৩.৭ সদানন্দর সন্ধান

পাথুরেপট্টি খুঁজতে প্রকাশ রায়ের বেশি দেরি হলো না। বহু বছর ধরে কলকাতায় যাতায়াত করে করে কলকাতার অলি-গলি প্রকাশ রায়ের মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। তখন বয়েস কম ছিল তার। দিদির পয়সায় প্রকাশ রায় কলকাতায় এসেছে, তারপর হাতের টাকা যখন ফুরিয়ে গিয়েছে তখন আবার খালি হাতে নবাবগঞ্জে ফিরে গিয়েছে। এসব অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তারপর একদিন দিদি মারা গিয়েছে, নবাবগঞ্জের আর সুলতানপুরের জমি-জমাও বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বলতে গেলে ভগ্নীপতি মারা যাওয়ার পর থেকে প্রকাশ রায়ের আশা ভরসাও চলে গিয়েছে। এখন ভরসা একমাত্র সদানন্দ।

তা সদানন্দর সন্ধান যে এমনভাবে পাওয়া যাবে তা আগে ভাবতে পারে নি প্রকাশ। অথচ আগে কত খুঁজে বেড়িয়েছে সদানন্দকে। কোথায় কালীঘাট, কোথায় শেয়ালদ’ , কোথায়, বড়বাজার। যে-মানুষটা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে, সে তো কলকাতার বাইরেও চলে যেতে পারে। কলকাতার বাইরে চলে গেলে অবশ্য তাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না।

মাসি জলখাবারের বন্দোবস্ত করেছিল প্রকাশের জন্যে। যেই শুনেছে সদানন্দ আট লক্ষ টাকার সম্পত্তি পাবে আমনি আপ্যায়নের বহর বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাবা, টাকা এমনই জিনিস রে! তোমার টাকা আছে সেই কথাটা শুনেই লোকে তোমায় খাতির করতে শুরু করবে! নইলে সুলতানপুর-সুদ্ধ লোক রাতারাতি তাকে এমন করে খাতির করছেই বা কেন?

বড়বাজারের কাছটায় এসে পড়তেই যেন ভিড়ে প্রকাশ রায়ের দম আটকে আসার অবস্থা হয়ে এল। প্রকাশ রায়ের মনে হলো বড়বাজারের ভিড় যেন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।

একটা অশ্বত্থ গাছের তলায় একটা আগাগোড়া সিঁদুর মাখানো মূর্তিকে ঘিরে তখন বেশ ধুপ-ধুনো দিয়ে কাঁসরঘণ্টা বাজিয়ে ঘটা করে পূজো হচ্ছে। কী ঠাকুর কে জানে! তবু প্রকাশ রায় সেখানে দাঁড়িয়েই ঠাকুরটার উদ্দেশ্যে দু’হাত জোড় করে প্রণাম করলে। প্রণাম করতে তো আর পয়সা খরচ হয় না। আর ঠাকুর মানেই ঠাকুর। তা সে পাথরেরই হোক আর মাটিরই হোক।

বললে–হে ঠাকুর, হে ভগবান, আমার দিকে একটু দেখো তুমি, আমার দিকে একটু নেকনজর দিও–আমার ভাগ্নেটা টাকা কড়ি কিছু চায় না, তা না চাক্‌ গে, সে সন্নিসী মানুষ, তার টাকা না হলে চলে যায়, কিন্তু আমার যে বড় টাকার টানাটানি–আমার অভাবটা একটু মিটিয়ে দিও বাবা। আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাইনে বাবা, অন্য লোককে তুমি যা-খুশী দিও, আমি কিছু বলতে যাবো না, কিন্তু আমাকে বেশ মোটা-রকম টাকা দিও তুমি, টাকা পেলে আর কোনও দিন তোমায় বিরক্ত করবো না বাবা, তুমি তো জানো বাবা, আমার সংসারের অবস্থা।

হঠাৎ পেছনে একটা মোটর-গাড়ির ভোঁ বেজে উঠলো। প্রকাশ রায় সঙ্গে সঙ্গে পাশে সরে এসেছে। কী বে-আক্কেলে সব লোক রে বাবা। গাড়ি চাপা দেবে নাকি। দেখছে ভগবানকে নমস্কার করছি, ঠিক সেই সময় পেছনে ভোঁ ভোঁ করছে! এ কোন্ যুগ এল রে বাবা যে ভগবানকে পর্যন্ত মানতে চায় না কেউ!

গাড়িটা চলে যেতেই প্রকাশ রায় আবার মনঃযোগ করবার চেষ্টা করলে। একটু যে মন দিয়ে ভগবানকে ডাকবো তারও উপায় নেই বড়বাজারে। বেছে বেছে সদা কি না এই হতচ্ছাড়া জায়গায় এসে উঠেছে।

প্রকাশ আবার ঠাকুরকে লক্ষ্য করে আট লাখ টাকার হিসেব দিতে লাগলো। সমস্ত টাকাটার সবটার হিসেব দিতে লাগলো–আট লাখ টাকার সবটা আমার চাই নে ঠাকুর, অত লোভ আমাকে দেখিও না তুমি! লোভ বড় খারাপ জিনিস ঠাকুর, কথায় আছে লোভে পাপ পাপে মৃত্যু। আমার চার লাখ পেলেই কোনও রকমে চলে যাবে ঠাকুর। এক লাখ দিয়ে প্রথমে একটা বাড়ি করবো কলকাতায়, আর বাকি তিন লাখ টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট রেখে দেব। তাতে আমার হাতে আসবে মাসে তিন হাজার টাকাতেই কোনও রকমে চালিয়ে নেব আমি ঠাকুর। বাকি চার লাখ টাকা সদা নিক। টাকা তিন হাজার আসলে তারই বাপের টাকা, আমি তো ফাউ ঠাকুর। আর সদার বউ? সে মাগীর কপালই খারাপ, মিছিমিছি বিয়ে করতে গেল। যদি আজ সে বিয়ে না করতে তো তার কপালেই এই টাকাটা ছিল। তা বিয়ে করেছে সে ভালো করেছে, আমারই ভালো হয়েছে! তুমি শুধু দেখো ঠাকুর, যেন আদ্দেক টাকাটা আমার হাতে আসে–

আট লাখের অর্ধেক হলো চার লাখ। প্রকাশ রায় আবার হিসেব করতে লাগল। অনেকবার হিসেব করেছে সে। যেদিন থেকে ভগ্নীপতি মারা গেছে সেই দিন থেকেই প্রকাশ হিসেব করে চলেছে।

বউ বলতো–অত হিসেব করছো কেন বার বার? তোমায় টাকা দেবে না কলা, ছাই দেবে–

প্রকাশ বলতো–তুমি চুপ করো তো! তুমি মেয়েমানুষ, মেয়েমানুষের মত থাকবে, সব কথায় তুমি কথা বলতে আসো কেন?

বউ বলতো–সারা জীবন তো তুমি কেবল টাকা-টাকা করে সকলের গায়ে তেল মাখিয়ে এসেছ, ক’টা টাকার মুখ দেখেছ তুমি শুনি?

প্রকাশ বলতো–এবার দেখ কী হয়! এবার শুধু বসে বসে দেখ, কেবল বসে বসে দেখে যাও। যদি কলকাতায় পেল্লায় বাড়ি না করি তো তুমি আমায় কুকুর বলে ডেকো–

–তা তোমার ভাগ্নে কি তোমায় টাকা দেবে ভেবেছ?

–দেবে না তো কী করবে সে এত টাকা? আমার ভাগ্নেকে আমি চিনি না, তুমি আমাকে চিনিয়ে দেবে? টাকা তার হাতের ময়লা তা জানো?

বউ বলতো–ওই টাকাই তোমাকে একদিন পথে বসাবে! এতদিন তোমার সঙ্গে ঘর করছি, তোমাকে আমি চিনি নে বলতে চাও?

প্রকাশ রেগেমেগে আর কোনও কথা বলতো না। কেবল শেষকালে বলতো মেয়েমানুষের সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি, ওই জন্যেই তো মেয়েমানুষের সঙ্গে আমি জীবনে কথা বলি না–

কথা বলি না বলতো বটে, কিন্তু এক মিনিট পরেই আবার কথাও বলতো। বলতো–তুমি কেবল আমার ওপর রাগই করতে পারো, কিন্তু টাকা আমি কার জন্যে চাইছি, আমার জন্যে টাকা চাইতে বয়ে গেছে। টাকা তো তোমাদের জন্যেই চাইছি, তাহলে টাকার ওপর যদি তোমার এতই বিরাগ তো আমার কাছে আর টাকা-টাকা কোর না এবার থেকে—

বউও রেগে যেত। বলতো–তা তোমার কাছে টাকা চাইবো না তো টাকা চাইবো কার কাছে শুনি? টাকা আমি রোজগার করতে বেরোব বলতে চাও? যদি রোজগার করতে বলো, তো এই বুড়ো বয়েসে তা-ও করতে পারি–

প্রকাশ রায় তখন খেতে বসেছিল। বউএর কথায় আর খেতে পারলে না। রাগে সেই ভাতের থালায় এক লাথি মেরে উঠে পড়লো। সমস্ত মেঝেময় তখন ভাত-ডাল-চচ্চড়ি একেবারে ছত্রখান। তারই ওপর ওপর পা দিয়ে মাড়িয়ে একেবারে কুয়োতলায় গিয়ে পা হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে বৈঠকখানা ঘরের দিকে চলে যেত। বলতো–দুত্তোর টাকার নিকুচি করেছে–

বৈঠকখানা ঘরে তখন মোসায়েবের দল রায় মশাই-এর জন্যে হাঁ করে বসে থাকতো। রায় মশাই সেখানে গিয়ে বসতো। পিসেমশাই এর হুঁকোতে তখন তামাক সাজাই থাকতো। সেই হুঁকো তখন সে ভুড়ুক-ভুড়ুক করে টানতো।

অশ্বিনী ভট্টাচার্যি জিজ্ঞেস করতো–সেবা হলো রায় মশাই?

প্রকাশ বলতো–হলো।

তারপর একটু থেমে ধোঁয়া ছেড়ে বলতো–সেবা হলে কী হবে, আমার মনে তো শান্তি নেই হে–

সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতো, বলতো–কেন, মনে শান্তি নেই কেন রায় মশাই?

প্রকাশ রায় বলতো–ওই যে টাকা! টাকা যে কী সব্বোনেশে জিনিস তোমরা কী করে জানবে? টাকা হোক তোমাদের, তখন বুঝবে টাকা কী সব্বোনেশে জিনিস! উঃ, জামাইবাবু আমার যে কী সব্বোনাশটাই করে গেল–

–কেন? চৌধুরী মশাই-এর কথা বলছেন? চৌধুরী মশাই আবার আপনার কী সব্বোনাশ করে গেলেন?

–সব্বোনাশ করে গেলেন না? এই লাখ-লাখ টাকা কি আমার ধাতে সয় হে? এই একটু আগে বউএর সঙ্গে এই নিয়ে ঝগড়া হচ্ছিল। আগে আমার টাকা ছিল না বেশ ছিলুম, খাচ্ছিলুম দাচ্ছিলুম পেট ভরে ঘুমোচ্ছিলুম, টাকা আসার পর থেকে আর ঘুম আসে না হে, বিছানার ওপর সারা রাত কেবল এপাশ-ওপাশ করি। তাই বউ বলছিল, এ কী আমাদের সব্বোনাশ হলো! তার চেয়ে টাকাগুলো তুমি নিও না, গাঁয়ের দশজনকে বিলিয়ে দাও–

–বউমা বলছিলেন নাকি? তা দিন না রায় মশাই। আমাদের একটু টাকা বিলিয়ে দিন না, আমরা একটু টাকার মুখ দেখি–

প্রকাশ রায় বলতো–খবরদার খবরদার, টাকার নাম মুখে এনো না, সব্বোনাশ হয়ে যাবে তোমাদের–

ভীম বিশ্বাস বলতো-হোক সব্বোনাশ, যে সব্বোনাশের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি তার চেয়ে আর কত বেশি সব্বোনাশ হবে তাই দেখতে চাই আমরা

প্রকাশ রায় বলতো–আরে, আমিও তো বউকে তাই বললুম। বললুম এত ঝঞ্ঝাট আর সইতে পারছি নে–টাকাগুলো সক্কলকে বিলিয়ে দিই–

–তা বউমা কী বললেন শুনে?

প্রকাশ রায় বলতো–বউ বললে–তুমি জেনে-শুনে ভালোমানুষদের এই সব্বোনাশ করবে? আমরা নিজে যা ভুগছি তা ভুগছি, পরকে কেন আবার ভোগানো মিছিমিছি! জামাইবাবুর অবস্থা তো আমি নিজের চোখে দেখেছি কি না। এত টাকা হাতে আসার পর থেকেই জামাইবাবু যেন কেমন হয়ে গেল। তখন থেকে কেমন মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, পেটের ক্ষিধে চলে গেল, চোখের ঘুম উবে গেল। যে-মানুষ আমাকে ডেকে ডেকে কথা বলতো, সেই মানুষই শেষকালে আবার আমাকে দেখলেই খেঁকিয়ে উঠতো–

–কেন রায় মশাই, ওরকম কেন হতো?

অশ্বিনী ভট্টাচার্য বলতো–তা হোক রায় মশাই, আগে তো টাকা হোক আমাদের তার পরে যা-হয় হবে। একবার টাকা হলে তখন আমরা চোখ কান-নাক বুঁজে না-হয় সব ঝঞ্ঝাট সহ্য করবো। আপনি কিছু কিছু দিন আমাদের। টাকা হাতে পেলে আমার নিজের মেয়েটার বিয়ে দিতে পারি তাহলে

ভীম বিশ্বাস বললে–আমিও তাহলে এক জোড়া বলদ কিনি, গেল মাসে আমার দুটো বলদই চুরি হয়ে গেল–

আশু চক্কোত্তি বললো, আমিও তাহলে বাস্তুভিটের খড়ের চালটার ওপর টিন দিয়ে ফেলি–

প্রকাশ রায় বলতো–তা টাকা না হয় তোমাদের আমি মাথা পিছু দু’দশ হাজার করে দিয়ে দিলাম, কিন্তু শেষকালে যেন আবার আমাকে তোমরা দুষো না, তা বলে রাখছি–

–আজ্ঞে তা কেন দুষবো? আমাদের কপালে যা আছে তা তো আর কেউ খণ্ডাতে পারবে না

প্রকাশ রায় বলতো–ঠিক আছে, তাহলে তাই-ই দেব। তাহলে অশ্বিনী, তুমি কত নেবে?

অশ্বিনী বলতো–আজ্ঞে, আমাকে যদি হাজার দশেক দেন তো খুব উবকার হয় আমার

প্রকাশ রায় বলতো–ঠিক আছে, তোমাকে দশ হাজারই দেব—

তারপর ভীম বিশ্বাসের দিকে ফিরে বলতো তুমি? তোমার কত চাই?

ভীম বিশ্বাস বলতো–আজ্ঞে আমাকে আপনি যা দেবেন তা-ই নেব। আমার কাছে এক টাকাও যা, এক হাজার টাকাও তাই–

প্রকাশ বলতো–ঠিক আছে, তোমাকেও দশ হাজার দেব। যত হাল্কা হতে পারি ততই তো আমার ভালো রে বাবা

অশ্বিনী জিজ্ঞেস করতো–কবে দেবেন?

প্রকাশ বলতো–আরে, টাকা তো আমি এখনই দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমার ভাগ্নে? সে আসুক আগে। সে না এলে তো আমি এ টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে পারছিনে–

–তা যদি আপনার ভাগ্নে না আসে?

–না আসে মানে? যেমন করে হোক তাকে এখানে ধরে আনতেই হবে। সে না এলে তাকে ছাড়বো কেন? সে না এলে গভর্মেন্ট যে সব টাকা বাজেয়াপ্ত করে নেবে–তাকে এখেনে পাকড়ে এনে তার হাতে টাকাটা তুলে দিয়ে তবে আমি খালাস পাবো, তার আগে নয়–

কথাটা শুনে আশেপাশের সকলের মুখ শুকিয়ে যেত। তবে আর টাকা পেয়েছে তারা! চৌধুরী মশাই-এর ছেলে এখানে এলে সব বানচাল হয়ে যাবে। আশ্চর্য! এতগুলো টাকা কিনা পরের হাতে চলে যাবে? তখন কি আর তাদের কেউ চিনতে পারবে?

যখন আসর ছেড়ে সবাই উঠতো তখন সকলের মুখ গম্ভীর হয়ে যেত। তাহলে আর অশ্বিনী ভট্টাচার্যির মেয়ের বিয়ে হয়েছে, তাহলে আর ভীম বিশ্বাস একজোড়া বলদ কিনেছে, তাহলে আর আশু চক্কোত্তির বাড়ির খড়ের চালের ওপর টিন উঠেছে! ভগবানের মনে কী আছে তা ভগবানই জানে।

প্রকাশ রায় তখনও রাস্তার ঠাকুরটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে তাকে তার মনের বাসনাগুলো মনে মনে জানাচ্ছে। বলছে-মা, তোমার কাছে গলা ছেড়ে কিছু বলতে পারছি না, আশে-পাশে সব লোকজন রয়েছে। হাটের মধ্যে কি মনের কথা গলা ছেড়ে বলা যায়? তুমিই বলো মা? তুমিই বলো মা! কিন্তু লোকে তো বলে তুমি অন্তর্যামী, মনের কথা তোমাকে বলা বৃথা। তুমি তো সবই জানো মা, তুমি তো সবই বুঝতে পারো

হঠাৎ পাশে একটা ষাঁড় এসে দাঁড়াতেই প্রকাশ চমকে উঠেছে। চমকে উঠে আবার পাশে সরে দাঁড়ালো। আর একটু হলেই তাকে গুতিয়ে থেঁতো করে দিত। বললে–দূর, দূর, বেরো বেরো–

সবাই মিলে তাড়া দিতেই শিবের জীবটা সরে চলে গেল। আবার প্রকাশ হাত-জোড় করে মনঃসংযোগ করবার চেষ্টা করলে। বলতে লাগলো–এই দেখ, ঠাকুর, ভালো কাজে কত বাধা, দেখলে তো? একটু আগে একটা মটর-গাড়ি এসে চাপা দিচ্ছিল, এখন আবার এসেছে একটা ষাঁড়। তোমাকে যে একটু মন দিয়ে ডাকবো তারও উপায় নেই। তা যাকগে বাজে কথা। কাজের কথাটা আগে ভাগে সেরে ফেলি। অনেক আশা করে এবার সদার খোঁজ পেয়েছি ঠাকুর? সেই কালীঘাটের মানদা মাসির বস্তি থেকে শুরু করে বউবাজারের বড়বাবুর বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছি। আবার এখন যাচ্ছি পাথুরেপটির মারোয়াড়ীদের ধর্মশালায়। সেখানে গিয়ে যেন সদার দেখা পাই। দেখো ঠাকুর, সদার যেন সুমতি হয়, সদা যেন টাকাটা আমাকে দিয়ে দেয়। সদার বাপের ওই আট লাখ টাকাটা পেলে আমার বড় উপকার হয় ঠাকুর…আমার বহুদিনের শখ আমি কলকাতায় একটা বাড়ি করবো, আর খাঁটি বিলিত হুইস্কি খাবো, দিশী মাল খেয়ে আমার জিভে একেবারে মরচে পড়ে গেছে।

–রাজাবাবু, রাজাবাবু…

একটা ভিড়ের গোলমাল কানে আসতেই প্রকাশ রায় আবার একপাশে সরে দাঁড়ালো। প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন ভিখিরি একজন লোককে ঘিরে ধরেছে। কাকে ঘিরে ধরেছে তা দেখা যায় না। কিন্তু সবাই মিলে গোল হয়ে তাকে ঘিরে ধরেছে আর চেঁচাচ্ছে রাজাবাবু, ও রাজাবাবু, ও রাজাবাবু, একটা পয়সা দাও

লোকটা বোধ হয় পয়সা দিচ্ছে না। বলছে–আমার কাছে পয়সা নেই এখন–-পয়সা নেই আমার কাছে—

তবু কেউ শুনছে না তার কথা। তারা একনাগাড়ে একই কথা বলে যাচ্ছে–রাজাবাবু, আমাকে একটা পয়সা–

বিচিত্র জায়গা এই বড়বাজার। দুশো বছর আগে এই বড়বাজার থেকেই প্রথম পয়সার আমদানি-রফতানি শুরু। পয়সা দিয়েই বড়বাজারের পত্তন আর পয়সা দিয়েই এই বড়বাজারের পরিসমাপ্তি। যেদিন পৃথিবীতে পয়সার খেলা থাকবে না, সেদিন বড়বাজারও ধ্বংস হবে। সেদিন আর সবই থাকবে, শুধু বড়বাজারই থাকবে না। এই বড়বাজারে এলেই দেখা যাবে পয়সা কাকে বলে, পয়সার চাহিদা কত। এই বড়বাজারে এলেই বোঝা যায় যে পৃথিবীতে সব কিছু মিথ্যে, একমাত্র সত্যি হচ্ছে পয়সা। পয়সার দৌলতেই বড়বাজার আর বড়বাজারের দৌলতেই পয়সা। শুধু যে বড়লোকদেরই ভিড় এখানে তা নয়, ভিখিরিদেরও ভিড়। এখানে পয়সা আছে বলে যারা পয়সাওয়ালা লোক তারা যেমন এখানে আসে, যাদের পয়সা নেই তারাও এখানে আসে।

প্রকাশ রায়ের বড় ভালো লাগলো দৃশ্যটা দেখতে। কই তাকে তো কেউ পয়সার জন্যে ঘিরে ধরছে না। ওই লোকটাকেই বা ধরছে কেন। লোকটার পয়সা আছে এটা বোধ হয় সবাই জানে। পয়সাওয়ালা লোক বোধ হয়।

পয়সাওয়ালা লোকদের দেখতে প্রকাশ রায়ের বড় ভালো লাগে। পয়সাওয়ালা লোকদের কাছাকাছি থাকতেও তার বড় আনন্দ হয়।

প্রকাশ ভিড় ঠেলে লোকটার চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। সদানন্দ না! ঠিক সদানন্দের মতন। কিন্তু যেন খুব রোগা হয়ে গেছে।

তখনও ভিখিরিদের ছেলে-মেয়ে বুড়োবুড়ি সবাই চিৎকার করছে রাজাবাবু, একটা পয়সা দাও–

সদানন্দর মুখটা গম্ভীর-গম্ভীর। সে হাত নেড়ে নেড়ে সকলকে বলছে–আজ আমার কাছে একটাও পয়সা নেই বাবা, তোমরা আজকে আমাকে ছেড়ে দাও, পরে তোমাদের পয়সা দেব আমি, পরে দেব

সদানন্দও পয়সা দেবে না, তারাও ছাড়বে না। সে এক তুমুল টানাটানি কাণ্ড!

–এই সদা, সদা—

গোলমালের চোটে সদানন্দর কানে সে-শব্দ পৌঁছুলো না। সে তখনও ভিখিরিদের হাত থেকে ছাড়ান পাবার চেষ্টায় ছটফট করছে। সকলকে লক্ষ্য করে বার বার বলছে–আমাকে তোমরা এখন ছাড়ো ভাই, আমি এখন ফতুর, পরে দেব

প্রকাশ রায় আরো ভিড় ঠেলে একেবারে সদানন্দর গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে–এই সদা, কোথায় যাচ্ছিস?

এতক্ষণে যেন সদানন্দর কানে গেল কথাটা। মুখ ফিরিয়ে প্রকাশ মামাকে দেখে চিনতে পারলে। বললে–প্রকাশ মামা? তুমি?

প্রকাশ মামা বললে–তুই এখানে? আর আমি যে এতকাল ধরে চারিদিকে খুঁজে বেড়াচ্ছি তোকে। তুই ধর্মশালায় কোথায় থাকিস আমাকে মহেশ বলে দিলে–

–মহেশ? তাকে তুমি চিনলে কী করে?

–সেখান থেকেই তো আসছি। তোকে খুঁজতে আমি সেই কালীঘাটে মানদা মাসির বস্তিতে গিয়েছিলুম। সে এক কাপ্তেন পাকড়েছে। পাকড়ে এখন পুলিসের বড়বাবুর সব্বোনাশ করবার মতলব করেছে, জানিস। মাগীর তো বরাবর টাকার খাঁই, তা তো তুই জানিস?

সদানন্দ বললে–আমি সে-সব কিছুই জানি না–

প্রকাশ মামা বললে–সে কি রে, তুই জানিস না মানে? মাসি যে বললে–তুই তাকে চিনিস। তোকেও মাসি নাকি ভাল করে চেনে।

সদানন্দ বললে–সে ভুল করেছে–

–ভুল করেছে কী রে! মাসি কি ভুল করবার মানুষ যে ভুল করবে? মাসি যে বললে সে নাকি তোর চরণ-পূজো করেছিল?

চরণ-পূজো! এতক্ষণে মনে পড়লো। সেই কালীঘাটের রাস্তায় তাকে ধরে চরণ-পূজো করার ঘটনা।

প্রকাশ মামা আবার বললে–আমি তো কিছুই বুঝতে পারলুম না মাসির কথা। মাসিটা একেবারে মিথ্যে কথার জাহাজ। সত্যিই তো, মাসি তোর চরণ-পূজো করতে যাবেই বা কেন, আর তুই-ই বা মাসিকে তোর চরণ-পূজো করতে দিবি কেন? সত্যিই তো!

সদানন্দ বললে–না মামা, মাসী আমার চরণ-পূজো করেছে–

–সে কী রে? মাসি তোর চরণ-পূজো করেছে? এত লোক থাকতে তোর চরণ-পূজো করলে কেন? কী মতলোবে?

সদানন্দ বললে–স্বপ্ন দেখেছিল–

–স্বপ্ন দেখেছিল মানে?

–স্বপ্ন দেখেছিল সে ঘুম থেকে উঠে যে ব্রাহ্মণকে প্রথম দেখতে পাবে তার চরণ পূজো করলে তার কোমরের বাত সেরে যাবে!

প্রকাশ মামা হো-হো করে হেসে উঠলো। বললে–মাগী তো কম মতলববাজ নয়। তারপর? তারপর কী হলো?

–তারপর আর কী হবে! সেই বড়বাবু এসে পড়াতে সব ভেস্তে গেল!

–বড়বাবু? পুলিশের বড়বাবু? তারই মেয়েমানুষের বাড়িতে তুই গিয়েছিলি?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ–

–আরে তা সেই বড়বাবুকেই তো মাসি এখন পাকড়েছে। বাপ মারা যাবার পর বড়বাবু নিজের মেয়েমানুষকেও যে সেখানে নিয়ে গেছে। আমি যে গিয়ে সব দেখে এসেছি রে। এখন মাসির মুসকিল হয়েছে, তার অনেক টাকা চাই। আমার কাছে সেই টাকার গন্ধ পেয়ে একেবারে চেপে ধরেছিল, আমি জানতে পেরে পালিয়ে এসেছি। কিন্তু মহেশ তার আগেই তোর ঠিকানাটা আমাকে বলে দিয়েছে। তা কোথায় আছিস তুই? কোন ধর্মশালায়? ভালোই হলো তোর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল

আজও মনে আছে সদানন্দর সেই সব দিনের কথাগুলো, সেই প্রকাশ মামার সঙ্গে রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়া আর তারপর আবার সেই ধর্মশালায় গিয়ে ওঠা। মানুষের জীবন সত্যিই বিচিত্র। কী ভাবে সে জীবন কাটাতে চেয়েছিল আর কী ভাবে শেষ পর্যন্ত তার জীবনটা কাটলো। আর প্রকাশ মামাই বা কী ভাবে টাকার জন্যে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

প্রকাশ মামা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে–তোর চেহারা এরকম হলো কেন রে? কোনও অসুখ-টসুখ করেছিল নাকি?

সদানন্দ বললে—হ্যাঁ–

–তা শরীরের দিকে একটু নজর না দিলে শরীর তো খারাপ হবেই। শরীরের আর দোষ কী রে! কিন্তু কেন এত কষ্ট করছিস বল্ তো? কার ওপরে তোর রাগ?

সদানন্দ এ কথার কোন জবাব দিলে না।

–তোকে একটা কথা বলা হয় নি। তুই বোধ হয় শুনিসও নি। দিদি জামাইবাবু সবাই মারা গেছেন, তা জানিস তো? দিদি অবশ্য আগেই মারা গিয়েছিল–

সদানন্দ বললে–সে আমি মহেশের কাছে আগেই শুনেছিলুম–

–তুই মাইরি অদ্ভুত ছেলে। তোর মা’র মারা যাওয়ার খবর শুনলি অথচ একবার নবাবগঞ্জে গেলি না? জামাইবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করলি না?

সদানন্দ বললে–গিয়েছিলুম তো। কিন্তু বাবার কাছে যে ব্যবহার পেয়েছি তারপর আর সেখানে থাকতে ইচ্ছে হয় নি।

–তা তোর বাপ খারাপ ব্যবহার করলো সেইটেই তোর মনে লাগলো? আর তোর বউ যে শ্বশুর-শাশুড়ীর সঙ্গে কী ব্যবহার করলে তা শুনেছিস? তখন আমি তোকে খুঁজতে কলকাতায় ঘুরে মরছি তাই নিজের চোখে দেখতে পাই নি। তুই শুনলে তোরও রাগ হতো তোর বউ-এর ওপর

সদানন্দ বললে–আমি জানি–

প্রকাশ মামা শুনে অবাক হয়ে গেল। বললে–সে কী রে, তুই জানিস সব? কী করে জানলি? কে বললে?

–দিদিমা!

–দিদিমা? তোর আবার দিদিমা কে?

–বেহারি পাল মশাই-এর স্ত্রী। তাদের বাড়িতেই তো সে-রাত্রে ছিলুম।

প্রকাশ বললে–আসলে তোর বউটারই দোষ, বুঝলি? আমি রূপ দেখে তোর সঙ্গে বিয়ে দেওয়ালুম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে মেয়েটা এত নচ্ছার তা কে জানতো! জানিস, তোর বউটা আবার ওদিকে একটা কাণ্ড করে বসেছে! আমি এখানে আসবার আগে তোর শ্বশুরবাড়ি কেষ্টনগরে গিয়ে সব শুনে অবাক! তোর বউ আবার একটা বিয়ে করেছে রে– শুনলুম এখন বরের সঙ্গে নাকি নৈহাটিতে বাসা করে আছে–

সদানন্দ এ কথার কোনও জবাব দিলে না।

প্রকাশ মামা বললে–তুই কিছু বলছিস না যে?

–কী আর বলবো!

প্রকাশ মামা বললে–তা তো বটে, তুই-ই বা কী বলবি! তোর বউ যদি বিয়ে করে তো তাতে তোরই বা বলবার কী আছে! যাকগে, তুই কিছু মন খারাপ করিস নি। বুঝলি, তুইও একটা বিয়ে করে ফ্যাল, তোর ভাবনা কী! আমি তখনই জানি মেয়েদের অত রূপ ভালো নয়; রূপসী মেয়েদের জীবন কখনও সুখের হয় না, এ আমি বরাবর দেখে এসেছি!

তারপর যেন হঠাৎ খেয়াল হলো। বললে–কই রে, আর কতদূর? আর কতদূর তোর ধর্মশালা?

সদানন্দ বললে–এই কাছেই—

প্রকাশ মামা বললে–উঃ, মাসির হাত থেকে যে ছাড়া পেয়েছি এই আমার রক্ষে–

–কেন?

–আরে, যেই শুনেছে তোর টাকা পাওয়ার কথা আর ওমনি আমাকে খাতির করতে আরম্ভ করেছে!

সদানন্দ বুঝতে পারলে না কথাটা। বললে–টাকা? আমার টাকা পাওয়ার কথা? আমার কীসের টাকা?

–হ্যাঁ, সেই কথা বলতেই তো তোর কাছে আসা রে! জামাইবাবু মারা যাওয়ার পর তো তোর জন্যে আট লাখ টাকা রেখে গেছে। সে-সব টাকা তো তোর রে! তুই-ই তো জামাইবাবুর একমাত্র সন্তান, তুই পাবি না তো কে পাবে? তুই না থাকলে সে টাকা পেত তোর বউ। কিন্তু তোর বউ তো আবার বিয়ে করে ফেলেছে। সুতরাং ভালোই হয়েছে। তুই এখন সে টাকার একমাত্র মালিক, আমি ব্যাঙ্কে গিয়ে সব কথা শুনে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছি। উকিলের কথামত তোর কাছে এসেছি, এখন তুই যা ইচ্ছে তাই কর–

সদানন্দ বললে–বাবার টাকা আমি নেব না–

প্রকাশ মামা বললে–কেন রে? বাবা না-হয় তোর দোষ করেছে, কিন্তু তোর বাবার টাকা কী দোষ করলে?

সদানন্দ বললে–না, ও টাকাও আমি নেব না–

–তা, কেন নিবি নে তা বলবি তো? ও তো তোর হক্কের টাকা! তুই না নিলে গভর্মেন্ট নিয়ে নেবে। মিছিমিছি গভর্মেন্টকে ও-টাকা দিয়ে তোর লাভ কী? গভর্মেন্ট তো চোর। চোরকে খাইয়ে তোর কী উপকারটা হবে শুনি? আর যদি তুই নিজে না নিতে চাস তো আমাকে দিয়ে দে। আমি ছাপোষা মানুষ। আমার ছেলেমেয়ে নাবালক, এই বয়েসে দুটো টাকা হলে আমি তবু একটু আরাম করে খাই-দাই! আরাম করে যে কটাদিন বাঁচি ঘুমোই, এখন আমার খেয়ে-দেয়ে-ঘুমিয়ে সুখ নেই, টাকা পেলে বুড়ো বয়েসে তাহলে আর আমাকে ভাবতে হয় না–জানিস, সংসারে টাকাই হলো আসল রে, টাকাই হলো বুকের বল–

ততক্ষণ ধর্মশালার কাছে এসে গিয়েছিল।

পাঁড়েজী খবর পেয়েই ছুটে এসেছে। সদানন্দকে দেখে হইচই বাধিয়ে দিলে। কতদিন আগে বাবুজী চলে গিয়েছিল, একটা খবর পর্যন্ত পায়নি সে। সবাই সদানন্দর খোঁজ নিয়েছে। কত লোক যে বাবুজীকে খোঁজ করতে এসেছিল তার ঠিক নেই।

–এ কী চেহারা হয়েছে আপনার বাবুজী?

সদানন্দ সে কথার উত্তর না দিয়ে বললে–পাঁড়েজী, তোমার কাছে কিছু টাকা আছে?

–টাকা? টাকা কী করবেন? কত টাকা?

সদানন্দ বললে–দু’চার-পাঁচ-দশ যা থাকে দাও না—

পাঁড়েজী বললে–আবার বুঝি কেউ চেয়েছে?

প্রকাশ মামা এতক্ষণ কথাগুলো শুনছিল। বললে–টাকা তো আমার কাছে আছে। কত টাকা তোর দরকার? আমাকে বল না–

সদানন্দ বললে–তুমি দিতে পারবে? তাহলে দাও? ওই ছেলেমেয়েগুলো অত করে চাইছিল, দিতে পারিনি–মনটা কেমন করছে–আমি তোমার টাকা আবার তোমাকে দিয়ে দেব–

যে-মানুষটা আট লাখ টাকার মালিক হতে যাচ্ছে তাকে টাকা দিতে প্রকাশ রায়ের কোনও ভয় নেই। তা ছাড়া একটু পরে সদানন্দর কাছেই তো তাকে হাত পাততে হবে। সুতরাং সদানন্দকে টাকা দিতে তার আপত্তি নেই। পকেট থেকে কটা টাকা সদানন্দর দিকে এগিয়ে দিতেই সে সেগুলো নিয়ে বেরোল–

পাঁড়েজী পেছন থেকে ডাকলে–বাবুজী, আবার কোথায় যাচ্ছেন?

–আমি আসছি পাঁড়েজী, আমি এখুনি আসছি–বলে সদানন্দ বাইরে বেরিয়ে গেল।

পাঁড়েজী জিজ্ঞেস করলেন–আপনি বাবুজীর কে হন?

প্রকাশ বললে–ও আমার ভাগ্নে হয়, আমি ওর মামা। কিন্তু ও এ ধর্মশালায় এসে জুটলো কী করে?

পাঁড়েজী বললে–বাবুজী পাগল আছে বাবু। আমিই বাবুজীকে এখানে ডেকে এনেছি। বাবুজীর তো থাকবার কোনও জায়গা ছিল না। বাড়িওয়ালা বাবুজীকে তাড়িয়ে দিয়েছিল—

কিন্তু এত দিন পরে বাপুজী এসে টাকা নিয়ে আবার কোথায় চলে গেল বুঝতে পারলে না সে।

প্রকাশ মামা জিজ্ঞেস করলে–তা পাঁড়েজী, তুমি জানো বাবুজী কে? কোন বংশের ছেলে? তুমি যে বাবুজীকে তোমার এখানে থাকতে দিলে, তা বাবুজীর কোনও খোঁজ-খবর কখনও নিয়েছ?

পাঁড়েজী বললে—না–

প্রকাশ বললে–যদি না জানো তো শুনে নাও। তোমার বাবুজী এখন আট লাখ টাকার মালিক, বুঝলে?

–আট লাখ রুপেয়া!

–হ্যাঁ, আট লাখ টাকা! ইচ্ছে হলে তোমার মালিকের এই ধর্মশালাটাও কিনে নিতে পারে! তোমাকে মাসকাবারি মাইনে দিয়ে চাকর রাখতে পারে! অথচ এই এখখুনি দেখলে তো, পকেটে একটা পয়সাও নেই বাবুর আমার কাছে টাকা ধার চেয়ে নিয়ে গেল–

পাঁড়েজী জিজ্ঞেস করলে–তা বাবুজী টাকা নিয়ে কোথায় গেল আবার?

–কোথায় আবার, ওই রাস্তায়। রাস্তায় কতকগুলো ভিখিরি ওকে ছেঁকে ধরেছিল তাদের ভিক্ষে দিতে গেল–আমি তো তাই তোমার বাবুজীকে দেশে নিয়ে যেতে এসেছি। যার অত টাকার সম্পত্তি, অত জমিদারী, সে কেন এখানে তোমার এই ধর্মশালায় পড়ে থাকবে! তা এখেনে ওর কী করে চলে? কে খেতে দেয়?

পাঁড়েজী বললে–ওই একটা চাকরি যোগাড় করে দিয়েছিলুম, ছেলে পড়ানোর চাকরি, তাইতে চলে–

–সেই টাকায় চলে?

পাঁড়েজী বললে–চলবে কি করে? রাস্তায় আসবার সময় যে হাত পাতে তাকেই দিয়ে দেয়– শীতকালে একটা গায়ের চাদর কিনে দিয়েছিলুম তা সেটাও একদিন কোথাকার কোন্ কালীগঞ্জের বউকে দিয়ে দিলে–

–কালীগঞ্জের বউ?

–হ্যাঁ বাবু, একটা বুড়ি আছে, সে এখানকার খাটাল থেকে গোবর কুড়িয়ে কুড়িয়ে দেয়ালে-দেয়ালে ঘুঁটে দিয়ে বেড়ায়, তাকে বাবুজী কালীগঞ্জের বউ বলে ডাকে—

আশ্চর্য! প্রকাশ মামা কথাটা শুনে আরো অবাক হয়ে গেল। বললে–এইজন্যেই তোমার বাবুজী এত রোগা হয়ে গিয়েছে

পাঁড়েজী বললে–-রোগা তো হবেই, বাবুজী তো কিছু খায় না। এই তো ক’মাস আগে চলে গিয়েছিল, এতদিন পরে এল, এখন দেখছি আরো রোগা হয়ে গিয়েছে।

প্রকাশ জিজ্ঞেস করলে–তা এতদিন কোথায় গিয়েছিল তা জানো?

–কে জানে কোথায় গিয়েছিল বাবুজী! দুদিনের জন্যে দেশে যাবে বলে গিয়েছিল, আর আজ তো আপনার সঙ্গে ফিরছে–

.

কিন্তু ওদিকে বড়বাজারের রাস্তার সেই ঠাকুরের সামনে তখনও ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ার মধ্যে জোরকদমে পূজো চলেছে। দর্শনার্থীর আর ভক্তের ভিড়ে তখন জায়গাটা আরো সরগরম। সরু গলি রাস্তা। পয়সার আমদানি-রফতানির যত ভিড়, তার চেয়ে ভিড় পয়সা চাওয়ার লোকের। পৃথিবীর সমস্ত লোক যেন পয়সা চাইবার তাগিদে এখানে এসে জুটেছে। তাই এসে জুটেছে কারবারীরা, তাই জুটেছে বেকাররা, তাই জুটেছে পূজারীরা আর তাই এসে জুটেছে ভিখিরিরা। পৃথিবীর সমস্ত টাকা যেন এখানে এই বড়বাজারে এসে মুখ থুবড়ে পড়ে খাবি খাচ্ছে।

ঠাকুরের সামনের লাল কাপড়টার ওপর অনেক খুচরো পয়সার পাহাড়।

সদানন্দ সেখানে গিয়ে একজনকে বললে–আমার এই দশ টাকার নোটটা ভাঙিয়ে দাও তো ভাই–

লোকটা চেনে সদানন্দকে। সবাই রাজাবাবু বলে ডাকে তা জানে।

বললে–আবার ওদের পয়সা দেবেন রাজাবাবু? কেন দেন?

সদানন্দ বললে–আমরা না দিলে ওদের কে দেবে বলো, ওদেরও তো খাওয়া-পরার দরকার হয়–

–না, রাজাবাবু, ওই পয়সা নিয়ে ওরা আবার বাটায় খাটায়। সুদখোর সব ওরা। চুরি বাটপাড়ি করে, মদ খায়, গাঁজা ভাঙ খায়–

সদানন্দ বললে–তা খাক, তখন পয়সা চাইছিল আমার কাছে, আমি দিতে পারি নি, এখন দাও, দিয়ে যাই–

নোটের ভাঙানি নিয়ে বাইরে যেতেই সবাই ছেঁকে ধরেছে–একটা পয়সা দাও রাজাবাবু, দাও একটা পয়সা–

সেই লোকগুলো এতক্ষণ কোথায় ছিল কে জানে। টের পেয়েই একেবারে সদানন্দর ঘাড়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। চারদিক থেকে সঙ্গে সঙ্গে পয়সা পয়সা রব উঠলো। সবার মুখে ওই একটাই কথা। পয়সা আর পয়সা। সদানন্দর মনে হলো সেই কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কালীগঞ্জের বউ যেন হাজার-হাজার মূর্তি ধরে তার সামনে হাত পেতে আছে–দাও দাও, আমাদের সব টাকা ফেরত দাও, যুগ যুগ ধরে তোমার পূর্বপুরুষেরা যে আমাদের ঠকিয়ে এসেছে তুমি তার প্রায়শ্চিত্ত করো আজ–

সদানন্দও বোধ হয় তাদের মনের কথাগুলো বুঝতে পারতো। সদানন্দও বলতো–তোমাদের কিছু বলতে হবে না, তোমাদের ওপর যে-পাপ করেছে আমার বাবা-ঠাকুর্দাদা, সেই সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি আজ রাস্তায় নেমেছি, যতদিন প্রায়শ্চিত্ত না হবে ততদিন আমি এমনি করে তোমাদের পয়সা দিয়ে যাবো–নাও নাও, আমার কাছে যা আছে সব তোমরা নাও–

দশ টাকার নোটের ভাঙানি আর কতক্ষণ থাকে! এক মুহূর্তের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে গেল সব। পকেট ফাঁকা হয়ে গেল।

পেছন থেকে প্রকাশ মামার গলা শোনা গেল–কী রে, এখানে কী করছিস, কতক্ষণ তোর জন্যে বসে আছি আর তুই এখেনে…

বলতে বলতে হঠাৎ প্রকাশ মামা শিউরে উঠেছে–ও কী, তোর গা এত গরম কেন? জ্বর হলো নাকি, দেখি–

হ্যাঁ, সত্যিই জ্বর। জ্বরই তো। প্রকাশ মামা তাকে ধরে ধরে ধর্মশালার দিকে টেনে নিয়ে চললো।

.

অনেক দিন পরে আবার নয়নতারা অফিসে এসেছিল। নিখিলেশ আর একা ছাড়তে ভরসা পায় নি তাকে। নৈহাটি থেকে একসঙ্গে দুজনে এসেছে। অদ্ভুত মেয়েমানুষের মন, আর অদ্ভুত সেই মনের গতি। যেন ঝড়ের মতন কেটে গিয়েছিল এই ক’টা মাস! কোথা থেকে কে একজন তাদের জীবন-ধারার মধ্যে এসে একটা ঘূর্ণি সৃষ্টি করে দিয়ে আবার একদিন নিঃশব্দে চলে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম নয়নতারা নিখিলেশের সঙ্গে কথাই বলতো না। সারা দিন মুখ ভার করে থাকতো। তারপর বাইরের ঘরে যেখানে সদানন্দ শুতে সেই ঘরে বিছানার ওপর গিয়ে শুয়ে পড়তো।

নিখিলেশ বলতো–তুমি এখানে শুচ্ছো কেন? ও-ঘরে শোবে না?

প্রথমে কোনও উত্তর দিত না নয়নতারা। তবু বার বার পীড়াপীড়ি করতে নিখিলেশ। বলতো–লক্ষ্মীটি ওরকম করতে নেই, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, সে কথা ভেবে তুমি মন-খারাপ করে রয়েছ কেন? মানুষ কি অন্যায় করে না? আমি তো বলছি আমি অন্যায় করেছি। তুমি ওঠো, ও-ঘরে গিয়ে শোবে চলো। চলো–

বলে নয়নতারার হাত ধরে আস্তে আস্তে টানতো। কিন্তু নয়নতারা তার নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্য পাশ ফিরে শুতো। নিখিলেশের কোনও কথায় আর জবাব দিত না সে। তখন আর কোনও উপায় না পেয়ে নিখিলেশ আবার তার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তো।

এমনি রোজ! রোজ-রোজই এমনি করে নিখিলেশ ডাকতে আসতো। সারা দিন সময় পেলেই বোঝাতে বসতো নয়নতারাকে। বলতো–এ রকম করে থাকলে যে শেষকালে একদিন অসুখ হবে তোমার, অসুখ হলে তখন কী করবে বলো তো? তখন তো আমাকেও অফিস কামাই করতে হবে–তখন সংসার কী করে চলবে বলো দিকিন? গিরিবালা বলছিল তুমি নাকি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছ? যদি সদানন্দবাবু চলে গিয়ে থাকেন তো আমি কী করবো বলো তো! আর যদি তুমি চাও তো আমি না-হয় নবাবগঞ্জে গিয়ে একবার দেখে আসতে পারি–

নয়নতারা নিখিলেশকে ঠেলে দিত, বলতো–তুমি যাও, তুমি আমার সামনে থেকে চলে যাও, আমি তোমার মুখ দেখতে চাই না–

সেদিন নিখিলেশ বললে–আচ্ছা আমি কালকে অফিসে না গিয়ে নবাবগঞ্জেই যাবো, কথা দিচ্ছি সেখানে গিয়ে দেখে আসবো তিনি কেমন আছেন, এখন হলো তো?

নয়নতারা এ-কথার উত্তর দিলে না।

কিন্তু সত্যি-সত্যিই নিখিলেশ পরদিন ভোরের ট্রেনেই চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল–আমি নবাবগঞ্জে যাচ্ছি বুঝলে, ফিরতে আমার একটু রাত হবে–

নিখিলেশ চলে গেল। সমস্ত দিনটা ঘরের ভেতরে নয়নতারা কেমন ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু রাত দশটার ট্রেনে নিখিলেশ ফিরে এল হাসতে হাসতে।

নয়নতারা সমস্ত দিন খবরটা শোনবার জন্যে উন্মুখ হয়ে বসে ছিল। আসলে নিখিলেশ নবাবগঞ্জেও যায় নি, কোথাওই যায় নি। সারাদিন কলকাতায় ঘুরে বাড়িতে এসেই নয়নতারার কাছে গিয়ে বললে–শুনেছ, দেখা হলে–

নয়নতারা এতদিন পরে সহজদৃষ্টিতে চাইলে নিখিলেশের দিকে।

নিখিলেশ বললে–দেখে এলুম খুব আরামে আছেন সদানন্দবাবু, এই কদিনেই দেখলুম তাঁর চেহারা একেবারে খুব ভালো হয়ে গেছে।

নয়নতারার মুখ দিয়ে তখনও কোনও কথা বেরোচ্ছে না।

নিখিলেশ বলতে লাগলো–আমি তো সে বাড়িতে গিয়ে প্রথমে চিনতেই পারি নি। বাড়ির চেহারাই বদলে গিয়েছে একেবারে। মনে হলো বাড়ির ভেতরে কিছু কাণ্ড-টাণ্ড চলেছে, খুব ধুমধাম, ভেতর থেকে লুচি-ভাজার গন্ধ নাকে আসছে। আমাকে তো প্রথমে চিনতেই পারলেন না–

নয়নতারার মুখে এতক্ষণে কথা বেরোল। বললে–তোমায় চিনতে পারলেন না?

নিখিলেশ বললে–না, শেষকালে যখন আমি বললুম আমি নয়নতারার স্বামী তখন খুব খাতির-যত্ন করলেন, আমাকে খেয়ে যেতে বললেন, তোমার কথাও জিজ্ঞেস করলেন। বললেন–নয়নতারা কেমন আছে?

শুনতে শুনতে নবাবগঞ্জ সম্বন্ধে নয়নতারার যেন আরো কথা শুনতে ইচ্ছে করতো।

মনে হতো যেন নিখিলেশ নবাবগঞ্জ সম্বন্ধে যদি আরো কিছু খবর দেয়। আরো কিছু বলে। কিন্তু নিজের মুখে সেকথা জিজ্ঞেস করতে তার সঙ্কোচ হতো। আসলে সদানন্দ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করাই তো অন্যায়। শুধু অন্যায় নয়, পাপ। যখন নিখিলেশ অফিসে চলে যেত তখন যেন আর তার সময়ই কাটতে চাইতো না। বাড়িতে সংসারের কত রকম কাজ পড়ে থাকত। গিরিবালা এক-এক সময় এসে জিজ্ঞেস করতো–দিদিমণি, খেয়ে নেবে না? অনেক বেলা হয়ে গেল যে।

অথচ যে না-খেলেই ভালো হয়। শুধু খাওয়া নয়, কোনও কিছু কাজ না করলেই যেন সে বেঁচে যায়। আগে সংসারের উপর কত মায়া ছিল নয়নতারার। এই খাট-আলমারি বাসন সমস্ত কিছু সে কত পছন্দ করে কিনেছে। নিখিলেশ আর সে মিলে দিনের পর দিন কলকাতায় গিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরেছে। কিছুতেই যেন আর তার পছন্দ হয় না। দোকানদাররাও তার খুঁতখুঁতে পছন্দের বহর দেখে বিরক্ত হয়ে গেছে। নিখিলেশও বলেছে–অত বাছাবাছি করলে চলে? যা হোক একটা কিনে নাও না–

নয়নতারা ঝাঁঝিয়ে উঠতো। বলতো–তুমি থামো তো, তুমি কেন বাড়ির ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছো? পছন্দ না হলে আমি জিনিস কিনবো কেন? আমার টাকা বুঝি সস্তা? দোকানদার তো তার জিনিস বিক্রি করতে পারলেই খুশী, কিন্তু আমি কেন তার কথায় কান দেব?

সে-সব দিনের কথাও মনে আছে নয়নতারার। সংসারের ওপর নিখিলেশের যত টান ছিল তার চেয়ে দশ গুন বেশি টান ছিল নয়নতারার। বলতে গেলে নয়নতারাই তখন নিখিলেশকে তাড়া দিত। একটা পয়সা বাজে খরচ করলে নিখিলেশকে কথা শোনাতো নয়নতারা। তখন নিখিলেশ কেউ না, নয়নতারাই ছিল সংসারের আসল মালিক। আর এখন যেন উল্টো হয়ে গেছে। এখন নিখিলেশকেই সব ব্যাপারে তাড়া দিতে হয় নয়নতারাকে। নিখিলেশ অফিসের পর সোজাসুজি হাতের কাছে যে ট্রেন পায় তাইতেই বাড়ি চলে আসে। এসে একেবারে সোজা নয়নতারার কাছে চলে যায়। বলে কী হলো, আজ খেয়েছ?

নয়নতারা বলে—হ্যাঁ—

নিখিলেশ আবার জিজ্ঞেস করে–তাহলে কবে থেকে অফিসে যাবে?

এ কথার কোনও জবাব দিতে পারে না নয়নতারা। নিখিলেশও জবাবের জন্যে তেমন পীড়াপীড়ি করে না। তাদের সংসারের ওপর যে ধাক্কাটা গেছে তার পর থেকে একটু সাবধানে কথা বলে নিখিলেশ। নইলে শেষ পর্যন্ত ঝোঁকের মাথাতে নয়নতারা আবার কী করে বসে কে বলতে পারে!

একদিন নিখিলেশ এসে বললে–একটা খবর আছে, জানো—

নয়নতারা মুখ তুলে চাইলে।

নিখিলেশ বললে–আজকে সদানন্দবাবুকে দেখলুম—

এতক্ষণে নয়নতারা আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারলে না! বললে–কোথায়?

–কলকাতায়। দেখলুম চেহারার মধ্যে খুব জৌলুস বেরিয়েছে আবার। খুব সাজগোজ। স্বাস্থ্য খুব ভালো হয়ে গেছে এখন–

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করলেন নাকি?

নিখিলেশ বললে–না, জিজ্ঞেস করবার তো সময়ই হলো না, আমাকে তো তিনি দেখতে পান নি, আমিই তাকে দেখলুম একটা গাড়ির মধ্যে।

–গাড়ি?

নিখিলেশ বললে–হ্যাঁ, মটরগাড়ি। মনে হলো একটা নতুন গাড়ি কিনেছেন, গাড়িটা সোঁ করে পাশ দিয়ে চলে গেল পাশে দেখলুম একজন মহিলা বসে আছে–

–মহিলা?

–হ্যাঁ, দেখতে খুব সুন্দরী মনে হলো, সিঁথিতে আবার সিঁদুর রয়েছে—

কথাটা শুনে নয়নতারা যেন খানিকক্ষণ হতবাক হয়ে চেয়ে রইল নিখিলেশের দিকে। কিছু বলবার ক্ষমতাও যেন তখন আর নেই তার।

নিখিলেশ তার সেই মুখের ভাব দেখে আরো কাছে সরে এল। বললে–দেখ, আসল জিনিস হচ্ছে টাকা। টাকা পেয়েই সব ভুলে গেলেন আর কি! মুখে তো আমরা কত বড় বড় আদর্শের কথা সবাই-ই বলি। এই আমারই কথা ধরো না। সদানন্দবাবুর মত কত আদর্শ এককালে তো আমারও ছিল। তুমি তো সবই জানো নয়ন তোমাকে তো সবই বলেছি। মদের দোকানে পিকেটিং-এর জন্যে পুলিসের কত লাঠির ঘা খেয়েছি। কিন্তু সেই আমিই তো এখন আবার চাকরি করছি। আর সে চাকরিও এমন কিছু কেষ্ট-বিষ্টুর চাকরি নয়। এখন কি আর আমি সেই আদর্শকে ধরে রাখতে পেরেছি? এখন কি আর সেই তখনকার মত খদ্দর পরি? এখন শুধু সস্তার প্রশ্ন, টেকসই এর প্রশ্ন। অথচ এককালে তো এসব কল্পনাও করতে পারতুম না–

কথাগুলো নিখিলেশ খুব সহজ সুরেই বলে গেল অবশ্য। কিন্তু সে জানতেও পারলে না সেই কথাগুলো নয়নতারার মনে কী গভীর কী স্থায়ী দাগ কেটে দিয়ে গেল।

নিখিলেশ সুযোগ বুঝে আবার বলতে লাগলো দেখ আমারও সদানন্দবাবুর জন্যে যে দুঃখ হতো না তা নয়। সত্যিই তো ভদ্রলোকের অত টাকা, অমন স্বাস্থ্য, বংশের একমাত্র সন্তান। আমি যদি ও রকম হতুম আর তোমার মত স্ত্রী পেতুম তো আমিই কি আর ওঁর মতন সংসার ছেড়ে বিবাগী হতুম? বিবাগী হতে বয়ে গেছে আমার! কবে পূর্বপুরুষ কী পাপ করে গেছে তা নিয়ে পৃথিবীতে কেউ মাথা ঘামায়? আসলে তো সবাই আমরা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমরা জন্মাবার আগে ও পৃথিবী ছিল কি ছিল না তা নিয়েও কেউ মাথা ঘামাই না। তেমনি আমি মারা যাবার পর এ পৃথিবী গোল্লায় যাবে না জাহান্নামে যাবে, তা নিয়েও কারো মাথাব্যাথা নেই। আসল হচ্ছে, কেবল আমি আমি আর আমি। আমি মনে করি যেদিন থেকে পৃথিবীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক, সেই-দিনই এই পৃথিবীর জন্ম হয়েছে। আর যা-কিছু এই চারপাশের পৃথিবীতে রয়েছে সবই আমার সুখ-সুবিধার জন্যে। যেদিন আমার সুখ-সুবিধার সঙ্গে চারপাশের এই পৃথিবীর ক্লাশ বাধবে, সেইদিনই আমি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো। এই-ই তো নিয়ম। সদানন্দবাবুও বোধ হয় এতদিন পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন, তাই এখন সোজা পথ ধরেছেন

এমন করে রোজই একতরফা বক্তৃতা দিত নিখলেশ। সেদিন সকাল বেলাই বললে– চলো চলো নয়নতারা, অফিসে চলো, আর কার জন্যে তুমি এমন মনমরা হয়ে থাকবে বলো। পৃথিবীতে কে কার? আমিও তোমার নই, তুমিও আমার কেউ নও। আজ যদি আমিই ধরো হঠাৎ মারা যাই, মারা যেতেও তো পারি, তখন তোমার কী অবস্থা হবে বলো তো? তখন তো এই চাকরিই তোমাকে বাঁচাবে? আর চাকরি মানেই নগদ টাকা! এই যে এতদিন তুমি কামাই করলে, কই, তোমার চাকরি কি গেল? রিটায়ার করবার দিনটা পর্যন্ত এই চাকরিটাই তোমার একমাত্র নিজের জিনিস, আর সব কিছু পর। তোমাকে যদি কেউ বাঁচাতে পারে তো সে সদানন্দবাবু নয়, কেউই নয়, সে কেবল এই চাকরি! চাকরির ওপর কখনও রাগ করতে আছে? চলো আজকে তোমাকে আমি অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসি– চলো, আমার কথা শোন–

আশ্চর্য, যে মানুষ এতদিন তার উপরোধ-অনুরোধ শোনেনি, সেই মানুষই আবার হঠাৎ সেদিন উঠলো। উঠে সকালে স্নান সেরে নিলে। ভাত খেলে। কাচা শাড়ি-ব্লাউজ পরলে, চুল আঁচড়ালে, সিঁথিতে সিঁদুর দিলে। আর তারপর চটি পায়ে আবার সেই আগেকার মত নিখিলেশের সঙ্গে রাস্তায় বেরোল সত্যিই তো, চাকরিটাই তো তার সব। এই শাড়ি ব্লাউজ চটি পরে যে সে অফিসে যাচ্ছে, এই যে একটা অফিসের চেয়ারে তার আশ্রয় পাকা হয়ে আছে, এটা তো সম্ভব হয়েছে শুধু তার চাকরির জন্যেই! চাকরিটা না থাকলে তার কী হতো! চাকরি না থাকলে তাকে সারাদিন সেই চারটে দেওয়ালের মধ্যেই বন্দী হয়ে কাটাতে হতো। নিখিলেশের মাইনের টাকার ওপর নির্ভর করলে তো তারই দাসত্ব করতে হতো তাকে। সে যে স্বাধীন, সে যে একটা মানুষ তা উপলব্ধি করবার মত শক্তিও তো তার হতো না।

আর যদি সে এতদিন নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির আদরের বউ হয়ে থাকতো, তাহলেই বা তার কী এমন অক্ষয় স্বর্গলাভ হতো। সেই তো শ্বশুর-শাশুড়ীর তাঁবে থেকে ঘোমটা দিয়ে সংসারের যাঁতাকলে পিষে রক্তাক্ত হয়ে রাত্রে স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে ঘুমোত আর বছরে বছরে সন্তানের জন্ম দিয়ে শ্বশুর বংশ বৃদ্ধি করতো। এই তো শতকরা নিরানব্বই ভাগ মেয়েরই বিধিলিপি। তার চেয়ে তো এ ভালো। এই সকালবেলা ট্রেনে করে অফিসে গিয়ে গল্প করা আর দু’চারটে কাজ সেরে আবার সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরা। এর চেয়ে আর বেশি ভালো কী হতে পারে! এর চেয়ে আর কোন্ মেয়ে বেশি পায়!

সমস্ত দিনটা যে কোথা দিয়ে কেটে গেল তা বুঝতেই পারলে না নয়নতারা। আবার সেই মালা বোস, সেই কেতকী হাজরা, আর সকলের ওপর সেই অরুণা পাল আর ডেসপ্যাঁচ সেকশনের বড়বাবু রসিকদাস চ্যাটার্জির প্রেমের গল্প। সমস্ত দিন অফিসখানা সেই তাদের প্রেমের গল্পের আলোচনাতেই গুলজার হয়ে রইল।

মালা বোস এল। কেতকী হাজরাও এল। মালা বললে–তুমি ছিলে না নয়নদি, আমাদের দিন আর কাটছিল না সত্যি–

আর শুধু কি অরুণাদির গল্প! আরো কত কেলেঙ্কারির গল্প যে এতদিন জমা হয়েছিল তার ঠিক নেই। নয়নতারাকে সব একে-একে শুনতে হলো। কে একটা নতুন সিফন শাড়ি কিনেছে, কে নতুন হার গড়িয়েছে, কার শাশুড়ীর বুড়ো বয়সে আবার একটা ছেলে হয়েছে, সব শুনতে হলো নয়নতারাকে। নয়নতারারও সে-সব খবর শুনতে বেশ ভালোও লাগলো। তারপর যখন গল্প বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ তখন হুঁশ হলো আর সবাই যে-যার কাজকর্ম ছেড়ে কখন উঠে পড়েছে। সকলকে ট্রামবাস ধরতে হবে। বাড়ি যাবার তাড়া তখন সকলেরই। তখন কোনও রকমে নিজের কোটরে গিয়ে আশ্রয় পেলেই যেন একটা রাত্রের জন্যে সবাই বাঁচে। তারপর কাল দিনেরবেলা আবার সবাই এসে এক জায়গায় জুটবে।

নিখিলেশ নিচের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সিঁড়ি দিয়ে দলে দলে সবাই হুড়-হুড় করে নামছে। তাদের মধ্যে মাঝে মাঝে এক-একজন মেয়ে। নিখিলেশ সকলের মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে একটা চেনা মুখই কেবল খুঁজতে লাগলো সকলের মুখের মধ্যে। প্রথম দিন কেমন যেন ভয় করতে লাগলো তার। নয়নতারাকে তার অফিসে ঢুকিয়ে দিয়ে সে নিজের অফিসে চলে গিয়েছিল। সমস্ত দিন কাজে মন লাগে নি। কেবল ভেবেছে কতক্ষণে ছুটি হবে, কতক্ষণে বিকেল পাঁচটা বাজবে।

শীতেশ একটা কাজে এসেছিল। বললে–কী হে, আজ কখন বাড়ি যাবে?

নিখিলেশ বললে–আজ ভাই একটু তাড়া আছে!

শীতেশ বললে–আজকাল তোমার এত তাড়া থাকে কেন বলো তো? আগে তো এরকম তাড়া থাকতো না–

নিখিলেশ আর কী বলবে! বললে–না ভাই, বাড়িতে সত্যিই একটু কাজ আছে–

–কেন? গিন্নীর অসুখ এখনও ভালো হয় নি?

–আজকে ভাই গিন্নী প্রথম অফিসে এসেছে—

এতক্ষণে বুঝলো শীতেশ। সে ব্যাচিলার মানুষ, একলা, তার কোনও দায়-দায়িত্ব নেই কারো ওপর। বেপরোয়া, নির্বিবাদী জীবন। সারা জীবন টাকা কামাতে চেয়েছে আর ফুর্তি করতে চেয়েছে। পৃথিবীতে কার কী সুখ-দুঃখ তা বোঝবার দায়-দায়িত্ব নেই তার। চাকরিটা যতদিন আছে ততদিন আরাম করে বেঁচে নাও। আর তারপর? তারপরের কথা তার পরে ভাববো মশাই। আগে তো বর্তমান, ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎই ভাববে।

কিন্তু নিখিলেশের তো অমন বেপরোয়া হলে চলে না। তাকে দশজনের মাথায় উঠতে হবে, আর দশজনের মাথার ওপরে উঠতে গেলে যা করতে হয় তাই করতে হবে। তা করতে গেলে লজ্জা পেলে চলবে না। সঙ্কোচ করলে চলবে না। লোকের পকেট কাটা ছাড়া আর যা-কিছু করতে হয় তা করতে সে পেছপাও হবে না।

–এই যে, এত দেরি হলো যে তোমার?

নয়নতারা তরতর করে আর সকলের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। সামনে এসে বললে–কখন পাঁচটা বেজে গেছে খেয়াল ছিল না কারো

নিখিলেশ বললে–কেন, এত গল্প কীসের?

–আমাদের সেই অরুণাদির কথা মনে আছে? তার সঙ্গে বাজেট-সেকশানের বড়বাবু আর-ডি চ্যাটার্জির বিয়ে!

–তাই নাকি? শেষ পর্যন্ত তোমাদের অরুণাদি তাহলে বিয়ে করলেন?

–সেই কথাই তো হচ্ছিল এতক্ষণ। অফিসময় তাই নিয়ে খুব হইচই হচ্ছিল, সারাদিন কাজই হয় নি কারো।

বলে সমস্ত গল্পগুলো একে-একে বলতে লাগলো নয়নতারা। নিখিলেশের মনে হলো নয়নতারা যেন একদিনেই বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনবার জন্যেই এতদিন চেষ্টা করে আসছিল নিখিলেশ। নয়নতারা তার পাশে পাশে চলেছে। ফুটপাথে রাস্তায় অনেক মানুষের ভিড়। কলকাতায় অফিসের ছুটি-পাওয়া মানুষ কেমন করে বাড়ি যাবে তারই উদ্বেগ নিয়ে সবাই রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে–

নিখিলেশ বললে–চলো একটা ট্যাক্সি ধরবার চেষ্টা করি–

নয়নতারা আপত্তি করলে। বললে–কেন আবার মিছিমিছি ট্যাক্সি করবে? তার চেয়ে হেঁটে যাওয়াই ভালো, সবাই তো হেঁটে যাচ্ছে–

এ সেই আগেকার নয়নতারা। যে নয়নতারা বাজে খরচ কমিয়ে তাদের দু’জনের সঞ্চয় বাড়িয়েছে, আর ভবিষ্যতের সমৃদ্ধি আর সুখকে উজ্জ্বল করবার জন্যে বর্তমানকে বঞ্চনা করেছে।

রাস্তায় ফুটপাথে চলতে চলতে নিখিলেশ বললে–-দেখ আমি ভাবছি একটা ব্যবসা করবো–

–ব্যবসা? ব্যবসা করতে গেলে তো টাকা লাগবে। আমাদের টাকা কোথায়?

নিখিলেশ বললে–চাকরি করলে কোনও দিন কিছু হবে না, সারাজীবন কেবল ওই চাকরিই করে যেতে হবে–তার চেয়ে ভাবছিলাম অফিসের পরে তো হাতে অনেক সময় থাকে, তখন সময় নষ্ট না করে বরং কিছু করলে হয়। আমাদের অফিসে অনেকে করছে

–কী ব্যবসা করবে?

নিখিলেশ বললে–তা ভাবি নি কিছু, শুধু ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বলছি। দুদিন বাদে তো সংসার বড় হবে, তখন খরচ আরো বাড়বে, এখন থেকে যদি কিছু প্ল্যান না করা যায় তো তখন মুশকিল হবে। তুমি কী বলো?

নয়নতারা বললে–আমি আর কী বলবো।

নিখিলেশ বললে–তুমি যদি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য না করো তো আমি একলা কত করতে পারবো বলো! তুমি আমি দু’জন মিলে হাত লাগালে কাজটা বেশি এগোবে তা সে যে কাজই হোক–

নয়নতারা বললে–আগে ঠিক করো তুমি কী ব্যবসা করবে তবে তো সাহায্য করব। এমন এমন ব্যবসা করো যাতে অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ হয়।

-হ্যাঁ, তা তো বটেই। শেষকালে যদি দেখি ব্যবসাতে বেশি লাভ হচ্ছে তখন না হয় দু’জনে চাকরি ছেড়ে দেব। ভেবে দেখছি চাকরি চালিয়ে গেলে কোনও দিনই অভাব ঘুচবে না। আর এতদিন তো চাকরি করে দেখলুম, আমাদের সুপারিন্টেন্ট ভাদুড়ী সাহেব, তিন হাজার টাকা মাইনে পেয়েও তাঁর অভাব ঘোচে নি, প্রায়ই তো কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে তাঁকে লোন নিতে হয়।

ফুটপাথ দিয়ে অসংখ্য মানুষের চলমান স্রোতে আরো দু’জন মানুষ নিজেদের অদূর ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনি করে রোজ মাথা ঘামায়। একদিন নয়, দুদিন নয়, বহুদিন থেকেই এমনি মাথা ঘামিয়ে এসেছে। আজও আবার মাথা ঘামাচ্ছে। মাঝখানে শুধু কয়েক মাস নয়নতারা একটু অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। তারপর আবার সুস্থ হয়েছে, আবার স্বাভাবিক হয়েছে। আবার যেন বুঝতে শিখেছে যে সংসারে ভাবপ্রবণতার কোন দাম নেই। ওসব সংস্কার। যতক্ষণ মনের সংস্কারকে প্রাধান্য দেবে ততক্ষণ জীবনে কোনও উন্নতি নেই। প্রচুর টাকার মালিক হবার পর ওসব মানায়। আমরা সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষ, আমাদের প্রধান কাজ হবে পয়সা উপায় করা আর পয়সা জমানো। সংসারে তো পয়সাটাই আসল, এই বোধটা যদি একবার মনের মধ্যে পাকা করে গেঁথে দিতে পারো, তখন আর ও-সব বাজে চিন্তা তোমাকে গ্রাস করতে পারবে না। দয়া-মায়া-মমতা-সহানুভুতি ও-সব ছাপানো বইতে পড়তে ভালো। তোমার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তুমি দেখেছ তো তাদের কত টাকা! অত টাকা ছিল বলেই কর্তারা আরাম করে খেয়েছে পরেছে আর দুনিয়াকে ভোগ করেছে। কিন্তু তাদের ছেলেটার সেই বৈষয়িক বুদ্ধি ছিল না বলে অমন করে সব নষ্ট হয়ে গেল। নষ্ট করতে এক মিনিট লাগে, গড়াটাই শক্ত। আমরা যদি একটু বুদ্ধি-বিবেচনা করে চলি তো আমাদেরও একদিন ওইরকম আরাম হবে, জীবনকে ওইরকম ভোগ করতে পারবো। আগে তুমি ঠিক করে নাও তুমি ভোগ চাও না ত্যাগ চাও। যদি ভোগ চাও তো তার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। দুহাতে টাকা জমাতে হবে। টাকার ওপরে মায়া থাকা চাই। পৃথিবীতে তো ভিখিরির শেষ নেই, তুমি যদি তাদের ওপর দয়া করে তোমার কষ্ট করে উপায় করা পয়সা দান করতে যাও তো দেখবে তোমার সব টাকা এক ফুঁ-এ ফুরিয়ে গেছে। টাকাকে ভালোবাসতে হবে, টাকাকে বিশ্বাস করতে হবে, টাকাকে আদর করতে হবে, তবে তো টাকাও তোমাকে ভালোবাসবে বিশ্বাস করবে আদর করবে। তোমার শ্বশুর কি কখনও বাজে খরচ করতো? করতো না। পৃথিবীতে যারা যারা বড়লোক হয়েছে তারা কেউই কখনও বাজে খরচ করে নি। বাজে-খরচ কমাও দেখবে আমাদেরও অনেক টাকা জমবে। সেইজন্যেই তো ইংরিজিতে একটা কথা আছে : Don’t trust money but put your money in trust-টাকা হাতে রাখলেই খরচ করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু ব্যাঙ্কে রাখো দেখবে টাকা থাকবে।

দিনের পর দিন, মাসের পর মাস নয়নতারার কানের কাছে নিখিলেশ কথাগুলো বলতো। আর নয়নতারা মন দিয়ে সব শুনতো। বুঝতো, বুঝতে চেষ্টা করতো। অফিস থেকে বাড়িতে গিয়ে অফিসের কাপড়টা পাট করে আলমারির ভেতরে তুলে রাখতো! আবার পরের দিন আলমারি খুলে সেটা পরতো। এ তার বহুদিনের অভ্যেস। এই অভ্যেসটা আবার শুরু করে দিলে সে।

তার পরদিন ঠিক আবার সেই রকম। একদিন সদানন্দকে নিয়ে তাদের সংসারে যে উৎপাত শুরু হয়েছিল তা আবার মন থেকে মুছে গেল। আবার নয়নতারা ঠিক সময়মত অফিসে যেতে লাগলো। আবার ছুটির পর নিখিলেশ গিয়ে তাকে নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি ফিরে আসতে লাগলো। একদিন যে তৃতীয় একটা মানুষকে নিয়ে তাদের মধ্যে এত সংঘাত বেধে গিয়েছিল তা আর কারো মনে রইল না।

নয়নতারা হঠাৎ এক-একদিন মনে করিয়ে দিত কই, তুমি যে সেই ব্যবসা করবার কথা বলেছিলে, সে-সব তো কিছু করলে না?

নিখিলেশ বলতো–তোমার তো ঠিক মনে আছে দেখছি–

নয়নতারা বলতো–বাঃ রে, মনে থাকবে না? মালা বোসের স্বামী তো চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করছে, মালা বোসকে জানো তো?

–খুব জানি। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়। তা কীসের ব্যবসা?

–হোটেলের ব্যবসা। একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেয়েদের বোর্ডিং-হাউস করেছে। যে সব মেয়েরা চাকরি করে, যে-সব মেয়েদের কলকাতায় থাকার জায়গা নেই, তাদের জন্যে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে–

–কটা ঘর?

–চারটে ঘর নিয়ে নাকি প্রথমে আরম্ভ করেছিল। তাতে জায়গা কুলোচ্ছিল না, এখন নাকি আর একটা মস্ত দোতলা বাড়ি ভাড়া নিয়েছে, তাতে শুনলুম অনেক টাকা আয় হচ্ছে এখন। এত টাকা হচ্ছে যে আর চাকরি করে দুদিক দেখা সম্ভব হচ্ছে না

–কত লাভ থাকে?

নয়নতারা বললে–মালা তো বললে–মাসে নাকি এখন এক হাজার দুহাজার টাকা আসছে। এর পরে যদি নিজেরা দেখতে পারে তাহলে লাভ বাড়বে। মালাও ভাবছে চাকরি ছাড়বে কি না–

নিখিলেশ বললে–তুমি একদিন বোর্ডিং হাউসটা গিয়ে দেখে এসো না–

তা একটা রবিবার দেখে নয়নতারা সত্যিই একদিন গেল। ভবানীপুরের একটা ভদ্রপাড়ায় বাড়িটা। দোতলা বাড়ি। আটখানা ঘর। মালার স্বামী ভদ্রলোকটি বেশ অমায়িক। নয়নতারার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই ভদ্রলোক হাসিমুখে অভ্যর্থনা করলেন। ঘুরে ঘুরে সব দেখলেন।

বললেন–দেখুন, আমরা তো দুজনেই চাকরি করি। চাকরি করতে করতে একদিন ভাবলুম চাকরি করে কেবল জীবন নষ্ট করছি। তখন থেকেই ভাবতে লাগলুম একটা কিছু করতে হবে–তা অনেক রকম কাজে হাত দিলুম, কিছুই হলো না, অনেকগুলো টাকা মাঝখান থেকে নষ্ট হয়ে গেল। শেষকালে এই মেয়েদের বোর্ডিং-হাউসের আইডিয়াটা এল–

মালা বললে–আমরা তো অফিসে গল্প ছাড়া আর কিছু করি না। ভাবছি এখেনে কাজ করলে তবু একটু কাজের কাজ করা হবে

মালার স্বামী বললে–এখন অফিস থেকে এসে এরও কাজে নেশা লেগে গেছে–

মালা বললে–প্রথমে আমি চাকরিটা ছাড়বো না নয়নদি, মাসকয়েকের ছুটি নেব প্রথম, তারপর একদিন রিজাইন দেব–

নয়নতারার বেশ লাগলো। নিখিলেশ কতদিন ধরে ব্যবসা করবার কথা ভাবছে। এই রকম ব্যবসা করলে মন্দ হয় না।

জিজ্ঞেস করলে–প্রথমে কত ক্যাপিটেল লেগেছিল?

মালার স্বামী বললে–বুঝতেই তো পারছেন আমাদের দুজনের চাকরিতে আর কত টাকাই বা জমতে পারে! হাজার পাঁচেক টাকার মত ব্যাঙ্কে জমা ছিল, তাই দিয়েই একদিন কাজ আরম্ভ করে দিলুম, তারপরেই এই…।

বাড়িতে ফিরে এসে নিখিলেশকে বললে–দেখে এলুম–

নিখিলেশ সেই কথা শোনবার জন্যেই আগ্রহ করে বসে ছিল। বললে–কী রকম দেখলে?

নয়নতারা বললে–খুব ভালো। হাঙ্গামা কিছু নেই। আমিও পারি—

–কত টাকা ক্যাপিটেল লেগেছিল প্রথমে?

–পাঁচ হাজার টাকা!

পাঁচ হাজার টাকা শুনে নিখিলেশের মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। পাঁচ হাজার টাকা কোথায় পাবে সে! ব্যাঙ্কের পাসবইটা বের করে দেখলে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে বহুদিন আগে একটা জয়েন্ট-অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। তাতে যে কত টাকা ছিল তা মনে ছিল না। পাস বইটা খুলতেই জমার অঙ্কটা দেখে নিখিলেশ অবাক হয়ে গেল। মাত্র পাঁচটা টাকা পড়ে আছে। অথচ নিখিলেশের মনে আছে শেষের দিকে পাঁচশো টাকার মত জমা ছিল। সে টাকা কে তুলে নিলে? আসলে টাকা কড়ি ব্যাঙ্কের পাসবই সবই তো নয়নতারার কাছে থাকতো।

নিখিলেশ নয়নতারার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলে–টাকা এত কমে গেল কী করে?

নয়নতারা বললে–আমি তুলে নিয়েছি–

নিখিলেশের মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে গেল। বললে–একেবারে পাঁচশো টাকাই তুলে নিয়েছ? আমার তো মনে আছে এতে পাঁচশো টাকাই ছিল–

নয়নতারা বললে–তখন দরকার হয়েছিল তাই তুলেছি–

–দেখ দিকিনি, তুমি এই রকম করে কত টাকা নষ্ট করেছ মিছিমিছি। কোথাকার কে, তার জন্যে সব টাকাটা তুমি এমনি করে জলে ফেলে দিলে? অথচ যার জন্যে তুমি এত করলে সে ওদিকে বেশ আরাম করে বউ নিয়ে ঘর-সংসার করছে। সে-টাকা থাকলে আজকে কত সুবিধে হতো বলে দিকিনি। বললে–তা তুমি এখন আমার ওপর রাগ করবে

নয়নতারা বললে–টাকা তো তুমি নিজেও কত নষ্ট করেছ—

নিখিলেশ প্রতিবাদ করে উঠলো–আমি? আমি আবার কবে টাকা নষ্ট করলুম?

নয়নতারা বললে–এখন যদি আমি সেই সব কথা তুলি তো তুমিও রাগ করবে। তুমি মদ খাও নি? মদ খেয়ে তুমি কত দিন কত টাকা নষ্ট করেছ বলো দিকিনি?

নিখিলেশ বললে–বাঃ, তুমি তো বেশ উল্টো চাপ দিতে পারো! আমি কি শখ করে মদ খেতে গেছি?

–তা শখ করে না তো কি! মদ তো শখেরই জিনিস। তুমি তো শখ করেই মদ খেয়ে টাকা উড়িয়েছে।

–তা তো তুমি বলবেই। দোষ করলে তুমি নিজে আর মাঝখান থেকে অপরাধী হলুম আমি, বেশ।

নয়নতারা বললে–তা তুমি কি ছেলেমানুষ যে শীতেশবাবু তোমার গলায় জোর কবে মদ ঢেলে দিলে, আর তুমিও খেয়ে ফেললে? মদের দাম কি কম নাকি? কত টাকা এমনি করে নষ্ট করেছ বল তো?

নিখিলেশ বললে–কিন্তু তুমি যদি একজন বাইরের মানুষকে বাড়িতে এনে না তুলতে তো আমি কি মদ খেতুম?

নয়নতারা বললে–তা আমি না-হয় একটা লোককে অসুখ থেকে বাঁচাবার জন্যে টাকা নষ্ট করেছি, আর তুমি? তুমি ওই বিষগুলো কী বলে খেলে? দুটো জিনিস কি এক হলো?

নিখিলেশের হঠাৎ বোধহয় জ্ঞানোদয় হলো। সে এবার নিজেকে সামলে নিলে। বললে– যাক, যা হবার হয়ে গেছে, তা নিয়ে আর তর্ক করতে চাই না। কপালে ছিল টাকা গচ্চা যাওয়া, গচ্চা গেছে। এখন যে বুঝতে পেরেছ এইটুকুই যথেষ্ট–এখন কী করা যায় তাই ভাবা যাক–

সেই কথা ভাবতে ভাবতেই দুজনের অনেক দিন চলে গেল। অফিসে যাওয়ার পথে শুধু পরামর্শ আর পরামর্শ। টাকার চুলচেরা হিসেব চলতে লাগলো। একটু খরচ কমাতে হবে। খরচ কমালেই টাকা জমে যাবে।

নয়নতারা বললে–আমি যত কম খরচে চালাই আর কোনও মেয়ে তেমন করে চালাতে পারবে না। আমাদের অফিসের বন্ধুরা সবাই আমার চেয়ে দামী-দামী শাড়ী পরে তা জানো?

নিখিলেশ বললে–তাহলে আমিই কী মনে করো দামী-দামী সুট্‌ পরি?

নয়নতারা বললে–তাহলে খরচ কমানোর কথা বলছো কেন আমাকে? আমি কি কোনও দিন একটা পয়সা বাজে-খরচ করেছি?

নিখিলেশ বললে–আঃ, তুমি রাগ করছো কেন? আমি কি সেকথা বলেছি তোমাকে?

নয়নতারা বললে–কেন, তুমি নিজেও তো দেখেছ রাস্তায় মেয়েরা আজকাল কত দামী দামী শাড়ি ব্লাউজ-গয়না পরে যাচ্ছে। আর কারো বউ এমন কম খরচে সংসার চালাতে পারবে? আমি বাজি রাখতে পারি–

নিখিলেশ বললে–তুমি রাগ করছো কেন?

নয়নতারা বললে–তাহলে এবার থেকে সংসার খরচের হিসেব আমি আর রাখবো না, তুমিই রাখো–

পরামর্শ করতে করতে এমনি করে পরামর্শের নৌকো ঝগড়ার চোরাবালিতে গিয়ে আটকে যায়, তখন পরামর্শ আর বেশিদূর এগোয় না। অথচ এক ছাদের তলায় এক বাড়িতে দুজনে বসবাস করে, একই সঙ্গে দুজনে অফিসে যাতায়াত করে। কিন্তু ছটফট করে দু’জনেই। দুজনেরই মনে হয় আরো বেশি টাকা হলে ভালো হয়, আরো বেশি টাকা হলে জীবনটা বেশ স্বচ্ছন্দ হয়, সুখের হয়, আরামের হয়।

কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে আরো বেশি টাকা আয়ের সুরাহা হয় না।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি এসে পৃথিবী যেন সেই টাকার খেলাতেই হঠাৎ উন্মাদ হয়ে উঠলো। আগে টাকা চাইতো কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়, টাকা চাইতো নরনারায়ণ চৌধুরীরা, টাকা চাইতে পুলিসের বড়বাবু সুশীল সামরো, আর তার সঙ্গে মুষ্টিমেয় কিছু লোক টাকা চাইতো। যেমন চাইতো মানদা মাসীরা আর প্রকাশ রায়েরা।

টাকার জন্যে নরনারায়ন চৌধুরীরা একদিন কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রীর সম্পত্তি যে গ্রাস করেছিলেন সেটা স্বাভাবিক। কারণ জমিদারে জমিদারে রেষারেষি আর প্রতিযোগিতার যুগ সেটা। তখন রাজা-মহারাজা-জমিদারের টাকার নেশা ছিল সমাজের ওপর-মহলের নেশা। তাতে প্রজাদের ক্ষতিবৃদ্ধির কথা উঠতো না। ওপরওয়ালারাই ছিল মুখ্য, প্রজারা গৌণ। প্রজাদের কাজ ছিল সহ্য করা। ওপর-ওয়ালাদের পীড়ন মাথা পেতে নেওয়া, আর সব অত্যাচার আর পীড়ন সহ্য করার পেছনে ছিল ধর্মের অনুশাসন। ধর্ম বলতো–ইহকালে ধর্মপথে থাকো তাহলে পরলোকে তোমার অক্ষয় স্বর্গবাস হবে–

কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকরাও টাকা চেয়েছে। কিন্তু সে টাকা-চাওয়া তাদের নেহাৎ পেট চালাবার জন্যে। পেট চালাবার বাইরে যে টাকার ব্যবহার তা তারা জানতো না। তার স্বপ্নও তারা কখনও দেখতো না। তারা জানতো না যে সে টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে তা সুদে বাড়ে। জানতো না সুদের তা দিয়ে দিয়ে একশো টাকাকেই আবার এক হাজার টাকা করা যায়। জানতো না সেই এক-হাজার টাকাকেই আবার একদিন আরো ভালো করে তা দিলে সেটা দশ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। তারা জানতো শুধু জমি, কিম্বা জানতো শুধু বাঁধা একটা চাকরি। সেটা পেলেই তোমাদের সব পাওয়া হয়ে গেল। তখন সন্ধ্যেবেলা নবাবগঞ্জের বারোয়ারিতলায় বসে বসে রাত জেগে কবির লড়াই শোন, যাত্রার পালায় রাম সেজে অভিনয় করো কিম্বা বন্ধুবান্ধব নিয়ে তাস খেলে সন্ধ্যেটা কাটিয়ে দিয়ে রাতে নাক ডাকিয়ে ঘুমোও।

কিন্তু জানতে পারলো যুদ্ধের পর। ১৯৩৯ সালের যুদ্ধ যখন শেষ হলো তখন জানতে পারলো, ওই যাত্রা, কবির লড়াই, তাস খেলা ও-সব কিছু নয়। জানতে পারলো ওই রামায়ণ পাঠ, পরলোক-টোক কিছু নয়। আমরা যখন ওই সব নেশায় বুঁদ হয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম তখন অন্য লোকেরা বেশ কাজ গুছিয়ে নিয়েছে। কেউ যুদ্ধের ঠিকেদারি করেছে, কেউ চালের সঙ্গে কাঁকর মিশিয়েছে, কেউ বা ওষুধের ভেজাল দিয়েছে। সবাই চোখ মেলে দেখল তামাম দুনিয়াটার চেহারা রাতারাতি বদলে গিয়েছে। সবাই যে কখন কাজ গুছিয়ে নিয়েছে তা কেউ টের পায় নি। আগে একজন কপিল পায়রাপোড়া ছিল, তখন লক্ষ লক্ষ কপিল পায়রাপোড়া জন্মেছে। লক্ষ লক্ষ মানিক ঘোষ আর ফটিক প্রামাণিকরা কর্তাবাবুদের অত্যাচারে মাথা নোয়াবে না ঠিক করে ফেলেছে। তারা বলতে আরম্ভ করেছে–আমাদেরও বাঁচবার অধিকার আছে, আমরাও বাঁচতে চাই, জমির ফসলের ভাগ চাই আমরা, জীবনধারণের জন্যে আমরা আরো টাকা চাই–

আর একদিকে কলকাতার অফিসের ক্লার্ক নিখিলেশ আর নয়নতারা, তারাও বলছে আমরা আর গরীব হয়ে থাকবো না, আমাদের আরো টাকা চাই–

সমস্ত পৃথিবীর সাধারণ মানুষও তাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তখন বলতে শুরু করেছে–আমরা আরও একটা চাই–

এদিকে সদানন্দর তখন কোনও দিকে চেয়ে দেখবারও সময় নেই। সমস্ত কিছু দেখা যেন তার শেষ হয়ে গেছে। সেই কবে একদিন নবাবগঞ্জ থেকে সে তার জীবন-পরিক্রমা শুরু করেছিল, সেই তখনই সে দেখেছিল বাড়িতে কে একজন বিধবা বুড়ি আসে আর কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে বলে–আমার টাকা দাও, আমার টাকা চাই–

তারপর প্রকাশ মামার সঙ্গে যখন রাণাঘাটের রাধার বাড়িতে যেত, সেখানে গিয়েও দেখতো রাধা প্রকাশ মামাকে বলতো–আমার টাকা চাই–

আর তারপর সেই পুলিসের থানা। সেই সেখানেও তো টাকা। প্রকাশ মামা টাকা দিলে বলেই তো সেদিন সে ছাড়া পেলে।

সমস্ত সুলতানপুরময় হঠাৎ রটে গেল যে চৌধুরী মশাই-এর ছেলে এসেছে।

অশ্বিনী ভট্টাচার্যি দৌড়তে দৌড়তে কাছারি বাড়িতে এসে হাজির। খবরটা ভীম বিশ্বাসও পেয়ে গিয়েছিল। আশু চক্কোত্তি তখন মাঠে গিয়েছিল। সেখান থেকেই সে একেবারে সোজা চলে এসেছে।

প্রকাশ রায় সদরবাড়িতেই সবাইকে ঠেকালো।

বললে–না বাপু এখন দেখা হবে না। এখন সদার শরীর খারাপ–

ভীম বিশ্বাস বললে–আমি তো তাকে বিরক্ত করবো না রায় মশাই, আমি শুধু একবার তাঁকে চোখের দেখা দেখবো–

প্রকাশ রায় ধমকে উঠলো–চোখের দেখা দেখে কী হবে শুনি? সে কী বাঘ না, ভাল্লুক যে চোখে দেখবে? আমাদেরই মতন দুটো হাত দুটো পা, দেখবার কী আছে?

অশ্বিনী ভট্টাচার্যি বললে–তা আমাদের কথা বলেছেন তো তাকে আজ্ঞে? আমার মেয়ের বিয়ের কথা?

–বলেছি, বলেছি, সব বলেছি। সবাই টাকা পাবে। তোমার মেয়ের বিয়ের টাকা, ভীম বিশ্বাসের টাকা, আশু চক্কোত্তির টাকা। সবাইকে টাকা দেওয়া হবে–

খুব পাহারা দিয়ে রাখতে হলো সদাকে। কেউ না ভালোমানুষ পেয়ে শেষকালে আবার কিছু লিখিয়ে নেয়। লিখিয়ে নিলেই হোলো। সদা যেমন ছেলে হয়ত সকলেরই অভাব অভিযোগের কথা শুনে জল হয়ে গেল আর সামনে যাকে পেলে তাকেই সব টাকা দিয়ে দিলে।

প্রকাশ মামা সমস্ত দিনই সদানন্দকে ঘরের মধ্যে বসিয়ে রাখে। কোথাও বোরোতে দেয় না।

বলে–না রে, তোর টাকার কথা শুনে সুলতানপুরের লোক সবাই হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখন হয়ত তোকে কিছু খাইয়ে-টাইয়ে দেবে।

সদানন্দ বুঝতে পারে না। বলে–কী খাইয়ে দেবে?

প্রকাশ মামা বলে–আরে কত কী খাইয়ে দিতে পারে তার কী ঠিক আছে? সুলতানপুরের মানুষ সব পারে। এদের তুই চিনিস না, এরা বিষও খাওয়াতে পারে–

বিষ?

–হ্যাঁ রে, বিষ! টাকার জন্যে মানুষ সব করতে পারে। তোর টাকা হয়েছে এ তো এখানকার সবাই জেনে গেছে কি না!

তা সাবধানের মার নেই। যখন যেখানে সদানন্দকে নিয়ে যায় চারিদিকে পাহারা দিয়ে রাখে। একবার উকিলের কাছে, একবার কাছারিতে, একবার রেজিষ্ট্রি অফিসে। গভর্মেন্টের টাকা পেতেও কী কম ঝঞ্ঝাট! সাকসেশান সার্টিফিকেট নিতেও ক’দিন সময় নষ্ট হয়ে গেল।

প্রকাশ মামার সঙ্গে সদানন্দ বেরোয় আর প্রকাশ মামার সঙ্গেই বাড়ি ফিরে আসে। প্রকাশ মামার তখন নাইবার খাবার সময় নেই। তার মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত লোক যেন ওঁৎ পেতে আছে। একবার গভর্মেন্টের ঘর থেকে টাকাটা পেলে তবেই নিশ্চিন্দি।

কাগজপত্র সব আস্তে আস্তে যোগাড় হয়ে গেল। প্রকাশ মামা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে মনে ভগবানকে ডাকতে লাগলো–হে মা কালী, আর একটা দিন, আর একটা দিন বাঁচিয়ে রেখো মা, সব যেন ভালোয় ভালোয় শেষ হয়ে যায়। টাকাটা পেলে আমি ঘটা করে তোমার পূজো দিয়ে দেব মা

সব যখন চুকলো তখন প্রকাশ মামা সদানন্দর সামনে একটা কাগজ ফেলে দিয়ে বললে–এইবার এখেনে একটা সই করে দে তুই–

সদানন্দ কাগজটা দেখলে। ওপরে কত টাকার যেন স্ট্যাম্প লাগানো।

জিজ্ঞেস করলে–এটা কিসের কাগজ?

প্রকাশ মামা বললে–আরে এটা কিছু না, তুই যে আমাকে টাকাগুলো দিলি, তারই দানপত্র আর কী! এ-এমন কিছু হাতী-ঘোড়ার ব্যাপার নয়, এক মিনিটেই আমি ঠিক করে নেব। আমার উকিল ড্রাফট্‌ করে দিয়েছে–তোর কিচ্ছু ভাবনা নেই, শুধু তুই সইটা করে দে–

সদানন্দ বললে–কিন্তু আমি সই করবো কেন?

প্রকাশ মামা বললে–কেন, সই করতে তোর আপত্তিটা কী? তুই তো টাকাগুলো সব আমাকেই দিয়ে দিবি? তোর তো আর টাকার দরকার নেই রে–

সদানন্দ বললে–না, টাকার দরকার আছে আমার–

–সে কী রে? তোর আবার টাকার কিসের দরকার?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, টাকার দরকার আছে আমার–

প্রকাশ মামার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়বার উপক্রম করেছে। সদানন্দর মুখের দিকে সে হাঁ করে চেয়ে দেখতে লাগলো।

জিজ্ঞেস করলে–হ্যাঁ রে, সত্যিই তোর টাকার দরকার? তুই তো বিয়েও করবি না, সংসারও করবি না, তোর এত টাকার দরকার কীসের?

ততক্ষণে চেক-পাসবই আরো অনান্য কাগজপত্র তৈরি হয়ে গেছে। সদানন্দ সেগুলো নিয়ে পকেটে পুরে ফেললে।

বললে–না প্রকাশ মামা, সংসার না-ই বা করলুম, আমার সত্যিই অনেক টাকার দরকার আছে–

–তা কত টাকার দরকার?

সদানন্দ বললে–সব টাকাটাই আমার দরকার…

বলে ব্যাঙ্ক থেকে রাস্তায় বেরিয়ে সোজা চলতে লাগলো। প্রকাশ মামার তখন পাগলের মত অবস্থা। সেও পেছন-পেছন চলতে চলতে বলতে লাগলো–ওরে, আমি যে তোর জন্যে এত করলুম, আমার কথা তুই একবার ভাববি না? আমি খবর না দিলে তো তুই টাকার কথা জানতেও পারতিস না–

কিন্তু সদানন্দ সেকথায় কান দিলে না। সে যেমন যাচ্ছিল, তেমনিই চলতে লাগলো।

.

সেদিন শীতেশ বোস অন্য পরামর্শ দিলে।

নিখিলেশ কদিন ধরেই বলছিল ব্যবসা করবার কথা। অল্প মূলধনে একটা কিছু ব্যবসা না  করলে চিরকাল এই কেরানীগিরি করেই জীবন কাটিয়ে দিতে হবে।

নিখিলেশ একদিন শীতশকে বললে–ভাবছি মেয়েদের একটা বোর্ডিং হাউস করবো, ওতে খুব লাভ–

শীতেশ সব শুনে বললে–না হে, ওতে বেশি লাভ নেই। একটা ব্যবসায় খুব লাভ আছে যদি করত পারো!

–কীসের ব্যবসা!

শীতেশ বললে–মেয়েমানুষের ব্যবসা!

নিখিলেশ চমকে উঠেছে। বললে–সে কী সে আবার কী রকম ব্যবসা?

শীতেশ বললে–আজকাল শহরকে তো আর চিনলে না হে, কত লোকে কত ধান্ধায় চারদিকে ঘুরছে। পয়সা এখানে উড়ছে, কুড়িয়ে নিতে পারলেই হলো–

নিখিলেশ বললে–মেয়েদের বোর্ডিং-হাউস তো অনেকে করেছে, আর নতুন কী ব্যবসা আছে?

শীতেশ বললে–ঠিক আছে, রবিবার দিন তোমার সময় আছে? আমার বাড়িতে আসতে পারবে?

–খুব পারবো।

–তাহলে তাই এসো। তোমাকে একেবারে, সরেজমিনে কারবারটা দেখিয়ে দেব–

পরের দিনই রবিবার। বিকেলবেলার দিকে নিখিলেশ বেরিয়ে পড়লো।

নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–কখন ফিরবে?

নিখিলেশ বললে–চেষ্টা করবো শিগগির ফিরতে–

বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। শীতেশ তৈরিই ছিল। নিখিলেশকে নিয়ে কালীঘাটের বাসে উঠলো। উঠে দু’খানা কালীঘাটের টিকিট কাটলো।

নিখিলেশ জিজ্ঞেস করলে–কালীঘাটে কোথায় যাচ্ছো? মন্দিরে নাকি?

শীতেশ বললে–আরে চলো না, ব্যবসা করতে নামছ, অত ভয় করলে চলে? ব্যবসার জন্যে মানুষ আজকাল জাহান্নামে যেতেও তৈরি, তা জানো?

একটা জায়গায় নেমে শীতেশ ভিড়ের মধ্যে হন হন করে চলতে লাগলো। নিখিলেশও চলতে লাগলো পেছন-পেছন। মানুষের ভিড়ে জায়গাটা তখন বেশ সরগরম হয়ে আছে। এদিকে আগে কখনও আসেনি নিখিলেশ।

একটা বস্তির মধ্যে ঢুকে শীতেশ একটা বাড়ির সামনে দাঁড়ালো। কয়েকজন মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেজেগুজে সেদিকে না চেয়ে শীতেশ ডাকতে লাগলো–মানদা মাসি আছো নাকি গো–ও মানদা মাসি–

নিখিলেশ পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। চারদিকের আবহাওয়া দেখে তার অবাক লাগছিল তখন। এও তো একরকমের ব্যবসা। শীতেশকে বললে–চলো শীতেশ, চলে যাই–

শীতেশ বললে—না না, যেও না হে, ব্যাপারটা দেখেই যাও না। ব্যবসা হচ্ছে ব্যবসা। সংসারে টাকা উপায় করবার কত রকমের পথ আছে সেটা দেখা ভালো।

আসলে মানদা মাসির কপাল ভালো না নিখিলেশের কপাল ভালো তা কে বলতে পারে। কে বলতে পারে কোন যোগসূত্রে জড়িয়ে গিয়ে কার ভাল হয় আর কারই বা মন্দ হয়। নিখিলেশ সামান্য একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ। বিংশ শতাব্দীর যুদ্ধোত্তর যুগের অসহিষ্ণু সমাজের একজন প্রতিনিধি সে। শুধু মোটা ভাত আর মোটা কাপড় পেলে তার চলবে না। সুস্থ স্বাভাবিক সহজ জীবনের শান্তিতে তার তৃপ্তি নেই। সে অল্প-পাওয়ার দুঃখকে অতিক্রম করবার জন্যে বেশি-পাওয়ার অশান্তি মাথায় তুলে নিতেও প্রস্তুত। ত্যাগের উপদেশ তার পক্ষে মৃত্যু, ভোগটাই তার কাছে চরম সত্য। ভোগের উপকরণ যোগাড় করতে সে জীবন বলি দিতেই পেছপাও নয়। তার ধারণা হলো ভোগই যদি না করতে পারলুম তো বেঁচে আছি কেন? আর ভোগ করতে গেলেই চাই টাকা? সেই টাকা যদি রাস্তার ধারের নর্দমাতেও পড়ে থাকে তো তা কুড়িয়ে নিতে আপত্তি করবো কেন? আসলে পুণ্যের টাকা আর পাপের টাকার মধ্যে তো কোনও তফাৎ নেই। টাকার গায়ে লেখাও থাকে না ওটা কীসের টাকা! সুতরাং টাকা চাই।

শীতেশ বোধ হয় ও-পাড়ার নিয়মিত যাত্রী। অন্তত তার হাবভাব দেখে নিখিলেশের তাই-ই মনে হলো। বস্তিবাড়ির সবাই-ই তাকে চেনে। মানদা মাসির সঙ্গেও তার খুব ঘনিষ্ঠতা আছে তার নমুনাও পাওয়া গেল।

মানদা মাসি নিখিলেশকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলে–ইনি কে?

শীতেশ বললে–আমার বন্ধু আমরা এক অফিসে কাজ করি–

মানদা মাসি বললে–তা তো বুঝলুম, তা তোমার সঙ্গে কেন? একা আসতে ভয় পায় বুঝি?

শীতেশ বললে–না, আরে তা না, সবারই কি আর আমার মত ক্যারেক্টার? তুমি ভাবো কী? কলকাতায় কি ভালো লোক নেই?

মানদা মাসি বললে–আমাকে আর ভালো লোক দেখিয়ো না বাবা। আমি সব দেখে নিয়েছি। ফরসা জামা কাপড় পরা লোকও দেখলুম, আবার কুলি কাবারি-মজুরদেরও দেখলুম। আমার কাছে সবাই লক্ষ্মী। খদ্দের মাত্তোরই হলো লক্ষ্মী। কারবার করতে যখন নেমেছি তখন অমন বাছ-বিচার করলে তো চলবে না আমার, আগে দেখবো তোমার ট্যাঁকে টাকা আছে কিনা! টাকা থাকলে তুমি ভালো আর টাকা না থাকলে তুমি খারাপ। সোজা কথা আমার কাছে–হ্যাঁ!

শীতেশ বললে–তা তুমি বলছিলে না তোমার টাকায় টান পড়েছে?

–টান তো পড়েছেই বাবা! টাকার আমার বড় টানাটানি পড়েছে–একদিন খদ্দেরের ভিড়ে আমার বাড়িতে কাগ-চিল বসতে পেত না, সেই আমার বাড়ির দিকে এখন শ্যাল কুকুরেও ফিরে তাকায় না, এমনই হাল হয়েছে। মেয়েগুলো খেতে পাচ্ছে না পেট পুরে, দুঃখের কথা তোমাকে আর কী বলবো–

শীতেশ জিজ্ঞেস করলে–তা এরকম কেন হলো মাসি? কলকাতায় মানুষগুলোর ক্যারেকটার কি রাতারাতি সব ভালো হয়ে গেল? নাকি পুলিসের হয়রানি?

মানদা মাসি বললে–পুলিস তো আমার হাতে! পুলিসের বড়বাবু তো আমার হাত ধরা, তা তো তুমি জানো বাবা। সে হলে এক কথায় আমি সকলকে ঠাণ্ডা করে দিতুম। আসলে আমার টাকার অভাব হয়ে পড়েছে। আমি যদি এ-কারবারে কিছু টাকা ঢেলে সাহেব পাড়ায় একটা বড় বাড়ি নিতে পারতুম তো আমার টাকা খায় কে? কিন্তু তা তো হচ্ছে না–

শীতেশ নিখিলেশকে দেখিয়ে বললে–সেই জন্যেই তো আমার বন্ধুকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি মাসি,–যে কোনও কারবারে এ টাকা খাটাতে চায়–

এতক্ষণে যেন মানদা মাসির হুঁশ হলো। নিখিলেশের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলে। বললে–কী কারবারে টাকা খাটাবেন?

বলে যেন হঠাৎ খেয়াল হলো। বললে–তোমরা চা-টা কিছু খাবে বাবা?

নিখিলেশ বললে–না না, ব্যস্ত হতে হবে না। আপনার ব্যবসা কেন ভালো চলছে না তাই বলুন। এত লাভের ব্যবসাতে কিনা লোকসান হচ্ছে!

মানদা মাসি বললে–দুঃখের কথা বলবো কি বাবা, এব্যবসায় আসলে লোকসান নেই, কিন্তু তবু লোকসান হচ্ছে আমার, হচ্ছে টাকার অভাবের জন্যে। টাকা যদি পেতুম কিছু তো দেখিয়ে দিতুম কাকে বলে ব্যবসা। এ ব্যবসায় যদি হাজার দশেক টাকা ঢালতে পারতুম আমি তো আজ পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে বসে থাকতে পারতুম–

এতক্ষণে নিখিলেশ কথা বললে। বললে–দশ হাজার টাকা পেলে আপনি কী করবেন?

–কী করবো? তা হলে বলি শোন, আমি তাহলে সাহেব পাড়ায় পাঁচশো টাকায় একটা বাড়ি ভাড়া করবো প্রথমে। দু’খানা ঘর হলেই আমার আপাতত চলবে, আর দুটো মেয়ে। তা সে মেয়ে আমি নিজে যোগাড় করবো, তার জন্যে ভাবনা নেই। আজকাল ভালো-ভালো ভদ্র ঘরের মেয়ে এ-লাইনে নামতে চায়, কিন্তু আমার এই বস্তি বাড়ি দেখে তারা আসতে চায় না, পিছিয়ে যায়। সাহেবপাড়ায় ব্যবসা করলে আমি ঘন্টা পিছু রেট বেঁধে দেব। তখন এত পয়সা আসবে সে পয়সা রাখবার জায়গা থাকবে না আমার–

নিখিলেশ বললে–আর এ কারবারে তো আপনার ট্যাক্স দিতে হয় না–

–ট্যাক্সো? কীসের ট্যাক্সো?

নিখিলেশ বললে–ইনকাম ট্যাক্সের কথা বলছি–

মানদা মাসি বললে–না বাবা, এতদিন কারবার করছি ট্যাক্সো-ফ্যাক্সো কখনও দিই নি, ট্যাক্সো আবার কাকে দেব? যাদের ট্যাক্সো দেব তারাই তো আমার খদ্দের বাবা, তা সেদিন একটা লোক এসেছিল, আমার বহুদিনের খদ্দের, সে এসে বলে গেল সে নাকি তার ভগ্নীপতির আট লাখ টাকা পাচ্ছে, ভাবলাম তাকে বসিয়ে খাতির-টাতির করে তাকে বলবো এ কারবারে কিছু ঢালতে, তা সে কিছু বলবার আগেই পালিয়ে গেল–

–পালিয়ে গেল মানে?

মানদা মাসি বললে–পালিয়ে গেল মানে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল! ভাবলে আমি তার টাকাগুলো বুঝি কেড়ে নেব। অবাক কাণ্ড বাবা, আমি তো বাবা, দেখে অবাক! ব্যবসা করতে গেলে টাকা নিতে হয় না? আমি তোমার টাকা খাটিয়ে যদি কারবার বাড়াতে পারি তো ক্ষেতিটা কী? সুদও দিতে পারি, আর নয়তো আধাআধি বখরা। আদ্দেক বা যদি দিই তাহলে তো ফেলে-ছড়িয়ে মাসে মোটা লাভ থাকবে। তেমন করে মন দিয়ে দেখলে হিসেব- ঠিকমত রাখলে এ-কারবারে তো লোকসান নেই বাবা। এতে সবটাই লাভ।

তারপর নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–তুমি কত টাকা ঢালতে পারবে বলো তো বাবা ঠিক করে?

শীতেশ সেকথাটা ঘুরিয়ে দিলে। বললে–তোমার সেই বড়বাবু কোথায় গেল? সেই পুলিসের বড়বাবু?

মাসি মুখ বাঁকালো। বললে–তাঁর কথা আর বোল না বাবা, আমি টাকার আশায় তার বাড়িতে গিয়েও ধর্না দিয়ে পড়েছিলুম। টাকার জন্যে আমি তার কী না করেছি। তার মেয়েমানুষের পা পর্যন্ত টিপে দিয়েছি–

–তবু তোমায় টাকা দিলে না?

–না বাবা, তাই তো আমি মনের দুঃখে সেখান থেকে চলে এসেছি। আমার কপাল বাবা, সবই আমার কপাল! অথচ আমি কি টাকা নিয়ে পালিয়ে যেতুম? আমি অমন বাপের জন্মিত নই বাবা! আমি বামুনের বংশের মেয়ে, গেরোয় পড়ে আমাকে আজ এই কারবার করতে হচ্ছে। কিন্তু তুমি তো জানো বাবা, আমি তোমাদের কখনও ঠকিয়েছি? কেউ বলতে পারে আমি কখনও মালের সঙ্গে এক ফোঁটা জল মিশিয়েছি!

তারপর আবার নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–তা তোমার মূলধন কত খাটাবে তা তো কই বললে না বাবা?

কিন্তু এ-কথার জবাব নিখিলেশকে দিতে হলো না। জবাব দিলে শীতেশ। বললে–টাকা তো এর অনেক আছে, এর বাবা অনেক টাকা রেখে গেছে। কিন্তু ব্যবসায় নামবার আগে আট-ঘাট বেঁধে নামতে হবে তো। লোকসান যাতে না হয় সেটা তো আগে দেখতে হবে–

মাসি বললে–তোমায় তো আগেই বলেছি বাবা যে এ-কারবারে লোকসান বলে কিছু নেই। কলকাতা থেকে বিলিতি সাবেরা এখন চলে গেছে, এখন দিশী সাহেবদের হাতে অনেক টাকা এসেছে। তাদের ছেলেরা এখন উড়তে শিখেছে, তেমন ভালো পাড়ায় একটা বাড়ি নিতে পারলে তাদের কল্যাণে ফুলে ফেঁপে একেবারে ঢোল হয়ে উঠবে। সে-সব আমার ওপরে ছেড়ে দাও–আমি এতদিন এই কারবার করছি, আমি জানি না কত চালে কত খুদ!

শীতেশ উঠলো, বললে–ঠিক আছে মাসি, আমি আর একদিন আসবো, এখন আসি—

মাসি বললে–সে কী বাবা, তোমরা বসবে না?

শীতেশ বললে–না মাসি, দুপুরবেলা আর বসবো না। আর একদিন সন্ধ্যের ঝোঁকে বরং আসবে কারবারের হালোকাল তো সব জানা হলো, এখন এ ভাবুক–

মাসি দোরগোড়া পর্যন্ত এগিয়ে এল। বললে–ভাববার কিছু নেই বাবা, আজকাল এ ব্যবসায় বড় বড় লোক সব নামছে, দেখছো না বাবা, চারদিকে পাড়ায়-পাড়ায় কত ‘ম্যাসাজ ক্লিনিক’ গজিয়ে উঠছে–

–ম্যাসাজ ক্লিনিক?

মাসি হেসে বললে–হ্যাঁ বাবা, ওই সব ইনরিজি নাম দিয়েছে। তা ইনরিজি নাম দিলে কী হবে, আসলে আমার ব্যবসাও যা ও-ও তো তাই বাবা, ইনরিজি নাম দিলে কি আর গায়ের গন্ধ যাবে?

ততক্ষণে রাস্তায় এসে পড়েছিল দু’জন। বাইরে এসেই শীতেশ বললে–কী রকম মনে হলো ব্রাদার?

নিখিলেশ হাসলো। বললে–ভাবছি শেষকালে কিনা এই কারবারে নামবো!

শীতেশ বললে–কেন? নামতে দোষ কী? আমার যদি ছেলে-মেয়ে বউ থাকতো তো আমি নিজেই এই ব্যবসাতে নামতুম। সত্যিই তো, চারদিকে এত ‘ম্যাসাজ ক্লিনিক’ হয়েছে তাকে তো কেউ খারাপ বলে না! টাকা হলে তখন কি আর তোমার গায়ে লেখা থাকবে যে এটা ম্যাসাজ ক্লিনিকের টাকা না লোহা-লক্কড়ের টাকা?

নিখিলেশ বললে–না, তা নয়। ভাবছি আমার গিন্নী শুনলে কী বলবে!

শীতেশ বললে–খবরদার, খবরদার এসব কথা তাকে বলো না হে। এসব ব্যাপার মেয়েদের বলতে নেই। আমি বিয়ে করিনি, কিন্তু বলতে পারি কোনটা পরিবারকে বলতে আছে আর কোনটা বলতে নেই–

–কিন্তু একদিন না একদিন তো জানতে পারবেই।

–তুমি নিজে না বললে কী করে জানতে পারবে? মেয়েমানুষরা টাকা পেলেই খুশী। কোত্থেকে টাকা আসছে সেকথা জানতে চাইবে না তারা।

নিখিলেশ বললে–আমার গিন্নী আবার সেরকম নয় ভাই। ভয়ানক সেন্টিমেন্টাল। এক একদিন আমার সঙ্গে এমন রাগারাগি করে যে কী বলবো! অথচ কলকাতায় তার বাড়ি করার খুব শখ। আমারও শখ, তারও শখ–

শীতেশ বললে–সকলেরই তাই।

নিখিলেশ বললে–কিন্তু কলকাতায় বাড়ি করতে গেলে টাকা খরচ তো কমাতে হবে। সেটা পারে না। নইলে এতদিনে আমার অনেক টাকা জমে যেত ভাই! ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বলে তো এখন আমাদের কিছুই নেই।

শীতেশ বললে–এখন থেকে জমাতে চেষ্টা করো তাহলে। তোমরা নেশা-ভাঙও করো না, কিছুই না, তাহলে দু’জনের মাইনের টাকাটা যায় কোথায়?

–সে ভাই একজনের অসুখে সব জমানো টাকা খরচ হয়ে গেল।

–অসুখ? কার? তোমাদের আবার কে আছে?

নিখিলেশ বললে–আমাদের নিজের কেউ না।

–নিজের কেউ না তো তার অসুখে তোমরা টাকা খরচ করতে গেলে কেন?

–সেও কপাল। আমার স্ত্রীকে বিয়ের সময় একটা সোনার হার গড়িয়ে দিয়েছিলুম, সেটা পর্যন্ত বাঁধা পড়ে গেল, আর ছাড়াতে পারলাম না। খরচ যে কোথা দিয়ে কী ভাবে কী উপলক্ষে হয়ে যায় কিছুই বুঝতে পারি না। অথচ রোজ কালিয়া-পোলাও খাই তাও নয়। এখন আমি দোষ দিই গিন্নীকে, আর গিন্নী দোষ দেয় আমাকে। তাই তো ঠিক করেছি চাকরি করে কিছু হবে না।

ততক্ষণে শেয়ালদ’ স্টেশনে এসে গিয়েছিল দুজন। শীতেশ বললে–আজকে একটু হবে নাকি?

নিখিলেশ বললে–না হে, ও-সব আর ছোঁব না–

–কেন? কী হলো আবার?

নিখিলেশ বললে–আমার স্ত্রী ঠাকুরের নাম করে আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে জীবনে আর কখনও মদ-টদ যেন না ছুঁই

শীতেশ বললে–এই জন্যেই তো আমি বিয়ে করি নি ভাই, বিয়ে করলে আমিও তোমার মত বউ-এর ভেড়ুয়া হয়ে যেতুম–

তারপর আর দাঁড়ালো না শীতেশ। সে তার নিজের গন্তব্যস্থানে চলে গেল।

বাড়িতে নয়নতারা নিখিলেশের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। নিখিলেশকে দেখেই জিজ্ঞেস করলে কী হলো? কিছু ঠিক করলে?

নিখিলেশ বললে—না–

–কেন? এতক্ষণ তা হলে কী করলে? কোথায় গেলে?

–গেলাম তো অনেক জায়গায়, কিন্তু আসলে তো টাকা! পাঁচ হাজার টাকা না হলে কোনও ব্যবসাতেই নামা যায় না। টাকাটা কোথায় পাবো?

কথাটা দুজনেরই জানা ছিল। টাকা না হলে যে কিছু হয় না এটা এমন কিছু নতুন কথা নয়। তবু নিখিলেশের একটা ক্ষীণ আশা ছিল হয়ত শীতেশ এমন একটা পথ বলে দিতে পারবে যাতে কম টাকা লাগে। শীতেশ কলকাতায় থাকে, কলকাতাতেই জন্মেছে, সে অনেক লোককে চেনে। এককালে শীতেশদের অবস্থা ভালো ছিল। ভাইরাও বড়লোক। কেবল সে-ই একলা আলাদা হয়ে আছে, আর চাকরি করে যা উপায় করে তা দু হাতে উড়িয়ে দেয়। নিজে বড় হয়নি, বড় হতে তার ইচ্ছেও নেই।

নয়নতারা বললে–কিন্তু টাকা তো ধারও পাওয়া যায়—

নিখিলেশ বললে–তাও তো ভেবেছি, কিন্তু শেষকালে যদি ব্যবসাতে লোকসান যায়? তখন যে একুল-ওকুল দুকুল যাবে! তার চেয়ে আগে বরং ভেবে-চিন্তে নামাই ভালো–

–তা হলে কীসের ব্যবসা করবে?

নিখিলেশ বললে–সে না-হয় ভেবে-চিন্তে একটা বার করা যাবে, কিন্তু টাকাটা কোথায় পাবো তাই আগে ভাবছি–

–ধরো আমার গয়নাগুলো যদি বেচে দিই তো কত টাকা আসবে?

–তুমি গয়না বেচে দেবে! যে গয়নাটা স্যাকরার দোকানে বাঁধা রয়েছে সেটাই তো এখনও ছাড়িয়ে আনা হলো না

নয়নতারা বললে–টাকা হলে আবার গয়না হবে, কিন্তু এখন তো কাজে লাগুক, আমাদের অফিসের মালা বোসও তো প্রথমে গয়না বিক্রি করে দিয়েছিল। এখন আবার নতুন-গয়না কিনে নিয়েছে–

কিন্তু গয়না বলতে নয়নতারার আছেই বা কী? চার গাছা করে চুড়ি দু’হাতে আর একখানা সরু চেন-হার। সব মিলিয়ে বড় জোর তের-চোদ্দ ভরি। একশো দেড়শো টাকা করে সোনার ভরি। বেচলে দেড় হাজার টাকাও হয়ত পাওয়া যাবে না। অথচ বিয়ের সময় কত সোনা ছিল তার! শ্বশুর একটা হীরের সীতাহার দিয়ে তার মুখ দেখেছিল। শাশুড়ীও দিয়েছিল একজোড়া জড়োয়ার বালা। হীরে-পান্না সেট করা। আরো কত গয়না পেয়েছিল, তার কি আর হিসেব আছে। সেদিন কি নয়নতারা জানতো যে সে আবার বিয়ে করবে! আবার সংসার হবে তার! সে কি জানতো যে তাকে চাকরি করতে হবে কোনও দিন? নাকি জানতো যে পাঁচ হাজার টাকার জন্যে আবার একদিন তার গয়না বাঁধা দেবার দরকার হবে!

সকালবেলা নিখিলেশ ঘুম থেকে উঠতেই নয়নতারা বললে–আচ্ছা সেদিন তুমি নবাবগঞ্জে গেলে তো আমার গয়নাগুলো চাইলে না কেন?

নিখিলেশের মনে ছিল না। বললে–আমি নবাবগঞ্জে গেলুম! কবে?

–বাঃ, তোমার মনে নেই? তুমিই তো বললে–তুমি নবাবগঞ্জে গিয়েছিলে। তোমাকে দেখে সে আমার কথা জিজ্ঞেস করলে–

এতক্ষণে মনে পড়লো নিখিলেশের। সে যে মিথ্যে কথা বলেছিল সেটা তার মনে ছিল না।

বললে–হ্যাঁ, জিজ্ঞেস করলেই তো। জিজ্ঞেস করলে নয়নতারা কেমন আছে!

–তা তুমি কী বললে?

–কী আর বলবো! বললুম তুমি ভালো আছো!

–তারপর?

–তারপর আর কী! মনে হলো বাড়ির ভেতরে বোধ হয় লুচি-ভাজাটাজা হচ্ছে।

নয়নতারা বললে–তা তখন আমার গয়নার কথাটা তুললে না কেন? বললে না কেন যে নয়নতারার গয়নাগুলো দিন–

নিখিলেশ এর জবাবে কী বলবে তা বুঝতে পারলে না। একটু ভেবে নিয়ে তখনই বললে–সেটা আমি বলবো ভেবেছিলুম কিন্তু আবার ভাবলুম শেষে যদি কিছু অপমান করে। গাল বাড়িয়ে চড় খেতে যাবো?

নয়নতারা বললে–বা রে, ও তো আমারই জিনিস, আমার বিয়ের সময় ও-সব তো আমাকেই দেওয়া হয়েছিল, সুতরাং ওটা তো আমারই প্রাপ্য!

নিখিলেশ বললে–দেখ, একবার গয়না চেয়ে আমি যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছি, তার পর আর কোন্ সাহসে চাই? তাই আর আমি কিছু বললাম না, যেমন গিয়েছিলুম তেমনি আবার চলে এলুম–

নয়নতারা বললে–তা আমার গয়না চাইতে যদি তোমার এতই লজ্জা তো আমিই যাবো, আমি নিজে গিয়ে আমার গয়নাগুলো চেয়ে আনবো–

–তুমি যাবে?

নিখিলেশ মনে মনে ভয় পেয়ে গেল। যদি সত্যি সত্যিই নয়নতারা নবাবগঞ্জে যাবার জন্যে জেদ ধরে, তখন?

নিখিলেশ বললে–ছি ছি, তুমি কেন যাবে? তুমি সেখানে গেলে লোকে কী বলবে বলো তো?

নয়নতারা বললে–লোকে যা ইচ্ছে বলুক গে, তাতে আমার কী এল গেল?

নিখিলেশ বললে–তবু, তুমি তো এককালে সেবাড়ীর বউ ছিলে, আবার দ্বিতীয়বার বিয়ে করছে, এসব দেখতে পেলে তারাই বা কী বলবে বলো দিকিনি! সে তো আর কলকাতাও নয়, নৈহাটিও নয়, সে একেবারে অজ পাড়া-গাঁ, তারা যখন তোমাকে জিজ্ঞেস করবে এতদিন কোথায় ছিলে, তখন কী বলবে? একদিন তুমিই তো সকলের সামনে বড় গলা করে শ্বশুর-শাশুড়ীকে কত কথা শুনিয়ে এসেছিলে, নিজের সিঁথির সিঁদুর ঘষে মুছে ফেলেছিলে, হাতের শাঁখা-নোয়াও ভেঙে ফেলেছিলে, এখন আবার তাদেরই কাছে মাথা নিচু করে হাত পাততে তোমার লজ্জা করবে না?

নয়নতারা বললে–হাত পাতার কথা বলছো কেন? আমি কি সেখানে দয়া ভিক্ষে করতে যাচ্ছি, আমার নিজের জিনিস চাইব তাতে লজ্জা কী? আমি তো পরের জিনিস চাইছি না–

–না, তবু তারা ভাববে টাকার অভাবে তুমি তাদের কাছে মাথা নীচু করছো! ভাবলেই হলো। তাদের ভাবনা তো তুমি আটকাতে পারছো না–

নয়নতারা বললে–তারা যা খুশী ভাবুক। আর সত্যি কথা বলতে কী, টাকারও তো আমাদের দরকার। এই যে আজ নৈহাটি থেকে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করছি, এখন কলকাতায় একটা বাড়ি থাকলে আমাদের কত সুবিধে হতো বলে দিকিনি। সে-গয়না-গুলো বেচলে তার দাম অন্তত কম করেও পঞ্চাশ হাজার টাকা তো বেকসুর হবে! আর সেই টাকা দিয়ে ছোটখাটো একটা বাড়ি কেনার পরও বাকি যা টাকা থাকবে তাই দিয়ে কোনও ব্যবসা ট্যবসাও তো করতে পারি আমরা। তারা বড়লোক, তাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা থাকলেই বা কী আর গেলেই বা কী!

নিখিলেশ বললে–তা সদানন্দবাবু যখন আমাদের বাড়িতে ছিলেন তখন গয়নার কথাটা একবার তুললেই পারতে। তা হলে আর এখন তোমাকে সেগুলো চাইতে সেখানে যেতে হতো না–

–আমার মনে ছিল না তখন। তুমি আমায় মনে করিয়ে দিলেই পারতে!

নিখিলেশ বললে–আমি তোমায় গয়নার কথা মনে করিয়ে দেব! তাহলেই হয়েছে। তখন তোমার যা মেজাজ, তোমার মুখ দেখতেই তো আমার ভয় হতো।

–কী যে তুমি বলো তার ঠিক নেই, একটা রোগী মানুষকে একটু সেবা করবো না বলতে চাও? মরো-মরো লোকটাকে বাঁচিয়ে তুলেছি, সেইটেই আমার মস্ত অপরাধ হলো?

নিখিলেশ বললে–থাক থাক, সে-সব পুরোন কথা আর না তোলাই ভালো, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, ল্যাঠা চুকে গেছে। এখন ও নিয়ে আর তেতো করার দরকার নেই–

নয়নতারা বললে–না, তেতো করছি না। কিন্তু আমি নবাবগঞ্জে যাবোই। কাল ছুটি আছে, কালই ভোরবেলার ট্রেনে এখান থেকে বেরিয়ে যাবো। তারপরে আবার দুপুরবেলার ট্রেনে ফিরে আসবো। বাড়িতে এসে খাওয়া-দাওয়া করবো। ওরা যদি খেয়ে যেতেও বলে তো তুমি যেন আবার রাজি হয়ে যেও না। যাদের বাড়ি একদিন ঘেন্নায় ছেড়ে এসেছি তাদের বাড়িতে জলগ্রহণ করাও পাপ–

তারপর গিরিবালাকে ডেকে নয়নতারা বলে দিলে–গিরিবালা, আমরা কালই ভোরের ট্রেনে বেরিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে আর সকাল-সকাল উনুনে আঁচ দিতে হবে না, আমরা বাইরেই চা খাবো। তুমি বেলা হলে ধীরে-সুস্থে নিজের চা করে নিও। আমরা বিকেলে বাড়ি এসে ভাত খাবো–

নিখিলেশ আপত্তি করতে গেল। বললে–কালকে না-ই বা গেলে–পরে না-হয় কোনও দিন যাওয়া যাবে’খন, এত তাড়াতাড়ি কীসের–

নয়নতারা বললে–না, আমি কালকেই যাবো, তোমাকে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠিয়ে দেব–

বড় মুশকিলে পড়লো নিখিলেশ। নয়নতারা যেরকম জেদী মেয়ে, সে যখন একবার নবাবগঞ্জে যাবো বলে মন করেছে তখন সে যাবেই। তাকে আর ঠেকানো যাবে না। কেন যে সেদিন নিখিলেশ মিথ্যে করে বলতে গিয়েছিল যে সে নবাবগঞ্জে গিয়েছিল। তখন যদি জানতো যে নয়নতারা একদিন তার সেই কথা বিশ্বাস করে নিজেই নবাবগঞ্জে যেতে চাইবে, তাহলে কি অমন করে মিথ্যে কথা বলে নয়নতারার মন ফেরাতে চাইতো!

ভোর তখনও হয়নি ভালো করে। চারিদিকে বেশ অন্ধকার। নয়নতারা নিখিলেশকে ঠেলতে লাগলো–ওগো, ওঠো–ওঠো–দেরি হয়ে যাবে—ওঠো–

নিখিলেশ আর শুয়ে থাকতে পারলে না, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। কিন্তু তার বড় ভয় করতে লাগলো। নবাবগঞ্জে গিয়ে সে কী দেখবে কে জানে! সদানন্দবাবু যদি শেষ পর্যন্ত সেখানে না থাকে! যদি সেখানে কেউই না থাকে, তখন?

ততক্ষণে ট্রেন আসবার সময় হয়ে যাচ্ছিল। নয়নতারার সঙ্গে নিখিলেশও সেই অস্পষ্ট অন্ধকার রাস্তায় পা বাড়িয়ে দিলে।

.

সেই ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গে দেশের ইতিহাস ভূগোল সব কিছুই আস্তে আস্তে বদলে গিয়েছিল। সব চেয়ে বদলে গিয়েছিল কলকাতা শহরটা। দু’শো বছরের জঞ্জাল কি সহজে পরিষ্কার হয়। কিন্তু তবু যতটুকু পরিষ্কার হবার হয়ত তা হয়েছিল। কিন্তু নবাবগঞ্জে তার কিছুই হয় নি। তখনও রেলবাজারে ট্রেন এসে থামলেই সামনে কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে খদ্দেরের আশায়। রিকশার খদ্দের তেমন হয় না। হলেও কাছাকাছি তার পরিধি।

কিন্তু নবাবগঞ্জের খদ্দের বড় একটা থাকে না। থাকে কালে-ভদ্রে। নবাবগঞ্জে রিকশা চড়ার লোক তেমন নেই। নবাবগঞ্জ তখনও সেই আগেকার মোগল আমলেই আটকে ছিল, আগে বাস যেমন চলতো তেমনি তখনও চলতো। কিন্তু সে বাস নবাবগঞ্জ ছুঁয়ে যেত না। নবাবগঞ্জের পাশ দিয়ে সোজা চলে যেত একেবারে বাজিতপুরের দিকে। কারো অসুখ হলে যেতে হবে সেই রেলবাজারে। ছেলেরা লেখাপড়া করবে তাও যেতে হবে রেলবাজারের ইস্কুলে কলেজে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও নবাবগঞ্জ তাই তখনও একটা পাণ্ডববর্জিত দেশ হয়েই বিরাজ করছিল।

বারোয়ারিতলার নিতাই হালদারের দোকানের মাচায় বসে তখনও সেই আগেকার মত তাস খেলা চলে। বেহারি পালের মুদিখানার সামনে তখনও খদ্দেররা তেল-হলুদ-মশলা কোরোসিন তেলের সওদা করে।

হঠাৎ পরমেশ মৌলিকের নজর পড়ল। রিকশায় কারা যায়।

 রিকশাওয়ালাকে উদ্দেশ্য করেই পরমেশ মৌলিক জিজ্ঞেস করলে–কোথাকার যাত্রী গো?

রিকশাওয়ালা জবাব দিলে—নবাবগঞ্জের–

নবাবগঞ্জে কাদের বাড়ি?

–চৌধুরীবাড়ি।

চৌধুরীবাড়ির নাম শুনেই সবাই অবাক। চৌধুরীবাড়ি তো ভূতের বাড়ি। ছোটমশাই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে কবে সুলতানপুর চলে গিয়েছিল সে-খবর কি এরা জানে না? আর সেই চৌধুরী মশাইও তো কবে মারা গেছে। শালাবাবু এসে সে খবরও একদিন দিয়ে গিয়েছিল। তাহলে এরা এতদিন পরে কার খোঁজ নিতে এসেছে।

নিতাই হালদার, গোপাল ষাট, কেদার, তারাও এবারে কৌতূহলী হয়ে উঠলো। রিকশার সামনে পর্দা দিয়ে ঢাকা রয়েছে। ভেতরে মেয়েছেলের আধখানা মুখ দেখা যাচ্ছে।

গোপাল ষাট বললে–ভেতরে কারা?

রিশার ভেতরে বসে নিখিলেশ বললে–দেখেছ, কী কাণ্ড! এদের সব কিছু জানা চাই, না জানলে এরা ছাড়বে না–

বলে পর্দাটা সরিয়ে দিয়ে নিজের মুখ বাড়ালো নিখিলেশ। জিজ্ঞেস করলে চৌধুরীবাড়িতে কেউ নেই?

পরমেশ মৌলিক সে কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলে–আপনারা কোত্থেকে আসছেন?

–আমরা আসছি নৈহাটি থেকে। এখানে সদানন্দবাবু আছে?

নিতাই হালদার, গোপাল ষাট আরো অবাক। এই তো কদিন আগে শালাবাবু এসে সদার খোঁজ করেছিল। আবার এরা তার খোঁজে এসেছে কেন? এদেরও কি টাকার লোভ?

নয়নতারা বললে–কই, তুমি যে বলেছিলে সে নবাবগঞ্জে থাকে, তুমি এসে তার সঙ্গে দেখা করেছ?

সমস্ত ব্যাপারটা যেন নয়নতারার কাছে কেমন গোলমেলে মনে হলো।

নিখিলেশ কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না। তারপরে বললে–বোধ হয় সদানন্দবাবু কোথাও চলে গিয়েছেন। আমি যখন এসেছিলুম সেদিন তো ছিলেন–

পরমেশ মৌলিক বললে–সে তো আজ ক’বছর হলো নিরুদ্দেশ মশাই, অনেক বছর গাঁয়ে আসে নি, আপনারা কি নতুন এলেন নাকি?

সে কথার জবাব না দিয়ে নিখিলেশ রিকশাওয়ালাকে বললে–চলো চলো রিকশাওয়ালা, তুমি চলো–

কিন্তু নয়নতারা বললে–না, যাবে না, থামাও–

বলে নয়নতারা নিজেই রিকশা থেকে নেমে পড়লো হঠাৎ। নেমে একেবারে নিতাই হালদারের দোকানের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালো।

বললে–সদানন্দবাবু কি এখানে থাকেন না?

 নিতাই হালদার তখন যেন সামনে ভূত দেখেছে! এ সেই সদানন্দর বউ না? পরমেশ মৌলিকও চিনতে পেরেছে। বিস্ময়ে কৌতূহলে সকলের মুখ-চোখ তখন হাঁ হয়ে গেছে। সেদিনকার বউরানীকে যে হঠাৎ এই পরিবেশে দেখতে পাবে তা তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। কারোর মুখ দিয়ে তখন আর কোনও কথা বেরোচ্ছে না।

ওদিকে বেহারি পাল মশাইও তার দোকান থেকে মুখখানা দেখে চিনতে পেরেছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ছুটে গিয়েছে গিন্নীর কাছে।

–ওগো, কোথায় গেলে তুমি? কারা এসেছে দেখে যাও—

সমস্ত বারোয়ারিতলায় তখন যেন একেবারে বিদ্যুৎ খেলে গেছে। এমনিতে নবাবগঞ্জ শান্ত-শিষ্ট জায়গা। তাদের জীবনে কোথাও কোনও বৈচিত্র্য থাকে না। চমকে ওঠবার মত ঘটনা ক্বচিৎকদাচিৎ ঘটে। সকালে সূর্য আকাশে উঠতে হয় বলেই ওঠে, আর সন্ধ্যে হয় বলেই যেন তা ডোবে। সদার বউকে সশরীরে এমনভাবে বারোয়ারিতলার মধ্যে দেখা যাবে তা ভাবাই যায় নি। সঙ্গে সঙ্গে তাসের সাহেব-টেক্কা-বিবি তাদের মাথায় উঠেছে। তার বদলে একেবারে জলজ্যান্ত-সাহেব বিবি তাদের সামনে এসে উদয় হয়েছে যেন।

–কেন, চৌধুরীদের কেউ নেই বাড়িতে?

চৌধুরীদের বাড়িটা বারায়ারিতলা থেকেই দেখা যাচ্ছিল। সামনে বন-জঙ্গল, বাড়ির গায়ে অশ্বত্থ গাছ জন্মে ছায়া করে রেখেছে। যেন ভুতের বাড়ির চেহারা নিয়েছে সেটা।

নিতাই হালদার বললে–আজ্ঞে, তাঁরা মারা গেছেন, ছোটমশাই-এর গিন্নীও মারা গেছেন, ছোট মশাইও ভাগলপুরে মারা গেছেন, আর তাঁর ছেলে সদা, সদানন্দ, সেও তো নিরুদ্দেশ–

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। বললে–নিরুদ্দেশ! এখানে নেই? তবে যে শুনেছিলুম তিনি এখন এখানে থাকেন–

-আপনি ভুল শুনেছেন, কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে ভুল শুনিয়েছে। সে তো বহুকাল নিরুদ্দেশ! একবার শুধু গাঁয়ে এসেছিল, তাও সে আজ অনেক দিন হয়ে গেল। তারপরে রেল বাজারের প্রাণকেষ্ট সা’মশাই এ বাড়ি কিনে নিয়েছিলেন, কিন্তু তারও তা সহ্য হলো না। কেনার দুদিন পরেই অপঘাতে মারা গেছেন। এখন তো এবাড়ি একরকম বেওয়ারিশই পড়ে আছে–

কথাগুলো শুনে নয়নতারা হঠাৎ নিখিলেশের দিকে ফিরলো। বললে–কই, তুমি যে বলেছিলে বাড়ির চেহারা নতুন হয়ে গেছে–

নিখিলেশ আমতা আমতা করতে লাগলো। হয়ত ভেবেচিন্তে একটা কিছু জবাব দিত, কিন্তু তার আগেই তাকে বাঁচিয়ে দিলে বেহারি পালমশাইএর বউ।

খবরটা পেয়ে বেহারি পালের বউ ঘোমটা দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। ‘বউমা’ বলে ডাকতে ডাকতে একেবারে সামনের দিকে এগিয়ে আসছিল। নয়নতারাও সামনে যেতেই বেহারি পালের বউ তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

–ওমা, কতদিন পরে তুমি এলে বউমা!

নয়নতারা বললে–আপনি কেমন আছেন দিদিমা–

দিদিমা তখন নয়নতারাকে টানতে টানতে একেবারে বাড়ির অন্দর মহলে নিয়ে গিয়ে তুলেছে। নিখিলেশ বাইরে রিকশাতে বসে রইল।

বাড়িতে ভেতরে গিয়ে দিদিমা অনেক কথা উজাড় করে দিতে লাগলো। কথা বলতে বলতে দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো তার। বেহারি পালের ছেলেমেয়ে কিছু নেই। নয়নতারা যখন নবাবগঞ্জে বউ হয়ে এসেছিল তখন তাকে নিজের মেয়ের মত করেই ভালাবেসেছিল বেহারি পালের বউ। সে আজ এতদিন পরে ফিরে এসেছে এ আনন্দ যেন রাখবার জায়গা নেই তার। নয়নতারা বললে–এদের বাড়িতে কেউ নেই কেন দিদিমা?

দিদিমা বললে–আর কে থাকবে বউমা? থাকবার আছেটা কে! তুমিও চলে গেলে আর সেই থেকেই ভাঙন শুরু হলো। সেই থেকে ওটা ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে আছে–

নয়নতারা আর কী বলবে এ-কথার জবাবে। সে যে সদানন্দর কাছ থেকে তার গয়নাগুলো চাইতে এসেছিল তা আর মুখ ফুটে বলা হলো না।

নয়নতারা বললে–আমি তাহলে আসি দিদিমা

দিদিমা বললে–সে কি বউমা, এতদিন পরে এলে আর এমনি হুট করে এসেই চলে যাবে?

–না, আমার সঙ্গে লোক আছে, রিকশায় বসে আছে, আমার আবার ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। যেতে হবে সেই নৈহাটিতে, ঝিকে রান্না করে রাখতে বলে এসেছি–

নৈহাটি? কেন বউমা, নৈহাটিতে আবার কে আছে তোমার?

নয়নতারা বললে–-নৈহাটিতেই তো এখন থাকি আমি দিদিমা। বিয়ে করার পর তো আমি নৈহাটিতেই আছি। আমরা দুজনে কলকাতায় চাকরি করি আর ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করি নৈহাটি থেকে–

কথাটা শুনে দিদিমা যেন কেমন আকাশ থেকে পড়লো। নয়নতারার মুখের দিকে আরো তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখলে। সত্যিই তো, নয়নতারার সিঁথিতে সিঁদুর উঠেছে। হাতে আবার নোয়া। অথচ…

নয়নতারা তখন আর বসলো না। তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে সোজা একেবারে বাইরে এসে দাঁড়ালো। নিখিলেশ তখন চুপ করে রিকশাটার ওপর বসেছিল। নয়নতারা রিকশায় উঠেই সোজাসুজি বলে উঠলো তুমি আমাকে সব মিথ্যে কথা বলেছিলে? বলল, কেন মিথ্যে কথা বলেছিলে? এখানে তো কেউ থাকে না! সে-ও তো এখানে নেই। তাহলে কেন তুমি বলেছিলে যে বাড়ি নতুন করে সারিয়েছে, বাড়িতে খুব ধুম-ধাম চলেছে, ভেতর থেকে লুচি ভাজার গন্ধ আসছে। আমাকে ভোলাবার জন্যে বলেছিলে? বলো? কথা বলছো না কেন, জবাব দাও–

রিকশাটা আবার তখন সেই বরোয়ারিতলার পথ দিয়ে রেলবাজারের দিকে চলতে আরম্ভ করেছে।

নয়নতারা বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগলে–বলো, কেন তুমি আমাকে অমন করে ঠকিয়েছিলে? সে ভালো থাকলে আমি খুশী হবো বলে, না আমাকে তুমি ওই বলে ভোলাতে চেয়েছিলে, বলো? আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? জবাব দাও?

রিকশাওয়ালা তখন ধুলোকাদার মধ্যে প্রাণপণে রিকশাটা টানতে টানতে নিয়ে চলেছে।

নয়নতারা আবার বলতে লাগলোবলো, জবাব দাও, এতদিন তুমি তাহলে আমাকে যা-কিছু বলে এসেছ সবই মিথ্যে? সমস্ত মিথ্যে কথা? কিন্তু আমি এতদিন সরল মনে তোমার সব মিথ্যে কথাগুলো বিশ্বাস করেছিলুম যে। তুমি এত মিথ্যেবাদী?

নয়নতারা আবার জিজ্ঞেস করলে কই, তুমি জবাব দিচ্ছ না যে?

নিখিলেশ বললে–দেখ, আমি তোমাকে মিথ্যে বলি নি, আমি যা শুনেছিলুম তাই-ই তোমাকে বলেছি, আমি একটু বাড়িয়েও বলি নি, কমিয়েও বলি নি–

নয়নতারা বললে–আবার তুমি মিথ্যে কথা বলছো? নিজের দোষ স্বীকার করতে তোমার এত লজ্জা? তুমি কী মনে করো কী? তুমিই একমাত্র চালাক আর সবাই বোকা? তুমি বোধ হয় ভেবেছিলে ওই কথাগুলো বললে আমি সদানন্দবাবুর ওপরে খুব চটে যাবো, না? ভেবেছিলে আমার মন ওর দিকে আর চলবে না, না? কিন্তু তুমি একবারও তো ভাবলে না যে তা কখনও সম্ভব হতে পারে না! আশ্চর্য, সে আর তুমি? তার সঙ্গে তুমি নিজের তুলনা করো? সে মানুষ নয় তা জানো, সে একজন দেবতা, তোমার মত জানোয়ার পশু নয় সে—

.

এমন কী নৈহাটিতে ফিরে এসেও নয়নতারার রাগ গেল না। যতক্ষণ ট্রেনে ছিল সমস্ত রাস্তায় একটা কথাও বললে না নয়নতারা। আস্তে আস্তে নিখিলেশ নয়নতারার মনটা স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে সবে মাত্র একটু সফল হয়েছিল। অনেক মিথ্যে কথা অনেক স্তোকবাক্য বলে মাত্র একটু শান্ত করেছিল নয়নতারাকে, তাও বিগড়ে গেল একদিনের মধ্যে।

শীতেশ সেদিন বললে–কী হে, আবার মন-মরা কেন? আবার কী হলো?

নিখিলেশ বললে–কিছু ভালো লাগছে না ভাই–

শীতেশ বরাবর বেপরোয়া মানুষ। বললে–মনকে প্রশ্রয় দিও না ভাই, মনকে একটু প্রশ্রয় দিয়েছ কী ওমনি সে-বেটা পেয়ে বসবে। সেই জন্যেই তো আমি মদ খাই হে। মদ খেলেই মন বাছাধন একেবারে জব্দ!

তারপর খানিক পরে আবার বললে–জানো, সেদিন মানদা মাসি তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল বলছিল আর একদিন তোমাকে নিয়ে যেতে–

নিখিলেশ বললে–আমি গিয়ে আর কী করবো ভাই, টাকা যোগাড় না করতে পারলে আমার সেখানে গিয়ে কী লাভ?

শীতেশ বললে–টাকা লোন নাও, ধার করো।

নিখিলেশ বললে–ধার শুধবো কী করে? ধার নিতে ভয় করে যে আমার। শেষকালে দেনার দায়ে একুল-ওকুল দুকুল যাবে যে।

–সে কী হে? কারবার করতে গেলে ধার না নিলে চলে? কে না ধার নেয়? টাটা ধার নেয় না? বিড়লা ধার নেয় না। এদিকে বড়লোক হবার ইচ্ছে আছে, ওদিকে আবার ধার নিতেও ভয়। ওকেই তো বলে মিডল-ক্লাস মেন্টালিটি! যদি বলো তো কম সুদে টাকা তোমাকে ধার পাইয়ে দিতে পারি আমি।

নিখিলেশ বললে–না ভাই, ওদিকে তুমি আমাকে লোভ দেখিও না—

সত্যিই তো, মধ্যবিত্ত সমাজের ছেলে নিখিলেশ। টাকা ধার করে সে পথে বসবে নাকি! এককালে দেশ-সেবা করবে বলে জীবন আরম্ভ করেছিল, তারপর কোথা দিয়ে কোন্ পাকে চক্রে পড়ে এখন কেরানীতে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আগেকার জীবনের সেই বড় বড় স্বপ্ন কোথায় চলে গেল! এখন আর সেই আদর্শবাদ নেই, সেই উদারতাও নেই তার। আগে কত দিকে চাঁদা দিয়ে টাকা বিলিয়ে দিয়েছে। মানুষের উপকার করবার সেই অলীক বিলাসিতাও কখন মন থেকে উবে গিয়েছে। এখন মনে হয় সবাই শুধু স্বার্থপর। আর সকলেই যখন স্বার্থপর তাহলে সে-ই বা স্বার্থপর না হবে কেন?

অফিস থেকে বেরিয়েও বাড়ি ফেরার আর কোনও তাড়া থাকে না তার। আগে ছুটতে ছুটতে যেতে হতো নয়নতারার অফিসে। যতক্ষণ না নিখিলেশ গিয়ে পৌঁছত ততক্ষণ নয়নতারা অফিসের সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন আবার নয়নতারা অফিসে আসা বন্ধ করেছে। এখন থেকে আর সে চাকরি করবে না বলেছে।

বলেছে–আমার চাকরি করবারও দরকার নেই, আর আমার টাকারও দরকার নেই। তুমি যখন আমাকে বিয়ে করেছ তখন আমাকে খাওয়ানো-পরানোর সমস্ত দায়িত্ব তোমার।

নিখিলেশ বলেছে–আমি তো বলছি আমাকে তুমি ক্ষমা করো–

নয়নতারা বলেছে তুমি আমার যা ক্ষতি করেছ এর পরে তোমার ক্ষমা চাইতে লজ্জা করে না? তুমি মনে করেছ তুমি একটার পর একটা দোষ করে যাবে আর আমি তোমাকে ক্ষমা করবো? দোষ করারও একটা সীমা থাকে মানুষের। তুমি কি সে সীমা রেখেছো যে তোমাকে আমি ক্ষমা করবো? আর ক্ষমা করবার কথা উঠছেই বা কেন? আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রাখারই বা কী দরকার? আমাকে তুমি ছেড়ে দাও না

–ছেড়ে দেব মানে?

–হ্যাঁ ছেড়ে দাও। আজকাল তো সে-আইনও হয়েছে। আর তুমি যদি ছাড়তে না পারো তো আমিই না হয় তোমাকে ছেড়ে চলে যাই।

–কোথায়? কোথায় যাবে তুমি?

–আমার যেখানে খুশি আমি চলে যাবো, তোমাকে তা বলবো কেন? আমার অনেক সাধ ছিল আমি সংসার করব। কিন্তু ভগবানের যখন তা ইচ্ছে নয়, তখন আর মিছিমিছি সে চেষ্টা কেন? আজকাল তো কত মেয়ে বিয়ে না করে একলা রয়েছে, আমিও না হয় সেই রকম একলা-একলাই জীবন কাটিয়ে দেব। মনে করে নেব আমার কেউ নেই–

নিখিলেশ বলেছে–না না, ও-সব কাণ্ড করতে যেও না, লোকে হাসাহাসি করবে

–তুমি থামো, লোকের হাসিটা বড় না মানুষের জীবনটা বড়? বাইরের লোক কী বললে না-বললে–তা নিয়ে ভাবতে আমার বয়ে গেছে–। মানুষের সহ্যেরও একটা সীমা আছে।

নিখিলেশ কাছে গিয়ে তাকে আদর করতে গেছে। বলেছে–শোন, শোন, ও-সব নিয়ে আর ভেবো না, যত ভাববে তত মাথা গরম হয়ে যাবে–

নয়নতারা তার হাতখানা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। বলেছে সরো তুমি, তোমার মুখ দেখলেও আমার ঘেন্না হয়—

বলে আর সারাদিন কথা বলে নি নিখিলেশের সঙ্গে। অফিসে যাবার আগে নিখিলেশ রোজ গিরিবালাকে বলে আসতো–তুমি একটু নজরে রেখো গিরিবালা, দিদিমণি যেন কোথাও বেরিয়ে না যায়–

বলে আসতো বটে, কিন্তু অফিসে বেরিয়েও নিখিলেশের মনে স্বস্তি ছিল না। অফিসে কাজ করতে করতেও কেবল বাড়ির কথা মনে পড়তো। যদি সত্যি-সত্যিই নয়নতারা কোথাও চলে যায়!

এক বাড়িতে এক ছাদের তলায় বাস করা অথচ কারোর সঙ্গে কারো বাক্যালাপ নেই। এরকম অবস্থা কতদিন সহ্য করা যায়! নিখিলেশের যেন দম আটকে আসতো।

এক-এক সময় নয়নতারার সামনে গিয়ে দাঁড়াতো। বলতো–কী হলো? এখনও কথা বলবে না?

সেদিন মাঝরাত্রে হঠাৎ কোথায় একটা শব্দ হতেই নিখিলেশের কেমন সন্দেহ হলো। মনে হলো পাশের ঘরের খিল খুলে যেন নয়নতারা বেরিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে পাসের ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দেখলে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিন্তু না, নিখিলেশ বাইরে থেকে কান পেতে শুনলে নয়নতারা ভেতরেই আছে, ঘুমোচ্ছে। মিছিমিছি ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে। আবার গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। আবার বিছানায় গা এলিয়ে দিলে। কিন্তু সারা রাত আর ঘুম এলো না তার। কতদিন এ রকম করে চালানো যায়! কতদিন বাড়িতে কথা না বলে মানুষ বাঁচতে পারে? একদিন কত স্বপ্ন ছিল দুজনের। স্বপ্ন ছিল চাকরি ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা করবে দুজনে। ব্যবসা করে টাকা জমিয়ে বড়লোক হবে। তারপরে সেই টাকায় কলকাতায় একটা নিজস্ব বাড়ি করবে, গাড়ি করবে, মানুষের সমাজের দশজনের মাথায় উঠবে। দশজনের মাথায় উঠে নিজেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। সেই সমস্ত স্বপ্ন সেই দিন থেকে গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেল। অথচ কেন যে চুরমার হয়ে গেল তা কেউ বুঝতে পারলে না, বুঝতে চাইলেও না। কেবল পরস্পরকে দোষারোপ করে পরস্পরে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতে লাগলো।

.

মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের স্বপ্ন হয়ত এমনি করেই সামান্য কারণে ভেঙে যায়। সামান্য কারণেই যেমন আশায় আনন্দে একদিন উত্তাল হয়ে ওঠে, তেমনি আবার সামান্য কারণেই একদিন হতাশার অন্ধকার অতলে তলিয়েও যায়।

তুমি কখনও সুখ পাও নি, স্বাচ্ছন্দ্য পাও নি, সচ্ছলতাও পাও নি। কিন্তু সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখতে তো তোমায় কেউ বারণ করতে পারে না। তাই সাধ তোমার অগাধ। কিন্তু স্বপ্ন যদি তোমার সার্থক না হয় তো হতাশ হওয়াই তো তোমার পক্ষে স্বাভাবিক। সংসারে সবাই তো যিশুখৃষ্ট হয়ে জন্মায় নি, তথাগত বুদ্ধদেব হবার জন্যেও জন্মায় নি। তেমনি সংসারে সদানন্দ হয়েও কেউ জন্মায় না। জীবনে সুখ-দুঃখ-আনন্দ-হতাশা সমস্ত কিছুকেই যে সমান ভাবে গ্রহণ করতে পারে তারই নাম তো সদানন্দ। সুখে থাকলেও সে সদানন্দ, দুঃখে থাকলেও সে সদানন্দ। টাকা থাকলেও সে সদানন্দ, টাকার অভাব থাকলেও সে সদানন্দ। কর্তাবাবু কি আগে থেকেই জানতে পেরেছিলেন তার নাতি সারা-জীবন সদানন্দ থাকবে তাই তার নাম রেখেছিলেন সদানন্দ।

তারিণী চক্রবর্তী তখন বাতে পঙ্গু। চলতে ফিরতে পারেন না। তবু এসেছেন বারোয়ারিতলায়। বেহারি পাল মশাইও এসেছে। কে আসে নি? বহু বছর পরে যেন নবাবগঞ্জে আবার উৎসব লেগে গেছে।

আগের দিন থেকেই আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। ছোটমশাই-এর ছেলে এতদিন পরে গ্রামে এসেছে। গ্রামে আগেও একবার এসেছিল সে। কিন্তু এবার এ অন্যরকম আসা। এবার যে-যত পারো খাও নিতাই হালদার, কেদার সরকার, গোপাল ষাট, পরমেশ মৌলিক কেউ বাদ নেই। ছোটমশাই-এর শ্রাদ্ধের খাওয়াটা বাদ পড়ে গিয়েছিল। সেজন্যে অনেকেরই আফসোস ছিল এতদিন। এবার তাও মিটলো। কর্তাবাবুর নাতি বাপের সম্পত্তি পেয়েছে, লাখ-লাখ টাকার উত্তরাধিকারী হয়েছে! কিন্তু তবু গ্রামের কথা ভোলে নি।

প্রকাশ মামা সেই যে সুলতানপুর থেকে তার পেছু নিয়েছিল তার পর থেকে আর তার সঙ্গ ছাড়ে নি। তার মুখে কেবল একটাই কথা। সে কেবল একটা কথাই বলে চলেছে–সব টাকাটা তুই নিয়ে নিলি সদা?

সদানন্দ বলেছে–না, সবটা নেব না, তোমাকে দশটা টাকা দেব–

–দশ টাকা মাত্তোর? কেন?

সদানন্দ বললে–দশটা টাকা সেই ধর্মশালাতে তোমার কাছ থেকে নিয়ে ছিলুম, সেই টাকাটা।

প্রকাশ মামার মুখটা কালো হলে গেল। বললে–দশটা টাকা নিয়ে আমি কী করবো? তুই পেলি আট লাখ টাকা আর আমি মাত্তোর দশ টাকা? অন্ততঃ চার লাখ আমাকে দে! আমি যে চার লাখ টাকার হিসেব করে রেখে দিয়েছি। চার লাখ টাকার কমে যে আমার কিছুতেই হবে না রে–

সেই সুলতানপুরে ট্রেনে ওঠবার সময় থেকে কেবল এই টাকার কথা নিয়েই সদানন্দর কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। কিন্তু সদানন্দ নির্বিকার। টাকার জন্যে এরকম ভিখিরিপনা সদানন্দর কাছে নতুন নয়। ছোটবেলা থেকে এ-সব দেখতে দেখতে তার কাছে এ-জিনিস পুরোন হয়ে গেছে। সেই ছোটবেলাকার কর্তাবাবু, সেই চৌধুরী মশাই, সেই কপিল পায়রাপোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক থেকে আরম্ভ করে এই প্রকাশ মামা পর্যন্ত সবাই এই টাকারই যন্ত্র। টাকার জন্যেই এদের সৃষ্টি, আর টাকার সৃষ্টিও বোধ হয় এদের জন্যেই। এই টাকার জন্যেই একদিন কপিল পায়রা-পোড়া, মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিক আর কালীগঞ্জের বউকে প্রাণ দিতে হয়ছে, এই টাকার জন্যেই প্রকাশ মামা আজ তার পেছু নিয়েছে।

বৈষয়িক কাজ তো সোজা কাজ নয়। টাকার নিয়মটাই বোধ হয় সেই জন্যে জটিল। কোর্ট থেকে সাকসেশান সার্টিফিকেট নেওয়া, তারপর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলা, তারও অনেক ঝঞ্ঝাট আছে। প্রকাশ মামা এসব ব্যাপারে ওস্তাদ লোক। সদানন্দর কোনও অসুবিধে হতে দিলে না। কিন্তু টাকাটা হাতে পাবার পর থেকেই যেন সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সদানন্দ যেন কেমন হয়ে গেল। একেবারে অন্য মানুষ।

প্রকাশ মামা বলতে লাগলো–কই রে, আমার ভাগের টাকাটা আমাকে দে–

সদানন্দ বললে–তোমার কীসের ভাগের টাকা?

প্রকাশ মামা আকাশ থেকে পড়লো যেন। বললো–বা রে, আমার ভাগের টাকা নেই? আমি তোকে কলকাতা থেকে ডেকে নিয়ে এলুম, তোর টাকার খবরটা দিলুম। আমি খবরটা দিলে তুই টাকার কথা কী জানতে পারতিস?

কিন্তু সদানন্দ তখন প্রকাশ মামার সেকথায় কান দিলে না। টাকাটা নিয়ে সোজা চলে গেছে কলকাতায়। প্রকাশ মামাও পেছন-পেছন গেছে।

সদানন্দ বলে–তুমি কেন আর আসছো প্রকাশ মামা?

প্রকাশ মামা বললে–সে কী রে, আমার ভাগের টাকা যতক্ষণ না পাই, ততক্ষণ তো আসতেই হবে। ভাগের টাকা না-পেলে আমি বাড়িতে গিয়ে বউ-এর কাছে মুখ দেখাবো কী করে?

সদানন্দ বললে–কিন্তু টাকাটা তো তোমার নয় প্রকাশ মামা, টাকাটা তো আমার–

–তা যেমন তোর টাকা, তেমনি তো আমিও ওর কিছু ভাগ পাবো–আমার ভাগের টাকাটা দে আমি চলে যাচ্ছি। তোর সঙ্গে আমি কেন মিছি মিছি ঘুরবো–

কিন্তু সদানন্দর কোনও দিকে কান নেই। একদিন নবাবগঞ্জ থেকে যখন প্রথম জীবন পরিক্রমা করতে বেরিয়েছিল তখনই মানুষ চিনে ফেলেছিল সে। কর্তাবাবুকে চিনেছিল, চৌধুরী মশাইকে চিনেছিল, কালীগঞ্জের বউকে চিনেছিল, রাধাকে চিনেছিল। চিনেছিল প্রকাশ মামাকে। আর শুধু তাদেরই বা কেন, নবাবগঞ্জের সব মানুষকেই চিনে ফেলেছিল সে। তারপর কলকাতার মানদা মাসি থেকে সুরু করে সমরজিৎবাবু কাউকেই চিনতে বাকি ছিল না তার। তারপর সমরজিৎবাবুর বাড়ির সেই পুত্রবধূটি। তারপর ছিল মহেশ, ছিল কত লোক। যে-লোকটা রাস্তায় তার পকেট থেকে টাকা চুরি করে নিয়েছিল তার কথাও তার মনে ছিল। এই সব মানুষ নিয়েই তো এই পৃথিবী। যে-পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে গড়ে তোলবার জন্যে একজনের পর একজন অবতারের আবির্ভাব হয়েছে, একজনের পর একজন মহাপুরুষ হাসি মুখে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, সেই পৃথিবীর মানুষের এই অধঃপতন কেন? কেন এত অবক্ষয়? আজ আর সদানন্দর কোনও সংশয় নেই। কী উদ্দেশ্য সাধন করতে সদানন্দ এই পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিল সেটা এই পরিস্থিতিতে গৌণ হয়ে গেছে। আজকে এমন আবদার সে করবে না যে সে নিজে ভালো আর সবাই মন্দ। ভালো-মন্দর বিচার করার ভার অনির্দেশ্য এক মহাকালের কাছে ছেড়ে দিয়ে সে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু যারা তার শুভাকাঙ্খী, যারা তার চলন্ত পথকে কুসুমাস্তীর্ণ করতে চেয়েছিল তাদের সে মনে রাখবে। মনে রাখার নিদর্শন সে তাদের সকলকে দিয়ে যাবে তার এই অযাচিত অর্থের ভাগ দিয়ে।

বউবাজারের সেই বাড়িটার কাছে আসতেই প্রকাশ মামা বললে––ওরে বাবা, ও বাড়িতে আমি যাবো না–

–কেন?

–না, ও বাড়িতে মানদা মাসি আছে, মাসি টাকার গন্ধ পেয়েছে, আমাকে পেলে আর ছাড়বে না, গিলে খাবে–

কিন্তু সদানন্দর না-গেলে চলবে না, প্রকাশ মামা রাস্তার মোড় পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। বললে–ওরে সদা, তুইও ওখানে যাসনে, মাগী তোর টাকাগুলো সব নিয়ে নেবে

বাড়ির সামনে গিয়ে কড়া নাড়তেই মহেশ বেরিয়ে এল। সদানন্দকে দেখে সে অবাক হয়ে গেছে। এই ক’মাসের মধ্যেই দাদাবাবুর এ কী চেহারা! কত সুন্দর দেখাচ্ছে।

–কাকীমা কোথায় মহেশ?

মহেশের চোখ ছলছল করে উঠলো।

সদানন্দ বললে–কী হলো, কাকীমা ভালো আছে তো?

মহেশ বললে–-বেঁচে আছেন, এই পর্যন্ত দাদাবাবু–

সদানন্দ বললে–আমার একটা কাজ আছে তাঁর কাছে। দেখ, একদিন এই বাড়িতে কাকাবাবু-কাকীমার কাছে অনেক আদর পেয়েছিলুম তা তো তুমি জানো। সেদিন যে আমি এ বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলুম তার জন্যে দায়ী আমি নই মহেশ–

মহেশ বুঝতে পারলে না কথাগুলো। বললে–হ্যাঁ, তা আপনাকে তো বাবু অত করে থাকতে বলেছিলেন–

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তবু থাকতে পারি নি। কাকাবাবুর দেওয়া সমস্ত সম্পত্তি আমি নিতে রাজি হই নি। কেন নিতে রাজি হই নি জানো?

–না।

–তোমাদের বাড়ির বউদিদিমণির কথা ভেবে। তার ভবিষ্যৎ আমি নষ্ট করতে চাই নি। তা আজকে আমি অনেক টাকার মালিক হয়েছি মহেশ, অনেক অনেক টাকা। এত টাকা আমার কোনও কাজে লাগবে না। তার থেকে কিছু টাকা আমি তার নাম করে কাকীমার হাতে দিয়ে যেতে চাই–

বউদিদিমণির নামে?

সদানন্দ বললে–হ্যাঁ, তিনি তো কারো সামনে বেরোন না, কাকীমার হাতে দিলে নিশ্চয়ই তার কাছে পৌঁছোবে!

মহেশ বললে–কিন্তু বউদিদিমণি তো আর নেই–

–নেই মানে? বলতে গিয়ে যেন মহেশের গলা আটকে গেল। একটু ধরা গলায় বললে–তিনি মারা গেছেন দাদাবাবু!

–মারা গেছেন? কবে?

–এই তো দু’মাস হলো। বিয়ে হওয়া এস্তোক তো জীবনে কখনও শান্তি পান নি তিনি–একদিন নিজের হাতেই নিজের প্রাণটা নিয়ে এলেন। আমরা কেউই জানতে পারি নি দাদাবাবু, যখন জানতে পারলুম দেখলুম তিনি আর কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়েছেন–

সদানন্দ শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। অথচ বাঁচার কত শখ ছিল তার। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কত সচেতন ছিলেন। সেই চিঠিটার কথাও মনে পড়লো সদানন্দর! অনেক রাত্রে দরজার তলার ফাঁক দিয়ে সেদিন চিঠিটা তার ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন সদানন্দ চৌধুরী বাড়ি থেকে বিদায় হয়ে গেলেই তার ভবিষ্যৎ নিরঙ্কুশ হয়ে যাবে।

–সেই থেকে মা-ও শয্যেশায়ী হয়ে পড়েছে। বাবু থাকলে তবু একটা কথা বলবার লোক থাকতো তাঁর। বড়দাদাবাবু তো আর মা’র নিজের ছেলে নয়, তা তো আপনি জানেন, ছোটবেলায় এই বড়দাদাবাবুকে বাবু পুষ্যি নিয়েছিলেন, ভেবেছিলেন নিজের ছেলে নেই, পুষ্যি ছেলেই নিজের ছেলের মত বাপ-মাকে দেখবে, তাই ছোটবেলাতেই ওঁর মেয়ের সঙ্গে বড়দাদাবাবুর বিয়ে দিয়েছিলেন–

সমস্তই জানতো সদানন্দ। সমস্তই তার মনে পড়তে লাগলো। হাতের মুঠোর মধ্যে টাকাগুলো তখনও কাঁটার মতন বিধছিল। এই কয়েক হাজার টাকা সে যার ভবিষ্যৎকে সুদৃঢ় করতে এসেছিল সে-ই কিনা নিজে থেকেই চলে গেল।

–আর ওই রাক্ষুসীকে ঘরে এনে তুলেছে বড়দাদাবাবু! সে-ই তো যত নষ্টের গোড়া! কিন্তু আমি তো কিছু বলতে পারি না। আমি পর। আমি বললেই লঙ্কাকাণ্ড বেধে যায়। তাই ভাবি ওই যদ্দিন মা আছেন তদ্দিন আমিও আছি দাদাবাবু, তারপর আমিও এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো–এখানে থাকতে আর আমার ভালো লাগে না–

–কী রে, এতক্ষণ কার সঙ্গে কথা বলছিলি?

হঠাৎ যেন সদানন্দর সম্বিৎ ফিরে এল। প্রকাশ মামাকে দেখে মনে পড়লো সে কখন রাস্তার মোড়ের কাছে এসে পড়েছে। মহেশের সঙ্গে কথা বলা কখন যে শেষ হয়েছে তা তার খেয়ালই ছিল না।

–মাসিকে দেখলি? মাসিকে ওখানে দেখলি নাকি?

সদানন্দ অন্যমনস্ক ছিল। তখনও তার মাথার ভেতরে মহেশের কথাগুলো তোলপাড় করছিল।

বললে–মাসি কে?

প্রকাশ মামা বললে–মাসিকে চিনিস না? সেই কালীঘাটের বস্তির বাড়িউলী মানদা মাসি, তোকে ধরে তোর চরণপূজো করেছিল রে। সেই মানদা মাসি তো ও বাড়িতে রয়েছে বড়বাবুর কাছ থেকে টাকা দুয়ে নেবে বলে। সেই ভয়েইে তো আমি তোর সঙ্গে গেলুম না? তা তোর কাছে টাকা চাইলে না মাসি?

–কীসের টাকা?

প্রকাশ মামা রেগে গেল। বললে–তুই এত কী ভাবছিস বল্ দিকিনি? কী এত আকাশ পাতাল ভাবছিস? তুই খুলে বল তো এখন কোথায় যাবি? আমি তো আর হাঁটতে পারছি না। সেই সুলতানপুর থেকে বেরিয়ে এত টো-টো করে ঘুরতে পারা যায়? এখন কোথায় যাবি তাই ঠিক করে বল্ তো আমাকে–

সদানন্দ বললে–তোমাকে আমার সঙ্গে ঘুরতে হবে না আর মামা। তুমি আমার সঙ্গে এলেই বা কেন?

–বা রে, তুই তো তাজ্জব কথা বললি? আমি তোর সঙ্গে ঘুরছি কেন? তা আমার ভাগের টাকাগুলো দিয়ে দে, আমি চলে যাচ্ছি–

সদানন্দ বললে–তোমাকে আমি টাকা দেব না মামা।

–তা টাকা দিবি না তো এতগুলো টাকা নিয়ে তুই করবি কী? তোর চাল-চুলো মাগ ছেলে কিছু তো নেই, এত টাকা তোর কী হবে?

সদানন্দ বললে–কী হবে তার জবাব আমি তোমাকে দেব না। আমি এখন নবাবগঞ্জে যাবো।

–নবাবগঞ্জে? নবাবগঞ্জে আবার কী করতে যাবি? সেখানে আবার কে আছে তোর? সে বাড়ি তো জামাইবাবু প্রাণকেষ্ট সা’কে বিক্রি করে দিয়েছে–

–তা হোক, আমার ইচ্ছে আমি নবাবগঞ্জে যাবো, তোমার তাতে কী?

বলে সদানন্দ শেয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে এই নবাবগঞ্জে এসেছিল, প্রকাশ মামাও সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল।

নবাবগঞ্জের খাওয়া-দাওয়ার বহর দেখে প্রকাশ মামা সদানন্দর কাছে এসে বললে– এ সব কী করছিস রে তুই? নাঃ, দেখছি শেষ পর্যন্ত টাকাগুলো তুই নয়-ছয় করে ফেলবি। শেষকালে তুই এই ভূত-ভোজন করাচ্ছিস–

তা প্রকাশ মামা যা ভয় করেছিল সদানন্দ তা-ই করলে। তারিণী চক্রবর্তী, বেহারি পাল তো ছিলই, গ্রামের আরো যত গণ্যমান্য লোক ছিল সদানন্দ তাদের সকলকে বারোয়ারিতলায় ডাকিয়ে আনলে। তারপর তাদের সামনে সদানন্দ যা প্রস্তাব করলে তাতে প্রকাশ মামা আরো অবাক।

সে এক রীতিমত নাটক বটে। নবাবগঞ্জে হাসপাতাল করে দেবে সদানন্দ, ইস্কুল করে দেবে। খরচের সমস্ত টাকা দেবে সদানন্দ।

সদানন্দ বললে–এ আমার টাকা নয় জ্যাঠামশাই, এ আপনাদেরই। আপনাদের মনে আছে বোধ হয় আমার ঠাকুরদাদার অত্যাচারে এই বটগাছের ডালে গলায় দড়ি দিয়ে মরেছিল কপিল পায়রাপোড়া। আপনারা জানেন কালীগঞ্জের হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রীকে ঠকিয়ে আমার ঠাকুর্দাদা এই জমিদারি করেছিলেন তা আপনারা জানুন আর না-জানুন আমি সব জানি। আমি আজ আপনাদের যে-টাকা দিলুম এ সেই টাকা। এ আপনাদেরই টাকা আপনাদেরই দিলুম। এ-টাকা আমার নেবার কোনও অধিকার। নেই–

পাশে প্রকাশ মামা ছিল। তার তখন পাগল হতে শুধু বাকি।

বললে–সব টাকা তুই এদের দিয়ে দিলি?

তারিণী চক্রবর্তী বললে–আমি তখনই জানতুম বাবা, যে তোমার মত ছেলে হয় না, তুমি দীর্ঘজীবী হয়ে বেঁচে থাকো বাবা–আমি তোমাকে এই আর্শীবাদ করি–

সদানন্দ বললে–অমন আশীর্বাদ আমাকে করবেন না জ্যাঠামশাই, বেশিদিন বাঁচার চেয়ে যেন বেশি ভালো কাজ করতে পারি এই আশীর্বাদ করলে আমি মাথায় তুলে নেব। ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি নবাবগঞ্জের ছেলেরা ছ’ক্রোশ দূরে রেলবাজারের স্কুলে কলেজে পড়তে যায়, একটা হাসপাতাল নেই যে নবাবগঞ্জের লোকদের চিকিৎসা হয়। আমার বাবা বা ঠাকুরদাদা তা করে দিতে পারতেন, কিন্তু করেননি। অথচ এ টাকা তো আপনাদেরই টাকা জ্যাঠামশাই। আপনাদের ঠকিয়েই তো এত টাকা তাঁদের সিন্দুকে জমেছিল। তাঁরা এই টাকার জন্যে কাউকে ঠকিয়েছেন, কাউকে জমি থেকে উৎখাত করেছেন। আবার কাউকে বা বংশী ঢালীদের দিয়ে খুনও করিয়েছেন। টাকার জোরে তাঁরা আপনাদের কিছু কথা বলতে দেননি, তেমনি পুলিসের মুখও টাকা দিয়ে চাপা দিয়ে দিয়েছেন…

বলতে বলতে সদানন্দ আবেগে উদ্বেল হয়ে উঠলো। সে বলতে লাগলো–আমি যখন বিয়ের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলুম তখন আপনারা সবাই আমাকে পাগল বলেছিলেন। সবাই যা করেছে তার বিরুদ্ধে গেলেই বুঝি পাগলামি করা হয়? তেমনি ফুলশয্যার দিন আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে একঘরে রাত কাটাইনি, সেও কি তাহলে পাগলামি? অথচ সেদিন তো সবাই আপনারা আমাকে পাগলই বলেছিলেন। এই তো আমার পাশে এখন প্রকাশ মামা বসে আছে, একে আপনারা জিজ্ঞেস করুন এরা আমাকে পাগল বলেছে কি না? কিন্তু আমি আমার স্ত্রীকে স্ত্রী হিসেবে কেন গ্রহণ করিনি সে প্রশ্ন কি কখনও আপনাদের মনে জেগেছে? তা জাগেনি, কারণ আপনারা ধরে নিয়েছিলেন আমি পাগল। সবাই যা করে তা না করার নামই আপনাদের কাছে পাগলামি। আসলে আমি চাইনি যে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হোক, আমি চাইনি যে অত্যাচারীর সংখ্যা বাড়ুক। আমি চেয়েছিলুম যে কালীগঞ্জের বউএর অভিশাপ সত্যি হোক, কালীগঞ্জের জমিদার হর্ষনাথ চক্রবর্তীর বিধবা স্ত্রী কর্তাবাবুকে নির্বংশ হওয়ার অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল তা ফলুক। আপনারা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন যে সে অভিশাপ ফলেছে, কারণ আপনারা হয়ত জানেন না যে আমার স্ত্রী আবার বিয়ে করেছে, আর আমি জীবনে কখনও বিয়ে করতে পারবোও না, কারণ বিয়ে করলে কালীগঞ্জের বউএর অভিশাপ মিথ্যে হয়ে যাবে। সে অভিশাপ যাতে মিথ্যে হয়ে না যায় সেইজন্যেই আমি বিয়ে করবো না। উত্তরাধিকারসূত্রে এত টাকা পাওয়ার পরও না–

বেহারি পাল আর থাকতে পারলে না। বললে–ধন্য ছেলে বাবা তুমি তুমি ধন্য–

সদানন্দ বললে–না দাদামশাই, আমাকে অত প্রশংসা করলে চলবে না। আপনাদের ওপর এই কাজের ভার দিয়ে গেলুম। আপনারাও দেখা-শোনা সব করবেন। আমি কলকাতায় গিয়ে গভর্নমেন্টের দফতরে গিয়েও এর জন্যে যা করা দরকার তা করবো। চার লাখ টাকা আমার বরাদ্দ। দু’লাখ টাকা হাসপাতাল করার জন্যে আর দু’লাখ টাকা দেব স্কুল-কলেজ করবার জন্যে। এর জন্যে যে কমিটি হবে তাতে আপনারাই থাকবেন, আপনারাই হবেন কর্তা, মাথার ওপর থাকবে শুধু সরকার। আমি চাই এতদিন নবাবগঞ্জের লোক যে কষ্ট পেয়ে এসেছে, সে কষ্ট দূর হোক–আমি চাই নবাবগঞ্জের ছেলে-মেয়েরা যেন স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে মানুষ হয়, নবাবগঞ্জের লোকেরা অসুখ-বিসুখে যেন হাসপাতালে ডাক্তারের সেবা পায়, ওষুধ-বিষুধ পায়–

ততক্ষণে বারোয়ারিতলায় ভিড় আরো বেড়ে গেছে। যারা ক্ষেত-খামারে কাজ করছিল তারাও এতক্ষণে এসে জুটলো।

একজন জিজ্ঞেস করলে–কী হয়েছে গো এখানে?

পাশের একজন বললে–এখানে ইস্কুল কলেজ হবে, হাসপাতাল হবে–চৌধুরী মশাই এর ছেলে চার লাখ টাকা দিয়ে এখানে সব কিছু করে দেবে–

সে এক রাজসূয় যজ্ঞের মত ধুমধাম শুরু হয়ে গেল চারদিকে। নবাবগঞ্জের কপালে এত সুখ হবে তা যেন কেউ কল্পনাই করতে পারছে না। একপাশে কেদার বসে আছে, নিতাই হালদার, গোপাল ষাট সবাই বসে আছে। তারাও শুনছিল। তাদের কাছেও এ যেন এক অভাবনীয় ঘটনা। একদিন এই সদানন্দর বউ-ই চৌধুরীদের বারবাড়িতে যে কেলেঙ্কারি করেছিল, তা দেখতেও সেদিন এমনি ভিড় হয়েছিল। কিন্তু তখন এমন আনন্দ হয়নি আজকের মত। বাহাদুর ছেলে বটে হে। লাখ-লাখ টাকার লোভ এমন করে ছেড়ে দিতে পারলে তো।

বেহারি পাল তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে চলে এল। বললে–কই, ওগো শুনছো–

গিন্নী সংসারের কাজে ব্যস্ত ছিল। তাড়াতাড়ি ছুটে এল। বললে–কী হলো, এসেছে?

বেহারি পাল বললে–না, সে এল না–

–তা বললে না কেন দিদিমা একবার ডাকছে?

–বলেছিলুম। তা বললে–সময় নেই। বললে–এখান থেকে আরো অন্য অনেক জায়গায় যেতে হবে আবার।

–তা কী বললে সদা?

বেহারি পাল বললে–জানো, একেবারে দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ হয়ে উঠেছে সদা—

–কী রকম?

–আহা, শুনলেও গর্ব হয়। বাপের আর দাদামশাই-এর অনেক টাকা পেয়েছে তো। সেই টাকাগুলো সব গাঁয়ের কাজে দিয়ে গেল। বললে–এসব আপনাদেরই টাকা, আপনাদেরই ভালোর জন্যে খরচ করবো এখানে। একটা ইস্কুল একটা কলেজ আর একটা হাসপাতাল করে দেবে বললে। গাঁয়ের ছেলেদের লেখাপড়া করার অসুবিধে, অসুখ-বিসুখ হলে দেখবার কেউ নেই–

বেহারি পালের বউএর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। বললে–তা তুমি একবার তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারলে না? আমি একবার তাকে চোখের দেখা দেখতুম। তা নয়নতারার কথা সে জানে? কিছু বললে সে?

বেহারি পাল বললে–সে জানে। নয়নতারা আবার বিয়ে করেছে তাও জানে! তার বউ এর কথাও তো সকলের সামনে দাঁড়িয়েই বললে।

–তা বললে না কেন যে, নয়নতারা তাকে খুঁজতে এসেছিল?

বেহারি পাল বললে–তাকে কি একলা পেলুম যে, তার সঙ্গে কথা বলবো? সেই চৌধুরী মশাই-এর শালাবাবু সে তো সব সময়ে তাকে আগলে-আগলে রয়েছে। একলা যে বাড়িতে তাকে নিয়ে আসবো, নিরিবিলিতে দুটো কথা বলবো তারও তো উপায় নেই। সে তো খুব রাগারাগি করছে

–কেন গো? রাগারাগি করছে কেন?

বেহারি পাল বললে–রাগারাগি করবে না? সে তো টাকাগুলো মারবার মতলব করেছিল, মারতে পারলে না বলে এখন গজরাচ্ছে। এই যে চার লাখ টাকা গাঁয়ের লোকের ভালোর জন্যে সদা দিলে এটা তো তার ভালো লাগলো না—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *