৪০. কুয়ো
আমেরিকায় গিয়ে বাংলাদেশের বাঙালিরা কী করে? মুসলমানরা মসজিদ বানায়, হিন্দুরা মন্দির বানায়। শুরু হয়ে যায় মহাসমারোহে ধর্মের কুয়োয় সাঁতার কাটা। আজ একটা খবর পড়লাম বাঙালি মুসলমানরা সুন্নি আন্দোলন করছে নিউইয়র্কের জামাইকায়। ডলার কামাবে, দেশের রাজনীতি নিয়ে এর ওর সাথে অর্থহীন কিছু কথা বলবে, আর ধর্ম করবে। এ ছাড়া বেশি কিছুতে আগ্রহ তাদের নেই। অথচ কত কিছু করার আছে দেশটিতে, কত কিছু জানার আছে, শেখার আছে! কত রকম আন্দোলন চলছে মেইনস্ট্রিমে, নারী-অধিকার আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, সমকামী-রূপান্তরকামীদের আন্দোলন, বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সেক্যুলার আন্দোলন, সবার জন্য ফ্রি শিক্ষা ফ্রি চিকিৎসার আন্দোলন, মুক্তচিন্তার আন্দোলন, আদিবাসীদের জন্য—কালোদের জন্য—অভিবাসীদের জন্য আন্দোলন, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, অক্যুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন, আরও কত সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলন! কিছুতে নেই বাঙালি। পড়ে আছে কুয়োয়। অথচ সমুদ্র কাছেই, সমুদ্রে সাঁতরাবে না।
বাংলাদেশের কুয়ো থেকে বেরিয়ে ইউরোপ আমেরিকাতেও এরা নিজেদের জন্য কুয়ো বানিয়ে নেয়।
৪ ১. মধ্যযুগ
মধ্যযুগই তো অন্ধকার যুগ। সে যুগে ছিল ছোট ছোট রাজ্য। সেই রাজ্যের রাজারা ছিল প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী, ক্ষমতার জন্য নির্বিচারে মানুষ খুন করতো, প্রজাদের তারা দু’পয়সার দাম দিত না। ছিল স্বার্থান্ধ, ছিল ধর্মান্ধ, ছিল নির্মম, নিষ্ঠুর, কেউ যদি মাথা না নোয়াতো, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো, তার সর্বনাশ করতো রাজারা।
হাজার বছর পার হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর রাজাদের এখন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি বলে ডাকা হয়। সময় বদলেছে, প্রজা বদলেছে, রাজ্য বদলে রাষ্ট্র হয়েছে, রাজতন্ত্র গিয়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ইত্যাদি নানা তন্ত্র এসেছে, কিন্তু রাজাদের চরিত্র বদল হয়নি।
৪২. মানববন্ধন
কুকুর নিধন করার কুবুদ্ধি দিতে মানববন্ধন। মানবের মতো হিংস্র বর্বর কুৎিসত কদাকার জন্তু আর নেই। কুকুর রাস্তায় কেন, না খেয়ে থাকে কেন, ডাস্টবিনে খাবার খোঁজে কেন? কুকুরদের ঘরে নিয়ে পোষো। মানুষ পোষার চেয়ে কুকুর পোষা ভালো। তা পুষবে কেন? দেশি কুকুর যে! বড়লোকি দেখানোর জন্য পুষবে বিদেশি কুকুর!!
৪৩. জলদস্যু
মধ্যযুগে ইউরোপের জলদস্যুদের জীবন ঠিক কেমন ছিল, তা জানতে গিয়ে পেলাম বিধর্মীদের খুন করে তাদের ধন সম্পদ জায়গা জমি দখল করতো বহুঈশ্বরবাদী পেগান জলদস্যুরা। এটিকে তারা তাদের ধর্মীয় কর্তব্য বলে মনে করতো। যুদ্ধের মাঠে বিধর্মীদের হাতে মৃত্যু হলে, তারা বিশ্বাস করতো, তারা সোজা ভালহালায় যাবে। ভালহালা মানে বেহেস্ত। ভালহালায় তারা চরমানন্দে বাস করবে, সুরা পান করবে, সুস্বাদু খানা খাবে। ইসলামেও তো একই জিনিস। ‘দারুল ইসলাম’ তো বিধর্মীদের মেরে তাদের জায়গা জমি দখল করার নামই। আর বিধর্মী দ্বারা খুন হওয়া মানেই তো শহিদ হওয়া, শহিদ হলে সোজা বেহেস্ত, ঠিক সোজা ভালহালার মতো। বেহেস্তেও ভালহালার মতো অপেক্ষা করছে সুরা আর সুস্বাদ্য খানা।
নামাজ রোজা হজ মজ সব তো আরবের মূর্তিপুজক পেগানদের কালচার রিচুয়াল।
আর আদম হাওয়ার গপ্প? ও তো বাইবেল থেকে কপি পেস্ট।
তাইলে কী দাঁড়াইলো?
কী দাঁড়াইলো তা আমরা টের পাইতাছি।
আসল কথা হল, জলদস্যুরা কি এখন জলদস্যু? না। তারা কি এখন বিধর্মীদের খুন করে জায়গা জমি দখল করায় বিশ্বাস করে? না। তারা কি বিশ্বাস করে বিধর্মী দ্বারা খুন হলে তারা ভালহালায় যাবে? না। ইহুদি খ্রিস্টানরা কি আদম হাওয়ার গপ্পে এখন বিশ্বাস করে? কিছু গোবর-মাথা ছাড়া কেউ বিশ্বাস করে না।
কাদের এইসব রূপকথা পুরাণকথায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস?
৪৪. আমি
বই পড়তে পড়তে বই বন্ধ করে দিতে হয়, ছবি দেখতে দেখতে পজ বাটন টিপতে হয়—যখনই দুঃখের কোনও ঘটনা আসে। কারও কোনও কষ্ট বা কোনও মৃত্যু আমি সইতে পারি না। সেই যে ছোটবেলায় গল্পের বই পড়তে পড়তে বালিশ ভেজাতাম, এখনও সেইরকমই। সিনেমা হল থেকে কত যে চোখের জল মুছতে মুছতে বেরিয়েছি। গত কয়েকদিন নেটফ্লিক্সে দ্য লাস্ট কিংডম সিরিজটা দেখছিলাম। টানা বেশিক্ষণ দেখতে পারি না। বার বার পজ বাটন টিপতে হয়। যখনই রাজা আলফ্রেড তাঁর যোদ্ধা উট্রেডের সঙ্গে জঘন্য ব্যবহার করেন, সোজা কথা বেইমানি করেন, তাঁকে প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করেন, তখনই আমাকে পজ বাটন টিপতে হয়। যখনই কোনও সংঘর্ষে এ ওর গলা চিরে দেয়, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয়, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকি, অথবা ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে অন্য দৃশ্যে নিয়ে যাই। কোনও যুদ্ধ, কোনও বর্বরতা, কোনও রক্তপাত আমি নিতে পারি না। উট্রেড যখন হাসিখুশি, যখন ওকে ভালোবাসে কেউ, তখন ভালো লাগে দেখতে। যখন মানুষ খাচ্ছে, পান করছে, হাসছে, জোক করছে, ভালো লাগে। র্যাগ্নার যখন অসুস্থ উট্রেডকে সেবা করে সুস্থ করে তোলে, ভালো লাগে। উট্রেড যখন র্যাগ্নারকে জড়িয়ে ধরে, ভালো লাগে।
এত পালকের মতো নরম কেন আমার মন! আমি নিজেই বুঝে পাই না। অথচ এক জীবনে কত ভয়ংকর ভয়ংকর বিরোধিতা, শত্রুতা, এমনকি আমাকে হত্যা করার নীল নকশার সামনে অনড় এবং দৃঢ় দাঁড়িয়েছি। ভাঙিনি তো কোনওদিন! তাহলে কি নিজের দুঃখ সইতে পারি, অন্যের দুঃখ পারি না?
৪৫. বিষফোঁড়া উপন্যাস নিষিদ্ধ
এভাবে আমার বইগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। লজ্জা, আমার মেয়েবেলা, উতল হাওয়া, ক, সেইসব অন্ধকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা হবে না, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত লাগবে ইত্যাদি বুলশিট কারণ দেখিয়ে নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। নিষিদ্ধ করে নারীবিরোধী মৌলবাদী অপশক্তিকে জিতিয়ে দিয়েছে।
এবার মাদ্রাসায় শিশু ধর্ষণ নিয়ে উপন্যাস নিষিদ্ধ করে ধর্ষকদের পক্ষে সরকার দাঁড়ালো। ধর্ষক যেহেতু ধার্মিক, তাই ধার্মিকের পক্ষে দাঁড়ালো সরকার। ধার্মিক যত অন্যায়ই করুক ধার্মিকের সাত খুন মাফ।
লেখকদের লেখা গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধের বই জননিরাপত্তার জন্য কখনো হুমকি নয়। মাদ্রাসার শিশু ধর্ষকেরা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি।
৪৬. ধর্মান্ধ
এক ধর্মান্ধ গোষ্ঠী আরেক ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ধর্মান্ধ হওয়ার অপরাধে গালি দিচ্ছে। সব ধর্মান্ধই মনে করে তার ধর্মই অন্য সব ধর্মের চেয়ে ভালো। তার ধর্মই সেরা।
ধর্মান্ধরা একে অপরকে অনুকরণ করে। তারা ওপরে ওপরে শত্রু, ভেতরে ভেতরে বন্ধু।
মধ্যযুগের ইউরোপ যেমন ধর্মান্ধ এবং বর্বর ছিল, আমরা এখন তেমন ধর্মান্ধ এবং বর্বর। ওপরে ওপরে আধুনিক, ভেতরে ভেতরে প্রাচীন ।
৪৭. গ্রন্থ
কোনও ধর্মগ্রন্থই সমতার কথা, সমানাধিকারের কথা বলেনি। বাইবেলও তো বলেছে বিধর্মীকে মেরে ফেলার কথা, নারীকে তাদের প্রাপ্য অধিকার না দেওয়ার কথা, কিন্তু ইহুদি খ্রিস্টানরা তো বাইবেলের উপদেশ মেনে চলছে না। তারা ধর্মগ্রন্থের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সংবিধানও লেখেনি, আইনও তৈরি করেনি। মুসলমানের দেশই শুধু ধর্মগ্রন্থ আঁকড়ে পড়ে আছে। ১৪০০ বছর আগে আরব দেশের বর্বর লোকেরা যে সমাজ তৈরি করেছিল, আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও সারা বিশ্বের মুসলমান সেই সমাজকে অনুকরণ করছে। মুসলমানদের সংবিধানে, রাষ্ট্রে, সমাজে, আইনে, রীতিতে সবখানে প্রাচীন কোরান হাদিস।
বাইবেল, কোরান পালটানো যায় না। কারণ ওসব অন্যের লেখা গ্রন্থ। কিন্তু সমাজ পালটানো যায়। ধর্মগ্রন্থে যা-ই লেখা থাকুক, যতই বৈষম্য, অসাম্য, থাকুক, সমাজকে সমতার ভিত্তিতে গড়ে তোলা সম্ভব। ইউরোপের খ্রিস্টানরাই প্রমাণ করেছে সম্ভব। এখনকার মুসলমান সমাজের মতো খ্রিস্টানরাও ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের এক কালে হত্যা করতো। এখন ঈশ্বরে অবিশ্বাস করাটাই আধুনিকতা। মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে সভ্যতার কথা নেই বলে মুসলমানেরা কোনওদিন সভ্য হবে না, এ আমি বিশ্বাস করি না। তারাও একদিন সংবিধান থেকে, আইন থেকে, সমাজের রীতিনীতি থেকে ধর্ম দূর করবে। সভ্য হওয়ার তাগিদেই করবে।
৪৮. জন্মদিন
জন্মদিন টন্মদিন আমার পালন করতে ইচ্ছে করে না। হিসেব করে দেখলাম আমার এখন যে বয়স, সে বয়সে আমার মা মারা গিয়েছিলেন। এই বয়সে পৌঁছোনোর আগে বুঝিনি, এখন বুঝি যে মা খুব অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। জন্মদিন আসা মানে কবরের দিকে আরও একটি বছর এগিয়ে যাওয়া। আমি তো মৃতদেহ দান করেছি হাসপাতালে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার কাজে। সুতরাং আমার মৃতদেহ কবরে যাবে না, চিতায় উঠবে না, জলে ভাসবে না, কফিনে ঢুকবে না, আমার মৃতদেহ শুয়ে থাকবে হাসপাতালের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে, অথবা ল্যাবে। এর চেয়ে ভালো সৎকার আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু মৃত্যুর কথা আমি ভাবতে চাই না। যেদিন চলে যেতে হবে, সেদিন চলে যাবো। কিন্তু শেষদিন পর্যন্ত যেন ভাবতে পারি, বলতে পারি, লিখতে পারি। যেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারি। সব নিষেধাজ্ঞাকে যেন উড়িয়ে দিতে পারি। শেষদিন পর্যন্ত।
আজ কত মানুষ যে জন্মদিনের শুভেচ্ছা পাঠাচ্ছে আমাকে! দেখে মনে হয় এতকাল আদর্শের জন্য সংগ্রাম ক’রে শুধু কি নির্বাসন, ফতোয়া, প্রত্যাখ্যান, নিষেধাজ্ঞা, অবজ্ঞা, অপবাদ, উপেক্ষা, নিন্দা আর ঘৃণাই জুটেছে? ভালোবাসাও তো পেয়েছি অনেক। আমি এক ভালোবাসার সামনেই মাথা নোয়াই।
৪৯. ভাইকিং
ভাইকিংরা কী বীভৎস বর্বর ছিল, কী অসভ্য, কী জঘন্য লোক ছিল ওরা! ওরা দস্যু ছিল, নৌকা দিয়ে বিভিন্ন দেশে যেত, যাকে পেতো তাকেই কুড়োল দিয়ে কুপিয়ে মারতো, আর অন্যের দেশ থেকে সোনা রূপা লুঠ করে নিয়ে আসতো। এটিই ছিল ওদের কাজ। অশিক্ষিত বর্বর, ধর্মান্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভাইকিংদের উত্তরসূরিরাই আজ ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ের নাগরিক। আজ ওসব দেশ বিশ্বের ধনী দেশই শুধু নয়, সভ্য দেশ, উন্নত দেশ, ধর্ম এবং কুসংস্কারমুক্ত দেশ, গণতন্ত্রের, বাকস্বাধীনতার, আর মানবাধিকারের জন্য শ্রেষ্ঠ দেশ।
৭৯৩ থেকে ১০৬৬ সাল। যে সময় ভাইকিংরা খুন আর লুটতরাজে ব্যস্ত, কী করছেন তখন আমাদের এ অঞ্চলের পূর্বসূরিরা? কাব্য রচনা করছেন, সংগীত সাধনা করছেন, দর্শন আওড়াচ্ছেন, শিল্প, স্থাপত্য আর সংস্কৃতির চর্চা করছেন। অত শিক্ষা সভ্যতা দিয়ে কী হল? আজ এ অঞ্চল পিছিয়ে থাকা, দারিদ্রে, ধর্মান্ধতায়, মূর্খতায়, অসভ্যতায় ডুবে থাকা। এতে সত্যিকার গণতন্ত্র নেই, বাকস্বাধীনতার বও নেই, মানবাধিকার তো নেইই।