৪০. অধ্যক্ষের ছুটি নেই

বৈশাখ মাস, সংস্কৃত কলেজে এখন গ্ৰীষ্মের ছুটি। কিন্তু এই কলেজের অধ্যক্ষের ছুটি নেই, খর্বকায় ব্ৰাহ্মণ ঠেঙো ধুতি ও উড়ানি গায়ে দিয়ে প্রখর রৌদ্রের মধ্যে বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পায়ে হেঁটে চরকির মতন ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

ভারতে সে অকালমৃত বেথুন সাহেব স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনেক উদ্দীপনার সঞ্চার করে গেছেন। যে স্ত্রীশিক্ষার জন্য তিনি প্ৰাণপাত করলেন, অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও তার প্রসার হতে লাগলো ক্রমে ক্ৰমে। তাছাড়া, বেথুন সাহেব বার বার আর একটি বিষয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট সকল ব্যক্তিকে যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না দিলে সে শিক্ষায় প্রকৃত মানুষ গড়া যায় না। যতই ইংরেজি বা সংস্কৃত শেখাবার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, বাংলাদেশে বাংলা পড়াবার সুবন্দোবস্ত না হলে শিক্ষা বিস্তার প্রকৃত পক্ষে অসম্ভব। এবং শুধু শহরে নয়, শিক্ষা ব্যবস্থা ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রামে গ্রামে। বেথুন সাহেব আরও বলে গেছেন যে, তিনি এ দেশের ছাত্রদের পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাদের মেধায় কোনো ঘাটতি নেই, উপযুক্ত শিক্ষা পেলে তারা জগতের যে-কোনো জাতির সমকক্ষ হতে পারে।

সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরও এ ব্যাপারে বেথুনের জীবদ্দশায় তাঁর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হয়েছিলেন। যারা পণ্ডিত হতে চায়, তারা সংস্কৃত শিখতে চায় শিখুক, কিন্তু দেশের আপামর জনসাধারণকে শিক্ষা দিতে হবে মাতৃভাষায়। এজন্য হাজার হাজার বিদ্যালয় খোলা দরকার। এবং সরকারের সাহায্য না পেলে এতবড় একটা ব্যাপক কর্মসূচী নেওয়া সম্ভব নয়। কোম্পানির গভর্নমেন্ট এ দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে, তার থেকে ছিটেফোঁটা পেলেও এ দেশের বালক বালিকাদের জন্য অনেক কিছু করা যাবে।

বিদ্যাসাগর গ্রামাঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিশদ পরিকল্পনা পেশ করলেন সরকারের কাছে। তা নিয়ে টালবাহানা চললো অনেকদিন, প্রচুর চিঠিপত্র ও মেমোরেণ্ডাম চালাচালি হলো। এর মধ্যে কাউন্সিল অব এড়ুকেশানের একজন সদস্য ফ্রেডরিক হ্যালিডে নিযুক্ত হলেন বাংলার ছোট লাট। হ্যালিডে সাহেব বিদ্যাসাগরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত পরিকল্পনার কথা জানতেন। ছোটলাট তখন সেইসব পরিকল্পনা পেশ করলেন বড়লাটের কাছে, বড়লাট নীতিগতভাবে তা মঞ্জুর করে দিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন উঠলো, এইসব স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য স্থান নির্বাচন, স্কুল স্থাপন এবং পরে সেগুলির পরিচালনার ব্যাপার তত্ত্বাবধানের জন্য একজন উপযুক্ত ব্যক্তি দরকার। কে করবেন সে কাজ? বিদ্যাসাগর নিজেই সে দায়িত্ব নিতে চান। বিদ্যাসাগরের যোগ্যতা বিষয়ে সরকারের কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সংস্কৃত কলেজের মতন এত বড় একটি প্রতিষ্ঠানের গুরুপূর্ণ দায়িত্ব যাঁর স্কন্ধে, তিনি কি আবার গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় খোলার জন্য এত পরিশ্রম করতে পারবেন? বিদ্যাসাগর এক বাক্যে রাজি, শুধু তাই নয়, এ কাজের জন্য তিনি আলাদা কোনো পারিশ্রমিকও চান না।

পায়ে হেঁটে ঘোরায় কোনো ক্লান্তি নেই বিদ্যাসাগরের। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হবার পরও কতবার নিজের মোট নিজেই মাথায় বহন করে নিয়ে দেশের বাড়িতে যাতায়াত করেছেন পদব্ৰজে। একটিই শুধু অসুবিধে, নতুন কোনো গ্রামে গিয়ে সেখানকার মুরুবিবাদের বিশ্বাস করাতেই অনেক সময় লেগে যায় যে পালকি বেহারাদের মতন চেহারার এই কদাকার পুরুষটিই বিদ্যাসাগর।

শিয়াখোলা, রাধানগর, কৃষ্ণনগর পর পর গ্রামগুলিতে ঘুরে বেশ ভালো সাড়া পাওয়া গেল। এক একটি গ্রামে উপস্থিত হয়ে তিনি সেখানকার চণ্ডীমণ্ডপে কিংবা বটতলায় গ্রামের গণ্যমান্যদের নিয়ে একটা বৈঠকে বসেন। লোক পাঠাবার বদলে তিনি নিজে তাঁদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ডেকে আনেন। তারপর তাঁদের কাছে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলেন, তাঁর উদ্দেশ্যের কথা। গ্রামের মানুষ যদি এক খণ্ড জমি দেয় এবং নিজেরাই চাঁদা তুলে একটি বাড়ি তুলে দেয়, তা হলে সে গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হবে আদর্শ বঙ্গ বিদ্যালয়। শিক্ষকদের বেতন দেবেন সরকার।

সব জায়গাতেই তিনি সার্থক হতে লাগলেন। পরপর চললেন ক্ষীরপাই, চন্দ্রকোনা, শ্ৰীপুর, কামারপুকুর, রামজীবনপুর, মায়াপুর, মলয়পুর, কেশবপুর, পাতিহাল। তাঁর খাওয়া-দাওয়ার কোনো ঝামেলা নেই, তিনি অতিশয় স্বল্পাহারী, গ্রামের যে-কোনো বাড়িতে দুটি চাল-ডাল ফুটিয়ে নিলেই চলে, নইলে শুধু ফলাহারেই ক্ষন্নিবৃত্তি হয়ে যায়। রাত্রিবাসের জন্যও চিন্তা করতে হয় না। যেকোনো গৃহস্থের বাড়িতেই মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হতে পারে, কিংবা গাছতলায় শয়ন করলেও চলে। প্রখর রৌদ্র কিংবা প্রবল বৃষ্টিতেও এ ব্ৰাহ্মণ নিরস্ত হয় না।

রামজীবনপুরে একদিন বিশ্রাম নিচ্ছেন ঈশ্বরচন্দ্র। এখানকার বিদ্যালয়টি চালু হয়ে গেছে। বৃক্ষতলে ছায়ায় উপবেশন করে তিনি শুনছেন উচ্চকণ্ঠে ছাত্রদের পাঠাভ্যাস। পণ্ডিতমশাই নামতা ঘোষাচ্ছেন, আর ছাত্ররা পরস্পরের সঙ্গে প্ৰতিযোগিতা করে গলা ফাটাচ্ছে একেবারে। ঈশ্বরচন্দ্রের ইচ্ছে হলো ছাত্রদের বিদ্যার উন্নতি পরীক্ষা করা।

তিনি চলে এলেন ক্লাস ঘরে। মেঝেতে পার্টি বিছিয়ে বসে আছে ছেলের দল, অনেকেরই উধবাঙ্গে কোনো বস্ত্র নেই, কেউ কেউ পরে আছে শুধু একটি গামছা। পণ্ডিতমশাইয়ের ধুতিখানি শতচ্ছিন্ন, সম্ভবত সেলাই করা বস্ত্ৰ পরিধান করার বিষয়ে তাঁর সংস্কার আছে বলে তিনি ছেড়া ধুতিখানিও সেলাই না করে জায়গায় জায়গায় গিট বেঁধে রেখেছেন। তবে তাঁর লোমশ বুকে ধপধাপে সাদা পৈতাখানিই শুধু অটুট। পণ্ডিতমশাই তাঁর বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে আসবার সময় প্রতিদিন একটি বালিশ ও একটি হাতপাখা নিয়ে আসেন। বালিশে মাথা রেখে তিনি লম্বা হয়ে শুয়ে থাকেন দ্বারের কাছে, যাতে কোনো দুষ্ট ছাত্র হঠাৎ পলায়ন করতে না পারে। ছাত্ররা পালা করে করে হাতপাখা দিয়ে বার্তাস করে তাঁকে। যে ছাত্র একবারও তাঁর মাথায় পাখা না ঠুকে বার্তাস করতে পারে, তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে একটু আগে ছুটি দেন।

বিদ্যাসাগরকে দেখে পণ্ডিতমশাই ব্যস্তসমস্ত হয়ে উঠে বসলেন। ইতিমধ্যেই এসব অঞ্চলে রটে গেছে যে, যে-ব্যক্তিকে দেখলে একেবারেই বিদ্যাসাগর বলে মনে হয় না, অথচ মুখচোখে একটা তেজী ভাব, সেই ব্যক্তিই বিদ্যাসাগর।

ঈশ্বরচন্দ্ৰ পণ্ডিতমশায়ের পাশে বসে পড়ে বললেন, আপনার ছাত্রদের একটু দেখতে এলাম। কেমন চলছে, এদের পড়াশুনোর আগ্রহ আছে তো?

পণ্ডিত বললেন, বিলক্ষণ! এগুলানের পড়াশুনো না হলে আমার চাকরিটি যে যায়। তাই তেড়েফুড়ে পড়াই। এদের শুধিয়ে দেখুন না।

ঈশ্বরচন্দ্ৰ ছাত্রদের কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। খুব নৈরাশ্যব্যঞ্জক কিছু না। ছাত্ররা বাংলা ও সরল গণিত কিছু কিছু শিখেছে। কিন্তু এটুকুই তো যথেষ্ট নয়। তিনি একটি ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, ওরে, দিন আর রাত কেমন করে হয়, তা বলতে পারিস?

এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে ছেলেটি অবাক। এর উত্তর তো তাদের মা-ঠাকুমারাও জানে, এজন্য কি আর বিদ্যালয়ে আসতে হয়? সূৰ্য উঠলে দিন আর সূর্য অস্ত গিয়ে চাঁদ উঠলে রাত।

ঈশ্বরচন্দ্র আবার প্রশ্ন করলেন, সূৰ্য কী করে ওঠে। আর কী করেই বা অস্ত যায়?

এর উত্তর পাছে ছাত্ররা না দিতে পারে, তাই পণ্ডিতমশাই নিজেই আগ বাড়িয়ে বললেন, কেন, সাত ঘোড়ার রথে চেপে সূর্যদেব পুবের আকাশে উঠলে দিন হয় আর সারাদিন পর সূর্যদেব পশ্চিম দিগন্তের পরপারে চলে যান।

ঈশ্বরচন্দ্ৰ মৃদু হেসে বললেন, সে তো পুরাণের কথা। আপনি আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতির কথা কিছু শোনেননি?

পণ্ডিত ঘাড় নাড়লেন দু-দিকে।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, সূর্য ঘোরে না। পৃথিবী ঘোরে। সূৰ্য আকাশে স্থির। পৃথিবী চব্বিশ ঘণ্টায় একবার ঘোরে।

পণ্ডিতমশাই বললেন, পৃথিবী ঘোরে? আপনি বলেন কি মশাই? মস্করা করছেন, না সত্যি কথা বলছেন?

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, মস্করা নয়, সত্যি। ছাত্রদের ভুল শেখাবেন না। পৃথিবী দুরকমভাবে ঘোরে।

পণ্ডিত বললেন, সে মশাই আপনি বলছেন যখন, তখন ঘোরে। তবে সে বোধহয় আপনাদের শহরের দিকের পৃথিবী ঘোরে। আমাদের এই পাড়াগাঁ দেশে পৃথিবী ঘোরে টোরে না। একেবারে স্থির হয়ে থাকে সব সময়। দেকছি তো!

অট্টহাস করে উঠলেন বিদ্যাসাগর। পণ্ডিত বলেছে ভালো!

তারপর তিনি ছাত্রদের সবিস্তারে আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, ঋতুবদল ও দিন রাত্রি ছোট বড় হওয়ার কারণ বোঝাতে লাগলেন। অপ্ৰসন্ন মুখে শুনতে লাগলেন পণ্ডিত। বিদ্যাসাগরের কথা শেষ হবার পর পণ্ডিত বিড় বিড় করে বলে উঠলেন, আপনি বলছেন যখন, ঘুরুক তাহলে পৃথিবী। চিরকাল ঘুরুক। পৃথিবীর ঘোরাঘুরি নিয়ে কে মাথা ঘামায়?

সেদিন ঈশ্বরচন্দ্ৰ উপলব্ধি করলেন, শুধু পরপর বিদ্যালয় স্থাপিত করে গেলেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, উপযুক্ত শিক্ষকও দরকার। অশিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষা আরও ভয়াবহ। ছাত্রদের মতন শিক্ষকদেরও আগে গড়ে পিটে নেওয়া দরকার, শিক্ষক তৈরির জন্যও একটা নমািল স্কুল খুলতে হবে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের সঙ্গে এ সম্পর্কে তাঁর আগে কিছু আলোচনা হয়েছিল। অক্ষয়কুমার দত্ত যেমন একজন কড়া ধাতের মানুষ, তেমনি সর্বপ্রকার সংস্কারমুক্ত, ওঁর ওপর নামলি স্কুলের ভার দেওয়া যায়, যদি উনি রাজি হন।

 

ছুটি ফুরিয়ে এসেছে, আবার কলকাতায় ফিরতে হবে, তার আগে পিতামাতাকে একবার দেখে যাবার জন্য ঈশ্বরচন্দ্ৰ এলেন স্বগ্রামে।

বীরসিংহ গ্রামে ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির রূপ এখন ফিরে গেছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশ্বরচন্দ্র সরকারের কাছ থেকে দেড় শত টাকা বেতন পায়। দেশীয় ব্যক্তিদের মধ্যে অঙ্গুলিগণ্য কয়েকজনই মাত্র এত অধিক বেতনের চাকরি করে। তা ছাড়াও গ্ৰন্থ রচনা করে ঈশ্বরচন্দ্রের এখন যথেষ্ট ধনোপার্জন হয়। ঈশ্বরচন্দ্রের পরের ভাইও চাকুরিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। ঠাকুরদাস-ভগবতী এক সময় কত কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন, আজ তাঁদের সুখের দিন এসেছে। গৃহের শ্ৰীবৃদ্ধি হয়েছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চণ্ডীমণ্ডপ, নতুন চালাঘর উঠেছে কয়েকখানা। এখন গোয়ালে বাঁধা গরু, মড়াইয়ে ভরা ধান, পুকুরে দাপায় বড় মাছ। শুধু নিজেদের সাচ্ছল্য নয়, এ গ্রামের প্রত্যেকেই সাহায্য পায় ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামাতার কাছ থেকে।

ঈশ্বরচন্দ্রের পাড়া বেড়ানো অভ্যোস, গ্রামে এলেই তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ান, কোথাও কেউ অভুক্ত আছে কি না সে সন্ধান তিনি ঠিক সংগ্রহ করেন। যে-বাড়িতে গিয়ে দেখেন যে উনুনে হাঁড়ি চড়েনি, সে বাড়ির সকলকে জোর করে টেনে আনেন নিজের বাড়িতে। খুব গোপনে তিনি কয়েকটি পরিবারকে মাসোহারা দিতেও শুরু করেছেন।

তবু কয়েকজন অভুক্ত থেকেই যায়। ঈশ্বরচন্দ্রের সাধ্য নেই তাদের মুখে অন্ন তুলে দেবার। তিনি সাধারণত নক্ষত্রের হিসেব রাখেন না, কিন্তু প্ৰতিবার গ্রামে এসেই তিনি মনঃস্থির করেন, এর পরের বার তিথি গণনা না করে তিনি আর গ্রামের মাটিতে পা দেবেন না।

এবারও ঈশ্বরচন্দ্ৰ যে সায়াহ্নে পৌঁছেলেন, তার পরদিনই একাদশী। এদিন সমস্ত বিধবাদের নির্জলা উপবাস। সেই ছাত্র বয়েসেই ঈশ্বরচন্দ্র গ্রামে এসে এরকম এক একাদশীর দিনে কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। ক্ষেত্রমণি নামে একটি বালিকা ছিল তার বাল্যের ক্রীড়া সঙ্গিনী। তখন তাঁর তের চোদ্দ বছর বয়েস, বাড়িতে পা দিয়েই শুনলেন মাত্র তিন মাস আগে ক্ষেত্রমণির বিবাহ হয়েছিল আবার ইতিমধ্যে সে বিধবাও হয়ে গেছে। নিজের ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্ৰ, ক্ষেত্রমণি সারাদিন এক ফোঁটা জলও পান করবে না, আর তিনি পেট ভরে আহার করবেন? কেন, ক্ষেত্রমণি কী দোষ করেছে?

সেই ক্ষেত্রমণি অবশ্য মরে গিয়ে বেঁচেছে, তবু প্রতি বৎসরই একজন দুজন বিধবা হয়। এবারেও কুক্ষণে এসে পৌঁছেলেন বিদ্যাসাগর। পরপর দুটি হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনতে হলো। যে-গুরুর কাছে তিনি প্ৰথম বর্ণমালা শিক্ষা করেছিলেন, সেই কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি সবাগ্রেই দেখা করতে যেতেন। ইদানীং অভিমানবশতঃ আর যেতেন না। এবার শুনলেন, কালীকান্ত মারা গেছেন এবং বিধবা করে দিয়ে গিয়েছেন ছটি রমণীকে, তার মধ্যে সর্বকনিষ্ঠাটির বয়েস নয়। তাছাড়া তাঁদের এক প্রতিবেশিনীর কন্যা, এগারো বৎসর বয়স্ক বালিকা সত্যভামাও মাত্র দেড় মাস আগে বিধবা হয়েছে।

সংবাদ দুটি শুনে ঈশ্বরচন্দ্রের মন বিষিয়ে গেল। এই সব কথা শুনলে তাঁর দুঃখ যতখানি হয়, রাগও ততটাই হয়। চোখে জল আসে, বুকটা জ্বলে। বিচারবুদ্ধিহীন অন্ধ সংস্কারে দুধের বাচ্চাদের বিবাহ দেওয়া হয় বৃদ্ধদের সঙ্গে, বিবাহ জিনিসটা কি তা বুঝবার আগেই তাদের কপাল পুড়ে যায়।

 

অপরাহ্ন চণ্ডীমণ্ডপে বসে পিতার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন ঈশ্বরচন্দ্র, এমন সময় ভগবতী দেবী এলেন সেখানে। আঁচলে চক্ষু চাপা দিয়ে বললেন, ওরে, মেয়েটার দিকে যে আর চোখ ফেলা যায় না। ওকে জন্মাতে দেখিছি, কোলে পিঠে নিয়েছি। কতবার, সেই মেয়ে রাঢ়ী হলো! মেয়েটা ভূয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে গড়াচ্ছে।

ঈশ্বরচন্দ্ৰ ক্ৰোধে নিবাক হয়ে ঘাড় হেঁট করে রইলেন।

ঠাকুরদাস জিজ্ঞেস করলেন, কার কথা বলতেছ? সত্যভামা? আহা, বেটী আমারও বড় আদরের-আমিও ওর দিকে আর চাইতে পারি না।

ভগবতী বললেন, আগেই আমি বলিছিলুম, ঐ তেজবরের সঙ্গে বিয়ে দিয়োনি—

ঠাকুরদাস পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে ঈশ্বর, তুই তো অনেক শাস্ত্ৰ পড়িছিস, তা সব শাস্ত্ৰে কি বিধবাদের এমন যাতনা দেবারই নির্দেশ রয়েছে? ওদের আর কোনো গত্যন্তর নাই?

ঈশ্বরচন্দ্ৰ মুখ তুলে রাগত স্বরে বললেন, কেন থাকবে না? বিধবাদের পুনর্বিবাহ দেবারও ব্যবস্থা রয়েছে।

—পুনর্বিবাহ? তুই বলিস কি?

–বাবা, আমি নানা শাস্ত্র ঘেঁটে দেখোঁচি, মোট তিন প্রকার নির্দেশ আছে বিধবাদের জন্য। ব্ৰহ্মচর্য অভাবে সহমরণ বা বিবাহ।

—রাজ আজ্ঞায় সহমরণ প্রথা নিবারিত। কলিযুগে ব্ৰহ্মচৰ্যই বা কতখানি সম্ভব? সুতরাং বিবাহই একমাত্র উপায়। তুই শাস্ত্রবচন উদ্ধার করে বিধবার পুনর্বিবাহ যে সিদ্ধ, তা প্রমাণ কক্তে পারবি?

ঈশ্বরচন্দ্রের চোখ জ্বলে উঠলো। তিনি পিতাকে বললেন, আপনি জানেন, কোনো কিছু যদি আমি একবার ধরি, তা হলে আর কিছুতে ছাড়ি না। প্রয়োজন হলে আমি সর্বশাস্ত্র মন্থন করে এর স্বপক্ষে যত নির্দেশ আছে সব তুলে আনবো। কিছুদিন ধরেই আমি একথা ভাবছি। যদি আপনি অনুমতি দেন এবং আশীর্বাদ করেন–

ঠাকুরদাস গাঢ় স্বরে বললেন, তুই যদি এ কাজ ভালো বুঝিস তা হলে আমরা নিষেধ কবো। কেন? এমনকি আমরা নিবারণ করলেও তোর ক্ষান্ত হওয়া কর্তব্য হয় না। লোকের নিন্দাবাদে বা অপর কোনো কারণেও পশ্চাৎপদ হবি না। তুই।

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, আচ্ছা বেশ, আমি আগামী কল্য থেকেই এ কর্মে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো।

সেদিন রাত্রে ঈশ্বরচন্দ্ৰ জননীকে নিভৃতে আবার জিজ্ঞেস করলেন, মা, তখন পিতাঠাকুরের সঙ্গে আমার যেসব কথাবার্তা হলো, তুই তো সব শুনিছিলি, কিন্তু কোনো কথা বললি না কেন? তোর কি এ বিষয়ে মত নেই, মা?

ভগবতী বললেন, আমি ভেবিছিলুম। উনি এসব কথা শুনে রাগ করবেন। উনি যখন মত দিলেন, তা হলে আর চিন্তা কি?

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, মা, তবু তোর মতটাও আমি শুনতে চাই।

ভগবতী বললেন, তুই ঠিক বুঝিছিস যে বেধবাদের বিয়ে দেওয়ায় শাস্তরে কোনো বাধা নেই?

ঈশ্বরচন্দ্র বললেন, হীমা, আমি ঠিক বুঝেছি। এ নিয়ে আমি বই রচনা করবো, আমি চেষ্টা করবো সরকারকে দিয়ে আইন পাশ করাবার। অনেক লোক বাধা দেবে আমি জানি, সে সব আমি গ্রাহ্য করি না, কিন্তু আমি তোর মতটা নিতে ইচ্ছা করি।

ভগবতী বললেন, তোকে আমি বারণ করি না, তুই এ কাজ করগে যা-যে যা বলে বলুক। যদি শেষ পর্যন্ত পারিস, আমি তোকে আশীর্বাদ কবো, লাখো লাখো দুখিনী মেয়ে তোকে দু-হাত তুলে আশীর্বাদ কৰ্বে।

কলকাতায় ফিরেই ঈশ্বরচন্দ্ৰ এবার নিমগ্ন হলেন শাস্ত্ৰ সমুদ্রে। তিনি জানেন, নৈতিকভাবে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তিই থাকতে পারে না। যারা বালিকা নয়, না-বালিকা, যারা বিবাহের মর্মই কিছু বোঝেনি, তাদের সারা জীবন বঞ্চিত রাখার বিধান যদি শাস্ত্ৰ দিয়েও থাকে, তবে সে শাস্ত্ৰই ভ্ৰান্ত। সে শাস্ত্র পরিত্যাজ্য, সেই লোকাচার, দেশাচারও পরিবর্তনীয়। কিন্তু এই সব কথা এ দেশের সংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের বোঝানো মুশকিল। শাস্ত্ৰ উদ্ধার করেই তাদের মুখ বন্ধ করতে হবে। ইংরেজ সরকারও এ দেশের ধর্মবিশ্বাসে সহজে হাত দিতে চায় না। এবং সরকার আইন প্ৰণয়ন না করলে কেউই এ মীমাংসা মানবে না। সুতরাং শাস্ত্ৰ বচন তুলে প্রমাণাদি দেখিয়ে সরকারের সম্মতি আদায় করতে হবে।

আহার নিদ্রা এক রকম পরিত্যাগ করলেন ঈশ্বরচন্দ্র। সারাদিন সংস্কৃত কলেজের কাজের পর আর বাড়ি ফেরেন না, সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারেই সারারাত কাটিয়ে দেন। সারা রাত্রিই সেখানে বাতি জ্বলে। তিনি স্তৃপাকার পুঁথিপত্রের মধ্যে ঠায় জেগে বসে থাকেন।

এক একদিন তাঁর বন্ধু রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় জোর করে তাঁকে টেনে নিয়ে যান নিজের গৃহে। সমেহ তিরস্কারে বলেন, তুমি এ কি করতেছ, ঈশ্বর? এমন ভাবে চললে যে অচিরেই ব্যারামে পড়বে।

ঈশ্বরচন্দ্ৰ হেসে বলেন, আমার কিছু হবে না। তুমি তো জানো, যখন জেদ ধরেছি, তখন এর শেষ না দেখতে পেলেই আমার ব্যারাম হবে। দেও বাপু, কী খাবার দেবে, দেও!

রাজকৃষ্ণ বললেন, সে তুমি যাই বলো, দু বেলা এখানে রোজ দুটি খেয়ে যেতেই হবে। সে কথা দেও! আর দিনের পর দিন না ঘুমালে কি মানুষ বাঁচে।

ঈশ্বরচন্দ্রের এসব কথার উত্তর দেবার সময় নেই। কোনো রকমে নাকে মুখে কিছু খাদ্য গুঁজেই তিনি আবার দৌড়েন সংস্কৃত কলেজের দিকে।

একদিন রাজকৃষ্ণ বললেন, তুমি এ পরিশ্রম যে কচ্চো, কিন্তু এতে লাভ হবে কি? বিধবার বিয়ে দেবার উদ্যোগ তো আগেও কেউ কেউ করেছিলেন। তেনারাও নানান শাস্ত্ৰ বচন ঘেটেছিলেন শুনতে পাই। কিন্তু তাতে তো কোনো সুরাহা হয়নি!

ঈশ্বরচন্দ্ৰ বললেন, জানি, আমি খুব ভালো রকমই জানি। ঢাকার রাজা রাজবল্লভ সেন থেকে আরম্ভ করে ডিরোজিও সাহেবের শিষ্যরা পর্যন্ত অনেকেই বিধবার বিয়ে দেবার স্বপক্ষে মত প্রচার করেছেন। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কেউই তা কার্যে পরিণত করতে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু আমাকে তো তুমি চেনো, আমি এক গোয়ার গোবিন্দ, আমার শুধু মুখের কথা নয় কিংবা নিউজ পেপারে প্রবন্ধ ফাঁদই নয়, ধরেছি। যখন তখন একে কার্যে পরিণত আমি করবোই। তার আগে আমার শান্তি নেই।

 

সংস্কৃত কলেজের গ্রন্থাগারে সারা রাত পড়াশুনো করতে করতে এক এক সময় মাথা গরম হয়ে যায়। মস্তিষ্কের শুশ্রুষার জন্য এক সময় তিনি ভোরের দিকে পথে বেরিয়ে পড়েন। ভোরের শীতল বার্তাস যেন স্নিগ্ধ প্রলেপের মতন কাজ করে।

একদিন তিনি সেইরকম অতি প্ৰত্যুষে পথে ভ্ৰমণ করতে করতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর আপন মনে বললেন, পেয়েছি!

শূন্য রাজপথে তিনি বিড়বিড় করে আবৃত্তি করে চললেন, কয়েকটি শ্লোকের পর শ্লোক। তারপর, সামনেই যেন তার প্রতিপক্ষীরা সব সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের উদ্দেশ্য করে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, এইগুলি দিয়েই আমি শুরু করবো আমার প্রস্তাব! দেখি, তোমাদের মধ্যে কোন পণ্ডিতের কটা মাথা আছে যার দ্বারা আমার এসকল যুক্তি ভঞ্জন করতে পারো!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *