৪০. আত্মঘাতী নারী!

এই কলামে মেয়েদের অধিকার এবং স্বাধীনতা বিষয়ে দীর্ঘদিন হল লিখছি। পাঠকের প্রতিক্তিয়া জানতে চেয়েছিলাম একদিন, পত্রিকা অফিস থেকে জানিয়ে দেওয়া হল আমার লেখার সবচেয়ে বেশি নিন্দা করছে মেয়েরা। ‘যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর।’ নাহ, আমার জন্য এই দুঃসংবাদটিও নতুন কিছু নয়।

আমাকে অনেকে বলেছে, ‘মেয়েদের দোষের কথা কিছু লেখো তো।’ সবচেয়ে মজার কথা, মেয়েরাই বলেছে।

‘মেয়েদের আবার দোষ কী?’ আমি বলি।

‘ওদের কোনও দোষ দেখ না?’ চোখ কপালে তুলে মেয়েরা বলে। ‘ভিকটিমদের আবার দোষ কী!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি।

ভিকটিমদের দোষ না লিখলে আমার উপায় নেই। পুরুষরাও বলছে, মেয়েদের দোষের কথা লিখতে। মেয়েরাও বলছে। কিছুদিন আগে নবনীতা দেবসেনএর সমালোচনা করে আমি যে লেখাটা লিখেছি, সেটির জন্য নারী ও পুরুষ উভয় পক্ষ থেকেই যত বাহবা আমি পেয়েছি, অন্য কোনও লেখার জন্য তত পাইনি। যারা মেয়েদের দোষের কথা আমি লিখি, চায়, সেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে আমি কোনও তফাৎ করতে পারি না। তাদের ভাষা একই রকম, একই রকম ইঙ্গিত। নারী যখন পুরুষের প্রতিনিধিত্ব করে, এবং পুরুষতন্ত্রের সমর্থক এবং সহায়কের ভূমিকায় সক্তিয়, তখন নারী আর পুরুষকে আলাদা করে চেনা যায় না। পুরুষতন্ত্র মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, নারীর এত সহায়তা না পেলে, এত সহযোগিতা আর সাহায্য না পেলে শুধু পুরুষের ষড়যন্ত্রে এবং চক্তান্তে, শুধু পুরুষের বুদ্ধিতে ও শক্তিতে টিকে থাকতে পারতো না।

বউ শাশুড়ির ঝগড়ার কথা ভারতীয় উপমহাদেশেই শুনি। যে সমাজে শ্বশুরবাড়িতে মেয়েরা থাকে না, এবং মেয়েরা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, এবং লিঙ্গবৈষম্যের শিকার নয়, সেখানে বউ শাশুড়ির মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয় না! ঝগড়ার পেছনে পরনির্ভরতা এবং পিতৃতন্ত্রের একটা বড় ভূমিকা আছে।

এখানকার সংস্কৃতিটা হল বিয়ে হওয়ামাত্র স্বামীর সঙ্গে সে্বামীর বাড়িতে বা শ্বশুরবাড়িতে জীবন যাপন করতে হবে মেয়েদের। শ্বশুরবাড়িতে, শ্বশুর তো বটেই, শাশুড়িও, যেহেতু তারা স্বামীর আত্মীয়, স্বামীর প্রতিনিধি। পুরুষের প্রতিনিধিত্ব যে করে, মোষ হোক, মুষিক হোক, সমান জোর। পিতৃতন্ত্রকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পুত্র যদি অপারগ হয়, তবে পুজ্ঞের হয়ে পুজ্ঞের মা-ই তা সাধন করে। বউ হচ্ছে আপাতত দাসী। শুরুটা করতে হয় দাসত্ব দিয়ে। দাসত্ব যদি নির্ভুলভাবে করে যেতে পারে, তবেই হবে তার প্রতিনিধিত্বে উত্তরণ। কোনও কোনও সংসারে পুরুষেরা নিজের মায়ের বদলে স্ত্রীকে নিজের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, সেখানে কিন্তু শাশুড়ির হাল মোটেও সুবিধের নয়। ঝগড়াটা মূলত পুরুষটায় আমার অংশ বেশি তোমার অংশ কম, এ নিয়ে। যে সমাজে লিঙ্গবৈষম্য নেই, সে সমাজে পুরুষ নিয়ে কাড়াকাড়িটা হয় না। কারণ পুরুষ যে মূল্য ধরে, নারীও একই মূল্য ধরে। পরনির্ভর মেয়েদের লড়াই করতে হয়, যার ওপর নির্ভরশীলতা, তার মনোরঞ্জন করে খানিকটা অনুকম্পা বেশি পাওয়ার জন্য। এ অনেকটা বেঁচে থাকার লড়াই।

ভাই ভাইয়ের হিংসা, শ্বশুর জামাইয়ের ঝগড়া, ভায়রা ভাইদের দ্বন্দ্ব, কাকা ভাইপোর মারামারি, স্বামী প্রেমিকের তাজ্জব — তুমুল হলেও এগুলো নিয়ে নিন্দা করার লোক নেই। কিন্তু মেয়েদের মধ্যে সামান্য কথা কাটাকাটি হলেই ছিছিত্তার। যেন মেয়েদের হতে হবে এই জগতের বাইরের কিছু। মেয়েদের আমরা পাকে ফেলবো, পজ্ঞে ডোবাবো, কিন্তু থাকতে হবে তাদের পূত পবিত্ত। বলিহারি আহ্লাদ।

মেয়েদের হাই প্রোফাইল ঝগড়াটা (বউ শাশুড়ি) একধরনের প্রফেশানাল জেলাসি। পরনির্ভরতা যাদের প্রফেশন, তাদের তো ও করেই খেতে হয়। মেয়েদের পরনির্ভর প্রফেশনিটা কার চাপে হচ্ছে? পিতৃতন্ত্রের চাপে। পিতৃতন্ত্রের কাঠামোটা কাদের তৈরি? পুরুষদের! শুধু তাই নয়, বউ শাশুড়ির ঝগড়ার মূলেও ওই একই জিনিস, পুরুষ। জেলাসি বা ঈর্ষাটা যদি থাকতেই হয়, তবে কর্মক্ষেত্র স্বনির্ভর মেয়েদের একে অপরকে ডিঙিয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতার মধ্যে থাকুক। সে ক্ষেত্রে পুরুষকে ডিঙিয়ে ওপরে ওঠার প্রতিযোগিতা এবং এই নিয়ে ঈর্ষা হলে তো কথাই নেই।

স্বনির্ভর না হলে, পুরুষের সমকক্ষ না হলে, পুরুষের নিচে অবস্থানকারীদের সঙ্গে মেয়েদের বচসা বেশি হয়। আর এ সমাজে পুরুষের নিচে অবস্থান সাধারণত মেয়েরাই করে, আর সে কারণে দেখা যায়, মেয়েদের সঙ্গে মেয়েদেরই ঠোকর লাগছে বেশি। যে মেয়েরা পিতৃতন্ত্রের ধারকবাহক আর যারা পিতৃতন্ত্রের নিন্দুক, তাদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে নিরন্তর। এই ঝগড়া, এই দ্বন্দ্ব এই মারামারি সত্যিকার অর্থে নারীতে নারীতে নয়, পুরুষে এবং নারীতে। একদল নারী নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে, আরেক দল অধিকারের পক্ষে। একদল পুরুষের পক্ষে, আরেক দল নারীর পক্ষে।

‘মেয়েরা মেয়েদের শত্রু’, এই বাক্যটি পুরুষের তৈরি, এবং একে জনপ্রিয় করার পেছনে পুরুষের আছে বিরাট অবদান। পুরুষ কি পুরুষের শত্রু নয়? হিসেব যদি হয় কে কার শত্রু বেশি, মেয়েরা মেয়েদের যত, তার চেয়ে শতগুণ পুরুষেরা পুরুষদের। এক মেয়ে যখন আরেক মেয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলে, পুরুষেরা খুশি হয়। সেই মেয়েটিকে খুব বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমতী বলে মনে করে। কোনও মেয়ের স্বল্প পোশাক, তার ছেলেবন্ধু, তার পুরুষগমন ইত্যাদি নিয়ে নিন্দা যখন মেয়েরা করে, পুরুষেরা আনন্দ পায়। কারণ এ তাদেরই কথা, মেয়েদের মুখ দিয়ে বলতে শোনে এই যা। মেয়েগুলো তাদেরই মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকা, তাদেরই কপি। কিন্তু ফিমেইল কপি। ফিমেইল বলে আনন্দ বেশি হয়। অন্য কোনও পুরুষ যদি মেয়ের নিন্দা করে, তাতে আনন্দ এত বেশি হয় না। ফিমেইল বলে যে আনন্দ, সেটা অনেকটা যৌনানন্দের মতো।

‘বাড়ির পরিচারিকারা পুরুষের চেয়ে নারী দ্বারা অত্যাচারিত হয় বেশি’ — বেশ জনপ্রিয় একটি অভিযোগ, পুরুষেরা যখন অত্যাচার করে পরিচারিকাদের, তা নিয়ে তত কথা হয় না, নারী হলেই ছি ছি ছ্যাঁ ছ্যাঁ। নারী তো নিয়ন্ত্রিত। নারীর নিয়ন্ত্রণ করার বেশি কিছু নেই। তাই তার নিচে যে আছে, যে পরিচারিকা তাকেই সে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। এতে পরিতৃপ্তি কিছুটা হলেও পায়। কিছুটা হলেও তার উচ্চতাকে সে অনুভব করতে পারে। পরিচারিকার জায়গায় পরিচারক হলেও ওই একই ব্যাপার ঘটে। স্বামীর ধর্ষনেচ্ছা যদি পরিচারিকাকে দেখে জাগে, তবে স্ত্রী পরিচারিকাকেই অত্যাচার করে, স্বামীকে নয়। এখানেও সবলকে না পিটিয়ে দুর্বলকে পিটিয়ে যন্ত্রণা লাঘব করতে হয় নারীদের। সবলকে পেটানোর শক্তি এখনও তারা অর্জন করেনি।

নারীকে লজ্জাবতী মায়াবতী, করুণাময়ী স্নেহময়ী ইত্যাদি বিশেষণ এতকাল ধরে এত দেওয়া হচ্ছে যে, লোকে ভুলে যায় নারী রক্তমাংসের মানুষ, পুরুষের মতো অত যুদ্ধবাজ, হিংসুক, প্রতিশোধপরায়ণ, সংকীর্ণমনা, বদ, বদমাশ, নিষ্ঠুর, নির্মম, ভয়ংকর, হিংস্র, নীচ, অশ্লীল, কুটিল না হতে পারলেও নারী কিছুটা তো হতে পারে। নারী তো মানুষ! পুরুষের সঙ্গে এতকাল থেকে কিছুই কি শেখেনি! বাসে যেভাবে দুটাকার পকেটমারকে পুরুষেরা পিটিয়ে লাশ বানায়, তেমন ভাবে নারীরা পেটাতে না পারলেও, একেবারেই যে কাউকে পারেনা পেটাতে, তা ভাবার কোনও কারণ নেই।

নারীর নিষ্ঠুরতা দেখে কেন লোকে শংকিত হয়! যেহেতু নারীর কাছ থেকে আশা করা হয় যা প্রচার হয় তা, যে, নারী মাত্রই মমতাময়ী! যেহেতু এই ধারণা মস্তিষ্কে গাঁথা, তাই নিষ্ঠুরতা আগাগোড়া অপ্রত্যাশিত। তাই পুরুষের নিষ্ঠুরতা সইতে পারলেও নারীর নিষ্ঠুরতা অসম্ভব সওয়া!

নারীর স্বাধীনতা এবং সমানাধিকারের জন্য যে সংগ্রাম, তা একটি আদর্শের জন্য সংগ্রাম। এই আদর্শে নারী বিশ্বাসী হতে পারে, পুরুষেরা অবিশ্বাসী হতে পারে। আবার এর উল্টোও হয়। নারী এই আদর্শে বিশ্বাস একেবারেই করে না, কিন্তু পুরুষেরা করে। (পুরুষেরা যারা নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাদের সংখ্যাটা নিতান্তই কম, বিশ্বাসী হলেও স্বাধীনতার সংগ্রামে সক্তিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুকের সংখ্যা আরও কম।) বিষয়টি নারী সম্পর্কিত হলেও এ কখনই লিঙ্গের ব্যাপার নয়, এ আদর্শের ব্যাপার। সুতরাং আমার নারী-অধিকার বিষয়ক লেখাগুলো যদি সব নারীর পছন্দ না হয়, তবে তো বিস্ময়ের কিছু নেই। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এত আহম্মক নয় যে সব নারীকে নারীর স্বাধীনতা বিষয়ে সচেতন করে তুলবে এবং তাদের স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করা মাত্র নারীরা হাত তুলে সমর্থন জানাবে। পরাধীন হয়ে থাকতে থাকতে বেশির ভাগ নারীই পরাধীনতাকে আশ্রয় বলে মনে করে, পরাধীনতার লোহার দেওয়ালের ফুটো গলে যে আলোটুকু আসে, ওটুকুই রোত্রুর তাদের, ওটুকুই স্বাধীনতা। ওটুকুতেই তৃপ্ত তারা।

আমি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি, এটা অনেক মেয়ের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। অনেকসময় মেয়েদের স্বাধীনতা বিষয়ে আমি যা বলি, তা মেয়েরা যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি পুরুষেরা বোঝে। বোঝে, কারণ, স্বাধীনতা ভোগ করে পুরুষ অভ্যস্ত, স্বাধীনতার অর্থ তারা তাই জানে। পুরুষেরা আমার লেখার বিরুদ্ধে বলে, কারণ তারা ঠিক জানে আমি কী বলতে চাইছি। নারীরা আমার লেখার বিরুদ্ধাচরণ করে, করে, কারণ তারা ঠিক জানে না আমি কী বলতে চাইছি। দুজনের বিরোধীতার ভাষাটা এক, কারণটা ভিন্ন।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ভিকটিম। এ কথা যেমন ঠিক, নারী আত্মঘাতী এটাও ঠিক। আজ যদি নারীরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো, আত্মপরিচয়ের সংকটমোচনে নিজেরা বিচ্ছিন্ন না থেকে সংগঠিত হতো, নারীর সঙ্গে নারীর যোগাযোগ যদি আরও বেশি হত, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যদি বাড়তো, যদি তারা আন্তরিকভাবে পরস্পরের হাতে সহযোগিতার হাত রাখতো, নারীর ক্ষমতায়নে এক নারী আরেক নারীর পাশে দাঁড়াতো, তবে চিড় ধরতো অথবা চুর চুর করে ভেঙে পড়তো পুরুষতন্ত্র। বাসযোগ্য হত জগৎ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *