দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আছি। সুকান্তর লাফালাফি-দাপাদাপিতে আমার ঘুম ছুটে গিয়েছে। পেটের যন্ত্রণাটাও যেন ক্রমে মন্দীভূত হয়ে আসতে লাগল। মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে সুকান্তকে ছুঁয়ে দেখি, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে কি না! বাড়ির মধ্যে খুট-খাট দুম-দাম অনেকরকম সন্দেহজনক শব্দ হয় আর ভয়ে শিউরে উঠি। একবার মনে হয়, সুকান্ত যদি মরে গিয়ে থাকে, তবে কি হবে? মনে হতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে-দিয়ে তখুনি জাগাই। সে একবার অতি ক্ষীণ একটু শব্দ করে আবার পাশ ফিরে শোয়। এমনি করতে-করতে আমিও আবার ঘুমিয়ে পড়লুম।
কতক্ষণ শুয়ে ছিলুম জানি না, একবার একটা বিকট চিৎকার শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল, একটা লোক সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে চিৎকার করে কি বলছে। লোকটা মারাঠী ভাষায় বললেও ভাবে বুঝতে পারলুম যে সে বলছে–ধর্মশালায় যদি কেউ থাক তা হলে নেমে এস। সুকান্তকে ধাক্কা দিতে গিয়ে দেখলুম, সেও জেগে গেছে।
লোকটা খানিকক্ষণ সেইরকম ষাঁড়ের বিকট চিৎকার করে চুপ করলে। আমি সুকান্তকে বললুম, কিছু দরকার নেই ওর কথার জবাব দেবার। চুপ করে পড়ে থাকা যাক, সে যে পুলিসের লোক তা তার হাঁক-ডাকেই বোঝা গিয়েছিল। আমরা ঠিক করলুম, তার যদি প্রয়োজন থাকে তো সে এখানে আসুক, আমরা যাব না।
অনেকক্ষণ আর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমের সাধনায় মন দিলুম। কিন্তু নিশ্চিন্ত হবার উপায় কি। একটু পরেই আবার সেইরকম হাঁকডাক শুনতে পাওয়া গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে খুব ভারী পদক্ষেপে লোহা-বাঁধানো জুতো পরে কে যেন ওপরে উঠে আসতে লাগল। আমি সুকান্তকে বললুম, মটকা মেরে পড়ে থাকা যাক, হাজার চেঁচামেচি করলেও ওঠা নয়।
লোকটা সেইরকম হৈ-হৈ করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। তারপর এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে আমাদের ঘরে এসে সেইরকম চিৎকার করে তার বৃষচক্ষু লণ্ঠন দিয়ে চারদিকে কি খুঁজতে আরম্ভ করলে। আমরা পড়ে পড়ে দেখতে লাগলুম। চক্রাকার একটুকরো আলো এ-কোণ ও-কোণ এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে শেষকালে আমাদের ওপরে এসে স্থির হল।
আমাদের দেখে লোকটা আরও ভীষণ চিৎকার করে সেইখানে দাঁড়িয়েই কি সব বলতে লাগল; কিন্তু আমরা কোনো সাড়া না দিয়ে তখনও মট্কা মেরে পড়ে রইলুম। তখন লোকটা ঘরের মধ্যে ঢুকে প্রায় আমাদের কাছে এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কি সব বলতে লাগল। সুকান্ত আর চুপ করে থাকতে না পেরে উঠে পড়ে বললে, কেয়া হ্যায়?
লোকটা একটু ভড়কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তুম্ কাঁহাকা আদমি হ্যায়?
সুকান্ত বললে, আমরা কলকাতার লোক।
–কিন্তু এখানে বাইরের কোনো লোক আসবার হুকুম নেই।
সুকান্ত আবার বললে, আমরা বাইরের লোক নই, আমরা এই ভারতবর্ষেরই লোক।
লোকটা বোধহয় বুঝতে পারলে যে, এদের সঙ্গে তর্ক করে কিছু হবে না, তখন সে অন্য উপায় অবলম্বন করলে। সে বললে, তোমাদের থানায় যেতে হবে।
সুকান্ত বললে, বেশ, যাওয়া যাবে। কাল সকালে যাব থানায়।
–এখুনি যেতে হবে।
–এখুনি যেতে পারব না।
-কেন পারবে না?
–আমার এই বন্ধুর জ্বর হয়েছে, এ এখন উঠতে পারবে না।
জ্বর হয়েছে শুনে লোকটা টপ করে তিন-চার পা পেছনে সরে গিয়ে বললে, জ্বর হয়েছে! কখন থেকে হয়েছে?
–আজ সকাল থেকে জ্বর হয়েছে।
পুলিস-কনস্টেবল আরও কয়েক পা পেছনে ছটকে গিয়ে চেঁচাতে লাগল, আরে ওর তো নির্ঘাত পেলেগ হয়েছে, এবার এদিকে খুব পেলেগ হচ্ছে, ও মরলে পরে মূর্দা ফেলবে কে? ও তো কালই মরবে।
সুকান্ত বললে, সে মরলে দেখা যাবে।
লোকটা বললে, তা হলে তুমি একাই থানায় চল। সেখানে গিয়ে ওর যা ব্যবস্থা হয় করা যাবে। সুকান্ত বললে, ওকে ছেড়ে আমি এই রাতে কোথাও যাব না। কাল সকালে যা হয় তখন দেখা যাবে।
সুকান্তর সঙ্গে লোকটা চেঁচামেচি করতে লাগল। আমি পড়ে ভাবতে লাগলুম, প্লেগ হয়েছে কি রে বাবা! কালই মরতে হবে!
ওদিকে লোকটা সুকান্তকে মারতে উদ্যত হয়েছে দেখে আমি টপ করে উঠে বসেই জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছে? তুমি অত চেঁচাচ্ছ কেন?
মুমূর্ষু প্লেগ-রুগিকে ওইরকম ঝাঁকি মেরে উঠতে দেখে লোকটা স্পর্শের ভয়ে একেবারে ঘরের বাইরে গিয়ে সেই বৃষচক্ষু লণ্ঠনটা আমার মুখের ওপর ধরলে। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলুম, কি চাই তোমার? রাত-দুপুরে এসে কেন হাঙ্গামা লাগিয়েছ?
সে বললে, তোমাদের থানায় যেতে হবে।
এবারের ভাষা এবং ভঙ্গি অনেক নরম। জিজ্ঞাসা করলুম, কেন থানায় যেতে হবে? আমরা কি চোর না ডাকাত?
লোকটা খুবই নরম হয়ে বললে, না না, তা নয়, থানার অফিসার তোমাদের ডাকছেন। চল্ সুকান্ত।–বলে তার হাত ধরে টেনে তুলে সেই লোকটাকে বললুম, চল, তোমার থানায় যাই।
লোকটার সঙ্গে সেই রাত্রে ধর্মশালা ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। স্টেশন-সংলগ্ন জায়গা বলে সেখানটা বেশ আলো। স্টেশনের পাশেই রেল-পুলিসের থানা। লোকটা আমাদের সেই থানার মধ্যে নিয়ে গেল।
সেখানে একটা ঘরের মধ্যে খুব উজ্জ্বল আলো জ্বলছিল। এখানে ওখানে দু’-তিনজন লোক চেয়ারে বসে কাজ করছে দেখলুম। পুলিস-কনস্টেবল এদেরই মধ্যে একজন মুরুব্বি-গোছের লোকের কাছে আমাদের নিয়ে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ‘ইক্ড়ে-তিড়ে’ করে কি-সব বললে। তার বলা শেষ হয়ে গেলে কর্মচারীটি আমাদের ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের বাড়ি কোথায়?
বললুম, আমাদের বাড়ি কলকাতায়।
–এখানে কি সিধে কলকাতা থেকে আসছেন?
-না, আমরা সুরাট থেকে আসছি।
লোকটির কথাবার্তা বেশ নম্র এবং ভদ্র–ঠিক পুলিস-জনোচিত নয়। একটু পরে জিজ্ঞাসা করলেন, সুরাটে আপনারা কি করেন, জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?
ধললুম, সুরাটে আমরা কিছুই করি না, সেখানে আমাদের বন্ধু আছেন–তিনি ব্যবসা করেন, আমরা সেখানে এসেছি কর্মের সন্ধানে।
–কি কর্ম?
–কোনো চাকরি-বাকরি।
–তবে নোভাসারিতে এসেছেন কেন?
–ওই একই উদ্দেশ্যে।
এবার লোকটি বললেন, আপনারা বসুন।
আমরা বসতেই ভদ্রলোক বললেন, দেখুন, এই জায়গাটি হচ্ছে গাইকোয়াড়ের রাজত্ব। এখানে বাইরের লোক এলে তার ওপর নজর রাখা হয়। আমি আপনাদের ভালোর জন্যেই বলছি–আপনারা এখান থেকে এখুনি চলে যান, নচেৎ নানারকম ফ্যাসাদে পড়বেন। আপনারা ছেলেমানুষ এবং এখানে কেউ চেনে না। হয়তো এমন বিপদে পড়বেন যে, ফাটক পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া কিছুদিন থেকে এখানে খুব প্লেগ হচ্ছে, সেদিক দিয়েও বিশেষ ভয় আছে।
লোকটির কথা আমাদের যুক্তিযুক্ত মনে হল। কিন্তু আমরা যাব কোথায় আর কি করেই বা যাব?–এইসব চিন্তা করছি, এমন সময় ভদ্রলোক বললেন, কি ঠিক করলেন?
বললুম, দেখুন, আপনার উপদেশ খুবই সমীচীন বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমাদের কাছে তো কিছুই নেই–রেল-ভাড়া দেব এমন পয়সাও আমাদের কাছে নেই।
ভদ্রলোক বললেন, কিছুই নেই?
–আনা দুই আছে।
তিনি সেই দু’-আনা আমাদের কাছ থেকে চেয়ে নিলেন। সেখান থেকে সুরাটের ভাড়া বোধ হয় তখন জন-প্রতি সাত আনা ছিল। বাকি পয়সা থানার ক্যাশ থেকে বার করে থানার একজন লোককে দিয়ে বললেন, সুরাটের দু’খানা টিকিট কেটে এদের গাড়িতে চড়িয়ে দিয়ে এস।
আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কিছু মনে করবেন না। এতে আপনাদের ও আমাদের দু’পক্ষেরই ভালো হবে। দুটো ক’মিনিটে একটা গাড়ি আছে। এতেই আপনারা ফিরে যান।
লোকটির সঙ্গে আমরা স্টেশনে ফিরে এলুম। একটু পরেই একখানা সুরাট-যাত্রী গাড়ি এল। তারই তৃতীয় শ্রেণীর একখানা কামরায় আমাদের তুলে দিয়ে গাড়ি যখন বেশ চলতে আরম্ভ করেছে সেই সময় সঙ্গের লোকটি টিকিট দু’খানা আমাদের হাতে দিয়ে দিলে।
আমরা এতই অবাঞ্ছিত যে, পুলিস গাঁটের পয়সা খরচ করে সেখান থেকে ভাগিয়ে দিলে! নলরাজার হাত থেকে পোড়া শোলমাছ পালিয়ে গিয়েছিল। নলের নাক কাটতে গিয়ে কলি পোড়া-শোলেরও প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছিল। শোলের ভাগ্যে কলির কোপ পড়েছিল নলের ওপর। পুরাণের কাহিনির মধ্যে নলের কাহিনিটি একটি আশ্চর্য কাহিনি। কিন্তু আমাদের কাহিনিটি ছিল অত্যাশ্চর্য কাহিনি। পুলিস যে কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে আমাদের নোভাসারি থেকে সরিয়ে দিলে, নিজের নাক বাঁচাবার জন্যে, না, পরের নাক কাটবার জন্যে–সে ইতিবৃত্ত আজও অপরিজ্ঞাত হয়ে আছে।
এর সঙ্গে আর-একদিনের কথা মনে পড়েছে। তখন আমি বোম্বাই শহরে বাস করি। এই নোভাসারির একটি বিশিষ্ট পার্শী পরিবারের দ্বারা নিমন্ত্রিত হয়ে সবান্ধবে ও সপরিবারে একবার সেই গাইকোয়াড়ী রাজ্যে গিয়েছিলুম। ভদ্রলোক সেখানে পুলিস-বিভাগে বড় চাকরি করতেন। সেখানে কয়েকদিনের খাতির-যত্নে আদরে-আপ্যায়নে একেবারে অভিভূত হয়ে পড়েছিলুম। একদিন রাত্রে ডিনারের পর আমরা পুরুষ ক’জন টেবিলে বসে খুব গল্প ওড়াচ্ছি, মেয়েরা আমাদের টেবিলের একটু দূরে বসে গল্পগাছা করছিলেন। কি জানি, কার একটা গল্প শুনে পুরুষদের মহলে খুব একটা হাসির হররা উঠতেই বাড়ির গিন্নি যিনি, তিনি তাঁদের দল থেকে উঠে এসে আমাদের বললেন, দেখ, তোমাদের এখানে খুব হাসি উড়ছে দেখে আমাদেরও এখানে বসতে ইচ্ছে করছে।
আমরা বললুম, তা দয়া করে এখানে এসে বসুন না।
গিন্নি বললেন, বসতে পারি যদি একটা প্রতিজ্ঞা করেন তা হলে।
–কি প্রতিজ্ঞা?
–আমাদের দলে ছোট ছোট কুমারী মেয়েরাও রয়েছে। আপনারা যদি প্রতিজ্ঞা করেন যে, কোনো অসভ্য গল্প করবেন না তা হলে সকলে বসতে পারি।
মেয়েরা এসে বসবার পর একজন প্রস্তাব করলেন, আচ্ছা, এখানে উপস্থিত প্রত্যেকের জীবনের কোনো একটা অদ্ভুত ঘটনার বর্ণনা কর। মেয়েরা ইচ্ছা করলে বলতেও পারে, কিন্তু পুরুষদের প্রত্যেককেই বলতে হবে।
প্রথমেই আমার পালা পড়ল। আমি তো ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমাদের নোভাসারির এই অভিজ্ঞতাটির বর্ণনা করলুম। আমার কাহিনি শুনে পুরুষেরা কোনো মন্তব্য না করে তাঁদের খালি পাত্র পূর্ণ করার দিকে মন দিলেন। মেয়েদের মন বোধ হয় আমার দুঃখে একটু ভিজেছিল। আমার পাশেই বাড়ির বড় মেয়ে দ্বাবিংশবর্ষীয়া সুন্দরী নাজু বসেছিল। সে বললে, আপনি কাজের জন্যে এত বাড়ি ঘুরলেন, কিন্তু আমাদের বাড়িতে যদি আসতেন তো নিশ্চয় সাহায্য পেতেন।
বললুম, আসবার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আসিনি এইজন্যে যে, কন্যে, তখনও তুমি জন্মাওনি।
হালকা হাসির ফুৎকারে ব্যথার বাষ্প উড়ে গেল।
এখন যা বলছিলুম। সুরাটে এসে যখন পৌঁছলুম, তখনও প্রায় দু’ঘণ্টা রাত্রি আছে। পুলিসের সঙ্গে বকাবকি করার ফলে আমার জ্বর ও পেটের ব্যথা সেরে গিয়েছিল। সুকান্তরও পেট-নামানো বন্ধ। স্টেশনের কাছেই দিল্লিদরওয়াজা। গুটি-গুটি গিয়ে আবার নিশিকান্তের দরজায় ধাক্কা দেওয়া গেল। কোনো কিছু না করে ফিরে আসায় তারা বিরক্তই হল।
নিশিকান্ত তার স্বভাবসিদ্ধ কাটা-কাটা বুলি ছাড়তে লাগল। কিন্তু তখন আর সে সব কথায় কান না দিয়ে শুয়ে পড়া গেল। পরের দিন অনেক বেলাতেই ঘুম ভাঙল।
উঠে দেখি, ওরা কেউ ঘরে নেই। অনেক বেলায় নিশিকান্তরা এসে রান্নাবান্না করে নিজেরা খেলে ও আমাদেরও খেতে দিলে। নোভাসারিতে কাল সারাদিন কি করেছি ও কেমন করে পুলিসের অত্যাচারে চলে আসতে হয়েছে, সে-কথা সব তাদের খুলে তাদের বললুম।
নিশিকান্ত বললে, এখানকার সবচেয়ে বড় ইঞ্জিনীয়ার যে, সে বাঙালি, রোজ সকালে অমুক জায়গায় সে কাজ দেখতে আসে। তোমরা কাল সকালে গিয়ে তাকে ধর-একটা চাকরি-বাকরির জন্যে। সেখানে কোনো সাহায্য যদি না পাও তো ওই কাছেই ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের বাড়ি। সোজা চলে যাবে তাঁর কাছে। তিনি কোনো-না-কোনো উপায় করে দেবেনই।
ওখানকার ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব অতিশয় দয়ালু বলে আমরাও শুনেছিলুম। কাল সকালে ইঞ্জিনীয়ার কিংবা ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের কাছে যাওয়া যাবে স্থির করে তখনকার মতন তো শুয়ে পড়া গেল। আমাদের সঙ্গে নিশিকান্ত, উপেনদা, জনার্দনও শুয়ে পড়ল। তারপর বিকেল হতে-না-হতে তারা জনার্দনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। এতক্ষণের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য ও জনার্দনকে আমরা একলা পেলুম না। স্নান করতে যাবার সময়ও নিশিকান্ত তাকে নিয়ে গেল।
আমরা দু’জনে পরামর্শ করে স্থির করেছিলুম যে, এখানে যদি কিছু না হয় তা হলে বোম্বাই চলে যাব। জনার্দন যদি আমাদের সঙ্গে যায় তো ভালোই, নচেৎ গোটাকয়েক টাকা তাকে দিয়ে নিশিকান্ত কিংবা উপেনদার কাছ থেকে চেয়ে নেব। কিন্তু এতক্ষণের মধ্যে তার সঙ্গে নিরিবিলি একটা কথা কইবারও অবকাশ পেলুম না।
অনেক রাত্রে নিশিকান্তরা ফিরে এসে শুয়ে পড়ল। তারা নিশ্চয় বাইরে আহারাদি সেরে এসেছিল, কারণ রান্না-বান্না কিছু করলে না এবং আমরা খেয়েছি কি না তাও জিজ্ঞাসা করলে না।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে আমরা যাত্রা করলুম সেই বাঙালি ইঞ্জিনীয়ারের উদ্দেশে। লোককে জিজ্ঞাসা করতে করতে অনেক দূরে সেই একেবারে প্রায় শহরের প্রান্তে এক জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হলুম। দেখলুম, রাস্তার ধারেই কতকগুলো বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তারই একপ্রান্তে আমাদের এই ইঞ্জিনীয়ার–সাহেব দাঁড়িয়ে কয়েকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন।
রাস্তায় আরও কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলুম যে, ইনিই সেই ইঞ্জিনীয়ার যাঁর উদ্দেশে আমরা এসেছি। ভদ্রলোক তখন অন্য লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে ব্যস্ত, তাই আমরা দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলুম, আশা–একটু ফাঁক পেলেই গিয়ে উপস্থিত হব। কিন্তু তাঁর কাজ আর শেষ হয় না–এক দলের সঙ্গে কথাবার্তা শেষ হল তো আর এক দল এসে গেল।
এইরকম চলেছে, এমন সময় আমাদের ওপর তাঁর দৃষ্টি পড়ল। দেখলুম, অন্য লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বলতে ঘন ঘন তিনি আমাদের দিকে তাকাচ্ছেন। শেষকালে এক দলের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে এগিয়ে এসে আমাদের তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে হে বাঙালি নাকি?
বললুম, আজ্ঞে হ্যাঁ, আমরা বাঙালি।
ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব চিৎকার করে উঠলেন–পরে দেখেছি যে ওইরকম চিৎকার করে কথা বলাই তাঁর অভ্যাস–বাড়ি কোথায়? কলকাতায় নিশ্চয়।
–আজ্ঞে হ্যাঁ।
-–তোমরা সব এইরকম বাড়ি থেকে পালিয়েছ আর সেখানে হৈ-হৈ খুনোখুনি চলেছে, তার কিছু খবর রাখ?
কিছু কিছু করে যে না রাখতুম তা নয়। তবে এক্ষেত্রে চেপে যাওয়াই সমীচীন বোধ করে তৃষ্ণীম্ভাবই অবলম্বন করা গেল।
ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব আবার হাঁক ছাড়লেন, দেখে শুনে তো মনে হচ্ছে, ভালোঘরের ছেলে, কিন্তু এমন দুর্মতি কেন হল? একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, তার পর? এখানে কি চাই? এখানে এসেছ কি করতে?
বললুম, বাইরে বেরিয়েছিলুম কাজকর্ম করব বলে। আমেদাবাদে কাপড়ের কলে কাজ শেখবার উদ্দেশ্য ছিল; কিন্তু তারা নিলে না। আপনার কাছে এসেছি যদি একটা কাজকর্ম দেন- –কুলিগিরি ও করতে আমরা রাজি আছি। একটা কাজকর্ম পেলে তবে প্রাণরক্ষা হয়। বিদেশে বড় কষ্টে পড়েছি–আপনি বাঙালি, তাই আপনার কাছে এসেছি।
আমাদের কাতর প্রার্থনায় ভদ্রলোকের মন গলল না। এক মুহূর্ত চিন্তা না করে তিনি বলে দিলেন, এখানে কিছু হবে না। আমি কিছু করতে পারব না।
বাস্, হয়ে গেল। ইঞ্জিনীয়ার-সাহেবের চিৎকার শুনে তাঁর যত কর্মচারী সেখানে ছিল, সব এসে সেখানে দাঁড়িয়ে গেল। রাহী লোকও কেউ কেউ দাঁড়াল। তিনি আরও কিছু উপদেশ দিয়ে আবার স্বস্থানে ফিরে গেলেন। আমরাও আস্তে আস্তে সরে পড়লুম।
কিছুদূর গিয়ে সুকান্ত বললে, চল, এখান থেকেই স্টেশনে গিয়ে বোম্বাই-যাত্রী ট্রেন ধরা যাক। বোম্বাইয়ের কেরামতিটা দেখে ওইখানেই শেষকালে সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া যাবে।
সুকান্তকে বললুম, আরও একটা জায়গা এখনও দেখতে বাকি আছে। ওই সামনেই ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। চল্, একবার ওখানকার কৃত্যটা শেষ করে আসি। পেছুটান- রেখে যাওয়াটা ঠিক নয়।
সামনেই ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের পাথরের বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল, প্রকাণ্ড গেট-দুটো খোলা–যেন উচ্চহাস্যে আমাদের ব্যঙ্গ করছে। তবুও আমরা যুগলে অগ্রসর হলুম। গেটের কাছে গিয়ে দেখা গেল, দারোয়ান ইত্যাদি কিছুই নেই।
আমরা ভেতরে ঢুকে গেলুম। খাঁ-খাঁ করছে গোটা বাড়িটা–কেউ কোথাও নেই। কি করে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের দেখা পাওয়া যাবে তাই ভাবছি ও একটু একটু করে সেই প্রাসাদের গভীরে প্রবেশ করছি, এমন সময় দীর্ঘ সোপান-শ্রেণী চোখে পড়ায় আস্তে আস্তে সেদিকে অগ্রসর হতে লাগলুম। তখনও লোকজন চোখে পড়ল না।
সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ উঠেই দেখলুম যে, সিঁড়িটা গিয়ে পৌঁছেছে একেবারে বড় একটা সাজানো ড্রয়িং-রুমের মধ্যে। আমরা রাস্তার ভিখিরি–একেবারে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের ড্রয়িংরুমে গিয়ে পৌঁছব, সাহায্যের বদলে জেল হয়ে যেতে পারে ভেবে সেইখানেই দাঁড়ানো গেল। কিন্তু ভেবে দেখলুম, জেল যদি হয় তা হলেও তো কিছুকালের জন্যে নিশ্চিন্ত–কুছ পরোয়া নেই মন! উঠে পড়।
গুটি-গুটি সিঁড়ি ভেঙে একেবারে গিয়ে উঠলুম সেই ড্রয়িং-রুমে
ঘরের মধ্যে–সিঁড়ি দিয়ে উঠেই বললে হয়–একজন লম্বা একটা ইজি-চেয়ারে শুয়ে কি পড়ছিলেন। আমরা উঠে ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াবার পর বেশ কয়েক সেকেন্ড পরে মুখ থেকে বইখানা সরিয়ে কিছুমাত্র আশ্চর্য না হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাই?
কি বলব ইতস্তত করছি–ইতিমধ্যে তিনি চেয়ার থেকে পিঠ তুলে পা-দুটো নামিয়ে সোজা হয়ে বসলেন। যতদূর মনে হচ্ছে, ভদ্রলোকের বয়স তখন চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে, তাঁর মাথার চুল কম হলেও লম্বা, কেশবিরল লম্বা দাড়ি, রোগা লম্বা একহারা চেহারা, একটা ঢোলা পা-জামা ও বাংলা পাঞ্জাবির মতো ঢোলা-হাতা একটা জামা-পা-জামা ও জামা দুটোই আধময়লা। বুঝতে পারলুম ইনিই ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব।
বললুম, মশাই, আমরা বাঙালি। দেশ থেকে বেরিয়েছিলুম নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়াব বলে; কিন্তু কিছু না করতে পেরে অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত হয়েছি। ইচ্ছে ছিল, আমেদাবাদে কাপড়ের কলে কাজ শিখব, কিন্তু সেখানে ঢুকতে পারলুম না। আশা আছে, বোম্বাই শহরে যদি যেতে পারি হয়তো সেখানকার মিলে ঢুকতে পারব। কিন্তু আমাদের কাছে একটি পয়সাও নেই–আপনার কাছে এসেছি যদি কিছু সাহায্য পাই।
আমাদের কথা শেষ হওয়া মাত্র ভদ্রলোক তড়াক করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমরা ভাবতে লাগলুম, কিরকম হল? এখান থেকে এখন বোধহয় সরে পড়াই উচিত।
এইরকম ভাবছি, বোধহয় মিনিট পাঁচেক গেছে, এমন সময় তিনি কর্করে দু’খানা দশটাকার নোট নিয়ে এসে একখানা আমাকে ও একখানা সুকান্তকে দিয়ে বললেন, যাও, বম্বে যাও। সেখানে গিয়ে কি করতে পারলে তা যদি আমাকে জানাও তো খুশি হব।
কি ব্যাপার! আমাদের সব হিসাব ধুয়ে মুছে দিয়ে এ কি ঘটল! উদ্গত অশ্রুতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল–কৃতজ্ঞতা ভাষায় আর প্রকাশ করতে পারলুম না। ভদ্রলোক আবার বললেন, মনে হচ্ছে তোমরা অত্যন্ত ক্লান্ত, আমার এখানে খেতে যদি তোমাদের আপত্তি না থাকে তো খেয়ে গেলে আমি খুশি হব।
বললুম, খেতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
ভদ্রলোক আবার লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবার প্রায় দশ মিনিট বাদে ফিরে এলেন, তাঁর পেছনে একটি লোক–তার দু’হাতে দু’খানা থালা। লোকটি থালা-দুটো নিয়ে এসে একটা টেবিলের ওপর রাখলে। ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব আমাদের বললেন, যাও, ওখানে বসে খাও।
আমরা গিয়ে বসে পড়লুম। থালার ওপরে দু’খানা করে ঘি-মাখানো ছোট ছোট হাতে গড়া রুটি, থালার কোণে একটু তরকারি। আমেদাবাদ ত্যাগ করে অনেকদিন সুখাদ্য খাইনি। আমরা তো মিনিট-খানেকের মধ্যেই দু’খানা করে রুটি চট্ করে মেরে দিলুম। একটু বাদেই লোকটা আবার চারখানা রুটি এনে দিলে। ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব আমাদের সামনেই বসেছিলেন–তিনি নিজেই উঠে গিয়ে কোথা থেকে দুটো কাঁচের গেলাস ও এক জগ জল নিয়ে এসে আমাদের দু’জনের সামনে দুটো গেলাস রেখে তাতে জল ভরে দিলেন। ইতিমধ্যে তাঁর লোক এসে খানকয়েক করে রুটি দিয়ে গেল। আমাদের পাতের তরকারি ফুরিয়ে যাওয়ায় আমরা শুধু রুটি খেতে আরম্ভ করেছি দেখে তিনি টেবিলের ওপর থেকে একটা জ্যামের টিন নিয়ে ছুরি দিয়ে আমাদের দু’জনের পাতেই রাশীকৃত করে জ্যাম ঢেলে দিলেন।
খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পর সেই লোকটা এসে আমাদের নিয়ে গিয়ে হাতে জল ঢেলে দিলে। হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখি, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব সেই ইজি-চেয়ারে শুয়ে আবার পাঠে মন দিয়েছেন। কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি মুখ থেকে বইখানা সরিয়ে হাস্যমুখে বললেন, এবার তোমরা যাবে?
যাবার আগে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভণিতা করব, এমন সময় সিঁড়িতে ধপ্ ধপ্ করে আমাদের সেই পূর্ববর্ণিত ইঞ্জিনীয়ারের আবির্ভাব হল। আমাদের দেখে ভদ্রলোক সেইখান থেকে একরকম ছুটে বাকি সিঁড়িগুলো পেরিয়ে এসে চিৎকার করে বলতে আরম্ভ করে দিলেন, এই যুবকেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। কলকাতায় এদের বাড়ি। আমার কাছে প্রতিদিন সেখান থেকে সংবাদপত্র আসে। এরা পালাবার পর সেখানে হৈ-হৈ ব্যাপার চলেছে, এমনকি খুন-খারাপি পর্যন্ত বাদ যায়নি–আর এখানে এরা দিব্যি মজাতে আছে।
ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব কিঞ্চিৎ স্থূলকায় ছিলেন। একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে হাঁপাতে লাগলেন। ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব অত্যন্ত ধীরভাবে তাঁর কথার জবাবে বললেন, কিন্তু সেখানকার হাঙ্গামার জন্য এদের কী-ভাবে দায়ী করতে পারেন? একটু চুপ করে থেকে তিনি আবার বললেন, এরা নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে।
ইঞ্জিনীয়ার সাহেব দমবার পাত্র নন। তিনি আবার সেইরকম চিৎকার করে বললেন, তা বলে বাপ-মাকে কাঁদিয়ে বাড়ি থেকে লম্বা দেবে? জানেন, এরা সব ভালো ঘরের ছেলে?
ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব বললেন, সেইজন্যেই তো এদের সাহায্য করা উচিত। এরা বোম্বাই গিয়ে সেখানকার কাপড়ের কলে কাজ শিখতে চায়। পরে ওদের দেশে যখন কাপড়ের কল হবে, তখন সেখানে যোগ দিতে পারবে।
–শোনেন কেন ওদের কথা! ওইসব ছেলে মন দিয়ে কাজ শিখবে?
–আহা, ও-বেচারিদের একটা সুযোগ দেবার আগেই ও-কথা বলছেন কেন? আপনার কোনো কাপড়ের কলের মালিকের সঙ্গে পরিচয় আছে?
–আমার তিন-চারটে কাপড়ের কলের ডিরেক্টারদের সঙ্গে বিশেষ পরিচয় আছে, কিন্তু তাদের না লিখলে তো কিছু বলতে পারছি না।
–তা হলে আপনি তাদের লিখুন।
–তাতে তো কয়েকদিন সময় যাবে। আপনি কি ওদের কিছু টাকাকড়ি দিয়েছেন নাকি?
–হ্যাঁ, দিয়েছি।
–কই, টাকা আমাকে দাও।–বলে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন।
আমরা নোট দু’খানা তাঁর হাতে দিয়ে দিলুম। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের হাতে টাকাগুলো ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, এখন ওদের হাতে টাকা দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি তাদের চিঠি লিখে আগে সব ঠিক করি। তারপর তিনি আমাদের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় থাক তোমরা?
ইতিপূর্বে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবকে বলেছিলুম,’আমাদের থাকবার কোনো আশ্রয় নেই, পথে পথে ঘুরে বেড়াই। আমাদের হয়ে তিনিই আগে জবাব দিয়ে দিলেন, ওদের থাকবার কোনো আশ্রয় নেই। এই ক’দিনের জন্যে আমাদেরই ব্যবস্থা করতে হবে।
ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব ফাঁপরে পড়ে গেলেন। একটু ভেবে আমাদের বললেন, আচ্ছা, দেখি, কি করতে পারি! আপনারা বসুন।
আমরা যেখানে বসে খেয়েছিলুম, সেই চেয়ারে গিয়ে বসলুম। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব ইজি-চেয়ার থেকে উঠে একটা লেখার টেবিলের সামনে গিয়ে বসে কাকে চিঠি লিখলেন। তারপরে একজন চাকর ডেকে তাকে কি-সব বলে চিঠিখানা দিয়ে আবার ইজি-চেয়ারে গিয়ে বসলেন।
আমরা এদিকে বসে রইলুম, ওদিকে ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব সশব্দে আলাপচারী করতে লাগলেন। চা এল, তিনি চা খেলেন। আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। আবার ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায় তাই ভাবছি। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছি যে, কোনো কলে ঢুকতে পারি তো ভালোই হয়। আমাদের দিন চলবার জন্যে নিশ্চয়ই তারা একটা মাসোহারা দেবে।
ঘরের মধ্যে একটা বড় ঘড়ি প্রতি আধঘণ্টায় একবার করে চমকে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের কোনো তাড়া নেই; দু’দিন একরকম অনাহারে থেকে আজ পেটে যা পুরেছি তাতে অন্তত দু’দিনও চলবে–এইরকম সব চিন্তা মনের মধ্যে লাফালাফি করছে, এমন সময় ঘরের মধ্যে আনন্দের তুফান তুলে একটি ভদ্রলোক ঢুকলেন।
যিনি ঢুকলেন, রোগা লম্বা তাঁর চেহারা, পেন্টুলান ও গলাবন্ধ কোট পরা, রঙ একেবারে ইউরোপীয়দের মতো বললেই হয়, মাথায় গোল টুপি, কপালে চন্দনের সঙ্গে কালো মতন কি-একটা মিলিয়ে তারই ফোঁটা কাটা। তাঁকে দেখলে সেদিক থেকে চোখ ফেরানা যায় না, মনে হয় যেন খানিকটা জ্যোতি কোথা থেকে ঠিকরে এল। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই তিনি হো-হো করে হেসে উঠলেন। ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব উঠে তাঁকে ইজি-চেয়ারে বসতে অনুরোধ করলেন। তিনি কিছুতেই এমন বেয়াদবি করবেন না, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবও ছাড়বেন না। শেষকালে ইঞ্জিনীয়ারসাহেব উঠে একদিক থেকে একটা চেয়ার তুলে নিয়ে গেলেন। আবার একটা হাসাহাসি পড়ল।
যা হোক, সকলে উপবেশন করার পর তাঁরা কথাবার্তা শুরু করলেন। কথাবার্তার মধ্যে মধ্যে এই নবাগত ভদ্রলোকটি এক-একবার ফিরে ফিরে আমাদের দিকে তাকাতে লাগলেন, কখনও হাস্যমুখে, কখনও গম্ভীর হয়ে। বেশ বুঝতে পারলুম, আমাদেরই কথা হচ্ছে। কথাবার্তার মধ্যেও মাঝে মাঝে উচ্চহাস্য হতে লাগল। এইরকম কথাবার্তা ও হাসাহাসি হতে হতে তাঁরা তিনজনেই হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন। এই সময় ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব আমাদের ডাক দিলেন, ওহে ছোকরারা, এদিকে এস।
আমরা তটস্থ হয়ে উঠে সেখানে যেতেই তিনি সেইরকম চিৎকার করে বলতে লাগলেন, তোমরা এখন আমাদের এই পণ্ডিতজীর বাড়িতে গিয়ে থাক। ও-দিকে মিলের মালিকদের চিঠি লেখা হচ্ছে, সেখান থেকে খবর এলেই তোমাদের পাঠিয়ে দেওয়া যাবে। দেখো, যেন পণ্ডিতজীকে জ্বালিয়ে আর বাঙালির বদনাম করো না, যা-সব গুণধর ছেলে-তোমাদের দ্বারা সব সম্ভব।
আমরা পণ্ডিতজীকে ঘাড় নীচু করে নমস্কার করতেই তিনি সস্মিতমুখে আমার পিঠে হাত দিয়ে ইংরিজিতে বললেন, চল।
আমরা অগ্রসর হতেই ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব এগিয়ে এসে বললেন, আমি আশা করি, পণ্ডিতজীর পরিবারের মধ্যে তোমাদের কোনো কষ্ট হবে না। তোমরা ভবিষ্যতে উন্নতি করলে আমি খুশিই হব, আমার কথা ভুলো না যেন।
আবার তাঁদের মধ্যে একটা হাসাহাসি পড়ে গেল। ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব আরও বললেন, যতদিন এখানে আছো মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে পার। বিকেলবেলা আমার কাজ থাকে না
ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু পণ্ডিতজী আমার একটা বাহু আকর্ষণ করে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবকে বললেন, আচ্ছা, আমরা তা হলে এখন যাই। আমাকে আবার একবার আপিসে যেতে হবে। আপনি ডাক দেওয়ায় কিছু কাজ ফেলেই আসতে হয়েছে।
এই অবধি বলেই আবার সেইরকম হো-হো করে হেসে আমাকে একরকম টানতে টানতে দুড়-দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। আসবার সময় ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবকে একটা কৃতজ্ঞতা জানানো তো দূরের কথা, বিদায় নেবারও অবসর পেলুম না। গেটের সামনেই ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল। পণ্ডিতজী বললেন, উঠে পড়–চটপট।
আমরা যতটা চটপট সম্ভব গাড়িতে উঠে বসলুম, আমরা ওঠবার পর পণ্ডিতজী গাড়িতে উঠলেন। উঠেই আদেশ দিলেন, চল দফ্তর।
গাড়ি ছুটল। গাড়িতে উঠেই এক মিনিটের মধ্যেই পণ্ডিতজীর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এই লোকই যে এক মুহূর্ত আগেই প্রতি কথায় উচ্চহাস্যে চারিদিক প্রতিধ্বনিত করছিলেন, তা এখন তাঁকে দেখলে বোঝাই যায় না।
আমি ঠিক তাঁর সামনেই বসেছিলুম। টকটকে গৌরবর্ণ তাঁর মুখমণ্ডল থেকে লাল আভা ফুটে বেরুচ্ছে। চোখের দৃষ্টি যেন ইহলোক ছাড়িয়ে কোনো সুদূরে প্রসারিত। কি যেন এক বেদনায় ক্লিষ্ট-মধুর সেই মূর্তি আমার কাছে অপূর্ব বলে মনে হতে লাগল। যে আনন্দময় মূর্তি ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের ওখানে দেখেছিলুম, তার ওপরে বিষাদের ছায়া এসে পড়ায় যেন আরও সুন্দর হয়ে উঠল সে-মূর্তি–আমি হাঁ করে পণ্ডিতজীর মুখের দিকে চেয়ে রইলুম। অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে অনেকক্ষণ পরে গাড়ি এসে আপিসের কাছে দাঁড়াতেই পণ্ডিতজী টপ করে নেমে গেলেন।
কিন্তু পণ্ডিতজীর কথা এখন থাক্, আগে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের কথা শেষ করি।
আমরা সুরাটে পৌঁছবার দু-চারদিন পরেই সেই দেশের একজন লোকের মুখের শুনেছিলাম, যে সেখানকার বর্তমান ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব অত্যন্ত ভালো লোক। ক্রমেই এর-ওর-তার কাছ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব সম্বন্ধে নানান কিংবদন্তী শুনতে লাগলুম। শুনলুম যে, সকালবেলা তিনি পকেটে পয়সা ভর্তি করে নিয়ে অনেক দূরে দরিদ্র পল্লীগুলির মধ্যে বেড়াতে চলে যান। সেখানে গিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে লোকের দুঃখ মোচন করবার চেষ্টা করেন–পকেটের সমস্ত টাকা-পয়সা দরিদ্রের মধ্যে ব্যয় করে চলে আসেন। দাতার ধর্ম হচ্ছে–কেউ এসে সাহায্য চাইলে তাকে নিরাশ না করা। কিন্তু ইনি চাইবার অবকাশ দিতেন না–তেড়ে গিয়ে দুঃখ ও দারিদ্র্যকে আক্রমণ করতেন। এইরকম করাতে মাস শেষ হবার অনেক আগেই তাঁর টাকা ফুরিয়ে যেত এবং অনেকসময়েই নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে অন্যের কাছে কর্জ পর্যন্ত করতে হত। অনেকসময় অনেক দুস্থ লোক তাঁর কাছে গেলে উপকৃত হবে জেনেও দয়া করে সেখানে যেত না। তাঁর এই স্বভাবের কথা সেখানে সকলেই জানত বলে সেখানকার উচ্চপদস্থ কর্মচারী ও তাঁর বন্ধুরা সর্বদাই কড়া নজর রাখতেন, যেন কেউ তাঁদের অগোচরে তাঁর কাছে পৌঁছে ভাঁওতা লাগিয়ে কিছু মেরে নিয়ে না যায়। আমরা পরে শুনেছিলুম যে, সেই বাঙালি ইঞ্জিনীয়ারের কাছ থেকে হতাশ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের বাড়িতে ঢুকেছি, এই সংবাদ পেয়েই ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব ছুটতে ছুটতে এসেছিলেন–আমাদের কবল থেকে তাঁকে রক্ষা করবার জন্যে।
ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের নাম ছিল মিস্টার গয়ারাম। তাঁর লম্বা চুল-দাড়ি দেখে প্রথম দর্শনেই তাঁকে শিখসম্প্রদায়ের লোক বলে মনে হয়েছিল; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, শিখের নাম গয়ারাম হওয়া সম্ভব নয়। আমার বিশ্বাস, তিনি বিশেষ কোনো ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না। সংসারে সবচেয়ে বড় ধর্ম হচ্ছে মনুষ্যত্ব–তিনি সেই মনুষ্যত্বে বিশ্বাস করতেন–
জীবনযাত্রার প্রাক্কালে আমরা যে মহাপুরুষের দর্শনলাভ করেছিলুম, আজ জীবন-সন্ধ্যায় বিশেষ করে তাঁকে স্মরণ করে বলি–হে মহাত্মন্। আজ হতে প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্বে যে দুটি দীন ও তুচ্ছ বাঙালি-বালক কম্পিতহৃদয়ে সাহায্যের জন্যে আপনার দ্বারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, দুঃখে সুখে তাদের দিন কেটে গিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন মধ্যপথেই বিদায় নিয়েছে, আর একজন পথের শেষে এসে অতিক্রান্ত অতীতের দিকে চেয়ে আপনাকে স্মরণ করছে। সেদিন তাদের জীবনে নেমেছিল ঘোর অন্ধকার, আশ্রয়দাতা হয়েছিল বিমুখ, বন্ধুরা নির্দয়ভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল–সমস্ত সংসার বিকট মূর্তি ধরে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ পৃথিবীর সেই বীভৎস মরুদাহে জীবন-লতা যখন শুষ্কপ্রায়, তখন দুর্দিনের সেই দারুণ দিনে আপনাকে অবলম্বন করে ঈশ্বরের যে করুণধারা তাদের ওপর বর্ষিত হয়েছিল সে-কথা তারা কোনোদিন ভোলেনি। তাদের চিত্তাকাশে সে-স্মৃতি চিরদিন ধ্রুবতারার মতোই জ্বলজ্বল করেছে। যতবার তা স্মরণ করেছি, ততবার কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধায় নত হয়েছি। আজ বিদায়বেলায় বিশেষ করে তাঁকে প্রণাম জানাচ্ছি।
পণ্ডিতজী নেমে যেতেই কোচোয়ান গাড়ি ঘুরিয়ে একটা গাছের ছায়ায় নিয়ে গিয়ে ঘোড়া খুলে দিলে। আমরা বসে আছি তো আছিই–আপিসে কতরকম লোক যাতায়াত করছে দেখছি। একবার দেখলুম, আমাদের সেই বাঙালি ইঞ্জিনীয়ার মশাই পাশ দিয়ে গাড়ি করে চলে গেলেন। বসে বসে ঢুলুনি এসে গেল। তখন দিনে ঘুমবো এমন সাধ্য ছিল না, তবুও দু’জনে এক ঘুম দিয়ে উঠলুম। কিন্তু তখনও দেখি, কোচোয়ান গাড়ির ছাতে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আর ঘোড়া-দুটো নিশ্চিন্তমনে ঘাস চিবুচ্ছে। ঘুমের ঝোঁকে দুপুরটার যেন অনেকখানি গড়িয়ে গেছে।
আরও কিছুক্ষণ এমনি নিশ্চিতভাবেই কেটে গেল। খানিকটা সময় পরে সহিস গাড়িতে ঘোড়া জুতলে ও যেখানে পণ্ডিতজীকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তারই কাছাকাছি গাড়িখানা আবার এনে রাখলে। তখনও আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। আরও কিছুক্ষণ বাদে পণ্ডিতজী হন্তদন্ত হয়ে এসে গাড়িতে চড়লেন। গাড়িতে উঠেই তিনি সেই আগের মতন হাসতে হাসতে বললেন, তোমাদের অনেকক্ষণ বসিয়ে রেখে কষ্ট দিলুম। তোমাদের পাঠিয়ে দিতে পারতুম, কিন্তু আগে যে পাঠিয়ে দিইনি তার কারণ বাড়িতে তোমাদের তো কেউ চেনে না। এ অবস্থায় সেখানে গিয়ে অসুবিধা হত। খুব কষ্ট হয়নি তো?
বললুম, না, কষ্ট কিসের! দিব্যি গাড়িতে বসে নানারকমের লোক দেখতে-দেখতে সময়টা কেটে গেল।
যা হোক, গাড়ি অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে একটা বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়াল। নদীর খুব কাছেই বাড়িটা। অনেকখানি জমির মধ্যে বাগান, তার চারপাশ পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা, সেই জমির মধ্যে একটা কোণে বাড়ি-অনেকটা ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের বাড়ির মতনই দেখতে।
পণ্ডিতজীর সঙ্গে আমরা দরজার কাছে আসতেই দেখলুম, একটি বারো-তেরো বছরের প্রিয়দর্শন ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছেলেটির চুল ছাঁটাই, পোশাক ও হালচাল দেখলেই মনে হয় যেন ফিরিঙ্গির ছেলে। পণ্ডিতজীকে দেখেই সে ছুটে এসে তাঁর হাত ধরলে, তারপর আমাদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, এরা কারা বাবা?
পণ্ডিতজী হাসতে হাসতে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। আমরাও তাঁর পিছু পিছু চললুম।
বাড়ির মধ্যে ঢুকে মনে হল বেশ বড় বাড়ি–প্রায় ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের মতন বললেই হয়। ওপরে উঠেই একটা বড় হল। সেখানকার আসবাবপত্র সব ইংরেজি কায়দায় সাজানো। শুধু ঘরের মাঝখানে ছাতের সিলিং থেকে একটা কাঠের দোলনা ঝুলছে। সেরকম দোলনা গুজরাটী ও মারাঠীদের বাড়িতেই শুধু দেখতে পাওয়া যায়। আমরা গোয়ালিয়রে অনেক বড়লোকের বাড়িতেও এইরকম দোলনার নানারকম সংস্করণ দেখেছিলুম। কিন্তু এত সুন্দর এত কারুকার্যমণ্ডিত দোলনা সেখানেও দেখিনি। এইরকম একটা কাঠের দোলনা একবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের ঘরে দেখেছিলুম। শুনেছিলুম, কে যেন সেটা তাঁকে উপহার দিয়েছে।
যাই হোক, আমাদের সেখানে বসতে বলে পণ্ডিতজী ছেলের হাত ধরে আর একদিকে চলে গেলেন।
আমরা ড্রয়িং-রুমে বসে রইলুম। দেশি ও বিলিতি দুই কায়দা মিলিয়ে ড্রয়িং-রুম সাজানো। দেওয়ালে অনেক ছবি টাঙানো রয়েছে, তার মধ্যে বিলিতি ছবিই বেশি–দু’চারখানা রবিবর্মার ছবিও আছে। এ ছাড়া অনেকগুলি বড় বড় ব্রোমাইড ফোটোও দেখলুম। এই ছবিগুলি সবই ইয়োরোপীয় নরনারীর। আশ্চর্যের বিষয়, এর মধ্যে একখানিও দেশি লোকের ছবি নেই। আমরা দেওয়ালের কাছে গিয়ে ছবিগুলি দেখছি–এমন সময় পণ্ডিতজী ছেলের হাত ধরে একেবারে ভোল ফিরিয়ে এসে উপস্থিত হলেন। খালি গায়ে একখানা রেশমের চাদর জড়ানো, পরনে একখানা ঘরে-কাঁচা ধুতি, খালি পা। আমাদের কাছে ডেকে নিয়ে সস্নেহে বললেন, তোমাদের সঙ্গে ভালো করে আলাপ করা হয়নি–সেজন্য আশা করি কিছু মনে করবে না। এতক্ষণে আমার অবসর হল। আমাকে সেই সকাল ন’টার সময় বেরুতে হয় আর বেলা দুটোর আগে আপিসের কাজ শেষ করতে পারি না। এই সময়টা এমন ব্যস্ত থাকতে হয় যে, পাশে কি হচ্ছে দেখবার সময় পাই না। এর মধ্যে আবার মাঝে মাঝে মফস্সলে যেতে হয় তদারকের কাজে। কিন্তু যাক সেসব কথা–বলেই একটু থেমে আবার শুরু করলেন, তোমার নাম কি?
নাম বললুম।
তারপরে সুকান্তকে বললেন, তোমার নাম?
সুকান্ত নাম বললে।
পণ্ডিতজী বললেন, আমার নাম অম্বাপ্রসাদ পণ্ডিত। তারপরে, তোমাদের বাড়িতে কে আছেন?
বললুম, বাড়িতে সবাই আছেন, কিন্তু আমরা চাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে, বাড়ির কারুর সাহায্য ব্যতিরেকে।
পণ্ডিতজী সেইরকম ঘর-ফাটানো উচ্চহাস্যে ঘর ফাটিয়ে চারিদিক কাঁপিয়ে তুলে বললেন, বেশ বেশ–ভারি খুশি হলুম তোমাদের সঙ্কল্প শুনে। এই তো চাই। আচ্ছা, আর কোনো প্রশ্ন করে তোমাদের বিব্রত করতে চাই না। এখন আমার ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে তোমাদের আলাপ করিয়ে দিচ্ছি। এই আমার ছেলে, এর নাম শঙ্করপ্রসাদ পণ্ডিত। এরা পাহাড়ে থাকে ও সেখানকার ইংরেজদের ইস্কুলে পড়ে। এখানে ভালো ইস্কুল নেই, তাই সেখানে দিতে হয়েছে। আসছে বছরে এরা ভাই-বোন দু’জনেই ইংলন্ডে যাবে পড়তে। সেখানকার ইস্কুলের সঙ্গে চিঠিপত্র চলছে, আমি গিয়ে ওদের ভর্তি করে দিয়ে আসব।
এই অবধি বলে তিনি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায়, তোমার বোন কোথায়?
ছেলে তার মাতৃভাষায় কি বললে, বুঝতে পারলুম না। পণ্ডিতজী ডাকতে লাগলেন, দেবী–দেবী-
কিছুক্ষণ ডাকাডাকি করবার পর নিঃশব্দে দরজার কাছে একটি মেয়ে এসে দাঁড়াল। আমার চোখ-দুটো এতক্ষণ তৃষ্ণাতুর পাখির মতন কোনো কিশোরীর আগমন-প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে ছিল, হঠাৎ সেই পথে যে এসে দাঁড়াল, প্রথম দৃষ্টিতে তাকে মনে হল অপূর্ব সুন্দরী–এ দৃশ্য আগে কখনও চোখে পড়েনি। এবার মনে হল, দেওয়ালে টাঙানো রবিবর্মার কোনো ছবি প্রাণ পেয়ে বুঝি চোখের সামনে এসে দাঁড়াল।
দীর্ঘাঙ্গী কিশোরী, ভারতীয় নারীর পক্ষে অসামান্য গৌরী। ভারতীয়ের পক্ষে ঈষৎ লালবর্ণ, সুবিন্যস্ত ঘন কেশ ঘাড় অবধি ঝুলে রয়েছে। সে অপূর্ব লাবণ্যমণ্ডিত তনুলতা দেখলে মুনিজনেরও চিত্তচাঞ্চল্য উপস্থিত হয়। কিশোরী হলে কি হবে, তার দেহসৌন্দর্য দেখে অকালেই যৌবন এসে তাকে আক্রমণ করেছে। কালোর ওপরে নানারঙের রেশমের সুতোর কাজ-করা একটি মারাঠী জামা তার গায়ে, আর পরনে একখানা লাল শাড়ি মারাঠী ধরনে অর্থাৎ কাছাকোঁচা দিয়ে পরা। আমি কলকাতা, বেনারস, গোয়ালিয়র ও অন্যান্য অনেক জায়গায় ইতিপূর্বে কাছা-কোঁচা-লাগানো মেয়ে দেখেছি। সত্যি বলতে কি, এই রকম করে শাড়ি-পরা আমার চোখে অত্যন্ত অভদ্র ও অসুন্দর মনে হয়েছে। একটি মারাত্মক প্যাঁচ মেরে বিধাতা আমার সে-ভুল ভেঙে দিলেন। শাড়ি যেমন করেই পরা হোক না কেন, ভদ্র-অভদ্র সুন্দর-অসুন্দর সবই নির্ভর করে যে পরেছে তার ওপরে। যাই হোক, দিব্যাঙ্গনা তো এসে দাঁড়ালেন এই পাপচক্ষুর সম্মুখে, কিন্তু তার সমস্ত শরীরেই যেন উড়ি উড়ি ভাব। হাতে একটা পেন্সিল ছিল সেটা একবার গালে ঠেকিয়েই মারাঠী ভাষায় জিজ্ঞাসা করলে, বাবা, আমায় ডাকছ?
আমরা যে এই নতুন লোক-দু’টি বাবার পাশেই বসে রয়েছি, সেদিকে দৃষ্টি-মাত্র না দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করকে কি-একটা প্রশ্ন করলে। আমি তো আগে থাকতেই অর্থাৎ দৃষ্টিপথে দেবী উদয় হবার আগেই সেদিকে তাকিয়ে ছিলুম–হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বোধহয় ওইরকম অসভ্যের মতন তাকিয়ে আছি দেখে তিরস্কারস্বরূপ চোখে একটা ভ্রূকুটি হেনে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলে, বাবা, ডাকছ কেন, বল?
পণ্ডিতজী হাস্যমুখে বললেন, হ্যাঁ বাবা, ডাকছিলুম তোমায়। তোমার সেই কলকাতার কথা মনে আছে? তখন তুমি খুব ছোট, তবুও একেবারে ভুলে যেতে নাও পার কলকাতা শহরের কথা। এদের বাড়ি সেই কলকাতায়। এদের সঙ্গে তোমার ভাব করিয়ে দিই এস। কলকাতায় এখন কত মজার কাণ্ড হচ্ছে–এদের কাছে শোন সেইসব কথা।
দেবী আবার দয়া করে চাইলেন আমাদের ওপর। চোখে আবার সেই ভ্রূকুটি ফুটে উঠল–এই ছোঁড়াগুলোর সঙ্গে ভাব করবার জন্যে আমায় ডাকা! বাবা যেন কি!
তারপর পরিষ্কার ইংরেজি সুরে ও ভাষায় বাবাকে বললে, বাবা, আমি এখন ভয়ানক ব্যস্ত আছি। একটা শক্ত অঙ্ক কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না, সেটাকে ঠিক না করে কোনো দিকে মন দিতে পারছি না।
স্খলিত আঁচলখানা দিয়ে কোনোরকমে দেহলতাকে জড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে যেমন সহসা দেবীর আগমন হয়েছিল। তেমনি, বেগে প্রস্থান হল।
মেয়ে চলে যেতেই পণ্ডিতজী আবার সেইরকম হো-হো করে হেসে বললেন, পাগলি! ওকে প্রথমে দেখলে মনে হয়, বোধহয় খুবই গর্বিতা কিন্তু মোটেই তা নয়–দু’একদিনের মধ্যেই বুঝতে পারবে যে, ও অত্যন্ত সরল, তবে একটু খেয়ালি। দেখ না, এখন অঙ্ক মাথায় ঢুকেছে, আর কোনো দিকেই মন নেই।
একটু পরেই একজন চাকর এসে জানালে যে, খাবার তৈরি। পণ্ডিতজী শঙ্করের হাত ধরে উঠে বললেন, চল, যাওয়া যাক। দেখ, আমি সকালবেলা বেরুবার সময় ভালো করে খেয়ে যাবার সময় পাই না, সমস্ত দিন বাদে এই একবার খাই–রাত্রে সামান্য একটু খাই–চল, যাওয়া যাক, তোমরাও নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত।
আমি বললুম, আমরা ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের ওখানে ভরপেট খেয়েছি, এখন খাবার কোনো স্পৃহা নেই।
পণ্ডিতজী আবার সেইরকম হেসে বললেন, আরে, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেবের ওখানে খেয়েছ তো কি হয়েছে? আচ্ছা, চল, না খাও তো অন্তত আমাকে সঙ্গদান করবে।
ড্রয়িং-রুম থেকে উঠে আমরা অপেক্ষাকৃত ছোট একটা ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলুম। দেখেই বোঝা যায়, সেটি খাবার ঘর। বড় একটা খাবার-টেবিল ঘরের মাঝখানে–তার চারিদিকে চেয়ার সাজানো। দু’দিকের দুই দেওয়াল ঘেঁষে দুটো বড় বড় সাইড-বোর্ড রয়েছে। তার ওপরে কাঁচের ডিনার-সেট সাজানো রয়েছে। টেবিলের মাঝখানে বড় সুদৃশ্য কাঁচের ফুলদানিতে নানা রঙের ফুল সাজানো।
পণ্ডিতজী নিজে বসে আমাদের বললেন, ব’স।
আমরা বসলুম। শঙ্কর তার বাপের পাশেই একটা চেয়ারে বসে কি সব বলতে লাগল। খানসামা এসে আমাদের প্রত্যেকের সামনেই একটা করে কাঁচের প্লেট রেখে গেল। আমার কিন্তু সেদিকে হুঁশ ছিল না। আমি ভাবছিলুম, মানুষের ভাগ্য কি অদ্ভুত রহস্যে আবৃত! এই আমি কালই নোভাসারির পথে পথে ‘ভিক্ষা দাও’ করে ঘুরে বেড়িয়েছি–একটা লোকেরও দয়া হয়নি, কেউ সহানুভূতির সঙ্গে একবার জিজ্ঞাসাও করেনি–তোমার বাড়ি কোথায়, কি চাই, কেন তোমার এমন অবস্থা! গভীর রাত্রে জ্বরের ঘোরে অজ্ঞাতপ্রায় হয়ে সেই অন্ধকারে অজানা দেশে পড়ে মরছিলুম–দুর্ভাগ্যের দূত সেখানে এসেও হানা দিতে ছাড়েনি। আর আজ ভাগ্যলক্ষ্মী এ কি খেলা শুরু করেছেন!
ঠন্ করে আওয়াজ হতে সংবিৎ ফিরে পেয়ে চেয়ে দেখি, আমার পাতে মোটা গোল একখানা সদ্য-ভাজা পরোটা–যাকে কলকাতায় ঢাকাই পরোটা বলে–পড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে।
পণ্ডিতজীর দিকে চাইতেই তিনি বললেন, খাও, ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়িতে খেয়েছ ও তো অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। ছেলেমানুষ তোমরা ওটুকু খেলে কোনো ক্ষতি হবে না।
খেতে খেতে পণ্ডিতজী গল্প করতে লাগলেন। বললেন, আমি জানি তোমরা আমিষ খাও। নিরামিষ খেতে তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে তো?
বললুম, এ-দেশে নিরামিষ খেয়ে খেয়ে আমাদের অভ্যেস হয়ে গেছে।
পণ্ডিতজী বললেন, আমাদের বাড়িতে মাছ-মাংস হয়।
এই কথা বলে তিনি তখুনি খানসামাকে ডেকে বললেন, দেখ আমাদের এখানে দু’জন মেহমান এসেছে, এদের জন্যে মাছ-মাংস করবে। বাংলাদেশের লোক এরা।
খানসামা চলে যেতেই বললেন, আমি আগে মাছ-মাংস খেতুম। অনেকদিন হল ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েরা মাছ-মাংস খায়।
বললুম, আমি কিন্তু জানতুম যে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণেরা মাছ-মাংস খান না।
পণ্ডিতজী টপ করে বললেন, আমরা তো মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ নই। আমাদের দেশ হচ্ছে সেই যোধপুর ও পাঞ্জাবের সীমান্তে। আমাদের কোনো পূর্বপুরুষ ইংরেজরা আসবার অনেক আগে সে-দেশ কোনো কারণে ছেড়ে এখানে এসে বসবাস আরম্ভ করেছিলেন। মূলত আমরা গৌড়-সারস্বত ব্রাহ্মণ। আমাদের আদি বাড়ি হচ্ছে কাশ্মীর দেশে। যাঁরা এ-দেশে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউ মহারাষ্ট্রীয়দের ঘরে বিবাহ করে একেবারে এ-দেশীয় বনে গিয়েছেন। আমার ঠাকুরদাই তো মহারাষ্ট্রীয় বিবাহ করেছিলেন। তিনি খুব বড় উকিল ছিলেন, দু-তিনবার বিলেতেও গিয়েছিলেন। ইংরেজদের সঙ্গে খুব মেলামেশা করতেন। তিনিই আমাদের পরিবারে মাছ-মাংস খাওয়ার প্রথা চালিয়ে গিয়েছেন। মহারাষ্ট্রীয়েরা এ-বিষয়ে অত্যন্ত গোঁড়া, এজন্য আমার ঠাকুরদার সঙ্গে ঠাকুরমার বনিবনাও হত না। আমার বাবাও মাছ-মাংস খাওয়ায় খুবই ওস্তাদ হয়ে উঠেছিলেন, এবং মহারাষ্ট্রীয়দের ঘরে বিবাহ করলে পাছে স্বামী-স্ত্রীতে অবনিবনা হয় সেজন্যে ঠাকুরদামশায় বাবার বিয়ে দিয়েছিলেন পাঞ্জাবী মেয়ের সঙ্গে। আমিও পাঞ্জাবী মেয়ে বিবাহ করেছিলাম। পাঞ্জাবীরা মাছ-মাংস খাওয়া সম্বন্ধে অনেক বেশি উদার।
আমি বললুম, মহারাষ্ট্রীয়েরা যে মাছ-মাংস খায় না সে আমি খুব ভালো করেই জানি এবং এ-বিষয়ে আমার খুব তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।
পণ্ডিতজী বললেন, তাই নাকি! কিরকম, কিরকম! শুনি তোমার অভিজ্ঞতা?
ইতিমধ্যে পাতে আরও পরোটা ও দু’-তিনরকম নিরামিষ তরকারি এসে পড়ল। কিছু কিছু মিষ্টিও আসতে লাগল। সন্দেশ-রসগোল্লার মতন সুখাদ্য না হলেও সেদিন তা ভালোই লাগতে লাগল। খেতে খেতে আমি আমাদের গোয়ালিয়রের চাকরি করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলুম। তারপরে আমাদের মাছ-মাংস খাওয়ার কথা শুনে সে-বাড়ির বড়-গিন্নি কিরকম ‘দূর হ, দূর হ’ বলতে বলতে ঝ্যাঁটা বার করেছিল ও তারপরে বিনায়কের মাথায় কিরকম করে হাঁড়ি ভর্তি গোবরজল ঢেলে দিয়েছিল–এইসব শুনে পণ্ডিতজী তো ঘর ফাটিয়ে টেবিল চাপড়ে হো-হো হাসতে আরম্ভ করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও হাসতে লাগল।
পণ্ডিতজী সেইরকম হাসতে হাসতে চেঁচাতে লাগলেন, দেবী দেবী–
কিন্তু দেবীর কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পণ্ডিতজী বললেন, আহা, দেবী থাকলে সে তোমার এই কাহিনি খুবই উপভোগ করত।
তারপরে হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক বলেছ, ওরা মাছ-মাংস সম্বন্ধে এই রকমই বটে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে ওঠবার আগেই আমরা পণ্ডিতজীর বাড়ির লোকদের মধ্যে গণ্য হয়ে গেলুম। তিনি বললেন, এ-বাড়িকে তোমাদের আপনার বাড়ি বলে মনে করবে। আমার এই অসহায় মাতৃহীন ছেলে-মেয়েকে তোমরা নিজেদের ভাই-বোন বলে মনে করো।
পণ্ডিতজীর কথা বলবার ধরন শুনে আমাদের চোখে জল এসে গেল। তিনি বললেন, এখন আমি ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম করব। তারপরে সেই সাড়ে সাতটা পর্যন্ত আমি আর কারুর সঙ্গে দেখা করি না–এ সময়টা আমি আমার মালিকের সঙ্গে একত্রে কাটাই। আচ্ছা, আবার সেই সন্ধের পর দেখা হবে।
এই কথা বলে তিনি শঙ্করকে বললেন, এদের বাড়ির সব জায়গা দেখাও।
পণ্ডিতজী নিজের ঘরে চলে গেলেন। শঙ্করের সঙ্গে আবার আমরা ড্রয়িং রুমে ফিরে এলুম। ড্রয়িং-রুমের একদিকে সুন্দর কারুকার্য করা কাঠের তাকে সব বই সাজানো ছিল–এরই মধ্যে একটা তাক মোটা মোটা অ্যালবামে ভর্তি। শঙ্কর আমাদের জিজ্ঞাসা করলে, ছবি দেখবে?
উত্তরের জন্যে আর অপেক্ষা না করেই সে একটা অ্যালবাম টেনে বার করে বললে, চল, ওখানে বসি।
তিনজনে একটা জায়গায় গিয়ে বসে ছবি দেখতে আরম্ভ করা গেল। শঙ্কর একটা পাতা ওলটায় আর এক-একটা ফোটোগ্রাফের বিবরণ দিতে আরম্ভ করে। এক পাতার বিবরণ শেষ হতে-না-হতে তার সেই অদ্ভুত হিন্দি ভাষার দম ফুরিয়ে এল। মারাঠী ভাষা সে জানে–মা পাঞ্জাবী মেয়ে হলেও মারাঠীই ছিল তাদের মাতৃভাষা। মা’র কাছ থেকে পাঞ্জাবী ভাষা শেখবার আগেই তিনি ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। আমরা হিন্দি ভাষা কতকটা বুঝতে পারি বলে এতক্ষণ সে হিন্দিতেই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু এবার আর না পেরে সে ইংরেজি ভাষায় বলতে আরম্ভ করলে। দেখলুম, সে চমৎকার ইংরেজি বলতে পারে। তখন তার তেরো বছর বয়স। ছ’বছর বয়স থেকে সে মুসৌরিতে ইংরেজদের ইস্কুলে পড়ছে। তার দিদিও একই সঙ্গে ইস্কুলে ভর্তি হয়। সে-সময় তার দিদির বয়স দশ বছর ছিল। তারা ইস্কুলে যাবার বছর দুই আগে তার মা মারা যান–মাকে তাদের একটু একটু মনে আছে। শঙ্কর বললে, আগামী বছর সে জুনিয়ার পরীক্ষা দেবে। তার দিদি জুনিয়ার পাশ করেছে, এইবছরই সে সিনিয়ার পরীক্ষা দেবে। ছবি দেখাতে আর দেখতে দেখতে এইসব গল্প হতে লাগল।
এক-একটা পাতা পণ্ডিতজীর ছবিতেই ভর্তি। পণ্ডিতজীর বাবা ছেলেবেলাতেই তাঁকে বিলেতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লেখাপড়া শেখার জন্যে,–সেই ছেলেবয়সেরও অনেক ছবি অ্যালবামে ছিল। পণ্ডিতজী বিলেতে গিয়েছিলেন ছেলেবয়সে এবং দেশে ফিরেছিলেন ত্রিশ বছর বয়সে। শঙ্কর আরও বললে যে, আগামী বছর তার দিদি সিনিয়ার পরীক্ষায় পাস করলে তার বাবা তাদের দু’জনকে বিলেতে নিয়ে গিয়ে ইস্কুল ও কলেজে ভর্তি করে দিয়ে আসবেন।
এমনি করে গল্প ও ছবি দেখায় মশগুল হয়ে কোথা দিয়ে সময় কেটে যাচ্ছে–এমন সময় হেলতে-দুলতে লীলায়িত ভঙ্গিতে দেবী ঢুকলেন ঘরের ভিতরে। আমরা যেখানে বসেছিলুম তারই একটু দূরে সে অঙ্গ এলিয়ে দিলে। মুখে তার প্রসন্ন হাসি–বোধহয় যে অঙ্কগুলো নিয়ে এতক্ষণ জানমারি চলছিল সেগুলোকে ঘায়েল করা হয়ে গেছে। দেবী আসতেই আমরা মুখ তুলে সেই আসল ছবির দিকে তাকিয়ে রইলুম। কিন্তু বৃথা–সে আমাদের দিকে একবার ভ্রূক্ষেপ করল না। একবার এক সেকেন্ডের জন্যে চোখাচোখি হতেই দেবী উঠে গিয়ে দূরের তাক থেকে একটা মোটা বই নিয়ে আবার সেই জায়গায় এসে মাথা নীচু করে বইয়ের পাতা উলটে যেতে লাগল। শঙ্কর আগের অ্যালবামখানা রেখে আবার একটা অ্যালবাম নিয়ে এল। এটাতে তার ঠাকুরমা, তার মা ও তাদের পরিবারের আরও অনেক মহিলার ফোটো ছিল। আমরা ছবি দেখছি ও শঙ্কর বকবক করে বকে চলেছে এমন সময় দেবী তার জায়গাতে বসেই তাকে যেন কি বললে। শঙ্কর মুখ তুলে দেওয়ালের ঘড়িটা দেখে আমাদের বললে, পাঁচটা বেজে গেছে, তোমরা কি চা খাও?
আমরা চা খাই জেনে সে কি বলতেই দেবী উঠে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে একজন চাকর এসে বললে, চা তৈরি–চলুন।
আমরা সেখান থেকে উঠে খাবার-ঘরের টেবিলে গিয়ে বসলুম–দেখি, দেবী চা তৈরি করছে। তৈরি হয়ে গেলে একটা বয়-মতন চাকর আমাদের সামনে কাপ এনে রাখলে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো প্লেট করে দু’রকম বিস্কুট ও দুটো একটা মিষ্টি এসে পড়ল। সবার শেষে একটা চায়ের কাপে চামচ ডুবিয়ে সেটা ঘোরাতে ঘোরাতে দেবী এসে টেবিলের একদিকে বসল। আমরা যেখানে বসেছিলুম দেবী তা থেকে বেশ খানিকটা দূরে বসে আস্তে আস্তে অন্যদিকে চেয়ে কাপে চুমুক দিতে লাগল। ইত্যবসরে আমরা প্লেট থেকে বিস্কুট তুলে নিয়ে খেলুম। দেবীর সঙ্গে কি করে আলাপ করা যায় ভাবছি–এমন সময় সে শঙ্করকে বললে, শঙ্কর, ওঁদের আর চা চাই কি না জিজ্ঞাসা কর।
আমি বললুম, আমায় দয়া করে আর এক কাপ চা দিন।
দেবী আমাকে কোনো কথা না বলে বয়টাকে বললে, এক কাপ চা ওঁকে দাও।
বয়টা তখুনি আর এক কাপ চা তৈরি করে এনে আমায় দিলে। ভাবছি, আর কি বলে আলাপ জমানো যায়, এমন সময় সুকান্তটা বলে উঠল, আমাদেরই খাওয়াচ্ছেন–কই, আপনি তো কিছুই খাচ্ছেন না?
সত্যিই দেবী চা ছাড়া আর কিছুই খেলে না। কিন্তু সে সুকান্তর অমন আপ্যায়ন-ভরা কথার কোনো জবাব না দিয়ে সামান্য একটু মাথা নাড়লে মাত্র।
সুকান্তর অবস্থা দেখে কোনো রকমে হাসি সামলে নতুন কাপে চুমুক দিতে লাগলুম। যাই হোক, চায়ের পালা বেশ সমারোহের সঙ্গে শেষ হল। একটুমাত্র দুঃখ রইল যে দেবী এখনও কথা বললে না। চা খাওয়ার পর শঙ্কর ও দেবী কোথায় উধাও হয়ে গেল।
আমরা সেদিন আর না বেরিয়ে বাড়িরই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। চারিদিকে বাতি জ্বালা হতেই আমরা আবার ড্রয়িংরুমে ফিরে এসে দেখি যে, সেই ঘরের এক কোণে একটি টেবিলে বসে শঙ্কর পড়াশুনো করছে। তাকে আর বিরক্ত না করে তাক থেকে এক-একটা বই টেনে নিয়ে আমরাও নাড়াচাড়া আরম্ভ করে দিলুম। বাড়ি একেবারে নিঃশব্দ, গোটা দুই-তিন চাঁকর দেখেছিলুম, কিন্তু তাদেরও কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না; শুধু ড্রয়িং-রুমের বড় ঘড়িটায় সময়ের পদক্ষেপ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে–টক্ টক্ টক্, আর আধঘণ্টা অন্তর অন্তর সে ঘোষণা করে চলেছে তার দিন-বিক্রান্তির কথা।
কি-একটা ছবি তন্ময় হয়ে দেখছিলুম। একবার মুখ তুলতেই দেখি, দেবদূতের মতন পণ্ডিতজী সস্মিত-মুখে আমার দিকে দেখছেন। সেদিন তাঁকে প্রায় সমস্ত দিন ধরেই দেখছি–আগেই বলেছি যে, তাঁর চেহারার মধ্যে এমন একটা বৈশিষ্ট্য ছিল যে দেখলেই মনে হত তিনি সাধারণ শ্রেণীর মানুষ নন। কিন্তু সেই রাত্রে মুখ তুলে হঠাৎ তাঁকে দেখে সত্যি-সত্যিই মনে হল–মানুষ এমন সুন্দরও হয়!
তাঁর মুখের ওপর–শুধু মুখের ওপরই নয়, আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম যে, তাঁর মুখমণ্ডলকে ঘিরে অতি ক্ষীণপ্রভ একটি জ্যোতি জ্বলজ্বল করছে। দেখলুম, তিনি একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছেন। প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়েছিল বটে, মৃদুহাস্যে মুখখানা ঝলমল করছে; কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল ওটা হাসি নয়–তাঁর মুখের ভাবই ওইরকম।
আমি তাঁকে দেখে দাঁড়িয়ে উঠতেই তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ব’স, ব’স।
তারপর তিনিও আমার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলেন, চা-টা খেয়েছ? কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
বললাম, চা খেয়েছি।
পণ্ডিতজী বললেন, দেখ, এই বিকেলবেলাটা আমি সংসারের কিছুই দেখতে পারি না। শঙ্কর ও দেবী এলে তারাই এই সময়টা সংসার চালায়; ওরা না থাকলে চাকর-বাকর চালায়। ওদেরও তো যাবার সময় হয়ে এল। তোমাদের এখানে যে কয়দিন এখন থাকতে হচ্ছে, ততদিন তোমরা নিজেরাই দেখে-শুনে চালিয়ে নেবে। তোমাদের আবার বলছি যে, এ পরিবারকে তোমরা নিজের পরিবার বলে মনে করো।
একটু পরে কোথা থেকে দেবী এল, সে বোধহয় অন্য কোনো ঘরে পড়াশুনো করছিল। দেবী এসেই জিজ্ঞাসা করলে, বাবা তোমরা কি এখন খাবে?
পণ্ডিতজী মেয়ের কথা শুনে আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, কি বল, এখন খাবে?
এ-কথার উত্তরে কি বলা উচিত তাই ভাবছিলুম, কারণ সারাদিনের খাদ্য তখনও পেটে গজ-গজ করছিল–এমন সময় আমাদের হয়ে পণ্ডিতজীই উত্তর দিয়ে দিলেন, আর একটু পরে হলে কি তোমাদের অসুবিধা হবে?
দেবী বললে, বেশ, আর একটু পরেই হবে।
পণ্ডিতজী কলকাতার গল্প করতে লাগলেন। কলকাতায় তিনি জীবনে বার-দুয়েক গিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, কলকাতার চেয়ে বোম্বাই শহর তাঁর ঢের বেশি ভালো লাগে।
জিজ্ঞাসা করলুম, বোম্বাই শহরে কি আপনার বাড়ি আছে?
পণ্ডিতজী বললেন, বোম্বাই শহরে আমাদের বাড়ি ছিল বলতে পার। আমার ঠাকুরদা ও বাবা সেখানে অনেক সম্পত্তি করেছিলেন। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর দেখলুম, চাকরি ও সেইসব সম্পত্তি–দুই রক্ষা করা আমার দ্বারা সম্ভব হয়ে উঠবে না। আমি সেইসব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছি। তাছাড়া আমার আর বছর-পাঁচেক চাকরি আছে–এর পর আমি বাকি জীবনটা ইউরোপে গিয়ে কাটাব স্থির করেছি। ফ্রান্সে আমার জমি কেনা আছে সমুদ্রের ধারে এক জায়গায়। হয় সেখানে বাড়ি করব, নয়তো ইংলন্ডের কোনো গ্রামে বাড়ি কিনব। কোথায় থাকব তা অনেকখানি নির্ভর করছে ছেলে-মেয়েদের ওপর। ওদের যে-জায়গা ভালো লাগবে সেইখানেই আমাকে থাকতে হবে। আমার ইচ্ছা ফ্রান্সেই থাকি। তবে কিছুই বলা যায় না, আমাদের ইচ্ছার চেয়ে যে অনেক শক্তিশালী আর একটি ইচ্ছা, এই জগতের সব কলকাঠি নাড়াচ্ছেন, তাঁর ইচ্ছাতে সবই ঘুরে যেতে পারে–
কথাটা বলেই সেই ঘর-ফাটানো উচ্চ হাসি তুললেন।
আমাদের কথার মধ্যে দেবীও দু’-একটা কথা বললে বটে, কিন্তু সে তার বাপকে উদ্দেশ করেই বললে। আমাদের উপস্থিতিকে একেবারে আমলই দিলে না। যাই হোক, একটু পরেই খেতে যাওয়া হল। পণ্ডিতজী রাতে খুব কমই খান–একটি বড় কাঁচের গেলাসের এক গেলাস দুধ একখানা চাপাটি একটু জেলি দিয়ে। দেবী ও শঙ্কর পরোটা খেতে লাগল, কিন্তু আমাদের প্রথমে ভাত দেওয়া হল। পণ্ডিতজী বললেন, আমি জানি তোমারা ভাতের ভক্ত। ওবেলা তোমাদের নিশ্চয়ই খেতে কষ্ট হয়েছিল।
পণ্ডিতজীকে বললুম, খাবার কষ্ট আমরা এত ভোগ করেছি যে যেমনই খাবার হোক না কেন, সোনা-হেন মুখ করে খেয়ে নিতে পারি। কাজেই খেতে পেলে আর কোনো কষ্ট পাই না–কষ্ট হয় না-খেতে পেলে।
কথাটা পণ্ডিতজী খুবই উপভোগ করলেন। তিনি হো-হো করে হেসে বললেন, তবু আমার এখানে যখন আছ তখন তোমাদের কোনো রকমে অসুবিধা না হয় তা দেখতে হবে বইকি।