কিস তরত্ কাটে কোঈ শবহা-এ তার-এ বর্ষগাল
হৈ নজর খুক্রদহ্-এ অন্তর-শুমারী, হায় হায়।।
(কেমন করে কাটবে বর্ষার অন্ধকার রাত্রিগুলি,
আমার চোখ যে তারা গুনতেই অভ্যস্ত হয়ে আছে, হায়।)
একটা কিস্সা শুনুন ভাইজানেরা মহাভারত-এ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে এই বৃত্তান্তটা বলেছিলেন। বনের ভিতরে এক শিকারির বিষাক্ত তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে এসে লেগেছিল বিরাট, প্রাচীন এক গাছের শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে গাছটা পুড়তে শুরু করল। সেই গাছের ডালে বাসা বেঁধে থাকত নানারকম পাখি। গাছের মৃত্যু অবধারিত জেনে পাখিরাও পালাতে শুরু করল।শুধু একটা শুকপাখি তার বাসাতেই রয়ে গেল। এদিকে গাছকে জড়িয়ে আগুন ছড়াচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই আগুন শুক পাখিকেও গ্রাস করবে। নিজের মৃত্যু সামনে দেখেও শুকপাখিটা তার বাসা ছেড়ে নড়ল না। আকাশপথ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র এই ঘটনা দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি শুকপাখিকে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই উড়ে চলে গেল, তুমি এখনও বসে আছ কেন? তুমি কি আগুনে পুড়ে মরতে চাও?
-দেবরাজ, এই গাছেই আমার জন্ম, এর ডালে-পল্লবে ঘুরে ঘুরে আমি বড় হয়েছি, এই প্রাচীন। বৃক্ষের কাছেই শিখেছি, কীভাবে ধৈর্য ধরে বেঁচে থাকতে হয়, কত ঝড় ঝঞ্ঝায় এই গাছই আমাদের বাঁচিয়েছে।
-কিন্তু গাছের সঙ্গে সঙ্গে তো তুমিও মরবে।
-তাই হোক, দেবরাজ।
-মৃত্যুকে ভয় পাওনা তুমি?
-কে না পায়? শুকপাখি ম্লান হেসে বলে, কিন্তু দেবরাজ, মৃত্যুভয়ের জন্য কি কেউ ধর্মকে ত্যাগ করতে পারে?
-কী তোমার ধর্ম?
-এই গাছের জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি। দুর্দৈবের দিনে তো আমি তাঁকে ছেড়ে যেতে পারি না।
-সাধু, সাধু। এমন ধার্মিক উত্তর আমি তোমার কাছে আশা করেছিলাম, হে শুকশ্রেস্ট। তুমি কী বর চাও, বলো?
-আমার প্রার্থণা আপনি পূরণ করবেন?
-অবশ্যই।
-তাহলে এই প্রাচীন বৃক্ষের জীবন ফিরিয়ে দিন।
ইন্দ্রের বরে বৃক্ষ আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। কিন্তু যে প্রাচীন গাছটিতে আমি জন্মেছিলাম, বড় হয়েছিলাম, তাঁকে বাচানোর মতো কেউ ছিল না মির্জাসাব। দেশভাগের বিষাক্ত তির তাঁকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিয়েছিল। একটা দেশ ভেঙে পরপর দুদিনে দুটো দেশের জন্ম হল সারা হিন্দুস্থান জুড়ে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। কে ভুল, কে ঠিক, তা আমি আজ বিচার করতে চাই না-তার জন্য তো রাজনৈতিক নেতা, ঐতিহাসিকরা আছেন-এই কবরেও দুঃস্বপ্নগুলো ফিরে ফিরে আসে। কেউ বলেছে, এক লাখ হিন্দু মারা গেছে, কেউ বলেছে, এক লাখ মুসলমান মারা। গেছে। আমি তাদের বলছি, বলো, দুলাখ মানুষ মারা গেছে, হিন্দুদের মেরে মুসলমানরা ভেবেছে, হিন্দু নিকেশ হয়ে গেছে, হিন্দুরা মুসলমানদের মেরে ভেবেছে ইসলামকে কবরে পাঠানো গেছে। মির্জাসাব কাকে বোঝাবেন বলুন, ধর্ম তো এভাবে মরে না, ধর্ম বেঁচে থাকে আমাদের হৃদয়ে, বিশ্বাসে। শুধু ধর্মের নামে ভাই ভাইকে হত্যা করেছে, ভাই বোনকে ধর্ষণ করেছে, আর এক দেশ থেকে অন্য দেশে উদ্বাস্তুর স্রোত বয়ে গেছে। ওই নেহেরু-জিন্না পটেলদের হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। কী ঘৃণা, কী অবিশ্বাস চারদিকে। এই। নেতারা সব ছারপোকা, ভাইজানেরা, গরম জল ঢেলে তাদের নিকেশ করতে হয়। আমাদের মতো মানুষের রক্ত খাওয়া ছাড়া এদের আর কোনও কাজ নেই। না, মির্জাসাব, এদের কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
এমন এক গনগনে আগুনের মধ্য দিয়ে দিনগুলো পেরিয়ে যাচ্ছিল, যখন বন্ধুও বন্ধুকে হত্যা করতে পিছপা হয় না। হত্যালিপ্সা কী চেহারা নিতে পারে, তা আমি একদিন বুঝতে পেরেছিলাম। প্রতিদিন হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান মরছে। একদিন শ্যাম আর আমি রাওয়ালপিন্ডি থেকে আসা এক শিখ পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। শ্যাম তো রাওয়ালপিন্ডিরই ছেলে। কিভাবে ওই পরিবারের আত্মীয়-পরিজনকে হত্যা করা হয়েছে, শুনতে শুনতে আমার হাড় হিম হয়ে যাচ্ছিল। শ্যামও খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। বুঝতে পারছিলাম, ওর মনের ভিতরে কী চলছে। বেরিয়ে আসার পর দেখলাম, শ্যাম তখনও কেঁপে – কেঁপে উঠছে। আমি ওর পিঠে হাত রাখলাম। শ্যাম আমার দিকে শূণ্য চোখে তাকিয়ে রইল, যেন আমাকে চেনেই না।
-শ্যাম
ও চুপচাপ হাঁটছিল।
-কী হয়েছে শ্যাম?
ম্লান হেসে বলল,কিছু না।
-তোমার কষ্ট হচ্ছে, না?
-না। শ্যামের দাঁত ঘষটানির আওয়াজ পেলাম।
-শ্যাম, আমি তো মুসলমান। আমাকে তুমি মারতে চাও না? আমি তার কাঁধ চেপে ধরি।
শ্যাম ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকায়।
-বলো শ্যাম, সত্যি বলো, আমাকে মারতে চাও না?
শ্যাম কেটে কেটে বলল, না, এখন আর চাই না।
-তার মানে?
-যখন ওদের কথাগুলো শুনছিলাম-মুসলিমরা কীভাবে আমাদের হত্যা করেছে-হ্যা, তখন-তখন আমি তোমাকে সত্যিই খুন করতে পারতাম, মান্টো।
শ্যাম আমার হাত চেপে ধরে কেঁদে ফেলেছিল, আমাকে ক্ষমা করো মান্টো।
মির্জাসাব, এ তো শুধু হিন্দুস্থান কা তক্সী নয়, এ যে বন্ধুত্বেরও তক্সী। এত খুন-খারাবি, লুঠপাট-রক্তের স্রোতে ভাসছে মুণ্ডহীন শরীর-শিশুদেরও দুঠ্যাং ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছে-উপর্যুপরি ধর্ষিতা মেয়েটির মুখের উপর ভনভন করে মাছি উড়ছে-আমি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, চারদিকে এত ঠাণ্ডা গোস্ত, ইয়া আল্লা আমি বেঁচে আছি তো?
হ্যাঁ, বেঁচে ছিলাম, ঈশ্বর সিংয়ের মতোই বেঁচেচিলাম। তখনও ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমি পুড়ছি। ঈশ্বর সিং কীভাবে বেঁচে থাকল, আমি ভেবেই পাই না, মির্জাসাব। ভাইজানরা, অনেকদিন। আগে কথা দিয়েছিলাম, ঠাণ্ডা গোস্ত-এর গল্প একদিন আপনাদের শোনাব।
সে এক মধ্যরাত্রির কাহিনি। ঈশ্বর সিং-এর জীবনের এক মধ্যরাত্রি, আর আমাদের জীবনেরও, যারা ভারতবর্ষ নামে একটা দেশের বুকেই বেঁচে ছিলাম, কিন্তু বুকটা দুফালি করে আমাদের আলাদা হয়ে যেতে হবে, কে জানত! সেই রাতে ঈশ্বর সিংকে ঘরে ঢুকতে দেখে কুলবন্ত কাউর বিছানা থেকে নেমে এসেছিল। ধারালো চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল কুলবন্ত। বিছানায় এসে বসে কুলবন্ত দেখল, ঈশ্বর সিং কেমন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেন কোনও সমস্যার সমাধান কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। হাতে কৃপাণ নিয়ে সে ঘরের এক কোণে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পাগরিটা ঢিলে হয়ে গেছে। কুলবন্ত দেখল, কৃপাণ ধরে থাকা হাতটা কাঁপছে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ কেটে যাওয়ার পর নীরবতা সহ্য না করতে পেরেই কুলবন্ত ডেকে উঠল, ঈশ্বর সিয়াঁ।
ঈশ্বর সিং এক মুহূর্ত কুলবন্তের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
-ঈশ্বর সিয়াঁ, কদিন ধরে কোথায় থাকো, কী করো, বলো তো? কুলবন্ত চেঁচিয়ে ওঠে।
-জানি না।
-এ আবার কোন উত্তর হল!
কৃপাণটা ছুঁড়ে ফেলে ঈশ্বর সিং বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাঁকে দেখে মনে হয়, বেশ কয়েকদিন ধরে সে অসুস্থ। ঈশ্বরের কপালে হাত রেখে কুলবন্ত বলল, কী হয়েছে জানি?
ঈশ্বর সিং সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। কুলবন্তের দিকে তাকিয়ে সে গুমরে উঠল, কুলবন্ত।
-বোলো জানি।
পাগড়ি খুলে ফেলে ঈশ্বর সিং আবার কুলবন্তের দিকে তাকাল। তার চোখ দেখে মনে হয়, কুলবন্তের কাছে সে আশ্রয় পেতে চায়। তারপর একটা গোঙানি বেরিয়ে এল তার মুখ থেকে, আমি পাগল হয়ে যাব কুলবন্ত।
ঈশ্বর সিংয়ের চুলে বিলি কাটতে কাটতে কুলবন্ত বলল, কদিন ধরে কোথায় আছ বলো তো?
দাঁতে দাঁত চিপে ঈশ্বর সিং বলল, শালা মাদারচোদ্দ, আমার শত্তুরের মায়ের সঙ্গে বিছানায়। হঠাই সে কুলবন্তকে জড়িয়ে ধরে তার বুক টিপতেটিপতে হাসতে লাগল, কসম ওয়াহে গুরু কি, তোমার মত অওরৎ আমি আর দেখিনি কুলবন্ত।
কুলবন্ত বুক থেকে ঈশ্বর সিংয়ের হাত সরিয়ে দিয়ে বলে, মেরি কসম, সাচ্চা বলো, কোথায় ছিলে? শহরেই?
-না।
-আমার মন বলছে, শহরেই ছিলে। প্রচুর টাকা লুঠ করে এখন আমার কাছে লুকোতে চাইছ, তাই না?
-তোমাকে মিথ্যে বললে আমি বাপের পুত্তর না।
কুলবন্ত কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফুঁসে উঠল, সেদিন রাতে তোমার কী হল, আমি তো এখনও বুঝতে পারছি না। আমার পাশেই তো শুয়েছিলে। লুঠ করে আনা অত গয়না আমাকে পরিয়ে দিয়েছিলে। চুমু খেতে খেতে কত কথাই না বলছিলে। তারপর হঠাৎ কী হল তোমার। একটা কথাও না বলে জামাকাপড় পরে বেরিয়ে গেলে। কী-কী হয়েছিল বলো তো?
ঈশ্বর সিং কে দেখে মনে হচ্ছিল, কেউ তার মুখ থেকে সব রক্ত শুষে নিয়েছে।
-ঈশ্বর সিয়াঁ তোমার ভেতরে কিছু চলছে। আমাকে লুকোচ্ছ।
-কিছু না। তোমার দিব্যি কুলবন্ত।
-কিন্তু আটদিন আগে যে মানুষটাকে দেখেছি, সে তো তুমি নও। কেন? কী করেছ, বলো?
ঈশ্বর সিং কোন কথা না বলে কুলবন্তকে জড়িয়ে ধরে, পাগলের মতো চুমু খেতে খেতে বলে, জানি, আমি তোমার সেই ঈশ্বর সিয়াঁ।
-সেদিন রাতে কী হয়েছিল, সত্যি সত্যি বলো।
-শালা মাদারচোদের মাকে
-আমাকে বলবে না?
-কী বলব? কী বলার আছে?
-মিথ্যে বললে তুমি নিজের হাতে আমাকে পোড়াবে ঈশ্বর সিয়াঁ।
কুলবন্তকে আরো জোরে চেপে ধরে ঈশ্বর সিং, তার গলায় চুমু খেতে থাকে। কুলবন্ত হেসে ওঠে, ঈশ্বর সিং-ও হাসতে থাকে। তারপর সে জামা খুলে ফেলে বলে ওঠে এসো, এবার তা হলে তাস খেলা যাক।
কুলবন্ত ছদ্মরাগ দেখিয়ে বলে, জাহান্নামে যাও।
ঈশ্বর সিং কুলবন্তের ঠোঁট চুষতে শুরু করে। কুলবন্ত আর আর বাধা দিতে পারে না। ঈশ্বর সিং চেঁচিয়ে ওঠে, শালা এবার তুরুপের তাস। কুলবন্তকে নগ্ন করে তার শরীর চাটতে থাকে সে।
কুলবন্ত বলে ওঠে, তুমি একটা জন্তু।
-হ্যাঁ, জন্তুই তো।
কুলবন্তের ঠোঁট, কানের লতি কামড়াতে থাকে সে, বুক টেপে, চোষে, পেটে মুখ ঘষতে থাকে। কুলবন্তের শরীরও জ্বলে ওঠে। কিন্তু ঈশ্বর সিং টের পায়, এত কিছু করেও তার নিজের শরীর জাগছে না। কুলবন্ত একসময় গোঙাতে-গোঙাতে বলে, অনেক তাস ভেঁজেছো ঈশ্বর সিয়াঁ। তুরুপের তাস কোথায়?
না, তুরুপের তাস আজ তার হাতে নেই। অবসন্ন, হতাশ ঈশ্বর সিং বিছানায় মুখ ঢেকে শুয়ে। পড়ে। এবার কুলবন্ত তাঁকে নানাভবে জাগানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়। শেষে বিরক্ত কুলবন্ত চেঁচিয়ে ওঠে, কোন ডাইনের সঙ্গে এই কদিন বিছানায় শুয়েছো ঈশ্বর সিয়াঁ? সে তো তোমাকে ছিবড়ে বানিয়ে দিয়েছে।
ঈশ্বর সিং হাফাতে থাকে। কুলবন্ত আরও চেঁচায়, বলো তো কোন ডাইন-তার নাম বলো
-কেউ না কুলবন্ত। আমার জীবনে আর কেউ নেই।
-আজ আমাকে সত্যিটা জানতেই হবে। ওয়াহে গুরুর নামে দিব্যি করে বলল, মাগীটা কে? মনে রেখো আমি সর্দার নিহাল সিংয়ের মেয়ে। মিথ্যে বললে তোমার মাংস কিমা করে ছাড়ব। এবার বলো, মাগীটা কে?
ঈশ্বর সিং শুধু মাথা নাড়ছিল। কুলবন্ত তখন রাগে উন্মাদ। মেঝেয় পড়ে থাকা কৃপান তুলে নিয়ে সে ঈশ্বর সিংয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঈশ্বর সিংয়ের গাল থেকে রক্ত ঝড়তে থাকে। কুলবন্ত ঈশ্বর সিংয়ের চুল ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গালাগালির ফোয়ারা ছোটায়। ঈশ্বর সিং ঠাণ্ডা গলায় বলে, এবার থামো কুলবন্ত।
-কুত্তিটা কে, আগে বলো।
ঈশ্বর সিংয়ের গাল বেয়ে রক্তধারা নামছে জিভ দিয়ে সে নিজের রক্তের স্বাদ নেয়। তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যায়। সে মাতালের মতো বলে, কী বলব আমি কুলবন্ত? এই কৃপাণ দিয়ে আমি ছজনকে খতম করেছি।
-আবার জিজ্ঞেস করছি, কুত্তিটা কে?
-মেয়টাকে কুত্তি বোলো না। ঈশ্বর সিং ধরা গলায় বলে।
-মানে? কে ও?
-বলছি। মুখ মুছে সে তার রক্তমাখা হাতের দিকে তাকায়। তারপর বিড়বিড় করে বলে, শালা সব-আমরা সব মাদারচোদ।
-আসল কথায় এসো ঈশ্বর সিয়াঁ। কুলবন্ত চেঁচিয়ে ওঠে।
-অপেক্ষা করো সব তোমাকে বলব। তবে সময় দিতে হবে, কুলবন্ত। সব কথা কি সহজে বলা যায়? মানুষ-বুঝলে কুলবন্ত-ওই যে বললাম -মাদারচোদ-মানুষ একমাত্র মাদারচোদ। শহর জুড়ে লুঠপাট চলছিল, আমিও ওদের সঙ্গে ভিড়ে মিশে গেলাম। যত টাকা, গয়না পেয়েছিলাম, সব তো তোমার হাতেই দিয়েছি। কিন্তু ওই একটা কথা, কুলবন্ত, আমি তোমাকে বলিনি, বলতে পারিনি।
-কী?
-একটা বাড়ির দরজা ভেঙে আমরা ঢুকেছিলাম..হ্যাঁ, সাত..সাতজন মানুষ ছিল বাড়িটাতে-এই কৃপাণ দিয়ে আমি একা ছজনকে মেরেছি-বাদ দাও-এ সব কথা বাদ দাও কুলবন্ত-একটা মেয়ে ছিল জানো-কী যে সুন্দর-ওকে আমি সবার মতোই কেটে কুচি কুচি করে ফেলতে পারতাম-কিন্তু ভাবলাম-। ঈশ্বর সিং হেসে ওঠে, কী যে সুন্দর মেয়েটা, জানি, কী বলব তোমাকে। ভাবলাম, রোজ তো কুলবন্তকে খাই, আজ না হয় নতুন কিছু খাওয়া যাক।
-আমি জানতাম। কুলবন্তের ধারালো চোখ একই সঙ্গে ঘৃণা ও বিদ্রুপ।
-মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে আমি বেরিয়ে পড়লাম।
-তারপর?
-যেতে যেতে। ঈশ্বর সিং কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। কী যেন বলছিলাম? মেয়েটাকে কাঁধে নিয়ে-সামনে একটা খাল পড়ল, চারপাশে ঝোপঝাড়ে ভরা। মেয়েটাকে ঝোপের ভেতরে শুইয়ে দিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, কিছুক্ষণ তাস ভাঁজা যাক। কিন্তু চারপাশে কে কোথায় ঘাপটি মেরে আছে, জানি না। তাই তুরুপের তাসই
-বলো-বলে যাও!
-তুরুপের তাসই ছুড়লাম।
-তারপর
ঈশ্বর সিং অনেকক্ষণ মাথা নীচু করে বসে রইল। তারপর যেন দীর্ঘদিনের ঘুম ভেঙে সে চোখ খুলেছে, সেভাবেই কুলবন্তের দিকে তাকাল।মেয়েটা মরে গেছে-কখন যেন মরে গেছে। একতাল ঠাণ্ডা গোস্ত শুধু। জানি-তোমার হাতটা-জানি-
কুলবন্ত ঈশ্বর সিংয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখল বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা।
হ্যাঁ, মির্জাসাব, সে যেন একটা হিমযুগের মধ্য দিয়েই আমরা হেঁটে চলেছি। কত লোক খুন হয়েছিল? কত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল? কত মানুষ মোহাজির হয়েছিল। এসব হিসেব আমার হাতে নেই, ভাইজানেরা। আর তা দিয়ে আমরা করবই বা কী বলুন? আমি একটা বাচ্চাছেলেকে দেখেছিলাম, সে কথা বলতে ভুলে গেছে। তার চোখের সামনে বাড়ির সবাই কে কুপিয়ে, গুলি করে মারা হয়েছে। সবাই যখন সংখ্যার কথা বলত, আমি ওই বাচ্চাটার মুখ দেখতে পেতাম-শূণ্য দৃষ্টি, নির্বাক-জলন্যাকড়ার এক ঘষায় ওর সব স্মৃতি মুছে গেছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম, এবার বম্বেকেও আমার জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে। শফিয়া, আমাদের বাচ্চারা অনেক আগেই লাহোর চলে গিয়েছিল। বারবার আমাকে লাহোরে যাওয়ার কথা লিখছিল শফিয়া। বম্বে আমার দ্বিতীয় জন্মস্থান, আমি কি করে তাঁকে ছেড়ে চলে যাব? তখন বম্বে টকিজে কাজ করি। নায়ক অশোককুমার আর সাভাক ওয়াচা বম্বে টকিজের মালিক। মুসলমানরা তখন সেখানে বড়বড় পদে। তাই হিন্দুদের বিদ্বেষ দিনে দিনে বাড়ছিল। ওয়াচা সাবকে হত্যা, বম্বে টকিজ পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কত যে চিঠি আসত। হিংসা আর অবিশ্বাসের পরিবেশটা আর ভাল লাগছিল না, মির্জাসাব। দিনে-দিনে মদের পরিমান বেড়ে যাচ্ছিল। অনেক হিন্দু কর্মচারী মনে করত, আমার জন্যই বম্বে টকিজে মুসলমানদের রমরমা। আমি, শহিদ, ইসমত,কামাল আমরোহি, হসরত লাখুনভি, নাজির আজমিরি, গোলাম হায়দার। আমরা সবাই তখন বম্বে টকিজে।
একদিন অশোককে বললাম, আমাকে এবার বরখাস্ত করো দাদামণি।
-মানে?
-আমি চাই না, আমার জন্য বম্বে টকিজ শেষ হয়ে যাক।
-তুমি পাগল হয়ে গেছে, মান্টো। ধৈর্য ধরো। আস্তে আস্তে সব থেমে যাবে। কিন্তু দিনে দিনে পাগলামি বাড়তে লাগল। ঘরে ঘরে আগুন, লুঠতরাজ, পথে ঘাটে খুনখারাবি। একদিন অশোক আর আমি বম্বে টকিজ থেকে বাসায় ফিরছিলাম। অশোকের বাড়িতে পৌঁছে ভাবছিলাম, কী করে নিজের বাসায় পৌঁছব। অশোক বলল, চলো মান্টো, তোমাকে পৌঁছে দিই। যা হয় হবে।
রাস্তা শর্ট করার জন্য অশোক মুসলমান বস্তির ভিতর দিয়ে গাড়ি চালাতে লাগল। সামনে থেকে একটা বিয়ের বরাত আসছিল। আমি অশোকের হাত ধরে বললাম, এ তুমি কোথায় এলে দাদমণি?
-চুপ করো। কোন চিন্তা নেই।
আমি সত্যিই খুব ভয় ভয়ে ছিলাম। অশোককে কে না চেনে? ওর মতো বিখ্যাত হিন্দুকে হত্যা করতে পারলে ওদের অস্ত্র সার্থক হবে। ওর গাড়ি যখন বরাতের সামনে এসে ঠেকল, তখন চিৎকার উঠল, অশোককুমার, অশোককুমার। আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল। অশোক কিন্তু নির্বিকার। আমি গাড়ির জানলা থেকে মুখ বার করে বলতে যাচ্ছিলাম, আমি মুসলমান। অশোককুমার আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাচ্ছেন। তার আগেই দুজন যুবক জানলার কাছে এসে বলল, অশোকভাই সামনের রাস্তা বন্ধ। বাঁদিকের গলি দিয়ে চলে যান।
আমরা নিরাপদে সেই রাস্তা পেরিয়ে এলাম। অশোক হেসে বলল, তুমি অযথা ঘাবড়াচ্ছিলে, মান্টো। আর্টিস্টদের ওরা ভালবাসে।
তাই? কে জানে! যারা দাঙ্গা করে, রাস্তাঘাট রক্তে ভাসিয়ে দেয়, তাদের কাছে শিল্পের কোন মূল্য আছে? কবিরজি একদিন লাহোরের পথে হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন, এক দোকানি কবি সুরদাসের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ঠোঙা তৈরি করছে। তিনি কান্না সামলাতে পারলেন না। তিনি গিয়ে দোকানিকে বললেন, এ কী করেছ তুমি?
-কেন?
-দেখতে পাচ্ছ না, এই বইতে কবি সুরদাসের কবিতা রয়েছে। এর পাতা ছিঁড়ে তুমি ঠোঙা করছ?
-সুরদাস? দোকানি হেসে ওঠে।-সুরদাস যার নাম, সে কখনও ভগত হতে পারে না।
-কেন?
-সুর মানে কী।
-যেমন গানের সুর। ঈশ্বরের নামও তো—
-সুর মানে যে শুয়োর, জানো না? দোকানি হাসতে থাকে।
-তুমি ওই মানেটাই ধরে বসে আছো?
আরেকদিন কবিরজি দেখলেন, কারা যেন দেবীলক্ষ্মীর মূর্তিকে খড়ে ঢেকে দিয়ে গেছে।
কবিরজি দেবীর মূর্তি থেকে নোংরা পরিস্কার করে দিতে লাগলেন। একদল লোক এসে বলল, এ কী করছেন আপনি?
-কেন?
-আমাদের ধর্মে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ জানেন না?
-সুন্দর প্রতিমাকে নোংরার করার কথা তো কোনও ধর্মে বলা নেই।
কবিরজির কথা শুনে লোকগুলো হাসতে শুরু করল, কাঁদতে কাঁদতে কবিরজি লাহোরের পথে পথে ঘুরতে লাগলেন। অবাক হচ্ছেন ভাইজানরা? কবিরজি কবে আর লাহোরে আসবেন? আমি তাঁকে নিয়েই একটা কিস্সা লিখেছিলাম-দেখ কবিরা রোয়ে। কবিরজি যেখানে খুশিই যেতে পারেন, মির্জাসাবের সাথে মণিকর্ণিকার ঘাটে যদি তার দেখা হতে পারে, তবে লাহোরের পথে পথেই বা তিনি হাটবেন না কেন?
শেষ পর্যন্ত লাহোরেই ফিরে যেতে হল আমাকে। ১৯৪৮-এর জানুয়ারি মাসে সব কিছু গুছিয়ে বম্বে থেকে করাচির জাহাজে উঠে বসলাম। হয়তো ভয় পেয়েছিলাম। আমি তো ভীতু মানুষ। ইসমতকেও বলেছিলাম, লাহোর চলো,ওখানকার হিন্দুরা এপারে চলে এসেছে, কারও না কারও বাড়ি পেয়ে যাব। চলো ইসমত, লাহোরে আবার সব নতুন করে শুরু করা যাক।
ইসমত রাজি হয়নি। শুধু বলেছিল, নিজের চামড়া বাঁচাতে এভাবে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?
-আমি এ-দেশে বহিরাগত, ইসমত।
-কে বলল?
-আমি জানি।
-না জানো না। ইউ আর আ কাওয়ার্ড। তাই পালাচ্ছ।
আমি তার চোখ দেখে বুঝেছিলাম, মির্জাসাব, সেদিন থেকে ইসমত আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করল। তাই বলে একটা চিঠি লিখবে না? আমার চিঠির উত্তর দেবে না? ঘৃণা কি সব স্মৃতি মুছে দেয়? হয়তো। না হলে দাঙ্গার দিনগুলোর ঘৃণা কত কত শতাব্দীর স্মৃতি মুছে দিয়েছিল কীভাবে?