সপ্তম পরিচ্ছেদ
১.
সব সমাজেরই নিচের তলায় একটা করে স্তর থাকে। সেই স্তরে ভালো ও মন্দ দিকে অনেক সুড়ঙ্গ থাকে। জটিল গোলকধাঁধার মতো কত সুড়ঙ্গপথ! ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিপ্লব কত সব তত্ত্ব ও নীতির সুড়ঙ্গপথ দেশের বিভিন্ন দিক ও অঞ্চলে প্রসারিত থাকে। যত সব অবান্তর চিন্তার এইসব সুড়ঙ্গপথেই জন্ম হয় এবং ক্রমে তারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেইসব চিন্তার প্রভাবে কত বৈপ্লবিক কাজকর্ম চলে সমাজের নিচের তলায়। আর সেই কাজের ফলে উপরতলাতে আসে এক পরিবর্তন।
উপরতলার সমাজ অনেক সময় তার নিচের তলায় কী সব কাজকর্ম হচ্ছে, তার কথা জানতেই পারে না। রুশো ভায়োজেনেসের হাতে এক ধারালো কুঠার তুলে দেন, ভায়োজেনেস তার পরিবর্তে তুলে দেন লণ্ঠন। ক্যালভিন ইতালীয় নাস্তিক হোসিনের সঙ্গে ঝগড়া করেন। সমাজের নিচের তলায় গোপনে যে প্রবল আলোড়ন চলবে তার আঘাতে সমাজের উপরতলায় এক রূপান্তর সংঘটিত হয়। এই আলোড়ন সমাজের উপরতলাটাকে প্রত্যক্ষভাবে স্পর্শ না করলেও তলায় তলায় গোপনে সমাজের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়েখুঁড়ে দিতে থাকে।
সমাজস্তরের গভীরে কেউ যদি নেমে যায় তা হলে সেখানে দেখবে শুধু শ্রমিক। যে স্তরে সমাজদর্শন কাজ করে সে স্তরে কাজকর্ম ভালোই হয়। কিন্তু তার নিচের স্তরে সব কিছুই সংশয়াত্মক, সব কিছুই ভয়ঙ্কর। সেই স্তরে সভ্যতার আলো প্রবেশ করতে পারে না। সেখানকার হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে পারে না মানুষ। সেখানে যত সব রাক্ষসের জন্ম হয়। যে মই দিয়ে নিচের তলার স্তরে নেমে যাওয়া হয় তার এক একটি আংটায় এক-একটি দর্শন, এক একটি তত্ত্ব দাঁড়িয়ে থাকে। এক একটি তত্ত্ব অনুসারে এক একজন লোক কাজ করে। হুসের তলায় লুথার, লুথারের তলায় দেকার্তে, দেখাতের তলায় ভলতেয়ার, ভলতেয়ারের তলায় কনভরসেত, কনভরসেতের তলায় রোবোসপিয়ার, রোবোসপিয়ারের তলায় মারাত, মারাতের তলায় বাবুফ… এইভাবে উপর থেকে নিচে নেমে গেছে। তার পর আর কিছু দেখা যায় না। শুধু কতকগুলি ছায়াচ্ছন্ন প্রেমূর্তি যাদের শুধু মনের চোখ দিয়ে দেখা যায় অস্পষ্টভাবে। তাদের মধ্যেই আছে ভবিষ্যতের প্রাণ। ভবিষ্যতের এক আকারহীন ভাবমূর্তি শুধু দার্শনিকের কল্পনায় ভাসতে থাকে। সেইসব ভাবমূর্তির আকারগুলো পরস্পরের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যায়।
সেই নিচের তলায় বিভিন্ন গ্যালারিতে সেন্ট সাইমন, ওয়েন, ফুরিয়েও আছেন। এক অদৃশ্য বন্ধনের দ্বারা তারা পরস্পরের সঙ্গে আবব্ধ হয়ে আছেন, যে বন্ধনের কথা তারা নিজেরাই জানেন না। তারা নিজেদের পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবেন। একজনের আলো অন্যজনের আলোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়ে পরে মিশে যায়। তাঁদের জীবন ও কর্ম উন্নত হলেও তার পরিণতি ছিল বড় মর্মান্তিক। তাঁদের মধ্যে যত পার্থক্যই থাক তাদের একটা মিল ছিল। তাঁরা সকলেই ছিলেন নিরাসক্ত। তবে তাদের শুধু একটাই লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্য হল সত্যের সন্ধান। তাঁদের মধ্যে যারা বড় তারা হয়তো স্বর্গ বা অনন্তলোকের সন্ধান পেয়েছেন, কিন্তু যারা বড় হতে পারেননি, তাঁদের চোখে থাকে শুধু অস্পষ্ট এক আলো।
কিন্তু আবার একদল আছে সমাজের নিচের তলায় যাদের চোখে কোনও আলোই নেই। যারা চোখে কিছু দেখতে পায় না। তাদের প্রতি আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। তাদের সামনে গিয়ে ভয়ে আমাদের কাঁপতে হয়। সব সমাজেরই নিচের তলায় এই ধরনের অনেক অন্ধ ছুঁচো আছে।
কিন্তু সমাজের নিচের তলার যত স্তরের কথা বলছি আমরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে গম্ভীর হচ্ছে তথাকথিত প্রগতি বা অবান্তর চিন্তাধারার গোপন সুড়ঙ্গপথ। মারাত, বাবুফ কেউ সে স্তরের তল খুঁজে পায় না। সমাজের সর্বনিম্ন সেই স্তর বা তলদেশই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। আসলে সেটা এক অন্ধকার গহ্বর যেখানে থাকে সেইসব মানুষ যারা মনের দিক থেকে একেবারে অন্ধ, যারা সত্যকে কোনওদিন দেখেনি এবং দেখতে চায়ও না।
.
২.
সমাজের সেই সর্বনিম্ন অন্ধকার গহ্বরের তলদেশে বিরাজ করে এক অন্তহীন অরাজকতা। সেখানে যত সব অন্ধ রাক্ষসগুলো ঝগড়া-মারামারি করে আর গর্জন করে ভয়ঙ্করভাবে। বিশ্বের অগ্রগতি সম্বন্ধে কোনও খবর রাখে না তারা। এ বিষয়ে কোনও চিন্তা করে না বা কোনও কথা বলে না। নিজেদের কামনাপূরণ ছাড়া আর কিছুই জানে না তারা। তাদের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর শূন্যতা আছে তা তারা জানে না। তাদের দুটি মাতা আছে; তা হল অজ্ঞতা আর দারিদ্র্য। তাদের জীবনে শুধু একটা নীতি আছে যার দ্বারা তারা সব সময় পরিচালিত হয়। সে নীতি হল দেহগত প্রয়োজন পরিতৃপ্তি। বাঘের মতোই ভয়ঙ্কর তাদের ক্ষুধা। দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝে লালিত-পালিত শিশু অন্ধকার জগতের এক অমোঘ নিয়মানুসারে একদিন পরিণত হয় এক পাকা অপরাধীতে। সমাজের সেই সর্বনিম্ন অন্ধকার স্তরে পরম সত্যের জন্য কোনও অনুসন্ধিৎসা নেই, আছে শুধু জড়বস্তুর প্রতি এক অকুণ্ঠ স্বীকৃতি। মানুষ সেখানে পরিণত হয় পশুর শিকারে। ক্ষুধা আর তৃষ্ণা কেন্দ্রচ্যুত করে নিয়ে বেড়ায় তাদের। শয়তান হওয়াই তাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই অন্ধকার গহ্বর হতেই একদিন কবি ও নরঘাতক লামেনেয়ারের উদ্ভব হয়।
আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা সমাজের উপরতলার স্তরে রাজনীতি, বিপ্লব আর ছাত্রদের দার্শনিক জগতের কথা বলেছি। সেখানে যারা থাকে স্বভাবতই তারা উচ্চমনা। তারা ভুল করে, দোষ করে ঠিক, কিন্তু তবু তারা শ্রদ্ধার পাত্র, কারণ তাদের ভুলের মধ্যেও এক ধরনের বীরত্ব আছে। তাদের শুধু জীবনে একটাই উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আছে এবং তা হল প্রগতি। কিন্তু এই প্রগতির গভীরে একবার উঁকি মেরে আমরা দেখব কী ধরনের বিভীষিকা আছে সেখানে।
সমাজের এই স্তরে থাকে যত সব তথাকথিত বিপ্লবীরা। সেখানে বিরাজ করে এক অজ্ঞতার অন্ধকার। তারা নিজেদের দার্শনিক বললেও কোনও দর্শনচিন্তার ধার ধারে না, তারা নিজেদের বিপ্লবী বললেও তাদের ছুরি কোনওদিন একটা কলমও কাটেনি। তারা কোনও বই বা খবরের কাগজের পাতা খোলে না কোনওদিন। অভিজাত শোষকদের মতো তারা মানুষকে ভুল তত্ত্ব ও নীতির দ্বারা প্রভাবিত করে। তাদের জীবনের লক্ষ্য শুধু একটাই এবং তা হল সব কিছু ধ্বংস করা।
তারা সব কিছুই ধ্বংস করতে চায়। তারা শুধু বর্তমান সমাজব্যবস্থার সবকিছু ধ্বংস করতে চায় না, সব বিজ্ঞান, দর্শন, নিয়ম-কানুন, চিন্তা-আদর্শ, সভ্যতা, প্রগতি এবং বিপ্লবকেও ধ্বংস করে আর নরহত্যাই তাদের একমাত্র কাজ। অজ্ঞতার প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত সেই অন্ধকার জগতের মধ্যে তারা চায় শুধু বিশৃঙ্খলা। সমাজের অন্য স্তরগুলো এইসব বিপ্লবীকে উচ্ছেদ করতে চায়। তাদের প্রগতির দর্শন, পরম সত্যের সন্ধান, সকল ভাবনাচিন্তা এবং প্রচেষ্টার এই হল ফলশ্রুতি। যে অজ্ঞতার অন্ধকার। সমাজের প্রকৃত শত্ৰু, সেই শত্রুকে নাশ করতে হবে।
সব মানুষই সমান। সব মানুষই একই মাটি হতে উদ্ভূত। একই ভাগ্যের শরিক সব মানুষ। একই শূন্যতা থেকে জন্মলাভ করি আমরা। আমাদের সকলের দেহে থাকে একই মাংস এবং মৃত্যুর পর একই ভস্মে পরিণত হই আমরা। কিন্তু যে অজ্ঞতার অন্ধকার দুরারোগ্য ব্যাধির মতো প্রতিটি আত্মাকে সংক্রমিত করে, তা নিঃসন্দেহে এক অশুভ অভিশাপ।
.
৩.
১৮৩০-৩৫ সাল পর্যন্ত চারটি শয়তান প্যারিসের সমাজজীবনের নিচের তলায় প্রভুত্ব করত। তাদের নাম হল ক্লাকেসাস, গুয়েলেমার, বাবেত আর মতপার্নোস।
গুয়েতেমার ছিল আধুনিক হাকিউলেস যে আর্কে মেরিয়ত আব্বনে বাস করত। তার চেহারাটা ছিল সাত ফুট লম্বা, হাতের পেশিগুলো ছিল ইস্পাতের মতো কঠিন, প্রশস্ত বক্ষস্থল –দেখতে দৈত্যের মতো, কিন্তু মস্তিষ্কটা পাখির মতো হালকা। তাকে দেখলেই মনে হত সে যেন সুতির পায়জামা আর মখমলের জ্যাকেটপরা এক আধুনিক যুগের হার্কিউলেস। তার বিশাল দেহের অমিত শক্তি দিয়ে সে যত সব মানুষরূপী দৈত্য-দানবদের জব্দ করতে পারত, কিন্তু তা না করে সে নিজেই একজন দানব হয়ে ওঠে এবং এইটাই হয়তো সহজ হয়ে ওঠে তার পক্ষে। বয়স তার চল্লিশের কিছু কমই হবে। মুখে ছিল অল্প। একটু দাড়ি, মাথার চুলগুলো ছোট করে ছাটা তার চেহারাটা চিত্রিত করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। তার হাতের পেশিগুলো কাজ চাইত, কিন্তু তার নির্বুদ্ধিতার জন্য সে কোনও কাজ করতে চাইত না। সে ছিল এক লক্ষ্যহীন কর্মহীন শক্তির মানুষ। মাঝে মাঝে সে মানুষ খুন করত। সে ছিল ক্রিওল উপজাতির লোক। ১৮৫৫ সালে সে মার্শাল ক্রনের অধীনে অভিযানে শ্রমিকের কাজ করত। এরপর সে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে।
বাবেতের রোগা রোগা চেহারাটা বিশালবপু গুয়েলেমারের একেবারে বিপরীত। বাবেত ছিল যেমন শীর্ণদেহ তেমনি চতুর। তাকে দেখতে খুব সরলমনা মনে হলেও আসলে তার প্রকৃতিটা ছিল যেমন গম্ভীর তেমনি দুর্বোধ্য। তার শীর্ণদেহের হাড়গুলোতে যেন উজ্জ্বল দিবালোকের ঢেউ খেলে যেত, কিন্তু সে আলোর কিছুমাত্র দেখা যেত না তার চোখে। সে বলত সে একজন কেমিস্ট বা ওষুধ প্রস্তুতকারক। কিন্তু আসলে সে মদের দোকানে কাজ করেছে আগে এবং বথিনোর সার্কাসে ভড়ের কাজ করে। সে খুব তাড়াতাড়ি কথা বলতে পারত এবং কথায় মানুষকে বশ করতে পারত। সে অনেক সময় মেলায় সঙু দেখাত। সে আবার পথে পথে ঘুরে দাঁত তোলার কাজও করে। সে ঘুরে ঘুরে। নিজের প্রচার নিজেই করে। তার গলার জোর খুব বেশি। তাছাড়া একটা গাড়ির উপর একটা প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে সে প্রচার করে বেড়ায়। সে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, দন্তশিল্পী বাবেত ধাতু এবং ধাতুজাত দ্রব্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকার্যে রত আছেন। তিনি দাঁত তোলেন এবং আগে ভোলা দাঁতের কোনও অবশিষ্টাংশ লেগে থাকলে সেটাও তুলে দেন। একটা দাঁত ভোলার জন্য ১.৫০ ফ্রাঁ, দুটি দাঁত তোলার জন্য ২.০০ স্ট্রা এবং তিনটি দাঁত তোলার জন্য ২.৫০ ফ্ৰাঁ লাগবে। এই সুযোগ হারাবেন না (তার মানে যে যত পারেন দাঁত তুলে নিন)। সে বিয়ে করেছিল এবং তার ছেলেপুলে ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী আর ছেলেমেয়েরা কোথায় আছে, তা সে জানে না। একটা রুমালের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। তাদের। একটা রুমাল যেমন মানুষ যেখানে-সেখানে ফেলে রেখে আসে তেমনি বাবেতও তার স্ত্রী ও সন্তানদের কোথায় ফেলে রাখে, তা সে নিজেই জানে না। সে খবরের কাগজের যতসব আজেবাজে খবরের ওপর জোর দিত। একবার মেসেঞ্জার নামে একটা সংবাদপত্রে সে একটা খবর পড়ে। কোথায় নাকি একজন মহিলা একটি গরুর বাছুরের মাথা প্রসব করেছে। খবরটা পড়ে সে বলে, এটা তো ভাগ্যের কথা। আমার স্ত্রীও এমনি এক সন্তান প্রসব করতে পারত। এরপর প্যারিসে চলে আসে বাবেত।
ক্লাকেসাস ছিল অন্ধকারের জীব। সে রাত্রির অন্ধকার নেমে না আসা পর্যন্ত তার আস্তানায় অপেক্ষা করত এবং অন্ধকার হলেই আস্তানা থেকে বেরিয়ে যেত এবং দিনের আলো ফুটে ওঠার আগেই সে ফিরে আসত তার আস্তানায়। রাত্রিবেলায় সে কোথায় যেত, কোথায় থাকত বা কী করত এবং তার আস্তানাই-বা কোথায় ছিল, তা কেউ জানত না। তার নামটাই আসলে ক্লাকেসাস ছিল কি না, তারও কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। একজন তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করায় সে রাগের সঙ্গে বলেছিল, আমার নাম যা-ই হোক তোমার কী? তুমি নিজের চরকায় তেল দাও। সে তার রাতের সহচরদেরও তার আসল নামটা কী, তা বলত না। বাবেত বলত, ক্লাকেসাসের দু রকম গলার স্বর আছে। কাউকে সে তার মুখটাও দেখাতে চাইত না। কেউ তার সামনে আলো নিয়ে এলে সে মুখোশ পরত সঙ্গে সঙ্গে। তার চালচলন সত্যিই বড় রহস্যময় ছিল। রহস্যময়ভাবে ঘুরে বেড়াত সে। সে কথাও বেশি বলত। কথা বলার থেকে খেত বেশি। সে ভূতের মতো হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যেত কোথায়, আবার হঠাৎ কোথা হতে এসে হাজির হত। মনে হত যেন সে মাটির ভেতর থেকে হঠাৎ উঠে এসেছে।
বেচারা মঁতপার্নেসির জন্য দুঃখ হয়। এদের সবার থেকে ছেলেমানুষ সে। তার বয়স কুড়িরও কম। সুন্দর মুখ। চেরি ফলের মতো লাল ঠোঁট, কালো চুল এবং চোখে ছিল বসন্তদিনের উজ্জ্বলতা। কিন্তু সব রকম পাপকাজ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত সে। সে ছেলেবেলা থেকেই ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াত এবং ক্রমে সে মরিয়া হয়ে ওঠে। চেহারাটা তার মেয়েলি ধরনের এবং সুন্দর হলেও বেশ বলিষ্ঠ ছিল। সে তার মাথায় টুপিটা বাঁ দিকে বাঁকিয়ে পরত বলে ডান দিকের চুলগুলো দেখা যেত। টেলকোটটা বেশ সুন্দর ছিল। সে-ও যখন-তখন মানুষ খুন করত এবং তার অপরাধের একমাত্র কারণ ছিল ভালো ভালো পোশাক পরার ইচ্ছা। যে মেয়ে প্রথম তার সুন্দর চোখের মোহে মুগ্ধ হয়ে সে-ই তার মধ্যে কামনার আগুন জ্বেলে দেয়। তার চেহারাটা সুন্দর বলে সে ভালো ভালো পোশাক পরে নিজেকে সাজাতে চাইত। কিন্তু রুজি-রোজগারের কোনও চেষ্টা ছিল না বলে টাকার জন্য তাকে অপরাধ করতে হত। মাত্র আঠারো বছর বয়সেই কয়েকটা খুন করার কৃতিত্ব অর্জন করে। তার মাথায় ছিল ঢেউখেলানো চুল, কোমরটা সরু, বুক এবং কাঁধ প্রুশিয়ার সামরিক অফিসারদের মতো। তার গলবন্ধনীটা সুন্দর করে লাগানো থাকত। কোটের বোতামে একটা ফুল লাগানো থাকত। মেয়েরা তার প্রশংসা করত। মঁতপার্নেসি ছিল যেন এক অন্ধকার জগতের ফোঁটা ফুল।
.
৪.
এই চারজনে মিলে একটা দল করেছিল। তারা আইনকে ফাঁকি দিয়ে ছদ্মবেশে বনে-পাহাড়ে যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াত। তারা যে কোনও সময়ে নিজেদের নামগুলো পাল্টে ফেলত এবং পোশাক পরিবর্তন করে পুলিশের চোখে ধুলো দিত। এক একসময় এক একরকম কৌশল অবলম্বন করত। তারা কখনও একা একা থাকত, আবার কখনও বা একসঙ্গে থাকত। যেন একই রাক্ষসের চারটে মুখ।
বাবেত, গুয়েতেমার, ক্লাকেসাস আর তপার্নেসি–এই চারজনে মিলে নানারকম অপরাধের এক প্রধান কার্যালয় গড়ে তুলেছিল। যারা তাদের মতো অপরাধ করে তাদের কুটিল উচ্চাভিলাষ পূরণ করে পারদর্শিতা দেখাত, তারাই ছিল তাদের কাছে আদর্শ মানুষ। তারা নানাভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলত অথবা পেছন থেকে ছুরি মারত। তারা একবার কোনও অপরাধের পরিকল্পনা করলে তা যেমন করে তোক কার্যকরী করে তুলঁত। কোনও কাজে কোনও বেশি লোকের দরকার হলে সে তোক জোগাড় করে ফেলত। কিছু বাড়তি লোক সব সময়ই তাদের হাতের কাছে থাকত।
রাত্রি হলে সালপেত্রিয়েরের একটা পোড়ো পতিত জমিতে চারজনে জড়ো হয়ে তারা। কী করবে না-করবে তা ঠিক করত। রাত্রিকালই ছিল তাদের কর্মকাল। দিন হলেই যেমন ভূতপ্রেত আর চোরেরা অদৃশ্য হয়ে যায় তেমনি তারাও অদৃশ্য হয়ে যেত দিনের বেলায়। এই চারজনের দলকে এককথায় বলা হত “পেনমিনেত্তে। একবার জেলে অ্যাসাইজ কোর্টের প্রেসিডেন্ট লামেনেয়ারকে একটা অপরাধের কথা জিজ্ঞাসা করেন। লামেনেয়ার বলে, এ অপরাধ সে করেনি। তখন প্রেসিডেন্ট তাকে জিজ্ঞাসা করেন, এ অপরাধ তা হলে কে করেছে? লামেনেয়ার তখন বলে, তা হলে পেনমিনেত্তে করে থাকবে। তার এক কথা ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে না পারলেও পুলিশ বুঝতে পারে। কারণ পুলিশ জানত পেনমিনেত্তে কী এবং তার সদস্য কারা। এই দলের লোকদের নামগুলো আজও পুলিশের খাতায় লেখা আছে। তারা সভ্যতার নিচের তলায় এক অন্ধকার জগতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠে। তাদের কারও কোনও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য বলে কিছু নেই। তারা সবাই মিলে একটা শ্রেণিকে গড়ে তুলেছে। তাই তাদের সকলের মধ্যে শ্রেণিগত বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকটিত দেখা যায়। সারারাত চুরি, জুয়েচুরি, খুন প্রভৃতি অপরাধমূলক কাজে ঘুরে বেড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে সকাল থেকে প্রায় সারাদিন ঘুমোয় তারা, ফলে দিনের বেলায় পথে কেউ তাদের দেখতে পায় না। তারা প্রেতের মতো ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন নাম নিয়ে। তারা আছে এবং যতদিন সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন না হবে ততদিন তারা থাকবে। তাদের একটা দল চলে গেলে আর একটা দল আসবে তাদের জায়গায়। পকেট মারা ও গলা কাটার কাজে সমান দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় তাদের। কার কোন পকেটে টাকা আছে তা তারা আগে ঠিক করে নেয়। সোনা-রুপো থাকলে যেন তার গন্ধ পায় তারা। শহরের নিরীহ লোকদের দেখলেই তারা চিনতে পারে এবং তাদের পিছু নেয়। কোনও বিদেশি অথবা গ্রাম থেকে আসা কোনও লোক দেখলেই শিকার দর্শনে উল্লসিত মাকড়সার মতো কাঁপতে থাকে তারা।
যেসব লোক তাদের গভীর রাত্রিতে কোনও নির্জন জায়গায় দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়। তারা সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তারা যেন সত্যিকারের মানুষ নয়, অন্ধকারের জীব। ছায়াশরীর। অন্ধকার থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে দানবিক জীবনযাপন করতে এসেছে।
এইসব অশুভ প্রেতাত্মার কবল থেকে মানুষকে মুক্ত করার উপায় কী? এর একমাত্র উপায় আলো, আরও আলো। কোনও বাদুড় কখনও সকালের আলোর সামনে দাঁড়াতে পারে না। সমাজের নিচের তলার সেই অন্ধকার স্তরগুলোকে এক বিরাট আলোকবন্যার দ্বারা আমরা প্লাবিত করে দিতে পারব যেদিন একমাত্র সেইদিন ওই সব অন্ধকারের অবাঞ্ছিত জীবগুলো চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাবে নিঃশেষে ও নিশ্চিহ্নভাবে।