তৃতীয় অধ্যায় । রাজনীতি । নবুওতি ও শাসন
নবি হিসেবে মুহাম্মদের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে হলে আমাদেরকে অবশ্যই মক্কি সুরা বিশেষ করে সুরা মুমিনুন এবং সুরা নজম পাঠ করতে হবে। এই সুরায় মুহাম্মদকে যিশুর মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। আর রাষ্ট্রনেতা, শাসক, আইনপ্রণেতা হিসেবে মুহাম্মদের ভূমিকা জানতে আমাদের পড়তে হবে সুরা বাকারা, সুরা নিসা, সুরা মুহাম্মদ, এবং সবশেষে সুরা তওবার মতো মাদানি সুরাগুলো। মদিনায় হিজরতের তিন-চার বছর পর ইহুদি গোত্রগুলো নির্মুল হলে এবং বানু মুস্তালিক গোত্রকে (মদিনার পশ্চিমে বসবাসকারী একটি বেদুইন উপজাতি) পরাজিত করার পর নবি মুহাম্মদের রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মুহাম্মদের জীবনী লিখতে গিয়ে ইতিহাসবিদ ইবনে হিশাম একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন। একবার ইহুদি ধর্মের বানু-নাজির গোত্রের হাওয়া বিন আক্তাবের কন্যা সাফিয়া স্বপ্নে দেখেন চাঁদ তার কোমরে নেমে এসেছে। সাফিয়া তার স্বামী কেনানা বিন আবু রাবিয়াকে স্বপ্নের ঘটনাটি বললে তিনি ক্রোধে সাফিয়ার চোখে জোরে আঘাত করেন। ফলে সাফিয়ার চোখ ফুলে উঠে। কেনান বিন রাবিয়া স্ত্রীকে গাল দিয়ে বলেন: তুমি কি হেজাজের রাজার স্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখ নাকি? পরবর্তীতে খায়বার দখলের পর নবি সাফিয়াকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। ইবনে হিশামের বর্ণনায় আরেকটি ঘটনার উল্লেখ আছে। বানু কায়নোকা গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন সালাম ইসলাম গ্রহণ করলে ইহুদিরা তাঁকে নিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। তারা বলতেন, তুমি ভালো করেই জানো নবুওত শুধুমাত্র ইহুদি সন্তানরাই লাভ করতে পারে। এটি আরবদের জন্যে নয়। তোমার মুনিব কোনোভাবেই নবি নন, তিনি একজন রাজা মাত্র। মক্কা বিজয়ের পর প্রাণভয়ে যখন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তিনি আব্বাস বিন আব্দুল মোতালেবকে বলেন ; তোমার ভাতিজার দখলে তো আছে বিশাল অঞ্চল। আব্বাস ফিরতি জবাব দিলেন : “হ্যাঁ। নবুওত প্রাপ্তির জন্যই এই রাজত্ব।”
হজরত ওমর বিন আল-খাত্তাব ইসলামের ইতিহাসে একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য তিনি নবি মুহাম্মদের কাছে খুব বিশ্বস্ত এবং শ্রদ্ধেয় ছিলেন। ওমরের চারিত্রিক এই গুণাবলীর কারণেই ইসলাম প্রচারের শুরু থেকে নবি ওমরকে তার ঘনিষ্ঠজনের বৃত্তে নিয়ে আসেন। কুরাইশদের সাথে হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মুহাম্মদের সম্মতি নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন হজরত ওমর। তার কাছে এসন্ধি ছিল এক ধরনের পরাজয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে নবি কয়েকজন সাহাবি ও বেদুইন অনুসারীদের সাথে মক্কার বাইরে অবস্থান নিয়ে হজ পালনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কুরাইশরা এ-সংবাদ শোনা মাত্র মুহাম্মদের প্রবেশ ঠেকাতে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মক্কা থেকে ছয় মাইল দূরে অবস্থান নিয়ে মুসলমানরা সমঝোতার চেষ্টা করেন। শেষে উভয়ে এই শর্তে উপনীত হয় যে, মুসলমানেরা এ-বছর মদিনায় ফিরে যাবে তবে পরের বছর তারা কাবায় হজ করতে পারবেন। এ-প্রস্তাবে ওমর ভেবেছিলেন কুরাইশরা নবিকে তাদের সব শর্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছে। তাই তিনি আবেগ-তাড়িত হয়ে মুহাম্মদের কাছে এবিষয়ে জানতে চান। নবি তখন উত্তেজিত হয়ে ওঠেন এবং চিৎকার করে বলেন : ‘তোমার মা তোমার জন্য শোক করুক।’ নবির মুখে এ অভিশাপের কথা শুনে ওমর নিজেকে সংবরণ করেন। যে নবি হুদায়বিয়ার সন্ধি করেছিলেন আর যে নবি দশ/বারো বছর আগে প্রবল আগ্রহ নিয়ে ওমর ও হামজাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করেছিলেন, দুজনের পার্থক্য আছে। হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কুরাইশদের নিকট আত্মসমর্পনের যুক্তিকে ভিন্ন আঙ্গিকে ভিত্তি দিতে নাজিল হয় সুরা ফাতাহ-এর প্রথম আয়াত : ‘আল্লাহ তোমার জন্য সুস্পষ্ট বিজয় অবধারিত করেছেন। (৪৮:১)। বর্তমানে সবাই স্বীকার করেন হজরত আবু বকরের কুশলী ভূমিকা ওমরসহ অনেকের অসন্তুষ্টি কমাতে ভূমিকা রেখেছিল।
যদিও হুদায়বিয়ার সন্ধি এক দৃষ্টিতে মুসলমানদের পিছপা হওয়া এবং এজন্য নবিকে ওমরসহ কয়েকজন সাহাবির অসন্তুষ্টির সমুখীন হতে হয় তবু এ-সন্ধি থেকে নবির গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়। নবি হয়তো এ-সময় কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েননি কারণ তিনি সম্ভবত নিশ্চিত ছিলেন না, মুসলমানরা আদৌ কুরাইশদের পরাজিত করতে পারবে কিনা। ফলে একটি সাময়িক আপোস বা সন্ধি তার কাছে অধিক নিরাপদ ছিল। নবি জানতেন মুসলমানদের একটি পরাজয় কুরাইশদের শক্তিশালী করবে। তাছাড়া এ পরাজয় বেদুইনদের ওপর মুসলমানদের প্রভাব হ্রাস করবে এবং ইহুদিদের ক্ষোভ উসকে দিবে। যা মুসলমানদের ভবিষ্যতকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে। এসব দিক বিবেচনা করেই সম্ভবত নবি কুরাইশদের সাথে সন্ধি করেন। তিনি সম্ভবত কুরাইশদের শর্তাবলী মেনে নিয়েছিলেন এই চিন্তা করে যে, শর্ত মানার ফলে তার প্রভাব ও মর্যাদা সমুন্নত থাকবে এবং পরবর্তী বছর তার অনুসারীরা হজ করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে পরাজয়ের কোনো শঙ্কা থাকবে না।
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মুহাম্মদ যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেবিষয়ে অনুধাবণ করা যায় তার পরবর্তী খায়বার যুদ্ধযাত্রা থেকে। মুহাজিরদের অনেক নিকট-আত্মীয় তখনো মক্কায় বাস করতেন। তাই নবি জানতেন, মুহাজিরদের অনেকে সে-জন্যে কুরাইশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে প্রাণপণে লড়াই করবেন না। কিন্তু ইহুদিদের শেষ শক্তিশালী ঘাঁটি খায়বার আক্রমণে সেধরনের কোনো শঙ্কা নেই। বরং খায়বারের যুদ্ধ জয় মুসলমানদের মনোবল ও গনিমতের মাল দুই-ই বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। সুরা ফাতহ-এর কয়েকটি আয়াতে এ-সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে। যেমন এই আয়াতে বলা হয়েছে : বিশ্বাসীরা যখন গাছের নিচে তোমার কাছে তোমার আনুগত্যের শপথ নিল তখন আল্লাহ তাদের ওপর সন্তুষ্ট হলেন। তাদের অন্তরে যা ছিল তিনি তা জানতেন…। (৪৮:১৮)।
হুদায়বিয়ায় যখন কুরাইশদের সাথে নবির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী মনে হয়েছিল, তখন নবি মুসলমানদের নিয়ে একটি গাছের নিচে দাঁড়ান। কুরাইশদের যেকোনো প্রতিরোধের মুখে যুদ্ধ করে যাবার শপথ গ্রহণ করেন সবাই। ইসলামের ইতিহাসে এই শপথের নাম ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির শপথ’( বায়াত অর-রেদওয়ান)। মানে আল্লাহ এই শপথ থেকে খুবই আনন্দিত হয়েছেন। আর তাদের জন্য স্থির করলেন আসন্ন বিজয়। (৪৮:১৮) । যুদ্ধে (তারা) লাভ করবে বিপুল সম্পদ। (৪৮:১৯)। আল্লাহ তোমাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তোমরা যুদ্ধ- লভ্য বিপুল সম্পদের অধিকারী হবে। তিনি তোমাদের জন্য এ ত্বরান্বিত করবেন। (৪৮:২০)। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর নবি দ্রুত মদিনাতে ফিরে আসেন এবং সেখানে এক পক্ষ কাটিয়ে খায়বারের উদ্দেশ্যে সৈন্য নিয়ে যাত্রা করেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন মুসলমানেরা হুদায়বিয়ার সন্ধি নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলতে পারে। আবার তিনি এ-ও জানতেন, খায়বার যুদ্ধ জয় হলে সন্ধি নিয়ে প্রশ্ন তোলার চেয়ে গনিমতের মালের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন সবাই।
গনিমতের মাল হস্তগত করার বিষয়টি বেদুইনদের এতোই আন্দোলিত করেছিল যে, যারা কুরাইশদের সাথে যুদ্ধে যেতে রাজি ছিলেন না তারাও পর্যন্ত খায়বার আক্রমণে সঙ্গী হতে রাজি হয়ে গেলেন। সুরা ফাতহ-এর ১৫ নম্বর আয়াতে এ-সম্পর্কেই বলা হয়েছে: তোমরা যখন যুদ্ধলব্ধ সম্পদ সংগ্রহের জন্য যাবে তখন যারা ঘরে থেকে গিয়েছিল তারা বলবে, আমাদেরকেও তোমাদের সঙ্গে যেতে দাও। (৪৮:১৫)। এর পরের আয়াতে আল্লাহ নবিকে নির্দেশ দিয়েছেন, “যে-সব মরুবাসী আরব ঘরে থেকে গিয়েছিল তাদেরকে বলো, তোমাদেরকে ডাকা হবে এক প্রবলপরাক্রান্ত জাতির সাথে যুদ্ধ করতে। তোমরা ওদের সাথে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না ওরা আত্মসমর্পণ করে। তোমরা এ-নির্দেশ পালন করলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো পুরস্কার দেবেন। কিন্তু তোমরা যদি আগের মতো পালিয়ে যাও তিনি তোমাদেরকে দারুণ শাস্তি দেবেন। (৪৮:১৬)। খায়বারের জলাশয়ে কাছে কয়েকটি রাজকীয় প্রাসাদ ছিল। প্রথম দিনে সালাম বিন মেশকাম প্রাসাদটি আক্রমণ করেন মুসলমানরা। কিন্তু দখলের আগে ভয়াবহ লড়াইয়ে ৫০ জন মুসলমান যোদ্ধা প্রাণ হারান। অন্যদিকে হজরত আবু বকরের নেতৃত্বে নাওম প্রাসাদ আক্রমণ করা হয়। কিন্তু সফল হতে পারেননি। হজরত ওমরের নেতৃত্বে আক্রমণ করেও দখল নেয়া যায়নি প্রাসাদটি। অবশেষে হজরত আলি প্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে প্রবেশ করতে সক্ষম হন। অন্যদিকে জাবির প্রাসাদের পানি-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ফলে প্রাসাদে অবস্থানকারীরা বের হয়ে আসতে বাধ্য হয়। বাইরে এসে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করলেও শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে একের পর এক কয়েকটি প্রাসাদের পতন ঘটে। সবশেষে মুসলমানেরা আস-সুলেমান এবং আল-ওয়াথি প্রাসাদদ্বয়ে পৌছেন। এই প্রাসাদ দুটিতে পূর্ব থেকে ইহুদি নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছিল। ইহুদিরা শেষমেশ যুদ্ধ বিরতির আবেদন করেন। নবি যুদ্ধবন্দীদের বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং ইহুদিদের কৃষি জমির মালিকানা মুসলমানদের হাতে দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও ইহুদিরা সে জমিতে কাজ করতে পারবে এবং তারা তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক মুসলমানদের দেবে।
খায়বার যুদ্ধ থেকে নবির কাছে গনিমতের ভাগ পড়ে সাফিয়া নামের ইহুদি রমণী। সেই সাফিয়া, যিনি স্বপ্নে চাঁদকে তার কোমরে নামতে দেখেছিলেন এবং স্বামীকে তা বলার পর আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। মদিনায় ফেরত আসার আগে নবি সাফিয়াকে বিয়ে করেন। খায়বারের পূর্বে ফাদাকের জলাশয়ের কাছে অন্য ইহুদি গোত্র বসবাস করত, তাও মুসলমানরা দখল নিতে সক্ষম হোন। এ-জন্যে তাদের কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। খায়বারের ইহুদিদের পরিণতির কথা বলতে ফাদাকের ইহুদিরা ভয়ে বিনা যুদ্ধে আত্মসমৰ্পন করেন এবং তাদের উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক মুসলমানদের দিতে রাজি হোন। মদিনার দক্ষিণে ওয়াদি আল-কোরা ও তায়মাতে বসবাসকারী ইহুদিরাও মুসলমানদের নিকট আত্মসমর্পণ করেন এবং আরোপিত শর্ত হিসেবে জিজিয়া কর দিতে রাজি হন। এভাবে মুসলমানদের বিজয় রথ এগুতে থাকে। হেজাজের সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল নবি মুহাম্মদের শাসনাধীন হয়। এটা উল্লেখ্য যে খায়বার যুদ্ধ জয়কে নবি অত্যন্ত দক্ষতার সহিত কূটনীতিতে কাজে লাগিয়েছেন। যুদ্ধ জয়ের পর বেদুইনদের বানু গাতাফান গোষ্ঠীকে নবি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেন। এই গোষ্ঠী ইহুদিদের সাথে বেশ সম্পর্কিত ছিল। তারা নবির সাহচর্যে না এসে ইহুদিদের সাথে থাকলে হয়তো মুসলমানদের এ-যুদ্ধ জয় করা অনেক কষ্টসাধ্য হতো। বানু গাতাফান গোষ্ঠীকে তাই গনিমতের মালের অর্ধেকই দিয়ে দেন নবি।
হিজরতের পরে নবির কার্যাবলী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসময় নবি ধর্মপ্রচারের সাথে সাথে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে সময় দিয়েছেন বেশি। যুদ্ধ জয়ে মুসলমানদের অন্যতম কৌশল ছিল ‘গাজওয়াবা আকস্মিক আক্রমণ করা। অন্য অনেক পদ্ধতি অনুসরণ করে আক্রমণ করা হতো, তবে তা সুনির্দিষ্ট গুপ্তচরদের পাঠানো গোপন তথ্যের উপর ভিত্তি করে। এভাবে কয়েকটি কুরাইশ বাণিজ্যিক কাফেলাকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হয়। এসব আক্রমণ যেমন বিপক্ষ দলকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি প্রাপ্ত গনিমতের মাল বিজয়ী মুসলমানদের আরও নিবেদিতপ্রাণ যোদ্ধা হতে উৎসাহিত করেছে।
হিজরি ৩ সালে (৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) মদিনার নিকট ওহুদ পাহাড়ের ময়দানে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজয় মুসলমানদের জন্য ছিল একটি বিরাট ধাক্কা। কিন্তু এই পরাজয় অবধারিত ছিল না। যুদ্ধে পরাজিত মুসলমানদের মদিনায় ফেরত না পাঠিয়ে আবু সুফিয়ানের কুরাইশ দল মক্কায় ফেরত চলে যায়। এই যুদ্ধে নবির রণকৌশল অনুসরণ করা হয়নি। নবির নির্দেশ মেনে মুসলমানরা পাহাড়ের ঢালে অবস্থান নেননি। নিলে অবশ্য এই যুদ্ধে হারতেন না। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে কেউ কেউ গনিমতের মাল আগেভাগেই হস্তগত করার জন্য যার যার জায়গা ছেড়ে যান। ফলে যুদ্ধে পরাজিত হন।
হিজরি ৫ সালে (৬২৭ খ্রিস্টাব্দে) মুসলমানরা পুনরায় বিপদের সমুখীন হোন। কুরাইশ এবং বেদুইনরা সমিলিতভাবে মদিনা দখলের চেষ্টা করেন। ইসলামের ইতিহাসে এ-ঘটনাকে বলা হয় খন্দকের যুদ্ধে। এই যুদ্ধে মুসলমানরা মদিনার চারপাশে এক ধরনের পরিখা খনন করেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি। প্রচলিত আছে যে, এই পরিখা নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম ইরানি নাগরিক সালমান আল-ফার্সি। কুরাইশদের পক্ষে পুনরায় নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। একজন কুরাইশ যোদ্ধাও পরিখা পার হয়ে মদিনায় প্রবেশ করতে পারেননি। মুসলমানদের জন্য ঝুঁকি ছিল মদিনার ভেতরে থাকা ইহুদি বানু কুরাইজা গোষ্ঠী কুরাইশদের সাথে যোগ দিতে পারে। কুরাইজা গোষ্ঠী যদি কুরাইশদের সাথে যোগ দিতো তবে মুসলমানরা এ যুদ্ধে পরাজিত হবার ও ইসলামের প্রসার থমকে যাবার সম্ভাবনা ছিল। নবি মুহাম্মদের কৌশলের কারণে সে যাত্রায় বিপদ কেটে যায়। দুই সপ্তাহ পর কুরাইশরা যুদ্ধ থেকে ক্ষান্ত দেন।
ও কুরাইশদের মধ্যে দ্বন্দু সৃষ্টির জন্য নিযুক্ত করেন। নোয়াম বিন মাসুদের সাথে মদিনার ইহুদি ও কুরাইশদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। ফলে উভয়েই তাকে নবি মুহাম্মদের প্রতিপক্ষ ভেবেছিলেন এবং তার বক্তব্য বিশ্বাস করেছিলেন। নোয়াম বিন মাসুদের ভূমিকার ফলে বানু কুরাইজা ও কুরাইশ বাহিনী একে অপরকে অবিশ্বাস করেন। অবশেষে বানু কুরাইজাদের তরফ থেকে কোনো সহযোগিতা না পেয়ে এবং হঠাৎ করে শৈতপ্রবাহে টিকতে না পেরে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যান। কুরাইশরা মক্কা ফেরত যাবার পরই নবি সশস্ত্র সৈনিকের একটি দল প্রেরণ করেন বানু কুরাইজাদের রাস্তায়। বানু কুরাইজা ভেবেছিল আবু সুফিয়ানের বাহিনীকে সাহায্য না করায় মুসলমানরা বোধহয় এবার সহনশীল আচরণ করবে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য ভবিষ্যতের হুমকি মনে হওয়াতে নবি তাদেরকে মদিনা থেকে সমূলে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কুরাইজাদের বিনাশ ইসলামের বিকশিত শক্তি সম্পর্কে অন্যদের ভীত করবে, মুসলমানদের জন্য বিশাল গনিমতের ব্যবস্থা হবে, তেমনি মদিনার আউস ও খাজরাজ গোষ্ঠীর লোকেরা ইসলামের পতাকার প্রতি আরও অনুগত হবেন।
৬২৫ খ্রিস্টাব্দের প্রেক্ষাপটে বানু-নাজির গোত্রের খেজুর গাছের বাগানে মুসলমানদের আগুন দেয়া ছিল ঘৃণিত একটি কাজ। যুদ্ধে পরাস্ত করার অন্য কোনো উপায় দেখে নবি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কোরানের সুরা হাশর-এর ২-১৭ নম্বর আয়াত নবির সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক ভিত্তি দেবার জন্য নাজিল হয়েছে। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানরা একই ধরনের কঠোর পদ্ধতি গ্রহণ করেন তায়েফ-নিবাসী বানু সাকিফদের অবরোধ করে রাখার সময়। অবরোধের মাধ্যমে মুসলমানরা বানু সাকিফদের বাইরে থেকে খাদ্য আসা বন্ধ করে দেন। কিন্তু শীঘ্রই মুসলমানরা বুঝতে পারেন, বানু সাকিফদের আবাসস্থলের ভেতরে খাদ্যের বড় মজুদ রয়েছে। দীর্ঘ মেয়াদে অবরুদ্ধ করে রাখলেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না। অন্যদিকে নবি আরব মুসলমান সৈনিকদের অস্থির চরিত্রের কথা চিন্তা করেন। অচিরেই সৈনিকেরা ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়বেন। তাই দ্রুত যুদ্ধ জয়ের কথা চিন্তা করে বানু সাকিফদের আঙ্গুরের ক্ষেত পুড়িয়ে দেবার আদেশ দেন। জীবিকার উৎস হিসেবে বানু সাকিফদের নিকট এই আঙ্গুরের ক্ষেত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তারা নবির কাছে একজন দূত প্রেরণ করে মুসলমানদের এ-রকম ধংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেন। বিনিময়ে সমস্ত আঙ্গুর ক্ষেতের মালিকানা মুসলমানদের দিয়ে দেবার প্রস্তাব দেন। নবি তায়েফ অবরোধ স্থগিত করে মক্কা ফিরে যান এবং হাওয়াজেন গোত্র থেকে নেয়া গনিমতের মাল বন্টন করেন। বানু সাকিফ গোত্রের এক নেতা মালেক বিন আউসকে প্রস্তাব দেন, মালেক ইসলামে দীক্ষিত হলে তার স্ত্রী-সন্তানদের মুক্তি দেবার সাথে সাথে একশত উট প্রদান করা হবে। প্রস্তাবে রাজি হয়ে মালেক বিন আউস নিজের ধর্ম-গোত্র ত্যাগ করে নবির উপস্থিতিতে ইসলাম গ্রহণ করেন। এই সব ঘটনা ইসলামের প্রাথমিক যুগে লিখিত বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থে লেখা আছে এবং তা নির্ভরযোগ্যও। ইসলামের প্রাথমিক বছরগুলোর ঘটনা নবি মুহাম্মদের মানসিকতা ও নতুন ধর্ম হিসেবে ইসলামের দ্রুত প্রসারের লৌকিক ব্যাখ্যা প্রদান করে।
মক্কা জয়ের পর এবং তায়েফ জয়ের পূর্বে নবি হাওয়াজেন গোত্রকে পরাস্ত করে প্রচুর গনিমতের মাল লাভ করেন। গনিমতের মাল বন্টনের সময় মুসলমানরা ভয় পেতেন, নবি উদারভাবে নব্য মুসলমানদের গনিমতের মাল সব দান করে ফেলবেন। যেভাবে তিনি মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায় কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান, তার সন্তান মুয়াবিয়া, আল-হারেস বিন আলহারেস, আল-হারেস বিন হিশাম, সোহেল বিন অমর এবং হাওয়াতেব বিন আব্দুল ওজাকে ১০০টি করে উট উপহার দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় মদিনার আনসারগণ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তাদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সাদ বিন ওবাদা নবির কাছে আনসারদের এ ক্ষোভের কথা জানান। নবি তখন আনসারদের ডেকে পাঠান, তাদের বক্তব্য শোনার জন্য। নবির এই কার্যক্রম তার কূটনৈতিক ও অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা প্রমাণ করে। নবি আনসারদের উদ্দেশ্যে বলেন, ও আমার আনসারেরা এটা কি ভালো নয় যে অন্যরা উট নিয়ে ফিরে গেল আর তোমরা ফিরে যাবে আল্লাহর দয়া নিয়ে?” মদিনায় অবস্থানকালীন সময়ে নবি মুহাম্মদ সম্পর্কে যে দলিল বা তথ্য ইসলামের ইতিহাসের প্রথমদিককার ঐতিহাসিকরা প্রকাশ করেছেন তাতে নবির চরিত্রে ধর্মপ্রচারকের সাথে একজন রাষ্ট্রনায়কের চিত্রও ধরা পড়ে। মুহাম্মদের জীবনী নিয়ে যে কোনো একনিষ্ঠ পাঠক পড়াশুনা করলে এ-ধরনের অসংখ্য প্রমাণ পাবেন।
তফসির আল-জালালাইনে সুরা নিসা-এর ১০৫-১০৭ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় নীচের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। তমা বিন ইবরিক নামের একজন ব্যক্তি একজন সৈনিকের পোশাক চুরি করে তা ইহুদি ব্যক্তির ঘরে লুকিয়ে রাখেন। পোশাকের মালিক পোশাকটি লুকানো স্থানে খুঁজে পান। পোশাকের মালিক যখন পোশাক চুরির জন্যে তমাকে দায়ী করেন তখন তমা নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ওই ইহুদি ব্যক্তিকে ‘চোর বলে দাবি করেন। তমার আত্মীয়রা এ-বিষয়টি নবির সামনে উপস্থাপন করেন এমনভাবে যে, তমা একজন মুসলমান তাই নবি যেন তমার পক্ষপাতিত্ব করেন। কিন্তু নবি তা করেননি। পক্ষপাতিত্বের চেয়ে তিনি সত্যকেই প্রাধান্য দিলেন। সুরা নিসার ১০৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ; আমি তোমার প্রতি সত্যসহ কিতাব অবতীর্ণ করেছি যাতে তুমি মানুষের মধ্যে সেই মতো বিচার করতে পার আল্লাহ তোমাকে যেমন জানিয়েছেন। তুমি বিশ্বাসঘাতকদের জন্য তর্ক করো না। (৪:১০৫)। সুরা হজুরাত-এর ৯ নম্বর আয়াতেও একই ধরনের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এখান থেকে নবি মুহাম্মদের নেতৃত্বের গুণাবলীই যে প্রকাশিত হয় শুধুতাই নয়, সেই সাথে তৎকালীন আরব মুসলমান সমাজের অবস্থা ও দলাদলির চিত্রও উঠে এসেছে। আয়াতটি হল: বিশ্বাসীদের দুই দল দ্বন্দুে লিপ্ত হলে তুমি তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবে। তারপর তাদের এক দল যদি অন্য দলের বিরুদ্ধে সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে তাদের সাথে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আল্লাহর নির্দেশের কাছে আত্মসমর্পণ করে। যদি তারা আত্মসমর্পণ করে তবে তাদের ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা করে দেবে, সুবিচার করবে। আয়াতটি একই সাথে পরিষ্কার এবং বোধগম্য। তফসির আল-জালালাইনে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ আছে যেখানে তৎকালীন আরবের সমাজিক অবস্থা ও নবি অনুসারীদের মধ্যকার মনোমালিন্যের বিষয়টি ফুটে ওঠেছে ; নবি একবার একটি গাধার পিঠে চড়ছিলেন এবং যখন তিনি আব্দুল্লাহ বিন উবায়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন গাধাটি শুকনো মলত্যাগ করে। ইবনে উবায় দুর্গন্ধের জন্যে নিজের নাক চেপে ধরেন। তখন সেখানে উপস্থিত আনসারদের এক নেতা আব্দুল্লাহ বিন রাওহা বলেন, ইবনে উবায়, আল্লাহর নামে শপথ নিয়ে বলছি, রসুলের কাছে তোমার শরীরে ব্যবহার করা সুগন্ধির চেয়ে গাধার এই মলের গন্ধ কম অসহনীয়। ইবনে রাওহার এই বক্তব্য নিয়ে তার অনুসারীদের সাথে ইবনে উবায়ের অনুসারীদের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে লাঠি-জুতা নিয়ে দুই পক্ষ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে।
মক্কা বিজয়ের পর কবি বোজায়ের বিন জোহায়ের বিন আবু সালমা তার ভাই কবি কাব বিন জোহায়েরকে একটি চিঠি লিখেন : যে কবিরা নবির নামে কবিতা লিখেছেন কিংবা নবির মনে কষ্ট দিয়েছেন, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হচ্ছে। যারা এধরনের কাজ করেছিল তাদের অনেকেই এখন মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তাই আপনি নিরাপদে থাকতে চাইলে নবির কাছে গিয়ে ক্ষমা চাওয়া উচিত। অতীত কাজের জন্য যারা ক্ষমা প্রার্থনা করছেন নবি তাদেরকে শাস্তি দিচ্ছেন না। অন্যথায় আপনার উচিত মক্কা ছেড়ে চলে যাওয়া যাতে মুসলমানরা আপনাকে দেখতে না পায়। কাব ঠিক করলেন তিনি ইসলাম গ্রহণ করবেন। জীবন বাঁচাতে তিনি নবির প্রশংসা করে একটি কবিতা লেখেন যা আলখাল্লার কবিতা নামে পরিচিত। কারণ নবি কবিতাটি শুনে এতো খুশি হয়েছিলেন যে, তিনি কাবকে তার নিজের একটি আলখাল্লাল উপহার দিয়েছিলেন।
ওই সময়ে আরবের মানুষ সরল এবং অনানুষ্ঠানিক জীবনযাপন করতেন। তাই তারা তাদের নেতার সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ করতেন। তাদের কাছে একমাত্র বাধ্যবাধকতা ছিল কোরানের নির্দেশ মেনে চলা। তারা নবি মুহামদকে নিজেদের একজন মনে করতেন। কিন্তু এধরনের সম্পর্ক বেশি দিন থাকেনি। নিয়ম-কানুনের বাধ্যবাধকতা ও রীতিনীতি মেনে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নবি মুহাম্মদকে সমান দেখানো প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে। সুরা হুজুরাত-এর ১-৫ নম্বর আয়াতে এবং কোরানের আরও কিছু আয়াতের মাধ্যমে নবির জন্য তার অনুসারীদের আদব-কায়দা নির্ধারিত করে দেয়া হয়েছে ; হে বিশ্বাসিগণ! আল্লাহ ও তার রসুলের আগে যাওয়ার চেষ্টা করো না। (৪৯:১)। যেহেতু আল্লাহর উপস্থিতি চোখে দেখা যায় না, তাই এই আয়াতের মৰ্মার্থ হচ্ছে, বিশ্বাসিগণ, তোমাদের সামনে নবি উপস্থিত থাকলে নবি স্থান ত্যাগ করা না পর্যন্ত তোমরা কোনো কথা বলো না বা কোনো কাজ করো না। পরবর্তী আয়াত হচ্ছে: “হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা নবির কণ্ঠস্বরের ওপরে নিজেদের কণ্ঠস্বর উচু করো না আর নিজেদের মধ্যে যেভাবে উচুগলায় কথা বলো তার সঙ্গে সেভাবে উচুগলায় কথা বলো না। (৪৯:২)। এই আয়াতের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে তারা যেন হজরত ওমরের মতো কোনো আচরণ না করেন। যেমন, হজরত ওমর হুদায়বিয়ার সন্ধির পর অন্যদের সমুখেই সন্ধির শর্তাবলী নিয়ে উচ্চস্বরে প্রশ্ন তুলেছিলেন এবং মুহামদকে ‘আল্লাহর রসুলনা বলে শুধু মুহাম্মদ বলে সম্বোধন করেছিলেন। ‘যারা আল্লাহর রসুলের সামনে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে, আল্লাহ তাদের অন্তরকে পরিশোধন করেছেন, যাতে তারা সাবধান হয়ে চলতে পারে। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার।’(৪৯:৩)। স্পষ্টত আরবেরা এধরনের আদব-কায়দার সাথে পরিচিত ছিলেন না। নবি মুহাম্মদের ক্ষমতা গ্রহণের পরই তারা এসব পালন করা শেখে। ( হে নবি!) যারা ঘরের পেছন থেকে তোমাকে উচুগলায় ডাকে তাদের বেশির ভাগই হচ্ছে নির্বোধ। (৪৯:৪)। নবির বাড়ির পেছন দিকে তার স্ত্রীরা থাকতেন। সেদিক দিয়ে যারা চলাফেরা করত এবং নবিকে শুধু মুহামদ বলে সম্বোধন করত, তা নবি পছন্দ করতেন না। (অথবা আল্লাহ এই আচরণ পছন্দ করতেন না, কারণ এই বাক্যগুলো তো আল্লাহর!) একটা সময় পর্যন্ত এই ধরনের সম্বোধন স্বাভাবিক ছিল। নবি তার সার্থী ও অনুসারীদের নিয়ে একসাথে কাজ করতেন। যুদ্ধের জন্য পরিখা পর্যন্ত খনন করেছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আরোহণের পর তা বন্ধ হয়ে যায়। তোমার বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা যদি ধৈর্য ধরত তা হলে তাই হতো তাদের জন্য ভালো।’(৪৯:৫)। মুসলমানদের জন্য শিষ্টাচারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি হয় সুরা মুজাদালা-এর এই আয়াতের মাধ্যমে: হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা রসুলের সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলে তার আগে কিছু সদকা দেবে।’(৫৮:১২)। অর্থাৎ নবির সাথে আদব-কায়দা প্রদর্শন কেমন হবে তা পরিষ্কার হয় এই আয়াত থেকে। কিন্তু যেসব দরিদ্র মুসলমানের নিকট এই নিয়ম মেনে চলা কষ্টসাধ্য মনে হয়েছিল তাদের জন্য পরবর্তী আয়াতে শৈথিল্য প্রদর্শন করা হয়েছে : “যদি তোমরা সদকা দিতে না পার, তবে আল্লাহ তোমাদের দিকে মুখ তুলে চাইবেন…। (৫৮:১৩)।
নবির বাড়িতে প্রবেশের বিধি-নিষেধ আবার আসে সুরা আহজাব-এর ৫৩ নম্বর আয়াতে: হে বিশ্বাসিগণ! তোমাদেরকে অনুমতি না দেয়া হলে, খাবার তৈরির জন্য অপেক্ষা না করেণ, খাওয়ার জন্য নবির বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না। তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে তোমরা যাবে ও খাওয়ার পর চলে আসবে। কথাবার্তায় তোমরা মেতে যেও না; এমন ব্যবহার নবির বিরক্তির সৃষ্টি করে। সে তোমাদেরকে উঠে যাওয়ার জন্য বলতে সংকোচ বোধ করে। কিন্তু আল্লাহ সত্য কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন না…। (৩৩:৫৩)। এই আয়াত নিয়ে মন্তব্যের প্রয়োজন নেই, কারণ তখন যা ঘটতো তারই সাক্ষী দিচ্ছে এই আয়াত। সাহাবিরা প্রায়ই আগে থেকে না-জানিয়ে নবির বাড়িতে প্রবেশ করতেন। খাবারের জন্য অপেক্ষা করতেন এবং খাবারের পর একে অন্যের সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করতেন। মুহাম্মদ রসুল হবার পর থেকে এ-ধরনের আচরণ আশোভন হিসেব বিবেচনা করা হয়। মুহাম্মদের সাথে সাধারণ মানুষের কিছুটা দূরে রাখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। কিন্তু সেটা মুহাম্মদের পক্ষে সরাসরি বলা অস্বস্তিকর। কিন্তু আল্লাহর জন্য নয়, কারণ তিনি এ-সকল অস্বস্তির উর্ধ্বে। অথবা অন্যভাবে বলা যায়, আল্লাহ তার রসুলের কণ্ঠে সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতি সঠিক ব্যবহারের শিক্ষা প্রদান করেন। এই ব্যখ্যার ভিত্তি আরও সুদৃঢ় করে একই আয়াতের পরের বাক্যটি। যদিও এক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর ভিন্নতা রয়েছে ; তোমরা তার (নবির) স্ত্রীদের কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এ-বিধান তোমাদের ও তাদের হৃদয়ের জন্য পবিত্রতর…। (৩৩:৫৩)। হজরত আয়েশা বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, রসুল মুহাম্মদ ও আমি একবার এক থালা থেকেই খাবার খাচ্ছিলাম। তখন হজরত ওমর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রসুল ওমরকে আমাদের সাথে খাবারের আমন্ত্রণ জানালেন। ওমর আমাদের সাথে খেতে বসলে ওমরের আঙুল আমার আঙুলকে স্পর্শ করে। ওমর নবিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, যদি পূর্বে আমার উপদেশ কর্ণপাত করতেন, তবে কারো চোখ তাকে (আয়েশা) দেখতে পারতো না। এরপর-ই পর্দা সম্পর্কে উপরোক্ত আয়াত নাজিল হয়।
আব্দুল্লাহ বিন আল-আব্বাসের বর্ণিত একটি হাদিস অনুযায়ী সুরা আহজাবের ৫৩ নম্বর আয়াত নাজিলের কারণ হচ্ছে হজরত ওমরের মন্তব্য। যেখানে হজরত ওমর নবিকে বলেন, আপনার স্ত্রীরা অন্য স্ত্রীলোকের মতো নয়। সুরা আহজাবের ৩২ নম্বর আয়াতও শুরু হয়েছে একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে: “হে নবিপত্নীগণ! তোমরা তো অন্য নারীদের মতো নও। (৩৩:৩২)। কেন রসুলের স্ত্রীরা অন্যদের থেকে আলাদা হবেন? কারণ সোজা কথায় নবি মুহাম্মদের মর্যাদা অন্য সাধারণ মানুষের মতো একই পর্যায়ে ছিল না। নবির মর্যাদা ধরে রাখার জন্যে তার স্ত্রীদের মর্যাদাও ধরে রাখতে হবে। তাদেরকে প্রাচ্যের রাজকুমারীদের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। সুরা আহজাব-এর ৫৩নম্বর আয়াতের (যার অংশবিশেষ ইতোমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে) শেষ বাক্য উপরোক্ত বিষয়বস্তুকে সমর্থন করে: . . . তোমাদের কারও পক্ষে আল্লাহর রসুলকে কষ্ট দেয়া বা তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীদেরকে বিবাহ করা সংগত হবে না। আল্লাহর কাছে এ গুরুতর অপরাধ। (৩৩:৫৩)। নবি মুহামদ তার স্ত্রীদের নিয়ে খুব সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, ইজরাইলের প্রাচীন রাজাদের মতো তার স্ত্রীরা কোনো পরপুরুষ থেকে অস্পৃশ্য থাকবেন। এমন কি নবি মারা গেলেও। সাধারণ ধর্মান্তরিত মুসলমান থেকে নবি মুহাম্মদের মর্যাদা বেশি তা কোরানের ভিন্ন আরেকটি আয়াত থেকে ধারণা পাওয়া যায়। মক্কা বিজয়ের পর সুরা হুজুরাত-এর ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: আরব মরুবাসীরা বলে, “আমরা বিশ্বাস করলাম। বলো, তোমরা বিশ্বাস করনি। বরং বলো, আমরা আত্মসমৰ্পন করার ভাব দেখাচ্ছি। কারণ এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মায়নি। (৪৯:১৪)।
সদ্য মুসলমান হওয়া ব্যক্তিরা যখন বলেন, তারা স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন, বল প্রয়োগ কিংবা যুদ্ধের ফলে ভীত হয়ে ধর্মান্তরিত হননি, তখন সুরা হুজুরাত-এর ১৭ নম্বর আয়াত নাজিল হয় ‘ওরা মনে করে ওরা আত্মসমর্পণ করে তোমাকে ধন্য করেছে। বলো, তোমাদের আত্মসমর্পণ আমাকে ধন্য করেছে মনে করো না, বরং বিশ্বাসের দিকে পরিচালিত করে আল্লাহই তোমাদেরকে ধন্য করেছেন। (৪৯:১৭)। অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণ করলেই বিশ্বাসী প্রমাণিত হয় না। নবির মতো ইসলামের জন্য উৎসর্গিকৃতও বোঝা যায় না। ফলে তাদের সাথে নবির মান-মর্যাদা তুলনীয় নয়।- অনুবাদক। সদ্য ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়া মুসলমানদের অত্যুৎসাহী মনোভাব আর গরিমার কথা জানতে পেরে নবি তাদের সমালোচনা করেন এবং সদকা দিতে নির্দেশ দেন। মক্কি সুরা ফাজর-এ এরকম ব্যক্তিদের সম্পর্কে একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে। এই সুরাটি তিনি কাবা ঘরের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠ করে মক্কাবাসীকে শুনিয়েছিলেন। দুঃখজনক হচ্ছে আরবি কোরানের এই মনোমুগ্ধকর আর চাঞ্চল্যে ভরা সুর আক্ষরিক অনুবাদের মধ্যে ফুটে ওঠে না। তথাপি এই সুরার কিছু আয়াত দুর্বল অনুবাদের মাধ্যমে তুলে ধরা হল: তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক কী করেছিলেন আদ বংশের ইরাম গোত্রের ওপর যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের”, যার সমতুল্য কোনো দেশে তৈরি হয়নি? আর সামুদদের ওপর? যারা কুরা উপত্যকায় পাথর কেটে ঘর বানিয়েছিল? আর বহু শিবিরের অধিপতি ফেরাউনের ওপর? যারা দেশে সীমালঙ্ঘন করেছিল, ও সেখানে অশান্তি বাড়িয়েছিল। তারপর তোমার প্রতিপালক তাদের ওপর শাস্তির কশাঘাত হানলেন। তোমার প্রতিপালক তো সতর্ক দৃষ্টি রাখেন।’ (৮৯৬-১৪)। না, আসলে তোমরা পিতৃহীনকে সম্মান কর না, তোমরা অভাবগ্রস্তদের অন্নদানে পরস্পরকে উৎসাহিত কর না, আর তোমরা উত্তরাধিকারীদের জন্য রেখে-যাওয়া ধনসম্পদ পুরো খেয়ে ফেল, আর তোমরা ধনসম্পদ বড় বেশি ভালোবাস। ( ৮৯:১৭-২০)।
লাগাম টেনে ধরার দরকার ছিল। সুরা নিসা-এর এই আয়াতে দেখতে পাই : হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা যখন আল্লাহর পথে বের হবে তখন পরীক্ষা করে নেবে। আর কেউ তোমাদের মঙ্গল কামনা করলে বা শ্রদ্ধা জানলে ইহজীবনের সম্পদের লোভে তাকে বলো না, তুমি বিশ্বাসী নও। কারণ আল্লাহর কাছে অনায়াসলভ্য সম্পদ (গনিমতের মাল) প্রচুর রয়েছে। তোমরা তো পূর্বে এমনই ছিলে! তারপর আল্লাহ তোমাদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, সুতরাং তোমরা পরীক্ষা করে নেবে। তোমরা যা কর আল্লাহ তা ভালো করেই জানেন। (৪৯৪)। এই আয়াতটি যে ঘটনার প্রেক্ষিতে নাজিল হয় তা হচ্ছে: এক অভিযানের সময় নবির কয়েকজন অনুসারী সোলায়াম গোত্রের এক মেষ-পালককে আক্রমণ করেন। সেই মেষ-পালক তাদেরকে সালাম জানিয়ে সম্ভাষণ করেছিলেন, যা মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত প্রিয় ও প্রয়োজনীয়। কিন্তু অনুসারীরা ধরে নিলেন, মেষ-পালকটি ভীত হয়ে তাদেরকে সালাম দিয়েছেন তাই মেষ-পালককে হত্যা করতে দ্বিধা করলেন না। আর মেষগুলো গনিমতের মাল হিসেবে দখলে নেন তারা।
আরব সমাজে সে-সময় প্রচলিত আদব-কায়দার আরও কিছু উল্লেখ পাওয়া যায় সুরা হুজুরাত-এর ১১ নম্বর আয়াতে : ‘হে বিশ্বাসিগণ! কোনো পুরুষ যেন অপর পুরুষকে উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয়, সে উপহাসকারীর চেয়ে ভালো হতে পারে; আর কোনো নারীও অপর নারীকেযেন উপহাস না করে, কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করো না। আর তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা খারাপ কাজ। (৪৯:১১)। এই আয়াত নাজিল হওয়া সম্পর্কে জানা যায়, তামিম গোত্রের কয়েকজন আমার, শোয়েবসহ কয়েকজন গরীব-অসহায় মুসলমানদের নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা করেছিলেন। কোরানে এরকম ডজনখানেক আয়াত রয়েছে যা মানুষের মূল্যবোধ, আচার-আচরণ, আদব-কায়দার প্রতি দিকনির্দেশনা দেয়; যেমন, কোন অবস্থায় কী করতে হবে, কী করা যাবে না, কিভাবে কী বলতে হবে এবং কখন নিশ্চপ থাকতে হবেইত্যাদি। একই সাথে এই আয়াতগুলি থেকে নবি মুহামদের সময় আরব মানুষের সামাজিক আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।