৩.৫ সমস্ত বাড়িটা ফাঁকা

সেদিন চৌধুরী মশাইএর ঘুমই হয়নি সারা রাত। ভোরের দিকে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। সমস্ত বাড়িটা ফাঁকা। আগে দীনু আসতো সকাল বেলা চা দিতে। চা খাবার খানিক পরে পরমেশ মৌলিক এসে পড়তো। তারপর একে একে প্রজা-পাঠক-খাতক দেন্দার এসে হাজির হতো। চণ্ডীমণ্ডপে বসে সমস্ত জমিদারি তদারকি কাজটা হয়ে যেত। কোন ক্ষেতে লাঙল পড়বে, কোন খামারের ছোলা মাড়াই হবে, কোন ফসল আড়তদারের কাছে পাঠাতে হবে তার হুকুম দিয়ে দিতেন তিনি। তারপর হয়ত ওপরে ডাক পড়তো কর্তাবাবুর ঘরে। সেখানে গিয়েও বৈষয়িক কাজ। বৈষয়িক কাজটাই ছিল তাঁর জীবন। ছোট বেলা থেকে বৈষয়িক কাজে হাত পাকিয়ে পাকিয়ে সে কাজে তাঁর নেশা লেগে গিয়েছিল।

তারপর যখন বেলা দুপুর হতো তখন দীনু ডাকতে আসত চান করবার তাগাদা দিতে। কুয়োতলায় দীনু জল তুলে দিত বড় মাটির গামলায়। দীনু তাঁকে তেল মাখিয়ে দিত। তারপর তিনি ঘটি করে মাথায় জল ঢালতে শুরু করতেন। তখন ভাত খাবার পাট। গৌরী সামনে ভাতের থালা এনে বসিয়ে দিত। তখনই যা একটু বিশ্রাম তাঁর। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করতেন–খোকা কোথায়, খোকা? খোকা খেয়েছে?

প্রীতি বলতো–সে কি আর বাড়িতে আছে? সে তো রানাঘাটে গেছে—

চৌধুরী মশাই বলতেন রানাঘাটে? রানাঘাটে গেছে কেন? কার সঙ্গে গেছে?

প্রীতি বলতে–প্রকাশের সঙ্গে গেছে, রামনবমীর মেলা দেখতে–

প্রকাশের সঙ্গে সদানন্দ রানাঘাটে রামনবমীর মেলা দেখতে যায় এটা চাইতেন না চৌধুরী মশাই। কিন্তু তাঁর কথা আর কে শুনবে! শুধু বলতেন–কখন আসবে?

প্রীতি বলতে–প্রকাশের সঙ্গে যখন গেছে তখন তুমি ভাবনা করছো কেন, সে তো আর জলে পড়ে নেই–

আর তখন থেকেই চৌধুরী মশাই জানতেন জিনিসটা ভালো হচ্ছে না। কিন্তু উপায় নেই। ছেলের ওপরে তাঁর যতখানি অধিকার আছে তার স্ত্রীরও ঠিক ততখানি। স্ত্রী যদি চায় যে ছেলে ওই সবই করুক তবে তাই হোক। কাছারির কাজ-কর্ম শিখে দরকার নেই। সংসার জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাক। তিনি যতদিন আছেন ততদিনই সংসার আছে, তারপর তিনি যখন থাকবেন না তখন যা হবে, তা তো আর তিনি দেখতে আসছেন না। এই সব ভাবতে ভাবতেই তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়তেন।

প্রীতি বলতেন–ওমা উঠে পড়লে যে, দুধ খেলে না?

সে-সব দিন কোথায় গেল! তিনি ভেবেছিলেন একরকম আর হলো আর একরকম। সেই ছেলেই বা কোথায় গেল আর সেই স্ত্রীই বা কোথায় চলে গেল! তারাই তাঁর আগে চলে গেল। এই যে তিনি সকাল থেকে চা-ও পেলেন না এক বাটি, কেউ দেখবারও নেই আজ। কাল রেলবাজারের আড়তদার সা’ মশাই জলের দরে সমস্ত কিছু কিনে নিয়েছে। সদরে গিয়ে দলিল রেজিস্ট্রি হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধি করে প্রকাশকে ভাগলপুরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাই রক্ষে, নইলে সে বড় গণ্ডগোল করতো। আজ যে এবাড়িতে তিনি এখনও বাস করছেন এটা তাঁর বে-আইনী কাজ। সা’ মশাই অবশ্য কিছু বলবে না। আরো কিছু দিন তিনি এখানে থাকতে পারেন, কিন্তু এ এখন সা’ মশাইএর বাড়ি। আইনত এখানে থাকবার অধিকারও তাঁর নেই আর।

বারোয়ারিতলায় বোধ হয় সমস্ত রাতই কবিগান হয়েছে। তাই সকাল বেলার দিকে সব ঠাণ্ডা। চৌধুরী মশাই বিছানা ছেড়ে বাইরের বারান্দার দিকে এলেন। দুদিন আগের স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। আশ্চর্য, হঠাৎ জেগে জেগে অমন স্বপ্নটাই বা দেখতে গেলেন কেন? কালীগঞ্জের বউ এখানে আসতে যাবেই বা কেন, আর কী করেই বা আসবে? যে-মানুষ মারা গেছে সে-মানুষ কখনও বেঁচে উঠতে পারে! বংশী ঢালী তো তাকে চিরকালের মত শেষ করে দিয়েছে। তার সঙ্গের পালকি-বেহারাদের পর্যন্ত তো রেহাই দেয়নি সে। তবে? তবে কেন তিনি ভয় পেয়েছিলেন অমন করে? কেন তিনি অমন করে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন?

কালীগঞ্জের বউএর সেই কথাগুলো তাঁর কানে বাজতে লাগলো। কালীগঞ্জের বউ ওই উঠোনে দাঁড়িয়ে একদিন বলে গিয়েছিল–আমি এই শাপ দিয়ে গেলাম নায়েব মশাই, আমি যদি বামুনের মেয়ে হই তো একদিন আমার শাপ ফলবেই, দেখবে তুমি ঠিক নির্বংশ হবে—

ফাঁকা উঠোনটার দিকে চেয়ে চৌধুরী মশাই-এর একটা কথা মনে পড়লো। সত্যিই, কালীগঞ্জের বউ-এর সেদিনকার সেই অভিশাপ কি এমন করেই বর্ণে বর্ণে ফলতে হয়। এমন করে কর্তাবাবুর এমন সাধের সংসার নির্বংশ হতে হয়। সেদিন কি তিনিই ভাবতে পেরেছিলেন সেই বুড়ির কথাই একদিন নিষ্ঠুর ভাবে সত্যি হবে!

একটু পরেই প্রকাশ এসে হাজির হলো। এই প্রকাশ, সেই যে একদিন চৌধুরী মশাইএর পিছু নিয়েছে সে বুঝি আর তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত তাঁকে ছাড়বে না। হয়ত একেবারে তাঁকে নিঃশেষ করে তবেই তাঁকে রেহাই দেবে।

চৌধুরী মশাই জিজ্ঞেস করলেন–সুলতানপুরের খবর কী?

প্রকাশ বললে–খবর ভালো, অশ্বিনী ভট্টাচার্যিকে খুব কষে বকে দিয়ে এলুম,–

–অশ্বিনী ভট্টাচার্যির কথা থাক, যে কাজে তোমাকে পাঠিয়েছিলুম সেকাজের কী হলো তাই বলো?

প্রকাশ বললে–সব ঠিক আছে দেখে এলুম, বিলের জমিতে এবার পাট ধান দুটোই বুনেছে সিকদাররা।

–কিন্তু গেল সনের টাকাটা? টাকার কথা কী বললে?

–আজ্ঞে টাকা দিলে না।

–কেন? টাকা দিলে না কেন?

প্রকাশ বললে–বললে–তোমার হাতে টাকা দেব না। যে মালিক তার হাতে টাকা দেব, তুমি কে? আমাকে এই রকম আরো কত কথা শোনালে। আমি বলে এলুম –আমিও তোমাকে দেখে নেব। এবার তোমার জমি খাস করে নেব তবে ছাড়বো–

চৌধুরী মশাই কিছু বললেন না। খানিক পরে বললেন–চলো, আজই সুলতানপুরে চলে যাবো আমি, এই সকালের ট্রেনে

–সকালের ট্রেনে? তাহলে খাওয়া? দুটো ভাত চড়াবো?

চৌধুরী মশাই বললেন–আমার খাবার দরকার নেই, আমি খাবো না—

প্রকাশ অবাক হয়ে গেল। বললে–খাবেন না মানে? উপোস করে থাকবেন?

চৌধুরী মশাই বললেন–তা একবেলা না হয় উপোসই করলুম, ক্ষতি কী?

–সে কী জামাইবাবু, আপনি না-হয় বুড়ো মানুষ উপোস করে থাকতে পারবেন, কিন্তু আমি? উপোস করলে যে কষ্ট হবে আমার। আমি কী উপোস করে থাকতে পারবো?

–খুব পারবে, খুব পারবে। আমি আর থাকবো না এখানে, আমার এখানকার কাজ সব মিটে গেছে। চলো–

–তার মানে?

–তার মানে আমি এবাড়ি বিক্রি করে দিয়েছি। আজ থেকে এবাড়ি রেল বাজারের আড়তদার প্রাণকেষ্ট সা’ মশাইএর।

প্রকাশ থমকে দাঁড়ালো। যেন বিশ্বাস করতে পারলে না কথাটা। জিজ্ঞেস করলে–আর জমি-জমা ক্ষেত-খামার?

–সমস্ত।

–সমস্ত বেচে দিলেন? কত টাকায় বেচলেন?

চৌধুরী মশাই চটে গেলেন। বললেন–সে-সব কথায় তোমার দরকার কী? আমি যদি লোকসান দিয়ে বেচি তো তোমার কী বলবার আছে?

প্রকাশ বললে–না, তা নয়, মানে বেহারি পাল মশাই আমাকে বলছিলেন কী না, বলছিলেন তিনি মোটা দর দিতে পারেন।

–মোটা দর? পাল মশাইএর বুঝি খুব টাকা হয়েছে? খুব টাকার গরম দেখাচ্ছে বুঝি? তাহলে তুমি পাল মশাইকে বলে এসো প্রকাশ যে আমি বরং সব জমি-জমা সরকারের খাস করে দেব তবু পাল মশাইকে দেব না, দশ লাখ টাকা দিলেও দেব না। দশ লাখ টাকা হয়েছে পাল মশাইএর?

প্রকাশ হতভম্বের মত চাইলে চৌধুরী মশাইএর দিকে। জামাইবাবু বলে কী! দশ লাখ! সে যে অনেক টাকা!

চৌধুরী মশাই বললেন–এই তো কাল সদা এসেছিল—

সদা? সদানন্দ? কোথায়? কখন?

–হ্যাঁ, কাল এখানে বারোয়ারিতলায় ওদের যাত্রা না কবিগান হচ্ছিল। সেই সন্ধ্যেবেলা আমার কাছে এসেছিল।

–এসে কী বললে?

–কী আবার বলবে! আমি কী কিছু কথা বলতে দিয়েছি যে কথা বলবে? আমি দিয়েছি তাড়িয়ে!

প্রকাশ বললে–আপনি ঠিক দেখেছেন সদা এসেছিল? সেবার তো ওই রকম করে কালীগঞ্জের বউকেও এ বাড়িতে আসতে দেখেছিলেন। ভুল দেখেন নি তো?

চৌধুরী মশাই তখন চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত। সারারাত ঘুম হয়নি, খাওয়া হয়নি। তারপর সদানন্দকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, মনটাও কেমন বিগড়ে ছিল। প্রকাশের কথায় আর কান দেবার সময় ছিল না তখন।

বললেন–চলো চলো, এখন ওসব কথা থাক–

প্রকাশ বললে–থাকবে কেন ওসব কথা, সদানন্দ এলো আর আপনি তাকে তাড়িয়ে দিলেন? কোথায় গেল সে?

–কোথায় গেল তা কি আমি দেখতে গিয়েছি? দেখতে আমার বয়ে গেছে। সে কী আমার ছেলে? সে আমার শত্রু! তা কোথায় আর যাবে, তার যাবার জায়গা আছেই বা কোথায়? ওই পাল মশাইএর বাড়িতেই বোধ হয় গিয়ে উঠেছে। ওখানেই বোধ হয় খেয়েছে দেয়েছে–ওদের জন্যেই তো আজকে এই সব্বোনাশটা হলো আমার–

প্রকাশ বললে–যাই গিয়ে দেখে আসি সদা আছে কি না

চৌধুরী মশাই বললেন–তা যাও, কিন্তু খবরদার বলছি, এখানে সদাকে ডেকে আনতে পারবে না, আমি তার মুখদর্শনও করবো না আর–

–আজ্ঞে না, তাই কখনও ডাকি? তার জন্যেই তো আমাদের এই হেনস্থা, তার জন্যেই তো আমার দিদি মারা গেল, তার জন্যেই তো আপনি জমিদারি বেচে দিলেন, আমি কি ভাবছেন জানি নে কিছু? ওকে খুঁজে বার করার জন্যে আমি কতবার কলকাতায় গেলুম, পুলিসকে কত টাকা ঘুষ দিলুম, আর সে কি না এখানে এসে হাজির হয়েছে

বলে প্রকাশ দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পেছন থেকে চৌধুরী মশাই বলে দিলেন–বেশি দেরি কোর না, এখুনি আবার রওনা দিতে হবে।

ততক্ষণে প্রকাশ একেবারে সোজা পাল মশাইএর দোকানে গিয়ে হাজির। বেহারি পাল মশাই তখন সবে মাত্র তার দোকান খুলে বসেছে। তখনও ভালো করে ধুনো-গঙ্গা জল দেওয়া হয়নি। পেছনে ডাক শুনেই মুখ ফিরিয়ে দেখে শালাবাবু। বললে–কী শালাবাবু, কী খবর? কখন এলে আবার?

প্রকাশ বললে–পাল মশাই, শুনলাম সদা নাকি চলে এসেছে, আপনার বাড়িতে আছে? সে কোথায়?

পাল মশাই–সদা? সদা তো এসেছিল কাল। সে তো কাল রাত্তিরে ছিল আমার বাড়িতে, কিন্তু এখন সে তো নেই, সে চলে গেছে

–চলে গেছে? কোথায় চলে গেল? কখন গেল?

পাল মশাই বললে–সে তো অনেকক্ষণ চলে গেছে। সে কি থাকবার ছেলে! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলুম কোথায় যাচ্ছে তা সে কথার কোনও উত্তরই দিলে না সে!

–তা তাকে একটু ধরে রাখতে পারলেন না আপনি? আপনি জানেন আমি তার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কলকাতায় গিয়ে পুলিসকে হাজার হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ধরবার চেষ্টা করছি, আর আপনি কিনা তাকে হাতের নাগালে পেয়ে ছেড়ে দিলেন? আর একটু আটকে রাখতে পারলেন না?

বেহারি পাল বললে–আরে তোমার ভাগ্নেকে আটকে রাখে, তেমনি সাধ্যি আছে কারো? তোমার জামাইবাবুর কাছে তো সদা গিয়েছিল, তা চৌধুরী মশাই তো তাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাকে–

তা তাড়িয়ে দেবে না? তাড়িয়ে দেওয়া কি অন্যায় হয়েছে? আপনিই বলুন না! ওই ছেলের জন্যেই তো আজ জামাইবাবুর এই হাল। নইলে যে বাড়িতে এককালে লোক গম্ গম করতো সেই বাড়ি এখন শ্মশান হয়ে যায় এমন করে? ওই বাড়িতেই তো এককালে আপনারা গাঁ-সুষ্ঠু লোক পাত পেতে খেয়ে এসেছেন, সে-সব কি কারো মনে নেই? তাই যে-ছেলের জন্যে এত কাণ্ড হলো, যে-ছেলের জন্যে দিদি মারা গেল, যে-ছেলের জন্যে বউমা জামাইবাবুর নামে এত কেলেঙ্কারি কথা রটালে সেই ছেলের মুখদর্শন কেউ করে? কতখানি কষ্ট হলে বাপ হয়ে মানুষ ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় তা আপনারা বুঝতে পারলেন না?

পাল মশাই বললে–তা হাজার হলেও ছেলে বলে কথা, নিজের ছেলেকে অমন করে কেউ তাড়িয়ে দেয়? জানো, যখন বললুম যে বউমা চলে যাবার সময় মাথার সিঁদুর, হাতের শাখা ভেঙে ফেললে, তখন আর দাঁড়ালো না, তখন আর কিছুতেই থাকতে চাইলে না। সদানন্দ, তখন সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল

–তা ও-সব কথা আপনারা বলতে গেলেনই বা কেন?

–বলবো না? আমরা নিজের চোখে যা দেখেছি তা বলবো না? বউমার সঙ্গে কি তোমরা কেউ ভালো ব্যবহার করেছিলে?

এ কথার আর কোনও উত্তর না দিয়ে প্রকাশ আবার বাড়ি ফিরে এল। দেখলে ততক্ষণের মধ্যে চৌধুরী মশাই চলে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে নিয়েছেন।

প্রকাশকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন–কী হলো, সে আছে?

–আজ্ঞে না জামাইবাবু, নেই, চলে গেছে–

–ভালোই হয়েছে, চলো সা’ মশাই-এর আসবার কথা আছে, চাবি দিতে হবে তাকে। চাবিগুলো তার হাতে দিতে পারলে তবে নিশ্চিন্ত হতে পারবো–

দোতলার ঘরে চাবি-তালা দেওয়া হলো। একেবারে চিরকালের মত দেশ ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া। দুজনেই নিচেয় নামলেন। সঙ্গে নিয়ে যাবার মত কিছুই নেই। যা দু একটা খাট-বিছানা আলমারি বাসনপত্র ছিল তা আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাকি যা পড়ে রইল তা পড়েই থাক। ওসব বোঝা। ওসব সুলতানপুরে অনেক আছে। আর কার জন্যেই বা নেওয়া। তিনি নিজেই বা কদিন বাঁচবেন? তিনি মারা যাওয়ার পর ওসব তো সাত ভূতে লুটে-পাটে খাবে।

তবু দেখতে ইচ্ছে হলো একবার। একতলায় নামলেন। পেছন-পেছন প্রকাশও আসতে লাগলো। মেঝের ওপর ধূলোর সর পড়েছে মোটা হয়ে। চলার পর স্পষ্ট পায়ের ছাপ পড়ছে। অন্দরমহলের দরজাটা খুলতেই কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধ নাকে এসে লাগলো। বহুদিনের চেনা জায়গা। বহু স্মৃতির জন্মভূমি। ওইখানে তিনি খেতে বসতেন, ওইটে তাঁর শোবার ঘর। আর ওই যে কোণের দিকের ঘরটা, ওইটে ছিল আঁতুড় ঘর। এইখানে জন্মেছিল সদানন্দ। গৌরী এসে প্রথম খবর দিয়েছিল যে কর্তাবাবুর নাতি হয়েছে।

কর্তাবাবু তখন রানাঘাটে। খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি। বলেছিলেন কী বললে? ছেলে? ছেলে হয়েছে?

কৈলাস গোমস্তা বলেছিল–আজ্ঞে হ্যাঁ কর্তাবাবু–

সমস্ত বাড়িময় সেদিন কী আনন্দ! কর্তাবাবুর নাতি হয়েছে, নাতি হয়েছে। তোমরা শাঁখ বাজাও, উলু দাও, আনন্দ করো। যে যেখানে আছে তাকে খবর দাও, গাঁ-সুদ্ধ লোককে ডাকো, তারা এসে দেখে যাক। দেখে যাক চৌধুরী বংশের ছেলে হয়েছে, চৌধুরী বংশের উত্তরাধিকারী জন্মেছে। বাজাও, শাঁখ বাজাও।

–কে?

চৌধুরী মশাই চমকে উঠেছেন। তাঁর মনে হলো যেন সত্যিই কে উলু দিলো, কে যেন শাঁখ বাজালো। সমস্ত বাড়িটা যেন আনন্দে একেবারে গম্-গম্ করে উঠলো।

কিন্তু না, প্রকাশ পেছনেই ছিল। সে ভুল ভাঙিয়ে দিলে। বললে–জামাইবাবু, সা’ মশাই এসেছেন–

এসেছে! চৌধুরী মশাই পেছনে ফিরে দেখলেন প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাই দাঁড়িয়ে আছে।

বললেন–এসে গেছে? ভালোই হয়েছে, আমি ভাবছিলুম আপনার কথা–

–আপনি আজই চলে যাচ্ছেন নাকি?

–হ্যাঁ চলি, এই নিন আপনার চাবি

সা’ মশাই চাবিটা হাতে নিয়ে বললে–তা এত তাড়াতাড়ি যাবার কী দরকার ছিল, আর দুটো দিন থাকলেই পারতেন, এ আপনার নিজের দেশ, নিজের বাড়ি, আমি তো আর এত শিগগির এখানে আসছি না–

–না, আর এখানে থাকা যায় না। চৌধুরী মশাই বললেন–এখানে থাকলে সুলতানপুরের জমি-জমা আবার কে দেখবে? সেখানেও তো আমার শ্বশুরমশাই-এর জমি জমা রয়েছে, সে-সব দেখবার লোকও তো নেই–

বলে প্রকাশের দিকে চেয়ে বললেন–এসো প্রকাশ–

প্রকাশও চলতে লাগলো পেছন পেছন। একদিন বড় আশা করে নরনারায়ণ চৌধুরী যে বংশের যে-সংসারের পত্তন করেছিলেন চৌধুরী মশাই-এর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা নিঃশেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। বোধহয় শেষ পর্যন্ত কালীগঞ্জের বউ-এর অভিশাপই ফললো। কে জানে!

.

নবাবগঞ্জের চৌধুরী বাড়ির সূতিকাগৃহে একদিন যে অসহায় শিশুটি ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে উলুধ্বনি উঠেছিল, শাঁখ বেজেছিল, সেদিন সেই নৈহাটি শহরের একটা গলির ভেতরের বাড়িতে সেই শিশুটিই তখন আবার তেমনি করেই অসহায় হয়ে একটা বিছানার ওপর শুয়ে ছিল। কিন্তু তখন আর তার জন্যে কেউ শাঁখও বাজাচ্ছে না, উলুধ্বনিও দিচ্ছে না।

ওদিকে ধর্মশালার পাঁড়েজী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোজ রাস্তার দিকে বসে থাকে– কই, বাবুজী তো আসছে না। কত লোক আসত ধর্মশালায়, কত লোক আবার চলেও যেত। কলকাতা শহরে মানুষের আনাগোনার বিরাম নেই। বিরাট জনস্রোতের সঙ্গে কর্মস্রোত জড়িয়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল বড়বাজারে।

মহেশ আসতো। জিজ্ঞেস করতো–আমার দাদবাবু আসেনি পাঁড়েজী?

পাঁড়েজী বলতো—নেই—

মহেশ বলতো–দাদাবাবুর এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে?

শুধু মহেশ নয়, কালীগঞ্জের বউও আসতো। কোন্ বিরাট এক প্রাসাদের পেছনকার খাটাল থেকে বুড়ো মানুষ সদানন্দের দেওয়া আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে হাজির হতো ধর্মশালার সামনে। পাঁড়েজীকে জিজ্ঞেস করতো–আমার খোকা এসেছে দারোয়ান বাবা?

পাঁড়েজী চাপাটি সেঁকতে সেঁকতে বলতো–না বুড়ি মাঈ, বাবুজী আসেনি–

মহেশও ফিরে চলে যেত, কালীগঞ্জের বউও আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে যেমন করে এসেছিল তেমনি করে খাটালে ফিরে যেত।

কিন্তু তাদের কেউই জানতো না তাদের এত সন্ধানের মানুষটা তখন নৈহাটির একটা বাড়িতে বিছানার ওপর সমস্ত চেতন-অচেতনের অতীত হয়ে শুয়ে আছে।

পাড়ার ডাক্তারবাবু আসতো। শরীর পরীক্ষা করতো। বলতো–রোগী যেন কখনও উঠে না বসে, একেবারে চুপ করে শুয়ে থাকতে দেবেন, নড়া-চড়া একেবারে বারণ—

প্রথমে ট্রেনটা থেকে যেদিন সদানন্দকে এখানে তুলে আনা হয়েছিল সেইদিন থেকেই কোনও চৈতন্য ছিল না তার। কিন্তু সেদিন সদানন্দ প্রথম চোখ মেললে।

বললে–কালীগঞ্জের বউ, ও কালীগঞ্জের বউ–

গিরিবালা ঘর সাফ করছিল। সদানন্দর ডাক শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। গিয়ে ডাকতে লাগলো,–দিদিমণি–

নয়নতারা তখন কলঘরের ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করলে কী রে? কী বলছিস?

গিরিবালা বললে–নতুন বাবুর জ্ঞান ফিরেছে, দিদিমণি, বিড় বিড় করে কী সব বকছেন—

নয়নতারা আর দেরি করলে না। গিরিবালাকে কাছে বসিয়ে রেখেই কলঘরে গিয়েছিল সে। ওইটুকুর মধ্যেই হঠাৎ সদানন্দর জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাড়াতাড়ি শাড়িটা বদলে মাথার খোঁপাটা ঠিক করে একেবারে সোজা সদানন্দের ঘরে এল। এসে দেখল সদানন্দর চোখ দুটো খোলা। কিন্তু দৃষ্টিটা বিহ্বল। মুখে যেন কী বলছে বিড়-বিড় করে।

নয়নতারা একেবারে সদানন্দর মুখের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যদি তাকে চিনতে পারে। কিন্তু তাতেও সদানন্দর চোখের দৃষ্টির কোনও তারতম্য হলো না।

নয়নতারা তখন সদানন্দর মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল।

জিজ্ঞেস করলে–আমায় তুমি কিছু বলছো?

সদানন্দ তেমনি বিহ্বল দৃষ্টি দিয়ে বিড়বিড় করে বললে–আমি প্রায়শ্চিত্ত করবো কালীগঞ্জের বউ, তুমি কিছু ভেবো না–

নয়নতারা কী বলবে বুঝতে পারলে না। আশ্চর্য, ও হয়ত নয়নতারাকে চিনতেও পারছে না। চিনতে পারলে হয়ত ঠিক আগেকার মত বিছানা থেকে ওঠবার চেষ্টা করতো, উঠে ঘর থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টাও হয়ত করতো।

নয়নতারা বললে–তুমি ওসব কথা ভুলে যাও, তুমি ওসব কথা আর ভেবো না।

সদানন্দ বলে উঠলো–কেন তাহলে ওরা আমাকে ঠকালে?

নয়নতারা এবার তার মুখটা সদানন্দর কানের কাছে নিয়ে এসে বললে–ওগো তুমি ওসব কথা ভুলে যাও, এই দেখ আমি, আমাকে চিনতে পারো? আমি নয়নতারা–

সদানন্দ এবার নয়নতারার দিকে চাইলে। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। নয়নতারা শাড়ির আঁচলটা দিয়ে সদানন্দর চোখ দুটো মুছিয়ে দিলে।

বললে–ছিঃ, কেঁদো না, কাঁদতে নেই।

সদানন্দ বললে–কিন্তু ওরা আমাকে ঠকালে কেন? আমি তো বলেছিলুম তোমাকে টাকা দিলে আমি বিয়ে করবো না, তবু কেন ওরা ঠকালে আমাকে? তবু কেন ওরা তোমাকে খুন করলে?

নয়নতারা আবার বললে–তুমি ঘুমোও, তুমি একটু ঘুমোতে চেষ্টা করো, বুঝলে? ঘুমোও, চোখ বোজ–

সদানন্দ বললে–তুমি তো কোনও দোষ করোনি, তাহলে কেন ওরা তোমাকে এত বড় শাস্তি দিলে? ওরা কপিল পায়রাপোড়াকে মেরেছে আমি কিছু বলিনি, মানিক ঘোষের সর্বনাশ করেছে তবু কিছু বলিনি, ফটিক প্রামাণিককে পাগল করেছে, তখনও তো আমি কোনও কথা বলিনি, কিন্তু তোমার টাকা কেন ঠকিয়ে নিলে ওরা? কেন তোমাকে ওরা খুন করলে? তোমাকে খুন করবে জানলে আমি তো বিয়ে করতুম না–

তারপর একটু থেমে বললে–আমাকে একটু জল দেবে? তোমার কথা ভাবলেই কেবল আমার জলতেষ্টা পায়, আমার গলা শুকিয়ে যায়–

নয়নতারা বললে–তুমি জল খাবে? দাঁড়াও, আমি তোমাকে জল এনে দিচ্ছি—

বলে কুঁজো থেকে জল এনে গেলাস মুখের কাছে নিয়ে গেল। বললে–মুখটা হাঁ করো, আমি জল দিচ্ছি–হাঁ করো–

–না, জল খাবো না। খাবো না জল—

নয়নতারা বললে–তবে যে বললে–তোমার জলতেষ্টা পাচ্ছে, তোমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে?

সদানন্দ বললে–হোক কষ্ট, আমার তেষ্টা পাক, তবু আমি জল খাবো না–

–কিন্তু জলতেষ্টা পেলে জল খাবে না কেন?

–ওগো আমার আর কতটুকু কষ্ট? কপিল পায়রাপোড়ার গলায় দড়ি দিয়ে মরতে বুঝি কষ্ট হয়নি? মানিক ঘোষ, ফটিক প্রামাণিকের কষ্টর কাছে আমার কষ্ট কতটুকু? আমার এ কষ্ট হওয়াই ভালো–হোক আমার কষ্ট–

–না না তুমি জল খেয়ে নাও–লক্ষ্মীটি খাও—

বলে নয়নতারা সদানন্দর চিবুকটা বাঁ হাতটা দিয়ে ধরলে। বললে–খাও জল, তোমার অসুখ ভালো হয়ে যাবে–

সদানন্দ মাথা নাড়তে লাগলো–আমি ভালো হবো না, আমি ভালো হতে চাই না–

নয়নতারা বললে–না, কথা শোন, আমার কথা শুনতে হয়, ভালো না হলে তুমি বাড়ি যাবে কী করে?

–আমি বাড়ি যাবো না, আমি এখানে থাকবো—

নয়নতারা বললে–ছিঃ, এখানে থাকতে নেই। তুমি শিগগির ভালো হয়ে ওঠো, উঠে তোমার বাড়ি চলে যাও, জল খাও–

হঠাৎ পেছনে কী একটা ছায়ার আভাস পেছন ফিরে চাইতেই নয়নতারা দেখলে নিখিলেশ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে–

নিখিলেশকে দেখেই নয়নতারা অবাক হয়ে গেছে। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বললে– তুমি? তুমি এ সময়ে? তোমার অফিস নেই?

নিখিলেশ এ-কথার উত্তর দিলে না। আস্তে আস্তে আবার বাড়ির ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। নয়নতারা হাতের গেলাসটা রেখে পাশের ঘরে ঢুকতেই দেখলে নিখিলেশ বিছানার ওপর চুপ করে বসে আছে।

নয়নতারা আবার সেই আগেকার প্রশ্নটাই করলে–কী হলো? তোমার অফিস ছুটি হয়ে গেল নাকি?

নিখিলেশ শুধু বললে—না–

নয়নতারা বললে–তবে? তবে কি তোমার শরীর খারাপ হলো নাকি? দেখি, কপাল দেখি–

বলে কাছে এগিয়ে গিয়ে নিখিলেশের কপালে হাত দিতে গেল। নিখিলেশ নয়নতারার হাতটা নিজের হাত দিয়ে সরিয়ে দিলে। বললে–না, আমার কিছু হয়নি।

নয়নতারা নিশ্চিন্ত হয়ে বললে–হয়নি ভালোই হলো। আমি তো ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। তুমি তো কখনও এমন করে ছুটি নাও না–তা এদিকে কী কাণ্ড হয়ে গেছে জানো। আমি এদিকে মহামুশকিলে পড়ে গিয়েছি। ও-ঘরে কে, চিনতে পারলে? কথা বলছো না যে? চিনতে পেরেছ, না চিনতে পারো নি?

নিখিলেশ মাথা নাড়লে। বললে–চিনেছি–

–চিনতে পেরেছ? তাহলে বলো তো এখানে ও কী করে এল? বলো না, কী করে এল ও এখানে?

নিখিলেশ কোনও উত্তর দিলে না। যেমন চুপ করে ছিল তেমনি চুপ করেই রইল।

নয়নতারা বললে–আমি ন’টা চল্লিশের ট্রেন ধরতে স্টেশনে গেছি, দেখি ট্রেনটা তখন এসে গেছে। তাড়াতাড়ি পৌঁছে দেখি প্লাটফরমের ওপর ভীষণ ভিড়। আমি উঁকি মেরে দেখি ও। একেবারে অজ্ঞান অচৈতন্য অবস্থা, স্টেশন মাস্টার তো ওকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছিল, আমিই বলে কয়ে বাড়িতে নিয়ে এলুম ওকে–

নিখিলেশ এতক্ষণে কথা বললে। বললে–তা হাসপাতালে পাঠাচ্ছিল ওরা তাতে কী দোষ হচ্ছিল? হাসপাতালের চেয়ে কি বাড়িতে ভালো সেবা হবে?

নয়নতারা বললে–না, ভাবলুম হাসপাতালে তো ওর নিজের কেউ নেই, তাই…

নিখিলেশ বললে–কিন্তু তার জন্যে আজকে তোমার অফিসটা কামাই হলো তো?

–বা রে, আমার তো ছুটি পাওনা আছে।

–ছুটি পাওনা হলেই বা, কত কষ্টে আমি তোমার চাকরিটা যোগাড় করে দিয়েছি, বি-এ পাস করেও কত মেয়ে চাকরির জন্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর তুমি এই রকম খবর না দিয়ে আজ অকারণ অফিস কামাই করলে, এটা কি ভালো হলো?

নয়নতারা বললে–তুমি এটাকে অকারণ বলছো?

–তা অকারণ নয় তো কী? রাস্তায়-ঘাটে এরকম কত লোকের অ্যাসিডেন্ট হচ্ছে, তুমি তাদের সকলকে বাড়িতে তুলে এনে সেবা করতে পারবে? সকলকে সেবা করে বাঁচিয়ে তুলতে পারবে?

নয়নতারা কথাটা শুনে মনে যেন একটু কষ্ট পেলো। বললে–সকলের সঙ্গে তুমি ওর তুলনা করলে? সকলে আর ও কি এক হলো? চোখের সামনে ওকে ওই অবস্থায় দেখলুম আর তারপর কী করে চুপ করে থাকতে পারি বলো?

নিখিলেশ বললে–ঠিক আছে, অফিস-টপিস গিয়ে তাহলে আর তোমার দরকার নেই, তুমি তাহলে ওর সেবাই করো–

বলে নিখিলেশ উঠে পড়লো। বললে–আমি যাচ্ছি—

নয়নতারা বললে–কোথায় যাচ্ছো!

নিলিখেশ বললে–একটা কাজ আছে–

–কী কাজ আবার তোমার এখন? অফিস থেকে কি তুমি ছুটি নিয়ে এলে নাকি? নিখিলেশ বললে–এখন বাজেট-তৈরির কাজ চলছে, এখন কি ছুটি পাওয়া যায়?

–তাহলে?

–টিফিনের সময় বেরিয়ে তোমার অফিসে গিয়েছিলুম তোমাকে বলতে যে আমি আজকে আটটা উনিশের ট্রেনে বাড়ি ফিরবো, তুমি অফিসে আমার জন্যে অপেক্ষা কোর না, একলাই বাড়ি চলে যেও। কিন্তু গিয়ে শুনি তুমি অফিসেই আসোনি–তাই খুব ভাবনা হলো। ভাবলুম এমন তো কখনও হয় না। মনে ভয়ও হলো হয়ত কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে অফিসে গিয়ে বললুম আমার স্ত্রীর খুব অসুখ, আমি চললুম–

নয়নতারা বললে–আমার অসুখ হয়েছে এ সন্দেহটাই বা তোমার হলো কী করে? যাবার সময় তুমি দেখে গেছ আমি দিব্যি সুস্থ আছি–হঠাৎ আমার শরীর খারাপ হতে যাবেই বা কেন?

–কিন্তু তা কি বলা যায়? আগে তো কখনও তুমি অফিস কামাই করোনি, আমি কী করে জানবো যে বাড়িতে এই কাণ্ড বেধে গেছে–মিছিমিছি আমার অফিসে হাফ-ডে কামাই হলো আজ। অথচ এখন বাজেট-তৈরি চলছে–

–তা এখন কোথায় চললে তুমি?

নিখিলেশ বললে–দেখি কোথায় যাই, কোনও রকমে সময়টা কাটাতে হবে তো–

নয়নতারা বলে উঠলো–তা আজ যে হঠাৎ সময় কাটাবার জন্যে তোমাকে বাইরে যেতে হচ্ছে? এতদিন তো বাড়িতেই তোমার সময় কাটতো ভালো করে–

–সে তখন কাটতো তোমার সময় ছিল বলে। আজকে তো তোমার নিজেরই সময় নেই। আজ তো ও-ঘরে রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকবে! তোমার যে অনেক কাজ!

–তুমি আমাকে অত খোঁটা দিয়ে কথা বলছো কেন?

নিখিলেশ বললে–খোটা? খোঁটা তোমায় কখন দিলুম? আমি তো সত্যি কথাই বলেছি, তোমার কাজ নেই?

নয়নতারা বললে–হাজার কাজ থাকলেও তোমার সঙ্গে কথা বলবার সময়ও আমার আছে। ওকে এ বাড়িতে এনেছি বলে তুমি রাগ করছো কেন? একটা লোক বেঘোরে মারা যাক এইটেই কি তুমি চাও?

–আমি কি তাই বলেছি–আমাকে কি তুমি অত নীচ ভাবো?

নয়নতারা বললে–না, লক্ষ্মীটি, তুমি আমার ওপর রাগ কোর না। ওকে তুমি চেনো না বলেই এত রাগ হচ্ছে তোমার, ওকে যদি তুমি চিনতে তাহলে বুঝতে পারতে ওর ওপর রাগ করা অন্যায়, বরং ওর ওপর দয়াই হওয়া উচিত সকলের–

নিখিলেশ বললে–আশ্চর্য, আজ তুমি কিনা ওর হয়ে সাফাই গাইছো, অথচ ওর জন্যেই তো আজ তোমার যত কষ্ট, যত যন্ত্রণা। মনে নেই, একদিন ওরা তোমাকে কী অপমানটাই না করেছিল, তোমার শ্বশুরবাড়ির সেই সব অত্যাচারের কথা এত শিগগির তুমি ভুলে গেলে? এত ভুলো মন তোমার? যে কদিন তুমি ওদের বাড়ি ছিলে একদিনের জন্যেও কি তুমি শান্তি পেয়েছিলে? তোমার সেই কান্নাকাটির কথা কি আমি ভুলে গেছি মনে করো?

নয়নতারা বললে–তুমি যা বলছো সব সত্যি কথা, কিন্তু তার জন্যে ওর কিছু দোষ নেই, ও কী করবে? এই দেখ না, এখনও এই অবস্থায়ও ‘কালীগঞ্জের বউ’ ‘কালীগঞ্জের বউ’ বলে প্রলাপ বকছে! কালীগঞ্জের বউকে আমার বৌভাতের দিন ওর ঠাকুর্দাদা খুন করেছিল তা এখনও ও ভুলতে পারছেন না–

–তা ওর ঠাকুর্দাদা দোষ করেছিল বলে তার শাস্তি পাবে তুমি? কোনও ভদ্রলোক নিজের বউ-এর সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে? এরকম ঘটনা কেউ কখনও শুনেছে? তুমি আবার সেই লোককে সাপোর্ট করছো?

নয়নতারা বললে–না, তুমি দেখছি সত্যিই আমার ওপর রাগ করেছ, নইলে সব জেনেও কেন ওকে তুমি গালাগালি দিচ্ছ?

–তা গালাগালি দেব না? আমি যদি সেদিন নবাবগঞ্জে থাকতুম তো আমি ওকে চাবুক মারতুম তা জানো?

–ছিঃ, কী বলছো তুমি? পাশেই ও রয়েছে, যদি শুনতে পায়? তোমার কি রাগ হলে আর জ্ঞান থাকে না? ওর ব্যবহারের জন্যে কি ও দায়ী?

–তা ও দায়ী না তো কে দায়ী?

–দায়ী ওর বাবা, ওর ঠাকুর্দাদা। দায়ী ওর পূর্বপুরুষ!

–তা ওর পূর্বপুরুষের জন্যে তুমি শাস্তি পাবে এ কোন্ শাস্ত্রে লেখা আছে? এ কোন্ দেশের বিচার?

নয়নতারা বললে–তুমি চুপ করো বাপু, বড্ড চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলছো তুমি। তুমি সব জেনে শুনেও এসব কথা কেন বলছো? ও তো আমাকে সব খুলেই বলেছিল। তার পরেও কি আমি ওকে দোষ দিতে পারি?

–তাহলে তুমি তোমার শ্বশুরবাড়ি থাকলেই পারতে। সেখান থেকে কেন চলে আসতে গেলে?

নয়নতারা বললে–নাঃ, তুমি দেখছি আজকে আমার সঙ্গে ঝগড়া না করে আর ছাড়বে না।

নিখিলেশ বললে–তুমি আমার ঝগড়া করাটাই শুধু দেখলে, আর আমি যে তোমাকে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাস করিয়ে চাকরি করে দিলুম, সেটা তো একবারও দেখলে না। তখন তো আমাকে বলেছিলে তুমি তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকের নামও কখনও মুখে আনবে না–

নয়নতারা বললে–ঠিক আছে, কথা থাক, আমি চা করে দিচ্ছি, চা খাও, আমিও চা খাবো, চা খেলে তোমার রাগ কমবে।

নিখিলেশ বললে–না, তুমি চা খাও, আমি খাবো না, আমি বেরোব—

নিখিলেশ বেরোতে যাচ্ছিল, কিন্তু নয়নতারা পথ আটকে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

বললে–চা না খেয়ে তুমি যেতে পারবে না, অফিসে তো এই সময়ে একবার চা খাও তুমি, আমি গিরিকে বলছি চা করতে

কথাটা বলে নয়নতারা চলে যাচ্ছিল কিন্তু নিখিলেশ বললে–-শোন, একটা কথা শুনে যাও–

–কী?

–ওকে আর কতদিন এখানে রাখবে?

নয়নতারা কথাটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। বললে–তার মানে তুমি কি চাও এই অসুস্থ মানুষটাকে এই অবস্থায় বাড়ি থেকে বার করে দিই?

নিখিলেশ বললে–আমি কি তাই বলেছি? তুমি আমার কথার উলটো মানে করছো কেন? আজ তো ওর জন্যে অফিস কামাই করলে, এখন থেকে কি রোজই অফিস কামাই করবে?

নয়নতারা বললে–অফিস কামাই না করলে বাড়িতে কে ওকে দেখবে? গিরিবালা? গিরিবালার ওপর ওর ভার ছেড়ে দিয়ে চলে যাবো? শেষকালে যদি একটা কিছু হয় তখন ওই একলা বুড়ো মানুষ সামলাতে পারবে?

–তার চেয়ে হাসপাতালে পাঠালে হতো না! হাসপাতালে পাঠালে ক্ষতিটা কী? সেখানে ডাক্তার আছে, নার্স আছে, দেখাশোনা করবার লোকের অভাব নেই, তাই পাঠাও না–আর তাছাড়া, খরচের কথাটাও তো ভাবতে হয়, বাড়িতে ডাক্তার ডাকতেও তো টাকা লাগে, এখন মাসের শেষের দিকে…

নয়নতারা নিখিলেশের মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। যে মানুষটা তার বিপদের দিনে তাকে বাঁচিয়েছে, তাকে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে প্রাইভেটে লেখাপড়া শিখিয়ে একটা ছোটখাটো চাকরিও যোগাড় করে দিয়েছে, তার মনও কি আজকে এমন একটা তুচ্ছ ঘটনায় ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠলো নাকি!

নিখিলেশ আবার বললে–কথাটা যা বলেছি অন্যায় বলিনি, তুমি বরং একটু ভালো করে ভেবে দেখ–এখন কতদিনে ভদ্রলোক ভালো হয়ে উঠবেন তার তো ঠিক নেই, আর ভালো হবেন কিনা তারও ঠিক নেই–

নয়নতারা যেন ককিয়ে উঠলো। বললে–ওগো, ওকথা বোল না তুমি, বরং বলো তাড়াতাড়ি ও ভালো হয়ে উঠুক–

–ভালো হয়ে উঠুক সে তো আমিও চাই, আমি কি চাই যে ভালো না হোক? কিন্তু তোমার কথা ভেবেই আমি কথাটা বলছি, তোমার অফিসের কথা ভেবেই বলছি। রোজ রোজ কামাই করা তো তোমার চলবে না, এখন যদি ভদ্রলোকের অনেকদিন লাগে সেরে উঠতে তখন কী করবে? ততদিন অফিস কামাই কররে?

নয়নতারা বললে–আমার তো ছুটি পাওনা আছে–ছুটি নিলে তো আর মাইনে কাটা যাবে না, না-হয় যতদিন ছুটি পাওনা আছে ততদিন ছুটি নেব–

–কিন্তু তারপর? তারপর যখন ছুটি পাওনা থাকবে না?

নয়নতারা বললে–ততদিন কি আর ও শুয়ে পড়ে থাকবে? দেখো তার আগেই ভালো হয়ে যাবে, ভালো হয়ে গেলেই আমি ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দেব–আর তা ছাড়া জ্ঞান হলে নিজেই আর এখানে থাকতে চাইবে না, ওকে তুমি চেনো না। আমাকে দেখলেই ও এড়িয়ে যেতে চাইবে

নিখিলেশ বললে– গেলেই ভালো। আমি তো চাই ও ভাল হয়ে উঠুক, ভালো হয়ে নিজের বাড়িতে যাক। যার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে তার তো এখানে থাকাটাই উচিত নয়–

–কিন্তু সে জ্ঞান এখন কি ওর আছে? জ্ঞান থাকলে কি আমি ওকে এ বাড়িতে আনতেই পারতুম?

–তা ডাক্তারবাবু কী বলছেন?

–ডাক্তারবাবু তো বলছেন সারতে সময় লাগবে। বলছেন অনেকদিন ধরে কোনও মানসিক শক পেয়ে পেয়ে নার্ভের চাপ পড়েছে, তা ছাড়া শরীরে নাকি রক্তও নেই এক ফোঁটা–

–রক্ত দিতে হলে সে তো আবার অনেক খরচের ধাক্কা।

নয়নতারার ভালো লাগলো না কথাটা। বললে–তুমি কেবল খরচের কথাটাই ভাবছো। একটা মানুষের জীবনের চেয়ে কি খরচটাই বড় হলো? তেমন যদি হয় তাহলে না হয় অফিস থেকে দু’চার শো টাকা যা পাওয়া যায় লোন নেব

–লোন নেবে? লোন নিলে শোধ করতে হবে না? মাইনে থেকে মাসে-মাসে কেটে নেবে না?

নয়নতারা বললে–তা তো নেবেই। কিন্তু কত লোকের বাড়িতে বুড়ো শ্বশুর শাশুড়ী থাকে, তাদের খাওয়াতে পরাতে হয় না? অসুখ-বিসুখ হলে তাদের চিকিৎসার খরচ দিতে হয় না জামাইকে? মনে করে নাও না সেই রকমই একটা কিছু মনে করে নাও না যে তোমার শ্বশুরবাড়ির কোনও নিকট-আত্মীয় বিপদে পড়ে তোমার বাড়িতে এসে উঠেছে–

–তা ও কি তোমার আত্মীয়? ওকে তুমি কি এখনও তোমার আত্মীয় বলে মনে করো?

নয়নতারা বললে–যাও, তোমার সঙ্গে আমি তর্ক করতে পারবো না, তোমার মুখে কি কোনও কিছু আটকায় না? তুমি বাজে কথা বলছো কেন?

নিখিলেশ বললে–আমি বাজে কথা বলছি? তুমি উটকো একটা বাইরের লোককে বাড়িতে এনে তুললে আর দোষ হয়ে গেল আমার? তাহলে দরকার নেই আমার কথা বলে, আমি চলি, পথ ছাড়ো–

নয়নতারা পথ ছাড়লো না। নিখিলেশের দু’কাঁধে দুটো হাত রেখে বললে–না, যেও না, যদি যাও তো চা খেয়ে যাও, নইলে বুঝবো তুমি আমার ওপর রাগ করেছ–

নিখিলেশ বলে উঠলো–তা চা খেলেই কি আমি আমার কথার জবাব পেয়ে যাবো?

নয়নতারা বললে–তোমার কথার জবাব তো দিলুম, আবার কোন্ কথার জবাব চাও তুমি? তুমি তো কেবল টাকা খরচের কথা ভাবছো। তা আমি যদি চাকরি না করতুম তো তুমি আমার খাওয়া-পরার ভার নিতে না? কত লোকের বউ তো চাকরি করে না, তা তারা কি তাদের বউদের খাওয়ায় না, পরায় না? অসুখ হলে ডাক্তার দেখায় না? এর বেলায় আমি না হয় আমার মাইনের টাকাটাই খরচ করলুম, সে টাকাটা তো আমার চাকরি করা টাকা। সে-টাকাটাও কি আমি আমার ইচ্ছেমত খরচ করতে পারবো না? বলো, চুপ করে রইলে কেন, এর জবাব দাও–

নিখিলেশ উত্তেজিত হয়ে নয়নতারার কথার কোনও জবাব দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে গিরিবালার গলার শব্দ শোনা গেল। গিরিবালা বাইরে থেকে ডাকলে—দিদিমণি–

নয়নতারা এতক্ষণে যেন জ্ঞান ফিরে পেলে। নিখিলেশের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সেও যেন তার পুরোন দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিল। হঠাৎ গিরিবালার ডাক শুনেই বললে–যাই–

গিরিবালা আবার বললে–ডাক্তারবাবু এসেছেন–

নয়নতারা চমকে উঠলো। নিখিলেশের দিকে চেয়ে বললে–ওই ডাক্তারবাবু এসেছেন, সকালবেলা একবার এসেছিলেন, বিকেলবেলা আর একবার আসতে বলেছিলুম। তুমি যেন চলে যেও না, ডাক্তারবাবু চলে গেলেই আমি তোমাকে চা করে দেব, চা খেয়ে তবে যেও

বলে তাড়াতাড়ি পাশের ঘরে চলে গেল। ডাক্তারবাবু তখন রোগীর ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

পেশেন্ট কেমন আছে? তারপরে আর জ্ঞান ফিরেছিল?

নয়নতারা তখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বললে–আপনি চলে যাবার পর প্রলাপ বকছিলেন, তারপর জল খেতে চাইলেন–

–আর ওষুধ?

–ওষুধ খাইয়েছি। যে বড়িগুলো খাওয়াতে বলেছিলেন ওটা এখনও কিনে আনা হয়নি, এইবার কিনতে পাঠাবো—

ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করতে করতে বললেন–ওইগুলো এতক্ষণে খাওয়ানো উচিত ছিল, ওইগুলোই আসল ওষুধ, ভিটামিন। ম্যালনিউট্রিশনের জন্যেই এই রকম হয়েছে

নয়নতারা বললে–আমি এখখুনি আনতে পাঠাচ্ছি–

–তাহলে পেশেন্টের জ্ঞান হয়েছিল!

ডাক্তারবাবু যেন নিজের মনেই কথাগুলো বললেন। তারপর রোগীর পরীক্ষা শেষ হতেই বললেন–ওই ওষুধগুলো পেটে পড়লে আরো তাড়াতাড়ি রোগীর জ্ঞান ফিরে আসতো–

নয়নতারা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে ভালো হতে আর কতদিন লাগবে ডাক্তারবাবু?

–বেশি দিন লাগবে না, তবে ওষুধটা আপনি তাড়াতাড়ি আনিয়ে নিন—

বলে বাইরে আসতেই নয়নতারা হাত-ধোবার জন্যে সাবান জল এগিয়ে দিলে। তারপর তাড়াতাড়ি আবার ঘরে ঢুকে আলমারিটা খুললে। আলমারির ড্রয়ারের মধ্যেই নয়নতারার সংসার-খরচের টাকা থাকে। নয়নতারা টাকাগুলো গুনে দেখলে। মাসের শেষ। মাত্র কটা টাকা পড়ে রযেছে। আটটা এক টাকার নোট নিয়ে এসে তাড়াতাড়ি ডাক্তারবাবুর হাতে দিয়েছে। সকালবেলাও একবার আটটা টাকা দিয়েছিল। মিকশ্চার কিনে আনতেও সাত-আট টাকা বেরিয়ে গেছে। অথচ আসল ওষুধগুলোই আনা হয়নি তখনও। সবগুলোই দামী দামী ভিটামিনের ওষুধ!

বাইরের উঠোনের ধারে ডাক্তারবাবু তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত দুটো মুছছিলেন। নয়নতারা কাছে গিয়ে টাকাগুলো দিতেই তিনি সেগুলো না গুনে পকেটে পুরে নিলেন।

তারপর বললেন–তাহলে কাল সকালের দিকে আমি আর একবার আসবো–আপনি ওই বড়িগুলো যেমন বলেছি তেমনি খাইয়ে দেবেন—

বলে তিনি রাস্তায় গিয়ে গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

ততক্ষণে গিরিবালা রান্নাঘরে গিয়ে চা করে ফেলেছে। দুকাপ চা নিয়ে এসে নয়নতারার হাতে দিলে। নয়নতারা কাপ দুটো নিয়ে বললে–তোমাকে একবার দোকানে যেতে হবে গিরি, ওষুধের দোকানে–

বলে শোবার ঘরে গিয়ে দেখলে ফাঁকা, নিখিলেশ নেই। কোথায় গেল নিখিলেশ? চা না খেলেই চলে গেল! নয়নতারা চায়ের কাপ দুটো নিয়ে সেখানেই খানিকক্ষণ হতভম্বের মতন দাঁড়িয়ে রইল। এমন না কখনও তো চলে যায় না।

বাইরে গিয়ে গিরিবালাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে–গিরি, দাদাবাবু কখন বেরিয়ে গেল?

গিরিবালা বললে–দাদাবাবু ঘরে নেই?

নিখিলেশ কখন নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে কেউই জানতে পারেনি। নয়নতারাও জানতে পারেনি, গিরিবালাও জানতে পারেনি। অথচ নয়নতারাকে বাদ দিয়ে নিখিলেশ এতদিনের মধ্যে একদিনও কোথাও বেরিয়েছে কি না সন্দেহ। অফিস যাবার সময় নিখিলেশ এক ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে। কারণ তার অফিস বসে আধ ঘণ্টা আগে, আর নয়নতারা বেরিয়েছে নটা চল্লিশের ট্রেনে। ফেরবার সময় প্রতিদিন নিখিলেশ নয়নতারার অফিসে গিয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে নৈহাটিতে ফিরেছে। এতদিন ধরে এই নিয়মই চলে এসেছে। এই প্রথম আজকেই এর ব্যতিক্রম হলো, আজকেই এই প্রথম নিয়মভঙ্গ!

নয়নতারা চা’টা খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি আবার বাইরের ঘরে এসে হাজির হলো। সে ঘরের বিছানার ওপর সদানন্দ তখন আঘোরে ঘুমোচ্ছে। সদানন্দ তখন জানতেও পারলে না যে কোথায় সে এসেছে। কোথায় কার বাড়িতে এসে সে কার সংসারের সব নিয়ম শৃঙ্খলা একেবারে ছত্রভঙ্গ করে দিলে।

.

এমনি করেই হয়ত একটা সংসারের একটা বংশের ইতিহাস-ভুগোল সব কিছু একদিন ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। একটা সামান্য তুচ্ছ কারণে মানুষের সঙ্গে মানুষের কিংবা একটা দেশের সঙ্গে আর একটা দেশের সম্পর্কে কনক্রীটে চিড় ধরে ফাটল গজায়। আর সেই ফাটলের ফাঁকে একটা অশ্বত্থের সর্বনাশা অঙ্কুর মাথা তুলে দাঁড়ায়। প্রথমে যখন সে অঙ্কুর অবস্থায় থাকে তখন কেউই টের পায় না। কেউই দেখতে পায় না। অতি নিঃশব্দে পাপের সেই বীজটি লোকচক্ষুর অন্তরালে তার আপন ক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকে। কালীগঞ্জের বউ এই রকমই একটা তুচ্ছ বীজ। কিন্তু সেই তুচ্ছ একটা বীজই যে এমন করে একটা মহীরুহে পরিণত হবে, নবাবগঞ্জের চৌধুরী বংশকে এমন করে ছিন্ন-ভিন্ন করবে তা সেদিন কেউ কল্পনা করতে পারেনি। না কল্পনা করতে পেরেছেন কর্তাবাবু নিজে, না চৌধুরী মশাই। চৌধুরী মশাই এর শ্বশুর কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ও কল্পনা করতে পারেননি। পারলে তাঁর একমাত্র প্রীতিলতাকে হয়ত এবংশে বিয়েই দিতেন না। আর কৃষ্ণনগরের কালীকান্ত ভট্টাচার্যও কল্পনা করতে পারেননি, নইলে তিনিই কি তাঁর একমাত্র সন্তান নয়নতারাকে এই বংশের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে জড়িয়ে দিতেন।

নয়নতারা যেদিন নবাবগঞ্জের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে হাতের শাঁখা ভেঙে কালীকান্ত ভট্টাচার্যের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো তার খানিক আগেই বিপিনরা পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা ভয়ে-সঙ্কোচে পণ্ডিত মশাই-এর কাছে কিছুই ভাঙেনি।

পণ্ডিত মশাই জিজ্ঞেস করলেন–নয়নতারা কেমন আছেন বিপিন?

বিপিন প্রামাণিক বললে–আজ্ঞে ভালো–

–আমার কথা কিছু জিজ্ঞেস করলে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, আমি বললাম–আপনি ভালো আছেন–

–আর বেয়াই-বেয়ান?

–আজ্ঞে তাঁরাও আপনার কথা জিজ্ঞেস করলেন।

–আর জামাইবাবাজী? জামাইবাবাজী কেমন আছেন?

সব শুনে কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই-এর মনটা প্রসন্ন হলো। যাক, নয়নতারা ভালো ঘরে ভালো ঘরে পড়েছে, এর চেয়ে সুখের খবর আর কী থাকতে পারে!

বললেন–আচ্ছা বিপিন, এবার তোমরা তাহলে বিশ্রাম করো গে যাও, তোমাদের খুব পরিশ্রম হয়েছে যাও–আমার দেওয়া জিনিসগুলো সব পছন্দ হয়েছে তো?

–হ্যাঁ পণ্ডিত মশাই, খুব পছন্দ হয়েছে। সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগলো জিনিস দেখে। দই মিষ্টি খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। গাঁয়ের লোক সব একেবারে পাড়া ঝেঁটিয়ে তত্ত্ব দেখতে এসেছিল–

–তা তোমাদের পেট ভরে খাইয়েছে দাইয়েছে তো?

–আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব খাইয়েছেন। বেয়াই মশাই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব খাওয়ালেন–

–কী কী খাওয়ালেন?

–পোনা মাছ সরু বাসমতী চালের ভাত, পায়েস, আম, কাঁঠাল, কাঁচাগোল্লা—

কিন্তু কথা তাদের শেষ হলো না। কথা শেষ হবার আগেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো নয়নতারা। কালীকান্ত ভট্টাচার্য মশাই চোখের সামনে যেন ভূত দেখলেন।

–বাবা!

নয়নতারার গলা শুনে আর তার সেই চেহারা দেখে তিনি আকাশ থেকে পড়লেন।

–এ কী মা, তুই? এ কী চেহারা হয়েছে তোর? তুই হঠাৎ চলে এলি যে? একবার বিপিনদের দিকে চেয়ে দেখেন, আর একবার নয়নতারার দিকে।

–এই যে এই বিপিন এক্ষুনি বলছিল তুই ভালো আছিস, বেয়াই-বেয়ান সবাই ভালো আছে, তোরা খুব পেট ভরে খাইয়েছিস ওদের…

নয়নতারা চিৎকার করে উঠলো–সব মিথ্যে কথা বাবা, সব ওদের মিথ্যে কথা। আমি তোমার পাঠানো তত্ত্ব সব ছুঁড়ে টেনে মাটিতে ফেলে দিয়েছি–

–সে কী মা, কেন? কী হয়েছিল?

উত্তেজনায় বৃদ্ধ কালীকান্ত ভট্টাচার্যের হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস শব্দ করতে লাগলো। মেয়ের চেহারা দেখে তিনি ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। বললেন–তোর এয়োতির চিহ্ন কোথায় গেল? তোর সিঁথির সিঁদুর, তোর হাতের শাঁখা? তোর হাতের চুড়ি? গলার হার?

–বাবা, সব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি। সিঁথির সিঁদুরও মুছে ফেলেছি, হাতের শাঁখাও ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলেছি।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য তখন উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠেছে। বললেন–তা আমার জামাই? জামাইবাবাজী কোথায়?

নয়নতারা বলে উঠলো– তোমার জামাই নেই বাবা, তোমার জামাই কোনও দিন ছিল না, কোনও দিন থাকবেও না।

–সে কী রে? কী বলছিস তুই? আমার জামাই নেই?

–না, তোমার জামাই বেয়াই বেয়ান কেউই নেই। মনে করে নাও তোমার মেয়ের কোনও দিন বিয়েই হয়নি। আমি ওবাড়ির সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে চলে এসেছি। আর কখনও ও-বাড়িতে যাবোও না–

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কিছুই বুঝতে পারছিলেন না। কৈলাস গোমস্তা বউমাকে নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। কিন্তু বেগতিক দেখে সে আর সেখানে দাঁড়ায়নি। নিঃশব্দে কখন সেখান থেকে সরে পড়েছে কেউই তা জানতে পারেনি।

কালীকান্ত ভট্টাচার্য কী করবেন তখন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। বললেন–তা সদানন্দ কোথায়? সে তোর সঙ্গে এল না কেন?

নয়নতারা বললে–তুমি তার কথা আর বোল না, তার নামও উচ্চারণ কোন না আমার সামনে, সে নেই–

নেই মানে? নেই মানে কী? অসুখ হয়েছে তার? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না রে। কবে তার অসুখ হলো, তাও তো জানতে পারলাম না। তার যে অসুখ হয়েছে, সে কথাও তো আমাকে বেয়াই মশাই জানান নি। আমি এখন কী করি। তোর মা নেই, আমিই তোর বাবা-মা সব কিছু, আমাকে সব খুলে বলবি তো! আমি বুড়ো বলে কি আমি কিছুই বুঝি না?

নয়নতারা বললে– সে তোমার বুঝে দরকার নেই বাবা, আমার ব্যাপার আমিই বুঝবো, এবার থেকে আমি আর কোথাও যাবো না, তোমার কাছেই বরাবর থাকবো, তোমার কাছে থাকতেই আমি এসেছি–

–কিন্তু—কিন্তু–

এর বেশি আর কিছু বলতে পারলেন না কালীকান্ত ভট্টাচার্য। সঙ্গে সঙ্গে নিখিলেশের ডাক পড়লো। বিপিনকে বললেন–একবার নিখিলেশকে খবর দাও তো বাবা, একবার তাকে ডাকো তো বাবা এখানে–

তারপর থেকেই পণ্ডিত মশাই যেন কেমন হয়ে গেলেন। নিখিলেশ তখনও চাকরিতে ঢোকেনি। বিএ পাস করেছিল আগেই। তখন আর কিছু না পেয়ে আইন পড়ছিল। ছোটবেলা থেকেই স্বাধীন স্বভাবের ছেলে। বিধবা মা থাকতো কেষ্ট-নগরের বাড়িতে আর নিখিলেশ কেষ্টনগর থেকে পাস করে কলকাতায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতো। ছোটবেলায় স্বদেশী করেছে। মদের দোকানে পিকেটিং করে একবার কয়েকমাসের জন্যে অন্য সকলের সঙ্গে জেলও খেটেছে। কলকাতা থেকে যে লীডার কেষ্টনগরে এসেছে, নিখিলেশ তার পেছন পেছন ঘুরেছে। যখন খদ্দর পরা পুলিসের চোখে অপরাধ ছিল, তখন সকলের সামনে বুক ফুলিয়ে খদ্দরও পরেছে। মীটিং-এ ডায়াসের ওপর দাঁড়িয়ে গরম গরম স্বদেশী বক্তৃতাও দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টাকার চিন্তাতে আর ওদিকে বেশিদিন থাকতে পারেনি। মাঝে মাঝে লেখা পড়ায় বাধা পেয়েছে। শেষে যখন থেকে মা মারা গেছে, তখন থেকে আর ওদিক মাড়ায়নি। দিনের বেলা চাকরি খোঁজা আর বিকেলের দিকে এক ঘণ্টার জন্যে আইন কলেজে গিয়ে বসেছে। আর বাকি সময়টা এখানে-ওখানে ছাত্র পড়িয়ে পেট চালিয়েছে।

যেদিন কালীকান্ত ভট্টাচার্য মারা গেলেন, সেদিন শ্মশান থেকে ফিরে এসেই নিখিলেশ বললে–তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে নয়নতারা–

নয়নতারা তখন শোকে মুহ্যমান হয়ে আছে। একমাত্র অবলম্বন বাবাকে হারিয়ে ভবিষ্যৎ তখন তার কাছে অন্ধকার হয়ে গেছে।

–কথাটা দুদিন পরে বললেও হতো। কিন্তু আমি মনস্থির করে ফেলেছি। আমার টাকা নেই জানি, বিয়ে করে স্ত্রীকে ভরণপোষণ করবার মত সংস্থানও নেই আমার, তা-ও জানি। কিন্তু তুমি অমত কোরো না–

মনে আছে নয়নতারার সমস্ত মন সেদিন নিখিলেশের প্রস্তাবে বিষিয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল নিখিলেশ যেন তার বাবার মৃত্যুর জন্যেই এতদিন প্রতীক্ষা করছিল। যেন নয়নতারার অসহায়তার সুযোগ খুঁজছিল সে। যেন নয়নতারার শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসাটাই তার কাছে কাম্য ছিল।

তারপর একদিন শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে গেল। নিখিলেশ এল একদিন। জিজ্ঞেস করলে–তুমি কিছু ভেবেছ নয়নতারা?

নয়নতারার মন থেকে তখনও শোকের ছাপ মোছেনি।

জিজ্ঞেস করলে–কী ভাববো?

–আমি যে প্রস্তাব দিয়েছিলুম, সেই সম্বন্ধে?

–কী প্রস্তাব?

–আমি বলছি তুমি আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী হয়ে এসো—

কথাটা শুনে নয়নতারার প্রথমে মনে হয়েছিল সেই মুহূর্তেই সে নিখিলেশকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অনেক কষ্টে সে তখন নিজেকে সামলে নিয়েছিল। তারপরই মনে পড়ল তার আশ্রয়ের কথা, তার জীবিকা নির্বাহের কথা, তার নিজের ভরণপোষণের কথা। পরের মাস থেকে তো তাকে তার বাড়ি ভাড়া দিতে হবে, তার নিজের জন্যে চাল-ডাল-নুন-মশলা সবই কিনতে হবে–

নয়নতারার মুখ তুলে বললে–কিন্তু কী করে তা সম্ভব?

নিখিলেশ বললে–কেন তা সম্ভব নয়? তোমার একবার বিয়ে হয়ে গেছে বলে? আইনের কথা যদি বলো তো তাতে তো আর এখন আটকাবে না, এখন তো আইন পাস হয়ে গেছে। আর সংস্কার? সংস্কারের কথা তুমি বলতে পারো অবশ্য, কিন্তু সেদিক থেকেও তো আর আটকাবার কারণ নেই, কারণ সদানন্দবাবুর সঙ্গে তুমি একদিন রাত্রিবাসও তো করোনি–সে তো তুমি নিজের মুখেই আমাকে বলেছো–

সেদিন নিখিলেশের যুক্তির কাছে নয়নতারা হার মেনে গিয়েছিল বটে, কিন্তু তবু হার মানাটা তার কাছে অত সহজ হয়নি। তখন তার চোখের সামনে ভবিষ্যৎ বলে কিছু ছিল না, বোধ হয় বর্তমান বলেও কিছু ছিল না। শুধু ছিল একটা অতীত। তা সে-অতীতটাও ছিল এত ভয়ানক যে তা স্মরণ করতেও তার ভয় লাগতো। আসলে ভবিষ্যৎ তারই থাকে যার আশা থাকে। সেদিন নয়নতারার আশা বলতেও তো কিছু ছিল না।

কিন্তু একদিন কেন যে তার আশা হলো! হয়তো নিখিলেশ তাকে আশা দিলে বলেই তার আশা হলো। নইলে যার পায়ের তলা থেকে মাটিটা পর্যন্ত সরে গেছে, তার তো হতাশায় আত্মঘাতী হবারই কথা। শেষ পর্যন্ত একদিন নিখিলেশ তাকে কলকাতায় নিয়ে গেল। এখন মনে নেই কোন্ ঠিকানায় নিয়ে গিয়ে তুললো তাকে। কোন্ একটা অফিস। আগে থেকে সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিল নিখিলেশ। কথা থেকে নিখিলেশের তিনজন বন্ধু এল। কী সব করলে একজন অফিসের লোক। সে কী উত্তর দিয়েছিল তাও ভালো করে তার কানে ঢোকেনি। কী একটা কাগজে সই করতে বললে তারা। তারা যেমন বললে–তেমনি সই করলে সে। তারপর সবাই তাকে নিয়ে চলে গেল কালীঘাটের মন্দিরে।

মনে আছে একটু আড়ালে পেয়েই নিখিলেশ বলেছিল–তুমি কাঁদছো কেন? ওরা তোমার কান্না দেখে কী ভাবছে বলো তো?

নয়নতারা নিজেই তখন জানতো না যে কেন সে কাঁদছে। শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মুখটা মুছতেই সিঁদুরে-জলে আঁচলটা লাল হয়ে উঠলো। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো। এ কী করলে সে! এ কেন সে করতে গেল! বিশ্বসংসারে কারো সামনে তার মুখ দেখাতে লজ্জা করতো। যখন নৈহাটিতে এই পাড়াতে নিখিলেশ বাড়ি ভাড়া করলে, তখন সারা দিন ঘরের ভেতরে কেবল বন্দী হয়ে থাকতো। কিন্তু যে সিঁথির সিঁদুর একদিন সে রাগে ঘেন্নায় নিজের হাতেই সকলের সামনে মুছে ফেলেছিল আবার নৈহাটির বাড়ির ভেতরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাত দিয়েই সেই সিঁদুর নিজের সিঁথিতে লাগিয়ে দিলে। এও তার জীবনের এক মর্মান্তিক পরিহাস। নিজের সিঁদুর পরা চেহারাটা দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো যেন আর একটা মুখ পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা নজরে পড়তেই লজ্জায় ঘেন্নায় শাড়ির আঁচল দিয়ে সে নিজের মুখটা ঢেকে ফেললে! তখন আর নিজের মুখ দেখতেও তার লজ্জা হলো। সে সেই অবস্থাতেই বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো।

সে-সব প্রথম দিককার কথা। তারপর আস্তে আস্তে কেমন যেন সব কিছু সহজ হয়ে এল। নিখিলেশই বলতে গেলে সব কিছু সহজ করে নিলে। মাঝে মাঝে নয়নতারাকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে বেড়িয়ে আনতে। আগে কখনও সে কলকাতা দেখেনি। কৃষ্ণনগরে মানুষ হয়ে একেবারে সোজা চলে গিয়েছিল নবাবগঞ্জে। সে আরও এক নিরিবিলি পাড়াগাঁ। কিন্তু সেদিন কে ভেবেছিল এমনি করে একদিন সে আবার কলকাতা দেখতে পাবে। কে ভাবতে পেরেছিল যে যে-পুরুষমানুষের সঙ্গে তার বাবা তার ভাগ্যকে জড়িয়ে দিয়েছিল, তার বদলে ঠিক সেই জায়গায় আর একজন পুরুষমানুষ এসে তাকে এমনি করে আর এক নতুন জীবনের আস্বাদ দেবে।

রাত্রে নিখিলেশের পাশে শুয়ে থাকতে থাকতে এক-একদিন হঠাৎ একটা পুরোন মুখের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতো। সঙ্গে সঙ্গে সে বিছানা থেকে উঠে মুখে চোখে জল দিয়ে এসে আবার শুয়ে পড়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতো।

নিখিলেশ টের পেলে জিজ্ঞেস করতো কী হলো, তোমার ঘুম আসছে না বুঝি?

নয়নতারা বলতো—না-–

নিখিলেশ বলতো–কেন ঘুম আসছে না? দুপুরবেলা ঘুমিয়েছিলে বুঝি?

নয়নতারা বলতো–হ্যাঁ–

তা ছাড়া আর কি বলবে সে! সারা দিন অফিস করে নিখিলেশ, তার ওপর আছে ডেলি প্যাসেঞ্জারি। সকাল সাড়ে আটটার ট্রেনে যায় সে আর সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসে। সমস্ত দিনটাই তখন একলা কাটতে নয়নতারার। বোসপাড়ার ছোট ভাড়াটে বাড়ির ভেতরে একলা বন্দী হয়ে থেকে কেবল আকাশ পাতাল করতো। তারপর যখন নিখিলেশ বাড়ি ফিরতো তখন বসতো নয়নতারাকে নিয়ে। কেস্টনগরে থাকতে ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েই তার পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। নবাবগঞ্জে বিয়ে হবার আগেও নিখিলেশ পড়াতো। এবার নিখিলেশের স্ত্রী হয়ে এ বাড়িতে আসার পরও আবার পড়ানো শুরু হলো। অঙ্ক আর ইংরিজি, ইতিহাস আর বাংলা, কোনও বিষয়ই বাদ গেল না। নতুন করে আবার নয়নতারা নিখিলেশের ছাত্রী হয়ে উঠলো। সে এমন এক ছাত্রী যে যাকে দরকার হলে শাস্তি দেওয়াও যায় না আবার প্রশয় দেওয়াও যায় না। প্রশ্রয় দিলে ছাত্রীর লেখাপড়া মাথায় উঠবে। আবার শাস্তি দিলেও স্ত্রীর অহমিকাকে আঘাত দেওয়া হবে।

আর তার পরেই একদিন কলকাতায় গেল প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে। নিখিলেশের সে কী পরিশ্রম, সে কী শান্তি। যেন যে-কোনও রকমে সে নয়নতারাকে মানুষ করে তুলবেই। নিখিলেশ কথায় কথায় নয়নতারাকে বললো–পুরোন কথা সব ভুলে যাও, মনে করে নাও নতুন করে তোমার জীবনের আরম্ভ হলো–

এ-সব কথার উত্তরে নয়নতারা কিছু বলতো না। এ-সব কথার জবাবও দিত না সে। নিখিলেশ যা বলতো তা-ই করতে চেষ্টা করতো। যেন কলের পুতুল সে। নিখিলেশ দম দিয়ে তাকে ছেড়ে দিত আর সে কলের পুতুলের মত শুতো, ঘুমোতো, ভাবতো, হাসতো, নড়তো সবকিছু করতো। কিন্তু তার মধ্যেও কোনও প্রাণ ছিল না। মানুষ বলে যে এক ধরণের জীব সংসারের প্রাণী হয়ে সকলের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে সকলের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে বেঁচে থাকে, নয়নতারা যেন তা নয়। তার কাছে তার সব কিছু কাজই যেন করতে হয় তাই করা, না করলে একজন অখুশী হবে তাই হুকুম পালন করা।

সত্যিই নিখিলেশ তার জন্য কী-ই না করেছে। একদিন হঠাৎ এসে বললে–জানো, তোমার একটা চাকরি হয়ে গেছে–

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। বললে–চাকরি? আমি চাকরি করবো?

নিখিলেশ বললে–হ্যাঁ, তোমাকে দিয়ে সেই যে একটা দরখাস্ত লিখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলুম, সেই চাকরিটা। গোড়াতেই দেড়শো টাকা দেবে, পাকা হয়ে গেলে আড়াই-শোর কাছাকাছি–

নয়নতারা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বললে–কিন্তু আমি চাকরি করতে পারবো?

নিখিলেশ বললে–আরে চাকরির আবার হাতী ঘোড়া কি আছে, গভর্ণমেন্টের চাকরিতে তো কোনও কাজই হয় না। শুধু অফিসে গিয়ে হাজরে দিলেই হলো। তার ওপরে তুমি তো মেয়েমানুষ। বেটাছেলেরাই কোনও কাজ করে না, আর তুমি মেয়েমানুষ হয়ে কি কাজ করবে? রেকড সেকশানের কাজ, শুধু সারা দিনে দু-চারটে চিঠি নম্বর মিলিয়ে ফাইলে অ্যাটাচ্ করলেই সারা দিনের মত ছুটি–

–কিন্তু রোজ ট্রেনে যাতায়াত? ডেলি-প্যাসেঞ্জারি?

–সে সঙ্গে আমার দু’চারদিন যাতায়াত করতে করতেই তোমার অভ্যেস হয়ে যাবে। তোমার একটা মান্থলি টিকিট করে দেব, রোজ টিকিট কাটতেও হবে না তোমায়। আর নৈহাটি থেকে অসংখ্য ট্রেন, যখন-তখন যেতে পারবে, যখন-তখন আসতে পারবে, এক একদিন তোমাকে অফিস থেকে নিয়ে বেরিয়ে সিনেমা-থিয়েটার দেখে ফিরবো–

তখন কলকাতা সম্বন্ধে নয়নতারার কোনও ধারণাই ছিল না। সেই নবাবগঞ্জে একরকম, এই নৈহাটিতে আর এক রকম। অথচ সেটাও শ্বশুরবাড়ি, এটাও বলতে গেলে শ্বশুরবাড়ি। তবু দুটোর মধ্যে কী তফাৎ!

তারপর একদিন শুরু হলে চাকরি করা। প্রথম-প্রথম নিখিলেশই সঙ্গে করে রোজ নিয়ে যেত তাকে। মানুষের ভিড় দেখে তখন ভয় করতো তার। গিরিবালা তখন একলা সারাদিন বাড়ি পাহারা দিত আর তারা তার হাতে বাড়ি পাহারা দেবার ভার ছেড়ে দিয়ে অফিসে চলে যেত–

তখন থেকেই নয়নতারা অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল। একেবারে অন্য মানুষ। নইলে যে লোক নবাবগঞ্জে একদিন শ্বশুর-শাশুড়ীর ভয়ে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারতো না, দুঃখের কথাগুলো বলবার জন্যে লুকিয়ে লুকিয়ে পাশের দিদিমার বাড়িতে যেত সেই মানুষই আবার মানুষের ভিড় ঠেলে কিনা অফিস করছে–এটা সে প্রথম প্রথম বিশ্বাসও করতে পারতো না।

প্রথম মাইনে পাওয়ার দিন নিখিলেশ বললে–চলো, আজ আর বাড়িতে খাবো না আমরা–

নয়নতারা বললে–বাড়িতে খাবে না মানে? কোথায় খাবে তাহলে?

নিখিলেশ বললে–সে তুমি জানো না, তোমার নৈহাটির বাজারের নোংরা হোটেল নয়, সে-সব দামী হোটেল। খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন চারিদিক, সেখানে খেতে তোমার ভক্তি হবে–

নয়নতারা বললে–কিন্তু হোটেলেই বা খাবো কেন? আমি যে গিরিবালাকে রান্না করতে বলে এসেছি, সে যে ভাত কোলে করে বসে থাকবে, তাকে তো কিছু বলে আসিনি–

নিখিলেশ বোঝালে প্রথম মাইনের টাকাটা দিয়ে একটু উৎসব করা ভাল। এরপর থেকে আর খাবো না। কিন্তু আজকে তুমি মাইনে পেয়েছ, এ-টাকাটা সদ্ব্যয় করা ভালো। নয়নতারার নিজের ইচ্ছেয় কিছুই হয়নি জীবনে। নিখিলেশর চেষ্টাতেই যখন তার চাকরি হয়েছে, নিখিলেশের চেষ্টাতেই যখন সে লেখা-পড়া শিখে পাস করেছে, তখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়। তা প্রথমে একটা সিনেমা দেখতে গেল দু’জনে। সিনেমা ভাঙবার পর ট্যাক্সি চড়ে কোথায় কোন পাড়ায় তাকে নিয়ে গেল নিখিলেশ। বিরাট একটা বাড়ির সদর দিয়ে ভেতের ঢুকলো দুজনে। চারিদিকে কীরকম একটা ভুরভুরে সুগন্ধ নাকে এসে লাগলো।

নয়নতারা চুপি চুপি নিখিলেশকে জিজ্ঞেস করলে–এ কীসের গন্ধ গো?

নিখিলেশ বললে–রান্নার, চপ্ কাটলেট পোলাও কালিয়া রান্নার গন্ধ, চলো না ভেতরে গিয়ে খেলে সব বুঝতে পারবে

সত্যিই ভেতরে সে এক স্বপ্নের রাজত্ব। নয়নতারার মনে হলো সে যেন এক স্বপ্ন পুরীতে ঢুকেছে। সার সার টেবিলে কত মেয়ে কত পুরুষ বসে বসে খাচ্ছে। মাথায় পাগড়ি পরা সব লোক সবাইকে পরিবেশন করতে ব্যস্ত! একটা কোণে গিয়ে ফাঁকা টেবিলে বসলে দুজনে।

নয়নতারা বললে–তুমি আগে বললে না কেন এখানে আসবে, তাহলে একটু সেজে গুজে ভদ্র হয়ে আসতুম, আমার লজ্জা করছে বড়

নিখিলেশ বললে–তোমার ভালো শাড়ি ব্লাউজই বা কই যে সেজেগুজে আসবে–

নয়নতারারও মনে হলো সত্যিই তার কোনও ভালো শাড়িই নেই। অন্তত এই সব জায়গায় আসবার মত কাপড়-জামা তো তার নেই-ই।

নিখিলেশ বললে–শুধু কি শাড়ি, তোমার গয়না-টয়নাও তো কিছু নেই–সব তো তোমার সেই আগেকার শ্বশুরবাড়িতে। আসবার সময় তুমি তো সেগুলো নিয়ে এলেই পারতে

নয়নতারা বললে–তাদের উপর যে আমার ঘেন্না হয়ে গিয়েছিল বড্ড। যাদের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এলুম তাদের দেওয়া জিনিস ছুঁতেও আমার ঘেন্না করলো যে—

–কিন্তু তোমার বাবার দেওয়া গয়নাগুলো? মাস্টারমশাইও তো তোমাকে কম গয়না দেননি। সেগুলো তো নিয়ে এলে পারতে, তাহলে এখন কত কাজ দিত! এখন সোনার দাম কত বলো তো? একশো ছত্রিশ টাকা ভরি, তা জানো? হয়ত দাম আরও বাড়বে–

নয়নতারার সব মনে পড়তে লাগলো। বললে–তখন কী আমার মাথার ঠিক ছিল? আমি যে আত্মহত্যা করিনি, সেইটেই তো আশ্চর্য! তুমি কল্পনা করতে পারবে না আমার সে কী কষ্ট! শ্বশুর হয়ে রাত্তিরে কখনও কেউ ছেলের বউ এর ঘরে ঢুকেছে? এ কথা কখনও কেউ কল্পনা করতে পারে? শুনলে ভাববে আমি বুঝি মিথ্যে কথা বলছি–

নিখিলেশ বললে—যাক্‌কে ও-সব কথা, ও সব ভুলে থাকাই ভালো–এখন খেয়ে নাও—

ততক্ষণে খাবার দিয়ে গিয়েছিল টেবিলে। কত রকমের কী-সব খাবার। নয়নতারা বললে–আমি চামচে দিয়ে খেতে পারবো না–হাত দিয়ে খাই–

–তা খাও, পরে তোমাকে বাড়িতে কাঁটা-চামচে দিয়ে খেতে শিখিয়ে দেব। এখন হাত দিয়ে খাও–

সেদিন সেই হোটেলের ঘরের ভেতরে নিখিলেশের সঙ্গে খেতে খেতে মনে হতে লাগলো তার জীবনে যা ঘটেছে হয়ত তা ভালোর জন্যেই ঘটেছে। নইলে কি এই সব দেখতে পেত, এই সব খেতে পেত। অথচ নবাবগঞ্জের-শাশুড়িরও তো যথেষ্ট টাকা ছিল। বাবা তো তার শ্বশুরবাড়ির টাকা দেখেই ওখানে তার বিয়ে দিয়েছিল। অথচ সেখানে তো এ-সব ছিল না এই আলো এই জাঁক-জমক, এই ঐশ্বর্য।

নয়নতারা বললে–দেখ, এখানে খেয়ে আর কী-ই বা হলো, তার চেয়ে এর পরের মাস থেকে এই টাকাগুলো জমিয়ে শাড়ি কিনবে। আমরা বাড়ির ভেতরে কী খাচ্ছি সেটা তো কেউ আর দেখতে পায় না, কিন্তু শাড়ি-গয়না লোকে দেখতে পায়—

নিখিলেশ হঠাৎ বললে–দেখ, একদিন ছুটি নিয়ে ভাবছি আমি নবাবগঞ্জে যাবো–

–কেন? নবাবগঞ্জে যাবে কী করতে?

–তোমার গয়নাগুলো চেয়ে আনতে! এ কী আবদার নাকি? তখনকার দিনের আট হাজার টাকার গয়না, এখন তার দাম কম করেও অন্তত বারো হাজার টাকা! বারো হাজার টাকা যদি এখন হাতে থাকত তো তাহলে কী আমাদের ভাবনা? মাসে-মাসে কত টাকার বাড়ি ভাড়া দিচ্ছি, তার বদলে নিজেদের একটা বাড়ি হয়ে যেত–

আর একদিনের কথাও মনে পড়লো নয়নতারার। বিয়ে করার পর সেদিন আর নৈহাটিতে ফিরলো না তারা। একটা রাত্রের জন্যে নিখিলেশের এক বন্ধু তাদের বাড়িতেই নেমন্তন্ন করলে এমন একটা শুভঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখবার জন্যে। সে-ঘটনাটাকে বন্ধুর বদান্যতাও বলতে পারা যায়, আবার আনন্দপ্রকাশও বলা যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর সেখানেই রাতটা কাটাতে হলো। তারপর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ভোরের ট্রেন ধরে নৈহাটিতে আসা। শেয়ালদ’ স্টেশনে যখন এসেছে তখন ট্রেনটা ছাড়ে-ছাড়ে। ট্রেনে উঠতে যাবার মুখেই মনে হলো পেছন থেকে ‘নয়নতারা’ বলে তাকে যেন কে ডাকলে–

তখন আর তাদের পেছন ফিরে দেখবার সময় নেই। ট্রেনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা ছেড়ে দিল। নিখিলেশ বলেছিল–কে যেন তোমার নাম ধরে ডাকলে না?

–আমাকে?

নয়নতারা অবাক হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–আমাকে আবার কে ডাকবে? আর এখানে আমাকে চিনবেই বা কে?

তবু নয়নতারা চলন্ত ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফেলে-আসা প্লাটফরমের দিকে একবার চেয়ে দেখলে। অসংখ্য লোকের ভিড় সেখানে। তাদের মধ্যে কে কোন্ লোকটা তাকে ডেকেছে, কেন ডেকেছে, কে জানতে পারবে? আর তা ছাড়া এ তো কেষ্টনগর নয়, নৈহাটিও নয়, এমন কি নবাবগঞ্জও নয়। আর সে তো ঘরের বাইরে বেরোনো মেয়েও নয় যে তাকে বাইরের লোকে চিনতে পারবে। তার ওপর সেটা কলকাতা শহর। কলকাতা শহরে কে কাকে চেনে!

ট্রেনটা প্লাটফরম ছাড়িয়ে তখন অনেক দূর চলে এসেছে। নিখিলেশ জিজ্ঞেস করলে–কাউকে দেখতে পেলে?

নয়নতারা বললে–না না, আমাকে আবার এখানে কে ডাকবে, ভুল শুনেছ তুমি–

হঠাৎ সদর-দরজায় কড়া নাড়তেই নয়নতারার যেন চমক ভাঙলো। এতগুলো ফেলে আসা বছরের স্মৃতি-রোমন্থনে যেন হঠাৎ ছেদ পড়লো।

ভেতর থেকে দরজা খুলেই বললে–কে?

হয়ত নিখিলেশ বাড়ি ফিরেছে। বাইরে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এখন বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে।

বাইরে থেকে গিরিবালা বললে–আমি দিদিমণি–

দরজা খুলে দিতেই গিরিবালা ভেতরে ঢুকলো। নয়নতারা জিজ্ঞেস করলে–ওষুধগুলো পেয়েছো?

ওষুধের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে গিরিবালা বললে–একুশ টাকা দাম নিলে দিদিমণি–

একুশ টাকা! একটা দিনের মধ্যেই এতগুলো টাকা বেরিয়ে গেল! একুশ টাকা থাকলে একটা নতুন শাড়ি হয়ে যেত তার। অথচ মানুষটার অসুখ যে খুব তাড়াতাড়ি সারবে তা তো নয়! কিন্তু যে-সব কথা ভাবলে এখন চলবে না। অসুখ তো নিখিলেশেরও হতে পারতো, অসুখ তো তার নিজেরও হতে পারতো। অসুখ হলে মানুষ কী করবে! অসুখের ওপর তো মানুষের হাত নেই।

ওষুধটা নিয়ে নয়নতারা সদানন্দর ঘরে ঢুকলো।

.

শুধু অসুখ নয়, হয়ত কোনও কিছুর ওপরেই মানুষের হাত নেই। হাত থাকলে কি চৌধুরী মশাইকেই নবাবগঞ্জের সমস্ত সম্পত্তি জলের দরে বিক্রি করে সুলতানপুরে চলে যেতে হয়! প্রত্যেকটা সম্পত্তি, বাড়ির প্রত্যেকটা ইট পর্যন্ত একদিন একজন মানুষের কাছে তাঁর শরীরের রক্তের মত প্রিয় ছিল। বলতে গেলে নিজের রক্ত দিয়েই সম্পত্তির পত্তন করে গিয়েছিলেন কর্তাবাবু। চৌধুরী মশাইও সে সব কিছু কিছু জানতেন। আর জানতেন বলেই নবাবগঞ্জ থেকে যখন শেষবারের মত চলে যাচ্ছিলেন তখন পা দুটো যেন কেমন কেঁপে উঠেছিল। তারপর বারোয়ারিতলার কাছে আসতেই চলতে গিয়ে হঠাৎ তিনি থেমে গেলেন। মনে হলো কপিল পায়রাপোড়ার ঝুলন্ত পা দুটো যেন তাঁর মাথায় ঠেকে যাবে। ওই গাছের ডালেতেই একদিন কপিল পায়রাপোড়া গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।

–কী হলো জামাইবাবু? কিছু ফেলে এলেন নাকি?

প্রকাশ ভাবলে হয়ত জামাইবাবু বাড়িতে কিছু ফেলে এসেছেন!

চৌধুরী মশাই বললেন, না চলো, ঠিক আছে—

বলে আরো তাড়াতাড়ি পা ফেলে আগে আগে চলতে লাগলেন। নবাবগঞ্জ থেকে মবারকপুর, মবারকপুর থেকে সোজা হাঁটা রাস্তা। হাঁটা রাস্তাটা যেন হেঁটে হেঁটে অনন্ত কালে গিয়ে মিশেছে। এই রাস্তা দিয়েই একদিন মোগল-পাঠান-ইংরেজরা এসেছিল, আবার এই রাস্তা দিয়েই তারা চৌধুরী মশাই-এর মত সর্বস্ব খুইয়ে ইতিহাসের পাতায় ছাপার অক্ষরে ভিড়ে মুখ লুকিয়ে বেঁচেছে। চৌধুরী মশাইও যেন সেদিন নিজের মুখ লুকোতে পারলেই বাঁচেন। পাঠান-মোগল-ইংরেজদের মতই শেষবারের মত তিনি যেন সব কিছু লুটপাট করে পুঁটলি বেঁধে পালিয়ে বাঁচতে চাইলেন।

কিন্তু তিনি কোথায় গিয়ে পালাবেন? কোথায় গিয়ে মুখ লুকোবেন? কপিল পায়রাপোড়া, ফটিক প্রামাণিক, মাণিক ঘোষ আর কালীগঞ্জের বউদের আত্মাদের হাত থেকে কেমন করে তিনি আত্মরক্ষা করবেন? সুলতানপুর তো পৃথিবীর বাইরে নয়। আর পৃথিবীর বাইরে হলেও জলে স্থলে-অন্তরীক্ষেও যে তাদের গতিবিধি। তুমি যদি জীবনকে এড়াতে চাও তো মৃত্যু যে তোমার জন্যে হাত বাড়িয়ে প্রতীক্ষা করবে। আর মৃত্যু তোমাকে গ্রাস করলেও তোমার সন্তান-সন্ততি তো রইল, তোমার বংশধররা তো রইল, তাদের কে বাঁচাবে? কপিল পায়রাপোড়া, ফটিক প্রামাণিক, মাণিক ঘোষ আর কালীগঞ্জের বউদের তো মৃত্যু নেই। তারা যে জন্ম-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে। তারা ইতিহাসের আদি যুগ থেকে রোম সাম্রাজ্যের পতন দেখেছে, মহেঞ্জোদারোর ধ্বংস দেখেছে, বংশানুক্রমে তারা পতন অভ্যুদয়ের কারণ খতিয়ে দেখে আসছে। তাদের ফাঁকি দিতে পারবে এমন নরনারায়ণ চৌধুরী বুঝি এখনও জন্মায়নি–

নইলে জীবনের শেষটায় কেন এক গণ্ডুষ জলও পেলেন না চৌধুরী মশাই? কেন সুলতানপুরের অত বড় বাড়ির মধ্যে একখানা ঘরে বন্দী হয়ে থেকে মৃত্যুকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতেন? কেন ভাবতেন পৃথিবীর আর সবাই চিরকালের নিয়ম অনুযায়ী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে, কেবল তিনিই যাবচ্চন্দ্রদিবাকরৌ বেঁচে থাকবেন?

নবাবগঞ্জের জমি-জমা বসতবাড়ি যেমন রেলবাজারের প্রাণকৃষ্ণ সা’ মশাইকে বেচে দিয়েছিলেন, সুলতানপুরের জমি-জমাও তেমনি একদিন সকলের চোখের আড়ালে আর একজনকে বেচে দিলেন। তারপর সব টাকাগুলো ভাগলপুরের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রেখে পাসবই আর চেকবইটা মাথার বালিশের তলায় রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে লাগলেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে থেকে যে বংশ ধনে-মানে পরিপূর্ণ হয়ে একদিন সারা বাংলা দেশে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল, তাদের কেউ-কেউ মোগলের সঙ্গে হাত মেলাবার দায়ে ইংরেজদের কোপানলে পড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, আবার কেউ-কেউ অবস্থা-বৈগুণ্যে পড়ে। একেবারে ভিখিরি হয়ে টিমটিম করে তখনও কায়ক্লেশে কোনও রকমে কৌলিক মর্যাদা বজায় রেখে মাথা বাঁচিয়ে চলছিল। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আমলে মাথা বাঁচানোও দায় হয়ে উঠলো অনেকের পক্ষে। তখন সব চারদিকে নতুন নতুন জমিদারির পত্তনি হচ্ছে। ইংরেজদের সূর্যাস্ত আইনের সুযোগ নিয়ে কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের পূর্বপুরুষ যেমন হাতে বেনিয়ানগিরির টাকা পেয়ে সুলতানপুরে জমিদারি কিনেছিলেন, তেমনি হর্ষনাথ চক্রবর্তীর পূর্বপুরুষও জমিদারি করেছিলেন কালীগঞ্জে। সেই সময়ই শুরু হয় সদানন্দর পূর্বপুরুষ নরনারায়ণ চৌধুরীর উত্থানের ইতিহাস। মুর্শিদাবাদ কিংবা জাহাঙ্গীরাবাদ কিংবা গৌড়বঙ্গের অন্য কোনও উৎখাত জমিদারের বংশধর ভাগ্যের স্রোতে ভাসতে ভাসতে বংশের পূর্বগৌরব উদ্ধার করার জন্যেই বোধ হয় নায়েবের চাকরি নিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন। তারপর সুলতানপুরের আর এক ভূস্বামীর সঙ্গে আত্মীয়তা পাতিয়ে নিজের মর্যাদা দ্বিগুণ করতে মতলব করেছিলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মধ্যপাদে এসেই ইতিহাস উল্টে গেল। কালীগঞ্জ আগেই গিয়েছিল, তারপর নবাবগঞ্জও গেল। এবার সুলতানপুরও বুঝি শেষ হয়ে যায়। সুলতানপুরের শেষ উত্তরাধিকারী হরনারায়ণ রায়চৌধুরীকে তখন আর কেউ চোখেই দেখতে পায় না। গঞ্জের একজন গোয়ালা প্রতিদিন এসে আধ সের দুধ দিয়ে যায়। আর মুদিখানার মালিকের লোক দিয়ে যায় একখানা এক পাউণ্ডের পাঁউরুটি।

চৌধুরী মশাই নিজেই সেই দুধটা একটা অ্যালুনিনিয়ামের কড়ায় জ্বাল দেন। তারপর আধখানা পাঁউরুটি সেই দুধে ডুবিয়ে সকালের আহারটা সারেন। আর আধখানা থাকে রাত্রের জন্যে। রাত্রেও ওই একই খাদ্য। তারপর ঘুম থেকে উঠে সাবান দিয়ে আবার কড়াটা মেজে ফেলেন। চৌধুরী মশাই কাউকেই বিশ্বাস করেন না পৃথিবীতে। সবাই তার টাকার জন্যে ওঁৎ পেতে বসে আছে।

প্রকাশ প্রথম প্রথম আসতো। চৌধুরী মশাই দরজায় খিল দিতেন। বলতেন–তুমি বেরোও দিকি, তুমি বেরোও এখান থেকে বেরিয়ে যাও–

প্রকাশ তবু নড়তো না। বলতো–আজ্ঞে, আপনি কেন হাত পুড়িয়ে রান্না করছেন জামাইবাবু, আপনি বুড়ো মানুষ, আমি বাড়ি থেকে আপনার খাবার রান্না করে আনতে পারি–

চৌধুরী মশাই বলতেন–তুমি থামো দিকিনি, তুমি আর কথা বলো না–

প্রকাশ বলতো–আজ্ঞে, আমি তো ভালো কথাই বলছি, আমার স্ত্রী থাকতে আমি নিজে থাকতে আপনার নিজের হাতে রান্না করা কি ভালো দেখায়?

–ভালো দেখায় কি না দেখায় তা তোমাকে ভাবতে হবে না, তুমি আর আমার সামনে এসো না বলে প্রকাশের মুখের ওপরেই চৌধুর মশাই দরজা বন্ধ করে দিতেন।

বন্ধ দরজার সামনে প্রকাশ খানিকক্ষণ চুপ করে নির্বোধের মত দাঁড়িতে থাকতো। তারপর আস্তে আস্তে বাড়ির রাস্তার দিকে পা বাড়াতো। তার হাতে তখন একটা পয়সাও নেই। ছেলে-মেয়ে-বউ ভালো করে পেট ভরে খেতে পায় না। দিদি মারা যাওয়ার পর থেকেই তার অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। তার চোখের সামনেই নবাবগঞ্জে জমি-জমা বিক্রি হয়ে গেল, তার চোখের সামনেই সুলতানপুরের জমি-জমাও বিক্রি হয়ে গেল। সেই টাকাকড়ি সমস্ত কিছু ভাগলপুরের ব্যাঙ্কে গিয়ে জামাইবাবু জমা দিয়ে এলেন। সেখান থেকে সুদের টাকা আনতে জামাইবাবু রিকশায় উঠে একলা চলো যান আর পেট চালানোর মত খরচার টাকাটা তুলে নিয়ে আসেন। প্রকাশ দূরে দাঁড়িয়ে শুধু হাঁ করে দেখে।

মুদিখানার সামনে আসতেই অখিল ডাকে।

–কী রায় মশাই, কিছু হলো? জামাইবাবু কী বলেন?

প্রকাশ বললে–জামাইবাবুর আর নাম কোর না অখিল, একেবারে চশমখোর, খাঁটি চশমখোর

–কেন? অত গালাগালি দিচ্ছ কেন?

প্রকাশ রায় বললে–গালাগালি দেব না, চশমখোর লোক না হলে নিজের হাতে দুধ জ্বাল দিয়ে খায়, তবু আমার বউ-এর হাতের রান্না খাবে না। তা তোমার পাঁউরুটির দাম পাচ্ছো তো ঠিক ঠিক?

অখিল বললে–একেবারে নগদ। এক হাতে পাঁউরুটি দিয়ে আসি, আর এক হাতে নগদ পয়সা। চৌধুরী মশাই বলেন বাকিতে খাবো না কারো কাছে–

শুধু অখিল নয়। যে দুধ দিয়ে আসে সেই গয়লানী বউও নগদনগদ পয়সা পেয়ে যায়। দুধের এমন কি খুচরো পয়সা পর্যন্ত ভাঙিয়ে রাখেন চৌধুরী মশাই। যেন দাম বাকি না পড়ে।

অখিল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে–তা এত কষ্ট করে নিজের হাতে রান্না করেন কেন বলো তো রায় মশাই?

প্রকাশ বলে–ওই যে, যদি টাকার লোভে আমরা বিষ খাইয়ে দিই!

বিষ? টাকার এত লোভ! যে শোনে সে অবাক হয়ে যায়। তারা কীর্তিপদ মুখুজ্জে মশাইকেও দেখেছে। তিনি তো এমন ছিলেন না। ওই প্রকাশের বউই তার খাবার বরাবর রান্না করে দিয়েছে। একবারও তো বিষ খাইয়ে দেবার ভয় হয়নি তাঁর। তা ছাড়া তিনি কত লোককে কত দান-ধ্যান করেছেন। কত লোক মাসোহারা পেয়েছে তার কাছে। তার জামাই হয়ে এ কেমন ব্যবহার! টাকা কি তোমার সঙ্গে যাবে বাপু? টাকা কি কখনও কারো সঙ্গে গেছে? চিরদিন তো কেউ সংসারে বাঁচতে আসেনি। তাহলে? একদিন তো এই এত টাকা সবই ফেলে যেতে হবে! কে খাবে তোমার টাকা? টাকার এত মায়া?

কিন্তু এ কথাগুলো যাঁর উদ্দেশ্যে বলা তার কানে তোলবার সুযোগও হয় না কারো, তাই তাঁর কানে যায়ও না। সুলতানপুরের মানুষ বহুদিন ধরে আশা করেছিল কীর্তিপদ মুখুজ্জে মশাই-এর মত একদিন চৌধুরী মশাইও তাদের সঙ্গে মেলামেশা করবেন, দরকারে অদরকারে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তা হলো না। কোথা থেকে কোন অঞ্চলের এক মানুষ এসে সুলতানপুরের সব জমিজমা কিনে নিয়ে সব কিছুর মালিক হয়ে বসলো। আর তাদের যে-দশা চলছিল সেই দশাই চলতে লাগলো।

কিন্তু সেদিন হঠাৎ এক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটলো। অখিল প্রতিদিন যেমন পাঁউরুটি নিয়ে গিয়ে দিয়ে আসে সেদিনও তেমনি গিয়েছে।

গিয়ে দেখলে দরজা বন্ধ। অবশ্য এমনিতে ঘরের দরজা সাধারণত বন্ধই থাকে। সদরের গেট দিয়ে ঢুকে উঠোন পেরিয়ে একতলার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায় সে। চৌধুরী মশাই যদি তখন জেগে থাকেন তো অখিলকে দেখে হাত বাড়িয়ে পাঁউরুটিটা নিয়ে পয়সাটা দিয়ে দেন। কিন্তু ক্বচিৎ কদাচিৎ ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। অখিল গিয়ে ডাকে–চৌধুরী মশাই–

একবার ডাকতে-না-ডাকতেই চৌধুরী মশাই দরজা খুলে দিয়ে পাঁউরুটিটা নিয়ে নেন। তারপর গয়লানী বউ-এর বেলাতেও তাই। দুজনের পয়সা যেন আগের রাত্রে হিসেব করে গুনে বালিশের তলায় রেখে দেন।

এমনিই বরাবর চলে আসছে।

কিন্তু সেদিন অখিলের ডাকে ভেতর থেকে আর কেউ সাড়া দিলে না।

অখিল কেমন যেন অবাক হয়ে গেল। এমন তো হয় না।

অখিল আবার ডাকলে–চৌধুরী মশাই, আমি অখিল, দরজা খুলুন—

তবু কারো সাড়া নেই। তবু দরজা খুললে না কেউ–

অখিল অন্য কোনও উপায় না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো–চৌধুরী মশাই, ও চৌধুরী মশাই–

তবু কেউ সাড়া দিলে না। ততক্ষণে দুধ নিয়ে গয়লানী বউও এসে গেছে। তাকে কোনও দিন তেমন অপেক্ষা করতে হয় না। দুধের কড়াতে দুধ মেপে দিয়ে দাম নিয়ে তার চলে যাবার কথা।

সেও একবার ডাকলে–চৌধুরী মশাই–চৌধুরী মশাই, আমি দুধ এনেছি–

তবু কারো সাড়া না পেয়ে দুজনেই কেমন ভয় পেয়ে গেল। এমন তো হয় না। চৌধুরী মশাই তো তেমন ঘুমকাতুরে মানুষ নন।

ততক্ষণে খবরটা এক কান থেকে আর এক কানে চলে গেছে। অশ্বিনী ভট্টাচার্যি ছুটে এসেছে। প্রকাশ খবরটা পেয়েই দৌড়ে এসে হাজির। সেও বার-দুই ডাকলে–জামাইবাবু, জামাইবাবু–

তবু ভেতর থেকে কোনও সাড়া-শব্দ নেই।

তখন সকলেরই কেমন ভয় হয়ে গেল। জ্যান্ত মানুষ হলে কি কেউ এত ডাকাডাকিতে ঘুমিয়ে থাকতে পারে!

প্রকাশ বললে–তোমরা সরো, আমি আলসে দিয়ে একবার ওধারের জানলার কাছে যাই, গিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে আসি—

সরু কার্নিশের ওপর পা ফেলে-ফেলে প্রকাশ জানলার দিকে যাবার আগেই দেখলে সার-সার ডেয়ো-পিঁপড়ে ভেতরের দিকে লক্ষ্য করে চলেছে। একেবারে অশেষ। কোত্থেকে বুঝি ওরা টের পায়। ওরা বুঝি মানুষের আগেই টের পেয়ে যায় কোথায় কোন্ মানুষের শরীর থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে।

অখিল বললে–খুব সাবধানে যাবেন রায় মশাই–পড়ে গেলে হাত-পা একেবারে গুঁড়িয়ে যাবে।

কিন্তু না, প্রকাশ বেশি দূর যেতে পারলে না। কালো কালো পিঁপড়েগুলো দেখে প্রকাশের ভয় করতে লাগলো। সে আবার ফিরে এল।

বললে–না গো, হলো না–পিঁপড়ে কামড়ে দেবে–

অশ্বিনী ভট্টাচার্য বলে উঠলো–তা হলে কী চৌধুরী মশাই-এর অসুখ হলো নাকি?

অখিল বললে–এই কালকেও তো পাউরুটি দিয়ে গেছি আমি, আমাকে পাঁউরুটির দাম দিয়েছেন উনি

গয়লানী বউও বললে–আমিও তো দুধ দিয়ে গেছি, দাম নিয়ে গেছি—

প্রকাশ বললে–এক কাজ করো, দরজা ভাঙো—

অনেক কথার পর শেষ পর্যন্ত তাই-ই সাব্যস্ত হলো। ভাঙো, দরজাই ভাঙো–

তারপর শাবল এল, হাতুড়ি এল। তা-ই দরজার ওপর দুম-দুম্ করে মারা হতে লাগলো। কীর্তিপদ মুখোপাধ্যায়ের ঠাকুরদার তৈরি বাড়ি। কাঠ নয় তো যেন লোহা। শাবলের এক একটা ঘায়ে কাঠ যেন কথা বলতে লাগলো। এক-একবার হাতুড়ির ঘা পড়ে আর অষ্টাদশ শতাব্দী, উনবিংশ শতাব্দী আর বিংশ শতাব্দীর মধ্য-দশক পর্যন্ত সমস্ত শাসক-শোষকের আত্মা আত্মা যেন একসঙ্গে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আর্তনাদ করে ওঠে। তাদের বুক থেকে ঘন-ঘন যন্ত্রণার অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসে-উঃ-উঃ।

যখন দরজাটা ভেঙে পড়ে গেল সবাই ভেতরে ঢুকে দেখল চৌধুরী মশাই তাঁর বিছানাটার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে আছে। আর জানলার ফাঁক দিয়ে দলে-দলে কালো পিঁপড়ে এসে তাঁর সর্বাঙ্গ অক্রমণ করেছে।

.

প্রতিদিনের মত সেদিনও লোকাল ট্রেনটা স্টেশনে এসে থামলো। ট্রেনটাকে ভালো করে থামবার ফুরসৎও কেউ দেয় না। ভালো করে থামবার আগেই সবাই নেমে পড়ে। সেই সকাল বেলা সবাই অফিসকাছারিতে গেছে আর ছুটির পর দৌড়তে দৌড়তে শেয়ালদা স্টেশনে এসে ট্রেন ধরেছে। তখন কে আগে আগে বাড়ি ফিরতে পারে তারই যেন প্রতিযোগিতা চলে। ট্রাম রাস্তা থেকেই ছুটতে শুরু করে। এক-একবার মাথার ওপরের ঘড়িটা দেখে আর ছোটে।

নয়নতারা যখন অফিসে যেত তখন ফেরার সময় সঙ্গে থাকত নিখিলেশ। তখন এত তাড়া ছিল না দুজনেরই। দুজনেই তখন অফিস থেকে বেরিয়ে ধীরে সুস্থে স্টেশনে আসতো। একটা ট্রেন যদি চলেই যায় তো ক্ষতি নেই, আর একটা ট্রেন আছে।

কিন্তু এখন অন্যরকম। এখন অফিস থেকে বেরিয়ে নয়নতারাকে সঙ্গে নেবার আর কোনও দায় নেই। এখন একলা-একাই স্টেশনে এসে নিখিলেশকে ট্রেন ধরতে হয়, আবার একলাই ট্রেন থেকে নামতে হয়। তারপর রাস্তা দিয়ে একমনে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি। অথচ যেন বাড়িতে না পৌঁছোতে পারলেই নিখিলেশ বাঁচে। যেন দেরি করে বাড়িতে পৌঁছে খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বিছানায় শুয়ে পড়তে পারলে সে নিষ্কৃতি পায়।

বাজারের কাছ দিয়ে যেতেই পেছনের দোকান থেকে কে যেন ডাকলে–ও নিখিলেশ বাবু– নিখিলেশবাবু–

নিখিলেশ পেছন ফিরে দেখল একজন অচেনা লোক একটা সোনারুপোর দোকানের ভেতর থেকে তাকে ডাকছে। ভদ্রলোককে চিনতে পারলে না আবার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।

ভদ্রলোক বললে–আমার নাম মনোহর দত্ত। আপনি চিনবেন না, কিন্তু আপনার স্ত্রী একটা সোনার হার বাঁধা রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন আমার কাছে, তার বদলে চারশো টাকা দিয়েছিলুম–

নিখিলেশ আকাশ থেকে পড়লো। নয়নতারা সোনার হার বাঁধা রেখে চারশো টাকা নিয়ে গেছে!

ভদ্রলোক আবার বলতে লাগলো–তা তিনি বলেছিলেন একমাসের মধ্যেই হারটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন, কিন্তু এতদিন হয়ে গেল, প্রায় দুমাস হতে চললো, তবু তিনি এলেন না–তাই আপনাকে কথাটা বলছি

নিখিলেশ এ-কথার কী জবাব দেবে বুঝতে পারলে না। তারপর একটু ভেবে নিয়ে বললে–আচ্ছা, আপনি কিছু ভাববেন না–আমি নিজে একদিন এসে টাকা দিয়ে হারটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো–

বলে আবার বাড়ির দিকে চলতে লাগলো।

রাস্তায় চলতে চলতে নিখিলেশের মনে হলো তার বাড়িটা যেন আরো দূরে হলে ভালো হতো। ভালো হতো যদি বাড়িতে গিয়ে আবার নয়নতারার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে না হতো। কিন্তু কেন নয়নতারা এমন কাজ করতে গেল। আর যদি ডাক্তার-ওষুধের জন্যে নিজের হার বাঁধা দেওয়ার দরকারই হয়েছিল তো তার কাছে জিনিসটা সে লুকোল কেন? কেন তাকে একবার বললে না পর্যন্ত? বললে কি সে বাধা দিত কিম্বা বারণ করতো?

অফিসের লোকরা বলে–তোমার কী হলো হে? এ রকম মনমরা হয়ে যাচ্ছ কেন দিন দিন?

নিখিলেশ হাসবার চেষ্টা করতো। একটা আড়ষ্ট হাসি হেসে বলতো–কেন, আমার তো কিছু হয়নি–

সত্যিই যে নিখিলেশের কী হয়েছে তা কাউকে বলবার নয়। বললে–লোকে মজা পাবে, বললে বরং লোকে হাসবে। মনে মনে বলবে, বেশ হয়েছে। অথচ বাইরে থেকে সবাই-ই তাকে হিংসে করে। হিংসে করে তার সৌভাগ্যের কথা ভেবে। সত্যিই তার সৌভাগ্য না তো কী? স্বামী-স্ত্রীতে উপায় করা ক’জনের ভাগ্যে জোটে! অফিসের বেশির ভাগ লোকই উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সংসার চালাতে গিয়ে হাঁফিয়ে ওঠে। সকলের মুখেই এক কথা–নেই। বউ-ছেলে-মেয়ের খরচ যোগাতেই মাসের মাঝামাঝি সবাই ফতুর। তারপর আর বাড়িতে মাছ আসে না। জিনিসপত্তোরের দাম নিয়ে যখন সবাই আলোচনা করে তখন নিখিলেশও কথা বলতে যায়। কিন্তু সবাই তাকে থামিয়ে দেয়। বলে–তুমি থামো হে, তুমি আর কথা বোল না

নিখিলেশ বলে–কেন? আমি থামবো কেন? আমি কি সংসার করি না?

তারা বলে–তোমরা তো হাজব্যাণ্ড-ওয়াইফ দু’জনে মিলে রোজগার করছো, তোমাদের কী ভাবনা?

নিখিলেশ হাসে। বলে–দু’জনে রোজগার করলেই কি সব সমস্যা মিটে গেল? টাকা ছাড়া কি মানুষের আর কোন সমস্যা নেই?

সবাই নিখিলেশের কথায় অবাক হয়ে যায়। টাকা ছাড়া আবার সমস্যাটা কী মানুষের? টাকাই তো সংসারে আসল জিনিস! আঢেল টাকা রোজকার করে, তারপর সেই টাকা ব্যাঙ্কে পুরে রেখে দাও, তখন পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করে খাও দাও আর ফুর্তি করো।

নিখিলেশের অফিসের সকলের মুখে এই একই কথা। এতদিন নিখিলেশেরই কম-বেশি ওই সমস্যা ছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে অনেকদিন নিখিলেশ নয়নতারাকে বলেছে চলো না, কোনও রেস্টুরেণ্টে ঢুকি–

নয়নতারা বলেছে–কেন? তোমার ক্ষিধে পেয়েছে নাকি?

নিখিলেশ বলেছে–কেন, তোমার ক্ষিধে পায়নি! তুমিও তো সেই কোন্ সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছ!

নয়নতারা বলেছে–মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করে কী হবে? তার চেয়ে এইটুকু রাস্তা একটু কষ্ট করে চলো না, একেবারে বাড়িতে গিয়েই খাবো–

নিখিলেশ ভাবতো নয়নতারা সত্যিই বড় কৃপণ। দু’জনের মাইনের টাকা মিলিয়ে অনেকগুলো টাকাই তো হচ্ছে তাদের। নয়নতারা ততদিনে কিছু টাকাও জমিয়ে ফেলেছিল ব্যাঙ্কে। নয়নতারার ইচ্ছে ছিল একদিন কয়েক বছর পরে যখন আরো কিছু টাকা হবে তখন এই কলকাতা শহরে তারা একটা বাড়ি করবে। বেশ ছোট সাজানো-গোছানো একটা বাড়ি।

–বাড়ি!

বাড়ির নাম শুনেই চমকে উঠতো নিখিলেশ। বলতো কলকাতায় বাড়ি করবে? তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি? কলকাতায় জমির দাম কত জানো? দশ হাজার বারো হাজার করে কাঠা–বাড়ি অমনি করলেই হলো?

নয়নতারা বলতো–তুমি একটু কম করে খরচ করো, দেখবে ছোট মতন একটা বাড়ি হয়ে যাবেই আমাদের।

অথচ প্রথমে একটা গয়না কিনতে চায়নি সে। গয়নার লোভ তার অনেকদিন আগেই মিটে গিয়েছিল। নয়নতারা বলতো–গয়না পরে হাতী-ঘোড়া কী এমন হবে! হোটেল রেস্টুরেন্টে খেয়েই বা কি হবে? অথচ কলকাতায় যদি একটা বাড়ি হয় তো কত আরাম বলো তো! তখন আর ছুটে ছুটে প্রাণ বের করে রোজ ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করতে হবে না। বাড়ি থেকে সকাল দশটায় বেরোব আর বাসে উঠে টপ করে আধ ঘণ্টার মধ্যে অফিসে গিয়ে পৌঁছবো। আর মাসে মাসে এই এতগুলো টাকা ভাড়া গুনতে হবে না মিছিমিছি। সে টাকায় পেটে খেলে তবু বরং কাজ দেবে।

অথচ আশ্চর্য, সেই লোক হঠাৎ আজ নিজের হারটা পর্যন্ত বাঁধা রেখে দিল। একবার তাকে বললে না পর্যন্ত পাছে সে বারণ করে। নয়নতারার অত কষ্টে না খেয়ে জমানো টাকাগুলো সমস্ত খরচ করছে বাইরের আর একজনের চিকিৎসার জন্যে–

চলতে চলতে কী মনে হলো, নিখিলেশ আবার ফিরলো। অনেকখানি রাস্তা চলে গিয়েছিল নিখিলেশ। আবার ফিরে এসে সেই মনোহরবাবুর সোনা-রুপোর গয়নার দোকানের সামনে দাঁড়ালো।

মনোহর দত্ত নিখিলেশকে দেখে বললে–কি হলো? আবার ফিরলেন যে? কিছু বলবেন?

নিখিলেশ বললে–দেখুন হারটা কবে আমার স্ত্রী বাঁধা রেখে দিয়ে গিয়েছিলেন বলুন তো? কোন্ তারিখে? আপনার খাতাটা একবার বার করে দেখুন তো–

মনোহর দত্ত লোহার সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা খেরো খাতা বার করলে। খাতার পাতা উল্টে উল্টে একটি জায়গায় এসে থামলো। বললে–এই যে, গেল মাসের চোদ্দ তারিখে। উনি বলেছিলেন মাইনেটা পেয়েই হারটা ছাড়িয়ে নেবেন–

নিখিলেশ বললে–ঠিক আছে, আপনি কিছু ভাববেন না মনোহরবাবু, আমি যত শিগগির পারি হারটা ছাড়িয়ে নিয়ে যাবো–বলে নিখিলেশ আবার বাড়ির দিকে চলতে লাগলো। গানের ফাটা রেকর্ডের মত ঘুরে ঘুরে ওই একটা কথাই তার মনের গ্রামোফোনে বার বার বাজতে লাগলো–গেল মাসের চোদ্দ তারিখে! গেল মাসের চোদ্দ তারিখ…

.

এই পৃথিবীর মানুষের ইতিহাস যেখান থেকে শুরু হয়েছিল সেখান থেকে মানুষ আজ অনেক দূরে সরে এসেছে। আগে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রা শুরু হতো আর সন্ধ্যে হবার সঙ্গে সঙ্গে তা শেষ হতো। কিন্তু যন্ত্রযুগের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সে-পৃথিবীর সব কিছু বদলে গেল। ভুগোল বদলে গেল, ইতিহাস বদলে গেল, আর যাকে নিয়ে ভুগোল ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান সব কিছু, সেই মানুষই আমূল বদলে গিয়ে একেবারে অন্য রকম হয়ে গেল। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের সূত্ৰতে জট বাধলো, বিশ্বাসের জায়গায় সন্দেহ, প্রীতির জায়গায় শত্রুতা, উদারতার জায়গায় বিচ্ছিন্নতা এসে মানুষকে কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিলে। অন্যদিকে তেমনি বিরোধ ঘটলো দেশের সঙ্গে দেশের, সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের, কালোর সঙ্গে কালোর, সাদার সঙ্গে সাদার, ভাষার সঙ্গে ভাষার, ধর্মের সঙ্গে ধর্মের। তারপর সেই বিরোধ এসে ঢুকলো পরিবারের ভেতরে। বিরোধ বাধলো পরিবারে, ভাইয়ে ভাইয়ে। শেষ সংঘাত বাধলো স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর।

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে বাঙলাদেশে এক ভূস্বামীর শেষ বংশধর বোধ হয় শেষ নিঃশ্বাস ফেলবার জন্যেই নৈহাটির এক মধ্যবিত্ত সংসারে এসে হাজির হয়েছিল। আর হাজির হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে আর একজনদের সংসারে বিপর্যয় ডেকে আনলে।

এ কি কম বিপর্যয়! নইলে যে-নিখিলেশ একদিন ছোটবেলায় স্বদেশী করেছে, স্বদেশী ফ্ল্যাগ নিয়ে কেষ্টনগরে মিছিলের মওড়া নিয়েছে, পুলিসকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করেনি, অবস্থার চক্রে পড়ে তাকেই আবার একদিন একটা সওদাগরি অফিসে চাকরি নিতে হয়েছে। তা হোক, চাকরি সকলকেই করতে হয়। চাকরি না করে সে করতই বা কী! নিখিলেশের অনেক বন্ধু বান্ধব দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড় বড় পোস্ট পেয়েছে। কেউ রাষ্ট্রমন্ত্রী, কেউ এম এল-এ। আবার কেউ বা কিছুই হয়নি। বড় জোর ফুড-ডিপার্টমেন্টে একটা চাকরি পেয়েই খুশী থেকেছে। কিন্তু তার বেশি আর কী সে চেয়েছিল? সে কি চেয়েছিল সে একটা কেষ্ট-বিষ্ট কিছু হবে?

ঠিক এই সময়েই তার জীবনে এসে গেল নয়নতারা। তখন থেকে নয়নতারাকে ঘিরেই তার জীবন বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলো। একটা ছোট বাড়ি, একটা ছোট সংসার আর ব্যাঙ্কে কিছু সংস্থান। সব মানুষের যা যা কাম্য থাকে সেইটুকুর বেশি আর কিছু নিখিলেশ তখন চাইতো না। প্রথম প্রথম যদিও বা একটু এধারে ওধারে বাজে খরচ করতো তাও তারা বন্ধ করে দিলে।

কিন্তু সমস্ত কিছু প্ল্যান গোলমাল করে দিলে সদানন্দ এসে। বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মত নিখিলেশের সমস্ত জীবন যেন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল।

অফিসের ভেতরে সেদিন কতক্ষণ কাজ করেছে নিখিলেশ তার খেয়াল ছিল না। যখন ঘড়ির দিকে নজর পড়েছে দেখলে সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে। খুব শীত পড়েছে।

হঠাৎ শীতেশ নিখিলেশকে দেখতে পেয়েছে। শীতেশ ভৌমিক! আপার ডিভিশন ক্লার্ক। বিয়ে-থা করেনি। যা মাইনে পায় তার সবটাই দু’হাতে ফেলে ছড়িয়ে খরচ করে। সে নিখিলেশের কাছে এসে দাঁড়ালো।

–কী রে, তুই এখনও কাজ করছিস যে?

নিখিলেশ বললে–এই ভাই কিছু এরিয়ার পড়ে ছিল তাই…

শীতেশ বললে–তা তোর স্ত্রী? তোর জন্যে ওয়েট করবে না?

নিখিলেশ বললে–না, আমার স্ত্রী আজকে অফিসে আসেনি–

–অফিসে আসেনি? তাহলে শরীর খারাপ বুঝি? তা ক’টার ট্রেনে তুই বাড়ি যাবি?

 নিখিলেশ বললে–-ট্রেনের কি অভাব আছে? অনেক ট্রেন যে-কোনও একটাতে গেলেই হলো। অন্য দিন তো সময় পাই না তাই বাকি কাজগুলো আজকে তুলে ফেলছি

শীতেশের কী হলো কে জানে। বললে–বড় শীত পড়েছে রে, চল্ না কোথাও গিয়ে একটু বসি, গা’টা গরম করি গিয়ে, যাবি?

গা-গরম করা মানেটা যে কী তা নিখিলেশ জানতো। শীতেশের যে সে-অভ্যেস আছে তা কম-বেশি অফিসের সবাই-ই জানে।

শীতেশ বললে–আরে অত ভাবছিস কেন? কাজ তো আছেই, কাজ তো লক্ষ্মী, লক্ষ্মীকে কখনও বাড়ি-ছাড়া করতে নেই, ওঠ ওঠ, আজকে তো আর তোর বউ নেই যে টের পাবে–

নিখিলেশের হঠাৎ মনে পড়লো বাড়িতে গেলেই সেই এক দৃশ্যঃ ডাক্তার আর রোগ! নয়নতারার দেখাই হয়ত পাওয়া যাবে না। গিরিবালাকে ডেকে চুপি চুপি ভাত খেয়ে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়া। তারপর যদি নয়নতারা দেখতে পায় তো অবাক হয়ে যাবে। বলবে–ওমা, তুমি কখন এলে?

এই ঘটনাই প্রায় প্রতিদিন। প্রতিদিনই বলবে–জানো, ওর জ্বরটা এখনও ছাড়ছে না—

নিখিলেশ এ-কথার কোনও উত্তর দেবে না প্রথমে। এক-একদিন বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে–তা ওর জন্যে এত ভাবনা তোমাকে কে করতে বলেছিল? ওকে হাসপাতালে পাঠালেই পারতে, ওর জ্বরও সেরে যেত–

কিন্তু না, কথাটা বলতে গিয়েও নিখিলেশের মুখে আটকে যেত। বলতে ইচ্ছে হতো– ওর ভাবনাই যদি ভাববে তাহলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে কেন? কেন আমার জীবন এমন নষ্ট করে দিলে তুমি? আমাকে বিয়ে করবার জন্যে কে তোমার পায়ে ধরে সাধাসাধি করেছিল?

না, এসব কথা বলাও শোভা পায় না নিখিলেশের। তাই নিখিলেশ কিছুই বলতো না। আগেও যেমন মাইনের টাকাটা নয়নতারার হাতে দিত, সেবারও তাই দিলে।

নয়নতারা বললে–আমার আমার মাইনেটা?

নিখিলেশ বললে–তা তুমি তো আমাকে পে-অথরিটি দাওনি।

নয়নতারা বললে–আমার কি ছাই মনে ছিল? তুমি তো দেখছো আমার অফিসের কথা ভাববার সময় নেই, দিনরাত কেবল রোগী নিয়ে ব্যস্ত, আমাকে তো মনে করিয়ে দেবে—

.

হঠাৎ শীতেশের কথায় নিখিলেশের যেন চমক ভাঙলো–কী হলো রে, অমন গুম্ মেরে বসে আছিস যে? নেশা হলো নাকি?

নিখিলেশ বললে–না–

–তাহলে–খা!

একটুখানি খেয়েই নিখিলিশের মাথাটা কেমন করছিল। যে-যন্ত্রণাটা এতদিন মনের মধ্যে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, সেটা যেন তখন খানিকটা কমলো।

শীতেশ বললে–আমি তো ভাই রোজ খাই। শীতকালে একটু খাওয়া ভালো। ডাক্তার খেতে বলেছে আমাকে–তুইও আর একটু খা–

বলে একজন ওয়েটারকে আর একটু আনতে বললে।

নিখিলেশ বললে–না ভাই, আর খাবো না।

–কেন, খেতে দোষ কী? এ খাওয়া তো পাপ নয় রে—

নিখিলেশ শীতেশের একটা হাত চেপে ধরলে। বললে–না ভাই, প্লিজ, আমি আর খেতে পারবো না, আমাকে বাড়ি যেতে হবে, সাড়ে ন’টায় একটা ট্রেন আছে সেটা ধরতে হবে

শীতেশ বললে–তা যাবি! আমি কি তোকে যেতে বারণ করছি? আমিও তো বাড়ি যাবো। সবাই-ই বাড়ি যাবে। এখানে কেউ কি সারারাত থাকতে এসেছে?

নিখিলেশ বললে–তা নয়, ভাবছি এককালে এই আমিই ভাই মদের দোকানে কতবার পিকেটিং করেছি, আর আমিই আজ সেই মদ খাচ্ছি–

শীতেশ হো হো করে হেসে উঠলো-আরে দূর, তুই কী বলছিস, আমি নিজেও তো একদিন মদের দোকানে পিকেটিং করে জেলে গিয়েছি। তখন মহাত্মা গান্ধী যা বলেছে তাই-ই করেছি। তুই জানিস, আমি নিজের হাতে চরকায় সুতো কেটেছি, সেই সুতোয় ধুতি জামা তৈরি করে পরেছি। কিন্তু এখন তো ইণ্ডিয়া স্বাধীন হয়ে গিয়েছে, এখন কী আর চরকা কাটি না খদ্দর পরি? এখন তো এই দ্যাখ না টেরিলিন ধরেছি, ট্রাউজার বুশ শার্ট পরি–

নিখিলেশ বললে–আমিও তো তাই–

শীতেশ বললে–শুধু তুই আমি কেন রে? এখন তো কেউই আর সে-সব কথা মানে না। যারা তখন মদ ছুঁতো না, তারা সবাই এখন খায়–

নিখিলেশ হঠাৎ বলে উঠলো–তুই আছিস বেশ, বিয়ে-টিয়ে করিসনি, বেশ ফ্রি। কাউকে কোনও জবাবদিহি করতে হয় না তোকে–

শীতেশ অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন, কার কাছে তোকে জবাবদিহি করতে হয়? কীসের জন্যে জবাবদিহি করতে হয়?

নিখিলেশ এতদিন হলো বিয়ে করেছে। নিজের সম্বন্ধে কখনও কারো কাছে কোনও গল্প করেনি। গল্প করা প্রয়োজনও মনে করেনি। প্রতিদিন ছুটি হবার সঙ্গে সঙ্গে সে দৌড়তে দৌড়তে নয়নতারার অফিসে গেছে। নয়নতারাও তার অফিসের গেটের সামনে প্রতিদিন নিখিলেশের জন্যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু এখন অন্য রকম। এখন বাড়ি যাবার তাড়া বিশেষ নেই আর। যখন হোক গেলেই হলো। ততক্ষণ অফিসের ফাইল কটা ক্লিয়ার করার তাগিদ যেন তার কাছে হঠাৎ বড় জরুরী হয়ে উঠেছে।

–জবাবদিহি?

কথাটা মনে লাগলো নিখিলেশের। তাকেই তো বরাবর জবাবদিহি দিতে হয়েছে নয়নতারার কাছে। প্রতিটি পয়সা খরচের পর্যন্ত জবাবদিহি করতে হয়েছে নয়নতারার কাছে। অথচ এখন? এখন যে নিজে অন্য একজনের জন্যে অকারণে টাকা খরচ করে যাচ্ছে, তার বেলায়?

বললে–চল উঠি এবারে—

শীতেশ বললেই, আমার কথার জবাব দিচ্ছিস না যে?

নিখিলেশ বললে–জবাব আর কী দেব। তুই তো বিয়ে করলি না। বিয়ে করলে বুঝতে পারতিস।

–কেন, তোর বউ কি গয়না-টয়না চায় বুঝি খুব?

নিখিলেশ বললে–না না, গয়নাটয়না মোটেই চায় না, কলকাতায় শুধু একটা বাড়ি করতে চায়। কলকাতায় নিজস্ব একটা বাড়ি করার খুব শখ নয়নতারার–

বলে নিখিলেশ হঠাৎ উঠে পড়লো। বললে–না আর খাবে না, খেলে গাড়ির লোক সব জানতে পারবে–

–জানতে পারলে তো বয়ে গেল। আমার পাড়ার লোক তো সবাই জানে আমি মদ খাই। কে মদ খায় না শুনি? সবাই তো খায়? সবাই লুকিয়ে লুকিয়ে খায় আর আমি বুক ফুলিয়ে খাই, এই যা তফাত। তারা তো মদ খাওয়ার চেয়েও আরো বড় বড় পাপ করছে–

নিখিলেশ বললে–কী পাপ?

–তুই তো জনিস সব, আমাকে আর কেন জিজ্ঞেস করছিস? আমাদের অফিসে দেখছিস না কত টাকার ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছে কোম্পানি? সেটা পাপ নয়? পলিটিক্যাল-পার্টির ফাণ্ডে চাঁদা দিচ্ছে বলে তাই গভর্ণমেন্টও কিছু বলছে না। আর আমরা তো শুধু নিজের গাঁটের পয়সায় মদ খাচ্ছি, এটা আর এমন কি অপরাধ?

তখন বিল চুকিয়ে দিয়েছে শীতেশ। নিখিলেশ বাইরের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালো। বললে– ও-সব বড় বড় কথা ভাই আমাদের আলোচনা করা শোভা পায় না। এরই মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে, এরই মধ্যে আমাদের মরতে হবে। আমরা তো রামমোহন রায়ও নয়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও নয়, নেহাৎ হরিপদ কেরানী, কষ্টে-সৃষ্টে যদি কোনও দিন ধার-দেনা করে কলকাতায় একটা বাড়ি করতে পারি তাহলেই আমাদের চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে–

–আয়, একটা পান খাই–

–পান কেন?

–তাহলে তোর নয়নতারা আর গন্ধ টের পাবে পাবে না–পান খেলে মুখের সব গন্ধ ঢেকে যায়–

নিখিলেশ নৈহাটির রাস্তায় চলতে চলতে ভাবছিল সত্যিই কেউ তার মুখের গন্ধ টের পাচ্ছে কিনা। না, তা পাচ্ছে না। পেলে গাড়িতেই সবাই টের পেত। গাড়িতেও অনেক চেনা শোনা লোকের সঙ্গে বাধ্য হয়ে কথাবার্তা বলতে হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ এই মনোহর দত্তের কথায় যেন তার নেশা কেটে যাবার উপক্রম হলো। কেন নয়নতারা কথাটা একবার বললে না তাকে! কেন তার শখের সোনার হারটা মনোহর দত্তর দোকানে বাঁধা রাখতে গেল! নিখিলেশ টের পাবে বলে?

বাড়ির সামনে গিয়ে সে দরজার কড়া নাড়বে কিনা ভাবতে লাগলো। কড়া নাড়লেই যদি নয়নতারা দরজা খুলতে আসে! দরজা খুলে যদি তার মুখের গন্ধটা টের পায়? তখন?

গলিরাস্তার ধারেই বাড়িটা। পাশের জানালাটা দিয়ে একবার উঁকি মেরে দেখলে হয়। ভেতরে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। জানালার নিচেকার পাল্লা দুটো বন্ধ। ভেতরে যেখানে ভদ্রলোক শুয়ে আছে সেইখানটা দেখতে গেলে জানলার ওপর থেকে উঁকি মারতে হয়।

নিখিলেশ এক কাণ্ড করে বসলো। এককোণ থেকে জানালার পাল্লার ওপর উঠলো। তারপর আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ভেতরে চেয়ে দেখলে তক্তোপোশটার ওপর ভদ্রলোক শুয়ে আছে। তার জ্ঞান আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। নিথর নিস্পন্দ মানুষটা। পাশ ফিরে শুয়ে আছে। আর তার মাথার কাছে জানালার দিকে পেছন ফিরে বসে নয়নতারা একমনে তার মাথায় আইসব্যাগ লাগিয়ে দিয়ে বসে আছে।

নিখিলেশ অনেক্ষণ ধরে একদৃষ্টে সেই দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো।

আশ্চর্য! যে মানুষটা একদিন নয়নতারার ওপরে অত্যাচার-অপমানের শেষ রাখেনি, যে মানুষটা একদিন নয়নতারার জীবনটা বিষিয়ে দিয়েছিল, যার জন্যে একদিন নয়নতারা যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সিঁথির সিঁদুর হাতের নোয়া সব কিছু মুছে আবার কুমারী হয়ে উঠেছিল, সেই তাকেই কিনা এই অমানুষিক সেবা! এও কি এক ভাগ্যের পরিহাস নয়! এ কেমন করে সম্ভব হলো! এই লোকটাই জন্যেই তার অত সাধের সোনার হারটা পর্যন্ত স্যাকরার দোকানে বাঁধা রেখে দিতে নয়নতারার বাধলো না! নারী-চরিত্র কি এমনিই বিচিত্র জিনিস!

সেখানে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা উঁকি মেরে দেখতে দেখতে নিখিলেশের নিজেরই লজ্জা করতে লাগলো। এ কী করছে সে! তার নিজের বাড়ি, তার নিজের স্ত্রী, তবু নিজের বাড়ির ভেতরে চেয়ে দেখবার সাহস নেই তার। এ কী কমপ্লেক্স তার, এ কী তার ব্যবহার!

নিখিলেশ তাড়াতাড়ি জানালা থেকে নেমে পড়লো। তারপর পাশের উঠোনের দিকের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজের মনকে শক্ত করে নিলে সে। না, সে কিছুই অপরাধ করেনি। এমন কিছু করেনি যে যার জন্যে নিজের বাড়িতে ঢুকতে তার লজ্জা করবে।

হাত বাড়িয়ে দরজায় কড়াটা নাড়তে যাবে এমন সময় ভেতর থেকেই দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। দেখা গেল গিরিবালা বেরোচ্ছে।

–গিরিবালা, তুমি কোথায় যাচ্ছো?

গিরিবালা বললে–ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, তাই ওষুধ আনতে—

তারপর কী ভেবে নিয়ে বললে–আপনি এখন খাবেন? আপনাকে খাবার দিয়ে যাবো?

নিখিলেশ বললেন, আমি অফিস থেকে খেয়ে এসেছি, খাবো না–তুমি যাও আমি দরজা বন্ধ করে দিচ্ছি–

বলে ভেতরে ঢুকে দরজায় খিল লাগিয়ে দিলে। তারপর আস্তে আস্তে কলঘরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আর তারপর চুপি-চুপি বিছানায় শুয়ে পড়ে লেপটা টেনে নিয়ে গায়ে চাপা দিয়ে দিলে।

.

–দিদিমণি–দিদিমণি–

গিরিবালার গলার আওয়াজ পেয়ে নয়নতারা হাতের আইসব্যাগটা পাশে রেখে উঠলো। ঘরের দরজাটা খুলে দিয়ে বললে–কী গো, কী?

হাতের ওষুধটা বাড়িয়ে দিলে গিরিবালা।

–ও মা, তুমি কখন ওষুধ আনতে গেলে আমাকে তো বলে যাওনি কিছু—

গিরিবালা বললে–বাবু যে বাড়ি এল তাই আর তোমাকে ডাকিনি—

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল। বললে–বাবু? বাবু কখন এল? আমি তো টের পেলুম না, কখন এল বাবু?

আশ্চর্য! কিছুই টের পায়নি সে। ওষুধটা রেখে নয়নতারা তাড়াতাড়ি তার শোবার ঘরে ঢুকে দেখলে নিখিলেশ অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

নয়নতারা অবাক হয়ে গেল নিখিলেশের কাণ্ড দেখে। আগে যখন দুজনে অফিসে যেত তখন তো এত দেরি করে অফিস থেকে আসতো না!

নয়নতারা বললে–শুনছো—ওগো—

তবু কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

নয়নতারা আবার ডাকলে–ওগো শুনছো–

তারপরে বাইরে এসে গিরিবালার কাছে গেল। বললে–হ্যাঁ গো গিরিবালা, বাবু কি না খেয়েই শুয়ে পড়েছে নাকি?

গিরিবালা বললে–না দিদিমণি, আমি জিজ্ঞেস করেছিলুম, বাবু বললেন আজ কিছু খাবেন না, অফিস থেকেই খেয়ে এসেছেন–

–কী মুশকিল! ভাতগুলো নষ্ট হলো তো! বললে–ভাতগুলোতে জল ঢেলে রেখে দিও, কাল সকালে না হয় আমিই জল দেওয়া ভাত খাবো–

বলে আর দাঁড়ালো না সেখানে। তখন আর দাঁড়াবার সময়ও ছিল না তার। ওদিকে ওঘরে মানুষটা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছে। মাথায় আইসব্যাগ দিতে দিতে উঠে এসেছে, আবার রোগীর কাছে এসে বসলো সে। এ ক’দিন যে কী বিপদের মধ্যে দিয়ে কাটছে তার ঠিক নেই। মানুষটার সমস্ত শরীর এই দু’মাসের মধ্যেই হাড়-সার হয়ে গিয়েছে।

–দিদিমণি!

নয়নতারা দরজার দিকে চেয়ে দেখলে গিরিবালা দাঁড়িয়ে।

–খাবে না?

ঘড়ির দিকে চাইতেই খেয়াল হলো রাত দশটা বেজে গেছে। কখন যে রাত দশটা বেজে গেল বুঝতেও পারেনি সে। বললে–তুমি তাহলে এসে এঁর মাথায় আইসব্যাগটা একটু ধরো তো, আমি তাড়াতাড়ি যা-হোক কিছু মুখে দিয়ে আসি–

গিরিবালা এসে আইসব্যাগটা ধরতেই নয়নতারা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। কিন্তু খেতে বসেও নয়নতারা মনটাকে কিছুতেই ওই রোগীর ঘর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে না। গিরিবালার হাতে মানুষটাকে ছেড়ে দিয়েও যেন শান্তি নেই তার। অর কতদিন এমন করে চলবে কে জানে! যে লোকটা এত অহঙ্কার করে তার ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে যে আবার এমন করে সেই তারই আশ্রয়ে এসে তারই কাছ থেকে সেবা পাবে এও বুঝি তার কপালে লেখা ছিল! অনেক দিন রাত্রে মানুষটা তার দিকে চেয়ে চেয়ে কী যেন বলতে চাইতো। অথচ সে কল্পনাও করতে পারতো না যে যার দিকে সে চেয়ে আছে সে নয়নতারা। নয়নতারাকে চিনতে পারলে সে কী করত কে জানে! ডাক্তারবাবুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিল নয়নতারা–আপনি কী রকম বুঝছেন ডাক্তার বাবু? উনি সেরে উঠবেন?

ডাক্তারবাবু বলেছিল–আগের থেকে তো এখন ইমপ্রুভ করেছে। ওষুধগুলো ঠিক ঠিক খাইয়ে যাবেন, তাহলে নিশ্চয়ই ফল পাবেন–

নয়নতারা জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু এখনও লোক চিনতে পারেন না কেন?

ডাক্তারবাবু বলেছিল–লোক চিনতে একটু সময় লাগবে। অত হাই-ফিভার থাকলে ব্রেনের ওপরেও তো তার অ্যাকশান হয়। আজকাল এই রকম রোগী অনেকগুলো পাচ্ছি। এই নতুন ধরনের টাইফয়েড আজকাল খুব হচ্ছে–

নয়নতারা বলেছিল–অনেকে বলেছিল হাসপাতালে পাঠাতে। আমি কিন্তু আপনার ভরসাতেই রেখেছি। কিছু বিপদ হবে না তো?

ডাক্তারবাবু বলেছিল–এতদিন যখন হাসপাতালে পাঠাননি তখন আর পাঠাবার দরকার নেই, ক্রাইসিসটা কেটে গেছে।

–দেখবেন ডাক্তারবাবু, আমার যেন মুখরক্ষা হয়। নইলে বড় বিপদে পড়বো।

ডাক্তরবাবু জিজ্ঞেস করেছিল–ইনি আপানার কে?

নয়নতারা বলেছিল–আমার খুব বিশেষ আত্মীয়–শ্বশুরবাড়ির লোক–

এঁর স্ত্রী ছেলে-মেয়ে কেউ নেই? বিয়ে হয়েছে এঁর?

নয়নতারা বলেছিল–হ্যাঁ–

–তা এঁর স্ত্রীকে খবর পাঠিয়েছেন? তারা কেউ এলে তো তবু আপনার কষ্টটা একটু কমতো। আপনি কতদিন একলা রাত জাগবেন এমন করে? মাসের পর মাস এমন করে রাত জাগলে শেষকালে আপনিও তো ভেঙে পড়বেন। এর পর যদি আপনি নিজে ভেঙে পড়েন তো তখন সব কিছু যে অচল হয়ে যাবে। তা ছাড়া মিস্টার ব্যানার্জীকে একটু সাহায্য করতে বলেন না কেন? তিনিও তো মাঝে মাঝে এক একদিন রাত জাগলে পারেন–

–তিনি তো সারাদিন অফিস করেন। সেই ভোরবেলা বেরিয়ে যান আর রাত্তির হয় ফিরতে, তাকেই বা কী করে বলি!

–তা হলে আপনার একটা নার্সের ব্যবস্থা করা উচিত। অবশ্য তাতে খুবই খরচ পড়বে। আর একজন নার্সের দ্বারা তো হবেও না, দুজন নার্স দরকার। পালা করে ডিউটি করবে।

নয়নতারা বলেছিল–এতদিনই যখন নার্স না-রেখেই সব কিছু করতে পারলুম, তখন আর কটা দিনের জন্যে কেনই বা বাইরের লোক রাখা! আর তা ছাড়া আমি যেরকম করে দেখাশোনা করবো সেরকম করে কি আর মাইনে করা নার্সরা করবে–

–তা ঠিক। তবে আপনি যা করছেন তা নিজের স্ত্রী তো দূরের কথা, কারো নিজের মা-ও তেমন করে করতে পারতো না।

কথাটা শুনে নয়নতারার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। বলেছিল–অমন করে বলবেন না। শুধু বলুন, ওঁর যে কষ্টটা হচ্ছে তা যেন তাড়াতাড়ি লাঘব হয়–আমি ওঁর কষ্ট আর দেখতে পারছি না–

ডাক্তারবাবু বলেছিল–ওঁর যা হবার তা তো হচ্ছেই, কিন্তু তার জন্যে আপনার কষ্টটা কি তার চেয়ে কিছু কম হচ্ছে?

এর উত্তরে নয়নতারা কিছুই বলেনি। আর বলবার ছিলও না কিছু। মানুষটা রোগ থেকে সেরে উঠে যত তাড়াতাড়ি চলে যায় সেই প্রার্থনাই সে কেবল করতো ভগবানের কাছে। মানুষটা চলে গেলেই সে আবার আগেকার মত নিয়ম করে অফিসে যেতে পারবে, আবার নিখিলেশেরও দেখাশোনা করতে পারবে নিয়ম করে। অফিসে যাবার আগে যখন নিখিলেশ খেতে বসতো তখন মাঝে-মাঝে নয়নতারা কাছে এসে দাঁড়াতো। বলতো–এ কি, তুমি কিছু খেলে না যে?

নিখিলেশ বলতো–আমার কথা তোমায় ভাবতে হবে না–

নয়নতারা বলতো–বা রে, ভাবতে হবে না মানে? আমি ভাববো না তো কে ভাববে? তোমার তো ট্রেনের দেরি আছে এখনও–আর দুটো ভাত নাও–

কিন্তু নিখিলেশ তার আগেই জায়গা ছেড়ে উঠে পড়তো। নয়নতারা বলতো–এ রকম করে খেলে তোমার শরীর কী করে টিকবে বলো তো?

–না, আমার আর ক্ষিদে নেই—

বলে কারো কথা না শুনে সোজা অফিসে চলে যেত। এরকম প্রায়ই হতো। তখন অন্তত আর এরকম হবে না। সংসারের কত কাজ পড়ে আছে, কোনও দিকে দেখতে পারছে না নয়নতারা। বিছানার চাদর ছিঁড়ে গেছে, ঘরের দেয়ালে সিলিং এ ঝুল জমেছে, কোনও দিকে দেখবার সময় পাচ্ছে না সে। এবার মানুষটা ভালো হয়ে গেলে সে আবার সমস্ত দেখতে পারবে। আবার নিখিলেশের অফিস যাবার পর সে নিজেও অফিসে যাবে, আবার ফেরার সময় একসঙ্গে এক গাড়িতে অফিস থেকে ফিরবে।

–দিদিমণি, নতুন বাবু কেমন করছে–

গিরিবালার কথায় খেতে খেতে নয়নতারা খাবার ফেলে দিয়ে উঠলো। বললে–কী রকম করছেন?

গিরিবালা বললে–খুব কষ্ট হচ্ছে বোধ হলো, কেমন যেন ছটফট করছেন—

নয়নতারা বললে–তুমি খেয়ে নাও, আমি যাচ্ছি–

বলে তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে সোজা রোগীর ঘরে গিয়ে নয়নতারা দেখলে সদানন্দ মাথাটা বালিশের ওপর একবার এদিক একবার ওদিক করছে। এমন তো হয় না। নয়নতারার মনে হলো যেন খুব যন্ত্রণা হচ্ছে তার। যেন যন্ত্রণা সহ্য করতে পারছে না। সমস্ত শরীরটা যেন যন্ত্রণায় ফুলে ফুলে উঠছে–

নয়নতারা সদানন্দর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতে লাগলো–কষ্ট হচ্ছে তোমার? কী কষ্ট হচ্ছে তোমার বল আমাকে। ডাক্তারবাবুকে একবার ডাকবো?

রাত বোধ হয় তখন দুটো। নিখিলেশ অঘোরে ঘুমোচ্ছিল। হঠাৎ একটা ডাকাডাকিতে তার ঘুম ভেঙে গেছে। নিখিলেশ চোখ মেলে দেখলে সামনে নয়নতারা।

নয়নতারা তাকে ঠেলতে ঠেলতে বললে–ওগো, আমার খুব ভয় করছে, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে–

নিখিলেশের ঘুমের জড়তা তখনও কাটেনি। লেপটা সরিয়ে কোনও রকমে উঠে বসলো। কিন্তু তার চোখে-মুখে তখনও তার ঘোর। নয়নতারা বললে–ওগো, একটু ওঠো না–

নিখিলেশ উঠলো। বললে–কি করতে হবে?

নয়নতারা বললে–ও-ঘরে ও কেমন করছে–

নিখিলেশের চোখে যেটুকু জড়তা ছিল তাও কেটে গেল। বললে–তা আমি কী করবো?

নয়নতারা বললে–ডাক্তারবাবুকে একবার ডেকে নিয়ে আসতে হবে। ও যন্ত্রণায় ছটফট করছে, ডাক্তারবাবুকে একবার না ডেকে পাঠালে আমি স্থির থাকতে পারছি না, আমার বড় ভয় করছে–

নিখিলেশ বললে–তা ঠাণ্ডার মধ্যে কি ডাক্তারবাবু আসবেন? আর এই এত রাত্তিরে? কাল সকালে গেলে হয় না?

নয়নতারা বললে–কিন্তু আমি যে ভালো বুঝছি না গো। রাতটা যদি না কাটে? ডাক্তারবাবু আমাকে বলে গেছেন যত রাত্তিরই হোক তাঁকে ডাকলে তিনি আসবেন–

নিখিলেশ বললে–কিন্তু আমি কী করে যাই?

–তা তুমি না গেলে কে যাবে? বাড়ীতে তুমি ছাড়া আর কে আছে? গিরিবালা মেয়েমানুষ, এই রাত্তিরে কী তাকে বাইরে পাঠানো ভালো? আর একা আমি আছি, তা তুমি যদি বলো তো আমিই যাই–

নিখিলেশ বিরক্ত হয়ে গেল। একে সন্ধ্যেবেলা শীতেশের সঙ্গে হোটেলে গিয়ে ওইটে খেয়েছে, তার ওপর শীতের ঠাণ্ডা, আর তারই ওপর অসময়ে ঘুম ভাঙানো। বললে–এই জন্যেই তো তোমাকে বলেছিলুম ওকে পাসপাতালে পাঠাতে–

নয়নতারা রাগ করলে না নিখিলেশের কথা শুনে। বললে–দেখ, এখন সেকথা তুলে লাভ নেই, আমি হয়ত ভুলই করেছি, কিন্তু তুমি কী চাও আমার ভুলের জন্যে একটা মানুষ মারা যাক?

কথাটা বলতে গিয়ে নয়নতারা নিখিলেশের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ যেন ধাক্কা খেয়ে পেছনে সরে এল। কী যেন একটা সন্দেহ হলো তার। বললে–তুমি মদ খেয়েছ?

নিখিলেশ কী বলবে বুঝতে পারলে না।

নয়নতারার সন্দেহ তখন কেটে গেছে। বললে–সে কী, তুমি মদ খেলে কী বলে? তুমি তো আগে মদ খেতে না? সত্যি বলো না, তুমি মদ খেয়েছ? সত্যি?

নিখিলেশের মুখে তখন আর কোনও জবাব নেই। তার অপরাধ ধরা পড়ে গেছে জেনে সে নতুন কিছু কৈফিয়ৎ খোঁজবার চেষ্টা করেও হতাশ হয়ে যেন হতবাক হয়ে গেছে।

নয়নতারা বললে–এদিকে আমি ভাবছি বুঝি অফিসের কাজের চাপে দেরি করে বাড়ি ফিরছ। তা আমি সঙ্গে থাকি না বলে তুমি এই রকম করে মদ খাবে? তুমি কি রোজই মদ খেয়ে বাড়ি ফেরো নাকি? আমি তো কিছুই জানতে পারিনি–রোজই মদ খাও তুমি?

 নিখিলেশের বিবেক যেন কোথায় বাধলো। বললে–না, আজকেই শুধু খেয়েছি–

–কখনো হতে পারে না, নিশ্চয়ই তুমি আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ যাও, নইলে বাড়ি আসতে তোমার এত দেরি হয় কেন রোজ?

নিখিলেশ বললে–না, সত্যিই রোজ খাই না–

–তো হলে আজই বা খেলে কেন? যে-জিনিস খাও না তা হঠাৎ আজই বা খেতে গেলে কেন?

নিখিলেশ বললে–শীতেশ খুব করে ধরলে তাই–ও-ই পয়সা খরচ করে খাওয়ালে।

–তা শীতেশবাবু ধরলে আর তুমিও তাই খেলে? পয়সা খরচ না-ই বা হলো, কিন্তু তুমি কোন আক্কেলে ওই ছাই-পাঁশ খেলে তাই আমি জিজ্ঞেস করছি? তুমি ছেলেমানুষ নাকি যে তোমাকে ধরলে আর তুমিও খেলে? তোমার নিশ্চয়ই খেতে ইচ্ছে করেছিল?

নিখিলেশ আমতা-আমতা করতে লাগলো। বললে–আজ খেয়েছি বলে কি আমি রোজই খাবো? একদিন খেলে কী এমন দোষ হয়?

–মানুষ যখন নেশা করে তখন প্রথম প্রথম ওই একদিনই খায়! ওই একদিন একদিন করতে করতেই শেষকালে তার নেশা হয়ে যায়। তা জানো না?

তারপর যেন কথা বলতে বলতে হঠাৎ পাশের ঘরের রোগীর কথাটা মনে পড়লো। বললে–আমি অফিসে যাচ্ছি না বলে তুমি মনে করেছ তোমার যা-ইচ্ছে-তাই করবে? এদিকে বাড়িতে এই বিপদ, আর ওদিকে তুমিও হয়েছ তেমনি। আমি একলা কোন্ দিক সামলাই বলো তো?

নিখিলেশ বললে–আমি তো তখনই বলেছিলুম ওকে হাসপাতালে পাঠাতে–

নয়নতারা বললে–তুমি আর কথা বোল না, কথা বলতে লজ্জা করে না তোমার! বিপদের সময় কোথায় তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে তা নয় কোত্থেকে কার কথায় মদ গিলে এলে! অফিস থেকে সোজা বন্ধুদের সঙ্গে গল্প না করে বাড়িতে আসতে পারো না? দেখ তো আমি এই দিনরাত রোগী নিয়ে পড়ে আছি, কত কাল ঘুমোতে পর্যন্ত পাইনি, ডাক্তারবাবু তো সেই কথাই বলছিলেন, বলছিলেন এরকম করে মাসের পর মাস না-ঘুমিয়ে কাটালে আমারও কোন দিন সিরিয়াস অসুখ হয়ে যাবে।

নিখিলেশ বললে–তা আমি কী করতে পারি বলো?

নয়নতারা বললে–তুমি? তুমি তো আমাকে একটু সাহায্য করলেও পারো।

–আমি তোমাকে সাহায্য করবো?

–তা করলে ক্ষতিটা কী? গিরিবালা বুড়ো মানুষ, একলা ও কি এত দিক সামলাতে পারে? আমারও শরীরে আর বইছে না। কোন্ দিন আমিও হয়ত বিছানায় শুয়ে পড়বো, তখন যে কী হবে ভগবান জানে! তুমি তো বেশ নেশা করে আরামে ঘুমোচ্ছ, আর আমার কথাটা একবার ভাবো দিকিন

নিখিলেশ বললে–আমি ও-সব কথার জবাব দিতে চাই না, এখন কী করতে হবে তাই বলো–

–ডাক্তারবাবুকে গিয়ে এখুনি একবার ডেকে নিয়ে আসতে হবে। বলবে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ–

–এখন ক’টা বেজেছে?

–দু’টো।

–নিখিলেশ বললে–কাল ভোরবেলা গেলে হয় না?

–ভোরবেলা হলে তো আর তোমাকে বলতে আসতুম না, তখন তো গিরিবালাও যেতে পারতো, পারলে আমিও যেতুম। কিন্তু এই মাঝ রাত্তিরে কী করে যাই বলো? তোমার এতটুকু আক্কেল নেই? ডাক্তারবাবুই বা কী ভাববেন বলো তো? ভাববেন বাড়িতে পুরুষমানুষ থাকতে মিস্টার ব্যানার্জি কি না তার বউকে এত রাত্তিরে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে–

নিখিলেশ রেগে গেল। বললে–কিন্তু কে তোমাকে সাধ করে এই ঝঞ্ঝাট মাথায় তুলে নিতে বলেছিল বলো তো? আমরা তো বেশ সুখে-শান্তিতে ছিলুম। কোনও অশান্তি ছিল না আমাদের। তুমিও তো এই ঝঞ্ঝাট বাধালে–

নয়নতারা বললে–এখন আর সেই পুরোন কাসুন্দি ঘাঁটবার সময় নেই তুমি তাড়াতাড়ি একটা সোয়েটার গায়ে দিয়ে নাও, শেষকালে আবার ঠাণ্ডা লাগিয়ে সর্দি বাধিয়ে বসবে—যাও–

নিখিলেশের তখন আর আপত্তি করবার সময় ছিল না। আলনা থেকে সোয়েটারটা নিয়ে গায়ে গলিয়ে নিলে। তারপর আলোয়ানটা জড়িয়ে বাইয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। পেছনে নয়নতারা দরজায় খিল লাগিয়ে দিয়ে আবার রোগীর মাথায় আইসব্যাগ দিতে বসলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *