৪। লোপামুদ্রা
একশত বছর অপেক্ষা করতে হয়নি, দু’বছর অজ্ঞাতবাসের পর একদিন হঠাৎই অগস্ত্য উপস্থিত হন বিদর্ভের রাজসভায়। রাজা বসুমান সেদিন অবাক হয়ে দেখেন যে তাঁর মুখের শ্মশ্রুগুফের ভার আর নেই, মাথার উপরে থাকা জটাটিও অদৃশ্য। সোনালি ধানের গায়ের রঙ আর চোখের উজ্জ্বল নীল বর্ণের মণি দেখে সেদিন রাজা চিনেছিলেন ঋষিকে। তবে তার শারীরিক চরিত্রের এই আমূল পরিবর্তন রাজাকে যত না অবাক করেছিল তার থেকেও বেশি অবাক করে অগস্ত্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীটি। সে যে-কোনওভাবেই ভারতবর্ষীয় নয় তা একবার দেখলেই বোঝা যায়।
সে লম্বায় অগস্ত্যের প্রায় সমান, গায়ের বর্ণ চন্দন কাঠের মতো। তার পরনে গাঢ় সবুজ বর্ণের একটিই কাপড়, কাঁধের থেকে শুরু হয়ে নেমে এসেছে হাঁটুর নীচ অবধি। তার বুকের কাছে লাল এবং হলুদ পাথরকুচির কারুকার্য। এই যুবতীর ত্বকের ঔজ্জ্বল্যে সেদিন রাজসভায় থাকা সবারই চোখ ধাঁধিয়ে যায়। পদ্মের পাতায় যেমন একবিন্দু জলও স্থির থাকতে পারে না তেমন মসৃণ যেন এই নারীর শরীর। দেবতা যেন অনেক সময় নিয়ে তৈরি করেছেন তাকে।
তবে সেই যুবতীর এত রূপও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছিল তারই দু’চোখের কাছে এসে। হরিণীর মতো টানা টানা সেই দুটি চোখ, সবুজ তার মণিদুটি, তীক্ষ্ণ তার দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে মেধার ঝলকানি সেদিন রাজা বসুমান স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন। নিজের সাময়িক মূঢ়তাকে কাটিয়ে উঠে দু’বাহু সামনের দিকে এগিয়ে রাজগুরুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তিনি। অগস্ত্য হাসিমুখে সেই অভিবাদন গ্রহণ করে। সামান্য কুশলমঙ্গল বিনিময়ের পরে যেন রাজার অন্তরের প্রশ্নের ইতি ঘটানোর জন্যই অগস্ত্য এবার বলে, ‘রাজন, দু’বছর আগে আপনাকে না জানিয়ে বিদর্ভ ত্যাগ করার জন্য আমি আগাম ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আমি শূন্য হাতে ফিরিনি। আপনি যদি রাজমহিষীকে এই সভায় আসতে অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের দুজনের উপস্থিতিতে কিছু বলতে পারি।’
সাধারণত আর্যদের রাজসভায় নারীর স্থান নেই। তাদের বাস অন্তঃপুরে। মগধের রাজার এক স্ত্রী অস্ত্রচালনায় ভীষণই সক্ষম তা জানা যায়, তিনি নাকি কখনও কখনও রাজসভায় আসন গ্রহণ করেন। তবে ওই একটিই ব্যতিক্রম। রাজা ভৃত্যকে পাঠিয়ে রানি কঙ্কাবতীকে রাজসভায় নিয়ে এলেন। তিনি সভায় এসে রাজার পাশে দাঁড়িয়েই অবাক হলেন অগস্ত্যের পাশে থাকা যুবতীকে দেখে।
অগস্ত্য এবার বলতে লাগল, ‘বৃক্ষ বড় হয়ে তার ছায়ায় আশ্রয় দেয় ক্ষুদ্রতম কীট এবং বৃহত্তম পশুকে। তার শাখাপ্রশাখায় বাসা বাঁধে পাখির দল। তারই কাণ্ড থেকে ঘর বানায় মানুষ, প্রবল শীতে বল্কলের আগুন তাদের শরীরকে উষ্ণ করে। এইভাবে সেই মহাবৃক্ষ সবার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিলেও তার নিজেরও কিছু ইচ্ছা থাকে। সেও চায় তার দেহে সুগন্ধী, রঙিন ফুল ফুটুক।’
এই কথায় রাজা এবং রানি একে অপরের দিকে একবার চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। অগস্ত্য বলে চলল, ‘হে রাজা বসুমান, আপনার ক্ষমতা বলে আপনি এই বিদর্ভকে আজ ভারতবর্ষের এক অন্যতম সেরা রাজ্যে পরিণত করেছেন। আপনার ক্ষমাসুন্দর কিন্তু দৃঢ় চরিত্রের সুফল লাভ করেছে আপনার প্রজারা। রাজ্য জুড়ে শান্তির কোনও অভাব নেই, বিগত তিনদশকে একটিও বড় যুদ্ধের সম্মুখীন যে হতে হয়নি বিদর্ভকে তা শুধু মাত্র আপনার কূটনৈতিক বুদ্ধির কারণে।
কিন্তু আপনার এবং রানি কঙ্কাবতীর একটি ব্যক্তিগত ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গিয়েছে। সন্তানলাভের আশায় আপনি কত যজ্ঞ করেছেন, কোশলের বিখ্যাত রাজচিকিৎসক নিজে এসে রানিকে পরীক্ষা করেছেন এ কথা আমার অজ্ঞেয় নয়। কিন্তু এত প্রচেষ্টার পরেও সেই অপার্থিব সুখলাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন আপনারা। রানি গর্ভধারণে সক্ষম নন, কিন্তু আপনি তার পরেও আর নতুন করে দারপরিগ্রহণ করেননি। ভারতবর্ষের অন্য রাজারা যখন অন্দরমহল একাধিক সুন্দরী নারীদের দ্বারা ভরিয়ে তোলার কাজে ব্যস্ত থেকেছেন তখন আপনি আপনার দিবারাত্র ব্যয় করেছেন প্রজাপালনে।’
এই কথায় রাজা বসুমান যেন সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। রাজসভায় নিজের সুখ্যাতি শুনতে অভ্যস্তই তিনি। কিন্তু এভাবে সোচ্চারে রাজগুরুর মুখে এমন গুণগান তাঁর আশাতীত ছিল। আবার রানির বন্ধ্যাত্বের কথা সবার সামনে এসে পড়াতেও বিচলিত তিনি। ঠোঁটে প্রশস্তিসূচক হাসি এনে তিনি অগস্ত্যকে বললেন, ‘আপনার মুখনিঃসৃত এমন বাক্যেরা আমার হৃদয় পরিপূর্ণ করছে মহর্ষি। আমি সামান্য রাজা, প্রজারাই আমার রাজত্বের আসল ঐশ্বর্য, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ আমার কর্তব্য বই আর কিছু তো নয়।’
সঙ্গে-সঙ্গেই রাজসভা ভরে উঠেছিল রাজার নামের সাধুবাদে। ডানহাত সামান্য উপরের দিকে তুলে সম্মিলিত সেই কণ্ঠ থামিয়ে রাজা আবার বলেছিলেন, ‘মহর্ষি আপনি নিশ্চয় ক্লান্ত, আজ এই বেলা অতিথিশালায় আশ্রয় গ্রহণ করুন, বিশ্রামের পর সন্ধ্যায় না হয় আমরা আবার আলাপ করব।’
এই কথা বলার সময়ও স্বাভাবিক কৌতূহলবশত রাজার দৃষ্টি ন্যস্ত ছিল অগস্ত্যের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবতীর দিকে। সেই যুবতীও যেন এক অজানা পরিবেশে এসে সামান্য বিব্রত বোধ করছে। তার উজ্জ্বল চোখ দুটি একবার রাজার চোখের উপরে পরেই আবার মাটির উপরে নিবদ্ধ হল। অগস্ত্য এবার বলল, ‘সত্যিই আমি ক্লান্ত, তবে বিশ্রাম নেওয়ার আগে যে কথা বলার উপক্রম করেছিলাম তা শেষ করে নিই।
আপনার কর্মে আমি যারপরনাই প্রফুল্ল হয়েছিলাম। কিন্তু আপনার এবং রাজমহিষীর নিঃসন্তান হয়ে থাকা আমাকে পীড়া দিত। তাই আমি এক রাত্রে গৃহত্যাগ করে চলে যাই গহীন অরণ্যে। সেখানে ঘোর কঠিন তপস্যায় তুষ্ট করি দেবতা ব্রহ্মাকে। তিনি এই জগতের সৃষ্টি কর্তা, এই পৃথিবীর প্রথম প্রাণটি তাঁরই সৃষ্টি। ব্রহ্মা যখন আমার তপস্যায় খুশি হয়ে বর দিতে চান তখন আমি তাঁর কাছে এক মানবীকে প্রার্থনা করি, যে রূপে অদ্বিতীয়া, মেধায় যার সমকক্ষ এই ভূভারতে আর কেউ নেই।
দেবতা তখন অরণ্যের পশুপাখি, ফুলের সৌন্দর্য থেকে তৈরি করেন আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এই যুবতীকে। বন্য প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্য বিলীন হয়েছে এই নারীর মধ্যে। তাই এর নাম লোপামুদ্রা। একে আপনি কন্যা রূপে গ্রহণ করুন। আপনাদের এই কন্যাটি ভূভারতে বিদর্ভের নামকে আরও উজ্জ্বল করবে।
অগস্ত্যের এই কথায় সভায় এক আশ্চর্য নীরবতার সৃষ্টি হল। মহর্ষি তার নিজ তপস্যা বলে রানির শূন্য গর্ভ ভরিয়ে দিয়েছে! রাজা এবং রানি দুজনেই একে একে রাজমণ্ডপ থেকে নেমে এসে প্রণাম করলেন অগস্ত্যকে। তাঁদের চোখে জল। মহর্ষি তাঁদের মনের সুপ্ত ইচ্ছাকে তার আশ্চর্য ক্ষমতায় সত্যি করল। এই অসামান্য যুবতী তাঁদের কন্যাসন্তান! রানি এবার অপত্যস্নেহে লোপামুদ্রাকে আলিঙ্গন করলেন।
যুবতী রাজা বসুমানের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন রাজা। সভায় মহর্ষি অগস্ত্যের নামের স্তুতি হতে থাকল। তা থামলে পর অগস্ত্য একটি কথা বলল, যা রাজা এবং রানিকে আরও একবার অবাক করল। অগস্ত্য বলল, ‘আরও একটি কথা আপনাকে জানাই রাজন, আগামী শুক্লপক্ষে আমি লোপামুদ্রাকে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করব। সে হবে আমার ধর্মপত্নী। এমনই প্রজাপতি ব্রহ্মার ইচ্ছা।’
এই প্রস্তাবে রাজা বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। প্রথমত স্বয়ম্ভূ প্রজাপতির আদেশকে অমান্য করার কোন সাহস বসুমানের ছিল না, উপরন্তু অগস্ত্যের মতো মহামানবকে নিজের জামাতা হিসাবে পাওয়াটা ছিল তাঁর এবং রাজ-রানির জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। দেবানুগ্রহে হয়তো মৃত্যুর পর স্বর্গবাসও সুলভ হবে এইবারে। একই দিনে এমন দুটি চমৎকার বসুমানের জীবনে আগে কখনও ঘটেনি।
সেই দিন থেকে বসুমান জানেন যে অগস্ত্য ভগবানের অংশবিশেষ। হেন কোনও কর্ম হয়তো নেই যা তার দ্বারা অসম্ভব। তাই অগস্ত্য যখন পয়োষ্ণী নদীর গতিপথ বদল করার অভিপ্রায় জানাল তখনই রাজা সানন্দে তাতে সায় দিলেন। শুরু হল এক বৃহৎ কর্মকাণ্ড। রাজ্যের বিভিন্ন কোণ থেকে খুঁজে আনা হল এক হাজার শ্রমিককে। এদের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। এদের প্রত্যেকের বয়স ত্রিশের কম, তারুণ্যের উচ্ছলতায় পরিপূর্ণ এদের হৃদয়।
প্রতিটি শ্রমিকের দেহ সৌষ্ঠব দেখার মতো, যেন এক হাতের পাঞ্জায় তাদের এক-একজন এক-একটি নিমবৃক্ষকে উপড়ে আনতে পারে। এই কাজের সফলতার পিছনে মুখ্য উপাদান দুটি। তাদের একটি হল শারীরিক শক্তি, যা পূরণ করবে এই হাজার শ্রমিকের এবং পঞ্চদশহস্তির দল। অন্যটি হল মেধা। এই দুটি উপাদানই সমান গুরুত্বপূর্ণ। বিদর্ভের সেরা দুই মস্তিষ্ক একসঙ্গে এই কাজে ব্রতী হল। তাদের একটি অবশ্যই অগস্ত্যের, অন্যটি রাজদুহিতা লোপামুদ্রার।