৩.৫ পোশাক-আশাকের অবস্থা

অধ্যায় ৪

পোশাক-আশাকের অবস্থা বেশি একটা সুবিধার না, তাই লাজ-লজ্জার ধার না ধেরে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে সব বদলে নিলো রাশেদ। সীমান্ত পার হতে হলে এটুকু সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। সারা শরীরে ময়লা, ছেঁড়া-পোশাক নিয়ে কাস্টমসে দাঁড়ালে হয়তো ওরা ফিরিয়েও দিতে পারে। রাশেদের দেখাদেখি রাজুও তার পোশাক বদলে নিয়েছে একটু আগে। তবে দুজনের মুখেই বেশ দাঁড়ি-গোঁফ জমেছে গত কয়েকদিনে। শেভ করার কোন উপায় নেই। কাঁধে ট্রাভেল ব্যাগ ঝুলিয়ে হাইওয়েতে উঠে এসেছে ওরা। আর কিছুটা হাঁটলেই কাস্টমস অফিস। অন্তত রামচরনের সাংকেতিক কথাবার্তায় তাই বের করতে পেরেছে রাশেদ। একটু আগে ওদের দুজনকে এই রাস্তায় উঠিয়ে দিয়ে চলে গেছে চরনদাস, কাঠমুন্ডুতে। যাবার আগে রাশেদ অবশ্য কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়েছে হাতে। এই ছেলেটা না থাকলে এতোদূর আসা হতো না, আকবর আলী মৃধার হাতে পড়ে জান দিতে হতো।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে পিস্তল দুটো নিয়ে। এই জিনিস নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয়া অসম্ভব। অস্ত্রসহ একবার ধরা পড়লে সহজে ছাড়া পাওয়া যাবে না, সোজা জেলে চালান করে দেবে। আবার অস্ত্র ছাড়া যেতেও ভরসা পাচ্ছে না রাশেদ। কিন্তু সত্যিই কিছু করার নেই।

লম্বা চলে গেছে রাস্তাটা। দুপাশে পাথুরে এলাকা, মাঝে মাঝে কিছু গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি কিংবা অন্যান্য যানবাহন খুব একটা চোখে পড়ছে না। পিস্তল দুটো এরমধ্যে রাজুর হাতে দিয়েছে রাশেদ, ও নাকি কী ব্যবস্থা করবে। যদিও ব্যবস্থা করার কোন লক্ষন এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল রাশেদের, রোদের তেজ নেই, শীতল হাওয়া বইছে। গতকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি,অবসন্ন লাগছিল। রাজুকে দেখে অবশ্য তেমন কিছু বোঝার উপায় নেই। হাঁটছে, মাঝে মাঝে শিস দিচ্ছে, যেন পুরো পরিস্থিতিটাকে উপভোগ করছে।

পিস্তলগুলো কোথায় লুকাবি? জিজ্ঞেস করল রাশেদ।

যেখানে সেখানে ফেলে যাবো না, এমন জায়গায় রাখবো যাতে ফিরে আসার সময় আবার খুঁজে পাই।

বুঝলাম, তাড়াতাড়ি কর, তাড়া দিল রাশেদ, কাস্টমস অফিস এখান থেকে খুব কাছেই মনে হচ্ছে।

নো চিন্তা, রাজু বলল, দূরে রাস্তার পাশে বড় একটা পাথরের টুকরো দেখাল, টুকরোটা গোল, ঐটার নীচে লুকাবো।

তোর কি মাথা খারাপ নাকি? নষ্ট হয়ে যাবে না?

নষ্ট হবে ক্যান, এমনভাবে লুকাবো যে… রাজু বলল, উদাহরনটা শেষ করতে পারলো না।

ঠিক আছে, রাশেদ বলল, কিন্তু পরে এই পাথরের টুকরো চিনবো কি করে?

একটা মার্ক করে যাবো, রাজু বলল, যেমন ধর, এর উপরে আমাদের নামের প্রথম অক্ষর আর লিখে যাবো, যাতে পরে খুঁজে পেতে সমস্যা না হয়।

আইডিয়া খারাপ না, বলল রাশেদ, কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছিল না তার। এই পিস্তলগুলো যদি ড. আরেফিনের কোন কাজে ব্যবহার করা না যায়, তাহলে এগুলো আবার বের করে আনার প্রশ্নই আসে না।

রাস্তার পাশে বসে পড়ল রাশেদ, রাজু কিছুক্ষনের মধ্যে পাথরের টুকরোর আড়ালে পিস্তলদুটো লুকিয়ে আসল।

চল, যাই তাহলে, রাজু বলল।

একটু রেস্ট নেয়া দরকার।

এখানেও কিন্তু সেই আকবর আলী মৃধা থাকতে পারে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সীমান্ত পার হওয়া জরুরি আমাদের জন্য।

রাজুর কথায় যুক্তি আছে। উঠে দাঁড়াল রাশেদ। অনেক দূরে একটা জিপ চোখে পড়ল, খুবই ধীর গতিতে আসছে। দুজন লোককে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। লিফট পাওয়ার আশায় হাত নাড়াতে শুরু করেছে রাজু।

***

দুপুরের দিকে থামলেন ড. কারসন। ভোরে উঠে শুরু করেছিলেন, মাঝে দশ মিনিটের ছোট খাট একটা বিরতি দিয়েছিলেন, তারপর ক্রমাগত পথচলা। এখানে চারপাশে দেখার কিছু নেই। চারপাশে শুধু বরফ, মেঘলা আকাশ, দূরে পাইন বনের সারি, আরো দূরে বিন্দুর মতো দেখা যায় কিছু মানুষকে যারা ভেড়া কিংবা চমড়ি গাই চড়াতে বের হয়েছে।

পাথুরে পথে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। বিশেষ করে তিব্বতি মুটেগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। টাকার লোভে মালপত্র টানাটানি করতে এলেও এই পেশায় এদের খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই। তাই থামতে মোটামুটি বাধ্য হয়েছেন ড. কারসন। এছাড়া ক্ষুধাও পেয়েছে খুব। মাঝে মাঝে সুরেশ এটা সেটা শিকার করে নিয়ে আসে, রান্নাও করে চমৎকার। কিন্তু আজ সুরেশকেও পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছে। টিনের খাবারেই লাঞ্চ সারতে হবে সবাইকে।

চমৎকার একটা জায়গা বেছে নিয়েছে সুরেশ। চারপাশ থেকে ঘেরা, ঠান্ডা হাওয়া খুব একটা বেশি ঢোকে না। চা বানানোর জন্য আগুন জ্বালানো হয়ে গেছে, গোল হয়ে বসেছেন ড. কারসন, সন্দীপ, সুরেশ আর লতিকা। একটু দূরে মুটে চারজন বসেছে, ওদের মধ্যে একজনকে কিছুটা অসুস্থ মনে হচ্ছে।

সুরেশ এক এক করে সবার কাপে গরম চা ঢেলে দিলো।

গতকাল বলেছিলাম, আমরা বসবো, ড. কারসন বললেন চায়ে চুমুক দিয়ে, খুব কাছাকাছি চলে এসেছি আমরা। তাই কিছু ব্যাপার এখানেই আলোচনা হয়ে যাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

আপনি বলুন, আমরা শুনছি, শুকনো টোস্ট বের করে এনেছে সে একটা টিনের কৌটা থেকে, কামড় বসাল।

পরশু নাগাদ আমরা আসল জায়গায় পৌঁছে যাবো, অন্তত আমার হিসেব তাই বলে, ড. কারসন বললেন, কিন্তু একটা জায়গায় আমার কিছুটা সন্দেহ আছে।

বলে ফেলুন, ড. কারসন, সন্দীপ বলল।

সুরেশকে এখান থেকেই ফিরে যেতে হবে। আমি চাই না, স্পর্শকাতর একটা বিষয় নিয়ে কোন ঝামেলা তৈরি হোক দুটো দেশের মধ্যে।

আমি ফিরে যাবো! অবাক হয়ে বলল সুরেশ, বাকি দুজনের দিকে তাকাল। কিন্তু লতিকা এবং সন্দীপ নীরব ভুমিকা পালন করবে বুঝে ড. কারসনের দিকে ফিরল সে, আমি না থাকলে এততক্ষনে মরে ভূত হয়ে যেতেন ড. কারসন।

আমি কোন স্পাইকে সাথে নিতে পারবো না, তুমি তোমার পরিচয় গোপন করে এসেছে আমাদের দলের সাথে। আগে জানলে কখনোই তোমাকে দলের সাথে নিতাম না।

আপনি কি মনে করেন আমাকে ছাড়া এগিয়ে যেতে পারবেন, সাম্ভালা খুঁজে বের করতে পারবেন?

হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি।

আপনার কথায় আমি কখনোই ফিরে যাবো না ড. কারসন। আমার উপর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ আছে।

সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তোমাকে নিয়ে আমি এক পা সামনে এগুবো না।

বাহ্! দারুন তো, সুরেশ হেসে বলল, আমি তো জানতাম, আমাদের উপমহাদেশের লোকেরা সময়ে অসময়ে ডিগবাজি খায়, কিন্তু আপনারাও দেখি কম যান না।

এসব বলে লাভ হবে না সুরেশ। তোমার কারনেই ড. আরেফিনের মতো একজন লোককে হারিয়েছি।

আমার কারনে? আমি কী করলাম?

উনাকে যারা অপহরন করেছে, তোমাকে ধরার জন্যই করেছে, আমার এই ধারনা অবশ্য ভুলও হতে পারে।

আপনার ধারনা ভুল, ড. কারসন।

আমরা এতোদূর এগিয়ে এসে ফিরে যাবো? এবার লতিকা প্রশ্ন করল ড. কারসনকে।

লতিকা, তুমি বুঝতে পারছে না। যেখানে আমরা যাচ্ছি, তা চীন ভূখন্ডের একটা অংশ। সেখানে ভারতীয় একজন স্পাই আমাদের সাথে থাকা মানে, আমরা ভারতের পক্ষে কাজ করছি। কিন্তু আসলে তো তা নয়।

আপনার কথা ঠিক আছে, ড. কারসন। কিন্তু সুরেশকে আমাদের দরকার। ওর মতো একজন লোক আমাদের সাথে থাকলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যায়।

ঠিক এই সময় এক পাশের পাথুরের দেয়ালের উপর জমে থাকা বরফ খন্ড ভেঙে নীচে পড়ল। সুরেশ লাফ দিয়ে সরে গেল, নইলে বরফের চাইটা ঠিক তার মাথায় পড়তে পারতো।

মুহূর্তেই শোল্ডার হোলস্টার থেকে রিভলবার বের করে এনেছে সুরেশ, দুই হাতে দুটো। সবাইকে আড়াল নেয়ার জন্য ইশারা করে একটা দেয়ালের আড়ালে পজিশন নিলো।

পাঁচ মিনিট কেটে গেল। শুধু বাতাসের গতি বেড়েছে, সোঁ সোঁ শব্দ ছাড়া আর কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই কোথাও। সন্দীপ এবং ড. কারসনও নিজেদের পিস্তল বের করে তাক করে আছেন নীচের দিকে। যদিও সেখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না। মুটে চারজন ছোট একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়েছে। লতিকা ড. কারসনের পেছনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা অবাক হলেও সামলে নিতে সময় লাগেনি তার।

পনেরো মিনিট এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল সবাই, সতর্ক অবস্থায়। সুরেশ রিভলবার দুটো শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখল। মাঝখানে যে আগুন জ্বালানো হয়েছিল নিভিয়ে ফেলল।

ড. কারসন, আপনার কি মনে হয় এটা স্রেফ একটা দূর্ঘটনা? ড. কারসনকে জিজ্ঞেস করল সুরেশ।

দূর্ঘটনা হতে পারে, আবার নাও হতে পারে, ড. কারসন বললেন। এগিয়ে এসে সুরেশের হাত ধরলেন।

এটা শুধু একটা সতর্কবার্তা ছিল, সুরেশ বলল, সামনে যতো এগুবেন, সতর্কবার্তা আরো বাড়বে, শেষপর্যন্ত কি হবে সেটা আপনার ধারনারও বাইরে। আমি থাকি কিংবা না থাকি, আপনারা এরমধ্যে ওদের শত্রু হয়ে গেছেন।

তুমি থাকো।

আপনি না বললেও আমি থাকবো। এটা আমার দায়িত্ব, বলল সুরেশ, তারপর হেঁটে চলে গেল নিজের তাঁবুর দিকে।

ড. কারসন তাকালেন সন্দীপের দিকে, একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল সন্দীপ। লতিকা হাসল, ম্লানভাবে।

সামনে অনেক বিপদ আসবে, এই লোকটাকে আসলেই আমাদের দরকার, লতিকা বলল নিচু স্বরে।

হুমম, সিদ্ধান্তটা সবার সাথে আলোচনা করে নেয়া দরকার ছিল, ড. কারসন বললেন, হ্যাভ অ্যা গুড নাইট, ডিয়ার।

একটু পর নিজের তাঁবুতে চলে এলো লতিকা। যতোটা সহজ হবে ভেবেছে তার চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে অভিযানটা, তবু ভালো যে সময়মতো বৃদ্ধ পিতাকে সরিয়ে নিজে আসতে পেরেছে। প্রফেসর সুব্রামানিয়াম এমন পরিস্থিতিতে পড়লে কী হতো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসে লতিকার। ঘুম আসবে না সহজে। তবু সাম্ভালা কেমন তা কল্পনা করতে করতে কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল লতিকা।

*

অধ্যায় ৪২

রাতের অন্ধকারে পথ চলতে সমস্যা হয় না তার, দীর্ঘদিনের অভ্যাস। কিন্তু যজ্ঞেশ্বর আর বিনোদ চোপড়া ঠিক তাল মিলিয়ে চলতে পারে না তার সাথে। যজ্ঞেশ্বরের শরীর মেদমুক্ত, নির্ভাজ, অন্যদিকে বিনোদ চোপড়া আয়েশী জীবন কাটিয়ে অভ্যস্ত। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে বিনোদ চোপড়ার। গুম্ফা থেকে আনা টংকাগুলো নতুন বোঝা হিসেবে যুক্ত হয়েছে। কোনমতেই টংকাগুলো পেছনে ফেলে রেখে যেতে রাজি হয়নি বিনোদ চোপড়া, এই জিনিসগুলোর মূল্য সে বোঝে। ইউরোপের বাজারে অন্তত লাখ ডলার রোজগার করা যাবে এই টংকাগুলো বিক্রি করে।

প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আর কোন সাড়াশব্দ পাননি তিনি। মাথায় যে চোট পেয়েছে তা সারতে বেশ কয়েকদিন লাগবে, তাতে অন্তত কয়েকটা দিন হাতে পাবেন আশা করছেন, এতে কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়া যাবে। লোকটাকে মোকাবেলা করতেই হবে দুদিন আগে কিংবা পরে।

কিছু স্মৃতি বেশ কিছু দিন ধরেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। ছবির মতো একের পর এক দৃশ্য মনে পড়ে, কখনো হাতে তলোয়ার, কখনো পিস্তল, কখনো স্রেফ খালি হাতে অচেনা শত্রুর মোকাবেলা করছেন। তার সারা শরীর রক্তাক্ত, পেছনের দৃশ্যপটও বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। হ্যাঁ, একসময় হয়তো অনেক যুদ্ধই করতে হয়েছে তাকে, অনেক স্মৃতিই এখন ঝাপসা হয়ে গেছে। কিন্তু একটা বিশেষ স্মৃতিকে তিনি উদ্ধার করছেন অল্প অল্প করে, অনেক দিন ধরে। অন্য সব স্মৃতির তুলনায় এই স্মৃতি উদ্ধার করে আনা বেশি জরুরি। আজকের এই লখানিয়া সিং হওয়ার আগে আরো কয়েক শত ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে তাকে। কিন্তু শুরুটা কিভাবে হয়েছিল তা জানা খুবই প্রয়োজন, মিনোস হচ্ছে তার আসল নাম, পাহাড়-পর্বত ঘেরা মরুময় একটা অঞ্চলে তার জন্ম, বেড়ে উঠা। এগুলো সব মনে পড়েছে। পরিবার-পরিজন সব হারিয়ে এক অদ্ভুত বৃদ্ধের সাথে দেশে দেশে ঘোরা, তারপর বৃদ্ধের মৃত্যুর পর সেই আলোকবর্তিকার সন্ধানে বেরিয়ে পড়া। হ্যাঁ, আরো অনেক কিছুই মনে পড়েছে। হীরকগুহা থেকে ক্রমশ নীচের দিকে পড়তে থাকা মিনোসের চিৎকার এখনো তার কানে বাজে। তারপর কি হয়েছিল…

একজন মানুষ যখন ক্রমাগত পড়তে থাকে তখন সে কী ভাবে? প্রানপন চেষ্টা করে কিছু একটা আঁকড়ে ধরতে, যাতে পতন ঠেকানো যায়, কিংবা হাল ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করে শেষ মুহূর্তের জন্য, জানে না শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে। একটানা চিৎকার করে ক্লান্ত মিনোস, কিন্তু অন্তহীন পতন যেন থামছেই না। আশপাশে তাকিয়ে আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়নি,চারদিক ঝকঝকে উজ্জ্বল, কাঁচের মতো পরিস্কার দেয়ালে নিজের অসহায় চেহারাটাই চোখে পড়ছিল শুধু। সে শুধু পড়েই যাচ্ছে, নিজেকে অনেক হাল্কা মনে হচ্ছিল, পাখির পালকের মতো। একসময় মনে হলো পতনের গতি কমে গেছে, শরীর ধীরে ধীরে সোজা হচ্ছে। দুই হাত দুপাশে দিয়ে সোজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করল মিনোস। শূন্যস্থানে কি সোজা দাঁড়ানো যায়? প্রথম চেষ্টায় ডিগবাজি খেল একবার, দ্বিতীয়বার কোনমতে ভারসাম্য রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু চারদিকে সাদার প্রাধান্য, ঝকঝকে উজ্জ্বল সাদা। পাখির পালকের মতো ধীরে ধীরে নামতে থাকল। চোখ বন্ধ করে আছে সে এখন। চিন্তাটা মাথায় এলো হঠাৎ করেই, আসলে সে এখন মৃত একজন মানুষ। তার শরীরের মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। এখন সে কেবল একজন আত্মা। যেখানে সে যাচ্ছে তা হয়তো স্বর্গ কিংবা নরক, যার অনেক গল্প শুনেছে বৃদ্ধ অভিভাবকের কাছ থেকে। যে মৃত তার আর কোন মৃত্যু নেই, ব্যথা নেই, চেতনা নেই।

পতন থেমেছে, বুঝতে পারল মিনোস। চোখ খুলল। চারপাশে আলোর উজ্জ্বলতা কমছে ধীরে ধীরে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ মেঝের উপর দাঁড়িয়ে আছে, মনে হচ্ছে বিশাল কোন একটা কক্ষে প্রবেশ করেছে, যার চারপাশে কোন দেয়াল নেই, মাথার উপর কোন ছাদ নেই। অদ্ভুত একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। হাত দিয়ে নিজের মুখে স্পর্শ করে দেখল, সারা শরীরে একবার হাত বুলাল, কোথাও কোন ব্যথা নেই। একদম তাজা অনুভব করছে সে।

আলো ধীরে ধীরে কমে আসছে। যেন অদৃশ্য কোন হাতের কারসাজিতে একে একে নিভে যাচ্ছে অদৃশ্য বাতি। উপরের দিকে তাকাল, সেখানে গাঢ় অন্ধকার, একটু আগেও আলোর ঝলকানিতে তাকানো যাচ্ছিল না।

আরো কিছুক্ষন স্থির দাঁড়িয়ে রইল মিনোস। এই সময়ে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল। সব আলো নিভে গেছে। কিন্তু তার বদলে আট-দশ হাত সামনে জ্বলে উঠেছে অদ্ভুত এক আলো। ছোটখাট একটা বেদির উপর গোলাকার এই আলোকে আগুন বললে ভুল হবে। আগুনের লেলিহান শিখা এখানে নেই, তার বদলে আছে স্নিগ্ধ গোলাপী আভা, আলোর শিখাগুলো যেন ফুলের পাপড়ির মতো বেড়ে উঠে আবার ঝরে যাচ্ছে। ছোটখাট এই বেদির আশপাশে ছোট ছোট ধাপে বেশ কিছু সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি বেয়ে যেতে হবে এই আলোর কাছে। অদ্ভুত আরো একটা জিনিস চোখে পড়ল। গোলাকার আলোকবর্তিকার নীচেই স্বচ্ছ সাদা পাত্র, সেই পাত্রে নীল তরল। কেমন অদ্ভুত নীল আভা ছড়াচ্ছে পাত্রটার গা থেকে। বৃদ্ধ অভিভাবক এই ধরনের কিছুর কথা উল্লেখ করেননি কখনো।

দম বন্ধ হয়ে আসছিল মিনোসের। এই সেই আলোকবর্তিকা যার চিহ্ন বৃদ্ধ এঁকে রেখেছিলেন পোড়া মাটির ফলকে!

নিজের করনীয় সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই মিনোসের। সে হয় মৃত, কিংবা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা একজন মূর্খ মানুষ। জীবনে এমন কিছু নেই যা তাকে পেছনে টেনে রাখবে, বরং একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে সব ধরনের ঝুঁকি নেয়ার স্বাধীনতা তার আছে। কাজেই পা বাড়াল মিনোস। কাঁচের মতো স্বচ্ছ সেই মেঝের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বারবার মনে হচ্ছিল, জীবন বড়ই আনন্দময়, কোন কিছুর বিনিময়েই ঝুঁকি নেয়া উচিত নয়। কিন্তু বৃদ্ধের শেষ কথাগুলোও মনে পড়ছিল, তার সামনে আছে অনন্ত জীবনের হাতছানি।

বড় করে নিঃশ্বাস নিলো মিনোস। সিঁড়ির ধাপগুলো বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে তার সারা শরীর কাঁপছিল উত্তেজনায়। এই আলো হয়তো তাকে গ্রাস করে নেবে, কিন্তু তবু নিজেকে আটকাতে পারছিল না মিনোস। মোহাবিষ্টের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল সে স্নিগ্ধ সেই আলোর দিকে। তার সারা শরীরে এখন গোলাপী আভা, আর দুই পা এগুলেই…

এরপরের দৃশ্যটা মনে করার আগেই চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটলো। সামনে বড় একটা খাদ, এতোটাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁটছিলেন যে পেছন থেকে যজ্ঞেশ্বর না আটকে ধরলে তার পতন কেউ ঠেকাতে পারতো না।

নার্ভাসভাবে হাসলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর এখনো তাকিয়ে আছে, বুঝতে পারছে না কি বলবে।

টের পাইনি, মৃদু স্বরে বললেন তিনি।

আমি আপনাকে কতোক্ষন ধরে ডাকছি জানেন? যজ্ঞেশ্বর বলল।

শুনিনি।

আমার এই ডাক হয়তো দিল্লি থেকেও শুনতে পেয়েছে লোকে, আর আপনি শুনতে পাননি,অদ্ভুত! আরেকটু হলেই তো গিয়েছিলেন।

চুপ করে থাকলেন তিনি। আসলেই উত্তর দেয়ার মতো কিছু নেই। ছবির মতো একটার পর একটা দৃশ্য মনে পড়ছিল। এখন বরং আফসোস হচ্ছে আরেকটু হলেই জানতে পারতেন কি হয়েছিল মিনোসের, তার নিজের! এ কথাগুলো অবশ্য যজ্ঞেশ্বরকে বলা সম্ভব না।

আজ রাতে এখানেই বিশ্রাম নেই, কি বলেন?

ধীরে ধীরে পিছু হটলেন তিনি। এই ধরনের খোলা জায়গায় রাত্রি যাপন করার পক্ষপাতি তিনি নন, কিন্তু কিছু করার নেই। অন্তত আজ রাতে যজ্ঞেশ্বর তার কথা শুনবে বলে মনে হয় না।

ছোট একটা পাথরখন্ডের উপর বসলেন তিনি। বিনোদ চোপড়া এসে বসল পাশে।

প্রায়ই দেখি এমন অন্যমনস্ক হয়ে যান আপনি, এতো কি ভাবেন বলুন তো? জিজ্ঞেস করলো বিনোদ চোপড়া।

নিজেকে জানার চেষ্টা করি, আর কিছু না, মৃদু স্বরে বললেন তিনি।

রাত অনেক হয়েছে। একটু আগেও আকাশ ছিল মেঘে ঢাকা। এখন মেঘ সরে গিয়ে পূর্ন চাঁদ দেখা যাচ্ছে, তার আলোয় সমস্ত পৃথিবী ঝলমল করে উঠেছে যেন। জীবনের অনেক পুরানো কিছু অধ্যায় একটু একটু করে উন্মোচিত হচ্ছে তার কাছে। আসলেই এগুলো তার জীবনে কখনো ঘটেছিল ভেবে অবাক হয়ে যান তিনি। কিন্তু বাস্তব কখনো কখনো রূপকথাকেও হার মানায়।

আমরা সবাই নিজেকে জানার চেষ্টা করি, কিন্তু নিজেকে জানাই বোধহয় সবচেয়ে কঠিন কাজ, গম্ভীর গলায় বলল বিনোদ চোপড়া।

কাল সারাদিন অনেক কাজ, কথা বাড়ালেন না তিনি, ক্লান্ত লাগছিল খুব, একটু বিশ্রাম তার প্রয়োজন এখন, ঘুমানোর ব্যবস্থা করা দরকার।

যজ্ঞেশ্বরজী ব্যবস্থা করছেন, আপনি ঘুমান, আজ রাতে আমি পাহারা দেবো, বলল বিনোদ চোপড়া।

অল্পসময়ের মধ্যে ছোট একটা বিছানা তৈরি করে ফেলেছে যজ্ঞেশ্বর। এগিয়ে গেলেন তিনি। ঘুমে জড়িয়ে আসছে তার চোখ। অনেক ঘুম।

***

রাগে-ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল মিচনারের, কিন্তু তা না করে কিছুক্ষন চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মিচনার। শিকার হাতের নাগালে এসেও আবার ছুটে গেছে। এখন মাথা গরম করার সময় নয়, প্রতিপক্ষ সবসময়ই তার চেয়ে দুই পা এগিয়ে আছে।

গুম্ফার ভেতর দাঁড়িয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করছে মিচনার। একটু আগেও অন্ধকার ছিল চারদিক, এখন বেশ আলো ফুটেছে। চাঁদের এই আলো অবশ্য গুফার ভেতর ঢোকে না, কিন্তু দীর্ঘদিন অন্ধকারে থাকার ফলে দেখতে সমস্যা হচ্ছে না তার। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি,এখনো চাইলে ধাওয়া করা যায়। কিন্তু তার বদলে গুফাটা একটু দেখে নিতে চাইল মিচনার। এমন একটা জায়গা তার প্রয়োজন, কাজ শেষ হলে এখানে এসে ঘাঁটি বানানো যাবে। লোকালয় এখান থেকে অনেক দূরে, এছাড়া আশপাশে খাবার-দাবারের কোন অভাব নেই। খাদের ওপাড়ের জঙ্গল থেকে শিকার করা খুব বেশি কঠিন হবে না। তবে সমস্যা হচ্ছে বিশালকায় ঐ প্রানীটা। এখানে থাকতে হলে ঐ প্রানীটাকে এই এলাকা ছাড়া করতে হবে।

সেই করিডোরটা ছিল একটা অন্ধগলি। একেবারে শেষমাথায় গিয়ে বিফল মনোরথে ফিরে এসেছিল মিচনার। যদিও গুহার প্রবেশপথ দিয়ে বের হবার সুযোগ ছিল না, বিশালকায় প্রানীটা পুরো একটা হরিন শেষ করেছে তার সামনে। তারপর ঘন্টাখানেক শুয়েছিল। অনেকটা মানুষের মতো শোয়ার ভঙ্গি, মানুষ যেমন ভরপেট খাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে নেয়, অনেকটা তেমন। প্রানীটার অনেক কিছুই মানুষের সাথে মেলে, যেমন চেহারার ধরন, এমনিতে বড় আকারের ভালুক মনে হলেও মুখের আদলে ভালুকের সাথে কোন মিল নেই। বরং মানুষ বা গরিলার সাথে মুখের আদল মিলে যায়। এছাড়া, প্রানীটা মানুষের মতো দুই পায়ে হাঁটে, আফ্রিকা অঞ্চলে থাকার ফলে অনেকবারই গোরিলা দেখার সুযোগ হয়েছে মিচনারের। ওরাও দুই পায়ে হাঁটে, তবে খুব অল্প সময়ের জন্য। তবে লম্বায় প্রানীটা অসাধারন, অন্তত আট ফুটের কম হবে না, এই ধরনের প্রানীর কথা কোন বই বা কোন মানুষের মুখে শোনেনি কখনো। অনেককাল সভ্য সমাজের বাইরে থাকার কুফল, নিজেকেই বলল মিচনার।

সন্ধার পরপর প্রানীটা বের হয়ে যায় গুহা থেকে, সেই সুযোগে বেরিয়ে আসে মিচনার। খুব সাবধানে খাদটা পার হয়ে এপাশে চলে এসেছিল। গুহার সামনে বরফে সেই প্রানীটার বিশাল পায়ের ছাপ ছিল, চাইলে প্রানীটাকে অনুসরন করতে পারতো। কিন্তু আপাতত তার লক্ষ্য অন্যরকম, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল না করা পর্যন্ত আর কোন কিছুই তাকে থামাতে পারবে না।

খুব বেশিদূর যেতে পারেনি প্রতিপক্ষ, এটুকু নিশ্চিত মিচনার। ক্রুর একটা হাসি খেলে গেল তার মুখে। যে শিকার সহজে ধরা দেয়, তার পেছনে আর যেই থাকুক মিচনার নেই। তার দরকার কঠিন শিকার, সেই শিকারের রক্ত নিজের গায়ে মাখতে পারলেই শান্তি। সে কতো বড় শিকারি, এবার সেটাই প্রমান হবে।

*

অধ্যায় ৪৩

লিফট চাইতেই পাওয়া গেল। লোকগুলো বেশ হাসিখুশি, ইংরেজি বলতে পারে না, তাতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ইশারা ইঙ্গিতে ভালোই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে রাজু। পেছনের সীটের এক কোনায় বসে আছে রাশেদ। মাথা ধরেছে খুব। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে দেখেছে সবকিছু। সাধারন অবস্থায় এখানক প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো অসাধারন লাগার কথা। কিন্তু শরীর খারাপ হলে কিছুই ভালো লাগে না।

বোঝাই যাচ্ছে চেকপোস্টে চলে এসেছে প্রায়। নেপালি লোকগুলো ব্যবসার কাজে সীমান্ত পারাপার করে, যদিও ওদের সাথে এখন মালপত্র কিছু নেই। রাজু টাকা দিতে চেয়েছিল ভাড়া হিসেবে, ওরা নেয়নি। এই আতিথেয়তাটুকু ভালো লাগল রাশেদের কাছে।

চোখ বন্ধ করে বসে আছে এখন সে। চমৎকার রাস্তা, আরেকটু হলেই ঘুমিয়ে পড়তো রাশেদ, রাজুর কনুইয়ের ধাক্কায় চোখ খুলল। চেকপোস্টে চলে এসেছে। তাড়াহুরা করে নামতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল রাশেদ। কোনমতে নিজেকে সামলাল। চেকপোস্টটা পার হলেই নিষিদ্ধ দেশের সীমান্ত। পৃথিবীর ছাদ। মানবসভ্যতার প্রায় পুরোটা সময় লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছে তিব্বত। এখনো এখানে অতিথিরা খুব বেশি প্রাধান্য পায় না, বরং তাদের উপর বিশেষ নজর রাখা হয়।

ঘন্টাখানেকের বেশি সময় লাগল না সব কাজকর্ম শেষ হতে। এবার ছোট সেতুটা পার হয়ে ওপারে চীনা কাস্টমস পার হতে হবে। অবসন্নবোধ করছিল রাশেদ, তিব্বতে ঢুকে অন্তত একদিন বিশ্রাম নিতে হবে, তারপর আবার বের হতে হবে। ড. আরেফিনের কোন খবর এখন পর্যন্ত পায়নি,আসলে পেছন থেকে বারবার ধাওয়া দেয়া হচ্ছে সেই কাঠমুন্ডুতে পা দেয়ার পর থেকে, ঠিকমতো খবর নিতেও পারেনি। তবে এটুকু নিশ্চিত রাশেদ, ড. আরেফিন কোদারি গ্রামে নেই। তিনি এখন তিব্বতে। হয়তো তার দলের সাথে আছেন, কিংবা অন্য কোথাও।

তবে কিছুটা স্বস্তিবোধ করছে রাশেদ, আকবর আলী মৃধা এবং তার দল হয়তো খুব সহজেই তিব্বতে ঢুকতে পারবে না। ওদের কাছে স্পেশাল পাস থাকার সম্ভাবনা কম। আবার এমনও হতে পারে আহমদ কবির লোকটা আকবর আলী মৃধার জন্যও স্পেশাল পাসের ব্যবস্থা করে রেখেছে। যাই হোক না কেন, সাবধান থাকতে হবে তাকে। সেই সাথে রাজুকেও। এই মুহূর্তে রাজুকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখি মানুষ বলে মনে হচ্ছে। মুখে হাসি, হাঁটাচলায় প্রানচাঞ্চল্য দেখলে মনেই হবে না কোন ধরনের সমস্যায় আছে ছেলেটা। বোটে কশি নদীর উপর দিয়ে ছোট সেতুটা পার হবার সময় অবসন্নভাবটা চলে গেল হঠাৎ করেই। লিলির কথা মনে হলো। মেয়েটাকে ইচ্ছে করেই দূরে সরিয়ে রেখেছে রাশেদ আপাতত, তবু মাঝে মাঝে যখন মনে পড়ে তখন বেশ অভিমান হয়। সুদূর ইংল্যান্ডে পড়তে না গেলেও পারতো লিলি। এতো চমৎকার একটা জায়গায় একসময় হয়তো লিলিকে নিয়ে আসবে সে, মনে মনে বলল রাশেদ।

চীনা কাস্টমস পার হতেও বেশি সময় লাগল না। ঝাংমু তিব্বতের মধ্যে হলেও এখানে সাদার চেয়ে সবুজের সমারোহ বেশি। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় দিন রাত এখানে লোকজন থাকে, পথের পাশে অনেক দোকান, সেখানে নেপালি আর তিব্বতি নানা ধরনের পন্য বেচাকেনা চলে।

রাতটা এখানকার একটা হোটেলে কাটাবে বলে ঠিক করলো রাশেদ। মধ্যম মানের একটা হোটেল দরকার। কাঁধের ব্যাগগুলো অনেক ভারি মনে হচ্ছিল। রাজুর দিকে তাকাল। মোবাইল ফোনে ছবি তোলাতে ব্যস্ত এখন রাজু। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে হাসল রাশেদ, এই আনন্দটুকু মাটি করার দরকার নেই আপাতত। ড. আরেফিনকে খুঁজে পাওয়ার আসল মিশন বোধহয় এখান থেকেই শুরু।

***

সকালে খেতে পারেননি,দুপুরেও একই অবস্থা। শরীর আর বশ মানতে চাইছে না যেন। একটানা এতোদিন এই ধরনের শারীরিক কষ্ট সহ্য করার মতো মানসিক ক্ষমতা তার নেই। তবু দাঁতে দাঁত চেপে আকড়ে ছিলেন। এখন শরীর অবাধ্য, কোন শক্তি পান না। আয়নায় চেহারা দেখেন না অনেকদিন, কিন্তু ধারনা করতে পারছেন গায়ের রঙ এখন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, চোখের নীচে কালি পড়েছে। আসলে কি কারনে তাকে আটকে রেখেছে এই লোকটা তাই বুঝতে পারছেন না ড. আরেফিন। চীনা সামরিক ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ অবশ্যই জড়িত তাকে অপহরনের ঘটনায়, কিন্তু এর সাথে ঐ বৃদ্ধ লামাও জড়িত। সাম্ভালা যদি থেকেও থাকে তা বাইরের কেউ খুঁজে বার করুক এরা তা চায় না। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন প্রত্নতত্ত্ববিদকে সরাসরি আঘাত করতে পারছে না, তাতে সমস্যা হতে পারে। এখানে বিভিন্ন দেশের মধ্যকার অভ্যন্তরীন সম্পর্কও জড়িত।

ভ্যানের পেছনের ডালা খুলে গেল, চ্যাঙ-কে ঢুকতে দেখলেন ড. আরেফিন। তার মুখে গোঁজা কালো কাপড়টা একটানে সরিয়ে ফেলল চায়নীজ অফিসার।

আজ শুধু ওদের ওয়ার্নিং দিলাম, এরপর আর ওয়ার্নিং হবে না, সরাসরি আক্রমনে চলে যাবো, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল চ্যাঙ লী।

ড. কারসন কি এখানে?

আমি কি এতোদূর হাওয়া খেতে এসেছি ড. আরেফিন! তোমাকে শেষবারের মতো বলছি, চাইলে এখনো নিজের প্রান বাঁচাতে পারো।

এমন কোন অন্যায় করিনি যার কারনে প্রান দিতে হবে আমাকে, বেশ জোর গলায় বললেন ড. আরেফিন।

সে তোমার ইচ্ছে। আমি তোমাকে দুদিন সময় দিলাম, সিদ্ধান্ত নাও, বলল চ্যাঙ, তারপর যেভাবে এসেছিল চলে গেল। যাওয়ার আগে মুখে কালো কাপড়টা খুঁজে দিতে ভুলল না।

গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেলেন ড. আরেফিন।

***

গতকাল রাতে লখানিয়া সিং আর বিনোদ চোপড়া কথা বলছিল, প্রায় ফিসফিস করে, দূর থেকে বোঝার চেষ্টা করছিল যজ্ঞেশ্বর। তারপর কোনমতে তাঁবু খাটানো, ঘুম। এতোদিন ধরে লখানিয়া সিংয়ের সাথে পরিচয়, কিন্তু এই প্রথম লোকটাকে কিছুটা লক্ষ্যভ্রষ্ট মনে হয়েছে তার কাছে। কিছুটা যেন দিশেহারা, কিংবা আত্মবিশ্বাসহীন। লোকটার অতীত নিশ্চয়ই তার চেয়েও খারাপ, সেই অতীত মানুষটাকে বারবার পেছনে টেনে নিয়ে যায়। তার নিজেরও একসময় এমন হতো। কিন্তু অতীত বলতে এখন আর কিছু বোঝে না যজ্ঞেশ্বর, তার সব কিছুই বর্তমানে, সে কখনো সাধারন কেউ ছিল না। সন্ন্যাস জীবন যাপনের জন্যই তার জন্ম হয়েছে। তবে পুরো ভারতবর্ষ ঘুরে একটা জিনিসের সন্ধান কেউ এখনো তাকে দিতে পারেনি,একমাত্র লখানিয়া সিং-ই বোধহয় পারবে তার সন্ধান দিতে। সম্রাট অশোকের সেই নয় জন পারিষদ কি পারবে তাকে ফেলে আসা জীবনের যন্ত্রনা ভুলিয়ে দিতে? জানে না যজ্ঞেশ্বর।

যতোক্ষন লখানিয়া সিং আছে, ততোক্ষন সেও থাকবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছে। যজ্ঞেশ্বর, এই মুহূর্তে মানসিকভাবে মানুষটা হয়তো আগের অবস্থায় নেই, কিন্তু এই একজনই পারবে তাকে মুক্তি দিতে, না বলতে পারা মানসিক যন্ত্রনা থেকে।

সূৰ্য্য উঠে যাওয়ার সময় হয়েছে, ঘুম থেকে উঠে অন্যান্য দিনের মতোই ধ্যান করতে বসার আয়োজন করছে যজ্ঞেশ্বর। চারপাশে তাকাল, লখানিয়া সিং সাধারনত উঠে পড়ে। আজ উঠেনি। সবচেয়ে অবাক হলো বিনোদ চোপড়ার তাঁবু দেখে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খালি, কেউ নেই সেখানে। আরেকটু এগিয়ে গেল যজ্ঞেশ্বর। বিনোদ চোপড়া নেই, সেই সাথে নেই দুটো ব্যাগ, যেগুলোতে গুম্ফা থেকে নিয়ে আসা টংকাগুলো রাখা হয়েছিল।

মন বলছিল, বিনোদ চোপড়া চলে গেছে, তবু চারপাশ একটু ঘুরে দেখল যজ্ঞেশ্বর। নেই। কাজ হাসিল হয়ে গেছে, তাই চলে গেছে বিনোদ চোপড়া। মন একটু খারাপ হলেও স্বাভাবিকভাবে নেয়ার চেষ্টা করল যজ্ঞেশ্বর, কিন্তু অবাক হয়ে দেখল প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। বিনোদের সাথে গত কিছুদিনে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। এতোটা স্বার্থপর আচরন আশা করেনি সে।

লখানিয়া সিং উঠে পড়েছে, পাহাড়ের কিনারে গিয়ে তাকিয়ে আছে উদীয়মান সূর্যের দিকে।

বিনোদ নেই, চলে গেছে, যজ্ঞেশ্বর বলল। তার কণ্ঠ কিছুটা ভারি শোনাল।

এখানে তার আর কোন কাজ নেই, ঘুরে বললেন লখানিয়া সিং, তার কণ্ঠে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, তবে, আমাদের সাথে থাকাটাই নিরাপদ হতো তার জন্য।

আপনার রাগ হচ্ছে না?

সবাই নিজেকে জানতে চায়, যজ্ঞেশ্বরজী, মৃদু হেসে বললেন তিনি, বিনোদ চোপড়া হয়তো নিজেকে জেনে ফেলেছে। রাগ হবে কেন?

বিনোদ চোপড়ার জন্য খারাপ লাগছে, লোকটা দীর্ঘদিন পাশে থাকায় বেশ মায়া পড়ে গেছে, বিনোদ চোপড়ার সামনে বড় বিপদ, কিন্তু সাবধান করার কোন উপায় নেই।

কি করবো আমরা তাহলে?

আমি আমার লক্ষ্য পূরন করবো, আপনি সাথে থাকুন, আশা করি আপনার লক্ষ্যও পূরন হবে।

আর কিছু বললেন না যজ্ঞেশ্বর, ভোরের এই সময়টা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরন করার সময়, নতুন দিনের শুরুতে নিজেকে প্রস্তুত করার সময়, এই সময়টা বিনোদ চোপড়ার মতো অকৃতজ্ঞ মানুষের কথা বলে নষ্ট করা ঠিক নয়।

*

অধ্যায় ৪৪

কোনমতে হোটেলে উঠেই ঘুমিয়ে নিয়েছে রাশেদ। সন্ধ্যার পরপর যখন ঘুম ভাঙল মাথাব্যথাটা তখনও পুরোপুরি যায়নি। তবে বেশ ঝরঝরে বোধ করছিল রাশেদ। কেমন একটা ঘোরের ভেতর ছিল সারাদিন, চেকপোস্ট পাড় হয়ে তিব্বতে ঢুকতে কোন সমস্যাই হয়নি। তারপর রাজুকে উপর দায়িত্ব ছিল মোটামুটি একটা হোটেলে এক রাতের জন্য একটা ডাবল রুম বুক করার। দায়িত্ব ভালোই পালন করেছে রাজু। ঢাকা কিংবা অন্যান্য শহরের তুলনায় হোটেলটাকে মোটামুটি বলা গেলেও, এখানকার তুলনায় এই হোটেলটাই সবচেয়ে চমৎকার। জানালা খুলে চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পড়ে, এছাড়া রুমের সাথে ছোটখাট একটা বারান্দাও আছে।

রাজু ঘুমায়নি,বাইরের দোকান থেকে কলা আর পাউরুটি কিনে নিয়ে এসেছে খাবার জন্য। রাশেদ ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে একটা কলা এগিয়ে দিলো সে রাশেদের দিকে।

এই কয়দিনে তোর চেহারা বসে গেছে দোস্ত, রাজু বলল, তার নিজের চেহারায় হাত দিয়ে দেখল, আমার অবস্থাও কাহিল নিশ্চয়ই?

আরে নাহ! ঠিকমতো ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, বিছানায় উঠে বসল রাশেদ, কলাটা একপাশে সরিয়ে রাখল, এসব খেয়ে আমার পেট ভরবে না, বাইরে যাই চল!

চল, এই প্রস্তাবের অপেক্ষাই কছিল রাজু, দরজা খুলে বের হওয়ার জন্য প্রস্তুত।

কিন্তু একটা কাজ করা দরকার, কিভাবে করা যায় চিন্তা করছি, রাশেদ বলল, চিন্তিত স্বরে।

কি কাজ?

ড. আরেফিনের কোন ক্লই পেলাম না এখন পর্যন্ত, তিনি যদি তিব্বতে ঢুকে থাকেন, তাহলে কোন না কোন হোটেলে অবশ্যই উঠেছেন। তোর কি ধারনা?

তাই তো হবার কথা। আমরা তাহলে প্রতিটা হোটেলে গিয়ে জিজ্ঞেস করবো ড. আরেফিন নামে কোন গেস্ট ছিল কি না তাদের, গত এক মাসে।

আমরা তথ্য চাইলেই কি ওরা দেবে? আমরা তো পুলিশের লোক না, তবে…

তবে কি?

কিছু খরচ করলে কাজটা মনে হয় হয়ে যাবে?

তাহলে খরচ করবো, সমস্যা কোথায়?

চল তাহলে, পরনের কাপড়-চোপড় বদলে নিয়েছিল আগেই, বাথরুমের দিকে এগুলো রাশেদ, শুরু করতে হবে আমাদের হোটেলের রিসেপশনিষ্টকে দিয়ে, লোকটাকে কেমন মনে হলো?

টাকা দেবো, ইনফোরমেশন দেবে অবশ্যই, আমি পটাবো, তুই চিন্তা করিস না।

কিছুক্ষনের মধ্যে দরজা লক করে নীচে নেমে এলো দুই বন্ধু। রিসেপশনিষ্টের কাছ থেকে তথ্য নিতে হবে। ড. কারসন আর তার দল এই ঝাংমুর কোন না কোন হোটেলে অবশ্যই উঠেছিলেন।

রিসেপশনের সামনে চমৎকার বসার ব্যবস্থা, বেশ কিছু সোফা, টেবিল সাজানো অতিথিদের জন্য। রাজুকে সেখানে বসিয়ে রিসেপশনিষ্টের দিকে এগিয়ে গেল রাশেদ। রিসেপশনিষ্ট লোকটা মধ্যবয়স্ক, ছোট ছোট চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ, চুল সজারুর কাটার মতো খাড়া হয়ে আছে। সোনালী রঙের নেমপ্লেটে এরিক নামটা দূর থেকেই দেখে নিলো রাশেদ।

গুড ইভনিং, মি. এরিক।

গুড ইভনিং, স্যার। হাউ মে আই হেল্প ইউ?

ইংরেজিতে খুব একটা দক্ষ বলে নিজেকে দাবি করে না রাশেদ, তবে লোকটার সাথে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারবে বলে বিশ্বাস করে।

আমরা দুই বন্ধু, বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তোমাদের রাজধানীতে কিভাবে যাবো এখান থেকে?

বেইজিং তো অনেক দূর! তোমরা…

আমরা আসলে লাছার কথা বলছি, কোনমতে লোকটাকে থামিয়ে দিলো রাশেদ।

প্রতি সকালে এখান থেকে বাস ছাড়ে, সকালে দুটো, তারপর দুপুরের পরপর দুটো। তোমরা টিকেট কেটে রাখতে পারো, কিছুটা কাটাকাটা উত্তর দিলো এরিক, বোঝাই যাচ্ছে, লাছাকে রাজধানী হিসেবে মেনে নিতে তার আপত্তি আছে। খাঁটি চায়নীজ।

থ্যাঙ্কস, রাশেদ বলল, আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করবো, যদি কিছু মনে না করো…

বলুন, স্যার।

গত কিছুদিনের মধ্যে ড. কারসন বলে কি কেউ এখানে গেস্ট হিসেবে এসেছিলেন, কিংবা…।

দিজ আর কনফেডেশিয়াল ইনফ…

এরিক কথা শেষ করার আগেই একশো ডলারের একটা নোট শার্টের পকেট থেকে বের করল রাশেদ, তারপর কিছুক্ষন নেড়েচেড়ে আবার পকেটে ঢোকাল। আবার বের করল, পুরোটা সময় তার চোখ এরিকের চোখের দিকে, লোকটার হঠাৎ থেমে যাওয়া বোঝাচ্ছে, শিকার এখন হাতের মুঠোয়।

এই ইনফরমেশন তোমরা কোথা থেকে পেয়েছ তা কিন্তু বলতে পারবে…

আমরা বলবো না।

হোটেলের একটা মেনু এগিয়ে দিলো এরিক, একশ ডলারের নোটটা মেনুর ভেতর দিয়ে দিলো রাশেদ, চারপাশে তাকাল, এখানে তাকিয়ে নেই কেউ।

আমি দেখছি, বলল এরিক, তার গেস্ট রেজিস্টার বুক খুলে নাম দেখতে লাগল, বেশ কয়েক পাতা উল্টিয়ে থেমে গেল হঠাৎ পেয়েছি।

কে কে ছিল?

তিনজন উঠেছিলেন একসাথে, ড. নিকোলাস কারসন, সন্দীপ চক্রবর্তী আর ড. লতিকা প্রভাকর।

আরো একজনের নাম থাকার কথা, ড. আরেফিন, তাই না?

না, আরো একবার নামগুলো খুটিয়ে দেখল এরিক, ড. আরেফিন বলে কোন নাম নেই লিস্টে।

তুমি শিওর? রেজিস্টারটা নিজের দিকে টেনে নিলো রাশেদ, নামগুলো দেখল, সেখানে ড. আরেফিন নামে কোন গেস্টের নাম নেই। হতাশ হয়ে রেজিস্টারটা ফেরত দিলো এরিকের হাতে।

তারা কয়দিন থেকেছিলেন?

মাত্র একরাত, পরেরদিন সকালেই চলে গিয়েছিলেন।

কোথায় গিয়েছিলেন তুমি জানো? জিজ্ঞেস করল রাশেদ। রাজু উঠে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।

এরিকের আমতা আমতা করা দেখে আর দেরি করলো না রাশেদ, আরো একটা একশ ডলারের নোট ঢুকিয়ে দিলো মেনুবইয়ের ভেতর।

দুটো জিপ নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন তারা, আশপাশে তাকাল এরিক, ড্রাইভারদের মধ্যে একজন ফেরত এসেছে, আরেকজন অবশ্য ফেরেনি এখনো।

যে ড্রাইভার ফিরে এসেছে তাকে চেনো? কোথায় পাওয়া যাবে? উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল রাশেদ।

ওকে দিয়ে কি করবে? ওর জিপ নাকি নষ্ট।

তারপরও ওকে আমাদের দরকার।

ঠিক আছে, আমি ওকে চিনি। রাতে তোমাদের রুমে পাঠিয়ে দেবো।

তাহলে এ কথাই রইলো, রাশেদ বলল।

টাকা দিয়েছো, কথার নড়চড় হবে না, হাসল এরিক, মেনুবইটা থেকে নোট দুটো সরিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি।

হোটেলের বাইরে এসে দাঁড়াল রাশেদ, রাজুও আছে পাশে। রাতের খাবারটা আশপাশের কোন রেস্টুরেন্টে সেরে নিতে হবে। জরুরি একটা কাজও সেরে নেয়া দরকার। ড. আরেফিনের স্ত্রীকে ফোন করে তার বর্তমান অবস্থান জানানো প্রয়োজন, তিনি হয়তো চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। নেপালে কেনা সিমগুলো এই সীমান্ত এলাকায় কাজ করার কথা থাকলেও কাজ করছে না।

কাল সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে, এখানে সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। ড. কারসনের দল অনেকটা এগিয়ে গেছে, ঐ দলটাকে ধরতে পারলেই ড. আরেফিনের খবর জানা যাবে। এরিকের উপর ভরসা আছে, রাতে নিশ্চয়ই জিপের ড্রাইভারকে পাঠাবে। ওর কাছেই খবর পাওয়া যাবে ড. কারসন কোনদিকে গিয়েছেন। এই এলাকায় শীত তুলনামূলকভাবে কম, আকাশে মেঘ নেই, মৃদুমন্দ বাতাসে মনটা ভালো হয়ে গেল রাশেদের। শিস দিতে দিতে হাঁটতে থাকল। অনেকদিন পর বন্ধুর মনটা ভালো দেখে হাসি ফুটে উঠলো রাজুর মুখে।

***

আরেকবার অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাল সোহেল। এরকম একটা ছেলে পাশে থাকলে কোনকিছু নিয়েই বেশি চিন্তা করতে হয় না। দুপুরের দিকে রাশেদ আর তার বন্ধু তিব্বতে ঢুকেছে বলে খবর পেয়েছেন তিনি। সীমান্ত পার করার জন্য তর সইছিল না তার, শিকার এর আগে হাতছাড়া হয়েছে কয়েকবার। এবার যদি সীমান্ত পার করতে না পারেন তাহলে হয়তো ওরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবে। আহমদ কবিরের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল, নিজ হাতে ওদের হাতে স্পেশাল পাস তুলে দিয়েছে। তবে লোকটা বোকা হলেও অনুগত। তবে এটাই আহমদ কবিরের শেষ ক্ষমা, এরপর আর কোন ভুল হলে সাথে সাথে শাস্তি দেবেন তিনি, সেই শাস্তি হবে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ।

চোরাকারবারিরা পরস্পরের বন্ধু, ঠিক সেরকম বন্ধু জুটিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি সোহেলের। শুধু অপেক্ষা ছিল রাত হওয়ার, একদল ছিঁচকে চোরাকারবারির দলে মিশে যেতে অস্বস্তি হলেও আপাতত তা গ্রাহ্য করলেন না আকবর আলী মৃধা। কাজ উদ্ধার হওয়া দিয়ে কথা।

ঠিক নয়টার কিছুটা পরপর তিব্বতে ঢুকলেন তিনি। বেশ কিছু টাকা অবশ্য খরচ করতে হয়েছে, কিন্তু তাতেও আপত্তি নেই। বরং ওদের প্রাপ্য টাকার চেয়ে কিছু বেশিই দিলেন। শীতে কাঁপছিলেন, ছোটখাট একটা খাল পার করতে হয়েছে এখানে আসতে গিয়ে। সারা শরীর এখনো ভেজা, একটা ব্যাগে করে শুকনো কাপড় নিয়ে এসেছিল আহমদ কবির।

চোরাকারবারি দলটা চলে গেছে, একজনকে গাইড হিসেবে রেখে দিয়েছে সোহেল, নেপালি ছেলে, অল্পবয়স্ক, সাধারনত বোঝাবহনের কাজ করে। আহমদ কবিরের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে ঝোঁপের আড়ালে চলে গেলেন তিনি। একটু পর বেরিয়ে এলেন, বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছিল তাকে। আহমদ কবির আর সোহেলও কাপড় পালটে নিলো কিছুক্ষনের মধ্যে।

সীমান্ত শহর ঝাংমু কাছেই, হোটেলে উঠতে গেলে কিছু নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। তাই আপাতত সেই ঝামেলায় যাবেন না বলে ঠিক করেছেন আকবর আলী মৃধা। আজ রাতটা এই জঙ্গলে কাটিয়ে দেবেন। ভোরে উঠে ঝাংমুতে যাবেন। রাশেদ আর তার বন্ধু নিশ্চয়ই শুধুমাত্র ঝাংমুতে আসার জন্য এতো ঝামেলা করেনি। ওরা ঝাংমু ছাড়ার আগেই ওদের ধরতে হবে।

*

অধ্যায় ৪৫

শিকার করতে ভালো লাগে মিচনারের, গন্ধ শুঁকে এঁকে শিকার খুঁজে নেয়ার আলাদা আনন্দ আছে, পৃথিবীর আদিমতম সুখ এই শিকারেই। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই গুম্ফা থেকে বেরিয়ে এসেছে সে, অনেকদূর হেঁটেছে, কোন তাড়াহুরা করছে না। প্রতিপক্ষের সামনে অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে চায় না কোনভাবেই। তিনজন মানুষের পায়ের ছাপ পরিস্কার চোখে পড়ছে, এমনকি পায়ের ছাপ লুকানোর বা মুছে ফেলার কোন চেষ্টাই করা হয়নি। ব্যাপারটা কি সাজানো? কোন ধরনের ফাঁদ? তাকে ভুল পথে চালাতে চায়? এর আগেও তিনজনের পায়ের ছাপ পেয়েছে মিচনার, তবে কখনোই এতোটা স্পষ্ট নয়। প্রতিপক্ষের সাথে সঙ্গি আছে দুজন, একজনকে সে দেখেছে, গোঁফ-দাড়িওয়ালা একজন সন্ন্যাসী, অন্যজনকে দেখেনি, তবে পায়ের ছাপ দেখে আন্দাজ করতে পারছে লোকটা বেশ স্বাস্থ্যবান এবং লম্বা।

সকাল থেকে ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু শিকার করার মতো কিছু এখনো চোখে পড়েনি। এতো উঁচুতে খুব কম প্রানীই চোখে পড়ে, তবে দূরে যে প্রানীটা চোখে পড়ল তাতে নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিল না মিচনার। একজন মানুষ!

ভারি পোশাক পরনে, সাথে ব্যাগ-বোঁচকাও আছে। ডান হাতে একটা লাঠি, একটু আড়ালে দাঁড়াল মিচনার, এমন জায়গায় নগ্নগাত্র একজন মানুষকে দেখলে যে কেউ অবাক হবেই। লোকটাকে কোন সুযোগ দেয়া যাবে না, অতর্কিতে হামলা করতে হবে। একপাশে খাদ খাড়া হয়ে নীচে নেমে গেছে, ঐদিক থেকে পালানোর পথ নেই, তাকে অতিক্রম করেই যেতে হবে লোকটাকে। আরো কিছুদূর আসার পর লোকটার অবয়ব আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। বেশ স্বাস্থ্যবান এবং লম্বা, তার প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় সঙ্গি এই লোকটা। কিন্তু এখানে একা একা কি করছে? পালাচ্ছে সঙ্গিদের রেখে? নাকি সঙ্গিরা পেছনেই আছে? সতর্ক হওয়ার প্রয়োজনবোধ করছে মিচনার, একটা পাথরের আড়ালে এমনভাবে দাঁড়াল খুব কাছ থেকে না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না সেখানে কোন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার, মনে হচ্ছে। অনেকদূর হেঁটে এসেছে, বারবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, সম্ভবত বিপদের আশংকা করছে।

হ্যাঁ, বিপদ তার জন্য ঘাপটি মেরে আছে। নিজের শরীরে অনেকদিন পর একধরনের উত্তেজনা অনুভব করল মিচনার। শিকার করার সময়ই কেবল এমন অনুভূতি হয়। এখন শুধু অপেক্ষা, শিকারের ক্ষেত্রে ধৈৰ্য্য একটা বড় জিনিস। দীর্ঘদিন এই শিকারের উপর ভরসা করেই চলতে হয়েছে তাকে, মাঝে কিছুসময় সভ্যমানুষের সমাজে ঠাঁই হয়েছিল। সে জীবনে যখন বিতৃষ্ণা এসে যাচ্ছিল তখনই দেখা শুরুর সাথে। আকবর আলী মৃধার কথা ভাবতেই দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো মিনারের বুক চিরে। এখানে সব কাজ শেষ হলে আবার হয়তো সেখানেই ফিরে যাবে সে, যদি সব ঠিকঠাক থাকে।

সকালটা রোদ্রকরোজ্জ্বল ছিল একটু আগেও, এখন মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করেছে, অন্ধকার হয়ে আসছে চারপাশ, এর আগে হিন্দুকুশ পর্বতমালায় দীর্ঘদিন কাটিয়ে আবহাওয়ার এই লক্ষনগুলো ভালোই চেনে মিচনার। যেকোন সময় তুষারঝড় শুরু হতে পারে। শিকার হাতছাড়া হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে তাহলে।

বেশ কাছাকাছি চলে এসেছে লোকটা। পেছনে কেউ নেই, থাকলে এতোক্ষনে দেখা যেত। সম্ভবত দলত্যাগ করেছে লোকটা, নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে যাচ্ছে যে পথে এসেছিল। পাথরের আড়াল থেকে বেরুল মিচনার, লোকটা এখনো তাকে দেখতে পায়নি,অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দৌড় দিল মিচনার, লোকটার কাছ থেকে পাঁচ ফুট দূরত্ব থাকা অবস্থায় ঝাঁপ দিল শিকারকে লক্ষ্য করে।

আচমকা আঘাতে পড়ে গেল লোকটা, বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে, এলোপাতাড়ি হাত-পা ছুঁড়ে মিচনারকে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শক্ত করে লোকটার গলা আঁকড়ে ধরেছে মিচনার। লোকটা সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে গলা থেকে হাতের বাঁধন ছাড়াতে, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পা দিয়ে ক্রমাগত মিনারের শরীরে লাথি দিচ্ছে, কিন্তু পাথরের মতো শরীর মিনারের, কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।

আমাকে মেরে কি লাভ তোমার? আর্তনাদ করে বলল বিনোদ চোপড়া, মিচনারকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে এখনো।

উত্তর দিলো না মিচনার, লাভ-লোকসানের বিবেচনা সে শেষ কবে করেছে এই বোকা লোকটা তা জানে না।

আমি তোমাকে অনেক টাকা দেবো, এবার লোভ দেখানোর চেষ্টা করল বিনোদ চোপড়া।

লোকটাকে পুরোপুরি নিজের আয়ত্ত্বের মধ্যে নিয়ে এসেছে মিচনার, বুকের উপর বসে আছে সে, দুই হাতে গলা টিপে ধরে আছে।

তোমার শত্রু খুব কাছাকাছি আছে, আমি তোমাকে চিনিয়ে দেবো, শেষ চেষ্টা করল বিনোদ চোপড়া। তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, চেহারা টকটকে লাল হয়ে গেছে।

উত্তরে কোন কথা বলল না মিচনার। এতো শক্ত করে গলা টিপে ধরেছে যে মট করে একটা আওয়াজ হলো। লোকটার সারা শরীর কাঁপল কিছুক্ষন, তারপর সব থেমে গেল।

শিকারকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল মিচনার। লোকটার চোখ এখনো খোলা, মুখ হা হয়ে আছে, বড় বড় চোখ খোলা, সেখানে জমে আছে রক্ত আর অবিশ্বাস।

লাশটাকে পা দিয়ে ঠেলে খাদের পাশে নিয়ে গেল মিচনার। তারপর নীচে ফেলে দিলো। কয়েক হাজার মিটার উপর থেকে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগে, লাশ ফেলার পর ব্যাগপত্রও ফেলল, এগুলো তার কোন কাজে আসবে না কোনদিন। খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে হাজার মিটার উপর থেকে লাশটাকে নীচে পড়তে দেখল, সরাসরি পানিতে পড়েছে। হিমশীতল পানি, যদিও তা টের পাবে না মৃত মানুষটা।

অনেকদিন পর কেমন শান্তি অনুভব করছিল মিচনার, সহজ শিকার হলেও নিজের বন্য প্রবৃত্তিটা এখনো যায়নি দেখে ভালো লাগছে। প্রতিপক্ষ কাছাকাছি আছে, হাঁটতে শুরু করল।

***

রাতেই জিপ ড্রাইভারের কাছে সমস্ত তথ্য জেনে নিয়েছিল রাশেদ। ড. কারসন আর তার দলকে কোথায় রেখে এসেছে, কবে রেখে এসেছে সব তথ্য দিয়েছে ড্রাইভার লোকটা। বিনিময়ে ভালো বখশিশ দিয়েছে রাশেদ। এমনকি ভোরে জিপ নিয়ে তৈরি থাকতে বলেছে ড্রাইভারকে। ড. কারসনদের যেখানে রেখে এসেছিল সেখানেই রেখে আসতে হবে তাদেরকে। তবে একটা ব্যাপারে হতাশ রাশেদ। ড. আরেফিনের কোন উল্লেখ করেনি ড্রাইভার। ড. আরেফিন ছিলই না দলটার সাথে। তিনি যদি ড. কারসনের সাথে না গিয়ে থাকেন, তাহলে কোথায় তিনি? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া। কঠিন, একমাত্র ড. কারসনই হয়তো বলতে পারবেন। অন্তত দুদিন লাগবে ড. কারসন যেখানে ছিলেন সেখানে যেতে। এই কদিনে ড. কারসন তার দলবল নিয়ে নিশ্চয়ই আরো কিছুটা পথ এগিয়ে যাবেন। যতোই ভাবছিল ততোই মেজাজ খারাপ হচ্ছিল রাশেদের। ড. কারসনের সাথে যোগাযোগের অন্য কোন পথ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু ড. কারসন যেখানে গেছেন সেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করে না।

ভোর হওয়ার আগেই তৈরি রাশেদ আর রাজু। হোটেলের বাইরে জিপ দাঁড়ানো ছিল। হোটেলের বিল শোধ করে রওনা দিয়ে দিল ওরা। সামনে অনেক পথ। যতো তাড়াতাড়ি পৌঁছাবে ড্রাইভারকে ততো বেশি বখশিশ দেয়া হবে বলে ঘোষনা করল রাশেদ। ফলাফল হলো চমৎকার। সাধারনত ধীর গতিতে চালিয়ে অভ্যস্ত ড্রাইভার, কিন্তু এখন খালি রাস্তায় প্রচন্ড গতিতে চলছে জীপটা।

***

রাশেদ আর রাজু হোটেল থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পর আরেকদলকে হোটেলে ঢুকতে দেখা গেল। চারজনের দলে একজন নেপালি, বাকি তিনজন বাঙ্গালি। একটু পরেই বেরিয়ে এলো সবাই। এর মধ্যে বয়স্ক মানুষটাকে ছটফট করতে দেখা যাচ্ছে। হাত দুটো মুঠো হয়ে আছে, অব্যক্ত রাগে ফুটছে মানুষটা।

সোহেল, আবারও হাতের নাগালের মধ্যে এসেও ছুটে গেল ওরা, রাগে ক্ষোভে কি বলবেন বুঝতে পারছেন না আকবর আলী মৃধা।

জি, বস।

কোথায় গেছে জানো?

রিসেপশনিষ্টকে কিছু দিয়েছি, ওর ধারনা কৈলাস রেঞ্জের দিকে গেছে।

কৈলাস রেঞ্জ! আমরাও যাবো, ব্যবস্থা করো এক্ষুনি, গর্জে উঠলেন আকবর আলী মৃধা।

কিন্তু এতো সকালে জিপ বা অন্য কিছু পাবো না আমরা, অসহায়ের মতো বলল সোহেল।

বেশি টাকা দাও, আমি এক্ষুনি রওনা দিতে চাই।

বসের কথার উপর আর কথা চলে না। হোটেলের লবিতে আকবর আলী মৃধা আর আহমদ কবিরকে বসতে বলে নেপালি ছেলেটাকে নিয়ে বাজারের দিকে এগুলো সোহেল। এখনো সব দোকান-পাট খোলেনি,এছাড়া এখানে কোথায় কি পাওয়া যায় সে সম্পর্কেও ধারনা নেই তার। নেপালি ছেলেটাকেও যথেষ্ট বোকা মনে হচ্ছে। একটাই উপায় আছে, হোটেলে ফিরতে হবে। রিসেপশনিষ্টকে বললে নিশ্চয়ই গাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যাবে, শুধু একটু বেশি খরচ করতে হবে।

*

অধ্যায় ৪৬

চুপচাপ বসে আছেন ড. কারসন। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। এরমধ্যে হেঁটে যাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষ করে ক্রমেই উপরের দিকে উঠছেন এখন দলটা নিয়ে। দলের সবাই খুব বেশি অভিজ্ঞ না, তবে লতিকাকে নিয়ে যে চিন্তা ছিল তা অমূলক প্রমানিত হয়েছে। মেয়েটা শুরুতে একটু আড়ষ্ট থাকলেও যতো দিন যাচ্ছে তত স্বাভাবিকভাবে তাল মেলাচ্ছে দলের সবার সাথে। সুরেশকে নিয়ে একটু চিন্তা ছিল, কিন্তু বেশ স্বাভাবিক আচরন করছে সুরেশ, যেন ভুলে গেছে তাকে বাদ দিয়েই এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন ড. কারসন।

লক্ষ্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছেন ড. কারসন। শুরু থেকেই তিনি জানতেন ঠিক কোথায় খুঁজতে হবে। তারপরও সময় নিয়েছেন, নিশ্চিত হতে চেয়েছেন, ম্যাকলডগঞ্জে যাওয়াটা ছিল সেই পরিকল্পনার অংশ। তাতে নিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এছাড়া দেখতে চেয়েছিলেন কেউ তার এই অভিযানে বাঁধা দিতে এগিয়ে আসে কি না। বাঁধা এসেছে, ঠিক যেমনটি তিনি আশা করেছিলেন। ড. আরেফিনকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের উপরও লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। সাম্ভালাকে আধুনিক পৃথিবী থেকে যারা দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তারা হাজার বছর ধরেই সক্রিয়, তাদের শেষ শিকার হয়েছিল নাৎসি পার্টির তিন কর্মকর্তা। যাদের একজন তার জন্মদাতা পিতা। নথি-পত্ৰ বা কাগজে কোথাও নেই কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেই তিনজন। কিন্তু তিনজন মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। নাৎসি পার্টির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কার্যকলাপের বেশ কিছু গোপন দলিল হস্তগত হয়েছে তার। হিমলারের নির্দেশে তিব্বতে যেসব অভিযান চলেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে, সেগুলোর নিখুঁত বিবরন ছিল সেই গোপন দলিলগুলোতে। সেখানেই প্রথম সাম্ভালার নাম শোনেন তিনি। কার্ল হসেনহফ, ফেলিক্স একহার্ট আর এডলফ শেফারের গোপন মিশনের কথা পরিস্কার লেখা আছে সেখানে, সাম্ভালা খুঁজতে গিয়ে যে তারা হারিয়ে যায়, সেটাও সেখানে লেখা। যদিও অফিসিয়ালি সবাইকে জানানো হয়েছে তারা নিখোঁজ। আর কোন ব্যাখ্যা বা তথ্য দেয়া হয়নি।

শুধু নিজের বাবার শেষ কাজ সফলভাবে শেষ করার জন্য নয়, একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে এমন একটি স্থানের খবর পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়া তার নৈতিক দায়িত্ব। এছাড়া জার্মান জাতির বর্তমান দৈন্যতার কারনও খুঁজে বের করেছেন তিনি। এর পেছনে দায়ি হচ্ছে ইহুদীরা। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সমরে ইহুদীদের চির আধিপত্য ভেঙে দিতে চান তিনি। সাম্ভালা খুঁজে পেলে জার্মান জাতিকে আবার পুরানো গৌরব তিনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন, শক্তিশালী একটি মানব গোষ্ঠী তৈরি করতে পারবেন, যারা পুরো পৃথিবী শাসন করবে। তিনি পুরো বিশ্বকে একটি পতাকার নীচে সমবেত করতে চান, সেটি হবে জার্মান পতাকা। সারা জীবন আমেরিকা আর ইউরোপে বড় হয়েও ইদানিং মনে প্রানে তিনি নিজের আসল শেকড়ের টান অনুভব করেন। তিনি একজন আর্য, একজন জার্মান, বিশুদ্ধ রক্ত বইছে তার শরীরে। এছাড়া আধুনিক থুল সোসাইটির প্রানপুরুষ তিনি। সেই সোসাইটির কার্যপরিধিও বাড়ছে দিন দিন। থুল সোসাইটিকে শুধু জার্মানীতে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি পুরো ইউরোপে বিস্তৃত করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

লতিকা আর সন্দীপ পাশাপাশি বসে আছে দূরে। সুরেশ ব্যস্ত আগুন জ্বালাতে, বাতাসের তোড়ে আগুন নিভে যাচ্ছে বারবার। এক কাপ কফি দরকার, সুরেশের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি।

লতিকার মন কিছুটা খারাপ ছিল সকালে যখন শুনলো আবহাওয়া খারাপ তাই আজ এখানেই অপেক্ষা করবেন ড. কারসন। একঘেয়ে লাগছিল, কথা বলার মতো মানুষ নেই একেবারে, সুরেশ কাজ নিয়ে ব্যস্ত, ড. কারসন তার তাঁবুতে। সন্দীপ এসে যখন পাশে বসল খুব একটা খারাপ লাগল না লতিকার।

বেশ কিছুক্ষন কেটে গেল চুপচাপ, কেউ কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না, শুরু করলো লতিকাই।

তোমার ছেলে কতো বড় হয়েছে? খুব স্বাভাবিক গলায় প্রশ্ন করলো লতিকা।

পাঁচে পড়েছে কিছুদিন হলো।

খুব দুষ্টু নাকি?

না, তেমন না।

আচ্ছা, আর বৌ কেমন আছে? কি নাম যেন ওর? সন্দীপ তাকাল, উত্তর দিলো না।

কি হলো বললে না যে?

বাদ দাও ওদের কথা, তোমার কথা বলো।

আমার আর কি কথা, জার্মানীতে থাকি, ইউনিভার্সিটিতে পড়াই, বিয়ে করিনি এখনো।

করবে না?

তোমার কি ধারনা তোমাকে না পাওয়ার শোকে বিয়ে করছি না? হাসল লতিকা, বিয়ে করবো যে কোন সময়। পাত্র প্রস্তুত।

তাই? খুব ভালো। পাত্র কে? কি করে?

সময়মতো দেখতে পাবে, লতিকা বলল, ড. কারসনকে সুরেশের দিকে এগিয়ে আসতে দেখল।

লতিকাও উঠলো, যাই, কফি হচ্ছে, গরম গরম খেতে ভালো লাগবে।

চুপচাপ বসে থাকল সন্দীপ। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে লতিকা বেশ অবহেলাই করলো তাকে, কিন্তু এটাই হয়তো নিয়ম। একসময় লতিকাকে ছেড়ে সেই চলে এসেছিল। আজ কি খুব আফসোস হচ্ছে? নিজেকে প্রশ্ন করলো সন্দীপ। কিন্তু এর উত্তর জানার আগ্রহ তার নিজেরও নেই খুব একটা।

ধীর পায়ে সুরেশের দিকে এগিয়ে গেল সন্দীপ, এই প্রচন্ড শীতে এক কাপ কফি তারও খুব দরকার।

***

অদ্ভুত আলো, অদ্ভুত সেই পাত্র, যার ভেতর নীলাভ তরল। পোকামাকড় যেভাবে আলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে অন্ধের মতো এগিয়ে যায়, সেভাবেই পা বাড়িয়েছিল মিনোস। শেষমুহূর্তে নিজেকে সামলাল। আলোকবর্তিকার চারপাশে পাক খেল। একটু আগেও স্বচ্ছ পাত্রটাকে মনে হয়েছিল আলোকবর্তিকার বাইরে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পাত্রটা ভেতরে। ওটা আনতে গেলে অবশ্যই আলোকবর্তিকার ভেতর ঢুকতে হবে। ঝুঁকিপূর্ন কাজ জীবনে অনেক করেছে মিনোস। কিন্তু…

বৃদ্ধের সাথে হওয়া শেষ কথোপকথন মনে পড়ে গেল। তিনি চেয়েছিলেন, অন্তত বৃদ্ধের চাওয়াটুকু পূরন করতে হলেও ঝুঁকিটুকু নেয়া উচিত হবে তার। আরো কয়েকবার আলোকবর্তিকার চারপাশে ঘুরল, চক্রাকারে। গোলাপী যে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে তা উত্তাপহীন, বরং কাছে গেলেই কেমন কোমল একটা অনুভূতি হচ্ছে। হয়তো এটা কোন ফাঁদ, একবার ভেতরে পা দিলে এখানেই আটকে যেতে হবে, কিংবা আপাতদৃষ্টিতে উত্তাপহীন মনে হলেও একবার পা দিলেই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে সে। অথবা অন্যকিছুও ঘটতে পারে।

নিজের অজান্তেই পা বাড়াল মিনোস। অদ্ভুত… পুড়ে যাওয়া বা আটকে যাওয়ার মতো কোন অনুভূতি হলো না। বরং কেমন শীত অনুভব করলো। চোখ বন্ধ রেখেছিল এতোক্ষন, চোখ খুলে তাকাল। চারপাশ কেমন মোহময় মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে সে আকাশে ভাসছে, পাখির মতো, ডানা মেলে, নীচে বিস্তৃত পৃথিবী দেখছে, পাহাড় সমুদ্র,বরফে ঘেরা পাহাড়, চকচকে দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমি, সব কিছু তার চোখের সামনে ভাসছে। মাঝে মাঝে মানুষ চোখে পড়ছে, কোথাও উৎসবে মেতে আছে, কোথাও একে অন্যের বুকে ছুরি বসাচ্ছে। অদ্ভুত হলেও সত্য, বৃদ্ধ অভিভাবককে সে দেখতে পাচ্ছে, ছোট একটি ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে, পরনে শুভ্র পোশাক, হাতে সেই লম্বা লাঠি। ছেলেটি চঞ্চল, বারবার এদিক-সেদিক যেতে চাচ্ছে, বৃদ্ধ হাসিমুখে যেতে দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। ছবির মতো চোখের সামনে সব ভাসছে। পাহাড়ের উপত্যকায় সেই গ্রাম, যেখানে বাবা-মা, ভাই-বোন সব উপরের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন দেখছে তাকে, হাসছে, হাত নাড়ছে। একটু দূরেই পাহাড়ের লুকানো গুহা থেকে ভেড়ার পাল নিয়ে আসছে এক কিশোর। নিজেকে চিনতে খুব একটা কষ্ট হলো না মিনোসের। মনে হচ্ছিল চলতে থাক এই অদ্ভুত দৃশ্যকল্প, সারাজীবন ধরে। কিন্তু হঠাৎ করেই থেমে গেল সব, বরং সেখানে এবার দেখা যাচ্ছে শুধু অদ্ভুত সাদা আলো। সেই আলোয় চারপাশের কিছু দেখা যাচ্ছে না, গমগমে একটা কণ্ঠস্বর একঘেয়ে সুরে কিছু বলে যাচ্ছে, কিন্তু ভাষা বুঝতে পারছে না মিনোস।

নিজের মাঝে অদ্ভুত পরিবর্তন অনুভব করছে। বেশ সতেজ লাগছে, বয়সের কারনে শরীর কিছুটা ভারি হয়ে গিয়েছিল। এখন মনে হচ্ছে শরীরে কোন মেদ নেই, একদম ঝরঝরে অনুভব করছে। মুখে হাত বুলাল। ত্বক এতো সতেজ কবে ছিল মনে করতে পারল না সে। পায়ের নীচের দিকে স্বচ্ছ নীলাভ পাত্রটা চোখে পড়ল। ঝুঁকে তুলে নিলো জিনিসটা। বেশ ভারি মনে হচ্ছে। মাটির বড় বড় পাত্রে যেমন পানি রাখা হয়, পাত্রটা অনেকটা সেরকম। ভেতরে রাখা নীলাভ তরলের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষন, স্বচ্ছ, ঘন এই তরলের নিশ্চয়ই কোন কাজ আছে, সেটা কী তা জানতে হবে।

উপরের ঢাকনা খুলে ঘ্রান নেয়ার চেষ্টা করল মিনোস। চমৎকার গন্ধ জিনিসটার। এতোদিনে সাধারন একটা ধারনা হয়েছে মিনোসের, সুগন্ধযুক্ত জিনিস খাদ্য হিসেবে খুব একটা খারাপ হয় না। আঙুল দিয়ে এক ফোঁটা তরল তুলে নিলো। চারপাশে তাকাল, এখন কোথাও কোন আলো নেই, গমগমে কণ্ঠস্বর নেই। অস্বাভাবিক নীরবতা চারদিকে। যেন সব থেমে আছে, কোন কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে।

আঙুলটা মুখে পুরল মিনোস, কিছুক্ষনের জন্য মনে হলো এমন কোন কিছুর স্বাদ সে কখনো নেয়নি। টক, মিষ্টি, ঝাল, পানসে কিংবা লবনাক্ত, এই স্বাদকে ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সব কিছু মিলিয়ে এমন অভাবিত স্বাদ কখনো পায়নি সে।

আলোকবর্তিকার মধ্যে অবস্থান করছিল মিনোস, অবাক হয়ে দেখল তার চারপাশের গোলাপী আলো মিলিয়ে যাচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করছিল, দুপায়ের উপর কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে সে, কিন্তু কততক্ষন দাঁড়াতে পারবে বুঝতে পারছিল না। চারপাশের সব কিছু কেমন বদলে যাচ্ছে। চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। ঘুম আসছে তার, গভীর ঘুম।

ঘুম যখন ভাঙল ধড়মড় করে উঠে পড়ল মিনোস। চারপাশে চমৎকার দিনের আলো। খোলা জায়গায় শুয়েছিল সে। একটু দূরেই নদীতীরে তার নৌকাটা বাঁধা। এতোক্ষন কি তাহলে সে কোন স্বপ্ন দেখছিল, ভাবল মিনোস। মাথাটা কেমন ভারি ভারি লাগছিল। কতক্ষন ধরে ঘুমাচ্ছে সে, একঘন্টা, দুঘন্টা, একদিন… নাকি… সব বাস্তব! স্বপ্নই হবার কথা, কারন দূর দূর পর্যন্ত কোন পাহাড় চোখে পড়ছে না, পোড়ামাটির ফলকে যেমন আঁকা ছিল কিংবা তার সাথে নীল তরলে পূর্ন কোন স্বচ্ছ পাত্রও নেই। দিনে দুপুরে অদ্ভুত স্বপ্ন দেখার জন্য বেশ লজ্জা লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে নৌকার কাছে চলে এলো সে। অদ্ভুত সব জিনিসের পেছনে দৌড়ে বেড়ানোর অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে, বৃদ্ধের সব কথাই যে সত্যি ছিল তা নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো বৃদ্ধের চিন্তাভাবনা পুরোই অমূলক।

তার ভুল ভাঙল নৌকার কাছে গিয়ে। নৌকার পাটাতনে চমৎকার স্বচ্ছ পাত্রটা শোভা পাচ্ছে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। লখানিয়া সিং নামটা যেখান থেকে পেয়েছিলেন সেই গ্রামে আপাতত রেখে এসেছেন এই স্বচ্ছ পাত্র। বুড়ি মার বাড়ির পেছনে, ছোট একটা গর্তের মধ্যে। কাজটা বুদ্ধিমানের মতো করা হয়নি। কখন কি ঘটে যায় তা কে বলতে পারে, তবে তার যাবতীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে ঘোরাঘুরি করাও কঠিন। এখানকার কাজ শেষ হলে বুড়ি মার কাছে ফিরে যাবে সে, লখানিয়া সিং হয়ে কাটিয়ে দেবে যতোদিন সম্ভব।

সঙ্গি এখন কেবল যজ্ঞেশ্বর, বিনোদ চোপড়া চলে যাওয়ার পর বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে সন্ন্যাসী। প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। দুপুরের পরপর এই সময়টায় প্রকৃতি যেন ঝিম মেরে আছে, একটা গোলগাল পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর একটু দূরে ধ্যানে বসেছে, নিজের মাঝে আবার ডুব দিলেন তিনি।

সেই স্বচ্ছ পাত্র নিয়ে ফিরে এসেছিলেন নিজের গ্রামের পাশের সেই পাহাড়ের গুহায়। তারপর একসময় বেড়িয়ে পড়েছেন পুরো পৃথিবী ভ্রমনে, বদ্ধ অভিভাবকের সাথে অনেক জায়গায় যাওয়া হয়েছিল তার, সেই এলাকাগুলো আবার নতুন করে দেখেছেন, কখনো মিনোস, কখনো বা অন্য নামে পরিচিত হয়েছেন মানুষের সাথে। কৌতূহলকেই কেবল জয় করতে পারেননি, জ্যোর্তিবিদ্যা, চিকিৎসাশাস্ত্র, হস্তরেখা, সমুদ্রবিজ্ঞান, শস্যবিজ্ঞান, অ্যালকেমী, সঙ্গিত, সব শাখাতেই ছিল তার অদম্য আগ্রহ। সাধারন মানুষ হিসেবে যখনই মানুষের উপকার করতে গিয়েছেন, বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। তাকে কালো জাদুকর, পিশাচ, শয়তানের দূত ইত্যাদি নানা অপবাদে অভিযুক্ত করেছে সেইসব দিনের মানুষেরা। যারা চাঁদ, সুৰ্য্য, সাপ, বাতাস, পানি, আগুন সব কিছুকেই আলাদা আলাদাভাবে পূজা করতো, দেবতাজ্ঞান করতো, সেখানে তার কর্মকান্ড ছিল নিতান্তই সাদামাটা। তাই কৌশল পরিবর্তন করা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। সাধারন মানুষদের যারা সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে তাদের দলে তিনি যোগ দেন। এই দলে ছিলেন মন্দিরের পুরোহিত থেকে শুরু করে স্বয়ং রাজা অথবা রাণী। রাজকীয় ক্ষমতা না থাকলে সাধারন মানুষের উপকার করা ছিল অসম্ভব। বড় বড় রাজার দরবারে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছে দীর্ঘ এই জীবনে। এর মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, সাহস তার মনে দাগ কেটে গেছে।

চমৎকার বাতাস বইছে, চোখ খুললেন তিনি। উঠে দাঁড়ালেন। যজ্ঞেশ্বর এখনো ধ্যানে মগ্ন। বিপদের আশংকা করছেন তিনি। এখানে বেশিক্ষন থাকা ঠিক হবে না। যজ্ঞেশ্বরের কাঁধে ঝাঁকি দিলেন, চোখ মেলে তাকাল যজ্ঞেশ্বর, শুন্য দৃষ্টিতে, কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, আমি জানি বিনোদ আর বেঁচে নেই।

অবশ্যই বেঁচে আছে, উঠুন যজ্ঞেশ্বর জী, আমাদের আবার যেতে হবে।

আমি যাবো না, এখানেই থাকবো।

আপনি যাবেন, এখানে বসে থাকার জন্য আপনি আমার সাথে আসেননি।

কিন্তু আমার উদ্দেশ্য পূরন হবে না আমি জানি, স্লান সুরে বলল যজ্ঞেশ্বর।

অবশ্যই পূরন হবে, আমি কথা দিচ্ছি, হাত ধরে টেনে উঠালেন যজ্ঞেশ্বরকে, অল্প কিছু জিনিসপত্র সাথে নিতেই হবে, সেগুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিলেন।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দিন দিন উচ্চতার দিকে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে তাই শ্বাস কষ্ট হয় যজ্ঞেশ্বরের। যজ্ঞেশ্বরকে দেখে মনে হলো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তারপরও সন্ন্যাসীকে এখানে রেখে যেতে সায় দিচ্ছে না মনে। বিনোদ চোপড়ার ভাগ্যে কি ঘটেছে কিংবা কি ঘটবে তিনি জানেন না, কিন্তু যজ্ঞেশ্বর যতোক্ষন তার পাশে থাকবে তার কোন ক্ষতি তিনি হতে দেবেন না। যজ্ঞেশ্বরের এক হাত নিজের কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। এমনিতে দেখলে ক্ষীণদেহ মনে হলেও ওজন নেহায়ৎ কম নয় সন্ন্যাসীর।

একটু আগেও আকাশ ছিল পরিস্কার, এখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আজ ঝড় হতে পারে, তেমন কিছু হওয়ার আগে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া দরকার।

*

অধ্যায় ৪৭

নিজেকে ফাঁসির আসামী মনে হয় মাঝে মাঝে, অন্ধকূপে বন্ধী করে রাখা হয়েছে, যেন যে কোন সময় তার মৃত্যু কার্যকর করা যায়। ফাঁসির আসামী তবু হয়তো জানে তার অপরাধ কি, কিন্তু নিজের অপরাধ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারনা নেই ড. আরেফিনের। সাম্ভালার খোঁজে তিব্বতে আসাই কি অপরাধ? অদ্ভুত হলেও এছাড়া আর কোন কারন বের করতে পারছেন না তিনি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব কিছু একই সাথে তার মাথায় ঘোরাঘুরি করে। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসেব করা হয়ে গেছে গত কিছুদিনে এই অন্ধকূপে থেকে। তাতে অন্তত একটি জিনিস পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন ড. আরেফিন, এভাবে মৃত্যু তার প্রাপ্য নয়, সারা জীবনে এমন কোন পাপ করেননি যার শাস্তি এভাবে পেতে হবে। এমনিতেই একটি শাস্তি তার মাথার উপর ঝুলছে, নিজের রক্তের কোন উত্তরাধিকার তিনি রেখে যেতে পারবেন না এই পৃথিবীতে। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি, আজ যদি তার একটা ছেলে থাকতো, অবশ্যই বাবার খোঁজে বেরিয়ে পড়তো। আফরোজা একা একা কি করে বেড়াচ্ছে কে জানে? এতোক্ষনে নিশ্চয়ই জেনে গেছে তিনি নিখোঁজ।

গতরাতে ভ্যান থেকে বের করে তাকে একটি তাঁবুতে রাখা হয়েছে। চোখে কালো কাপড় আর মুখে টেপ বেঁধে এখানে আনা হয়েছে তাকে। জায়গাটা বেশ উঁচুতে বুঝতে পারছেন। শোঁ শোঁ শব্দে শীতল হাওয়া টের পেয়েছেন, বুট জুতোতে টের পেয়েছেন বরফের অস্তিত্ব, এই লোকগুলো সম্ভবত সত্যি সত্যি ড. কারসনের দলের আশপাশে ঘাঁটি গেড়েছে। তাকে চোখে চোখে রাখার জন্য উপরে টেনে নিয়ে এসেছে। ধারনা ঠিক কি না বোঝার উপায় অবশ্য নেই। গত দুদিন ধরে বৃদ্ধ লামা কিংবা চ্যাঙ তার ধারে কাছে আসেনি। চ্যাঙের শেষ কথা অনুযায়ী আজ দুদিন শেষ হচ্ছে। ওরা তার কাছে কি চায় তা পরিস্কার করে বলেনি এখনো। তবে যেটুকু বুঝতে পেরেছেন ড. কারসনের দলের সাথে থেকে ওদের কাছে তথ্য পাচার করার জন্যই তাকে বলা হচ্ছে, বিশেষ করে সাম্ভালা খুঁজে নেয়ার ঝামেলাটা ওরা নিজেরা করতে চাইছে না। ড. কারসন যখন সাম্ভালা খুঁজে পাবেন তখনই দলবলসহ হামলা করবে তারা। এক্ষেত্রে ড. আরেফিনকে নিজেদের লোক হিসেবে ড. কারসনের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছে। কিন্তু ওরা জানে না, বেঈমানি অপছন্দ করেন ড. আরেফিন। জীবন দিয়ে হলেও কারো সাথে বেঈমানি করবেন না।

তাঁবুটা ছোটখাট, তাকে একটা খুটির সাথে শক্ত করে বেঁধে রেখে গেছে ওরা। অন্তত চার-পাঁচজনের কণ্ঠস্বর শুনেছেন, দলে অন্তত কুড়িজন আছে বলে ধারনা তার। বৃদ্ধ লামারও কিছু লোক আছে, যারা সাধারন বৌদ্ধ লামা, বয়সে তরুন এই ছেলেগুলো বৃদ্ধ লামার ইশারায় যে কোন কাজ করতে প্রস্তুত।

তাঁবুতে লোক ঢুকছে টের পেলেন তিনি। সম্ভবত চ্যাঙ, ওর উপস্থিতিটাই বেশ অদ্ভুত, শব্দ না করলেও টের পাওয়া যায়। বৃদ্ধ লামাও ঢুকেছেন সাথে।

চোখের উপর থেকে কালো কাপড় সরে গেল, মুখের টেপ টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলল কেউ। ছোট ছোট দুটো চেয়ার নিয়ে সামনে বৃদ্ধ লামা আর চ্যাঙ বসে আছে। বৃদ্ধ লামার মুখে কোন হাসি নেই, অন্যদিকে চ্যাঙের চোখে আনন্দ দেখতে পেলেন তিনি। তরুন অফিসার উত্তেজনায় কেমন টগবগ করছে, মুখিয়ে আছে কিছু করার জন্য।

তোকে দুই দিন সময় দিয়েছিলাম, সময় শেষ, হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল চ্যাঙ, যেন সত্যি সত্যি স্টপ ওয়াচে দেখে নিচ্ছে আটচল্লিশ ঘন্টা পার হয়েছে কি না।

কি চাও আমার কাছে?

বুদ্ধিমান মানুষ ইশারাতেই সব বোঝে, মি. আরেফিন, চ্যাঙ বলল, আমরা শুধু চাই তথ্য, সাম্ভালা খুঁজে পাবেন ড. কারসন, আমরা নিশ্চিত। তুই শুধু আমাদের সঠিক তথ্য পাচার করবি, ব্যস। অত্যাধুনিক কিছু জিনিস দেবো তোকে এই তথ্য পাচারের জন্য, কেউ বুঝতেও পারবে না জিনিসগুলোর কাজ কি, কিংবা আসলেই তুই আমাদের সাথে জড়িত কি না।

আমি তোমাদের সাথে জড়িত ছিলাম না, জড়িত হওয়ারও কোন ইচ্ছে নেই, বেশ কর্কশ কন্ঠে বললেন ড. আরেফিন, রাগে ক্ষোভে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে, বেয়াদব এই চায়নীজ অফিসারের গালে গোটা কয়েক চড় বসাতে পারলে ভালো লাগত।

দেখ, আরেকবার ভাব, সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না, আবার বলল চ্যাঙএকটু ঝুঁকে এলো তার দিকে, আমরা তোকে কিছু টাকাও দেবো।

মি. লামা তো আমাকে বলেছেন, তারা নাকি সাম্ভালার রক্ষক, বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বললেন ড. আরেফিন, এখন কী রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকা নিচ্ছেন?

উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে তাকালেন বৃদ্ধ লামা।

বেশ কিছু টাকা পাবি তুই, আরেফিন, বেশ নরম গলায় বলল চ্যাঙ, যে টাকা দিয়ে সন্তানহীন বৃদ্ধ জীবন চমৎকার কেটে যাবে।

তা নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না বদমাশ! চেঁচিয়ে বললেন ড. আরেফিন, খুঁটি থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু বাঁধন এতো শক্ত করে দেয়া হয়েছে একটুও ঢিলে করতে পারলেন না।

ড. কারসন আর তার দলের সবগুলোকে মারব, নিজের হাতে, বেশ জোরের সঙ্গে বলল চ্যাঙ, সবার আগে মারবো ঐ ভারতীয় ছুঁচোকে, তোর চোখের সামনে, তিলে তিলে।

উত্তর দিলেন না ড. আরেফিন, মিথ্যে হুমকিতে ভয় পাওয়ার লোক তিনি নন।

আমার কিছু করার নেই ড. আরেফিন, এবার বৃদ্ধ লামা বললেন চাপা গলায়, আমি অহিংসাতে বিশ্বাসী, তবে মাঝে মাঝে সত্যের পথে কিছু কিছু হিংসাত্মক কাজ করা লাগে।

আমাকে মেরে ফেলবেন, এই তো…।

কথা শেষ করতে পারলেন না ড. আরেফিন, বৃষ্টির মতো কিল-ঘুষিতে আক্রান্ত হলেন তিনি। চ্যাঙ একাধারে তাকে মেরে যাচ্ছে। তার মুখে একের এক ঘুষি পড়ছে, ক্রমেই রক্তাক্ত হয়ে উঠছে চেহারাটা। ঠোঁট ফেটে গেছে, চোখের পাপড়ি ফুলে গেছে, কোন কিছু অনুভব করছেন না তিনি। মনে হচ্ছিল ব্যথার অতল জলে হারিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চোখের কোন বৃদ্ধ লামাকে তাঁবু থেকে বের হয়ে যেতে দেখলেন, ধীর গতিতে। যাওয়ার আগে চ্যাঙকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলে গেলেন বৃদ্ধ লামা, আর দেরি করা যাবে না, কাল সকালেই আক্রমন করতে হবে।

মার থামিয়ে একমুহূর্তের জন্য বৃদ্ধ লামার কথা শুনল চ্যাঙ, তারপর ঘুরে তাকাল। ড. আরেফিনের চেহারায় ঘুষি দেয়ার মতো জায়গা নেই আর। বীভৎস রুপ ধারন করেছে এরমধ্যে। কোন মতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে লোকটা বুঝতে পেরে সোজা হয়ে দাঁড়াল চ্যাঙ।

তোকে মেরে ফেললে মজা শেষ! বলে তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল চ্যাঙ। দুজন রক্ষী এসে সাদা তোয়ালে দিয়ে ঢেকে দিল ড. আরেফিনের চেহারা।

***

একটানা চলছে জীপটা, গন্তব্য যেহেতু জানা আছে তাই চালাতে কোন সমস্যা হচ্ছে না ড্রাইভারের। এছাড়া বাড়তি বখশিসের একটা ব্যাপার আছে। সেই ভোরে রওনা দেয়ার পর একটানা চলেছে জীপ, দুই গ্যালন বাড়তি তেল নিয়ে রাখা আছে, যাতে জ্বালানি সমস্যা না হয়। শুকনো খাবার হিসেবে কিছু পাউরুটি, কলা, জ্যাম, পানির বোতল কিনে নিয়েছিল রাশেদ, রওনা দেয়ার সময়। এছাড়া ছোট দুটো তাঁবুও কিনে নিয়েছে রাতে বাইরে থাকার জন্য।

ঘুম পেলেও রাশেদ ঘুমায়নি এরমধ্যে, রাজু ঘুমাচ্ছে, মাঝে মাঝে রীতিমতো নাক ডাকছে। আশপাশের প্রকৃতি দেখার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই রাজুর। কোন পথে যাচ্ছে, আর কতোদূর বাকি প্রতিনিয়ত জানার চেষ্টা করছে রাশেদ, ড্রাইভার লোকটা হিন্দি কিংবা ইংরেজি খুব কম বোঝে। তবে এটুকু বোঝাতে পেরেছে রাশেদকে আরো অন্তত একদিন লাগবে জায়গামতো পৌঁছাতে।

সন্ধ্যার পরপর গাড়ি থামাতে বলল রাশেদ। ড্রাইভারের কথামতো একটা ঝোঁপের পাশে জীপটা লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে তাঁবু খাঁটিয়ে ফেলল রাজু, ঘুমে জড়িয়ে আসছিল রাশেদের চোখ। ড্রাইভারকে জিপে পাঠিয়ে দিয়ে তাবুর সামনে বসল দুজন। আগুন জ্বালিয়েছিল রাজু, সেটা জ্বলছে এখনো। ঘড়ির সময় অনুযায়ী বেশি রাত হয়নি। কিন্তু দীর্ঘসময় জীপে থাকার কারনে বেশ ক্লান্ত দুজনেই।

সকাল সকাল উঠেই রওনা দিতে হবে। ড. কারসন আর তার দলকে যেখানে রেখে এসেছিল এখনো নিশ্চয়ই সেখানে বসে নেই তারা। কাজেই যতো তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছাতে পারবে ততই মঙ্গল। ড. আরেফিনকে খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ড. কারসনের দলের সাথে দেখা করতে পারলেই জানা যাবে আসলে তিনি কোথায় আছেন, ড. আরেফিন এই দলের সাথে দিল্লি থেকে রওনা দিলেও তিব্বতের হোটেলে কেন মাত্র তিনজনের জন্য রুম বুক ছিল? প্রশ্নগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল রাশেদকে। আফরোজা আরেফিনকে কী জবাব দেবে যদি খালি হাতে দেশে ফিরতে হয়! তিনি অনেক ভরসা করে আছেন রাশেদের উপর।

আকাশ বেশ পরিস্কার। রাজু গান ধরেছে। ইশারায় রাজুকে থামতে বলল রাশেদ, এই পাহাড়ি এলাকায় কোথায় কোন বিপদ লুকিয়ে আছে বলা যায় না। এই মুহূর্তে কোন রকম ঝামেলায় পড়তে রাজি নয় রাশেদ। পেছনে এখনো আকবর আলী মৃধা লেগে আছে, সেই লোকটাকে কোনমতে খসাতে পারলেও সে যে তার পেছন পেছন এই পাহাড়ি এলাকায় এসে পড়বে না তার নিশ্চয়তা নেই।

বিষণ্ণমুখে বসে আছে রাজু, ইশারায় ওকে ঘুমাতে যেতে বলল রাজু। ঘড়িতে এখন আটটা বাজে। ঠিক বারোটা পর্যন্ত পাহারায় থাকবে সে। কাল ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে রওনা দিতে হবে।

***

টাকার লোভ সবারই আছে, আর বেশি টাকা দিলে তিব্বতের মতো জায়গায়ও যা খুশি তাই পাওয়া যায়। খুব বেশি কিছু চাননি আকবর আলী মৃধা, চমৎকার একটা জীপ, ভালো একজন ড্রাইভার চেয়েছিলেন, পেয়েছেন, সোহেল জোগাড় করেছে।

বুড়ো আহমদ কবিরকে কেন সাথে নিয়ে এসেছেন এইজন্য মাঝে মাঝে আফসোস হচ্ছে, সোহেল নিষেধ করেছিল, তিনি শোনেননি,এই লোকটা জলজ্যান্ত একটা যন্ত্রনা। এই অঞ্চলে ঠান্ডা বেশি পড়ে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আহমদ কবিরকে দেখে মনে হচ্ছে প্রচন্ড ঠান্ডায় মারা যাচ্ছে লোকটা, দাঁত কপাটি মেরে বসে আছে পেছনের সীটে। সোহেলও আছে সঙ্গি। তিনি বসেছেন ড্রাইভারের পাশের সীটে, সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই অঞ্চলে এবারই প্রথম আসা হয়েছে, পাহাড়ে উঠার কোন অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নন তিনি, রাশেদকে ধরতে যদি মাউন্ট এভারেস্টে উঠতে হয় তাও তিনি রাজি। তবে যতোটুকু বুঝেছেন রাশেদ এখানে পর্বতারোহন করতে আসেনি,তাহলে আরো কিছু নিয়ম কানুন মেনে আসতে হতো, সাথে দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত শেরপা রাখতে হতো, রাশেদ আর তার বন্ধু এসেছে অন্য কাজে। রাশেদকে খুন করার আগে অন্তত উদ্দেশ্যটা জেনে নেবেন, তার খুব কৌতূহল হচ্ছে, রাশেদের উদ্দেশ্য জানার জন্য।

ভাগ্য ভালো সোহেল ডাইভার হিসেবে যে ছেলেটাকে বেছে নিয়েছে সে রাশেদের জিপের ড্রাইভারের ছোট ভাই, বড় ভাই কোথায় গেছে, কতো টাকা ভাড়ায় গেছে সব তার নখদর্পনে, একই জায়গায় যাওয়ার জন্য তাকে দ্বিগুন ভাড়া দেয়া হবে এটুকুতেই সে মহাখুশি, এছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের আগে পৌঁছাতে পারলে আলাদা বখশিস তো আছেই। বখশিসের লোভে আরো জোরে গাড়ি চালাচ্ছে ছেলেটা।

আকবর আলী মৃধা চারপাশে প্রকৃতি দেখছেন, এতো চমৎকার জায়গা তার কল্পনারও বাইরে। রাশেদের সাথে কাজ শেষ হলে এখানে আরো কিছুদিন থেকে যাবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি।

আর কতোদূর? প্রশ্ন করলেন আকরব আলী মৃধা।

বাংলা বুঝতে পারলো না ড্রাইভার, ইংরেজি বললেও হয়তো বুঝতো না, তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে আকবর আলী মৃধা কি বোঝাতে চেয়েছেন।

দুই আঙুল এক করে যে চিহ্নটা সে দেখাল তাতে আকবর আলী মৃধা বুঝলেন খুব কাছেই চলে এসেছেন। ধৈৰ্য্য ধরতে হবে কিছুক্ষন। তারপর হবে চরম প্রতিশোধ।

*

অধ্যায় ৪৮

ছয় হাজার মিটার উঁচু কৈলাস পর্বত, মানস সরোবর আর রাক্ষসতালহ্রদ এই অঞ্চলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কৈলাস স্বয়ং শিবের নিবাস, জানেন ড. কারসন, হিন্দুদের তীর্থভূমি। পাশে থাকা মানস সরোবরের ভূমিকাও হিন্দু ধর্মে অসীম। কৈলাস আর মানস সরোবরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি, ভাবলেন ড. কারসন। এখন সঠিক জায়গাটা বেছে নেয়ার অপেক্ষা।

ঘুম থেকে উঠেছেন কিছুক্ষন হলো, তাঁবু থেকে বের হননি এখনো। বাইরে লতিকা, সন্দীপ আর সুরেশের গলা শুনতে পেলেন। কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করছে। ছোট একটা ব্রিফকেস থাকে তার সঙ্গে, সেই ব্রিফকেস খুলে বেশ কিছু কাগজপত্র বের করলেন ড. কারসন। চারকোনা বিশেষ একটা কাগজ ভাঁজ করে রাখলেন বিছানার উপর। পুরো কৈলাস রেঞ্জের চমৎকার একটা ম্যাপ। জায়গায় জায়গায় চিহ্ন দেয়া ম্যাপটায়। এখন তিনি যে জায়গায় আছেন তা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। যতো সামনে এগুবেন এই উচ্চতা ক্রমশ বাড়বে। শারীরিকভাবে নিজেকে ফিট মনে করেন ড. কারসন। লতিকাকে নিয়েও সমস্যা নেই, সন্দীপকে নিয়ে একটু দ্বিধায় আছেন তিনি। শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে শক্তিশালী মনে হয় না লোকটাকে। কিন্তু আপাতত এগুলো নিয়ে ভাবার সময় নেই। সবচেয়ে সমস্যা হবে সুরেশকে নিয়ে। এতোদিন সুরেশের প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ ছিল না, কিন্তু এখন সুরেশকে সাথে নিতে চাচ্ছেন না তিনি। সাম্ভালার খোঁজ পেলে তা নিয়ে ভারত আর চীন কী করবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। একটা যুদ্ধ লেগে যাওয়াও অসম্ভব কিছু নয়।

আজ সারাদিন লাগবে মোটামুটি কাছাকাছি একটা অবস্থানে যেতে। ম্যাপটায় লাল রঙ দিয়ে একটা জায়গাকে মার্ক করে রেখেছেন তিনি। আগামীকাল দুপুরের মধ্যে মার্ক করা জায়গাটায় পৌঁছাতে পারবেন বলে আশা করছেন, ম্যাপ অনুযায়ী জায়গাটা কৈলাস আর মানস সরোবরের মাঝামাঝি একটা জায়গা। এই অঞ্চলে তীর্থযাত্রীরা সবসময়ই আসা যাওয়া করে। তাদের পা পড়েনি এমন কোন জায়গা এখানে নেই, শুধু কৈলাস শীর্ষ ছাড়া। এতে একটা জিনিস পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে, সাম্ভালার অবস্থান এই এলাকায় হলেও জায়গাটা এমনভাবে লুকানো সাধারন চোখে তা ধরা পড়বে না। বিশেষ কোন চিহ্ন বা সংকেত থেকে খুঁজে নিতে হবে। হয়তো সবার চোখের সামনেই রয়েছে সাম্ভালার প্রবেশ পথ, কিন্তু হয়তো বিশেষ কোন ক্ষন বা বিশেষ কোনভাবে খুঁজতে হবে, যা কারো জানা নেই।

তাবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন ড. কারসন। সন্দীপ, সুরেশ আর লতিকা পাশাপাশি বসে কফি খাচ্ছে, এই কয়দিনে বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওদের মধ্যে। বিশেষ করে সন্দীপের মধ্যে যে অস্বস্তি দেখেছেন আগে তা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। তাকে দেখে কফির কাপ দেখিয়ে বসতে বলল লতিকা।

আমরা আজ বের হবো, ড. কারসন বললেন, লতিকার পাশে বসতে বসতে।

কফির কাপ এগিয়ে দিল লতিকা।

তাহলে দেরি করা ঠিক হবে না, সুরেশ বলল, আমি তৈরি।

ভেরি গুড, মি. সুরেশ, হেসে বললেন ড. কারসন, সাম্ভালা খুঁজে পাওয়ার জন্য তোমার তর সইছে না দেখছি!

ড. কারসন, সাম্ভালার খোঁজ পাওয়া আপনার জন্য যেমন জরুরি, আমার জন্যও জরুরি হয়ে পড়েছে এখন, সুরেশ বলল, উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চেহারায় গভীরভাব, ড. কারসনের কথায় সে কিছুটা আহত হয়েছে বোঝা গেল।

তোমরা কি সাম্ভালাকেও ভাগ করে নেবে? এবার বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন ড. কারসন।

দেখুন ড. কারসন, দিল্লি থেকে আপনার সাথে আমি আছি, সাম্ভালা বলে কিছু আছে আমি বিশ্বাস করতাম না, উপরমহল থেকে আমাকে যখন পাঠানো হলো, সত্যিই আমি আসতে চাইনি, সুরেশ বলল, কিন্তু মনে হলো, আমার আসা দরকার। কয়েকজন বোকা, বৃদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ যেন বিপদে না পড়ে, আমার তা দেখা দরকার। এছাড়া চীনের সাথে আমাদের সীমান্ত নিয়ে সমস্যা তো আছেই। আরো একটা কারনে আসতে বাধ্য হয়েছি, একটু থামল সুরেশ, তাকাল চারপাশে, সাম্ভালা খুঁজে পেলেও আপনারা জীবন নিয়ে দেশে ফিরতে পারতেন না, অন্তত সেরকম ব্যবস্থা করে রেখেছে চীন গোয়েন্দা সংস্থা। সাম্ভালা বলে সত্যি কিছু আছে, তা দুনিয়ায় কখনো প্রকাশ পেতো না, অনেকগুলো কথা বলে একটু দম নিলো সুরেশ, কফিতে চুমুক দিল, আমি এতোটুকু বলতে পারি, সাম্ভালা খুঁজে পেলে আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না, কারন তাহলে বাকি জীবনটা সেখানেই কাটিয়ে দিতে পারবো, কি বলেন? উত্তরের অপেক্ষা না করে হেঁটে সামনের দিকে চলে গেল সুরেশ।

সুরেশ চলে যাওয়ার পর নীরবতা নেমে এলো, চুপচাপ কফিতে চুমুক দিচ্ছে। সবাই। ড. কারসন বুঝতে পারছেন এভাবে বারবার আক্রমন করা ঠিক হয়নি সুরেশকে। এই ছেলেটা না থাকলে হয়তো এতোদূর আসতেও পারতেন না, কিন্তু মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না তিনি।

তোমরা তৈরি হয়ে নাও, আমরা বের হচ্ছি, বলে উঠে দাঁড়ালেন ড. কারসন।

অবাক হওয়ার মতো ঘটনা ঘটল তখনই। চারপাশের সাদা বরফ আর কালো পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো কিছু লোক, পুরো সাদা পোশাক পরনে, এতো চমৎকার ক্যামোফ্লাজ পোশক আগে কখনো দেখেননি ড. কারসন।

লোকগুলোর হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র, অন্তত দশ জন হবে, এরা হয়তো সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল এতোক্ষন। সুরেশকে পড়ে যেতে দেখলেন বরফে, পেছন থেকে রাইফেলের বাট দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে একজন। বৃত্তাকারে তাদের ঘিরে ফেলেছে দলটা।

লতিকার আর সন্দীপের পাশে এসে বসলেন ড. কারসন। বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, বুঝতে পারছেন না কি করবেন।

হ্যান্ডস আপ! কেউ একজন বলল সাদা পোশাকধারীদের মধ্য থেকে।

দুই হাত উঁচু করে দাঁড়ালেন ড. কারসন, লতিকা আর সন্দীপও দাঁড়াল। ড. কারসনের দিকে তাকাল লতিকা, বোঝাই যাচ্ছে হতাশায় ডুবে গেছেন ভদ্রলোক, এভাবে তীরে এসে তরী ডুববে তা কখনো ভাবেননি নিশ্চয়ই। তবে কিছুটা স্বস্তিবোধ করল সে, নিজের বাবাকে এই অভিযান থেকে ফেরত পাঠানো গেছে এটাই স্বস্তির কারন, এই পরিস্থিতিতে প্রফেসর সুব্রামানিয়াম কি করতেন তা কে জানে।

***

দ্রুত নিঃশ্বাস নিচ্ছে মিচনার। ধীরে ধীরে আরো উচ্চতায় উঠছে সে। এই পাহাড়টা কতোটুকু উঁচু কোন ধারনা নেই তার। তবে এখানে উঠতে পারলে আশপাশের অনেক কিছু পরিস্কার দেখা যাবে। অনেক দূর থেকে কেউ তাকে দেখলে পাগল ছাড়া কিছু ভাববে না, কোন ধরনের দড়াদড়ি ছাড়া একজন মানুষ যে এভাবে পাহাড় বেয়ে উঠতে পারে তা কল্পনারও বাইরে। এছাড়া তার গায়ে কোন কাপড়ও নেই। শীত-গ্রীষ্ম আলাদাভাবে অনুভব করে না সে।

অনেক উপর থেকে নীচের দিকে তাকালে অস্বস্তি লাগে, তারপরও মাঝে মাঝে পেছন ফিরে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখছে মিচনার। উপরে উঠার গতি খুব ধীর হয়ে যাচ্ছে, আরো ঘন্টাখানেক সময় লাগবে একেবারে উপরে উঠতে। এখন পর্যন্ত যতোদূর উঠেছে তাতেও অনেক খানি জায়গা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চারপাশে শুধু বরফঢাকা উঁচু পর্বত, পাইন, ইউক্যালিপ্টাস গাছের সারি, মানুষজন দেখা যাচ্ছে অনেক দূরে, সাথে গৃহপালিত কিছু ইয়াক আর ভেড়ার দল।

যে লোকটাকে খাদ থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিল তার পায়ের ছাপ ধরে অনেকদূর এগিয়েছিল মিচনার। কিন্তু ছাপগুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। তার আশপাশে অনেক খুঁজেছে সে, কিন্তু আর কোন চিহ্ন বা গন্ধ কোনকিছুই পায়নি। এখন মনে হচ্ছে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠে প্রতিদ্বন্ধীকে খুঁজে বের করার বুদ্ধিটা একেবারে অকাজের। লোকটা নিশ্চয়ই এমনভাবে চলছে না যে সহজেই খুঁজে বের করা যাবে। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল মিচনারের। চূড়ার দিকে তাকাল, আরো অনেকটা পথ উঠতে হবে, হতাশ হয়ে নামার চিন্তা করছিল মিচনার। ঠিক তখনই অনেক দূরে ছোট কালো বিন্দুর মতো কিছু চোখে পড়ল তার। পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। চেহারা দেখতে না পেলেও ঐ দুজনের একজন যে তার প্রতিদ্বন্ধী এটা নিশ্চিত মিচনার। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার, কোন কুক্ষনে এই পাহাড়ে উঠার চিন্তাটা মাথায় এসেছিল! অবশ্য এই পর্যন্ত উঠেছিল বলেই দুজনকে খুঁজে পেয়েছে সে।

উপরে উঠার চেয়ে নামা বেশ কঠিন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মিচনার। প্রচন্ড শীতেও দরদর করে ঘামছে সে, হাত পিচ্ছিল হয়ে গেছে। পাথরের খাঁজে খাঁজে পা রেখে নীচে নামতে গিয়ে বারবার তাকাতে হচ্ছে।

পায়ের নীচে বেশ লম্বা একটা পাথরের টুকরো দেখা যাচ্ছে, সাবধানে এক পা রাখল মিচনার, তারপর আরেক পা। ভুলটা হলো তখনই। দেখতে মজবুত মনে হলেও মিনারের ভার নিতে পারলো না পাথরটা, ভেঙে গেল। আচমকাই পড়তে শুরু করল সে, দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে কোন খাঁজে নিজেকে আটকাতে। নিজের অজান্তেই আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে উঠল মিচনার। এই পতন হয়তো ঠেকাতে পারবে না সে।

*

অধ্যায় ৪৯

বিনোদ চোপড়ার কথা বারবার মনে পড়ছে, শেষ মুহূর্তে লোকটা নিজের লোভকে সামলাতে পারলো না। হয়তো যে টংকাগুলো পেয়েছিল সেগুলোকেই যথেষ্ট মনে করেছিল। কিন্তু এভাবে চলে গিয়ে নিজের প্রানের উপর যে ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা হয়তো হারিয়ে ফেলেছিল বিনোদ। কোন সন্দেহ নেই বিনোদ চোপড়া এখন মৃত। তিনি নিজে বিনোদ চোপড়ার পায়ের ছাপ অনুসরন করে গিয়েছিলেন, কিছু ধ্বস্তাধ্বস্তির নমুনা দেখেছেন, সম্ভবত লোকটাকে মেরে ফেলে খাদ থেকে ফেলে দিয়েছে তার প্রতিপক্ষ। সেই সাথে সেই দুষ্প্রাপ্য টংকাগুলোও হারিয়ে গেছে চিরতরে। টংকাগুলো নিয়ে কোন খেদ নেই, গত কিছুদিন ধরে মানুষটা পাশে ছিল, এখন কেমন নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। যদিও যজ্ঞেশ্বর আছে সাথে, কিন্তু বিনোদ চোপড়া চলে যাওয়ার পর থেকে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে সন্ন্যাসী, প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলে না।

ফিরে আসার সময় বিনোদ চোপড়ার ট্র্যাক খুব সাবধানে মুছে ফেলেছেন তিনি, এতোদিন খুব বেশি সাবধানতা অবলম্বন করেননি। ভেবেছেন, সময়মতো ঝেড়ে ফেলবেন পেছন থেকে, কিন্তু একটু দেরি হয়ে গেছে। একটু আগে থেকে সাবধান হলে বিনোদ চোপড়াকে হারাতে হতো না।

যজ্ঞেশ্বরকে নিয়ে পাশাপাশি হাটছেন তিনি। সন্ন্যাসীর সেই আগের চপলতা না থাকলেও চুপচাপ তাকে অনুসরন করছে। গতরাতে শেবারনের দেয়া ম্যাপ খুলে যা বুঝেছেন আর বেশি দূর যেতে হবে না। সম্ভবত সাম্ভালার খুব কাছেই চলে এসেছেন। এখন আরো বেশি সাবধান হতে হবে।

চারপাশে পাহাড় আর পাহাড়, ভারি কাপড়-চোপড় আর কিছু ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে যজ্ঞেশ্বরের, তিনি নিজেও খুব স্বস্তিবোধ করছেন তাও নয়। ক্রমশ উচ্চতার দিকে যাচ্ছেন, বাতাস পাতলা হয়ে যাচ্ছে, অক্সিজেনের পরিমান কমছে। এই পরিস্থিতিতে সাধারন একজন মানুষের শ্বাসকষ্ট হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু সন্ন্যাসী অনেকদিন ধরেই যোগাসনে অভ্যস্ত, ফলে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না যজ্ঞেশ্বরের।

অনেক দূরে চমৎকার একটা পাহাড়চূড়া চোখে পড়ল। যজ্ঞেশ্বরকে দেখলেন থেমে গেল, চোখে বিস্ময়।

লখানিয়া জী, আমরা কৈলাস শৃঙ্গ দেখছি এখন, যজ্ঞেশ্বর বলল, হাঁটা থামিয়ে দুই হাত জোর করে প্রনাম করলো পাহাড়চূড়া বরাবর।

আপনি নিশ্চিত, এটা কৈলাস শৃঙ্গ?

নিশ্চিত, কৈলাস পার হলেই আমরা মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল দেখতে পাবো।

কৈলাস শৃঙ্গের নাম শুনেছেন তিনি, মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হ্রদের নামও তার কাছে অপরিচিত নয়। ম্যাপ দেখে যতোটুকু আন্দাজ করতে পেরেছেন, কৈলাস এবং মানস সরোবরের কাছাকাছি সাম্ভালার অবস্থান।

মানস সরোবরে তো প্রচুর তীর্থ যাত্রী থাকার কথা, বললেন তিনি, যজ্ঞেশ্বরের প্রনাম এখনো শেষ হয়নি,বিড়বিড় করে সংস্কৃত ভাষায় শ্লোক আবৃত্তি করে যাচ্ছে।

বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে তীর্থ যাত্রীরা সুযোগ পায় মানস সরোবরে আসার, যজ্ঞেশ্বর বলল, এখন সেখানে কারো থাকার কথা নয়।

যুগ যুগ ধরে মানস সরোবর আর তার আশপাশের এলাকায় মানুষজনের পা পড়েছে, সেখানে সাম্ভালার মতো একটা জায়গা লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার ব্যাপারটা অনেকটাই অসম্ভব, কিন্তু তারপরও এমন কোন ব্যাপার আছে যা সাম্ভালাকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে সাহায্য করেছে, ভাবলেন তিনি।

জানি না আমার উদ্দেশ্য পূরন হবে কি না, প্রনাম সেরে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল যজ্ঞেশ্বর, কিন্তু এতোদূর আসতে পেরেছি, সেটাও কম নয়।

যদি সত্যি রহস্যময় নয়জন থেকে থাকেন, তাহলে অবশ্যই আপনি তাদের দেখা পাবেন, বললেন তিনি, আমি কথা দিচ্ছি।

হাসল যজ্ঞেশ্বর, সান্তনার জন্য কথাগুলো বলেননি তিনি বুঝতে পেরেছে। হাঁটতে থাকল সে, এবার একটু দ্রুত গতিতে।

উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়ায় কেঁপে উঠলেন তিনি। পা বাড়ালেন দ্রুত, খুব বেশি সময় হাতে নেই। প্রতিপক্ষ আসছে।

***

দুপুরের আগেই জায়গামতো পৌঁছে গেল ওরা। ঝোঁপের পাশে জীপটা রাখা, বরফ আর গাছের পাতা দিয়ে এমনভাবে ক্যামোফ্লাজ তৈরি করা হয়েছে যে বাইরে থেকে কেউ দেখে বুঝতে পারবে না এখানে কি আছে। দক্ষ হাতের কাজ নিঃসন্দেহে। ড্রাইভার লোকটা আগে থেকে জানতো বলে খুঁজে বের করতে পেরেছে, নইলে রাজু আর রাশেদ কখনোই খুঁজে পেতো না। এই পর্যন্তই এসেছিল এই নেপালি ড্রাইভার, তারপর জিপ নিয়ে ফিরে গেছে ঝাংমুতে। বোঝাই যাচ্ছে এখান থেকে বাকিটা পথ পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন ড. কারসন আর তার দল।

নেপালি ড্রাইভারকে বিদায় করে দিল ওরা, এখন আর জিপের কোন প্রয়োজন নেই, বাকিটা হাঁটতে হবে। প্রয়োজনীয় সব জিনিস জিপ থেকে নামিয়ে বড় একটা পাথর খন্ডের উপর বসেছে রাশেদ, জায়গাটা একটু উঁচুতে অবস্থিত, আশপাশের অন্যান্য জায়গা থেকে এখানে বেশ খানিকটা জায়গা সমতল, একটু দূরেই রাজু দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে বুঝতে পারছে না। চারপাশে খোলা জায়গা, এরমধ্যে ঠিক কোথায় ড. কারসন তার দলবল নিয়ে রওনা দিয়েছেন বোঝা মুশকিল।

পাহাড়ে উঠার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয় রাজুর, এর আগে বান্দরবানে যা ঘটে গেছে তারপর পাহাড়ের প্রতি তার বিতৃষ্ণা চলে এসেছিল। কিন্তু পাহাড় যেন তার পিছু ছাড়ছে না। এখানে উঁচু-নীচু অনেক ধরনের পাহাড় দেখা যাচ্ছে চারদিকে। সব কটাই প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে।

রাশেদের দিকে তাকাল রাজু, মন দিয়ে কিছু একটা ভাবছে রাশেদ, কিন্তু বেশিক্ষন অপেক্ষা করার সময় হাতে নেই, সিদ্ধান্ত যা নেয়ার এখনই নিতে হবে।

ওরা কোনদিকে যেতে পারে বলে তোর ধারনা? রাজু জিজ্ঞেস করলো রাশেদকে।

আমি জানি না।

আমরা কি তাহলে এখানেই বসে থাকবো?

হাসল রাশেদ, ম্লান হাসি।

নেপালে নেমেই আমি একটা ম্যাপ কিনেছিলাম, মনে আছে তোর? রাশেদ বলল, রাজু মাথা ঝাঁকাল সে লক্ষ্যই করলো না, প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে ভাঁজ করা একটা কাগজ বের করে নিয়ে আসলো।

এবার এখান থেকে খুঁজে বের করতে হবে আমাদের অবস্থান এখন ঠিক কোথায়, রাশেদ বলল, ম্যাপটা ভাঁজ করে রাখল পাথরের টুকরোর উপর, ঠান্ডা বাতাসে বারবার উড়ে চলে যেতে চাচ্ছে ম্যাপটা, আমরা ঝাংমু দিয়ে ঢুকেছি, তারপর একটানা…

রাশেদ একটানা কিছু কথা বলে গেল, যার কিছুই মাথায় ঢুকলো না রাজুর, কোন একটা কিছু চোখে পড়েছে তার, হেঁটে এগিয়ে গেল সে।

দুপুরের রোদ ঝিমিয়ে পড়েছিল কিছুক্ষনের জন্য, মেঘ সরে যাওয়ায় হঠাৎ হেসে উঠলো যেন পৃথিবী। রাজুর হাতে ছোট্ট একটা ক্লিপ, মাথায় পড়ার, মেয়েদের।

উত্তরে যেতে হবে আমাদের, চেঁচিয়ে বলল রাজু।

ম্যাপ থেকে মাথা তুলল রাশেদ, উত্তরে যেতে হবে কেন?

এদিকে দেখে যা, রাজু ডাকল, বরফে ঢাকা মাটির দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যাচ্ছে সে।

রাশেদ এগিয়ে গেল, উৎসুক হয়ে উঠেছে।

এখানে আগুন জ্বালানো হয়েছিল, কালো হয়ে যাওয়া একটা কাঠের টুকরো। বরফের ভেতর থেকে বের করে আনল রাজু, ড. কারসন এখানেই ক্যাম্প করেছিলেন।

টুকরোটা হাতে নিলো রাশেদ, গন্ধ শুকল, পোড়া গন্ধ।

এই জায়গাটা ভালো করে খুঁজতে হবে, রাশেদ বলল, কোন না কোন চিহ্ন আছে। যা আমাদের চোখে পড়ছে না এখন।

তোর চোখে চশমা নিতে হবে শিগগিরি, রাজু বলল, হাত ইশারায় কাছে ডাকল রাশেদকে।

সমতল এই জায়গাটা থেকে সরু একটা পথ চলে গেছে উপরের দিকে, সেখানে কিছু একটা চোখে পড়েছে রাজুর।

এখানে কমপক্ষে তিন-চারজনের পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে, দ্যাখ, বলে বরফের উপর কয়েকটা পায়ের ছাপ দেখাল রাশেদকে।

পায়ের ছাপগুলো দেখল রাশেদ, খুব বেশি পুরানো মনে হচ্ছে না।

তাহলে দেরি করে লাভ নেই, রাশেদ বলল, আমরা এক্ষুনি রওনা দেবো।

এক্ষুনি! হাহাকার করে উঠলো যেন রাজু।রেস্ট নেয়া দরকার একটু।

সময় নেই, রাজু। আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি।

উত্তর দিকে যাবো আমরা?

হ্যাঁ, ম্যাপ অনুযায়ী কৈলাস রেঞ্জ, মানস সরোবর উত্তর দিকে, সম্ভবত সেখানেই কিছু খুঁজতে গেছেন ড. কারসন।

কিন্তু…

এখানে শুধু শুধু সময় নষ্ট হবে, চল, তাড়া দিল রাশেদ, জানে এখন একবার বিশ্রাম নিতে গেলে আরো বেশি দেরি হয়ে যাবে।

অনিচ্ছাসত্ত্বেও রওনা দিল রাজু, এবার পথ দূৰ্গম, সামনে কী আছে জানা নেই।

*

অধ্যায় ৫০

কিছুক্ষন আগে নীচে নামিয়ে আনা হয়েছে পুরো দলটাকে, ড. কারসন, ড. লতিকা, সন্দীপ চক্রবর্তী, সুরেশ আর সাথে চারজন তিব্বতি মুটে। দলটাকে একটা তাঁবুর ভেতর ঢোকানো হয়েছে। চারপাশে সাদা পোশাক পড়া অস্ত্রধারী সৈন্যদের দেখছেন ড. কারসন, কিন্তু দলনেতা এখনো সামনে আসেনি।

তিব্বতি মুটে চারজনকে বাইরে কোথাও রেখেছে ওরা, তাঁবুর ভেতর দুটো খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে ড. কারসন আর তার দলকে। সবার মধ্যে সুরেশের অবস্থা একটু খারাপ। সাদা পোশাকধারীরা প্রথম সুরেশের উপরই আক্রমন করেছে, কেননা তারা জানতো এই লোকটাকে ধরাশায়ী করতে পারলে বাকিদের ধরে ফেলা কোন সমস্যাই না। প্রথমেই পেছন থেকে আক্রমন করেছে ওরা, মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায়নি সুরেশ, পড়ে গিয়েছিল। একেবারে মেরে ফেলার নির্দেশ ছিল না, তাই ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে ওরা। সুরেশ জ্ঞান ফিরে পেয়েছে কিছুক্ষন আগে, এখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে চারপাশে।

সুরেশ আর সন্দীপকে একটা খুঁটির সাথে বাধা হয়েছে, সন্দীপ বেশ চুপচাপ, তার চেহারায় আত্মসমর্পনের ছাপ স্পষ্ট, তাকে যদি এখানে মেরেও ফেলা হয় তবু যেন তার কিছু যায় আসে না। লতিকার চেহারায় যন্ত্রনার ছাপ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, ড. কারসন আর তাকে একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। বারবার তাকাচ্ছে চারদিকে, বোঝার চেষ্টা করছে কী হচ্ছে চারপাশে।

এই জন্যই সুরেশকে ছাড়াই এগুতে চেয়েছিলাম, ড. কারসন বললেন হতাশ কণ্ঠে।

তার কথার উত্তর দিলো না কেউ। সুরেশ তাকাল ড. কারসনের দিকে, কিন্তু উত্তর দেয়ার মতো শক্তি তার নেই, ঠোঁট ফেটে রক্ত জমে গেছে, চোখের নীচে কালো দাগ পড়ে গেছে এরমধ্যে।

ড. কারসন আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন, রুমে একজন ঢুকল, সাধারন সৈনিকদের কেউ নয় তা তার হাঁটাচলায় বোঝা যাচ্ছে। সাধারন পোশাক পরনে, কিন্তু কোমরে রিভলবার ঝোলানো। তাঁবুর ভেতর দুজন সৈনিক পাহারায় ছিল, লোকটার ইশারায় বাইরে চলে গেল।

আমার পরিচয় দিই, আমি চ্যাঙ, চীন সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা শাখায় কাজ করি, গলা পরিস্কার করে বলল লোকটা, আপনারা এখন চীন সীমানার ভেতর অবস্থান করছেন, সবচেয়ে বড় ব্যাপার… একটু থামল চ্যাঙ, সুরেশের দিকে এগিয়ে গেল, একহাতে সুরেশের চুল মুঠো করে ধরল, ব্যথায় ককিয়ে উঠলো সুরেশ। একটা ইঁদুর ধরা পড়েছে আমাদের ফাঁদে, মজার ব্যাপার… হাসল চ্যাঙ, চুল ছেড়ে দিয়ে পায়চারি করছে সে এখন তাঁবুর ভেতর, ইঁদুরকে আমরা বিষ দিয়ে মেরে ফেলি না, খুশি হবার কিছু নেই, মি. রোহিত গোয়েঙ্কা ওরফে সুরেশ ঝুনঝুনওয়ালা, আমরা মারবো, তবে ধীরে ধীরে, তোমার কাছ থেকে অনেক তথ্য পাওয়ার কথা আমাদের।

এবার ড. কারসনের দিকে এগুলো চ্যাঙ, মি. কারসন, আপনি সত্যিই বিশ্বাস করেন সাম্ভালা আছে? হুম! ড. লতিকার দিকে এগুলো এবার, দেখা যাচ্ছে আপনি। বিশ্বাস করেন, এই সুন্দরি বিশ্বাস করে এবং এই বাঙ্গালী বাবুও বিশ্বাস করে, অদ্ভুত! যে জিনিস নেই তার পেছনে এভাবে ছুটে চলা মানে হচ্ছে অর্থের অপচয়, সময়ের অপচয়, অন্তত আমি তাই ভাবতাম, এবার চিন্তিত ভঙ্গিতে ঘুরে দাঁড়াল চ্যাঙ, যেন কিছু মনে পড়ে গেছে তার, কিন্তু… প্রশ্ন হচ্ছে আপনারা এতো বড় বড় বিজ্ঞানী, আপনারা কি ভুল জিনিসের পেছনে দৌড়াবেন? উত্তরটা আমি দিচ্ছি, মনে হয় না। এমন কিছু ড. কারসন জানেন যা আমি জানি না, আমরা জানি না… দম নেয়ার জন্য থামল চ্যাঙ, তাঁবুর প্রবেশমুখের দিকে তাকাল, কাউকে আশা করছে সে।

তাঁবুর প্রবেশমুখ তুলে এবার অন্য একজনকে ঢুকতে দেখা গেল, ড. কারসন অবাক হলেও প্রকাশ করলেন না, এই লোকটার সাথে দেখা হওয়ার পর মনে হয়েছিল কোথাও কোন সমস্যা আছে, খুব সাধারন লামা তিনি নন, এখন দেখা যাচ্ছে ধারনা ভুল নয়। ম্যাকলডগঞ্জের পাহাড়ি এলাকার সেই মন্দিরের পুরোহিত, এই শীতের মধ্যেও গেডুয়া ধারন করে আছেন। চেহারায় সৌম্যভাব। হাতে তিব্বতি যপ-যন্ত্র, একটানা ঘুরিয়ে যাচ্ছেন।

আপনারা আমাকে বিপদে ফেলে দিয়েছেন, চ্যাঙ বলে চলল, আমার কাজ ছিল ঐ ছুঁচোটার সাথে, সুরেশকে দেখাল, ওকে আমরা অনেকদিন ধরেই ট্র্যাক করছিলাম, জানতাম তিব্বতই ওর আস্তানা। কিন্তু ছদ্মবেশটা এতো নিখুঁত ধরেছিল যে আমরা ধারনাই করতে পারিনি,আপনাদের নেপাল সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সুরেশ, তারপর তার আবির্ভাব ঘটে ঝাং শহরে, একজন সাধারন জীপচালক হিসেবে। তখনই আমরা তাকে ধরতে পারতাম, কিন্তু… হাঁফ ছাড়ল চ্যাঙ, একটু সময় নিলাম, দেখছিলাম কততদূর যেতে পারে। যাই হোক, ড. কারসন, আমার ধারনা আপনি সাম্ভালার খোঁজ জানেন, নাকি জানেন না? ড. কারসনের দিকে এগিয়ে এলো চ্যাঙ।

জানি না, খুঁজছি, শান্ত গলায় বললেন ড. কারসন।

বোকা মনে হয় আমাদের, অ্যাঁ! বিস্ময় প্রকাশ করলো চ্যাঙ, বৃদ্ধ লামার দিকে তাকাল, এবার আপনার কাজ।

এগিয়ে এলেন বৃদ্ধ, হাঁটু গেড়ে বসলেন ড. কারসনের সামনে, আপনি জানেন মি. কারসন। খুলে বলুন, কারো কোন ক্ষতি হবে না, কথা দিচ্ছি আমি।

আমি সত্যিই জানি না, ড. কারসন বললেন, জানলে এতো সময় নষ্ট হতো না।

ড. কারসন, আমরা আপনার সব ইতিহাস জানি, আপনার বাবাও এসেছিলেন একসময় সাম্ভালার খোঁজে, আপনি সব জেনে শুনে বের হয়েছেন, পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য, এবার বলে ফেলুন, প্লিজ, বেশ নরম গলায় কথা বলছেন লামা, মনে হচ্ছে ছোট বাচ্চাকে বোঝাচ্ছেন।

আমি জানি না, ড. কারসন বললেন, আমি সত্যিই জানি না।

আপনার উপর ব্যপক অনুসন্ধান করেছি আমরা, যাই হোক, এবার উঠে দাঁড়ালেন লামা, চ্যাঙের দিকে তাকালেন। আমার আর কিছু করার নেই, চ্যাঙ, তোমার যা ইচ্ছে হয় করো, বলে তাঁবু থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন লামা।

পরিশ্রম করতে আমার ভালো লাগে না, তবে একটা মেয়ের হাত কেটে ফেলাটা খুব কষ্টকর কাজ হবে না, কি বলেন ড. কারসন? বলল চ্যাঙ, এগিয়ে গেল লতিকার দিকে।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লতিকা, চ্যাঙের দিকে। একজন সাধারন সৈনিক এসে চ্যাঙের হাতে ধারাল একটা তলোয়ার দিয়ে গেছে মাত্র। বেশ চকচকে একটা জিনিস, হয়তো এই ধরনের কাজের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

নৃশংসতা আপনাকে মানায় না, লামার উদ্দেশ্যে বললেন ড. কারসন, আমি সত্যিই জানি না।

দেখুন, আমি শান্তির পূজারি, তারপরও কিছু কিছু কাজে চুপচাপ থাকতে হয়, বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে, হাসলেন লামা, আপনি বলে দিলেই কারো কোন ক্ষতি হতো না।

চ্যাঙ এগিয়ে যাচ্ছে লতিকার দিকে, একজন সৈনিক লতিকার বাঁধন খুলে দিয়েছে, লতিকার সামনে ছোট একটা টেবিল এনে রেখেছে, টেবিলের উপর লতিকার ডান হাত রাখা, বেশিরভাগটাই বাইরের দিকে। চ্যাঙ তলোয়ারের ধার পরীক্ষা করে নিলো আঙুল দিয়ে, বেশ ধারাল, অল্প ছোঁয়াতেই কেটে রক্ত বের হয়ে এলো তার হাত থেকে।

এখনো সময় আছে ড. কারসন, লামা বললেন, রক্ত আমি পছন্দ করি না, কিন্তু চ্যাঙের কথা আলাদা।

চোখ বন্ধ করে রেখেছে লতিকা। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এতো দূর দেশে এসে এভাবে অঙ্গহানি হবে, এমনকি জীবনও যেতে পারে। যে কোন সময় ধারাল তলোয়ারের আঘাতে ডান হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে তার শরীর থেকে। মনে মনে এক দুই গুনছে লতিকা।

আমি বলবো, আমি বলবো, চেঁচিয়ে উঠলেন ড. কারসন।

চোখ খুলল লতিকা, বেশ হতাশ চেহারায় চ্যাঙ-কে দেখতে পেল, তলোয়ার উঁচু করে ধরেছিল, লামার ইশারায় সরে গেল।

আমি জানি আপনি বলবেন, লামা বললেন, কাল সকালে শুরু করবো আমরা, ঠিক আছে?

ঠিক আছে, মাথা নাড়ালেন ড. কারসন, লতিকার দিকে তাকালেন, মেয়েটা এতো শক্ত বুঝতে পারেননি। চরম বিপদেও নিজেকে স্থির রেখেছে।

ওদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো, চ্যাঙের উদ্দেশ্যে বললেন লামা, তারপর বেরিয়ে গেলেন তাঁবু থেকে।

পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে অসন্তুষ্ট হয়েছে চ্যাঙ, লতিকাকে আবার খুঁটির সাথে বেঁধে সেও বের হয়ে গেল তাঁবু থেকে।

তাঁবুর ভেতর এখন আর কেউ নেই, দুজন সৈনিক তাঁবুর মুখে পাহারা দিচ্ছে।

সন্দীপ এতোক্ষন কথা বলেনি,কথা বলার মতো অবস্থা সুরেশের নেই, সে শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছে।

আপনি আগে থেকেই জানতেন, সাম্ভালা কোথায়? আপনার বাবাও যে একসময় সাম্ভালার খোঁজে এসেছিলেন তা কিন্তু একবারও বলেননি আমাদের, বেশ রাগের সাথে বলল সন্দীপ।

এসব কথা বলার সময় নেই এখন মি. সন্দীপ, বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ড. কারসন।

কাল সকালে আমরা কোথায় যাচ্ছি?

সেটা কাল সকালেই দেখতে পাবেন, ড. কারসন বললেন, আমার উপর বিশ্বাস রাখুন, কারো কোন ক্ষতি হতে দেবো না আমি।

চুপচাপ তাকিয়ে আছে লতিকা, সে কী ভাবছে তার চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না, তবে তার বিশ্বাস অনেকটাই টলে গেছে।

***

মানুষ তার কর্মের মাধ্যমেই অমর হতে পারে, এমন কোন কীর্তি করতে পারে যা তাকে শতাব্দির পর শতাব্দি মানুষের মনে বাঁচিয়ে রাখবে। অনেক অনেক বছর পর, মানব সমাজে একটু থিতু হয়ে বসেছে মিনোস। বয়স এখন তার চল্লিশের কোঠায়। প্রায় তিনশ বছর চলে গেছে এরমধ্যে, সেই নীলাভ তরল পান করার পর। পাহাড়ের সেই গুহায় অনেককাল থাকার পর কিছুদিন হলো বের হয়েছে এসেছে। আশ্রয় নিয়েছে এক মহাগুরুর কাছে।

গ্রীষ্মের বিকেলে মাঝে মাঝেই গুরুর সাথে হাঁটতে বের হয় মিনোস, তার পরনে লিনেনের পোশাক, মাথা কামানো, চেহারায় বেশ সৌম্যভাব। গুরুর ঠিক পাশাপাশি হাঁটে না মিনোস, বলা যায় ঠিক পেছনেই থাকে। কখন কোন কাজে ডাক পড়ে তা বলা যায় না। মাঝে মাঝে অনেক কিছুই ভুলে যান গুরু, তখন মিনোসকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, তার স্মৃতিশক্তির উপর গুরুর অগাধ আস্থা দেখে ভালো লাগে মিনোসের। এমন নয় গুরুর বয়স হয়েছে, এখনো পঞ্চাশ পার করেননি,কিন্তু এই বয়সেই মিশরে তার উপর একমাত্র সম্রাট ছাড়া আর কেউ কথা বলে না, লোকটার ব্যক্তিত্বই তাকে অন্য সবার কাছ থেকে আলাদা করে তুলেছে।

এসিরিয়ান যাদুকরের সাথে তার যাদুবিদ্যার লড়াই এই কালের মানুষের আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু। সম্রাট নেতজারিখেত যখন এসিরিয়ান আক্রমন সামলাতে ব্যস্ত তখন তিনি এসিরিয়ান যাদুকরকে আহবান করেন দ্বৈত লড়াইয়ে এবং জিতে যান। তারপর থেকেই স্রাটের চোখের মনিতে পরিণত হন তিনি। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রেই সম্রাট এবং নীলনদের পাশ্ববর্তী এলাকার মানুষের উদ্ধারকর্তা হয়ে উঠেন।

গুরুর নাম ইমহোটেপ। রাজার প্রধান পরামর্শদাতা, প্রধান পুরোহিত, একাধারে রাজ্যের প্রধান কবিরাজ, প্রধান স্থপতি, প্রধান কাঠশিল্পী এবং প্রধান মূর্তি নির্মাতা। এই ধরনের একজন মানুষের সান্নিধ্যে আসতে পারা ভাগ্যের ব্যাপার। ফারাও সম্রাট নেতজারিখেতের সবচেয়ে কাছের মানুষ এই ইমহোটেপ, তার সান্নিধ্যে আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে মিনোস। বলাই বাহুল্য, মিনোস নামে কেউ তাকে এখন চেনে না। বরং তাকে সবাই চেনে নেবকা নামে। সূর্য দেবতা রাএর পূজা করে সে। ইমহোটেপের বেশিরভাগ দাপ্তরিক কাজে এখন তাকে পূর্ন সহযোগিতা করতে হয়।

ইমহোটেপের বেশিরভাগ সময় কাটে গাছগাছড়া থেকে ঔষধ তৈরির কাজে, সেই ঔষধ শুধু রাজকীয় কাজে ব্যবহার হয় তা নয়, বরং জনসাধারনের কাজেও তিনি ব্যবহার করেন। নেবকা আগে থেকেই এইসব কাজে সিদ্ধহস্ত, কিন্তু নিজেকে কোনভাবেই গুরুর সামনে তুলে ধরে না, বরং ইমহোটেপের কাছ থেকে শিখে নেয়ার চেষ্টাটাই তার মধ্যে বেশি।

ইমহোটেপ এমন একজন মানুষ যিনি সর্বজ্ঞ, পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব জানেন, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় নিজের অমরত্বের বিষয়টা গুরুকে খুলে বলতে। কিন্তু তাতে কেবল সমস্যাই বাড়বে, কেননা গত কিছুদিন আগে নৌকা নিয়ে সেই জায়গাটায় গিয়েছিল সে, সেখানে এখন কোন পাহাড় নেই, পুরো সমতলভূমি। এককালে সেখানে পাহাড় ছিল তা কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। যে গোপনীয়তা সে ধারন করে আছে তা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নেয়ার উপায় নেই।

রাজকীয় বাহিনীর ঘোড়া এগিয়ে আসছে দেখে সরে দাঁড়াল নেবকা। ইমহোটেপের জন্য কোন সংবাদ বয়ে এনেছে ঘোড়সওয়ার।

ঘোড়া থেকে নেমে লোকটা হাঁটু গেড়ে বসল ইমহোটেপের সামনে, প্যাপিরাসের গোল একটা চিঠি এগিয়ে দিল। হাত বাড়িয়ে নিলেন ইমহোটেপ, তার চেহারায় চিন্তার ছায়া খেলা করছিল তা পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিল নেবকা। যাই হোক, কোন শুভ সংবাদ নেই এটা নিশ্চিত।

বার্তাবাহক চলে গেল সাথে সাথেই, ইশারায় তাকে ডাকল ইমহোটেপ।

নেবকা, গম্ভীর গলায় বললেন ইমহোটেপ, আগামী একশ বছর পর আমার কোন অস্তিত্ব থাকবে না পৃথিবীতে, এমন জায়গায় আমাকে সমাহিত করবে যা কেউ খুঁজে পাবে না।

মাথা নাড়াল নেবকা, এর আগেও এই কথাগুলো বলেছেন ইমহোটেপ, সবাই তাকে মনে করে দেবতা থার সন্তান, যদিও তিনি নিজেকে একজন সাধারন মানুষের বেশি মনে করেন না, নিজেকে দেবতার আসনে দেখতে পছন্দ করেন না ইমহোটেপ।

ম্রাট নেতজারিখেত উর্ধ্বালোকে গমন করেছেন, একটু থেমে বললেন ইমহোটেপ, তাকে সমাধিস্থ করতে হবে।

অবাক হলেও প্রকাশ করলো না নেবকা।

আমরা রওনা দেবো এখন, বললেন ইমহোটেপ।

হাঁটতে থাকল নেবকা, পেছন পেছন। এর আগে মৃতদেহ সংরক্ষনের কথা শুনেছে, কিভাবে করতে হয় সে শিখেছে ইমহোটেপের কাছ থেকে, কিন্তু হাতে-কলমে করা হয়নি,এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর কি হতে পারে।

আমি একাই যাবো প্রাসাদে, ইমহোটেপ বললেন, বেশ জোরে হাঁটছেন তিনি, তুমি সরাসরি সাক্কারায় চলে যাবে।

মাথা নাড়াল নেবকা। আসতে লাগল ইমহোটেপের পিছু পিছু।

ঘুরে দাঁড়ালেন ইমহোটেপ, যা বললাম, তা করো, এক্ষুনি রওনা দাও।

এরপর আর কথা থাকে না। ঘুরে হাঁটতে থাকল নেবকা। সাক্কারা এখান থেকে অনেক দূর, পায়ে হেঁটে যেতে রাত পেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কিছু করার নেই। সাক্কারায় সম্রাটের শেষ বিশ্রামের জন্য যে বিশালকায় স্তূপ বানানো হয়েছে তার প্রধান স্থপতি হচ্ছেন ইমহোটেপ, সম্রাট নেতজারিখেত সিংহাসনে বসার পরপর এই বিশালকায় স্তূপের কাজ শুরু হয়, শেষ হয়েছে কিছুদিন আগে। বিশাল বিশাল পাথর, হাজার হাজার মানুষের সে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। পুরো কাজ নিজের হাতে তদারকি করেছেন ইমহোটেপ, সেই কাজের পাশাপাশি চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়েও কাজ করে গেছেন নিরলস।

রাতের মধ্যেই হেঁটে পাথরের স্তূপের কাছে গিয়ে দাঁড়াল নেবকা। বিশাল এই পাথরের স্তূপ অদ্ভুত দক্ষতায় তৈরি করেছেন ইমহোটেপ। এর ভেতরে সম্রাটকে সমাধিস্থ করা হবে। চারপাশে মাটি দিয়ে তৈরি উঁচু দেয়াল, অনেকগুলো দরজা থাকলেও শুধুমাত্র পূর্ব দিকের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢোকা যায়। দেয়ালটা এখনো চকচকে, কিছুদিন আগেই কাজ শেষ হয়েছে। চারপাশ প্রহরী দিয়ে ঘেরা থাকে সবসময়। নেবকাকে দেখে সম্মানসূচক মাথা নাড়ল একজন প্রহরী। পূর্ব দিকের দরজা খুলে দিল। এখানে এর আগেও অনেকবার এসেছে নেবকা, কিন্তু এর চমৎকার রূপ দিনের আলোতে এভাবে ধরা পড়েনি। কিভাবে ইমহোটেপ এতো বড় আর ভারি পাথর উপরে নিয়ে গেছেন তা পরবর্তী আরো বহু প্রজন্মের জন্য ধাঁধা হয়ে থাকবে।

ইমহোটেপের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনেক কিছু শেখা হয়ে গেছে, এবার এখান থেকে যাওয়ার সময়ও হয়ে গেছে, বহুদিন ধরে একই চেহারায় তাকে দেখছে। ইমহোটেপ, তাই সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। এছাড়া স্রাট মৃত, তাই সিংহাসন নিয়ে খেলা শুরু হবে এখন, সম্রাটের কোন পুত্রসন্তান নেই, এক কন্যা, এখানে থাকা মানে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নেয়া।

ধুলি-ধুসরিত পথ সামনে, চাঁদের আলোয় চকচক করছে, প্রহরীকে অবাক করে দিয়ে ভেতরে ঢুকল না নেবকা, পাথরের বিশালকায় স্তূপ থেকে সরে যেতে হবে দূরে, অনেক দূরে।

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। এসব অনেক অনেক আগের কথা, পাথরের এই স্তূপ নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই, পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম পিরামিড, ছয় ধাপ বিশিষ্ট, অদ্ভুত যান্ত্রিক দক্ষতায় বানিয়েছিলেন মহান কারিগর ইমহোটেপ, চোখ বন্ধ করলে এখনো চেহারাটা ভেসে উঠে। সম্রাট নেতজারিখেতকে বর্তমান প্রজন্ম চেনে ফারাও যোসের নামে। সাক্কারায় এরপর যাওয়া হয়েছিল, এখনো সগৌরবে টিকে আছে। সেই পিরামিড, যদিও গিজায় অবস্থিত তার পরবর্তী পিরামিডগুলোর তুলনায় সাক্কারার পিরামিড আকারে অনেক ছোট, কিন্তু তারপরও পিরামিডটাকে তার খুব ভালো লাগে। মনে হয় পৃথিবীর এই একটা জিনিসই তাকে চেনে, হাজার বছর ধরে।

একটানা হেঁটে ক্লান্ত যজ্ঞেশ্বরকে বিশ্রাম দেয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে সাময়িক বিরতি দিয়েছেন। ছোট তাঁবু টেনে ভেতরে শুয়েছিলেন, তন্দ্রাচ্ছন অবস্থায় কখনো সুদূর অতীতে ফিরে গেছেন বুঝতেও পারেননি। দুপুর হয়েছে, কিছু খেয়ে নেয়া দরকার, যজ্ঞেশ্বরকে ডাকতে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি।

সামনে পাহাড় ধীরে ধীরে আরো উঁচু আর দূর্গম হয়ে উঠেছে, এখানে বিশাম না নিলে সামনে ঠিক এভাবে নেয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে না। অক্সিজেনের পরিমান ক্রমশ কমছে, তার নিজের খুব একটা কষ্ট না হলেও অনভ্যস্ত যজ্ঞেশ্বর নিশ্চয়ই কষ্ট পাচ্ছে। যজ্ঞেশ্বরের তাঁবুটা পাশেই, চেইন খুলে ভেতরে তাকালেন। মনে মনে একটা আশংকা হচ্ছিল। আশংকা সত্যি প্রমানিত হতে যাচ্ছে, যজ্ঞেশ্বর ভেতরে নেই।

ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। জ্যাকেটের পকেটে হাত দিলেন, চামড়ার খোপটা আছে। বরফে পায়ের ছাপ খোঁজার জন্য এগিয়ে গেলেন সামনে। বেশ ভারি একজোড়া বুট পরেছে যজ্ঞেশ্বর। সেই ছাপ পরিস্কার চিনতে পারবেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরের যদি পালানোর উদ্দেশ্য থাকে তাহলে সে অবশ্যই নীচের দিকে যাবে, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পায়ের ছাপ ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে।

অবাক হলেও ছাপ ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে বোঝা যাচ্ছে লোকটা।

কোন শব্দ করবেন না।

একটু দূর থেকে কণ্ঠস্বরটা শুনে থেমে গেলেন তিনি। কণ্ঠস্বরটা যজ্ঞেশ্বরের, বড়সড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে উবু হয়ে কিছু দেখছে, নীচের দিকে।

ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। যজ্ঞেশ্বরের পাশে দাঁড়ালেন, বুঝতে পারছেন অনেক দূরের কিছু দেখছে সন্ন্যাসী, কিন্তু তার জন্য শব্দ করা যাবে না কেন বুঝতে পারছেন না।

কি দেখছেন? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

আমার পাশে দাঁড়ান, ঐ দিকে তাকান, আঙুল দিয়ে একটা জায়গা নির্দেশ করলো যজ্ঞেশ্বর, দেখতে পাচ্ছেন?

বিস্মিত হলেও প্রকাশ করলেন না তিনি। অন্তত মাইলখানেক দূরে অল্প কিছু তাঁবু দেখা যাচ্ছে, ভারি পোশাক পরনে কিছু লোক চলাফেরা করছে, হাতে অস্ত্র। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। চায়নীজ সরকার এই এলাকায় পাহারা বসাতেই পারে। কিন্তু অবাক হয়েছেন পরিচিত লোকটাকে দেখে। দুই হাত পেছন দিকে বাঁধা অবস্থায় একটা তাঁবু থেকে বের করা হয়েছে মাত্র। এই লোক এখানে কেন, তাও বন্দি অবস্থায়? এই লোক খুব খারাপ কিছু করতে পারে বলে বিশ্বাস হয় না, এছাড়া রাশেদকে একসময় সাহায্য করেছিল মানুষটা, এঁকে সাহায্য করা নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন তিনি। যজ্ঞেশ্বর এখনো তাকিয়ে আছে, বোঝার চেষ্টা করছে।

সাবধানে এগুতে হবে, ফিসফিস করে বলল যজ্ঞেশ্বর, দেখছেন না ওদের হাতে রাইফেল!

এগুবো না, মৃদু হেসে বললেন তিনি, পেছাবো। তৈরি হয়ে নিন, ঐ লোকটাকে উদ্ধার করতে হবে।

ঐ লোককে উদ্ধার করতে হবে কেন? কে তিনি? যজ্ঞেশ্বর সরে আসল উঁচু জায়গাটা থেকে, এতোদূর এসে আবার পেছাবো!

অনেক সময় দুই কদম পিছু হটতে হয়, জোরে লাফ দেয়ার জন্য, কি বলেন, যজ্ঞেশ্বর জী?

আপনার কথার উপর কথা চলে না, হাঁটতে থাকল যজ্ঞেশ্বর। লখানিয়া সিং যেখানে যাবে আপাতত সেখানে না গিয়ে তার উপায় নেই। এই এলাকায় লখানিয়া সিংয়ের সাহায্য ছাড়া সে নিজে একদিন টিকতে পারবে কি না সন্দেহ।

***

আরেকটু হলেই পথ হারিয়ে ফেলতেন, কিন্তু ভাগ্য ভালো বলেই মনে হচ্ছে আকবর আলী মৃধার কাছে। এখন জিপ চালাচ্ছে রাশেদ আর রাজুর ড্রাইভার, তার কানের কাছে। রিভলবার ধরে রেখেছে আহমদ কবির, তার উপর নির্দেশ আছে একটু এদিক-সেদিক করলেই খুলি উড়িয়ে দিতে, এমনিতে ড্রাইভারের সাথে ভাষাগত অমিল থাকলেও জীবন-মৃত্যু নিয়ে করা ইশারা বোধহয় সবাই ধরতে পারে।

রাশেদ আর রাজুর ড্রাইভার ফিরছিল, একাই, পথে মুখোমুখি হয়ে যায় আকবর আলী মৃধার জিপের সাথে। ছোট ভাইকে দেখে ড্রাইভার হাত নাড়তেই বিপদ হয়ে গেল। আকবর আলী মৃধা বুঝে গেলেন কষ্ট করে আর খুঁজে বের করতে হবে না রাশেদ আর রাজুকে। এই ড্রাইভারই বলে দিতে পারবে কোথায় নামিয়ে এসেছে দুজনকে। শুরুতে রাজি না হলেও তিনজনের হাতে তিনটা রিভলবার দেখে মানা করতে পারেনি। রাস্তার পাশে জিপ রেখে আকবর আলী মৃধার জীপে উঠে এসেছে লোকটা। ছোট ভাইকে পাশের সীটে বসিয়ে রাশেদ আর রাজুকে যেখানে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল সেখানেই নিতে হচ্ছে আকবর আলী মৃধাকে।

বেশিক্ষন লাগলো না জায়গাটায় পৌঁছাতে। বুঝতে পারলেন ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছে ড্রাইভার, একটু আগেই যে জীপটা এখানে এসেছিল তার ছাপ স্পষ্ট। সোহেলকে ইশারা করলেন। সোহেল যে বুদ্ধিমান তা আবার প্রমানিত হলো। আকবর আলী মৃধার ইশারা পেয়ে ড্রাইভার দুজনকে বাঁধল জিপের সাথে। জীপে আগে থেকেই কিছু দড়ি ছিল। বেশ শক্ত করে বাঁধল সোহেল। ফেরার সময় যদি দুজনের কেউ বেঁচে থাকে তাহলে কাজে দেবে, নইলে নিজেদেরই চালিয়ে যেতে হবে জীপটা।

চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পায়ের ছাপ, কোনগুলো রাশেদ আর রাজুর বোঝা খুব কষ্টকর। খুব মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন আকবর আলী মৃধা। আহমদ কবিরকে পাঠালেন ডান দিকে, সোহেলকে বামে, তিনি নিজে দাঁড়িয়ে হিসেব করার চেষ্টা করছেন। ঠিক কোনদিকে যেতে পারে বোঝা যাচ্ছে না। উত্তর দিকে রাস্তা ক্রমশ উঁচু হয়ে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে, এখানে জিপ রেখে যাওয়ার একটাই মানে, ওরা ডানে বামে কোথাও যায়নি। ওরা উত্তরে গেছে। বেশ খানিকটা দূরে মাথা উঁচু করে সুবিশাল এক পর্বত দাঁড়িয়ে। জ্যাকেটের পকেট থেকে ম্যাপ বের করে নিজেদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছেন আকবর আলী মৃধা। হিসেব মতো উত্তরের এই সুবিশাল পবত চূড়ার নাম কৈলাস।

রাশেদ আর রাজু তাহলে কৈলাসের দিকে গেছে, ধারনা করলেন তিনি। তার ধারনা আবার বেশিরভাগ সময়ই মিলে যায়।

সোহেল আর আহমদ কবিরকে হাত ইশারায় ডাকলেন তিনি। এবার উঁচুতে উঠার পালা।

***

ভাগ্য বলে কি কিছু আছে? সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য কোনটাই ঠিক টের পায়নি মিচনার কোনদিন। সাধারন মানুষ জন্মায়, ছোট থেকে বড় হয়, পরিবার-পরিজন, পেশা, বন্ধুবান্ধব নিয়ে জীবন কেটে যায়, সেখানে হয়তো ভাগ্যের বড় একটা প্রভাব থাকে। কিন্তু তার এই জীবনে ভাগ্য কী জিনিস তাই বুঝতে পারেনি মিচনার। এই দীর্ঘ, প্রলম্বিত জীবন কি সৌভাগ্য না দূর্ভাগ্য, এখন পর্যন্ত তাই নির্নয় করতে পারেনি সে।

প্রতিপক্ষের খুব কাছাকাছি এসেও তাকে বারবার ধরতে না পারাটা কি দূর্ভাগ্য? নাকি এতো উঁচু পাহাড় থেকে পরতে পরতে বেঁচে যাওয়াটা সৌভাগ্য! কিছুই মাথায় আসে না মিচনারের। অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছে সে, দীর্ঘ পতন কোনভাবেই থামাতে পারছিল না, পাথরের এক কার্নিশে কোনমতে আঙুল আটকাতে পেরেছিল বলে রক্ষা। নইলে হয়তো বেঁচে থাকতো সে, কিন্তু এতোক্ষনে হাত-পা গুড়ো হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে হতো।

সেক্ষেত্রে ভাগ্য ভালোই বলা চলে, সাধারন কিছু ছড়ে-কেটে যাওয়া ছাড়া খুব বেশি একটা ক্ষতি হয়নি। প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার সময় পূর্ন শক্তিতে মোকাবেলা করতে চায় সে, কোন সুযোগ দেয়া যাবে না। অল্প কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়েই আবার চলা শুরু করেছে মিচনার। এবার আগের চেয়ে দ্রুতগতিতে চলছে মিচনার। যে সময়টা নষ্ট হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে হবে, নইলে প্রতিপক্ষ হাতের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।

দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতমালা দেখে একটু থামল মিচনার, মনে হচ্ছে খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এই পথ দিয়েই গেছে তার শত্রু। নিজের মধ্যে কেমন আসুরিক শক্তি অনুভব করছে মিচনার, মনে হচ্ছে চিৎকার করে জানিয়ে দিতে সে আসছে, শত্রুকে খতম করতে, এই পৃথিবীতে তার মতো মানুষ একজনই যথেষ্ট, একজন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *