্যে জঙ্গল পোড়াতে?
না রে পাগলা সায়েব, তা-ও নয়। চিনাসঙবাকে খুঁড়তে যাচ্ছে ওরা। সদ্দার চিনাসঙবার মুণ্ডু এনে মোরাঙে ঝোলাবে। ওর রক্ত দিয়ে মোরাঙ চিত্তির করবে। ছোট ছোট ছেলেগুলোর গলা থেকে উল্লসিত শোরগোল আকাশের দিকে উঠে গেল।
শুনতে শুনতে খাড়া মেরুদাঁড়াটার মধ্য দিয়ে যেন হিম নামতে শুরু করল পিয়ার্সনের; রক্তের কণাগুলোর মধ্য দিয়ে এক ঝলক বিদ্যুৎ বয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় পিয়ার্সন বলল, চিনাসঙবা কে রে?
চিনাসঙবা হল ইটিভেনের মেয়ে।
তাকে খুঁড়বে কেন?
অসংখ্য শিশুকণ্ঠে এবার দোইয়াঙ নদীর জলোচ্ছাসের মতো শব্দ হল, তুই কি রে পাগলা সায়েব! তোর একটুও মগজ নেই। আমাদের বস্তির, লাঞ্চ বস্তির, হুই ফচিয়াগা বস্তির সবাই জানে আর তুই জানিস না! কাল মাঝরাত্তিরে চিনাসঙবা যে মোরাঙে এসে ঢুকেছিল। মাগীদের তো মোরাঙে ঢুকতে নেই। সদ্দার খেপে গেছে। ভয়ে চিনাসঙবা জঙ্গলে পালিয়েছে। তাকে ফুড়বার জন্যেই তো সকালবেলা জোয়ান ছেলেদের নিয়ে সদ্দার জঙ্গলে যাচ্ছে। মাগীটার রেহাই নেই। ওর ঘাড় থেকে আজ নিঘাত মুণ্ডু নেমে যাবে।
বিমূঢ়ের মতো পিসায়ন বলল, মোরাঙে কেন ঢুকেছিল চিনাসঙবা, কি রে?
ছেলেগুলো এবার চুপ করে গেল। এই জটিল জিজ্ঞাসার কোনো সরল উত্তর তাদের জানা নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল তারা। ফিসফিস করে একজন বলল, তা তো জানি না রে পাগলা সায়েব।
যে ছেলেটা পিয়ার্সনের লালচে চুলের গোছা ধরে ঝুলছিল, এবার সে একটা বুনো আপেলের মতো টুপ করে নিচে খসে পড়ল। তার মাথায় কয়েক গাছা মরা মরা ফ্যাকাসে চুল, লিকলিকে ঘাড়ের ওপর বড় মাথা, অতিকায় দুটো কান। অস্বাভাবিক ছোট দুটো কুতকুতে চোখ, বিরাট পেট, হাত-পা সরু সরু, মাংসহীন নীরক্ত দেহ। পাটকিলে রঙের মোটা ঠোঁটের মিটিমিটি হাসির সঙ্গে ছোট ছোট চোখে মজাদার ভঙ্গি ফুটিয়ে ছেলেটা বলল, ইজা হুবুতা! শয়তানের বাচ্চারা, তা-ও জানিস না! হুই চিনাসঙবার গায়ে যে পিরিতের জ্বালা ধরেছে। সদ্দারের ছোট ছেলে হল ওর গোয় লেন (প্রেমিক)। রাত্তিরে মরদের গন্ধ না পেলে মাগীর ঘুম আসে না। সেই ছোঁড়াটার খোঁজেই তো চিনাসঙবা কাল রাত্তিরে মোরাঙে ঢুকেছিল।
ছোট ছেলেটাকে বড় বিজ্ঞ বিজ্ঞ দেখাচ্ছে। দুচোখে কৌতুক মিশিয়ে তাকে লক্ষ করছিল পিয়ার্সন। যতটা ছোট সে তাকে মনে করেছিল, আসলে ততটা ছোট সে নয়। তেরো চোদ্দ বছর বয়স হবে। এই পাহাড়ের অফুরন্ত রোদবাতাস-আলো থেকে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য জোগাড় করে নিতে পারেনি সে। দেহের মধ্যে নানা রোগ শিকড় গেড়ে বসেছে। সেই সব রোগ তার পুষ্টি, তার স্বাস্থ্য এবং বাড়কে চিরকালের জন্য ঠেকিয়ে রেখেছে। দেহটা বাড়তে পারেনি। দুর্বল, অশক্ত শরীর নিয়ে আর পাঁচটা শিশুর মতো সে দৌড়ঝাঁপ করতে, কি শিকারে যেতে পারে না। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্রিয়া নেই, সঞ্চালনও নেই। একপাশে বসে বসে সে কেবল দেখে আর ভাবে। ক্রমাগত ভাবতে ভাবতে মনটা অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে ক্রিয়া করে। সুস্থ মানুষের ভেতর সহজ বৃত্তিগুলির অনুশীলন যেমন হয়, এই সব অসুস্থ জীর্ণ দেহের মানুষের মধ্যে তেমন হয় না।
পাহাড়ী গ্রামে যেমন নানা শাসনবিধি, আচার-বিচার, ন্যায়-অন্যায়ের কড়াকড়ি রয়েছে, ঠিক তেমনি খোলামেলা আকাশের নিচে দিনের আলোতে হঠাৎই হয়তো জীবনের আদিম প্রবৃত্তির নগ্ন প্রকাশ দেখা যায়। সেসবই চোখে পড়ে ছেলেটির। তার মন পঙ্গু, হাড় জিরজিরে দেহের শিরা-উপশিরার আলো-আঁধারি গলিখুঁজিতে অসহ্য তাড়নায় ছুটতে থাকে। একটু একটু করে মনটা পাকে। বয়সের তুলনায় জৈব প্রবৃত্তিগুলি সম্বন্ধে অনেক বেশি ধারণা হয়। মনের মধ্যে তোলপাড় চলে। রোগা অশক্ত দেহের, অকালপক্ক ছেলেটির দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত কৌতুক বোধ করছে পিয়ার্সন।
আচমকা পিয়ার্সন চমকে উঠল। নিচের উপত্যকা থেকে ভয়ঙ্কর হইচই উঠে আসছে। দোইয়াঙ নদীর দু’পাশের বনভূমিতে অসংখ্য বর্শা ঝলকাচ্ছে। সমগ্র সত্তা ভীষণভাবে নাড়া . খেয়ে উঠল পিয়ার্সনের।
হো-ও-ও-ও-য়া-য়া—
হো-ও-ও-ও-য়া—য়া–
ছেলেদের জটলাটা ভেঙেচুরে উপত্যকার দিকে ছুটে চলল পিয়ার্সন। পায়ের তলা দিয়ে ছিটকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে লাগল ছোট ছোট কাটা গাছ, টিলা, কর্কশ পাথুরে পথ। মাথার ওপর সরে সরে যাচ্ছে অজস্র বুনো গাছের ডালপালা, ফুল আর হালকা মেঘের আকাশ। এই মুহূর্তে, এখনই, দোইয়াঙ নদীর পাড়ে ওই ঘন জঙ্গলটার পাশে তাকে পৌঁছুতে হবে। আরো, আরো জোরে পা চালিয়ে দিল স্পোটসম্যান পিয়ার্সন। আর পেছন থেকে ছোট ছোট ছেলেদের কলকলানি ধাওয়া করে আসতে লাগল, ও পাগলা সায়েব, শিকারে যাবি না? ও পাগলা সায়েব, গল্প বলবি না? তুই কোথায় পালাচ্ছিস? দাঁড়া দাঁড়া—
.
হো-ও-ও-ও-য়া-য়া—
হো-ও-ও-ও-য়া—য়া–
একটা খেজাঙের কাঁটাঝোঁপ ঘিরে চিৎকার উঠছে।
লাংফু গ্রামের সর্দার কানের নীয়েঙ দুলে নাড়া দিয়ে, হাতের বাঁকা বল্লম ঝাঁকিয়ে হুঙ্কার ছাড়ল, হু-হু, মাগীটা এই ঝোঁপের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। তোরা সবাই বর্শা হাঁকড়া। মাগীটার একটা পা আমি দেখতে পেয়েছি। হুই যে, হুই যে–
জনতিনেক জোয়ান ছেলে ঝোঁপের পাশ থেকে সর্দারের কাছে ছুটে এল, কই রে সদ্দার?
সমস্ত মুখে চামড়া কুঁকড়ে অসংখ্য আঁকিবুকি ফুটে রয়েছে। কপিশ চোখজোড়া জ্বলছে। লাংফু গ্রামের সর্দার হুমকে উঠল, আহে ভু টেলো! একেবারে কানা হয়ে গেছিস দেখি। বর্শা হাঁকড়ে আগে তোর চোখ উপড়ে নেওয়া দরকার। হুই দেখছিস না?
খেজাঙের কাঁটা ঝোঁপটার একেবারে মাঝখানে একটি উলঙ্গ নারীদেহ হাঁটু মুড়ে গুটিসুটি বসে আছে। চারপাশে কাটার ঝাড়। কিভাবে ঝোঁপের মধ্যে ঢুকেছে, সে-ই জানে। অসহায় করুণ চোখে সর্দারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটি।
হো-ও-ও-ও-য়া-য়া—
হো-ও-ও-ও-য়া—য়া–
জোয়ান ছেলেরা সমানে চেঁচাতে লাগল। একজন মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে ঝোঁপের মধ্যে বর্শা ঢুকিয়ে খোঁচাতে চেষ্টা করছে।
হুই, হুই তো বসে রয়েছে মাগীটা। হুই তো চিনাসঙবা।
লাংফু গ্রামের সর্দার পাখির পালকের মুকুটে ঝকানি দিয়ে চিৎকার করে উঠল, আর দেরি করছিস কেন? এবার বর্শা হাঁকড়াতে শুরু কর। মাগীটাকে ছুঁড়ে আবার বস্তিতে ফিরতে হবে না? দুপুর হয়ে এল। খিদে পাচ্ছে। নে, তাড়াতাড়ি কর।
খেজাঙের কাঁটাঝোপে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ উঠল। চিনাসাঙবা বলল, আমাকে মারিসনা সদ্দার। বর্শা হাঁকড়ালে একেবারে সাবাড় হয়ে যাব। একটু থেমে ওপাশের বেঁটেখাটো জোয়ানটাকে লক্ষ করে বলল, এই উলুবাঙ, আমাকে মারিস না। তুই না আমার পিরিতের জোয়ান। তোর খোঁজেই তো কাল রাত্তিরে মোরাঙে ঢুকেছিলাম।
উলুবাঙ দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠল, পিরিতের মরদ! কাল কি তোকে আমি মোরাঙে ঢুকতে বলেছিলাম? এখন তোকে কে বাঁচাবে? বলতে বলতেই খেজাঙ ঝোঁপের ওপর বর্শা ছুড়ল।
চিনাসঙবা কি জানত, উলুবাঙ নামে এক সুন্দর পিরিত, এক উদ্দাম পাহাড়ী যৌবন এত নির্মম, এত নিষ্ঠুর? সে কি জানত, পাহাড়ী সমাজের রীতিতে মমতা নেই, করুণা নেই, সামান্য বিচ্যুতি ঘটলেও প্রেমিক পুরুষটিও ক্ষমা করবে না।
খেজাঙের কাটাঝোপে এতটুকু কঁক নেই। পাতায়, কাঁটায় এবং সরু সরু ডালে সেটা নিবিড় এবং জটিল হয়ে রয়েছে। উলুবাঙের বর্শা কাটাঝোঁপ ভেদ করে চিনাসঙবার সুন্দর কোমল দেহটাকে খুঁড়তে পারেনি।
উলুবাঙের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জোয়ানেরা বর্শা ছুঁড়তে লাগল, কিন্তু খেজাঙের কাটাঝোঁপ বড় ঘন। তার মধ্য দিয়ে বর্শা ঢোকে না। একটা আঁচড় পর্যন্ত লাগল না চিনাসঙবার গায়ে। নিস্পলক, অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে, হাঁটু দুটো বুকের মধ্যে গুঁজে দলা পাকিয়ে রয়েছে। চিনাসঙবা। এখন আর কথা বলছে না, নড়ছে না, কাঁপছে না। একেবারেই বোবা হয়ে গিয়েছে
লাংফু গ্রামের সর্দার সাঙ্ঘাতিক খেপে উঠল। একটা বর্শাও লক্ষ্যে গিঁথছেনা। সব নিশানাই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসছে। কদর্য মুখভঙ্গি করে সে হুঙ্কার ছাড়ল, পাহাড়ী জোয়ান হয়েছে শয়তানের বাচ্চারা! ঝোঁপের মধ্যে মাগীটা বসে রয়েছে, তাকে যদি একজনও খুঁড়তে পারে! ইজা টিবুঙ! তোদের কিছু করতে হবে না। যা, ভাগ। আমিই হুই চিনাসঙবাকে সাবাড় করব।
দুটো ঘোলাটে চোখ চারিদিকে ঘুরপাক খাইয়ে লাংফু গ্রামের সর্দার আবার গর্জে উঠল, এই চিনাসঙবা, এই মাগী, ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে আয়। নইলে ঝোপে আগুন ধরিয়ে দেব। হু-হু–
এতক্ষণে চিনাসঙবা নড়ে উঠল। বুকের মধ্যে গোঁজা হাঁটু দুটো ছিটকে গেল তার। চারপাশের বনভূমি চমকে দিয়ে আর্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, আ-উ-উ-উ-উ, না না, আগুন দিস না সদ্দার। পুড়িয়ে পুড়িয়ে না মেরে বর্শা দিয়েই খতম করে দে।
হ্বিক-হ্বিক-হ্বিক–বিকট গলায় টেনে টেনে হেসে উঠল লাংফু গ্রামের সর্দার। বলল, হু-হু, এর নাম হল ওষুধ। বেরিয়ে আয়, বেরিয়ে আয় শিগগির। বর্শা হাঁকড়াবার জন্যে হাতটা বড় নিশপিশ করছে। বলতে বলতেই দৃষ্টিটাকে জোয়ান ছেলেদের দিকে ঘুরিয়ে দিল, শোন রে টেফঙের বাচ্চারা, তোরা কেউ চিনাসঙবার গায়ে হাত দিবি না। আমি বর্শা দিয়ে গেঁথে, বল্লম দিয়ে ফুঁড়ে, সুচেন্যু দিয়ে কুপিয়ে একটু একটু করে মারব। হ্রিক-হি-হিক। ফের সেই হাসি শুরু হল।
খেজাঙের কাটাঝোঁপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল চিনাসঙবা। তার সমস্ত দেহ থরথর কাঁপছে।
হ্বিক- হ্বিক-হ্বিক–বীভৎস হাসির রেশটা তখনও থামেনি। লাংফু গ্রামের সর্দার পরিতৃপ্ত, ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, তোকে তারিয়ে তারিয়ে মারব রে মাগী। যা, হই আতামারী গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়া।
সর্দারের নির্দশমতো আতামারী গাছের গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়াল চিনাসঙবা। দৃষ্টিটা বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছে। কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না, শুনতে পাচ্ছে না। তামাটে মুখখানা
পাঁশুটে দেখাচ্ছে, নগ্ন সুঠাম দেহটা টলছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না চিনাসঙবা। একটা কথাই সে এখন ভাবতে পারছে, কখন সর্দারের থাবা থেকে বিরাট খারে বর্শার ফলাটা ছুটে এসে তার পাজর কুঁড়ে দেবে।
একটু দূর থেকে বর্শা দিয়ে তাক করতে করতে ভয়ানক চোখে তাকাল লাংফু গ্রামের সর্দার। তার চোখের কালো খসখসে পাতা পড়ছে না। ঘোলাটে, ঈষৎ লালের ছোপধরা তারা দুটোতে ভয়ঙ্কর হিংস্রতা।
আকাশের দিকে বর্শাটা তুলে সর্দার যেই ছুঁড়তে যাবে, তার আগেই বিরাট একটা আলারি পাখির মতো দুটো বাহু বিস্তার করে মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল পিয়ার্সন।
বর্শা নামিয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে হুমকে উঠল লাংফু গ্রামের সর্দার, আছে ভু টেলো! এর মধ্যে তুই আবার কেন এসেছিস পাগলা সায়েব? ভেগে পড় এখান থেকে। মাগীটাকে খুঁড়তে দে।
না। গলায় স্বর অনেক উঁচুতে তুলে চেঁচিয়ে উঠল পিয়ার্সন। সেই চিৎকার দু’পালের পাহাড়ে আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে বাতাসে মিশে গেলে। চারিদিকের বনস্থলীতে তার রিশ অনেকক্ষণ ছড়িয়ে রইল।
লাংফু গ্রামের লোকেরা প্রথমটা চমকে উঠে, তারপর স্তব্ধ হয়ে গেল। পিয়ার্সন যে এমন হুঙ্কার দিতে পারে, তাদের ধারণা ছিল না।
এবার শান্ত, ধীর গলায় পিয়ার্সন বলল, না, আমার সামনে মেয়েলোককে খুন করতে দেব
লাংফু গ্রামের সর্দার ক্রুর চোখে তাকাল। বলল, এখনও সরে যা বলছি পাগলা সায়েব। নইলে জানে মেরে ফেলব। তুই আমাদের বস্তিতে রোজ আসিস, তোকে আমরা খাতির করি। তাই বর্শা হাঁকড়াই না। এবার ভেগে যা। মাগীটাকে সাবাড় করতে দে।
স্থির দৃষ্টিতে একবার সর্দারের দিকে তাকাল পিয়ার্সন। মিশনারি পিয়ার্সন নয়, স্পোর্টসম্যান পিয়ার্সন। সর্দারের ঘোলাটে চোখে হত্যা ঝিলিক দিচ্ছে। ভীষণ, ভয়ঙ্কর এবং বীভৎস হত্যা। শিউরে উঠল পিয়ার্সন। নাগা পাহাড়ের এই বনস্থলীতে, এই উপত্যকায়, এই উজ্জ্বল রোদে ভরা দিনটাতে তার স্পোর্টসম্যান জীবনের এবং মিশনারি জীবনের এমন একটা মারাত্মক অরডিল, এমন একটা সাংঘাতিক পরীক্ষা অপেক্ষা করছিল, তা কি সে জানত?
এবার খানিকটা দূরে আতামারি গাছের গায়ে একটা নগ্ন নারীদেহের দিকে তাকাল পিয়ার্সন–চিনাসঙবা। এতক্ষণ চিনাসঙবা ভয়ে কাঁপছিল। টলছিল। এখন একেবারেই নিথর হয়ে গিয়েছে। তার স্নায়ুশিরা, অস্ফুট বন্য মনের বোধ বুদ্ধি-অনুভূতি, হাড়-মেদ-মজ্জা, নিষ্ঠুর অপঘাতের প্রতীক্ষায় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। চোখের ঈষৎপিঙ্গল তারা দুটো স্থির হয়ে রয়েছে।
এধারে লাংফু গ্রামের সর্দার নামে এক আদিম হত্যা, ওধারে চিনাসঙবা নামে এক অসহায় প্রাণ। আলারি পাখির মতো বিশাল দুই বাহু বিস্তার করে এই ঝকঝকে উজ্জ্বল দিনে নাগা পাহাড়ের একটি হত্যা এবং একটি নিরুপায় জীবনকে দেখতে দেখতে স্থির সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছুল পিয়ার্সন। জীবন আর মৃত্যু। এই পাহাড়ী পৃথিবীতে তারা কত সহজ, কত স্বচ্ছন্দ, কত অন্তরঙ্গ, কত পাশাপাশি!
পিয়ার্সনের সমস্ত চেতনা জুড়ে একটা অমোঘ কর্তব্যের বোধ ক্রমাগত তাড়না করছে। চিনাসঙবাকে বাঁচাতেই হবে, যেমন করে হোক।
লাংফু গ্রামের সর্দার ফের হমকে উঠল, সরে যা পাগলা সায়েব।
না। নির্মম চোখে তাকাল পিয়ার্সন। তার গলায় বাজ চমকালো যেন, ওকে কেন মারবি? ও কী করেছে?
ইজা হুবুতা! দাঁতে দাঁত ঘষে লাংফু গ্রামের সর্দার বলল, সে আমাদের বক্তির ব্যাপার। হুই মাগী মোরাঙে ঢুকে মোরাঙের ইজ্জত মেরেছে। মাগীর আবার মরদ না পেলে রাত্তিরে ঘুম আসে না। মরদের খোঁজে মোরাঙে ঢুকেছিল। আমরা জেগে উঠে তাড়া দিতে এই জঙ্গলে পালিয়ে এসেছে। চারপাশের জোয়ানদের দিকে দৃষ্টিটা ঘুরিয়ে সর্দার বলল, তাই না রে শয়তানের বাচ্চারা?
হু-হু–মাথা নেড়ে সমস্বরে সকলে সায় দিল, হুই উলুবাঙের খোঁজে মোরাঙে ঢুকেছিল। উলুবাঙ হল চিনাসঙবার পিরিতের জোয়ান।
একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সকলের ভাবগতিক লক্ষ করছিল উবাঙ। এবার প্রবল বেগে চওড়া ঘাড়, সেই সঙ্গে কোমর থেকে শরীরের উঁচু অংশটা নাড়তে নাড়তে বলল, হু-হু, ঠিক কথা। চিনাসঙবা আমার পিরিতের মাগী। তাই বলে রাত্তিরে ও মোরাঙে ঢুকবে! ও জানে না, মাগীদের মোরাঙে ঢুকতে নেই? ঢুকলে খুনখারাপি হয়ে যায়? বস্তির সব মানুষকে সারাদিন না খেয়ে গেন্না পালতে হয়? আনিজার নামে হলদে কুকুর বলি দিতে হয়? শয়তানীকে সাবাড়ই করে ফেলব। বলতে বলতে উলুবাঙ খুঁসে উঠল। বর্শা উঁচিয়ে লালচে, ক্রুদ্ধ চোখে চিনাসঙবার নিস্পন্দ দেহটার দিকে তাকাল।
বিহ্বল চিনাসঙবা তাকিয়েই রয়েছে। কিছুই যেন শুনতে, দেখতে বা বুঝতে পারছে না। যন্ত্রণা উত্তেজনা রোষ হিংসা-পাহাড়ী মনের তীক্ষ্ণ এবং স্পষ্ট ধর্মগুলো পর্যন্ত সে যেন হারিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুত ধরনের এক মৃত্যুভয় তার শিরা-স্নায়ু-শোণিতের দেহটাকে বিকল, অথর্ব করে দিয়েছে। আতামারী গাছের গায়ে হেলান দিয়ে নিঝুম দাঁড়িয়ে আছে সে।
সব শুনলি তো? এবার মাগীটাকে খুঁড়তে দে। অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বলল লাংফু গ্রামের সর্দার।
না, ওকে আমি মারতে দেব না।
না মারলে মাগীটা থাকবে কোথায়? জঙ্গলে থাকলে বাঘ কি ময়ালের পেটে যাবে। হয়তো বুনো মোষের গুঁতোয় সাবাড় হবে। নইলে ডাইনি হবে। গুণতুক শিখে আমাদের খতম করবে। একটু থেমে, দম নিয়ে সর্দার আবার বলল, ও পাপ রেখে কাজ নেই। তুই যা পাগলা সায়েব, আমরা ওকে খুঁড়ি। বস্তিতে তো ওকে ঢুকতে দেব না, এই পাহাড়েও থাকতে দেব না। যা, যা সায়েব।
বস্তিতে ঢুকতে দিবি না কেন?
বস্তিতে ঢোকালে আমাদের ওপর আনিজার খারাপ নজর এসে পড়বে। সিঁড়িখেতে ফসল ফলবে না। গাছে ফল ধরবে না। কুকুর শুয়োরেরা বিয়োবে না। নতুন বিয়ের ছুঁড়িগুলো বাঁজা হয়ে যাবে। এবার বুঝতে পারছিস, মাগীটাকে কেন খুন করব?
যদি ও বাঁচতে চায়? যদি চিনাসঙবা অন্য পাহাড়ে পালিয়ে যায়?
সর্দার গর্জে উঠল, পালালেই হল!ইজা ঘুতা। আমরা পাহাড়ী মানুষ না? আমাদের হাতে বর্শা নেই? বলতে বলতে চোখজোড়া জ্বলতে লাগল সর্দারের।
একটু চমকে উঠল পিয়ার্সন। চমকের ভাবটা কাটলে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, মারবিই তবে মেয়েটাকে?
হু-হু, মাগীটাকে মারবার আগে তোকে সাবাড় করব। মোরাঙে ঢুকে হুই শয়তানী মোরাঙের ইজ্জত মেরেছে। তুই এসেছিস তাকে বাঁচাতে! তুই একটা আস্ত আনিজা। বলতে বলতে সর্দার বর্শাটা ছুঁড়ে মারল।
দীর্ঘ, টান টান একটা দেহ। শিরায় শিরায় চলমান রক্তের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। ছিপছিপে বেতের মতো দেহটা একপাশে নুয়ে পড়েই খাড়া হয়ে গেল। এর মধ্যে বর্শাটা সাঁ করে পাশের একটা খাসেম গাছে গেঁথে গিয়েছে। নিমেষের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল।
তারপর একান্ত আচমকা, সারপ্লিসটা খুলে ফেলল পিয়ার্সন। বেরিয়ে এল সাড় ছ ফিট ঋজু এক স্পোর্টসম্যান। একবার সর্দারের দিকে সে তাকাল। লোকটার ঘোলাটে, ঈষৎ লালচে চোখে মৃত্যু ঝিলিক দিচ্ছে। সেই ভয়ানক চোখজোড়া নিষ্পলক পিয়ার্সন নামে এক দুর্দান্ত প্রতিপক্ষের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
প্রথমটা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সর্দার। তার বর্শার লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দিয়েছে ওই সাদা মানুষটা, ওই পাগলা সাহেব। তার অসংখ্য বছরের জীবনে এমনটি আর কোনোদিনই ঘটেনি। তার বর্শার তাক এমন করে আর কখনও ব্যর্থ হয়নি। সর্দারের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ী জোয়ানগুলোও অবাক এবং স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
কেউ কিছু করা বা বলার আগেই আমারী গাছটার দিকে ছুটল পিয়ার্সন। চিনাসঙবার একটা হাত ধরে টানতে টানতে সামনের নিঝুম ঝরনাটা পেরিয়ে গেল। প্রথমটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ছুটছিল চিনাসঙবা। বলা যায়, পিয়ার্সনই তাকে ছোটাচ্ছিল। একটু একটু করে ঘোরটা কেটে গেল। প্রাণ বাঁচাবার আদিম, জৈবিক তাড়নায় পিয়ার্সনের পাশাপাশি নিজেই সে এবার দৌডুতে লাগল। জোরে, আরো জোরে। তীব্র, প্রবল গতিতে।
একটা সাদা এবং একটা উজ্জ্বল বাদামি দেহ সাঁ সাঁ করে দূরের চড়াইটার দিকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
পেছনে থেকে সর্দার চিৎকার করে উঠল, শয়তানের বাচ্চারা ভাগল। ধর—ধর–ফুঁড়ে ফেল।
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের জোয়ানদের গলা থেকে একটা আকাশ ফাটানো গর্জন বেরিয়ে এল, হো-ও-ও-ও-য়া-য়া–
.
৪২.
কোহিমা পাহাড়ে বাতাস মেতে উঠেছে। সমতলের দেশ পাড়ি দিয়ে কত দূর থেকে বাতাস এসেছে, কে জানে। পাক খেতে খেতে চারপাশের বনভূমি মাতিয়ে ঝাঁকিয়ে নাচিয়ে, ফল-পাতা ঝরিয়ে, এলোপাথাড়ি ডালপালা ভেঙেচুরে, টিলায় টিলায় আছাড়ি পিছাড়ি খেয়ে সোঁ সোঁ ছুটছে। কোহিমার বাতাস-জখমী জানোয়ারের মতো সেটা কেবল ফেঁসে আর গর্জায়।
আকাশে আশ্চর্য সুন্দর চাঁদ উঠেছে। সু লু (শুক্ল পক্ষের চাঁদ। ধবধবে জ্যোৎস্না ফেনার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এই শহর কোহিমা, চারপাশে টিলায় টিলায়, চূড়ায় চূড়ায় দোল-খাওয়া নাগা পাহাড় আলো আঁধারির বুননে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।
চার্চের সামনে নিরপেক্ষভাবে ছাঁটা ছোট ঘাসের জমি। সবুজ মখমলের মতো নরম এবং সুখস্পর্শ। একটু দূরে কাঠের সাদা ক্রস। মানবপুত্র নিজের রক্ত দিয়ে এই রিপুতাড়িত, ভোগাসক্ত এবং সংস্কারাচ্ছন্ন জগৎকে শুদ্ধ করেছিলেন, পবিত্র করেছিলেন। এই ক্রস আক্ষেপ, মূঢ়তা এবং প্রায়শ্চিত্তের স্মৃতি।
ঘাসের জমিতে খানকয়েক বেতের চেয়ার ইতস্তত ছড়ানো। একটিতে জাঁকিয়ে বসেছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে অলস ভঙ্গিতে জপমালা ঘোরাচ্ছে।
সামনের গেটে কাঁচ করে শব্দ হল।
বিডস জপতে জপতে গভীর, আত্মগত ভাবনায় মগ্ন হয়ে ছিল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি। কপালে মাকড়সার জালের মতো অনেকগুলো সূক্ষ্ম হিজিবিজি রেখা ফুটে রয়েছে। গেটে শব্দ হতেই চমকে তাকাল সে। ভাবনাটা পেঁজা তুলোর মতো মনের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। সামনের দিকে তাকিয়ে চোখের কটা মণিদুটো একটু নেচে উঠেই প্রসন্নতায় ভরে গেল। কপাল থেকে মাকড়সার জালটা মুছে গিয়েছে। সোচ্ছ্বাসে ম্যাকেঞ্জি রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে উঠল, আরে, তুমি দাঁড়িয়ে রইলে কেন? ওই চেয়ারটায় বোসো।
কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে সামনের বেতের চেয়ারে বসল জনসন। ম্যাকেঞ্জি এবার বলল, তারপর মাই চ্যাপ, জুনোবটতে কেমন প্রিচিঙ চলছে? বলতে বলতে সমস্ত মুখে সস্নেহ হাসি ফোঁটাল। এই ধরনের হাসি বহুদিনের সাধনায় আয়ত্ত করেছে ম্যাকেঞ্জি। যে-কোনো সময়, একান্ত অবলীলায় সে এমন ভঙ্গিতে হাসতে পারে। সমস্ত মুখে হাসি আর দুই চোখের মণিতে অতি ধূর্ত, অতি চতুর এবং সূক্ষ্ম একটা ফাঁদ পেতে জনসনের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
প্রিচিঙ খুব সুবিধের হচ্ছে না ফাদার। বিষঃ দেখাল জনসনকে।
কেন? কটা চোখের মণিতে সেই ফাঁদটা এবার একটু একটু করে স্পষ্ট হতে লাগল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির।
কেন আবার, এদিকে যীশু মেরী বলবে, ওদিকে আবার কুকুর শুয়োর মোষ বলি দেবে। নুড়ি-পাখি-সাপবাঘ পুজো করবে। এমন করলে এত কষ্ট করে পিচ করে কী লাভ? হতাশ, মুষড়ে-পড়া গঙ্গিতে জনসন বলল।
আইডেলেটারস, ইনফিডেলস, হিলি বিস্টস–জপমালা ঘোরাতে ঘোরাতে শব্দগুলোকে কড়মড় করে চিবুতে লাগল যেন ম্যাকেঞ্জি, এই প্যাগানগুলোকে ব্যাপটাইজ করা আমরা তো কোনো ছার, যীশুর ফোরফাদারেরও সাধ্য নেই।
পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির উচ্চারণে মহিমা আছে। এমন সংযতভাবে, মুখের একটি রেখাকেও বিকৃত করে, জপমালার ওপর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা নিরুত্তেজ রেখে, এত আস্তে কথাগুলো জিভ থেকে বার করে আনে, মনে হয়, সে বুঝি কোনো সুনীতি-বিষয়ক অরাকল আওড়াচ্ছে।
জনসন বলল, কী বললেন ফাদার?
ও কিছু নয়। ব্যাপার কি জানো জনসন–বেতের চেয়ারটা আরো একটু এগিয়ে এনে সরাসরি জনসনের চোখের দিকে তাকাল ম্যাকেঞ্জি। দৈব আবেশ যেন ভর করল তার গলায়, এত সহজে বিশ্বাস হারালে কিংবা হতাশ হলে তো চলবে না মাই বয়। প্রভুর নির্দেশমতো আমরা, এই মিশনারিরা সমস্ত ওয়ার্ল্ডে ছড়িয়ে পড়েছি। সন্স অব সিনারদের অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যেতে হবে। ডোন্ট বী ডিজেক্টড মাই চ্যাপ। পৃথিবীর দশ দিকে যেশাসের নাম ছড়িয়ে দিতে হবে। ইন দা ডেজার্ট, ইন দা সী, ইন দা ফরেস্ট, ফ্রম ওয়ান পোল টু অ্যানাদার, বুঝলে কিনা জনসন, যেখানে এতটুকু জীবনের চিহ্ন রয়েছে, সেখানেই আমরা, ইয়াস আমরা উড হোল্ড অ্যালফট ফ্ল্যাগ অব ক্রিস্ট্যানিটি। সার্টেনলি, ডু উই মাস্ট–ম্যাকেঞ্জির ভরাট গম্ভীর গলা ধীর স্থির শান্ত। উত্তেজনা নেই, অস্থিরতা নেই তার মুখেচোখে। তীক্ষ্ণ কর্তব্যবোধে জনসনকে সজাগ করে দিতে দিতে ম্যাকেঞ্জি আবার বলল, জানো তো জনসন, অন্ধকারের সঙ্গে যেশাসকে কত সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই অন্ধকার পাশব প্রকৃতির মানুষের কুসংস্কার, তাদের মূঢ়তা হীনতা এবং হিংস্রতার অন্ধকার। শেষ পর্যন্ত জগতের কল্যাণের জন্যে, পাপাচারীর সন্তানদের মতিগতি শুদ্ধ করার জন্যে প্রাণ পর্যন্ত তাকে দিতে হয়েছে। তবু কর্তব্য থেকে তিনি এক-পা সরে যাননি। আমরা তারই সন্তান। তাঁর অভিপ্রেত পথে নেমে আমাদের বিচলিত হলে তো চলবে না, মাই বয়।
ম্যাকেঞ্জি লক্ষ করতে লাগল, তার কথাগুলোতে জনসনের মুখেচোখে কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
লজ্জিত সুরে জনসন বলল, না না ফাদার, আমি তা মীন করিনি। কর্তব্যে কি সংগ্রামে আমি একটুও ভয় পাই না। ক্রিস্ট্যানিটির জন্য আমি প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারি। কিন্তু–
কিন্তু কী?স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ম্যাকেঞ্জি। চোখের ফঁদটা এবার আরো স্পষ্ট হয়েছে, বল বল, থামলে কেন?
আপনি যা বলেছেন তা করতে গিয়ে জুনোবটতে মারা পড়েছিলাম আর কি। পাহাড়ীরা স্পিয়ার নিয়ে তাড়া করেছিল। অল্পের জন্য বেঁচে গেছি। ত্রস্ত গলায় জনসন বলে চলল, আমি তো ভেবেই পাই না ফাদার, প্রিচিঙের সঙ্গে এর সম্বন্ধ কোথায়?
ম্যাকেঞ্জির মুখ থেকে সুন্দর, সস্নেহ হাসিটুকু এবার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। মসৃণ, শুভ্র কপালে একটা অদৃশ্য মাকড়সা আবার আঁকাবাঁকা রেখায় কুটিল জাল বুনতে লাগল। ফিসফিস গলায় বড় পাদ্রী বলল, ইউ টু ডেসপেয়ার অ্যান্ড ড্রপ, মাই চ্যাপ! তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। ইয়াস, তোমার ওপর ভরসা করে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। জুনোবটর ছোট সেন্টারে এখন তুমিই সর্বেসর্বা। তুমি জানো না, কোহিমার এই বড় চার্চে আমার পর তুমিই বড় পাদ্রী হবে। ইউ উইল বী মাই সাকসেসর।
থ্যাঙ্কস, মেনি থ্যাঙ্কস ফাদার। আপনার এই মহত্ত্বের জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব আই উড রিমেন এভার গ্রেটফুল। উদ্দীপনায় দেশলাইর কাঠির মতো ফস করে জ্বলে উঠেই কিন্তু পরক্ষণে নিভে গেল জনসন। কঁপা, ভাঙা গলায় বলল, কিন্তু ফাদার, প্রাণের ভয়ের কথা বাদ দিলেও কনসায়েন্সে বড় বাধছে। মন থেকে কিছুতেই সায় পাচ্ছি না। কনসায়েন্স–
সরু, চিকন শব্দ করে হাসল ম্যাকেঞ্জি। জনসনের পিঠে মৃদু চাপড় মারতে মারতে বলল, কনসায়েন্স খুব ভালো জিনিস জনসন। ভেরি গুড থিঙ। কিন্তু জানো মাই বয়, মাঝে মাঝে ওই বিবেক বোধটাকে ধরেবেঁধে শিকেয় তুলে রাখা দরকার। নইলে ওটা ভীষণ গণ্ডগোল পাকিয়ে দেয়। হে হে, বুঝলে কিনা, কনসায়েন্স, অনেস্টি, মোরাঙলিটি এই সব গোলমেলে শব্দগুলো মাঝে মাঝে ভুলে যেতে হয়। নইলে অসুবিধা হয়, ভয়ানক অসুবিধা হয়।
কিন্তু ফাদার–বলতে বলতে কুণ্ঠিতভাবে জনসন থেমে গেল। তার থতমত দৃষ্টিটা ম্যাকেঞ্জির মুখের ওপর থমকে গেল।
এই কোহিমা শহর, সু-লুর রাত্রি, শুভ্র ফেনার মতো জ্যোৎস্না, আকাশের ছায়াপথ, চারপাশে বন-টিলা-পাহাড়, মাঝখানে এই চার্চ। কেমন এক আবছা রহস্যে সব কিছু ভরে রয়েছে।
ম্যাকেঞ্জি হাসছে। জনসনের মনে হয়, ম্যাকেঞ্জির হাসি বড় দুর্বোধ্য। জটিল অঙ্কের চেয়েও দুরূহ। সেই হাসিটা এখন স্বর্গীয় হয়ে উঠেছে। শান্ত, গম্ভীর গলায় ম্যাকেঞ্জি বলল, বুঝেছি, সব বুঝেছি জনসন। একটা কথা তোমাকে পরিষ্কার করে দিতে চাই। তার আগে বলব, আমার জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। তোমার চেয়ে আমার বয়েসও কম করে পঁচিশ বছর বেশি হবেই। অভিজ্ঞতা বল, বয়েস বল, জীবনদর্শন বল সব দিক থেকেই আমি তোমার সিনিয়র। আই থিঙ্ক, ইউ মাস্ট অ্যাডমিট।
ও–সিয়োরলি ফাদার, সিয়োরলি–জনসন মাথা নাড়ল।
মাকড়সা যেমন জাল বুনে বুনে মাছি, ভোমরা কি অন্য পতঙ্গ শিকারের আশায় তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনই ভঙ্গিতে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি তাকাল জনসনের দিকে। বলল, ভেরি গুড মাই বয়। এবার আসল কথায় আসা যাক। সাত বছর ধরে এই নাগা পাহাড়ে আমি প্ৰিচ করছি। এখানে এসে একটা বড় সত্য খুঁজে পেয়েছি। ইয়াস, আ কলোসাল টুথ, পারহ্যাপস দা বেস্ট ইন মাই লাইফ। বলতে পার মাই বয়, সেটি কী?
ম্যাকেঞ্জির চোখজোড়া সন্ধানী আলোর মতো জনসনের মুখে এসে পড়ল। সে মুখ বোকা, মূঢ় এবং বিহ্বল দেখাচ্ছে।
ম্যাকেঞ্জি ফের বলতে লাগল। তার গলায় আত্মপ্রসাদ এবং কৌতুকের সুর, পারলে না তো? জানি, পারবে না। কিন্তু মাই বয়, কথাটা আমি অনেক অনেকবার বলেছি। লাইক এনি ওল্ড টেল টোল্ড, দেন রি-টোল্ড সো মেনি টাইমস। যাই হোক, সত্যটি হল, আমরা প্রথমে ব্রিটিশারস, তার পরে মিশনারি। এ শুধু সত্য নয়, এ আমাদের আদর্শ, জীবনদর্শন।
কিন্তু ফাদার, পিয়ার্সন যে বলে আমরা প্রথমে মিশনারি, পরে ব্রিটিশার।
পিয়ার্সন! সারা মুখের সেই স্বর্গীয় হাসিটুকু নিভে নিভে ঠোঁটের ফাঁকে একটা সূক্ষ্ম এবং কুটিল ভঙ্গির মধ্যে মিলিয়ে গেল। চোখের কটা মণি দুটো একবার যেন জ্বলে উঠল। গলাটা একটু কঠিনও যেন শোনাল, কোহিমায় আসার পর তোমার সঙ্গে আজ পিয়ার্সনের দেখা হয়েছে কি?
না ফাদার। জুনোবট যাবার আগে পিয়ার্সনের কাছে ওকথা শুনেছি।
বিড়বিড় করে প্রায় নিঃশব্দে কী যেন বলতে লাগল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি।
জনসন বলল, আই কান্ট ফলো ইউ ফাদার–
না না, ও কিছু নয়। আমার কথাটা সবসময় মনে রাখতে চেষ্টা করবে, আমরা প্রথমে ব্রিটিশারস, পরে মিশনারি।
ও তো ন্যারো আউটলুকের কথা।
ম্যাকেঞ্জি করুণার হাসি হাসল। মুখেচোখে পরম বাৎসল্যের ভঙ্গি ফুটে বেরুল তার। বলল, তোমাদের বয়েসে ওকথা মনে হবে। কিন্তু অনুপাতটা কষে দেখ। তুমি তো অঙ্কের ছাত্র ছিলে। দেখ, ব্রিটিশারদের যে জনসংখ্যা তার তুলনায় আমরা মিশনারিরা কজন? খুব সামান্য। ভেরি মাইনর ইন নাম্বার। তা হলেই বোঝ, মিশনারি নামে পরিচিত হতে দৃষ্টিভঙ্গি আরো কত ছোট করতে হয়।
ইয়াস ফাদার–বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জনসন। ম্যাকেঞ্জির সামনে এলে বিচারবুদ্ধি, বিবেক, দেহমন এবং শিরাস্নায়ুর সমস্ত জোর বিকল হয়ে যায়। নিরুপায়ের মতো বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। কী এক সম্মোহন যেন জানে ম্যাকেঞ্জি। তার গলার স্বরে, চোখের মণিতে অদ্ভুত ধরনের কুহক আছে।
ম্যাকেঞ্জি বলল, লোকের কাছে আমাদের পরিচিত হতে হবে মিশনারি নামে, আর কাজ করতে হবে ব্রিটিশার হিসেবে।
কেন?
জাতির স্বার্থের খাতিরে। ফর আ বেটার কজ, ফর আ গ্রেটার ইন্টারেস্ট। বুঝলে কিনা, একটু আগে বলেছিলাম সারা পৃথিবীতে ক্রিস্ট্যানিটি প্ৰিচ করতে হবে। তার মানে কী? তার মানে হল, ক্রিস্ট্যানিটির তলায় তলায় ব্রিটিশ রাজত্বকে বাড়ানো। আন্ডার ওয়ান ব্রিটিশ ব্যানার, আন্ডার হিজ একজন্টেড ম্যাজেস্টিস রুল সমস্ত পৃথিবীকে জড়ো করতে হবে। এই কাজে ক্রিস্ট্যানিটি হল আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। প্রভু যীশুর পুণ্যনাম আমাদের স্বার্থে লাগাতে হবে। রাজত্ব বাড়লে প্রিচিঙের ক্ষেত্রও বাড়বে। আশা করি, সব কিছু পরিষ্কার হয়েছে।
হয়েছে। কিন্তু ফাদার, এ তো ক্রিস্ট্যানিটি আর যীশুর নামকে দস্তুরমতো এক্সপ্লয়েট করা।
বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির মুখে আবার সেই স্বর্গীয় হাসি ফুটে বেরিয়েছে। আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, মাই বয়, এক্সপ্লয়েট শব্দটা শুনতে খারাপ। ওকথা বোলো না। সমস্ত পরিষ্কার করে দিয়েছি, এ সম্পর্কে আর আলোচনা নয়। এবার অন্য প্রসঙ্গে আসা যাক।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ম্যাকেঞ্জির আঙুলের তলা দিয়ে জপমালাটা মসৃণ গতিতে সরে সরে যাচ্ছে। মাথার ওপর চাঁদ আরো উজ্জ্বল হয়েছে। দূরে ওক বনের মাথা চিকচিক করছে। শান্ত, স্তব্ধ এবং সমাহিত হয়ে রয়েছে চারপাশের পাহাড়। একটা আঁচড়ের মতো ফুটে বেরিয়েছে আনিজা উইখুর দীর্ঘ রেখাটা।
জনসন বলল, ক্ষমা করবেন, একটা ব্যাপার আমার কাছে কিছুতেই ক্লিয়ার হচ্ছে না ফাদার।
কী ব্যাপার?
আপনি যে পাহাড়ী মেয়েগুলো জোগাড় করে এখানে পাঠাতে বলেছিলেন, তার সঙ্গে আমাদের প্রিচিং আর রাজত্ব বাড়বার কী সম্পর্ক? তা ছাড়া ও তো সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। আপনার কথামতো মেয়ে জোগাড় করতে গিয়ে প্রাণটা গিয়েছিল আর একটু হলে। আমার বড় ভয় করে এসব করতে। স্তিমিত, ভীরু গলায় জনসন বলল।
গেটে ক্যাচ করে শব্দ হল। ঘাসের জমিতে মসমস আওয়াজ করে একজোড়া উদ্ধত ভারী বুট এগিয়ে আসছে। পুলিশ সুপার বসওয়েল।
সোল্লাস অভ্যর্থনায় গদগদ হয়ে উঠল বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি, আসুন, আসুন মিস্টার বসওয়েল।
একটা বেতের চেয়ার টেনে বসে পড়ল বসওয়েল। বিরাট পাইপের পেটে টোবাকো পুরতে পুরতে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকাল, তারপর ফাদার, আমাদের সেই স্কিমটা যে তামাদি হতে চলল। আপনার সাহায্য না পেলে বড় অসুবিধায় পড়ব। অসুবিধা কি, স্কিম স্কিমই থেকে যাবে। তাকে আর বাস্তবে রূপ দেওয়া যাবে না। একটু থেমে আবার বলল, ইয়াস, কয়েক ডজন পাহাড়ী গার্ল আমার চাই। এই হিলি বিউটি দিয়েই বিস্টগুলোকে আমি শায়েস্তা করব। বুঝতেই পারছেন, আমরা মানে পুলিশের লোকেরা গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে তো মেয়ে জোগাড় করতে পারি না। তাতে অনেক ল্যাঠা। পাহাড়ীগুলো সাঙ্ঘাতিক খেপে রয়েছে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে দ্যাট মিনক্স ড্যামনড় উইচ গাইডিলিওটা আমাদের বিপক্ষে পাহাড়ী কুত্তাগুলোকে তাতাচ্ছে। কী বলব ফাদার, গ্রেট ওয়ারের সমস্ত হরর, সব ম্যাসাকর আমার চোখের সামনেই ঘটেছে। জীবনে আমার অনেক অভিজ্ঞতা। কিন্তু গাইডিলিও শয়তানী আমাকে পাগল করে ছাড়ছে। পাইপটা আধাআধি আন্দাজ মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে হিংস্রভাবে কামড়ে ধরল বসওয়েল।
পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির বুড়ো আঙুলের নিচে জপমালাটা থমকে গেল। তীক্ষ্ণ স্বরে সে জিগ্যেস করল, গাইডিলিও এখন কোথায়?
তাই যদি জানব, তা হলে কি কোহিমার পাহাড়ে চুপচাপ বসে থাকি, না পাইপ কামড়াই? দু হাতের দশটা মোটা মোটা আঙুলে হতাশাব্যঞ্জক মুদ্রা ফুটিয়ে বসওয়েল বলল, বুঝলেন ফাদার, গ্রেট ওয়ার ফেরত লোক আমি। জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। কিন্তু এই গাইডিলিও মেয়ে নয় ফাদার, একটা দুঃস্বপ্ন। একশো পুলিশ নিয়ে শিকারি কুকুরের মতো পাহাড়ে পাহাড়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই হয়তো খবর পেলাম শয়তানীটা লোহটাদের গ্রামে রয়েছে। দলবল নিয়ে সেখানে ছুটলাম। কোথায় কে? পৌঁছে দেখি বেমালুম হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গেছে। এই তো পরশু রাত্রিতে কোনিয়াক সর্দার খবর দিয়ে গেল, ছুকরিটা নাকি তাদের পাশের গ্রামে আস্তানা গেড়েছে। আবার দৌড়। সমস্ত রাত গ্রামটাকে ঘিরে রইলাম। সকালবেলা পাহাড়ীদের ঘরে ঘরে ঢুকে সার্চ করলাম। তাজ্জবের ব্যাপার, কখন যে আমাদের করডনের মধ্য দিয়ে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে মাগীটা ভেগেছে, টেরই পেলাম না। লাইফটাকে একেবারে মিজারেবল করে তুলেছে পাহাড়ী কুত্তীটা। ওহ ক্রাইস্ট, যা দেখছি, গ্রেট ওয়ারের সব ফেম আমার নষ্ট হয়ে যাবে এই কোহিমাতে এসে। অবসন্ন ভঙ্গিতে বেতের চেয়ারে নিজের বিরাট দেহটাকে টান টান করে ছেড়ে দিল বসওয়েল।
পাশ থেকে জনসন বলল, এমনও তো হতে পারে, পাহাড়ী সর্দারেরা হ্যারাস করার জন্যে আজেবাজে খবর দিচ্ছে।
বিরাট মাথাটা প্রবলভাবে নেড়ে মৃদু হাসল বসওয়েল, ওহ নো নো, মাই ইয়ং ফাদার। এ একেবারেই অসম্ভব। ব্রিটিশার স্পাই চিনতে ভুল করে না। যদি করত, তা হলে এত বড় দুনিয়ায় রাজত্ব করা আমাদের কোনোকালেই সম্ভব হত না। তাছাড়া, এই পাহাড়ী মানুষগুলো অন্য ধাতুতে গড়া। আমাদের সভ্য জগৎ থেকে বিশ্বাসঘাতকতা, নিমকহারামি নামে বিশেষ বিশেষ শব্দগুলো এখনও এই সব পাহাড়ে এসে পৌঁছুতে পারেনি। তাই বাঁচোয়া। একবার যদি এদের টাকা কাপড়-খাবার দিয়ে বশ করে নিতে পারা যায়, তা হলে জীবনে এরা কোনোদিনই বেইমানি করবে না। তাই ভরসা আছে, আজ হোক, কাল হোক, গাইডিলিও ধরা পড়বেই। আর তা সম্ভব হবে এই পাহাড়ীদের দিয়েই। একটু থামল পুলিশ সুপার বসওয়েল। দু’পাটি দাঁতের ফাঁকে পাইপটাকে আরো হিংস্রভাবে কামড়ে ধরল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগল, সেদিন, ইয়াস–দ্যাট ডে কোহিমার খোলা রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মাগীকে আমি চাবুক মারব। তার ওপর বেয়নেট প্রাকটিশ করাব। অ্যান্ড দেন–ভয়ঙ্কর মুখভঙ্গি করে, একটা সাঙ্ঘাতিক ইঙ্গিত দিয়ে বসওয়েল থেমে গেল।
কিছুক্ষণের জন্য নিরেট স্তব্ধতা নেমে এল ঘাসের জমিতে।
দাঁতের ফঁক থেকে পাইপটাকে হাতের তালুতে নিয়ে মোটা মোটা আঙুল দিয়ে বারকয়েক তাল ঠুকল বসওয়েল। তারপর বলতে লাগল, অবশ্য সব ব্যবস্থাই আমি করেছি। প্লেনসম্যানদের সঙ্গে যাতে এই পাহাড়ের কোনো যোগাযোগ না থাকে, গাইডিলিওর মুভমেন্টের খবর যাতে প্লেনসের লোকেরা জানতে না পারে, তার জন্যে সব পথ বন্ধ করে দিয়েছি। সে সব থাক। যে জন্যে আসা, আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। সমতলের লোকেদের সঙ্গে কোনোমতেই পাহাড়ীগুলোকে মিশতে দেওয়া হবে না। তা ছাড়া, কাঁটা দিয়ে কাটা তুলতে হবে। সেই জন্যে স্কিমটা কেঁদেছিলাম। তা মেয়ে জোগাড় করতে পারলেন ফাদার?
আমি তো আপনার কথামতো জুনোবট, চোঙলিয়া, সাজুবট–সব জায়গায় মিশনারিদের খবর পাঠিয়েছি। তারা যেন মেয়ে জোগাড় করে কোহিমা পাঠিয়ে দেয়। এই তা জুনোবট থেকে জনসন এসেছে। তাকে জিগ্যেস করুন। ম্যাকেঞ্জি বলল। তার আঙুলের তলায় জপমালাটা আবার সচল হয়েছে।
পাইপের মাথায় তাল ঠুকতে ঠুকতে বসওয়েল বলল, কী ব্যাপার ইয়ং ফাদার, মেয়ে জোটানো গেল?
না। একেবারেই ইমপসিবল। আমি নিজে গিয়েছিলাম গ্রামে গ্রামে। পাহাড়ীরা বর্শা নিয়ে তেড়ে আসে। প্রখর দৃষ্টিতে বসওয়েলের মুখের দিকে তাকাল জনসন।
চুক চুক–আলটাকরা এবং জিভের সহযোগে অদ্ভুত শব্দ করল বসওয়েল, সর্বনাশ! আপনি নিজে যান কেন? কক্ষনো এই সব ব্যাপারে নিজে সামনে থাকবেন না। পেছনে থেকে পাহাড়ীদের দিয়ে করাবেন। নিজে গেলে মিশনারিদের সম্বন্ধে এই হিলি বিস্টগুলো খারাপ ধারণা করে নেবে। এতে আমাদের ক্ষতি, ভীষণ ক্ষতি।
পাহাড়ীদের দিয়ে কী করে করাব?
হাঃ-হাঃ-হাঃ–কোহিমার শান্ত সমাহিত রাতকে চমকে দিয়ে বসওয়েলের গলায় অট্টহাসি বাজল, এবারে হাসালেন ইয়ং ফাদার। এমন একটা ওয়ার্থলেস বোকা প্রশ্ন আমি আপনার কাছে আশা করি নি। পাইপের মাথায় মোটা মোটা আঙুলের তালটা এবার আরো উদ্দাম হয়ে উঠেছে। বসওয়েল আবার শুরু করল, মানি মানি–টাকা, ব্রাইব, ইয়াস ব্রাইব, এই ব্রাইব দিয়ে এদের রিপুতে ক্রমাগত সুড়সুড়ি দিতে হবে। তারপর এই পাহাড়ের মনুষ্যত্ব আর সরলতাকে কিনে নিতে হবে। আই থিঙ্ক মাই ইয়ং ফাদার, দিস সিলভার মেটাল ক্যান মেক এনি ইমপসিবস পসিবল, পসিবল ইমপসিবল। তবে রুটির কোন দিকে মাখন মাখাতে হবে সেই আর্টটা জানা দরকার। অর্থাৎ টাকাটা কেমন করে খরচ করতে হবে সে সম্বন্ধে দস্তুরমতো জ্ঞান থাকা চাই। আর একটা কথা, পাহাড়ীগুলো একটু একটু করে চালাক হয়ে উঠছে। তাই এই সব গুরুতর ব্যাপারে ইউ মাস্ট চুজ রাইট পারসনস।
জনসন বলল, আমি কিন্তু একটা বিষয় কিছুতেই বুঝতে পারছি না মিস্টার বসওয়েল। এই মেয়ে সংগ্রহের সঙ্গে ধর্মপ্রচারের কী সম্পর্ক? একটু আগে ফাদারকে আমি সেকথা জিগ্যেস করছিলাম। এ তো দস্তুরমতো পাপ। আমার বড় ভয় করে।
পরিষ্কার গলায় বসওয়েল বলল, এতটুকু সম্পর্ক নেই। প্রিচিং-এর সঙ্গে মেয়ে জোগাড়ের কোনোরকম যোগাযোগ থাকতে পারে না। আবার পারেও। দুটো মোটা মোটা ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো রহস্যময় হাসি ঝুলতে লাগল বসওয়েলের। আগের কথার খেই ধরে বলল, কী বলছিলেন ইয়ং ফাদার, ভয়! হেঃ—ভয় শব্দটা কিন্তু ইংরেজের জীবন থাকতে নেই। আর পাপ? আপনি দেখছি অত্যন্ত ইমোশানাল শুচিবাইগ্রস্ত যুবক। অনেক লোককে অন্ধকার থেকে আলোতে আনতে গেলে, ব্যাপটাইজ করতে গেলে, এসব ব্যাপার ধর্তব্যের মধ্যে আনতে নেই। ভয় করে! পাপ! হেঃ, কাওয়ার্ড কোথাকার?
কিন্তু মিস্টার বসওয়েল, আপনি তো বললেন না প্রিচিং-এর সঙ্গে মেয়ে জোগাড়ের সম্পর্ক কী? কাঁপা কাঁপা, ভাঙা গলায় জনসন জিগ্যেস করল। তার চোখ দুটো অসহায়ভাবে বসওয়েলের বিরাট মুখে আটকে রইল।
সেটা হল আমার স্কিমের ব্যাপার। ব্রিটিশ রাজত্বকে এই পাহাড়ে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে ওটা দরকার। মেয়েগুলোকে আমি কোহিমার পুলিশ ব্যারাকে ছেড়ে দেব। পুলিশ হল ইন্ডিয়ার প্লেনসমেন। এবার বুঝতে পারছেন, আশা করি। একটা রহস্যময় হাসি বসওয়েলের বিরাট ভয়ঙ্কর মুখখানায় কতকগুলো কুটিল রেখা ফুটিয়ে তুলল।
বিমূঢ় মুখে তাকিয়ে রইল জনসন। প্রায় অসাড় গলায় বলল, পুলিশ ব্যারাকে মেয়েগুলোকে পাঠিয়ে কী হবে মিস্টার বসওয়েল?
কী হবে! হে-হে-হে–টেনে টেনে শব্দ করে হাসতে লাগল বসওয়েল। সে হাসিতে মেদস্ফীত বিপুল দেহটা দুলতে লাগল। একটা বিরাট মাংসের পিণ্ড থরথর কাঁপছে। হাসির দমকে আঙুলের ফাঁক থেকে আইভরি পাইপটা ঘাসের জমিতে ছিটকে পড়ল।
আঙুলের নিচে জপমালাটা আবার থেমে গিয়েছে বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জির। মুখে বিরক্তি ফুটে বেরিয়েছে। ঈষৎ ঝঝাল গলায় সে বলল, এতটা মাড়ল-হেডেড তোমাকে আমি ভাবতে পারিনি জনসন; এতটা বোকা তুমি! খাতার পাতায় খালি অঙ্কই কষেছ, তাকে জীবনে প্রয়োগ করতে শেখনি। গম্ভীর, ভরাট গলায় ম্যাকেঞ্জি বলে চলল, আমাদের পুলিশগুলো হল ইন্ডিয়ান। সমতলের লোক। আর মেয়েগুলো এই পাহাড়ের। প্লেনসে গ্যান্ডি স্বরাজ স্বরাজ করে চল্লিশ কোটি লোককে খেপিয়ে তুলছে। এই নাগা পাহাড়ে তার দেখাদেখি গাইডিলিও পাহাড়ী কুত্তাগুলোকে তাতাচ্ছে। সমতল আর পাহাড়ের লোকেরা একসঙ্গে হলে উপায় থাকবে না। তাই দুদলের মধ্যে সবসময় একটা বিরোধ জিইয়ে রাখতে হবে। এর নাম হল রাজনীতি। বলে একটু থামল ম্যাকেঞ্জি।
পেঁজা তুলোর মতো কয়েক টুকরো মেঘ আকাশের কোনোকুনি পাড়ি দিচ্ছে। দূরের ওক বনে কক কক শব্দ করে এক ঝাক আউ পাখি ডেকে উঠল। এখন রাত কত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে। না। তবে কোহিমা শহর আশ্চর্য নিস্তব্ধ, অদ্ভুত রকম নিঝুম।
একটু পর ম্যাকেঞ্জি আবার শুরু করল, পাহাড়ীগুলো মনে করবে, তাদের মেয়েদের ইজ্জত নিচ্ছে সমতলের লোকেরা। আমরা গ্রামে গ্রামে তাই চাউর করে দেব। আর বউ কি সুইটহার্ট ছেড়ে চাকরির দায়ে যেসব প্লেনসম্যান এখানে এসেছে, তাজা হিল বিউটি পেলে তারা পোষা কুকুরের চেয়েও বেশি বশে থাকবে। এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। আমার বিশ্বাস, পাহাড়ীদের একবার খেপিয়ে দিতে পারলে গাইডিলিওর মুভমেন্ট ইন্ডিয়ার প্লেনসম্যানদের বিরুদ্ধে ঘুরে যাবে। তারপর বুঝতেই পারছ। ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক করে শব্দহীন অথচ ইঙ্গিতময় হাসি হাসল ম্যাকেঞ্জি।
ঘাসের জমি থেকে আবার পাইপটাকে কুড়িয়ে নিয়েছে বসওয়েল। নতুন উদ্যমে তামাক পুরতে পুরতে সে বলল, এবার আশা করি বুঝতে পারছে ইয়ং ফাদার। ব্যাপারটা সহজ সরল করে দিলে এই দাঁড়ায়। যেমন করেই হোক, পাহাড়ের এই মুভমেন্ট ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে হবে। আই থিঙ্ক, নাউ ইউ উইল অ্যাডমায়ার মাই স্কিম।
ডান দিকের ভুরুটা কুঁচকে, কপালে খাঁজ ফেলে জনসনের পিঠে গোটাকয়েক মৃদু এবং সস্নেহ চাপড় দিল ম্যাকেঞ্জি। বলল, মাই বয়, এবার যাও। অনেক রাত হয়েছে। তুমি টায়ার্ড হয়ে আছ। খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড় গিয়ে।
বেতের চেয়ার থেকে উঠে পড়ল জনসন। ক্লান্ত, এলমেলো পা ফেলে সামনের চ্যাপেলের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। কপালের দু’পাশে দুটো রগ দপদপ করে লাফাচ্ছে। গলার কাছে একটা নীল শিরা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। স্নায়ু ইন্দ্রিয় হাড় মেদ দিয়ে গড়া দেহটা অবসাদে ঝিমঝিম করছে। কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। বুকের মধ্যে শ্বাসকষ্টের মতো একটা অনুভূতি। আতঙ্কে এবং উত্তেজনায় ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছে কপালে। সমস্ত চেতনা কেমন যেন অবশ, অসাড় হয়ে যাচ্ছে। জনসনের মনে হল, এখন পিয়ার্সনকে পেলে ভাল হত, খুব ভাল হত।
রূপকথায় গরগনদের কাহিনী শুনেছে। জনসন ভাবল, বড় পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি এবং পুলিশ সুপার বসওয়েল, দুজনেই গরগন। তাদের সামনে এলে সমস্ত চেতনা, বিচার বুদ্ধি, বিবেক লোপ পেয়ে যায়। সমস্ত সত্তা পাথরের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে যায়। নিজের স্বাধীন ভাবনা এবং চিন্তাগুলি প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় না। শুধু মাথা নেড়ে তাদের কথায় সায় দেওয়া ছাড়া দেহমনের সক্রিয় ইন্দ্রিয়গুলো বিকল হয়ে যায়।
গরগন, এই নামকরণের কৃতিত্ব পিয়ার্সনের। পিয়ার্সন ওদের দুটোকে গরগন নামে ডাকে। জনসনের মনে হয়, শুধু গরুগন নয়, নরকের দুটো প্রেত ম্যাকেঞ্জি আর বসওয়েল নাম নিয়ে কোহিমার পাহাড়ে উঠে এসেছে।
পাহাড়ী অজগর যেমন নিশ্বাসে এবং দৃষ্টির জাদুতে নিরীহ সম্বরকে আচ্ছন্ন এবং বিমূঢ় করে তার গ্রাসের মধ্যে টেনে আনে, ঠিক তেমন করেই ম্যাকেঞ্জি ও বসওয়েল তার বুদ্ধি বিচার-চিন্তা-ভাবনা অথর্ব করে তাকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসে। আর একটা অসহায়, নিরুপায় শিকারের মতো তাদের সামনে চুপচাপ বসে থাকে জনসন।
চ্যাপেলের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে অতীত জীবনটাকে মনে পড়ে জনসনের। সঙ্গে সঙ্গে মনের সঙ্গোপন কোণে বর্তমান জীবনের সঙ্গে একটা তুলনামুলক দ্বন্দ্বও বুঝি চলে।
সে জীবনটা ইংলণ্ডের আঙুর খেতে, ছায়াতরুর তলায় তলায়, পাইন এবং ফুলপাতা-ভরা ঝোপেঝাড়ে ছড়িয়ে ছিল। সেসব দিনে য়ুনিভার্সিটিতে পিওর ম্যাথমেটিকসের নোট নিত জনসন আর রোমান্টিক কবিতা লিখত। কবিতার বিষয় ছিল নিসর্গ। নদীর নীল জলে উইলো পাতার ছায়া কাঁপে, রুপোলি মাছ লাফায়, আকাশে সূর্য রং ঢেলে দেয়, সোনার জরিমোড়া মেঘ উড়ে যায়, রুপোর গুঁড়োর মতো ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে, হু-হু–বাতাস ছোটে, উঁচু উঁচু গাছগুলো এলোপাথাড়ি মাথা কোটে, রাত্রি নামে, কখনও আঁধি, কখনও জ্যোৎস্না। ফেনার মতো সাদা ধবধবে শান্ত আলো ছড়িয়ে ছড়িয়ে স্থির হয়ে থাকে। চাঁদের আলোয় রোদবৃষ্টি-মেঘ-বাতাস এবং মরশুমি পাখির ডানার শব্দ রক্তে মিশে ছিল জনসনের। সুযোগ পেলেই নিঃসঙ্গ নিরালা আখবনের ধারে ঘাসফড়িং আর প্রজাপতি দেখত সে। দূরে দূরে কৃষাণদের ফার্ম হাউস, বাতাসের শব্দ, পাখির ডাক–সব মিলিয়ে একটা অনির্বচনীয় খুশিতে মনটা ভরে থাকত।
এদেশে আসার আগে ইংরেজ মিশনারি, যারা ভারতবর্ষ ঘুরে এসেছে, তাদের কাছে এখানকার অনেক কথা শুনেছে জনসন। শুনে মুগ্ধ, বিস্মিত হয়ে গিয়েছে। টেগোর এবং কোনো কোনো ইংরেজ লেখকের রচনায় ভারতবর্ষের কিছু কিছু কাহিনি সে পড়েছে। এ দেশের নিসর্গ নাকি অপূর্ব। অতি মনোরম। যতদূর দৃষ্টি ছড়ানো যায়, শুধু সীমাহীন নীল আকাশ, ফসলভরা সবুজ খেত। পাহাড়-নদী-সমুদ্র। শুনতে শুনতে কিংবা পড়তে পড়তে মন নেচে উঠেছে। এক দুর্দম, অমোঘ আকর্ষণে ইণ্ডিয়ার মাটি তাকে ক্রমাগত টেনেছে।
ভারতবর্ষে আসার সবচেয়ে সোজা, সহজ পথটাই ধরেছিল জনসন। সরাসরি সে চার্চে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে পরম পিতার পতাকা মাথায় তুলে কিছুদিন দক্ষিণ ভারতের এক উপজাতি গ্রামে কাটিয়ে কোহিমা পাহাড়ে এসেছে, তা-ও মাস কয়েক হল।
এই নাগা পাহাড়। টিলা-উপত্যকা-মালভূমি-গুহা বন, ফুল-পাখি-গাছ, সাপের মতো পাক খাওয়া পথ, ঝরনা আর গর্জমান নদী। জনসনের ভালো লেগেছিল। অপরিসীম ভালো লাগার আনন্দে মনটা সবসময় ভরে থাকত। রক্তে রক্তে এই পাহাড়, তার আকাশ বাতাস নেশার মতো জড়িয়ে থাকত।
কোহিমা থেকে যে পাহাড় কাটা পথটা মাও-এর দিকে চলে গিয়েছে, সেটা ধরে একা একা অনেকদূর চলে যেত জনসন। বাঁ পাশে অতল গভীর খাদ, ঘন বন। লালচে রঙের আখুশি ফল থোকায় থোকায় পেকে রয়েছে, সবুজ পাতায় রোদ চিকচিক করে। শান্ত, হিম হিম ছায়া রয়েছে খেজাঙ কাটার ঝোপে। ঝাঁকে ঝাঁকে আউ পাখি পাখা ঝাঁপটায়। বাতাসে ঢেউ ওঠে, সোঁ সোঁ শব্দ হয়। কখনও চোখে পড়ে, খাসেম গাছের মাথায় পাহাড়ী বানর লাফাচ্ছে। নিচের উপত্যকায় দাঁতাল শুয়োর ছুটছে। এক ধরনের নীলাভ পাহাড়ী সাপ হামেশাই দেখা যায়। হিলহিলে দেহ নিয়ে এঁকে বেঁকে পলক পড়তে না পড়তেই অদৃশ্য হয়। বেশ লাগে জনসনের। দেখতে দেখতে বিস্ময়ে দুচোখ ভরে যায়। মন বুঁদ হয়ে থাকে।
পড়ন্ত বিকেলে পশ্চিম পাহাড়ের মাথায় সূর্যটা রক্তপিণ্ডের মতো দেখায়। রোদ নিভু নিভু হয়ে আসে। বাতাসে হিম হিম আমেজ ঘন হতে থাকে। সেইসময় কোহিমায় ফেরার পথ ধরে জনসন।
সন্ধ্যায় চার্চে ফিরে সোৎসাহে বলতে থাকে, ফাদার, অদ্ভুত ধরনের সব গাছ আর লতা দেখলাম। এত মোটা লতার এত ছোট পাতা হোমে দেখিনি। সাদা গাছ দেখলাম একটা, নাম জানি না। আমাদের চার্চে তো পাহাড়ীরা আসে, তাদের কাউকে নিয়ে একদিন যাব, লতা আর গাছ চিনিয়ে দেবে।
ম্যাকেঞ্জি বিশেষ কথা বলত না। দুঠোঁটে মৃদু, নীরব হাসি ফুটিয়ে মাথা নাড়ত। প্রথম প্রথম সে হাসিতে সস্নেহ প্রশ্রয় ছিল, কিছুটা বা কৌতুক।
একদিন হয়তো জনসন বলল, এই দেশটা চমৎকার। এমন সুন্দর বন আর পাহাড় আগে দেখিনি। আজকে ফাদার নীলচে সাপ দেখলাম। এত ভালো লাগল! গলায় মুগ্ধ সুর ফুটে উঠত জনসনের।
ম্যাকেঞ্জি বিড়বিড় করে কী বলত, ঠিক বোঝা যেত না।
উচ্ছ্বাসে ছেদ পড়ত। থতমত গলায় জনসন বলত, বেগ ইওর পারডন।
আশ্চর্য ক্ষমতা ম্যাকেঞ্জির। একটু বিচলিত হয় না সে। মুখের রেখাগুলোকে একটুও না ভেঙে, যথাযথ রেখে, সেই মৃদু, নিঃশব্দ হাসিটা হাসত। বলত, খুব খুশি হলাম। এই দেশ তা হলে তোমার ভালো লেগেছে।
বলেন কী ফাদার! প্রবল উৎসাহে ফেটে পড়ত জনসন, এমন দেশ জীবনে আর দেখি নি।
শান্ত, নির্লিপ্ত গলায় ম্যাকেঞ্জি বলত, বেশ বেশ। তবে একা একা বেশি ঘুরো না। তোমার ওই চার্মিং নীলচে সাপগুলো কিন্তু সাঙ্ঘাতিক বিষাক্ত। বাঘ, হাতি, দাঁতাল শুয়োর কিন্তু হামেশাই বেরোয়। আর পাহাড়ীরা বিদেশি দেখলে বর্শা দিয়ে কুঁড়েও ফেলতে পারে। সাবধানে ঘোরাফেরা করবে।
দিনগুলো চমৎকার কাটছিল। রোদ-পাখি-মেঘ-আকাশ নদী ঝরনা দেখতে দেখতে,পাহাড়ী ধুলো গায়ে মেখে পথ হাঁটতে হাঁটতে নেশা ধরে যেত। একদিন সন্ধ্যার পর ম্যাকেঞ্জি বলল, পাহাড় দেখে, বন-নদী-ঝরনা দেখে তো মাসখানেক কাটালে। আশা করি, এবার তুমি আসল। কাজের জন্যে তৈরি হবে।
একটু চমকে জনসন বলেছিল, কী কাজ?
বাঃ! যে জন্যে তোমার এখানে আসা সেই কাজ। প্রিচিং। একটু কঠিনই হয়তো শুনিয়েছিল ম্যাকেঞ্জির গলা, শোন, আমি ঠিক করেছি, আসছে সপ্তাহ থেকেই তোমাকে পিয়ার্সনের সঙ্গে পাহাড়ীদের গ্রামে পাঠাব। ওর কাছে কেমন করে প্ৰিচ করতে হয়, শিখে নেবে। আর পাহাড়ীদের ভাষাটা শিখে নিয়ো, বুঝলে? একটু ছেদ। তারপর আবার বলেছে, কাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবে। প্রিচিং সম্বন্ধে দুচারটে কথা বলব।
ইয়াস ফাদার। দু পাশে মাথা হেলিয়ে জনসন বলেছিল খুব আস্তে, নিরুৎসুক গলায়।
কথা বলতে বলতে আচমকা চোখে পড়েছিল জনসনের, পাশের বেতের চেয়ারে পিয়ার্সনের সাড়ে ছ ফিট ঋজু দেহটা চুপচাপ বসে রয়েছে। নিশ্বাসের শব্দ হচ্ছিল না। বুকটা। ওঠানামা করছে কিনা, বোঝা যাচ্ছিল না। চওড়া কাঁধ, ঈষৎ মোটা নাক, জানু পর্যন্ত দীর্ঘ পেশীপুষ্ট হাত এবং বিশাল সবল একখানা বুকের দুর্দান্ত মানুষটা কেমন নিঝুম হয়ে ছিল। জনসনের নজর পড়েছিল পিয়ার্সনের চোখে। দেখেছিল, পিয়ার্সনের চোখজোড়া জ্বলন্ত ধাতুপিণ্ডের মতো জ্বলছে এবং নির্নিমেষে ম্যাকেঞ্জির মুখে আটকে আছে। তার দৃষ্টিতে জ্বালা। রোষ ক্ষোভ এবং হিংস্রতা একাকার হয়ে মিশে ছিল। দেখতে দেখতে জনসন কেমন যেন হতবাক হয়ে গিয়েছিল।
একটু পরে ম্যাকেঞ্জি উঠে ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।
তারপর দাঁতে দাঁত চেপে পিয়ার্সন গর্জে উঠেছিল, স্কাউণ্ডেল।
জনসন চমকে উঠেছিল, কে?
কে আবার? ম্যাকেঞ্জি।
না, ও কথা বলছ কেন? ফাদার লোক খুব ভালো। আমাদের কত ভালোবাসেন।
বিরক্ত, ঝাঁঝাল গলায় পিয়ার্সন বলেছিল, কাল সকালে বুঝবে, কেন গালাগালি দিলাম। কাল তোমার জন্যে যে সকালটা আসবে, একদিন এমনই একটা সকাল আমার জীবনেও এসেছিল। বলতে বলতে সশব্দে বেতের চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিল পিয়ার্সন।
এই পাহাড়ের নিসর্গের রূপ স্বপ্নের মতো মনে হয়েছে জনসনের। পরের দিন সকালে সুরটা ছিঁড়ে গেল। একটা তীব্র ঝনঝনানি সমস্ত না জুড়ে প্রবল ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল।
ম্যাকেঞ্জি প্রিচিংয়ের নতুন ভাষ্য শুনিয়েছিল, অদ্ভুত তাৎপর্য শিখিয়েছিল। মিশনারি হবার আগে, কি নাগা পাহাড়ে আসার আগে প্রিচিং সম্বন্ধে এমন হীন ধারণা তার কোনোদিন হয়নি। ভয়ে, আশঙ্কায় বুকটা তার থরথর কেঁপেছে। ধর্মপ্রচার সম্বন্ধে এমন কথা আগে কখনও শোনেনি সে। মনের দিক থেকে তখনও সুন্দর শুভ্র পবিত্র শৈশব পেরিয়ে আসতে পারে নি জনসন। তাই ম্যাকেঞ্জির ভাষ্য তার স্নায়ুগুলোকে মুচড়ে-দুমড়ে বিকল করে দিয়েছে। চারপাশের সুন্দর পাহাড়, আকাশ-ওক বন-পাইন বন, এর মধ্যে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি নামে এক সাঙ্ঘাতিক দুঃস্বপ্ন ছিল, এর আগে তা কি কোনোদিন ভাবতে পেরেছিল জনসন।
মনে মনে জনসন ভীরু, দুর্বল এবং কুণ্ঠিত। প্রতিবাদ করতে সে জানে না। কুণ্ঠা, দ্বিধা ও সহজাত সংকোচ সবসময় তাকে আড়ষ্ট করে রাখে। অথচ ভেতরে ভেতরে সমগ্র সত্তার মধ্যে ভীষণ আলোড়ন হয়। যে-প্রতিবাদ বেরিয়ে আসার পথ পায় না তা ভাবনায় চিন্তায় পাক খেয়ে খেয়ে ছটফট করতে থাকে। যন্ত্রণায় বেদনায় জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে।
দিনকয়েক আগে জুনোবটতে বড় পাদ্রী লোক পাঠিয়েছিল। জনকতক পাহাড়ী মেয়ে জোগাড় করে কোহিমায় পাঠাতে হবে। ম্যাকেঞ্জির আদেশ, হ্যাঁ আদেশই বলা উচিত, অমান্য করার সাহস নেই তার। গ্রামে গ্রামে মেয়ের খোঁজে নিজেই গিয়েছিল জনসন। মেয়ে মেলেনি। পাহাড়ীরা বর্শা উঁচিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। শাসিয়েছে, আর কোনোদিন এমন মতলব নিয়ে এলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে হবে না। অনেকদিনের জানাশোনা, তার কাছ থেকে নিমক কাপড় খাবার অনেক পেয়েছে, তাই এবারটা রেহাই দিয়েছে।
.
চার্চের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে এলোমেলো নানা কথা ভাবছিল জনসন। আচমকা ভাবনার ঝোঁকটা অন্য দিকে ঘুরে গেল। একটু আগে বসওয়েলের স্কিমের কথা শুনেছে সে। পাহাড়ী মেয়েদের দিয়ে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে তা বুঝতে পেরেছে। শুনতে শুনতে ক্ষমাহীন। পাপবোধে, জঘন্য অপরাধের ছোঁয়ায় সমস্ত চেতনা কুঁকড়ে গিয়েছে, সারা শরীর ঘিন ঘিন করছে। এখন একটা পিণ্ডের মতো প্রবল কান্নার বেগ হাড়-মেদ-শিরা রক্ত চুরমার করে গলার কাছে ডেলা পাকিয়ে রয়েছে। কান্নাটা বেরিয়ে আসছে না, নিচের দিকে নেমেও যাচ্ছে না। অনড় হয়ে গলায় চেপে রয়েছে। জনসন ভাবল, একটু কাঁদতে পারলে বুকটা হালকা হয়ে যেত। সমস্ত সত্তার ওপর যে অসহ্য, অকথ্য পীড়ন চলছে তা থেকে মুক্তি পেতে হলে কাঁদতে হবে। কাঁদতেই হবে।
সে ভীরু, দুর্বল এবং কুণ্ঠিত। এখানে এসে পিয়ার্সনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। পিয়ার্সন অদম্য এক যুবক। তাকে পাওয়া গেলে এখন সব কিছু বলা যেত। এই মানসিক পীড়ন, এই ভীষণ নির্যাতন সে আর সহ্য করতে পারছে না। বুকের মধ্যে বাতাস আটকে আটকে আসছে। চারপাশে এত অফুরন্ত বায়ুস্রোত, তবু জনসনের নিশ্বাস নেবার মতো সামান্য বাতাস যেন কোথাও নেই।
ক্লান্ত পা ফেলে ফেলে পবিত্র ভজনালয়ে চলে এল জনসন। শ্বেত পাথরের মসৃণ বেদি। সামনে ক্রাইস্টের মর্মর মূর্তি। জ্যোতির্ময় পুরুষের প্রসারিত বাহুতে বরাভয় এবং করুণা। চোখে ক্ষমাসুন্দর প্রসন্ন দৃষ্টি। জনসন তাকিয়ে রইল। আচমকা একটু আগের কান্নাটা গলার কাছে ফুলে ফুলে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। শুভ্র বেদিতে আছড়ে পড়ল জনসন, আছড়ে পড়ল একটি পাপের অনুভূতি। পরম পুরুষের পায়ের নিচে লুটিয়ে লুটিয়ে একটু আশ্রয় চাইল, ক্ষমা প্রার্থনা করল ব্যাকুলভাবে।
বেদিতে ফুলে ফুলে জনসন কাঁদছে। যে কান্নাটা গলার কাছে আটকে ছিল এবার সেটা পথ। পেয়েছে। হু-হু–বেগে নেমে আসছে। কাঁপা কাঁপা আকুল গলায় জনসন বলছে, ওহ্ ক্রাইস্ট, আই অ্যাম আ সিনার। সেভ মি, সেভ মি। আই কনফেস, আই অ্যাম আ সিনার। ওহ ক্রাইস্ট–
জ্যোতির্ময় পুরুষের পদপ্রান্তে একটি অন্যায়, একটি অনিচ্ছাকৃত পাপ কেঁদে কেঁদে শুদ্ধ হচ্ছে, পবিত্র হচ্ছে, চোখের জলে কালিমা ধুয়ে যাচ্ছে।
.
৪৩.
মুখোমুখি নিঝুম বসে রয়েছে পাদ্রী ম্যাকেঞ্জি আর পুলিশ সুপার বসওয়েল। কেউ কথা বলছে না, একেবারেই চুপচাপ। শুধু ম্যাকেঞ্জির আঙুলের তলা দিয়ে রুপোবাঁধানো জপমালাটা মসৃণ গতিতে সরে সরে যাচ্ছে। ঠুনঠুন করে মৃদু ধাতব আওয়াজ হচ্ছে। এ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। রাতের শান্তি এখন অবাধ, একটানা।
লোহার গেটে কাঁচ করে আওয়াজ হল। ম্যাকেঞ্জির রোমশ আঙুলের তলায় জপমালা এবং বসওয়েলের দাঁতের ফাঁকে আইভরি পাইপটা চমকে উঠল।
একটি মাত্র মুহূর্ত। তার পরেই উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জি, আরে সর্দার, এসো এসো। তারপর তোমদের সালয়ালা গ্রামের খবর কী?
সামনের ঘাসের জমিটার ওপর বড় বড় পা ফেলে সালুয়ালা গ্রামের সর্দার এগিয়ে এল। ম্যাকেঞ্জির পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। লম্বা বর্শা এবং ঝাকড়া মাথাটা একসঙ্গে ঝাঁকিয়ে সে বলল, হু-হু– ফাদার, অনেক খবর আছে। মজাদার খর।
বল কী খবর? কৌতূহলে চোখজোড়া তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল ম্যাকেঞ্জির।
হুই যে টেপঙের বাচ্চা সেঙাই তোর কাছে এসেছিল, তাদের বক্তির নাম কেলুরি। আমাদের বস্তির মেহেলী শয়তানী সেখানে ভেগেছে, সেকথা তো তুই জানিস। মেহেলীকে ওরা আটকে রেখেছে। দুটো ছোকরাকে সেদিন রাত্তিরে ওদের বস্তিতে পাঠিয়েছিলাম। তাদের বর্শা দিয়ে ফুড়েছে। এর শোধ তুলতে হবে। তোরা আমাদের হয়ে লড়বি। তোদের বন্দুক নিয়ে আমাদের সঙ্গে যাবি। কেলুরির শয়তানগুলো ভালো লড়ে। বন্দুক না নিয়ে গেলে হবে না। ঘঘালাটে চোখে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকাল সালুয়ালা গ্রামের সর্দার।
বিরক্ত উগ্র গলায় ম্যাকেঞ্জি বলল, এই কথা বলবার জন্যেই বুঝি এত রাতে কোহিমা এসেছ!
না রে সায়েব, অন্য খবরও আছে। আরো একটু ঘন হয়ে দাঁড়াল সালুয়ালা গ্রামের সর্দার। তার গা থেকে একটা মিশ্র দুর্গন্ধ ধক করে নাকে এসে লাগল ম্যাকেঞ্জির। নাকটা স্বাভাবিক নিয়মেই কুঁচকে গেল।
মুখে নিস্পৃহ ভঙ্গি ফুটিয়ে ম্যাকেঞ্জি বলল, অন্য খবর বলতে?
তিন দিন ধরে গাইডিলিও ডাইনিটা কেলুরি বস্তিতে এসে রয়েছে। হু-হু–ঘন ঘন মাথা নাড়তে শুরু করল সালুয়ালাঙের সর্দার। বলল, তুই আমাকে টাকা কাপড় খাবার দিয়েছিলি। নিমকহারামি করব না। গাইডিলিওর খবর দিয়ে গেলাম ফাদার।
এতক্ষণ অনেক দূরের আবছা পাহাড়চূড়ার দিকে তাকিয়ে ছিল বসওয়েল। অলস ভঙ্গিতে তামাকের ধোঁয়া ছাড়ছিল। গাইডিলিওর নামটা কানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে নড়ে চড়ে খাড়া হয়ে বসল। বলল, কোথায়–হোয়ার ইজ দ্যাট উইচ, দ্যাট মিংক্স গাইডিলিও?
সর্দার বলল, তিন দিন ধরে কেলুরি গ্রামে আস্তানা গেড়েছে।
এখুনি, জাস্ট নাউ আমরা স্টার্ট করব। আমি আউট-পোস্টে যাচ্ছি। ফোর্স নিয়ে রেডি হই গিয়ে। আপনিও আমাদের সঙ্গে যাবেন ফাদার। আর এই ভিলেজ হেডম্যানটাকে ধরে রাখুন। আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বলতে বলতে বিরাট দেহ নিয়ে লাফিয়ে উঠে পড়ল বসওয়েল। তারপর একরকম ছুটতে ছুটতে ঘাসের জমিটা পেরিয়ে কোহিমার আঁকাবাঁকা পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
সর্দারের পিঠে একখানা হাত রেখে সোহ্লাসে ম্যাকেঞ্জি বলল, বুঝলে সর্দার, এখুনি তোমাদের সঙ্গে পুলিশ আর বন্দুক নিয়ে আমরা যাব। কেলুরি বস্তি থেকে মেহেলীকে ছিনিয়ে
এনে তোমাদের হাতে তুলে দেব। কি, খুশি তো?
খুব খুশি, হু-হু, খুব খুশি–আনন্দ এবং উত্তেজনার মিশ্র অনুভূতিতে সালুয়ালাঙের বুড়ো সর্দারের চোখজোড়া বুজে আসতে লাগল। জড়ানো গলায় বলল, মেহেলীকে না আনতে পারলে না খেয়ে মরতে হবে। আমাদের বস্তির মেয়ে অন্য বস্তিতে পালিয়ে রয়েছে, আমাদের ইজ্জত সাবাড়। সাঙটামরা অঙ্গামীরা এখন ধান বদল করে না, হাঁড়ি দেয় না, লোহার ছুরি আর লাঙল দেয় না। আবাদ করতে পারি না। চল ফাদার, তাড়াতাড়ি চল।
কোহিমার আকাশে সুলু পক্ষের চাঁদ পরিপূর্ণ গোলাকার হয়ে উঠেছে। স্নিগ্ধ, উজ্জ্বল আলোয় দিগদিগন্ত ভেসে যাচ্ছে।
.
খানিকটা সময় কেটে গেল। পায়ের কাছে বশংবদ কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে রয়েছে সালুয়ালাঙের সর্দার।
একটু পরেই বসওয়েল আসবে। কেলুরি গ্রামে হানা দিতে হবে। তবু কেন যেন তেমন উৎসাহ পাচ্ছে না ম্যাকেঞ্জি। সে ভাবল, ইণ্ডিয়ার মাটিতে সাত সাতটা বছর কাটিয়ে তার। উদ্দামতা কেমন মরে আসছে। রক্ত ঝিমিয়ে যাচ্ছে। দেহমনের সক্রিয় ইন্দ্রিয়গুলোর ওপর মাকড়সার জালের মতো ছায়া নেমেছে। ব্রেটব্রুকশায়ারের সেই দুর্দান্ত আউটল একটু একটু করে যেন নিজের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। মুখে মুখে যতই তর্জন গর্জন করুক, এই ভয়ঙ্কর সত্যটা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই ম্যাকেঞ্জির। কাছে কেউ না থাকলে এই ভাবনাটা টুটি টিপে ধরে। পারতপক্ষে তাই একা থাকে না ম্যাকেঞ্জি। ইণ্ডিয়ার নরম মাটির বিশ্রী প্রভাব আছে। জীবনের উদ্দাম ভীষণ গতিকে সেটা পদে পদে থামিয়ে দেয়।
ইণ্ডিয়ায় প্ৰিচ করতে এসে একটি নগদ লাভ হয়েছে ম্যাকেঞ্জির। কয়েক দিন বাদে বাদে নিয়মিত কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। কয়েক ঘন্টা মাত্র মেয়াদ। তার মধ্যেই শরীরটাকে বড় পঙ্গু করে দেয়। দেহের সঙ্গে সঙ্গে মনেরও রুগণতা দেখা দিয়েছে। যতটা সম্ভব, ম্যাকেঞ্জি সব রকম দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলতে চায়। দেহ যাক, মনের দিকে দুর্বলতার হাত সে কিছুতেই বাড়াতে দেবে না। যতই ভাবে মনের জোর ততই যেন কমতে থাকে। ভেতরে ভেতরে যুঝতে বুঝতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ম্যাকেঞ্জি।
চোখ জ্বালা করছে। অবসাদে হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। কপালের দু’পাশে দুটো রগ নাচছে। জ্বর আসবে বোধ হয়।
আরো কিছুক্ষণ পর ঝড়ের মতো এসে পড়ল পিয়ার্সন। তার পেছনে একটি পাহাড়ী মেয়ে। চিনাসঙবা। ম্যাকেঞ্জি চমকে উঠল। তীক্ষ্ণ চড়া গলায় বলল, কী ব্যাপার পিয়ার্সন?
ফাদার, এই মেয়েটাকে ওর গ্রামের লোকেরা মেরে ফেলছিল। আমি বাঁচিয়ে এখানে নিয়ে এসেছি। একে আশ্রয় দিতে হবে।
ম্যাকেঞ্জি চিৎকার করে উঠল, ইট ইজ চার্চ। বদমাইশি করার জায়গা নয়। রাত দুপুরে ন্যাংটো মেয়ে নিয়ে এখানে উঠবে, আমি কিছুতেই বরদাস্ত করব না।
থতমত, বিস্মিত, কিছুটা বা ভীত গলায় পিয়ার্সন বলল, কী বলছেন ফাদার! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। অসহায় মানুষকে রক্ষা করা তো ধর্ম পালনের মধ্যেই পড়ে।
আমি তোমার কাছে নীতিকথা শুনতে চাই না। পাহাড়ীদের গ্রামে গ্রামে তুমি কিসের খোঁজে যাও, সব খবরই আমি পাই। এতকাল শুনেছি, এখন দেখলাম। তোমার লজ্জা করে না, মিশনারি হয়ে পাহাড়ী মেয়েদের ওপর সুযোগ নিচ্ছ। ছিঃ ছিঃ, মিশনারিদের মর্যাদা আর রইল না। তোমার জন্যে মিশনারিরা পাহাড়ীদের চোখে ছোট হয়ে গেল। ধিক্কার দিয়ে থামল ম্যাকেঞ্জি।
মাথার কোনো অদৃশ্য বারুদের স্তূপে আগুন ধরে গেল যেন। জ্বলন্ত চোখে ম্যাকেঞ্জির দিকে তাকাল পিয়ার্সন, কিন্তু আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, আপনি স্পাই পাঠিয়ে গ্রামে গ্রামে আমি কী বলি, কী করি, সমস্ত খোঁজখবর নেন, তা জানি। পরে সেসব বোঝাপড়া হবে। এখন এর একটা ব্যবস্থা করুন ফাদার। ওর গ্রামের লোকেরা ওকে পেলে মেরে ফেলবে।
শুধু ওকেই মারবে, তোমাকে নয়? চোখের মণি দুটো একপাশে এনে তেরছা নজরে তাকাল ম্যাকেঞ্জি। বলল, যাক সে কথা, এ ব্যাপারে আমার কিছুই করার নেই।
কিন্তু–
তীব্র গলায় এবার গর্জে উঠল ম্যাকেঞ্জি, তোমার কোনো অজুহাত আমি শুনতে চাই না। তুমি চরিত্রহীন, রিপু আর কামের বশীভূত, চার্চ তোমার জায়গা নয়। গেট আউট, বেরিয়ে যাও। ইয়াস, বোথ অফ ইউ–
কী বলছেন ফাদার!
ঠিকই বলছি। চার্চে তোমাকে থাকতে দেওয়া হবে না। মিশনারি হওয়ার তুমি অযোগ্য। তোমার মতো লোক থাকলে ক্রিস্ট্যানিটির পক্ষে ভয়ানক বিপদের কথা। গেট আউট, গেট আউট–চিৎকার করে উঠল ম্যাকেঞ্জি। উত্তেজনায় গলার শিরাগুলো ফুলে ফুলে উঠছে। ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে।
ম্যাকেঞ্জির চিৎকারে চার্চ থেকে আরো কয়েকজন মিশনারি বেরিয়ে এসেছে। একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা।
স্থির গলায় পিয়ার্সন বলল, বেশ, তাই হোক ফাদার। আমরা চলেই যাচ্ছি। আশা করি, আবার দেখা হবে। সেদিনের জন্যে সব বোঝাপড়া ভোলা রইল।
বলতে বলতে চিনাসাঙবার একটা হাত ধরে শান্ত ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে কোহিমার পথে নেমে গেল সে।
.
৪৪.
রানী গাইডিলিও এসেছে।
ছোট্ট কেলুরি গ্রামটা খুশিতে, উত্তেজনায় এবং হল্লায় মেতে উঠেছে।
গ্রামের পশ্চিম দিকে যে বড় মোরাঙটা রয়েছে, তার পাশ ঘেঁষেই একখানা সুন্দর ঘর বানিয়ে দিয়েছে কেলুরি গ্রামের মানুষেরা। মোটা মোটা বাঁশের পাটাতন, আতামারি পাতার ছাউনি আর ভেরা কাঠের দেওয়াল। ভেতরে বাঁশের মাচানে তুলোর দড়ির লেপ, খড়ের বালিশ, সব মিলিয়ে পরিপাটি বিছানা।
সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত ঘরটার সামনে নারী-পুরুষের জটলা থাকে। কেউ নিয়ে আসে রুণ স্বামীকে, কেউ পঙ্গু বাপ-মা বা ছেলেকে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের বিকলাঙ্গ, অসুস্থ, অক্ষম প্রিয়জনকে নিয়ে হাজির হয়। গাইডিলিও একটু ছোঁবেন। তার স্পর্শে রোগ-জরা চলে যাবে, অক্ষম পঙ্গু অসুস্থ মানুষগুলো সুস্থ, বলিষ্ঠ এবং সক্ষম হবে। আনিজার খারাপ নজর সরে যাবে। সেই আশায় সারাদিন ভিড় জমে থাকে গাইডিলিওর ঘরের সামনে।
এখন দুপুর। ঝকঝকে রোদে ভরে গিয়েছে চারিদিক। দূরের বনটা নিশ্চল সবুজ নদীর মতো দেখায়। বনের মাথায় এক ধরনের লাল ফুল থোকায় থোকায় ফুটেছে। মনে হয়, সবুজ নদীর মাথায় আগুন জ্বলছে।
ঘরটার পাশেই একখণ্ড তিনকোনা পাথর। তার ওপর বসে রয়েছে রানী গাইডিলিও। তাঁর সঙ্গে এসেছে জদোনাঙ, লিকোক্যুঙবা এবং আরো জনকয়েক পাহাড়ী তরুণ। গ্রামে গ্রামে দমকা ঝড়ের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন গাইডিলিও।নাগাপাহাড়ের প্রাণকোষে স্বাধীনতার যে প্রখর আকাঙ্ক্ষাটি ফুটেছে, দিকে দিকে তা প্রতিটি নাগার মনে ছড়িয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার ক্ষান্তি নেই, বিরাম নেই।
গাইডিলিওর ঘরের সামনের ফাঁকা জায়গাটায় কেলুরি গ্রামের লোকজন ভিড় করে আছে। রীতিমতো শোরগোল শুরু হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি মাতবৃরি করছে সেঙাই। কখনও ধমকে, কখনও গর্জে, আবার কখনও বর্শার বাজু দিয়ে ধাক্কা মেরে সকলকে বাগে রাখছে।
কেলুরি গ্রামে গাইডিলিও এসেছেন। এর সবটুকু কৃতিত্ব এবং গৌরব যেন একমাত্র সেঙাই এর প্রাপ্য। ঘন ঘন মাথা নেড়ে সে বলছে, বলেছিলাম না রানী আসবে, হু। দ্যাখ, কেমন বড় বড় চোখ, চওড়া কপাল–
সকলেই এসেছে, কিন্তু মেহেলী আসেনি। মাঝখানে আর পনেরো দিন, তার পরেই তেলেঙ্গা সু মাসের শুরু। সেই মাসেই সেঙাই-এর সঙ্গে মেহেলীর বিয়ে। বিয়ের আগে মেহেলীর সঙ্গে সেঙাই-এর দেখা হওয়া বারণ। তাই মেহেলী আসেনি।
ওপাশে পিঙলেই সমানে চিৎকার করছে। তার পাঁজরে বর্শার বাজু দিয়ে একটা খোঁচা লাগায় সেঙাই। সঙ্গে সঙ্গে পিঙলেই হুমকে উঠল, ওরে টেফঙের বাচ্চা, খুব ফুটুনি হয়েছে তোর। পনেরো দিন পর মেহেলীকে বিয়ে করে মোরাঙ থেকে ভাগবি, তাই বুঝি মেজাজ গরম হয়ে রয়েছে। একেবারে জানে সাবাড় করে ফেলব।
ইজু হুবতা! চুপ কর শয়তান, দেখছিস না, রানী কথা বলছে। সেঙাই ধমকে উঠল।
কে যেন বলল, ও রানী,বল না, আমাদের এই পাহাড়ের গল্প বল। কাল অনেক রাত হয়ে গেল। তাই সবটা শোনা হয়নি। আজ বাকিটা বল।
প্রসন্ন হাসিতে মুখখানা ভরে গেল রানী গাইডিলিওর। বললেন, গল্প নয়, সত্যি কথা। জানো তো, কত বড় আমাদের এই নাগা পাহাড। কত জাত আমাদের। বেঙমা, সাঙটাম, আও, লোহটা, কোনিয়াক, অঙ্গামী, সেমা। তাদের যে কত বংশ, তার ইয়ত্তা নেই। আমাদের পাহাড়ে সাহেবরা এসেছে। সাহেবদের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া নেই, কিন্তু তারা যখন আমাদের পাহাড়ে সর্দারি করছে তখন তো আর সহ্য করা যায় না।
হু-হু, একেবারে কুঁড়ে ফেলব সায়েব শয়তানগুলোকে। হু-হু– অসংখ্য গলা থেকে ক্রুদ্ধ গর্জন কেলরি গ্রামের আকাশের দিকে উঠে গেল।
সামনে হাত বাড়িয়ে গাইডিলিও বললেন, যে কথাটা বলবার জন্যে আমি পাহাড়ে পাহাড়ে ছুটে বেড়াচ্ছি সেটা মন দিয়ে শোন। সাহেবরা আমাদের মেয়েদের ইজ্জত নিচ্ছে। আমাদের ধর্ম নষ্ট করছে। এটা কি আমরা মানুষ হয়ে সইতে পারি? দু’টি শান্ত, স্নিগ্ধ চোখ কঠিন এবং তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল গাইডিলিওর। পরনে মণিপুরী বেশভূষা; তার নিচে রক্তমাংস মেদমজ্জার আড়ালে যেন একটি মশাল জ্বলছে। দুচোখের তারায় তার ছটা ফুটে বেরিয়েছে।
না-না–মাথা নেড়ে নেড়ে, লম্বা হাতের বর্শা ঝাঁকিয়ে মানুষগুলো হল্লা করতে লাগল।
অসান্যরা (সমতোলের বাসিন্দা) সাহেবদের খেদাবার চেষ্টা করছে। আমরা পাহাড়ীরা সাহেবদের পছন্দ করি না। এই পাহাড় থেকে তাদের ভাগাতে হবে। কি, তোমরা রাজি তো? স্থির দৃষ্টিতে সামনের জটলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন গাইডিলিও।
হু-হু, তুই যা বলবি, আমরা তাই করব রানী। তুই আমাদের বস্তির সেঙাই আর সারুয়ামারুকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস। সায়েবরা কি মারই দিয়েছিল! তোর কথামতো আমরা চলব। জটলার মধ্য থেকে বুড়ো খাপেগার গলা পর্দায় পর্দায় চড়তে লাগল।
গাইডিলিও বলতে লাগলেন, আমাদের এই নাগা পাহাড়ে আমরা কত জাত একসঙ্গে রয়েছি। একজনের সঙ্গে আরেকজন ঝগড়া করেছি, আবার ভালোও বেসেছি। সুচেন্যু দিয়ে একে অন্যকে কুপিয়েছি, বর্শা দিয়ে কুঁড়েছি। আবার আওশে ভোজে কি টেটসে আনিজার নামে যখন শুয়োর বলি দিই, তখন রেঙমা হলে সেমাকে ডেকে খাওয়াই, সাঙটাম হলে কোনিয়াকদের নেমন্তন্ন করি। ঝগড়া হলে নিজেরাই মিটমাট করি, কি পুষে রাখি, পিরিত করলে নিজেরাই করি। এর মধ্যে অন্য কাউকে ডাকি না, ডাকবও না। একটু দম নিয়ে আবার শুরু হল, সাহেবরা আমাদের ওপর সর্দারি করতে এসেছে। আমরা পাহাড়ী মানুষ, গায়ে রক্ত থাকা পর্যন্ত আমাদের পাহাড়ে সাহেবদের সর্দারি করতে দেব না।
ঠিক ঠিক–আবার চেঁচামেচি শুরু হল। একটানা সেই চিৎকারে ছেদ নেই। থামবার লক্ষণ নেই।
বুড়ো খাপেগা হুঙ্কার ছাড়ল, চুপ রামখোর বাচ্চারা—
শোরগোল থেমে এল।
একসময় আবার গাইডিলিও বলতে লাগলেন, তার গলাটা তীক্ষ্ণ ধাতব শব্দের মতো বাজতে লাগল, এই পাহাড়ের এক দিক থেকে আর এক দিকে আমি আর আমার বন্ধুরা ছুটে বেড়াচ্ছি। বস্তিতে বস্তিতে গিয়ে সকলকে জানিয়ে দিচ্ছি, সাহেবরা আমাদের পাহড়ে এসে কেমন করে মেয়েদের ইজ্জত নিচ্ছে, ধর্ম নষ্ট করছে, সর্দারি করছে। সেই রাগে আমাদের পেছনে লেগেছে ওরা। পুলিশরা বন্দুক নিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের পেলে গুলি করে মারবে।
তোকে মারবে! তুই আমাদের বস্তিতে রয়েছিস; একবার এদিকে এসে দেখুক না শয়তানের বাচ্চারা। জান নিয়ে ফিরতে হবে না। তুই আমাদের বস্তিতে থাক রানী। ভিড়ের ভেতর থেকে কেলুরি গ্রামের সর্দার বুড়ো খাপেগা উঠে দাঁড়াল। অর্ধনগ্ন দেহ, লাফাতে লাফাতে গাইডিলিওর পাশে চলে এল সে।
তা হয় না সর্দার। অন্য বস্তিতেও আমাদের ঘুরতে হবে। নাগা পাহাড়ের প্রতিটি মানুষকে সাহেবদের শয়তানির কথা বলতে হবে। আসান্যুরা সাহেবদের ভাগাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। দরকার হলে জান দিচ্ছে। তাদের সর্দারের নাম হল গান্ধিজি। তোমরা যদি আমার পাশে একসঙ্গে দাঁড়াও, এই পাহাড় থেকে সাদা শয়তানগুলোকে আমরাও খেদিয়ে দিতে পারি। সকলে মিলে রুখে না দাঁড়ালে সাহেবদের সঙ্গে পারা যাবে না। গাইডিলিওর গলা অত্যন্ত দৃঢ় শোনাল।
বুড়ো খাপেগার ঘোলাটে চোখের তারাদুটো নড়ে উঠল। হাতের বর্শায় ঝকানি দিয়ে সে বলল, হু-হু, তুই একবার বল না রানী, জোয়ানগুলোকে বর্শায় শান দিতে বলি, সুচ্যের ফলায় ধার দিতে বলি, অনেক তীরধনুক বানাতে বলি। আসান্যুরা সায়েবদের সঙ্গে লড়ছে, আর আমরা পারব না!
না না–সন্ত্রস্ত গলায় গাইডিলিও বললেন, খবরদার মারামারি নয়। আমরা মারব না, ওরা আমাদের মারুক। কত মারবে? মারতে মারতে নিজেরাই একদিন ঘায়েল হয়ে যাবে।
বিস্মিত, বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বুড়ো খাপেগা। বলল, এ কেমন লড়াই, মার খাব তবু মারব না!
ওপাশ থেকে সেঙাই চেঁচিয়ে উঠল, কি রে সদ্দার, কোহিমা থেকে ফিরে রানীর এই লড়াইটার কথা তোকে বলেছিলাম না? মার খেতে হবে, কিন্তু মারা চলবে না।
হু-হু–বুড়ো খাপেগা ঘাড় নাড়ল।
গাইডিলিও হয়তো আরো কিছু বলতেন–তার মুখচোখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল; তার আগেই আচমকা বুড়ো খাপেগা সরোষ, ক্ষিপ্ত গলায় চিৎকার করে উঠল, ইজা হুবুতা! এই। মেহেলী, এই মাগী, তোকে না বলেছি সেঙাই-এর সামনে বেরুবি না। পনেরো দিন পর তেলেঙ্গা সু মাসে তোদের বিয়ে। কতবার বলেছি, বিয়ের আগে তোদের দেখা হলে আনিজার গোসা হবে। তা নয়, মরদের গন্ধ না পেলে মাগী ঠিক থাকতে পারে না। তর আর সইছে না। আজ সাবাড়ই করে ফেলব শয়তানীকে। বিশ্রী, কুৎসিত মুখভঙ্গি করল বুড়ো খাপেগা।
বুড়ো খাপেগার চিৎকারে এবং তার চেয়েও অনেক বেশি আতঙ্কে, পাহাড়ী নারী-পুরুষের জটলাটা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বিয়ের আগে মেহেলীর সঙ্গে সেঙাইর দেখা হয়েছে। পাহাড়ীদের সংস্কার এবং বিশ্বাসের দিক থেকে এ এক সাঙ্ঘাতিক অপরাধ। এই অজুহাতেই আনিজার রোষ এবং দণ্ড কখন কী রূপ ধরে এসে পড়বে, সেই আশঙ্কায় মানুষগুলোকে স্রিয়মাণ দেখাচ্ছে।
জমায়েতের এক পাশে চুপচাপ কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছিল মেহেলী। ভিড়ের মধ্যে একাকার হয়ে মিশে রানী গাইডিলিওকে দেখছিল।
রানী গাইডিলিওর কথা মেহেলী শুনেছে খাপেগার কাছে। তা ছাড়া, কোহিমা থেকে ফিরে বুড়ো খাপেগার কেসুঙে বসে গাইডিলিওর অনেক গল্প করেছে সেঙাই। ভেতরের ঘর থেকে সেসবও শুনেছে মেহেলী। সেই থেকে তার মনে গাইডিলিও সম্বন্ধে এক অদম্য আগ্রহ জন্মেছে।
দু দিন হল কেলুরি গ্রামে রানী গাইডিলিও এসেছেন। মেয়ে-মরদ সকলেই তাঁকে দেখছে। অথচ মেহেলীর বেরুবার উপায় ছিল না। কেননা গাইডিলিওর কাছে সেঙাই আছে।
কাল রাতে জোয়ান ছেলেমেয়েরা রানীকে ফসল বোনার নাচ দেখিয়েছে। সারুয়ামারুর বউ জামাতসু সুরেলা গলায় গান শুনিয়েছে। খুলি এবং মোটা বাঁশের বাঁশির সুরে সমস্ত কেলুরি গ্রামটা কুঁদ হয়ে ছিল। ফুর্তিতে দুটো মোষ পুড়িয়ে খেয়েছে জোয়ানেরা। চোঙায় চোঙায় রোহিমধু গিলেছে। নাচ গান হল্লা চিৎকার বাজনা, এসব এই দু দিন অবিরাম চলছে। রানী গাইডিলিও নাচগানের খুব তারিফ করেছেন। বাজনদারেরা আর গায়েনরা খুব উৎসাহ পেয়েছে। নাচগান এবং গাইডিলিও সম্বন্ধে অদ্ভুত অদ্ভুত কথা মেহেলীকে শুনিয়ে গিয়েছিল নানাজনে। অসহ্য কৌতূহলে চুপিচুপি একবার দেখতে এসেছিল মেহেলী। ভেবেছিল, ভিড়ের আড়াল থেকে গাইডিলিওকে এক পলক দেখেই চলে যাবে, কিন্তু ঠিক খাপেগা সর্দারের নজরে পড়ে গেল।
ভয়ে আতঙ্কে বুকের ভেতরটা দূর দূর করছে। চোখের সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। ক্রমে ক্রমে বুনো অস্ফুট মনের অনুভূতিগুলো লোপ পেয়ে যাচ্ছে মেহেলীর। ঘোর ঘোর আচ্ছন্ন দৃষ্টি, বেহুঁশের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। পা-মাথা টলছে। গা কাঁপছে থরথর।
এই পাহাড়ী সমাজ বড়ই নিষ্ঠুর। তার প্রথা, সংস্কার এবং বিশ্বাসগুলো অমান্য করলে চরম শাস্তি পেতে হয়। এ ব্যাপারে সামান্য করুণা আশা করাও বৃথা।
বুড়ো খাপেগা বর্শা বাগিয়ে এগিয়ে আসছে। রানী গাইডিলিওর পাশ থেকে লিকোক্যুঙবা চেঁচিয়ে উঠল, এই সর্দার, কী করছ? খুনখারাপি করবে নাকি? এই–
লিকোক্যুঙবার গলায় বাকি কথাগুলো আটকে রইল। হঠাৎ সামনের পাঁশুটে রঙের ঘাসবন কুঁড়ে ঝড়ের গতিতে সারুয়ামারু ছুটে এল। উত্তেজনায় তামাটে মুখখানা লাল দেখাচ্ছে। বুকটা উঠছে, নামছে। ফোঁস ফোঁস নিশ্বাস পড়ছে। লম্বা দম নিয়ে সে বলল, সদ্দার, সর্বনাশ হয়ে গেছে।
মেহেলীর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল খাপেগা সর্দার। লাল লাল নোংরা দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কী হয়েছে?
সালুয়ালাঙ বস্তি থেকে অনেক সায়েব আর পুলিশ বন্দুক নিয়ে আমাদের বস্তির দিকে আসছে। কোহিমার সেই ফাদারও ওদের সঙ্গে আছে। আমাকে আর সেঙাইকে যারা মেরেছিল তারাও আছে। এতক্ষণে টিজু নদী বুঝি পেরিয়ে এল শয়তানগুলো। কী হবে সদ্দার? কী হবে রানী? সারুয়ামারুর গলাটা উত্তেজনায় এবং ভয়ে কাঁপতে লাগল।
তিনকোনা পাহাড়ী গ্রাম কেলুরি। এপারে চড়াই, ওপারে উতরাই। চারপাশে মালভূমি এবং উপত্যকা। কেলুরিতে এসেই গ্রামের তিনটি প্রান্তে তিনজন পাহাড়ী জোয়ানকে মোতায়েন রেখেছিলেন রানী গাইডিলিও। কখন, কোন দিক থেকে অতর্কিতে পুলিশ এসে হানা দেবে, কিছু ঠিক নেই। গাইডিলিও উঠে দাঁড়ালেন। শান্ত গলায় বললেন, এইবার আমাদের যেতে হবে সর্দার। টিজু নদীর দিক দিয়ে পুলিশরা আসছে। বাঁ দিকে খাদ। আমরা কোন দিক দিয়ে যাব? কোন দিক দিয়ে গেলে ওরা আমাদের দেখতে পাবে না, সেটা দেখিয়ে দাও সর্দার।
কেন যাবি আমাদের বস্তি থেকে? সায়েবরা আসছে, লড়াইটা বাধিয়ে দিই। আসান্যুরা সায়েবদের সঙ্গে লড়াই করছে, আমরা পাহাড়ীরা পারি কিনা দেখ?
না না সর্দার, মারামারি খুনোখুনি আমাদের লড়াই নয়। একথাটা তোমাদের অনেক বার বলেছি। একটু থেমে, দৃঢ় গলায় বলতে লাগলেন গাইডিলিও, আমরা ধরা পড়লে তো চলবে সর্দার। নাগা পাহাড়ের সব মানুষকে সাহেবদের সম্বন্ধে বলতে হবে। বোঝাতে হবে। বুড়ো খাপেগা মাথা নাড়ল, হু-হু–
গাইডিলিও বললেন, একটা কথা তোমরা মনে রেখো সর্দার, একটু পরেই পুলিশ আসবে। গ্রাম তছনছ করে দেবে, তোমাদের মারবে, ঘরে হয়তো আগুন ধরিয়ে দেবে। তোমরা কিন্তু তাদের মেরো না। না মেরে, মার খেয়েই আমাদের লড়াই চলবে।
বিহ্বল চোখে তাকিয়ে রইল বুড়ো খাপেগা। খানিক পর বলল, সায়েবরা মারবে, মার খাব আর মারব না, তেমন মানুষ আমরা পাহাড়ীরা নাই। হু-হু–
শঙ্কিত গলায় গাইডিলিও বললেন, না না, মারামারি নয় সর্দার। তোমরাই তো বলেছিলে আমি যা বলব, তাই করবে।
নীরবে ঘাড় নাড়ল বুড়ো খাপেগা। তাতে হাঁ-না কিছুই বোঝা গেল না।
সামনের দিকে এগিয়ে এলেন রানী গাইডিলিও। তার পেছনে জদোনাঙ। পাশে পাশে আরো জনকয়েক পাহাড়ী তরুণ।
চলতে চলতে গাইডিলিও বললেন, এখন যাচ্ছি সর্দার, আবার আমরা তোমাদের গ্রামে আসব। যেদিন এই পাহাড়ের কোথাও সাহেবদের সর্দারি থাকবে না সেদিন নিশ্চয়ই আসব। আজ সাহেবদের ভয়ে আমাদের পালিয়ে যেতে হচ্ছে, সেদিন পালাতে হবে না। আবেগে গলাটা কাঁপতে লাগল তার।
অস্ফুট মন দিয়ে গাইডিলিওর ভাবাবেগ বোঝা সহজ নয়। তবু তার কথাগুলো বুড়ো খাপেগার মন ছুঁয়েছে। নিঃশব্দে সে মাথা নাড়ছে।
গাইডিলিও আবার বললেন, দু’দিন তোমাদের গ্রামে রইলাম। তোমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না সর্দার।
বুড়ো খাপেগা ফের বলে উঠল, তুই থেকে যা রানী, তোর যদ্দিন খুশি।
একটু ম্লান হাসি ফুটল গাইডিলিওর মুখে, এখন আর তা হয় না সর্দার, যেদিন নিশ্চিন্তে এসে থাকতে পারব সেদিন আসব।
একসময় সকলে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে এসে পড়ল। বুড়ো খাপেগা সামনের দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে বলল, হুই উতরাই ধরে চলে যা। তিনটে পাহাড় পেরিয়ে গেলে কোনিয়াকদের বস্তি ইটিগুচি পাবি। ওদের সদ্দারের কাছে আমার নাম বলবি। সে আমার দোস্ত। সেখানে তোদের কোনো ভয় নেই। হুই সায়েব শয়তানদের সাধ্যি নেই সেখানে গিয়ে তোদের গায়ে হাত তোলে।
উতরাই ধরে দু’পা নিচের দিকে নেমে গিয়েছিলেন গাইডিলিও। থেমে, পেছন ফিরে বললেন, পুলিশরা তোমাদের বস্তিতে আসছে। হয়তো অনেক অত্যাচার করবে। তোমরা কিন্তু ওদের মেরো না। তাতে আমাদের, এই নাগা পাহাড়ের ভীষণ ক্ষতি হবে।
এর পর নিচে নামতে লাগলেন রানী গাইডিলিও।
সামনে নিবিড় জটিল বন, প্রকৃতির অফুরান বদান্যতা। মধ্যে মধ্যে আঁকাবাঁকা ঝরনা, জলপ্রপাত এবং ছোট ছোট পাহাড়ী নদী। সেগুলোর মধ্য দিয়ে একটা পথ সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। একটি মাত্র পথ। দুর্গম এবং ভয়ঙ্কর।
চলতে চলতে মুখ উঁচু করে গাইডিলিও আকাশের দিকে তাকালেন।