জয়পুর শহরে যখন প্রবেশ করলুম, তখন বেশ রাত্রি হয়ে গিয়েছে। প্রায় দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি–ক্ষুধায় প্রাণ যায় অবস্থায় এক দোকানে ঢুকে কিছু খেয়ে আমাদের ডেরায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল। সেখানে জিনিসপত্র যা-কিছু ছিল তা বগলদাবা করে স্টেশনে গেলুম। একখানা ট্রেন সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল, একখানা খালি কামরা দেখে তাতে উঠে পড়লুম। টিকিট কাটবার ঝঞ্ঝাট নেই, কোথায় যাবে কখন যাবে তাও জানবার কোনো প্রয়োজন নেই। টিকিট-চেকারের কাছে ধরা পড়বার ভয়ে আত্মগোপন করবার সতর্কতা নেই। উঠেই মাথায় পুঁটলি গুঁজে লম্বা হয়ে পড়া গেল–যেখানে যায়, যখন যায় কিংবা থাকে, ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমের কোলে আত্মসমর্পণ করলুম।
এইভাবে রাজস্থানের শহর জঙ্গল ও মরুভূমিতে পাক খেতে খেতে বর্ষণমুখর একরাত্রে আহমেদাবাদে গিয়ে পৌঁছনো গেল। স্টেশনে পৌঁছবার অনেক আগেই বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। দেখলুম প্রকাণ্ড ইস্টিশান কিন্তু লোকজন বিশেষ কিছু নেই। আমাদের সঙ্গে আরও অল্প কয়েকজন যাত্রী নামল। নামতেই সামনে দেখি একজন টিকিট-কালেক্টর দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে আমরা সরে পড়বার তাল খুঁজছি কিন্তু সে অবসর না দিয়ে লোকটা যেন ঝাঁপিয়ে এসে পড়ল– টিকিট!
-আজ্ঞে, টিকিট তো নেই।
–তবে কি আছে বার কর। তিনজনের তিন টাকা লাগবে।
লোকটার আগ্রহ দেখে বেশ বুঝতে পারা যেতে লাগল যে, সে দিন তার বরাতে বিনা-টিকিটের যাত্রী মোটেই জোটেনি।
তিন টাকা চাইতে স্পষ্টই বলা গেল, হুজুর তিনটাকা তো দূরের কথা আমাদের কাছে তিনটে পয়সা নেই।
–বেশ তা হলে চল তোমাদের পুলিসের হাতে সমর্পণ করি–ছ’মাস খাটলেই আক্কেল হয়ে যাবে।
বাঁচা গেল! অন্তত মাস ছয়েকের জন্যে আহার ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল মনে করে লোকটার সঙ্গে সঙ্গে চেকারদের ঘরে যাওয়া গেল। সেখানে কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা ছোট জায়গায় আমাদের ঢুকিয়ে দিয়ে সে একটা টুলে গিয়ে বসল। সেই ঘেরা জায়গাটায় দেখলুম, আরও দু-তিনজন লোক বসে রয়েছে। তাদের দেখে উত্তরপ্রদেশের লোক বলে মনে হল। জিজ্ঞাসা করলুম, কি বন্ধু কতক্ষণ হল এসেছ?
একজন বললে, বিকেলের ট্রেনে।
আর একজন বললে, সন্ধ্যার ট্রেনে।
অপরাধ একই, বিনা-টিকিটের যাত্রী সব। ওদিকে একটা বড় গোল টেবিলে ঘিরে বসে আরও কয়েকজন চেকার হাসিঠাট্টা গান করতে লাগল। হঠাৎ একজনের দৃষ্টি আমাদের দিকে পড়ায় সে সঙ্গীদের বললে, আজকে জালে তো অনেক মাছ পড়েছে দেখতে পাচ্ছি।
গুজরাটী ভাষা শুনে শুনে তখন কিছু কিছু বুঝতে শিখেছিলুম। সেই লোকটা আবার বললে, এগুলিকে যথাস্থানে জিম্মা করে দিয়ে জায়গা খালি কর না–আবার তো মেল আসছে–
আর এক ব্যক্তি বললে, দূর, দূর! পুলিসের হাতে দিলে তারা বেশ করে মেরে হাতের সুখ করে ছেড়ে দেয়। আর তাদেরই বা দোষ কি বলো? তিনদিন খরচ করে খাইয়ে-দাইয়ে আদালতে নিয়ে যাবার পর হাকিম দেয় ছেড়ে– পুলিসের হাতে দেওয়ার চাইতে নিজেরাই হাতের সুখ করে নিই। বলেই একটা চেকার সেই কাঠের রেলিংয়ের দরজা খুলে আমার সামনেই যে হিন্দুস্থানী লোকটা বসে ছিল, তার চুল ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে তাকে কিল লাথি মারতে লাগল ধড়াধ্বড়।–বাপ রে, সে কি মার! সেই মার দেখে, আমাদের দিব্যজ্ঞান হয়ে গেল। আমরা ইতিমধ্যে গুজগুজ করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগলুম যে, আমাদের মধ্যে একজনকেও যদি ওরা মারে তো আমরা তিনজনে মিলে সে-ব্যক্তিকে আক্রমণ করব। চেকারদের টেবিলের ওপরে রুল, তা ছাড়া পাথর ও লোহার অনেকগুলো কাগজ-চাপা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিল–ঠিক করলুম ওরই গোটা-কয়েক তুলে নিয়ে বাগিয়ে ছুঁড়তে পারলে অন্তত দুটোকে নিশ্চিন্তপুরের কাছাকাছি পাঠাতে পারা যাবে। রোদে বৃষ্টিতে অনাহারে নিরাশ্রয় অবস্থায় ঘুরে ঘুরে অনিদ্রায় পথশ্রমে আমাদের চেহারাগুলোও প্রায় খুনের মতো হয়ে উঠেছিল। কখনও কোনো আয়নায় নিজেদের প্রতিচ্ছায়া, দেখলে শিউরে উঠতুম। মাথার চুলগুলো রুক্ষ, প্রায় জট ধরে এসেছে, চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, শরীর মেরে গেছে পাকতেড়ে–দেখে কখনও কখনও নিজেরাই হাসাহাসি করতুম আর বলতুম, আঃ উন্নতি যা হচ্ছে সে আর কয়ে কাজ নেই —
যা হোক ঠিক সেইসময় কোনো-একটা বিশেষ ডাকগাড়ি স্টেশনে এসে পড়ায় চেকাররা সদলবলে স্টেশনের দিকে বেরিয়ে গেল। এদের ঘরেরই আর-একদিকে একটা দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে যাওয়া যায় দেখে আমরা আর কালবিলম্ব না করে সেই দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লুম–আমাদের দেখাদেখি অন্য আর যারা ধরা পড়েছিল তারা সবাই বেরিয়ে এল। শুধু যে-ব্যক্তি মার খাচ্ছিল সে বসে রইল, বোধ হয় আরও কিছু দক্ষিণার প্রতীক্ষায়। একেই বলে, এক-যাত্রায় ভিন্ন ফল।
বাইরে তখন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে, অনেক লোক স্টেশনের গাড়ি-বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেখানে দাঁড়াতে আমাদের সাহস হল না। পাছে আবার ধরা পড়ি সেই ভয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল।
ঝঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, পথে লোকজন নেই, রাস্তার বাতিগুলো পর্যন্ত বৃষ্টির ঝাঁপটে ঘোলা হয়ে উঠেছে। এই আলো-আঁধারি অস্বচ্ছতার ভেতরে সেই অপরিচিতা নগরীর সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় ঘটল।
প্রায় এক পোয়া পথ চলে পথের ধারে একটা সাজানো চকচকে চায়ের দোকান দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে ঢুকলুম। বেঞ্চিতে বসে তিন কাপ চায়ের অর্ডার করা গেল। সামনেই একখানা বড় আয়না টাঙানো ছিল, তাতে আমাদের চেহারা দেখে তো পরম পুলকিত হলুম। একে সেই মূর্তি, তার ওপরে বৃষ্টিতে ভিজে যেন-সে-রূপ একেবারে অপরূপে দাঁড়িয়েছে। চা-ওয়ালারা কিছুক্ষণ আমাদের সেই বৃষ্টি-ভেজা নব-কলেবর দেখে নিজেদের মধ্যে কি-সব আলোচনা করে বললে, চা নেই, রাত্রি হয়ে গিয়েছে এখন আর চা পাওয়া যাবে না–উঠে যাও।
দোকানের লোকগুলো যেরকম ভাষা প্রয়োগ করে এবং যেভাবে দোকান থেকে আমাদের তাড়িয়ে দিলে তাতে অন্য কোনো দিন হলে অন্তত আমরা কিছু প্রতিবাদ করতুম; কিন্তু তখন বিনা-টিকিটে রেলে চড়ার অপরাধ সম্বন্ধে মনটা খুবই সজাগ থাকায় আর বৃথা বাক্যব্যয় না করে সেখান থেকে নেমে পড়া গেল।
খানিক দূরে গিয়ে একটা অপেক্ষাকৃত গরিব দোকানে জিজ্ঞাসা করলুম, চা পাওয়া যাবে?
দোকানদার বেশ ভদ্রভাবে আমাদের ভেতরে আহ্বান করায় সেখানে ঢোকা গেল। তিন কাপ চায়ের অর্ডার করা-মাত্র চা এসে হাজির হল। বেশ ভালো চা, দাম দু’পয়সা করে কাপ।
চা খাচ্ছি দোকানদার জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের উগ্রা শির কেন?
প্রথমটা তার প্রশ্ন বুঝতেই পারলুম না। আবার জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের মাথা খালি কেন?
হঠাৎ এ-প্রশ্নের কি জবাব দেব তা ঠিক করে উঠতে পারলুম না। এমন একটা প্রশ্ন ভবিষ্যতে কোনো দিন ওঠবার সম্ভাবনা আছে এমন চিন্তাও মনের মধ্যে কখনও জাগেনি। ভেবে-চিত্তে বলা গেল যে, আমাদের দেশের লোক মাথায় টুপি ব্যবহার করে না।
জবাব শুনে তারা আবার প্রশ্ন করলে, কোনো দেশের লোক তোমরা?
এই প্রশ্নের মধ্যে একটা সুর প্রচ্ছন্ন ছিল, যেটাকে সরল করলে বলতে হয় সে কোনো অসভ্য দেশ, যেখানকার লোকে মাথা খালি রাখে।
বললুম, আমরা বাংলাদেশের লোক। বাংলাদেশের লোক শুনে দোকানের খদ্দেররা পর্যন্ত হুমড়ি খেয়ে এগিয়ে এসে আমাদের নিরীক্ষণ করতে লাগল। তারা নিজেদের মধ্যে আমাদের সম্বন্ধে আলোচনাও করলে কিছুকাল। বেশ বোঝা গেল যে, বাংলাদেশের জীবগুলি সম্বন্ধে তাদের বিশেষ কৌতূহল আছে। আমরা জিজ্ঞাসা করলুম, তোমরা কি ইতিপূর্বে বাংলার লোক দেখনি? দোকানদার বললে, না। তবে শুনেছি এখানে জনকয়েক বাংলাদেশের লোক কাপড়ের কলে কাজ করে, কিন্তু তাদের চোখে দেখিনি।
পঞ্চাশ বছর আগে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে জানাশোনা খুবই কম ছিল। বাংলাদেশের শহরের লোকেরা জানত বেহারী, মাড়োয়ারী ও ওড়িয়াদের। বেহারীদের বলা হত খোট্টা, মাড়োয়ারীদের মেড়ো ও ওড়িশাবাসীদের–উড়ে বলা হত। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব ও মাড়োয়ারীদের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা খুব কম লোকেই বুঝতে পারত। তেমনই ওড়িশা, অন্ধ্র, মাদ্রাজ, মহীশূরবাসী সকলকেই ওড়িয়া বলে মনে করা হত। খুব শিক্ষিত লোক ছাড়া এদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারত না।
স্বদেশী আমলের পর থেকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের লোকেদের মধ্যে পরস্পরের জানাশোনা বাড়তে থাকে। আজ ভারতের যেসব প্রদেশের লোক বাঙালির নাম শুনলেই উদ্যতমুষল হয়ে ওঠেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে নিবেদন করছি যে, এই বাঙালিরাই সর্বপ্রথম ভারতের সমস্ত প্রদেশকে একত্রে গাঁথবার চেষ্টা করে–তাদের উপন্যাসে, কাব্যে ও গানে।
যাই হোক, কিছুক্ষণ চায়ের দোকানদারের সঙ্গে আলাপের পর বুঝতে পারা গেল যে, বাংলাদেশের লোকের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা আছে বটে, কিন্তু যারা মাছ খায় তারা, ইত্যাদি ইত্যাদি–। ওইটুকু সময়ের মধ্যেই বুঝে নিতে দেরি হল না যে, সেখানে ছুৎমার্গ খুবই প্রবল।
এদিকে রাত্রির জন্যে আশ্রয় একটু চাই। নতুন জায়গা, পথে পড়ে থাকা চলে না। ওদিকে বৃষ্টি থেমে যাওয়ায় দোকানদার দোকান বন্ধ করবার ব্যবস্থা করছে দেখে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এখানে রাত্রে থাকবার মতন কোনো জায়গা টায়গা আছে?
ওঃ,’ঢের। বলেই সে দোকানের একটি ছোট ছেলেকে কি বললে। তার পরে আমাদের বললে, আপনারা এর সঙ্গে যান।
ছেলেটি দোকানের কাছেই আমাদের একটা বাড়িতে নিয়ে গেল। সেটা ঠিক হোটেল কিংবা ধর্মশালা না হলেও সেখানে ঘর ভাড়া পাওয়া যায়। সেইখানে একটা যাচ্ছেতাই ঘরে কোনোরকমে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া গেল।
সকালবেলা ঠিক করা গেল যে, সেইদিনই সুকান্তর সেই দাদার সঙ্গে দেখা করে কাজকর্মের একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। এদিকে আমাদের ধুতি জামা সব ছিঁড়ে গিয়েছিল, ওদিকে বিস্কুটের টিনও প্রায় খালি। সুকান্তর দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে পরিচ্ছদের একটা ব্যবস্থা হওয়া দরকার মনে করে বাড়িওয়ালাকে তার প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লুম।
বেশ মনে পড়ে, কয়েকটা দোকান ঘুরে আমরা তিন-জোড়া ধুতি ও তিনটে পকেটহীন সেই-দেশীয় জামা খরিদ করলুম। এই আহমেদাবাদ শহরে একটি নতুন রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা গেল যা ইতিপূর্বে ভারতবর্ষের অন্য কোনো শহরে হয়নি। আমরা দোকানে জিনিস কিনতে ঢুকে দোকানদারকে বললুম ধুতি দেখি।
দোকানদার ধুতি দেখাবে কি, সে অবাক হয়ে হাঁ করে আমাদেরই দেখতে লাগল। যে ভাষার মাধ্যমে এতদিন আমাদের ভাব ও অভাবের আদান-প্রদান চলেছিল, দেখা গেল এখানকার লোক সে-ভাষা একদম বুঝতে পারে না। সেখানকার জনসাধারণ হিন্দী ও উর্দু বোঝা তো দূরের কথা শোনেনি বললেও চলে–বরঞ্চ ইংরেজি বললে তার চেয়ে বেশি বুঝতে পারে। তার ওপর আমাদের চেহারাই তাদের কাছে একটা দ্রষ্টব্য জিনিস হয়ে দাঁড়াল। আমরা দোকানদারকে বলি, কিরকম জামা আছে দেখাও দিকিন। দোকানদার হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক বকাবকির পর হয়তো বললে, তোমাদের মাথায়’ টুপি নেই কেন?
ভ্যালা বিপদেই পড়া গেল! যা হোক, অনেক কষ্টে ধুতি-জামা কিনে তো রাস্তায় বেরিয়ে পড়া গেল। কিন্তু পথ চলব কি! চলতে চলতে দেখি, রাস্তার লোক আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে যায়, অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ-বা সাহস করে আমাদের মস্তকের টুপিহীনতার কথা জিজ্ঞাসা করে, কোথাও বা নিজেদের মধ্যে এই অত্যাশ্চর্য কাণ্ডের আলোচনা করে।
দু-চারজন রাস্তার লোককে আমাদের লক্ষ্যস্থানের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলুম, অবিশ্যি সঙ্গে সঙ্গে উগ্রা শিরের কারণও বলতে হল। প্রায় ঘণ্টা দুই রাস্তায় ঘুরে ঘুরে গলির গলি তস্য গলির মধ্যে প্রকাণ্ড একটা বাড়িতে এসে পৌঁছলুম। এখন আহমেদাবাদে কিরকম হয়েছে জানি না, সে-সময় দেখেছি অধিকাংশ বাড়ির কাঠামোটা ইট কিংবা পাথর দিয়ে তৈরি হলেও প্রচুর পরিমাণে কাঠ ব্যবহার করা হত। অনেক বাড়িতে কাঠের থাম, বাহারের জন্যে কাঠের কার্নিশ এবং নানারকম খোদাই কাঠের ব্যবহার দেখেছি। খুব সম্ভব, কাঠের এই প্রাচুর্যের জন্যে সেখানে কাঠবেড়ালের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। এখনকার কথা ঠিক বলতে পারি না, তবে তখনকার দিনে বিহার, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি দেশে মাছির উপদ্রব যত ছিল, আহমেদাবাদে কাঠবেড়ালের উপদ্রব তার চেয়ে কিছু কম ছিল না।
যা হোক, আমরা তো নানা রাস্তা ঘুরে ঘুরে বেলা প্রায় দশটা নাগাদ সেই বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। প্রকাণ্ড বাড়ি–একতলাটা খাঁ-খাঁ করছে। কেউ কোথাও নেই। বেরিয়ে এসে আবার পাড়ার লোকদের জিজ্ঞাসা করায় তারা বললে, সিঁড়ি দিয়ে সোজা তেতলায় উঠে যাও। সিঁড়িটা অত্যন্ত পুরনো, বোধ হয়, পঞ্চাশ বছর ধরে ধুলো জমে তার ওপরে পুরু আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। পরে শুনেছিলুম, বাড়িটা ভূতের বাড়ি, অনেকদিন ধরে খালি পড়ে ছিল–ওখানকার কোনো-এক ধনী শেঠের বাড়ি। সে-ব্যক্তি দয়া করে বাঙালি ছাত্রদের থাকতে দিয়েছে–ভাড়া-টাড়া লাগে না।
সিঁড়ি বেয়ে ঘুরতে ঘুরতে তো তেতলায় ওঠা গেল। তেতলায় প্রকাণ্ড একটা হল-ঘর। সেখানে তিন-চারটি বাঙালি যুবক নিজের বিছানায় বসে আছেন–বিছানাগুলি ঘরের মেঝেতে পাতা। ঘরের মধ্যে আরও দশ-বারোটা বিছানা গোটানো অবস্থায় রয়েছে। তিন-চারটে দড়ি টাঙানো–তাতে গামছা ইত্যাদি ঝুলছে। মেঝেতে আরও টুকিটাকি জিনিস এলোমেলোভাবে ছড়ানো রয়েছে।
ঘরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞাসা করলুম, রমেশবাবু আছেন?
উত্তর পেলুম, রমেশবাবু নেই, তিনি সকালবেলা কাজে বেরিয়েছেন, এগারোটা সাড়ে-এগারোটায় এসে পড়বেন। আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
–আমরা কলকাতা থেকে আসছি।
কলকাতার নাম শুনেই তাঁরা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। বাংলাদেশ থেকে বহুদূর সেই আহমেদাবাদে বসে কলকাতা থেকে আগত কারুকে দেখলে বাঙালির প্রাণ যে একটু চঞ্চল হবে সে আর বেশি কথা কি!
দেখলুম, তাঁরা আমাদের সম্বন্ধে অনেক কথাই জানেন। আমাদের নিয়ে ইতিমধ্যে তাঁদের আলোচনাদিও হয়ে গেছে। একজন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের মধ্যে রমেশদার ভাই কেউ আছেন?
সুকান্ত বললে, আজ্ঞে, আমি তাঁর ভাই।
হল-এর মধ্যে অনেক খালি জায়গা তখনও পড়ে ছিল। একজন উঠে আমাদের সেই দিকটায় নিয়ে গিয়ে বললেন, আপনারা এখানে বিছানা পেতে বিশ্রাম করুন, রমেশদা এখুনি এসে পড়বেন।
সেইখানে বসে বসে আমরা তাঁদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করতে লাগলুম। জানা গেল যে, ওখানে বাংলাদেশের নানা জায়গা থেকে কুড়িটি ছেলে এসে কাপড়ের কলে কাজ শিখছে। বছর-তিনেক লাগে কাজ শিখতে–পরে মিল-এ চাকরি পাওয়া যায়। ভালো করে কাজ শিখতে পারলে ভবিষ্যতে উন্নতির সম্ভাবনা আছে। ওখানে মাসে চোদ্দো পনেরো টাকা খরচ লাগে। এখানকার ছেলেদের মধ্যে একদল সেই ভোরে উঠে কাজে বেরিয়ে যায় আর ফিরে আসে দশটা নাগাদ–আবার যেতে হয় একটা নাগাদ আর ছুটি হয় বেলা পাঁচটায়। আর একদল যায় দশটায় আর ফিরে আসে বেলা পাঁচটায়। যাই হোক, সকলেই বলতে লাগল, ভারি খাটুনি–বাঙালির ছেলের পক্ষে এত খাটুনি সহ্য করা মুশকিল।
আমরা বললুম, ওই কাজে ঢুকব বলেই তো এখানে এসেছি।
আমাদের কথা শুনে সকলেই বেশ একটু গম্ভীর হয়ে পড়লেন। একটু পরে একজন বললেন, খাটুনি সহ্য করতে পার তো ভালোই। প্রথমটা কষ্ট হয়, তারপরে সহ্য হয়ে যায়।
আর একজন একটু পরেই বললেন, এখানে ঢোকা খুবই শক্ত–ঢুকব বললেই ঢোকা যায় না। এইরকম সব কথাবার্তা চলছে, এমন সময় সুকান্তর দাদা রমেশবাবু ও আর-কয়েকজন সকালের কাজ থেকে ফিরে এলেন। চারঘণ্টা মিল-এ খেটে তার ওপরে প্রায় মাইলখানেক পথ হেঁটে এসে গলদঘর্ম শরীরে তেতলায় উঠে রমেশবাবু আমাদের দেখে তো পরম পুলকিত হয়ে উঠলেন। একটি গেলাস ঠান্ডা জল টেনে ও আর-একটি গেলাস জল সামনে রেখে ভদ্রলোক আমাদের–বিশেষ করে সুকান্তকে গাল পাড়তে আরম্ভ করলেন। ভদ্রলোক গাল দিতে দিতে মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে সুকান্তকে মারতে যান, আর অন্যান্য সকলে ধরে ফেলে–এইরকম করে প্রায় বেলা একটা অবধি গালাগালি দিয়ে আর একটি গেলাস জল টেনে তখনকার মতন স্নান করতে নেমে গেলেন। এতক্ষণ যে-যুবকটি আমাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন ও বেশ সহানুভূতির সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি এবং অন্যান্য প্রায় সকলেই আমাদের সম্বন্ধে বেশ চটকদার টিপ্পনী কাটতে আরম্ভ করলেন। ইতিমধ্যে রমেশদা স্নান করে এলেন। স্নানের ফলে মেজাজ ঠান্ডা হওয়ার পরিবর্তে দেখা গেল, তাঁর উষ্মা বেড়েই গিয়েছে।
রমেশদা বললেন, তোমরা যে সেখান থেকে এমন করে পালিয়ে এলে–সেখানকার অবস্থা কিছু জান? সেখানে যে তোমাদের জন্যে মারপিট খুনখারাপি চলেছে তার কিছু খবর রাখ?
সুকান্ত চুপ করে রইল। বড়ভাইয়ের কথার ওপর কোনো কথা বলা সে-যুগে ভদ্ররীতির বহির্ভূত ছিল। আমি কিছুক্ষণ সহ্য করে থেকে বললুম, আমরা চলে এসেছি–কারুর কিছু ক্ষতি করে তো আসিনি। যদি ক্ষতি করে থাকি তো নিজেদেরই করেছি–
আমার কথা থামিয়ে দিয়ে একজন বললেন, খুব লম্বা-লম্বা কথা ছাড়ছ যে ছোকরা! জান, তোমাদের জন্যে সেখানে কি হচ্ছে?
–কি হচ্ছে?
–যা তো, শচে, নীচে থেকে কাগজগুলো নিয়ে আয় তো।
বলামাত্র একজন উঠে গিয়ে একতাড়া খবরের কাগজ নিয়ে এল। দেখলুম, সবগুলোই কলকাতার কাগজ, তার মধ্যে বাংলা সংবাদপত্রও আছে।
–এই দেখ।–বলে কাগজের তাড়াটা রমেশদা আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। দেখলুম, অনেকগুলো কাগজের নানা জায়গায় সব লাল পেনসিল দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেইসব স্থান দেখিয়ে রমেশদা বললেন, পড়ে দেখ।
কাগজ পড়ে বুঝতে পারা গেল যে আমরা কলকাতা ছাড়বার আগে ছেলেধরা ব্যাপার নিয়ে যে হাঙ্গামা সেখানে শুরু হয়েছিল, আমাদের পলায়নের পর সে-হাঙ্গামা আরও বেড়ে উঠেছে। এই নিয়ে এক খবরের কাগজ বলছে যে, ছেলেধরা-টরা কিছুই নয়–এইসব বালকেরা অতি দুর্বৃত্ত, অতি খলিফা–কলকাতার নামজাদা ছেলে এরা–এদের ধরে নিয়ে যায় এমন ছেলে ধরা এখনও জন্মায়নি। এই তিনটির মধ্যে দুটির স্বভাবই হচ্ছে বাড়ি থেকে পালানো, ইত্যাদি ইত্যাদি। অপর দল পুলিস ও গবর্মেন্টের প্রতি দোষারোপ করছেন। তাঁরা বলছেন–ছেলে-ধরার কথা তো অনেকদিন থেকেই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। গুজব মনে করে আমরা এতদিন চুপচাপই ছিলুম, কিন্তু অমুকের মতন অমন সোনার-চাঁদ ছেলেও যখন গায়েব হতে আরম্ভ করেছে তখন এ সম্বন্ধে আর নীরব থাকা অন্যায় হবে। এই বলে পুলিসের অসতর্কতা ও গবর্মেন্টের উদাসীনতাকে লক্ষ্য করে তুড়ে খিস্তি করেছে।
টুর্গেনিভ-এর বিখ্যাত সেই চুটকি গল্পের নায়ক মাল টেনে গাড়ি-চাপা পড়ে খবরের কাগজে নিজের নাম দেখে নিজেকে যেমন বিখ্যাত লোক বলে মনে করেছিল–এই খবরের কাগজগুলো পড়ে আমাদের মনেরও প্রায় সেই অবস্থা হল। রমেশদা যতই বকতে থাকেন ও তাঁর আশপাশ থেকে যুবকেরা যতই বিনামূল্যে পরামর্শ বিতরণ করতে থাকেন–মনে হতে লাগল, তাঁরা আমাদের চেয়ে ঢের ঢের নিম্নশ্রেণীর জীব। আর যাই হোক-না কেন, আমরা হচ্ছি সেই শ্রেণীর লোক যাদের নিয়ে খবরের কাগজে আন্দোলন চলতে থাকে।
বলা বাহুল্য, এক ‘স্টেটসম্যান’ ছাড়া সে কাগজগুলির একখানিও আজ জীবিত নেই।
আমাদের বুকনি দিতে দিতে রমেশদা ও অন্যান্য অনেকে সেদিন কাজে যেতেই ভুলে গেলেন–রমেশদা তো খেতেই ভুলে গেলেন।
বেলা চারটের পর আমরা নীচে নেমে স্নান করে এলুম। রমেশদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের কাছে টাকাকড়ি কিছু আছে?
আমাদের বিস্কুটের টিন প্রায় খালিই হয়ে এসেছিল। বললুম, টাকাকড়ি বিশেষ কিছু নেই।
আগ্রাতে আমরা ধরা পড়েও ফাঁকি দিয়ে পলায়ন করেছিলুম বলে রমেশদা আবার এক পক্কড় বক্-বক্ শুরু করলেন। তারপরে প্রায় সন্ধ্যা অবধি এইভাবে কাটিয়ে আমাকে ও জনার্দনকে বললেন, তোমরা বাড়িতে টাকা চেয়ে চিঠি লিখে পাঠাও। এখান থেকে কলকাতার ভাড়া আঠারো টাকা–এখানে ক’দিন খাওয়া-দাওয়ার খরচ আছে। ত্রিশটি টাকা চেয়ে পাঠাও। আমি সুকান্তর বাড়িতে টাকার জন্যে চিঠি লিখছি-।
এতসব সত্ত্বেও আমরা মিনতি করে বললুম যে, আমরা কলে কাজ শিখব বলে এসেছি। তা না হলে কোথাও কিছু নেই খামকা তাঁদের খপ্পরে এসে পড়বার অন্য কোনো কারণই নেই। দয়া করে আমাদেরও মিল-এর কাজে ঢুকিয়ে দিন, এখানে থাকার খরচা আমরা বাড়ি থেকে আনিয়ে নেব।
আমাদের কথা শুনে রমেশদা তো বটেই তা ছাড়া উপস্থিত প্রায় সকলেই অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন।–কী, আম্বা তো তোমাদের কম নয়! বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এ-কথা বলতে লজ্জা করছে না!
অবিশ্যি ওখানে থাকতে-থাকতেই আমরা জানতে পেরেছিলুম যে, সেখানকার অনেকগুলি ছেলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে।
কিছুক্ষণ বাদে ঘরে বাতি জ্বালার পর আমরা উঠে পড়লুম। বিস্কুটের টিনটি রমেশদা ইতিপূর্বেই হাতিয়ে রেখেছিলেন। আমরা বললুম, বিস্কুটের টিনটি দেখি!
–আবার কেন?
–আজ্ঞে, ওতে এখনও কিছু অর্থ আছে। বাজারে যাই, কিছু খেতেটেতে হবে তো–উপদেশ আর বকুনি খেয়ে তো পেট ভরবে না।
আমাদের কথা শুনে একজন বললেন, বুক্নি-টুক্নি তো বেশ শিখেছ ছোকরা!
কি আর বলব! চুপ করে থাকাই সমীচীন বোধ করলুম। রমেশদা বললেন, তোমাদের সঙ্গে বকাবকি করে সারাদিন আমারও খাওয়া হল না। চল আমরা যে-হোটেলে খাই সেখানে তোমাদেরও বন্দোবস্ত করে দিই–দুবেলা গিয়ে সেখানে খেয়ে আসবে।
আহমেদাবাদে সে সময় চায়ের দোকানের মতন যেখানে-সেখানে ‘ভিসি’ দেখা যেত–’ভিসি’ বলে ভাত ও রুটির হোটেলকে। সেখানে অসংখ্য লোক দুবেলা এইসব ভিসি-তে খেত। যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময় কলকাতাতেও যত্রতত্র ভাতের হোটেল দেখতে পাওয়া যেত। তখনকার দিনে এইসব হোটেলে একজন প্রমাণ লোকের পেট ভরে খেতে লাগত ছ’পয়সা। ছ’পয়সায় ভাত, একটা নিরামিষ তরকারি, ডাল ও মাছের ঝোল পাওয়া যেত–তাতে একটুকরো মাছ থাকত। সাত-পয়সা দিলে একটা ভাজা মাছ পাওয়া যেত। কলকাতার এইসব ভাতের হোটেলে সকাল ও সন্ধ্যায় অসংখ্য লোক খেত বটে, কিন্তু সেসব জায়গা ছিল নোংরার ডিপো। পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে কোনো নিয়মেরই ধার সেখানে ধারা হত না। তার ওপরে বাঙালির খাবারই
এমন যে, একদল লোক খেয়ে গেলে সেখানে আর-একদল বসা প্রায় অসম্ভব। আহমেদাবাদে সে-সময় জীবনযাত্রার খরচ ছিল কলকাতার প্রায় দ্বিগুণ। ভিসিগুলোতে একবেলা খেতে দশ কি বারো পয়সা লাগত। খাবার দিত খুব মিহি চালের ভাত, পাতলা রুটি, একটা তরকারি–শুকনো ঝুঁরো-মতন, জলের মতন ডাল, ঘি ও চিনি–সে যত পার। খাদ্য-হিসাবে কলকাতার তুলনায় সে কিছুই নয় বটে, কিন্তু সেখানকার পরিচ্ছন্নতা অনুকরণীয়। গুজরাটীরা যে পরিচ্ছন্ন জাতি, তার প্রমাণ এইসব ভিসি-তে পাওয়া যায়।
যা হোক, সন্ধ্যাবেলায় আমাদের নিয়ে রমেশদা ভিসি-তে উপস্থিত হলেন। তখনও বুভুক্ষুর দল আসতে আরম্ভ করেনি। তকতকে পরিষ্কার ঘরে তিন দিকের দেওয়ালে ঘেঁষে কাঠের পিঁড়ে পাতা রয়েছে, দেখেই চক্ষু জুড়িয়ে গেল। সকালবেলা রমেশদাদের উদ্দেশে যাত্রা করবার আগে এক কাপ করে চা পেটে পড়েছিল। সমস্ত দিন আহার নেই–তারপর সেই বেলা বারোটা থেকে সন্ধে অবধি নিরবচ্ছিন্ন গালাগালি খেতে-খেতে মন একেবারে বিষিয়ে উঠেছিল। কিন্তু চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ–ভিসি-তে গিয়ে আমাদের সর্বসত্তাপ কোথায় উবে গেল। আপনারা হয়তো মনে করছেন গুজরাটী আহার্য দেখে একেবারে মোহিত হয়ে গেলুম। কিন্তু তা নয়। ভিসিওয়ালা ছিল খুব উঁচুদরের মনস্তত্ত্ববিদ। পার্থিব আহার্যের সঙ্গে সঙ্গে খদ্দেরদের মনের কথাটা সে একেবারে ভুলে যায়নি।
রাস্ত থেকে একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে তো ভিসি-তে ওঠা গেল। পিঁড়ি পাতার কথা আগেই বলেছি। আরও দেখলুম, ঘরের খানিকটা জায়গা ইট দিয়ে উঁচু করে সেখানটা মাটি দিয়ে লেপা হয়েছে। এই জায়গাটা হচ্ছে চৌকা অর্থাৎ এইখানেই রান্না হয়। পাশাপাশি তিনটে উনুন জ্বলছে–যতদূর মনে পড়ে কাঠকয়লার উনুন। একজন ব্রাহ্মণ রন্ধনকার্যে ব্যস্ত–ব্রাহ্মণের দীর্ঘ চেহারা, যেমন লম্বা তেমনই চওড়া। টকটক করছে গায়ের রঙ–দেখলে মনে হয় বাড়ি তার ছান্দোগ্য-উপনিষদে।
ব্রাহ্মণ রন্ধন করছিলেন দাঁড়িয়ে, তাঁরই পায়ের কাছে একটি মেয়ে বসে–শাঁখের মতন লালচে সাদা তার দেহের বর্ণ, একটি মোটা সাদা থান পরা, তুলি দিয়ে আঁকা মুখখানি, টিকলো নাকে একটা হিরে অথবা সাদা পোখরাজের নাকছাবি ঝক্ঝক্ করছে। অঞ্চল দিয়ে যতটা সম্ভব অঙ্গ আবৃত ডান বাহু ও বাঁ-হাতের খানিকটা দেখা যাচ্ছে–সুন্দর গড়ন যেন অমিয় ছানিয়া সে-দেহ তৈরি–ঘাড় হেঁট করে একমনে রুটি বেলে যাচ্ছে। সামনেই তিনটে গনগনে উনুন, তারই লাল আভা পড়ে তার মুখখানি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল–এমন সুশ্রী মেয়ে খুব কমই দেখেছি। প্রথম-দর্শনেই কবির লাইন মনে পড়ে গেল। ইচ্ছে হল বলে ফেলি–এত শ্রম মরি মরি, কেমনে চলেছ করি, কোমল করুণ ক্লান্ত কায়?
তারপর অনেকদিন অতীত হয়েছে–এই দুর্ধর্ষ দুর্ভাগার বন্ধুর দীর্ঘ জীবনপথে সেই সপ্তদশী আমায় ত্যাগ করেনি। আজ বিশেষ করে তার মুখখানা মনে পড়ছে–সে যেখানেই থাক তাকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা পাঠিয়ে দিলুম।
ভিসি-তে উঠে একটা পিঁড়িতে গিয়ে বসতেই সেই ব্রাহ্মণ–’আও শেঠ’ বলে রমেশদাকে অভিবাদন করে বললে, ও-বেলা আসা হয়নি কেন?
রমেশদা বললেন, আমার এক ভাই ও তার দুই বন্ধু বাড়ি থেকে পালিয়ে আমাদের এখানে এসে উঠেছে। সেই হাঙ্গামায় ও-বেলা খেতে পর্যন্ত আসতে পারিনি। এই তিনজনকে চিনে রাখ–এরা এখন দিনকয়েক এখানে দুবেলা খেয়ে যাবে।
রমেশদার কথা শুনে মুহূর্তের জন্যে সেই সুন্দরী একবার মুখ তুলে কমলনয়ন দিয়ে মাল-তিনটিকে দেখে দিলেন–এই একবার ছাড়া দিন-দশেকের মধ্যে তাকে আর ঘাড় তুলতে দেখিনি।
আহমেদাবাদে আমাদের অবস্থা হল এক অদ্ভুত রকমের। কলে কাজ শেখবার যেসব কল্পনা নিয়ে সেখানে গিয়েছিলুম, তা কল্পনাতেই পর্যবসিত হল। গোড়াতেই এক-কথায় রমেশদা আমাদের আশার বাতি ধমকের ফুৎকারে নিবিয়ে দিয়েছিলেন। তার ওপর রমেশদার নির্দেশমতো কি না জানি না, দ্বিতীয় দিন থেকে সেখানকার সকলেই আমাদের সঙ্গে বাক্যালাপই বন্ধ করে দিলেন। নেহাত কোনো কথা গায়ে-পড়ে জিজ্ঞাসা করলে কেউ কেউ উত্তর মাত্র দিতেন, কেউ-বা তাও দিতেন না–কেবল রমেশদা প্রতিদিন একবার করে জিজ্ঞাসা করতেন, বাড়ি থেকে কোনো খবর এল?
বলতুম এখনও কোনো জবাব আসেনি।
বলা বাহুল্য যে, বাড়িতে কোনো চিঠিপত্রই লেখা হয়নি–কিন্তু এরকমও যে বেশি দিন চলতে পারে না তাও বেশ বুঝতে পারছিলুম। ঘটনার স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় আর ছিল না। মনে-মনে আশা করতে লাগলুম, আমাদের অনুকূলে নিশ্চয় একটা কিছু ঘটবে।
সকালবেলা সকলে কাজে বেরিয়ে যাবার পর আমরাও স্নান করে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তুম। চা পান বা বিড়ি-ফোঁকা বন্ধ, কারণ ট্যাকে একটা পয়সাও নেই। তখন আবার বর্ষাকাল –আহমেদাবাদে বর্ষা নেমেছে। জলে কাদায় পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে দশটা নাগাদ খেয়ে-দেয়ে আবার ঘুরতে বেরুই। বিকেল অবধি ঘুরে ঘুরে একটু দিন থাকতে থাকতেই ভিসি-তে গিয়ে ঠাকুরের সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করি–উদ্দেশ্য সেই সুন্দরীর রূপসুধা পান করা। তার পরে সেখানে অন্যান্য খদ্দের আসতে আরম্ভ করলেই খেয়ে-দেয়ে চলে আসি।
একদিন রাত্রিবেলা আশ্রয়ে ফিরে শুনলুম যে, সুকান্তর বাড়ি থেকে টাকা এসে গিয়েছে। আমরা বাড়িতে চিঠি লিখেছি কি না, সে-বিষয়ে রমেশদা সন্দেশ প্রকাশ করতে লাগলেন। শেষকালে তিনি আমাদের কাছে থেকে বাড়ির ঠিকানা চেয়ে নিলেন। গত্যন্তর না দেখে সত্যি-ঠিকানাই দিয়ে দিলুম।
পরের দিন সেখানকার ভিক্টোরিয়া পার্কে একটা বেঞ্চির ওপর বসে আমরা পরামর্শ করছি, এমন সময় দেখতে পেলুম দুটি গুজরাটী ভদ্রলোক পথ চলতে চলতে আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে গেল। আহমেদাবাদে এসে অবধি এরকম দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলুম। আশা করতে লাগলুম, এখুনি এগিয়ে এসে তারা প্রশ্ন করবে–কোথায় বাড়ি তোমাদের? তোমাদের মাথায় টুপি নেই কেন?
‘নিজেদের মধ্যে এইসব কথা বলাবলি করতে-না-করতে দেখলুম, তারা আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের কাছাকাছি এসে তাদের মধ্যে একজন পরিষ্কার বাংলাভাষায় বললে, মশায়দের আমারই সমগোত্রীয় বলে বোধ হচ্ছে! কতদিন হল ভেগেছেন?
সুকান্ত বলে উঠল, আসতে আজ্ঞা হোক। বুলি শুনে মনে হচ্ছে যেন একই গাছের বাসিন্দা আমরা। আমরা ছ’সাত মাস হল হাওয়া হয়েছি। আপনি?
–আমার প্রায় ছ’সাত বছর হবে।
–তা হলে তো আপনি আমাদের দাদা–বসতে আজ্ঞা হোক।
লোকটি তার সঙ্গীকে বললে, শেঠজী, আপনি দোকানে যান। এরা আমার দেশের লোক, এদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমি আপনার ওখানে যাচ্ছি।
লোকটির কথা শুনে তার সঙ্গী আমাদের নমস্কার করে তাকে বললে, তা হলে আসবার সময় আপনার এই বন্ধুদেরও নিয়ে আসবেন, আমাদের ওখানেই চা খাবেন।
সঙ্গী চলে যেতে লোকটি আমাদের কাছে এসে বসলেন। মাথা থেকে টুপি খুলে ফেলে বললেন, ভাই, যস্মিন্ দেশে যদাচার। মাথায় টুপি না থাকার কৈফিয়ত দিতে দিতে মাথা বিগড়ে যাওয়ার পর এই টুপি ধরেছি।
ভদ্রলোকের বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। একহারা চেহারা। সুকান্ত ঠিকই ধরেছিল, কথায় সামান্য পূর্ববঙ্গীয় টান আছে; দিব্যি মজলিসি ও দিলখোলা লোক বলে মনে হল।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিলুম, দু-এক জায়গায় চাকরির চেষ্টা যে করিনি তা নয়, কিন্তু কোথাও কিছু হয়ে উঠল না। ছ’-সাত বছর আগে একদিন কিরকম মনে হল বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে না পারলে আর কিছুই হবে বলে মনে হচ্ছে না। যাঁহা মনে হওয়া অমনি বেরিয়ে পড়া–নানা অবস্থার মধ্যে দিয়ে নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে শেষকালে এক জংলী রাজার ওখানে চাকরি পেয়ে গেলুম। রাজার অন্যান্য কর্মচারীরা আমাকে প্রাইভেট সেক্রেটারি বলত, কিন্তু আসলে করতে হত রাজার মোসাহেবি।
রাজামশায় ঘুম থেকে উঠতেন দুপুর বারোটায়। তখন থেকে বেলা প্রায় তিনটে অবধি তাঁর সঙ্গে থাকতে হত। ওইসময় তিনি স্নানাহার করতে চলে যেতেন, আমার ছুটি হত। তারপর রাত্রি এগারোটার পর তিনি আবার দেখা দিতেন। রাজার তিন স্ত্রী থাকেন হারেমে, আর তিনটি রক্ষিতা রাত্রিবেলা প্রাসাদে আসতেন–আসতেন মানে, প্রতিদিন একটি একটি করে তাদের নিয়ে আসা ও রাত্রি তিন-চারটের সময় একটি একটি করে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া–এই ছিল আমার খাস-ডিউটি।
রাজা বলতেন, প্রাইভেট সেক্রেটারিকেই এইসব প্রাইভেট কাজ করতে হয়।
রাত্রিবেলা রাজার সঙ্গে সমানে মদ খেতে হত–মদ খেয়ে তাসখেলা ছিল তাঁর শখ। রাত্রি তিনটে অবধি তাস খেলে যেদিন যে-রক্ষিতার ওপর প্রসন্ন হতেন তাকে রেখে অন্যদের ছুটি দিতেন।
এইরকম নিত্যি প্রাইভেট কাজ করতে করতে আমি একটির প্রেমে পড়ে গেলুম। শুধু আমি প্রেমে পড়লে ক্ষতি ছিল না, দুর্ভাগ্যক্রমে সেও আমার প্রেমে পড়ল। উভয়ে উভয়ের প্রেমে মশগুল–আমাদের আর দিনরাত্রি জ্ঞান নেই, এমন সময় ব্যাপারটা রাজার অন্যান্য কর্মচারীদের কানে উঠল। দু-একজন কর্মচারী আমাকে সাবধান করে দিয়ে বললে, তুমি এখান থেকে পালাও, নইলে রাজামশায়ের কানে যদি এই কথা ওঠে তবে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে হবে না।
আমি স্থির করলুম, মরতে হয় মরব, তাকে ছেড়ে কোথাও যাব না। ক্রমে প্রাসাদের প্রায় সবাই ব্যাপারটা জেনে গেল। শত্রু-মিত্র সকলেই আমাকে পরামর্শ দিতে লাগল পালাও পালাও–নইলে মরবে।
আমি প্রতিদিন সকাল ও বিকালে লুকিয়ে যেতুম আমার প্রিয়তমার কাছে। সেদিন বিকেলবেলা সেখানে যাওয়ামাত্র সে বললে, তুমি এখুনি পালাও। আমি জানতে পেরেছি যে, আজ ওরা তোমাকে এইখানেই মেরে ফেলবে।
আমি বললুম, আমি মরতে রাজি আছি, কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাব না।
সে আমায় ধিক্কার দিতে লাগল। বললে, একটা বেশ্যার জন্যে এই অমূল্য মানবজীবন কেন নষ্ট করবে? পালাও–পালাও, নইলে আমি মরব।
সে এক শিশি বিষ নিয়ে এসে বললে, এই দেখ আমি ঠিক করে রেখেছি তোমাকে মারলেই আমিও বিষ খেয়ে মরব। আমায় যদি ভালোবাস তো আমার কথা শোন, এখুনি পালাও
সে-ই আমায় টাকাকড়ি দিলে। নিজের সব জিনিস, এমনকি টাকাকড়ি পর্যন্ত সব প্রাসাদে পড়ে রইল–আমি সেই এককাপড়েই বেরিয়ে পড়লুম।
বললুম, দাদা তো একেবারে বিল্বমঙ্গল! “ভেবে দেখ মন, কত তোরে নাচায় নয়ন। ছিলি ব্রাহ্মণকুমার—”
ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, ব্রাহ্মণকুমার নয় ভাই–আমি কায়স্থকুমার। নাম উপেন্দ্রনাথ ঘোষ। সেই থেকে আজ বছর-দেড়েক ধরে ঘুরেই বেড়াচ্ছি।
এই অবধি বলে ভদ্রলোক বললেন, এবার ভাই তোমাদের কথা বলো। নিজের কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছি।
আমরা আমাদের কাহিনি বললুম এবং বর্তমানে অবিলম্বেই একটা সুরাহা না হলে যে পিঞ্জরাবদ্ধ হতে হবে, সেটাও জানিয়ে ফেললুম। ভদ্রলোক বললেন, কুছ পরোয়া নেই–সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভাই সঙ্গীর অভাবে বড় কষ্ট পাচ্ছি। সারাজীবন ধরে আড্ডাই মেরে এসেছি। বুদ্ধিশুদ্ধি সবই ছিল, কিন্তু আড্ডার জন্যে কিছুই করতে পারিনি। এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই নিঃসঙ্গ জীবন অবসান করে দিই। একলা এই বাগানের নির্জন কোনো জায়গায় বসে কবিতা লিখি, নয়তো বসে বসে ভাবতে থাকি, আমি কি হতে পারতুম আর কি হয়েছি! এবার ভগবান যখন তোমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন, তখন আর ছাড়ছি না। আমরা চারজনে মিলিলে কত কাজ করতে পারি!
দেখলুম ভদ্রলোক আমাদের চাইতেও আশাবাদী। তাঁর কথা শুনতে-শুনতে আবার আশায় বুক ভরে উঠতে লাগল। পৃথিবী আবার সোনার রঙে রঙিন হয়ে উঠল। উপেনদাকে বললুম এক্ষুনি আহমেদাবাদ থেকে আমাদের সরে পড়তে হবে অথচ ট্যাকে একটি কপর্দকও নেই।
উপেনদা বললে, কুছ পরোয়া নেই–আমার কাছে একশোটা টাকা আছে। তা ছাড়া ওই-যে গুজরাটী লোকটি আমার সঙ্গে দেখলে, ও সোনা-রূপার গয়না তৈরি করে–ওকে আমি শান-পালিশের কাজ ও সে-কাজের জন্যে শানটা কি দিয়ে তৈরি করতে হয় তা শিখিয়ে দিয়েছি–এখানকার কেউ তা জানে না। এজন্যে ওর কাছ থেকে একশোটা টাকা পাব। এই দুশো টাকায় আমাদের অন্তত দু’মাস তো চলবে, তারপরে দেখা যাবে কি হয়!
বাগান থেকে উঠে আমরা সেই গুজরাটী স্যাকরার ওখানে গেলুম। মাঠ-কোঠার মতন বাড়ির দোতলায় রাস্তার দিকের একখানা ঘরে দোকান। দক্ষিণ-দেশে ছোট-বড় সব বাড়িতেই বসবার ঘরে একটা করে কাঠের দোলনা টাঙানো থাকে। একখানা কাঠের বড়-গোছের পিঁড়ি, যাতে জন-দুই লোক বসতে পারে–তারই চার কোণে ছ্যাঁদা করে লোহার শিক বা শিকল দিয়ে ছাতের সিলিংয়ে টাঙানো হয়। এই দোলনা খুব খাতিরের আসন। আমরা উপস্থিত হওয়া-মাত্র দোকানদার খাতির করে দুজনকে সেই দোলানয় বসালে। খবর পাওয়া-মাত্র দোকানদার ও আরও অন্যান্য বাড়ির মেয়েরা আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের দেখতে আসতে লাগল। দেখলুম, দোকানদার ও তার বাড়ির মেয়েরা উপেনদাকে একেবারে দেবতার মতো ভক্তি করে। চায়ের কথা বলা-মাত্র তখুনি ডালচিনির-আরক দেওয়া চা এসে হাজির হল, বিড়িও এসে পড়ল এক বাণ্ডিল। বিস্কুটের টিন হাত-ছাড়া হওয়ার পর থেকে চায়ের আস্বাদ ভুলেই গিয়েছিলুম। কয়েকদিন পরে চা খেয়ে বিড়ি টেনে ধাতস্থ হওয়া গেল। খানিক পরে দোকানদার উপেনদার শেখানো সেই ‘শান’ বের করলে। সেটাকে কি করে বসিয়ে কেমন করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গয়না পালিশ করতে হয়, ত্বা উপেনদা দেখিয়ে দিতে লাগল।
সব দেখাশোনা হয়ে গেল বটে, কিন্তু টাকা সেদিন পাওয়া গেল না, দোকানদার বললে, কাল তিনটের মধ্যে নিশ্চয় টাকা দিয়ে দেবে।
সেখান থেকে বেরিয়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেতে-খেতে আমরা পরামর্শ করতে লাগলুম, কি করা যায়! ঠিক করা গেল, স্যাকরার কাছ থেকে টাকাটা আদায় হলেই কাল চারটের ট্রেনে আমরা আহমেদাবাদ ত্যাগ করে বরোদা যাব।
সে-সময় রমেশচন্দ্র দত্ত মশায় ছিলেন বরোদা রাজ্যের দেওয়ান। স্থির করা গেল যে, সেখানে গিয়ে তাঁকে ধরে সে-রাজ্যে একটা কাজ জুটিয়ে নেব। সেখানে কিছু না হয় চলে যাব সুরাটে–সেখানে না হয়, বোম্বাই শহরে। আমরা চারজনেই চিরদিন কিছু বেকার বসে থাকব না। একজনের একটা কিছু জুটে গেলেই ক্রমে সকলেরই হবে, তারপরে ব্যবসা তো আছেই।
পরামর্শ ঠিক হয়ে যাবার পর উপেনদার কাছ থেকে বিদায় নেওয়া গেল। কথা রইল, কাল বেলা তিনটের মধ্যে আমরা সেই স্যাকরার ওখানে গিয়ে জুটব। উপেনদা আমাদের এই বিপদের সময় যেরকম ঈশ্বরপ্রেরিত হয়ে উপস্থিত হলেন, তাতে মনে হতে লাগল ভগবান বুঝি এতদিন বাদে আমাদের পানে মুখ তুলে চাইলেন।
মহা উৎসাহ বুকে নিয়ে ভিসি-তে গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল। আমাদের সুন্দরী সেই ঘাড় হেঁট করে রুটি বেলে চলেছেন। মনে-মনে বলতে লাগলুম, তোমায় ছেড়ে চললুম সুন্দরী! তুমি রুটি বেলছ বটে, কিন্তু এখানে আমার রুটির সংস্থান হল না। তার ওপরে তোমার মতন রূপসির যেখানে আগুনের সামনে বসে দিনরাত-রুটি বেলতে হয়–রূপের উপাসকের অবস্থা সেখানে আর কি হবে! তবুও তোমায় নিয়ে চললুম বুকের মধ্যে করে–সারাজীবন তুমি সেইখানেই থাকবে।
প্রাণপণে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করতে লাগলুম, যদি একবার সে ঘাড় তুলে আমার দিকে চায়! কিন্তু ইচ্ছাশক্তি যদি ঈপ্সিতের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারত, তবে অধিকাংশ সুন্দরীর পক্ষেই দুনিয়ায় বাস করা অসম্ভব হত। খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরও অনেকক্ষণ বসে থাকলুম, কিন্তু প্রেয়সী মুখ তুললে না দেখে আস্তে আস্তে ভিসি থেকে বেরিয়ে এলুম।
পরের দিন ছেলেরা সকালবেলাকার কাজ সেরে বাড়ি ফেরবার আগেই স্নান সেরে আমাদের ছোট ছোট পুঁটলিগুলি বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লুম। তাড়াতাড়ি আহারপর্ব শেষ করে ভিক্টোরিয়া-বাগানে বেলা প্রায় আড়াইটে অবধি কাটিয়ে সেই স্যাকরার ওখানে গিয়ে হাজির হওয়া গেল। গিয়ে দেখি, উপেনদা সেখানে খুব জমিয়েছে। তার চারদিকে স্যাকরার ও তার প্রতিবেশীদের বাড়ির মেয়েরা বসেছে–তাদের মধ্যে ফলাও করে সে গীতার মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছে।
আমরা উপস্থিত হতেই সে বললে, ওই দেখ, আমার বন্ধুরা এসে পড়েছে, বেলা চারটেয় আমাদের গাড়ি। এবার আমায় বিদায় কর।
উপেনদার কথা শুনে স্যাকরা উঠে গিয়ে তার প্রকাণ্ড লোহার সিন্দুক খুলে একটি আংটি বার করে এনে তার আঙুলে পরিয়ে দিলে। উপেনদা তখুনি আংটিটা আঙুল থেকে খুলে হাতের তেলোয় ফেলে ওজন দেখে বললে, তা আধ ভরির ওপর হবে হে!
ইতিমধ্যে স্যাকরা আর-একটি বাক্স খুলে তিনখানা দশটাকার নোট নিয়ে উপেনদার সামনে ধরতেই সে তো চটে আগুন! সে বলতে লাগল, কি! এই ক’টি টাকার জন্যে কি আমি তোমাদের গুপ্ত বিদ্যা শিখিয়ে ছিলুম।
দুইপক্ষে ধস্তাধস্তি লেগে গেল। উপেনদাও নেবে না, তারাও এর বেশি দেবে না–শেষকালে স্যাকরা-গিন্নি তাঁর আঁচলের খুঁট খুলে আর-একটা দশ-টাকার নোট বের করে বললে, আমরা তোমার ছেলে-মেয়ে, এই নিয়ে ছেলে-মেয়েদের অব্যাহতি দাও।
উপেনদা বললে, তা হলে আমার একপয়সাও চাই না। আমি মনে করব, আমার ছেলে-মেয়েদের একটা বিদ্যা শিখিয়ে দিয়েছি।
উপেনদা আমাদের দিকে ফিরে বললে, চল ভায়া, আমাদের ট্রেনের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ঘরের এক কোণে তার ছোট বিছানা বাঁধা পড়ে ছিল, সেই পুঁটলিটা তুলে বগলদাবা করে উপেনদা তাদের বললে, আচ্ছা তা হলে চললুম, তোমাদের ভালো হোক।
উপেনদার কাণ্ড দেখে স্যাকরা, স্যাকরা-বউ কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে। শেষকালে তারা আরও দশটা টাকা বের করতে তবে শান্তি হল।
একখানা টাঙ্গা ভাড়া করে তখুনি ছুটলুম স্টেশনে। উপেনদাকে বললুম, দাদা, টিকিট কিনে ট্রেনে চড়া তো একদম ভুলেই গিয়েছি।
উপেনদা বললে, ট্যাকে যখন পয়সা রয়েছে তখন টিকিট কিনতে আপত্তি হওয়া উচিত নয়। ট্যাকে যখন থাকে না, তখন আমিও টিকিট কাটি না। ব্রাদার, ও সবই ‘গিভ্ অ্যান্ড টেক্’-এর প্রশ্ন। টিকিট কাটা হল বটে, কিন্তু তবুও বিনা-টিকিটের যাত্রী হয়ে এসে এই স্টেশনে যে ধরা পড়েছিলুম, সে-কথা ভুলিনি। তাই অতি সন্তর্পণে চেকারদের এড়িয়ে একখানা তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ঢুকে পড়া গেল।
আহমেদাবাদ থেকে বরোদা খুব বেশি দূর নয়। বরোদায় গিয়ে যখন গাড়ি পৌঁছল, তখন সন্ধে হতে দেরি আছে। স্টেশনে নেমেই দেখি, সামনেই দু-তিন-জন প্যান্টলুনধারী লোক দাঁড়িয়ে–তাদের মধ্যে একজনের হাতে একখানা মোটা বাঁধানো খাতা। লোকগুলো যেন আমাদের অভ্যর্থনা করবার জন্যেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা প্ল্যাটফর্মে পদার্পণ করা-মাত্র তাদের মধ্যে একজন বেশ একটু অভ্যর্থনাসূচক হাসি হেসে বললে, আসুন। কোথা থেকে আসা হচ্ছে মশায়দের?
–আজ্ঞে, আমরা আসছি এই আহমেদাবাদ শহর থেকে।
–কিন্তু আপনাদের দেখে তো গুজরাটের লোক বলে মনে হচ্ছে না। দেশ কোথায় বলতে আজ্ঞা হয়।
বললুম, আমাদের দেশ বাংলাদেশে।
লোকটি তার সঙ্গীদের দিকে চেয়ে একটু, অর্থসূচক হাসি হেসে বললে, তাই বলুন। এখন আমাদের সঙ্গে আসতে আজ্ঞা হয়।
লোকটির সঙ্গে প্ল্যাটফর্মের পুলিস-আপিসে যাওয়া গেল। তারা খাতির করে বসবার জন্যে আমাদের টুল দিলে।
তারপরে সেই প্রকাণ্ড খাতায় আমাদের নাম ধাম ইত্যাদি লিখে নিয়ে বললে, দেখুন, এটা গাইকোয়াড়ী জায়গা–এখানে অন্য জায়গা থেকে লোক আসবার নিয়ম নেই। আপনারা কি করতে এখানে এসেছেন?
উপেনদা খুব বিনীতভাবে বললে, দেখুন আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিবেদন করছি যে, আমরা ব্রিটিশ গবর্নমেন্টের প্রজা–ভারতবর্ষের সমস্ত দেশে যাবার অধিকার আমাদের আছে। যদি আমরা কোনো অপরাধ করি তো ধরে সাজা দেবার অধিকার আপনাদের কাছে।
উপেনদার কথা শুনে লোকগুলো চটে একেবারে কাঁই হয়ে গেল। একজন বেশ উত্তেজিত হয়ে বললে, আপনারা এখানে কি করতে এসেছেন তা না বললে এ-রাজ্য থেকে চলে যেতে হবে।
উপেনদা এবার বললে, আপনাদের রাজ্যের দেওয়ান সার্ রমেশচন্দ্র দত্তের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ করতে চাই।
ঘরের মধ্যে আরও অনেকগুলি লোক বসে ছিল–কথাটা শুনে তাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সাড়া পড়ে গেল। নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ গুজগুজ ফুসফুস করে কোথায় যেন টেলিফোন করলে। খানিকক্ষণ পরে আমাদের বললে দেখুন, আমাদের দেওয়ান-সাহেব তো এখানে নেই। বিশেষ কাজে তিনি ইংলন্ড গিয়েছেন–ফিরতে দু-তিন মাস দেরি হতে পারে।
বলা বাহুল্য, এবারকার সুর অনেক নরম।
–তা হলে এখানে থাকবার আর আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। শহরটা একটু দেখে কাল এই ট্রেনেই আমরা আপনাদের এই স্বর্গরাজ্য ছেড়ে চলে যাব।
আমরা এত সহজেই চলে যাচ্ছি দেখে লোকগুলো খুশি হয়ে উঠল।
জিজ্ঞাসা করলুম, তোমাদের এখানে ধর্মশালা আছে? আর, রাত্রির মতন একটু আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে?
দেওয়ানের সঙ্গে যারা দেখা করতে চায় তারা ধর্মশালায় আশ্রয় খুঁজছে দেখে তারা বেশ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলে হোটেলের কথা বলছেন?
হোটেলের কথা বলছেন? ভালো-ভালো হোটেল আছে এখানে–টাঙ্গাওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে।
বেরিয়ে আসবার সময় লোকগুলো বললে, কাল যখন চলে যাবেন তখন আমাদের এই আপিসে দয়া করে একটু খবর দিয়ে যাবেন।
স্টেশনের সামনেই বিরাট ধর্মশালা। সেখানে জিনিসপত্র রেখে তখুনি শহর দেখতে বেরুনো গেল। পরের দিন যথাসময়ে সুরাট যাত্রা করলুম। বরোদা ত্যাগ করবার সময়ে ইচ্ছা করেই পুলিসে কোনো খবর দিলুম না। যা হোক, রাত্রি দশটা এগারোটার সময় সুরাটে পৌঁছুলাম। স্টেশনের কাছেই একটা হোটেলে তখনকার মতো গিয়ে ওঠা গেল। এইসব জায়গায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা নেই, অনেকটা আগ্রার হোটেলের মতন। মাথা-পিছু বা ঘর-পিছু দৈনিক ভাড়া দেওয়া হয়। আমরা যে ঘরখানায় উঠলুম সেটা বেশ সাজানো ছিল। একটা ছোটগোছের টেবিল-হারমোনিয়াম রয়েছে দেখে বাজাতে গিয়ে দেখলুম, তার হাপরে বিরাট ছিদ্র–একটু পিঁ-পিঁ করে সুর বেরোয় বটে, কিন্তু হাপরের সেই ছেঁদা দিয়ে ‘বাব্বা’”বাব্বা’ শব্দ বেরুতে লাগল তার দশগুণ জোরে। হোটেলের একটি ছোকরা দালাল আমাদের স্টেশন থেকে নিয়ে এসেছিল, কিছুক্ষণ পরে আসল মালিক এলেন আলাপ করবার জন্যে। আমরা বাঙালি জেনে ভারি খুশি হয়ে বললেন, এখানে আরও একজন বাঙালি আছেন–তিনি আমার বন্ধু। ভদ্রলোক রোজই সকালে আমার এখানে আসেন।
উপেনদা বললে, কাল যখন তিনি আসবেন তখন আমাদের ডেকে দেবেন, আমরাও তাঁর সঙ্গে আলাপ করব।
হোটেলওয়ালা বললেন, নিশ্চয় ডাকব।
সৈ-রাত্রে হোটেলেরই চাকরকে দিয়ে খাবার আনানো হল–অতি জঘন্য খাদ্য। কি আর করা যাবে! ভাই খেয়ে তখনকার মতো শুয়ে পড়া গেল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। চা-পানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, এমন সময় হোটেলের একটি ছোকরা চাকর এসে বললে, শেঠ ডাকছে।
আমি যাচ্ছি।–বলে সুকান্ত সেই ছেলেটির সঙ্গে বেরিয়ে গেল। মিনিট কয়েক পরেই দেখি, সুকান্ত একজনকে জড়িয়ে ধরে আমাদের ঘরের দিকে আসছে। লোকটি আমাদের চেয়ে বোধ হয় তিন-চার বছরের বড় অর্থাৎ কুড়ি-একুশের বেশি বয়স হবে না। তার মাথায় একটা ছোট পাগড়ির মতো বাঁধা, বাঙালির মতো কোঁচা ঝুলছে। তাকে ঘরের মধ্যে এনে সুকান্ত বললে, আমার চেনা লোক।
পরিচয় হল। সুকান্তদের দেশেই তাদের বাড়ি। নাম নিশিকান্ত গুহ। কথায় বার্তায়, চাল ও চলনে খুবই খলিফা বলে মনে হতে লাগল। আমাদের দেখাবার ও শোনাবার জন্যে নানারকম চটকদার কথাবার্তা বলতে লাগল। একবার হারমোনিয়ামে বসে সেই ছেঁদা হাপর ঠেলেই গান সুরু করে দিলে–দিদি লাল পাখিটি আমায় ধরে দে না লো। ওরই মধ্যে কথায় বার্তায় বের হয়ে গেল, মস্ত জমিদার-ঘরের ছেলে সে। বাপ খুড়ো মামা পিসে মেসো কেউ জজ কেউ বা ম্যাজিস্টর। বাংলাদেশের প্রায় সব বড়লোকদেরই সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে–নিজের চেনাশোনা তো আছেই।
সত্যিই তার হালচাল দেখে মনের মধ্যে একটা ছাপ পড়ল। নিশিকান্ত বললে, বছরখানেক আগে প্রায় হাজার টাকা নিয়ে সে বাড়ি থেকে চম্পট দিয়েছিল, তারপর অনেক ঘাটের জল খেয়ে শেষকালে এই সুরাটে এসে আড্ডা গেড়েছে এবং এইখানেই সে ব্যবসা করবে। কিসের ব্যবসা করবে এই নিয়ে বাড়ির সঙ্গে লেখালেখি চলেছে–মস্ত ফলাও ব্যবসা, সব একরকম ঠিকঠাক ও হয়ে গিয়েছে।
নিশিকান্ত বলতে লাগল, তোমরা এসেছ ভালোই হয়েছে–আমরা এতগুলো বাঙালি ছেলে একসঙ্গে জুটলে কি না করতে পারি! আমি যে ব্যবসা করব তাতে অনেক বিশ্বাসী লোকের দরকার, ভগবান তোমাদের জুটিয়ে দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে হোটেলওয়ালা এসে জানালে–কাল রাত্রে তোমাদের নাম-ঠিকানার জন্যে পুলিসের লোক এসেছিল, কিন্তু অনেক রাত্রি হয়ে যাওয়ায় তোমাদের আর খবর দিইনি। নিশিকান্ত তাকে বললে যে, আমি বাড়ি যাবার মুখে পুলিস-আপিসে গিয়ে এদের কথা বলে যাব।
দেখলুম, নিশিকান্ত কাজ-চালানো-গোছের গুজরাটী ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছে। সে বললে, এখানে আর হোটেলওয়ালাকে পয়সা দিয়ে কি হবে, চল আমার ওখানে। আমার যা ঘর তাতে আরও পাঁচ-সাতজন লোক ধরতে পারে।
তখুনি হোটেলওয়ালাকে তার পাওনা-গণ্ডা চুকিয়ে দিয়ে আমাদের পোঁটলা নিয়ে নিশিকান্তর সঙ্গে বেরিয়ে পড়া গেল। পথে পুলিসের ফাঁড়িতে ঢুকে সে বললে, এরা আমার লোক, এখন এখানেই থাকবে।
নিশিকান্তকে দেখে পুলিসের লোক আমাদের নাম-ধাম পর্যন্ত জানতে চাইলে না।
নিশিকান্তর ডেরায় পৌঁছনো গেল। দিল্লি-দরজার কাছেই এক মাঠকোঠার দোতলায় বড় একখানা ঘর। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এই ঘরখানা ছাড়া সেদিকে আর অন্য ঘর নেই। ঘরের মধ্যে আসবাব জিনিসপত্র কিছু নেই বললেই হয়। দড়িতে একখানা ধুতি ঝুলছে, একখানা বড় চেটাই-গোছের জিনিস মাটির মেঝেতে পাতা, তার ওপরে এখানে ওখানে অগোছালোভাবে কয়েকটা জিনিস পড়ে আছে। এক কোণে একটা ঝাঁটার মতন জিনিস পড়ে আছে বটে, কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে মনে হয় না যে কোনো জন্মে ঝাড়ু লাগানো হয়। ঘরের মধ্যিখানে একটা ছাঁই-ভর্তি উনুন, তার চারপাশে ভাত ছড়ানো। ঘরের অবস্থা দেখলেই বুঝতে পারা যায়, যে সেখানে থাকে সে অত্যন্ত অপরিষ্কার ও অগোছালো লোক।
একটু বসেই আমরা ঝাঁটা নিয়ে. মেঝে সাফ করে কাপড়চোপড় ও অন্যান্য জিনিসগুলিকে গুছিয়ে ঘরখানিকে তকতকে ঝকঝকে করে ফেললুম। ঘরেই কাঠকয়লা ছিল, তাই দিয়ে উনুন ধরিয়ে খিচুড়ি চাপিয়ে দেওয়া হল। নিশিকান্তর ঘরেই চাল ডাল পেঁয়াজ ছিল–বাজার থেকে কিছু মসলার গুঁড়ো ও ঘি আনানো হল।
খিচুড়ি খেয়ে দুপুরবেলা পরামর্শ-সভা বসল। নিশিকান্ত বললে, সে সাবান তৈরি করতে জানে। ঘরের কোণ থেকে একটা ঝুড়ি টেনে এনে সে কতকগুলো সাবান দেখিয়ে বললে যে, সেগুলো সে নিজে তৈরি করেছে। দেখলাম, তার মধ্যে দু-তিন রকমের গায়ে মাখবার ও দু-তিন রকমের কাপড়-কাঁচবার সাবান রয়েছে।
নিশিকান্ত বলতে লাগল যে, এখানকার জনকয়েক মহাজন তার পেছনে লেগেছে; কিন্তু সে বাড়ির টাকার জন্যে অপেক্ষা করছে। কারণ মহাজনের হাতে পড়লে ক্রমে তার হাতে কারবার চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। সে ভরসা করছে, বাড়ি থেকে শিগগিরই কিছু অর্থ এসে পড়বে।
জনার্দন বললে, আমি চেষ্টা করলে বাড়ি থেকে কিছু টাকা জোগাড় করতে পারি। আমি ও সুকান্ত বললুম, আমরা গায়ে খাটব, টাকা-কড়ি কিছু দিতে পারব না। উপেনদা বললে, আমার কাছে ভাই মাত্র একশো টাকা আছে।
নিশিকান্ত খুবই উৎসাহিত হয়ে উঠে বললে, আমরা পাঁচজনে আছি, এই পাঁচজনের লোকবল কিছু কম নয়। আপাতত শতখানেক টাকার সাবান তৈরি করে বিক্রি তো করি, তারপরে কিছু এসে গেলে আবার ভিয়েন চড়ানো যাবে।
মনে পড়ে, উৎসাহের চোটে সেদিন সে কোথা থেকে নোনা-ইলিশের ডিম কিনে নিয়ে এল। তিলের তেল দিয়ে ভাজা সেই মাছের ডিম দিয়ে খিচুড়ি খেতে যা লাগল তা আর কি বলব!
চার-পাঁচদিন এমনিভাবে কেটে গেল, কিন্তু নিশিকান্ত সাবান তৈরির কিছুই করে না। বরঞ্চ দেখতে লাগলুম, আমার ও সুকান্তর প্রতি তার ব্যবহারের পরিবর্তন হচ্ছে। ক্রমে তারা তিনজন যেন আলাদা হয়ে পড়তে লাগল।
বিকেলবেলা তারা তিনজনে কোথায় বেরিয়ে যায়–আমি ও সুকান্ত সঙ্গে যেতে চাইলেই বলে, কাজের জায়গায় অত ভিড় করবার দরকার নেই। আমরা দুজনে শহরের অন্যান্য রাস্তায় ঘুরে বেড়াই।
কয়েকদিন বাদে নিশিকান্ত হঠাৎ স্পষ্টই বলে দিলে, এক জায়গায় সকলে বসে গুঁতোগুতি করলে কারুরই কিছু হবে না, তোমরা অন্যত্র চেষ্টা কর।
সেই অপরিচিত জায়গায় অকস্মাৎ এইরকম বিপদে পড়ে সুকান্ত অত্যন্ত ভগ্নহৃদয় হয়ে পড়ল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি–নিশিকান্তর এই ব্যবহার আমাকে খুব কাবু করতে পারেনি। উপেনদার সঙ্গে আমাদের নতুন আলাপ। তাকে আমরা একরকম পথে কুড়িয়ে পেয়েছিলুম বললেই হয়। অতি দুর্দিনে সে আমাদের সাহায্যও করেছিল এবং ভবিষ্যতের অনেক ভরসাও দিয়েছিল। আজ যদি সে আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তাকে কিছু বলবার নেই। নিশিকান্তর সঙ্গেও তাই। কিন্তু জনার্দন! –যার সঙ্গে একসঙ্গে বাড়ি ছেড়ে বেরুলুম, এত দুঃখ-কষ্ট একসঙ্গে সহ্য করলুম, সে আজ আমাদের ছেড়ে ওদের দলে গিয়ে মিশল কি করে! এই চিন্তাটাই আমার মনের মধ্যে অত্যন্ত পীড়া দিতে লাগল যে, মানুষ কেমন করে এত সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারে!
আমাদের বিভিন্ন অস্তিত্ব বন্ধুত্বের আশ্রয়ে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল। এই ব্যবহার আমাদের সেই যুক্ত-অস্তিত্বের শিকড়ে টান দিলে, মূলোৎপাটনের সেই বেদনাই আমাকে পীড়া দিতে লাগল। বন্ধু বলে যাকে টেনেছিলুম, আজ সুবিধাবাদী বলে তাকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হচ্ছিল।
জনার্দনের সঙ্গে খোলাখুলি একটু কথাবার্তা কইতে পারছিলুম না। তাকে উপেনদা ও নিশিকান্ত দিনরাত এমনভাবে আগলে থাকতে লাগল যে, তাকে নিরিবিলি একটু পাওয়া পর্যন্ত অসম্ভব হয়ে উঠল। আমরা বুঝতে পারলুম যে, জনার্দনের বাড়ি থেকে টাকা পাবার আশায় নিশিকান্ত তাকে এত খোশামোদ করছে। আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করবার সুযোগ হলে পাছে আমরা তাকে বিগড়ে দিই–এই ভয়ে তারা তাকে এমন করে আগলে রাখছে। যাই হোক, তাদের স্বার্থের জন্যে তারা হয়তো এমন করেছিল। কিন্তু জনার্দনের নিজেরও তো একটা মতামত আছে! সে কি বলে ওদের দলে গিয়ে ভিড়ল! এই অভিমানটাও সেদিন আমার লেগেছিল বড় করে। কারণ, বিপদের মধ্যে বাস করে আমার মনের মধ্যে একটা সংস্কার হয়ে গিয়েছিল যে, বিপদ একদিন নিশ্চয়ই কেটে যাবে, নয়তো অভ্যেস হয়ে যাবে।
সেইজন্যে জনার্দন নিশিকান্তর সঙ্গে যোগ দেওয়ায় যে বিপদের সম্ভাবনা আসন্ন হয়ে উঠেছে সে-ভাবনা তেমন কাতর করতে পারেনি, যতখানি করেছিল সুকান্তকে।
এই রকম চলেছে,. সেইসময় একদিন বিকেলবেলা উপেনদা, নিশিকান্ত ও জনার্দন কোথায় বেরিয়েছে–আমরাও দুজনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি, এমন সময় সুকান্ত বললে, ক’দিন উপরি-উপরি দুবেলা আধসেদ্ধ-খিচুড়ি খেয়ে আমার ভয়ানক আমাশা হয়েছে, ঘুরতে পারছি না–চল্, বাড়ি ফিরে চল্।
ঘরে ফিরে এসে দেখি, ওরা তিনজনেই ফিরেছে। আমরা যেতেই নিশিকান্ত বললে, এই যে আড্ডা দিয়ে ফেরা হল! লজ্জা করে না এমন ভাবে বসে বসে খেতে?
সুকান্ত তো কথা না বলে শুয়ে পড়ল। আমি বললুম, কি করব বল, কাজ-কর্ম যতদিন না জোটে–
নিশিকান্ত বললে, কাজকর্ম জোটাবার কি চেষ্টা হচ্ছে শুনি? এখানে তোমাদের কিছু হবে না। আগেই বলেছি, সবাই মিলে এক জায়গায় মাথায় ঠোকাঠুকি করে মরলে কিছুই হবে না। আমরা এখানে রইলুম। তোমরা দুজনে অন্য কোনো শহরে চলে যাও–দেখ, সেখানে কিছু করতে পার কি না!
জিজ্ঞাসা করলুম, কোন্ শহরে যাব?
–এখানে থেকে কিছু দূরে নোভাসারি অর্থাৎ ‘নয়া সরাই’ একটা শহর আছে–সেখানে চলে যাও। চেষ্টা-চরিত্র করে দেখ। একজনের জুটে গেলে আর-একজনের জুটতে দেরি হবে না। নিশিকান্তর কাছে টাইম-টেব্ল্ ছিল। সে তাই দেখে তখুনি বলে দিলে, ভোর পাঁচটায় একটা গাড়ি আছে, চলে যাও–ঘণ্টা-দুয়ের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে যাবে।
বললুম, আচ্ছা তাই যাব।
আমাদের সঙ্গে কথা বলে নিশিকান্তরা আবার বেরিয়ে গেল। ওরা বাইরে যাবার পর সুকান্তর অসুখ বাড়তে লাগল। সন্ধের মধ্যেই বোধ হয় আট-দশবার তাকে উঠতে হল। পেটের যন্ত্রণায় সে একেবারে ছটফট করতে আরম্ভ করে দিলে। ঘরে রাঁধবার জন্যে যে তিলের তেল ছিল, তাই একটু নিয়ে জল দিয়ে তার পেটে কিছুক্ষণ মালিশ করতে করতে সে নিঝুম হয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে আমিও তার পাশে শুয়ে পড়লুম। শুয়ে শুয়ে কেবলই মনে পড়তে লাগল, সেই ঝড়ের রাতের কথা–যেদিন জনার্দন বিচ্ছুর দংশনে কাতর হয়ে চিৎকার করছিল আর একান্ত অসহায়ের মতন আমরা দুজনে তার শিয়রে বসে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিলুম। ভাবতে-ভাবতে আবার নিরাশার অন্ধকারে আশার জ্যোতি ঝিলিক দিতে লাগল। মনে হতে লাগল, সেদিনও যখন কেটেছে, এদিনও তখন কেটে যাবে।
সন্ধ্যা উত্তরে রাত্রি অনেকখানি গড়িয়ে গেল, তখনও নিশিকান্তরা ফিরল না। তার ঘরে ছোট্ট একটা ঘড়ি ছিল সেটাতে দেখলুম ন’টা বাজে। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ব কি না ভাবছি, এমন সময় কাঠের সিঁড়িতে খটখট শব্দ শুনে মনে হল তারা আসছে। আর বাক্যব্যয় না করে শুয়ে পড়া গেল। ওরা ঘরের মধ্যে ঢুকে জামা খুলে বসল। নিশ্চয় বাইরে কোনো জায়গা থেকে খেয়ে এসেছিল, কারণ রান্নাবান্নার কোনো আয়োজন করলে না বা আমি জেগে আছি দেখেও একবার জিজ্ঞাসা করলে না, খাওয়া হয়েছে কি না! রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় ওরা আলো নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। চারটের সময় উঠতে হবে বলে ঘড়িটা কাছেই রেখে দিলুম। সমস্ত রাত্রি একরকম জেগেই কাটল। চারটের সময় উঠে মুখ-টুখ ধুয়ে সুকান্তকে নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল।
বিদায়ের সময় উপেনদা একটা টাকা দিয়ে বললেন, টাকাটা রাখ হে, সময়ে অসময়ে দরকার হতে পারে।
ভাবলুম, টাকাটা নেব না। কিন্তু Discretion is the best part of valour –মনে করে টাকাটা নেওয়াই গেল।
স্টেশনে যখন গাড়ি থামল, তখন বেলা প্রায় আটটা। ছোট পরিষ্কার স্টেশনটি–লোকজন নেই বললেই হয়। আমাদের সঙ্গে কেউ নামল না। সুরাট থেকে আনা-সাতেক ভাড়া–দুজনের চোদ্দ আনার টিকিট কেনা হয়েছিল, আর মাত্র দু’আনা ট্যাকে আছে। এই সম্বল করে নোভাসারিতে পদার্পণ করলুম ভাগ্য অন্বেষণ করতে।
স্টেশন থেকে বেরিয়েই একটা সরু পথ চলে গিয়েছে শহরের দিকে। আশ্চর্য নির্জন শহর, পথে লোকজন গাড়ি-ঘোড়া কিছুই নেই। মনে হতে লাগল, গল্পের দৈত্যের সেই ঘুম-পাড়ানো শহরে ঢুকে পড়লুম নাকি! রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট সুদৃশ্য বাড়ি–ইংলন্ডের গ্রামের যেসব ছবি দেখতে পাওয়া যায় অনেকটা সেইরকম।
আমরা ঠিক করেছিলুম, বাড়ি-বাড়ি ঢুকে কাজের চেষ্টা করব–দেখি কি হয়! সুকান্তকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি বাড়ির মধ্যে ঢুকতে লাগলুম।
কিন্তু কোথায় সেই দুর্লভ চাকরি! কোনো বাড়িতে ঢোকামাত্র দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিতে লাগল। কোথাও-বা দুঃখের কাহিনি শুনে বললে, এখানে কিছু হবে না। নোভাসারি জায়গাটা দেখলুম পার্শীপ্রধান জায়গা। পার্শীদের বাড়িতে ঢুকলে তো দেখ্-তাড়া করতে লাগল। বেলা বারোটা নাগাদ প্রায় পঞ্চাশখানা বাড়িতে চেষ্টা করে নিরাশ হয়ে আবার স্টেশনের দিকে ফেরা গেল।
শহরের কোথাও বসে একটু বিশ্রাম করবার মতন জায়গা নেই। কলকাতার বাড়ির মতন সেখানে কোনো বাড়িতে একটু রক নেই যে একটু বসব। এদিকে সুকান্তও অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। ওরই মধ্যে ঝোপে-ঝাড়ে সে কাজ সারতে লাগল। রাস্তায় লোকজন কম বলে সেদিকে একটু সুবিধাই ছিল।. ঘুরতে-ঘুরতে আমরা স্টেশনের কাছেই একটা ঘাসওয়ালা জমিতে বসে পড়লুম।
কাল রাত্রি থেকে আহার নেই, তার ওপর এতখানি ঘোরা হয়েছে–শরীর যেন ভেঙে পড়তে লাগল। সুকান্ত তো বসেই শুয়ে পড়েছিল, আমিও খানিকক্ষণ বসে-বসে গা এলিয়ে দিলুম।
বেলা প্রায় আড়াইটে-তিনটের সময় ঘুম ভাঙল। অবসাদে শরীর অত্যন্ত ভারী বলে বোধ হতে লাগল। দেখলুম, সুকান্ত আমার আগেই উঠে বসেছে। আমিও উঠে বসলুম। খিদেয় পেটের মধ্যে পাক দিচ্ছিল। বলাবলি করতে লাগলুম, আজ আর নারায়ণ অন্ন জোটাবেন না। যাক, যা হয় ভালোর জন্যেই হয়–হয়তো আমাশার ওপর খেয়ে তার অসুখ আরও বেড়ে যেত।
এইরকম আলোচনা করছি আর মাঝে মাঝে বলছি–নারায়ণ, তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। বলতে বলতে নারায়ণ এসে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ভক্তকে অভিবাদন করলেন–নমস্কার!
পাঠক! চমকিত হবেন না। মানুষের রূপ ধরে বুভুক্ষু ভক্তের সামনে এমনভাবে এর আগে নারায়ণ অনেকবার এসে দাঁড়িয়েছেন-পরমান্ন বয়ে এনেছেন গোপবালকের বেশে, দধিভাণ্ডকে অফুরন্ত করেছেন অপমানিতের অশ্রুমোচন করতে, আর শরণাগতের মহিমা প্রচার করেছেন এক-কুচি শাকান্ন দিয়ে সহস্র উগ্রচণ্ড ব্রহ্মর্ষির অমিতোেদর পরিপূরণে। তুঁহু জগতারণ জগতে কহায়সি–ত্রাণকর্তার জগতে বুভুক্ষু যখন আছে তখন আসতেই হবে তাঁকে তার কাছে।
–নমস্কার! কে বাবা তুমি?
মুখ তুলে দেখলুম, একটি লোক, রোগা লম্বা একহারা চেহারা, মাথায় গোল টুপি, বয়স ত্রিশের মধ্যেই হবে–সস্মিত মুখে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। আমরা প্রতি-নমস্কার করতেই সে রাস্তা ছেড়ে একেবারে আমাদের কাছে এসে বসে হিন্দি ভাষায় বললে, আপনাদের বাড়ি বোধ হয় কলকাতায়?
বললুম, ঠিক অনুমান করেছেন।
লোকটি বললে, আমি কলকাতায় থাকি কিনা, বাঙালি দেখলে চিনতে পারি।
–কি উপলক্ষে কলকাতায় থাকা হয়?
–সেখানে আমার এক আত্মীয়ের ব্যবসা আছে, সেখানে চাকরি করি।
জিজ্ঞাসা করলুম, এইখানে দেশ বুঝি?
–হ্যাঁ, দু’বছর পরে কিছুদিনের জন্যে দেশে এসেছি আবার শিগগিরই চলে যেতে হবে। –একটু চুপ করে থেকে লোকটি আবার বললে, এখানে আমার বাপ-মা আছেন তাই আসতে
হয়, নইলে কলকাতাই আমার ভালো লাগে। আসলে সেইটেই আমার দেশ, এইখানে আমি বেড়াতে এসেছি। এই বলে নিজের রসিকতায় লোকটি হো-হো করে হেসে উঠল। –কিন্তু আপনারা এখানে কি করতে এসেছেন?
–চাকরি খুঁজতে।
–কলকাতা ছেড়ে এসে এখানে চাকরি! এখানে কি কোনো ব্যবসা আছে যে, চাকরি পাবেন? বললুম, আমরা লোকেদের বাড়ির চাকরের কাজ পেলেও করতে পারি। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে চুরি ডাকাতি ছাড়া আর সব কাজই আমরা করতে রাজি আছি।
–তা কিছু কাজের সন্ধান মিলেছে কি?
–না, অনেক বাড়ি তো ঘুরলাম, কেউ রাখতে রাজি হয় না।
আমাদের কথা শুনে লোকটির মুখ চিন্তায় গম্ভীর হয়ে উঠল। ভাবলুম, একটা চাকরি-বাকরির আশা বোধ হয় পাব তার কাছ থেকে। কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থেকে সে বললে, চলুন, ওই দোকানে বসে চা খেতে-খেতে আপনাদের সঙ্গে গল্প করা যাবে।
জানি না, রাধার কানে শ্যামনাম কি মধুবর্ষণ করেছিল, কিন্তু সেদিন চায়ের নামে আমার কর্ণকুহরে যে অমৃতবর্ষণ হয়েছিল, সে-কথা স্মৃতিপথে উদিত হলে আজও রোমাঞ্চিত হয়ে উঠি।
রাস্তার ওপারেই একটা ছোট্ট চায়ের দোকান ছিল, তিনজনে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হওয়া গেল। দোকানে তখন খদ্দেরপাতি কিছুই ছিল না। সামান্য দোকান, একটা লম্বা টেবিলের দু’পাশে দু’খানা অত্যন্ত সরু বেঞ্চি পাতা। আমরা বসতেই সঙ্গের লোকটি দোকানদারকে বললে, তিন কাপ গরম চা দাও তো। বলেই বললে, আচ্ছা দাঁড়াও কিছু খাবার-দাবার আছে?
–খাবার? নিশ্চয়ই। আমার কাছে ভালো খাবার আছে।
বোম্বাই অঞ্চলে ব্যাসন দিয়ে ভাজা বেগুনি-ফুলুরি খাবারের খুব প্রচলন আছে। সম্ভব অসম্ভব যতরকম পাতা ফুল তরকারি আছে তাই কুটে ব্যাসন লেপটে ভেজে দোকানিরা বিক্রি করে। ওখানকার লোকেরা সকালে বিকালে রাশি রাশি সেইসব পত্র-পুষ্প ইত্যাদি ভর্জিত দ্রব্য ভক্ষণ করে থাকে। আমি সেসব ভাজাভুজি ইতিপূর্বে খেয়ে দেখেছি, কিন্তু চিনেবাদাম বা সমজাতীয় অন্য তেলে ভাজা সেই সুখাদ্য আমার মোটেই ভালো লাগেনি। আমি জোর করে বলতে পারি যে, আমাদের এখানকার সরষের তেলে-ভাজা বেগুনি-ফুলুরি তার চেয়ে খেতে ঢের ভালো।
দোকানদারকে খাবার আছে কি না জিজ্ঞাসা করায় সে একটা বড় থালার দিকে চেয়ে বললে, ওই যে রয়েছে। কত চাই?
থালার দিকে চেয়ে দেখলুম। সকালবেলাকার ভাজা সেই রাবিশ কতকগুলো থালার এক কোণে পড়ে রয়েছে। সেগুলোর চেহারা দেখলেই মনে হয়, খদ্দেরে নেহাত নেয়নি বলেই পড়ে রয়েছে। সকালবেলা থেকে তার ওপরে পরতে-পরতে ধুলো পড়ে সে-দ্রব্যগুলি তখন একেবারে অখাদ্যে পরিণত হয়েছে। যে আমাদের দোকানে নিয়ে এসেছিল, সে ওই খাবারের দিকে চেয়ে শিউরে উঠে দোকানদারকে বললে, আরে, বাবুরা কলকাতার লোক, ওঁরা কি ওই খাবার খেতে পারবেন! তারপর আমাদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে, কি বলেন, দেবে ওই ভাজি?
আমাদের অবস্থা তখন শোচনীয়। খিদের চোটে হাত-পা কাঁপতে আরম্ভ করেছে। সেই ভাজাভুজির থালার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত করে অত্যন্ত অবহেলাভরে বলা গেল, বিদেশে নিয়মো নাস্তি।
দোকানদার তাড়াতাড়ি একটা পিরিচ ধুয়ে নিয়ে থালা থেকে সেই মাল তেলসমেত সাপটে তুলে নিয়ে পিরিচে সাজিয়ে আমাদের সামনে রাখলে।
আমরা টপ টপ করে সেই ভাজি গোটা-কয়েক মুখে দিয়ে তাকে বললুম, আপনি খান।
লোকটি বললে, না না, আমি খেয়ে এসেছি, আপনারা খান
একটু পরেই আমাদের লোকটি দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলে, কিছু মিষ্টিটিষ্টি নেই?
দোকানদার ঘাড় নেড়ে বললে, খুব ভালো মিষ্টি আছে, দেব?
–কি মিষ্টি আছে?
দোকানদার আমাদের মাথার ওপরের দিকে হাত দেখিয়ে বললে, ওই যে। মাথার ওপরে চেয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড গোল তিলে-খাজার মধ্যিখানে ছেঁদা করে সেটাকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। তার ওপর মৌমাছি, বোলতা, নীল কালো বেগনি ইত্যাদি নানা রঙের মাছি বসে আছে, দু-চারটে মশাও দেখলুম উড়তে সেটাকে ঘিরে।
আমাদের কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে মুড়ি মুড়কি চিঁড়ে বেগুনি-ফুলুরির মেলা দোকান ছিল। এইসব দোকানের অধিকাংশেরই মালিক ছিল ওড়িশাদেশবাসী। উড়ের দোকান বললেই এইসব দোকান বোঝাত। এদের জ্বালাতন-করা আমাদের ছেলেবেলার খেলা ছিল। এইসব দোকানে ওইরকম গোল তিলে-খাজা ঝুলতে দেখেছি বটে, কিন্তু ওই খাদ্যটির প্রতি কখনও আকর্ষণ বোধ করিনি এবং আস্বাদনও কখনও করিনি। আমাদের নারায়ণ জিজ্ঞাসা করলে, খাবেন ওই জিনিস?
বললুম, মন্দ কি?
দোকানদার তখন অগ্রসর হয়ে সেই তিলে-খাজার প্রায় অর্ধেকটা ভেঙে আমাদের দিলে। ফলে ‘রাজ্যের মাছি-মৌমাছি-বোলতটা প্রথমটা গোঁ-গোঁ করে আপত্তি জানিয়ে শেষকালে আমাদের তাড়া করলে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে উঠে বাইরে পালিয়ে এলুম।
দোকানদার বলতে লাগল, ওরা কিছু বলবে না, কিছু বলবে না, সব পোষা
যা হোক, সেগুলোকে তাড়িয়ে দেবার পর আমরা আবার খাবারের সামনে গিয়ে বসলুম। কিন্তু সেই তিলে-খাজা বহুদিন ধরে মশা-মাছির তিল-তিল পীড়নে এমন নেতিয়ে পড়েছিল যে মুখের মধ্যে গিয়ে তাঁরা দাঁতে লেপটে যেতে লাগল। তার ওপরে দীর্ঘকালব্যাপী শোষণের ফলে বস্তুটি একেবারে মাধুর্যহীন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু পাকস্থলীর প্রচণ্ড তাগাদায় আহার্যের ভালোমন্দের দিকে মনোযোগ দেবার অবস্থা আমাদের ছিল না। কোনোরকমে পাকলে পাকলে সেই তিলে-খাজা ও তেলেভাজা উদরস্থ করে তার ওপরে কাপ দুই করে চা চাপিয়ে আমরা দোকান থেকে বেরিয়ে আবার সেই জায়গায় এসে বসলুম।
আমাদের প্রাণদাতা অত্যন্ত সমীহ করে বলতে লাগল, আপনারা কলকাতার লোক, এই খাবার আপনাদের পক্ষে অযোগ্য। কিন্তু কি উপায়! এইখানে এর চেয়ে ভালো খাবার আর পাওয়া যায় না।
আমরা বললুম, এই খাবারটুকু আমাদের পেটে আজ না গেলে কি যে হত বলতে পারি না। যতদিন প্রাণধারণ করব ততদিন আপনার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করব।
ভদ্রলোকের নাম ও ঠিকানা চেয়ে নিলুম। কলকাতার পর্তুগীজ চার্চ লেনে বাড়ি। পরে কলকাতায় এসে দু-তিনবার তার খোঁজ করেছি, দেখা পাইনি। কিন্তু সে-কথা যাক।
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলে, এখন আপনারা কি করবেন? এখানে আপনাদের চাকরি-বাকরি কিছু সুবিধে হবে বলে তো মনে হয় না। কারণ এটা অত্যন্ত ছোট জায়গা, তার ওপর আপনাদের এখানে কেউ চেনে না, কোনো জামিনও জোগাড় করতে পারবেন না।
আমরা বললুম, কাজ আমাদের জোগাড় করতেই হবে, নইলে অনাহারে মরতে হবে। লোকটি বললে, তবে আপনারা বোম্বাই চলে যান। বোম্বাই বড় শহর, সেখানে কোনো রকম কাজ যদি না পাওয়া যায় তবে মুটেগিরি করেও ভরণ-পোষণ চালানো যেতে পারে।
কথাটা আমাদের মনে লাগল। কিন্তু বোম্বাই যেতে হলে অন্তত দু-চার দিনের খরচও সঙ্গে থাকা চাই। কিন্তু আমাদের পকেটে যে কিছুই নেই! লোকটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করে খাইয়ে একরকম প্রাণ বাঁচিয়েছে–মনে হল, গোটা দুই টাকা তার কাছে চাইলে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বলি-বলি করেও তার কাছে মুখ ফুটে চাইতে পারলুম না। ওদিকে রোদ পড়ে আসতে আরম্ভ করলে। সম্মুখে রাত্রি–কোথাও আশ্রয় পাব কি না তা জানা নেই।
লোকটি বললে, এবার আমি আসি, ভাই। চার মাইল দূরে গ্রামে আমার বাড়ি, এই চার মাইল– পদব্রজে যেতে হবে। তারপরে হাসতে হাসতে বললে, কলকাতা হলে তো ট্রামেই চলে যাওয়া যেত। তারপর একটা বিড়ি ধরিয়ে বললে, তারপরে–
আমরা বললুম, আপনার কথামতো আমরা বোম্বাই শহরেই চলে যাব। কিন্তু যাবার আগে এখানে আরও দিন-দুয়েক দেখব।
সেই ভালো কথা।–বলে লোকটি উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও উঠলুম। বললুম, চলুন, আপনাকে কিছুদূর অবধি এগিয়ে দিয়ে আসি।
কয়েক পা অগ্রসর হয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলে, রাত্রে কোথায় থাকবেন? এটা আবার গাইকোয়াড়ী জায়গা, নতুন লোক দেখলে পুলিসে হাঙ্গামা করে। ধরে নিয়ে থানায় আটক করে রেখে দেয়।
গাইকোয়াড়ী জায়গার কিছু পরিচয় পেয়েছিলুম বরোদায় নেমে। সে-কথা মনে হওয়ায় ভয় পেয়ে গেলুম। বললুম, তাই তো, কোথায় থাকব তা হলে?
লোকটি সামনেই একখানা বড় বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে বললে, এই বাড়িটা হচ্ছে ধর্মশালা। রাত্রে এইখানেই থেকে যান। এত বড় বাড়ি এর এক কোণে পড়ে থাকলে কেউ জানতেও পারবে না।
এইখানেই–আচ্ছা সাহেবজী–বলে সে বিদায় নিলে। আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলুম, লোকটি হনহন করে এগিয়ে যেতে লাগল। ক্রমে তার মূর্তি পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। সে অদৃশ্য হওয়ার পর আমরা পথের ধারে এক জায়গায় গিয়ে বসলুম। যতক্ষণ সে ছিল, ততক্ষণ কথায়-বার্তায় নিজেদের অবস্থার কথা একরকম ভুলেই ছিলুম। কোথা থেকে এসে কে সে অজানা অচেনা আমাদের সংশয়াকুল হৃদয়-সমুদ্রে একটু আশার তরঙ্গ তুলে দিয়ে চলে গেল! সে চলে যেতে মনটা বড় খারাপ হয়ে পড়তে লাগল। অজানা দেশ, সামনেই রাত্রি–মনে হতে লাগল, এতক্ষণে জনার্দনেরা সুরাটের রাস্তায় নিশ্চিন্ত মনে বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আর কিছু না থাকলেও অন্তত রাত্রের আশ্রয়টুকু তাদের আছে। নিরাশায় বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগল। আমরা অনেকক্ষণ সেই নির্জন রাস্তায় একরকম নর্দমার ধারে চুপ করে বসে রইলুম– আমাদের চারিদিকে ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সুকান্ত বলে উঠল, দেখ এই যে লোকটা হঠাৎ কোথা থেকে এসে আমাদের খাইয়ে গেল, এ কে, বুঝতে পেরেছিস কি?
বললুম, না, কে এ?
–লোকটি হচ্ছে ঈশ্বরপ্রেরিত। এদেরই বলে দেবদূত। মানুষের রূপ ধরে এসে আমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়ে চলে গেল। এরকম হয়–এদের কথা ‘অলৌকিক রহস্য’ বলে একটা মাসিকপত্রে আমি পড়েছি। কিছুক্ষণ বসে থেকে সুকান্ত বললে, রাত্রে যে ধর্মশালায় থাকব–তা একটা আলো চাই তো। চল, বাজার থেকে মোমবাতি কিনে আনিগে।
সেখান থেকে উঠে বাজারে চললুম। সেদিন সকাল থেকে শরীরটা আমার ভালো লাগছিল না। দুপুরবেলাটায় একটু জ্বরও এসেছিল। বাজারের দিকে যেতে যেতে বুঝতে পারলুম, বেশ জ্বর এসেছে। শরীরের গ্লানি ও ক্লান্তিতে পথ-চলা দুষ্কর হতে লাগল। তার ওপরে বিকেলে ওইসব যাচ্ছেতাই খাবার খেয়ে আরও খারাপ লাগতে লাগল। বাজারে পৌঁছে সারা বাজার ঘুরে কোথাও মোমবাতি পেলুম না। আমার যতদূর মনে হয় দোকানদারদের বোঝাতেই পারলুম না, আমাদের কি দ্রব্য চাই! মোমবাতি তো কিনতে পারলুম না, একপয়সার বিড়ি ও আধপয়সার একটা দেশলাই কিনে স্টেশনে অর্থাৎ ধর্মশালার দিকে চললুম। পথ একরকম অন্ধকার বললেই হয় যেটুকু আলো আছে তাতে বড় শহরে পথ-দেখায় অভ্যস্ত এই চোখে অন্ধকারই ঠেকতে লাগল।
শরীরও এত খারাপ বোধ হতে লাগল যে, একরকম সুকান্তর ওপর ভর দিয়েই চলতে লাগলুম। পেটের মধ্যে থেকে থেকে একটা বেদনার সঙ্গে-সঙ্গে গা বমি-বমি করতে লাগল। শেষকালে পথের ধারে বসে বমি করবার চেষ্টা করতে লাগলুম। কিন্তু বমি কি হয়! অনেক চেষ্টা করে এক-চামচ-টক জল ভেতর থেকে উঠে এল। জোর করে বমি করবার চেষ্টা করায় পেটের যন্ত্রণা অসম্ভব-রকম বেড়ে গেল। একটুখানি বিশ্রাম করে নিয়ে আবার চলব ভেবে সেইখানেই বসে পড়লুম। সুকান্ত আমার পাশে বসে বিড়ি টানতে টানতে লেকচার দিয়ে যেতে লাগল। সে বললে, তোর নিশ্চয় আমাশা হয়েছে। আমারও আমাশা হবার আগে ওইরকম পেটের ব্যথা শুরু হয়েছিল। কিন্তু বলতে নেই–ওইসব অখাদ্য খেয়ে একদম ভালো হয়ে গিয়েছে। কাল ও আজ সারাদিন ধরে পেটে যা কিছু ময়লা ছিল সব সাফ হয়ে গেছে। বিষস্য বিষম্ ঔষধম্–ইত্যাদি, ইত্যাদি–
সে নানা ভাবে নানা ভঙ্গিতে আমাকে উৎসাহ দিতে লাগল, ও-সব কিছু নয়। এক্ষুনি ভালো হয়ে যাবে।
এইভাবে সেখানে কিছুক্ষণ বসে থাকবার পর গুটিগুটি ধর্মশালার দিকে অগ্রসর হলুম। যখন বাড়িটার কাছে গিয়ে পৌঁছলুম, তখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। বাড়িটার ভেতরে ঢুকে মনে হল যেন হানাবাড়ি। চতুর্দিকে কেউ কোথাও নেই, অন্ধকার ঘুটঘুট করছে। প্রকাণ্ড বাড়ি- — দরজা-জানলা সব খোলা হাঁহাঁ করছে। অন্ধকারে দেশলাই জ্বেলে হাতড়াতে-হাতড়াতে আমরা সিঁড়ি খুঁজে বার করলুম। দোতলায় উঠে লম্বা টানা বারান্দা। বারান্দার দুদিকে বড়-বড় ঘর, ঠিক স্কুলবাড়ির মতন। স্টেশনের কাছে বলে সেখানকার একটু আলো ছিটকে এসে বাড়িটার কোনো কোনো জায়গায় পড়েছে। অন্ধকার ও দূরাগত সেই স্বল্প আলোকে জায়গাটা যেন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।
বাড়িটায় যে কতদিন লোক ঢোকেনি, তা বলা যায় না। এমন বেপোট জায়গায় ধৰ্মশালা করবারও মানে বুঝতে পারা গেল না। কোথাকার কোন্ শেঠ যাত্রীদের প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তৈরি করে দিয়েছেন–কথায় বলে, পয়সা থাকলে ভূতের বাপেরও শ্রাদ্ধ হয়–এই প্রকাণ্ড ধর্মশালা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ
একটুখানি ঘোরাঘুরির পর একটা ঘোর অন্ধকার ঘরে ঢুকে আমরা তো আশ্রয় নিলুম। বসেই বুঝতে পারলুম, সেখানে প্রায় আধ-ইঞ্চি-টাক ধুলোর আস্তরণ পাতা রয়েছে। এখন আর সেসব বিচার করবার অবসর নেই। সুতরাং সেই ধুলোর ওপরেই গড়িয়ে পড়া গেল।
পেটের মধ্যে তখন সেই সাংঘাতিক খাদ্যগুলি ও পাকস্থলী–এই দুইপক্ষে ভীষণ ঝগড়া শুরু হয়েছে। কে এসেছ চোপরাও-ড্যাম্ রাস্কেল–কোঁওও–পোঁওও– চোওও–ইত্যাদি তো অনেকক্ষণ থেকেই চলেছিল, এবার দু’পক্ষে যুদ্ধ শুরু হল। পটকা, হাউই, বোমা, ছুঁচোবাজি ছাড়তে লাগল উভয়পক্ষেই। প্রাণ যায়-যায়! তার ওপরে এতক্ষণ পেটে যে একটু কুকুনে ব্যথা চলেছিল সেটা বাড়তে লাগল সাংঘাতিকভাবে। ক্রমে সেটা পেট জুড়ে বুকের দিকে উঠতে লাগল। শেষে নিশ্বাস নিতে পারি না এমন অবস্থা।
যন্ত্রণায় আমি ঘরময় গড়াতে আরম্ভ করে দিলুম। একবার সুকান্তকে ডেকে বললুম, সুকান্ত ভাই, আমার বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে। আমি মরে গেলে তুই বাড়ি ফিরে যাস।
সুকান্ত জিজ্ঞাসা করলে, তোর কিরকম হচ্ছে?
বললুম, পেটের যন্ত্রণায় নিশ্বাস নিতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে, এই দেখ, হাত ঠান্ডা হয়ে গেছে।
সুকান্ত আমার একটা হাত নিয়ে দু’হাত দিয়ে ঘষে ঘষে গরম করতে-করতে বললে, তোর খুব সম্ভব শুকো-কলেরা হয়েছে। কিছু ভয় নেই, কিছু ভয় নেই, ভগবানের নাম কর্।–এই অবধি বলেই সে উঠে একরকম দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, আমি সেই ধূলিশয্যায় পড়ে রইলুম।
অন্ধকার ঘর, জনমানবশূন্য বাড়ি, চিৎকার করবার শক্তি পর্যন্ত নেই, অব্যক্ত যন্ত্রণা–মনে হচ্ছে, এখনি মৃত্যু হবে। কিন্তু তার মধ্যেও একলা, ভয় করতে লাগল–মৃত্যুভয় নয়, ভূতের ভয়। ভাবছি, মরে যাব দেখে সুকান্ত বোধহয় পালাল। আবার মনে হল, এ-সময়ে কি কেউ ফেলে পালাতে পারে? তবে সে কোথায় গেল? পেটের ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। শেষকালে অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
আমার মনে হয়, খুব অল্প সময়ই সংজ্ঞাহীন ছিলুম। জ্ঞান ফিরে আসার একটু পরে দেখলুম, সুকান্ত ছুটে ঘরের মধ্যে এসে একবার আমার মাথার কাছে এসে বসল। একবার যেন আমার মাথায় হাত দিলে। তারপর চাপা কণ্ঠে একবার কেঁদে উঠে বললে, ওঃ বাবা গো, আর পারি না!
একটুক্ষণ পরে আবার সে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমার মনে হল, হয়তো সুকান্ত আমার এই যন্ত্রণা দেখতে পারছে না, তাই চোখের আড়ালে সরে গেল। হয়তো-বা সে কোনো ডাক্তারের সন্ধানে এমনভাবে ছুটোছুটি করছে। ওদিকে পেটের যন্ত্রণা এমন হল যে, সে-সময় একমাত্র সেই চিন্তা ছাড়া অন্য চিন্তা অসম্ভব হয়ে উঠল। মাঝে মাঝে হাতে-পায়ে খিল ধরতে আরম্ভ করলে, আমি প্রায় সংজ্ঞাহীনের মতন পড়ে-পড়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে লাগলুম। এর মধ্যে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সুকান্ত একবার ঘরের মধ্যে এল, আমার কাছেই এসে বসল, কিছুক্ষণ পরে আবার যেন ছুটে বেরিয়ে গেল।
এইরকম কিছুক্ষণ চলতে-চলতে হয়তো যন্ত্রণাটা একটু কম পড়ায় একবার তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলুম; এমন সময় স্বপ্নে যেন মনে হল, কে আমায় কাতর কণ্ঠে ডাকছে। যেন অনেক দূর থেকে কোনো দুঃস্থ লোক কাতরে আমার নাম ধরে ডাকছে–স্থবির, ও স্থবির!
চট্ করে ঘুমের সেই আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গিয়ে দেখি, সুকান্ত আমায় ডাকছে। জিজ্ঞাসা করলুম, কি বলছ?
সে ফিসফিস করে বলতে লাগল, দুপুরবেলা যে-লোকটা এসেছিল না–
–কোন্ লোকটা?
–ওই যে, আমাদের খাবার খাইয়ে গেল-
–বললুম, হ্যাঁ কি হয়েছে?
–বলছি, সেই লোকটা দেবদূত নয়, ও-লোকটা হল আসলে যমদূত। আমাদের দুজনকেই খাবার খাইয়ে মেরে দিয়ে চলে গেল।
জিজ্ঞাসা করলুম, কেন, তোমার কি হয়েছে?
সুকান্ত বললে, সেই থেকে পেটে অসহ্য যন্ত্রণা আর মিনিটে মিনিটে পেট নামাচ্ছে।–বলতে-বলতে সুকান্ত “ওরে বাবা, ওরে বাবা” বলে চেঁচাতে-চেঁচাতে আবার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।
আমার পেটের ব্যথা তখন অনেক কমে গিয়েছিল। মনে হতে লাগল, জ্বরও যেন কমে গিয়েছে। খানিক বাদে সুকান্ত ফিরে আসতে তাকে বললুম, একটু সহ্য করে থাক্, পেটের ব্যথা কমে যাবে। আমার পেটের ব্যথা যেন অনেক কমে গিয়েছে।
কিন্তু সুকান্তর অসুখ ক্রমে বাড়তে লাগল। ক্রমে তার এমন অবস্থা হল যে, সেই ঘরেতেই কাজ সারতে লাগল। সুকান্ত বলতে লাগল, তার পেটের অসুখ তো প্রায় সেরে গিয়েছিল, সেই লোকটাই কোথা থেকে এসে কি-সব খাইয়ে দিয়ে তার এই হাল করে দিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণ এইরকম দাপাদাপি করে সুকান্ত যেন এলিয়ে পড়ল। শেষকালে সে আমার পাশে এসে গা ঢেলে দিলে। দু-একবার ডাক দিয়ে দেখলুম, সে মরে গেল কি না! সুকান্ত বললে, বড্ড ঘুম পেয়েছে।