৩.৫ দুর্যোগের ঘনঘটা

দুর্যোগের ঘনঘটা

১১৭৪ সালের মে মাস। সুলতান নুরুদ্দীন জঙ্গী মৃত্যুবরণ করলেন এই মাসের কোন একদিন। এটি ইসলামের ইতিহাসের একটি অন্ধকার দিন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃতদেহকে এখনো গোসলও দেয়া হয়নি। তার আগেই আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বেশকিছু মানুষের চেহারা। এরা খৃস্টান নয়। কথাটা এভাবেও বলা যায় যে, নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুতে যারা আনন্দিত হয়েছিল, তারা শুধু খৃস্টানই ছিল না, তাদের মধ্যে এমন কতিপয় মুসলমানও ছিল, যাদের আনন্দ ছিল খৃস্টানদের অপেক্ষা বেশী। এরা মুসলিম রিয়াসত ও জমিদারির আমীর-শাসক। জঙ্গীর মৃত্যু সংবাদ শোনামাত্র এরা সকলেই জঙ্গীর বাসভবনে ছুটে এসেছে। এসেছে জঙ্গীর জানাযায় শরীক হওয়ার জন্য। তাদের মধ্যে কতিপয়কে এমন অস্থির দেখাচ্ছিল, যেন তারা জঙ্গীর মৃত্যুতে শোকাহত। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাদের অস্থিরতা ছিল জঙ্গীকে দ্রুত সন্ধ্যার আগেই দাফন করার জন্য। তাদের তর সইছে না।

জঙ্গীর মৃত্যুতে তারা সকলেই সমবেত হয়েছে। এদিক থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তাদের হৃদয় শতধা-বিভক্ত। একজন অপরজনকে সন্দেহের চোখে দেখছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। তাদের ধর্ম এক, আল্লাহ এক, রসূল এক, কুরআন এক, দুমশনও এক। কিন্তু অন্তর তাদের একটি থেকে অপরটি আলাদা। তাদের দৃষ্টান্ত কোন গাছের এমন কতগুলো ডালের ন্যায়, যেগুলো গাছ থেকে ভেঙ্গে আলাদা হয়ে পড়ে গছে।

যুগটা ছিল মূলত নবাবী ও জামিদারীর। কিছু মুসলিম রিয়াসত সামান্য বিস্তৃত হলেও অন্যগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র। তাদের শাসকদেরকে আমীর বলা হত। তারা ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফতের অধীন। ইসলামের কোন দুশমনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে এই আমীরগণ খেলাফতকে আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা দিত। কিন্তু এই সাহায্য শুধুমাত্র সাহায্য পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। তাতে কোন জাতীয় চেতনা ছিল না। তারা জমিদারী টিকিয়ে রাখার জন্য খেলাফতের দাবি পূরণ করত। আবার সেই একই লক্ষ্যে ইসলামের একমাত্র দুশমন খৃস্টানদের সঙ্গে তলে তলে বন্ধুত্ব গড়ে তুলত। তাদের কেউ কেউ গোপনে খৃস্টানদের সঙ্গে চুক্তিও করে রেখেছিল। কিন্তু নুরুদ্দীন জঙ্গীর অস্তিত্ব খৃস্টানদের অগ্রগতির পথে বিরাট এক প্রতিবন্ধক ছিল। তিনি এই মুসলিম আমীরদেরকে বহুবার সতর্কও করেছিলেন। তাদেরকে একথা বুঝাবার প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন যে, খৃস্টানরা তোমাদেরকে ইসলামী ঐক্য থেকে সরিয়ে নিয়ে হজম করে ফেলবে। কিন্তু খৃস্টানদের পরিবেশিত ইউরোপীয় মদ, সুন্দরী নারী আর চকচকে সোনার টুকরোর মধ্যে এতই শক্তি ছিল যে, এগুলো তাদের কানে তুলা ও বিবেকে অর্গল এঁটে দিয়েছিল। জঙ্গীর আহ্বান পাথরের সঙ্গে টক্কর খেয়ে ফিরেই আসে শুধু।

তাদের প্রথম পরিচয় তারা জমিদার জায়গীরদার, নবাব, আমীর ও হাকেম। ধর্মের প্রশ্ন দেখা দিলে পরে মুসলমান। মুসলমান পরিচয়টা ছিল তাদের তৃতীয় এবং গৌন। তাদের ধর্ম পরিচয় যদিও ছিল, ছিল তা ক্ষমতা আর জায়গীরদারীর জন্য। এটাই তাদের ঈমান। তারা ইসলামী ঐক্যের কথা ভাবত না। তারা যুদ্ধের ঘোর বিরোধী ছিল। কেননা, তাদের আশংকা ছিল, খৃস্টানরা তাদের জায়গীরদারী কেড়ে নেবে। তাদের মনে এই ভয়ও ছিল যে, তাদের প্রজারা যদি দুশমনের পরিচয় পেয়ে যায়, তাহলে তাদের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও ঈমানী শক্তি জেগে উঠবে। তারা তাদের নবাবীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেবে। বস্তুত প্রজারা তাদের জন্য স্বতন্ত্র এক হুমকিই ছিল। তাদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ছিল বিদ্যমান। জঙ্গীর বাহিনী তাদেরই ভাই-বন্ধু ছিল। জঙ্গীর মুজাহিদরা নিজেদের অপেক্ষা দশগুণ বেশী সৈন্যের মোকাবেলা করেছে। এ ছিল চেতনার ফল। এই চেতনা দুচোখে সহ্য করতে পারত না আমীরগণ। তাই নুরুদ্দীন জঙ্গী ছিলেন তাদের অপ্রিয়। আর সালাহুদ্দীন আইউবীকেও তারা দুশমন ভাবত। এখন জঙ্গী মারা গেছেন। তারা আনন্দিত। তারা মনে করত, এই জগত দ্বিতীয় আর কোন জঙ্গীর জন্ম দেবে না। জঙ্গীর সঙ্গে জিহাদও দাফন হয়ে যাবে।

জঙ্গীকে দাফন করা হয়েছে। খৃস্টানদের মনে মুসলমানদের যে ভীতি ছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। এখন আর একটি কাটা অবশিষ্ট আছে, সে হল সুলতান। আইউবী। কিন্তু এ কাটা নিয়ে তাদের তেমন কোন ভাবনা নেই। সুলতান আইউবী এখন নিঃসঙ্গ। তাকে সাহায্যদাতা জঙ্গী মারা গেছেন। খৃস্টানদের বড় আনন্দ এই জন্য যে, জঙ্গীর মৃত্যুর পর তাদের অনুগত আমীর-উজীরগণ জঙ্গীর অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র আল মালিকুস সালিহকে সিংহাসনে বসিয়েছে। বয়স তার এগার বছর। খেলাফতের মূল সিংহাসন এখন খৃস্টানদের হাতে।

খৃস্টানদের অনুগত আমীরদের মধ্যে একজন হলেন গোমস্তগীন। একজন মওসেলের গবর্নর সাইফুদ্দীন। একজন দামেস্কের শাসক শামসুদ্দীন ইবনে আবদুল মালেক। আল জাজীরা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার রাজত্ব নুরুদ্দীন জঙ্গীর ভাতিজার হাতে। তাছাড়া আরো কয়েকজন জায়গীরদার আছেন। তারা সকলেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তারা সকলেই আনন্দিত। কিন্তু এই বুঝ তাদের নেই যে, বালি-কণার ন্যায় বিক্ষিপ্ত হয়ে এখন তারা খৃস্টানদের সহজ শিকারে পরিণত।

জঙ্গীর মৃত্যুতে ইসলামী দুনিয়ার যে ক্ষতি হয়েছে, জঙ্গীর স্ত্রী তা অনুধাবন করতে পেরেছেন। উপলব্ধি করেছেন সুলতান আইউবীও। আর বুঝেছে তারা, যাদের অন্তরে ইসলামের মর্যাদা জাগ্রত ছিল।

***

নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর বেশ কদিন পর। সুলতান আইউবী নিজ কক্ষে পায়চারী করছেন। কক্ষে বসে কথা বলছেন মোস্তফা জুদাত।

মোস্তফা জুদাত একজন ঊর্ধ্বতন তুর্কী সেনা অফিসার। নুরুদ্দীন জঙ্গীর সেনাবাহিনীতে তিনি মিনজানীকের কমান্ডার ছিলেন। জঙ্গীর ওফাতের পর ইসলামী দুনিয়ায় তিনি যে ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন, তা তাকে কাঁপিয়ে তুলেছে। তিনি এই বলে ছুটি নিয়ে এসেছেন যে, বাড়ি গিয়েছি কয়েক বছর হয়ে গেল; এবার একটু বাড়ি যাওয়া দরকার। দামেস্ক থেকে রওনা হয়ে তিনি কায়রোতে সুলতান আইউবীর নিকট চলে আসেন। মোস্তফা জুদাত সেই অফিসারদের একজন, যারা আগে মুসলমান পরে অফিসার। তিনি জানতেন, নুরুদ্দীন জঙ্গীর পর সুলতান আইউবীই ইসলামের মর্যাদা সুরক্ষার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম এবং করবেনও। তার আশংকা ছিল, সুলতান আইউবী এদিককার খবর হয়ত জানেন না, তাই তাকে তিনি দামেস্কের কারগুজারী শুনাতে এসেছেন।

.. আর ফৌজ কি অবস্থায় আছে? সুলতান আইউবী জিজ্ঞেস করেন।

মহামান্য জঙ্গী ফৌজের মধ্যে যে জযবা সৃষ্টি করেছিলেন, তা অটুট আছে- মোস্তফা জুদাত জবাব দেন। কিন্তু এই জযবা বেশীক্ষণ টিকবে না। আপনি জানেন, খৃস্টানদের সয়লাব শুধু সেনাবাহিনীই রোধ করে রেখেছে। মাননীয় জঙ্গীর জীবদ্দশায় কার্যত সেনাবাহিনীই দেশ শাসন করত। যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীরই হাতে ছিল। কিন্তু সেই পদক্ষেপ ছিল খেলাফতের অপছন্দনীয় ও রাষ্ট্রীয় নীতির পরিপন্থী। এখন আমরা খেলাফতের অনুগত। আমরা এখন নিজেদের মত করে কোন পদক্ষেপ নিতে পারি না। খলীফা যদি কোন যুদ্ধ পরিকল্পনা হাতে না নেন, তাহলে সেনাবাহিনীর কিছুই করার নেই। জাতীয় ও ধর্মীয় স্বার্থে লড়াই করার ও জীবন দেয়ার মত আত্মমর্যাদাবোধ মুসলিম আমীরদের মধ্যে নেই। আমীরদের জাতীয় ও ধর্মীয় চেতনাবোধ খৃস্টানরা ক্রয় করে নিয়েছে। এবার তারা আমাদের সেনাপতিদের ক্রয় করার অভিযানে নেমেছে। তাদের এই ধ্বংসাত্মক তৎপরতা ফৌজ ও জনগণ উভয় ক্ষেত্রেই শুরু হয়ে গেছে। এই অপতৎপরতা যদি অতিদ্রুত প্রতিহত করা না যায়, তাহলে খৃস্টানরা যুদ্ধ ছাড়াই সালতানাত ইসলামিয়ার মালিক হয়ে যাবে। আমাদের সালতানাতে ইসলামী জায়গীর-জমিদারীতে বিভক্ত হয়ে গেছে। আমীরদেরকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। তারা মদে আকণ্ঠ ডুবে গেছে। খৃস্টানরা ওখানে নারীর ফাঁদ ছড়িয়ে দিয়েছে। আপনি শুনে অবাক হবেন যে, এই মেয়েরা আমাদের আমীরদের হেরেমে অবস্থান করছে। তারা হেরেমে বিনোদন অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সেই অনুষ্ঠানে আমাদের সেনাঅফিসারদের নিমন্ত্রণ করে তাদেরকে বেহায়াপনার ফাঁদে আটক করছে।

আর আমি জানি তারপর কী হবে- সুলতান আইউবী বললেন আমাদের সৈন্যদেরকে অপকর্মে অভ্যস্ত করা হবে।

অভ্যস্ত করা হচ্ছেও- মোস্তফা জুদাত বললেন- আর হাশীশীরাও তাদের তৎপরতা পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। এখন হবে কি জানেন? আমাদের যে সালার বা নায়েব সালার মন থেকে খৃস্টানদের দুশমনী ঝেড়ে না ফেলবে এবং জিহাদের পক্ষে কাজ করবে, তাদেরকে হাশীশীদের পেশাদার ঘাতকদের দিয়ে রহস্যময় উপায়ে হত্যা করা হবে।

কোন আমীর কী করছেন, মোস্তফা জুদাত সুলতান আইউবীকে তার বিস্তারিত বিবরণও প্রদান করেন। তার সারাংশ হল, নিজ নিজ অঞ্চলে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী আমীরগণ একে অপরকে দুশমন ভাবতে শুরু করেছেন। তারা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খৃস্টানরা মুসলিম আমীরদের এই কপটতা ও কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে ইন্ধন যোগাচ্ছে।

আপনি আমাকে ওখানকার পরিস্থিতি জানাতে এসে ভালই করেছেন সুলতান আইউবী বললেন- আপনি না আসলে আমি এতকিছু জানতাম না। তবে আমার এতটুকু অনুমান করা কঠিন ছিল না যে, এগার বছরের বালককে খলীফা নিযুক্ত করে মানুষ কী করতে চায়।

আর আপনি কী করতে চান?- মোস্তফা জুদাত জিজ্ঞেস করেন- আপনি যদি অবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ না করেন, তাহলে মনে করুন সালতানাতে ইসলামিয়ার সূর্য ডুবে গেছে। আর আপনার পদক্ষেপ হওয়া উচিত শুধুই যুদ্ধ।

আহ! সেই দিনটিও আমাকে প্রত্যক্ষ করতে হল যে, আজ আমাকে আমার ভাইদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার কথা ভাবতে হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সুলতান আইউবী বললেন- আমি আশংকা করছি, আমার মৃত্যুর পর গাদ্দাররা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করবে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী গৃহযুদ্ধের অপরাধে অপরাধী ছিল।

কিন্তু আপনি যদি এই ভয়ে কায়রো বসে থাকেন, তাহলে ইতিহাস আপনার পথে এই লজ্জাজনক অভিযোগ আরোপ করবে যে, নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুবরণ করার পর সালাহুদ্দীন আইউবীরও দম বেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি মিসরের কজা অটুট রাখার জন্য সালতানাতে ইসলামিয়াকে কুরবান করে দিয়েছিলেন।

তা ঠিক- সালাহুদ্দীন আইউবী বললেন- এই অভিযোগ বেশী অপমানজনক। আমি সবদিকেই চিন্তা করেছি মোস্তফা! শোন, আমি যদি জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর জন্য বের হই, তাহলে আমি দেখব না আমার ঘোড়ার পদতলে কে পিষ্ট হচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে সেই কালেমাগো মানুষগুলো কাফেরদের চেয়েও বেশী ঘৃণ্য, যারা কাফেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতে…।

আপনি ফিরে যান। আমি আলী বিন সুফিয়ানকে ওখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি গেছেন গোয়েন্দাবেশে। ওখানকার কেউ টের পাবে না যে, আলী বিন সুফিয়ান তাদের মাঝে ঘোরাফেরা করছে এবং পরিসংখ্যান নিচ্ছে যে, এখানে কোন্ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার। আপনি গিয়ে দেখুন, কোন্ কোন সালার সন্দেহভাজন। আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে আরো অনেক লোক গেছে। ওখানে তাদের করণীয় কী, তা তারাই ভাল জানে। পাশাপাশি আমি আমীরদের প্রতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাওয়ার আহ্বান সম্বলিত বার্তা দিয়ে দূতও প্রেরণ করেছি। তারা আমার পয়গাম বুঝবার চেষ্টা করবে, সেই আশা আমি করি না। আমি শুধু তাদেরকে সোজা পথটা শেষবারের মত দেখিয়ে দিতে চাই। আমি তাদেরকে একথা বলব না, তারা যদি আমার নির্দেশমত কাজ না করে, তাহলে আমি কী করব।

মোস্তফা জুদাত বিদায় নিয়ে যান। সুলতান আইউবী দারোয়ান ডাকেন। দারোয়ান আসলে তিনি কয়েকজন সালার ও প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে বললেন, এদেরকে জলদি আমার কাছে আসতে বল।

এরা সকলেই সুলতান আইউবীর হাইকমান্ডের সদস্য।

***

কাজী বাহাউদ্দীন শাদ্দাদ তাঁর রোজনামচায় লিখেছেন

আল্লাহ সালাহুদ্দীন আইউবীকে কঠিন হৃদয় দান করেছেন। তিনি নিজের ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে এত শক্ত করে তৈরি করেছিলেন যে, পাহাড় সমান বেদনাও তিনি হাসিমুখে সহ্য করে নিতেন। তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী ও স্বতন্ত্র মেজাজের অধিকারী। আমীর-গোলাম সকলকে তিনি সমান মর্যাদা প্রদান করতেন। একজনের উপর আরেকজনকে প্রাধান্য দিতেন বীরত্ব ও বাহাদুরীর ভিত্তিতে। যারা তাঁর কাছে ঘেঁষত, তারা তার থেকে দুরকম প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করত। প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ভালবাসা। তার সৈনিকরা যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে দেখলে এতই উজ্জীবিত হয়ে উঠত যে, তারা শত্রুর উপর বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ত। একবার তাঁর এক খাদেম অপর খাদেমের গায়ে জুতা নিক্ষেপ করে। তিনি তখন কক্ষ থেকে বের হচ্ছিলেন। ঘটনাক্রমে জুতাটি এসে তার গায়ে পড়ে। খাদেমরা ভয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। কিন্তু সালাহুদ্দীন আইউবী তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান, যেন কিছুই হয়নি। এ ছিল তার চরিত্র মাধুরী। বন্ধু তো ভাল, শত্রুও তার সম্মুখে উপস্থিত হলে তার ভক্ত-অনুরক্তে পরিণত হয়ে যেত।

নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যু সালতানাতে ইসলামিয়াকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল। সেই সমস্যার সর্বাপেক্ষা গুরুতর দিক ছিল, মুসলমানদের নিজেদেরই আমীর-উজীরগণ খৃস্টানদের বন্ধু ও ইসলামের দুশমনে পরিণত হয়েছিল।

মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সালাহুদ্দীন আইউবী এখনো মিসর থেকে বের হতে পারছেন না। এমনি পরিস্থিতিতে তার সাধ্য এতটুকুই ছিল যে, তিনি সালতানাতে ইসলামিয়ার প্রতিরক্ষার চিন্তা বাদ দিয়ে শুধু মিসরের প্রতিরক্ষাকে অটুট রাখবেন। তার চেয়ে বেশী কিছু করার সাধ্য তাঁর ছিল না। কিন্তু আমার এই বন্ধুটি বিন্দু পরিমাণ ঘাবড়ালেন না। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন, আমি যদি ইসলামের সংরক্ষণের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নেই, তাহলে কিয়ামতের দিন আমাকে খৃস্টানদের সঙ্গে হাশর করা হবে। তিনি ইসলামের সংরক্ষণ ও প্রচার-প্রসারকে তাঁর জীবনে সবচে বড় কাজ মনে করতেন। তিনি কখনো নিজেকে শাসক ভাবেননি। সালাহুদ্দীন আইউবীর যৌবনকালের কথা আমার স্মরণ আছে। যৌবনে তিনি পূর্ণরূপে ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে গিয়েছিলেন। তিনি মদপান করতেন, নাচ-গানের আসর বসাতেন। বাদ্য-বাজনা ও নাচের খুঁটিনাটি বুঝতেন। আরো দশজন বিপথগামী যুবক যা করে থাকে, তিনি তার কোনটিই বাদ দিতেন না। কেউ কখনো কল্পনাও করেনি যে, এই যুবক অল্প কবছরেই ইসলামের সবচেয়ে বড় পতাকাবাহী ও ইসলামের দুশমনের যমদূতে পরিণত হবেন। চাচার সঙ্গে প্রথমবারের মত খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ময়দানে এসেই তিনি সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে তিনি সর্বপ্রথম বিলাসিতা পরিত্যাগ করলেন এবং নিজের জীবনকে ইসলামের জন্য কুরবান করে দিলেন। তিনি দেশের জনগণ ও সৈন্যদেরকে শিক্ষা দেন যে, ইসলামের কোন সীমানা-সরহদ নেই…।

তার এই পরিবর্তিত চরিত্র দেখে কারো বিশ্বাস করার উপায় ছিল না যে, একসময় তিনি বিলাসী ছিলেন। প্রবৃত্তিকে দমন করে রাখারই নাম চরিত্রের উঁচুতা ও আদর্শের পরিপক্কতা। এই পরিপক্কতা সালাহুদ্দীন আইউবীর মধ্যে ছিল। বন্ধুদের আসরে তিনি বলতেন, আমাকে কাফেররা মুসলমান বানিয়েছে। আমরা যদি আমাদের বিপথগামী যুবকদেরকে খৃস্টানদের মন-মানসিকতা বুঝাতে পারি, তাহলে তারা সঠিক পথে ফিরে আসবে। দুশমনের সঙ্গে যে বন্ধুত্বের দীক্ষা তাদেরকে দেয়া হচ্ছে, তা তাদেরকে জাতীয় মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করছে। আমি আপনাদেরকে রাসূল (সাঃ)-এর একটি হাদীস স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। নবীজী (সাঃ) বলেছেন, তোমরা নিজেদেরকে চিনে নাও যে, তোমরা কী এবং কারা। আর দুশমনকেও ভাল করে চিনে নাও যে, তারা কারা এবং তাদের লক্ষ্য কী। সালাহুদ্দীন আইউবীর চরিত্র ও আদর্শের মোড় দুশমনই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। তিনি নিজ কাজে এতই নিমগ্ন থাকতেন যে, কখনো ভাববারই সময় পাননি, তিনি ইসলামী দুনিয়ার বড় মাপের একজন নেতা, মিসরের প্রতাপান্বিত শাসক এবং এমন একজন বীরযোদ্ধা যে, খৃস্টানদের বড় বড় কমান্ডাররা ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরও তার ভয়ে তটস্থ থাকছে। তার আর্থিক অবস্থা এমন ছিল যে, তিনি অর্থাভাবে জীবনে কখনো হজ্ব করতে পারেননি। জীবনের শেষ মুহূর্তে তার একটিই বাসনা ছিল- হজ্ব করা। কিন্তু তার কাছে প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না। তাঁর মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল মাত্র পঁয়তাল্লিশ দেরহাম রূপা ও একখণ্ড সোনা। সম্পদ বলতে ছিল একটি ঘর, তা-ও পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত।

তার চারিত্রিক পরিপক্কতার বিস্ময়কর বহিঃপ্রকাশ ছিল যে, তিনি যখন তাঁর সালার প্রমুখকে বৈঠকের তলব করলেন, তখন তার চেহারায় ভীতি বা পেরেশানীর লেশমাত্র ছিল না। উপস্থিত পারিষদবর্গ নীরব-নিস্তব্ধ। তাদের ধারণা ছিল, এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে তিনি ঘাবড়ে গিয়ে থাকবেন। কিন্তু না, তিনি মুচকি হেসে সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন এবং বললেন, আমার বন্ধুগণ! তোমরা অত্যন্ত কঠিন ও সংকটময় পরিস্থিতিতেও আমার সঙ্গ দিয়েছ। আজ এমন এক পরিস্থিতি আমাকে বিচলিত করে তুলেছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবার মত নয়। কিন্তু স্মরণ রেখ, তারপরও যদি আমরা পরিস্থিতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তা হবে আমাদের জন্য দুনিয়াতেও অপমান, আল্লাহর দরবারেও অপমান। ইতিহাস আমাদের উপর অভিশম্পাত করবে এবং কিয়ামতের দিন সেই শহীদগণ আমাদেরকে লজ্জা দেবে, যারা ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন কুরবান করেছে। এখন আমাদের প্রত্যেককে জীবন কুরবান করার সময় এসেছে।

এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর সুলতান আইউবী তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দেন এবং বললেন, আমাদেরকে এখন আমাদের ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

এই বলে তিনি সকলের চেহারা নিরিক্ষণ করেন। কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। সকলের চেহারার রং বিবর্ণ হয়ে গেছে। সুলতান নিশ্চিত বুঝে নেন যে, হ্যাঁ, আমার এই কর্মকর্তাগণ যে কোন পরিস্থিতিতে আমার সঙ্গ দেবে। তিনি বললেন, আমার প্রথম পদক্ষেপ হল, আমি আমার স্বাধীনতা ঘোষণা দিতে যাচ্ছি। আমি আর কেন্দ্রীয় খেলাফতের অনুগত থাকতে চাই না। কিন্তু এই ঘোষণা আমি তোমাদের প্রত্যেকের সম্মতি ছাড়া করব না। এ ব্যাপারে মতামত দেয়ার আগে তোমরা আরো দুটি বিষয় নিয়ে ভেবে দেখ। প্রথমত, খেলাফত কার্যত শেষ হয়ে গেছে। তোমরাই বলেছ যে, খলীফা এখন এগার বছরের বালক, তিন-চারজন আমীর তাকে ঘিরে রেখেছে। আর এই আমীরগণ খৃস্টানদের বন্ধু। কাজেই বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে, খেলাফত এখন খৃস্টানদের মুঠোয়। তাই এবার আমাদের সংঘাত হবে খেলাফতের বিরুদ্ধে। এমতাবস্থায় তোমরা যদি স্বাধীন না হও, তাহলে তোমাদের খলীফাকে মান্য করতে হবে আর এই মান্যতা হবে সালতানাতে ইসলামিয়ার জন্য ধ্বংসাত্মক। তোমরাই বল, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের এই পদক্ষেপ কি সঠিক হবে না যে, আমি মিসরের খেলাফতকে কেন্দ্রীয় খেলাফত থেকে স্বাধীন করে ফেলব এবং তারপর আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ হবে স্বাধীন, যা এখন ইসলামের জন্য অত্যাবশ্যক?

তাহলে কি আপনি খেলাফতের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে চান? এক সালার জিজ্ঞেস করেন।

এখনো সিদ্ধান্ত নেইনি- সুলতান আইউবী জবাব দেন- কাল-পরশু পর্যন্ত আমার দূত ফিরে আসবে। পরিস্থিতি যদি আমাকে খেলাফতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে বাধ্য করে, তাহলে আমি কুণ্ঠিত হব না।

আপনি মিসরকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে দিন- এক কর্মকর্তা বলল আমরা এগার বছরের বালককে খলীফা মানতে পারি না।

তো তোমরা কি সকলে আমাকে মিসরের সুলতান হিসেবে মেনে নেবে? সালাহুদ্দীন আইউবী জিজ্ঞেস করেন।

সর্বান্তকরণে উপস্থিত সকলে একবাক্যে বলে উঠলেন, হ্যাঁ, আমরা আপনাকে মিসরের সুলতান হিসেবে মেনে নেব। সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী তখনই মিসরের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর থেকেই সালাহুদ্দীন আইউবী সুলতান অভিধায় ভূষিত হন।

আমি রাসূলের উম্মতের নয়- রনাঙ্গনের বাদশাহ- সুলতান আইউবী বললেন- তোমরা তো দেখেছ, আমি খৃস্টান সৈন্যদের অভ্যন্তরে ঘোরাফেরা করে থাকি। আমি দশ দশজন জানবাজ দিয়ে দশ দশ হাজার দুশমন সৈন্যকে পরাভূত করেছি। কিন্তু যখন আমি আপন ভাইদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ভাবি, তখন আমার সব রণকৌশল মাথা থেকে উধাও হয়ে যায়, আমার তরবারী তখন কোষ থেকে বেরুতে চায় না। দুর্ভাগ্য, আমাকে ও তোমাদেরকে সেই দিনটিও প্রত্যক্ষ করতে হল যে আমরা পরস্পর লড়াই করব আর খৃস্টানরা বসে বসে তামাশা দেখবে!

এই তামাশা আমাদের দেখাতেই হবে মহামান্য সুলতান!- এক সালার বলল- মুখের ভাষা যদি আমাদের ভাইদের উপর ক্রিয়া না করে, তাহলে তরবারী ব্যবহার করতেই হবে। আমাদের কারো মধ্যে খেলাফতের গদির মোহ নেই। আমরা যা কিছু করব, ইসলামের খাতিরেই করব- ব্যক্তি স্বার্থে নয়।

***

সুলতান আইউবী ইতিপূর্বে দামেস্ক, হাব, মওসেল এবং আরো দুতিনটি রিয়াসতের আমীরদের নিকট দুজন দূত প্রেরণ করেছিলেন। সকলের নিকট তিনি দীর্ঘ পয়গাম প্রেরণ করেছেন। তাতে তাদের প্রত্যেককে খৃস্টীয় ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছেন এবং ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। তিনি তাদেরকে ইসলামী ঐক্যের পক্ষে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দূতদ্বয় ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। একজন আমীরও সুলতানের পয়গাম গ্রহণ করেননি, বরং অনেকে বিদ্রুপের সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

দূতগণ সুলতান আইউবীকে জানায়, আমরা প্রথমে খলীফার দরবারে গমন করি। পয়গাম পেশ করলে তা খলীফা নিজে পাঠ না করে তাকে ঘিরে রাখা আমীরদের পড়তে দেন। এই আমীরগণই তাকে খেলাফতের গদিতে বসিয়েছে। তারা আপনার পয়গাম পাঠ করে পরস্পর ফিসফিস করতে থাকে। একজন খলীফাকে বললেন, সালাহুদ্দীন আইউবী খৃস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বাহানা দেখিয়ে সকল মুসলিম রিয়াসতকে এক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন। তারপর তিনি নিজেই হবেন সেই রাজ্যের অধিপতি। আরেকজন মুখ খুললেন। তিনিও এগার বছর বয়সী খলীফাকে সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে উস্কে দিলেন এবং বললেন, আপনি তাকে নির্দেশ দিতে পারেন যে, যুদ্ধ করা না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার মালিক একমাত্র খলীফা। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি খলীফার আদেশ অমান্য করেন, তাহলে আপনি তাকে বরখাস্ত করতে পারেন; মিসরের নেতৃত্ব অন্য কাউকে দিতে পারেন।

বালক খলীফা আমাদেরকে এই নির্দেশই প্রদান করেন এবং বললেন, সালাহুদ্দীন আইউবীকে বলবে, সে যেন আমার নির্দেশের অপেক্ষা করে। ইসলামী ঐক্যের প্রয়োজন আছে কিনা, আমিই তার সিদ্ধান্ত জানাব। 

সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট যে ফৌজ আছে, তন্মধ্যে মরহুম জঙ্গীর প্রেরিত অনেক বাহিনীও আছে– এক আমীর খলীফাকে বললেন আপনি তাকে নির্দেশ প্রেরণ করুন, যেন তাদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। নিজের মর্জিমত ফৌজ ব্যবহার করার সুযোগ তার থাকা উচিত নয়।

তাকে আরো বলবে, খেলাফতের পক্ষ থেকে যে বাহিনী প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদেরকে যেন ফেরত পাঠায়- দূতদের উদ্দেশে খলীফা বললেন আর তোমরা এবার যেতে পার।

আইউবীকে আরো বলবে, ভবিষ্যতে যেন তিনি খলীফাকে এরূপ পয়গাম পাঠানোর দুঃসাহস না দেখান। অন্য এক আমীর বললেন।

দূতরা সুলতান আইউবীকে জানায়, আমরা অন্যান্য আমীরদের নিকটও গমন করি। সবাই অবজ্ঞার সাথে আপনার পয়গাম প্রত্যাখ্যান করে। কেউ কেউ আপনার বিরুদ্ধে অবমাননাকর উক্তিও করে।

রিপোর্টে সুলতান আইউবীর চেহারায় কোন পরিবর্তন আসল না, যেন তিনি এরূপই হওয়ার আশা করছিলেন। তিনি মূলত আলী বিন সুফিয়ানের অপেক্ষা করছিলেন। গোয়েন্দা প্রধান আলী একশত যোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে দামেস্ক চলে গেছেন। গিয়েছেন বণিক ও বণিক কাফেলার বেশে। সুলতান এখনো তার কোন সংবাদ পাননি। নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুর পরপর-ই সুলতান আইউবী সংবাদ পেয়ে যান যে, বিভিন্ন রিয়াতের আমীরগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিয়েছেন। সংবাদটা পেয়েছেন স্বয়ং নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রীর মাধ্যমে, যিনি বর্তমান খলীফার মা। তিনি অতি সঙ্গপনে একজন দূত কায়রো পাঠিয়ে দেন এবং সুলতান আইউবীকে জঙ্গীর মৃত্যুর পর উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি সুলতান আইউবীকে বলে পাঠান

ইসলামের ইজ্জত এখন আপনার হাতে। আমার অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্রকে খলীফা নিযুক্ত করা হয়েছে। মানুষ আমাকে সম্মান করতে শুরু করেছে। কেননা, আমি খলীফার মা। তারা মনে করছে, আমি সৌভাগ্যশীল মা। কিন্তু আমার হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে আমার পুত্রকে খলীফা বানানো হয়নি তাকে আমার বুক থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। মওসেলের আমীর সাইফুদ্দীন ও অন্যসব আমীর আমার পুত্রের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। আমার স্বামীর ভ্রাতুস্পুত্ররাও স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। তারপরও এই আমীরদের মধ্যে যদি ঐক্য থাকত, তাহলে আমি এতটুকু বিচলিত হতাম না। প্রকৃতপক্ষে তারা একে অপরের দুশমন। আপনি যদি বলেন, তাহলে আমি নিজ হাতে পুত্রকে হত্যা করে ফেলব। কিন্তু তার পরিণতিকে আমি ভয় করি। ভাল হবে, আপনি এসে পড় ন। কিভাবে আসবেন, এসে কী করবেন, তা আপনিই ভাল জানেন। আমি আপনাকে সতর্ক করতে চাই যে, আপনি যদি এদিকে দৃষ্টি না দেন কিংবা যদি বিলম্ব করে ফেলেন, তাহলে প্রথম কেবলা তো খৃস্টানদের কজায় আছেই, পবিত্র কাবাও তাদের হাতে চলে যাবে। সেই লাখো শহীদের খুন কি বৃথা যাবে, যারা জঙ্গী ও আপনার নেতৃত্বে জীবন কুরবান করেছে? আপনি হয়ত আমাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমার পুত্রকে আমি কেন নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখলাম না? তার জবাব আমি দিয়েছি। আমীরগণ আমার পুত্রকে ছিনিয়ে নিয়েছে। পিতার মৃত্যুর পর একবার মাত্র সে আমার কাছে এসেছে। এখন তাকে আমার পুত্র মনে হয় না। বোধ হয় তাকে হাশীশ খাওয়ানো হয়েছে। সে ভুলে গেছে, আমি তার মা। ভাই সালাহুদ্দীন! আপনি জলদি এসে পড় ন; দামেস্কের জনগণ আপনাকে স্বাগত জানাবে। আমার এই দূতের নিকটই জবাব দিন, আপনি কী করবেন কিংবা কিছুই করবেন কিনা!

সুলতান আইউবী তখনই জবাব দিয়ে দূতকে বিদায় করে দেন। তিনি জঙ্গীর স্ত্রীকে এই নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, আমি অতিশয় কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছি। কিন্তু পা ফেলব বুঝে-শুনে।

দূত রওনা হওয়ার পরপর সুলতান আইউবী আলী বিন সুফিয়ানকে দামেস্ক, মওসেল, হাব, ইয়েমেন ও অন্যসব ইসলামী অঞ্চলে গিয়ে তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ প্রদান করেন। আলী বিন সুফিয়ানের এ সফর কোন সরকারী সফর ছিল না। তিনি গুপ্তচরের বেশে এলাকাগুলোতে চলে যান। তার দায়িত্ব হল, যেসব মুসুলিম আমীর একনায়কত্ব ঘোষণা করেছে, তারা কী চায়, খৃস্টানদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে কি-না, খলীফার বাহিনীর মতিগতি কেমন, এই বাহিনীকে খলীফার এমন সব নির্দেশের বিরুদ্ধাচারণের জন্য প্রস্তুত করা যায় কি-না, যা ইসলামের জন্য ক্ষতিকর, দুশমনের জন্য লাভজনক। আলী বিন সুফিয়ানের এ-ও জানার বিষয় ছিল যে, ও-সব এলাকার জনগণের মতিগতি ও চিন্তাধারা কী এবং ফেদায়ীরাও খলীফার সঙ্গে মিশে গেছে কি-না। তাকে এ ব্যাপারেও তথ্য সংগ্রহ করতে হবে যে,সুলতান আইউবী দামেস্ক কিংবা অন্য কোন মুসলিম এলাকায় অভিযান পরিচালনা করলে জনগণের প্রতিক্রিয়া কী হবে।

সুলতান আইউবী অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়েন না। কোথাও যেতে হলে বা অভিযান পরিচালনা করতে হলে আগে গোয়েন্দা মারফত সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি, সুবিধা ও সমস্যা সম্পর্কে আগে তথ্য-পরিসংখ্যান জেনে নেন। এখানেই ছিল তার সাফল্য। সুলতান জঙ্গীর মৃত্যুর পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন নিশ্চিত হওয়ার জন্য একই ধারায় তিনি আলী বিন সুফিয়ানকে প্রেরণ করেন। আলী বিন সুফিয়ান রিপোর্ট নিয়ে আসবেন, তারপর তিনি সে মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এখন অপেক্ষা শুধু আলী বিন সুফিয়ান কবে ফিরবেন।

***

সুলতান আইউবীর নির্দেশ প্রাপ্তির পর আলী বিন সুফিয়ান এক মুহূর্ত নষ্ট করে একশ যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা বাছাই করে ফেলেন। তিনি তাদেরকে মিশন সম্পর্কে অবহিত করেন এবং বলেন, ইসলামের আব্রু-ইজ্জত তোমাদের থেকে বিরাট কুরবানী তলব করছে। এই মিশনে তোমাদেরকে পূর্ণ যোগ্যতা ও দক্ষতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে।

এই একশ গোয়েন্দাকে বণিকের পোশাক পরানো হয়। আলী বিন সুফিয়ান কাফেলার সরদার সাজেন। তারা কতগুলো উটের পিঠে বিভিন্ন ধরনের পণ্য বোঝাই করে। দামেস্ক ইত্যাদির বাজারে নিয়ে এগুলো বিক্রি করা হবে এবং তৎপরিবর্তে অন্য মাল ক্রয় করা হবে। বেশকিছু উট ছাড়াও তাদের সঙ্গে আছে কয়েকটি ঘোড়া। বাণিজ্যিক পণ্যের অভ্যন্তরে তারা তরবারী, বর্শা ইত্যাদি অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে। তন্মধ্যে আছে দাহ্যপদার্থ ও আগুন জ্বালানোর অন্যান্য বস্তু। আলী বিন সুফিয়ানের নেতৃত্বে কাফেলা রাতের বেলা কায়রো থেকে রওনা হয় এবং রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত বহুদূর এগিয়ে যায়।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর কাফেলা আবার রওনা হয়। আলী বিন সুফিয়ান যথাশীঘ্রই গন্তব্যে পৌঁছুতে চাচ্ছেন।

কাফেলা দিনভর চলতে থাকে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরও কাফেলা কোথাও থামেনি। রাত গম্ভীর হতে চলেছে। এবার একটি উপযুক্ত জায়গা পাওয়া গেল। এলাকাটা সবুজ-শ্যামল। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে উঁচু-নীচু টিলা আছে এখানে। আছে পানিও। বিশ্রাম ও পানির জন্য কাফেলা থেমে যায়।

লোকগুলো আসলে বণিক নয়- সৈনিক। তাদের চাল-চলনে শৃঙ্খলা আছে। আছে সতকর্তা। তাদের উট-ঘোড়াগুলো এমনি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যে, মানুষগুলোর ন্যায় ওরাও সুশৃঙ্খল। কারো মুখে টু-শব্দ নেই। না মানুষের মুখে, না পশুগুলোর মুখে। আলী বিন সুফিয়ান টিলা ও পর্বতের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে বাইরেই ছাউনী ফেলেন। দুব্যক্তিকে পানির সন্ধানে প্রেরণ করা হয়। এখন সবারই হাতে অস্ত্র। কারণ, এই সফরে দুটি ভয় রয়েছে। এক. মরুদস্যুর ভয়, দুই. খৃস্টান কমান্ডোদের ভয়।

পার্বত্য এলাকার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে লোক দুজন। পানির সন্ধান ছাড়াও তাদের দেখতে হবে, এখানে দুশমনের কোন কমান্ডো কিংবা কোন টহল বাহিনী অবস্থান নিয়ে আছে কিনা। তারা কিছুদূর চলে যায়। একস্থানে আলোর মত কিছু একটা দেখতে পায়। চলে যায় আরো সম্মুখে একটি টিলার উপরে উঠে যায়। এখানে মাঠের ন্যায় মনোরম একটি জায়গা। পানি আছে। সবুজ-শ্যামল এলাকা। আছে খেজুর বাগানও। দুটি প্রদীপ জ্বলছে এখানে। সেই প্রদীপের আলোতে দশ-এগারজন মানুষ চোখে পড়ে তাদের। ছয় সাতজন পুরুষ। অন্যরা নারী। মেয়েগুলো অতিশয় সুন্দরী। তারা আগুন জ্বালিয়ে গোশত ভুনা করছে আর পেয়ালায় করে কি যেন পান করছে। বোধ হয় মদ। খানিকটা আড়ালে একটি ঘোড়া ও কয়েকটি উট বাঁধা। অনেকগুলো সামানও একদিকে পড়ে আছে।

আলী বিন সুফিয়ানের লোক দুজন লুকিয়ে লুকিয়ে নিকটে চলে যায়। রাতের নীরবতায় তাদের কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তাদের হাসি-কৌতুক প্রমাণ করছে, তারা মুসলমান নয়। মেয়েগুলো অশ্লীল আচরণ করছে।

লোক দুজন ফিরে এসে আলীকে ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করে। এবার আলী বিন সুফিয়ান নিজে যান। লুকিয়ে লুকিয়ে কাছে থেকে দেখেন। আলী লোকগুলোর ভাষা বুঝতে পারছেন না। ওরা খৃস্টান। আলী বিন সুফিয়ান ভাবছেন, তিনি তাদের নিকটে চলে যাবেন এবং জিজ্ঞেস করে জেনে নেবেন, তারা কারা, কোথায় যাচ্ছে। আবার ভাবছেন, গিয়ে কাজ নেই, এখান থেকেই তাদের গতিবিধি লক্ষ্য করি। তার সঙ্গে একশ যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা আছে। এই ছয়-সাতজন পুরুষ আর চারটি মেয়েকে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।

লোকগুলোকে গোয়েন্দার দৃষ্টিতে দেখছেন আলী বিন সুফিয়ান। তার মনে সন্দেহ জাগে, তারা খৃস্টান গুপ্তচর ও সন্ত্রাসী এবং কোন ইসলামী ভূখন্ডে অভিযানে যাচ্ছে। তা-ই যদি হয়, তাহলে আলীকে তাদেরই তো প্রয়োজন।

আরো নিকটে যাওয়ার জন্য তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যান। চলে যান টিলার একেবারে শেষপ্রান্তে। এখান থেকে চোখ পড়ে তার নীচে। আরো দুজন লোক দেখতে পান তিনি। তাদের মুখমণ্ডল ও মাথা কালো কাপড়ে ঢাকা। তারা টিলার আড়াল থেকে ঐ লোকগুলোর প্রতি বারবার তাকাচ্ছে। আলী বিন সুফিয়ান বুঝে ফেললেন, ওরা মরুদ্যু। ওদের দৃষ্টি মেয়েগুলোর প্রতি।

লোকগুলো আস্তে আস্তে পেছন দিকে সরে যায়। পরস্পর কথা বলে। আলী বিন সুফিয়ান তাদের কথা শুনতে পান, বুঝতেও পারেন। আলীর ভাষায়-ই কথা বলছে তারা।

ওদের কাছে কি অস্ত্র আছে? এক দস্যু জিজ্ঞেস করে।

হ্যাঁ, আছে- অপরজন বলল- আমি দেখেছি। তাদের তরবারী সরু। তারা খৃস্টান।

তারা সাধারণ মুসাফির বলে মনে হয় না।

ঠিক আছে, ওরা ঘুমিয়ে পড় ক, আমি সবাইকে ডেকে নিয়ে আসি।  

আমরা তো আটজন; ঘুমন্ত অবস্থায়ই আমরা ওদেরকে ধরে ফেলতে পারব।

ধরার প্রয়োজন কি। পুরুষদেরকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করে ফেলব আর মেয়েগুলোকে ঘোড়ায় তুলে নিয়ে যাব।

তারা সঙ্গীদের ডেকে আনতে চলে যায়। আলী বিন সুফিয়ান লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের অনুসরণ করেন। তারা অন্য একটি পথে বের হয়ে যায়। ওখানে তাদের ঘোড়া দণ্ডায়মান। তারা ঘোড়ায় আরোহন করে অন্ধকালে অদৃশ্য হয়ে যায়।

আলী বিন সুফিয়ান ভাবেন কী করা যায়। লোকগুলোকে সাবধান করে দেবেন, নাকি নিজ কাফেলায় নিয়ে যাবেন। গভীর ভাবনা-চিন্তার পর তিনি একটি পন্থা উদ্ভাবন করেন। নিজ কাফেলার লোকদের নিকট ফিরে আসেন। জনাবিশেক লোককে বর্শাসজ্জিত করে সঙ্গে করে নিয়ে যান। তাদেরকে উপযুক্ত স্থানে প্রস্তুত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখেন এবং কর্তব্য বুঝিয়ে দেন। নিজেও সতর্ক অবস্থায় এদিক-ওদিক টহল দিতে থাকেন। দস্যুরা কখন আসবে তিনি জানেন না। তিনি দেখতে পান যে, মেয়েরা ও তাদের সঙ্গের পুরুষরা ঘুমিয়ে পড়েছে। মাত্র একজন লোক বর্শা হাতে পাহারা দিচ্ছে। তাতে বুঝা গেল, লোকগুলো প্রশিক্ষিত। প্রদীপগুলো জ্বলছে।

রাতের শেষ প্রহর ঘনিয়ে আসছে। পার্বত্য এলাকার অভ্যন্তরে ঘোড়ার পায়ের শব্দ কানে আসে। সবাই সতর্ক হয়ে যায়। মেয়েদের প্রহরীও বদল হয়। এবার পাহারা দিচ্ছে অন্যজন। দস্যুরা পার্বত্য এলাকার মাঝামাঝিতে এসে পড়েছে। আলী বিন সুফিয়ান ও তার লোকেরা টিলার উপরে। খানিক পর আট-নয়জন দস্যু সেই স্থানে ঢুকে পড়ে, যেখানে তাদের শিকার ঘুমিয়ে আছে। প্রহরী ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি ঘুমন্ত সঙ্গীদের জাগিয়ে তোলে। দস্যুরা তাদের চারপাশ ঘিরে ফেলে এবং ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে পড়ে। মেয়েদের সঙ্গী পুরুষরা জেগে ওঠে। কিন্তু দস্যুরা তাদেরকে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ না দিয়েই চিৎকার করে বলে, সব মালপত্র ও মেয়েগুলোকে আমাদের হাতে তুলে দাও এবং নিজেদের প্রাণ বাঁচাও। দুজন দস্যু তাদেরকে ধাক্কা দিয়ে একদিকে সরিয়ে দেয়। লোকগুলো নিরস্ত্র। তারপরও দুজন মোকাবেলা করার চেষ্টা করে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোক। বীর বিক্রমে লড়ে যায় অনেকক্ষণ।

সংকেত দেন আলী বিন সুফিয়ান। বাজের ন্যায় ছুটে আসে তার লোকেরা। এরা কারা ডাকাত দল তা বুঝে ওঠার আগেই এক একটি বর্শা এক একজন দস্যুর দেহে গিয়ে বিদ্ধ হয়। তার আগে দস্যুদের হাতে মেয়েদের সঙ্গের দুজন লোক মারা পড়েছে। তবে এর জন্য আলী বিন সুফিয়ানের কোন দুঃখ নেই।

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েদের কাছে চলে যান। মেয়েগুলো ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। তাদের সামনে এগারটি লাশ পড়ে আছে। দুটি তাদের দুসঙ্গী পুরুষের। নয়টি দস্যুদের। আলী বিন সুফিয়ান তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। আলীর প্রতি মেয়েরা অতিশয় কৃতজ্ঞ। তিনি তাদেরকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কারা? কোথা থেকে এসেছ? কোথায় যাচ্ছ? তাদের জবাব শুনে সুলতান আইউবীর প্রখর ধীশক্তিসম্পন্ন বিচক্ষণ গোয়েন্দা প্রধান আলী মুচকি হাসলেন এবং বললেন, তোমরাও যদি আমাকে এরূপ প্রশ্ন করতে, আমিও তোমাদেরকে এমন অসত্য জবাব-ই দিতাম। আমি তোমাদের প্রশংসা করছি যে, এমনি এক ভীতিপ্রদ অবস্থায়ও তোমরা নিজের আসল পরিচয় গোপন রাখতে সক্ষম হয়েছ।

আপনি কোথা থেকে এসেছেন?- আলী বিন সুফিয়ানকে পাল্টা প্রশ্ন করে একজন- আপনি কোথায় যাচ্ছেন?

তোমরা যেখান থেকে এসেছ- আলী বিন সুফিয়ান জবাব দেন- আর যাবও সেখানে, যেখানে তোমরা যাচ্ছ। আমাদের কাজ ভিন্ন; কিন্তু গন্তব্য এক।

তারা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে। সবিস্ময়ে তাকায় আলীর প্রতি। আলীর মুখে মুচকি হাসির রেখা। তিনি বললেন, দেখেছ তো কেমন চাল খেলে দস্যুদের হত্যা করে ফেললাম। কোন সাধারণ পথিক-মুসাফির কি এমন চাল খেলতে পারে? আমি যে দক্ষতা প্রদর্শন করলাম, তাকি একজন সুশিক্ষিত সেনা কমান্ডারের ওস্তাদীকর্ম নয়?

তুমি মুসলমান সৈনিকও হতে পার। এক মেয়ে বলল।

আমি ক্রুশের সৈনিক। আলী বিন সুফিয়ান জবাব দেন।

 তুমি কি তোমার ক্রুশ দেখাতে পারবে? প্রমাণ চায় মেয়েরা।

তুমি পারবে আমাকে তোমার ক্রুশ দেখাতে? আলী বিন সুফিয়ান পাল্টা প্রশ্ন করেন এবং সকলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন, আমি জানি, তোমরা একজনও ক্রুশ দেখাতে পারবে না। তোমাদের সঙ্গে ক্রুশ নেই। কারণ, তোমরা যে কাজে যাচ্ছ, সেখানে ক্রুশ সঙ্গে রাখা যায় না। আমি তোমাদের কাছে তোমাদের নামও জিজ্ঞেস করব না, নিজের নামও বলব না। আর আমার মিশন কি তাও বলব না। শুধু এতটুকুই বলব যে, আমরা একই পথের পথিক। আর আমাদের কারুরই জানা নেই যে, আমাদের মধ্য থেকে কে নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারবে। যীশুখৃস্ট যেভাবে আমাকে ও আমার লোকদেরকে তোমাদের সাহায্যার্থে প্রেরণ করেছেন, তা প্রমাণ করে তোেমরা। সঠিক পথে আছ এবং তোমরা কামিয়াব হবে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয়ে গেছে, সমগ্র পৃথিবীতে ক্রুশের রাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। মুসলমানদের কোন্ আমীর এমন আছে, যে আমাদের জালে আটকা পড়েনি? আমি তোমাদের উপদেশ দেব, তোমরা দৃঢ়পদ থাক।

আলী বিন সুফিয়ান মেয়েদের প্রতি তাকিয়ে বললেন, তোমাদের কাজ সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ। খোদাও ঈসা মসীহ তোমাদের কুরবানীকে বিফল করবেন না। আমরা যারা পুরুষ, তারা জীবন বিলিয়ে দুনিয়ার ঝক্কি ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে যাই। কিন্তু কেউ তোমাদের জীবন হরণ করে না- হরণ করে তোমাদের সম্ভ্রম। আর তোমাদের পক্ষে এটাই সবচেয়ে বড় কুরবানী।

আলী বিন সুফিয়ান ঝানু অতিশয় সুদক্ষ গোয়েন্দা। মুখের ভাষা তার জাদুমাখা। সবাই তন্ময় হয়ে শুনছে তার কথাগুলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তিনি তাদের থেকে স্বীকৃতি আদায় করে নেন যে, তারা খৃস্টান এবং নাশকতামূলক কাজের উদ্দেশ্যে দামেস্কসহ অন্যান্য অঞ্চলে যাচ্ছে। তারা বণিকের বেশে।

আলী বিন সুফিয়ান খৃস্টানদের গুপ্তচরবৃত্তির নিয়ম-নীতি, গোপন সংকেত ও পরিভাষাসমূহ সম্পর্কে অবহিত। এ পর্যন্ত বহু খৃস্টান গুপ্তচরকে গ্রেফতার করে তিনি অপরাধের স্বীকৃতি আদায় করেছেন। এবার যখন তিনি তাদেরই পরিভাষায় কথা বলছেন, তখন মেয়েরা ও তাদের সঙ্গী পুরুষরা শুধু নিশ্চিতই হয়নি যে, তিনি খৃস্টান, বরং তাকে খৃস্টান গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে বিশ্বাস করে নেয়। তিনি ওদেরকে অবহিত করলেন যে, আমার সঙ্গে একশ লোক আছে। তাদের মধ্যে যুদ্ধবাজ গোয়েন্দাও আছে। আছে ফেদায়ীও। আমরা দামেস্কসহ অন্যান্য এলাকায় মুসলমানদের সেসব উধ্বতন অফিসারদের খুন কিংবা গুম করতে যাচ্ছি, যারা সালাহুদ্দীন আইউবীর চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। তিনি তাদেরকে আরো জানালেন, আমি দীর্ঘদিন যাবত মিসরে কাজ করেছি, এবার আমাকে ওদিকেই পাঠানো হয়েছে।

খৃস্টান দলটি আলী বিন সুফিয়ানের সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে একটি সমস্যার কথা ব্যক্ত করে। সমস্যাটা হল, তাদের কমান্ডার দস্যুদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা যেসব এলাকায় যাচ্ছে, ঐসব এলাকায় সে আগে গিয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুতে এরা এখন দিশেহারা। এদেরক পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন লোকের প্রয়োজন।

আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, অসুবিধা হবে না, প্রয়োজনে আমি নিজের কাজে ব্যাঘাত ঘটিয়ে হলেও তোমাদের পথ-নির্দেশনা করব। তোমাদের মিশন কি আমাকে খুলে বল।

তারা আলী বিন সুফিয়ানকে তাদের মিশন খুলে বলে। তাদেরকে কয়েকজন মুসলিম সালারের নাম দিয়ে বলা হয়েছে, তাদের কাছে উপঢৌকন পৌঁছিয়ে দেবে এবং প্রয়োজন অনুপাতে মেয়েদের ব্যবহার করবে। তাদের এমন কতিপয় সালার ও আমীর পর্যন্ত পৌঁছতে হবে, যারা খৃস্টানদেরকে দুশমন মনে করে। তাদেরকে খৃস্টানদের বন্ধু বানাতে হবে।

দেখ, এই স্তরে এসে তোমাদের ও আমার কাজ এক হয়ে যাচ্ছে–আলী বিন সুফিয়ান বললেন- আমাকেও ঐসব সালার ও নেতাদের খতম করতে হবে, যারা অন্তর থেকে খৃস্টানদের দুশমনী দূর করছে না।.. আচ্ছা, তোমরা দামেস্কে কোথায় থাকবে?

আপনি তো দেখতেই পাচ্ছেন যে, আমরা বণিকের বেশে যাচ্ছি- একজন জবাব দেয়- দামেস্কের নিকেট গিয়ে এই মেয়েরা পর্দানশীল মুসলিম নারীতে রূপান্তরিত হবে। আমরা সরাইখানায় অবস্থান নেব। ওখান থেকে বণিকের বেশ ধারণ করে সালার প্রমুখদের নিকট যাব।

***

পরদিন ভোরবেলা। আলী বিন সুফিয়ানের কাফেলা দামেস্ক অভিমুখে এগিয়ে চলছে। খৃস্টান দলটিও এই কাফেলার শামিল হয়ে গেছে। পশুর মধ্যে ডাকাতদের ঘোড়াগুলো এখন অতিরিক্ত। খৃস্টান নারী-পুরুষরা আলী বিন সুফিয়ানকে তাদের নেতা মেনে নিয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে তিনিও খৃস্টান। তিনি তাদেরকে বলে দিয়েছেন, তোমরা আমার লোকদের সঙ্গে কথা বলবে না। কারণ, তাদের মধ্যে মুসলমানও আছে, যারা ফেদায়ী ও হাশীশী বটে, কিন্তু তাদের উপর ভরসা রাখা যায় না। পথে আলী বিন সুফিয়ান খৃস্টানদেরকে নিজের সঙ্গে রাখেন এবং তাদের সাথে কথাবার্তা বলতে থাকেন। এই ফাঁকে তার অনেক কাজের কথা জানা হয়ে গেছে।

পরদিন কাফেলা দামেস্ক প্রবেশ করে। আলী বিন সুফিয়ানের নির্দেশ মোতাবেক কাফেলা সরাইখানায় অবস্থান নেয়ার পরিবর্তে একটি মাঠে তাঁবু স্থাপন করে। মাঠে মানুষের ভীড় জমে যায়। বাহির থেকে কোন বণিক কাফেলা আসলে এলাকার মানুষ এভাবেই ভীড় জমায়। তারা চেষ্টা করে, পণ্য বাজারে যাওয়ার আগেই সরাসরি কাফেলার কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে সংগ্রহ করতে।

আলী বিন সুফিয়ান ঘোষণা করে দেন, দশটি ঘোড়াও বিক্রি হবে। এই ভীড়ের মধ্যে দামেস্কের ব্যবসায়ী-দোকানদাররাও আছে। দুচার ঘন্টার মধ্যে লোক সমাগম এক মেলার রূপ ধারণ করে। আলী বিন সুফিয়ান তার লোকদেরকে বলে দেন, যেন তারা মালপত্র দ্রুত বিক্রি না করে আটকে রাখে। তিনি তার কয়েকজন বিচক্ষণ লোককে বলে দেন, তোমরা জনতার মধ্যে মিশে যাও এবং সুযোগমত তাদের মনমানসিকতা জেনে নাও। তারা পরিধানের চোগা খুলে ফেলে ছদ্মবেশে ভীড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। দুতিনজন চলে যায় শহরে।

আলী বিন সুফিয়ান ও তার সকল লোকজন মাগরিবের নামায বিভিন্ন মসজিদে আদায় করে নেয়। তিনি খৃস্টান দলটিকে তাঁবুতে রেখে যান। তারা মসজিদে স্থানীয় লোকদেরকে জানায়, আমরা ব্যবসায়ী, কায়রো থেকে এসেছি। গল্প-গুজবের মধ্যদিয়ে তারা লোকদের মনোভাব জেনে নেয়। লোকদের চিন্তাধারা ও চেতনা আশাব্যঞ্জক। কিছু লোককে ভীত-সন্ত্রস্ত পাওয়া যায়। তারা নতুন খলীফা ও আমীরদের বিরুদ্ধে কথা বলে। তাদের মধ্যে সমাজের উঁচু স্তরের লোকও আছে। অধিকাংশেরই বিশ্বাস, খৃস্টশক্তি ইসলামী দুনিয়ার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং খেলাফত বিলাসী আমীরদের হাতে চলে গেছে। তারা অত্যন্ত বিচলিত ও হতাশাগ্রস্ত। তারা বলে, জঙ্গীর পর এখন একমাত্র সালাহুদ্দীন আইউবীই অবশিষ্ট আছেন, যিনি ইসলামের নাম জীবিত রাখতে সক্ষম হবেন।

আলী বিন সুফিয়ান তার লোকদেরকে বলে দিয়েছেন, এই নারী ও পুরুষগুলো খৃস্টান এবং তাদের নিকট এক কথাই প্রকাশ করতে হবে যে, আমরা সবাই ক্রুশের মিশন নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি তাদের কোন সন্দেহ নেই। তিনি তাদেরকে বলে দিয়েছেন, এ রাতটা তোমরা বিশ্রাম কর এবং আমার নির্দেশের অপেক্ষা কর।

আলী বিন সুফিয়ান রাতে তাওফীক জাওয়াদের ঘরে চলে যান। বেশভূষা বণিকের। মুখমণ্ডলে কৃত্রিম দাড়ি। তিনি দারোয়ানকে বললেন, ভেতরে সংবাদ দাও, কায়রো থেকে আপনার এক বন্ধু এসেছেন। দারোয়ান ভেতরে সংবাদ পাঠায়। আলী বিন সুফিয়ানকে ভেতরে ডেকে নেয়া হয়। তাওফীক জাওয়াদ আলীকে চিনতে পারলেন না। আলী কথা বললে এবার তিনি চিনে ফেলেন এবং দাঁড়িয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এই লোকটার প্রতি আলী বিন সুফিয়ানের আস্থা আছে। তিনি তার আগমনের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন এবং বললেন, আমি কয়েকজন খৃস্টান গোয়েন্দাকে ফাঁদে আটকিয়েছি। এখন ভাবতে হবে তাদেরকে কিভাবে কাজে লাগান যায়।

তার আগে বলুন এখানকার পরিস্থিতি কী?- আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন- কায়রোতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক সংবাদ পৌঁছেছে।

সুলতান জঙ্গীর মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থতি সম্পর্কে কায়রো যেসব সংবাদ পৌঁছেছে, তাওফীক জাওয়াদ তার সবগুলোরই সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান করেন। তিনি বললেন

আলী ভাই! তুমি একে হয়ত গৃহযুদ্ধ বলবে; কিন্তু খৃস্টানদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে হলে সালাহুদ্দীন আইউবীকে খেলাফতের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান পরিচালনা করতেই হবে।

আচ্ছা, আমরা যদি কায়রো থেকে সেনা অভিযান পরিচালনা করি, তাহলে এখানকার ফৌজ কি আমাদের মোকাবেলা করবে? আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন।

তোমরা হামলার ভাব নিয়ে এস না- তাওফীক জাওয়াদ জবাব দেন সালাহুদ্দীন আইউবী উপরে উপরে প্রকাশ করবেন, তিনি খলীফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন এবং খলীফার সম্মানার্থে সঙ্গে সৈন্য নিয়ে এসেছেন। এমতাবস্থায় আমীরদের উদ্দেশ্য যদি ভাল হয়, তাহলে তারা সুলতানকে স্বাগত জানাবে। অন্যথায় তারা যে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, তা সময়মত দেখা যাবে। আমি পূর্ণ নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি, এখানকার ফৌজ তোমাদের মোকাবেলা করবে না, বরং সঙ্গ-ই দেবে। তবে এ কথাও মাথায় রাখতে হবে, তোমরা সময় যত নষ্ট করবে, এই ফৌজ তোমাদের থেকে ততই দূরে সরতে থাকবে। এখানকার ফৌজের যে জযবা-চেতনা এখনো বিদ্যমান আছে, তা নষ্ট করার প্রচেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আর এই জযবাই তো ইসলামী ফৌজের আসল শক্তি। তুমি তো জান আলী ভাই! যে শাসক ভোগ বিলাসিতায় নিমজ্জিত হয়, সে সর্বপ্রথম দুশমনের সঙ্গে সমঝোতা করে। তারপর দেশের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে এবং এমন সব সালারদেরকে আপন বানিয়ে নেয়, যারা আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে তার অনুগত হয়। এই কর্মধারা, এখানে শুরু হয়ে গেছে। আমাদের উচ্চপদস্থ কয়েকজন সেনা অফিসার ইতিমধ্যেই জাতীয় চেতনা ও ঈমানী জযবা হারিয়ে ফেলেছেন। তবে এখনো আমার মত এমন কিছু সালারও আছেন, যারা খৃস্টানদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেননি এবং নুরুদ্দীন জঙ্গীর জিহাদী চেতনাকে জীবিত রাখতে প্রস্তুত। কিন্তু খেলাফতের নির্দেশ ছাড়া নিজের থেকে তারা কিই-বা করতে পারবে?

তাহলে কি আমি সুলতান আইউবীকে নিশ্চিতভাবে একথা বলতে পারি যে, এখানকার সৈন্যরা আমাদের সঙ্গ দেবে? আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন।

অবশ্যই বলতে পারেন- তাওফীক জাওয়াদ জবাব দেন। তবে খলীফা ও আমীরদের দেহরক্ষীরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। তাদের সংখ্যাও কম নয় এবং তারা ফৌজের বাছা বাছা সৈনিক। সম্ভবত তাদেরকে গৃহযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।

এখানকার জনসাধারণের মধ্যে আমি যে জাতীয় চেতনা লক্ষ্য করেছি, তাতে আমি আশান্বিত যে, আমরা যদি এখানে আসি, তাহলে সফল হব। আলী বিন সুফিয়ান বললেন।

দেখ, দেশের জনসাধারণ অত তাড়াতাড়ি বোধ হারায় না- তাওফীক জাওয়াদ বললেন- যে জাতি তাদের সন্তানদেরকে কুরবানী দিয়েছে, তারা দুশমনকে কখনো ক্ষমা করতে পারে না। আবার যে সেনাবাহিনী দুশমনের মুখোমুখি লড়াই করেছে, তারাও এত দ্রুত দমে যায় না। কিন্তু শাসকদের হাতে এমন সব অস্ত্র থাকে, যা দেশের জনগণ ও সেনাবাহিনীকে লাশে পরিণত করে ফেলে। এখন জনগণ ও ফৌজের মধ্যে নেফাঁকের বীজ বপন করা হচ্ছে। ফৌজকে জনগণের চোখে হেয় করা হচ্ছে।

আমি মোহতারাম নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই– আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তিনি খলিফর মা-ও বটে। সুলতান আইউবীর নিকট তিনি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যে, আপনি ইসলামের মর্যাদা রক্ষা করুন। তাকে কি এখানে ডেকে আনা সম্ভব?

এই তো কাল-ই তার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল- তাওফীক জাওয়াদ জবাব দেন- ঠিক আছে, তাকে ডেকে পাঠাচ্ছি। তোমার নাম শুনলে তিনি ছুটে আসবেন।

তাওফীক জাওয়াদ তার চাকরানীকে ডেকে বললেন, খলীফার আম্মার কাছে গিয়ে আমার সালাম জানাবে এবং কানে কানে বলবে, কায়রো থেকে একজন মেহমান এসেছেন।

***

আলী বিন সুফিয়ান যখন তাওফীক জাওয়াদের গৃহে বসে কথা বলছেন, সে সময় তার তাঁবু এলাকায় চলছিল সরগরম অবস্থা। রাত অনেক হয়েছে। ক্রেতাদের ভীড় শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ হল। আলীর একশ লোক এসেছে দীর্ঘ সফর করে। বাজার থেকে বকরী ও দুম্বা কিনে এনেছে। এখন তারা রান্না করে সেগুলো আহার করছে। চলছে হাসি-কৌতুক। মেয়েগুলো আলাদা একটি তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছে। খৃস্টান পুরুষরা বসে আছে আলীর লোকদের সঙ্গে। আসরের পূর্ণতা লাভের জন্য মদের পাত্র বের করে নিয়েছে তারা। সবাইকে মদপান করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আলীর লোকেরা সকলেই না করে দেয়। খৃস্টানরা অবাক হয়। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে বলেছিলেন, আমার লোকদের মধ্যে মুসলমানও আছে, খৃস্টানও আছে। যারা মুসলমান তাদের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, এরা ফেদায়ী। আর ফেদায়ীরা তো নামের মুসলমান। হাসান ইবনে সাব্বাহর দলের মানুষ, যারা মদকে হারাম ভাবে না। অথচ এদের একজনও মদপান করতে রাজি হল না! ব্যাপারটা কি? খৃস্টানদের মনে সন্দেহ জাগে। পরিস্থিতি যাই হোক, এরা তো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গোয়েন্দা। তারা আরো এমন দুচারটি লক্ষণ দেখতে পায়, যার ভিত্তিতে তাদের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। তারা এক এক করে আসর থেকে উঠতে শুরু করে, যেন তাঁবুতে ঘুমাতে যাচ্ছে।

আসর থেকে উঠে গিয়ে তারা মেয়েদেরকে বলে, তোমরা তোমাদের যোগ্যতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন কর, দেখ, আসলে এরা কারা। একটি মেয়ে স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় এবং এই বলে বাইরে চলে যায় যে, এই তবুটি খালি করে দাও। মেয়েটি উঠে গিয়ে বেশ কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক পায়চারি করতে থাকে। অবশেষে আলী বিন সুফিয়ানের এক লোক উঠে মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়। লোকটি কেন গেল বুঝা গেল না। মেয়েটি তাকে থামিয়ে বলল, তাঁবুতে বসে বসে ভয় পাচ্ছিলাম, তাই একটু বাইরে বেড়াতে আসলাম। মেয়েটা পুরুষদেরকে আঙ্গুলে করে নাচাতে জানে। তার মোহনীয় কথা ও ভঙ্গিমায় লোকটা ভুলেই যায় যে, সে কোথায় যেতে উঠেছিল। মেয়েটি বলল, আমাদের সঙ্গে যে লোকগুলো আছে, ওরা বড় খারাপ মানুষ। আমরা এখানে তোমাদের ন্যায় অন্য এক কাজে এসেছিলাম। কিন্তু লোকগুলো আমাদেরকে বেজায় উত্যক্ত করে ফিরছে। আচ্ছা, তুমি কি আমার তাঁবুতে এসে ঘুমাতে পার? তাহলে আমি ওদের থেকে রক্ষা পাই। বলে মেয়েটি এমন কিছু আচরণ করে, যার ফলে লোকটি মোমের মত গলে যায় এবং মেয়েটির তাঁবুতে চলে যায়।

তাঁবুর মধ্যে মিটমিট করে একটি প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের ক্ষীণ আলোয় মেয়েটি লোকটির আপাদমস্তক এক নজর দেখে নিয়ে অত্যন্ত আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলল, উহ! তুমি তো বড় সুশ্রী পুরুষ। তুমিই আমার হেফাজত করতে পারবে। এই বলে এক পেয়ালা মদ লোকটির প্রতি এগিয়ে দিয়ে বলল- নাও, পান কর।

না।

কেন?

আমি মুসলমান।

এত পাক্কা মুসলমানই যদি হয়ে থাক, তাহলে ক্রুশের জন্য মুসলমানদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতে আসলে কেন?

লোকটি চমকে উঠে বলল, এর বিনিময় পাই।

মেয়েটা যতটা না রূপসী, তার চেয়ে বেশী চতুর। এই উভয় অস্ত্র ব্যবহার করে সে আলী বিন সুফিয়ানের এই লোকটির দেল-দেমাগ কজা করে ফেলে। মেয়েটি বলল, মদপান না কর তো শরবত এনে দেই। বলেই সে অন্য তাবুতে চলে যায় এবং একটি পেয়ালা হাতে নিয়ে আসে। শরবতের পেয়ালাটা লোকটির দিকে বাড়িয়ে দেয়। লোকটি পেয়ালাটা হাতে নিয়ে মুখের সঙ্গে লাগিয়েই মুচকি একটা হাসি দিয়ে পেয়ালাটা রেখে দেয়। মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, এর মধ্যে হাশীশ কতটুকু দিয়েছ?

অকস্মাৎ মেয়েটি নিরুত্তর হয়ে যায়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, বেশী নয়; এই যতটুকুতে কিছু সময়ের জন্য তোমাকে আত্মভোলা করে রাখা যায়।

কেন?

আর কেন? আমি তোমাকে হাত করতে চাই- ধীর কণ্ঠে মেয়েটি বলল আমার কথাগুলো যদি তোমার কাছে খারাপ লাগে, তাহলে তোমার খঞ্জরটা আমার বুকে বিদ্ধ করে দাও। আমি তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যাইনি। আমি তোমার ওদিকে আসা দেখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। সফরকালে আমি তোমাকে গভীর মনে দেখেছিলাম। মনে হচ্ছিল, তুমি আর আমি কোথায় যেন কখনো একত্রে ছিলাম এবং একজন আরেকজনের পরিচিত। তোমাকে আমার মনে ধরেছে। দেখলে না, আমি তোমাকে মদ পেশ করেছি, কিন্তু নিজে পান করিনি। কারণ, আমি মুসলমান। এরা আমাকে জোর করে মদপান করায়।

লোকটি চকিত হয়ে জিজ্ঞেস করে, তা তুমি এই কাফেরদের সঙ্গে কিভাবে আসলে?

আমি বারটি বছর ধরে এদের সঙ্গে আছি- মেয়েটি জবাব দেয়- আমি জেরুজালেমের বাসিন্দা। তখন আমার বয়স ছিল বার বছর। আমার পিতা যখন আমাকে বিক্রি করে দেন, তখন আমি জানতাম না, আমার খরিদ্দার খৃস্টান। তারা আমাকে সেই কাজের প্রশিক্ষণ দেয়, এই আজ যে কাজের জন্য আসলাম। আমি দামেস্ক ও বাগদাদের নাম শুনেছি। নামগুলো আমার কাছে বেশ ভাল লাগে। এই ভূখণ্ডে পা রাখা মাত্র এর আবহাওয়া আমার ভেতরে ধর্মীয় চেতনা জাগিয়ে দিয়েছে। আমি মুসলমান, মুসলমানদের ধ্বংসের জন্য আমি কাজ করতে পারব না।

মেয়েটি অতিশয় আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে। বলল- আমার হৃদয় কাঁদছে। আমার আত্মা কাঁদছে। লোটটির হাত দুটো চেপে ধরে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বলল, তুমিও মুসলমান, চল আমরা পালিয়ে যাই। তুমি আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, আমি সেখানেই যাব। ধু ধু মরু প্রান্তরে নিয়ে যাবে? আমি সহাস্যবদনে সেখানে যাব। তুমিও স্বজাতিকে ধোঁকা দেয়া থেকে ফিরে আস। আমাদের কাছে অনেক স্বর্ণমুদ্রা আছে; আমি সেগুলো নিয়ে নেব। চল, আমরা পালিয়ে যাই।

আলী বিন সুফিয়ানের এই লোকটি বুদ্ধিমান ছিল বটে, কিন্তু এখন মেয়েটির রূপ ও কথার ফাঁদে আটকা পড়ে যায়। তার ডিউটির কথা মনে পড়ে। সে মদপান করেনি, হাশীশও নয়। হাশীশের ঘ্রাণ কেমন তার জানা আছে। সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, তোমরা এখানে কেন এনেছ? মেয়েটি তাদের মিশনের কথা জানায়। লোকটি বলল, আমি তোমাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, এখানে তোমরা মুসলমানদেরকে ধোঁকা দিতে পারবে না। সত্য সত্যই যদি তুমি এ- কাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে থাক, তাহলে তোমার সৌভাগ্য যে, তুমি আমাদের হাতে এসে পড়েছ। পালাতে হবে না, তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারবে। আমরা কেউ খৃস্টানদের গুপ্তচর নই। আমরা সবাই মিসরের যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা।

 মেয়েটি আনন্দের আতিশয্যে লোকটিকে জড়িয়ে ধরে। লোকটি বলল, আমি আমার কমান্ডারকে বলব, তোমাকে যেন অন্য মেয়েদের থেকে আলাদা রাখা হয় এবং কোন আমীর বা অন্য কারো হাতে সোপর্দ না করেন।

মেয়েটি অস্থিরচিত্তে লোকটির হাতে চুমো খেতে শুরু করে। মিশন তার সফল। আলী বিন সুফিয়ানের এত সতর্ক একজন গোয়েন্দা একটি খৃস্টান গোয়েন্দা মেয়ের প্রতারণার শিকার হয়ে পড়ল।

একটু অপেক্ষা করুন- মেয়েটি বলল- আমি দেখে আসি আমার সঙ্গীরা ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা। .. .।

মেয়েটি তাবু থেকে বেরিয়ে যায়।

***

আলী বিন সুফিয়ান সালার তাওফীক জাওয়াদের ঘরে বসে নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রীর অপেক্ষা করছেন। ইসলামের মহান মুজাহিদের স্ত্রী দূত মারফত সালাহুদ্দীন আইউবীর নিকট তার চিন্তা-চেতনা ও আবেগের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। তারপরও আলী বিন সুফিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা জরুরী। তার নিকট থেকে অনেক তথ্য জানতে হবে এবং পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

কিছুক্ষণ পর সম্মানিতা মহিলা এসে উপস্থিত হন। তিনি কালো ওড়নায় আবৃতা। মুখে কৃত্রিম দাড়ি থাকার কারণে আলী বিন সুফিয়ানকে প্রথমে চিনতে পারেননি। পরক্ষণে পরিচয় পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন

এমন একটি সময়ও আমাদের ভাগ্যে লেখা ছিল যে, আমরা দুজন এভাবে লুকিয়ে ও ছদ্মবেশ ধারণ করে পরস্পর সাক্ষাৎ করব। তুমি এখানে মাথা উঁচু করে আসতে। এবার এসেছ এমনভাবে, যেন তোমাকে কেউ চিনতে না পারে। আর আমিও ঘর থেকে এমন সাবধানে বের হয়েছি, যেন কেউ আমার পিছু না নেয় যে, আমি কোথায় যাচ্ছি।

আলী বিন সুফিয়ানও অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না তিনি। আবেগে এতই আপ্লুত হয়ে পড়েন যে, দীর্ঘক্ষণ কোন কথাই তার মুখ থেকে বেরুল না। নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী বললেন 

আলী বিন সুফিয়ান! এই পোশাক আমি স্বামীর শোক পালনের জন্য পরিধান করিনি। আমি শোক পালন করছি ইসলামের সেই মর্যাদার জন্য, যা আমার জাতির অলংকার। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রদেশের শাসকরা আমার পুত্রকে ক্রীড়নকে পরিণত করে জাতীয় মর্যাদাকে খৃস্টানদের পায়ে অর্পণ করেছে। তুমি সম্ভবত জান না, যে খৃস্টান সম্রাটকে সুলতান জঙ্গী বন্দী করে রেখেছিলেন, গতকাল খলীফার নির্দেশে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এই সেই সম্রাট রেজােল্ড, যাকে মাস কয়েক আগে নুরুদ্দীন জঙ্গী বেশ কজন খৃস্টান সৈন্যের সঙ্গে এক লড়াইয়ে গ্রেফতার করেছিলেন। নুরুদ্দীন জঙ্গী তাকে ও অন্যান্য বন্দীদেরকে কার্ক থেকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন।

এ ঘটনায় জঙ্গী বেশ আনন্দিত ছিলেন। তিনি বলতেন, আমি খৃস্টানদের সঙ্গে এমন একটি চাল খেলে এই সম্রাটকে মুক্ত করব, যে চাল তাদের কোমর ভেঙ্গে দেবে। একজন সম্রাট ও উচ্চপদস্থ কমান্ডারের গ্রেফতারি সাধারণ কোন ব্যাপার ছিল না। আমরা তার পরিবর্তে খৃস্টানদের থেকে আমাদের অনেক দাবি-দাওয়া আদায় করে নিতে পারতাম। কিন্তু গতকাল আমার পুত্র আনন্দের সাথে আমাকে বলল, মা! আমি খৃস্টান সম্রাট এবং তার সঙ্গীসহ সব খৃস্টান বন্দীকে মুক্ত করে দিয়েছি। সংবাদটি আমার মনে প্রচণ্ড একটা আঘাত হানে। আমি অনেকক্ষণ পর্যন্ত আত্মভোলার ন্যায় বসে থাকি। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পুত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, বিনিময়ে নিজের বন্দীদের ছাড়িয়ে এনেছ কি? পুত্র জবাব দেয়, ওদেরকে ফিরিয়ে এনে আমরা আর কি করব। আমরা তো আর কারো সঙ্গে যুদ্ধ করব না। আমি পুত্রকে বললাম, তুমি এখন থেকে আর তোমার বাপের কবরের নিকট যাবে না। আর তুমি মারা গেলেও তোমার পিতার কবরস্থানে তোমাকে দাফন করব না। সেই করবস্থানে এমন বহু মুজাহিদও শুয়ে আছেন, যারা খৃস্টানদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তোমাকে সেখানে দাফন করে আমি তাদের অবমাননা করতে চাই না। তুমি নুরুদ্দীন জঙ্গীর কলংক…।

কিন্তু যা-ই বলি, পুত্র তো আমার নাবালক, এখনো সবকিছু বুঝে উঠার বয়স হয়নি। আমার পুত্র যেসব আমীর দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে আছে, আমি তাদের নিকটও গিয়েছি। তারা আমাকে শ্রদ্ধা করে বটে, কিন্তু মান্য করতে প্রস্তুত নয়। তারা আমার কথা মানছে না। খৃস্টানরা তাদের সম্রাট ও বন্দী সৈন্যদের মুক্তি দিয়ে ইসলামের মুখে চপেটাঘাত করেছে। আমার নিকট অবাক লাগে যে, সুলতান আইউবী কায়রোতে বসে কী করছেন। তিনি আসছেন না কেন? সালাহুদ্দীন আইউবী কী ভাবছেন আলী বিন সুফিয়ানঃ তুমি তাকে বলবে, তোমার এক বোন তোমার আত্মমর্যাদার জন্য মাতম করছে। তাকে বলবে, আমি এই কালো পোশাক সেইদিন খুলব, যেদিন তোমরা দামেস্কে প্রবেশ করে বিলাসপ্রিয় ও ঈমান বিক্রেতাদের হাত থেকে মিল্লাতে ইসলামিয়ার মর্যাদাকে রক্ষা করবে। অন্যথায় আমি এই পোশাকেই মৃত্যুবরণ করব আর অসিয়ত করে যাব, যেন আমাকে এই পোশাকেই দাফন করা হয়। আমি কিয়ামতের দিন আমার স্বামী ও আল্লাহর সম্মুখে সাদা পোশাকে উপস্থিত হতে চাই না।

আমি আপনার মনের কথা বুঝতে পারছি- আলী বিন সুফিয়ান বললেন আসুন আমরা কাজের কথা বলি। সুলতান আইউবীও আপনারই ন্যায় অস্থির বেকারার। আবেগ ও উত্তেজনাবশত আমাদের কোন পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না। এখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক। আমরা চেষ্টা করছি, যাতে গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে যেতে পারি। তার পন্থা একটাই যে, দেশের জনগণ আমাদের পক্ষে থাকবে। আর সেনাবাহিনীর ব্যাপারে ভাই তাওফীক জাওয়াদ আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, ফৌজ আমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না। তবে খলীফা ও আমীরদের রক্ষীবাহিনী মোকাবেলা করতে পারে।

দেশের জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে- জঙ্গীর স্ত্রী বললেন- আমি মহিলা মানুষ; ময়দানে গিয়ে যুদ্ধ করতে পারব না। তবে আমি অন্য অঙ্গনে লড়ে যাচ্ছি। আমি দেশের নারী সমাজের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করে রেখেছি যে, আপনি যে কোন সময় তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে যেতে পারবেন। আমার ব্যবস্থাপনায় এখানকার যুবতী মেয়েরা তরবারী চালনা ও তীরন্দাজীতে দক্ষতা অর্জন করেছে। তারা তাদের পুত্র, পিতা, স্বামী ও ভাইদেরকে স্ফুলিঙ্গ বানিয়ে রেখেছে। আমি যেসব মহিলাদের দ্বারা প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তারা আমার অনুগত। পরিস্থিতি যদি গৃহযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায়, তাহলে প্রতিটি গৃহকে মহিলারা খলীফার ফৌজের বিরুদ্ধে দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে ফেলবে। সালাহুদ্দীন আইউবী যদি ফৌজ নিয়ে আসেন, তাহলে আমার খলীফা পুত্র ও তার চাটুকাররা নিজেদেরক সঙ্গীহীন দেখতে পাবে। তুমি যাও ভাই আলী! ফৌজ নিয়ে আস। এখানকার পরিস্থিতি আমার উপর ছেড়ে দাও। তুমি নিশ্চিত থাক, জনগণের দিক থেকে একটি তীরও তোমাদের গায়ে বিদ্ধ হবে না। যদি আমার পুত্রকে হত্যা করে ফেলার প্রয়োজন মনে কর, তাহলে। ভুলে যেও সে আমার ও নুরুদ্দীন জঙ্গীর পুত্র। আমি আমার পুত্রকে খণ্ডবিখণ্ড করাতে রাজি আছি, সালতানাতে ইসলামিয়াকে টুকরো টুকরো করতে দিতে রাজি নই।

তাওফীক জাওয়াদও আলী বিন সুফিয়ানকে নিশ্চয়তা প্রদান করেন যে, গৃহযুদ্ধ হবে না। তারপর তিনজন মিলে পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন যে, সুলতান আইউবী কিভাবে আসবেন এবং এসে কি করবেন। সিদ্ধান্ত হল, সুলতান আইউবী আসনে নীরবে, খলীফা ও তার চাটুকারদের অজান্তে।

***

আলী বিন সুফিয়ানের লোকটিকে তাঁবুতে বসিয়ে রেখে খৃস্টান মেয়েটি তার সঙ্গীদের নিকট গিয়ে বলে, শিকার জালে আটকা পড়েছে। এরা সবাই মিসরী ফৌজের যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা। বিখ্যাত গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান তাদের কমান্ডার।

এই তথ্য খৃস্টানদের চমকে দেয়। তারা ভাবতে শুরু করে যে, এখন কি করা যায়। এখানে থাকা তাদের জন্য নিরাপদ নয়।

মেয়েটি পুনরায় মিসরী গোয়েন্দার কাছে ফিরে যায়। এক খৃষ্টান বাইরে বেরিয়ে আলী বিন সুফিয়ানকে খুঁজতে থাকে। কিন্তু আলীকে পায় না সে। তিনি তো তখন তাওফীক জাওয়াদের ঘরে বসা। আলী এখানে আছে কি নেই, এটাই লোকটির জানা দরকার। আলীকে অনুপস্থিত দেখে মনে ভয় জাগে যে, তিনি তাদেরকে গ্রেফতার করার ব্যবস্থা করছেন। সঙ্গীদের নিকট গিয়ে সে জানায়, বিলম্ব না করে এক্ষুণি এখান থেকে পালাতে হবে।

এখন মধ্য রাত। এরা এই নগরী সম্পর্কে অজ্ঞ। দিনের বেলা হলে গন্তব্য একটা ঠিক করে নিতে পারত। তাছাড়া এই রাত দুপুরে মেয়েদের নিয়ে চলাও অনুচিত।

একজন পরামর্শ দিল, চল আমরা কোন একটা সরাইখানায় গিয়ে উঠে। বলব, আমরা কায়রোর ব্যবসায়ী; বাইরে খোলা মাঠে ঘুমুতে পারি না, তাই সরাইখানায় রাত কাটাতে চাই। তার এই মতের উপরই সিদ্ধান্ত হল। কিন্তু সরাইখানা কোথায়, সেটা তাদের জানা নেই।

একজন লুকিয়ে লুকিয়ে সরাইখানার সন্ধানে বের হয়। লোকটি হাঁটছে। রাস্তাঘাট, হাটবাজারে কোথাও জনমানুষের চিহ্ন নেই। একজন মানুষও তার নজরে পড়ল না, যাকে জিজ্ঞেস করবে এখানে সরাইখানার কোথায়।

লোকটি এলোপাতাড়ি ঘুরছে। হঠাৎ সামনে একজন লোককে এগিয়ে আসতে দেখে। অন্ধকারে এতটুকুই বুঝতে পারে, একজন মানুষ আসছে। নিকটে আসলে খৃস্টান লোকটি তাকে জিজ্ঞেস করে, ভাই এদিকে সরাইখানা কোথায় বলতে পারেন কি?

লোকটির মাথা ও মুখের অর্ধেকটা চাদর দিয়ে ঢাকা। তিনি বললেন, এখানে ধারে-কাছে কোন সরাইখানা নেই।

আছে এখান থেকে অনেক দূরে- নগরীর ওই প্রান্তে। বলে লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, এত রাতে আপনি সরাইখানা খুঁজছেন কেন? এখন তো আর আপনার জন্য কেউ সরাইখানার দরজা খুলবে না।

খৃস্টান বলল, এই আজই আমি একটি বণিক কাফেলার সঙ্গে এসেছি। সঙ্গে চারটি মেয়ে আছে; ওদেরকে তো আর তাঁবুতে রাখা যায় না।

হ্যাঁ, এটা তো সমস্যা- আগন্তুক বলল- আপনাকে সন্ধ্যার আগেই এর ব্যবস্থা করে রাখা আবশ্যক ছিল। যা হোক, আসুন, আমি আপনার সাহায্য করব। আপনি বিদেশী মানুষ, এখান থেকে গিয়ে যাতে বলতে না হয় যে, দামেস্কে আমার মেয়েরা খোলা মাঠে রাত কাটিয়েছে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। মেয়েদেরকে নিয়ে আসুন, আমি সরাইখানা খুলিয়ে আপনাদের রাত যাপনের ব্যবস্থা করে দেব।

আগন্তুক খৃস্টান লোকটির সঙ্গে হাঁটা দেয়। দুজন কাফেলার তাঁবুর নিকট চলে যান। খৃস্টান তাকে একস্থানে দাঁড় করিয়ে বলল, আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি ওদেরকে নিয়ে আসছি। বলেই সে তাঁবুর একদিক থেকে চক্কর কেটে কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।

খৃস্টানদের তাঁবু এখান থেকে সামান্য দূরে অন্য জায়গায়। তাঁবুতে পৌঁছে সে সঙ্গীদের বলল, একজন লোক আমার সঙ্গে এসেছে, তিনি আমাদেরকে সরাইখানায় জায়গার ব্যবস্থা করে দেবেন। সঙ্গীরা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। পাছে এই লোকটিও ধোঁকা দিয়ে বসে কিনা। কিন্তু ভয় পেয়ে লাভ নেই। যে জালে আটকা পড়েছে, সেখান থেকে যে কোন মূল্যে হোক বের তাদের হতেই হবে। মিসরী গোয়েন্দা মেয়েটিকে এতটুকুও বলে দিয়েছে যে, খলীফা ও আমীরগণ খৃস্টানদের পদানত হয়ে পড়েছেন। সে জন্য আলী বিন সুফিয়ান ছদ্মবেশে একশ যুদ্ধবাজ গোয়েন্দা নিয়ে এখানে এসেছেন। তার মিশন হল, এখানকার পরিস্থিতি যাচাই করা যে, খৃস্টানদের প্রভাব কতটুকু বিস্তার লাভ করেছে এবং সালাহুদ্দীন আইউবীর জন্য সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী কিনা।

মেয়েটি আলী বিন সুফিয়ানের এই মিশনের কথা তার সঙ্গীদের অবহিত করেছিল। তাদের কাছে এটা এতই মূল্যবান তথ্য যে, রাতারাতি খলীফার কানে দিতে পারলে প্রশংসা লাভ করা যেত। তাছাড়া খৃস্টান শাসকদের নিকটও সংবাদটা পৌঁছানো দরকার, যাতে তারা সময়মত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তারা এমনও সংকল্প করে যে, আলী ও তার এই দলটিকে খলীফাকে দিয়ে ধরিয়ে দিতে পারলে মন্দ হত না।

তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা তো ঘুমিয়ে আছে; আমরা সবাই একত্রে বেরিয়ে যাব। মালপত্র ও পশুগুলোকে এখানেই রেখে যাব। ভোর পর্যন্ত তো এই মিশরী দলটি খলীফার হাতে ধরা পড়ছেই। পরে আমাদের মালামাল আমরা নিয়ে নেব।

সব কজন একত্রে তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে। পা টিপে টিপে আড়ালে আড়ালে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে সেই স্থানে গিয়ে পৌঁছে, সেখানে সাহায্যকারী লোকটিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু এখন লোকটা জায়গায় নেই। সবাই এদিক-ওদিক তাকাতে থাকে। ঠিক এমন সময় উটের আড়াল থেকে বেশ কজন লোক উঠে দাঁড়ায় এবং খৃস্টান দলটিকে ঘিরে ফেলে। তাদেরকে হাঁকিয়ে একদিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কয়েকটি প্রদীপ জ্বালান হয়। আলী বিন সুফিয়ান তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, দোস্তরা, কোথায় যাচ্ছ? তারা মিথ্যা জবাব দেয়। আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করেন, সরাইখানার সন্ধানে দিশেহারার ন্যায় ঘুরছিল যে লোকটি, সে কে?

একজন বলল, আমি।

আর যার নিকট সরাইখানার সন্ধান জিজ্ঞাসা করেছিলে- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- সে হলাম আমি।

এ এক আকস্মিক ঘটনা। আলী বিন সুফিয়ান তাওফীক জাওয়াদের ঘর থেকে ফিরছিলেন আর একই পথে খৃস্টান লোকটি সরাইখানার সন্ধানে যাচ্ছিল। লোকটি আলী বিন সুফিয়ানকে সরাইখানার পথ জিজ্ঞেস করে। আলো থাকলে লোকটি আলীকে চিনে ফেলত। কিন্তু একে তো ছিল অন্ধকার, দ্বিতীয়ত আলী বিন সুফিয়ানের মাথা ও মুখমণ্ডল ছিল রুমাল দ্বারা ঢাকা। লোকটির দুএকটি কথা শুনেই তিনি বুঝে ফেললেন, ওরা জেনে ফেলেছে যে, ওরা ফাঁদে আটকা পড়েছে; তাই পালাবার পথ খুঁজছে। আলী বিন সুফিয়ান নিশ্চিত ছিলেন, এই খৃস্টানরা গোয়েন্দা। কিন্তু এখানে আমীরদের কেউ না কেউ তাদেরকে আশ্রয় দেবেন। তাই তিনি সাহায্যের ফাঁদ পেতে তাকে আটকে ফেলেছেন এবং তার সঙ্গে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। তিনি ভাবছিলেন, এ মুহূর্তে কী পদক্ষেপ নেয়া যায়। খৃস্টান লোকটি তাঁর প্রতি করুণাই করেছে যে, তাকে তাবু থেকে অনেক দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে গেছে।

আলী বিন সুফিয়ান তৎক্ষণাৎ তাঁর দুতিনজন লোককে জাগিয়ে তোলেন এবং নেহায়েত দ্রুততার সাথে তাদেরকে তাদের কর্তব্য বুঝিয়ে দিলেন। দিক নির্দেশনা দিয়ে তিনি নিজে খৃস্টানদের তাঁবুর নিকটে নিয়ে যান। মেয়েদেরসহ তারা সবাই একটি তাঁবুতে জড়ো হয়েছে। আলী বিন সুফিয়ান পা টিপে টিপে সন্নিকটে গিয়ে তাদের কথোপকথন শ্রবণ করেন। তিনি এতটুকু জানতে পারেন যে, খৃস্টান গোয়েন্দারা তার মিশন জেনে ফেলেছে। কিন্তু এই গোপন তথ্য কিভাবে ফাঁস হল, তা জানতে পারলেন না।

ইত্যবসরে আলী বিন সুফিয়ানের লোকেরা তার নির্দেশনা মোতাবেক বর্শাসজ্জিত হয়ে উটপালের আড়ালে গিয়ে বসে পড়েছে। খৃস্টানদের এখানেই আসবার কথা। যেইমাত্র তারা এখানে এসে উপস্থিত হয়, সঙ্গে সঙ্গে আলী বিন সুফিয়ানও এসে হাজির হন এবং সবাইকে ঘিরে ফেলে বন্দী করে ফেলেন।

দোস্তরা! আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তোমাদের চরবৃত্তি অনেক দুর্বল। এখনো তোমাদের অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। গুপ্তচর কি এভাবে সুনসান- জনমানবশূন্য অলিগলিতে ঘোরাফেরা করে? আর গুপ্তচর কি কোন অজানা লোকের সঙ্গে তার পরিচয় না পাওয়া পর্যন্ত কথা বলে? এই বিদ্যা তোমাদের আমার নিকট থেকে শিখতে হবে।

এই বিদ্যা আপনি আপনার লোকদেরই শিক্ষা দিন- এক খৃস্টান বলল আপনি কি আমাদের এই দক্ষতার প্রশংসা করবেন না যে, আমরা আপনারই একজন থেকে আপনাদের আসল পরিচয় জেনে নিয়েছি? এতো ভাগ্যের লীলা। আজ আপনি জিতে গেছেন, আমরা হেরে গেছি। আমাদের কমান্ডার যদি মৃত্যুবরণ না করতেন, তাহলে আজ আমরা এভাবে ধরা খেতাম না।

আমার সেই লোকটি কে, যে আমার গোপন তথ্য ফাঁস করে দিল? আলী বিন সুফিয়ান জিজ্ঞেস করলেন।

ঐ যে ঐ তাঁবুতে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটি একটি তাঁবুর প্রতি ইশারা করে উত্তর দিল- ও আমার ফাঁদে এসে পড়েছিল।

যাক গে, এসব আলাপ কায়রো গিয়ে হবে। আলী বিন সুফিয়ান বললেন।

ভোর হল। জনতা দেখতে পেল, একটি বণিক কাফেলা এগিয়ে চলছে। অনেকগুলো উটের পিঠে যেখানে ব্যবসার পণ্য বোঝাই করা, সেখানে কয়েকটি তাঁবুও পেঁচিয়ে রাখা আছে। আলী বিন সুফিয়ান ও তার একশ লোক ব্যতীত কেউ জানে না, এই তাঁবুগুলোর মধ্যে চারটি মেয়ে ও চারজন পুরুষ শুয়ে আছে। রওনা হওয়ার প্রাক্কালে আলী বিন সুফিয়ান শেষ রজনীর আলো আঁধারীতে এক একজন খৃস্টানকে এক একটি তাঁবুর মধ্যে পেঁচিয়ে উটের পিঠে বোঝাই করে বেঁধে নিয়েছেন। ওরা দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে, নাকি জীবিত থাকবে, তার কোন ভাবনা নেই আলী বিন সুফিয়ানের।

কাফেলা দামেস্ক অতিক্রম করে বেরিয়ে যায়। এখন আর পেছনের দিকে তাকালে শহরটা দেখা যায় না। আলী বিন সুফিয়ান বন্দী খৃস্টান গোয়েন্দাদেরকে তাঁবুর মধ্য হতে বের করেন। সকলেই জীবিত। তিনি মেয়েগুলোকে উটের পিঠে আর পুরুষদেরকে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে নেন। তারা মুক্তির জন্য তাদের সমুদয় মণি-মাণিক্য ও সোনাদানা আলী বিন সুফিয়ানকে দিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করে। এগুলো তারা খলীফা ও আমীদেরকে উপঢৌকন দেয়ার জন্য এনেছিল। আলী বিন সুফিয়ান মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, এসব দৌলত তো আমার সঙ্গে যাচ্ছেই।

***

সে সময়ে রেমান্ড নামক এক খৃস্টান ত্রিপোলীর শাসক ছিলেন। বর্তমানকার লেবাননকে সে যুগে ত্রিপোলী বলা হত। অন্যান্য খৃস্টান শাসকরা অবস্থান করতেন জেরুজালেম ও তার আশপাশের এলাকায়। নুরুদ্দীন জঙ্গীর মৃত্যুতে তারা সকলেই আনন্দিত। ইতিমধ্যে তারা একটি বৈঠক করে ফেলেছেন। পরিকল্পনাসমূহকে পুনর্বিবেচনা করে দেখেন, ঠিক আছে কিনা। সে মোতাবেক খৃস্টান কমান্ডার আইরিজ তার বাহিনী নিয়ে হাল্ব পৌঁছে যান। হাবের আমীর হলেন শামসুদ্দীন। আইরিজ শামসুদ্দিনের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন, আপনি হাবকে আমাদের হাতে তুলে দিন কিংবা চুক্তিনামায় সই করে আমাদেরকে কর প্রদান করুন। শামসুদ্দিন এই ভয়ে খৃস্টানদের কাছে। আত্মসমর্পণ করেন যে, দামেস্ক ও মওসেলের আমীরগণ আমাকে যুদ্ধে লিপ্ত দেখলে আমার রাজ্য কজা করে নেবে।

এই একটি মাত্র সাফল্যে খৃস্টানরা দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। তারা বুঝে ফেলে যে, এই মুসলমান আমীরগণ পরস্পর সহযোগী হওয়ার স্থলে একে অপরের দুশমন। তাই তারা বিনা যুদ্ধেই মুসলমানদেরকে পদানত করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করে ফেলে। তাদের ভয় ছিল শুধু সালাহুদ্দীন আইউবীকে। আইউবীর নীতি ও চরিত্র সম্পর্কে তারা অবহিত। তাদের আশংকা ছিল, সুলতান আইউবী যদি দামেস্ক বা অন্য কোন এলাকায় এসে পড়েন, তাহলে তিনি সব আমীরকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলবেন। তিনি সকল আমীরকে অতিদ্রুত ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেনও। রেমান্ড খলীফা আল-মালিকুস্ সালিহকে দূত মারফত মূল্যবান উপঢৌকনসহ এই প্রস্তাব পেশ করেছিলেন যে, প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে সামরিক সহেযাগিতাও প্রদান করব।

ইসলামের অস্তিত্ব ও মর্যাদা প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন। এ মুহূর্তে ইসলামের বাঁচা-মরা নির্ভর করছে সুলতান আইউবীর পদক্ষেপের উপর। বিলীয়মান প্রতিটি মুহূর্ত ইসলামকে ধ্বংসের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। সুলতান আইউবী কায়রোতে আলী বিন সুফিয়ানের অপেক্ষা করছেন। তাকে আলীর রিপোর্ট অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। তিনি বাগদাদ, দামেস্ক, ইয়ামান প্রভৃতি অঞ্চলে সেনা অভিযান প্রেরণের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তার জন্য সমস্যা হল, মিসরের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভাল নয় এবং সৈন্যও প্রয়োজনের তুলনায় কম। মিসর থেকে তিনি বেশী সৈন্য নিয়ে যেতে পারবেন না। এ মুহূর্তে এটাই তার বড় সমস্যা, যার জন্য তিনি অতিশয় বিচলিত যে, এত সামান্য সৈন্য দিয়ে কি তিনি সাফল্য অর্জন করতে পারবেন! কিন্তু তবুও সেনা অভিযান ছাড়া তরি গত্যন্তর নেই। সুলতান আইউবী প্রতিদিন দুএকবার ঘরের ছাদে উঠে একনাগাড়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন, যেদিক থেকে আলী বিন সুফিয়ান আসবেন। দিগন্তে দৃষ্টি মেলে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকছেন তিনি।

এভাবে একদিন তিনি দূর দিগন্তে ধূলিবালির কুন্ডলী দেখতে পান। ধূলির কুন্ডলী জমিন থেকে উত্থিত হয়ে যেন উপরদিকে উঠে যাচ্ছে। সুলতান আইউবী বাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছেন। ধূলির কুন্ডলী ধীরে ধীরে নিকটে এগিয়ে আসছে। একসময় ধূলির ভেতর ঘোড়া ও উটের কায়া নজরে আসে। এটা আলী বিন সুফিয়ানেরই কাফেলা। দামেস্ক থেকে রওনা হওয়ার পর পথে তিনি কমই যাত্রাবিরতি দিয়েছেন। মিসরের মিনার চোখে পড়া মাত্র তিনি উট ঘোড়ার গতি আরো বাড়িয়ে দেন। এ পরিস্থিতিতে একটি মুহূর্তের মূল্য কত, তা তিনি জানেন। তাঁর অপেক্ষায় যে সুলতান আইউবীর রাতে ঘুম আসছে না, সেই অনুভূতিও তার আছে।

আপাদমস্তক ধূলিমলিন আলী বিন সুফিয়ান সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবীর সম্মুখে দণ্ডায়মান। সুলতান আইউবী তাকে নাওয়া-খাওয়ার সময়ও দিলেন না। রিপোর্ট শোনার জন্য তিনি অস্থির-বেকারার। এখানেই তার খাওয়ার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়ে তাকে দফতরে নিয়ে যান। আলী বিন সুফিয়ান সুলতান আইউবীকে বিস্তারিত রিপোর্ট শোনান। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীর পয়গাম, তার আবেগ ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। সালার তাওফীক জাওয়াদের সঙ্গে যে কথপোকথন হয়েছে, তারও বিবরণ দেন। শেষে বললেন, দামেস্ক থেকে আমি একটি উপঢৌকন নিয়ে এসেছি। এই উপঢৌকন হল চারজন খৃস্টান গোয়েন্দা পুরুষ ও চারটি মেয়ে। তিনি সুলতান আইউবীকে বললেন, আমি সন্ধ্যার আগে আগে তাদের থেকে কিছু মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করব।

তার মানে আমাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতেই হবে! সুলতান আইউবী বললেন।

হ্যাঁ, করতে হবে এবং আমরা অবশ্যই করব- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তবে আমার আশা, গৃহযুদ্ধ হবে না।

সুলতান আইউবী তাঁর দুজন উপদেষ্টাকে তলব করেন। এই উপদেষ্টাদ্বয়ের উপর তার পূর্ণ আস্থা আছে। সুলতান তাদেরকে বললেন, এই মুহূর্তে আমি তোমাদেরকে যে কথাগুলো বলব, সেগুলো মনে গেঁথে নেবে। তোমরা দুজন ব্যতীত আলী বিন সুফিয়ানও এই গোপন ভেদ সম্পর্কে অবহিত থাকবে।

সুলতান আইউবী তাদেরকে দামেস্ক ও অন্যান্য ইসলামী রিয়াসত ও জায়গীরের পরিস্থিতির বিবরণ প্রদান করেন। আলী বিন সুফিয়ানের নিয়ে আসা রিপোর্ট শুনিয়ে বললেন, আল্লাহর সেনারা তাঁরই হুকুম তামিল করে থাকে। আমীর ও খলীফাদের আনুগত্য আমাদের উপর ফরজ। কিন্তু আমীর খলীফা যদি ইসলাম ও মুসলমানের দুশমনে পরিণত হয়, তখন ইসলাম ও মুসলমানদের রক্ষা করার জন্য তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা আল্লাহর সৈনিকদের জন্য ফরয হয়ে দাঁড়ায়। আমার অস্তিত্ব যদি দেশ ও জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে আমাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া কিংবা পায়ে শিকল পরিয়ে বন্দীশালায় আবদ্ধ করে রাখা তোমাদের জন্য কর্তব্য হয়ে পড়বে। আজ এমনি একটি কর্তব্য আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। আমাদের খলীফা ইসলাম ও সার্বভৌমত্বের কথা ভুলে গিয়ে দুশমনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তিনি আজ ইসলামের দুশমনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছেন, তাদের গুপ্তচরদের আশ্রয় প্রদান করছেন। তার আশপাশের লোকেরা ভোগ-বিলাসিতায় ডুবে আছে। তারা সালতানাতে ইসলামিয়াকে বিক্রি করে খাচ্ছে। হাব-এর গবর্নর শামসুদ্দীন খৃস্টানদের হাতে আত্মসমর্পণ করে কর প্রদান করছে এবং তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। খৃস্টজগত চতুর্দিক থেকে আলমে ইসলামকে ঘিরে ফেলছে। এমতাবস্থায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে খলীফাকে গদিচ্যুত করে ইসলামের অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কিনা পরামর্শ দিন।

অবশ্যই ফরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উভয় উপদেষ্টা একবাক্যে জবাব দেন।

আমাদের পদক্ষেপ-পরিকল্পনা এই চারজনের মধ্যেই গোপন থাকবে। সুলতান আইউবী বললেন এবং তাদেরকে নিয়ে পরিকল্পনা প্রস্তুত করার কাজ শুরু করে দেন।

খৃস্টান গোয়েন্দা ও মেয়েদেরকে আলী বিন সুফিয়ান একটি বিশেষ পাতাল কক্ষে নিয়ে যান এবং বললেন, তোমরা এমন একটি জাহান্নামে এসে প্রবেশ করেছ, যেখানে তোমরা জীবিতও থাকবে না, মরবেও না। তোমাদের দেহগুলোকে কংকালে পরিণত করে আমি তোমাদের থেকে যেসব তথ্য উদ্ধার করব, ভালোয় ভাল আগেই সব বলে দাও। তবেই এই জাহান্নাম থেকে তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে। তোমাদেরকে চিন্তা করার জন্য কিছুক্ষণ সময় দিলাম। আমি একটু পরে আসছি।

আলী বিন সুফিয়ান যখন তাদেরকে বেড়ী পরানোর নির্দেশ প্রদান করেন, তখুন তাদের একজন বলল, আমরা আপনাকে সব কথা বলে দেব। আমরা বেতনভোগী কর্মচারী। শাস্তি যদি দিতেই হয়, আমাদেরকে না দিয়ে যারা আমাদেরকে খাটায়, তাদেরকে দিন। তাছাড়া আমরা পুরুষরা না হয় শাস্তি বরদাশত করতে পারব; কিন্তু এই মেয়েগুলোকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করুন।

কেউ তাদের গায়ে হাত দেবে না- আলী বিন সুফিয়ান বললেন- তোমরা যদি আমার কাজ সহজ করে দাও, তাহলে তোমাদের মেয়েরা তোমাদেরই সঙ্গে থাকবে। এই পাতাল প্রকোষ্ঠ থেকে তোমাদেরকে বের করে নেয়া হবে এবং সসম্মানে নজরবন্দী করে রাখা হবে।

খৃস্টান গোয়েন্দারা যেসব তথ্য প্রদান করে, তাতে নুরুদ্দীন জঙ্গীর ওফাতের পর উদ্ভূত পরিস্থিতির সত্যতা প্রমাণিত হয়ে যায়।

***

তিন দিন পর।

মিসরের সীমান্ত থেকে অনেক দূরে- উত্তর-পশ্চিমে বিস্তীর্ণ একটি ভূখণ্ড। এলাকাটি পর্বতময়, উঁচু-নীচু টিলায় পরিপূর্ণ। মাঝে-মধ্যে সবুজ গাছগাছালী। আছে পানিও। এলাকাটা কাফেলা ও সেনা চলাচলের সাধারণ রাস্তা থেকে ভিন্ন। তার-ই অভ্যন্তরে এক স্থানে অনেকগুলো ঘোড়া বাঁধা আছে। ঘোড়াগুলোর সামান্য দূরে আড়ালে শুয়ে আছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। সেখান থেকে খানিক ব্যবধানে একটি তাঁবু। তাঁবুর ভিতরে শুয়ে আছেন এক ব্যক্তি। তিন চারজন লোক বিভিন্ন টিলার উপর হাঁটাহাটি করছে। এলাকার বাইরে বিক্ষিপ্তভাবে টহল দিয়ে ফিরছে আরো জন চারেক লোক।

তাঁবুর ভিতরে শায়িত লোকটি সুলতান সালাহুদ্দীন আইউবী। টিলার উপরে-নীচে যারা ঘোরাফেরা করছে তারা প্রহরী। বেঁধে রাখা অশ্বপালের অদূরে শুয়ে থাকা লোকগুলো সুলতান আইউবীর সৈন্য। তারা সংখ্যায় সাতশত।

সুলতান আইউবী গভীর ভাবনা-চিন্তার পর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, তিনি যথাসম্ভব কম সৈন্য নিয়ে দামেস্ক যাবেন। যদি একজন সুলতানের ন্যায় তাকে স্বাগত জানানো হয়, তবে তো ভাল, মৌখিক আলাপ-আলোচনায়-ই সমস্যার সমাধান হবে। আর যদি সংঘর্ষ বাধে, তাহলে এই সল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারাই মোকাবেলা করবেন। আলী বিন সুফিয়ান তাঁকে নিশ্চয়তা প্রদান করেছিলেন যে, খলীফা ও আমীরদের রক্ষীবাহিনী যদি সংঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে সালার তাওফীক জাওয়াদ তার বাহিনীকে সুলতানের হাতে তুলে দিবেন। জঙ্গীর স্ত্রীও নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, নগরবাসী সুলতান আইউবীকে স্বাগত জানাবে। কিন্তু সুলতান আইউবী নিজেকে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হতে দেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ধরে নিয়েছিলেন যে, দামেস্কের প্রত্যেক সৈনিক ও জনতা তাঁর দুশমন। তাই তিনি তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী থেকে এমন সাতশত সৈন্য বেছে নেন, যারা অসংখ্য যুদ্ধে লড়াই করেছে। তাদের মধ্যে আছে এমন সব গেরিলা যোদ্ধাও, যারা দুশমনের পিছনে যুদ্ধ লড়ায় অভিজ্ঞ। সামরিক দক্ষতা ছাড়াও এসব সৈন্য জাতীয় ও ঈমানী চেতনায় বলীয়ান। খৃস্টানদের নাম শুনলেই লাল যায় হয়ে তাদের চোখ।

সুলতান আইউবী কায়রো থেকে এই সৈন্যদেরকে রাতের আঁধারে গোপনে বের করে এনেছেন। তারা এক-দুজন করে কায়রো থেকে বেরিয়ে আসে এবং কায়রোর অনেক দূরে পূর্ব নির্ধারিত একস্থানে সমবেত হয়। সুলতান আইউবীও কায়রো থেকে বের হন অতি গোপনে। বিষয়টা জানতেন শুধু আলী বিন সুফিয়ান ও সুলতানের দুই খাস উপদেষ্টা। সুলতান আইউবীর রক্ষী বাহিনী যথারীতি কায়রোতে তার বাসগৃহ ও হেডকোয়ার্টার পাহারা দিচ্ছে। তারা জানে, সুলতান এখানেই আছেন।

সকল ইউরোপীয় ও মুসলমান ঐতিহাসিক একমত যে, সুলতান আইউবী শত শত অশ্বারোহী বেছে নিয়ে শহর থেকে গোপনে বের হয়ে দামেস্ক রওনা হয়েছিলেন। কায়রো এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় খৃস্টান গোয়েন্দারা তৎপর ছিল। তাদের মধ্যে এমন মিসরী মুসলমানও ছিল, যারা সরকারী কর্মচারী। কিন্তু কেউ টের পায়নি যে, কায়রো থেকে সুলতান আইউবী এবং সাতশ অশ্বারোহী উধাও হয়ে গেছেন।

ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন, সুলতান আইউবী দামেস্ক প্রবেশ করা পর্যন্ত তার সকল তৎপরতা গোপন রাখতে চেয়েছিলেন। সে জন্য তিনি পথ চলতেন রাতে। দিনের বেলা কোথাও লুকিয়ে থাকতেন। সাতশ ঘোড়া ও সাতশ আরোহীকে লুকিয়ে রাখা কঠিন ছিল না। তিনি এমন পথে অতিক্রম করেন, যে পথে কোন কাফেলা চলাচল করে না। দুজন ঐতিহাসিক লিখেছেন, সুলতান আইউবী এই গোপন সফরে সৈন্যদের সঙ্গে একজন সাধারণ সৈনিকেরই ন্যায় মিলেমিশে অবস্থান করেন। সকলের সঙ্গে খোশ-গল্প করতে থাকেন এবং কথা দিয়ে তাদেরকে শক্রর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে থাকেন। পাশাপাশি তাদেরকে বুঝাতে থাকেন যে, পরিস্থিতি কেমন এবং কিরূপ হতে যাচ্ছে। তিনি তার সৈনিকদেরকে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার হতে দেননি, মিথ্যা আশ্বাস দেননি। তাদেরকে তিনি সমস্যা ও বিপদ সম্পর্কে অবহিত করতে থাকেন। তার ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের প্রভাবে প্রত্যেক সৈন্য প্রভাবিত হয়ে পড়ে। তারা উড়ে দামেস্কে পৌঁছে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিকদের মধ্যে অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিমত পাওয়া যায় যে, সময়টা ১১৭৪ সালে কোন্ মাস ছিল। কারো মতে জুলাই মাস। কারো মতে নবেম্ভর মাস। ইতিহাস পাঠে বুঝা যায়, সুলতান আইউবী সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে দামেস্কের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি মিসরের নির্বাহী ক্ষমতা গোপনে দুজন উপদেষ্টার হাতে সোপর্দ করে এসেছিলেন। সুদানের দিককার সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত করে রেখে এসেছিলেন। উত্তরদিকের নৌবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়, সর্বক্ষণ দিনে-রাতে সমুদ্রে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত নৌযান টহল দিতে থাকবে এবং নৌসেনাদের নিয়ে নৌজাহাজ সারাক্ষণ প্রস্তুত হয়ে থাকবে। সুলতান আইউবী তাঁর স্থলাভিষিক্তদের বলে এসেছেন, কোনদিক থেকে আক্রমণ আসলে আমার অপেক্ষা না করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তিনি এই নির্দেশও প্রদান করে যান যে, কোন সীমান্তে দুশমন সামান্য গড়বড় করলেও কঠোর জবাব দেবে। সর্বক্ষণ আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত থাকবে। প্রয়োজন হলে সুদানের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়ে মিশরের প্রতিরক্ষা অটুট রাখবে।

সুলতান আইউবী মিসরকে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে সাতশ অশ্বারোহী নিয়ে চুপিসারে দামেস্ক অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন।

***

দামেস্কের দুর্গের প্রধান ফটকে সান্ত্রীরা টহল দিয়ে ফিরছে। হঠাৎ তারা দূর দিগন্তে ধূলিবালির মেঘ দেখতে পায়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মেঘগুলো দামেস্কের দিকে ধেয়ে আসছে। সান্ত্রীরা কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবে, ব্যবসায়ী ও মুসাফিরদের কাফেলা হবে বোধ হয়। কিন্তু তাতে তো এত ধূলি উড়তে পারে না। সম্ভবত এগুলো ঘোড়া। মেঘমালা অনেক নিকটে চলে আসে। এবার মেঘের ভেতরে আবছা আবছা ঘোড়া দেখা যায়। তারপর ঊর্ধ্বে উঁচিয়ে ধরা বর্শার ফলা নজরে আসতে শুরু করে। প্রতি বর্শার মাথায় পতাকা বাধা। নিঃসন্দেহে এরা সৈন্য হবে। কিন্তু খলীফার ফৌজ হতে পারে না। এক সান্ত্রী নাকারা বাজিয়ে দেয়। দুর্গের অন্যান্য ফটক থেকেও নাকারা বেজে উঠে। দুর্গে যেসব সৈন্য ছিল, তারা প্রস্তুত হয়ে যায়। তীরন্দাজরা ধনুকে তীর সংযোজন করে পাঁচিলের উপর উঠে যায়। দুর্গের কমান্ডারও উপরে উঠে আসে। ধূলি উড়াতে উড়াতে আরোহীরা দুর্গের নিকটে চলে আসে এবং আক্রমণের বিন্যাসে এসে থেমে যায়। দুর্গের কমান্ডার অশ্বারোহীদের কমান্ডারের ঝাণ্ডা দেখে চমকে উঠেন। এত সালাহুদ্দীন আইউবীর ঝাণ্ডা! দুর্গের কমান্ডারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বলে দেয়া হয়েছিল, সুলতান আইউবী স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তিনি যদি এদিকে আসেন, তাহলে যেন তিনি শহরে ঢুকতে না পারেন।

আপনি কী উদ্দেশ্যে এসেছেন? দুর্গের কমান্ডার জিজ্ঞাসা করে- খলীফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে সৈন্যদের পেছনে দূরে কোথাও নিয়ে রেখে আসুন এবং আপনি একা সম্মুখে অগ্রসর হোন।

খলীফাকে এখানে ডেকে নিয়ে আস- সুলতান আইউবী উচ্চকণ্ঠে বললেন- আর তুমি শুনে নাও, আমার সৈন্যরা পেছনে হটবে না- শহরে প্রবেশ করবে। খলীফাকে সংবাদ পাঠাও, সে যদি বাইরে না আসে, তাহলে অনেক মুসলমানের রক্ত ঝরবে এবং তার দায়ভার তাকেই বহন করতে হবে।

নাজমুদ্দীন আইউবের পুত্র সালাহুদ্দীন!- দুর্গের কমান্ডার বলল- আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি, তোমার একজন সৈন্যও জীবিত ফিরে যেতে পারবে না। আমি খলীফার হুকুমের পাবন্দ। তোমার জন্য নগরীর দ্বার খোলা হবে না।   

দুর্গের বাইরে প্রহরারত সৈন্যরা সংবাদ দেয়ার জন্য এক সিপাইকে খলীফার নিকট প্রেরণ করে। সুলতান আইউবীও তার সৈন্যদেরকে কি যেন নির্দেশ প্রদান করেন। সৈন্যরা বিদ্যুতের ন্যায় দ্রুত নড়েচড়ে ওঠে। তারা আরো বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ধনুক বের করে হাতে নেয়। তাতে তীর সংযোজন করে।

ওদিকে দামেস্কের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শহরের পাঁচিলে তীরন্দাজ সৈন্যরা প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। দুর্গের কমান্ডার সম্ভবত খলীফার নির্দেশ কিংবা ভেতর থেকে বাহিনী আসার অপেক্ষা করছে। কোন পদক্ষেপ নেয়নি সে। কিন্তু মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

খলীফা ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হন। বাচ্চা মানুষ। একবার প্রচণ্ড ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন। পরক্ষণেই আবার ঘাবড়ে যান। তার উপদেষ্টাগণ তাকে সাহস দেয় এবং তার থেকে এই নির্দেশ আদায় করে নেয় যে, ফৌজ বাইরে গিয়ে সুলতান আইউবীকে ঘিরে ফেলবে এবং অস্ত্র সমর্পণে বাধ্য করিয়ে তাকে গ্রেফতার করবে।– ইতিমধ্যে নগরবাসীও জেনে যায় যে, সুলতান আইউবী ফৌজ নিয়ে এসেছেন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রীও সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তার প্রশিক্ষিত মহিলারাও তৎপর হয়ে ওঠে। ঘরে ঘরে সংবাদ পৌঁছে যায় যে, সুলতান আইউবী এসেছেন। মহিলারা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে এবং স্লোগান তুলে, সালাহুদ্দীন আইউবী জিন্দাবাজ, সালাহুদ্দীন আইউবীর আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। অনেকে আইউবীকে উপহার দেয়ার জন্য ফুল সংগ্রহ করে। পুরুষরাও রাস্তায় নেমে আসে, তাকবীর ধ্বনিতে দামেস্কের আকাশ মুখরিত হয়ে ওঠে।

খলীফার চাটুকারদের এ দৃশ্য পছন্দ হল না। কিন্তু হাজার হাজার মানুষের ঢেউ আছড়ে পড়ছে নগরীর প্রধান ফটকের উপর। বানের মত ছুটে আসছে মানুষ। অনেকে পাঁচিলের উপর উঠে যায় আর স্লোগান দেয়, খোশ আমদেদ সালাহুদ্দীন আইউবী।

দামেস্কের ফৌজ সুলতান আইউবীর মোকাবেলা করতে অস্বীকৃতি জানায়। সংবাদ চলে আসে খলীফার কানে। খলীফা ও আমীরগণ ভাবনায় পড়ে যান। আমীরদের অনুগত কমান্ডাররা নিজ নিজ বাহিনীকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেয়। খলীফার বিরোধী কমান্ডাররা তাদেরকে সাবধান করে দেয় যে, সুলতান আইউবীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলে পরিণতি ভাল হবে না। ঘোড়ার পেছনে বেঁধে তোমাদেরকে শহরময় টেনে-হেঁচড়ে খুন করা হবে। তিন চারজন কমান্ডার পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়। এমন সময়ে জঙ্গীর স্ত্রী এসে উপস্থিত হন। মহিলা পাগলের ন্যায় দৌড়ে আসেন। আসেন ঘোড়ায় চড়ে। ঘোড়াটাও হাঁফাচ্ছে তার। তিনি দেখতে এসেছেন, ফৌজ কী করছে। পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করছে না তো? তিনি দেখতে পান যে, তিন-চারজন কমান্ডার তরবারী উঁচিয়ে একে অপরকে শাসাচ্ছে। তাওফীক জাওয়াদও আছেন তাদের মধ্যে। জঙ্গীর স্ত্রীকে দেখেই তিনি তার দিকে এগিয়ে যান এবং বললেন, আপনি এখানে কেন এসেছেন?

এখানে কী হচ্ছে?- জঙ্গীর স্ত্রী জিজ্ঞেস করেন- ফৌজ সালাহুদ্দীন আইউবীকে স্বাগত জানাতে যাচ্ছে, নাকি মোকাবেলা করতে?

ফৌজ যাচ্ছে না- তাওফীক জাওয়াদ জবাব দেন- আমরা খলীফার নির্দেশ অমান্য করেছি। আর এরা পরস্পর সংঘাতে লিপ্ত হতে চাচ্ছে। এদের মধ্যে দুজন আছে খলীফার অনুগত।

জঙ্গীর স্ত্রী ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে যান এবং বিবদমান কমান্ডারদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে যান। তিনি নিজের মাথাটি উলঙ্গ করে চিৎকার দিয়ে বললেন, ওহে আত্মমর্যাদাহীন লোক সকল! তোমরা আগে এই মাথাটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন কর, আপন মায়ের মস্তক মাটিতে ছুঁড়ে মার। তারপর কাফেরদের পক্ষে যুদ্ধ কর। তোমরা ঐসব কন্যাদের কথা ভুলে গেছ, যাদেরকে কাফেররা তুলে নিয়ে গেছে। তোমরা ভুলে গেছ ঐসব শিশু কন্যাদের কথা, যারা কাফেরদের নির্মমতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। বল, তোমরা কার সমর্থনে একে অন্যের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করেছ? আমার পুত্রের অনুগতরা কাফের। তোমরা আস, আগের আমার গর্দানটা উড়িয়ে দাও, তারপর আইউবীর মোকাবেলায় গমন কর।

জঙ্গীর স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তার দুচোখ বেয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরতে শুরু করে। মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসে। কমান্ডারগণ তরবারী কোষবদ্ধ করে মাথানত করে কেটে পড়ে।

ফৌজ কি নির্দেশ অমান্য করল? খলীফার এক উপদেষ্টার ভীতিপ্রদ কণ্ঠস্বর। এক ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে খলীফার দরবারে।

রক্ষীদেরকে বাইরে বের করে নিয়ে যাও- ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এক আমীর বলল দৃঢ়তার সাথে মোকাবেলা কর।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রক্ষী বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায়। এতক্ষণে নগরবাসীদের ভীড় আরো বেড়ে গেছে। মহিলারা চিৎকার করে বলছে, ফটক খুলে দাও। আমাদের ইজ্জতের মোহাফেজ এসেছেন। পুরুষরা উচ্চকণ্ঠে ধ্বনি দিচ্ছে। রক্ষী বাহিনী সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার পথ পাচ্ছে না।

খেলাফতের কাজী (প্রধান বিচারপতি) কামালুদ্দীন তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি খলীফার দরবারে ছুটে যান। তিনি খলীফাকে বললেন, আপনি যদি সালাহুদ্দীন আইউবীর মোকাবেলায় ফৌজ প্রেরণ করেন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ তাদের মোকাবেলা করবে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হবে। গৃহযুদ্ধ বাঁধবে। তার চেয়ে বেশী ক্ষতি এই হবে যে, আশপাশে অবস্থানরত খৃস্টান ফৌজ বিনা যুদ্ধে ভেতরে ঢুকে পড়বে, খৃস্টানরা দেশটা দখল করে নেবে। তারপর না থাকবে আপনার খেলাফত, না থাকবেন আপনি নিজে। দেশটা তছনছ হয়ে যাবে। শরীয়তের নির্দেশ হল, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ করা যায় না। আপনি একটুখানি বাইরে এসে মানুষের উৎকণ্ঠা দেখুন। আপনি এই স্রোত কিভাবে প্রহিত করবেন? ভাল হবে, নগরীর চাবি আমার হাতে দিয়ে দিন; আমি একটা সুন্দর সমাধান করে ফেলি।

চাবি কাজী কামালুদ্দীনের হাতে তুলে দেয়া হল। তিনি নিজ হাতে নগরীর ফটক খুললেন। চাবিটা সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দেন। সুলতান আইউবী অবনত মস্তকে তার হাতে চুম্বন করেন এবং তারই সঙ্গে শহরে প্রবেশ করেন। নুরুদ্দীন জঙ্গীর স্ত্রী সুলতান আইউবীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হন। সুলতান আইউবী ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন। জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী আবেগের অতিশয্যে সুলতান আইউবীকে জড়িয়ে ধরেন এবং শিশুর ন্যায় হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন। মহিলারা সুলতান আইউবী ও তার সৈন্যদের উপর ফুল ছিটিয়ে দেয় এবং স্লোগান দিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়।

দুর্গের চাবিও সুলতান আইউবীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তিনি সর্বপ্রথম নিজে বাড়িতে যান। আইউবী দামেস্কেরই সন্তান। একসময় তিনি এ বাড়িতে বাস করতেন। বড় আবেগের সাথে তিনি পুরাতন ঘরটিতে প্রবেশ করেন, যেখানে তার জন্ম হয়েছিল।

***

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর সুলতান আইউবী ছোট-বড় কমান্ডারদেরকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠান। তাদের সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ করে নেন,তাদের উপর কতটুকু নির্ভর করা যায়। ফৌজের অবস্থা জিজ্ঞেস করেন এবং নির্দেশ জারি করেন।

এ সময়ে তিনি সংবাদ পান যে, খলীফা তার অনুগত আমীর ও উপদেষ্টাদের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন। ফৌজের উচ্চপদস্থ দুতিনজন কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে পালিয়ে গেছে।

সুলতান আইউবী তৎক্ষণাৎ তৎপর হয়ে যান এবং পালিয়ে যাওয়া লোকদের ঘরে ঘরে তল্লাশী অভিযান প্রেরণ করেন। এ গৃহগুলো মূলত বালাখানা। পলাতকরা শুধু আপন আপন জীবন নিয়েই পালিয়েছে। বিত্তবৈভব সবই পড়ে আছে। হেরেমের নারী, নর্তকী ও বিলাস সামগ্রী সবই পেছনে রয়ে গেছে।

সুলতান আইউবী সমস্ত মাল-দৌলত কজা করে নেন। তার একাংশ বাইতুলমালে জমা দেন, অবশিষ্টগুলো গরীব ও পঙ্গুদের মাঝে বন্টন করে দেন। সুলতান আইউবী খলীফা ও ফেরার আমীর প্রমুখদের ধাওয়া করা প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি মিসর ও সিরিয়ার একীভূত হওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেন এবং আপন ভাই তকিউদ্দীনকে দামেস্কের গবর্নর নিযুক্ত করেন। অন্যান্য প্রদেশগুলোতেও নতুন গবর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি নিজে সালতানাতের সুরক্ষা ও ভিত শক্ত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু তার ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্টসমূহ তাকে জানান দিয়ে যাচ্ছে যে, তার আমীরগণ যারা আল-মালকুস্ সালিহের অফাদার- তাকে শান্তিকে বসতে দেবে না। ইউরোপীয় রাজ্যসমূহ থেকে আসা তথ্যাদি থেকে জানা গেল, খৃস্টানরা সুবিশাল সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করছে, যাদের নিয়ে ইসলামী বিশ্বের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানবে। সুলতান আইউবীর জন্য সর্বাপেক্ষা বড় সমস্যা হল, তার আমীরগণ তাকে পরাস্ত করার জন্য খৃস্টানদের পথপানে চেয়ে আছে। তাই তার জন্য আবশ্যক হল, প্রথমে এই বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করা। কাজটা অত সহজ নয়। দামেস্কের ফৌজের যোগ্যতা কেমন, তাও তিনি জানেন না। তাই কালবিলম্ব না করে তিনি এই ফৌজের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেন। যে অঞ্চলে তাকে লড়তে হবে, জায়গাটা পর্বতময়। শীতের মওসুমে ঐসব পাহাড়ে বরফ জমে যায়। আর এখন শীতকাল।

সুলতান আইউবী কায়রো ও দামেস্কের মধ্যে একটি পার্থক্য লক্ষ্য করেন। কায়রোতে খৃস্টান ও সুদানী গোয়েন্দা ও দুবৃত্তদের একাধিক গোপন আখড়া আছে। সেসব এলাকার মানুষের উপর সুলতান আইউবীর পূর্ণ আস্থা নেই। পক্ষান্তরে দামেস্কেও খৃস্টান দুবৃত্ত আছে বটে; কিন্তু এখানকার সাধারণ নাগরিক, এমনকি অবুঝ শিশুরা পর্যন্ত তার সহযোগী বরং তারা তার আঙ্গুলের ইশারায় আগুনে ঝাঁপ দিতেও প্রস্তুত। তাই এখানকার সাধারণ মানুষদের ব্যাপারে এই আশংকা কম যে, তারা দুশমনের গোয়েন্দা ও দুবৃত্তদের ক্রীড়নকে পরিণত হবে। দামেস্ক ও সিরিয়ার মানুষ নুরুদ্দীন জঙ্গীর আমলে মর্যাদাপূর্ণ জীবন অতিবাহিত করছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেই ব্যক্তি মর্যাদা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নতুন শাসকরা তাদেরকে প্রজায় পরিণত করেছে। আমীর-উজীরগণ ভোগ-বিলাসিতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। প্রশাসনের কর্মকর্তাগণ জনগণের জন্য আপদে রূপান্তরিত হয়েছে। আইনের শাসন ও মর্যাদা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বেশ্যালয় ও শরাবখানা চালু হয়ে গেছে। মাত্র চার-পাঁচ মাসেই মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। খাদ্যদ্রব্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে এবং মানুষ অভাব ও দুর্ভিক্ষ অনুভব করতে শুরু করেছে।

এখানকার জনসাধারণ অভাব-অনটন বরদাশত করার জন্য প্রস্তুত বটে, কিন্তু জাতীয় মর্যাদা বিলুপ্ত হতে দিতে প্রস্তুত নয়। তারা খৃস্টানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের পক্ষপাতি নয়। তারা অনুভব করতে শুরু করে যে, তাদের শাসকরা তাদেরকে দুশমনের হাতে তুলে দিচ্ছে। নুরুদ্দীন জঙ্গীর শাসনামলে ঝুপড়ি ও ছেঁড়া তাঁবুতে বসবাসকারী লোকেরাও সরকার কখন কী করছে জানতে পারত। যুদ্ধের সময় তারা যুদ্ধের পরিস্থিত সম্পর্কে অবহিত হতে পারত। কিন্তু জঙ্গীর ওফাতের পর দেশের জনগণ এখন অস্পৃশ্য ঘোষিত হয়েছে। তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছে, সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মাথা ঘামাবার অধিকার তোমাদের নেই। তোমরা যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাক, নিজের চরকায় তেল দাও। দুটি মসজিদের ইমামকে শুধু এই জন্য চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে যে, তারা মুসল্লীদেরকে আত্মমর্যাদা ও স্বাধীনতার ওয়াজ শোনাতেন। খলীফার মহল ও অন্যান্য সরকারী ভবনের নিকটে আসাও জনগণের জন্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। যারা এক সময় নুরুদ্দীন জঙ্গীকেও পথরোধ করে দাঁড় করিয়ে কথা বলত এবং রণাঙ্গনের খবরাখবর নিত, এখন তারা সরকারের একজন সাধারণ কর্মকর্তাকে দেখলেও পেছনে সরে যায়।

মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। জিহাদের স্লোগান হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু স্লোগান হারিয়ে যেতে পারে, মানুষের জযবা এত তাড়াতাড়ি বিলুপ্ত হওয়ার নয়। মানুষ লুকিয়ে লুকিয়ে পরস্পর মিলিত হয়ে মতবিনিময় করতে শুরু করে যে, এমন অবস্থায় আমরা কী করতে পারি।

নুরুদ্দীন জঙ্গীর বিধবা স্ত্রী মহিলাদের একটি দল গঠন করেছিলেন। এই কঠিন পরিস্থিতিতে তারা জানতে পারে যে, সালাহুদ্দীন আইউবী এসেছেন এবং তিনি ফৌজ নিয়ে এসেছেন। তারা সুলতানকে স্বাগত জানানোর জন্য বেরিয়ে আসে। যখন তারা জানতে পারে যে, খলীফা সুলতান আইউবীকে সামরিক শক্তি প্রযোগ করে প্রতিহত করতে চাচ্ছেন, তখন তারা খলীফার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত হয়ে যায়। খলীফার রক্ষীবাহিনী তাদের সঙ্গে অসদাচরণ করে। আর এই কারণেই খলীফা আল-মালিকু সালিহ ও তার সহযোগিরা চোরের ন্যায় দলবলসহ পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এখন মানুষ সুলতান আইউবীর নির্দেশে জীবন দিতে প্রস্তুত। জনগণের এই আবেগ-উচ্ছ্বাস সুলতান আইউবীর মিশনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে।

***

দামেস্কের মুসলিম নারীদের মধ্যে ঈমানী জযবা ও জাতীয় চেতনা পূর্ব থেকেই বিদ্যমান। এখন সেই জযবা জ্বলন্ত অঙ্গারের রূপ লাভ করেছে। যুবতী মেয়েদের একটি প্রতিনিধি দল সুলতান আইউবীর নিকট এসে নিবেদন জানায়, মহামান্য সুলতান! আপনি আমাদেরকে ফৌজের সঙ্গে রণাঙ্গনে প্রেরণ করুন এবং আমরদের সামরিক প্রশিক্ষণ দিন। আমরা আহত মুজাহিদদের সেবা চিকিৎসা ছাড়া লড়াইও করতে চাই। সুলতান আইউবী তাদেরকে বললেন, যেদিন প্রয়োজন হবে, তোমাদেরকে ঘর থেকে বের করে আনব। আপাতত তোমাদের ময়দান হল ঘর। আমি তোমাদেরকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে চাই না। তোমরা যদি মা হয়ে থাক, তাহলে স্বামী-সন্তানদেরকে মুজাহিদরূপে গড়ে তোেল। যদি বোন হও, ভাইদেরকে ইসলামের মোহাফেজ বানাও। ওয়াদা দিচ্ছি, আমি তোমাদের সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। কিন্তু তোমরা একথা ভুল না যেন, তোমাদেরকে নিজ নিজ ঘর সামলাতে হবে।

এরূপ আরো কিছু কথা বলতে বলতে সুলতান আইউবীর হঠাৎ কি যেন মনে পড়ে যায়। তিনি বললেন, আরো একটি ময়দান আছে, যেখানে তোমরা কাজ করতে পার। তোমরা হয়ত শুনেছ, খলীফার মহল এব আমীর-উজীর ও শাসকদের বাসভবন থেকে অনেকগুলো মেয়ে উদ্ধার হয়েছে। তাদের সংখ্যা দু- তিনশ। আমি তাদেরকে মুক্ত করে দিয়েছিলাম। তারা এই শহরেই কিংবা শহরের আশপাশে কোথাও অবস্থান নিয়ে থাকবে। তারা কে কোথাকার বাসিন্দা আমার জানা নেই। এখনইবা কোথায় কোথায় ঘুরে ফিরছে, নিজেদের জীবন বরবাদ করছে, তাও আমি বলতে পারব না। এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। আমার সম্মুখে বিশাল বিশাল কাজের পাহাড় পড়ে আছে। এই কাজটা আমি তোমাদের উপর সোপর্দ করছি যে, তোমরা তাদেরকে খুঁজে বের কর। তাদের মধ্যে অনেকে এমনও থাকবে, যাদেরকে ক্রয় কিংবা অপহরণ করে আনা হয়েছিল। এখন তাদের ভবিষ্যৎ এই যে, তারা বেশ্যালয়ে ঢুকে পড়বে, সরাইখানায় মুসাফিরদের সেবা করবে এবং এভাবে লাঞ্ছিত হয়ে জীবনের অবসান ঘটাবে। তাদেরকে কেউ বিয়ে করবে না। তোমরা তাদেরকে খুঁজে বের কর এবং তাদের বিয়ের ব্যবস্থা কর।

মেয়েরা কালবিলম্ব না করে অভিযান শুরু করে দেয়। তারা নিজ নিজ ঘরের পুরুষদের থেকে সহযোগিতা নেয় এবং কয়েকদিনের মধ্যেই বেশকটি মেয়েকে খুঁজে বের করে নিজেদের ঘরে রেখে তাদের চরিত্র শোধরানোর প্রশিক্ষণ শুরু করে দেয়।

হতভাগা মেয়েগুলোর মধ্যে একটি মেয়ের নাম সাহার। সাহারকে জোরপূর্বক নর্তকী বানানো হয়েছিল। তাকে এক আমীরের ঘর থেকে উদ্ধার করে মুক্ত করা হয়েছিল। মুক্তি পেয়ে মেয়েটি এক দরিদ্র পরিবারে আশ্রয় নেয়। উদ্ধারকারী মেয়েরা খোঁজ পেয়ে তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসে।

সাহার যখন দেখল, দামেস্কের মেয়েরা নিয়মতান্ত্রিক সেনাবাহিনীর ন্যায় কাজ করছে, তখন তার ঘুমন্ত মর্যাদাবোধ জেগে ওঠে। জাগ্রত হয়ে উঠে তার প্রতিশোধস্পৃহাও। সে মেয়েদেরকে জানায়, আমার সঙ্গের এক নর্তকী সরাইখানার মালিকের নিকট থাকে। সাহার সরাইখানার মালিককে চেনে। সে জানায়, এই লোকটি খৃস্টানদের গুপ্তচর। লোকটি একটি পাতাল কক্ষ তৈরি করে রেখেছে। সেখানে ফেদায়ী ও খৃস্টান গোয়েন্দারা রাত কাটায়। সেখানে নাচ হয়, মদের আসর বসে। আমাকেও এক রাত সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি সেই গোয়েন্দাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারি। কিন্তু আমি তা করতে চাই না। আমি সরাইখানার মালিককে তাদের সঙ্গে নিজ হাতে হত্যা করতে চাই। একাকী করা সম্ভব নয়। তোমরা আমার সঙ্গ দাও।

মেয়েরা প্রস্তুত হয়ে যায়। তারা একটি পরিকল্পনা ঠিক করে ফেলে। সে মোতাবেক সাহার একদিন পর্দাবৃত হয়ে সরাইখানার মালিকের নিকট চলে যায়। সরাইখানার মালিক সাহারকে দেখে বেজায় আনন্দিত। সাহার বলে, আমি তখনই তোমাদের নিকট পৌঁছে যেতাম। কিন্তু শহরে ধরপাকড় চলছিল। আমি আশংকা করি, যদি আমি তোমাদের নিকট চলে আসি, তাহলে তোমরাও ধরা পড়ে যাবে। আমি এতিম মেয়ের পরিচয় দিয়ে একটি দরিদ্র পরিবারে লুকিয়ে থাকি। এখন পরিস্থিতি ভাল। তোমাদের প্রতি কারো কোন সন্দেহ নেই। তাই এবার তোমাদের নিকট চলে এলাম।

সরাইখানার মালিক সাহারকে তার নর্তকীর নিকট নিয়ে যায়। নর্তকীও অত্যন্ত আনন্দিত হয়। এখানে সে কয়েক রাত অতিবাহিত করে। সাহার দেখতে পায় যে, খলীফা ও বিলাসী আমীরদের পতন এবং সুলতান আইউবীর ক্ষমতা দখল সত্ত্বেও সরাইখানার পাতাল কক্ষের জৌলুস আগেরই মতই অক্ষুণ্ণ আছে। এতো উত্থান-পতনের পরও তাতে কোন ব্যাত্যয় ঘটেনি। মুসাফিররা নিজ নিজ কক্ষে ঘুমিয়ে পড়ার পর এই পাতাল কক্ষের জগত সক্রিয় হয়ে উঠে। এখানে এখনো খৃস্টান গুপ্তচর ও দুবৃত্তরা আছে। সাহার তাদের মনোরঞ্জন করতে থাকে। রাতে নাচে ও তাদেরকে মদপান করায়। এরা মুসাফিরের বেশে সরাইখানায় আসা-যাওয়া করে।

সাহার আরো দেখে নেয় যে, রাতে সরাইখানার বাইরে পাহারার ব্যবস্থা থাকে, যাতে কোন সমস্যা দেখা দিলে সে সংবাদ যথাসময়ে পাতাল কক্ষে পৌঁছে যায়। সাহার একাকী বাইরে যেতে পারে না। মনের বিরুদ্ধে হলেও সে নাচতে গাইতে থাকে। একরকম বন্দীই করে রাখা হয়েছে তাকে। মেয়েটি এই ভেবে নিরাশ হয়ে যায় যে, আসলাম প্রতিশোধ নিতে এখন কিনা হয়ে গেলাম বন্দী। কিন্তু এই নৈরাশ্য সে কাউকে বুঝতে দেয়নি। তাকে সবাই তাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। অনেক গোপনীয় কথাও তার উপস্থিতিতে আলোচনা হচ্ছে এখন।

এক রাতে পাতাল কক্ষের আসরে এক খৃস্টান গোয়েন্দা সরাইখানার মালিককে বলল, শুধু এই দুটি মেয়েতে আমাদের একঘেঁয়েমী এসে গেছে। নতুন মেয়ে আন।

গোয়েন্দা যখন কথাটা বলে, তখন মেয়ে দুটো সেখানেই উপস্থিত ছিল। তাতে অন্য নর্তকী ব্যথিত হলেও সাহারের চোখে আশার আলো জ্বলে ওঠে। সরাইখানার মালিক বলল,সালাহুদ্দীন আইউবী এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেছেন যে, এখন দামেস্কে আর কোন নর্তকী বা নতুন কোন মেয়ে পাওয়া যাবে না।

কেন পাওয়া যাবে না? সাহার বলল- আমীর-উজীরদের ঘর থেকে যেসব নর্তকীদের উদ্ধার করে মুক্ত করে দেয়া হয়েছে, তারা এখনো এই শহরেই আছে। আমার মত তারাও লুকিয়ে আছে। আপনারা যদি আমাকে দু তিন দিনের জন্য বাইরে যেতে দেন, তাহলে পর্দানশীল নারীর বেশে আমি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসতে পারব।

সাহার অনুমতি পেয়ে যায়। সরাইখানার মালিক তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয়। সকাল হলে সাহার পর্দাবৃত হয়ে সরাইখানা থেকে বেরিয়ে যায়।

***

চার-পাঁচ দিন পর সরাইখানার চোরা দরজা দিয়ে আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা আটটি মেয়ে প্রবেশ করে এবং সোজা সরাইখানার মালিকের কক্ষে চলে যায়। মেয়েগুলোর মুখমণ্ডল নেকাবে ঢাকা। মালিকের কক্ষে প্রবেশ করে সবাই মুখের নেকাব সরিয়ে ফেলে। মালিক চোখ মেলে তাদের প্রতি তাকায়। সব কটি মেয়ে যুবতী এবং একটির চেয়ে অপরটি রূপসী। সাহার তাদের পার্শ্বে দণ্ডায়মান। এরা কোন্ কোন্ আমীরের নিকট ছিল, সাহার তা মালিককে অবহিত করে। আরো জানায় যে, এদের নাচ দেখে, গান শুনে আপনি পাগল হয়ে যাবেন। আরো বলল, আজ রাত আপনার সব বন্ধু-বান্ধবকে এখানে দাওয়াত করুন।

সরাইখানার মালিক পাগলের মত উঠে দৌড় দেয়। বন্ধু-বান্ধবদের দাওয়াত দিতে ছুটে যায়। সাহার মেয়েগুলোকে পুরাতন নর্তকীর কাছে নিয়ে যায়। নর্তকী তাদেরকে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়, এদের একজনকেও সে চেনে না। নর্তকী একটি মেয়ের সঙ্গে তার বিশেষ পরিভাষায় কথা বললে মেয়েটি খানিকটা বিব্রত হয়ে পড়ে। সাহার বলল, নতুন জায়গা কিনা, মেয়েটি ভয় পেয়েছে। তাছাড়া আমি এদেরকে এক বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উদ্ধার করে এনেছি। রাতে এদের নৈপুণ্য, দেখলে তখন তুমি বুঝতে এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে।

সাহারের কথায় নর্তকী আশ্বস্ত হল না। সন্দেহ হোক বা না হোক এই অনুশোচনা তা অবশ্যই আছে যে, এই মেয়েদের সামনে তার মূল্য শেষ হয়ে গেছে। সে সাহারকে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে বলল, বোধ হয় তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে! এই মেয়েগুলো টাটকা যুবতী। তাছাড়া অতিশয় রূপসী। এদের সামনে আমাদের আর মূল্য কি? এ-কী করলে তুমি? এদেরকে কোত্থেকে এনেছ? কেনইবা এনেছ? বড় ভুল করলে সাহার!

আসলে আমি আমাদের পরিশ্রম কমাতে চাচ্ছি- সাহার বলল- ওদের আগমনের পর এখন আমাদের কাজ কমে যাবে।

নর্তকী তার এই যুক্তি মানতে পারল না। সাহারের নিকট আর কোন যুক্তি নেই, যা দ্বারা সে নর্তকীকে আশ্বস্ত করবে। দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়ে যায়। নর্তকী ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, আমি সরাইখানার মালিককে বলব, এই মেয়েগুলো নর্তকী নয়- বেশ্যা। এদেরকে এই স্পর্শকাতর স্থানে নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। এই পাতাল কক্ষের গোপন তথ্য বাইরে গেলে বিপদ অনিবার্য।

এদেরকে কিসের ভিত্তিতে বিশ্বাস করব?– এই নর্তকী অতিশয় অভিজ্ঞ ও চতুর। সে সাহারের মুখ বন্ধ করে দেয়। আবার সাহারও তার বক্তব্য মানতে প্রস্তুত নয়। অবশেষে নর্তকী হুমকি দিল, তুমি যদি এখনই ওদেরকে এখান থেকে না তাড়িয়েছ, তাহলে আমি মেহমানদেরকে এই বলে ফিরিয়ে দেব যে, তুমি এদের দ্বারা তাদেরকে গ্রেফতার করাবার ষড়যন্ত্র করছ।

সাহার অস্থির হয়ে যায়। নর্তকী ক্ষোভের সাথে বের হওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায় এবং দরজার দিকে হাঁটা দেয়। অমনি সাহার তার কামিজের নীচে হাত ঢুকিয়ে কটিবন্ধ থেকে খঞ্জর বের করে নর্তকীর পিঠে এক ঘা বসিয়ে দেয়। আহত হয়ে মেয়েটি ঘুরে যায়। সাহার খঞ্জরের আরেকটি আঘাত করে নর্তকীর হৃদপিন্ডে। তারপর দাঁত কড়মড় করে বলে উঠে, তুমি আমাকে খুন করাতে চাচ্ছিলে। কিন্তু তোর মরণই যে হল আমার হাতে।

সাহার নর্তকীর পরিধানের কাপড় দ্বারাই খঞ্জর পরিষ্কার করে। লাশটা তার খাটের উপর তুলে কম্বল দ্বারা ঢেকে রাখে। তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নিজের কক্ষে চলে যায়। পরনের রক্তাক্ত পোশাক পরিবর্তন করে এবং খঞ্জরটা আবার কটিবন্ধে সেঁটে কামিজের নিচে লুকিয়ে রাখে।

***

রাতে সরাইখানার মালিক ছাড়াও আরো সাতজন লোক এই পাতাল কক্ষে আসে। মালিক সাহারকে পুরাতন নর্তকীর কথা জিজ্ঞেস করে, ও কোথায়? সাহার নাক ছিটকে, ভ্রু কুচকে বলল, ও এই নতুন মেয়েদের দেখে জ্বলে-পুড়ে মরছে। নিজেকে সে এদের চেয়েও বেশী রূপসী মনে করে। আজ রাত সে এখানে না আসলেই ভাল হবে। আসর রং ধরবে।

লানত পড় ক ওর উপর মালিক বলল- ওকে ওর কক্ষেই পড়ে থাকতে দাও।

সাহার ছয় মেহমানকে উদ্দেশ করে বলল, এই মেয়েদের সঙ্গে ভাল পোশাক নেই; আপনারাই এদের উপযুক্ত পোশাকের ব্যবস্থা করতে হবে। এই রাতটা এখন ওরা যে পোশাকে আছে, সে পোশাকেই আপনাদের সামনে আসবে।

তারা যখন মেয়েদের দেখল, তখন ভুলেই গেল, ওরা কোন্ পোশাকে আছে। মেয়েগুলোকে পেশাদার নর্তকীর মত মনে হয় না। চেহারার রং তাদের একদম টাটকা এবং নিষ্পাপ বলে মনে হয়। তাদের মাথার চুলগুলোও পরিপাটি করা হয়নি। তাদের আচরণ প্রমাণ করে যে, তারা পেশাদার নর্তকী নয়। ভাবসাব তাদের সহজ-সরল। সাহার তাদেরকে উদ্দেশ করে বলল, এবার মেহমানদের মদ পরিবেশন কর। তারা সোরাহী থেকে পেয়ালায় মদ ঢালতে শুরু করে। এক মেহমান একটি মেয়েকে খানিকটা উত্যক্ত করে। মেয়েটি লাফ মেরে পেছনে সরে যায়। তার চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে।

সাহার!- লোকটি বলল- এদেরকে কোথা থেকে এনেছ? এরা কার কাছে ছিল?

সাহার অট্টহাসি হেসে বলল, বিদ্যা ভুলে গেছে। ঐ সালাহুদ্দীন আইউবীর ভয়। অল্প পরেই ঠিক হয়ে যাবে, ধৈর্য ধরুন।

সালাহুদ্দীন আইউবী!- তাচ্ছিল্যের সাথে একজন বলল- এবার বেটা আমাদের জালে এসেছে। আমরা তাকে তারই আমীর-সালারদের হাতে খুন করাব। লোকটি তার এক সঙ্গীর কাঁদে চাপড় মেরে বলল, এর খঞ্জর সালাহুদ্দীন আইউবীর খুনের পিয়াসী। চিন তো একে? এ হাসান বিন সাব্বাহর দলের লোক- ফেদায়ী। লোকটি এক মেয়ের গালে আলতো আঘাত করে বলল, আইউবীর ভয় মন থেকে ঝেড়ে ফেল। ও তো দিন কয়েকের মেহমান মাত্র।

কিছুক্ষণ পর। মদপান শুরু হল। নাচের ফরমায়েশ হল। মেয়েরা সোরাহী ও পেয়ালাগুলো এদিক-ওদিক সরিয়ে রাখার ভান করে ছয়জন লোকের পেছনে চলে যায়। অকস্মাৎ সবাই যার যার কামিজের তলে হাত ঢুকায়। প্রত্যেকে একটা করে খঞ্জর বের করে। একটি খঞ্জর বের করে নেয় সাহারও। প্রথমে সাহার সরাইখানার মালিকের উপর আঘাত হানে। অন্যরা ছয় পুরুষের উপর উপর্যুপরি আঘাত হানতে থাকে। সবাই ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। একজনও নিজেকে সামলানোর সুযোগ পেল না। সাহার এক এক করে প্রত্যেকের গায়ে আঘাত করতে থাকে, যেন মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। মেয়েটা প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।

এই মেয়েগুলো সম্ভ্রান্ত পরিবারের সেইসব মেয়ে, যারা সুলতান আইউবীর নিকট নিবেদন পেশ করেছিল যে, আমাদেরকে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করার সুযোগ দিন। তারাই সাহারকে একটি জীর্ণ গৃহ থেকে উদ্ধার করে এনেছিল। সাহার যখন মেয়েগুলোকে সমর বিষয়ক কাজ করতে দেখল, তখন তার সরাইখানার মালিকের কথা মনে পড়ে যায়। তাদেরকে অবহিত করে যে, সরাইখানার পাতাল কক্ষটি খৃস্টান গোয়েন্দা ও দুবৃত্তদের আখড়া; তোমরা সহযোগিতা করলে আমি তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারি। এই পরিকল্পনা দিয়ে সে ওখানে গেল। কিন্তু সরাইখানার মালিক তাকে আটকে ফেলল। এক পর্যায়ে গোয়েন্দারা ফরমায়েশ করল নতুন মেয়ে নিয়ে আস। সাহার সুযোগ পেয়ে যায়। সে নতুন মেয়ে নিয়ে আসার জন্য বের হওয়ার অনুমতি লাভ করে।

বেরিয়ে এসে সে মেয়েদেরকে বিষয়টা অবহিত করে এবং বলে, তোমরা নর্তকী সেজে চল এবং লোকগুলোকে হত্যা কর। মেয়েরা প্রস্তুত হয়ে যায়। পরিকল্পনা ঠিক করে সাহারের সঙ্গে চলে যায়। কিন্তু তারা এই চিন্তা করল না যে, লোকগুলোকে ফাঁদে ফেলে গ্রেফতার করাতে পারলে অনেক লাভ হবে তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য উদ্ধার করা যাবে। মেয়েরা আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। তারা এতটুকুই জানত যে, দুশমনকে খুন করাই বড় কাজ। তারা তাদের জিহাদী চেতনাকে কাজে লাগাতে চাচ্ছিল। সাহারের বক্ষও প্রতিশোধ স্পৃহায় ফেটে যাচ্ছিল। ওদেরকে সে নিজ হাতে হত্যা করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে।

সাহার পুরাতন নর্তকীকে এ জন্য খুন করে ফেলে, তার দ্বারা মেয়েদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছিল। বস্তুত তাদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়ার উপক্রমও হয়েছিল। এ জাতীয় নোংরামীপূর্ণ আসরের রীতি নীতি ও মদপান করানোর পন্থা-পদ্ধতি সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল না। ভাগ্য ভাল যে, তারা যথাসময়ে খঞ্জর বের করে ফেলে এবং উদ্দেশ্য সফল হয়ে যায়।

কাজ সমাধা করে তারা সবাই চোরাপথে পাতাল কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী কিছুক্ষণ পর সৈন্যরা সরাইখানায় হামলা দেয় এবং পাতাল কক্ষে চলে যায়। ওখানে পড়ে আছে সাতটি লাশ। কক্ষে কক্ষে তল্লাশি চালানো হয়। একটি কক্ষে সাহার-এর সঙ্গী নর্তকীর লাশ পাওয়া যায়। সরাইখানার মালিকের কক্ষে এমন কিছু দলিল পাওয়া যায়, যার দ্বারা প্রমাণিত হল, এরা গুপ্তচর এবং দুবৃত্তই ছিল।

 কিন্তু অনাগত ভবিষ্যত সুলতান আইউবী ও সালতানাতে ইসলামিয়ার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ নিয়ে আসছে। সুলতান আইউবী দিন রাত যুদ্ধ পরিকল্পনা ও সেনা প্রশিক্ষণে মহা-ব্যস্ত।

[তৃতীয় খণ্ড সমাপ্ত]

2 Comments
Collapse Comments

ঈমানদিপ্ত দাস্তান ৪র্থ খন্ডের অপেক্ষায়।

ঈমানদীপ্ত দাস্তানের ও অপারেশন আলেপ্পোর বাকি খণ্ডের অপেক্ষায়

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *