একদিন অনেক রাতে বৈকুণ্ঠ আসে তমিজের বাপের হাত ধরে। তমিজও তখন কেবল ফিরেছে। বৈকুণ্ঠ বলে, তোর বাপ নিন্দের মধ্যে পাকুড়তলাত ঘুরিচ্ছিলো। হামাক চিনবার পারলো না। ধর্যা লিয়া আলাম। মাচায় শুয়ে তমিজের বাপ তার ঘুম অব্যাহত রাখে। বৈকুণ্ঠ বলে, তমিজ, তোর বাপোক দেখ্যা রাখিস। আজ ক্যামা মুনসির ডাক শুনলাম রে। পাকুড়গাছ তো নাই, মুনসি কোটে বস্যা ডাক পাড়ে দিশা পাই না।
তমিজ বলে, বাজানেক ধরবি এক মুনসি। তোমাকে ধরার মানুষের অভাব নাই বৈকুণ্ঠদা। হুঁশিয়ার হয়া থাকা ভালো।
মুকুন্দ সাহাও বলে, বৈকুণ্ঠ রাতবিরাতে ঘোরাফেরা করিস, দিনকাল ভালো লয়। আসমান আর মোসলমান—এই দুয়ে বিশ্বাস নাই। এই মেঘ, এই ফর্সা। এই রোদ এই আন্ধার। কাদের মিয়া কয়া গেলো, ইনডিয়ার রিফিউজি দিয়া টাউন বলে ভরা গেছে। ইগলান কথা হামাক শোনায় কিসক?
যুধিষ্ঠির একদিন মুকুন্দ সাহার দোকানে এসে কেঁদে ফেলে, কন তো বাবু, ইগলান কী জুলুম! মাঝিপাড়ার কয়টা চ্যাংড়া সেদিন বাড়িত যায়া দুইটা কোদাল আর একটা দাও লিয়া আলো। দাম চালাম তো চেত্যা উঠলো। কয়, এই দাও দিয়া আফসারের মরার শোধ লেওয়া হবি। কন ভো বাবু, এখন কি করি? যুধিষ্ঠিরের দুজন সঙ্গীর একজন অতোটা ভীতু নয়, সে এটার বিহিত করতে যাবে নায়েববাবুর কাছে। নায়েববাবুর ভরসাতেই তো তারা দশরথের হত্যার প্রতিশোধ নিতে তৈরি হচ্ছিলো। তা মুকুন্দ সাহা কি আর করে, নায়েববাবুর কাছে চললো ঐ তিনজনকে নিয়ে। নায়েব কাছারিতে নাই, কয়েকদিন ধরে সে আসে না। কামারদের আবদারে মুকুন্দকে তখন দল নিয়ে ছুটতে হলো টাউনে। নায়েববাবু টাউনেও নাই। পরিবার ছেলেমেয়ে নিয়ে গেছে জলপাইগুড়ি। চাকরের কাছে শোনা গেলো, কোন মুসলমানের সঙ্গে বাড়ি বদল করার ব্যবস্থা করতে গেছে।নায়েবাবু অবশ্য আসবে, তাকে তো আসতেই হবে। নইলে জমিদারি দেখাশোনা করবে কে? কিন্তু সেরকম আসাযাওয়ায় মুকুন্দ সাহা কি কামাররা ভরসা পায় না।
বৈকুণ্ঠ অভয় দেয়, হামাগোরে সন্ন্যাসী ঠাকুর আছে না? মোসলমানরা কি তাক কম মানে?
ভরসা দিয়ে যায় কালাম মাঝি, সাহাচিন্তার কারণ নাই। কোনো শালা কিছু করবার পারবি না। তবে সে নিজেই খানিকটা চিন্তিত, মুশিকল কি, হিন্দুস্থানে মোসলমানেক কচুকাটা করিচ্ছে, টাউনের মানুষ দেখলাম খুব গরম।
হিন্দুর লাশভরা বগি নিয়ে পাকিস্তান থেকে রোজ ট্রেন যাচ্ছে শেয়ালদা। স্টেশনে আজ টাউন থেকে নিয়ে আসা তিন দিন আগের আনন্দবাজার পত্রিকার এই খবরটা বলতে মুকুন্দ সাহার ভয় করে। কালাম মাঝির মেজাজ যে কখন কী হয় বলা মুশকিল। এর এক সপ্তাহের মধ্যে টাউন থেকে ফিরে কালাম মাঝি তার দোকানে হাটের স্থায়ী দোকানদারদের সবাইকে ডাকে। বৈকুণ্ঠকে দশ টাকার নোট দিয়ে বলে, গোপালের দোকান থ্যাকা মিষ্টি লিয়া আয়। দশ টাকারই আনবু।
এতো খুশি কিসের?—আজ ইসমাইল হোসেনের সাক্ষাতে নায়েববাবুর সঙ্গে কালাম মাঝি বন্দোবস্ত করে এলো, কাৎলাহার বিলের পত্তন এখন থেকে তার নামে। লেখাপড়া সব শেষ। মণ্ডলের মেয়াদ চৈত্র পর্যন্ত। নায়েববাবুর তেমন ইচ্ছা ছিলো না, মণ্ডলের কাছ থেকে টাকা তো কম খায় নি। কিন্তু ইসমাইল হোসেন কলকাতা থেকে জমিদারের চিঠি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলো। নায়েব বাপ বাপ করে কালামের নামে লিখে দিলো।
মাঝিপাড়ায় খবর চলে যায়। কালাম মাঝি রাত্রে বাড়ি আসবে জেনেও মাঝিরা দলে দলে তার মুখে সব শুনতে ছুটে আসে গোলাবাড়িতে। মাঝিদের বিল মাঝিদের হাতে ফিরে এসেছে শুনে কেউ কেউ তখনি বিলে গিয়ে জাল ফেলতে চায়। কালাম মাঝি তাদের থামায়, উগলাম কাম করো না গো। ল্যাখাপড়া সব ফাইনাল। এখন মণ্ডলের কাছ থ্যাকা বুঝা লেওয়া বাকি।
তমিজও খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলো হুরমতুল্লার জমি থেকে বাড়ি থেকে তার বাপটাও এসেছে। তমিজের বাপের হাত ধরে নিজের দোকানে তুলতে তুলতে কালাম মাঝি বলে, এই বুড়া মানুষটাক কী বেইজ্জতি না করিছে! এখন ইনসাফ কায়েম হবি। হামার কাৎলাহার বিলে পরথম জাল ফেলার হুকুম হামি দিমু এই বুড়া মানুষটাক। তোমরা সোগলি শুন্যা রাখো। বাঘাড় মাঝির লাতি, যি সি মানুষ লয়।