৪র্থ অধ্যায় – হামিন অস্ত! হামিন অস্ত! : মুসলমানি বা ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত
মুখবন্ধ
‘ইসলাম’ শব্দের অর্থ ঈশ্বরের কাছে ঐকান্তিক সমর্থন। ‘ইসলাম’১ সেই বিশ্বাস যা মানুষকে ঈশ্বরের কাছে নিয়ে আসে, নিয়ে আসে একান্ত সমর্পণের মাধ্যমে। এ সেই আকুল সমর্পণ যা মানবজীবনকে ঈশ্বরে লীন হতে শেখায়। আর যাঁরা নিজেদের এই সমর্পণে নিয়ে আসেন তাঁরাই মুসলিম। এই সমর্পণ অনুদীর্ঘ, উদ্দেশ্যরহিত। এই সমর্থন বা আত্মবিনিয়োগ ধবনিত হয় মুসলমানদের ‘সালাম-আলায়কুম’-এ, যার অর্থ ‘ঈশ্বর বা আল্লা সবর্দা যেন আপনার ওপর শান্তিধারা বর্ষিত করেন’। প্রত্যুত্তরে ‘ওয়ালেকুম’ অর্থাৎ, ‘তা যেন নিজের উপরেও বজায় থাকে’।২ পয়গম্বর হজরত মহম্মদ ইসলামিক ইতিহাসের সেই সর্বজনবিদিত কিংবদন্তি—ঈশ্বরপ্রেরিত অন্তিম দূত—যিনি মানবজাতির কল্যাণসাধন করেছেন। ইনি কোনো নতুন ধর্ম প্রতিস্থাপন করেননি। শুধু প্রচার করেছেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মৈত্রী ও ভালোবাসার নিবিড় পাঠ যা ঈশ্বরের অন্যান্য সন্তানেরা যেমন—আদম, নোয়া, ইব্রাহিম ও মোজেস করে এসেছেন। ত্রুসেডের সময় এই বিশেষ ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসীদের ‘মহামেডান’ (Muhammadan) বলা হয়েছিল যা অবমাননাকর। যাঁরা ইসলামের ‘রসুল’ ও হজরতের বাণী মেনে চলেন তাঁরাই ‘মুসলিম’ বা ‘মুসলমান’। পয়গম্বর মহম্মদ (৫৭০ – ৬৩১ খ্রি.)৩ তাঁর দীর্ঘ জীবনপথে বিশ্বসৌহার্দ্য, শান্তি ও ভালোবাসার বাণী এভাবেই ছড়িয়ে দিয়েছেন মানবসভ্যতার মননে।
‘ইসলামিক সংগীত’৪ বা মুসলিম ধর্মীয় সংগীত এই ধর্মের এক অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এটি মূলত নানান সাংগীতিক মাধ্যমে জনগণের মঙ্গলার্থে বা ধর্মীয় আবেগে বান ডাকার জন্য (অন্যান্য সকল ধর্মের ন্যায়) নানান স্থান-এ পরিবেশিত হয়। সনাতনি ইসলামিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক দেশগুলির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, মিশর, ইরান, মধ্য এশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যেহেতু ইসলাম একটি বহুমুখী সংস্কৃতির প্রতিফলক সেহেতু এর ধর্মীয়সংগীতেও বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য পরিলক্ষিত হয়।
‘ইসলামীয়’ ধর্মীয় সংগীতের প্রথম লিখিত বিবরণ পাওয়া যায়, দশম শতাব্দীতে আরবপণ্ডিত ও বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আবু আল-ফারাবির (Abu Al-farabi) লেখায়। বিখ্যাত এই পণ্ডিতের লেখা কিতাব-অল মিউসিকি অল-কবির (প্রাকৃত ফারসি ভাষায় লেখা, The great book of music)৫ বহু পণ্ডিতের মতানুসারে বিশ্ব সংগীত ও ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের আদিগ্রন্থ। পণ্ডিত আল-ফারাবি বহু বাদ্যযন্ত্র বাজাতে জানতেন এবং নানান যন্ত্রের উদ্ভাবক। এঁর সৃষ্ট লাতিন-আরবি সংগীতের ব্যবহারিক ও প্রায়োগিক তত্ত্ব আজও আধুনিক ইসলামিক সংগীতে বর্তমান। এই সুফি সাধক শুধু বিদ্বানই ছিলেন না, ইসলামিক ধর্মীয়সংগীতে এঁর নানাবিধ অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয়। আল-ফারাবি নিজে সনাতনি হিন্দু শাস্ত্রীয় বা মার্গসংগীতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর মতে মুসলমানদের আবশ্যিক কর্তব্যের মধ্যে দিনে পাঁচ মুহূর্তের ‘নামাজ’ (ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ) যথা, ফজর হতে ঈশা। প্রত্যেক ‘নামাজের’ সময় ব্যবহৃত ‘আজানে’ (ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জমায়েত) আরবি ও হিন্দুস্থানী শাস্ত্রীয় সংগীতের রাগ-রাগিণীর বিধান পাওয়া যায়। এছাড়াও দুটি বিশেষ ইসলামীয় সংগীত যথা—’হমদ-এ-খুদা’ ও ‘নাদ-এ রসুল’৬-এর কথা এঁর লেখায় জানা যায়, যা বস্তুত মহম্মদের স্তুতিগান। এছাড়াও মুসলমানদের নানাবিধ উৎসবেও ধর্মীয় সংগীতের প্রচুর ব্যবহার (যেমন মহরমের সময় ‘মরসিয়া’৭ বা শোকগাথা) এঁর লেখাতেই জানা যায়।
ইসলামের ভাবদর্শন ইসলামীয় সংগীতের ব্যবহারব্যতীত অন্তঃসার শূন্য। এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীত মূলত প্রাচীন আরবদেশীয় যাযাবর শ্রেণি থেকে উদ্ভূত। ইসলামের প্রচারের বহু আগে থেকেই সেখানে ধর্মীয় বাতাবরণের সৃষ্টি। কোরান অনুসারে মক্কার আদিবাসিন্দারা পৌত্তলিক ছিলেন। এঁরা মরুভূমি, সূর্য ও যুদ্ধের দেবতার সাধনা করতেন। এঁদেরই লোকসংগীতে ইসলামের মূল স্বর নিহিত।
প্রকারভেদ
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতকে আরও ভালোভাবে বোঝার সুবিধার্থে একে কয়েকটি খণ্ডে ভাগ করা যেতে পারে। ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রত্যেকটি ধারাই স্বতন্ত্র, স্বতঃস্ফূর্ত ও আধ্যাত্মিকতার মার্গদর্শনরূপে বিরাজমান। বিশেষ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য খণ্ড নিয়ে নীচে আলোচনা করা যেতে পারে :
১. শাস্ত্রীয় আরবি ·(Arabic Classical)
ইসলামীয় ধর্মীয়সংগীতের আদিখণ্ড। মূলত যাযাবর বা আরবি গোষ্ঠীগত সংগীত এখানে প্রকাশ পায়। নোমাডিক অধিবাসীদের মধ্যে এক্ষেত্রে সেলজুক তুর্কি বা আরবি তুর্কিদের কথা সর্বাগ্রে বিদ্যমান। এঁরাই প্রথমত ইসলামধর্মে দীক্ষিত হন। মূলত এঁরা ‘কুরেশ’৮ জাতিগত (মহম্মদ যে জাতিটির প্রধান ছিলেন) এবং ত্রুসেডের সময় আনাতোলিয়া বা পারস্য জয় করেন। অটোমান তুর্কি নামে পরিচিত এই বিশেষ জাতিটিতে সর্বপ্রথম ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ত্রুসেডের সময় এঁরা শুধু যুদ্ধই করেননি, এঁদেরই একটি বিশেষ জাতের চারণকবিরা নানাবিধ ধর্মীয় বীরগাথা, ঈশ্বরীয় উপাসনা ও প্রার্থনা রচনা করে গেয়ে গেয়ে বেড়ান। এই চারণকবিদের একটি ভাগ আধ্যাত্মিকতার পথ অবলম্বন করে ঐশ্বরিক স্তুতিগান ও ইসলামীয় দার্শনিক সংগীতে মনোনিবেশ করেন—যাঁদের আমরা ‘সুফি’ নামে চিনি। কয়েকশ বছরের পুরোনো এই সুপ্রাচীন ধর্মীয় সাংগীতিক উন্মেষ ইসলামধর্মে এক নতুন যুগের প্রবর্তন করে যা আজও সুচর্চিত ও ব্যবহারযোগ্য।
২. শাস্ত্রীয় তুর্কি (Turkish classical)
আনাতোলিয়া বা পারস্য জয়ের পর অটোমান তুর্কিদের রাজত্বে ইসলামিক সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় ও ধর্মীয় সংগীতের ভাবধারায় তুমুল পরিবর্তন আসে। তুর্কিদের রাজত্বকালে ধর্মীয় সংগীতে প্রথম যন্ত্রানুষঙ্গের সুপরিকল্পিত ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত ইসলাম বিশেষজ্ঞ ক্যারেন আমস্ট্রং-এর মতানুসারে পূর্ব ইসলামিক টার্কিতে বসবাসকারী নানা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামীয় ভাবধারা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় এক আর্থ-সামাজিক উত্তরণ এ সময়ে লক্ষণীয়। এই সামাজিক ও রীতিনীতির প্রভূত বিবর্তন ইসলামি সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্যেও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। ধর্মীয় সংগীতে যোগ হয় তুর্কি সংস্কৃতির ছোঁয়া।৯ সৃষ্টি হয় নতুন রচনা, নতুন সুর। পরমকরুণাময় ঈশ্বরের উদ্দেশে এক নতুন নৈবেদ্য। এই সাংগীতিক বিবর্তনের যুগে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন নব্য শ্রেণির চারণকবির দল।
কোরান ও হাদিশ-এর বিভিন্ন রচনা থেকেই শুরু হয় ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতের জয়যাত্রা। পরবর্তীকালে এই সংগীতের জয়রথ দক্ষিণ এশিয়া থেকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্য প্রাচ্যের ধর্মীয় ভাবধারায় ও আধ্যাত্মিকতায় উদবুদ্ধ এই সংগীত দক্ষিণ এশিয়ার মার্গসংগীতের প্রভাবে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে। এছাড়াও সাব-সাহারান আফ্রিকায়, ককেশাস,১০ ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ ফিলিপিনের বৃহৎ মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকসংগীত ও সনাতনি সাংগীতিক ধারায় এই সংগীত আধ্যাত্মিকতার নতুন বিপ্লব ঘটায়।
ধর্মীয় সংগীতের শাখা-উপশাখা
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত নানান শাখা-উপশাখায় বিভক্ত। এই সমস্ত আবশ্যকীয় শাখা-উপশাখাগুলি যুগে যুগে ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তন এনেছে এর উপস্থাপনায়, ধর্মীয় মতবাদের ভিত্তিতে এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের মূল কাঠামোয় :
১. নাশিদ (Nasheed)
ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও স্বতন্ত্র দিক হল ‘নাশিদ’ বা ‘নাস-হিদ’। এটি ইসলামীয় সংগীতের এমন এক ধারা যেখানে নানান ইসলামীয় ভাবাদর্শকে লোকায়ত সংগীতের প্রেক্ষাপটে তুলে ধরা হয়েছে। এই ধর্মীয় সংগীতের বিশেষ রূপটিতে কোরান শরীফ-এর বিভিন্ন কলমা, বা তনায়াত সুর করে পড়া হয়ে থাকে এবং পরিবেশিত হয় সম্পূর্ণ যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই। এই ‘নাশিদে’র১১ সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার ‘শ্রুতি’-র মিল পাওয়া যায়। যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে বেশ কিছু এমন সংগীতকারের দলের পরিচয় পাওয়া যায় যাঁরা ‘নাশিদে’-র পরিবেশনায় প্রথম বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ সাধন করেন। একসময় এই বিশিষ্ট সাংগীতিক ধারাটি পৃথিবীর বহু রক্ষণশীল মুসলমান সমাজে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই ‘নাশিদ’-এর প্রচলন সর্বত্র ছড়ায় এবং জনপ্রিয় হয়। ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত ‘নাশিদ’ ব্যতীত অসম্পূর্ণ ও ভ্রান্ত।
২. সুফি (Sufi)
ইসলামিক ধর্মীয় সংগীতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, গভীরতম ও আধ্যাত্মিকতার উজ্জ্বল ভাবদর্শনের আধার হল ‘সুফি’ সংগীত বা সাংগীতিক অধ্যায়। আরবিতে তাউফ (taawuf), পারস্যে সুফিগারী, ও ইরানে ‘তাসাউফ’১২ নামে এটি পরিচিত। ইসলামীয় দর্শন, ভাবজগৎ ও অতীন্দ্রিয়বাদের এক স্বতন্ত্র ঘরানা হল সুফিজম। এই বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক ধারার অনুশীলনকারীদের ‘সুফি’ বলা হয়ে থাকে। সুফি সংস্কৃতি, দর্শন ও সংগীতের ধারক-বাহকদের ‘দারবিশ’ বা ‘দরবেশ’ বলা হয়ে থাকে।
প্রাচীন সুফি বিশেষজ্ঞরা একে ‘ঈশ্বরের প্রতি একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণের বিজ্ঞান’ বলে অভিহিত করে থাকেন। বিখ্যাত সুফি সাধক আহমেদ ইবন অজীবার মতে—’এটি এমন একটি বিজ্ঞান যার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি নিজের অন্তরের শুদ্ধতা, ঈশ্বর বিশ্বাস ও পবিত্র ভাবদর্শনে ভ্রমণ করে শিখে নিতে পারে অনন্তের সন্ধান’। সুফি আন্দোলন যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে এবং ঘটিয়েছে শতসহস্র সংস্কৃতির মেলবন্ধন, ভাষা ও সুরের যোগসূত্র। এই ভাবধারা মূলত ‘সুফি’ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিস্তৃত, যাঁরা নিজেদের পয়গম্বর মহম্মদের বংশধর বলে মানেন।
সমগ্র মুসলমান জগতের মতো সুফি মতাবলম্বীরাও মনে করেন তাঁরা ঈশ্বরের পথযাত্রী এবং একদিন মৃত্যু এবং ‘কেয়ামতের দিন’ পেরিয়ে তাঁরা সেই পবিত্র স্বর্গোদ্যানে হাজির হবেন। শুধু তাঁদের মাধ্যমটি ভিন্ন। সুফিদের মতে সংগীত বা আধ্যাত্মিক সুরের জগৎ-সাধনার মাধ্যমেই এই মার্গটি বা ‘মোকাম’ পাওয়া সম্ভব। অনেকের মতে ‘সুফি’ শব্দের উৎপত্তি আরবি ‘সুউফ-উলফা’ থেকে, যার অর্থ ‘পবিত্র পশমের টুপি’ যা দিয়ে মাথা ঢেকে ধর্মপ্রাণ মুসলিম আল্লার ‘ইবাদৎ’ করেন। আবার অনেকের মতে এটি লাতিন ‘সোফিয়া’ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ—’পবিত্র জ্ঞান’।১৩ সুফি—অনেকের মতে—গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বিবর্তিত হয়।
মতান্তরে জানা যায়, প্রথম প্রথম সুফির প্রয়োগ হয়েছিল শুধুমাত্র ইসলামের বিশ্বপরিচিতি ঘটানোর স্বার্থে। আবার অন্যদের মতে, এটি সরাসরি পবিত্র কোরান থেকে জাত যা অবিরত পাঠ করে, গেয়ে, সুরযোজনা করে তার সমৃদ্ধি ঘটাত। ‘পবিত্র’ সেই ‘জগতে’ প্রবেশপথের এটিই মূলফটক বা প্রধানদ্বার। সুফি সাহিত্যেও এর প্রভূত অবদান লক্ষণীয়। সুফি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য ‘প্রথম’ অবদান যাঁদের, তারা হলেন—উওয়েশ-অল কারণী, হর্ম বিন হিয়ান, হাসান বাসরী ও সৈয়দ ইবন-অল মুসিব।১৪ সুফি মহিলা সাধকদের মধ্যে রাবিয়া বাসরী উল্লেখনীয়। ঈশ্বরের প্রতি তাঁর নজিরবিহীন ভালোবাসার ব্যাখ্যা তাঁর কবিতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে। হারিখ অল-মুহাগিবি প্রথম সুফি সাধক যিনি ইসলামীয় ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব-র উপরে কাজ করেন। এছাড়াও রুমি, সুলতান বাহু, সেলিম চিস্তি, বুল্লেহশা ও ইদ্রীশ শা-র কথা ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। এঁরা শুধু সুফিসংগীতের মাধ্যমে ইসলামের সাধনাই করেননি উপরন্তু খুব সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় ঈশ্বরের আখ্যান বা ইসলামের দর্শন, আধ্যাত্মিকতা ও ভাববাদের এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব ঘটান প্রাত্যহিক জীবনে। এঁদের নাম ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতে সর্বদা স্বর্ণোজ্জ্বল থাকবে।
সুফি সাধনার পথকে অনেক সময় ‘ধীকড়’ (dhikr) বা ‘জীকড়’ (zikr) বলা হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশীয় মুসলমানি ধর্মীয় সংগীতে ‘ধীকড়’ বেশ অনাড়ম্বর। এখানে বহুলাংশে সুফিসংগীত যন্ত্রানুষঙ্গ বর্জিত—মূলত লোকায়ত ভাবধারায় সম্পৃক্ত। সুফি সংগীতের চরম উৎকর্ষের নিদর্শন দেখা যায় পশ্চিম এশীয় দেশগুলিতে, যেখানে স্তুতিপাঠ, অসামান্য যন্ত্রানুষঙ্গ এবং ‘মেভলভী দরবেশ’দের ‘ঘুরন্ত’ নৃত্য-র অসাধারণ প্রদর্শন-এর মাধ্যমে।
‘ইদগাহ’, ‘দরগা’ বা ‘মাজার’ ছাড়াও সুফিসংগীত নানান জনসভাতেও পরিবেশিত হয়ে থাকে। পরিবেশিত হয়ে থাকে বিনোদনের মাধ্যমে পরম করুণাময়ের করুণালাভের উদ্দেশ্যে। এই হল সুফিসংগীত ও সংস্কৃতির উদ্দেশ্য-কর্ম ও বিধেয়।
৩. কাসিদা (Qasidah)
এটি মূলত ইসলামের এক ভিন্নধর্মী কাব্যরূপ। এটি ‘কুরাণ’-এর কিছু নির্বাচিত অংশ ও হজরতের স্তুতিপাঠ। ‘কাসিদা’১৫-কে চারভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে, যেমন :
ক. হমদ : এটি একটি বিশেষ কাব্যসংগীত যা আল্লার গুণগান করে। স্তুতিমন্ত্র বিশেষ।
খ. নাত বা নদ : এই বিশেষ সংগীতে পয়গম্বর মহম্মদের স্তুতি করা হয়ে থাকে।
গ. মনকবাত : এই বিশেষ সংগীত বা গান যা ইসলামের ‘ওয়াহিদ’ বা পরমপূজনীয় সাধকদের স্তুতি ও ইসলামীয় দর্শন ও ভ্রাতৃত্ববোধের উন্মেষ ঘটায়।
ঘ. মদাহ বা মদ-হা : এটিও ধর্মীয় গুরু ও শ্রদ্ধেয় পূর্বসূরিদের উদ্দেশ্যে গীত চারণগীতি।
‘কাসিদা’-র এই চারটি ভাগ ছাড়াও আরও একটি বিশেষ ধর্মীয় সাংগীতিক অঙ্গ হল—’গজল’। ‘গজল’ সেই সংগীত যা মানবজীবনে নশ্বর প্রেম, ভালোবাসা, প্রত্যাখ্যান ও প্রেমাস্পদসহ রসকাব্যের আধার। ‘গজল’ সেই পথ যা সাধারণ মনুষ্যজীবনের দুঃখ, দুর্দশা, প্রেম-ভালোবাসা ও গ্লানিকে পবিত্র মনন ভাবধারায় মেলাতে পারে।
এছাড়াও ‘সিয়া’ সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘নাত’ বা ‘নাদ’ প্রীতি লক্ষণীয়। এখানে ঈশ্বরের স্তুতি কালক্রমে পর্যবসিত হয় তাঁর সন্তান ও শেষ পয়গম্বর হজরত মহম্মদের স্তুতিগানে। এই অংশে আরও একটি বিশেষ সাংগীতিক ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়, যার নাম—’মরসিয়া’ জারি যা কিনা একটি বিশেষ শোকগাথা। এই শোকগাঁথা বস্তুত কারবালার যুদ্ধে নিহত হাসান-হুসেনের স্মৃতির উদ্দেশে গাওয়া হয়ে থাকে। মূলত মহরমের সময় এই ‘মরসিয়া’ গাওয়া হয়ে থাকে। সমবেত জনতা এই সময় ‘হা হাসান!’ ‘হা হুসেন!’ বলতে বলতে মরসিয়া গায়।
৪. কাওয়ালি (Qawali)
সুফিসংগীতের অন্যতম জনপ্রিয় অঙ্গ হল—’কাওয়ালি’। মূলত এটি সমবেত সংগীত এবং যাঁরা এই সংগীত পরিবেশন করেন তাদের ‘কাওয়াল’১৬ বলা হয়ে থাকে। এই সংগীত সুফিসংগীতের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত অংশ। কাওয়ালির মূল সৃষ্টি অনেকের মতে পারস্যে আবার অনেকের মতে আরবে পয়গম্বর মহম্মদের ‘কুরেশ’ সম্প্রদায় থেকে, যদিও ইরানের মেভলভী দরবেশদের মধ্যে কাওয়ালির প্রথম উন্মেষ ঘটতে দেখা যায়।
অন্যতম জনপ্রিয় এই ধর্মীয় সংগীতমাধ্যমটি ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতা করে। অত্যন্ত সহজ-সরল অথচ গভীর ভাবদর্শনে সম্পৃক্ত এই ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীতটি অবিভক্ত ভারতের বিখ্যাত সুফিসাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সময় বিস্তার লাভ করে। খাজা মইনুদ্দিন চিস্তি নিজেও অসাধারণ কাওয়ালি গাইতেন। কিংবদন্তি আছে যে, মইনুদ্দিন একবার বোগদাদে নিজ বৈমাত্রেয় ভাই-এর বাড়িতে যান অথচ সেই ভাই নিজে ‘হাফিজ’ (প্রবল ধর্মপ্রাণ মুসলিম) হওয়ায় তিনি কোনো ধরনের কোনো সংগীত বরদাস্ত করতে পারতেন না। খাজা মইনুদ্দিন একবেলা সেখানে ঈশ্বর সাধনায় নির্মিত ‘কাওয়ালি’ সংগীত পরিবেশন করতে না-পেরে প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়েন এবং বাড়ি ছেড়ে বহুদূরে মরুভূমির মধ্যে গিয়ে ‘কাওয়ালি’ গান। গানের এমনই প্রভাব যে সেই রুক্ষ মরুভূমিতে বৃষ্টি নামে ও মরুদ্যান তৈরি হয়। কাওয়ালির জনপ্রিয়তা এ জাতীয় কিংবদন্তি অনুসারে যে-কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
‘কাওয়ালি’-তে মূলত অংশ নেন এক বা দুই প্রধান গায়ক বা ‘খাদিম’। একটি ছোটো গায়কের দল তাঁর গানের রেশ ধরেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কাওয়ালিতে প্রথম অংশ নেয় তবলা, গাব (নাল জাতীয় বাদ্য) এবং হারমোনিয়াম যন্ত্রানুষঙ্গরূপে। কাওয়াল গায়করা অতিদীর্ঘ বা নাতিদীর্ঘ ‘কাসিদা’ ধরে আল্লা বা হজরতের বা অন্যান্য খলিফাদের গুণগান করেই সরাসরি ‘হমদ’-এ প্রবেশ করেন। এখানে ‘হমদ’-এর বিলম্বিত রূপ প্রায় চোখেই পড়ে না। মূলত মধ্যম ও দ্রুত অঙ্গে এই সংগীত পরিবেশন করা হয় যাতে শ্রোতারা ইসলামের ধর্মীয় আচার-আচরণের পরিপূর্ণ স্বাদ থেকে বঞ্চিত না-হন।
ইতিহাসে বিখ্যাত নানান কাওয়াল গায়ক ও তাঁদের কাওয়ালির উৎকর্ষের পরিচয় পাওয়া যায়। বিখ্যাত সুফিসাধক খোজা মইনুদ্দিন চিস্তি, হজরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া,১৭ সেলিম দরবেশ, বদরুদ্দিন রিয়াজ কাজি প্রমুখের কাওয়ালি আজও গাওয়া হয়ে থাকে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে লখনউয়ের কাওয়াল বাচ্চা ভ্রাতৃদ্বয়, রাজস্থানের শাহনাওয়াজ কাওয়াল, আজিম দুরানী ইসলামাবাদী এবং নুসরত ফতে আলি খান ও বেগম আবিদা পরভীন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যুগে যুগে কাওয়ালির গঠন ও প্রয়োগতত্ত্ব নিয়ে প্রচুর কাজ হয়েছে। মূলত আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় এইসব কাওয়ালি নানান মসজিদ, দরগা ও মাজারের সঙ্গে সঙ্গে ইদানীং বিশেষ জনসমাবেশেও পরিবেশিত হচ্ছে। আল্লা এক এবং একক—এই বাণীর সঙ্গে বিশ্বমৈত্রী, সংবেদনা ও সৌহার্দ্যর নিদর্শন হচ্ছে কাওয়ালি।
অন্যান্য ইসলামিক ধর্মীয়সংগীত
ইসলামের নানাবিধ বৈচিত্র্যের অন্যতম বৈচিত্র্য এর নানারকম ধর্মীয় সংগীতের প্রয়োগ ও বিবর্তনে। সুফিসংগীত অনুসারে কাসিদা, নাশিদ ও কাওয়ালি ছাড়াও অন্যান্য বেশ কিছু স্বতন্ত্র ধর্মীয়সংগীতের প্রয়োগ ও প্রভাব ইসলামে পাওয়া যায়, যেমন :
১. মাওলিদ
এই বিশেষ ধর্মীয় সংগীতটি মূলত পয়গম্বর হজরত মহম্মদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে নানান ভাবে, নানান মতে পরিবেশিত হয়। এই সংগীত সনাতন মতে যন্ত্রানুসঙ্গ বর্জিত ভাবে পরিবেশিত হয়ে থাকে।
২. তাজিয়া
এই সংগীতটি মূলত মহরমে গাওয়া হয়। এটি একটি আবেগপূর্ণ, সাংগীতিক নাট্যরূপ যা ইরান, পাকিস্তান ও ভারত ব্যতীত খুব কম স্থানে পরিবেশিত হয়ে থাকে। এতে মূলত ‘মরসিয়া’১৮ গাওয়া হয় যা ধর্মীয় শোকগাথা এবং কারবালায় ইমাম হুসেন ও তার সঙ্গীদের মৃত্যুর উপর অশ্রুমোচন করার উদ্দেশ্যে।
৩. আসুরা
তাজিয়ার মতো এটিও মহরমের দিন শোকগাথারূপে গাওয়া হয়।
৪. সিকিরি
এটি আরবি শব্দ ‘ধীকড়’ অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ থেকে জাত। মূলত এটি কাদিরিয়া সুফি-সংগীতরূপে খ্যাত যা পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকা অর্থাৎ তানজানিয়া, মোজাম্বিক, মালাবী, জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়া-ইয়াও বা ইয়াও জাতিগোষ্ঠীতে প্রচলিত।
৫. মনজুমা
ইসলামি মানবতাবাদী সংগীত যা ইথিওপিয়া, ঘানা ও উগান্ডাতে বিখ্যাত।
৬. মাদিনাবায়ী
মূলত এটি আরবি ভাষায় রচিত পয়গম্বর মহম্মদের স্তুতিগান বিশেষ।
সাংগীতিক বৈধ-অবৈধতা
বহু মুসলিম পণ্ডিতদের মতানুসারে কোরান ও হাদিশ অনুসারে সংগীত ও সংগীতচর্চাকে ইসলামধর্মে অবৈধ বা ‘হারাম’ (forbidden)১৯ মানা হয়। ইসলামিক সংস্কৃতি অনুসারে হজরত মহম্মদ নিজে যে-কোনো সংগীত বা সংগীতচর্চাকে ইসলামে নিষিদ্ধ বা ইসলাম বিরোধী বলে ঘোষণা করেন। যদিও ইসলামি সংগীতজ্ঞ সাফি অল-দিন (১২৯৪ খ্রিস্টাব্দ), অল-মওসিলি (৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) ও জিয়ারবে (৮২০ খ্রিস্টাব্দ)-র নেতৃত্বে ইসলামে সংগীতচর্চার যাত্রা শুরু তবু বহু মুসলিম হজরত নির্দেশিত সেই বাণী ‘তারাই আমার প্রেমাস্পদ ও স্নেহভাজন যারা ঈশ্বর সাধনার সময় যৌনচিন্তা, মসলিন, সুরা, নারী ও সংগীত বিসর্জন দেবে’—মেনে চলেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কণ্ঠসংগীতকে ‘হালাল’-রূপে (Permissible) মানা হলেও যন্ত্রসংগীতকে আজও বহুদেশে (ইসলামিক রাষ্ট্র) ‘হারাম’ রূপে মানা হয়। সনাতনি ইসলামি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে—দাফ, বেনজির, জার্ব, রেবানা, তোম্বাক, রেবাব বা রবাব, খামাঞ্চে, তানবুর, আউদ ও শানাই বর্তমান। হারমোনিয়ামের প্রচলন শুধু ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে দেখা যায়।
এত কিছু বিধিনিষেধ সত্ত্বেও আজ ইসলামিক ধর্মীয়সংগীত বিশ্বধর্মীয় সংগীত সভায় তার স্বতন্ত্র স্থান পেয়েছে। এ শুধু ঈর্ষণীয় নয়, গর্বের, অহংকারের। তাই এই সংগীতকে অনুধাবন করে সোচ্চারে বলা যায়—’হামিনস্ত’! —পৃথিবীতে স্বর্গ বলে যদি কিছু থেকে থাকে তা সত্যি এখানে—এখানে—এখানেই! সুম্মা-মিন!
***
৪র্থ অধ্যায়
হামিন অস্ত! হামিন অস্ত! : মুসলমানি বা ইসলামীয় ধর্মীয় সংগীত
১. Karen Armstrong (2002), Islam : a short history, Modern library, 978-0812966183, p. 20
২. Ibid, p. 27
৩. Karen Armstrong (2007) ; Muhammad : A prophet for our time, Harper One, 978-0061166772, p. 9
৪. Amnon Shiloah (1995), Music in the world of Islam : A socio-cultural study, Wayne State University press, 978-0814325896, p. 16
৫. Sayed Hussin Nassir and Mehdi Aminrazavi (2007) ; An Anthology of philosophy in Persia, vol., I. B. Tauris, p. 135
৬. Armon Shiloah, p. 87
৭. Karen Armstrong (2007) ; Islam, p. 113
৮. Habib H. Touma (2003) ; The Music of the Arabs, Amadeus press, 978-0691150109, p.57
৯. Bernard Lewis (2010), Music of a Distant Dream, Princeton up, 978-0691150109, p. 57
১০. Ibid, p. 179
১১. Amnon Shiloah (1995), p. 136
১২. Regula B. Qureshi (2006), Sufi music of India and Pakistan, OUP, 978-015979107, p. 15
১৩. Ibid, p. 37
১৪. Ibid, pp. 72-74
১৫. Suzanne P. Stetkevych (2002), The Poetics of Islamic legitimacy, Indiana UP, p. 86
১৬. Regula b. Qureshi, p. 181
১৭. Ibid, pp. 113-119
১৮. Kristina Nelson (2001), The Art of Reciting the Quran, AUC Press, 978-9774245947, pp. 97-99
১৯. M.A.S. Abdul Haleem (2008), The Quran : Oxford world classics ; OUP, 978-0199535958, p. 321