তৃতীয় খণ্ড – সপ্তম অধ্যায়: গুরুভাবে মথুরের প্রতি কৃপা
জানবাজারে মথুরের বাটীতে ঠাকুরকে লইয়া ৺দুর্গোৎসবের কথা
অহমাত্মা গুড়াকেশ সর্বভূতাশয়স্থিতঃ।
অহমাদিশ্চ মধ্যঞ্চ ভূতানামন্ত এব চ॥
– গীতা, ১০।২০
এ বৎসর মথুরানাথের জানবাজারের বাটীতে ৺দুর্গোৎসবে বিশেষ আনন্দ। কারণ, শ্রীশ্রীজগদম্বার পূজায় বৎসরে বৎসরে আবালবৃদ্ধবনিতার যে একটা অনির্বচনীয় আনন্দ, তাহা তো আছেই, তাহার উপর ‘বাবা’ আবার কয়েকদিন হইতে মথুরের বাটী পবিত্র করিয়া ঐ আনন্দ সহস্রগুণে বর্ধিত করিয়াছেন। কাজেই আনন্দের আর পরিসীমা নাই। মা-র নিকটে বালক যেমন আনন্দে আটখানা হইয়া নির্ভয়ে আবদার, অনুরোধ ও হেতুরহিত হাস্য-নৃত্যাদির চেষ্টা করিয়া থাকে, নিরন্তর ভাবাবেশে প্রতিমাতে জগন্মাতার সাক্ষাৎ আবির্ভাব প্রত্যক্ষ করিয়া ‘বাবার’ সেইরূপ অপূর্ব আচরণে, প্রতিমা বাস্তবিকই জীবন্ত জ্যোতির্ময়ী হইয়া যেন হাসিতেছেন! আর ঐ প্রতিমাতে মা-র আবেশ ও ঠাকুরের দেবদুর্লভ শরীর-মনে মা-র আবেশ একত্র সম্মিলিত হওয়ায় পূজার দালানের বায়ুমণ্ডল কি একটা অনির্বচনীয়, অনির্দেশ্য সাত্ত্বিক ভাবপ্রকাশে পূর্ণ বলিয়া অতি জড়মনেরও অনুভূতি হইতেছে! দালান জম জম করিতেছে – উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে! আর বাটীর সর্বত্র যেন সেই অদ্ভুত প্রকাশে অপূর্ব শ্রী ধারণ করিয়াছে!
হইবারই কথা। ধনী মথুরের রাজসিক ভক্তি, ঘর দ্বার ও মা-র প্রতিমা বিচিত্র সাজে সাজাইতে, পত্র পুষ্প ফল মূল মিষ্টান্নাদি পূজার দ্রব্যসম্ভারের অপর্যাপ্ত আয়োজনে এবং নহবতাদি বাদ্যভাণ্ডের বাহুল্যে মনোনিবেশ করিয়া বাহিরের কিছুরই যেমন ত্রুটি রাখে নাই, তেমনি আবার এ অদ্ভুত ঠাকুরের অলৌকিক দেবভাব বাহিরের ঐ জড় জিনিসসকলকে স্পর্শ করিয়া উহাদের ভিতর সত্য সত্যই একটা প্রাণপ্রতিষ্ঠা করিয়া দিয়াছে! কাজেই তুষারমণ্ডিত হিমালয়বক্ষে চিরশ্যামল দেবদারুকুঞ্জের গম্ভীর সৌন্দর্যে সাধু-তপস্বীর গৈরিক বসন যে শান্তিময় শোভা আনয়ন করে, সুন্দরী রমণীর কোলে স্তন্যপায়ী সুন্দর শিশু যে করুণামাখা সৌন্দর্যের বিস্তার করে, সুন্দর মুখে পবিত্র মনোভাব যে অপূর্ব প্রকাশ আনিয়া দেয়, মথুরবাবুর মহাভাগ্যোদয়ে তাঁহার ভবনে আজ সেই সৌন্দর্যের বিচিত্র সমাবেশ! পূজাসংক্রান্ত নানা কার্যের সুবন্দোবস্তে নিরন্তর ব্যস্ত থাকিলেও বাবু ও তাঁহার গৃহিণী যে ঐ ভাবসৌন্দর্য প্রাণে প্রাণে অনুভব করিয়া এক অব্যক্ত আনন্দে পূর্ণ হইতেছিলেন, এ কথা আর বলিতে হইবে না।
দিবসের পূজা শেষ হইল। তাঁহারাও কোনরূপে একটু সময় করিয়া ‘বাবার’ ও জগন্মাতার শ্রীচরণে মহানন্দে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিলেন।
ঠাকুরের ভাবসমাধি ও রূপ
সন্ধ্যা সমাগতা। এইবার শ্রীশ্রীজগন্মাতার আরাত্রিক হইবে। ‘বাবা’ এখন অন্দরে বিচিত্র ভাবে আবিষ্ট হইয়া তাঁহার পুরুষ-শরীরের কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়াছেন! কথায়, চেষ্টায় কেবলই প্রকাশ – যেন তিনি জন্মে জন্মে যুগে যুগে শ্রীশ্রীজগন্মাতার দাসী বা সখী। জগদম্বাই তাঁহার প্রাণ-মন, সর্বস্বের সর্বস্ব; মা-র সেবার জন্যই তাঁহার দেহ ও জীবনধারণ। ঠাকুরের মুখমণ্ডল ভাবে প্রেমে সমুজ্জ্বল, অধরে মৃদু মৃদু হাসি, চক্ষের চাহনি, হাত-পা নাড়া, অঙ্গভঙ্গী প্রভৃতি সমস্তই স্ত্রীলোকদিগের ন্যায়! ঠাকুরের পরিধানে মথুরবাবু-প্রদত্ত সুন্দর গরদের চেলি – স্ত্রীলোকদিগের ন্যায় করিয়া পরিয়াছেন – কে বলিবে যে, তিনি পুরুষ! ঠাকুরের রূপ তখন বাস্তবিকই যেন ফাটিয়া পড়িত – এমন সুন্দর রং ছিল; ভাবাবেশে সেই রং আরও উজ্জ্বল হইয়া উঠিত, শরীর দিয়া যেন একটা জ্যোতি বাহির হইত! সে রূপ দেখিয়া লোকে চক্ষু ফিরাইয়া লইতে পারিত না, অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিত! শ্রীশ্রীমা-র মুখে শুনিয়াছি, ঠাকুর শ্রীঅঙ্গে যে স্বর্ণ-ইষ্ট-কবচখানি তখন সর্বদা ধারণ করিতেন, তাহার সোনার রঙে ও গায়ের রঙে যেন মেশামেশি হইয়া এক হইয়া যাইত! ঠাকুরের নিজ মুখেও শুনিয়াছি – “তখন তখন এমন রূপ হয়েছিল রে যে, লোকে চেয়ে থাকত; বুক মুখ সব সময় লাল হয়ে থাকত, আর গা দিয়ে যেন একটা জ্যোতি বেরুত! লোকে চেয়ে থাকত বলে একখানা মোটা চাদর সর্বক্ষণ মুড়ি দিয়ে থাকতুম, আর মাকে বলতুম, ‘মা, তোর বাহিরের রূপ তুই নে, আমাকে ভিতরের রূপ দে’, গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে চাপড়ে চাপড়ে বলতুম, ‘ভিতরে ঢুকে যা, ভিতরে ঢুকে যা’; তবে কতদিন পরে ওপরটা এই রকম মলিন হয়ে গেল।”
কামারপুকুরে ঠাকুরের রূপ-গুণে জনতার কথা
রূপের কথায় ঠাকুরের জীবনের আর একটি ঘটনা এখানে মনে আসিতেছে। এই সময় প্রতি বৎসর বর্ষার সময় ঠাকুর তিন-চারি মাস কাল জন্মভূমি কামারপুকুরে কাটাইয়া আসিতেন। কামারপুকুরে থাকিবার সময় মাঝে মাঝে শিওড় গ্রামে ভাগিনেয় হৃদয়ের বাড়িতেও যাইতেন। ঠাকুরের শ্বশুরালয় জয়রামবাটী গ্রামের ভিতর দিয়া শিওড়ে যাইবার পথ। সেখানকার লোকেরাও উপরোধ-অনুরোধ করিয়া ঠাকুরকে সেখানে কয়েক দিন এই অবসরে বাস করাইয়া লইতেন। ঠাকুরের পরম অনুগত ভক্ত ভাগিনেয় হৃদয় তখন সর্বদা ঠাকুরের সঙ্গে থাকিয়া তাঁহার সর্বপ্রকার সেবা করিতেন।
কামারপুকুরে থাকিবার কালে ঠাকুরকে দেখিবার ও তাঁহার মুখের দুটো কথা শুনিবার জন্য সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত গ্রামের স্ত্রী-পুরুষের ভিড় লাগিয়াই থাকিত। প্রত্যূষেই প্রতিবাসী স্ত্রীলোকেরা বাড়ির পাট-ঝাঁট সারিয়া স্নান করিয়া জল আনিবার জন্য কলসী কক্ষে লইয়া আসিতেন ও কলসীগুলি ঠাকুরের বাটীর নিকট হালদারপুকুরের পাড়ে রাখিয়া চাটুয্যেদের বাড়িতে আসিয়া বসিতেন; এবং ঠাকুরের বাটীর মেয়েদের ও ঠাকুরের সহিত কথাবার্তায় এক-আধ ঘণ্টা কাল কাটাইয়া পরে স্নানে যাইতেন। এইরূপ নিত্য হইত। এই অবকাশে আবার কেহ কেহ রাত্রে বাটীতে কোন ভালমন্দ মিষ্টান্নাদি তৈয়ার করা হইলে, তাহার অগ্রভাগ তুলিয়া রাখিয়া তাহা লইয়া আসিয়া ঠাকুরকে দিয়া যাইতেন। রঙ্গরসপ্রিয় ঠাকুর ইঁহারা রাত্রি প্রভাত হইতে না হইতে আসিয়া উপস্থিত হন দেখিয়া কখনো কখনো রঙ্গ করিয়া বলিতেন – “শ্রীবৃন্দাবনে নানাভাবে নানা সময়ে শ্রীকৃষ্ণের সহিত গোপীদের মিলন হতো – পুলিনে জল আনতে গিয়ে গোষ্ঠ-মিলন, সন্ধ্যাবেলা ঠাকুর যখন গরু চরিয়ে ফিরতেন তখন গোধূলি-মিলন, তারপর রাত্রে রাসে মিলন – এই রকম, এই রকম সব আছে। তা, হাঁগা, এটা কি তোদের স্নানের সময়ের মিলন নাকি?” তাঁহারা ঠাকুরের কথা শুনিয়া হাসিয়া গড়াগড়ি দিতেন। মেয়েরা দিবসের রন্ধনাদি করিতে চলিয়া যাইবার পর পাড়ার পুরুষেরা ঠাকুরের নিকট আসিয়া যাহার যতক্ষণ ইচ্ছা বসিয়া কথাবার্তা কহিত। অপরাহ্ণে আবার স্ত্রীলোকেরা আসিত এবং সন্ধ্যার পর রাত্রে আবার পুরুষদের কেহ কেহ আসিয়া উপস্থিত হইত। আর দূর-দূরান্তর হইতে যে সকল স্ত্রী-পুরুষেরা আসিত, তাহারা প্রায় অপরাহ্ণেই আসিয়া সন্ধ্যার পূর্বেই চলিয়া যাইত। এইরূপে সমস্ত দিন রথ-দোলের ভিড় লাগিয়া থাকিত।
ঠাকুরের রূপ লইয়া ঘটনা ও তাঁহার দীনভাব
একবার কামারপুকুর হইতে ঐরূপে জয়রামবাটী ও শিওড় যাইবার বন্দোবস্ত হইয়াছে। অনুক্ষণ ভাবসমাধিতে থাকায় ঠাকুরের অঙ্গ বালক বা স্ত্রীলোকের ন্যায় সুকোমল হইয়া গিয়াছিল। অল্প দূর হইলেও পালকি, গাড়ি ভিন্ন যাইতে পারিতেন না। সেজন্য জয়রামবাটী হইয়া শিওড় যাইবার জন্য পালকি আনা হইয়াছে। হৃদয় সঙ্গে যাইবার জন্য প্রস্তুত। ঠাকুর আহারান্তে পান খাইতে খাইতে লাল চেলি পরিয়া, হস্তে সুবর্ণ ইষ্ট-কবচ ধারণ করিয়া পালকিতে উঠিতে আসিলেন। দেখেন, রাস্তায় পালকির নিকটে ভিড় লাগিয়া গিয়াছে; চারিদিকে স্ত্রী-পুরুষ দাঁড়াইয়া আছে! দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া হৃদয়কে জিজ্ঞাসা করিলেন – “হৃদু, এত ভিড় কিসের রে?”
হৃদয় – কিসের আর? এই তুমি আজ ওখানে যাবে, (লোকদিগকে দেখাইয়া) এরা এখন আর তোমাকে কিছুদিন দেখতে পাবে না, তাই সব তোমায় দেখতে এসেছে।
ঠাকুর – আমাকে তো রোজ দেখে; আজ আবার কি নূতন দেখবে?
হৃদয় – এই চেলি পরে সাজলে গুজলে, পান খেয়ে তোমার ঠোঁট দুখানি লাল টুকটুকে হলে খুব সুন্দর দেখায়; তাই সব দেখবে আর কি?
তাঁহার সুন্দর রূপে ইহারা আকৃষ্ট, শুনিয়াই ঠাকুরের মন এক অপূর্ব ভাবে পূর্ণ হইল। ভাবিলেন – হায় হায়! এরা সব এই দুই দিনের বাহিরের রূপটা লইয়াই ব্যস্ত, ভিতরে যিনি রহিয়াছেন, তাঁহাকে কেহ দেখিতে চায় না!
রূপে বিতৃষ্ণা তো তাঁহার পূর্ব হইতেই ছিল; এই ঘটনায় তাহা আরও সহস্রগুণে বর্ধিত হইল। বলিলেন –
“কি? একটা মানুষকে মানুষ দেখবার জন্য এত ভিড় করবে? যাঃ, আমি কোথাও যাব না। যেখানে যাব, সেইখানেই তো লোকে এই রকম ভিড় করবে?” – বলিয়াই ঠাকুর বাটীর ভিতরে নিজ কক্ষে যাইয়া কাপড়-চোপড় সব খুলিয়া ক্ষোভে দুঃখে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন। দীনভাবে পূর্ণ ঠাকুর সেদিন বাস্তবিকই জয়রামবাটী ও শিওড়ে যাইলেন না। হৃদয় ও বাটীর সকলে কত মতে বুঝাইল, সকলি ভাসিয়া গেল। আপনার শরীরটার উপর এ অলৌকিক পুরুষের যে কি তুচ্ছ, হেয় বুদ্ধি ছিল, তাহা একবার হে পাঠক, ভাবিয়া দেখ! আর ভাব আমাদের কথা, কি রূপ রূপ করিয়া পাগল! – কি মাজা-ঘষা, আরশি, চিরুণী, ক্ষুর, ভাঁড়, বেসন, সাবান, এসেন্স, পোমেডের ছড়াছড়ি! আর পাশ্চাত্যের অনুকরণে ‘হাড়মাসের খাঁচাটার’ উপর নিত্য ভ্রমের বাড়াবাড়ি করিয়া একেবারে উৎসন্ন যাইবার হুড়াহুড়ি! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকিয়া শুদ্ধ পবিত্রভাবে পূর্ণ থাকা, আর এটা – দুই কি এক কথা হে বাপু? যাক আমরা জানবাজারের পূর্ব কথাই বলি।
ঠাকুরের সমাধি ভাঙ্গাইতে জগদম্বা দাসীর কৌশল
জগদম্বার আরাত্রিক আরম্ভ হয় হয়, ঠাকুরের কিন্তু সে ভাব আর ভাঙে না! মথুরবাবুর পত্নী শ্রীমতী জগদম্বা দাসী ঠাকুরকে কোনরূপে প্রকৃতিস্থ করিয়া বাটীর স্ত্রীলোকদিগের সহিত আরতি দেখিতে যাইবেন মনে করিয়াছিলেন, কিন্তু ঠাকুরের ঐরূপ ভাবাবেশের বিরাম নাই দেখিয়া এবং তাঁহাকে একাকী ফেলিয়া যাওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত নয় ভাবিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ়া হইলেন। ভাবিলেন – করি কি? আমি যাহাকেই রাখিয়া চলিয়া যাইব, একবার আরতির বাজনা বাজিয়া উঠিলেই সে নিশ্চয়ই তথায় ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিবে। আর ‘বাবা’ও তো ভাবে বিহ্ব্ল হইলে নিজেকে নিজে সামলাইতে পারেন না। একবার তো ঐরূপে বাহ্যজ্ঞানশূন্য অবস্থায় গুলের আগুনের উপর পড়িয়া যাইয়াও হুঁশ হয় নাই – পরে সে ঘা কতদিনে কত চিকিৎসায় সারিয়াছে। একাকী রাখিয়া যাইলে এ আনন্দের দিনে পাছে ঐরূপ একটা বিভ্রাট হয় – তখন উপায়? কর্তাই বা কি বলিবেন? এইরূপ নানা চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ তাঁহার মনে একটা উপায় আসিয়া জুটিল। তাড়াতাড়ি নিজের বহুমূল্য গহনাসকল বাহির করিয়া বাবাকে পরাইতে পরাইতে তাঁহার কানের গোড়ায় বার বার বলিতে লাগিলেন, ‘বাবা, চল; মার যে আরতি হইবে, মাকে চামর করিবে না?’
ঠাকুরের সমাধি হইতে সাধারণ অবস্থায় নামিবার প্রকার শাস্ত্রসম্মত
ভাবাবেশে ঠাকুর যতই কেন বাহ্যজ্ঞানশূন্য হউন না, যে মূর্তি ও ভাবে তাঁহার মন সমাধিস্থ হইয়াছে, তাহা ছাড়া অপর সকল বস্তু, ব্যক্তি ও ভাব-সম্বন্ধ হইতে তাঁহার মন যতই কেন দূরে যাইয়া পড়ুক না, এটা কিন্তু সকল সময়েই দেখা গিয়াছে যে, ঐ মূর্তির নাম বা ঐ মূর্তির ভাবের অনুকূল কথা কয়েকবার ঠাকুরের কানের কাছে বলিলেই, তখনই তাঁহার মন উহাতে আকৃষ্ট হইত এবং উহা ধরিতে বুঝিতে সক্ষম হইত। একাগ্রচিত্তের নিয়ম ও আচরণ যে ঐরূপ হইয়া থাকে, তাহা মহামুনি পতঞ্জলি প্রভৃতির যোগশাস্ত্রে সবিস্তার না হউক সাধারণভাবে লিপিবদ্ধ আছে। অতএব শাস্ত্রজ্ঞ পাঠকের ঠাকুরের মনের ঐরূপ আচরণের কথা বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। আর বহু পুণ্যফলে যাঁহারা কিছুমাত্রও চিত্তের একাগ্রতা জীবনে লাভ বা অনুভব করিয়াছেন, তাঁহারা আরও সহজে এ কথা বুঝিতে পারিবেন। অতএব আমরা প্রকৃত ঘটনারই অনুসরণ করি।
সখীভাবে ঠাকুরের ৺দুর্গাদেবীকে চামর করা
মথুরবাবুর পত্নীর কথা ঠাকুরের কর্ণে প্রবেশ করিল। অমনি তিনি অনেকটা প্রকৃতিস্থ হইয়া অর্ধ-বাহ্যদশায় আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া তাঁহার সঙ্গে চলিলেন। তাঁহারা ঠাকুর-দালানে পৌঁছিবামাত্র আরতি আরম্ভ হইল। ঠাকুরও স্ত্রীগণপরিবৃত হইয়া চামরহস্তে প্রতিমাকে বীজন করিতে লাগিলেন। দালানের এক দিকে স্ত্রীলোকেরা এবং অপর দিকে মথুরবাবু-প্রমুখ পুরুষেরা দাঁড়াইয়া শ্রীশ্রীজগদম্বার আরতি দেখিতে লাগিলেন। সহসা মথুরবাবুর নয়ন স্ত্রীলোকদিগের দিকে পড়িবামাত্র দেখিলেন, তাঁহার পত্নীর পার্শ্বে বিচিত্রবস্ত্রভূষণে অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্যবিস্তার করিতে করিতে কে দাঁড়াইয়া চামর করিতেছেন! বার বার দেখিয়াও যখন বুঝিতে পারিলেন না তিনি কে, তখন ভাবিলেন, হয়তো তাঁহার পত্নীর পরিচিতা কোন সঙ্গতিপন্ন লোকের গৃহিণী নিমন্ত্রিতা হইয়া আসিয়াছেন।
আরতি সাঙ্গ হইল। অন্তঃপুরবাসিনীরা শ্রীশ্রীজগদম্বাকে প্রণাম করিয়া তাঁহাদের নির্দিষ্ট স্থানে চলিয়া গেলেন ও নিজ নিজ কার্যে ব্যাপৃতা হইলেন। ঠাকুরও ঐরূপ অর্ধবাহ্য অবস্থায় মথুরবাবুর পত্নীর সহিত ভিতরে যাইলেন এবং ক্রমে সম্পূর্ণ সাধারণ ভাবে প্রকৃতিস্থ হইয়া অলঙ্কারাদি খুলিয়া রাখিয়া বাহিরে পুরুষদিগের নিকট আসিয়া বসিলেন, ও নানা ধর্মপ্রসঙ্গ তুলিয়া দৃষ্টান্ত দ্বারা সকলকে সরলভাবে বুঝাইয়া চিত্তহরণ করিতে লাগিলেন।
মথুরের তাঁহাকে ঐ অবস্থায় চিনিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা
কিছুক্ষণ পরে মথুরবাবু কার্যান্তরে অন্দরে গিয়া কথায় কথায় তাঁহার পত্নীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আরতির সময় তোমার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া কে চামর করিতেছিলেন?” মথুরবাবুর পত্নী তাহাতে হাসিয়া বলিলেন, “তুমি চিনিতে পার নাই? বাবা ভাবাবস্থায় ঐরূপে চামর করিতেছিলেন। তা হইতেই পারে, মেয়েদের মতো কাপড়-চোপড় পরিলে বাবাকে পুরুষ বলিয়া মনে হয় না।” এই বলিয়া মথুরবাবুকে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা খুলিয়া বলিলেন। মথুরবাবু একেবারে অবাক হইয়া বলিলেন, “তাইতো বলি – সামান্য বিষয়েও না ধরা দিলে বাবাকে চেনে কার সাধ্য? দেখ না, চব্বিশ ঘণ্টা দেখে ও একত্র থেকেও আজ তাঁকে চিনতে পারলুম না।”
বিজয়া দশমী
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পরমানন্দে কাটিয়া গিয়াছে। আজ বিজয়া দশমীর প্রাতঃকাল। পুরোহিত তাড়াতাড়ি শ্রীশ্রীজগদম্বার সংক্ষেপ পূজা সারিয়া লইতেছে, কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দর্পণ-বিসর্জন করিতে হইবে। পরে সন্ধ্যার পর প্রতিমাবিসর্জন। মথুরবাবুর বাটীর সকলেরই মনে যেন একটা বিষাদের ছায়া – কিসের যেন একটা অব্যক্ত অপরিস্ফুট অভাব – যেন একটা হৃদয়ের অতি প্রিয় বস্তু বা ব্যক্তির সহিত অপরিহার্য আশু বিচ্ছেদাশঙ্কা! পৃথিবীর অতি বিশুদ্ধ আনন্দের পশ্চাতেও এইরূপ একটা বিষাদছায়া সর্বদা সংলগ্ন আছে। এই নিয়মের বশেই বোধ হয় অতি বড় ঈশ্বর-প্রেমিকের জীবনেও সময়ে সময়ে অসহ্য ঈশ্বরবিরহের সন্তাপ আসিয়া উপস্থিত হয়। আর কঠিন মানব, আমাদের হৃদয়ও বিজয়ার দিনে প্রতিমাবিসর্জন দিতে যাইয়া উষ্ণ অশ্রু বর্ষণ করে! মথুর-পত্নীর তো কথাই নাই – আজ প্রাতঃকাল হইতে হস্তে কর্ম করিতে করিতে অঞ্চলে অনেকবার নয়নাশ্রু মুছিয়া চক্ষু পরিষ্কার করিয়া লইতে হইতেছে।
মথুরের আনন্দে ঐ বিষয়ে হুঁশ না থাকা
বাহিরে মথুরবাবুর কিন্তু অদ্যকার কথা এখনও ধারণা হয় নাই। তিনি পূর্ববৎই আনন্দে উৎফুল্ল! শ্রীশ্রীজগদম্বাকে গৃহে আনিয়া এবং ‘বাবা’র অলোকসামান্য সঙ্গ ও অচিন্ত্য কৃপাবলে তিনি আনন্দে আত্মহারা হইয়া আপনাতে আপনি ভরপুর হইয়া রহিয়াছেন। বাহিরে কি হইবে না হইবে, তাহা এখন খোঁজে কে? খুঁজিবার আবশ্যকই বা কি? মাকে ও বাবাকে লইয়া এইরূপেই দিন কাটিবে। এমন সময় পুরোহিতের নিকট হইতে সংবাদ আসিল – এইবার মা-র বিসর্জন হইবে, বাবুকে নিচে আসিয়া মাকে প্রণাম-বন্দনাদি করিয়া যাইতে বল।
দেবীমূর্তি-বিসর্জন দিবে না বলিয়া মথুরের সংকল্প
কথাটা মথুরবাবু প্রথম বুঝিতেই পারিলেন না। পুনরায় জিজ্ঞাসা করিয়া যখন বুঝিতে পারিলেন, তখন তাঁহার হুঁশ হইল – আজ বিজয়া দশমী! আর সেই জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে এক বিষম আঘাত পাইলেন। শোকে দুঃখে পূর্ণ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন, “আজ মাকে বিসর্জন দিতে হইবে – কেন? বাবা ও মা-র কৃপায় আমার তো কিছুরই অভাব নাই। মনের আনন্দের যেটুকু অভাব ছিল, তাহা তো বাড়িতে মা-র শুভাগমনে পূর্ণ হইয়াছে। তবে আবার কেন মাকে বিসর্জন দিয়া বিষাদ ডাকিয়া আনি? না, এ আনন্দের হাট আমি ভাঙিতে পারিব না। মা-র বিসর্জন, মনে হইলেও যেন প্রাণ কেমন করিয়া উঠে!” এরূপ নানা কথা ভাবিতে ও অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।
এদিকে সময় উত্তীর্ণ হয়। পুরোহিত লোকের উপর লোক পাঠাইতেছেন, বাবু একবার আসিয়া দাঁড়ান, মা-র বিসর্জন হইবে। মথুর বিষম বিরক্ত হইয়া বলিয়া পাঠাইলেন, “আমি মাকে বিসর্জন দিতে দিব না। যেমন পূজা হইতেছে, তেমনি পূজা হইবে। আমার অনভিমতে যদি কেহ বিসর্জন দেয় তো বিষম বিভ্রাট হইবে – খুনোখুনি পর্যন্ত হইতে পারে।” এই বলিয়া মথুরবাবু গম্ভীরভাবে বসিয়া রহিলেন। ভৃত্য বাবুর ঐরূপ ভাবান্তর দেখিয়া সভয়ে সরিয়া দাঁড়াইল এবং পূজার দালানে যাইয়া সকল কথা পুরোহিত মহাশয়কে জানাইল। সকলে অবাক!
সকলে বুঝাইলেও মথুরের উত্তর
তখন সকলে পরামর্শ করিয়া বাবু বাটীর ভিতরে যাঁহাদের সম্মান করিতেন, তাঁহাদের বুঝাইতে পাঠাইলেন। তাঁহারাও যাইলেন, বুঝাইলেন, কিন্তু বাবুর সে ভাবান্তর দূর করিতে পারিলেন না। বাবু তাঁহাদের কথায় কর্ণপাত না করিয়া বলিলেন, “কেন? আমি মা-র নিত্যপূজা করিব। মা-র কৃপায় আমার যখন সে ক্ষমতা আছে তখন কেন বিসর্জন দিব?” কাজেই তাঁহারা আর কি করেন, বিমর্ষভাবে ফিরিয়া আসিয়া সিদ্ধান্ত করিলেন – মাথা খারাপ হইয়াছে! কিন্তু ঐরূপ সিদ্ধান্ত করিলেই বা উপায় কি? হঠকারী মথুরকে বাটীর সকলেরই ভালরকম জানা ছিল! সকলেই জানিত, ক্রুদ্ধ হইলে বাবুর দিক-বিদিক-জ্ঞান থাকে না। কাজেই তাঁহার অনভিমতে দেবীর বিসর্জনের হুকুম দিয়া কে তাঁহার কোপে পড়িবে বল? সে বিষয়ে কেহই অগ্রসর হইলেন না। গিন্নির নিকট অতিরঞ্জিত হইয়া সংবাদ পৌঁছিল; তিনি ভয়ে ডরে অভিভূতা হইয়া ঠাকুরকে বুঝাইয়া বলিতে অনুরোধ করিলেন; কারণ, ‘বাবা’ ভিন্ন তাঁহাদের বিপদ হইতে উদ্ধার করিবার আর কে আছে? – বাবুর যদি বাস্তবিকই মাথা খারাপ হইয়া থাকে!
ঠাকুরের মথুরকে বুঝান
ঠাকুর যাইয়াই দেখিলেন, মথুরের মুখ গম্ভীর, রক্তবর্ণ, দুই চক্ষু লাল এবং কেমন যেন উন্মনা হইয়া ঘরের ভিতর বেড়াইয়া বেড়াইতেছেন। তাঁহাকে দেখিয়াই মথুর কাছে আসিলেন এবং বলিলেন, “বাবা, যে যাহাই বলুক, আমি মাকে প্রাণ থাকিতে বিসর্জন দিতে পারিব না। বলিয়া দিয়াছি, নিত্যপূজা করিব। মাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব?”
ঠাকুর তাঁহার বুকে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিলেন, “ওঃ – এই তোমার ভয়? তা মাকে ছেড়ে তোমায় থাকতে হবে কে বললে? আর বিসর্জন দিলেই বা তিনি যাবেন কোথায়? ছেলেকে ছেড়ে মা কি কখনো থাকতে পারে? এ তিন দিন বাইরে দালানে বসে তোমার পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে তোমার আরও নিকটে থেকে – সর্বদা তোমার হৃদয়ে বসে তোমার পূজা নেবেন।”
ঠাকুরের কথা ও স্পর্শের অদ্ভুত শক্তি
কি এক অদ্ভুত মোহিনী শক্তিই যে ঠাকুরের স্পর্শে ও কথায় ছিল, তাহা বলিয়া বুঝানো কঠিন! দেখা গিয়াছে, অনেক সময় লোকে আসিয়া তাঁহার সহিত কোন বিষয়ে বিরুদ্ধ মত অবলম্বন করিয়া খুব তর্ক করিতেছে – তাঁহার সিদ্ধান্ত কিছুতেই লইতেছে না, ঠাকুর তখন কৌশলে কোনরূপে তাহার অঙ্গস্পর্শ করিয়া দিতেন; আর অমনি তখন হইতে তাহার মনের স্রোত যেন ফিরিয়া যাইত এবং ঐ ব্যক্তি কথাটা গুটাইত – ঠাকুরের কথা বা সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ মানিয়া লইয়া! ঐ বিষয়ে তিনি আমাদের কাহারও কাহারও নিকট বলিয়াছেনও – “কথা কইতে কইতে অমন করে ছুঁয়ে দি কেন জানিস? যে শক্তিতে ওদের অমন গোঁ-টা থাকে, সেইটের জোর কমে গিয়ে ঠিক ঠিক সত্য বুঝতে পারবে বলে।” এইরূপে স্পর্শমাত্রেই অপরের যথার্থ সত্য উপলব্ধি করিবার পথের অন্তরায়স্বরূপ দণ্ডায়মান শক্তিসমূহকে নিজের ভিতর টানিয়া লইয়া তাহাদের প্রভাব কমাইয়া দেওয়া বা ঐসকলকে চিরকালের মতো একেবারে হরণ করার সম্বন্ধে অনেক দৃষ্টান্ত ঠাকুরের জীবনে দেখিয়াছি ও শুনিয়াছি। দেখিয়াছি, যে সকল কথা অপরের মুখ হইতে বাহির হইয়া কাহারও মনে কোনরূপ ভাবোদয় করিল না, সেই সকলই আবার তাঁহার মুখনিঃসৃত হইয়া মানবহৃদয়ে এমন অদম্য আঘাত করিয়াছে যে, সেইক্ষণ হইতে শ্রোতার জীবনের গতি পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে! সে সকল পাঠককে সবিস্তারে বলিবার অন্য কোন সময় চেষ্টা করিব। এখন মথুরবাবুর কথাই বলিয়া যাই।
মথুর প্রকৃতিস্থ কিরূপে হইয়াছিল
ঠাকুরের কথায় ও স্পর্শে মথুর ক্রমে প্রকৃতিস্থ হইলেন। তাঁহার ঐরূপে প্রকৃতিস্থ হওয়া, ঠাকুরের ইচ্ছা এবং স্পর্শে কোনরূপ দর্শনাদি হইয়াছিল কিনা, তাহা আমাদের জানা নাই। তবে মনে হয়, উহাই সম্ভব। মনে হয়, শ্রীশ্রীজগদম্বার মূর্তি তাঁহার হৃদয়কন্দর অপূর্ব আলোকে উজ্জ্বল করিয়া বিদ্যমান – দেখিতে পাইয়াই তাঁহার আনন্দ আরও শতগুণে উচ্ছলিত হইয়া উঠিয়া বাহিরের প্রতিমা রক্ষা করিবার মনে যে ঝোঁক উঠিয়াছিল, তাহা কমিয়া গিয়াছিল। যথার্থ গুরু এইরূপে উচ্চতর লক্ষ্যের উজ্জ্বল ছটায় শিষ্যের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়া দেন। কাজেই তখন নিম্নাঙ্গের ভাব-দর্শনাদি তাহার মন হইতে আপনা-আপনি খসিয়া যায়।
মথুরের ভক্তিবিশ্বাসের অবিচলতা ঠাকুরকে পরীক্ষার ফলে
মথুরের ভক্তি-বিশ্বাস আমাদের চক্ষে অদ্ভুত বলিয়া প্রতীত হইলেও উহা যে নানারূপে ঠাকুরকে যাচাইবার ফলেই উপস্থিত হইয়াছিল, সে বিষয়ে আর সন্দেহ নাই। মথুর ধন দিয়া, সুন্দরী রমণী দিয়া, নিজের ও বাটীর সকলের উপর অকুণ্ঠ প্রভুতা দিয়া, ঠাকুরের আত্মীয়বর্গ – যথা, হৃদয় প্রভৃতির জন্য অকাতরে অর্থব্যয় করিয়া, সকল ভাবে ঠাকুরকে যাচাইয়া দেখিয়াছিলেন – ইনি অপর সাধারণের ন্যায় বাহ্যিক কিছুতেই ভুলেন না। বাহ্যিক ভাব-ভক্তির কপটাবরণ ইঁহার সূক্ষ্ম দৃষ্টির কাছে অধিকক্ষণ আত্মগোপন করিয়া রাখিতে পারে না! আর নরহত্যাদি দুষ্কর্ম করিয়াও মন-মুখ এক করিয়া যথার্থ সরলভাবে যদি কেহ ইঁহার শরণ গ্রহণ করে, তবে তাহার সাত খুন মাপ করিয়া তাহাকে সাদরে গ্রহণ করেন, দিন দিন উচ্চ লক্ষ্য চিনিবার ও ধরিবার সামর্থ্য দেন এবং কি এক বিচিত্র শক্তি-বলে তাহার জন্য অসম্ভবও সম্ভব হইয়া দাঁড়ায়!
মথুরের ভাবসমাধিলাভের ইচ্ছা
ঠাকুরের সঙ্গে থাকিয়া এবং ভাবসমাধিতে তাঁহার অসীম আনন্দানুভব দেখিয়া বিষয়ী মথুরেরও এক সময়ে ইচ্ছা হইয়াছিল, ব্যাপারটা কি একবার দেখিবে ও বুঝিবে। মথুরের তখন হৃদয়ে দৃঢ় ধারণা হইয়াছে, ‘বাবা ইচ্ছামাত্রেই ও-সকল করিয়া দিতে পারেন। কারণ, শিব বল, কালী বল, ভগবান বল, কৃষ্ণ বল, রাম বল – সবই তো উনি নিজে! – তবে আর কি! কৃপা করিয়া কাহাকেও নিজের কোন মূর্তি যে দেখাইতে পারিবেন, ইহার আর বিচিত্র কি!’ বাস্তবিক ইহা এক কম অদ্ভুত ব্যাপার নহে। ঠাকুরের দর্শনলাভের পর যাহারাই তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াছে, তাহাদেরই ক্রমে ক্রমে এইরূপ ধারণার উদয় হইত! সকলেরই মনে হইত, উঁহার ইচ্ছায় অসম্ভবও সম্ভব হয় – উনি ইচ্ছামাত্রেই ধর্মজগতের সমস্ত সত্যই কাহাকেও উপলব্ধি করাইয়া দিতে পারেন। আধ্যাত্মিক শক্তি ও নিজ পূত চরিত্রবলে একজনের প্রাণেও ঐরূপ ভাবের উদয় করিতে পারা কঠিন – তো অনেকের প্রাণে! উহা কেবল এক অবতার-পুরুষেই সম্ভবে। তাঁহাদের অবতারত্বের বিশিষ্ট প্রমাণসমূহের মধ্যে ইহা একটি কম প্রমাণ নহে। আর, এ মিথ্যা, শঠতা ও প্রতারণার রাজ্যে তাঁহাদের নামে অনেক ভেল জুয়াচুরি চলিবে দেখিতে পাইয়াই, তাঁহারা সকলের সমক্ষে ডঙ্কা মারিয়া বলিয়া যান, “আমার অদর্শনের পর অনেক ভণ্ড ‘আমি অবতার, আমি দুর্বল জীবের শরণ ও মুক্তিদাতা’ বলিয়া তোমাদের সম্মুখে উপস্থিত হইবে; সাবধান, তাহাদের কথায় ভুলিও না।”1
1. ঈশা – (Matthew XXIV – 11, 23, 24, 25, 26).
ঐ জন্য ঠাকুরের নিকট প্রার্থনা
মথুরের মনে ঐরূপ ভাবের উদয় হইবামাত্র ঠাকুরকে যাইয়া ধরিলেন। বলিলেন, “বাবা, আমার যাহাতে ভাবসমাধি হয়, তাহা তোমায় করিয়া দিতেই হইবে।” ঠাকুর ঐরূপ স্থলে সকল সময়েই যেমন বলিতেন, সেইরূপই বলিয়াছিলেন, ইহা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। বলিলেন, “ওরে, কালে হবে, কালে হবে। একটা বিচি পুঁতবামাত্রই কি গাছ হয়ে তার ফল খেতে পাওয়া যায়? কেন, তুই তো বেশ আছিস – এদিক-ওদিক দুদিক চলছে। ও-সব হলে এদিক (সংসার) থেকে মন উঠে যাবে, তখন তোর বিষয়-আশয় সব রক্ষা করবে কে? বার ভূতে সব যে লুটে খাবে। তখন কি করবি?”
উদ্ধব ও গোপীদের দৃষ্টান্তে ঠাকুরের তাহাকে বুঝান
ও-সব কথা সেদিন শুনে কে? মথুর একেবারে ‘নাছোড়বান্দা’ – ‘বাবা’কে ভাবসমাধি করিয়া দিতেই হইবে। ঐরূপ বুঝানোয় ফল হইল না দেখিয়া ঠাকুর আর এক গ্রাম চড়াইয়া ধরিলেন। বলিলেন, “ওরে, ভক্তেরা কি দেখতে চায়? তারা সাক্ষাৎ সেবাই চায়। দেখলে শুনলে (ঈশ্বরের) ঐশ্বর্যজ্ঞানে ভয় আসে, ভালবাসা চাপা পড়ে। শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গেলে গোপীরা বিরহে আকুল! শ্রীকৃষ্ণ তাদের অবস্থা জেনে উদ্ধবকে বুঝাতে পাঠালেন। উদ্ধব জ্ঞানী কিনা! বৃন্দাবনের কান্নাকাটি ভাব, খাওয়ানো, পরানো ইত্যাদি উদ্ধব বুঝতে পারত না। গোপীদের শুদ্ধ ভালবাসাটাকে মায়িক ও ছোট বলে দেখত; তারও দেখে শুনে শিক্ষা হবে সেও এক কথা। উদ্ধব গিয়ে গোপীদের বুঝাতে লাগল – ‘তোমরা সব কৃষ্ণ, কৃষ্ণ বলে অমন কেন করছ? জান তো, তিনি ভগবান, সর্বত্র আছেন; তিনি মথুরায় আছেন আর বৃন্দাবনে নেই, এটা তো হতে পারে না। অমন করে হা-হুতাশ না করে একবার চক্ষু মুদে দেখ দেখি, দেখবে, তোমাদের হৃদয়মাঝে সেই নবঘনশ্যাম মুরলীবদন বনমালী সর্বদা রয়েছেন’ – ইত্যাদি। তাই শুনে গোপীরা বলেছিল, ‘উদ্ধব, তুমি কৃষ্ণসখা, জ্ঞানী, তুমি এসব কি কথা বলছ! আমরা কি ধ্যানী, না জ্ঞানী, না ঋষি-মুনির মতো জপ-তপ করে তাঁকে পেয়েছি? আমরা যাঁকে সাক্ষাৎ সাজিয়েছি-গুজিয়েছি, খাইয়েছি, পরিয়েছি, ধ্যান করে তাঁকে আবার ঐ সব করতে যাব? আমরা তা কি আর করতে পারি? যে মন দিয়ে ধ্যান-জপ করব, সে মন আমাদের থাকলে তো তা দিয়ে ঐসব করব! সে মন যে অনেক দিন হলো, কৃষ্ণপাদপদ্মে অর্পণ করেছি! আমাদের বলতে আমাদের কি আর কিছু আছে যে, তাইতে অহং-বুদ্ধি করে জপ করব?’ উদ্ধব তো শুনে অবাক! তখন সে গোপীদের কৃষ্ণের প্রতি ভালবাসা যে কত গভীর ও কি বস্তু, তা বুঝতে পেরে তাদের গুরু বলে প্রণাম করে চলে এল! এতেই দেখ না, ঠিক ঠিক ভক্ত কি তাঁকে দেখতে চায়? তাঁর সেবাতেই তার পরমানন্দ। তার অধিক – দেখা, শুনা, সে চায় না; তাতে তার ভাবের হানি হয়।”
ইহাতেও যখন মথুর বুঝিলেন না, তখন ঠাকুর বলিলেন, “তা কি জানি বাবু? মাকে বলব, তিনি যা হয় করবেন।”
মথুরের ভাবসমাধি হওয়া ও প্রার্থনা
তাহার কয়েক দিন পরেই মথুরের একদিন ভাবসমাধি! ঠাকুর বলিতেন, “আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। গিয়ে দেখি, যেন সে মানুষ নয়! চক্ষু লাল, জল পড়ছে; ঈশ্বরীয় কথা কইতে কইতে কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্চে! আর বুক থর থর করে কাঁপচে। আমাকে দেখে একেবারে পা-দুটো জড়িয়ে ধরে বললে, ‘বাবা ঘাট হয়েছে! আজ তিন দিন ধরে এই রকম, বিষয়কর্মের দিকে চেষ্টা করলেও কিছুতে মন যায় না! সব খানে খারাপ হয়ে গেল। তোমার ভাব তুমি ফিরিয়ে নাও, আমার চাই নে।’ বললুম – ‘কেন? তুই যে ভাব হোক, বলেছিলি?’ তখন সে বললে, ‘বলেছিলুম, আনন্দও আছে; কিন্তু হলে কি হয়, এদিকে যে সব যায়। বাবা, ও তোমার ভাব তোমাকেই সাজে। আমাদের ও সবে কাজ নেই! ফিরিয়ে নাও।’ তখন আমি হাসি আর বলি, ‘তোকে তো এ কথা আগেই বলেছি?’ সে বললে, ‘হাঁ বাবা, কিন্তু তখন কি অত-শত জানি যে, ভূতের মতো এসে ঘাড়ে চাপবে? আর তার গোঁয়ে আমার চব্বিশ ঘণ্টা ফিরতে হবে? – ইচ্ছা করলেও কিছু করতে পারব না!’ তখন তার বুকে আবার হাত বুলিয়ে দি!”
ত্যাগী না হইলে ভাবসমাধি স্থায়ী হয় না
বাস্তবিক ভাব বা সমাধি হইলেই হয় না। উহার বেগ সহ্য করিতে – উহাকে রক্ষা করিতে পারে কয়টা লোক? এতটুকু বাসনার পশ্চাৎটান থাকিতে উহা পারা অসম্ভব। ঈশ্বরীয় পথের পথিককে শাস্ত্র সেজন্যই পূর্ব হইতে নির্বাসনা হইতে বলিয়াছেন – ‘ত্যাগেনৈকেনামৃতত্বমানশুঃ’ – একমাত্র ত্যাগ ও বৈরাগ্যই অমৃতত্ব দিতে সমর্থ। ক্ষণিক ভাবোচ্ছ্বাসে নিম্নাঙ্গের সমাধি হইল, কিন্তু ভিতরে ধন হোক, মান হোক ইত্যাদি বাসনার রাশি গজ গজ করিতেছে, এরূপ লোকের ঐ ভাব কখনই স্থায়ী হয় না।
ঐ বিষয়ের দৃষ্টান্ত – কাশীপুরের বাগানে আনীত জনৈক ভক্ত যুবকের কথা
আচার্য শঙ্কর যেমন বলিয়াছেন –
আপাতবৈরাগ্যবতো মুমুক্ষূন্ ভবাব্ধিপারং প্রতিযাতুমুদ্যতান্।
আশাগ্রহো মজ্জয়তেঽন্তরালে, নিগৃহ্য কণ্ঠে বিনিবর্ত্য বেগাৎ॥
– বিবেকচূড়ামণি, ৭৯
অর্থাৎ, যথার্থ বৈরাগ্যরূপ সম্বল অগ্রে সংগ্রহ না করিয়া, ভবসমুদ্রের পারে যাইবার জন্য যাহারা অগ্রসর হয়, বাসনা-কুম্ভীর তাহাদের ঘাড়ে ধরিয়া ফিরাইয়া বলপূর্বক অতলজলে ডুবাইয়া দেয়। – বাস্তবিক, কতই না ঐরূপ দৃষ্টান্ত আমরা ঠাকুরের নিকট দেখিয়াছি! কাশীপুরের বাগানে ঠাকুর তখন অবস্থান করিতেছেন; একদিন কয়েকজন বৈষ্ণব ভক্ত একটি উন্মনা যুবককে সঙ্গে লইয়া উপস্থিত। ইঁহাদের পূর্বে কখনো আসিতে আমরা দেখি নাই। আসিবার কারণ, সঙ্গী যুবকটিকে একবার ঠাকুরকে দেখাইবেন এবং তাঁহার আধ্যাত্মিক কি অবস্থা সহসা উপস্থিত হইয়াছে, তদ্বিষয়ে ঠাকুরের মতামত শ্রবণ করিবেন। ঠাকুরের নিকট সংবাদ দেওয়া গেল।
যুবকটিকে দেখিলাম – বুক ও মুখ লাল, দীনভাবে সকলের পদধূলি গ্রহণ করিতেছে; ভগবানের নামে ঘন ঘন কম্পন ও পুলক; এবং দু-নয়নে অবিশ্রান্ত জলধারা বহায় চক্ষুর্দ্বয় রক্তিম ও কিঞ্চিৎ স্ফীতও হইয়াছে। দেখিতে শ্যামবর্ণ, না স্থূল না কৃশ, মুখমণ্ডল ও অবয়বাদি সুশ্রী এবং সুগঠিত, মস্তকে শিখা। পরিধানে একখানি মলিন সাদাধুতি, গায়ে উত্তরীয় ছিল না বলিয়াই মনে হয়; পায়ে জুতা নাই; এবং শরীর-সংস্কার বা রক্ষার বিষয়ে একেবারে উদাসীন! শুনিলাম – হরিসংকীর্তন করিতে করিতে একদিন সহসা এইরূপ উত্তেজিত অবস্থা উপস্থিত হইয়াছে। তদবধি আহার এক প্রকার নাই বলিলেই হয়, নিদ্রা নাই এবং ভগবানলাভ হইল না বলিয়া দিবারাত্র কান্নাকাটি ও ভূমে গড়াগড়ি! আজ কয়েক দিন হইল, ঐরূপ হইয়াছে।
আধ্যাত্মিক ভাবের আতিশয্যে উপস্থিত বিকারসকল চিনিবার ঠাকুরের শক্তি। গুরু যথার্থই ভবরোগ-বৈদ্য
আধ্যাত্মিক ভাবসমূহের আতিশয্যে মানবশরীরে যেসকল বিকার আসিয়া উপস্থিত হয়, তদ্বিষয় ধরিবার ও চিনিবার শক্তি ঠাকুরের যেমন দেখিয়াছি, এমন আর কুত্রাপি দেখি নাই! গুরুগীতাদিতে শ্রীগুরুকে ‘ভবরোগ-বৈদ্য’ ইত্যাদি শব্দে অভিহিত করা হইয়াছে; তাহার ভিতর যে এত গূঢ় অর্থ আছে, তাহা ঠাকুরের পুণ্যদর্শনলাভের পূর্বে একটুও বুঝি নাই। শ্রীগুরু যে বাস্তবিকই মানসিক রোগের বৈদ্য, এবং ভিন্ন ভিন্ন আধ্যাত্মিক ভাবে মানবমনে যে যে বিকার আসিয়া উপস্থিত হয়, তাহা দেখিবামাত্র চিনিয়া, লক্ষণ দেখিয়া ধরিয়া অনুকূল হইলে – উহা যাহাতে সাধকের মনে সহজ হইয়া দাঁড়ায় ও তাহাকে উচ্চতর ভাবসোপানে আরোহণ করিবার ক্ষমতা দেয়, তাহার এরূপে ব্যবস্থা করিয়া দেন এবং প্রতিকূল বুঝিলে তাহা যাহাতে সাধকের অনিষ্টসাধন না করিয়া ধীরে ধীরে অপনীত হইয়া যায়, তদ্বিষয়েরও ব্যবস্থা করেন, এ কথা পূর্বে কিছুই জানা ছিল না। ঠাকুরকে প্রতিদিন ঐরূপ করিতে দেখিয়াই মনে সে কথার দৃঢ় ধারণা হইয়াছে। দেখিয়াছি – পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম নির্বিকল্প সমাধিলাভ হইলে অমনি ঠাকুর ব্যবস্থা করিতেছেন, “তুই এখন কয়েকদিন কাহারও হাতে খাস নি, নিজে রেঁধে খাস। এ অবস্থায় বড় জোর নিজের মার হাতে খাওয়া চলে, অপর কারও হাতে খেলেই ঐ ভাব নষ্ট হয়ে যায়! পরে ঐটে সহজ হয়ে দাঁড়ালে, তখন আর ভয় নেই!” গোপালের মার বায়ুবৃদ্ধিতে শারীরিক যন্ত্রণা দেখিয়া বলিতেছেন, “ও যে তোমার হরি-বাই, ও গেলে কি নিয়ে থাকবে? ও থাকা চাই; তবে যখন বিশেষ কষ্ট হবে, তখন যা হোক কিছু খেও।” জনৈক ভক্তের বাহ্যিক শৌচে অত্যন্ত অভ্যাস ও অনুরাগের জন্য শরীর ভুলিয়া মন একেবারে ঈশ্বরে তন্ময় হয় না দেখিয়া গোপনে ব্যবস্থা করিতেছেন, “লোকে যেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করে, সেইখানকার মাটিতে তুমি একদিন ফোঁটা পরে ঈশ্বরকে ডেকো।” একজনের সংকীর্তনে উদ্দাম শারীরিক বিকার তাহার উন্নতির প্রতিকূল দেখিয়া তিরস্কার করিয়া বলিতেছেন, “শালা, আমায় ভাব দেখাতে এসেছেন। ঠিক ঠিক ভাব হলে কখনো এমন হয়? ডুবে যায়; স্থির হয়ে যায়। ও কি? স্থির হ, শান্ত হয়ে যা। (অপর সকলকে লক্ষ্য করিয়া) এ সব কেমন ভাব জান? যেমন এক ছটাক দুধ কড়ায় করে আগুনে বসিয়ে ফোটাচ্ছে; মনে হচ্চে, যেন কতই দুধ, এক কড়া; তারপর নামিয়ে দেখ, একটুও নেই, যেটুকু দুধ ছিল, সব কড়ার গায়েই লেগে গেছে।” একজনের মনোভাব বুঝিয়া বলিতেছেন, “যাঃ শালা, খেয়ে লে, পরে লে, সব করে লে, কিন্তু কোনটাই ধর্ম কচ্চিস বলে করিসনি”; ইত্যাদি কত লোকের কত কথাই বা বলিব!
ঐ যুবকের অবস্থা সম্বন্ধে ঠাকুরের মীমাংসা
সেই যুবককে দেখিয়াই এক্ষেত্রে ঠাকুর বলিলেন, “এ যে দেখচি মধুরভাবের1 পূর্বাভাস! কিন্তু এ অবস্থা এর থাকবে না, রাখতে পারবে না। এ অবস্থা রক্ষা করা বড় কঠিন। স্ত্রীলোককে ছুঁলেই (কামভাবে) এ ভাব আর থাকবে না! একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।” যাহা হউক, আগন্তুক ভক্তগণ ঠাকুরের কথায় যুবকটির যে মাথা খারাপ হয় নাই, এ বিষয়টি জানিয়া কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হইয়া ফিরিলেন। তাহার পর কিছু কাল গত হইলে সংবাদ পাওয়া গেল – ঠাকুর যাহা বলিয়াছিলেন, তাহাই হইয়াছে – যুবকটির কপাল ভাঙিয়াছে! সংকীর্তনের ক্ষণিক উত্তেজনায় সে ভাগ্যক্রমে যত উচ্চে উঠিয়াছিল, হায় হায় – ভাবাবসাদে দুৰ্ভাগ্যক্রমে আবার ততই নিম্নে নামিয়াছে! পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দ ঐরূপ হইবার ভয়েই সর্বদা জ্ঞানমিশ্রা ভক্তিরই পক্ষপাতী ছিলেন এবং ঐরূপ ভক্তির অনুষ্ঠান করিতে শিক্ষা দিতেন।
1. বৃন্দাবনে শ্রীমতী রাধারানীর যে সর্বাঙ্গসম্পূর্ণ ঊনবিংশ প্রকার অষ্টসাত্ত্বিক শারীরিক বিকার শ্রীকৃষ্ণপ্রেমে প্রকাশ পাইত, যথা – হাস্য, ক্রন্দন, অশ্রু, কম্প, পুলক, স্বেদ, মূর্ছা ইত্যাদি – বৈষ্ণব-শাস্ত্রে উহাই মধুরভাব বলিয়া নির্দিষ্ট হইয়াছে। মধুরভাবের পরাকাষ্ঠাকেই ‘মহাভাব’ বলে। ঐ মহাভাবেই ঊনবিংশ প্রকার শারীরিক বিকার ঈশ্বর-প্রেমে আসিয়া উপস্থিত হয়। উহা জীবের সর্বাঙ্গীণ হওয়া অসম্ভব বলিয়া কথিত আছে।
ঠাকুরের মথুরকে সকল বিষয় বালকের মত খুলিয়া বলা ও মতামত লওয়া
মথুরের যেমন ‘বাবা’র নিকট কোন বিষয় গোপন ছিল না, ‘বাবা’রও আবার মথুরের উপর ভাবসমাধির কাল ভিন্ন অপর সকল সময়ে, মাতার নিকট বালক যেমন, সখার নিকট সখা যেমন, অকপটে সকল কথা খুলিয়া বলে, পরামর্শ করে, মতামত সাদরে গ্রহণ করে ও ভালবাসার উপর নির্ভর করে, তেমনি ভাব ছিল। পরাবিদ্যার সর্বোচ্চ সোপানে আরোহণ করিলে মানবের অবস্থা যে উন্মাদ, পিশাচ বা বালকবৎ সাধারণ নয়নে প্রতীত হইয়া থাকে, শাস্ত্রের এ কথা আমরা পাঠককে পূর্বেই বলিয়াছি। শুধু তাহাই নহে, জগৎপূজ্য আচার্য শঙ্কর এ কথাও স্পষ্ট লিখিয়া গিয়াছেন যে, ঐরূপ মানব, অতুল রাজ-বৈভব উপভোগ করিয়া বা কৌপীনমাত্রৈকসম্বল ও ভিক্ষান্নে উদরপোষণ করিয়া ইতর-সাধারণে যাহাকে বড় সুখের অবস্থা বা বড় দুঃখের অবস্থা বলিয়া গণ্য করে, তাহার ভিতর থাকিয়াও, কিছুতেই বিচলিত হন না; সর্বদা আত্মানন্দে আপনাতে আপনি বিভোর হইয়া থাকেন।
ক্বচিন্মূঢ়ো বিদ্বান্ ক্বচিদপি মহারাজবিভবঃ
ক্বচিদ্ভ্রান্তঃ সৌম্যঃ ক্বচিদজগরাচারকলিতঃ।
ক্বচিৎ পাত্রীভূতঃ ক্বচিদবমতঃ ক্বাপ্যবিদিত-
শ্চরত্যেবং প্রাজ্ঞঃ সততপরমানন্দসুখিতঃ॥
– বিবেকচূড়ামণি, ৫৪৩
অর্থাৎ, ‘মুক্ত ব্যক্তি কখনো মূঢ়ের ন্যায়, আবার কখনো পণ্ডিতের ন্যায়, আবার কখনো বা রাজবৎ বিভবশালী হইয়া বিচরণ করেন। তাঁহাকে কখনো পাগলের ন্যায়, আবার কখনো ধীর, স্থির, বুদ্ধিমানের ন্যায় বলিয়া বোধ হয়। আবার কখনো বা তাঁহাকে নিত্যাবশ্যকীয় আহার্য প্রভৃতির জন্যও যাচ্ঞারহিত হইয়া অজগরের ন্যায় অবস্থান করিতে দেখা যায়। তিনি কোথাও বা বহু মান প্রাপ্ত হন, আবার কোথাও বা অপমানিত হন, আবার কোথাও বা একেবারে অপরিচিতভাবে থাকেন। এইরূপে সকল অবস্থায় তিনি পরমানন্দে বিভোর ও অবিচলিত থাকেন।’ জীবন্মুক্ত পুরুষদিগের সম্বন্ধেই যখন ঐ কথা, তখন মহামহিম অবতার-পুরুষদিগের ঐরূপে সর্বাবস্থায় অবিচলিত থাকা ও বালকবৎ ব্যবহার করাটা আর অধিক কথা কি? অতএব মথুরের সহিত ঠাকুরের ঐরূপ আচরণ কিছু বিচিত্র নহে। কিন্তু মথুরের তাঁহার সহিত ঐরূপ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ থাকিয়া এত কাল কাটাইতে পারাটা বড় কম ভাগ্যের কথা নহে!
মথুরের কল্যাণের দিকে ঠাকুরের কতদূর দৃষ্টি ছিল
কি একটা মধুর সম্বন্ধই না ঠাকুরের মথুরের সহিত ছিল! সাধনকালে এবং পরেও কখনো কোন জিনিসের আবশ্যক হইলে, অমনি তাহা মথুরকে বলা ছিল। সমাধিকালে বা অন্য সময়ে যাহা কিছু দর্শনাদি ও ভাব উপস্থিত হইত, তাহা মথুরকে বলিয়া “এটা কেন হলো, বল দেখি?” “ওটা তোমার মনে কি হয় – বল দেখি?” ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা ছিল। তাহার পয়সার যাহাতে সদ্ব্যয় হয়, দেবসেবার পয়সাতে যাহাতে যথার্থ দেবসেবা হইয়া অতিথি, কাঙাল, সাধু-সন্ত প্রভৃতি পালিত হয় ও তাহার পুণ্যসঞ্চয় হইয়া কল্যাণ হয়, সে বিষয়ে ঠাকুরের লক্ষ্য থাকিত – এইরূপ সকল বিষয়ে কত কথাই না আমরা শুনিয়াছি। পুণ্যবতী রানী রাসমণি ও মথুরের শরীর যাইবার অনেক পরে যখন আমরা সকলে ঠাকুরের নিকট গিয়াছি, তখনও ঠাকুরের মধ্যে মধ্যে ঐ ভাবের পরিচয় আমরা পাইয়াছি। একটি দৃষ্টান্ত দিলে এখানে মন্দ হইবে না।
ঐ বিষয়ক দৃষ্টান্ত – ফলহারিণী-পূজার প্রসাদ ঠাকুরের চাহিয়া লওয়া
মথুরের আমল হইতে বন্দোবস্ত ছিল, ৺মা কালী ও ৺রাধাগোবিন্দের ভোগরাগাদির পর বড় থালে করিয়া এক থাল প্রসাদী অন্নব্যঞ্জন ও এক থাল ফল-মূল-মিষ্টান্নাদি ঠাকুরের ঘরে নিত্য আসিবে ও ঠাকুর নিজে ও তাঁহার নিকট যাঁহারা উপস্থিত থাকিবেন, তাঁহারা প্রসাদ পাইবেন। তদ্ভিন্ন বিশেষ বিশেষ পর্বদিনে মা কালী ও রাধাগোবিন্দজীকে যে বিশেষ ভোগরাগাদি দেওয়া হইত, তাহারও কিয়দংশ ঐরূপে ঠাকুরের নিকট পৌঁছাইয়া দেওয়া হইত।
বর্ষাকাল। আজ ফলহারিণী পূজার দিন। এ দিনে ঠাকুরবাড়িতে বেশ একটি ছোট-খাট আনন্দোৎসব হইত। শ্রীশ্রীজগন্মাতা কালিকার বিশেষ পূজা করিয়া নানা প্রকারের ফল-মূল ভোগ-নিবেদন করা হইত। আজও তদ্রূপ হইতেছে। নহবত বাজিতেছে। ঠাকুরের নিকট অদ্য যোগানন্দ স্বামীজী প্রভৃতি কয়েকটি ভক্ত উপস্থিত আছেন।
বিশেষ বিশেষ পর্বদিনে ঠাকুরের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের ভাব-সমাধির স্বভাবতঃ উদয়
বিশেষ বিশেষ পর্বদিনে ঠাকুরের শরীর-মনে বিশেষ বিশেষ দেবভাব প্রকাশিত হইত। বৈষ্ণবদিগের পর্বদিনে বৈষ্ণবভাব এবং শাক্তদিগের পর্বদিনে শক্তিসম্বন্ধীয় ভাবসমূহ প্রকাশিত হইত। যথা, শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার সময়, বিশেষতঃ ঐ পূজার সন্ধিক্ষণে, অথবা ৺কালীপূজাদিকালে ঠাকুর শ্রীশ্রীজগদম্বার ভাবে আবিষ্ট, নিস্পন্দ ও কখনো কখনো বরাভয়কর পর্যন্ত হইয়া যাইতেন; জন্মাষ্টমী প্রভৃতি পর্বদিনে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীমতীর ভাবে আরূঢ় হওয়ায় কম্প-পুলকাদি অষ্টসাত্ত্বিক লক্ষণ তাঁহার শরীরে দেখা যাইত – এইরূপ। আবার ঐ ঐ ভাবাবেশ এত সহজে স্বাভাবিক ভাবে আসিয়া উপস্থিত হইত যে, উহা যে কোনরূপ বিশেষ চেষ্টার ফলে হইতেছে, একথা আদৌ মনে হইত না! বরং এমন দেখা গিয়াছে, ঐরূপ পর্বদিনে ঠাকুর আমাদের সহিত অন্য নানা প্রসঙ্গে কথায় খুব মাতিয়াছেন, ঐ দিনে ঈশ্বরের যে বিশেষ লীলাপ্রকাশ হইয়াছিল, সে কথা ভুলিয়াই গিয়াছেন, এমন সময় হঠাৎ তাঁহার মন ঐসকল বাহিরের ব্যাপার হইতে গুটাইয়া একেবারে ঈশ্বরের ঐ ভাবে যাইয়া তন্ময় হইয়া পড়িল! কে যেন জোর করিয়া ঐরূপ করাইয়া দিল! কলিকাতায় শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে আমরা ঐরূপ দৃষ্টান্ত অনেক দেখিয়াছি। ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখ একঘর লোকের সহিত কথা কহিতে কহিতে শ্রীশ্রীদুর্গাপূজার সন্ধিক্ষণে হঠাৎ ঠাকুরের ঐরূপ ভাবাবেশ হইল! তখনকার সেই হাস্যচ্ছটায় বিকশিত জ্যোতিঃপূর্ণ তাঁহার মুখমণ্ডল ও তাহার পূর্বক্ষণের অসুস্থতা-নিবন্ধন কালিমাপ্রাপ্ত বদন দেখিয়া কে বলিবে যে, ইনি সেই লোক – কে বলিবে, ইঁহার কোন অসুস্থতা আছে!
অদ্যকার ফলহারিণী পূজার দিনেও ঠাকুরের শরীর-মনে মধ্যে মধ্যে ঐরূপ ভাবাবেশ হইতেছে; কখনো বা তিনি আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া পঞ্চমবর্ষীয় শিশুর ন্যায় মা-র নাম গাহিয়া আনন্দে নৃত্য করিতেছেন। সকলে মুগ্ধ হইয়া সে অপূর্ব বদনশ্রীর প্রতি চাহিয়া রহিয়াছেন এবং সে অদৃষ্টপূর্ব দেবমানবের সঙ্গগুণে মনে কতপ্রকার অপূর্ব দিব্যভাব অনুভব করিতেছেন। মা-র পূজা সাঙ্গ হইতে প্রায় রাত্রি শেষ হইল। একটু বিশ্রাম করিতে না করিতেই প্রভাত।
বেলা প্রায় ৮।৯টার সময় ঠাকুর দেখিলেন যে, তাঁহার ঘরে যে প্রসাদী ফল-মূলাদি পাঠাইবার বন্দোবস্ত আছে, তাহা তখনো পৌঁছায় নাই। কালীঘরের পূজারী ভ্রাতুষ্পুত্র রামলালকে ডাকিয়া উহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কিছুই বলিতে পারিলেন না; বলিলেন – “সমস্ত প্রসাদী দ্রব্য দপ্তরখানায় খাজাঞ্চী মহাশয়ের নিকট যথারীতি প্রেরিত হইয়াছে; সেখান হইতে সকলকে, যাহার যেমন পাওনা বরাদ্দ আছে, বিতরিত হইতেছে; কিন্তু এখানকার (ঠাকুরের) জন্য এখনো কেন আসে নাই, বলিতে পারি না।” রামলালদাদার কথা শুনিয়াই ঠাকুর ব্যস্ত ও চিন্তিত হইলেন। “কেন এখনো দপ্তরখানা হইতে প্রসাদ আসিল না?” – ইহাকে জিজ্ঞাসা করেন, উহাকে জিজ্ঞাসা করেন, আর ঐ কথাই আলোচনা করেন! এইরূপে অল্পক্ষণ অপেক্ষা করিয়া যখন দেখিলেন – তখনো আসিল না, তখন চটিজুতাটি পরিয়া নিজেই খাজাঞ্চীর নিকট আসিয়া উপস্থিত! বলিলেন, “হ্যাঁগা, ও ঘরের (নিজের কক্ষ দেখাইয়া) বরাদ্দ পাওনা এখনো দেওয়া হয়নি কেন? ভুল হলো নাকি? চিরকেলে মামুলি বন্দোবস্ত, এখন ভুল হয়ে বন্ধ হবে, বড় অন্যায় কথা!” খাজাঞ্চী মহাশয় কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হইয়া বলিলেন – “এখনো আপনার ওখানে পৌঁছায়নি? বড় অন্যায় কথা! আমি এখনি পাঠাইয়া দিতেছি।”
ঠাকুরের ঐরূপে প্রসাদ চাহিয়া লওয়ায় যোগানন্দ স্বামীর চিন্তা
স্বামী যোগানন্দ তখন বালক। সত্কুলে বনেদী সাবর্ণ চৌধুরীদের ঘরে জন্ম, কাজেই মনে বেশ একটু অভিমানও ছিল। ঠাকুরবাড়ির খাজাঞ্চী, কর্মচারী, পূজারী প্রভৃতিদের একটা মানুষ বলিয়াই বোধ হইত না। তবে ঠাকুরের ভালবাসায় ও অহেতুক কৃপায় তাঁহার শ্রীপদে মাথা বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছেন; এবং রাসমণির বাগানের একপ্রকার পার্শ্বেই তাঁহাদের বাড়ি বলিলেও চলে। কাজেই ঠাকুরের নিকট নিত্য যাওয়া-আসার বেশ সুবিধা। আর না যাইয়াই বা করেন কি? ঠাকুরের অদ্ভুত আকর্ষণ যে জোর করিয়া নিয়মিত সময়ে টানিয়া লইয়া যায়! কিন্তু ঠাকুরকে মানেন বলিয়া কি আর ঠাকুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে প্রীতির সহিত আলাপ করা চলে? অতএব ‘প্রসাদী ফল-মূলাদি কেন আসিল না’ বলিয়া ঠাকুর ব্যস্ত হইলে তিনি বলিয়াই ফেলিলেন – “তা নাই বা এল মশায়, ভারি তো জিনিস! আপনার তো ও-সকল পেটে সয় না, ওর কিছুই তো খান না – তখন নাই বা দিলে?” আবার ঠাকুর যখন তাঁহার ঐরূপ কথায় কিছুমাত্র কর্ণপাত না করিয়া অল্পক্ষণ পরেই নিজে খাজাঞ্চীকে ঐ বিষয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে যাইলেন, তখন যোগীন ভাবিতে লাগিলেন – ‘কি আশ্চর্য! ইনি আজ সামান্য ফল-মূল-মিষ্টান্নের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন কেন? যাঁকে কিছুতে বিচলিত হতে দেখিনি, তাঁর আজ এ ভাব কেন?’ ভাবিয়া চিন্তিয়া বিশেষ কোনই কারণ না খুঁজিয়া পাইয়া শেষে সিদ্ধান্ত করিলেন – ‘বুঝিয়াছি! ঠাকুরই হন, আর যত বড় লোকই হন, আকরে টানে আর কি! বংশানুক্রমে চাল-কলা-বাঁধা পূজারী ব্রাহ্মণের ঘরে জন্ম নিয়েছেন, সে বংশের গুণ একটু না একটু থাকবে তো? তাই আর কি! বড় বড় বিষয়ে ব্যস্ত হন না, কিন্তু এ সামান্য বিষয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন! তা নহিলে, নিজে ও-সব খাবেন না, নিজের কোন দরকারেই লাগবে না, তবু তার জন্য এত ভাবনা কেন? বংশানুগত অভ্যাস!’
ঠাকুরের ঐরূপ করিবার কারণ নির্দেশ
যোগীন বা যোগানন্দ স্বামীজী এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া বসিয়া আছেন, এমন সময় ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন এবং তাঁহাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিলেন, “কি জানিস, রাসমণি দেবতার ভোগ হয়ে সাধু-সন্ত ভক্ত লোকে প্রসাদ পাবে বলে এতটা বিষয় দিয়ে গেচে। এখানে যা প্রসাদী জিনিস আসে, সে সব ভক্তেরাই খায়; ঈশ্বরকে জানবে বলে যারা সব এখানে আসে, তারাই খায়। এতে রাসমণির যে জন্য দেওয়া, তা সার্থক হয়। কিন্তু তার পর ওরা (ঠাকুরবাড়ির বামুনেরা) যা সব নিয়ে যায়, তার কি ওরূপ ব্যবহার হয়? চাল বেচে পয়সা করে! কারু কারু আবার বেশ্যা আছে; ঐসব নিয়ে গিয়ে তাদের খাওয়ায়, এইসব করে! রাসমণির যেজন্য দান, তার কিছুও অন্তত সার্থক হবে বলে এত করে ঝগড়া করি!” যোগীন স্বামীজী শুনিয়া অবাক। ঠাকুরের এ কাজেরও এত গূঢ় অর্থ!
মথুরের সহিত ঠাকুরের অদ্ভুত সম্বন্ধ
এইরূপে কি একটা মধুর সম্বন্ধই না ঠাকুর মথুরের সহিত পাতাইয়াছিলেন! মথুরের ভালবাসা ঘনীভূত হইয়া শেষে যে ‘বাবা’-অন্ত-প্রাণ হইয়াছিল, তাহা যে ঠাকুরের এইরূপ অহেতুক কৃপার ফলে, এ কথা বেশ বুঝিতে পারা যায়। তাহার পর ঠাকুরের বালকবৎ অবস্থা মথুরকে কম আকর্ষণ করে নাই। সাংসারিক সকল বিষয়ে অনভিজ্ঞ বালকের প্রতি কাহার মন না আকৃষ্ট হয়? নিকটে থাকিলে – ক্রীড়া-মত্ততায় পাছে তাহার কোন অনিষ্ট হয় বলিয়া ভয়চকিত নয়নে তাহার অকারণ-মধুর চেষ্টাদি দেখিতে ও তাহাকে রক্ষা করিতে কে না ত্রস্তভাবে অগ্রসর হয়? আর ঠাকুরের বালকভাবটাতে তো আর কৃত্রিমতা বা ভানের লেশমাত্র ছিল না! যখন তিনি ঐ ভাবে থাকিতেন, তখন তাঁহাকে ঠিক ঠিক আত্মরক্ষণাসমর্থ বালক বলিয়াই বোধ হইত! কাজেই তেজীয়ান, বুদ্ধিমান মথুরের তাঁহাকে সকল বিষয়ে রক্ষা করিবার স্বতই যে একটা চেষ্টার উদয় হইবে, তাহাতে আর বিচিত্রতা কি? অতএব একদিকে মথুর যেমন ঠাকুরের দৈবশক্তির উপর নির্ভর করিতেন, অপরদিকে তেমনি আবার তিনি ‘বাবা’কে অনভিজ্ঞ বালক জানিয়া সর্বদা রক্ষা করিতে প্রস্তুত থাকিতেন। সর্বজ্ঞ গুরুভাব ও অল্পজ্ঞ বালকভাবের ‘বাবা’তে এইরূপ বিচিত্র সমাবেশ দেখিয়া, মথুর বোধ হয় মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন যে, সাংসারিক সকল ব্যাপারে, এমনকি দেহরক্ষাদি-বিষয়েও তাঁহাকে ‘বাবা’কে রক্ষা করিতে হইবে; আর মানব-চক্ষু ও শক্তির অন্তরালে অবস্থিত সূক্ষ্ম পারমার্থিক ব্যাপারে ‘বাবা’ই তাঁহাকে রক্ষা করিবেন। অতএব একই কালে দেব ও মানব, সর্বজ্ঞ ও অল্পজ্ঞ, মহাজটিল বিপরীত ভাবসমষ্টির অপরূপ সম্মিলনভূমি এ অদ্ভুত ‘বাবা’র প্রতি মথুরের ভালবাসাটাও যে একটা জটিল ভাব ধারণ করিয়াছিল, এ কথা আমরা বেশ বুঝিতে পারি। ভাবমুখে অবস্থিত বরাভয়কর ‘বাবা’ মথুরের উপাস্য হইলেও বালকভাবাবিষ্ট সরলতা ও নির্ভরের ঘনমূর্তি সেই ‘বাবা’কেই আবার সময়ে সময়ে মথুরকে নানা কথায় ভুলাইতে ও বুঝাইতে হইত!
মথুরের কামকীটের কথা বলিয়া বালকভাবাপন্ন ঠাকুরকে বুঝান
বাবার জিজ্ঞাসিত বিষয়সকল বুঝাইবার উদ্ভাবনী শক্তিও মথুরের ভালবাসায় বেশ যোগাইত! মথুরের সহিত কথা কহিতে কহিতে হঠাৎ বহির্দেশে গমন করিয়া ‘বাবা’ একদিন চিন্তায় মুখখানি শুষ্ক করিয়া ফিরিয়া আসিয়া মথুরকে বলিলেন, “একি ব্যারাম হলো, বল দেখি? দেখলুম, প্রস্রাবের দ্বার দিয়ে শরীর থেকে যেন একটা পোকা বেরিয়ে গেল! শরীরের ভিতরে এমন তো কারুর পোকা থাকে না। আমার একি হলো?” ইতঃপূর্বেই যে ‘বাবা’ হয়তো গূঢ় আধ্যাত্মিক তত্ত্বসকল অপূর্ব সরলভাবে বুঝাইয়া মোহিত ও মুগ্ধ করিতেছিলেন, সেই ‘বাবা’ই এখন বালকের ন্যায় নিষ্কারণ ভাবিয়া অস্থির! মথুরের আশ্বাসবাক্য এবং বুদ্ধির উপর নির্ভর করিতেছেন! মথুর শুনিয়াই বলিলেন, “ও তো ভালই হয়েছে, বাবা! সকলের অঙ্গেই কামকীট আছে। উহাই তাদের মনে নানা কুভাবের উদয় করে কুকাজ করায়। মা-র কৃপায় তোমার অঙ্গ থেকে সেই কামকীট বেরিয়ে গেল! এতে এত ভাবনা কেন?” ‘বাবা’ শুনিয়াই বালকের ন্যায় আশ্বস্ত হইয়া বলিলেন, “ঠিক বলেছ; ভাগ্যিস তোমায় এ কথা বললুম, জিজ্ঞাসা করলুম!” বলিয়া বালকের ন্যায় ঐ কথায় আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।
মথুরের সহিত ঠাকুরের ভক্তদিগের আগমনের কথা
কথায় কথায় একদিন ‘বাবা’ বলিলেন, “দেখ, মা সব আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েচেন, এখানকার (ঠাকুরের নিজের) সব ঢের অন্তরঙ্গ আছে; তারা সব আসবে; এখান থেকে ঈশ্বরীয় বিষয় জানবে, শুনবে, প্রত্যক্ষ করবে; প্রেমভক্তি লাভ করবে; (নিজের শরীর দেখাইয়া) এ খোলটা দিয়ে মা অনেক খেলা খেলবেন, অনেকের উপকার করবেন, তাই এ খোলটা এখনও ভেঙে দেন নি – রেখেচেন। তুমি কি বল? এ সব কি মাথার ভুল, না ঠিক দেখেচি, বল দেখি?”
মথুর বলিলেন, “মাথার ভুল কেন হবে, বাবা? মা যখন তোমায় এ পর্যন্ত কোনটাই ভুল দেখান নাই, তখন এটাই বা কেন ভুল হবে? এটাও ঠিক হবে; এখনও তারা সব দেরি করচে কেন? (অন্তরঙ্গ ভক্তেরা) শিগ্গির শিগ্গির আসুক না, তাদের নিয়ে আনন্দ করি।”
‘বাবা’ও বুঝিয়া গেলেন, মা ওসব ঠিক দেখাইয়াছেন। বলিলেন, “কি জানি বাবু, কবে তারা সব আসবে; মা বলেছেন, দেখিয়েছেন, মার ইচ্ছায় যা হয় হবে।”
ঠাকুরের বালকভাবের দৃষ্টান্ত – সুষনিশাক তোলার কথা
রানী রাসমণির পুত্র ছিল না, চার কন্যা ছিল। মথুরবাবু তাঁহাদের মধ্যে তৃতীয়া ও কনিষ্ঠাকে পর পর বিবাহ করিয়াছিলেন। অবশ্য একজনের মৃত্যু হইলে অপরকে বিবাহ করিয়াছিলেন। জামাতাদিগের ভিতর বিষয় লইয়া পরে পাছে কোন গণ্ডগোল বাধে, এজন্য বুদ্ধিমতী রানী স্বয়ং বর্তমান থাকিতে থাকিতে প্রত্যেকের ভাগ নির্দিষ্ট করিয়া চিহ্নিত করিয়া দিয়া যান। ঐরূপে বিষয়ভাগ হইবার পরে একদিন মথুরবাবুর পত্নী বা সেজগিন্নি অপরের ভাগের এক পুষ্করিণীতে স্নান করিতে যাইয়া সুন্দর সুষনি শাক হইয়াছে দেখিয়া তুলিয়া লইয়া আসেন। কেবল ঠাকুর তাঁহার ঐ কার্য দেখিতে পাইয়াছিলেন। তাঁহার ঐরূপ কার্য দেখিয়াই ঠাকুরের মনে নানা তোলাপাড়া উপস্থিত! না বলিয়া ওরূপে অপরের বিষয় সেজগিন্নি লইয়া গেল, বড় অন্যায়। না বলিয়া ওরূপে লইলে যে চুরি করা হয়, তাহা ভাবিল না। আর অপরের জিনিসে ওরূপ লোভ করা কেন বাবু? – ইত্যাদি, ইত্যাদি। ঐরূপ নানা কথা ভাবিতেছেন, এমন সময় রানীর যে কন্যার ভাগে ঐ পুষ্করিণী পড়িয়াছে, তাঁহার সহিত দেখা। অমনি ঠাকুর তাঁহার নিকট ঐ বিষয়ের আদ্যোপান্ত বলিলেন। তিনি শুনিয়া এবং সেজগিন্নি যেন কতই অন্যায় করিয়াছে বলিয়া ঠাকুরের ঐরূপ গম্ভীর ভাব দেখিয়া হাস্য সংবরণ করিতে পারিলেন না। ব্যঙ্গ করিয়া বলিলেন, ‘তাই তো বাবা, সেজ বড় অন্যায় করেছে।’ এমন সময় সেজগিন্নিও তথায় আসিয়া উপস্থিত। তিনিও ভগ্নীর হাস্যের কারণ শুনিয়া পরিহাস করিয়া বলিলেন, ‘বাবা, এ কথাটিও কি তোমার ওকে বলে দিতে হয়? আমি পাছে ও দেখতে পায় বলে লুকিয়ে শাকগুলি চুরি করে নিয়ে এলুম, আর তুমি কিনা তাই বলে দিয়ে আমাকে অপদস্থ করলে!’ এই বলিয়া দুই ভগ্নীতে হাস্যের রোল তুলিলেন। তখন ঠাকুর বলিলেন, “তা, কি জানি বাবু, যখন বিষয় সব ভাগ-যোগ হয়ে গেল, তখন ওরূপে না বলে নেওয়াটা ভাল নয়; তাই বলে দিলুম যে, উনি শুনে যা হয় বোঝা-পড়া করুন।” রানীর কন্যারা ‘বাবা’র কথায় আরও হাসিতে লাগিলেন এবং ভাবিলেন, বাবার কি সরল উদার স্বভাব!
সাংসারিক বিপদে মথুরের ঠাকুরের শরণাপন্ন হওয়া
একপক্ষে ‘বাবা’র এইরূপ বালকভাব! অপর দিকে আবার অন্য জমিদারের সহিত বিবাদে মথুরের হুকুমে লাঠালাঠি ও খুন হইয়া যাওয়ায় বিপদে পতিত মথুর আসিয়া ‘বাবা’কে ধরিলেন, ‘বাবা, রক্ষা কর।’ ‘বাবা’ প্রথম চটিয়া মথুরকে নানা ভর্ৎসনা করিলেন। বলিলেন, “তুই শালা রোজ একটা হাঙ্গামা বাধিয়ে এসে বলবি ‘রক্ষা কর’! আমি কি করতে পারি রে শালা? যা, নিজে বুঝগে যা; আমি কি জানি?” তারপর মথুরের নির্বন্ধে বলিলেন, “যাঃ, মার ইচ্ছায় যা হয় হবে।” বাস্তবিকই সে বিপদ কাটিয়া গেল!
কৃপণ মথুরের ঠাকুরের জন্য অজস্র অর্থব্যয়ের দৃষ্টান্ত
ঠাকুরের উভয় ভাবের পরিচায়ক এইরূপ কত দৃষ্টান্তই না বলা যাইতে পারে! এই সকল দেখিয়া শুনিয়াই মথুরের দৃঢ় ধারণা হইয়াছিল, বহুরূপী ‘বাবা’র কৃপাতেই তাঁহার যাহা কিছু – ধন বল, মান বল, প্রতাপ বল, আর যা কিছুই বল। সুতরাং বাবাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বরাবতার বলিয়া রাজসম্মান দেওয়া ও অচল ভক্তি-বিশ্বাস করাটা মথুরের পক্ষে একটা বিচিত্র ব্যাপার হয় নাই। বিষয়ী লোকের ভক্তির দৌড় ভক্তিভাজনের প্রতি অর্থব্যয়েই বুঝিতে পারা যায়। তাহাতে আবার মথুর – সুচতুর হিসাবে বুদ্ধিমান বিষয়ী ব্যক্তি সচরাচর যেমন হইয়া থাকে – একটু কৃপণও ছিলেন। কিন্তু ‘বাবা’র বিষয়ে মথুরের অকাতরে ধনব্যয় দেখিয়া তাঁহার ভক্তি-বিশ্বাস যে বাস্তবিকই আন্তরিক ছিল, এ কথা স্পষ্ট বুঝা যায়। ‘বাবা’কে যাত্রা শুনাইতে সাজ-গোজ পরাইয়া বসাইয়া, গায়কদের প্যালা বা পুরস্কার দিবার জন্য মথুর তাঁহার সামনে দশ দশ টাকার থাক করিয়া একেবারে একশত বা ততোধিক টাকা সাজাইয়া দিলেন। ‘বাবা’ যাত্রা শুনিয়া যাইতে যাইতে যেমনি কোন হৃদয়স্পর্শী গান বা কথায় মুগ্ধ ও ভাবাবিষ্ট হইলেন, অমনি হয়তো সে সমস্ত টাকাগুলিই একেবারে হাত দিয়া গায়কের দিকে ঠেলিয়া তাহাকে পুরস্কার দিয়া ফেলিলেন! মথুরের তাহাতে বিরক্তি নাই! ‘বাবার যেমন উঁচু মেজাজ, তেমনি তাহার মতোই প্যালা দেওয়া হইয়াছে’, বলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। আবার ঐরূপ টাকা সাজাইয়া দিলেন! ভাবমুখে অবস্থিত ‘বাবা’ – যিনি ‘টাকা মাটি, মাটি টাকা’ করিয়া একেবারে লোভশূন্য হইয়াছেন – তাঁহার সম্মুখে উহা আর কতক্ষণ থাকিতে পারে? আবার হয়তো ভাবতরঙ্গের উন্মাদ-বিহ্ব্লতায় আত্মহারা হইয়া সমস্ত টাকা এককালে দিয়া ফেলিলেন! পরে কাছে টাকা নাই দেখিয়া হয়তো গায়ের শাল ও পরনের বহুমূল্য কাপড় পর্যন্ত খুলিয়া দিয়া কেবলমাত্র ভাবাম্বর ধারণ করিয়া নিস্পন্দ সমাধিস্থ হইয়া রহিলেন! মথুর তাঁহার টাকার সার্থকতা হইল ভাবিয়া আনন্দে বিভোর হইয়া ‘বাবা’কে বীজন করিতে লাগিলেন।
ঐ বিষয়ক অন্যান্য দৃষ্টান্ত
কৃপণ মথুরের ‘বাবা’র সম্বন্ধে এইরূপ উদারতার কতই না দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়! মথুর ‘বাবা’কে সঙ্গে লইয়া ৺কাশী, বৃন্দাবনাদি তীর্থপর্যটনে যাইয়া ‘বাবা’র কথায় ৺কাশীতে ‘কল্পতরু’ হইয়া দান করিলেন, আবশ্যকীয় পদার্থ যে যাহা চাহিল, তাহাকে তাহাই দিলেন! ‘বাবা’কে সে সময়ে কিছু চাহিতে অনুরোধ করায় ‘বাবা’ কিছুরই অভাব খুঁজিয়া পাইলেন না! বলিলেন, “একটি কমণ্ডলু দাও!” ‘বাবা’র ত্যাগ দেখিয়া মথুরের চক্ষে জল আসিল।
ঠাকুরের ইচ্ছায় মথুরের বৈদ্যনাথে দরিদ্রসেবা
মথুরের সহিত কাশী বৃন্দাবনাদি তীর্থদর্শনে যাইবার কালে ৺বৈদ্যনাথের নিকটবর্তী কোন গ্রামের ভিতর দিয়া যাইবার সময় গ্রামবাসীর দুঃখ-দারিদ্র্য দেখিয়া ‘বাবা’র হৃদয় একেবারে করুণায় পূর্ণ হইল। মথুরকে বলিলেন, “তুমি তো মা-র দেওয়ান; এদের এক মাথা করে তেল ও একখানা করে কাপড় দাও, আর পেটটা ভরে একদিন খাইয়ে দাও।” মথুর প্রথম একটু পেছপাও হইলেন। বলিলেন, ‘বাবা, তীর্থে অনেক খরচ হবে, এও দেখছি অনেকগুলি লোক, এদের খাওয়াতে-দাওয়াতে গেলে টাকার অনটন হয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় কি বলেন?’ সে কথা শুনে কে? বাবার তখন গ্রামবাসীদের দুঃখ দেখিয়া চক্ষে অনবরত জল পড়িতেছে, হৃদয়ে অপূর্ব করুণার আবেশ হইয়াছে। বলিলেন, “দূর শালা, তোর কাশী আমি যাব না। আমি এদের কাছেই থাকব; এদের কেউ নেই, এদের ছেড়ে যাব না।” এই বলিয়া বালকের ন্যায় গোঁ ধরিয়া দরিদ্রদের মধ্যে যাইয়া উপবেশন করিলেন! তাঁহার ঐরূপ করুণা দেখিয়া মথুর তখন কলিকাতা হইতে কাপড় আনাইয়া ‘বাবা’র কথামত সকল কার্য করিলেন। ‘বাবা’ও গ্রামবাসীদের আনন্দ দেখিয়া আনন্দে আটখানা হইয়া তাহাদের নিকট বিদায় লইয়া হাসিতে হাসিতে মথুরের সহিত কাশী গমন করিলেন। শুনিয়াছি, মথুরের সহিত রাণাঘাটের সন্নিহিত তাঁহার জমিদারিভুক্ত কোন গ্রামে অন্য এক সময়ে বেড়াইতে যাইয়া, গ্রামবাসীদের দুর্দশা দেখিয়া ঠাকুরের হৃদয়ে ঐরূপ করুণার আর একবার উদয় হইয়াছিল এবং মথুরের দ্বারা আর একবার ঐরূপ অনুষ্ঠান করাইয়াছিলেন।
ঠাকুরের সহিত মথুরের সম্বন্ধ দৈবনির্দিষ্ট; ভোগবাসনা ছিল বলিয়া মথুরের পুনর্জন্ম সম্বন্ধে ঠাকুর
গুরুভাবমুখে অবস্থিত ঠাকুর এইরূপ মধুর সম্বন্ধে মথুরকে চিরকালের মতো আবদ্ধ করিয়াছিলেন। সাধনকালে একসময়ে ঠাকুরের মনে যে অদ্ভুত ভাবের সহসা উদয় হইয়া তাঁহাকে শ্রীশ্রীজগদম্বার নিকট প্রার্থনা করাইয়াছিল, “মা, আমাকে শুকনো সাধু করিস নি, রসে বশে রাখিস” – মথুরানাথের সহিত এই প্রকার অদৃষ্টপূর্ব সম্বন্ধ তাহারই পরিণত ফলবিশেষ। কারণ, সেই প্রার্থনার ফলেই ৺জগন্মাতা ঠাকুরকে দেখাইয়া দেন, তাঁহার দেহরক্ষাদি প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য চারিজন রসদ্দার তাঁহার সঙ্গে প্রেরিত হইয়াছে এবং মথুরানাথই তাঁহাদের ভিতর প্রথম ও অগ্রণী। দৈবনির্দিষ্ট সম্বন্ধ না হইলে কি এতকাল এ সম্বন্ধ এরূপ অক্ষুণ্ণভাবে কখনও থাকিতে পারিত? হায় পৃথিবী, এরূপ বিশুদ্ধ মধুর সম্বন্ধ এতকাল কয়টাই বা তুমি নয়নগোচর করিয়াছ! আর বলি, হায় ভোগবাসনা, তুমি কি বজ্রবন্ধনেই না মানবমনকে বাঁধিয়াছ! এই শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত-স্বভাব অহেতুক ভালবাসার ঘনীভূত প্রতিমা এমন অদ্ভুত ঠাকুরকে দেখিয়া ও তাঁহার সঙ্গে সম্বন্ধ পাতাইয়া এখনও আমাদের মন তোমাকে ছাড়িয়াও ছাড়িতে চাহে না! জনৈক বন্ধু ঠাকুরের নিজমুখ হইতে একদিন মথুরানাথের অপূর্ব কথা শুনিতে শুনিতে তাঁহার মহাভাগ্যের কথা ভাবিয়া স্তম্ভিত ও বিভোর হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “(মৃত্যুর পর) মথুরের কি হলো, মশায়? তাকে নিশ্চয়ই বোধ হয় আর জন্মগ্রহণ করতে হবে না!” ঠাকুর শুনিয়া উত্তর করিলেন, “কোথাও একটা রাজা হয়ে জন্মেছে আর কি! ভোগবাসনা ছিল।” এই বলিয়াই ঠাকুর অন্য কথা পাড়িলেন।