চতুর্থ সর্গ
রাত্রিশেষে গোলাপী আলোর আভা পূর্বাকাশে ফুটে উঠতেই ঘুম থেকে জেগে উঠল আদম। প্রতিদিন এই সময়েই ওঠে সে। প্রতিদিন সকালে মৃদু বাতাসে গাছের পাতাগুলো যখন পতপত্ শব্দ করতে থাকে, যখন সকালের আলো আকাশ থেকে মুক্তোর মত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, যখন নদী ও ঝর্ণার জলধারাগুলি বয়ে যেতে থাকে কলকল শব্দে, যখন গাছের শাখায় শাখায় পাখিরা গান গাইতে থাকে তখনি ঘুম থেকে জেগে ওঠে আদম। তার সঙ্গে সঙ্গে ঈভও জেগে ওঠে।
কিন্তু সেদিন উঠে এক বিরল ব্যতিক্রম দেখল ঈভের জীবনে। দেখল, ঈভ তখনো ওঠেনি ঘুম থেকে। তার বিস্ত কেশপাশ মাথার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। তার নিটোল মসৃণ গালদুটো কচক করছিল। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল রাত্রিতে তার ভাল ঘুম হয়নি বলেই সে এখনো ঘুমোচ্ছে।
আদম তখন ঘুমন্ত ঈভের উপর ঝুঁকে পড়ে দাম্পত্য প্রেমের মাধুর্যমণ্ডিত দৃষ্টিতে তার পানে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেল তার সরল স্বাভাবিক সৌন্দর্যে। ঘুমন্ত বা জাগ্রত অবস্থায় সকল সময়ে একই সুষমার দ্যুতি বিকীরণ করে।
আদম এবার জেফাইরাস যেমন একদিন ফ্লোরাকে ডেকেছিল মৃদুস্বরে ঈভের কোমল হাতটি স্পর্শ করে সেও ডাকলো, হে আমার সুন্দরী প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা পত্নী ওঠ, জাগো। তুমি ঈশ্বরের সর্বোত্তম দান, আমার আনন্দপ্রতিমা। তুমি জাগো, ওঠ, প্রভাতসূর্য নবীন কিরণ জাল বিস্তার করছেন। সজীব শস্যক্ষেত্র আমাদের ডাকছে। এখন না গেলে কিভাবে আমাদের রোপিত চারাগাছগুলি বেড়ে উঠছে, কিভাবে বাতাসে কুঞ্জবনগুলি কঁপছে, কিভাবে প্রকৃতির বিচিত্র বর্ণে পাহাড় কাঁপছে, পর্বত, বন, প্রান্তর, সব কিছুকে রঞ্জিত করে দিয়েছে, কেমন করে মধুমক্ষিকাগুলি প্রস্ফুটিত ফুলের উপর বসে তার থেকে নির্যাস বার করে তা পান করছে–তা আমরা দেখতে পাব না।
এইভাবে ঈভের কানে কানে মৃদুস্বরে কথা বলে তাকে জাগিয়ে তুলল। জেগে উঠেই ঈভ আদমের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে তাকে আলিঙ্গন করে বলল, হে আমার সকল গৌরবের একমাত্র বস্তু, আমার সকল পূর্ণতার মূর্ত প্রতীক, তোমার মধ্যেই আমার সকল চিন্তা-ভাবনা কেন্দ্রীভূত। প্রভাতের আলোয় তোমাকে প্রথম দেখে আনন্দিত হলাম। গতরাত্রির মত ভয়ঙ্কর রাত্রি জীবনে কখনো যাপন করিনি আমি।
গতরাত্রে আমি এমন এক আশ্চর্য স্বপ্ন দেখেছি যে স্বপ্ন আমি আর কখনো দেখিনি। সাধারণত তোমারই স্বপ্ন দেখি, সারাদিনের কাজের স্বপ্ন, অথবা পরবর্তী দিনের কাজের পরিকল্পনার স্বপ্ন। গতরাতে আমি দেখেছি যত সব বিপজ্জনক অপরাধজনক কামনা-বাসনার স্বপ্ন, যার কথা এর আগে আর কোনদিন মনে আসেনি আমার।
আমি স্বপ্নে দেখলাম কে যেন আমার কানে কানে মৃদুস্বরে তার সঙ্গে হাঁটতে বলছে। আমি ভাবলাম তুমি। সে বলল, কেন ঘুমোচ্ছ ঈভ, শান্ত স্তব্ধ রাত্রির মনোরম
অবকাশে যখন পূর্ণচন্দ্রের আলো বনচ্ছায়ার জালগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে প্রতিভাত করে তুলছে বিভিন্ন বস্তুর মুখগুলিকে, যখন রাতের পাখিরা ঢেলে দিচ্ছে সুমধুর প্রেমসঙ্গীতের ধারা, তখন কেউ যদি এসব না দেখে তাহলে ঈশ্বরের জাগ্রত দৃষ্টি তোমাকে ছাড়া আর কাকে দেখতে পাবে? হে প্রকৃতির কামনার বস্তু, তুমি ছাড়া আর কাকে সকল জীব দেখবে, আর কাকে দেখে এত আনন্দ পাবে?
তুমি ডাকছ ভেবে আমি উঠে পড়ি, কিন্তু তোমাকে দেখতে না পেয়ে তোমাকে দেখার জন্য হাঁটতে শুরু করি। আমার তখন মনে হচ্ছিল আমি একাই হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে এমন একটি পথ ধরলাম যে পথ আমাকে সেই জ্ঞানবৃক্ষের কাছে। নিয়ে গেল।
দিনেতে যেমন দেখি তার থেকেও তখন সুন্দর লাগছিল গাছটিকে। আমি যখন দেখছিলাম ঠিক সেই সময় স্বর্গের দেবদূতের মত পাখাওয়ালা এক মূর্তি যাকে আমরা প্রায়ই দেখতে পাই এবং যার শিশিরসিক্ত কেশপাশ থেকে অমৃতের মধু ঝরে পড়ছিল, সেই জ্ঞানবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে সেও গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলতে লাগল, হে সুন্দরী ফলবতী বৃক্ষ, তুমি কাউকে কখনো তোমার ফল আস্বাদন করতে দাও না। কাউকে দান করো না তোমার ফল। দেবতা বা মানুষ কাউকে না। জ্ঞান কি এতই তুচ্ছ যে তা লাভ করার উপযুক্ত নয় অথবা তা কি এতই মূল্যবান যে তা সকলের জন্য নয়? অথবা এ বৃক্ষের স্রষ্টা কি ঈর্ষাবশত অন্যের জন্য এর ফলকে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন? কিন্তু যেই তা নিষিদ্ধ করে রাখুক, আমাকে আর কেউ তোমার এই প্রসারিত বাহুবিধৃত ফল থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না।
এই বলে সে তার দুঃসাহসী হাতদুটি বাড়িয়ে সেই জ্ঞানবৃক্ষ হতে ফল তুলে খেতে লাগল।
তার এই অসমসাহসিক কথা ও কাজ দেখে ভয়ে হিমশীতল হয়ে উঠল আমার দেহ।
কিন্তু সে তখন আনন্দে উল্লসিত হয়ে বলতে লাগল আবার, হে স্বর্গীয় ফল, তুমি এমনিতেই মধুর, কিন্তু তুমি নিষিদ্ধ বলে তোমাকে এইভাবে গোপনে তুলে খেতে আরও মধুর মনে হচ্ছে। মনে হয় তুমি যেন শুধু দেবতারই ভক্ষণযোগ্য, তবু তোমার এ ফল ভক্ষণ করলে মানুষও দেবতা হয়ে উঠতে পারে। আর মানুষরাই বা ভক্ষণ করবে না কেন? জ্ঞানের মত ভাল জিনিস যতই প্রচারিত হয় ততই ভাল, সে ফল যত বেশি উৎপন্ন হয় ততই ভাল, তাতে তার স্রষ্টা ঈশ্বরের গৌরবহানি হয় না কিছুমাত্র। বরং তাতে বেড়ে যায় তার গৌরব ও সম্মান।
হে দেবদূতোপম সুন্দরী ঈভ, সুখী প্রাণী, তুমিও আমার মত ফল ভক্ষণ করো, যদিও তুমি সুখী, এই ফল ভক্ষণে আরও সুখী হবে। আরও যোগ্য হয়ে উঠবে সবদিক দিয়ে। এই ফল ভক্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও দেবতাদের মাঝে এক দেবী হয়ে উঠবে। শুধু মর্ত্যভূমির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে না। তুমি তখন আমাদের মত কখনো শূন্যপথে উড়ে বেড়াতে পারবে, কখনো স্বর্গলোকে উঠতে পারবে। সেখানে উঠে দেখতে পাবে দেবতারা স্বর্গে কি ধরনের জীবন যাপন করে। তুমিও তাদের মতোই স্বর্গীয় সুষমায় পূর্ণ এক দৈব জীবন যাপন করতে পারবে।
এই বলে সে আমাকে ধরে টেনে নিয়ে আমার মুখের উপর সেই ফলের এক অংশ তুলে ধরল। জ্ঞানবৃক্ষ হতে সে ফলটি তুলে সে খাচ্ছিল তখন। সেই ফলের সুমধুর গন্ধে আমার মধ্যে এমনই ক্ষুধার উদ্রেক হলো যে আমি তা না খেয়ে পারলাম না। সে ফলের রস আস্বাদন করার মুহূর্তমধ্যে সেই মূর্তির সঙ্গে আমি মেঘের উপর উঠে পড়লাম। তার তলদেশে দেখলাম অন্তহীন বৈচিত্র্যে প্রসারিত হয়ে আছে এই মহাপৃথিবী। আমার এই আকস্মিক পরিবন ও সমুন্নতি দেখে আমার সেই পথপ্রদর্শক সহসা অন্তর্হিত হয়ে গেল কোথায়। আমার তখন মনে হলো আমি যেন পড়ে যাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
তারপর জেগে উঠে যখন বুঝলাম সবই স্বপ্ন তখন আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে কত আনন্দ পেলাম।
এইভাবে ঈভ তার গতরাত্রির অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করলে আদম বলতে লাগল, হে আমার অন্তরের থেকে প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী, আমার প্রতিমূর্তি, গতরাত্রিতে নিদ্রাকালে তোমার দেখা দুঃস্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নজনিত ক্লেশ আমাকেও তোমার মত সমানভাবে বিব্রত করে তুলছে। কোন অশুভ শক্তির দ্বারা উৎপন্ন এই কুৎসিত স্বপ্নকে আমিও মেনে নিতে পারছি না। আমার ভয় হচ্ছে। কিন্তু পবিত্রতার মূর্ত প্রতীকরূপে সৃষ্ট তুমি। তোমার মধ্যে তো কোন অশুভ শক্তি স্থান পেতে পারে না। কিন্তু জেনে রেখো, মানুষের আত্মার মধ্যে এমন কতকগুলি হীন অন্তরবৃত্তি আছে যারা যুক্তিকেই তাদের একমাত্র প্রভুরূপে সেবা করে। এই অন্তরবৃত্তিগুলির মধ্যে কল্পনা হচ্ছে প্রধান, যুক্তির পরেই যার স্থান। আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয় বহির্জগতের সকল বস্তুর প্রতিনিধিত্ব করে মনের সঙ্গে তাদের সংযোগসাধন করে, তাদের সাহায্যেই অলীক কল্পনার সৃষ্টি হয় আমাদের মনে। এই কল্পনার সঙ্গে যুক্তিযুক্ত বা নিযুক্ত হয়ে জ্ঞান বা মতামতের সৃষ্টি করে যার দ্বারা আমরা কোন বস্তু বা ঘটনাকে স্বীকার বা অস্বীকার করি।
রাত্রিতে স্তব্ধ অবকাশে মানুষের নিদ্রাকালে তার যুক্তি আর জ্ঞানও বিশ্রামলাভ করে তার গোপন কক্ষে। কিন্তু মাঝে মাঝে সহসা কল্পনা জাগ্রত হয়ে যুক্তি ও জ্ঞানকে জাগ্রত করে স্বপ্নের মধ্যে কতকগুলি অসংগঠিত মূর্তির উদ্ভব ঘটায় এবং উদ্ধত ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। স্বপ্নে দেখা অসংলগ্ন অসঙ্গত কথা ও ক্রিয়াসমূহের মধ্যে আমার সুদূর বা অদূরবর্তী অতীতের কথা ও কাজের কিছু সাদৃশ্য খুঁজে পাই ঠিক। কিন্তু তার বাইরেও কিছু অদ্ভুত কথা ও কাজের ব্যাপার থাকে। তথাপি এতে বিষণ্ণ হবার কোন কারণ নেই। কারণ দেবতা বা মানুষের মনের মধ্যে অশুভ শক্তি আসে এবং যায় কিন্তু তা কোন সমর্থন পায় না সে মনে। কোন দোষ বা কলঙ্কের চিহ্ন রেখে যেতে পারে না সে শক্তি। এটাই হচ্ছে আশার কথা আমার পক্ষে।
নিদ্রাকালে স্বপ্নের মধ্যেও যে কাজ করতে তুমি ঘৃণাবোধ করেছিলে, নিশ্চয় সে কাজ করতে চাইবে না তুমি। সুতরাং হতাশ হয়ো না। প্রথম প্রভাতের হাস্যোজ্জ্বল কিরণমালা যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে তখন তোমার যে দৃষ্টি সবচেয়ে আনন্দময় ও প্রশান্ত থাকে সে দৃষ্টিকে বিষাদের কুটিল মেঘের দ্বারা আচ্ছন্ন করে তুলল না। তার থেকে বরং যখন প্রস্ফুটিত কুসুমরাজি তাদের সারারাত্রি সঞ্চিত সুগন্ধিরাশি বনে, প্রান্তরে ও ঝর্ণাধারায় ঢেলে দিচ্ছে তখন আমরা নূতন উদ্যমে চলে গিয়ে কাজ শুরু করি।
এইভাবে তার সুন্দরী স্ত্রীকে উৎফুল্ল করে তোলার চেষ্টা করল আদম। ঈভও তাতে কিছুটা উৎফুল্ল হলো। কিন্তু নিঃশব্দে একটি করে শান্ত অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ল তার দুচোখ থেকে এবং সে তার আলম্বিত কেশপাশ দিয়ে তা মুছে ফেলল সঙ্গে সঙ্গে।
আরো দুটি স্ফটিকস্বচ্ছ অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল ঈভের চোখে। কিন্তু তারা ঝরে পড়ার আগেই এক মধুর সমবেদনার প্রতীকচিহ্ন হিসাবে এক নিবিড় চুম্বনের দ্বারা আদম মুছে দিল সে অশ্রুবিন্দুটিকে।
এইভাবে সকল দুঃস্বপ্নজনিত সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটল। তারা তাড়াতাড়ি মাঠে কাজ করতে চলে গেল। কিন্তু কাজ শুরু করার আগে তারা ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবন হতে নবোদিত সূর্যের শিশিরসিক্ত আলোয় এসে দাঁড়িয়েই প্রথমে তারা নত হয়ে স্বতস্ফূর্ত উচ্চারণে গদ্যে ও পদ্যে মিলিয়ে প্রভাতের স্তোত্ৰগান শুরু করল। এক আধ্যাত্মিক আবেগের আতিশয্যে তাদের কণ্ঠ হতে স্বতস্ফূর্তভাবে নিঃসৃত সেই প্রার্থনাসঙ্গীত বীণা বা কোন বাদ্যযন্ত্রসহযোগে গীত না হলেও কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি তার মাধুর্য।
পরমস্রষ্টার উদ্দেশ্যে উচ্চারিত সেই স্তোত্ৰগানে তারা বলল, হে পরম মঙ্গলময়, সর্বশক্তিমান, এইসব সুন্দর বস্তুরাজিই তোমার গৌরবময় সৃষ্টি, এই হলো তোমার বিশ্বব্যাপী রূপ। তোমার সৃষ্টি এইসব বস্তু যদি এত সুন্দর ও বিস্ময়কর হয় তাহলে তুমি নিজে কত না সুন্দর ও বিস্ময়কর।
তোমার রূপ ও গুণ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তুমি অবর্ণনীয়রূপে স্বর্গের ঊর্ধ্বলোকে সতত অধিষ্ঠিত থাকায় অপরিদৃশ্য অথবা অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান আমাদের কাছে। এইসব সুন্দর বস্তু তোমার নিম্নমানের সৃষ্টি হলেও এই সব সৃষ্টি তোমার অচিন্ত্যনীয় সততা, তোমার শুভপ্রদায়িনী ও ঐশ্বরিক শক্তির কথাই ঘোষণা করে। আলোর সন্তান হে দেবদূতবৃন্দ, ঈশ্বরের অবর্ণনীয় মহিমার কথা তোমরাই সবচেয়ে ভাল করে ব্যক্ত করতে পার। কারণ তোমরাই তাঁর দর্শনলাভে ধন্য এবং স্বর্গে তাঁর সিংহাসনের চারপাশে রাত্রিবিহীন অবিচ্ছিন্ন দিবালোকে সতত সমবেত হয়ে সমস্বরে এক সুমধুর ঐকতানে তাঁর জয়গান গেয়ে থাক।
হে মর্ত্যবাসী সকল জীব, তোমরাও ঈশ্বরের অনন্ত গৌরবগানে যোগদান করো সকলে। সে গানের যেন আদি, অন্ত, মধ্য বলে কিছু না থাকে। সে সঙ্গীতের সুরলহরী যেন অনাদ্যন্ত ধারায় চিরপ্রবাহিত হতে থাকে সারা জগতে।
রাত্রিশেষে উদিত সমস্ত নক্ষত্ৰকুলের মধ্যে সুন্দরতম ধ্রুবতারা, তুমিই তোমার স্থির উজ্জ্বল জ্যোতির দ্বারা ঊষাকালকে দ্যোতিত করো। তুমি প্রত্যুষে ঈশ্বরের জয়গান করো তোমার কক্ষপথে।
হে জগচ্চক্ষু ও জগতাত্মা দিবাকর, সেই সর্বশক্তিমান পরমেশ্বরকে তোমার প্রভু বলে স্বীকার করে। তার প্রার্থনা গান করো। যখন তুমি উদিত হও, যখন তুমি মধ্যাহ্ন গগনে ভাস্বর হয়ে ওঠ ভাস্বর মহিমায় অথবা তুমি যখন অস্তাচলে অধোগমন করো–সব সময় সব অবস্থাতেই তুমি তোমার শাশ্বত কক্ষপথে ঈশ্বরের গৌরবগান করো।
হে নক্ষত্রমণ্ডলমধ্যবর্তী চন্দ্র, যিনি অন্ধকার হতে আলোর সৃষ্টি করেন সেই পরমস্রষ্টার গুণগান করো।
বায়ুসহ হে পঞ্চমহাভূত, তোমরাই প্রকৃতির গর্ভজাত আদি সৃষ্টি, তোমরা বিচিত্ররূপে বিরাজিত হয়ে বিশ্বের সকল বস্তুকে লালন করো। অন্তহীন বিরামহীন রূপ পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমাদের মহান স্রষ্টার জয়গান করো।
পাহাড় ও উত্তপ্ত জলরাশি হতে উখিত হে কুয়াশা ও বাষ্পরাশি, বিশ্বস্রষ্টার সম্মানে উদিত হয়ে সূর্য যতক্ষণ পর্যন্ত না ধূসরবর্ণের তোমাদের দেহগুলিকে সোনালী বর্ণে অণুরঞ্জিত করে দেয় ততক্ষণ বিরাজিত থাকবে তুমি। বর্ণহীন আকাশ মেঘের বা প্রান্তরভাগগুলি পরিশোভিত করার জন্যই হোক, বা তৃষ্ণার্ত পৃথিবীতে কয়েক পশলা বৃষ্টির দ্বারা বারিসিক্ত করার জন্যই হোক বা যে কোন কারণেই তোমাদের উৎপত্তি হোক না কেন, তোমরা উখানে-পতনে সমানভাবে ঈশ্বরের সেবা করে যাও, তাঁর গুণগান করো।
হে বাতাস, তুমি তাঁরই গৌরবগান চারদিকে প্রবাহিত হয়ে ছড়িয়ে দাও। হে পাইনগাছ, অন্যান্য গাছপালার সঙ্গে তোমরা তোমাদের মাথা নেড়ে তারই গৌরবগান ধ্বনিত করো সশব্দে। হে ঝর্ণাধারা, তোমরা কলশব্দে তারই গুণগান করো। হে পাখিরা, তোমরাও সকল জীবের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঈশ্বরের প্রার্থনাস্তোত্র গাও। তোমাদের সেই স্তোত্রের সম্মিলিত সুরধারা স্বর্গাভিমুখে উৎক্রমণ করুক। তোমরা পাখা মেলে চারদিকে উড়ে বেড়িয়ে মধুর কলকাকলির মাধ্যমে তাঁর গুণগান করো। আকাশ-বাতাস পূর্ণ হোক সে গানে।
হে জলচর, স্থলচর, উভচর ও সরীসৃপ জাতীয় জীবকুল, তোমরা দেখ, আমি সকাল-সন্ধ্যায় পাহাড়ে-পর্বতে, উপত্যকায় বা নদীতটে যেখানেই যখন থাকি না কেন, জঙ্গম সকল বস্তুকেই তাঁর গুণগান করতে শেখাই।
হে বিশ্বস্রষ্টা, জগৎপতি, তুমি আমাদের মঙ্গলদান করো। অশুভ শক্তির কুটিল অন্ধকার কালরাত্রির মতো আমাদের চারদিকে যতই ঘন হয়ে উঠুক না কেন, আলো যেমন অন্ধকারকে অপসৃত করে তেমনি তুমিও আমাদের চারদিকে ঘনীভূত সে অন্ধকারকে বিদূরিত করো।
এইভাবে সেই আদি পিতামাতা নির্মল নিষ্কলুষ অন্তঃকরণে ঈশ্বরের প্রার্থনা গান করল। আবার এক অনাবিল প্রশান্তি প্রতিষ্ঠিত হলো তাদের অন্তরে। তখন তারা মাঠে তাদের কাজে চলে গেল। যে সব ফলবতী গাছের শাখাগুলি অত্যধিক বেড়ে গিয়ে অন্যান্য গাছগুলিকে উদ্ধতভাবে আলিঙ্গন করতে যাচ্ছিল তাদের সেই সব শাখাগুলিকে কিছুটা করে ছেটে দিল তারা। আঙ্গুরের লতাগুলিকে এলম গাছের সঙ্গে জড়িয়ে দিল। বিবারে যৌতুকস্বরূপ গুচ্ছ গুচ্ছ ফলের উপহার দিয়ে আঙ্গুর লতাগুলি দুহাত বাড়িয়ে এলম গাছগুলিকে বিবাহের বর হিসাবে বরণ করে নিতে চাইছিল যেন। আদম ও ঈভ তাদের সাহায্য করছিল।
স্বর্গাধিপতি ঈশ্বর আদম ও ঈভকে এইভাবে কর্মে নিযুক্ত দেখে রাফায়েল নামে একজন দেবদূতকে ডাকলেন। রাফায়েল তোরিয়াস নামে এক মেয়ে দেবদূতকে বিয়ে করে তার সঙ্গে ঘুরে বেড়াত।
ঈশ্বর রাফায়েলকে ডেকে বললেন, তুমি হয়ত শুনেছ শয়তানদের রাজা অন্ধকার নরকপ্রদেশ থেকে পালিয়ে শূন্যপথে স্বর্গে এসে উঠেছে, মর্ত্যে সে বিচরণ করছে। গত রাতে সে সমগ্র মানবজাতির সর্বনাশ সাধনের জন্য আদি মানবপিতা ও মানবতার সুখনিদ্রাকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছিল। তুমি আজ তাদের কাছে গিয়ে আজকের মত কাজ থেকে বিরত হয়ে তাদের বিশ্রাম নিতে বল। তুমি আদমের সঙ্গে বন্ধুভাবে কথা বলবে। কোন এক ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে তাদের কাছে বসবে।
এমনভাবে তার সঙ্গে কথা বলবে যাতে সে বুঝতে পারে তার এই সুখী জীবন সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করছে তার স্বাধীন ইচ্ছার উপরে। সে যেন বুঝতে পারে তার নিজের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন হলেও তা পরিবর্তনযোগ্য। তাকে সাবধান করে দেবে কথাপ্রসঙ্গে সে যেন তার এই স্বাধীন ইচ্ছাকে সতত অবিচলিত ও অপরিবর্তনীয় রাখতে পারে।
সেই সঙ্গে তার বিপদের কথাটাও বলে দেবে। তার সে বিপদটা কোন্ দিক থেকে আসতে পারে সেটাও বুঝিয়ে দেবে। বলবে তার শত্রু কে। তার সেই শত্রু স্বর্গ থেকে বিতাড়িত ও নরকে নির্বাসিত হবার পর সে পালিয়ে এসে মানবজাতির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে। সে চাইছে তার মত মানবজাতিরও পতন ঘটুক। সে কিন্তু কোনরকম বলপ্রয়োগ করবে না। কারণ সে জানে তাতে সে বাধা পাবে। এ ব্যাপারে সে শুধু মিথ্যা ও ছলনার আশ্রয় নেবে।
আদমকে সাবধান করবে এ বিষয়ে, সে যেন স্বেচ্ছায় ন্যায়নীতি লঙ্ঘন করে পরে সে কিছু জানত না বলে অজুহাত না দেখায়।
এই বলে পরম পিতা রাফায়েলকে যাবার নির্দেশ দিলেন। রাফায়েলও আর দেরি না করে রওনা হয়ে পড়ল। অসংখ্য দেবদূতের মাঝখানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। ঈশ্বরের আদেশ পেয়ে সে তার বিরাট পাখা মেলে আকাশপথে উড়ে গেল। স্বর্গদ্বারের কাছে গিয়ে একবার থামল সে। রুদ্ধদ্বার সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। পরম স্থপতিরূপে ঈশ্বর এমনইভাবে স্বর্গদ্বারের সোনার স্প্রিং দেওয়া দরজাটি নির্মাণ করেন।
স্বর্গের দ্বারপথ পার হয়ে আবার উড়ে চলল রাফায়েল। কোন মেঘ বা নক্ষত্র কোন বাধা সৃষ্টি করল না তার গতিপথে। রাফায়েল অন্যান্য উজ্জ্বল গ্রহগুলির মত পৃথিবী ও স্বর্গের উদ্যানটিকে দেখতে পেল। রাত্রিতে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যেমন চাঁদের মধ্যবর্তী ভূমিখণ্ডকে দেখা যায়, নাবিকরা যেমন সমুদ্র থেকে দক্ষিণ ঈজিয়ান দ্বীপগুলির মধ্যে ভেলস ও সামসকে অস্পষ্টভাবে দেখতে পায় তেমনি অস্পষ্টভাবে রাফায়েল দূরের আকাশ হতে অরণ্যাচ্ছাদিত পাহাড় ঘেরা ইডেনের উদ্যানটিকে দেখতে পেল।
গতিটার বেগ কমিয়ে দিয়ে স্বর্গলোকের পূর্বদিকে অবতরণ করল রাফায়েল। একটা পাহাড়ের উপর নেমেই তার নিজের আসল মূর্তি ধারণ করল। তার স্বর্গীয় পোশাকটা ঢাকার জন্য দুটো পাখা ধারণ করল সে দেহের বিভিন্ন জায়গায়। একজোড়া কাঁধে, একজোড়া বুকে আর একজোড়া জানুতে বেঁধে নিল। তাতে পায়ের আর গোড়ালিদুটো ঢাকা পড়ে গেল।
এইভাবে ছয়টি পাখাদ্বারা তার দেহটিকে যুক্ত করে মাইয়ার পুত্র হামিসের মত দাঁড়িয়ে রইল রাফায়েল। তার পাখার পালক থেকে এক সুগন্ধ নির্গত হয়ে চারদিক আমোদিত করে তুলল।
যে সব দেবদূত সেখানে পাহারা দিচ্ছিল আগে হতে তাদের দলের সবাইকে একনজরে চিনতে পারল রাফায়েল। তারাও তাকে দেখে বুঝতে পারল স্বর্গীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোন নির্দেশ বা কোন বাণী নিয়ে এসেছে সে।
প্রহরারত দেবদূতদের শিবিরের চকচকে তাঁবুগুলির মধ্যে দিয়ে স্বর্গোদ্যানের সেই মনোরম ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে চলে গেল রাফায়েল। বিচিত্র ফুলের গন্ধভরা সেই কুঞ্জবনে চিরবসন্তের বর্ণগন্ধময় বিচিত্র শোভায় শোভিত প্রকৃতি বিরাজ করছিল উজ্জ্বল মহিমায়। সেখানে অনন্ত সুখ ছিল সতত লীলায়িত।
আকাশে প্রদীপ্তভাস্বর সূর্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে তাপ বিকীরণ করছিল তা মর্ত্যভূমির মাটির গর্ভে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে মাটিকে উত্তপ্ত করে তোলায় কুঞ্জবনের দ্বারপথে শীতল ছায়াতলে বসেছিল আদম। রাফায়েলকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে এল সে। ঈভ তখন কুঞ্জবনের ভিতরে থেকে তাদের মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করছিল। তাদের ক্ষুধাতৃপ্তির জন্য নানারকমের সুস্বাদু রসাল ফল সে সাজিয়ে রাখছিল। এই সব ফল খেয়ে তারা নিকটবর্তী কোন ঝর্ণা থেকে দুধের মত জলপান করে তৃষ্ণা মেটায়।
দূরে এক দেবদূতকে আসতে দেখে ঈভকে ব্যস্ত হয়ে ডাকল আদম। বলল, এখানে এস ঈভ, পূর্বদিকে একবার চেয়ে দেখ। কি এক উজ্জ্বল মূর্তি আমাদের এই দিকে আসছে। মনে হচ্ছে বেলা দ্বিপ্রহরে অসময়ে এক চাঁদ উঠেছে আকাশে। আর সেই চাঁদ নেমে আসছে আকাশ থেকে। নিশ্চয় কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে কোন বাণী নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। ঐ স্বর্গীয় অতিথিকে যথাযথভাবে আপ্যায়িত ও প্রীত করার জন্য তাড়াতাড়ি করে তোমার ভাঁড়ারে কি সব ফলমূল আছে দেখ। না থাকে সংগ্রহ করে রাখ। প্রকৃতিজাত ফলমূল কখনো ফুরোয় না। প্রকৃতি যতই ফল দান করে ততই তা জন্মায়।
তা শুনে ঈভ আদমকে বলল, প্রকৃতি জগতে সকল ঋতুতেই প্রচুর পাকা ফল পাওয়া যায়। আমি প্রতিটি বৃক্ষশাখায় ঝুলতে থাকা ভাল ভাল রসাল ফল তুলে এনে তা আমাদের সম্মানীয় দেবদূত-অতিথিকে প্রদান করব। সেইসব ফল ভক্ষণ করে তিনি যেন স্বীকার করতে বাধ্য হন স্বর্গের মত এই মর্ত্যলোকেও ঈশ্বরের দানের সীমা নেই।
এই কথা বলে একমাত্র অতিথিসেবার কথা ভাবতে ভাবতে ব্যস্ত হয়ে ফলবতী বৃক্ষগুলির দিকে চলে গেল ঈভ। অনেক ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বৃক্ষশাখা থেকে অনেক পাকা রসাল ফল তুলল ঈভ। সেগুলি একটি পাত্রে করে নিয়ে কিছু সুগন্ধি গোলাপ ফুল তুলে পথে ছড়াতে ছড়াতে কুঞ্জমাঝে ফিরে এল সে।
ইতিমধ্যে আমাদের মহান আদিপিতা সেই দেবোপম অতিথিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবার জন্য এগিয়ে গেল। তার নিজস্ব কতকগুলি গুণ ছাড়া কোন অনুচর ছিল না তার সঙ্গে। সে ছিল একা। কিন্তু সে একা হলেও এবং তার অভ্যর্থনায় কোন জাঁকজমক না থাকলেও তা ছিল রাজা-মহারাজের জানানো জাঁকজমক ও প্রভূত ঐশ্বর্যসম্পন্ন অভ্যর্থনার থেকে অনেক ভাল। তা ছিল সরল, স্বাভাবিক এবং গুরুগম্ভীর। কোন কৃত্রিমতা বা অহেতুক কোন উচ্ছ্বাস ছিল না তার মধ্যে।
রাফায়েল কাছে এসে গেলে ভীত না হলেও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ননত ভঙ্গিতে তার সামনে এসে দাঁড়াল আদম। তারপর বলতে লাগল, হে স্বর্গাধিবাসী, স্বর্গ ছাড়া আর কোন লোক এমন উজ্জ্বল মূর্তি ধারণ করতে পারে? স্বর্গলোক ছেড়ে কিছুক্ষণের জন্য তুমি যে আমাদের মত এক মানবদম্পতিকে মনে করে তাদের সাহচর্য দান করতে এসেছ, এজন্য কি বলে ধন্যবাদ দেব তোমায়? এই মাঠটুকু ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন। এই মাঠেই আমরা কাজ করি। তবে দুপুরের এই দুঃসহ তাপটা না কমা পর্যন্ত আমরা এই কুঞ্জেই বিশ্রাম করি।
আগন্তুক দেবদূত রাফায়েল তখন বলল, হ্যাঁ আদম, আমি তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ যাপন করার জন্যই এসেছি এখানে। তোমরা এই মনোরম উদ্যানে ও ভূখণ্ডে বাস করলেও স্বর্গের দেবদূতরা মাঝে মাঝে প্রায়ই আসবে তোমাদের কাছে। এখন তোমার ঐ ছায়াশীতল কুঞ্জে চল। আমি এই দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকব তোমার কাছে।
আদম তখন তার কুসুমদামসজ্জিত ও সুবাসিত কুঞ্জমাঝে নিয়ে গেল রাফায়েলকে। ঈভের কিন্তু কোন সাজসজ্জাই ছিল না। তার নগ্ন দেহটি ছিল প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও লাবণ্যে সমৃদ্ধ। তবু তাকে বনপরী ও যে তিনজন পরমাসুন্দরী দেবী একদিন আইডা পর্বতে রাখালবেশি প্যারিসের কাছে তাদের সৌন্দর্য বিচারের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের সকলের থেকে সুন্দরী দেখাচ্ছিল। পরম রূপবতী ও গুণবতী ঈভের মাথায় কোন বস্ত্রের অবগুণ্ঠন ছিল না, মনে কোন দুর্বলতা ছিল না, গণ্ডদ্বয়ের উপর লজ্জার অরুণ আভা ছিল।
তাকে দেখে দেবদূত রাফায়েল সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন করে বলল, হে মানবজাতির মাতা, তোমার ফলবতী গর্ভ হতে জাত সন্তানদের দ্বারা সমগ্র জগৎ হবে একদিন পরিপূর্ণ। তারা সংখ্যায় এইসব গাছের ফলের থেকেও বেশি।
তৃণাচ্ছন্ন একটি মাটির উচ্চ টিপি তাদের খাবার টেবিলের কাজ করল। সেই কুঞ্জে বসন্ত ও শরৎ যেন হাত ধরাধরি করে নাচছিল। কথাবার্তা বা আলাপ-আলোচনার আগে তাদের ভোজনপর্ব সেরে ফেলার জন্য আদিপিতা আদম বলল, হে স্বর্গীয় অতিথি, এই সব ফল ভক্ষণ করুন। পরম পিতা ঈশ্বরের ইচ্ছায় এইসব সুস্বাদু ফল প্রচুর পরিমাণে মর্ত্যভূমিতে জন্মায়। এ সবই আমাদের পরম পিতার দান।
তখন দেবদূত রাফায়েল বলল, পরম গৌরবময় ঈশ্বর-সৃষ্ট মানবজীবনের দুটি দিক আছে–দেহ ও আত্মা। দেহ ও আত্মার দুইয়েরই খাদ্য চাই। একটি স্কুল, একটি সূক্ষ্ম। মানুষের আত্মিক দিকে আছে বুদ্ধিবৃত্তি আর যুক্তিবোধ আর আছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় যার দ্বারা তারা চোখে দেখে, কানে শোনে, নাক দিয়ে ঘ্রাণ নেয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করে আর জিভ আস্বাদন করে। এইভাবে তারা কর্মেন্দ্রিয়কে জ্ঞানেন্দ্রিয়তে পরিণত করে। এই ইন্দ্রিয়জ্ঞানই মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তিকে খাদ্যের উপাদান করে পুষ্ট করে তোলে। আবার যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা পুষ্ট ও বলিষ্ঠ আত্মা উন্নত হয়। ঈশ্বর সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার খাদ্য চাই। খাদ্যবস্তুদ্বারা পুষ্টি বা লালিত না হলে কোন বস্তু বা জীব কখনো বাঁচতে পারে না।
আবার দেখবে স্কুল বা সূক্ষ্ম যে সব উপাদানের দ্বারা বিশ্বজগৎ গঠিত তাদের মধ্যে স্থূল উপাদানগুলি সূক্ষ্ম উপাদানগুলিকে খাদ্য সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখে। পঞ্চ মহাভূতের মধ্যে দেখ মাটি সমুদ্র বা জলকে খাদ্য দান করে, জল বাতাসকে খাদ্য দান করে, বাতাস অগ্নিকে খাদ্য দান করে, অগ্নি আবার আকাশ ও চন্দ্রকে খাদ্য যোগায়। যে সূর্য বিশ্বের সকল বস্তু ও জীবকে আলো ও জীবন দান করে সেই সূর্যও পৃথিবীর জলরাশিকে বাষ্পকারে শোষণ করে বেঁচে থাকে। সৃষ্ট হয়। ঈশ্বর এই মানুষের দেহ ও মনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন বস্তুর সৃষ্টি করেছেন।
এই বলে খেতে বসল রাফায়েল। সে দেবদূত হলেও মানুষের মত তারও পেটে ছিল দারুণ ক্ষুধা এবং সেই ক্ষুধার তাড়নায় সে প্রচুর খেল। তার হজমশক্তি যেন মানুষের মতোই বেশি। যে কোন স্কুল খাদ্যবস্তুকে সে জীর্ণ করে সহজেই তার থেকে আসল নির্যাস আকর্ষণ করে তা দিয়ে তার প্রাণশক্তিকে পুষ্ট করতে পারে। স্বর্ণকারেরা যেমন খাদমিশ্রিত সোনার টুকরোগুলিকে কয়লার আগুনে গলিয়ে খাঁটি সোনায় পরিণত করে।
এদিকে ঈভ তাদের খাবার পরিবেশন করতে লাগল সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায়। খাবার দেওয়ার পর তাদের কাপগুলি উত্তম মদ্যদ্বারা পূর্ণ করে দিল কানায় কানায়। কিন্তু স্বর্গসুলভ এক নিষ্কলুষ নির্দোষিতায় ভরা তখন ঈশ্বরের সৃষ্ট সন্তানদের মনপ্রাণ ছিল কত পবিত্র। কত নির্বিকার। খাদ্যবস্তু পরিবেশনকারিণী ঈভের নগ্ন সৌন্দর্য দেখেও কোন কামপ্রবৃত্তি জাগল না তাদের মনে। যে দুর্বার কামপ্রবৃত্তি প্রেমকে আদর্শচ্যুত করে তার অধোগতি ঘটায়, যে ঈর্ষা প্রেমিক-প্রেমিকাকে নরকে নিয়ে যায়, সে কামপ্রবৃত্তি ও ঈর্ষা থেকে মুক্ত ছিল তাদের মন।
এইভাবে পানভোজনে তৃপ্ত হলো তারা। আদম তখন ভাবল, এই সুযোগ তার হাতছাড়া করা চলবে না। দেবদূত রাফায়েলের কাছ থেকে ঊর্ধ্বলোকে বিরাজিত স্বর্গধামে দেবতাদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনে নেবে। কারণ সে জানত দেবতাদের গুণ, গরিমা ও শক্তি মানুষের থেকে অনেক বেশি। তাদের রূপও মানবদেহের তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু দেবতাও মানব–দুই জাতির একই পিতা ঈশ্বরের সৃষ্ট হলেও তাদের মধ্যে এই পার্থক্য প্রভেদের মধ্যে কোথায় কোন্ রহস্য আছে তা জানতে চায় সে।
আদম তাই বলল, হে ঈশ্বরের নিকটতম প্রতিবেশী, জানি তুমি শুধু আমাদের প্রতি দয়াবশত স্বর্গের আসন ছেড়ে এখানে এসে যে ফল যে খাদ্য ও পানীয় দেবদূতদের পক্ষে উপযুক্ত নয় তা তৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করেছ। আমাদের হীন ঘরে মাথা নত করে প্রবেশ করেছ।
দেবদূত রাফায়েল তখন বলল, আদম, সর্বশক্তিমান এক অদ্বিতীয় ঈশ্বর থেকেই সকল বস্তু ও জীবের জন্ম হয় এবং মৃত্যুর পর তার কাছেই ফিরে যায়। কোন জীব যদি সততা থেকে বিচ্যুত না হয় তবে তা পূর্ণতা লাভ করবেই। প্রথমে ঈশ্বর বিচিত্র রূপ ও গুণবিশিষ্ট বস্তুজগৎ সৃষ্টি করেন। তারপর সৃষ্টি করেন প্রাণীজগৎ ও পরে আরও সূক্ষ্ম আরও পবিত্র জ্যোতিষ্কমণ্ডলী যা স্বর্গের নিকটবর্তী আকাশমণ্ডলে বিরাজ করে। একটি বৃক্ষকে দেখ। প্রথমে শিকড়, তারপর কাণ্ড, তারপর পাতা, সবশেষে ফুল ও ফল।
মানুষের জীবনও দেখবে ধীরে ধীরে এক মহান সমুন্নতির দিকে উঠে গেছে। প্রথমে অস্থিমজ্জা মাংসরক্তসমন্বিত দেহ, তারপর প্রাণ, তার মন ও ইন্দ্রিয়সমূহ, বৃদ্ধি, কল্পনা, যুক্তি। সবশেষে আছে আত্মা। এই আত্মার দ্বারাই পূর্ণতা লাভ করে মানুষ। আত্মার চুড়ান্ত উন্নতির দিকেই পরিচালিত হবে মানুষের সকল অন্তরবৃত্তি।
এই আত্মিক উন্নতির মধ্য দিয়ে মানুষ পূর্ণতা লাভ করতে করতে ভবিষ্যতে এমন একদিন আসবে যেদিন মানুষ তার স্থূল দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্ম উজ্জ্বল দেবদূতের দেহ ধারণ করবে। আমাদের মত পাখা নিয়ে আকাশে বাতাসে উড়ে যেতে পারবে আর স্বর্গলোকে বাস করবে। অবশ্য যদি তোমরা একান্তভাবে মনে-প্রাণে ঈশ্বরের প্রতি অনুগত থাকতে পার, তাঁর প্রতি প্রেমে ও বিশ্বস্ততায় অবিচল থাকতে পার তাহলে একদিন তোমরা এই মর্ত্যজীবন থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পরম স্বর্গীয় সুখের আস্বাদন লাভ করে ধন্য হতে পারবে। আপাতত যে অবস্থায় আছ তাতেই সন্তুষ্ট থাক। এখন এর বেশি কিছু পাওয়া সম্ভব নয়।
তা শুনে আদি মানবপিতা বলল, হে দৈব অতিথি, বন্ধু দেবদূত, কিভাবে আমরা আমাদের জ্ঞানকে ঠিকপথে পরিচালিত করে সৃষ্ট জীব হিসাবে ধাপে ধাপে ক্ষেত্র থেকে পরিধির পথে যেতে পারি, কিভাবে এই স্কুল দেহ ত্যাগ করে পবিত্র ও অতিসূক্ষ্ম উজ্জ্বল দেবমূর্তি ধারণ করে স্বর্গলোকে গিয়ে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারি সে বিষয়ে যথার্থ শিক্ষা ও উপদেশ দান করেছ।
কিন্তু একটা জিনিস বল, তুমি কথা প্রসঙ্গে বললে, যদি তোমরা অনুগত থাক–একথার অর্থ কি? তবে কি আমরা ঈশ্বরের প্রতি অনুগত নই? তিনি আমাদের সৃষ্টি করলেও তাঁর প্রেম কি আমাদের এখন পরিত্যাগ করেছে? তিনিই তো আমাদের এখানে প্রতিষ্ঠিত করে মানুষ যে সুখ কামনা করে সেই সুখ চূড়ান্তভাবে ঈশ্বর আমাদের দান করেছেন।
রাফায়েল তখন বলল, হে স্বর্গ ও মর্ত্যের সম্ভান, শোন, তুমি এখন সুখী এবং এই সুখের জন্য ঈশ্বরের কাছে ঋণী, আবার তোমার এই সুখ যদি স্থায়ী হয় তাহলেও তুমি থাকবে তাঁর কাছে। তোমার এই সুখ-শান্তি নির্ভর করবে তাঁর প্রতি আনুগত্যের উপর। আমি তখন ‘অনুগত’ কথাটির মধ্য দিয়ে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম।
সুতরাং আমার উপদেশ শোন। ঈশ্বর তোমাকে পূর্ণতা দান করেছেন ঠিক, কিন্তু তোমার এই পূর্ণতা অপরিবর্তনীয় নয়। তোমার গুণাবলীর অভাব ঘটলে, তোমার মধ্যে সততা ও নীতিবোধের অভাব ঘটলে এই পূর্ণতা তোমার নাও থাকতে পারে।
ঈশ্বর তোমাকে সৎ করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন কিন্তু চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের দ্বারা তোমার জীবনের নির্দিষ্ট কর্ম সম্পাদন করে এই সততা বজায় রাখা তোমার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করে। মনে রেখো, তোমার ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন, তা ভাগ্য বা কঠোর অভাব বা প্রয়োজনীয়তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।
ঈশ্বর চান আমাদের ঐচ্ছিক সেবা ও আনুগত্য। কোন প্রয়োজনের দ্বারা বাধ্য হয়ে আমরা তাঁর সেবা করি–এটা চান না তিনি। এ ধরনের সেবা গ্রহণ করেন না তিনি। মানুষের অন্তর যদি স্বাধীন হয়, তবে কেন মৃত্যুর পর তার বিচার হয়, সে স্বেচ্ছায় ঈশ্বরের সেবা করেছে কোন প্রয়োজনের বা কোন কামনার তাড়নায় সে সেবা করেছে তা বিচার করে দেখা হয়? যদি মানুষের ইচ্ছাশক্তি স্বাধীন না হত, যদি তারা ভাগ্যের দ্বারা তাড়িত হয়ে সবকিছু করত তাহলে সে কাজের জন্য বিচার করার কি অর্থ হত?
আরও দেখ, আজ আমি ও আমার মত যত সব দেবদূতেরা স্বর্গ-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ঈশ্বরের চারদিকে অবস্থান করে পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছি, তা শুধু তার প্রতি আমাদের আনুগত্যের জন্য। এই আনুগত্য যতদিন আমাদের থাকবে ততদিনই আমরা উপভোগ করে যাব এ সুখ। অন্য কোন কারণ নেই। আমরা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছার বশবর্তী হয়েই ঈশ্বরকে ভালবাসি এবং তাঁর সেবা করি। এই দেশ, ভালবাসা ও আনুগত্যের দ্বারাই আমরা এই অবস্থার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকব। আবার এই গুণগুলির অভাব ঘটলেই আমাদেরও পতন ঘটবে। আজ যারা অধঃপতিত, স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকে নির্বাসিত, আনুগত্যের অভাব আর ঈশ্বরদ্রোহিতাই তার একমাত্র কারণ। আর সেই পতনের ফল কি দেখ। কি পরিমাণ স্বর্গীয় সুখ থেকে আজ কি ভীষণ নরকযন্ত্রণা তারা সহ্য করছে!
তখন আমাদের আদিপিতা বলল, তোমার কথাগুলি সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। হে ঐশ্বরিক। পরামর্শদাতা, তোমার উপদেশামৃত আমি সানন্দে আমার কণ্ঠদ্বারা পান করেছি। চেরাবজাতীয় দেবদূতদের নৈশ সঙ্গীতের থেকেও শ্রুতিমধুর তোমার নীতি উপদেশ। আমি জানতাম না মানুষের ইচ্ছা ও কর্ম স্বাধীন। যাই হোক, আমি কখনো আমাদের পরম পিতার প্রতি ভালবাসার কথাকে ভুলব না। তার ন্যায়সঙ্গত আদেশ আমি কখনো অমান্য করব না। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত, আমার চিন্তা ও সংকল্প স্থির। যদিও তুমি ঈশ্বরের নামে অনেক কিছুই বলেছ তথাপি কিছু সংশয় রয়ে গেছে আমার মনে। আমি আরো কিছু জানতে চাই। অবশ্য যদি তোমার অমত না থাকে তবে বলতে পার। ঈশ্বর ও আমাদের মধ্যে যে রহস্যময় সম্পর্ক বিদ্যমান তার পূর্ণ বিবরণ আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। এখনো সময় আছে। সূর্য সবেমাত্র তার আহ্নিক গতিপথের অর্ধাংশ অতিক্রম করেছে।
আদমের এই অনুরোধে রাফায়েল সম্মত হয়ে কিছুক্ষণ থামার পর বলতে আরম্ভ করল, হে আদি মানবপিতা, তুমি আমার উপর যে কাজের ভার দিলে তা যেমন কঠিন তেমনি বিষাদজনক আমার পক্ষে। কেমন করে আমি অদৃশ্য দেবতাদের কার্যাবলী মানুষের জ্ঞানের বিষয়ীভূত করে তুলব? একদিন যারা পূর্ণতার গৌরবে মণ্ডিত হয়ে স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের ধ্বংস ও পতনের কথা প্রকাশ করে অন্য এক জগতের রহস্য কি করে উদঘাটিত করব? তবু আমি শুধু তোমার মঙ্গলের জন্য মানুষের জ্ঞানের অতীত বিষয় প্রকাশ করব তোমার কাছে। যদিও এই মর্ত্যলোক স্বর্গেরই ছায়ামাত্র এবং যদিও দেহধারী মানুষের সঙ্গে বিদেহী দেবতাদের সম্পর্ক খুবই জটিল তথাপি সে সম্পর্কের কথা বলব তোমায়।
কেন্দ্র ও পরিধিবিশিষ্ট যে জগৎ আজ এখানে দেখছ, যে সব গ্রহ ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলীকে আজ মহাশূন্যে শৃংখলাবদ্ধভাবে ঘুরতে দেখছ, সৃষ্টির আদিকালে এসব কিছুই ছিল না। ছিল শুধু এক মহাশূন্য আর যত সব বিশৃংখলা।
এই সময় একদিন যখন স্বর্গের বৎসর গণনা শুরু হয় সেদিন ঈশ্বরের ডাকে স্বর্গের বিভিন্ন প্রান্ত হতে দশ হাজার দেবদূত ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে সমবেত হয়। পরম পিতার কোলে ছিল তখন তার সন্তান।
তিনি তখন দেবদূতদের সম্বোধন করে বললেন, শোন হে দেবদূতবৃন্দ, আলোর জনক, কত রাজা, রাজ্য, গুণ ও শক্তির জন্মদাতা। আজ আমি আমার একমাত্র পুত্রের জন্ম ঘোষণা করছি। আজ আমি এই পবিত্র পাহাড়ে তার অভিষেক করছি। যাকে তোমরা আমার কোলের ডানদিকে দেখছ তাকে আমি তোমাদের নেতা নিযুক্ত করেছি। তোমরা তার কাছে মাথা নত করে তাকে তোমরা তোমাদের প্রভু বলে মেনে নেবে। তোমরা তার অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুখে শান্তিতে বাস করবে। যে আমার পুত্রকে অমান্য করবে সে আমাকেই অমান্য করবে। সে ঐক্যকে বিচ্ছিন্ন করবে সে ঈশ্বরের আশীর্বাদ হতে বঞ্চিত হবে, ঈশ্বরের দর্শন হতে বঞ্চিত হবে, নরকের গভীর অন্ধকারে পতিত হবে। প্রতিকারের অতীত পাপে মগ্ন হবে সে। অনন্তকাল ধরে নরকজ্বালা সহ্য করবে সে।
সর্বশক্তিমান পরম পিতা এই কথা বলতে উপস্থিত সকলে সন্তুষ্ট হলো বলে মনে হলো, কিন্তু একেবারে সকলে সন্তুষ্ট হলো না। সেদিন দিনের শেষে আসন্ন সন্ধ্যায় অন্যান্য দিনের মত সমবেত দেবদূতেরা নাচগানে মত্ত হয়ে উঠল। তখন মনে হলো তাদের সেই নৃত্যগীতের তালে তালে মহাশূন্যে ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলিও যেন নৃত্য করছে।
দেবদূতদের সমবেত কণ্ঠে ও নৃত্যরত গ্রহনক্ষত্রদের তানের মধ্যে এমনই একটি সুমধুর ঐকতান ছিল যে তা শুনে পরম প্রীত হলেন ঈশ্বর। সেদিন কিন্তু ঘূর্ণমান গ্রহনক্ষত্রগুলির মধ্যে আমাদের তেমন শৃংখলা বা নিয়মনিষ্ঠা ছিল না।
ক্রমে সন্ধ্যা সমাগত হলো। তখন কিন্তু সকাল-সন্ধ্যার মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে নাচগান ছেড়ে নৈশভোজনে মন দিল দেবদূতেরা। তারা চক্রাকারে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন তাদের সামনে খাবার টেবিল সাজানো হলো আর দেবদূতদের উপযুক্ত রাশিকৃত খাবার সাজিয়ে দেওয়া হলো। স্বৰ্গজাত পুষ্পমণ্ডিত নানা ফল পরিবেশন করা হলো তাদের। তার সঙ্গে দেওয়া হলো লাল মুক্তোর মত মদ। পরম পিতা ঈশ্বর নিজে প্রচুর পানভোজনের ব্যবস্থা করেছিলেন।
দেবদূতেরা সকলে মিলেমিশে তৃপ্তির সঙ্গে পানাহার করল। পরম আনন্দের এক অমৃতধারা বয়ে যাচ্ছিল যেন তাদের সেই ভোজনসভায়। পরমেশ্বরও তাদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করছিলেন। আলোছায়ার নাচন চলছিল যেন ঈশ্বরবিরাজিত সেই পবিত্র পাহাড়ে। চলছিল আলোছায়ার চঞ্চল লীলামাধুরী।
রাত্রি আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গের উজ্জ্বল মুখমণ্ডল সহসা ধূসরবণ হয়ে উঠল। কারণ স্বর্গলোকে কখনো ঘনীভূত হয়ে ওঠে না রাত্রির অন্ধকার। রাত্রিকালে ঈশ্বরের চক্ষু কখনো নিদ্রিত হয় না। তিনি শুধু দিনের শেষে শায়িত হয়ে বিশ্রাম লাভ করেন।
দেবদূতেরা তখন দলে দলে তাদের শিবিরে প্রস্থান করল। জীবন-বৃক্ষের চারপাশে অসংখ্য চত্বর ছিল। সেখানে তারা শীতল বাতাসে শরীর তোষণ করে সুখনিদ্রায় অভিভূত হয়ে উঠল। যারা শুধু সারারাত ঈশ্বরের সিংহাসনের চারপাশে পালাক্রমে মধুর স্তোত্ৰগান করত তারাই জেগে রইল।
আজ যে শয়তানরাজ নামে অভিহিত, সেদিন রাত্রিতে সেই শয়তান তখন স্বর্গেই থাকল। সেদিন ঘুমোল না, আবার স্তোত্ৰগানরত দেবদূতদের মত কোন কাজ করতে লাগল না। অথচ সে জেগে রইল।
সেদিন আজকের এই শয়তানরাজ ছিল প্রধানতম দেবদূত। সে তখন ঈশ্বরের অনুগৃহীত এবং প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু ঈশ্বরের প্রকাশ্য পুত্রের প্রতি তার মনে ছিল দারুণ ঈর্ষা। সেদিন ঈশ্বর যখন সেই পবিত্র পাহাড়ে তাঁর পুত্রকে যুবরাজরূপে অভিষিক্ত করেন তখন সে দৃশ্য সইতে পারেনি শয়তান। সে দৃশ্য সে ঈর্ষার জ্বালায় দেখতে পারেনি। তার অহঙ্কারে আঘাত লেগেছিল।
এক গভীর হিংসা ও তীব্র ঘৃণার বশবর্তী হয়ে সেদিন মধ্যরাত্রিতে সংকল্প করল সে, সে ঈশ্বরের প্রতি আর কোন আনুগত্য প্রদর্শন করবে না। তাঁর আদেশ পালন বা মান্য করবে না, শুধু তাই নয়, তাকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করবে। সে আর ঈশ্বরের কোন উপাসনা করবে না।
প্রধান দেবদূতরূপী শয়তান এই সংকল্প মনে মনে করার পর, তার প্রধান সহকর্মীকে জাগাল ঘুম থেকে। সে বলল, হে আমার প্রিয় সঙ্গী, তুমি ঘুমোচ্ছ? কি করে ঘুম নেমে এল তোমার চোখের পাতায়? গতকাল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মুখ থেকে যে কথা নিঃসৃত হয়েছে তা তুমি শুনেছ? আমরা যখন দুজনেই জাগ্রত অবস্থায় ছিলাম তখন আমাদের মনপ্রাণ সব এক ছিল। আমি আমার মনের কথা তোমায় বলতাম, তুমি আমায় বলতে তোমার মনের কথা। এক নতুন আইন প্রবর্তিত হয়েছে। রাজা যখন নতুন আইন বলবৎ করেছে তখন আমরা তাঁর প্রজা হিসাবে সে আইনে সন্দেহ হওয়ায় সে আইন পর্যালোচনা করে অবশ্যই দেখব। সে সন্দেহ আমাদের নিরসন করতে হবে। তবে এখানে এ বিষয়ে বেশি কথা বলা নিরাপদ নয়। তাই আমাদের অধীনে যারা কাজ করে তাদের সবাইকে সমবেত করে উত্তরদিকে আমাদের যে সব বাসা আছে সেখানে তাড়াতাড়ি যেতে আদেশ করো। সেখানে রাত্রি শেষ হবার আগেই আমি চলে যাব। সেখানে আমরা আমাদের রাজার নূতন বিধান ও তার যুবরাজপুত্র সম্বন্ধে বিশেষভাবে আলোচনা করে দেখব। তারা যথাশীঘ্র সম্ভব। তাদের এই নূতন বিধান সর্বত্র বলবৎ করতে চায়।
এইভাবে সেই আর্কেঞ্জাল বা দেবদূতপ্রধান তার সহকর্মীদের মনকে প্রভাবিত করে তার কথা বুঝিয়ে বলল। তার সহকর্মী ও তাদের অধীনস্থ দেবসেনাদের সমবেতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে ডেকে তার প্রধানের কথাগুলি বুঝিয়ে বলল। দ্বৰ্থবোধক কথায় ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে সে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের কু-অভিসন্ধির কথাগুলি বুঝিয়ে দিল। তাদের ক্ষমতাশালী নেতার কথা তারা মেনে চলতে সম্মত হলো।
রাত্রিশেষে ধ্রুবতারা আকাশে উঠতেই স্বর্গের সেনাদলের এই একটি অংশ সমবেত হলো তাদের প্রধানের আদেশমতো। লুসিফারই হলো এই ধ্রুবতারা। তাকে দেখে উৎসাহিত হলো তারা।
এদিকে সর্বশক্তিমান সর্বদশী ঈশ্বরের যে চক্ষু সকল অন্তঃগূঢ় গোপন চিন্তাগুলিকেও দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে, সেই চক্ষু সেই পবিত্র পর্বতে সারারাত্রি ধরে প্রজ্জ্বলিত স্বর্ণদীপের শিখায় দেখতে পেল এক বিদ্রোহের অভ্যুত্থান হচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন কারা তাঁর সৃষ্ট দেবসন্তানদের একটি অংশের মধ্যে সেই বিদ্রোহের বিষাক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। বুঝতে পারলেন তারা তাঁর বিধানের বিরোধিতা করছে।
তিনি যখন তাঁর পুত্রকে হাসিমুখে বললেন, হে আমার পুত্র, আমার শক্তির একমাত্র অধিকারী, আমার গৌরবের মূর্ত প্রতীক, এখন আমাদের অবিসম্বাদিত শক্তিপরীক্ষার সময় এসেছে। আমাদের শক্তি কতখানি সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে আমাদের। আমাদের প্রাচীন সাম্রাজ্য রক্ষা করার জন্য অস্ত্র প্রয়োগ করতে হবে। এমন এক প্রবল শত্রুর উদ্ভব হয়েছে যে স্বর্গলোকের উত্তরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আমাদের মতোই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে সিংহাসনে বসতে চায়। আবার এতেই সন্তুষ্ট নয় সে। সে আমাদের অধিকার ও প্রভুত্বকে অস্বীকার করে যুদ্ধে আমাদের শক্তি পরীক্ষা করতে চায়। এখন এ বিষয়ে কি করা উচিত বল। এখন দেখ, আমাদের কি পরিমাণ শক্তি অর্থাৎ সৈন্য ও অস্ত্রবল আছে এবং সেই সমস্ত সামরিক শক্তি আমাদের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত করে বিপদটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করো। তা না হলে শত্রুদের অতর্কিত আক্রমণে আমাদের এই পবিত্র পার্বত্য রাজ্যটিকে হারাতে হতে পারে।
এ কথার উত্তরে ঈশ্বরপুত্র প্রশান্ত চিত্তে মৃদু অথচ স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে বলল, হে পরম শক্তিমান পিতা, শত্রুরা যতই চক্রান্ত করুক, যতই হৈচৈ করুক, তাদের ষড়যন্ত্র ও প্রয়াস ব্যর্থ হতে বাধ্য। এটা আমার পক্ষে সত্যিই এক গৌরবের বিষয়। আমিই হলাম তাদের এই বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারণ। তারা যখন দেখল তুমি তাদের উদ্ধত গর্বকে খর্ব করার জন্য আমাকে তোমার সমস্ত রাজশক্তি দান করেছ তখন তারা এ বিষয়ে আমার যোগ্যতা কতখানি তা যাচাই করে দেখতে চাইল।
ঈশ্বরপুত্র যখন এইসব কথাগুলি বলছিল ঠিক সেই সময় শয়তান তার সেনাদল নিয়ে বহু দূরবর্তী উত্তরাঞ্চল থেকে পাখায় ভর দিয়ে অনেক পথ পার হয়ে একটি পাহাড়ের দিকে উড়ে আসতে লাগল।
যে পাহাড়ে ঈশ্বরপুত্রের অভিষেকক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল, এ পাহাড়টি ছিল তারই অনুরূপ। সেই পাহাড়ের উপরেই ছিল দেবদুতপ্রধান লুসিফারের প্রাসাদ। সেখানে ঈশ্বরপুত্রের অনুরূপ এক রাজকীয় সিংহাসন স্থাপন করেছিল সে। এইখানেইলুসিফাররূপী শয়তান তার অধীনস্থ সেনাদের সমবেত করে তার পরিকল্পনার কথা জানায়। ছলনা ও এক হীন অপকৌশলের দ্বারা নানাভাবে যত অসত্য কথা বলে তাদের বশীভূত করে তোলে।
সে তাদের বলতে লাগল, ভাই সব, রাজত্ব ও রাজক্ষমতার কোনরকম বিকেন্দ্রীকরণ না করে একজনমাত্র সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। তারপর তার পুত্রকে যুবরাজরূপে অভিষিক্ত করে আইনের বিধানদ্বারা আমাদের সব অধিকার গ্রাস করে আমাদের সকলকে তার অধীনস্থ দাস করে রেখেছে।
এই কারণেই আজ এই মধ্যরাত্রিতে তাড়াতাড়ি এই সভার আয়োজন করেছি। আজ যে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে পিতার নিজের দ্বিগুণীকৃত শক্তি ও সম্মানে ভূষিত সেই ঈশ্বরপুত্রকে আমরা ক্রীতদাসের মত নতজানু বা প্রণিপাত হয়ে সসম্মানে বরণ করে নেব কিনা সে বিষয়ে আলোচনা করব এই সভায়। অথবা ভেবে দেখতে হবে এই হীনতা ও পরাধীনতার জোয়াল হতে মুক্ত করার জন্য কোন ভাল পরিকল্পনা খাড়া করতে পারি কি না। তোমরা কি তোমাদের কাঁধের উপর জোয়াল ধারণ করবে? তোমরা কি তার সামনে নতজানু হবে?
আমি যতদূর জানি তোমরা তা পারবে না। তোমরা যদি নিজেদের সম্বন্ধে ভালভাবে জান এবং নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হও তাহলে বুঝতে পারবে পদের দিক থেকে তোমরা সকলে সমান না হলেও তোমরা সকলেই সমানভাবে স্বাধীন। পদের তারতম্য ও শৃংখলা কখনো স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। শক্তি ও ঐশ্বর্যে সমান না হলেও অধিকারের দিক থেকে আমরা যদি সমান ও সকলেই স্বাধীন হই তাহলে একজন কেন শুধু তার রাজশক্তির জোরে আমাদের সকলের উপর প্রভুত্ব করবে? কেন সে আইনের বিধান আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়ে শাসন করবে আমাদের? কেন আমাদের প্রভু হয়ে শুধু সম্মান আর শ্রদ্ধা উপচার চাইবে আমাদের কাছ থেকে? কিন্তু যে নীতি অনুসারে আমরাই আমাদের প্রভু, আমরা কারো দাসত্ব করতে বাধ্য নই, আমাদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় যে নীতি সে নীতিকে লঙঘন করতে চায় ঈশ্বর।
এইরকম উদ্ধতভাবে অনেকক্ষণ ধরে উত্তেজনামূলক কথাগুলি বলে চলল সেই দেবদূতপ্রধান শয়তান। এমন সময় এ্যাবদিয়েল নামে সেরাফিম জাতীয় এক দেবদূত যে ঈশ্বরকে খুব ভক্তি করত এবং সব ঐশ্বরিক আদেশ নির্বিবাদে পালন করত, শয়তানের কথা শুনে প্রচণ্ড ক্রোধানলে উত্তপ্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। এক জ্বলন্ত প্রতিবাদে ফেটে পড়ে সে বলতে লাগল, হে নাস্তিক, ঈশ্বরদ্রোহী, এই মিথ্যা গর্বোদ্ধত কথাগুলি স্বর্গলোকের মধ্যে অন্তত তোমার মুখে শোভা পায় না। যে তুমি আর সকলের থেকে উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত সেই তোমার মুখ থেকে এসব কথা শোনার কেউ আশাই করতে পারে না। ঈশ্বর তাঁর একমাত্র পুত্রকে ন্যায়সঙ্গতভাবে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত ও রাজশক্তিতে ভূষিত করে যে শপথবাক্য উচ্চারণ করেছেন ও যে বিধান ঘোষণা করেছেন সেই বিধানের বিরুদ্ধে ন্যায়, নীতি ও ধর্মবিহর্গিতভাবে তীব্র ভাষায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছ।
অথচ স্বর্গলোকের প্রত্যেকে নতজানু হয়ে ঈশ্বরের পুত্রকে তার সকল শক্তি ও সম্মানের একমাত্র বৈধ উত্তরাধিকারী হিসাবে বরণ করে নেবে। আইনের বিধানের সঙ্গে স্বাধীনতাকে যুক্ত করে এক করে দেখে তুমি যা কিছু বলেছ তা সর্বতোভাবে অন্যায়। সমানাধিকারের ভিত্তিতে সকলে সমান হলেও সকল শক্তির অধিকারী একজনই শাসন করে যাচ্ছে। এটাই হলো ঈশ্বরের বিধান। আইন ও স্বাধীনতার মধ্যে কোন বিরোধ নেই। যে ঈশ্বর তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাকে এই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছেন সেই ঈশ্বরের বিধানকে খণ্ডন করে তার বিরোধিতা করে এক পাল্টা বিধান তুমি সৃষ্টি করতে চাও।
ঈশ্বর গলোকের মধ্যে সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গতভাবে সকলের মধ্যে যোগ্যতানুযায়ী ক্ষমতা বণ্টন করে সে ক্ষমতা নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন, যাতে কারো সঙ্গে কোন বিরোধ না বাধে। তাছাড়া আমরা আমাদের অভিজ্ঞতার দ্বারা এটা বেশ বুঝেছি ঈশ্বর পরম মঙ্গলময়, তিনি আমাদের সকল মঙ্গল, সম্মান ও উন্নতির বিধানকর্তা। তিনিই। আমাদের এই সুখী অবস্থায় উন্নীত করেছেন। তিনিই আমাদের ঐক্যবদ্ধ করেছেন।
তোমার মধ্যে দেবদূতের সব গুণগুলি মূর্ত হয়ে ওঠায় তোমাকে ঈশ্বর সৃষ্টি করে এক মহান ও গৌরবময় আসনে অধিষ্ঠিত করে শক্তিতে তাঁর প্রায় সমকক্ষ করে তুলেছেন। ঈশ্বর তোমাকে ও সকল দেবদূতকে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকে তাদের আপন আপন গুণ ও যোগ্যতানুসারে গৌরবে মণ্ডিত করেছেন। তিনি এই স্বর্গরাজ্য শাসন করলেও সে শাসনের দ্বারা কিছুমাত্র খর্ব হয়নি আমাদের গৌরব, বরং তা উজ্জ্বল হয়েছে আরও। তাঁর প্রণীত আইন আমরা বিবেকের আইন ভেবেই মেনে চলি। তাঁর প্রতি যে সম্মান প্রদর্শন করি তা আমাদেরই কাছে ফিরে আসে। সুতরাং এই অধর্মোচিত ক্রোধ পরিহার করা। মিথ্যা কারণে এদের প্ররোচিত করো না। তোমার আচরণে রুষ্ট আমাদের পরম পিতা ও তাঁর পুত্রের কাছে তাড়াতাড়ি গিয়ে তাঁদের সন্তুষ্ট করো। যথাসময়ে চাইলে ক্ষমা মিলতে পারে। কিন্তু দেরি হলে আর মার্জনা পাবে না।
দেবদূত এ্যাবদিয়েল এইসব কথাগুলি আবেগের সঙ্গে বলল। কিন্তু তার কথা উপস্থিত কেউ সমর্থন করল না। সবাই ভাবল এই কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কোন এক হঠকারীর ব্যক্তিগত মতামতমাত্র। ফলে সেই দেবদূতপ্রধানরূপী শয়তান খুশি হলো। সে তখন আরও উদ্ধতভাবে বলতে লাগল, তুমি বলছ, ঈশ্বরই আমাদের সৃষ্টি করেন, তাই তার সঙ্গে আমাদের পিতাপুত্রের সম্পর্ক। এ এক অভিনব এবং অদ্ভুত যুক্তি। কোথা থেকে একথা শিখেছ তা জানতে পারি কি?
এই সৃষ্টির উৎপত্তি কে দেখেছে? তোমার জন্মকথা কি তোমার মনে আছে? স্রষ্টা ঠিক কখন তোমার এই অস্তিত্ব দান করেন তা কি মনে আছে তোমার? কেউ তা জানে না। জেনে রেখো, তুমি আমি আমরা সবাই স্বয়ম্ভু, আপনা হতেই সৃষ্টি হয়েছে আমাদের। আপন আপন শক্তিতেই আমাদের জন্ম ও বৃদ্ধি ঘটে। একটি ঘূর্ণমান গ্রহের কক্ষপথ সম্পূর্ণ হওয়ার সময় আমাদের জন্মস্থান এই স্বর্গলোকের যখন উৎপত্তি হয় তখনই আমাদের জন্ম হয়। হে স্বয়ম্ভু সন্তানগণ, তোমরা স্বজাত, স্বয়ংসিদ্ধ। আমাদের এই দক্ষিণ হস্তই আমাদের প্রধান কর্তব্যকগুলি কি তা শিখিয়ে দেবে। কে আমাদের সমকক্ষ, তা আপন শক্তির দ্বারাই প্রমাণিত হবে। এবার তোমরা বিচার-বিবেচনা করে দেখবে, স্বর্গাধিপতির সিংহাসনের চারপাশে স্তাবকের মত সমবেত হয়ে প্রার্থনা ও অনুনয়-বিনয়ের দ্বারা তাঁকে তুষ্ট করবে, না সেই সিংহাসন অবরোধ করবে। অথবা চূড়ান্ত শক্তিপরীক্ষার মাধ্যমেই এ বিষয়ের নিষ্পত্তি করবে।
এই সংবাদ অভিষিক্ত যুবরাজের কাছে যথাশীঘ্র বহন করে নিয়ে যাও। তা না হলে কোন অশুভ শক্তি তোমাদের গতিরোধ করতে পারে।
শয়তান এই কথা বললে গভীর সমুদ্রগর্জনের মত এক প্রবল সমর্থনধ্বনি বিপুল হর্ষধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হয়ে অসংখ্য বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। কিন্তু এ্যাবদিয়েল একাকী শত্রু দ্বারা পরিবৃত হয়েও কোন ভয় পেল না। আগের মত সে নিতীকভাবে উত্তর করল, হে ঈশ্বরদ্রোহী, হে অভিশপ্ত দেবদূত, আজ তুমি সমস্ত শুভ অমঙ্গলকে পরিত্যাগ করলে। আমি দেখতে পাচ্ছি তোমাদের পতন অনিবার্য। তোমরা এই বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতারণাময় কুকর্মের সঙ্গে তোমার অধীনস্থ এই দেবসেনা দলও সংজড়িত হয়ে পড়ল। তোমার অপরাধ ও শাস্তি সংক্রামক রোগজীবাণুর মত ছড়িয়ে পড়বে তাদের জীবনে।
ঈশ্বরের পুত্রের প্রভুত্বকে পরিহার করার জন্য আজ থেকে আর বিব্রত হতে হবে না তোমায়। ঈশ্বরঘোষিত আইনের বিধান আর মেনে যেতে হবে না তোমাকে। অমোঘ অপরিবীয় শক্তির বিধান জর্জরিত করে তুলবে তোমায়। সুবর্ণময় যে ঐশ্বরিক রাজদণ্ডকে অমান্য করেছ তুমি, সেই রাজদণ্ড আজ লৌহদণ্ড হয়ে তোমার বিদ্রোহের মূলে আঘাত হানবে, তাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।
তুমি ভালই উপদেশ দিয়েছ। কিন্তু তোমার উপদেশ যত খারাপই হোক, আমি তার ভয়ে অথবা তোমার ভয়ে তোমাদের এই অধ্যুষিত বাসস্থান ছেড়ে চলে যাচ্ছি না। আমি যাচ্ছি কারণ ঈশ্বরের ধূমায়িত রোষ সহসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলে তখন কে ভাল কে মন্দ তা বিচার বা বাছাই করার কোন অবকাশ থাকবে না।
আমি বলে দিচ্ছি, শীঘ্রই তুমি অগ্নি উদগীরণকারী বস্ত্রের আঘাত তোমাদের মাথার উপর অনুভব করবে। তবে বুঝতে পারবে কে তোমায় সৃষ্টি করেছে। তখন বুঝতে পারবে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তোমাকে ধ্বংস করছেন।
অসংখ্য অবিশ্বস্তের মাঝে একমাত্র বিশ্বস্ত দেবদুত এ্যাবদিয়েল অটুট অবিচলভাবে এই কথাগুলি বলল। কোন ভয়ে কম্পিত না হয়ে, সে তার অদম্য শক্তিকে অটুট রাখল যে শক্তি সমস্ত প্রলোভনকে জয় করে অব্যাহত রয়ে গেল তার ঈশ্বরপ্রেম। কোন কিছুই সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারল না তাকে। অসংখ্যের মাঝে সে একা হলেও তার মন পরিবর্তিত হলো না কিছুতেই।
তাদের মধ্য থেকে সভা ছেড়ে চলে গেল এ্যাবদিয়েল। উপস্থিত সকলের ঘৃণার উত্তরে সে সকলের সামনে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে উড়ে চলে গেল।